What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নারী (প্রবন্ধ) (2 Viewers)

কিশোরীতরুণী


বালিকার পরিণতি কিশোরী, কিশোরীর পরিণতি তরুণী; তাদের বিপন্ন পরিণতি নারী। পিতৃতন্ত্রের নানা প্রান্তে তাদের বিকাশের মধ্যে, যদি একে বিকাশ বলতে পারি, রয়েছে মিল : তাদের জৈব বিকাশে মিল রয়েছে পৃথিবী জুড়ে; কিন্তু বিভিন্ন দেশ, সমাজ, শ্রেণী কিশোরীতিরুণীদের একইভাবে বাড়তে দেয় না। বাড়া নয়, বলা যায়, রুদ্ধ করে রাখা হয় তাদের বিকাশ। বাঙালি আর মার্কিন কিশোরীর মধ্যে জৈব মিল স্পষ্ট, কিন্তু সমাজ তাদের এমন পৃথক ক’রে রাখে। যেনো তারা ভিন্ন গ্রহ বা প্রজাতির। আরবি কিশোরী জৈবিকভাবে বাঙালি আর মার্কিন কিশোরীর মতোই বাড়ে, তবে তার ওপর সামাজিক বোঝা এতো ভারী এতো নির্মম যে তার মনই শুধু নয়, বিকৃত হয়ে যায় তার দেহও। তাদের সবার পরিণতি নারী; সব দেশেই নারী বিপন্নতার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ, এবং বহু দেশে তাবা পুবোপুরি পর্যাদস্ত। একই দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর কিশোরীতিরুণীর মধ্যেও রয়েছে মিল-অমিল; চাষী আর আমলার মেয়ের জৈবিক বিকাশ অভিন্ন, কিন্তু তারা এতো ভিন্ন শ্রেণীর যে তারা পরস্পরের সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু তারা একই পংক্তির। ধনী পরিবারের কিশোরীটির সাথে ওই পরিবারের কিশোরটির যতোটা মিল, তার চেয়ে অনেক মিল তার দরিদ্র চাষী পরিবারের কিশোরীটির সাথে; তারা শিকার একই সামাজিক নিয়তির। সব নারী, সব কিশোরীতিরুণীর ভাগ্য একই পীড়নের সুতোয় গাথা! সমাজ কিশোরীর দিকে ওৎ পেতে থাকা বাঘ একটু বিচূতি ঘটলে বাঘ লাফিয়ে পড়ে তার ওপর। সমাজ তার দেহকে যেভাবে বাড়া৩ে চায়, তাকে সেভাবে বাড়াতে হয়। দেহ; সমাজ যেভাবে স্বপ্ন দেখাতে চায় তরুণীকে, সেভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় তাকে। তারা সমাজনিয়ন্ত্রিত প্ৰাণী, খাচার মধ্যে তারা বাড়তে থাকে আদর্শ নারী হওয়ার জন্যে। বাঙালি নারীরা তাদের আত্মজীবনীতে বারবার ‘খাচা’ আর “পিঞ্জার’-এর কথা বলেছেন, পাখির রূপকে দেখেছেন নিজেদের; কিন্তু তারা পোষা পাখি ছিলেন না, ছিলেন পোষােজন্তু। সমাজ পোষােজন্তুটিকে বলে নারী। তার দেহ আছে; যে-দেহটি সে নিজের ব’লে পেয়েছে, সেটি তাকে বিব্রত করে, তাকে মাঝে মাঝেই অসুস্থ করে; তবে কিশোরী ওই দেহ, তরুণী ওই দেহ। তার দেহও সমাজেরই বিবেচনার বস্তু; তার দেহ পরিখের কর পরখ করতে থাকে অনেক সমাজ। অনেক সমাজে কিশোরী বুঝতেই পারে না। কীভাবে সে বেড়ে উঠেছে, তরুণী হয়েছে; তার আগেই তার দেহ কোনো বর্বর অত্যাচারে বিকৃত হয়ে যায়। প্রতিটি সমাজ কিশোরীতিরুণীর জন্যে বের করেছে সামািজীকিকরণের বিশদ বিধিমালা, যার লক্ষ্য তাকে পিতৃতন্ত্রের আদর্শকাঠামোর আদলে শিশুস্বভাবের নারী ক’রে তোলা।

সামাজিকীকরণের ফলে বদলে যেতে থাকে বালিকা, ভিন্ন হয়ে যেতে থাকে বালকের থেকে; সে খাপ খাইয়ে নিতে থাকে তার লিঙ্গভূমিকার সাথে, তবু সে তার স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ফেলে না। যেই সে পৌঁছে কৈশোরে, তার ভবিষ্যৎ বাসা বাঁধে তার শরীরে; দ্য বোভোয়ারের (১৯৪৯, ৩৫১) ভাষায়, ‘বয়ঃসন্ধির সাথে ভবিষ্যৎ শুধু ঘনিয়ে আসে না; তার শরীরে বাসা বাধে; পরিগ্রহ করে চরম মূর্ত বাস্তব রূপ।’ ভিন্ন হয়ে যায় কিশোরকিশোরী। কিশোর সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্কতার দিকে; তার ভবিষ্যৎ তার জন্যে চমৎকারভাবে সৃষ্টি ক’রে রেখেছে সমাজ, সেখানে সে প্রবেশ করে স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে; কিন্তু কিশোরী অপেক্ষা করতে থাকে, তার জীবন হয়ে ওঠে অনন্ত অপেক্ষা। কৈশোর বালিকার জন্যে ক্রাস্তিকাল; এ-সময়ে তার কোনো বিশেষ লক্ষ্য নেই, সে জানে না তার জীবনের উদ্দেশ্য। কিশোরী তরুণী হয়ে ওঠে, তার শরীরের বিপজ্জনক সুন্দর পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু সে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে না। তার জীবনে। তরুণীর সময় কাটে অবসাদগ্ৰস্ত প্ৰতীক্ষায়। সে প্রতীক্ষা করে পুরুষের } তার জীবন সে নিজে সৃষ্টি করতে পারে না, সমাজ সে-ব্যবস্থা রাখে নি; সমাজ উদ্ভাবন করেছে তাকে রুদ্ধ করার সমস্ত বিধি। তার জন্যে রেখেছে একটি প্রতীক্ষার মহাসামগ্ৰী : পুরুষ। তার জীবনের সারকথা সংহত একটি শব্দে : পুরুষ। কিশোরীকে, তরুণীকে সমাজ একটিই স্বপ্ন দিয়েছে; পুরুষ। কিশোরও স্বপ্ন দেখে নারীর, কিশোরও কামনা করে নারী; তবে তা তার জীবনের খণ্ডাংশ। নারী তার জীবনের নিয়তি নয়, নারীর মধ্যে সে দেখে না জীবনের পূর্ণতা। যুবক নিজের জীবনের পূর্ণতার স্বপ্ন দেখে বাস্তব সাফল্যে, নারী ওই সাফল্যের একটি অংশ; কিন্তু তরুণীর জীবনের সারকথা পুরুষ, যে পূর্ণ ক’রে তুলবে তার জীবন। এটা কোনো জৈব বিধান নয়; প্রকৃতি তাকে প্রতীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করে নি, কিন্তু সমাজ তার জন্যে পুরুষের প্রতীক্ষাকে ক’রে তুলেছে অবধারিত।

তরুণী থাকে অবসাদগ্ৰস্ত অস্তিত্বের মধ্যে বন্দী। তার কোনো লক্ষ্য নেই উদ্দেশ্য নেই; সে নিরর্থক প্রাণী। তাকে ওই নিরর্থকতার বন্দীত্ব থেকে যে উদ্ধার করবে, সে পুরুষ। সমাজব্যবস্থা পুরুষকে দিয়েছে ত্ৰাতার ভূমিকা। সব পুরুষ সমান শক্তিশালী, সমান ঐশ্বৰ্যশালী নয়; কিন্তু পুরুষ হওয়াই ঐশ্বৰ্য। পুরুষ শক্তিশালী, ধনী; তার হাতে আছে সুখের চাবি, সে স্বপ্নের রাজপুত্র। বালিকা বয়স থেকেই বালিকা দেখে পুরুষ উৎকৃষ্ট; পুরুষ। আয় করে টাকা। যে টাকা আয় করে সে-ই প্ৰভু। সমাজ নারীর পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে রেখেছে আর্থনীতিক ভিত্তিটি, যার ওই ভিত্তি নেই। সে কখনো দাঁড়াতে পারে না। কিশোরতরুণী জানে সে কখনো টাকা আয় করবে না, যে-সব কাজ সে শিখছে মায়ের পুণ্য আদর্শ অনুসাবণ করে সে-সবের কোনো আর্থ মূল্য নেই। তার কাজের আর্থ মূল্য নেই, তাই তারও মূল্য নেই! সে ব্যক্তি হয়ে উঠবে না, প্ৰভু হয়ে উঠবে না। সমাজের সব কিছু তাকে বুঝিয়ে দেয় তার জন্যে সবচেয়ে ভালো কোনো পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তি হওয়া। তার চাহিদা সামগ্ৰী হিশেবে। যে-মেয়ের জন্যে ঘন ঘন পাত্র আসে, তাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে বাবামা; যাকে বউ করার জন্যে প্রতিযোগিতা পড়ে যোগ্যদের মধ্যে, অন্য মেয়েরা ঈর্ষা করে তাকে; কারণ পুরুষ পাওযাই তার জীবনের সাফল্য। বিয়ে নারীর শ্রেষ্ঠ পেশা। তরুণীর জন্যে অন্যান্য পেশার থেকে এটা বেশি সম্মানজনক, এবং কম শ্রমসাধ্য; একটি দেহই তাকে এর যোগ্য ক’রে তোলে। বিয়ে তাকে দেয় সামাজিক মর্যাদা, এর মাধ্যমে তৃপ্ত হয় তার কাম ও মাতৃত্বম্পুহা। স্বামী পাওয়াই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণতম কাজ। এ-কাজ সে নিজে বেছে নেয় নি, এ-কাজকে সে নিজের জন্যে স্থির করে নি; সমাজই নির্ধারণ ক’রে দিয়েছে।

বিয়ে তার শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পেশা; কিন্তু এর জন্যে তাকে মূল্যও দিতে হয় প্রচুর। পুরুষ কোনো পেশার জন্যে এমন মূল্য দেয় না। সে একটি পেশার জন্যে উৎপাটিত করে নিজের অস্তিত্ব, তার যা কিছু পরিচিত আপন ছিলো তাদের থেকে সে সরিয়ে নেয় নিজেকে। সে মেনে নেয় নির্বাসন। সে নিজেকে সরিয়ে নেয় বাপের বাড়ি থেকে, পিতামাতার অধিকার থেকে, তার পরিচিত প্রিয় দৃশ্যগুলো থেকে। সে সক্রিয় বিজয়ীর বেশে ঢোকে না তার ভবিষ্যতে। সে শুধু নিজেকে সমর্পণ করে এক নতুন প্রভুর অধিকারে। সে যে নিজেকে সমর্পণ করে একটি পুরুষের কাছে, এর তাৎপর্য বের করার চেষ্টা করেছে। পুরুষতন্ত্ৰ : এর তাৎপর্য নারী নিকৃষ্ট পুরুষের থেকে, তার পুরুষের সমান হওয়ার শক্তি নেই। তাই সে অসম প্ৰতিযোগিতায় না নেমে নিজেকে সমর্পণ করে পুরুষের পায়ে, যার রয়েছে জয়ী হওয়ার শক্তি। বিয়ে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর নারীর নিকৃষ্টতার প্রমাণ। নারী নিজেকে সমর্পণ করে, তবে তার সমর্পণের মূলে কোনো জৈব কারণ নেই; প্রকৃতি তাকে পুরুষের অধীনে থাকার জন্যে সৃষ্টি করে নি। সমাজই তাকে তৈবি করেছে এমনভাবে। সমাজ তার জন্যে নির্ধারিত করে রেখেছে এমন ভবিষ্যৎ, যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বিয়ে তাকে কিছুটা স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তার বিবাহিত জীবন এক নিরন্তর সংকট; পুরুষেব স্বেচ্ছাচারিতার শিকার।

বয়ঃসন্ধি বদলে দেয়। বালিকার দেহ। এর আগে বালকবালিকার শরীরে থাকে সমান শক্তি, প্রাণবন্ততাও থাকে সমান; কিন্তু বয়ঃসন্ধি বালিকাকে জন্ম দেয় নতুন করে। তার দেহ হয়ে ওঠে আগের থেকে ভঙ্গুর, এক ঠুনকো অবয়ধের অধিকারী হয় সে, তার কামপ্রত্যঙ্গগুলো সহজে বোধ করে আহত, আর বুকের দু-পাশে দুটি বিব্রতকর। ফলের মতো দেখা দেয় অদ্ভুত, বিপত্তিকর স্তন। পুরুষের চোখে স্তন সুন্দর, তার শরীরের ওই স্ফীত পিণ্ড দুটি পুরুষের চোখে জাগায় তীব্র আবেদন; কিন্তু কিশোরী তা নিয়ে থাকে বিরত। অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে, আগের জামা তাকে পীড়া দিতে থাকে; সে দৌড়েতে গেলে ওগুলো দোলে, ব্যায়াম করতে গেলে দোলে। তার বুকে যন্ত্রণা হয়ে যা ফুলে ওঠে তা স্তন, যা তার নিজের কোনো কাজে লাগে না; একদিন পুরুষ ও-দুটি মথিত করে, শিশু শোষণ করে। কিশোরী হয়ে ওঠে দুর্বল, কমতে থাকে। তার পেশির শক্তি, সে হারিয়ে ফেলে তৎপরতা। একই বয়সে কিশোর অর্জন করে পেশি, অর্জন করে তৎপরতা। এমন একটি প্রক্রিয়া দেখা দেয় তার শরীরে, যা কখনো বোধ করে না পুরুষ; তা তার ঋতুস্রাব। পশ্চিমে একে এক সময় বলা হতো “অভিশাপ’, যা কিশোরীর কাছে আসলেই অভিশাপ মনে হয়। অধিকাংশ সমাজেই এর জন্যে তাকে প্রস্তুত ক’রে তোলা হয় না, তাই হঠাৎ অনভিপ্রেতি রক্তের প্রবাহ তাকে ভীত ক’রে তোলে। কিশোরী বোধ করে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, তলপেটে ব্যথা। ব্যাহত হয়ে পড়ে তার স্বাভাবিক জীবনধারা, তার শরীর হয়ে ওঠে তার জন্যে সমস্যা। সব ধর্মই শেখায় যে এটা অশুচি অপবিত্র, যদিও এতে নেই কোনো অশুচিতা অপবিত্রতা, তবুও কিশোরী নিজের অশুচিতা ও যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৩৫৩) বলেছেন, ‘সমগ্র মহাজগতকে তার মনে হয় এক দুৰ্বহ ভার। দুৰ্বহ ভারগ্রস্ত, নিমজ্জিত, সে নিজের কাছেই নিজে হয়ে ওঠে। অপরিচিত, কেননা বাকি সমগ্র জগতের কাছেই সে অপরিচিত।’ মাসে মাসে একই অগ্ৰীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে পাগল ক’রে তুলতে পারে; তবে কিশোরী জানে তাকে বেঁচে থাকতে হবে এ নিয়ে।

কৈশোরে, বছর তেরোর দিকে, বিকাশ ঘটে বালকের ইচ্ছাশক্তি। এ-সময় প্রকাশ ঘটতে থাকে তাদের আক্রমণাত্মক প্রবণতা, শরীর দিয়ে তারা পরখ ক’রে দেখতে চায় চারপাশ, জয়ের বাসনা দেখা দিতে থাকে শরীরের প্রতিটি কাজে; বালকেরা প্রতিযোগিতায় নামে। শারীরিক শক্তি হয়ে ওঠে বালকের জীবনের প্রধান সত্য; কিন্তু ওই বয়সেই, এবং তারো আগে, বালিকা নিজেকে গুটিয়ে নেয় শক্তির এলাকা থেকে। সমাজ তার মনে শক্তি চায় না, শরীরে শক্তি চায় না, সমাজের চোখে অপ্রয়োজনীয় তার অস্থি আর পেশি। তার কাছে সমাজ চায় কোমল মেদ। অধিকাংশ সমাজে ছোটো বালিকাদের জন্যেও নেই কোনো খেলাধুলো; এবং কৈশোরে পৌঁছে যা অবশিষ্ট থাকে, তাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বাঙালি বালিকা কোনো খেলার সুযোগ পায় না, তবু তারা মাঝে মাঝে দৌড়োনোর সুযোগ পায়, কিশোরীর জন্যে তাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠিনীরা মারাত্মক খেলোয়াড় ছিলো, দৌড়ে ওদের সাথে পেরে ওঠা ছিলো কঠিন; কিন্তু একদিন ওরা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। আমরা মাঠে খেলে চলেছি, ওরা উকি দিয়ে চলেছে আমাদের দিকে। এর পর ওরা আমাদের দেখে লাজা পেয়েও পিছলে পড়তো, মনে হতো। ওরা হাঁটতেও ভুলে গেছে। কিশোরী শক্তি, পেশি, গতির এলাকা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঢ়োকে ঘিরে, ঘর তার দেহকে শিথিল অবসন্ন করে তোলে। তারা হয়ে ওঠে অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পুরবালা, অসূৰ্যম্পশ্যা।

কিশোরীতিরুণীর শরীর বিকশিত হয় না। সক্রিয়ভাবে, তাদের দেহ অক্রিয়ভাবে ভোগ করে বিভিন্ন ব্যাপার। শরীর’ শব্দটিতে রয়েছে এক ধরনের সক্রিয়তা; তাই এক সময় নারীর শরীর বোঝাতে এ-শব্দটি ব্যবহৃতই হতো না : ব্যবহৃত হতো দেহ, দেহলতা, দেহবল্লরী, তনু, তনুলতার মতো অপেশল শব্দ। তাদের ক’রে দেয়া হয় সীমাবদ্ধ, তারা যেতে পারে না। সীমার বাইরে; তরুণের জীবনের প্রাণ প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতা, কিন্তু তরুণীর জীবনের কোনো সক্রিয় প্রতিযোগিতা থাকে না। প্রতিযোগিতার এলাকা থেকে নির্বাসিত তারা তুলনা করে, শুধু তুলনা করে। তারা তুলনা করে ছেলেদের সাথে ছেলেদের, তুলনা করে নিজেদের সমস্ত তুচ্ছ বিষয়ের। তুলনা কোনো সক্রিয় কাজ নয়: তুলনা করা সক্রিয় প্রতিযোগিতার বিপরীত। সক্রিয়র কাজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া, জয় লাভ করা, আর অক্রিয় দর্শকের কাজ প্রতিযোগীদের মধ্যে তুলনা করা। কিশোরীতিরুণী হয়ে ওঠে। জয়পরাজয়কম্পিত মুখরিত পৃথিবীর দর্শক। প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে জয়পরাজয়, থাকে অন্যদের পরাভূত ক’রে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ; কিন্তু কিশোরীতিরুণী কখনো প্রতিযোগিতায় নামে না। এটাও কোনো রহস্যজনক জৈব ব্যাপার নয়, এটা সম্পূর্ণরূপে সামাজিক। সমাজ চায় না তারা প্রতিযোগিতায় নামুক, তারা মেতে উঠুক জয়পরাজয়ে; সমাজ চায় তারা তাদের আরাধ্য পুরুষদের মধ্যে তুলনা করুক। তরুণীর শারীরিক শক্তির অভাবের ফলে তার মধ্যে জন্ম দেয় ভীরুতা। সে যে শুধু টিকটিকি তেলেপোকাকে ভয পায়, তা নয়; সে ভয় পায় সক্রিয় সব কিছুকেই। পিতৃতন্ত্র খুব পছন্দ করে এটা, নারীর ভয় তার মনে হয় সুন্দর: চরম ভয়ের মধ্যে বাস করারই নারীত্ব। কিশোরীতিরুণী যেহেতু নিজেদেব শরীরে শক্তি অনুভব করে না, তাই নিজেদের ওপর তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে; তারা কখনো রুখে দাঁড়ায় না, মেনে নেয়। তাদের ওপর সব আক্রমণ। তারা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তাদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও আত্মরক্ষা করতে পারে না; কেননা নিজেদের শক্তিতে তারা অবিশ্বাসী। তারা ছেড়ে দেয় উদ্যমশীলতা, বিদ্রোহের সাহস তাদের থাকে না। তারা দণ্ডিত ভীরুতা ও আত্মসমর্পণে, তারা অবস্থান নেয়। তাদের সমাজনির্ধারিত স্থানে। তারা হয়। বাশমানা, তাদের মনে হয় যা যে-অবস্থায় আছে থাকবে সে-অবস্থায়ই। নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের কথা ভাবনায় আসে না তাদের। শরীর তাদের নিয়তি নয়, তবু শরীরই হয়ে ওঠে তাদের সামাজিক নিয়তি।

কিশোরীতিরুণীর শরীর নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেক সমাজ, ওই সমস্ত সমাজ চায় পুরুষের জন্যে তারা প্ৰস্তুত রাখবে একটি অক্ষত দেহ, এমন কাচের পাত্রের মতো যন্তে রাখবে শরীর যাতে তাদের রন্ধের ঝিল্লিটির একটি তত্ত্বও না ছেড়ে। তরুণীকে রক্ষা করতে হবে তার সতীত্ব। পিতৃতন্ত্র তরুণের সততা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়, তরুণের সততা ভিন্ন ব্যাপাের; তরুণীব সতীত্ব হচ্ছে তার অক্ষত সতীচ্ছদ। পিতৃতন্ত্রকে সে শ্রেষ্ঠ যে-উপহারটি দিতে পাবে, তা একটি অটুট সতীচ্ছদ। মধ্যপ্ৰাচ্য ও ৩ার সনিকট অঞ্চলের মুসলমান পিতৃতন্ত্র রখনো তরুণীর সতীত্ব ও সতীচ্ছদের ওপর দেয় বিভীষিকাজাগানো গুরুত্ব, যার ফলে প্রতিটি তরুণী বাস করে দোজখের ভীতির থেকে ভয়ানক ভীতির মধ্যে। ভূমধ্যসাগবীয় পুরুষদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের একটি হচ্ছে অটুট যোনিচ্ছদসম্পন্ন কুমারী, যাকে এর আগে আর কোনো পুরুষ ছোয় নি। ফাতিমা মের নিসসি (১৯৮২, ১৮৩) বলেছেন, সেখানে পুরুষের মর্যাদা অবস্থিত নারীর দু-উরুর মাঝখানে। প্রকৃতিকে বশ বা পর্বত জয় ক’রে তারা অর্জন করে না মর্যাদা, তারা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে আয়ত্ত করে মানসম্মান। সেখানে পুরুষ চায় নারীর সতীত্ব, চায় তার অক্ষত সতীচ্ছদ; এবং এ-কামনাকে তারা এতো দূর নিয়ে যায় যে তা হয়ে ওঠে মহাজাগতিক উন্মত্ততা। ওই পুরুষেরা চায় তাদের নারীরা সতী হবে, কিন্তু তারা নিজেরা লিপ্ত হবে। অবৈধ যৌনসম্পর্কে, যাবে কাম থেকে কামে। সতীত্ব ও সতীচ্ছদ নিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পুরুষের পরাবাস্তব পাগলামোর বিবরণ দিয়েছেন নওঅল এল সাদাওয়ি তার হাওয়ার লুকোনো মুখ (১৯৮০, ২৪-৩২) বইয়ের ‘সতীত্ব/সম্মান নামক খুব পাতলা ঝিল্লিী’ নামের বমিজাগানো পরিচ্ছেদে।

প্ৰত্যেক আরব বালিকার থাকতে হয় একটি পাতলা পর্দা, যার নাম সতীচ্ছদ। এটা তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ। তবে শুধু সতীচ্ছদ থাকলেই চলবে না, সতীচ্ছদটিকে হ’তে হবে বিশুদ্ধ: বাসর রাতে ওটিকে প্রচুর রক্তপাত ক’রে প্রমাণ করতে হবে যে তার অধিকারিণী ছিলো পরম সতী। বিছানার শাদা চাদরে পড়তে হবে রক্তের দৃষ্টিগ্রাহ্য দাগ। মেয়েটি যদি অভাগিনী হয়, তার থাকতে পারে একটি শক্ত স্থিতিস্থাপক চ্ছদ। ওই চ্ছদটিকে আঙুল বা শিশ্ন দিয়ে ঘাটলেও কোনো রক্ত বেরোবে না। সে প্রমাণ করতে পারবে না। সে সতী। পরদিনই হয়তো তাব লাশ পাওয়া যাবে কোনাে বালুকাস্তুপে। কোনো কোনো মেয়ের চ্ছদ এতো পাতলা হয় যে তা হাঁটতে ফিরতে দৌড়োতে গিয়েই ছিড়ে যেতে পারে, সেও প্রমাণ করতে পারবে না। সে ছিলো সতী । বংশের সম্মানের জন্যে সেও হয়তো লাশ হবে। কোনো কোনো মেয়ের ওই চছদটি নাও থাকতে পারে, সে প্রাকৃতিকভাবেই অসতী! নওঅল চিকিৎসক, তার কাছে একবার একটি ষোলো বছরের ‘গৰ্ভবতী’ মেয়ে আসে। তিনি দেখেন মেয়েটি গর্ভবতী নয়; তার যোনিচ্ছদে কোনো রন্ধ নেই বলে বছরের পর বছর ধ’রে তার পেটে জমেছে ঋতুস্রাবের রক্ত। তার ভাগ্য ভালো, সে বিবাহিত: অবিবাহিত হ’লে হয়তো পরিবারের নামে তাকে কোরবানি করতো ভাই বা বাবা। এমন ঘটনা মিশরে অনেক ঘটেছে। সুঠু যোনিচ্ছদ নিয়ে জন্মে মাত্র ৪১.৩২% মেয়ে; ১১.২% মেয়ের কোনো চছদই থাকে না, ১৬.১৬% মেয়ের চ্ছদ এতো পাতলা হয় যে ছিড়ে যায় সহজে, আর ৩১.৩২% মেয়ে জন্মে মোটা স্থিতিস্থাপক চ্ছদ নিয়ে নওঅল (১৯৮০, ২৬)]। তাই বাসর রাতে রক্ত ঝরতে পারে ৪১.৩২% মেয়ের, কিন্তু সতীচ্ছদপাগল আরব চায় সব বাসরশয্যা হবে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো রক্তাক্ত । সেখানে স্বামী বিছানায় রক্তের দাগ না পেয়ে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে আসে চিকিৎসকের কাছে স্বচ্ছদ আছে কিনা পরীক্ষা করানোর জন্যে, পিতামাতা চায় তাদের মেয়ের জন্যে একটি সতীচ্ছদের সার্টিফিকেটা! আরব সমাজে তরুণীর দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রত্যঙ্গ’ তার যোনিচ্ছদ; তা তার চোখ, হাত বা পায়ের থেকে অনেক মূল্যবান। মেয়ে একটি হাত বা চোখ হারালে ততোটা দুঃখ পায় না। আবব পিতামাতা, যতোটা পায় তার চচ্ছদটি নষ্ট হ’লে । বাসর রাতে যে-মেয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে প্রমাণ করতে পারে না যে সে সতী, সে তালাক পায়, মৃত্যুও তার প্রায় অবধারিত। এ নিয়ে তৈরি হয় বড়ো কেলেঙ্কারি, নষ্ট হয় বংশের মর্যাদা। পরিবারটি ডুবে যায় অপমানে, যা শুধু ‘মোছা সম্ভব রক্তে’ } তারা বিশ্বাস করে আল্লা মেয়েদের যোনিচ্ছদ দেয় সতীত্ব রক্ষার জন্যে, মেয়েদের দায়িত্ব ওই চািচ্ছন্দ পুরুষকে উপহার দেয়া ।

বাসররাতে সেখানে প্রতিটি বন্ধুকে দিতে হয় রক্তাক্ত সতীত্বের পরীক্ষা। স্বামীটি নিজে শিশ্ন বা আঙুল দিয়ে যোনি খুঁড়ে দেখতে পারে, কিন্তু অনভ্যস্ত যুবকেরা সব সময় ঠিক মতো কাজটি পারে না। তাই মিশরে আছে দায়া’ বা ‘নারী হাজাম’, যাদের কাজ মেয়েদের খৎনা করানো, এবং বাসর রাতে সতীচ্ছদ ছেড়া। তারা দেখতে কুৎসিত, হাতে রাখে বড়ো বড়ো নখ, যা তাদের পেশার জন্যে দরকার। দায়াকে পারিশ্রমিক ছাড়াও বেশ ঘুষ দিয়ে থাকে মেয়ের বাবামা, যাতে সে নখ দিয়ে গভীর ক’রে খুঁড়ে প্রত্যঙ্গটির দেয়াল-চ্ছদ-ওষ্ঠ ছিন্নভিন্ন ক’রে প্রমাণ ক’রে দেয় মেয়ের সতীত্ব। বাসরঘরে ঢোকে দায়া, বাইরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মেয়ের বাবামা আত্মীয়স্বজন। মেয়ের সতীত্বে অসতীত্বে দায়ার কিছু যায় আসে না, সে জানে সতী প্রমাণ হ’লে তার মিলবে প্রচুর টাকা। সে তার নোংরা আঙুল আর বড়ো নখ ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের যোনিতে, মেয়েটির ভাগ্য ভালো হ’লে রক্ত বেরিয়ে আসে সহজে, সে ওই রক্তে ভেজায় শাদা রুমাল। যদি সহজে না বোরোয়, সে তার দীর্ঘ নখ ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের যোনির দেয়ালে, খুঁড়ে ফেলে দেয়াল, ফিনকি দিয়ে বেরোয় রক্ত; আর ওই রক্তভেজা রুমাল তুলে দেয় মেয়ের পিতার হাতে। পিতা মেয়ের যোনিরক্তভেজা রুমাল পতাকার মতো উড়িয়ে ঘোষণা করে মেয়ের সতীত্ব, হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে আত্মীয়স্বজন। মেয়েটি বিছানায় কাতরাতে থাকে, রক্তে তার মহাজগত ভিজে যায়; কিন্তু মরুভূমিকে সে একটি চ্ছদ দিতে পেরে ধন্য বোধ করে। এমনই বর্বর ওই মরুভূমি। সতীচ্ছদ আরব পুরুষদের জাতীয় পতাকা।

চোখের বদলা যেমন চোখ, মিথ্যার বদলা তেমনই মিথ্যা: আর প্রতারণার বদলা প্রতারণা। আরব পুরুষ নিজে যৌনসৎ নয়, কিন্তু চায় সতী; তাই প্রতারণা তার প্রাপ্য। আরব পুরুষ রক্ত চায়, তাকে পেতে হয় রক্তের প্রতারণা। আগে বাসর রাতে মেয়ের যোনিতে ঢুকিয়ে দেয়া হতো মুরগির রক্তের দিলা, এখনো গরিব পরিবারে তা করা হয়; আর ওই বক্তের দাগ দেখে শান্ত হয় আরবের হৃদয়। এখন সেখানে দেখা দিয়েছে। সতীচ্ছদের শল্যসংযোজনা! শল্যচিকিৎসক এখন সতীত্ব হারানো তরুণীর রন্ধে কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি সতীচ্ছদ জুড়ে দিয়ে তাকে আবার ক’রে তোলে সতী। আরব অঞ্চলে এখন দেখা দিয়েছে কৃত্রিম সতী। এ-সুযোগ নিচ্ছে ধনী পরিবারের মেয়েরা। ১৯৬৮তে সতীচ্ছদ সংযোজনের ব্যয় ছিলো ২০০০ দিবাহাম, এখন নেমেছে ৫০০-১০০০ দিরহামে। সেখানে একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের বার্ষিক ব্যয় ৬৫ দিরহাম, একটি মেয়ের রন্ধ শেলাইয়ের ব্যয় ২০০০ দিরহাম! সতীচ্ছদ সংযোজনে ব্যবহৃত হয় অতি আধুনিক পদ্ধতি, কিন্তু এটি সেবা করছে সবচেয়ে আদিম পিতৃতন্ত্রের। ফাতিমার (১৯৮২, ১৮৫) মতে, কৃত্রিম সতীত্ব উদ্ভাবিত হয়েছে, কেননা আরব পুরুষ চায় অসম্ভবকে। তারা নিজেরা বিয়ের আগে নারীদের সতীত্ব হরণ করে, কিন্তু বিয়ের সময় হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে একটি সতী-একটি সতীচ্ছদ! কৃত্রিম সতীচ্ছদ আরব পুরুষের জন্যে যোগ্য পুরস্কার, শঠকে পুরস্কৃত করতে হয় শঠতা দিয়েই। নওঅল (১৯৮০, ৩০-৩১) আরবদের ওপারস্পরিক প্রতারণার একটি তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা বলেছেন। এক দিন একটি মেয়ে তার চিকিৎসালয়ে আসে। সে পাচ মাসের গর্ভবতী, কিন্তু তার সতীচ্ছদ রয়েছে অটুট! মেয়েটি তাঁকে জানায় যে বার বার অগভীর সঙ্গমের ফলে তার গর্ভ ঘটেছে। মেয়েটি তাকে অনুরোধ করে পেট কেটে বাচ্চাটি ফেলে দিতে, যাতে অক্ষত থাকে তার মূল্যবান চ্ছদটি। তিনি রাজি না হওয়ায় মেয়েটি চলে যায়; বহু বছর পর মেয়েটির সাথে তাঁর দেখা হয়, মেয়েটি তাকে জানায় সে অন্য এক ডাক্তার দিয়ে পেট কেটে গর্ভপাত করিয়েছিলো। এখন সে এক সফল প্রকৌশলীর স্ত্রী, তাদের দুটি সন্তান হয়েছে। নওঅল (১৯৮০, ৩১) বলেছেন :





‘কল্পনায় আমি মাঝে মাঝে আমার অদেখা সে-প্রকৌশলীটিকে দেখি, দেখতে পাই বাসর রাতে সে পবিত্র অনুষ্ঠানরূপে তার স্ত্রীর চচ্ছদ ছিন্ন করছে, বুঝে নিচ্ছে যে তার স্ত্রী ছিলো কুমারী; এবং পবিম সুখে সে দেখতে পায় তার স্ত্রীর চচ্ছদটি অটুট বয়েছে। তবে কাছে ওই মেয়েটির পেটের লম্বালম্বি কাটাদাগটি তুচ্ছ, যেমন ওই মেযেটিব হৃৎপিণ্ড বা যকৃৎ বা মস্তিষ্কে একটি কাটা দাগেব কোনো তা ৎপর্য নেই তার কাছে, তবে এক মিলিমিটাব দীর্ঘ ওই চ্ছদে যদি থাকতো একটি ছোটো ছেড়া, তাহলে তা উল্টেপাল্টে দিতো তার সমগ্ৰ জগত।‘

কিশোরীবালিকা রখনো এমন আদিমতার শিকার পিতৃতন্ত্রের নানা প্রান্তে। তার দেহ যেমন অক্ষত পেতে চায় অনেক সমাজ, আবাবা অনেক দর্শনবিজ্ঞান মনে করে সহজাতভাবেই তার দেহ বিকলাঙ্গ। প্লাতো ও তাঁর অনুসারীরা মনে করতেন নারীর শরীর নিকৃষ্ট পুরুষের শরীর থেকে; এবং উনিশশতকে অটো ভিনিঙ্গার নামের এক জর্মন বালক লিঙ্গ ও চরিত্র নামে একটি বই লিখে দেখায় কতো নিকৃষ্ট নারীর দেহ ও চরিত্র। ফ্ৰয়েড গভীর প্রভাবিত ছিলেন তার দ্বারা, এবং তারই নারীধারণাকে তিনি দিয়েছিলেন ছদ্মবৈজ্ঞানিক রূপ। ভিনিঙ্গার বইটি লিখে অল্প বয়সেই আত্মহত্যা করে, তবে তার লেখায় রূপ পায় তরুণীর দেহ ও চরিত্র সম্পর্কে পুরুষের আদিম ঘৃণা। তার চোখে নারী অভিন্ন তার দেহ ও তার অবচেতন কামের সাথে; তাই নারী পাশব। তার মতে, ‘যে-পুরুষ নারী সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে তার পক্ষে নারী সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা অসম্ভব; পুরুষ নারীকে ঘৃণা করে, বা তারা কখনো নারী সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবে না’। তার সিদ্ধান্ত [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭০, ১০৫)] :

‘একটি সম্পূর্ণ নগ্ন নারীদেহ এমন অনুভূতি সৃষ্টি করে যেনো তার অভাব রয়েছে কোনো কিছুর, তার রযেছে এমন অসম্পূর্ণতা যা সৌন্দর্যের সাথে অসমঞ্জস।… নারীকে আকৃষ্ট করে কামের বিকশিত চিহ্নগুলো; সে বিকর্ষণ বোধ কবে মনের উন্নত গুণাবলির প্রতি। নারী মৌলিকভাবে লিঙ্গপূজারী।‘

তরুণের যৌনপ্রবর্তনা তার শারীর শক্তিরই প্ৰকাশ, সম্ভোগ করে সে উপলব্ধি করতে চায় পৌরুষ। তরুণী তার কামনার ভেতরে পোষণ করে লজ্জা। কেননা সে জানে। সে সম্ভোগ করবে না, তাকে সম্ভোগ করবে। পুরুষ; সে হবে পুরুষের খাদ্য। যুবক তার কামের সাফল্যে গৌরব বোধ করে, একের পর নারী সম্ভোগ করার জন্যে বোধ করে ব্যগ্ৰতা; এতে তার কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু তরুণী লজ্জায় কুঁকড়ে থাকে, সম্ভোেগ তার জন্যে নয়। তার কামের সাফল্যের অর্থ হচ্ছে নিজের শরীরকে পুরুষের সম্ভোগের বস্তু ক’রে তোলা। তার সারা দেহ তার কাছে বিব্রতকর। প্ৰতি মাসের রক্তক্ষরণের ফলে নিজের দেহকে তার নিজের কাছে মনে হয় বিরক্তিকর। ঋতুস্রাব তার এক প্ৰতিবন্ধকতা। প্রতি মাসে তার জীবনে একটা ব্যাঘাতের মতো দেখা দেয় ওই রক্ত। এটা তার জীবনে সৃষ্টি করে বিভীষিকা, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে তার চেতনা জুড়ে। সে সন্দেহ করে নিজের দেহকেই, ভয়ে ভয়ে থাকে নিজের দেহ নিয়ে; নিজের দেহকে মনে করে অসুস্থ। যদিও ঋতুস্রাব এতো বিকল করার মতো ব্যাপার নয, তবু তার মনোজগতে এটা এমন বিকলন ঘটিযে দেয় যে তার সম্পূর্ণ মহাজগতই হয়ে ওঠে বিকল। নারী হওয়ার অস্বস্তি ধ্বংস ক’রে দেয় নারীর শরীর। তবে নারীর শরীর তার জন্যে প্রতিবন্ধকতা, কেননা চারপাশ চায় তার শরীর তার জন্যে হোক প্রতিবন্ধকতা। এমন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্যে কোনো পেশা থেকে দূরে থাকার দরকার পড়ে না। এ-সময় দু-এক দিন সে অসুস্থ থাকতে পারে, কিন্তু এটা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। এ-সময়ে অধিকাংশ নারীই তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ ক’রে থাকে। কিন্তু ধর্ম বলে সে অশুচি, সমাজ বলে সে রুগ্ন।

সমাজ নারীর জন্যে নিষিদ্ধ ক’রে রাখে। বাইরের সমস্ত কাজ। এখন দেশে দেশে নারী বাইরের অনেক কাজ করছে, তবু অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নারীর জন্যে বাইর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে-সব দেশে নারী বাইরে কাজ করতে পারছে, সেখানেও নারীর জন্যে রাখা হয় বিশেষ ধরনের কাজ। এমন কোনো কাজে নেই, যা অসম্ভব নারীর পক্ষে; কিন্তু সমাজ তাকে কাজ না দিয়ে, তার জন্যে কাজ নিষিদ্ধ করে, প্রমাণ করে সে অনুপযুক্ত বা নিকৃষ্ট। সমাজ সব দিকে তার বিকাশের পথ বন্ধ ক’রে দিয়ে প্রমাণ করে যে তার পক্ষে বিকাশ অসম্ভব। সুপরিকল্পিতভাবে সমাজ তাকে ঠেলে দেয় হীনমন্যতাগূঢ়ৈষার দিকে। মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতার কথা ধরা যাক। প্রচলিত লোকবিশ্বাস হচ্ছে যে কৈশোর থেকে মেয়েদের হ্রাস পেতে থাকে মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা। এ-লোকবিশ্বাস কি সত্য বা সত্য হ’লে কী কারণ রয়েছে। এর পেছনে? স্বীকার ক’রে নেয়া যাক যে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এটা সত্য; কিন্তু এর কারণ কি? এর কারণ নারীর জৈবসংগঠনে খুঁজলে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে সমাজসংস্থায়। এর কারণ মেয়েদের উৎসাহ দেয়া হয় না। এসব ব্যাপারে; আগে নিষেধ করা হতো, এখন নিষেধ করা না হ’লেও তাদের অনুপ্রাণিত করা হয় না। ভাইটির জন্যে সব সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়, তার পড়াশুনোয় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে তা দেখে পিতামাতা, এমনকি বোনটিও। বোনটির কাছে আশা করা হয় না মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা; সে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি হবে এ তো আশা করাই হয় না, এমনকি সে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা হবে তাও আশা করা হয় না। তার কাছে। আশা করা হয় নারীত্ব, তার কাছে দাবি করা হয় সে হবে নারী। যে-মেয়েটি লেখাপড়া করছে, তার কাছে ভালোভাবে লেখাপড়া চাওয়া হয় না, চাওয়া হয় লেখাপড়ার সাথে সে ভালোভাবে আয়ত্ত করবে নারীর কাজগুলো। লেখাপড়া তার কোনো কাজে আসবে না, কাজে আসবে নারীর কাজগুলো। এমন প্রত্যাশা করা হয় যার কাছে, সে কী ক’রে হবে মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল? বাসার কিশোর বা তরুণ পুত্রটির পড়াশুনো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, তার জীবনে আছে প্রমোদের ব্যবস্থাও। তাকে কেউ কুটোটিও নাড়তে বলে না; কিন্তু বাসার কিশোরী বা তরুণী কন্যাটিকে করতে হয় গৃহপরিচারিকার ক্লান্তিকর কাজগুলো।

ঘরকন্নার কাজগুলো হচ্ছে সবচেয়ে ক্লান্তিকর কাজ। একই কাজের পুনরাবৃত্তি চলে তাতে সারা জীবন ভরে, আর যে জড়িয়ে পড়ে ওই কাজে তার জীবন হয় ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির পুনরাবৃত্তি। যে-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাকে জানতে হবে চমৎকার মাছ ভাজী; যে-কিশোরী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাকে শিখতে হবে চমৎকার শেলাই। বাসার কিশোর আর তরুণটির কাছে তা আশা করা হয় না, কিন্তু কিশোরীতিরুণীর কাছে দাবি করা হয়। ছেলেটি তার বিছানা গুছিয়ে না রাখলে মা খুশি হয়, দেখতে পায় একটি পুরুষের জন্ম হচ্ছে; কিন্তু মেয়েটি বিছানা না গোছালে একটি নারীর মৃত্যু দেখে মা আতংকিত হয়ে পড়ে। এমন দাবি করা হয় যার কাছে তার পক্ষে মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল হওয়া অসম্ভব। মা মেয়ের বড়ো শুভাখী, কিন্তু মা-ই মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেয় পারিবারিক কাজের বোঝা। এতে তার কোনো অশুভ উদ্দেশ্য নেই, খুবই শুভ তার উদ্দেশ্য; মা জানে তার মেয়ের জীবন সৃষ্টিশীলতার নয়, সমাজ তাকে ওই অধিকার দেয় নি, ওই অধিকার দিয়েছে পুত্ৰকে। সমাজের বিশ্বস্ত পুলিশের মতো কাজ করে চলে মা: এবং মেয়েটিকে বন্দী করে ফেলে। কিন্তু এ-মা-ই ছেলেটিকে দেয় স্বাধীনতা। মেধাবী মেয়েটির থেকে অনেক বেশি যত্ন নেয়া হয় নির্বোধ ছেলেটির, এবং একদিন দেখা যায় নির্বোধ ছেলেটি ছাড়িয়ে গেছে মেধাবী মেয়েটিকে। যে-কিশোরী প্রথম হয় মাধ্যমিক পরীক্ষায়, পনেরো বছর পর সেও দেখতে পায় তার থেকে অনেক সাফল্য লাভ করেছে তার সাথের সাধারণ মেধার ছেলেরা; কেননা সে ক্রমশ ছেড়ে দিয়েছে উচ্চাভিলাষ, কিন্তু ছেলেরা সমাজের প্রেরণায় ও চাপে হয়েছে উচ্চাভিলাষী। উচ্চাভিলাষের জন্যে স্বাধীনতা দরকার, কিন্তু তরুণীর জীবনে তা নেই।

সামাজিক সমস্ত প্ৰথা তরুণীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। অনেক দেশ আছে, যেখানে মেয়েদের জন্যে পথ নিষিদ্ধ, তারা পথে বেরোতে পারে না; বেরোলে নিজেদের ঢেকে রাখতে বাধ্য হয় বোরখার মধ্যযুগীয় অন্ধকারে; এবং অবরোধের অন্ধকারের মধ্যে কাটে তাদের জীবন। আরবদেশগুলো এখনো মেয়েদের ঢেকে রাখছে। এ-অন্ধকারে। বাঙলাদেশে বিশশতকের কয়েক দশক জুড়ে তারা থেকেছে অবরুদ্ধ। পিতৃতন্ত্রের মধ্যে মুসলমান পিতৃতন্ত্র রখনো হিংস্রভাবে রক্ষণশীল; ইরান-মধ্যপ্রাচ্যের তরুণীরা জানে না স্বাধীনতার একটি বিন্দুর স্বাদ কেমন [দ্র ফাতিমা (১৯৭৫, ১৯৮৪), নওঅল (১৯৮০)]। ফাতিমা মেরনিসসির বোরখা পেরিয়ে (১৯৭৫) ও মুসলমানের অবচেতনায় নারী (১৯৮৪), এবং নওঅল এল সাদাওয়ির হাওয়ার লুকোনো সুখ-এ (১৯৮০) ভয়াবহ বিবরণ মেলে মুসলমান তরুণীদের জীবনবিভীষিকার। তাদের তুলনায় বাঙালি কিশোরীতিরুণীরা অনেক স্বাধীন; তবে ওই স্বাধীনতা ছেলেদের স্বাধীনতার তুলনায় তুচ্ছ। বাঙলাদেশে মেয়েরা রাস্তায় বেরোতে পারে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মধ্যে; তাদের বেরোনোয় কোনো নিষেধ নেই, কিন্তু পথে পথে তারা দেখে নিষেধ। পাড়ার মাস্তান তাকে দেখে শিস দেয়, মুদি মন্তব্য করে, ধার্মিকেরাও তার বুকের দিকে নির্লজের মতো তাকায়। সে একা নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া যেতে পারে না, তাকে স্বাধীনতা শিক্ষা দেয়ার জন্যে পথেঘাটে ধানখেতের আলে ওৎ পেতে আছে শিশ্নধারীরা। কিশোরীতিরুণী বাঙলাদেশে স্বাধীনতা ভোগ করে ধর্ষণকারীর উদ্যত শিশ্নের ছায়ার নিচে, তারা স্বাধীনতা ভোগ করে ক্যামুকের অ্যাসিডের ধারাপাতের বিভীষিকার নিচে। তারা রাস্তায় বেরোয় যেনো পথের দু-দিকে দেখার মতো কিছু নেই, যেনো গন্তব্য ছাড়া তারা আর কিছু জানে না। সমাজ তাদের জানিয়ে দেয় তাদের পথে বেরোনোর অনুমতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু পথের স্বাধীনতা দেয়া হয় নি। ছেলের জন্যে পথই গন্তব্য, কিন্তু কিশোরীতিরুণীর জন্যে পথ গন্তব্য নয়। তাই তাদের সব সময় চলতে হয় নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিতে, দণ্ডিত নাগরিক হিশেবে; ঘরে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বাইরে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে করে শুকিয়ে যায়। তাদের স্বতস্ফুৰ্ততা। তাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে মানসিক চাপ, সারা শরীর জুড়ে দেখা দেয় ক্লান্তি অবসাদ। তরুণী হয়ে ওঠে। ক্লান্তি অবসাদের রক্তমাংসস্তুপ।

অবসাদে পরিবৃত থাকে তরুণীর শরীর ও জীবন। তাই তরুণীরা একে অন্যকে ক্লান্ত অবসন্ন ক’রে তোলে সহজে, দুটি ক্লান্ত শরীরপ্রাণ বেশিক্ষণ পরস্পরকে সজীব রাখতে পারে না। তারা পছন্দ করে, দরকার বোধ করে তরুণের সাহচর্য। সমাজ তাদের বুঝিয়ে দেয় তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাদের বাধা দেয় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে। কিন্তু তারা পারে না। স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে, কোনো কিছুই একলা করতে পারে না, পারলেও তাদের দ্বিধা থেকে যায়। অস্বয়ংসম্পূর্ণতার অশক্তি তাদের ভেতরে বাড়িয়ে তোলে ভীরুতা, দ্বিধাগ্ৰস্ততা, যা দেখা দেয়। তাদের কাজে ও জীবনে। কামিনী রায়ের ‘করিতে পারি না কাজ/ সদা ভয় সদা লাজ / সংশয়ে সংকল্প সদা টলে’ মহিলা কবি ও কিশোরী ও তরুণীর কথা, কিশোর বা তরুণের কথা নয়। সমাজ তাদের বুঝিয়ে দেয়, তারাও মনে করে অসামান্য কোনো সাফল্য অর্জন তাদের জন্যে নয়; ওসব ছেলেদের জন্যে। তাই তারা উচ্চাভিলাষ পোষণ করতেও ভয় পায়, পরিহাব ক’রে চলে সব উচ্চাভিলাষ। তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে ছেলেরা উৎকৃষ্ট, তারা যা পারে না তা অবশ্যই পারে ছেলেরা, পারতেই হবে ছেলেদের। সমাজ ছেলেদেব ওপর বিশ্বাস করে, তরুণীরাও বিশ্বাস করে ছেলেদের সমাজ তাদের ওপর আস্থাহীন, তারাও আস্থাহীন নিজেদের ওপর। এমন আত্মবিশ্বাসহীনতা যাদের, তাদের বিকাশ অসম্ভব; তারা অবিকশিত থাকতে বাধ্য। এর পরিণতি আলস্য আর নিম্নমাঝারিত্ব, কোনো কিছু ভালোভাবে করতে না পারা। তরুণী বিশ্বাস করে সে যা পারে না, তা অবশ্যই পারে তরু%; পারতেই হবে তরুণকে। নিজে না পারার জন্যে সে অস্বস্তি বোধ করে না, কিন্তু তা যদি না পারে ছেলে তবে সে বোধ করে অস্বস্তি 1 ছেলেরা যে ছেলে। কিশোরীতিরুণীকে সমাজ দীক্ষা দিয়েছে এমন পরাজয়ী মনোভাবে। তার পরাজয়ী মানসিকতার কারণ তরুণী জানে তার ভবিষ্যৎ তার হাতে নয়; তার মনোভাব এমন যে কী হবে এতো সাধ্যসাধনা করে যেখানে তার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভর করছে অন্যের ওপর। এটা এক দিকে যেমন নিয়তির কাছে আত্মসমৰ্পণ, তেমনই প্রতিবাদও। সমাজে যেহেতু পুরুষই সব, তাই সে চায় পুরুষই তার হয়ে রক্ত বাষ্প ক’রে অর্জন করুক সাফল্য।

তরুণীর পরাজয়ী মানসিকতার মূলে নিজের নিকৃষ্টতার বোধ কাজ করে না, সে মনে করে না যে সে সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট, বরং তার প্রতিবাদী মনোভাবই জন্ম দেয় তার এ-বোধ : তাকে যে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে, সমাজ যে চায় সে নির্ভর করবে: কোনো পুরুষের ওপর, এটা তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে; এবং সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় সাফল্যলাভের সব ইচ্ছে। তার কোনো যোগ্যতা সমাজের চোখে গুরুত্বপূর্ণ নয়, পুরুষ তাকে তার যোগ্যতার জন্যে মূল্যবান ভাবে না; তার মূল্য ততোটাই যতোটা সে হয়ে ওঠে। পুরুষেব স্বপ্লের আদলে। মেয়েরা শিখে ফেলে যে পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে তাকে ছেড়ে দিতে হবে তার অধিকার, পুরুষ তখনই খুশি হয় যখন সে ছেড়ে দেয় নিজের সব যোগ্যতালাভের বাসনা। পুরুষ মেধাবী নারী পছন্দ করে না; তারা ভয় পায় নারীর সাহস, মেধা, যোগ্যতাকে । পুরুষের আকর্ষণ নির্বোিধ রূপসীর প্রতি, তাই তরুণীকে হয়ে উঠতে হয় নির্বোিধ, কিন্তু রূপসী । রূপই তার একমাত্র যোগ্যতা। রমণীয় হওয়ার অর্থ দুর্বল, নিরর্থক, অনুগত হওয়া। তরুণীকে চেপে রাখতে হয় তার সমস্ত স্বতস্ফুৰ্ততা, তার বদলে আয়ত্ত করতে হয় রূপ। যদি সে কোনো সক্রিয়তা দেখায়, তবে তা নষ্ট ক’রে দেয় তার নারীত্ব, তার আবেদন; অক্রিয়তাই তার সৌন্দর্য। তরুণীর ব্যক্তিসত্তা ও নারীসত্তার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি ক’রে রেখেছে সমাজ।। কৈশোর যে তার জন্যে বিশেষ সংকটের কাল, তার কারণ এতো দিন সে ছিলো স্বায়ত্তশাসিত, কিন্তু কৈশোরে পৌছে তাকে ত্যাগ করতে হয় তার স্বায়ত্তশাসন। মানুষ হিশেবে সে হয়ে উঠতে চায় সক্রিয়, স্বাধীন, প্রধান; কিন্তু সমাজ চায় সে হবে অক্রিয় সামগ্ৰী। সক্রিয় সত্তা ও অক্রিয় সামগ্ৰী হয়ে ওঠার বিরোধে কিশোরী দুলতে থাকে আশা ও ভয়, কামনা ও ঘূণার মধ্যে। নারী হওয়ার জন্যে তাকে মেনে নিতে হবে অধীনতা, করতে হবে আত্মসমর্পণ। এ-সমস্যা বিভিন্ন কিশোরীর মধ্যে সৃষ্টি করে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া। যে-বালিকা দীক্ষিত হয়ে গেছে নারী ভূমিকায়, সে সহজে মেনে নেয় অধীনতা; কিন্তু যে-বালিকা দীক্ষিত হয় নি, তার পক্ষে অধীনতা মেনে নেয়া কঠিন হয় । তবে সে এড়াতে পারে না তার সামাজিক নিয়তিকে । সে কিছুটা প্রতিবাদের সাথে স্বীকার ক’রে নেয় তার নারীত্ব। তখন সে হয়ে ওঠে অক্রিয়, হয়ে উঠতে চায় রূপসী, জাগিয়ে তোলে মেয়েলিপনা; মন দেয় রূপচর্চায়। সে তখন নিজের বিব্রতকর স্তন দুটিকে আর লুকিয়ে রাখে না, সে-দুটি নিয়ে আর অস্বস্তি বোধ করে না; সে-দুটিকে মনে করে নিজের সম্পদ, ক’রে তোলে আকর্ষণীয়। সে নিজেকে দেখতে শুরু করে আয়নায়, মুগ্ধ হতে থাকে নিজের রূপে, সে জানে তার যা মূল্য তা ওই রূপের জন্যে; নিজের শরীরে সে খোজে এক নারীকে ।

কাম মানুষের সমান বয়সী। কাম উপভোগের শক্তি তরুণীর অনেক বেশি তরুণের থেকে, কিন্তু তার উপভোগ নিষিদ্ধ; তরুণীকে তার কামবাসনা চরিতাৰ্থ করার জন্যে হয়ে উঠতে হয় শিকার । পুরুষতন্ত্র তাকে মনে করে কামসামগ্ৰী, অনেক উপভোগ্য বস্তুর মতো সেও বস্তু। তাই তরুণী বস্তু বা সামগ্ৰী হয়ে ওঠে, নিজেকে সে মনে করে বস্তু, এবং নিজের নতুন সত্তাকে দেখে বিস্ময়ের চোখে । নিজের শরীরে সে দেখতে পায় এক অচেনা শরীর; যেনো অচেনা এক নতুন দেহ দখল করেছে তার চেনা শরীরকে । নিজের শরীর তাকে বিহ্বল ক’রে তোলে, বিস্মিত হয়ে শরীরের দিকে দিকে দেখে অভাবিত বন্যা। যৌবন কোনো তরুণীকে ক্ষমা করে না, ভিখিরি বালিকার দেহকেও প্লাবিত করে নির্দয়ভাবে; যা সে চায় নি, যার মূল্য সে দিতে পারবে না তা তাকে নিতেই হয়। চিত্রাঙ্গদার মতো। হতভাগ্য খুবই কম তরুণী, তাদের দেবতার কাছে বর চাইতে হয় না: কিন্তু তারা সবাই শিউরে ওঠে চিত্রাঙ্গদার মতোই অভাবিতকে নিজের শরীরে দেখে । চিত্রাঙ্গদা নতুন শরীর পায় বর হিশেবে, সেটিকে সে নিজের মনে করে নি; নিজের শরীরে নিজের শক্রকে দেখে সে চিৎকার করে উঠেছে, ‘কোন মহাবাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া /অঙ্গসহচরী করি ছায়ার মতন।’ কিন্তু তরুণী নিজের নতুন শরীরে কোনো রাক্ষসীকে নয়, দেখে এক দেবীকে। সে তার নতুন শরীরকে আদর করে, মুগ্ধ হয় নিজের আঙুল বাহু উরুর দিকে তাকিয়ে, নিজে মোহিত হয় নিজের দু-স্তনের সৌন্দর্যে। শুরু হয় তরুণীর একলা নির্জন অন্তরঙ্গ সংগোপন দিবাস্বপ্নের কাল। দিবাস্বপ্ন কিশোরকিশোরী, তরুণতরুণী, এবং যে-কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। দিবাস্বপ্নে মানুষ সৃষ্টি করে এমন এক বাস্তবতা যা সে কোনো দিন পাবে না, পেলে হয়তো ক্ষুন্ন বোধ করবে। তরুণী নিজের সাথে নিজে কথা বলে, অজস্র স্বপ্নের মধ্যে বাস করে। সে তখন তার নিজের স্বপ্নে বিভোর, তার ওই স্বপ্ন এতো মূল্যবান যে তা প্ৰকাশ করা যাবে না। কারো কাছে, প্রকাশ করলে বাস্তবের নোংরা ছোয়ায় স্বপ্নের সোনা হয়ে উঠবে। আবর্জনা। তাই তার মধ্যে জন্মে গোপন করার প্রবণতা, সব কিছু সে গোপন করতে চায়, তার সমগ্র স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে সে পুরে ব্যাখতে চায় এক গোপন চন্দনকাঠের সিন্দুকে।

কিশোরীতিরুণীর দিবাস্বপ্ন পেরিয়ে যায় বাস্তবতার সমস্ত সীমা, ডুবে যায় সে রুগ্ন দিবাস্বপ্নে। তরুণীর দিবাস্বপ্ন হচ্ছে সে যা পায় নি, কখনো পাবে না, এমনকি কখনো পেতে চাইবে না, তার ক্ষতিপূরণ। কিন্তু দিবাস্বপ্ন কখনো বাস্তবতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না; দিবাস্বপ্ন যদি সীমা পেরিয়ে যায়, তা মানুষকে অসুস্থ ক্লান্ত করে তোলে। প্রতিটি তরুণী দিবাস্বপ্নক্কান্ত। একলা নির্জন দিবাস্বপ্ন তাকে ভরে তুলতে পারে না, স্বপ্ন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পরই সে দেখে সে পড়ে আছে বাস্তবের আবর্জনার ওপর- নিঃসঙ্গ। সে তখন খোজে বান্ধবী, নিজের একান্ত দ্বিতীয় সত্তাকে। অনেক মেয়ে পরস্পরকে দেখায় নিজেদের নগ্ন দেহ, তুলনা করে নিজেদের স্তনের, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজের, আবিষ্কার করে পরস্পরের দেহবিশ্ব। প্রতিটি মেয়ের, এবং ছেলের, মধ্যেই রয়েছে সমকামীপ্রবণতা; তরুণীর ওই প্রবণতার মূলে রয়েছে তার আত্মপ্রেম। তরুণীরা পরস্পরের শরীরে খুঁজে পায় নারীত্ব। কিন্তু তরুণী জানে সমকামী সম্পর্ক অস্থায়ী; এবং অনেক তরুণী এ-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও পায় না, অনেকে পেয়েও গ্রহণ করে না। প্রচণ্ড বিধিনিষেধের খড়গ ঝোলে তার ওপর; সমগ্র পিতৃতন্ত্র তাকে নিষেধ করে ওই সম্পর্কে যেতে। কেননা পুরুষই তার নিয়তি। তখন তার চোখে মোহনীয় হয়ে ওঠে পুরুষ। তবে পুরুষ তাকে মুগ্ধ করে, আবার সন্ত্রস্তও করে। যে-পুরুষ তাকে সন্ত্রস্ত করে, সে তাকে বাদ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে রাজপুত্রের। এখন চারদিকে রাজপুত্রের ভিড়; একালে রাজপুত্রেরা জন্মেছে সিনেমার অভিনেতা, গায়ক, খেলোয়াড় ইত্যাদি হয়ে। তরুণী তাদের স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে অন্য এলাকার কোনো বিখ্যাত পুরুষেরও। তার এ-স্বপ্ন বিশুদ্ধ স্বপ্ন, সে স্বপ্ন দেখে স্বপ্ন দেখার জন্যেই; বাস্তবে ওই পুরুষকে পাওয়ার জন্যে নয়। সে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এড়িয়ে বাস করে কল্পনায়, সে একাকার করে দেয় বাস্তবতা আর কল্পনাকে। তরুণী কামনা করতে থাকে শ্ৰেষ্ঠ পুরুষ, যার কাছে সে আত্মসমৰ্পণ করতে পারে।

আত্মপ্রেম থেকে আত্মসমৰ্পণ হচ্ছে সমকামী প্রবণতা থেকে মর্ষকামিতার জগতে প্ৰবেশ। নারী সহজাত মর্ষকামী বলে নারীকে নিন্দিত ক’রে দিয়েছেন ফ্রয়েড; তবে নারী সহজাত মর্ষকামী নয়। পুরুষেরও রয়েছে মর্ষকামিতা। পুরুষতন্ত্র নারীকে দীক্ষা দিয়েছে। মর্ষকামে, যন্ত্রণাসম্ভোগে; বাধ্য করেছে মর্ষকামে। পুরুষতন্ত্র যে-সমস্ত নারীকে প্রশংসাপত্ৰ দিয়েছে, তারা সবাই তা কিনেছে মর্মান্তিক মর্ষকামিতার মূল্যে : তারা পুরুষের জন্যে সব ত্যাগ করেছে, জীবন উৎসর্গ করেছে, অজস্র পীড়ন সহ্য করেছে, এবং পুরুষতন্ত্র তাদের স্বীকার করে নিয়েছে আদর্শ নারীকাঠামোরূপে। পুরুষতািন্ত্র তরুণীকে শিখিয়েছে। পুরুষের জন্যে দুঃখ স্বীকারই প্ৰেম, অবিরাম আত্মোৎসৰ্গই নারীত্ব। প্রেমে যে পড়ে সে-ই মর্ষকামী, তার কাজ যন্ত্রণায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। তরুণী অসংখ্য উপাখ্যানে শোনে আদর্শ প্রেমিকদের দুঃখ স্বীকারের কাহিনী, সেও মনে মনে হয়ে ওঠে এক আদর্শ প্রেমিক, যে প্রিয়তমের জন্যে সইবে অনন্ত দুঃখ। সে কল্পনা করে পিতামাতা সমাজসংসারকে অস্বীকার ক’রে সে বেরিয়ে পড়েছে প্রেমিকের হাত ধ’রে, তাদের জন্যে আর কিছু নেই, আছে শুধু প্রেম আর অবিরাম দুঃখ। সে দুঃখের পর দুঃখকে জয় করতে থাকে, প্রেমিককে রক্ষা করে সমস্ত বিপদ থেকে, এবং সুখ পায় প্রেমিকের বুকে মুখ রেখে। সে হয়ে ওঠে আরেক আদর্শ প্রেমিকা, নারী, যার নাম চিরকাল মনে রাখবে ইতিহাস। কিশোরতরুণও এমন অপরাজিত প্রেমের স্বপ্ন দেখে, তবে তার স্বপ্লটি বিপরীত; সে দেখে প্রেমিকাটি তার জন্যে সব ত্যাগ ক’রে এসেছে, তার বুকে স্থান পেয়ে ধন্য হয়েছে। কিশোর প্রেমিকেরা কিশোরী প্রেমিকার চোখে বার বার জল দেখতে চায়, জল দেখে খুব সুখ পায়; কিশোরীরাও চোখকে সমুদ্রের মতো ভরে তুলতে জানে। তরুণীকে সমাজই তৈরি করেছে মর্ষকামী ক’রে, কারণ সে নারী হবে; এবং তার জীবন হবে ধারাবাহিক মর্ষকামিতা। তার জৈব সংকেতের মধ্যে নেই এ-ব্যাধি, রয়েছে সামাজিক সংকেতে।

কাল্পনিক প্রেম থেকে বাস্তব প্রেমে যেতে ভয় পায় অনেক তরুণী; যখন স্বপ্লের পুরুষ সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সন্ত্রস্ত হয় অনেকে। তরুণী পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, চায় পুরুষের অনুরাগ, কিন্তু ধরা পড়তে চায় না। বয়ঃসন্ধির সাথে সে লজ্জা বোধ করতে শেখে, পুরুষতন্ত্র তাকে লজ্জা বোধ করতে বলে; সে লজ্জা আর ছেনালিপনাকে একাকার ক’রে দেয়। তার লজ্জা সবখানি লজ্জা নয়, তার লজ্জা হচ্ছে উল্টোনো লজ্জাহীনতা। সে চায়। তার দিকে তাকাক পুরুষ, কিন্তু তার দিকে কোনো পুরুষ তাকালে সে একই সাথে সুখ পায় ও আহত হয়। সে চায় তার সৌন্দর্যে পুরুষ মুগ্ধ হোক, কিন্তু যখন তারা তাকায় তার পায়ের দিকে, তার নিতম্বের দিকে, তার স্তনের দিকে, তখন সে লজ্জা পায়। তরুণী পুরুষের কামনা জাগিয়ে দিতে চায়, কিন্তু যখন দেখে সে কামনা জাগিয়ে দিয়েছে পুরুষের, তখন গুটিয়ে নেয় নিজেকে। সে স্পর্শ পেতে চায়, কিন্তু স্পর্শ পেলে প্রকাশ করে বিরক্তি। পৃথিবী জুড়ে তরুণীর জীবনেব মূল লক্ষ্য একটি স্বামী পাওয়া; এবং অধিকাংশ সমাজে এখনো তার জন্যে স্বামীটি সংগ্রহ করে অভিভাবকেরা। সে নিজেকে নিজের পছন্দ মতো সমৰ্পণও করতে পারে না, সমৰ্পণ করে অন্যরা। তাই তরুণী স্বাধীন সত্তা হিশেবে বিকশিত করতে পারে না নিজেকে। কোনো কোনো সমাজে তরুণী নিজের ভবিষ্যতকে নিতে পারে নিজের হাতে, তারা নিরন্তর পুরুষভাবনা থেকে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশ সমাজে আজো তা অসম্ভব। দিন দিন তা আরো অসম্ভব ক’রে তোলা হচ্ছে। বাঙলাদেশে তার কানে যে-অশ্লীল গানটি নিয়মিত বাজানো হয়, তা হচ্ছে বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে। বিয়েতে মুক্তি নেই তরুণীর, তার মুক্তি নিজের স্বাধীন সত্তায়। কিন্তু পরিবার ও সমাজ তার সত্তা বিকাশের জন্যে উৎসাহী নয়, উৎসাহী তাকে অবিকশিত ক’রে দিতে। আমাদের সমাজের প্রায় সবাই এখন কাজ করছে কিশোরীতিরুণীর বিকাশের বিরুদ্ধে; সমাজনীতি আর রাজনীতি কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে। তারা এখন আর বিকশিত ও স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে না, দেখছে। বন্দী হওয়ার বন্দী থাকার স্বপ্ন।
 
নষ্টনীড়


দ্য বোভোয়ার নারীর মাসিক রক্তক্ষরণের প্রক্রিয়াটিকে দৃষ্টি ও আবেগগ্রাহ্য ক’রে তুলেছেন একটি চিত্রকল্পে; বলেছেন (১৯৪৯, ৬১) নারীর ভেতরে প্রতি মাসে গ’ড়ে ওঠে একটি দোলনা, অপেক্ষা করে শিশুর জন্যে, কিন্তু শিশু আসে না ব’লে ভেঙে যায় দোলনটি; ওই নষ্ট দোলনা নারীর ভেতর থেকে ক্ষরিত হয় বিষন্ন রক্তিম ধারারূপে। নারী এ-সময় তার শরীরকে অনুভব করে সবচেয়ে যন্ত্রণার মধ্যে, মনে করে ওই শরীর তার নিজের নয়; এক অচেনা রাক্ষসীকে বেঁধে দেয়া হয়েছে তার সাথে। নারী, পুরুষেরই মতোই, দেহ; তবে এ-সময় তার দেহ সে নয়, অন্য কিছু। নারী প্রজাতির শিকার: নারী তার জীবনের অনেকগুলো বছর বিশেষ বিশেষ সময়ে বন্দী থাকে তার আভ্যন্তরে ঋতুচক্ৰে। প্রতিটি নারী মোটামুটি দশ থেকে পয়তাল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে, বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত, চার শো পঞ্চাশ বারের মতো গড়ে আর ভাঙে নিজের আভ্যন্তর দোলনা; একে বলা হয় ঋতু, ঋতুস্রাব, মাসিক, রজঃ, পুষ্প, মেনস্ট্রয়েশন, মেনসিজ। বলা হয়ে থাকে যে ঋতুস্রাব জরায়ুর কান্না-সন্তান আসে নি বলে মাসে মাসে বক্তধারায় কাব্দে জরায়ু। নারী একে মেনে নিতে বাধ্য হয়, তবে এটা তার জন্যে প্ৰীতিকর নয়। অ্যাংলো-স্যাক্সানরা একে বলে “অভিশাপ’: প্রতিটি নারীই একে মনে করে তার জীবনের পুনরাবৃত্ত অভিশাপ। নারী যদি এর হাত থেকে রেহাই পেতো, তবে বাঁচতো। ঋতুক্ষরণ তার জীবনের এক বড়ো বিরক্তি, বড়ো বোঝা; সন্তান ধারণ আর প্রসবও এমন বিরক্তিকর নয়। নারীর কাছে। তবে নারীর জীবনের এ-সত্যটির জন্যে পিতৃতন্ত্র নারীকে পুরস্কার দেয় নি, তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে নি, তাকে দিয়েছে শাস্তি। নারী খুব বিব্রত বোধ করে তার মাসিক নিয়ে, তার কারণ পিতৃতন্ত্রের চোখে এটা দূষণ; এ-সময়ে নারী নিজে দূষিত, দূষিত করে পুরুষদের, এমন বাজে ধারণা সৃষ্টি করেছে সমস্ত পিতৃতন্ত্র। এ-ধারণা দিয়ে আধুনিক সময়ও আচ্ছন্ন। এ-সময়েও নারীও বলে যে তার শরীর “খারাপ’। কোনো কোনো সমাজে মেয়ে প্রথম ঋতু দেখার সময় উৎসব করা হতো; আঠারোশতকের কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে ঋতুসূচনাকে বলা হতো পুষ্পদেখা”; এবং সেখানে ‘কন্যা বা বধূ প্রথম রজস্বলা হলে বাজনা বাজিয়ে এবং সহেলা ও নৃত্যাদির অনুষ্ঠান করে উৎসব করা হত; তবে রজম্বালা নারীকে মুসলিম ঘরেও অপবিত্ৰ মনে করা হত।’ (আহমদ শরীফ (১৯৭৭, ১৫০)]। পিতৃতন্ত্রের তিরষ্কারের ফলেই ঋতুস্ৰাব পরিণত হয়েছে গোপন নিষিদ্ধ ঘটনায়, তবে এটা গোপন নিষিদ্ধ ব্যাপার হওয়ার মতো কিছু নয়। একে প্রকাশ্য ঘটনার মর্যাদা দেয়ার জন্যে সিলভিয়া প্লাথ কবিতা লিখেছেন ঋতুস্রাব নিয়ে; এবং জারমেইন গ্রিয়ার প্রস্তাব করেছেন আধুনিক ঋতুস্রাব উৎসবের। তাতে যে-বালিকা প্রথম রক্ত দেখে শিউরে উঠেছে, নিজেকে ভাবতে শুরু করেছে। ঘূণ্য, সে পাবে আত্মবিশ্বাস, নিজেকে মনে করবে জীবনের জন্যে প্রস্তুত।

আদিম মানুষেরা নারীর পুনরাবৃত্ত ক্ষরণকে দেখেছে ভয় বিস্ময় ঘৃণার চোখে। ঋতুমতী নারীকে নির্দেশ করেছে অশুচি, তাকে ক’রে তুলেছে নিষিদ্ধ অস্পৃশ্য প্রাণী। পৃথিবীর চারটি প্রধান ধর্ম-হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্ট, ইসলাম ধর্মের চোখে নারীর মাসিক চক্র অত্যন্ত অপবিত্র। প্রতিটি ধর্মের চোখেই নারীর শরীর ঘৃণার বস্তু; নারীর রন্ধটির জন্যে পুরুষ পাগল থাকলেও ওটির নিন্দা করতে কেউ কুষ্ঠা বোধ করে নি, তাই ওই রন্ধ থেকে রক্তক্ষরণকে প্রতিটি ধর্মই ঘূণ্য ব’লে গণ্য করেছে। প্রতিটি ধর্মে ঋতুমতী নারী পশুর থেকেও নিকৃষ্ট। মানুষের চোখে রক্ত বিস্ময়কর বস্তু, তা একই সাথে শক্তি ও ভয়ের ব্যাপার; আদিম মানুষেরা মাসিক রক্তকে মনে করেছে ভীতিকর। তারা ঋতুকে মনে করেছে শয়তানের কাজ, তাই ঋতুমতী নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করেছে সব কিছু, এবং তাকে নিষিদ্ধ করেছে সব কিছুতে। জুরথুস্ত্রীয় বিধান হচ্ছে ঋতুমতী নারী পবিত্ৰ শিখার দিকে তাকাতে পারবে না, জলে নামতে পারবে না, সূর্যের দিকে তাকাতে পারবে না, পুরুষের সাথে কথা বলতে পারবে না। পাপুয়া নিউগিনির কাফিরা ঋতুমতী নারীকে একলা এক সপ্তাহ ধরে আটকে রাখে অন্ধকার কুঁড়েঘরে, তাকে কিছু খেতে দেয়া হয় না। এভাবে তাকে শিখিয়ে দেয়া হয় যে সে নিজের ও অন্যদের জন্যে ভয়ঙ্কর। তার শরীর ও বক্তের ছোয়ায় পুরুষের বমি পায়, পুরুষের রক্ত কালো হয়ে যায়, পুরুষের মাংস দূষিত ও বুদ্ধি নষ্ট হয়, মৃত্যু হয়। পিতৃতন্ত্রগুলো এমন আদিম বিশ্বাস থেকেই বিধান তৈরি করেছেঋতুমতী নারীর জন্যে। বাইবেলের লেবীয় পুস্তক-এ /লেভিটিকাস} ঋতুমতী নারীকে বারো দিনের জন্যে নিদাহা’ বা অশুচি হিশেবে নির্দেশ করা হয়েছে; এবং ১৫৬৫ সালে লেখা একটি বিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে যে সে স্বামীর সাথে একই শয্যায় শোবে না, পরিবারের কারো সাথে খাবে না, অনাদের সাথে এক ঘরে থাকবে না, স্যাবাথের প্রদীপ জ্বালবে না, সিনেগাগে ঢুকবে না, স্বামীকে স্পর্শ করবে না, তাকে কিছু দিতেও পারবে না। তাকে পরতে হবে এমন পোশাক যাতে তাকে দেখায় ইহুদিদের মধ্যে ইহুদি দ্ৰ মাইলস্ (১৯৮৮, ৮২-৮৩)!! অর্থাৎ সে পচা নোংরা প্রাণী। খ্রিষ্ট ও মুসলমানধর্ম ইহুদিধর্ম থেকে প্রচুর ধার করেছে প্যালেস্টাইনের গোত্রীয় কুসংস্কার; আর সেগুলোকে বিধিবদ্ধ করেছে ধর্মের বিধানরূপে। ঋতুমতী নারী সম্পর্কে হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমানের বিধানও নিষ্ঠুর, হিন্দু নিষ্ঠুরতায় ইহুদির সমান [দ্র ‘দেবী ও দানবী’]। সব ধর্মেই ঋতুকালে নিষিদ্ধ করেছে সঙ্গম, তবে অধিকাংশ নারী এ-সময়েই বোধ করে তীব্র কাম, ও পুলক বোধ করে সবচেয়ে বেশি।

পিতৃতন্ত্রের নিন্দিত নারীর শরীর ও সত্তা জুড়ে এ-সময় ঘটে এমন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া, যা তাকে ক’রে রাখে অভিভূত। অনেক নারীর জন্যে এটা কোনো বিশেষ বিপন্নতা নয়, কিন্তু ঋতুক্ষরণকালে, এবং শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই, অধিকাংশ নারী বোধ করে বিপন্ন। শুরুর আগে অনেক নারীর দেখা দেয় একরাশ উপসর্গ, যাকে বলা হয় প্রাকত্ৰাব সিড্রোম। চিকিৎসকেরা মনে করে। এসবের পেছনে কোনো বাস্তব কারণ নেই, তবে ওগুলো অনেকের জন্যেই বাস্তব; সেগুলো হয়তো নেই, কিন্তু তারা বোধ করে; তাদের জীবন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অনেক নারী বোধ করে তাদের শরীর ভারী হয়ে উঠছে, জুতোতে পা আংটিতে আঙুল ঢুকছে না; দেখা দিচ্ছে মাথা ব্যথা, পাচ্ছে বিবমিষায়। শুরুর আগে বাড়ে তাদের রক্তচাপ, আবার শেষের দিকে হ্রাস পায় রক্তচাপ, অনেক সময় শরীরে দেখা দেয় উত্তাপ, বোধ হয় জ্বর, তলপেটে দেখা দেয় যন্ত্রণা। অনেকের দৃষ্টি আর শুতিতে ঘটে ব্যাঘাত, অনেকের শরীরে দেখা দেয় দুৰ্গন্ধ। নারী হয়ে পড়ে অস্থির। তার মনোজগতে দেখা দেয় বিচলন। অনেকের মেজাজা ঠিক থাকে না, বোধ করে চরম বিষন্নতা, স্মৃতিভ্ৰংশত ঘটে অনেকের, অনেককে পায় স্বপ্নগ্ৰস্ততায়। টি এস এলিঅটের প্রথম স্ত্রী এর শিকার হয়ে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। এ-সময়েই নারী শরীরকে বোধ করে সবচেয়ে যন্ত্রণার মধ্যে, বাস করে রাক্ষসীর সাথে।

বালিকার জীবনের দশ থেকে বারো বছর বয়সের সময়টি তার বয়ঃসন্ধির কাল: এ-সময়ে সে হয়ে ওঠে কিশোরী। দশ থেকে ষোলো বছর বয়সের সময়টিকে ধরতে পারি কৈশোর হিশেবে। তার কৈশোরজীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ঋতুস্রাবসূচনা। দশ থেকে ষোলো, এমনকি উনিশ, বছর বয়সের মধ্যে যে-কোনো সময় এটা ঘটতে পারে। ঋতুর প্রথম আবির্ভাবকে বলা হয় ঋতুসূচনা মেনার্কি। ঋতুসূচনাকে মনে করা হয় বালিকার নারী হয়ে ওঠা; অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রের মতে নারীর প্রধান যে-কাজ, সন্তানধারণ, বালিকা তার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ঋতুসূচনা কখন ঘটবে নির্ভর করে বালিকার শরীরের পুষ্টির ওপর; গরীব পরিবারের মেয়েদের ঋতুসূচনা ঘটে দেরীতে, ধনী পরিবারের মেয়েদের ঘটে কিছুটা কম বয়সে। এর সাথে জলবায়ুর সম্পর্ক নেই; উষ্ণ অঞ্চলে তাড়াতাড়ি আর শীতল অঞ্চলে বিলম্বে ঘটে, এমন নয়; এর সম্পর্ক শরীরের পুষ্টির সাথে। আর্থসামাজিক অবস্থার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, তা স্বৰ্গকে প্রভাবিত করে, করে বালিকার মস্তিষ্ককেও। ঋতুসূচনা বালিকার শরীরের ভেতরে ঘটা একরাশ ঘটনার পরিণতি। তার শরীরের এ-পরিবর্তন ঘটে কয়েকটি গ্ল্যান্ড বা লালাগ্ৰন্থির পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের ফলে। এ-সব ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রক গ্ৰন্থিটির নাম হাইপোথালামাস; এটি অবস্থিত মস্তিষ্কের এক বিশেষ স্থানে। এটি পিটুইটারি গ্রন্থির সাথে সমন্বয় ক’রে কাজ করে, এবং নিয়ন্ত্রণ করে পয়াবতী ঘটনাগুলো। অজানা কেনো কারণে ঋতুসূচনার বছর চারেক আগে থেকে হাইপোথালামাস এক ধরনের বস্তু নিঃসরণ করতে থাকে, তার নাম নিঃসারিক হরমোন। নিঃসারিক হরমোনের কাজ অন্য হরমোনের নিঃসরণ ঘটানো। হাইপোথালামাস ও পিটুইটারির সংযোজক রক্তনালিগুলোর ভেতর দিয়ে নিঃসারিক হরমোন বইতে থাকে, এর ফলে পিটুইটারি থেকে নিঃসৃত হয় কয়েকটি হরমোন। এগুলোর একটি শরীরবৃদ্ধিকারক হরমোন, যার ক্রিয়ায় ঋতুসূচনার আগে শবীর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ঋতুসূচনার চার বছর আগে থেকে বালিকা বাড়তে শুরু করে; প্রথম দু-বছর বেশি বাড়ে, ঋতুসূচনা যতোই কাছিয়ে আসে ততোই তার বাড়া কমতে থাকে। বারো বছর বয়সের দিকে পিটুইটারি গ্রন্থি দেড় ঘন্টা পর পর ঝলকে ঝলকে নিঃসরণ করে আয়েকটি নিঃসাবক হরমোন। এর নাম গোনাডোট্রোফিন নিঃসরক হরমোন। এ-হরমোন সক্রিয় ক’রে তোলে পিটুইটারির বিশেষ কিছু কোষকে। ওই কোষগুলো উৎপাদন করে এমন দুটি হরমোন, যা নিয়ন্ত্রণ করে বালিকার ডিম্বাশয়কে। এর একটির নাম ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন; অন্যটির নাম হলুদ-উৎপাদক হরমোন।

বয়ঃসন্ধির কালে বালিকার ডিম্বাশয়ে থাকে দু-লক্ষের মতো ডিম্বাণু, তার মধ্যে এক ধরনের ডিম্বাণু থাকে, যেগুলোর ভেতরে দেখা দেয় তরল পদার্থ; ওগুলোর নাম ফলিকল। ফলিকল শব্দের অর্থ আধার। ফলিকল-উদ্দীপক হরমোনের কাজ ফলিকলকে উদ্দীপ্ত করা, এর ক্রিয়ার ফলে ডিম্বাশয়ের কোনো কোনো ফলিকল বিকশিত হয়। প্রথম দিকে খুব কম ফলিকলই বিকশিত হয়; তবে সেগুলো বৃদ্ধি পাওয়ার সময় উৎপন্ন হয় ইষ্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন। ইষ্ট্রোজেন শব্দের অর্থ “ডিম্ব-উৎপাদক’ নাম থেকেই এর কাজ বোঝা যায়। ইষ্ট্রোজেন বালিকাকে করে নারী। উদ্দীপ্ত ফলিকলগুলো মাসখানেক ধ’রে ইষ্ট্রোজেন উৎপাদন ক’রে মারা যায়। এ-সময়ে আরো অনেক ফলিকলও উদ্দীপ্ত হয়, এগুলোও ইস্ট্রোজেন উৎপাদন করে। প্ৰতি মাসে আরো বেশি ক’রে (১২ থেকে ২০টি) ফলিকল উদ্দীপ্ত হ’তে থাকে, তাই ধীরেধীরে ইষ্ট্রোজেন উৎপাদনও বাড়ে। ইস্ট্রোজেনের অনেক কাজ; এটি স্তননালি ও স্তনবৃন্তের চারপাশের এলাকার বৃদ্ধি ঘটায়; এটি ডিম্বনালি, জরায়ু ও যোনিকে বাড়ার জন্যে উদ্দীপ্ত করে। এটি নিতম্বে মেদ সঞ্চার করে, তবে শরীরের বৃদ্ধি শ্লথ ক’রে দেয়। ক্রমশ শরীরে বেশ বৃদ্ধি পায় ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ, ঋতুসূচনা সন্নিকট হয়ে আসে। ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ার ফলে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালের আস্তরণ বাড়ে। ওই আস্তরণকে বলে এন্ডোমেট্রিয়াম। এ-সময়ে হ্রাস পায়ে ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন। যেই ফলিকলউদ্দীপক হরমোনের পরিমাণ কমতে থাকে, অমনি ডিম্বাশয়ে ফলিকল বাড়া থেমে যায়, এবং ইস্ট্রোজেন নিঃসরণও হ্রাস পায়। তখন জরায়ুর ভেতরের দেয়ালের আস্তরণ গঠিত যে-সব রক্তনালিতে, সেগুলো ভেঙে যায়; জরায়ুতে রক্তক্ষরণ ঘটে। চুৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে যায এন্ডোমেট্রিয়াম। রক্ত, তত্ত্বর তরল পদাৰ্থ এবং এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষ জমা হয় জরায়ুতে, তারপর বাইরে বেরিয়ে আসে যোনিপথ দিয়ে। শুরু হয়। রক্তস্রাব, দেখা দেয় ঋতুসূচনা।

ঋতুসূচনার পর থেকে প্রথমে অনিয়মিত, পরে নিয়মিতভাবে কিছু দিন পর পর দেখা দেয় মেয়েদের ঋতুস্রাব। সূচনার চার থেকে ছ-বছর, সতেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের মধ্যে প্রতিটি মেয়ের ঋতুস্রাবের একটি বিশেষ ধরন দাঁড়িয়ে যায়। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ধরন, তবে অধিকাংশ নারীরই, যদি সে গর্ভবতী না হয়, পয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মাসে একবার ঋতুস্ৰাব ঘটে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দিকে আবার অনিয়মিত হয়ে ওঠে; এবং চিরকালের জন্যে ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। একে বলে ঋতুসমাপ্তি মেনোপজয়। এক ঋতুস্রাবের সূচনা থেকে আরেক স্রাবের সূচনা পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ঋতুস্রাব চক্র। প্রতিটি চক্র শুরু হয়ে ক্ষরণ শুরুর দিন। তাই ঋতুচক্রের মধ্যে পড়ে ক্ষরণেব দিনগুলো, এবং আরেক স্রাব শুরু হওয়া পর্যন্ত দিনগুলো। অধিকাংশ নারী নিজের ঋতুচক্ৰ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিছুই জানে না; এমনকি চক্রের দিনগুলো গোণার নিয়মও জানে না। উচ্চশিক্ষিত অধিকাংশ নারীও মনে করে একেকটি চক্র শুরু হয় ক্ষরণ সমাপ্ত হওয়ার পর দিন থেকে, যদিও চক্র শুরু হয় ক্ষরণ শুরুর দিন থেকে। সবার চক্ৰ সমান দীর্ঘ নয়; ঋতুচক্র ২২ থেকে ৩৫ দিনের হতে পারে, এবং গড়ে হয় ২৯ দিনের। পরবতী স্রাব ঠিক কোন দিন শুরু হবে, তা একশো ভাগ নিশ্চিতির সাথে বলা অসম্ভব, সাধারণত দু-চারদিন এদিক-সেদিক হয়। কিশোরীদের ঋতুস্রাব বেশ অনিয়মিত, সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দিন পর পর হয়, তবে কোনো কোনো মেয়ের হয় ঘন ঘন। ঋতুসূচনার পর প্রথম দু-এক বছর বছরে মাত্র দু-তিনবার দেখা দেয়, যখন দেখা দেয় তখন প্রবলভাবে দেখা দেয়। তবে পরে একটা নিয়মিত চক্র দাঁড়িয়ে যায়। ঋতুস্রাবে নারীর আভ্যন্তর ঘটনারাশির নিয়ন্ত্রক হাইপোথালামাস। মস্তিষ্কের এ-অংশটিও আবেগকাতর হয়, বিপর্যস্ত হয়; এবং প্রবল আবেগকাতরতার ফলে ঋতুস্রাব সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যেতে পারে। কোনো মেয়ে বাড়ি থেকে অন্য কোথাও গেলে, বা পেশা বদলালেও সাময়িকভাবে স্থগিত হতে পারে তার চক্ৰ। আবেগগত কারণে দু-তিন মাস, এমনকি বছর খানেকের জন্যেও স্থগিত হয়ে যেতে পারে ঋতুচক্র। এর নাম আমেনোিরয়েয়া বা ঋতুবিরতি। এটা রোগের ফলে ঘটতে পারে, এবং এর পেছনে কোনো রোগ নাও থাকতে পারে। রোগের কারণে না হ’লে ঋতুবিরতি কোনো গুরুত্বের ব্যাপার নয়। অনেকের ধারণা ঋতুস্রাবে শরীর পরিচ্ছন্ন হয়, তবে ঋতুস্রাবে শরীর পরিচ্ছন্ন হয় না; আর ঋতুস্রাব না হ’লেও তার ভেতরে কোনো আবর্জনা জমে না। ঋতুক্ষরণকে পুরুষেরা ঘেন্না করে, কামুকও এ-সময় নারীকে ছুতে চায় না; নারীরাও নিজেদের মনে করে অশুচি। এতে অশুচিত্বের কিছু নেই, সঙ্গম না। করারও কিছু নেই; বরং এ-সময়টা সম্পূর্ণ নিরাপদ, এবং অধিকাংশ নারী এ-সময়েই বোধ করে বেশি কামবেগ। ঋতুক্ষরণের রক্ত দূষিত নয়, ঘৃণার বস্তু নয়। গ্রিয়ার (১৯৭০, ৫১) বলেছেন, যদি তুমি নিজেকে মুক্ত মনে করো, তবে তুমি তোমার ঋতুরক্ত একটু চেখে দেখার কথা ভেবে দেখতে পারো-যদি তোমার এতে ঘেন্না লাগে, তবে আরো অনেক পথ বাকি আছে, মেয়ে।’

নারীর অভ্যন্তরে তার জীবনের প্রায় পয়ত্ৰিশ বছর ধরে মাসে মাসে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে একই ধরনের সংকেত, সংকেতের ফলে ঘটতে থাকে একই ধরনের ঘটনা। ঘটনাগুলোর নিযন্ত্রক মস্তিষ্কের একটি অংশ, তার নাম হাইপোথালামাস। প্রথমে হাইপোথালামাস কাজ শুরু করে, সেটি গোনাডোট্রোফিন-নিঃসারিক হরমোন পাঠায় পিটুইটারি গ্রন্থিতে, উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে পিটুইটারির কোষ। পিটুইটারি ক্ষরণ করে দুটি হরমোন : একটি ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন, আরেকটি হলুদ-উৎপাদক হরমোন। ফলিকল-উদ্দীপক হরমোনের কাজ ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণু ফলিকলগুলোকে উদ্দীপ্ত করা। রক্তে ফলিকল উদ্দীপক হরমোন বাড়ার ফলে ডিম্বাশয়ে ১২ থেকে ২০টির মতো ডিম্বাণু উদ্দীপ্ত হয়। এ-ফলিকলগুলো বৃদ্ধি পায়, এবং উৎপাদন করে ইস্ট্রোজেন। ইস্ট্রোজেন-এর অর্থ ডিস্ক-উৎপাদক, এক্স কাজ ডিম্বাণু ফোটানো। ইস্ট্রোজেন একটি নারী হরমোন, এটি নারীদেহে নানা কাজ করে; তবে এর বিশেষ কাজ হচ্ছে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালের আস্তরণ সৃষ্টি করা। ইষ্ট্রোজেন জরায়ুর আস্তরণকে উদ্দীপ্ত করে, তার ফলে আস্তরণ বিকশিত হয়। এ-আস্তরণের নাম এন্ডোমেট্রিয়াম। এর বৃদ্ধি ঘটে চক্রের ৫ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত। এটি সরু সরু নালিতে গঠিত, এতে থাকে কোষের কয়েকটি স্তর { ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে কোষের স্তর বৃদ্ধি পায়। জরায়ুতে যে পরিবর্তন ঘটে, তা বৃদ্ধিমূলক, তাই ঋতুচক্রের এ-পর্বকে বলা হয় চক্রের বৃদ্ধিপর্ব। এ-পর্বে নারীর ভেতরে তৈরি হয় নীড়, যেখানে বাসা বঁধতে পারে ভ্রূণ।

ফলিকল বাড়তে থাকে, সাথে সাথে রক্তে বাড়তে থাকে ইষ্ট্রোজেন। চক্রের ১৩ দিনের দিন রক্তে এর পরিমাণ শুরুর দিনের ছ-গুণ হয়ে দাঁড়ায়। এ-সংবাদ পৌঁছে যায় হাইপোথালামাসে, সেটি বুঝতে পারে যে আর ফলিকল উদ্দীপ্ত করার দরকার নেই; তাই কমিয়ে দেয়। ফুলকল-উদ্দীপক হরমোন উৎপাদন। তখন হাইপোথালামাস নিঃসরণ করে একটি হরমোন, যার নাম হলুদ-উৎপাদক-হরমোন-নিঃসারিক হরমোন। বাঙলায় নামটি বেশ বিদঘুটে শোনাচ্ছে, এর কাজ হচ্ছে হলুদ-উৎপাদক হব।মোন নিঃসরণে পিটুইটারিকে উদ্দীপ্ত করা। এর প্রভাবে পিটুইটারি উৎপাদন করে হলুদ-উৎপাদক হরমোন বা লিউটিনাইজিং হরমোন। এ-হরমোন ডিম্বাণু ফলিকলগুলোর কোনো একটিকে ফুটিয়ে তার ভেতরের ডিম্বাণুটিকে বের হতে সাহায্য করে; এবং ফলিকলের কোষগুলোকে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণেরঞ্জিত ক’রে তোলে। এ-জন্যেই এর নাম লিউটিনাইজিং বা হলুদ-উৎপাদক হরমোন। চক্রের ১৪ দিনের দিন হঠাৎ রক্তনালি দিয়ে হলুদ-উৎপাদক হরমোনের প্রবল প্রবাহ বয়ে যায়। এ-হরমোন পৌঁছে ডিম্বাশয়ে, সেখানে এটি সবচেয়ে বিকশিত ফলিকলটিকে ফুটিয়ে ডিম্বাণুটিকে বের করে দেয়। একে বলা হয় ওভিউলেশন বা ডিম্বস্ফোটন। ডিম্বাণুটি ধৰিঃ পড়ে ডিম্বনালির আঙুলাকৃতির প্রান্তে, এবং সেটি ডিম্বাণুটিকে ছেড়ে দেয় ডিম্বন্যালিতে। ফোটা বা উর্বর ডিম্বাণু এগোতে থাকে সামনের দিকে।

ডিম্বনালিতেই ঘটে উর্বরায়ণ বা গর্ভসূচনা। ডিম্বাণু বেরিয়ে যাওয়ার পর তার শূন্য ফলিকল বা আধারটি চুপসে যায়, হলুদ-উৎপাদক হরমোন সেটিকে হলদে ক’রে তোলে। চোপসানো ফলিকলটিকে বলা হয় হলুদ বস্তু। এ-হলুদ বস্তুটি, এবং অন্যান্য ১১ থেকে ১৯টি ফলিকল যেগুলো তাড়াতাড়ি বাড়তে পারে নি, সবাই মিলে একটি নতুন হরমোন উৎপাদন করতে থাকে। এর নাম প্রোজেসটেরোন। এর অর্থ গর্ভ-উৎপাদক। প্রোজেসটেরোন দ্বিতীয় প্রধান নারী হরমোন। এর নানা কাজের মধ্যে প্রধান কাজটি হচ্ছে জরায়ুকে ভুণধারণ ও লালনপালনের জন্যে প্রস্তুত করা। প্রোজেসটেরোন জরায়ুর দেয়ালআস্তরণকে পুরু করে তোলে, গ্রন্থি থেকে পুষ্টিকর তরল পদার্থের নিঃসরণ ঘটিয়ে জরায়ুকে ভূণলালনের উপযুক্ত করে। ডিম্বাণু ফোটার পর চক্রের পর্বকে বলা হয় হলুদপর্ব বা গর্ড-উৎপাদক পর্ব। যদি ডিম্বাণু উর্বর অর্থাৎ গর্ভসঞ্চার না হয়, এবং ভূণ এন্ডোমেট্রিয়ামে স্থান না নেয়, তাহলে ডিম্বাশয়ে হলুদ বস্তুটি ও উদ্দীপ্ত ফলিকলগুলো মারা যায়। তখন রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেসটেরোন হ্রাস পায়। এর ফলে হাইপোথালামাস আবার গোনাডোট্রোফিন নিঃসারিক হরমোন ছাড়তে থাকে, এবং পিটুইটারি। আবার ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেসটেরোন ক’মে যাওয়ার ফলে পরবর্তী ঋতুস্রাবের দিন চারেক আগে থেকে জরায়ুর মোটা রসপূর্ণ আস্তরণ কুঁচকে যেতে থাকে; এর ফলে এর রক্তনালিগুলো গুটিয়ে যায়। ভাঙতে শুরু করে গোটানো রক্তনালিগুলো, আস্তরণের গভীরতর স্তরে ঘটতে থাকে রক্তপাত। এর ফলে রক্তের ওপর ভাগের আস্তরণ পৃথক হয়ে পড়ে; এটি ভেঙেচুরে পড়ে জরায়ুতে, এর সাথে পড়ে এন্ডোমেট্রিযাম থেকে টুইয়ে পড়া রক্ত ও তরল পদার্থ। ঋতুস্রাবে রক্ত বেশি থাকে না, নিঃসৃত বস্তুর এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক হয় রক্ত। এ-রক্ত সাধারণত চাপ বাঁধে না। কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতোটা বর্জ্য জমে যে জরায়ু সংকুচিত হয়ে যোনির ভেতর দিয়ে তা বের করে দেয়। শুরু হয় ঋতুস্রাব।

ঋতুক্ষরণ তিন থেকে পাচ দিন ধরে চলে; তবে এক দিনের ক্ষরণ যেমন ঘটে, তেমনই আট দিন ধরেও ক্ষরণ ঘটতে পারে। ক্ষরণে সাধারণত গড়ে ৩০ মিলিলিটার রক্ত ঝরে। চক্রের প্রথম পর্ব, অর্থাৎ ঋতুক্ষরণ শুরু থেকে ডিম্বাণু ফোটা পর্যন্ত সময়টা নির্দিষ্ট নয়। এ-পর্বটি ৯ থেকে ২৫ দিনের, বা তারও বেশি দিনের হতে পারে। ডিম্বাণুটি কবে ফুটবে, তা জানাই কঠিন; জানলে সহজে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যেতো। কেননা ডিম্বাণু ফলিকল থেকে বোরোনোর পর বাঁচে প্ৰায় ৭২ ঘন্টা, তবে তা উর্বর হতে পারে ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত। শুক্রাণু বাঁচতে পারে। ৪৮ ঘন্টা। তাই ২৮ দিনের একটি চক্রে উর্বরতার কাল ১২০ ঘন্টার বেশি নয়; কমও হতে পারে। সমস্যা হচ্ছে নারীর ডিম্বস্ফোটনের দিনটি জানা দুরূহ। তবে চক্রের ৯ম দিনের আগে ও ২০তম দিনের পর গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা কম। চক্রের দ্বিতীয় পর্ব, অর্থাৎ ডিম্বাণু ফোটার দিন থেকে নতুন চক্রের ক্ষরণ শুরুর দিন সব সময়ই হয় ১৪ দিন; তাই ডিম্বাণু ফোটার দিনটি জানা গেলে পরবতী চক্র শুরুর দিন কবে হবে, তা ব’লে দেয়া যায়। কিন্তু ডিম্বাণু ফোটার দিনটি নির্দিষ্টভাবে জার্নাঁ খুবই কঠিন। নারীর ভেতরে যা ঘটে, তার জন্যে তার প্রাপ্য ছিলো স্তব; কিন্তু পিতৃতন্ত্র তাকে করেছে তিরষ্কার; ঘোষণা করেছে। দূষিত ব’লে। কারণ নারীর কোনো-না-কোনো দোষ খুঁজে বের করতে পারলেই পিতৃতন্ত্র তার বিধানকে করে তুলতে পারে আরো নির্মম।
 
প্রেম ও কাম


প্রেম ও কাম পরস্পর সম্পর্কিত, দুটিই নারীপুরুষের জীবনের বিশেষ পর্বে প্রবলভাবে দেখা দেয়, যদিও জীবনে দুটির গুরুত্ব সমান নয়। প্রেম স্বল্পায়ু, মানুষ প্রেমে বাঁচে না, জীবনে প্রেম অপরিহার্য নয়; প্ৰেম বিশেষ বিশেষ সময়ে কোনো কোনো নরনারীর জীবনে জোয়ারের মতো দেখা দেয়, তাতে সব কিছু- অধিকাংশ সময় তারা নিজেরাই- ভেসে তলিয়ে যায়; তবে আজীবন মানুষ বাস করে নিম্প্রেম ভাটার মধ্যে। প্রেম তীব্র আবেগ, তা ঝড় জোয়ার বন্যা স্রোত ঘূর্ণির মতোই; ওগুলোর মতোই প্রেমও দীর্ঘস্থায়ী নয়, এবং ঘার বার দেখা দিতে পারে। তবে প্ৰেমকে অতিশায়িত ক’রে দেখা রোম্যান্টিক আন্দোলন-উত্তর কালের, পুরুষের, স্বভাব। প্রেমের থেকে কামের, আশ্লেষের, আয়ু অনেক বেশি কাম দোলনা থেকে কবর, চিতা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অপ্ৰেম জীবন দশকপরম্পরায় যাপন করে মানুষ, অধিকাংশের জীবনেই কখনোই প্রেমের ছোয়া লাগে না; কিন্তু কামহীন জীবন অসম্ভব। যাদের কাম আচরিতার্থ, যারা সঙ্গী পায় না। কামোর, তারাও একান্ত কামযাপন করে। প্ৰেম বলতে গত আড়াই শো বছর ধরে পশ্চিমের পৃথিবী যা বোঝে, এবং পশ্চিম থেকে ঋণ করে আমরা যা বুঝি এক শতাব্দী ধ’রে, তা রোম্যানটিকদের আবিষ্কার। পুরোনো পৃথিবীতে প্রেম ছিলো না; আজি আছে একটি বড়ো কিংবদন্তি হয়ে। যে-আবেগ প্ৰেম নামে নরনারীর মনে জেগে ওঠে বিপরীত লিঙ্গের কারো জন্যে, কিশোরতরুণের কাছে যা রক্তমাংসের অনেক ওপরের কোনো স্বপ্ন ব’লে মনে হয়, তা আসলে মাংসের জন্যে মাংসের সোনালি ক্ষুধা।

কিশোর বয়সে অভাব থাকে মাংসের অভিজ্ঞতার, তাই প্রেমকে মনে হয় একান্ত হৃদয়ের; কিন্তু অভিজ্ঞতার পর তা হৃদয়াবেগ রূপে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, দুপুরের হৃদয় সন্ধ্যায়ই মাংসের উল্লাস হয়ে দেখা দেয়। প্রেম ও কাম একই জিনিশের সূচনা ও সমাপ্তি; সূচনার সঙ্গে জড়িত কাতরতা, যন্ত্রণা, আত্মোৎসর্গপরায়ণতা, মর্ষকামিতা, ব্যর্থতাবোধ; পরিণতির সঙ্গে জড়িত সম্ভোগ, সুখ, বিজয়, ধর্ষকামিতা। প্রেম উত্তেজনাপর্ব, যখন নারীপুরুষের মনে জগতে থাকে আবেগ; কাম হচ্ছে পুলকপর্ব, যখন শরীরের সাথে শরীরের ঘর্ষণে ওই আবেগ ছোয় চুড়ো; আর পরবর্তী জীবন হচ্ছে নিবৃত্তিপর্ব। প্রেম একটি মানসিক অবস্থা, এবং খুব স্বাভাবিক অবস্থা নয়; তা স্বাভাবিকতা থেকে পতন। বাঙলায় যে বলা হয় ‘প্রেমে পড়া’, তা নির্দেশ করে স্বাভাবিকতা থেকে ওই বিদ্যুতিকেই। প্রেমের উপসর্গগলোর মধ্যে রয়েছে অনিদ্রা, অন্যমনস্কতা, ক্ষুধাহীনতা, কাতরতা। প্রেমিকপ্রেমিকার চোখ ভ’রে থাকে তাদের প্ৰেমাস্পদ, তারা বাস করে অস্বাভাবিকতার মধ্যে। তবে প্রাপ্তির সম্ভাবনা তাদের কিছু কালের জন্যে সুখে ভরে দেয়। যাকে চাই তাকে না পাওয়া প্রেম, তাকে পাওয়া কাম।

মানুষ পেতে চায়, তাই কাম বা যৌনতা জীবনের খাদ্য ও পানীয়। কামচরিতার্থতা অনেকটা জীবনচরিতার্থতা। যার কামজীবন পরিতৃপ্ত নয়, সে সুস্থ নয়, খুব ভেতরে তার নিরন্তর দংশন চলতেই থাকে। একটি পুলকপ্লাবিত সঙ্গম নারীপুরুষকে যা দিতে পারে, তা আর কিছু দিতে পারে না; জন্মজন্মান্তরের আচরিতার্থ প্রেমের থেকে একবার পুলকিত সঙ্গম উত্তম। সঙ্গম বাইরের দিক থেকে রুচিকর নয়; সভ্য সংস্কৃত মানুষ কীভাবে মেতে উঠতে পারে অমন বন্যতায়, তা ভেবে অনেক মনীষী বিস্মিত হয়েছেন, এবং প্রায় সমস্ত কিশোরকিশোরী বোধ করে ঘৃণা। আমার মাবাবাও এমন করে, এমন করে আমার শিক্ষক অধ্যাপকও?-এসব প্রশ্ন জাগে তাদের মনে; এবং ঘেন্নায় তারা শিউরে নিঃশব্দে চিৎকার করে-না, না, তারা এমন করে না; তারা এতো খারাপ নয়। কিন্তু কামের কাছে কেউ বাবামা শিক্ষক অধ্যাপক মহাপুরুষ দেবদূত নয়; কামে সবাই মানুষ। পুংসকতার সাথে আদিমতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে ব’লেও অনেকের বিশ্বাস; লরেন্স বিশ্বাস করতেন যে বুর্জোয়ারা এতো সংস্কৃত যে তারা নপুংসক ক্লীব বন্ধ্যা; তাই তাদের উর্বর করার জন্যে দরকার অসংস্কৃত বর্বরের বীর্য। কাম মানবিক, কাম মানুষের সমান বয়সী।

পুরুষতন্ত্র প্রেমের জয়গান গায়, তবে প্রেমে বিশ্বাস করে না; আর কামের নিন্দা করে, তবে বিশ্বাস করে কামে। পুরুষতন্ত্রের প্রধান বিশ্বাসগুলোর প্রধানটি সম্ভবত কাম; তার বিধানগুলোতে কামকে যেটুকু নিন্দ করা হয়েছে, তা পুরুষের অংশগ্রহণের জন্যে নয়, নারীর অংশ গ্রহণের জন্যে। পুরুষ নিজের সম্ভোগের সমস্ত পথ খোলা রেখে নারীকে দীক্ষিত করেছে। সতীত্ত্বে, ঘরে রেখেছে। সতী আর বাইরে রেখেছে। পতিতা। পুরুষ নারীর কামকে নিরুদ্ধ করার জন্যে নারীকে অবরোধে, পর্দায়, জেনানায় বন্দী করেছে, তাকে সূর্যের আলো দেখতে না দিয়ে তার নাম রেখেছে অসূৰ্যম্পশ্যা, তার ভগাঙ্কুর ছিন্ন করেছে, তাকে সতীত্ববন্ধ পরিয়েছে; কিন্তু নিজের কামের তৃপ্তি খুঁজেছে নারী থেকে নারীতে। চীনের তাওবাদ- “প্রকৃতির দিকে পরম পথ”- দার্শনিক সত্যে পৌচেছে যে ‘একটি পুরুষ যতো বেশি নারীর সাথে সঙ্গম করবে ততো বেশি কল্যাণ হবে তার; যদি পুরুষ একরাতে দশটির বেশি নারীর সাথে সঙ্গম করতে পারে, তাহলে তাই সর্বোত্তম” [দ্র ট্যানাহিল (১৯৮০, ১৫৬)]। ইসলাম পুরুষের জন্যে বহুবিবাহের, এবং ক্রীতদাসীসম্ভোগের বিধান রেখে স্বীকৃতি দিয়েছে পুরুষের কামকে, আর নারীকে সতী রাখার সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। পুরুষতন্ত্র নারীর জন্যে রেখেছে প্রেম, পুরুষের জন্যে রেখেছে কাম; নারীকে দিয়েছে প্রেমের মর্ষকামিতা উপভোগ, পুরুষের জন্যে রেখেছে কামের উদ্দীপনা। যার জীবনে কিছু নেই প্রেমই তার আশ্রয়, যার জীবনে রয়েছে সাফল্য প্রেম তার জীবনের মনে-না-পড়ার মতো খণ্ডাংশ। নারী হয়ে উঠেছে প্রেমের শিকার; নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তার কাম, যদিও পুরুষতািন্ত্র বিশ্বাস করে আগুন আর রক্কের ক্ষুধা কখনো মেটে না। সত্য হচ্ছে সভ্যতার কয়েক হাজার বছর ধরে নারী পুরুষের প্রেমে নিজের জীবন ব্যর্থতায় ভরে তুলেছে, কিন্তু তার কাম চরিতার্থতা লাভ করে নি। লৈঙ্গিক রাজনীতির সূচনাই হয় শয্যায়; শয্যায় নারীকে পরাভূত ক’রে তাকে পরাজিত করা হয়েছে জীবনের সমস্ত এলাকায়। সমস্ত কামসূত্র লেখা হয়েছে পুরুষের জন্যে; তার কামবাসনাকে চূড়ান্তরূপে পরিতৃপ্ত করার জন্যে।

নারীর জীবনে অতিশায়িত করা হয়েছে প্রেমকে। তবে তাও বৈধ প্ৰেম, যে-পুরুষের সে আশ্রিত নারীর প্রেম শুধু তারই জন্যে। যে-নারীরা বৈধ প্রেমের পথে না গিয়ে গেছে অবৈধ প্রেমের পথে, তারা নিন্দিত হয়েছে, শাস্তি পেয়েছে, তাদের জীবন বিপদ ও যন্ত্রণায় ভ’রে উঠেছে; তবে বৈধ-অবৈধ সব প্রেমই মূলত নারীর জন্যে ব্যর্থতা। পুরুষ নারীর প্রেমে দেখতে চেয়েছে মর্ষকামের প্রকাশ; পীড়িত হয়েই তারা স্মরণীয় হয়েছে। বায়রনের একটি উক্তি হচ্ছে ‘প্ৰেম পুরুষের জীবনের একটি অংশ, আর নারীর সমগ্র অস্তিত্ব।’ নারীর জীবনে কোনো সাফল্য নেই, তাই নারীর সমগ্র অস্তিত্ব সংকৃচিত হয়ে পড়ে একটি আবেগে, বা পুরুষতন্ত্র চায় নারীর সমগ্র অস্তিত্ব সংকুচিত হোক পুরুষের জন্যে আবেগে, আর সে-ই ততো মহীয়সী যে সহ্য করে যতো বেশি পীড়ন। তবে মহাপ্রেম কিংবদন্তি; প্ৰেম প্ৰধান ব্যাধি হয়ে থাকে শুধু তাদেরই জীবনে, যাদের কামনা মেটে নি। পুরুষের মতো প্ৰেম নারীর জীবনেরও অংশমাত্র; প্রেম তার জীবনে প্রধান নয়, তবে তার জীবন সংকীর্ণ, ব্যৰ্থ বলে তাকে থাকতে হয়েছে প্রেমের অসুস্থতার মধ্যেই। এখনো কি থাকে? ভাবালুতার যুগের উপন্যাসে যে-নায়িকাদের পাওয়া যায়, তাদের জীবনে প্রেম ও পুরুষ ছাড়া আর কিছু ছিলো না, তাই তারা কেঁদে বালিশ ভেজাতো, তাদের চোখ থেকে অবিরল বেরিয়ে আসতো অশ্র, আজ তেমন ঘটে না। বিরাহিণীও আজকাল দুগ্ধপ্ৰাপ্য, কিন্তু এককালে নারীমাত্রই ছিলো বিরাহিণী, আর তার নানা দশারও শেষ ছিলো না। বিরহের একেক দশায় সে ভোগ করতো একেক ধরনের পীড়ন। প্রেম ও নারীর অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সম্বন্ধে যতো উপকথা প্রচলিত রয়েছে, তা জৈবিক নয়; তা সামাজিক পরিস্থিতিরই পরিণতি। নিটশে বলেছেন [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৬৫২) :

‘পুরুষ ও নারীর কাছে একই শব্দ প্ৰেম বোঝায় দু-জিনিশ। নারী প্রেম বলতে যা বোঝে, তা খুবই স্পষ্ট : তা শুধু ভক্তি নয়, তা প্রত্যাশাহীন নিঃশর্ত সম্পূর্ণ দেহমান সমর্পণ। তার প্রেমের শর্তহীনতার বৈশিষ্ট্য তার প্ৰেমক পরিণত করে এক ধরনের ধর্মবিশ্বাসে; এবং এই তার একমাত্র বিশ্বাস। পুরুষ যখন ভালোবাসে কোনো নারীকে, তখন সে নারীর কাছে চায় প্ৰেম;..যদি কোনো পুরুষ বোধ কবে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের বাসনা, তাহলে, আমার কথা হচ্ছে, সে পুরুষ নয়।‘

পুরুষ ধরেই নেয় যে নারী যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে ভুলে যায় তার অস্তিত্ব, তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব; কেননা প্রেমে পুরুষ ঈশ্বর আর নারী ভক্ত। ভক্ত যেমন নিজেকে সম্পূর্ণ সমৰ্পণ করে প্রভুর পদতলে, নারীও করে তাই; কেননা প্ৰভু ছাড়া নারী নিরস্তিত্ব। পুরুষতন্ত্র নারীর আত্মোৎসর্গ আত্মসমর্পণপরায়ণতাকে মনে করে প্রাকৃতিক; মনে করে প্রকৃতিই নারীকে সৃষ্টি করেছে এভাবে। কিন্তু এর সাথে প্রাকৃতিক বা জৈববিধির কোনো সম্পর্ক নেই; এখানেও কাজ করে সামাজিক সূত্র। পুরুষ নারীকে শিখিয়েছে আত্মোৎসর্গ করতে, তাকে বাধ্য করেছে আত্মসমৰ্পণ করতে। নারী ও পুরুষের পরিস্থিতি ভিন্ন বলে তারা সব কিছুই দেখে ভিন্নভাবে, ভিন্নভাবে দেখে প্রেমকেও। নারী অস্বায়ত্তশাসিত, সমাজ তাকে কোনো কিছুর কর্তা হয়ে উঠতে দেয় না, তাই নারী প্ৰেমেও আত্মতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে না। নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া তার উপায় নেই; প্রেমে তাই সে নিজেকে সমর্পণ করে সমাজপতি পুরুষের কাছে। নারী সমৰ্পণ করে নিজের দেহ ও আত্মা পরম সত্তার কাছে, ওই পরম সত্তা কখনো পুরুষ কখনো বিধাতা। নারী জানে পরনির্ভরতাই তার নিয়তি, তাই তার জন্যে ভালো হচ্ছে কোনো দানবের বদলে কোনো দেবতাকে পুজো করা। তাই প্রেমকে নারী ক’রে তোলে ধর্ম, আত্মসমৰ্পণ ক’রে সে করতে চায় আত্মরক্ষা। নারী তার প্রেমে পড়ে, যে তাকে উন্নীত করতে পারে নিজের অবস্থান থেকে; সে পুজো করে পৌরুষের. সম্পদের, সামজিক অবস্থানের। যে-নারী নিজের থেকে নিম্ন অবস্থানের কারো জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে, সে বেছে নেয় চরম মর্ষকামিতা।

নারীর জীবনে প্রেমের অবকাশ খুবই কম। তার রয়েছে স্বামী, সংসার, সন্তান, গৃহস্থলি, কাম, এবং অনেকের রয়েছে পেশা! কাম জৈবিক, প্রেম সাংস্কৃতিক; নারী প্রেম শেখে প্রেমের অতি প্রচারের ফলেই। প্ৰেম এখন সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপিত পণ্য, অন্যান্য পণ্যের মতো এরও প্রধান ক্রেতা নারী। তবে অধিকাংশ সংস্কৃতিই নারীর জন্যে প্রেম নিষিদ্ধ ক’রে রেখেছে, তাদের জন্যে রেখেছে। বিবাহিত প্ৰেম, যা বিশেষ দরকারে পড়ে না। অনেক কিশোরীতিরুণী বিশেষ বয়সে প্রেমের স্বপ্ন দেখে : তাদের ওই স্বপ্নের পেছনে রয়েছে তাদের শরীরের প্ররোচনা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ। মনোবিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেন নারী প্রেমিকের মধ্যে খোজে পিতাকে। আসলে তারা পিতা নয়, খোজে। পুরুষকেই; যে তাকে দিতে পারে মহিমা। পুরুষ নারীর চোখে মহিমান্বিত, বাল্যকাল থেকেই তারা দেখে পুরুষের মহিমা; প্রেমিক বা স্বামীর মধ্যে তারা দেখতে চায় তা। পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজে নারী পুরুষের কাছে নিজেকে মনে করে শিশু, প্রেমিক যখন তাকে ডাকে “মিষ্টি মেয়ে’, ‘ময়না’, ‘আমার পাখি’, তখন তা তার হৃদয় স্পর্শ করে। পুরুষের বাহুতে আবার বালিকা হয়ে ওঠার আনন্দ তাদের অসীম। নারীর আত্মসমৰ্পণ। তার টিকে থাকার অভিলাষের প্রকাশ; ধর্মে ভক্ত বিধাতার কাছে আত্মসমৰ্পণ ক’রে নিজের জন্যে একটি অসামান্য স্থান ক’রে নেয়, নারীও তেমনি প্রেমে স্থান ক’রে নেয় নিজের জন্যে। দেবতার পদতলে সে হয়ে ওঠে নৈবেদ্য। প্রেমে নারীর আচরণ সামাজিক ব্যবস্থারই ফল, বাঙালি-সৌদি-মার্কিন নারীর প্রেম-আচরণ এক রকম নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ নারী কখনো প্রেমের আবেগ বোধ করে নি।

প্রেম অপরিহার্স নয়; তবে কাম অপরিহার্য। অধিকাংশ সমাজেই প্ৰেম নিষিদ্ধ, তবে কাম নিষিদ্ধ নয়। নারীর জীবনে সাধারণত কাম আসে বিয়ের মধ্য দিয়ে, বিয়েই তাদের জন্যে কামের কানাগলি। তবে নারীর বিয়ে নিজের কামের জন্যে নয়, পুরুষের কামের জন্যে; নারীর বিয়ে নারীর আত্মরক্ষার জন্যে! কোনো সংস্কৃতিই নারীর কামতৃপ্তিকে মূল্য দেয় নি, ববং বহু যত্নে লিখেছে তার কাম দমন করার বিধান। পুরুষ নারীকে চিরকাল ভয় করেছে তার কামশক্তির জন্যে, পুরুষ বুঝতে পেয়েছে কামবাসনা ৩ার য৩োই প্রবল হোক স্থলনের পর তার আর কোনো উদ্যম থাকে না; কিন্তু নারী যেনো অনন্তকাল লিপ্ত হয়ে থাকতে পারে। আরবরা নারীকে ফিৎনা বা বিশৃঙ্খলা ব’লে ভয় করে; তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে; হিন্দুরা তার কামশক্তি দেখে হয়েছে আতংকিত। পুরুষ নিজের কামকে বিরামহীনভাবে চরিতাৰ্থ করেছে, কিন্তু নারীর কামতৃপ্তির কথা ভাবে নি। পুরুষের কাছে সতী সে, যে সঙ্গমের সময়ও নড়াচড়া করে না; ভিক্টোরীয় এক পুরোহিত বলেছিলেন, ‘নোড়ো না, নারী।’ নারীর কাম সম্পর্কে পুরুষতন্ত্র দুটি বিরোধী ধারণা পোষণ ও প্রচার করে; একটি হচ্ছে নারীর কাম ক্ষুধার শেষ নেই, কিছুতেই ওই আগুন নেভে না; অন্যটি হচ্ছে নারী কাম পছন্দ করে না, নারী প্রাকৃতিকভাবেই একপুরুষে পরিতৃপ্ত। দুটিই অপপ্রচার; কেননা নারী তৃপ্ত হয়, এবং নারী কাম পছন্দ করে, নারী জৈবিকভাবে একপুরুষের সতী নয়। একাধিক পুরুষের সাথে কামসংসর্গে তার আপত্তি নেই, তবে পুরুষতন্ত্রের ভয়ে অধিকাংশ নারীই তা স্বীকার করে না। একপতিপত্নী প্রথার উদ্ভব সম্পর্কে বাখোফেন বলেছেন যে নারীরাই উদ্যোগ নিয়েছিলো একটি পুরুষের সাথে সঙ্গমের অধিকার পাওয়ার, কেননা বহু পুরুষের সাথে সঙ্গম তাদের ভালো লাগে নি। তার এ-মত সমর্থন করেছেন বিপ্লবী এঙ্গেলসও (১৮৮৪, ২১০); তিনি বলেছেন বহু পুরুষের সাথে সঙ্গমের পীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আগ্রহের সঙ্গে পরিত্রাণ হিসাবে তারা অবশ্য পাতিব্ৰত্যের অধিকার, একটি পুরুষের সঙ্গে অস্থায়ী বা স্থায়ী বিবাহ চেয়ে থাকবে।’ তাঁর এ-সিদ্ধান্তের মূলে আছে ভিক্টোরীয়বাদ, যার সিদ্ধান্ত হচ্ছে নারীরা কাম পছন্দ করে না। নারীরা কাম পছন্দ কবে না বলে একটি পুরুষের শয্যায় নিষ্ঠার সাথে পালন করতে চেয়েছে পাতিব্ৰত্য, এবং নারীদের আগ্রহেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একপতিপক্ট বিয়ে, এ-মত ঠিক নয়। পুরুষ চেয়েছে ব’লই এটা ঘটেছে; পুরুষ তার বহুসম্ভোগেব পথ খোলা রেখে নারীকে নিজের একান্ত সম্ভোগের বস্তু ক’রে তোলার জন্যেই সৃষ্টি করেছে একপতি(বহু)পত্নী বিয়ে। নারী কাম পছন্দ করে, খুবই উপভোগ করে। একনিষ্ঠতা জৈবিক নয়, সামাজিক; আর তা মনে চলতে বাধ্য হয়। শুধু নারী। পুরুষ কখনোই একনিষ্ঠতাকে মনপ্ৰাণে স্বীকার করে নি; রাজ্যের সাধুতম পুরুষটিও অভ্যন্তরে অত্যন্ত লোলুপ।

বাঙালির কামজীবন এক নিষিদ্ধ গোপন এলাকা, যদিও বাঙালি পুরুষ কামে চিংড়ির মতোই উৎসাহী। বাঙালির সামাজিক জীরনে কাম বেশ প্রবল ভূমিকা পালন ক’রে থাকে, বাঙালি পুরুষেরা একত্ৰ হ’লেই কামালাপে মেতে ওঠে, এবং তাদের সমস্ত আচরণেই কামলোলুপতা প্রকাশ পায়। বাঙালি সমাজকে অবদমিত কাম-দিয়ে-ঘেরা সমাজও বলা যায়; এবং ওই অবদমন নিয়মিতভাবে প্ৰকাশ পায় ধর্ষণরূপে। তবে শয্যায় তাদের আচরণ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। বাঙালি নারীপুরুষের কামজীবন সম্পর্কে কিন্সে ও অন্যান্যের পুরুষের যৌন আচরণ (১৯৪৮), নারীর যৌন আচরণ (১৯৫৩), বা মাস্টার্স ও জনসনের মানুষের যৌন সাড়ার (১৯৬৬) মতো বই লেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে এ-বিষয়ে যে কিছুই লেখা হয় নি, তাতে বোঝা যায় বাঙালির কামজীবন সুস্থ নয়। যা গোপন ক’রে রাখা হয়, তা সাধারণত অসুস্থ হয়ে থাকে। এটা নিষিদ্ধ বিষয়; আর এর পীড়ন ভোগ করে নারী। বাঙালি নারীর যৌনজীবন বলাৎকার ও চরম বিবক্তিকর অবসাদের সমষ্টি। উচ্চশিক্ষিত কিছু নারী আমাকে জানিয়েছেন তারা পুলক সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাদের স্বামীরা লাফ দিয়ে উপসংহারে পৌঁছেন, এই তাদের চাঞ্চল্যকর কামজীবন। দরিদ্র অশিক্ষিত নারীরা সাধারণত ভোগ করে স্বামীর বলাৎকার। বাঙলাদেশে প্রতিটি শয্যাকক্ষ, যদি থাকে, নারীর জন্যে বলাৎকার বা বিরক্তিকর অবসাদকক্ষ।

নারীর জীবনে কাম এক প্রধান ব্যাপার, তবে নারী যেমন তার জীবনকেই সমৰ্পণ করে কোনো পুরুষের কাছে, তেমনই সমৰ্পণ করে তার কামকেও। তার শরীর তার অধিকারে নয়, তার কামও তার অধিকারে নয়; মাৰ্গারেট স্যাংগার বলেছেন, ‘কোনো নারী নিজেকে স্বাধীন বলতে পারে না, যে তার নিজের শরীরের মালিক ও নিয়ন্ত্রক নয়।’ নারী মালিক আর নিয়ন্ত্রক নয়। তার কামেরও। ক্যাথেরিন ম্যাককিনন (১৯৮২, ১) বলেছেন, মার্ক্সবাদে যেমন শ্রম নারীবাদে তেমন কাম : যা মানুষের একান্ত আপন, কিন্তু যা হরণ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।’ নারীর কামকে অপরিতৃপ্ত রাখাই পুরুষতন্ত্রের রীতি। নারী কামে সক্রিয় সম্ভোগী হতে পারে না, কোনো সংস্কৃতিই চায় না। কামে নারী উদ্যোগী ভূমিকা নিক; সব সংস্কৃতিই চায় নিজের কাম দিয়ে নারী সেবা করবে। পুরুষের। নারীর জন্যে বিয়ে হচ্ছে কাম দিয়ে পুরুষের সেবা। নারী পুরুষের ভোগ্যসামগ্ৰী। কামে নারী ও পুরুষের ভিন্নতা অসীম জৈবিক সামাজিক মনস্তাত্ত্বিকভাবে : সব সংস্কৃতি চায় যে কামে পুরুষ থাকবে কর্তা, পুরুষই নিয়ন্ত্রণ করবে শয্যা; পুরুষই স্থির করবে। কখনও কতোটা কামের প্রয়োজন, কীভাবে তা পরিতৃপ্ত করা হবে। কামে পুরুষ ভূমিকা পালন করে সক্রিয় কর্তার, পুরুষের কাম তার দেহ থেকে ধাবিত হয় নারীর শরীরের দিকে, নারীর শরীর পুরুষের কামের শিকার। দ্য বোভোয়ার বলেছেন (১৯৪৯, ৩৯৪), ‘নারীকে বিদ্ধ ও উর্বর করা হয় তার যোনি দিয়ে, যা শুধু পুরুষের মধ্যবর্তীতার ফলেই পরিণত হয় কামকেন্দ্রে, এবং এটা সব সময়ই এক ধরনের বলাৎকার।’ পুরুষতন্ত্র নারীর ওই রন্ধটিকেই মনে করে নারীর কামের আকার, যেনো ওই রন্ধটিতে কয়েক মুহূর্ত কাজ করলেই নারীর কাম পরিতৃপ্ত হয়ে যায। আধুনিক যৌনবিজ্ঞান ও নারীবাদীরা দেখিয়েছেন কামসূখের জন্যে ওটি উত্তম নয়; কেননা যোনির দেয়ালের স্পর্শকাতরতা কম। নারীর রয়েছে একটি অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ, ভগাঙ্কুর, যেটি নারীকে পৌঁছে দিতে পারে চরম পুলকে। তবে পুরুষতন্ত্র এটিকে শুধু উপেক্ষাই করে না, অনেক অঞ্চলে এটিকে উচ্ছেদও করে, যাতে নারী কখনো কাম বোধ না করে। তাই নারীর জন্যে অবধারিত বলাৎকার; বলাৎকারের ফলেই বালিকা নারী হয়ে ওঠে। পৃথিবী জুড়ে রখনো নারীর জন্যে বিবাহিত বা অবিবাহিত প্রথম সঙ্গম বলাৎকার। বাঙলাদেশের যে-কিশোরীকে আত্মীয়রা খাটের সাথে বেঁধে বাধ্য করে বাসর রাত কাটাতে, যে-কিশোরী জানে না তার শরীরকে, যে প্রস্তুত হয় নি নিজের ভেতরে কোনো শিশুগ্রহণের জন্যে, এটা তার জন্যে যেমন বলাৎকার, তেমনই বলাৎকার শিক্ষিত তরুণীর জন্যেও, কেননা তার ভেতরেও একইভাবে ঠেলে ধাব্ধিয়ে ভেঙেচুড়ে ছিড়ে ফেড়ে ঢোকে একটি অচেনা উদ্যত অবিবেচক শিশ্ন। অধিকাংশ সমাজে লৈঙ্গিক রাজনীতির হিংস্র রূপটি- বলাৎকার বা ধর্ষণ- দেখা দেয় বাসর শয্যায়। প্রথম রাতেই ছিন্নভিন্ন ওই নারীরা আর খাপ খাওয়াতে পারে না কামের সাথে, কাম হয়ে ওটে তাদের জীবনের ভীতি, অবৰ্ণনীয় অবসাদ।

কামে নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর; পুরুষই নেয় আক্রমণাত্মক ভূমিকা, নারী নিজেকে সমর্পণ করে তার আগ্রাসনের কাছে। পুরুষ, যদি সে নিজে প্রস্তুত থাকে, নারীর ভেতরে ঢুকতে পারে যে-কোনো সময়, তাই শুধু পুরুষই করতে পারে ধর্ষণ: নারী প্রস্তুত কিনা তা পুরুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বা পুরুষ মনে করে নারী সব সময়ই প্রস্তুত। চিরকালই অধিকাংশ নারী পুরুষকে তার ভেতরে গ্রহণ করেছে অপ্ৰস্তৃত অবস্থায়; তীব্ৰ পীড়নে ঘুম ভেঙে তারা দেখে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পুরুষ, অসুস্থ অবস্থায়ও তারা বাধ্য হয় পুরুষকে প্রবেশাধিকার দিতে। নারী পুরুষকে অপ্ৰস্তুত অবস্থায় ব্যবহার করতে পারে না; কিন্তু পুরুষ পারে অপ্ৰস্তুত নারীর ভেতরে ঠেলে ঢুকতে। পুরুষ চাইলে লাশের সাথেও সঙ্গম করতে পারে। সঙ্গমে অধিকাংশ সমাজে নারীর অনুমতি বা আগ্রহের প্রয়োজন হয় না; পুরুষের কাছে নারী নিজের শস্যক্ষেত্র, ওই খেতে পুরুষ যে-কোনো সময় যে-কোনো দিক দিয়ে ঢুকতে পারে। পুরুষ নিজের কামের প্রহরীরূপে স্বর্গীয় সত্তাদেরও নিয়োগ করতে দ্বিধা করে না; হাদিসে আছে স্বামী যদি সঙ্গম চায় আর স্ত্রী না চায়, তাতে কামোর্ত স্বামীটি যদি জেগে রাত কাটায়, তবে ফেয়েশতাদের অভিশাপ সারা রাত বৰ্ষিত হয় পাপী নারীটির মাথার ওপর [দ্র পিতৃতন্ত্রের খড়গ’। এতো গুরুত্বপূর্ণ পুরুষের কাম, নারী আছে ওই কামের খাদ্য হওয়ার জন্যে। এ-জন্যেই সঙ্গমকে অনেকে মনে কবেন নারীর পরাজয, সঙ্গমের আসনেও প্রকাশিত দেখেন পুরুষাধিপত্য। দ্য বোভোয়ারও (১৯৪৯, ৪০৫-৪০৬) বলেছেন :

‘তরুণীর নিজের বলতে আছে শুধু দেহখানি : এটি তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ; যে-পুরুষটি তার ভেতরে প্রবেশ করে, সে এটি গ্রহণ করে তার থেকে;.যে-অপমান সে আশংকা করেছে তা পরিণত হয়। সত্যে : তাকে পরাভূত করা হয়, সম্মত হতে বাধ্য করা হয়, জয় করা হয়। অধিকাংশ প্রজাতির মাদিটির মতো, সঙ্গমের সময় সে থাকে পুরুষটির নিচে। অ্যাডলাব এ থেকে উৎপন্ন হীনমন্যতার চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাল্যকাল থেকেই উচ্চমন্যতা ও হীনমন্ট, তার ধারণা দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; উঁচু গাছে ওঠা কৃতিত্ব; স্বর্গ পৃথিবীর ওপরে, নরক নিচে; পড়ে যাওয়া, নিচে নামা ব্যর্থতা; ওপরে ওঠা সাফল্য; কুস্তিতে জিততে হলে প্রতিপক্ষের কােধ মাটির সাথে লাগিয়ে দিতে হয়। এতে, নারীটি পড়ে থাকে পরাজয়ের ভঙ্গিতে: তার চেয়েও খারাপ হচ্ছে পুরুষটি তার ওপর চড়ে থাকে যেভাবে সে চাবুক হাতে বল্পা ধ’রে চড়ে কোনো পশুর ওপর। সে নিজেকে সব সময় বোধ করে অক্রিয়; তাকে শৃঙ্গার করা হয়, বিদ্ধ করা হয়; সে ভোগ করে সঙ্গম, আর পুরুষটি নিজেকে প্রয়োগ করে সক্রিয়ভাবে।’

সঙ্গমের আসনও আধিপত্য-অধীনতার প্রকাশ? অসুস্থ সভ্যতায় সব কিছুই যেখানে রাজনীতি, সব কিছুই যেখানে নির্দেশ করে আধিপত্য-অধীনতার সম্পর্ক, সেখানে অন্তরঙ্গতম ব্যাপারটিও হয়ে ওঠে আধিপত্য-অধীনতার প্রতীক। বাইবেলের ভাষ্যকারেরা বুঝেছিলেন এর রাজনীতিটুকু, পুরুষ ওপরে নারী নিচেই তাঁদের মনে হয়েছে প্রাকৃতিক বিধিবদ্ধ আসন। নুহের প্লাবনের কারণ হিশেবে তাঁরা দেখিয়েছেন নারীপুরুষের বিপরীত বিহারকে, যাতে ‘নারীরা প্ৰভুত্ব করে পুরুষের ওপর’ [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ৫১)]।

পুরুষতন্ত্রে প্রধান পুরুষের কাম; তবে নারীর রয়েছে কামসুখভোগের অধিকতর শক্তি। কাম অনেকাংশে পুরুষের একটি প্রত্যঙ্গের কাজ; কয়েক মুহূর্তে স্থলিত হ’তে পারলেই পুরুষ মুক্তি পায়। কিন্তু নারীর কাম তার পরিস্থিতির মতোই জটিল বহুস্তরিক। কোনো স্থলনে যেহেতু তার কামনার সমাপ্তি ঘটে না, তার কাম যেহেতু তার সমগ্ৰ শরীর ও চেতনায় ছড়িয়ে পড়ে, সে যেহেতু হঠাৎ জ্বলে উঠে৷ হঠাৎ নিভে যায় না, তার সূচনা থেকে সমাপ্তি যেহেতু ধীরমন্থর জলস্রোতের মতো, তাই সুখ। যেমন তাকে পরিষ্যাপ্ত করতে পারে, তেমনই সুখের অভাবও তাকে জ্বালাতে পারে দীর্ঘ সময় ধ’রে। সঙ্গমে চূড়ান্ত আত্মবিলোপ ঘটে নারীর; সে ডুবে যায় অক্রিয় অবসন্নতায়, তার চোখ বুজে আসে, যেনো ভেসে যায় ঝড় প্লাবনে অনন্ত অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, প্রবেশ করে মাংস, জরায়ু, কবরের অন্ধকারে। নারীর মতো চূড়ান্ত আত্মবিলুপ্তির মধ্যে কাম পুরুষ কখনো উপভোগ করতে পারে না; পুরুষকে থাকে সচেতন, তার সচেতনতা তার বড়ো বাধা। নারীর জন্যে সঙ্গম ধ্যান, ধ্যানে আত্মসচেতনতা বিঘ্নকর; পুরুষের জন্যে সঙ্গম কাজ, কাজে আত্মসচেতনতা অপরিহার্য। তাই ওই ধ্যানের সময় নারীকে ডাকলে, কেমন লাগছে জানতে চাইলেও সে বিরক্ত বোধ করে; কেননা অনির্বাচনীয়কে সে উপলব্ধি করতে চায় অনির্বাচনীয়রূপেই। ষাটের দশকে নারীর কাম সম্পর্কে মাস্টার্স ও জনসনের (১৯৬৬) গবেষণা পশ্চিমে নারীকে অনেকখানি মুক্তি দেয়। পুরুষের কােমাধিপত্য থেকে; এবং নারীবাদীরা ঘোষণা করেন তাদের কামসার্বভৌমত্বের কথা। কয়েক দশক আগে ভোটাধিকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তাদের কাছে, ষাটের দশকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কামাধিকার। এর ফলে পশ্চিম মুক্তি পায় ভিক্টোরীয়বাদ নামের রোগ থেকে, নারী অনেক বেশি উপভোগ করে তার শরীর। ষাটের দশকে নারী ফিবে পায় তার শরীর।

মাস্টার্স ও জনসন নারীর যৌন সাড়াকে ভাগ করেছেন চারটি পর্বে : উত্তেজনাপর্ব, অধিত্যকাপর্ব, পুলকপির্ব, ও শমাপর্ব। পুরুষও যায় এ-চারটি পর্বের ভেতর দিয়ে; তবে তাদের প্রত্যঙ্গের ভিন্নতা অনুসারে উপভোগ করে ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

উত্তেজনাপর্ব : এর সূচনা ঘটে কোনো পুরুষের শরীরসংস্পর্শে, তবে কোনো পুরুষকে দেখেও এবা সূচনা ঘটতে পারে। বিভিন্ন নারী বছরের বিভিন্ন সময় বোধ করে বিশেষ উত্তেজনা; কেউ ঋতুকালে, কেউ চক্রের মধ্যভাগে, কেউ ঋতুসূচনার আগে বোধ করে তীব্ৰ কাম-উত্তেজনা। সব ধর্মেই ঋতুকালে সঙ্গম নিষিদ্ধ, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অনেক নারী এ-সময়েই বেশি কাম বোধ করে। এ-সময়টা নিরাপদও, গর্ভসূচনার কোনো সম্ভাবনা নেই। নারীর উত্তেজনাপর্ব পুরুষের উত্তেজনাপর্বের থেকে দীর্ঘ, পুরুষ যতো সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে নারী তেমন হয় না। এ-পর্বে স্তনবৃন্ত খাড়া হয়ে ওঠে, ভগাঙ্কর আয়তনে বাড়ে, ‘ওষ্ঠগুলো’ কোমল পুরু হয়ে স্ফীত হয়, যোনি সিক্ত হয়; এবং রক্তপ্রবাহের ফলে তুকে দেখা দিতে পারে ঝিলিক, যাকে বলা হয় ‘কাম ঝিলিক’।

অধিতাক পৰ্ব : উত্তেজনাপর্বেরই সম্প্রসারণ অধিত্যকাপর্ব, উত্তেজনাপর্বে যা কিছুর সূচনা ঘটে, এ-পর্বে সে-সব পেঁৗছে তুঙ্গে। নারী এ-পর্বে ভেতরে চায় শিশ্ন। এ-পর্বে জরায়ুর গ্ৰীবা বৃদ্ধি পায়, যোনিরন্ধও বাড়ে। এর ফলে যোনির গভীরদেশে তৈরি হয় একটি থলের মতো এলাকা, যেখানে ঘটবে বীর্যপাত। এ-সময় যোনির বাইরের দিকটা বেড়ে এ-এলাকাটির ব্যাস হ্রাস পায়। মাস্টার্স ও জনসন একে বলেছেন ‘পুলকমঞ্চ’। অধিত্যকাপর্ব যতো দীর্ঘ হয় ততোই সুখকর নারীর জন্যে।

পুলকপর্ব: পুলক শরীরমিলনের লক্ষ্য। পুলক এক অনির্বচনীয় অনুভূতি; নারী এ-পর্বে বোধ করে তীব্রতম সুখ, যা প্রতি নারীর জন্যে অনন্য। পুলকই কাম্য, কেননা তা নরনারীকে পৌঁছে দেয় সুখের শিখরে; একে ভয়ও পায় অনেকে। ফরাশিরা একে বলে ‘ছোটো মৃত্যু’। নারীর পুলকের সূচনা হয় শ্রোণীদেশে, পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। এর সূচনা ঘটে স্তব্ধতায়, তারপর ঘটে। অদম্য পেশিসঞ্চালন, শিহরণ, ভাসমানতার অনুভূতি, উষ্ণতা, মানসিক উত্তেজনামুক্তি, ও উল্লাস। পুলক ঘটে প্রতিবর্তীতার ফলে। ভগাঙ্কুরের সাথে শিশ্ন, ওষ্ঠ বা আঙুলের ঘর্ষণের ফলে উত্তেজনার সংবাদ পৌঁছে সুষুম্নাকাণ্ডে; সেখান থেকে তা পৌঁছে দেয়া হয় নারীর শ্রোণীনিয়ন্ত্রক স্নায়ুরাশিতে। এর ফলে ঘটে পুলক। তবে সব নারীর সব সময় পুলক নাও ঘটতে পারে। ঘটবে কী ঘটবে না, তা নির্ভর করে ওই প্রতিবর্তীতায় তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ওপর। যে-নারী কোনো যৌননিষেধগ্রস্ত নয়, সে হয়তো সহজেই পৌঁছোয় পুলকে; কিন্তু যে নারী যৌননিষেধগ্রস্ত, সে হয়তো কখনোই পৌঁছোয় না। কেউ কেউ পুলকের সময় আলোড়িত ক’রে তোলে তার শরীর ও পরিবেশকে, শীৎকারে ভরে দেয় চারপােশ, কেউ কেউ থাকে স্তব্ধ। পুরুষের সাথে নারীর পুলকের পার্থক্য হচ্ছে নারীর কোনো বীৰ্যপাত ঘটে না।

আগে মনে করা হতো পুলক রয়েছে দু-ধরনের; একটি ভগাঙ্কুরীয়, আরেকটি যোনীয়। এ-ধারণার মূলে রয়েছে ফ্রয়েডের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সূত্র। তাঁর বিশ্বাস ছিলো যে ভগাঙ্কুরীয় পুলক নারীর বিকাশহীনতার পরিচায়ক, কেননা তা হস্তমৈথুনেই লাভ করা যায়, বালিকাও তা লাভ করতে পারে; আর যোনীয় পুলক নারীর কাম ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের পরিচায়ক, কেননা এতে বাল্যের কাম ভগন্ধুর থেকে স্থানান্তরিত হয় যোনিতে। ফ্রয়েডীয় সিদ্ধান্ত প্রথাগত কুসংস্কারের প্রকাশ : পুলক হচ্ছে পুলক, কীভাবে তার উৎপত্তি ঘটেছে তা বিবেচনার বিষয় নয়। কেউ যদি কবিতা পড়ে, সূর্যস্ত দেখে, জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় নিজের নামে শ্লোগান শুনে পুলক বোধ করে, তাও চমৎকার! এটা নিশ্চিত যে পুলকের উৎস ভগাঙ্কর, উত্তেজিত ভগান্ধুরই শুরু করে ঘটনাটি, তবে যোনিও এতে কিছুটা অংশ নেয়। ষাটের দশক থেকে নারীর কামে যোনির মর্যাদা কমে গেছে, প্রধান হয়ে উঠেছে ভগান্ধুর। কারো কারো ভগাঙ্কুর এতো প্রতিভাশালী যে একের পর এক, মেশিনগানের মতো, পুলক বোধ করতে পারে; কেউ কেউ পঞ্চাশটি পুলকের সংবাদও দিয়েছে! তবে সম্প্রতি নারীর পুলককেও পুরুষ ব্যবহার করছে নারীকে নতুন ধরনের দাসী ক’রে তুলতে; পুরুষ দাবি করছে সে যখন শিশ্ন চালাবে, তখন নারীকে বাধ্যতামূলকভাবে পেতে হবে পুলকের পর পুলকের পর পুলক। নারীর একটি দায়িত্ব হয়ে উঠেছে পুলক অর্জন করা, যে-নারী পুলক অর্জন করে না পুরুষ তাকে মনে করে প্রতারক; তাই পশ্চিমে নারী এখন পুরুষকে কামসেবা করতে গিয়ে বাধ্য হচ্ছে পুলকলাভের অভিনয় করতে। পুরুষ এখন মনে করছে নারী হচ্ছে পুলকলাভের যন্ত্র, তার কাজ শয্যাকে পুলকে পুলকে প্লাবিত করা [দ্র ক্লাইন ও স্পেন্ডার (১৯৮৭, ১১০-১২৪)]। নারীর পুলকও পুরুষেরই জন্যে!

শমপর্ব: শমাপর্ব পুলকোত্তর বা পুলকহীন সঙ্গমোেত্তর পর্ব, যখন নারীপুরুষ ফিরে যায় তাদের প্রাক-উত্তেজনা অবস্থায়। এ-পর্বে ঘটে সব কামনার নিবৃত্তি বা দেখা দেয় ব্যৰ্থতার ফলে যন্ত্রণা। পুলকের পর পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে যোনি নীরস হয়ে ওঠে, তবে উত্তেজিত করা হ’লে নারী আবার পুলকের পর পুলক পেতে পারে। নারী যদি অধিত্যকাপর্বের পর কোনো পুলক অনুভব না করে, বা ব্যর্থ সঙ্গমের পর হস্তমৈথুন করে পুলক বোধ না করে, তবে তার শান্ত অবস্থায় ফিরতে অর্ধেক দিনরাত কেটে যেতে পারে। বার বার উত্তেজনা ও পুলকলাভে ব্যর্থতা নারীর জীবনে নিয়ে আসতে পারে হতাশা ক্লান্তি অবসাদ, দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। পৃথিবী জুড়ে অধিকাংশ নারী পুলকের অভাবে অবসাদগ্ৰস্ত।

ষাটের দশকে পশ্চিমে নারীবাদ নানা মুক্তির সাথে ঘটায় নারীর কামেরও মুক্তি; প্রধান হয়ে ওঠে পুলক, ভগাঙ্কর; কামে প্রথাগত রীতির বদলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আরেক রীতি— মুখসঙ্গম। পুলক একটি শ্লোগানে, মহান ভাবাদর্শে, পরিণত হয়। ফ্রয়েড সৃষ্টি ক’রে গিয়েছিলেন ভগাঙ্কুর ও যোনির বিরোধ; তাঁর কাছে ভগাঙ্কুর ছিলো অবিকাশের আর যোনি বিকাশের পরিচায়ক। তাঁর মতে প্রকৃত নারীকে সুখ বোধ করতে হবে যোনিতে, ভগাঙ্গুরে নয়। যদি করে, তবে সে রয়ে গেছে বালিকা; তার বিকাশ ঘটে নি, তার চিকিৎসা দরকার। এটা ইহুদি-খ্রিস্টান ধারণার ছদ্মবৈজ্ঞানিক রূপ; তিনি উচ্ছেদ না ক’রে সম্পন্ন করেন নারী খৎনা। ষাটের দশকে নারীবাদীরা ফ্রয়েডকে বাতিল করেন, বাতিল করেন অনেকটা যোনিকেও। তাদের মতে ভগান্ধুরই সুখবোধের অনন্য প্রত্যঙ্গ, এটির সাহায্যেই পুলক বোধ করে নারী; যোনি গৌণপ্রত্যঙ্গ। মাস্টার্স ও জনসন (১৯৬৬, ৪৫) বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ মানব অঙ্গসংস্থানে ভগাঙ্কুর অনন্য। এর কাজ ইন্দ্ৰিয় উদ্দীপনা গ্রহণ ও বৃদ্ধি করা। তাই নারীর রয়েছে এমন একটি প্রত্যঙ্গ, যার শারীরিক ভূমিকা শুধু যৌন উত্তেজনার সূচনা ও বৃদ্ধি করার মধ্যেই সীমিত। পুরুষের দেহসংস্থানে এমন কোনো প্রত্যঙ্গ নেই।’ কিন্তু যোনি কি বাতিল, এটা কি সম্পূর্ণরূপেই একটি নির্বোধ চামড়ার থলে? গ্রিয়ার (১৯৭০, ৪৩) প্রতিবাদ ক’রে বলেছেন, ‘এটা বাজে কথা যে পুরুষ যখন যোনিতে শিশ্ন চালায় তখন নারী কোনো কিছু অনুভব করে না; শূন্য যোনির বদলে যখন যোনির ভেতর একটি শিশ্ন ভরা থাকে তখন পুলক গুণগতভাবেই ভিন্ন।’ যোনি একেবারে অনুভূতিহীন নয়, এটিও সক্রিয় হতে পারে; অনেক যোনি শিশ্নকে ওষ্ঠ ও জিভের মতো চুষতে পারে। নারীবাদীরা ষাটের দশকেই মেটানি যোনি ও ভগাঙ্কুরের ফ্রয়েডীয় বিরোধ; তবে প্রধান ক’রে তোলেন ভগাঙ্কুরকেই। এর ফলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মৌখিক সঙ্গম। পশ্চিমে নারীরা অনেকটা ফিরে পেয়েছে তাদের শরীর, কিন্তু গ্রহ জুড়ে নারীর শরীর এখনো পুরুষের জমিদারি।
 
বিয়ে ও সংসার


পিতৃতন্ত্র নারীর জন্যে যে-পেশাটি রেখেছে, তা বিয়ে ও সংসার; এ-ই। পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত নারীর নিয়তি। এরই মাধ্যমে নারীকে বিস্তৃত জীবন থেকে সংকুচিত ক’রে, তার মনুষ্যত্ব ছেটে ফেলে, তাকে পরিণত করা হয় সম্ভাবনাশূন্য অবিকশিত প্রাণীতে। নারীকে দেয়া হয়েছে বিয়ে নামের অনিবাৰ্য স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন, যার মধ্য দিয়ে সে ঢোকে একটি পুরুষের সংসার বা পরিবারে; পালন করে পুরুষটির গৃহিণীর ভূমিকা, কিন্তু বন্দী থাকে দাসীত্বে। প্রথাগত স্ত্রীর ভূমিকা একটি প্রশংসিত পরিচারিকার ভূমিকা, যে তার প্রভুর সংসার দেখাশোনার সাথে কাম ও উত্তরাধিকার দিয়ে চরিতার্থ করে প্রভুর জীবন। বিয়ে ও সংসার নারীর সম্ভাবনার সমাপ্তি; অবশ্য পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে না। নারীর কোনো সম্ভাবনায়ই, মনে করে দাসীত্বেই নারী লাভ করে পরিপূর্ণতা। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২১৪) পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাকে বলেছেন “স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়’; এর ফলে পুরুষ গৃহস্থলির কর্তৃত্বও দখল করল, স্ত্রীলোক হল পদানত, শৃংখলিত, পুরুষের লালসার দাসী, সন্তানসৃষ্টির যন্ত্র মাত্র। বিয়ে, তাঁর মতে, ‘মোটেই স্ত্রী ও পুরুষের সদ্ভাব সূত্রে দেখা দেয় নি, দেখা দেয় ‘নারী পুরুষের একজন কর্তৃক অপরের উপর আধিপত্য হিসাবে”; আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে স্ত্রী-ই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি’। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৯) দেখিয়েছেন ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে… বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে বিত্তবান শ্রেণীগুলির মধ্যে পুরুষই হচ্ছে ৬পার্জনকারী, পরিবারের ভরণপোষণের কর্তা এবং এইজন্যই তার আধিপত্য দেখা দেয়, যার জন্য কোন বিশেষ আইনগত সুবিধা দরকার পড়ে না। পরিবারের মধ্যে সে হচ্ছে বুর্জোয়া; স্ত্রী হচ্ছে প্রলেতারিয়োত।’ প্রতিটি পরিবার গড়ে ওঠে একজন ব্ৰাহ্মণ ও একটি শূদীর সমবায়ে, যাতে পুরুষটি ব্ৰাহ্মণ নারীটি শূদ্রী। পুরুষই বিয়ে ও সংসারের কর্তা, সে-ই সংসারে সার্বভৌম, তার বিধানই সংসারে ধ্রুব ধর্মগ্রন্থ নারীটি ওই সংসারের পরিচারিকা। বাড়ির দাসীর সাখে বুর্জেয়া স্ত্রীটির পার্থক্য হচ্ছে দাসীটিকে (যৎসামান্য) বেতন দেয়া হয়, আর নারীটি (কখনো কখনো মর্যাদা ও বিলাসে) রক্ষিত হয়। রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর সময়ের বুর্জোয়া নারীদের বলেছিলেন ‘পরগাছার পরগাছা’, ম্যাককিনন (১৯৮২, ৮) প্রলেতারিয়েত নারীদের বলেছেন ‘ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী; এবং মিল রয়েছে দু-শ্রেণীর নারীর মধ্যেই যে তারা একই রকমে শোষিত। রক্ষণশীল বঙ্কিমও ‘প্রাচীনা ও নবীনায় (১৮৮৭, ২৫১) বলেছেন, ‘পুরুষ প্ৰভু, স্ত্রী দাসী; স্ত্রী জল তুলে, রন্ধন করে, বাটনা বাটে, কুটনা কোটে। বরং বেতনভাগিনী দাসীর কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বনিতা দুহিতা স্বাসার তাহাও ছিল না।’ তবে তারা শুধু শোষক ও শোষিতই নয়, তাদের ভিন্নতা আরো বেশি; শোষকশোষিতরা হয় একই প্ৰজাতির, কিন্তু স্বামীেূীঘ ভাবগতভাবে বিধাতা ও ভক্তের পর্যায়ের; হিন্দুমতে পতি পরম গুরু; সে ‘স্বামী’, ‘পতি’, বা ‘ঈশ্বর’: মুসলমান মতে স্বামীর পায়ের নিচে বেহেস্ত, স্বামী প্রায় সেজদার উপযুক্ত; খ্রিস্টান মতে স্বামীই নারীর ঈশ্বর। মিল্টনের ইভ আদমের কাছে আত্মসমৰ্পণ ক’রে বলে। [উদ্ধৃত, ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ (১৭৯২, ১০১)] :

আমার প্রণেতা ও ব্যবস্থাপক, তুমি যা আদেশ কবো
প্রশ্নহীন আমি মান্য করি; এ-ই বিধাতার বিধি:
বিধাতা তোমার বিধি, তুমিই আমার : এর বেশি কিছু
না জানাই নারীর সবচেয়ে সুখকর জ্ঞান ও গুণ।

নারী আজো রয়ে গেছে বিবি হাওয়ার পর্যায়েই।

সমাজ বিয়ে ও সংসারের নামে নারীর জন্যে বিধিবদ্ধ করেছে। এ-ভবিতব্যই। বিয়ের জন্যে দরকার পুরুষ ও নারী দুজনকে; তবে বিয়েতে তাদের ভূমিকা সমান নয়; পুরুষ

নারী অক্রিয়; তার বিয়ে হয় অন্যদের দৌত্যে, বা প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপের মতো। প্রতিটি পিতৃতন্ত্র বিয়ের যে-বিধান তৈরি করেছে, তা সম্পূর্ণ পুরুষের স্বার্থে প্রস্তুত, নারীর স্বাৰ্থ তাতে দেখা হয় নি; নারীকে ব্যক্তি হিশেবেই গণ্য করা হয় নি। হিন্দু বিধানে বিয়ে নারীরলি, মুসলমান বিধানে বিয়ে চুক্তিবদ্ধ দেহদান, খ্রিস্টান বিধানে বিয়ে নারীর অস্তিত্ব বাতিল। এ-সম্পর্কে আগেই, ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’ পরিচ্ছেদে, বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। বিয়ে পুরুষ ও নারীর কাছে ভিন্ন ব্যাপার; বিয়ে দুটি অসম মানুষের স্থায়ী বা অস্থায়ী সম্পর্ক, ও চুক্তি, যাতে বাতিল হয়ে যায় নারীটির স্বায়ত্তশাসন। তবে বিধানের থেকে অনেক মানুষ উৎকৃষ্ট ব’লে সব সময় বিধানের পীড়ন সহ্য করতে হয় না। নারীকে, কিন্তু গোপনে সে মেনে নেয় নিজের ভাগ্য। পুরুষ স্বাধীন সম্পূর্ণ ব্যক্তি, সে উপার্জন করে, উপার্জনই তাকে প্রতিষ্ঠা করে ব্যক্তি হিশেবে: নারী করে গৃহস্থালি ও গর্ভধারণের কাজ, যা কখনো তাকে পুরুষের সমকক্ষ ক’রে তোলে না। মনু{৯:৩] যে বলেছেন, ‘নারীকে কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে, নারী কখনোই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়’, এটা সব পিতৃতন্ত্রেরই বিশ্বাস; নারীকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিলে বিপন্ন হয়ে পড়ে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারসংস্থা। নারী কখনোই স্বায়ত্তশাসিত নয়; সে বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে আশ্ৰিত থাকে, বিয়ের ফলে ঘটে তার প্রভুবদল; পিতার বদলে স্বামীটি হয় তার নতুন প্ৰভু। এক প্ৰভু ধর্মীয় বা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে তাকে হস্তান্তরিত করে আরেক প্রভুর কাছে; এ-হস্তান্তরণ চুক্তি সাধারণত সম্পন্ন হয় দু-প্ৰভু, শ্বশুর ও জামাতার, মধ্যে। বিয়েতে নারী পাত্র নির্বাচন করে না, কিন্তু বিধান ও সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে তার পক্ষে অবিবাহিত থাকাও অসম্ভব, তাই বিয়ে তার জন্যে জীবিকার একমাত্র উপায়। বিয়ের মধ্য দিয়েই নারীর ব্যবস্থা হয় জীবনধারণের: তার অস্তিত্ত্বের যে কিছুটা মূল্য আছে নারী তা প্রমাণ করে বিয়ের মধ্য দিয়েই; বিয়ে ছাড়া তার অস্তিত্ত্বের কোনো মূল্য নেই, বিয়ে ছাড়া তার অস্তিত্ব পিতৃতন্ত্রের কাছে আপত্তিকর। তবে সমাজ যে চায় অবশ্যই বিবাহিত হ’তে হবে নারীকে, তা নারীর জন্যে নয়; তা সমাজ ও পুরুষের জন্যে।

সমাজ দু-কারণে চায় নারী বিয়ে বসবে, না বসে থাকতে পারবে না; হিন্দু পিতৃতন্ত্র এমন ব্যবস্থা করেছে যে নারীকে শেষ নিশ্বাসের পূর্ব-মুহূর্তে বা কোনো বস্তুর সাথে হ’লেও অবশ্যই বিয়ে বসতে হবে। নারীর বিয়ে না করা সমাজের সাথে আমাজনীয় বেয়াদবি, মারাত্মক সমাজদ্রোহিতা। বিয়ে নারীর জন্যে অবধারিত, এর প্রথম কারণ সমাজের জন্যে তাকে সন্তান, সম্ভব হ’লে পুরুষ, উৎপাদন করতে হবে, তাকে মা হ’তে হবে; মানুষ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে তাকে। তবে পুরুষতন্ত্র মনে করে মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার ভার পুরুষকেই দিয়েছে প্রকৃতি, নারীর কাজ শুধু অক্রিয় আধারের ভূমিকা পালন করা: নারী যদি আধারের ভূমিকা পালনে সম্মত না হয়, তাহলে পুরুষ, যেমন ফ্ৰযোড বলেছেন, নারীর সম্মতির অপেক্ষা না ক’রেই তার জরায়ুতে উৎপাদন করবে মানুষ। দ্বিতীয় কারণ তাকে পরিতৃপ্ত করতে হবে পুরুষের কাম, পরিচর্য করতে হবে পুরুষের সংসার। নারীর জন্যে বিয়ে পুরুষসেবা, যার বিনিময়ে পুরুষ তার ভরণপোষণ করে! যে-দুটি কারণে নারীকে বাধ্য করা হয় বিয়েতে, তাতে নারীকে মানবিক সমস্ত এলাকা থেকে তাড়িয়ে ঢোকানো হয়। জৈবিক এলাকায়, সেখানে তার একমাত্র কাজ প্ৰাণপোষণ ও লালন। নারী উৎপাদন করে পুরুষের উত্তরাধিকারী; তার ভূমিকাই যদিও প্রধান এতে, কিন্তু তা মুছে দেয়া হয়, সন্তান পরিচয় ধারণ করে শুধু পুরুষের। কামের পরিতৃপ্তি বিয্যের আশুউদ্দেশ্য; বিয়ের দিন কেউ মানবজাতির ভবিষ্যতের কথা ভাবে না, ভাবে যৌনসংসর্গের কথা; এবং ভাবে পুরুষটির দিক থেকে। নারীটি অনাঘাত কিনা, পুরুষটি কীভাবে নারীটিকে ভোগ করবে: ক’রে তৃপ্তি পাবে কিনা, নারীটি কতোখানি উপযুক্ত সম্ভোগের, এসবই সংগোপন বিবেচনার বিষয় হয়। সবার। এজন্যেই বিয়ের আগে মেয়ের দেহটিকে নানাভাবে আকর্ষণীয় ক’রে তোলা হয়; আর পুরুষটিকে সুখাদ্য খাইয়ে ক’রে তোলা হয় কামশক্তিমান। বিয়েতে পুরুষের কােমই প্রধান, নারীর কামের পরিতৃপ্তি বিয়ের উদ্দেশ্য নয়; পুরুষের কাম মেটাতে গিয়ে যদি নারীর কামও মেটে, তাহলে আপত্তি নেই, যদি না মেটে তাহলে তা আপত্তিকর। বিয়ের বাইরে নারীর কামের পরিতৃপ্তি নিষিদ্ধ। বহুবিবাহের সুবিধা ভোগ করে পুরুষ চিরকালই; হিন্দুধর্ম ও ইসলামে তা স্বীকৃতও; তাছাড়াও পুরুষ মিলিত হয় দাসীর সাথে, পুরুষ উপপত্নী রাখে, বেশ্যাসম্ভোগ করে; কিন্তু নারী একটি পুরুষ ছাড়া আর কোথাও কাম পরিতৃপ্ত করতে পারে না। কামনিষ্ঠতা পুরুষের কাছে প্রত্যাশা করা হয় না, কিন্তু নারীর জন্যে তা বিধিবদ্ধ; নারী ওই বিধান থেকে বিচ্যুত হ’লে পায় চরম শাস্তি।

বিয়ে স্বামীস্ত্রী উভয়েরই জন্যে একই সাথে ভার ও উপকারী, তবে দুজনের পরিস্থিতি ভিন্ন। পুরুষ বিয়ে না করলেও সমাজে গৃহীত হয়, সমাজে গৃহীত হওয়ার একমাত্র শর্তই পুরুষ হওয়া; কিন্তু নারী শুধু বিয়ের মধ্য দিয়েই গৃহীত হতে পারে সমাজে। বিয়ে তাকে একটি সংসার দেয়, যদিও সংসারটি তার নয়; সে পরিচিত হয়। পুরুষটির পরিচয়ে, অৰ্থাৎ পুরুষের সংস্পর্শে সে স্থান পায় সমাজে। বিয়ে না হ’লে তার জীবনই নষ্ট। তাই তাকে বিয়ে দেয়ার জন্যে ব্যগ্র থাকে পিতামাতা, তাতে তার মত আছে কিনা তাতে কেউ আগ্রহ বোধ করে না; সমাজ ধরেই নেয় বিয়ের জন্যে প্রস্তুত থাকাই নারীত্ব। প্রথাগত সমাজে তার জন্যে ঠিক করা হয় একটি স্বামী; অপ্ৰথাগত সমাজে তাকে সাধনা করতে হয় স্বামী ধরার। প্রথা-অপ্ৰথার মিশ্র সমাজে তার অবস্থা হয়ে ওঠে আরো জটিল, তাকে প্রস্তুত থাকতে হয় যে-কোনো পুরুষের জন্যে, আবার তাকে ফাঁদ পাততে হয় বিশেষ পুরুষের জন্যে, যেমন বাঙলাদেশে। তবে বিয়েতে সে অক্রিয়; সে বিয়ে করে না, বিয়ে বসে বা তাকে বিয়ে দেয়া হয়। পুরুষ বিয়ে করে অস্তিত্বসম্প্রসারণের জন্যে; বাল্যকাল থেকেই সে তার অস্তিত্বকে সম্প্রসারিত করতে থাকে, বিয়ে তার অস্তিত্বসম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার একটি অংশ, তার অস্তিত্বের চূড়ান্ত সার্থকতা নয়। তার জীবন যেমন সক্রিয়তার, বিয়েতেও সে তেমনই সক্রিয়; বিয়ে তার প্রতিষ্ঠার ভিত্তিকে দৃঢ়তা দেয়। বিয়ে নারীকে কিছু অধিকার দেয়; বিয়ের মাধ্যমে সে পায় নিরাপত্তা, তবে সব নারী নিরাপত্তা পায় না, কিন্তু সে পরিণত হয় একটি পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তিতে।

বিয়ের ফলে উদ্ভূত সংসার সংস্থাটির প্রধান হয় পুরুষটি; সে-ই হয় সমাজে পরিবার বা সংসারের প্রতিনিধি। একটি পরিবার সৃষ্টি একটি নতুন সামন্ত রাজ্য সৃষ্টির মতো; সেখানে অধিরাজ পুরুষটি, আর নারীটি ওই রাজ্যে লুপ্ত করে দেয় নিজের সত্তা। পশ্চিমে নারীটিকে গ্ৰহণ করতে হয়। পুরুষটির নাম, সে অন্তর্ভুক্ত হয়। পুরুষটির ধর্মে ও শ্রেণীতে; তার সমস্ত জীবন বদল করতে হয় একটি নতুন জীবনের সাথে। মূলত নারীর কোনো ধর্ম ও শ্রেণী নেই, সে যে-প্রভুর অধীনে যায় অন্তৰ্ভুক্ত হয় সে-প্রভুরই ধর্ম ও শ্রেণীতে। নাম বদল নারীকে নতুন শূদ্র পরিণত করে; হিন্দুধর্ম অনুসারে ব্ৰাহ্মণ দুবার জন্ম নেয়, কিন্তু নারীও জন্ম নেয় দুবার, দ্বিতীয় জন্ম ঘটে তার বিয়েতে;-শূদ্ররূপে। আমাদের দেশে নারীর নামই ছিলো এক সময় বাহুল্য, তাই স্বামীর নাম গ্ৰহণ করতে হতো না তাকে; তবে পশ্চিমের প্রভাবে এ-দেশেও বিত্তশালীদের মধ্যে প্রচলিত হয় পুরুষাধিপত্যের এ-রীতিটি। পুরুষতন্ত্র নারীকে কিছুতেই স্বাধীন, নিজের নামেও স্বাধীন থাকতে দেয় না; এর করুণ রূপ দেখা যায় বেগম রোকেয়ার নামে। বাঙলায় পুরুষতন্ত্রের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন যিনি, তার নামের সাথেও পুরুষতািন্ত্র স্বামীর নামটি যোগ করে তীকে ক’রে তুলেছে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন! নারীর পক্ষে পুরুষাধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়া এতোই কঠিন। বিয়ের ফলে নারীটি যোগ দেয় পুরুষটির সংসারে, হয় পুরুষটির অর্ধাঙ্গিনী; সৃষ্টি হয় একটি পরিবার। এক সময় পুরুষটি স্ত্রীটিকেই বলতো নিজের পরিবার, তবে সে-ই পরিবারে সর্বময়। পুরুষটি যেখানে থাকে বা থাকতে বলে, সেখানে থাকে এবং যেভাবে চলতে বলে, সেভাবে চলে নারীটি। নারীটি ছিড়ে ফেলে তার প্রাক্তন জীবনের সাথে সম্পর্ক। নারীটি পুরুষটিকে দেয় দেহ, তার কুমারীত্ব, তাকে থাকতে হয়। পুরুষটির একান্ত অনুগত। পুরুষটির কাছে সে হয়ে ওঠে বিকশিত দেহের এক অবিকশিত বালিকা।

পুরুষটির রয়েছে আর্থনীতিক ভিত্তি, নারীটির নেই; পিতৃতন্ত্র সূচনাব কালেই নারীকে আর্থ ভিত্তি থেকে উৎখাত ক’রে পুরুষনির্ভরতাকে ক’রে তুলেছে তার ভবিতব্য। আর্থনীতিক ভিত্তি যার নেই, সে পৃথিবীতে দাঁড়াতে পারে না, তার কোনো মেরুদণ্ড নেই। নারী আর্থ মেরুদণ্ডহীন; তার রখনো দরকার ‘ভাতার”। স্বামীটি উপার্জন করে, সে গৃহে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না; সে অংশ গ্ৰহণ করে সভ্যতায়। নারীটি দণ্ডিত হয় সন্তানপ্রসবের জৈবিক ও সংসারের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্ত কাজে। নারী শুধু দেহ সৃষ্টি ও দেহ লালনের কাজে নিযুক্ত থাকে ব’লে দেহোত্তীর্ণ হতে পারে না; কিন্তু পুরুষটি দেহোত্তীর্ণ, সে শুধু সম্ভোগের সময়ই জড়িত হয় দেহের সাথে। পুরুষের জন্যে রয়েছে দু-ই : প্রকৃতি ও সংস্কৃতি; পুরুষ বিয়ের মধ্য দিয়ে তার দেহকে যেমন পরিতৃপ্ত করে, তেমনই গৃহের বাইরে গিয়ে অংশ নেয় দেহোন্তীর্ণ সভ্যতায়। সঙ্গম ও সন্তান সৃষ্টি কোনো মহৎ মানবিক কাজ কিনা, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে; তবে পিতৃতন্ত্র একে জরুরি মনে করলেও মহৎ মনে করে না। তাই নারীর কাজে কোনো মহত্ত্ব নেই, সে সভ্যতায় অংশ গ্রহণ করে না। যে-নারীরা সভ্যতায় অংশ নিয়েছে ও নেয়, পুরুষতন্ত্র তাদের মনে করে বিকৃত। অনেকেই মনে করেন। জৈবিকতাই যেহেতু নারীকে বন্দী ক’রে রেখেছে আদিম স্তরে, সন্তান ধারণই যেহেতু তার প্রধান সীমাবদ্ধতা, তাই নারীকে মুক্তির জন্যে সন্তান ধারণই অস্বীকার করতে হবে। পুরুষ তার পেশা ও সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে বিকশিত সম্প্রসারিত করে নিজেকে; যখন সে এসবে ক্লান্তি বোধ করে, তখন বিশ্রাম নেয় গৃহের মনোরমতায়। গৃহ পুরুষের জন্যে বিশ্রামকক্ষ, সে গৃহের নয়। বাঙালি কবি, কালিদাস রায়, বলেছেন, ‘গৃহই মোদের সব, প্ৰাণপণে করি তার আঁধার হরণ, /নিভে যদি কার ক্ষতি? গৃহের ক্ষতির আর হয় কি পূরণ। কিন্তু পুরুষ গৃহের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে গৃহের বাইরে থেকে, গৃহের ওই অন্ধকারে যে থাকে সে নারী। সে গৃহিণী, কুলবতী, কুলবালা, কুলস্ত্রী, কুলনারী, পুরনারী, পুরস্ত্রী; সে সভ্যতার কেউ নয়, সে গৃহের অন্ধকারের।

প্রসব, পালন, ও সংসাবের কাজে নিয়োজিত থেকে নারী প্ৰজাতির সংরক্ষণ করে, এবং নিজে থেকে যায় অপরিবর্তিত। এ-জন্যেই পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে চিরন্তন নারীপ্রকৃতি, চিরন্তনী, শাশ্বতী প্রভৃতি ছক। সে কোনো কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করে না, সে ঘরের সীমার বাইরে গেলেও ঘর ও বাইরের মধ্যে তার সেতু হয়ে থাকে স্বামীটি। দেশের বিখ্যাত নারীটিরও পরিচয় স্বামীর স্ত্রী হিশেবে; পিতৃতন্ত্র যে-সব নারীকে স্বীকৃতি দেয়, তারাও স্বামীর পরিচয় দিয়েই বোধ করে গৌরব। বিয়ে আজো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথাগত ব্যাপারগুলোর একটি, চলছে প্রথাগত রীতিতেই। বিয়ে চাপিয়ে দেয়া হয় নারীর ওপর, পুরুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয না; কেননা নারীর সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। বিয়ে না হ’লে সে হয়। পিতা, ভাই বা অন্য কারো গলগ্ৰহ দাসী; তার জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় কেটে যাওয়ার পর পিতার বাড়িই তার জন্যে সবচেয়ে অসুখকর, অবিবাহিত অবস্থায় পিতার বাড়িতে থাকা কলঙ্ক। সে অরক্ষণীয়া। বিয়ে তাকে একটি সংসার দেয়। তাই সে একটি স্বামী চায়, এমন একটি স্বামী খোঁজে, যার অবস্থান তার অনেক ওপরে। নারী যেহেতু যে-শ্রেণীতে থাকে অন্তর্ভুক্ত হয় সে-শ্রেণীরই, তাই নিজের শ্রেণীউন্নতির জন্যে চায় তার চেয়ে ওপরের শ্রেণীর স্বামী, সমোজও তাই চায়। পেশাজীবী নারীরাও বিয়ে বসে তাদের থেকে অনেক উঁচুপেশার পুরুষের সাথে; দরিদ্র পরিবারে স্বামীস্ত্রীটির মধ্যে আর্থভিত্তির যে-পার্থক্য থাকে, তার চেয়ে বেশি পার্থক্য থাকে সাধারণত পেশাজীবী স্বামীস্ট্রীর মধ্যে; তাই স্বামী থাকে। প্রথাগত স্বামী, স্ত্রী প্রথাগত স্ত্রী।

বিয়েতে নারীর কাম কিছুটা মেটে, তবে তার কাম নিজের জন্যে নয়; সে নিজের কাম দিয়ে সেবা করে পুরুষটির। সে দেহদান করে, পুরুষটি তাকে সম্ভোগ করে, বিনিময়ে তার ভরণপোষণ করে। নারীর দেহ সে একটি পণ্যরূপে কিনে নেয়, পণ্যটিকে নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করে; কিন্তু এটি পণ্য হিশেবে উৎকৃষ্ট। এটি যেমন অক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনই সক্রিয় হ’তে পারে গ র কাজে : তার কাজ দেহদান, সন্তান ধারণ, প্রসব ও পালন, আর ঘরকন্না। এর জন্যে তাকে কোনো বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করতে হয় না, কোনো বিশেষ কুঁকিও নিতে হয় না। তাই পেশা হিশেবে নারীর কাছে একে মনে হয় চমৎকার। তার সামনে অন্য কোনো পেশার দরোজা খোলা নেই, কোনো পেশাই তার জন্যে এতো সহজ সুবিধাজনক নয়। তাই পেশা হিশেবে নারীর জন্যে আজো বিয়েই শ্রেষ্ঠ পেশা! অপদাৰ্থ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীরা এর সুবিধা ভোগ করে চরমভাবে; তারা দেহদান ও প্রসবের জৈবিক ভূমিকা পালন ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই পালন করে না। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীদের জন্যে বিয়ে আকর্ষণীয় বৈধ পবিত্র পতিতাবৃত্তি; তাই তাদের নিজেদের বা অভিভাবকদের প্রধান উদ্বেগ একটি উৎকৃষ্ট খদের বা স্বামী সংগ্ৰহ করা। তারা দরকার হ’লে স্বামী কিনে নেয়। এরা সুবিধাজনক পেশার আলস্যে অপদাৰ্থ হয়ে উঠে এক সময় দেহদানের যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলে; তখন তাদের আমলা, লুঠতরাজ্যদক্ষ পতিরা খোঁজে। নতুন নারী। এরা বাস করে কারুকার্যখচিত আরামদায়ক কারাগারে, এবং কাজ করে নারীমুক্তির প্রতিপক্ষরুপে।

অবিবাহিত নারীর কামপরিতৃপ্তি পৃথিবীর অধিকাংশ জুড়ে নিষিদ্ধ; পশ্চিমের মুক্ত সমাজে তার পক্ষে কাম পরিতৃপ্ত করা আর অসম্ভব নয়, কিন্তু অত্যন্ত নিষিদ্ধ পূর্বাঞ্চলে। বিবাহিত নারীর বিবাহবহির্ভূত কামসম্পর্ক আইনগত অপরাধ, কিন্তু অবিবাহিত নারীর কামসম্পর্ক আরো মারাত্মক অপরাধ। কাম চাইলে নারীকে বিয়ে করতেই হবে। মাতৃত্বের জয়গান গাওয়া প্রতিটি পিতৃতন্ত্রের অভ্যাস, কিন্তু পিতৃতন্ত্র বিশুদ্ধ মাতৃত্বে বিশ্বাস করে না; বিশ্বাস করে বিবাহিত মাতৃত্বে। মাতৃত্ব বিবাহিত নারীর গৌরব, অবিবাহিত নারীর কলঙ্ক। তাই তরুণীর জীবনের লক্ষ্যই বিয়ে, কিন্তু বিয়ে কোনো তরুণের জীবনের লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য আর্থনীতিক সাফল্য, বিয়ে তার জীবনের একটি কাজ। আজকের তরুণের চোখে বিয়ে আগের মতো মোহ সৃষ্টি করে না, এটা তার কাছে বোঝাই মনে হয়, কেননা বিয়ের উপকাবিতা আগের থেকে অনেক ক’মে গেছে। পশ্চিমে থাকা, খাওয়া, কামযাপন করা সম্ভব সংসার পাতার থেকে অনেক সহজে; পুবে বিয়ের বাইরে কামযাপন প্ৰায় অসম্ভব বলে আজো বিয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ রয়েছে। বদ্ধ সমাজে বিয়েতে প্ররোচিত করে, মুক্ত সমাজে বিয়েতে অহীহ করে; বিয়ে মুক্তির নয়, বন্ধনের ব্যাপার। বাঙলায় একে “বিবাহবন্ধন’ই বলা হয়ে থাকে। বিয়ে জীবনকে কিছুটা চরিতাৰ্থ করে; বিয়ে নরনারীকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দেয়, কামের পরিতৃপ্তি ঘটায়, সন্তান ও সংসার দেয়: নিরর্থক জীবনকে প্রথাগতভাবে অর্থপূর্ণ ক’রে তোলে। তবে পুরুষ যে বিয়ে খুব চায়, তা নয়; নারীই পুরুষের মধ্যে এ-চাওয়া সৃষ্টি করে। অধিকাংশ সমাজেই এখনো বিয়ে ঠিক করা হয়, তাতে উদ্যোগ নেয় পাত্রীপক্ষই বেশি, কেননা বিয়ে ছাড়া নারীর জীবনে কোনো সাফল্য নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সব দেশেই কনে দেখার রীতি প্ৰচলিত ছিলো; বাঙলাদেশে আজো আছে। গ্রামে মেয়েরা চরম লাঞ্ছনার মধ্যে আজো নিজেদের দেখায়. রূপ ও বিদ্যার পরীক্ষা দেয়; শহরেও কোনো নিউ মার্কেট, বিপনিবিতানে পিতামাতারা প্রদর্শন করে কন্যাদের। তাদের মাংস পছন্দ হ’লেই পুরুষেরা এগিয়ে আসে।

তরুণীরা বিয়ের প্রতীক্ষা করে, তবে ভয়ও পায়; কেননা বিয়েতে তাদের ঠেলে ফেলা হয় জীবনের পরিণতিতে, যার ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিয়ে নারীটির জন্যে বেশি উপকারী পুরুষটির থেকে, বিয়ে ছাড়া তার আর কোনো পরিণতি নেই; তবে বিয়েতে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় নারীকেই, পুরুষকে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয় না। নারীটিকে ছিড়ে ফেলতে হয় তার অতীতের সাথে সম্পর্ক, যো-জীবনের মধ্যে সে বেড়ে উঠেছে সেখান থেকে বিয়ে তাকে উপড়ে নিয়ে স্থাপন করে অন্য জীবনে, দিন দিন অচেনা হয়ে যায় তার পরিচিত মুখ আর দৃশ্যগুলো। তাই বিয়ে যতোই ঘনিয়ে আসে ততোই উদ্বিগ্ন বোধ করে তরুণীরা, ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তা যেমন তাদের বিপন্ন করে তেমনই দুৰ্বহ হয়ে ওঠে একটি পুরুষের কাছে আত্মদানের ভাবনা। তারা বোঝে এ-ই। তাদের জন্যে ভালো, এ-ই। তাদের জীবনের লক্ষ), এ-ই। তাদের জীবনসমস্যার শ্ৰেষ্ঠ সমাধান, তবু মনের তলে থাকে ভয়। বিয়ে তাদের জন্যে নিরুদ্দেশ যাত্রা; যদি ওই যাত্রার শেষে থাকে কোনো সব পেয়েছির দেশ, তাহলে চমৎকার, নইলে তা বিভীষিকা। পৃথিবীর অধিকাংশ মেয়ের জন্যে বিয়ে আনন্দ নয়, পরিত্রাণ; কিন্তু বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথাও তাদের বুকে জেগে থাকে। মুসলমান সমাজে বিয়ের কথা মনে এলেই তালাকের কথাও মনে আসে; এ-তালাক পশ্চিমের বিবাহবিচ্ছেদ নয়। পশ্চিমের নারী আজ অসহায় নয়, বিবাহবিচ্ছেদ তার জন্যে বিপর্যয় নয়, কিন্তু দরিদ্র সমাজে তা খড়গের মতো নারীটির মাথার ওপর ঝুলতে থাকে।

প্ৰেম এখন কিংবদন্তির মতো চারপাশে ছড়ানো, এটা এক আধুনিক পুরাণ; তবে প্রেম বিয়ের ভিত্তি নয়, এমনকি বিয়ের সিমেন্টও নয়। বিয়েতে চাওয়া হয় না যে নারীপুরুষ পরস্পরকে ভালোরাসবে প্রেমিকপ্রেমিকার মতো, এমনকি নারীটিকেও প্রেমের দায়িত্ব দেয়া হয় না; তার কাছে চাওয়া হয় সে পালন করবে। স্ত্রীর দায়িত্ব। প্রেম নয়, তার কাছে কাম চাওযা হয়; স্ত্রী হ’তে হ’লে তাকে এ-শর্তটি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তবে তাকে মানতে হবে যে বিয়ের বাইরে সে কোনো কামসম্পর্ক পাতবে না: পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এটি, তবে তা মানা হয় না, কঠোরভাবে মানতে হয় শুধু নারীকেই। পুরুষ আজো একপতিপক্ষী বিয়ে মেনে নেয় নি, বিয়ের বাইরে পুরুষের কামপরিতৃপ্তির অজস্র রাস্তা খোলা রয়েছে। বিয়ে নারীর কামতৃপ্তির জন্যে নয়, তার কামদমনের জন্যে। নারীর কামতৃপ্তি বিবেচনার বিষয় বলে মনে করে না সংসারসংস্থাটি, মনে করে নারী ক্ষণিক সুখের বদলে বহন করবে। দীর্ঘ গৰ্ভ ও প্রসবের বেদনা। বাইবেলে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করা হয়েছে অভিশাপটি : ‘আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করিব, তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করিবে’! আদিপুস্তক, ৩:১৬]। পিতৃতান্ত্রিকেরা বিশ্বাস করে যে নারী মর্ষকামী, তার পীড়ন দরকার; পীড়নের মধ্য দিয়েই তার ভেতর জেগে ওঠে মাতৃত্ব। প্রসব নারীর কাছে সুখকর নয়, প্রসবে কোনো অসামান্য অপার্থিব অনুভূতি নেই; বিকল্প থাকলে নারী প্রসবের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে নিতো নিজেকে। নারী ভোগ করে প্রসবের যন্ত্রণা, পুরুষের এসব নেই; পুরুষ চায় শয্যায় তার স্ত্রীটি হবে সমস্ত যৌনাবেদনময়ী অভিনেত্রীর সমষ্টি; তারা নারীকে চায় সব সময় সতী, কিন্তু শয্যায় বারাঙ্গনা। এ-বিরোধ কী ক’রে সে মেটাবে? যাকে বাল্যকাল থেকে শেখানো হয়েছে কাম খারাপ, সে কী ক’রে মেতে উঠবে শারীরিক প্রমোদে? মতেন বলেছেন, ‘আমরা একাধারে চাই স্বাস্থ্যুবতী, তীব্ৰ, গোলগাল, এবং সতী- অর্থাৎ গরম ও ঠাণ্ডা, দু-ই’ দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৪৫৬)। এখন এ-অপপ্রত্যাশার শিকার পূর্বাঞ্চলের নারীরা, যেখানে পুরুষ পাশবিক।

মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিয়ের সময় কনেটিকে কুমারী থাকতো হতো না, বরং বিয়ের আগেই তার সতীত্বমোচন করতে হতো, না হ’লেই তা গণ্য হতো ত্রুটি ব’লে; কিন্তু পিতৃতন্ত্র তার রন্ধে আবিষ্কার করে একটি দামি চ্ছদ। বিয়েতে নারীটির দায়িত্ব চম ৎকারভাবে প্যাককরা অটুট চছদসমৃদ্ধ একটি যোনি স্বামীটিকে উপহার দেয়া দ্ৰ নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর’]। এটা যে-কোনো তরুণীর মনে জাগায় ভয়, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলমান দেশগুলোতে আজো তা নববিবাহিত নারীর বিভীষিকা। পৃথিবীর নানা দেশে আজো বাসর রাতের ভোরে শয্যায় খোজা হয়। রক্ত। বাঙলাদেশে রক্ত খোজা বিভীষিকা হয়ে ওঠে নি কখনো, তবে আজো তা খোজা হয়, পুরুষটি ও তার আত্মীয়রা বিছানায় রক্ত পেলে সুখ বোধ করে। নারীর জন্যে বাসর রাত বলাৎকারের রাত; বাঙলাদেশ ধর্ষণের দেশ, তবু বিয়েতে যতো বলাৎকার সম্পন্ন হয় এখানে তার একাংশও সড়কে বা খেতের আলো হয় না। অধিকাংশ নারী পুলক বোধ না ক’রেই মা, দাদীনানী হয়; অনেকে কামবোধ না ক’রেই মেটায় স্বামীর কাম। যদিও নারীদের কাম অশেষ কিন্তু বিয়ের ফলে অনেকেই কামবোধ হারিয়ে ফেলে, কাম হয়ে ওঠে তাদের জন্যে পীড়ন।

য়ে ও সংসার নারীকে দেয় দুটি ভূমিকা : গৃহিণী ও জননী। প্রথাগতভাবে নারী এ-দুটি ভূমিকা সম্পন্ন করতে পারলেই নারীর জীবন সাৰ্থক বলে গণ্য করা হয়। নারীর এ-দুটি ভূমিকাকে খুবই আদর্শায়িত করেছে পিতৃতন্ত্র; সমস্ত ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি নারীর এ-দুটি ভূমিকার স্তবগানে মুখর। তবে নারীর এ-ভূমিকা দুটিই নারীর মুক্তির প্রতিবন্ধক, সাম্যের বিরোধী। এ-ভূমিকা দুটিকে পেরিয়ে যেতে না পারলে নারী বন্দী হয়ে থাকবেই, তাকে থাকতেই হবে ঘরে ও আঁতুড় ঘরে। দুটি ভূমিকাই নারীকে পালন করতে হয় গৃহবন্দীত্বের মধ্যে মানবিক সমস্ত ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে; এ-ভূমিকা দুটিই নারীকে বহিষ্কৃত করে সভ্যতা থেকে। প্রথাগতভাবে মনে করা হয় নারী বিয়ের পর স্ত্রী, ও মায়ের দায়িত্ব হাসিমুখে চমৎকারভাবে পালন করবে, কেননা এগুলোই তার জন্যে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক, যেনো নারীর জৈবনির্দেশের মধ্যে খচিত হয়ে আছে কীভাবে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে হবে, কীভাবে ঢালতে হবে স্বামীর পা ধোয়ার পানি, কীভাবে ইন্ত্রি করতে হবে স্বামীর শার্ট, কীভাবে বসে থাকতে হবে শিশুবিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায়- এসব নির্দেশা! প্রথাগতদের ঋষি বঙ্কিম (১৮৮৭, ২৫২-২৫৩) ‘নবীনা’র কয়েকটি ক্রটি ধরেছিলেন :

‘তাঁহাদের প্রথম দোষ আলস্য। প্রাচীনা অত্যন্ত শ্রমশালিনী এবং গৃহকর্মে সুপটু ছিলেন; নবীনা ঘোরতর বাবু;… গৃহকৰ্ম্মের ভার, প্রায় পরিচারিকার প্রতি সমৰ্পিত। ইহাতে অনেক অনিষ্ট জন্মিতেছে;-প্রথম শারীরিক পরিশ্রমের অল্পতায় যুবতীগণের শরীর বালশূন্য এবং রোগের আগার হইয়া উঠিতেছে।… স্ত্রীগণের আলস্যের আর একটি গুরুতর কুফল এই যে, সন্তান দুৰ্ব্বল এবং ক্ষীণজীবী হয়। শিশুদিগের নিত্য রোগ এবং অকালমৃত্যু অনেক সময়ই জননীর শ্রমে অনুরাগীশূন্যতার ফল।… নবীনগণ গৃহকৰ্ম্মে নিতান্ত অশিক্ষিতা এবং অপটু। …তিনি পশুজাতির অপেক্ষা কিঞ্চিৎ ভাল হইলে হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীজন্ম নিরর্থক।… গৃহিণী গৃহকৰ্ম্ম না জানিলে রুগ্নগৃহিণীর গৃহের ন্যায় সকলই বিশৃঙ্খল হইয়া পড়ে; অর্থে উপকার হয় না;…
স্ত্রীলোকের প্রথম ধৰ্ম্ম পাতিব্ৰত্য।… নবীনাগণ পতিব্ৰতা বটে, কিন্তু যত লোকনিন্দাভিয়ে, তত ধৰ্ম্মভয়ে নহে। ….ধৰ্ম্মে যে নবীনাগণ প্রাচীন দিগের অপেক্ষা নিকৃষ্ট, তাহার একটি বিশেষ কারণ অসম্পূর্ণ শিক্ষা। লেখাপড়া বা অন্য প্রকারের শিক্ষা তাহারা যাহা কিঞ্চিৎ প্রাপ্ত হয়েনি, তাহাতেই বুঝিতে পাবেন যে, প্রাচীন ধর্মের শাসন অমূলক।‘

এ হচ্ছে প্রথাগতদের বিশ্বাসী; এর সবই সহজে বাতিল ক’রে দেয়া সম্ভব, কিন্তু আজো বাতিল হয় নি। নবীনাদের মূল দোষ শিক্ষা; অসম্পূর্ণ শিক্ষা; আর অল্পবিদ্যা সত্যই ভয়ঙ্করী, কেননা তা আরো শেখার আগ্রহ সৃষ্টি করে, এবং প্রথার অন্তঃসারশূন্যতা বুঝতে শেখায়। নারীর স্থান গৃহ, সে গৃহ সাজিয়েগুছিয়ে রাখবে, সংসার ঠিক মতো চলার জন্যে সব কিছু করবে, এ হচ্ছে প্রথাগত বিধান। যে-নারী এটা করে না সে অস্বাভাবিক, অনৈতিক, নারী নামের অযোগ্য। কিন্তু গৃহস্থলির কাজ শুধু নারীকেই কেনো করতে হবে, পুরুষও তা করতে পারে। পুরুষকে রেহাই দেয়া হয় এ-ক্লান্তিকর কাজ থেকে, যাতে পুরুষ অংশ নিতে পারে সভ্যতার কাজে-রাজনীতি, বিজ্ঞান, ব্যবসা, সাহিত্যে, এমনকি প্রমোদে। বঙ্কিমের যে-প্রবীণারা জল তুলতো, বাটনা বাটতো, তাদের স্বাস্থ্যের যে এতে উন্নতি ঘটতো এমন নয়; পুরুষও তাহলে নিতো স্বাস্থোন্নতির ওই এ-পদ্ধতি। এটা নারীপীড়ন, এবং পীড়ন আদর্শায়িতকরণ। বাইবেলের হিতোপদেশ ‘গুণবতী ভাৰ্যার বর্ণনায় বলেছে যে “তিনি রাত্ৰি থাকিতে উঠেন, আর নিজ পরিজনন্দিগকে খাদ্য দেন, ‘তিনি বলে কটি বন্ধন করেন, আপনি বাহুযুগল বলশালী করেন, ‘রাত্ৰিতে তাহার দীপ নিৰ্ব্বাণ হয় না’ এবং তিনি আলস্যের খাদ্য খান না”: অর্থাৎ গুণবতী গৃহিণী এক সার্বক্ষণিক দাসী। সবাই বাইবেলে বিশ্বাস করে না, কিন্তু বিশ্বাস করে। এ-বাণীতে। সংসারের কাজগুলো চাপিয়ে দেয়া হয় নারীর ওপর, ক্লান্তিকর বিরক্তিকর কাজগুলো সম্পন্ন করাই তার জন্যে ধর্ম, এসব কাজ যার জীবনে পুনরাবৃত্ত হয়, তার কোনো সম্ভাবনার বিকাশ ঘটতে পারে না।

সামন্ত ও বুর্জোয়া দু-সমাজই গৃহিণীপনাকে এক মহৎ ভাবাদর্শে পরিণত করেছে, গৃহ ও গৃহিণীর স্তুতি করেছে ও করছে, যদিও উত্তম গৃহিণী উত্তম পরিচারিকা মাত্র। অম্বুজাসুন্দরী নামের এক নারী কবি লিখেছিলেন [দ্ৰ যোগেন্দ্ৰনাথ (১৩৬০, ৩৩৭)];

বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী,
ধাবিত নম্রতা মাখা, ঘোমটায় মুখ ঢাকা
রয়েছে উনন-ধাবে চিরকাল ধবি,
বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী।
নয়নে কজলা-দাগা, অধরে তাম্বুল-বাগ
ললাটে সিন্দুর-বিন্দু লক্ষ্মীর আসন,…
বুক-ভরা স্নেহ-ধারা, পতি-প্ৰেমে মাতোয়ারা
স্থির সবসীর ন্যায় গম্ভীর সুস্থিব।

এর কাব্যটুকুর মূল্য নেই; সেটুকু বাদ দিলে সত্য যা থাকে, তা হচ্ছে “রয়েছে উনন-ধারে চিরকাল ধরি।’ গৃহ তার স্থান, তবে গৃহসুখ তার জন্যে নয়; তার কাজ গৃহকে পুরুষদের জন্যে সুখকর করে তোলা। গৃহে তার সমস্ত কাজ পুরুষদের লক্ষ্য ক’রে, গৃহ তার দ্বিতীয় দেহ; পুরুষের জন্যে যেমন তাকে আকর্ষণীয় করতে হয় দেহখানি তেমনই আকৰ্ষণীয় করতে হয় গৃহখানিকে। সামন্ত সমাজে নারীর স্থানই গৃহ, তাই নারীকে দেয়া হযেছে গৃহের সমস্ত ক্লান্তিকর কাজ। ওই কাজগুলো সে যেখানে করতো সে-এলাকাটি হতো গৃহের নিকৃষ্টতম অংশ; গৃহের নিকৃষ্ট অংশে জীবনের নিকৃষ্ট কাজগুলো গৃহিণীকে সম্পন্ন করতে হতো পুরুষের সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ঘটিয়ে। দরিদ্র নারীদের গৃহ নেই, তবে কাজের অভাব নেই। আধুনিক বুর্জোয়ারা ব্যবসার স্বার্থে সৃষ্টি করেছে পালে পালে গৃহিণী, গৃহিণী সৃষ্টিতে তাদের গবেষণা ও প্রচারের শেষ নেই; তারা আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে চলছে পুরোনো গৃহিণীকে আধুনিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত করতে। একটি আদর্শ গৃহিণী সৃষ্টির অর্থ হচ্ছে একরাশ পণ্য বিক্রয়ের নিশ্চিত সম্ভাবনা সৃষ্টি; এবং প্রগতিশীলতা প্রতিরোধ।

গৃহিণী এমন নারী, যে নিজের সমস্ত সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান ক’রে ঢেকে আরামদায়ক বন্দীশিবিরে; সে পণ্য উৎপাদনকারীদের মানসসুন্দরী, যাকে লক্ষ্য ক’রে পৃথিবীর দিকে দিকে ঘুরছে পুঁজিবাদী কারখানাগুলোর চাকা। আদর্শ গৃহিণীর কাজ হচ্ছে পুঁজিবাদী পণ্যে নিজের গৃহ ভরে তোলা। ধনী বিশ্বে আদর্শ গৃহিণীদের গন্তব্য বিপনকেন্দ্র; গরিব বিশ্বে ধনী গৃহিণীদের গন্তব্য বিপনিকেন্দ্র। তাদের স্বামীদের পবিত্র গৃহ ব্যাংক, আর স্থল মস্তিষ্কহীন আদর্শ গৃহিণীদের পবিত্র এলাকা বিপনিকেন্দ্র। ধনী বিশ্বে গৃহিণীদের গৃহের কাজ করতে হয়; কিন্তু গরিব বিশ্বে দাসদাসী এতোই সুলভ যে ধনী গৃহিণীদের সাংসারিক কাজও করতে হয় না, তবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র নারীরা ব্যগ্র থাকে নিপুণভাবে গৃহিণীর দায়িত্ব পালন করতে। গরিব বিশ্বে শোষণ সহজ, তাই ধনী গৃহগুলাতে উৎপন্ন হয় একপাল অপদাৰ্থ নারী, যারা দেহসম্ভোগ ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখে না। তারা জীবনকে বাতিল ক’রে দিয়ে মনে করে জীবন উপভোগ করছে। গৃহিণীর কাজ এমন কাজ, যা পেশা, আবার পেশা নয়। গৃহিণী হওয়ার জন্যে প্রশিক্ষণ নিতে হয় না, মনে করা হয় যে প্রতিটি নারীর মধ্যেই রয়েছে একেকটি অনন্যসাধারণ গৃহিণী, যে জেগে ওঠে সংসারে ঢুকেই। গৃহিণীর কাজ হচ্ছে পুনরাবৃত্তির পর পুনরাবৃত্তি; আদর্শ গৃহিণী একই কাজ ফিরে ফিরে করে, প্রতিদিন করে, কাজ করতে করতেও তার কাজের শেষ হয় না, তার কোনো অবসর নেই। তার জীবন হচ্ছে রান্না, ধোয়ামোছা, কাপড় ধোয়া, ইন্ত্রি করা, রান্না, ধােয়ামোছা, কাপড় ধােয়া, ইন্ত্রি করা, রান্না। গৃহিণীর কাজকে ‘পেশা’ বলা পশ্চিমি সুভাষণ; এটি তৈরি করা হয়েছে গৃহিণীর নিরর্থক কাজকে অর্থপূর্ণ ক’রে তোলার জন্যে। যে-কোনো পেশায় রয়েছে বিশেষ অধিকার ও দাযিত্ব, গৃহিণীর কাজে তা নেই, তার বেতন নেই, কাজের নির্দিষ্ট সময় নেই, অনেককে ব্যস্ত থাকতে হয়। সারাক্ষণ অনেককে করতে হয় না কিছুই। কোনো পেশায় না থাকাই হচ্ছে গৃহিণীর পেশায় থাকা; বিবাহিত যে-নারী আর কিছু নয়, যে কোনো আৰ্থযোগ্যতা অর্জন করে নি, সে-ই গৃহিণী। তার কাজকে মর্যাদা দিলে আছে, না দিলে নেই; এমন মহৎ কাজে জড়িত গৃহিণী।

চল্লিশের দশক থেকে পশ্চিমে পুঁজিবাদ আবার বিয়ে, সংসার, গৃহিণীকে গৌরবান্বিত করার সর্বগ্রাসী অভিযানে নামে; তার লক্ষ্য পণ্য বিক্রয়, সে জানে গৃহিণী হচ্ছে আদর্শ ক্ৰেতা; তাই নারীকে আবার আদর্শ নারী, খাঁটি গৃহিণী, বিশুদ্ধ মাতা ক’রে তোলার ধর্মযুদ্ধ শুরু করে পুঁজিবাদ। যে-নারী কোনো পেশায় জড়িত, যে নিজে চিন্তা করে, যে ব্যক্তিগত সাফল্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, বিয়ে সংসার পণ্য তার কাছে গৌণ; কিন্তু যে-নারী কোনো বাইরের জগত নেই, তার থাকে বিয়ে, গৃহ, পণ্য, কাম। পুঁজিবাদী মাধ্যমগুলো নিরন্তর প্রচার চালাতে থাকে যে পেশা নারীকে অসুখী করে, পেশা নারীর নারীত্ব নষ্ট করে; নারীর জীবন চরিতার্থ হয় বিয়ে, সংসার, কাম, আর পণ্যে। তারা তরুণীদের মনে ভয় ঢুকিযে দেয জ্ঞান আর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, তাদের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করে যে বিশ্বে কী হচ্ছে তা নিয়ে ঘর্মািক্ত থাকা পুরুষের কাজ; নারীদের কাজ পড়াশুনো চুকিয়ে দিয়ে সতেরো আঠারো বছর বয়সে বিয়ে ও ঘরসংসার এবং মাতৃত্ব ও পণ্যস্তুপে জীবন চরিতার্থ করা। পুঁজিবাদী কারখানাগুলো উৎপাদন করতে থাকে পণ্য, আর প্রচার মাধ্যমগুলো উৎপাদন করতে থাকে খাঁটি গৃহিণী, যারা তরুণী, অগভীর, রূপসী, অক্রিয়; শয্যাকক্ষ, রান্নাঘর, কাম, শিশু, গৃহ যাদের জগত। এদের বার বার শোনানো হয় খাদ্য, পোশাক, রূপচর্চা, আসবাবপত্র ও কামের কথা; তাদের জীবনে নিষিদ্ধ হয়ে যায় জ্ঞান, রাজনীতি, চেতনা, যা কিছু মানবিক। তাদের দীক্ষিত কিবা হয় এ-ধর্মে যে নারীর বাইরে জগতে প্রতিষ্ঠা লাভের বাসনা বিকৃতি, তাদের জন্যে পুণ্য হচ্ছে অক্রিয় কাম, পুরুষাধিপত্য ও বিয়োনোর মধ্যে জীবনকে পূর্ণ করা। তাদের শেখানো হয় যে নারীকে হতে হবে “গৃহিণী’; এবং তাদের অহমিকাকে তৃপ্ত করার জন্যে বলা হয় তাদের ‘পেশা : গৃহিণী”। তাদের কাজ রান্না, ঘর ঝাঁটা, মায়া, কাপড় ধোয়া, ইন্ত্রি করা, রান্না। চিন্তাজগতের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তাদের; তারা বই পড়ে না, পড়ে বিনোদনমূলক পত্রিকা, যেগুলোতে থাকে রান্না, রূপচর্চা, গৃহসজ্জার কথা; যেগুলোতে থাকে না কোনো পেশাজীবী নারীর কথা, একমাত্র ‘পেশাজীবী’ যে-নারী এগুলোতে ফিরে ফিরে স্থান পায়, সে অভিনেত্রী;–পুরুষের প্রধান সম্ভোগ্যপণ্য ও নারীমুক্তির এক বড়ো প্রতিপক্ষ। গৃহিণীর কাজ পশ্চিমে খুব কমে গেছে, গৃহে এতো কাজে নেই যে সে কাজে ব্যস্ত রাখবে নিজেকে। হাতে কাজে নেই, অথচ সময়ের অভাব নেই, এমন গৃহিণী কী করতে পারে? সে পারে নিরর্থক কাজকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। পার্কিন্সনের একটি সূত্র বদলে ফ্রাইডান (১৯৬৩, ২০৫-২২৫) নতুন সূত্র তৈরি করেছেন যে “গিন্নিপনা ফেপে সবটুকু সময়কে ভরে রাখে”; অৰ্থাৎ খাঁটি গৃহিণীর হাতে কাজ না থাকলে সে চালডাল মিশিয়ে বাছতে বসে! পেশাজীবী নারী যে-কাজ করবে আধা ঘন্টায়, আদর্শ গৃহিণী করবে। চার ঘন্টায়, তার কাজে নেই। কিন্তু সময় অনেক। আদর্শ গৃহিণী এক শোচনীয় অপচয়।

গৃহিণীর মহত্তম কাজ প্রসব করা, মা হওয়া। পুরোনো কাল থেকেই সবচেয়ে আদর্শায়িত ভূমিকাগুলোর একটি মা; পিতৃতন্ত্র মায়ের জয়গানে অনেক শ্লোক রচনা করেছে। এর মূল কারণ নারীর মর্ষকামিতার চূড়ান্ত রূপ মা; মা এমন নারী, যার জীবন অপাের দুঃখের। মা ভাবমূর্তির মধ্যে গৌরবায়িত করা হয়েছে অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তিকে, মা দুঃখের নারীমূর্তি। মা সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহীদ। কিন্তু নারীকে কি চিরকাল বেছে নিতে হবে অপার দুঃখকেই, নারী কি যন্ত্রণা ভোগ ক’রেই পাবে মহিমা, শহীদ হওয়াই হবে নারীর নিয়তি আদি নারীবাদীরা নারীর মা ভূমিকাটিকে প্রত্যাখ্যান করেন নি, তবে আক্রমণ করেছিলেন; শার্লোিট পার্কিন্স গিলম্যান (১৮৯৮) পরিহাস ক’রে বলেছিলেন যে অন্য কোনো গ্রহের কোনো সমাজবিজ্ঞানী এসে যদি শোনেন মানবপ্রজাতির কল্যাণের জন্যে মায়ের ত্যাগাস্বীকারের” কথা, তবে তিনি অত্যন্ত অভিভূত ও মুগ্ধ হবেন। ‘কী চমৎকার’ বলবেন তিনি। কী পরম করুণ ও কোমল! মানবজাতির অর্ধেক সমস্ত মানবিক উৎসাহ ও কাজ ফেলে তাদের সমস্ত সময়, শক্তি ও নিষ্ঠা নিয়োগ করছে মাতৃত্বে! সে-মহান জাতিকে লালন ও পালন করার জন্যে যাতে সে ভালোভাবে অন্তর্ভুক্তও নয়! কী মহান অসামান্য শহীদত্বরণ দ্র। উইলিয়মস্ (১৯৭৭, ২৯৬)]! প্রথাগতভাবে নারীদের সারা বছর ধ’রে গর্ভবতী ক’রে রাখাই ছিলো পুরুষের কৃতিত্ব, আর নারীদের গৌরব ছিলো জরায়ুর উর্বরতায়; কিন্তু আধুনিক কালেও যখন পরিবার পরিকল্পনা হয়ে উঠেছে মহাজাগতিক শ্লোগান, তখনও পুঁজিবাদ নারীদের শেখাচ্ছে মাতৃত্বেই নায়ীর পূর্ণতা: কেননা তা প্রকাশ করে নারীদের মৌল আদিমতা। ফ্রাইডান (১৯৬৩, ২৯৫) পেশ করেছেন এক গৃহিণী মায়ের স্বপ্লভঙ্গের তাৎপৰ্যপূর্ণ স্বীকারোক্তি :

‘আমি স্ত্রী ও মায়ের সুন্দর ভাবমূর্তিটি রক্ষা করার জন্যে খুব পরিশ্রম করতাম। আমি আমার সব সন্তান প্রসব করেছি। স্বাভাবিকভাবে। আমি তাদের বুকের দুধ দিয়েছি। একবার এক পার্টিতে এক বৃদ্ধায় কথায় আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, যখন আমি তাঁকে বলি যে সস্তান প্রসবই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আদিম পাশবিক কাজ, এবং তিনি আমাকে বলেন, ‘তুমি কি পশুর চেয়ে বেশি কিছু হ’তে চাও না?’

স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব, তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, ঘন ঘন তার কথা বদলানো, তার বিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায় বসে থাকাতে নারীর মুক্তি নেই। মার্কিন গৃহিণীরা এক দিন দেখতে পায় গৃহ, কাম, সন্তান, স্বামী, আসবাবপত্র তাদের আটকে ফেলেছে; বাতিল হয়ে গেছে তাদের সত্তা। তাকে ধরেছে এক নতুন রোগে, যার নাম “গৃহিণীর ক্লান্তি’, যে-ধারাবাহিক পুলকের জন্যে সে পাগল ছিলো, সে পুলকও দুর্লভ হয়ে উঠেছে, স্বামীও চ’লে গেছে। অন্য তরুণীর শয্যায়; তাকে গ্ৰাস করেছে এমন এক সমস্যা যার কোনো নাম নেই। বিয়ে, কাম, সংসার, মাতৃত্বে মুক্তি নেই নারীর। মানুষ মুক্তি পেতে পারে শুধু মানুষ হয়ে।

বাঙলাদেশে বিয়ে ও সংসার নারীর অনিবাৰ্য তীর্থ গরিব নারীদের জন্যে তা অবধারিত উৎপীড়নের লীলাক্ষেত্র, মধ্য ও উচ্চবিত্ত নারীদের জন্যে সুখকর বন্দীশিবির। বিয়ে ও সংসার এখন বিশেষ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে শিক্ষিত তরুণীদের জন্যে; তাদের শিক্ষা সমস্ত লক্ষ্য ও তাৎপর্য হারিয়ে নিরর্থক হয়ে উঠছে। বিয়ে ও সংসার তাদেরও জীবনের প্রধান, একমাত্র, লক্ষ্য; বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া নিরর্থক অপব্যয়। বিয়ে এখানে তরুণীদের অত্যন্ত দরকার, সমাজ তাদের দেয় না অবিবাহিত কামের অধিকার, এবং জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা। কিন্তু বিয়ে ও সংসারই জীবনের লক্ষ্য হয়ে বাতিল ক’রে দিচ্ছে জীবনকে। প্রথম উচ্চশিক্ষিত বাঙালি তরুণীদের অনেকেই বিয়ে করেন নি; চিকিৎসক বিধুমুখী, যামিনী, আর রাধারানী, সুরবালা, হেমপ্ৰভা, লজ্জাবতী বিয়ে করেন নি; বা অনেকে বিয়ে করেছিলেন বেশি বয়সে- চন্দ্ৰমুখী বসু, ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র, কামিনী রায়, সরলা, কুমুদিনী বিয়ে করেন। তিরিশ পেরোনোর পর; এবং যারা বিয়ে করেছিলেন, তাদের কারো কারো জীবনে শিক্ষা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম দিকের স্নাতক কামিনী রায় বিয়ের আগে কবিতা লিখেছিলেন, বিয়ের পর বিয়ের সুখে এতো পাগল হয়ে যান যে আর কবিতা লেখেন নি; আবার লেখেন যখন স্বামীর মৃত্যুতে মুক্তি পান সংসারের সুখ থেকে। আজো যে তাকে স্মরণ করি, তা ওই সুখের বিয়ের জন্যে নয়; কয়েকটি পদ্যের জন্যে। ষাটের দশকেও বাঙলাদেশের শিক্ষিত তরুণীরা বিয়ে ও সংসারের বাইরের স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করতো, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতা এখন এতো প্রবল যে তরুণীদের অন্যান্য স্বপ্ন সম্পূর্ণ নষ্ট করে বিয়েকেই ক’রে তোলা হয়েছে একমাত্র দুঃস্বপ্ন। প্রগতিশীলেরাও আজ কন্যাদের সতেরো বছর বয়সে স্বামীর সংসারে পাঠিয়ে জীবন সার্থক করেন। দুর্বর পশ্চাৎমুখিতার ফলে তরুণীদের জন্যে উচ্চশিক্ষা তাদের সমস্যার সমাধান না হয়ে রূপ নিচ্ছে সংকটের; যদি তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে না। ঢুকতো, তাহলে ষোলোসতেরো বছর বয়সে কারো সংসারে ঢুকে জরায়ুর সাফল্য অর্জন করতে পারতো, কিন্তু এখন উচ্চশিক্ষা তাদের জন্যে কোনো পেশার ব্যবস্থাও করে না, এবং বিয়ের সম্ভাবনাও নষ্ট করে। আজকের প্রতিক্রিয়াশীল তরুণেরা তাদের পিতামহদের মতো আবার উন্মাদ হয়ে উঠেছে কিশোরীসম্ভোগের জন্যে; তারা চিকিৎসক প্রকৌশলী আমলা হয়ে ব্যগ্রতা বোধ করছে। দশম শ্রেণীর বালিকার দেহ ভোগের জন্যে। তারা শিক্ষাকে ভয় পায়, শিক্ষিত নারীকে ভয় পায়, তারা তৃপ্তি বোধ করে নির্বোধ বালিকায়।

বিয়ে, একপতিপত্নী বিয়ে, সংসার ও মাতৃত্ব সম্প্রতি নারীবাদীদের তীব্র আক্রমণেব বিষয় হয়েছে; কারণ প্রধানত। এরই মাধ্যমে পীড়ন করা হয় নারীদের, বাতিল ক’রে দেয়া হয় তাদের সত্তা। নষ্ট ক’রে দেয়া হয় তাদের সম্ভাবনা, তাদের মেধা ও প্রতিভা। আমি কতিপয় নারীকে জানি, যারা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে, কিন্তু এখন তাদের কোনো পার্থক্য নেই মাধ্যমিক পাশ গৃহিণীর সাথে; সংসার তাদের মেধা গ্ৰাস করেছে। একজন জানিয়েছেন তাঁর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে উঠেছে যে তিনি বই পড়ে বুঝতে পারেন। না, ভালো সাময়িকীও পড়তে পারেন না, পড়তে পারেন। শুধু রম্যপত্রিকার কেলেঙ্কারি, যদিও ছাত্রজীবনে তিনি লিখতেন। চমৎকার প্রবন্ধ। বিয়ে সংসার নারীদের কী ক’রে তোলে বোঝা যায় তাদের দিকে তাকালে। বিয়ে সংসাব কি আজো জীবনের প্রার্থিত লক্ষ্য হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমে বিয়েসংসার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, বাঙলাদেশেও আর বিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব’লে বিবেচিত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিয়ে কি সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বাধীনতা ও সাম্যের সাথে? বিয়ে এখনো নারীটিকে অধীন ক’রে তোলে পুরুষটির, পুরুষটি নারীটির থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন হ’লেও। বিয়েতে স্বামী স্ত্রীর যে-প্রথাগত ভূমিকা রয়েছে, তারও বদল ঘটা দরকার; স্ত্রীকেই যে দেখতে হবে সংসার, একে আর অবধারিত মনে করার কারণ নেই। দরিদ্র দেশগুলোতে নারীদের অবস্থা শোচনীয়, শুধু প্ৰগতিশীলতা তাদের উদ্ধার করতে পারে ওই শোচনীয়তা থেকে। নারীর জন্যে প্রগতিশীলতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, প্রতিক্রিয়াশীলতা নারীর চিরশত্ৰু। পশ্চিমে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের, যাতে স্বামী কুলপতি স্ত্রী দাসী ও আর্থনীতিকভাবে নির্ভরশীল, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা। নারীর শিক্ষা, কাম, ও আর্থনীতিক স্বাধীনতা, যাকে বলা হয় “ইএসই ফ্যাক্টর’, বদলে দিচ্ছে বিয়ে ও সংসারের চরিত্র। প্রথাগত বদ্ধ বিয়ের বদলে দেখা দিচ্ছে উন্মুক্ত বিয়ে, বহুজনীয় বিয়ে, একত্ৰবাস: এবং বদলে যাচ্ছে পবিবার সংস্থা। } প্রথাগত বিয়ে একদিন এখানেও হয়ে উঠবে অতীতের ব্যাপার।
 
ধর্ষণ


নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ, যাতে পুরুষ নারীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। পুরুষ সুবিধার জন্যে বা আক্রোশবশত নারীকে খুন করতে পারে- মাঝেমাঝেই করে: কিন্তু খুনের থেকেও মর্মান্তিক ধর্ষণ, কেননা খুন নারীটিকে কলঙ্কিত করে না। ধর্ষণ একান্ত পুরুষের কর্ম; নারীর পক্ষে পুরুষকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। পুরুষের দেহসংগঠন এমন যে পুরুষ সম্মত আর শক্ত না হ’লে নারী তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক পাতাতে পারে না; কিন্তু উত্তেজিত পুরুষ যে-কোনো সময় নারীকে তার শিকারে পরিণত করতে পারে। অসম্মত নারীর সাথে জোর ক’রে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়াকে কয়েক দশক আগে সাধারণত বলা হতো বলাৎকার, এখন অকপটে বলা হয় ধর্ষণ। ধর্ষণ কোনো আধুনিক ব্যাপার নয়, এবং বিশেষ কোনো সমাজে সীমাবদ্ধ নয়। তবে কোনো কোনো সমাজ বিশেষভাবে ধর্ষণপ্রবণ, আর কোনো কোনো সমাজ অনেকটা ধর্ষণমুক্ত; যদিও সম্পূর্ণ ধর্ষণমুক্ত সমাজ ও সময় কখনোই ছিলো না, এখনো নেই। মানবসমাজ ধর্ষণের ইতিহাস লিখে রাখার দরকার বোধ করে নি; কিন্তু প্রাচীন পুরাণ ও উপাখ্যানে ধর্ষণের যে-বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় প্রাচীনেরা ধর্ষণকে অনেকটা ধর্মে ও দর্শনে পরিণত করেছিলো।

ভারতীয় পুরাণে পরাশর কর্তৃক সত্যবতীকে ধর্ষণের উপাখ্যান বিখ্যাত; আর দেবরাজ ইন্দ্ৰ মাঝেমাঝেই স্বৰ্গমর্ত্য জুড়ে ধর্ষণ ক’বে বেড়াতো। গ্রিক পুরাণ ভরেই পাওয়া যায় ধর্ষণ, যাতে প্রধান ধর্ষণকাৰী দেবরাজ জিউস। গ্রিক পুরাণ জানিয়ে দেয় নারীদেহ পুরুষের কামাক্রমণের চিরকালীন লক্ষ্যবস্তু; এবং এতে এমন একটি বাণীও পাওয়া যায় যে আক্রমণ ও অধিকার করা যেতে পারে নারীকে, লুণ্ঠন করা যেতে পারে তার দেহ, যদি না সে বের করতে পারে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার কোনো চরম উপায। আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার এক উপায় হচ্ছে মৃত্যুবরণ, মৃত্যুই নারীর ধ্রুব সখা; তবে গ্রিক পুরাণে ধর্ষণকারীকে প্রতিহত করার নাটকীয় উপায় রূপান্তরগ্রহণ। ধর্ষণকারীকে প্রতিহত করাব চেষ্টা করতে করতে, পেরে না উঠে, শেষ মুহুর্তে নারী নিজের শরীরকে রূপান্তরিত করে কোনো প্রাকৃতিক বস্তুতে; যেমন দাফনে অ্যাপোলোর কামঙ্গুধা থেকে বাঁচার জন্যে রূপান্তরিত হয় লরেলতরুতে। তবে যারা পলাতে পারে না, বিশেষ ক’রে ধর্ষণকারী যখন কোনো দেবতা, তখন তাদের শরীরের ঘটে আরেক রূপান্তর; তারা গর্ভবতী হয়, প্রসব করে বীরসন্তান, যারা নগরপত্তন করে, সৃষ্টি করে সভ্যতা। পুরাণের নানা ব্যাখ্যা সম্ভব। গ্রিক পুরাণের ধর্ষণ সরাসরি কাম ও নারীপুরুষের ভূমিকা নির্দেশ করতে পারে; আবার নির্দেশ করতে পারে বিয়ে ও বিয়ের বাইরে নরনারীর আচরণের বিধিবিধান। পৌরাণিক ধর্ষণ অস্তিত্ব, ধর্ম ও রাজনীতিক ব্যাপারের প্রতীকও হতে পারে। গ্রিক পুরাণ পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজের সৃষ্টি; তাই ধর্ষণ নির্দেশ করতে পারে পুরুষাধিপত্য ও শিশ্নের শক্তি, যার রূপ দেখা যায় দেবরাজ, ‘দেবতা ও মানুষের পিতা, জিউসের ক্রিয়াকলাপে। অলিম্পাসে অধিষ্ঠিত দেবরাজের শক্তির শেষ নেই, যা ঝলকে ওঠে তার রাজদণ্ড ও বজো; এবং তার কামশক্তি আর কামনাও অনন্ত। সে তার কামশক্তি অবাধে প্রয়োগ করে দেবী আর মানবীদের ওপর। পৌরাণিক ধর্ষণের তাৎপৰ্য যাই হোক, তা প্ৰমাণ করে ধর্ষণ মানুষের সমান বয়সী। ব্ৰাউনমিলার বলেছেন, ‘শুরুতে পুরুষ ছিলো প্রাকৃতিক লুণ্ঠনকারী আর নারী ছিলো প্রাকৃতিক শিকার’ [দ্র পোর্টার (১৯৮৬, ২৩০)]; এবং আজো তাই রয়ে গেছে।

পৃথিবীতে পৌরাণিক কাল আর নেই, দেবতারা আর ধর্ষণ করে না; তবে দেবতাদের স্থান নিয়েছে আজ পুরুষেরা; প্রায়-অবাধ ধর্ষণ চলছে পৃথিবী জুড়ে। ধর্ষণ এখন দেখা দিয়েছে মারাত্মক মড়করূপে;–আমেরিকার মতো শিল্পোন্নত সমাজে যেমন চলছে। ধর্ষণ, তেমনি চলছে বাঙলাদেশের মতো অনুন্নত সমাজে। বাঙলাদেশ এখন সবচেয়ে ধর্ষণপ্রবণ সমাজের একটি: মনে হচ্ছে পৌরাণিক দেবতারা আর ঋষিরা দলবেঁধে জন্মলাভ করেছে। বাঙলাদেশে। ধর্ষণের সব সংবাদ অবশ্য জানা যায় না; সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে ধর্ষিতারাই তা চেপে রাখে; কিন্তু যতোটুকু প্ৰকাশ পায় তাতেই শিউরে উঠতে হয়। বাঙলাদেশে ধর্ষণ সবচেয়ে বিকশিত সামাজিক কর্মকাণ্ড, পৃথিবীতে যার কোনো তুলনা মেলে না। বাঙলাদেশে এককভাবে ধর্ষণ করা হয়, এবং দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়; এবং ধর্ষণের পর ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। এখানে পিতা ধর্ষণ করে কন্যাকে (কয়েক বছর। আগে মধ্যপ্ৰাচ্য থেকে ফিরে এক পিতা ধর্ষণ করে তার তিন কন্যাকে), জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়ীকে, সহপাঠী ধর্ষণ করে সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে কার্যালয়ের মেথরানিকে, গৃহশিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, ইমাম ধর্ষণ করে আমপারা পড়তে আসা কিশোরীকে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধুকে, দেবার ধর্ষণ করে ভাবীকে; এবং দেশ জুড়ে চলছে অসংখ্য অসম্পর্কিত ধর্ষণ। চলছে দলবদ্ধ ধর্ষণ:-রাতে গ্রাম ঘেরাও করে পুলিশ দলবদ্ধভাবে ধর্মণ করে গৃহবধুদের (কয়েক বছর আগে ঠাকুরগাঁয়ে ঘটে এ-ঘটনা); নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে পুলিশ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করে একটি বালিকাকে; ১৯৯৫ার আগস্ট মাসে, দিনাজপুরে, যার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সারা শহর, এবং প্রাণ দেয় সাতজন; মহাবিদ্যালয়ে প্রেমিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছাত্ররা দলগতভাবে ধর্ষণ করে ছাত্রীকে (ব্ৰজমোহন কলেজ, ১৯৯৫); মাস্তানরা বাসায় ঢুকে পিতামাতার চোখের সামনে দলগতভাবে ধর্ষণ করে কন্যাদের (বিভিন্ন শহর ও গ্রামে)। বাঙলাদেশ আজ ধর্ষণকারীদের দ্বারা অবরুদ্ধ। বাঙলাদেশে নারী বাস করছে নিরন্তর ধর্ষণভীতির মধ্যে; চাষীর মেয়ে মাঠে যাবে-সে আর কোনো ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের; মেয়েটি ইস্কুলে বা মহাবিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে-সে। আর কোনো ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের: মেয়েটি বাইরে যাবে-সে। আর কোনো ভয় পাচ্ছে না, কিন্তু ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। সুজান গ্রিফিন বলেছেন, ‘আমি কখনোই ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারি নি’ [দ্র পোর্টার (১৯৮৬, ২২১)]। বাঙলাদেশে প্রতিটি নারী এখন সুজ্যান গ্রিফিন।

ধর্ষিত হওয়া নারীর জন্যে মৃত্যুর থেকেও মারাত্মক; ধৰ্ষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা ধসিয়ে দেয় ধর্ষিত নারীর জীবনের ভিত্তিকেই। ধর্ষিত হওয়ার মুহুর্তে নারী গভীরতম অন্ধকারে পতিত হয়; তার যদি সঙ্গমের পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে যন্ত্রণা আর বিভীষিকা৷ তাকে পাগল ক’রে তুলতে পারে। ধর্ষণ অনেকের ওপর ফেলে দীর্ঘপ্রসারী প্রভাব-নষ্ট হয়ে যায় তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার শক্তি, তারা আর কোনো পুরুষের সাথেই জড়িত হতে পারে না, পুরুষের প্রতিটি আচরণ তাদের কাছে ধর্ষণ বলে মনে হয়; বদলে যায় তাদের আচরণ, মূল্যবোধ, এবং সব সময়ই তারা থাকে শঙ্কিত। ধর্ষিত নারী আণবিক বোমাগ্ৰস্ত নগরী, যার কিছুই আর আগের মতো থাকে না। কিন্তু ধৰ্ষিত হওয়ার পর সমাজ তার সাথে সুব্যবহার করে না, তার জন্যে বেদনার্ত হয় না, করুণা করে না। ধর্ষিত অধিকাংশ নারীই ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে না, কেননা সমাজ অনেকটা ধর্ষণকারীর পক্ষেই। তাই অধিকাংশ ধৰ্ষিত নারীই ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ না তুলে ঘটনাটিকে ভাগ্য বলে মেনে নেয়। ধর্ষিত নারী কিছুটা সান্তুনা পেতে পারতো বিচার বিভাগের কাছ থেকে; কিন্তু বিচার বিভাগ, যা পুরুষেরই সৃষ্টি, তাকে নিয়ে অনেকটা খেলায় মেতে ওঠে। বিচার বিভাগের সাহায্য চাওযার পর ধর্ষিত নারী ধৰ্ষিত হওয়ার বিভীষিকার পর পড়ে বিচারব্যবস্থার বিভীষিকার মধ্যে। পৃথিবী জুড়েই বিচার বিভাগের ক্রিয়াকলাপ ধর্ষিতদের পীড়িত করে প্রচণ্ডভাবে; বিচার বিভাগের আচরণে ধর্ষিতদের মনে হয় তারা ধর্ষিত হচ্ছে। আবার। ধর্ষণের অভিযোগের পর কাজ শুরু করে পুলিশ, তারা তথাকথিত সত্য ঘটনা বের করার নামে নির্মম অশ্লীলভাবে জেরা করতে থাকে ধর্ষিতদের, যেনো ধর্ষিতারাই অপরাধী; যেনো তারা দেবতুল্য পুরুষকে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্যেই ধর্ষণের অভিযোগ আনে। পুলিশ মনে করে কোনো নারী যদি সত্যিই ধৰ্ষিত হয়, তার শরীরে নানা রকম চিহ্ন থাকবেই। নারী বাধা দেবে, ধর্ষণকারী তাকে আঘাত করবে; তার দাগ ফুটে থাকবে। ধর্ষিতের শরীরে। দাগগুলো সাক্ষী দেবে যে নারীটি ধর্ষিত। যদি কোনো নারী এমন দাগ ছাড়া পুলিশের কাছে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করে, পুলিশ তাকে একটা মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কিছু মনে করে না। পলিটিক্যাল রিভিউতে প্ৰকাশিত রচনায় এক গোয়েন্দা সার্জেন্ট তার সহকমীদের দিয়েছে এ-উপদেশ [দ্র টেমকিন (১৯৮৬, ১৭)] :

‘মনে রাখতে হবে যে শিশুদের বেলা ছাড়া বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্ত্রাস ব্যতীত ধর্ষণ অসম্ভব, তাই তাদের শরীরে সন্ত্রাসের চিহ্ন থাকবেই। যদি কোনো নারী শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছাড়া থানায় এসে ধর্ষণের অভিযোগ তোলে, তাহলে তাকে খুব কঠোরভাবে জেরা করতে হবে। যদি তার অভিযোগ সম্বন্ধে সামান্যও সন্দেহ জাগে, তবে তাকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বলতে হবে। যে-মেয়েরা গর্ভবতী বা বেশি রাতে বাসায় ফেরে, তাদের ওপর কড়া দৃষ্টি দিতে হবে, কেননা এমন ধরনের মেয়েরা খুব বদমাশ; তারা সহজেই ধর্ষণ বা অশোভন আক্রমণের অভিযোগ তোলে। তাদের কোনো সহানুভূতি দেখাবে না।‘

এ-উপদেশ থেকেই বোঝা যায় ধর্ষিত নারী কতোটা সহযোগিতা পায় পুলিশের। যেমন শুধু ভিখিরি হ’লেই চলবে না, হতে হবে অন্ধ খোড়া কুণ্ঠরোগী; তেমনি নারী শুধু ধৰ্ষিত হ’লেই চলবে না, তার শরীরে মারাত্মক আঘাতের দাগ থাকতেই হবে; তা যতো গভীর আর প্রশস্ত হয় ততোই ভালো। বিচার বিভাগ জানতে চায়, সে কি একটুও সুখ পেয়েছে? তাহলে চলবে না। বিলেতের এক বিচারক, সত্তরের দশকে, ধর্ষিতদের উপদেশ দিয়েছিলো : আপনারা দু-পা চেপে রাখবেন।’ এক লেখিকা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ধৰ্ষিত হওয়ার সময় দু-পা চেপে রাখার কথা মনে থাকে না।’ বিচার বিভাগ আসলে ধৰ্ষিত নারীর কাছে কী চায়? চায় তার মৃত্যু। বিচার বিভাগ বলে, তোমার উচিত ছিলো ধর্ষণকারীকে বাধা দেয়া, যদিও তার হাতে একটা ছুরিকা ছিলো, যদিও তার হাতে একটা আগ্নেয়াস্ত্র ছিলো, যদিও সে তোমার থেকে শক্তিমান; এবং তোমার উচিত ছিলো মৃত্যুবরণ। বিচার বিভাগ বা পুরুষতন্ত্র ধর্ষিত নারীর থেকে মৃত নারী পছন্দ করে। ধর্ষিত নারী অভিযোগ তোলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে; মৃত নারী মেনে নেয়। পুরুষতন্ত্রকে।

ধৰ্ষিত নারী পুলিশ পার হয়ে বিচারালয়ে যাওযার পর শুরু হয় নতুন বিভীষিক; পুলিশের নিষ্ঠুর আচরণের পর বিচারালয় মেতে ওঠে আরো নিষ্ঠুর আচরণে। পুরুষ ধৰ্ষিত নারীর অভিযোগ বিচারের যে-প্রক্রিয়া বের করেছে, তা দেখে মনে হয় ধর্ষণকারীর বিচার তাদের লক্ষ্য নয়, তাদের লক্ষ্য ধর্ষিত নারীর বিচার। যেনো ধৰ্ষিত হয়ে সে অপরাধ করেছে; বিচারালয় সে-অপরাধটুিকুই খুঁজে বের করতে চায়। বিচার চলার সময় পুরুষটির বদলে বিচারালয়ের সব মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে নারীটির ওপর। বিচারালয়ে প্রথমেই নারীটির চরিত্রের ওপর লেপন করা হয় একরাশ কলঙ্ককালিমা; খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করা হয় তার যৌনজীবনের ইতিহাস। অবিবাহিত নারী ধৰ্ষিত হ’লেই তার জীবন কলঙ্কিত হয়ে যায়; কিন্তু বিচার বিভাগের কাছে তা-ই যথেষ্ট নয়; বারবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তার সঙ্গমের অভিজ্ঞতা আছে কি না, থাকলে তা কেমন, কার কার সাথে সে সঙ্গম করেছে, সঙ্গমে সে সুখ পায় কি না প্রভৃতি। আসামীর উকিল নিজের মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে নিয়ে থাকে কয়েকটি কৌশল; সে বারবার প্রশ্ন করে ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে-কখন ধর্ষণ করা হয়েছে, কীভাবে করা হয়েছে, কতোক্ষণ করেছে, এসব সম্পর্কে সে বিরতিহীন প্রশ্ন করতে থাকে। নারীটিকে বারবার বর্ণনা করতে হয় নিজের ধর্ষিত হওয়ার উপাখ্যান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই নারীর বিবৃতির মধ্যে অসঙ্গতি বের করা, আর দেখানো যে ঘটনাটিতে নারীটির সম্মতি ছিলো। যে-সব ক্ষেত্রে ধর্ষিত আর ধর্ষণকারী পূর্বপরিচিত সেখানে ব্যবহার করা হয় আরেক কৌশল। এ-ক্ষেত্রে চলতে থাকে কুৎসিত প্রশ্নের ঝড়, যার লক্ষ্য প্রমাণ করা যে তাদের মধ্যে আগে থেকেই যৌনসম্পর্ক ছিলো; এটা নতুন কিছু নয়, এবং ধর্ষণ নয়। তারপর রয়েছে চিরকালীন কৌশলটি, যার কাজ প্রমাণ করা যে নারীটি অসতী, আর দেখিয়ে দেয়া যে এমন অসতীর পক্ষে এমন স্থানকালে সঙ্গমে সম্মতি দেয়াই স্বাভাবিক। মনে করা যাক নারীটি সন্ধ্যার পর (বাঙলাদেশে) বা মধ্যরাতে (পশ্চিমে) বাসায় ফিরছিলো। তখন দাবি করা হবে যে-নারী সন্ধ্যার পর বা মধ্যরাতে বাড়ি ফেরে, তার চরিত্র ভালো নয়, তাই তার পক্ষে সম্মতি দেয়াই স্বাভাবিক।

এ তো উকিলের কাজ, আর উকিলের কাজ উকিল করবেই। ধর্ষিত নারীটি তাকে পয়সা দেয় নি, দিয়েছে ধর্ষণকারী; তাই সে সীমা পেরিয়ে গিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করবে: মক্কেলকে। কিন্তু বিচারক কী করে? যখন উকিল অশ্লীল জেরা করতে থাকে নারীটিকে তখন মাননীয় বিচারকেরা কী করে? অপরাধমূলক বিচারে আইন শুধু প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থিত করারই অনুমতি দেয়; কিন্তু ধর্ষণের মামলায় বিচারকেরা উকিলকে দেয় লাগামহীন স্বাধীনতা, যা পরিবেশকে ক’রে তোলে সবার জন্যে উপভোগ্য; আর নারীটির জন্যে পুনরায় ধৰ্ষিত হওয়ার সমান। বিচারকেরা উকিলদের শুধু অবাধ স্বাধীনতাই দেয় না, মাঝেমাঝে নিজেরাও আপত্তিকর মন্তব্যের পর মন্তব্য ক’রে উকিলদের উৎসাহিত আর ধর্ষিতকে পীড়িত ক’রে থাকে। ১৯৮২ সালে বিলেতে এক বিচারক মন্তব্য করে দ্র। টেমকিন (১৯৮৬, ১৯-২০)]! :

‘যে-নারীর না বলে তারা সব সময় না বোঝায় না। বিষয়টা শুধু না বলাব নয়, বিষযটা হচ্ছে সে কীভাবে না বলছে, কীভাবে সে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করছে। সে যদি এটা না চায় তাহলে তার উচিত তাব দু-পা চেপে বন্ধ ক’রে রাখা; বলপ্রযোগ ছাড়া তার ভেতবে ঢোকা সম্ভব নয, তাই তার শবীবে বলপ্রয়োগেব চিহ্ন থাকবেই।‘

ধর্ষিত হওয়া যেনো নারীরই অপরাধ- কেনো সে দু-পা চেপে সব কিছু বন্ধ ক’রে রাখে নি? ধর্ষণের বিচার ধর্ষিতাদের জন্যে চরম বিভীষিকার ব্যাপার। নিউজিল্যান্ডে ধর্ষণ সম্পর্কে গবেষকেরা জানিয়েছেন ধর্ষিতারা বিচারের পীড়নকে খারাপ মনে করে ধর্ষণের থেকেও; যা অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সমতুল্য। ধর্ষিত নারী বিচার চাইতে গেলে ধৰ্ষিত হয় কমপক্ষে তিনবার- দুবার রূপকার্থে।

নারীর ওপর বলপ্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ; কিন্তু এ-সম্পর্কে ইতিহাসরচয়িতারা সাধারণত চুপ থাকতেই পছন্দ করেছেন। বাশার বলেছেন, ‘আজকের পুরুষ ঐতিহাসিকদেব পক্ষে স্বস্তির সাথে আলোচনার জন্যে সৃষিণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, খুবই রাজনীতিক বিষয়’ [দ্র পোর্টার (১৯৮৬, ২১৬)। পুরুষের লেখা অপরাধের ইতিহাসে ধর্ষণ গুরুত্ব পায় নি; তাকে গণ্য করা হয়েছে তুচ্ছ ব্যাপার ব’লে। ধর্ষণের বিভীষিকা৷ প্রথম তুলে ধরেন আধুনিক নারীবাদীরা; এবং প্রস্তাব করেন ধর্ষণের তত্ত্ব। তাঁরা দাবি করেন ধর্ষণকে শুধু কিছু ব্যাধিগ্ৰস্ত মানুষের বিকৃত কাজ ব’লে একপাশে সরিয়ে রাখা যায় না; ব্যাপারটিকে বুঝতে হবে লৈঙ্গিক সম্পর্ক ও লৈঙ্গিক রাজনীতি, কলঙ্কিত ও নিন্দিতকরণ, সন্ত্রাস ও অপরাধের ভাষায়। কেইট মিলেটই (১৯৬৯, ৪৩-৪৬) প্রথম ‘বলপ্রয়োগ’ নামে ধর্ষণ বিষয়টি আলোচনা করেন; দেখান যে পিতৃতন্ত্রে নারীর ওপর পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলগুলোর একটি ধর্ষণ। ১৯৭৫-এ বেরোয় ধর্ষণ সম্পর্কে সুজান ব্ৰাউনমিলারের সাড়াজাগানো বই আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে : পুরুষ, নারী ও ধর্ষণ। তার বইয়ের প্রধান প্ৰতিপাদ্য হচ্ছে ধর্ষণ সব সময়ই কাজ করেছে এক প্রধান সামাজিক শক্তিরূপে, পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় উপাদানরূপে। এরপর বেরিয়েছে বহু বই : ক্যারোলিন হার্সের ধর্ষণ নিয়ে সমস্যা (১৯৭৭), সুজ্যান গ্রিফিনের ধর্ষণ : চেতনার শক্তি (১৯৭৮), রুথ ই হলের যে-কোনো নারীকে জিজ্ঞেস করুন (১৯৮৫) প্রভৃতি, ও আরো বহু বই ও নিবন্ধ।

পুরুষ কেনো ধর্ষণ করে? এ-সম্পর্কে পাওয়া যায় তিনটি তত্ত্ব : একটি নারীবাদীদের, একটি সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের, ও একটি জীববিজ্ঞানীদের। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বে ধর্ষণ একটা সামাজিক ব্যাধি, যার উদ্ভব ঘটেছে আধুনিক শিল্পনির্ভর সমাজের জটিলতা থেকে। এ-তত্ত্বটি বাতিল হয়ে যায় সহজেই; কেননা ধর্ষণ শুধু আধুনিক শিল্পনির্ভর সমাজে সীমাবদ্ধ নয়। ধর্ষণ আগেও ছিলো, এখনও আছে; শিল্পোন্নত সমাজে যেমন রয়েছে ধর্ষণ, তেমনি রয়েছে। এ-কালের আদিম ও অর্ধআদিম সমাজগুলোতে। ধর্ষণ আন্তঃসাংস্কৃতিক। ধর্ষণ সম্পর্কে নারীবাদী ও জীববিজ্ঞানীদের তত্ত্বের সমন্বয় করলে পাওয়া যায় ধর্ষণ সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ ধারণা। ধর্ষণ সম্পর্কে নারীবাদীদের তত্ত্বের মূলকথা হচ্ছে নারীর ওপর পিতৃতান্ত্রিক পুরুষাধিপত্যের একটি কৌশল হিশেবেই পিতৃতন্ত্র লালন করে আসছে ধর্ষণ; আর জীববিজ্ঞানীদের তত্ত্বের সারকথা হচ্ছে বিবর্তনের ফলেই পুরুষের কামতৃপ্তির একটি প্রক্রিয়ারূপে উদ্ভূত হয়েছে ধর্ষণ। নারীবাদীরা ধর্ষণ সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্তে পৌচেছেন : প্রথমটি হচ্ছে ধর্ষণ শুধু ধর্ষণকারীর আলোকে বোঝা সম্ভব নয়, বুঝতে হবে পুরুষের সমগ্র মূল্যবোধের আলোকে; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ধর্ষণ যতোটা অবদমিত কামের প্রকাশ তারচেয়ে অনেক বেশি প্ৰকাশ নারীবিদ্বেষের।

কেইট মিলেট লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯) গ্রন্থে ধর্ষণের যে-তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন, তাই সম্প্রসারিত ক’রে ব্ৰাউনমিলার আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে (১৯৭৫) গ্রন্থে প্রস্তাব করেন ধর্ষণের বিস্তৃত তত্ত্ব। তাঁর তত্ত্বই এখন ধর্ষণের নারীবাদী তত্ত্ব হিশেবে গৃহীত। নারীবাদীরা নারীর অস্তিত্বকে দেখেন পিতৃতান্ত্রিক পীড়ন ও আধিপত্যের কাঠামোতে; তারা মনে করেন পিতৃতন্ত্রের উদ্ভবই নারীর দুরবস্থার মূলে। কেউ কেউ পিতৃতন্ত্র ও পীড়নকে একাৰ্থক ব’লেই মনে করেন। যেমন, মেরি ড্যালি পিতৃতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : পিতৃতন্ত্র, ধর্ষণবাদের ধর্ম [দ্র পোর্টার (১৯৮৬, ২৩১)]। ব্ৰাউনমিলার ধর্ষণের স্বরূপ দেখাতে গিয়ে দাবি করেন যে প্রকৃত ধর্ষণকারী কোনো ব্যক্তি নয়, প্রকৃত ধর্ষক হচ্ছে পিতৃতন্ত্র। তাঁর মতে ধর্ষণ পিতৃতন্ত্রের জন্যে দরকার; কেননা ধর্ষণ পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নয়, ধর্ষণ পিতৃতন্ত্রকে বিপন্ন করে না; বরং কাজ করে পিতৃতন্ত্রের সেনাবাহিনীর মতো। পিতৃতন্ত্র ‘পৌরুষকে দেখে যে-মুগ্ধ চোখে, আর পোষণ করে যে-নারীবিদ্বেষ, তাতে গড়ে ওঠে এমন গণমনস্তত্ত্ব, যা উৎসাহিত করে ধর্ষণকে। পুরুষের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ষণের কাজ করে, সবাই করে না; তবে সব পুরুষই সম্ভাব্য ধর্ষণকারী। সুযোগ পেলে, যেমন যুদ্ধের সময় অবরোধকারী সেনাবাহিনী উল্লাসের সাথে করে (স্মরণীয়; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কোরিয়ায় জাপানি বাহিনী; ১৯৭১-এ বাঙলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) সব পুরুষই ধর্ষণের কাজটি করতে পারে; আর বহু স্বামী বাসর ঘরে ও অন্যান্য সময় যে-যৌন আচরণ করে, তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। বহু স্বামী নিয়মিতভাবে ধর্ষণ করে স্ত্রীদের। ইতিহাস ভরেই ধর্ষণ চলে আসছে, যদিও তা স্বীকার করা হয় নি। ব্ৰাউনমিলারের মতে ধর্ষণ বৈধতা দেয়। পিতৃতন্ত্রকে। কর্ম হিশেবে ধর্ষণ বর্বরভাবে নারীকে করে পুরুষের ইচ্ছার অধীন; আর ভীতি হিশেবে ধর্ষণ সব সময় খবরদারি করে নারীর আচরণের ওপর। ধর্ষণ সীমিত করে নারীর স্বাধীনতা; আর প্রচার করে পিতৃতন্ত্রের ভাবাদর্শ যে পুরুষের রক্ষণাবেক্ষণ নারীর সব সময়ই দরকার। নারী যেখানেই যায় কোনো-না-কোনো মহৎ পুরুষ তার অভিভাবকত্ব করে; তাকে আগলে রাখতে চায়। এটা দেখেই মে ওয়েস্ট পরিহাস ক’রে বলেছিলেন, ‘কী মজার, যে-পুরুষেরই সাথে দেখা হয় সে-ই আমাকে রক্ষা করতে চায়; আমি বুঝতে পারি না। কী থেকে দ্র। পোর্টার (১৯৮৬, ২১৮)।

ব্ৰাউনমিলার বের করতে চেয়েছেন ধর্ষণের প্রতি পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি। আদি বাইবেলের ইহুদি বিধান থেকে সামন্ততন্ত্রের বিধান পর্যন্ত সমাজ ধর্ষণকে দেখেছে কী চোখে? বাইবেলি আর সামন্ত সমাজের চোখে ধর্ষণ কোনো নারীর কাছে কোনো পুরুষের অপরাধ নয়; ধর্ষণ ছিলো এক পুরুষের কাছে আরেক পুরুষের অপরাধ। ধর্ষণ বিবেচিত হতো চৌর্যবৃত্তি ব’লে, যাতে একটি পুরুষ চুরি করতো আরেক পুরুষের ধান; – ওই বিধানে চোর কোনো নারীর কাছে অপরাধ করতো না, করতো আরেক পুরুষের কাছে। অপরাধটি ছিলো যে চোর কোনো নারীকে চুরি করেছে তার বৈধ মালিকের-পিতা বা স্বামীর-কাছে থেকে; এবং হরণ করেছে তার সতীত্ব, যার মালিক তার পিতা বা স্বামী। নারীটি যদি অবিবাহিত হতো, ধর্ষণের ফলে নষ্ট হয়ে যেতো বিয়ের বাজারে তার পণ্যমূল্য; সতীত্ব নষ্ট হওয়ায় তার পরিবারের ওপর পড়তো কলঙ্ক। তখনকার বিচারব্যবস্থা পরিবারের প্রধানকে, পিতা বা স্বামীকে, ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করতো। ধর্ষিত মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেয়া হতো যাজিকাশ্রমে, বা বিয়ে দেয়া হতো হরণকারী বা ধর্ষণকারীর সাথে। ধর্ষণের ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত যে-নারী, তা স্থির করতে কয়েক হাজার বছর লেগেছিলো পিতৃতন্ত্রের।

ব্ৰাউনমিলার ও নারীবাদীদের মতে ধর্ষণ কিছু বিকৃত মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাজ নয়, সমাজেরই কাজ; ধর্ষণ বিকারগ্রস্তের রোগ নয়, পিতৃতন্ত্রেরই রোগ। ব্ৰাউনমিলার বলেছেন, ‘প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত, আমার বিশ্বাস, ধর্ষণ এক চরম ভূমিকা পালন ক’রে এসেছে; এটা এক সচেতন ভীতিপ্রদর্শনপ্রক্রিয়া, যার সাহায্যে সব পুরুষ সব নারীকে রাখে সন্ত্রস্ত অবস্থায়’ দ্র। পোর্টার (১৯৮৬, ২১৮)]। নারী বাস করে ধর্ষণকারীর দীর্ঘ ছায়ার নিচে। ধর্ষণ নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের মূল অস্ত্র; ধর্ষণ এক রাজনীতিক অপরাধ, নারীকে অধীনে রাখার পুরুষের চরম উপায়। ধর্ষণ যে এক রাজনীতিক অস্ত্র, এ-মতের বিকাশ ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে; কেননা সেখানেই লৈঙ্গিক রাজনীতিতে ধর্ষণ একটি বড়ো হাতিয়ার বলে গণ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের পরিমাণ ভীতিকরভাবে বেশি; ১৯৭৯ সালে জানা যায় ৭৫, ৯৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা; এরপর আরো বাড়ে ধর্ষণের পরিমাণ। যুক্তরাষ্ট্রেই ধর্ষণকে রাজনীতিক রূপ দিয়েছে পুরুষেরাই; ব্ল্যাক প্যান্থার নেতা এলড্রিজ ক্লিভার কালোদের সংগ্রামের কৌশল হিশেবে অনুসারীদের নির্দেশ দেয় শ্বেত নারীদের ধর্ষণের দ্ৰ পোর্টার (১৯৮৬, ২১৮)]। ধর্ষণ যে অনেকটা রাজনীতিক ব্যাপার এটা বোঝা যায় দখলকারী সেনাবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত অঞ্চলের নারীদের ধর্ষণের ঘটনায়। ব্ৰাউনমিলার মনে করেন ধর্ষণের উদ্ভব ঘটেছে আদিকাল থেকে পুরুষের দেহ ও মনস্তত্ত্বের বিবর্তনের ফলে; তবু এটা একটি রাজনীতিক অপরাধ। পুরুষই শুধু ধর্ষণ করতে পারে, নারী পারে না। পুরুষের শরীরসংগঠন ধর্ষণের যোগ্যতাসম্পন্ন। ব্ৰাউনমিলার বলেছেন, ‘ধর্ষণ করার জন্যে পুরুষের শারীরিক যোগ্যতাই সৃষ্টি করেছে। পুরুষের ভাবাদর্শ, যার নাম ধর্ষণ।’

ধর্ষণের পরিমাণ সব দেশে সমান নয়, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে পার্থক্য রয়েছে ধর্ষণহারের। সব সমাজ ধর্ষণকারীদের সমানভাবে অনুপ্রাণিত করে না। কিছু সমাজ অনেকটা ধর্ষণমুক্ত, কিছু সমাজ প্ৰচণ্ড ধর্ষণপ্রবণ। পশ্চিম সুমাত্রা প্রায়ধর্ষণমুক্ত; সেখানে ধর্ষণকারী নিজেকে ছোটো করে, ছোটো করে তার আত্মীয় পরিজনকে। সেখানে সবাই পরিহাস করে তার পৌরুষকে, তার ভাগ্যে জোটে পীড়ন, কখনো মৃত্যু: অনেক সময় সে নিৰ্বাসিত হয় গ্রাম থেকে, যেখানে সে আর ফিরে আসতে পারে না। [দ্র স্যানডে (১৯৮৬, ৮৪)]। কিছু সমাজ ধর্ষণপ্রবণ, যেমন বাঙলাদেশ। কোন সমাজ উৎসাহিত করে ধর্ষণ? যে-সমাজ বিশৃঙ্খল, যে-সমাজে মৌলবাদের বিকাশ ঘটছে কিন্তু মৌলবাদী কঠোরতা নেই, যে-সমাজ পুরুষাধিপত্যবাদী, যে-সমাজে কারোই নিরাপত্তা নেই, আর নারী যেহেতু সমাজে সবচেয়ে অসহায়, তাই সেখানে ধর্ষণ প্রকটরূপে দেখা দেয়। বাঙলাদেশে মাস্তান ছাড়া সবাই অসহায়; তাই বাঙলাদেশ হয়ে উঠেছে ধর্ষণের লীলাভূমি। ম্যালিনোস্কি বলেছেন, ‘কাম, বিস্তৃততম অর্থে, শুধু দুটি মানুষের শারীর সম্পর্ক নয়, এটা এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।’ নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন নারীপুরুষের লৈঙ্গিক পার্থক্যের পেছনে প্রাকৃতিক যে-ভিত্তিই থাকুক-না-কেনো, নারী আর পুরুষ, কাম আর সন্তান উৎপাদন সাংস্কৃতিক ব্যাপার [দ্র স্যানডে (১৯৮৬, ৮৪); } বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধর্ষণের ব্যাপার দেখে এ-মতটিকেই মেনে নিতে হয়। পুরুষ জন্মসূত্রেই পাশবিক বা ধর্ষণপ্রবণ এটা কোনো কাজের কথা নয়; মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে ধর্ষণের ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যায় না। কামের জৈবিক ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে, তবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধর্ষণের ঘটনার যে ভিন্নতা দেখা যায়, তাতে এটা স্পষ্ট যে সংস্কৃতি মানুষের কামপ্রবৃত্তিকে প্রবলভাবেই চালিত করে। ধর্ষণ পুরুষাধিপত্যের সামাজিক ভাবাদর্শেরই প্ৰকাশ। ধর্ষণপ্রবণ সমাজে নারীর ক্ষমতা আর আধিপত্য নেই, নারী সেখানে কোনো সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারে না-যদিও কোনো নারী হঠাৎ সরকারপ্রধান হয়ে যেতে পারে; সেখানকার পুরুষেরা ঘৃণা করে নারীর সিদ্ধান্ত। ধর্ষণপ্রবণ সমাজে পৌরুষ বলতে বোঝানো হয় হিংস্ৰতা আর কঠোরতা। বাঙলাদেশ এমনই এক সমাজ।

জীববিজ্ঞানীরা বিবর্তনবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করেন ধর্ষণ ব্যাপারটিকে দ্ৰ থর্নহিল। ও অন্যান্য (১৯৮৬)]। তাদের মতে ধর্ষণ পুরুষের এমন আচরণ, যা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিবর্তনতত্ত্বের বিরোধী। তবে তাঁরা মনে করেন ধর্ষণ হয়তো বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ শর্তনির্ভর এক আচরণ। এ-মত অনুসারে ধর্ষণে লিপ্ত হয় সে-পুরুষেরাই, যারা কাঙ্খিত সঙ্গিনীকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় বার্থ, যারা প্রয়োজনীয় সম্পদ আর মর্যাদায় অধিকারী নয়। এ-মতের ভিত্তি হচ্ছে বলপ্রয়োগে সঙ্গমের তুলনামূলক জীববিজ্ঞান। জীববিজ্ঞানীরা প্যানোর্পা প্রজাতির বৃশ্চিকমক্ষিকার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে কীভাবে বলপ্রয়োগে সঙ্গমের উদ্ভব ঘটেছে, সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌচেছেন। ব্যাপারটি এমন। পুরুষ প্যানোেপা ক’রে থাকে তিন রকম যৌন আচরণ। প্রথম আচরণ দুটি বেশ মধুর, বেশ সফল পুরুষের আচরণ; এ-ক্ষেত্রে পুরুষ প্যানোর্পা বিনামূল্যে কাম চরিতার্থ করতে চায় না; সে সঙ্গম চায় খাদ্যের বিনিময়ে-সে। সঙ্গমের আগে নারী প্যানোর্পার সামনে খাবার রাখে; নারী প্যানোপটি যখন খাবার খেতে থাকে, তখন পুরুষটি সঙ্গমের কাজ সম্পন্ন করে। তৃতীয় আচরণটি হচ্ছে সবল সঙ্গম বা বলাৎকার বা ধর্ষণ। এ-ক্ষেত্রে পুরুষ প্যানোৰ্পা নারী প্যানোর্পকে কোনো সঙ্গমপূর্ব খাবার দিতে পারে না, তাই নারী প্যানোর্পাকে সে আকৃষ্ট করতে পারে না। নারী প্যানোর্প তার আবেদনে সম্মত হয় না। ব’লে সে বলপ্রয়োগ করে; পাশ দিয়ে কোনো নারী প্যানোৰ্পা যাচ্ছে দেখলেই পুরুষ প্যানোর্প তার দিকে ছুটে যায়, নিজের নমনীয় তলপেট বাড়িয়ে দেয়। যদি সে নারীটির একটি পা বা পাখা আটকে ধরতে পারে, তবে সে নারী প্যানোপটিকে স্থাপন করে নিজের জন্যে সুবিধাজনকভাবে, বলপ্রয়োগে কাবু ক’রে ফেলে নারী প্যানোপটিকে, এবং শক্ত ক’রে ধীরে সঙ্গমের কাজ সম্পন্ন করে। পুরো কাজের সময় সে নারী প্যানোপটিকে শক্তভাবে ধ’রে রাখে। পুরুষ প্যানোর্পাের। এ-বলাৎকারকে কিছুতেই অস্বাভাবিক বা বিকৃত আচরণ বলা যায় না;–প্যানোপদের সমাজ রাষ্ট্র সভ্যতা বিজ্ঞান দর্শন মনোবিজ্ঞান নেই। কিছু কিছু পুরুষ প্যানোর্পার মধ্যে এ-ধরনের আচরণের বিকাশ ঘটেছে বিবর্তনের ফলেই।

নারী প্যানোর্পার আচরণও লক্ষ্য করার মতো;–যে-পুরুষ প্যানোর্পা তাকে সঙ্গমপূর্ব দেনমোহর বা খাবার দিতে পারে, তার সাথে নারী প্যানোর্পা বেশ মধুর আচরণ করে; আর যে-পুরুষ প্যানোেপা সঙ্গমপূর্ব খাবার দিতে পারে না, তাকে সে নিজের কাছে ঘেষতে দেয় না, তার কাছ থেকে সে দ্রুত পালিয়ে বাঁচে; এমন গরিব পুরুষ প্যানোর্পা তাকে ধ’রে ফেললে সে তার কবল থেকে নিজেকে মুও করার জন্যে লড়াই করে; কিন্তু সম্পদশালী পুরুষ প্যানোেপা সঙ্গম করতে চাইলে সে বাধা দেয় না। নারী প্যানোর্পার সাথে সঙ্গমের জন্যে পুরুষ প্যানোর্পা কৌশল তিনটির কোনটি প্রয়োগ করবে, তা নির্ভর করে খাবারের সুলভতা-দুর্লভতর ওপর। এগুলোর খাদ্য হচ্ছে মরা সন্ধিপদী পতঙ্গ। সঙ্গমের অধিকার লাভের জন্যে পুরুষ প্যানোর্পা প্রথম যে-কৌশলটি প্রয়োগ করে, সেটিই শ্রেষ্ঠ কৌশল;-সে নারী প্যানোর্পার সামনে মরা পতঙ্গ নিবেদন করে। মরা পতঙ্গের অভাবে সে বেছে নেয়। দ্বিতীয় কৌশলটি;—সে নারীটিকে নিবেদন করে নিজের ভেতর থেকে নিঃসৃত লালা। কিন্তু লালাও যদি সে দেনমোহর হিশেবে দিতে না পারে, তখন বেছে নেয়। চরম কৌশলটি-সে নারী প্যানোর্পাটিকে জোর ক’রে ধীরে সঙ্গম করে। পুরুষ প্যানোর্পাের দেহের আকৃতিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বড়ো আকারের পুরুষ প্যানোর্প সাধারণত খাবার বা লালা নিবেদন করতে পারে, তাই তার বলাৎকার করার দরকার পড়ে না; বলাৎকার সাধারণত ক’রে থাকে ছোটো আকারের পুরুষ প্যানোর্পা।

পুরুষ প্যানোৰ্পা সঙ্গমের কোন পদ্ধতি গ্ৰহণ করবে, তা নির্ভর করে তার যোগ্যতার ওপর; আর তার যোগ্যতার বিচারক হচ্ছে নারী প্যানোর্পা। নারী প্যানোর্পার কাছে সে-পুরুষ প্যানোর্পাই সবচেয়ে যোগ্য, যে খাবার হিশেবে মরা পতঙ্গ সরবরাহ করতে পারে। যে-পুরুষ প্যানোর্পা লালা নিবেদন করে, আর যে-পুরুষ প্যানোর্পা মরা পতঙ্গ নিবেদন করে, তাদের মধ্যে পতঙ্গশালী প্যানোৰ্পাের সাথেই সে সঙ্গমে সম্মত হয়। যে খাবার বা লালা কিছুই যোগাতে পারে না, শুধু জোর করে সঙ্গম করতে চায়, এমন পুরুষের সাথে সে মিলতেই রাজি হয় না; তার উদ্যোগকে সে সব শক্তি দিয়ে বাধা দেয়। পুরুষ প্যানোর্পাের বলপ্রয়োগে সঙ্গম নারী প্যানোর্পাের পছন্দ নয়; শুধু জোর করেই পুরুষ প্যানোেপা নারী প্যানোর্পার ওপর এমন কাজ সম্পন্ন করে।

সঙ্গমের অধিকার লাভের জন্যে পুরুষ প্যানোর্পাের যে-প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যায়, তার প্রকৃতি দেখে সিদ্ধান্তে পোঁছানো সম্ভব যে যেখানে সঙ্গমের সঙ্গিনী লাভ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে একটি বিকল্প আচরণ রূপে বিকশিত হতে পারে বলপ্রয়োগে সঙ্গম। যখন নারী তার সঙ্গী বেছে নেয়। পুরুষের সম্পদ ও মর্যাদা অনুসারে, আর পুরুষদের মধ্যে একদল থাকে সম্পদশালী ও মর্যাদাসম্পন্ন, এবং আরেকদল থাকে সম্পদ ও মর্যাদাহীন, তখন সম্পদ আর মর্যাদাহীনেরা ধর্ষণকেই বেছে নিতে পারে কার্যকর বিকল্পরূপে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্যানোর্পার আচরণ থেকে আহরিত এ-সিদ্ধান্ত মানুষের ক্ষেত্রে প্ৰেযোজ্য কি না? আমরা কি বলবো যেহেতু কিছু কিছু আমনুষ্য প্রাণীর পুরুষেরা বিশেষ কারণে বলপ্রয়োগে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, তাই মনুষ্য পুরুষেরাও লিপ্ত হবে বলাৎকারে? আমরা কি বলবো যে বিবর্তনের ফলে যেমন প্যানোর্পার মধ্যে একটি বিকল্প আচরণ হিশেবে দেখা দিয়েছে বলপ্রয়োগে সঙ্গম, একইভাবে বিবর্তনের ফলেই মানুষ পুরুষের মধ্যে বিকশিত হয়েছে বলাৎকার বা ধর্ষণ প্যানোর্পার আচরণ দিয়ে আমরা মানুষের আচরণকে গ্রহণযোগ্য করতে পারি না।

তবে বহুপত্নীক বিবাহসংশ্রয়ে যেখানে পুরুষদের মধ্যে রয়েছে যৌন প্রতিযোগিতা, সেখানে বিবর্তনমূলক নির্বাচন কীভাবে কাজ করতে পারে, তা খুঁজে দেখতে পারি। বিয়ে করা তো আসলে কামপ্রতিযোগিতা। বহুপত্নীক বিবাহ এমন সংশ্রয়, যাতে কম সংখ্যক পুরুষ যৌন সম্পর্কে মিলিত হতে পারে বহুসংখ্যক নারীর সাথে। এ-পদ্ধতিতে পুরুষদের মধ্যে চলে সাফল্যের প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা, কেননা সফল পুরুষেরাই শুধু লাভ করতে পারে। কাম্য-সুন্দরী স্বাস্থ্যুবতী আবেদনময়ী-নারী। সফল পুরুষেরা আকর্ষণীয় নারীর কাছে। মানুষ প্রজাতির মধ্যে পুরুষের বহুপত্নীত্বের ব্যাপারটি অনেকটা বিবর্তনের ফলেই উদ্ভূত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন [দ্র থর্নহিল ও অন্যান্য (১৯৮৬, ১১০-১১১)]। অনেক সমাজে হারেমে বহুপত্নী রাখা অনুমোদিত। এমন সমাজে কিছু পুরুষ বহু নারীর সাথে মিলিত হয়, অধিকাংশ পুরুষ এক সময়ে এক নারীর সাথে মিলিত হয়, আর বহু পুরুষ কোনো নারীর সাথেই মিলনের সুযোগ পায় না। সব সমাজেই কমবেশি বহুপত্নীকতা রয়েছে। মানব সমাজের এ-বহুপত্নীকতা প্ৰত্যক্ষভাবে নারী লাভের জন্যে সৃষ্টি করে পুরুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, আর পরোক্ষভাবে সৃষ্টি করে ধন ও মর্যাদা লাভের প্রতিযোগিতা। ধন ও মর্যাদা পিতৃতন্ত্রের নারীর কাছে খুবই আকর্ষণীয়।

ধর্ষণ হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক বলপ্রয়োগে নারীসঙ্গম। বলপ্রয়োগে সঙ্গম হচ্ছে সে-সঙ্গম, যাতে নারীর স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন সম্মতি নেই। এতে সব সময় বলপ্রয়োগের দরকার পড়ে না। ধর্ষণ পুরুষের এমন আচরণ, যা নারীকে তার সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার দেয় না। বিবর্তনবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ তখনই সংঘটিত হয়, যখন পুরুষ নারীর পছন্দকে বিপর্যস্ত ক’রে বলপ্রয়োগে তার সাথে সঙ্গম করে। এটা নারীর দুটি বিবর্তনমূলক স্বার্থ ক্ষুন্ন করে : নারীর যৌনসঙ্গী বাছাইয়ের অধিকার নষ্ট করে, আর ধন ও মর্যাদার বিনিময়ে নিজের শরীর দানের অধিকারকে অস্বীকার করে। থর্নহিল ও অন্যান্য (১৯৮৬) সিদ্ধান্তে পৌচেছেন যে বিবর্তনের একটি পরিণতিরূপেই বিকাশ ঘটেছে ধর্ষণের। তারা নারীবাদীদের ধর্ষণতত্ত্বকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তাদের মতে পুরুষাধিপত্যই যদি থাকতো ধর্ষণের মূলে, তাহলে পুরুষ ক্ষমতাশালী বয়স্ক নারীদের ধর্ষণ করতো; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ধর্ষণকারীদের লক্ষ্য সাধারণত যুবতী ও দরিদ্র নারী। তাদের মতে নারীবাদীদের তত্ত্ব জ্ঞাপন করে যে সব শ্রেণী ও বয়সের পুরুষেরাই ধর্ষণকারী; তাও সত্যু নয়; ধর্ষণকারীরা সাধারণত তরুণ ও দরিদ্র।

জীববিজ্ঞানীদের ধর্ষণতত্ত্বে বেশ সত্য রয়েছে, যাকে বলতে পারি জীবতাত্ত্বিক সত্য; নারীবাদীদের তত্ত্বে রয়েছে সামাজিকসাংস্কৃতিক সত্য, যা, বিবর্তনের বর্তমান পর্যায়ে, জীববৈজ্ঞানিক সত্যের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জীববিজ্ঞানেব সূত্রে দাবি করতে পারি যে হত্যা, স্বৈচারাচার, পীড়ন, লুণ্ঠন, শোষণ প্রভৃতি প্রবণতা উদ্ভূত হয়েছে বিবর্তনের ফলেই; তবে বিবর্তনের সূত্রের সাহায্যে সামাজিকসাংকৃতিক অন্যায়কে বিধানসম্মত করা যায় না। মানুষ প্যানোর্পা নয়, মানুষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রাণী; এবং মানুষের বর্তমান পর্যায়ে কেউ অন্য কারো ওপর আধিপত্য করার অধিকার রাখে না। পুরুষের ধর্ষণের প্রবণতা রয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই; না থাকলে পুরুষ ধর্ষণ করতো না; কিন্তু ধর্ষণে তাকে উৎসাহ দেয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। ধর্ষণরোধের উপায় হচ্ছে সমাজরাষ্ট্রের সব এলাকায় নারীর প্রতিষ্ঠা, পুরুষের সমান প্রতিষ্ঠা; তবে তাতেও হয়তো ধর্ষণ লুপ্ত হবে না। ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্যে নারীকে হয়ে উঠতে হবে পুরুষের সমকক্ষ–ঘরে ও বাইরে, এবং শারীরিক শক্তিতে।
 
মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ : অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু



মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ (১৭৫৯-১৭৯৭) চোখে জাগিয়ে তোলেন দুটি আপাতবিষম সুন্দর ভয়াবহ চিত্ৰকল্প : অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দুর। মনে হয় কোথাও গভীর মিল রয়েছে অগ্নি ও অশুর, অন্তত মেরি মিলিয়ে দিয়েছিলেন দুটিকে আগুন তার মধ্যে অশ্রু হয়ে টলমল ক’রে উঠতে পারতো, আবার অশ্রু হয়ে উঠতে পারতো লেলিহান অগ্নিশিখা ৷ মেরি, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, ১৭৯১-এ বত্ৰিশ বছরের তরুণী; মাত্র ছ-সপ্তাহে লেখেন তার তেরো পরিচ্ছেদের ভয়ঙ্কর বইটি : ‘ভিডিকেশন অফ দি ব্লাইটস্ অফ ওম্যান : উইথ স্ট্রিকচার্স অন পলিটিকেল অ্যান্ড মোরাল সাবজেক্টস্’ বেরোয় ১৭৯২-এ; দু-শো বছর আগে; ভাবতে ভালো লাগছে, শিহরণ বোধ করছি এজন্যে যে বাঙলা ভাষায়, পৃথিবীর এক অন্ধকার এলাকায়, একা পালন করছি বইটির দ্বিশতবার্ষিকী! বইটি নারীবাদের প্রথম মহাঘোষণা; মানুষের লেখা সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক, বিখ্যাত ও আপত্তিকর বইগুলোর একটি তার ভিন্ডিকেশন । বইটি প্রকাশের পর পিতৃতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম বিপ্লবী নারী, তেত্রিশ বছরের মেরি পান প্রগতিশীলদের অভিনন্দন ও প্রশংসা, কিন্তু নিন্দাই জোটে বেশি। নিন্দই ছিলো তার স্বাভাবিক প্রাপ্য, তখন পৃথিবী জুড়েই ছিলো তাঁর শত্রুরা, আজো তারা আছে; তাই ওই বই লিখে সকলের চোখের মণি হয়ে উঠবেন তিনি, তা আশা করতে পারি না, মেরিও করেন নি। তিনি পান তার পুরস্কার : রক্ষণশীল পুরুষতািন্ত্র ক্ষেপে ওঠে, তাঁর নাম অভিন্ন হয়ে ওঠে অনাচারের সাথে; রক্ষণশীলদের কাছে মেরি হয়ে ওঠেন নিষিদ্ধ ঘূণ্য নাম । তবে তিনি ঘূণাই শুধু পান নি, পেয়েছেন অনুরাগও। টমাস কুপার উল্লসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এবার পুরুষতন্ত্রের সমর্থকদের বলো (যদি পারে) নারী-আধিকার-এর উত্তর দিতে।’ মেতে ওঠে রক্ষণশীলেরা, অশ্লীল গালাগালিতে ভূ’রে ফেলে চারপাশ: হোরেস ওয়ালপোল মেরিকে বলেন ‘পেটিকোটপরা হয়েনা; আরেকজন বলে ‘দার্শনিকতাকারিণী সপিণী।’ ইত্যাদি । মেরি তাদের চোখে হয়ে ওঠেন অশুভর নারীমূর্তি। তার নিন্দুকেরা শুধু তখনই ছিলো না, ছিলো। উনিশ শতকে, বিশশতকের অর্ধেক ভ’রে তাবা ছিলো, আছে আজো । ফ্রয়েভীয়দের চোখে মেরি এক খোজাগৃঢ়ৈষ্যারুগ্ন। শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত নারী, যে নারীবাদ নামের নষ্টের মূলে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত নারীবাদীরাও সংকোচ করতো তার নাম নিতে, ভয়ে কুঁকড়ে যেতো একথা ভেবে যে মেরির নাম নিলে পুরুষতন্ত্র ক্ষেপে উঠবে, তাদের কোনো দাবি পূরণ হবে না। মেরি সমস্ত ‘সদগুণের বিনাশকারিণী, তাঁর নাম নিলে হানি ঘটবে সতীত্বের। কিন্তু জয় হয়েছে মেরিরাই, যিনি বত্ৰিশ বছরে লিখেছিলেন একটি বিপজ্জনক বই, এবং অশুর মতো মিলিয়ে গিয়েছিলেন মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। মেরি আবার ফিরে এসেছেন, তাঁর নাম এখন পাচ্ছে নারীবাদী সন্তের মহিমা; মার্ক্স যেমন সমাজতন্ত্রের মেরি তেমনই নারীবাদের। তাঁর সমাধিতে মৃত্যুর একশো একষট্টি বছর পর দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে অৰ্পিত হয়েছে পুষ্পার্ঘ্য।

নারীবাদের প্রথম মহান নারী মেরি ছিলেন অগ্নি ও অশ্রুর সমবায়; তাঁর জীবন ছিলো যেমন লেলিহান, তেমনই কোমলকাতর; তার সমাপ্তি ঘটেছিলো বিষন্ন আর্ত চিৎকারে। তিনি বেঁচে ছিলেন অন্যদের সময়ে, বেশি দিন বাঁচেন নি; কিন্তু তাঁর বই পড়লে, মধুর মুখচ্ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয় মেরি বেঁচে আছেন: এবং রক্ষণশীলদের সাথে ক’রে চলছেন নিরন্তর বোঝাপড়া। ১৭৫৯-এ লন্ডনের বাইরে এপিং বনের কাছাকাছি এক গরিব চাষীপরিবারে জন্ম হয় মেরির। মেরি ছিলেন প্ৰথম সন্তান। তার বাবা অ্যাডওয়ার্ড ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ তখন অপচয় ক’রে ক’রে নিঃস্ব, সংসােরও চালাতে পারছিলো না। মেরির পরে ওই পরিবারে জন্মে আরো তিনটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। তার বাবা জীবিকার সন্ধানে সপরিবার ঘোরে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের নানা স্থানে, কিন্তু কখনো সচ্ছলতা পায় নি। তার বাবা ছিলো রাগী, অত্যাচারী; মা ছিলো ভীরু। মেরি বাল্যকাল থেকেই বেড়ে ওঠেন দায়িত্বশীল মেয়েরূপে, এবং মেনে নিতে পারেন নি বাবার স্বৈরাচার। বাবা তার মাকে মারতো মাঝেমাঝেই, আর মেরি মাকে বাচানোর জন্যে ঝাপিয়ে পড়তেন। বাবামা দুজনের মাঝখানে। মেরি বলেছেন, তার বাবা ছিলো স্বৈরাচারী, মা স্বৈরাচারের স্বেচ্ছশিকার। তার মায়ের চরিত্রে প্রতিবাদের এক কণাও ছিলো না; এবং তার মা মেয়েদের তুচ্ছ গণ্য ক’রে মনে করতো একদিন বড়ো ছেলেটিই উদ্ধার করবে। তাকে। পরে দেখা যায় ছেলে মায়ের দিকে তাকায়ও নি, মেরিই সাহায্য করেছেন মাকে।

গরিব চাষীপরিবারের মেয়ে মেরি বেড়ে ওঠেন খ’মারে খামারে; মধ্যবিত্ত মেয়েদের সুবিধা যেমন পান নি। তিনি, তেমনই পান নি তাদের সীমাবদ্ধতাগুলো। মেরি খেলাধুলো কবতেন ভাইদের সাথে, যা তাকে ভিন্নভাবে বিকশিত করেছিলো; মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নিরর্থক অর্জনগুলো তাকে আয়ত্ত করতে হয় নি। বাসায় লেখাপড়ার সুযোগ ছিলো না, তবু তিনি লেখাপড়া শেখেন নিজের চেষ্টায়। বাল্য থেকেই তাঁর সাধনা ছিলো স্বাধীন স্বাবলম্বী হওয়ার, মেয়েমানুষের পুরুষনির্ধারিত ভূমিকায় তিনি বন্দী থাকতে চান নি। উনিশ বছর বয়সে, ১৭৭৮-এ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন মেরি স্বাধীন জীবিকার খোঁজে, যা সে-সময় ছিলো দুঃসাধ্য। নানা পেশা গ্ৰহণ করেন তিনি, যার কোনোটিই খুব ভালো ছিলো না। প্রথম তিনি নেন এক ধনী বিধবার সহচরীর কাজ, বইতে শুরু করেন পরিবারের দায়িত্ব। তিনি ভার নেন ভাইবোনদের শিক্ষার, পালন করেন অভিভাবকের দায়িত্ব। ১৭৮৩তে তিনি আর্থিক স্বায়ত্তশাসনের জন্যে নেন একটি বিশেষ উদ্যোগ; বান্ধবী ফ্যানি ব্লাড ও বোনদের নিয়ে লন্ডনের নিউইংটন গ্রিনে স্থাপন করেন বিদ্যালয়। তখন নিউইংটন ছিলো ডিসেন্টার, উদারনীতিক বুদ্ধিজীবী ও যাজকদের আবাসিক এলাকা; তাই সেটি ছিলো মেরির মতো স্বাধীনচেতা নারীর উপযুক্ত বাসস্থল। ওই এলাকায় বাস করতেন সংসদসংস্কারপন্থী জেমস বার্গ, বিপ্লববাদী যাজক রিচার্ড প্রাইস। মেরি আর্থিক স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করছিলেন ব’লে তারা সবাই উৎসাহ দিতেন মেরিকে।

মেরি বাল্যকাল থেকে বিরোধী ছিলেন পিতার স্বেচ্ছাচারিতার, নিউইংটনে উদারনীতিক বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে তিনি বিরোধী হয়ে ওঠেন সব ধরনের স্বেচ্ছাচারী শক্তির। তাঁর বিদ্যালয় সফল হয় নি; এবং নানা সংকটে জীবন ভরে ওঠে মেরির। নিউইংটনেই একজন তাকে পরামর্শ দেয় লিখে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করার, যা সে-সময়ে কোনো নারীর জন্যে ছিলো অসাধ্য পেশা। কিন্তু মেরির কাছে অসাধ্য ব’লে কিছু ছিলো না। কী নিয়ে লিখবেন তিনি? তিনি বিদ্যালয় খুলেছিলেন বালিকাদের জন্যে, তাই শিক্ষা সম্পর্কে লেখাই ছিলো তার জন্যে সবচেয়ে সহজ। ১৭৮৭তে। মেরি লেখেন প্রথম বই কন্যাদের শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তা। এ-বইতে তিনি প্রথার বিরুদ্ধে যান নি, খ্রিস্টানরা নারীদের জন্যে যে-ভূমিকা ও অবস্থান ঠিক ক’রে রেখেছিলো, তাই মেনে নেন। তিনি; কিন্তু ভিভিকেশন-এ আর মানেন নি। এ-বই থেকে আয় হয় দশ গিনি। তখন তাঁর নিজের অর্থাভাবের শেষ ছিলো না, তবু ওই টাকাটা তিনি দিয়ে দেন মৃত বান্ধবীর পরিবারকে, কেননা তাদের খুব দরকার। কিছুতেই আর্থস্বনির্ভরতা অর্জন করতে না পেরে ১৭৮৬তে মেরি নেন একটি হীন চাকুরি। তিনি নেন আয়ারল্যান্ডের লেডি কিংসবরোর গভর্নেসের কাজ। এখানেই পরিচিত হন তিনি উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিলাসবহুল অবসর ভরপুর অকৰ্মণ্য জীবনের সাথে, যে-জীবনকে মেরি ঘেন্না করেছেন অন্তর থেকে। তিনি দেখেন উচ্চবিত্ত নারীদের জীবন কাটে কী অসার বিলাসের মধ্যে, কীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। তাদের চরিত্রের বিকাশ। পরে মেরি এদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কথা বলেছেন, উদ্ধার অযোগ্য বলে ঘোষণা ক’রে বিলোপ কামনা করেছেন এদের। সুখের বিষয় গভর্নেসের কাজে মেরির বেশি দিন থাকতে হয় নি।

মেরি যোগাযোগ করেন তাঁর উদারনীতিক প্রকাশক জোসেফ জনসনের সাথে, জানান নিজের পরিকল্পনা। জনসন মেরিকে ফিরে আসতে বলেন লন্ডনে, তার বই প্রকাশ করবেন ব’লেও প্রতিশ্রুতি দেন। মেরি ১৭৮৭তে ফেরেন লন্ডনে; লেখেন তাঁর প্রথম উপন্যাস : মেরি (১৭৮৮)। মোর বেশ ভাবাবেগপূর্ণ উপন্যাস, যাতে স্থান পায় তাঁরই দুঃখকষ্টপূর্ণ জীবন। এটি এমন এক তরুণীর কাহিনী, যে প্রতিবেশের চাপ অগ্রাহ্য ক’রে করছে নানা ভালো কাজ। লন্ডনে ফিরে মেরি মুক্তি পান আয়ারল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের অন্তঃসারশূন্যতা থেকে, এবং পান নিজেকে বিকশিত করার মতো চমৎকার মননশীল পরিবেশ। প্ৰকাশক জনসনের দোকানের ওপরের তলায় তখন মিলিত হতেন

পেইন প্রমুখ উদারনীতিক বুদ্ধিজীবী। মেরি পান তাদের সঙ্গ। তিনি নেন লেখকের জীবিকা, নিজেকে বলেন ‘এক নতুন প্ৰজাতির প্রথম’; কেননা তখনো লেখা কোনো নারীর জীবিকা হয়ে ওঠে নি। মেরিই প্রথম নারী, যিনি লেখাকে করেন জীবিকা।

এ-অভিনব পেশা গ্রহণের পর মেরির জীবন হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ কর্মের ও লক্ষ্যের; তবে মেরি ছিলেন এমন তরুণী, যার মস্তিষ্কটি ছিলো মেধাবী, হৃদয়টি রোম্যান্টিক। তিনি মন দেন লেখায় এবং লেখায়, খুব দ্রুত লেখায়। তিনি কতোটা দ্রুত লিখতে পারতেন, তার পরিচয় বহন করছে ভিন্ডিকেশন, যা লিখতে আজ যে-কেউ বছরখানের সময় নেবে, তিনি নিয়েছিলেন মাত্র ছ-সপ্তাহে। রূপসী ছিলেন মেরি, কিন্তু সাজগোজ পছন্দ করতেন না; তার বাসায় বিশেষ আসবাবপত্রও ছিলো না। ফরাশি নেতা ট্যালিরাদ তাঁর বাসায় এলে তিনি তাকে ভাঙা পেয়ালায় চা খেতে দিয়েছিলেন। টাকা তার সহজ আয়ের জিনিশ ছিলো না, তাই অপচয়ের জিনিশাও ছিলো না। মেরি লিখতে আর অনুবাদ করতে থাকেন জনসনের অ্যানালিটিকেল রিভিউর জন্যে, ক্রমশ বিশ্বাস অর্জন করতে থাকেন নিজের সামাজিক রাজনীতিক নান্দনিক বোধ সম্পর্কে। তিনি পুস্তক সমালোচনা লিখে লিখে তৈরি করতে থাকেন নিজের দৃঢ় ভিত্তি। তখনকার লন্ডনের রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রধান বার্ক দু-হাতে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলেন সব বিপ্লব ও সামাজিক পরিবর্তন। ফরাশি বিপ্লবের বিরুদ্ধে তিনি লেখেন রিফ্লেকশনস অন দি ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন। মেরি এর উত্তরে লেখেন এ ভিন্ডিকেশন অফ দি স্নাইটুস অফ মেন (১৭৯০); নারী-অধিকার প্রতিপাদনের আগে মেরি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন মানুষের অধিকার। এ-বইতে মেরি আক্রমণ করেন। রক্ষণশীলতাকে, ব্যাক্ত করেন মানুষ, সমাজব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে তার প্রগতিশীল বক্তব্য; দাবি করেন যে নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা মানুষের জন্মাধিকার, শুধু স্বৈরাচারই মানুষকে বঞ্চিত করে এসব অধিকার থেকে। বার্ক যাদের সেবক, সে-অভিজাতদের তিনি বলেন ‘উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত নপুংসকতা দ্বারা খাসি করা পদাধিকারী উড়নচন্তী লম্পট’। মেরি চরম প্রতিপক্ষ ছিলেন উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত শক্তিমান ও ধন্যবানদের।

মানুষের অধিকার দাবির এক বছর পর, ১৭৯১-এ, মেরি দাবি করেন নারীর অধিকার; লেখেন ভিডিকেশন। জোসেফ জনসন বইটি প্রকাশ করেন। ১৭৯২-এ। প্রথম সংস্করণে মুদ্রণক্রটি ছিলো অনেক, তাই মেরি ওই বছরই বের করেন। দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ, এবং এটিই গৃহীত বইটির শুদ্ধ সংস্করণ রূপে। মেরির বইটিই অকাট্য নীতিপ্ৰণালিভিত্তিক নারীমুক্তির প্রথম সুপরিকল্পিত প্ৰস্তাব, ইশতেহার, ঘোষণা; নারীবাদের আদিগ্রন্থ। বিপ্লবকে কাছে থেকে দেখার জন্যে ১৭৯২-এ মেরি যান ফ্রান্সে। এর মাঝে বেরিয়েছে। বইটির ফরাশি সংস্করণ, তাই মেরি সেখানে হয়ে উঠেছেন খ্যাতিমান। তিনি সেখানে গৃহীত হন সাহিত্যিক ও রাজনীতিক লেখকদের এক আন্তর্জাতিক সংঘে, যাতে ছিলেন হেলেন মারিয়া উইলিয়ামস, জোয়েল বারলো, ফরাশি বিপ্লবী ব্রিসো, এবং মানুষের মুক্তির মহাপ্রবক্তা টমাস পেইন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ফরাসি নেতা ট্যালিবাঁদের নামে, আশা করেছিলেন নারীশিক্ষা সম্পর্কে আইনপ্রণয়নে ট্যালিরাঁদ প্রভাবিত করবেন সংসদকে। তার আশা পর্যবসিত হয় হতাশায়। বিপ্লবীরাও বিশ্বাস করে নারী-অধীনতায়। ব্যর্থ হয়ে যায় ফরাশি বিপ্লব, খুশি হয় বার্কেরা; তবু মেরি লেখেন অ্যান হিষ্টিকেল অ্যান্ড মোরাল ভিউ অফ দি অরিজিন অ্যান্ড প্রোগ্রেস অফ দি ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন (১৭৯৪)। তিনি হতাশ হন, তবু জনগণের ওপর বিশ্বাস হারান না।

প্যারিসে মেরির পরিচয় হয় গিলবার্ট এমলের সাথে। সে মার্কিন, একটি ভাবালু উপন্যাসের লেখক, তবে ব্যবসায়ী। তার সাথে পরিচয়ই মেরির জীবনের প্রধান দুর্ঘটনা। মেরি তার প্রেমে পড়েন, কিন্তু এমলে আকর্ষণ বোধ করে মেরির দেহের প্রতি। তারা তিন বছর একত্র বাস করেন, বিয়েতে বিশ্বাসহীন মেরি বিয়ে করতে চাইলেও বিয়ে তাদের হয় নি। তাদের একটি মেয়ে (মে ১৭৯৪) হয়, নাম ফ্যানি এমলে। এর পর এমলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মেরির কাছে থেকে; আর মেরি মেয়ে নিয়ে ছোটেন এমলের পেছনে পেছনে, প্যারিস থেকে লা। হাভারে, লন্ডনে, আবার প্যারিসে। এমলে ছুটতে থাকে টাকা আর অন্য নারীর পেছনে। ১৭৯৫-এ মেরি মেয়ে আর একটি পরিচারিকা নিয়ে যান স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়। সেখানে পালন করেন এক অদ্ভুত দায়িত্ব, করেন এমলের ব্যবসাপ্রতিনিধির কাজ। সেখানে থাকার সময় মেরি এক কল্পিত অনুপস্থিত প্রেমিকের উদ্দেশে পত্রাকারে লেখেন জার্নাল: কয়েক মাস পরে তা বেরোয় লেটার্স রিটেন ডিউরিং এ শার্ট রেসিডেন্স ইন সুইডেন, নরওয়ে অ্যান্ড ডেনমাক (১৭৯৬) নামে। তাঁর জীবনের চরম সংকটকালে লেখা এ-চিঠিগুলো বিস্ময়করভাবে প্রশান্ত, কাব্যিক, এবং সমাজসমালোচনামুখর। লন্ডনে ফিরে মেরি দেখেন এমলে বাস করতে শুরু করেছে একটি অভিনেত্রীর সাথে। ক্লান্ত কাতর মেরির কাছে জীবন হয়ে ওঠে দুৰ্বহী; একরাতে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন টেমস নদীতে। কিন্তু ব্যর্থ হন আত্মহত্যায়। যে-প্রেমের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন মেরি ভিন্ডিকেশন-এ, তার প্ররোচনায়ই নারীবাদের মহাদেবী বেছে নেন আত্মহত্যা।

কিন্তু জীবন তখনো অপেক্ষা ক’রে ছিলো তার জন্যে; মৃত্যু থেকে উঠে এসে মেরি ঢোকেন জীবনে : এনকোয়ারি কনসারনিং পলিটিকেল জাষ্টিস-এর (১৭৯৩) আলোড়নজাগানো লেখক দার্শনিক উইলিয়াম গডউইনের সাথে গ’ড়ে ওঠে তার হৃদয়সম্পর্ক। গডউইনের সাথে সম্পর্কের সময়টা মেরির জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়: ওই দার্শনিক ভালোবেসেছিলেন মেরিকে, ও মেরির লেখাকে। মেরির মৃত্যুর পর তিনিই লিখেছিলেন মেবিন্ন অকপট জীবনী, ও সম্পাদনা করেছিলেন মেরির রচনাবলি; মেরি ও গডউইন কেউই বিশ্বাস করতেন না বিয়েতে: তাদের কাছে বিয়ে ছিলো কৃত্রিম চুক্তি, যা সৎমানুষের জন্যে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তারা, মেরি গর্ভবতী হয়ে পড়লে, বিয়ে করেন। সন্তান প্রসবের জন্যে যখন অপেক্ষা করছিলেন মেরি, তখন তিনি লিখে চলছিলেন রিংস অফ উইমেন (১৭৯৮) নামে একটি উপন্যাস! মেরি যখন সুখী, তখনই পরিহাসের মতো এগিয়ে আসে মৃত্যু। নারীবাদের মহানারী, বিয়েতে অবিশ্বাসী। কিন্তু বিবাহিত, মেরি মৃত্যু বরণ করেন নারীদেরই এক পুরোনো শাস্তিতে; সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মৃত্যু হয় মেরির ১৭৯৭-এর আগস্টে, আটত্রিশ বছর বয়সে। তিনি উপহার দিয়ে যান একটি মেয়ে, যার নাম মেরি গডউইন শেলি : পৃথিবীর বিখ্যাততম গথিক উপন্যাস ফ্ল্যাংকেনস্টাইন-এর লেখিকা, কবি শেলির দ্বিতীয় স্ত্রী।

মেরি ভিডিকেশন লিখেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন পশ্চিমে চলছিলো প্ৰচণ্ড সামাজিক রাজনীতিক ভাঙাগড়া, যখন বিপ্লব ছিলো অধিকাংশের স্বপ্ন। ফ্রান্সে তখন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছিলো সাধারণ মানুষের অধিকার, বিলেতে আমূল্যবাদীদের ভয়ে শংকিত হয়ে পড়ছিলো অভিজাততন্ত্র। ওই আমূল্যবাদেরই এক উৎসারণ মেরির ভিন্ডিকেশন / তারা তখন প্রশ্ন তুলছিলেন সমস্ত প্রচলিত সামাজিক রাজনীতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে অনুপ্রাণিত ছিলেন লক ও রুশোর মত দিয়ে যে রাজা বা অভিজাততন্ত্র ক্ষমতার অধিকারী নয়, সাধারণ মানুষই সাৰ্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। বিলেতে তখন অধিকাংশ মানুষেরই ছিলো না। সাধারণ নাগরিক অধিকার, সব অধিকার ছিলো অভিজাতমগুলির। সেটা টম পেইনের রাইটস্ অফ ম্যান-এর কাল। যে-বোধ থেকে পেইন লিখেছিলেন ব্লাইটুসূ অফ ম্যান, সে-বোধেই মেরি লিখেছিলেন রাইটস্ অফ ওমান! মেরির আগেও কেউ কেউ বলেছেন নারীর ভূমিকা ও অধিকারের কথা, তবে মেরি তাদের মতো ক’রে বলেন নি; মেরি বলেছেন নিজের বিপ্লবী রীতিতে। তিনি কোনো পুরোনো ধারার উত্তরাধিকারী নন, তিনিই স্রষ্টা এক নতুন ধারার, যাকে এক সময় বলা হতো নারীমুক্তি আন্দোলন, এখন বলা হয় নারীবাদ। মেরি নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে তুলে ধরেন। সমগ্র রাজনীতিক ও সামাজিক সংশ্রয়কে, যা নারীপুরুষের জীবনের সাফল্য সম্পর্কে তৈরি করেছে দ্বৈত মানদণ্ড, নারীকে ঠেলে দিয়েছে নিকৃষ্ট অবস্থানে, করেছে। পুরুষাধীন। বিলেতে তখন নারী ছিলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই শোচনীয় অবস্থায়; ধর্ম সমাজ, আইন সব কিছুই নারীকে ক’রে রেখেছিলো। মনুষ্যেতর। গরিব নারীদের শেষ ছিলো না দুৰ্দশার, আর অভিজাত নারীরা জীবন যাপন করছিলো বিলাসী পশুর জীবন। মেরির আগে যারা নারীর অবস্থাবদলের কথা বলেছেন, তারা কেউ নারীর মুক্তির কথা বলেন নি; তারা বলেছেন। পুরুষাধীন থেকে নারীর আরেকটুকু ভালো থাকার কথা। তাঁরা সবাই প্রচার করেছেন যে পুরুষের কাছে মোহনীয়, রমণীয় হওয়াই নারীর সার্থকতা। সে-সমযে, যে-নারীরা কিছুটা মুক্তি’ পেয়েছিলেন, যারা ‘নীলমুজো’ নামে বদনাম অর্জন করেছিলেন, তারাও প্রথাগত ধারণা থেকে দূরে যান নি, তারাও বিশ্বাস করতেন নারীর সহজাত নিকৃষ্টতায়।

এ ভিডিকেশন অফ দি রাইটস্ অফ ওম্যান সুশীল ভদ্ৰবই বা কোনো সুশীলা ভদ্ৰবালার লেখা বই নয়, এটি বিপ্লবীর লেখা বিপ্লবী বই। মেরি চিত্তবিনোদন করতে বা ঘুম পাড়াতে চান নি, চেয়েছেন জাগিয়ে তুলতে। তিনি লিখতে চেয়েছেন উপকারী বই, বলেছেন, ‘আমার লক্ষ্য উপকারে আসা। বইটির প্রতি অনুচ্ছেদে ছড়িয়ে আছে মেরির তীব্র ব্যক্তিত্ব, তার কৌতুক ও ক্ৰোধ জ্বলে উঠেছে বার বার। মেরি নারীর অধিকারের কথা বলেছেন, তবে বলেছেন প্রধানত মধ্যবিত্ত নারীর কথা। উচ্চবিত্ত নারীদের তিনি ঘেন্না ও করুণা করতেন, বিশ্বাস করতেন যে উচ্চবিত্ত শ্রেণীটি লুপ্ত হয়ে যাবে। দারিদ্র্য তার চোখে মহান ছিলো না, দারিদ্র্যের নির্মমতার সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন মেরি; তাই নিম্নবিত্তদের জন্যে তার দরদের অভাব না থাকলেও কীভাবে তাদের সমস্যার সমাধান হবে, তা তিনি বলেন নি। তিনি বলেছেন মধ্যবিত্ত নারীদের কথা, কেননা তারাই রয়েছে ‘স্বাভাবিক অবস্থায়’। মেরি তাঁর বইয়ের শুরুতে, প্রথম তিন পরিচ্ছেদে, প্রতিষ্ঠা করেছেন মৌল নীতিগুলো, যার ওপর ভিত্তি ক’রে তিনি দাবি করেছেন নারীর অধিকার। তারপর তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতিবেশের প্রভাবে বিকৃত হয়েছে নারীরা; দেখিয়েছেন। আঠারোশতকের নারীবিরোধী ধারার কয়েকজনের, বিশেষ ক’রে রুশোর লেখার প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ভ্ৰান্তি। শেষে আলোচনা করেছেন নারীর অবস্থান, শিশুশিক্ষা, পরিবার প্রভৃতি সম্পর্কে।

মেরির লক্ষ্য ছিলো সুস্পষ্ট, বইটির প্রতি পাতায় তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নারীপুরুষের অসাম্য মানুষের তৈরি ব্যাপার। বইয়ের শুরুতে, ভূমিকার প্রথম বাক্যেই মেরি বলেছেন :

‘ইতিহাসেবী পাতা উল্টিয়ে, এবং চাবপাশেব জগতের দিকে উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে আমার চেতনা পীড়িত হয়েছে বেদনার্তা ক্ষোভের সবচেয়ে বিষণু আবেগে, এবং আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। একথা স্বীকার করে যে হয়তো প্রকৃতিই পুরুষ ও নারীর মধ্যে সৃষ্টি করেছে বড়ো বিভেদ, নয়তো পৃথিবীতে এ-পর্যন্ত যে-সভ্যতাব বিকাশ ঘটেছে, তা খুবই পক্ষপাতপূর্ণ।‘

নারীপুরুষের প্রাকৃতিক বিভেদের কথাটা তাঁর নয়, প্রথাগতদের; তিনি বিশ্বাস করেন। যে সভ্যতা একদেশদশী, বিভেদ মানুষেরই সৃষ্টি। তিনি বেছে নিয়েছেন মধ্যবিত্ত নারীদের বলেছেন, ‘আমি বিশেষ মনোযোগ দেবো মধ্যবিত্তদের প্রতি, কেননা তারাই সবচেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আছে বলে মনে হয়।’ তিনি তার সময়ের নারীদের জানতেন ভালোভাবে, যারা পুরুষতন্ত্রের সমস্ত বাজে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলো মন দিয়ে; তিনি চান তাদের বিপরীত দৃষ্টিকোণ দেখতে, ও ভিন্ন মানুযে পরিণত করতে। মেরি বলেছেন [ভূমিকা] :

‘আমাক লিঙ্গশ্রেণীষীরা, আশা করি, আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি আমি তাদের রমণীয় রূপের তোষামোদ করার বদলে তাদের গণ্য কবি বুদ্ধিমান প্রাণীরূপে, এবং যদি আমি মনে না করি যে তারা রয়ে গেছেন চিবশৈশবে, যারা নিজের দাড়াতে পারেন না।‘

তার লিঙ্গশ্রেণীয়রা দুর্বল সব দিকে, তিনি তাদের উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন, যাতে তারা শরীর ও মন উভযেরই শক্তি অর্জনের চেষ্টা করেন :’ নারীর যে-অবস্থা তিনি দেখেছেন :

‘একমাত্র উপায়ে নবীরা পৃথিবীতে দাঁড়াতে পাবে-বিয়ে বসে। এ-কামনা তাদের পশুতে পরিণত কবে, যখন তাদের বিয়ে হয় তখন তারা এমন আচরণ কবে যা শুধু শিশুদের কাছেই আশা করা যায। -তারা সাজগোজ করে, তারা বস্তু মাখে।‘

মেরি তার বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ফরাশি রাজনীতিক নেতা ট্যালিরাদের নামে। পােচ পাতার উৎসর্গবক্তব্যে তিনি কতকগুলো দাবি জানান, বলেন, ‘আমি আমার লিঙ্গের পক্ষে দাবি করছি, নিজের জন্যে নয়।’ ফরাশি বিপ্লবের বাণী ছিলো তায় সমস্ত চেতনা জুড়ে, তা তিনি প্ৰকাশ করেছেন স্পষ্ট ভাষায় [উৎসর্গ] :

‘স্বাধীনতাকে আমি দীর্ঘ কাল ধবে আমার জীবনের শ্ৰেষ্ঠ ধন, সব গুণেব ভিত্তি বলে গণ্য ক’রে আসছি, আমার সব চাওয়া সংকুচিত ক’রে হ’লেও আমি নিশ্চিত করবো। আমার স্বাধীনতাকে, যদি আমাকে উষর প্ৰান্তরে বাস করতে হয় তবুও।’

একটি মৌলিক প্রশ্ন করেছেন মেরি : ‘চরম বিচারক ক’রে কে তৈরি করেছে পুরুষদের?’ তিনি দাবি করেছেন নারীপুরুষের সাম্য, যার মূলে রয়েছে তাঁর নৈতিকবোধ ও বিশ্বাস যে পীড়ন অশুভ পীড়নকারী ও পীড়িত দুয়ের জন্যেই { তিনি বলেছেন, ‘তারা সুবিধাজনক দাসী হতে পারে, তবে দাসত্ত্বের বিক্রিয়া ঘটে সব সময়, তা পতিত করে প্রভুকে এবং তার শোচনীয় আশ্ৰিতকে ৷’

ভিন্ডিকেশন-এর প্রথম দু-পরিচ্ছেদের নাম মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব বিবেচনা’ ও লৈঙ্গিক চরিত্র সম্পর্কে প্রচলিত মতামত বিবেচনা’। মেরি এ-দু-পরিচ্ছেদে নারী ও তার ভূমিকা সম্পর্কে প্রচলিত মত আলোচনা ক’রে দেখিয়েছেন সেগুলোর ভ্রান্তি, এবং বর্জন করেছেন সেগুলো। শতাব্দী পরম্পরায় সবাই বলেছে ও লিখেছে। বিধাতাই নারীকে তৈরি করেছে। পুরুষের থেকে হীন ক’রে, নারী সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট; একে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন ‘বাজে কথা’ ব’লে। তাঁর কাছে মানুষের বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি বা যুক্তিশীলতা; তিনি স্বীকার করতে রাজি নন যে বিধাতা নারীকে মানুষ হিশেবে তৈরি করে তারপর কেড়ে নিয়েছে তার বুদ্ধিবিবেচনা। মেরির মতে মানুষ ও সভ্যতার অগ্রগতির বড়ো বাধা স্বেচ্ছাচারী অবৈধ ক্ষমতা, এবং ক্ষমতাসংঘগুলো ব্যক্তি ও সমাজকে পীড়ন করে দূষিত ক’রে ফেলেছে। মেরি স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার চরম প্রতিপক্ষ, তিনি ঘৃণা করেন উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষমতাকে; ভিন্ডিকেশন-এ বার বার মেরি প্রকাশ করেছেন তার ঘেন্না। তিনি বলেছেন, যে-সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্যদের ওপর আধিপত্য করে উত্তরাধিকারলদ্ধ ধন ও ক্ষমতার মতো কৃত্ৰিম অধিকার দিয়ে, তারা হয়ে ওঠে তোষামোদপরায়ণ, অলস, অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। প্ৰচণ্ড আক্রমণ করেছেন মেরি অভিজাততন্ত্র, সেনাবাহিনী, ও গির্জাকে, কেননা এগুলো স্বেচ্ছাচারী শক্তিসংঘ। মেরি (১৭৯২, ৯৩) বলেছেন, ‘উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত মর্যাদা, ধন, রাজত্ব থেকে উৎসারিত হয়েছে।’ অশেষ দুৰ্দশা; এবং সব ধরনের ক্ষমতাই দুর্বল মানুষদের মাতাল করে তোলে; এবং এর অপব্যবহার প্রমাণ করে যে মানুষের মাঝে যাতে, বেশি সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজে ততো বেশি বিরাজ করবে। নৈতিক উৎকর্ষ ও সুখ’ (১৭৯২, ৯৬)।

মেরি রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুরোহিততন্ত্রের করেছেন প্রবল সমালোচনা, কেননা এগুলো টিকে আছে উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাচারী শক্তির ওপর ভর ক’রে। তিনি বলেছেন এসব সংস্থা যতোদিন আছে, ততোদিন অসম্ভব পরিবর্তন, তাই দরকার এসব সংস্থার বিলোপসাধন। মেরি নারীর অবস্থার একটু-আধটু উন্নতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না; নারীর অবস্থা একটু ভালো করা হ’লে, বা একদল অভিজাত নারীকে একটু ওপরে উঠোনো হ’লে সমস্যার সমাধান হবে না, তাই তিনি চেয়েছেন সার্বিক বদল। তিনি বলেছেন, সামাজিক ও আর্থ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বদল ছাড়া সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটবে না। উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত ধন, ক্ষমতা সবই যুক্তি ও পরিবর্তনের প্রতিবন্ধক। সমাজের সম্পূর্ণ বদলের কথা না বলে শুধু নারীর অবস্থাবদলের কথা তাঁর কাছে ছিলো নিরর্থক, কেননা যে-শ্বেস্বচ্ছাচারী শক্তি পীড়ন করছে নারীকে, সে-শক্তিই আধিপত্য করছে সমাজের অধিকাংশ পুরুষের ওপর। মেরি বার বার চমৎকার আক্রমণ করেছেন উত্তরাধিকাপ্ৰাপ্ত স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে, দেখিয়েছেন। ওগুলো কীভাবে রোধ করছে মানুষের মুক্তি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে মেরি দেখিয়েছেন। পুরুষতন্ত্র নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্যে কীভাবে ভিন্ন ক’রে দিয়েছে নারীদের ভূমিকা, নারীকে দিয়েছে সাফল্যের ভিন্ন আদর্শ, ‘নিষ্পাপতা’র নামে রেখে দিয়েছে ‘অজ্ঞানতা’র মধ্যে। নারীকে কী শিক্ষা দেয়া হয়? মেরি (১৭৯২, ১০০) বলেছেন :

‘বাল্যকাল থেকেই নারীদের বলা হয়, এবং তাদের মাদের উদাহরণ দেখিযে, শিক্ষা দেয়া হয, যে পুরুষের দুর্বলতা সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান, যাকে ঠিকভাবে বলতে হয় চতুরতা, নাম মেজাজ, দেখানো আনুগত্য, বালসুলভ শোভনতার প্ৰতি সতর্ক মনোযোগেব সাহায্যেই তারা পাবে পুরুযের বক্ষণাবেক্ষণ; আর যদি রূপসী হয়, তাহলে তাদের জীবনের কমপক্ষে বিশ বছবের জন্যে আর কিছুর দরকার নেই।‘

এভাবেই নষ্ট ক’রে দেয়া হয়েছে নারীকে। পুরুষ নারীর মধ্যে চেয়েছে ‘নমতা ও মধুর আবেদনময়ী সৌন্দর্য’, নারীকে ক’রে রাখতে চেয়েছে ‘চিরশিশু’, দেয় নি তাকে বিকশিত হতে। নারীকে যে-শিক্ষা দেযা হয়েছে, তা শুধু নিরর্থকই নয়, ক্ষতিকরও। মেরি (১৭৯২, ১০৩) বলেছেন :

‘আমাকে দুর্বিনীত বলতে পাবেন, তবু আমি যা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস কবি তা আমাকে বলতে হবে যে রুশো থেকে ৬৪ গ্রেগবি পর্যন্ত যাব নালীশিক্ষা ও ভদ্রতা সম্পর্কে লিখেছেন, তথবা সবাই নারীকে সাহায্য করেছেন আবো কৃত্রিম, দুর্বল চরিত্রেব হয়ে উঠতে, এবং পবিণামে তাদের ক’রে তুলেছেন মাজের আরো বেশি অপদাৰ্থ সদস্য।‘

তিনি দেখিয়েছেন নারীদের দেয়া হয়েছে যে-শিক্ষা, তা তাদের পরিণত করেছে। পুরুষের ভোগ্যবস্তুতে। নারীকে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে দেয়া হয় নি, তাকে উ ৎসাহিত করা হয়েছে ইন্দ্ৰিয়ের বিকাশ ঘটাতে। মস্তিষ্কহীন নারী ও সেপাইয়ের তুলনা ক’রে মেরি (১৭৯২, ১০৬) বলেছেন, ‘তাদের শেখানো হয়েছে। অন্যদের সন্তোষ বিধান করতে, এবং তারা বেঁচে আছে শুধু সন্তোষবিধানের জন্যে!’ রুশো ছিলেন মেরির প্ৰিয়, কিন্তু মেরি রুশোর নারীতত্ত্ব বাতিল ক’রে দিয়েছেন যুক্তিসম্মতভাবে। রুশো শিক্ষা দিয়েছেন নারী মুহূর্তের জন্যেও নিজেকে স্বাধীন ভাধিবে না, পুরুষের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় ক’রে তোলার জন্যে নারী হবে আবেদনময়ী ছেনাল, নারী হবে পুরুষের অবসর বিনোদনের মধুর সহচরী! মেরি (১৭৯২, ১০৮) একে বলেছেন, ‘হোয়াট ননসেন্স!’ নারীকে যে প্রেমের কথা বেশি ক’রে শোনানো হয়, তারও বিরুদ্ধতা করেছেন মেরি, কেননা তা নারীকে দুর্বল ক’রে তোলে। নারীকে সমাজ একরাশ বাজে শিক্ষা দিয়ে যে অদ্ভুত প্ৰাণীতে পরিণত করেছে, মেরি তা আলোচনা ক’রে বাতিল ক’রে দিয়েছেন। পুরুষ সম্পর্কে মেরি (১৭৯২, ১২১) বলেছেন :

‘পুরুষকে আমি ভালোবাসি আমার সমকক্ষ সঙ্গী হিশেবে; তবে তার রাজদণ্ড, সত্য বা আরোপিত, যেনো আমার দিকে প্রসারিত না হয়, যদি না কোনো ব্যক্তির যুক্তিবুদ্ধি দাবি কবে আমার শ্ৰদ্ধানুগত্য, এমনকি তখনো আমার আনুগত্য হবে তার বুদ্ধির কাছে, পুরুষটির কাছে নয়।‘

নারী এতোদিন ধরে পুরুষের অধীন রয়েছে বলেই যে নারী পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট এটা মেরির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সমান, তাই তারা পালন করবে। একই মানবিক দায়িত্ব। মেরি (১৭৯২, ১৩৯) বলেছেন, ‘আমি মেনে নিচ্ছি যে নারীর রয়েছে ভিন্ন দায়িত্ব পালনের ভার; তবে সেগুলো হবে মানবিক দায়িত্ব, এবং আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে সে-সব পালনের নীতিও হবে অভিন্ন।’

ভিন্ডিকেশন-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদ বিভিন্ন কারণে নারী যে-অধঃপতিত অবস্থায় পৌচেছে, সে-সম্পর্কে মন্তব্য’। মেরি বলেছেন, নারী প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল, না পরিস্থিতির প্রভাবে দুর্বল এটা স্পষ্ট; এবং তিনি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে নারী পরিস্থিতির শিকার। মেরির মতে নারী বর্তমানকে উপভোগ করতে গিয়ে, ভবিষ্যতের কথা না ভেবে নষ্ট করেছে নিজেকে। মেরি মনে করেন ‘নারীকে শুধু পুরুষের বিনোদেব জন্যে সৃষ্টি করা হয় নি, এবং তার লৈঙ্গিকতা নষ্ট ক’রে দেবে তার মানবিকতা, তা হ’তে পারে না।’ পুরুষ নারীকে ক’রে রাখতে চেয়েছে লৈঙ্গিক প্রাণী, নারীকেও শিখিয়েছে যে লৈঙ্গিক প্রাণী হওয়াই তার জন্যে ভালো! নারীকে করতে দেয়া হয় নি বুদ্ধির চর্চা, তার প্রবৃত্তিকে ক’রে তোলা হয়েছে প্রধান। মেরি বলেছেন, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণ সূত্র তৈরি করার শক্তিই জ্ঞান, কিন্তু নারীকে দেয়া হয় নি তার সুযোগ। পুরুষ নারীকে এ-শক্তিলাভের সুযোগ তো দেয়ই নি, বরং প্রচার করেছে যে, নারীর লৈঙ্গিক স্বভাবের সাথে জ্ঞান সামঞ্জস্যহীন। মেরির মতে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার সুযোগ না পেয়েই পতন ঘটেছে নারীর; তারা মেতে উঠেছে বা তাদের মাতিয়ে তোলা হয়েছে স্থল ইন্দ্ৰিয়চর্চায়। নারীর পেশা হয়েছে বিনোদন করা, নারী রূপের সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে তার স্বাধীনতাকে, এবং বোধ করেছে ‘হীনতার গৌরব’! নারীকে শেখানো হয়েছে তুচ্ছ সব ব্যাপারে গৌরব বোধ করতে। মেরি দেখিয়েছেন উপন্যাস, সঙ্গীত, কবিতা নারীকে ক’রে তুলেছে ইন্দ্ৰিয়াতুর প্রাণী; তারা সব কিছু অর্জন করতে চায় রূপ ও দুর্বলতা দিয়ে। তারা ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে, শ্যই সব কিছুতে নির্ভর করে পুরুষের ওপর।

ভিন্ডিকেশন-এর পঞ্চম পরিচ্ছেদ কয়েকজন লেখক, যারা নারীকে পরিণত করেছেন করুণার পাত্রে, যা প্রায় মানহানির কাছাকাছি, তাদের সমালোচনা’। অসামান্য, এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী, পরিচ্ছেদ এটি; এটি নারীবাদীদের অনুপ্রাণিত করে চলছে দু-শো বছর ধ’রে। এটির প্রেরণায় আধুনিক নারীবাদীরা বাতিল ক’রে দিয়েছেন সাম্প্রতিক অনেক মহাপুরুষকে, যেমন মেরি বাতিল করেছিলেন রুশো ও অন্যদের। মেরি অনুরাগী ছিলেন রুশোর, বিশ্বাসী ছিলেন তাঁর রাজনীতিক আদর্শে; কিন্তু রুশোর নারীদর্শন তাঁর কাছে মনে হয়েছে অত্যন্ত আপত্তিকর, কেননা তা নারীকে পুরুষাধীন রাখার দর্শন। উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি দিয়ে মেরি বাতিল করেছেন রুশোকে, দেখিয়েছেন রুশোর প্রতিক্রিয়াশীলতা। মেরির আলোচনার পর রুশো আর রুশো থাকেন না, হয়ে ওঠেন এক বিভ্রান্ত দার্শনিক, র্যাব নারীতত্ত্ব গ্রহণ করলে মানুষের মুক্তির কথা হয়ে ওঠে হাস্যকর প্রলাপ। মেরি দেখিয়েছেন রুশো তার নিজের দর্শনের করুণ শিকার; তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। উদারনীতিক আদর্শের সাথে। মেরি বলেছেন, রুশোর যেখানে দেখা উচিত ছিলো যুক্তি দিয়ে, সেখানে তিনি দেখেছেন আবেগ দিয়ে; এবং নারীকে নষ্ট করেছেন। নারী সম্পর্কে রুশোর তত্ত্বকে মেরি বলেছেন ‘পুংস্বৈরাচার’। রুশোর আদর্শ নায়িকা সোফি মেরির কাম্য নারীর সম্পূর্ণ বিপরীত। রুশো চান পুরুষনির্ভর রূপসী ছেনাল; মেরি চান স্বাধীন, চরিত্রসম্পন্ন নারী, যে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভর। রুশোর কাছে যা রমণীয়, মেরির কাছে তা অনৈতিক ও বিপজ্জনক। রুশোর আদর্শ নারী একই সাথে নির্বোধি ছেনাল ও শোচনীয় সতী। রুশো নারীকে শিখিয়েছেন স্বামী স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে অসতী’ও বললে নারী তার প্রতিবাদ করবে না; সে অভিযোগ মেনে নিয়ে থাকবে স্বামীর অনুগত। মেরির মতে এটা নারীকে সম্পূর্ণ নষ্ট করার কুশিক্ষা। মেরি রুশোকে যেমন বাতিল করেছেন তেমনই বাতিল করেছেন জেমস ফোরডাইস ও ডঃ গ্রেগরিকে। তখন খুব প্রভাবশালী ছিলো ফোরডাইসের সারামনুস টু ইয়াং উইমেন (১৭৬৫), দি ক্যারেক্টর অ্যান্ড কভাক্ট অফ দি ফিমেল সেক্স (১৭৭৬), ও গ্রেগরির লেগাসি টু হিজ ডটার। মেরি দেখান এঁদের ভ্রান্তি। এ ছাড়া মাদাম গেনলিসের লেটার্স অন এডুকেশন, লর্ড চেষ্টারফিল্ডের লেটাস ও আলোচনা ক’রে দেখান এগুলোর অপশিক্ষা। এ-পরিচ্ছেদে মেরি পরিষ্কার করেন বিপুল আবর্জনা, যা এতোদিন চলছিলো দর্শন ও প্রাজ্ঞতার নামে।

মেরির ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ চরিত্রের ওপর আবাল্যজড়িত ভাবাদর্শের প্রভাব’! মেরি প্রয়োগ করেন জন লকের মনোবিজ্ঞান, শূন্য শ্লেটতত্ত্ব, এবং দেখান নারীর চরিত্রের ওপর প্রতিবেশের প্রভাব অশেষ। রক্ষণশীলদের মতে নারী বিধির বিধানেই অধম, মেরি দেখান প্রতিবেশই নারীকে করেছে এমন! নারীর নিকৃষ্টতার মূলে নক্ষত্র নেই, তার শরীরও নেই, আছে সৰ্ব্বনাশা প্রতিবেশ। বাল্যকাল থেকেই, মেরি দেখান, মাবাবা ও অভিভাবকেরা বালিকাকে শেখায় যে তাকে হ’তে হবে আদর্শ নারী; তাকে ঢালাই করা হয় শোচনীয় আদর্শ নারীর ছাঁচে। মেয়েরা দেখে তাদের সুখ নির্ভর করে তারা কতোটা পুরুষের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে, তার ওপর। সামাজিকীকরণের ফলে তারা হয়ে ওঠে শারীরিক মানসিকভাবে দুর্বল, নির্বোধ, অন্তঃসারশূন্য, মুর্থ, চতুর, রূপসচেতন, ভাবালুতাপূর্ণ, অর্থাৎ অপদার্থ। প্রথম তারা এসব শেখে মায়ের কাছে থেকে, তারপর সারা সমাজ থেকে। তিনি মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক দু-রকম শক্তি অর্জনের কথাই বলেছেন। মেবি বলেন, ঘরকন্নাও নষ্ট করে নারীদের ঘরকন্ন তাদের এমন বিপর্যস্ত করে যে তাদের পক্ষে চিন্তা করার শক্তি ও সুযোগ থাকে না। মেয়েরা কী পড়ে? মেরি বলেছেন, সুযোগ পেলে তারা ইতিহাস, দর্শন পড়ে না, পড়ে সাধারণত উপন্যাস। না পড়ার থেকে যা-কিছু পড়াই মেরির কাছে ভালো, তবে উপন্যাস পড়া তার কাছে কোনো শিক্ষাই নয়। তিনি ভাবালুতাপূর্ণ উপন্যাসের কথাই বলেছেন; ওই উপন্যাস মেয়েদের উদ্ভট কল্প রাজ্যে নিয়ে যায়, বাস্তবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় না। ভিন্ডিকেশন-এ মেরি নারীর ভূমিকা, শিক্ষা, শিশুপালন, অর্থনীতি, কাজ, ভূমিকা-সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন বিস্তৃতভাবে। অর্থনীতিটা ছিলো তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার মতে জীবিকা অর্জনের সামর্থ্যই মানুষকে দেয় স্বাধীনতা, তাই যতোদি নারী আর্থ স্বাধীনতা অর্জন করবে না, ততোদিন কোনো স্বাধীনতাই অর্জন করবে না। তিনি বার বার বলেছেন নারীর আর্থস্বাধীনতার কথা।

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন নারীমুক্তির সার্বিক প্রস্তাব; এটি থেকেই জন্ম নিয়েছে। পরবর্তী বিভিন্ন ধারার নারীবাদ। তাঁর প্রস্তাব সম্পূর্ণ বিপ্লবাত্মক, এবং তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত ও রাজনীতিকভাবে তার অধিকাংশ উত্তরাধিকারীর থেকে অনেক বেশি আধুনিক, ও প্রগতিশীল। তবে মৃত্যুর পর তাঁর প্রস্তাবের থেকে তার প্রথাবিরোধী জীবনই সাধারণত বিষয় হয় আলোচনা ও বিতর্কের। তিনি প্রথাগত নৈতিকতা অস্বীকার ক’রে অবিবাহিত বাস করেছেন এক পুরুষের সাথে, জন্ম দিয়েছেন তথাকথিত অবৈধ সন্তান, এটাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিলো কপট রক্ষণশীলদের কাছে। মেরি সম্পূর্ণ সৎ ছিলেন, অনেক বেশি সৎ ছিলেন প্রথাগত সৎদের থেকে; এবং এখন পশ্চিম মেনে নিয়েছে মেরির জীবনরীতিকেই। উনিশ শতকের নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের সাথে সন্ধি ক’রেই পেতে চেয়েছিলেন অধিকার, এবং তারা মেরির মতো সার্বিক পরিবর্তনে বিশ্বাস করেন নি। তারা পেতে চেয়েছিলেন একটু-আধটু সুবিধা, আর ভোটাধিকার। পুরুষতন্ত্রের সাথে সন্ধিপাতানো নারীবাদীরা আচরণ করেছেন অবলা সতীসাধ্বীর মতো; যাতে পুরুষেরা রেগে উঠতে পারে, তা থেকেই সুশীলা কুলবালার মতো সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের। তারা জোসেফিন বাটলারকে অস্বীকাব করেন, যখন তিনি পতিতাদের পক্ষে কথা বলেন (১৮৬৪): তারা এলিজাবেথ স্ট্যান্টনকে অস্বীকার করেন, যখন তিনি নারীর বাইবেল (১৮৯৫, ১৮৯৮) লেখেন; তারা অ্যানি বেসান্টকে অস্বীকার করেন, যখন তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। তবে সুশীলা নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের কাছ থেকে বিশেষ কিছু আদায় করতে পারে নি, ভোটাধিকারও নয়; তখনই পুরুষতন্ত্র নারীবাদীদের দাবি মেনেছে যখন দেখা দিয়েছেন কোনো অশীল নারীবাদী। মেরিকেও তারা অস্বীকার করে চলতে চেয়েছেন, তবে মেরি তাদের চেতনায় থেকেছেন সব সময়ই, এবং তার বইটির বেরিয়েছে নানা সংস্করণ। মোরি পুরুষবিদ্বেষী ছিলেন না, পুরুষ তার ছিলো খুবই পছন্দ; তিনি চেয়েছিলেন সমানাধিকার। তিনি অবাধ কমেও বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি যে-দুটি পুরুষের সাথে শারীরিকভাবে মিলেছেন, তাদের তিনি ভালোবেসেছিলেন। মেরি, নারীবাদের জননী, ছিলেন আদর্শ জননী; অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দুর সমবায়, যিনি আজো তীব্ৰ, জীবন্ত, এবং প্রেরণার অশেষ উৎস।
 
রামমোহন ও বিদ্যাসাগর : প্ৰাণদাতা ও জীবনদাতা


মানুষের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী চক্রান্তে হিন্দু পিতৃতন্ত্র অনন্য; আর কোনো পিতৃতন্ত্রে অভিজাতশ্রেণী সমাজের অধিকাংশ মানুষকে এমন নিপুণভাবে পীড়ন ও পর্যুদস্ত করতে পারে নি। হিন্দু পিতৃতন্ত্র সমাজকে শুধু চার বর্ণে বিভক্ত করে নি, অভিজাতমগুলি অনভিজাতদের ওপর শুধু নির্মম পীড়ন চালায় নি; হিন্দু পিতৃতন্ত্র পীড়িত হওয়াকে পরিণত করেছিলো নিম্নবর্ণের ধর্মে। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে অধিকাংশ মানুষ মর্ষকামিতার শিকার, মর্ষকাম তাদের পুণ্য ধর্ম। উৎপীড়িত হওয়া মানুষের শোচনীয়তার লক্ষণ নয়, ওই উৎপীড়ন মেনে নেয়াই মানুষের শোচনীয়তার লক্ষণ; এবং মানুষকে হিন্দু পিতৃতন্ত্র এমন শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলো যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ উৎপীড়িত হওয়াকেই ভক্তি করেছে। ধর্ম ব’লে। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে অধিকাংশ পুরুষই যেখানে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বলি, সেখানে নারীর অবস্থা যে হবে চূড়ান্ত শোচনীয়, তার অস্তিত্বই যে অস্বীকার করা হবে, তাকে যে শারীরিকভাবে পীড়ন করা হবে, তা ধরে নেয়া যায়; এবং হিন্দু পিতৃতন্ত্র নিষ্ঠুরতায় ছাড়িয়ে গেছে সমস্ত সীমা। অন্যান্য পিতৃতন্ত্র নারীকে মনে করেছে দাসী ও ভোগ্যসামগ্ৰী, আর হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীকে গণ্য করেছে বলির পশু; নারীকে ধারাবাহিকভাবে বলি দিয়েছে পুরুষেব যুপকাঠে। হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীকে সম্পত্তির অধিকার দেয় নি, পুরুষকে করেছে নারীর ঈশ্বর, পুরুষকে দিয়েছে অবাধ নারীঅপব্যবহারের অধিকার, বিধবাকে দেয় নি বিয়ের অধিকার, এবং নারীপোড়ানোকে ক’রে তুলেছে। ধর্ম। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে নারীর প্রাণের মূল্য নেই, জীবনেরও অধিকার নেই; নারী শূদ্রের থেকে শূদ্ৰ, যদিও এ-পিতৃতন্ত্রই নারীকে কপট স্তব করেছে। দেবীরূপে। বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৯) গভীর ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই..আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’; তিনি আর্তনাদ করেছিলেন, ‘হা অবলাগাণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি ন!’ নারীর জন্যে নিষ্ঠুরতম ভূভাগের নাম ভারতবর্ষ, নিষ্ঠুরতম ব্যবস্থার নাম হিন্দু পিতৃতন্ত্র।

যেখানে ধর্মহীনতা বেশি সেখানেই জন্ম নেয়। ধর্মপ্রবর্তকেরা, আর যেখানে পীড়ন বেশি সেখানেই ঘটে ত্ৰাতাদের আবির্ভাব। নারী সবচেয়ে পীড়িত ছিলো ভারতে, তাই এখানেই প্রথম দেখা দেন নারীত্ৰাতারা; রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর। রামমোহন নারীকে বঁচিয়ে রাখার জন্যে সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবাৰ্ত্তকের সম্বাদপ্রথম প্রস্তাব প্রকাশ করেন। ১৮১তে, দ্বিতীয় প্রস্তাব ১৮১৯-এ; এ-বিষযে তার শেষলৈখা সহমরণ বেরোয় ১৮২৯-এ। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্ৰচলিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক- প্ৰথম প্রস্তাব প্রকাশ করেন। ১৮৫৫তে, এবং একই বছর প্রকাশ করেন দ্বিতীয় প্রস্তাব। পৃথিবীর আর কোথাও তাদের, অন্তত রামমোহনের, আগে নারীর পক্ষে কোনো পুরুষ কিছু লেখে নি, লড়াইয়ে নামে নি। বিলেতে নারীর পক্ষে প্রথম যে-পুরুষ বই লেখেন, তিনি দার্শনিক উইলিয়াম টমসন; তাঁর বই মানবজাতির অর্ধেক, নারীদের আবেদন মানবজাতির অপর অর্ধেক, পুরুষদের দুরূহঙ্কারের বিরুদ্ধে বেরোয় ১৮২৫-এ; কিন্তু তিনি হন উপহাসের পাত্র। পশ্চিমে নারীর পক্ষে পুরুষের লেখা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বই জন স্টুয়ার্ট মিলের নারী-অধীনতা বেরোয় ১৮৬৯-এ। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর পৃথিবীর দুই আদি নারীবাদী পুরুষ, মহাপুরুষ। তাঁরা কর্মবীর হিশেবেও অসামান্য; তারা বই লিখেই থেমে যান নি, যাওয়ার উপায় ছিলো না; তারা আইন প্রণয়ন করিয়ে বাস্তবায়িত করেছিলেন নিজেদের স্বপ্ন। পৃথিবীর নারীবাদের ইতিহাসে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নাম স্বর্ণলিপিতে লেখা থাকার কথা।

তবে রামমোহন ও বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি বা নারী-স্বাধীনতার কথা বলেন নি, মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা বলা যায় সভ্য সমাজে:- যেমন বলেছেন মিল, তারা নারীর জন্যে দাবি করেছেন দুটি সামান্য জিনিশ;–বেঁচে থাকা ও জীবনযাপনের অধিকার, যা তখন হিন্দু নারীদের জন্যে ছিলো মুক্তির থেকেও অনেক বড়ো। হিন্দু পিতৃতন্ত্রের নৃশংসতা সম্পর্কে তারা ছিলেন সচেতন; বিদ্যাসাগর হিন্দু পিতৃতন্ত্রকে তীব্র ভাষায় আক্রমণও করেছেন, একে নিকৃষ্টতম বলতে তিনি দ্বিধা করেন নি, এবং হাহাকার করেছেন বার বার। নারীপুরুষের সম্পর্ক যে লৈঙ্গিক রাজনীতি, তা বুঝেছেন তারা দুজনেই, যদিও এর ওপর জোর দেন নি। হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীর ওপর বলপ্রয়োগে নির্মম, নারীর নিন্দায় মুক্তকণ্ঠ; রামমোহনের প্রবর্তকের কণ্ঠে কথা বলেছে হিন্দু পিতৃতন্ত্র। প্রবর্তক বা পিতৃতন্ত্রের অভিযোগের উত্তরে নবর্তক বা রামমোহন (১৮১৮, ২০২) বলেছেন :

‘স্ত্রীলোককে যে পৰ্যন্ত দোষান্বিত আপনি কহিলেন, তাহা স্বভাবসিদ্ধ নহে।. স্ত্রীলোকেরা শারীবিক পরাক্রমে পুরুষ হইতে প্ৰায় নূ্যন হয়, ইহাতে পুরুষেরা তাহারাদগকে আপনা হইতে দুৰ্ব্বল জানিয়া যে ২ উত্তম পদবীর প্রাপ্তিতে তাহারা স্বভাবত যোগ্য ছিল, তাহা হইতে উহারদিগের পূৰ্ব্বািপব বঞ্চিত করিযা আসিতেছেন। পবে কাহেন, যে স্বভাবত তাহাবা সেই পদ প্রাপ্তির যোগ্য নহে।‘

লৈঙ্গিক রাজনীতিটি এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন রামমোহন। একগোত্র বলপ্রয়োগে আরেক গোত্রকে পরাভূত ক’রে কেড়ে নিয়েছে তার সমস্ত অধিকার, নারীর যা পাওয়ার কথা ছিলো তা তাকে না দিয়ে রটিয়ে দিয়েছে যে নারী ওসবের অযোগ্য, এ-রাজনীতি ধরা পড়েছে রামমোহনের চোখে, যদিও তাঁর পক্ষে তখন এ-রাজনীতিক লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া সম্ভব ছিলো না। তার রাজনীতি ছিলো বাঁচিয়ে রাখার রাজনীতি, নারীর বেঁচে থাকাই ছিলো রাজনীতি। বিদ্যাসাগরও (১৮৭১,৮৪৩) বলেছেন :

‘স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সামাজিকনিয়ম্দোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধীনতা নিবন্ধন, তাহারা পুরুষজাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালাহরণ করিতেছেন। প্রভূতপন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যাদৃচ্ছিাপ্রবৃত্ত হইয়া, অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, সেই সমস্ত সহ্য করিয়া জীবনযাত্রা সমাধান করেন। পৃথিবীর প্রায় সর্ব প্রদেশেই স্ত্রীজাতির ঈদৃশী অবস্থা।‘

বিদ্যাসাগরের বর্ণনায়ও নারী রাজনীতিকভাবে, শারীরিক দুর্বলতাবশত, পরাভূত জাতি; যেনো পুরুষের থেকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনার্যের মতো ভিন্ন ও পরাভূত জাতি; তাই তারা ‘পুরুষজাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালাহরণ’ করছে, যেমন করেছে ইংরেজের অধীনে ভারতীয়রা। পুরুষজাতি বিদ্যাসাগরের চোখে নৃশং স্বৈরাচারী, যাদের অত্যাচার ও অন্যায় আচরণ নারী মেনে নিয়েছে নিরুপায় হয়ে। দুজনেই পুরুষনারীর সম্পর্কের ভেতরে দেখেছেন রাজনীতি, লৈঙ্গিক রাজনীতি, যদিও আর এগোন নি। কেননা তারা নারীমুক্তির যুদ্ধে নামেন নি, তারা দাবি করেছেন নারীর জন্যে সামান্য অধিকার, যা নিশ্বাসের মতো সামান্য, জীবনযাপনের মতো সামান্য।

রামমোহন হিন্দু নারীকে দিয়েছেন প্ৰাণ, বিদ্যাসাগর দিয়েছেন জীবনী; রামমোহনের যেখানে শেষ, বিদ্যাসাগরের সেখানে শুরু। রামমোহন চেয়েছেন শুধু বিধবার প্রাণটুকু, আর বেশি কিছু নয়; কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে ওই প্ৰাণটুকু যথেষ্ট নয়, নারীর জন্যে তার দরকার জীবন, যা শুধু নিশ্বাসপ্রশ্বাস নয়, উপভোগের। বিধবা বেঁচে আছে, চিতার আগুনে ছাই হয়ে যায় নি, সে পেয়েছে ব্ৰহ্মচর্য পালনের অধিকার, এ-ই যথেষ্ট রামমোহনের জন্যে; তাঁর পক্ষে আর কিছু চাওয়া সম্ভব ছিলো না, হিন্দু পিতৃতন্ত্রের কাছে তা মনে হতো বড়ো বেশি বাড়াবাড়ি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবার ব্ৰহ্মচর্য এক ধরনের চিতাগ্নিতে দগ্ধ হওয়াই, তা জীবন নয়, তা বাঁচা নয়। মানুষ শুধু নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে না। রামমোহন (১৮১৮, ১৭০) বারবার বলেন ও প্রমাণ করেন, ‘পতির মৃত্যু হইলে পবিত্র যে পুষ্প মূল ফল তাহার ভোজনের দ্বারা শরীরকে কৃশ করিবেন এবং অন্য পুরুষের নামও করিবেন না। আর আহারাদি বিষয়ে নিয়ামযুক্ত হইয়া এক পতি যাহাদের অর্থাৎ সাধবী স্ত্রী তাহদের যে ধৰ্ম্ম তাহার আকাঙক্ষা করিয়া যাবজীবন ব্ৰহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক থাকিবেন।’ তিনি চেয়েছেন শুধু বিধবার ব্ৰহ্মচর্যোবে অধিকব। ওই ব্ৰহ্মচর্যও অত্যন্ত নৃশংস : নারী শুধু মৃত পতির ধ্যান ক’রে ফলমূল খেয়ে ও না খেয়ে বেঁচে থাকবে; তার রক্ত থাকবে না মাংস থাকবে না, জীবন থাকবে না। তবে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের কাছে এও ছিলো এক অনুমোদন অযোগ্য আবদার। বিদ্যাসাগরের কাছে নিশ্বাসপ্রশ্বাস যথেষ্ট নয়, ব্ৰহ্মচর্যে তিনি বিশ্বাসই করতেন না; তার দাবি জীবন। রামমোহনের নারী শুধু নিশ্বাসপ্রশ্বাস; বিদ্যাসাগরের নারী রক্তমাংসের সজীব মানুষ, যার একটি শরীর আছে, আর ওই শরীরের রয়েছে আগুনের থেকেও লেলিহান ক্ষুধা। বিদ্যাসাগর যখন বিধবার বিয়ের কথা বলেন, তখন বিধবার শরীরটিকে বাস্তব ও সত্য ক’রে তোলেন; নারীকে ফিরিয়ে দেন তার হারানো অস্বীকৃত শরীর। বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৯) যখন বলেন :

‘তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না;… দুৰ্জয় রিপুবৰ্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়।‘

তখন বড়ো হয়ে ওঠে নারীর শরীর, শরীরই হয়ে ওঠে নারী। যার নিজের শরীরের ওপর অধিকার নেই, তার আর কোনো অধিকার নেই। বিদ্যাসাগর একথা বুঝেছিলেন, তাই তিনি পড়েন আমূল নারীবাদীদের শ্রেণীতে, যারা শুধু নারীর আর্থস্বাধীনতাকেই নয়, শরীরকেও মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক বই দুটিতে তিনটি শব্দ- বৈধব্যযন্ত্রণা’, ‘ব্যভিচার্দোষ’ ও ‘ভ্রূণহত্যাপাপ’-ধ্রুবপদের মতো পুনরাবৃত্ত হয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে নারীর শরীরকে। তাঁর বর্ণনা পড়ার সময় উনিশ শতকের সমস্ত হিন্দু বাল্যবিধবার আচরিতাৰ্থ কাম দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। এতেই প্রকাশ পেয়েছে বিদ্যাসাগরের অকপট আধুনিকতা। এ-সম্পর্কে তার রচনায় পাই :

‘[ক] কত শত বিধবারা, ব্ৰহ্মচৰ্যনির্বাহে অসমর্থ হইয়া, ব্যভিচারদোষে দূষিত ও ভূণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকুল, পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যভিচারদোষ ও ক্রুণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিন কুলের কলঙ্ক নিরাকবণ হইতে পাবে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০৬]।

[খ] দুৰ্ভাগ্যক্রমে যাহারা অল্প বয়সে বিধবা হয়, তাহারা যাবজীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, এবং বিধবাবিবাহেব প্রথা প্রচলিত না থাকাতে, ব্যভিচার্দোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত যে উত্তরোত্তব প্রবল হইয়া উঠিতেছে, ইহা, বোধ করি, চক্ষকৰ্ণবিশিষ্ট ব্যক্তিমাত্ৰেই স্বীকার করিবেন। অতএব, হে পাঠক মহাশয়বর্গ। আপনারা অন্ততঃ কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত, স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া বলুন, এমন স্থলে, দেশাচারের দাস হইয়া, শাস্ত্রের বিধিতে উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্বক, বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত না। করিয়া, হতভাগা বিধবাদিগকে যাবজীবন অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করা, এবং ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত উত্তরোত্তর প্রবল হইতে দেওয়া উচিত; অথবা দেশাচারের অনুগত না হইয়া, শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত কবিয়া, হতভাগা বিধবাদিগের অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা নিরাকরণ এবং ব্যভিচাব্দোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত নিবারণ করা উচিত বিদ্যাসাগর [বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৮)]।

[গ] তোমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোতে উচ্ছলিত হইয়া যাইতেছে [বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৮)]।

[ঘ] হতভাগা বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্যরসের সঞ্চার হওয়া কঠিন এবং ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত। তোমরা প্রাণত্তুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্ৰণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ, তাহারা, দুর্নিবাররিপুবশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ, ধর্মলোপভায়ে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল লোকলজ্জাভয়ে, তাহাদের ক্রুণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্যযন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে… সন্মত নহ। [বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৮-৮৩৯)]।

বিদ্যাসাগরের রূপকগুলো লক্ষ্য করার মতো : শরীর জ্বলে উঠেছে লেলিহান আগুনের মতো, পাপ বয়ে চলেছে নদীস্রোতের মতো;–যাবজীবন অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানল’, ‘ব্যভিচারদোষের ও ভ্রাণহত্যাপাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত’ প্রভৃতি রূপক চোখের সামনে নারীর অতৃপ্ত শরীরটিকে যেমন উপস্থিত করে, তেমনি হাজির করে ভারতীয় কামোর্ত লম্পট পুরুষ জাতিটিকে। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন জীবন হচ্ছে কাম, ব্ৰহ্মচর্য জীবন নয়। বিদ্যাসাগর ‘ব্যভিচারদোষ’ ও ‘ত্ৰাণহত্যাপাপের স্রোত’-এর কথা বলেছেন, এজন্যে তিনি বিধবাকে দায়ী করেন নি; বিধবাকে তিনি তার সময়ের ধর্মপ্ৰাণ সামাজিকদের মতো একেকটি সম্ভাব্য বারাঙ্গনা মনে করেন নি, তিনি দায়ী করেছেন সমাজকেই। বিদ্যাসাগর এ-রূপকগুলো ব্যবহার ক’রে স্বীকৃতি জানিয়েছেন নারীর শরীরকে, শরীরকে ক’রে তুলেছেন জীবনী; এবং এগুলো দিয়ে আক্রমণ করেছেন তাঁর সময়ের ভণ্ড সমাজকে। বিধবা একা ব্যভিচার করতে পারে না, একা জন্ম দিতে পারে না ভুণ, তার জন্যে দরকার কোনো ধাৰ্মিক পুরুষ, তিনি তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রামমোহন উদার নারীবাদী; আর বিদ্যাসাগর আমূল নারীবাদী, যিনি শরীরকে ক’রে তুলেছেন জীবন।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর সহমরণ নিবারণে, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণে বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের চেষ্টা করেন : শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে বাতিল ক’রে প্রবর্তন করেন নববিধান। তারা কি বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে? রামমোহন হয়তো কিছুটা করতেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের ওই শাস্ত্ৰে বিশ্বাস ছিলো না বিন্দুমাত্ৰ; কিন্তু তারা জানতেন মধ্যযুগীয় এ-অঞ্চলে এটাই উপায়। যুক্তি এখানে মূল্যহীন, মূল্যবান এখানে পুরোনো শ্লোক। বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৬৯৫-৬৯৬) বলেছেন, যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্ৰতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্ৰতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এদেশে শাস্ত্ৰই সর্বপ্ৰধান প্ৰমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্য কর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে।’ তাই তাঁরা দুজনেই ঘেঁটেছেন শাস্ত্ৰ, শাস্ত্র থেকে নিয়েছেন সে-সব অংশ, যা তাদের পক্ষে। তারা শাস্ত্রকে প্রমাণ হিশেবে নিয়েছেন এজন্যে নয় যে তারা ওই শাস্ত্রের সাথে একমত, তারা ওই শাস্ত্ৰ নিয়েছেন কেননা ওই শাস্ত্ৰ তাদের সাথে একমত। তাদের দুজনের জন্যে এটা ছিলো বিশেষ সুবিধাজনক; পাণ্ডিত্যে ও মেধায় তারা তাদের প্রতিপক্ষের থেকে এতো শ্রেষ্ঠ ছিলেন যে তাদের পরাজিত করা ছিলো অসম্ভব। তারা শাস্ত্ৰে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন আইনে, তাই শাস্ত্ৰ দিয়ে তাঁরা প্রথাগ্রস্ত দেশবাসীদের কাবু ক’রে প্রবর্তন করেন আইন। তারা জানতেন আইন ছাড়া অসম্ভব হবে। সহমরণ নিবারণ, বা বিধবাবিবাহ প্রবর্তন; এবং এও জানতেন যদি তাদের দেশবাসী তাঁদের যুক্তি মেনে নেয়, কিন্তু আইন প্রণীত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আবার দেখা দিতে পারে সহমরণপ্ৰথা, নিষিদ্ধ হতে পারে বিধবাবিবাহ। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর যদি উনিশ শতকে ওই আইন পাশ না করাতেন, তাহলে বিশশতকে গান্ধির ভারতবর্ষে ওই আইন কখনো প্রবর্তিত হতো না; কেননা বিধবা হতো দুষ্ট রাজনীতিকদের জন্যে চমৎকার রাজনীতি। বিদ্যাসাগর (১৮৭১, ৮৮৪-৮৮৫) কেনো আইন চেয়েছেন, তা শোনার মতো :

‘কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন… বহুবিবাহ সামাজিক দোষ; সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কাৰ্য সে বিষয়ে গবৰ্ণমেণ্টকে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া কোনও ক্রমে বিধেয় নহে।
এই আপত্তি শুনিয়া আমি, আমি কিয়াৎ হাস্য সংবরণ করিতে পারি নাই। সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য, এ কথা শুনিতে আপাততঃ অত্যন্ত কর্ণসুখকর …
যাহারা এই আপত্তি করেন, তাহারা নবা সম্প্রদায়েব লোক। নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যাহারা অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ ও বহুদশী হইয়াছেন, তাহারা অর্বািচীনের ন্যায়, সহসা এরূপ অসার কথা মুখ হইতে বিনিৰ্গত করেন না। হই যথাৰ্থ বটে, তাহারাও এক কালে অনেক বিষয়ে অনেক আস্ফালন কবিতেন,… কিন্তু এ সকল পঠদ্দশার ভাব। তাহাবা পঠদ্দশা সমাপন করিয়া বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে ক্রমে, পঠদ্দশার ভাবের তিরোভাব হইতে লাগিল। অবশেষে, সামাজিক দোষের সংশোধন দূরে থাকুক, স্বযং সেই সমস্ত দোষে সম্পূর্ণ লিপ্ত হইয়া, সচ্ছন্দ চিত্তে কালব্যাপন করিতেছেন।‘

বাঙলা ও বাঙালি এখনো এমনই আছে; ছাত্রজীবনেই তারা প্ৰগতিশীল পরে প্রতিক্রিয়াশীল। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন। এদের বিশ্বাস করেন নি, বিশ্বাস করেছেন আইনে। আইনই নতুন কালের শাস্ত্ৰ।

রামমোহন লিখেছেন সম্বাদ, তিনি তাঁর প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেছেন পুরোনো দার্শনিক সংলাপের কাঠামোতে; বিদ্যাসাগর লিখেছেন প্রস্তাব, তিনি সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে। রামমোহনের সময় বাঙলা গদ্যের, এবং রামমোহন নিজের বাঙলা গদ্যোর, যে-অবস্থা ছিলো, তাতে বিদ্যাসাগরের মতো সরাসরি তীব্র গবেষণাধর্মী প্ৰস্তাব লেখা সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে: তাই তিনি প্রবর্তক-নিবর্তকের বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিপাদন করেছেন যে শাস্ত্রে রয়েছে বিধবার বেঁচে থাকার বিধান। শুধুই বেঁচে থাকা, এর বেশি নয়; বিধবা বেঁচে থেকে পালন করবে ব্ৰহ্মচর্য, আর কিছু নয়। রামমোহনের প্রবর্তক হচ্ছে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের উনিশশতকী দেশাচারগ্রস্ত রূপটি, যেটি দুর্বল হয়ে পড়েছিলো সব দিকে, এবং রামমোহন তাদো করেছেন দুর্বল থেকে দুর্বলতর } রামমোহন প্রবর্তকের মুখে দিয়েছেন শাস্ত্রের পুরোনো সমস্ত কথা; নিবর্তকের মুখে দিয়েছেন শাস্ত্রের সাথে মানবতাবাদী যুক্তি, যার আক্রমণে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে প্রবর্তক। সম্বাদ-এর শুরুতেই রামমোহন (১৮১৮, ১৬৯) প্রবর্তকের সংলাপে পেশ করেছেন। পুরোনো সংস্কার :

‘স্বামী মবিলে পর যে স্ত্রী ঐ পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতী যে বশিষ্ঠের পত্নী তাহার সমান হইয়া স্বর্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বৰ্গে বাস করে। আর যেমন সৰ্পগ্রাহকেরা আপন বলের দ্বারা গৰ্ত্ত হইতে সর্পকে উদ্ধার করিয়া লয় তাহার ন্যায় বলের দ্বারা ঐ স্ত্রী স্বামীকে লইয়া তাহার সাহিত সুখ ভোগ করে। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন কবে সে মাতৃকুল পিতৃকুল এবং স্বামিকুল এই তিনি কুলকে পবিত্র করে। আর অন্য স্ত্রী হইতে শ্ৰেষ্ঠ এবং শ্ৰেষ্ঠ ইচ্ছাবতী আর স্বামীর প্রতি অত্যন্ত শ্ৰদ্ধাযুক্ত যে ঐ স্ত্রী সে পতির সহিত তাবৎ পৰ্যন্ত স্বর্গ ভোগ করে যাবৎ চতুৰ্দশ ইন্দ্ৰপাত না স্থায়; আর পতি যদি ব্ৰহ্মহত্যা করেন। কিম্বা কৃতঘ্ন হয়েন কিম্বা মিত্রহত্যা করেন তথাপি ঐ পতিকে সৰ্ব্বপাপ হইতে মুক্ত করে ইহা অঙ্গিরামুনি কহিয়াছেন। স্বামী মরিলে সাধী স্ত্রী সকলের অগ্নি প্ৰবেশ ব্যতিরেকে আর অন্য ধৰ্ম্ম নাই।‘

প্রবর্তক গ্ৰহণ করেছে। হারীত, অঙ্গিরার মত; রামমোহন গ্ৰহণ করেছেন। মনুর মত। রামমোহন বারবার যে-শাস্ত্ৰবাক্যটির হাতুড়ি পিটিয়েছেন, সেটি মনুর : ‘স্ত্রীলোক পতির কাল হইলে পর ব্ৰহ্মচয্যের দ্বারা মোক্ষ সাধন করিবেন।’ রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ভাগ্য ভালো যে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পরস্পরবিরোধী বিধানের সমষ্টি; ওই পরস্পরবিরোধী বিশাল ভাণ্ডার থেকে বচন উদ্ধার ক’রে যে-কোনো কিছুকে শাস্ত্রসম্মত বলে প্রমাণ করা সম্ভব, অপ্রমাণও সম্ভব। রামমোহনের আশ্রয় মনু, যে-মনু নারীকে বহু তিরষ্কার ক’রে একটিমাত্র কৃপা করেছিলেন : ব্ৰহ্মচর্য পালন ক’রে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছিলেন দ্র। ‘দেবী ও দানবী’, ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’]। রামমোহন স্বীকার করেছেন শাস্ত্ৰে সহমরণের বিধান রয়েছে, কিন্তু তিনি নির্ভর করেছেন বিকল্পবিধানের ওপর। তিনি (১৮১৯, ১৯০) শাস্ত্ৰবাক্যকে ব্যাকরণবিদ-যুক্তিশাস্ত্রীর মতো ভেঙে ভেঙে বের করেছেন বিকল্প বিধানটি :

‘পতি ১ মরিলে ২-ব্ৰহ্মচৰ্য্য ৩ অথবা ৪ সহগমন ৫। অতএব ব্ৰহ্মচর্য্যের প্রথম গ্রহণ দ্বারা ব্ৰহ্মচৰ্য্য বিধবার শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম হয়।‘

বিধবার সহমরণও রামমোহন মেনে নিতে প্ৰস্তুত ছিলেন, যদি তা স্বেচ্ছাসহমরণ হয়। নিবর্তক (১৮১৮, ১৭৩) প্রশ্ন করেছে : ‘তোমাদের রচিত সংকল্পবাক্যেতে স্পষ্ট বুঝাইতেছে যে পতির জ্বলন্ত চিতাতে স্বেচ্ছাপূৰ্ব্বক আরোহণ করিয়া প্ৰাণ ত্যাগ করিবেক কিন্তু তাহার বিপরীত মতে তোমরা অগ্রে ঐ বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ় বন্ধন কর পরে তাহার উপর এত কাষ্ঠ দেও যাহাতে ঐ বিধবা উঠিতে না পারে।’ তিনি স্বেচ্ছাসহমরণ মেনেছেন, কেননা তিনি জানতেন অধিকাংশ নারী স্বেচ্ছাসহমরণে যায় না। বা যাবে না; তাদের বাধ্য করা হয় সহমরণে। প্রবর্তক সহমরণ চায় কলঙ্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্যে, তার কাছে নারী হচ্ছে সম্ভাব্য কলঙ্ক। প্রবর্তকের (১৮১৮, ১৭৪) মতে, ‘স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সহমরণ করিলে এ আশঙ্কা থাকে না জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন এবং পতিও যদি জীবৎকালে জানিতে পারে তবে তাহারো মনে স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের কোনো চিন্তা হয় না।’ সম্ভাব্য কলঙ্ক থেকে বাচার উপায় বিধবাকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা; যেনো তারা কোনো মানুষকে পোড়ায না, পোড়ায় কলঙ্ককে!

রামমোহন প্রথম সম্বাদ শেষ করেছেন। সহমরণ সম্পর্কে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের মনকে কিছুটা কোমল ক’রে; কিন্তু তার মন অতো সহজে গলার বস্তু নয়। তাই রামমোহনকে লিখতে হয় দ্বিতীয়, দীর্ঘতর, প্রস্তাব; এতে তাঁর একটিই প্রতিপাদ্য : ‘ভৰ্ত্তার মৃত্যু হইলে পর, স্ত্রী ব্ৰহ্মচৰ্য্য করবেন।’ রামমোহন বিধবাকে বঁচিয়ে রাখার জন্য মেনে নিয়েছেন নিষ্কাম ধর্ম, কামনাকে গণ্য করেছেন পাপ; এমনকি স্বৰ্গকামনাও তাঁর কাছে পাপ। পিতৃতন্ত্র নিজের স্বাৰ্থ উদ্ধারের জন্যে নারীকে যে-কোনো স্তব করতে পারে, দেখাতে পারে যে-কোনো প্রলোভন। তিনি (১৮১৯, ১৯২) প্রশ্ন করেছেন, ‘স্বর্গের প্রলোভ দেখাইয়া এরূপ অবলা স্ত্রীবধেতে প্ৰবৰ্ত্ত হওয়াতে কি স্বাৰ্থ দেখিয়াছেন?’ আবার (১৮১৯, ১৯৪) প্রশ্ন করেছেন, তবে বিধবাকে স্বৰ্গ কামনাতে প্রলোভ কেন দেখান? মুক্তিসাধন নিষ্কাম কৰ্ম্মে কেন প্ৰবৰ্ত্ত না করান?’ স্বর্গের প্রলোভন দেখানো যে প্রতারণা রামমোহনের কাছে তা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। স্বর্গের প্রলোভনে নারী যদি সহমরণে না যায়, তখন হিন্দু পিতৃতন্ত্র কী করে? তখন বিধবাকে ‘বন্ধনপূৰ্ব্বক দাহ’’’ করে, এটা ‘দেশাচারপ্রযুক্ত সৎকৰ্ম্ম। রামমোহন বলেছেন, এটা দসু্যুবৃত্তি। যেভাবেই হোক হিন্দু পিতৃতন্ত্রকে মুক্তি পেতে হবে বিধবার ভার থেকে, তাই তার শেষ যুক্তি হচ্ছে নারীনিন্দা রামমোহন (১৮১৮, ২০১)] :

‘স্ত্রীলোক স্বভাবত অল্পবুদ্ধি, অস্থিরান্তঃকরণ, বিশ্বাসের অপত্র, সানুবাগা, এবং ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্য হয়। স্বামীর পরলোক হইলে পর, শাস্ত্রানুসারে পুনরায় বিধবার বিবাহ হইতে পারে না, এককালে সমুদায় সাংসারিক সুখ হইতে নিরাশ হয়, অতএব এ প্রকার দূর্ভাগা যে বিধবা তাহার জীবন অপেক্ষা মরণ শ্ৰেষ্ঠ।‘

রামমোহন একটি একটি করে উত্তর দিয়েছেন এসবের। তার উত্তরের মধ্যে ধরা পড়েছে বলতন্ত্রের পীড়নের রাজনীতিক রামমোহন (১৮১৮, ২০২)। রূপটি :

‘প্রথমত বুদ্ধির বিষয়, স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইযাছেন যে অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান শিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয়। ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?’

আধিপত্যকারী শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা অধীন শ্রেণীকে কোনো অধিকার, দায়িত্ব দেয় না; না দিয়ে দিয়ে তাদের ক’রে তোলে সম্পূর্ণ অযোগ্য, এবং শেষে ঘোষণা করে যে অধীনের সহজাতভাবেই অযোগ্য। তাদের দণ্ডিত করা হয় সে-অযোগ্যতায়, যে-যোগ্যতা তাদের অর্জন করতে দেয়া হয় নি। রামমোহন দেখিয়েছেন নারীর বুদ্ধিাচৰ্চা নিষিদ্ধ ক’রে দিয়ে তাদের নিন্দিত করা হয়েছে নির্বোধ অল্পবুদ্ধি ব’লে, তবে এটা তাদের সহজাত স্বভাব নয়; পুরুষতন্ত্রের পীড়নেরই ফল। নারী কি ‘অস্থিরান্তঃকরণ’ ‘বিশ্বাসের অপাত্রে? ‘সানুরাগা’ অর্থাৎ পাবপুরুষাসক্ত? ‘ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্যা’ তিনি দেখিয়েছেন নারীর বিরুদ্ধে এগুলো মিথ্যে অভিযোগ; আর এসব দিকে নারী পুরুষের থেকে অনেক উ ৎকৃষ্ট। সে-উৎকৃষ্ট নারী পুরুষের দাসী (১৮১৮, ২০২-২০৩) : ‘স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জন, ভোজনাদি পাত্রে মার্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কৰ্ম্ম করিয়া থাকে; এবং সূপকারের কৰ্ম্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাতিতে করে…।’ নারী এমন দাসী, যাকে উঠতে হয় প্রভুর চিতায়! তিনি স্বেচ্ছাসহমরণও মেনে নিয়েছেন, চেয়েছেন ‘এই পৰ্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনীদের যেনো বন্ধনপূৰ্ব্বক দাহ করা থেকে রক্ষা করা হয়।

রামমোহন তাঁর ‘সম্বাদ’ লিখেছেন নৈর্ব্যক্তিক রীতিতে; কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে তার সকাতর আবেগ। তার প্রস্তাবগুলো অভিসন্দর্ভ হিশেবে অসামান্য, কিন্তু তিনি নারীর কথা বলতে গিয়ে কেঁপেছেন আবেগে। তিনি মুখোমুখি লড়াই করেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে, ওই পিতৃতন্ত্র তার সাথে যে-নিষ্ঠুরতা করেছে, তা তিনি ভোলেন নি। তিনি নারীকে শুধু নিশ্বাসের অধিকার নয়, দিতে চেয়েছেন জীবনের অধিকার, তাই তাঁর লড়াই ছিলো আরো রক্তাক্ত। সহমরণ নৃশংস বলে তার নিবারণও সহজ, সহজেই মানুষ ও জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে নারীকে পোড়ানো নৃশংসতা। কিন্তু যাদের সংবেদনশীলতা আদিম, তাদের বোঝানো অত্যন্ত কঠিন যে ব্ৰহ্মচর্য পালন করে বেঁচে থাকা চিতায় ছাই হওয়ার থেকেও মর্মান্তিক। নারীর আর্থ ও অন্যান্য স্বাধীনতা চাওয়ার মতো অবস্থা তখন ছিলো না, তিনি তা চান নি; চেয়েছেন জীবনযাপনের অধিকার। তিনি নারীর দেহকে মূল্য দিয়ে, নারীর দেহকে স্বীকার ক’রে হয়ে উঠেছেন একজন আমূল নারীবাদী; এবং উনিশশতকের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ। একটি আদিম পিতৃতন্ত্রের মুখোমুখি একজন আধুনিক মানুষ দাঁড়ালে তাকে যে-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, তার সবখানিই ভোগ করেছেন বিদ্যাসাগর; তাঁর বুকে ক্ষোভও জেগেছে অশেষ। হিন্দু পিতৃতন্ত্র তাকে সহ্য করে নি; অমূল্যচরণ বসু জানিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত; কেহ পরিহাস করিত, কেহ গালি দিত। কেহ কেহ তাহাকে প্রহার করিবার এমনকি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভুক্ষেপও করিতেন না। একদিন শুনিলেন, মারিবার চেষ্টা হইতেছে। কলিকাতার কোন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে মারিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন। দুৰ্বত্তেরা প্রভুর আজ্ঞা পালনের অবসর প্রতীক্ষা করিতেছে। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না। যেখানে বড় মানুষ মহোদয় মন্ত্রিবর্গ ও পরিষদগণে পরিবৃত হইয়া প্রহরীরক্ষিত অট্টালিকায় বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ-প্ৰহারের কাল্পনিক সুখ উপভোগ করিতেছিলেন, বিদ্যাসাগর একবারে সেইখানে গিয়া উপনীত হইলেন’ (বিনয় (১৯৭৩, ২৬৮)। এ হচ্ছে বিপন্ন পিতৃতন্ত্রের ইতির আচরণ। প্রিয় বালিকা প্রভাবতীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন (প্ৰভাবতী সম্ভাষণ, ৪১৯) :

‘তুমি, স্বল্প কালে নরলোক হইতে অপসৃত হইয, আমার বোধে অতি সুবোধের কার্য কবিযািছ। অধিক কাল থাকিলে, আর কি অধিক সুখভোগ করিতে; হয় ত, অদৃষ্টদ্বৈগুণ্যবশতঃ অশেষবিধ যাতনাভোগের একশেষ ঘটিত। সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে, তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে, কখনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে, জীবনযাত্রাব সমাধান কবিতে পারিতে না।‘

বেঁচে থাকার চেয়ে ভারতে নারীর ম’রে যাওয়াও তার কাছে মনে হয়েছে ‘সুবোধের কাৰ্য’; বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় প্রস্তাব-এ (১৮৫৫খ, ৮৩৯) বলেছেন, ভারতবর্ষে যেনো ‘হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’, আর্তনাদ করেছেন, ‘হা অবলা গণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর।’ এ-ক্ষুব্ধ বিলাপ থেকেই বোঝা যায়। এ-মহৎ আমূল নারীবাদীকে কতোটা যন্ত্রণা দিয়েছিলো নির্বোধ হিন্দু পিতৃতন্ত্র।

নারীকে জীবন দেয়ার জন্যে বিদ্যাসাগর লিখেছেন ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামের একটি প্রবন্ধ, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব-প্রথম পুস্তক (১৮৫৫), বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব- দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার-প্রথম পুস্তক (১৮৭১), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার—দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৭৩) নামের চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্ৰন্থ, এবং ব্রজবিলাস (১৮৮৪) নামের একটি বিদ্রুপাত্মক প্ৰতিআক্রমণাত্মক বই। বিদ্যাসাগরের রচনাবলির এক বড়ো অংশ নারীকল্যাণমূলক রচনা, এবং ওগুলো মানবিকতা, পাণ্ডিত্য, ও যুক্তিতে অসাধারণ। শাস্ত্ৰে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু শাস্ত্ৰ দিয়েই তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিলো যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, বহুবিবাহ শাস্ত্রবিরোধী। আধুনিক কালের এক বড়ো ট্র্যাজেডি হচ্ছে একে চলতে হয় পুরোনো কালের বিধান দিয়ে, কেননা তা স্মৃতিশাস্ত্রপ্রতিপাদিত কল্পিত ফলমৃগতৃষ্ণায় মুগ্ধ’, এবং বিদ্যাসাগরকে তা ঘেটে দেখাতে হয়। বর্তমানকালসন্মত বিধান, যদিও তাতে তাঁর বিশ্বাস নেই, ও তিনি নিজেই লিখতে পারতেন ওই সব পুরোনো বস্তুর থেকে অনেক উৎকৃষ্ট শাস্ত্ৰ। নারীকে জীবন দেয়ার জন্যে তিনি শুরু করেছেন শেকড় থেকেবাল্যবিবাহ থেকে; কেননা বাল্যবিবাহই বলবিধবা উৎপাদনের প্রধান ব্যবস্থা। তার মতে, অল্প বয়সে যে বৈধব্যদশা উপস্থিত হয়, বাল্যবিবাহই তাহার মুখ্য কারণ; সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া অতিশয় নির্দয় ও নৃশংসের কর্ম’ (‘বাল্যবিবাহের দোষ’, ৬৮৫); ‘বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার। এবং এই বিচিত্ৰ সংসার তাহার পক্ষে জনশূন্য অরণ্যাকার’ (ওই, ৬৮৪)। বিধবাকে তিনি জনশূন্য বনবাস থেকে মুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন মানবিক সংসারে।

বিদ্যাসাগর শাস্ত্ৰ মেনেছেন, কেননা লোকে শাস্ত্ৰ মানে, এবং তিনি শাস্ত্রে পেয়েছেন তাঁর প্রস্তাবের সমর্থন। যদি তিনি সমর্থন না পেতেন। শাস্ত্রে, তাহলে কী করতেন বিদ্যাসাগর? তিনি কি শাস্ত্ৰকেই শেষ কথা বলে মানতেন? না, তিনি বাতিল ক’রে দিতেন। শাস্ত্রকে; হয়তো দেখাতেন। ওই সব শাস্ত্রের কাল শেষ কয়ে গেছে, ওই সব শাস্ত্ৰ কলিকালের জন্যে নয়। শাস্ত্র কী? বিদ্যাসাগর প্রথমে দেখান শাস্ত্র হচ্ছে ধর্মশাস্ত্র; আর মনু, অত্রি, বিষ্ণু, হারােত, যাজ্ঞবল্ক্য, উশনাঃ, আঙ্গিরা, যম, আপস্তম্ব, সংবর্ত, কাত্যায়ন, বৃহস্পতি, পরাশর, ব্যাস, শঙ্খ, লিখিত, দক্ষ, গোত, শাতাতপ, বশিষ্ঠ প্রমুখ ধর্মশাস্ত্ৰকৰ্তা। এর মাঝে উনিশটিকে বাতিল ক’রে বিদ্যাসাগর রেখেছেন একটিকে, কেননা সেটি তাকে সমর্থন করে; যদি সমর্থন না করতো তাহলে সেটিকেও বাতিল করতেন। তিনি। তিনি স্বীকার করেছেন। পরাশর সংহিতাকে। মনু বলেছেন, ‘কলিযুগের ধর্ম অন্য’, আর পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ে আছে : ‘পরাশরনিরূপিত ধৰ্ম কলিযুগের ধর্ম।’ পরাশর বলেছেন ব’লেই বিদ্যাসাগর তাকে মেনেছেন, তা নয়; তিনি পরাশরকে স্বীকার করেছেন, কেননা তাতে রয়েছে বিধবার বিয়ের বিধান। তাই তিনি অন্য সব শাস্ত্ৰ বাতিল ক’রে বলেছেন, ‘কলিযুগের লোক পূর্ব পূর্ব যাগের ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে অক্ষম’ (১৮৫৫ক, ৬৯৭); স্থির করেছেন : ‘পরাশরসংহিতা কলিযুগের ধর্মশাস্ত্ৰ’ (১৮৫৫ক, ৬৯৯)। বাতিল অন্য সব শাস্ত্র। পরাশর বলেছেন বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০০) :

‘স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগেব পুনর্বাবে বিবাহ করা শাস্ত্ৰবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে স্বৰ্ণলাভ করে। মনুষ্যশরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বৰ্গে বাস করে।‘

স্বৰ্গলাভের কোনো মোহ তার ছিলো না, নারী বিয়ে কবতে পারলে স্বর্গের কোনো দরকার বোধ করবে। ব’লেও তার মনে হয় নি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ‘রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে।’ পরাশরের বিধানের বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০০) দিয়েছেন। এ-ভাষ্যে :

‘পরাশর কলিযুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিতেছেন, বিবাহ, ব্ৰহ্মচৰ্য, সহগমন। তন্মধ্যে, বাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। বিধবাদিগের দুই মাত্র পথ আছে বিবাহ ও ব্ৰহ্মচৰ্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্ৰহ্মচর্য করিবেক। কলিযুগে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন কবিয়া, দেহযাত্ৰা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান পরাশব সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন।‘

পরাশর প্রথমেই দিয়েছেন বিয়ের বিধি। প্রশ্ন জাগে রামমোহন কেনো খুঁজে পান নি। পরাশরের এ-বিধিটি, তাকে কেনো সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো মনুর বিধি নিয়েই যে বিধবা ব্ৰহ্মচর্য পালন করবে বা সহমরণে যাবে? রামমোহন কি পেয়েও এড়িয়ে গিয়েছিলেন বিধিটিকে? তিনি কি, ১৮১৮-তে, মনে করেছিলেন যে প্ৰাণই যথেষ্ট নারীর জন্যে, ব্ৰহ্মচৰ্যই নারীর জীবন? রামমোহন কি মনে করেছিলেন বিধবার জন্যে প্ৰাণের বেশি কিছু চাইতে গেলে পণ্ড হবে সব কিছু, বা তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন যে বিধবার বিয়ে হওয়া ঠিক নয়? কিন্তু আটত্রিশ বছরেই দেখা যায় প্রাণই যথেষ্ট নয়- ‘কলিযুগে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্ৰা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।’ যে-বিধবা ছিলো সামান্য নিশ্বাস, মাত্র আটত্রিশ বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগর দাবি করেন যে তার রয়েছে একটি শরীর, তার রয়েছে কামনাবাসনা, আর ওই শরীরে রিপুরা অন্যান্য শরীরের মতোই সক্রিয়। বিধবাদের বৈধব্যযন্ত্রণা ছাড়াও ছিলো আৰ্থনিরাপত্তাহীনতার সমস্যা; তাদের অধিকাংশের জীবনই ছিলো অবহেলিত দাসীর জীবন। বিদ্যাসাগর সে-সব প্রসঙ্গ তোলেন নি, মনে করেছেন বিয়ে হ’লে ওগুলো মিটবে। বিধবাকে বিয়ে দিয়ে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সম্পূর্ণরূপে: তাই তাদের ও সন্তানদের কী মর্যাদা হবে, তাও দেখিয়েছেন শাস্ত্র ঘেটে। তার চোখে কুমারী ও বিধবার কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু হিন্দু পিতৃতন্ত্র কেনো মেনে নেবে এ-মানবিকতা? তার পাণ্ডারা কি কোলাহল করবে না? মেতে উঠবে না। শাস্ত্রের শুদ্ধ-অশুদ্ধ ব্যাখ্যায়? তারা মেতে ওঠে; এবং তাকে লিখতে হয় দীর্ঘ দ্বিতীয় পুস্তক, যাতে প্রতিপাদ্য একই, কিন্তু শ্লোক আর যুক্তি অনেক বেশি। কিন্তু তিনি জানতেন শুধু শ্লোকে কাজ হবে না, আইন পাশ করাতে হবে। তা তিনি করিয়েছিলেন, বিধবাবিবাহের আইন পাশ হয় ১৬ জুলাই ১৮৫৬তে।

নারীকে সংসারে সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করার সুপরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যাসাগর কাজ শুরু করেছিলেন: তাই বিধবাবিবাহ প্রচলনের পর তার কাজ হয় বহুবিবাহ রহিত করা। এ-লড়াইয়ে নামতে হয়েছে বিদ্যাসাগরকে, কেননা বহুবিবাহ নিষিদ্ধ না হ’লে তার নারী পুরুষতন্ত্রের পীড়ন থেকে বাঁচে না। বহুবিবাহ বিষয়ক তাঁর বই দুটি আকারে অনেক বড়ো, গবেষণা হিশেবে অসামান্য; এবং এ-দুটিতে তিনি হিন্দু কুলবিন্যাস ও পুরুষের কুৎসিত রূপ তুলে ধরেছেন বিস্তৃতভাবে। তিনি বিয়ে দিয়েছেন বিধবাকে, কিন্তু ওই বিয়ে জিনিশটি কী? বিয়ে হচ্ছে নারীর জন্যে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হওয়া; তিনি বলেছেন, ‘এ দেশে বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে বহুবিধ অনিষ্ট হইতেছে’ (১৮৭১, বিজ্ঞাপন। বহুবিবাহ নিষেধেও তিনি শাস্ত্ৰকেই নিয়েছেন প্রমাণ হিশেবে, কিন্তু তিনি শাস্ত্রের শেষে চেয়েছেন আইন। বহুবিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকে তিনি প্রমাণ করেছেন : স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে, নির্দিষ্ট নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যাদৃচ্ছিাক্রমে পুনরায় সবর্ণবিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত নহে’ (১৮৭১,৮৪৭)। তিনি দেখান যে ‘বল্লাল গুণ দেখিয়া কুলমর্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; দেবীবর দোষ দেখিয়া কুলমর্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছেন’ (১৮৭১, ৮৫৮)। দেবীবর ঘটক কুলীনদের দোষের তালিকা ক’রে যে-কুলবিন্যাস করেন, তাকে বলা হয় ‘মেলবন্ধন’, এবং এরই ফলে দেখা দেয়। বহুবিবাহ। আগে অনেক বেশি ঘরে নারীদের বিয়ে দেয়া যেতো, কিন্তু মেলবন্ধনের ফলে বিয়ে দেয়ার মতো ঘরের সংখ্যা ক’মে যায়। কিন্তু নারীদের বিয়ে দিতেই হবে; তাই দেখা দেয় বহুবিবাহ! কুল কোনো ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়; তিনি দেখিয়েছেন, ‘কুলীন মহাশয়েরা যে কুলের অহঙ্কারে মত্ত হইয়া আছেন, তাহা বিধাতার সৃষ্টি নহে’ (১৮৭১,৮৬২), নিতান্তই দেবীবর ঘটকের সৃষ্টি। বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘যদি ধর্ম থাকেন, রাজা বল্লাল সেন ও দেবীবর ঘটকবিশারদ নিঃসন্দেহে নরকগামী হইয়াছেন।’ (১৮৭১, ৮৬৮)। বিদ্যাসাগর দিয়েছেন কুলীনদের অমানুষিক বর্বরতার পরিচয়; বলেছেন, ‘এ দেশের ভঙ্গকুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই’ (১৮৭১, ৮৬৯)। তাঁর এ-পুস্তক হিন্দু পিতৃতন্ত্রের পরোহিতদের উত্তেজিত করে, তারা শাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন বিদ্যাসাগরের ওপর। তখন তিনি লেখেন। দ্বিতীয় প্রস্তক; একে একে তর্কবাচস্পতিপ্রকরণ, ন্যায়রত্নপ্রকরণ, স্মৃতিরত্নপ্রকরণ, সামশ্রমিপ্রকরণ, কবিরত্নপ্রকরণ প্রভৃতি পরিচ্ছেদে খণ্ডন করেন পিতৃতন্ত্ররত্নদের শ্লোক ও যুক্তি। কিন্তু তিনি বহুবিবাহ রহিত করতে পারেন নি।

রামমোহন হিন্দু বিধবার প্রাণদাতা, বিদ্যাসাগর জীবনদাতা; তবে প্ৰাণ দেয়ার চেয়ে জীবন দেয়া অনেক কঠিন। বিধবাকে এখন আর চিতায় উঠতে হয় না, যদিও ভারতে আবার সহমরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু হিন্দু বিধবা আজো জীবনে স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা পায় নি। এখনো বিধবার বিয়ের কথায় হিন্দু পিতৃতন্ত্র বিচলিত হয়ে ওঠে; এমনকি বিধবারাও কেঁপে ওঠে নরকের ভয়ে। প্রথাবাদের ভারতীয় অঞ্চলে জীবনের থেকেও শক্তিশালী প্রথা।
 
পুরুষতন্ত্র ও রোকেয়ার নারীবাদ


বোকেয়া এখন বাঙালি মুসলমান পিতৃতন্ত্রের কাছে এক মহীয়সী, তিনি আজ অলঙ্কত করছেন পুণ্যময়ীদের পংক্তি;–কোনো প্রথাগত নারীর জন্যে এটা পরম প্রাপ্তি, কিন্তু রোকেয়ার জন্যে এটা খুবই শোচনীয় স্বীকৃতি। ভারতীয় ভূভাগের এক বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে বিদ্রোহীদের মূলেই উপড়ে ফেলা হয় বা চেষ্ট করা হয় উপড়ে ফেলার, তবে তা সম্ভব না হ’লে তাদের নিষ্ক্রিয় ক’রে দেয়া হয় প্রথার ভেতর বিন্যস্ত ক’রে। বিদ্রোহীরা হয়ে ওঠেন প্রথাগত। রোকেয়াকেও তাই করা হয়েছে; রোকেয়া হয়ে উঠেছেন এক মহীয়সী পুণ্যময়ী সতী নারী, বা একজন মুসলমান ভদ্রমহিলা। এভাবে চূড়ান্তরূপে নিনি স্ক্রয় ক’রে দেয়া হয়েছে রোকেয়াকে। তার নামটিই এর ভালো পরিচয় দেয়। পুরুষেরা ও তাঁর ভক্ত প্রথাগ্রস্ত নারীরা তাকে বিখ্যাত ক’রে তুলেছেন ‘বেগম রোকেয়া’ নামে, যদিও তার নামে কখনো ‘বেগম ছিলো না। তার নাম ছিলো রোকেয়া বা রুকাইয়া খাতুন; তবে তিনি নিজেও মেনে নিয়েছিলেন পশ্চিমি পুরুষতান্ত্রিক নাম ‘আর এস হোসেন’ বা ‘রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন’। তার জন্মের সালতারিখকেও অনেকটা কিংবদন্তি মনে হয়;-অনেকে শুধু ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে তার জন্ম হয়েছিলো বলে জানান, জন্মের তারিখ উল্লেখ করেন না; আবার কেউ কেউ বলেন তার জন্ম হয়েছিলো। ১৮৮০ সালের ডিসেম্বরের ৯ তারিখে, এবং পুণ্যবানদের মতো তার মত্যুও হয়েছিলো ডিসেম্বরের ৯ তারিখেই (১৯৩২)। হয়তো তার জন্মের আসল তারিখটি লুপ্তই হয়ে গেছে। তাঁর জীবনকাহিনীও জানা যায় সামান্য; তবে তার ভেতরেও চোখে পড়ে রোকেয়া নামের অগ্নিশিখাটি।

পিতৃতান্ত্রিক, দুশ্চরিত্র, অপব্যয়ী, জমিদার পিতার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিলো। বেড়েছেন তিনি অন্ধকার অবরোধের মধ্যে, যেখানে মেয়েদের পড়াশুনো ছিলো নিষিদ্ধ। তবে বড়ো ভাইয়ের কাছে গোপনে শিখেছেন বাঙলা ও ইংরেজি, এবং শিখেছেন অত্যন্ত ভালোভাবে নিজেরই সহজাত প্ৰতিভায়। কেউ কেউ মনে করেন। রোকেয়া বিয়ের পরে স্বামীর কাছে ভালোভাবে শিখেছিলেন ইংরেজি: এটাও এক পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস। তাদের কাছে নারীর ইংরেজি শেখা বিস্ময়কব ব্যাপাব, বাঙলা নিজে নিজেই শেখা সম্ভব; ইংরেজি শিখতে হ’লে দরকার একটি উদার শিক্ষিত স্বামী! যদি ধরি যে রোকেয়ার বিয়ে হয়েছিলো আঠারো বা ষোলো বছর বয়সে, তাহলে স্বামীর কাছে ইংরেজি শেখার তত্ত্বটি বাতিল ক’রে দিতে হয়; কেননা ওই বন্যাসের পর একটি বিদেশি ভাষা শেখা এবং তাতে Sultana’s Draum লেখা ভাষা অর্জন সম্পর্কে ভুল ধারণামাত্র। তাঁর বিয়ে হয়। কারো মতে ষোলো, কায়ো মতে আঠারো বছর বয়সে। বেশ বড়ো পরিহাস বলে মনে হয় রোকেয়াব বিয়েটিকে : বাঙালি নারীমুক্তির সন্তের বিয়ে হয় এক দোজবর, অবাঙালি, বিহারির সাথে। তার স্বামীটি যে-বছর, ১৮৮০তে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন, সে-বছর জন্ম হয় তার; তিনি স্ত্রী হন। পিতার বয়স্ক এক পুরুষের। সাখাওয়াতের বয়স তখন ছিলো ৩৮ বা ৪২, রোকেয়ার ছিলো ১৬ বা ১৮। ওটি ছিলো বিয়ের জন্যে বিয়ে; বিয়ের সময়ই সবাই জানতো যে দীর্ঘ বৈধব্য পালনই হবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন। মুসলমান পিতৃতন্ত্র রোকেয়ার জীবনকে মর্মস্পশী ক’রে তুলতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে নি; তাকে ধ্বংস ক’রে দিতে পারলেই সেটি সার্থকতা বোধ করতো, কিন্তু পারে নি।

রোকেয়ার পিতা অমানুষ ছিলেন, কিন্তু বড়ো ভাই ও তাঁর স্বামীটি ভিন্ন ছিলেন ওই সময়ের মুসলমান পুরুষদের থেকে। রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলি ভ’রে বয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ও ঘৃণা; পুরুষ’ ধারণাটিই ছিলো তার কাছে আপত্তিকর। পুরুষদের তিনি যে সামান্য করুণা করেছেন, তা সম্ভবত ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। রোকেয়ার রচনাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; পশ্চিমের প্রথম নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মধ্যেও এতোখানি পুরষবিদ্বেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না। মেরি পুরুষকে সমকক্ষ বন্ধু হিশেবে মেনে নিয়েছিলেন রোকেয়া তাও মানতে রাজি হন নি। মেরিব সাথে রোকেয়ার জীবনের মিল ও অমিল দু-ই চোখে পড়ে। মেরি ছিলেন গরিব পরিবারের মেয়ে, লেখাপড়া শিখেছিলেন নিজের চেষ্টায়, বালিকা বিদ্যালয় খুলেছিলেন, বই লিখেছিলেন বালিকাদের শিক্ষা সম্পর্কে। তিনি বিয়ে না ক’রে বাস করেছেন প্রেমিকের সাথে, জন্ম দিয়েছেন অপ্ৰথাগত কন্যা; প্রতারিত হয়েছেন, তারপর আবার প্রেমে পড়ে গর্ভবতী হয়েছেন, এবং কন্যা জন্ম দিতে গিয়ে লোকান্তরিত হয়েছেন মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। মেলােমশার সুযোগ পেয়েছেন মেরি ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের সাথে। রোকেয়া জন্মেছেন ধনী পরিবারে, ব্যান্য কেটেছে অবরোধে, বিয়ে হয়েছে পিতার বয়সী পুরুষের সাথে, জন্ম দিয়েছেন দুটি অকালমৃত কন্যা। তাঁর বিবাহিত জীবন এগারো বা তেরো বছরের। মেরি শারীরিক সম্পর্কে এসেছেন দুটি পুরুষের সাথে, এবং সংস্পর্শে এসেছেন বহু পুরুষের; রোকেয়া শারীরিকভাবে জেনেছেন একটি পুরুষকে, সে-জানাও ছিলো সম্ভবত অতৃপ্তিকর; আর সংস্পর্শে আসেন নি কোনো পুরুষের। রোকেয়ার সমাজের পুরুষ তার কাছে ছিলো পশুর সমান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পুরুষপ্রসঙ্গ তোলেনই নি : পিতাকে তিনি প্রায় পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন, স্বামী ও ভাইদের স্বীকার করেছেন অনেকটা করুণা ক’রে।

নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে নীরবতাই ছিলো তার স্বভাব, কিন্তু ইঙ্গিতেই তিনি জানাতে পারতেন প্রচুর। ৩০, ৪ ৩১-এর এক চিঠিতে লিখেছিলেন : শৈশবে বাপের আব্দর পাই নি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ Urine পরীক্ষা করেছি। পথ্য রোধেছি, ডাক্তাবকে চিঠি লিখেছি। দুবার মা হয়েছিলুম-তাদেরও প্রাণভরে কোলে নিতে পারি নি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি’ [দ্র মোশফেকা (১৯৬৫, ১৫)]। এ হচ্ছে রোকেয়ার সমগ্র আত্মজীবনী, কয়েক পংক্তিতে লেখা কয়েক খণ্ড। এতে জীবনের প্রথাগত ব্যর্থতার ছবিটি যেমন মর্মস্পশী, তেমনই এর একটি পংক্তি সাংঘাতিক : ‘আর এই ২২ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি।’ বৈধব্যের কথা এলেই কেনো আসে আগুনের রূপক, দাউ দাউ ক’রে ওঠে কেনো দেহবিহঁকুৎসব? বিদ্যাসাগর বালিকা বিধবার ‘অসহ্য বৈধব্যযন্ত্ৰণানলের কথা বার বার বলেছেন, রোকেয়া বলেছেন নিজেরই কথা। শরীরকে তিনি সম্পূর্ণ চেপে গেছেন কাজে ও লেখায়, পালন ক’রে গেছেন মুসলমান ব্ৰহ্মচর্য। মুসলমান পুরুষেরা যে তাকে ধন্যধন্য করে, তার অনেকটা তার ওই মর্ষকামী ব্ৰহ্মচর্যের জন্যে। তিনি বলেছেন, ‘আশরাফগণ সপ্তম বর্ষীয়া বিধবা কন্যাকে চির-বিধবা রাখিয়া গৌরব বোধ করেন (রানী ভিখারিণী’, রোর, ২৯১); পদ্মরাগ-এ (রোর, ৪৬২) বলেছেন, ‘সিদিকা নিজেকে ‘চিরকুমারী’ জ্ঞান করিবেন না, কারণ চিরকুমারী নিঃস্ব;.তিনি নিজেকে বিধবা মনে করবেন, যেহেতু বিধবার স্বামী-স্মৃতিরূপ বহুমূল্য সম্পদ থাকে। পতিধ্যান তাহার জীবনের নিত্যসহচর। তাহা না হইলে বিধবা বাচিবে কি লইয়া?’ এ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রকে মেনে নিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

তবে রোকেয়া নিজে পতিধ্যান করেন নি। ২৫ ৪ ৩২-এর এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন : ‘আপনি ঘৃণাক্ষরেও ভাববেন না যে, আমার শ্রদ্ধেয় স্বামীর স্মৃতিরক্ষার জন্যই আমি এ স্কুল আঁকড়ে পড়ে আছি।… আমি আমার স্বামীর নামের কাঙ্গাল নই [মোশফেকা (১৯৬৫,২৪-২৫)]। তিনি বিদ্যালয়ের নামবদলের জন্যেও প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু তাঁর পুরুষ অভিভাবকেরা তাতে রাজি ছিলেন না; কেননা তারা সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল’ নামটিতে দেখতেন পুরুষতেন্ত্রর জয়’;–একটি নারী বালিকাদের শিক্ষা দেয়ার ছলে পুজো ক’রে চলছেন একটি মৃত পুরুষকে! নারীকে মুক্তি চাইতে হবে পুরুষাধিপত্য মেনে নিয়ে; পুরুষের লাশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবিত নারীর থেকে। রোকেয়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি, বিয়ে তার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলো না: তবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পুরুষতন্ত্রের কাছে। রোকেয়া যদি আবার বিয়ে করতেন, তাহলে পুরুষতন্ত্র তাকে বাতিল ক’রে দিতো; নারীমুক্তির কথা ভুলে তাকে থাকতে বাধ্য করতো স্বামীর পদতলে। রোকেয়া ছিলেন আমূল নারীবাদী, কিন্তু তিনি জানতেন। তিনি পৃথিবীর এক বর্বর পিতৃতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত; তাঁকে বিদ্রোহ করতে হবে ওই বর্বরতাকে স্বীকার ক’রেই। ওলস্টোক্র্যাফটের জীবন এ-সমাজে অকল্পনীয় { রোকেয়া নিজের মধ্যে সংহত করেছিলেন প্রবল দ্রোহিতা ও মর্ষকামিতাকে, পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ ও পরাভূত করার জন্যে তাকে সুখের সাথে সহ্য করতে হয়েছে পুরুষতন্ত্রের পীড়ন। কিন্তু তিনি পুরুষতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্যে নিরন্তর লড়াই ক’রে গেছেন; তাঁর রচনাবলি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধারাবাহিক মহাযুদ্ধ।

রোকেয়া লিখেছেন প্ৰবন্ধ, গল্প, উপন্যাস; এবং প্রতিটি আঙ্গিক তিনি ব্যবহার করেছেন। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্ররূপে। তাঁর প্রবন্ধ বিশুদ্ধ মননশীল প্ৰবন্ধ নয়, তাতে রয়েছে কথাশিল্পিতার ছাপ; আবার তার উপন্যাসও পুরোপুরি উপন্যাস নয়, তাতে রয়েছে প্রাবন্ধিকতার ছাপ। বিশুদ্ধ শিল্পসৃষ্টি তাঁর লক্ষ্য ছিলো না; তাঁর লক্ষ্য ছিলো পৌনপুনিক আক্রমণে পুরুষতন্ত্রকে দুর্বল ক’রে নারীকে সমাজে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা। চেতনায় তিনি এগিয়ে ছিলেন তাঁর সময়ের মুসলমান ও হিন্দু সমস্ত পুরুষ, নারী ও মহাপুরুষদের থেকে; তার ছিলো সরাসরি মতপ্রকাশের চমৎকার স্বভাব, এবং ছিলো। প্রখর পরিহাসের শক্তি। স্বামীর মৃত্যুর আগের রোকেয়ার লেখায় দেখা যায় আক্রমণাত্মক প্রবণতা, একাকী জীবনে তাঁর লেখায় বড়ো হয়ে ওঠে পরিহাস, তীক্ষু উইট, যা তাঁর অন্তৰ্গত বিষগ্নতার প্রকাশ। তিনটি ভাষা-বাঙলা, উর্দু, ইংরেজি-ছিলো তাঁর আয়ত্তে, তার হাতের লেখা ছিলো পুষ্পপাপড়ির মতো মনোহর; অনুরাগী ছিলেন তিনি প্রথাগত কবিতার, তিনি নিজেই ছিলেন ভালো কবি; এবং মননশীলতায় ছিলেন সে-সময়ের শ্রেষ্ঠদের একজন। উপন্যাস রচনায় ছিলেন তিনি বঙ্কিমানুসারী, তার পদ্মরাগ-এর প্লট বঙ্কিমী রীতিতে তৈরি। তিনি কি ওলস্টোনক্র্যাফটের নাম শুনেছিলেন, তার বইটি দেখেছিলেন? এর কোনো প্রমাণ তিনি রেখে যান নি, তবে মনে হয় মেরির বই তিনি দেখেন নি; দেখলে রোকেয়া স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে প্ৰবন্ধ না লিখে লিখতেন। সুপরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ বই। তিনি ইংরেজিতে একটি চমৎকার ইউটোপিয়া লিখেছিলেন, এবং বাঙলায় অনুবাদ করেছিলেন; আজো সেটিই বাঙলায় লেখা একমাত্র ইউটোপিয়া। ইউটোপিয়া ও অ্যান্টি-ইউটোপিয়া বা ডিস্টোপিয়া তার চেতনায় বড়ো স্থান ক’রে নিয়েছিলো; কেননা তিনি যে-সমাজে বাস করতেন সেটিই ছিলো এক মূর্ত অ্যান্টি-ইউটোপিয়।, এবং তিনি পেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ওই সমাজকে। শুধু ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নয়, তাঁর পদ্মরাগও একধরনের ইউটোপিয়া, আর তার কয়েকটি রূপকথা- ‘জ্ঞানফল’, ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘নারীসৃষ্টি’, ‘মুক্তিফল’ ইউটোপিয়া ও অ্যান্টি-ইউটোপিয়ার মিশ্রণী।

রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন সার্বিক আক্রমণ। তিনি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন। পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী ও পুরুষের ভাতৃমূর্তি, বর্জন করেছেন নারীপুরুষের প্রথাগত ভূমিকা; তুলনাহীনভাবে আক্রমণ করেছেন। পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা ধর্মকে। রোকেয়া পরে ধর্মের সাথে কিছুটা সন্ধি করেছেন আত্মরক্ষার জন্যে; নইলে তাকে ও তাঁর আদর্শকে অত্যন্ত বিপন্ন ক’রে তুলতো মুসলমান পিতৃতন্ত্র। তিনি এমন এক পিতৃতন্ত্রের সদস্য ছিলেন, যেখানে পুত্র মাকে শেখায় সতীত্ব। তাঁর ভাগনে আবদুল করিম গজনভি, বাল্যকালেই বিলেতে গিয়েছিলেন, মন্ত্রী আর স্যার হয়েছিলেন, কিন্তু মধ্যযুগ থেকে বেরোতে পারেন নি; তিনি খালা রোকেয়াকে পর্দা শেখাতে দ্বিধা করেন নি। খালাকে শর্ত দিয়েছিলেন যদি খালা পর্দা মানেন (এর অর্থ রোকেয়ার আচরণ পর্দাসম্মত ছিলো না বিলোতফেরত স্যার-ভাগনের মতে), তবে তিনি রোকেয়ার স্কুলটি সরকারি করে দেবেন। পুত্র যেখানে মাকে সতীত্ব শেখায়, সে-উৎকট ভূখণ্ডে রোকেয়া ধর্মের নামে মাঝেমধ্যে দু-একটি খাই উৎসর্গ ক’রে নিস্তেজ ক’রে দিতে চেয়েছেন ধর্মকে। ১৯০৪-এ বেরোয রোকেয়ার মূর্তিভাঙা প্ৰবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’ (নবনূর : ১৩১১, ভাদ্র)। মতিচুর-এ (প্রথম খণ্ড : ১৯০৫) মুদ্রিত হয় এর খণ্ডিত, মুসলমান পিতৃতন্ত্রের অনুমোদিত রূপ : স্ত্রীজাতির অবনতি’। এটি রোকেয়ার Vindication of the Rights of Wonian। ওলস্টোনক্র্যাফটের মতো রোকেয়া নারীমুক্তির সার্বিক প্ৰস্তাব পেশা করেন নি। এ-প্রবন্ধে, তবে নারীমুক্তির মূলকথার সবই এতে রয়েছে সংক্ষেপে। এর ‘আপত্তিকর’ অংশের সাথে বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায় এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন ও অন্যান্যের ‘নারীর বাইবেল’-এর (১৮৯৫, ১৮৯৮)।

নারীবাদনেত্রী স্ট্যান্টন দেখেছিলেন, নারীমুক্তির বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্র সব সময়ই উচিয়ে ধরে বাইবেল, তাই তিনি বাতিল ক’রে দেন বাইবেলকেই। তিনি আক্রমণ করেন বাইবেলি নারীর ভূমিকা ও ভাবমূর্তিকে; বলেন : ‘বাইবেলকে আমরা দীর্ঘকাল ধ’রে অন্ধভক্তির বস্তু ক’রে তুলেছি। এখন এটি অন্যান্য বইয়ের মতো পড়ার সময় এসে গেছে, নিতে হবে এর ভালো শিক্ষা বাদ দিতে হবে খারাপটা’ [দ্র হোল ও লেভিন (১৯৭৩, ৪৪৫)]। তিনি ‘পাঁজরের হাড়ের গল্পটিকে ‘তুচ্ছ অস্ত্ৰোপচার’ বলে বাতিল ক’রে দেন; দেখান যে সম্পূর্ণ বাইবেল দাঁড়িয়ে আছে হাওয়া বা নারীর পাপের ধারণা ভিত্তি করে। তিনি বলেন, সাপটি, ফলগাছটি এবং নারীটিকে সরিয়ে নাও; তারপর আর থাকে না কোনো পতন, কোনো ক্রুদ্ধ বিচারক, কোনো নরক, কোনো চিরশাস্তি:- সুতরাং দরকার পড়ে না কোনো ত্ৰাতার। এভাবে খসে পড়ে সমগ্র খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের তলদেশ। এ-কারণেই সমস্ত বাইবেলি গবেষণা ও উচ্চতর সমালোচনায় পণ্ডিতেরা কখনো নারীর অবস্থানটি ছুয়ে দেখেন না’ [দ্র হোল ও লেভিন (১৯৭৩, ৪৪৫)]। এর ফলে হৈচৈ পড়ে পশ্চিমে; ভদ্ৰ নারীমুক্তিবাদীরা অস্বীকার করেন স্ট্যান্টনকে। এর মাত্র ন-বছর পরে পৃথিবীর এক অন্ধকার কোণে উগ্র পিতৃতন্ত্রের মধ্যে রোকেয়া, মাত্র চব্বিশ বছরের তরুণী, ঘোষণা করেন : ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।’ পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী সরাসরি বাতিল ক’রে দেন কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থকে নয়, সমস্ত ধর্মগ্রন্থকে; ধর্মগ্রন্থের পেছনের সত্যকে প্রকাশ করেন অকপটে। পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থাটি এর আগে, ও পরে, এমন আঘাত আর কখনো বোধ করে নি। [রোর, সম্পাদকের নিবেদন, (১১)-(১৩)] :

‘আমাদেব যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়াব পর দাসত্ত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পাৱি নাই;. যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা কবিয়াছেন, আমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্ৰাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহ পরে ধর্মেৰি আদেশ ভাবিয়া শিবোধাৰ্য করিয়াছি; এখন ত অবস্থা এই যে, ভূমিষ্ঠ হওয মাত্রই শুনিতে পাই : ‘প্যাটু তুই জন্মেছিস্ গোলাম, থাকিবি গোলাম।’ সুতরাং আমাদের আত্মা পর্যন্ত গোলাম হইয়া যায় …
আমরা যখনই উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানেব প্রতি দৃষ্টিপাত করি, আমনই সমাজ বলে : ‘ঘুমাও, ঘুমাও, ঐ দেখ নরক।’ মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্ততঃ আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি।…. আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ কবিয়াছেন।…
এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রূচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আব্ব কিছুই নহে। মুণিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুণির পিন্ধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিযাম দেখিতে পাইতেন। যাহা হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কি না, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত বৰ্মণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না।…এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্ৰভুত্ব সহ উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।…
‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর কবিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।…’

রোকেয়া কোনো বিশেষ ধর্মকে বাতিল করেন নি, বাতিল করেছেন সব ধর্মকেই। ১৯০৪-এ এটা সম্ভব ছিলো, কিন্তু রোকেয়া যদি আজ একথা বলতেন, তবে তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় ছিড়ে ফেলা হতো। মুসলমান পিতৃতন্ত্র তাঁর ধর্মসমালোচনা অনুমোদন করে নি, তাই রোকেয়াকে বাদ দিতে হয়েছিলো তাঁর রচনার শ্রেষ্ঠাংশ; এবং পরে তাকে কিছুটা সন্ধি করতে হয়েছিলো মুসলমান পিতৃতন্ত্রের সাথে। স্ত্রীজাতির অবনতি’তে রোকেয়া শুধু পিতৃতন্ত্রের হিংস্র বলপ্রয়োগসংস্থাটিকে আক্রমণ করেন নি, তিনি আক্রমণ করেছেন। পুরুষতন্ত্রের সমগ্র জীবনপরিকল্পনাকেই। তিনি ব্যাখ্যা ও বাতিল করেছেন। পুরুষতন্ত্রের তৈরি প্রতিটি ভাবমূর্তি। নারীর সমস্ত প্রথাগত ভাবমূর্তি বর্জন ক’রে তিনি নারীর অবস্থানের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন নারী দাসী মাত্র। তিনি বলেছেন, ‘এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি? দাসী৷’ (রোর, ১৭)!! একবার নয়, বলেছেন বার বার। তিনি বলেছেন, ‘দাসী৷’ শব্দে অনেক শ্ৰীমতি আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ কি? দানকর্তাকে ‘দাতা’ বলিলে যেমন গ্রহণকর্তালে “গ্রহীতা” বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে “স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর” বলিলে অপরকে “দাসী” না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন’ (রোর, পাদটীকা, ১৮-১৯)? তার কাছে নারীপুরুষের প্রথাগত সম্পর্ক কোনো পবিত্র মহৎ ব্যাপার নয়; তা শক্তিব সম্পর্ক, যাতে একজন জয়ী ও আরেকজন পরাজিত। রোকেয়া জানতেন। নারীপুরুষের লৈঙ্গিক রাজনীতিতে বলপ্রয়োগের ফলে নারী পরাজিত; তাদের সম্পর্ক লৈঙ্গিক রাজনীতিক।

নারী কেনো দাসী হয়েছে, তাও ব্যাখ্যা করেছেন রোকেযা; তাঁর ব্যাখ্যা অনেকটা এঙ্গেলসের (১৮৮৪) ব্যাখ্যার কাছাকাছি। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন ব্যক্তিমালিকানা ও পরিবারের উৎপত্তিই নারীর পুরুষাধীনতার মূলে; এবং রোকেয়া (রোর, ১৭) বলেছেন :

‘পুবাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ মানবজাতিব এক অংশ (নর) যেমন নানা বিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পাবিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।‘

তিনি বিশ্বাস করেন যখন সমাজবন্ধন ছিলো না, তখন মুক্ত স্বায়ত্তশাসিত ছিলো নারী। সমাজবন্ধনের মূলেই রয়েছে পরিবার, তাই পরিবারই যে নারীর দাসীত্বের মূল কারণ, তা অস্পষ্ট থাকে নি তার কাছে। পরিবারে পুরুষ হয়েছে প্ৰভু, নারী দাসী। তিনি অবশ্য প্রশ্ন করেছেন, ‘আমাদের এ বিশ্বব্যাপী অধঃপতনের কারণ কেহ বলিতে পারেন কি? সম্ভবত সুযোগের অভাব ইহার প্রধান কারণ। স্ত্রীজাতি সুবিধা না পইয়া সংসারের সকল প্রকার কার্য হইতে অবসর লইয়াছে’ (রোর, ১৭)। সুযোগটা যে নারীকে দেয় নি। পুরুষ, তাও তিনি জানিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে দাসত্বের কুপ্রভাব পড়ে দাসদের স্বভাবের ওপর, নারীর ওপরেও পড়েছে; রোকেয়া তাও দেখিয়েছেন চমৎকার ও বিস্তৃতভাবে। ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিডিকেশন-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদের নাম ‘Observations on the State of Degradation to which Woman is Reduced by Various Causes’: নানা কারণে নারীর যে-অবনতি ঘটেছে, সে-সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ’। রোকেয়ার প্রবন্ধটির নাম ‘আমাদের/স্ত্রীজাতির অবনতি’ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ওলস্টোনক্র্যাফটু দেখিয়েছেন নারীকে বন্দী করার পর তার মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট ক’রে ফেলা হয়েছে, নারীকে শেখানো হয়েছে তুচ্ছ রূপ, বিনোদন, ভাবাবেগ প্রভৃতিতে মেতে থাকতে, আর তারাও বোধ করেছে ‘নিকৃষ্টতায় মহিমান্বিত’! রোকেয়াও বলেছেন একই কথা : ‘আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে’ (রোর, ১৭)। ওলস্টোনক্র্যাফটু রূপচর্চা, অলঙ্কার, বিনোদন, উপন্যাস পড়া, শারীরিক ও মানসিক বলহীনতাকে আক্রমণ করেছেন। প্রবলভাবে, রোকেয়াও তাই করেছেন। রোকেয়া বলেছেন, ‘সৌন্দর্যবর্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্বলতা নহে* (রোর, ২১)? তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘আমরা শারীরিক বল, মানসিক সাহস, সব কাহার চরণে উৎসর্গ করিয়াছি (রোর, ২৪)? ওলস্টোনক্র্যাফটের মতোই বলেছেন, ‘শরীর যেমন জড়পিণ্ড, মন ততোধিক জড়’ (রোর, ২৫); বলেছেন, আমাদের শয়ন-কক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না’ (রোর, ২৬); বহুকাল হইতে নারী-হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায়, নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই “দাসী” হইয়া পড়িয়াছে’ (রোর, ১৮)।

রোকেয়া ভিন্ডিকেশন পড়েন নি ব’লেই মনে হয়, পড়লে নারীর অধিকার সম্পর্কে হয়তো সম্পূর্ণ বইই লিখতেন; কিন্তু কেনো মিল ওলস্টোনক্র্যাফটের সাথে তাঁর? এর এক চমৎকার উত্তর অন্য প্রসঙ্গে তিনি নিজেই দিয়েছেন : ‘বঙ্গদেশ, পাঞ্জাব, ডেকান (হায়দরাবাদ), বোম্বাই, ইংলন্ড- সৰ্ব্বত্র হইতে একই ভাবের উচ্ছাস উখিত হয় কেন? …ইহার কারণ সম্ভবতঃ ব্রিটীশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা’ (মতিচুর, নিবেদন)! এ যে প্রচণ্ড পরিহাস- ব্রিটীশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা’- এটাও পুরুষতন্ত্রকেই পরিহাস। তিনি জানেন এটা আধ্যাত্মিক নয় সম্পূর্ণ বাস্তবের একতা, নারীর দাসীত্ব বিশ্বজনীন ব্যাপার। অলঙ্কারের যে-ব্যাখ্যা রোকেয়া (রোর, ১৯-২০) দিয়েছেন, তা নারীকে দাসী থেকে পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে :

‘আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি-এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ! এখন ইহা সৌন্দর্যবর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলঙ্কার দাসত্ত্বের নিদর্শন (originally hadges of slavery) ছিল। তাই দেখা যায় কারাগারে বন্দীগণ পায় লৌহনির্মিত বেড়ী পরে, আমরা (আদরের জিনিস বলিয়া) স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী অর্থাৎ ‘মল’ পারি। উহাদের হাতকড়ি লৌহ-নির্মিত, আমাদেব হাতকড়ি স্বর্ণ বা রৌপ্য-নির্মিত চুড়িা কুকুরের গলে যে গলাবন্ধ (চমথ-ড়মফফটব্য) দেখি, উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয় চিক নির্মিত হইয়াছো…গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া ‘নাকাদড়ী’ পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের ‘নোলক’ পরাইয়াছেন!! ঐ নোলক হইতেছে ‘স্বামী’ব অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন!’

নারী শুধু দাসীই নয়, তারও নিম্নস্তরের; তিনি বলেছেন, ‘আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি’ (রোর, ২৭৭)। তিনি দেখিয়েছেন নারী আসলে নিরাশ্রয়, কেননা তার নিজের বলে কিছু নেই; এমনকি নিজের ওপরও নেই নারীর নিজের অধিকার। নারীর সবখানেই থাকে পরাশ্ৰিত; যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধুরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রভু-গৃহে থাকি। যখন… গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই,-তখনও অভিভাবকের বাটিতে থাকি।.গৃহ বলিতে আমাদের একটিও পর্ণকুটীর নাই। প্ৰাণী-জগতের কোন জন্তুই আমাদের মত নিরাশ্রয় { নহে। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের’ (‘গৃহ’, রোর, ৭৪)। মনে পড়ে উলফের এ রুম অফ ও অ্যান্স জেট্রন-এর কথা। পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের জন্যে তিনি নারীর অবস্থানটিকে শনাক্ত ক’রে নিয়েছেন, এবং নারীর বিকৃত স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন।

‘পুরুষ’ ধারণাটি রোকেয়ার ধারাবাহিক আক্রমণস্থল : তিনি উপহাস করেছেন পুরুষকে, তাকে গণ্য করেছেন পশুর থেকেও নিকৃষ্ট, আদমেব কাল থেকেই পুরুষকে দেখিয়েছেন নির্বোধরূপে। পুরুষ তার চোখে প্ৰতারক আর পীড়নকারী। প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বজুড়ে চলে এসেছে নারীবিদ্বেষের যে-ধারাটি, রোকেয়া একা যেনো তাকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন প্রচণ্ড পুরুষবিদ্বেষের সাহায্যে। পুরুষ তাঁর নিরন্তর আক্রমণলক্ষ্য, কেননা পুরুষ নারীকে পরিণত করেছে দাসীতে, পুরুষ কেড়ে নিয়েছে নারীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা; কিন্তু তিনি নারীর সাম্য চেয়েছেন তাঁর ধিক্কৃত পুরুষের সাথেই। তাঁর পুরুষবিদ্বেষ ও পুরুষের সাথে সাম্য লাভের দাবি এমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে ফ্রয়েড বা ফ্রয়েডীয়রা তাকে পেলে খুব সুখবোধ করতেন; তাঁরা তাকে শনাক্ত করতেন এক পুংগূঢ়ৈষ্যা-শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত নারীরূপে; কিন্তু তিনি তাদের যে-উত্তর দিতেন, তাতে অনেক আগেই ভেঙে পড়তো ফ্রয়োডীয় মনোবিজ্ঞানের কুসংস্কারসৌধ। তিনি পুরুষকে বলেছেন, ‘নিরাকারে পিশাচ’ (‘গৃহ’, রোর, ৭৩); বলেছেন, ‘ডাকাতী, জুয়াচুরি, পরস্বাপহরণ, পঞ্চ ‘মকার’ আদি কোন পাপের লাইসেন্স তাঁহাদের নাই’ (পদ্মরাগ : রোর, ৩৩৪)? বাঙালি পুরুষকে পরিহাস ক’রে বলেছেন, ‘ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা’ (‘নিরীহ বাঙ্গালী’, রোর, ৩২)! পদ্মরাগ-এর সকিনা লতিফকে বিদ্রুপ করে বলেছে, ‘খোদাতালার সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব পুরুষ হইয়াছেন, ইহা অপেক্ষা আর কি বাঞ্ছনীয়’ (রোর, ৩৫২)? এক বাক্যে তিনি কাঁপিয়ে দিয়েছেন পুরুষ ও তার স্রষ্টাকে। পুরুষকে বলেছেন প্রতারক : বহুকাল হইতে পুরুষ নারীকে প্রতারণা করিয়া আসিতেছে, আর নারী কেবল নীরবে সহ্য করিয়া আসিতেছে’ (রোর, ২৭৮)। বলেছেন, ‘কুকুরজাতি পুরুষাপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য। (‘ডেলিশিয়াহত্য’, রোর, ১৬২); যদি স্বার্থপরতা, ধূৰ্ততা ও কপটাচারকে সদগুণ বলা যায়, তবে অবশ্য পুরুষজাতি কুকুরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ’ (রোর, ১৭০)! পুরুষ তাঁর চোখে অলস, বলেছেন : ‘অলসেরা অতিশয় বাকপটু হয়’ (‘সুলতানার স্বপ্ন’, রোর, ১৩৫)।

রোকেয়া তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে পুরুষদের রেখেছেন, তাদের সম্পূর্ণ বহিষ্কার করেন নি; হয়তো তিনি ভেবেছেন। পুরুষদের অন্তত একটি উপযোগিতা রয়েছে; কিন্তু সাম্প্রতিক প্ৰজননবিজ্ঞানের কথা যদি তিনি কল্পনা করতে পারতেন, ভাবতে পারতেন যদি কোনো ‘সাহসী নতুন বিশ্ব’-এর কথা, তাহলে হয়তো তিনি পুরুষ প্ৰজাতিটিকেই বাতিল ক’রে দিতেন। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রে পুরুষ রেখেছেন, কিন্তু তাদের বন্দী করেছেন। অবরোধে। নারীস্থানে রাস্তায় কেনো পুরুষ নেই, জানতে চায় সুলতানা। সারা তাকে জানায়, ‘এ দেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে’ (‘সুলতানার স্বপ্ন’, রোর, ১৩৬); এতে পরম তৃপ্তি পেয়েছে সুলতানা : ‘আমি প্ৰাণে বড় আরাম পাইলাম;-পৃথিবীতে অন্ততঃ এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে’ (রোর, ১৩৬)! তাদের জন্যে তিনি তৈরি করেছেন ‘জেনানা’র প্রতিরূপ মর্দানা’। সেখানকার ভাষা বিপরীত ধরনের লিঙ্গবাদী, বাঙলায় ‘নারীভাবাপন্ন বলতে যা বোঝায়, নারীস্থানে তা বোঝায্য ‘পুরুষভাবাপন্ন’ শব্দে, যার অর্থ ‘পুরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম’ (রোর, ১৩৪)। তার কাছে পুরুষ বন্য জন্তু, বদ্ধ পাগল; তাই নারী ‘নিরাপদ নহে,-যতদিন পুরুষজাতি বাহিরে থাকে’ (রোর, ১৩৬)! সারা বলেছে, তাহারা (পুরুষেরা) কোন ভাল কাজের উপযুক্ত নহে (রোর, ১৩৮)। তিনি পুরুষদের নিয়োগ করেছেন নিম্নপদ ও পেশায় : ‘তাহারা (পুরুষেরা) কেরানী মুটে মজুরের কাজ করিয়া থাকেন’ (রোর, ১৪৯)। নারীস্থান যে কল্যাণময়, তার কারণ পুরুষ-শয়তানেরা সেখানে অবরুদ্ধ; সুলতানা বলেছে, আপনার স্বয়ং শয়তানকেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, আর দেশে শয়তানী থাকিবে কিরূপে (রোর, ১৪৭)। রোকেয়া চান না যে তাঁর একটি তীরও ব্যৰ্থ হোক; তাই তিনি পাদটীকায় ‘শয়তানকে’ কথাটি ব্যাখ্যা ক’রে দিয়েছেন ‘পুরুষ জাতিকে’ বলে।

কিন্তু রোকেয়া নারীর জন্যে চেয়েছেন অপদাৰ্থ নির্বোধি দুশ্চরিত্র পাপিষ্ঠ শয়তান পাশবিক পুরুষেরই সমকক্ষতা। এটা কোনো শিশ্নাসূয়াগ্ৰস্ততা বা পুংগূঢ়ৈষ্যা নয়, এটা একটি হারানো শিশ্ন ফিরে পাওয়ার ফ্রয়োড়ীয় রোগ নয়; এটা নারীর পূর্ণ অধিকার লাভ। তিনি পুরুষকে ঈর্ষা করেন নি, ঈৰ্ষা করেছেন। পুরুষের স্বাধীনতা ও অধিকারকে; বলেছেন, ‘একই সঙ্গে সকলে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হও…। স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে …পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব’ (স্ত্রীজাতির অবনতি’, রোর, ২৯)। পুরুষের সাথে সমকক্ষতার ব্যাপারটি তিনি ব্যাখ্যা ক’রে দিয়ে কোনো ফ্রয়েডীয় অপবিজ্ঞানের অপব্যাখ্যার সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ (রোর, পাদটীকা, ২৯)। রোকেয়া চেয়েছেন পুরুষের সাথে সম্পূর্ণ সাম্য; তাঁর কাছে নারীপুরুষ লিঙ্গগতভাবে ভিন্ন, কিন্তু উভয়ই মানুষ, এবং উভয়ের জীবনেরই লক্ষ্য ও সার্থকতা এক : ‘পুরুষদের স্বাৰ্থ এবং আমাদের স্বাৰ্থ ভিন্ন নহে- একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই’ (রোর, ৩১)। তিনি নারীর অধীনতার মূল কারণ হিশেবে, প্রাচীন থেকে আধুনিক কালের অন্যান্যের মতোই, ধরেছেন শারীরিক দুর্বলতাকে : শারীরিক দুর্বলতাবশতঃ নারীজাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ ‘প্ৰভু!’ হইতে পারে না’ (অর্ধাঙ্গী’, রোর, ৪৩)। অপর জাতি’ কথাটি লক্ষ্য করার মতো; পুরুষ যেনো একটি ভিন্ন ও বিরোধী জাতি নারীর থেকে। তিনি শারীরিক শক্তির উপকারিতা বুঝেছেন, তিন্তু তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড ব’লে স্বীকার করেন নি; তার কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড মানসিক শক্তি। তিনি নারীর জন্যে চেয়েছেন মানসিক শক্তি, যা অর্জনের উপায় হচ্ছে শিক্ষা : ‘আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দ শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি (রোর, ৪৩-৪৪)।

পুরুষতন্ত্রের তৈরি এক ঐশী ভাবাদর্শ স্বামী, যা পুরুষকে উত্তীর্ণ করেছে নারীর বিধাতার স্তরে। হিন্দু নারীরা স্বামীকে পুজো করে, হিন্দু নারীর জন্যে স্বামী ছাড়া আর কোনো প্ৰভু নেই; মুসলমান নারীর বেহেস্তও স্বামীর পদতলে, এবং হাদিসে আছেআল্লা ছাড়া আর কাউকে সেজদা করার বিধান যদি থাকতো, তাহলে নারীকে নির্দেশ দেযা হতো স্বামীকে সেজদা করার। বাঙলায় ‘স্বামী’ শব্দ ও ধারণাটি এখন অশ্লীল হয়ে উঠেছে, এটা এখন পরিহার্য শব্দগুলোর একটি; রোকেয়া অনেক আগেই বাতিল করেছিলেন ‘স্বামী’ ধারণাটি। এটিকে বাতিল করার অর্থ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের একটি বড়ো মন্দিব ধ্বংস করা। রোকেয়া বলেছেন, ‘তাঁহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্ৰমে আমাদের স্বামী হইয়া উঠিলেন। আর আমরা ক্রমশঃ তাঁহাদের গৃহপালিত পশুপক্ষীর অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হই। পড়িয়াছি (রোর, ১৮-১৯)! তিনি দাবি করেছেন নারী দাসীত্ব করে, তবে পুরুষও প্রেমবশত একধরনের দাসত্ব করে, কিন্তু পুরুষকে ‘দাস’ বলা হয় না। তিনি প্রশ্ন করেছেন, সমাজ তবু বিবাহিত পুরুষকে ‘প্রেম-দাস’ না বলিয়া স্বামী বলে কেন’ (রোর, পাদটীকা, ১৯)? ‘স্বামী’ তাঁর কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর শব্দ; প্রশ্ন করেছেন, শ্ৰীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্ৰীমানদিগকে ‘স্বামী’ ভাববেন কেন’ (রোর, ৪৩)? তিনি এ-শব্দটি বাতিল ক’রে প্রস্তাব করেছেন একটি নতুন শব্দ : ‘আশা করি এখন ‘স্বামী’ স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দ প্রচলিত হইবে’ (রোর, ৪৪)।

রোকেয়া প্রথাগত ছকবাধা নারীভাবমূর্তি বা ‘স্টেরিঅটাইপ স্বীকার করেন নি; তিনি ওই ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে তা বর্জন করেছেন। নারী হবে সীতা বা রহিমা, হবে মর্ষকামিতার উদাহরণ, পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে এমন ধারণা; তিনি তা বাতিল করেছেন। রোকেয়া বলেছেন, ‘এ দেশের গ্রন্থকারেরা নারী চরিত্রকে নানা গুণ ভূষায় সজ্জিত করেন বটে; বেশীর ভাগে অবলা হৃদয়ের সহিষ্ণুতা বর্ণনা করা হয় (কারণ রমণী পাষাণ প্ৰায় সহিষ্ণু না হইলে তাহার প্রতি অত্যাচারের সুবিধা হইত না যে!)’ (‘ডেলিশিয়া-হত্য’, রোর, ১৫৫)। পুরুষতন্ত্র নারীকে ক’রে তুলেছে মর্ষকামিতার উদাহরণ, সে-নারীই পুরুষতন্ত্রের প্রশংসিত যে সহ্য করে অসহ্য পীড়ন; কিন্তু রোকেয়া তা মানেন নি। তিনি (রোর, ৩৬-৩৭) বলেছেন :

‘নারীকে শিক্ষা দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন।… পুতুলের সঙ্গে কোন বালকের যে-সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্ধও প্রায় সেইরূপ।… রামচন্দ্ৰ ‘স্বামিত্বের’ ষোল আনা পরিচয় দিয়াছেন!! আর সীতা?–কেবল প্ৰভু রামের সহিত বনযাত্রার ইচ্ছা প্ৰকাশ কবিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাহারও ইচ্ছা প্ৰকাশের শক্তি আছে।‘

তিনি সীতার এক প্রতিরূপ তৈরি করেছেন পদ্মরাগ-এ, যার নাম সিদ্দিকা। রামায়ণ-এ রাম ত্যাগ করেছিলো সীতাকে, পদ্মরাগ-এ নেয়া হয় তার প্রতিশোধ : সিদিকা ত্যাগ করে স্বামীকে। সমগ্ৰ নারীসমাজের পক্ষে প্ৰতিশোধ নেয়ার জন্যে কয়েক হাজার বছরের প্রস্তুতি নেয় একটি নারী, তাকে সৃষ্টি করেন রোকেয়া, তার নাম সিদ্দিকা। রোকেয়ার পদ্মরাগ, অসাধারণ উপন্যাস নয়, কিন্তু এতেই ঘটে এক অসাধারণ ঘটনা : এই প্রথম পূর্বদেশের এক নারী পরিত্যাগ করে পুরুষকে, তার স্বামীকে। সিদ্দিকা বলেছে (রোর, ৪৫৩) :

‘আমি যদি উপেক্ষা লাঞ্ছনার কথা ভুলিয়া গিয়া সংসারের নিকট ধরা দিই, তাহা হইলে ভবিষ্যতে এই আদর্শ দেখাইয়া দিদিমা ঠাকুমাগণ উদীয়মানা তেজস্বিনী রমণীদের বলিবেন, ‘আর রােখ তোমার পণ ও তেজ- ঐ দেখ না, এতখানি বিড়ম্বনাব পরে জয়নব আবার স্বামী-সেবাই জীবনের সার করিয়াছিল।’ আর পুরুষ-সমাজ সগৰ্বে বলিবেন, ‘নারা যতই উচ্চশিক্ষিতা, উন্নতমনা, তেজস্বিনী, মহীয়সী, গবীয়সী হউক না কেন,- ঘুরিয়া ফিৱিযা আবাব আমাদের পদতলে পড়িবেই পড়িবে!’ আমি সমাজকে দেখাইতে চাই, একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী-জন্মের চরম লক্ষ্য নহে; সংসারধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে। পক্ষান্তরে আমার এই আত্মত্যাগ। ভবিষ্যতে নারীজাতির কল্যাণের কারণ হইবে বলিয়া আশা করি।‘

সিদ্দিকা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তার অতীতের, বর্তমানের, ভবিষ্যতের সমস্ত সমস্ত নারীর পক্ষে। সে দেখিয়েছে ‘একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী-জন্মের চরম লক্ষ্য নহেঃ সংসারধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে।’ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এমন স্পষ্ট উচ্চারণ ও পদক্ষেপ সমগ্র বাঙলা সাহিত্যে দুর্লভ; সিদ্দিকা শুধু মনে করিয়ে দেয় ইবসেনের নোরাকে। লতিফ জানতে চেয়েছে, ‘সিদ্দিকী, স্পষ্ট বল, তুমি আমার গৃহিণী হইবে কি না?’ সিদিক বলেছে, ‘না। তুমি তোমার পথ দেখ, আমি আমার পথ দেখি’ (রোর, ৪৫৯)। সিদিক নিষ্ঠুর নয়, সে যেমন বিবাহবিচ্ছেদ চায় নি, তেমনই চায় নি। স্বামীর পায়ের নিচে বেহেস্তও। সিদ্দিকা হয়ে উঠেছে বিশ্বপুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীতন্ত্রের কণ্ঠস্বর, এবং সে শুধু কথা বলে নি, বাস্তবায়িত করেছে নিজের লক্ষ্য। সমগ্ৰ নারীজাতির দায়ভার সে তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে। রোকেয়া কোনো মধুর মোহ জাগিয়ে রাখতে চান নি, পাঠকের মনে এমন কোনো রোম্যানটিক ভাববিলাস লালনের সুযোগ রাখেন নি যে পরে কোনো দিন মিলন ঘটবে সিদ্দিকা আর লতিফের। উপন্যাসের শেষবাক্য দুটি যেমন মানবিকতায় কোমল, তেমনই বিদ্রোহে নির্মম; লতীফ সিদ্দিকার হাত ধরিয়া গাড়ী হইতে নামাইলেন। এই তাহদের শেষ দেখা’ (‘রোর, ৪৬৮)। সিদ্দিকা নোরার থেকেও কঠোর।

নারীর পুরুষাধীনতার দুটি প্রধান কারণ : শরীর ও অর্থনীতি। রোকেয়া বিশ্বাস করেছেন। পুরুষ নারীকে প্রথমে শারীরিক শক্তিতে পরাভূত ক’রেই বন্দী করেছে, শেষে নারীকে আর্থনীতিক এলাকা থেকে বের করে দিয়ে ক’রে তুলেছে অসহায়। শারীরিক শক্তিতে নারী কখনো পুরুষের সমান হবে না বলে তিনি বিশ্বাস করেছেন, তার দরকার আছে ব’লেও মনে করেন নি। কিন্তু যদি প্রতিষ্ঠিত হয় আর্থনীতিক সাম্য, তাহলে ঘুচিবে নারীর পুরুষাধীনতা। তাই তিনি দাবি করেছেন নারীর আর্থ স্বাধিকার। তিনি বলেছেন, ‘পুরুষের উপার্জিত ধন ভোগ করে বলিয়া নারী তাহার প্রভুত্ব সহ্য করে। কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক। বোধ হয়, স্ত্রীজাতি প্ৰথমে শারীরিক শ্ৰমে অক্ষম হইয়া পরের উপার্জিত ধনভোগে বাধ্য হয় এবং সেইজন্য তাহাকে মস্তক নত করিতে হয়’ (রোর, ২৮)। নারীর মুক্তির উপায় আর্থ স্বনির্ভরতা লাভ : ‘যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব।’ (রোর, ২৯-৩০)। তিনি জানেন যে নারী কম পরিশ্রম করে না, তবে তার পরিশ্রমের কোনো আর্থ মূল্য নেই। স্বামীর সংসারে নারী বেতনাহীন দাসী। তিনি বলেছেন, ‘উপার্জন করিব না কেন?…যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামী’র গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না।’ (রোর, ৩০)? কোনো পেশাই তার কাছে উপেক্ষণীয় নয়; বলেছেন, ‘আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাদিয়া মারি কেন’ (রোর, ৩০)? তিনি উচ্চারণ করেছেন নারীমুক্তির এক চরম বাণী (রোর, ৩০) :

‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কাৰ্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের। অন্নবস্ত্ৰ উপাৰ্জন করুক।‘

কিন্তু আজো কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করা হয় নি; আর যাদের করা হয়েছে তারা কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতার থেকে পছন্দ করে শুভবিবাহেম শেকল।

পুরুষতন্ত্রকে বহুমুখি আক্রমণে বিপর্যস্ত করে রোকেয়া প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর নারীতন্ত্র। নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি সৃষ্টি করেছেন নারীস্থান, এবং পুরুষকে অবরুদ্ধ করেছেন গৃহের ভেতরে (পুরুষের প্রয়োজন কেনো তা তিনি স্পষ্ট করে বলেন নি), বদলে দিয়েছেন পুংলিঙ্গবাদী ভাষার স্বভাব, বার বার লিখেছেন ইউটোপিয়া ও অ্যান্টি-ইউটোপিয়া (বা ডিস্টোপিয়া)। নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সার্বিক উদ্যোগ নিয়েছেন রোকেয়া Sultana’s Dream (১৯০৫) বা সুলতানার স্বপ্ন’-এ। ইউটোপীয় ভাবনাকল্পনার মূলে থাকে বিশেষ ধরনের সমাজ, ওই বিকৃত সমাজের চরম সংশোধন সম্পন্ন করা হয় ইউটোপিয়ায়। অরওয়েল বলেছেন, ‘ন্যায়সঙ্গত সমাজের স্বপ্ন মানুষের কল্পনাকে যুগে যুগে দুৰ্মরভাবে আলোড়িত করেছে, তাকে আমরা স্বৰ্গরাজ্য বলতে পারি বা বলতে পারি শ্রেণীহীন সমাজ, বা তাকে মনে করতে পারি অতীতের কোনো স্বর্ণযুগ, যা থেকে অধঃপতিত হয়েছি আমরা ‘ [দ্র কৃষাণ কুমার (১৯৮৭, ২)। ইউটোপিয়ার উদ্ভববিকাশ ঘটেছে পশ্চিমে, পূর্বাঞ্চলে কেউ। ইউটোপিয়া লেখেন নি; এর একমাত্র ব্যতিক্রম রোকেয়া। অনেকে মনে করেন। পশ্চিমে যতো ইউটোপিয়া লেখা হয়েছে, তার সবই কোনো-না-কোনোরূপে প্লাতোর রিপাবলিক থেকে উৎসারিত, ওগুলো রিপাবলিক-এর





পাদটীকা। তবে প্লাতোর অনেক আগেই ইউটোপীয় ভাবনার বিকাশ ঘটেছে ইউরোপে, যার পরিচয় মেলে খ্রিপূ সপ্তম শতকের হেসিঅব্দের ও অর্কস অ্যান্ড ডেইজ-এ। তিনিই প্রথম কল্পনা করেছিলেন এক স্বর্ণযুগের, যখন মানুষেরা বাস করতো দেবতার মতো, যাদের মন মুক্ত ছিলো সমস্ত দুঃখকষ্ট থেকে, যখন কোনো কাজ ছিলো না, যখন গাছে গাছে ধ’রে থাকতো সুমিষ্ট ফল। অসংখ্য ইউটোপিয়া লেখা হয়েছে, তবে সাহিত্যের এ-আঙ্গিকটি নাম পেয়েছে টমাস মুরের ইউটোপিয়া (১৫১৬) থেকে। মুরের বই থেকে ইউটোপিয়ার চরিত্র বদলে যায়; তিনি একটি শুদ্ধ সমাজের বিধান না দিয়ে তা বাস্তবায়িত করেন তাঁর বইতে। ইউটোপিয়ায় চিত্রিত হয় উৎকৃষ্টতম সমাজব্যবস্থা, তাকে বিমূর্ত না রেখে ক’রে তোলা হয় মূর্ত। ইউটোপিয়া বর্তমানে প্রচলিত কোনো সমাজের বিদুপাত্মক রূপ নয়, তাতে চিত্রিত হয় একটি সম্পূর্ণ সমাজ। অ্যান্টি-ইউটোপিয়া বা ডিস্টোপিয়ায় চিত্রিত হয় নিকৃষ্টতম সমাজ।

রোকেয়া তার নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে লিখেছেন ইউটোপিয়া ও ডিস্টোপিয়া দু-ই। রোকেয়ার ‘সৌরজগৎ’ সংলাপটিতে আভাস পাওয়া যায় ইউটোপিয়ার : ওই পরিবারে একটি মাত্র পুরুষ, আর সবাই নারী। ওই পরিবারে রয়েছে গৃহিণী ও নটি কন্যা, কোনো ছেলে নেই। সেখানে পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে জাফর আলী। বিজ্ঞানের প্রতি রোকেয়ার আকর্ষণ ছিলো, ওই পরিবারের মেয়েবাও বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট; তাদের তিনজন ভর্তি হতে চায় ‘টেকনিকাল স্কুলে’। রোকেয়াই বোধ হয় এ-অঞ্চলে প্রথম ভাষায় লিঙ্গবাদ ব্যাপারটি উপলব্ধি করেছিলেন। গওহর জাফরকে তিরষ্কার করে, ‘ইহা C57 womanishness (স্ত্রীভাবে)।’ নূরজাহী এতে প্ৰবল আপত্তি জানিয়ে বলে : ‘womanish’ শব্দে আমি আপত্তি করি! ভীরুতা’, ‘কাপুরুষতা’ বল না কেন’ (রোর, ১১৬)? পশ্চিমের নারীবাদীদের ভাষিক লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনেক আগে রোকেয়া এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন; ভাষা থেকে মুছে দিয়েছিলেন। লিঙ্গবাদ। নূরজাহী প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রশংসা ক’রে বলে, ‘উক্ত শিক্ষয়িত্রীটি অতিশয় ভদ্রলোক’ (রোর, ১১৭)। ভাষা থেকে লিঙ্গবাদ কমছে, কিন্তু শিক্ষয়িত্রীকে ‘ভদ্রলোক’ বলার অবস্থা আজো আসে নি, তবে রোকেয়া ১৯০৫ সালেই ‘ভদ্রমহিলা’ বাদ দিয়ে ব্যবহার করেছিলেন ‘ভদ্রলোক’। শুধু লিঙ্গবাদ মুছে দিয়েই তিনি তৃপ্তি পান নি, তিনি শুরু করেছিলেন বিপরীত ধরনের লিঙ্গবাদ। ‘সুলতানার স্বপ্ল’-এ সারা সুলতানাকে বলে, আপনি অনেকটা পুরুষভাবাপন্ন।’ রোকেয়া ‘পুরুষভাবাপন্ন’ শব্দের দেন নতুন অর্থ : ‘পুরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম’ (রোর, ১৩৪)। বিয়ের ভাষায় প্রকাশ পায় পুরুষের সক্রিয়তা আর নারীর নিষ্ক্রিয়তা; রোকেয়া ওই ভাষারীতিকেও উল্টে দিয়েছেন। ডেলিশিয়ার বিয়েকে তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘সচরাচর বলা হয়, ‘বর কন্যাকে বিবাহ করিল’, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বলিতে হইবে, ‘কন্যা বরকে বিবাহ করিলেন। কেননা ডেলিশিয়াই মিঃ কারলীঅনের অন্নবস্ত্ৰ ইত্যাদি যোগাইবার ভার লাইলেন’ (রোর, ১৫৬)!

রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। পুরুষতন্ত্রের বদলে নারীতন্ত্র, পুরুষাধিপত্যের স্থলে নারী-আধিপত্য। তার ডিক্টোপিয়াধর্মী রূপকথাগুলোতে সমাজের দুরবস্থার জন্যে সম্পূর্ণরূপে দায়ী করেছেন তিনি পুরুষদের, যারা তার চোখে সমস্ত দোষের সমষ্টি। তারা অপদাৰ্থ, দায়িত্বহীন, অবিবেচক, মিথ্যাবাদী, এবং সমাজরাষ্ট্র পরিচালনার অযোগ্য। তার ‘জ্ঞানফল’-এ দেশটির নাম কনকদ্বীপ হ’লেও সেটি বসবাসের অযোগ্য: পুরুষেরা সেটি নষ্ট করেছে। রোকেয়া বাইবেলি স্বৰ্গচ্যুতির উপাখ্যানটি ব্যাখ্যা করেছেন নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, এবং ওই পতনই তার কাছে গ্ৰহণযোগ্য, নির্বোধের স্বৰ্গ গ্রহণযোগ্য নয়। নারী যে আগে নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলো একে তিনি নিয়েছেন নারীর গৌরব হিশেবে, কেননা নারীরই রয়েছে জ্ঞানের প্রতি সহজাত আকর্ষণ : ‘ফল ভক্ষণ করিবামাত্র হাভার জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হইল।. এই সময় তথায় আদম গিয়া উপস্থিত হইলেন। হাভা তাঁহাকে স্বীয় হস্তস্থিত ফল খাইতে অনুরোধ করিলেন। পত্নীর উচ্ছিষ্ট জ্ঞানফল ভক্ষণে আদমেরও জ্ঞানোদয় হইল’ (রোর, ১৮০)। রোকেয়ার বর্ণনায় আদম নির্বোধ পুরুষ, জ্ঞানের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। ‘পত্নীর উচ্ছিষ্ট জ্ঞানফল ভক্ষণে’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ; রোকেয়া বোঝাতে চান পুরুষ জ্ঞানী নারীর উচ্ছিষ্ট জ্ঞানে। আদম শুধু নির্বোধ, উচ্ছিষ্টভোজীই নয়, সে অমানিবকও; রোকেয়ার হাওয়া তার কন্যাদের বর দিয়ে দীর্ঘায়ু করেছে, কিন্তু আদম- ‘তাঁহার ইচ্ছাশক্তি তাদৃশ প্রবল না থাকায়’- পুত্রদের কোনো বক্স দেয় নি। ওই দ্বীপের পতন ঘটেছিলো পুরুষেরা ‘নারীর আহৃত জ্ঞানে নারীকেই বঞ্চিত করিয়ছিল’ (রোর, ১৮৮) ব’লে। মুক্তিফল’ও আরেক অ্যান্টি-ইউটোপিয়া, ভোলাপুরেরও পতন ঘটে নারীকে অধিকারহীন ক’রে রাখার ফলে। সেখানে নারীর অধিকারের মাত্রা প্ৰকাশ পেয়েছে ভাই প্ৰবীণের উক্তিতে : ‘না বোন, তোমাকে কৈলাস পর্যন্ত যাইতে দিতে পারি না। তুমি আমার সহিত গল্প কর, উপন্যাস পাঠ কর, আমার সঙ্গে পারমার্থিক গান গাও-এই পর্যন্তই যথেষ্ট, ইহা অপেক্ষা অধিক স্বাধীনতা বা সমকক্ষতা দিতে পারি না’ (রোর, ২:১২)। নারীকে দেয়া হয়েছে গল্প করার. উপন্যাস পড়ার, আর ‘পারমার্থিক গান গাওয়ার স্বাধীনতা; ভোলাপুর যে ভারতবর্ষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই!

পুরুষের সৃষ্ট অ্যান্টি-ইউটোপিয়ার বর্ণনা রোকেয়াকে তৃপ্তি দিতে পারে নি, কেননা সেখানকার নষ্ট সমাজে নারীও অসুস্থ। তাই রোকেয়া পুরুষের সমাজকেই অস্বীকার ক’রে প্রতিষ্ঠা করেন তার নারীস্থান। রোকেয়ার পক্ষে অসম্ভব ছিলো Sultana’s Dream বা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ না লেখা; কেননা নারীতন্ত্র বা নারী-আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত দেখা ছিলো তার জন্যে অনিবাৰ্য। এজন্যে তাকেই লিখতে হয় বাঙলা ভাষায় প্রথম ও শেষ ইউটোপিয়া; সম্ভবত কোনো এশীয় ভাষায়ও এটিই একমাত্র ইউটোপিয়া। পচিশ বছরের এক আমূল নারীবাদী তরুণীর নারী-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ল’-এ, যা কোমলমধুর। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহায় ক্ষমাহীন নির্মম। রোকেয়া ব্যাপকভাবে নারীস্থানেব সমাজজীবন উপস্থাপিত করেন নি, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করেছেন। পুরুষদের। পুরুষের ওই দেশে কী প্রয়োজন, তা তিনি বলেন নি; তবে প্রতিশোধগ্রহণের জন্যে পুরুষদের অত্যন্ত দরকার ছিলো সেখানে। রোকেয়া পুরুষজাতিটিকেই বাদ দিতে পারতেন। ওই সমাজ থেকে, কিন্তু তিনি দেন নি; তিনি হয়তো মনে করেছেন সামাজিকভাবে পুরুষ দরকার, তবে তার চেয়ে বেশি দরকার পুরুষপীড়নের জন্যে। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বৈজ্ঞানিক ইউটোপিয়া; তিনি কোনো আদিম স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেন নি, সৃষ্টি করেছেন ভবিষ্যতের বিজ্ঞাননির্ভর সমাজ, কেননা বিজ্ঞানই শুধু মুক্তি দিতে পারে নারীকে। রোকেয়া নারীর শারীরিক দুর্বলতা সম্পর্কে ছিলেন সচেতন, তাই কোনো আদিম আর্কেডিয়া তার কাজে আসতো না; তার দরকার ছিলো এমন শক্তি, যা শারীরিক শক্তিকে সহজেই পরাভূত করে। বিজ্ঞান সে-শক্তি, তাই রোকেয়ার নারীস্থান বিজ্ঞাননির্ভর। রোকেয়ার নারীস্থান তাঁর স্বদেশের বিপরীত : ‘ভারতে পুরুষজাতি প্ৰভু,- তাহারা সমুদয় সুখ-সুবিধা ও প্ৰভুত্ব আপনাদের জন্য হস্তগত কবিয়া ফেলিয়াছে, আর সরলা অবলাকে অন্তঃপুর রূপ পিঞ্জরে রাখিয়াছে’ (রোর, ১৩৭)! তিনি তার নারীস্থান থেকে মুছে ফেলেছেন ভারতবর্ষের সমস্ত সামাজিক ব্যাধি। ‘সুলতানার স্বপ্ন রোকেয়ার নারীতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয়ের ও পুরুষতন্ত্রের চূড়ান্ত পরাজয়ের কাহিনী।

যে-পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধারাবািহক লড়াই করেছেন রোকেয়া, তার সাথে কি তিনি কিছুটা সন্ধি করেছিলেন। কখনো কখনো? পিতৃতন্ত্রের সাথে সন্ধির কিছুটা পরিচয় রয়েছে তাঁর রচনাবলিতে। পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থাটির সাথে, সম্ভবত বাধ্য হয়ে, তিনি সন্ধি করেছেন মাঝেমাঝে; কিন্তু খুব বেশি ছাড় দেন নি সেটিকে। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি প্ৰচণ্ড আক্রমণ করেছিলেন ধর্মকে, ওই আক্রমণের পরেও যে তিনি টিকে ছিলেন তার কারণ তখন পরিবেশ ছিলো ভিন্ন: আজ হ’লে রাস্তায় তার লাশ পাওয়া যেতো, ব। তিনি নিন্দিত জীবন কাটাতে বাধ্য হতেন নির্বাসনে। তার ওপর নিশ্চয়ই পড়েছিলো মুসলমান পিতৃতন্ত্রের প্রবল চাপ। তিনি বুঝেছিলেন টিকে থাকতে হ’লে কিছুটা সন্ধি পাতিয়ে নিষ্ক্রিয় ক’রে দিতে হবে পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থাটিকে। তিনি মাঝেমাঝে ধর্মকর্মের কথা বলেছেন, কিন্তু প্রথাগত ধর্মে তার অন্ধ আস্থা ছিলো না। তার নারীস্থানেও ধর্ম আছে : সেখানে ‘ধর্মবিধান’ হচ্ছে ‘প্রেম ও সত্য’, যা খুবই প্রথাবিরোধী। তিরিশোত্তর রোকেয়া ধর্মের কথা কিছু বলেছেন, এবং অবরোধবাসিনীদের ভয়াবহ জীবন আঁকার পাশাপাশি অবরোধের পক্ষেও বলেছেন কিছু কথা। শুনে স্তম্ভিত বোধ করি যখন অবৰ্বোধিবাসিনীর রোকেয়া বলেন, ‘আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই’ (অর্ধাঙ্গী’, রোর, ৩৫)!! নিশ্চয়ই বড়ো একটা চাপের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি তখন।

পিতৃতন্ত্রের সাথে বেশ কিছুটা মিটমাটের উদাহরণ ‘বোরকা’ প্ৰবন্ধটি } তিনি এতে যে শিকার হয়েছেন স্ববিরোধিতার, তা নিজেও বুঝেছেন; তাই আত্মসমর্থনের যে-চমৎকার প্রতিভা ছিলো তাঁর, তা তিনি প্রযোগ কবেছেন পুরোপুরি। তিনি বলেছেন, ‘তাহারা প্রায়ই আমাকে ‘বোরক’ ছাড়িতে বলেন। বাল, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে’। (বোরকা’,রোর, ৫৬)? বোরকা জিনিশটি কুৎসিত, মধ্যযুগীয় পিতৃতন্ত্র এটি চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর, এটা তার বোঝার কথা; তবু তিনি এর পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি কি মনে করেছিলেন যে নারী উন্নতি করবে। বোরকার ভেতরে থেকেই? তা কি হবে না নারীর জন্যে চরম গ্রানিকরা? অবরোধপ্রথার উদ্ভব ঘটে নারী সম্পর্কে একটি অত্যন্ত আপত্তিকর ইসলামি ধারণা থেকে যে নারী হচ্ছে ‘ফিৎনা’। ইসলামি বিশ্বাস হচ্ছে যে নারীর কাম প্রবল, তা নষ্ট ক’রে দিতে পারে সমাজশৃঙ্খলা; তাই নারীকে রুদ্ধ করে রাখতে হবে অবরোধে। ইসলামি ধারণায় নারী মানসিক শক্তিতে দুর্বল, সে নিজের কামকে বশে রাখতে পারে না; তাই নারীর কামের গ্রাস থেকে সমাজকে বাচানোর জন্যে নারীকে আটকে রাখতে হবে অবরোধে, তাকে ঢেকে দিতে হবে বোরকায়। রোকেয়া বোরকা মেনে নিয়েছেন, খুব অবজ্ঞা করেছেন ‘জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী’কে, কেননা তিনি চেয়েছেন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীর কল্যাণ; এবং একটি কথা বুঝতে চান নি যে তাঁর অবজ্ঞার ‘জেলেনী, চামারনী, ডুমুনীরা আসলেই অনেক উন্নতি করেছে অবরুদ্ধ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের থেকে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীরা যেখানে অপদাৰ্থ, ‘জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী’রা সেখানে অনেক মুক্ত। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ত বিশ্বাস যে, অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই’ (রোর, ৫৭)। ‘বেশী বিরোধ নাই’ ব’লে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে অবরোধ ও উন্নতির মধ্যে বিরোধ রয়েছে, এবং তিনি বোরকার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে ক্রমশ চ’লে গেছেন নিজেরই বিপক্ষে।

তিনি বলেছেন, ‘অবরোধ-প্ৰথা স্বাভাবিক নহে-নৈতিক।…মানুষের ‘অস্বাভাবিক’ সভ্যতার ফলেই অন্তঃপুরের সৃষ্টি’ (রোর, ৫৭)। ‘স্বাভাবিক’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন অসভ্যতাকে, আর অস্বাভাবিক’ বলতে সভ্যতাকে; তিনি সভ্যতা ও অস্বাভাবিকতার পক্ষে, তাই অবরোধেরও পক্ষে। যদি তিনি মেনে নেন সভ্যতার সৃষ্টি অন্তঃপুরকে, তাহলে তাকে মেনে নিতে হয়। অন্যান্য বিধানও। তিনি নৈতিকতার কথা বলেছেন, এ-নৈতিকতা পুরুষতন্ত্রের নৈতিকতা; যে-পুরুষতািন্ত্ৰ মনে করে নারী ফিৎনা বা বিশৃঙ্খলা। রোকেয়৷ কি নিজেকে ফিৎনা ব’লে স্বীকার করবেন? রোকেয়ার পক্ষে স্বাভাবিক ছিলো পুরুমকে বোরকা পরানোর প্রস্তাব করা, যেমন করেছেন তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ল’-এ, পুরুষকে ঢুকিয়েছেন। অবরোধে। তিনি বোরকার পক্ষে একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন (রোর, ৫৮) :

‘বেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সন্ত্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরুপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকেব। ঘৃণা, উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই।.. রেলওয়ে ভ্ৰমণকালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে বাক্ষা পাইবার জন্য ঘোমটা কিম্বা বোরকার দবকার হয়।’

যদি রেলস্টেশনে কোনো মহিলা দর্শক আকৃষ্ট করেন, তবে ্দোষটা কার? মহিলার, না লোলুপ দর্শকের? যে-অপরাধ পুরুষের, তার জন্যে শাস্তি পাবেন মহিলা? তিনি ‘কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক ক’রে রক্ষা করবেন পর্দা? রোকেয়া অবরোধবাসিনীতে রেলস্টেশনে নারীর দুরবস্থার বেশ কয়েকটি শোচনীয় কাহিনী বলেছেন, আর তিনিই চাচ্ছেন নারী বোরকা পরে সেখানে পুরুষের মনে ঘৃণা জাগিয়ে আত্মরক্ষা করবে। তিনি অবরোধের পক্ষে দিয়েছেন সভ্যতার দোহাই : ‘সকল সভ্য জাতিদেরই কোন-না-কোন রূপ অবরোধ-প্ৰথা আছে (রোর, ৫৯)। তিনি জানেন যে তথাকথিত সভ্যতা হরণ করেছে নারীর অধিকার, আর তিনি লড়াই করছেন ওই পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধেই। তিনি অবরোধের পক্ষে একটি ভুল যুক্তি দিয়েছেন : ‘আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই- শিক্ষার অভাবে হইয়াছে’ (রোর, ৬১)। অবরোধ ও শিক্ষা একসাথে চলতে পারে না; কাউকে মহাপণ্ডিত ক’রে যদি রেখে দেয়া হয়। অবরোধে, তাহলে সে তেজপূর্ণ, মহৎ সাহসী হবে না; ব্যর্থ হয়ে যাবে তার শিক্ষা; শিক্ষিত হওয়ার পরও সে থাকবে পুরুষের দাসী ও কামসামগ্ৰী। তবে রোকেয়া জানেন। অবরোধ ক্ষতিকর; তিনি বলেছেন (রোরা, ৫৯-৬০) :

‘আমাদের অববোধ-প্রথাটা বেশী কঠোর হইযা পড়িষাছে … ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম (numderate ); কবিতে হইবে 1. আমরা অন্যান্য পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব।…বোরকাব আকৃতি অত্যন্ত মোটা (c(parse) হইয়া থাকে। সুহাকে কিছু সুদর্শন কবিতে হইবে।‘

তিনি অবরোধকে সুদৰ্শন করার প্রস্তাব করেছেন, চেয়েছেন মসৃণ অবরোধ; কিন্তু অবরোধ হচ্ছে অবরোধ, তা কোনো মসৃণতা জানে না। ‘বোরকা’ রচনাটিতে বিস্ময়করভাবে রোকেয়ার ওপর চেপে আছে আরব পিতৃতন্ত্র, এবং তিনি বিচ্যুত হযেছেন নিজের স্বভাব থেকে। ধৰ্মকর্মের কথাও রোকেয়া বলেছেন। পুরুষতন্ত্রের চাপে, কিন্তু ভালোভাবে চোখ দিলে দেখি যে ধর্মকে রোকেয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ব’লে ভাবতেন না। ‘বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি : সভানেত্রীর অভিভাষণ’-এ (রোর, ২৮২) রোকেয়া একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন :

‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোবান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন ,। আপনাবা কেহ মনে কবিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষাধঃ সঙ্গে সঙ্গে কোবান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোড়ামীব পবিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোড়ামী হওঁতে বহু দূৰে! প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়!’

তিনি বালিকাদের কোরান শেখাতে চেয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষার সাথে, কারণটিও বলে দিয়েছেন : ‘প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়। তিনি ইসলামি পিতৃতন্ত্রের সাথে সুর মিলিয়ে বলেন নি যে সব শিক্ষাই পাওয়া যায় ওই গ্রন্থে; তিনি বলেছেন প্ৰাথমিক শিক্ষার জন্যে ওই গ্রন্থটি উৎকৃষ্ট। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য।

পুরুষতন্ত্র নারীকে কয়েকটি ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করেছে; তার একটি গৃহিণীর ভূমিকা। রোকেয়া নারীর প্রথাগক ভূমিকায় বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু গৃহিণীর ভূমিকাটি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। এটা তার একান্ত নিজের বিশ্বাস থেকে নয়, অন্যদেব বিশ্বাসকে তিনি দিয়েছিলেন স্বীকৃতি। তিনি প্রশ্ন করেছেন : ‘আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি? বোধ হয় আপনারা সমস্বরে বলিবেন, ‘সুগৃহিণী হওয়া’ (সুগৃহিণী,রোর, ৪৫)। বোকেয়া সুগৃহিণী হওয়াকে যে বড়ো কাজ বলে স্বীকার করেছেন, তা নয়; তবে তিনি মেনে নিয়েছেন। পুরুষতন্ত্রের এ-বিধানটি। বলেছেন, ‘পুরুষ বিদ্যালাভ করেন। অন্ন উপার্জনের আশায়’, আর আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental Culture) করব। কিসের জন্যে? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental Culture) আবশ্যক’ (রোর, ৪৫-৪৬)। সুশিক্ষার উদ্দেশ্য সুগৃহিণী হওয়া? তাহলে কি সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে পড়ে না শিক্ষা? যে-কাজ অশিক্ষিত পরিচারিকা করতে পারে একটু যত্ন নিলে, বা চিরকাল ধরে ক’রে আসছে নিরক্ষর সুগৃহিণীরা, তার জন্যে সুশিক্ষা এক প্রচণ্ড অপচয়। রোকেয়া ঘরকন্নার ক্লান্তিকর কাজের যে-দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন : ‘গৃহ এবং গৃহসামগ্ৰী পরিষ্কার ও সুন্দরীরূপে সাজাইয়া রাখা, পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থলী সম্পন্ন করা, রন্ধন ও পরিবেশন, সূচিকর্ম, পরিজনন্দিগকে যত্ন করা, সন্তানপালন করা’ (রোর, ৪৬), এবং সেগুলো সম্পন্ন করার যে-রীতি নির্দেশ করেছেন, তাতে সুগৃহিণী হয়ে ওঠে একটি শিক্ষিত দাসী, শিক্ষার শোচনীয় অপব্যয়। রোকেয়া নিশ্চয়ই উন্নত জাতের দাসী উৎপাদনের জন্যে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন নি। রোকেয়া সূর্যোিত্তাপে রান্না’র স্বপ্ন দেখেছিলেন গৃহিণীকে ক্লান্তিকর ঘরকন্না থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে, কিন্তু ‘সুগৃহিণীতে তিনি গৃহিণীর ওপর যে-ভার চাপিয়ে দেন তাতে খুব খুশি হবে পুরুষতন্ত্র। তারা তাদের স্ত্রীদের শিক্ষা দেয়ার জন্যে খুব ব্যগ্র হয়ে উঠবে, কিন্তু শুধু নষ্ট হয়ে যাবে রোকেয়ার নারীরা।

পুরুষতন্ত্রের সাথে, বাধ্য হয়ে, সামান্য সন্ধির কথা বাদ দিলে রোকেয়া হয়ে ওঠেন পৃথিবীর এক শ্ৰেষ্ঠ আমূল নারীবাদী, পিতৃ-ও পুরুষ-তন্ত্রকে যিনি ধারাবাহিক আক্রমণে বিপর্যস্ত করে গেছেন। কিন্তু বঙ্গীয় মুসলমান পুরুষতন্ত্র তাকেও নিষ্ক্রিয় ক’রে দিয়েছে, এবং তিনি যে-উত্তরাধিকারীদের সৃষ্টি ক’রে গেছেন, তাঁরা বহু দূরে স’রে গেছেন তার চেতনা থেকে। তার উত্তরাধিকারী নারীবাদ f হয়েছেন ‘ভদ্রমহিলা’, স্বামীর শিক্ষিত দাসী ও প্রমোদসঙ্গিনী, সামাজিক সুবিধাভোগী, এবং তারা ব্যৰ্থ ক’রে দিয়েছেন রোকেয়াকে।
 
বঙ্গীয় ভদ্রমহিলা : উন্নত জাতের নারী উৎপাদন


উনিশ শতকেব। বাঙলা দেখতে পায় এক অভিনব জাতের নারীর উদ্ভব, যার সাথে মিল নেই তার আগের নারীদের। বাঙলার নারী আগের হাজার বছর ধরে ছিলো গাঢ় অন্ধকারে; তার নিজের কোনো সত্তা ছিলো না, স্বাধীনতার কথা সে কখনো শোনে নি, তার কোনো স্বপ্ন ছিলো কিনা তা কেউ জানে না। পুরুষ তাকে পশুর থেকেও নিকৃষ্টরূপে বঁচিয়ে রেখেছে, আগুনে পুড়েছে, ইচ্ছেমতো গ্ৰহণ করেছে ও ছেড়েছে, তাকে অবরোধের কারাগারে আটকে রেখেছে। উনিশ শতকে পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি ছিলো নারীর জনপ্ৰিয়তম রূপক, তবে আবহমান বাঙালি নাৰী পিঞ্জর বা ‘সোনার খাচা’য় পোষা ময়না ছিলো না; সে ছিলো পশুর থেকেও নিকৃষ্ট, পশুকেও মূল্যবান গণ্য করেছে বাঙালি পুরুষ কিন্তু নারীকে কখনো মূল্যবান মনে করে নি। তার জন্ম ছিলো বাঙালি পুরুষতন্ত্রের জন্যে বিভীষিকা, তার মৃত্যু ছিলো তৃপ্তিকর। তার সাথে পুরুষ কখনো আন্তরিক সম্পর্কে আসে নি, তার শরীরকেও কখনো পরিতৃপ্ত করে নি ব’লেই মনে হয়, যদিও তার ‘মদন আট গুণ’ বলে তাকে ধিক্কার দিয়েছে। শতাব্দীপরম্পরায় বাঙালির জন্ম হয়েছে পুরুষের ক্ষণিক উত্তেজনায়, অক্রিয় নারীদেহ ক্ষণিক পীড়নের ফলে। উনিশশতকের আগের বাঙালি নারী সম্পূর্ণ মুখাবয়বহীন, পুরুষতন্ত্রের যুপকাঠে রক্তাক্ত উৎসৰ্গিত একটি প্রাণী নারী। এ-অঞ্চলেব দুটি সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমান, প্রবল পিতৃতান্ত্রিক; উনিশশতক পর্যন্ত তার বাস করেছে গভীর মধ্যযুগীয়তার মধ্যে, এখনো তারা সম্পূর্ণ উঠে আসে নি ওই মধ্যযুগ থেকে বরং সেখানে ফেরার জন্যে তারা আজ খুবই ব্যগ্ৰ। ঐতিহাসিকভাবে এ-অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষেরই কোনো স্বতন্ত্র সত্তা ছিলো না, তারাই ছিলো মুষ্টিমেয় সমাজপতির প্রচণ্ড পীড়নের শিকার; তাই নারীর দুরবস্থা ছিলো এখানে শোচনীয়তম। তারা ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী ছিলো না, তারা ছিলো পশুর অধীনে পশুতর নারী।

উনিশশতকে উৎপন্ন হয় এক নতুন জাতের ন্যায়ী, যার সাথে মিল নেই তার পূর্বপ্রজাতির। যে-প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় তারা, তার নাম শিক্ষা। শিক্ষার ফলে উৎপন্ন অভিনব নারীদের বোঝানোর জন্যে দরকার পড়ে অভিনব শব্দ, তাদের জন্যে ইংরেজির অনুকরণে তৈরি করা হয় এক অভিনব শব্দ; ভদ্রমহিলা। উনিশশতকে তারা ছিলো সমগ্র বাঙালি নারীসমুদ্রে ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো, আঙুলে গোণা যেতো তাদের, সমকালের অধিকাংশের সাথে তাদের লিঙ্গগত মিল ছাড়া আর বেশি মিল ছিলো না। আজো যেমন ভদ্রমহিলাব সমগ্র বাঙালি নারীসমাজের একটি ছোটো সুবিধাভোগী অংশ, তারাও ছিলো তেমনই। সমাজে তারা দেখা দিয়েছিলো এক নতুন প্রপঞ্চরূপে, সমাজ তাদের চেয়েছে এবং চায় নি, আজো যেমন সমাজ তাদের চায় ও চায় না। এ-ভদ্রমহিলারা হয়ে আছে বাঙালি নারীসমাজের এক বিচ্ছিন্ন অংশ, পুরুষতন্ত্রের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন। ওই নারীরা ছিলো শিক্ষা নামের অভিনব প্রক্রিয়ার অভিনব উৎপাদন। শিক্ষায় সাথে বাঙালি নারীর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। উনিশ শতকের আগে, যদিও ইতিহাসে মেলে হুটী বিদ্যালঙ্কার বা চন্দ্রাবতীর মতো দু-একটি নাম। হিন্দু সংহিতা লিখে তার শিক্ষা নিষিদ্ধ ক’রে দিয়েছিলো, মুসলমানও তাই করেছিলো; মুসলমানের অবস্থা ছিলো আরো নিকৃষ্ট। উনিশ শতকে কিছু নারী হঠাৎ আলো দেখতে পায়। তারা সবাই ব্ৰাহ্ম, দেশি খ্রিস্টান, ও হিন্দুসম্প্রদায়ের, সমাজের উঁচু ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। ওই আলো, শিক্ষা, তাদের বদলে দিয়েছিলো; এমন নারী দেখা দিয়েছিলো বাঙলায়, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। কিন্তু তারা ছিলো পুরুষতন্ত্রেরই পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তুত। তারা নিজেরা স্থির করে নি। তারা কী হবে, নিজেদের জীবন কীভাবে গড়ে তুলবে, তারা নিজেরা চায় নি নিজেদের স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন; তারা উৎপাদিত হয়। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষাকলে পুরুষতন্ত্রের জীবনপরিকল্পনা অনুসারে। তবু তারা অভিনব, কিন্তু অসম্পূর্ণ।

উনিশ শতকে, যেমন আজো, পুরুষ নারীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে ও দিচ্ছে নিজেরই স্বার্থে নিজেরই সুবিধার জন্যে; নারীর স্বার্থে নয়। তারা চেযেছে সমাজের সব কিছু থাকবে অক্ষুণু, অটুট থাকবে শোষণের সমস্ত ব্যবস্থা, পুরুষ থাকবে প্ৰভু নারী থাকবে তার অধীন, কিন্তু নারী কিছুটা শিক্ষা পাবে। শিখবে লেখাপড়া, পাশও করবে, কিন্তু থাকবে প্রথাগত পদানত নারী। পুরুষ চেয়েছে নারী তার ভূমিকা পালন করে যাবে মনুসংহিতানুসারে; এবং হবে সহচরী, উন্নত জাতের শয্যাসঙ্গিনী, প্রসবকারিণী, ধাত্রী; হবে শিক্ষিত পরিচারিকা। তারা চেয়েছে ভিক্টোরীয় নারীরূপে দেখা দেবে সীতাসাবিত্রী; তারা চেয়েছে শিক্ষিত সতী ও পতিব্ৰতা। উনিশ শতকি পুরুষতন্ত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবাদ পুবোপুরি বজায় রেখে সূচনা করেছিলো স্ত্রীশিক্ষার; নািসর স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন তাদের লক্ষ্য ছিলো না, বরং সাবধান থেকেছে যাতে স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসনের মতো। আপত্তিকর ব্যাপারগুলোতে উৎসাহী না হয়ে ওঠে নারীরা। হাজার বছর ধরে পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত নারীরাও দিয়েছে। পুরুষতন্ত্রের কাম্য অনুকূল সাড়া, তারাও সাধারণত জয়গান গেয়েছে প্রথাবা; বিদ্রোহ সাধারণত তাদের স্বভাবে ছিলো না। পুরুষতািন্ত্র তাদের জন্যে যত্নের সাথে শিক্ষক বেছেছে, তাদের জন্যে এমন পাঠ্যবই লিখতে চেয়েছে যাতে নারী হয়ে ওঠে নারী, যদিও ঠিক মতো লিখতে পারে নি; পুরুষতন্ত্র লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করেছে যাতে শিক্ষা ভূমিকা বদলে দিয়ে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী করে না তোলে। তারা চেয়েছে শিক্ষিত নারীসম্বলিত প্রথাগত বা প্ৰাচীন ভারতবর্ষ। তারা উৎপাদন করতে চেয়েছে বাহ্যিকভাবে উন্নত জাতের নারী, যারা পুরুষের সেবা করবে উন্নতভাবে, প্রমোদ যোগাবে উন্নতভাবে, গর্ভবতী হবে ও সন্তান লালন করবে উন্নতভাবে, কিন্তু থেকে যাবে। পুরোনো নারী, রমণী, অবলা, বামা, সতী, ও পুরুষাশ্ৰিত। বাঙলায় নারীশিক্ষা প্রথম থেকেই নারীকে নষ্ট ক’রে দেয়, তার বিকাশের পথ দেয় বন্ধ করে; তাই দেড় শো বছরের নারীশিক্ষা শুধু উন্নত জাতের নারী উৎপাদন ক’রে নিঃশেষ হয়, ব্যর্থ হয় নারীকে মুক্ত বা স্বাধীন করতে।

উন্নত জাতের বাঙালি নারী, যার নাম দেয়া হয়েছে ভদ্রমহিলা, উৎপাদনের স্বপ্ন বাঙালি পুরুষ প্রথম দেখে নি, দেখে বিদেশিরা। রামমোহন উনিশশতকের তৃতীয় দশকে নারীকে বাঁচান। শ্মশানের গ্রাস থেকে, বিদ্যাসাগর দু-দশক পর বিধবাকে দেন আইনসম্মত সংসার, কিন্তু নারীকে শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ তাঁরা নেন নি। বাঙলায় উন্নত জাতের, ভিক্টোরীয়, নারীর স্বপ্ন দেখে প্রথম ইংরেজ ধর্মপ্রচারকেরা, প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করে তারাই। বাঙালির প্রথম প্রয়াস ছিলো। ওই উদ্যোগ ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া, স্বপ্ন বার বার ভেঙে দেয়া। ওই ইংরেজ ধর্ম ও শিক্ষাপ্রচারকেরাও প্ৰগতিশীল গোত্রের ছিলো না, তারা বিশ্বাস করতো না। নারীমুক্তিতে; তারা বিশ্বাস করতো কিঞ্চিৎ শিক্ষায়। নারীশিক্ষার সঙ্গে এদেশে বিদেশি ও দেশি যারা প্রথম জড়িত ছিলো, তারা ছিলো ভিক্টোরীয়; ভিক্টোরীয় যুগের সমস্ত কুসংস্কারে তারা ছিলো আচ্ছন্ন, যদিও ভিক্টোরীয় কুসংস্কারকেই তারা মনে করতো সভ্যতা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙলায় যখন নারীশিক্ষা একটু ব্যাপকভাবে শুরু হয়, তখন নারীপুরষ সম্পর্কে ভিক্টোরীয় জনপ্রিয় ধারণা ছিলো যে নারী ও পুরুষ পৃথক ও পরিপূরক: নারীর স্থান গৃহ, পুরুষের স্থান বাইর। টেনিসনের প্রন্সেস (১৮৪৭), রাসকিনের সিসেম অ্যান্ড লিলিজ-এ (১৮৬৫) প্রস্তাবিত হয় যে- পৃথক এলাকা তত্ত্ব বা পরিপূরকতত্ত্ব, তাই গ্ৰহণ করেছিলো তারা, মিলের দি সাবজেকশন অফ উইমেন-এ (১৮৬৯) নারীর যে-অধিকার দাবি করা হয়, তা ছিলো তাদের কাছে ভীতিকর। টেনিসন, রাসকিন ও ভিক্টোরীয়রা চেয়েছিলেন নারী কিছুটা শিক্ষা পাবে, যা হবে মূলত নিরর্থক, হবে পুরুষের আকর্ষণীয় সহচরী। নারী কিছুটা অগভীর ব্যবহারিক জ্ঞান আয়ত্ত করবে, কিন্তু তার জ্ঞান কাজে খাটাতে পারবে না, সে হবে স্বামীর সুখকর সেবিকা ও বিনোদসঙ্গিনী। নারী হবে পুরুষের বাইবেলি ‘হেল্পমিট’ বা দাসী। উনিশ শতকের নারীদের জন্যে ও নারীদের সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর নাম বেশ তাৎপৰ্যপূর্ণ: বামবোধিনী পত্রিকা (১৮৬৩), অবলাবান্ধব। (১৮৬৯), বঙ্গমহিলা (১৮৭৫), ভারতী (১৮৭৭), পরিচািরকা (১৮৭৮), পাক-প্ৰণালী (১৮৮৩), গাৰ্হস্থ্য (১৮৮৪), মহিলা-বান্ধব (১৮৮৭), দাসী (১৮৯৭), মহিলা (১৮৯৭), অন্তঃপুর (১৮৯৮)। পরিচারিকা, আর দাসীধর্মী নামেই জানিয়ে দিয়েছে নারী আসলে কী?

যে-ব্রাহ্মরা এদেশে প্রবল উৎসাহের সাথে এগিয়ে গিয়েছিলো নারীশিক্ষার দিকে, তারা ছিলো বাইবেলি সহচরীতত্ত্বের অনুরাগী, আর দেশি খ্রিস্টানবা তো ধর্মীয় কারণেই ছিলো তার অনুরাগী। বাঙালি পুরুষ সহস্ৰক ধ’রে নিরক্ষর নারীর আত্মোৎসর্গপরায়ণতা, ত্যাগ, সতীত্ব, পাতিব্ৰত্য উপভোগ করেছে, উনিশশতকে তারা উপভোগ করতে চায় শিক্ষিত সতীত্ব, মাতৃত্ব, পাতিব্ৰত্য, আত্মোৎসর্গপরায়ণতা। রাসকিন-টেনিসনি পৃথক এলাক্যতত্ত্ব ছিলো নারীর জন্যে কারুকাজকরা নতুন শেকল, নারীর জীবন ব্যর্থ ক’রে দেয়ার ভিক্টোরীয় চক্রান্ত দ্ৰ নারীর শত্রুমিত্ৰ’]। তাই উনিশ শতকের বাঙলায় নারীশিক্ষার যে-ধারা প্রবর্তিত হয়, তা উৎপাদন করেছে এক ধরনের উন্নত জাতের নারী, যাব পবিত্র কাজ পুরুষতন্ত্রের সেবা করা। তখন বাঙলায় নারী বোঝানোর জন্যে পিতৃতান্ত্রিক শব্দ ছিলো স্ত্রীলোক’, ‘মাগীও ছিলো বহুলপ্রচলিত; কিন্তু এ-নতুন জাতের নারীর জন্যে ভিক্টোরীয় আদলে তৈরি করা হয় একটি নতুন শব্দ; ভদ্রমহিলা। ‘মহিলা’ শব্দও তাদের জন্যে যথেষ্ট মনে হয় নি, কেননা শব্দটি সম্ভবত তৈরি করেছিলো ভিক্টোরীয় ভাবাদর্শদীক্ষিত পিউরিটান ব্ৰাহ্মরা, যদিও মহিলা’র অর্থই ‘ভদ্র বা সম্রােন্ত নারী’। রাসকিন বিলেতি নারীদের কপটভাবে তোষণের জন্যে প্রস্তাব করেছিলেন ‘লেডি’ শব্দটি, যার অর্থ তিনি করেছিলেন ‘ব্রেড-গিভার’, যার কাজ দীনদক্ষিণা করা বা ভিক্ষা দেয়া। ওই ‘লেডি’র বাঙলাই হয় ‘ভদ্রমহিলা’ : ব্যাকরণিক ও প্রজাতিগতভাবে এক অভিনব নারী, কিন্তু মৰ্মমূলে প্রথাগত।

বাঙলায় সুযোগসুবিধা চিরকালই প্ৰাপ্য একমুঠো মানুষের, শিক্ষার সুযোগও পেয়েছিলো একমুঠো নারী। মুসলমানেরা তখন শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিলো; আর এ-দেশের অধিকাংশ যারা, সে-দরিদ্রদের শিক্ষা কেনো জীবনেরই অধিকার নেই, তাই তারা শিক্ষা থেকে সব সময়ই বহু দূরে। মুসলমানদের মধ্যে যারা উচ্চবিত্ত ছিলো, তারা অধিকাংশই বাঙালি ছিলো না; আর বাঙালি মুসলমান মাত্রই ছিলো দরিদ্র, এবং সমগ্র মুসলমান সমাজ ছিলো মধ্যযুগাচ্ছন্ন। শিক্ষালাভের সুযোগ ছিলো। উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের, ব্ৰাহ্মদের, ও দেশি খ্রিস্টানদেব। অধিকাংশ সামন্ত হিন্দু ওই সুযোগের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ক’রে থেকেছে৷ অন্ধকারে, ব্ৰাহ্ম ও দেশি খ্রিস্টানরা সুযোগ নিতে চেয়েছে প্ৰাণপণে। তখনও দেশ জুড়ে জমাট মধ্যযুগ, কুসংস্কারের অপ্রতিহত আধিপত্য; নারী সম্পূর্ণরূপে নিশূপ। বাঙলার পুরুষতন্ত্র নারীকে মুখ খুলতে দেয় নি আবহমান কাল ধ’রে, নারী তার কথা বলে নি কখনো, সে হয়ে উঠেছিলো অবলা ও নির্বাক। নারী জানতো লেখাপড়া শেখার অর্থ বিধবা হওয়া, নারী জানতো কালিকলমের সংস্পর্শ তার জীবনকে শোচনীয় ক’রে তুলবে; তাই নারীর বুকে শিক্ষার জন্যে আকুলতা জাগার কথা নয়; তবুও আকুলতা জেগেছে, কিন্তু নারী তা প্ৰকাশ করতে পারে নি। উনিশশতকের নারীদের আত্মজীবনীতে মাঝেমাঝে প্রকাশ পেয়েছে লেখাপড়ার জন্যে লোকোত্তর আকুলতা, রাসসুন্দর দিয়েছেন যার অবিস্মরণীয় বর্ণনা, সে-আকুলতা নিশ্চয়ই জন্ম নিয়েছে অজস্র নারীর বুকে; কিন্তু তা কখনো প্ৰকাশ পায় নি।

উনিশশতকে নারীশিক্ষার কথা প্ৰথম বলে বিদেশি পুরুষেরা, পরে দেশি পুরুষেরা: নারীরা নয়। বলার কোনো উপায় ছিলো না, বলার মতো কোনো মানুষ ছিলো না। বাঙলার দরিদ্র নারীরা চিরকাল বাইরে বেরিয়েছে, বাইরের কাজ করেছে, তারা স্বাধীনতার আগুনের মধ্যে জুলেছে; কিন্তু উচ্চবর্ণের সামন্ত পরিবারের নারীরা বন্দী থেকেছে৷ অবরোধে। ভারতবর্ষে অবরোধ নিয়ে এসেছিলো মুসলমানেরা, এবং হিন্দুরা ওই অবরোধে মুসলমানদের মতোই অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। অবরোধের শিকার ছিলো উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীরা। ওই অবরুদ্ধ নারীদের বোঝানোর জন্যে বেশ কিছু শব্দ মেলে বাঙলায় : অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পৌরস্ত্রী, পুরস্ত্রী, পুরমহিলা, পুরবালা, পুরবাসিনী, অন্তঃপুরবাসিনী, পৌরাঙ্গনা, অসূৰ্যসম্পশ্য। পাথরখণ্ডের মতো এ-শব্দগুলোই বুঝিয়ে দেয় কেমন শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিলো বাঙলার উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীদের। একটি সামন্ত জমিদার বা ধনী গৃহস্থের বাড়ির বর্ণনা দেয়া যাক। ওই বাড়িটি বিশাল; ওই গৃহের সম্মুখভাগের বড়ো অংশ জুড়ে সদরমহল, এবং পেছনের দিকে অল্পজায়গা জুড়ে অন্তঃপুর বা অন্দরমহল বা জেনানা, যেখানে বন্দী থাকতো নারীরা। অন্দরমহলটি হতো অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর, যাতে ধুকে ধুকে বাঁচতো উচ্চবর্ণের নারীরা। তাদের জীবনে কোনো আলো ছিলো না, জীবন ছিলো না। বাড়ির কর্তাও দিনের বেলা অন্দরমহলে ঢুকতে পারতো না; রাতে হয়তো কখনো এসে আকস্মিকভাবে মিলিত হতো স্ত্রীর দেহের সাথে। সামন্ত প্ৰভুদের অবশ্য স্ত্রীসহবাসের বিশেষ শারীরিক প্রয়োজন পড়তো না, বাগানবাড়িতে ও পতিতাপল্লীতে তাদের প্রয়োজন মিটাতো, তবু তারা উত্তরাধিকার সৃষ্টির গভীর আগ্রহেই মিলিত হতো স্ত্রীদের শরীরের সাথে। উনিশ শতকের আগে বাঙলায় স্বামীস্ত্রীর মধ্যে কোনো মানবিক সম্পর্ক ছিলো না, উচ্চবিত্তের পুরুষ পতিতার সাথে যতোটা সময় কাটাতো স্ত্রীর সাথে তার একাংশও কাটাতো না; মানসিক সম্পর্কের কথা ছিলো অজানা, শারীরিক সম্পর্ক ছিলো খণ্ড উত্তেজনার। তাই নারীর কথা কেউ শুনতে পায় নি, নারী কারো কাছে নিজের কথা বলে নি। দরিদ্র নারীরা ভাত নিয়ে চিরকাল চিৎকার করেছে, জীবনের কথা বলার অধিকার তাদের ছিলো না। পুরুষই চিরকাল বলেছে নারীর কথা, উনিশশতকে নারীর কথা বলে, আর নারীর জন্যে জীবনপরিকল্পনা করে পুরুষই।

১৮১৭তে যেদিন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিনই অনিবাৰ্য হয়ে ওঠে নারীশিক্ষা। ওই কলেজ যে-অভিনব পুরুষ সৃষ্টির ভার নেয়, তার জন্যে যে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। অভিনব ধরনের নারী, তা হয়তো সেদিন কেউ ভাবে নি, কিন্তু সেদিনই হয় নারীশিক্ষার বীজ বোনা। নারীশিক্ষা এদেশে নারীর জন্যে হয় নি, হয়েছে পুরুষের জন্যে; নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো নারী শিক্ষিত হবে, তার ফল ভোগ করবে। পুরুষ। ১৮১৮তে চুচুড়ায় এক ইংরেজ ধর্মপ্রচারক প্ৰতিষ্ঠা করেন। এদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় সম্ভবত ক্রাইষ্টের করুণা নারীজাতির কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে, কিন্তু তার করুণা পাওয়ার জন্যে বিশেষ কারো আগ্রহ জাগে নি। মেরি অ্যান কুক ১৮২৩ থেকে কয়েক বছরের মধ্যে স্থাপন করেন বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয়, কিন্তু সেগুলো সফল হয় নি; কেননা হিন্দু কলেজের ছাত্ররা তখনো নিজেদের চাহিদা জানায় নি। তখনো সৃষ্টি হয় নি লেখাপড়াজানা মেয়ের জন্যে যুবকদের বুকে আবেগ, বা শিক্ষিত বউবাজার। কিন্তু ১৮৩০-এর দশকেই দেখা দেয় এক অভিনব ব্যাপার, স্বামীরা বাড়িতে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করে স্ত্রীদের। স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি সত্য যে হিন্দু কলেজে অভিনব পুরুষ তৈরি হয়েছে, তার জন্যে দরকার অভিনব নারী। ১৮৩৮–এই সমাচাব দীপাণ-এ চিঠি বেরোয়; দিবসীয় মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের পর পুরুষের যে সান্তনা ও সাহায্যের আবশ্যকতা তাহা কি তিনি ঐ অজ্ঞান স্ত্রীর নিকটে পাইতে পরিবেন?’ তিরিশের দশক থেকে ফল ফলতে শুরু করে হিন্দু কলেজের; তখন যারা ওই কলেজে পড়তে, বা পড়া শেষ করেছে তাদের পক্ষে পিতামহীকে নিয়ে জীবন কাটানো সম্ভব ছিলো না। তাই তরুণ স্বামীরা নিজেদের চাহিদা অনুসারে ঢালাই করতে শুরু করে স্ত্রীদের, নিজেরাই প্ৰস্তুত করতে শুরু করে স্বপ্নের স্ত্রী। শুরু হয় বঙ্গীয় হাওয়া উপাখ্যান; ব্রাহ্ম-হিন্দু আদমেরা পাঁজরের অস্থির বদলে পুস্তক দিয়ে সষ্টি করতে থাকে ব্রাহ্ম-হিন্দু হাওয়া। নিজের স্বার্থে নিজের উপভোগের জন্যে।

তরুণ স্বামীরা দেখা দেয় শিক্ষকরূপে, এবং তিরিশের দশক থেকে কয়েক দশক ধ’রে বাড়িতে স্বামীর কাছে লেখাপড়া শেখে অনেকেই: শেখে বেশ ভালো লেখাপড়া। কৈলাসবাসিনী দেবী, দ্রবময়ী, বামাসুন্দরী, কুমুদিনী, নিস্তারিণী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী ও আরো কজন গৃহশিক্ষিত নারী এখন বিখ্যাত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম ভারতবষীয় আইসিএস, যেভাবে স্ত্রীকে শিক্ষিত ক’রে তোলেন, তা নিজের জন্যে উপযুক্ত স্ত্রী সৃষ্টির অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে! সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যম, উদ্দীপনা ও প্রগতিশীলতাকে স্বীকার না ক’রে পারা যায় না, কিন্তু ওই রীতিতে শিক্ষিত নারী সৃষ্টিই বাঙলায় নারীশিক্ষার এক মৌল দুর্বলতা। স্বামী শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে শিক্ষিত স্ত্রী; গড়ে নেয় নিজের মতো ক’রে, স্ত্রী হয় স্বামীর ব্যবহারের সুখকর সামগ্ৰী। জ্ঞান্দোনন্দিনী যদি অন্য কারো হাতে পড়তেন, তাহলে হয়তো অশিক্ষিতই থাকতেন; বা কোনো উকিলের স্ত্রী হ’লে তিনি হতেন উকিলের স্ত্রী। এতে নারীর মুক্তি ঘটে না, ব্যক্তিগতভাবেও নয়, শ্রেণীগতভাবে তো নয়ই। মুক্তি না ঘটলেও কিছুটা মুক্তি ঘটেছে অবশ্যই, তাতে ব্যক্তিগতভাবে উপকার হয়েছে অনেকের; কিন্তু বাঙালি নারীর তাতে বিশেষ উপকার হয় নি।

১৮৪৯ সালে জে ই ডি বেথুন বা বিটন কলকাতায় স্থাপন করেন ভিক্টোরিয়া গার্লস স্কুল, পরে শার নাম হয় বেথুন বালিকা বিদ্যালয়। এ-বিদ্যালয় থেকেই শুরু হয় বাঙালি নারীদের ধারাবাহিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ইংরেজের উদ্যোগে, ও বিদ্যাসাগরের মতো দেশি উৎসাহীদের সহযোগিতায়। দেশি বুড়োদের নারীশিক্ষায় উৎসাহ থাকার কথা ছিলো না, কেননা ওই শিক্ষার ফল তারা ভোগ করতে না; তাই তারা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় নি; রক্ষণশীল রাধাকান্ত দেবের উৎসাহে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার লিখেছিলেন স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক (১৮২২); রাধাকান্ত নারী শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন, কিন্তুদের নিজের কন্যাদের শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন না; যেমন অনেক পরে রবীন্দ্রনাথও নিজের কন্যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেন নি। বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উৎসাহ ছিলো বিদেশিদেব, তারা জীবনে মহৎ কিছু করতে চেয়েছিলো, আর ছিলো তরুণ শিক্ষিতদের, কেননা তারা স্ত্রী হিশেবে পেতে চেয়েছে শিক্ষিত নারী। তরুণদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গতি ছিলো না, তাই বিদেশিরাই ছিলো বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা। বিদেশিরা চেয়েছিলো ভিক্টোরীয় নারী তৈরি করতে, তরুণীরা চেয়েছিলো শিক্ষিত বা আধুনিকা স্ত্রী। ১৮৭০-এর দশকে লেখাপড়াজানা বউর প্রবল চাহিদা সৃষ্টি হয়ে যায়, তাই দিকে দিকে ব্যাঙের ছাতায় মতো বালিকা বিদ্যালয় দেখা দিতে থাকে, যেগুলোর লক্ষ্য মেয়েদের বিয়ের বাজারে আকর্ষণীয় ক’রে তোলা। ওই সব বিদ্যালয় টেকে নি। জ্ঞানাঙ্কুর ১৮৭৫ সালেই জানায় যে ‘এক্ষণকার যুবকেরা শিক্ষিত স্ত্রী চাহেন, কেনই বা না চাহিবেন? যুবকদের লেখাপড়া শিখাইলে স্ত্রীদিগকে অবশ্যই লেখাপড়া শিখাইতে হইবে…আরো কিছু দিন পরে, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে অশিক্ষিত স্ত্রীলোকদিগের বিবাহ হওয়া ভার হইয়া উঠিবে। [উদ্ধৃত গোলাম মুরশিদ (১৯৮৫, ৩২)। তখন পর্যন্ত একটি বাঙালি মেয়েও প্রবেশিকা পাশ করে নি, কিন্তু শিক্ষিত স্ত্রীর বাজার তৈরি হয়ে গেছে, বউ হওয়ার জন্যেই দরকার পড়ে ক খ গ ঘ এ বি সি ডি লেখাপড়া। শিক্ষিত বাউর বিবোধীরও অভাব ছিলো না। চন্দ্ৰশেখর মুখোপাধ্যায় জ্ঞানাঙ্কুর-এ ১৮৭৩-এ লিখেছিলেন, ‘বিদ্যাবতী স্ত্রীলোকের সংসৰ্গ অপেক্ষা নরকবাস বরং ভাল।’ প্রথম যে-বাঙালি মেয়েটি প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স আর্টস পাশ করেন, তিনি দেশি খ্রিস্টান চন্দ্ৰমুখী বসু। দেরাদুন বিদ্যালয় থেকে ১৮৭৬-এ তিনি পাশ করেন। তাঁর দু-বছর পর ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কাদম্বিনী বসু ব্ৰাহ্মা, যিনি এক নম্বরের জন্যে প্রথম বিভাগ পান নি। ১৮৮০তে চন্দ্ৰমুখী ও কাদম্বিনী ফাষ্ট্র আর্টস পরীক্ষা দেন, দুজনেই বিএ পাশ করেন। ১৮৮৩তে। চন্দ্ৰমুখী ১৮৮৪ তে এমএ পাশ করেন, কাদম্বিনী চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন। বিদ্যাসাগর চন্দ্ৰমুখীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেক্সপিয়রের রচনাবলি উপহার দেন। ১৯০০ সালের মধ্যে ২৭জন নারী বিএ পাশ করেন। শিক্ষা খুব এগোয় নি, কিন্তু তখন আলোড়ন তৈরি হয়েছে বিপুল।

বাঙলায় নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো আকর্ষণীয় সহচরী, সুগৃহিণী, সুমাতা উৎপাদন করা। এর কোনোটিই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য নয়। আগের নারীরা অশিক্ষিত ছিলো, কিন্তু তারা যে সুগৃহিণী ও সুমাতা ছিলো না, তা নয়; তারা খুবই উৎকৃষ্ট ছিলো মা ও গৃহিণী হিশেবে। এ-বস্তু উৎপাদনের জন্যে মেঘনাদবধকাব্য, জ্যামিতি, বা শেক্সপিয়রের কবিতা লাগে না; কাউকে লেখাপড়া শিখিয়ে এমনভাবে গর্ভবতী করা সম্ভব নয় যে সে প্রসব করবে। কোনো রবীন্দ্রনাথ বা নিউটন। আদর্শ মাতার ধারণাও খুবই ভুল ছিলো, যেমন আছে আজো; তখন অনেকেই কামনা করেছে শিক্ষা এমন মা উৎপাদন করবে, যারা দলে দলে প্রসব করবে। নেপোলিয়ন বা জর্জ ওয়াশিংটন বা গারিবান্ডি! যে-মা নেপোলিয়ন বা হিটলার প্রসব করতে পারে, তার সম্পর্কে তো আগে থেকেই সাবধান হওয়া দরকার। আসলে নারীশিক্ষার লক্ষ্য ছিলো আকর্ষণীয় সহচরী ও শয্যাসঙ্গিনী উ ২ৎপাদন। নারীর বিকাশ ঘটানো, তাকে স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে বেড়ে উঠতে দেয়া এর লক্ষ্য ছিলো না; তাকে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন করা এর উদ্দেশ্য তো ছিলোই না, বরং এটাই অনেকের ভয় ছিলো যে নারী একদিন স্বাধীন হয়ে পড়তে পারে। তাই নারী যাতে স্বাধীন স্বনির্ভর না হতে পারে, নারীর জন্যে প্রস্তাবিত হয় ভিন্ন ধরনের শিক্ষা; ভূতা শিক্ষা নয়, নারীশিক্ষা, যাতে বিকশিত হবে নারীর নারীত্ব ও রমণীয়তা। নারীর পাঠক্রম নিয়ে শুরু হয় বড়ো বিতর্ক।

১৮৬০-এর দশকে প্রস্তাব করা হয যে নারীদের বিশেষভাবে দিতে হবে ঘরকন্না, রান্নাবান্না, শেলাই, শিশুপালন ইত্যাদি নারীসুলভ শিক্ষা। ভারতীয় মহাপুরুষেরা কপটতায়ও মহান হয়ে থাকেন। যেমন কেশবচন্দ্ৰ সেন বিলেতে নারীদের সম্পর্কে এতো মহৎ সব কথা বলেন যে অ্যানেট অ্যাক্রয়েড তাতে মুগ্ধ হয়ে নারীশিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন; এসে দেখেন কেশব সেন নারীদের প্রথাগত নারী ক’রে রাখতেই চান। তাঁর প্রকাশ্য কলহ বাধে কেশব সেনের সাথে, কেননা কেশব সেন চান ‘ভদ্রমহিলা’, অ্যাক্রয়েড চান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী দ্ৰ বোর্থউইক (১৯৮৪, ৫৮-৫৯)। কেশব সেন চেয়েছিলেন নারী শিখবে রমণীয় শিক্ষা:- তারা জ্যামিতি, দর্শন, অঙ্ক প্রভৃতি পুরুষালি বিষয় পড়বে না, শিখবে শেলাই, রান্না, শিশুপালন; শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর অনুরাগীরা অবশ্য দাবি করেছেন যে নারীরা পড়বে সব কিছুই। রাজনারায়ণ বসু (১৮৭৪, ৪৭) বলেছেন, ‘হয় স্ত্রীদিগের রীতিমত শিক্ষা দেও, নতুবা শিক্ষা দেওয়ায় কাজ নাই।’ দেড় দশক পরে ইন্ডিয়ান ক্রিস্টান হেরাল্ড (১৮৮২) উগ্রতার সঙ্গেই নারীদের নারী বানিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে চায় : ‘ভারত চায় যে তার পুত্ররা হবে পুত্র এবং কন্যারা হবে কন্যা, পুত্র নয়’ [উদ্ধৃত বোর্থউইক (১৯৮৪, ৯৮)। ভারতকন্যা বানানোর জন্যে তাদের কী পড়াতে হবে? পড়াতে হবে গাৰ্হস্থ্য অর্থনীতি, অঙ্কন, সঙ্গীত, রান্না, শেলাই ও স্বাস্থ্যবিধি, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয়।

পুরুষ চেয়েছে শিক্ষিত স্ত্রী, আর নারী শিক্ষিত হতে চেয়েছে ভালো বর পাওয়ার জন্যে : বাঙলায় নারীশিক্ষার এ-মহান উদ্দেশ্য আজো পুরোপুরি বজায় রযেছে। পিতৃতন্ত্র নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে একটি পথ, সেটি বিয়ে; তাকে দিয়েছে একটি পেশা, সেটি বিয়ে। উৎকৃষ্ট পেশায় নিয়োজিত হওয়ার যোগ্যতার থেকেও এ-অঞ্চলে কঠিন একটি ভালো বিয়ে; এবং বিয়েই যেহেতু নারীর নিয়তি, তাই শিক্ষা হয়ে ওঠে নারীর নিয়তিউন্নয়নের হাতিয়ার। তবে একমাত্র শিক্ষাই ভালো বিয়ের সোনার চাবি নয়। নারীর জন্যে, শিক্ষা নারীর জন্যে শুরু থেকেই হয়ে ওঠে প্ৰসাধন : তাকে ভালো বংশের হতে হবে, তার বাপের সমৃদ্ধ অর্থকোষ থাকতে হবে, তার রূপ থাকতে হবে, তারপর থাকতে হবে শিক্ষা। শিক্ষা হচ্ছে অতিরিক্ত যোগ্যতা, এবং কখনো কখনো অযোগ্যতা। নারীশিক্ষার শুরু থেকেই বাঙলায় শিক্ষা নারীর জন্যে বিয়ের অতিরিক্ত যোগ্যতা হয়ে আছে; এবং এজন্যেই নারীশিক্ষা অনেকটা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ওই সময়, যেমন এখনো, যারা শিক্ষাকে নিয়েছিলো বিয়ের সিড়িরূপে, যারা আসলে জ্ঞানের দিকে এগোয়ই নি, তারা প্ৰায্য সবাই সুয়োগ পেলেই বিয়ে বসে শিক্ষার আশুউদ্দেশ্যকে সফল করেছে। কিন্তু যারা শিক্ষাকে নিয়েছিলেন গুরুত্বের সাথে, বিয়ে হয়ে ওঠে তাদের জন্যে সংকট। তারা অনেকে বিয়েই করেন নি, বা করেছেন বেশ দেরিতে, এবং কেউ কেউ বিয়ে ক’রে নষ্ট করেছেন জীবন।

প্রথম এমএ চন্দ্ৰমুখী বসু একচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন বিপত্নীক কেশবানন্দকে, তার বোন বিধুমুখী, প্রথম দুই মহিলা এমবির একজন, অবিবাহিত থাকেন আজীবন। ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র, প্রথম দুজন মহিলা এমবির একজন, যিনি অধিকার করেছিলেন প্রথম স্থান, উনচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন এক চিকিৎসককে। ভার্জিনিয়া নিজে ছিলেন সুচিকিৎসক, কিন্তু বিয়ের পর চিকিৎসা ছেড়ে হয়ে ওঠেন স্বামীর রোগীদের সেবিকা। কামিনী সেন (রায়) বিয়ে করেন তিরিশ বছর বয়সে। এর আগেই কবি হিশেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি, বিয়ের পর কল্যাণী স্ত্রী হওয়ার তার সাধ জাগে, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে বলেন যে সংসারই তার কবিতা। তবে কবিতাও প্রতিশোধ নিতে দেরি করে নি: অনতিবিলম্বেই বিধবা হয়ে কামিনী রায় ফিরে আসেন কবিতায়। বিয়ে তাকে অপমৃত্যু দিয়েছিলো, কবিতা আজো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার বোন যামিনী সেন চিকিৎসক হয়েছিলেন, বিলেত থেকে ডিপ্লোমা নিয়েছিলেন, বুঝেছিলেন সংসার কাকে বলে; তাই বিয়েই করেন নি।

জগদীশচন্দ্র বসুর অনুজা হেমপ্ৰভা বসু এমএ, রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লজ্জাবতী বসু বিএ, রাধারাণী লাহিড়ী বিএ, সুরবালা ঘোষ বিএ বিয়ে করেন নি। তারা অস্বীকার করেছিলেন পুরুষতন্ত্রকে, এবং পুরুষতন্ত্র আজো তাদের দেখে সন্দেহের চোখে। বিয়ের পায়ে অনেকেই, নারীশিক্ষার সূচনায়ই, উৎসর্গ ক’রে দেন শিক্ষাকে। সরলা দাস প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রবেশিকার জন্যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরীক্ষার অনুমতিও মিলেছিলো, কিন্তু এক ডাক্তারের সাথে বিয়ে হবে ব’লে তিনি পরীক্ষা দেন নি। হেমন্তকুমারীও একই কারণে প্ৰবেশিকা পরীক্ষা দেন নি। সবলা সেনের ইচ্ছে ছিলো বিএ পাশ ক’রে কোনো পেশায় ঢুকবেন, কিন্তু এক ব্যারিস্টারের বউ হওয়ার পর সংসারের পেশায় এতো সুখ পান যে আর কোনো পেশার কথা ভাবতে পারেন নি। শিশিরকুমারী বাগচী ১৮৯৮-এ বিএ পাশ ক’রে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন, কিন্তু বিয়ের পর করেন সুখের সংসার } শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে হেমলতা ১৮৯৩-এ বিয়ের পর ছেড়ে দেন একটি ভালো চাকুরি। তাই লেখাপড়া হয়ে থাকে বিয়ের সিঁড়ি, প্রধান পেশা থাকে বিয়ে ও সংসার। বাঙালি নারী আজো বহন করছে। এ-সুখকর অভিশাপ।

কেউ বিএ পাশ করে যদি বাসায় বসে থাকে, বা হয় সুগৃহিণী বা সুমাতা, তবে তা হচ্ছে শিক্ষার অপচয়, এবং ক্ষতিকর। শিক্ষিত সুগৃহিণী, যে কোনো পেশায় জড়িত নয়, তার পক্ষে পরগাছা হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। নারীশিক্ষা, পুরুষতন্ত্রের পরিকল্পনা অনুসারে, বাঙলায় সৃষ্টি করেছে পরগাছার জঙ্গল। প্রথম দুজন নারী স্নাতক বেরোতে না বেরোতেই নিউ ডিস্পেন্সেশন (৮ জুলাই ১৮৮৩) লেখে উদ্ধৃত বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১০)] :

‘স্নাতক পরীক্ষার জন্যে ছাত্রীদেব ভর্তি করার বিশ্ববিদ্যালয়েব নীতির বিরুদ্ধে যাই বলা হোক না। কেনো, সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে, এবং তা হচ্ছে যে এর মাঝেই আমরা কয়েকজন নারী-বিএ পেয়েছি। আমরা তাদের নিয়ে কী করবো? যদি তাদের শুধু তাদের ডিগ্রি নিয়ে থাকতে দিই, তবে তাঁরা শিক্ষক হিশেবে পচবেন এবং অহমিকায় নষ্ট হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো পথ থাকবে না। নারী স্নাতকদের শুধু ডিগ্রি দিয়ে বিদায় ক’রে দিলে তা সমাজের নৈতিকতা উন্নয়নে কতোটা কাজে আসবে, তা আমরা জানি না। জনস্বার্থে সর্বোৎকৃষ্ট নীতি হবে তাদের সদ্ব্যবহার করা।‘

কিন্তু শুরু থেকেই এর সদ্ব্যবহার হয় নি। প্রথম পর্যাযে যারা লেখাপড়া শিখেছিলেন, তারা ধনী পবিবারেরই ছিলেন; তাই তাদের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামে নামতে হয় নি। বেশি। আর বিয়ে হয়ে গেলে তো চমৎকার। ছিলো প্ৰচণ্ড রক্ষণশীলতা, দু-এক দশক আগে পর্যন্ত নারীর কোনো পেশায় নিযুক্ত থাকাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে নি। নারীরাও নষ্ট করেছে নিজেদের; একটা ভালো বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তারা হারিয়ে ফেলে শিক্ষার সবটুকু, হয়ে ওঠে সচ্ছল স্বামীর অপদাৰ্থ শয্যাসঙ্গিনী। তারা অশিক্ষিত নামীর থেকেও অনেক অধম। উনিশশতকে, যেমন আজো, নারী যখন পেশা গ্ৰহণ করতে চেয়েছে, তখন সমাজ তার জন্যে রেখেছে দুটি নারীসুলভ পেশা : শিক্ষকতা, ও চিকিৎসা বা ধাত্রীবিদ্যা। আজো প্ৰধানত এ-দুটি পেশায় আটকে আছে নারী। ১৯০১-এ কলকাতায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন ৭২৫জন নারী দ্ৰ বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১°১) , তার মধ্যে অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, শিক্ষকের পেশায় ৫৮৭ জন, প্ৰশাসন ও পরিদর্শন ৬জন, চিকিৎসায় ১২৪জন, চিত্রগ্রহণে ৪জন, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক ৪জন। পেশা হিশেবে শিক্ষকতাকে প্রথম নিয়েছিলেন পাবনার বামাসুন্দরী দেবী। ১৮৬৩তে ২০ বা ২১ বছরের এ-তরুণী প্ৰতিষ্ঠা করেন একটি বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৬০-এর দশকে ব্ৰাহ্ম মনোরমা মজুমদার বরিশালে নানা বৈরিতার মধ্যে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি ঢাকা সরকারি বয়স্ক বালিকা বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সহকারী শিক্ষক হিশেবে যোগ দেন। মাসে ৬০ টাকা বেতনে। যারা প্রথম চাকুরি নিয়েছিলেন তারা সাধারণত ছিলেন দেশি খ্রিস্টান ও হিন্দু বিধবা। খিস্টানদের কোনো সামাজিক বাধা ছিলো না, আর হিন্দু বিধবার ছিলো জীবিকার সমস্যা; তাই তারা পেশায় জড়িয়েছেন নিজেদের। ১৮৬৬ সালে রাধামণি দেবী মাসে ৩০ টাকা বেতনে শেরপুর বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকরূপে যোগ দেন। তিনি চশমা পরতেন, এটা ছিলো তার সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য। রাধারানী লাহিড়ী বিএ। ১৮৮০তে মাসিক ৬০ টাকা বেতনে বেথুন বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শিক্ষক নিযুক্ত হন; ১৮৮৬তে তিনি হন মাসে ১০০ টাকা বেতনের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক। তারা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন বাঙালি নারী আগের হাজার বছরে তা ভোগ করে নি, কেননা তারা ছিলেন আর্থনীতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত।

চন্দ্ৰমুখী বসু, প্রথম নারী এমএ, ১৮৮৪ তে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে বেথুন বিদ্যালয়ের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হন; ১৮৮৬ সালে হন মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের তত্ত্বাবধায়ক। চমৎকার বেতন! কেউ কেউ চাকুরির জন্যে নিজের এলাকা থেকে চ’লে যান সুদূরে : ১৮৯০-এ অবিবাহিত শরৎ চক্রবর্তী বিএ অমৃতসরে আলেকজান্দ্রা খ্রিস্টান বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চলে যান; কামিনী বসু প্রধান শিক্ষিকা হয়ে চ’লে যান দেরাদুন বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৮৯১-এ অঘোরকামিনী রায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে যান লক্ষ্মেী, ফিরে নিজেই স্থাপন করেন। বিদ্যালয়। কুমুদিনী খাস্তগীর ১৮৯৩-এ মহিশুরের মহারানী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা নেন। সরলা দেবী ছিলেন। চাঞ্চল্যকরভাবে ব্যতিক্ৰম; তিনি ১৮৯৫-১৮৯৬ সালে চাকুরি নেন। হায়দ্রাবাদের মহারানীর সহকারীর মাসে অসাধারণ ৪৫০ টাকা বেতনে। তার চাকুরির প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু তিনি নরনারীর স্বায়ত্ত জীবিকা অর্জনে সমান দাবি প্রতিপন্ন করার জন্যেই চাকুরি নেন, ছেড়ে দেন অল্প পরেই দ্ৰ গোলাম মুরশিদ (১৯৮৩, ১০৪), বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১৭-৩২২)]। দেশি খ্রিস্টানরা লেখাপড়া শিখেছিলেন আগে, এবং লেখাপড়াকে কাজে লাগিয়েছিলেন নানা পেশায় নিযুক্ত হয়ে। ১৮৭৬-এ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা, ইংরেজের বিধবা, মনোমোহিনী হুইলার ২০০ টাকা বেতন ও ৩০ টাকা। যাতায়াত ভাতায় নিযুক্ত হন বিদ্যালয় পরিদর্শক। এঁরাই রেখেছিলেন শিক্ষার মর্যাদা, শিক্ষিত সুগৃহিণীরা নয়।

চিকিৎসা, শিক্ষকতার মতোই, হয়ে দাঁড়িয়েছিলো অনেকটা নারীর পেশা। আর্থিক কারণে এটি শিক্ষকতার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। অবরোধপ্রথা ছিলো নারী চিকিৎসকদের জন্যে আশীৰ্বাদ। নারীর চিকিৎসার জন্যে পুরুষ চিকিৎসক গ্রহণযোগ্য ছিলো না, তাই বেশ কজন নারী চিকিৎসক হয়েছিলেন, পেশায ভালোও করেছিলেন। তাঁদের পেশাগত বাধাবিপত্তির অভাব ছিলো না। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ১৮৮৬তে এলএমএস পাশ ক’রে হন বাঙলার প্রথম নারী চিকিৎসক। ১৮৮৮-তে তিনি লেডি ডাফরিন নারী হাসপাতালে ৩০০ টাকা বেতনে চিকিৎসক নিযুক্ত হন। প্রাইভেট চিকিৎসা, এবং নেপালে মহারাজার চাকুরি ক’রে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন; এবং ১৮৯৩-এ উচ্চশিক্ষার জন্যে বিলেত যান। ফিরে আসেন এডিনবরা, ডাবলিন, গ্লাসগো থেকে নানা ডিগ্রি নিয়ে। যামিনী সেন ১৮৯৭-এ এলএমএস পাশ করেন, ১৮৯৯-এ নেপালে চাকুরি নেন। তিনিও বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। নাৰী চিকিৎসকদের পেশা ছিলো বিপদসংস্কুল, বিশেষ ক’রে মফস্বলে তাদের মাঝেমাঝেই বিপদে পড়তে হতো। তাদের বিরুদ্ধে শহরেও কুৎসার শেষ ছিলো না। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি যখন কলকাতায় চিকিৎসা শুরু করেন বঙ্গনিবাসী পত্রিকা সম্পাদকীয়তে তাকে অশ্লীলভাবে আক্রমণে করে। তিনিও মানহানির মামলা করেন, এবং ১৮৯১-এ সম্পাদক মহেন্দ্ৰ পালের এক বছর কারাদণ্ড হয়। অভদ্র মধ্যযুগীয় পুরুষতন্ত্রকে একটি ভালো শিক্ষা দিয়েছিলেন কাদম্বিনী। ১৯০২ সালে মালদায় ঘটে নারীচিকিৎসক হরণ ও শ্লীলতাহরণ। প্রমীলাবালা ছিলেন মালদায় নারীচিকিৎসক; সেখানকার লম্পট জমিদার মদনগোপাল তার স্ত্রীর চিকিৎসার নামে রাতের বেলা তাকে ডেকে পাঠায়। জমিদারের নীেকোয় নিয়ে তার শ্ৰীলতাহানি করা হয়। ওই সমাজ নারী ডাক্তার বেশি দিন সহ্য করে নি, কেননা তা পুরুষের অহমিকাকে ঘা দেয়; তাই দেখা যায় পুরুষেরা অল্পকালের মধ্যেই নারী ডাক্তারের বদলে চায় ধাত্রী। ডাক্তারকে ধাত্রী বানাতে না পারলে পুরুষতন্ত্রের মনে শান্তি থাকে না। কেশব সেন দাবি করেন যে তাদের নারী ডাক্তার দরকার নেই, দরকার ধাত্রী। ধাত্রী খুবই দরকার ছিলো সন্দেহ নেই; চিকিৎসার অভাবে নারী মরলে ক্ষতি ছিলো না, কিন্তু পুরুষের উত্তরাধিকারীকে প্রসব করানো ছিলো খুবই জরুরি।

বাঙালি নারীর জন্যে নারীকে লেখাপড়া শেখায় নি, শেখাতে বাধ্য হয়। পুরুষেরই জন্যে; কিন্তু নারীশিক্ষাবিরোধী প্রবণতা তার কখনোই কমে নি। তার মনের মধ্যে সব সময়ই কাজ ক’রে চলেছে। এ-বোধ যে এটা খর্ব করে পুরুষের প্রভূতু, শিক্ষায় নারী হয়ে ওঠে অসতী, শিক্ষিত নারী নষ্ট করে পরিবার। সতীত্বের চিন্তায় বড়ো উদ্বিগ্ন পুরুষযতন্ত্র, যদিও নারীর সতীত্ব নষ্ট করে পুরুষই। নারীশিক্ষার শুরুতেই ধৰ্মসভার মুখপত্ৰ সমাচারচন্দ্ৰিকা ভয় দেখায় যে বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংগঠনের শঙ্কা আছে, কেননা বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎপুরুষেরা তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িবে না, কারণ খাদ্য খাদক সম্পর্ক।…ধন্যবানদিগের কন্যারা পথিমধ্যে ভূত্য দ্বারা রক্ষিত হইয়া গমন করিলে তথাপি কীেমার হরণের ভয় আছে, কেননা রক্ষকেরাই স্বয়ং ভক্ষক হইবে।’ ৰূদ্ৰ শ্ৰীপান্থ (১৯৮৮, ২৩)]। এ-বৰ্ণনা যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে বাঙালি পুরুষ। আপাদমস্তক লম্পট। নারীশিক্ষা আজো বাঙালির বড়ো উদ্বেগ, যদি তা হয় প্রকৃত নারীশিক্ষা; ছদ্মনারীশিক্ষায় তার আপত্তি নেই। শিক্ষা যদি নারীকে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, মুক্ত করে, তবে তা আপত্তিকর হিন্দু-মুসলমান-ব্ৰাহ্মর কাছে, কিন্তু তা যদি নারীকে উন্নত দাসী করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য। নারীর প্রকৃত শিক্ষা এখানকার পুরুষ চায় নি, নারীও সাধারণত তা বুঝে উঠতে পারে নি। নারীশিক্ষা একই সাথে পুরুষের কাছে ছিলো বিষ ও অমৃত- আনন্দ ও উদ্বেগের ব্যাপার, যদি তা নারীকে পরিণত করে আবেদনময়ী পরিচারিকায়, তবে তা আনন্দদায়ক, যদি তা নারীকে মুক্ত করে, তবে তা উদ্বেগের কারণ।

উনিশ শতকে নারী যখন লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছে, সমাজ তাকে দেখেছে গভীর সন্দেহের চোখে। তরুণেরা শিক্ষার পক্ষে থাকলেও মহাপুরুষদের অনেকেই ‘নবীনা’র সমালোচনায় থেকেছেন মুখর, যেমন বঙ্কিম। তখন ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ বা আলেকজান্ডার পোপের ‘লিটল লানিং ইজ এ ডেঞ্জারাস থিং নারীশিক্ষার অপকারিতা প্রমাণের জন্যে ফিরেছে মুখেমুখে। অল্পবিদ্যা আসলেই ভয়ঙ্কর, কেননা তা আরো শেখার আগ্রহ জাগায়। বঙ্কিম প্রাচীনা ও নবীনা’ প্ৰবন্ধে প্রাচীনার গুণগানে মুখর থেকে দোষ ধরেছেন নবীনার; নবীনার বহু দোয্যের একটি হচ্ছে তারা একটু লেখাপড়া শিখেই ধর্মকে অবহেলা করতে শিখেছে। নিরপেক্ষ বিচারে বোঝা যায় তারা অল্প লেখাপড়া শিখে যতোটা বুঝেছিলো, বঙ্কিম অনেক লেখাপড়া শিখে মহাপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও ততোটা বোঝেন নি: বোঝেন নি যে ধর্ম আসলেই গুরুত্বহীন। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার বিস্ফোরণ ঘটতে দেরি হয় নি। ১৮৭০-এর দশকে প্রথম প্রবেশিকা পাশ মেয়েটি বেরোনোর আগেই প্রতিক্রিয়ার কলরোল শোনা যায়; এবং অচিরেই প্রহসনে প্রহসনে নারীশিক্ষার বদনাম রটাতে থাকে মঞ্চে মঞ্চে। লৈঙ্গিক রাজনীতিতে পুরুষতন্ত্রের শেষ অশ্ৰীল অস্ত্র হচ্ছে ব্যঙ্গবিদ্যুপ। পাশকরা ম্যাগ, কেয়াবাৎ মেয়ে, পরিণয়ে প্রগতি, মডেল ভগিনী, স্বাধীন জেনানা ধরনের অশ্লীল প্রহসনে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ দূষিত হয়ে ওঠে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। ১৮৭৮-এই লেখে, স্ত্রীশিক্ষার যে বিষময় ফল দাড়াইতেছে তাহা কেবল এই প্রণালীর দোষ।… যে সমস্ত পুস্তক পাঠ করিলে স্ত্রীজাতি উৎকৃষ্ট গৃহিণী ও মাতা হইতে পারে তাঁহাই তাহাদের বিশেষ পাঠ্য” [উদ্ধৃত গোলাম মুরশিদ (১৯৮৫, ৩৮)]। একটি মেয়েও তখনো প্রবেশিকা পাশ করে নি, কিন্তু শুরু হয়ে গেছে বিষময় ফল ফলা! পুরুষতন্ত্রের অভিযোগ তারা উৎকৃষ্ট মাতা ও গৃহিণী নয়; তারা আশা করেছিলো নারী শিক্ষিত হয়ে ঘরে ঘরে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন প্রসব করবে; পুত্রদের ক’রে তুলবে মহাপুরুষ, স্বামীদের করবে শিক্ষিত সেবা। কিন্তু দেখতে পায় স্বৰ্গে গোলমাল শুরু হয়ে গেছে, হাওয়া গন্ধম খেতে শুরু করেছে আদমের অনুমতি ছাড়াই।

১৮৮৫তে প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেস; ১৮৮৯ সালের দিকে কতিপয় নারী যোগ দেন। কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির উদ্যোগে ১৮৮৯ সালে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন ছ-জন নারী, তাদের দুজন বাঙালি : একজন দ্বারকানাথের স্ত্রী কাদম্বিনী, আরেকজন জানকীনাথ ঘোষালের স্ত্রী স্বর্ণকুমারী দেবী। তারা যোগ দিয়েছিলেন স্ত্রী হিশেবে, ব্যক্তি হিশেবে নয়। নারীদের যোগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়ায় কংগ্রেসিরা দ্বারকানাথকে উপহাসও করে। কংগ্রেসের ষষ্ঠ সম্মেলনে, কলকাতায়, যোগ দিয়েছিলেন মাত্র একটি নারী- স্বর্ণকুমারী দেবী। কিন্তু তিনি উপস্থিত থেকেও ছিলেন অস্তিত্বহীন। সম্মেলনে ধন্যবাদ প্রস্তাব ইংরেজিতে পড়েন। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সবার। অ্যানি বেসান্ট এ-ঘটনায় খুঁজে পান প্রতীকী তাৎপৰ্য; তিনি বলেন যে কাদম্বিনীর অংশগ্রহণ ‘এমন প্রতীক, যা বুঝিয়ে দেয় যে ভারতেব স্বাধীনতা উন্নীত করবে। ভারতের নারীজাতিকে’ দ্রা বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩৪২)]। কিন্তু ১৮৯০-এর দশকে শুরু হয়ে যায় জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতা, সমাজপতিরা বলতে থাকে যে গৃহই নারীর স্থান। এরপর কংগ্রেস নারীদের নানাভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের দিয়ে চাঁদা সংগ্ৰহ করিয়েছে, মিছিল করিয়েছে, কারাগারে পাঠিয়েছে, দু-একটি নারীকে প্রচ্ছদ ক’রে তুলেছে, কিন্তু কংগ্রেসি রাজনীতিতে নারী হচ্ছে পুরুষের পরিচারিকা। পরে কিছু নারী ভয়াবহ উদ্যোগ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন সন্ত্রাসবাদী শিহরণজাগানো ঘটনায়, জয় করেছেন জনচিত্ত, কিন্তু তারাও মুক্ত নারী ছিলেন না; তারাও ছিলেন পুরুষেরই পুতুল।

উনিশশতকে বাঙালি মুসলমান ভদ্রমহিলার উন্মেষ ঘটে নি, উন্নত জাতের নারী উৎপাদন করতে মুসলমান সম্প্রদাষকে অপেক্ষা করতে হয় বিশশতকের কয়েক দশক। রোকেয়ার বালিকা বিদ্যালয়ও বাঙালি মুসলমানের বিশেষ উপকারে আসে নি, কেননা ওটি আসলে ছিলো উর্দু বিদ্যালয়। ফজিলতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ পাশ করেন ১৯২৭-এ, তার পরীক্ষার ফল প্রায় জাতীয় উল্লাসে পরিণত হয়েছিলো; তবু পঞ্চাশ, এমনকি ষাটের দশকের আগে, উন্নত জাতের মুসলমান নারী উৎপাদনের কলটি ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থাকে নি। মুসলমান সমাজ ছিলো, এখনো আছে, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজের থেকে অনেক অনগ্রসর, নারীমুক্তির কথা এখনো তারা ভাবতে পারে না। বিয়েই ছিলো, আজো আছে, মুসলমান নারীশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য: এবং এর ফলে মুসলমান নারীশিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে কূট প্রতিক্রিয়াশীলতা: আবার অদ্ভুত বোরখায় ঢেকে দেয়া হচ্ছে মুসলমান নারীর মুখমণ্ডল, এবং এভাবে চলতে থাকলে দু-এক দশকের মধ্যেই হয়তো মুসলমান নারী আবার বন্দী হয়ে পড়বে অবরোপে: বাস করবে। হারেমে। মুসলমান পিতৃতন্ত্র এখন দেখা দিচ্ছে উগ্র পিতৃতন্ত্ররূপে, নারী হয়ে উঠছে তার শিকার; অনতিবিলম্বেই মুসলমান নারীকে পুরোপুরি মধ্যযুগে পাঠিয়ে দেয়া হবে, এমন আভাস এখন চারপাশে। শিক্ষা এখন সংকট হয়ে উঠছে নারীর জন্যে; সমাজ শিক্ষিত নারীকে আর্থনীতিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে না, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতাবশত নষ্ট হচ্ছে শিক্ষিত নারীর প্রথাগত পেশা বা বিয়ের সুযোগ। নবমধ্যযুগীয় তরুণ তার পিতামহের মতো শিক্ষিত নারী এড়িয়ে স্ত্রী হিশেবে খুঁজছে কচি মেয়ে, যার শরীর তার চোখে বেশি আবেদনময়, এবং যার ওপর সে প্রভুত্ব করতে পারবে মধ্যযুগীয় পুরুষের মতো। উনিশ শতকে যে-ভদ্রমহিলা প্ৰজাতিটির উদ্ভব ঘটেছিলো বাঙলায়, মুসলমান পিতৃতন্ত্ৰ যেটিকে প্রতিহত করার চেষ্টা ক’রেও প্রতিরোধ করতে পারে নি, সেটি আজ বিপন্ন, শিগগিরই হয়ে উঠবে বিপন্নতর, কেননা প্ৰতিক্রিয়াশীলতার প্রথম শিকারই হয় নারী!
 
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা


নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ গত আড়াই দশকের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নারীবাদীরা যেমন আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক ও রাজনীতিক কাঠামো, তেমনি আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত লিঙ্গবাদী চিন্তাধারা। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা, আবেগ, উপলব্ধি, ও প্রচারেব এক প্রধান এলাকা সাহিত্য। গত কয়েক হাজার বছরের বিশ্বসাহিত্য পুরুষতান্ত্রিকতার বিশ্ব; পুরুষ সৃষ্টি করেছে। ওই সাহিত্য, তৈরি করেছে তার তত্ত্ব, করেছে মূল্যায়ন। সাহিত্য সৃষ্টি ও ব্যাখ্যার সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে; সেখান থেকে নারী শুধু বাদই পড়ে নি, তাতে তৈরি করা হয়েছে নারীর মিথ্যে ভাবমূর্তি, নিন্দিত হযেছে নারী। পুরুষ আশা করে নি যে নারী সৃষ্টি করবে সাহিত্য, তবু নারী সাহিত্য সৃষ্টি করেছে, তবে তা মূল্য পায় নি। পুরুষের কাছে, বা পুরুষ তার অপব্যাখ্যা করেছে। বিশ্বসংস্কৃতির অজস্র পুরাণে পুরুষকেই দেখানো হয়েছে সৃষ্টিশীল বলে; সৃষ্টিশীলতাব সব এলাকায়-ধর্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান প্রভৃতিতে স্বীকৃতি পেয়েছে শুধু পুরুষের সৃষ্টিশীলতা। সব ধর্মেই বিধাতা পুরুষ, যে শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করেছে বিশ্ব। শেলি, কোলরিজ, কিটুস, রাসকিন লেখককে দেখেছেন পুরোহিত, ধর্মপ্রবর্তক, যোদ্ধা, বিধানপ্রণেতা, বা সমাটরূপে; অর্থাৎ পুরুষের চোখে পুরুষই সৃষ্টিশীল। পুরুষের চোখে নারীও পুরুশেরই সৃষ্টি। ওই নারীর, পিগম্যালিআনের আইভরি তরুণীর মতো, কোনো নাম বা সত্তা বা কণ্ঠস্বর নেই। নারী বস্তু, নারী অপর। নারী শুধু বস্তু নয়, পুরুষের চোখে নারী শিল্পকর্ম; নারী মর্মর মূর্তি, বা পুতুল, বা কবিতা, নারী কখনো ভাস্কর বা কবি নয়। শেক্সপিয়রের ওথেলো (৪:২) দেসন্দিমোনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে : ‘এই শুভ্র কাগজ, এই উৎকৃষ্টতম বইটি/কি তৈরি হয়েছিলো। এতে ‘বেশ্যা’ লেখার জন্যে?’ নারী লেখে না, লিখিত হয়, নারী কবিতাকল্পনািলতা; নারী আঁকে না, অঙ্কিত হয়; নারী ভাস্কর হয় না, ভাস্কর্য হয়।

হেনরি জেমসের এক মহিলার ছবিতে শুদ্ধ এক তরুণীকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘কাগজের একটি শূন্য পৃষ্ঠা’ রূপে; সে ‘এতো সুন্দর ও মসৃণ পৃষ্ঠা যে তাকে এক সময় ভ’রে তুলতে হবে মানসিক উন্নতিসাধক পাঠে। জেমসের চোখে অভিজ্ঞ নারী এমন কাগজ, ‘যার ওপর নানান হাত লিখেছে নানান পাঠ। কনরাডের বিজয়-এ অ্যালমা ‘এক অপরিচিত ভাষার লিপির মতো’, বা ‘নিরক্ষরের কাছে যে-কোনো লিপির মতো’ দ্র গুবার (১৯৮১, ২৯৪)]। সমালোচকেরাও সাহিত্যপাঠকে বর্ণনা করেন লৈঙ্গিক ভাষায়। দেরিদা কলমকে শিশ্নের সাথে, আর যোনিচ্ছদকে কাগজের সাথে অভিন্ন ক’রে দেখেছেন। কলম-শিশ্ন লিখে চলে কুমারী পৃষ্ঠার ওপর, এ-বোধের ঐতিহ্য বেশ দীর্ঘ। এ–বোধ অনুসারে লেখক পুরুষ, ও প্রধান; নারী তার অক্রিয় সৃষ্টি, গৌণ বস্তু, যার নেই কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা, যার কখনোবা স্ববিরোধী অর্থ রয়েছে কিন্তু কোনো অভিপ্ৰায় নেই। এ-ধারা সংস্কৃতিসৃষ্টির প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয় নারীকে, এবং গণ্য করে শিল্পকর্মরূপে। উনিশ শতকে অনেক নারী লেখক হ’তে গিয়ে সমস্যায় পড়েন, কেননা কলম তাদের জন্যে নয়; কলম ধরা তাদের কাছে মনে হয় দানবিক কাজ, তাই তারা নেন নানা কৌশল। এ-কৌশলগুলো সাইেড্রা এম গিলবার্ট ও সুজান গুবার বর্ণনা করেছেন দি ম্যান্ড ওম্যান ইন দি অ্যাটিক : দি ওম্যান রাইটার অ্যাদি দি নাইনটিনৰ্থ-সেঞ্চুরি র্কিন টেবেরি ইমাজিনেশন (১৯৭৯) বা চিলেকোঠার পাগলীতে। সুজান গুবার আইসক ডিনেসেনের শূন্যপৃষ্ঠা’ নামের একটি গল্প ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিশ্বাস করে যে নারীর পক্ষে শিল্পী হওয়া অসম্ভব, তবে সে নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে শিল্পকর্মে। তিনি আরো দেখিয়েছেন অনেক নারী বোধ করে যে শরীরই তাদের শিল্পীসৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম। এর ফলে নারী শিল্পী ও তার শিল্পকর্মের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকে না। নারীদেহ যে-সব রূপক সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে রক্তের রূপক, তাই নারীর শিল্পীসৃষ্টি হয়ে ওঠে একধরনের যন্ত্রণাকর ক্ষত। প্রসবে ও লেখায় নারীর নিয়তি যন্ত্রণা।

নারীবাদীরা পুরুষের সৃষ্টিশীলতাতত্ত্ব মানেন নি, এবং পুরুষের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতিকে সংশোধন করার জন্যে গড়ে তোলেন নিজেদের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতি। এ-ক্ষেত্রে গত আড়াই দশকে সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক কাজ করেছেন। তারাই, যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমালোচকেরা আজো দ্বিধা করেন তা স্বীকার করতে। অনেকে শুধু দ্বিধা নয় ক্ষুব্ধ বোধ করেন। তাদের মতে নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার কাজ ‘মহৎ পুরুষ লেখকদের ধ্বংস করা; এটা ‘সমালোচনার মুখোশ পারে নারীবাদী অপপ্রচার’। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার লক্ষ্য সব সময়ই রাজনীতিকং এর প্রচেষ্টা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বের করা। নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা দেখা দিয়েছিলো মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওমান-এই (১৭৯২), যেখানে তিনি পুনর্বিচার ও তিরষ্কার করেন রুশো ও পুরুষতন্ত্রের নানা মহাপুরুষকে; তবে এর ধারাবাহিক বিকাশ ঘটে নি। তাই উনিশ শতকে নারীবাদী সমালোচনা, স্ট্যান্টনের নারীর বাইবেল (১৮৯৫) ছাড়া, বিশেষ চোখে পড়ে না। এ-শতকেও ১৯৬৯-এর মধ্যে নারীবাদী সমালোচনার বই বেরোয় গুটিকয়; ভার্জিনিয়া উলফের এ রুম অফ ও অ্যাস স্রৌন : কারো নিজের ঘর (১৯২৭), সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ (১৯৪৯), ক্যাথবিন এম রজার্সের দি টাইেবলসাম হেল্পমেট : বিরক্তিকর সহধর্মিণী (১৯৬৬), মেরি এলমানের থিংকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা (১৯৬৮), এবং কেইট মিলেটের সেক্সয়াল পলিটিক্স : লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯)। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটে নারীবাদী সংগ্রামের এক শক্তিশালী অঙ্গরূপে। নারীবাদী সংগ্রাম চায় পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস বা রূপান্তরিত করতে; সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা করতে চায় একই কাজ, ভিন্নভাবে ভিন্ন এলাকায়। তাই তত্ত্ব ও সমালোচনায় নারীবাদীদের মিলন ঘটাতে হয়েছে রাজনীতি ও সমালোচনার। প্রথাগত পুরুষি সমালোচনার মানদণ্ডে চলতে পারে না। নারীবাদী সমালোচকের তাদের খুঁজতে হয়েছে ভিন্ন মানদণ্ড। নারীবাদী সমালোচনা ভালো লাগার কথা নয় প্রথাগত পুরুষ সমালোচক ও পুরুষি প্রতিষ্ঠানগুলোর। নারীবাদী সমালোচকদের সামনে খোলা ছিলো দুটি পথ : প্রচলিত মানদণ্ডের সাথে সন্ধি ক’রে পুরুষের স্বীকৃতি আদায় করা, অথবা প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডগুলোকে ঘৃণাভরে বর্জন ক’রে নিজেদের নতুন মানদণ্ড তৈরি করা। নারীবাদীরা বেছে নেন। দ্বিতীয় পথ। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার দুটি ধারা রয়েছে : একটি ইঙ্গমার্কিন, অন্যটি ফরাশি। এর মাঝে ইঙ্গমার্কিন ধারাটিই অর্জন করেছে প্রাধান্য।

বিশশতকের ষাটের দশকের শেষ থেকে, আন্তর্জাতিক নারীবাদের এক প্রবল শাখারূপে, বিপ্লবাত্মক বিকাশ শুরু হয় নারীবাদী সমালোচনা ও সাহিত্যতত্ত্বের, এবং অনেকখানি বদলে দেয় সাহিত্য মূল্যায়নের প্রথাগত রীতি। বিশ্ব জুড়ে এতোকাল ধরে নেয়া হয়েছে যে পুরুষই লেখক, পাঠক, সমালোচক; নারীবাদীরা দেখান নারী সমালোচক ও পাঠক সাহিত্য উপলব্ধি করেন ভিন্নভাবে, ও সাহিত্যের কাছে তাদের প্রত্যাশা ভিন্ন। তাঁরা আরো দেখান যে বিশ্ব জুড়েই নারীরা সৃষ্টি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য। পুরুষের সভ্যতা জুড়ে কয়েক হাজার বছর ধরে সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা থেকেছে পুরুষের অধিকারে, নারীবাদীর, ঢোকেন সেখানে, পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেন পূৰ্ববতী সমগ্ৰ সাহিত্য। নারীবাদী সমালোচনার প্রধান মানদণ্ড লিঙ্গ i নারীবাদীরা বিকাশ ঘটান সাহিত্য সৃষ্টি, পাঠ, ও সমালোচনার লৈঙ্গিক স্বাতন্ত্র্যের তত্ত্ব। তাদের তত্ত্ব ও সমালোচনারীতি কোনো একক উৎস থেকে জনে নি, তাদের নেই কোনো পুণ্য বা ঐশী গ্রন্থ বা মহামাতা। যেমন রয়েছেন মার্ক্সীয়দের মার্ক্স, সাংগঠনিকদের সোসু্যার, মনোবিজ্ঞানবাদীদের ফ্রয়েড বা লাক, বিসংগঠনবাদীদের দেরিদা, নারীদের নেই তেমন কেউ। নারীরা নিরীশ্বর। একাধিক উৎসকে কাজে লাসিয়েছেন তারা। তারা নারীসাহিত্য পড়েছেন, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্বে গবেষণারত নারীবাদীদের সাথে ভাববিনিময় করেছেন, প্রচলিত সাহিত্যতত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, কৌশল ধার করেছেন মার্ক্সবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, বিসংগঠনবাদ থেকে, এবং গড়ে তুলেছেন নিজেদের তত্ত্ব ও রীতি। যদিও আজো কোনো সমন্বিত সাহিত্যতত্ত্ব তারা গড়ে তুলতে পারেন নি- অনেকে তা চানও না, তবু সমন্বিত সাহিত্যতত্ত্বের দিকে তারা এগিয়েছেন। অনেকখানি। নারীবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক বা সমালোচককে যে নারীই হতে হবে, তা নয়; তবে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটান নারীরাই; তারাই লড়াই করেন এর জন্যে, কখনো কখনো বিপদগ্ৰস্তও হন। তারা চেষ্টা করেন তত্ত্ব ও ব্যক্তিতার সমন্বয় ঘটাতে। তারা খোঁজেন নিজেদের একান্ত ভাষা, আঙ্গিক, কণ্ঠস্বর, সংগঠন, যা নিয়ে তারা ঢুকতে পারেন। পুরুষাধীন একটি এলাকায়। নারীবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচকেরা কখনো ক্রুদ্ধ আর তিরষ্কারমুখর, কখনো আবেগাত্র ও গীতিময়; আর তাদের তত্ত্ব ও সমালোচনায় মূর্ত তাদের নারীমুক্তির রাজনীতি। নারীবাদ নারীদের মহাজাগরণ, সাহিত্য সমালোচনায় ঘটে ওই মহাজাগরণেরই প্ৰকাশ। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, যাতে রয়েছে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ভাঙার উত্তেজনা ও নতুন দৃষ্টি আবিষ্কারের সাধনা। তাঁরা প্রকাশ করেছেন নানা নারীবাদী পত্রিকা, যাতে নিয়মিতভাবে বেরোয় নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা বিষয়ক তীব্র মননশীল প্ৰবন্ধ। এগুলোর মধ্যে বয়েছে ক্যামেরা অ্যাবস্কিউফ্যারা : লস অ্যাঞ্জেলেস, কোন্ডিশন্স : ব্রকলিন, কানেকশন্স : অকল্যান্ড, ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি : শিকাগো, ডায়াক্রিটিক্স; ইথাকা, ফেমিনিষ্ট রিভিউ : লন্ডন, হেকেট : কুইন্সল্যান্ড, হেরাসিঁজ; নিউ ইআর্ক, এম/এফ : লন্ডন, সেইজ : আটলান্টা, সিনিস্টার উইজডম : রকল্যান্ড প্রভৃতি।

নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার উন্মেষের বছরগুলোতে জোর দেয়া হয়। পুরুষের লেখা সাহিত্যে লিঙ্গবাদ ও নারাবিদ্বেষের স্বরূপ উদঘাটনের ওপর। তারা দেখান পুরুষ তৈরি করেছে ছকবাধা নারীভাবমূর্তি, সৃষ্টি করেছে দেবী ও দানবী; দেখান ধর্মগ্রন্থে, ধ্রুপদী ও জনপ্রিয় সাহিত্যে নারীকে পীড়ন ও অপব্যবহার করা হয়েছে নানাভাবে. আর নারীকে বাদ দেয়া হয়েছে সাহিত্যেব ইতিহাস থেকে। সমাজে যেমন চলে নারীপীড়ন, নারী যেমন হয় ধর্ষণের শিকার, তেমনি যুগেযুগে সাহিত্যে পীড়িতধর্ষিত হয়েছে নারী। তাঁরা পুরুষের ‘মহৎ’ সাহিত্য ঘেটে দেখান যে তাতে নারীবিদ্বেয পুরুষের নিশ্বাসের মতো। প্রচুর মহৎ সাহিত্যুের মহিমা তারা হরণ করেন। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কেইট মিলেট। মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯) আধুনিক নারীবাদের সবচেয়ে সাড়াজাগানো বই, পিএইচডি অভিসন্দৰ্ভ, যাতে মিলন ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সমালোচনার; আর কাজ করে ধ্বংসাত্মক বোমার মতো। এটি শুধু সাহিত্য সমালোচনা নয; এর রয়েছে তিনটি ভাগ : লৈঙ্গিক রাজনীতি’, ‘ঐতিহাসিক পটভূমি’, এবং ‘সাহিত্যিক প্রতিফলন’। প্রথম ভাগে মিলেট দেখান নারীপুরুষের লৈঙ্গিক বাজনীতির স্বরূপ, দ্বিতীয় ভাগে লেখেন উনিশবিশশতকের নারীমুক্তি আন্দােলনের নিয়তির ইতিহাস, তৃতীয় ভাগে উদঘাটন করেন ডি এইচ লরেন্স, হেনরি মিলার, নরমান মেইলার, ও জয় জোনের লেখায় লৈঙ্গিক রাজনীতির রূপ। টোরিল মোই (১৯৮৫, ২৪-৩১), যিনি অন্যায়ভাবেই কঠোর সমালোচনা করেছেন মিলেটের, তিনিও স্বীকার করেছেন, ‘এটি সৃষ্টি করে যে-অভিঘাত, তাতে এটি হয়ে ওঠে। পরবতী ইঙ্গমার্কিন নারীবাদী সমালোচনামূলক সমস্ত গ্রন্থের জননী ও অগ্রদূত, এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০র নারীবাদীরা কখনোই মিলেটের পথিকৃৎ প্রবন্ধটির কাছে ঋণ স্বীকার বা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে অস্বীকার করেন নি।’ মিলেট বেরিয়ে আসেন সে-সময়ের মার্কিন নবসমালোচনার রীতি থেকে; নবসমালোচনা রীতির বিরোধিতা ক’রে তিনি যুক্তি দেন যে ঠিক মতো সাহিত্য বুঝতে হ’লে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশকে। মিলেটের সমালোচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য অসম্ভব অভাবিত প্ৰতিভাদীপ্ত সাহস। ১৯৬৯-এ যখন ‘মহৎ’ লেখকদের কাছে বিনীত থাকাই ছিলো সাহিত্য সমালোচনার আদব, তখন লরেন্স, মিলার, মেইলার, জাঁ জোনের সাথে প্ৰচণ্ড বেয়াদবি করেন মিলেট। তার আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এ-আধুনিকেরা। মিলেট লেখককে বিধাতা হিশেবে মানেন নি; তিনি পাঠককে ক’রে তোলেন লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং প্রশ্ন করেন পংক্তিতে পংক্তিতে। মিলেট সমালোচক-পাঠক হিশেবে বিনীত বা ভদ্রমহিলাসুলভ নন; তিনি লেখকের মুখোমুখি দাঁড়ান উদ্ধত তরুণের মতো, প্রতি মুহূর্তে বিরোধিতা করেন লেখকের আধিপত্যের। তিনি মূর্তিভগ্নকারী: তাঁর সমালোচনা পড়ার পর ওই আধুনিক প্রধানদের ভাবমূর্তি আর আগের মতো থাকে না; তাঁরা তাদের কীর্তিসহ ধীসে পড়েন। মিলেটের রীতির একটু নমুনা দিচ্ছি। মিলেট (১৯৬৯, ২৩৭-২৩৮) ডি এইচ লরেন্স সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক (১৯২৮) থেকে উদ্ধৃত করেন প্রচণ্ড লিঙ্গবাদী এ-অংশটুকু :

‘’তোমাকে আমি দেখতে চাই।’
সে [মেলার্স] তার শার্ট খুলে ফেললো এবং লেডি জেইনের [যোনিব অপভাষা] দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়ালো। নিচু জানোলা দিয়ে সূর্যবশ্মি ঢুকে তার উরু, আর কুশ উদরকে, এবং জ্বলজ্বলে স্বর্ণ-লাল কেশেব ছোটো মেঘের ভেতর থেকে জেগে ওঠা কৃষ্ণাভ ও তপ্ত চেহারাব দাঁড়ানো শিশ্নকে আলোকিত ক’রে তুললো।
‘কী অদ্ভুত।’ সে ধীরে ধীরে বললো। ‘কী অদ্ভুতভাবে সে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! কী বিশাল এবং কী কৃষ্ণাভ এবং সুনিশ্চিত! সে কি তার মতো?’
পুরুষটি তার পাতলা শাদা শবীরেব সম্মুখভাগের নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ছোট্ট বুকের মাঝখানে কেশোধ বঙ কৃষ্ণাভ, প্রায় কৃষ্ণ; কিন্তু উদরেব মূলদেশে, যেখান থেকে শিশ্নটি মোটা ও ধনুকাকৃতি খিলানের মতো উঠে এসেছে, সেখানকাল কেশ সোনা-লাল, ছোটো মেঘেব মতো জ্বলজ্বলে।
‘কী গৰ্বিত’। সে গুনগুন কবলো, অস্বস্তি। ‘এবং কী প্ৰভুসুলভ { এখন বুঝতে পারছি কেনো পুরুষেবা এতো কর্তৃতৃপবায়ণ। কিন্তু সে শিশ্না সত্যিই সুন্দর। আরেকটি মানুষেব মতো! একটু ভীতিকবি! তবে সত্যিই সুন্দর। এবং সে আমার দিকে আসছে।-’ সে ভয়ে ও উত্তেজনায় অধর কামড়ে ধরলো। পুরুষটি নীবলে নিচে তার শক্ত শিশ্নের দিকে তাকালো। শু’ ? কোনো বদল ঘটে নি।
‘ভোদা, তুই যা৷ চাৰ্চ তা অইল ভোদা। ক তুই লেডি জেনারে চাচ। জন টমাস [শিশ্নের অপভাষা] লেডি জেনারে চায়। –’
‘আহা, তাকে ক্ষেপিয়ো না…’ বিছানায় হাঁটু ভর ক’রে তার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে এগোতে কোন বললে। সে দু-হাতে তার কৃশ কটি ধ’রে তাকে নিজের দিকে টানলো যাতে তার ঝুলন্ত আন্দোলিত স্তনদুটি স্পর্শ কবলে উত্তেজিত, উত্থিত শিশ্লোব শীর্ষ, এবং তাতে লাগলো তরল পদার্থের ফোঁটা। সে পুরুষটিকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো।
‘শোও!’ সে বললো। ‘শোও। আমাকে হ’তে দাও।’
সে এখন খুবই তাড়ার মধ্যে।‘



মিলেট বলেন লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক একটি আপাত-ধর্মীয় রচনা, যাতে এক আধুনিক নারীর আত্মার মুক্তি ঘটানো হয়েছে লেখকের নিজস্ব ধর্মমত শিশ্নের রহস্যে’র সাহায্যে। এখানে আবির্ভাব ঘটেছে শিশ্নদেবতার। অলিভার মেলার্স হচ্ছে চূড়ান্ত লবেলীয় পুরুষ, মনুষ্যদেব, সে মারাত্মক যৌনপীড়নে সক্ষম, তবে এ-উপন্যাসে কোনো যৌনপীড়ন নেই। এতে কনস্ট্যান্স চাটার্লিকে দেয়া হয়েছে ঈশ্বরদর্শনের অনুমতি। এ-বইটি অলিভার মেলার্সের শিশ্নের পূজানুষ্ঠান; এতে পুরুষের মহিমাকে উন্নীত করা হয়েছে এক অতীন্দ্ৰিয় ধর্মে। এটা লৈঙ্গিক ৰাজনীতিপ সবচেয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ রূপ। লৈঙ্গিক রাজনীতিকদের মধ্যে লরেন্স সবচেয়ে প্রতিভাবান ও একাগ্র; তিনি সবচেয়ে নিপুণও, কেননা তিনি লৈঙ্গিক বার্তা জ্ঞাপন করেন নারীর চেতনার মাধ্যমে। নারীটিই আমাদের জানায় যে সোনালি যৌনকেশের জ্যোতিশ্চিক্রের ভেতর থেকে জেগে ওঠা দাঁড়ানো শিশ্নটি সত্যিই গর্বিত’, আর ‘প্ৰভুসুলভ’, এবং সর্বোপরি, সুন্দর। সেটি ‘কৃষ্ণাভ এবং সুনিশ্চিত, আর ভীতিকর’ ও ‘অদ্ভূত’, যা নারীকে যেমন ‘ভীত’ করে তেমনি করে ‘উত্তেজিত’। শিশ্নের দাঁড়ানো নারীকে দীক্ষিত করে এ-ধর্মে যে পুরুষাধিপত্য শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোনি চমৎকার শিষ্যের মতো সাড়া দেয়, ‘এখন বুঝতে পারছি কেনো পুরুষেরা এতো কর্তৃত্বপরায়ণ।’ এ-বইয়ের সঙ্গমদৃশ্যগুলো লেখা হয়েছে ফ্রয়েডীয় বিধিমতে যে নারী অক্রিস, পুরুষ সক্রিয়।’ এতে শিশ্নই সব, কোনি হচ্ছে ‘ভোদা’, যে-বস্তুর ওপর ক্রিয়া করা হয়। এভাবে বিশ্লেষণ ক’রে মিলেট লরেন্সকে মহিমাহীন ক’রে তুলেছেন।

মিলেটের মতো তীব্ৰভাবে না হ’লে একই কাজ করেন মেরি এলমান থিাকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তায় (১৯৬৮)। তার বইটি বেরোয় মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতির এক বছর আগে, কিন্তু এটা, একান্তভাবেই সাহিত্যকেন্দ্ৰিক বই ব’লে, ততোটা সাড়া জাগায় নি। এলমান পিতৃতন্ত্রকে সামাজিক ও রাজনীতিকভাবে আক্রমণ করেন নি, তিনি আক্রমণ করেন সাহিত্যে রূপায়িত পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গবাদকে। মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি ও তার নারীদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তায় জন্মে নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা, যা নারীভাবমূর্তি সমালোচনা নামে পরিচিত। পুরুষদের লেখায় নারীর ছক খোঁজেন এলমান, দেখান যে পুরুষ সমালোচকেরা নারীর লেখা বই আলোচনার সময়ও ব্যবহার করেন লৈঙ্গিক ধারণা। তাঁর মতে পশ্চিমি সংস্কৃতির বড়ো বৈশিষ্ট্য লৈঙ্গিক সাদৃশ্যমূলক চিন্তা’, অর্থাৎ যে-কোনো চিন্তায়ই নারী বা পুরুষ ধারণাটি জেগে ওঠে, আর প্রধান হয়ে ওঠে। পুরুষ ধারণাটি। পশ্চিম বা দু-গোলার্ধেরই সমস্ত চিন্তার মূলে আছে। লিঙ্গভিন্নতার বোধ। সাহিতা সমালোচনাযাও, তিনি দেখান, অত্যন্ত প্ৰবল লৈঙ্গিক চিন্তা; তিনি এর নাম দেন ‘ফ্যালিক ক্রিটিসিজম’ বা শৈশ্লিক সমালোচনা’। তার মতে পুরুষ সমালোচকদের কাছে নারীর লেখা বইও নারী, সম্ভোগের সামগ্ৰী; ওই বই সমালোচনার নামে তারা মাপামাপি করেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব,। পুরুষ লেখক-সমালোচকদের লেখায় তিনি খুঁজে পান নারী ও নারীত্বের এগারোটি ছক; সেগুলো হচ্ছে নিরবয়বতা, অক্রিয়তা, অস্থিরতা, বন্দীত্ব, ধার্মিকতা, বস্তৃজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা, অযৌক্তিকতা, পরের ইচ্ছাপূরণে সম্মতি, দানবী ও মুখরা স্ত্রী।

নারীবাদী সমালোচনার এক উর্বর ধারানারীভাবমূর্তিমূলক সমালোচনা। এ-ধারাব অজস্র নিবন্ধ ও বই বেরিয়েছে। ১৯৭২-এ সুজান কোপোলম্যান কোরানিলনের সম্পাদনায় বেরোয় নারীভাবমূর্তিমূলক সমালোচনাসংগ্ৰহ ইমেজেজ অফ উইমেন ইন ফিকশন : ফেমিনিস্ট পারস্পেকটিভূস : কথাসাহিত্যে নারীভাবমূর্তি: নারীবাদী প্রেক্ষিত। এ-বইতে উনিশবিশশতকের বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ ঔপন্যাসিকের আঁকা নারীর ভাবমূর্তি তুলে ধরে প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয় ওই সব অবাস্তব নারীচরিত্রের। অবাস্তব নারী সৃষ্টির জন্যে শুধু পুরুষেরাই অভিযুক্ত হয় নি। এ-প্রবন্ধগুচ্ছে, বরং দেখানো হয় যে এ-কাজে পুরুষদের থেকে অনেক নিকৃষ্ট নারী লেখকেরা। অবাস্তব নারী সৃষ্টি করে নারী লেখকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নিজেদের লিঙ্গের সাথে। এ-ধরনের সমালোচনায় মিলিয়ে দেখা হয় লেখকের ও পাঠকের অভিজ্ঞতাকে; আর পাঠকের অভিজ্ঞতার সাথে যদি না মেলে লেখকের অভিজ্ঞতা, তাহলে অভিযোগ তোলা হয় লেখকের বিরুদ্ধে। নারীভাবমূর্তি সমালোচকেরা আত্মজীবনীকে ব্যবহার করেন সমালোচনার মানদণ্ডরূপে; তারা মনে করেন কোনো সমালোচনাই মুক্ত নয় নিজের মূল্যবোধ থেকে। প্রতিটি মানুষ, এবং লেখকও, কথা বলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, ও ব্যক্তিগত ব্যাপারে গ’ড়ে ওঠা বিশেষ অবস্থান থেকে। এ-পরিপ্রেক্ষিত সীমাবদ্ধ, একে সর্বজনীন ব’লে চালানো খুবই আধিপত্যমূলক কাজ। নারীভাবমূর্তি সমালোচনার কাজে সাহিত্যে রূপাযিত মিথ্যে নারীভাবমূর্তির স্বরূপ বের করা। ওই মিথ্যে ভাবমূর্তি যেমন পুরুষ লেখকেরা তৈরি করেছেন, তেমনি করেছেন নারী লেখকেরাও। এতে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার ওপর; মনে করা হয় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা উপস্থাপনই সাহিত্যেব লক্ষ্য। তাই এ-সমালোচনা আধুনিকতাবিরোধী, সব ধরনের আধুনিক রীতিকেই আক্রমণ করা এর স্বভাব। তাদের মানদণ্ডে সে-সাহিত্যের মূল্য কম, যা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়; তাকেই তারা বাতিল করেন যা তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে না।

লিঙ্গবাদ ও নারীভাবমূর্তি বের করার পর, ১৯৭৫ থেকে, নারীবাদী সমালোচনার বিষয় হন নারী লেখকেরা; নারীবাদী সমালোচনা হয়ে ওঠে নারীকেন্দ্ৰিক। নারীবাদীরা আবিষ্কার করেন যে নারী লেখকদের ছিলো নিজেদের এ ধরনের সাহিত্য, যে-সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও বিষয়গত সামঞ্জস্য, আর শৈল্পিক গুরুত্ব স্বীকৃতি পায় নি। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাছে। তাঁরা বলেন নারীকল্পনাপ্রতিভার কথা। ১৯৭১-এ শোঅল্টার দাবি করেন নারী লেখকদের রয়েছে এক বিশেষ ইতিহাস, যা গুরুত্বের সাথে বিবেচনাযোগ্য। নারীরা আলোচনা করেন নারীরচিত সাহিত্য, এটা হয়ে ওঠে ইঙ্গমার্কিন নারীবাদী সমালোচনার প্রধান প্রবণতা। সত্তর দশকের শেষের দিকে বেরোয় এ-ধারার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই; যেমন এলেন মোয়ের্সের লিটেরেরি উইমেন : সাহিত্যিক নারী (১৯৭৬), ইলেইন শোঅল্টারের এ লিটেরেচার অফ দেয়ার অেনৈ : তাঁদের নিজেদের সাহিত্য (১৯৭৭), শিরিল এল ব্ৰাউন ও কারেন ওলসন সম্পাদিত ফেমিনিষ্ট ক্রিটিসিজম : এসেইজ অন থিয়োরি, পোয়েট অ্যান্ড প্রোউজ : নারীবাদী সমালোচনা : তত্ত্ব, কবিতা ও গদ্য বিষয়ক প্রবন্ধ (১৯৭৮), এবং সান্দ্রা গিলবার্ট ও সুজান গুবারের দি ম্যান্ড ওম্যান ইন দি অ্যাটিক : সিলেকোঠার পাগলী (১৯৭৯)। এ-বইগুলোতে শনাক্ত করা হয় সাহিত্যে নারী-ঐতিহ্যের পৃথক ধারা; দেখানো হয় নারীর লিঙ্গ নয়, সমাজই স্থির করে দেয় নারীর বিশ্বদৃষ্টি ও সাহিত্যে তার উপস্থাপন। এলেন মোয়ের্স সাহিত্যিক নারীতে সবার আগে উদ্যোগ নেন নারীসাহিত্যের ইতিহাস লেখার। তার মতে পুরুষ-ঐতিহ্যের তলে বা পাশাপাশি নারীসাহিত্য এক গতিশীল ও শক্তিমান অন্তঃস্রোত। বইটিতে কোনো তত্ত্ব প্রস্তাব না ক’রেই তিনি দেখান যে পুরুষের পাশাপাশি দেখা দিযেছিলেন মহৎ নারী লেখকেরাও, কিন্তু তারা মূল্য পান নি। ইলেইন শোঅল্টার তাঁদের নিজেদের সাহিত্য-এ বর্ণনা করেন ব্রোন্টিদের থেকে বর্তমান পর্যন্ত লেখা ইংরেজি উপন্যাসের ইতিহাস; দেখান এ-ধারার বিকাশের রীতি সাহিত্যিক উপসংস্কৃতি বিকাশের রীতির মতো। তিনি নির্দেশ করেন এ-ধারা বিকাশের তিনটি পর্ব। প্রথম পর্বটি হয় বেশ দীর্ঘ এ-পর্বে অনুকরণ করা হয় আধিপত্যশীল ঐতিহ্যকে, এবং অন্তরীকরণ করা হয় শিল্পকলার মান ও সামাজিক ভূমিকা; দ্বিতীয় পর্বে দেখা দেয় এসব ধারণা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দাবি করা হয় স্বায়ত্তশাসন; সব শেষে দেখা দেয় আতুয়- আবিষ্কার-এর পর্ব। এ-পর্ব তিনটির নাম তিনি দেন ফেমিনিন, ফেমিনিস্ট এবং ফিমেলা। তার মতে ইংরেজি সাহিত্যে ফেমিনিন পর্ব শুরু হয় ১৮৪০-এর দশকে, যখন নারী লেখকেরা দেখা দেন পুরুষছদ্মনামে। এ-পর্ব সমাপ্ত হয় ১৮৮০ সালে জর্জ এলিঅটের মৃত্যুতে। ফেমিনিস্ট পর্বের কাল ১৮৮০ থেকে ১৯২০; এবং ফিমেল পর্ব ১৯২০-এ শুরু হয়ে এখনো চলছে। সাহিত্যের ইতিহাস ও নারীবাদী সমালোচনায় শোঅল্টারের বড়ো কৃতিত্ব বিস্মৃত ও উপেক্ষিত নারী লেখকদের পুনরাবিষ্কার।

সান্ড্রা এম গিলবার্ট ও সুজান গুবারের চিলেকোঠার পাগলী বিশাল বই। এতে আলোচিত হন। জেইন অস্টিন, মেরি শেলি, ব্রোন্টি বোনেরা, জর্জ এলিঅট, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, ক্রিস্টিনা রসেটি, এবং এমিলি ডিকিনসন। তারা তুলে ধরেন উনিশশতকের ‘সুস্পষ্টভাবে পৃথক নারীসাহিত্যধারা’র প্রকৃতি, এবং প্রস্তাব করেন নারীর সাহিত্য-সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এক অভিনব তত্ত্ব। তারা দেখান উনিশশতকে পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শ এমন বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতা একান্ত পুরুষের গুণ। লেখক রচনার ‘জনক’, বিধাতার আদলে তিনি সষ্টা বা প্রণেতা বা গ্রন্থকার। সৃষ্টিশীলতার এ-শিশ্নতান্ত্রিক উপকথার মধ্যে নারী লেখকদের দাঁড়াতে হয় কঠিন অবস্থায় মুখোমুখি। সৃষ্টিশীলতাকে পিতৃতন্ত্র যেহেতু গণ্য করে পুরুষালি কাজ ব’লে, তাই নারীভাবমূর্তিও তৈরি হয়েছে। পুরুষের কল্পনায়; নারী অধিকার পায় নি নারী বা নারীত্ব সম্পর্কে ভাবমূর্তি সৃষ্টির, তাদের বাধ্য করা হয়েছে পুরুষের কল্পিত ভাবাদর্শের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। গিলবাট ও গুবার বিশ্লেষণ করেন পিতৃতন্ত্রে নারীশিল্পীর অবস্থান। তাঁরা দেখা পিতৃতন্ত্রের তৈরি নারীধারণা নারী ও নারীশিল্পীর মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে, নারী ও নারী শিল্পীর মধ্যে তৈরি করে জটিলতা; এব। ফলে ন্যায়ী লেখক হ’তে গিয়ে ভোগে তীব্ৰ উদ্বেগে, কেননা তার অধিকার নেই লেখক হওয়ার। পিতৃতন্ত্রে লেখক অবধারিতভাবে পুরুষ, আর নারী পুরুষের দাসী; তাই নারী কীভাবে ধরবে কলম, হবে লেখক? নারী লেখকেরা এ-সংকট থেকে মুক্তির জন্যে নেন এক কৌশল : তামা তাদের সাহি৩্যের বাহ্যসংগঠন ও আন্তর তাৎপর্যের মধ্যে রাখেন দূরত্ব। বাইরে তারা মেনে নেন। পিত্তন্ত্রের বিধান, কিন্তু ভেতরে গোপন ক’রে রাখেন ধ্বংসাত্মক তাৎপৰ্য, কাজ করেন। পিতৃতান্ত্রিক বিধানের বিরুদ্ধে। এমিলি ডিকিনসন বলেছিলেন, ‘সত্য বলো, তবে তির্যকভাবে বলো’; তারা নেন ওই তিৰ্যক ভঙ্গি। তাদের মতে নারীর কণ্ঠস্কর ছলনাময়, তবে সত্য। তারা যে-চিলেকোঠার পাগলীর কথা বলেছেন, সে কে? ওই পাগলীটি আর কেউ নয়, সে নারী লেখকের ডবল’, নারী লেখকের উদ্বেগ ও ক্রোধের উন্মাদিনী রূপ। পিতৃতন্ত্রের চাপে উনিশশতকের নারী লেখকদের প্রায় প্রত্যেকে সৃষ্টি করেন একেকটি পাগলী, যে তাঁরই আরেক সত্তা। এ-পাগলী সৃষ্টি ছিলো তাদের এক সাহিত্যিক কৌশল, যা উনিশশতকের নারীদের লেখা উপন্যাসকে দিয়েছে বিপ্লবাত্মক প্রকৃতি।

নারীবাদীরা নারীসাহিত্যের ওপর যে-গুরুত্ব আরোপ করেন, তাতে দেশে দেশে পুনরাবিষ্কৃত হয় বিপুল পরিমাণে নারীসাহিত্য। সেগুলোকে নতুনভাবে পড়েন তাঁরা। তাঁরা পুনরাবিষ্কার করেন বহু বিস্মৃত নারী লেখককে, প্রকাশ করেন তাদের চিঠিপত্র ও দিনপঞ্জি, এবং দেখান যে নারীসাহিত্যের রয়েছে এক বিশেষ স্বভাব। নারীবাদী সমালোচনার প্রথম সুফল পান আঠারোউনিশ শতকের নারী লেখকেরা, যাদের বই শিকার হয়েছিলো উপেক্ষা আর বিস্মৃতির। নারীবাদী প্রকাশনা থেকে ১৯৭২-এ পুনঃপ্রকাশিত হয় রেবেকা হার্ডিং ড্যাভিসের উপন্যাস লাইফ ইন দি জায়রন মিলস। (১৮৬১), ১৯৭৩-এ পুনঃপ্রকাশিত হয় শার্লেট পার্কিন্স গিলমানের ছোটগল্প ‘দি ইয়েলো ওয়ালপেপার’ (১৮৯২), বেরোয় বিস্মৃত নারী লেখকদের নানা রচনাসংগ্ৰহ। এসব লেখায় পাওয়া যায় নীরব বিদ্রোহ, এমনকি আমূল্যবাদী মনোভাব; এবং নারীবাদীরা খুঁজতে শুরু করেন কেনো এসব লেখা বাদ পড়েছিলো ‘প্রধান রচনার পংক্তি থেকে? ১৯৭৮-এ বিরোয় নিনা বায়ামের ওমানস ফিকশান : এ গাইড টু নোভেলস বাই অ্যান্ড অ্যাবাউট উইমেন ইন আমেরিকা, ১৮২০-১৮৭০। এতে দেখানো হয় যে উনিশ শতকের অধিকাংশ জনপ্ৰিয় ঔপন্যাসিকই ছিলেন নারী, তারা ‘বেস্ট-সেলার’ লিখেছিলেন, কিন্তু বাদ পড়ে গেছেন সাহিত্যের প্রধান পংক্তি থেকে। বেস্ট-সেলার উ ৎকৃষ্ট সাহিত্য হয় না ঠিকই, কিন্তু নারীবাদীরা মনে করে- ওই নারী লেখকদের কেউ কেউ স্বীকৃতি পেতে পারতেন।

১৯৭০ থেকে নারীবাদীরা বিকাশ ঘটাতে থাকেন নারীর নন্দনতত্ত্ব বলে একটি ধারণার, তারা বলতে থাকেন নারীর বিশেষ সাহিত্যচৈতন্য-এর কথা। অ্যাড্রিয়েন রিচ, মার্জেপিয়ের্সি, জুডি শিকাগো, সুজ্যান গ্রিফিন, অ্যালিস ওয়াকার প্রমুখের রচনায় দেখা দেয় নারীর নন্দনতত্ত্বের ধারণা; তাঁরা দাবি করেন নারীসংস্কৃতি ব’লে এক বিশেষ সংস্কৃতি। তবে নারীর নন্দনতত্ত্বের ধারণা নিয়ে বিতর্ক বেধেছে; অনেকে একে নারীসমকামবাদী চৈতন্য, ও নারীসমকামবাদী স্বাতন্ত্র্যবাদের সাথে এক ক’রে দেখেন। অ্যাড্রিয়েন রিচ লিখেছেন [দ্র শোঅল্টার (সম্পাদক ১৯৮৫, ৭)] :

‘প্রত্যেক নারীর মধ্যে রয়েছে একটি নারীসমকামী, সে অভিভূত হয় নারীশক্তি দিয়ে, সে আকর্ষণ বোধ করে শক্তিশালী নারীর প্রতি, সে খোঁজে এমন সাহিত্য যাতে প্ৰকাশ পায় ওই শক্তি ও জোর। আমাদের আন্তর নারীসমকামীটিই আমাদের চালায় কল্পনাদীপ্ত অনুভবের দিকে, আর ভাষায় প্রকাশ করে নারীর সাথে নারীর পূর্ণ সম্পর্ক। আমাদের আন্তর নারীসমকামীটিই শুধু সৃষ্টিশীল, কেননা পিতাদের দায়িত্বশীল কন্যারা ভাড়াটে লেখকমাত্র।‘

অনেকে অবশ্য মেনে নিতে রাজি হন নি যে নারীসত্তা শুধু একটি বিশেষ সাহিত্যশৈলীর মধ্যেই প্রকাশ পায়, বা নারীর সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পায় নারীসমকামে। ১৯৮০ থেকে নারীসমকামবাদী নন্দনতত্ত্ব ভিন্ন হয়ে যায় নারীনন্দনতত্ত্ব থেকে।

নারীবাদী সমালোচকেরা নিজেরা পুনর্বিচার ক’রে দেখতে চান সাহিত্যের সব কিছু, তাঁরা রাজি নন পুরুষের মূল্যায়ণ বিনীতভাবে মেনে নিতে। তাঁদের বিরুদ্ধে পুরুষের অভিযোগ হচ্ছে তাঁরা ছুড়ে ফেলে দিতে চান হাজার বছরের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। নারীবাদী সমালোচকদের একটি চাবিশব্দ ‘পুনঃ’ বা ‘আবার’। ‘ইতিহাস পুনর্লিখনের কথা বলেছেন ভার্জিনিয়া উলফ, অ্যাড্রিয়েন রিচ বলেছেন নারীর লেখা শুরু হতে হবে। অতীতকে পুনরাবলোকন বা সংশোধন করে, নারীত্ব পুনরাবিষ্কারের কথা বলেছেন ক্যারোলিন হিলবার্ন, জোন কেলি বলেছেন, ‘নারীদের পুনরুদ্ধার করতে হবে ইতিহাসে, এবং ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হবে নারীর কাছে [দ্ৰ গিলবার্ট (১৯৮০, ৩২)]। পুরুষ এতোদিন যেভাবে সাহিত্য পড়েছে, সেভাবে নয়, পড়তে হবে নারীর, নারীবাদীর চোখে; তখন ওই সাহিত্য ভ’রে ছড়ানো দেখা যাবে লিঙ্গের পীড়ন। ওই পীড়নে বিকৃতরূপে গ’ড়ে উঠেছে নারী। সাইেড্রা গিলবার্ট ‘নারীবাদী সমালোচকেরা কী চান? অগ্নিগিরি থেকে পোস্টকার্ড’ (১৯৮০) প্রবন্ধে বলেন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পুরুষ লেখকদের ভাণ্ডার, পূৰ্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পুরুষ লেখকদের সম্পত্তি। ওই সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রায় নেই। তাঁর মতে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির স্রষ্টা গান্তীর পণ্ডিত, সংরক্ত কবি, আর চিন্তাক্লিষ্ট দার্শনিকেরা সবাই পুরুষ, মহাজগত তাদেরই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তি। তার মতে পুরুষের সব শক্তি ছিলো, ছিলো বাকশক্তিও, কিন্তু নারীদের পালন করতে হয়েছে। নীরবতা; পুরুষ তাদের দিয়েছে যে-ভাষা, তা হচ্ছে নীরবতা। যে-নারীরা নীরবতাবিত পালনে রাজি হন নি, তাদের কী হয়েছে? তারা হারিয়ে গেছেন অন্ধকারে, বা তাদের ভুল বোঝা আর অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। নারীদের রচনা হয়তো মহৎ সাহিত্য হয় নি, তা হয়তো খুবই বশ্যমান; তবে ওই লেখার ভেতরে রয়ে গেছে বিপজ্জনক বস্তু, যা অনেক সময় অগ্নিগিরির মতো, এবং গভীরভাবে রিভিশনারি-সংশোধনপন্থী।

অ্যানেট কোলোডনিও (১৯৮০) বলেন একই কথা: বলেন যে নারী সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে দেখে তার কোনো ঐতিহ্য নেই। সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্য বলে যা গৃহীত, নারী লেখকেরা একাত্ম বোধ করতে পারেন নি। তার সাথে, ওই ঐতিহ্যকে মনে কবতে পারেন নি নিজেদের ব’লে। পুরুষ যেমন লিখতে বসেই মনে করে একটা মহৎ বস্তু সে উপহার দিচ্ছে মানবজাতিকে, নারী লেখকেরা তা মনে করতে পারেন নি; মহৎ কিছু বা শিল্পকলা সৃষ্টি করছেন, এমন ভাবাও সম্ভব হয় নি তাদের পক্ষে; তারা, অধিকাংশ সময়, নিজেদের বিচ্ছিন্ন ক’রে রেখেছেন ‘লেখকদের’ থেকে। তারা বারবার জানিয়েছেন পণ্ডিতদের জন্যে তারা গল্প লিখছেন না, লিখছেন সাধারণদের জন্যে, যারা সাহিত্য’ থেকে দূরবতী। নিনা বায়াম বলেছেন, সবাই আশা করতো যে নারী লেখকেরা লিখবেন নারীদেব জন্যে, তারা সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। তাঁরাও কখনো নিজেদের মিল্টন বা স্পেন্সারের উত্তরসূরী বলে মনে করেন নি [দ্র কোলোড়নি (১৯৮০, ৪৯)]। ১৮৯৯–এ কেইট শপিনের দি অ্যাওকেনিং উপন্যাসটি প্রকাশের পর পাঠকেরা বেশ বিব্রত বোধ করে; উপন্যাসটিতে তিনি বিবাহবহির্ভূত যৌনতার যে-বিবরণ দেন, তা কোনো নারী ঔপন্যাসিকের কাছে পাঠক প্রত্যাশা করে নি। নারীর কাছে চাওয়া হয় ‘ভদ্র উপন্যাস’। বায়াম (১৯৮১) দেখান মার্কিন সাহিত্য পাঠ ও সমালোচনায় সক্রিয় যে-তত্ত্ব, তা নারী লেখকদের মহৎ সাহিত্যের পংক্তি, ক্যান্যান, থেকে বাদ দেয়। তিনি দেখান ১৭৭৪-১৭৯৯ কালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আটতিরিশটি উপন্যাস বেরোয়। এগুলোর নটির লেখকের নাম আজো অজানা, হয়তো সেগুলো লিখেছিলেন নারীরাই; বাকি উন্নতিরিশটি লেখেন আঠারোজন লেখক, যাদের চারজন নারী। তাদের একজন, সুজানা রোওসন, একাই লেখেন ছটি উপন্যাস। তাঁর উপন্যাস শার্লোিট প্রথম প্রকাশের দশকে তিনবার, ১৮০০-১৮১০ সালের মধ্যে উনিশবার, উনিশশতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আশিবার ছাপা হয়। হ্যানা মুরের দি ককেট উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তিবিশিবার ছাপা হয়। নারী ঔপন্যাসিক হ্যারিয়েট বিশার স্টোর অ্যাংকেল টমস্ কেবিন মার্কিন সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত উপন্যাস। উনিশ শতকে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পঠিত ঔপন্যাসিক ছিলেন ই ডি ই এন সাউথওয়ার্থ, একজন নারী। এসব সত্ত্বেও তারা মার্কিন সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের কাছে মূল্য পান নি; তারা বাইরে থাকেন। সাহিত্যের মহৎ ধারার। কেনো এমন হয়েছে? এর এক কারণ, বায়ামের মতে, পক্ষপাত; সমালোচকেরা পছন্দ করেন না। নারীদের লেখক হিশেবে দেখতে, তারা বিশ্বাস করেন না যে নারীরা লেখক হতে পারে; তাই চোখের সামনের নারী লেখকদেরও দেখতে পান না তারা। আরেকটি কারণ হয়তো নারী লেখকেরা মহৎ কিছু লিখে উঠতে পারেন নি। পারেন নি এটা অনেকখানি সত্য, তবে • পারার রয়েছে সামাজিক কারণ। এটা ভুলে গিয়ে পুরুষ সমালোচকেরা নারী লেখকদের উপেক্ষা করেন প্রধানত লৈঙ্গিক কারণে; তাবা সাহিত্যকে মনে করেন মূলত পুরুষের কাজ ব’লে।

লিলিআন রবিনসনও (১৯৮৩) আক্রমণ করেছেন সাহিত্য মূল্যায়নের প্রতিষ্ঠিত ক্যান্যান বা মানদণ্ড ও রুচিকে। তার মতে প্রধান/অপ্রধান ব্যাপারগুলো ভদ্ৰলোকের চুক্তি। ওই ভদ্রলোকেরা সুবিধাভোগী শ্রেণী ও পুংলিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্যের যে-ক্যান্যান স্বীকৃত, তা সম্পূর্ণরূপে ভদ্রলোকদের সৃষ্টি; তাই তাদের রুচির বাইরের কোনো কিছুই মহৎ বলে গণ্য হয় না। পশ্চিমের মহৎ বইগুলো সবই পুরুষের লেখা, সেখানে কোনো নারীর বই নেই; কখনো তাতে অস্টিন, ব্রোন্টি বোনেরা, জর্জ এলিঅট, বা এমিলি ডিকিনসনের স্থান হয়, কিন্তু তারাও থাকেন বেশ নিচে। এ-অবস্থা কাটানোর জন্যে লিলিআন রবিনসন নারীবাদী সমালোচনার দুটি দায়িত্ব নির্দেশ করেন; নতুনভাবে

লিঙ্গবাদী ভাবাদর্শ, এবং দাঁড়াতে হবে তার মুখোমুখি। আর প্রয়াস চালাতে হবে নারী লেখকদের ক্যান্যানভুক্ত করার। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌, কেইট মিলেট, ইভা ফিজেস, এলিজাবেথ জেনওয়ে, জারমেইন গ্রিয়ার, ক্যারোলিন হিলবুন করেছেন তাই তারা প্রশ্ন তুলেছেন মহৎ বইগুলোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। মহৎ সাহিত্য পুনর্মূল্যায়ন করলে কি দেখা যাবে নারীর লেখা অনেক মহৎ সাহিত্য বাদ পড়ে গেছে সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্য থেকে? তাঁরা কি কোনো হ্যামলেট, যুদ্ধ ও শক্তি, বা গীতাঞ্জলি লিখেছেন, যা স্বীকৃতি পায় নি। পুরুষের? নিনা বায়াম স্বীকার করেছেন অমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। ১৮২০-১৮৭০ সালের মধ্যে লেখা মার্কিন নারী ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস সম্পর্কে তিনি বলেছেন। ওগুলোতে নান্দনিক, মননগত, নৈতিক জটিলতা ও শিল্পিতার অভাব রয়েছে, যা আমরা প্রত্যাশা করি মহৎ সাহিত্যের কাছে। ওই সময়ের নারী ঔপন্যাসিকদের রচনা নানাভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু কোনো বিস্মৃত জেন অস্টিন বা জর্জ এলিঅট আবিষ্কার করা যায় না। তাদের মধ্যে, বা এমন কোনো উপন্যাস খুঁজে পাওয়া যায় না, যা দি স্কারলেট লেটার-এর মানের। তবু তিনি মনে করেন সাহিত্য মূল্যায়নের যে-মানদণ্ড আমেরিকায় ব্যবহৃত হয়, তা পুরুষের কাজের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ। ওই মানদণ্ডে শেলাইয়ের থেকে তিমি শিকার অনেক বেশি মহৎ কাজ বলে গণ্য হয়, তাই নারী বাদ পড়ে। এক নতুন ধরনের উপন্যাস দেখা দিয়েছে সম্প্রতি, যেগুলোকে বলা হয় নারীবাদী উপন্যাস। ব্যবসায়িকভাবে এগুলো অত্যন্ত সফল। এ-ধরনের উপন্যাস নারীবাদী প্রকাশনাসংস্থা, এমনকি ব্যবসায়িক প্রকাশনাসংস্থা থেকেও বেরোচ্ছে। তবে এগুলোর সবই কি নারীবাদী উপন্যাস? এগুলো কি উপকারে আসছে নারীবাদী আন্দােলনের, নাকি শুধুই প্রথাগত বিনোদন সামগ্ৰীর কাজ করছে এগুলো? ঔপন্যাসিক নারী হ’লেই নারীবাদী হন, তিনি যা লেখেন তাই কি হয় নারীবাদী উপন্যাস? কিছু উপন্যাস নারীকেন্দ্ৰিক, তবে নারীকেন্দ্ৰিক উপন্যাসমাত্রেই নারীবাদী উপন্যাস নয়। নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস নতুন ব্যাপার নয়; অনেক আগে থেকেই নারীরা নারীদের জন্যে নারীকেন্দ্ৰিক উপন্যাস লিখে আসছেন, যেমন ঘটেছে রোম্যান্টিক উপন্যাসে। ওই সব উপন্যাসের চেতনা, সেগুলোতে চিত্রিত লিঙ্গ, জাতি, ও শ্রেণী-আনুগত্যের ব্যাপারগুলো নারীবাদবিরোধী। তাই নারীকেন্দ্ৰিক উপন্যাসমাত্ৰই নারীবাদী উপন্যাস নয়, তা চরিত্রগতভাবে ভিন্ন [দ্র কাওয়ার্ড (১৯৯০)]।

ইলেইন শোঅল্টার (১৯৭৯) দুটি রীতিতে ভাগ করেছেন নারীবাদী সমালোচনাকে। প্রথম রীতিতে নারীবাদী সমালোচক হচ্ছেন পাঠক হিশেবে নারী; তিনি পুরুষ লেখকদের সাহিত্য পড়ে তার লৈঙ্গিক ইঙ্গিতগুলো খুঁজে বের করেন। } শোআল্টার এ-রীতির সমালোচনাকে বলেন নারীবাদী সমালোচনা। এ-রীতিতে বিচার করা হয় ভাবাদর্শগুলো, বের করা হয় নারীভাবমূর্তি ও নারীছক, খোজা হয় কোথায় প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে নারী লেখককে, আর রটনা করা হয়েছে নারী সম্পর্কে কুৎসা। দ্বিতীয় রীতির সমালোচনার বিষয় লেখক হিশেবে নারী এতে বিচার করা হয় নারীসাহিত্য, নবীসাহিত্যের ইতিহাস, বিষয়, শ্রেণী, ও সংগঠন। এতে আলোচিত হয়।

লেখক। শোঅল্টার। এ-রীতির সমালোচনাকে বলেছেন গাইনেক্রিটিক বা গাইনে ক্রিটিসিজম। তাঁর মতে নারীবাদী সমালোচনা রাজনীতিক ও বিতর্কমূলক, যা বহু কিছু নিয়েছে মার্ক্সীয় সমাজবিজ্ঞান ও নন্দনতত্ত্ব থেকে; আর তাঁর প্রস্তাবিত গাইনোক্রিটিক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিরীক্ষাধর্মী। শোঅল্টারকথিত নারীবাদী সমালোচনা অনেকটা আদি টেস্টামেন্টের মতো, যার কাজ ‘অতীতের পাপ ও ভুলভ্রান্তি খোঁজা’, আর গাইনোক্রিটিক অনেকটা নতুন টেস্টামেন্টের মতো, যার কাজ ‘কল্পনাপ্রতিভার শোভা’ খোঁজা। প্রথম রীতিটি ন্যায়পরায়ণ, রাগী, ও ভৎসনাপূর্ণ; দ্বিতীয় রীতিটি নিরাসক্ত। দুটি রীতিই দরকারী; কেননা আদর্শের জেবিমাইঅ্যারাই শুধু ‘দাসত্বের মিশর থেকে’ নারীদের মুক্তি দিয়ে পৌঁছে দিতে পারেন মানবতাবাদের প্রতিশ্রত ভূখণ্ডে [দ্র শোঅল্টার (১৯৮১, ২৪৩)]

নারীবাদীরা কতোখানি আগ্রহী সাহিত্য ও সমালোচনাতত্ত্বে? তত্ত্ব জিনিশটি পুরুষের সম্পত্তি; সব তত্ত্বের তারাই স্রষ্টা, নারীর তাতে কোনো অংশ নেই, যদিও নারী ধারাবাহিকভাবে হয়েছে তত্ত্বের শিকার। এখন নারীবাদীরা মনে করেন সেখানে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়েও নারীবাদী সমালোচনার কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিলো না; ১৯৭৫-এ শোঅল্টার বলেছিলেন কোনো তত্ত্বই নারীবাদী ভাবাদর্শ ও পদ্ধতি ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়। কোলোড়নি বলেন, নারীবাদী সমালোচনা দেখা দিয়েছে ‘কোনো সামঞ্জস ধারা বা সমন্বিত লক্ষ্যের বদলে একরাশ পরস্পর বদলসম্ভব কৌশল হিশেবে।’ এর পরও সমন্বিত তত্ত্ব গড়ে ওঠে নি। কৃষ্ণনারীবাদীরা অভিযোগ করেন যে নারীবাদী সমালোচনা কৃষ্ণ ও তৃতীয় বিশ্বের নারী লেখকদের সম্পর্কে পালন করে প্রকাণ্ড নীরবতা’; তাঁরা চান কৃষ্ণনারীবাদী সমালোচনা, যা বিবেচনার মধ্যে নেবে জাতিক ও লৈঙ্গিক উভয় ব্যাপার; মার্ক্সীয় নারীবাদীরা গুরুত্ব দেন শ্রেণী ও লিঙ্গ দুয়েরই ওপর; নারীবাদী সাহিত্য-ঐতিহাসিকেরা পুনরুদ্ধার করতে চান এক লুপ্ত ঐতিহ্য; বিসংগঠনবাদীরা চান এমন সমালোচনা, যা একই সঙ্গে পাঠগত ও নারীবাদী। প্রথম দিকে অনেক নারীবাদীই কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করতে চান নি নারীবাদী সমালোচনার; তাঁরা মনে করেছিলেন তত্ত্ব নারীবাদের মতো গতিশীল ব্যাপারকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। তারা চেয়েছিলেন নারীবাদী সমালোচনাকে খোলা রাখতে। সত্তরের দশকে সাংগঠনিক, উত্তরসাংগঠনিক, বিসাংগঠনিক ইত্যাদি যে-সমস্ত বিতর্ক দেখা দেয়, নারীবাদীদের কাছে সেগুলোকে মনে হয়। উষর ও ছদ্মবিস্তুনিষ্ঠ। ওই সমস্ত ক্ষতিকর পুরুষতান্ত্রিক রচনার কবল থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে চান। ভার্জিনিয়া উলফ থেকে শুরু করে মেরি ড্যালি, অ্যাড্রিয়েন রিচ, মাৰ্গারেট ডুরাস, ও আরো অনেকে উপহাস করেন ‘পুংপাণ্ডিত্যের নপুংসক আত্মপ্রেম কে, এবং মুক্ত থাকতে চান পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিপুজো থেকে। তবে নারীবাদীরা আজ আর তত্ত্ববিমুখ নন। স্যান্দ্রো গিলবার্ট (১৯৮০, ৩৬) বলেন, ‘যে-সব ছদ্মপ্রশ্ন ও উত্তর, পাঠ ও যৌনতা, আঙ্গিক ও লিঙ্গ, মনোলৈঙ্গিক সত্তা ও সাংস্কৃতিক সত্তার সম্পর্ককে ছায়াবৃত ক’রে রেখেছে’ নারীবাদী সমালোচনা ‘সে-সবের পাঠোদ্ধার ও রহস্য উন্মোচন’ করতে চায়। সংশোধনপন্থী নারীবাদী সমালোচনা অনেকটা গ’ড়ে উঠেছে চলতি সমালোচনা কাঠামো ভিত্তি ক’রেই। তবু নারীবাদীরা লেগে আছেন। পুরুষের সমালোচনা রীতি সংশোধন ও তাকে মানবিক ক’রে তুলতে, এবং তাকে নিরন্তর আক্রমণ ক’রে চলছেন; পুরুষের সমালোচনাতত্ত্ব হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা, সাহিত্যের ইতিহাস বা সাহিত্য ব্যাখ্যার সে-তত্ত্ব, যার ভিত্তি পুরুষের অভিজ্ঞতা, তবে তা পেশ করা হয় সর্বজনীন বলে। শোঅল্টারের (১৯৮১) মতে নারীবাদীরা যতোদিন পুরুষকেন্দ্রিক সমালোচনাকাঠামো ভিত্তি হিশেবে ব্যবহার করবে, এমনকি তা সংশোধন ক’রে যোগ করবে কিছুটা নতুনত্ব, ততোদিন নারীরা নতুন কিছুই শিখবে না। তাঁর মতে পুরুষের ধারণা দিয়ে চলবে না। নারীদের; লার্ক, দেরিদায় নারীর চলবে না; কেননা এতে নারী মেনে চলে পুরুষ প্ৰভুদেরই। তিনি চান একটি একাত্ত নারীবাদী সমালোচনারীতি, যা হবে নারীকেন্দ্ৰিক, স্বাধীন, ও মননগতভাবে সুসামঞ্জস। তার মতে নারীবাদী সমালোচনাকে ‘বের করতে হবে নিজ বিষয়, নিজ পদ্ধতি, নিজ তত্ত্ব, এবং নিজ কণ্ঠস্বর।’

এলেন সিজো বলেছেন, ‘আরো দেহ, তাই আরো লেখা।’ নারীবাদীদের কেউ কেউ জৈব বা দেহবাদী সমালোচনারও প্রস্তাব করেছেন। এতে দেহই হয়ে ওঠে রচনা বা বই ৷ দেহকে সমালোচনার মানদণ্ড করা বিপজ্জনক, কেননা সব জাতিই বিশ্বাস করে যে নারী দৈহিকভাবে দুর্বল, তার মস্তিষ্কও দুর্বল। জৈব নারীবাদী সমালোচকেরা অবশ্য দৈহিক হীনতা স্বীকার করেন না, কিন্তু মনে করেন নারীর শরীর তার লেখাকেও স্বতন্ত্ৰ ক’রে তোলে। পিতৃতন্ত্রের বিশ্বাস হচ্ছে লেখক জনক, যার কলম অনেকটা শিশ্নের মতোই জন্মদানের হাতিয়ার। গিলবার্ট ও গুবার প্রশ্ন করেছেন, ‘যদি কলম হয়ে ওঠে একটি রূপক-শিশ্ন, তাহলে কোন অঙ্গ থেকে নারী উৎপাদন করবে। পাঠ বা রচনা?’ উত্তরে শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫০) বলেছেন, নারী পাঠ বা রচনা জন্ম দেয় মস্তিষ্ক থেকে, বা ওয়ার্ড-প্রসেসর থেকে, যা একটি রূপক-জরায়ু। সাহিত্যিক পিতৃত্বের রূপক নারীদের পীড়ন করছে আবহমান কাল ধ’রে; তবে আঠারোউনিশশতকে সাহিত্যিক মাতৃত্বের রূপকও বেশ বড়ো হয়ে উঠেছিলো, যাতে সাহিত্যসৃষ্টি হয়ে ওঠে৷ গৰ্ভধারণ ও প্রসবের মতো ব্যাপার। বিশেষ ক’রে ফ্রান্সে ও আমেরিকায় কোনো কোনো আমূল নারীবাদী মনে করেন এসব রূপককে নিতে হবে শুরুত্বের সাথে, ন্যায়ী পুরুষের জৈব পার্থক্যকে দেখতে হবে নতুনভাবে, এবং খুঁজতে হবে দেহের সাথে লেখার সম্পর্ক। তারা মনে করেন নারীর লেখা বেরোয় দেহ থেকে, তাদের দৈহিক পার্থক্য তাদের লেখাব উৎসও। অ্যাড্রিয়েন রিচ বলেন শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫১)] :

‘আমরা এখনো যতোটা বুঝতে পেরেছি, নারীদেহের রযেছে তার চেযে অনেক বেশি আমূল তাৎপৰ্য। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা তার সংকীর্ণ নির্দেশ অনুসাবে নারীদেহকে সীমাবদ্ধ ক’বে ফেলেছে। এ-কারণে নারীবাদী দৃষ্টি সবে এসেছে নারীর জৈবসংগঠন থেকে; আমি বিশ্বাস করি তা একদিন আমাদের দেহকে নিয়তি মনে না করে সম্পদ ব’লেই গণ্য করবে। পরিপূর্ণ মানবিক জীবন যাপনের জন্যে আমাদের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করাই শুধু আমাদের জন্যে জরুরি নয়, আমাদেব স্পর্শ করতে হবে। আমাদের দেহের ঐক্য ও অনুনাদকে, যা আমাদের মননের দৈহিক ভিত্তি।‘

নারীবাদী জৈল সমালোচনায় খোজা হয় কীভাবে দেহ ব্যবহৃত হয় চিত্রকল্পের উৎসরূপে; আর নারীবাদী জৈব সমালোচনা, যা উৎসারিত করা হয় সমালোচকের দেহ থেকে, হয়ে থাকে অন্তরঙ্গ, স্বীকারোক্তিমূলক, ও আঙ্গিকগতভাবে অভিনব। তবে নারীসত্তার খোঁজে বেরিয়ে দেহকেই তার কেন্দ্ৰ ব’লে গণ্য করা ভয়ঙ্কর কাজ, কেননা দেহকেই পুরুষতন্ত্র ব্যবহার করেছে নারীশোষণের প্রধান যুক্তিরূপে। নারীর দেহেই খুঁজতে হবে নারীর সৃষ্টিশীলতা? এর চমৎকার উত্তর দিয়েছেন ন্যান্সি মিলার; তিনি বলেছেন নারীর সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য খুঁজতে হবে তার দেহের লেখায় নয়, বরং তার লেখার দেহে’ [দি শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫২)]।

বোনি জিমারম্যান (১৯৮১) ‘যা কখনো ছিলো না’ নামক একটি তীব্র প্রবন্ধে তুলে ধরেন এমন এক বিষয়, যা পিতৃতন্ত্রের বিধানে নিষিদ্ধ, আর নারীবাদীরাও চান চেপে রাখতে। তিনি আলোচনা করেন নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতি। নারীসমকামবাদকে উপেক্ষার বিরুদ্ধে তিনি জানান প্রবল প্ৰতিবাদ। নারীসমকাম নিষিদ্ধ ব্যাপার, তা যে ছিলো আর আছে, তা-ই কেউ স্বীকার করতে চায় নি ও চায় না; কিন্তু সত্য হচ্ছে তা ছিলো, এবং আছে। নায়ীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রস্তাবের সূচনায়ই প্রশ্ন ওঠে যে নারীর যৌন ও প্রীতির সম্পর্ক কতোখানি প্রভাব ফেলে তার লেখা, পড়া, ও চিন্তার ওপর? নারীসমকামবাদী নন্দনতত্ত্ব কি পৃথক হবে নারীবাদী নন্দনতত্ত্ব থেকে? কী হবে নারীসমকামবাদী সমালোচকের কাজ? সম্ভব কি কোনো নারীসমকামবাদী মানদণ্ড বা বিধান প্রতিষ্ঠা করা? নারীসমকামবাদীরা কি বিকাশ ঘটাতে পারেন এমন কোনো অন্তদৃষ্টির, যা ঋদ্ধ করবে। সমগ্র সমালোচনাশাস্ত্রকে? নারীসমকামবাদী সমালোচনার কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রায় সব নারীসমকামবাদীই একমত। তারা মনে করেন এমন নয় যে নারীসত্তা স্থির করতে হবে শুধু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ক’রেই, নারীসাহিত্যকেও যে পুরুষসাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত ক’রে দেখতে হবে, তাও নয়; তাদের মতে নারীর সাথে নারীর তীব্র সম্পর্কও নারীর জীবনের বড়ো ব্যাপার, এবং নারীর যৌন ও আবেগগত প্রবণতা গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার চেতনা ও সৃষ্টিশীলতাকে। পিতৃতন্ত্র স্বীকার করে শুধু বিষমকা কে; নারীসমকামবাদীদের মতে বিষমকামই একমাত্ৰ স্বাভাবিক যৌন ও আবেগগত সম্পর্ক নয়। বিষমকামকেই শুধু স্বাভাবিক ভাবা পিতৃতন্ত্রের শিক্ষামাত্র। জিমারম্যান দেখান যে নারীবাদীরাও দীক্ষিত পিতৃতন্ত্রের বিষমকামবাদে; তাই নারীবাদী সংগ্রহ থেকে বাদ পড়েন নারীসমকামী রেনি ভিভিয়েন ও র্যাডক্লিফ হল, বা সংকলিত হয় ক্যাথেরিন ফিলিপস, ও অ্যাড্রিয়েন রিচের বিষমকামী বা নিষ্কাম রচনা, যদিও তারা বিখ্যাত নারীসমকামী লেখার জন্যে। জিমারম্যান (১৯৮১, ২০১-২০২) বলেন :

‘যখন পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত কোনো সংগ্রহে থাকে স্ত্রী, মাতা, যৌনসামগ্ৰী, তরুণী, বৃদ্ধা, এবং মুক্ত নারী প্রভৃতি বিভাগ, কিন্তু থাকে না নারীসমকামী- তখন তা বিষমকামবাদ। নারীবাদী সংগ্রহে বিষমকামবাদ-পুংকেন্দ্ৰিক সংগ্রহে লিঙ্গবাদের মতো- মুছে ফেলে নারীসমকামবাদী অস্তিত্ব এবং লালন করে এ-মিথ্যেটি যে নারী শুধু পুরুষের মধ্যেই খোঁজে কাম ও আবেগের তৃপ্তি, বা একেবারেই খোঁজে না।‘

নারীসমকামবাদীরা অভিযোগ করেন নারীবাদী পত্রিকা- ফেমিনিস্ট স্টাডিজ, উইমেন্স স্টাডিজ, উইমেন অ্যান্ড লিটেরেচার প্রভৃতিতে যে নারীসমকামবাদী রচনা বেরোয় না, তার মূলে রয়েছে বিষমকামবাদ, বা পরিকল্পিত উদ্দেশ্য। অধিকাংশ নারীসমকামবাদী লেখা প্রথম বেরোয় বিকল্প, অপ্রাতিষ্ঠানিক নারীসমকামবাদী পত্রিকা সিনিস্টার উইজডম, কোভিশন্স প্রভৃতিতে। বিষমকামবাদের প্রতাপ দেখা যায় নারীবাদী সমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ সব সংগ্রহে; যেমন দি অথোরিটি অফ এক্সপেরিএন্স বা শেক্সপিয়রসূ সিস্টারসূ-এ নেই কোনো নারীসমকামবাদী প্ৰবন্ধ। নারীবাদী সমালোচকেবা চেপে গেছেন নারীসমকামবাদকে; তাই নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার ভিত্তি স্থাপন করতে এগিয়ে আসেন নারীসমকামবাদীরাই। ১৯৫৬তে বেরোয় জেনেট ফস্টারের সেক্স ভাবিয়েন্ট উইমেন ইন লিটেরেচার, ১৯৬৭তে জেন ড্যামন (ছদ্মনাম), জ্যান ওয়াটসন, ও রবিন জর্ডানের দি লেসবিয়ান ইন লিটেরেচার : এ বিবলিওগ্রাফি।

নারীসমকামবাদী সমালোচনার মূলে, নারীবাদী সমালোচনার মতোই, রয়েছে রাজনীতিক ভাবাদর্শ। তাদের মতে নারীসমকাম এক সুস্থ জীবনপদ্ধতি, নারীরা যা যাপন করেছে ও করছে সব দেশে ও কালে। তাই তাঁরা দূর করতে চান এর ওপর চাপানো নিষেধ। এতে সফল হওয়ার এক উপায় নারীদের পুরুষের মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একান্তভাবে নারীসমাজভুক্ত করা। এক ধরনের নারীস্থান গড়ে তোলা। র্যাডিক্যালেসবিয়ান বা আমূলনারীসমকামবাদীরা মনে করেন যে নারীর কাছে নারীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নারীরা মিলে গ’ড়ে তুলবে এক নতুন চৈতন্য, তারা নিজেদের কেন্দ্ৰ খুঁজবে নিজেদের ভেতরে। তাদের মতে বিষমকামবাদ এক রাজনীতিক সংস্থা, তা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার নয়। নারীসমকামবাদীরা বিকাশ ঘটাতে চান একান্ত নারীসমকামী নারীবাদী প্রেক্ষিত; তাই তাদের প্রশ্ন; কখন কোনো রচনা হয়ে ওঠে, বা তার লেখক হন নারীসমকামবাদী? এটা নির্ভর করে নারীসমকামী বলতে কী বোঝায়, তার ওপর। নারীসমকামী বলতে কি বোঝাবে শুধু সে-নারীদেরই, অন্য নারীর সাথে যাদের যৌন অভিজ্ঞতার প্রমাণ রয়েছে? এটা অসম্ভব কাজ। অনেকেই তো তার কোনো প্রমাণ রেখে যান নি। তাছাড়া এতে নারীসমকাম হয়ে ওঠে শুধুই যৌন ব্যাপার। অ্যাড্রিয়েন রিচের মতে নারীসমকামবাদ শুধু অন্য নারীর সাথে যৌনসংসর্গ নয়, তা নারীর সংসর্গে নারীর অভিজ্ঞতা, নারীর সাথে নারীর আন্তর জীবনের ঐক্য, রাজনীতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নারীদের ঐক্য দ্ৰ জিমারম্যান (১৯৮১, ২০৫)]। তবে নারীদের সব ধরনের সম্পর্ককেই যদি নারীসমকামী সম্পর্ক বলা হয়, তাতে অসুবিধা দেখা দেয়; নারীদের মধ্যে নারীসমকামী ও অসমকামী সম্পর্কের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অনেকে নারীসমকামবাদের রাজনীতিক সংজ্ঞাও দিয়েছেন; বলেছেন নারীসমকাম হচ্ছে শক্তি, স্বাধীনতা, ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। লিলিআন ফ্যাডারম্যান সািরপাসিং দি লাভ অফ ম্যান : রোম্যান্টিক ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড লাভ বিটুইন উইমেন ফ্লম দি রেনেসাঁস টু দি প্রসেন্ট (১৯৮১) বইতে দিয়েছেন নারীসমকামবাদের মাঝপথি সংজ্ঞা [দ্র জিমারম্যান (১৯৮১, ২০৬)] :

‘‘নারীসমকামী’ বলতে বোঝায় সে-সম্পর্ক, যাতে দুটি নারীর তীব্ৰতম আবেগ ও পীতি ধাবিত হয়। পরস্পরের দিকে। এ-সম্পর্কে থাকতে পারে কম বা বেশি যৌন সংসৰ্গ, এমনকি একেবারে নাও থাকতে পারে। এতে দুটি নারী পছন্দ করে তাদের অধিকাংশ সময় একসাথে কাটাতে এবং জীবনের অধিকাংশ ব্যাপার তারা যাপন করে পরস্পবেক সাথে।‘

নারীসমকামবাদী সমালোচকের একটি দায়িত্ব নারীসমকামবাদের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা, যাতে তা হয়ে উঠতে পারে শ্ৰদ্ধেয়। জেন রুল লেসবিয়ান ইমেজেজ : নারীসমকামবাদী ভাবমূর্তিতে (১৯৭৩) প্রথম নারীসমকামবাদের ঐতিহ্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। এটি নারীসমকামবাদী সমালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। এর পর ডোলোরেস ক্লাইস ওম্যান প্লাস ওম্যান : নারী যোগ নারী (১৯৭৪), লুইসে বারনিকেও দি ওয়ার্ল্ড স্পিলিটু ওপেন : ফালি করে খোলা পৃথিবী (১৯৭৪) বইতে প্রতিষ্ঠা করেন নারীসমকামবাদের এক মহৎ ঐতিহ্য। তারা স্যাফো থেকে শুরু ক’রে তাদের ধারায় পান মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটু, এমিলি ডিকিনসন, ভার্জিনিয়া উলফ, ভিটা স্যাকভিল-ওয়েস্ট, এথেল স্মাইথি, জারটুড স্টেইন, র্যাডক্লিফ হল, নাটালি বার্নি, কোলে ৎ, রেনি ভিভিয়েন, রোমেইন ব্রুকস, ও আরো অনেককে। নারীসমকামবাদী সমালোচনার এক বৈশিষ্ট্য ঐতিহ্য আবিষ্কার হ’লেও এই এর একমাত্ৰ লক্ষ্য নয়; নারীসমকামবাদীরা খুঁজেছেন উপন্যাসে নারীসমকামীর ভাবমূর্তি, ছক প্রভৃতি। বার্থ হ্যারিস দেখিয়েছেন উপন্যাসে নারীসমকামী চিত্রিত হয় দানবীরূপে, যে ভেঙেচুরে ফেলে নারীর আনুগত, অক্রিয়তা, সতীত্বের প্রথাগত ধারণা। তারা রচনাশৈলী ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষেয়েও কিছু কাজ করেছেন। নারীসমকামবাদীদের কাছে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শতাব্দী পরম্পরায় তাদের মুখ খুলতে দেয়া হয় নি, তাদের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। এক সময় তারা সাংকেতিক ভাষায় কথা বলেছেন, এখন চালাচ্ছেন নানা নিরীক্ষা। তাদের ব্যাকরণ অপ্রথাগত, কথা বলেন তারা ঘটমান বর্তমান কালে, নিয়মিতভাবে তৈরি করেন। নতুন শব্দ।

নারীবাদ, এবং নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ ধারার বিকাশ ঘটে ফরাশিদেশে। একে বলা হয় ফরাশি নারীবাদ। ফরাশি ও বিশ্বনারীবাদের মহত্তম তাত্ত্বিক সিমোন দা বোভোয়ার। তার কাছে, অন্যদের মতো, ফরাশি নবনারীবাদীরা ঋণী, ও ঋণস্বীকারে অকুণ্ঠ। তিনি নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনারও সূত্রপাত করেছিলেন দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ, লিঙ্গবাদের রূপ দেখিয়েছিলেন পাঁচজন- মথেরল, ডি এইচ লরেন্স, ক্লাদেল, ব্ৰেতো, স্তাদাল- লেখকের উপন্যাস ও কবিতায়। তবে ১৯৬৮ার ছাত্রবিদ্রোহ থেকে উদ্ভূত ফরাশি নবনারীবাদীরা সাহিত্য সমালোচনায় তাঁকে অনুসরণ করেন নি। ১৯৭০ থেকে ফরাশি নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উৎস হয় দেরিদীয় বিসংগঠন ও লাকীর ফ্ৰয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের সাংগঠনিক ভাষ্য। তারা পুরুষ প্ৰভুদের ধারণা নিয়েই করেন নারীবাদী কাজ। ১৯৭৪-এর মধ্যে ফরাশি নারীবাদীরা তাদের ভয়াবহ মননশীল নারীবাদীতত্ত্বের অনেকটা রচনা ক’রে ফেলেন; কিন্তু অতিমননশীলতাভারাক্রান্ত ওই তত্ত্ব বাইরে গৃহীত হ’তে সময় নেয়। মার্ক্স, নিীটশে, হাইডেগার, দেরিদা, লাকীর চিন্তায় তাদের তত্ত্ব পরিপূর্ণ, যা অফরাশি পাঠকের কাছে বিপন্নকরভাবে দুরূহ। এলেন সিজোর দুরূহজটিল ভাষারীতি, লুসি ইরিগারের গ্রিক বর্ণমালামোহ, জুলিয়া ক্রিস্তেভার এক বাক্যে পাঁচসাতজন তাত্ত্বিককে উল্লেখ করার প্রবণতা পাঠকের মনে ভয় জাগায়। ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীরা যেমন সৃষ্টি করেন বিপুল পরিমাণ নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা, ঠিক সে-ধরনের সমালোচনা ফরাশি নারীবাদীরা লিখেছেন কম; তারা লিখেছেন পাঠগত, ভাষাতাত্ত্বিক, সাংকেতিক বা মনোবিশ্লেষণাত্মক তত্ত্বের সমস্যা সম্পর্কে, এবং লিখেছেন এমন রচনা, যাতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবিতা ও তত্ত্ব। তারা ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীদের মতো প্রশ্ন তোলেন নি। ‘মহৎ’ সাহিত্যের মহত্ত্ব সম্বন্ধে, তারা তা মেনে নিয়েছেন; তাই তারা ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীদের মতো সফলভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন নি পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্যের পীড়নমূলক সামাজিক ও রাজনৈতিক চক্রান্তের মুখোমুখি। পুরুষেরা যে-সমস্ত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে ফরাশিদেশে, তারাও ব্যস্ত থেকেছেন তা নিয়েই; তবে তা বিশ্লেষণ করেছেন নারীবাদী দৃষ্টিতে। ফরাশি নারীবাদীদের কাছে ভাষা প্ৰধান গুরুত্বের বস্তু। ফরাশি নবনারীবাদের তিন প্রধান এলেন সিজো, লুসি ইরিগারে, ও জুলিয়া ক্রিস্তেভা।

এলেন সিজে। ১৯৭৫-১৯৭৭ সময়ের মধ্যে লেখেন একরাশ তাত্ত্বিক রচনা, যাতে খোজা হয় নারী, নারীত্ব, নারীবাদ, ও লেখার সম্পর্ক। তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে ল্য জািন নে (ক্যাথেরিন ক্লেমওর সাথে, ১৯৭৫), ‘মেদুসার হাস্য’ (১৯৭৫), ‘নপুংসকীকরণ না শিরচ্ছেদীকরণঃ’ (১৯৭৬), ল্য ভ্যানু7 লেক্রিতুর : লেখায় আসা (১৯৭৭)। তাঁর লেখায় কিছু কেন্দ্রীয় ধারণা ও চিত্ৰকল্প ফিরে ফিরে আসে, আর তাঁর লেখা হয়ে ওঠে এমন যেনো তা সরলরৈখিকভাবে পড়ার জন্যে নয়। তাঁর লেখা কাব্যিক, রূপকভরা, চিত্রকল্পের বিশ্লেষণ অসম্ভব জালের মতো। দেরিদার মতে পশ্চিমি পরাবিদ্যা আলোচনার ভিত্তি পুরুষ, পুরুষের একটি অতিশায়িত আদর্শায়িত রূপ গঠন ক’রে সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রে বসানো হয়েছে পুরুষকে। দর্শনের সূচনাকাল থেকে পুরুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এমন এক জ্ঞানতত্ত্বের কেন্দ্রে, যা গ’ড়ে উঠেছে ক্ৰমস্তরিকভাবে বিন্যস্ত একরাশ দ্বিমুখি ধারণায়। তাতে পুরুষ সব সময় অধিকার ক’রে আছে সুবিধাজনক স্থান : সত্তা/অপর, কর্তা/কর্ম উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, বিধি বা শৃঙ্খলা/বিশৃঙ্খলা, পুরুষ/নায়ী প্রভৃতি দ্বিমুখি ধারণায় পুরুষই মূল ধারণা দ্ৰ জোন্স (১৯৮৫, ৮১)]। ফরাশি নারীবাদীরা দেখান পুরুষ নারীকে এই ক্রমস্তরিক বিন্যাসের ঋণাত্মক প্রান্তেব্য দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং নারীকে জড়িয়ে দিয়েছে সে-সব ধারণার সাথে যেগুলো বোঝায়। মানুষ-নয়’। পুরুষ এভাবে অধিকার করেছে কেন্দ্রিকতা ও ক্ষমতা। তারা পুরুষাধিপত্যবাদী পরাবিদ্যাকে বুঝিয়ে থাকেন একটি শব্দে, শব্দটি ‘ফ্যালোসেন্ট্রিজম’ বা ‘শিশ্নকেন্দ্রিকতা’, যাতে শিশ্নই কেন্দ্র, পুরুষই সব। পিতৃতন্ত্রে নারীপুরুষের মূল্য কী, তা দেখানোর জন্যে সিজো পেশ করেছেন তাঁর পিতৃতান্ত্রিক দ্বিমুখি বৈপরীত্যু’-এর তালিকা; সক্রিয়/অক্রিয়, সূৰ্য/চন্দ্ৰ, সংস্কৃতি/প্রকৃতি, দিন/রাত, পিতা/মাতা, মস্তিষ্ক/আবেগ, বোধগম্য/ভাবাবেগপরায়ণ প্রভৃতি; এবং দেখিয়েছেন এ-তালিকাব ধনাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো সবই পুরুষের, ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো নারীর। এ-ধরনের চিন্তায় সিজে সক্রিয় দেখেছেন মৃত্যুকে। তাঁর মতে দ্বিমুখি বৈপরীত্যের একটি ধারণাকে অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্যে দরকার অপরটির বিনাশ; তাই আধিপত্যের জন্যে লড়াই ক’রে চলছে। ধারণাগুলো। এতে বিজয় = সক্রিয়তা, আর পরাজয় ১° অক্রিয়তা। পিতৃতন্ত্রে পুরুষই সব সময় বিজয়ী। তাই নারী অভিন্ন মৃত্যুর সাথে। সিজো সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এক্রিত্যুর ফেমিনিন বা নারীর লেখা বলে একটি ধারণা। তার মতে নারীর লেখার অভিমুখ ভিন্নতার দিকে, যার লক্ষ্য শিশ্নবাক্যকেন্দ্ৰিক- ফ্যালোগোসোস্ট্রিক- যুক্তি উপেক্ষা করা। তিনি নির্দেশ করেছেন লেখারও লিঙ্গ; তবে ওই লিঙ্গ লেখকের লিঙ্গের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাঁর মতে অনেক নারীই এমন লেখা লিখেছেন, যা আসলে পুংলিঙ্গ। তবে তিনি লিঙ্গ ধারণাই ত্যাগ করতে চান।

লুসি ইরিগারের প্রথম বই চিত্তভ্রংশতার ভাষা (১৯৭৩) বেশ সুদূর নারীবাদী লক্ষ্য থেকে, কিন্তু দ্বিতীয় বই অপর নবীর অবতল দৰ্পণ-এ (১৯৭৪) তিনি নারীবাদের জন্যে পেশ করেন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, এবং এ-বইয়ের জন্যে তিনি বহিষ্কৃত হন লার্কর ফ্রয়োড়ীয় ইস্কুল থেকে। বইটি অতিবিতর্কিত। ১৯৭৭-এ বেরোয় এই লিঙ্গ যা একটি নয়, এর পর বরোয় এবং একজন অপরজনকে ছাড়া আলোড়িত হয় না (১৯৭৯), ফ্রিডরিখ নিটশের জলীয় প্রেমিক (১৯৮০), মায্যের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ (১৯৮১), প্রাথমিক সংরাগ (১৯৮২)। তাঁর অবতল দিপর্ণ-এর প্রথম ভাগে রয়েছে ফ্রয়েডের নারীমনোবিজ্ঞানের কঠোর সমালোচনা, তবে তিনি মিলেটের মতো মনোবিজ্ঞানকে সহজাতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল বলে বাদ দেন নি। বইটি তিনি ফ্ৰযোডকে দিয়ে শুরু এবং প্রাতোকে দিয়ে শেষ ক’রে নষ্ট ক’রে দেন স্বাভাবিক কালানুক্রম। এ-বইয়ের গঠনের সাথে মিল রয়েছে স্ত্রীরোগবিদদের ব্যবহৃত অবতল দর্পণের, যা দিয়ে তারা নারীদেহের নানা রন্ধ পর্যবেক্ষণ করে। তাঁর রচনাপদ্ধতি বিসাংগঠনিক। জুলিযা ক্রিস্তেভা বুলগেরীয়, ১৯৬৬তে আসেন প্যারিসে। রোল বার্তা তার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘জুলিয়া ক্রিস্তেভা বস্তুর স্থান বদলে দেন; তিনি ধ্বংস করেন অতিসাম্প্রতিক পৰ্ব্বধারণা, তিনি ধ্বংস করেন কর্তৃত্ব, একযৌক্তিক বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব’ [দ্র মোই (১৯১, ৫, ১৫০)। তাঁর বইয়ের মধ্যে রয়েছে কাব্যভাষার বিপ্লব (১৯৭৪), ভাষায় কামনাবাসিনা (১৯৮০), বিভীষিকার ক্ষমতা (১৯৮০) প্রভৃতি। ক্রিস্তেভার প্রধান প্রবণতা ভাষার সমস্যা বিশ্লেষণ। তাঁর মতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ভাবাদর্শগত ও দার্শনিক ভিত্তিটি কর্তৃত্বপরায়ণ ও পীড়নবাদী। ক্রিস্তেভা, রুশ ভাষাবিজ্ঞানী ভোলোসিনোভের মতো, ভেঙে দিতে চান ভাষাবিজ্ঞান, অলঙ্কারশাস্ত্র ও কাব্যতত্ত্বের মধ্যবর্তী দেয়াল, এবং তৈরি করতে চান একটি নতুন ক্ষেত্র, যার নাম পাঠগত তত্ত্ব।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top