আসলে এতো জটিল হয়ে গেছে জগতটা যে সরল জীবনযাপন আর কেউ করতে পারে না। আমরাও তো মনের কথা বলার জন্য ফোরামে আসি। একটা স্বাভাবিক কথোপকথন আজপান্তাভাত সবাই খেতে পারে না৷
এলেবেলেরা খায় সেদিনের ভাতে জল ঢেলে।
আনকোরারা খায় আগের দিনের রাতের ভাতে জল ঢেলে।
লেজেন্ডরা খায় আগের দিন সকালে রান্না করা ভাতে জল ঢেলে। পরেরদিন দুপুরে৷ যখন ভাতটা একটু ফেটে ফেটে যাবে, একটা টক টক ভাব আসবে, সাথে একটা হাল্কা টক টক গন্ধ৷ গন্ধরাজ লেবুর টুকরোর রস চিপে নিয়ে, নখ দিয়ে তার সবুজ পিঠ আঁচড়ে পান্তার জলে মেখে নেওয়া সুবাস, কাঁচা লঙ্কার সুগন্ধ আর পেঁয়াজের ঝাঁজ মিলেমিশে সে এক আলাদাই প্রকৃতি৷ ছাঁচি পেঁয়াজ হলে তো কথাই নেই৷
পান্তাভাত সবাই খেতে পারে না৷
এলেবেলেরা খায় এসি ঘরে বসে।
আনকোরারা খায় পাখার নিচে বসে।
লেজেণ্ডরা খায় ধান ক্ষেতের পাশে, অশ্বত্থের ছায়ায় বসে৷ সবুজ পাতার কালো ছায়া, রোদ মাখা সবজে সোনালী ধানের শিষ দোলানো, ঢেউ খেলানো বাতাস ভেজা গা, ঘেমো চুল সব শীতল করে দেয়৷ আর গপাগপ পান্তা গলা, বুক, পেট, সারা শরীর ঠাণ্ডা করে৷ মাঝে মাঝে কাঁধের গামছাটা মাথার ওপর উড়িয়ে পাখি তাড়ায় তারা৷ পাতায় পাতায় শিরশির, পাখির কিচমিচ আর কাঁচা পেঁয়াজ চিবানোর কচ কচাৎ আওয়াজ, সব শেষে কানা উঁচু থালা তুলে জলটা ঢক ঢক ঢক... আহা, তৃপ্তি।
সবাই পান্তাভাত খাওয়াতেও পারে না।
এলেবেলেরা পান্তাভাত বেড়ে দিয়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে এসি চালিয়ে বসে শুয়ে মোবাইল ফোনে রীল বানায়৷
আনকোরারা পান্তাভাত বেড়ে দিয়ে সোফায় বসে টিভি চালিয়ে সিরিয়াল দেখে অথবা ফোন ঘাঁটে।
লেজেণ্ডরা এলুমিনিয়ামের বড় বাসনে পান্তা, কাঁঠাল পাতায় নুন আর গামছা বেঁধে লঙ্কা পেঁয়াজ আলুমাখা নিয়ে আল বেয়ে আসে। হাতে জলের ঘটি৷ মাথায়, নাকে শাড়ীর আঁচল প্যাঁচায়, বড় রোদ৷ দূর থেকে এসে সেই অশ্বত্থের গোড়ায় আস্তে আস্তে খাবারগুলি রেখে একটা ঢেলা কুড়োয়৷ মাঠে কাদায় কাজ করা নিজের মরদটার দিকে ছুঁড়ে মারে ঢেলাটা। আনমনে কাজ করতে থাকা রোদে পোড়া পাথুরে শরীরটা, ঝাঁকড়া চুলো মাথাটা... বড় চেনা তার৷ ছুঁড়েই টুক করে লুকিয়ে পড়ে অশ্বত্থের পিছনে৷ ঢেলাটা ছপাৎ করে পড়ে পায়ের কাছে, অল্প জল কাদা ছিটে লাগে পায়ে, হাঁটুতে। মানুষটা চমকে গিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। পরক্ষণেই চোখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে৷ ছুট্টে কাছে আসে, দুই হাত ভর্তি কাদা... 'মাখাই? মাখাই?’ গাছ ঘিরে কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি চলে দুজনের৷ তারপরে শ্যালোর জলে বা কাছের পুকুরে হাত পা ধুয়ে খেতে বসে আয়েশ করে৷ লেজেণ্ডরা বেড়ে দেয়, পাশে বসে, আঁচল দুলিয়ে হাওয়া করে৷ দু'চোখ মেলে দেখে তার মরদটাকে৷ সেই ভোরে লাঙল নিয়ে বেরিয়েছে। বাড়ির কাজ করতে করতে কতবার যে মনে পড়েছে এর কথা৷ হাপুসহুপুস খেতে থাকা ক্ষুধার্ত, সরল মানুষটার কপালের ঘাম মুছিয়ে দেয় সেই আঁচল দিয়েই।
পান্তা সবাই খেতে পারে না, খাওয়াতেও পারে না৷
Collected
দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে।