What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নারী (প্রবন্ধ) (1 Viewer)

জাঁ-জাক রুশো (নারীর শত্রুমিত্ৰ)


মার্ক্স-পূর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো, যাঁর রচনা অন্তত একটি বিপ্লব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলো। সাম্যবাদী মার্ক্সের রচনায় যেমন শ্রেণীসংগ্রাম, রোম্যানটিক রুশোর রচনায় তেমনি প্রকৃতি; এবং প্রকৃতি নামক মিথ্যার শেকলে রুশো বন্দী করেছেন নারীকে। রুশো বিভিন্ন রচনায় বিচার করেছেন নারীর প্রকৃতি বা স্বভাব, শিক্ষা, ও সামাজিক-রাজনীতিক ক্ষেত্রে নারীর স্থান। নারী সম্পর্কে তাঁর আবেগতাড়িত মত পশ্চিমকে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়েছিলো, পশ্চিমের দেশেদেশে তাঁর মতকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো উগ্রভাবে, কেননা পশ্চিম রুশোর মধ্যে পেয়েছিলো এক নতুন বিধানকর্তাকে। রুশো, ফরাশি বিপ্লবের দার্শনিক, বিরোধী ছিলেন সমস্ত শৃঙ্খলের, ভাঙতে চেয়েছিলেন সমস্ত শেকল ও মূর্তি; কিন্তু নারীর জন্যে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেকগুলো শক্ত শেকল, এবং অবিনশ্বর করে রাখতে চেয়েছিলেন পিতৃতন্ত্রেব তৈরি নারীমূর্তিটি। তাঁর বিখ্যাততম উক্তি : ‘মানুষ জন্মে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’–সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য শুধু পুরুষ-মানুষের ক্ষেত্রে। ‘মানুষ’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘পুরুষ’, নারী রুশোর কাছে মানুষ ছিলো না। নারী পরাধীনভাবে জন্ম নিলেও তাঁর কোনো আপত্তি থাকতো না, খুবই সুখী বোধ করতেন। তিনি, কেননা তাহলে নারীকে সুচারুরূপে পুরুষাধীন করার জন্যে এতোগুলো বই তাকে লিখতে হতো না। নারী সম্পর্কে রুশোর দর্শনের সম্পূর্ণটাই ভ্ৰান্ত, যার সারকথা হচ্ছে: ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, এবং তাকে চিরকাল পুরুষাধীন রাখতে হবে’ বা ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, তবে কোনো নারী যদি স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়, তবে পুরুষের কাজ হচ্ছে তাকে পুরুষাধীন করা।’ মানুষ ও রুশোর জন্যে বিশেষ মর্মান্তিক যে সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক রচনা করেছিলেন নারীকে বন্দী করার দর্শন, যা বাতিল ক’রে দেয় তাঁর মূল দার্শনিক প্রতিপাদ্যকে। রুশো ছিলেন পিতৃতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত। পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নারীপুরুষের যে-বিভেদ ও চালিয়েছে যে-পীড়ন, রুশো তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। নারী ও পুরুষের জন্যে তিনি নির্দেশ করেন। সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ও বিপরীত স্থান ও ভূমিকা। তবে তিনি নারীপুরুষের ভিন্ন স্থান ও ভূমিকাকে দাবি করেছেন ধ্রুব সত্যরূপে; তাঁর মতে, নারীপুরুষের প্রথাগত স্থান ও ভূমিকা কোনো প্রথা বা সামাজিক ব্যাপার নয়, তা প্রাকৃতিক। তবে তাঁর কাছে পুরুষের জন্যে যা প্রাকৃতিক নারীর জন্যে তা প্রাকৃতিক নয়, নারীপুরুষ রুশোর দর্শনে দুই প্রকৃতির অন্তর্গত। তাই প্রকৃতির এ-দার্শনিক সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন কী প্রাকৃতিক নারীর জন্যে, আর কী প্রাকৃতিক পুরুষের জন্যে। নারীর প্রকৃতি রুশো নির্দেশ করেন নারীর ভূমিকা বা উপযোগিতা অনুসারে, অর্থাৎ নারীর যৌন ও সন্তান জন্ম দানের উদ্দেশ্য দিয়ে; আর পুরুষের প্রকৃতি নির্দেশ করেন পুরুষের চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতার অশেষ সম্ভাবনা দিয়ে। রুশোর নারী জৈবিক, পুরুষ অজৈবিক; নারী মাংস, পুরুষ দেবদূত। রুশোর নারী শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত; আর পুরুষ সৃষ্টিশীল ও মননশীল। এসব ধারণা রুশো পেয়েছেন প্রথা থেকে; এবং প্রথা থেকে পেয়েছেন নারী সম্পর্কে আরো অনেক অশীল ধারণা। পশ্চিমের পিতৃতন্ত্র যেমন নারীকে মনে করে সমস্ত অশুভর উৎস, রুশোর চোখেও নারী পৃথিবীর সমস্ত অশুভর প্রধান উৎস। নারী সম্পর্কে রুশোর সমগ্র দর্শনই ভ্ৰান্ত; তিনি তার চারপাশে যা দেখেছেন, তাকেই ধ্রুবসত্য ব’লে গণ্য করে চর্চা করেছেন দর্শনের।

রুশোর দর্শনে নারী হচ্ছে পুরুষের কামসামগ্ৰী, এবং তার স্থান পুরুষের অধীনে। নারী পুরুষের কামের তৃপ্তি যোগাবে, কিন্তু নিজে থাকবে কামবাসনাহীন। রুশোর মতে পুরুষের কাম অত্যন্ত মূল্যবান; নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের মূল্যবান কামকে চূড়ান্তরূপে পরিতৃপ্ত করা। রুশোর দর্শন হচ্ছে পুরুষ তার প্রবল কামবেগ ও প্রমোদের জন্যে চায় যে নাস্ত্রী হবে পরম কামবেদনময়ী ও চরম কামোত্তেজক; এবং একই সাথে পুরুষ আরো চায় যে নারী নিয়ন্ত্রণে রাখবে পুরুষের অনন্ত কামাবেগকে; তাই নারী হবে অযৌন ও শীতল সতী; নারীকে, একই সাথে ও শরীরে, হতে হবে তীব্ৰ কামজাগানো অগ্নিগিরি ও তুষারের মতো পরিশুদ্ধ; অতিকামময়ী ও নিষ্কাম। নারীর কাছে রুশো চান যে নারী একই সাথে পরিপূর্ণ থাকবে লােজনম সতীত্বে ও চিত্ৰতারকার প্রচণ্ড যৌনাবেদনে; নারী হবে মর্মরের মতো শুদ্ধ, আবার তীব্রতম সুরার মতো কামোদীপক, সবার জন্যে নয় শুধু স্বামীর জন্যে। একই শরীরে একই সাথে নারী হবে শুদ্ধতমা কুমারী ও বিলোল বেশ্যা। রুশো নিজে ছিলেন কামার্ত লম্পট, অনেক অবৈধ সস্তানের দায়িত্বহীন জনক, যিনি অনুরাগিণীদের গর্ভবতী ক’রে ফেলে যেতে দ্বিধা করেন নি, কিন্তু তিনিই আবার দর্শনচর্চার সময় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন সঠিক পিতৃত্বের ব্যাপারে। বারবার তিনি বলেছেন যে স্বামীদের নিশ্চিত হতে হবে তাদের স্ত্রীদের সতীত্বে, যাতে তাদের সন্তানেরা আসলেই হয় তাদের নিজেদের সন্তান। সাবধান থাকতে হবে যাতে তাদের পুকুরে মাছ না ধরে অন্য কেউ। রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে প্রস্তাব করেছেন ভিন্ন নৈতিকতা। নারীদের সতী রাখার জন্যে আবদ্ধ ক’রে রাখতে চেয়েছেন বাড়িতে, যাতে নারীরা অন্য পুরুষের সংসর্গে এসে হারিয়ে না ফেলে তাদের সতীত্বের হীরের টুকরোটি। রুশোর কাছে সতীই শ্রেষ্ঠ নারী; সতীত্ব ছাড়া নারীর আর কোনো গুণ থাকতে পারে না। সাম্য ও মুক্তির এ-দার্শনিক নারীপুরুষকে এক মানদণ্ডে বিচার করেন নি, এটা বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক। রুশো বিখ্যাত মূর্তিভগ্নকারীরূপে, কিন্তু নারীর ব্যাপারে তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের চূড়ামণি।

রুশো নারীর বিরুদ্ধে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত চক্রান্তকে, নারীর অধীন অবস্থা ও পীড়নকে, শুধু প্রথা হিশেবেই মানেন নি, একেই তিনি মনে করেছেন সত্য বা ধ্রুব। রুশো অবশ্য পিতৃতন্ত্র, পরিবার ও রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রক্রিয়া ঠিকমতো বোঝেন নি; রোম্যানটিক হিশেবে তিনি যা কল্পনা করেছেন, যা তাঁর আবেগকে তৃপ্ত করেছে, তাকেই তিনি ধ্রুব বা প্রাকৃতিক বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে পুরুষাধিপত্য ও নারীর অধীনতা একান্তভাবেই প্রাকৃতিক। তিনি বিশ্বাস করেন পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও আইনে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তা মানুষের সৃষ্টি নয়; তা শাশ্বত, প্রাকৃতিক, এবং যুক্তিসঙ্গত। রুশো মনে করেন প্রকৃতিই নারীপুরুষকে ভিন্ন ক’রে সৃষ্টি করেছে, পুরুষকে দিয়েছে যুক্তি ও শক্তি, নারীকে দিয়েছে রূপ; পুরুষ যে কামে সাহসী আর নারী লাজনাম, তা স্থির ক’রে দিয়েছে প্রকৃতিই। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শব্দ দুটি পুরোনো কাল থেকেই বারবার ব্যবস্তৃত হয়েছে নারীর অধীন অবস্থাকে শোভন ও গ্রহণযোগ্য, এবং নারীকে বশীভূত করার জন্যে। রুশো, রোম্যানটিকতার পুরোধা, পুরোধা ছিলেন প্রকৃতিতত্ত্বের। নারী অক্রিয়, অধীন, সতী, যুক্তিরহিত, স্পর্শকাতর, লাজুক, ছলনাময়ী, ও আরো বহু কিছু; একথা পুরুষতন্ত্র রটাচ্ছে অনেক শতাব্দী ধ’রে; আর রুশো এগুলোকে ক’রে তোলেন তাঁর দার্শনিকতার ভিত্তি। নারীর এ-বৈশিষ্ট্যগুলো যে বিশেষ সামাজিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি, তা না মেনে বা না বুঝে রুশো। ধ’রে নিয়েছেন যে প্রকৃতিই নারীকে নির্ভুলভাবে সাজিয়ে দিয়েছে এসব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে। রুশো প্রকৃতিকে ব্যবহার করে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছেন নারীর পুরুষাধীন শেকলপারা অবস্থা। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় ‘প্রকৃতি, প্রকৃতি, এবং প্রকৃতি’, এবং ‘প্রকৃতি কখনো মিথ্যা বলে না’র মতো ধ্রুবপদ। যা কিছু রুশো যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি বা চান নি, তাতেই সহায়তা নিয়েছেন তিনি প্রকৃতি নামক অবৈজ্ঞানিকতার। প্রকৃতি রুশোর ও রোম্যানটিকদের একটি বড়ো কুসংস্কার; ওই কুসংস্কারের মন্দিরে রুশো বলি দিয়েছেন নারীদের। নারী সম্পর্কে রুশোর ধারণা দু-শো বছর আগেই বাতিল করে দিয়েছিলেন নারীবাদের প্রথম পুরোহিত, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌, তাঁর ‘এ ভিনডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান’ (১৭৯২, পঞ্চম পরিচ্ছেদ) গ্রন্থে।

নারীর প্রকৃতি, ভূমিকা, অবস্থা, শিক্ষা প্রভৃতি নির্দেশ ও ব্যাখ্যা করার জন্যে রুশো লিখেছেন একটি উপন্যাস : জুলি বা ল্য নোভেল এলোইজ (১৭৬১) ও একটি উপন্যাসসন্দর্ভ এমিল বা শিক্ষা (১৭৬২) , এবং নানা সন্দর্ভ। রুশো সভ্যতাবিরোধী, কেননা সভ্যতা নষ্ট করে মানুষকে। এমিল-এর (খণ্ড ১, ৫) শুরুতেই রুশো বলেছেন, ‘বিধাতা সব কিছু সৃষ্টি করে শুভরূপে; মানুষ তাতে হাত দেয়। আর সে-সব হয়ে ওঠে অশুভ।’ তার কাছে শুভ হচ্ছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক থাকা; রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন মানুষ, ক্রীতদাস, এমনকি কুকুর, আর ঘোড়ার মুক্তির জন্যে, শুধু নারীকে ছাড়া। তিনি নারীর অধীন অবস্থাকে স্থায়ী করার জন্যে এসব রচনা জুড়ে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতিকে। তিনি নারীকে ক’রে তুলতে চেয়েছেন প্রাকৃতিক নারী, আর পুরুষকে প্রাকৃতিক পুরুষ; কিন্তু পুরুষকে প্রাকৃতিক করার জন্যে যে-রীতি অবলম্বন করেছেন নারীকে প্রাকৃতিক করার জন্যে অবলম্বন করেছেন তার বিপরীত রীতি। নারীকে প্রাকৃতিক করার নামে তিনি করেছেন পুরুষের দাসী। তাঁর এমিল উপন্যাসসন্দর্ভের নায়ক এমিল, আর নায়িকা সোফি, যাদের তিনি দূষিত পৃথিবীর ছোঁয়াচ থেকে বাঁচিয়ে ক’রে তুলতে চেয়েছের প্রাকৃতিক নরনারী। কিন্তু তাদের তিনি দিয়েছেন সম্পূর্ণ বিপরীত শিক্ষা। এ-উপন্যাসে মানুষরূপে বিকশিত করা হয়েছে এমিলকে, যে হবে স্বামী; আর নারীরূপে তৈরি করা হয়েছে সোফিকে, যে হবে প্রাকৃতিক পুরুষের অধীনস্থ প্রাকৃতিক স্ত্রী। এমিলকে শেখানো হয়েছে যে ‘পিতৃতান্ত্রিক পল্পীজীবনই মানুষের আসল জীবন, যা সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ আর সবচেয়ে প্রাকৃতিক’; আর সোফিকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে : ‘যখন এমিল তোমার স্বামী হবে, তখন সে হবে তোমার প্রভু; প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে যে তুমি অনুগত থাকবে তার’ [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৪)]। রুশোর কাছে নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক ও ধ্রুব (এমিল, ৫:৩২৪) :

‘নারীপুরুষের আপেক্ষিক দায়িত্ব এক নয়, ও এক হতে পারে না। যখন নারী তার ওপর পুরুষের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় অসাম্য সম্পর্কে অভিযোগ করে, তখন নারী ভুল কবে; এ-অসাম্য কোনো মানবিক প্ৰথা নয়, অন্তত এটা কোনো কুসংস্কারের ক্রিয়া নয়, বরং যুক্তিরই ক্রিয়া : যে-লিঙ্গের ওপর প্রকৃতি ভার দিয়েছে সন্তান ধারণের, সে-লিঙ্গ অবশ্যই সে-জন্যে জবাবদিহি করবে। অন্য লিঙ্গের কাছে।‘

স্ত্রীকে হ’তে হবে নিখুঁত সতী, কেননা সে স্বামীর সন্তান ধারণ করে গর্ভে; তবে, রুশোর মতে, স্বামীকে সৎ হওয়ার বিশেষ দরকার নেই। পুরুষকে একশো ভাগ নিশ্চিত হতে হবে তার নারীর গর্ভে জন্মেছে যে-সন্তান, যে হবে তার উত্তরাধিকারী, সে আর কারো নয়, তার। রুশো কাকের বাসায় কোকিলের বাচ্চা সহ্য করেন না। এ-কারণে রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে স্থির করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন নৈতিকতা ও নৈতিক শিক্ষা।

রুশো তাঁর প্রাকৃতিক নারী শনাক্ত করার জন্যে জোর দিয়েছেন লিঙ্গ বা কামের ওপর। এমিল-এ (৫,৩২১) সোফির শিক্ষা সম্পর্কে রুশো বলেছেন, ‘তার লিঙ্গ ছাড়া, নারী হচ্ছে পুরুষ; তার আছে একই প্রত্যঙ্গ, একই প্রয়োজন, একই গুণ’; এবং একটু পরেই রুশো বলেছেন, ‘তবে যেখানে কাম বা লিঙ্গ জড়িত, সেখানে পুরুষ ও নারী ভিন্ন; তারা পরস্পরের পরিপূরক।’ রুশোর কাছে নারী হচ্ছে নিজের লিঙ্গনিয়ন্ত্রিত; এবং তাঁর মতে, ‘একটি খাটি নারী ও একটি খাটি পুরুষের মধ্যে মুখে যতোখানি মিল রয়েছে মনেও তার চেয়ে একটুকুও বেশি মিল নেই।’ (এমিল ৫:৩২২)। রুশো প্রথম দিকে, অসাম্য সম্পর্কে প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫), মনে করেছেন যে সঙ্গম একটি সহজাত দরকারি ক্রিয়া, যাতে নারীপুরুষ অংশ নেয় স্বাধীনভাবে; কিন্তু পরে কাম উপভোগ রাখেন তিনি পুরুষের জন্যে, নারীকে দেন পুরুষের কাম পরিতৃপ্ত করার দায়িত্ব। পুরুষ হয়ে ওঠে আক্রমণকারী, নারী আক্রান্ত। তবে নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষের কাম জাগিয়ে তোলা, তাকে আক্রমণকারী ক’রে তোলা; তাই নারীকে হতে হবে পুরুষের কাছে আবেদনময়ী; নারীকে হ’তে হবে লাজনম্র সতী, কিন্তু তার থাকতে হবে সুখকর ছেনালিপনা। কারণ পুরুষ সতী চায়, আবার নারীর ছলাকলা না থাকলে পুরুষ উদ্দীপ্ত হয় না। রুশো প্রকৃতির দোহাই দিয়েছেন, কিন্তু আসলে তিনি প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে প্রাকৃতিক ব’লে মনে করেছেন তাঁর সময়ের ফরাশিদের কামাচরণকে। নারীকে সতী হতে হবে, তবে তা নারীর নিজের জন্যে নয়; পুরুষের কাম জাগানোর জন্যে, কেননা নারীর ‘সতীত্ব প্রজ্জ্বলিত করে পুরুষদের’। রুশোর মতে নারীকে তৃপ্ত করা পুরুষের কাজ নয়, তবে ‘নারীকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে পুরুষের প্রমোদের জন্যে’ (এমিল, ৫:৩২২)। রুশো প্রকৃতিকে পরিণত করেছেন ছেনাল পতিতায়। নারী পুরুষের কাম জাগাবে, পুরুষের কামকে পরমভাবে পরিতৃপ্ত করবে, আবার নারীকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অতিকামে পুরুষ ধ্বংস হয়ে না যায়। কেননা তাতে- ‘ধ্বংস হয়ে যাবে উভয়েই, আর মানবজাতি লুপ্ত হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা’ (এমিল, ৫:৩২২)। নারীকে দিয়েছেন রুশো দুটি বিপরীত দায়িত্ব : নারী হবে উর্বশী ও সীতা; নারী প্রলুব্ধ করবে পুরুষকে, আবার নিবৃত্ত করবে তাকে; নারী হবে কামোদীপক, রূপসী, সংরাগপূর্ণ, আবার হবে সুচারু সতী–এক দেহে মেরি ও মেরেলিন মনরো।

রুশোর মতে পুরুষের জীবনে তার লিঙ্গের প্রভাব কম, আর নারীর সম্পূর্ণ জীবনই তার লিঙ্গের পরিণতি; অর্থাৎ পুরুষ হচ্ছে মানুষ, কিন্তু নারী সব সময়ই নারী। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২৪): ‘পুরুষ কখনো কখনো পুরুষ, নারী সব সময়ই নারী, অন্তত তার যৌবনকাল ভ’রেই নারী; তার সব কিছুই মনে করিয়ে দেয় তার লিঙ্গকে।’ তার মতে সন্তানধারণই হচ্ছে নারীর ‘প্রকৃত কর্তব্য’। তাই নারীকে শিক্ষা দিতে হবে। এমনভাবে, যাতে ‘নারী পরিতৃপ্ত করতে পারে পুরুষকে ও অধীনে থাকতে পারে পুরুষের’; কেননা ‘প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের।‘ রুশো প্রকৃতির কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন প্রতারণারূপে; তাঁর নারদর্শনে প্রাকৃতিক কিছু নেই. এর সবটাই পিতৃতান্ত্রিক। রুশো পিতৃতন্ত্রকেই মনে করেছিলেন প্রকৃতি, যদিও তা একটি সুপরিকল্পিত শোষণমূলক ব্যবস্থা। রুশোর অনেক আগে প্লাতো নারীপুরুষকে দিতে চেয়েছিলেন একই শিক্ষা; রুশো তার প্রতিবাদ করেছেন। নায়িকা জুলিকে দিয়ে রুশো বলিয়েছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১১৮)]; ‘আক্রমণ ও প্রতিরোধ, পুরুষের সাহস আর নারীর লাজনম্রতা, তোমাদের দার্শনিকেরা যেমন ভাবেন তেমন প্রথা নয়, এগুলো প্রাকৃতিক ব্যাপার। এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় সহজেই, এবং এগুলো থেকে বের করা যায় আর সমস্ত নৈতিক ভিন্নতা।’ তাই রুশো এমিল-এর নায়ক এমিলের জন্যে উদ্ভাবন করেছেন এক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা, আর নায়িকা সোফির জন্যে আরেক রকম প্রাকৃতিক শিক্ষা। সোফিকে তৈরি করেছেন তিনি পুরুষের কামসামগ্ৰী, পতির অনুগত সতী স্ত্রী ও সন্তানবৎসল মাতারূপে। এমিলকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে স্বাধীন পুরুষরূপে বিকশিত হওয়ার, সোফিকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে এমিলের নারী হওয়ার : এ হচ্ছে রুশোর প্রকৃতির নির্দেশ। রুশো পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁর ‘প্রাকৃতিক নারী’র অবস্থান নির্দেশ করেছেন। পুরুষের পদতলে (এমিল, ৫:৩২৮) :

‘নারীপুরুষ সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরের জন্যে, তবে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা সমান নয় : পুরুষ নারীর ওপব নির্ভরশীল তার কামনার জন্যে; নারী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল তার কামনা ও প্রয়োজন দুয়েরই জন্যে; পুরুষ নারী ছাড়া চমৎকার চলতে পারে। কিন্তু নারী পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। পুরুষের সাহায্য, সদিচ্ছা, শ্রদ্ধা ছাড়া নারী তার জীবনের লক্ষ্য পূর্ণ করতে পারে না; তারা আমাদের অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল, তা নির্ভর করে আমাদের কাছে তাদের যোগ্যতা, তাদের রূপ আর সতীত্ব কতোটা মূল্যবান বলে মনে হয়, তার ওপর। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে নারীরা, তাদের নিজেদের ও তাদের সন্তানদের জন্যে, পুরুষের বিচারবিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।‘

রুশো শোষণমূলক পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে প্রাকৃতিক মনে ক’রে নারীর জন্যে এমন দর্শন ও ব্যবস্থা রচনা করেছিলেন, যা মানুষ সম্পর্কে তাঁর দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। রুশো ঘেন্না করতেন তাঁর সময়ের পুরুষদের, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের সহজাত অনন্ত শক্তিতে; মনে করতেন প্রতিবেশ ও শিক্ষার দোষেই বিকাশ ঘটতে পারছে না তাদের শক্তির। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীও রয়েছে পুরুষের নষ্টের মূলে; নারী কাম দিয়ে নষ্ট করছে পুরুষদের। নারীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়েই পুরুষ ব্যর্থ হচ্ছে মহান সব অর্জনে, হারাচ্ছে জ্যোতির্ময় পৌরুষ ও প্রতিভা!

রুশো নারীর বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা তৈরি করেছেন এমিল-এ (৫:৩৩২-৩৪৫), এবং দাবি করেছেন নারীর ওই সব বৈশিষ্ট্য সহজাত। লজ্জা, নমতা, সাজসজ্জা ও অলঙ্কারপ্রিয়তা, অন্যদের খুশি করার স্বভাব, বিনয়, চতুরতা রুশোর মতে নারীর সহজাত; এমনকি অন্যায় সহ্য করারও নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। রুশো মনে করেন দাসীত্ব নারীর জন্যে প্রাকৃতিক; এবং এসব থাকলেই নারী হয়ে ওঠে খাঁটি নারী! রুশোর মতে, নারীকে যেহেতু পুরুষের অনুগত থাকতে হবে, এমনকি অবিচার সহ্য ক’রে বাঁচতে হবে, তাই নারীর থাকা দরকার সহজাত মাধুর্য। নারীর যে রয়েছে মেধা, রুশো তা স্বীকারই করেন না। তিনি বলেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১২৯)], ‘নারী সাধারণত কোনো শিল্পকলা পছন্দ করে না, সেগুলোর কিছু জানে না, এবং তাদের কোনো প্রতিভা নেই। যে-সমস্ত তুচ্ছ কাজে লাগে ত্বরিৎ বোধ, রুচি, শোভা, কখনো কখনো লাগে সামান্য দর্শন ও যুক্তি, সেগুলো তারা পারে। কিন্তু তাদের নেই প্ৰতিভার অলৌকিক শিখা’। রুশোর নারীর কোনো মেধা নেই, সে কামসামগ্ৰী; নারী হবে স্ত্রী ও মা, তাই তার থাকতে হবে মেধা ছাড়া সমস্ত মেয়েলি গুণ। নারীর মেধাহীনতা সম্পর্কে রুশোর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য পুরোপুরি উদ্ধৃত ক’রে, একবার ‘কী ছাইপাশ’ ব’লে, রুশোকে বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ (১৭৯২, ১২৪, ও পঞ্চম পরিচ্ছেদ)। নারীর মেধাশূন্যতা সম্পর্কে রুশোর সারকথা (এমিল, ৫: ৩৪৯-৩৫০) :

‘বিমূর্ত ও প্রকল্পনিক সত্য অনুসন্ধান, বিজ্ঞানের নীতি ও সূত্র উদঘাটন, যা কিছুতে দরকার পড়ে চিন্তার সাধারণীকরণ, তা নারীর আয়ত্তের বাইরে; তাদের বিদ্যা হবে ব্যবহারিক, তাদের কাজ হচ্ছে পুরুষের আবিষ্কৃত সুত্র প্রয়োগ করা, এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সে-সব পর্যবেক্ষণ করা, যা ভিত্তি ক’রে পুরুষ রচনা করবে সাধারণ সূত্র। নারীর সমস্ত ভাবনা চলবে পুরুষকে ঘিরে, এবং তারা আয়ত্ত করার করার চেষ্টা করবে সে-সব সুখকর সাফল্য, যা সুন্দর; কেননা প্ৰতিভার কাজ তাদের আয়ত্তের বাইরে। তাদের নেই বিজ্ঞানে সফল হওয়ার মতো যথেষ্ট যথাযথতা বা মনোযোগশক্তি, আর পদার্থবিদ্যায় সফল হতে পাবে তারাই, যারা সক্রিয়তম, চবম অনুসন্ধিৎসু, যারা অনুধাবন করতে পারে বিচিত্র ধরনের বস্তু, এটা তাদের এলাকা, যাদের রয়েছে। তীব্ৰতম শক্তি, যারা ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য সত্তা ও প্রকৃতির নিয়মের সম্পর্ক বিচাবের জন্যে চরমভাবে প্রয়োগ করে তাদের শক্তি। নারী প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল,এবং নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারে না।… নারীর আছে বোধশক্তি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী পর্যবেক্ষণ করে, পুরুষ প্রয়োগ করে যুক্তি।’

রুশোর মতে, ‘চিন্তার ব্যাপারটি নারীদের অচেনা নয়, তবে তাদের উচিত যুক্তির ওপরে শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া’; তাই রুশোর কাছে নারীর মানসিক শক্তির কোনো মূল্য নেই। রুশোর বিধান হচ্ছে নারীকে শরীর-মনে হ’তে হবে তাই, পুরুষ তাকে যা হওয়াতে চায় : নারী হবে পুরুষের সহচরী বা সহকারী বা রক্ষিতা। গবেষণাগারে পুরুষ হবে বৈজ্ঞানিক, আর নারী, বড়োজোর, হবে তার গবেষণা সহকারী।

নারী স্বায়ত্তশাসিত নয়, নারীর কোনো দরকার ছিলো না, পুরুষ আছে বলেই নারী দরকার। বাইবেলের বিধাতা ও রুশোর মধ্যে রয়েছে সুন্দর মিল; বিধাতা স্বর্গে একটি পুরুষ সৃষ্টির পর তার সহচরী বা পত্নীরূপে সৃষ্টি করে একটি নারী। রুশোও এমিলকে সৃষ্টি করার পর, বইয়ের চারখণ্ড জুড়ে তাকে বিকশিত ক’রে, পঞ্চম খণ্ডে এসে এমিলের জন্যে সৃষ্টি করেন একটি নারী, যার নাম সোফি। এমিল-এর পঞ্চম খণ্ডের নাম ‘সোফি, বা নারী’। এ-খণ্ডের (৫:৩২১) শুরুতেই বিধাতার স্বরে রুশো বলেন, ‘পুরুষের একলা থাকা ভালো নয়। এমিল এখন পুরুষ, এবং তাকে আমাদের দিতে হবে তার প্রতিশ্রুত পত্নী [হেল্‌প্‌মিট : সহচরী]। সে-পত্নী হচ্ছে সোফি।’ রুশো নারীকে দেখেছেন। পুরুষের পত্নী বা সহকারী-সহচরীরূপে, নারীকে হতে হবে এই অন্য কিছু হওয়া নারীর জন্যে অশুভ। রুশো তাঁর জুলি বা ল্য নভেল এলোইজ-এর নায়িকা জুলিকে করেছেন নিজের কণ্ঠস্বর; ওই নারী তার প্রেমিককে উচ্চকণ্ঠে জানায় যে নারীপুরুষের সমশিক্ষা সম্বন্ধে প্লাতো যা বলে গেছেন, তা ভুল; কারণ প্রকৃতির উদ্দেশ্য” ও ‘স্রষ্টার অভিলাষ’ থেকে স্পষ্ট যে নারীপুরুষ একধরনের নয় [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৩২)]। প্রকৃতি আর স্রষ্টা নারীর নিয়তিই করেছে মাতৃত্ব, সন্তানলালন ও ঘরকন্ন; পুরুষের জন্যে রেখেছে বাইরের জগতের সাফল্য; তাই ‘এক লিঙ্গের আরেক লিঙ্গকে অনুকরণ করা চরম নির্বুদ্ধিতা’। রুশোর কোনো উৎসাহ ছিলো না নারীর শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে; তিনি চেয়েছেন নারীকে পুরুষের অধীনে পুরুষের পরিপূরক ক’রে গড়ে তুলতে। বালিকাদের মধ্যে তিনি মাঝেমাঝে পরিচয় পেয়েছেন বুদ্ধির, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে বালিকাদের ওই বুদ্ধিটুকু বিধাতা দিয়েছেন তাদের সতীত্বের দামি রত্নটিকে রক্ষা করার জন্যে। জুলি বলেছে, নারীর রয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সম্পদ, যার নাম সতীত্ব, আর তাদের বুদ্ধি দরকার শুধু ওই সম্পদটিকে রক্ষার জন্যে। রুশোর কাছে নারীপুরুষ, নৈতিক ও মননগতভাবে, পরস্পরের পরিপূরক; একা তারা অসম্পূর্ণ, কিন্তু একত্রে তারা গড়ে তোলে এক সম্পূর্ণ সুষম সত্তা। নারীর আছে সামান্য স্ত্রীবুদ্ধি, পুরুষের আছে প্রতিভা; নারী শুধু দেখে, পুরুষ রচনা করে আভ্যন্তর সূত্র। রুশোর মতে, নারীপুরুষ পরস্পরের পরিপূরক না হ’লে বিয়ে ব্যাপারটি হবে বিপদসঙ্কুল, এবং বিপদগ্ৰস্ত হবে সামাজিক স্থায়িত্ব। পরিপূরক শব্দটি বেশ প্রতারক; নারী ও পুরুষ ঠিক তেমন পরিপূরক পরস্পরের যেমন পরিপূরক প্ৰভু ও দাস, ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্ৰ।

রুশো নারী ও পুরুষের জন্যে দু-রকম শিক্ষার প্রস্তাব করেছেন। পুরুষকে দিয়েছেন তিনি এমন শিক্ষা, যাতে সে হয়ে ওঠে নাগরিক বা স্বাধীন-প্ৰাকৃতিক মানুষ, আর নারীকে দিয়েছেন এমন শিক্ষা, যাতে নারী স্বাধীন বা প্রাকৃতিক হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে পুরুষের অনুগত স্ত্রী। তাকে শেখাতে হবে লােজনম্রতা, গৃহপালন, আর প্রথার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ বেড়ে ওঠে মুক্ত মানুষরূপে, নারী বেড়ে ওঠে নিয়ন্ত্রিতভাবে, তার জীবনের উদেশ্য অনুসারে। তাই এমিল বেড়ে উঠেছে তার মাতারূপে। রুশো নারীর জন্যে প্রস্তাব করেছেন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত উপযোগিতামূলক শিক্ষা, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয় (এমিল : ৫ ) :

‘নারীর সমস্ত শিক্ষা হবে পুরুষের আপেক্ষিক। তাদের খুশি করা, তাদের কাছে উপকারী হওয়া, তাদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হওয়া, শিশুকালে তাদের লালন করা, বয়স্ককালে তাদের যত্ন করা, তাদের পরামর্শ ও সান্ত্বনা দেয়া, তাদের জীবনকে মধুর ও সুন্দর করা হচ্ছে নারীর সব সময়ের দায়িত্ব, এবং শিশুকালেই তাদের এসব শেখাতে হবে। এ-নীতি আমরা যতোটা অমান্য করবো, ততোটা বিচ্যুত হবো। আমাদেব লক্ষ্য থেকে, এবং এছাড়া আর যে-শিক্ষাই নারীদের দেয়া হোক-না-কেনো, তা তাদের বা আমাদের জন্যে সুখের হবে না।’

তাই নারীকে কোনো মননগত শিক্ষা দেয়া যাবে না, তাদের দিতে হবে নারীশিক্ষা। নারী মেনে চলবে স্বামীর অধীনতা, লালন করবে সন্তানদের। সতী নারী থাকবে কোথায়? রুশোর উত্তর হচ্ছে, নারী জীবন কাটাবে অবরোধের মধ্যে। রুশোর মতে, ‘সম্পূর্ণ অবরোধ ও গৃহিণীপনার মধ্যে জীবন কাটানোই নারীর জন্যে প্রকৃতি ও যুক্তির বিধান’। পেরিক্লেসের আদর্শে তিনি আস্থা পোষণ করেন যে সেই উৎকৃষ্ট নারী, যার সম্পর্কে কেউ কখনো কোনো কথা বলে না। রুশো শিক্ষা দিয়ে নারীকে অভ্যস্ত ক’রে তুলতে চেয়েছেন অধীনতার মধ্যে বাস করতে। এ-উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেছেন মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়াশীল বিধান (এমিল, ৫:৩৩৩) :

‘নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ নারীর মধ্যে সৃষ্টি করে একরকম বশমানা ভাব, যা নারীর দরকার সারা জীবনভর, কেননা সে সারা জীবন থাকবে পুরুষের অধীনে, বা পুরুষের বিচারবিবেচনার অধীনে, এবং সে কখনো পুরুষের মতের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না নিজের মত। নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার ভদ্রতা; নারী তৈরি হয়েছে পুরুষ নামক এমন এক ক্রুটিপূর্ণ, এমন এক দুশ্চরিত্র ও ভ্ৰান্তিপূর্ণ প্রাণীর কাছে অনুগত থাকার জন্যে যে নারীকে শিশুকালেই শিখতে হবে অন্যায়ের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে এবং বিনাপ্রতিবাদে স্বামীর সমস্ত অন্যায় সহ্য করতে।‘

অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মন্ত্রণামূলক দর্শন রচনা করেছেন যে-দার্শনিক, তিনি নারীর জন্যে বিধান তৈরি করেছেন। পুরুষের অধীনে থাকার, অন্যায়ে অভ্যস্ত হওয়ার। তবে রুশো বিপদে পড়েছেন তার নারী নিয়ে। নারীকে তিনি একই দেহে করতে চেয়েছেন কামোদ্দীপক যৌনসামগ্ৰী ও পরম সতী; কিন্তু দেখেছেন এমন নারী তাঁর প্রাকৃতিক পুরুষের প্রাত্যহিক সাথী হ’তে পারে না। রুশোর প্রাকৃতিক পুরুষ ও আবেদনময়ী সতীর নিয়তি হচ্ছে অধিকাংশ সময় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা!

রুশোর প্রাকৃতিক নারী প্রাকৃতিক নয়, বানানো; রুশোর নারী পুরুষতন্ত্রের কলে উৎপাদিত সবচেয়ে আকর্ষণীয় সামগ্ৰী। রুশো প্ৰবক্তা সাম্যমুক্তির; তবে তাঁর দর্শনে সাম্যমুক্তির মতো মানবিক ব্যাপারগুলো পুরুষের জন্যে, নারীর জন্যে নয়। মানুষের অসাম্যে ক্ষুব্ধ রুশো উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন এমন সামাজিক-রাজনীতিক পদ্ধতি, যাতে দূর হবে মানুষের অসাম্য। রুশো অবশ্য বৈজ্ঞানিকের বস্তুনিষ্ঠ চোখে, মার্ক্সের মতো, অসাম্যকে দেখেন নি, দেখেছেন ব্যক্তিগত মন্ময় দৃষ্টিতে; অসাম্য সম্পর্কে তাঁর ঘৃণা জন্মেছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। রুশো অসামাবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) দেখিয়েছেন কীভাবে আদিম স্বাধীন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণের ফলে সমাজে উৎপত্তি ঘটে অসাম্যের। রুশো বলেছেন [ দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪২)] :

‘অগণন মানুষ বলি হবে মুষ্টিমেয়র কাছে, আর সাধারণের সুবিধা বলি হবে ব্যক্তিগত সুবিধার কাছে। সুবিচার ও অধীনতার মতো আপাতসুন্দর শব্দগুলো সবসময় কাজ করবে সন্ত্রাসের উপকরণ ওঅবিচারের অন্ত্ররূপে; এভাবে উচ্চশ্রেণীগুলো, যারা নিজেদের পাবি করে অন্যদের জন্যে উপকারী ব’লে, আসলে অন্যদের শুষে সেবা করছে নিজেদের।‘

রুশোর মতে বেশি শক্তি বা সম্পদ কাউকে বৈধ অধিকার দিতে পারে না। তাঁর বিশ্বাস প্রকৃতি একজনকে দেয় নি অন্যের ওপর প্রভুত্বের অধিকার, এবং কেউই বলপ্রয়োগে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। রাজনীতিক আধিপত্যের সমস্যাটির বৈধ সমাধান হতে পারে শুধু সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে, যাতে মানুষের অভিলাষ হয়ে ওঠে। সার্বভৌম। এমন চুক্তি ছাড়া রাজনীতিক ব্যবস্থা হয় ‘উদ্ভট, স্বৈরাচারী’। রুশো পুরুষের জন্যে চান সার্বভৌম অভিলাষ, কিন্তু নারীকে রাখেন পুরুষের উদ্ভট স্বৈরাচারের অধীনে।

রুশো বিশ্বাস করেন সব পুরুষের অসীম সম্ভাবনায়; তিনি মনে করেন সুযোগ পেলে ভূমিদাসও ভূষিত হতে পারে জমিদারের সমস্ত গুণে। রুশোর কাছে ক্রীতদাসত্ব সম্পূর্ণ অবৈধ; কেননা ক্রীতদাসত্ব মনুষ্যত্বের অবমাননা; এতে একটি মানুষ নিজের জীবন, স্বাধীনতা, অধিকার সমর্পণ করে আরেকটি মানুষের কাছে। প্রকৃতি মানুষের এমন স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার বিরোধী। কিন্তু সাম্যমুক্তির এ-প্রচণ্ড প্রবক্তা নারীর ক্ষেত্রে ভুলে যান সাম্যমুক্তির কথা; তিনি সাম্যমুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান নারীকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে। তিনি নারীর ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ করেন অসাম্য ও অধীনতা। রুশোর মতে, নারী অধীনে থাকবে পুরুষের, আর পুরুষকে বশে রাখার জন্যে ব্যবহার করে যাবে তার রূপ, বুদ্ধি, বোধি; এর সাহায্যেই নারী ক্ষতিপূরণ করে নেবে নিজের অসাম্য ও অধীনতার। রুশোর কাছে পুরুষ শক্তিমান আর নারী পুরুষের অধীন, এ হচ্ছে ধ্রুব সত্য; নারী জীবনযাপন করবে। এ-সত্য মেনে নিয়ে রুশোর চিন্তায় নারীর রাজনীতিক অধিকারের কথাই ওঠে নি; নারীর ভোটাধিকারের কথা তিনি ভাবেন নি। ‘জেনেভার মধুর ও সতী নারীদের’ তিনি বলেছেন যে তাদের নিয়তি হচ্ছে পুরুষদের শাসন করা, অর্থাৎ তারা প্রভাব বিস্তার করবে স্বামীদের মাধ্যমে। রুশোর রাজ্যে পুরুষ রাজা শাসন করবে, আর রাজাকে নিজের ‘সতীত্বের শক্তি’তে শাসন করবে নারী! নারী সতী আর অনুগত হয়ে পুরুষের ওপর বিস্তার করবে। ‘আনুগত্যমূলক আধিপত্য’! এই হচ্ছে নারীর রাজনীতিক অধিকার। শুধু রাষ্ট্রে নয়, রুশোর বিধানে পরিবারের মধ্যেও নারীর কোনো কর্তৃত্ব নেই, স্বামীই পরিবারের প্রভু। রুশোর কাছে পরিবার একটি প্রাকৃতিক সংস্থা, তার প্রাকৃতিক প্ৰভু স্বামী। রুশো বলেছেন [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৪৬), ‘প্রকৃতির বিধান হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের’; আর ‘জীবন ধারণ করবে তার স্বামীর নিরঙ্কুশ আইনের অধীনে।’ পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে ছলেবলে খুশি রেখে অর্জন করবে সামান্য ক্ষমতা। রুশো যে-পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা মোটেই প্রাকৃতিক নয়; তা একটি সুশৃঙ্খল, সম্পদভিত্তিক, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। রুশোর মতে, পরিবারে কর্তৃত্ব স্বামী ও স্ত্রী উভয়েবই থাকতে পারে না, কেননা পরিবারে থাকা দরকার একজন প্রধান, যে নোবে সমস্ত সিদ্ধান্ত। সাধারণ অভিলাষের এ-প্রবক্তা পরিবারের মতো একটি সংস্থায়ও সাধারণ অভিলাষের মূল্য দেন নি। রুশো নারীকে পুরুষের অধীনে রাখতে চেয়েছেন নারীর গর্ভধারণের জন্যেও, কারণ তখন নারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; রুশোর মতে, ‘নারীকে কর্তৃত্ব না দেয়ার এ-ই যথেষ্ট কারণ।’ আরেকটি কারণেও পুরুষের অধীনে রেখেছেন তিনি নারীকে, তা হচ্ছে নিশ্চিত পিতৃত্বের পরিচয়; পুরুষকে ঠিকমতো বুঝে নিতে হবে তার নারীর গর্ভে যারা জন্মাচ্ছে তারা তার কিনা? নারীপুরুষের সাম্য স্বীকার না করার পেছেনে ছিলো রুশোর একটি গোপন ভীতি। রুশোর ভয় হচ্ছে যদি পুরুষের অধীনে না রাখা হয় নারীকে, তাহলে নারী পুরুষের ওপর স্থাপন করবে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। রুশোর বিশ্বাস ছিলো যে নারীকে প্রকৃতি দিয়েছে এমন কামক্ষমতা, যা দিয়ে নারী বশীভূত পরাভূত ক’রে রাখতে পারে পুরুষকে; নারী পুরুষকে ক’রে তুলতে পারে অসহায়। অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারী নিয়ন্ত্রক। রুশো নারীভীতি পেয়েছেন ঐতিহ্য থেকে; নারীকে দেখেছেন তিনি কামদানবী অশুভ শক্তিরূপে। একটি কবিতায় নারীকে সম্বোধন ক’রে রুশো লিখেছিলেন, ‘সম্মোহিনী ও ভয়ঙ্করী, যাকে আমি পুজো আর ঘৃণা করি,… পুরুষকে যে পরিণত করে ক্রীতদাসে।’

রুশোর দর্শনে সাম্যের মতোই মূল্যবান মুক্তি বা স্বাধীনতা; তবে সাম্য যেমন পুরুষের ব্যাপার, মুক্তিও পুরুষেরই ব্যাপার, নারীর নয়। নারীর মুক্তি খুঁজেছেন রুশো পুরুষের পায়ে; মুক্তি নারীর জন্যে নয়, নারীকে তিনি সুপরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত করেছেন পুরুষের অধীনে। রাজনীতিক অর্থনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ-এ (১৭৫৫) রুশো [দ্র ওকিন (১৯৭৯, ১৫৪)] বলেছেন, ‘শুধু স্বাধীন মানুষের মধ্যেই মনুষ্যত্ব স্পষ্ট; স্বাধীনতা মানুষের গুণাবলির মধ্যে মহত্তম’; এবং ‘স্বাধীনতা অস্বীকার করা মনুষ্যত্ব অস্বীকার করা, মনুষ্যত্বের অধিকার, এমনকি তার দায়িত্ব, বর্জন করা। এমন অস্বীকার অসামঞ্জস মানুষের প্রকৃতির সাথে, এবং তার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে তার নৈতিকতা হরণ করা।’ তবে রুশো হরণ করেছেন নারীর স্বাধীনতা ও নৈতিকতা দু-ই, কেননা রুশোর চোখে নারী মানুষ নয়, মেয়েমানুষ। রুশো বলেছেন (এমিল, ৫:৩২২), ‘দু-লিঙ্গের মিলনে প্রত্যেকে কাজ করে একই উদ্দেশ্যে, তবে ভিন্ন উপায়ে। তারা ‘ভিন্ন উপায়ে’ কাজ করে, কেননা তারা ভিন্ন; একজন প্ৰভু, আরেকজন তার দাসী। ‘ভিন্নতা’ ধারণাটিও প্রতারক, নারীকে পুরুষের থেকে ভিন্ন বলার অর্থ হচ্ছে নারী ‘নিকৃষ্ট’। রুশোর কাছে পুরুষ হচ্ছে শক্তিমান ও সক্রিয়, নারী দুর্বল ও অক্ৰিয়। তাই নারী থাকবে পুরুষের অধীনে, কেননা পুরুষ শক্তিমান; রুশোর কাছে শক্তিমানের অধীনে থাকাই প্রকৃতির বিধান। কিন্তু ফরাশি বিপ্লবেও নারী পালন করেছিলো অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা, যদিও ওই বিপ্লবের দার্শনিক বলেছেন নারী দুর্বল ও অক্রিয়! নারী রুশোর দর্শনের জন্যে শোচনীয় এলাকা, এ-এলাকায়ই রুশো এমনভাবে পদস্থলিত হয়েছেন যে তার অজ্ঞাতে তার দর্শনের মূল বক্তব্য বাতিল হয়ে গেছে। রুশো নারীর স্বাধীনতা পুরোপুরি অস্বীকার ক’রে নারীকে করেছেন। পুরুষের ক্রীতদাসী, যার কাজ পুরুষের বিনোদ যোগানো ও সেবা করা। রুশোর নারী প্রাকৃতিক নয়, স্বাধীন নয়, তা পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে বানানো পুরুষভোগ্য সামগ্ৰী। রুশো নারী সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সামান্যও অভিনব নয়; পিতৃতন্ত্রের সমস্ত পুরোনো গ্রন্থে এসব বিধিবিধান অনেক আগেই প্রণীত হয়েছিলো; রুশো শুধু সেগুলোকে রোম্যানটিক রীতিতে প্ৰকাশ ক’রে আঠারো-উনিশ শতকের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ক’যে তুলেছিলেন, এবং নারীকে বেঁধেছিলেন নতুন শক্ত শোকলে।
 
জন রাসকিন (নারীর শত্রুমিত্ৰ)


পুরুষাধিপত্যের প্রতিক্রিয়াশীল রোম্যানটিক রূপটি পাওয়া যায় রুশোর রচনায়; চাটুকারিতাপূর্ণ ভিক্টোরীয় ভণ্ডামোর রূপটি পাওয়া যায় জন রাসকিনের ‘সিসেম অ্যান্ড লিলিজ’ (১৮৬৫) গ্রন্থের ‘লিলিজ : অফ কুইন্স গার্ডেনস্’ (১৮৬৪) নামের বক্তৃতাপ্রবন্ধে। রাসকিনের বক্তব্যে মৌলিক কিছুই নেই, তিনি নারী সম্পর্কে সব কিছু পেয়েছেন প্রথা, সাহিত্য, ও চারপাশ থেকে; তবে তিনি নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় পর্বের কপট, প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকাশ করেছিলেন খুবই বীরত্বের সাথে। ভিক্টোরীয়রা তার কাছে যা শুনতে চেয়েছিলো, তিনি তাদের তা শুনিয়েছিলেন উদ্দীপনার সাথে, এবং অর্জন করেছিলেন অশেষ জনপ্রিয়তা। সব জনপ্রিয় বস্তুই এক সময় হাস্যকর হয়ে ওঠে, রাসকিনের বক্তৃতাটিও তাই; কিন্তু দুঃখ লাগে রাসকিনের আবর্জনা প্রভাব বিস্তার করেছিলো বিপুলভাবে; তিনি প্রভাবিত করেছিলেন এমনকি উনিশশতকের শেষাংশের শিক্ষিত বাঙালিদেরও, যাঁরা রাসকিনের পরামর্শে নিজেদের নারীদের ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘ভদ্রমহিলা’ বা ‘লেডি’। রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’-এর প্রকাশের চার বছর পর বেরিয়েছিলো জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ (১৮৬৯); কিন্তু ওই সত্যনিষ্ঠ বইয়ের ভাগ্যে জুটেছিলো তিরষ্কার। মিলেট (১৯৬৯, ৮৯) বলেছেন, ‘মিলে পাওয়া যায় লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতা, আর রাসকিনে পাওয়া যায় রোমান্স ও রূপকথা।’ রাসকিন বাস্তবতার থেকে বাগিতায়, সত্যের থেকে রূপকথায় বেশি আগ্রহী; তোষামোদে তিনি নির্লজ্জ, পুরুষাধিপত্যে একনিষ্ঠ। নারীদের ডেকেছেন তিনি ‘লিলি’ বা ‘পদ্ম’। ব’লে, ‘রানী’ ব’লে, কিন্তু বন্দী করতে চেয়েছেন গৃহকূপে। ‘পদ্ম’ বা ‘রানী’ ডাকে রয়েছে বেশখানিকটা কাম; ‘পদ্ম’ স্মরণ করিয়ে দেয় অক্ষত শুভ্র সতীত্বের ব্যাপারটিকে, ‘রানী’ও আশ্লেষজাগানো ডাক। রাসকিনকে অনেকখানি নষ্ট করেছে সাহিত্য : তিনি দান্তে, শেক্সপিয়র, ও রোম্যানটিক কবিতার নারীদের ভেবেছেন বাস্তব, কিন্তু ওই নারীরা যে বাস্তব নারী থেকে সুদূরে, তা বোঝেন নি। রোম্যানটিক কবিতা নারীকে দেবী ক’রে শেষ পর্যন্ত পরিণত করে পুরুষের সেবিকায়, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে; এখানে দুটি কবিতা উল্লেখযোগ্য, কেননা কবিতা দুটি রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের মনে বদ্ধমূল করেছিলো নারীর বিশেষ রূপ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি কবিতার নাম ‘শি ওয়াজ এ ফ্যান্টম অফ ডেলাইট’। কবি বলছেন : যখন সে প্রথম আমার চোখে পড়লো, সে ছিলো আনন্দের মায়ামূর্তি। আবেগের তীব্র মুহূর্তে সে দেবী; কিন্তু আবেগ কেটে গেলে কবি দেখতে পান : সে দেবী, কিন্তু নারীও বটে! তাই আনন্দের মায়ামূর্তি হয়ে ওঠে পুরুষের গৃহিণী, যার কাজ সংসার দেখাশোনা, মানসসুন্দরী শুরু করে মাছ কোটা। কভেন্ট্রি প্যাটমোরের ‘দি অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ বা ‘গৃহলক্ষ্মী’ কবিতায় বিয়ে ও নারীত্ব সম্পর্কে ভিক্টোরীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ভালোভাবে। রাসকিনের বক্তৃতায় প্রকাশ পায় ওই ‘দেবী, কিন্তু নারীও বটে’ এবং ‘গৃহলক্ষ্মী’র ধারণা।

রাসকিন ১৮৬৪ অব্দে ম্যানচেস্টার শহরের টাউন হলো মধ্যবিত্ত নরনারীদের সামনে দিয়েছিলেন বক্তৃতাটি। বক্তৃতাটিতে পাওয়া যায় এমন এক ব্যক্তিকে, যিনি পরিপূর্ণ মধ্যযুগীয় শিভালরি ও প্রতিক্রিয়াশীলতায়; যার চোখে নারীমাত্ৰই নাবালিকা। চাটুবাক্যে শুরু করেছেন তিনি বক্তৃতাটি; শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের বসিয়েছেন ‘বিপথগামী ও অশিক্ষিতদের রাজার আসনে, এবং নারীদের বসিয়েছেন ‘রানী’র অসার সিংহাসনে। পরোক্ষভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি সে-সময়ের নারীবাদীদের, যারা বলছিলেন নারীর অধিকারের কথা; কেননা রাসকিন নারীর অধিকারে বিশ্বাস করেন না। সে-সময় জনপ্রিয় ছিলো স্যাপারেট স্ক্যোরিস বা পৃথক এলাকা, অর্থাৎ ঘরে-বাইরে তত্ত্ব, যা তখন সুচতুরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো নারীদের পোষমানানোর জন্যে। রাজকবি টেনিসন ‘প্রিন্সেস’ (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে বলেছিলেন : ‘নারী অসম্পূর্ণ পুরুষ নয়/ তবে ভিন্ন… অভিন্নরূপে এক নয়, তবে বিভিন্নরূপে এক’, ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা/ অর্ধেক, আর খাঁটি বিয়েতে কেউ/ সমান বা অসমান নয়, প্রতিটি পূরণ করে/ অন্যটির ক্রটি।’ টেনিসনের এ-কাব্যিক ভিন্নতার মধ্যে অভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এমন এক শোভন কৌশল, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষণকে সুখকর ক’রে তোলা। রাসকিন ঘরেবাইরে ও পরিপূরক তত্ত্ব নানাভাবে পেশ করে নারীকে তার অধিকারের কথা ভুলিয়ে চেয়েছেন। পুরুষের সেবিকা ক’রে রাখতে। নারীদের ‘রানী’ ব’লে কপট সম্বোধনের পর রাসকিনের কাজ হচ্ছে ওই রানীরা কোথায় থাকবে, কী করবে, কী শিখবে তার বিধান রচনা। তিনি নতুন কিছু বলেন নি, পুরুষতন্ত্র যা ব’লে এসেছে কয়েক হাজার বছর ধরে, আর তাঁর একশো বছর আগে রুশো, এবং রোম্যানটিক কবিরা যা বলেছেন, তিনি তাই বলেছেন ভিক্টোরীয় নাইটের ভঙ্গিতে।

নারীরা রাসকিনের চোখে রানী, কী ক্ষমতা ওই রানীদের, এবং কীভাবে প্রয়োগ করবে তারা তাদের রানীসুলভ ক্ষমতা? কিন্তু রাসকিন ক্ষমতার কথা বলতে গিয়েই দ’মে গেছেন, তার মনে পড়ে গেছে নারীরা রানী, তবে আসলে তো তারা নারী! তাই আগে ঠিক করতে হবে কী হবে তাদের ক্ষমতা নারী হিশেবে? রাসকিন (১৮৬৫, ৬১) এখন দেখা দেন মুখোশ খুলে; বলেন, ‘নারীদের রানীসুলভ ক্ষমতা কী হবে তা স্থির করতে পারি না, যদি না আমরা একমত হই তাদের সাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে।’ বিপত্তি ঘটে এখানেই, কেননা রাসকিনের বিধানে নারীদের সাধারণ ক্ষমতা খুবই তুচ্ছ, নারীর ক্ষমতা হচ্ছে নারীর ভূমিকা পালন করা। নারী পুরুষের সমান হবে না, নারী হবে পুরুষের সহায়ক। উনিশ শতকে পুরুষতন্ত্রীরা বের করেছিলেন পৃথক এলাকার ধারণা, রাসকিন তা নিজের ক’রে নিয়েছিলেন, এবং একেই ঘোষণা করেছিলেন প্রাকৃতিক ব’লে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পুরুষ ও শোষকতন্ত্রের বড়ো প্রতারণা; রুশো প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে, রাসকিনও প্রতারণা করেছেন প্রকৃতি দিয়ে। উনিশশতকে প্রকৃতি শুধু আবেগাতুর শব্দ ছিলো না, শোষকতন্ত্র এ-শব্দটিতে পেয়েছিলো সমস্ত সমস্যার সমাধান। তারা যা কিছু বুঝতে পারতো না, বা যা কিছু নিজেদের সুবিধার জন্যে তারা বিধিবদ্ধ করতে চাইতো, তাকেই বলতো তারা ‘প্রাকৃতিক’ : শ্রেণী, স্বৈরাচার, শোষণ সব কিছুই প্রাকৃতিক! রাসকিন যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট বলা শোভন ছিলো না, তাই তাদের সুভাষণ বের করতে হয়েছিলো। টেনিসনের প্রন্সেস-এ মেলে নারীপুরুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্ব :

For Woman is not underdevelopt man
But diverse:..
Not like to like, but like in difference…
either sex alone
Is half itself, and in true marriage lies
Nor equal, nor unequal each fulfills
Defect in each

নারী নয় অবিকশিত পুরুষমানুষ
তবে ভিন্ন…
একজন নয় অপরজনের মতো, কিন্তু ভিন্নতার মধ্যে একরূপ…
দু-লিঙ্গের মধ্যে একটি একলা
শুধুই অর্ধেক, আর প্রকৃত বিবাহে
কেউ সমান বা অসমান নয়; প্রত্যেকে পূরণ করে
অপরের ত্রুটি

ভিক্টোরীয় রাজকবির মতে নারী অবিকশিত মানুষ বা পুরুষ নয়, ভিন্ন ধরনের মানুষ; শুনতে এটা ভালো শোনালেও কবি আর ভিক্টোরীয়রা নারীকে অসম্পূর্ণ মানুষই মনে করতো। এ-কবিতার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও পরিপূরকতত্ত্বের প্রতিধ্বনি ক’রে রাসকিন (১৮৬৫, ৭২) বলেন :

‘আমরা নির্বোধি, ক্ষমাহীনভাবে নির্বোধ, যখন আমরা এক লিঙ্গের ওপর আরেক লিঙ্গের শ্ৰেষ্ঠতার কথা বলি, যেন তাদের তুলনা করা সম্ভব অভিন্ন বিষয়ে। একটির যা আছে অন্যটির তা নেই; একটি পূর্ণতা দেয় অন্যটিকে, এবং পূর্ণতা পায় অন্যটি দিয়ে : তারা কোনো কিছুতেই একরকম নয়, উভয়ের সুখ ও উৎকর্ষ নির্ভর করে অন্যের যা আছে তা চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে, যা শুধু দিতে পারে অন্যটি।‘

রাসকিনের এ-নাইটপনা হচ্ছে নারীপুরুষের সামাজিক ও মেজাজগত পার্থক্যকে জৈবিক যুক্তির সাহায়ে বৈধ করার কূটকৌশল। তিনি উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্টতে না গিয়ে গেছেন টেনিসনি ভিন্নতায় ও পরিপূরকতায়, শয্যা থেকে সাম্রাজ্য পর্যন্ত যার সুফল পাবে পুরুষ আর দুর্ভোগ পোহাবে নারী। পুরুষ : নারী ভিন্ন ও পরিপূরক, যেমন ভিন্ন ও পরিপূরক ব্ৰাহ্মণ; শূদ্ৰ, শোষক : শোষিত, যারা সৃষ্টি করে সামাজিক বৈচিত্র্যের সঙ্গীত! নারীপুরুষের কোনো মৌল পার্থক্য নেই; যোনিলিঙ্গস্তন প্রভৃতি পার্থক্যের নেই কোনো সামাজিক-রাজনীতিক মূল্য, কিন্তু রাসকিনেরা এসবের জন্যেই পুরুষকে প্ৰভু আর নারীকে দাসী ক’রে রাখার কৌশল বের করেছেন চিরকাল।

রাসকিন নারীপুরুষের দ্বিমেরুত্ব ও পরিপূরকত্ব প্রস্তাব ক’রেই ধ’রে নিয়েছেন যে তা প্রমাণ হয়ে গেছে; এবং সাথেসাথেই তিনি আঁকা শুরু করেছেন নারীপুরুষের ভিন্ন ও পরিপূরক জগতের মানচিত্র। তিনি পুরুষকে দিয়েছেন মুক্ত পৃথিবী, নারীকে ঢুকিয়েছেন বদ্ধ ঘরে; সৃষ্টি করেছেন ঘরে-বাইরের ভিন্ন ও বিপরীত পরিপূরক বিশ্ব। রাসকিনের রাজারা পুরুষ, তাই তারা দায়িত্ব পেয়েছে সমস্ত মানবিক কাজের, আরা রাসকিনের রানীরা নারী, তাই তারা পেয়েছে গৃহপরিচারিকার দায়িত্ব : এই হচ্ছে রাজারানীর পরিপূরকতা! নারীপরুষের ভিন্নতা সম্পর্কে আবহমান পুরুষতন্ত্র যা বলেছে, রুশো যা বলেছেন, যা বলেছে ভিক্টোরীয়রা, তাই বলেছেন রাসকিন (১৮৬৫, ৭২-৭৩) :

‘তাদের চাবিত্রিক ভিন্নতা সংক্ষেপে এগুলো। পুরুষের শক্তি সক্রিয়, প্রগতিশীল, প্রতিরোধাত্মক। সে প্রধানত কর্তা, স্রষ্টা, আবিষ্কারক, রক্ষক। তার মেধা প্ৰকল্পনার ও আবিষ্কারের; তার শক্তি অভিযাত্রার, যুদ্ধের, বিজয়ের, যেখানে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত, যেখানে বিজয় দরকার। কিন্তু নারীর শক্তি শৃঙ্খলার, যুদ্ধের নয়; আব্ব তার মেধা আবিষ্কার বা সৃষ্টির নয়, তা মধুর শৃঙ্খলার, বিন্যাসের, এবং সিদ্ধান্তের। তার কাজ প্রশংসার : সে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় না, কিন্তু কার শিরে মুকুট পরানো হবে সে তার রায় দেয; তার কাজ ও স্থান দিয়ে সে সব রকম বিপদ ও প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত। পুরুষ, মুক্ত পৃথিবীতে বিভিন্ন কর্কশ। কাজে, মুখোমুখি হয় বিপদ ও বিচারেব্য;–তাই পুরুষেবই জন্যে রয়েছে ব্যর্থতা, অপরাধ, অনিবাৰ্য ভুল: মাঝেমাঝেই সে আহত বা পরাভূত হবে, বিপথে যাবে, এবং সব সময় কঠিনতর হবে। কিন্তু সে নারীকে রক্ষা করে এসব থেকে; তার গৃহের মধ্যে, যা শাসন করে নারী, যদি নারী নিজে না চায়, তবে নারীকে ঢুকতে হবে না কোনো বিপদ, প্রলোড়ন, ভুল বা অপরাধের মধ্যে। এ হচ্ছে গৃহের আসল প্রকৃতি–এটা শান্তির এলাকা।‘

রাসকিনের বুলির সারকথা : পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সেবিকা। গৃহে থাকা, সংসার শাসন করা, পুরুষের সেবা করাই রাসকিনের মতে ‘নারীর প্রকৃত স্থান ও শক্তি’। নারীকে হ’তে হবে গৃহের উপযুক্ত, ওই বদ্ধকূপে থেকেই সে সফল ক’রে তুলবে তার জীবন। নারী হবে। আপাদমস্তকআত্মা এমন নারী যে সে যেখানেই রাখবে তার পা দুখানি, তাই হয়ে উঠবে গৃহ। তাঁর, ও তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদী গোত্রের, কাছে এই প্রাকৃতিক। রাসকিনের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে প্ৰথাই প্রাকৃতিক; যা চলে এসেছে, তা যতোই নিষ্ঠুর অমানবিক অস্বাভাবিক হোক-না-কেনো, তাদের কাছে তাই প্রাকৃতিক শাশ্বত। নারীকে তার জীবন সফল করার জন্যে আয়ত্ত করতে হবে নানা রমনীয় গুণ। রাসকিন (১৮৬৫,৭৩-৭৪) তাঁর রানীদের ভূষিত দেখতে চেয়েছে আত্মবিনাশী গুণে :

‘সে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে ভালো; সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে জ্ঞানী-জ্ঞানী, আত্মবিকাশের জন্যে নয়, বরং আত্মোৎসর্গের জন্যে : জ্ঞানী, এজন্যে নয় যে সে নিজেবে প্রতিষ্ঠা করবে স্বামীর ওপরে, ববং এজন্যে যাতে সে ব্যর্থ না হয় স্বামীর পাশে থাকতে।‘

রাসকিন পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছেন নারীদের অস্তিত্ব, কেননা নারীর কিছুই নারীর নিজের জন্যে নয়। নারীকে ভালো হতে হবে স্থায়ীভাবে, অটলভাবে; জ্ঞানীও হতে হবে সহজাতভাবে, অভ্রান্তভাবে; কিন্তু সে আত্মবিকাশ ঘটাতে পারবে না, সে নিজেকে তৈরি করবে। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের পায়ে আত্মোৎসর্গের জন্যে। এ হচ্ছে একধরনের সতীদাহ। রাসকিন নারীদের পরিণত করেছেন শোচনীয় প্রাণীতে, অথচ ভিক্টোরীয় কপটতায় তাদের ডেকেছেন ‘রানী’ বলে।

পুরুষতন্ত্র শুধু পীড়ন ক’রে নারীদের নারী ক’রে তোলে নি, তাদের দীক্ষিত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাক্ত মন্ত্রে, যার নাম নারীমন্ত্র। নারীমন্ত্রে দীক্ষণ দেয়ার জন্যে পুরুষতন্ত্র উদ্ভাবন করেছে বিশেষ ধরনের নারীশিক্ষা, যা প্রকৃতপক্ষে কোনো শিক্ষাই নয়। রুশোর এমিল-এর বিকল্প নাম শিক্ষা, কিন্তু ওই শিক্ষা নারীদের জন্যে অশিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। রাসকিনও ওই শিক্ষায় শিক্ষিত অর্থাৎ অশিক্ষায় অশিক্ষিত করতে চেয়েছেন নারীদের। রাসকিন নারীদের জন্যে রেখেছেন স্বামী ও সংসার, তাই তাদের দিতে চেয়েছেন সে-শিক্ষা যাতে নারীরা সম্পূর্ণরূপে খাপ খায় স্বামী ও সংসারের অন্ধকূপে। রাসকিন বলেছেন, ‘আমি নারীদের স্থান ও শক্তি দেখিয়েছি’; তারপর প্রশ্ন করেছেন নারীদের শিক্ষা সম্পর্কে, ‘এর সাথে খাপ খাবে কী ধরনের শিক্ষা’ নারীদের জন্যে তিনি বিধিবদ্ধ করেছেন খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা, যার লক্ষ্য নারীদের পুরুষাধীনতায় অভ্যস্ত করে তোলা। রাসকিন (১৮৬৫,৭৬) বলেন, ‘প্রথমে নারীর দেহখানিকে ছাচে ফেলে ঢালাই করতে হবে’; তারপর ওই নমনীয় ভঙ্গুর দেহখানির ভেতর যে-মনটি থাকবে, সেটিকে বদলে দিতে হবে ও ভ’রে তুলতে হবে।’ আত্মোৎসর্গ্র শিক্ষায়। রাসকিনের মতে নারীর জ্ঞান যেমন আত্মবিকাশের জন্যে নয়, তেমনি শিক্ষাও আত্মবিকাশের জন্যে নয়;–নারীর শিক্ষা পুরুষের সেবা করার জন্যে, পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার জন্যে। এ-শিক্ষায় নারী বড়েজোর হয়ে উঠবে সখি, সচিব ও প্রিয়শিষ্যা, যা তাকে ক’রে তুলবে পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়, কিন্তু সে কখনো স্বাধীন ব্যক্তি হয়ে উঠবে না।

রাসকিন (১৮৬৫, ৭৬-৭৯) নারীকে দিতে চেয়েছেন পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার শিক্ষা। নারীকে দিতে হবে সে-সব জ্ঞান, যা নারীকে সাহায্য করবে। ‘পুরুষের কাজ বুঝতে, এমনকি সহায়তা করতে’। অর্থাৎ পুরুষ হবে ঔপন্যাসিক, আর তাঁর স্ত্রী হবে পাণ্ডুলিপি।প্রস্তুতকারক ও গ্রুফসংশোধক, পুরুষ বিশ্ববিখ্যাত হবে। আর নারী স্বামীর খ্যাতিতে ধন্য বোধ করবে! এ-প্রসঙ্গে টলষ্টয় ও তার স্ত্রী সোফিয়া স্মরণীয়। টলষ্টয় পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষের স্থান পেয়েছেন, আর নিন্দিত হয়ে আছেন সোফিয়া, যদিও ওই নারী সহচরীরূপে তাঁর সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছেন টলষ্টয়ের বিখ্যাত নিষ্ঠুর পায়ে। টলস্টয় দুশ্চরিত্র ছিলেন, নিজের অবৈধ পুত্রদের লাগিয়েছিলেন ভূমিদাসের কাজে, পরিচারিকদের গর্ভবতী করেছেন, আর শেষ জীবনে যখন ধর্ম ও নিষ্কামতা প্রচার করছিলেন তখনও জড়িত ছিলেন চেরট্‌কভের সাথে সমকামে; এবং নিয়মিতভাবে গৰ্ভবতী ক’রে চলছিলেন সোফিয়াকে, আর সোফিয়া ক’রে চলছিলেন স্বামীর সহকারীর কাজ। টলষ্টয় তাকে তেরোবার গর্ভবতী করেন, ওই নারী নটি জীবিত সন্তান লালনপালন করেন, জমিদারি দেখাশোনা করেন, প্ৰকাশ করেন স্বামীর রচনাবলি, এবং বারবার অনুলিপি প্রস্তুত করেন স্বামীর পাণ্ডুলিপির। টলষ্টয়ের অপাঠ্য হস্তাক্ষরে লেখা যুদ্ধ ও শান্তি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করেন তিনি সাতবার, রাত জেগেজেগে বিবর্ধক কাচ দিয়ে দেখে, এবং নষ্ট করেন নিজের জীবন [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ১৬৩-১৬৪)]। রাসকিন এভাবেই নষ্ট করতে চান নারীকে। রাসকিন বলেন, নারীকে ‘জ্ঞান দেয়া যাবে না জ্ঞান হিশেবে, নারীদের জ্ঞান দিতে হবে এমনভাবে যাতে নারী শুধু ‘অনুভব ও বিচার করতে পারে’। নারীর মাথাটি নষ্ট করে দিয়ে তার বুকের ভেতরে সৃষ্টি করতে হবে স্যাঁতসেঁতে ভাবালুতা। নারীর জ্ঞান ‘নারীর গর্ব বা বিশুদ্ধির জন্যে নয়’; তা শুধু তাকে দয়াবতী ক’রে তোলার জন্যে। রাসকিনের বিধান হচ্ছে নারীকে বিজ্ঞান শেখানোর দরকার নেই, তাকে শুধু বিজ্ঞানের দু-একটি খবর জানানো যেতে পারে। নারীকে জ্ঞানের অভিধানে পরিণত করার দরকার নেই; তবে তাকে ক’রে তুলতে হবে ভাবালুতার ঝরনাধারা। নারীকে ধর্মতত্ত্বও শেখানো যাবে না, এটা বিশেষভাবেই বারণ করেছেন রাসকিন, কেননা এটা এক ভয়ঙ্কর বিজ্ঞান’, যেখানে পদষ্মলন ঘটেছে শ্রেষ্ঠ পুরুষদেরও। নারীরা ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, তবে তাদের ভীরে তুলতে হবে ধর্মভাবে, যাতে তারা হয়ে ওঠে বিনীত ও করুণাময়ী।

স্ববিরোধিতা করে এক সময় রাসকিন বলেন, ‘এটা (ধর্মতত্ত্ব) বাদে, ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, পাঠে ও বিষয়ে, হবে প্ৰায় একই; তবে তাদের শিক্ষার লক্ষ্য হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন’। ‘প্রায় একই’ অবশ্য অভিন্নতা বোঝায় না, বোঝায় সম্পূর্ণ ভিন্নতা; আর লক্ষ্য তো ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন’। রাসকিন চান পুরুষের জন্যে শিক্ষা, আর নারীর জন্যে অশিক্ষা :

নারীর শিক্ষা হবে স্বামীমুখি। স্বামী যা কিছু জানে স্ত্রীকে জানতে হবে সে-সব, তবে ভিন্নভাবে; ওই জ্ঞানে স্বামীর ‘অধিকার হবে মৌলিক ও অগ্রসর’; আর স্ত্রীর অধিকার হবে ‘সাধারণ, যাতে তা প্রাত্যহিক জীবনে উপকারে আসে’। রাসকিনের বিধান হচ্ছে ‘পুরুষ তার জানা ভাষা বা জ্ঞান আয়ত্ত করবে ব্যাপকভাবে, আর নারী ওই ভাষা বা জ্ঞান জানবে ততোটুকু, যতোটুকু হ’লে সে তার স্বামীর আনন্দের সঙ্গে তাল দিতে পারে’। সারকথা হচ্ছে নারীকে কোনো যথার্থ শিক্ষাই দেয়া হবে না, তাদের দিতে হবে নারী হয়ে ওঠার, স্বামীর সহচরী হয়ে ওঠার সবক। তারা হয়ে উঠবে উন্নত জাতের দাসী ও শয্যাসঙ্গিনী। রাসকিনের নারীশিক্ষা হচ্ছে পুরুষের সাথে খাপ-খাওয়ানোর শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করেন নারী-অধীনতায়; তার শিক্ষাও নারীকে পুরুষের অধীন করার মন্ত্র। নারীশিক্ষা পুরুষতন্ত্রের একটি বড়ো ভীতির ব্যাপার, কেননা শিক্ষা নারীকে পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের সাথে, তাকে বুঝিয়ে দেয় তার পতনের শোচনীয়তা ও সম্ভাবনাকে।

ভিক্টোরীয় যুগে নানা চক্রান্ত হয়েছে নারীর শিক্ষা নিয়ে, যে-চক্রান্তের একটি আদর্শ রূপ পাওয়া যায় টেনিসনের ‘প্রিন্সেস’-এ (১৮৪৭, ১৮৫৩), যার দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত ছিলেন রাসকিন। প্রিন্সেস একটি শিক্ষাবিতর্কমূলক কাব্য। ভিক্টোরীয় যুগে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিলো; এমনকি এর প্রভাব পড়েছিলো রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদার ওপরও, যার ফলে একটি বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসিত রাজকন্যা হয়ে ওঠে পুরুষের শোচনীয় সহচরী। প্রিন্সেস-এ বিবাহবিরোধী রাজকন্যা আইডা নারীশিক্ষার জন্যে স্থাপন করে একটি নারী-বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে ছাত্রীর ছদ্মবেশে ভর্তি হয় আইডার অনুরাগী মৃগীরোগগ্ৰস্ত এক রাজপুত্র ও তার বন্ধু। রাজপুত্র যখন ধরা পড়তে যাচ্ছিলো, তখন একদিন সে জলমগ্ন আইডাকে উদ্ধার ক’রে প্রাণে বাঁচায়, এবং প্ৰেম নিবেদন করে। আইডা তা প্রত্যাখ্যান করে। এক সময় যুদ্ধ বাধে আইডা ও রাজপুত্রের দলের মধ্যে, যুদ্ধে আহত হয় রাজপুত্র। আইডা আহত রাজপুত্রের সেবা ক’রে নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে; বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সেখানে সে স্থাপন করে হাসপাতাল। বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে ও শিক্ষানুরাগী বিবাহবিরোধী রাজকন্যাকে নার্সে পরিণত করে পুরুষতন্ত্র প্ৰতিশোধ গ্রহণ করে নারীবাদ ও নারীশিক্ষার ওপর।

প্রিন্সেস-এ প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে নারীবাদের ওপর; দেখিয়ে দেয়া হয়েছে যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ, নারীর কাজ পুরুষের সেবা করা। নারীর শিক্ষা হচ্ছে বাজে কথা, আর নারীপুরুষ কখনো সমান হ’তে পারে না। প্রিন্সেস-এর নায়ক আইডাকে বিয়ে করতে চায়, তবে সে এমন কাউকে বিয়ে করতে পারে না যে তার সমকক্ষ। নারীর সমকক্ষতা দাবি দ্রোহিতা, তাই তাকে পেতে হবে উপযুক্ত শাস্তি। দ্রোহী নারীকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে যাতে সে হয়ে ওঠে অনুগত স্বামীপরায়ণ দাসীস্বভাব স্ত্রী। নারী যদি সমান হয়ে ওঠে। পুরুষের, তাহলে কি বিয়ে টিকতে পারে, সুখের হতে পারে সংসার’ ভিক্টোরীয়রা বিশ্বাস করতো সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে; আর রমণীর শ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে পুরুষের নিচে থাকা। শিক্ষা হচ্ছে সে-শক্তি যাতে নারী সমান হয়ে উঠতে পারে পুরুষের, তাই নারীকে সরিয়ে নিতে হবে শিক্ষার দরোজা থেকে। নারীকে থাকতে হবে ঘরে, তাই প্রিন্সেস-এ গানেগানে প্রচার চালানো হয়েছে ঘর আর চুলোর সপক্ষে; হিটলার যেমন প্রচার চালিয়েছে কিন্ডের, কুচে উন্ট কিরচে’র [শিশু, রান্নাঘর ও গির্জা] পক্ষে। তাদের কাছে প্ৰেম/বিবাহ ও শিক্ষা ছিলো পরস্পরবিরোধী; একটি করা যাবে, একসাথে দুটি করা যাবে না। এ-কাব্যে পুরুষাধিপত্যবাদী ভিক্টোরীয় মনোভাব প্ৰকাশ পেয়েছে প্রচণ্ডভাবে [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ’৭৮-৭৯)];

মাঠেন্য জন্যে পুরুষ আর চুলোর জন্যে নারী;
তলোয়ারের জন্যে পুরুষ সূচের জন্যে নারী;
পুরুষেব আছে মগজ, নারীর আছে হৃদয়;
পুরুষ দেবে আদেশ, আর পালন করবে নারী;

পুরুষ শিকারী; নারীরা শিকার।
মৃগয়ার চকচকে ঝলমলে মৃগ,
আমরা শিকার করি তাদের চামড়ার সৌন্দর্যের জন্যে;
এজন্যেই তারা ভালোবাসে আমাদের
এবং আমরা অশ্ব ছুটিয়ে তাদের ভূপাতিত করি।

হিংস্র পুরুষাধিপত্যের কোমল চতুর রূপ হচ্ছে নারীপুরুষের পরিপূরক পার্থক্যের তত্ত্ব। নারীপুরুষের সাংস্কৃতিক আপাতপার্থক্যকে ভিক্টোরীয় রীতিতে জৈবিক ক’রে তুলেছেন টেনিসন ‘প্রতিটি লিঙ্গ একলা অর্ধেক’ বলে। তাঁর মতে নারীপুরুষ দুজনে মিলে গ’ড়ে তোলে ‘বিশুদ্ধ সঙ্গীত’; তবে এ-দ্বৈত সঙ্গীতে পুরুষই প্রধান সুর। টেনিসন বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে, জ্ঞানার্থী তরুণীকে নার্সে পরিণত ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে সৃষ্টি করেছেন ভিক্টোরীয় বিবাহের বিশুদ্ধ সঙ্গীত; রাসকিন করেছেন একই কাজ। নারীকে শিক্ষার নামে দিয়েছেন অশিক্ষা, নবীর পুরুষাধীনতাকে ক’রে তুলেছেন মহিমানিত।

রাসকিনের রানীদের রাজ্য গৃহ, সংসারই তাদের রাজদরবার; তবে শিভালরিতে তিনি অদ্বিতীয়, তাই তিনি রাষ্ট্রের সাথে তার রানীদের/নারীদের কী সম্পর্ক হবে, তাও দেখাতে ভোলেন নি। তিনি বলেছেন (১৮৬৫, ৮৭), ‘আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে যে পুরুষের দায়িত্ব বাইরে, আর নারীর দায়িত্ব ঘরে। তবে আসলে তা নয়।’ তাঁর মতে নারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব রয়েছে সংসারের প্রতি, তবে বাইরের প্রতিও রয়েছে তার দায়িত্ব। নারীর বাইরের জগত, রাসকিনের মতে, তার সংসারেরই সম্প্রসারণ। পুরুষের নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ‘ভরণপোষণ, উন্নতি ও নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা, আর নারীর কাজ হচ্ছে সংসারকে সাজানোগোছানো, আরামপ্রদ ও মনোরম করা’। রাসকিন রাষ্ট্রের প্রতি নারীপুরুষের যে-দায়িত্ব নির্দেশ করেছেন, তাতে পুরুষ প্ৰভু, নারী তার সহায়ক অলঙ্কার। পুরুষের দায়িত্ব ‘রাষ্ট্রকে সচল রাখা, তাব উন্নতি করা, তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা’; আর নারীর দায়িত্ব হচ্ছে ‘রাষ্ট্রকে সাজিয়েগুছিয়ে, আরামপ্রদ ও সুন্দর ক’রে রাখা’। এরপর রাসকিন পুরুষকে ‘ভদ্রলোক’-এর বদলে ভূষিত করেন লর্ড উপাধিতে, নারীকে ‘ভদ্রমহিলা’র বদলে ‘লেডি’তে। তবে তিনি ‘লর্ড’ ও ‘লেডি’ শব্দের যে-অর্থ নির্দেশ করেন, তাতে নারীর সব মহিমা লুটিয়ে পড়ে। ‘লেডি’ শব্দের অর্থ ‘রুটিদানকারিণী’, অৰ্থাৎ যে ভিক্ষা দেয়; আর ‘লর্ড’ শব্দের অর্থ ‘আইনরক্ষণকারী’ বা ‘প্ৰভু। সমস্ত ক্ষমতা থাকছে পুরুষের হাতে, নারী শুধু পালন করবে দান বা ভিক্ষা দেয়ার কাজ। কিন্তু নারী দান করবে কার ধন? সে নিজেই তো সর্বহারা, ভিখিরি; পুরুষের ধন ছাড়া দেয়ার মতো কোনো ধন তার নেই। তাহলে কি তার কাজ প্রভুর ধন থেকে মাঝেমাঝে কিছু ভিক্ষে দিয়ে প্রভুর শোষণব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা? রাসকিনের ‘পদ্ম : রানীর বাগানের’ হচ্ছে পুরুষাধিপত্যের ভিক্টোরীয় মন্ত্র ও চক্রান্ত, যার থেকে এখনো উদ্ধার পায় নি মধ্যবিত্ত নারীরা। নিম্নবিত্ত নারীদের কথা তিনি ভাবেনই নি, তার চোখে তারা রানী নয়, নারীও নয়, সম্ভবত মানুষও নয়।
 
জন স্টুয়ার্ট মিল (নারীর শত্রুমিত্ৰ)



রুশো-রাসকিন পুরুষতন্ত্রের মহাপুরোহিত; নারীর জন্যে তাঁরা বিধিবদ্ধ করেছেন বিনোদযোগানো দাসীর ভূমিকা। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁদের বিপরীত; পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম নারীকে দেখেছেন মানুষরূপে, এবং নারীর জন্যে খুলে দিতে চেয়েছেন মানবিক সমস্ত এলাকা। ১৮৬৯-এ বেরোয় মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ [নারী-অধীনতা। মিল ছিলেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তির অধিকারের দার্শনিক; তিনিই প্রথম পুরুষ, যিনি একটি সম্পূর্ণ বই লেখেন নারীর অধিকারের সমর্থনে। তাঁর আগে কোনো পুরুষ নারীর দুর্দশার কথা ভাবে নি বা দুৰ্দশা থেকে উদ্ধার করতে চায় নি নারীদের, তা নয়; তাঁর আগে বাঙলায়ই আমরা পেয়েছি দুজন মানবিক নারীবাদী : রামমোহন ও বিদ্যাসাগরকে; তবে মিলই প্রথম বিস্তৃতভাবে দেখান পুরুষতন্ত্রের নারীশোষণের রূপটি। মিল রুশো বা রাসকিনের মতো ভাবালুতগ্রস্ত নন, তার মধ্যে নেই রুশোর স্ববিরোধিতা; মিল তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে, মাঝেমাঝে ক্ষোভ মিশিয়ে, পেশ করেছেন নিজের বক্তব্য। মিল দেখান নারীর জীবনের শোচনীয় বাস্তবতা, পুরুষের অধীনে নারীর দুরবস্থা। তাঁর দেড় দশক পরে এঙ্গেলস ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’তে (১৮৮৪) উদঘাটন করেন শোষণের বিশ্বজনীন সূত্র। মিলের লেখায় পাওয়া যায় ভিক্টোরীয় পর্বের লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতার দিকটি; ভিক্টোরীয় পুরুষ ও মহাপুরুষদের মতো নারী সম্পর্কে তিনি পরীর গল্প বলেন নি, বলেছেন নির্মম সত্য। মিলের নারী-অধীনতা প্রথাবিরোধী রচনা, তাতে প্রথার সমস্ত শেকড় তুলে ফেলা হয়েছে অকাট্য যুক্তির সাহায্যে। মানুষের অগ্ৰগতি ও স্বাধীনতার বড়ো বাধা হচ্ছে প্রথা, সুবিধাভোগীরা ওই প্রথাকেই ঐশ্বরিক, শাশ্বত, প্রাকৃতিক বলে প্রচার করে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের স্বার্থ। নারী প্রথার প্রধান শিকার। যিনি প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন, প্রথাবাদীরা তাঁর নিন্দা রটায়; নিন্দা রটানো হয়েছিলো মিলের বিরুদ্ধেও। মিল বইটি লিখেছিলেন ১৮৬১তে; বইটি লেখায় তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন স্ত্রী হ্যারিয়েট টেইলর, এবং সহায়তা করেছিলেন সৎকন্যা হেলেন টেইলর। হ্যারিয়েট নারীবাদী আন্দোলনকারী ছিলেন, মিল তাঁকে বিয়ে করার সময় খ্রিস্টান স্বামীর সমস্ত আইনসঙ্গত অধিকার লিখিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেননা তা স্বামীস্ত্রীর সাম্যের বিরোধী। তাই মিলের নারী-অধীনতা পারিবারিক আবেগ থেকেই জন্মেছিলো, যদিও বইটিতে আবেগের কোনো চিহ্ন নেই। মিলের ‘নারী-অধীনতা’য় উপস্থাপিত হয়েছে কালকালান্তর ধ’রে নারীর শোচনীয় অবস্থার বাস্তবতা; তিনি আক্রমণ করেছেন নারীর আইনগত দাসীত্বকে, শিক্ষার নামে অশিক্ষাকে, ভিক্টোরীয় যুগের স্ত্রীসুলভ অধীনতাকে। তাঁর বক্তব্য বিপ্লবাত্মক, যখন নারীর জন্যে দাসীর দর্শন রচনা করাই ছিলো মহাপুরুষত্ব, তখন তিনি দাবি করেছিলেন নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে বিশুদ্ধ সাম্য। মিলের মূল প্রতিপাদ্য (১৮৬৯, ১) :

‘যে-নীতি নিয়ন্ত্রণ করে দু-লিঙ্গের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক সম্পর্ক–এক লিঙ্গের কাছে আরেক লিঙ্গের আইনগত অধীনতা–তা সম্পূর্ণ ভুল; এবং এখন মানুষের অগ্রগতির এক প্রধান বাধা; এর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিশুদ্ধ সাম্যের নীতি, এতে একপক্ষের থাকবে না বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা, অন্যপক্ষেরও থাকবে না কোনো অসুবিধা।‘

পুরুষতন্ত্রের কাছে তখন এমন বক্তব্য ছিলো পুরুষতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি জানতেন তাঁর বক্তব্য কলহ বাধাবে, এবং তা বেধেছিলো প্ৰচণ্ডভাবে। তাঁর বক্তব্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্র; এবং মিলকে দিয়েছিলো উন্মাদ আর অনৈতিকের অপবাদ।

পুরুষতন্ত্রের কোনো যুক্তি ছিলো না, কিন্তু ছিলো প্ৰথা, আর গোঁড়ামি। মিল জানতেন, যাঁরা আক্রমণ করেন কোনো বিশ্বজনীন বিশ্বাস বা প্রথাকে, তাদের ভাগ্যে জোটে দুঃসহ দুৰ্দশা, কখনো সুপরিকল্পিত অবহেলা। মিলের নারী-অধীনতা প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তির আক্রমণ; এতে নেই ভাবাবেগ বা মিথ্যার দোহাই, যদিও যে-সময় তিনি লিখছিলেন তখন প্রথাবদ্ধ গোড়াদের শক্তির প্রকাশ ঘটতো প্রথাগত ভাবাবেগের মধ্য দিয়ে, যেমন আজো ঘটে। মিল (১৮৬৯, ৫) বলেছেন, ‘আমি কলহ করতে চাই না তাদের সাথে, যাদের বিশ্বাস নেই যুক্তিতে, কিন্তু অতিবিশ্বাস রয়েছে প্রথায় ও সাধারণ আবেগে।’ নারী পুরুষের অধীনে, এ-সম্পর্কে মিল (১৮৬৯, ৮) বলেছেন, যারা মনে করে নারীদের থাকতে হবে পুরুষদেরই অধীনে, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে বিশেষ এক তত্ত্ব। ওই তত্ত্বটি তারা গোঁড়ামির সাথে পোষণ করে আসছে, তাই ওই তত্ত্বের বিরোধী আর কিছু কখনো পরীক্ষা ক’রে দেখতে দেয়া হয় নি। নারীপুরুষের অসাম্য, মিলের মতে, বিশেষ বিচারবিবেচনার ফল নয়; এর উদ্ভব ঘটেছে পুরুষের শারীরিক শক্তির ফলে। পুরুষ শক্তিবশত নারীকে নিজের অধীন করেছে। পরে আইন বিধিবদ্ধ করেছে তাই। মিল দেখিয়েছেন শক্তিপ্রয়োগের ফলেই সূচনা ঘটেছে সব রকম আধিপত্য ও অধীনতার, তারপর আধিপত্য ও অধীনতাকেই পরিণত করা হয়েছে বিধানে। নারীর অধীনতাকে মিল তুলনা করেছেন দাসত্বপ্রথার সাথে। মিল দেখিয়েছেন দাসত্ব শুরুতে ছিলো প্ৰভু ও দাসের মধ্যে শক্তির ব্যাপার; কিন্তু পরে তা বিধানে পরিণত করা হয়। প্রভুরা একত্র হয়ে দাসত্বকে পরিণত করে বিধানে। মিলের মতে প্ৰাচীন কালে অধিকাং নরনারীই ছিলো দাস; পরে মুক্তি লাভ করে পুরুষ দাসেরা, আর নারীকে বিন্যস্ত করা হয় একটু কোমল ধরনের অধীনতার ভেতবে। বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তার মূলে রয়েছে শক্তিমানের আইন। মিল মনে করেন শক্তিমানের আইন এখন পরিত্যক্ত হ’লেও তা রয়ে গেছে নানা এলাকায়, যেমন নারীর বেলা। শক্তিমানের বিধি অনুসারে নারী পরিণত হয়েছে গৃহদাসীতে।

পুরুষতন্ত্র প্রচার করে যে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। কোনো কিছুকে প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে তা মানুষের তৈরি নয়, তা কোনো শাশ্বত বিধানের ফল। তাই তা প্রশ্নের ওপরে, তা অসংশোধনীয়। কিন্তু মানুষের জীবনে কোনো কিছুই শাশ্বত নয়; বিধাতা, ধর্ম, রাজা, প্ৰজা, ধনী, দরিদ্র সবই মানুষের তৈরি। সুবিধাভোগীরা চিরকালই দোহাই দেয় ঈশ্বরের, প্রকৃতির, স্বভাবের; কেননা তাতে রক্ষা পায় তাদের স্বার্থ। মিল (১৮৬৯, ২১) প্রশ্ন করেছেন, ‘এমন কি কোনো আধিপত্য রয়েছে, যা প্রাকৃতিক মনে হয় নি প্ৰভুদের কাছে?’ তিনি দেখিয়েছেন এক সময় মানবসমাজকে ভাগ করা হতো দুটি ভাগে : ছোটো ভাগটিতে পড়তো প্রভুরা আর বড়ো ভাগটিতে দাসেরা, এবং তাকেই মনে করা হতো প্রাকৃতিক; এমনকি শ্রেষ্ঠ পুরুষেরাও তাই মনে করতো। জ্ঞানী আরিস্তলের কাছেও প্ৰভু ও দাসের বিভাগকে মনে হয়েছিলো প্রাকৃতিক। তিনি মনে করতেন মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে দুটি ভাগ : একটি স্বাধীন প্রকৃতির, যেমন গ্রিকরা; আরেকটি দাসপ্রকৃতির, যেমন থ্রেসীয় ও এশীয়রা। মার্কিন দাসমালিকেরাও প্রাকৃতিক বলে মনে করতো শাদার প্রভুত্ব ও কালোর দাসত্বকে। রাজতন্ত্রবাদীরা সব সময়ই মনে করেছে যে রাজতন্ত্রই প্রাকৃতিক। এসবের মূলকথা হচ্ছে যারা জোর ক’রে ক্ষমতা দখল করেছে, যারা প্ৰভু হয়ে উঠেছে, তাদের কাছে প্ৰভুত্ব মানেই প্রাকৃতিক। চিরকাল বিজয়ীরা মনে করেছে যে প্রকৃতির নির্দেশ হচ্ছে বিজিতরা অধীনে থাকবে বিজয়ীদের। মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুরা নিজেদের প্রভুত্বকে মনে করতো প্রাকৃতিক; নিম্নশ্রেণীর মানষেরা তাদের সমান হবে এমন ভাবনাকে তারা মনে করতো সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক বা অর্থাভাবিক। তা-ই মানুষের কাছে অস্বাভাবিক/ অপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়, যা অপ্রথাগত; যা প্রথায় পরিণত হয়েছে, তা যতোই অস্বাভাবিক উৎকট পাশবিক হোক-না-কেনো, তা-ই মানুষের কাছে স্বাভাবিক। মিল (১৮৬৯, ২২-২৩) তথাকথিত প্রাকৃতিককে নির্দেশ করেছেন প্ৰথা বলে :

‘এটা এতো সত্য যে অস্বাভাবিক বলতে সাধারণত বোঝানো হয় শুধু অপ্ৰথাগতকে, আর যা কিছু প্রথাগত তাকেই মনে করা হয় প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক। নারীর পুরুষাধীনতা যেহেতু বিশ্বজনীন প্রথা, তাই এর থেকে সামান্য স’রে যাওয়াকে মনে হয় অস্বাভাবিক।‘

অপ্ৰথাগত ব’লে অস্বাভাবিক মনে হওয়ার নানা উদাহরণ দিয়েছেন মিল। বিলেতের শাসক একজন নারী, এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয় পৃথিবীর নানাদেশের মানুষের কাছে; রানীর শাসন তাদের কাছে অবিশ্বাস্যরূপে অস্বাভাবিক। ইংরেজের কাছে এটা অস্বাভাবিক নয়, কেননা এতে তারা অভ্যস্ত; কিন্তু নারীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বা সংসদ সদস্য হওয়া তাদের কাছে অস্বাভাবিক। চিরকালই সুবিধাবাদী শোষকেরা নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখার জন্যে দোহাই দেয় প্রকৃতির। নারীকে বশে রাখার জন্যে তারা দোহাই দিয়েছে প্রকৃতির। মিল ‘প্রাকৃতিক’ ধারণাকেই বাতিল ক’রে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা এবং তাদের সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক অবস্থাকে প্রাকৃতিক বলে দাবি করা একধরনের রাজনীতি। মিলের কাছে কোনো কিছুই প্রাকৃতিক নয়। পুরুষতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর দাসীত্ব প্রাকৃতিক; মিল দেখিয়েছেন এটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম।

পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে থাকে যে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ভিন্ন অন্যান্য আধিপত্য থেকে, কেননা এটা শক্তির আধিপত্য নয়; নারী এ-আধিপত্য মেনে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে স্বেচ্ছায়। এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই নারীর, নারী স্বীকৃতি দিয়েছে এ-আধিপত্যকে। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে; এখনকার নারীপুরুষের অবস্থা দেখে মনে হতে পারে যে পুরুষাধিপত্য নারীর কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে প্রকৃত সত্যটি যে নারী পুরুষাধীনতা মেনে নেয় নি। মিল বলেছেন, বহু নারী পুরুষাধিপত্যকে স্বীকার করে না; অনেকে লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে তাদের মনোভাব, এবং এখন নারীরা এর বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ জানাচ্ছে প্রকাশ্যে। নারীরা ভোটাধিকার চায়, চায় পুরুষের সাথে সমান শিক্ষা ও পেশা। মিলের সময় পর্যন্ত নারীবাদীরা স্পষ্টভাবে বলে নি যে তারা পুরুষাধিপত্য মানে না, তারা সম্পূর্ণ মুক্তি চায়; কিন্তু মিল তাদের আন্দোলনে দেখেছেন পূর্ণ মুক্তির অভিলাষ। মিল বলেছেন, কোনো পরাধীন শ্রেণীই একবারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে না। যারা বহুদিন প্রচলিত কোনো শক্তির অধীনে থাকে, তারা শুরুতেই ওই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় না, প্রতিবাদ জানায় শুধু তার পীড়নের বিরুদ্ধে। অসংখ্য নারী প্রতিবাদ জানায় তাদের স্বামীদের পীড়নের বিরুদ্ধে। মিল বলেছেন, নারীরা একযোগে নানা কারণে পুরুষের ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে না। তারা অন্য সমস্ত অধীন-শ্রেণী থেকে ভিন্ন; তাদের প্রভুরা তাদের কাছে শুধু শ্ৰম চায় না, প্রভুরা তাদের কাছে শ্রমের থেকে কিছুটা বেশি চায়। পুরুষ শুধু নারীদের আনুগত্য চায় না, পুরুষ চায় নারীদের আবেগানুভূতি। শুধু বর্বর ছাড়া কোনো পুরুষই নারীকে একটি বাধ্য ক্রীতদাসী হিশেবে পেতে চায় না, চায় একটি স্বেচ্ছাদাসী; পুরুষ তার নারীর কাছে শুধু দাসী চায় না, চায় প্রিয়দাসী। তাই পুরুষ সব রকমের চেষ্টা চালায় নারীর মনকে দাসীতে পরিণত করার। অন্য ধরনের দাসদের প্রভুরা ভয় জাগিয়ে আনুগত্য আদায় করে দাসদের কাছ থেকে, আর নারীর প্রভুরা যেহেতু শুধু আনুগত্যে সুখী নয়, যেহেতু তারা নারীর কাছে চায় আবেগানুভূতি, তাই তারা নারীকে দেয় এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। পীড়ন ক’রে নয়, শিক্ষা দিয়ে পুরুষ নারীকে ক’রে তোলে প্রিয় ক্রীতদাসী। পুরুষতন্ত্রের উদ্ভাবিত নারীশিক্ষা হচ্ছে নারীকে পুরুষের দাসী করার শিক্ষা। শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তাদের প্রকৃতি পুরুষের বিপরীত; নারীরা নিয়ন্ত্রণ করবে না, তারা আত্মসমৰ্পণ করবে। অন্যের নিয়ন্ত্রণের কাছে; সব ধরনের নীতিশাস্ত্র শেখায় যে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণই তাদের কর্তব্য; আর সব ধরনের ভাবালুতা তাদের শেখায় যে নারীর প্রকৃতি হচ্ছে অন্যের জন্যে বেঁচে থাকা, নিজেদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা। বঞ্চিত হওয়াই নারীত্ব! নিজের স্বার্থে নিজের অধীনে রাখার জন্যে পুরুষ নারীকে এমন শিক্ষা দিয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যাতে নারী হয়ে উঠেছে বিনম, বশ্যতাপরায়ণ, এবং নিজের অভিলাষ ছেড়ে দিয়েছে সে পুরুষের হাতে।

পুরুষতন্ত্রের মতে বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অবস্থা, পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা, ঘটেছে নারীপুরুষের স্বভাব বা প্রকৃতি অনুসারে। মিল একে বাতিল ক’রে দিয়েছেন, কেননা তাঁর মতে নারীপুরুষের স্বভাব বিজ্ঞানসন্মতভাবে জানার মতো উপায় তখনো উদ্ধাবিত হয় নি। তাই তাদের স্বভাব বলে যা নির্দেশ করা হয়, তা বানানো জিনিশ। মিল (১৮৬৯,৩৮) বলেছেন :

‘একথা বলা যাবে না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি অনুসারেই তাদের বর্তমান ভূমিকা ও অবস্থান নির্ণীত হয়েছে, এবং এ-ই। তাদের জন্যে উপযুক্ত। সাধারণ বুদ্ধি ও মানবমনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমি একথা স্বীকার করি না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি কেউ জানে বা জানতে পারে, বিশেষ ক’রে যখন তাদের দেখা হয় তাদের বর্তমান পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসারে।… এখন যাকে নারীপ্রকৃতি বলা হয়, তা সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম জিনিশ–একদিকে তা পীড়নের, আরেক দিকে তা অস্বাভাবিক প্ররোচনার ফল। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আর কোনো অধীন-শ্রেণীর চরিত্র তাদের প্রভুদের সাথে সম্পর্কের ফলে এতো অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত হয় নি।‘

পুরুষ শিক্ষা দিয়ে বদলে, বিকৃত ক’রে দিয়েছে নারীর স্বভাবকে; নারীকে ক’রে তুলেছে বশ্যতাপরায়ণ, ভীরু, ভাবালুতগ্রস্ত, এবং এর ফলে নারীকে আর যোগ্য মনে হয়। না কোনো মানবিক কাজের। নারীপুরুষের স্বাভাবিক পার্থক্য কোথায়? পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে যে তারা তা জেনে গেছে সম্পূর্ণরূপে; কিন্তু মিলের মতে সমাজের বর্তমান অবস্থায় তা জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব। মিল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্বভাবের ওপর প্রতিবেশের প্রভাবের দিকে। নারীপুরুষের নৈতিক ও মননগত পার্থক্য যতো ব্যাপকই মনে হোক-না-কেনো এখন, মিল তাকে কিছুতেই স্বাভানিক পার্থক্য বলে মেনে নিতে রাজি নন। কেননা শিক্ষা ও প্রতিবেশের প্রভাবে নারী তার প্রকৃত স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে, গ্রহণ করেছে কৃত্রিম স্বভাব। মিলের মতে, পুরুষ নারীকে যা মনে করে নারী তা নয়। পুরুষ নারী সম্পর্কে যা বলে তা ঠিক নয়, নারীর কথা বলতে পারে শুধু নারী।

পুরুষ সাধারণত ধারণা করে যে নারীর ভূমিকা হচ্ছে স্ত্রী ও মাতার। মিল একে শুধু ধারণা ব’লেই মনে করেন, ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন না, কেননা সমাজের বর্তমান অবস্থায় জানার কোনো উপায় নেই নারী নিজেকে দেখতে পছন্দ করে কোন ভূমিকায়। এমনও হতে পারে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাকে ঘেন্না করে তারা; তবে নারীদের যেহেতু স্বাধীনভাবে কোনো ভূমিকা বা পেশা বেছে নিতে দেয়া হয় নি, তাদের ওপর যেহেতু চাপিয়ে দেয়া হয়েছে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা, তাই তারা বাধ্য হয়ে তা পালন করে; কিন্তু একে তাদের স্বাভাবিক ভূমিকা মনে করার কোনো কারণ নেই। মিলের মতে দাসদের যেমন বাধ্য করা হতো বিশেষবিশেষ কাজ করতে, কারণ ওই কাজ সমাজের জন্যে দরকার, তেমনি নারীদের বাধ্য করা হয় বিয়েতে ও সন্তান লালনে, কেননা সমাজের তা দরকার। পুরুষ নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে। শুধু বিয়ের গলিটি, তাই ওই কানাগলিতে নারীকে ঢুকতেই হয়। মিলের মতে বিয়ে হচ্ছে নারীর সমাজনির্ধারিত নিয়তি। মিল দেখিয়েছেন এক সময় খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বামী ছিলো স্ত্রীর জীবনমৃত্যুর অধিপতি। মিল (১৮৬৯, ৫৫) বলেছেন :

‘এখন স্ত্রী হচ্ছে তার স্বামীর দাসখত দেয়া দাসী : আইনের চোখে তারা ক্রীতদাসদের থেকে একটুও কম দাস নয়। বেদীতে সে স্বামীর প্রতি জীবনব্যাপী আনুগত্যের শপথ নেয়।… স্ত্রী নিজের জন্যে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে পারে না, স্বামীর জন্যে পারে; তার সম্পত্তি অবলীলায় স্বামীর সম্পত্তি হযে ওঠে। বিলেতের সাধারণ আইনে স্ত্রীর অবস্থা অনেক দেশের ক্রীতদাসের অবস্থার থেকেও খারাপ।‘

মিল অবশ্য দেখিয়েছেন যে আইনের চেয়ে মানুষ, এমনকি পুরুষও অনেক ভালো; যদি তা না হতো তবে পৃথিবীটা বেশ একটা নরক হয়ে উঠতো। আইন পুরুষকে যতোটা নিষ্ঠুরতার অধিকার দিয়েছে পুরুষ ততোটা নিষ্ঠুর নয়, বা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব ততোটা নিষ্ঠুর হওয়া। তবে আইনে নারী পুরুষের দাসীই।

নারী পুরুষের ওপর নানা প্রভাব খাটাতে পারে, মেষ বানিয়ে রাখতে পারে পুরুষকে; কিন্তু নারীর ওই শক্তির কোনো কোনো মূল্য নেই। মিলের মতে নারীর এ-শক্তি কিছুতেই নারীর স্বাধীনতাহীনতার ক্ষতি পূরণ করতে পারে না। নারীর এ-শক্তি নারীকে অবৈধ অধিকার দিতে পারে, কিন্তু তাকে তার বৈধ অধিকার দাবি করার অধিকার দেয় না। মিল (১৮৬৯,৭০) বলেছেন, সুলতানের প্রিয় ক্রীতদাসীর অধীনেও থাকে অনেক দাসদাসী, তাদের ওপর সে উৎপীড়নও চালিয়ে থাকে; কিন্তু তাতে সে স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠে না, সে থাকে ক্রীতদাসীই। যা কাম্য তা হচ্ছে সে নিজেও দাসী হবে না, আর তার অধীনেও থাকবে না দাসদাসী। কোনোকোনো নারী থাকে অশেষ সুখ ও শক্তির মধ্যে, তবে তা দাসীর সুখ ও শক্তি; সে ওই সুখশক্তি পায় প্রভুকে সেবার ও প্রমোদ দেয়ার বিনিময়ে। মিল ভিক্টোরীয় সমাজের একটি ভণ্ডামোরও সমালোচনা করেছেন। ভিক্টোরীয়রা বারবার বলতো যে নারী পুরুষের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, আর একথা বেশি বলতো তারা, যারা নারীদের আসলেই মনে করতো দাসী। এটা কি এক পরিহাস নয় যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে? ভিক্টোরীয়রা নারীদের উৎকৃষ্টতায় বিশ্বাস করতো না, তবে তাদের বশে রাখার জন্যে করতো। এ-তোষামোদটুকু। মিল প্রশ্ন করেছেন, নারীরা উৎকৃষ্ট কিসে, এবং দেখিয়েছেন নারীরা পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট শুধু আত্মোৎসর্গপরায়ণতায়! কেননা পৃথিবী জুড়েই শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তারা জন্ম নেয় আত্মোৎসর্গের জন্যে; তারা নিজেদের যতো বঞ্চিত কববে ততোই উন্নতি ঘটবে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার! নারী বেঁচে থাকে নিজেকে বঞ্চনা করে, কেননা আত্মবঞ্চনাই পুরুষতন্ত্রের মতে নারীত্ব। মিল মনে করেন নারীপুরুষ যদি সমানাধিকার পায়, তবে লোপ পাবে নারীর এ-আত্মঘাতী প্রবণতা। ভিক্টোরীয়রা বড়াই করতো নৈতিকতায়, মিল তাদের নৈতিকতার ভেতরে লুকোনো অনৈতিকতার রূপটিও তুলে ধবেছেন। মিল মনে করেন সাম্যই নৈতিকতা, আর সে-সমাজই নৈতিক যেখানে রয়েছে সাম্য। এতোদিন ধরে যে-সমাজ চলে এসেছে, সেটা বলতান্ত্রিক সমাজ; সেখানে সমান হওয়ার অর্থই হচ্ছে শত্রু হওয়া। ওই সমাজ ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শেকল বা মইয়ের মতো, সেখানে কেউ ওপরে কেউ নিচে; তাতে কেউ আধিপত্য করে কেউ থাকে অধীনে। তাই প্ৰচলিত নৈতিকতা হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার নৈতিকতা। মিল মনে করেন আধিপত্য ও অধীনতা হচ্ছে সমাজের বিকার; সমাজের স্বাভাবিক রূপ হচ্ছে পারস্পরিক সাম্য। তিনি মনে করেন মনুষ্যত্ব নিহিত পরস্পরের সাথে সমভাবে বসবাসের মধ্যে। তিনি দেখিয়েছেন বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবার হচ্ছে স্বৈরাচারের রাজ্য; তবে তিনি মনে করেন ঠিক মতো গড়ে উঠলে পরিবার হবে স্বাধীনতার রাজ্য। মিল আক্রমণ করেছেন পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে, যেখানে পুরুষ প্ৰভু নারী তার অধীন। মিল দাবি করেছেন নারীপুরুষের আইনগত সমানাধিকার, পরিবারে কেউ প্ৰভু বা দাসদাসী হবে না; স্বামীস্ত্রী হবে সমান।

পুরুষতন্ত্র নারীপুরুষের বিশ্বকে দুটি পরিচ্ছন্ন ভাগে ভাগ করে; নারীর জন্যে বরাদ্দ করে ঘর, পুরুষের জন্যে বাইর। ভিক্টোরীয়রা ছিলো ঘরে বাইরে তত্ত্বের একনিষ্ঠ উপাসক। পুরুষ নারীকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে, তাকে মা-স্ত্রী-কন্যার ভূমিকা দিয়ে কেড়ে নেয তার সমস্ত মানবিক অধিকার। মানবিক প্রায় সব পেশাই তারা নিষিদ্ধ করে নারীর জন্যে। নারী যে ওই সব পেশার অযোগ্য, তা নয়; তবে পুরুষ জোর ক’রেই নারীকে ঘোষণা করে ওইসব পেশার অযোগ্য বলে। পুরুষের সমান হয়ে ওঠার জন্যে নারীর ফিরে পাওযা দরকার সমস্ত মানবিক পেশা। নারীপুরুষের সাম্যের জন্যে মিল নারীর জন্যে চেয়েছেন সে-সব ভূমিকা ও পেশা, যা এতোদিন ধরে রয়েছে পুরুষের অধিকারে। তিনি দেখিয়েছেন নারীকে সব পেশা ও ভূমিকা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, যাতে নারী পরিবারের মধ্যে সহজে মেনে নেয় পুরুষের আধিপত্য। তাঁর মতে অধিকাং পুরুষ সমান কারো সাথে বসবাসের কথা ভাবতেই পারে না। তাই পুরুষ নারীকে দূরে রেখেছে সমস্ত আকর্ষণীয় পেশা থেকে, যা নারীকে ক’রে তুলবে পুরুষের সমান। পুরুষ অবশ্য যুক্তি দেয় যে নারী ওই সব কাজের উপযুক্ত নয়, নারীর নেই ওই সব কাজের প্ৰতিভা বা যোগ্যতা। মিল ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে নারী সম্পর্কে এ-ধারণা সত্য নয়; সত্য হচ্ছে নারী সব কাজই যোগ্যতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে। তবে নারীকে অনেক কাজ করতেই দেয়া হয় নি, তাই তারা যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পায় নি। তাদের যে-কাজ করতেই দেয়া হয় নি, সে-কাজে তাদের অযোগ্যতা প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও বলা হয় তারা সে-কাজের উপযুক্ত নয়। মিল বলেছেন, এখনো কোনো নারী হোমার, আরিস্তাতল বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো দেখা দেয় নি; তাই ব’লে মনে করা যায় না যে কোনো কালে ওই মাপের কোনো নারী দেখা দেবে না। তবে নারীরা এলিজাবেথ বা জোয়ান অফ আর্ক হয়েছে। মিল দেখিয়েছেন এখনকার আইনের এক বিস্ময়কর বিধান হচ্ছে যে-কাজে নারীরা দক্ষতা দেখিয়েছে, সে-কাজ থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে নারীদের। এমন কোনো আইন নেই, যাতে নারীদের শেক্সপিয়র বা মোৎসার্ট হওয়া নিষেধ, তবে নারীরা রাজ্যশাসনে দক্ষতা দেখালেও তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা লাভ নিষিদ্ধ। এলিজাবেথ বা ভিক্টোরিয়া ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে, নইলে তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা পাওয়ার কোনো পথ ছিলো না। পুরুষতান্ত্র নারীর বিরুদ্ধে তোলে যে-সব অভিযোগ, মিল সেগুলোর উত্তর দিয়েছেন এক-এক করে, এবং দেখিয়েছেন সব অভিযোগই বানানো; সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। নারীর মেধা কম নয়, শক্তিও কম নয়; নারী কোনো কিছুতেই নিকৃষ্ট নয় পুরুষের থেকে; নারী পুরুষের সমান। তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার পরিপূর্ণ সাম্য। স্টুয়ার্ট মিল নারীপুরুষের সাম্য চেয়েছেন শুধু নারীর কল্যাণের জন্যে নয়, চেয়েছেন মানবজাতি ও সভ্যতার কল্যাণের জন্যে। মিলের বইটিকে সে-সময়ের নারীবাদীরা নিজেদের পবিত্র বই হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন; এবং তাঁর বিভিন্ন যুক্তি গত একশতকের বেশি সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে বই থেকে বইয়ে। নারীর মুক্তিতে মিল ও নারী-অধীনতার ভূমিকা অশেষ।
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নারীর শত্রুমিত্ৰ)


রবীন্দ্রনাথ, রুশো-রাসকিনের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ওই দুজন, ও আরো অনেককে, দিয়ে। রোম্যানটিক ছিলেন তিনি, এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্ৰেম, কবিতা, সমাজ, সংসার, রাজনীতি, জীবন, এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোম্যানটিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে-সবের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য। রুশো ও রাসকিনের নারীবিষয়ক লেখার সাথে পরিচিত ছিলেন তিনি, বোঝা যায়; নারী সম্পর্কে তাঁর অনেক উক্তিই রুশো-রাসকিনের প্রতিধ্বনি। মিলের সাথেও পরিচিত ছিলেন, যদিও মিলের সাথে তাঁর মিল ছিলো না; তাঁর মিল ছিলো টেনিসনের সাথে, এবং ‘প্রিন্সেস’-এর নারীবিষয়ক ধারণা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদায়। তার নারীধারণা রোম্যানটিক; বাস্তব নারী তিনি দেখেছেন, তবে অনেক বেশি দেখেছেন স্বপ্নের নারী। রোম্যানটিকের চোখে নারীমাত্রই তরুণী, রূপসী, মানসসুন্দরী, দেবী; আর তারা নিজেরা দেবতা। তারা অবাস্তব নারীর উপাসক, তারা জন্মজন্মান্তর ধ’রে স্তব ক’রে যেতে পারে লোকোত্তর নারীর; তবে বাস্তবে নারী তাদের কাছে গৃহিণী, সুন্দর করে যাকে বলা হতো ‘গৃহলক্ষ্মী’। রোম্যানটিকেরা অহমিকায় ছাড়িযে যায় বিধাতাকেও, তারা মানসসুন্দরীর স্তব করলেও নিজেদের দেখে নারীর স্রষ্টারূপে। রবীন্দ্রনাথও তাই দেখেছেন। রবীন্দ্ৰনাথ অপরূপ রূপসী নারীর স্তবগান করেছেন, কিন্তু নারীর বাস্তব অস্তিত্বও অনেক সময় স্বীকার করেন নি। রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখতে পছন্দ করতেন। স্বপ্নে ও ঘরে, নারী স্বপ্নে থাকবে নইলে থাকবে ঘরে; বাস্তবের অন্য কোথাও থাকবে না। দুই বোন (১৩৩৯) উপন্যাসের শুরুতে তিনি মন্তব্য কবেছেন, ‘মেয়েরা দুই জাতের, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন কথা শুনেছি। এক জাত প্ৰধানত মা, আর-এক জাত প্রিয়া।‘ কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এটা তার শোনার দরকার ছিলো না, এটা তাঁর নিজেরই কথা; একটি পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি একথা প্রমাণ করার জন্যেই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন না নারীমুক্তিতে, যদিও তার কোনো কোনো পংক্তি নারীবাদের ইশতেহারের মতো শোনায়; তিনি বিশ্বাসী ছিলেন পুরুষতন্ত্রে ও পুরুষাধিপতো। ভিক্টোরীয় ঘরেবাইরে তত্ত্বে তাঁর আস্থা ছিলো দৃঢ়, এ-নামে একটি উপন্যাস লিখে তিনি তা দেখিয়েছেন; এবং নারীপ্রকৃতি ব’লে পুরুষতন্ত্র যে-উপকথা তৈরি করেছিলো, তিনি ছিলেন তাতে অন্ধ বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথের নারীধারণা রুশো-রাসকিন-টেনিসনের নারীধারণারই বাঙালি রূপ; তাদের মতই তিনি ভিন্ন ভাষায় কিছুটা ভারতীয় ভাবাবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন না নারীর, ছিলেন নারীর প্রতিপক্ষের এক বড়ো সেনাপতি । তিনি চেয়েছিলেন নারীরা কবিতা পড়বে, আর হবে তাঁর মতো কবির একান্ত অনুরাগিনী ।

নারী সম্পর্কে তিনি লিখেছেন প্রচুর; কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্ৰবন্ধ, ভাষণ, ভ্ৰমণকাহিনীতে বারবার তিনি কথা বলেছেন নারী সম্পর্কে–বাঙালি, ভারতি, বিদেশি, এবং সনাতনী, শাশ্বতী, চিরন্তনী, কল্যাণী সম্পর্কে। তাঁর কথা ধাধায় ভরা, অনেক সময় কথা বলার জন্যেই কথা বলা! ঘুরিয়েপেঁচিয়ে সুন্দর কথা অনেক বলেছেন, যা প্রথম মনে হয় চমৎকার; কিন্তু একটু ভাবলেই ধরা পড়ে যে নারীকে তিনি মনে করেন অসম্পূর্ণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের চোখে পুরুষের বিকাশ ঘটেছে, বিবর্তন ঘটেছে সব কিছুর; শুধু বিকাশবিবর্তন ঘটে নি নারীর; এবং তিনি চান নারীর কোনো বিকাশ না ঘটুক, নারী থেকে যাক আদিমতম বা চিরন্তনী। পুরুষ মহাজগত পেরিয়ে চলে যাক, কিন্তু নারী থাকুক ঘরের কোণে কল্যাণী হয়ে। পুরোনো ভারতের ঋষিদের মতো আধুনিক ভারতের এ-ঋষি কুৎসা রটান নি নারীর নামে, বরং প্রতিবাদ করেছেন ওই সব আশীল কুৎসার; তবে পুরোনো ঋষিরা নারীদের যেখানে ও যে-ভূমিকায় দেখতে পছন্দ করতো, তিনিও পছন্দ করতেন তাই। বাস্তব নারী তাঁর চোখে গৃহিণী, আর অবাস্তব নারী মানসসুন্দরী, এমনকি জীবনদেবতা। পুরোনো ঋষিদের মানসসুন্দরীর মোহ ছিলো না, তবে রোম্যানটিক রবীন্দ্রনাথের সে-মোহ ছিলো প্ৰবল; ওই মোহটুকু বাদ দিলে নারী হচ্ছে গৃহিণী : জায়া ও জননী। নারী যে খাচায় বন্দী, এটা তাঁর চোখে পড়েছে; তবে তিনি খাঁচার রূপেই মুগ্ধ হয়েছেন, মনে করেছেন নারী আছে ‘যেন সোনার খাঁচায়’। নারী যে শেকলে বন্দী, তাও তার চোখে পড়েছে; তবে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন শেকলের রূপেই, মনে করেছেন শেকলটি সোনার। নারী যখন বন্দী, রবীন্দ্রনাথের চোখে নারী তখন ‘কল্যাণী’! রবীন্দ্রনাথের নারীধারণার বিবর্তন পরে আলোচনা করবো; শুরুতে তাঁর দুটি কবিতা পড়ে নিতে চাই, কেননা ওই কবিতা দুটিতে প্ৰকাশ পেয়েছে তাঁর নারীধারণার সম্পূর্ণ রূপ : নারীর বাস্তবতা ও অবাস্তবতা। সোনার তরী (১৩০০) কাব্যে আছে একটি কবিতা, যার নাম ‘সোনার বাঁধন’ (১২৯৯) :

বন্দী হয়ে আছো তুমি সুমধুর স্নেহে
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণ ক্ৰন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কন দুটি বহিতে্যুছ দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়নানন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজ
বহ্নিবাণ বীজসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্ৰেম-করুণার মাঝে
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখানি।

ভিক্টোরীয় ইংরেজ, বা উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাঙালি ভদ্রলোক গৃহিণীকে যেভাবে আদর্শায়িত ক’রে সুখ পেতো, এতে রূপায়িত হয়েছে সে-ছবিটিই। এর সাথে বাস্তবের মিল নেই। ভদ্রলোক বাঙালির চোখে যা ‘গৃহলক্ষ্মী’, ভিক্টোরীয়দের চোখে তা ‘অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’, দুটিই সুভাষণ। কবিতাটি বাস্তবভাবে পড়লে বোঝা যায় যে একটি স্বাধীন দেবীকে বন্দী করা হয়েছে বা বেঁধে ফেলা হয়েছে, বাঁধনটি অবশ্য সোনার। বন্দী ওই দেবীর কোনো দুঃখ আছে কিনা, তাতে কবির উৎসাহ নেই; তাকে যে বন্দী করা গেছে, এটাই বেশ স্বস্তিকর। এতে স্তব করা হচ্ছে শেকলটিরই। নারী বন্দী, বন্দীত্বই তার সুখ। পুরুষ স্বাধীন বীর, সব সময় সংগ্ৰাম ক’রে চলছে; পুরুষ এতোই বীর যে সে বন্ধনহীন দেবীকেও বেঁধে ফেলেছে। এখন দেবীর কাজ শুধু ‘শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন’। যদি ওই শুভকর্ম ও নিশিদিন সেবার একটি তালিকা তৈরি করা যায়, তাহলে দেবী আর দেবী থাকে না, হয়ে ওঠে গৃহপরিচারিকা। ওই দেবী ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে যায়, বাসন মাজে, স্বামীর খাবার তৈরি করে, শাশুড়ীর তিরষ্কার শোনে, স্বামীর জামার বোতাম শেলাই করে, বছরে বছরে নোংরা আঁতুড়ঘরে বাচ্চা বিয়োয়, বিয়োতে গিয়ে মারা যায় অনেকেই, আর যারা বেঁচে থাকে তাদের আর যা-ই থাক, রূপ নামের কিছু থাকে না, যা টানতে পারে কোনো রোম্যানটিক কবিকে বা মাংসাশী স্বামীকে। তখন পুরুষ পুরোনো দেবীকে ছেড়ে নতুন দেবী খোঁজে। রবীন্দ্রনাথ যখন গৃহিণীর দিকে তাকিয়েছেন, তখন তাকিয়েছেন রোম্যানটিকের চোখে, তাকে আদর্শায়িত করেছেন, যদিও তিনি নিজের ঘরেও আমন কোনো দেবী দেখেন নি। তবে তিনি চান বাস্তবে নারী হবে গৃহিণী। রোম্যানটিকের চোখে নারীর আরেক রূপ মানসী, তিন বছর পরে লেখা ‘মানসী’ (১৩০২) কবিতায় যার পরিচয় পাওয়া যায় :

শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দৰ্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না–
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্ৰাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা–
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।।

এ-কবিতায় পুরুষ নারীর দ্বিতীয় বিধাতা, যে অনেক শক্তিশালী প্রথম বিধাতার থেকে। প্রথমটি নারীকে সৃষ্টি করেছে, আর দ্বিতীয়টি সৃষ্টির নামে বন্দী করেছে নারীকে। কবিতাটিতে পুরুষ সক্রিয় : পুরুষ স্রষ্টা, স্থপতি, ভাস্কর, কবি, শিল্পী; নারী নিষ্ক্রিয় : নারী পুরুষের তৈরি মূর্তি; আর সম্ভোগসামগ্ৰী। কবিতাটিতে নারীর বাস্তব অস্তিত্বকেই অনেকটা অস্বীকার করা হয়েছে; নারী ‘অর্ধেক মানবী’, বা অর্ধেক বাস্তব; তার ‘অর্ধেক কল্পনা’ বা অর্ধেক অবাস্তব। এটি নারীর রোম্যানটিক স্টেরিওটাইপ। পুরুষের চোখে যদি নারী অর্ধেক কল্পনা হয়, তবে নারীর চোখেও পুরুষ অর্ধেক কল্পনা হওয়ার কথা; এবং পুরুষও তথাকথিত একলা বিধাতার সৃষ্টি নয়, নারীরও সৃষ্টি। তবে এ-কবিতায় বলা হয়েছে যে-নারীর কথা, সে সম্পূর্ণ কল্পনা; যার বাস পুরুষের ক্ষণায়ু উন্মাদনার মধ্যে। ওই মানসী যদি কবি বা পুরুষের স্ত্রী হয়, তবে দেখা যাবে মানসসুন্দরী মাছ কুটিছে রান্নাঘরে, বোতাম শেলাই করছে, আর অস্বাস্থ্যকর আঁতুড়ঘরে প্রসব ক’রে চলেছে বাচ্চাকাচ্চা! কবিতা হিশেবে চমৎকার এটি, তবে এটিতে প্রবলভাবে প্ৰকাশ পেয়েছে পুরুষতন্ত্র ও পুরুষাধিপত্যের অহমিকা। পুরুষ নারীকে সৃষ্টি করার নামে যে বন্দী করেছে, তাকে লজ্জা-সজা-আবরণ দিয়ে যে ঘরের মাঝে আটকে ফেলেছে, এটা চোখে পড়ে নি পড়ে নি রোম্যানটিকের।

রবীন্দ্ৰনাথ নারী সম্পর্কে গদ্যে প্রথম কথা বলেন বিলেতে গিয়ে [১৮৭৮-১৮৮০] ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’-এ (১৮৮১)। একটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্ত সমাজে গিয়ে সতেরো-আঠারো বছরের এক নারীসঙ্গকাতর রোম্যানটিক তরুণ উচ্ছসিত হয়ে পড়েন তরুণীদের দেখে, তাদের সংস্পর্শে এসে, তাদের সাথে হাতে হাত ধ’রে গালে গাল লাগিয়ে নেচে। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র ছেয়ে আছে নারী আর নাচের বিবরণে। তাঁর বিবরণে পাওয়া যায় উচ্চবিত্ত বিলেতি সমাজের যে-নারীদের, তারা ‘রাসকিনের মেয়ে’ বা ‘রানীর বাগানের পদ্ম’, যারা আপাদমস্তক অপদাৰ্থ : তারা নাচ, গান, ফ্লার্ট করা ছাড়া আর কিছু জানে না। বিলেতে গিয়েই তিনি তাদের সাথে মিশে যেতে পারেন নি, তাদের দেখেছেন দূর থেকে, এবং খুঁত খুঁজেছেন তাদের; তবে তাদের কাছাকাছি আসার পর উচ্ছসিত হয়েছেন। তাদের অন্তঃসারশূন্যতা তাঁর চোখে পড়েছে বিলেতে যাওয়ার সাথে সাথেই; ‘মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে…মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে থাকে, তুমি নাচে গিয়েছিলে কি না, কনসার্ট কেমন লাগল, থিয়েটারে একজন নূতন অ্যাকটর এসেছে, কাল অমুকু জায়গায় ব্যাণ্ড হবে ইত্যাদি (রবীন্দ্র-রচনাবলী:১, ৫৪২)। এ-বৰ্ণনায় রয়েছে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের জন্যে গৌরবজনক নারীবিদ্বেষ, যখন নারীবিদ্বেষই ছিলো অনেকটা বুদ্ধিজীবিতার লক্ষণ। সতেরো-আঠারো বছরের তুলনায় একটু বেশি পাকাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তবে তিনি ধ’রে নিয়েছিলেন যে নারীমাত্রই লঘু, যারা বেশভূষা, নাচ, অ্যাকটর প্রভৃতির ওপরে উঠতে পারে না। ভিক্টোরীয় সমাজ যে নারীদের তৈরি করেছে ওভাবেই, সেটা তার চোখে পড়ে নি। ওই নারীদের প্রাত্যহিক জীবন কর্মহীন প্রমোদের : ‘এ দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজায়, গান গায়, আগুনের ধারে আগুন পোহায়, সোফায় ঠেসান দিয়ে নভেল পড়ে, ভিজিটরদের সঙ্গে আলাপচারি করে ও আবশ্যক বা অনাবশ্যক মতে যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে’ (রর : ১, ৫৪২)। রবীন্দ্ৰনাথ ‘এ দেশের মেয়ে’ যাদের বলেছেন, তারা উচ্চবিত্ত অপদাৰ্থ নারী, সাধারণ নারীদের সাথে তাদের কোনো মিল নেই। এ-অকর্মী নারীদের তিনি সমালোচনা করেছেন, এমনকি যে-মেয়েরা বিয়ে না করে কিছু একটা করছে, তাদের কাজেরও বিদ্রুপ করেছেন : ‘এ দেশের চির-আইবুড়ো মেয়েরা কাজের লোক। টেমপারেন্স মীটিং, ওয়ার্কি মেনস সোসাইটি প্রভৃতি যতপ্রকার অনুষ্ঠানের কোলাহল আছে, সমুদয়ের মধ্যে তাদের কণ্ঠ আছে’ (রর : ১. ৫৪২)। ওই উচ্চবিত্ত নারীরা ওই সব ছাড়া আর কী করতে পারে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য বিপদে পড়তেন; এবং ওই সব ছাড়া তারা অন্য কিছু করলেও তিনি হয়তো তাদের সমালোচনা করতেন। তিনি ক্রমশ ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন পিয়ানোবাজানো মেয়েদের সাথে, দেখেছেন ‘এক-একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে’ , সুখ পেয়েছেন ‘শত রমণীর রূপের আলোকে গ্যাসের আলো ম্রিয়মাণ’ (রর : ১, ৫৪৪-৫৪৫) দেখে। তখনি তার মনে পড়েছে ‘আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পাই নে’ (রর : ১, ৫৫৫)। নারীদের সাথে মুক্তভাবে মিশতে পাওয়াটা তার নিজের জন্যে, নারীর জন্যে নয়; নারীর সাথে মুক্তভাবে মিশতে পাওয়ার বেশি স্বাধীনতা তিনি নারীর জন্যে চান না।

ভিক্টোরীয় সমাজে মেয়েদের জীবনের লক্ষ্য যে বিয়ে, সেখানে পুরুষই যে সর্বময়, ওই সমাজের সাথে বাঙালি সমাজের পার্থক্য যে গুণের নয় মাত্রার তা চোখে পড়েছে। তাঁর (রর : ১, ৫৭০) :

‘আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্যে প্রস্তুত করে, যথেষ্ট লেখাপড়া শেখায় না, কেননা মেয়েদের আপিসে যেতে হবে না; এখানেও তেমনি মাগ্‌গি দরে বিকোবার জন্যে মেয়েদের পালিশ করতে থাকে, বিয়ের জন্যে যতটুকু লেখাপড়া দরকার ততটুকু যথেষ্ট। একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা ফরাশি ভাষা বিকৃত উচ্চারণ, একটু বোনা ও সেলাই করা জানলে একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত রঙচঙে পুতুল গড়ে তোলা যায়। এ-বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের ও এ-দেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত মাত্র।…আমাদের দিশি মেয়েদের পিয়ানো ও অন্যান্য টুকিটাকি শেখাবার দরকার করে না, বিলিতি মেয়েদেরও অল্পসল্প লেখাপড়া শিখতে হয়, কিন্তু দুই-ই দোকানে বিক্রি হবার জন্যে তৈরি। এখানেও পুরুষেরাই হৰ্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের অনুগতা; স্ত্রীকে আদেশ করা, স্ত্রীর মনে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছেমত চালিয়ে বেড়ানো স্বামীরা ঈশ্বর নির্দিষ্ট অধিকার মনে করেন।‘

তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য সমাজ ও নারী দু-ই, তবে মেয়েদের ওপরই আক্রমণটা একটু বেশি; তিনি মনে করেছেন যেনো মেয়েরা নিজেরাই পুতুল হওয়ার জন্যে পাগল। অন্য ধরনের নারীও তিনি দেখেছেন ওই সমাজে; ফ্যাশনী মেয়ে ছাড়া বিলেতে আরো অনেকরকম মেয়ে আছে, নইলে সংসার চলত না। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মেয়েদের অনেকটা মেহনত করতে হয়, বাবুয়ানা করলে চলে না।…এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গিন্নিরা সাদাসিদে। যদিও তারা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি, তবু তারা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার’ (রর : ১, ৫৭০-৫৭১)। তিনি কিছুটা শ্ৰদ্ধাশীল সে-নারীদের প্রতি, যারা ফ্যাশনমত্ত নয়, যারা কমী, মধ্যবিত্ত, যারা আছে ব’লে ‘সংসার চলে’। তবে ওই ফ্যাশনমত্তরাই কিছুদিনের জন্যে তাঁকে ক’রে তুলেছিলো সীমিত নারীস্বাধীনতাবাদী, কেননা ওই স্বাধীনতাটুকু ছাড়া মেয়েদের নাচের আসরে পাওয়া অসম্ভব। মেয়েরা অবাধে নাচের আসরে আসতে না পারলে মেয়েদের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মতো তরুণেরা, যারা গালে গাল ঘষে নাচতে চায়। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রে তিনি নারীস্বাধীনতার অর্থাৎ নারীপুরুষের মেলামেশার পক্ষে কিছু মত প্রকাশ করেছিলেন, বাঙালি নারীকে ঘরে আটকে রাখার অপরাধে অভিযুক্ত করেছিলেন পুরুষদের। বলেছিলেন, ‘একজন বুদ্ধি ও হৃদয়বিশিষ্ট মানুষকে জন্তুর মতো, এমন কি তার চেয়ে অধম, একটা জড়পদার্থের মতো সম্পূর্ণরূপে নিজের প্রয়োজনের জিনিষ করে তোলা… এ-সকল যদি পাপ না হয় তবে নরহত্যা করাও পাপ নয়’ [য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র থেকে বর্জিত, উদ্ধৃত অনন্যা (১৩৯৪, ২০)]। এমন কয়েকটি স্ত্রীস্বাধীনতাবাদী অংশ বইটি থেকে বর্জনের সাথে সাথে রবীন্দ্ৰনাথ বর্জন করেছিলেন স্ত্রীস্বাধীনতার ধারণাটিও। রবীন্দ্ৰনাথের ওই স্ত্রীস্বাধীনতায় বিশ্বাস ছিলো বিলেতি তরুণীদের সাথে মেশার ফলে তরুণ রক্তমাংসের ভেতর থেকে বেরোনো অস্থায়ী উচ্ছাস, যা মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে নি। বাঙালি নারীকে অন্তঃপুর থেকে মুক্তি দেয়া সম্পর্কে যে-কয়েক পংক্তি লিখেছিলেন তিনি আঠারো-উনিশ বছর বয়সে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তা বই থেকে মুছে ফেলে তারুণ্যের অশিষ্ট উচ্ছ্বাসের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি দ্বিধা করেন নি।

এর পর দু-বছরের মধ্যেই রবীন্দ্ৰনাথ নিজে হন স্বামী (৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩), এবং এক দশক কাটার আগেই হয়ে ওঠেন নারীমুক্তিবিরোধী, সম্ভবত তখন তার তরুণীদের সাথে মেলামেশার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে। পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে তিনি আয়ত্ত করে ফেলেন নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় ও ভারতীয় দর্শন : প্ৰবক্তা হয়ে ওঠেন ‘ঘরেবাইরেতত্ত্বের’, ‘প্রকৃতিতত্ত্বের’, ‘নারীপুরুষের অসাম্যতত্ত্বের’, ‘পরিপূরকতত্ত্বের’ এবং আপন ক’রে নেন পুরুষতন্ত্রের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা। এর পরিচয় প্রথম ধরা পড়ে ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (১২৯৬, রব : ১২, ৪৫০-৪৫৫) নামের পত্রপ্রবন্ধে। মহারাষ্ট্র নারীবাদী রমাবাই নারীমুক্তি সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন পুনায় (জ্যৈষ্ঠ ১২৯৬), তবে শেষ করতে পারেন নি বক্তৃতাটি; পুরুষাধিপত্যবাদীদের প্রচণ্ড উৎপাতে তিনি স্থগিত করতে বাধ্য হন তাঁর বক্তৃতা। আটাশ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনো উৎপাত করেন নি, তবে ওই বক্তৃতা সম্পর্কে তিনি যে-মত দিয়েছেন তাতে তাঁর পুরুষাধিপত্যবাদিতা প্ৰকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে। তিনি রুশো-রাসকিন, ভিক্টোরীয় ও সমগ্র পুরুষতন্ত্রের মতো বিশ্বাস করেন যে নারীপুরুষ সমকক্ষ নয়, নারী প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট। একজন চমৎকার ভিক্টোরীয় হিশেবে তিনি নারীদের মধ্যে দেখেছেন শুধু রূপ আর আবেগ, দেখেছেন নারীদের শক্তিহীনতা, প্রতিভাহীনতা, আর এ-সবই তাঁর মতে প্রাকৃতিক। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা সকল বিষয়েই যদি পুরুষের সমকক্ষ, তাহলে পুরুষের প্রতি বিধাতার নিতান্ত অন্যায় অবিচার বলতে হয়।’ তার চোখে নারীপুরুষের অসাম্যই ন্যায়সঙ্গত, আর সাম্য অন্যায়; প্রকৃতি বা বিধাতা এমন অন্যায় করতে পারে না। ভিক্টোরীয়দের মতো তিনি নারীপুরুষকে প্রাকৃতিকভাবেই দুটি বিপরীত ও পরিপূরক জাতির সদস্য ব’লে মনে করেন :

‘আমরা যেমন বলে শ্ৰেষ্ঠ, মেয়েবা তেমনই রূপে শ্রেষ্ঠ; অন্তঃকরণের বিষয়ে আমরা যেমন বুদ্ধিতে শ্ৰেষ্ঠ, মেয়েরা তেমনই হৃদয়ে শ্ৰেষ্ঠ; তাই স্ত্রী পুরুষ দুই জাতি পরস্পর পরস্পরকে অবলম্বন করতে পারছে। স্ত্রীলোকের বুদ্ধি পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অল্প বলে…স্ত্রীশিক্ষা অত্যাবশ্যক এটা প্রমাণ করবার সময় স্ত্রীলোকোব বুদ্ধি পুরুষের ঠিক সমান এ কথা গায়েব জোরে তোলাবার কোনো দরকার নেই।‘

রুশো-রাসকিন-টেনিসন ও সমগ্র পুরুষতন্ত্র এখানে কথা বলছে রবীন্দ্রনাথের মুখে। তাঁর কিছু বিশ্বাস বেশ ভয়ঙ্কর, যেমন বিশ্বাস করেন তিনি প্রাকৃতিক ও সামাজিক অসাম্যে। তিনি বিশ্বাস করেন পরস্পরকে অবলম্বন করতে হ’লে সমান হ’লে চলে না, হতে হয় অসম; এটা শুধু পারিবারিকভাবেই ভয়ঙ্কর তত্ত্ব নয়, সামাজিকভাবেও ভয়ঙ্কর। পুরুষের বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠতা সম্পর্কে তিনি এতো নিশ্চিত যে সে-সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি রুষ্ট হন। তিনি বিশ্বাস করেন একটি বানানো উপকথায় যে নারী বুদ্ধিতে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট: এবং ঘোষণা করেন ‘মেয়েরা কখনোই পুরুষদের সঙ্গে (কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে) বুদ্ধিতে সমকক্ষ হবে না।’ পুরুষাধিপত্যবাদীরা বারবার যুক্তি দেয় নারীর প্রতিভা নেই, পৃথিবীতে কোনো বড়ো নারীপ্রতিভা জন্মে নি, মিল যা খণ্ডন করেছেন নারী-অধীনতায় (১৮৬৯); কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯-এ পেশ করেছেন পুরুষাধিপত্যবাদীদের পুরোনো যুক্তি আর উদাহরণ :

‘মেয়েব এতদিন যেরকম শিক্ষা পেয়েছে তাই যথেষ্ট ছিল …শ্ৰীজাতির মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কবির আবির্ভাব এখনো হয় নি। মনে ক’রে দেখো, বহুদিন থেকে যত বেশি মেয়ে সংগীতবিদ্যা শিখছে এত পুরুষ শেখে নি। য়ুরোপে অনেক মেয়েই সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পিয়ানো ঠং ঠাং এবং ডোরেমিফা চেঁচিয়ে মরছে, কিন্তু তাদের মধ্যে ক’টা, Mozart কিংবা Beethoven জন্মাল।‘

পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছেন ব’লেই তিনি বলতে পেরেছেন মেয়ের যে-শিক্ষা পেয়েছে, তাই যথেষ্ট। মেয়েদের যে-শিক্ষা দেয়া হয়েছে এতোদিন, তা কোনো শিক্ষাই নয়; তা পুরোপুরি অশিক্ষা। ওই অশিক্ষার মধ্যে থেকে যে কারো পক্ষে ভিঞ্চি, দান্তে বা বিটোফেন হওয়া সম্ভব নয়, তা রবীন্দ্রনাথ, একজন প্রবল পুরুষাধিপত্যবাদী, মানেন নি; এও তাঁর মনে পড়ে নি যে পৃথিবীতে মোৎসার্ট-বিটোফেন দুটির বেশি জন্মে নি—পুরুষমাত্ৰই একেকটি সম্ভাব্য মোৎসার্ট বা নিউটন বা রবীন্দ্রনাথ নয়; এবং রুশোর মতো বলেছেন, ‘প্ৰতিভা একটা শক্তি (ঋভণবথহ), তাতে অনেক বল আবশ্যক, তাতে শরীর ক্ষয় করে। তাই মেয়েদের একরকম গ্ৰহণশক্তি ধারণাশক্তি আছে, কিন্তু সৃজনশক্তির বল নেই’, বা ‘মেয়েদের একরকম চটপটে বুদ্ধি আছে, কিন্তু সাধারণত পুরুষদের মতো বলিষ্ঠ বুদ্ধি নেই।’ উগ্র পুরুষাধিপত্যবাদী রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছেন, ‘মেয়েরা হাজার পড়াশুনো করুক, এই কার্যক্ষেত্রে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে নাবতে পারবে না।’ মেয়েদের পড়াশুনোয় তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই, বা তিনি মনে করেন মেয়েদের পড়াশুনো বিশেষ কাজে লাগে না; তবে তার আপত্তি ‘কার্যক্ষেত্ৰ’ দখলে। পুরুষ যে-সমস্ত পেশা দখল ক’রে রেখেছে, সেগুলোতে নারী ঢুকুক তা তিনি চান না; নারী যদি নিষেধ না শুনে সেখানে ঢুকে পড়ে তাহলে তিনি চান তার ব্যর্থতা।

নারীপুরুষের অসাম্যকে শাশ্বত করার জন্যে এর পর তিনি সাহায্য নিয়েছেন। রুশো-রাসকিন ও ভিক্টোরীয়দের প্রকৃতিতত্ত্বে। সুবিধা ও আধিপত্যবাদীরা, এবং পুরুষতন্ত্র প্রকৃতিকে চিরকাল ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথও নারীদের ঘরে আটকে রাখার জন্যে দোহাই দিয়েছেন প্রকৃতির, যদিও প্রকৃতি নয় সমাজের চক্রান্তেই নারীরা বন্দী হয়ে আছে ঘরে। প্রকৃতির কণ্ঠস্বর শুনে তিনি তা বাঙলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন এভাবে :

‘যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাহিরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সে-রকম অভিপ্ৰায় না হত তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাত। যদি বল, পুরুষদের অত্যাচারে মেয়েদের এই দুর্বল অবস্থা হয়েছে, সে কোনো কাজেরই কথা নয়।‘

প্রকৃতির স্বর শোনা প্রথাবাদীদের স্বভাব, কেননা তাতে যুক্তি ও সত্যের বদলে উপস্থিত করা যায় অলৌকিক শক্তিকে, এবং সব কিছু চাপিয়ে দেয়া যায় শোষিতদের ওপর। প্রকৃতি স্থির ক’রে দিয়েছে যে মানুষ স্বামীস্ত্রী হবে, সংসার করবে, সমাজ বানাবে, রাষ্ট্র তৈরি করবে, একদল শোষণ করবে। আরেকদল শোষিত হবে, এটা খুবই হাস্যকর ও সুবিধাবাদী বিশ্বাস; রবীন্দ্রনাথ প্রথা-ও সুবিধা-বাদীদের মতো দোহাই দিয়েছেন প্রকৃতিরই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন নারীদের থাকতে হবে ঘরে, আর জীবনধারণের জন্যে নির্ভর করতে হবে পুরুষের ওপর : ‘যখন শারীরিক দুর্বলতা এবং অলঙঘনীয় অবস্থাভেদে মেয়েদের সেই গৃহের মধ্যে থাকতেই হবে তখন কাজে- কাজেই প্রাণধারণের জন্যে পুরুষদের প্রতি তাদের নির্ভর করতেই হবে।’ মেয়েরা যে ঘরের ভেতরে থাকে, এটাও এক উপকথা। সুবিধাভোগী শ্রেণীর নারীরাই ঘরে বন্দী থাকে, পুরুষকে সেবা ও দেহ দিয়ে ব্যবস্থা করে নিজেদের জীবিকার; কিন্তু অধিকাংশ নারী কাজ করে ঘরে ও বাইরে, যদিও তাদের বাইরের কাজ স্বীকৃতি পায় না, আর মূল্য পায় না ঘরের কাজ। রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত উচ্চবর্ণের নারীদের সম্পর্কেই, এবং প্রকৃতির দোহাই দিযে তাদেরই আটকে রাখতে চান ঘরে। নিম্নশ্রেণীর নারীরা নরকে যাক, সেটা তাঁর ভাবনার ব্যাপার নয়। নারীর দুরবস্থা যে পুরুষতন্ত্রেরই চক্রান্তের ফল, একথার প্রতিবাদ করেছেন তিনি সমস্ত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে।

রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির আন্দোলনের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে তাকে বলেছেন ‘কোলাহল’, এবং নারী-অধীনতাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন এমন কথা, যা শুধু নারীমুক্তির বিরুদ্ধেই যায় না, যায় মানুষের সব রকমের মুক্তির বিরুদ্ধেই :

‘আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল উঠেছে, সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়। পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত; তাতে এই হত যে, চরিত্রের ওপর অধীনতার কুফল ফলতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমন-কি অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদন করত। প্ৰভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তা হলে ভূত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না।‘

এর অর্থ হচ্ছে অধীনতা মেনে নেয়াই মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্ব; অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ বা বিদ্রোহ অন্যায়। এ-ধরনের বিশ্বাস অত্যন্ত ভয়ঙ্কর; এমন প্রতিক্রিয়াশীলতার উদ্দেশ্য সব রকমের শোষণকে তরল আধ্যাত্মিকতা দিয়ে গ্রহণযোগ্য ক’রে তোলা। নারী আন্দোলন তাঁর কাছে অমঙ্গলজনক, তা হ’তে পারে; কিন্তু তা মঙ্গলজনক নারীদের ও অধিকাংশ মানুষের জন্যে, যারা বিশ্বাস করে সাম্যে। নারী-আন্দোলন অসংগত হবে কেনো? তার বিশ্বাস পরাধীন থাকাই সঙ্গত; এ-ধরনের বিশ্বাসের সীমা বাড়িয়ে দিলে দাঁড়ায় যে রাজনীতিক স্বাধীনতা চাওয়াও অসঙ্গত, যা সব সময়ই বলে সাম্রাজ্যবাদীরা। ‘পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত’ বলে যে-সত্যে তিনি বিশ্বাস করেন, তাও সত্য নয়। মেয়েরা পুরুষাধীনতাকে ধর্ম মনে করতো না, পুরুষেরাই ওটাকে ধর্ম বলে চাপিয়ে দিয়েছিলো নারীদের ওপর, যেমন বৰ্ণভেদকেও ধর্ম বলে চাপিয়ে দিয়েছে শক্তিমানেরা। প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে খুব বিশ্ৰী যুক্তি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ : তাঁর মতে অধীনতা মেনে নিলে চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদিত হয়! এর অর্থ হচ্ছে খাঁটি দাসের চরিত্রই মহত্ত্বসম্পন্ন, বিদ্রোহী দাসেরা মহত্ত্বহীন। ভৃত্যের চরিত্রের মহত্ত্ব রক্ষার উপায় হচ্ছে জন্মজন্মান্তর ধ’রে ভূত্য থাকা! রবীন্দ্রনাথ, যাকে মনে করা হয় নিজের সময়ের থেকে অনেক অগ্রসর, পিছিয়ে ছিলেন নিজের সময়ের থেকে হাজার বছর।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস কিছু মানুষ জন্মে প্ৰভু হয়ে, আর কিছু মানুষ জন্মে দাস হয়ে; তাই তিনি মনে করেন, ‘কতকগুলি অবশ্যম্ভাবী অধীনতা মানুষকে সহ্য করতেই হয়।’ নারীর পুরুষাধীনতা, তার মতে, অবশ্যম্ভাবী, নারীকে তা সহ্য করতেই হবে; শুধু তা-ই নয়, পুরুষাধীনতাই নারীর জন্যে ধর্ম। পুরুষতন্ত্রের অবিচল অনুসারী। রবীন্দ্রনাথ স্বামীকে দেখেন নারীর দেবতারূপে, যাকে ভক্তি করা নারীর জন্যে ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের চোখে পরিবার, সামাজিক সংস্থা নয়, দেবমন্দির, যার অধিষ্ঠিত দেবতার নাম স্বামী; স্ত্রী তার, জন্মজন্মান্তরের, ভক্ত :

‘পতিভক্তি বাস্তবিকই স্ত্রীলোকের পক্ষে ধর্ম। আজকাল একরকম নিষ্ফল ঔদ্ধত্য ও অগভীর ভ্ৰান্ত শিক্ষার ফলে সেটা চলে গিয়ে সংসারের সামঞ্জস্য নষ্ট করে দিচ্ছে এবং স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই আন্তরিক অসুখ জন্মিয়ে দিচ্ছে। কর্তব্যের অনুরোধে যে-স্ত্রী স্বামীর প্রতি একান্ত নির্ভর করে সে তো স্বামীর অধীন নয়, সে কর্তব্যের অধীন।‘

ধর্ম যে বড়ো প্রতারণা ও পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা, তা মনে জাগার কথা নয় প্রথা ও পুরুষাধিপত্যবাদী রবীন্দ্রনাথের; তিনি বরং দাসত্বকেই মহিমান্বিত করেছেন ধর্মরূপে। স্বামীস্ত্রী মিলে গ’ড়ে তোলে একটি সামাজিক সংস্থা-পরিবার, তাতে ভক্তির কথা ওঠে না; তবে পুরুষ নারীকে দাসী ক’রেই স্বস্তি পায় নি, নিজেকে দেবতার স্তরে উঠিয়ে স্ত্রীর আনুগত্যকে ক’রে তুলেছে ঐশ্বরিক। শুধু আনুগত্যে নিশ্চিন্ত বোধ করেন না রবীন্দ্রনাথ, তিনি চান নিশ্চিত ভক্তি, কেননা ভক্তি হচ্ছে আত্মসমর্পণের বা সত্তাবিলোপের চূড়ান্তরূপ। ‘পতিভক্তি’র মতো একটি মধ্যযুগীয় ধারণা ও শব্দ যে তিনি ব্যবহার করেছেন, তা আমাদের খুব বিস্মিত করে। স্বামীর অধীনতাকে তিনি বিধিবদ্ধ করতে চেয়েছেন আধ্যাত্মিক ও ইহজাগতিক দু-রকম যুক্তি দিয়েই : স্বামীর অধীনে থাকা নারীর জন্যে একদিকে আধ্যাত্মিক ধর্ম, আরেক দিকে ইহজাগতিক কর্তব্য! দু-ধরনের শিকলেই নারীকে বেঁধেছেন তিনি। মনে রাখা দরকার যে এ-রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধ নন, ঐর বয়স উনত্রিশ! সংসারের সামঞ্জস্য নষ্ট হওয়ার জন্যে তিনি দোষী করেছেন। আজকালকার ‘একরকম নিম্বফল ঔদ্ধত্য ও অগভীর ভ্রান্ত শিক্ষা’কে। রবীন্দ্ৰনাথ যাকে ‘নিস্ফল ঔদ্ধত্য’ বলেছেন, তা ঔদ্ধত্য নয়, অধিকার দাবি, এবং গত একশো বছরে প্রমাণিত হয়েছে যে তা নিস্ফল নয়, বেশ সফল। তিনি যাকে ‘অগভীর ভ্রান্ত শিক্ষা’ বলেছেন, তাও অগভীর নয়, ভ্রান্ত তো নয়ই, তা-ই প্রকৃত শিক্ষা; আর রবীন্দ্রনাথ নারীর জন্যে যে-শিক্ষার কথা ভেবেছেন, তার গভীরতা- অগভীরতার কথাই ওঠে না, কেননা তা আসলে কোনো শিক্ষাই নয়।

স্বামীকে যিনি মনে করেন নারীর দেবতা, তিনি যে অবধারিতভাবে হবেন নারীমুক্তির বিরোধী, এটা আগে থেকেই ধ’রে নিতে পারি; আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাই। তিনি নারীমুক্তির বিরোধী হয়ে ওঠেন বিলেত থেকে ফেরার পরপরই; তাই তিনি মেনে নিতে পারেন নি নারীমুক্তি-আন্দোলনকারীদের। নারীদের আধুনিক শিক্ষা দেয়ারও তিনি ছিলেন বিরুদ্ধে। রবীন্দ্ৰনাথ জীবনে নানা ধরনের প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করেছেন, তারা সবাই যে তাঁর সত্যিকার প্রতিপক্ষ ছিলো, এমন নয়; অনেক সময় তিনি নিজেই ছিলেন প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষের সাথে রবীন্দ্রনাথের লড়াইয়ের রীতি হচ্ছে তিনি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন, তারপর উপহাস আর ব্যঙ্গ করেন। যদিও নারীমুক্তি-আন্দোলনকারীরা তার সাথে কোনো লড়াইয়ে লিপ্ত হন নি, তবুও তিনিই এগিয়ে গিয়ে লড়াইয়ে নামেন তাদের সাথে; এবং উপচে পড়ে তাঁর উগ্র পুরুষতান্ত্রিক ঘেন্না :

‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগতই নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষেব আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতা প্রাপ্ত হচ্ছে; অথচ সে-বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই।‘

তাঁর অবজ্ঞা আর ঘেন্না দেখে মনে হয় তিনি কোনো আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন শেষ খড়কুটো। তাঁর সংবেদনশীলতার অভাবও শোচনীয়; নারীমুক্তির দাবি তাঁর কাছে উপহাসের ব্যাপার- ‘নাকী সুরে’ বিলাপ। মনে হচ্ছে আদি-মধ্য-আধুনিক সমস্ত পুরুষতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি ঠেকাবেন নারীমুক্তি। তিনি ধ’রে নিয়েছেন নারীদের মুক্তি কখনো ঘটবে না, বা নারীদের মুক্তি ঘটা অনুচিত ও ক্ষতিকর। তিনি যাকে বলেছেন ‘স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন’, তা প্ৰভু ও এক বা একাধিক দাসীর বন্ধন, যাতে বাঁধা নারী। তিনি ওই বন্ধনের হীনতাপ্ৰাপ্তির ভয়ে উদ্বিগ্ন, যদিও সত্য হচ্ছে আন্তরিকভাবে ওই বন্ধন কখনোই উন্নত ছিলো না। নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে ভুলও বুঝেছেন রবীন্দ্রনাথ; তিনি মনে করেছেন নারীমুক্তির অর্থ হচ্ছে নারীরা বিয়ে করবে না। এমন একটা ভয় অবশ্য ছিলো ভিক্টোরীয়দের মনে; তারা মনে করতো নারী যদি মুক্তি পায়, পুরুষের পেশা অধিকার করে, সমান হয়ে ওঠে পুরুষের, তবে তারা বিয়ে করতেই অস্বীকার করবে। এটাও নারী সম্পর্কে পুরুষের ভুল ধারণার ফল : পুরুষ নিজের কামকেই প্রধান ক’রে দেখে দমিয়ে রেখেছে নারীর কাম, মনে করেছে কাম নারীর জন্যে খুবই গৌণ ব্যাপার, ওটা না হ’লেও চলে নারীর। তাই নারী যদি স্বায়ত্তশাসিত হয়, তবে নারীর বিয়ের কোনো দরকার পড়বে না; তখন পুরুষ তার মহৎ কামের অগ্নিতে জ্বলবে একলা। নারী মুক্তি চেয়েছে পুরুষের অধীনতা থেকে, বিয়ে থেকে নয়; তবে বিয়ে যে করতেই হবে, মাংসকে সুখী করার জন্যে বিয়েই যে বিকল্পহীন উপায়, তাও নয়। বিয়ে একটি প্রথা।

তিনি ভিক্টোরীয়দের মতো প্রকৃতির দোহাই দেন বারবার, ঘোষণা করেন প্রকৃতির বিধান বা নারীর নিয়তি হচ্ছে পুরুষাধীনতা :

‘নানা দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, সংসারের কল্যাণ অব্যাহত রেখে স্ত্রীলোক কখনো পুরুষের আশ্রয় ত্যাগ করতে পারে না। প্রকৃতি এই স্ত্রীলোকের অধীনতা কেবল তাদের ধর্মবুদ্ধির উপরে রেখে দিয়েছেন তা নয়, নানা উপায়ে এমনই আটঘটি বেঁধে দিয়েছেন যে, সহজে তার থেকে নিস্কৃতি নেই। অবশ্য পৃথিবীতে এমন অনেক মেয়ে আছে পুরুষের আশ্রয় যাদের আবশ্যক করে না, কিন্তু তাদের জন্যে সমস্ত মেয়ে-সাধাবণের ক্ষতি করা যায় না।‘

নারীকে পুরুষের অধীনে থাকতে হবে ‘সংসারের কল্যাণ অব্যাহত’ রাখার জন্যে, ও নারীর বিবেকের আদেশে; তবে নির্বোধ নারী সংসার কল্যাণেব কথা প্রাজ্ঞ পুরুষের মতো অতোটা ভাবতে নাও পারে, আর বিবেক বা ‘ধর্মবুদ্ধি’ নাও থাকতে পারে তার; তাই রাবীন্দ্রিক প্রকৃতি আগে থেকেই নিয়েছে উপযুক্ত ব্যবস্থা;–পুরুষের অধীনে রাখার জন্যে প্রাকৃতিক শেকলে বেঁধে নারীকে পাঠিয়েছে পুরুষের কারাগারে! প্রকৃতি পুরুষের ধর্মবুদ্ধির ওপর আস্থাশীল, তাই আটঘটি বেঁধে পুরুষকে পাঠায় নি; কিন্তু প্রকৃতি নারীকে বিশ্বাস করে না, প্রকৃতির আস্থা নেই নারীর ধর্মবুদ্ধিতে, তাই নারীকে করেছে দুর্বল, তাকে দিয়েছে প্রতি মাসের বিশ্ৰী ব্যাপার, দিয়েছে নিজের ভেতরে মানুষ জন্মানোর শাস্তি! তাই উদ্ধার নেই নারীর, তাকে মেনে নিতেই হবে পুরুষের অধীনতা! নারীকে থাকতে হবে পুরুষের আশ্রয়ে; রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর জন্যে এটাই লাভজনক, মুক্তি নারীর জন্যে ক্ষতিকর। প্ৰগতিবিরোধী হিন্দু ও ভিক্টোরীয় মানসিকতার মিশ্ররূপ মূর্ত দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। তিনি অবশ্য বলেছেন যে তার মতের সাথে স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতার কোনো বিরোধ নেই; তবে বিরোধ রয়েছে প্ৰচণ্ড, কেননা তিনি ‘স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতা’ বলতে যা বোঝেন, তা শিক্ষাও নয়, স্বাধীনতাও নয়।

রবীন্দ্ৰনাথ আটাশ-উনত্রিশ বছর বয়সে হয়ে ওঠেন চমৎকারভাবে প্ৰগতিবিরোধী। উনত্রিশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিলেতে যান তিনি, তবে তার প্রথম ও দ্বিতীয় বিলেত যাত্রার মধ্যে রয়েছে দু-মেরুর বৈপরীত্য : প্ৰথমবার তিনি গিয়েছিলেন ইউরোপের কাছে শিখতে, দ্বিতীয়বার যান ইউরোপকে শেখাতে, যদিও ইউরোপকে শেখানোর কাজটি করেন তিনি মনে মনে। নিজেকে তিনি গণ্য করেন এক তরুণ ভারতীয় গুরু ব’লে, যিনি ইউরোপ সম্পর্কে তৈরি ক’রে ফেলেছেন বা আহরণ করেছেন এমন এক ভুল দর্শন যে কর্ম-আবিষ্কার-উন্নতি মানুষকে অসুখী করে, আর ইউরোপ যেহেতু ওইসব করছে, তাই ইউরোপ খুব অসুখী! দ্বিতীয়বারের বিলেত যাত্রার বিবরণ লেখেন তিনি য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারিতে (১৮৯১), যার খসড়া অংশে প্রকাশ পায় ইউরোপ ও নারী সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ভারতীয় বদ্ধ মানসিকতা। তিনি পরে তা বাদ দেন বই থেকে; তবে নারী সম্পর্কে তার ওই সময়ের মত মেলে ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য” (১২৯৮, রব; ১২, ২৩৬-২৫০) প্রবন্ধে। তিনি বলেন, ‘য়ুরোপে সভ্যতা যত অগ্রসর হচ্ছে স্ত্রীলোক ততই অসুখী হচ্ছে’, যা শুনলে মনে হয় সুখ সম্বন্ধে সর্বজ্ঞ এক মহর্ষি বলছেন জীবনের সারকথা। এখানে অবশ্য কথা বলছেন রুশো, যার মতে সভ্যতা কৃত্রিম ব্যাপার, যা মানুষের সুখ নষ্ট করে। রবীন্দ্রনাথ একে একটু সংশোধন ক’রে প্রয়োগ করেন ইউরোপি নারীর ক্ষেত্রে। তার উক্তি পুরোপুরি ভুল ধারণার ফল : ‘সুখ’ ব্যাপারটিই বিভ্রান্তিকর, কেননা তা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত; আর সভ্যতার অগ্রসরতা নারীপুরুষ উভয়েরই জন্যে হয়েছে কল্যাণকর। তার কথার মধ্যে রয়েছে এক গোপন তুলনাও;– তিনি বলতে চান ভারতে সভ্যতা এগোচ্ছে না ব’লে ভারতীয় নারীরা খুব সুখে আছে!

রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের অধীনে ও ঘরে আটকে রাখার জন্যে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, নৈতিক কোনো অস্ত্রই অব্যবহৃত রাখেন নি; এবং শেষ অস্ত্রটি, আধুনিক কালে যার মহিমার শেষ নেই, সে-বৈজ্ঞানিক অস্ত্রটিও ব্যবহার করতে ভোলেন নি। তিনি নিউটনীয় সৌরলোকের দু-রকম শক্তির রূপ দেখেছেন নারীপুরুষের মধ্যে :

‘স্ত্রীলোক সমাজের কেন্দ্রানুগ (centrapetal ) শক্তি; সভ্যতার কেন্দ্রাতিগ শক্তি সমাজকে বহির্মুখে যে-পরিমাণে বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে, কেন্দ্ৰানুগ শক্তি অন্তরের দিকে সে-পরিমাণে আকর্ষণ করে আনতে পারছে না।…স্ত্রীলোকের রাজত্ব ক্রমশ উজাড় হয়ে যারার উপক্রম হয়েছে।‘

‘কেন্দ্ৰানুগ : কেন্দ্রাতিগ’ পরিভাষা ব্যবহার ক’রে রবীন্দ্রনাথ যে-কথাটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করেছেন, তার সরল বাঙলা অনুবাদ হচ্ছে যে নারীর জগত ঘর, আর পুরুষের জগত বাইর। নিউটনীয় সৌরজগতের সাথে ভিক্টোরীয়দের মতো তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন পরিবারের, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন নারীপুরুষের পৃথক জগত ও ভূমিকা। তবে এটা বিজ্ঞান নয়, অপবিজ্ঞান। সভ্যতার সংকটের জন্যে তিনি দায়ী করেছেন নারীকে; পুরুষ তার সাফল্যের জন্য বেরিয়ে পড়েছে বাইরে, শেষ নেই তার কর্ম-উত্তেজনার, কিন্তু নারী ঘরকে আকর্ষণীয় ক’রে তুলতে পারছে না বলে পুরুষ ঘরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ছন্দ, দেখা দিচ্ছে সভ্যতার সংকট। এর জন্যে দায়ী নারী। পুরুষ তো বেরিয়ে পড়বেই, নারীর কাজ তাকে ঘরে ফিরিয়ে এনে সুখশান্তিতে ভ’রে দেয়া, কিন্তু নারী তা আর পারছে না। রাসকিনও নারীপুরুষকে দেখেছেন এভাবেই। রুশো, রাসকিন ও আরো অসংখ্য ভিক্টোরীয়র মতো রবীন্দ্রনাথ নারীকে দেখছেন ঘরের সম্রাজ্ঞীরূপে, তিনি চান নারী থাকুক সেখানেই; নারী ঘরে না থাকলেই নষ্ট হয় সমাজের সামঞ্জস্য। নারীপুরুষকে এমন কেন্দ্রানুগ : কেন্দ্রাতিগ, ঘর : বাইর ধরনের সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় ও ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য একটিই; নারীকে পুরুষের অধীনে রাখা। নারী কেনো হবে কেন্দ্রানুগ, তার কেন্দ্রাতিগ হওয়ার কোনো বাধা নেই; পুরুষ কেনো হবে শুধু কেন্দ্রাতিগ, তার কেন্দ্রানুগ হওয়ার কোনো বাধা নেই। নারীপুরুষ একই সাথে হতে পারে ঘর ও বাইর, কেন্দ্রানুগ ও কেন্দ্রাতিগ; কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ভাবতে পারে না। প্রথা হিশেবে যা চ’লে এসেছে, তাকেই রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের ধ্রুব সূত্ৰ!

রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের নারীমুক্তির আন্দোলনকে মনে করেছেন সমাজের সামঞ্জস্যনাশের পরিণতি। যদি পশ্চিমি সভ্যতার কেন্দ্ৰানুগ-কেন্দ্রাতিগ শক্তি ঠিক মতো কাজ করতো, অর্থাৎ নারী থাকতো ঘরে আর পুরুষ বাইরে, তাহলে, তার বিশ্বাস, এমন নারীমুক্তির আন্দোলন দেখা দিতো না। ধ’রে নিতে পারি। যে তখন যেহেতু ভারতে ইউরোপীয় ধরনের নারীমুক্তির আন্দোলন দেখা দেয় নি, তাই ভারতীয় সমাজের সামঞ্জস্য ছিলো অটুট, বা ভারতীয় পুরুষেরা সমাজের সামঞ্জস্য রক্ষা করতো। সে-উপায়ে যেভাবে তারা পুনায় থামিয়ে দিয়েছিলো নারীমুক্তিবাদী রামাবাইর বক্তৃতা! নারীমুক্তির ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :

‘য়ুরোপে স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারপ্রাপ্তির যে-চেষ্টা করছে সমাজের এই সামঞ্জস্যনাশই তার কারণ বলে বোধ হয়। নরোয়েদেশীয় প্ৰসিদ্ধ নাট্যকার ইবসেন-রচিত কতকগুলি সামাজিক নাটকে দেখা যায়, নাট্যোক্ত অনেক স্ত্রীলোক প্রচলিত সমাজবন্ধনের প্রতি একান্ত অসহিষ্ণুতা প্ৰকাশ করছে, অথচ পুরুষেরা সমাজপ্রথার অনুকূলে। এইবকম বিপরীত ব্যাপার পড়ে আমার মনে হল, বাস্তবিক, বর্তমান য়ুবোপীয় সমাজে স্ত্রীলোকের অবস্থাই নিতান্ত অসংগত।‘

রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রস্তাব করেছেন এক ভয়ঙ্কর প্রগতিবিরোধী তত্ত্ব যে সমান অধিকার পাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সমাজের সামঞ্জস্যনাশ। তার কাছে অসাম্য হচ্ছে সামাজিক সামঞ্জস্য, আর সাম্যের অধিকার দাবি হচ্ছে সমাজের সামঞ্জস্য নষ্ট করা। তাঁর তত্ত্বানুসারে দরিদ্র সাম্য দাবি করতে পারবে না ধনীর সাথে, শোষিত সাম্য দাবি করতে পারবে না শোষকের সাথে, নারীও সাম্য দাবি করতে পারবে না পুরুষের সাথে; তাতে নষ্ট হয়ে যাবে সামাজিক সঙ্গীতের সুর, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য। অসাম্যই যে সামঞ্জস্যহীনতা, বিভিন্ন ধরনের অসাম্যের জন্যেই যে মানবসমাজ আজো সামঞ্জস্যহীন, তাই অসাম্য দূর ক’রেই যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রকৃত সামঞ্জস্য বা সৌন্দর্য, তা মনে পড়ে নি তাঁর। নারীমুক্তিবাদীরা চাইছিলো সমাজের বিশুদ্ধ সামঞ্জস্য সৃষ্টি করতে, তা তিনি বোঝেন নি, কেননা তার মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করছিলো প্ৰথা। তিনি ইবসেনের ‘পুতুলের খেলাঘর’ (১৮৭৯) নাটকের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তবে তিনি নোরা হেলমারের বিদ্রোহের প্রকৃতি অনুভব করার মতো সংবেদনশীল ছিলেন না। ইবসেন নাটকটিতে সরলভাবে বলেছেন যে নারী মানুষ। নোরা, লৈঙ্গিক বিপ্লবের প্রথম নায়িকা, যা প্রকাশ করে তা ‘অসহিষ্ণুতা’ নয়, সে সূচনা করে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের। নোরা তার স্বামীকে বলে :

‘তুমি আমার প্রতি সব সময়ই সদয় ছিলো। তবে তোমার গৃহটি ছিলো খেলাঘর। আমি ছিলাম তোমার পুতুল বউ, যেমন আমাদের বাড়িতে আমি ছিলাম বাবার পুতুল মেয়ে; আর এখানে শিশুরা আমার পুতুল। তুমি যখন আমাকে নিয়ে খেলতে তখন আমার খুব মজা লাগতো, যেমন শিশুদের নিয়ে আমি যখন খেলতাম তখন তারা খুব মজা পেতো। টোরভান্ড, এই হচ্ছে আমাদের বিয়ে… সন্তানদের মানুষ করার জন্যে আমি কীভাবে উপযুক্ত? তার আগে আমার আরেক কাজ আছে। আমি প্রথম শিক্ষা দেবো নিজেকে–তুমি আমাকে তাতে সহায়তা করাব মতো মানুষ নও। আমার নিজেকেই তা করতে হবে। আর সে-জন্যেই আমি ছেড়ে যাচ্ছি। তোমাকে, নিজেকে আর আমার চার পাশের সব কিছু বোঝার জন্যে আমাকে দাঁড়াতে হবে সম্পূর্ণ একলা! সে-জন্যেই আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারি না…’

এমন কথায় সমগ্র পুরুষতন্ত্র ও রবীন্দ্রনাথ আহত বোধ করবেন, এবং আহত বোধ করে নোরার স্বামীও। খাঁটি পুরুষাধিপত্যবাদী স্বামী হিশেবে সে নোরাকে বোঝায় স্বামী ও সন্তানের প্রতি নারীর রয়েছে ‘পবিত্র দায়িত্ব’; সবার আগে নোরা হচ্ছে ‘স্ত্রী ও মা’। কিন্তু নোরা মনে করে অন্যরকম :

‘আমার বিশ্বাস সবার আগে আমি একজন মানুষ, ঠিক তুমি যেমন; বা আমি চেষ্টা করবো একজন মানুষ হয়ে উঠতে। টোরভাল্ড, আমি জানি অধিকাংশ মানুষই মনে করবে যে তুমিই ঠিক, আর ওই ধরনের কথা পাওয়া যাবে বইপুস্তকে; তবে অধিকাংশ মানুষ কী বলে আর বইতে কী পাওয়া যায়, তা নিয়ে আমি খুশি থাকতে পারি না। নিজের জন্যে সব কিছু আমার নিজেকেই ভাবতে হবে, বুঝতে হবে…’
 
নোরা, ও পশ্চিমের নারীমুক্তিবাদীরা, নারীর জন্যে চেয়েছে মানুষের অধিকার; তারা অভিনয় করতে চায় নি। পুরুষতন্ত্রের দেয়া স্ত্রী বা মায়ের পার্টে। এটা কোনো অসঙ্গত ব্যাপার না হ’লেও রবীন্দ্রনাথের কাছে তা ‘অসংগত’। বৈষম্য আর নারীর পুরুষাধীনতা সঙ্গত তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ইউরোপের ‘স্ত্রীলোকেরা যেন তাদের স্ত্রীস্বভাবের জন্যে লজ্জিত।‘ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেন ‘স্ত্রীস্বভাব’ ব’লে একটা কৃত্রিম বিকৃত জিনিশে, যা মিল বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন ‘নারী-অধীনতায়’ (১৮৬৯)।

‘এক দশক আগে প্ৰথমবার বিলেতে গিয়ে সেখানকার নারীদের স্বাধীনতা দেখে তার মনে হয়েছিলো যে ভারতীয়রা নিজেদের প্রয়োজনে নারীদের ক’রে তুলেছে ‘জন্তু’ আর ‘জড়পদাৰ্থ’। এক দশকের মধ্যে তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ ভারতীয়, যিনি নারীদের ক’রে রাখতে চান ওই জন্তু আর জড়পদার্থ, যিনি বিশ্বাস করেন না নারীমুক্তিতে, যিনি প্রচার করেন ভারতীয় নারীর সুখের রূপকথা :

‘আমরা তো দেখতে পাই আমাদের দেশের মেয়েরা তাদের সুগোল কোমল দুটি বাহুতে দু-গাছি বালা পরে সিঁথের মাঝখানটিতে সিঁদুরের রেখা কেটে সাদাপ্রসন্ন মুখে স্নেহ প্ৰেম কল্যাণে আমাদের মধুর করে রেখেছেন। কখনো কখনো অভিমানের অশ্রুজলে তাদের নয়নপল্লব আর্দ্র হয়ে আসে, কখনো-বা ভালবাসার গুরুতর অত্যাচারে তাদের সরল সুন্দর সুখশ্ৰী ধৈর্যগম্ভীর সকরুণ বিষাদে স্নানকান্তি ধারণ করে;…যা হোক, আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি এবং তাঁরা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনো প্রকাশ করেন নি, মাঝের থেকে সহস্ৰ ক্রোশ দূরে লোকের অনৰ্থক হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় কেন।‘

যে-চোখে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এখানে ভারতীয় নারীদের, সে-চোখকে অন্ধ বললে ভুল বলা হয় না। তিনি নারীদের দেখেছেন পুরুষতন্ত্রের চোখে, আর রোম্যানটিকের দৃষ্টিতে; তার চোখে পড়েছে নারীর সুগোল কোমল বাহু, দু-গাছি বালা, স্নেহ প্রেম কল্যাণের মতো কল্পিত ব্যাপারগুলো। এ-বৰ্ণনা পড়ে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বাস্তব নারীদের কখনো দেখেন নি, বা দেখেছেন সামন্ত সচ্ছল পরিবারের অবাস্তব নারীদের, যাদের ছিলো সুগোল বাহু, এবং তা কোমলও, আর তাতে বালাও ছিলো; কিন্তু অধিকাংশ ভারতীয় নারীর রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতীয় নারীর দুর্দশা থেকে গেছে তার চোখের আড়ালে। ‘আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরা তো বেশ সুখে আছি’, তার এ-স্বীকারোক্তি হয়তো সত্য; তবে তারা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনো প্ৰকাশ করেন নি, একথা সত্য নয়। নারীরা তাদের অসুখের কথা বলেছে বা জানিয়েছে বারবার, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তাতে কান দেয় নি, বা তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। যেমন স্তব্ধ করেছে তারা রমাবাইকে। নারী যে অসুখী হতে পারে, তা-ই বিশ্বাস করতে পারে নি পুরুষাধিপত্যবাদীরা রবীন্দ্রনাথ তাদেরই একজন।

তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আমাদের সমাজের যেরকম গঠন, তাতে সমাজের ভালোমন্দ যা-ই হোক আমাদের স্ত্রীলোকেরা বেশ রকম সুখে আছেন। ইংরেজেরা মনে করতে পারেন লনটেনিস না খেললে এবং ‘বলে’ না নাচলে স্ত্রীলোক সুখী হয় না, কিন্তু আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস, ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ। তবে সেটা একটা কুসংস্কার হতেও পারে।’ একজন খাঁটি প্রথাবাদী ভারতীয় হিশেবে রবীন্দ্রনাথ জোর ক’রেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সুখে আছে ভারতীয় নারীরা। সুখ ব্যাপারটি খুবই মানসিক, সুখে থাকতে পারে রবীন্দ্রনাথের ভূত্য আর অসুখে থাকতে পারেন প্ৰভু রবীন্দ্রনাথ, তবে ভারতীয় নারীরা আসলে বেশ রকম সুখে ছিলো না। তিনি লন টেনিস খেলা আর বল নাচাকে নিন্দা করেছেন, তিনি মনে করেন ওগুলো নারীর সুখের জন্যে দরকার নয়; কিন্তু তিনি যদি ভারতীয় নারীদের কাছে জানতে চাইতেন এ-সম্পর্কে, তাহলে যে-উত্তর পেতেন তাতে ক্ষুব্ধ বোধ করতেন। দেখতেন খেলতে আর নাচতে চায় ভারতীয় নারীরাও! তিনি বিশ্বাস করেন, ‘ভালোবেসে এবং ভালোবাসা পেয়েই স্ত্রীলোকের প্রকৃত সুখ।’ তার উপলব্ধি চমৎকার, তবে প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষের সুখ কীসে;–ভালো না বেসে, ভালোবাসা না পেয়ে? পুরুষের জন্যে কি ভালোবাসা নিরর্থক? পুরুষ কি এমন জন্তু, যার দরকার নেই ভালোবাসার ও ভালোবাসা পাওয়ার? রবীন্দ্রনাথ নারীকে মনে করেছেন খেলার পুতুল, টোরভান্ডের মতো তিনিও পছন্দ করেন পুতুল খেলতে; মনে করেন নারীর কাজ হচ্ছে পুরুষকে ভালোবাসা, আর কখনো কখনো পুরুষের আদর পাওয়া। পুরুষের এ-ভালোবাসা যে অপমান, তা বুঝেছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘নারীর উক্তি’র নারীটি; সে জানিয়েছিলো, ‘আছি যেন সোনার খাঁচায় /একখানি পোষ-মানা প্ৰাণ! /এও কি বুঝাতে হয়–/প্রেম যদি নাহি রয়/হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান।’ ভারতীয় নারী হয়তো প্রাণভ’রে ভালোবেসেছে তাদের পুরুষদের, কিন্তু তারা ভালোবাসা পায় নি, পেয়েছে সোহাগের নামে অপমান। তবে ওই সোহাগও জোটে নি। অধিকাংশ নারীর ভাগ্যে।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, ‘আমাদের পরিবারে নারীহৃদয় যেমন বিচিত্রভাবে চরিতার্থতা লাভ করে এমন ইংরেজ-পরিবারে অসম্ভব।‘ ইংরেজ পরিবারের তুলনায় হিন্দু/ব্ৰাহ্ম পরিবারে নারীহৃদয়ের বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থ লাভের যে-বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তা চূড়ান্তরূপে মর্মস্পর্শী। নারীর ধারাবাহিক লাঞ্ছনাকে তিনি বলেছেন নারী হৃদয়ের চরিতার্থতা/ ভারতীয় নারীহৃদয়ের চরিতার্থতা প্রমাণের জন্যে তিনি তুলনা করছেন ইংরেজ চিরকুমারী ও ভারতীয় বিধবার মধ্যে :

‘বাহ্য সাদৃশ্যে আমাদের বিধবা য়ুরোপীয় চিরকুমারীর সমান হলেও প্রধান একটা বিষয়ে প্রভেদ আছে। আমাদের বিধবা নারীপ্রকৃতি কখনো শুষ্ক শূন্য পতিত থেকে অনুর্বরতা লাভের অবসর পায় না। তাঁর কোল কখনো শূন্য থাকে না, বাহু দুটি কখনো অকৰ্মণ্য থাকে না হৃদয় কখনো উদাসীন থাকে না। তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী। এইজন্যে চিরজীবনই তিনি কোমল সরস স্নেহশীল হয়ে থাকেন। বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ববন্ধন, বাড়ির পুরুষদেব সঙ্গে স্নেহভক্তিপরিহাসের বিচিত্র সম্বন্ধ; গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তার অভাব নেই।…বরং একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে, কিন্তু বিধবাদের হাতে হৃদয়ের সেই অতিরিক্ত কোণটুকুও উদ্যুবৃত্ত থাকতে প্রায় দেখা যায় না।‘

রবীন্দ্রনাথের মতো একজন স্পর্শকাতর রোম্যানটিক কবি কী ক’রে এতো সংবেদনহীন হয়ে উঠতে পারেন, তা ভাবতেও শোক জাগে। তিনি স্তব করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে শোচনীয় মর্মান্তিক এক ব্যাপারের। হিন্দু বিধবা সব ধরনের বিধবার মধ্যে শোচনীয়তম, তার জীবন হচ্ছে ধারাবাহিক সতীদাহ; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকেই বলেছেন ‘হৃদয়ের চরিতার্থতা’। যার জীবন সম্পূর্ণ শূন্য শুষ্ক পতিত অনুর্বর, তার জীবনকে কতকগুলো নিরর্থক শব্দে পূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ কি মনে করেন যে বিধবার জীবন ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তার নারীপ্ৰকৃতি হয়ে ওঠে বিচিত্ৰভাবে চরিতার্থ, কেননা তার আশ্রয়দাতা পরিবারটি তাকে এতো কাজ দেয় যে তাতেই সে ভরে ওঠে? রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা বাস্তবভাবে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় যে বিধবার নিজের সন্তান না থাকলেও পরের সন্তান পালন করতে করতে কাটে তার সকাল থেকে সন্ধ্যা। পরের সন্তান পালন কী কঠিন কাজ, তা জানে শুধু বিধবারাই। ‘তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী’;–এটা মধুর শোনালেও মধুর ব্যাপার নয়, খুবই বিষাক্ত ব্যাপার। এর বাস্তব অনুবাদ হচ্ছে বিধবা এমন মানুষ, যার নিজের কোনো সত্তা নেই জীবন নেই, সে ঘোরে অন্যদের কেন্দ্র করে; তার জীবন নিরবচ্ছিন্ন লাঞ্ছনার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই মধুর। ‘গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তাঁর অভাব নেই’, এর প্রথমাংশ সত্য না হ’লেও দ্বিতীয়াংশ খুবই সত্য যে বিধবা ক’রে থাকে দাসীর কাজ, আর তার কাজের কোনো শেষ নেই। ওই কাজের জন্যে সে পারিশ্রমিক পায় না, তার ভাগ্যে জোটে লাঞ্ছনা। ‘একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে’, কিন্তু তা থাকে না বিধবার; এর কারণ এ নয় যে তার হৃদয়পাত্র থেকে অমৃত উপচে পড়েছে, এসব তুচ্ছ কাজ করার মতো অবসর তার নেই। এর কারণ হচ্ছে দাসীর কোনো সুযোগ নেই ওই সব সামন্ত শখের। বিধবা হচ্ছে দণ্ডিত নারী, যে কোনো অপরাধ করে নি; কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথ নিরপরাধ নারীর ওই দণ্ডকেই মনে করেন। হৃদয়ের চরিতার্থতা!

এ-সময়ে (১৮৯১) তিনি নারীমুক্তি সম্পর্কে স্বেচ্ছায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নারীমুক্তিবাদী কৃষ্ণভাবিনী দাসের সাথে। কৃষ্ণভবিনী ‘শিক্ষিতা নারী’ (১২৯৮) নামের একটি প্রবন্ধে দাবি করেন নারীশিক্ষা, চান কিছুটা স্বাধীনতা। নারীকে ঘরছাড়া করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিলো না, তিনিও চেয়েছিলেন শিক্ষার সাহায্যে উন্নতজাতের নারী উৎপাদন করতে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যগ্র হয়ে পড়েন নারীকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে। তিনি নিজেকে দেখেন পুরুষতন্ত্রের মুখপাত্ররূপে, যাকে বাঁচানো তার কাজ, যার মহিমা রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব। পুরুষই যে নারীকে আটকে রেখেছে ঘরে, কৃষ্ণভাবিনীর এ-অভিযোগ কাটানোর জন্যে তিনি আবার দোহাই দেন প্রকৃতির [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ১৯)] :

‘প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কাৰ্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন–পুরুষের সাৰ্ব্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে–অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।‘

উনিশশতকের বাঙালি নারীরা নিজেদের অবস্থা বর্ণনার জন্যে দুটি রূপক ব্যবহার করেছেন বারবার : পিঞ্জর ও কারাগার। গৃহকে তারা দেখেছেন ওই রূপকে, তাঁরা দাবি করেছেন নারীকে সেখানে ঢুকিয়েছে পুরুষেরাই। কৃষ্ণভাবিনীও তা-ই বলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একে মনে করেন প্রকৃতির শাশ্বত বিধান। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস প্রকৃতিই বিকলাঙ্গ ক’রে তৈরি করেছে নারীকে, তাই তাকে থাকতে হবে ঘরে, মানতে হবে পুরুষাধিপত্য। ভিক্টোরীয়দের মতো রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নিজেকে উৎসর্গ করাই নারীত্ব। এ-সম্পর্কে কৃষ্ণভাবিনী যা বলেন, তা অবিস্মরণীয় [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ২০)] :

‘পরোপকার ও অন্যের জন্যে জীবন ধারণ করা যেমন নারীর উদ্দেশ্য, রমণী তেমনি নিজের নিমিত্তও বাঁচিয়া থাকে।‘

কৃষ্ণভাবিনীর উক্তির প্রথমাংশ উগ্র পুরুষতন্ত্রের সাথে আপোষ, আর দ্বিতীয়াংশ নিজেকে আবিষ্কার। নোরার মতো কৃষ্ণভাবিনী শুধু নিজের জন্যে বাঁচতে চান নি, জীবন ধারণ করতে চেয়েছেন প্রধানত পরেরই জন্যে, একটুকু শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছেন নিজের জন্যে। পুরুষতন্ত্র আর রবীন্দ্রনাথ তাতে রাজি নন; তিনি চান নারী হবে ক্রুশবিদ্ধ জিসাস, ত্যাগ স্বীকার করে যাবে আমরণ। নারীর যে-স্তব করেন তিনি, তা পুরুষ করেছে বারবার নারীকে নিজের বশে রাখার জন্যে [উদ্ধৃত, অনন্যা (১৩৯৪, ২১)] :

‘নারী নারী বলিয়াই শ্রেষ্ঠ। তিনি পুরুষের কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে যে শ্ৰেষ্ঠতর হইবেন তাহা নহে বরং বিপরীত ঘটিতে পারে, তাহাতে তাঁহাদের চরিত্রের কোমলতা, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তার সমাঞ্জস্য নষ্ট হওয়া আশ্চৰ্য নহে।‘

ভিক্টোরীয়রা নারীকে পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট ব’লে অবিরাম প্রশংসা করেছে, কিন্তু তাকে অধীনে রাখার সব রকম কৌশল নিয়েছে; ‘উৎকৃষ্ট’ কথাটি ছিলো এক নিরর্থক সুভাষণ। সে-নারীই ছিলো তাদের কাছে উৎকৃষ্ট, যে পুরুষের অধীনে থাকে। একে বিদ্রুপ ক’রে উনিশ শতকের এক বিলেতি ব্যঙ্গচিত্রকর একটি ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন, যাতে একটি পুরুষ চেয়ারে বসে তার স্ত্রীর দিকে পা বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘হে নারী, সৃষ্টির শ্ৰেষ্ঠ, মানবতার সমাজী, মানবজাতির জননী, আমার জুতো খোলো’ [দ্র ট্যানাহিল। (১৯৮০, চিত্র ১৯)]। মিল বলেছিলেন এটা এক পরিহাস যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে! নারী নারী বলিয়াই শ্ৰেষ্ঠ এক শূন্য বুলি। রবীন্দ্রনাথ ভালোভাবেই বিশ্বাস করেন ভিক্টোরীয় ঘরে বাইরে বা ভিন্ন এলাকাতত্ত্বে, এবং বিশেষ ধরনের নারীস্বভাবে। তিনি নারীকে মনে করেন প্রকৃতির হাতে তৈরি বিশেষ এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যাতে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যদি নারী চেষ্টা করে বাইরে আসার। ওই দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যাবে নারীর স্বভাব-কোমলতা, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা! নারীর স্বভাব যে পুরুষতন্ত্রেরই তৈরি, তা ভাবেন নি রবীন্দ্রনাথ।

নারী সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি ও বদ্ধমূল ক’রে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিশ-একুশ বছর বয়সে, যা তিনি পুষেছেন আশি বছর বয়স পর্যন্ত। নারীর দুটি বিপরীত ধ্রুবরূপে বিশ্বাস করেছেন তিনি; প্রিয়া ও জননী, উর্বশী ও কল্যাণী, বা পতিতা ও গৃহিণী। প্রিয়া-উৰ্বশী-পতিতা নারীর একরূপ, জননী-কল্যাণী-গৃহিণী আরেক রূপ। প্রথম রূপটির স্বপ্ন দেখেছেন তিনি কবিতার জন্যে, দ্বিতীয় রূপটিকে তিনি চেয়েছেন বাস্তবে। তার কবিতা, গল্প, উপন্যাসে এ-রূপ দুটি ফিরে ফিরে এসেছে। এ-রূপ দুটি তিনি পেয়েছেন হিন্দুপুরাণের সমুদ্রমন্থন উপাখ্যানে, এবং এদের মনে করেছেন শাশ্বত, চিরন্তন। নারীকে তিনি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, আর্থনীতিকভাবে স্বনির্ভর দেখতে চান নি। তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে দেখতে চাই তিনি নারীকে দেখেছেন কী রূপে, আর কোন রূপ চেয়েছেন স্বপ্নে ও বাস্তবে। ‘ উর্বশী’ [১৩০২, চিত্রা] কবিতাটিতে পাওযা যায় নারীর এক রূপ, যে ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নাহ বধু’, সে ‘সুন্দরী রূপসী’। তার জন্ম হয়েছিলো ‘মন্থিত সাগরে’। সে সৌন্দর্য, কিন্তু সে ‘বৃন্তহীন পুষ্প’, তার জীবন ট্র্যাজিক বেদনাপূর্ণ, কেননা সে কল্যাণী নয়। নারীর ওই রূপের জন্যে তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে পারেন, কিন্তু তাকে গৃহে কামনা করেন না। বলাকার (১৩২১) ২৩-সংখ্যক কবিতায়ও মেলে নারীর দুই রূপ :

‘কোন ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
অতলের শয্যাতল ছাড়ি
একজন উর্বশী, সুন্দরী,
বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,
স্বর্গের অপ্সরী।
অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,
স্বর্গের ঈশ্বরী।

রবীন্দ্রচিন্তায় এ-দু-নারী আদিম, চিরন্তনী, শাশ্বতী; এদের পরিবর্তন নেই, এরা রবীন্দ্রনাথ ও পুরুষতন্ত্রের দুই নারী স্টেরিওটাইপ। তাই নারী চিরকালই থেকে যাবে। পৌরাণিক উর্বশী, যে কামনার তৃপ্তি যোগাবে পুরুষের, আর কল্যাণী, যে পুরুষের গৃহকে ক’রে তুলবে স্বর্গের মতো সুখকর। এরা পরস্পরের বিপরীত; উর্বশী রূপসী, সে বেশ্যা, তাকে দেবদানব আর পুরুষ কেউ গ্রহণ করে নি; আর কল্যাণীকে পুরুষ বন্দী করেছে নিজের গৃহে। নারীর দু-রূপকে পুরুষ ও রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখেছেন, তাতে নারী হয়ে উঠেছে এক শোচনীয় প্রাণী; যাকে গৃহে গ্ৰহণ করা হয় নি, সে হয়েছে বেশ্যা-তার কাজ সকলের চিত্ত ও শরীরবিনোদন; আর যাকে গ্ৰহণ করা হয়েছে, সে হয়েছে দাসী। নারীর এ-দু-রূপই কাজ করেছে তাঁর কবিতার প্রেরণারূপে, সম্ভবত উর্বশী রূপটিই তাকে বেশি প্রেরণা দিয়েছে, তবে তিনি স্তব করেছেন নারীর কল্যাণী বা দাসী রূপটির। কল্যাণীর ভবনখানি, রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ [১৩০৭, ক্ষণিক ] কবিতার পরিকল্পনা অনুসারে, পুষ্পকানন-মাঝে সাধারণত থাকে না, তবে একথা ঠিক যে ‘কল্যাণী, নিত্য আছ আপন গৃহকাজে।’ ভিক্টোরীয়দের ‘অ্যাঞ্জেল ইন দি হাউজ’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ দেবী, তাই ভাবতেই বিবমিষায় ধরে যে দেবী সরক্ষণ করছে গৃহকাজ, অর্থাৎ দাসীবৃত্তি। পুরুষ দেবীকে ক’রে তুলেছে গৃহপরিচারিকা! এ-দাসীর নামে তিনি ‘সর্বশেষের শ্রেষ্ঠ’ গানটি উৎসর্গ করেছেন, তাকে উপাধি দিয়েছেন ‘স্বর্গের ঈশ্বরী’, এবং তাকে করেছেন পার্থিব নারীর অনুসরণীয় আদর্শ : ‘রূপসীরা তোমার পায়ে রাখে পূজার থালা,/বিদুষীরা তোমার গলায় পরায় বরমালা।’ রূপসীরা ওই দাসীকে পুজো করে, বিদুষীরা তাকে অভিনন্দিত করে! অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সারকথা হচ্ছে নারীর রূপের মূল্য নেই, জ্ঞানের মূল্য নেই। আরো, নারীর মহিমা তার গৃহকাজে বা দাসীত্বে; এবং তাকে বন্দী ক’রে রাখতে হবে গৃহে।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীকে হ’তে হবে নারী; পুরুষ হবে কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, শাসক প্রভৃতি, অর্থাৎ প্ৰভু বা স্রষ্টা। পুরুষতন্ত্র যে-ছকে তৈরি করেছে ও দেখতে চায় নারীকে, তিনি নারীকে দেখেন সে-ছক অনুসারেই; নারী যখন ছক ভেঙে ফেলে, তখন দেখা দেয় বিপর্যয়। এমনকি তিনি নিজেও যখন ছক ভেঙে নারীকে ব্যক্তি ক’রে তোলেন, তখন অবিলম্বে তাকে পুনর্বিন্যস্ত করেন ছকের মধ্যে। ‘সাধারণ মেয়ে’ [১৩৩৯, পুনশ্চ] কবিতাটিতে মেলে এর পরিচয়। মালতী এ-কবিতায় নিতে চেয়েছে মহৎ প্রতিশোধ। দেবযানীর মতো অভিশাপ দেয়ার সুযোগ সে পায় নি, তাই সে গণিতে হ’তে চেয়েছে প্ৰথম, বিলাতে গিয়ে সম্ভবত করতে চেয়েছে ডক্টরেট। নরেশ যদি তাকে বিয়ে করতো, তবে সে ঢাকাই শাড়ি পরে কপালে সিঁদুর মেখে হয়ে উঠতো প্রথাগত কল্যাণী–তার নাম হতো শ্ৰীমতি মালতী দাসী; তবে ব্যর্থতা যেমন অনেক মহৎ কাজের প্রেরণা, মালতীর প্রেমের ব্যর্থতাও মালতীকে অনুপ্রাণিত করে মহৎ প্রতিশোধের স্বপ্ন দেখতে। মালতী ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়ে; প্রতারিত প্রেমিকা দিবাস্বপ্নে হয়ে ওঠে মেধাবী ছাত্রী;–সাহিত্যের নয়, গণিতের। সে বিলেতে যায়, তার কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে পড়ে চারপাশ। তবে মালতী ছক ভাঙতে-না-ভাঙতেই রবীন্দ্ৰনাথ তাকে ফিরিয়ে আনেন পুরুষতন্ত্রের চিরন্তন ছকের মধ্যে :

‘মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদেব মতো আবিষ্কার করুক ওকে–
শুধু বিদুষী ব’লে নয়, নারী ব’লে:
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য—‘

যদি নারীত্বই হয় তার শ্রেষ্ঠ পরিচয়, তাহলে গণিতে প্রথম শ্ৰেণী আর বিলেতে গবেষণা হয়ে ওঠে শোচনীয় পণ্ডশ্রম। মালতী এতো কিছু ক’রেও অর্জন করে নি কোনো সাফল্যই, তার পরম সাফল্য পরনে ঢাকাই শাড়ি আর কপালে সিঁদুরে! জ্ঞানী, বিদ্বান, বীর, কবি, শিল্পী, রাজারা ওর মাঝে আবিষ্কার করবে এক ছক-বাঁধা নারীকে, আর বিদুষী মালতী, রবীন্দ্রনাথের ‘কল্যাণী’ কবিতা অনুসারে, বরণমালা পরাবে কল্যাণী বা দাসীর কণ্ঠে। এ-ছকের মধ্যেই নারীকে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি তার বিদ্রোহী নারী, যে উদ্ধত প্রশ্ন করে : ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার /কেন নাহি দিবে অধিকার /হে বিধাতা?’, যে ঘোষণা করে, ‘যাব না বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী’, সেও ছকের মধ্যেই থেকে বলে; “যাহা মোর অনির্বাচনীয় /তারে যেন চিত্তমাঝে পায় মোর প্রিয়’ [‘সবলা’ (১৩৩৫); মহুয়া)]। ওই অনির্বচনীয়টুকু হচ্ছে নারীত্ব, যা পুরুষতন্ত্রের অত্যন্ত প্রিয়।

ছক-ভাঙা নারীকে ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করার সফল উদাহরণ চিত্রাঙ্গদা (১২৯৯)। চিত্রাঙ্গদা ভিক্টোরীয় ঘরেবাইরে বা পৃথক এলাকা বা সহচরীতিত্ত্বের এক নিরীক্ষা, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে নারী স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার অযোগ্য; সে হ’তে পারে বড়জোর পুরুষের সহচরী। ভিক্টোরীয়রা নারীকে ততোটুকু শিক্ষা দিতে রাজি হয়েছিলো, যতোটুকুতে তারা হতে পারে স্বামীর যোগ্য সহচরী:–নারী নিজে প্রধান হয়ে উঠবে না, পুরুষই থাকবে প্রধান, নারী পালন করবে। সহকারী সহচরীর ভূমিকা। নারী যদি ছক ভেঙে বেরিয়ে পড়ে, তবে তাকে ছকের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে যে-কোনো কৌশলে, বা ঠেলে তাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে ঘরের কারাগারে। টেনিসনের প্রিন্সেস (১৮৪৭, ১৮৫৩) কাব্যে পাওয়া যায়। এর আদর্শ ভিক্টোরীয় রূপ। ওই কাব্যে বিদ্রোহী স্বায়ত্তশাসনলিঙ্গু রাজকন্যা আইডাকে ক’রে তোলা হয় স্বামীর পদানত, তার প্রতিষ্ঠিত নারী-বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসপাতালে রূপান্তরিত ক’রে ওই বিদ্রোহিনীকে পরিণত করা হয় পুরুষেয় সেবিকা ও স্বামীর সহচরীতে। পুরুষতন্ত্র প্রতিশোধ নেয় চরমভাবে।

‘চিত্রাঙ্গদা’র কাঠামো অভিন্ন, একটি বিদ্রোহী স্বাধীন রাজকন্যাকে এতে কামের সহযোগিতায় রূপান্তরিত করা হয় পুরুষের সহচরীতে। চিত্রাঙ্গদার শুরু ছক-ভাঙা নারীরূপে, আর তার বিলুপ্তি ঘটে ছকবদ্ধ নারীতে; ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্রের তৈরি ছকে তাকে চমৎকারভাবে পুনর্বিন্যস্ত করেন রবীন্দ্রনাথ, যাতে মুগ্ধ হয় পুরুষেরা, এবং উন্নতজাতের নারী-উৎপাদনকারীরা। কাব্যনাটকটির যে-অংশ নারী-স্বাধীনতার বিভ্রান্তিকর শ্লোগান হিশেবে খ্যাতি অর্জন কবেছে, তা হচ্ছে [চিত্রাঙ্গদা : ১১] :

‘আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।
পূজা কবি রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে, সেও আমি নাহি। যদি পার্শ্বে রাখ
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্ৰতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়।‘

এখানে পাওয়া যাচ্ছে এক ভিক্টোরীয় চিত্রাঙ্গদাকে, যে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার সমস্ত স্বপ্ন বাতিল ক’রে বেছে নিয়েছে সহচরীর ভূমিকা। সে দেবী নয়, দাসী নয়, তবে স্বাধীন সত্তাও নয়; সে পুরুষের সহচরী বা প্রিয় পরগাছা। সে নিজে যাবে না। কোনো সংকটের পথে, নিজে করবে না কোনো দুরূহ চিন্তা, নিজে গ্রহণ করবে না। কোনো কঠিন ব্ৰতা; ওই সমস্ত কাজ পুরুষের, সে-সব করবে। তার স্বামী, সে হয়ে থাকবে স্বামীর সহচরী, বা শিক্ষিত দাসী। রুশো-রাসকিন নারীকে দিতে চেয়েছিলেন এ-ধরনের শিক্ষাই। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো ‘রঘুবংশ’-এর ‘প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ’ শ্লোকটি, পছন্দ ছিলো স্ত্রীর সখি, সচিব, মিত্রের ভূমিকা; এর সাথে মিলে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় মতবাদ যে নারী হবে স্বামীর সহচরী। চিত্রাঙ্গদায় সহচরী নামের সুভাষিত দাসীর ভূমিকায় বিলুপ্তি ঘটে এক স্বায়ত্তশাসিত তরুণীর। চিত্রাঙ্গদার সাথে মিল আছে শেষের কবিতার (১৩৩৬) লাবণ্যের, তাকেও চিত্রাঙ্গদার মতো ছকের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। লাবণ্যের বাবা অধ্যক্ষ অবনীশ দত্ত মেয়েকে বিদুষী ক’রে গ’ড়ে তুলতে চেয়েছিলো; কিন্তু মেয়েটি একদিন জ্ঞান বাদ দিয়ে জেগে ওঠে কামের মধ্যে, যেমন জেগে উঠেছিলো চিত্রাঙ্গদাও। রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের জ্ঞান সহ্য করেন না, তাদের জাগিয়ে তোলেন কামে বা প্ৰেমে-নারীত্বে; এবং মনে করেন এখানেই নারীর জীবনের সার্থকতা। তবে ওই প্ৰেমই নারীর জীবনকে ব্যর্থ ক’রে দেয়, নারী হয়ে ওঠে পুরুষের দাসী বা সহচরী। পুরুষতন্ত্রের শেখানো প্ৰেম নারীর জন্যে এক বড়ো সমস্যা।

রবীন্দ্রচিন্তায় পুরুষ অনন্য সত্তা, পুরুষ স্রষ্টা, ধ্যানী, শিল্পী, নারী গৌণ। সাতাত্তর বছর বয়সে লেখা ‘নারী’ [১৯৩৭, সনাই] নামের একটি কবিতার উল্লেখযোগ্য অংশ এমন :

‘ স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধায় মত্ত পুরুষেরে করিবারে বশ
যে-আনন্দরস
রূপ ধরেছিল রমণীতে ,
ধরণীর ধমনীতে
তুলেছিল চাঞ্চল্যের দোল
রক্তিম হিল্লোল ,
সেই আদি ধ্যানমূর্তিটিরে
সন্ধান করিছে ফিরে ফিরে
রূপকার মনে-মনে
বিধাতার তপস্যার সংগোপনে ।…
পুরুষের অনন্ত বেদন
মর্তের মদিরা-মাঝে স্বর্গের সুধারে অন্বেষণ ।…
সেই পূর্ণ লোকে —
সেই ছবি আনিতেছ ধ্যান ভরি
বিচ্ছেদের মহিমায় বিরহীর নিত্যসহচরী । ‘

এর অর্থ আদিতে ছিলো পুরুষ, যে স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধী, স্বর্গের অধিবাসী। তখন নারী ছিলো না। নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো পুরুষের অনন্ত স্বাতন্ত্র্যস্পৃহা নিয়ন্ত্রণের জন্যে, নারী দেখা দিয়েছিলো আনন্দরূপে। কে সৃষ্টি করেছিলো নারীকে? সৃষ্টি করেছিলো সম্ভবত পুরুষ নিজেই, পুরুষই নারীর বিধাতা, নারী পুরুষের ধ্যানলব্ধ মূর্তি। তবে নারী সে-মূর্তি আর আনন্দ ধ’রে রাখতে পারে নি, তাই পুরুষ শিল্পী হয়ে বারবার সৃষ্টি করছে সে-মূর্তি। পৃথিবীতে নারী আছে, কিন্তু তারা পৃথিবীর শস্তা মদ, পুরুষ এ-মর্ত্যের মদেই আস্বাদ করার চেষ্টা করছে স্বর্গের সুধা। পুরুষ স্বৰ্গ থেকে নির্বাসিত হয়ে নানা শিল্পকলায় সৃষ্টি করছে আদিনারীকে। পৃথিবীতে যে-নারীরা আছে, তারা একদা অপূর্ব আলোতে উদ্ভাসিত ছিলো, এখন নেই। পুরুষ তাই চিরবিরহী, তার স্বপ্নে আছে আদিনারী; পার্থিব নারী পুরুষের সহচরী মাত্র। এ-নারী পুরুষের সেবা করবে, গৃহকাজ করবে, পুরুষ একে সম্ভোগ করতে করতে স্বপ্ন দেখবে আদি ধ্যানমূর্তিটির! কাব্যিকভাবে একে স্বর্গীয় মনে হতে পারে, তবে গদ্যে বা বাস্তবে এ খুবই শোচনীয় ব্যাপার।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো গল্প-উপন্যাসও কল্যাণী বা গৃহবন্দী নারীর স্তব। নারীর বেদনা স্থান পেয়েছে তাঁর কথাসাহিত্যে, তবে তা প্রেমহীনতার বেদনা, নারীর স্বায়ত্তশাসনহীনতার বেদনা নয়। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নারীর রূপও এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাকে তিনি স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন নি। তাঁর কোনো কোনো উপন্যাস, যেমন ‘দুই বোন’ (১৩৩৯), লেখা হয়েছে দুই নারীতত্ত্ব–নারীর এক রূপ উর্বশী আরেক রূপ কল্যাণী–প্রমাণের জন্যে; কোনো কোনো উপন্যাস, যেমন ঘরে-বাইরে (১৩২৩), চার অধ্যায় (১৩৪১), লেখা হয়েছে পৃথক এলাকা তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্যে। তিনি বিশ্বাস করেন গৃহ আর ভালোবাসা পেলে এবং ভালোবাসতে পারলেই চরিতার্থ নারীর জীবন। বাইরের জগত নারীর জগত নয়, সেখানে নারী প্রবেশ করলে শুভকে গ্ৰাস করে অশুভ, দেখা দেয় সর্বনাশ। প্রেমের ওপর চরম গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নষ্ট করেছেন নারীদের সম্ভাবনা। প্ৰেম নামক ভাবাবেগ নারীপুরুষ উভয়ের জীবনেরই খণ্ডকালীন সত্য, কিন্তু প্রেমই জীবনের সাফল্য নয়; ভাবাবেগকাতর একটা সময় কেটে যাওয়ার পর পুরুষ প্রেমের জন্যে কাতরতা বোধ করে না, কিন্তু নারী কেনো আত্মবিনাশ ঘটাবে ওই প্রেমেই? প্ৰেমকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে পুরুষতন্ত্রই, তবে পুরুষ নিজেকে তার গ্রাস থেকে মুক্ত রেখে নারীকে ঠেলে দিয়েছে প্রেমের কারাল গ্রাসে। বাইরের জগত প্রেমের নয়, তা স্বাধীনতা ও সাফল্যের। ওই স্বাধীনতা ও সাফল্য রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন। পুরুষের জন্যে, আর নারীকে গ্রস্ত ক’রে রেখেছেন প্রেমের ভাবালুতার মধ্যে! নারী হবে বাইরে সফল পুরুষের অনুরাগিণী। রবীন্দ্রনাথের নারীদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিদ্রোহী ‘স্ত্রীর পত্র’-এর (১৯১৪) মৃণাল। সে তার স্বামীকে জানিয়েছে, ‘আমি আর তোমাদের সেই সাতাশ-নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না’; কারণ সে জেনেছে ‘সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা’ কী। তবে সংসার ছেড়ে মৃণাল গিয়েছে শ্ৰীক্ষেত্রে সমুদ্রের ধারে জগদীশ্বরের কাছে। পুরুষ যে ওই জগদীশ্বরের নামেই তাকে মেয়েমানুষ ক’রে রেখেছে, তা জানে না মৃণাল। মৃণাল স্বামীর ঘরে ফিরে নাও আসতে পারে, তবে সে বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠা পাবে না; তার বিদ্রোহ বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠালাভের নয়। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে পৃথক এলাকা তত্ত্ব প্রমাণের জন্যে রবীন্দ্রনাথ নিরীক্ষা চালিয়েছেন। বিমলার ওপর; এবং দেখিয়েছেন বাইরে গেলে নারী সর্বনাশ করে বাইরের ও ঘরের। বিমলার জীবন তখনি সার্থক যখন সে অবনত স্বামীপ্রেমে, আর ব্যর্থ যখন সে সাড়া দেয় বাইরের হাতছানিতে; চার অধ্যায় এ-তত্ত্বের আরেক নিরীক্ষা ও প্রমাণ। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি রবীন্দ্রনাথের চোখে খুবই জঘন্য, আর তা চরম জঘন্য হয়ে ওঠে যখন তাতে যোগ দেয় নারী। নারী সন্ত্রাসে যাবে না, তারা যাবে প্রেমে; আর প্রেমের পবিত্র জায়গা হচ্ছে গৃহ, যেখানে নারী হবে তার স্বামীর খণ্ডকালীন খেলার পুতুল ও আমরণ দাসী।

রবীন্দ্রনাথের আমেরিকায় (১৯১৭) প্রদত্ত বক্তৃতার একগুচ্ছ প্রকাশিত হয় পারসনালিটি (১৯১৭) গ্রন্থে। বইটির শেষ নিবন্ধের নাম ‘নারী”। বইটি বাঙলাদেশে দুষ্পপ্ৰাপ্য ব’লে আমি পড়ার সুযোগ পাই নি, তবে কেতকী কুশারী (১৯৮৫, ২৪৮-২৫৩) পশ্চিম ও নারী সম্পর্কে এ-বইতে রবীন্দ্ৰমতের যে-পরিচয় দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় এতে পশ্চিম ও নারী সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ধারণারই (১৮৯১) পুনরাবৃত্তি করেছেন তিনি। দ্বিতীয়বার তিনি যখন ইউরোপে গিয়েছিলেন, তখন তিনি মনে মনে নিজেকে গণ্য করেছিলেন এক তরুণ ভারতীয় ঋষি ব’লে, এবং ইউরোপ সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন অনেক গ্ৰহণঅযোগ্য বাণী, তবে তখন পশ্চিম তাঁর বাণী শোনার জনো প্রস্তুত হয় নি। আমেরিকায় বক্তৃতার সময় তিনি নোবেলপ্রাপ্ত প্রাচ্যের পুরোহিত, যাঁর কথা টিকেট কেটে শুনতে চায় আমেরিকা, এবং তিনি পশ্চিমকে শোনান প্রচুর ভারতীয় কথামৃত। তিনি বলেন, পশ্চিমা সভ্যতা বড়ো বেশি পুরুষালি হয়ে উঠেছে ব’লেই ভরে গেছে সংকটে। এ-সংকটের সমাধান হচ্ছে নারী : ‘অবশেষে সে-সময় এসেছে, যখন প্ৰবেশ করতে হবে নারীকে, ক্ষমতার এ-বেপরোয়া গতির মধ্যে নারীকে সঞ্চারিত করতে হবে আপন জীবনছন্দ’ [দ্ৰ কেতকী (১৯৮৫, ২৪৮)]। রবীন্দ্রনাথ তিরষ্কার করছেন পুরুষ ও পশ্চিমের পুরুষালি সভ্যতাকে, কেননা পশ্চিমকে সমালোচনা করাই ছিলো তখন প্রাচ্য ঋষিত্ব; তবে তিনি তা করতে পারেন না, কেননা ‘পুরুষ’ বলতে তিনি বোঝেন যে অসামান্য ভাবকে, পশ্চিমের পুরুষ তা-ই। পুরুষ, রবীন্দ্ৰচেতনায়, কল্পনাপ্রতিভা, সৃষ্টি, গতি, অনন্ত অস্থিরতা, উদ্ভাবন, বিধাতা যাকে সম্পূর্ণ সৃষ্টি করতে পারে নি ব’লে যে নিরন্তর সৃষ্টি ক’রে চলছে নিজেকে। তাই তিনি পশ্চিমের পুরুষদের নিন্দা করতে পারেন না, কেননা তারা করেছে পুরুষেরই কাজ। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু পশ্চিমকে বাণী শোনাতে গেছেন, তাই পশ্চিমের যে-পুরুষ কাজ করেছে তাঁরই আদর্শ অনুসারে, তাকেই তিনি আক্রমণ করেছেন। তবে এ-বাহ্যিক আক্রমণ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখি রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছেন আসলে নারীকেই, যারা নিজেদের জীবনছন্দ সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে সভ্যতায়, তাই পশ্চিমের সভ্যতা ভরে গেছে সংকটে। রবীন্দ্রনাথের পুরুষধারণা ‘নারী’ (১৯৩৭) কবিতায় যেমন, গদ্যেও তেমনি; ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’তে (১৩৩৬) পুরুষ এমন :

‘পুরুষের কর্মপথে এখনো তার সন্ধানচেষ্টায় শেষ হয় নি। কোনো কালেই হবে না। অজানার মধ্যে কেবলই সে পথ খনন করছে, কোনো পরিণামের প্রান্তে এসে আজও সে অবকাশ পেলে না। পুরুষের প্রকৃতিতে সৃষ্টিকর্তার তুলি আপন শেষ রেখাটা টানে নি। পুরুষকে অসম্পূর্ণই থাকতে হবে (রর : ১৯, ৩৭৯)।
গতিবেগমত্ত পুরুষের চলমান সৃষ্টি সর্বদাই স্থিতির একটা মূল সুরকে কানে রাখতে চায়; পুরুষের শক্তি তার অসমাপ্ত সাধনার ভার বহন ক’রে চলবার সময় সুন্দরেব প্রবর্তনার অপেক্ষা রাখে (রবী; ১৯, ৩৮০)।‘

রবীন্দ্রনাথের পুরুষধারণার সাথে পশ্চিমের পুরুষকে মিলিয়ে নিলে দেখি পাশ্চাত্য পুরুষ অন্যায় করে নি কোনো; তারা যা করছে, তাকেই পুরুষের কাজ বলে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ। পুরুষ সন্ধান করবে, গতিবেগমত্ত হয়ে ছুটে চলবে, উদ্ভাবন করবে, নিজের অসম্পূর্ণ রূপটিকে সম্পূর্ণ করে তুলবে। তাই পশ্চিমে যদি কোনো সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে, তা পুরুষের দোষ নয়, দোষ নারীরই; কেননা নারীই তার রবীন্দ্ৰকথিত ‘জীবনছন্দ সঞ্চার করতে পারে নি। সভ্যতায়, গতিবেগমত্ত পুরুষকে শোনাতে পারে নি তার স্থিতির মূল সুর’। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নারীকে দোষী করতে চান না, দোষী করেন পশ্চিমের পুরুষকেই, কেননা তিনি দণ্ড দিতে চান পশ্চিমা সভ্যতাকে। এটা খুবই অন্যায় দণ্ড। রাসকিন বলেছিলেন পুরুষ যখন যুদ্ধ বাধায়, তার জন্যে পুরুষের চেয়ে নারীই বেশি দোষী; কেননা নারী তার নারীত্ব দিয়ে পুরুষকে শান্তির দিকে টেনে রাখতে পারে নি! রবীন্দ্রনাথও অনেকটা তাই বলেন, নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা রাসকিনের ধারণার মতোই। পুরুষ যোগাবে সভ্যতার গতি, নারী যোগাবে স্থিতি; তাহলেই সভ্যতা হয়ে উঠবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতার মতো ছন্দাবেদ্ধ। পুরুষ গতি, তাই সে তার স্বাভাবিক গতিকে সঞ্চার করবেই সভ্যতায়; নারীর কাজ যদি হয় সভ্যতায় স্থিতি সঞ্চার করা, আর তা যদি না পারে নারী, তবে দণ্ড প্ৰাপ্য নারীরই। তাই রবীন্দ্ৰনাথ পশ্চিমের সভ্যতার সংকটের জন্যে মূল দোষী করেছেন নারীকে, যদিও রবীন্দ্রনাথ তা অবধান করেন নি। রবীন্দ্রনাথ সভ্যতায় নারীর যে-ভূমিকা নির্দেশ করেন, তা হচ্ছে ছক-বাঁধা কল্যাণীর ভূমিকা, যার কাজ পুরুষকে গৃহের স্থিতির মধ্যে মাঝেমাঝে স্থিত ক’রে পুরুষের অনন্ত গতিকে ছন্দোবদ্ধ করা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘স্থিতির আদর্শ নারীর প্রকৃতি-দ্বারা গভীরভাবে সমাদৃত’, নারীর কাজ হচ্ছে ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ ও আরোগ্যসাধন’। নারীর যে-প্রকৃতি ও ভূমিকা তিনি নির্দেশ করেছেন, তা নারীকে সীমাবদ্ধ করে রাখে গৃহে, আর তাকে পংক্তিভুক্ত ক’রে রাখে আদিম পশুরই সাথে। তিনি মনে করেন, নারীর দায়িত্ব ছিলো পশ্চিমা সভ্যতার সেবিকারূপে আবির্ভূত হওয়া, নারী হবে সভ্যতার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, কিন্তু নারী তা পারে নি। রবীন্দ্রনাথ নারীকে প্রকাশ্যে দোষী করেন নি; কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার সংকটের দায়ভার, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনছন্দ’ ও ‘স্থিতির মূল সুর’ তত্ত্বানুসারে, বইতে হচ্ছে নারীকেই। রবীন্দ্রনাথ আগের মতো এ-প্রবন্ধেও বলেন যে নারীর স্থান হচ্ছে গৃহ। রাসকিনের মতোই গৃহকে একটু সম্প্রসারিত করে বলেন, ‘মানবিক জগতই নারীর জগত’ [দ্র কেতকী (১৯৮৫, ২৮৪-২৮৫)]। তবে ওই মানবিক জগত গৃহেরই সম্প্রসারিত রূপ; সেখানে সেবা আছে, গ্ৰীতি আছে, কল্পনাপ্রতিভা নেই, আবিষ্কার বা সৃষ্টি নেই।
 
রবীন্দ্রনাথের নারী জৈবিক। জৈবিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে নারী মানুষ হয়ে ওঠে নি; তার কাজ সন্তান ধারণ আর লালন ক’রে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা। পুরুষের কাজ সভ্যতা সৃষ্টি করা। রবীন্দ্রনাথের নারীর মূল কাজ যেখানে গর্ভধারণ আর প্রসব, সেখানে পুরুষের কাজ হচ্ছে সভ্যতা সৃষ্টি; মৃণালিনী দেবীর গর্ভধারণ করবে, টিকিয়ে রাখবে মানবপ্রজাতিকে, আর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ক’রে চলবেন সভ্যতা। প্রাণসৃষ্টি এক দরকারি আদিম কাজ, সেটা সভ্যতা সৃষ্টি নয়, ওই কাজটি নারীর; ওই কাজ কাউকে মহৎ বা মানুষ করে না। পুরুষ করে সভ্যতা সৃষ্টির মহৎ কাজ; রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এই প্রাণসৃষ্টি-বিভাগে পুরুষের প্রয়োজন অত্যত্র, এইজন্যে প্রকৃতির একটা প্রবল তাগি থেকে পুরুষ মুক্ত। প্রাণের ক্ষেত্রে ছুটি পেয়েছে ব’লেই চিত্তক্ষেত্রে সে আপন সৃষ্টিকার্যের পত্তন করতে পারলে। সাহিত্যে কলায় বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে বিধিব্যবস্থায় মিলিয়ে যাকে আমরা সভ্যতা বলি সে হল প্রাণপ্ৰকৃতির পলাতক ছেলে পুরুষের সৃষ্টি’ (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রর : ১৯, ৩৮০)। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেন ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ’, তা কোনো কৃতিত্বের ব্যাপার নয়, তাকে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর প্রধান সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্ৰনাথ সভ্যতা থেকেই বহিষ্কার ক’রে দিয়েছেন নারীকে তিনি মনে করেন সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে পুরুষের সৃষ্টি; এবং পুরুষ তা পেরেছে, কেননা পুরুষকে জীবন পোষণ আর সংরক্ষণ করতে হয় নি। এ-সভ্যতা যে পুরুষতান্ত্রিক, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু সভ্যতা শুধু পুরুষের সৃষ্টি নয়, নারী আছে এর ভিত্তিতে আর ওপরকাঠামোতে, কিন্তু পুরুষাধিপত্যবাদীদের মতো রবীন্দ্রনাথের তা মনে পড়ে নি। তিনি বলেন, ‘প্ৰাণের টানে মেয়ে আটকা পড়েছে আর পুরুষ ছুটেছে মনের তাড়ায়’ (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮২)। দুটি বিপরীত বস্তু পাচ্ছি। এখানে : প্ৰাণ আর মন; নারী ওই প্রাণসৃষ্টি সৃষ্টি করে চলছে সভ্যতা। এর অর্থ হচ্ছে নারী মানহীন প্রাণী, যার কাজ নিজের অভ্যন্তরে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করা। নারী যেখানে জৈবস্তরে রয়ে গেছে, সেখানে পুরুষ উত্তীর্ণ হয়েছে অভিনব দেবতার স্তরে :

‘মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্রেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টিব আলো কল্পনাবৃত্তি। পুরুষের চিত্ত আপন ধ্যানেব দৃষ্টি দিয়ে দেখে, আপনি ধ্যানের শক্তি দিয়ে গড়ে তোলে। We are the dreamers of dreams-এ কথা পুরুষের কথা। পুরুষের ধ্যানই মানুষের ইতিহাসে নানা কীর্তির মধ্যে নিরন্তর রূপ পরিগ্রহ কবছে।… নারীর সৃষ্টি ঘরে, এই জন্যে সব-কিছুকেই সে যত্ন করে জমিয়ে রাখতে পারে: তাব ধৈর্য বেশি কেননা, তার ধারণার জায়গাটা বড়ো। পুরুষের সৃষ্টি পথে পথে, এই জন্যে সব-কিছুর ভার লাঘব করে দিয়ে সমগ্রকে সে পেতে ও রাখতে চায়। এই সমগ্রের তৃষ্ণা, এই সমগ্রের দৃষ্টি, নির্মম পুরুষের কত শত কীর্তিকে বহুব্যয়, বহুত্যাগ, বহু পীড়নের উপন: স্থাপিত করেছে।…পুরুষের কল্পনাবৃত্তির সাহস এত অত্যন্ত বেশি তার কারণ, স্থিতির ক্ষেত্রে স্থির হযে বসে বিচিত্রের সহস্ৰ খুঁটিনাটিকে মমত্বের আঁকড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরবার দীর্ঘ সময় তাব কখনো ছিল না। এই জন্যে সৃষ্টির প্রয়োজনে প্ৰলয় করতে তার দ্বিধা নেই (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮৫-৩৮৬)।

এ-বৰ্ণনায় নারী সামান্য প্রাণী পুরুষের তুলনায়; নারীর রয়েছে তুচ্ছ প্রেম আর গৃহ, তাও পুরুষেরই জন্যে; আর পুরুষের রয়েছে ‘কল্পনাবৃত্তি’, রয়েছে ‘ধ্যানের দৃষ্টি’, সে সৃষ্টি করে ‘ধ্যানের শক্তি দিয়ে’। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিলো ও’শনেসির “আমরা সঙ্গীতরচয়িতা, /এবং আমরা স্বপ্নের স্বাপ্লিক” পংক্তিগুচ্ছ, অনেক স্থানে তিনি এগুলো উল্লেখ করেছেন কবির নাম না নিয়ে- মূল কবির নাম না নেয়া তার স্বভাব (যেমন The Religion of Man -এ ‘The Music Maker’ পরিচ্ছেদে), এখানে উল্লেখ করেছেন; এবং রবীন্দ্রনাথের পুরুষ হচ্ছে সঙ্গীতরচয়িতা, স্বপ্নের স্বাপ্লিক, তার ধ্যান রূপ পরিগ্রহ করছে নানা কীর্তির মধ্যে। পুরুষ তৈরি করে চলছে নতুন পথ, সমগ্রের তৃষ্ণায় আর্ত তার প্রকৃতি, এবং সৃষ্টির জনো ধ্বংস করতেও পুরুষ দ্বিধাহীন তাই দু-দুটি মহাযুদ্ধ এবং সভ্যতার সংকটের জন্যে রবীন্দ্রনাথ দায়ী করতে পারেন না পশ্চিমের পুরুষকে, কেননা তারা সৃষ্টির প্রয়োজনে আয়োজন করেছিলো প্রলয়ের। এ-পুরুষের তুলনায় নারী একটি জরায়ু। পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক ভাববাদী মহত্ত্ব বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ অক্লান্ত :

[ক] পুরুষের অধ্যবসায়ের কোথাও সমাপ্তি নেই, এইজন্যেই সুসমাপ্তির সুধারাসের জন্যে তার অধ্যবসায়ের মধ্যে একটা প্রবল তৃষ্ণা আছে। মেয়েদের হৃদয়ের মাধুর্য এই রসই তাকে পান করায়। পুরুষের সংসারে কেবলই চিন্তার দ্বন্দু, সংশয়ের দোলা, তর্কের সংঘাত, ভাঙাগড়ার আবর্তন—এই নিরন্তর প্রয়াসে তার ক্ষুব্ধ দোলায়িত চিত্ত প্ৰাণলোকের সরল পরিপূর্ণতার জন্যে ভিতরে ভিতরে উৎসুক হয়ে থাকে (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯,৩৮১)।

[খ] পুরুষ তার আপনি জগতে বারে বারে নূতন আগন্তুক। আজ পর্যন্ত কতবার সে গড়ে তুলেছে আপন বিধিবিধান। বিধাতা তাকে তার জীবনের পথ বাঁধিয়ে দেন নি; কত দেশে কত কালে তাকে আপন পথ বানিয়ে নিতে হল (‘নারী’, কালাস্তর, রব : ২৪, ৩৭৮)।

[গ] পুরুষের সৃষ্টি বিনাশের মধ্যে তলিয়ে যায়, নূতন করে বাঁধতে হয় তার কীর্তির ভূমিকা।…পুরুষের বিচিত সভ্যতায় আদিকাল থেকে এইরকম ভাঙা-গড়া চলছে (‘নারী’, কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৮)।

[ঘ] নানা বিঘ্ন কাটিয়ে অবস্থার প্রতিকূলতাকে বীর্যের দ্বারা নিজের অনুগত করে পুরুষ মহত্ত্ব লাভ করে (‘নারী’ কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৯)।

রবীন্দ্রনাথের পুরুষ নিরন্তর সক্রিয় দেবতা, সে বিধাতার থেকেও শক্তিমান; সে অবিরাম সৃষ্টি ক’রে চলছে নিজেকে, সম্পূর্ণ করছে বিধাতার অসম্পূর্ণ কাজ। রাসকিনের মতোই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ যে পুরুষের কেবলই চিন্তার দ্বন্দ্ব, সংশয়, সংঘাত, ভাঙাগড়া; নারী হচ্ছে ওই দেবতার শান্তির পানীয়। রবীন্দ্রবিশ্বে নারীর প্রয়োজন বেশি নয়, পুরুষকে সন্তান ও প্ৰেম দেয়ার জন্যেই দরকার নারী। পুরুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ভাববাদী ও পুরুষতান্ত্রিক।

পুরুষ, রবীন্দ্রনাথের ধারণা, পুরুষ হয়েছে এজন্যে যে প্রাণসৃষ্টিতে পুরুষের ভূমিকা ক্ষণউত্তেজনার; আর নারী নারী হয়েছে ওই প্রাণ সৃষ্টি, পোষণ আর সংরক্ষণ করতে গিয়েই। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন আদিম শেকলে নারীকে বেঁধেছে। প্রকৃতি, তাই নারী রয়ে গেছে প্রাকৃতিক আদিম স্তরে। নারীর এ-আদিমতার কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন, এমনকি ১৩৪৩-এ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীসম্মিলনে যখন তিনি ‘নারী’ বিষয়ে প্ৰবন্ধ পড়েন, তখনও নারীদের তাদের আদিমতার কথা স্মরণ করাতে ভোলেন নি। রবীন্দ্ৰচেতনায় নারী :

[ক] জীবপ্রকৃতিব একটা বিশেষ অভিপ্রায় তার মধ্যে চরম পরিণতি পেয়েছে। সে জীবধাত্রী, জীবপালিনী: তাব সম্বন্ধে প্রকৃতির কোনো দ্বিধা নেই। প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্ৰাণতোষণের বিচিত্র ঐশ্বৰ্য তার দেহে মনে পর্যাপ্ত (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮০)।

[খ] প্ৰকৃতির ব্যবস্থায় মেয়ের একটা জায়গা পাকা করে পেয়েছে, পুরুষরা তা পায় নি (পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারি, রব : ১৯, ৩৮৩)।

[গ] মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী। নারীসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে।…প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদন প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীবপালনের সমস্ত প্ৰবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহামনের অন্তুতে অন্তুতে। এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেযে হৃদয়বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্তভাবে। এই সেই প্রবৃত্তি নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাঁথছে নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখবার জন্যে প্রেমে, মেহে, সকরুণ ধৈৰ্যে। মানবসংসারকে গড়ে তোলবার, বেঁধে রাখবার এই আদিম বাঁধুনি (‘নারী’, কালান্তর, রুর : ২৪, ৩৭৭)।

[ঘ] তাই গৃহে নারী যেমনি প্রবেশ করেছে কোথা থেকে অবতীর্ণ হল গৃহিণী, শিশু যেমনি কোলে এল মা তখনই প্রস্তুত। জীবরাজ্যে পরিণত বুদ্ধি এসেছে অনেক পরে (নারী’, কালান্তর, রব ২৪, ৩৭৮)।

পারসন্যালিটিতে (১৯১৭) রবীন্দ্রনাথের যে-কথা কেতকী কুশারীর (১৯৮৫, ২৪৮) অনুবাদে হয়েছে ‘জীবনের পোষণ, সংরক্ষণ ও আরোগ্যসাধনা’, তাকে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারিতে (১৩৩৬) বলেছেন, ‘প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণ’; এবং এ-ই হচ্ছে নারীর মৌল কাজ। নারীর এ-কাজটি আদিম জৈবিক, এবং রবীন্দ্রনাথের মতে এটা উদ্দেশ্যহীন ঘটনা নয়; ‘জীবপ্রকৃতির একটা বিশেষ অভিপ্ৰায়’ নারীর মধ্যে ‘চরম পরিণতি পেয়েছে’। নারী হচ্ছে প্রকৃতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জরায়ুসম্বলিত জীব। প্রকৃতি দ্বিধাহীনভাবে প্রাণসৃষ্টির দায়িত্ব দিয়েছে নারীকে। একথা তিনি ১৯১৭তে, ১৯১৯-এ, ১৯৩৬-এ বলেছেন; এবং এতে বিশ্বাস করেন তিনি যৌবনকাল থেকেই। ১৯৩৬-এ তিনি নারীদের সভায়ই বলেছেন, ‘মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী’; নারী ‘জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্ৰাণকে পোষণ করে’, ‘প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে’, এবং জীবপালনের সমস্ত প্রবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহমানের তত্ত্বতে তন্তুতে।’ নারী সন্তানধারণ করে, প্রসব করে এটা সত্য; তবে রবীন্দ্রনাথ এখানে নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে যেভাবে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে প্ৰকাশ পেয়েছে নারী সম্পর্কে তাঁর ভাববাদী পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা পোষণ করে যে নারী পুরুষের থেকে অনেক বেশি ‘প্রাকৃতিক’; ভারতীয় অঞ্চলে প্রকৃতি ও নারীর ভেদ অস্বীকার করে নারীকে ‘প্রকৃতি’ই বলা হয়। পুরুষতন্ত্র মনে করে যে নারী অচ্ছেদ রূপে জড়িত প্রকৃতির সাথে, তাই নারীর পক্ষে অসম্ভব প্রকৃতি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া। অন্যদিকে পুরুষের রয়েছে দ্বৈত প্রকৃতি : পুরুষ তার দ্বিতীয় প্রকৃতির সাহায্যেই সৃষ্টি করে সভ্যতা। পুরুষ সম্বন্ধে ভাববাদী ধারণা জোর দেয় পুরুষের এ-দ্বিতীয় প্রকৃতির ওপর, যেমন জোর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং পুরুষকে ক’রে তুলেছেন দেবতা। পুরুষতন্ত্র নারীর জন্যে নির্দেশ করেছে একক প্রকৃতি, যা জড়িত আদিম জৈবিকতার সাথে; আর পুরুষের জন্যে দ্বৈত প্ৰকতি, যার দ্বিতীয়টি পুরুষকে করেছে। জৈবিকতা-পেরিয়ে-যাওয়া মানুষ। এটা শুধু পুরুং, তন্ত্রের দার্শনিকতা নয়, এর রয়েছে বাস্তব রূপ : এটা জীবনকে ভাগ করেছে দুটি পৃথক এলাকায়, একটি গাৰ্হস্থ ও অন্যটি সামাজিক জীবন। পুরুষ জীবন যাপন করে দু-এলাকায়ই, তবে সামাজিক এলাকায়ই পুরুষ যাপন করে তার মানবিক জীবন। গাৰ্হস্থ্য জীবন হচ্ছে পুরুষের জৈবিক জীবন, আর সামাজিকটি তার মানবিক জীবন। গাৰ্হস্থ্য জীবন হচ্ছে প্রকৃতির, প্রয়োজনের, অস্বাধীনতার জীবন, যেখানে বাস করে নারী; আর পুরুষ এ-জীবনকে পেরিয়ে সামাজিক জীবনে লাভ করে মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা। নারী গাৰ্হস্থ্যু জৈবিকতার জীবনে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্ৰকথিত ‘প্রাণসৃষ্টি প্রাণপালন ও প্রাণতোষণের’ জন্যে, এবং এটাকে তিনি ও পুরুষতন্ত্র একটা পাশবিক কাজ ব’লেই মনে করেন। এর প্রভাব এতো প্রবল যে নারীবাদী দ্য বোভোয়ারও মনে করেছেন যে সন্তানধারণ ও প্রসব একটি হীন পাশবিক কাজ, এবং নারী অভিশপ্ত এ-জৈবিক অভিশাপে। এ-অভিশাপের ফলেই নারী বন্দী হয়ে আছে গৃহে, আদিম প্রকৃতির শেকলে জড়িয়ে আছে, তার মুক্তি নেই। নারী বন্দী হয়ে আছে মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার অমানবিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই! শুলামিথ ফায়ারস্টোন এ-তত্ত্বটিকে তার যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, নারী-অধীনতার মূল কারণ হয় যদি সন্তানপ্রজনন, তাহলে নারীমুক্তির জন্যে দরকার নারীর সন্তানধারণ করতে অস্বীকার করা [দ্র ওব্রিয়েন (১৯৮২, ১০৪)]। মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়; পুরুষ যদি চায় যে টিকে থাকুক মানবপ্রজাতি, তাহলে তাকে উদ্ভাবন করতে হবে সে-প্ৰযুক্তি, যা টিকিয়ে রাখবে মানবপ্রজাতিকে।

রবীন্দ্রনাথ নারীকে গৃহে দেখতে চান, এবং সব সময় মনে করেছেন প্রকৃতিই নারীর মধ্যে নিজের অভিপ্ৰায় বাস্তবায়িত করার জন্যে নিয়েছে। এ-ব্যবস্থা। পুরুষই যে নারীকে ঢুকিয়েছে ঘরে, একথা তিনি স্বীকার করতে চান নি। ১৯৩৬-এ নারীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি এ-মত কিছুটা বদলান; স্বীকার করেন, ‘মেয়েদের হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্যকে পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপনি ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে কড়া পাহারার বেড়া দিয়ে রেখেছে’ (‘নারী’, কালান্তর, রব : ২৪, ৩৭৯)। পুরুষকে এবার তিনি স্নেহের সাথে দায়ী করেন; এবং সাথেসাথে উচ্চারণ করেন এক সাংঘাতিক কথা : ‘মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বাঁধন-মানা প্রবণতা আছে, সেইজন্যে এটা সর্বত্রই এত সহজ হয়েছে‘ (ওই, ৩৭৯)। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে রয়েছে জন্মক্রীতদাসের বৈশিষ্ট্য, তাই পুরুষ পেরেছে নারীকে বন্দী করতে। পুরুষ যে-জন্যে গৃহে অবরুদ্ধ করেছে নারীকে, তা হচ্ছে ‘হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্য’, বা নারীত্ব, যা নারী পেয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর থাকতেই হবে ওই গুণ : ‘প্রকৃতির কাছ থেকে তারা পেয়েছে অশিক্ষিতাপটুত্ব, মাধুর্যের ঐশ্বর্য তাদের সহজে লাভ করা। যে মেয়ের স্বভাবের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সহজ রসটি না থাকে, কোনো শিক্ষায়, কোনো কৃত্রিম উপায়ে সংসারক্ষেত্রে সে সার্থকতা পায় না’ (ওই, ৩৭৯)। রবীন্দ্রনাথের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ছকবাধা নারীত্ব নামের ‘সহজ রসটি’, যার অভাবকে তিনি মনে করেন ‘দুৰ্ভাগ্য’। কোনো শিক্ষাই ওই রসাভাবের ক্ষতিপূরণ করতে পারে না; নারী কবি, বৈজ্ঞানিক, প্রধান মন্ত্রী হ’লেও বা নোবেল পুরস্কার পেলেও কিছু যায়-আসে না, ওই সব নারীর দুর্ভাগ্য মাত্র। তার সব সাফল্যই, রবীন্দ্ৰমতে, চরম ব্যর্থতা, যদি তার না থাকে ওই সহজ রসটি।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীর পক্ষে কবি-বৈজ্ঞানিক-প্রধান মন্ত্রী হওয়া অস্বাভাবিক, কেননা নারী সহজাতভাবেই পায় নি মানুষের সে-গুণ, যা দরকার ওই সব সামাজিক-মানবিক সাফল্যের জন্যে। ‘পুরুষের আছে বীৰ্য আর মেয়েদের আছে মাধুর্য’; আর ‘মেয়েদের সৃষ্টির আলো যেমন এই প্ৰেম তেমনি পুরুষের সৃষ্টির আলো কল্পনাবৃত্তি’ (পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি, রব; ১৯, ৩৭৯, ৩৮৫)। প্ৰেম-মাধুর্য নারীকে গৃহে আটকে রাখে, তা মধুর ও আলোকিত করে ঘরকে; আর পুরুষের বীর্য ও প্রতিভা উপভোগ ও আলোকিত করে বিশ্ব ও সভ্যতাকে। নারীর ব্যর্থতার মূলে তার জরায়ু; রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বস্তৃত জীবপালনের কাজটাই ব্যক্তিগত। সেটা নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বের কোঠায় পড়ে না, সেই কারণে তাঁর আনন্দ বৃহৎ তত্ত্বের আনন্দ নয়; এমন-কি, মেয়েদের নৈপুণ্য যদিও বহন করেছে রস, কিন্তু সৃষ্টির কাজে আজও যথেষ্ট সার্থক হয় নি’ (‘নারী’, কালাস্তর, রব :২৪, ৩৭৯)। পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধিরা এমন বিশ্বাস পোষণ ও প্রচার করেছেন ধর্মগ্রন্থে, দর্শনশাস্ত্রে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, ও তাদের সব কিছুতে; নারীর প্রতিভার সৃষ্টিকে তারা শুধু অবহেলাই করেন নি, নারীর প্রতিভা থাকতে পারে বলেই বিশ্বাস করেন নি তারা। নারীর প্রতিভাহীনতার কারণ তার জরায়ু, তার অপরাধ সে পালন করে মানুষকে গর্ভে ধারণের মতো অমানবিক কাজ। নারী কীভাবে কাটাবে তার এ-প্রতিবন্ধিতা? যদি জরায়ই তার শক্ৰ হয়, তাহলে জরায়ুকেই বাতিল ক’রে দিতে হবে তার। নারীকে যদি সৃষ্টশীল হতে হয়, তাহলে সন্তানধারণ ও লালনের ব্যক্তিগত কাজ অস্বীকার ক’রে মন দিতে হবে নৈর্ব্যক্তিক কাজে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ নারীকে নৈব্যক্তিক কাজের এলাকায় ঢোকার অনুমতি দিতে রাজি নন।

নারী কী কাজের উপযুক্ত, ঘরের বাইরে গেলে নারীকে মানায় কোন কাজে? নারীর মানানসই কাজের নমুনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন জাপানযাত্রীতে (১৯১৯)। বর্মীনারীদের কর্মের হিল্লোল দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাদের দিয়েছেন। এ-প্ৰশংসাপত্ৰ :

‘লোকের কাছে শুনতে পাই এখানকার পুরুষেরা অলস ও আরামপ্ৰিয়, অন্য দেশের পুরুষের কাজ প্রায সমস্তই এখানে মেয়েরা কবে থাকে। হঠাৎ মনে আসে, এটা বুঝি মেয়েদের উপরে জুলুম করা হয়েছে। কিন্তু, ফলে তো তার উলটোই দেখতে পাচ্ছি–এই কাজকর্মের হিল্লোলে মেয়েরা আরো যেন বেশি করে বিকশিত হয়ে উঠেছে। কেবল বাইরে বেরতে পারাই যে মুক্তি তা নয়, অবাধে কাজ করতে পাওয়া মানুষের পক্ষে তাধ চেয়ে বড়ো মুক্তি। পরাধীনতাই সব চেয়ে বড়ো বন্ধন নয়, কাজের সংকীর্ণতাই হচ্ছে সব চেয়ে কঠোর খাঁচা।

এখানকাব মেয়েরা সেই খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে এমন পূর্ণতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তারা নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজের কাছে সংকুচিত হয়ে নেই; রমণীর লাবণ্যে যেমন তারা প্রেয়সী, শক্তির মুক্তিগৌরবে তেমনি তারা মহীয়সী! কাজেই যে মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, সাঁওতাল মেয়েদের দেখে তা আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলুম। তারা কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু কারিগর যেমন কঠিন আঘাতে মূর্তিটিকে সুব্যক্ত করে তোলে তেমনি এই পরিশ্রমের আঘাতেই এই সাঁওতাল মেয়েদের দেহ এমন নিটোল, এখন সুব্যক্ত হয়ে ওঠে; তাদের সকল প্রকার গতিভঙ্গিতে এমন একটা মুক্তির মহিমা প্ৰকাশ পায়’ (জাপানযাত্রী, রক্স : ১৯, ৩১৫০)।

কী কাজ করতে দেখেছেন তিনি ওই নারীদের? অধ্যাপকের, চিকিৎসকের, প্রকৌশলীর, বিজ্ঞানীর, পৌরপতির, সেনাপতির, মন্ত্রীর? এমন কোনো কাজে তিনি দেখেন নি তাদের; দেখেছেন হয়তো মেয়েরা বাজারে যাচ্ছে, চাষ করছে, পানি আনছে, মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে, বা কারখানায় করছে শ্রমিকের কাজ। তিনি মনে করেন এ-ধরনের কাজে বিকশিত হয় মেয়েরা। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে কাজই মেয়েদের যথার্থ শ্ৰী দেয়, কিন্তু তিনি কি চাইবেন জোড়াসাঁকোর মেয়েরাও ওই ধরনের কাজ ক’রে অর্জন করুক ‘যথাৰ্থ শ্ৰী’? তিনি তা চাইবেন না; তাই রবীন্দ্রনাথ বর্মীনারীদের যে-প্ৰশংসাপত্র দিয়েছেন, তার মূল্য বেশি নয়। পৃথিবী জুড়েই মেয়েরা চিরকাল ধ’রে এ-ধরনের নিম্নকাজ করে আসছে, তা সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্যে নয়; সামাজিক ব্যবস্থাই তাদের বাধ্য করেছে এসব কাজে। সাঁওতাল মেয়েদের কাজেরও তিনি প্রশংসা করেছেন, তাদের কাজের থেকে অবশ্য তার চোখে বেশি পড়েছে ওই নারীদের দৈহিক নিটোলতা। কাজ তাদের দেহকে নিটোল করে নি, কাজ নারীদেহকে নিটোল করলে পৃথিবী জুড়েই দরিদ্র নারীদের দেহ নিটোল হতো, রূপসীশ্রেষ্ঠরা দেখা দিতো সামাজিক শূদ্ৰদের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন বাইরের শারীরিক কাজ মেয়েরা ভালোই করতে পারে, এবং এটা যদি তারা করে, বেশ হয়, বা মেয়েদের খামোখা বাইরে বেরোনো ঠিক নয়, তাদের বাইরে বেরোনো উচিত শুধু কাজ করতে। তিনি মুগ্ধ হয়েছেন নারীদের ভূমিদাসী বা শ্রমিকের কাজ করতে দেখে।

তিনি মনে করেন মেয়েরা ভালো দাসীবৃত্তিতেই; জাপানি দাসীদের দেখে তাঁর মনে হয়েছে :

‘এখানকাব ঘরকন্নার মধ্যে প্রবেশ কলে সব-চেয়ে চোখে পড়ে জাপানি দাসী। … যেন মানুষের সঙ্গে পুতুলের সঙ্গে, মাংসের সঙ্গে মোমের সঙ্গে মিশিয়ে একটা পদার্থ: আর সমস্ত শরীরে ক্ষিপ্ৰতা, নৈপুণ্য, বলিষ্ঠতা।… জানালার বাইরে চেয়ে দেখলুম, প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘবকন্নার হিল্লোল তখন জাগতে আরম্ভ করেছে–সেই হিল্লোল মেয়েদের হিল্লোল। ঘরে ঘরে এই মেয়েদের কাজের ঢেউ এমন বিচিত্র বৃহৎ এবং প্রবল ক’রে সচরাচব দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু, এটা দেখলেই বোঝা যায়, এমন স্বাভাবিক আর কিছু নেই। দেহযাত্ৰা জিনিসটার ভাব আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত মেয়েদেরই হাতে; এই দেহযাত্রার আযোজন উদ্যোগ মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক এবং সুন্দর। কাজেই এই নিয়ত তৎপরতায় মেয়েদের স্বভাব যথার্থ মুক্তি পায় ব’লে শ্ৰীলাভ করে। বিলাসের জড়তায় কিম্বা যে-কারণেই হোক, মেয়েরা যেখানে এই কর্মতৎপরতা থেকে বঞ্চিত সেখানে তাদের বিকার উপস্থিত হয়, তাদের দেহমনের সৌন্দর্যহানি হতে থাকে, এবং তাদের যথার্থ আনন্দের ব্যাঘাত ঘটে (জাপানযাত্রী, রব : ১৯, ৩৩৫)।

রবীন্দ্রনাথের জাপানি দাসীবন্দনার নিচে লুকিয়ে আছে নারীদের কর্মযোগ্যতা সম্বন্ধে এক ভীতিকর দর্শন : দাসীবৃত্তি নারীদের জন্যে স্বাভাবিক। নারীদের রূপান্তরিত করতে হবে দাসী নামের পদার্থে, একাকার করে দিতে হবে মানুষ-মোম-মাংসকে; তারা হিল্লোল জাগিয়ে কাজ করবে, এতে তাদের স্বভাব বিকাশ লাভ ক’রে হয়ে উঠবে সুন্দর। ‘স্বাভাবিক’ হচ্ছে ‘প্রাকৃতিক’-এর অন্যনাম; তাই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীদের দাসীবৃত্তি প্রাকৃতিক। নারীদের বিলাস অবৈধ, কাজ না করলে বিকৃত হয় নারীরা, হানি ঘটে তাদের দেহমানসৌন্দর্যের। মনু বিধান দিয়েছিলেন যে নারীদের কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে সব সময়, নইলে নারীরা পরপুরুষের চিন্তায় নষ্ট হয়ে যাবে; বাইবেলে ঈশ্বর ও গুণবতী ভাৰ্যার প্রশংসা করে বলেছে যে সে আলস্যের খাদ্য খায় না। জাপানি দাসীরা আলস্যের অন্ন তো খায়ই না, বরং তারা কাজকে পরিণত করে সৌন্দর্যের হিল্লোলে, বা কর্মনাট্যে, যা অনুমোদন করবেন মনু আর ঈশ্বর, যার বন্দনা করেন রবীন্দ্রনাথ। নারীরা শুধু দাসীত্বে সফল নয়, রবীন্দ্ৰনাথ দেখেছেন তারা ব্যবসাও করতে পারে :

‘এই ব্যবসাটি এই স্ত্রীলোকেরই নিজের হাতে তৈরি। আমি যে-কথা বলছিলুম এই ব্যবসায়ে তারই প্রমাণ দেখতে পাই। মানুষের মন বোঝা এবং মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ রক্ষা করা স্ত্রীলোকের স্বভাব সিদ্ধ;… কর্মকুশলতা মেয়েদের স্বাভাবিক।…যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না সে-সব কাজ মেয়েরা পুরুষের চেয়ে ঢের ভালো করে করতে পারে, এই আমার বিশ্বাস।… যে-সব কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে-সব কাজে পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার, সে-সব কাজ মেয়েদের’ ( জাপানযাত্রী, রব :১৯, ৩২৩)।

রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন নারীদের কয়েকটি স্বাভাবিক বা প্ৰাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : নারীরা মানুষের মন বুঝতে পারে; মানুষের সাথে সম্বন্ধ রক্ষা করতে পারে; এবং তারা কর্মকুশল। পিতৃতন্ত্র নারীদের এ-গুণগুলোর প্রশংসা করে আসছে কয়েক সহস্ৰক ধরে, এবং নারীরা যাতে বিরত না হয় এগুলোর চর্চা থেকে তার ওপর রেখেছে তীক্ষ দৃষ্টি। এগুলো দাসদের গুণ; মন বুঝে চলতে হয় তাদের, নইলে তাদের পড়তে হয় বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে; সম্বন্ধও রক্ষা করতে হয় তাদের, এবং কর্মকুশলতায় তারা জয় করে প্রভুর মন। স্বাধীন পুরুষের কাছে এসব কাপুরুষতা; কিন্তু নারী যেহেতু দাসশ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত, যেমন দাবি করেছেন আমূল নারীবাদীরা, তাই তারা চলার চেষ্টা করে অপরের মন বুঝে, মানিয়ে নিতে চায় অপরের সাথে। একে স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে শূদ্ৰদের শূদ্ৰত্ব স্বাভাবিক। পিতৃতন্ত্র সমস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাপারকে জৈবিক ও শাশ্বত বলে গণ্য করেছে, রবীন্দ্রনাথও করেছেন। পুরুষতন্ত্র নারীদের বিকৃত করে নিজের উপযোগী ক’রে নিয়েছে, এসব নারীদের স্বাভাবিক স্বভাব নয়। নারীরা ব্যবসা করতে পারে, এতে তিনি বিশ্বাস করেন, এবং তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন; তবে তিনি ব্যবসা বলতে বোঝেন মুদিদোকান চালানো, যার যোগ্য নারীরা। নারীরা যে শারীরিকভাবে দুর্বল, এটা সকলের জানা; রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারীরা মানসিকভাবেও দুর্বল। ‘যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না’, রবীন্দ্রনাথের মতে, সে-সব করতে পারে নারীরা। তাঁর এ-মত অভিনব নয়, পুরুষ নারীদের সম্পর্কে এ-ধারণা পোষণ ও প্রচার করে আসছে পিতৃতন্ত্রের সূচনাকাল থেকেই। রুশো ‘এমিল’-এ এটা আলোচনা করেছেন বিশদভাবে; রবীন্দ্রনাথের মত রুশোর মতেরই প্ৰতিধ্বনি। নারী যেমন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তেমনি প্রতিবন্ধী মানসিকভাবে; তারা করতে পারে সে-সব কাজ যাতে ‘উদ্ভাবনার দরকার নেই’, যাতে ‘পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সব-চেয়ে দরকার’। রবীন্দ্ৰনাথ নারীদের প্রশংসাপত্র দিয়েছেন যে তারা ব্যবসা করতে পারে, তবে ‘ব্যবসা’ বলতে তিনি আসলে ব্যবসা বোঝান নি। ব্যবসার জন্যে দরকার সাহস, উদ্ভাবন শক্তি, তাই নারীরা ব্যবসার উপযুক্ত নয়; রবীন্দ্রনাথ মনে করেন নারী বড়োজোর হতে পারে মুদি; তিনি তা বিলেতে দেখেছেন, জাপানে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন নারীপুরুষের পৃথক এলাকায় বিশ্বাসী, তেমনি নারী যখন বাইরের কাজে আসে তখনও তিনি নারীপুরুষের পৃথক কাজে বিশ্বাসী। একশ্রেণীর তুচ্ছ কাজ আছে, যা করবে নির্বোধ দুর্বল নারী; আর অধিকাংশ সভ্যতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। উদ্ভাবনশীল সাহসী পুরুষ। নারী হবে মুদি, সেবিকা, বিমানবালা, পুরুষ নিৰ্বাহীর ব্যক্তিগত সহকারী; আর পুরুষ হবে সভ্যতার নিয়ন্ত্রক।

রবীন্দ্রনাথ, তার কালের অধিকাংশ মহাপুরুষের মতোই, বিরোধী ছিলেন নারীমুক্তির; যে-নারীরা পুরুষাধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্তির কথা বলে, তারা বিকারগ্রস্ত ব’লে বিশ্বাস করেন তিনি। প্রাকৃতিক স্বাভাবিক নারী কল্যাণী হয়ে থাকবে গৃহে, প্রেম হবে তাদের জীবনের মূলধন; শুধু বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা পেতে চায় বাইরে। পশ্চিমাযাত্রীর ডায়ারিতে (১৩৩৬) তিনি লিখেছেন :

‘প্রকৃতিস্থ অবস্থায় সাধারণত কোনো মেয়ের দল বলে না, পুরুষকে সম্পূর্ণ বর্জন করাটাই তাদের জীবনের চরম ও মহোচ্চ লক্ষ্য। সম্প্রতি কোথাও কোথাও কখনো এমন কথার আভাস শোনা যায়, কিন্তু সেটা হল আস্ফালন। প্রাণের রাজ্যে মেয়েদের যে চিরকেলে স্থান আছে সেখানকার বন্দরের নোঙর ছিঁড়ে মনটাকে নিয়ে তারা নিরুদেশ হয়ে যাবে, এমন কথা দুই-একজন মেয়ে বলতেও পারে: কারণ যাত্রারম্ভে ভাগ্যদেবতা যখন জীবনের সম্বল স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেয় তখন প্যাক করবার সময় কিছু যে উলটোপালটা হয় না, তা নয়’ (বর : ১৯, ৩৮৩)।

নারীমুক্তির কথা, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, কোনো নারী ‘প্রকৃতিস্থ’ অবস্থায় বলতে পারে না; উন্মাদিনীরাই শুধু বলতে পারে এমন অস্বাভাবিক কথা। নারীমুক্তি হচ্ছে পাগলামো! তিনি পশ্চিমের নারীমুক্তিবাদীদের লক্ষ্য ক’রেই এসব বলেছেন, তাদের ক্রিয়াকলাপকে নিন্দা করেছেন ‘আস্ফালন’ বলে। তিনি চান নারী থাকবে ‘প্ৰাণের রাজ্যে’ চিরস্থায়ীভাবে; নারী সন্তান ধারণ ও প্রসব করবে, মনের রাজ্যে তার অধিকার নেই। যদি কোনো নারী মনের রাজ্যে ঢুকতে চায়, বুঝতে হবে তার ভেতরে রয়েছে কোনো গোলমাল। যে-নারী কবিতা লেখে, বিজ্ঞানচর্চা করে সে বিকৃত, প্রকৃতি ভুল করে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা পুরুষকে। যারা বাইরে নারী আর ভেতরে পুরুষ, তারা অবশ্যই বিকৃত। রবীন্দ্রনাথের প্যাকিংতত্ত্ব অনুসারে কৃতী সব নারীই বিকৃত : স্বর্ণকুমারী দেবী, বা বেগম রোকেয়া, মেরি ওলস্টোনক্রাফ্‌ট্‌, জর্জ এলিয়ট, মাদাম ক্যুরি বিকৃত, তাঁদের ভেতরে প্রকৃতি ভুল ক’রে বোঝাই করেছে পুরুষের স্বভাব। রবীন্দ্রনাথের এ-মতের সাথে মিল আছে ফ্রয়েডের ‘পুংগূঢ়ৈষা’র, যার সারকথা হচ্ছে ব্যর্থ বিকৃত নারীরাই প্রতিষ্ঠা চায় বাইরের জগতে। মেয়েরা মুক্তি চায় কেনো? তার কারণ নির্দেশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ :

একদল মেয়ে বলতে শুরু করেছে যে, ‘মেয়ে হওয়াতে আমাদের মগৌরব, আমাদের ক্ষতি। অৰ্থাৎ, আমাদের আত্মপ্রকাশের ধাবায় পুরুষের সঙ্গে প্রভেদটাতে পীড়া পাচ্ছি।’ এর থেকে বোধ হচ্ছে, একদিন যে পুরুষ সাধক ছিল এখন সে হয়েছে বণিক (পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি, রব :১৯, ৩৯১)।

পুরুষ সম্পর্কে অসাধারণ ভাববাদী ধারণা পোষণ রবীন্দ্রনাথের স্বভাব; যে-পুরুষ সফলভাবে নারীকে গৃহে আটকে রাখতো, সে তাঁর চোখে সাধক; যে-পুরুষ নারীকে আটকে রাখতে পারছে না, সে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চোখে সবচেয়ে ঘৃর্ণিত মানুষ-বণিক। তিনি আরো বলেছেন, ‘পুরুষ একদিন ছিল মিষ্টিক, ছিল অতল রসের ডুবারি। এখন হয়েছে মেয়েদের মতোই সংসারী।’ (ওই, ৩৯২)। পুরুষ বণিক হয়ে পড়েছে, সংসারী হয়ে পড়েছে, তাই নারী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে চাইছে, এটা বেশ আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষীয় ব্যাখ্যা। নারীরা কেনো মুক্তি চায়, রবীন্দ্রনাথের এ-রচনা লেখার সময় তা নারীরা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কি নারীবাদীদের কোনো লেখা পড়ার আগ্রহ বোধ করেন নি কখনো?

১৯৩৬-এর অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথ নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীসম্মিলনে পড়েন ‘নারী’ (কালান্তর, রব :২৪, ৩৭৭-৩৮৩) প্ৰবন্ধটি। প্ৰবন্ধটি লিখেছিলেন তিনি নারীদের আমন্ত্রণে যে-নারীরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন মুক্ত বা মুক্তিপিপাসু, বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অপ্ৰকৃতিস্থ’, বা ভুলপ্যাককরা। প্রবন্ধটিতে পাই দুই রবীন্দ্রনাথকে : এক রবীন্দ্রনাথ পিতৃতান্ত্রিক, যিনি নারীকে মনে করেন প্রকৃতির অভিপ্ৰায় বাস্তবায়নের মাংসল যন্ত্র, যার কাজ সন্তানধারণ ও পালন, যে বইছে ‘আদিপ্রাণের সহজ প্রবর্তনা’ নিজের স্বভাবের মধ্যে; আরেক রবীন্দ্রনাথ, অনেকটা বাধ্য হয়ে, মেনে নেন যে নারীকে বেরিয়ে আসতে হবে বাইরে। যে-নারীরা আর কল্যাণী হয়ে থাকতে চান না, তাদের আমন্ত্রণে তাদের সম্মেলনে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে বলবেন, এমন অরুচিকর স্বভাব ছিলো না তাঁর। তিনি খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন নতুন নারীদের সাথে। এ-প্রবন্ধে নারীবাদবিরোধী রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ওপরে দিয়েছি, এখন দেখতে চাই রবীন্দ্রনাথ কতোটা মেনে নিয়েছেন নারীমুক্তিকে। কৃতজ্ঞ বোধ করছি নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের প্রতি, কেননা তারা নিজেদের সভায় আমন্ত্ৰণ ক’রে উদ্ধার করেছিলেন পিতৃতান্ত্রিক রবীন্দ্রনাথকে। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ না জানালে তাঁর তিরোধান ঘটতো নারীমুক্তিবিরোধী পুরুষতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত রূপে; আমন্ত্রিত হয়ে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, কাটিয়ে ওঠেন নিজের আযৌবন প্রগতিবিরোধিতা, স্বীকার ক’রে নেন নারীমুক্তিকে, অনেকটা বাধ্য হয়ে। নারীরাই সৃষ্টি করেন এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে, যখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর। যে-নারীমুক্তি একদিন তাঁর কাছে ছিলো অপ্রকৃতিস্থ ভুলপ্যাককরা একদল নারীর আস্ফালন, তা এখন তার কাছে হয়ে ওঠে অনিবাৰ্য :

‘এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এসিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা-ভাঙার যুগ এসে পড়েছে।…বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, নূতন নূতন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার-বিচারের পরিবর্তন অনিবাৰ্য হয়ে পড়ছে’ (ওই ৩৭৯-৩৮০)।

অনেক কাল তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিই নারীকে বন্দী করেছে। ঘরে, এখন প্রকৃতির সে-অমোঘ নিয়ম হয়ে ওঠে। ‘আচার-বিচার’ অর্থাৎ প্রথা। তাঁর সব বিশ্বাসই বাতিল হয়ে যায় এর ফলে। যে-গৃহ একদা ছিলো তার চোখে নারীর অনিবাৰ্য এলাকা, তা হয়ে ওঠে। অতীতের ব্যাপার :

‘কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই-যে স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এই-যে মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে, এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মানের জন্যে তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা, বিদ্যার চর্চা, একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল’ (ওই, ৩৮১)।

রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন মেয়েদের এলাকা ‘স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে’, ‘মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়েছে’; তবে একটু ভুল বুঝেছেন তিনি, কেননা ঘটনাটি এতো স্বতই-ও আপনিই ঘটে নি। এর জন্যে নারীদের লড়াই করতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাথেও। যে-রবীন্দ্রনাথ নারীদের বিশেষ বুদ্ধি ও বিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি এখন তার আবশ্যক বোধ করেন নারীদের জন্যে; তিনি দেখেন তার ‘কল্যাণী’র বদলে গেছে, বদলে দিচ্ছে পুরুষের সভ্যতাকে :

‘ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই উপলক্ষে মানুষের সৃষ্টিশীল চিত্তে এই-যে নূতন চিত্তের যোগ, সভ্যতায় এ আর-একটি তেজ এনে দিলে। আজ এর ক্রিয়া প্রত্যক্ষে অপ্রত্যক্ষে চলছে। একা পুরুষের গড়া সভ্যতায় যে ভারসামঞ্জস্যের অভাব প্রায়ই প্ৰলয় বাধাবার লক্ষণ আনে, আজ আশা করা যায় ক্ৰমে সে যাবে সাম্যের দিকে … একটিমাত্র বড়ো আশ্বাসের কথা এই যে, কল্পান্তের ভূমিকায় নূতন সভ্যতা গড়বার কাজে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে–প্ৰস্তুত হচ্ছে তারা পৃথিবীর সর্বত্রই। …এখন অন্ধসংস্কারের কারখানায় গড়া পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করা আর তাদের সাজবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবপালিনী বুদ্ধি, কেবল ঘরের লোককে নয়, সকল লোককে রক্ষার জন্যে কায়মনে প্রবৃত্ত হবে’ (ওই, ৩৮২-৩৮৩)।

তাঁর এতোদিন প্রিয় ছিলো ভুবনের মেয়েকে ভবনেয় মেয়েরূপে দেখা, বিশ্বাস ছিলো প্রকৃতির বিধান তাই। এক সময় মনে করতেন তিনি মেয়েরা বাইরে এলে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে; এখন তিনি তাদের প্রতিভাকে, যাতে তাঁর বিশ্বাস ছিলো না, কাজে লাগাতে চাইলেন সভ্যতার ভারসাম্য সৃষ্টিতে। নারী পুরুষকে অনুপ্রাণিত ক’রে, নিজের নারীত্বকে সভ্যতায় সংক্রমিত ক’রে পুরুষালি সভ্যতাকে কোমল করবে, বিধান করবে সভ্যতার সামঞ্জস্য, এমন কথা তিনি আগে (১৯১৭) বলেছেন; তবে এখন যে-ভারসাম্যের কথা বলেন তা প্রকৃতিতে ভিন্ন। তবে নারী যে সন্তান জন্ম দেয় আর লালন করে, তা ভোলেন নি তিনি, তাই নারীকে দেন ‘সকল লোককে রক্ষার দায়িত্ব’। রবীন্দ্রনাথের মুক্ত নারী হয়ে ওঠে সব মানুষের মা। তাহলে পুরুষ কী করবে? রবীন্দ্রনাথ নারীপুরুষের নতুন সভ্যতার রূপরেখাও আঁকেন :

‘সভ্যতা সৃষ্টির নূতন কল্প আশা করা যাক। এ আশা যদি রূপ ধারণ করে তবে এবারকার এই সৃষ্টিতে মেয়েদের কাজ পূর্ণ পরিমাণে নিযুক্ত হবে সন্দেহ নেই। নবযুগের এই আহ্বান আমাদের মেয়েদের মনে যদি পৌঁছে থাকে। তবে তাদের রক্ষণশীল মন যেন বহু যুগের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাকে একান্ত আসক্তিব সঙ্গে বুকে চেপে না ধলে। তাঁরা যেন মুক্ত করেন হৃদয়কে, উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়। সামনে আসছে নূতন সৃষ্টির যুগ’ (ওই ৩৮৩)।

রবীন্দ্রনাথ নতুন কল্প আশা করেন, যাতে পুরোপুরি অংশ নেবে নারীরা। তবে তিনি যেনো মনে করেন এ-নতুন কল্প সূচনা করেছে পুরুষ, তারা ডাকছে নারীকে, আর নারীদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজেদের রক্ষণশীলতা ছেড়ে নতুন কল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করা। অভিযুক্ত করছেন তিনি নারীদেরই, যেনো তারা হৃদয়কে মুক্ত আর, বুদ্ধিকে উজ্জ্বল করে নি ব’লে, জ্ঞানের তপস্যায় নিষ্ঠা প্রয়োগ করে নি ব’লে বিলম্বিত হয়েছে নতুন কল্প। কিন্তু ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত, পুরুষেরাই—যাদের মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথও, সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ ক’রে এসেছে নতুন কল্পকে। তবু সুখকর হচ্ছে যে পঁচাত্তর বছব বয়সে রূপান্তরিত হন রবীন্দ্রনাথ, এবং আরো সুখকর হচ্ছে যে নারীরাই রূপান্তরিত করেছিলো তাঁকে।
 
ফ্ৰয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা


বিশশতকের এক বড়ো স্থপতির মহিমা পেয়েছেন সিগমুন্ড ফ্ৰয়েড; অবচেতনার আবিষ্কারকরূপে তাঁর জুটেছে খণ্ডকালীন অমরতা। এ-শতকের মানবিক সমস্ত কিছুর ওপর পড়েছে এ-মনোবিশ্লেষকের প্রভাব, নারীও তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে নি। তার আবিষ্কার মূল্য পেয়েছে নতুন কোনো সৌরলোক আবিষ্কারের থেকেও বেশি, কেননা তিনি উদঘাটন করেছেন মহাজগতের দুর্জেয়তম সৌরলোক–মানুষের মন-এর সূত্র! তবে এখন খুব বিরক্তিকর প্রশ্ন জাগছে তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে বিশশতকের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি যে-অবচেতনা, তাও আজ বিপন্ন। নারীসম্পর্কে ফ্ৰয়েডের সমস্ত সিদ্ধান্ত এখন গণ্য হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক বলে; শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলও : একরাশ পিতৃতান্ত্রিক, গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত কুসংস্কার তিনি পেশ করেছিলেন মনোবিশ্লেষণরূপে। ফ্ৰয়েড যখন উদঘাটন ও প্রকাশ করে চলছিলেন ‘মনের অদৃশ্য’ সূত্র, শোনাচ্ছিলেন লিবিডো, অহম্‌, অবচেতনা, ইডিপাস-ইলেক্ট্রা গুঢ়ৈষা, শিশ্নাসূয়ার পুরাণ; কামকে ক’রে তুলছিলেন বিশশতকের আল্লা; বিহ্বল হয়ে পড়ছিলো চারদিক। কেউ কেউ বিরোধিতা করেছেন তার : অ্যাডলার, হোরনি, টমসন সরে এসেছিলেন ফ্রয়োড়ীয় আঁধার থেকে; তবে ফ্রয়েডীয় আদিম অন্ধকারের পাতালে নেমে-যাওয়া বিশশতক তাদের আলোর ডাকে সাড়া দেয় নি। ফ্রয়েডের মানুষধারণাকেই ভুল মনে হয় আজ; পিতৃতন্ত্রের, গোত্রের ও নিজের দুঃস্বপ্ন মানুষ নামে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে। ফ্রয়েডের মানুষ জৈবিকভাবে নিয়ন্ত্রিত, যার মুক্তি নেই প্রবৃত্তির কারাগার থেকে; ফ্রয়েডের মানুষ এমন জীব, যার জন্ম সংঘাত থেকে, যে চালিত প্রবৃত্তি দিয়ে, যাকে ঘিরে আছে স্তরেস্তরে নিরাশা; যে নিরন্তর সংঘাতরতা নিজের আর বিশ্বের সাথে। ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্ব সহজাত প্রবৃত্তির তত্ত্ব; লিবিডো হচ্ছে মানুষের মৌল কামশক্তি; মানুষের বিকাশ ঘটে ওই অন্ধ আদিম কামশক্তির সাথের ভয়াল সংঘাতের মধ্য দিয়ে; এ-সংঘাতের ভেতর দিয়ে বিকশিত হয় মানুষের চরিত্র, বিবেক ও সৃষ্টিশীলতা। ফ্রয়েডের জৈবিক প্রবৃত্তিনিয়ন্ত্রিত কামচালিত মানুষের সমস্ত বাস্তব কাজ তার অবদমিত কামের বহিঃপ্রকাশ। গীতাঞ্জলি অবদমিত কামের প্রকাশ, আপেক্ষিকতত্ত্বও তাই। তার তত্ত্ব যে বিশশতককে সম্মোহিত করতে পেরেছিলো, তার কারণ বাইরে তা নিখুঁতভাবে বৈজ্ঞানিক, কিন্তু ভেতরে আদিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ওই তত্ত্বের আপাতজটিলতা, রহস্যময় কাব্যিকতা, প্রতীক ও চিত্রকল্পের ভীতিকরতা মুগ্ধ করেছিলো মানুষকে, যদিও তা সৃষ্টি করেছে মানুষ সম্পর্কে আদিম ও ভুল ধারণা।

হোরনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্ব; মানুষকে আদিম প্রবৃত্তির সংঘাতে জর্জরিত জীবরূপে দেখার বদলে তিনি দেখেছিলেন অশেষ সম্ভাবনাময়রপে। অ্যাডলার বেরিয়ে এসেছিলেন ফ্রয়োডীয় বৃত্ত থেকে; দাবি করেছিলেন যে মানুষ জৈবিক প্রবৃত্তির ক্রীড়নক নয়; কাম প্রধান নিয়ন্ত্রক নয় মানুষের। মানুষ খেলার পুতুল নয় অবচেতন শক্তিরাশির। অবচেতনার থেকে চেতনার মূল্য ছিলো তার কাছে বেশি; কিন্তু বিশশতকের মানুষ বিজ্ঞানের বিস্ময়ের মধ্যে বাস করেও নিজেদের দেখতে পছন্দ করেছে আদিম প্রবৃত্তি ও কামের ক্রীড়নকারূপে। ফ্ৰয়েডের লিবিডো, অবচেতনা, প্রবৃত্তি সবই খুব সন্দেহজনক ব্যাপার। ফ্রয়েড আধুনিক কালে জন্ম দিয়েছিলেন পালেপালে আদিম মানুষ। ফ্রয়েড বিশ্বাসী ছিলেন অতীতে, অ্যাডলার ভবিষ্যতে; ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষের প্রত্যাশা করার কিছু নেই, অ্যাডলার বিশ্বাস করতেন প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাই মানুষ। ফ্রয়েড যে-অন্ধকারকে মানুষ নামে উপস্থিত করেছিলেন, তার হাতছানি ছিলো তীব্র; তাতে বিজ্ঞান, আদিমতা, কবিতা, কল্পনা, পুরাণ, কুসংস্কার ছিলো প্রচুর, তাই তাতে সাড়া দিয়েছে মানুষ। ফ্রয়েড বিশশতকের এক বড়ো স্থপতি, এবং পিতৃতন্ত্র, কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীলতারও এক বড়ো মহাপুরুষ।

ফ্রয়েডের কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মর্মস্পশী রূপ ধরা পড়ে তাঁর নারীধারণায় ও নারীবিশ্লেষণে; তাই নারীবাদীরাই প্রথম প্রবলভাবে আক্রমণ করেন তাকে। নারীবাদীদের বহুমুখি তীব্র যৌক্তিক আক্রমণে তার জ্যোতিশ্চিক্রটি এখন ম্লান। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৬৯-৮৩) ফ্রয়েডকে অনেকটা মেনে নিয়ে অনেকখানি প্রতিবাদ করেছিলেন চার দশক আগে, তাঁর অনেক কিছু বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন বিনয়ের সাথে; তবে নবনারীবাদীরা তার মতো বিনয়ী নন : ফ্রাইডান (১৯৬৩, ৯১-১১১) ফ্রয়েডের প্রতিক্রিয়াশীল কুসংস্কারের রূপটি তুলে ধ’রে দেখান তাঁর ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা; আর মিলেট (১৯৬৯, ১৭৬-২২০) প্রচণ্ড আক্রমণ চালান ফ্রয়েড ও উত্তর-ফ্রয়েডীয়দের বিরুদ্ধে। তিনি কোনো কিছুই বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে রাজি নন; এবং বিজ্ঞানের নামে প্রচলিত সমস্ত কুসংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করতে দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ। প্রধানত মিলেটের মূর্তিভাঙা আক্রমণের ফলেই ফ্রয়েড নারীবাদীদের, এবং অন্যদের কাছেও, হয়ে ওঠেন এক প্রতিক্রিয়াশীল অবৈজ্ঞানিক নাম। মিলেটের আক্রমণ তুলনাহীন ভাষায় ও যুক্তিতে। পরে নারীবাদীদেরই কেউকেউ, যেমন মিশেল (১৯৭৪), কিছুটা ভুল ধরার চেষ্টা করেন মিলেটের; অভিযোগ করেন যে মিলেট কোনো কোনো স্থলে বিশ্বস্তভাবে ফ্রয়েডকে উপস্থাপিত করেন নি। এসব সত্ত্বেও মিলেটের আক্রমণ যথাৰ্থ: ফ্রয়েড যেখানে উদঘাটন করেছেন মানুষ ও নারীর জৈবিক-মানসিক সূত্র, মিলেট সেখানে উদঘাটন করেছেন ফ্রয়েডের সীমাবদ্ধতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সূত্র; এবং দেখিয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব ও ভিক্টোরীয় রক্ষশীলতাই ফ্ৰয়েডকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে নারীত্ব সম্পর্কে ফ্ৰয়েডীয় সূত্ররাশি। ১৯৩০-১৯৬০ সময়টিতে পশ্চিমে ঘটেছিলো রক্ষণশীলতার প্ৰত্যাবর্তন; নানা ধরনের রক্ষণশীলতার মধ্যে একটি ছিলো নারীকে আবার নারী ক’রে তোলা, নারীকে আবার চিরন্তনী ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া। এ-সময় পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বন্যা ধর্ম থেকে আসে নি, এসেছিলো পশ্চিমের ঝকঝকে শাস্ত্রগুলো থেকে : সাহিত্য থেকে, এবং বিজ্ঞান থেকে, বিশেষ ক’রে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব থেকে। বিজ্ঞানের মলাটের ভেতরে এ-সময়ের মহাপুরুষেরা পরিবেশন করেন পুরোনো পৃথক এলাকা ও ভূমিকাতত্ত্ব। মিলেটের (১৯৬৯, ১৭৮) মতে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী সিগমুন্ড ফ্রয়েড, যিনি ছিলেন ওই সময়ের ‘লৈঙ্গিক রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিমান একক প্রতিবিপ্লবী শক্তি’। নারীসম্পর্কে যতো কুসংস্কার তৈরি করা হয়েছিলো গত কয়েক সহস্ৰকে, নারীবাদীদের প্রতিবাদে যা হ’টে গিয়েছিলো অনেকখানি, তার সবই এ-সময়ে ফিরে এসেছিলো ফ্রয়েডীয় ছদ্মবেশে। ফ্রয়েডের জনপ্রিয় বাজারি ভাষ্যকারেরা তা ছড়িয়ে দিয়েছিলো দিকে দিকে। এতোদিন যে-নারী ছিলো ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বিকলাঙ্গ আর অধম, ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞানে সে হয়ে ওঠে বৈজ্ঞানিকভাবে বিকলাঙ্গ ও বিকৃত; ফ্ৰয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের কুসংস্কার নারীকে যতোটা শোচনীয় জীবে পরিণত করে, তা করে নি কোনো ধর্মগ্রন্থও। ফ্রয়েড যদিও মেরি বোনাপার্তের কাছে স্বীকার করেছিলেন [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১০১), মিলেট (১৯৬৯, ১৭৮)] : ‘যে-বিশাল প্রশ্নটির উত্তর কখনো দেয়া হয় নি এবং তিরিশ বছর ধরে নারী-আত্মা সম্পর্কে গবেষণা ক’রে যার উত্তর আমিও দিতে পারি নি, তা হচ্ছে নারী কী চায়?”, তবু নারীমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে তৈরি করেছিলেন তিনি এক ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব, যার ভিত্তি তাঁর এক ধ্রুববিশ্বাস যে ‘দেহই নিয়তি : অ্যানাটমি ইজ ডেসটিনি’। ফ্রয়েডের নারী নিজের বিকলাঙ্গ শরীরের শিকার।

ফ্ৰয়েড ছিলেন নিপুণ পর্যবেক্ষক; তবে রোগিনীদের সমস্যা বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন ইহুদি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির বন্দী। তিনি জন্মেছিলেন মধ্য ইউরোপের প্রবল পিতৃতান্ত্রিক ইহুদি পরিবারে; বেড়েছিলেন ওই সমাজে যেখানে নারীপুরুষের এলাকা ও ভূমিকা ছিলো সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। সেখানে পুরুষেরা প্রতিদিন প্রার্থনায় বিধাতাকে ধন্যবাদ জানাতো : ‘তোমাকে ধন্যবাদ, প্ৰভু, তুমি আমাকে নারী করে সৃষ্টি করো নি ব’লে’; আর নারীরা বিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতো : ‘তোমাকে ধন্যবাদ, প্ৰভু, আমাকে তুমি তোমার অভিলাষ অনুসারে সুষ্টি করেছে বলে।’ তাদের পরিবারে বাবা ছিলো জিহোভার সমান প্রতাপশালী, মা পতঙ্গের মতো অসহায়। পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা ছিলো ওই পরিবারে ও সমাজে প্রকৃতির শাশ্বত বিধান। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন পুরুষাধিপত্যবাদীরূপে, নারীমুক্তি ছিলো তার কাছে উদ্ভট ব্যাপার। মিলের নারী-অধীনতা (১৮৬৯) পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তিনি; নারী পুরুষের মতো বাইরে বেরিয়ে জীবিকা অর্জন করবে। এটা ভাবতে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছেন তিনি, এবং উদ্বিগ্ন বোধ করেছেন যে এতে নষ্ট হয়ে যাবে নারীর নারীত্ব ও রমণীয়তা। তিনি নিজের পরিবারে ছেলেবেলা থেকে পুরুষকে দেখেছেন প্রবল, নারীকে অসহায়, পর্যুদস্ত, দুর্বল; এবং এটা তার কাছে মনে হয়েছে স্বাভাবিক। নারীর যে-স্বভাব ও অবস্থা তিনি দেখেছেন, তা যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাপের ফল হতে পারে, এমন বোধ তাঁর মনে জাগে নি কখনো; বরং একে তিনি ভেবেছেন প্রাকৃতিক ও জৈবিক। বিয়ের আগে ফ্রয়েড তাঁর ভাবী স্ত্রী মাৰ্থ বারনেইসকে লিখেছিলেন ন-শোর মতো চিঠি : ওই চিঠিগুলোতে পাওয়া যায় এক পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষাধিপত্যবাদী ফ্ৰয়েডকে, যিনি ভাবী স্ত্রীকে করেন ‘আমার মিষ্টি মেয়ে’, ‘প্ৰিয় ছোট্ট নারী’, ‘রাজকন্যা, আমার ছোট্ট রাজকন্যা’র মতো সম্বোধন। ওই তরুণীকে তিনি মনে করেছেন বালিকা; বিয়ের পর তাকে মনে করেছেন বালিকাবধু, যার কোনো বিকাশ ঘটা অসম্ভব। একটি চিঠিতে লিখেছেন [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ৯৭-৯৮)] : ‘আমি জানি তুমি কতো মিষ্টি, কীভাবে তুমি গৃহকে পরিণত করতে পারো স্বর্গে…যতোটা চাও আমি তোমাকে শাসন করতে দেবো আমাদের গৃহ, আর তুমি আমাকে পুরস্কৃত করবে তোমার মধুর প্রেমে’; আরেক চিঠিতে (৫ ১১ ১৮৮৩) স্টুয়ার্ট মিলের নারীমুক্তির প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি লেখেন :

‘তাঁর সম্পূর্ণ রচনায় এটা কখনো ধরা পড়ে নি যে নারীরা পুরুষের থেকে ভিন্ন–নিকৃষ্ট বলবো না, বলবো বিপরীত৷… পুরুষের মতো নারীকেও জীবনসংগ্রামে পাঠাতে হবে, এটা সত্যিই একটা মৃতজাত ভাবনা। যদি আমি আমার মিষ্টি মেয়েকে কল্পনা করি এমন প্রতিযোগীরূপে, তাহলে তাকে আমি শুধু বলতে চাই, যেমন সতেরো মাস আগে বলেছি যে আমি তাকে ভালোবাসি এবং আমি চাই সে নিজেকে ওই সংগ্রাম থেকে গুটিয়ে নিয়ে আশ্রয় নেবে আমাব গৃহের শান্ত প্রতিযোগিতাহীন কাজে৷…প্রকৃতি নারীর নিয়তি নির্দিষ্ট ক’রে দিয়েছে রূপ, মোহনীয়তা, ও মাধুর্যের মধ্য দিয়ে। আইন ও প্রথার নারীকে তার অনেক প্রাপ্য দেয়ার আছে, তবে নারীর নিশ্চিত মৰ্যাদা হচ্ছে : যৌবনে পূজিত প্রিয়তমা আর বাৰ্ধক্যে প্ৰিয় পত্নী।

ফ্ৰয়েড ছিলেন রক্ষণশীল, আদর্শ ভিক্টোরীয়; তিনি সর্বত্ৰ কাম দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু নিজে কামপরায়ণ ছিলেন না। তিনি ছিলেন অনেকটা আইবুড়ো আচারনিষ্ঠ নারীর মতো যে চারদিকে দেখতে পায় শুধু কাম। যে-মার্থকে বিয়ের আগে ন-শো চিঠি লিখেছিলেন তিনি, বিয়ের পর তাকে আর চিঠি লিখেন নি; বিয়ের পর তাকে ফ্রয়েড দায়িত্ব দেন পত্মীর, যে তার সংসার দেখে আর দেয় ছটি সন্তান। তার সংসারকে মার্থা স্বর্গে পরিণত করতে পারে নি, অবধারিতভাবে সেটি হয়ে ওঠে একটি পিতৃতান্ত্রিক ইহুদি সংসার, যেখানে স্ত্রীর কাজ স্বামীসেবা প্রসব ও লালনপালন।

ফ্রয়েডের নারীতত্ত্বে প্রতিটি নারীর জীবনী হচ্ছে শিশ্নাসূয়ার ইতিহাস। প্রতিটি নারী ধারাবাহিক শিশ্নাসূয়া [পেনিস এনভি]। লিঙ্গপুজোর ইতিহাসে ফ্রয়েড অতুলনীয়; তাঁর তত্ত্বে শিশ্ন বা (পুং)লিঙ্গই বিধাতা; লিঙ্গের এমন বৈজ্ঞানিক উত্থান কখনো ঘটে নি। লিঙ্গপুজোয় অদ্বিতীয় হিন্দুরা; ফ্রয়েড তাদেরও ওপরে। শিবলিঙ্গপুজোর একটি মন্ত্র আছে : ‘পবিত্র শিব, স্বগীয লিঙ্গধারী, স্বর্গীয় মূল, স্বর্গীয় শিশ্ন, প্ৰভু লিঙ্গ, তোমার জ্যোতির্ময় লিঙ্গ এতো বিশাল যে ব্ৰহ্মা আর বিষ্ণুও তা পরিমাপ করতে পারে না’ [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৩৬)]। প্রাচীন কালে দেবীদের উৎখাত ক’রে দেবতাদের প্রতিষ্ঠার পর (পুং)লিঙ্গের যে-উত্থান ঘটে, তা চরম পরিণতি পায় ফ্রয়েডের তত্ত্বে। ফ্রয়েডের তত্ত্বে নারীর ব্যক্তিত্বের মূলে রয়েছে তার শাশ্বত শিশ্নাসূয়া; নারীর জীবন কাটে পুরুষের লিঙ্গটিকে অবিরাম ঈর্ষা করে। নারী পুরুষের প্রচণ্ড লিঙ্গের ঈর্ষায় পোড়ায় নিজের সমগ্র অস্তিত্ব। নারী সম্পর্কে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের পরিণত রূপ উপস্থাপিত হয়েছে ‘নারীমনস্তত্ত্ব’ বা ‘নারীত্ব’ (১৯৩৩) নামক বক্তৃতায়। ফ্রয়েড নারীকে স্বায়ত্তশাসিত মানুষ রূপে না দেখে দেখেছেন পুরুষের ঋণাত্মক প্রাণী রূপে; নারী এমন মানুষ, যে পুরুষ নয়; নারী এমন মানুষ বা পুরুষ, যার কিছু একটা হারিয়ে গেছে। নারী হারিয়ে ফেলেছে তার শিশ্ন; নারী হচ্ছে শিশ্নহীনতা। ফ্রয়েডের মতে নারী যখন আবিষ্কার করে তার লিঙ্গ, দেখতে পায় তার শিশ্ন নেই, তখন সে মুখোমুখি হয় ভয়াবহ বিপর্যয়ের, যা নিয়ন্ত্রণ করে তার ব্যক্তিত্ব ও সারা জীবনকে। ফ্রয়েডের নারীমনস্তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে একটি বিপন্নকর অভিজ্ঞতার ওপর যে তার রয়েছে শিশ্নের বদলে একটি যোনি। নারী তার রন্ধটিকে কী চোখে দেখে? ফ্রয়েড বলেন, বালিকা নিজের যোনিটি দেখেই মনে করে বা বুঝে ফেলে যে ওখানে একটি শিশ্ন থাকার কথা ছিলো; কিন্তু সেটি কেটে ফেলা হয়েছে, তাকে খোজা ক’রে ফেলা হয়েছে। নারী হচ্ছে খোজা পুরুষ, যে নিজের খোজাত্বের যন্ত্রণায় আমরণ ঈর্ষা ক’রে চলে পুরুষের অনন্য অসাধারণ অঙ্গটিকে।

ফ্রয়েড পুরুষনারীর কামবিকাশকে ভাগ করেছেন কয়েকটি স্তরে। শিশুর প্রথম বছরটি তার মনোকামিক বিকাশের মৌখিক স্তর, এ-সময় মুখই তার কাম-এলাকা। দ্বিতীয় বছরে শিশু উত্তীর্ণ হয় পায়ুস্তর-এ, পায়ুতে বোধ করে কামসুখ। তৃতীয়-চতুর্থ বছরে শিশু পৌঁছে লিঙ্গস্তর-এ, ছেলেরা শিশ্নে আর মেয়েরা ভগাঙ্কুরে বোধ করে কামসুখ। ছ-বছরের দিকে শিশুর কামবোধ কিছুটা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন চলে তার সুপ্তিস্তর। এরপর কৈশোর আসে তার জননেন্দ্ৰিয় স্তর, যখন আবার জাগে তার কাম। এ-সময়ে সে আকর্ষণ বোধ করে অন্য লিঙ্গের প্রতি; এবং সম্পন্ন হয় তার মনোকামিক বিকাশ। তবে ফ্রয়েডে ছেলে ও মেয়ের মনোকামিক বিকাশ অভিন্ন নয়; লিঙ্গস্তরে এসে তাদের মধ্যে ঘটে ভয়ঙ্কর ভিন্নতা। এ-স্তর থেকেই ফ্রয়েড ছেলেকে পুরুষ আর মেয়েকে বিকলাঙ্গ নারী ভাবতে শুরু করেন; এ-স্তরেই ঠিক হয়ে যায় যে ছেলে হবে পুরুষ আর মেয়ে হবে শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত নারী। ফ্রয়েড জানিয়েছেন শিশুরা এ-স্তরেই আবিষ্কার করে তাদের লিঙ্গ, লিপ্ত হয় হস্তমৈথুনে; ছেলেরা শিশ্নের, মেয়ের ভগাঙ্কুরের সাহায্যে। ফ্রয়েড ছেলের শিশ্ন ও মেয়ের ভগাঙ্কুরের মধ্যে দেখেছেন মহত্ত্ব ও নিকৃষ্টতা; তিনি শিশ্নকে বলেছেন ‘ছেলের বহুগুণে উৎকৃষ্ট হাতিয়ার’, ভগাঙ্কুরকে বলেছেন ‘তার নিকৃষ্ট ভগাঙ্গুর’, ‘জননেন্দ্রিয়গত ত্রুটি’, ‘আদি যৌন নিকৃষ্টতা’। ফ্রয়েডের মতে লিঙ্গস্তরে প্রতিটি মেয়ের নিয়তি হচ্ছে একটি ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের’ মুখোমুখি হওয়া; সে আবিষ্কার করে যে ছেলেদের রয়েছে একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য বৃহৎ শিশ্ন, এবং সাথেসাথে বুঝে ফেলে যে ওটা তার নিজের তুচ্ছ ভগাঙ্কুরের থেকে কতো উৎকৃষ্ট! এ-মহৎ আবিষ্কারের পর তার আর কোনো ক্ষমা নেই; ফ্রয়েড বলেন, ‘সে-মুহূর্ত থেকেই চিরকালের জন্যে সে আক্রান্ত হয় শিশ্নাসূয়ায়’! বালিকা মনে করে তার শিশ্নটি কেটে ফেলে খোজা ক’রে ফেলা হয়েছে তাকে, সে বইছে একটি ঘা; আর ওই ঘা’টি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক। এর ফলে জন্মে তার চিরজীবী হীনমন্যতাবোধ–হীনমন্যতা গূঢ়ৈষ্যা। ফ্রয়েডের বর্ণনা ও সিদ্ধান্ত খুবই মন্ময়, যা যুক্তিতে টেকে না। ছেলেমেয়েরা শিশুকালে পরস্পরের লিঙ্গ দেখে, তবে বালিকার পক্ষে বালকের শিশ্ন দেখা কেনো হবে এতো গুরুত্বপূর্ণ? কেনো বালিকা বালকের ‘বৃহৎ’ শিশ্নটিকে মনে করবে উৎকৃষ্ট? বড়ো হ’লেই হয় উৎকৃষ্ট? তার কাছে বালকের ঝুলন্ত মাংসাটুকরে মনে হ’তে পারে হাস্যকর, নিজের প্রত্যঙ্গটিকে স্বাভাবিক। বালিকা কেনো নিজের প্রত্যঙ্গটি দেখেই মনে ক’রে ফেলবে ওটি বিকল, বালকেরটিকে মনে করবে উৎকৃষ্ট, এবং সাথেসাথে আক্রান্ত হবে চিরশিশ্নাসূয়ায়? বালিকাদের অভিজ্ঞতা জানায় যে ফ্রয়েডীয় ওই সব অনুমান সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তারা বালকদের শিশ্ন দেখে ঈৰ্ষায় কাতর হয়ে ওঠে না।

ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনেকখানি দাঁড়িয়ে আছে বালিকার ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ আবিষ্কারের ওপর যে তার শিশ্ন নেই। ফ্রয়েড একে উপস্থাপিত করেছেন ভয়াবহভাবে, তার বর্ণনা শিউরে দিতে পারে যে-কাউকে; মিলেট একে বলেছেন বাইবেলি স্বৰ্গচ্যুতির পুনরাভিনয়। তবে পৌরাণিক বিধাতা স্বৰ্গচ্যুত কবেছিলেন দুজনকেই; কিন্তু বিশশতকের মনোবিজ্ঞানের বিধাতা স্বৰ্গচ্যুতি ঘটান শুধু ইভের। ফ্রয়েড বিশ্বাস করেন, এবং আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন যে বালিকা তার ভগাঙ্কুরকে মনে করে শিশ্ন। কেনো বালিকা তার ওই শিউলিবোটাটিকে শিশ্ন মনে করে? ফ্রয়েড বলেন, বালিকা হস্তমৈথুন করে ওটি দিয়ে, তাই ওটিকে সে মনে করে শিশ্ন। যেনো ওই কাজটির জন্যে রয়েছে এক আদর্শ হাতিয়ার, যার নাম শিশ্ন; তাই যা দিয়েই করা হবে ওই কাজটি, তাকেই মনে করতে হবে শিশ্ন, বা নকল শিশ্ন, যা প্লাতোর দর্শন অনুসারে বাস্তবতা থেকে দ্বিগুণ দূরবর্তী, এবং ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানে নিকৃষ্ট! তিনি আরো বলেন, বালিকা ওটি দিয়ে হস্তমৈথুন করতে গিয়েই বুঝে ফেলে যে এ-কাজের জন্যে শ্রেষ্ঠ সামগ্ৰী হচ্ছে শিশ্ন। ফ্রয়েডের বালিকা তার মতোই জ্ঞানী, সে নিজের ভগাঙ্কর ছুঁয়েই সব বুঝে ফেলে; তুলনা ক’রে ফেলে শিশ্ন ও ভগাঙ্কুরের মধ্যে, এবং পৌঁছে যায় নিজের নিয়তিতে। এসব কি বালিকার ভাবনা, বালিকার বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত? পুরুষতান্ত্রিক ফ্রয়েডই বালিকা হয়ে মনে করছেন এসব, নিজের ভাবনাকে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন বালিকার ওপর। মেয়েশিশু যখন প্রথম দেখে কোনো ছেলেশিশুর শিশ্ন, তখনই সে কীভাবে বোঝে যে ওই সম্রান্ত প্রত্যঙ্গটি দিয়ে হস্তমৈথুন করে ছেলেশিশুটি? ধরা যাক কোনো মেয়েশিশু জীবনে প্রথম শিশ্ন দেখে এমন এক ফ্রয়েডীয় বালকের, যখন সে লিপ্ত ছিলো হস্তমৈথুনে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সে কী ক’রে বোঝে যে, ওইটিই সর্বোত্তম এ-ক্রিয়ার জন্যে? ফ্রয়েড নিজের সিদ্ধান্ত বালিকার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তৈরি করেছেন এমন কিংবদন্তি, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হস্তমৈথুনের উৎকৰ্ষই যদি মানদণ্ড হয় শ্রেষ্ঠত্বের, তবে স্বীকার করতেই হবে যে শিশ্নের থেকে ভগান্ধুর অনেক উৎকৃষ্ট! এর স্পর্শকাতরতা, বৈদ্যুতিক পুলকের প্রতিভা নেই পুরুষের কোনো প্রত্যঙ্গের। ফ্রয়েডের বিশ্বাসে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, নারী নিকৃষ্ট; এবং পুরুষকে, শুধু পুরুষকে নয় পুরুষের সভ্যতাকে, তিনি সংহত করেছিলেন একটি প্রতীকে: প্রতীকটি হচ্ছে শিশ্ন। ফ্রয়েডীয় বিশ্বে শিশ্নই বিধাতা; তাই তার চোখে শিশ্নের পাশে ভগাঙ্কুর শোচনীয়ভাবে নিকৃষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারী জৈবিকভাবেই নিকৃষ্ট পুরুষের থেকে। ক্লারা টম্পসন বলেছেন, ফ্রয়েড নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় মানসিকতা থেকে কখনোই মুক্তি পান নি। তাঁর সমগ্ৰ চিন্তার দুটি মূল ভাবনা, খোজা গৃঢ়ৈষা ও শিশ্নসূয়া, প্রস্তাব করা হয়েছে এ-ধারণা থেকে যে নারী জৈবিকভাবে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট’ [দ্র ফ্ৰাইডান (১৯৬৩, ১০২)]। নারী কি সত্যিই ঈৰ্ষা করে পুরুষের প্রত্যঙ্গটিকে, নাকি কি ঈর্ষা করে ওই প্রত্যঙ্গধারীদের শিশ্নাসূয়ার পেছনে যে কোনো জৈবিক কারণ নেই, রয়েছে সামাজিক কারণ, এটা ফ্রয়েড উপেক্ষা করেছেন পুরোপুরি। তাঁর পরিভাষাটি খুবই আপত্তিকর; এটি নারীকে চিহ্নিত করে পুরুষের একটি নির্বোধ প্রত্যঙ্গের অসূয়ায় জর্জরিত জীব ব’লে, গোপন ক’রে যায় নারীর দ্ৰোহকে।

শিশ্নাসূয়ার সাথে শিশুনারীকে, ফ্রয়েডের মতে, ধরে আরেকটি রোগে; তার নাম খোজাগূঢ়ৈষ্যা। ছেলেকেও ধরে এ-ব্যাধিতে; ফ্রয়েড বলেন, সে যখন দেখতে পায় মেয়েদের নেই তার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ, তখন তাকে পায় খোজা হয়ে যাওয়ার ভয়ে। সে মনে করে কোনো কুকর্মের শাস্তি হিশেবে কেটে নেয়া হয়েছে মেয়েদের শিশ্ন; এবং তখন সে ভয় পেতে থাকে যে তার শিশ্নটিকেও কেটে ফেলে হয়তো খোজা ক’রে দেয়া হবে তাকে। তার ভয়ের কারণ সে বাবাকে হটিয়ে, ইডিপাসের মতো, কামনা করছে মাকে। সে কিছুকাল থাকে উদ্বেগ আর ভয়ের মধ্যে; কিন্তু একদিন সে অর্জন করে পৌরুষ, নিজেকে অভিন্ন মনে করে পিতার সাথে; কেটে যায় তার রোগ। মেয়ের বেলা তা ঘটে না, তা হয়ে থাকে দুরারোগ্য জন্মব্যাধি। মেয়ে যখন দেখে তার নেই শিশ্ন, সে বুঝে ফেলে তাকে খোজা ক’রে দেয়া হয়েছে; সে ভুগতে থাকে ঈর্ষায় ও হীনমন্যতায়। যখন সে দেখে তার মতো অন্য মেয়েদের, তার মায়েরও, নেই শিশ্ন, সে তখন ঘেন্না করতে শুরু করে নারীজাতিকেই। ফ্ৰয়েড (১৯৩৩, ১৬০-১৬১) বলেছেন :

‘দু-লিঙ্গের শারীরিক পার্থক্য ছাপ ফেলে মানসিক জীবনের ওপর। বিশ্লেষণ থেকে এটা আবিষ্কার করা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলো যে মেয়ে নিজের শিশ্নের অভাবের জন্যে দায়ী কবে তার মাকে; আর এ-অভাবের জন্যে তাকে কোনোদিন ক্ষমা করে না …মেয়েদের বেলাও খোজা গূঢ়ৈষা দেখা দেয় অন্য লিঙ্গের জননেন্দ্ৰিয় দেখার পর। সে তৎক্ষণাৎ পার্থক্যটা লক্ষ্য করে, এবং বুঝতে পারে, স্বীকার করতেই হবে, এর তাৎপৰ্য সে বোধ কবে মারাত্মক অসুবিধা, এবং মাঝেমাঝেই ঘোষণা করে সেও ‘চায় ওরকম একটা কিছু’; এবং হয়ে পড়ে শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত, যা তার বিকাশ ও চরিত্রগঠনের ওপব অমোচনীয় ছাপ ফেলে যায়, যা অশেষ মানসিক শক্তি ছাড়া জয় করা যায় না। বালিকা বুঝতে পারে তার শিশ্ন নেই, এর অর্থ এ নয় যে এর অভাবকে সে মেনে নেয় হাল্কাভাবে। ঘটে এর বিপরীত, সে দীর্ঘকাল ধ’রে থাকে আমন একটা কিছু পাওয়ার বাসনায়; এবং এর সম্ভবপরতায় বিশ্বাস কবে বহু বছর; এমনকি যখন তার বাস্তবতাবোধ তাকে বাধ্য করে ওই বাসনা ত্যাগ করতে, কেননা তা চরিতাৰ্থ কিবা অসম্ভব, বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে তখনো তা বিরাজ করে তার অবচেতনায়, এবং ধারণ করে বেশপরিমাণ শক্তি। শিশ্ন লাভের যে-বাসনা এতো বেশি সে পোষণ কবে, তাই হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মনোবিশ্লেষণে আসার পেছনে থাকে; এবং মনোবিশ্লেষণ থেকে তারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই যা প্রত্যাশা কবে, যেমন কোনো মননশীল কর্মজীবন চালানো, তাকেও অনেক সময মনে করা যায় এ-অবদমিত বাসনার উৎকর্ষিত রূপ ব’লে।‘

অর্থাৎ শিশ্নের ঈর্ষায় ও খোজা মনোভাবের জন্যে চিরকালের জন্যে বিকৃত হয়ে যায় নারী।

শিশ্নাসূয়া ও খোজাগূঢ়ৈষার কুফল ফলে আরো; জীবনের শুরুতে মেয়েশিশু মাকে নেয় নিজের প্ৰেমাস্পদরূপে, কিন্তু এ-স্তরে এসে সে ত্যাগ করে মাকে। ফ্রয়েড বলেন, সে ছেড়ে দেয় মাকে গর্ভবতী করার বাসনা! মাকে সে বর্জন করে, কেননা মা-ই ‘দায়ী তার শিশ্নহীনতার জন্যে’; মা-ই ‘তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে এমন অপ্রস্তুতভাবে’। ফ্ৰয়েড বলেন, ‘নিজের খোজাত্ব আবিষ্কার তার জীবনের এক মোড়-বিন্দু’; এ-সময় থেকে মা ও সব নারীর মূল্য কমে যায় তার চোখে, যে-শিশ্নহীনতার কারণে পুরুষের চোখেও নারীর মূল্য কম। এ-সময়ে তার লিবিডো ছোটে পিতার দিকে, কেননা তার আছে একটি শিশ্ন। পিতা হয়ে ওঠে তার প্ৰেমাস্পদ, মাকে সে দেখতে থাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। শিশুমেয়ে, ফ্রয়েড বলেন, মনে করে যে তার পিতা খুব উদার হয়ে তাকে উপহার দেবে একটি শিশ্ন। কিন্তু হতাশ হ’তে তার দেরি হয় না; তখন সে নিজের কামনা পূরণ করতে চায় গৰ্ভে সন্তান ধারণ করে। তবে ওই সন্তান শিশ্নের বিকল্প, শিশু নয়। ওটি এক ‘শিশ্নশিশু’। ফ্রয়েড বলেন, নারীর শিশ্নকামনা কখনো কাটে না, কেননা ‘শিশ্নকামনাই হচ্ছে একান্ত নারীর কামনা’। নারী শিশু চায়, কিন্তু কেনো চায়? নারী শিশুর জন্যে শিশু চায় না; ফ্রয়েড বলেন, নারী শিশু চায়, কেননা ওই শিশু ছাড়া শিশ্নের কাছাকাছি আর কিছু পাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব! নারী শিশ্নাতুর, শিশ্ন ছাড়া আর কিছু নারী চায় না; না পেয়ে সে চায় শিশু; তাই নারীর প্ৰেমাস্পদ হয়ে ওঠে শিশু। পুরুষ ঠিকমতো বেড়ে নারীকে ভালোবাসতে শেখে, তবে নারী পুরুষকে ভালোবাসতে শেখে না; শেখে শিশুকে ভালোবাসতে, কেননা শিশুর মধ্যেই পায় সে তার হারানো শিশ্নকে। নারীর শিশ্নকামনা একদিন চরম চরিতার্থতা লাভ করে ফ্রয়েডের (১৯৩৩, ১৬৫) মতে এভাবে :

‘তার সুখ হয় সত্যিই অসামান; যেদিন চরিতাৰ্থ হয় তার শিশুলাভের বাসনা; এ-সুখ আরো বিশেষ হয়ে ওঠে যদি শিশুটি হয় ছেলে, যে তার জন্যে নিয়ে আসে বহুকামনার শিশ্নটি।‘

ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে নারীর সন্তানকামনাও হয়ে ওঠে শিশ্নের জন্যে অনন্ত মৃগয়া। নারীর সন্তান কামনাকে ফ্রয়েড চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন শিশ্নকামনার সাথে; এবং নারীকে উৎখাত ক’রে দিয়েছেন তার কীর্তিত আসন থেকেও। নারীর সন্তান কামনাও জৈবিক নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক; পিতৃতন্ত্র নারীকে দেখতে চায় জননীরূপে, তাই নারী মা হয়ে পিতৃতন্ত্রের কাছে হ’তে চায় গ্রহণযোগ্য। পুত্রের শিশ্নটির প্রতি তার নেই কোনো আকর্ষণ; তার আকর্ষণ পুত্রের প্রতি, কেননা পিতৃতন্ত্রের মধ্যে টিকে থাকার জন্যে তার দরকার এমন একজন যে হবে পিতৃতন্ত্রের সদস্য।

বালক তার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গটি নিজে নিজে ব্যবহার করে সুখ পায়, এটা ফ্ৰয়েড অনুমোদন করেন; কিন্তু বালিকা তার নিকৃষ্ট অন্ধুরটি নেড়ে সুখ আহরণ করবে, ফ্রয়েড তা অনুমোদন করেন না। কেননা তার কাছে হস্তমৈথুন একটি একান্ত পুরুষি কাজ। বালিকাকে নারী হয়ে উঠতে হবে; তাই তাকে বন্ধ করতে হবে পুরুষি কাজটি, নইলে নষ্ট হবে তার নারীত্ব। পরিপূর্ণ নারীত্ব অর্জনের জন্যে এটা দরকার। বালিকা যখন নিজের খোজাত্ব উপলব্ধি করে মর্মেমর্মে, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয়? ফ্ৰয়েড বলেন [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ১৮৬)] :

‘সে মেনে নেয় তার খোজাত্ত্বের সত্য, এবং এর পরিণতিরূপে পুরুষের শ্ৰেষ্ঠত্ব ও নিজের নিকৃষ্টতা, তবে সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এ-অপ্ৰিয সত্যের বিরুদ্ধে।‘

তখন নারীর শরীরের ভেতর শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ; এ-যুদ্ধে স্বাভাবিক নারীরা জীবনের পূর্ণতা লাভ করে মাতৃত্ত্বে, কেননা জৈবিকভাবে এরই জন্যে তৈরি করা হয়েছে তাদের। বিকৃত নারীরা যায় ভুল পথে, তারা যায় সে-দিকে জৈবিকভাবে তারা যার অনপুযুক্ত। তারা বিকৃতির শিকার। ফ্রয়েড এর নাম দিয়েছেন পুংগূঢ়ৈষা। যে-নারীরা মাতৃত্ব ছাড়া অন্য কোনো কাজে সাফল্য পেতে চায়, ফ্রয়েডের চোখে তারা ব্যাধিগ্রস্ত; তারা আক্রান্ত পুংগূঢ়ৈষ্যায়। তারা সন্তানের মধ্য দিয়ে পেতে চায় না কাম্য শিশ্নটিকে, শিশ্ন পেতে চায় তারা অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, রাজনীতিক হয়ে বিভিন্ন পদের মধ্য দিয়ে। তারা ব্যাধিগ্রস্ত, তাই তাদের চিকিৎসা দরকার মনোবিকলনগ্রস্ত’ রূপে! ফ্রয়েডের মতে এরা অবিকশিত, ‘নাবালেগ’ নারী। নারী যদি তার ভাগ্যকে, নিকৃষ্টতাকে, মেনে নেয়, তাহলে সে একধরনের তৃপ্তি পেতে পারে মাতৃত্বে; কিন্তু উদ্ধত অবাধ্য নারীরা নিজেদের ব্যাধির জন্যেই ঢুকতে চায় পুরুষোল এলাকায়। এমন নারী দেখলেই বুঝতে হবে সে পুংগূঢ়ৈষ্যাগ্ৰস্ত বা পুরুষালি প্রতিবাদের শিকার। ফ্ৰয়েড ও ফ্রয়েডীয়দের মতে এদের চিকিৎসা দরকার। ফ্রয়েড বিজ্ঞানের নামে যা চালিয়েছেন, তার সবটাই কুসংস্কার : তিনি প্রথাকে ভেবেছেন সহজাত, পুরুষাধিপত্যকে মনে করেছেন প্রাকৃতিক। শিশ্নাসূয়াকে তিনি মনে করেছেন জৈবিক, যদিও তা আসলে সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া। ভিক্টোরীয় সমাজব্যবস্থায় পুরুষ ছিলো দেবতার মতো, তাই নারীর পক্ষে পুরুষকে ঈর্ষা করা ছিলো স্বাভাবিক। ওই নারীরা শিশ্নকে ঈর্ষা করতো না, বা এখনো করে না, কিন্তু তারা দেখে একটি শিশ্ন কতো সুযোগ এনে দিতে পারে। তাই তারা ঈর্ষা করে, তবে শিশ্নকে নয়, করে শিশ্নধারীদের। ফ্রয়েড নারীকে পুরুষের সাথে জড়িত দেখেছেন শুধু কামসম্পর্কে, মুছে ফেলেছেন আর সব সম্পর্ক। তাঁর সময় সমাজ নারীকে কোনো সুযোগাই দিতো না, এখনো সমাজ নারীকে দেয় না। তার প্রাপ্য সুযোগ; সমাজ রোধ করে তার সমস্ত সম্ভাবনা। তাই নারীর পক্ষে পুরুষকে ঈর্ষা করা খুবই স্বাভাবিক, এটা কোনো ব্যাধি নয়, বরং সুস্থতা; কিন্তু ফ্ৰয়েড নারীর এ-সুস্থ মানবিক ব্যাপারটিকেই নির্দেশ করেছেন রোগ হিশেবে। ফ্রয়েড তার নারী রোগীদের সমস্যাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, কিন্তু সেগুলোর ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিশ্নাসূয়া নামে। তিনি দেখেছেন নারী অর্জন করতে চায় পুরুষের সাফল্য, বা মানবিক সাফল্য; একে যখন তিনি বাতিল ক’রে দিয়েছেন শিশ্নাসূয়া নামে, তখন তিনি বিজ্ঞানচর্চা করেন নি, প্রকাশ করেছেন নিজের কুসংস্কার। তাঁর কুসংস্কারটি হচ্ছে যে নারী কখনো পুরুষের সমান হবে না, যেমন নারী পাবে না একটি মহামানা শিশ্ন। ফ্রয়েড সমাজপরিবর্তনে উৎসাহী ছিলেন না, তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজসংস্কৃতির চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেছেন : নারীপুরুষকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি ওই পীড়াদায়ক সমাজের সাথে। ফ্রয়েড মানুষের মনোলোকের বৈজ্ঞানিক সূত্র লেখেন নি, তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বাহ্যিক সূত্ৰগলোকে মনোবিজ্ঞানের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন মানুষের মনের সাথে।

ফ্রয়েডের চমৎকার উপাত্ত ও তার শোচনীয় ভাষ্য দেখে খুব দুঃখ হয়; এমন চমৎকার উপাত্তের এমন অপব্যবহার বেশি হয় নি বিজ্ঞানের ইতিহাসে। পিতৃতান্ত্রিক পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজ নারীর সমস্ত সম্ভাবনা রোধ করে নারীকে কতোটা অসুস্থ ক’রে তুলতে পারে, তা উদঘাটন করা সম্ভব ওই উপাত্ত থেকে; কিন্তু তিনি সেদিকে না গিয়ে গেছেন ভুল পথে। তিনি নারীর অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেছেন অবধারিত জৈবিক সূত্ররূপে, যা সম্পূর্ণ ভুল। যে-অপরাধ সমাজের, তাকে তিনি কুৎসিত শিশ্নাসূয়া নামে চাপিয়ে দিয়েছেন নারীর ওপর। শিশ্নাসূয়া হচ্ছে পুরুষ-অসূয়া, যা অবধারিত বিশেষ সামাজিক পরিবেশে। পৃথিবী জুড়ে মেয়েশিশুরা ভাইয়ের শিশ্ন দেখার আগেই দেখে যে পৃথিবীটা পুরুষের। তারা দেখে সব দিকে পুরুষের আধিপত্য; পরিবার তাদের শেখায় পুরুষ প্রধান, ধর্ম শেখায় পুরুষ প্রধান, সমাজ শেখায় পুরুষ প্রধান, বিদ্যালয় আর মহাবিদ্যালয়, প্রচার মাধ্যম শেখায় পুরুষ প্রধান। সমাজরাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থা পুরুষের প্রাধান্য প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের সংস্থা। ওই প্রধান্যকে একটি শিশ্নে সংহত করা মেয়েদের কাজ নয়, ফ্রয়েডের কাজ। নারীরা শিশ্নটিকে ঈর্ষা করে না, একটি শিশ্ন কী দিতে পারে তাকে ঈর্ষা করে। পুরুষকে তারা শিশ্ন বলেও ভাবে না, ভাবে পুরুষ ব’লে, যারা অধিকার করে আছে পৃথিবী। মিলেট (১৯৬৯, ১৮৭) বলেছেন, ‘ফ্রয়েড প্রধান ও নির্বোধ গোলমাল করেছেন শরীর ও সংস্কৃতি, অঙ্গসংস্থান ও মর্যাদার মধ্যে।’ ফ্ৰয়েড বিরোধী ছিলেন নারীবাদের, নারীপ্রসঙ্গে তিনি বারবার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে কটাক্ষ করেছেন; পৃথিবীকে মুক্ত রাখতে চেয়েছেন নারীমুক্তিরোগ থেকে। সাফল্য অর্জনের জন্যে, ফ্রয়েডের বিশ্বাস, থাকতে হবে একটি ঝুলন্ত প্রত্যঙ্গ; রন্ধ থাকলে চলবে না! তাঁর বিশ্বাস মেধা আর শিশ্নের মধ্যে রয়েছে জৈবিক সম্পর্ক; পুরুষের মেধাগত শ্রেষ্ঠতার জৈবিক প্রকাশ হচ্ছে শিশ্ন। ফ্রয়েড পুরুষতন্ত্রকে দেখেছেন শিশ্নরূপে, এমনকি মস্তিষ্কের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছেন ওই প্রত্যঙ্গটিকে; এবং মনোবিজ্ঞানের মুখোশে প্রকাশ করেছেন কুসংস্কার।

ফ্রয়েড নারীর দুটি একান্ত বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন : সে-দুটি হচ্ছে লজ্জা ও ঈর্ষা। তিনি দাবি করেছেন এ-দুটির মূলেও রয়েছে শিশ্নাসূয়া। নারীর লজ্জাশীলতার প্রশংসায় পিতৃতন্ত্ৰ পাগল, কিন্তু ফ্ৰয়েড জানিয়েছেন নারীদের লাজনম্রতার কারণ তাদের খোজত্বেবোধ, নিজেদের বিকলাঙ্গচেতনা। ফ্রয়েড (১৯৩৩, ১৭০) বলেন :

‘লজ্জাশীলতা, যাকে মনে করা হয় নারীর একান্ত ভূষণ, তাও আসলে, আমাদের মতে, নারী শুরু করেছিলো নিজের যৌনাঙ্গের ত্রুটি ঢাকার জন্যে।‘

নারী লজ্জায় ম’রে যায় একথা ভেবে যে তার রয়েছে রন্ধ, তার শিশ্ন নেই। ফ্রয়েড মনে করেন জৈবিক কারণেই নারী কোনো কিছু দান করতে পারে নি। সভ্যতায়, তার সে-শক্তি নেই; তবে নারীকে তিনি সভ্যতার দুটি আবিষ্কারের গৌরব দিয়েছেন। তাঁর মতে, নারীরাই আবিষ্কার করেছিলো কাপড় বোনা আর বেণীপাকানো। কেনো? তার ক্ষতের লজ্জা ঢাকতে! তাঁর মতে, নারী যৌনদেশ দিয়ে রন্ধ্রটিকে ঢাকতে গিয়েই আবিষ্কার করেছিলো বেণীপাকানো। নারী তার রূপের গর্বেও বিভোর থাকে; এর মূলেও আছে, ফ্রয়েডের মতে, তার যৌনাঙ্গের নিকৃষ্টতা; এ দিয়ে নারী পূরণ করে তার শিশ্ন না থাকার ঘাটতি! নারীর ঈর্ষা পুরুষতন্ত্রের প্রসিদ্ধতম কিংবদন্তি আর দূৰ্মবতম কুসংস্কারগুলোর একটি। তাঁর মতে এর জন্ম শিশ্নাসূয়া থেকে। নারীর সহজাত নিকৃষ্টতা থেকে জন্ম নেয়া শিশ্নাসূয়ার ফলে, ফ্রয়েড বলেন, নারীর পরাসত্তা–সুপার ইগো–পুরুষের মতো সম্পূর্ণ বিকশিত হয় না, তাই নারীর বিবেক, ন্যায়-অন্যায় ও আদর্শবোধ, সমাজচেতনা খুবই কম। ফ্রয়েড বলেন : ‘নারীর ন্যায়-অন্যায় বোধ খুবই কম; নিঃসন্দেহে এর সম্পর্ক রয়েছে নারীর মানসিক জীবনে ঈর্ষার প্রাধান্যের সাথে।’ এ-কারণেই নারীর নেই সমাজচেতনা, এবং তাদের প্রবৃত্তি লাভ করে না উৎকর্ষ। ফ্রয়েডের এসব হচ্ছে বিজ্ঞানের নামে পুরুষের প্রাধান্য স্থায়ী করার সচেতন ও অবচেতন চক্রান্ত। নারীকে ঈর্ষাকাতর বলার অর্থ হচ্ছে শোষিতরা সবাই ঈর্ষাকাতর; ধনীদের সুখ দেখে গরিবদের চোখ জ্বলে ব’লেই তো গরিবেরা ঈর্ষাকাতর, এবং তাদের নেই বিবেক, ন্যায়-অন্যায় ও আদর্শবোধ আর সমাজের প্রতি দায়িত্ব! ফ্রয়েড বিজ্ঞানের নামে শুধু পুরুষতন্ত্রকেই রক্ষা করতে চেষ্টা করেন নি, টিকিয়ে রাখতে চেয়েছেন সব ধরনের শোষণতন্ত্রকেই।

ফ্রয়েডের ধ্রুববিশ্বাস নারীচরিত্রের, শিশ্নাসূয়া ও অন্যান্য রোগের, শেকড়ে রয়েছে তার বিকলাঙ্গ দেহ। তিনি ভুল বুঝেছিলেন প্রায় সবটাই। নারীমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ফ্রয়েডের ভ্ৰান্তির বড়ো কারণ হচ্ছে তিনি বোঝেন নি বা বুঝতে চান নি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপারের ভিন্নতা : তিনি বোঝেন নি যে নারীর শরীর আর অবস্থার মধ্যে কোনো জৈবিক সম্পর্ক নেই। তিনি, অনেকের মতোই, মনে করেছেন যে নারীর সামাজিক অবস্থা নারীর শরীরের মতো প্রকৃতিরই সৃষ্টি; নারী রয়েছে যে-অবস্থায়, তা-ই নারীর অবধারিত নিয়তি। নারীর অবস্থা যে সামাজের তৈরি, নারী যে শিকার সমাজের, তা তিনি বোঝে নি, কেননা সে-মানসিকতা তার ছিলো না; তিনি বিশ্বাস করেছেন। পুরুষ নারীকে যা করেছে, প্রকৃতি নারীকে করতে চেযেছে তাই! পুরুষ কাজ করেছে শাশ্বত প্রকৃতির বিশ্বস্ত প্ৰতিনিধিরূপে।

ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞানে পুরুষ সক্রিয়তা, আর নারী অক্রিয়তা। পুরুষের সক্রিয়তা আর নারীর অক্রিয়তা তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন এমন ব্যাপার ভিত্তি ক’রে, যার ভিত্তি খুবই দুর্বল। তিনি প্রমাণ হিশেবে নিয়েছেন তাঁর সমকালের নারীপুরুষের যৌন আচরণ, এবং শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর ক্রিয়াকলাপ। তিনি দেখেছেন পুরুষ নারীকে তাড়া ক’রে ফেরে, আর সঙ্গমে নারী থাকে মাটির মতো অক্রিয় আর পুরুষ থাকে বৃষের মতো সক্রিয়, এবং এরই মাঝে প্রমাণ পেয়েছেন নারীপুরুষের জৈবিক স্বভাবের। এটা যে জৈবিক নয়, সামাজিক তা বোঝেন নি তিনি; পিতৃতন্ত্র পুরুষকে শিখিয়েছে সক্রিয়, আর নারীকে অক্রিয় হতে; নারীপুরুষ অভিনয় ক’রে যাচ্ছে নির্দেশিত ভূমিকায়। এর কিছুই জৈবিক নয়; অনুমোদন পেলে নারীও হ’তে পারে চরম সক্রিয়। সামাজিক আচরণ পেরিয়ে ঢুকেছেন তিনি আরো ভেতরে, এবং বিশ্বাস করেছেন যে প্রবিষ্টকরণের কাজটি আর শুক্রাণুর চরিত্র সক্রিয়, আর যোনি ও ডিম্বাণুর আচরণ অক্রিয়। ফ্রয়েড (১৯৩৩, ১৪৭) বলেন :

‘পুরুষের শুক্রাণু সক্রিয় ও চলমান; এটা খুঁজে বের ক’রে নারীর অণুকে, আর ডিম্বাণু অচল এবং অপেক্ষা ক’রে থাকে অক্রিয়ভাবে। কামের অণুজীবরাশির আচরণ সঙ্গমে নারীপুরুষের আচরণের কমবেশি আদর্শ। পুরুষ সঙ্গমের জন্যে নবীকে প্ৰবোচিত করে, আবদ্ধ করে এবং ঠেলে নারীর ভেতরে নিজের পথ ক’বে নেয়।‘

ফ্রয়েড বেশ বাড়িয়ে বলেছেন শুক্রাণুর সক্রিয়তার কথা, এবং তিনি পুরোপুরি অক্রিয় ক’রে দিয়েছেন ডিম্বাণুকে, যদিও তা ঠিক নয়। ডিম্বাণুও পালন করে বেশ সক্রিয় ভূমিকা। ডিম্বাণু ফেলোপীয় নালি দিয়ে বেরিয়ে আসে, শুক্রাণুকে আবদ্ধ করে সক্রিয়ভাবে। তবে এ-অণুজীবরাশির আচরণকে আদর্শ কাঠামো হিশেবে ধরে সমাজকাঠামো ব্যাখ্যা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক কাজ। পুরুষের তথাকথিত সক্রিয়তা আর নারীর অক্রিয়তার কোনো জৈবিক ভিত্তি নেই, রয়েছে সামাজিক ভিত্তি; পিতৃতান্ত্রিক সমাজই অনুশাসনের মাধ্যমে তাদের চরিত্রকে দিয়েছে এমন রূপ। তবে ফ্রয়েড মনে করেন সক্রিয়তা-অক্রিয়তা জৈবিক, মনে করেন সমাজও দাঁড়িয়ে আছে জৈবভিত্তির ওপর। তাঁর মতে, নারীর কাজ হচ্ছে অক্রিয় থাকা যেমন পুরুষের কাজ সক্রিয় থাকা, কেননা তাঁর প্রকৃতি তাই চেয়েছে।

ফ্রয়োড়ীয় মনোবিজ্ঞানে মানুষের প্রাণশক্তি বা কামের চালকশক্তির নাম লিবিডো। ১৯০৫-এ তিনি লিবিডোকে নির্দেশ করেছিলেন পুরুষধর্মী ব’লে, বলেছিলেন যে লিবিডো ‘নিয়মিতভাবে ও ন্যায়সঙ্গতভাবে পুরুষপ্রকৃতির, তা পুরুষ বা নারীর যারই হোক’ [মিলেট (১৯৬৯, ১৯২)]। পরে, ১৯২৩-এ, তিনি কিছুটা মত বদলে বলেন যে লিবিডো লিঙ্গনিরপেক্ষা; তবুও ভেতরে ভেতরে তিনি বিশ্বাস করেন যে লিবিডো আসলে পুরুষপ্রকৃতিরই। ১৯৩৩-এ লিবিডো সম্পর্কে ফ্রয়েড (১৯৩৩, ১৬৮-১৬৯) বলেন :

‘কামজীবনের চালিকাশক্তিকে আমরা বলেছি ‘লিবিডো’। এ-কামজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। পুরুষধর্মী ও নারীধর্ম দুই বৈপবীত্য দিয়ে; তাই অনেকে লিবিডোকে এ-দুই বৈপরীত্যের সাথে সম্পর্কিত করার প্ররোচনা বোধ করতে পারেন। এটা বিস্ময়কর মনে হতো না। যদি দেখা যেতো যে কামের প্রত্যেক কপোব বয়েছে নিজ ধরনেব লিবিডো, এর ফলে এক ধরনেব লিবিডো কাজ করতো পুরুষধর্ম কামজীবনের লক্ষ্য থেকে, এবং অন্যটি নারীধর্মী লক্ষ্য থেকে। তবে এমন কিছু ঘটে না। লিবিডো রয়েছে এক ধরনেরই, যা পুরুষের কামের ভূমিকা যতোটা পালন কবে ততোটাই পালন করে নারীর কামের ভূমিকা। এর আমরা কোনো লিঙ্গ নির্দেশ করতে পারি না; যদি আমরা প্রথাগত পুরুষধর্মিতা ও সক্রিয়তার সাদৃশ্য অনুসাবে একে পুরুষধর্ম বলি, তবে আমাদের ভুললে চলবে না যে এর অক্রিয় লক্ষ্যের প্রবর্তনাও রয়েছে। তবে ‘নারীধর্মী লিবিডো’ পদটি গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের ধারণা হচ্ছে যখন লিবিডোকে লাগানো হয় নারীধর্ম কাজে, তখন তার ওপর পীড়ন করা হয় বেশি; এবং পরমকারণমূলকভাবে বলতে গেলে–প্রকৃতি পুরুষেব ভূমিকার দাবির প্রতি যতোটা মনোযোগ দিয়েছে নারীর ভূমিকার দাবির প্রতি ততোটা মনোযোগ দেয় নি। এবং আবারও পরমকারণমূলকভাবে-এর কারণ সম্ভবত এই যে জৈবিক লক্ষ্য অর্জনের ভার দেয়া হয়েছে। পুরুষের আক্রমণাত্মকতার ওপর, যা কিছু পরিমাণে নারীর সহযোগিতা বা সম্মতি নিরপেক্ষ।‘
 
নারীসম্পর্কে ফ্রয়েডের সবচেয়ে আপত্তিকর সিদ্ধান্তগুলোর কয়েকটি পাচ্ছি এখানে। তিনি যদিও বলেছেন লিবিডোর কোনো লিঙ্গ নেই, তবুও তিনি বিশ্বাস করেন লিবিডো আসলেই পুরুষধর্মী; তাই পুরুষেরই রয়েছে সভ্যতা সৃষ্টির শক্তি, এবং তার ওপর অর্পণ করেছে সমস্ত মানবিক দায়ভার। প্রকৃতি নারীকে দিয়েছে সামান্য লিবিডো, নারীর দাবির দিকে মনোযোগ দেয় নি, এসবই বিজ্ঞানের বেশে ভিক্টোরীয় কুসংস্কার প্রচার। তিনি বিশ্বাস করেন নারীর যেহেতু লিবিডো কম, তাই নারীর পক্ষে পুরুষের মহত্ত্ব অর্জন অসম্ভব; নারীর প্রতিভা নেই সভ্যতাকে কিছু দেয়ার। তিনি নারীকে বাইরে রেখেছেন সভ্যতার; ‘সভ্যতা ও তার অতৃপ্তি’তে (১৯৩০) দেখিয়েছেন নারী আসলে সভ্যতার শক্ৰ। ফ্ৰয়েড শুধু সভ্যতাসংস্কৃতির ভারই পুরুষের হাতে দেন নি, তিনি মানবপ্রজাতিকে রক্ষার ভারই দিযেছেন পুরুষের ওপর। নারী ধারণ করে মানব, কিন্তু ফ্ৰয়েড একে মূল্যবান মনে করেন না; নারী ফ্রয়েডের দৃষ্টিতে আধারমাত্র। প্রকৃতি নারীকে মানবপ্রজাতি টিকিয়ে রাখার ভার দেয় নি, দিয়েছে পুরুষকে! তিনি বলেছেন, জৈবিক লক্ষ্য অর্জনের ভার দেয়া হয়েছে পুরুষের আক্রমণাত্মকতার ওপর, যা কিছু পরিমাণে নারীর সহযোগিতা বা সম্মতি নিরপেক্ষ’; অৰ্থাৎ নারী চাক বা না চাক, প্রকৃতি যেহেতু পুরুষকে দিয়েছে মানবপ্রজাতি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব, তাই পুরুষ নারীকে ফাঁক ক’রে ঠেলে ভেতরে ঢুকে রক্ষা করবে মানবপ্রজাতি। ফ্রয়েডের মানবপ্রজাতি রক্ষার প্রকল্প তাই হয়ে দাঁড়ায় বলাৎকার, যা সহ্য করতে হবে নারীকে।

ফ্রয়েডের চোখে নারীর তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য : অক্রিয়তা, মর্ষকাম, ও আত্মপ্ৰেম। বর্ণনা হিশেবে এগুলো ভুল নয়, তিনি তাঁর সময়ের নারীদের এ-বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন ঠিক মতোই, কিন্তু ব্যাখ্যা করেছেন ভুল। শিতৃতন্ত্র নারীকে দেখতে চায় অক্রিয়, তাই নারী তার স্বভাবের মধ্যে মেনে নিয়েছে অনেকখানি অক্রিয়তা, কেননা সক্রিয় হ’লেই পুরুষতন্ত্র ক্ষেপে ওঠে তার ওপর। পিতৃতন্ত্র সে-নারীকেই মহীয়সী মনে করে যে সহ্য করতে পারে চরম দুঃখযন্ত্রণা, পিতৃতন্ত্র বিরামহীন পীড়ন সহ্য করারকেই মনে করে নারীত্ব। পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে অসংখ্য সতীচরিত্র, সীতা ও রহিমা, যারা মহত্ত্ব অর্জন করেছে শুধু অপাের পীড়ন সহ্য করে। পুরুষ, শো’পনহায়ারের মতো, মনে করে যে নারী জীবনের ঋণ কাজ দিয়ে শোধ করে না, করে দুঃখ দিয়ে। তাই নারীকে বাধ্য হয়েই হয়ে উঠতে হয়েছে মর্ষকামী। পিতৃতন্ত্র নারীকে সম্ভোগসামগ্ৰী রূপে দেখে, এজন্যে নারী আত্মপ্রেম আয়ত্ত কলে অনেকখানি। অর্থাৎ পিতৃতন্ত্র নারীকে যে-ভূমিকা দিয়েছে, নারী তাতে অভিনয় করেছে নিজের অস্তিত্বের জন্যেই। তবে ফ্রয়েড নারীর অক্রিয়তা, মর্ষকাম, আত্মপ্রেমকে এ-চোখে দেখেন না; তিনি একে মনে করেন জৈবিক ও নারীত্ব। তিনি নারীর মধ্যে খোঁজেন এসবই। তিনি বিধান দেন যে নারীকে হতে হবে অক্রিয়, মর্ষকামী, আত্মপ্রেমিক, এসব যাদের আছে তারাই স্বাভাবিক নারী। নারীকে অক্রিয় হ’তে হবে; কী করতে হবে এর জন্যে? তিনি বলেন, নারীকে ভগাঙ্কুরের সুখ ছেড়ে যেতে হবে মাতৃত্বের দিকে, সুখ খুঁজতে হবে রন্ধে। তাঁর মতে অক্রিয়তা আর মর্ষকাম একান্ত নারীর বৈশিষ্ট্য, এবং জড়ানো একে অন্যের সাথে; তাই এ-দুটি নারীর জন্যে স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক পুরুষের জন্যে। মর্ষকাম নারীসুলভ, আর নারীত্ব মর্ষকামধর্ম। ফ্ৰয়েড বলেন (১৯৩৩, ১৪৮-১৪৯) :

‘তাদের আক্রমণাত্মকতা অবদমনের ফলে, যা নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয় তাদের গঠন ও সমাজ, তাদের মধ্যে বিকশিত হয় তীব্র মর্ষকামবাদী প্রবর্তনা, যার ফলে তাদের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা কামগতভাবে রুদ্ধ হয়ে হযে ওঠে অন্তর্মুখি। তাই মর্ষকাম, যেমন বলা হয়ে থাকে, সত্যিকাব্যভাবেই নারী ধর্মী। তবে যখন আমরা মাঝেমাঝেই পুরুষের মধ্যে মর্ষকাম দেখতে পাই, তখন একথা ছাড়া আর কী বলতে পারি যে ওই সব লোকের মধ্যে প্রকাশ ঘটেছে সুস্পষ্ট নারীধর্মী বৈশিষ্ট্য?’

ফ্ৰয়েড মনে করেন নারী জৈবিকভাবেই তৈরি হয়েছে পীড়ন ভোগ করার জন্যে; পীড়ন নারীর জন্যে একধরনের সুখ। তাই পুরুষ যখন পীড়ন করে নারীকে, তখন পুরুষ কোনো অপরাধ করে না, বরং তাকে দেয় সুখ। ফ্রয়েডীয় মর্ষকামবাদকে তার যৌক্তিক পরিণতিতে নিলে দাঁড়ায় যে পীড়নধর্ষণ নারীর জন্যে শুধু ভালোই নয়, বরং নারী ব্যাকুল হয়ে থাকে এরই জন্যে। নারীকে ছিঁড়েফেড়ে ফেললেও, ফ্রয়েডের তত্ত্বানুসারে, পুরুষের কোনো অপরাধ হওয়ার কথা নয়, কেননা তা পরিতৃপ্ত করে নারীর সহজাত মর্ষকামকে! নারী পীড়িত হয়ে সুখ পায়, এমন একটি বাজে কথা চালু রয়েছে কয়েক হাজার বছর ধরে; পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষেরা এ-ধারণাকে জনপ্রিয় করেছেন নানাভাবে, আর ফ্রয়েড দিয়েছেন তাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। ফ্রয়েডীয় মর্ষকামতত্ত্ব নারীপীড়নের বৈজ্ঞানিক প্রস্তাব, এবং অপবিজ্ঞান।

ফ্রয়েডের নির্দেশিত নারীর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য আত্মপ্রেম বা নার্সিসিজম। নার্সিসিজম শব্দটি যদিও জন্মেছে আত্মপ্ৰেমমত্ত এক পৌরাণিক পুরুষের নাম থেকে, তবু পুরুষতন্ত্র পৃথিবী জুড়েই আত্মপ্রেমকে মনে করে একান্ত নারীর রোগ; ফ্রয়েডও তাই মনে করেন। নারীর আত্মপ্রেম, নারীর অক্রিয়তা বা মর্ষকামের মতোই, ফ্রয়েডের মৌলিক আবিষ্কার নয়; তাঁর আগে, কয়েক হাজার বছর ধ’রে, নারীর আত্মপ্রেমের বহু উপকথা লিখেছে পুরুষ, ফ্রয়েড দিয়েছেন তার অপবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তাঁর মতে নারীর আত্মপ্রেম বিকার, তবে খুবই স্বাভাবিক নারীর জন্যে। পুরুষও হতে পারে আত্মপ্রেমিক, স্বীকার করেন ফ্ৰয়েড; তবে পুরুষের আত্মপ্রেম বিকার নয়, তা উন্নত প্রকৃতির; পুরুষের রয়েছে আত্মপ্রেমের উৎকর্ষীয়ণের প্রতিভা। পুরুষ, ফ্রয়েড বলেন, নিজের প্রেমে পড়ে অন্যের বা নারীর প্রেমে পড়ার মতো করে, তাই তা সুস্থ; কিন্তু স্বভাববিকৃত বিকলাঙ্গ ক্ষীণলিবিডো শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত নারী তা পারে না; তার আত্মপ্রেম নিজের দেহকেন্দ্ৰিক। নারী নিজের প্রেমে পড়ে যেমন পুরুষ পড়ে নারীর প্রেমে, অর্থাৎ নারী নিজে পুরুষ হয়ে পড়ে নিজের শরীরের প্রেমে। এটা বিকার। নারী পারে না আত্মপ্রেমের উৎকর্ষ সাধন করতে, পুরুষ পারে। আত্মপ্রেম, ফ্রয়েডের মতে, একান্তভাবেই নারীধর্মী, এবং এর মূলে রয়েছে নারীর শাশ্বত শিশ্নাসূয়া। ফ্রয়েড (১৯৩৩, ১৭০) বলেন :

‘আমরা লক্ষ্য করি যে নারীর মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণ আত্মপ্রেম, তাই তারা অন্যের প্রেমে পড়ার আবেগের থেকে অনেক বেশি বোধ করে অন্যেরা তাদের প্রেমে পড়বে, সে-আবেগ; রূপের জন্যে গর্ববোধও আংশিকভাবে তাদের শিশ্নাসূয়ারই ফল, তারা তাদের মৌলিক কামানিকৃষ্টতার বিলম্বিত ক্ষতিপূরণ হিশেবেই নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্যকে অতি বেশি মূল্য দিয়ে থাকে।‘

নারী যদি একটি শিশ্ন পেতো, তাহলে নিজের রূপে অন্ধ হতো না; শিশ্নের অভাব নারী মিটিয়ে নেয আত্মপ্রেমে! নারীর আত্মপ্রেমের সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফ্রয়েড; তার মতো চমৎকার পর্যবেক্ষক ও শোচনীয় অপব্যাখ্যাকার বেশি মেলে না। সমাজ নারীকে যে-রোগে রুগ্ন দেখতে পছন্দ করে, তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় যে-রোগের বীজ, ফ্রয়েড তাকে ক’রে তুলেছেন জৈবিক। নারী নিজের রূপসচেতন, রূপের জন্যে অশেষ তার আকুলতা, নিজের রূপে সে বিভোরও হয়, এমনকি পুরুষের চোখেও সে দেখে নিজের মাংসের বিন্যাস; তার কারণ সে জানে সে কামসামগ্ৰী, তার মূল্য তার সম্ভোগযোগ্যতায়। নিজেকে নিজে সম্ভোগের জন্যে নারী আত্মপ্ৰেমমুগ্ধ নয়; পুরুষতন্ত্রের বিধান অনুসারে পুরুষের সম্ভোভযোগ্য হয়ে ওঠার জন্যেই নারী রূপসচেতন। সে জানে তার দেহ খাদ্য হবে পুরুষের, তাই নারী নিজেকে ক’রে তুলতে চায় সুস্বাদু খাদ্য। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌ (১৭৯২) বলেছেন, ‘শিশুবেলা থেকেই শেখানো হয় যে রূপই নারীর রাজদণ্ড, তার মন বেঁকে যায় তার দেহের আদলে, এবং এর কারুখচিত খাঁচার চারদিকে ঘুরেঘুরে সাজাতে শেখে শুধু কারাগারটিকে’ [দ্র। গ্রিয়ার (১৯৭১, ৫৫)]। ফ্রয়েড এসব মনে করেছেন জৈবিক; নারী জৈবিকভাবে অক্রিয়, মর্ষকামী, আর আত্মপ্ৰেমমুগ্ধ। ফ্রয়েড তাঁর সময়ের নারীস্বভাব বর্ণনা করেছিলেন নির্ভুলভাবে, তবে প্রতিক্রিয়াশীলতাবশত তা ব্যাখ্যা করেছেন ভুলভাবে; আর বিধান দিয়েছেন সম্পূর্ণ নারীবিরোধী। যদি দেখি একদল মানুষকে ক’রে ফেলা হযেছে অক্রিয়, দুঃখযন্ত্রণাকে ক’রে তোলা হয়েছে তাদের জীবন, তাদের বাধ্য করা হয়েছে প্ৰভুদের মনোরঞ্জন ক’রে তুচ্ছ গর্বে মেতে উঠতে, তখন কি বলবো যে এসবই অবধারিত, এ-ই। তাদের জৈবস্বভাব? নিশ্চয়ই বলবো না, কিন্তু বলেন মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড। বিশশতকে ফ্রয়োউীয়বাদ দেখা দিয়েছিলো নারীবাদের প্রধান প্রতিপক্ষীরূপে।



ডান পেজ ১৬৫

কারেন হোরনি, ক্লারা টম্পসন, আলফ্রেড অ্যাডলার বেশ আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ফ্রয়েডীয় প্রতিক্রিয়াশীল নারীমনোবিজ্ঞান, কেননা ওই মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য নারীর পুরুষাধীনতাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা। ধর্মের বিরুদ্ধে আজ কথা বলা যায়, প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে যে-কোনো নির্বোধ; কিন্তু বিশশতকে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কথা বলা অসম্ভব। বিজ্ঞানের মুখোমুখি সবাই অসহায়, তার সূত্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার শক্তি নেই সাধারণের। তাই ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান নারীর বিরুদ্ধে কাজ করেছে প্রথাগত পুস্তকগুলোর থেকে অনেক বেশি প্রচণ্ডভাবে। মনোবিজ্ঞানীরাই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন ফ্রয়েডীয় নারীমনোবিজ্ঞানের, যদিও তা বিশশতকের শ্রুতিতে প্রবেশ করে নি। কারেন হোরনি মনোবিশ্লেষকদের মধ্যে দেখেছিলেন পুরুষবাদী ঝোঁক; তারা মানুষ বলতে বুঝেছেন পুরুষ, এবং নারীকে দেখেছেন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি শিশ্নাসূয়া, পুংগূঢ়ৈষ্যা, নারীদের হীনমন্যতাবোধ প্রভৃতি ধারণা ব্যাখ্যা করে দেখান যে এগুলো জৈবিক নয়, সাংস্কৃতিক। মর্ষকামের কথা ধরা যাক। হোরনি দেখেছেন কোনোকোনো মনোব্যাধিগ্রস্ত নারী মর্ষকামী, কিন্তু তিনি একে জৈবিক ব’লে মনে করেন নি। তিনি এর দিয়েছেন ফ্রয়েডের থেকে অনেক অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাখ্যা। তিনি বলেছেন, ‘কোনো জীবন্ত প্ৰাণী যখন পড়ে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে, তখন সে তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয় নিজেকে’ [দ্র উইলিয়মস (১৯৭৭, ৬৮)]। নারী পড়েছে প্ৰাণীজগতের সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায়, তাই নারী খাপ খাইয়ে নিয়েছে বিপর্যয়ের সাথে। নারীর অবস্থা ও মন ব্যাখ্যার জন্যে বিবেচনা করতে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাপারগুলো; তার শরীরের বাঁকে, রন্ধে, অন্ধুরে খোঁজাখুঁজি ক’রে ওগুলোর সূত্র মিলবে না। তিনি মর্ষকামের একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। জারের শাসনকালে রাশিয়ার চাষীনারীরা চাইতো যে তাদের স্বামীরা তাদের প্রহার করুক, ওই প্ৰহার ছিলো প্রেমের প্রমাণ। এতে যদি মনে করা হয় যে নারীরা বা রুশ নারীরা মর্ষকামী, তবে বড়ো ভুল করা হবে। ওই সমাজব্যবস্থায় প্রহারকেই মনে করা হতো প্রেমের প্রকাশ; কিন্তু আজকের রাশিয়ার নারীরা প্রেমের প্রমাণরূপে প্ৰহারের কথা ভাবতেই পারে না। ওই সমাজের বদল ঘটেছে, তাই বদল ঘটেছে নারীর বাহ্যিক আচরণেরও, তবে নারীর প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে নি। প্রতিটি জাতির ধর্মে, সাহিত্যে, কিংবদন্তিতে নারীকে দেখানো হয়েছে মর্ষকামীরূপে, গাওয়া হয়েছে নারীর মর্ষকামের গাঁথা। আদর্শ সতী মর্ষকামী, আদর্শ মা মর্ষকামী, আদর্শ প্রেমিকা মর্ষকামী, আদর্শ কন্যা মর্ষকামী; নারী পিতৃতন্ত্রের ধর্ষকামের ধারাবাহিক ভোগ্যসামগ্ৰী।

হোরনি বলেছেন, নারীপ্রকৃতি সম্পর্কে যে-ভাবাদর্শ গড়ে তোলা হয়েছে, তা হচ্ছে নারী দুর্বল, আবেগপরায়ণ, অক্রিয়, পরনির্ভর : এ-ভাবাদর্শের জন্যেই নারীকে মনে হয় ওই সব অপবৈশিষ্ট্যের সমষ্টি। পুরুষ নারীকে এমনই দেখতে চায়। এসবের জন্যেই নারী ভূমিকা পালন করে অক্রিয়তার, হয় মর্ষকামী বা আত্মপ্ৰেমমুগ্ধ; কিন্তু একে জৈবিক মনে করার কারণ নেই। ‘প্রেমের অতিমূল্যায়ন’ (১৯৩৪) নামের একটি লেখায় তিনি দেখান যে সামাজিক অবস্থা নারীকে শেখায় যে তাকে হ’তে হবে পিতৃতন্ত্রের আদর্শ নারী; তার জীবনের লক্ষ্য হবে বিশেষ কোনো পুরুষকে ভালোবাসা ও তার ভালোবাসা পাওয়া, তার সেবা করা। তার জীবন হবে বিশেষ পুরুষকেন্দ্রিক, সে ঘুরবে পুরুষসূর্যকে কেন্দ্ৰ ক’রে। এমন অবস্থা পুরুষের মনে বাড়িয়ে দেয় আত্মমর্যাদাবোধ, আর কমিয়ে দেয় নারীর আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস। প্রতিটি ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে বারবার পাওয়া যায় এমন সব নির্দেশ, যা পুরুষকে দেবতা আর নারীকে ক’রে তোলে আত্মমর্যাদাহীন জন্তু। ইহুদিধর্মের বিধান হচ্ছে স্ত্রী স্বামীকে সম্বোধন করবে বাআল [প্ৰভু] বা আদোন [বিধাতা] বলে; সম্পূর্ণ আত্মসমৰ্পণ করবে তার কাছে। একটি হাদিসে আছে [দ্র ফজলুর রহমান (১৯৭৭, ৩৩৫)] :

‘স্বামী যদি কুষ্ঠরোগী হয় আর তাহার পুঁজ ইত্যাদি স্ত্রী নিজ জিহ্বা দ্বারা চাটিয়া পরিষ্কার করে, উহাতেও স্ত্রী স্বামীর হাক আদায় করিতে পাবিনে না।‘

হিন্দুদের কামকল্প-এ আছে [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৭১)] :

‘স্বামী ছাড়া পৃথিবীতে নারীর আর কোনো দেবতা নেই।…স্বামী হ’তে পারে বিকলাঙ্গ, বৃদ্ধ, পাপিষ্ঠ, বদমেজাজি, লম্পট, অন্ধ, বধিব বা বোবা। তবু সাবাজীবন নারী তাকে মান্য ক’রে চলবে।‘

এসব বিধানে যেমন পীড়ন করা হয়েছে নারীকে, তেমনি মুছে ফেলা হয়েছে তার আত্মমর্যাদার শেষ কণাটিকেও। নারীপীড়ন, ও তার মর্যাদা অস্বীকারের উৎকট বিধান দিয়েছে আঠারোশতকের এক জাপানি দাম্পত্যবিধিপ্রণেতা; ‘স্ত্রীর প্রতি উপদেশ’-এ সে বলেছে [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৭১)] :

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বামীর প্রতি নারীর ভক্তি।… স্ত্রী সব সময় কল্পনা করবে সে-সব, যা তার স্বামীর আনন্দ বাড়াবে, তাকে কোনো কিছু করতে দিতে অস্বীকার করবে না। যদি সে অল্পবয়স্ক বালক পছন্দ করে, তবে স্ত্রী বালকের মতো হাঁটু গেড়ে বসবে যাতে স্বামী পেছন দিক থেকে তাকে নিতে পারে। তবে স্ত্রীকে ভুললে চলবে না যে পুরুষ নারীর পায়ুর কোমল প্রকৃতি বুঝতে পারে না, সে জোর ক’রে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে পারে। তাই স্ত্রীব উচিত ধীরেধীরে নিজেকে প্রস্তুত করা এবং সিজিশুমি ক্রিম ব্যবহার করা…

এসবের পরেও নারী কী ক’রে রক্ষা করে তার আত্মমর্যাদাবোধ? যে-নারী মেনে নেয় এসব, তার জন্যে সমস্যা নেই, সে চলে যায় সব সমস্যার পরপারে; কিন্তু যে-নারী হ’তে চায় স্বাধীন, জড়িত হতে চায় কোনো পেশায়, তার জন্যে এসব তৈরি করে সংকট। এমন নারী হয়ে পড়ে অসুস্থ, সে ব্যর্থ হয় কর্মে ও প্রেমে। এর পেছনে নারীর শরীরের কোনো ভূমিকা নেই, আছে সমাজসংস্কৃতির ক্রিয়া। সমাজই ব্যর্থ ও অসুস্থ ক’রে দিচ্ছে নারীকে, কিন্তু ফ্ৰয়েড তার নিন্দা করেন পুংগূঢ়ৈষাগ্ৰস্ত ব’লে। হোরনি দেখিয়েছেন, মূলসংকট হচ্ছে প্রেমের অতিমূল্যায়ন, প্রেমকেই নারীর জীবনের সব ব’লে ভাবা; যেনো পুরুষের সাথে নারীর কামসম্পৰ্কই জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিশ। যদি নারী প্রেমেই না পড়লো, প্রেমই না পেলো, স্ত্রীই না হ’তে পারলো, তাহলেই যেনো তার জীবনের সব নষ্ট হয়ে গেল; তার জীবন হয়ে উঠলো অস্বাভাবিক। যে-নারী পিতৃতন্ত্রের বিধান মানে না, সে-ই ব্যাধিগ্রস্ত ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে; মদিও তা রোগ নয়, তা পিতৃতন্ত্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতামনস্ক নারীর বিদ্রোহ।

ক্লারা টম্পসন আরো প্রবলভাবে প্ৰত্যাখ্যান করেছিলেন ফ্রয়েডকে। তিনি দেখান যে নারীমনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ফ্রয়েডের সিদ্ধান্তগুলো জন্মেছে নারীর নিকৃষ্টতা সম্পর্কে ফ্রয়েডের বদ্ধমূল ধারণা থেকে; তাই ফ্রয়েড শিশ্নাসূয়া, ঈৰ্ষা, মর্ষকাম, হীনমন্যতাবোধ প্রভৃতিকে মনে করেছেন জৈবিকা; তবে এসবের উৎপত্তি ঘটেছে সাংস্কৃতিক কারণে। মানুষ যে-অবস্থায় পড়ে সাধারণত তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, নারীও নিয়েছে। শিশ্ন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুবিধা আর আধিপত্যের প্রতী, নারী ঈর্ষা করে পুরুষের ওই সুবিধা আর আধিপত্যকে। নারী শিশ্নকে ঈর্ষা করে না, আর ঈর্ষাও সর্বজনীন নয়। ঈর্ষাবিদ্বেষ প্রতিযোগিতামূলক সংস্কৃতির চরিত্র; নারীকে বাদ দেয়া হয় ওই প্রতিযোগিতা থেকে, তাকে দেয়া হয় না বিকশিত হতে। তাই তার মনে ঈর্ষা জন্মানো স্বাভাবিক, তবে এর পেছনে কোনো জৈব কারণ নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় একটি নিৰ্বোধি পুরুষ যে-সাফল্য লাভ করতে পারে, একটি বুদ্ধিমান নারী তা পারে না; তাই সে হতে পারে ঈর্ষাকাতর। সমাজই ঈর্ষার জনক। নারীর হীনমন্যতাবোধও সমাজে তার প্রকৃত অবস্থারই প্রতিফলন; তা শিশ্নাহীনতার ফল নয়, মনোব্যাধিও নয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিজের অবস্থা দেখে দেখে নারী ভোগে হীনমন্যতায়, এর পেছনে তার শরীর নেই; আছে সমাজ। নারীর পরাসত্তা দুর্বল, এটা নারীর জৈবিক স্বভাব নয়; এটা সমস্ত অধীন জাতিরই কৃত্রিম স্বভাব। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে চায় শক্তিমানদের স্বীকৃতি। ভিক্টোরীয় তরুণী বা আজকের মধ্যপ্রাচ্যের বা বাঙলাদেশের তরুণী নির্ভরশীল তার পিতার ওপর, তার কোনো সুযোগ নেই স্বাধীন মন বিকাশের। যদি সে স্বাধীন হ’তে চায়, তবে তা হবে বিপজ্জনক। দুর্বলকে সব সময়ই আত্মরক্ষার জন্যে শক্তিমানের ভাবাদর্শ মেনে নিতে হয়। নারীও তা মেনে নিয়েছে, তাই মনে হয় নারীর পরাসত্তা দুর্বল; তবে এটা প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে ঘটে নি, ঘটেছে সামাজিক কারণে।

ফ্রয়েডের মতে নারীদের আবেগমননগত বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায় পুরুষের অনেক আগে। তিনি (১৯৩৩, ১৭৩) বলেন, ‘তিরিশের কাছাকাছি কোনো পুরুষকে মনে হয় প্রাণবন্ত, এক অর্থে অপূর্ণ বিকশিত ব্যক্তি, যার কাছে প্রত্যাশা করি যে সে তার বিকাশের সব সম্ভাবনা পূরণ করবে… তবে ওই বয়সের নারীরা মাঝেমাঝেই তাদের মনস্তাত্ত্বিক অনমনীয়তা ও অপরিবর্তনীয়তা দিয়ে আমাদের বিচলিত করে।’ এ দেখেই তিনি ধ্রুব সূত্রে পৌঁছে গেছেন যে তিরিশ বছরের পর নারীদের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না! তিরিশ বছরেই নারী সমাপ্ত; এবং এর মূলে আছে তার শরীর। সম্পূর্ণ ভুল তার সূত্র, যদিও পর্যবেক্ষণ নির্ভুল। ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণের আভ্যন্তর ব্যাখ্যা দিয়েছেন টম্পসন; তিনি দেখিয়েছেন ওই কালে এ-ই ছিলো স্বাভাবিক। তখনো পৃথিবীর অধিকাংশ জুড়ে এটাই স্বাভাবিক যে নারী সমাপ্ত তিরিশে। এক সময় বাঙলায় জনপ্রিয় ছিলো একটি শ্লোক যে বাঙালির মেয়ে কুড়িতেই বুড়ী, অৰ্থাৎ তার জীবন নিঃশেষিত বিশ বছরেই। টম্পসন বলেছেন, নারীর জীবনের সাফল্য যতোদিন নির্ভর করবে বিয়ে ও মাতৃত্বের ওপর, ততোদিন তিরিশেই তার জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা অর্জিত হয়ে যাবে। যদি তার বিয়ে হয় ষোলো বা আঠারোতে, তাহলে তিরিশ বছরের মধ্যে উজাড় হয়ে যায় তার জরায়ু ও সৌন্দৰ্য, যা ছিলো তার জীবনের সম্ভাবনার ভিত্তি। যদি তার বিয়ে না হয়, তাহলে তার জীবন ব্যৰ্থ, বিয়ে হ’লেও ব্যর্থ কেননা বিয়ে ও সন্তান কোনো সাফল্যই নয়। এখনো পৃথিবী জুড়ে তিরিশ বছর বয়স্ক অধিকাংশ নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। টম্পসন ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণ মেনে নিয়ে দেখিয়েছেন তাঁর ব্যাখ্যার ত্রুটি; দেখিয়েছেন ফ্রয়েড নারীকে দেখেছেন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, ফ্রয়েডের নারী হচ্ছে পুরুষের না-সূচক রূপ। ফ্রয়েড দেখেছেন তাঁর নিজের সংস্কৃতির নারীদের, আর ওই নারীদের স্বভাবকে মনে করেছেন বিশ্বজনীন ও শাশ্বত। ফ্রয়েড স্বাভাবিক নারীদের ব্যাখ্যা করেন নি, করেছেন পিতৃতন্ত্রের পর্যুদস্ত নারীদের। তিনি ফ্রয়েডের পুংগূঢ়ৈষ্যারও দিয়েছেন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা; তিনি দেখিয়েছেন সংস্কৃতিই নারীকে ডাকে ওই দিকে। নারী যখন প্রথাগত আশ্রিত ভূমিকা ছেড়ে স্বাধীন জীবনের খোজে বেবিয়ে পড়ে, তখন সে সাফল্যের জন্যে অনুসরণ করে সফলদেরই : নারী দেখে সফল হচ্ছে পুরুষ, তাই নারী অনুকরণ করে পুরুষের আচরণ। পুরুষের জগতে পুরুষের অনুকরণ করে সাফল্য অর্জন করে নারী, যা তার পুরুষাধীন অবস্থায় অসম্ভব। তাই পুংগূঢ়ৈষ্যা কোনো রোগ নয়। ফ্রয়েভ নারীর যে-সব বৈশিষ্ট্যকে মনে করেছেন একান্তভাবে নারীসুলভ ও জৈবিক, সেগুলোকে টম্পসন দেখিয়েছেন সামাজিক অবস্থার ফল ব’লে। তা শাশ্বত নয়, তার সাথে দেহের সম্পর্ক নেই, তা নারীর মৌল স্বভাব নয়। নারীর মৌল স্বভাব কী? টম্পসন বলেছেন, নারীর মৌল স্বভাব আজো অজানা’ [দ্র উইলিয়মস (১৯৭৭, ৭৬)।

অ্যাডলার ছিলেন ফ্রয়োডীয় বৃত্তে, কিন্তু বেরিয়ে এসেছিলেন যখন বুঝতে পারেন যে বদ্ধমূল ফ্রয়েডীয় ধারণা দিয়ে বিজ্ঞানচর্চা অসম্ভব। নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন ফ্রয়েডীয় ধারণা থেকে, এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। অ্যাডলার [দ্র উইলিয়মস্ (১৯৭৭, ৮০)] বলেছেন :

‘আমাদের সমস্ত সংস্থা, আমাদের প্রথাগত প্রবণতা, আমাদের বিধান, আমাদের নৈতিকতা, আমাদেব প্রথা সাক্ষী দেয় যে পুরুষাধিপত্যের গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্যে ওই সব প্রণয়ন ও রক্ষণ করেছে সুবিধাভোগী পুরুষেরা।‘

শিশুকাল থেকেই শিশুরা পিতৃতন্ত্রের বিধানের শিকার হয়ে ওঠে। ছেলেশিশুকে ক’রে তোলা হয় আধিপত্যবাদী, মেয়েশিশুর মধ্যে জাগিয়ে তোলা হয় অধীন ও অপদার্থের বোধ। অ্যাডলারের মতে, বালিকা চারপাশে নারীর বিরুদ্ধে কুসংস্কার দেখে দেখে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে নিজের আর নারীজাতির ওপর; এটা কোনো খোজা গূঢ়ৈষ্যাব ফল নয়, সমাজব্যবস্থাই তাকে ক’রে তোলে আত্মঅবিশ্বাসী। নারীকে বের ক’রে দেয়া হয় শক্তির এলাকা থেকে, পুরুষের সমাজব্যবস্থা তার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে যে তার মনে দেখা দেয় সংকট। সমগ্র সভ্যতা নারীর ওপর যে-চাপ সৃষ্টি করে, তা নারীকে বাধ্য করে পুরুষেব কাছে আত্মসমর্পণ। তবে পক্ষে সুস্থ থাকা কঠিন। তিনি দেখিয়েছেন সমাজ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজকেই মনে করে পুরুষের কাজ, গুরুত্বহীন কাজকে মনে করে নারীর কাজ; পুরুষ গুরুত্বপূর্ণ শক্তিমান, সুযোগ্য; নারী বাধ্য, দাসভাবাপন্ন, অধীনস্থ। তিনি দেখিয়েছেন পুরুষ নারীর প্রতি যে-সৌজন্য দেখিয়ে থাকে, তাতে মনে হয় যে নারীদের খুব মূল্য দেয়া হচ্ছে; তবে তাও করা হয় পুরুষের সুবিধারই জন্যে। নারী ভূমিকা নিয়ে রয়েছে যে-বিশ্বজনীন অসন্তোষ, অ্যাডলারের মতে তা নিতে পারে তিন রকম রূপ। নারী হয়ে উঠতে পারে পুরুষের মতো সক্রিয়, বিদ্রোহ ক’রে সে ক্ষতিপূরণ করতে পারে নিজের অবস্থার। এ-ই হচ্ছে পুরুষালি প্রতিবাদ, যার অপব্যাখ্যা করেছেন ফ্রয়েড; তবে পুরুষালি প্রতিবাদের আশ্রয় নিতে পারে নারীপুরুষ উভয়ই, যখন তারা দেখে যে তাদের মানসম্মান বিপন্ন। তার মতে নারীর জন্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে বিশেষ সীমা, ওই সীমা থেকে নারী একটু ক’রে গেলেই তার নিন্দা করা হয় পুরুষালি বলে। তিনি বলেন, এটা কোনো রহস্যময় ক্ষরণের ফলে ঘটে না, ঘটে বিশেষ স্থানে ও কালে, কেননা এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। নারী আরেক ধরনের প্রতিবাদ জানায় নিজেকে সম্পূর্ণ নারী ক’রে, পুরুষের পুরোপুরি অধীন হয়ে, নিজের ব্যর্থতায় নিজেকে অসুস্থ ক’রে। আছে আরেক ধরনের নারী, যারা ভাবতে পারে যে পুরুষই সব, তারা নিজেরা কোনো কাজের নয়, সম্পূর্ণ অযোগ্য তারা; তাদের অধীনতা ন্যায়সঙ্গত। তাদের এ-মনোভাবও একধরনের প্রতিবাদ, পরোক্ষ প্রতিবাদ : পুরুষের ওপর সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, নিজেরা সামান্যও দায়িত্বভার না নিয়ে তারা জানায় প্রতিবাদ। তাদের ভাব এমন : যেহেতু তোমরা পুরুষ, তাই তোমাদেরই সব কিছু করতে হবে, আমরা কিছু করতে পারবো না। ফ্রয়েডের পুংগূঢ়ৈষ্যা তিনি মানেন নি, মানেন নি শিশ্নাসূয়া। তিনি মনে করেন ফ্রয়েড যে-সবকে মনে করেন জৈবিক ও বিশ্বজনীন, তা আসলে সামাজিক; তাই দরকার সমাজবদল।

ফ্ৰয়েড মনোবিজ্ঞানের নামে নারী সম্পর্কে প্ৰকাশ করেছিলেন একরাশ পুরুষতান্ত্রিক কুসংস্কার; পুরুষাধিপত্যকে তিনি ক’রে তুলেছিলেন জৈবিক, যদিও তা সাংস্কৃতিক। তাঁর প্রভাবেরও সীমা ছিলো না; তিনিই যেহেতু ছিলেন মনোবিজ্ঞানের শেষ কথা, তাই দেখা দিয়েছিলেন তাঁর অসংখ্য অনুসারী, ও জনপ্রিয় ভাষ্যকার, যারা প্রচার ক’রে চলছিলেন যে নারী বিকলাঙ্গ, আর পুরুষাধিপিত্য মেনে নেয়াই নারীজীবনের সার্থকতা। চল্লিশের দশকে দেখা দেন একদল মনোবিজ্ঞানী, যাদের বলা হয় উত্তর-ফ্রয়েডীয়, যাদের মধ্যে ছিলেন অনেক নারীও; কিন্তু তারা ফ্রয়েডের সমস্ত কুসংস্কারকে চূড়ান্ত বিজ্ঞান মনে ক’রে বিচিত্ৰভাবে প্রমাণ করেন যে নারী বিজ্ঞানসম্মতভাবেই বিকলাঙ্গ পুরুষ। ইয়ুং ফ্ৰয়েডকে বলেছিলেন, ফ্রয়েডের মৃত্যুর পরে তাঁর অনুসারীরা তাঁর ভুলগুলোকেও ‘পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন’ হিশেবে গণ্য করবে, তা প্রমাণিত হয় সত্য ব’লে। উত্তর-ফ্রয়েডীয়রা ফ্রয়েডের সমস্ত ভুলকে ধ্রুব জ্ঞান ক’রে সেগুলোকে চাপিয়ে দিতে থাকেন নারীর ওপর; জনপ্রিয় ভাষ্যকারেরা সেগুলোকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে নারীদের সন্ত্রস্ত ক’রে তোলেন। ফ্রয়েডের নারীতিত্ত্বের দুজন আদি সম্প্রসারণকারী নারী : মারি বোনাপার্তা ও হেলেন ডয়েটশ; কিন্তু তারা কোনো প্রশ্ন তোলেন নি ফ্রয়েডের নারীমনোবিজ্ঞান সম্পর্কে, বরং তারা ফ্রয়েডকে ছাড়িয়ে গিয়ে প্রবলভাবে প্ৰকাশ করেন নারী সম্পর্কে ছদ্মবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার। যেমন ফ্রয়েডীয় নারীর অক্রিয়তা ও মর্ষকামতত্ত্বকে বোনাপার্ত [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ২০8)] চরমরূপ দেন এভাবে :

‘পশু বা উদ্ভিদ, প্ৰাণীজগতের সবটা জুড়েই অক্রিয়তা হচ্ছে নারীকোষেব বৈশিষ্ট্য, ডিম্বের লক্ষ্যই হচ্ছে পুরুষকোষের জন্যে অপেক্ষা করা, অপেক্ষায় থাকা যে সক্রিয় সচল শুক্রাণু আসবে ও তাকে বিদ্ধ কববে। এমন বিদ্ধকরণেব অর্থ হচ্ছে তার কোষলংঘন, তবে কোনো জীবিত প্রাণীর কোষলংঘন বোঝাতে পারে ধ্বংস : মৃত্যু অথবা জীবন। তাই নারীকোষের উর্ববতা সূচিত হয় এক ধরনের ক্ষত দিয়ে; স্বভাবে, নারীকোষ আদিরূপেই ‘মর্ষকামী’।‘

তাঁর চোখে শুক্রাণু আক্রমণাত্মক, তাই পুরুষও আক্রমণাত্মক; একেই মনে করেন তিনি স্বাভাবিক। নারী তার খর্ব ভগাঙ্কুরের মতোই, তার পক্ষে আক্রমণাত্মক হওয়া অসম্ভব। বোনাপার্তের মতে, নারীর লিবিডো যেমন দুর্বল তেমনি দুর্বল তার আক্রমণাত্মকতা; তাই নারীকে থাকতে হবে পুরুষপর্যুদস্ত। তিনি প্রচার করেন যে পুরুষ যেহেতু জৈবিকভাবেই আক্রমণাত্মক, তাই তার আধিপত্য অনিবাৰ্য। এ-সবই হচ্ছে ফ্ৰয়েডীয় তত্ত্বকে ধ্রুব মনে ক’রে চরমে নিযে যাওয়া, ফ্রয়েডেব কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমৰ্পণ করা, ও নারীকে সমর্পণ করা পুরুষের কাছে। বোনোপার্ত আত্মসমর্পণ করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে ফ্রয়েডের কাছে, তাই নারী তার কাছে চরম মর্ষকামী; তিনি মনে করেন নারী সঙ্গমে যে সুখ পায়, তা আসলে উৎপীড়িত হওয়ারই সুখ। তার মতে সঙ্গমে নারী উপভোগ করে শিশ্নের প্রহার; সে শিশ্নের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়, সে ভালোবাসে শিশ্নের সন্ত্রাস! নারী যদি পছন্দ না করে শিশ্নের সন্ত্রাস, তাহলে? তাহলে, ফ্রয়েড যেমন বলেছেন, তা নারীরই অপরাধ বা বিকার; যে-নারী এটা পছন্দ করে না সে পুংগূঢ়ৈষাগ্ৰস্ত, পুরুষালি প্রতিবাদের শিকার! ফ্রয়েড বলেছেন, স্বাভাবিক নারী সঙ্গমে সুখ বোধ করে যোনির ভেতরে, স্বাভাবিক নারীর পুলক হচ্ছে যোনীয় পুলক; শুধু বিকৃতরা পুলক বোধ করে ভগাঙ্কুরে, তারা ভগাঙ্কুরীয়। ভগাঙ্কুরীয় হওয়া বিকার ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে; তাই এমনভাবে সঙ্গম করতে হবে যাতে শিশ্ন একটুও স্পর্শ না করে ভগাঙ্কুরটিকে। বোনাপার্ত নারীকে শুধু মর্ষকামী হিশেবে বর্ণনা করেন নি, তিনি অনুশাসন দিয়েছেন যে নারীকে হতেই হবে মর্ষকামী। যে হবে না সে বিকৃত। তবে এতে কোনো বিজ্ঞান নেই, রয়েছে ভিক্টোরীয় কুসংস্কার; ফ্রয়েডের ভুল পদতলে নারীসমৰ্পণ।

ফ্রয়েডের ভ্রান্তি আর কুসংস্কারগুলোকে ধ্রুব সত্যরূপে মেনে নিয়েছিলেন আরেক নারী মনোবিজ্ঞানী। তিনি হেলেন ডয়েটশ, যার দু-খণ্ডের ‘নারীমনোবিজ্ঞানমনোবিশ্লেষণাত্মক ভাষ্য’ (১৯৪৪) এক সময় হয়ে উঠেছিলো খুবই প্রভাবশালী, এমনকি দ্য বোভোয়ারও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার নানা অপব্যাখ্যা। তিনি নারীত্বকে অক্রিয়তার ও পুরুষত্বকে সক্রিয়তার সাথে অবিচ্ছেদ্য ক’রে তুলেছিলেন; শুধু কামে নয়, জীবনের সব এলাকায়। লৈঙ্গিক রাজনীতি তিনি শুরু করেছিলেন শয্যায়, এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জীবনের সবখানে। যে-নারী সক্রিয়, তার মতে সে-ই পুংগূঢ়ৈষাগ্রস্ত; ওই পুংগূঢ়ৈষ্যার মূলে রয়েছে নারীর খোজাত্ব, তার শিশ্ন আর অণ্ডকোষের অভাব। তার মতেও নারীর তিন মৌল বৈশিষ্ট্য আত্মপ্রেম, ক্রিযতা, ও মর্ষকাম। তার চোখেও নারী বিকলাঙ্গ পুরুষ, যার শিশ্ন নেই, রয়েছে একটি অক্ষম খর্ব ভগাঙ্কুর; এবং দেহসংস্থানই নারীর নিয়তি। যে-নারী আত্মপ্রেমিক, অক্রিয়া, মধকামী, সে-ই স্বাভাবিক নারী তার চোখে; আর অস্বাভাবিক তারা, যারা বর্জন করে আত্মপ্ৰেম, যারা পোষণ করে বাস্তব জীবনে সাফল্যের লক্ষ্য, যারা উপভোগ করে না মর্ষকাম। স্বাভাবিক হয়ে ওঠার জন্যে নারীকে ছেড়ে দিতে হবে সব লক্ষ্য, জীবনকে চরিতার্থ ক’রে তুলতে হবে স্বামী বা পুত্রের কাজ ও সাফল্যের মধ্যে। তার মতে যে-নারীরা অর্জন করেছে নানা সাফল্য, তারা তা অর্জন করেছে স্বাভাবিক নারীত্ব বিসর্জন দিয়ে; তাই তারা বিকৃত। স্বাভাবিক নারী, ডয়েটশের মতে, হবে কামপরায়ণ; তার জীবনের লক্ষ্যই হবে প্রেম দেয়া ও পাওয়া; এ-স্বাভাবিক নারীরা বিশিষ্ট ক’রে তুলতে চায় না নিজেদের, তারা একাত্ম বোধ করে কোনো পুরুষের সাথে, এবং এর মধ্য দিয়েই বোধ করে জীবনের চরিতার্থতা। যে-নারী সাফল্য অর্জন করতে চায় সে বিকৃত, সে পুরুষালি প্রতিবাদের শিকার, যেমন তিনি দেখিয়েছেন যে, জর্জ স্যা শিকার ওই রোগের। এ-মনোবিজ্ঞানী, যিনি নিজে নারী ও সাফল্য অর্জন করেছিলেন পুরুষের ক্ষেত্রে, আসলে বিশ্বাসী ছিলেন নারী সম্পর্কে কুসংস্কারে, এবং প্রথাগত নারী ধারণায় [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭০, ৯৪-৯৫)] :

‘যদি তাদের থাকে প্রচুর পরিমাণে বোধি, যেটা নারীর বৈশিষ্ট্য, তারা হয় আদর্শ সহচরী, যারা নিয়ত অনুপ্রাণিত করে তাদের পুরুষদের, এবং তারা এ-ভূমিকায় পায় সবচেয়ে বেশি সুখ। তাদের সহজেই প্রভাবিত করা যায় এবং তারা তাদের সঙ্গীদের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং তাদের বুঝতে পারে। তারা সুন্দরতম ও সবচেয়ে কম আক্রমণাত্মক সঙ্গিনী এবং তারা থাকতে চায় ওই ভূমিকায়ই তারা নিজেদের অধিকারের জন্যে চাপ দেয় না-বরং তার বিপবীত। শুধু প্রেম দিয়ে তাদের যে-কোনোভাবে সহজে চালানো যায়। কামে তারা সহজেই উদ্দীপিত হয় এবং খুব কম সময়ই তারা কামশীতল; তবে কামে তারা আরোপ করে মর্ষকামী শর্ত যা অবশ্যই পরমভাবে পরিতৃপ্ত করতে হবে। তারা প্রেম চায় এবং প্রত্যাখান কবে সব ধরনের সক্রিয় প্রবণতা।
যদি তাদের কোনো প্রতিভা থাকে তবে তারা ওই শক্তিকে মৌলিক ও সৃষ্টিশীলভাবে কাজে লাগায়, তবে তারা প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রামে যোগ দেয় না। তারা সব সময়ই নিজেদের অর্জন বিসর্জন দিতে প্ৰস্তুত, এতে তারা একটুও মনে করে না যে তারা কিছু বিসর্জন দিচ্ছে, এবং তারা তাদের সহকর্মীদেব সাফল্যে উল্লাস বোধ করে, যাদের তারা অনুপ্রাণিত করেছে। যখন তারা নিয়োজিত হয়। কোনো বহির্মুখি কাজে তখন তারা অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ করে সহায়তার, তবে তারা যখন তাদের অন্তর্জীবনের কোনো অনুভূতি বা চিন্তায় জড়িত হয়, অর্থাৎ নিয়োজিত হয় অন্তর্মুখি কাজে তখন তারা চূড়ান্ত স্বাধীন। তাদের পুরুষেব সাথে একাত্মতাবোধের শক্তি কোনো আন্তর দারিদ্র্যের প্রকাশ নয়, বরং আন্তব সম্পদের প্রকাশ।‘

এটা নারীর বৈজ্ঞানিক বর্ণনা নয়, এটা অনুশাসন; তিনি চান এমন আদর্শ নারী, যা শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয়, অসম্ভব। তাঁর নারী বর্জন করবে নিজের সত্তা। এমন নারী কোনো মানুষ নয়, সে নিজের জন্যে বাঁচে না; তবে নারী নিজের জন্যেও বেঁচে থাকে। এমন নারী জীবিত থাকে যখন তার পাশে থাকে কোনো পুরুষ, যার ওপর সে শুধু নির্ভরই করে না, যে তার প্রাণধারণের নিশ্বাস। ডয়েট্‌শ নারীকে পরামর্শ দিয়েছেন নিজেকে প্রত্যাখ্যান করার, পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার, পুরুষের সাথে খাপ খাওয়ানোর ও একাত্মাতাবোধের; এর বদলে নারী পাবে সব কিছু। সে পাবে পুরুষের আদর, কাম, প্রেম, গৃহ; পুরুষ তাকে প্রভাবিত করবে, যেমন ইচ্ছে চালাবে, চাষ করবে, যেখানে ইচ্ছে রাখবে। এমন নারী আকর্ষণীয় মনে হ’তে পারে অনেকের কাছে, কিন্তু আসলে এমন ডয়েটুশীয় নারী আপাদমস্তক ক্লান্তিকর। সে আত্মবিসর্জনের মর্মস্পৰ্শী উদাহরণ। একে মনোবিশ্লেষণ হিশেবে চালিয়েছেন ডয়েট্‌শ, তবে এ হচ্ছে নারী সম্পর্কে প্রথাগত কুসংস্কার। তাঁর বইয়ের দু-খণ্ডকে এক সময় মনে করা হতো নারী সম্পর্কে শেষকথা, কিন্তু তিনি নিজে নারী হয়েও প্রচার করেছিলেন পুরুষতান্ত্রিক কুসংস্কার; বোনাপার্ত ও ডয়েট্‌শ্‌ পুরুষতন্ত্রে দীক্ষার মর্মস্পশী উদাহরণ।

চল্লিশের দশকে শুরু হয় ফ্রয়েডীয় নারীতত্ত্বের জনপ্রিয়করণ, বিচিত্র ধরনের রচনা ও বইয়ে চারপাশ ছেয়ে যায়, প্রতিক্রিয়াশীলতা উপচে পড়তে থাকে ঝকঝকে ছাপা পৃষ্ঠার ভেতর থেকে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনোবিশ্লেষক ফার্ডিনান্ড লুন্ডবার্গ ও সমাজতাত্ত্বিক মারিনিয়া ফার্নহ্যামের আধুনিক নারী, বিলুপ্ত লিঙ্গ (১৯৪৭) নামের একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল বই। বইটি সাধারণ পাঠকদের ও পাঠ্যপুস্তক হিশেবে তরুণতরুণীদের অত্যন্ত প্রভাবিত করে। বইটি মধ্যযুগের একটি প্রচারপুস্তক; এটিতে আধুনিক সমস্ত কিছুকে নিন্দা করা হয়, মধ্যযুগকে চিত্রিত করা হয় স্বর্ণযুগ রূপে, আর সমস্ত আধুনিক প্রগতিশীল আন্দোলনগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার করা হয় ঘৃণা। তাদের বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্য নারীমুক্তি আন্দোলন। লেখকদের মতে, যাদের একজন নারী, বর্তমান কালের অনেক নিষ্টের মূলেই রয়েছে নারীবাদ, এবং এরই জন্যে নারী পরিণত হয়েছে ‘বিলুপ্ত লিঙ্গ’-এ। তাদের মতে নারীবাদের মূলকথা বিদ্বেষ, নারীবাদ একধরনের নাৎসিবাদ। এ-প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের মতে মার্ক্স আর মিল বিকৃত পুরুষ, আর বিশেষভাবে বিকৃত হচ্ছেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌। ওই নারীই শুরু করেছিলেন নারীবিপ্লব নামক উন্মত্ততা! তাঁদের মতে নারীবাদ শুধু অশুভই নয়, একটি রোগ, মনোবিকার, গৃহের শত্রু; নারীবাদ আবেগগত রুগ্নতার প্রকাশ। তাদের মতে নারীপুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষ্য থাকলে তারা শারীরিকভাবে একই হতো। তারা ঘোষণা করেন যে নারীবাদীরা পুরুষ হ’তে চায়, তারা ভোগে চরম শিশ্নাসূয়ায়। তাদের মতে, ‘নারীবাদ হচ্ছে নারীর আত্মহত্যা, পুরুষের মতো বাঁচার প্রয়াস’ [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ২০০৮)]। তাঁদের মতে মা হওয়া ছাড়া নারীর অন্য কোনো ইচ্ছে পোষণ করাই অসম্ভব অভিলাষ, পুরুষ হওয়ার অভিলাষ; এবং তারা ওই অভিলাষকে তিরষ্কার করেন প্ৰাণ ভরে। তাঁরা চান নারী থাকবে নারী হয়ে; তারা মা হবে, পুরুষের অধীনে থাকবে, পুরুষের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। নারী সৃষ্টি হয়েছে শুধু এ-জন্যেই। তাদের মতে নারীবাদী আন্দোলন কমিয়ে দিয়েছে বিবাহ ও সংসারের মহিমা; আর নারীবাদীরা যে পুরুষের জন্যে এক নৈতিকতা আর নারীর জন্যে আরেক নৈতিকতার বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ জানায়, তার কারণ তাদের ভেতরে রয়েছে। অবৈধ কামের গভীর বাসনা। তাঁরা বিবাহপূর্ব কৌমাৰ্য চান, তবে তা শুধু নারীর জন্যে; আর মনে করেন যে নারীপুরুষের ভিন্ন নৈতিকতা শুধু অনিবাৰ্যই নয়, বিশেষভাবেই কাম্য। তারা জয়গান করেন নারীত্বের, পরিবারের, নারী-অধীনতার, মাতৃত্বের। তাদের মতে পুরুষ থাকবে পুরুষের এলাকায়, নারী নারীর এলাকায়। যে-নারী খাপ খাওয়াতে পারে না পুরুষতন্ত্রের সাথে, তারা বিকৃত, ব্যাধিগ্রস্ত। এ-দুই লেখক মনোবিজ্ঞানের নামে প্রচার করেছেন প্রতিক্রিয়াশীলতা; তাদের বইয়ের ভেতর কোনো মনোবিজ্ঞান নেই, আছে অপবিজ্ঞান।

এক মনোবিশ্লেষক, এরিক এরিকসন, নারীকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে বের করেন ইনার স্পেস বা অন্তর বা আভ্যন্তর জগততত্ত্ব। তিনি গবেষণা করেন কিশোরকিশোরীদের নিয়ে, তাদের হাতে দেন নানা মালমশলা এবং তৈরি করতে বলেন মনের মতো কাঠামো। তিনি দেখতে পান মেয়েরা বানাতে পছন্দ করে কোনো গৃহের অভ্যন্তর, যেখানে আছে সুখশান্তি; তারা তৈরি করে স্থির নানা অবস্থা, যেমন কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছে। অন্যদিকে ছেলেরা তৈরি করে উঁচু অট্টালিকা, অট্টালিকার ভেঙে পড়া, এবং সড়ক, যেখান দিয়ে ছুটে চলছে যানবাহন। এ দেখেই এরিকসন ঠিক ক’রে ফেলেন যে এর সাথে সম্পর্ক আছে নারীপুরুষের লিঙ্গসংস্থানের; পুরুষ চায় উচ্চতা, সক্রিয়তা; নারী চায় অবরোধ, নিরাপত্তা। তিনি তত্ত্ব তৈরি করে ফেলেন যে নারীর শরীরসংগঠনই, তার জরায়ু ও যোনির আভ্যন্তর জগতই স্থির করে দেয় নারীর সত্তা, যা ভিন্ন পুরুষের থেকে। যেনো নারীর দেহসংগঠন পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে শিশুপালনের শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক অঙ্গীকার! ফ্রয়েড বলেছিলেন যে নারী বোধ করে তার শিশ্ন নেই, আর এরিকসন আবিষ্কার করেন যে নারী বোধ করে যে তার অভ্যন্তরে একটি জগত রয়েছে, যেটির নাম জরায়ু। এরিকসন যে-উপাত্ত থেকে এতো বড়ো সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন, তা একটু ভালোভাবে দেখলেই তার ইনার স্পেস ও আউটার স্পেসতত্ত্ব ভেঙে পড়ে। মধ্যবিত্ত কিশোরকিশোরীরা বড়ো হয় যে-আবহাওয়ার মধ্যে, তাই তাদের শিখিয়ে দেয় যে মেয়েরা ভালোবাসবে ঘর, আর ছেলেরা বাইর, তাই তারা মেয়েলি ব্যাপারগুলোই বেছে নেয়, ছেলেরা বেছে নেয় পুরুষের ব্যাপারগুলো। এরিকসনের ইনার স্পেস, আউটার স্পেসতত্ত্ব আমেরিকার মহাকাশ বিজয়ের সময়ের এক মার্কিন মনোবিশ্লেষকের অপবৈজ্ঞানিক পাগলামো! অন্যরা অন্তত পুরুষের জন্যে বাইর রেখে নারীর জন্যে রেখেছিলেন ঘর; মার্কিন মহাজগতমত্ততার কালে এ-বিজ্ঞানী পুরুষের জন্যে রাখেন মহাজগত, আর নারীর জন্য রাখেন জরায়ু।

মনোবিশ্লেষণাত্মক কুসংস্কারের পর পশ্চিমে নারী সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়ে সমাজতাত্ত্বিক কুসংস্কার; সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজকে স্থির ক’রে দেয়ার জন্যে তৈরি করেন এক ঝকঝকে তত্ত্ব, তার নাম দেন ফাংশনালিজম বা ভূমিকাবাদ। তাঁরা কাজ করেন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে, ঢুকে পড়েন পরিবারের ভেতরে, এবং তাদের বিদ্যাকে বিজ্ঞানসম্মত করার জন্যে নানা ধারণা ধার করতে থাকেন শরীরবিজ্ঞান থেকে, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাকে বর্ণনা করতে থাকেন সংগঠন, ভূমিকা ইত্যাদি ধারণার সাহায্যে, যেনো, যেমন ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১২) বলেছেন, ওই সব সংস্থার রয়েছে শক্ত অস্থি-পেশি প্রভৃতি। তাঁরা তাদের বিদ্যাকে ক’রে তোলেন ছদ্মবিজ্ঞান। তাঁরা বর্ণনার বদলে প্রচার করতে থাকেন অনুশাসন; কে কী ভূমিকা পালন করে, তার বদলে নির্দেশ দিতে থাকেন কার কর্তব্য কী ভূমিকা পালন। নারী হয়ে ওঠে ভূমিকাবাদের শিকার; নারীকে তারা বন্দী ক’রে ফেলেন নারী-ভূমিকায়। ভূমিকাবাদ বিবর্তনে বিশ্বাস করে না, মনে করে যে সব কিছু চিরস্থির হয়ে থাকবে, যে আছে যে-ভূমিকায় সে থাকবে তাতেই। লৈঙ্গিক বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে প্রথাগত লিঙ্গভেদ অস্বীকার করা, বিশেষ লিঙ্গের ব’লেই কাউকে পালন করতে হবে বিশেষ ভূমিকা বা হ’তে হবে বিশেষ মেজাজের, তা মেনে না নেয়া; আর ভূমিকাবাদের মূলকথা ওই সব মেনে নেয়া। ভূমিকাবাদীরা ফ্ৰয়েডীয় মনোবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব, গণিত প্রভৃতি মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন এমন এক অপবিজ্ঞান, যার সারবাণী হচ্ছে গৃহই নারীর স্থান। ‘আধুনিক বিবাহ’ (১৯৪২) নামের এক বইয়ে এক সমাজবিজ্ঞানী লিখেছেন [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১৪)] :

‘নারীপুরুষ পরিপূরক!…পুরুষ ও নারী মিলে গ’ড়ে তোলে এক কার্যকর একক। একলা প্রত্যেকেই অসম্পূর্ণ। তারা পরিপূরক।… পুরুষ ও নারী যখন নিয়োজিত হয় একই পেশায় বা সম্পন্ন করে একই ভূমিকা, তখন এ-পরিপূরক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।’

একথা বলার জন্যে নতুন সমাজবিজ্ঞানীর দরকার ছিলো না; টেনিসন, রাসকিন ও অনেক ভিক্টোরীয় মহাপুরুষ একথা বলে গেছেন আরো আকর্ষণীয় মৌলিক ভঙ্গিতে; কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে যে একথা আবার বলা হয়েছে বিশশতকের চল্লিশের দশকে, বলেছেন ‘বিজ্ঞানী’!

এ-বিজ্ঞানীরা তরুণীদের শিখিয়েছেন যে সারা জীবনের জন্যে কোনো পেশা গ্রহণ করা ঠিক নয়। যদি কোনো পেশা নিতে হয়, তবে নিতে হ’বে কিছু কালের জন্যে; ওই সময় চেষ্টা চালাতে হবে বিয়ের জন্যে, আর বিয়ে হয়ে গেলে পেশাকে বিদায় দিয়ে ঢুকতে হবে ঘরে, জরায়ুকে চরিতার্থ ক’রে তুলতে হবে মাতৃত্বে। তাঁরা শিখিয়েছেন বিয়ে আর পেশা একসাথে চালানো খুব খারাপ, পেশার থেকে বিয়ে অনেক ভালো; তাই ছেড়ে দিতে হবে বাইরের জীবন। কারণ মেয়েরা গৃহেই সুন্দর। তাঁরা শিখিয়েছেন যদি মেয়েরা পেশাই বেছে নেয়, তবে তাদের থাকতে হতে পারে চিরঅবিবাহিত; যদি তারা মিলন ঘটাতে চায় বিয়ে ও পেশার, তবে তা ডেকে আনবে বিপর্যয়। ওই বিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যানের পর পরিসংখ্যান ছেপে প্রমাণ ক’রে দিয়েছেন যে খুব বেশি মানুষের পক্ষে একই সাথে দুটি পেশা, সংসার ও চাকুরি, চালানো সম্ভব নয়, তা পারে শুধু অসাধারণেরা। কেননা এ-পেশা দুটির দাবি দু-রকম: সংসার চমৎকারভাবে চালানোর জন্যে দরকার নিজেকে পুরোপুরি অস্বীকার করা, দরকার পারস্পরিক সহযোগিতা; আর চাকুরির জন্যে দরকার আত্মবিকাশ, প্রবল প্ৰতিযোগিতা। তারা তরুণীদের জানিয়েছেন যে আত্মবিকাশ খুব বিপজ্জনক ব্যাপার, খুবই সহজ ও মনোরম হচ্ছে আত্মঅস্বীকার। তারা শিখিয়েছেন সংসারে সুখী হওয়া যায়। তখনই যখন স্বামী-স্ত্রী হয় পরস্পরের পরিপূরক, স্ত্রী থাকে ঘরে স্বামী বাইরে। দুর্ঘটনা ঘটে যখন দুজনই করে একই কাজ। এ হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত ভূমিকাবাদ। ভূমিকাবাদীদের প্রধান ছিলেন ট্যালকট পারসন্স্‌, যিনি মার্কিনদেশে নারীপুরুষের ভূমিকা বিশ্লেষণ ক’রে দেখান যে নারীর শ্রেষ্ঠ ভূমিকা হচ্ছে গৃহিণীর ভূমিকা! তাঁর মতে [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১৬)] :

‘নারীর মৌল মর্যাদা হচ্ছে স্বামীর স্ত্রী, আর সন্তানের মায়ের মর্যাদা।‘

এটা অসার মর্যাদা; নিজের নয়, অন্যের থেকে তার ওপর পতিত মৰ্যাদা; আর একথা বলার জন্যে কোনো নতুন সমাজবিজ্ঞানীর দরকার ছিলো না, পুরুষতন্ত্রের বিভিন্ন বই আর মনীষী এসব বলে আসছে কয়েক হাজার বছর ধরে। পুরুষ তো পিতা আর স্বামী হওয়ার মর্যাদায় গৌরব বোধ করে না। নারী ব্যস্ত থাকবে ঘর আর সন্তান নিয়ে? তবে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন নারীর ঘরকন্নার কাজ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, দিনভর করার মতো কাজ আর সংসারে নেই; তিনি স্ত্রীর জৌলুশপূর্ণতার কথা বলেছেন, তবে দেখেছেন ওটা থাকে শুধু যৌবনের কালে; তারপর সব কিছু ধ’সে পড়ে। পারসন্স চান সমাজ যেভাবে চলছে চলবে সেভাবেই, নারী পালন ক’রে যাবে তার প্রথাগত দাসীর ভূমিকা। তিনি, ও তাঁর সঙ্গীরা, জানেন সমাজ চলছে, কেননা বিপুল জনগোষ্ঠি মেনে নেয় তাদের অবস্থা, তারা খাপ খাইয়ে নেয় তাদের ভূমিকার সাথে। সমাজ তাদের বিন্যস্ত করে যেখানে সেখানে থেকেই তারা পালন করে তাদের ভূমিকা; ব্ৰাহ্মণ পালন করে ব্ৰাহ্মণের শূদ্ৰ পালন করে শূদ্রের ভূমিকা; তাঁরা চান এ-ভূমিকা পালন চলবে চিরকাল। বালিকা, যেহেতু ভবিষ্যতে হবে স্ত্রী, প্রস্তুতি নেবে স্ত্রী হওয়ার; বালক নেবে স্বামী হওয়ার প্রস্তুতি। বালিকা প্ৰস্তুতি নেবে আনুগত্যের, নির্ভরতার; বালক নেবে স্বাধীনতা, আধিপত্য, আক্রমণাত্মকতা, ও প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি।

এক ভূমিকাবাদী সমাজবিজ্ঞানী একটি আদর্শ সমকালীন তরুণীর চিত্র এঁকেছেন এভাবে [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১৮)] :

‘আজকের ঐতিহাসিক মুহূর্তে, শ্ৰেষ্ঠ খাপ-খাওয়া মেয়ে সম্ভবত সে, যার পরীক্ষায় ভালো করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি আছে, তবে সব বিষয়ে ‘এ’ পাওয়ার মতো মেধা নেই…যে বেশ উপযুক্ত, তবে সে-সব বিষয়ে নয় যেগুলো নারীদের কাছে নতুন; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং নিজের জীবিকা অর্জন করতে পাবে, কিন্তু পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো ভালোভাবে পারে না; কোনো কাজ ভালোভাবে করতে পারে (যদি সে বিয়ে না করে, বা অন্য কোনো কারণে তাকে কাজ করতে হয়) তবে সে তার পেশার সাথে একাত্ম বোধ করে না, নিজের সুখের জন্যে তা দরকারি মনে করে না।‘

যে-আদর্শ মেয়েটিকে তিনি কামনা করেছেন, সে চিরবালিকা; ভূমিকাবাদীরা চান তাই। এখানে পাই একটি শোচনীয় মেয়েকে, যার শরীরের ভাজ আর মস্তিষ্কের কোষ সবই পুরুষের জন্যে। পরীক্ষায় সে ভালো করবে, কিন্তু বেশি ভালো করবে না; সে চাকুরি করবে, কিন্তু বেশি ভালো চাকুরি করবে না। ওসব করবে ছেলে। সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে নারীর ভূমিকায়। এসব কথা অনেক আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে অনেক আগে বলেছেন রাসকিন ও অন্যান্য ভিক্টোরীয়। তবে ভিক্টোরীয়রা বিজ্ঞানের বেশে এগুলো প্রকাশ করেন নি, এরা প্রতিক্রিয়াশীলতা প্ৰকাশ করেছেন বিজ্ঞানের বেশে। বিজ্ঞানীরা, ও বিজ্ঞান, হয়ে থাকেন ভবিষ্যৎমুখি, কিন্তু ভূমিকাবাদী এ-সমাজবিজ্ঞানীরা পুরোপুরি বর্তমানগ্রস্ত; না, তারা সম্পূর্ণরূপে অতীতগ্রস্ত। তাঁরা তাদের তত্ত্বে শক্তিশালী ক’রে তুলেছেন বাতিল অতীতের কুসংস্কার, এবং রোধ করতে চেয়েছেন পরিবর্তন। ভূমিকাবাদ বিজ্ঞান নয়, অনুশাসন; আগে যে-বিধান দেয়া হতো ধর্মের নামে, ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান থেকে পারসন্সীয় ভূমিকাবাদ তাই করে ছদ্মবিজ্ঞানের নামে। ধর্মকে অস্বীকার করা সম্ভব, কিন্তু বিজ্ঞানকে অস্বীকার আজকাল অসম্ভব; তাই এসব নারীর ক্ষতি করেছে খুবই বেশি। ভূমিকাবাদ চায় যে মানুষ খাপ খাইয়ে চলবে তার অবস্থার সাথে, কেননা খাপ খাওয়ানোই স্বাভাবিকতা। ভূমিকাবাদীরা দেখেছেন প্রথাগত ব্যবস্থা বেশ কার্যকর, তাই তারা বিধান দিয়েছেন যে তাই ঠিক, এবং তাই মেনে চলতে হবে। তারা নারীদের আবার ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন ঘরে, নারীদের ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন মাৰ্গারেট মিডের ভাষায় আধুনিক ‘গুহামানবী’। মিড নিজে যদিও মুক্তি আদায় ক’রে নিয়েছিলেন পুরুষতন্ত্রের শেকল থেকে, তবু তিনি নিজেও পরে অজ্ঞাতসারে কাজ করেছেন পুরুষতন্ত্রের পক্ষে; এবং শেষে বুঝতে পেরেছেন ভুল ক’রে ফেলেছেন অনেকখানি। বিশশতক আধুনিক সময় হিশেবে চিহ্নিত, কিন্তু এর বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে ছড়িয়ে আছে কুসংস্কার, যার একটি বড়ো লক্ষ্য নারীকে পুরুষাধীন ক’রে তোলা।
 
নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর



লিঙ্গ শুধু নারীপুরুষের কয়েকটি প্রত্যঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, লিঙ্গ শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়ানো। নারীর প্রতিটি কোষ সংবাদ বহন করে সে নারী, পুরুষের প্রতিটি কোষ সংবাদ বহন করে সে পুরুষ। তাই পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ ও নারীতে, তবে তা দু-মেরুর পার্থক্য নয়। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাসে নারীপুরুষ মেরুপ্রমাণ সুদূর আর বিপরীত; কিন্তু ওই সুদূরতা ও বৈপরীত্য জৈবিক লিঙ্গের জন্যে ততোটা নয়, যতোটা সাংস্কৃতিক লিঙ্গের জন্যে। প্রকৃতি নারীপুরুষকে বিপরীত ক’রে তৈরি করে না, সমাজই তাদের বিপরীত ক’রে তোলে। নারীপুরুষের উদ্ভব ও বিকাশও ঘটে একই রকমে, মাঝে ঘটে কিছুটা ভিন্নতা; কেউ হয় পুরুষ কেউ নারী, তবে ওই ভিন্নতাকেই পিতৃতন্ত্ৰ ক’রে তোলে প্রধান। প্রকৃতি পুরুষতান্ত্রিক নয়, সমাজই পুরুষতান্ত্রিক পুরুষাধিপত্যবাদী; মানুষের উদ্ভববিকাশের প্রক্রিয়া বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানা গেছে সম্প্রতি, কিন্তু আজো অধিকাংশের মধ্যে টিকে আছে পুরোনো বিশ্বাস যে নারী জন্মসূত্রেই সামাজিক লিঙ্গসম্পন্ন নারী। ধর্মগ্রন্থগুলো নারীর উদ্ভব সম্পর্কে প্রচার করেছে ভ্ৰান্ত পুরাণ; দার্শনিকেরা, এমনকি বিজ্ঞানীরাও, ওই ভ্ৰান্তিকেই প্ৰকাশ করেছেন আকর্ষণীয় রূপে; এবং নারী পুরুষের কাছে কামসামগ্ৰী হিশেবে কাম্য হ’লেও তার দেহের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গগুলোকে, সেগুলোর ক্রিয়াকলাপকে দেখেছে ঘৃণার চোখে। নারী স্ত্রীলিঙ্গ, তার অর্থ এ নয় যে তাকে সাংস্কৃতিক নারী হয়ে উঠতে হবে। স্ত্রীলিঙ্গ ও সাংস্কৃতিক নারীর দূরত্ব অনেক, দুটি বিষম : একটি জৈবিক আরেকটি পুরুষতন্ত্রের বিধানে প্রস্তুত। নারী আজো নিজেকে জানে না, জানে না তার উদ্ভবের প্রকৃতি ও শরীরকে; তবে পুরুষতন্ত্রের মুখোমুখি দাড়ানোর জন্যে এটা জানা অত্যন্ত দরকার।

মানুষ উদ্ভূত হয় উর্বরকৃত বা নিষিক্ত একটি কোষ থেকে [দ্ৰ লিউইলিন-জোন্স (১৯৭১), উইলিয়মস (১৯৭৭), গ্যানোংগ (১৯৮৯)]। ওই কোষটি বা ডিম্বাণুটি উর্বর হওয়ার সাথে সাথে বিশ্লিষ্ট হয় দুটি অভিন্ন কোষে; ওই কোষ দুটি আবার বিশ্লিষ্ট হয়ে সৃষ্টি করে চারটি অভিন্ন কোষ। এভাবে সেগুলো বার বার বিশ্লিষ্ট হ’তে ও সৃষ্টি করতে থাকে অসংখ্য নতুন কোষ। পুরুষের বেলা তা ঘটে, ঘটে নারীর বেলা। ভাঙতে ভাঙতে আর গড়তে গড়তে কিছু কিছু কোষগুচ্ছ বিভিন্ন হয়ে ওঠে, এবং তৈরি করে বিশেষ বিশেষ তন্ত্রি বা প্রত্যঙ্গ। কোনো কোষগুচ্ছ তৈরি করে কংকাল, কোনো গুচ্ছ তৈরি করে পেশি, কোনো গুচ্ছ তৈরি করে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি। কোনো গুচ্ছ তৈরি করে লাল রক্তকণিকা, কোনো গুচ্ছ তৈরি করে শাদা কণিকা। একগুচছ কোষ বহুগুণে বেড়ে তৈরি করে মস্তিষ্কের কোষ ও স্নায়ুতান্ত্র। এসব কোষই উদ্ভূত হয় মাত্র একটি গর্ভবতী ডিম্বাণু থেকে; এবং এসব কোষের প্রত্যেকটি ধারণ করে অজস্র তথ্য। এসব তথ্যের অর্ধেক আসে জনকের কাছে থেকে, সে-শুক্রাণুটির মধ্য দিয়ে যেটি গর্ভবতী করেছে ডিম্বাণুটিকে; বাকি অর্ধেক আসে জননীর কাছে থেকে ওই ডিম্বাণুর মধ্য দিয়েই। প্ৰত্যেকটি কোষ পালন করে একরাশ দায়িত্ব। কোষটিকে কী কাজ করতে হবে, সে-নির্দেশ খচিত থাকে প্রত্যেকটি কোষের কেন্দ্ৰস্থিত একধরনের পাকানো বস্তুতে। ওই পাকানো বস্তুর নাম ক্রোমোসোম। ওই ক্রোমোসোম গঠিত কয়েক কোটি গুটিকার দীর্ঘ মালায়। এগুলোর নাম জিন। জিন হচ্ছে তথ্যের ক্ষুদ্রতম একক। জিন গঠিত হয় ডিএনএ-এর [ডিঅক্সিরি বোনিউক্লেইক এসিড], পাকানো তন্ত্রিতে। কোনো একটি কোষে কাজ করে মাত্র গুটিকয় জিন, বাকিগুলো থাকে নিষ্ক্রিয়।

মানবশরীরের প্রতিটি কোষে থাকে ৪৬টি ক্রোমোসোম; তবে এর ব্যতিক্রম দুটি কোষ : একটি নারীদেহের ডিম্বাণুকোষ, অন্যটি পুরুষদেহের শুক্রাণুকোষ।। ৪৬টির মধ্যে ৪৪টি ক্রোমোসোম নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সমস্ত শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও ক্রিয়াকলাপ। এ-৪৪টি ক্রোমোসমের নাম অটোসোম। বাকি ২টি স্থির করে লিঙ্গ, এ-দুটি লিঙ্গ ক্রোমোসোম। লিঙ্গ ক্রোমোসোম দুটির একটিকে বলা হয় x লিঙ্গ ক্রোমোসোম; অন্যটিকে বলা হয় Y লিঙ্গ ক্রোমোসোম। নারীশরীরের কোটি কোটি কোষের প্ৰত্যেকটিতে রয়েছে ৪৪টি অটোসোম এবং ২টি X ক্রোমোসোম; পুরুষশরীরের প্ৰত্যেকটি কোষে রয়েছে ৪৪টি অটোসোম, এবং ১টি X ও ১টি Y ক্রোমোসোম। নারী হচ্ছে ৪৪টি অটোসোম + xx; পুরুষ হচ্ছে ৪৪টি অটোসোম + XY। পুরুষ তার শরীরের কোটি কোটি কোষের প্রত্যেকটিতে পৃথক নারীর থেকে, কেননা তার প্রত্যেকটি কোষে রয়েছে ১টি Y ক্রোমোসোম, যা নেই নারীর শরীরে। নারীপুরুষের পার্থক্য একটি লিঙ্গ ক্রোমোসমে। নারীপুরুষের শরীরের প্রত্যেকটি কোষেই রয়েছে ৪৬টি ক্রোমোসোম, শুধু নারীর ডিম্বাণুকোষ আর পুরুষের শুক্রাণুকোষ এর ব্যতিক্রম; এ-দুটিতে ৪৬টি ক্রোমোসোম নেই, আছে মাত্র ২৩টি ক্রোমোসোম। তাই এ-দুটির আচরণও ভিন্ন। পুরুষ নারীর থেকে ভিন্ন শুধু ১টি Y ক্রোমোসমের জন্যে; এটিই ঠিক ক’রে দেয় সন্তানটি হবে পুরুষ, না নারী। Y ক্রোমোসমটি নিয়ে গর্ব করতে পারে পুরুষাধিপত্যবাদীরা, কিন্তু এর স্বভাবচরিত্র খুব প্রশংসনীয় নয়। এটির কাজ ধনাত্মক নয়, ঋণাত্মক; এটি কিছু সৃষ্টি করে না, এটি প্রকৃতি বদলে দেয় অন্যের। যখন কোনো Y ক্রোমোসোমবাহী শুক্রাণু উর্বর বা গর্ভবতী করে কোনো ডিম্বাণুকে, তখন এটি শুধু ওই ডিম্বাণুর স্ত্রীলিঙ্গতা কমিয়ে দেয়, তাই সন্তানটি পুরুষ হয়ে ওঠে। প্রথাগত ধারণা এমন যে নারীর সাথে কিছু যোগ করলে পুরুষ হয়; আসলে নারীর থেকে কিছু বাদ দিলে হয় পুরুষ। এটি কিছু ব্যাধিরও বিকাশ ঘটায়। পুরুষ যে নারীর থেকে কম বাঁচে, এর পেছনে আছে এটি। অপরাধবিজ্ঞানীরা এর একটি সাংঘাতিক স্বভাব লক্ষ্য করেছেন। তারা দেখেছেন বড়ো বড়ো অপরাধীদের অনেকের রয়েছে একটি অতিরিক্ত Y ক্রোমোসম; তারা XYY। অপরাধের সাথে সম্ভবত Y-র রয়েছে মৌল সম্পর্ক।

ডিম্বাণু উর্বর হওয়ার দিন বিশেক পর ভ্রূণের অন্ত্রের রন্ধের দেয়ালে এক রকম কোষ দেখা দেয়। তারপর এ-কোষগুলো তন্ত্রির ভেতর দিয়ে চলে যায় অন্ত্রের রান্ধের দু-দিকে অবস্থিত নিচু পুরু এলাকায়। এ-তন্ত্রি থেকেই সৃষ্টি হয় ডিম্বাশয়। গর্ভধানের তিরিশ দিন পরে এ-কোষগুলো ওই তান্ত্রিতে স্থির হয়ে বসে, ও বাড়তে থাকে। একে বলা হয় গোনাড। গর্ভধানের ১৪০ দিন পরে গোনাডে প্ৰায় ৭০ লাখ কোষ পাওয়া যায়। এগুলোর অনেকগুলো ঢাকা থাকে আবরণে। আবরণের ভেতরে এগুলো বাড়তে থাকে, এবং অনেক কোষের মধ্যে দেখা দেয় তরল বস্তু। এগুলো ডিম্বাণু [ওসাইট]। যে-কোষগুলোতে তরল বস্তু দেখা দেয, সেগুলোকে বলে আধার বা ফলিকল। যে-কোষগুলোর আবরণ থাকে না, সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়, এবং জন্মের সময়ে মাত্র ২০ লাখ ডিম্বাণু অবশিষ্ট থাকে। এরপরও নষ্ট হয় বহু ডিম্বাণু, বয়ঃসন্ধির সময় অবশিষ্ট থাকে ২ লাখের মতো ডিম্বাণু। ঋতুস্রাবের সূচনা থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত প্ৰতি মাসে ১২ থেকে ২০টির মতো ডিম্বাণু বিকশিত হয়, এবং সবচেয়ে বেশি যেটি বিকশিত হয়, সেটিকে বের করে দেয়া হয়। ডিম্বাশয় থেকে। এটি পরিপক্ক ডিম্ব, এটি গর্ভবতী বা নিষিক্ত হতে পারে। মাঝেমাঝে একাধিক ডিম্বাণুও বেরিয়ে পড়ে, যার ফলে জন্মে একাধিক সন্তান। ডিম্বাশয়ে বাড়ার সময় প্রতিটি ডিম্বাণু ভেঙে সৃষ্টি হয় দুটি কন্যা-ডিম্বাণু এ-দুটি আকারে সমান নয়, একটি বড়ো একটি ছোটো। প্রতিটি ডিম্বাণুতে থাকে ২৩টি ক্রোমোসোম : ২২টি অটোসোম, ও ১টি x ক্রোমোসোম। নিষিক্তির সময় বড়ো কোষটি শুক্রাণুর মাথাটিকে নিজের ভেতরে টেনে নিয়ে সৃষ্টি করে সন্তান। ছোটো কোষটি কোনো কাজ করে না।

নারীর ডিম্বাণু আদিম কোষ, তা ডিম্বাশয়ে জন্ম নেয় নারীর জন্মের অনেক আগে; পরে আর একটি ডিম্বাণুও জন্মে না। পুরুষের বেলা ঘটে অন্য রকম; যৌবনারম্ভ থেকে বুড়ো কাল পর্যন্ত পুরুষের অণ্ডাশয়ে ধারাবাহিকভাবে উৎপন্ন হ’তে থাকে। শুক্রাণু। অণ্ডকোষে পাওয়া যায় এক রকম আদিম কোষ, যার থেকে তৈরি হয়। শুক্রাণু। পরিপক্ক হওয়ার আগে সেগুলোর পরিবর্তন ঘটে বেশ কয়েকবার, এবং এ-সময় প্রতিটি শুক্রাণুতে ক্রোমোসোমের সংখ্যা অর্ধেক হ্রাস পায়। প্রতিটি পরিপক্ক শুক্রাণুতে থাকে ২৩টি ক্রোমোসোম, যার মধ্যে ২২টি অটোসোম এবং ১টি লিঙ্গ ক্রোমোসোম। শুক্রাণুর লিঙ্গ ক্রোমোসোমে থাকতে পারে ১টি X ক্রোমোসোম, বা ১টি Y ক্রোমোসোম। পুরুষের কোটি কোটি শুক্রাণুকে যদি দু-ভাগে ভাগ করে ফেলি, তবে এক ভাগের শুক্রাণুতে থাকে ২২টি অটোসোম ও ১টি X ক্রোমোসোম, এবং আরেক ভাগের শুক্রাণুতে থাকে ২২ টি অটোসোম ও ১টি Y ক্রোমোসোম। তাই যখন কোনো Y ক্রোমোসোমবাহী শুক্রাণু কোনো ডিম্বাণুকে উর্বব করে, তখন নতুন কোষটিতে থাকে ৪৪টি অটোসোম, এবং ১টি X ক্রোমোসোম ও ১টি Y ক্রোমোসোম। এর ফলে যে-শিশু জন্ম নেয়, সে হয় ছেলে। আর যদি ১টি X ক্রোমোসোমবাহী শুক্রাণু ডিম্বাণুকে উর্বর করে, তাহলে নতুন কোষটিতে থাকে ৪৪টি অটোসোম ও ২টি X ক্রোমোসোম। ফলে সন্তানটি হয় মেয়ে। তাই পিতাই নিয়ন্ত্রণ করে সন্তানের লিঙ্গ, যদিও তার কোন ধরনের শুক্রাণু গর্ভবতী করবে ডিম্বাণুকে তা নিয়ন্ত্রণের শক্তি নেই তার।

নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় তখন, যখন মাত্র একটি শুক্রাণু উর্বর করে একটি ডিম্বাণুকে। সঙ্গমের ফলে যোনিতে স্খলিত হয় কোটি কোটি শুক্রাণু, তার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার পৌঁছোতে পারে জরায়ুতে। তার মাত্র কয়েক শো ঢুকতে পারে ডিম্বনালিতে, এবং তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি ওই নালি দিয়ে সাঁতরে এগোতে পারে ডিম্বাণুর দিকে। শুক্রাণু্রা আদিম সাঁতারু। সব সাঁতারু সফল হয় না, মাত্র একটি ডিম্বাণুর শক্ত উজ্জ্বল আবরণ ভেদ ক’রে ঢুকতে পারে ডিম্বাণুর ভেতরে। যেই কোনো শুক্রাণু ডিম্বাণুর আবরণ ভেদ ক’রে ভেতরে ঢুকে পড়ে, অমনি এমনভাবে বদলে যায় আবরণটি যে তাকে ভেদ ক’রে আর কোনা শুক্রাণু ভেতরে ঢুকতে পারে না। যখন ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর ক্রোমোসোম পরস্পরের সাথে মিলেমিশে যায়, তখনই সূচনা হয় নতুন জীবনের। জিনের নিয়ন্ত্রণে তখন নতুন কোষটি বার বার ভেঙে ভেঙে সৃষ্টি করে নতুন মানব। শুক্রাণুর শরীরটি এক চমৎকার সাঁতারুর; তার থাকে একটি মাথা, একটি মাঝভাগ, একটি লেজ। মাথায় থাকে ক্রোমোসোম, মাঝভাগটি যোগায় শক্তি, লেজটি কাটে সাতার। শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছে ডিম্বাণুর আবরণ ভেদ ক’রে ক্রোমোসোমসহ নিজের মাথাটিকে ঢুকিয়ে দেয় ডিম্বাণুর ভেতরে। সে পৌঁছে তার গন্তব্যে। মাথাটি তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মাঝভাগ ও লেজ থেকে। মাঝভাগে আর লেজ আটকে থাকে আবরণে, এবং নষ্ট হয়ে যায়। ডিম্বাণুর ভেতর শুক্রাণুর মাথা ঢোকার পর তার কেন্দ্ৰস্থলটির আবরণ খসে ক্রোমোসোম বেরিয়ে পড়ে, এবং একই সাথে ডিম্বাণুর কেন্দ্ৰস্থলের আবরণও লুপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে জননীর ২৩টি ও জনকের ২৩টি ক্রোমোসোম সম্মিলিত হয় পরস্পরের সাথে; কোষের ক্রোমোসোমের সংখ্যা হয় ৪৬৷ এভাবে মানবদেহের প্রতিটি কোষে ক্রোমোসোম থাকে ৪৬টি। নারী হচ্ছে নারী, কেননা তার শরীরের, শুধু ডিম্বকোষ ছাড়া, প্রতিটি কোষে থাকে ৪৪টি অলিঙ্গ অটোসোম আর ২টি x লিঙ্গ ক্রোমোসোম। তার শরীরে কোনো Y ক্রোমোসোম থাকে না। Y ক্রোমোসোম না থাকায় তার আভ্যন্তর ও বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো পায় বিশেষ রূপ।

পুরুষাধিপত্যবাদীদের মনে বহু শতাব্দী ধরে একটি কুসংস্কার জমে আছে যে শুক্রাণু শ্রেষ্ঠতর ডিম্বাণুর থেকে; এবং তারা এ থেকে দর্শন তৈরি করেছে যে পুরুষ নারীর থেকে উৎকৃষ্ট। এটা এক বড়ো ভুল ও পিতৃতান্ত্রিক অপপ্রচার। ডিম্বাণু-শুক্রাণুর মধ্যে কোনোটি উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নয় অন্যটির থেকে; ওগুলো সমান, এবং পালন করে নিজ নিজ দায়িত্ব। ডিম্বাণুর অক্রিয়তার কথা খুব বড়ো ক’রে রটানো হয়েছে, তার থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেছে যে নারী অক্রিয়। ডিম্বাণু অক্রিয় নয়। ডিম্বাণু সক্রিয়ভাবে মাসে মাসে বেরিয়ে আসে ডিম্বাশয় থেকে, নিজের মধ্যে টেনে নেয় শুক্রাণুকে; দু-ধরনের কোষের সম্মিলনে জ্বলে ওঠে জীবন। জীবন কোনো বিশেষ এক ধরনের কোষের সৃষ্টি নয়। নারী অক্রিয় নয়। তার যে-অক্রিয়তা দেখা যায়, তা সাংস্কৃতিক; পুরুষের বিধানেই নারী হয়ে উঠেছে অক্রিয়। এর সাথে ডিম্বাণুর আচরণের কোনো সম্পর্ক নেই। জীবন সৃষ্টিতে শুক্রাণু-ডিম্বাণুর ভূমিকা সমান; তবে মানুষের কৃতজ্ঞ থাকার কথা ডিম্বাণুর কাছে, কেননা জীবন লালনে ডিম্বাণুর ভূমিকা অনেক বেশি। ডিম্বাণুর ভেতর শুক্রাণু প্রবেশের পর ডিম্বাণু ভ্রূণটিকে লালন করে, পুষ্টি যোগায়, তাকে বিকশিত ক’রে তোলে। এজন্যেই ডিম্বাণু আকারে অনেক বড়ো শুক্রাণুর থেকে। প্রাচীনেরা ডিম্বাণু সম্পর্কে গড়ে তুলেছেন নানা উপকথা, তাকে ক’রে তুলেছেন সন্দেহজনক ও ভীতিকর। তাদের চোখে ডিম্বাণু স্থির, যার কাজ অপেক্ষা ক’রে থাকা; আর শুক্রাণু স্বাধীন, সচল, যেনো তা বহন করে জীবনচাঞ্চল্যের বাণী। এসবই জল্পনা ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর স্বভাব দেখে শুধু লৈঙ্গিক রাজনীতিদীক্ষরাই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারে যে নারীর এলাকা ঘর, পুরুষের বাইর। ডিম্বাণু থেকে একটি নারী অনেক দূরের ব্যাপার; তাই ডিম্বাণু-শুক্রাণুর আচরণ থেকে নারীপুরুষের স্বভাব সম্পর্কে তত্ত্বসৃষ্টি নির্বুদ্ধিতা।

Y ক্রোমোসোম কী করে? এটি কাজ করে শুধু গোনাডের, অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের, ওপর। এর অনুপস্থিতিতে ভ্রূণে বিকশিত হয় ডিম্বাশয়, উপস্থিতিতে বিকশিত হয় অণ্ডকোষ। অন্যান্য লৈঙ্গিক ভিন্নতা সৃষ্টি হয় হরমোনোর নিয়ন্ত্রণে। নারীর লিঙ্গ ক্রোমোসোম XX; এর একটি আসে জননী থেকে, অন্যটি জনক থেকে। তবে জনকের X ক্রোমোসোমটির উপস্থিতির ফলে সন্তানটি স্ত্রীলিঙ্গ হয় না, বরং স্ত্রীলিঙ্গ হয় Y-এর অনুপস্থিতির ফলে। ভ্রণে ডিম্বাশয় বা অণ্ডকোষ বিকশিত হতে লাগে সাত সপ্তাহ। এ-সময়টিতে ভ্ৰাণটি নারী নয়, পুরুষও নয়; বা বলা যেতে পারে নারী, কেননা Y-এর উপস্থিতিতে ভ্রণের গোনাড অণ্ডকোষে পরিণত হয়, আর যদি উপস্থিত না থাকে তবে তা যা ছিলো। তাই থেকে যায়, অর্থাৎ সেখানে বিকাশ ঘটে ডিম্বাশয়ের। তাই নারী ও পুরুষ উভয়েরই সূচনা ঘটে নারীরূপে, সপ্তম সপ্তাহে এসেই শুধু কোনো কোনো ভ্রূণ পুরুষ হয়ে ওঠে। নারী হচ্ছে শুরু থেকে নারী, পুরুষ হচ্ছে শুরুতে নারী তারপর পুরুষ। এ দেখে মেরি জেন শারফি (১৯৭২) সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন [দ্র উইলিয়ামস (SS8, So) :

‘নারী ভ্রূণের রূপতত্ত্বের প্রাথম্য আমাদের বাধ্য করে লিঙ্গভিন্নতার প্রকৃতি সম্পর্কে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধারণা উল্টে দিতে; ভ্রূণতাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে শিশ্ন হচ্ছে অতিশায়িত ভগাঙ্কুর, অণ্ডকোষ উদ্ভূত হয় বৃহ্দোষ্ঠ থেকে, আদি লিবিডো নারীধর্মী ইত্যাদি।… সমস্ত স্তন্যপায়ীর জন্যে আধুনিক ভূণবিজ্ঞান দাবি করে হাওয়া-থেকে-উদ্ভূত-আদম পুরাণ।‘

নারীপুরুষের যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো বিকশিত অবস্থায় খুবই ভিন্ন দেখায়, তবে ওগুলো অভিন্ন আদিম প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন বিকাশ। আদি গোনাডের একটিই রূপ, এর কোনো লিঙ্গভেদ নেই। এর দুটি অংশ : আভ্যন্তর ভাগ বা মেডুলা; এবং বহির্ভাগ বা কর্টেক্স। Y থাকলে সপ্তম-অষ্টম সপ্তাহে মেডুলা বেড়ে হয়ে ওঠে অণ্ডকোষ, কর্টেক্সটি পড়ে থাকে অদৃশ্য চিহ্নরূপে। যদি Y না থাকে, তাহলে কটেক্স বারো সপ্তাহে বেড়ে হয়ে ওঠে ডিম্বাশয়, মেডুলা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ভ্রণের সপ্তম সপ্তাহে তার থাকে পুরুষ [ওলফীয় নালি] ও স্ত্রী [ম্যুলারীয় নালি] উভয় ধরনেরই আদি জননেন্দ্ৰিয় নালি। পুরুষের বেলা ওলফীয় নালি বেড়ে সৃষ্টি হয় ভাস ডেফেরেন বা শুক্রনালি, শুক্রথলে, ও বীর্যনিৰ্গম নালি। নারীর বেলা মুলারীয় নালি বেড়ে সৃষ্টি হয় জরায়ু, ফ্যালোপীয় নালি বা ডিম্বনালি, ও যোনির ওপরের অংশ। যখন পুরুষের বিকাশ ঘটে তখন মুলারীয় নালি অদৃশ্য চিহ্নের মতো পড়ে থাকে; যখন নারীর বিকাশ ঘটে তখন ওলকীয় নালি পড়ে থাকে অদৃশ্য চিহ্নের মতো। প্রতিটি পুরুষ তার দেহে বয় নারীর পরিত্যক্ত আদি যৌনপ্রত্যঙ্গ, প্রতিটি নারী বয় পুরুষের পরিত্যক্ত আদিযৌনপ্রত্যঙ্গ। নারীপুরুষের বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোও বিকশিত হয় একই আদি প্রত্যঙ্গ থেকে; আদি একই রূপেরই ঘটে দু-রূপ বিকাশ। ভ্রূণের আট সপ্তাহ বয়স হওয়ার আগে এগুলোর কোনো ভিন্নতা থাকে না, এগুলোর সমান সম্ভাবনা থাকে নারীর বা পুরুষের যৌনাঙ্গরূপে বিকাশের। এ-সময়ে এটি হচ্ছে জননেন্দ্ৰিয় খাজের কিছু ওপরে অবস্থিত একটি যৌনকন্দ বা গুটিকা। খাজটির দু-পাশে থাকে মূত্রনালীয় ভাজ, তার পাশে থাকে৷ ঔষ্ঠ্যঅণ্ডকোষীয় স্ফীতি। নারীর বেলা কন্দটি হয়ে ওঠে ভগাঙ্কুর, মূত্রনালীয় ভাজটি ক্ষুদ্রোষ্ঠ, ঔষ্ঠ্য অণ্ডকোষীয় স্ফীতি হয় বৃহ্দোষ্ঠ। পুরুষের বেলা কন্দটি হয় শিশ্ন ও শিশ্নের শীর্ষ, মূত্রনালীয় ভাজ মূত্ররান্ধের চারপাশে মিশে যায়, ঔষ্ঠ্য অণ্ডকোষীয় স্ফীতি হয় অণ্ডকোষ। তাই নারীপুরুষের যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো বা নারীপুরুষ হচ্ছে এক অভিন্ন আদিরূপের দু-রকম উৎসারণ।

নারীপুরুষের মধ্যে ভিন্নতার থেকে অভিন্নতাই বেশি, তবে ভিন্নতা নেই এমন নয়। ওই ভিন্নতা এমন নয় যে শরীর বা লিঙ্গই হয়ে উঠবে তাদের নিয়তি, একজন করবে আধিপত্য আরেকজন থাকবে অধীন। বাস্তবে পুরুষতন্ত্র নারীপুরুষের জৈব লিঙ্গের থেকে সাংস্কৃতিক লিঙ্গকেই ক’রে তুলেছে প্রধান। ইংরেজিতে দুটি শব্দ আছে : সেক্স ও জেন্ডার, বাঙলায় শুধুই লিঙ্গ। সেক্স জৈব লিঙ্গ, জেন্ডার হচ্ছে বিশেষ লিঙ্গের জন্যে বিশেষ সাংস্কৃতিক বিধান। স্ত্রীলিঙ্গ মানুষকে নারী, আর পুংলিঙ্গ মানুষকে পুরুষ হিশেবে গড়ে তোলা সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যাপার, লৈঙ্গিক রাজনীতি। সামাজিক লিঙ্গের সাথে যে জৈব লিঙ্গের সম্পর্ক নেই, তা প্রমাণিত হয় লিঙ্গদুর্ঘটনাগ্রস্তদের আচরণে। জন্ম নেয় অনেক শিশু, যারা জৈব বা মানবিক ভুলের জন্যে বিন্যস্ত হয় ভিন্ন লিঙ্গশ্রেণীতে, এবং লালিতপালিত হয় তার নতুন লিঙ্গপরিচয়ে। কোনো শিশু জৈবিকভাবে পুংলিঙ্গের, কিন্তু তার শিশ্নটি জৈব বিপর্যয়ের ফলে ঠিক মতো গড়ে ওঠে নি, বা কোনো দুর্ঘটনায় সে হারিয়ে ফেলেছে শিশ্ন, তাকে পালন করা হয়েছে মেয়েরূপে; বা কোনো জৈবিক স্ত্রীলিঙ্গ কিন্তু বিশেষ সিনড্রোমগ্ৰস্ত মেয়েদের কাউকে লালন করা হয়েছে ছেলেরূপে, কাউকে মেয়েরূপে; তখন দেখা গেছে তারা আচরণ করে তাদের নতুন লিঙ্গ অনুসারে। এদের আচরণে বোঝা যায় জৈবিক লিঙ্গের সাথে সাংস্কৃতিক লিঙ্গের বিশেষ সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় বছব থেকে পাঁচ বা ছ-বছর পর্যন্ত শিশুকে যে-লিঙ্গ অনুসারে লালন করা হয়, সে আয়ত্ত করে সে-লিঙ্গেরই আচরণ, তার জৈবিক লিঙ্গ যাই হোক। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বালিকাদেরই বিশেষভাবে দীক্ষা দেয়া হয় সাংস্কৃতিক লিঙ্গে, তারা হয়ে ওঠে নারী, তাদের স্বভাব হয়ে ওঠে নারীধর্মী। এর সাথে জৈব লিঙ্গের সম্পর্ক নেই। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২৯৫) বলেছেন :

‘কেউ নারীরূপে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী; সমাজে যে-নারী দেখা যায, কোনো জৈব, মনস্তাত্ত্বিক, বা আর্থনীতিক ভাগ্য তার রূপ স্থির করে না: সমগ্র সভ্যতাই উৎপাদন করে পুরুষ ও খোজাব মাঝামাঝি এ-প্ৰাণীটিকে, যাকে বলা হয় নারী।’

নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো ঢাকা রহস্যে আর নিষেধে। নারীর শরীর যেনো আকর্ষণীয় রহস্যময় ভীতিকর দুর্গ, যার সংগঠন সে নিজে জানে না; জানাও নিষেধ। আজো মানুষের সবচেয়ে বড়ো ট্যাবো নারীর শরীর। তার একটি প্রত্যঙ্গ, স্তন, দৃষ্টিগ্রাহ্য; অধিকাংশ সংস্কৃতির পুরুষের চোখে ওটির আবেদন তীব্ৰ, যদিও আদিম সমাজের পুরুষের চোখে ওর কোনো আবেদন নেই। তবে নারীর অধিকাংশ যৌনপ্রত্যঙ্গ দেহাভ্যন্তর ও অদৃশ্য, আর যেগুলো বাহ্যিক সেগুলোও অন্তরালবর্তী। একটি নগ্ন নারীর দিকে তাকিয়ে থেকেও তার কোনো যৌনপ্রত্যঙ্গ দেখা যায় না, শুধু আভাসের ঢেউ উঠতে থাকে। বালক শিশুর শিশ্নটি বাইর থেকে দেখা যায়, ‘কী মিষ্টি’ বলে ওটি নিয়ে তার পিতামাতারা খেলাও করে, ওটিকে দেয় নানা প্রিয় ডাকনাম;–সোনা, নুনু, ধন; কিন্তু বালিকার বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোকেও নিষিদ্ধ বস্তুর মতো ঢেকে রাখে সিন্দুকে। বালিকার যৌনপ্রত্যঙ্গের কোনটি কেমন, কোনটির কী নাম ও কী কাজ তা জানতে দেয়া হয় না বালিকাকে, জানতে চাইলে তাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। যেনো ওগুলো অপার লজ্জার, ঘৃণার, অপরাধের, এমনকি পাপের। তাই নারী শৈশব থেকেই বিব্রত থাকে তার যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে। ওগুলো তার লজ্জা, লজ্জাস্থান; ওগুলো দেখতে নেই, দেখাতে নেই, ছুতে নেই, ছুঁতে দিতে নেই, ওগুলোর নাম নিতে নেই। অনেক ভাষায় বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হয় ‘লজ্জাস্থান’, এগুলোর চিকিৎসাশাস্ত্রীয় পরিভাষা হচ্ছে ‘পুডেনডাম’ অর্থাৎ লজ্জার বিষয়। প্রথাগত লজ্জা, ঘৃণা, পাপ আর অপরাধবোধের সাথে আরেকটি দুর্নাম জড়িত ক’রে দিয়েছেন ফ্রয়েড; তিনি নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোতে দেখেছেন বিকলাঙ্গতা। নারীর শিশ্ন নেই, রয়েছে ভগাঙ্কুর; তাই নারী বোধ করে শিশ্নের অভাব, ভোগে খোজাগূঢ়ৈষায়, নিজেকে মনে করে বিকলাঙ্গ পুরুষ, এসব বাজে ধারণা তিনি যুক্ত ক’রে দিয়েছেন নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোর সাথে। এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গ, ওগুলো একশো ভাগ স্বাভাবিক; আর ওগুলো লজ্জা, অপরাধ, ঘৃণা বা পাপের ব্যাপার নয়। তবু কোনো নারী নিদ্বিধায় ছুঁতে পারে না তার প্রত্যঙ্গ, কেননা ওগুলো নিষিদ্ধ। প্রতিটি নারীর জানা উচিত তার আভ্যন্তর ও বাহ্যিক প্রত্যঙ্গগুলো, তবে শুধু অশিক্ষিত নারীরাই নয়, শিক্ষিত নারীরাও জানে না তাদের প্রত্যঙ্গগুলোকে ও সেগুলোর ক্রিয়াকলাপ। শৈশব থেকে তাদের বার বার দেখা দরকার নিজেদের প্রত্যঙ্গগুলো, বিশ্বাস করা দরকার যে ওগুলো কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নয়। ওগুলো নিয়ে বিব্রত হয়ে থাকার জন্যে প্রকৃতি ওগুলো দেয় নি নারীকে।

নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোর কয়েকটি বাহ্যিক, কয়েকটি আভ্যন্তর। তবে এগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে নগ্ন হ’লেও, স্তন ছাড়া, নারী কখনো নগ্ন নয়। নারীর বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গ এলাকার নাম যৌনাঞ্চল [ভালভা]। চমৎকার এলাকা এটি, আপলিনিয়ের এ-এলাকাকেই বলেছিলেন ‘বিশুদ্ধ ত্রিভুজ’। এ-এলাকায় রয়েছে কয়েকটি প্রত্যঙ্গ, যেগুলো পালন করে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব। এগুলো নারীর বাইরের যৌনপ্রত্যঙ্গ, কিন্তু বাইর থেকে দেখা যায় না, দেখার জন্যে তাকাতে হয় কাছে থেকে, দেখতে হয় আঙুল দিয়ে ফুলের পাপড়ির মতো নেড়ে নেড়ে।

বৃহ্দোষ্ঠ : এটি হচ্ছে দু-ভাঁজ চামড়া; ঠোঁট যেমন মুখগহ্বরকে ঢেকে রাখে। এ-দুটিও ঢেকে রাখে এ-দুটির মধ্যবর্তী ভগগহ্বরকে। দুটি বড়ো মোটা গোলাপপাপড়ি ব’লে মনে হতে পারে। এ-দুটিকে। শিশু ও বুড়োকালে বৃহ্দোষ্ঠ দুটি থাকে ছোটো, ভেতরে মেদ থাকে না, তবে বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ হওয়া পর্যন্ত বৃহ্দোষ্ঠ থাকে পরিপুষ্ট। ওপরের দিকে বৃহ্দোষ্ঠ দুটি মিলিত হয় এক মেদপুষ্ট অঞ্চলে, যাকে বলা হয় ভেনাসের পাহাড় মোন্স ভেনারিস] বা যোনিবিটপ। বৃহ্দোষ্ঠ, বিশেষ ক’রে মোন্স ভেনারিসের ওপর উদগত হয় যৌনকেশ।

ক্ষুদ্রোষ্ঠ : এ-দুটি মেদপুষ্ট স্পর্শকাতর চামড়ার ভাঁজ, গোলাপের ছোটো পাপড়ির মতো। ওপরের দিকে এ-দুটির একটি চলে যায়। ভগাঙ্করের ওপরে, আরেকটি ভগাঙ্কুরের নিচে; নিচের দিকে এ-দুটি মিলিত হয় পরস্পরের সাথে। বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত এটি গুপ্ত থাকে বৃহ্দোষ্ঠের আড়ালে, দেখতে হয় আঙুল দিয়ে খুলে; তবে শিশু ও বুড়োকালে এ-দুটি বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে।

ভগাঙ্কুর : পুরুষের যেমন শিশ্ন নারীর তেমন ভগাঙ্কুর; তবে শিশ্নের যৌন ছাড়া অন্য কাজ রয়েছে, কিন্তু ভগাঙ্কুরের একমাত্র কাজ যৌনসুখ অনুভব। তাই এটি অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ, পুরুষের এমন কোনো অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ নেই। এটি যেহেতু শুধু কামসুখের জন্যেই, আর কোনো কাজের জন্যে নয়, তাই দেশে দেশে পিতৃতন্ত্র এর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে এটি কেটে ফেলার বিধান দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক মুসলমান দেশে এখনো ভগাঙ্কুরছেদ বা নারীর খৎনা প্রচলিত রয়েছে। এটি কেটে ফেলার অর্থ হচ্ছে নারীর কামসুখের চিরাবসান। গত কয়েক দশকে নারীবাদীরা, ও মাস্টার্‌স্‌ ও জনসনের গবেষণা, প্রতিষ্ঠা করেছেন এর প্রাধান্য। তাঁদের মতে অরগাজম বা পুলকের জন্যে সঙ্গম অপ্রয়োজনীয়, এটি মৈথুন ক’রেই অনুভব করা সম্ভব চরম পুলক। ইলিয়েরসেন ‘আমি অভিযোগ করি’ (১৯৬৯) নামের বইতে লিখেছেন [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭১, ৪৩)] :

‘(যৌনবিজ্ঞানীরা) পরামর্শ দেন যে সঙ্গমের অবতরণিকা হিশেবে নাড়তে হলে ভগাঙ্কুরটিকে, সঙ্গমকেই অধিকাংশ পুরুষ মনে করে ‘আসল জিনিশ’। তাদের জন্যে যা আসল জিনিশ, নারীর জন্যে তা পুরোপুরি সুখানুভূতিহীন। এটিই হচ্ছে মূল জিনিশ! যাকে বিনীত, লজ্জাশীল ও অনুগত নারীরা শতো শতো বছর ধ’রে লুকিয়ে রেখেছে।‘

এটি অবস্থিত যৌনাঞ্চলের ওপরের দিকে মধ্যস্থলে। এটি মোটা শিউলিবোঁটার মতো, এর রয়েছে তিনটি অংশ; শীর্ষ, শরীরদণ্ড, ও পা। এর শীর্ষটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, দণ্ডটিও বেশ স্পর্শকাতর। শীর্ষ ও দণ্ড নেড়েই নারী পেতে পারে চরম পুলক। সঙ্গমে নারী পুলক বোধ করে প্রধানত শিশ্নের সাথে এটির ঘর্ষণে। অনেক নারী সঙ্গমে কোনো পুলক বোধ করে না, কিন্তু তারা ভগাঙ্কর মৈথুন ক’রে চরম পুলক লাভ করে। ভগাঙ্করের একটু নিচেই থাকে মূত্ররন্ধ।

যোনিচ্ছদ : মূত্ররন্ধের নিচে অবস্থিত নারীর যোনিমুখ, যেটি সাধারণত ঢাকা থাকে একটি পাতলা পর্দায়। পর্দাটির প্রথাগত নাম সতীচ্ছদ, তবে এটি থাকা-না-থাকা তথাকথিত সতীত্বের প্রমাণ-অপ্ৰমাণ নয়। সতীত্ব বলে কিছু নেই; এটি না থাকার অর্থ এটি নেই। এটিকে যোনিচ্ছদ বলাই ভালো। এটি এক অপ্রয়োজনীয় জিনিশ। এটি একটি পাতলা পর্দা, যাতে থাকে এক বা একাধিক ছিদ্র, যার ভেতর দিয়ে নিঃসৃত হয় ঋতুস্রাব। এটির আকার ও স্থিতিস্থাপকতা ভিন্ন হয়ে থাকে নারী থেকে নারীতে; সঙ্গম না করেও এটি ছিঁড়ে যেতে পারে, আবার বহুসঙ্গমেও থাকতে পারে অটুট। এটি ছেড়ার সময় সাধারণত কিছুটা রক্ত বেরোয়। অনেক সমাজে যোনিচ্ছদ ছেঁড়া ও রক্তক্ষরণকে মনে করা হয় নারীর সতীত্বের প্রমাণ। বাসর রাতের ভোরে তারা বিছানা খুঁজে দেখে রক্তের দাগ আছে কি-না। আরব ও আফ্রিকি সমাজে যোনিচ্ছদ ও বাসর রাতের রক্তক্ষরণ আজো চরম গুরুত্বের বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে কনের পিতা চরম উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বাসরঘরের দরোজায়, তার হাতে দেয়া হয় কন্যার যোনিরক্তভেজা একটি শাদা রুমাল, আর সে সেটিকে পতাকার মতো উড়িয়ে ঘোষণা করে কন্যার সতীত্ব! রক্ষা করে বংশের মান। সেখানে এখন যোনিচ্ছদ জোড়ালাগানোর শল্যচিকিৎসা ধনীদের মধ্যে খুবই জনপ্ৰিয়।

নারীর আভ্যন্তর যৌনপ্রত্যঙ্গের মধ্যে রয়েছে যোনি, জরায়ু, ডিম্বনালি বা ফ্যালোপীয় নালি, ও ডিম্বাশয়।

যোনি : এটি পুরুষের প্রধান স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন। পুরুষ এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, এমনকি ভয় পায় ও ঘৃণা করে এটিকে। যোনি একটি পেশল নালি, এটি পেছনের দিকে উঁচু হয়ে গিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে। এটি পেশিতে গঠিত, এবং এতে আছে রক্তবাহী শিরাজাল, যা কামোত্তেজনার সময় ফুলে ওঠে। স্বাভাবিকভাবে যোনির দেয়াল লেগে থাকে পরস্পরের সাথে; তবে এটি যেহেতু স্থিতিস্থাপক, তাই এর ভেতর দিয়ে লিঙ্গ বা ট্যাম্পূন প্রবেশের বা সন্তান প্রসবের সময় এটি বিস্ময়করভাবে প্রসারিত হয়। যোনি সাধারণত ৩.৭৫ ইঞ্চি দীর্ঘ। জরায়ুর গ্ৰীবা বা সারভি-স্য ঢুকে পড়ে এর ভেতর। যোনি প্রত্যঙ্গ হিশেবে বিস্ময়কর। এটা শুধু স্থিতিস্থাপকই নয়, এটির আছে নিজেকে নিজে পরিচ্ছন্ন রাখার শক্তি। নারীর আভ্যন্তর প্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে এটিই বেশি লিপ্ত হয় কামে; সাধারণ বোধে এটিই নারীর একমাত্ৰ কামপ্রত্যঙ্গ। পুরুষ এটির ভেতরে শিশ্ন ঘর্ষণ ও ধাতুপাত ক’রেই চরম সুখ পায়। এটির সব অংশ সমান স্পর্শকাতর নয়, এর মধ্যভাগের কোনো স্পর্শকাতরতাই নেই, শুরু ও শেষভাগের রয়েছে কিছুটা স্পর্শকাতরতা। তাই শুধু এটির ভেতরে সঙ্গম করা হ’লে নারী পুলক বোধ করে না। ছোটো যোনি বলে কিছু নেই, যে-কোনো যোনিতে প্রবেশ করতে পারে যে-কোনো শিশ্ন। কামোত্তেজনার সময় যোনি সিক্ত হয়, সিক্ততা শিশ্নের প্রবেশের সহায়ক। যোনি কোনো অক্রিয় প্রত্যঙ্গ নয়, সঙ্গমের সময় এটি শিশ্নকে জিভের মতো চুষতে পারে।

জরায়ু: জরায় আরো বিস্ময়কর। গৰ্ভধারণের আগে এটি দেখতে অনেকটা নাশপাতির মতো, দৈর্ঘ্যে প্রায় চার ইঞ্চি, পাশে আড়াই ইঞ্চির মতো, ওজন দু-আউন্স। গৰ্ভধারণের সময় এটির ওজন হয় আড়াই পাউন্ড, ধারণ করতে পারে সতেরো ইঞ্চি দীর্ঘ একটি শিশু। সন্তান জরায়ুতে উদ্ভূত হয় না, লালিত হয়। জরায়ু এক শূন্য পেশল আধার, এর সামনে মুত্রাশয় পেছনে মলাশয়। সামনের দিক থেকে দেখতে এটি ত্রিকোণ, আর এটি বাঁধানো গ্রন্থিল তন্তুজালে। এ-তত্ত্বজালকে বলা হয় এন্ডোমিটিয়াম। প্রতি ঋতুস্রাব্যচক্রে ঘটে এ-এন্ডোমিটিয়ামের পরিবর্তন। এর ওপরের দিকের কোণকে বলা হয় ‘করনু’বা শিং, যা ধারাবাহিকভাবে ঢুকে গেছে ডিম্বনালির ভেতর।

ডিম্বনালি বা ফ্যালোপীয় নালি : ডিম্বনালি দুটি শূন্য ছোটো নালি, দুটি দু-দিকে। চার ইঞ্চির মতো লম্বা এ-নালি দুটি দু-দিকের ডিম্বাশয়ের সাথে সংযুক্ত রাখে জরায়ুকে। ডিম্বনালি খুব গুরুত্বপূর্ণ, এরই ভেতরেই ঘটে ডিম্বাণুর গর্ভ বা উর্বরায়ণ। এ-নালিতে গৰ্ভ ঘটার পর ভ্রণ ক্রমশ স’রে গিয়ে বাস করে জরায়ুতে।

ডিম্বাশয় : ডিম্বনালির দু-প্রান্তে থাকে দুটি ডিম্বাশয়, দেখতে ডিমের মতো। দেড় ইঞ্চি লম্বা ও পাশে এক ইঞ্চির কম। শিশুবালিকার ডিম্বাশয় থাকে ছোটো, বয়ঃসন্ধির পর আকারে বাড়ে। ঋতুবন্ধের পর আবার ছোটো হয়ে যায়। এর আছে একটি কেন্দ্ৰস্থল, কেন্দ্ৰস্থলকে ঘিরে আছে কৰ্টেক্স। কটেক্সই প্রকৃত ডিম্বাশয়, যার ভেতর ঘুমিয়ে থাকে প্রায় দু-লাখের মতো ডিম্বাণু। পুরুষের যেমন অণ্ডকোষ নারীর তেমনি ডিম্বকোষ।

জৈব লিঙ্গ সত্য, তবে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবলতর সত্য হচ্ছে সাংস্কৃতিক লিঙ্গ। পিতৃতন্ত্র চায় পুরুষ হবে আক্রমণাত্মক, স্বাধীন, নিরাবেগ; আর নারী হবে অনাক্রমণাত্মক, দমন ক’রে রাখবে কাম: হবে অক্রিয়, সেবাশুশ্রুষাপরায়ণ, আকর্ষণীয়। সাংস্কৃতিক লিঙ্গের বিধান অনুসারে বেড়ে উঠতে হয় তাদের। বাল্যকালে তাদের লালনপালন করা হয় এ-বিধান অনুসারে, তারা দীক্ষিত হয়। এতে, এবং মানবপ্রজাতি হয়ে ওঠে। দুটি বিপরীত প্রাণীর সমষ্টি। এর পুরস্কার পায় পুরুষ, শাস্তি ভোগ করে নারী। জৈব লিঙ্গ মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্দেশ ক’রে দেয় না, ব’লে দেয় না যে নারী অধীনে থাকবে পুরুষেব; কিন্তু সাংস্কৃতিক লিঙ্গ সৃষ্টি করা হয়েছে এ-উদ্দেশ্য থেকে যে তা সব সময় নির্দেশ করবে নারীপুরুষের অবস্থান, ঘোষণা করবে। যে পুরুষ আধিপত্যশীল নারীর ওপর। সাংস্কৃতিক লিঙ্গের ওপর গুরুত্ব আরোপ হচ্ছে লিঙ্গবাদঅর্থাৎ পুরুষ হচ্ছে পুরুষ নারী হচ্ছে নারী, যা পুরুষাধিপত্যকে মনে কবে চিরন্তন! নারীর শরীর দূষিত বা লজ্জার বস্তু নয়, একে নিয়ে বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি লিঙ্গবাদের প্রকাশ। নারী তার শরীর হারিয়ে ফেলেছে পুরুষ, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে; কিন্তু নারীকে মনে রাখতে হবে তার শরীর তার নিজস্ব সম্পত্তি, এর ওপর সে ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, বা অলৌকিক কারো অধিকার নেই।
 
বালিকা


একটি নারী যেই গর্ভবতী হয়, শুভার্থীরা যখন পায় সে-সংবাদটি, সবাই স্বাগত জানাতে শুরু করে একটি সম্ভাব্য পুরুষকে, এবং নিষেধ জানাতে শুরু করে সম্ভাব্য একটি নারীকে। তারা জানে আসবে ছেলে, অথবা মেয়ে; কিন্তু যে আসবে তার ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই, যদি থাকতো তবে তা খাটাতে মাবাবা দুজনই, কেউ দ্বিধা বোধ করতো না। আজ এটা জানা যে জনকই নিয়ন্ত্রণ করে সন্তানের লিঙ্গ, তার Y ক্রোমোসোমাই স্থির করে দেয় যে সন্তানটি হবে ছেলে। তবে সে মেপে মেপে নারীর ভেতরে নিজের Y ক্রোমোসোম নিক্ষেপ করতে পারে না। তাই তারা নির্ভর ক’রে থাকে দৈবের ওপর। পিতামাতা চায় ছেলে, অন্যরাও তাই চায়; মেয়ে বেশি মানুষ চায় না। যে-পুরুষের জন্মে একের পর এক মেয়ে, সে অপুরুষ হয়ে ওঠে সমাজের চোখে; যে-নারী একের পর এক মেয়ে প্রসব করে, তার জরায়ুর নিন্দার কোনো শেষ নেই। একটি ছেলে জন্ম দিতে পারলে মা কৃতিত্ব বোধ করে, তার দাম বেড়ে যায়, সে মাথা তুলে দাড়াতে পারে; সভ্যতার দাবি মেটাতে পেরেছে বলে সে নিজেকে সফল মনে করে। সন্তানটি যদি প্রথম সন্তান হয়, তাহলে কথাই নেই; সবাই প্রতীক্ষা আর দোয়াকলামা পড়তে থাকে একটি ছেলের জন্যে। সবার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত ক’রে ছেলে হ’লে সাড়া প’ড়ে যায় স্বৰ্গমর্ত্যে, মুসলমানের আজান দিয়ে আল্লা আর মহাজগতকে তা জানিয়ে দেয়, হিন্দুরা শঙ্খকাসর বাজিয়ে উৎসব করে, অন্যান্য ধর্মের মানুষেরাও তাকে নিয়ে মেতে ওঠে নানা আড়ম্বরে। একটি মেয়ে জন্ম নিলে চারদিকে পড়ে শোকের ছায়া। যেনো বাড়িতে কেউ জন্ম নেয় নি, মৃত্যু হয়েছে কারে , একটি মেয়ের জন্ম পিতৃতন্ত্রের জন্যে অন্যতম প্রধান দুঃসংবাদ; একটি মেয়ের জন্ম পুরুষতন্ত্রের প্রচণ্ড প্রত্যাশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক সময় আরবে, এমনকি ভারতেও, জন্মের সাথেসাথেই তাকে পুঁতে ফেলা হতো, এখন পুঁতে ফেলা হয় না; কিন্তু জন্যেই মেয়ে দেখে বিরূপ বিশ্ব, এবং সে নিয়ত একাকী। তার বিরুদ্ধে সবাই। ধাত্রী তাকে অবহেলায় তুলে ধরে, মা চোখ ফিরিয়ে নেয়, বাবার মুখ কালো হয়ে যায়। তবে সে মেয়ে, অবহেলা আর পীড়ন সহ্য করার অপার শক্তি তার, জন্মসূত্রেই সে নিয়ে আসে টিকে থাকার শক্তি। মেয়ে মায়ের গর্ভে থাকে ছেলের থেকে কিছুটা কম সময়, কিন্তু বাড়ে অনেক বেশি; তার অস্থিও হয় ছেলের অস্থির থেকে বেশি শক্ত। তার নার্ভতন্ত্রও হয় অনেক বেশি পরিণত। মেয়েরা জন্মে ছেলেদের থেকে অনেক কম ত্রুটি নিয়ে, বেঁচে থাকার শক্তিও নিয়ে আসে বেশি। গর্ভপাতে নষ্ট হয় অনেক বেশি ছেলে, মৃত ছেলেও জন্মে অনেক বেশি। জন্মের পর ছেলের মৃত্যুর হার অনেক বেশি মেয়ের মৃত্যুর হারের থেকে। পল্লীবাঙলায় মেয়ের প্রাণকে তুলনা করা হয় কইমাছের প্রাণের সাথে, কুটলেও যে মরে না। মেয়ে, পৃথিবীতে অনভিনন্দিত, বেঁচে থাকে শুধু অদম্য প্রাণশক্তিতে।

নারীপুরুষের ডিম্বাণু আর শুক্রাণুতে x ক্রোমোসোমের পরিমাণ অনেক বেশি, তাই মেয়েই বেশি জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা, জন্মও নেয় বেশি; কিন্তু মেয়ে পৃথিবীতে স্বাগত নয়। পৃথিবীর নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও পৃথিবী এখনো আদিম, তার আদিমতার একটি হচ্ছে মেয়ে নিয়ে বিব্রত বোধ করা। গরিব প্রথাগত পরিবারেই শুধু নয়, আধুনিক পরিবারেও পুত্ৰ ঐশ্বরিক ব্যাপার। আধুনিক পিতামাতা, যারা একটি সন্তানই যথেষ্ট শ্লোগানে দীক্ষিত, তারাও একটি ছেলের জন্যে একের পর এক মেয়ে জন্ম দিয়ে চলে, এবং একটি ছেলে জন্ম দিতে না পারার শোক সারাজীবনে ভুলতে পারে না। ‘পুত্র’ শব্দের মূল অর্থ ‘পূত-নরক-ত্ৰাতা’, যে পিতার মুখাগ্নি ক’রে পিতাকে উদ্ধার করে ওই ভয়ঙ্কর নরক থেকে; তাই পুত্রের জন্যে হিন্দুর ব্যাকুলতার শেষ নেই। পুত্র হচ্ছে ‘নন্দন’, যে আনন্দ দেয় চিত্তে। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ তাঁর সূত্ররচনার সাফল্যকে তুলনা করেন পুত্রলাভের সাথে; বলেন, সূত্র থেকে একটি মাত্রা কমাতে পারলে তিনি পান পুত্ৰ লাভের আনন্দ। হিন্দুশাস্ত্রে পুত্রের জন্যে বাতিল ক’রে দেয়া হয়েছে নারীর সতীত্বের ধারণা : স্বামী যদি পুত্র জন্ম দিতে না পারে তবে পুত্র উৎপাদনের জন্যে বিধান রয়েছে পুত্রবীর্যবান পুরুষ নিয়োগের! মন্ত্র তো রয়েছে সম্ভবত অসংখ্য। মেয়ে তার বিপরীত; মেয়ে অস্বাগত অযাচিত। মার্কিন নারীমুক্তি আন্দোলনের বিখ্যাত নেত্রী লুসি স্টোনের জন্মের সময় তার মা চিৎকার ক’রে উঠেছিলো, ‘হায়! আমি দুঃখিত। এটি মেয়ে। মেয়েমানুষের জীবন কী কষ্টকর।’ ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবী পরে আনন্দ দিয়েছিলেন অনেককে, কিন্তু তাঁর জন্মের সময় সকলের বুক থেকে যে-দীর্ঘশ্বাস বেরিয়েছিলো, তা তিনি মুছে ফেলতে পারেন নি জীবন ও মন থেকে। তিনি বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়ে কাহারও আনন্দ বর্ধন করতে সমর্থ হইনি। বরং সকলকারই আশাপ্রণোদিত চিত্তে হতাশা এবং নিরানন্দই এনে দিয়েছিলাম।‘ কারণ সবাই আকুল প্ৰতীক্ষায় ছিলো পুত্রের জন্যে, ‘গড়ের বাদ্য’ও প্রস্তুত ছিলো; কিন্তু ‘গড়ের বাদ্যি’ ছেড়ে একটি শাকও বাজল না, যদিও পুত্রসন্তানের শুভাগমন কল্পনায় সেটা আঁতুড় ঘরের দোরগোড়াতেই এনে রাখা হয়েছিলা’ [দি চিত্রা (১৯৮৪, ৩০-৩১)] ভার্জিনিয়া উলফ শেক্সপিয়রের বোনের কথা বলেছেন; এভাবেই পৃথিবীতে আসে শেক্সপিয়রের বোনেরা। বাঙলায় নারীদের মধ্যে যিনি প্রথম আত্মজীবনী লিখেছেন, সে-রাসাসুন্দরী বলেছেন, মেয়েমানুষের জন্ম নিছা। সে স্ত্রীলিঙ্গ, তবে তার লিঙ্গে এমন কোনো নির্দেশ নেই যে সে হয়ে উঠবে ‘নারী’ : পুরুষের বিপরীত, পরাধীন পর্যুদস্ত পরনির্ভর। তার জন্মের পর পুরুষের সভ্যতা তাকে শাসন করে তাকে বানিয়ে তোলে নারী, তাকে নানা তুচ্ছ পুরস্কার দিয়ে তাকে গ’ড়ে তোলে এমন বস্তুরূপে, যার নাম নারী। সে বেড়ে ওঠে বালিকারূপে; তার ভেতরে চলতে থাকে অবিরাম ভাঙাগড়া, তার বাইরে চলে পুরুষতন্ত্রের হাতুড়ির আঘাতে নিরন্তর ধ্বংস ও নির্মাণ। যে-নারী চারপাশে দেখতে পাই, তা এক বিকৃত জিনিশ; তা সামাজিক ভাঙাগড়ার অস্বাভাবিক পরিণতি। কোনো নারীকে স্বভাব অনুসারে বাড়তে দেয় না পিতৃতন্ত্র। জন্মসূত্রে সে স্ত্রীলিঙ্গ; কিন্তু পিতৃতন্ত্রের হাতুড়ির ঘায়ে সে হয়ে ওঠে এমন এক লিঙ্গ, যাকে বোভোয়ার (১৯৪৯, ২৯৫) বলেছেন ‘পুরুষ আর খোজার মাঝামাঝি লিঙ্গ’।

পিতৃতান্ত্রিক সমোজসভ্যতা বিচিত্র ধরনের পুলিশবাহিনীর সমষ্টি; গায়ের জোরে টিকে থাকতে হ’লে পুলিশ ছাড়া উপায় নেই। পিতামাতা পরিবার পুলিশ, শোয়ার ঘর রান্নাঘর পুলিশ, রাস্তা পুলিশ, বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ, মসজিদ মন্দির গীর্জা সিনেগগ প্যাগোডা পুলিশ, সবাই পুরুষতন্ত্রের পুলিশ। এসব বাহিনীর প্রহরার মধ্যে বন্দী বালিকা বেড়ে ওঠে নারী হয়ে। এসব সংস্থা তাকে শুধু ভয় দেখায় না, তাকে পুরস্কারের লোভও দেখায়; তাকে ভয় দেখায় যাতে সে পুরুষের মতো বেড়ে উঠতে না চায়, তাকে পুরস্কারের লোভ দেখায় যাতে সে বেড়ে ওঠে। পুরুষতন্ত্রের আদর্শ নারীকাঠামো অনুসারে। একে বলা হয় বলীয়ানকরণ বা রিইনফোর্সমেন্ট। এসব সংস্থা তার সামনে উপস্থিত রাখে অনুকরণীয় আদর্শকাঠামো, নিজেকে ঢেলে তৈরি হ’তে নির্দেশ দেয় ওই কাঠামোর আদলে। এর নাম আদর্শকাঠামো অনুকরণ বা মডেলিং। বালকের জন্যেও রাখে আদর্শকাঠামো অনুকরণের ব্যবস্থা, তবে তার আদর্শকাঠামো বিপরীত। বালিকার অনুকরণের আদর্শ মা ও চারপাশের দীক্ষিত নারীরা; তাই বালিকা হয়ে ওঠে নারী। বালকবালিকা জন্মের পরই বুঝে ওঠে না যে তারা পুরুষ বা নারী, লিঙ্গ তাদের কাছে গুরুত্বের ব্যাপার নয়। শুরুতে তারা নিজেদের মধ্যে কোনো পার্থক্যই করে না। তাদের চোখে তারা এক, তাদের জগত এক; তারা, বালিকা আর বালক, উভয়েই বিশ্বকে উপলব্ধি করে হাত দিয়ে, পা দিয়ে, চোখ কান নাসিকা দিয়ে। পৃথিবীতে এসেই তারা শিশ্ন বা যোনি দিয়ে পৃথিবীকে পরখ করে না। তারা ছোটোবেলা বাড়ে একই রকমে, একই রকমে মায়ের স্তন চোষে, জড়িয়ে ধরে একই রকমে, তারা আদর উপভোগ আর ঈর্ষা বোধ করে একই রকমে। বারো বছর বয়স পর্যন্ত বালকবালিকার দেহে থাকে সমান শক্তি, মনোবেলও থাকে একই পরিমাণে। তবে তিন বছর বয়স থেকে, বিশেষ ক’রে বয়ঃসন্ধি থেকে বালিকার আচরণে দেখা দিতে পাকে নারীত্ব। আগে এ-নারীত্বের অভিব্যক্তি ঘটতো অত্যন্ত সমারোহের সাথে, এখন তার প্রকাশ অনেক ক’মে গেছে। ওই নারীত্ব দেখে বিস্মিত আর মুগ্ধ হয়ে পড়তো পুরুষতন্ত্র, তারা মনে করতো বালিকার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে এক নারী, যে জেগে উঠতে শুরু করেছে। বিদ্যাসাগর (১৯৮৭, ৪১৮] ‘প্ৰভাবতীসম্ভাষণ’-এ প্ৰভাবতী নামের একটি বালিকার নারী আদর্শ অনুকরণের উল্লেখযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন :

১। কখনও কখনও, স্নেহ ও মমতার আতিশয্যপ্রদর্শনপূৰ্ব্বক, ঐকান্তিক ভাবে, তনয়ের লালনপালনে বিলক্ষণ ব্যাপৃত হইতে।
২। কখনও কখনও, ‘তাহার কঠিন পীড়া হইয়াছে’ বলিয়া, দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া, বিষন্ন বদনে, ধারাসনে শয়ন করিয়া থাকিতে।
৩। কখনও কখনও, ‘শ্বশুরালয় হইতে অশুভ সংবাদ আসিয়াছে’ বলিয়া, স্নান বদনে ও আকুল হৃদয়ে, কালব্যাপন করিতে।
৪। কখনও কখনও, ‘স্বামী আসিয়াছেন বলিয়া, ঘোমটা দিয়া, সঙ্কুচিতভাবে, এক পার্শ্বে দণ্ডায়মান থাকিতে; এবং, সেই সময়ে, কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, লজ্জাশীলা কুলমহিলার ন্যায়, অতি মৃদু স্বরে উত্তর দিতে।
৫। কখনও কখনও, ‘পুত্রটি একলা পুকুরের ধারে গিয়াছিল, আর একটু হইলেই ডুবিয়া পড়িত’, এই বলিয়া, সাতিশয় শোকাভিভূত হইয়া, নিরতিশয় আকুলতাপ্রদর্শন করিতে।
৬। কখনও কখনও, ‘শ্বাশুড়ীর (sic) পীড়ার সংবাদ আসিয়াছে’ বলিয়া, অবিলম্বে শ্বশুরালয়ে যাইবার নিমিত্ত, সজ্জা করিতে।

তবে প্ৰভাবতী কোনো জন্মনারী নয়, সে নারীর নকল। বিদ্যাসাগর তার আচরণে মুগ্ধ হ’লেও তার আচরণকে কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার বলে মনে করেন নি, মনে করেছেন সে যদি ‘এই পাপিষ্ঠ নৃশংস নরলোকে’ আরো বেঁচে থাকতো তাহলে তার ‘যে সকল লীলা ও অনুষ্ঠান করিতে হইত’ সে তা সম্পন্ন ক’রে গেছে শৈশবেই। সে কাঠামো অনুকরণের এক অসাধারণ উদাহরণ। বালিকার মধ্যে নারীত্বের প্রকাশ রহস্যময় জৈবিক নিয়ন্ত্রণের অবধারিত ফল নয়, জিনক্রোমোসোম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংবাদ রাখে না। নারীত্ব হচ্ছে সমাজের অনিবাৰ্য প্রভাব ও পীড়নের পরিণতি। সমাজে বেড়ে ওঠার অর্থ হচ্ছে সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল আয়ত্ত করা। সে টিকে থাকে, যে খাপ খায়; যে খাপ খায় না। সমাজ তাকে ধ্বংস ক’রে দেয়, বা সে বদলে দেয় সমাজকে। অধিকাংশ মানুষই নিজেদের অস্তিত্বের জন্যে খাপ খায় সমাজের সাথে, শেখে সে-সব বিধিবিধান, যা তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। ভঙ্গুর বালিকার পক্ষে সমাজ বদলে দেয়া অসম্ভব, তাই শেখে সামাজিক সূত্র। বালিকা তার জীবনের দ্বিতীয় বছর থেকে চারপাশ দেখে দেখে বোঝে য়ে নারী হয়ে ওঠাই তার সামাজিক নিয়তি। প্রতিটি বালকবালিকার কাছে সমাজ একটি বিশাল আয়না, যাতে তারা দেখতে পায় নিজেদের, ও তাদের, হয়ে উঠতে হবে যাদের মতো। তারা দেখে হয়ে উঠতে হবে পিতামাতার মতো; পিতা তাদের সামনে এক আদর্শকাঠামো, মা তাদের সামনে এক আদর্শকাঠামো। ওই কাঠামো অনুসারে ছেলে হয় পুরুষ, বালিকা হয় নারী। কোনো জৈবিক কারণে তারা সামাজিক নারীপুরুষ হয়ে ওঠে না।

ছোটোবেলা থেকেই বালিকার সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে প্রিয়জনেরা। বালিকা জন্মের সময় অভিনন্দিত হয় নি, জন্মের পরও সে পায় না ভাইয়ের সমান আদর। প্রথাগত পরিবারে, দরিদ্র পরিবারে, অনুন্নত সমাজে বালিকা অনেক কম আদর পায় ভাইয়ের থেকে। অবহেলার মধ্যে বড়ো হয় বালিকা। তার খাবার হয় কম, ও নিম্নমানের; ছেলের জন্যে তোলা থাকে মাছের মুড়োটি, দুধের সরটুকু রেখে দেয়া হয় ছেলের জন্যে, গাছের ফলটিও পাকে তারই জন্যে। বাঙালি সমাজে শৈশব থেকেই মেয়ের ভাগে জোটে এঁটোকাঁটা বাসি খাবার। সবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর আসে। তার খাওয়ার পালা, উচ্ছিষ্ট থেকেই মেয়েকে সংগ্ৰহ করতে হয় বেঁচে থাকার শক্তি। ওই উচ্ছিষ্ট খেয়ে কারো পক্ষে বীর হওয়া সম্ভব নয়, মেয়েও বীর হয় না; তার কাছে প্রত্যাশাও করা হয় না। জন্মসূত্রে সে নিয়ে এসেছিলো ছেলের থেকে অনেক শক্ত অস্থি, কিন্তু অপুষ্টির ফলে তার অস্থি হয়ে পড়ে দুর্বল। পরিপূর্ণ নারীর কংকালও থেকে যায় শিশুর কংকালের মতো অসুগঠিত, শরীরবিদ্যায় যাকে বলা হয় পেডোমোফিক বা বালরোপিক, তার কারণ বালিকার আশৈশব অপুষ্টি। শিশুছেলেকে যে-যত্নে শোয়ানো হয়, পরিষ্কার করা হয় তার মলমূত্র, বালিকা সে-যত্ন পায় না। পৃথিবী জুড়ে অধিকাংশ বালিকা বড়ো হয় অনাদরে। ধীরেধীরে বালিকা জড়িয়ে পড়ে একজনের সাথে, যে বড়ো হয়েছে ও বেঁচে আছে তারই মতো অনাদরে, সে তার মা। মায়ের সাথে মেয়ের নাড়ি কখনো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় না। বাঙালি নারীদের আত্মজীবনীতে একটি শব্দ বারবার মেলে, শব্দটি ‘অভাগিনী’। এক অভাগিনী বড়ো হ’তে থাকে আরেক অভাগিনীর আঁচলের নিচে। নিয়তি নিজের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে জড়িয়ে দেয় মা ও মেয়েকে। বালিকা জড়িয়ে পড়ে মায়ের সাথে, আর ছেলে একটু একটু দূরে স’রে যেতে থাকে; মনে হতে পারে যে বালিকা একটু বেশি আদর পাচ্ছে আর কম আদর পাচ্ছে ছেলেটি। তবে এও এক পিতৃতান্ত্রিক প্রতিভাস।

উন্নত, এমনকি আমাদের সমাজেও একটু বড়ো হবার পর ছেলে আর মাবাবার আলিঙ্গন আদর আগের মতো পায় না, কিন্তু মেয়েটি পায়। বালিকা হয়ে ওঠে তাদের পুতুল। মায়ের শরীর ঘেষে থাকতে পারে বালিকা, ছেলে পারে না; সে নির্বাসিত হয় মায়ের আঁচলের বাহুর আলিঙ্গনের আপাতমনোরম এলাকা থেকে। বাবাও মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখে, আদর করে কাজেঅকাজে, একটু দূরে সরিয়ে দেয় ছেলেকে। মেয়েকে দেয়া হয় রঙিন জামাকাপড়, তার ঠোঁটের বাকী কারুকাজে মুগ্ধ হয় মাবাবা, তার চোখে অশ্রু মুক্তো মনে হয় তাদের। তার চুল আঁচড়ে দেয়া হয় যত্নে, তার মেয়েলিপনা দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। সে থাকে মনোরম বাগানে; আর ছেলেকে যেনো নির্বাসিত করা হয় দণ্ডকারণ্যে। তার আদুরোপনা অসহ্য মনে হয়, তার ছলাকলা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তাকে বার বার বলা হয় ‘পুরুষ এটা করে না’, ‘পুরুষ সেটা করে না’, ‘পুরুষ শাড়ি পরে না’, ‘পুরুষ লিপষ্টিক দেয় না’। মেয়েকেও বলা হয় ‘মেয়েরা এটা করে না’, ‘মেয়েরা ওটা করে না’, ‘মেয়েরা শার্ট পরে না’, ‘মেয়েরা এভাবে কথা বলে না”। স্থির ক’রে দেয়া হয় তাদের লিঙ্গপরিচয় ও লিঙ্গভূমিকা। ভিন্ন ক’রে দেয হয় তাদের ভূমিকা; তাদের বাধ্য করা হয় বিপরীত ভূমিকার পাত্ৰপাত্রী হয়ে উঠতে। ভিন্ন ক’রে দেয়া হয় ছেলে ও মেয়ের কাজ, আচরণ, এলাকা। ছেলেকে কাজ দেয়া হয় মুক্ত এলাকার, তাকে দেয়া হয় স্বাধীনতা; মেয়েকে দেয়া হয় অবরুদ্ধ এলাকার কাজ, তাকে দীক্ষিত করা হয় অধীনতা আর অবরোধে। মেয়ে ভয় পেলে খুশি হয় সবাই, আর ছেলে ভয় না পেলে খুশি হয় সবাই। মেয়েকে হ’তে হবে ভীত, সন্ত্রস্ত; টিকটিকি দেখেও সে কেঁপে উঠলে সবাই স্বস্তি বোধ করে যে একটি নারীর জন্ম হচ্ছে; সভ্যতা পাচ্ছে একটি বিশুদ্ধ নারী। তারা পৃথক, তারা পৃথক এলাকার; একজন অবরুদ্ধ ঘরের, আরেকজন মুক্ত বাইরের। তাদের জৈবনির্দেশের মধ্যে এসব নেই, আছে সামাজিক নির্দেশে; স্ত্রী ও পুংলিঙ্গ জৈব, নারী ও পুরুষ সামাজিক।

ছেলেকে যে থাকতে দেয়া হয় না মায়ের আঁচলের নিচে আর বাবার বুকের কাছে, স্থাতে মনে হতে পারে যে মেয়েটিকে আদর করছে। সবাই, অনাদর করছে ছেলেটিকে; মেয়েটি সকলের চোখের মণি। কিন্তু আসলে চোখের মণি ছেলেটিই। তার সাথে যে আপাতরূঢ় আচরণ করা হয়, তার কারণ তার জন্যে সামনে পড়ে আছে অসামান্য সব ব্যাপার, যা ওই আদরের থেকে অনেক মহৎ, যার ভাগ মেয়ে কখনো পাবে না। ছেলেবেলা থেকেই ছেলের কাছে প্রত্যাশা করা করা হয়। বড়ো বড়ো কাজ, কেননা সে উৎকৃষ্ট মেয়ের থেকে। সে পিতৃতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, পিতৃতন্ত্র তারই হাতে অৰ্পণ করবে সভ্যতা। সে ছেলে, তাকে করতে হবে বিশ্বের কাজ; তাই সে হবে ভিন্ন, তাকে হ’তে হবে সাহসী, হাতে হবে পুরুষ। সে সাগর পেরিয়ে যাবে, আকাশ ভেদ ক’রে ছুটবে; সে ভোগ করবে বসুন্ধরা। সে পুরুষ, তাকে হয়ে উঠতে হবে পুরুষ। তার পুরুষত্ত্বের একটি প্রতীকও সমাজ খুঁজে পায় তার শরীরে, সেটি শিশ্ন। বালক তার শিশ্নকে সহজাত মহৎ মনে করে না, ওই প্রত্যঙ্গটির যে রয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনা তাও সে জানে না; কিন্তু চারপাশের আচরণ থেকে সে বুঝতে পারে ওটির গুরুত্ব। বড়োরা তার শিশ্নটিকে নানা ডাকনামে ডাকে, ওটিকে বলে সোনা নুনু ধন, ওটিকেই ক’রে তোলে একটি ব্যক্তি। শিক্ষিত সমাজে শিশ্নের মহিমা কমেছে, কিন্তু চাষীসমাজে এর মহিমা এখনো অপ্ৰতিহত। শিশ্নটি বড়ো হয়ে একাধিক দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু শৈশবে এর দায়িত্ব প্রস্রাবের। মেয়ের শিশ্ন নেই, রয়েছে দুটি রন্ধ, যা সে দেখতে পায় না। সে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে পারে না। এটা এক অসুবিধা। মুসলমানদের অবশ্য পুরুষনারী উভয়েরই জন্যে বিধান রয়েছে বসে প্রস্রাব করার; তবে দাঁড়িয়ে প্রস্রাবের রয়েছে বিশেষ সুবিধা। বালিকা সে-সুবিধা নিতে পারে না। বালকের শিশ্ন তাকে ক’রে তোলে বিশিষ্ট।

বালিকার যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো মা, বা অন্য কারো চোখে মর্যাদা পায় না। সে তার প্রত্যঙ্গগুলো দেখতে পায় না, তাকে বলা হয় ওগুলো লুকিয়ে রাখতে; তার মনে এমন বোধ সৃষ্টি ক’রে দেয়া হয় যে, ওগুলো লজ্জার বিষয়, ওগুলো নিষিদ্ধ, ওগুলোর কথা যতো ভুলে থাকা যায় ততোই ভালো, যেনো ওগুলো নেই। তার প্রত্যঙ্গগুলো যে আড়ালে থাকে, সে যে দেখতে পায় না। ওগুলো, এতে বালিকা কোনো অভাব বোধ করে না। তবে সে বুঝতে পারে তার অবস্থান ছেলের অবস্থানের থেকে অনেক ভিন্ন, অনেক নিম্ন। পরিবার, সমাজ, সভ্যতা বালিকার বিরুদ্ধে ও বালকের পক্ষে এমনভাবে অবিরাম কাজ করতে থাকে যে সে অসহায় বোধ করে, এমনকি বোধ করে হীনমন্যতা। সবাই যাদের উপেক্ষার বিষয় মনে করে, তাদের পক্ষে হীনমন্যতাবোধ স্বাভাবিক যুগ যুগ ধরে নিজেদের হীন অবস্থান দেখে দেখে তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তারা আসলেই হীন। বালিকাও তা বোধ করতে পারে, বালিকাও তা বোধ করে। বালিকা বোধ করে সে নিকৃষ্ট তার ভাইয়ের থেকে। ভাইয়ের শিশ্ন আছে, তাকে ভালোটা খেতে দেয়া হয়, তার দাবি পূরণ করা হয় দ্রুত। বালিকা দেখে তার দাবি মেটে না, সে খাবার বেলা পায় মাছের বাজে টুকরোটি, মুড়ো খাওয়ার স্বপ্ন তার স্বপ্লই থেকে যায়। তাই তার জগতে পারে, এবং জাগে হীনমন্যতাবোধ। ফ্রয়েড বালিকার হীনমন্যতা দেখেছেন; তিনি মনোবিজ্ঞানী হিশেবে উৎকৃষ্ট হতে পারেন, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী হিশেবে খুবই নিকৃষ্ট। তিনি বলেছেন খোজাগূঢ়ৈষার কথা, বালিকার শিশ্নাভাবের কথা, শিশ্নাসূয়াগ্ৰস্ততার কথা। তিনি বলেছেন বালিকা ঈর্ষা করে বালকের শিশ্নকে, কেননা তার শিশ্ন নেই; বালিকা শিশ্নের অভাবে ভোগে হীনমন্যতায়। ফ্রয়েডের তথ্য নির্ভুল, তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভুল।

বালিকা শিশ্নকে ঈর্ষা করে না, ঈৰ্ষা করে শিশ্নের অধিকারীকে। একটি শিশ্ন থাকলে অশেষ অধিকার, না থাকলে অধিকার নেই। শিশুবয়সে সামনের দিকে লেজের মতো ঝুলে থাকা শিশুটিকে বরং হাস্যকর আর খাপছাড়া ব’লেই মনে হয়। ওটি দেখে যে ঘেন্না জন্মে, তা নয়; আবার ওটি দেখার সাথে সাথে যে ওটির মহত্ত্বের কাছে অবনত হয়ে পড়তে হয়, এমনও নয়। ফ্রয়েড মনে করেছেন, আর তার অনুসারীরা রটিয়েছেন, যে বালিকা বালকের শিশ্ন দেখার সাথেসাথেই লাভ করে দিব্যদৃষ্টি, তখনই বুঝে ফেলে যে তার নেই শিশ্ন, এবং সাথে সাথে আক্রান্ত হয় হীনমন্যতায়। তারা ভুল বুঝেছেন বালিকার মনস্তত্ত্ব। একটি প্রত্যঙ্গ দেখেই হীনমন্যতার আবেগ জাগে না, এর জন্যে থাকা দরকার নিজের অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ। বালিকা দেখে দেখে বড়ো হয় যে অনেক কিছুই তার প্রাপ্য নয়, আর ছেলের প্রাপ্য সব কিছু তখন সে ঈর্ষা করে বালককে, পুরুষকে, তার শিশ্নটিকে নয়। বালিকা শিশ্নের ঈর্ষায় কাতর নয়, তবে একটি শিশ্নের অভাব তার জীবনে নিয়তির মতো কাজ করে। বোভোয়ারের মতে বালক তার শিশ্নে অনুভব করে নিজের ব্যক্তিত্ব, কিন্তু বালিকা তার কোনো প্ৰত্যঙ্গে ব্যক্তিত্ত্বের আশ্বাস পায় না। ছেলে খেলতে পারে তার শিশ্ন নিয়ে, মেয়ে নিজের যৌনপ্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলতে পারে না। খেলার জন্যে সে পায় পুতুল। পুতুল বস্তু, বালিকা ওই বস্তুর সাথে নিজেকে বোধ করে অভিন্ন। বালিকা পুতুল সাজায়, তাকে নিয়ে খেলে, তাকে আদর করে, যেমন আদর সে নিজে চায়। সে নিজেকে মনে করে পুতুল। বালক যখন ব্যক্তি হয়ে ওঠে, তখন বালিকা হয়ে ওঠে পুতুল। সে চারপাশে দেখে নারীদের, বালিকা শেখে রূপের মূল্য, নিজে হয়ে উঠতে গায় রূপসী। সাজগোজ হয় তার প্রিয়, আয়নায় সে দেখে নিজেকে, অন্যরা যখন তাকে সুন্দর বলে সে সুখ পায়। সে হয়ে উঠতে চায় পরী বা রাজকন্যা। সে তখন থেকে আর নিজের জন্যে বাঁচে না, বাঁচে অন্যের জন্যে। যে-রূপের জন্যে তার ব্যাকুলতার শেষ নেই, সে-রূপও তার নিজের জন্যে নয়, যেমন তার জীব ও নিজের জন্যে নয়। বালিকা নারী হয়ে উঠতে থাকে, আর হারাতে থাকে স্বায়ত্তশাসন।

বালিকার জীবনে দেখা দেয় নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম, তবে তা কোনো রহস্যময় জৈবিক কারণে নয়। বালিকা দেখে তার কোনো কাজের জন্যে সে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার গুরুত্ব শুধু তার রূপের জন্যে। চারপাশের নারীদের দেখে সে, দেখতে পায় রূপই তাদের সম্পদ। সে তখন মন দেয় নিজের শরীরের দিকে, তাকে সাজিয়ে ক’রে তুলতে চায় রক্তমাংসের পুতুল। সে বুঝে ফেলে তার রূপ দিয়ে সে সম্ভোগ করবে না, বরং সে হবে সম্ভোগের বস্তু। নারী অক্রিয়, তবে তার অক্রিয়তাও কোনো জৈবিক কারণে নয়; তাকে রহস্যময়ী বলা হ’লেও তার কোনো আচরণই রহস্য নয়। আত্মপ্রেম আর অক্রিয়তার পাঠ সে নেয় সমাজের কাছ থেকেই, সে হয়ে ওঠে সমস্ত সামাজিক নিয়মের মেধাবী ছাত্রী। কেননা তাতে উত্তীর্ণ হ’লে সে পুরস্কার পাবে, ব্যর্থ হ’লে জুটবে শান্তি। বালিকা যখন ঘরে বন্দী হয়ে মেতে থাকে দিবাস্বপ্নে, লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে অক্রিয়তায়, তখন বালক বেরিয়ে পড়ে বাইরের জগতে। সে গাছে ওঠে, নৌকো চালায়, রাস্তায় যায়, মারামারি করে; সে নিজের দেহকে মনে করে আধিপত্য হাতিয়ার। বালিকার শরীর যখন হয়ে ওঠে সুন্দর বোঝা, তখন বালকের শরীর হয়ে ওঠে তার বড়ো সম্পদ। সে তার শরীর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে পরিপার্শ্বকে। সে সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে অনুভব করে তার অস্তিত্ব। বালিকার বেলা ঘটে বিপরীত, সক্রিয়তা নিষিদ্ধ তার জীবনে। বালিকা তার সত্তা আর জীবনের লক্ষ্যের মধ্যে বোধ করে বিরোধিতা। বালিকাকে শেখানো হয় তার কাজ অন্যদের মনোরঞ্জন করা; সে নিজের সুখ চাইবে না, সুখ চাইবে অন্যের; অন্যের সুখই তার সুখ। তাকে শেখানো হয় যে সে নিজেকে পরিণত করবে নিম্প্রাণ বস্তুতে, সে ছেড়ে দেবে নিজের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার।

সে হয়ে ওঠে জীবন্ত পুতুল, বাতিল হয়ে যায় তার স্বাধীনতা। সে কোনো কিছু নিজে বোঝার চেষ্টা করবে না, তার হয়ে বুঝবে অন্যরা; সে নিজে কিছু জানতে চাইবে না, তার হয়ে জানবে অন্যরা; সে নিজে কিছু করবে না, তার হয়ে করবে অন্যরা। বালিকা এভাবে হারিয়ে ফেলে তার মানসিক শক্তি, ক’মে যায় তার ভেতরের সম্পদ। সে হয়ে ওঠে শূন্য পাত্র। এভাবে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পর সে আর নিজেকে প্রধান ক’রে তোলার সাহস করে না। যদি তাকে উৎসাহিত করা হতো, তবে সেও পারতো বালকের মতো সাহসী, উদ্যমপরায়ণ, নিভীক, স্বাধীন হয়ে উঠতে। যখন কোনো মেয়েকে ছেলের মতো পালন করা হয়, তখন তার মধ্যে দেখা যায় সাহস, উদ্যম, স্বাধীনতা। বালিকারা যখন পুরুষের লালনে বড়ো হয়, তখন তারা কাটিয়ে ওঠে নারীত্বের ত্রুটিগুলো; কিন্তু সমাজ বালিকাকে বালকরুপে লালনের অনুমতি দেয় না। কোনো মেয়ে চুল ছোটো করলেই সমাজ হাহাকার করে ওঠে। বাবার প্রভাবে বালিকা অনেকটা স্বাধীন হয়ে ওঠে, কিন্তু তার স্বাধীনতা হরণ করার মতো চারপাশে মা, খালা, ফুপুর অভাব নেই। কোনো বালিকাকে লালনের ভার নারীর হাতে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাকে বিকলাঙ্গ ক’রে তোলা। নারীরাই চিরকাল পালন করে আসছে বালিকাদের, এবং তৈরি করছে বিকলাঙ্গ মানুষ। বালিকার সবচেয়ে বড়ো শুভার্থী তার মা; তবে মা-ই হয়ে ওঠে বালিকার বড়ো শত্ৰু। মা হচ্ছে পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত প্ৰাণী, যে নিজের জীবন দিয়ে সেবা করে পুরুষতন্ত্রের। মা মেয়েকে নিজের থেকেও নারী ক’রে তুলতে চায়, আর ছেলের মধ্যে চায় চূড়ান্ত পৌরুষ। মা পিতৃতন্ত্রের আদর্শ নারী গড়ার পারিবারিক কুম্ভকার। সে মেয়েকে ভালোবেসে নিজের মতো করে তুলতে চেয়ে নিজের নিয়তি চাপিয়ে দেয় মেয়ের ওপর। মা নিয়তির মতো থাকে মেয়ের পাশে। মা ময়েকে ক’রে তুলতে চায় খাঁটি নারী, সতীসাধ্বী, কেননা সমাজ তার মেয়েকে এভাবে পেতেই পছন্দ করবে। মা তার জন্যে সংগ্রহ করে বান্ধবী, দেখে তার মেয়ের যাতে কোনো বন্ধু না জোটে: মা মেয়েকে শেখায় ধর্মকর্ম, শোনায় সতীসাধ্বীদের কাহিনী, শেখায় রান্নাবান্না, শেলাই। মা জানে রূপ খুব দরকার, তাই বালিকাকে শেখায় যে তাকে হয়ে উঠতে হবে সুন্দরী, অন্যের কাছে আকর্ষণীয়, নাম, লজ্জাবতী; মা তার কন্যার জীবনকে সফল ক’রে তোলার আপ্ৰাণ চেষ্টা ক’রে নষ্ট করে কন্যার সত্তা। বালকবালিকার পোশাকেও আছে সক্রিয়তা ও অক্রিয়তার ব্যাপার। বালকের পোশাক সক্রিয়তার, বালিকার পোশাক সম্পূর্ণ অক্রিয়তার। বালক তার পোশাক তাড়াতাড়ি পরতে আর খুলতে পারে, যে-কোনো অবস্থায়ই তার পোশাক তার সক্রিয়তাকে বাধা দেয় না। কিন্তু বালিকা তার পোশাক নিয়ে সারাক্ষণ থাকে বিব্রত। বালিকাকে পরতে হয় শাড়ির মতো বিব্রতকর পোশাক, যা তাকে ঘিরে রাখে, তাকে গ্ৰাস ক’রে রাখে। ওই শাড়ি পরে দৌড়োনো যায় না, গাছে ওঠা যায় না, সাঁতার দেয়া যায় না। শাড়ি পরে শুধু শুয়ে থাকা যায়। শাড়ির প্ৰতিবন্ধকতায় বালিকার পক্ষে সক্রিয় হওয়া অসম্ভব। তার পোশাকের অক্রিয়তার সাথে তাকে শেখানো হয় যে সোজা হয়ে হাঁটবে না, হাঁটবে মেরুদণ্ড বাঁকা ক’রে, সংকুচিত হয়ে। নিজেকে নিয়ে সব সময় থাকবে বিব্রত। এভাবে নষ্ট ক’রে দেয়া হয় তার স্বতস্ফুৰ্ততা। তাকে বানিয়ে তোলা হয় দাসী, পুতুল। আজকাল মধ্যবিত্তদের মধ্যে এটা কমছে, বালিকাকে দেয়া হচ্ছে সক্রিয়তার অনেক সুযোগ, তবে তা বালকের সুযোগের একাংশও নয়। লক্ষ্য হচ্ছে যেভাবেই হোক বালিকাকে নারী ক’রে তুলতে হবে।

বালিকার জগত ছোটো, মাকে দেখে দেখে তার মনে হয় মা পিতার থেকে শক্তিমান। তাই মা তার অনুকরণীয় আদর্শকাঠামো। সে মায়ের অনুকরণ করে, মায়ের মতো হয়ে উঠতে চায়, মা হয়ে উঠতে চায়। এক সময় পুতুল খেলার খুব চল ছিলো মেয়েদের মধ্যে, প্রতিটি মেয়েরই থাকতো একরাশ পুরোনো কাপড় দিয়ে তৈরি পুতুল। বালিকারা পুতুলকে মেয়েই মনে করতো নিজেদের, তাকে মেয়ের মতো সাজিয়ে বিয়েও দিতো। খুব মা মা ভাব দেখা যেতো ছোটো ছোটো বালিকাদের কথায়, কাজে, আচরণে; বাঙলা সাহিত্যে মায়ের আদলে গ’ড়ে ওঠা ছোটো ছোটো মায়েদের ছবি বেশ আবেগের সাথে আঁকা হয়েছে। এ-ছোটো মায়েরা সহজাত মা নয়, তারা আদর্শকাঠামো অনুকরণের দৃষ্টান্ত। কিন্তু আগে ছোটোদের আদর্শকাঠামো অনুকরণ দেখে মনে করা হত্যে বালিকাদের মধ্যে রয়েছে সহজাত মাতৃত্ব; একে মনে করা হতো কোনো রহস্যময় বিধানের ফল। বালিকাদের মাতৃত্ববোধ সমাজেরই শিক্ষার পরিণতি। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর, গবেষকেরা দেখিয়েছেন বালকবালিকাবা অনুকরণ করে তাদের মাবাবাদের, তিন বছর বয়স থেকেই ছোটোদের আচরণ হয়ে পড়ে বিশেষ লিঙ্গ অনুকরণমূলক, ‘সেক্স-টাইপড’। চাষী পরিবারে বালিকা উঠোনে বসে মাটির হাঁড়িপাতিলে রান্না করে মাটির কাল্পনিক ভাতমাছ, তারপর ধোয় হাঁড়িপাতিল, গুছিয়ে রাখে থালাবাসন; বালকটি একটু দূরে হয়তো অভিনয় করে তার পিতার মতো কাল্পনিক চাষবাসের। শহরে মধ্য- বা উচ্চ-বিত্ত পরিবারে ছোটো বালিকা তার মায়ের মতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিপস্টিক ঘষে, উঁচু গোড়ালির জুতো পরে হাতে ব্যাগ নিয়ে খটখট ক’রে হাঁটে, নিউমার্কেটে যাওয়ার অভিনয় করে; সে হয়ে ওঠে তার মায়ের মতো পরগাছার পরগাছা। আর বালকটি হয়তো বাবার মতো টেবিলে বসে অনবরত ফোন করার অভিনয় ক’রে চলে; সে হয়ে ওঠে পরগাছা। বালিকাদের সহজাত মাতৃত্বের বোধ এক পুরোনো উপকথা; তাদের দেহ নয়, সমাজই তাদের শিখিয়ে দেয় যে তারা মা হবে। তাই মায়ের পেশা তাদের শিখতে হয় শুরু থেকেই। বালিকা বুঝতে পারে শিশুপালনের ভার পড়ে মায়েরই ওপর। তাকে শিখিয়ে দেয়া হয় যে মা হওয়া এক দারুণ ব্যাপার, মা হওয়াই বালিকার জীবনের লক্ষ্য। নিজের মাকে বার বার বিয়োতে দেখে বালিকা বুঝে ফেলে একদিন সেও মা হবে, তার পেটেও জন্ম নেবে বাচ্চা, সেও বিয়োবে তার মায়ের মতো। বাচ্চা জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়া যখন সে বুঝতে পারে, তখন ঘেন্নায় ভয়ে শিউরে ওঠে বালিকা; কিন্তু কিছু করার নেই তার।

বালিকা দেখে নিজেকে আর তার বয়সের বালকদের, সব কিছু দেখে তার মনে জাগে ঈর্ষা। ঈর্ষা খারাপ আবেগ নয়, ঈৰ্ষা নিজের অবস্থান সম্পর্কে অসন্তোষের অনিবাৰ্য আবেগগত পরিণতি। সে দেখতে পায় সে ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত প্ৰাণী। নিজের ভাগ্যকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু এ-ভাগ্য নিয়ে থাকে অসুখী। সে যতোই বাড়তে থাকে, বুঝতে থাকে সমাজ আর জীবনের রীতিনীতি, ততোই সে ঈর্ষা করতে থাকে ছেলেদের কিন্তু ওই ঈর্ষাকেও সে চেপে রাখতে বাধ্য হয়। বালিকা দেখে ছেলেরা স্বাধীন, তাদের জীবন অনেক সুবিধাজনক; তাতে বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু তার জীবন বিধিনিষেধ দিয়ে ঘেরা। বালিকার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি তার দেহ, কিন্তু সে-দেহ নিয়েও সে থাকে বিব্রত। তারপর বোধ করে বিপন্ন। বালিকার দেহ বেড়ে ওঠে আবদ্ধ ফলের মতো। তার শরীব কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসতে পারে না, সেটি নিষিদ্ধ বস্তুর ঢাকা থাকে আবরণের পর আবরণে। তার দেহ সরাসরি সংস্পর্শে আসতে পারে না। জলের, বাতাসের, রৌদ্রের। ঘাস অনেক দিন ঢাকা থাকলে যেমন বিবৰ্ণ হয়ে ওঠে, বালিকার দেহও হয়ে ওঠে তেমনই। সে পানিতে নামে একরাশ পোশাক নিয়ে, প্রচণ্ড গরমেও সে গা থেকে একটু কাপড় সরাতে পারে না; তার দেহ জানে না বৃষ্টির সরাসরি ছোয়ার স্বাদ, তার শরীর জানে না রোদের সরাসরি ছোয়া কেমন। বালক নগ্ন শরীরে সাতার কাটে, বাতাসে নগ্ন শরীর মেলে দেয়; খেলার সময় বালকের শরীর আসে অন্য শরীরের সংস্পর্শে। বালিকার শরীরকে বাড়াতে হয় অন্যাঘাত পুজোর ফুলারূপে। তার ভেতরে জন্ম নেয় গুমোট, যা পুরুষের কাছে মনে হয় আকর্ষণীয়। প্রচণ্ড গরমের সময় এক কিশোরী আমাকে বলেছিলো, ‘তোর মতো যদি খালি গায়ে বসে থাকতে পারতাম!’ ওটা ছিলো তার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ সাধা! বালিকা তার দেহকে নগ্ন মেলে ধরতে চায় প্রকৃতির সামনে, পেতে চায় প্রকৃতির সমস্ত আদর; কিন্তু তার জীবনে তা নিষিদ্ধ।

বালিকা বয়সেই তার শরীরে ওপর অনেক সমাজ শুরু করে নৃশংস আক্রমণ। এমন এক আক্রমণ হচ্ছে নারী-খৎনা। মেয়েদের খৎনার বিভীষিকাজাগানো প্ৰথা আজো প্রচলিত আরব দেশগুলোতে, বিশেষ ক’রে মিশর, সুদান, ইয়েমেন, ও নানা উপসাগরীয় রাজ্যে; এবং সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জনিয়া, ঘানা, গিনি, ও নাইজেরিয়ায়। এসব দেশে কুমারীত্ব আর যোনিচ্ছদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যোনির এক টুকরো পাতলা পর্দার ওপর দাড়ানো সেখানে বংশের মানসম্মান। যাতে বংশের মানসম্মান বা বালিকার সতীত্ব ও সতীচ্ছদ অক্ষত থাকে, তার জন্যে খৎনা করানো হয় বালিকাদের। নারী সেখানে ফিৎনা, বিশৃঙ্খলা, যার কাজ বিপর্যয় ঘটানো; ওই বিপর্যয় থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্যে সেখানে কুরিয়ে ফেলে দেয়া হয় যোনির পাপপরায়ণ প্রত্যঙ্গগুলো। ওই বর্বর পিতৃতন্ত্র জানে যদি কেটে ফেলা হয় বালিকার ভগাঙ্কুর, বৃহ্দোষ্ঠ, ক্ষুদ্রষ্ঠ, তাহলে থাকবে না তার কাম ক্ষুধা। রক্ষা পাবে সতীত্ব, আর সমাজ। বালিকাদের খৎনা করানো হয় সাত-আট বছর বয়সে, ঋতুস্রাব দেখা দেয়ার আগে [দ্ৰ নওঅল (১৯৮০, ৩৩-৪৩), মাইলস (১৯৮৮, ৮৮-৮৯)]। সেখানে রয়েছে মেয়েদের খৎনা করানোর জন্যে হাজামী। দুজন নারী মেয়েটিকে শক্ত ক’রে চেপে ধরে, যেমন ধবা হয় কোরবানির পশু; দু-উরু জোরে টেনে ধ’রে তারা ফাক করে বালিকার যোনিঅঞ্চল, আর হাজামী ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে বালিকার ভগাঙ্কুর ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গ। খৎনার সময় তারা আবৃত্তি করতে থাকে, ‘আল্লা মহান, মুহম্মদ তার নবী : আল্লা আমাদের দূরে রাখুক সমস্ত পাপ থেকে।’ যে-ডুরিটি দিয়ে খৎনা করা হয়, সেটি সব সময় ধারালোও হয় না। ছুরিটি হতে পারে ধারালো পাথর, ব্লেড, বা কাচের টুকরো। খৎনায় প্রথমে কেটে ফেলা হয় বালিকার সম্পূর্ণ ভগাঙ্কুর, তারপর কাটা হয় ক্ষুদ্রোষ্ট, তারপর বৃহ্দোষ্ঠের ভেতর ভাগের মাংস। খৎনার পর শেলাই ক’রে দেয়া হয় যোনিরন্ত্র, একটু ফাক রাখা হয় ঋতুস্রাবের জন্যে, খোলা রাখা হয় মূত্ররন্ধ। খৎনার সময় বালিকার মা ও আত্মীয়ারা ক্ষতের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে খৎনা ঠিক মতো হয়েছে কিনা। খৎনার পর চল্লিশ দিনের জন্যে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয় বালিকার দু-উরু, যাতে যোনি ভালোভাবে জোড়া লাগে। হাজামীরা অশিক্ষিত নারী, তারা খৎনা করতে গিয়ে বিপন্ন ক’রে তোলে বালিকার জীবন। খৎনা সফল করার জন্যে তারা গভীরভাবে কাটে বালিকার ভগাঙ্কুর, যাতে দেহে কামের একটি কণাও অবশিষ্ট না থাকে।

খৎনার অব্যবহিত ফল প্রবল রক্তক্ষরণ, জীবাণুসংক্রমণ, মূত্ররন্ধ ফেড়ে যাওয়া, মূত্রথলে ও পায়ুদ্বার বিক্ষত হওয়া। যোনি অঞ্চল শেলাই ক’রে দেয়ার ফলে অনেক বালিকা পরে ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। খৎনার পর যদি বালিকা বেঁচে থাকে, সে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে; সারাজীবনের জন্যে তার কাম ক্ষুধা মিটে যায়। সুদানে মেয়েদের খৎনা চলে মেয়েদের সারজীবন ধ’রে, মেয়েদের যোনি সেখানে নিরন্তর কাটাছেড়া ও শেলাইয়ের বস্তু। সুদানে বালিকার খৎনায় গভীর ক’রে কেটে ফেলা হয় ভগাঙ্কুর, বৃহদোষ্ঠ, ক্ষুদ্রোষ্ঠ, বলা যায় কামিয়ে ফেলা হয় ওই আপত্তিকর জিনিশগুলো; তারপর মেষের অন্ত্র দিয়ে শেলাই ক’রে দেয়া হয় যোনিরন্ধ, একটু ফাক রাখা হয় যাতে চুইয়ে বেরোতে পারে ঋতুস্রাব, আর প্রস্রাবের জন্যে খোলা রাখা হয় মূত্ররন্ধটি। বিয়ের সময় যোনির শেলাই একটু কেটে ফাঁক করা হয় রন্ধটি, যাতে শিশ্ন ঢুকতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় শেলাই আরো কাটা হয় যোনি প্রসারিত করার জন্যে। প্রসবের পর আবার শেলাই ক’রে দেয়া হয় রন্ধ। নারী তালাক পেলে বা বিধবা হ’লে শেলাই ক’রে বন্ধ ক’রে দেয়া হয় যোনি, এবং আবার বিয়ে হ’লে আবার কেটে ফাক করা হয় রন্ধ। এভাবে চলতে থাকে নারীর রন্ধ কাটাকাটি জোড়াতালি। খৎনার ফলে সঙ্গম ও প্রসব হয়ে ওঠে বিপজ্জনক, আর মনে যে-ক্ষতটি জন্ম নেয় তা নারীর জীবনকে ঢেকে ফেলে দুঃস্বপ্নে। খৎনা হওয়া নারীর জন্যে বিবাহ ভয়ংকর। সোমালিয়ার একটি বাসর রাত এমন : স্বামী প্ৰথমে নতুন বউকে পিটোয় চাবুক দিয়ে, তারপর ছুরি দিয়ে যোনির শেলাই কেটে ‘খোলে তাকে। খোলার পর তিন দিন ধরে চালাতে থাকে অবিরাম সঙ্গম! কেনো স্বামীকে এতো পরিশ্রম করতে হয়? তার কারণ [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৮৯)] :

‘তাকে এ-‘শ্ৰম’ করতে হয় একটি ‘প্ৰবেশ পথ’ তৈরি করার জন্যে, যাতে ক্ষতটি আবার জোড়া লেগে না যায়।…বাসর রাতের ভোরে স্বামী তার ছুরিটি কাধে ঝুলিয়ে সারা এলাকা ঘুরে আসে, সবাই প্রশংসার চোখে তাকায় তার দিকে। সে-সময় বউটি বিছানায় শুয়ে থাকে, নড়াচড়া করে না, লক্ষ্য রাখে যাতে তার ক্ষতটি খোলা থাকে।‘

নওঅল (১৯৮০, ৭-১১) বর্ণনা করেছেন তার নিজের খৎনার বিভীষিকা, যাতে শোনা যায় নৃশংস পিতৃতন্ত্রের আক্রমণে সমস্ত আরব বালিকার চিৎকার। ছ-বছরের নওঅল রাতে আধো ঘুমে আধো জাগরণে শুয়ে ছিলো নিজের বিছানায়। হঠাৎ সে অনুভব করে তার চাদরের নিচে ঢুকছে একটি শক্ত রোমশ হাত। হাতটি তাকে ধরে শক্ত ক’রে: আরেকটি হাত চেপে ধরে তার মুখ। সে চিৎকার ক’রে উঠতে চায়, কিন্তু পারে না। তারা তাকে গোশলখানায় নিয়ে যায়। সে দেখতে পায় নি। তারা কজন ছিলো, বা তারা পুরুষ না নারী। তারা লোহার মতো শক্ত ক’রে ধরে তার হাত, বাহু, দু-উরু। সে একটুও নড়তে চড়তে পারে না। সে শুনতে পায় ছুরি শানানোর শব্দ, তার মনে পড়ে যায় ঈদের দিনে মেষ জবাইয়ের দৃশ্য। তার রক্ত হিম হয়ে আসে, হৃৎপিণ্ড থেমে যায়। সে বোধ করে তারা তার পেটের নিচে দু-উরুর মাঝে কী যেনো খুঁজছে। একটু পরে সে বুঝতে পারে তারা তার দু-উরু যতোটা সম্ভব ফাক ক’রে ধরেছে। তার মনে হয় এই একটি ধারালো ছুরি কেটে ফেলবে তার গলা, কিন্তু সে অনুভব করে যে ছুরিটি নেমে আসে তার দু-উরুর মাঝখানে, এবং সেখান থেকে কেটে ফেলে এক টুকরো মাংস ৷ তার মনে হয় তার শরীরে আগুন ধ’রে গেছে, সে চিৎকার ক’রে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ হয় না। সে দেখতে পায় রক্তে ডুবে গেছে তার নিতম্ব। কারা তার ভগাঙ্গুর কেটেছে সে জানে না, তবে সে যখন তার মাকে দেখতে পায় পাশেই, তখন তার দুঃখের সীমা থাকে না। সে দেখে তার মা হেসে কথা বলছে। ওই লোকগুলোর সাথে, যারা কিছুক্ষণ আগে জবাই করেছে তাকে। তারা তাকে তার ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়, এবং চেপে ধরে তার ছোটো বোনকে। বোনটি তার চেয়ে দু-বছরের ছোটো। সে না, না” ক’রে চিৎকার ক’রে ওঠে। সে দেখে ভয়ে তার বোনের মুখ নীল হয়ে গেছে, তার চোখে পড়ে বোনের চোখ, যাতে জমাট হয়ে আছে আতঙ্ক। তাদের দৃষ্টি বিনিময় হয়, যে-দৃষ্টিতে তারা বলতে চায় : ‘এখন আমরা জানি এটা কী। এখন আমরা জানি কোথায় আমাদের ট্র্যাজেডি। আমরা এক বিশেষ লিঙ্গের, স্ত্রীলিঙ্গের। পীড়ন ভোগ করাই আমাদের নিয়তি, আর আমাদের নিয়তি হচ্ছে যে ঠাণ্ডা নিমর্ম হাত ছিড়ে নেবে। আমাদের দেহেব একটি অংশ।‘ এ-নৃশংস অভিজ্ঞতার পর আর কোনো বালিকা কামের কথা ভাবতে পারে না; তার যোনিটি হয়ে ওঠে একটি স্পর্শকাতরতাহীন গর্ত, যাতে একদিন স্বামী খুঁজে পায় বহু স্বপিত বহু আকাঙ্খিত একটি পর্দা, কিন্তু সেটি কখনো কামসুখ বোধ করে না।

বালিকা যখন একটু বড়ো হয়, বড়ো হয় তার জগতটি; তখন সে চারপাশে দেখে পুরুষাধিপত্য। দেখে পৃথিবীটা পুরুষের। বালিকা এর বিরুদ্ধে যেতে পারে না, সে মেনে নেয় পুরুষাধিপত্য। বালকের শিশ্ন দেখতে পাওয়া নয়, পুরুষাধিপত্য দেখতে পাওয়াই তার জীবনের চরম সত্যেকে দেখতে পাওয়া। এটা তার নিজের সম্বন্ধে ধারণাই পাল্টে দেয়। সে এখন বুঝতে পাবে পিতাই বাড়ির প্রভু, সম্রাট, ঈশ্বর; মা তার মতোই তুচ্ছ। পরিবারে পিতাই সূর্য, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সব কিছু। সে দেখতে পায় পিতার ইচ্ছেই সব, মায়ের ইচ্ছে কিছু নয়। যখন সে আরো ছোটো ছিলো, সে মনে করেছিলো সে হবে মায়ের মতো শক্তিমান, এখন দেখতে পায় মায়ের শক্তি নেই। সে চারপাশে দেখতে পায় পুরুষের মহিমা, শুনতে পায় পুরুষের বন্দনা। তার স্থান সেখানে নেই। সে সব কিছুতেই দেখে তার শোকাবহ নিয়তি। সে শুনতে পায় সব মহাপুরুষ পুরুষ, মহাপুরুষদের তালিকায কোনো নারী নেই; যারা রাজ্য জয় করেছে, মানুষকে ধর্মের পথে এনেছে, যারা সভ্যতা সৃষ্টি করেছে, তারা সবাই পুরুষ। কিছু কিছু নারীর কথাও শোনে বালিকা, তবে ওই নারীরা আকর্ষণীয় শুধু মর্মস্পশী মর্ষকামের জন্যে। ওই নারীরা শুধু ত্যাগ করেছে, দুঃখ ভোগ করেছে, পরিত্যক্ত হয়েছে, তারা স্মরণীয় হয়ে আছে পুরুষের পায়ে আত্মবিসর্জনের জন্যে। ধর্ম তাকে শোনায় ভয়ঙ্কর কথা, শোনায় পুরুষের পাজার থেকে জন্মেছে নারী। সে কি একথা বিশ্বাস করবে নাকি করবে না? তার মা তাকে বিশ্বাস করতে বলে, বাবা তাকে বিশ্বাস করতে বলে, সবাই বিশ্বাস করতে বলে; সে কী ক’রে করবে। অবিশ্বাস? সে দেখে ধর্ম তারই জন্যে, তার ভাই ধর্মের কথা সব মেনে চলে না, সে-জন্যে তার ভাইকে চাপ দেয়া হয় না; কিন্তু দেখে তার ওপর খুব বেশি চেপে বসছে ধর্ম। সে শোনে পতির পায়ের তলে নারীর বেহেস্ত। সে শুনতে পায় নারীই সমস্ত নষ্টের মূলে, দিকে দিকে সে শুনতে পায় তার লিঙ্গের নিন্দা। সে নাটকে চলচ্চিত্রে পাঠ্যপুস্তকে উপন্যাসে দেখে পুরুষাধিপত্যের জয়। সে ধোঝে সে বালিকা, সে নারী হয়ে উঠবে; সে কিছু উপভোগ করবে না, কিন্তু ভোগ করবে যন্ত্রণ। সে বোঝে পুরুষভোগ্য পৃথিবী!

সেও পুরুষের ভোগ্য। সবাই তাকে শেখায় তাকে প্রস্তুত হ’তে হবে পুরুষের উপভোগের জন্যে। তার শরীর তার উপভোগের জনে! নয়, তার কাজ ওই শরীরকে আবেদনময়, পুরুষের উপভোগের জন্যে নিটোল ক’য়ে তোলা। তার কাজ কোনো পুরুষের মন জয় করা। সে কি পুরুষের মন জয় করবে তার বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে? না, পুরুষের মন জয় করতে হবে তাকে শরীর দিয়ে, তাকে হ’তে হবে রূপসী। সে হবে যৌনসামগ্ৰী। তাকে হ’তে হবে মর্ষকামী। সে হবে বিবি রহিমা, সে হবে সতী সীতা। সমাজ বালিকাকে শিক্ষা দেয় আত্মপ্রেমের, মর্ষকামিতার। বালিকা দেখতে শুরু করে দিবাস্বপ্ন, ওই স্বপ্নে ঘোড়া ছোটোয় রাজপুত্ররা। সে হয় আত্মপ্রেমবিভোর, ভরে ওঠে মেয়েলিপনায়; সে শেখে কটাক্ষ, শেখে শরীর বাকিয়ে দাঁড়াতে। অশু হয়ে ওঠে তার সম্পদ। বালকেরা মুগ্ধ হয় তার চোখের জলের গভীরতায়, তাই সে শেখে চোখ ছলছল করতে। বালিকাকে শেখানো হয় সে কিছু করতে পারবে না, করবে ছেলেরা; তাকে শেখানো হয় অক্রিয়তা অনেক বেশি সুখকর। তাই সে হয় অক্রিয়। অক্রিয় ভূমিকাকে সে প্রতিবাদ না ক’রে মেনে নেয়, কেননা সে মনে করে এই তার নিয়তি। বালকের জন্যে আছে। ভবিষ্যৎ, তার জন্যে নেই। বালক বড়ো হয়ে কর্মকর্তা হবে, বিমান চালাবে, সমুদ্রে যাবে, মাঠে যাবে, শহরে যাবে, পৃথিবী দেখবে, ধনী হবে; আর বালিকা হবে স্ত্রী, মা, পিতামহী, মাতামহী। সে তার মায়ের মতো সংসার দেখবে, সে সন্তান প্রসব আর পালন করবে তার মায়ের মতো। খুব বড়ো হয়ে ওঠে একটি কথা যে সে হবে মা।

বালিকা জেনে ফেলে সে হবে মা, তাই জন্মের রহস্য তার জন্যে হয়ে ওঠে এক বড়ো ব্যাপার। বালক যে-বয়সে জন্মের রহস্য সম্পর্কে ভাবেই না, সে-বয়সে বালিকার বড়ো ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে। জন্ম রহস্য আর কাম। বালকও ভাবে শরীরের কথা, তবে সে রহস্য উদঘাটনের জন্যে ভাবে না, ভাবে উপভোগের জন্যে। বালিকা উপভোগের জন্যে ভাবে না, ভাবে উদঘাটনের জন্যে, নিজের নিয়তিকে জানার জন্যে। বালক নারীদেহ সম্পর্কে খুবই উৎসাহী হয়, লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করে নারীদেহ নিয়মিত হস্তমৈথুনও করে, তবে সে এ-বয়সে স্বামী, পিতা হিশেবে কল্পনা করে না নিজেকে। কিন্তু বালিকা ভাবতে থাকে বিয়ের কথা, দেখতে থাকে নিজেকে স্ত্রী, মা-রূপে। বালিকা বুঝে ফেলে যে মায়ের পেটে সন্তান জন্ম নেয়, মা জন্ম দেয় সন্তান। সে বোঝে, গ্রামে হ’লে সে দেখতেও পায়, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার সন্তান জন্ম দেয়া; কেঁপে ওঠে তার অস্তিত্ব। কীভাবে মায়ের পেটে ঢোকে৷ শিশু, এটা বালকবালিকা উভয়ের চিন্তায়ই স্থান পায়। বালক জানে এ-দায়িত্ব তাকে বইতে হবে না, তাই সে মাথা ঘামায় না। এ নিয়ে; কিন্তু বালিকার চিন্তায় তা স্থির হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে একটু একটু আভাস পেতে থাকে কী ক’রে মায়ের পেটে আসে সন্তান। এক সময় সে মনে করতো বিয়ে হ’লেই সন্তান হয়; এখন সে বোঝে কিছু একটা করতে হয় বাবামাকে। কী করতে হয়? স্পষ্ট ক’রে কারো থেকে সংবাদ পায় না, তবু এক সময় সঙ্গমের সংবাদ সে পায়। প্রথমে বোঝে না, বোঝার পর বালিকা শিউরে ওঠে। বালকবালিকা যখন বুঝতে পারে সঙ্গম কী, তখন তারা প্রত্যেকে ঘেন্নায় চিৎকার ক’রে ওঠে : না, না, তাদের বাবামা অতো খারাপ নয়, তারা এ-কাজ করতে পারে না। কিন্তু বালিকা চিৎকার ক’রে সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না; তবে তার ভয় জাগে বিয়ে সম্পর্কে। বালিকা হয়তো দেখে ফেলে (কানো পুরুষের শিশ্ন, ভয়ে সে আরো কুঁকড়ে যায়। তার জগতে নেমে আসে বিভীষিকা। বালিকা এক সময় অনুভব করে বদল ঘটছে তার ভেতরে, তার শরীর হয়ে উঠছে নারীর শরীর। বারো তেরো বছরের সময় শুরু হয় তার কৈশোরসংকট: দেখা দিতে থাকে তার স্তন, আর সে বিপন্ন বোধ করতে থাকে নিজেকে নিয়ে। তার শরীর তার কাছে হয়ে ওঠে। লজ্জার বস্তু, যা নিয়ে সে থাকে বিব্রত। এক সময় হঠাৎ ময়লা রক্তে ভেসে যায়। তার উরু, আর বিছানা; আর ভীত রক্তাক্ত অপরাধবোধগ্রস্ত বালিকা এগিয়ে চলে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top