What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

মৌ কথা কও (1 Viewer)

একই বাড়ীতে ওরা থাকলেও বিয়ের যা কিছু নিয়ম আছে সব একেবারে ঠিকঠাক ভাবে করতে হবেই এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সামনের বৃহস্পতিবার ভালো দিন আছে, একই দিনে ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই আশীর্বাদ করা হবে ভবানীপুরের বাড়ীতে। অরিত্রর জন্য আসছেন মৌয়ের মামা আর মেয়েকে আশীর্বাদ করার জন্য তো লোকের অভাব নেই। তার আগে মৌকে সাথে নিয়ে গিয়ে তানিস্কের শোরুম থেকে একটা হীরের আংটি পছন্দ করে এসেছে অরিত্র। যথারীতি মৌ এত দামের আংটি নিতে রাজী হচ্ছিল না প্রথমে। পুবালী হেসে ফেলে বলেছে, তুই কি বোকা রে মৌ? আমি হলে তো বলতাম...আরো বেশী দামের কিছু থাকলে দেখাতে। মৌ দিদির কানে কানে বলেছে, কি হবে আমার এত দামের আংটি। পুবালী প্রথমে বুঝতে পারেনি ও কি বলতে চেয়েছে, তারপরেই বুঝতে পেরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছে... সে তো জানি, তোর সব থেকে দামী জিনিষটা কি। অরিত্র ওদিকে কাউন্টারে পেমেন্টের জন্য গেছে, মৌ পুবালীর কাছে সরে গিয়ে আস্তে করে বলল...মেজদি, আমাকেও তো তোমার ভাইকে কিছু দিতে হবে...কি দিই বলো না। তারপর দুজনে মিলে রুপসাকে ফোন করে ঠিক করেছে কি করবে কিন্তু সেটা কিছুতেই অরিত্র যেন না জানতে পারে এমন ভাবে করেছে ওরা। ফেরার সময়ে ওদের দুজনকে চুপি চুপি কথা বলতে দেখে অরিত্র একবার জিজ্ঞেস করেছে... কি ব্যাপার রে দিদিভাই...কি এত তোদের গোপন আলোচনা চলছে? পুবালী খুব গম্ভীর হওয়ার ভান করে ভাইকে বলেছে...মেয়েদের কত কথা থাকে...ও তুই বুঝবি না...

আশীর্বাদের দিন ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে একসাথে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। এক এক করে বড়দের সবাইয়ের আশীর্বাদ করা হয়ে গেলে অরিত্র মৌয়ের আঙ্গুলে হীরের আংটিটা পরিয়ে দিলে জেঠিমা মজা করে জেঠুকে বলল...দেখেছো, আমাদের দুষ্টু কত সুন্দর একটা আংটি দিয়েছে...তুমি তো আমাকে কি একটা দিয়েছিলে কে জানে। জেঠু হেসে ফেলে বলল...আমি তো আর ওর মতো এত মাইনে পেতাম না তখন যে তোমাকে হীরের আংটি দেবো। দাদু হেসে ফেলে বলল...শুধু হীরের আংটি দিলেই হবে না বাবা, আমি লিস্ট বানিয়ে রেখেছি আরো কি কি করতে হবে।

সব কিছু মিটে গেলে দাদু মৌকে পাশে বসিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল...নে পড়ে শোনা তো দেখি বুদ্ধুটাকে কি কি করতে হবে বিয়ে করতে গেলে। মৌ কাগজটা দেখেই মুখ কাঁচুমাচু করে বলল...আমি কেন দাদু...
- আরে আমি কেন মানে? তুই এখন আমার নাতনী...আর ও ব্যাটা এখন এই বাড়ীর ছেলে, আমার কেউ নয় কিছুক্ষনের জন্য। সব কটা নিয়ম মেনে যদি চলবে কথা দেয় তবেই বিয়ে হবে আর যদি বলে মানবো না তো আমি তোর অন্য জায়গায় বিয়ে দেব...তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমার হাতে অনেক ভালো ভালো ছেলে আছে...বুঝলি...

দাদুর কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা। মোটামুটি সবাই দাদুকে একটু গম্ভীর দেখেছে এতদিন কিন্তু সেই মানুষটা যে এত মজা করতে পারে কারুরই প্রায় জানা ছিল না। জেঠু হাসতে হাসতে বলল...এই দুষ্টু, ভয় করিস না, আমি তোর পাশে আছি। বুক চাপড়ে বলে দে...হ্যাঁ বলো কি কি নিয়ম আছে...

মৌ কিছুতেই পড়বে না কি লেখা আছে, শেষে দাদু নিজেই পড়তে শুরু করল...

১) এখন থেকে গাড়ী নিয়ে অফিস যাওয়া আসা করতে হবে। নিজে ড্রাইভ করাতে আপত্তি থাকলে ড্রাইভার রাখতে হবে।
২) দেরী করে অফিস থেকে ফেরা যাবে না। দরকার হলে বাড়ীতে বসে কাজ করতে হবে। অনেক অফিসেই এখন এই নিয়ম চালু হয়ে গেছে, এতএব এই ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা হবে না।
৩) শনিবার কোনো অবস্থাতেই অফিস আছে বলা যাবে না। এক্ষেত্রেও পয়েন্ট নাম্বার ২ প্রযোজ্য হতে পারে যদি মৌ অনুমতি দেয়।
৪) মাসে অন্তত একবার সস্ত্রীক ভবানীপুরের বাড়ীতে এসে দুদিন থাকতেই হবে। জেঠুরা চাইলে দিনের সংখা বাড়তে পারে। শুধু ভবানীপুর এলেই হবে না, ওদিকে বড় জেঠুদের কথাও খেয়াল রেখে বছরে অন্তত একবার যেতে হবে। এছাড়াও বাকি আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে সময় সুযোগ করে যাওয়া আসার ব্যাপারটা থাছে।
৫) বছরে দুটো বড় বা একটা বড় ও একটা ছোট বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম রাখতেই হবে এবং সেটা আমাদের সাথে অবশ্যই নয়। আমাদের সাথে যেতে চাইলে এর বাইরে যাওয়া যেতে পারে।
৬) আগামী অন্তত চার বছর একেবারে ঝাড়া হাত পা থাকতেই হবে। মৌ সংসার করার সব কিছু শিখে গেলে তবেই বাচ্চাকাচ্চা নেবার ব্যাপারে ভাবতে হবে।
৭) এখন থেকে দেশের বাইরে কোথাও গিয়ে থাকতে গেলে একা একা যাওয়া চলবে না।
সব কটা নিয়ম পড়া হয়ে গেলে দাদু মুখ তুলে সবার মুখে হাসি দেখে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল...বল, কি করবি...
অরিত্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। একটু সময় চুপ করে থেকে হাসি মুখে বলল...ধরো আমি এখন হ্যাঁ বলে দিলাম আর পরে মানলাম না...তাহলে কি হবে...
দাদু এবারে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি রে...কি হবে? মৌ মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল...আমি কি জানি...তোমার নাতি, তুমি বুঝবে...

দাদু হাসতে হাসতে বলল...সে কি রে...আমি তো তোর জন্যই এত কিছু ভাবছি আর তুই আমার কোর্টেই বল ফেলে দিলি...যাকগে, শোন...এগুলো আমি মোটেও মজা করার জন্য ভাবিনি...চাইলে সবকটা নিয়মই মেনে চলা যায় বুঝলি...
 
এতদিন পর হঠাৎ বোন এসেছে খবর পেয়ে কোনো রকমে রাতটা কাটিয়ে এগারোটা নাগাদ সুমনা ওর ছেলে পাপাইকে নিয়ে আসানসোল থেকে এসেছে, ওর বর আসতে পারেনি অফিসের জরুরী কাজের জন্য। আরো একটু আগে পৌছোতে পারতো কিন্তু রাস্তায় বাসটা খারাপ হয়ে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। মামনের কাছে ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে মৌকে জড়িয়ে ধরে দুবোনের এক প্রস্থ হাসি কান্নার পর দুজনে বসে গল্প করছিল। মৌ এর যখন চার বছর বয়স…ওর মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর বাবার সাথে মামা বাড়ী এসে দু বোনের শেষ দেখা হয়েছিল। এখন কিছু কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই সব দিনের কথা একে অপরকে মনে পড়িয়ে দিতে দিতে কখোনো চোখে জল… কখোনো হাসি। গল্প করতে করতে সুমনা উঠে গিয়ে আলমারী খুলে একটা পুতুল বের করে ওকে দেখিয়ে বলল ‘চিনতে পারছিস মৌ’? পুতুলটা দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল…ওর খুব প্রিয় পুতুলটা ফিরে যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, বাড়ী ফিরে কত মনে পড়তো কিন্তু কোনো উপায় ছিল না ফেরত পাবার…বাবা এত ব্যাস্ত যে একটা তুচ্ছ পুতুলের জন্য আর এত দুরে আসতে পারতো না। তারপর সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে গিয়েছিল। পুতুলটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘দিদি…তুই এত যত্ন করে রেখেছিস? একেবারে নতুনের মতো আছে এখোনো। সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘তোর এত সুন্দর পুতুল আছে কিন্তু আমার নেই ভেবে খুব হিংসা হোত…বুঝলি…তুই চলে যাবার আগে ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছিলাম এই ভেবে যে যদি তুই ভুলে যাস…কি খুশী হয়েছিলাম জানিস…তুই যখন চলে গেলি ওটা না নিয়ে… রোজ মাকে লুকিয়ে এক বার করে দেখতাম, তারপর একদিন মা দেখতে পেয়ে কি মার মেরেছিল… কেন আমি মনে করিয়ে দিই নি তোকে… তারপর যখন আর তুই এলি না… পুতুলটা দেখে খুব কষ্ট হোত। মৌ পুতুলটা হাতে নিয়ে এক মনে দেখতে দেখতে বলল ‘মা কিনে দিয়েছিল…খুব ভালো করেছিলি রেখে দিয়ে… একটা পুতুল হলেও কি হয়েছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে তো থেকে গেছে’।

- এই মৌ...নিয়ে যাস কিন্তু এবারে…
- না রে... থাক, তোর কাছে রেখে দে… কত যত্ন করে রেখেছিস এত বছর…
ওদের কথার মাঝে মামন পাপাইকে নিয়ে এসে বলল ‘দেখ না দিদি…কি কাঁদছে…দাদুর কাছেও থাকছে না…ক্ষিধে পেয়েছে বোধ হয়’।
- না…না…এই তো আসার সময় একটা গোটা ক্যাডবেরী খেতে খেতে এল…এখন ওনার খেলা চাই…এই সময়টা আমাদের পাশের বাড়ীর বাপ্পা স্কুল থেকে ফিরে এসে ওর সাথে হুটোপুটি করে।
মৌ পাপাইকে কোলে নিয়ে আদর করে থামাবার চেষ্টা করেও না পেরে মামনকে বলল ‘এক কাজ কর না মামন…ওর কাছে নিয়ে যা…ঠিক চুপ করিয়ে দেবে। সুমনা হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল ‘তাই নাকি…খুব বাচ্চা ভালোবাসে’?
- হবে হয়তো…বাচ্চা আর কুকুর…ওর কাছে যেন অপরিচিত নয়…একবার দেখলেই যেন বন্ধু হয়ে যায়…জানিস তো কাল এসেই লালুর সাথে জমিয়ে নিয়েছে।

মামন চলে যাবার পর সুমনা চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ‘এই…মৌ…এই ও-টা কে রে? কেমন যেন একটু অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। মৌ হাসি হাসি মুখে বলল ‘কেউ একটা হবে হয়তো’।
- যাই বল…দারুন জুটিয়েছিস কিন্তু…যেমন দেখতে…তেমনি চেহারা…
- হুমম…লোভ হচ্ছে নাকি রে দিদি?
- তা…যদি তোর ভাগ দিতে অসুবিধা না থাকে…আমার নিতে কি ক্ষতি আছে… বলে হেসে ফেলল সুমনা।
- আ-চ্ছা…খুব শখ…তাই না… পুতুল নিয়েছিস… কিচ্ছু বলিনি…এটায় কিন্তু ভাগ বসাতে দিচ্ছিনা…তবে…পুরোনো হয়ে গেলে না হয়…ভেবে দেখতে পারি…
- না বাবা…থাক…তোর জিনিষ তোর কাছে…আমার যা আছে সেটাই ভালো…
- এই দিদি…তোরটা কেমন রে?
- ভালোই…তবে…তোরটার মতো এত হ্যান্ডসাম নয়…
দুবোনে গল্প করতে করতে খুব হাসছিল, মামন ফিরে এসে বলল ‘দিদি… ঠিকই বলেছিলে গো…সত্যিই চুপ করিয়ে দিয়েছে…দেখবে চলো কেমন সুন্দর খেলছে’।

দুপুরে সবাই এক সাথে খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। সবাই বলতে দাদু, মামা আর ওদের চার ভাই বোনের সাথে অরিত্র। মাসী আর মামীমা পরিবেশনে ব্যাস্ত। পাপাইকে নিয়ে গিয়ে দিদা ঘুম পাড়াচ্ছে। মামীমা আরো একটু ভাত দিতে গেলে অরিত্র প্রায় থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল ‘মামীমা…সত্যি বলছি আর পারবো না। তারপরেও মামীমা জোর করতে গেলে মামা হেসে ফেলে বারন করে বললেন ‘আরে…ছেড়ে দাও…দেখছো না কেমন থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না বলছে। মামীমা হেসে ফেলে বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে… অরিত্র…কিছু মনে কোরোনা…তোমরা কি এদেশীয় নাকি ওপার বাংলার? অরিত্র একটু মজা করে বলল ‘খাঁটি নয় মামীমা…ভেজাল আছে। ওর কথা বলার ধরন দেখে সবাই হেসে ফেললে বলল… ‘আমার দাদু এদেশীয়…দিদান ওপার বাংলা…তবে দিদান কোনোদিন যায়নি…এখানেই জন্ম আর বাবার আদি বাড়ী হুগলী…তো…আমি ভেজাল ছাড়া আর কি। দাদু হাসতে হাসতে বললেন ‘তাহলে ওপার বাংলার ভাগটা খুবই কম…বেশির ভাগটাই এদিকের…তাই তো’? অরিত্রও হাসতে হাসতে বলল ‘আমারও তাই মনে হয়’।
- তা তোমাদের বাড়ীতে রান্না বান্না কি ধরনের হয়…এদিকের নাকি ওদিকের?
- বোঝা খুব মুশকিল…ইলিশ আর চিংড়ি দুটোই হয়…তবে মনে হয় এদিকের ভাগটাই বেশী…দিদানের বাবার ট্রান্সফারের চাকরী ছিল… দু তিন বছর অন্তর জায়গা পালটাতে হোতো বলে দিদানের মায়ের অসুবিধার জন্য নাকি রাঁধুনি ছিল…মেদিনীপুরের লোক…
সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘মা…এখন তোমার ঘটি না বাঙ্গাল জেনে কি হবে…পছন্দ না হলে কি পালটানো যাবে নাকি… আমার বেলায় না হয় আগে থেকে ঘটি না হলে বিয়েই দেবে না জ়েদ ধরে বসেছিলে…মৌ এর বেলা তো আর তা হবে না’।
- ওমা…তাই বলে কি জানতে ইচ্ছে হবে না? অরিত্র্, তুমি কিছু মনে করনি তো?

- না না… মনে করার কি আছে…
 
মৌ চলে যাবার পর অরিত্র ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল…তুমি কোন ক্লাসে পড়?

- সেভেনে…
- স্কুল কোথায়?
- ওই তো…আসার সময় যেখানটা তোমরা দাঁড়িয়েছিলে…বড় একটা খেলার মাঠ আছে…
- এই দেখো…আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম…তুমি জানলে কি করে?
- বা রে…ক্লাসের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় তো। আমাদের এখানে তো এত সুন্দর গাড়ী আসে না…তাই সবাই মিলে দেখছিলাম…
- তাই…তোমার গাড়ী ভালো লাগে?
- খুউব…আচ্ছা…অনেক দাম…তাই না?
- না না…খুব বেশি না…
অর্ক খুব অবাক গিয়ে বলল…বেশী না? এত সুন্দর দেখতে…
- বড় হও…তখন না হয় দাম নিয়ে ভাববে…
- আচ্ছা…দিদি তো বললো না তোমাকে কি বলে ডাকবো…
- হুমম…দুষ্টু দাদা বলে ডাকতে পারো…
অর্ক কেমন যেন অবাক হয়ে বলল…ধ্যাত…দুষ্টু আবার কারুর নাম হয় নাকি?
- হয়…সত্যিই আমার নাম দুষ্টু…
- তোমাকে কিন্তু একটুও দুষ্টু বলে মনে হচ্ছে না…
ওর কথা শুনে অরিত্র হাসি মুখে বলল…তাই? কি মনে হচ্ছে?
- বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। কেমন সুন্দর গল্প করছো আমার সাথে…রাজুদা তো পাত্তাই দেয় না…
- তাই? রাজুদা কে?
- বড়দির বর…বাইকে হাত দিলেই কেমন যেন করে…আমি যেন ভেঙ্গে ফেলবো…
- হুমম…বাইকটাকে খুব ভালোবাসে তো…তাই…
- তুমি গাড়ীটাকে ভালোবাসো না?
- খুব…
- আমাকে এক বার গাড়ী চড়াবে?
- কেন চড়াবো না? চলো…তোমার স্কুলের সামনে থেকে ঘুরে আসি…
- না না…এখন না, দাদু বকবে…তোমাকে নিয়ে বাড়ীতে যেতে বলেছে একটু পরে, বেড়াতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। কাল সকালে যাবো…থাকবে তো?
- হুম…থাকবো…

অর্ক আনন্দে প্রায় নেচে উঠে বলল…খুব মজা হবে। ওদের কথার মাঝখানে কুকুরটা একবার ডেকে উঠলে অরিত্র জিজ্ঞেস করল… ওর কোনো নাম আছে? অর্ক খুব গর্বের সাথে বলল…হ্যাঁ…লালু…জানো তো…ও একদিন স্কুলের সামনে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল…খুব ছোটো…স্কুলের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছিলাম। মা তো কিছুতেই রাখতে দেবে না…এত ছোটো…ওর মা নাকি কাঁদবে…কান্নাকাটি করে দাদুকে দিয়ে বলাতে তবে রাজী হয়েছিল।
 
‘আর একটু বোসো না’ কথাটার ভেতরে ঠিক কি ছিল তা একমাত্র যাকে বলা হয়েছে সেই বুঝল, না...আর কোনো কথা হয়নি ওদের, কেউ কারুর দিকে তাকায়নি, কেউ কাউকে ছোঁয়নি...তবুও যেন অনেক কিছু বলা...অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেল। নীরবে বসে থাকার ভেতরেও যে কত কথা বলা যায় তা ওরাই বোঝে। আরো কিছুক্ষন থাকার পর মৌ ফিরে গেছে… ঠিক তার আগের মুহুর্তে চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল, কে আগে তাকিয়েছে জানা না থাকলেও দুজনেই যে কিছু বলতে চেয়েছে বা জানতে চেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না...

কেমন একটা অদ্ভুত ঘোরের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল অরিত্র...কিছুই ভাবছে না তবুও যেন অনেক কিছু ভাবছে। একটা ছোট্ট কথাও যে এভাবে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তা নিজের জীবনে না ঘটলে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারতো না। মনের বোঝা হালকা হয়ে গেলে হয়তো এমনটাই হয়, শরীর নামে যে কিছু একটা আছে অনুভব করতে পারছে না, নিজেকে মনে হচ্ছে আকাশে ভেসে যাওয়া ভারবিহীন এক টুকরো মেঘের মতো... এই মুহুর্তে নিঃসঙ্গ কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা যন্ত্রনাদায়ক নয় মোটেও…

একা থাকাও যে কতোটা সুখের হতে পারে তা নিজেকে দিয়ে অনুভব করতে করতে মনে হল ফোনটা মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। এই মুহুর্তে ফোন ধরার ইচ্ছে না থাকলেও ছোড়দি ফোন করেছে দেখে ধরতে হল। পুবালীর উদ্বিগ্ন গলায় ‘ভাই কি হয়েছে… ফোন ধরছিস না কেন’ শুনে আস্তে করে বলল…না রে, কিছু না, রুপসাকে একবার লাইনে নিবি দিদিভাই? ওকে দেখতে না পেলেও ভাই এর গলায় এমন কিছু ছিল যাতে পুবালীর বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হল না যে কিছু একটা ভালো খবর থাকলেও থাকতে পারে। ওদিকে পুবালী ওকে হোল্ড করে রুপসাকে ফোনে ধরার চেস্টা করতে করতে নিজেকে কথা বলার মতো অবস্থায় নিয়ে এসে অপেক্ষা করছিল ও। বোনেদেরকে একটু একটু করে সব কিছু জানিয়ে ওরা কি ভাবছে জানতে চেয়েছে। পুবালী কি বলবে বুঝতে পারছিল না, ফোনটা কানে চেপে ধরে নিজেকে সামলাবার চেস্টা করছে ওদিকে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই রুপসা একটুও সময় নেয় নি, ও খুশীতে ফেটে পড়ে বলেছে…দাদাভাই, আমি ভাবতেই পারছি না রে। তুই কি রে…কেন বলে দিলি না যে তোর আর কিছু ভাবার নেই? ওর যদি আবার অন্য কিছু মনে হয় তখন কি করবি? অরিত্র ওকে আস্তে করে বলেছে, না রে, আর কোনো ভয় নেই। দুবোনেই চেয়েছিল সেই রাতেই ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু অরিত্র ওদেরকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেছে এই বলে যে মৌ যদি ভাবে ওকে চাপ দেওয়া হচ্ছে…ওর কথা শোনা হচ্ছে না…ওর কথার ভেতরে যুক্তি থাকায় বোনেরা তখনকার মতো মেনে নিলেও বার বার করে ওকে বলেছে…ও যেন আর দেরী না করে আর কাল সকালেই ওরা মৌ এর সাথে কথা বলবেই…

অনেকদিন পর আজ ভালো ঘুম হয়েছে, ভোর রাতে কি একটা সুখের স্বপ্নও দেখেছে কিন্তু ঘুম থেকে উঠে কিছু মনে করতে পারছে না। ঘুম চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে মনে হল দুটো বুলবুলি পাখি মাঝে মাঝে জানলায় এসে বসছে, দু একবার করুন ভাবে ডেকে আবার ফিরে যাচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য। কি মনে করে একবার দেখি তো ভেবে উঠে গিয়ে একটু আড়াল থেকে দেখল কাল ঝড়ে ওদের বাসাটা ভেঙ্গে পড়ে গেছে। দুজনে মিলে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাখি দুটো অচেনা নয়, বাগানের বকুল গাছটায় কিছুদিন ধরে দেখছিল দুজনে মিলে বাসা বানাচ্ছে...মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারুর ভাঙ্গে আর কারুর গড়ে ভাবতে ভাবতে মনে হল বাসাটা যদি ও তুলে দেয় তাহলে কি ওরা সেটাতে থাকতে চাইবে? মানুষের ছোঁয়া নাকি অনেক প্রানী পছন্দ করে না। ঠিক আছে, তুলে তো দি... দেখি না ওরা কি করে ভেবে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করেছে দেখার জন্য ওরা কি করে এর পর। একটু পরেই দুটোতে কোথায় যেন চলে গেল দেখে নিচে গিয়ে পাঁচিলে উঠে বাসাটা গাছে তুলে দিয়ে ফিরে আসছিল। কি মনে করে উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ আটকে গেল। সেই মিষ্টি মুখটা এক পলকের জন্য দেখা দিয়ে হারিয়ে গেছে। মৌ যে ওকে দেখছিল বুঝতে পেরে বুকের ভেতরে ছোট্ট একটা আলোড়নের সাথে সাথে ভালো লাগায় বুক ভরে উঠলে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াল...

তারপর আরো একটা সপ্তাহ চলে গেছে…যেহেতু ও কথা দিয়েছিল তাই অনেক ভেবে দেখেছে কিন্তু কোনোভাবেই ওকে ছাড়া নিজেকে কিছুতেই ভাবতে পারছে না। সেদিনের পর থেকে মৌ আর ওর কাছাকাছি আসেনি…কিন্তু দুর থেকে ওর মিষ্টি মুখে এক চিলতে হাসি…কখোনো আড় চোখে ভ্রু তুলে তাকানো হয়তো বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে যে ওর কোনো ভয় নেই…ও বুঝে গেছে অরিত্রর মনের কথা…একটু একটু করে সেই আগের মতো ওর ভেতরে খুশী খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে… যেটা কিনা ওর স্মৃতি ফিরে আসার পর থেকে ছিল না। আজ রবিবার…মৌ সেই আগের মতো ওর জন্য চা করে নিয়ে এসে ঘুম ভাঙ্গালো… চোখে মুখে খুব প্রিয়জনকে একান্তে পাওয়ার ছাপ… অরিত্র একটু দুরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোমার কিছু জানার ছিল আমার থেকে। মৌ সারা মুখে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলল… আমার মনে হয় জানি।
- কি জানো?
- আমি তো জানি… তুমি ব’লো।
এত সকালে দিদানরা উপরে আসে না … অরিত্র বিছানা থেকে নেমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে’? মৌ চায়ের কাপটা পাশের ট্রেতে রেখে বলল ‘কিসের জন্য’?
- তোমার জন্য…
- আমি তো তোমার কাছেই আছি…
- এইভাবে নয়…একেবারে নিজের করে…
- আমি কি জানি?
- কে জানবে?
- বারে…তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে…যা কিছু করার তো তোমাদেরকেই করতে হবে…তাই না…
আর কিছু বলার ছিল না…মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল, জিজ্ঞেস করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে বলে ফেললো…মৌ…একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- বলো…
- নাঃ…থাক…পরে কোনোদিন বলবো…
- বলো না…আমি কিছু মনে করবো না…
অরিত্র কিন্তু কিন্তু করেও বলে ফেলল… কেউ কি তোমাকে রাজী করিয়েছে…মৌ ওর প্রশ্নটা শুনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল… কে আবার… তুমি। অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল… আমি তো এমন কিছু করিনি যাতে তোমাকে বোঝানো যায়…
- উমম… বিশ্বাস করতে পারছো না… তাই তো?
অরিত্র ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে আগের মতো হাসি মুখে বলল…থাক না…কিছু কথা না বলা…কিছু কথা না জানা…
- পরে বলবে?
- উমম…বলবো…

দুজনে মিলে কথা বলতে অরিত্রর হটাৎ মনে পড়ে গেল পাখি দুটোর কথা। ইস, একেবারে ভুলে গেছি ভেবে বলল... এই যাঃ। মৌ একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে?
- সেদিন দেখলে না...পাখীর বাসাটা তুলে দিয়ে এলাম...
- হুঁ দেখেছি...
- ওরা ফিরেছে কিনা আর দেখা হয়নি...
- ফিরেছে...আমি রোজ দেখি...
অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে একটু যেন অবাক হয়ে বলল... রোজ দেখো?
- হু...রোজ দেখি তো...তুমি ওদের কথা ভেবে বাসাটা তুলে দিয়ে এলে আর আমি দেখবো না?

অরিত্র ওর চোখে যেন কিছু খোঁজার চেস্টা করে বলল... চলো না, একবার দেখি। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পাখী দুটোকে দেখা যাচ্ছিল না, খাওয়ারের খোঁজে বেরিয়েছে হয়তো। অরিত্র গাছটার দিকে তাকিয়ে যেন নিজের মনেই বলল... প্রচুর ফুল হয় গাছটাতে... কি সুন্দর গন্ধে ভরে যায় চারদিক...জানো তো... মৌ আস্তে করে বলল... জানি... তুমি ছোটবেলায় দিদানের বাপের বাড়ী থেকে বায়না করে নিয়ে এসে লাগিয়েছিলে। কিছুটা বিরতি, কেউ কোনো কথা বলছে না, একজন হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করছে, আর একজন নিজের কল্পনায় গল্পের ভেতরে শোনা কথা গুলোকে সাজানোর চেস্টা করছে। একটু পরেই মেয়ে পাখিটা কোত্থেকে উড়ে এসে জানলায় বসতে গিয়ে ওদেরকে দেখে ফিরে গিয়ে গাছের ডালে বসে ঘাড় কাত করে এদিক ওদিক দেখছে...একটু পরেই ওর সঙ্গী ফিরে এসে পাশে বসলে মেয়েটি ঘাড় কাত করে তাকালো। দুজন দুজনের গায়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভালোবাসা জানাচ্ছে। দুজনে এক দৃষ্টে পাখী দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওদের মনের ভেতরেও হয়তো ইচ্ছে করছিল আরো কাছাকাছি আসতে কিন্তু এতদিনের ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কটা এই সবে জুড়তে শুরু করেছে, কেউই পারলো না নিজের থেকে এগোতে। মৌ আস্তে করে বলল... জানো তো...ওরা মনে হয় জানে তুমি ওদের বাসাটা তুলে দিয়েছিলে। অরিত্র ওর মতোই মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল... কি করে বুঝলে? রোজ এই জানলায় এসে বসে থাকে...বোধ হয় তোমাকে খোঁজে, কিছু বলতে চায়। মৌ এর কথাটা শুনে ওর দিকে তাকালো, কিছু যেন ও বলতে চাইছে ভেবে জিজ্ঞেস করল...কিছু বলবে? মুখটা নিচু করে ও আস্তে করে বলল... আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি... তাই না? প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ বা না কোনোটাই দেওয়া যায় না, অরিত্র একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...থাক না... পুরোনো কথা। মৌ অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে আর কখোনো কষ্ট দেবো না...বিশ্বাস কর। এতক্ষনের জড়তা যেন এই একটা কথাতে কেটে গেল... অরিত্র আর কিছু না ভেবে ওকে কাছে টেনে নিলে মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল... অরিত্র মুখে কিছু না বললেও ও ভালো করেই জানে উত্তরটা কি। মৌ নিজেকে ওর বুকে নিশ্চিন্তে মিশিয়ে দিতে দিতে ভাবছিল... ওই পাখী দুটোর মতোই আমিও তোমার কাছে ফিরে পেয়েছি আমার আশ্রয়...আমার যে আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার কাছে...
 
অরিত্র ঠিকই ভেবেছিল, কয়েকদিন ধরে মৌ-এর আচার ব্যাবহারে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা দাদুদের চোখ এড়ায়নি স্বাভাবিক ভাবেই। অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও ওর মুখেও যে সেই যন্ত্রনার ছাপ নেই সেটাও না বোঝার কথা নয়। ওদের দুজনকে একসাথে আসতে দেখে দাদু একটু গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল…কি ব্যাপার… আবার কিছু সমস্যা? অরিত্র দাদু আর দিদানের মাঝে বসে পড়ে বলল… না...না …সমস্যা আবার কি হবে…

- তাহলে?
- না … মানে…তোমাদেরকে কিছু বলার ছিল…
- বুঝেছি…

অরিত্র একবার দাদু আর একবার দিদানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল কি বুঝেছে। দিদান ওকে ওইভাবে তাকাতে দেখে কাছে টেনে নিয়ে বলল...তোকে সেই কোন ছোটোবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি আর তোকে দেখে বুঝবো না রে বোকা? অরিত্র দিদানকে জড়িয়ে ধরে থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থেকে ভাবছিল ‘বাঁচলাম, নিজের মুখে এসব কথা বলা যে কতটা ঝামেলার তা যেন হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি। দিদান ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দাদু কিছু বলতে চাইছে দেখে থেমে গিয়ে বলল...আচ্ছা, তুমি আগে বলে নাও। দাদু এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে দেখতে না পেয়ে বলল...আগে আমার ওই মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে…এই মেয়ে কোথায় গেলি আবার… সামনে আয়। মৌ সোফার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুক্লাদি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলে মুখ কাঁচুমাচু করে মিনমিন করে বলল…আমি আবার কি করলাম দাদু? দাদু আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল… আমি আবার কি করলাম? পরের জিনিষ না বলে নেওয়াকে কি বলে শুনি? মৌ শুক্লাদির গা ঘেঁষে বসে থেকে আস্তে করে বলল…আমি কেন চুরি করতে যাবো দাদু… আমি তো শুধু তোমাদেরকে কে দেখাশোনা করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম…
- হুম… বুঝেছি…তুই জিজ্ঞেস করলি কে আমাদেরকে দেখাশোনা করবে আর তার উত্তরে বুদ্ধুটা তোর চুলে ফুল গুঁজে দিল…বাঃ…

মৌ দাদুর কথা শুনে লজ্জায় জিব কেটে কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চাইলো...দেখলে তো কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে গেল। একবার তো মনে করিয়ে দিতে পারতে... অরিত্রর ওর চোখে চোখ রেখে যেন বোঝাতে চাইলো...খেয়াল না থাকলে কি করবো আমি। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে দাদু হেসে ফেলে বলল...থাক আর লজ্জা পেতে হবে না, বেশ তো লাগছে দেখতে। দাদু তারপরেই দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল...কি গো বলোনা...কি মিষ্টি লাগছে না আমাদের মেয়েটাকে? ঠিক তোমাকে যেমন দেখতে লাগতো...মনে আছে? এবারে দিদানের লজ্জা পাওয়ার পালা, দাদুকে বকুনি দিয়ে বলল...বুড়ো হয়ে গেলে তবু ছেলেমানুষী গেল না। দাদু হাসতে হাসতে বলল...নাতির কাছে আবার লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তারপরেই মুখটা আগের মতো গম্ভীর করে বলল... এই শোন, তোরা দুটোতে মিলে খুব জ্বালিয়েছিস আমাদেরকে… আর যেন এদিক ওদিক না দেখি…বুঝলি? আর যদি কথা না শুনিস তো বিয়ে দিয়ে দুটোকেই ঘর থেকে বের করে দেব… দেখবো কি করিস। দাদুর কথা শুনে দিদান হেসে ফেলে বলল… ঘর থেকে বের করে দিলে তো যেদিকে পারবে চলে যাবে…ওদের আর কি…যত চিন্তা তো আমাদের। ওদিকে মৌ শুক্লাদিকে জড়িয়ে ধরে লজ্জা মাখানো আদুরে গলায় বলল...ও শুক্লাদি দেখোনা...দাদু কেমন বকে দিল আর দিদানও কিসব বলছে। শুক্লাদি ওকে আদর করতে করতে বলল...বকবে না তো কি... কম চিন্তায় ফেলেছিলি নাকি?

মৌ ওকে কেন চুমু দিয়েছে শোনার পর মনে হল, ও তো জানেনা যে আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে না চাইলেও চোখ চলে গিয়েছিল। ও তো আমাকে বিশ্বাস করে... তাহলে কি আমার না বলাটা ঠিক হবে? মৌ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভেবেছে ওর একটা চুমুতে মন ভরেনি,আরো চাই... তাই হাসি মুখে বলল...কি...আরো চাই? ততক্ষনে অরিত্রও ভেবে নিয়েছে কি বলবে, ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল... রাগ করবে না বলো...মৌ ওর সেই মন ভোলানো হাসি মাখা মুখে উত্তর দিল...উঁ হু...

- আমি না তোমাকে দেখে ফেলেছি...

ওকে দেখে ফেলেছে শুনে কয়েক মুহুর্ত পরেই মুখ লুকিয়েছে তারই বুকে যার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কি বলবে বা কি করবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না ও, তারপর ভেবেছে... আচ্ছা আমি তো পেছন ফিরে ছিলাম, তাহলে ও কি করে দেখেছে বলছে? বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে রেখেই অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করেছে...সত্যিই দেখেছো?

অরিত্র ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ওরই মতো মৃদু স্বরে বলেছে...সত্যিই দেখেছি...এই তো এই টুকুনি...

ও পিঠের উপরে হাত রেখে কি দেখেছে বললো সেটা বুঝতে পেরে মৌ জিজ্ঞেস করল... আর কিছু না তো?

- উঁ হুঁ...
- তাই? কি করে?
- কি জানি, কি মনে করে আয়নাটার দিকে চোখ পড়ে গিয়েছিল...

মৌ কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকালো...তখোনো ওর লজ্জা পুরোপুরি না কাটলেও তাকিয়ে থেকে ওর দুচোখে কি যেন খুঁজলো...তারপর যখন বুঝলো ও সত্যিই ইচ্ছে করে কিছু করেনি, আস্তে করে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে আবার একটা চুমু দিল ঠোঁটে...আগের মতোই আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার সোনা আমাকে ঠকাতে চায়নি বলে...
 
শুধু বাড়ীর মানুষ গুলোই যেন নয়, সাথে সাথে সারা বাড়ীটাও যেন খুশী ধরে রাখতে পারছে না। বাগানের ভুঁইচাপা ফুল গুলো যেন এতদিন অপেক্ষা করছিল যার হাত ধরে এই বাড়ীতে এসেছিল তার জীবনে বসন্ত ফিরে আসার জন্য, তার জীবনে ভালোবাসা ফিরে এসেছে আর তাই তাদের ফুটতে সময় লাগেনি একটুও...সবুজ ঘাসের কার্পেটের মাঝে মাটি ছুঁয়ে থাকা বেগুনী ফুল গুলো যেন এক একটা একটা ছবি। শুধু কি ভুঁইচাপা... সাথে সাথে লাল টুকটুকে গ্লোব-ও তাদের সৌন্দর্য যেন কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে ন... একে অপরকে ছুঁয়ে থেকে যেন বোঝাতে চাইছে কতো ভালোবাসি তোমায়। একটা করে দিন আসছে আর কিভাবে চলে যাচ্ছে যেন বোঝাই যাচ্ছে না। সকালে অফিস বেরোবার সময় খুব তাড়াহুড়ো থাকে বলে অরিত্রর হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা অনেক দিনের। আগে যেটা হোতো ও বেরোবার জন্য তৈরী হতে শুরু করলে প্রায় দিনই দিদান বা শুক্লাদি কেউ না কেউ ওকে খাইয়ে দিতো, না হলে হয়তো প্রায় কিছু মুখে না দিয়েই চলে যাবে দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে। মৌ আসার পরেও একই ভাবে চলে আসছিল ব্যাপারটা, দিদান বা শুক্লাদির ওকে আদর করে খাইয়ে দেওয়াটা ও খুব ইচ্ছে করলেও কোনোদিনই চায়নি নিজের হাতে নিতে, হয়তো দিদা নাতির সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করে বুঝেছিল ওর ওই অধিকারটা ছিনিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। এসবই ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছিল প্রায়, বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অরিত্রর সাথে সাথে নিজেদেরও মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় দিদানরাও খুব একটা জোর করতো পারতো না। এই মুহুর্তে সব কিছু আগের মতো বা তার থেকেও বেশী কিছু হয়ে যাওয়ায় অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও দিদান নিজের থেকেই ওকে না খেয়ে বেরোতে দিতে চাইছিল না। প্রথম দিন নিজের হাতে খাইয়ে দিতে গেলে অরিত্র সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়ে দিদানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি মুখে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে... উমম দিদান...দাও...কতোদিন তোমার হাতে খাইনি বলোতো। দিদান ওকে খাইয়ে দিয়ে ... তুইও তো খেতে চাইতিস না বললে ও দিদানকে জড়িয়ে ধরে বলল...তুমিও তো আগের মতো জোর করতে না...তাই না। দিদান হেসে ফেলে বলল...আমাকে আর জোর করতে হবে না...জোর করার জন্য আর একজন তো আছে। অরিত্র খেতে খেতে বলল... ‘উমম না দিদান...তোমার হাতে খাওয়া কি আর... ওর কথা শেষ হবার আগেই মৌ ঘরে ঢুকে ওকে দিদানের হাতে ওকে সেই আগের মতো খেতে দেখে থেমে গেলে দিদান ওকে ডেকে বলল...এই নে মৌ...খাইয়ে দে তো। মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলে দিদান ওর হাতে খাওয়ারটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... এতদিন আমরা সামলেছি, এবারে বাবা তোর জিনিষ তুই বুঝে নে। অরিত্র দিদানের কথা শুনে হেসে ফেলে বলল...দিদান, আমি কি জড় পদার্থ নাকি? দিদানও হাসি মুখে বলল... তা কিছুটা বই কি। মৌ দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার নাতি তো তোমার হাতে খেতে বেশী ভালো লাগে বলছিল মনে হয়। দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল...ওর কথা ছাড়তো, পেটে ক্ষিধে আর মুখ ফুটে না বলা ওর চিরকালের অভ্যাস। দিদান তারপরেই ওর কানে কানে বলল... ছেলেদের সব কথা শুনতে নেই...বুঝলি? মৌ হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে।

দিদান চলে যাবার পর মৌ ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল, কিছুটা খাওয়ার পর... এই, না ...আর খেতে পারবো না বলাতে মৌ মুখটা ভার করে বলল... তাহলে আমিও আজ সারাদিন কিছু খাবো না। আরে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আট-টা পঞ্চাশের গ্যালপিং লোকালটা ধরতে পারবো না বললেও মৌ শুনতে চাইলো না... গলা নীচু করে বলল ওই সব খাওয়ার সময় হয় আর আর একটু খেতে গেলে দেরী হয়ে যায়...তাই না? অরিত্র দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে আস্তে করে বলল... ওইগুলো তো অনেক মিষ্টি খেতে...তাই না...

- পেট ভরবে ওতে?
- পেট না ভরুক, মন তো ভরবে...
মৌ কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে বলল...এই...
- উমম...না...আগে বলো খাবে...
- আচ্ছা বাবা খাবো...আগে দাও...
- উঁ হুঁ...আগে খাও, তারপরে দেবো...

মিষ্টি মেয়ের আরো মিষ্টি গলায় বলা কথা তো ফেলে দেওয়া যায় না, তার উপরে আবার দিদান বলে গেছে ও নাকি ওর জিনিষ...তাই মেনে নিতে হয়েছে ও যা বলেছে। খাওয়া হয়ে গেলে অরিত্রকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌ চোখ পাকিয়ে বলল...উঁ হুঁ...আগে মুখ ধুয়ে এসো আর তাই শুনে আর একজন মাথা নেড়ে বোঝালো না আগে চাই। কি আর করা যাবে কথা যখন দিয়েছি, তাই হোক ভেবে আর একজন হাসি মুখে চোখ বুজে থেকে বোঝালো... তোমার যা চাই নাও...

বেশ কিছুক্ষন অর্কর সাথে গল্প করার পর বাড়ীর সামনে থেকে কেউ জোরে...এই অর্ক…দাদাকে নিয়ে আয় বলাতে ও বেশ জোরে চেঁচিয়ে বলল…আসছি দাদু… তারপর অরিত্রর হাত ধরে বলল…চলো…দাদু ডাকছে। অর্কর সাথে ভেতরে যেতে গিয়ে দাদুর সাথে দেখা হয়ে গেল, উনি অরিত্রর হাত ধরে বললেন…কিছু মনে করো না বাবা…মৌকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো আশা ছিল না…মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। অরিত্র দাদুকে প্রনাম করে বলল…না না…আমি কিছু মনে করিনি…এই তো এতক্ষন আপনার নাতির সাথে গল্প করলাম।

- যাও…বাবা…ভেতরে যাও…আমি এখুনি আসছি…ছেলেটাও বাড়ী নেই…কখন ফিরবে কে জানে…
দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই একটা ভ্যান রিকশা এসে বাড়ীর সামনে দাঁড়ালো…ওদিকে তাকিয়ে দাদু বললেন…যাক…বাবা…ছেলেটা এসে গেছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন…আরে শোন মৌ এসেছে…আমি মাছের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা দেখি।
- বাস থেকে নেমে মাধবের কাছে শুনেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম কাজ ফেলে…মাছের ব্যাবস্থা করে এসেছি…একটু পরে মাধবের ছেলে এসে জাল ফেলবে…
- যাক বাবা…ভালো করেছিস। নিশ্চিন্ত হলাম…ছেলে মেয়ে দুটোকে ভালো করে খাওয়াতে পারবো কিনা চিন্তা হচ্ছিল…আর শোন…এ হল অরিত্র…আমাদের মৌ কে সাথে করে নিয়ে এসেছে...
অরিত্র মামাকে প্রনাম করতে যেতে না না করে উঠে বললেন…থাক…থাক…প্রনাম করতে হবে না…সারা দুনিয়ার ধুলো পায়ে…কেমন জায়গায় থাকি দেখছো তো…
মানুষ কতটা আন্তরিক হতে পারে এখানে না এলে বোঝা যেত না ভাবতে ভাবতে অর্কর সাথে ভেতরে যাওয়ার পর মৌ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে অরিত্র হেসে ফেলে বলল…আমার তো মনে হয়…তুমি নিজেই এখোনো ঠিক করে জানো না কে কোন জন…
- ইস…আমি চিনি না নাকি…শুধু মামন আর অর্ক ছাড়া আর সবাইকে দেখেছি…দাদু, দিদা, মাসী, মামা, মামীমা, সুমনাদি…
- না না…আরো এক জন আছে যাকে তুমি দেখোনি আগে…
ওর কথা শুনে মৌ বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…কে?

অরিত্র একটু গম্ভীর হয়ে ‘লালু’ বলতেই সবাই হেসে ফেলল। মৌ বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছে দেখে অর্ক দিদির কাছে গিয়ে বলল…দিদি…লালু মানে আমাদের কুকুরটা…
 
এত বড় এক একটা অনুষ্ঠানে কিছু না কিছু গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটে যাওয়াতে জেঠুরা খুব খুশী। অরিত্রকে জড়িয়ে ধরে বড় জেঠু এমন ভাবে তুই না থাকলে কি যে হত বলল যেন ওর জন্যই সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে। যদিও কথাটা কিছুটা হলেও ঠিক যে ও বারে বারে সব ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখে নিয়েছিল...নিজেদের ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দেখাশোনা করতে করতে মোটামুটি জানা ছিল কি করা উচিত। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লেগে যাওয়ায় ওর নিজেরও ভালো লাগছিল। জেঠিমা পাশেই ছিল, জেঠুকে ওইভাবে বলতে দেখে বলল...তোমাকে বলেছিলাম না...আমাদের দুষ্টু এই বয়সে যা দায়িত্ব নেয়...কটা ছেলে নেয় বলোতো। অরিত্র এত প্রশংসা শুনে হেসে ফেলে বলল...উঃ বাবা...তোমরা এমন করে বলছো যেন আমি একাই সব কিছু করেছি আর তোমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছো। আরো কিছুক্ষন জেঠু জেঠিমা ওর সাথে কথা বলে চলে যাবার পর ছোট জ়েঠিমা ওকে খুঁজে খুঁজে এসে পাকড়াও করে বলল...এই দুষ্টু...তোর সাথে কথা আছে...চল কোথাও বসি। জেঠিমা আবার কি বলবে ভাবতে ভাবতে মনে হল রুপসার বিয়ে নিয়ে কিছু হবে হয়তো। ও যা ভেবেছিল ঠিক তাই, রুপসা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না দেখে জেঠিমা ভেবেছে ওর হয়তো নিজের পছন্দের কেউ আছে। অরিত্র নিশ্চয় জানে সেটা কারন ভাই বোনের সম্পর্কটা যে একেবারে বন্ধুর মতো সেটা ভালোই জানা আছে জেঠিমার। রুপসার যে কেউ সেরকম নেই বুঝিয়ে বলার পর জেঠিমা ধরে বসল ওকে রাজী করাতেই হবে। রুপসা যদি চায় তাহলে এখন না হয় রেজিস্ট্রি করে রেখে দেওয়া যাবে। এক কথায় জেঠিমা কিছুতেই এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চাইছে না দেখে অরিত্র বলল...আচ্ছা...ঠিক আছে, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুপসার সাথে কথা বলবো। জ়েঠিমা আরো কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বলে উঠে গেছে। একা হয়ে যাওয়াতে মা বাবার কথা মনে পড়ে গেলে ও চুপ করে বসেছিল... কতক্ষন একা একা বসে ছিল নিজেও বুঝতে পারেনি। পুবালীর মাসতুতো ভাই বুকাই এর ডাকে প্রায় চমকে উঠল...দুজনে প্রায় একই বয়সী...আগে তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও বিয়েতে এসে তুই তোকারির জায়গায় সম্পর্কটা চলে এসেছে। বুকাইকে আয় আয় বোস বলাতে ও ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে গলা নামিয়ে বলল...কিছু ব্যাবস্থা রেখেছিস নাকি রে? বুকাই কিসের কথা বলছে বুঝতে পেরে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... তোর জন্য আনিয়ে রেখেছি...দাঁড়া, নিয়ে আসছি। বুকাই খুব খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠে বলল...ওঃ গুরু...তোর তো দেখছি সব দিকেই নজর...চল... চল...গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। ছাদে গিয়ে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে ঢেলে নিয়ে দুজনে বসে কথা বলতে বলতে খাচ্ছিল। অরিত্র ওর অভ্যাস মতো সামান্য একটু খেয়ে আর খাবে না বলাতে বুকাই চোখ গোল গোল করে বলল...সে কি আমি একা একা খাবো আর তুই বসে থাকবি? ওকে আসল কারনটা বলতে আর জোর করেনি...একা একাই খেয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষনের ভেতরেই ওর পেট থেকে দুঃখের কথা বেরোতে শুরু হয়ে গেল। ওর গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে দু বছর আগে খুব সামান্য কারনে সেই নিয়ে কিছুক্ষন বকবক করে নিজেই... কি হবে দুঃখ পেয়ে,যে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই... বলে চুপ করে গেছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর নিজেই আবার কথা বলতে শুরু করল। সবে মাত্র অরিত্র আর মৌ এর ব্যাপারে কথা তুলেছে ঠিক সেই সময়ে রুপসা এসে হাজির। দুজনকে এক সাথে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে উঠে বলল...উঃ দাদাভাই তোরা এখানে আর আমি খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে গেলাম...চল চল...ছোড়দি তোদেরকে ডাকছে। ছোড়দি ডাকছে মানে বাসর ঘরে গিয়ে এক গাদা মেয়ের মুখোমুখি হতে হবে ভেবে ভেবে অরিত্র কেটে পড়ার তালে ছিল। রুপসা বুঝতে পেরে ওকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলে পেছন পেছন বুকাইও চলে এল। বাসর ঘরে যাওয়া মানেই বেশ মজা করা যাবে...আর কিছু না হোক দু চারটে মেয়ে তো থাকবেই...ভালোই কাটবে সময়। বাসর ঘর একেবারে গমগম করছে, কে যে কার পেছনে লাগছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। শুভ্রদীপের দু জন বন্ধু সানি ও রজতাভ, মামাতো বোন দিয়া ও রাকা আর সাথে ওদের একেবারে পাশের বাড়ীর একজন মেয়ে নম্রতা আর পুবালীর দিক থেকে রুপসা, মৌ, অরিত্র, বুকাই আর পুবালীর মামাতো বোন সৃজা। আরো কয়েক জন নাকি ছিল, এই কিছুক্ষন আগে ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেছে। অরিত্ররা আসতে পুবালী ওর কাছে বসতে বলাতে ও কোথায় বসবে দেখছে...পুবালীর গা ঘেঁসে মৌ বসে আছে, না সরে গেলে ও বসতে পারবে না দেখে শুভ্রদীপ মৌ কে বলল...মৌ তুমি আমার পাশে চলে এসো...এক মাত্র শালার এক মাত্র ইয়ে বলে কথা। তোমার সাথে খাতিরটা ভালোই রাখতে হবে তাই না...।

রুপসা শুভ্রদীপের পাশে বসে পড়ে বলল...না না...সুন্দরী ছোটো শালী থাকতে থাকতে শালার বৌ কি করে চান্স পাবে? ওসব চলবে না, ওর যার পাশে বসার কথা সেখানেই বসবে। সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলাতে বাধ্য হয়ে মৌ এর পাশেই ওকে বসতে হল। এত রাত হয়ে গেলে কি হবে...কারুরই যেন ক্লান্তি নেই...বাসর ঘর আরো জমে উঠল। আরো ঘন্টাখানেক বাসর জাগার পর শুভ্রদীপের বন্ধুরা ফিরে যাবে বলে বলল। ওরা পাঁচ জন গাড়ী করে ফিরবে, সেই মতো প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিল। সারাদিন বিয়ের নানা রকম আচার অনুষ্ঠানের জন্য শুভ্রদীপ আর পুবালী বিশ্রাম পায়নি...ওদেরও কিছুটা বিশ্রামের দরকার। রুপসা বুকাইকে কানে কানে কিছু একটা বলতে ও একেবারে লাফিয়ে উঠে বলল...বলিস কি রে? হ্যাঁ...চল চল... কেন যাবো না। পুবালী কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করাতে রুপসা ফাজিল মার্কা হাসি হেসে বলল...তোর এত জানার দরকার নেই এখন...এটা আমাদের আন ম্যারেডদের ব্যাপার। বৌ ভাতের দিন তো আসছি...সব জানতে পারবি...বুঝলি। শুভ্রদীপ পুবালীর কানে কানে বলল...মনে হচ্ছে নম্রতার সাথে বুকাই এর কিছু হলেও হতে পারে। পুবালী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলল...তোরা কি এখন বেরুবি নাকি আবার? রুপসা চোখ ছোট ছোট করে শুভ্রদীপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল...এটা তো ভালো হোলো না শুভ্রদা।

পরের দিন সকালে অরিত্র ফিরে যাওয়ার কথা তুলতেই মামীমা এক কথায় নাকচ করে দিয়ে বলল…না…না…তা কি করে হয়। এতদিন পরে মেয়েটা এসেছে, অন্তত আর একটা দিন থাকতেই হবে। মামীমা এত আন্তরিকভাবে থাকার কথা বলল যে না বলার কোনো উপায় ছিল না, তবুও একবার শেষ চেস্টা করতে গিয়ে মৌয়ের দিকে তাকালে ও এমনভাবে ‘আমি কি জানি ...তুমি দেখো কি করবে’ বলল যে তাতে পরিস্কার হয়ে গেল ওর থাকার ইচ্ছেটাই বেশী। আর কিছু করার নেই দেখে অরিত্র থাকতে রাজী হয়ে যেতে মামীমা বলল... যাও না আজ সবাই মিলে শুশুনিয়া পাহাড় দেখে এসো। মামন পাশেই ছিল, মায়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বলল... হ্যাঁ মা, খুব ভালো হবে। অর্ক তো শুনেই লাফাতে শুরু করে দিল...পাহাড় দেখার থেকে ওর বেশী আনন্দ হচ্ছে গাড়ীতে করে ঘুরতে যেতে পারবে।

সাড়ে এগারোটা মতো বাজে। অরিত্রর সাথে পাপাই আর অর্ক, দূর্গামন্ডপের মেঝেতে তিন অসমবয়সীর খেলা চলছে জোর কদমে...আরো একজন অবশ্য সাথে আছে, সে হল লালু। অরিত্রর বুকের উপরে চেপে বসে পাপাই নাচন কোদন চালিয়ে যাচ্ছে সমানে, নাচন কোদনের সাথে চলছে চিল চিৎকার। মাঝে মাঝে অর্ক আর পাপাইয়ের গলার আওয়াজ এত বেড়ে যাচ্ছে যা লালুও থাকতে না পেরে ওদের সাথে গলা মেলাচ্ছে ভো-উ-উ ভো-উ-উ করে। মাঝে একবার দিদা এসে লালুকে মন্দীরের চাতালে দেখতে পেয়ে তাড়া করতে গেলে লালু দৌড়ে গিয়ে দূর্গা প্রতিমার কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে পড়লে দিদা আর কিছু করতে পারেনি। ঠাকুমা স্নান না করে মন্ডপে উঠতে পারবে না বুঝতে পেরে অর্ক বক দেখিয়ে বলেছে
পা-র-বে না...পা-র-বে না...লালুকে তাড়াতে পারবে নাআআআআ... নাতির সাথে না পেরে ঠাকুমা নিজের মনে বকতে বকতে ফিরে গেলে পর লালু বেরিয়ে এসে লেজ নাড়াতে নাড়াতে যেন অর্ককে বলতে চেয়েছে...ভাগ্যিস ঠাকুমাকে ভাগিয়ে দিলে...না হলে আমার অবস্থা খারাপ করে দিতো...

একটু পরে মামন এসে তাড়া লাগালো...অরিত্রদা...দিদি ডাকছে, এখুনি চলো। একটু পরে তিন মুর্তিমানকে ধুলো মাখা অবস্থায় দেখে ওদের তিন বোনের হাসি যেন আর থামে না। ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে পাপাইও কিছু না বুঝে ওদের হাসিতে যোগ দিয়েছে দেখে অরিত্র নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে বলল... কি হয়েছে বাবা এত হাসির, একটু না হয় ধুলো লেগেছে। মৌ মুখে হাত আড়াল করে হাসি চাপতে চাপতে বলল... একটু ধুলো? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো একবার। ওদিক থেকে সুমনা থাকতে না পেরে বলল... এই, চল তো তিনটেকে পুকুরে নিয়ে যাই। সবাই মিলে পুকুরে স্নান করতে যাবে শুনে অর্ক হৈ হৈ করে উঠে লাফাতে শুরু করলে সুমনা ভাইকে আদরের বকুনি দিয়ে বলল...এই বাঁদর...আর লাফাতে হবে না...দাদাকে নিয়ে যা, আমরা আসছি...বুঝলি?
 
সুমনা আসায় মামন আজ মৌ দিদির সাথে শুতে পায়নি…মুখ ভার করে মায়ের কাছে গিয়ে শুয়েছে। সুমনা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল আর ওদিকে মৌ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে …আজ বোধহয় পূর্নিমা…চারদিক মিষ্টি জ্যোতস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ফ্যানটা এত আস্তে ঘুরছে যে হাওয়া আছে কিনা বোঝা না গেলেও জানলা দিয়ে ঝির ঝির করে দখিনা হাওয়া ঘরের ভেতরে এসে যেন গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে যাচ্ছে। সুমনা পাপাইকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল ‘কি রে মৌ… এত চুপচাপ…কি ভাবছিস’?
- চাঁদের আলোয় বাইরেটা কি সু্ন্দর লাগছে …তাই না… সত্যি গ্রামে না এলে প্রকৃতিকে ঠিক মতো চেনা যায় না…
- বুঝেছি…চাঁদের আলো দেখছিস শুধু নাকি আর একজনের কথা ভাবছিস রে? কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে…তাই না রে?
- এই দিদি…তুই না খালি পেছনে লাগিস...
- আচ্ছা বাবা…আয়…শুয়ে শুয়ে গল্প করবো…
দিদির হাতটা জড়িয়ে ধরে মৌ চুপচাপ শুয়ে ছিল। সুমনা ওর খুব কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল ‘এই মৌ…কেমন পারে রে’? মৌ ওর প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ‘কি’?
- আহা…ন্যাকা…কি আবার…কেমন করতে পারে?
মৌ ভীষন লজ্জা পেয়ে গিয়ে ভাবছিল…ইস দিদিটা যে কি… কি সব জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের পর মেয়েদের বোধহয় মুখে কিছু আটকায় না। সুমনা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ‘খুব ভালো…তাই না’?
- কি করে বলবো?
- এই বল না…আমি কি ভাগ বসাবো নাকি? তোর জিনিষ বাবা তোরই থাকবে…
- জানি না রে…কিছু হলে তো বলবো কেমন…
- ধুস…কিছু নাকি হয়নি…আজকাল গ্রামেই সব কিছু হচ্ছে…আর তোরা শহরে একই বাড়ীতে থাকিস…আর কিছু করিস নি…বললেই হোলো…
- সত্যি বলছি রে দিদি…বিশ্বাস কর,কিছু হয়নি…ও ওরকম নয়…
- হুমম…করলাম…তাহলে কি শুধু চুমু খেয়েছে…আর…হাত দিয়েছে… তাই তো?
- শুধু প্রথমটা…
- এই মৌ…আমি কিন্তু আর বিশ্বাস করতে পারছি না…এই বল না…
- সত্যি বলছি…
- তোর ইচ্ছে করে না?
- কি জানি…তেমন কিছু না…
- ওকে দেখে বুঝতে পারিস না? হয়তো তুই না করে দিবি ভেবে ইচ্ছে থাকলেও এগোয় না...
- তেমন কিছু মনে হয়নি…বিশ্বাস কর…
- ঠিক আছে বাবা…করলাম…
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মৌ দিদিকে ডাকলো ‘এই…দিদি’
- কি?
মৌ কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সুমনা বলল ‘বল না…কি বলবি’।
- প্রথম প্রথম খুব লাগে…তাই না?
সুমনা বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘একটু তো লাগবেই…তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই’।
- তাই? ঠিক বলছিস?
- অবশ্য ছেলেদের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে…
দিদির কথা শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘এই দিদি…তোর লাগেনি’?
- উঁ…
- বল না দিদি…
- লেগেছিল…
মৌকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমনা তারপরেই ফিসফিস করে বলল… খুব লেগেছিল…তবে ভালো। মৌ দিদির বুকে মুখ গুঁজ়ে চুপ করে শুয়ে কিছু একটা হয়তো ভাবছিল, সুমনা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল ‘এই…মৌ’
- উঁ…
- তোরা নাকি কাল চলে যাবি?
- হ্যাঁ…সোমবার ওর অফিস আছে।
- আর একটা দিন থাক না… কতদিন পর দেখা হল…
- আমারও তো ইচ্ছে করছে…দেখি বলে দেখবো…
- এই…শোন না…ভালো করে বলবি কিন্তু…
- আচ্ছা…
- এই মৌ...
- হু...
- তোর কথা শুনবে তো?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজের মনেই যেন বলল... জানিস তো দিদি, মা যে আমাকে দেখতে পারতো না তাতে আমার আর একটুও দুঃখ হয় না। সেদিন যদি বাড়ী থেকে না বেরিয়ে আসতাম তাহলে কি ওর সাথে কোনোদিন দেখা হত...

বোন কি বলতে চেয়েছে ওর প্রশ্নের উত্তরে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা ছিল না। সুমনা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সত্যিই তোর কপালটা ভালো রে, সেদিন যদি ওর জায়গায় অন্য কারুর হাতে পড়তিস তাহলে কি হতে পারতো ভাবতেই ভয় লাগে। মৌ আস্তে করে বলল... ওর কাছে থাকলে আমার কেন জানি না... মনে হয় আর কোনো ভয় নেই...যাই হোক না কেন ও আমাকে ঠিক আগলে রাখবে...
 
পুকুরটা বেশ বড়ই...টলটলে পরিস্কার নীল জল...ঘাটের পাশেই একটা বেশ ঝাঁকড়া আম গাছ থাকায় ছায়া হয়ে আছে জায়গাটা। শান বাধানো ঘাটে বসে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে পাপাইকে জলে দাঁড় করিয়ে ধরে রাখতে হয়েছে, যা ছটপটে ছেলে হাত ফসকে কখন জলে পড়ে যাবে তার ঠিক নেই। অর্ক কোমর পর্যন্ত জলে নেমে গিয়ে পাপাইয়ের দিকে জল ছেটালে পাপাইও ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মামার দিকে জল ছেটাবার চেস্টা করে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ওদের মামা ভাগ্নের জল কেলী চলতে চলতে একটু পরেই ওরা তিন বোন চলে এলো সাজগোজ করে। টাইট চুড়িদার পরে ওড়না বুকের উপর দিয়ে নিয়ে এসে কোমরে গিঁট মেরে বেঁধে রেখেছে যাতে খুলে না যায়। ওরা এসে যেতেই অর্ক ঝাঁপ দিলো জলে... জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেই পাপাইকে আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না...ওকেও মামার মতো জলে নামতে দিতে হবে। সুমনা জলে নামতে নামতে ওকে সাঁতার জানে কিনা জিজ্ঞেস করায় অরিত্র উত্তর দিলো... জানি, তবে অনেক দিন হয়ে গেল জলে নামা হয়নি। মৌ জলে পা ডুবিয়ে জল ছেটাতে ছেটাতে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...সত্যি তুমি সাঁতার জানো? অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... চলো, তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দি আজ। মৌ হাত দিয়ে একটু জল ওর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল... ধ্যাত, কেউ এসে গেলে? ওদিকে ওরা দু বোনে গলা অব্দি জলে নেমে মৌকে ডাকাডাকি করলেও কিছুতেই যাবে না দেখে অরিত্র পাপাইকে কোলে নিয়ে কিছুটা জলে নেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালে মৌ কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উঠে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোঝালো ওকে ধরতে হবে। এক একটা করে ধাপ নিচে নামতে নামতে কখন ও অরিত্রকে জড়িয়ে ধরেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। মৌ ভালো করে ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেও ভয় পাচ্ছে দেখে অরিত্র আস্তে করে বলল... আমি ধরে আছি তো, কিছু হবে না। মৌ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আস্তে করে বলল... কি করবো ভয় করলে...

বুক পর্যন্ত জলে নেমে ও আর কিছুতেই নামবে না দেখে অরিত্র ওখানেই দাঁড়িয়ে গেছে... একটু একটু করে ভয় কেটে গিয়ে মৌ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক...ওদের ভাইবোনের সাঁতার কাটা দেখতে দেখতে পাপাইয়ের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল... এই যে দুষ্টু ছেলে, মামার কোলে খুব আদর খাওয়া হচ্ছে...না। পাপাই মাসির গালে ওর ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে খামচানোর চেস্টা করতে করতে উত্তরটা দিল ওর অবোধ্য ভাষায়। অরিত্র হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল...কিছু বুঝলে? মৌ পাপাইকে আরো একটা চুমু দিয়ে আস্তে করে বলল...বুঝেছি, ও বলছে...মামা তো আর একা আমাকে আদর করে না...তোমাকেও তো করে।

একটু পরেই সুমনা ফিরে এসে পাপাইকে নিয়ে গেছে স্নান করিয়ে বাড়ীতে দিয়ে আসতে না হলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে আর অরিত্ররও আর স্নান করা হবে না। মামন আর অর্ক ওদিকে কে আগে সাঁতার কেটে পুকুরের ওপারে গিয়ে ফিরে আসতে পারবে দেখাতে গিয়ে সাঁতরাতে শুরু করেছে, এখন আর কেউ নেই ওরা কি করছে দেখার... অরিত্র ওকে আস্তে করে বলল...এই, নাকটা চেপে ধরো না এখুনি। মৌ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নাক চেপে ধরলে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভালো করে ধরে টুপ করে জলে ডুব দিয়েছে... হঠাৎ করে ওইভাবে জলে ডুব দেওয়ায় মৌ ভীষন ভয় পেয়ে গিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে...ওর আর কিছু বোঝার মতো অবস্থা ছিল না... একটু পরে যখন জলের ভেতর থেকে উঠে এলো দুজনে, ততক্ষনে মৌ বুঝেছে কি হয়েছে... ভালো করে নিশ্বাস নিতে নিতে ওর বুকে গোটা কয়েক দুমদাম করে কিল মেরে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো রকমে বলেছে...পাজী কোথাকার। অরিত্র কিছু না বলে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল...তোমার ভালো লাগেনি? ততক্ষনে মৌ একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে...ভাইবোন তখোনো সাঁতার কেটে যাচ্ছে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল... আগে থেকে তো বলবে। অরিত্র এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলল...তাহলে আর একবার? মৌ দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হাসি মুখে ঘাড় কাত করে বুঝিয়েছে ওর কোনো আপত্তি নেই। আগে থেকে জানা থাকায় বুক ভরে হাওয়া নিয়ে এবারের অদৃশ্য হওয়াটা আরো বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে...ওরাই জানে ঠিক কি কি হয়েছে সবার চোখের আড়ালে...
 
দিদান এতক্ষন কিছু বলেনি, চুপচাপ বসে দাদুর কথা শুনছিল। দাদুর কথা শেষ হতেই বলল...এ তো দেখছি এক তরফা হয়ে গেল। আমারও কিছু বক্তব্য আছে...এক এক করে বলছি, শোনো...

১) সারাদিন যখন তখন তুমি মৌ কোথায় গেল বলে হাঁক ডাক করতে পারবে না।
২) আমাদের লুকিয়ে মৌকে চুপিচুপি বলা যাবে না চা খাওয়াতে।
৩) আমরা ওষুধ দিলেও খেয়ে নিতে হবে চুপচাপ।

দিদানের কথা শেষ হলে দাদু বেশ গম্ভীরভাবে... ‘হুম, বুঝেছি... তুমি আজকাল খুব হিংসে করছো আমাকে’...বললে, সবাইয়ের হেসে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর ঠিক হয়েছে দু পক্ষই সব কিছু মেনে নিচ্ছে।

মৌয়ের বাবার ব্যাপারে ওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলেও অরিত্র মনের ভেতরের খচখচানিটা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে ও একা একাই ঠিক করে ফেলেছে সবকিছু জানিয়ে দেবে ওকে, যদিও ঠিক কি ভাবে বললে ঠিক হবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। কয়েকদিন ধরে ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখে দিদান দু একবার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও অফিসের কিছু কাজের কথা ভাবছে বলে ও এড়িয়ে গেছে। দিদান এমনিতেই খুব ব্যাস্ত থাকায় আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে পারেনি বা পরে একা ওর সাথে কথা বলবে ভেবেও ভুলে গেছে।

আজকাল অরিত্রকে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে আসতে হচ্ছে তার উপরে মাঝে মাঝে ছুটি নিতে হচ্ছে বলে রাতের দিকে বাড়ীতে বসে অফিসের কিছুটা কাজকর্ম করতে হচ্ছিল। সেদিন ও রাতে একা একা কাজ করছে, রাত প্রায় সাড়ে বারোটা পৌনে একটা মতো বাজে। একটানা কাজ করতে করতে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য ও চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিল। অবশ্য শুধু হয়তো বিশ্রাম নেওয়া নয়, সাথে সাথে ওই ব্যাপারটা নিয়েও ভাবছিল। কি করবো ভাবতে ভাবতে তো একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছে... আর দেরী করা যাবেই না, যেভাবেই হোক ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবার আগেই জানানোটা দরকার...কিন্তু কি ভাবে?

চোখ বুজে থেকে ভাবতে ভাবতে খুব পরিচিত হালকা কিন্তু মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলে চোখ না খুলেই বুঝে গেল কে এসেছে। যাই থাকুক না কেন মনের ভেতরে, ও এসেছে বুঝতে পেরে ভালো লাগার অনুভুতিতে মনটা ভরে উঠলো। শুধু ভালো লাগা নয়, সাথে সাথে ওকে বলতে পারার সুযোগটা অযাচিত ভাবে এসে যাওয়ায় সাথে সাথেই মনস্থির করে নিল কি করবে। ও যে বুঝতে পেরেছে মৌ এসেছে সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে আরো কিছুক্ষন চোখ বুজে চুপ করে বসে থেকে হয়তো দেখতে চাইছিল ও কি করে। ভালো করেই জানে ও এসেছে যখন কথা না বলে ফিরে যাবেই না। অরিত্র ওকে আর অপেক্ষা করানোটা ঠিক হবে না ভেবে চোখ না খুলেই বলল...ঘুমোওনি? ও কিভাবে বুঝলো যে আমি এসেছি ভাবতে ভাবতে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে মৌ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ও যে নিঃশব্দে আরো কাছে সরে এসেছে বুঝে গিয়ে অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিলে ও আস্তে করে বলল...কি করে বুঝলে আমি এসেছি? প্রশ্নটা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলে মৌ ওর কপালে হাত রেখে আস্তে করে বলল...একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তারপরেই ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল...তোমার কি হয়েছে আমাকেও বলতে পারবে না?

দিদানকে এড়িয়ে যেতে পারলেও মৌকে এড়ানো গেল না বা এড়িয়ে যাবার প্রশ্নই ছিল না। ‘তুমি একটু বোসো, চোখে মুখে জল দিয়ে আসছি এখুনি’ বলে অরিত্র উঠে গেছে। চোখে মুখে জল দেওয়াটা একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তার সাথে নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরী করে নেবারও একটু সময়ের দরকার ছিল। সময়ের দরকার থাকলেও খুব একটা বেশী সময় নেওয়া যাবে না ভেবে ফিরে এসেছে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। মৌ কোলের উপরে হাতটা রেখে চুপ করে বসেছিল। অরিত্র ওর দিকে একবার তাকিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ফিরে এলো ওর পাশে। ওকে কাছে টেনে নিয়ে কিছূক্ষন চুপ করে বসে থাকলে...মৌ নিচু গলায় বলল...কই বললে না তো কি হয়েছে তোমার। অরিত্র আস্তে করে বলল...তোমাকে একটা কথা জানানোর ব্যাপারে ভাবছি কিন্তু পেরে উঠছি না।
- কি?
- আগে বলো, যা বলবো তুমি ছাড়া আর কেউ জানবে না...

কাউকে না জানানোর মতো কি হতে পারে ভাবতে গিয়ে ও একটু অবাক হয়ে গিয়ে চুপ করে থাকার পর বলল...আচ্ছা...
ও আচ্ছা বললেও অরিত্র খুব ভালো করেই জানে শোনার পর ওর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে আর সেই অবস্থায় ওর পাশে থাকার কতটা দরকার আছে। ওকে নিবিড় ভাবে বুকে চেপে ধরে অনেকটা সময় নিয়ে একটু একটু করে যা জেনেছে বলা হয়ে গেছে। মৌ কথাগুলো শুনে কান্না আটকানোর চেস্টা করলেও পারলো না, গুমরে গুমরে বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। অরিত্র ওকে এই মুহুর্তে আর কিছু বলতে চাইছিল না, মুখে কিছু না বলে যে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে থেকে অনেক বেশী সান্তনা দেওয়া যায় সেটা আরো একবার প্রমান হয়ে গেল আজ। এরকম একটা মর্মান্তিক খবর শোনার পরেও যে ও নিজেকে ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাতে পেরেছে সেটা আর কেউ না বুঝুক ও নিজে জানে। চুপচাপ আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, মৌ অস্ফুট গলায় বলল... আমি কিভাবে নেবো সেই ভেবে কি তুমি আগে বলোনি?
উত্তরটা হ্যাঁ শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আগের মতোই বলল... তুমি কিছু ভেবোনা আর এই নিয়ে..আমি চাইনা আমার জন্য সবার খুশী নষ্ট হোক, এমনিতেই আমাকে নিয়ে তোমার ...
ও কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে অরিত্র আস্তে করে বলল... কাজটা সোজা নয়, তবুও নিজেকে শক্ত করতে হবে মৌ...এখন তুমি আর একা নয়...
ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে ও জবাব দিয়েছে...জানি...

এরপর আর বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয়নি। চুপচাপ দুজনে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পর ও ফিরে গেছে। অরিত্র ওকে আরো কিছুটা সময় থাকতে বললে ও বলেছিল...চিন্তা করবে না,আমি ঠিক আছি। ওকে এখন একা থাকতে দেওয়াটা হয়তো ভালো হবে ভেবে আর জোর করেনি। মৌ চলে যাবার পরও অরিত্র শুতে যেতে পারেনি, চুপ করে বসে থেকে ভাবছিল ঠিক কি কি ঘটে গেছে এইটুকু সময়ে, কোথাও কোনো ফাঁক থেকে গেল কিনা... যেটাকে নিয়ে ওকে ভাবতে হবে। ভাবতে ভাবতে ওর একটা কথা বারে বারে মনে আসছে... আমার জন্য তো রাতের অন্ধকার আছেই, ওইটুকু সময় আমি না হয় বাবার জন্য একটু কাঁদবো...

অরিত্র যতটা ভয় পেয়েছিল ঠিক তা হয়নি, ভেতরে যতই যন্ত্রনা থাকুক না কেন কাউকে সেটা একেবারেই বুঝতে দেয়নি ও। একমাত্র অরিত্রকে যেটুকু সময় একা পেতো সেই সময়টুকু ও চেস্টা করতো না স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করার। মাঝে একবার নিজের থেকেই অরিত্রকে বলেছিল...ভেবে আর কি করবো বলো...বাবা তো আর ফিরে আসবে না...
 

Users who are viewing this thread

Back
Top