What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি -শির্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় 🥴 (2 Viewers)

বরদাচরণ মেঝেয় পড়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছেন আর তাঁর দু পাশে দাঁড়িয়ে ভজবাবু আর গণেশ ঘোষাল প্রচণ্ড ঝগড়া করছেন। ঝগড়া করতে করতে উত্তেজিত ভজবাবু মাঝে মাঝেই খাঁড়া বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে থাকেন। তাতে বরদাচরণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, “দোহাই ভজবাবু! খাঁড়া সামলে। নাকে মুখে লেগে যাবে যে!”

কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভজবাবু বুক চিতিয়ে বলছেন, “এঃ! বলে সারেগামা জানি না! আপনি জানেন? করুন দেখি সারেগামা।”

গণেশ ঘোষালও বুক চিতিয়ে বলেন, “সারেগামা আমাকে করতে বলছেন, ভাল কথা। কিন্তু করলে বুঝবেন কি? গানের ‘গ’ ও তো জানেন না। অথচ আজ প্রকাশ্যে সুরের অপমান করে সারা শহর ঢি ঢি ফেলে দিয়েছেন।”

রাগে ভজহরিবাবু বাঁইবাঁই করে আরও কয়েকবার খাঁড়া ঘোড়ালেন। আতঙ্কে চিঁ চিঁ করে বরদাচরণ বলতে থাকেন, “খাঁড়া সামলে, ভজবাবু! আর-একটু হলে-”

গণেশ ঘোষাল একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, “হ্যাঁ, ওই খাঁড়া ঘোরানো, পিস্তল দিয়ে ভয় দেখানো, এসবই আপনাকে তবু মানায়। কিন্তু গান নয়। শুনুন” এই বলে গণেশবাবু খুব আবেগ দিয়ে বাঁ হাতে নিজের বাঁ কান চেপে ধরে ডান হাতটা ভজবাবুর মুখের সামনে একটু খেলিয়ে তান ধরলেন, “সা…রে….গা….মা, কোন স্কেলে ধরেছি বলুন তো?”

ভজবাবু একটু থমকে গিয়ে বলেন, “স্কেল? গানের মধ্যে আবার স্কেল কী মশাই? এ কি হাতের লেখা নাকি যে রুল টানতে স্কেল চাই! নাকি গলার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে দেখবেন।”

“হাঃ হাঃ! বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো। স্কেল কাকে বলে তাই যখন জানেন না, তখন আর গেয়ে হবেটা কী? তবু গানের মধ্যে যে সম্মোহনী শক্তি আছে তাতে আপনার মতো অসুর লোকেরও হয়তো উপকার হতে পারে। তাই শোনাচ্ছি! শুনুন, সা…রে…গা..মা…”।

ডাকাতদলের প্রচণ্ড চেঁচামেচি, গণেশবাবুর গলা সাধা, বরদাচরণের ক্ষীণ আর্তনাদ মিলেমিশে সে এক বিটকেল কাণ্ড।

মেজ-সদার তার কয়েকজন স্যাঙাত নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ একবার থমকে দাঁড়িয়ে সদার তার মশালটা তুলে দেয়ালে একটা মস্ত তৈলচিত্র দেখে কানাইকে বলল, “ওটা কার জানিস?”

কানাই বলে, “কার?”

মেজ-সদার শ্বাস ফেলে বলে, “আমিও জানি না। তবে খুব চেনা-চেনা ঠেকছে। এ পুরো বাড়িটাই আমার খুব চেনা লাগছে।”

কানাই উৎসাহ পেয়ে বলে, “তবে চোর-কুঠুরিটা কোথায় তা খুঁজে বের করে ফেল।”

মেজ-সদার ধমক ছেড়ে বলে, “চোপ! চোর কুঠুরি চোর কুঠুরি করে গলা শুকাবি না। আগে আমাকে সব দেখতে দে।”

কানাই ভয় খেয়ে চুপ করে যায়।

অন্য সব ডাকাতরা যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। একটা লোভী ডাকাত রান্নাঘরে ঢুকে জলে ভেজানো ভাত খেতে ব্যস্ত। একজন বাসনকোসন বস্তায় ভরছে। আর-একজন রাজবাড়ির যত জামাকাপড় সরাচ্ছে। চারদিকেই খুব হাল্লা-চিল্লা।

বিড়ি-চোর বলল, “মেজ-সদারের ডাকাতির দিকে মন নেই।” কানাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বড়সদারও তাই বলে।”

“কী বলে?”

“বলে, মেজটা ভদ্রঘরে জন্মেছিল। তারপর আট-দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে ভেঙ্গে পড়ে। হরিণগড় রেলস্টেশনে গাড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে মাথা ফেটে যায়। সেই থেকে হারানো কথা মনে করতে পারে না। তবে সেই গাড়িতে বড় সদার কাশী যাচ্ছিল তীর্থ করতে। মেজ-সদার কোন্ বাড়ির ছেলে তা সে বুঝতে পেরেছিল। সে-ই টেনে ট্রেনের মধ্যে ছেলেটাকে তুলে নেয়। মাথায় মতলব ছিল যে, ছেলেটাকে লুকিয়ে রেখে তার বাপের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করবে। কিন্তু সে আর হয়নি। বড় সর্দারের বউয়ের ছেলেপুলে ছিল না, সে ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো করে বুকে আগলে রাখল। পাছে ছেলেটাকে তার মা বাবা কোনওদিন চিনতে পেয়ে দাবি করে বসে সেই জন্য পরে বউয়ের আবদারে তীর্থ থেকে ফিরে এসে ছেলেটার বাড়ি থেকে তার সব ছবি চুরি করে নিয়ে যায়। ওদিকে বড়-সদারের মতি ফেরানোর জন্য তার বউ তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়াত খুব। সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটাকেও রাখত। তা বড়সদারের মতিগতি ভালর দিকেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর দুই আগে যেই বউ মরল অমনি আবার পুরনো পোকা মাথায় কিলবিল করে উঠল। সদার আমাকে গোপনে বলেছে, ছেলেটার বাবার অবস্থা এখন পড়তির দিকে। টাকা চেয়েও লাভ হবে না। তার চেয়ে ছেলেটাকে ডাকাতির তালিম দিয়ে ছেড়ে দিলে বুড়ো বয়সে দুটো পয়সার মুখ দেখা যাবে।”



বিড়ি-চোর বড়বড় চোখ করে গল্প শুনছিল। একটা ঢোক গিলে বলে, “তাহলে মেজ-সদার কোন্ বাড়ির ছেলে?”

“সে কথা সদার প্রাণ গেলেও বলবে না।”

“আমার তো সন্দেহ হয়”

“আমারও হয়। কিন্তু কথা চেপে রাখ। নইলে গোলমালে পড়বি।”

মেজ-সদার রাজবাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে অয়েল পেইন্টিং দেখে দেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিছনে ডাকাতের দল, কিন্তু তারা সদারের ভাবসাব দেখে কিছু বুঝতে পারছে না। ছবি দেখবে তো পটের দোকানে গিয়ে যত খুশি দেখো, না হয় একজিবিশনে যাও, ডাকাতি করতে এসে ছবি দেখার কথা তারা জন্মে শোনেনি।

একসময়ে ছবি দেখা শেষ করে মেজ-সদার গম্ভীর ভাবে বলে, “হুঁ।”

কানাই গলা বাড়িয়ে বলে, “কিছু বুঝলে সর্দার?”

মেজসদার গম্ভীর মুখে বলে, “চোর-কুঠুরি কোথায় তা এবার জলের মতো বুঝতে পারছি। এই পুব দিকের দেয়ালে এবংশের তৃতীয় রাজা হেরম্বনারায়ণের ছবি। এ ছবিতে হেরম্বনারায়ণের বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা যেদিকে বেঁকে আছে সেটা হল চোর-কুঠরিতে যাওয়ার প্রথম পথ। পথটা অন্দরমহলে গেছে। সেখানে গোঁসাঘরের বাইরের দেওয়ালে পঞ্চম রাজা ভীমনারায়ণের ছবি আছে, তাঁর ডান হাতের তর্জনী চোরকুরিতে যাওয়ার দ্বিতীয় পথটা চিনিয়ে দেবে। সে পথ ধরে গেলে একটা মস্ত শোবার ঘর পাওয়া যাবে। সেখানে দেওয়ালে নবম রাজা পবননারায়ণের ছবিটা ভাল করে দেখলে দেখা যাবে যে, তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে কুঁচকে কী যেন খুঁজছেন। অর্থাৎ আমাদেরও মেঝেতেই খুঁজতে হবে। মেঝেটা ভাল করে খুঁজলে কয়েকটা সূক্ষ্ম চিহ্ন দেখা যাবে। সেগুলো অনেকটা তীরের ফলার মতো। সেই চিহ্ন ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলে খাটের তলায় এক জায়গায় গুপ্ত দরজা দেখা যাবে।”

সবাই অবাক। কানাই বলে, “কী করে বুঝলে এত সব?”

মেজ-সদার ভু কুঁচকে বলে, “কে জানে কী করে বুঝলাম! কিন্তু আমার সব মনে পড়ে যাচ্ছে যেন।”

বিড়ি-চোর বলে, “সদারের মাথা খুব পরিষ্কার।” মেজ-সদারের পিছু পিছু ডাকাতরা এগোতে লাগল। ঠিক এই সময়ে একটা বিশাল কালো চেহারা এক তলা থেকে এক লাফে রাজবাড়ির দোতলায় উঠে গেল। দরবার-ঘরের দরজা থেকে একটা টর্চের ঝলকানি এল, সেই সঙ্গে গুডুম করে গুলির শব্দ।

গণেশবাবু ভৈরবীতে চমৎকার বিলম্বিত করছিলেন। গুলির শব্দ হতেই তিনি দড়াম করে মেঝেতে পড়ে নিশুপ হয়ে গেলেন।
 
ভজবাবু খানিকটা হতভম্ব হয়ে রইলেন। ডাকাতদের কারও বন্দুক পিস্তল নেই, তিনি জানেন। তবে কি পুলিশ? সন্দেহ হতেই ভজবাবু বিপুল বিক্রমে খাঁড়া ঘোরাতে ঘোরাতে বীরদর্পে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন।

কে যেন সতর্ক গলায় ডাকল, “ছোড়দা!”

আর একজন বলল, “মেজকাকু।”

মেঝে থেকেই বরদাচরণ বললেন, “দোহাই ভজবাবু।”

ভজবাবু একটু থমকে গেলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “নহি দাদা, নহি আমি কারও মেজকাকু। সম্মুখসমরে আত্মীয়তা ঘোর দুর্বলতা। ছাড়ো দ্বার, যাবো অস্ত্রাগারে…”

মেঝে থেকে বরদাচরণ প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “ভজবাবু, দোহাই আপনার, শিগগির শুয়ে পড়ুন যদি বাঁচতে চান। একটা লাশ পড়েছে, আপনাকেও গুলি করবে।”

দরজার কাছ থেকে হারাধন বলে ওঠে, “কারও লাশ পড়েনি। গুলি আমি ছাদে চালিয়েছি।”

বরদাচরণ বলেন, “তা হলে গণেশবাবু?”

রাজমাতা ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে, আমার গোবিন্দকে তোরা কী করেছিস?”

মেজ-সদার গম্ভীর গলায় বলে, “সে ভাববেন না ঠাকুমা, রাজামশাই দাঁড়িয়ে আছেন সামনের দিকের বারান্দায়।”

“আর আমার খুঁটে? কাল যে নন্দী বাড়ির চাকর পাঁচশো খুঁটে নিতে আসবে।”

“দেবেন। খুঁটে আমরা নিই না। আমরা টাকা সোনা আর দামী জিনিস নেব। আপনারা ঘর ছেড়ে দিন। এখন মেলা কাজ আছে আমাদের। চোর কুঠুরির গুপ্ত দরজা খুঁজে বের করতে হবে।”

রানীমা শ্বাস ফেলে বললেন, “সে আর খুঁজতে হবে না বাছা, পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ওই খাটটা সরালেই দেখতে পাবে। চোরকুইরির দরজা খোলাই আছে। কিন্তু নেওয়ার কিছু নেই। লাখ লাখ অচল টাকা। যাও নিজেরাই দেখে এসো গে।”

“অচল টাকা?” মেজ-সর্দারের মুখটা খানিকক্ষণ থমথম করে। কী একটু ভাবে সে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “তাই বটে। অচলই হওয়ার কথা। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি ওসব টাকা বহুঁকালের পুরনো। তখনই বোধ হয় বাজারে চলত না। এখন তো আরও চলবে না।”

রানী-মা ভ্রু কুঁচকে বলেন, “ছেলেবেলায় দেখেছ মানে? তুমি কি বাবা এবাড়িতে এসেছ কখনও?”

“মনে হয় যেন এসেছি। সবই চেনা লাগছে।”

রানী-মা উদ্বেল হয়ে বললেন, “তুমি একটু কাছে এসো তো বাবা, তোমার মুখোনা একটু ভাল করে দেখি। ও আমার ডাকাত-ছেলেরা, তোমরা একটু মশালগুলো ভাল করে ধরো তো।”

রাজা গোবিন্দনারায়ণের মূর্ছা হঠাৎ ভাঙল। কারণ, কে যেন তাঁর ঘাড়ে আর মুখে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। মূর্ছা ভেঙে তিনি হাই তুলে পিছু ফিরতেই আবার মূর্ছা গেলেন। এবং দাঁড়িয়ে। তামর কারণ হারাধনের কিম্ভুত এবং অতিকায় গোরিমানটা গোবিন্দনারায়ণকে খুঁকে দেখছিল।

গোবিন্দনারায়ণকে ও রকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গোরিমানটা বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে ভিতরবাগে চলল। একটা ছ্যাঁচড়া ডাকাত টুলের ওপর উঠে রাজবাড়ির একটা দেয়াল থেকে পুরনো একটা দেয়ালঘড়ি খুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। গোরিমানটা পিছন থেকে গিয়ে টুলটা ধরে অল্প অল্প ঝাঁকাতে লাগল। ডাকাতটা পিছু না ফিরেই বলল, “ঝাঁকাস না বাপ! ঘড়িটা বেচে যা পাব তা দু-জনের ভাগ।”

গোরিমানটা আরও জোরে ঝাঁকায়। ডাকাতটা পেল্লায় একটা ধমক দিয়ে ভাল করে না-দেখেই পিছনে একটা লাথি চালিয়ে দিল। সে ভেবেছিল তার স্যাঙাতদেরই কেউ হবে।

গোরিমান লাথি খেতে পছন্দ করে না। তাই সে খুব গম্ভীরভাবে টুলটা টেনে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ডাকাতটা মাটিতে পড়ে পেল্লায় চেঁচাতে থাকে। বিরক্ত গোরিমান তাকে তুলে বগলে থার্মোমিটারের মতো চেপে ধরে চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগল।



রাজবাড়ির ফটকে ততক্ষণে পুলিশের গাড়িটাড়ি সব এসে পৌঁছেছে। একটা জিপগাড়ি থেকে অতি সাবধানে নামতে নামতে নিশি দারোগা বললেন, “কালী, কালী! ওরে, তোরা সব সাবধানে চারদিক দেখে-টেখে এগো। আমার আজ শরীরটা ভাল নেই। বড্ড হাই উঠছে।”

সন্ধেবেলা গোরিমানগুলোর হাতে নাকাল হয়ে সেপাইরাও একটু ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বন্দুক বা লাঠি হাতে থাকলেও তারা খুব সাহস পাচ্ছে না। একজন সেপাই বলে উঠল, “বড়বাবু, আপনার শরীর খারাপ হলে আমারও খারাপ। পেটটা তখন থেকে বকম বকম করছে।”

আর একজন সেপাই বলে দিল, “আমরা যখন জাম্বুবানের হাতে ধোলাই খেলাম, তখন আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন বড়বাবু। এবার না জানি আবার কার পাল্লায় পড়ি, এবার দয়া করে আপনি আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে থাকুন।”

নিশি দারোগা বললেন, “কালী কালী। চল দেখি।”

বলে খুব অনিচ্ছেয় তিনি টর্চ আর রিভলবার বাগিয়ে সাবধানে রাজবাড়ির ফটক পার হয়ে ঢুকলেন।

ওদিকে রানী-মা চার-পাঁচটা মশাল আর সেজবাতির আলোয় মেজ-সর্দারের মুখ দেখছেন। আর মেজ-সদার, যার ভয়ে গোটা গঞ্জ কাঁপে, ডাকাতরাও যাকে যমের মতো ডরায়, সেই মহাতেজী মেজ-সদার রানী-মার খাটের পাশে মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসে খুব লজ্জা লজ্জা ভাব করে রানী-মাকে নিজের মুখ দেখতে দিচ্ছে।

এসব ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে বিড়ি-চোর চোর কুঠুরিতে যাবে বলে খাটের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছিল, কানাই তার ঠ্যাং ধরে টেনে এনে খুব ঘাতক দিয়ে বলল, “সদারের হুকুম হয়নি, তার আগেই ঢুকছিলি যে বড়? দেব গদান নামিয়ে?”

বিড়ি-চোরও তেড়িয়া হয়ে বলে, “আমিও গদান নামাতে জানি।”

দুজনে তুমুল ঝগড়া লেগে পড়ল।

সে গোলমালে অবশ্য রানী-মা বা মেজ-সদারের কান নেই। রানী-মা ডাকাতের সদারের মাথায় হাত বুলোতেবুলোতে বললেন, “ভাবতেও ভয় করে, যদি সত্যি না হয়। কিন্তু বাবা, তুমি যদি আমার হারানো ছেলে কন্দর্পনারায়ণ হতে।”

রাজমাতাও বললেন, “আহা, যদি আমার নাতি কন্দু এখন ফিরে আসত।”

ঠিক এই সময়ে পিস্তল হাতে হারাধন, খাঁড়া হাতে গোয়েন্দা বরদাচরণ এবং ছবি হাতে মনোজ ঘরে এসে ঢুকল।

বরদাচরণ মননজের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছবিটা কেড়ে নিয়ে

হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে বললেন, “মহারানী, হওয়া-হওয়ির কথা আর বলবেন না। আপনার সামনে ওই যে ডাকাত দলের সদার বসে আছে, সে-ই হল আপনার হারানো ছেলে কুমার কন্দর্পনারায়ণ। আগে দেখুন এই ছবিটা কুমার কন্দর্পের ছবি কিনা।”

রানী-মা বরদাচরণের মতোই হুবহু ছোঁ মেরে ছবিটা কেড়ে নিয়ে দেখেই বলে উঠলেন, “বলো কী বাবা গোয়েন্দা! এই তো আমার কন্দর্পর ছবি! সেবার আমরা দেওঘরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কন্দর্প দুধের গেলাশ পাশে রেখে ছবি তুলতে বসেছিল, পিছনের ঘরে পর্দার আড়ালে আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। হতচ্ছাড়া বেড়ালটা তখন কোত্থেকে এসে দুধটা খেয়ে যাচ্ছিল…হুবহু সব মনে পড়ে যাচ্ছে যে!”

বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “এবার ছবির সঙ্গে ডাকাতের সদারকে মিলিয়ে দেখুন।”

রানী-মা মেজ-সদারকে কাছে টেনে “ও আমার কন্দু রে” বলে কেঁদে ফেললেন।

মেজ-সদার বিড়বিড় করে বলল, “তাই সব এত চেনা-চেনা লাগছিল বটে!”

বরদাচরণ ‘হেঃ হেঃ করে হেসে বললেন, “কত বুদ্ধি খাঁটিয়ে যে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি তা আর বলার নয়।”

হারাধন ধমক দিয়ে বলে, “বেশি বোকো না। মেজ-সর্দারকে রাজকুমার বলে প্রথম যে চিনতে পারে সে হল আমার ভাইপো মনোজ।”

বরদাচরণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মননজেরও যথেষ্ট অবদান আছে। এসো মনোজ, এগিয়ে এসো।”





মনোজ এগিয়ে আসে। রানী-মা তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে বলেন, “সবাই শোনো তোমরা, রাত এখন যতই হোক, আমার ঘরে আজ অনেক ঘি আর ময়দা আছে। গতকাল আমাদের একটা তালুক থেকে জিনিসপত্র অনেক এসেছে। আমি এখন সবাইকে লুচি ভেজে খাওয়াব। আমার ডাকাত ছেলেদের কয়েকজন চলো গিয়ে একটু ময়দা মেখে দেবে।”

ডাকাতরা অবস্থা বুঝে যে যার হাতের অস্ত্রশস্ত্র এদিক ওদিক ফেলে দিয়ে ভাল মানুষের মতো ব্যবহার করছিল। মেজ-সর্দার যে রাজকুমার তা জানলে তারা কক্ষনো রাজবাড়িতে ঢুকত না। কানাই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “রাত খুব বেশি হয়নি রানী-মা। মোটে সাড়ে বারোটা, ময়দা মাখতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না।”

ঠিক এই সময় নিশি দারোগা পিছন থেকে বলে উঠলেন, “হ্যান্ডস আপ।”

কেউ হাত তুলল না। হারাধন বলে উঠল, “আহা দারোগাবাবু, এখানে কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে না।”

বরদাচরণও বললেন, “একটা হ্যাপি এন্ডিং হচ্ছে নিশিবাবু, এখানে কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে না।”

রানী-মা বললেন, “ও বাবা নিশি, লুচি হচ্ছে, সবাই খেয়ে যাবে।” বলে মহারানী চারজন ডাকাতকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

দারোগাবাবু খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি সবাইকে হাত তুলতে বলেছি, সেকথা কারও কানে যাচ্ছে না নাকি?”

কিন্তু কেউ নিশিবাবুকে তেমন পাত্তা দিতে চাইছে না। বরদাচরণ তাঁকে বোঝাতে লাগলেন, “আপনার আসবার কোনও দরকারই ছিল না নিশিবাবু, আমি একাই সিচুয়েশনটা সামলে নিয়েছিলাম! হেঃ হেঃ!”

এদিকে রাজামশাইয়ের মূর্ছা আবার ভেঙেছে। ভেঙেছে অন্য কিছুতে নয়, গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজার গন্ধে। শিউরে উঠে তিনি আপন মনে বললেন, “আবার গাওয়া ঘিয়ের লুচি?”

রাজবাড়ির পুরনো চাকর দৌড়ে এসে খবর দিল, “রাজামশাই, কুমার কন্দর্পনারায়ণ ফিরে এসেছেন। শিগগির যান, রান্নাঘরে রানী-মার কোল ঘেঁষে বসে কেমন লুচি খাচ্ছেন দেখুন গে।”

রাজা গোবিন্দনারায়ণ খানিকটা হতভম্ব থেকে তারপর তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।
 
আরো পড়ুন, শির্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রোমান্টিক উপন্যাস "অসুখের পরে"

 

Users who are viewing this thread

Back
Top