“তুমি পাগল হয়ে গেছো, প্রকাশ। তুমি কি বলছো, তুমি নিজেই তা জানো না।” কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে প্রকৃতিস্থ হল মিতা। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো কোনোরকমে উগড়ে দিল ও। কিন্তু উল্টোদিকে বসে থাকা প্রকাশের মধ্যে যেন কোনোরকম হেলদোল নেই। তার মুখে রাগ বা বিরক্তির কোনো ছাপই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বরং যে ভাবটা এখনো তার চেহারায় লেগে রয়েছে, সেটাকে খুব সহজেই অনুরাগ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। মিতার কর্কশ কণ্ঠের ঝাঁঝালো উক্তির পরেও প্রকাশ কোনো উত্তর দিল না। সে আগের মতোই মিতার দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। মিতার আর সহ্য হচ্ছে না। না এই মানুষটাকে, না তার এই আপাতনিরীহ দৃষ্টিটাকে। অসহ্য এক ঘৃণায় গোটা গা গুলিয়ে উঠছে ওর। মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে তবে এতটা নিচে নামা সম্ভব হয়, এটা আজকের আগে মিতা কখনোও জানতোও না, আর কখনোও কল্পনাও করেনি। কিন্তু আজ ও যেটা বলেছে, তারপর আর ওকে বিশ্বাস করাটা কেবল মূর্খামীই হবে তা নয়, বরং সবদিক দিয়েই বিপজ্জনকও বটে। মিতা আবার আগের মতই ঝাঁঝিয়ে বলল, “আসলে তুমি ভালোবাসা পাওয়ারই যোগ্য নও। লতার মতো মেয়ের তো নয়ই। এইমুহুর্তে তুমি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। আর দয়া করে কখনোও এই বাড়িতে বা লতার সামনে এসো না। বেরিয়ে যাও, বলছি।” একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মিতা উত্তেজনায় হাঁফাতে হাএফাতে লাগল। প্রকাশ আরো কিছুক্ষণ একইভাবে বসে থাকার পর শান্তকণ্ঠে বলল, “শান্ত হও মিতা। তুমি আমায় ভুল বুঝছো।”
“আমি তোমায় কিচ্ছু বুঝছি না প্রকাশ, প্লিজ তুমি বেরিয়ে যাও। তোমায় আমি ভালো ছেলে বলেই জানি। এতদিন সেটাই জেনে এসেছি। তুমি কমলের ছোটোবেলার বন্ধু। তোমরা একইসাথে মানুষ হয়েছো। আজ এই কথাটা বলতে তোমার এতটুকুও লজ্জা হলোনা? ছিঃ!!”
“আগে আমার কথাটা শোনো মিতা। তারপর তুমি...” প্রকাশ বলতে গেল। কিন্তু তার আগেই মিতা চেঁচিয়ে বলল, “আমি তোমার একটা কথাও শুনতে চাইনা, বেরিয়ে যাও এক্ষুণি।”
“তোমায় শুনতে হবে। আমি বলবো। তুমি শুনবে।” এই প্রথমবার প্রকাশ গলা তুলে কথা বলল। ওর গলা শুনে মিতা একবারের জন্য থমকে গেল। “আমার কথা তোমায় শুনতে হবে।” প্রকাশ আবার বলে চলল, “আমি কক্ষণো বলিনি যে, আমি লতাকে ভালোবাসি। তুমি আমায় ইনসিস্ট করেছিলে। কিন্তু আমি লতাকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, আজও বাসিনা। আমি তোমায় ভালোবাসি মিতা। আমি তোমাকে কাছে পেতে চাই।” প্রকাশ থামল। মিতা কিছু বলতে গেল। প্রকাশ ওকে হাত নেড়ে ইশারা করে থামতে বলল। “এখনো আমার কথা শেষ হয়নি। আমি তুমি আমায়, নির্লজ্জ, ইতর, ছোটোলোক, জানোয়ার, আরো অনেক কিছু ভাবছো। সেটাই স্বাভাবিক। তোমার জায়গায় আমি থাকলে, হয়তো এগুলোই ভাবতাম। কিন্তু আমি তোমায় যা বলেছি, সব সত্যি। আমি যেদন প্রথমবার তোমায় দেখেছিলাম, সেদিনই আমি তোমায় প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু তুমি হলে কমলের স্ত্রী। আমার বন্ধুপত্নী। তোমার সম্পর্কে এই ভাবাটা একটা অপরাধ, সেটা আমি মানছি। কিন্তু আমি নিজের মনের এই ভাব, কিছুতেই বদলাতে পারছি না মিতা।”
“তোমার কথা বলা শেষ হয়েছে? বেরিয়ে যাও এবার।” দরজার দিকে ইশারা করে বলল মিতা।
ছোট্ট এখটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রকাশ বলল, “তুমি আমাকে এটা করতে বাধ্য করালে মিতা। আমি এটা করতে চাইনি। তুমি ভুলে যাচ্ছো মিতা। একটু আগে তুমি নিজেই আমার সঙ্গে একটা চুক্তি করেছো...”
“আমি কোনো চুক্তি মানি না।” প্রকাশের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতা বলল।
“তোমায় মানতে হবে। আবার বলছি, আমি এটা করতে চাইনি, তুমি আমায় করতে বাধ্য করালে।” বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মিতার দিকে এগিয়ে দিল প্রকাশ। মিতা অবাক হয়ে বলল, “এটা নিয়ে কি করবো?”
“জানি, লতা তোমায় হয়তো সবকথা খুলে বলেনি। হয়তো লজ্জাতেই বলতে পারেনি। আমিও বলতাম না। যদি তুমি চুপচাপ আমার সব কথা মেনে নিতে, তাহলে এই কথাটা গোপন থাকতো। কিন্তু তুমি সেটা হতে দিলে না। যাক সে কথা ছাড়ো। মোবাইলের গ্যালারীটা খোলো। আর কয়েকটা ছবি আছে, দেখো।” প্রকাশ বলল।
ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে মিতার গ্যালারীটা খুলল। বেশী ঘাঁটতে হলো না। খুব সহজেই ছবিগুলো বেরিয়ে এল। ছবিগুলো দেখেই মিতার মাথা যেন ঘুরতে শুরু করল। ও প্রকাশের পাশেই বিছানার উপরে ধপ্ করে বসে পড়ল। একবার ছবিগুলো দেখে, আর দেখতে ইচ্ছা করলো না ওর। ওর হাত থেকে প্রকাশ নিজের ফোনটা ফেরত নিয়ে বলল, “ছবিগুলো মাসদুয়েক আগে তোলা। সেদিন আমরা এখটা হোটেলে গিয়েছিলাম, সেখানেই তুলেছি। বুঝতেই পারছো সব। ভয় পেয়ো না, এই ছবিগুলো আমি নেটেও ছাড়বো না, আর লিফলেট করে পাড়াতেই বিলোবো না। ইনফ্যাক্ট তোমার সামনে আমি এগুলো ডিলিট করতে রাজী আছি। লতার কোনো ক্ষতি হোক, সেটা আমিও চাই না। কিন্তু কিছু পেতে গেলে, কিছু দিতে হয়, সেটা জানোতো মিতা? আমি কেবল একটা শর্তেই ছবিগুলো ডিলিট করবো।”
“কি শর্ত?” ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞাসা করল মিতা। তবে উত্তরটাও ওর জানা।
“কিছুই না। প্রথমত এতসব কথা কেবল আমাদের দুজনের মধ্যেই থাকবে। কেউ জানবে না। আর দুই। আমি তোমাকে নিজের করে পেতে চাই। অন্তত একবার হলেও চাই।” প্রকাশ বলল।
মিতা কোনো উত্তর দিল না। কারণ ওর উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিলও না। ছবিগুলো দেখার পরেই কি হতে চলেছে, সেটা মিতা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল। লতার কোনো ক্ষতি সে চায় না। কেবল লতার কথা ভেবেই ওকে রাজী হতে হতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় তার নেই। ও বলল, “আমি রাজী। তবে আমারো একটা শর্ত আছে।”
“বলো।”