কিশোরীতরুণী
বালিকার পরিণতি কিশোরী, কিশোরীর পরিণতি তরুণী; তাদের বিপন্ন পরিণতি নারী। পিতৃতন্ত্রের নানা প্রান্তে তাদের বিকাশের মধ্যে, যদি একে বিকাশ বলতে পারি, রয়েছে মিল : তাদের জৈব বিকাশে মিল রয়েছে পৃথিবী জুড়ে; কিন্তু বিভিন্ন দেশ, সমাজ, শ্রেণী কিশোরীতিরুণীদের একইভাবে বাড়তে দেয় না। বাড়া নয়, বলা যায়, রুদ্ধ করে রাখা হয় তাদের বিকাশ। বাঙালি আর মার্কিন কিশোরীর মধ্যে জৈব মিল স্পষ্ট, কিন্তু সমাজ তাদের এমন পৃথক ক’রে রাখে। যেনো তারা ভিন্ন গ্রহ বা প্রজাতির। আরবি কিশোরী জৈবিকভাবে বাঙালি আর মার্কিন কিশোরীর মতোই বাড়ে, তবে তার ওপর সামাজিক বোঝা এতো ভারী এতো নির্মম যে তার মনই শুধু নয়, বিকৃত হয়ে যায় তার দেহও। তাদের সবার পরিণতি নারী; সব দেশেই নারী বিপন্নতার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ, এবং বহু দেশে তাবা পুবোপুরি পর্যাদস্ত। একই দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর কিশোরীতিরুণীর মধ্যেও রয়েছে মিল-অমিল; চাষী আর আমলার মেয়ের জৈবিক বিকাশ অভিন্ন, কিন্তু তারা এতো ভিন্ন শ্রেণীর যে তারা পরস্পরের সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু তারা একই পংক্তির। ধনী পরিবারের কিশোরীটির সাথে ওই পরিবারের কিশোরটির যতোটা মিল, তার চেয়ে অনেক মিল তার দরিদ্র চাষী পরিবারের কিশোরীটির সাথে; তারা শিকার একই সামাজিক নিয়তির। সব নারী, সব কিশোরীতিরুণীর ভাগ্য একই পীড়নের সুতোয় গাথা! সমাজ কিশোরীর দিকে ওৎ পেতে থাকা বাঘ একটু বিচূতি ঘটলে বাঘ লাফিয়ে পড়ে তার ওপর। সমাজ তার দেহকে যেভাবে বাড়া৩ে চায়, তাকে সেভাবে বাড়াতে হয়। দেহ; সমাজ যেভাবে স্বপ্ন দেখাতে চায় তরুণীকে, সেভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় তাকে। তারা সমাজনিয়ন্ত্রিত প্ৰাণী, খাচার মধ্যে তারা বাড়তে থাকে আদর্শ নারী হওয়ার জন্যে। বাঙালি নারীরা তাদের আত্মজীবনীতে বারবার ‘খাচা’ আর “পিঞ্জার’-এর কথা বলেছেন, পাখির রূপকে দেখেছেন নিজেদের; কিন্তু তারা পোষা পাখি ছিলেন না, ছিলেন পোষােজন্তু। সমাজ পোষােজন্তুটিকে বলে নারী। তার দেহ আছে; যে-দেহটি সে নিজের ব’লে পেয়েছে, সেটি তাকে বিব্রত করে, তাকে মাঝে মাঝেই অসুস্থ করে; তবে কিশোরী ওই দেহ, তরুণী ওই দেহ। তার দেহও সমাজেরই বিবেচনার বস্তু; তার দেহ পরিখের কর পরখ করতে থাকে অনেক সমাজ। অনেক সমাজে কিশোরী বুঝতেই পারে না। কীভাবে সে বেড়ে উঠেছে, তরুণী হয়েছে; তার আগেই তার দেহ কোনো বর্বর অত্যাচারে বিকৃত হয়ে যায়। প্রতিটি সমাজ কিশোরীতিরুণীর জন্যে বের করেছে সামািজীকিকরণের বিশদ বিধিমালা, যার লক্ষ্য তাকে পিতৃতন্ত্রের আদর্শকাঠামোর আদলে শিশুস্বভাবের নারী ক’রে তোলা।
সামাজিকীকরণের ফলে বদলে যেতে থাকে বালিকা, ভিন্ন হয়ে যেতে থাকে বালকের থেকে; সে খাপ খাইয়ে নিতে থাকে তার লিঙ্গভূমিকার সাথে, তবু সে তার স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ফেলে না। যেই সে পৌঁছে কৈশোরে, তার ভবিষ্যৎ বাসা বাঁধে তার শরীরে; দ্য বোভোয়ারের (১৯৪৯, ৩৫১) ভাষায়, ‘বয়ঃসন্ধির সাথে ভবিষ্যৎ শুধু ঘনিয়ে আসে না; তার শরীরে বাসা বাধে; পরিগ্রহ করে চরম মূর্ত বাস্তব রূপ।’ ভিন্ন হয়ে যায় কিশোরকিশোরী। কিশোর সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্কতার দিকে; তার ভবিষ্যৎ তার জন্যে চমৎকারভাবে সৃষ্টি ক’রে রেখেছে সমাজ, সেখানে সে প্রবেশ করে স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে; কিন্তু কিশোরী অপেক্ষা করতে থাকে, তার জীবন হয়ে ওঠে অনন্ত অপেক্ষা। কৈশোর বালিকার জন্যে ক্রাস্তিকাল; এ-সময়ে তার কোনো বিশেষ লক্ষ্য নেই, সে জানে না তার জীবনের উদ্দেশ্য। কিশোরী তরুণী হয়ে ওঠে, তার শরীরের বিপজ্জনক সুন্দর পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু সে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে না। তার জীবনে। তরুণীর সময় কাটে অবসাদগ্ৰস্ত প্ৰতীক্ষায়। সে প্রতীক্ষা করে পুরুষের } তার জীবন সে নিজে সৃষ্টি করতে পারে না, সমাজ সে-ব্যবস্থা রাখে নি; সমাজ উদ্ভাবন করেছে তাকে রুদ্ধ করার সমস্ত বিধি। তার জন্যে রেখেছে একটি প্রতীক্ষার মহাসামগ্ৰী : পুরুষ। তার জীবনের সারকথা সংহত একটি শব্দে : পুরুষ। কিশোরীকে, তরুণীকে সমাজ একটিই স্বপ্ন দিয়েছে; পুরুষ। কিশোরও স্বপ্ন দেখে নারীর, কিশোরও কামনা করে নারী; তবে তা তার জীবনের খণ্ডাংশ। নারী তার জীবনের নিয়তি নয়, নারীর মধ্যে সে দেখে না জীবনের পূর্ণতা। যুবক নিজের জীবনের পূর্ণতার স্বপ্ন দেখে বাস্তব সাফল্যে, নারী ওই সাফল্যের একটি অংশ; কিন্তু তরুণীর জীবনের সারকথা পুরুষ, যে পূর্ণ ক’রে তুলবে তার জীবন। এটা কোনো জৈব বিধান নয়; প্রকৃতি তাকে প্রতীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করে নি, কিন্তু সমাজ তার জন্যে পুরুষের প্রতীক্ষাকে ক’রে তুলেছে অবধারিত।
তরুণী থাকে অবসাদগ্ৰস্ত অস্তিত্বের মধ্যে বন্দী। তার কোনো লক্ষ্য নেই উদ্দেশ্য নেই; সে নিরর্থক প্রাণী। তাকে ওই নিরর্থকতার বন্দীত্ব থেকে যে উদ্ধার করবে, সে পুরুষ। সমাজব্যবস্থা পুরুষকে দিয়েছে ত্ৰাতার ভূমিকা। সব পুরুষ সমান শক্তিশালী, সমান ঐশ্বৰ্যশালী নয়; কিন্তু পুরুষ হওয়াই ঐশ্বৰ্য। পুরুষ শক্তিশালী, ধনী; তার হাতে আছে সুখের চাবি, সে স্বপ্নের রাজপুত্র। বালিকা বয়স থেকেই বালিকা দেখে পুরুষ উৎকৃষ্ট; পুরুষ। আয় করে টাকা। যে টাকা আয় করে সে-ই প্ৰভু। সমাজ নারীর পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে রেখেছে আর্থনীতিক ভিত্তিটি, যার ওই ভিত্তি নেই। সে কখনো দাঁড়াতে পারে না। কিশোরতরুণী জানে সে কখনো টাকা আয় করবে না, যে-সব কাজ সে শিখছে মায়ের পুণ্য আদর্শ অনুসাবণ করে সে-সবের কোনো আর্থ মূল্য নেই। তার কাজের আর্থ মূল্য নেই, তাই তারও মূল্য নেই! সে ব্যক্তি হয়ে উঠবে না, প্ৰভু হয়ে উঠবে না। সমাজের সব কিছু তাকে বুঝিয়ে দেয় তার জন্যে সবচেয়ে ভালো কোনো পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তি হওয়া। তার চাহিদা সামগ্ৰী হিশেবে। যে-মেয়ের জন্যে ঘন ঘন পাত্র আসে, তাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে বাবামা; যাকে বউ করার জন্যে প্রতিযোগিতা পড়ে যোগ্যদের মধ্যে, অন্য মেয়েরা ঈর্ষা করে তাকে; কারণ পুরুষ পাওযাই তার জীবনের সাফল্য। বিয়ে নারীর শ্রেষ্ঠ পেশা। তরুণীর জন্যে অন্যান্য পেশার থেকে এটা বেশি সম্মানজনক, এবং কম শ্রমসাধ্য; একটি দেহই তাকে এর যোগ্য ক’রে তোলে। বিয়ে তাকে দেয় সামাজিক মর্যাদা, এর মাধ্যমে তৃপ্ত হয় তার কাম ও মাতৃত্বম্পুহা। স্বামী পাওয়াই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণতম কাজ। এ-কাজ সে নিজে বেছে নেয় নি, এ-কাজকে সে নিজের জন্যে স্থির করে নি; সমাজই নির্ধারণ ক’রে দিয়েছে।
বিয়ে তার শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পেশা; কিন্তু এর জন্যে তাকে মূল্যও দিতে হয় প্রচুর। পুরুষ কোনো পেশার জন্যে এমন মূল্য দেয় না। সে একটি পেশার জন্যে উৎপাটিত করে নিজের অস্তিত্ব, তার যা কিছু পরিচিত আপন ছিলো তাদের থেকে সে সরিয়ে নেয় নিজেকে। সে মেনে নেয় নির্বাসন। সে নিজেকে সরিয়ে নেয় বাপের বাড়ি থেকে, পিতামাতার অধিকার থেকে, তার পরিচিত প্রিয় দৃশ্যগুলো থেকে। সে সক্রিয় বিজয়ীর বেশে ঢোকে না তার ভবিষ্যতে। সে শুধু নিজেকে সমর্পণ করে এক নতুন প্রভুর অধিকারে। সে যে নিজেকে সমর্পণ করে একটি পুরুষের কাছে, এর তাৎপর্য বের করার চেষ্টা করেছে। পুরুষতন্ত্ৰ : এর তাৎপর্য নারী নিকৃষ্ট পুরুষের থেকে, তার পুরুষের সমান হওয়ার শক্তি নেই। তাই সে অসম প্ৰতিযোগিতায় না নেমে নিজেকে সমর্পণ করে পুরুষের পায়ে, যার রয়েছে জয়ী হওয়ার শক্তি। বিয়ে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর নারীর নিকৃষ্টতার প্রমাণ। নারী নিজেকে সমর্পণ করে, তবে তার সমর্পণের মূলে কোনো জৈব কারণ নেই; প্রকৃতি তাকে পুরুষের অধীনে থাকার জন্যে সৃষ্টি করে নি। সমাজই তাকে তৈবি করেছে এমনভাবে। সমাজ তার জন্যে নির্ধারিত করে রেখেছে এমন ভবিষ্যৎ, যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বিয়ে তাকে কিছুটা স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তার বিবাহিত জীবন এক নিরন্তর সংকট; পুরুষেব স্বেচ্ছাচারিতার শিকার।
বয়ঃসন্ধি বদলে দেয়। বালিকার দেহ। এর আগে বালকবালিকার শরীরে থাকে সমান শক্তি, প্রাণবন্ততাও থাকে সমান; কিন্তু বয়ঃসন্ধি বালিকাকে জন্ম দেয় নতুন করে। তার দেহ হয়ে ওঠে আগের থেকে ভঙ্গুর, এক ঠুনকো অবয়ধের অধিকারী হয় সে, তার কামপ্রত্যঙ্গগুলো সহজে বোধ করে আহত, আর বুকের দু-পাশে দুটি বিব্রতকর। ফলের মতো দেখা দেয় অদ্ভুত, বিপত্তিকর স্তন। পুরুষের চোখে স্তন সুন্দর, তার শরীরের ওই স্ফীত পিণ্ড দুটি পুরুষের চোখে জাগায় তীব্র আবেদন; কিন্তু কিশোরী তা নিয়ে থাকে বিরত। অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে, আগের জামা তাকে পীড়া দিতে থাকে; সে দৌড়েতে গেলে ওগুলো দোলে, ব্যায়াম করতে গেলে দোলে। তার বুকে যন্ত্রণা হয়ে যা ফুলে ওঠে তা স্তন, যা তার নিজের কোনো কাজে লাগে না; একদিন পুরুষ ও-দুটি মথিত করে, শিশু শোষণ করে। কিশোরী হয়ে ওঠে দুর্বল, কমতে থাকে। তার পেশির শক্তি, সে হারিয়ে ফেলে তৎপরতা। একই বয়সে কিশোর অর্জন করে পেশি, অর্জন করে তৎপরতা। এমন একটি প্রক্রিয়া দেখা দেয় তার শরীরে, যা কখনো বোধ করে না পুরুষ; তা তার ঋতুস্রাব। পশ্চিমে একে এক সময় বলা হতো “অভিশাপ’, যা কিশোরীর কাছে আসলেই অভিশাপ মনে হয়। অধিকাংশ সমাজেই এর জন্যে তাকে প্রস্তুত ক’রে তোলা হয় না, তাই হঠাৎ অনভিপ্রেতি রক্তের প্রবাহ তাকে ভীত ক’রে তোলে। কিশোরী বোধ করে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, তলপেটে ব্যথা। ব্যাহত হয়ে পড়ে তার স্বাভাবিক জীবনধারা, তার শরীর হয়ে ওঠে তার জন্যে সমস্যা। সব ধর্মই শেখায় যে এটা অশুচি অপবিত্র, যদিও এতে নেই কোনো অশুচিতা অপবিত্রতা, তবুও কিশোরী নিজের অশুচিতা ও যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৩৫৩) বলেছেন, ‘সমগ্র মহাজগতকে তার মনে হয় এক দুৰ্বহ ভার। দুৰ্বহ ভারগ্রস্ত, নিমজ্জিত, সে নিজের কাছেই নিজে হয়ে ওঠে। অপরিচিত, কেননা বাকি সমগ্র জগতের কাছেই সে অপরিচিত।’ মাসে মাসে একই অগ্ৰীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে পাগল ক’রে তুলতে পারে; তবে কিশোরী জানে তাকে বেঁচে থাকতে হবে এ নিয়ে।
কৈশোরে, বছর তেরোর দিকে, বিকাশ ঘটে বালকের ইচ্ছাশক্তি। এ-সময় প্রকাশ ঘটতে থাকে তাদের আক্রমণাত্মক প্রবণতা, শরীর দিয়ে তারা পরখ ক’রে দেখতে চায় চারপাশ, জয়ের বাসনা দেখা দিতে থাকে শরীরের প্রতিটি কাজে; বালকেরা প্রতিযোগিতায় নামে। শারীরিক শক্তি হয়ে ওঠে বালকের জীবনের প্রধান সত্য; কিন্তু ওই বয়সেই, এবং তারো আগে, বালিকা নিজেকে গুটিয়ে নেয় শক্তির এলাকা থেকে। সমাজ তার মনে শক্তি চায় না, শরীরে শক্তি চায় না, সমাজের চোখে অপ্রয়োজনীয় তার অস্থি আর পেশি। তার কাছে সমাজ চায় কোমল মেদ। অধিকাংশ সমাজে ছোটো বালিকাদের জন্যেও নেই কোনো খেলাধুলো; এবং কৈশোরে পৌঁছে যা অবশিষ্ট থাকে, তাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বাঙালি বালিকা কোনো খেলার সুযোগ পায় না, তবু তারা মাঝে মাঝে দৌড়োনোর সুযোগ পায়, কিশোরীর জন্যে তাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠিনীরা মারাত্মক খেলোয়াড় ছিলো, দৌড়ে ওদের সাথে পেরে ওঠা ছিলো কঠিন; কিন্তু একদিন ওরা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। আমরা মাঠে খেলে চলেছি, ওরা উকি দিয়ে চলেছে আমাদের দিকে। এর পর ওরা আমাদের দেখে লাজা পেয়েও পিছলে পড়তো, মনে হতো। ওরা হাঁটতেও ভুলে গেছে। কিশোরী শক্তি, পেশি, গতির এলাকা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঢ়োকে ঘিরে, ঘর তার দেহকে শিথিল অবসন্ন করে তোলে। তারা হয়ে ওঠে অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পুরবালা, অসূৰ্যম্পশ্যা।
কিশোরীতিরুণীর শরীর বিকশিত হয় না। সক্রিয়ভাবে, তাদের দেহ অক্রিয়ভাবে ভোগ করে বিভিন্ন ব্যাপার। শরীর’ শব্দটিতে রয়েছে এক ধরনের সক্রিয়তা; তাই এক সময় নারীর শরীর বোঝাতে এ-শব্দটি ব্যবহৃতই হতো না : ব্যবহৃত হতো দেহ, দেহলতা, দেহবল্লরী, তনু, তনুলতার মতো অপেশল শব্দ। তাদের ক’রে দেয়া হয় সীমাবদ্ধ, তারা যেতে পারে না। সীমার বাইরে; তরুণের জীবনের প্রাণ প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতা, কিন্তু তরুণীর জীবনের কোনো সক্রিয় প্রতিযোগিতা থাকে না। প্রতিযোগিতার এলাকা থেকে নির্বাসিত তারা তুলনা করে, শুধু তুলনা করে। তারা তুলনা করে ছেলেদের সাথে ছেলেদের, তুলনা করে নিজেদের সমস্ত তুচ্ছ বিষয়ের। তুলনা কোনো সক্রিয় কাজ নয়: তুলনা করা সক্রিয় প্রতিযোগিতার বিপরীত। সক্রিয়র কাজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া, জয় লাভ করা, আর অক্রিয় দর্শকের কাজ প্রতিযোগীদের মধ্যে তুলনা করা। কিশোরীতিরুণী হয়ে ওঠে। জয়পরাজয়কম্পিত মুখরিত পৃথিবীর দর্শক। প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে জয়পরাজয়, থাকে অন্যদের পরাভূত ক’রে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ; কিন্তু কিশোরীতিরুণী কখনো প্রতিযোগিতায় নামে না। এটাও কোনো রহস্যজনক জৈব ব্যাপার নয়, এটা সম্পূর্ণরূপে সামাজিক। সমাজ চায় না তারা প্রতিযোগিতায় নামুক, তারা মেতে উঠুক জয়পরাজয়ে; সমাজ চায় তারা তাদের আরাধ্য পুরুষদের মধ্যে তুলনা করুক। তরুণীর শারীরিক শক্তির অভাবের ফলে তার মধ্যে জন্ম দেয় ভীরুতা। সে যে শুধু টিকটিকি তেলেপোকাকে ভয পায়, তা নয়; সে ভয় পায় সক্রিয় সব কিছুকেই। পিতৃতন্ত্র খুব পছন্দ করে এটা, নারীর ভয় তার মনে হয় সুন্দর: চরম ভয়ের মধ্যে বাস করারই নারীত্ব। কিশোরীতিরুণী যেহেতু নিজেদেব শরীরে শক্তি অনুভব করে না, তাই নিজেদের ওপর তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে; তারা কখনো রুখে দাঁড়ায় না, মেনে নেয়। তাদের ওপর সব আক্রমণ। তারা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তাদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও আত্মরক্ষা করতে পারে না; কেননা নিজেদের শক্তিতে তারা অবিশ্বাসী। তারা ছেড়ে দেয় উদ্যমশীলতা, বিদ্রোহের সাহস তাদের থাকে না। তারা দণ্ডিত ভীরুতা ও আত্মসমর্পণে, তারা অবস্থান নেয়। তাদের সমাজনির্ধারিত স্থানে। তারা হয়। বাশমানা, তাদের মনে হয় যা যে-অবস্থায় আছে থাকবে সে-অবস্থায়ই। নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের কথা ভাবনায় আসে না তাদের। শরীর তাদের নিয়তি নয়, তবু শরীরই হয়ে ওঠে তাদের সামাজিক নিয়তি।
কিশোরীতিরুণীর শরীর নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেক সমাজ, ওই সমস্ত সমাজ চায় পুরুষের জন্যে তারা প্ৰস্তুত রাখবে একটি অক্ষত দেহ, এমন কাচের পাত্রের মতো যন্তে রাখবে শরীর যাতে তাদের রন্ধের ঝিল্লিটির একটি তত্ত্বও না ছেড়ে। তরুণীকে রক্ষা করতে হবে তার সতীত্ব। পিতৃতন্ত্র তরুণের সততা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়, তরুণের সততা ভিন্ন ব্যাপাের; তরুণীব সতীত্ব হচ্ছে তার অক্ষত সতীচ্ছদ। পিতৃতন্ত্রকে সে শ্রেষ্ঠ যে-উপহারটি দিতে পাবে, তা একটি অটুট সতীচ্ছদ। মধ্যপ্ৰাচ্য ও ৩ার সনিকট অঞ্চলের মুসলমান পিতৃতন্ত্র রখনো তরুণীর সতীত্ব ও সতীচ্ছদের ওপর দেয় বিভীষিকাজাগানো গুরুত্ব, যার ফলে প্রতিটি তরুণী বাস করে দোজখের ভীতির থেকে ভয়ানক ভীতির মধ্যে। ভূমধ্যসাগবীয় পুরুষদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের একটি হচ্ছে অটুট যোনিচ্ছদসম্পন্ন কুমারী, যাকে এর আগে আর কোনো পুরুষ ছোয় নি। ফাতিমা মের নিসসি (১৯৮২, ১৮৩) বলেছেন, সেখানে পুরুষের মর্যাদা অবস্থিত নারীর দু-উরুর মাঝখানে। প্রকৃতিকে বশ বা পর্বত জয় ক’রে তারা অর্জন করে না মর্যাদা, তারা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে আয়ত্ত করে মানসম্মান। সেখানে পুরুষ চায় নারীর সতীত্ব, চায় তার অক্ষত সতীচ্ছদ; এবং এ-কামনাকে তারা এতো দূর নিয়ে যায় যে তা হয়ে ওঠে মহাজাগতিক উন্মত্ততা। ওই পুরুষেরা চায় তাদের নারীরা সতী হবে, কিন্তু তারা নিজেরা লিপ্ত হবে। অবৈধ যৌনসম্পর্কে, যাবে কাম থেকে কামে। সতীত্ব ও সতীচ্ছদ নিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পুরুষের পরাবাস্তব পাগলামোর বিবরণ দিয়েছেন নওঅল এল সাদাওয়ি তার হাওয়ার লুকোনো মুখ (১৯৮০, ২৪-৩২) বইয়ের ‘সতীত্ব/সম্মান নামক খুব পাতলা ঝিল্লিী’ নামের বমিজাগানো পরিচ্ছেদে।
প্ৰত্যেক আরব বালিকার থাকতে হয় একটি পাতলা পর্দা, যার নাম সতীচ্ছদ। এটা তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ। তবে শুধু সতীচ্ছদ থাকলেই চলবে না, সতীচ্ছদটিকে হ’তে হবে বিশুদ্ধ: বাসর রাতে ওটিকে প্রচুর রক্তপাত ক’রে প্রমাণ করতে হবে যে তার অধিকারিণী ছিলো পরম সতী। বিছানার শাদা চাদরে পড়তে হবে রক্তের দৃষ্টিগ্রাহ্য দাগ। মেয়েটি যদি অভাগিনী হয়, তার থাকতে পারে একটি শক্ত স্থিতিস্থাপক চ্ছদ। ওই চ্ছদটিকে আঙুল বা শিশ্ন দিয়ে ঘাটলেও কোনো রক্ত বেরোবে না। সে প্রমাণ করতে পারবে না। সে সতী। পরদিনই হয়তো তাব লাশ পাওয়া যাবে কোনাে বালুকাস্তুপে। কোনো কোনো মেয়ের চ্ছদ এতো পাতলা হয় যে তা হাঁটতে ফিরতে দৌড়োতে গিয়েই ছিড়ে যেতে পারে, সেও প্রমাণ করতে পারবে না। সে ছিলো সতী । বংশের সম্মানের জন্যে সেও হয়তো লাশ হবে। কোনো কোনো মেয়ের ওই চছদটি নাও থাকতে পারে, সে প্রাকৃতিকভাবেই অসতী! নওঅল চিকিৎসক, তার কাছে একবার একটি ষোলো বছরের ‘গৰ্ভবতী’ মেয়ে আসে। তিনি দেখেন মেয়েটি গর্ভবতী নয়; তার যোনিচ্ছদে কোনো রন্ধ নেই বলে বছরের পর বছর ধ’রে তার পেটে জমেছে ঋতুস্রাবের রক্ত। তার ভাগ্য ভালো, সে বিবাহিত: অবিবাহিত হ’লে হয়তো পরিবারের নামে তাকে কোরবানি করতো ভাই বা বাবা। এমন ঘটনা মিশরে অনেক ঘটেছে। সুঠু যোনিচ্ছদ নিয়ে জন্মে মাত্র ৪১.৩২% মেয়ে; ১১.২% মেয়ের কোনো চছদই থাকে না, ১৬.১৬% মেয়ের চ্ছদ এতো পাতলা হয় যে ছিড়ে যায় সহজে, আর ৩১.৩২% মেয়ে জন্মে মোটা স্থিতিস্থাপক চ্ছদ নিয়ে নওঅল (১৯৮০, ২৬)]। তাই বাসর রাতে রক্ত ঝরতে পারে ৪১.৩২% মেয়ের, কিন্তু সতীচ্ছদপাগল আরব চায় সব বাসরশয্যা হবে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো রক্তাক্ত । সেখানে স্বামী বিছানায় রক্তের দাগ না পেয়ে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে আসে চিকিৎসকের কাছে স্বচ্ছদ আছে কিনা পরীক্ষা করানোর জন্যে, পিতামাতা চায় তাদের মেয়ের জন্যে একটি সতীচ্ছদের সার্টিফিকেটা! আরব সমাজে তরুণীর দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রত্যঙ্গ’ তার যোনিচ্ছদ; তা তার চোখ, হাত বা পায়ের থেকে অনেক মূল্যবান। মেয়ে একটি হাত বা চোখ হারালে ততোটা দুঃখ পায় না। আবব পিতামাতা, যতোটা পায় তার চচ্ছদটি নষ্ট হ’লে । বাসর রাতে যে-মেয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে প্রমাণ করতে পারে না যে সে সতী, সে তালাক পায়, মৃত্যুও তার প্রায় অবধারিত। এ নিয়ে তৈরি হয় বড়ো কেলেঙ্কারি, নষ্ট হয় বংশের মর্যাদা। পরিবারটি ডুবে যায় অপমানে, যা শুধু ‘মোছা সম্ভব রক্তে’ } তারা বিশ্বাস করে আল্লা মেয়েদের যোনিচ্ছদ দেয় সতীত্ব রক্ষার জন্যে, মেয়েদের দায়িত্ব ওই চািচ্ছন্দ পুরুষকে উপহার দেয়া ।
বাসররাতে সেখানে প্রতিটি বন্ধুকে দিতে হয় রক্তাক্ত সতীত্বের পরীক্ষা। স্বামীটি নিজে শিশ্ন বা আঙুল দিয়ে যোনি খুঁড়ে দেখতে পারে, কিন্তু অনভ্যস্ত যুবকেরা সব সময় ঠিক মতো কাজটি পারে না। তাই মিশরে আছে দায়া’ বা ‘নারী হাজাম’, যাদের কাজ মেয়েদের খৎনা করানো, এবং বাসর রাতে সতীচ্ছদ ছেড়া। তারা দেখতে কুৎসিত, হাতে রাখে বড়ো বড়ো নখ, যা তাদের পেশার জন্যে দরকার। দায়াকে পারিশ্রমিক ছাড়াও বেশ ঘুষ দিয়ে থাকে মেয়ের বাবামা, যাতে সে নখ দিয়ে গভীর ক’রে খুঁড়ে প্রত্যঙ্গটির দেয়াল-চ্ছদ-ওষ্ঠ ছিন্নভিন্ন ক’রে প্রমাণ ক’রে দেয় মেয়ের সতীত্ব। বাসরঘরে ঢোকে দায়া, বাইরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মেয়ের বাবামা আত্মীয়স্বজন। মেয়ের সতীত্বে অসতীত্বে দায়ার কিছু যায় আসে না, সে জানে সতী প্রমাণ হ’লে তার মিলবে প্রচুর টাকা। সে তার নোংরা আঙুল আর বড়ো নখ ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের যোনিতে, মেয়েটির ভাগ্য ভালো হ’লে রক্ত বেরিয়ে আসে সহজে, সে ওই রক্তে ভেজায় শাদা রুমাল। যদি সহজে না বোরোয়, সে তার দীর্ঘ নখ ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের যোনির দেয়ালে, খুঁড়ে ফেলে দেয়াল, ফিনকি দিয়ে বেরোয় রক্ত; আর ওই রক্তভেজা রুমাল তুলে দেয় মেয়ের পিতার হাতে। পিতা মেয়ের যোনিরক্তভেজা রুমাল পতাকার মতো উড়িয়ে ঘোষণা করে মেয়ের সতীত্ব, হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে আত্মীয়স্বজন। মেয়েটি বিছানায় কাতরাতে থাকে, রক্তে তার মহাজগত ভিজে যায়; কিন্তু মরুভূমিকে সে একটি চ্ছদ দিতে পেরে ধন্য বোধ করে। এমনই বর্বর ওই মরুভূমি। সতীচ্ছদ আরব পুরুষদের জাতীয় পতাকা।
চোখের বদলা যেমন চোখ, মিথ্যার বদলা তেমনই মিথ্যা: আর প্রতারণার বদলা প্রতারণা। আরব পুরুষ নিজে যৌনসৎ নয়, কিন্তু চায় সতী; তাই প্রতারণা তার প্রাপ্য। আরব পুরুষ রক্ত চায়, তাকে পেতে হয় রক্তের প্রতারণা। আগে বাসর রাতে মেয়ের যোনিতে ঢুকিয়ে দেয়া হতো মুরগির রক্তের দিলা, এখনো গরিব পরিবারে তা করা হয়; আর ওই বক্তের দাগ দেখে শান্ত হয় আরবের হৃদয়। এখন সেখানে দেখা দিয়েছে। সতীচ্ছদের শল্যসংযোজনা! শল্যচিকিৎসক এখন সতীত্ব হারানো তরুণীর রন্ধে কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি সতীচ্ছদ জুড়ে দিয়ে তাকে আবার ক’রে তোলে সতী। আরব অঞ্চলে এখন দেখা দিয়েছে কৃত্রিম সতী। এ-সুযোগ নিচ্ছে ধনী পরিবারের মেয়েরা। ১৯৬৮তে সতীচ্ছদ সংযোজনের ব্যয় ছিলো ২০০০ দিবাহাম, এখন নেমেছে ৫০০-১০০০ দিরহামে। সেখানে একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের বার্ষিক ব্যয় ৬৫ দিরহাম, একটি মেয়ের রন্ধ শেলাইয়ের ব্যয় ২০০০ দিরহাম! সতীচ্ছদ সংযোজনে ব্যবহৃত হয় অতি আধুনিক পদ্ধতি, কিন্তু এটি সেবা করছে সবচেয়ে আদিম পিতৃতন্ত্রের। ফাতিমার (১৯৮২, ১৮৫) মতে, কৃত্রিম সতীত্ব উদ্ভাবিত হয়েছে, কেননা আরব পুরুষ চায় অসম্ভবকে। তারা নিজেরা বিয়ের আগে নারীদের সতীত্ব হরণ করে, কিন্তু বিয়ের সময় হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে একটি সতী-একটি সতীচ্ছদ! কৃত্রিম সতীচ্ছদ আরব পুরুষের জন্যে যোগ্য পুরস্কার, শঠকে পুরস্কৃত করতে হয় শঠতা দিয়েই। নওঅল (১৯৮০, ৩০-৩১) আরবদের ওপারস্পরিক প্রতারণার একটি তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা বলেছেন। এক দিন একটি মেয়ে তার চিকিৎসালয়ে আসে। সে পাচ মাসের গর্ভবতী, কিন্তু তার সতীচ্ছদ রয়েছে অটুট! মেয়েটি তাঁকে জানায় যে বার বার অগভীর সঙ্গমের ফলে তার গর্ভ ঘটেছে। মেয়েটি তাকে অনুরোধ করে পেট কেটে বাচ্চাটি ফেলে দিতে, যাতে অক্ষত থাকে তার মূল্যবান চ্ছদটি। তিনি রাজি না হওয়ায় মেয়েটি চলে যায়; বহু বছর পর মেয়েটির সাথে তাঁর দেখা হয়, মেয়েটি তাকে জানায় সে অন্য এক ডাক্তার দিয়ে পেট কেটে গর্ভপাত করিয়েছিলো। এখন সে এক সফল প্রকৌশলীর স্ত্রী, তাদের দুটি সন্তান হয়েছে। নওঅল (১৯৮০, ৩১) বলেছেন :
‘কল্পনায় আমি মাঝে মাঝে আমার অদেখা সে-প্রকৌশলীটিকে দেখি, দেখতে পাই বাসর রাতে সে পবিত্র অনুষ্ঠানরূপে তার স্ত্রীর চচ্ছদ ছিন্ন করছে, বুঝে নিচ্ছে যে তার স্ত্রী ছিলো কুমারী; এবং পবিম সুখে সে দেখতে পায় তার স্ত্রীর চচ্ছদটি অটুট বয়েছে। তবে কাছে ওই মেয়েটির পেটের লম্বালম্বি কাটাদাগটি তুচ্ছ, যেমন ওই মেযেটিব হৃৎপিণ্ড বা যকৃৎ বা মস্তিষ্কে একটি কাটা দাগেব কোনো তা ৎপর্য নেই তার কাছে, তবে এক মিলিমিটাব দীর্ঘ ওই চ্ছদে যদি থাকতো একটি ছোটো ছেড়া, তাহলে তা উল্টেপাল্টে দিতো তার সমগ্ৰ জগত।‘
কিশোরীবালিকা রখনো এমন আদিমতার শিকার পিতৃতন্ত্রের নানা প্রান্তে। তার দেহ যেমন অক্ষত পেতে চায় অনেক সমাজ, আবাবা অনেক দর্শনবিজ্ঞান মনে করে সহজাতভাবেই তার দেহ বিকলাঙ্গ। প্লাতো ও তাঁর অনুসারীরা মনে করতেন নারীর শরীর নিকৃষ্ট পুরুষের শরীর থেকে; এবং উনিশশতকে অটো ভিনিঙ্গার নামের এক জর্মন বালক লিঙ্গ ও চরিত্র নামে একটি বই লিখে দেখায় কতো নিকৃষ্ট নারীর দেহ ও চরিত্র। ফ্ৰয়েড গভীর প্রভাবিত ছিলেন তার দ্বারা, এবং তারই নারীধারণাকে তিনি দিয়েছিলেন ছদ্মবৈজ্ঞানিক রূপ। ভিনিঙ্গার বইটি লিখে অল্প বয়সেই আত্মহত্যা করে, তবে তার লেখায় রূপ পায় তরুণীর দেহ ও চরিত্র সম্পর্কে পুরুষের আদিম ঘৃণা। তার চোখে নারী অভিন্ন তার দেহ ও তার অবচেতন কামের সাথে; তাই নারী পাশব। তার মতে, ‘যে-পুরুষ নারী সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে তার পক্ষে নারী সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা অসম্ভব; পুরুষ নারীকে ঘৃণা করে, বা তারা কখনো নারী সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবে না’। তার সিদ্ধান্ত [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭০, ১০৫)] :
‘একটি সম্পূর্ণ নগ্ন নারীদেহ এমন অনুভূতি সৃষ্টি করে যেনো তার অভাব রয়েছে কোনো কিছুর, তার রযেছে এমন অসম্পূর্ণতা যা সৌন্দর্যের সাথে অসমঞ্জস।… নারীকে আকৃষ্ট করে কামের বিকশিত চিহ্নগুলো; সে বিকর্ষণ বোধ কবে মনের উন্নত গুণাবলির প্রতি। নারী মৌলিকভাবে লিঙ্গপূজারী।‘
তরুণের যৌনপ্রবর্তনা তার শারীর শক্তিরই প্ৰকাশ, সম্ভোগ করে সে উপলব্ধি করতে চায় পৌরুষ। তরুণী তার কামনার ভেতরে পোষণ করে লজ্জা। কেননা সে জানে। সে সম্ভোগ করবে না, তাকে সম্ভোগ করবে। পুরুষ; সে হবে পুরুষের খাদ্য। যুবক তার কামের সাফল্যে গৌরব বোধ করে, একের পর নারী সম্ভোগ করার জন্যে বোধ করে ব্যগ্ৰতা; এতে তার কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু তরুণী লজ্জায় কুঁকড়ে থাকে, সম্ভোেগ তার জন্যে নয়। তার কামের সাফল্যের অর্থ হচ্ছে নিজের শরীরকে পুরুষের সম্ভোগের বস্তু ক’রে তোলা। তার সারা দেহ তার কাছে বিব্রতকর। প্ৰতি মাসের রক্তক্ষরণের ফলে নিজের দেহকে তার নিজের কাছে মনে হয় বিরক্তিকর। ঋতুস্রাব তার এক প্ৰতিবন্ধকতা। প্রতি মাসে তার জীবনে একটা ব্যাঘাতের মতো দেখা দেয় ওই রক্ত। এটা তার জীবনে সৃষ্টি করে বিভীষিকা, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে তার চেতনা জুড়ে। সে সন্দেহ করে নিজের দেহকেই, ভয়ে ভয়ে থাকে নিজের দেহ নিয়ে; নিজের দেহকে মনে করে অসুস্থ। যদিও ঋতুস্রাব এতো বিকল করার মতো ব্যাপার নয, তবু তার মনোজগতে এটা এমন বিকলন ঘটিযে দেয় যে তার সম্পূর্ণ মহাজগতই হয়ে ওঠে বিকল। নারী হওয়ার অস্বস্তি ধ্বংস ক’রে দেয় নারীর শরীর। তবে নারীর শরীর তার জন্যে প্রতিবন্ধকতা, কেননা চারপাশ চায় তার শরীর তার জন্যে হোক প্রতিবন্ধকতা। এমন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্যে কোনো পেশা থেকে দূরে থাকার দরকার পড়ে না। এ-সময় দু-এক দিন সে অসুস্থ থাকতে পারে, কিন্তু এটা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। এ-সময়ে অধিকাংশ নারীই তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ ক’রে থাকে। কিন্তু ধর্ম বলে সে অশুচি, সমাজ বলে সে রুগ্ন।
সমাজ নারীর জন্যে নিষিদ্ধ ক’রে রাখে। বাইরের সমস্ত কাজ। এখন দেশে দেশে নারী বাইরের অনেক কাজ করছে, তবু অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নারীর জন্যে বাইর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে-সব দেশে নারী বাইরে কাজ করতে পারছে, সেখানেও নারীর জন্যে রাখা হয় বিশেষ ধরনের কাজ। এমন কোনো কাজে নেই, যা অসম্ভব নারীর পক্ষে; কিন্তু সমাজ তাকে কাজ না দিয়ে, তার জন্যে কাজ নিষিদ্ধ করে, প্রমাণ করে সে অনুপযুক্ত বা নিকৃষ্ট। সমাজ সব দিকে তার বিকাশের পথ বন্ধ ক’রে দিয়ে প্রমাণ করে যে তার পক্ষে বিকাশ অসম্ভব। সুপরিকল্পিতভাবে সমাজ তাকে ঠেলে দেয় হীনমন্যতাগূঢ়ৈষার দিকে। মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতার কথা ধরা যাক। প্রচলিত লোকবিশ্বাস হচ্ছে যে কৈশোর থেকে মেয়েদের হ্রাস পেতে থাকে মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা। এ-লোকবিশ্বাস কি সত্য বা সত্য হ’লে কী কারণ রয়েছে। এর পেছনে? স্বীকার ক’রে নেয়া যাক যে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এটা সত্য; কিন্তু এর কারণ কি? এর কারণ নারীর জৈবসংগঠনে খুঁজলে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে সমাজসংস্থায়। এর কারণ মেয়েদের উৎসাহ দেয়া হয় না। এসব ব্যাপারে; আগে নিষেধ করা হতো, এখন নিষেধ করা না হ’লেও তাদের অনুপ্রাণিত করা হয় না। ভাইটির জন্যে সব সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়, তার পড়াশুনোয় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে তা দেখে পিতামাতা, এমনকি বোনটিও। বোনটির কাছে আশা করা হয় না মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা; সে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি হবে এ তো আশা করাই হয় না, এমনকি সে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা হবে তাও আশা করা হয় না। তার কাছে। আশা করা হয় নারীত্ব, তার কাছে দাবি করা হয় সে হবে নারী। যে-মেয়েটি লেখাপড়া করছে, তার কাছে ভালোভাবে লেখাপড়া চাওয়া হয় না, চাওয়া হয় লেখাপড়ার সাথে সে ভালোভাবে আয়ত্ত করবে নারীর কাজগুলো। লেখাপড়া তার কোনো কাজে আসবে না, কাজে আসবে নারীর কাজগুলো। এমন প্রত্যাশা করা হয় যার কাছে, সে কী ক’রে হবে মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল? বাসার কিশোর বা তরুণ পুত্রটির পড়াশুনো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, তার জীবনে আছে প্রমোদের ব্যবস্থাও। তাকে কেউ কুটোটিও নাড়তে বলে না; কিন্তু বাসার কিশোরী বা তরুণী কন্যাটিকে করতে হয় গৃহপরিচারিকার ক্লান্তিকর কাজগুলো।
ঘরকন্নার কাজগুলো হচ্ছে সবচেয়ে ক্লান্তিকর কাজ। একই কাজের পুনরাবৃত্তি চলে তাতে সারা জীবন ভরে, আর যে জড়িয়ে পড়ে ওই কাজে তার জীবন হয় ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির পুনরাবৃত্তি। যে-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাকে জানতে হবে চমৎকার মাছ ভাজী; যে-কিশোরী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাকে শিখতে হবে চমৎকার শেলাই। বাসার কিশোর আর তরুণটির কাছে তা আশা করা হয় না, কিন্তু কিশোরীতিরুণীর কাছে দাবি করা হয়। ছেলেটি তার বিছানা গুছিয়ে না রাখলে মা খুশি হয়, দেখতে পায় একটি পুরুষের জন্ম হচ্ছে; কিন্তু মেয়েটি বিছানা না গোছালে একটি নারীর মৃত্যু দেখে মা আতংকিত হয়ে পড়ে। এমন দাবি করা হয় যার কাছে তার পক্ষে মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল হওয়া অসম্ভব। মা মেয়ের বড়ো শুভাখী, কিন্তু মা-ই মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেয় পারিবারিক কাজের বোঝা। এতে তার কোনো অশুভ উদ্দেশ্য নেই, খুবই শুভ তার উদ্দেশ্য; মা জানে তার মেয়ের জীবন সৃষ্টিশীলতার নয়, সমাজ তাকে ওই অধিকার দেয় নি, ওই অধিকার দিয়েছে পুত্ৰকে। সমাজের বিশ্বস্ত পুলিশের মতো কাজ করে চলে মা: এবং মেয়েটিকে বন্দী করে ফেলে। কিন্তু এ-মা-ই ছেলেটিকে দেয় স্বাধীনতা। মেধাবী মেয়েটির থেকে অনেক বেশি যত্ন নেয়া হয় নির্বোধ ছেলেটির, এবং একদিন দেখা যায় নির্বোধ ছেলেটি ছাড়িয়ে গেছে মেধাবী মেয়েটিকে। যে-কিশোরী প্রথম হয় মাধ্যমিক পরীক্ষায়, পনেরো বছর পর সেও দেখতে পায় তার থেকে অনেক সাফল্য লাভ করেছে তার সাথের সাধারণ মেধার ছেলেরা; কেননা সে ক্রমশ ছেড়ে দিয়েছে উচ্চাভিলাষ, কিন্তু ছেলেরা সমাজের প্রেরণায় ও চাপে হয়েছে উচ্চাভিলাষী। উচ্চাভিলাষের জন্যে স্বাধীনতা দরকার, কিন্তু তরুণীর জীবনে তা নেই।
সামাজিক সমস্ত প্ৰথা তরুণীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। অনেক দেশ আছে, যেখানে মেয়েদের জন্যে পথ নিষিদ্ধ, তারা পথে বেরোতে পারে না; বেরোলে নিজেদের ঢেকে রাখতে বাধ্য হয় বোরখার মধ্যযুগীয় অন্ধকারে; এবং অবরোধের অন্ধকারের মধ্যে কাটে তাদের জীবন। আরবদেশগুলো এখনো মেয়েদের ঢেকে রাখছে। এ-অন্ধকারে। বাঙলাদেশে বিশশতকের কয়েক দশক জুড়ে তারা থেকেছে অবরুদ্ধ। পিতৃতন্ত্রের মধ্যে মুসলমান পিতৃতন্ত্র রখনো হিংস্রভাবে রক্ষণশীল; ইরান-মধ্যপ্রাচ্যের তরুণীরা জানে না স্বাধীনতার একটি বিন্দুর স্বাদ কেমন [দ্র ফাতিমা (১৯৭৫, ১৯৮৪), নওঅল (১৯৮০)]। ফাতিমা মেরনিসসির বোরখা পেরিয়ে (১৯৭৫) ও মুসলমানের অবচেতনায় নারী (১৯৮৪), এবং নওঅল এল সাদাওয়ির হাওয়ার লুকোনো সুখ-এ (১৯৮০) ভয়াবহ বিবরণ মেলে মুসলমান তরুণীদের জীবনবিভীষিকার। তাদের তুলনায় বাঙালি কিশোরীতিরুণীরা অনেক স্বাধীন; তবে ওই স্বাধীনতা ছেলেদের স্বাধীনতার তুলনায় তুচ্ছ। বাঙলাদেশে মেয়েরা রাস্তায় বেরোতে পারে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মধ্যে; তাদের বেরোনোয় কোনো নিষেধ নেই, কিন্তু পথে পথে তারা দেখে নিষেধ। পাড়ার মাস্তান তাকে দেখে শিস দেয়, মুদি মন্তব্য করে, ধার্মিকেরাও তার বুকের দিকে নির্লজের মতো তাকায়। সে একা নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া যেতে পারে না, তাকে স্বাধীনতা শিক্ষা দেয়ার জন্যে পথেঘাটে ধানখেতের আলে ওৎ পেতে আছে শিশ্নধারীরা। কিশোরীতিরুণী বাঙলাদেশে স্বাধীনতা ভোগ করে ধর্ষণকারীর উদ্যত শিশ্নের ছায়ার নিচে, তারা স্বাধীনতা ভোগ করে ক্যামুকের অ্যাসিডের ধারাপাতের বিভীষিকার নিচে। তারা রাস্তায় বেরোয় যেনো পথের দু-দিকে দেখার মতো কিছু নেই, যেনো গন্তব্য ছাড়া তারা আর কিছু জানে না। সমাজ তাদের জানিয়ে দেয় তাদের পথে বেরোনোর অনুমতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু পথের স্বাধীনতা দেয়া হয় নি। ছেলের জন্যে পথই গন্তব্য, কিন্তু কিশোরীতিরুণীর জন্যে পথ গন্তব্য নয়। তাই তাদের সব সময় চলতে হয় নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিতে, দণ্ডিত নাগরিক হিশেবে; ঘরে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বাইরে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে করে শুকিয়ে যায়। তাদের স্বতস্ফুৰ্ততা। তাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে মানসিক চাপ, সারা শরীর জুড়ে দেখা দেয় ক্লান্তি অবসাদ। তরুণী হয়ে ওঠে। ক্লান্তি অবসাদের রক্তমাংসস্তুপ।
অবসাদে পরিবৃত থাকে তরুণীর শরীর ও জীবন। তাই তরুণীরা একে অন্যকে ক্লান্ত অবসন্ন ক’রে তোলে সহজে, দুটি ক্লান্ত শরীরপ্রাণ বেশিক্ষণ পরস্পরকে সজীব রাখতে পারে না। তারা পছন্দ করে, দরকার বোধ করে তরুণের সাহচর্য। সমাজ তাদের বুঝিয়ে দেয় তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাদের বাধা দেয় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে। কিন্তু তারা পারে না। স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে, কোনো কিছুই একলা করতে পারে না, পারলেও তাদের দ্বিধা থেকে যায়। অস্বয়ংসম্পূর্ণতার অশক্তি তাদের ভেতরে বাড়িয়ে তোলে ভীরুতা, দ্বিধাগ্ৰস্ততা, যা দেখা দেয়। তাদের কাজে ও জীবনে। কামিনী রায়ের ‘করিতে পারি না কাজ/ সদা ভয় সদা লাজ / সংশয়ে সংকল্প সদা টলে’ মহিলা কবি ও কিশোরী ও তরুণীর কথা, কিশোর বা তরুণের কথা নয়। সমাজ তাদের বুঝিয়ে দেয়, তারাও মনে করে অসামান্য কোনো সাফল্য অর্জন তাদের জন্যে নয়; ওসব ছেলেদের জন্যে। তাই তারা উচ্চাভিলাষ পোষণ করতেও ভয় পায়, পরিহাব ক’রে চলে সব উচ্চাভিলাষ। তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে ছেলেরা উৎকৃষ্ট, তারা যা পারে না তা অবশ্যই পারে ছেলেরা, পারতেই হবে ছেলেদের। সমাজ ছেলেদেব ওপর বিশ্বাস করে, তরুণীরাও বিশ্বাস করে ছেলেদের সমাজ তাদের ওপর আস্থাহীন, তারাও আস্থাহীন নিজেদের ওপর। এমন আত্মবিশ্বাসহীনতা যাদের, তাদের বিকাশ অসম্ভব; তারা অবিকশিত থাকতে বাধ্য। এর পরিণতি আলস্য আর নিম্নমাঝারিত্ব, কোনো কিছু ভালোভাবে করতে না পারা। তরুণী বিশ্বাস করে সে যা পারে না, তা অবশ্যই পারে তরু%; পারতেই হবে তরুণকে। নিজে না পারার জন্যে সে অস্বস্তি বোধ করে না, কিন্তু তা যদি না পারে ছেলে তবে সে বোধ করে অস্বস্তি 1 ছেলেরা যে ছেলে। কিশোরীতিরুণীকে সমাজ দীক্ষা দিয়েছে এমন পরাজয়ী মনোভাবে। তার পরাজয়ী মানসিকতার কারণ তরুণী জানে তার ভবিষ্যৎ তার হাতে নয়; তার মনোভাব এমন যে কী হবে এতো সাধ্যসাধনা করে যেখানে তার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভর করছে অন্যের ওপর। এটা এক দিকে যেমন নিয়তির কাছে আত্মসমৰ্পণ, তেমনই প্রতিবাদও। সমাজে যেহেতু পুরুষই সব, তাই সে চায় পুরুষই তার হয়ে রক্ত বাষ্প ক’রে অর্জন করুক সাফল্য।
তরুণীর পরাজয়ী মানসিকতার মূলে নিজের নিকৃষ্টতার বোধ কাজ করে না, সে মনে করে না যে সে সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট, বরং তার প্রতিবাদী মনোভাবই জন্ম দেয় তার এ-বোধ : তাকে যে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে, সমাজ যে চায় সে নির্ভর করবে: কোনো পুরুষের ওপর, এটা তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে; এবং সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় সাফল্যলাভের সব ইচ্ছে। তার কোনো যোগ্যতা সমাজের চোখে গুরুত্বপূর্ণ নয়, পুরুষ তাকে তার যোগ্যতার জন্যে মূল্যবান ভাবে না; তার মূল্য ততোটাই যতোটা সে হয়ে ওঠে। পুরুষেব স্বপ্লের আদলে। মেয়েরা শিখে ফেলে যে পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে তাকে ছেড়ে দিতে হবে তার অধিকার, পুরুষ তখনই খুশি হয় যখন সে ছেড়ে দেয় নিজের সব যোগ্যতালাভের বাসনা। পুরুষ মেধাবী নারী পছন্দ করে না; তারা ভয় পায় নারীর সাহস, মেধা, যোগ্যতাকে । পুরুষের আকর্ষণ নির্বোিধ রূপসীর প্রতি, তাই তরুণীকে হয়ে উঠতে হয় নির্বোিধ, কিন্তু রূপসী । রূপই তার একমাত্র যোগ্যতা। রমণীয় হওয়ার অর্থ দুর্বল, নিরর্থক, অনুগত হওয়া। তরুণীকে চেপে রাখতে হয় তার সমস্ত স্বতস্ফুৰ্ততা, তার বদলে আয়ত্ত করতে হয় রূপ। যদি সে কোনো সক্রিয়তা দেখায়, তবে তা নষ্ট ক’রে দেয় তার নারীত্ব, তার আবেদন; অক্রিয়তাই তার সৌন্দর্য। তরুণীর ব্যক্তিসত্তা ও নারীসত্তার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি ক’রে রেখেছে সমাজ।। কৈশোর যে তার জন্যে বিশেষ সংকটের কাল, তার কারণ এতো দিন সে ছিলো স্বায়ত্তশাসিত, কিন্তু কৈশোরে পৌছে তাকে ত্যাগ করতে হয় তার স্বায়ত্তশাসন। মানুষ হিশেবে সে হয়ে উঠতে চায় সক্রিয়, স্বাধীন, প্রধান; কিন্তু সমাজ চায় সে হবে অক্রিয় সামগ্ৰী। সক্রিয় সত্তা ও অক্রিয় সামগ্ৰী হয়ে ওঠার বিরোধে কিশোরী দুলতে থাকে আশা ও ভয়, কামনা ও ঘূণার মধ্যে। নারী হওয়ার জন্যে তাকে মেনে নিতে হবে অধীনতা, করতে হবে আত্মসমর্পণ। এ-সমস্যা বিভিন্ন কিশোরীর মধ্যে সৃষ্টি করে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া। যে-বালিকা দীক্ষিত হয়ে গেছে নারী ভূমিকায়, সে সহজে মেনে নেয় অধীনতা; কিন্তু যে-বালিকা দীক্ষিত হয় নি, তার পক্ষে অধীনতা মেনে নেয়া কঠিন হয় । তবে সে এড়াতে পারে না তার সামাজিক নিয়তিকে । সে কিছুটা প্রতিবাদের সাথে স্বীকার ক’রে নেয় তার নারীত্ব। তখন সে হয়ে ওঠে অক্রিয়, হয়ে উঠতে চায় রূপসী, জাগিয়ে তোলে মেয়েলিপনা; মন দেয় রূপচর্চায়। সে তখন নিজের বিব্রতকর স্তন দুটিকে আর লুকিয়ে রাখে না, সে-দুটি নিয়ে আর অস্বস্তি বোধ করে না; সে-দুটিকে মনে করে নিজের সম্পদ, ক’রে তোলে আকর্ষণীয়। সে নিজেকে দেখতে শুরু করে আয়নায়, মুগ্ধ হতে থাকে নিজের রূপে, সে জানে তার যা মূল্য তা ওই রূপের জন্যে; নিজের শরীরে সে খোজে এক নারীকে ।
কাম মানুষের সমান বয়সী। কাম উপভোগের শক্তি তরুণীর অনেক বেশি তরুণের থেকে, কিন্তু তার উপভোগ নিষিদ্ধ; তরুণীকে তার কামবাসনা চরিতাৰ্থ করার জন্যে হয়ে উঠতে হয় শিকার । পুরুষতন্ত্র তাকে মনে করে কামসামগ্ৰী, অনেক উপভোগ্য বস্তুর মতো সেও বস্তু। তাই তরুণী বস্তু বা সামগ্ৰী হয়ে ওঠে, নিজেকে সে মনে করে বস্তু, এবং নিজের নতুন সত্তাকে দেখে বিস্ময়ের চোখে । নিজের শরীরে সে দেখতে পায় এক অচেনা শরীর; যেনো অচেনা এক নতুন দেহ দখল করেছে তার চেনা শরীরকে । নিজের শরীর তাকে বিহ্বল ক’রে তোলে, বিস্মিত হয়ে শরীরের দিকে দিকে দেখে অভাবিত বন্যা। যৌবন কোনো তরুণীকে ক্ষমা করে না, ভিখিরি বালিকার দেহকেও প্লাবিত করে নির্দয়ভাবে; যা সে চায় নি, যার মূল্য সে দিতে পারবে না তা তাকে নিতেই হয়। চিত্রাঙ্গদার মতো। হতভাগ্য খুবই কম তরুণী, তাদের দেবতার কাছে বর চাইতে হয় না: কিন্তু তারা সবাই শিউরে ওঠে চিত্রাঙ্গদার মতোই অভাবিতকে নিজের শরীরে দেখে । চিত্রাঙ্গদা নতুন শরীর পায় বর হিশেবে, সেটিকে সে নিজের মনে করে নি; নিজের শরীরে নিজের শক্রকে দেখে সে চিৎকার করে উঠেছে, ‘কোন মহাবাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া /অঙ্গসহচরী করি ছায়ার মতন।’ কিন্তু তরুণী নিজের নতুন শরীরে কোনো রাক্ষসীকে নয়, দেখে এক দেবীকে। সে তার নতুন শরীরকে আদর করে, মুগ্ধ হয় নিজের আঙুল বাহু উরুর দিকে তাকিয়ে, নিজে মোহিত হয় নিজের দু-স্তনের সৌন্দর্যে। শুরু হয় তরুণীর একলা নির্জন অন্তরঙ্গ সংগোপন দিবাস্বপ্নের কাল। দিবাস্বপ্ন কিশোরকিশোরী, তরুণতরুণী, এবং যে-কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। দিবাস্বপ্নে মানুষ সৃষ্টি করে এমন এক বাস্তবতা যা সে কোনো দিন পাবে না, পেলে হয়তো ক্ষুন্ন বোধ করবে। তরুণী নিজের সাথে নিজে কথা বলে, অজস্র স্বপ্নের মধ্যে বাস করে। সে তখন তার নিজের স্বপ্নে বিভোর, তার ওই স্বপ্ন এতো মূল্যবান যে তা প্ৰকাশ করা যাবে না। কারো কাছে, প্রকাশ করলে বাস্তবের নোংরা ছোয়ায় স্বপ্নের সোনা হয়ে উঠবে। আবর্জনা। তাই তার মধ্যে জন্মে গোপন করার প্রবণতা, সব কিছু সে গোপন করতে চায়, তার সমগ্র স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে সে পুরে ব্যাখতে চায় এক গোপন চন্দনকাঠের সিন্দুকে।
কিশোরীতিরুণীর দিবাস্বপ্ন পেরিয়ে যায় বাস্তবতার সমস্ত সীমা, ডুবে যায় সে রুগ্ন দিবাস্বপ্নে। তরুণীর দিবাস্বপ্ন হচ্ছে সে যা পায় নি, কখনো পাবে না, এমনকি কখনো পেতে চাইবে না, তার ক্ষতিপূরণ। কিন্তু দিবাস্বপ্ন কখনো বাস্তবতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না; দিবাস্বপ্ন যদি সীমা পেরিয়ে যায়, তা মানুষকে অসুস্থ ক্লান্ত করে তোলে। প্রতিটি তরুণী দিবাস্বপ্নক্কান্ত। একলা নির্জন দিবাস্বপ্ন তাকে ভরে তুলতে পারে না, স্বপ্ন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পরই সে দেখে সে পড়ে আছে বাস্তবের আবর্জনার ওপর- নিঃসঙ্গ। সে তখন খোজে বান্ধবী, নিজের একান্ত দ্বিতীয় সত্তাকে। অনেক মেয়ে পরস্পরকে দেখায় নিজেদের নগ্ন দেহ, তুলনা করে নিজেদের স্তনের, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজের, আবিষ্কার করে পরস্পরের দেহবিশ্ব। প্রতিটি মেয়ের, এবং ছেলের, মধ্যেই রয়েছে সমকামীপ্রবণতা; তরুণীর ওই প্রবণতার মূলে রয়েছে তার আত্মপ্রেম। তরুণীরা পরস্পরের শরীরে খুঁজে পায় নারীত্ব। কিন্তু তরুণী জানে সমকামী সম্পর্ক অস্থায়ী; এবং অনেক তরুণী এ-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও পায় না, অনেকে পেয়েও গ্রহণ করে না। প্রচণ্ড বিধিনিষেধের খড়গ ঝোলে তার ওপর; সমগ্র পিতৃতন্ত্র তাকে নিষেধ করে ওই সম্পর্কে যেতে। কেননা পুরুষই তার নিয়তি। তখন তার চোখে মোহনীয় হয়ে ওঠে পুরুষ। তবে পুরুষ তাকে মুগ্ধ করে, আবার সন্ত্রস্তও করে। যে-পুরুষ তাকে সন্ত্রস্ত করে, সে তাকে বাদ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে রাজপুত্রের। এখন চারদিকে রাজপুত্রের ভিড়; একালে রাজপুত্রেরা জন্মেছে সিনেমার অভিনেতা, গায়ক, খেলোয়াড় ইত্যাদি হয়ে। তরুণী তাদের স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে অন্য এলাকার কোনো বিখ্যাত পুরুষেরও। তার এ-স্বপ্ন বিশুদ্ধ স্বপ্ন, সে স্বপ্ন দেখে স্বপ্ন দেখার জন্যেই; বাস্তবে ওই পুরুষকে পাওয়ার জন্যে নয়। সে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এড়িয়ে বাস করে কল্পনায়, সে একাকার করে দেয় বাস্তবতা আর কল্পনাকে। তরুণী কামনা করতে থাকে শ্ৰেষ্ঠ পুরুষ, যার কাছে সে আত্মসমৰ্পণ করতে পারে।
আত্মপ্রেম থেকে আত্মসমৰ্পণ হচ্ছে সমকামী প্রবণতা থেকে মর্ষকামিতার জগতে প্ৰবেশ। নারী সহজাত মর্ষকামী বলে নারীকে নিন্দিত ক’রে দিয়েছেন ফ্রয়েড; তবে নারী সহজাত মর্ষকামী নয়। পুরুষেরও রয়েছে মর্ষকামিতা। পুরুষতন্ত্র নারীকে দীক্ষা দিয়েছে। মর্ষকামে, যন্ত্রণাসম্ভোগে; বাধ্য করেছে মর্ষকামে। পুরুষতন্ত্র যে-সমস্ত নারীকে প্রশংসাপত্ৰ দিয়েছে, তারা সবাই তা কিনেছে মর্মান্তিক মর্ষকামিতার মূল্যে : তারা পুরুষের জন্যে সব ত্যাগ করেছে, জীবন উৎসর্গ করেছে, অজস্র পীড়ন সহ্য করেছে, এবং পুরুষতন্ত্র তাদের স্বীকার করে নিয়েছে আদর্শ নারীকাঠামোরূপে। পুরুষতািন্ত্র তরুণীকে শিখিয়েছে। পুরুষের জন্যে দুঃখ স্বীকারই প্ৰেম, অবিরাম আত্মোৎসৰ্গই নারীত্ব। প্রেমে যে পড়ে সে-ই মর্ষকামী, তার কাজ যন্ত্রণায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। তরুণী অসংখ্য উপাখ্যানে শোনে আদর্শ প্রেমিকদের দুঃখ স্বীকারের কাহিনী, সেও মনে মনে হয়ে ওঠে এক আদর্শ প্রেমিক, যে প্রিয়তমের জন্যে সইবে অনন্ত দুঃখ। সে কল্পনা করে পিতামাতা সমাজসংসারকে অস্বীকার ক’রে সে বেরিয়ে পড়েছে প্রেমিকের হাত ধ’রে, তাদের জন্যে আর কিছু নেই, আছে শুধু প্রেম আর অবিরাম দুঃখ। সে দুঃখের পর দুঃখকে জয় করতে থাকে, প্রেমিককে রক্ষা করে সমস্ত বিপদ থেকে, এবং সুখ পায় প্রেমিকের বুকে মুখ রেখে। সে হয়ে ওঠে আরেক আদর্শ প্রেমিকা, নারী, যার নাম চিরকাল মনে রাখবে ইতিহাস। কিশোরতরুণও এমন অপরাজিত প্রেমের স্বপ্ন দেখে, তবে তার স্বপ্লটি বিপরীত; সে দেখে প্রেমিকাটি তার জন্যে সব ত্যাগ ক’রে এসেছে, তার বুকে স্থান পেয়ে ধন্য হয়েছে। কিশোর প্রেমিকেরা কিশোরী প্রেমিকার চোখে বার বার জল দেখতে চায়, জল দেখে খুব সুখ পায়; কিশোরীরাও চোখকে সমুদ্রের মতো ভরে তুলতে জানে। তরুণীকে সমাজই তৈরি করেছে মর্ষকামী ক’রে, কারণ সে নারী হবে; এবং তার জীবন হবে ধারাবাহিক মর্ষকামিতা। তার জৈব সংকেতের মধ্যে নেই এ-ব্যাধি, রয়েছে সামাজিক সংকেতে।
কাল্পনিক প্রেম থেকে বাস্তব প্রেমে যেতে ভয় পায় অনেক তরুণী; যখন স্বপ্লের পুরুষ সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সন্ত্রস্ত হয় অনেকে। তরুণী পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, চায় পুরুষের অনুরাগ, কিন্তু ধরা পড়তে চায় না। বয়ঃসন্ধির সাথে সে লজ্জা বোধ করতে শেখে, পুরুষতন্ত্র তাকে লজ্জা বোধ করতে বলে; সে লজ্জা আর ছেনালিপনাকে একাকার ক’রে দেয়। তার লজ্জা সবখানি লজ্জা নয়, তার লজ্জা হচ্ছে উল্টোনো লজ্জাহীনতা। সে চায়। তার দিকে তাকাক পুরুষ, কিন্তু তার দিকে কোনো পুরুষ তাকালে সে একই সাথে সুখ পায় ও আহত হয়। সে চায় তার সৌন্দর্যে পুরুষ মুগ্ধ হোক, কিন্তু যখন তারা তাকায় তার পায়ের দিকে, তার নিতম্বের দিকে, তার স্তনের দিকে, তখন সে লজ্জা পায়। তরুণী পুরুষের কামনা জাগিয়ে দিতে চায়, কিন্তু যখন দেখে সে কামনা জাগিয়ে দিয়েছে পুরুষের, তখন গুটিয়ে নেয় নিজেকে। সে স্পর্শ পেতে চায়, কিন্তু স্পর্শ পেলে প্রকাশ করে বিরক্তি। পৃথিবী জুড়ে তরুণীর জীবনেব মূল লক্ষ্য একটি স্বামী পাওয়া; এবং অধিকাংশ সমাজে এখনো তার জন্যে স্বামীটি সংগ্রহ করে অভিভাবকেরা। সে নিজেকে নিজের পছন্দ মতো সমৰ্পণও করতে পারে না, সমৰ্পণ করে অন্যরা। তাই তরুণী স্বাধীন সত্তা হিশেবে বিকশিত করতে পারে না নিজেকে। কোনো কোনো সমাজে তরুণী নিজের ভবিষ্যতকে নিতে পারে নিজের হাতে, তারা নিরন্তর পুরুষভাবনা থেকে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশ সমাজে আজো তা অসম্ভব। দিন দিন তা আরো অসম্ভব ক’রে তোলা হচ্ছে। বাঙলাদেশে তার কানে যে-অশ্লীল গানটি নিয়মিত বাজানো হয়, তা হচ্ছে বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে। বিয়েতে মুক্তি নেই তরুণীর, তার মুক্তি নিজের স্বাধীন সত্তায়। কিন্তু পরিবার ও সমাজ তার সত্তা বিকাশের জন্যে উৎসাহী নয়, উৎসাহী তাকে অবিকশিত ক’রে দিতে। আমাদের সমাজের প্রায় সবাই এখন কাজ করছে কিশোরীতিরুণীর বিকাশের বিরুদ্ধে; সমাজনীতি আর রাজনীতি কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে। তারা এখন আর বিকশিত ও স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে না, দেখছে। বন্দী হওয়ার বন্দী থাকার স্বপ্ন।
বালিকার পরিণতি কিশোরী, কিশোরীর পরিণতি তরুণী; তাদের বিপন্ন পরিণতি নারী। পিতৃতন্ত্রের নানা প্রান্তে তাদের বিকাশের মধ্যে, যদি একে বিকাশ বলতে পারি, রয়েছে মিল : তাদের জৈব বিকাশে মিল রয়েছে পৃথিবী জুড়ে; কিন্তু বিভিন্ন দেশ, সমাজ, শ্রেণী কিশোরীতিরুণীদের একইভাবে বাড়তে দেয় না। বাড়া নয়, বলা যায়, রুদ্ধ করে রাখা হয় তাদের বিকাশ। বাঙালি আর মার্কিন কিশোরীর মধ্যে জৈব মিল স্পষ্ট, কিন্তু সমাজ তাদের এমন পৃথক ক’রে রাখে। যেনো তারা ভিন্ন গ্রহ বা প্রজাতির। আরবি কিশোরী জৈবিকভাবে বাঙালি আর মার্কিন কিশোরীর মতোই বাড়ে, তবে তার ওপর সামাজিক বোঝা এতো ভারী এতো নির্মম যে তার মনই শুধু নয়, বিকৃত হয়ে যায় তার দেহও। তাদের সবার পরিণতি নারী; সব দেশেই নারী বিপন্নতার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ, এবং বহু দেশে তাবা পুবোপুরি পর্যাদস্ত। একই দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর কিশোরীতিরুণীর মধ্যেও রয়েছে মিল-অমিল; চাষী আর আমলার মেয়ের জৈবিক বিকাশ অভিন্ন, কিন্তু তারা এতো ভিন্ন শ্রেণীর যে তারা পরস্পরের সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু তারা একই পংক্তির। ধনী পরিবারের কিশোরীটির সাথে ওই পরিবারের কিশোরটির যতোটা মিল, তার চেয়ে অনেক মিল তার দরিদ্র চাষী পরিবারের কিশোরীটির সাথে; তারা শিকার একই সামাজিক নিয়তির। সব নারী, সব কিশোরীতিরুণীর ভাগ্য একই পীড়নের সুতোয় গাথা! সমাজ কিশোরীর দিকে ওৎ পেতে থাকা বাঘ একটু বিচূতি ঘটলে বাঘ লাফিয়ে পড়ে তার ওপর। সমাজ তার দেহকে যেভাবে বাড়া৩ে চায়, তাকে সেভাবে বাড়াতে হয়। দেহ; সমাজ যেভাবে স্বপ্ন দেখাতে চায় তরুণীকে, সেভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় তাকে। তারা সমাজনিয়ন্ত্রিত প্ৰাণী, খাচার মধ্যে তারা বাড়তে থাকে আদর্শ নারী হওয়ার জন্যে। বাঙালি নারীরা তাদের আত্মজীবনীতে বারবার ‘খাচা’ আর “পিঞ্জার’-এর কথা বলেছেন, পাখির রূপকে দেখেছেন নিজেদের; কিন্তু তারা পোষা পাখি ছিলেন না, ছিলেন পোষােজন্তু। সমাজ পোষােজন্তুটিকে বলে নারী। তার দেহ আছে; যে-দেহটি সে নিজের ব’লে পেয়েছে, সেটি তাকে বিব্রত করে, তাকে মাঝে মাঝেই অসুস্থ করে; তবে কিশোরী ওই দেহ, তরুণী ওই দেহ। তার দেহও সমাজেরই বিবেচনার বস্তু; তার দেহ পরিখের কর পরখ করতে থাকে অনেক সমাজ। অনেক সমাজে কিশোরী বুঝতেই পারে না। কীভাবে সে বেড়ে উঠেছে, তরুণী হয়েছে; তার আগেই তার দেহ কোনো বর্বর অত্যাচারে বিকৃত হয়ে যায়। প্রতিটি সমাজ কিশোরীতিরুণীর জন্যে বের করেছে সামািজীকিকরণের বিশদ বিধিমালা, যার লক্ষ্য তাকে পিতৃতন্ত্রের আদর্শকাঠামোর আদলে শিশুস্বভাবের নারী ক’রে তোলা।
সামাজিকীকরণের ফলে বদলে যেতে থাকে বালিকা, ভিন্ন হয়ে যেতে থাকে বালকের থেকে; সে খাপ খাইয়ে নিতে থাকে তার লিঙ্গভূমিকার সাথে, তবু সে তার স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ফেলে না। যেই সে পৌঁছে কৈশোরে, তার ভবিষ্যৎ বাসা বাঁধে তার শরীরে; দ্য বোভোয়ারের (১৯৪৯, ৩৫১) ভাষায়, ‘বয়ঃসন্ধির সাথে ভবিষ্যৎ শুধু ঘনিয়ে আসে না; তার শরীরে বাসা বাধে; পরিগ্রহ করে চরম মূর্ত বাস্তব রূপ।’ ভিন্ন হয়ে যায় কিশোরকিশোরী। কিশোর সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্কতার দিকে; তার ভবিষ্যৎ তার জন্যে চমৎকারভাবে সৃষ্টি ক’রে রেখেছে সমাজ, সেখানে সে প্রবেশ করে স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে; কিন্তু কিশোরী অপেক্ষা করতে থাকে, তার জীবন হয়ে ওঠে অনন্ত অপেক্ষা। কৈশোর বালিকার জন্যে ক্রাস্তিকাল; এ-সময়ে তার কোনো বিশেষ লক্ষ্য নেই, সে জানে না তার জীবনের উদ্দেশ্য। কিশোরী তরুণী হয়ে ওঠে, তার শরীরের বিপজ্জনক সুন্দর পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু সে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে না। তার জীবনে। তরুণীর সময় কাটে অবসাদগ্ৰস্ত প্ৰতীক্ষায়। সে প্রতীক্ষা করে পুরুষের } তার জীবন সে নিজে সৃষ্টি করতে পারে না, সমাজ সে-ব্যবস্থা রাখে নি; সমাজ উদ্ভাবন করেছে তাকে রুদ্ধ করার সমস্ত বিধি। তার জন্যে রেখেছে একটি প্রতীক্ষার মহাসামগ্ৰী : পুরুষ। তার জীবনের সারকথা সংহত একটি শব্দে : পুরুষ। কিশোরীকে, তরুণীকে সমাজ একটিই স্বপ্ন দিয়েছে; পুরুষ। কিশোরও স্বপ্ন দেখে নারীর, কিশোরও কামনা করে নারী; তবে তা তার জীবনের খণ্ডাংশ। নারী তার জীবনের নিয়তি নয়, নারীর মধ্যে সে দেখে না জীবনের পূর্ণতা। যুবক নিজের জীবনের পূর্ণতার স্বপ্ন দেখে বাস্তব সাফল্যে, নারী ওই সাফল্যের একটি অংশ; কিন্তু তরুণীর জীবনের সারকথা পুরুষ, যে পূর্ণ ক’রে তুলবে তার জীবন। এটা কোনো জৈব বিধান নয়; প্রকৃতি তাকে প্রতীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করে নি, কিন্তু সমাজ তার জন্যে পুরুষের প্রতীক্ষাকে ক’রে তুলেছে অবধারিত।
তরুণী থাকে অবসাদগ্ৰস্ত অস্তিত্বের মধ্যে বন্দী। তার কোনো লক্ষ্য নেই উদ্দেশ্য নেই; সে নিরর্থক প্রাণী। তাকে ওই নিরর্থকতার বন্দীত্ব থেকে যে উদ্ধার করবে, সে পুরুষ। সমাজব্যবস্থা পুরুষকে দিয়েছে ত্ৰাতার ভূমিকা। সব পুরুষ সমান শক্তিশালী, সমান ঐশ্বৰ্যশালী নয়; কিন্তু পুরুষ হওয়াই ঐশ্বৰ্য। পুরুষ শক্তিশালী, ধনী; তার হাতে আছে সুখের চাবি, সে স্বপ্নের রাজপুত্র। বালিকা বয়স থেকেই বালিকা দেখে পুরুষ উৎকৃষ্ট; পুরুষ। আয় করে টাকা। যে টাকা আয় করে সে-ই প্ৰভু। সমাজ নারীর পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে রেখেছে আর্থনীতিক ভিত্তিটি, যার ওই ভিত্তি নেই। সে কখনো দাঁড়াতে পারে না। কিশোরতরুণী জানে সে কখনো টাকা আয় করবে না, যে-সব কাজ সে শিখছে মায়ের পুণ্য আদর্শ অনুসাবণ করে সে-সবের কোনো আর্থ মূল্য নেই। তার কাজের আর্থ মূল্য নেই, তাই তারও মূল্য নেই! সে ব্যক্তি হয়ে উঠবে না, প্ৰভু হয়ে উঠবে না। সমাজের সব কিছু তাকে বুঝিয়ে দেয় তার জন্যে সবচেয়ে ভালো কোনো পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তি হওয়া। তার চাহিদা সামগ্ৰী হিশেবে। যে-মেয়ের জন্যে ঘন ঘন পাত্র আসে, তাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে বাবামা; যাকে বউ করার জন্যে প্রতিযোগিতা পড়ে যোগ্যদের মধ্যে, অন্য মেয়েরা ঈর্ষা করে তাকে; কারণ পুরুষ পাওযাই তার জীবনের সাফল্য। বিয়ে নারীর শ্রেষ্ঠ পেশা। তরুণীর জন্যে অন্যান্য পেশার থেকে এটা বেশি সম্মানজনক, এবং কম শ্রমসাধ্য; একটি দেহই তাকে এর যোগ্য ক’রে তোলে। বিয়ে তাকে দেয় সামাজিক মর্যাদা, এর মাধ্যমে তৃপ্ত হয় তার কাম ও মাতৃত্বম্পুহা। স্বামী পাওয়াই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণতম কাজ। এ-কাজ সে নিজে বেছে নেয় নি, এ-কাজকে সে নিজের জন্যে স্থির করে নি; সমাজই নির্ধারণ ক’রে দিয়েছে।
বিয়ে তার শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পেশা; কিন্তু এর জন্যে তাকে মূল্যও দিতে হয় প্রচুর। পুরুষ কোনো পেশার জন্যে এমন মূল্য দেয় না। সে একটি পেশার জন্যে উৎপাটিত করে নিজের অস্তিত্ব, তার যা কিছু পরিচিত আপন ছিলো তাদের থেকে সে সরিয়ে নেয় নিজেকে। সে মেনে নেয় নির্বাসন। সে নিজেকে সরিয়ে নেয় বাপের বাড়ি থেকে, পিতামাতার অধিকার থেকে, তার পরিচিত প্রিয় দৃশ্যগুলো থেকে। সে সক্রিয় বিজয়ীর বেশে ঢোকে না তার ভবিষ্যতে। সে শুধু নিজেকে সমর্পণ করে এক নতুন প্রভুর অধিকারে। সে যে নিজেকে সমর্পণ করে একটি পুরুষের কাছে, এর তাৎপর্য বের করার চেষ্টা করেছে। পুরুষতন্ত্ৰ : এর তাৎপর্য নারী নিকৃষ্ট পুরুষের থেকে, তার পুরুষের সমান হওয়ার শক্তি নেই। তাই সে অসম প্ৰতিযোগিতায় না নেমে নিজেকে সমর্পণ করে পুরুষের পায়ে, যার রয়েছে জয়ী হওয়ার শক্তি। বিয়ে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর নারীর নিকৃষ্টতার প্রমাণ। নারী নিজেকে সমর্পণ করে, তবে তার সমর্পণের মূলে কোনো জৈব কারণ নেই; প্রকৃতি তাকে পুরুষের অধীনে থাকার জন্যে সৃষ্টি করে নি। সমাজই তাকে তৈবি করেছে এমনভাবে। সমাজ তার জন্যে নির্ধারিত করে রেখেছে এমন ভবিষ্যৎ, যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বিয়ে তাকে কিছুটা স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তার বিবাহিত জীবন এক নিরন্তর সংকট; পুরুষেব স্বেচ্ছাচারিতার শিকার।
বয়ঃসন্ধি বদলে দেয়। বালিকার দেহ। এর আগে বালকবালিকার শরীরে থাকে সমান শক্তি, প্রাণবন্ততাও থাকে সমান; কিন্তু বয়ঃসন্ধি বালিকাকে জন্ম দেয় নতুন করে। তার দেহ হয়ে ওঠে আগের থেকে ভঙ্গুর, এক ঠুনকো অবয়ধের অধিকারী হয় সে, তার কামপ্রত্যঙ্গগুলো সহজে বোধ করে আহত, আর বুকের দু-পাশে দুটি বিব্রতকর। ফলের মতো দেখা দেয় অদ্ভুত, বিপত্তিকর স্তন। পুরুষের চোখে স্তন সুন্দর, তার শরীরের ওই স্ফীত পিণ্ড দুটি পুরুষের চোখে জাগায় তীব্র আবেদন; কিন্তু কিশোরী তা নিয়ে থাকে বিরত। অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে, আগের জামা তাকে পীড়া দিতে থাকে; সে দৌড়েতে গেলে ওগুলো দোলে, ব্যায়াম করতে গেলে দোলে। তার বুকে যন্ত্রণা হয়ে যা ফুলে ওঠে তা স্তন, যা তার নিজের কোনো কাজে লাগে না; একদিন পুরুষ ও-দুটি মথিত করে, শিশু শোষণ করে। কিশোরী হয়ে ওঠে দুর্বল, কমতে থাকে। তার পেশির শক্তি, সে হারিয়ে ফেলে তৎপরতা। একই বয়সে কিশোর অর্জন করে পেশি, অর্জন করে তৎপরতা। এমন একটি প্রক্রিয়া দেখা দেয় তার শরীরে, যা কখনো বোধ করে না পুরুষ; তা তার ঋতুস্রাব। পশ্চিমে একে এক সময় বলা হতো “অভিশাপ’, যা কিশোরীর কাছে আসলেই অভিশাপ মনে হয়। অধিকাংশ সমাজেই এর জন্যে তাকে প্রস্তুত ক’রে তোলা হয় না, তাই হঠাৎ অনভিপ্রেতি রক্তের প্রবাহ তাকে ভীত ক’রে তোলে। কিশোরী বোধ করে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, তলপেটে ব্যথা। ব্যাহত হয়ে পড়ে তার স্বাভাবিক জীবনধারা, তার শরীর হয়ে ওঠে তার জন্যে সমস্যা। সব ধর্মই শেখায় যে এটা অশুচি অপবিত্র, যদিও এতে নেই কোনো অশুচিতা অপবিত্রতা, তবুও কিশোরী নিজের অশুচিতা ও যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৩৫৩) বলেছেন, ‘সমগ্র মহাজগতকে তার মনে হয় এক দুৰ্বহ ভার। দুৰ্বহ ভারগ্রস্ত, নিমজ্জিত, সে নিজের কাছেই নিজে হয়ে ওঠে। অপরিচিত, কেননা বাকি সমগ্র জগতের কাছেই সে অপরিচিত।’ মাসে মাসে একই অগ্ৰীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে পাগল ক’রে তুলতে পারে; তবে কিশোরী জানে তাকে বেঁচে থাকতে হবে এ নিয়ে।
কৈশোরে, বছর তেরোর দিকে, বিকাশ ঘটে বালকের ইচ্ছাশক্তি। এ-সময় প্রকাশ ঘটতে থাকে তাদের আক্রমণাত্মক প্রবণতা, শরীর দিয়ে তারা পরখ ক’রে দেখতে চায় চারপাশ, জয়ের বাসনা দেখা দিতে থাকে শরীরের প্রতিটি কাজে; বালকেরা প্রতিযোগিতায় নামে। শারীরিক শক্তি হয়ে ওঠে বালকের জীবনের প্রধান সত্য; কিন্তু ওই বয়সেই, এবং তারো আগে, বালিকা নিজেকে গুটিয়ে নেয় শক্তির এলাকা থেকে। সমাজ তার মনে শক্তি চায় না, শরীরে শক্তি চায় না, সমাজের চোখে অপ্রয়োজনীয় তার অস্থি আর পেশি। তার কাছে সমাজ চায় কোমল মেদ। অধিকাংশ সমাজে ছোটো বালিকাদের জন্যেও নেই কোনো খেলাধুলো; এবং কৈশোরে পৌঁছে যা অবশিষ্ট থাকে, তাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বাঙালি বালিকা কোনো খেলার সুযোগ পায় না, তবু তারা মাঝে মাঝে দৌড়োনোর সুযোগ পায়, কিশোরীর জন্যে তাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠিনীরা মারাত্মক খেলোয়াড় ছিলো, দৌড়ে ওদের সাথে পেরে ওঠা ছিলো কঠিন; কিন্তু একদিন ওরা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। আমরা মাঠে খেলে চলেছি, ওরা উকি দিয়ে চলেছে আমাদের দিকে। এর পর ওরা আমাদের দেখে লাজা পেয়েও পিছলে পড়তো, মনে হতো। ওরা হাঁটতেও ভুলে গেছে। কিশোরী শক্তি, পেশি, গতির এলাকা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঢ়োকে ঘিরে, ঘর তার দেহকে শিথিল অবসন্ন করে তোলে। তারা হয়ে ওঠে অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পুরবালা, অসূৰ্যম্পশ্যা।
কিশোরীতিরুণীর শরীর বিকশিত হয় না। সক্রিয়ভাবে, তাদের দেহ অক্রিয়ভাবে ভোগ করে বিভিন্ন ব্যাপার। শরীর’ শব্দটিতে রয়েছে এক ধরনের সক্রিয়তা; তাই এক সময় নারীর শরীর বোঝাতে এ-শব্দটি ব্যবহৃতই হতো না : ব্যবহৃত হতো দেহ, দেহলতা, দেহবল্লরী, তনু, তনুলতার মতো অপেশল শব্দ। তাদের ক’রে দেয়া হয় সীমাবদ্ধ, তারা যেতে পারে না। সীমার বাইরে; তরুণের জীবনের প্রাণ প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতা, কিন্তু তরুণীর জীবনের কোনো সক্রিয় প্রতিযোগিতা থাকে না। প্রতিযোগিতার এলাকা থেকে নির্বাসিত তারা তুলনা করে, শুধু তুলনা করে। তারা তুলনা করে ছেলেদের সাথে ছেলেদের, তুলনা করে নিজেদের সমস্ত তুচ্ছ বিষয়ের। তুলনা কোনো সক্রিয় কাজ নয়: তুলনা করা সক্রিয় প্রতিযোগিতার বিপরীত। সক্রিয়র কাজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া, জয় লাভ করা, আর অক্রিয় দর্শকের কাজ প্রতিযোগীদের মধ্যে তুলনা করা। কিশোরীতিরুণী হয়ে ওঠে। জয়পরাজয়কম্পিত মুখরিত পৃথিবীর দর্শক। প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে জয়পরাজয়, থাকে অন্যদের পরাভূত ক’রে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ; কিন্তু কিশোরীতিরুণী কখনো প্রতিযোগিতায় নামে না। এটাও কোনো রহস্যজনক জৈব ব্যাপার নয়, এটা সম্পূর্ণরূপে সামাজিক। সমাজ চায় না তারা প্রতিযোগিতায় নামুক, তারা মেতে উঠুক জয়পরাজয়ে; সমাজ চায় তারা তাদের আরাধ্য পুরুষদের মধ্যে তুলনা করুক। তরুণীর শারীরিক শক্তির অভাবের ফলে তার মধ্যে জন্ম দেয় ভীরুতা। সে যে শুধু টিকটিকি তেলেপোকাকে ভয পায়, তা নয়; সে ভয় পায় সক্রিয় সব কিছুকেই। পিতৃতন্ত্র খুব পছন্দ করে এটা, নারীর ভয় তার মনে হয় সুন্দর: চরম ভয়ের মধ্যে বাস করারই নারীত্ব। কিশোরীতিরুণী যেহেতু নিজেদেব শরীরে শক্তি অনুভব করে না, তাই নিজেদের ওপর তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে; তারা কখনো রুখে দাঁড়ায় না, মেনে নেয়। তাদের ওপর সব আক্রমণ। তারা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তাদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও আত্মরক্ষা করতে পারে না; কেননা নিজেদের শক্তিতে তারা অবিশ্বাসী। তারা ছেড়ে দেয় উদ্যমশীলতা, বিদ্রোহের সাহস তাদের থাকে না। তারা দণ্ডিত ভীরুতা ও আত্মসমর্পণে, তারা অবস্থান নেয়। তাদের সমাজনির্ধারিত স্থানে। তারা হয়। বাশমানা, তাদের মনে হয় যা যে-অবস্থায় আছে থাকবে সে-অবস্থায়ই। নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের কথা ভাবনায় আসে না তাদের। শরীর তাদের নিয়তি নয়, তবু শরীরই হয়ে ওঠে তাদের সামাজিক নিয়তি।
কিশোরীতিরুণীর শরীর নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেক সমাজ, ওই সমস্ত সমাজ চায় পুরুষের জন্যে তারা প্ৰস্তুত রাখবে একটি অক্ষত দেহ, এমন কাচের পাত্রের মতো যন্তে রাখবে শরীর যাতে তাদের রন্ধের ঝিল্লিটির একটি তত্ত্বও না ছেড়ে। তরুণীকে রক্ষা করতে হবে তার সতীত্ব। পিতৃতন্ত্র তরুণের সততা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়, তরুণের সততা ভিন্ন ব্যাপাের; তরুণীব সতীত্ব হচ্ছে তার অক্ষত সতীচ্ছদ। পিতৃতন্ত্রকে সে শ্রেষ্ঠ যে-উপহারটি দিতে পাবে, তা একটি অটুট সতীচ্ছদ। মধ্যপ্ৰাচ্য ও ৩ার সনিকট অঞ্চলের মুসলমান পিতৃতন্ত্র রখনো তরুণীর সতীত্ব ও সতীচ্ছদের ওপর দেয় বিভীষিকাজাগানো গুরুত্ব, যার ফলে প্রতিটি তরুণী বাস করে দোজখের ভীতির থেকে ভয়ানক ভীতির মধ্যে। ভূমধ্যসাগবীয় পুরুষদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের একটি হচ্ছে অটুট যোনিচ্ছদসম্পন্ন কুমারী, যাকে এর আগে আর কোনো পুরুষ ছোয় নি। ফাতিমা মের নিসসি (১৯৮২, ১৮৩) বলেছেন, সেখানে পুরুষের মর্যাদা অবস্থিত নারীর দু-উরুর মাঝখানে। প্রকৃতিকে বশ বা পর্বত জয় ক’রে তারা অর্জন করে না মর্যাদা, তারা নারীদের নিয়ন্ত্রণ করে আয়ত্ত করে মানসম্মান। সেখানে পুরুষ চায় নারীর সতীত্ব, চায় তার অক্ষত সতীচ্ছদ; এবং এ-কামনাকে তারা এতো দূর নিয়ে যায় যে তা হয়ে ওঠে মহাজাগতিক উন্মত্ততা। ওই পুরুষেরা চায় তাদের নারীরা সতী হবে, কিন্তু তারা নিজেরা লিপ্ত হবে। অবৈধ যৌনসম্পর্কে, যাবে কাম থেকে কামে। সতীত্ব ও সতীচ্ছদ নিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পুরুষের পরাবাস্তব পাগলামোর বিবরণ দিয়েছেন নওঅল এল সাদাওয়ি তার হাওয়ার লুকোনো মুখ (১৯৮০, ২৪-৩২) বইয়ের ‘সতীত্ব/সম্মান নামক খুব পাতলা ঝিল্লিী’ নামের বমিজাগানো পরিচ্ছেদে।
প্ৰত্যেক আরব বালিকার থাকতে হয় একটি পাতলা পর্দা, যার নাম সতীচ্ছদ। এটা তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ। তবে শুধু সতীচ্ছদ থাকলেই চলবে না, সতীচ্ছদটিকে হ’তে হবে বিশুদ্ধ: বাসর রাতে ওটিকে প্রচুর রক্তপাত ক’রে প্রমাণ করতে হবে যে তার অধিকারিণী ছিলো পরম সতী। বিছানার শাদা চাদরে পড়তে হবে রক্তের দৃষ্টিগ্রাহ্য দাগ। মেয়েটি যদি অভাগিনী হয়, তার থাকতে পারে একটি শক্ত স্থিতিস্থাপক চ্ছদ। ওই চ্ছদটিকে আঙুল বা শিশ্ন দিয়ে ঘাটলেও কোনো রক্ত বেরোবে না। সে প্রমাণ করতে পারবে না। সে সতী। পরদিনই হয়তো তাব লাশ পাওয়া যাবে কোনাে বালুকাস্তুপে। কোনো কোনো মেয়ের চ্ছদ এতো পাতলা হয় যে তা হাঁটতে ফিরতে দৌড়োতে গিয়েই ছিড়ে যেতে পারে, সেও প্রমাণ করতে পারবে না। সে ছিলো সতী । বংশের সম্মানের জন্যে সেও হয়তো লাশ হবে। কোনো কোনো মেয়ের ওই চছদটি নাও থাকতে পারে, সে প্রাকৃতিকভাবেই অসতী! নওঅল চিকিৎসক, তার কাছে একবার একটি ষোলো বছরের ‘গৰ্ভবতী’ মেয়ে আসে। তিনি দেখেন মেয়েটি গর্ভবতী নয়; তার যোনিচ্ছদে কোনো রন্ধ নেই বলে বছরের পর বছর ধ’রে তার পেটে জমেছে ঋতুস্রাবের রক্ত। তার ভাগ্য ভালো, সে বিবাহিত: অবিবাহিত হ’লে হয়তো পরিবারের নামে তাকে কোরবানি করতো ভাই বা বাবা। এমন ঘটনা মিশরে অনেক ঘটেছে। সুঠু যোনিচ্ছদ নিয়ে জন্মে মাত্র ৪১.৩২% মেয়ে; ১১.২% মেয়ের কোনো চছদই থাকে না, ১৬.১৬% মেয়ের চ্ছদ এতো পাতলা হয় যে ছিড়ে যায় সহজে, আর ৩১.৩২% মেয়ে জন্মে মোটা স্থিতিস্থাপক চ্ছদ নিয়ে নওঅল (১৯৮০, ২৬)]। তাই বাসর রাতে রক্ত ঝরতে পারে ৪১.৩২% মেয়ের, কিন্তু সতীচ্ছদপাগল আরব চায় সব বাসরশয্যা হবে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো রক্তাক্ত । সেখানে স্বামী বিছানায় রক্তের দাগ না পেয়ে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে আসে চিকিৎসকের কাছে স্বচ্ছদ আছে কিনা পরীক্ষা করানোর জন্যে, পিতামাতা চায় তাদের মেয়ের জন্যে একটি সতীচ্ছদের সার্টিফিকেটা! আরব সমাজে তরুণীর দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রত্যঙ্গ’ তার যোনিচ্ছদ; তা তার চোখ, হাত বা পায়ের থেকে অনেক মূল্যবান। মেয়ে একটি হাত বা চোখ হারালে ততোটা দুঃখ পায় না। আবব পিতামাতা, যতোটা পায় তার চচ্ছদটি নষ্ট হ’লে । বাসর রাতে যে-মেয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে প্রমাণ করতে পারে না যে সে সতী, সে তালাক পায়, মৃত্যুও তার প্রায় অবধারিত। এ নিয়ে তৈরি হয় বড়ো কেলেঙ্কারি, নষ্ট হয় বংশের মর্যাদা। পরিবারটি ডুবে যায় অপমানে, যা শুধু ‘মোছা সম্ভব রক্তে’ } তারা বিশ্বাস করে আল্লা মেয়েদের যোনিচ্ছদ দেয় সতীত্ব রক্ষার জন্যে, মেয়েদের দায়িত্ব ওই চািচ্ছন্দ পুরুষকে উপহার দেয়া ।
বাসররাতে সেখানে প্রতিটি বন্ধুকে দিতে হয় রক্তাক্ত সতীত্বের পরীক্ষা। স্বামীটি নিজে শিশ্ন বা আঙুল দিয়ে যোনি খুঁড়ে দেখতে পারে, কিন্তু অনভ্যস্ত যুবকেরা সব সময় ঠিক মতো কাজটি পারে না। তাই মিশরে আছে দায়া’ বা ‘নারী হাজাম’, যাদের কাজ মেয়েদের খৎনা করানো, এবং বাসর রাতে সতীচ্ছদ ছেড়া। তারা দেখতে কুৎসিত, হাতে রাখে বড়ো বড়ো নখ, যা তাদের পেশার জন্যে দরকার। দায়াকে পারিশ্রমিক ছাড়াও বেশ ঘুষ দিয়ে থাকে মেয়ের বাবামা, যাতে সে নখ দিয়ে গভীর ক’রে খুঁড়ে প্রত্যঙ্গটির দেয়াল-চ্ছদ-ওষ্ঠ ছিন্নভিন্ন ক’রে প্রমাণ ক’রে দেয় মেয়ের সতীত্ব। বাসরঘরে ঢোকে দায়া, বাইরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মেয়ের বাবামা আত্মীয়স্বজন। মেয়ের সতীত্বে অসতীত্বে দায়ার কিছু যায় আসে না, সে জানে সতী প্রমাণ হ’লে তার মিলবে প্রচুর টাকা। সে তার নোংরা আঙুল আর বড়ো নখ ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের যোনিতে, মেয়েটির ভাগ্য ভালো হ’লে রক্ত বেরিয়ে আসে সহজে, সে ওই রক্তে ভেজায় শাদা রুমাল। যদি সহজে না বোরোয়, সে তার দীর্ঘ নখ ঢুকিয়ে দেয় মেয়ের যোনির দেয়ালে, খুঁড়ে ফেলে দেয়াল, ফিনকি দিয়ে বেরোয় রক্ত; আর ওই রক্তভেজা রুমাল তুলে দেয় মেয়ের পিতার হাতে। পিতা মেয়ের যোনিরক্তভেজা রুমাল পতাকার মতো উড়িয়ে ঘোষণা করে মেয়ের সতীত্ব, হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে আত্মীয়স্বজন। মেয়েটি বিছানায় কাতরাতে থাকে, রক্তে তার মহাজগত ভিজে যায়; কিন্তু মরুভূমিকে সে একটি চ্ছদ দিতে পেরে ধন্য বোধ করে। এমনই বর্বর ওই মরুভূমি। সতীচ্ছদ আরব পুরুষদের জাতীয় পতাকা।
চোখের বদলা যেমন চোখ, মিথ্যার বদলা তেমনই মিথ্যা: আর প্রতারণার বদলা প্রতারণা। আরব পুরুষ নিজে যৌনসৎ নয়, কিন্তু চায় সতী; তাই প্রতারণা তার প্রাপ্য। আরব পুরুষ রক্ত চায়, তাকে পেতে হয় রক্তের প্রতারণা। আগে বাসর রাতে মেয়ের যোনিতে ঢুকিয়ে দেয়া হতো মুরগির রক্তের দিলা, এখনো গরিব পরিবারে তা করা হয়; আর ওই বক্তের দাগ দেখে শান্ত হয় আরবের হৃদয়। এখন সেখানে দেখা দিয়েছে। সতীচ্ছদের শল্যসংযোজনা! শল্যচিকিৎসক এখন সতীত্ব হারানো তরুণীর রন্ধে কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি সতীচ্ছদ জুড়ে দিয়ে তাকে আবার ক’রে তোলে সতী। আরব অঞ্চলে এখন দেখা দিয়েছে কৃত্রিম সতী। এ-সুযোগ নিচ্ছে ধনী পরিবারের মেয়েরা। ১৯৬৮তে সতীচ্ছদ সংযোজনের ব্যয় ছিলো ২০০০ দিবাহাম, এখন নেমেছে ৫০০-১০০০ দিরহামে। সেখানে একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের বার্ষিক ব্যয় ৬৫ দিরহাম, একটি মেয়ের রন্ধ শেলাইয়ের ব্যয় ২০০০ দিরহাম! সতীচ্ছদ সংযোজনে ব্যবহৃত হয় অতি আধুনিক পদ্ধতি, কিন্তু এটি সেবা করছে সবচেয়ে আদিম পিতৃতন্ত্রের। ফাতিমার (১৯৮২, ১৮৫) মতে, কৃত্রিম সতীত্ব উদ্ভাবিত হয়েছে, কেননা আরব পুরুষ চায় অসম্ভবকে। তারা নিজেরা বিয়ের আগে নারীদের সতীত্ব হরণ করে, কিন্তু বিয়ের সময় হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে একটি সতী-একটি সতীচ্ছদ! কৃত্রিম সতীচ্ছদ আরব পুরুষের জন্যে যোগ্য পুরস্কার, শঠকে পুরস্কৃত করতে হয় শঠতা দিয়েই। নওঅল (১৯৮০, ৩০-৩১) আরবদের ওপারস্পরিক প্রতারণার একটি তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা বলেছেন। এক দিন একটি মেয়ে তার চিকিৎসালয়ে আসে। সে পাচ মাসের গর্ভবতী, কিন্তু তার সতীচ্ছদ রয়েছে অটুট! মেয়েটি তাঁকে জানায় যে বার বার অগভীর সঙ্গমের ফলে তার গর্ভ ঘটেছে। মেয়েটি তাকে অনুরোধ করে পেট কেটে বাচ্চাটি ফেলে দিতে, যাতে অক্ষত থাকে তার মূল্যবান চ্ছদটি। তিনি রাজি না হওয়ায় মেয়েটি চলে যায়; বহু বছর পর মেয়েটির সাথে তাঁর দেখা হয়, মেয়েটি তাকে জানায় সে অন্য এক ডাক্তার দিয়ে পেট কেটে গর্ভপাত করিয়েছিলো। এখন সে এক সফল প্রকৌশলীর স্ত্রী, তাদের দুটি সন্তান হয়েছে। নওঅল (১৯৮০, ৩১) বলেছেন :
‘কল্পনায় আমি মাঝে মাঝে আমার অদেখা সে-প্রকৌশলীটিকে দেখি, দেখতে পাই বাসর রাতে সে পবিত্র অনুষ্ঠানরূপে তার স্ত্রীর চচ্ছদ ছিন্ন করছে, বুঝে নিচ্ছে যে তার স্ত্রী ছিলো কুমারী; এবং পবিম সুখে সে দেখতে পায় তার স্ত্রীর চচ্ছদটি অটুট বয়েছে। তবে কাছে ওই মেয়েটির পেটের লম্বালম্বি কাটাদাগটি তুচ্ছ, যেমন ওই মেযেটিব হৃৎপিণ্ড বা যকৃৎ বা মস্তিষ্কে একটি কাটা দাগেব কোনো তা ৎপর্য নেই তার কাছে, তবে এক মিলিমিটাব দীর্ঘ ওই চ্ছদে যদি থাকতো একটি ছোটো ছেড়া, তাহলে তা উল্টেপাল্টে দিতো তার সমগ্ৰ জগত।‘
কিশোরীবালিকা রখনো এমন আদিমতার শিকার পিতৃতন্ত্রের নানা প্রান্তে। তার দেহ যেমন অক্ষত পেতে চায় অনেক সমাজ, আবাবা অনেক দর্শনবিজ্ঞান মনে করে সহজাতভাবেই তার দেহ বিকলাঙ্গ। প্লাতো ও তাঁর অনুসারীরা মনে করতেন নারীর শরীর নিকৃষ্ট পুরুষের শরীর থেকে; এবং উনিশশতকে অটো ভিনিঙ্গার নামের এক জর্মন বালক লিঙ্গ ও চরিত্র নামে একটি বই লিখে দেখায় কতো নিকৃষ্ট নারীর দেহ ও চরিত্র। ফ্ৰয়েড গভীর প্রভাবিত ছিলেন তার দ্বারা, এবং তারই নারীধারণাকে তিনি দিয়েছিলেন ছদ্মবৈজ্ঞানিক রূপ। ভিনিঙ্গার বইটি লিখে অল্প বয়সেই আত্মহত্যা করে, তবে তার লেখায় রূপ পায় তরুণীর দেহ ও চরিত্র সম্পর্কে পুরুষের আদিম ঘৃণা। তার চোখে নারী অভিন্ন তার দেহ ও তার অবচেতন কামের সাথে; তাই নারী পাশব। তার মতে, ‘যে-পুরুষ নারী সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে তার পক্ষে নারী সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা অসম্ভব; পুরুষ নারীকে ঘৃণা করে, বা তারা কখনো নারী সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবে না’। তার সিদ্ধান্ত [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭০, ১০৫)] :
‘একটি সম্পূর্ণ নগ্ন নারীদেহ এমন অনুভূতি সৃষ্টি করে যেনো তার অভাব রয়েছে কোনো কিছুর, তার রযেছে এমন অসম্পূর্ণতা যা সৌন্দর্যের সাথে অসমঞ্জস।… নারীকে আকৃষ্ট করে কামের বিকশিত চিহ্নগুলো; সে বিকর্ষণ বোধ কবে মনের উন্নত গুণাবলির প্রতি। নারী মৌলিকভাবে লিঙ্গপূজারী।‘
তরুণের যৌনপ্রবর্তনা তার শারীর শক্তিরই প্ৰকাশ, সম্ভোগ করে সে উপলব্ধি করতে চায় পৌরুষ। তরুণী তার কামনার ভেতরে পোষণ করে লজ্জা। কেননা সে জানে। সে সম্ভোগ করবে না, তাকে সম্ভোগ করবে। পুরুষ; সে হবে পুরুষের খাদ্য। যুবক তার কামের সাফল্যে গৌরব বোধ করে, একের পর নারী সম্ভোগ করার জন্যে বোধ করে ব্যগ্ৰতা; এতে তার কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু তরুণী লজ্জায় কুঁকড়ে থাকে, সম্ভোেগ তার জন্যে নয়। তার কামের সাফল্যের অর্থ হচ্ছে নিজের শরীরকে পুরুষের সম্ভোগের বস্তু ক’রে তোলা। তার সারা দেহ তার কাছে বিব্রতকর। প্ৰতি মাসের রক্তক্ষরণের ফলে নিজের দেহকে তার নিজের কাছে মনে হয় বিরক্তিকর। ঋতুস্রাব তার এক প্ৰতিবন্ধকতা। প্রতি মাসে তার জীবনে একটা ব্যাঘাতের মতো দেখা দেয় ওই রক্ত। এটা তার জীবনে সৃষ্টি করে বিভীষিকা, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে তার চেতনা জুড়ে। সে সন্দেহ করে নিজের দেহকেই, ভয়ে ভয়ে থাকে নিজের দেহ নিয়ে; নিজের দেহকে মনে করে অসুস্থ। যদিও ঋতুস্রাব এতো বিকল করার মতো ব্যাপার নয, তবু তার মনোজগতে এটা এমন বিকলন ঘটিযে দেয় যে তার সম্পূর্ণ মহাজগতই হয়ে ওঠে বিকল। নারী হওয়ার অস্বস্তি ধ্বংস ক’রে দেয় নারীর শরীর। তবে নারীর শরীর তার জন্যে প্রতিবন্ধকতা, কেননা চারপাশ চায় তার শরীর তার জন্যে হোক প্রতিবন্ধকতা। এমন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্যে কোনো পেশা থেকে দূরে থাকার দরকার পড়ে না। এ-সময় দু-এক দিন সে অসুস্থ থাকতে পারে, কিন্তু এটা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। এ-সময়ে অধিকাংশ নারীই তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ ক’রে থাকে। কিন্তু ধর্ম বলে সে অশুচি, সমাজ বলে সে রুগ্ন।
সমাজ নারীর জন্যে নিষিদ্ধ ক’রে রাখে। বাইরের সমস্ত কাজ। এখন দেশে দেশে নারী বাইরের অনেক কাজ করছে, তবু অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নারীর জন্যে বাইর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে-সব দেশে নারী বাইরে কাজ করতে পারছে, সেখানেও নারীর জন্যে রাখা হয় বিশেষ ধরনের কাজ। এমন কোনো কাজে নেই, যা অসম্ভব নারীর পক্ষে; কিন্তু সমাজ তাকে কাজ না দিয়ে, তার জন্যে কাজ নিষিদ্ধ করে, প্রমাণ করে সে অনুপযুক্ত বা নিকৃষ্ট। সমাজ সব দিকে তার বিকাশের পথ বন্ধ ক’রে দিয়ে প্রমাণ করে যে তার পক্ষে বিকাশ অসম্ভব। সুপরিকল্পিতভাবে সমাজ তাকে ঠেলে দেয় হীনমন্যতাগূঢ়ৈষার দিকে। মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতার কথা ধরা যাক। প্রচলিত লোকবিশ্বাস হচ্ছে যে কৈশোর থেকে মেয়েদের হ্রাস পেতে থাকে মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা। এ-লোকবিশ্বাস কি সত্য বা সত্য হ’লে কী কারণ রয়েছে। এর পেছনে? স্বীকার ক’রে নেয়া যাক যে বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এটা সত্য; কিন্তু এর কারণ কি? এর কারণ নারীর জৈবসংগঠনে খুঁজলে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে সমাজসংস্থায়। এর কারণ মেয়েদের উৎসাহ দেয়া হয় না। এসব ব্যাপারে; আগে নিষেধ করা হতো, এখন নিষেধ করা না হ’লেও তাদের অনুপ্রাণিত করা হয় না। ভাইটির জন্যে সব সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়, তার পড়াশুনোয় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে তা দেখে পিতামাতা, এমনকি বোনটিও। বোনটির কাছে আশা করা হয় না মেধা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা; সে বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি হবে এ তো আশা করাই হয় না, এমনকি সে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা হবে তাও আশা করা হয় না। তার কাছে। আশা করা হয় নারীত্ব, তার কাছে দাবি করা হয় সে হবে নারী। যে-মেয়েটি লেখাপড়া করছে, তার কাছে ভালোভাবে লেখাপড়া চাওয়া হয় না, চাওয়া হয় লেখাপড়ার সাথে সে ভালোভাবে আয়ত্ত করবে নারীর কাজগুলো। লেখাপড়া তার কোনো কাজে আসবে না, কাজে আসবে নারীর কাজগুলো। এমন প্রত্যাশা করা হয় যার কাছে, সে কী ক’রে হবে মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল? বাসার কিশোর বা তরুণ পুত্রটির পড়াশুনো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, তার জীবনে আছে প্রমোদের ব্যবস্থাও। তাকে কেউ কুটোটিও নাড়তে বলে না; কিন্তু বাসার কিশোরী বা তরুণী কন্যাটিকে করতে হয় গৃহপরিচারিকার ক্লান্তিকর কাজগুলো।
ঘরকন্নার কাজগুলো হচ্ছে সবচেয়ে ক্লান্তিকর কাজ। একই কাজের পুনরাবৃত্তি চলে তাতে সারা জীবন ভরে, আর যে জড়িয়ে পড়ে ওই কাজে তার জীবন হয় ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির পুনরাবৃত্তি। যে-তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাকে জানতে হবে চমৎকার মাছ ভাজী; যে-কিশোরী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাকে শিখতে হবে চমৎকার শেলাই। বাসার কিশোর আর তরুণটির কাছে তা আশা করা হয় না, কিন্তু কিশোরীতিরুণীর কাছে দাবি করা হয়। ছেলেটি তার বিছানা গুছিয়ে না রাখলে মা খুশি হয়, দেখতে পায় একটি পুরুষের জন্ম হচ্ছে; কিন্তু মেয়েটি বিছানা না গোছালে একটি নারীর মৃত্যু দেখে মা আতংকিত হয়ে পড়ে। এমন দাবি করা হয় যার কাছে তার পক্ষে মেধাবী, মননশীল, সৃষ্টিশীল হওয়া অসম্ভব। মা মেয়ের বড়ো শুভাখী, কিন্তু মা-ই মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেয় পারিবারিক কাজের বোঝা। এতে তার কোনো অশুভ উদ্দেশ্য নেই, খুবই শুভ তার উদ্দেশ্য; মা জানে তার মেয়ের জীবন সৃষ্টিশীলতার নয়, সমাজ তাকে ওই অধিকার দেয় নি, ওই অধিকার দিয়েছে পুত্ৰকে। সমাজের বিশ্বস্ত পুলিশের মতো কাজ করে চলে মা: এবং মেয়েটিকে বন্দী করে ফেলে। কিন্তু এ-মা-ই ছেলেটিকে দেয় স্বাধীনতা। মেধাবী মেয়েটির থেকে অনেক বেশি যত্ন নেয়া হয় নির্বোধ ছেলেটির, এবং একদিন দেখা যায় নির্বোধ ছেলেটি ছাড়িয়ে গেছে মেধাবী মেয়েটিকে। যে-কিশোরী প্রথম হয় মাধ্যমিক পরীক্ষায়, পনেরো বছর পর সেও দেখতে পায় তার থেকে অনেক সাফল্য লাভ করেছে তার সাথের সাধারণ মেধার ছেলেরা; কেননা সে ক্রমশ ছেড়ে দিয়েছে উচ্চাভিলাষ, কিন্তু ছেলেরা সমাজের প্রেরণায় ও চাপে হয়েছে উচ্চাভিলাষী। উচ্চাভিলাষের জন্যে স্বাধীনতা দরকার, কিন্তু তরুণীর জীবনে তা নেই।
সামাজিক সমস্ত প্ৰথা তরুণীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। অনেক দেশ আছে, যেখানে মেয়েদের জন্যে পথ নিষিদ্ধ, তারা পথে বেরোতে পারে না; বেরোলে নিজেদের ঢেকে রাখতে বাধ্য হয় বোরখার মধ্যযুগীয় অন্ধকারে; এবং অবরোধের অন্ধকারের মধ্যে কাটে তাদের জীবন। আরবদেশগুলো এখনো মেয়েদের ঢেকে রাখছে। এ-অন্ধকারে। বাঙলাদেশে বিশশতকের কয়েক দশক জুড়ে তারা থেকেছে অবরুদ্ধ। পিতৃতন্ত্রের মধ্যে মুসলমান পিতৃতন্ত্র রখনো হিংস্রভাবে রক্ষণশীল; ইরান-মধ্যপ্রাচ্যের তরুণীরা জানে না স্বাধীনতার একটি বিন্দুর স্বাদ কেমন [দ্র ফাতিমা (১৯৭৫, ১৯৮৪), নওঅল (১৯৮০)]। ফাতিমা মেরনিসসির বোরখা পেরিয়ে (১৯৭৫) ও মুসলমানের অবচেতনায় নারী (১৯৮৪), এবং নওঅল এল সাদাওয়ির হাওয়ার লুকোনো সুখ-এ (১৯৮০) ভয়াবহ বিবরণ মেলে মুসলমান তরুণীদের জীবনবিভীষিকার। তাদের তুলনায় বাঙালি কিশোরীতিরুণীরা অনেক স্বাধীন; তবে ওই স্বাধীনতা ছেলেদের স্বাধীনতার তুলনায় তুচ্ছ। বাঙলাদেশে মেয়েরা রাস্তায় বেরোতে পারে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার মধ্যে; তাদের বেরোনোয় কোনো নিষেধ নেই, কিন্তু পথে পথে তারা দেখে নিষেধ। পাড়ার মাস্তান তাকে দেখে শিস দেয়, মুদি মন্তব্য করে, ধার্মিকেরাও তার বুকের দিকে নির্লজের মতো তাকায়। সে একা নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া যেতে পারে না, তাকে স্বাধীনতা শিক্ষা দেয়ার জন্যে পথেঘাটে ধানখেতের আলে ওৎ পেতে আছে শিশ্নধারীরা। কিশোরীতিরুণী বাঙলাদেশে স্বাধীনতা ভোগ করে ধর্ষণকারীর উদ্যত শিশ্নের ছায়ার নিচে, তারা স্বাধীনতা ভোগ করে ক্যামুকের অ্যাসিডের ধারাপাতের বিভীষিকার নিচে। তারা রাস্তায় বেরোয় যেনো পথের দু-দিকে দেখার মতো কিছু নেই, যেনো গন্তব্য ছাড়া তারা আর কিছু জানে না। সমাজ তাদের জানিয়ে দেয় তাদের পথে বেরোনোর অনুমতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু পথের স্বাধীনতা দেয়া হয় নি। ছেলের জন্যে পথই গন্তব্য, কিন্তু কিশোরীতিরুণীর জন্যে পথ গন্তব্য নয়। তাই তাদের সব সময় চলতে হয় নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিতে, দণ্ডিত নাগরিক হিশেবে; ঘরে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বাইরে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে করে শুকিয়ে যায়। তাদের স্বতস্ফুৰ্ততা। তাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে মানসিক চাপ, সারা শরীর জুড়ে দেখা দেয় ক্লান্তি অবসাদ। তরুণী হয়ে ওঠে। ক্লান্তি অবসাদের রক্তমাংসস্তুপ।
অবসাদে পরিবৃত থাকে তরুণীর শরীর ও জীবন। তাই তরুণীরা একে অন্যকে ক্লান্ত অবসন্ন ক’রে তোলে সহজে, দুটি ক্লান্ত শরীরপ্রাণ বেশিক্ষণ পরস্পরকে সজীব রাখতে পারে না। তারা পছন্দ করে, দরকার বোধ করে তরুণের সাহচর্য। সমাজ তাদের বুঝিয়ে দেয় তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাদের বাধা দেয় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে। কিন্তু তারা পারে না। স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে, কোনো কিছুই একলা করতে পারে না, পারলেও তাদের দ্বিধা থেকে যায়। অস্বয়ংসম্পূর্ণতার অশক্তি তাদের ভেতরে বাড়িয়ে তোলে ভীরুতা, দ্বিধাগ্ৰস্ততা, যা দেখা দেয়। তাদের কাজে ও জীবনে। কামিনী রায়ের ‘করিতে পারি না কাজ/ সদা ভয় সদা লাজ / সংশয়ে সংকল্প সদা টলে’ মহিলা কবি ও কিশোরী ও তরুণীর কথা, কিশোর বা তরুণের কথা নয়। সমাজ তাদের বুঝিয়ে দেয়, তারাও মনে করে অসামান্য কোনো সাফল্য অর্জন তাদের জন্যে নয়; ওসব ছেলেদের জন্যে। তাই তারা উচ্চাভিলাষ পোষণ করতেও ভয় পায়, পরিহাব ক’রে চলে সব উচ্চাভিলাষ। তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে ছেলেরা উৎকৃষ্ট, তারা যা পারে না তা অবশ্যই পারে ছেলেরা, পারতেই হবে ছেলেদের। সমাজ ছেলেদেব ওপর বিশ্বাস করে, তরুণীরাও বিশ্বাস করে ছেলেদের সমাজ তাদের ওপর আস্থাহীন, তারাও আস্থাহীন নিজেদের ওপর। এমন আত্মবিশ্বাসহীনতা যাদের, তাদের বিকাশ অসম্ভব; তারা অবিকশিত থাকতে বাধ্য। এর পরিণতি আলস্য আর নিম্নমাঝারিত্ব, কোনো কিছু ভালোভাবে করতে না পারা। তরুণী বিশ্বাস করে সে যা পারে না, তা অবশ্যই পারে তরু%; পারতেই হবে তরুণকে। নিজে না পারার জন্যে সে অস্বস্তি বোধ করে না, কিন্তু তা যদি না পারে ছেলে তবে সে বোধ করে অস্বস্তি 1 ছেলেরা যে ছেলে। কিশোরীতিরুণীকে সমাজ দীক্ষা দিয়েছে এমন পরাজয়ী মনোভাবে। তার পরাজয়ী মানসিকতার কারণ তরুণী জানে তার ভবিষ্যৎ তার হাতে নয়; তার মনোভাব এমন যে কী হবে এতো সাধ্যসাধনা করে যেখানে তার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভর করছে অন্যের ওপর। এটা এক দিকে যেমন নিয়তির কাছে আত্মসমৰ্পণ, তেমনই প্রতিবাদও। সমাজে যেহেতু পুরুষই সব, তাই সে চায় পুরুষই তার হয়ে রক্ত বাষ্প ক’রে অর্জন করুক সাফল্য।
তরুণীর পরাজয়ী মানসিকতার মূলে নিজের নিকৃষ্টতার বোধ কাজ করে না, সে মনে করে না যে সে সহজাতভাবেই নিকৃষ্ট, বরং তার প্রতিবাদী মনোভাবই জন্ম দেয় তার এ-বোধ : তাকে যে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে, সমাজ যে চায় সে নির্ভর করবে: কোনো পুরুষের ওপর, এটা তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে; এবং সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় সাফল্যলাভের সব ইচ্ছে। তার কোনো যোগ্যতা সমাজের চোখে গুরুত্বপূর্ণ নয়, পুরুষ তাকে তার যোগ্যতার জন্যে মূল্যবান ভাবে না; তার মূল্য ততোটাই যতোটা সে হয়ে ওঠে। পুরুষেব স্বপ্লের আদলে। মেয়েরা শিখে ফেলে যে পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যে তাকে ছেড়ে দিতে হবে তার অধিকার, পুরুষ তখনই খুশি হয় যখন সে ছেড়ে দেয় নিজের সব যোগ্যতালাভের বাসনা। পুরুষ মেধাবী নারী পছন্দ করে না; তারা ভয় পায় নারীর সাহস, মেধা, যোগ্যতাকে । পুরুষের আকর্ষণ নির্বোিধ রূপসীর প্রতি, তাই তরুণীকে হয়ে উঠতে হয় নির্বোিধ, কিন্তু রূপসী । রূপই তার একমাত্র যোগ্যতা। রমণীয় হওয়ার অর্থ দুর্বল, নিরর্থক, অনুগত হওয়া। তরুণীকে চেপে রাখতে হয় তার সমস্ত স্বতস্ফুৰ্ততা, তার বদলে আয়ত্ত করতে হয় রূপ। যদি সে কোনো সক্রিয়তা দেখায়, তবে তা নষ্ট ক’রে দেয় তার নারীত্ব, তার আবেদন; অক্রিয়তাই তার সৌন্দর্য। তরুণীর ব্যক্তিসত্তা ও নারীসত্তার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি ক’রে রেখেছে সমাজ।। কৈশোর যে তার জন্যে বিশেষ সংকটের কাল, তার কারণ এতো দিন সে ছিলো স্বায়ত্তশাসিত, কিন্তু কৈশোরে পৌছে তাকে ত্যাগ করতে হয় তার স্বায়ত্তশাসন। মানুষ হিশেবে সে হয়ে উঠতে চায় সক্রিয়, স্বাধীন, প্রধান; কিন্তু সমাজ চায় সে হবে অক্রিয় সামগ্ৰী। সক্রিয় সত্তা ও অক্রিয় সামগ্ৰী হয়ে ওঠার বিরোধে কিশোরী দুলতে থাকে আশা ও ভয়, কামনা ও ঘূণার মধ্যে। নারী হওয়ার জন্যে তাকে মেনে নিতে হবে অধীনতা, করতে হবে আত্মসমর্পণ। এ-সমস্যা বিভিন্ন কিশোরীর মধ্যে সৃষ্টি করে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া। যে-বালিকা দীক্ষিত হয়ে গেছে নারী ভূমিকায়, সে সহজে মেনে নেয় অধীনতা; কিন্তু যে-বালিকা দীক্ষিত হয় নি, তার পক্ষে অধীনতা মেনে নেয়া কঠিন হয় । তবে সে এড়াতে পারে না তার সামাজিক নিয়তিকে । সে কিছুটা প্রতিবাদের সাথে স্বীকার ক’রে নেয় তার নারীত্ব। তখন সে হয়ে ওঠে অক্রিয়, হয়ে উঠতে চায় রূপসী, জাগিয়ে তোলে মেয়েলিপনা; মন দেয় রূপচর্চায়। সে তখন নিজের বিব্রতকর স্তন দুটিকে আর লুকিয়ে রাখে না, সে-দুটি নিয়ে আর অস্বস্তি বোধ করে না; সে-দুটিকে মনে করে নিজের সম্পদ, ক’রে তোলে আকর্ষণীয়। সে নিজেকে দেখতে শুরু করে আয়নায়, মুগ্ধ হতে থাকে নিজের রূপে, সে জানে তার যা মূল্য তা ওই রূপের জন্যে; নিজের শরীরে সে খোজে এক নারীকে ।
কাম মানুষের সমান বয়সী। কাম উপভোগের শক্তি তরুণীর অনেক বেশি তরুণের থেকে, কিন্তু তার উপভোগ নিষিদ্ধ; তরুণীকে তার কামবাসনা চরিতাৰ্থ করার জন্যে হয়ে উঠতে হয় শিকার । পুরুষতন্ত্র তাকে মনে করে কামসামগ্ৰী, অনেক উপভোগ্য বস্তুর মতো সেও বস্তু। তাই তরুণী বস্তু বা সামগ্ৰী হয়ে ওঠে, নিজেকে সে মনে করে বস্তু, এবং নিজের নতুন সত্তাকে দেখে বিস্ময়ের চোখে । নিজের শরীরে সে দেখতে পায় এক অচেনা শরীর; যেনো অচেনা এক নতুন দেহ দখল করেছে তার চেনা শরীরকে । নিজের শরীর তাকে বিহ্বল ক’রে তোলে, বিস্মিত হয়ে শরীরের দিকে দিকে দেখে অভাবিত বন্যা। যৌবন কোনো তরুণীকে ক্ষমা করে না, ভিখিরি বালিকার দেহকেও প্লাবিত করে নির্দয়ভাবে; যা সে চায় নি, যার মূল্য সে দিতে পারবে না তা তাকে নিতেই হয়। চিত্রাঙ্গদার মতো। হতভাগ্য খুবই কম তরুণী, তাদের দেবতার কাছে বর চাইতে হয় না: কিন্তু তারা সবাই শিউরে ওঠে চিত্রাঙ্গদার মতোই অভাবিতকে নিজের শরীরে দেখে । চিত্রাঙ্গদা নতুন শরীর পায় বর হিশেবে, সেটিকে সে নিজের মনে করে নি; নিজের শরীরে নিজের শক্রকে দেখে সে চিৎকার করে উঠেছে, ‘কোন মহাবাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া /অঙ্গসহচরী করি ছায়ার মতন।’ কিন্তু তরুণী নিজের নতুন শরীরে কোনো রাক্ষসীকে নয়, দেখে এক দেবীকে। সে তার নতুন শরীরকে আদর করে, মুগ্ধ হয় নিজের আঙুল বাহু উরুর দিকে তাকিয়ে, নিজে মোহিত হয় নিজের দু-স্তনের সৌন্দর্যে। শুরু হয় তরুণীর একলা নির্জন অন্তরঙ্গ সংগোপন দিবাস্বপ্নের কাল। দিবাস্বপ্ন কিশোরকিশোরী, তরুণতরুণী, এবং যে-কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। দিবাস্বপ্নে মানুষ সৃষ্টি করে এমন এক বাস্তবতা যা সে কোনো দিন পাবে না, পেলে হয়তো ক্ষুন্ন বোধ করবে। তরুণী নিজের সাথে নিজে কথা বলে, অজস্র স্বপ্নের মধ্যে বাস করে। সে তখন তার নিজের স্বপ্নে বিভোর, তার ওই স্বপ্ন এতো মূল্যবান যে তা প্ৰকাশ করা যাবে না। কারো কাছে, প্রকাশ করলে বাস্তবের নোংরা ছোয়ায় স্বপ্নের সোনা হয়ে উঠবে। আবর্জনা। তাই তার মধ্যে জন্মে গোপন করার প্রবণতা, সব কিছু সে গোপন করতে চায়, তার সমগ্র স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে সে পুরে ব্যাখতে চায় এক গোপন চন্দনকাঠের সিন্দুকে।
কিশোরীতিরুণীর দিবাস্বপ্ন পেরিয়ে যায় বাস্তবতার সমস্ত সীমা, ডুবে যায় সে রুগ্ন দিবাস্বপ্নে। তরুণীর দিবাস্বপ্ন হচ্ছে সে যা পায় নি, কখনো পাবে না, এমনকি কখনো পেতে চাইবে না, তার ক্ষতিপূরণ। কিন্তু দিবাস্বপ্ন কখনো বাস্তবতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না; দিবাস্বপ্ন যদি সীমা পেরিয়ে যায়, তা মানুষকে অসুস্থ ক্লান্ত করে তোলে। প্রতিটি তরুণী দিবাস্বপ্নক্কান্ত। একলা নির্জন দিবাস্বপ্ন তাকে ভরে তুলতে পারে না, স্বপ্ন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পরই সে দেখে সে পড়ে আছে বাস্তবের আবর্জনার ওপর- নিঃসঙ্গ। সে তখন খোজে বান্ধবী, নিজের একান্ত দ্বিতীয় সত্তাকে। অনেক মেয়ে পরস্পরকে দেখায় নিজেদের নগ্ন দেহ, তুলনা করে নিজেদের স্তনের, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজের, আবিষ্কার করে পরস্পরের দেহবিশ্ব। প্রতিটি মেয়ের, এবং ছেলের, মধ্যেই রয়েছে সমকামীপ্রবণতা; তরুণীর ওই প্রবণতার মূলে রয়েছে তার আত্মপ্রেম। তরুণীরা পরস্পরের শরীরে খুঁজে পায় নারীত্ব। কিন্তু তরুণী জানে সমকামী সম্পর্ক অস্থায়ী; এবং অনেক তরুণী এ-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও পায় না, অনেকে পেয়েও গ্রহণ করে না। প্রচণ্ড বিধিনিষেধের খড়গ ঝোলে তার ওপর; সমগ্র পিতৃতন্ত্র তাকে নিষেধ করে ওই সম্পর্কে যেতে। কেননা পুরুষই তার নিয়তি। তখন তার চোখে মোহনীয় হয়ে ওঠে পুরুষ। তবে পুরুষ তাকে মুগ্ধ করে, আবার সন্ত্রস্তও করে। যে-পুরুষ তাকে সন্ত্রস্ত করে, সে তাকে বাদ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে রাজপুত্রের। এখন চারদিকে রাজপুত্রের ভিড়; একালে রাজপুত্রেরা জন্মেছে সিনেমার অভিনেতা, গায়ক, খেলোয়াড় ইত্যাদি হয়ে। তরুণী তাদের স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে অন্য এলাকার কোনো বিখ্যাত পুরুষেরও। তার এ-স্বপ্ন বিশুদ্ধ স্বপ্ন, সে স্বপ্ন দেখে স্বপ্ন দেখার জন্যেই; বাস্তবে ওই পুরুষকে পাওয়ার জন্যে নয়। সে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এড়িয়ে বাস করে কল্পনায়, সে একাকার করে দেয় বাস্তবতা আর কল্পনাকে। তরুণী কামনা করতে থাকে শ্ৰেষ্ঠ পুরুষ, যার কাছে সে আত্মসমৰ্পণ করতে পারে।
আত্মপ্রেম থেকে আত্মসমৰ্পণ হচ্ছে সমকামী প্রবণতা থেকে মর্ষকামিতার জগতে প্ৰবেশ। নারী সহজাত মর্ষকামী বলে নারীকে নিন্দিত ক’রে দিয়েছেন ফ্রয়েড; তবে নারী সহজাত মর্ষকামী নয়। পুরুষেরও রয়েছে মর্ষকামিতা। পুরুষতন্ত্র নারীকে দীক্ষা দিয়েছে। মর্ষকামে, যন্ত্রণাসম্ভোগে; বাধ্য করেছে মর্ষকামে। পুরুষতন্ত্র যে-সমস্ত নারীকে প্রশংসাপত্ৰ দিয়েছে, তারা সবাই তা কিনেছে মর্মান্তিক মর্ষকামিতার মূল্যে : তারা পুরুষের জন্যে সব ত্যাগ করেছে, জীবন উৎসর্গ করেছে, অজস্র পীড়ন সহ্য করেছে, এবং পুরুষতন্ত্র তাদের স্বীকার করে নিয়েছে আদর্শ নারীকাঠামোরূপে। পুরুষতািন্ত্র তরুণীকে শিখিয়েছে। পুরুষের জন্যে দুঃখ স্বীকারই প্ৰেম, অবিরাম আত্মোৎসৰ্গই নারীত্ব। প্রেমে যে পড়ে সে-ই মর্ষকামী, তার কাজ যন্ত্রণায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। তরুণী অসংখ্য উপাখ্যানে শোনে আদর্শ প্রেমিকদের দুঃখ স্বীকারের কাহিনী, সেও মনে মনে হয়ে ওঠে এক আদর্শ প্রেমিক, যে প্রিয়তমের জন্যে সইবে অনন্ত দুঃখ। সে কল্পনা করে পিতামাতা সমাজসংসারকে অস্বীকার ক’রে সে বেরিয়ে পড়েছে প্রেমিকের হাত ধ’রে, তাদের জন্যে আর কিছু নেই, আছে শুধু প্রেম আর অবিরাম দুঃখ। সে দুঃখের পর দুঃখকে জয় করতে থাকে, প্রেমিককে রক্ষা করে সমস্ত বিপদ থেকে, এবং সুখ পায় প্রেমিকের বুকে মুখ রেখে। সে হয়ে ওঠে আরেক আদর্শ প্রেমিকা, নারী, যার নাম চিরকাল মনে রাখবে ইতিহাস। কিশোরতরুণও এমন অপরাজিত প্রেমের স্বপ্ন দেখে, তবে তার স্বপ্লটি বিপরীত; সে দেখে প্রেমিকাটি তার জন্যে সব ত্যাগ ক’রে এসেছে, তার বুকে স্থান পেয়ে ধন্য হয়েছে। কিশোর প্রেমিকেরা কিশোরী প্রেমিকার চোখে বার বার জল দেখতে চায়, জল দেখে খুব সুখ পায়; কিশোরীরাও চোখকে সমুদ্রের মতো ভরে তুলতে জানে। তরুণীকে সমাজই তৈরি করেছে মর্ষকামী ক’রে, কারণ সে নারী হবে; এবং তার জীবন হবে ধারাবাহিক মর্ষকামিতা। তার জৈব সংকেতের মধ্যে নেই এ-ব্যাধি, রয়েছে সামাজিক সংকেতে।
কাল্পনিক প্রেম থেকে বাস্তব প্রেমে যেতে ভয় পায় অনেক তরুণী; যখন স্বপ্লের পুরুষ সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সন্ত্রস্ত হয় অনেকে। তরুণী পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, চায় পুরুষের অনুরাগ, কিন্তু ধরা পড়তে চায় না। বয়ঃসন্ধির সাথে সে লজ্জা বোধ করতে শেখে, পুরুষতন্ত্র তাকে লজ্জা বোধ করতে বলে; সে লজ্জা আর ছেনালিপনাকে একাকার ক’রে দেয়। তার লজ্জা সবখানি লজ্জা নয়, তার লজ্জা হচ্ছে উল্টোনো লজ্জাহীনতা। সে চায়। তার দিকে তাকাক পুরুষ, কিন্তু তার দিকে কোনো পুরুষ তাকালে সে একই সাথে সুখ পায় ও আহত হয়। সে চায় তার সৌন্দর্যে পুরুষ মুগ্ধ হোক, কিন্তু যখন তারা তাকায় তার পায়ের দিকে, তার নিতম্বের দিকে, তার স্তনের দিকে, তখন সে লজ্জা পায়। তরুণী পুরুষের কামনা জাগিয়ে দিতে চায়, কিন্তু যখন দেখে সে কামনা জাগিয়ে দিয়েছে পুরুষের, তখন গুটিয়ে নেয় নিজেকে। সে স্পর্শ পেতে চায়, কিন্তু স্পর্শ পেলে প্রকাশ করে বিরক্তি। পৃথিবী জুড়ে তরুণীর জীবনেব মূল লক্ষ্য একটি স্বামী পাওয়া; এবং অধিকাংশ সমাজে এখনো তার জন্যে স্বামীটি সংগ্রহ করে অভিভাবকেরা। সে নিজেকে নিজের পছন্দ মতো সমৰ্পণও করতে পারে না, সমৰ্পণ করে অন্যরা। তাই তরুণী স্বাধীন সত্তা হিশেবে বিকশিত করতে পারে না নিজেকে। কোনো কোনো সমাজে তরুণী নিজের ভবিষ্যতকে নিতে পারে নিজের হাতে, তারা নিরন্তর পুরুষভাবনা থেকে মুক্তি পায়, কিন্তু অধিকাংশ সমাজে আজো তা অসম্ভব। দিন দিন তা আরো অসম্ভব ক’রে তোলা হচ্ছে। বাঙলাদেশে তার কানে যে-অশ্লীল গানটি নিয়মিত বাজানো হয়, তা হচ্ছে বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে। বিয়েতে মুক্তি নেই তরুণীর, তার মুক্তি নিজের স্বাধীন সত্তায়। কিন্তু পরিবার ও সমাজ তার সত্তা বিকাশের জন্যে উৎসাহী নয়, উৎসাহী তাকে অবিকশিত ক’রে দিতে। আমাদের সমাজের প্রায় সবাই এখন কাজ করছে কিশোরীতিরুণীর বিকাশের বিরুদ্ধে; সমাজনীতি আর রাজনীতি কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে। তারা এখন আর বিকশিত ও স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে না, দেখছে। বন্দী হওয়ার বন্দী থাকার স্বপ্ন।