What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

মৌ কথা কও (1 Viewer)

দেখতে দেখতে আরো মাস দুয়েক কেটে গেছে। মৌ কি ডিশিশান নিয়েছে জানায়নি কিন্তু কিছুটা হলেও যেন ওর ভেতরে পরিবর্তন এসেছে আস্তে আস্তে কিন্তু সেটা অরিত্রর ব্যাপারে একেবারেই নয়। আগেও যেমন ওকে এড়িয়ে যেতো সেরকমই আছে কিন্তু দাদু দিদানদের সাথে আগের থেকে অনেক বেশী মেশার চেষ্টা করে। সবাই ভেবেছে দেখা যাক, আরো কিছুদিন গেলে হয়তো আরো কিছুটা স্বাভাবিক হবে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে ও একাই ঘরের দরজা বন্ধ করে শোয় রাতে যেটা আগে করতো না। অরিত্র ব্যাপারটা নিয়ে যে একেবারেই ভাবেনি তা নয়...কখোনো ভেবেছে তাহলে কি ও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না? ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে আমি ওর উপরে জোর করবো? কথাগুলো ভেবেও নিজেই নিজেকে বলেছে...নাঃ, তা কি করে হবে। ওর ঘরে তো অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বালানো থাকে... বই পড়ে হয়তো। আজকাল অফিস থেকে বেরোতে বেশী রাত হয়ে গেলে আর বাড়ী না ফিরে দিদানকে জানিয়ে দিয়ে ভবানীপুরের বাড়িতে চলে যায়। কি আর তফাৎ আছে এখানে আর ওখানে? যন্ত্রনা তো দু জায়গাতেই আছে। শুধু ধরনটা যা আলাদা। দিদির বিয়ের পর এমনিতেই জেঠিমারা খুব একা হয়ে গেছে, ওকে পেলে তবু একটা রাতের জন্য হলেও খুশী হয়। প্রথম প্রথম জেঠিমারা মৌ-এর ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলার চেস্টা করতো কিন্তু ও চায় না দেখে এখন আর কিছু বলে না। একটা রাতের জন্য এসেছে ছেলেটা, থাক ওকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই ভেবে নিজেদেরকে সান্তনা দেয়। অনেকদিন হয়ে গেল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না, বারে বারে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে চুপ করে শুয়েও থাকতে পারে না। উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কি ভাবে নিজেই বোঝে না। যতই মাথার ভেতরটা ফাঁকা করে দেবার চেস্টা করুক না কেন বারে বারে পুরোনো স্মৃতি গুলো ভীড় করে আসে। মাঝে মাঝে ভেবেছে এই ধরনের সমস্যায় অনেকেই তো ড্রিঙ্ক করে...তাতে নাকি দুঃখ ভোলা যায়, ভাবলেও আবার নিজের থেকে পিছিয়ে এসেছে... আমার যা হবে হোক...যে তিনটে মানুষ আমার মুখ চেয়ে বেঁচে আছে তাদেরকে তো আর কেউ নেই দেখার। নিজের জন্য না হোক ওদের জন্য আমাকে স্বাভাবিক থাকতেই হবে যেভাবেই হোক...ভেতরে না হলেও বাইরেটা দেখে যেন কেউ না বোঝে আমার ভেতরে কি হচ্ছে। যতই ও নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেস্টা করুক না কেন সবাই বোঝে ও কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। প্রায়দিন রাতে দিদান বা শুক্লাদি ওর ঘরে এসে দেখে যায় ঘুমোতে পারছে কিনা। মাঝে মাঝে ওদের কাছে ধরাও পড়ে যায়...ওকে কাছে টেনে নিয়ে সান্তনা দেবার চেস্টা করে নিজেরাই কেঁদে ফেলে দিদানরা... মা বাবা হারানো ছেলেটাকে খুশী দেখতে চাওয়া ছাড়া আর কিছু যাদের কাম্য নয় তাদের কাছে ওকে এইভাবে দিনের পর দিন যন্ত্রনা পেতে দেখার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ভেবে নিজেরাই কষ্ট পেলেও কোনোদিন ওদের কেউই এর জন্য মৌকে দায়ী করেনি। এটাই ওর ভবিতব্যে ছিল ভেবে মেনে নিয়েছে এই ভেবে যে মেয়েটা তো আর নিজের থেকে আসেনি বা থাকতে চায়নি...ওরাই চেয়েছিল ও এখানে থাকুক।

এর মাঝে কোনো এক শনিবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় সুস্মিতাকে উল্টোডাঙ্গায় দেখতে পেয়ে কি মনে করে গাড়ী থেকে নেমে দৌড়ে যায় দেখা করতে। ব্যাপারটা হঠাৎই এমন ভাবে ঘটে যায় যে নিজেই ভাবেনি যে এই সেই মেয়ে যাকে ও একটা সময় এড়িয়ে যেতে গিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই ভুলে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে। সুস্মিতা হঠৎ ওকে ওইভাবে দৌড়ে আসতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল...আরে অরিত্রদা...তুমি? ওর প্রশ্নটা শুনে প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল... আরে, বাড়ী ফিরছিলাম...তোমাকে দেখতে পেয়ে চলে এলাম।

- বাব্বা, কি সৌভাগ্য আমার... বলো কেমন আছো?
- আমি এই এক রকম আছি...তুমি?
সুস্মিতা ওর উত্তরটা শুনে কেমন কেমন লাগছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল...বুঝলাম না...এক রকম মানে?
- ওই এক রকম মানে এক রকম...বলো তোমার কি খবর...
- আমার খবর বেশ ভালোই... যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম তা নয়...
- তার মানে তুমি তোমার বরকে ভালোবাসতে পেরেছো...তাই তো?

সুস্মিতা হেসে ফেলে বলল... তা ছাড়া আর কিছু করার আছে কি? তবে জানো তো ও বড্ড ভালো...আমি নিজের থেকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিলাম বিয়ের আগেই...সব কিছু জেনেই ও আমাকে বলেছিল...চিন্তা কোরো না, তুমি যে আমার কাছে কিছু লুকোতে চাওনি এটাই আমার কাছে অনেক। সুস্মিতা যে সুখী হয়েছে এটা জেনে ভালো লাগলো। খুব ইচ্ছে করছিল কিছুক্ষন ওর সাথে সময় কাটায়...সাতপাঁচ না ভেবেই বলে ফেলল... তোমার হাতে কি সময় আছে? যদি তোমার অসুবিধা না থাকে তাহলে চলো না কোথাও গিয়ে একটু বসি। সুস্মিতা ওর আগ্রহ দেখে বলল...ঠিক আছে, চলো। আমার তেমন কোনো তাড়া নেই।

একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুজনের কথা হচ্ছিল। অরিত্র যতই নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেস্টা করুক না কেন ও যে মৌ এর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে না পারার কথা নয়। সুস্মিতা বাধ্য হয়ে বলল...অরিত্রদা, আমি তো তোমার কাছে কিছু আড়াল করিনি...তুমি কেন এড়িয়ে যাচ্ছো আমাকে? বলো না কি হয়েছে? সুস্মিতার আন্তরিক ভাবে বলা কথাটা এড়িয়ে যেতে না পেরে একটু একটু করে বলল ওকে ঠিক কি কি হয়েছে। এতদিন নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে গিয়ে কারুর কাছে নিজের কথা তেমন ভাবে বলতে না করতে পেরে যে কষ্ট পাচ্ছিল আজ তা বলতে পেরে নিজেকে যেন একটু হাল্কা লাগছিল। কিছুটা শোনার পর ওকে মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখে সুস্মিতা বলল...তুমি কেন ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করছো না ও কি চায়? অরিত্র মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নিচু করে নিয়ে আস্তে করে বলল... তুমি হয়তো জানো না, আমি জোর করতে পারি না। তার থেকেও বড় কথা ও কেন যে আমাকে এড়িয়ে যায় বুঝতে পারি না। সবকিছু শোনার পর সুস্মিতা ওর সাথে কথা বলার জন্য আসতে চাইলে অরিত্র ওকে বারন করে বলল...কোনো লাভ হবে না সুমি, তুমি হয়তো জানো না আমার ছোড়দি আর ছোটো বোনের সাথে ওর কতটা কাছের সম্পর্ক ছিল। সব কিছু ওকে জানানোর পরেও তাদেরকেও ফিরিয়ে দিয়েছে বারে বারে। আমি সত্যিই বুঝতে পারি না ওর সমস্যাটা ঠিক কোথায়...আমরা তো ওর কোনো ক্ষতি চাই না...কেন যে ও সেটা বুঝতে চাইছে না কে জানে। সুস্মিতা কিছুক্ষন চুপ পরে থাকার পর নিজের মনেই যেন উত্তর দিল... কিছু তো একটা আছে যেটা ও পারছে না বলতে...

অরিত্রর এরপরে আরো বার তিনেক সুস্মিতার সাথে দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে বললে হয়তো ভুল হবে, মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতে গিয়ে নিজেরাই ঠিক করেছে দেখা করবে। এতদিন বোনেদেরকে বোঝাতে গিয়ে নিজের আসল অবস্থার কথা কিছুটা হলেও চেপে যেতে হত যাতে ওরাও এতটা কষ্ট না পায় কিন্তু সুস্মিতার সাথে মন খুলে শেয়ার করার পর থেকে কিছুটা হলেও যেন শান্তি পায়। নিজের থেকে দেখা করতে বললেও শেষের দিন ওকে অবাক করে দিয়ে সুস্মিতা কেঁদে ফেলে বলল... অরিত্রদা প্লিজ তুমি আর আমার সাথে দেখা কোরো না। আমি সত্যিই আর পারছি না। অরিত্র চুপ করে থেকে ওর কথাগুলো শুনে বলল...আমি তো তোমার কাছে কিছু আশা করে আসি না সুমি, এতদিন কারুর কাছে নিজেকে এতটা খুলে ধরতে না পেরে হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছিলাম...তাই হয়তো তোমাকে বলতে পারি বলে বার বার ফিরে আসি। সুস্মিতা নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে বলল...জানি অরিত্রদা, কেন জানি না আমি তোমার এই অবস্থায় নিজেকে খুব দুর্বল করে ফেলছি, ইচ্ছে করছে তোমার পাশে দাঁড়াই আরো বেশী করে কিন্তু ভেবে দেখলাম সেটা ঠিক হবে না। অনেক কষ্ট করে কিছুটা হলেও তোমাকে ভুলতে পেরেছি, তার থেকেও বড় কথা ও আমাকে বিশ্বাস করেছে, আমি ওকে ঠকাতে পারবো না। ওর এই কথার পর আর কিছু বলার ছিল না অরিত্রর। যদিও বা এতদিন পর কাউকে বলতে পেরে কিছুটা হালকা হতে পারার সুযোগ এসেছিল, সেটাও আর সম্ভব হল না ধরে রাখা যেখানে ও সুস্মিতাকে কোনোভাবেই দায়ী করতে পারবে না। সবকিছু মেনে নিয়ে আসার আগে ও বলে এসেছে...যদি পারো আমাদের যে দেখা হয়েছিল ভুলে যেও। বিশ্বাস করো আমিও চাইনা আমার জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হোক। সুস্মিতা উঠে এসে ওর হাত ধরে বলেছিল...প্লিজ অরিত্রদা তুমি আমকে ভুল বুঝলে না তো? অরিত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিয়েছে... ভুল বোঝার কিছু নেই সুমি।
 
পুজ়ো এসে গেল প্রায়, কোনো কিছুই আর এবারে করা হয়ে ওঠেনি…কারুরই মানসিকতা ছিল না কিছু করার…এই পুজ়োটা বোধহয় ওদের জীবনের সব থেকে খারাপ কাটবে। দাদুরা বারন করলেও তার ভেতরেই ও একা গিয়ে সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে এনেছিল পুজোর ঠিক আগে আগে…যতই নিজের বুকের ভেতরে কুরে কুরে খেয়ে যাওয়া যন্ত্রনা থাকুক, যাকে যা দেবার তাতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে সেদিকে যতটা সম্ভব নজর দিয়েছে ।মৌকে আর নিজের হাতে দিতে পারেনি,দিদানের হাতে দিয়েছিল ওকে দেবার জন্য। পরে দিদানের কাছে শুনেছিল, মৌ নিয়েছে ওটা, কিন্তু দেখে বোঝা যায়নি ও খুশী কি খুশী নয়। দেখতে দেখতে পূজো এসে গেল। সপ্তমীর সন্ধে, দাদুরা সবাই পুজোর ওখানে, না গেলে অনেকে অনেক প্রশ্ন করবে তাই যেতে হয়েছে। অরিত্র শরীর খারাপ বলে যেতে পারবে না জানিয়ে দিয়েছে আগেই। এক মাত্র শুভ জানতো আসল ঘটনাটা…ও বাকিদেরকে সামলে নিয়েছিল আগেই। রাত প্রায় নটা বাজে, অরিত্র একা একা ছাদে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল…চারিদিকে আলোর রোশনাই, ঢাক বাজছে পূজো প্যান্ডেলে…সবার মনে খুশী, ওর মনের ভেতরে শুধুই অন্ধকার। গত বছর এই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। মৌকে নিয়ে বেরিয়েছিল ওই রাতে ওর পছন্দ করে দেওয়া ড্রেসটা পরে। সত্যিই ওকে খুব সুন্দর লাগছিল সেদিন ওই জমকালো পোষাকে। ওর সাথে বেরোতে পেরে কি না খুশী ছিল সেদিন ভাবতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। সব কটা প্যান্ডেলে গাড়ী থেকে নেমে ও অরিত্রর গা গা ঘেঁষে হাত চেপে ধরে থাকছিল, মনে হচ্ছিল যেন ঠাকুর দেখার জন্য ও বেরোয় নি। ওর আসল ইচ্ছে অরিত্রর সাথে একেবারে একা একা থাকবে। রাত দুটো নাগাদ ওকে কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে লাজুক হেসে মুখ নীচু করে নিয়েছিল। ওর মুখটা তুলে ধরে বলতে হয়েছিল…এই মৌ… কিছু খাও…সেই কখন খেয়েছো। ইশারা করে কিছুটা দুরের একটা ফুচকার দোকান ও দেখিয়েছিল তারপর। সামান্য ফুচকা খেতে চাওয়ার কথা জানাতে গিয়ে ওর লজ্জা পাওয়া দেখে ভালো লাগার সাথে সাথে হাসিও পেয়েছিল। ফুচকাওয়ালার বোধ হয় আজ ভালো বিক্রি হয়নি বা অনেক সময় কোনো কাস্টমার ছিল না। ওদের দুজনকে পেয়ে বেশ যত্ন করে আস্তে আস্তে দিচ্ছিল যাতে ওদের খেতে অসুবিধা না হয়, একা একা ও খেতে রাজী না হওয়ায় নিজেকেও খেতে হয়েছিল ওর সাথে। মনে আছে, একটা ফুচকা হাতে নিয়ে সবে মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল…মৌ এর দিকে তাকালে, বুঝেছিল…ওটা ওকে খাইয়ে দিতে হবে। হাসি মুখে ওর দিকে এগিয়ে দিলে খুব খুশী হয়ে খেতে খেতে নিজেরটা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছিল…এবারে আমি তোমাকে খাইয়ে দেবো। তারপরের গুলো ওরা একে অপরের হাতেই খেয়েছিল। ওদের এত খুশী দেখে বুড়ো ফুচকাওয়ালাও যেন ওদেরকে খাওয়ানোতে মজ়ে গিয়ে নিজেই হিসেব গুলিয়ে ফেলেছিল প্রায়। ভোর সাড়ে তিনটের সময় ফিরে বাড়ীর সামনে গাড়ীটা থামাতেই ও হাতটা চেপে ধরে কিছু যেন বলতে চাইছিল। ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সামনের দিকে ইশারা করে বুঝিয়েছিল ওকে নিয়ে নদীর পাড়ে যেতে হবে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেউ কোথাও নেই…নির্জন নদীর পাড়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপরে ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে। হাওয়াতে মোটামুটি ঠান্ডার আমেজ… ওদেরকে যেন আরো ঠান্ডার অনুভুতিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। শুধু কি ঠান্ডা হাওয়া ওদেরকে মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল? হয়তো শুধু তাই নয়…আরো কাছাকাছি আসার ইচ্ছেতেই হয়তো শীত করছিল দুজনের। কখন ওরা আরো কাছাকাছি এসে দুজনে দুজনের সান্নিধ্যে থেকে একে অপরের শরীরের উত্তাপে নিজেকে তৃপ্ত করেছে বুঝতে পারেনি…দুরে কোথাও থেকে কোনো মসজিদের আজান কানে ভেসে এলে ইচ্ছে না থাকলেও উঠতে হয়েছিল…ভোর হতে যে আর দেরী নেই।

এবছর আর কোথাও বেড়াতে যাবারও প্রশ্ন ছিল না। অফিস যেতে হয় তাই যায়… ওখানে কাউকে বুঝতেও দিতে চায়নি যে ওর কিছু হয়েছে…কিন্তু ওকে চুপচাপ থাকতে দেখে অনেকেই প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছে। কালী পূজোর পর আবার অফিস থেকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে বললে জানিয়েছে দু একদিন পরে জানাবে যেতে পারবে কিনা। দাদুদেরকে বলাতে, না করেনি… ‘দিন গুলো তো কেটে যাচ্ছে… তুই না থাকলেও চলে যাবে…যা ঘুরে আয়’ বলেছে দাদু।

সবকিছু ভালোয় ভালোয় ঠিক হয়ে গেলে পর মামারা ফিরে গেলেও দাদু ফিরতে পারেনি। মৌ বায়না করে বলেছে দাদু...ও দাদু, আর কটা দিন থেকে যাও না। কি করবে ওখানে গিয়ে। আরে তোর বিয়ের জোগাড় যন্ত্র করতে হবে যে বলাতে মৌ দাদুর হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছে...ও ঠিক হয়ে যাবে, মামা আছে তো...তুমি থাকো এখানে। আর কিছু করার ছিল না দাদুর, নাতনির বায়না রাখতেই হয়েছে। সময় কাটাবার কোনো অসুবিধাই নেই এই বাড়ীতে। দুই দাদুর সারাদিন কেটে যায় দাবার বোর্ডে চাল দিতে দিতে গল্প গুজবে। মোক্ষম একটা চাল চেলে এদিকের দাদু বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার নাতনীর খুব দেমাক হয়েছে। ওদিকের দাদু নাতনীর দেমাক হয়েছে শুনে দাবার চাল দিতে ভুলে গিয়ে একটু ভয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে? মেয়ের তরফের দাদু, একটু ভয় তো হবেই। এদিকের দাদু একটু গম্ভীর হয়ে বলল...আরে মশাই...ওই টুকু পুঁচকে মেয়ে...সাত চড়ে রা বেরোয় না আর বলে কিনা তোমার নাতি তো আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে... আমি বেঁচে থাকতে কিনা আমার নাতবৌ ডাল ভাত খেয়ে থাকবে... বুঝলেন কিছু?

মুখুজ্জে মশাইয়ের এতক্ষনে ধড়ে প্রান ফিরে এসেছে, হেসে ফেলে বললেন... তা কি নিয়ে মেয়ের এত দেমাক দেখাতে হল?
- আর বলবেন না, আমি শুধু বলেছিলাম...তোর দিদান গয়নাগুলো দিতে চাইছে তো নিবি না কেন... সোনা দানা তো মানুষ ভবিষ্যতের জন্য ভেবেও রাখে নাকি? তার উত্তরে বলে কিনা, কি হবে আমার এত গয়না...তোমার নাতি আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে...উঃ, কি দেমাক...আরে বাবা, পেলি কোথায় আমার নাতিটাকে... কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলাম বলেই না...
মুখুজ্জে মশাই আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বললেন...ঠিক বলেছেন মশাই, এত দেমাক ভালো নয়। আসলে আজকালকার ছেলে মেয়ে তো...বুঝতেই পারছেন...

মৌ দাদুদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছিল, ট্রে টা টেবিলের এক পাশে রেখে টিপট থেকে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল... কি হয়েছে দাদু?
ও মুখ নীচু করে থাকায় দেখতে পেলো না যে দুই দাদুর ইশারায় কিছু কথা হয়ে গেছে, তারপরেই দাদু বললেন...আমি তোর দাদুকে তোর ওই ডাল ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা বলছিলাম আর কি...আমাদের অনেক পয়সা বেঁচে যাবে তো...
মৌ চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল... বুঝেছি, তুমি নালিশ করছিলে...
দাদু ওকে মুখ ভার করে কথাটা বলতে দেখে ওর হাত ধরে কাছে বসিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার এই নাতনিটি একটু অভিমানী। আসলে কি জানেন...আমরা একটু বেশী ভালোবাসি তো... তাই মেয়ের আমার এত অভিমান...
দাদু মজা করছে বুঝতে পেরে মৌ আদুরে গলায় বলেছে...ইস, আমি অভিমানী? যাও তোমার সাথে আমি কথা বলবো না...
দাদুও সাথে সাথে বলেছে...ইশ, কথা বলবো না বললে আমি শুনছি না..সেদিন যে বললাম আমি তোর বুড়ো বর...গা হাত পা টিপে দিবি...আমার বুড়ি তো আর পারে না আজকাল...
মৌ আর থাকতে না পেরে উঠে যেতে যেতে বলল...ধ্যাত, তোমাকে আমার বিয়ে করতে বয়েই গেছে...দিদানকে গিয়ে বলছি দাঁড়াও...তোমাকে আচ্ছা করে দেবে...

ওদের দাদু নাতনির খুনসুটি দেখতে দেখতে ওদিকের দাদুর চোখে জল এসে গেছে...মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে এত গুলো বছর কিন্তু এখানে যে ও সুখে থাকবে সেটা বারে বারে বুঝতে পেরে দাদু ধুতির কোন দিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলেও মৌ বা এদিকের দাদু কিন্তু একেবারেই খেয়াল করতে পারেনি মানুষটা আনন্দে চোখের জল ফেলছে...
 
পরের দিন সকালে যথারীতি অরিত্র পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, রুপসা ওর কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে করে ঝাঁকালে চোখ খুলে একবার তাকিয়ে আবার ঘুমোবার জন্য চোখ বুজে ফেললো…রুপসা ধপাস করে ওর পাশে বসে পড়ে বলল…এই দাদাভাই ওঠ না…

অরিত্র কোল বালিশ টাকে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে বলল…আর একটু ঘুমোতে দে না বাবা…তাড়াতাড়ি উঠে কি করবো…

রুপসা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দুষ্টুমি করে বলল…তোর জন্য কেউ একজন আসছে…তাই তাড়াতাড়ি উঠবি…আর…কোলবালিশটা কে এমন করে জড়াবার কি আছে…বাড়ীতে তো একজন আছেই জড়িয়ে ধরার জন্য…তার কাছে যেতে পারছিস না?

এই…রুপসা…ভালো হবে না বলছি…

ইস…ভালো হবে না বলছি…কি করবি রে তুই আমার… ব্যাটা বুদ্ধুরাম…কিচ্ছু বুঝিস না…

অরিত্র ঘুরে শুয়ে রুপসার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল…খুব প্রিয় কেউ একজন হাতে একটা ট্রে…তিনটে চায়েরকাপ তাতে…ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…

রবিবারের বাজার টা সাধারনত অরিত্র ই করে, মোটামুটি সারা সপ্তাহে কি কি লাগতে পারে দেখে নিয়ে চলে আসে। বাজার থেকে ফিরে ক্লাবে গিয়ে একবার ঘুরে এলো…কালচারাল প্রোগ্রামের মিটিং ছিল…এবারে ওকে জয়েন্ট সেক্রেটারী করে দিয়েছে জোর করে…না গেলে খারাপ দেখাতো…ক্লাব থেকে ফিরে এলে দিদান বললো…রুপসা তোকে দুবার খুঁজে গেছে…। ঘরে ঢুকে দেখে দুজনে কালকের মতো গল্প করছে…রুপসা সরে গিয়ে ওকে বসতে বলে বলল…খুব মজা করছি রে দাদাভাই…আমি কিন্তু সব বলে দিয়েছি…বলেই মুখ টিপে হাসতে শুরু করল…

সব বলে দিয়েছিস মানে…বুঝলাম না…কি বলেছিস?

আরে সেই যে তোর আমাদের বাড়ী থেকে পালাতে গিয়ে বাগানে পা মুচকে সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে পড়ে থেকে ধুম জ্বর এসে গিয়েছিল…

অরিত্র হেসে ফেলে বলল…ও আচ্ছা…কি জন্য পালাতে গিয়েছিলাম সেটাও বলেছিস নাকি?

বলবো না মানে…ওটাই তো আসল ব্যাপার…না বললে কি করে বুঝবে।

রুপসা…তুই না একটা যা তা…লজ্জা বলে কিছু নেই…ওটা আবার কেউ বলে নাকি।

রুপসা হেসে ফেলে বলল…দাদাভাই…মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানিস? তুই বোধ হয় ছেলেদের মতো দেখতে একটা মেয়ে... তোকে চুমু খেতে ইচ্ছে হয়েছিল…তাই খেয়েছিলাম…এতে আবার লজ্জার কি আছে? বয়স কম ছিল…

থাক তোকে আর পাকামো করতে হবে না…নিজের মাথা টা খারাপ আর এখন ওর মাথা টা খারাপ করছিস।

রুপসা মৌ এর দিকে তাকিয়ে বলল…জানো তো…দাদাভাই তার পর প্রায় এক বছর আমার সাথে কথা বলেনি…কত সাধ্য সাধনা করে যে বাবুর রাগ ভাঙ্গাতে হয়েছিল সে আমি জানি…

রবিবার দুপুরে এমনিতে খেতে কিছুটা দেরী হয়, আজ দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে রুপসা এসেছে বলে অনেক রকম রান্না করতে গিয়ে আরো একটু বেশী দেরী হয়ে গিয়েছিল। অরিত্র খাওয়ার পর কিছুক্ষন গড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল, সবাই বোধ হয় ঘুমোচ্ছে ভেবে ছাদে গিয়ে চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল…মাঝে মাঝে মনটা খুব অশান্ত হয়ে উঠছে…কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না…কখন যে রুপসা এসেছে বুঝতে পারেনি। রুপসার ডাকে ফিরে তাকালো…কি রে দাদাভাই…কি ভাবছিস?

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…না…সেরকম কিছু না…এমনি ই ঘুম আসছিল না…

দাদাভাই তুই তো ভবানীপুরের বাড়ীতে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকতে পারিস…ছোড়দিরা খুব দুঃখ করছিল…

না রে…তুই যতটা সোজা ভাবছিস…তা নয়…উপরের ঘরটা তে গেলেই মনে হয় বাবা বসে আছে…বুকের ভেতর টা কেমন যেন গুমরে ওঠে…শুনেছি বাবা নাকি আমাকে খুব ভালোবাসতো…অফিস থেকে ফিরে আগে আমাকে কোলে নিয়ে আদর …তারপর…অন্য কাজ…গত বছর একদিন গিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিলাম…সারারাত ঘুমোতে পারিনি…খালি মনে হচ্ছিল…মা বাবা…আমার দুদিকে বসে…বার বার বলছে…দুষ্টু…তোর দাদু দিদান খুব অসহায়…ওদের কে কোনো কষ্ট দিস না রে… তুই তো জানিস…রুপসা…দাদু, দিদান আর শুক্লাদির আমি ছাড়া আর কেউ নেই, তিনটে মানুষ আমার মুখ চেয়ে বেঁচে আছে…ওদের কষ্ট হবে ভেবে আমি কোথাও যেতে পারিনা…অফিস থেকে বার বার চাপ দিচ্ছে দু বছরের জন্য সিডনি যেতে…কোনো রকমে আটকে রেখেছি কিন্তু সামনের ডিসেম্বরে অন্তত দু মাসের জন্য যেতে হবেই। জানিনা কি হবে…দেখা যাক…যদি আটকাতে পারি…চাকরীটা ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম কিন্ত যেখানে জয়েন করবো সেখানেও তো একই রকম কিছু হতে পারে ভেবে আর এগোই নি… জানি না আমার জীবনে কেন এত সমস্যা…তোরা উপর থেকে হয়তো মনে করিস আমার মতো সুখী আর কেউ নেই…এত সম্পত্তি…দাদুর যা আছে আমি পাবো…ওদিকে ভবানীপুরে এত বড় বাড়ীর ভাগ…বম্বের মতো জায়গায় দু দুটো ফ্ল্যাট…ভালো চাকরী…কিন্তু মনের ভেতরে যে কি আছে আমিই জানি…ভীষন ভয় করতো…যার সাথে বিয়ে হবে সে দাদুদের কে মানিয়ে যদি না নিতে পারে…তার পর জীবনে এলো মৌ…যার দাদুদের কে মানিয়ে না নেবার কথা ভাবার কোনো প্রশ্ন উঠছে না কিন্তু…

রুপসা চুপ করে ওর কথা শুনছিল…থেমে যেতে দেখে ওর দিকে তাকালো…কিন্তু কি দাদাভাই…আমি যতদুর বুঝেছি…মৌ তোকে ভীষন ভাবে চায়…

জানি…

তাহলে? আটকাচ্ছে কোথায়?

ওর অতীত…আমরা তো কেউ জানিনা ও কে…

দাদাভাই…অতীত নিয়ে ভেবে কি লাভ আছে আমি জানি না…

জানি লাভ নেই…কিন্তু…এমনও তো হতে পারে ওর কেউ খুব কাছের আছে…কোনোদিন যদি ওর স্নৃতি ফিরে আসে আর ও তার কাছে ফিরে যেতে চায়…আমার কি উচিত হবে ওকে আটকানো…নাকি…আমি পারবো…

দাদাভাই…এখানে অনেক গুলো যদি আছে…এমন ও তো হতে পারে…তুই যা ভাবছিস … তা নয়… I feel…if you want to see the Light then you have to face the Dark….

অরিত্র কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল…জানি…আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না…
 
ঝড় বৃষ্টির পর চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে। শুক্লাদি এসে দুবার ডেকে গেছে চা খাবার জন্য। অনেক দিন হয়ে গেছে ও আর এখানে একা একা চা খায় না...নিচে গিয়েই খেয়ে আসে। উঠি উঠি করেও যেতে ইচ্ছে করছে না... যদি মৌ এসে ফিরে যায়? কি করবে ভাবতে ভাবতে ...... কখন মৌ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারেনি। ওকে দেখতে পেয়েই আবার সেই সকালের মতো অভিমান বুকে দানা বাঁধতে শুরু করলেও মনের শেষ আশাটুকুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়ে ওকে ভেতরে ডাকলো। মৌ ভেতরে এসে একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...’তুমি তো মাঝে মাঝেই থাকো না…দাদুদের বয়স হচ্ছে…কিছু ভেবেছো’? অরিত্র ওর কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল... ‘কি ভাববো’? কিছুক্ষন ও চুপ করে থাকার পর বলল ‘তুমি যখন থাকো না তখন দাদুদের দেখা শোনার জন্য তো কাউকে চাই। অরিত্র ওর কথার উত্তরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আস্তে করে বলল...তুমি তো আছো। ‘আমি যে নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি’ বলতে গিয়েও বলতে পারলো না মৌ। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো ওর। অরিত্র ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ’কিছু বললে না তো’? প্রশ্নটা শুনে ও অস্ফুট স্বরে বলল ‘আমার কি আর এখানে থাকা ঠিক হবে’?

- আমাদের দিক থেকে কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
- না।
- তাহলে?
- আমার মনে হয় চলে যাওয়া উচিত আমার।
- কেন?
- কেউ তো আসবে… আজ না হয় কাল।


অরিত্র অবাক হয়ে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ‘তুমি কি আমার বিয়ের কথা বলছো’? মৌ এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘হ্যাঁ। অরিত্র বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো… যাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবেসে ফেলেছে তার মুখে ওকে ওন্য কাউকে বিয়ে করতে বলাটা যে কি যন্ত্রনার সেটা ওর থেকে হয়তো ভালো কেউ বুঝবে না। অরিত্র চুপ করে বসে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তোমার যদি অন্য কোনো কিছু কারন থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই’। ওর উত্তরটা শুনে মৌ যেন নিজের মনেই বলল...কিসের অধিকারে থাকবো? অরিত্র কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না…ও অধিকারের কথা কেন বললো? কি বলতে চাইছে? মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এলে, ও যা ভাবে ভাবুক…আর তো নতুন করে হারানোর কিছু নেই ভেবে কোনোরকমে বলল ‘অধিকার চাইলেই পেতে পারো কিন্তু তুমি তো চাইছো না। কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকায় বুঝতে পারছিল না ওর প্রতিক্রিয়াটা কি…বেশ কিছুক্ষন কেটে গেলেও কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো…মৌ নিজের কোলে মুখ গুঁজে বসে নিঃশ্বব্দে কাঁদছে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না… কোনোদিন ওকে নিজের অজান্তে হলেও কাঁদাবে ভাবেনি…আজও চায়নি… কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতে উঠে গিয়ে পাশে বসে ওর পিঠে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল…’প্লিজ…আমি বুঝতে পারিনি…তোমার এতটা খারাপ লাগবে’…
নিজেকে আর বোধ হয় ও আটকে রাখতে পারলো না…ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলতে চাইলো ‘আমি নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি যা তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে। অরিত্র চুপ করে বসে থাকলো… ও এত কাঁদছে যে এই মুহূর্তে ওকে কিছু বলা আর না বলা একই ব্যাপার। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে, আস্তে আস্তে কান্না থেমে গেলেও আগের মতো মুখ গুঁজে বসে ছিল…হয়তো বুঝতে পারছিল না… মুখ তুলে কি শুনতে হবে… জীবনে কোনোদিন কিছু না পেয়ে আজ কিছু পাওয়ার সন্ধিক্ষনে এসেও বুঝতে পারছিল না কি করবে।

আরো কিছুক্ষন কেটে গেল… কিছু একটা শুনে আস্তে আস্তে মুখ তুলে এতদিন অভিমান বুকে করে নিয়ে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিজেই বুঝতে পারছিল না যা শুনেছে ঠিক কিনা… সত্যি না কি স্বপ্ন দেখছে… নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে না পেরে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল… মন চাইছে … আরো একবার নয় … বার বার ওই কথাটা শুনতে … সত্যিই যে ও বিশ্বাস করতে পারছে না … অরিত্রর মোবাইলটা বেজে বেজে থেমে গেল… প্রয়োজন মনে করল না উঠে গিয়ে ফোনটা ধরার… এই মূহুর্তে ফোন ধরার থেকে অনেক বেশী প্রয়োজন ওর পাশে থাকা… না হলে যে ওকে সারা জীবন কিছু না পাওয়ার ব্যাথা বুকে করে নিয়ে বেড়াতে হতে পারে… ওর পাশে বসে থাকা একজন যে এখোনো ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি…আজ যে ওর প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে… হারিয়েও ফিরে পাবার এত কাছে এসে আবার হারানোর ব্যাথা ও পারবে না সহ্য করতে ভেবে জিজ্ঞেস করল… ‘কই ব’লো’…
কান্না ভেজা গলায় মৌ প্রশ্ন করলো ‘আমার ভুলটা কি না জেনেই এগোবে’?
- আমার আর কিছু জানার নেই মৌ…তোমাকে আমি যা জানি তাই আমার কাছে যথেষ্ট...
- তবুও, আমার অতীত…তোমার জানা উচিত...
- তোমার অতীত নিয়ে আমি জানতে চাই না…ভাবতেও চাই না ...
ওর দৃঢ স্বরে বলা কথাটা শুনে মৌ কয়েক মুহুর্ত থমকে গিয়ে আস্তে করে বলল...আমি চাই না…ভবিষ্যতে তোমার আমার কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক।
- ঠিক আছে… তুমি যদি চাও… বলতে পারো।

বেশ কিছুক্ষন চুপ করে হয়তো নিজের সাথে বোঝাপড়া করল ও… আস্তে করে বলল… ‘আমি কারুর সাথে চলে যাবার জন্য বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। অরিত্র অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে, তাহলে কি ওর মায়ের কোনো ভুমিকা ছিল না? ওকে কিছু একটা চিন্তা করতে দেখে হয়তো মৌ বুঝতে পেরেছিল ও কি ভাবছে… আবার ও আস্তে আস্তে বলল… ‘মায়ের জন্যই বেরিয়ে আসতে হয়েছিল… না হলে কি হত জানি না’।
- যার সাথে যেতে চেয়েছিলে সে আসেনি?
- না
- কেন?
- তখন বুঝতে পারিনি
- তুমি কি তাকে ভালোবাসতে?
- হয়তো।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...
অরিত্র বুঝতে পারছে না বলাতে মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... ‘বিল্টুকে একজন পড়াতে আসতো বাড়ীতে… ভাই এর পড়াশোনা নিয়েমাঝে মধ্যে কথা হোতো আমাদের। আগে কোনো ছেলের সাথে না মেশায় হয়তো কিছুটা হলেও আমার ভেতরে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। তারপর যখন বুঝতে পারলাম মায়ের দিক থেকে বিপদ আসছে, কি করবো ভেবে না পেয়ে ওকেই ভরসা করে বাড়ী ছাড়তে চেয়েছিলাম’…
অরিত্র কিছুটা সময় ওর থেকে শোনা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল...তুমি কি ওকে তোমার দুর্বলতার কথা জানিয়েছিলে?
- না
- তারপর?
- ওকে কারনটা বলিনি…শুধু বলেছিলাম আমাকে বাড়ী থেকে চলে যেতে হবে।
- কি বলেছিল? আসবে?
- হ্যাঁ
- আসেনি...তাই তো?
- হ্যাঁ
- তুমি একদিন যেন একা একা কোথাও গিয়েছিলে?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… জানতে গিয়েছিলাম কেন আসেনি …
- তোমার কি তখোনো সেই সামান্য হলেও দূর্বলতাটা ছিল?
- ঠিক তা নয়, খুব খারাপ লেগেছিল তাই মনে হয়েছিল জানা দরকার...
- দেখা হয়েছিল?
- হয়েছিল।
- আসেনি কেন?
- মা যদি ওর কিছু ক্ষতি করে ভেবে ও ভয় পেয়েছিল...এছাড়াও আগে থেকেই একজনের সাথে রিলেশান ছিল তাই আর আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চায়নি।
- তোমার দিক থেকে যখন তেমন কিছু ছিল না তো ওটা নিয়ে ভাবছো কেন?
- কিছুটা হলেও তো ছিল…তোমার সব কিছু শোনার পর মনে হয়েছিল ঠকানো ঠিক হবে না…অনেকবার ভেবেছিলাম চলে যাবো কিন্তু ভয় পেতাম যদি তুমি কিছু করে ফেলো… বলতে পারো দোটানায় পড়ে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত...
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…
- কি?
- তুমি সেদিন ফিরে এসে কেন কেঁদেছিলে…
- নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল…জানতাম তোমার কাছে ফিরতে চাইলে তুমি না করবে না কিন্তু নিজেই পারছিলাম না… আবার চলেও যেতে পারছিলাম না…
- আমি যদি বলি ওটা কোনো ব্যাপার নয়…তুমি আমার কাছে যা ছিলে তাই থাকবে…
- তবুও আমার মনে হচ্ছে…তুমি একবার ভেবে দেখো… সারাটা জীবনের ব্যাপার...
- ঠিক আছে…তুমি যখন চাইছো…তাই…আরো ভালো করে ভেবে দেখবো…

এরপরে হয়তো আর কারুর কিছু বলার ছিল না এই মুহুর্তে। মৌ আরো কিছুক্ষন বসে থাকার পর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে আমি আসি? অরিত্র হয়তো কিছু ভাবছিল, ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে থেকে তখুনি বলতে ইচ্ছে করছিল...আমার আর নতুন করে ভাবার কি আছে... তারপরেই মনে হল ...না থাক, আমি তো কথা দিলাম ভেবে দেখবো বলে। কথা যখন দিয়েছি আর ও যখন আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে তাহলে আর তো কোনো ভয় নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বলে ফেলল...এখুনি চলে যাবে? আর একটু বোসো না...
 
এদিকে বিয়ের নানান কাজের সাথে সাথে আরো একটা গুরুত্বপুর্ন কাজ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপার রয়েছে। মৌয়ের ইচ্ছে বিয়ের আগেই ও বাড়ীর ভাগ, টাকাপয়সার ব্যাপারে যা যা করার করে ফেলবে কিন্তু তার জন্য একবার হলেও ওকে বাড়ী যেতে হবে মায়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। না গেলেও চলতো কিন্তু কাজটা করতে গেলে বাবার ডেথ সার্টিফিকেটের কপি আর ওর ব্যাঙ্কের কাগজপত্র যা আছে সেগুলো লাগবে। কাজটা ভাবতে যত সোজ়া, কাজে মোটেও ততটা সোজ়া নয়। এখন ও আর সেই বাধ্য হয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করার জায়গায় নেই, এদিকের সবাই ছাড়াও নিজের ভাই বোন ওর পাশে আছে, তবুও কিছুটা হলেও চিন্তা আছে ঠিক কি দাঁড়াবে ব্যাপারটা, মাকে কি আগেই জানিয়ে দেওয়া হবে যে ও যাচ্ছে নাকি বিল্টুদের কাছ থেকে মা কবে থাকবে জেনে নিয়ে কিছু না বলেই চলে যাবে সেটা ঠিক করা যাচ্ছিল না। সে যাই হোক একটা ভেবে ঠিক করা যাবে, এখন যেটা করার দরকার সেটাই করা হোক ভেবে একজন ভালো লইয়ার ঠিক করা হয়েছে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় জানা গেল উনি এক সময়ে দাদুর ছাত্র ছিলেন। পরিচয় পাওয়ার পর উনি খুব মন দিয়ে সমস্ত ঘটনা আর কি করতে চাওয়া হচ্ছে শুনে বললেন চিন্তা করার কারন নেই, উনি যতটা সহজে কাজটা করা যায় করে দেবেন, তেমন হলে মৌকে যেতেও হবে না...রেজিস্টারকে বাড়ীতে এনেও কাজটা করা সম্ভব।

সবার সাথে আলোচনা করে মৌয়ের মতামত নিয়ে ঠিক করা হয়েছে আগে থেকে খবর না দিয়েই যাওয়াই ভালো। সেই মতো বিল্টুর কাছ থেকে খবর নিয়ে সপ্তাহ দুয়েক পরে যাওয়া হবে ঠিক করা আছে। যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে যাবার পর থেকেই মৌকে মাঝে মাঝে কিছুটা অন্যমনস্ক হতে দেখা যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে...’কই কিছু না তো’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেস্টা করেছে। হয়তো ও এখোনো কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছে ভেবে ওকে বোঝানো হয়েছে যাতে ওখানে গিয়ে আবার ভেঙ্গে না পড়ে কারন ওর উপরেই অনেকটা নির্ভর করছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সবার সামনে ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বললেও পরে অরিত্রকে একা পেয়ে চুপি চুপি বলেছে... মায়ের সাথে যদি ঝগড়া করার দরকার হয় তাই রিহার্সাল দিচ্ছিলাম...বুঝেছো। অরিত্র ওর ঝগড়া করার কথা শুনে কিছুক্ষন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে হাসি মুখে বলেছে... বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? অরিত্র আরো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল...তুমি করবে ঝগড়া আর আমাকে তাই বিশ্বাস করতে হবে? এ তো সেই সোনার পাথর বাটির মতো কিছু একটা হবে। মৌ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... আচ্ছা ঠিক আছে বিশ্বাস করতে হবে না... আমি না হয় ওখানে গিয়ে কিছু করলাম না কিন্তু তোমার সাথে তো ভবিষ্যতে একটু আধটু করতে হবে আর তার জন্যও তো এখন থেকে শিখতে হবে...নাকি। অরিত্র এবারে আর না হেসে পারলো না ওর কথা বলার ভঙ্গীতে...কোনো রকমে হাসি চাপতে চাপতে বলল...বুঝলাম, কিন্তু আমার সাথে ঝগড়া করতে এলে কি হবে জানা আছে তো? অরিত্র ওকে কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে মৌ কাছে এসে আস্তে করে বলল...বয়ে গেছে আমার... পাজি কোথাকার...

সব কিছুই প্ল্যান মতো এগোচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে পাওয়া একটা খবর পুরো ব্যাপারটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বিশ্বাস কাকু অনেক দিন ধরেই চেস্টা করছিলেন ভেতরের কিছু খবর জোগাড় করার জন্য কিন্তু হঠাৎ করে যে এরকম একটা খবর পাওয়া যাবে নিজেই হয়তো জানতেন না। মৌয়ের বাবার মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়নি, ওটা করানো হয়েছিল এবং সেটাও আবার বাইরের কারুর করানো নয়। এতবড় একটা মর্মান্তিক খবর কিভাবে মৌকে জানানো হবে বা আদৌ এখন জানানো হবে কিনা সেই নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনার পর ঠিক করা হয়েছে না জানানোই ভালো এই মুহুর্তে, আবার একটা শক পেয়ে যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আর কিছু করার থাকবে না হয়তো। এত সমস্যার পর সবকিছু একটু একটু করে পরিনতির দিকে এগোচ্ছে, কেউই চাইছিল না নতুন করে আবার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে। ওকে এই মুহুর্তে জানানো হবে না ঠিক করলেও অরিত্র ব্যাপারটা নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল এই ভেবে যে পরে যদি ও জানতে পারে যে সব কিছু জেনেও ওকে জানানো হয়নি তাহলে খারাপ ভাবে নিতে পারে, যতই হোক ও বাবাকে এখোনো ভীষন ভাবে মিস করে। এই মুহুর্তে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়েছে অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করে তাই আর ওটা নিয়ে নিজের মনে যাই থাকুক না কেন সেটাকে চেপে রাখতে হয়েছে যাতে মৌ ওকে দেখে কিছু বুঝতে না পারে কারন ও যদি নিজের থেকে এসে জিজ্ঞেস করে তাহলে ওকে ভুল বোঝানো যাবে না, তাতে সারা জীবনের মতো একটা অবিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়ে যেতে পারে।
 
অরিত্র মন দিয়ে ওর লেখা পড়তে পড়তে ভালোলাগার রেশ বুকে নিয়ে কিছুক্ষন বসে থাকার পর ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো আগের থেকে ঠান্ডা, জ্বর একটু কমেছে বুঝে মুখ নামিয়ে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে আবার পড়তে শুরু করেছে...

মধুচন্দ্রিমা

সত্যিই কি মিষ্টি শব্দটা...দুটো সুখী হৃদয়ের নিজেদের ভেতরে একাত্ম হয়ে গিয়ে নিজেদেরকে নতুন করে জানার...নতুন করে চেনার.......একে অপরকে বোঝার আর এক নাম....... ম-ধু-চ-ন্দ্রি-মা...
জানি, আমার মতো সুখ সবাই পায় না...সবাই তো আর তোমার মতো ভালবাসতে জানে না আর ভালোবাসা পেতে জানে না। হ্যাঁ, ঠিকই তো ভালোবাসতে গেলে ভালোবাসা নিতেও জানতে হয়...তাই না?
জানো তো...একটু একটু করে আমাদের যাওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল...আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভুতিতে ভরে উঠছিল...ঠিক কিসের অনুভুতি আমাকে জিজ্ঞেস করলেও বলতে পারবো না...সেই অনুভুতি শুধু নিজে অনুভব করা যায়...মুখ ফুটে কাউকে বলা হয়তো যায় না...এতদিন তোমাকে একভাবে দেখার পর...বোঝার পর... সবেমাত্র তোমার ভেতরের আসল মানুষটাকে বুঝতে শুরু করেছি...তোমার সব কিছুই যেন একেবারে নতুন ভাবে আমার কাছে ধরা পড়ছে একটু একটু করে...নতুন করে চেনার ঠিক সেই মুহুর্তে তোমাকে একেবারে নিজের মতো করে কাছে পাওয়ার ইচ্ছেটা যেন আমাকে অস্থির করে তুলছিল...ইশ, না না...তুমি আবার হয়তো ভাবছো যে আমি শুধু ওইসবের কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম...উঁ হু...কথাটা একেবারে সত্যিও নয় আবার একেবারে মিথ্যেও নয়...তোমার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেবার ভেতরে যে কি সুখ তা কি আমি বুঝি না... নাকি চাই না...সাথে সাথে তোমাকে আরো বেশী করে জানার ইচ্ছেটাও ছিল...মনটা ছটপট করে উঠতো...তুমি আর আমি একেবারে নিজেদের মতো করে একে অপরকে কাছে পেলে...তুমি কি করো...কিভাবে আমাকে দেখতে চাও...কিভাবে পেতে চাও জানার জন্য... সাথে সাথে আমাকেও কি করতে হবে ভাবতে শুরু করেছি...আমারও তো তোমাকে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল...আমি যেমন তোমাকে জানতে চাইছি তেমনি তুমিও তো আমাকে আরো বুঝতে চাইতে...তাই না...

দেখতে দেখতে আমাদের যাওয়ার দিন এসে গিয়েছিল...আমরা দুজনে এক বৃষ্টির দুপুরে পৌঁছেছিলাম গোয়া। ভেবেছিলাম আর পাঁচটা হোটেলের মতোই হবে আমাদের হোটেল...সমুদ্রের দিকে মুখ করে আর পাঁচটা হোটেলের মতোই একটা বিল্ডিং... জানো তো কি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওখানে পৌঁছে...চারিদিকে শুধু সবুজ...কিছু চেনা আর কিছু না জানা কতরকমের গাছ, কোনটা ফুলে ভরা, কোনটায় শুধু পাতা...তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছবির মতো সুন্দর এক একটা কটেজ...আমাদের কটেজটা একেবারে উপরের দিকে ছোট্ট একটা টিলার উপরে...বেশ কিছুটা নীচে সমুদ্রের নীল জল...এতদুর থেকে ঢেউগুলোও যেন কত ছোট দেখাচ্ছে... ভেতরে ঢুকে আরো একবার অবাক হবার পালা...এত সুন্দর সাজানো গোছানো...ছবিতে দেখেছি এর আগে কিন্তু ভাবতেই পারিনি তুমি আমাকে নিয়ে আসবে এরকম একটা জায়গায়। আমাকে অবাক হয়ে যেতে দেখে আরো কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে আমার পছন্দ হয়েছে কিনা... তোমার বুকে মাথা রেখে চুপ করে থেকে বুঝিয়েছিলাম আমার ভীষন পছন্দ হয়েছে...আর তার থেকেও বড় কথা তুমি সাথে থাকলে এই পৃথিবীর যে কোন জায়গাই আমার কাছে স্বর্গের চেয়েও সুন্দর...

বিশ্বাসই হচ্ছিল না শুধু তুমি আর আমি...আর কেউ কোথাও নেই...কোনো কিছু ভাবার নেই। দুজনে মিলে যখন যা ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি...সময়ের কথা কে মনে রাখবে বলো... এক একটা মুহুর্ত যেন এক একটা স্বপ্নের টুকরো। তুমি চাওনি সেই স্বপ্নের টুকরো গুলোকে শুধুমাত্র শরীরের কথা ভেবে গুঁড়িয়ে দিতে..ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না...কখোনো বা পাশাপাশি বসে থাকা...কখোনো বা হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাওয়া, সব কিছুতেই যেন আমরা খুশী ছিলাম। তোমার আমাকে নিবিড় করে চাওয়ার সেই সব মুহুর্ত গুলো যেন আজও আমার মনে গেঁথে আছে। আমার সব থেকে ভালো কি লেগেছিল জানো? তুমি একবারের জন্যও চাওনি আমার স্বাভাবিক স্বভাবে কিছু পরিবর্তন আসুক...তুমি চেয়েছিলে তোমার মৌমি সোনা সেই আগের মতোই একটু নরম...একটু লাজুক থাকুক...আমি তোমার অনেক কাছের হয়ে গেলেও যেন থাকে কিছু অদেখা...অচেনা...তুমি মুখে কিছু না বলেও বুঝিয়েছিলে সবই যদি দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে যায় তাহলে কি আর দেখতে চাওয়ার ইচ্ছেটা থাকবে? থাক না একটু আড়াল...

একদিন তুমি আমাকে সাজিয়েছিলে নিজের মতো করে... গলায় পরিয়ে দিয়েছিলে গুলঞ্চ ফুলের মালা, চুলে গুঁজে দিয়েছিলে আরো দুটো ফুল...শুধু কি তাই? হাতেও ছিল ফুলের বালা। তুমি আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিলে...আয়নায় নিজেকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না...ঠিক যেন আমি কোনো স্বল্পবাস দ্বীপবাসীনি... লাজুক মুখে চুপ করে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম... আমার অবাধ্য চোখ দেখতে চাইছিল তোমাকে..নিজের অজান্তেই মুখ তুলে তাকিয়েছিলাম... তুমি চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে...ভাবছিলাম, দুষ্টুটা এখন কি কিছু ভাবছে নাকি শুধুই দেখে যাচ্ছে? না না...শুধু তো দেখছে বলে মনে হচ্ছে না...ওর চোখ দুটো যেভাবে বুজে আসছে মাঝে মাঝে তাতে তো মনে হচ্ছে যেটুকু আবরন আছে আমার শরীরে তা না থাকলে কি হোতো তাই ভাবছে। ইস, কি অসভ্য...না, আমি আর পারছি না এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে...কেমন যেন শিহরন জাগছে... পা দুটো থরথর করে কেঁপে উঠছে...তুমি হয়তো বুঝেছিলে আমাকে...কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলে পাশ ফিরে যেতে চেয়েছি, না...কিছুতেই দেখতে দেবো না তোমাকে... ওইভাবে আবরনের আড়ালে থেকেও নিরাবরন হয়ে যেতে তোমার মনের ক্যমেরায়...শুনবে নাকি তুমি আমার কথা...চুমু দিতে দিতে তোমার একটা দুষ্টু হাতটা কোথায় যেন ঘোরা ফেরা করছিল...আঃ, ইস...উমমম...না-আ...করে বাধা দিলে শুনছেটা কে? আমার নাকের পাটা নাকি ফুলে ফুলে উঠছিল, ফর্সা মুখে রক্ত জমে গিয়ে নাকি আরো মিষ্টি দেখাচ্ছিল...চোখ খুলে রাখতে না পেরে তোমাকে নিজের উপরে টেনে নিয়ে আশ্লেষ ভরা গলায় বিড়বিড় করে কি বলেছি নিজেই জানি না... তারপর? কি জানি তারপর কি হয়েছিল...তুমি কি আমাকে আর কিছু মনে রাখার সুযোগ দিয়েছিল?

আরো একটা রাতের কথা কি ভুলতে পারবো নাকি কখোনো? মাঝ রাত কখন পেরিয়ে গেছে জানিই না... আমাদের কটেজের সামনের বাগানে দোলনায় আমরা দুজনে...তোমার বুকে মাথা রেখে আমি শুয়েছিলাম...আকাশে ঘন মেঘ...মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা হাওয়া এসে চারদিকের গাছগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। পাশের নারকেল গাছ থেকে একটা ডাবের কুশি খসে পড়ল একটু দুরেই... দোলনায় তোমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে থাকতে একবার মুখ তুলে ভালো করে তোমার বুকে নিজেকে আটকে রেখে শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল...নাই বা গেলাম আজ শুতে...এখানেই থেকে যাই না আজ রাতটা... এক ফোঁটা দু ফোঁটা করে বৃষ্টি জল গায়ে এসে পড়ছে...পড়ুক না...কি আসে যায় তাতে...
আস্তে আস্তে বৃষ্টির জোর বাড়ছে...একটু কি শীত শীত করছে? তাই হবে হয়তো...দুরের গার্ডেন লাইটের আবছা আলো বৃষ্টি ভেদ করে এতদুর আসছে না ঠিক...আলো আঁধারের লুকোচুরি আর ঝমঝম বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে দুই প্রেমিক হৃদয় চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে...কোথায় আছে বোঝার কিছু আছে কি? দোলনাতে চুপচাপ শুয়ে থাকা যায়...আদর করা যায় কিন্তু তার থেকে বেশি কিছু? কখন আমাকে বুকে তুলে নিয়ে তুমি গার্ডেন চেয়ারে চলে এসেছে বোঝার দরকার হয়তো ছিল না...তারপর? তারপর তোমার সেই পৃথিবী ভোলানো ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলে...আমিও পারিনি নিজেকে আটকে রাখতে...আমাদের আকাঙ্খার উত্তাপে বৃষ্টির ফোঁটা আমাদের শরীরকে আর ভেজাতে না পেরে হয়তো বাস্প হয়ে ফিরে যাচ্ছিল... হয়তো জ্ঞান হারিয়েছিলাম তোমার আমার সেই ভালোবাসার স্ত্রোতে ভেসে যেতে যেতে...তারপর একটু একটু করে আমি ফিরে পেয়েছিলাম আমাকে...তুমি আমাকে বুকে আগলে রেখেছিলে...কি যে হয়েছিল তারপর কে জানে আমার...এই খোলা আকাশের নীচে তুমি আমাকে ভালোবেসেছ ভাবতে গিয়ে কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলাম না...কিভাবে যে টাওয়েলটা গায়ে জড়িয়ে ফিরে এসেছিলাম কে জানে...তুমি ফিরে এলে আমার পেছনে পেছনে...ভীষন অভিমান হচ্ছিল যখন তুমি আমার দিকে তাকিয়েছিলে দুষ্টুমির হাসিতে তোমার মুখ ভরিয়ে...ভাবছিলাম...না তাকাবো না তোমার দিকে...অসভ্য, জংলী একটা ভুত...ছি ছি...লজ্জা নেই...যদিও এত রাতে ওখানে কেউ থাকার কথা নয়...তবুও কেউ দেখেছে কিনা কে জানে ভাবতে ভাবতে শুনলাম এই, সোনা...তাকাও প্লিজ...তোমার অনুনয়ের গলায় বলা কথাগুলো শুনেও আমি জেদ করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম...তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়ালে...আমাকে বোঝাবার চেস্টা করলে...আমি কি পারবো বলো তোমার কথা ফেরাতে...সবকিছু ভুলে গিয়ে তোমার হাতের বাঁধনে নিজেকে সমর্পন করেছিলাম ...আবার সেই সুখের মুহুর্ত গুলোর কথা মনে পড়ে গেলে আর নিজেও কি করেছি মনে পড়ে গেলে লজ্জা পেয়ে গিয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে শুনলাম এই, চলো স্নান করে আসি। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলেছিলাম...উমম না...এক সাথে না...তুমি আবার দুষ্টুমি করবে। আমি না না করলে কি হবে...তুমি কি শুনবে নাকি? ঠিক সেই আমাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলে... এত সময় বৃষ্টিতে ভেজার পর ভীষন শীত করছিল...তোমার বুকের ভেতরে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম আমি...দুজনে মিলে থেকে উষ্ণ জলের ধারায় ভিজতে ভিজতে অনুভব করেছিলাম তোমার আকাঙ্খার উষ্ণতা...একটু একটু করে সেই উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছিল আমার সারা শরীর মনে...আবার আমরা দুজনে হারিয়ে গিয়েছিলাম দুজনায়...

আর পারছি না গো লিখতে আজ...পরে আবার লিখবো ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সেই গানটার কথা... ‘আজ তবে এইটুকু থাক... বাকি কথা পরে হবে’...
 
এরপরে আরো কিছুদিন কেটে গেছে। মে মাসের মাঝামাঝি, গরম পড়ে গেছে মোটামুটি ভালোই। রবিবারের সকাল, বাড়ীতে থাকলে এখোনো রবিবারের বাজারটা ও-ই করে। বাজার থেকে ফিরে এসে নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজটা দেখছিল। দরজার কাছে কেউ এসে দাঁড়ালো মনে হতে মুখ তুলে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল...যা দেখছে তা কি সত্যি?

মৌ দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠিক বাইরে। অনেকদিন হয়ে গেল অরিত্র থাকাকালীন মৌ এই ঘরে আসে না, আজ ওকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েও বলল… বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন… ভেতরে এসো। বুকের ভেতরে একটা অভিমান দলা পাকিয়ে উঠে আসছিল…বলতে ইচ্ছে করছিল…আজ এতদিন পরে মনে পড়ল আমাকে? মৌকে ভেতরে আসতে বলে খবরের কাগজ়টা ভাঁজ করে পাশে রেখে দিয়ে ভাবছিল…ও নিশ্চয় কিছু বলবে… না হলে তো আসার কথা নয়। ভেতরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে বসতে বলল অরিত্র। এতদিন পর আজ এক ঝলকের জন্য দেখলেও হল একটু যেন রোগা হয়ে গেছে ও। মুখটাও যেন বেশ শুকনো লাগছে। মৌ ভেতরে এসে বসলেও কিছু না বলে চুপ করেছিল। কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে বসে থাকার পর বাধ্য হয়ে অরিত্র জিজ্ঞেস করলো…কিছু বলবে? মৌ মুখ নিচু করে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল…হ্যাঁ। জানলার বাইরের ফুলে ভরা মাধবীলতা গাছটায় একটা টুনটুনি পাখি দোল খাচ্ছিল… অরিত্র পাখীটাকে দেখতে দেখতে বলল…বলো। মনের ভেতরে একটা ক্ষীন আশা উঁকি দিয়ে চলে গেল…এতদিন ধরে যা চেয়ে এসেছি…আজ কি তা পাবো? পরক্ষনেই সেই ক্ষীন আশা বিলীন হয়ে গিয়ে হতাশায় বুক ভরে গেল…কি করে সম্ভব…এই মৌ তো সে নয় যে এক সময় ওকে বলেছিল…’কাছে থাকতে চাও না তো ডাকো কেন’? মৌকে এর পরেও চুপ করে বসে থাকতে দেখে অরিত্র ওর দিকে ফিরে তাকালে ও নিজের আঙ্গুলে ওড়নার এক প্রান্ত জড়াতে জড়াতে বলল…আমার কিছু বলার ছিল। অরিত্র ওকে বলো বলার পরেও কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর বলল…এখন না… বিকেলে। তারপরেই মুখ তুলে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…তুমি থাকবে তো বিকেলে? কয়েক সেকেন্ডের জন্য হয়তো দুজনের চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল নিজেদের অজান্তেই। মৌ ওর চোখে কি খুঁজতে চেয়েছে না বুঝলেও অরিত্র অবচেতন মনে হয়তো খুঁজতে চেয়েছিল ওর চোখের সেই হারিয়ে যাওয়া আকুতি, কিছু বলতে চাওয়ার ইচ্ছে... কিন্তু দেখতে পেলো কি তা? মনে হল ওর দুচোখে যেন যন্ত্রনার স্পষ্ট আভাস, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলল...হ্যাঁ থাকবো। উত্তরটা দিয়ে ও ভাবছিল... এতদিন পরে তুমি আমাকে কিছু বলতে চাইছো... আমি কি পারবো তোমাকে এড়িয়ে যেতে? ওদিক থেকে আর কোনো সাড়া না পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলো মৌ নেই...কখন যেন নিঃশব্দে ফিরে গেছে...

আজ দুদিন হোলো অরিত্র চলে এসেছে, এবারেও সিঙ্গাপুর। বেশ কিছু দিন হয়ে গেল ডাইরি লেখা হয়নি ভেবে দাদুদের সাথে কথা বলা হয়ে গেলে ডাইরিটা ব্যাগ থেকে বের করতে গিয়েও খুঁজে পেলো না। বেশ কিছুক্ষন বসে চিন্তা করেও ঠিক মনে করতে পারলো না এবারে ব্যাগে নিয়েছিল কিনা ডাইরিটা। হয়তো ভুলে গেছে নিতে, ভেবে তখনকার মতো ছেড়ে দিয়েছে। ঠিক আছে, এই কদিন না হয় সফট কপিতে রেখে দেবে…ফিরে গিয়ে লিখে নেবে ভেবে অনেক রাত অব্দি বসে লিখতে লিখতে কখন যে প্রায় ভোর হয়ে এসেছে বুঝতে পারেনি। অফিস থেকে দেওয়া ওর স্কাইহাই এপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতে কফির কাপটা নিয়ে উদাস হয়ে সামনেই কিছুটা দুরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোর কথা ভাবছিল। ঘরের ভেতর থেকে ওর ল্যাপটপে বেজে যাওয়া Elvis Presley র ওর অনেক দিনের প্রিয় একটা গান ভেসে আসছে...

Maybe I didn't treat you
Quite as good as I should have
Maybe I didn't love you
Quite as often as I could have
Little things I should have said and done
I just never took the time

You were always on my mind
You were always on my mind

Tell me, tell me that your sweet love hasn't died
Give me, give me one more chance
To keep you satisfied, satisfied

Maybe I didn't hold you
All those lonely, lonely times
And I guess I never told you
I'm so happy that you're mine
If I make you feel second best
Girl, I'm sorry I was blind

You were always on my mind
You were always on my mind

Tell me, tell me that your sweet love hasn't died
Give me, give me one more chance
To keep you satisfied, satisfied

Little things I should have said and done
I just never took the time
You were always on my mind
You are always on my mind
You are always on my mind…...

মৌকে পেয়েও হারানোর ভয়টা মনের ভেতরে ছিল কিন্তু সত্যিই যে মিলে যাবে এত তাড়াতাড়ি হয়তো ভাবেনি। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো গানটা শুনতে শুনতে… ভাবছিল, যদি এমন হোতো… গানের কথা গুলো নিজের মুখেই বলতে পারতো ওকে…কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়…ওকে দেখলেই যে মৌ নিজেকে গুটিয়ে নেয় কোনো এক অজানা কারনে… তাহলে কি সত্যিই তাই? ওর খুব কাছের কেউ আছে যাকে ও চায়। তাই বা কি করে হয়… যদি কেউ থাকতো তাহলে ও কেন বলছে না বা ফিরে যাচ্ছে না তার কাছে… আস্তে আস্তে পুর্ব দিক লাল হয়ে উঠতে শুরু করল, আর একটু পরেই সুর্য উঠবে, আরো একটা হাসিখুশী সুখী দিনের শুরু হবে এই সুন্দর সুর্যোদয়েয় ভেতর দিয়ে...কিন্তু সেই সুন্দর দিনটা ওর জন্য নয়... এই সুন্দর ভাবে শুরু হওয়া দিনটা ওর জন্য বয়ে নিয়ে আসবে না কোনো সুখের ঠিকানার সন্ধান...
 
আজ বিয়ের দিন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যে কজন আত্মীয় স্বজন আসার বাকি ছিল তারাও এসে গেছে এক এক করে। এত দিন ধরে যে বাড়ীতে মাত্র তিনটে মানুষ থাকতো সেই বাড়ীটাকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে যেন চাঁদের হাট বসে গেছে। দীর্ঘদিন এই বাড়ীতে কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান হয়নি বলে জেঠুরা কাউকে বাদ রাখেননি নিমন্ত্রন করতে, শুধু তাই নয় সবাই যাতে আসে তার জন্য নিমন্ত্রন করে আসার পরেও আবার ফোনে যোগাযোগ করেছেন। দু এক জন যাদের খুব অসুবিধা আছে তারা ছাড়া প্রত্যেকেই এসেছেন। এতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবার সুযোগ কেউ ছাড়তে চান নি। অরিত্র আর রুপসার অবস্থা খুব খারাপ, বহুদিন পর দেখা সাক্ষাত হওয়াতে আর এত জনের ভীড়ে কাউকে সকালে মাসীমনি বলে ডেকেছে তো দুপুরে ভুল করে পিসীমনি বলে ডেকে ফেলেছে। কেউ হয়তো সবার সামনে গাল টিপে আদর করে ফেলে বলেছে...ও মা রুপসা..তুই কতো বড় হয়ে গেছিস। সেই তোর অন্নপ্রাশনে এসে তোকে কোলে করে নিয়ে কান্না থামিয়েছিলাম। অরিত্রর সাথেও কম বেশী একই ব্যাপার ঘটেছে। মৌ প্রায় সারাক্ষন রুপসার সাথে থাকায় ওর পরিচয় নিয়েও স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠলে ও রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছে...এ হোলো আমার আদরের হবু বৌদি...মৌ। অরিত্রকে যারা মনে রেখেছে তারা খুব খুশী এত মিষ্টি মেয়ে এই বাড়ীর বৌ হয়ে আসবে জেনে। কিছুটা অন্যরকমের ঘটনাও ঘটে গেছে হঠাৎ করে, কেউ একজন মৌ এর পরিচয় জানতো না। মেয়েটাকে দেখে এত ভালো লেগে গেছে যে কোনো কিছু না বুঝেই নিজের নাতির সাথে বিয়ে দেওয়া যায় কিনা সেই নিয়ে জেঠিমার সাথে কথা বলে ফেলেছে। তারপরে জেঠিমার কাছ থেকে শুনে লজ্জায় কি করবে নিজেই ঠিক করতে পারছিল না। জেঠিমার কাছ থেকে পুবালী আর পুবালীর কাছ থেকে রুপসা শুনেই প্রায় লাফাতে লাফাতে অরিত্র কোথায় আছে খুঁজে পেতে বের করে বলেছে...দাদাভাই...সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল রে। ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে অরিত্র কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছে...কি হয়েছে? তারপর বোনের কাছে শুনে হেসে ফেললে রুপসা রেগে গিয়ে বলেছে... তুই কি রে দাদাভাই? তোর এটা ছোট ব্যাপার মনে হচ্ছে? আমার শুনেই রাগে গা রি রি করছে আর তুই হাসছিস?

- কি করবো...বিয়ে বাড়িতে এসব একটু আধটু হবে, তুই তো আছিস ওকে আগলে রাখার জন্য...
- হু...তুই তো আছিস...আমি কি পাহারাদার নাকি যে তোর জিনিষ পাহারা দেবো...আচ্ছা শোন না...সন্ধেবেলা কিন্তু তুই আবার এদিক ওদিক কেটে পড়িস না...আমাদের কাছে কাছে থাকবি...বুঝলি?
- কেন রে?
- ধুস তুই না কিছু বুঝিস না...বর যাত্রীদের ভেতরে তো কিছু ছেলে থাকবেই...
- সে তো থাকবেই...কি হয়েছে তাতে? একটু না হয় তাকাবে...
- শোন তোকে এত সাধু সাজতে হবে না...তুই আমাদের পাশে পাশে থাকলে বুঝে যাবে বুকিং হয়ে আছে...ঝাড়ি মেরে লাভ নেই...বুঝলি?
বোনের কথা শুনে আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে অরিত্র বলল...আচ্ছা এক কাজ করি...তোর পেছনে লিখে দেবো বুকিং ওপেন আর ওর পেছনে লিখে দেবো বুকিং ক্লোজড, তাহলে আর ওর দিকে কেউ তাকাবে না ... উল্টে তোর কপালে কেউ একটা জুটে যেতে পারে।

দাদু আর মামার সাথে বসে জলখাবার খেতে খেতে অরিত্রর কথা হচ্ছিল। মৌকে অর্ক ডেকে নিয়ে গেছে মাছ ধরা দেখতে, মামনও সাথে গেছে, দিদি এসেছে তাই আজ ওরা কেউই স্কুলে যাবে না। মামীমা সামনে বসে কার কি লাগবে দেখাশোনা করতে করতে বলল… এবারে তেমন কিছু খাওয়াতে পারলাম না, আবার কিন্তু আসা চাই। খেতে খেতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর এদিকে মামীমা বলছে নাকি কিছুই খাওয়াতে পারলো না শুনে অরিত্র মজা করে বলল… এত খাওয়ালে…আমি আর আসছি না বাবা। দাদু পাশ থেকে বললেন…তোমরা ভাই আজকালকার ছেলেপুলেরা খেতেই পারো না…এ আর এমন কি খাওয়া…আমাদের সময়ে যদি দেখতে…খাওয়া কাকে বলে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল…আপনাদের সময়ে তো আর আমাদের মতো এতো চাপ ছিল না…ধীরে সুস্থে সব কিছু করার সময় ছিল। দাদু ওর কথা শুনে বললেন…তা অবশ্য ঠিক তবে তোমাকে কিন্তু ভাই আবার আসতেই হবে…না হলে আমাদের মৌ মাকে কে নিয়ে আসবে বলো…ওর বাবা তো আর কোনোদিন নিয়ে এলো না…কি যে হয়ে গেল…কত করে বলেছিলাম তুমি বিয়ে করতে চাইছো কর…মেয়েটাকে আমাদেরকে দিয়ে দাও। দাদুর কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো অরিত্রর, খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল…আপনারা পরে আর যোগাযোগ করেননি? দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন…তা আর করিনি…কতবার ছেলেটা গেছে তার ঠিক নেই…কোনোবারই জামাই এর সাথে দেখা হয়নি…ব্যাবসার কাজে সব সময় বাইরে বাইরে থাকে…মেয়েটার সাথেও দেখা করতে দিতো না ওর মা … যে ফোন নাম্বারটা ছিল সেটাতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে লাভ হয়নি… ওদেরই একজন কর্মচারীর কাছে জানা গিয়েছিল জামাইকেও নাকি উল্টোপাল্টা বলতো…যাতে আমাদের সাথে না যোগাযোগ রাখে…শেষের দিকে তো খুব অপমান করতো শুনে আমিই যেতে বারন করে দিয়েছিলাম…সেও আজ হয়ে গেল পাঁচ ছ বছর…তুমি বাবা…আমাকে কথা দাও…মৌকে নিয়ে আবার আসবে। অরিত্রর একটু সময় চুপ করে থেকে মনে হল এখনই বলা ভালো, কথা যখন উঠেছে তখন আর দেরী করে লাভ নেই। ও গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল…আমার কিছু বলার আছে মৌয়ের ব্যাপারে…একটু সময় লাগবে… বড়রা সবাই থাকলে ভালো হয়।

দাদুর কথায় ঘরের আবহাওয়া একটু থমথমে হয়ে গিয়েছিল… সাথে সাথে অরিত্ররকেও ওইভাবে বলতে দেখে সবাই যেন কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি অপ্রত্যাশিত ভাবে মৌকে পেয়ে বাকি কিছুর ব্যাপারে কেউই সেভাবে ভাবতে পারেনি বা সেভাবে কথা বলার সময়ও ছিল না। বাকি ছিল মাসী আর দিদা…মামীমা গিয়ে ওদেরকে ডেকে নিয়ে এলে অরিত্র বলতে শুরু করল…অনেক কিছু ঘটেছে কিন্তু সবটা হয়তো জানিনা। যেটুকু জেনেছি…মোটামুটি ভাবে বলার চেষ্টা করছি…একটু আগে থেকে না বললে বুঝতে পারবেন না তাই আমাকে দিয়েই শুরু করছি… আমি ছোটবেলা থেকেই আমার দাদু দিদানের সাথে থাকি…মা বাবাকে হারিয়েছি অনেক ছোটোবেলায়… বছর দুয়েক আগে একদিন অফিস থেকে ফেরার সময়ে ট্রেনের খুব গন্ডগোলে অনেক রাতে কোনোরকমে ট্রেনে উঠতে পেরেছিলাম…ওখানেই মৌকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়… সাথে কেউ ছিল না…বলতে পারেন…নিতান্তই মানবিক কারনে অত রাতে ওকে ফেলে চলে যেতে না পেরে বাড়ী নিয়ে যাই…বেশ কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে উঠলেও কথা বলতে পারতো না…এমনকি ওর স্মৃতিশক্তিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল…অনেক ভাবে চেষ্টা করেও… ও কে…কোথায় বাড়ী জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি…অনেক ডাক্তারও দেখানো হয়েছিল কিন্তু কিছু লাভ হয়নি…ডাক্তারদের মতে কোনো শক পেয়ে হয়তো এইসব হয়েছে…ভালো হতেও পারে আবার নাও হতে পারে…এই অবস্থাতে ওকে কোনো সরকারী হোমে পাঠানোর কথা আমরা ভাবতে পারিনি হোমগুলোতে মেয়েদের নিয়ে কি নোংরামো হয়। ততদিনে অবশ্য ওর উপরে আমাদের সবার এত মায়া পড়ে গিয়েছিল যে কিছুটা হলেও রিস্ক নিয়ে আমাদের কাছেই রাখা হয়…কিছুদিন পর পূজোর সময় কাকতালীয়ভাবে আমাদেরই পরিচিত একটি মেয়ের কাছ থেকে একটা সামান্য সুত্র ধরে ওর বাড়ীর খোঁজ পাওয়া যায়…কিন্তু বাড়ীর কাউকে পাওয়া যায়নি কথা বলার জন্য…কোথাও যেন বেড়াতে গিয়েছিল। যে সময়ে ওই খোঁজটা পাওয়া যায় তখন আমরা সবাই মিলে দার্জিলিং বেড়াতে গেছি…ওখানে আমি একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাই ওর সামনে …খুব সম্ভবত আরো একটা শক পেয়ে ওর কথা বলা শুরু হয়েছিল কিন্তু স্মৃতি ফিরে আসেনি…

অরিত্র এতটা বলে থেমে গেলে কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না…সবাই কেমন যেন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে … অরিত্র যদি ওইদিন ওকে না নিয়ে যেত সাথে করে তাহলে মেয়েটার কপালে কি হতে পারতো ভেবে সবাই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। দিদা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ফেলে উঠে এসে অরিত্রকে জড়িয়ে ধরলো…কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু কান্নার দমকে বোঝা যাচ্ছিল না…মামীমা এসে দিদাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল…মা…ওকে বলতে দাও… বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই তো ভগবান ওকে পাঠিয়েছিল। দিদাকে কোনোরকমে শান্ত করে সরিয়ে নিয়ে গেলে দাদু চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন…ভাই…তারপর বলো…

তারপর দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে ওর বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় কি হয়েছিল জানতে কারন আমরা না জানলেও অনুমান করেছিলাম যে নিশ্চয় কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা আছে আর সেটা না জানা পর্যন্ত ওকে সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না…ওর মা মুখ না খুললেও পরে ওর ভাই বোনের সাথে আলাদা করে দেখা করে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওদের মা মৌকে ভীষন ভাবে টর্চার করতো…বেশির ভাগটাই মানসিক…ভালো যা সব কিছু নিজের ছেলে মেয়ের জন্য কিন্তু ওকে একেবারে দেখতে পারতো না…কোথাও একা একা যেতে দিতো না…কারুর সাথে মিশতে দিতো না…ভাই বোনেরা কিন্তু ওকে ভীষন ভালোবাসতো কিন্তু মায়ের ভয়ে কিছু করতে বা বলতে পারতো না… তারপর একদিন সন্ধে থেকে নাকি দিদিকে পাওয়া যাচ্ছিল না…মা একাই বাড়ীতে ছিল ওই সময়…ওরা ভাই বোন পড়তে গিয়েছিল…
মামীমা জিজ্ঞেস করল…ওর বাবা মানে রজতদা কিছু বলে না?
অরিত্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল…উনি আর নেই। বছর তিনেক আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ঘরের মধ্যে শ্মশানের নিস্তব্ধতা… দাদু হাতের পেছন দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে ধরা গলায় বললেন… ভগবান ওকে শান্তিতে রাখুন… একটাই দুঃখ নিয়ে হয়তো চলে গেছে অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারলো না। মামা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন… কাকে যে ঘরে নিয়ে এলো… সংসারটাকে শেষ করে দিল একেবারে। আরো একটা খারাপ খবর পেয়ে যেন মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না কারুরই। বেশ কিছুক্ষন সবাই চুপচাপ থাকার পর মামা ওকে তারপরে কি হয়েছে বলতে বললেন…

পরদিন ওদের বকখালি যাবার কথা ছিল…মা যাওয়া ক্যানসেল করে দেয় কিন্তু দিদিকে খোঁজার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায় নি…উল্টে ওদের ভাই বোনকে মারধোর করে যেহেতু ওরা দিদির খোঁজ করতে বলেছিল। এরপর ওদের মাকে না জানিয়ে ভাই বোনকে এক জায়গায় নিয়ে আসা হয় যদি ওদেরকে দেখে মৌ চিনতে পারে কিন্তু সেটাও কাজে দেয়নি। ওর কোনো রকম উত্তেজনা যাতে না হয় কারন তাতে আরো খারাপ হতে পারে বলে ডাক্তার বারবার সাবধান করে দিয়েছিল তাই ভাই বোনের পরিচয় দেওয়াও যায়নি। ওরা ভাইবোনে মাঝে মাঝে এসে দেখে যেত…এই ভাবে চলছিল…এর মাঝে আমি দুবার কিছুদিনের জন্য বাইরে গিয়েছি…মাঝে আমার জেঠতুতো দিদির বিয়ে হয়, তারপর আমি কিছুদিনের জন্য যখন আবার বাইরে তখন দাদু একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাদুর ওই অবস্থা দেখে মৌয়ের কি হয়েছিল জানিনা… কান্নাকাটি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল…পরের দিন সকালে জ্জান ফিরে আসে… নিজের পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসে কিন্তু আমি যে ভয়টা পাচ্ছিলাম তাই হয়…মাঝের ঘটনাগুলো ওর স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। এর মধ্যে ও আমাদের বাড়ী থেকে চলে যেতে চাইলে ওর কি হয়েছিল আর চলে গেলে কি হতে পারে বোঝাতে থাকতে রাজী হয় কিন্তু নিজেকে ভীষন ভাবে গুটীয়ে নেয়…কারুর সাথে কথা বলতো না…চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকতো। ওর ভাই বোন এলে যা একটু আধটু কথা বলতো…যতটা সম্ভব বাড়ীর সবাই অনেক চেষ্টা করেছিল ওর সাথে কথা বলার কিন্তু তেমন কিছু কাজ হয়নি প্রথম দিকে…তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও একেবারে আগের মতো হতে হতে বেশ কিছু দিন কেটে যায়…সেটাও এই কয়েকদিন আগে…
 
বাসটা চলে গেলে সামান্য একটু এগোনোর পর একটা মোরাম রাস্তা পাওয়া গেল, নামেই রাস্তা…খানা খন্দে ভরা…সামনে একটা ভ্যান রিকশা দুজন সওয়ারী নিয়ে যাচ্ছে, পেরিয়ে যাবার উপায় নেই দেখে ওটার পেছন পেছন আস্তে আস্তে করে যেতে হচ্ছিল। বেশ কিছুটা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে যাবার পর এক জায়গায় একটা খেলার মাঠ আর স্কুল দেখা গেল, খুব একটা পুরোনো স্কুল বলে মনে হল না। সামনেই কিছুটা চওড়া জায়গা আছে দেখে অরিত্র ভাবছিল ভ্যান রিক্সাটাকে পেরিয়ে গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করে নেবে কিন্তু তা আর হল না। ভ্যান রিক্সাটা স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেল দেখে সামান্য একটু এগিয়ে গেলে দুজন স্কুলের ছেলেকে পাওয়া গেল। ওদেরকে গ্রামের নাম করে জিজ্ঞেস করতে সামনের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল আরো কিছুটা যেতে হবে। ততক্ষনে ভ্যান রিক্সাটাও চলে এসেছে দেখে ওদেরই একজন বলল ওই ভ্যানটা নাকি ওই গ্রামের দিকেই যাচ্ছে, তারপর নিজেই এগিয়ে এসে ভ্যানওয়ালাকে বলল…ও মাধব কাকা, তোমাদের গ্রামে যাবে গো…রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাও। ভ্যানওয়ালা নেমে এসে জিজ্ঞেস করল কার বাড়ী যাবে ওরা। দেবাশীষ মুখার্জি বলাতে স্কুলের ছেলেটা খুব যেন খুব আপন এমন ভাব করে বলল ‘ও আপনারা স্যারের বাড়ী যাবেন? হ্যাঁ বলাতে ছেলেটি জানালো স্যার স্কুলে নেই, স্কুলের কাজে বাঁকুড়া গেছেন।

আবার সেই আগের মতো ভ্যানের পেছন পেছন যেতে যেতে একটা পুরোনো মন্দীর আর সামনের দীঘি দেখে মৌ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল…খুব চেনা চেনা লাগছে…ঠিক জায়গাতেই এসেছি মনে হচ্ছে। ওর চোখে মুখে যেন খুশী ঝরে পড়ছিল, ভালো করে দেখে বলল…হ্যাঁ…এটাই…আর একটু এগোলেই মামার বাড়ী…খুব ছোটো বেলায় দেখা কিন্তু এখোনো মনে আছে। ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেছে বুঝতে পেরে মৌ বাইরের দিকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল আরো কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা যেটা ও ওর ছোটোবেলায় দেখেছিল।

আরো কিছুটা যাবার পর ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বলল এসে গেছি, তারপরেই নিজে নেমে গিয়ে ডাকাডাকি করে বাড়ীর লোকজনকেও বের করে নিয়ে এলো। ততক্ষনে সামনের রাস্তার ধার ঘেঁসে গাড়ীটা রেখে ওরা দুজনে নেমে এসেছে। মৌ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর সেই ছোটোবেলার স্মৃতি থেকে আরো কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা, বাড়ীটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অরিত্রর হাত চেপে ধরলে ওর দিকে তাকিয়ে অরিত্র বুঝতে অসুবিধা হল না যে আর কোনো ভুল নেই, ওরা ঠিক জায়গাতেই এসেছে। একজন মাঝ বয়সী মহিলা ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলে ভ্যানওয়ালা বলল…আরে বৌদি…কুটুম এসে দাঁড়িয়ে আছে…আর তোমরা সব ঘুমোচ্ছো। মৌকে দেখে চিনতে পারার কথা নয়…সেই কোন ছোটো বেলায় এসেছিল ও। মহিলা কি করবে বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলে মৌ এগিয়ে গিয়ে বলল… আমি মৌ…কোলকাতা থেকে আসছি। ওর কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…মৌ? মানে বর্নার মেয়ে…মৌ? হ্যাঁ বলাতে জড়িয়ে ওকে ধরে কি করবে যেন বুঝতে পারছিল না…ওকে আদর করতে করতে বলল…চিনতে পারছিস আমাকে? আমি তোর মামীমা…এক এক করে বাড়ীর ভেতর থেকে বোধ হয় ওর দাদু আর দিদা বেরিয়ে এসে কে এসেছে জানতে পেরে ওকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। অরিত্র চুপচাপ একটা খাটিয়ার উপরে বসে ছিল, সবাই মৌকে নিয়ে ব্যাস্ত…ওর দিকে কে তাকাবে এখন। খারাপ লাগার কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক…মেয়েটা কত বছর পর এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। ওকে নিয়েই তো সবাই থাকবে এখন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে ওদের কান্নাকাটি দেখে ভৌ ভৌ করে ডাক দিয়ে অরিত্রর দিকে এগিয়ে এসে জুল জুল করে দেখতে শুরু করল…নাক উঁচু করে গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করল নতুন মানুষটা ভালো না খারাপ। অরিত্র চুক চুক করে আওয়াজ করে ডাকলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে লেজ নাড়াতে শুরু করল… অরিত্র ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলে কত দিনের চেনা এমন একটা ভাব করে পায়ের কাছে বসে পড়ল। অরিত্রর মনে মনে হাসি পেয়ে গেল…যাক…কেউ একজন তো ওর কাছে এসেছে ভেবে… একটু পরে গোটা দুয়েক মুরগী কোঁক কোঁক করে ডাকতে ডাকতে এসে খাটিয়ার নিচে ঢুকে পড়ল দেখে কুকুরটা ঘ্যাঁক করে ডেকে উঠল…ভাবখানা যেন এমন…এই…তোরা এখান থেকে ভাগ। আমাদের বাড়ি কেন এসেছিস…ঠাকুমা দেখতে পেলে কিন্তু তাড়া করবে… ওর ডাক শুনে মুরগী দুটো ত্রাহি মধুসুদন ভাব করে দৌড় লাগালো…কুকুরটা একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে লেজ নেড়ে বোঝালো…দেখলে তো…কেমন ভাগিয়ে দিলাম। হাসি মুখে ওর মাথায় আদর করে একটা চাপড় দিতে আবার পায়ের কাছে বসে পড়ল কুকুরটা। মৌকে নিয়ে সবাই বাড়ীর ভেতরে গেছে দেখে ও উঠে চারদিকটা দেখছিল…উঠোনের একদিকে এক চালা একটা ঠাকুর দালান… ভেতরে সপরিবারে মা দূর্গা…খড়ের কাঠামো…এখোনো মাটির প্রলেপ পড়েনি…তার মানে বাড়ীতে দুর্গা পূজো হয়…বনেদী বাড়ী হবে…বাড়ীটা বেশ পুরোনো হলেও তো তাই মনে হচ্ছে। পেছনে কারুর পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে বছর পনেরো ষোলর একটা মেয়ে…স্কুল থেকে ফিরছে…অচেনা মানুষ দেখে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখাচুখি হলে বোধ হয় লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। পেছন পেছন আরো একজন স্কুল থেকে ফিরলো…মেয়ে নয়…ছেলে… বয়স আর একটু কম…বড়জোর বছর বারো হতে পারে…আগের জনের মতো ওকে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল। কুকুরটা ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল, ছেলেটাকে দেখে লেজ নেড়ে হয়তো বলতে চাইলো আজ আর খেলতে যেতে হবে না, দেখো গিয়ে কে এসেছে। ছেলেটা ভেতরে চলে যাবার পর অরিত্র রাস্তার দিকে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে কুকুরটাকে কয়েকটা বিস্কুট দিলে খুব খুশি হয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে খেয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে বলতে চাইলো আরো চাই। অরিত্র হাসি মুখে বাকি বিস্কুট গুলো একটা একটা করে খাওয়াতে খাওয়াতে দাদুকে ফোনে জানিয়ে দিল ওরা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছতে পেরেছে। দাদু খুব খুশী হয়ে বলল...যাক বাবা, ভালোই হয়েছে...আমরা সবাই খুব চিন্তায় ছিলাম। আরো কিছুক্ষন বাড়ীতে কথা বলার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে আসতে দেখা গেল…সাথে ওই ছেলেটা। ও কাছে এসে সারা মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব নিয়ে বলল…এই…কিছু মনে কোরো না…সবাই আমাকে নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে তোমার কথা ভুলেই গেছে। অরিত্র হাসি মুখে বলল…মনে করার কিছু নেই, এত বছর পরে তোমাকে পেয়েছে…এটাই স্বাভাবিক...

- সত্যিই কিছু মনে করনি তো?
- না রে বাবা…দেখোনা…এর মধ্যে কেমন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছি।
মৌ অবাক হয়ে আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল…কাকে আবার জোটালে? অরিত্র কুকুরটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালে মৌ হেসে ফেলে বলল…তুমি ও না পারো বাবা…শোনো না…এ আমার মামাতো ভাই…অর্ক…ওর সাথে আর একটু থাকো…কেমন...
- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আমার জন্য এত ভাবতে হবে না…তুমি যাও…
মৌ যাবার আগে শুভকে বলল…এই অর্ক…কোথাও চলে যাবি না কিন্তু, দাদার সাথে থাকবি। যাকে বলা হল সে খুব মন দিয়ে গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ঘাড় নেড়ে জানালো বুঝেছে।

বিকালে রুপসা আর মৌকে নিয়ে ভবানীপুরের বাড়ীতে যেতে হবে, জেঠিমা আর পুবালীদি রুপসার কাছ থেকে মৌ এর ব্যাপারে শুনে ফোনেই খুব হইচই করে বলেছে একবার ওদের ওখানে নিয়ে যেতেই হবে। অরিত্র ওদের কে যে আগে জানায়নি তার জন্য দুজনেই খুব অভিমান করে বলেছে…তুই কি আমাদের পর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না।পরে জানাবো ভেবেছিলাম…তারপর আর নানান ঝামেলায় জানানো হয়ে ওঠেনি বলে ওদের কে কোনোরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করেছে। দুটো নাগাদ বেরোতে হবে, না হলে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে বলে অরিত্র রুপসা কে তাড়া লাগালে কি হবে…সেই যে সাজতে বসেছে দুজনে…ওঠার নামই করে না। রুপসা মৌকে একটু একটু করে সাজিয়ে আরো অপরুপা করে তুলছিল…আই লাইনার টা খুব সাবধানে চোখের পাতায় বোলাতে বোলাতে ওর দিকে তাকিয়ে হাত যেন আটকে গেল…কি সুন্দর টানা টানা মায়াবী চোখ…দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে…

মৌ এর মুখটা দুহাতে আলতো করে ধরে বলল… এই…মৌ…

মৌ রুপসার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ওর চোখে চোখে রেখে ফিসফিস করে বলল……এই…তুমি আমার বৌদি হবে?

মৌ আস্তে আস্তে করে চোখ নামিয়ে নিল…একটু আগেই যে মুখে হাসি ছিল…এখন সেখানে যেন শ্রাবনের মেঘ…রুপসা বুঝতে পারছিল না ওর মনের ভাষা…যেটুকু বুঝেছে তাতে তো একবার ও মনে হয়নি যে ও দাদাভাই কে পছন্দ করে না…

এই আমার দিকে তাকাও…দাদাভাইকে কি তোমার ভালো লাগে না?

একবার চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ নাবিয়ে নিল…একটু একটু করে শ্রাবনের মেঘ সরে গিয়ে ওর মিষ্টি মুখে লাজুক হাসি ফিরে এসে বোঝালো…ভীষন ভালো লাগে…

তাহলে?

দু চোখের ভাষায় বোঝালো…শুধু কি আমার ভালো লাগলে হবে?

রুপসা একটু চুপ করে থেকে বলল…জানি…আমার দাদাভাই টা কি…বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটবে না…ওর কেন যে মনের ভেতরে এত কিন্তু বুঝি না। একটু থেমে মৌ এর কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বলল…তুমি পারবে না আমার বুদ্ধু দাদাভাই টাকে দিয়ে বলাতে যে ও তোমাকে চায়?
 
সবাই চুপচাপ বসে শুনছিল, কারুরই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন হতে পারে… প্রাথমিক মানসিক ধাক্কাটা এর মধ্যে একটু একটু করে কেটে উঠেছে সবার ভেতরে... যাই হোক না কেন এখন তো মেয়েটার আর কোনো ভয় বা সমস্যা নেই। মামা অরিত্রকে থামতে দেখে চায়ের কথা বলে বললেন… অরিত্র এক নাগাড়ে কথা বলছে …ওরও কিছুটা বিশ্রাম হয়ে যাবে। মামীমা উঠে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এলে পর চা খেতে খেতে মামা বললেন ‘এখন তো আর কিছু সমস্যা নেই…তাই তো’? অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল ওর মায়ের দিক থেকে ঠিক কি ঘটেছিল যার জন্য ওকে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল সেটা এখোনো জানা নেই তবে ও মায়ের মুখোমুখি হতে রাজী হয়েছে। ওদিকটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে খুব ভালো হয়, আর কোনো সমস্যা থাকবে না তাহলে। যত সমস্যা তো সম্পত্তি আর টাকা নিয়ে তাই ওর ইচ্ছে সবকিছু দিয়ে দেবে। ইচ্ছে আছে এখান থেকে ফিরে যাবার পর কিছু একটা ভেবে ঠিক করে ফেলতে ওই ব্যাপারে। আর, এদিকে আপনাদের সাথেও দেখা হয়ে গেল... মৌ সবকিছু ফিরিয়ে দেবে শুনে মামীমা বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল... কেন ফিরিয়ে দেবে, ওর নিজের কথা ভাবতে হবে না? ওরও তো ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে...এতক্ষনে শেষ কথাটা বলার সুযোগ পেয়ে অরিত্র বলল... ওর টাকা যদি ও ফিরিয়ে দিতে চায় তো আমাদের কোনো কিছু বলার নেই বা অসুবিধাও নেই। মামা বোধ হয় বুঝতে পারলেন ও কি বলতে চাইছে...ওর দিকে তাকিয়ে বললেন...যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তুমি কি...অরিত্র মুখটা নিচু করে নিয়ে বলল...ঠিকই ধরেছেন... আপনাদের অমত না থাকলে আমরা...

দাদু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় অর্ক হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে বলল ‘দাদু…কি বড় একটা কাতলা মাছ উঠেছে দেখবে চলো। অর্ক দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে মাছের যা সাইজ দেখালো তাতে সবার হেসে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। দাদু গম্ভীর ভাবে বললেন ‘আচ্ছা…উঠুক…তোর দিদি কোথায়’?
- কোন দিদি?
- কোন দিদি আবার…মৌ। যা ডেকে নিয়ে আয়...

অর্ক একটু যেন মুষড়ে গেল, ভেবেছিল এত বড় একটা খবর দিলে খুশি হবে সবাই। তা নয়…ওকে এখন দিদিকে ডেকে আনতে হবে। বড়রা যে কখন কি চায় বোঝা দায় ভেবে ‘আচ্ছা…যাচ্ছি’ বলে মুখ গোমড়া করে বেরিয়ে গেল। একটু পরে মামনকে সাথে নিয়ে মৌ ফিরে এলেও অর্ক আর ফিরে আসেনি…ওর কাছে বড়দের গোমড়া মুখ দেখার থেকে মাছ ধরা দেখা অনেক ভালো। মৌ সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল ‘দাদু কি হয়েছে… অর্ক মুখ ভার করে ফিরে গেল… বকা দিয়েছো নাকি? দাদু আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বললেন ‘না… তোকে বকবো বলে ডেকে আনালাম’।
- কেন দাদু…আমি আবার কি করলাম?
দাদু এবারে হাসি মুখে বললেন ‘আয় মা…আমার কাছে আয়। মৌ পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন ‘তুই কি রে? এত বড় একটা খবর…কাল থেকে একেবারে চেপে গেছিস। দাদু কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে মৌ লজ্জায় মুখ লাল করে নিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। সবাই খুশী মনে হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে...মামন ব্যাপারটা কি হতে পারে আঁচ করে মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিফফিস করে বলল ‘মা… দিদি আর অরিত্রদা কি… ইয়ে… মানে’…
মামীমা মেয়েকে আস্তে করে মিষ্টি একটা বকা দিয়ে বলল ‘পাকামো করতে হবে না…যা এখান থেকে… পরে শুনবি। মায়ের বকা খেয়েও মামন আদুরে গলায় বলল ‘ও মা…বলো না ঠিক বলছি কিনা। দাদু হেসে ফেলে বললেন ‘থাক না… কি হয়েছে… দিদির বিয়ে… ও আনন্দ করবে না তো কে করবে। দাদু বলে দিয়েছে থাকতে তাই আর কে কি বলছে দেখার দরকার নেই। মামন ওর কিশোরী সুলভ আনন্দের সাথে দিদিকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল ‘দিদি… আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম’…

এরপর অরিত্র দাদু আর দুই জেঠুর সাথে ওনাদের ফোনে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই মৌ ওর হারানো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ায় সবাই খুশী ছিল তার উপরে ওনাদের সাথে আলাপ হওয়ায় সবাই আরো খুশী। মৌয়ের দাদু ও মামা দুজনেই চাইছেন বিয়েটা ওনারাই দিতে চান, অরিত্রর দাদু বা জেঠুরা ওনাদের ব্যাপারটা বুঝে আর না করেননি তখনকার মতো, ভেবে রেখেছেন ওনারা এলে সামনা সামনি কথা বলে ব্যাপারটা ঠিক করে নেবেন কারন বিয়েটা যেভাবে হবে ভাবা আছে তাতে খরচের অঙ্কটা বেশ মোটা হবে । তার আগে অবশ্য অরিত্র ওর কে কে আছে, কে কি করে…কোথায় থাকে…মোটামুটি সব বলেছে। ঠিক করা হয়েছে সামনের সপ্তাহের শেষে মামা কোলকাতা এসে অরিত্রর বাড়ী আর সাথে ভবানীপুরের বাড়ীতে যাবেন কথাবার্তা বলার জন্য।

মৌ সেই যে গেছে, লজ্জায় আর এমুখো হয়নি। মাঝে মাসী একবার অরিত্র কিছুক্ষনের জন্য উঠে গেলে ওরা ব্রাম্ভন কিনা খোঁজ নিতে বলায় দাদু বলেছেন ‘তোর বিয়েটা তো জাতপাত সব কিছু দেখে তবে দিয়েছিলাম… পারলি কি সংসার করতে’? মাসী ‘গ্রামের লোকজন কি বলবে…আত্মীয় স্বজনরাই বা কি ভাববে’ বলতে গেলে দাদু খুব রেগে গিয়ে বললেন ‘রাখ তোর আত্মীয় স্বজন, গ্রামের লোক… কিছু হয়ে গেলে কেউ দেখতে তো আসেই না উল্টে মজা লোটে …সব থেকে বড় কথা…মেয়েটা সুখী হবে… আর কিছু দেখার দরকার নেই আমার… তোর ভালো না লাগলে আমার কিছু করার নেই’।

বিকেলে এক ফাঁকে পুবালী কাকু কাকীমার ঘরে এসেছে প্রনাম করে যেতে, সাথে রুপসা আর মৌ। এর পরেই বিউটিশিয়ান সাজাতে এসে যাবে তাই আর সময় পাবে না আসার। যতই বাড়ীতে লোকজন আসুক এই ঘরটা বন্ধ করা ছিল, জেঠু জেঠিমা একেবারেই চায় না এই ঘরের কোনো কিছু এদিক ওদিক হোক। পুবালীর প্রনাম করা হয়ে গেলে রুপসা মৌকে কাকু কাকীমার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল...কে বলো তো? মৌ একটু অবাক হয়ে বলল...জানি না নাকি...তোমার কাকু। রুপসা হাসি মুখে বলল...হু...সে তো আমার কাকু বটেই...আর কি? ছোড়দি কি শুনতে চাইছে বুঝতে পেরে মৌ এড়িয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল...ওর বাবা। হু...সেটাও ঠিক...আর কি? বলো বলো...।
দিদি কিছুতেই ছাড়বে না দেখে মৌ আস্তে করে বলল...এখোনো তো হয়নি। ইস...এখোনো হয়নি...কি হয়েছে তাতে? মৌ বেশ লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে দেখে হেসে ফেলে বলল...আচ্ছা থাক...আর এত লজ্জা পেতে হবে না। তারপরেই কথা ঘুরিয়ে বলল...কাকুর ছবিটা দেখো...কি হ্যান্ডসাম…আমার তো ভীষন ভালো লাগে...কাকীমাও কি সুন্দর...দাদাভাইটা ওই জন্যই এত হ্যান্ডু হয়েছে...তাই না? মৌ এতক্ষনে পেছনে লাগার সু্যোগ পেয়ে মুখ টিপে হেসে বলল... হু তাই হবে...তোমার তো আবার দেখলেই নাকি বুকের ভেতরে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠতো। রুপসাও ছাড়ার পাত্রী নয়, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলল...আমার তো না হয় ছলাৎ ছলাৎ করে উঠতো ...আর তোমার? তোমার তো বড় বড় ঢেউ ওঠে...চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যায়...তাই না? ছোড়দির পেছনে লাগতে গিয়ে যে নিজেই বিপদে পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি। কি বলবে বুঝতে না পেরে পুবালীর দিকে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের ভাব করে তাকালে ও হেসে ফেলে বলল...রুপসা তুইও না...খুব ফাজিল আছিস...পেছনে লাগতে পারলে যেন আর কিছু চাই না।

ওদিকে বিয়ের অনুষ্টান চলছে আর এদিকে অরিত্র বর যাত্রীদের খাওয়া দাওয়া তদারকি করছিল। রুপসা দৌড়ে এসে ওকে টেনে নিয়ে গেল, খই পোড়াবার জন্য ভাইকে লাগবে। পুবালীর হাতে খই গুলো আস্তে আস্তে ঢেলে দিতে দিতে সামনের দিকে চোখ চলে গিয়েছিল… একেবারে সামনের সারির চেয়ারে মৌ আর রুপসা পাশাপাশি বসে আছে… দুই অপরুপার মুখে আগুনের লাল আভার প্রতিফলন যেন ওদেরকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। রুপসা ওর অভ্যাস মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে… মেয়েটা যেন কোনো অবস্থাতেই স্থির থাকতে পারে না। ওদিকে মৌ এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নিজেকেই চোখ ফিরিয়ে নিতে হ’ল। এখানে এত জনের সামনে ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে দেখলে কে কি ভাববে তার ঠিক নেই। তার থেকেও বড় কথা স্টিল আর ভিডিও দুটোই এক সাথে তোলা হচ্ছে। ওদের তাকানোটা তো আর নিজেদের ভেতরে থাকবে না… কতজনে যে দেখবে তার তো ঠিক নেই। সব থেকে বেশী ভয় তো রুপসাকে নিয়ে, আর কেউ না হোক ও যে পেছনে লাগতে ছাড়বে না একেবারেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top