What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি -শির্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় 🥴 (1 Viewer)

ভয়ে গোবিন্দনারায়ণ ঘাড় ঘোরাতে পারছেন না। না, আসলে তিনি তেমন ভয় পাননি, ঘাড়টাই ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে গেছে। চোখদুটোও ভয় পেয়ে ঢাকনা ফেলে বসে আছে, খুলতে চাইছে। আর হাত পাগুলো বেয়াদপের মতো থরথর করে কাঁপছে।

গলার স্বরটা একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, “মহারাজ, ভয় পেলেন নাকি? ভয়ের কিছু নেই। আমি গোয়েন্দা বরদাচরণ।”

মুহূর্তে ঘাড় ঢিলে হয়ে গেল, চোখের পাতা খুলে গেল, আর গোবিন্দনারায়ণের বীরের রক্ত টগবগ করে উঠল। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, “তুমি এখানে এলে কেমন করে, হ্যাঁ?”

বরদাচরণ খুবই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “এ আর কী দেখলেন? একবার একটা আঙুলের ছাপ খুঁজতে আলিপুরের টাঁকশালে ঢুকে গিয়েছিলাম সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। গোয়েন্দাদের সব বিদ্যে থাকা চাই।”

স্তম্ভিত গোবিন্দনারায়ণ বরদাচরণের দিকে চেয়ে বললেন, “শোনো বাপু, এই চোর-কুঠুরিতে তুমি ঢুকেছ, তার মানে তুমি রাস্তা জানো। এরপর যদি আমার এখান থেকে একটা টাকাও হারায়, তবে তোমাকে পুলিশে দেব। মনে থাকে যেন।”

“সে আর বলতে!” বলে বরদাচরণ একটু অমায়িক হেসে বললেন, “কিন্তু আপনার অত সতর্কতার প্রয়োজন কী মহারাজ? ও টাকাগুলো তো সবই মান্ধাতার আমলের। ওর তো কোনও দামই নেই।”

গোবিন্দনারায়ণ একটা শশার ঢেকুর তুলে বললেন, “বলো কি? চলবে না মানে? টাকা চলে না, এ কখনও হয়?”

বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “ও-সব মান্ধাতার আমলের টাকা কবে তামাদি হয়ে গেছে। মহারাজ, আপনি কি কোনও খবর রাখেন না? সময় থাকতে যদি ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিতেন তা হলে সুদও পেতেন, টাকাটাও নষ্ট হত না।”

গোবিন্দনারায়ণ হাঁ করে খানিকক্ষণ চোর কুঠুরির দেওয়ালের দিকে চেয়ে থেকে কী যেন ভাবলেন। হঠাৎ মনে হল, তাই তো! এতকাল ধরে টাকা গুনে আসছেন গোনার নেশায়, কিন্তু কখনও তো মনে পড়েনি যে, দিন কাল পালটে গেছে, টাকাও পালটেছে।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এতক্ষণ ধরে টাকা গুনে যে জিনিসটা ভুলে গিয়েছিলেন সেই জিনিসটা মাথার মধ্যে ফিরে এল। গাওয়া ঘিয়ের লুচি। গোবিন্দনারায়ণ নিজের মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে ডুকরে উঠলেন–গাওয়া ঘিয়ের লুচি! গাওয়া ঘিয়ের লুচি!

বরদাচরণ কিছু বুঝতে পারলেন না। কিন্তু ভাবলেন, টাকার শোকে রাজামশাই নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছেন। আর একথা কে না জানে যে, পাগলরা অনেক সময় লোককে ধরে কামড়ায়। এই ভেবে বরদাচরণ দুই লাফে চোর কুঠুরির চৌকাঠের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন।

সন্ধেবেলা মনোজ চুপিসারে রামায়ণ বইটা খুলে ছবিটা বের করল। ভারী চমৎকার ছবি। যখনই মনোজ ছবিটার দিকে তাকায় তখনই মনে হয় ছবির ছেলেটা যেন এক্ষুনি বলে উঠবেবন্ধু, কেমন আছ?

ছবিটা আজ মনোজ অনেকক্ষণ দেখল। এই কুমার কন্দর্পনারায়ণ? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। মনোজ শুনেছে, রাজা গোবিন্দনারায়ণ অসম্ভব কিপটে লোক। রাজবাড়ির বুড়ো দারোয়ানের সঙ্গে ইস্কুলের বেয়ারা সুখলালের খাতির আছে। দুজনের বাড়ি এক গাঁয়ে। বুড়ো দারোয়ান নাকি সুখলালকে একবার বলেছিল, রাজা ভীষণ কৃপণ বলে রানী অম্বিকা নিজেই তাঁর এক ভাইয়ের কাছে কুমার কন্দর্পকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাপের কাছে থাকলে নাকি কন্দর্প মানুষ হত না। কন্দর্পর মামা মস্ত বড় চাকরি করে, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। সেই মামার আবার ছেলেপুলে নেই। কন্দর্প সেই মামার কাছে মহাসুখে আছে। কিন্তু মনোজের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে, কৃপণ গোবিন্দনারায়ণের এত সুন্দর একটা ছেলে থাকতে পারে। ছবিটা যারই হোক মনোজ এই ছবিটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবে না। তার যত ছেলে বন্ধু আছে তাদের চেয়েও এই ছবির বন্ধুটা তার বেশি প্রিয়।

মনোজ রামায়ণ বইটা অন্য সব বইয়ের পিছনে সাবধানে লুকিয়ে রেখে দিল।

তাদের বাড়ির অবস্থাটা এই ভর সন্ধেবেলা খুবই থমথমে। রাখোবাবু ঘড়ি হাতে দিয়ে উঠোনে পায়চারি করতে করতে ঘন-ঘন টাইম দেখছেন আর মাঝে মাঝে হাঁক ছেড়ে সবাইকে সময় জানাচ্ছেন। বাড়ির লোকেরা সবাই ছবি খুঁজে খুঁজে হয়রান। এখন আর কেউ রাখোবাবুর হাঁকডাকে গ্রাহ্য করছে না।


মনোজের ছোট ভাইবোন দুটো কিরমিরিয়ার কাছে বসে গল্প শুনছে। গণেশ ঘোষালের কাছে বসে গলা সাধছে পুতুল। ঠাকুমা আর ঠাকুরঝি ঠাকুরঘরে বসে জপের মালা টপকাচ্ছে। মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বাবাকে উদ্দেশ করে বলছে, “ওই একজনের চেঁচামেচিতে বাড়ি অতিষ্ঠ হয়ে গেল। হাতে ঘড়ি বেঁধে ঘড়িবাবু হয়ে চৌকিদারের মতো চেঁচাচ্ছেন তখন থেকে।” ইত্যাদি। রঘু আর রামু হ্যারিকেন হাতে হারিকেনকে খুঁজতে বেরিয়েছে। ভজবাবুকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়ার থিয়েটারে ভজবাবুই মধ্যমণি, তাঁর খোঁজে ছেলেরা বার বার আসছে। কিন্তু ভজবাবু ফিরছেন না। সবাই কিছু চিন্তিত।

কিন্তু ভজবাবুর এখন আর ফেরার উপায় নেই। ব্যাপারের তলায় পিস্তল নিয়ে সেই যে বেরিয়েছিলেন, তারপর সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড হয়ে গেছে শহরে।

উত্তর দিকের শহরতলিটা একটু নির্জন, গা-ছমছম করা জায়গা। এদিকে অনেক গাছ-গাছালি, মাঠঘাট আর ডোবা আছে। ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতদের আস্তানা ছিল এক সময়। এখনও গুণ্ডা বদমাস-ডাকাতরা এই অঞ্চলটাতেই রাজত্ব করে। শহরের ভদ্রলোকেরা সন্ধের পর বড় একটা এদিকে আসে না।

কানাই মাছওলার বাড়িও এই উত্তর দিকের শহরতলিতেই, বড় রাস্তা থেকে একটা হাঁটা পথ ঘন বাঁশঝোঁপের ভিতর দিয়ে নেমে গেছে। সেই রাস্তার দুধারে কচুবন, ভাঁটবন আর বেঁটে কুলগাছের ঝোপে ভরা। খানিক এগোলে একটা মান্ধাতার আমলের ভাঙা কালীমন্দির চোখে পড়বে। দ্বাদশ শিবের মন্দিরও আছে বটে, তবে তার বেশির ভাগই তক্ষক, চামচিকে আর সাপখোপের বাসা, গোটা চারেক মন্দির ভেঙে স্তূপ হয়ে আছে। তবে কালীমন্দিরের কালী খুব জাগ্রত। লোকে বলে ডাকাতে কালীবাড়ি।

কথাটা মিথ্যে নয়। কানাই মাছওলা আর তার জনা বিশেক সাঙাৎ রোজ সন্ধেবেলা মন্দিরের চাতালে বসে গাঁজা কিংবা কারণবারি খেয়ে নেশা করে। শুটকোমতো এক পুরুতমশাই সন্ধেবেলা এসে ধূপধুনো দিয়ে আরতি করেন ভয়ে-ভয়ে, আর বাইরে কানাই আর সাঙাত্রা ‘জয় মা জয় মা’ বলে বিকট সুরে হাল্লা-চিল্লা করে।

কানাই বৈকালী বাজারে গিয়ে মাছ বেচতে বসবার আগে কালী-প্রণাম সেরে যায়। লোকে বলে, কানাই রাত-দুপুরে ডাকাতি করতে বেরোয়। তা কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। তবে কিনা, কানাইকে এখনও কেউ হাতে-নাতে ধরে ফেলতে পারেনি।

আজকের আরতি খুব জমে উঠেছে। রোগা পুরুতমশাই নেচে-নেচে আরতি করে ঘেমে উঠেছেন। কিন্তু বাইরে ষণ্ডারা প্রচণ্ড হুমকি দিয়ে বলছে, “ঘুরে ফিরে। আবার হোক। চালিয়ে ৯০

যাও।”

পুরুতমশাই আর করেন কী! ওরা থামতে না বললে তো আর থামতে পারেন না। বেয়াদপি করলে খাঁড়ার কোপে গলা নামিয়ে দেয় যদি! এদের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার পর থেকে পুরুতমশাইয়ের জীবনে আর শান্তি নেই। শহরের উত্তর দিকটা নিরিবিলি দেখে কী কুক্ষণে এদিকে একখানা কুঁড়েঘর তুলে থাকতে এলেন। তারপর একদিন মাঝরাতে ডাকাতরা তাঁর গলায় সড়কি ধরল এসে, বলল, “ভাল চাও তো আমাদের কালীর পুজো করবে চলো।”

সেই থেকে আজ পাঁচ বছর একটানা কালীপুজো করতে হচ্ছে। পয়সা কড়ি পান না যে, তা নয়। ডাকাতরা মতলব হলে দেয় থোয় ভালই। কিন্তু তার বদলে অনেক নাচন-কোঁদন দেখাতে হয়। ঝাড়া ঘণ্টা দুই আরতি না করলে ডাকাতদের মন ওঠে না। পায়ে বাত হোক, জ্বর জ্বারি, আমাশা, বায়ু, পিত্ত, কফ কিছু মানে না ব্যাটারা। কেবল বলে–ঘুরে ফিরে। জোরসে চালাও। আবার হোক।

পুরুতমশাইয়ের জীবনটাই অন্ধকার হয়ে গেছে। তার ওপর ডাকাতদের সংস্পর্শ দোষে কবে যে পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতবাস করায়। নানা দুশ্চিন্তায় পুরুতমশাই আজকাল খেতে পারেন না, ঘুমোতে পারেন না। দিন-দিন রোগা হয়ে যাচ্ছেন। মনে-মনে কেবল মা কালীর কাছে মানত করেন–জোড়া পাঁঠা দেব মা, এদের হাত থেকে উদ্ধার করো।

আজকের পুজোর আয়োজনটা খুব জাঁকালো রকমের। যেদিন এরকম পুজো হয়, সেদিনই পুরুতঠাকুর বুঝতে পারেন যে, আজ কোথাও কোনও গেরস্তর কপাল পুড়েছে। সাধারণত ডাকাতি করার রাতেই বড় করে পুজো দেওয়া হয়।
 
একজোড়া পাঁঠা আজ বলি হয়েছে। বলির পর পাঁঠার রক্ত আঁজলা করে নিয়ে ডাকাতরা কপালে আর গায়ে মেখেছে মহা উল্লাসে। মুড়ো দুটি মায়ের ভোগে উৎসর্গ করে এখন একটা মুশকো-মতো লোক পাঁঠা দুটোকে একটা আম গাছের ডালে ঠ্যাং বেঁধে ছাল ছাড়িয়ে নাড়িভুড়ি বের করছে পেট থেকে।

মন্দিরের চাতালে বসে কানাই একটার-পর-একটা হেঁসো বালি দিয়ে ঘষে ধার তুলছে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল। পানের রসে ঠোঁট দুটোও রক্ত-শোষার মতো দেখাচ্ছিল।

অন্য সব ডাকাতরা মদ-গাঁজা খেয়ে পেল্লায় হাঁকডাক ছাড়ছে। এইসব দেখে পুরুতমশাইয়ের ঠ্যাং দুটো থরথর করে কাঁপে। বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ। গলা শুকিয়ে কাঠ।

এই ডাকাতের দলে একটা ছেলে আছে যে একটু অন্য রকমের। তাকে দেখতে ডাকাতের মতো নয় মোটেই। ভারী সুন্দর ফুটফুটে চেহারা তার। লম্বা হলেও খুব কেটা জোয়ান নয় সে। মুখখানা মিষ্টি, চোখ দুটো ঢুলুঢুলু। গায়ের রঙ এক সময়ে টকটকে ফসা ছিল, কিন্তু এখন অযত্নে রঙটা জ্বলে গেছে। দেখে মনে হয়, এ বোধহয় ভদ্র ঘরের ছেলে।

কিন্তু পুরুতমশাই শুনেছেন, ডাকাত দলের বুড়ো সর্দারকে হটিয়ে একদিন নাকি একেই নতুন সর্দার বানানো হবে। ছেলেটা মদ গাঁজা খায় না, চেঁচামেচিও করে না। বেশির ভাগ সময়ে চুপচাপ বসে থাকে। তবে ছোঁকরা নাকি ভারী এলেমদার। বন্দুক পিস্তলের হাত খুব পরিষ্কার, বশার টিপ একেবারে অব্যর্থ, তা ছাড়া দুর্জয় তার সাহস।

পুরুতমশাই ঘণ্টা নেড়ে আরতি করতে করতেই শুনতে পেলেন, একজন ডাকাত বলছে, “ওরে, আজ রাজবাড়ি লুট হবে, তোরা বেশি মদ গাঁজা খাসনি। খেলে মাথা ঠিক রাখতে পারবি না।”

শুনে পুরুতমশাইয়ের হাত থেকে ঘণ্টাটা টঙাস করে পড়ে গেল।

ওদিকে একটা বাঁশঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ডাকাতদের দৃশ্যটা লক্ষ করছিলেন আর-একজনও। তাঁর গায়ে ব্যাপার, পরনে ধুতি। দেখলে খুব নিরীহ মানুষ বলে মনে হয়। আসলে মানুষটা নিরীহই। কিন্তু আজ তাঁর ডান হাতে একটা পিস্তল। আর চোখ দুটোও অসম্ভব জ্বলজ্বল করছে।

এ লোকটা আর কেউ নয়, স্বয়ং ভজহরি বাজাড়।

ভজবাবুকে যাঁরা রোজ বাজারে হাটে দেখেন, তাঁরা এই ভজবাবুকে দেখলে কিন্তু চিনতেই পারবেন না। তার মানে এ নয় যে, বেঁটেখাটো ভজবাবু হঠাৎ ছ ফুট লম্বা হয়ে গেছেন, কিংবা তাঁর থলথলে চেহারাটা হঠাৎ মাসকুলার হয়ে গেছে। সে সব না হলেও, ভজবাবুর চেহারায় এখন এমন একটা বেপরোয়া ভাব, এমন হিংস্র আর কঠিন মুখচোখ যে, লোকে দেখলেই তিন হাত পিছিয়ে পালানোর পথ খুঁজবে।

আজ বিকেলে পিস্তলটা হাতে পাওয়ার পর থেকেই ভজবাবুর এই পরিবর্তন। আপনমনে মাঝে মাঝে হাসছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, “এতদিন পিস্তল ছিল না বলেই কেউ আমাকে পাত্তা দিত না তেমন! আজ সব ব্যাটাকে ঢিট করে ছাড়ব। আজ আর কারও রক্ষে নেই।”

ভজবাবু ছেলেবেলায় যে ইস্কুলে পড়তেন তার হেড স্যার ছিলেন গোলোকবিহারী চক্রবর্তী। অমন কড়া ধাতের মানুষ হয় না। এক-একখানা থাবড়া খেলে মনে হত, বুঝি গাছ থেকে পিঠে তাল পড়ল। তাঁর ভয়ে ছেলেরা ছবি হয়ে থাকত, কারও খাস পর্যন্ত জোরে বইত না। ভজবাবুর ছেলেবেলাটা এই হেড স্যারের শাসনে কেটেছে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, ইস্কুল ছাড়বার পরেও ভজবাবু গোলোকবিহারীর ভয় আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গোলোকবিহারীর বয়স এখন অষ্টাশি, কিন্তু পেল্লায় সটান চেহারা তাঁর। চোখে ঈগল পাখির মতো দৃষ্টি, গলায় বাঘের আওয়াজ, হাতির মতো মাটি কাঁপিয়ে রাস্তায় হাঁটেন, দেখা হলেই পিলে চমকে দিয়ে গাঁক করে বলেন, “এই যে ভজু, বল তো সাইকোলজি বানান কী?”

বলতে না পারলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, “তোকে গাধা বললে গাধাদের অপমান করা হয়।”

গোলোকবাবুর এই অসহ্য মাস্টারি ভজবাবু বহুকাল সহ্য করেছেন। এই বুড়ো বয়সেও ভজবাবুকে রাস্তায়-ঘাটে বাজারে সর্বত্র ওই গোলোকবাবু এইভাবে অপমান করে বেড়ান। তাই পারতপক্ষে গোলোকবাবুর মুখোমুখি পড়ে যেতে চান না ভজবাবু।

আজ পিস্তল হাতে পেয়েই প্রথম তাঁর গোলোকবাবুর কথা মনে পড়ল। ওই লোকটাকে টিট করতে না পারলে জীবনে শান্তি, সুখ, স্বাস্থ্য কিচ্ছু নেই।

র্যাপারের মধ্যে পিস্তল লুকিয়ে নিয়ে ভজবাবু তাই সোজা আজ বিকেলে গিয়েছিলেন গোলোকবাবুর কদমতলার বাড়িতে।

গোলোক স্যার তাঁর বাইরের ঘরে বিশাল চৌকির ওপর কম্বলমুড়ি দিয়ে বসা। সামনে খোলা একখানা পাঁচসেরী এনসাইক্লোপিডিয়া। বিনা চশমায় খুদে-খুদে অক্ষর দিব্যি পড়ে যাচ্ছেন এই অষ্টাশি বছর বয়সেও।

ভজবাবু দরজার চৌকাঠে দাঁড়াতেই তিনি মুখ তুলে দেখে বললেন, “ভজু নাকি রে?”

সেই কণ্ঠস্বরে হাতে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও ভজবাবুর বুকটা কেঁপে গেল। বললেন, “আজ্ঞে।”

অভ্যাসবশে কম্বলের ভিতর থেকে হেড স্যার একজোড়া পা বার করে দিয়ে বললেন, “পেন্নাম তাড়াতাড়ি সেরে নে, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।”



শহর ভরে গোলোকবাবুর ছাত্র। বুড়ো ধুড়ো, ছেলে, ছোঁকরা মিলে বিশাল ছাত্রের ব্যাটেলিয়ান। সারাদিন তাদের সঙ্গে গোলোকবাবুর দেখা হচ্ছে আর টপাটপ প্রণাম পাচ্ছেন। প্রণাম পাওয়ার এই অভ্যাসবশেই পা বের করে ফেলেছেন তিনি।

কিন্তু আজ প্রণাম করতে আসেননি ভজবাবু। তাঁর উদ্দেশ্য গোলোকবাবুর যেখানে-সেখানে মাস্টারি করার অভ্যাসটাকে বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু ব্যাপারের তলায় পিস্তলটা হাতের চেটোয় ঘেমে উঠল ভয়ে। গোলোকবাবু তাকিয়ে আছেন চোখে-চোখে।

ডান হাত থেকে পিস্তলটা বাঁ হাতে চালান করে প্রণামটা সেরে নেবেন বলে ভেবেছিলেন ভজবাবু। কিন্তু একটা মুশকিল হল র‍্যাপারের তলায় হাত-চালাচালি করতে গিয়ে দেখেন মাঝখানে র‍্যাপারের একটা পল্লা এসে যাচ্ছে। পিস্তলটা হাত বদল করা যাচ্ছে না। অথচ প্রণামে দেরি করাও চলে না। গোলোকবাবুর পায়ে ঠাণ্ডা লাগছে।

অগত্যা ভজবাবু ডান হাতেই পিস্তলটা ধরে রেখে বাঁ হাতে গোলোকবাবুর পায়ের ধুলো নিলেন।

গোলোকবাবু একগাল হেসে বললেন, “আমি বরাবর লোককে বলি ভজু গর্দভটার ডান বাঁ জ্ঞান নেই, তা এখন দেখছি বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব কটা ফোরকাস্ট তোর জীবনে মিলে যাচ্ছে। বলি, তুই সব্যসাচী হলি কবে থেকে যে, বাঁ হাতে পায়ের ধুলো নিচ্ছিস?”

ভজুবাবু মাথা চুলকে বললেন, “ডান হাতে ব্যথা স্যার।”

“ব্যথা? কেন, ঢিল ছুঁড়তে গিয়েছিলি নাকি?”

“আজ্ঞে না।”

“বল দেখি, সব্যসাচী মানে কী?”

“যার দুই হাত সমানে চলে।” টপ করে বলে দিলেন ভজবাবু। আর বলে তাঁর খুব আনন্দ হল। গোলোকবাবুর বিদখুটে সব প্রশ্নের মধ্যে খুব অল্পেরই ঠিক জবাব দিতে পেরেছেন তিনি।

“বটে?” গোলোকবাবু খুব মিষ্টি করে হেসে বললেন, “এবার তা হলে বল, সব্যসাচীর ইংরাজিটা কী হবে?”

ভজবাবুর একগালে মাছি। হাতের পিস্তলটার কথা আর মনেও পড়ল না। ভয়ে পেটের ভিতরে গোঁতলান দিচ্ছে।

“স্টুপিড।” বলে গর্জন করে উঠলেন গোলোকবাবু। ধপাস করে বইটা বন্ধ করে বললেন, “বুড়ো হতে চললি, এখনও এই সব রপ্ত হল না? গোলোক মাস্টারের ছাত্র বলে সমাজে কী করে পরিচয় দিস তোরা, অ্যাাঁ? কত জুয়েল ছেলে এই হাত দিয়ে বেরিয়েছে জানিস? ওঠবোস কর। কর ওঠবোস।”

ভজবাবুর হাঁ আরও দু ইঞ্চি বেড়ে আলজিভ দেখা যেতে লাগল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গোলোক স্যার তাকে ওঠবোস করতে বলছেন। অ্যাঁ।

“ওঠবোস করব স্যার?” অতিকষ্টে জিজ্ঞেস করেন ভজবাবু।

“তা নয় তো কি ডন-বৈঠক করতে বলেছি। দশবার ওঠবোস করে তারপর ছুটি পাবি। শুরু করে দে।”

“হাঁটুতে বাত যে স্যার।”

“বাত সেরে যাবে।”

“হাড়ে মটমট শব্দ হয়।”

“হোক শব্দ, তাতে তোর শব্দরূপ ধাতস্থ হবে।”

“আমার যে পঞ্চান্ন বছর প্রায় বয়স হল স্যার।”

“শিক্ষার আবার বয়স কী রে উল্লুক? কর ওঠবোস। বাঁ হাতে পেন্নাম করা তোমার বের করছি। কর ওঠবোস!” গোলোকবাবু একটা হুঙ্কার ছাড়লেন।

সেই হুঙ্কারে ভজবাবু কুঁকড়ে যেন ক্লাশ সিক্স-এর ভজু হয়ে গেলেন। তারপর বাতব্যাধি ভুলে, বয়স উপেক্ষা করে, হাড়ের মটমট শব্দ তুচ্ছ করে দশবার তাঁকে ওঠবোস করতে হয়েছে।

শাস্তির দৃশ্যটা খুব আয়েস করে দেখলেন গোলোকবাবু। শুধু তিনিই নন, ভজবাবু ওঠবোস শুরু করার মুখে গোলোক স্যারের দুই নাতি আর এক নাতনিও এসে দরজায় দাঁড়াল। তাদের সে কী মুখচাপা দিয়ে হাসি!

দশবার ওঠবোস করার পর ভজবাবু যখন হ্যাঁ-হত্যা করে হাঁফাচ্ছেন তখন গোলোকবাবু বললেন, “যা। আর কক্ষনো যেন ডানবাঁ ভুল না হয় দেখিস।”

সেই অপমানের পর বেরিয়ে এসেই ভজবাবুর চেহারাটা একদম পাল্টে গেল। ভরসন্ধেবেলা দশবার ওঠবোস! হাতে পিস্তল থাকতেও!

ভাবতে-ভাবতে ভজবাবুর চেহারা হয়ে গেল খ্যাপা খুনীর মতো। সারা দুনিয়াকে তখন তাঁর দাঁতে-নখে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মাথাটা এত তেতে গেছে যে, মনে হচ্ছিল এক্ষুনি মাথার ব্রহ্মতালুতে আগ্নেয়গিরির গহ্বরের মতো ছাঁদা হয়ে মাথার ঘিলু তপ্ত লাভার মতো ছিটকে বেরিয়ে পড়বে।

রাস্তার কল থেকে খানিক ঠাণ্ডা জল মাথায় দিয়ে ভজবাবু আবার রওনা দিলেন। সব পাজি বদমাশকে আজ ঠাণ্ডা করতে হবে।
 
চৌরাস্তার মোড়ে একজন কনস্টেবল একজন রিকশাওলার কাছ থেকে পয়সা নিচ্ছিল। প্রায়ই নেয়। রিকশাওলার গাড়িতে বাতি ছিল না, তাই ধরা পড়ে কাঁচুমাচু মুখে একটা সিকি ঘুষ দিচ্ছিল।

ঠিক এই সময়ে ভজবাবু পিস্তল বাগিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির।

বিকট একটা হুঙ্কার দিয়ে কনস্টেবলটাকে বললেন, “সিকি ফিরিয়ে দে।”

পিস্তল দেখে সিপাইটার চোখ লুচির মতো গোল হয়ে গেল, আর রিকশাওলাটা বাবারে’ বলে গাড়ি ফেলে দৌড়।

“দে বলছি ফিরিয়ে।” ভজবাবু ধমকালেন।

কিন্তু সিপাই সিকিটা ফিরিয়ে দেবে কাকে! রিকশাওলাটা হাওয়া দিয়েছে যে। অগত্যা সে ভয়ে-ভয়ে ভজবাবুর দিকেই সিকিটা ছুঁড়ে দিয়ে জোড়হাতে বলল, “জান বাঁচিয়ে দিন ভজবাবু। আর কখনও–”

ভজবাবু নির্দয়। খুনীর গলায় বললেন, “ওঠবোস কর। দশবার।”

লোকটা খানিক গাঁইগুঁই করল বটে, কিন্তু শেষে রাজি হয়ে চৌরাস্তার ধারে সরে এসে একটু অন্ধকারে দশবার বৈঠকী দিল।

সিপাইটাকে ওঠবোস করিয়ে গায়ের ঝাল খানিকটা মিটল ভজবাবুর। ভারী খুশি হয়ে উঠলেন পিস্তলের গুণ প্রত্যক্ষ করে।

আবার ব্যাপারের তলায় অস্ত্রটা লুকিয়ে নিয়ে সোজা চলে এলেন ইউরোপীয়ান ক্লাবে।

ক্লাবে অবশ্য এখন ইউরোপিয়ান আর কেউ নেই। বিলিয়ার্ড টেবিলের ওপরকার দামি কাপড়টা কে বা কারা ব্লেড দিয়ে কেটে তুলে নিয়েছে। টেবিল টেনিসের টেবিলের ওপর এখন দারোয়ানের মেয়ে আর জামাই শোয়। আর বল নাচের ঘরে টেবিল-চেয়ার পেতে কয়েকজন অফিসারগোছের লোক পয়সা দিয়ে তাস-টাস খেলে।

জুয়াখেলা দুচক্ষে দেখতে পারেন না ভজবাবু। বহুকাল ধরে তাঁর ইচ্ছে, এই জুয়ার চক্রটা ভাঙতে হবে।

ঘরে ঢুকেই ভজবাবু পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে বললেন, “হাতটাত তুলে ফেল হে। দেরি কোরো না।”

জুয়াড়িরা খেলায় মজে আছে। ভাল করে শুনতেও পেল না, কিংবা শুনলেও গ্রাহ্য করল না।

“কই হে!” বলে ভজবাবু এবার যে হুমকি ছাড়লেন তা অবিকল গোলোকবাবুর গলার মতো শোনাল।

এইবার চার-পাঁচজন জুয়াড়ি মুখ তুলে তাকিয়ে থ।

“এই যে ভজ বাজাড়!”

“হাতে পিস্তল যে! ও ভজবাবু, হল কী আপনার?…

ভজবাবু সেসব কথায় কান দিলেন না। তবে লোকগুলো যাতে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে না নেয় তার জন্য হঠাৎ পিস্তলের নলটা ছাদের দিকে তাক করে গুড়ম করে একটা গুলি ছুঁড়লেন।

সেই শব্দে, নাকি গুলি লেগে কে জানে, ঘরের আলোর ডুমটা ফটাস করে ভেঙে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আর সেই অন্ধকারে চার-পাঁচটা জুয়াড়ি প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল, “গুলি! গুলি! গেলাম! মলাম!”

ভজবাবু অন্ধকারে আপনমনে একটু হেসে বেরিয়ে এলেন। পিস্তলের মজা এখনও শেষ হয়নি। এই তো সবে শুরু। ভাবলেন ভজবাবু। তারপর জোর কদমে আর-এক দিকে হাঁটতে লাগলেন।

চোট্টা গোবিন্দ ভাল লোক নয়। সে সুদে টাকা খাটায় লোকের গয়না জমি বন্ধক রেখে টাকা ধার দেয়। এইসব করে সে এখন বিশাল বড়লোক। আসল নাম গোবিন্দচন্দ্র বণিক। কিন্তু সুদখোর আর অর্থলোভী বলে তার নামই হয়ে গেছে চোট্টা গোবিন্দ।

যারা টাকা ধার দিয়ে সুদ খায় বা বন্ধকী কারবার করে, তাদের বড় একটা ভাল হয় না। এই যেমন চোট্টা গোবিন্দরও ভাল কিছু হয়নি। তার ছেলেপুলেরা কেউ মানুষ হয়নি। দুটো ছেলেই বখে গিয়ে বাড়ি থেকে চুরি করে পালায়। তারপর একজন খুন করে জেলে গেছে, অন্যজন পাগল হয়ে পাগলাগারদে আছে। একটিই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল সাধ করে। কিন্তু সে-মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বলে দিয়েছে, ওরকম সুদখোর বাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা চলবে না। তাই মেয়েও বাপের কাছে আসে না।



পুলিশ চৌকির কাছেই চোট্টা গোবিন্দর বাড়ি। ছোট আর পুরনো হলেও বাড়িটা খুব মজবুত। জানালায় মোটা মোটা গরাদ, লোহার পাত মারা পুরু কাঠের দরজা আর তাতে আবার সব সময়ে তালা লাগানো থাকে। ঘরে বিশাল বিশাল কয়েকটা সিন্দুকে কয়েকশো ভরি বন্ধকী গয়না আর জমিজমার দলিল, কোম্পানির কাগজপত্র রাখা থাকে।

কৃপণ চোট্টা গোবিন্দর পয়সা থাকলে কী হয়, কখনও ভাল খাবে পরবে না। বুড়ো শকুনের মতো বাজারে ঘুরে ঘুরে যত সব শস্তার পচা বাসী তরিতরকারি কিনবে। বাজারের ভাল জিনিসটার প্রতি যার চোখ নেই, তাকে ভজবাবু মোটেই ভাল চোখে দেখেন না। তার ওপর আবার লোকটা সুদখোর।

চোট্টা গোবিন্দর একটা স্বভাব হচ্ছে সব কাজ করার আগে পাঁজি দেখে নেবে। তিথি-নক্ষত্রের যোগ না দেখে সে কখনও কোনও কাজ করে না। এমনকী, দিন খারাপ থাকলে বন্ধক নেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখে।

হঠাৎ চোট্টা গোবিন্দর কথা মনে পড়তেই ভজবাবুর শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল। হ্যাঁ, এ লোকটা মানুষের সমাজে এক বিদঘুঁটে কলঙ্ক, পৃথিবীর এক কুটিল শত্রু। এই নরাধমকে কিছু উত্তম শিক্ষা দেওয়া দরকার।

ভজবাবু এসে চোট্টা গোবিন্দর দরজায় কড়া নাড়লেন।

চোট্টা গোবিন্দ সাবধানী লোক। সন্ধের পর হুট বলতে সদর দরজা খোলে না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্তুষ্ট হলে দরজা খোলে, নয়তো পরদিন আসতে বলে বিদায় দেয় লোককে। নিতান্ত কেউ দায়ে ঠেকলে জানালা দিয়ে গয়না টাকার লেনদেন হয়। তাও আবার তিথি-নক্ষত্র ভাল থাকলে।

কিন্তু ভজবাবুর কপালটা আজ নিতান্তই ভাল। যে সময়টায় তিনি কড়া নাড়ছিলেন, ঠিক সে সময়েই দরজার ভিতর থেকে হুড়কো খোলার শব্দ হল। কপাটের পাল্লা খুলে শার্দুল চৌধুরী বেরিয়ে আসছিল।

শার্দুল নামকরা শিকারি। তার যে কত বন্দুক পিস্তল ছিল তার লেখাজোখা নেই। সাতটা তেজী ঘোড়া ছিল, পাঁচটা গ্রে-হাউন্ড ব্লাড-হাউন্ড কুকুর, বাড়িতে বাগান, পুকুর, দারোয়ান ছিল। তা ছাড়া শার্দুলের চেহারাটাও ছিল পাহাড়ের মতো বিশাল; আর মনটা ছিল আকাশের মতো উদার। মুঠো মুঠো টাকা যেমন ওড়াত তেমনি বিলিয়ে দিত।

তবে একটা কারণে শার্দুলকেও ভজবাবু দেখতে পারেন না। শার্দুল বাজারে গিয়ে কখনও দরদাম করে না। দোকানদাররা যা দাম চায় তাই হাসিমুখে দিয়ে দেয় আর রাশি রাশি তরিতরকারি, মাছ, ডিম, মাংস কিনে ফেলে। শার্দুল যেদিন বাজারে যায় সেদিন দোকানদারদের পোয়াবারো, আর ভজবাবুর কপালে দুঃখ। সেদিন ভজবাবু যে-দোকানদারের কাছেই গিয়ে বাবা, বাছা বলে দু পয়সা কমানোর চেষ্টা করেন সেই দোকানদারই তাঁকে না-চেনার ভান করে, পাত্তাই দিতে চায় না। কানাই মাছওলা একবার তো বলেই ১০২

ফেলল, “বাজাড়দের মধ্যে ভ ভদ্রলোক দেখলাম একমাত্র ওই শার্দুলবাবুকেই। আর তো সব ছ্যাঁচড়া।”

সেই থেকে ভজবাবুর রাগ। শার্দুল চৌধুরীর অবশ্য আর সেই বাঘ-সিংহী মারার দিন নেই। অমিতব্যয়ের ফলে তার পয়সাকড়ি সব চলে গেছে, বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। বন্দুক, ঘোড়া, কুকুর সবই বেহাত। শার্দুলের সে চেহারাও আর নেই। রোগাটে লম্বা মানুষটাকে দেখলে মনে হয় বুঝি শার্দুলের বাবা। অত বুড়ো দেখায়।

শার্দুল ভজবাবুকে দেখে চোখ নাচিয়ে বলল, “কী খবর হে ভজু শিকারি?”

ভজবাবু জন্মেও কিছু শিকার করেননি। তবে কিনা ভাল বাজার করেন বলে শাল তাঁকে মুনাফা-শিকারি বলে ডাকে। সংক্ষেপে শিকারি।

ভজবাবুর ব্যাপারের তলায় তৈরি পিস্তল। কিন্তু যখন-তখন সেটা ব্যবহার করতে তো আর পারেন না। সতর্কতার একান্ত প্রয়োজন। তাই ভালমানুষের মতো বললেন, “ভিতরে চলুন শার্দুলবাবু, আপনার সঙ্গে কথা আছে।”

শার্দুল ব্যস্ত হয়ে বলে, “কথা বলার সময় নেই। বাড়িতে আজ জলসা বসিয়েছি, লখনউ থেকে এক বড় ওস্তাদ এসেছে। তাকে মুজররা দিতে হবে বলে একটা সোনার পকেটঘড়ি বাঁধা দিয়ে গেলাম। জোর খানাপিনাও হবে।”

ভজবাবু দাঁত কিড়মিড় করলেন। অমিতব্যয়ী আর কাকে বলে। এই লোকটার এই দেদার টাকা খরচ করে ফুর্তি করা আর বাজারের দোকানদারদের আশকারা দেওয়া আজ বের করতে হবে। ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথাটা একান্তই জরুরি। বেশি সময়ও লাগবে না।”

এই বলে শালকে একরকম ঠেলে দরজার ভিতরে এনে ভজবাবু দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে পিস্তল বের করে বললেন, “হ্যান্ডস আপ।”

শার্দুল বলে উঠল, “উ-হুঁ-হুঁ, আজ থিয়েটার দেখার সময় নেই। ওস্তাদজি বসে আছেন। তোমাদের পূর্বপল্লী কি এবার গোয়েন্দা-নাটক করছে নাকি?”

ভজবাবু হাসলেন, তারপর বিনাবাক্যে পিস্তলের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ঘোড়া টিপে দিলেন।

প্রচণ্ড শব্দ, আগুনের ঝলক আর ধোঁয়ার ভিতরে দাঁড়িয়ে ভজবাবুর নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বীর বলে মনে হল।
 
পিস্তলের শব্দে শার্দূল তিন হাত ছিটকে গেল। চোট্টা গোবিন্দ সিন্দুকের চাবি ট্যাকে খুঁজতে যাচ্ছিল, ঝনাত করে চাবির গোছাটা পড়ে গেল মেঝেয়।

ভজবাবু বললেন, “হ্যান্ডস আপ।”

এবার আর শার্দুলও চোট্টা গোবিন্দর হাত ওপরে তুলতে বেশি দেরি হল না। তবে কিনা চোট্টা গোবিন্দ ইংরিজি জানে না, ‘হ্যান্ডস আপ’ কথাটার মানে বুঝতে পারেনি বলে তার কিছু দেরি হয়েছিল। শার্দুল চৌধুরী কথাটার মানে বলে দিল তাকে; তখন সে তড়িঘড়ি হাত তুলে বলল, “বাবা ভজু, দোহাই তোমার। পাঁজিটা একটু দেখতে দাও।”

ভজবাবু হেসে বললেন, “পাঁজি দেখবেন? না পাঁজি দেখতে চান? পাঁজি দেখতে চাইলে একটা আয়না নিয়ে নিজের মুখখানা দেখুন, সবচেয়ে বড় পাজিকে দেখতে পাবেন।”

চোট্টা গোবিন্দ কাকুতি-মিনতি করে বলতে থাকে, “লক্ষ্মী ছেলে ভজু, অমন করে না, ছিঃ! আটটা কত মিনিটে যেন অমৃতযোগ আছে। যদি মারতেই হয় তবে সময়টা একটু দেখে মেয়েরা বাপ। নইলে কোন নরকে গিয়ে পচব।”

“হাঃ হাঃ,” হাসলেন ভজবাবু, তারপর ডাকলেন, “শার্দুল চৌধুরী।”

ভজবাবুর গলায় ডাকটা বাঘের ডাকের মতো শোনাল। শব্দে কেঁপে ওঠে শার্দুল। আর ভজবাবু অবাক হয়ে নিজের গলায় হাত রেখে ভাবেন, “এও কি পিস্তলের গুণ? নইলে এরকম বাঘের আওয়াজ আমার গলায় এল কোত্থেকে?”

ভজবাবু পিস্তলটার গায়ে আদরে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “শুনুন শার্দুলবাবু আর গোবিন্দবাবু, আপনাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। গোবিন্দবাবু, আপনি সুদখোর, বন্ধকী মহাজন, মানবতার শত্রু, পৃথিবীর পঙ্কিলতম জঘন্যতম কী যেন! কী যেন! থাকগে। আর শার্দুলবাবু, আপনি আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ, বেহিসাবি। দরিদ্রের রক্ত শোষণ করে, পৃথিবীর সম্পদ লুণ্ঠন করে, বাজারে গিয়ে নিজের ধনসম্পদের অপপ্রয়োগের দ্বারা মূল্যমানকে জঘন্যতম উর্ধ্বে তুলে দিয়ে যে অহমিকার ধ্বজা–এত কথারই বা কাজ কী! ওঠবোস করুন। দশবার।”

শার্দুল খুব মন দিয়ে ভজবাবুর কথা শুনছিল, ভজবাবু, থেমে যেতেই চোট্টা গোবিন্দর দিকে চেয়ে বলে উঠল, “পার্ট ভুলে গেছে?”

ভজবাবু ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েগ বললেন, “ভুলিনি। আরো শুনতে চান? আপনাদের লজ্জা হয় না শুনতে? ওঠবোস করুন, ওঠবোস করতে থাকে।

চোট্টা গোবিন্দ প্রায় কেঁদে ফেলে বলে উঠল, “আটটা পনেরো মিনিট উনচল্লিশ সেকেন্ড গতে অমৃতযোগ লাগবে। বাবা ভজু, ততক্ষণ বসে না হয় বিশ্রাম করো। বসেবসে গালাগাল করো। খানিক শুনি। বেশ বলছিলে বাবা।”

ভজবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “কথা কানে যাচ্ছে না নাকি? ওঠবোস করতে বলছি যে!”

“ওঠবোস!” চোট্টা গোবিন্দ ভারী বিমর্ষ গলায় বলে, “ওঠবোস করব সেই ভাগ্য কি আমার আছে বাপ! দু হাঁটুতে বাত। একবার বসলে আর উঠতে পারি না, ধরে তুলতে হয়। দশবার ওঠবোস করতে একটা বেলা চলে যাবে। তাও যদি তোমরা ধরাধরি করে করাও।”

ওদিকে শার্দুল শেষবার ওঠবোস করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, “দশ। এবার ছুটি তো ভজু?”

ভজবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “ছুটির দেরি আছে। গোবিন্দবাবু, আপনার কাছে তামা-তুলসী-গঙ্গাজল থাকে বলে শুনেছি। সেসব বের করুন।”

চোট্টা গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “থাকে বাবা। যারা ধারকর্জ করতে আসে তাদের তামা-তুলসী-গঙ্গাজল ছুঁইয়ে শপথ করিয়ে নিই যাতে সুদ ঠিকমতো দেয়, মামলা-মোকদ্দমা না করে শাপশাপান্ত না দেয়।”

পিস্তল নাচিয়ে ভজবাবু বললেন, “সেসব বের করুন। আজ আপনাদের শপথ করিয়ে নেব।”

কাঠের আলমারি খুলে চোট্টা গোবিন্দ তাপাত্রে গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা বের করে হাতে নিয়ে দাঁড়াল। ভজবাবুর পিস্তলের ইশারায় শার্দুল চৌধুরীও তাম্রপাত্রটি ছুঁয়ে দাঁড়াল।

ভজবাবু বললেন, “এবার বলুন, আর কখনও টাকা ধার দিয়া সুদ লইব না, বন্ধকের কারবার করিব না, মানুষের সর্বনাশ করিয়া ধনী হইব না—”

চোট্টা গোবিন্দ বলতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে শার্দুলও বলে, “আর কখনও টাকা ধার দিয়া সুদ লইব না, বন্ধকের কারবার–”

ভজবাবু বিরক্ত হয়ে শার্দূলকে বলেন, “আহা, ও কথা আপনার বলবার নয়। আপনার শপথবাক্য আলাদা।”

এরপর ভজবাবু শার্দুলকে দিয়ে শপথ করাতে থাকেন, “আর কখনও বেহিসাবি খরচ করিব না, ফুর্তি করিয়া টাকা উড়াইব না, আর বাজার করিতে গিয়া দরাদরি না করিয়া জিনিস কিনিব না–”

এবার শার্দুলের সঙ্গে সেসব কথা চোট্টা গোবিন্দও বলতে থাকে, “আর কখনও বেহিসাবি খরচ করিব না, ফুর্তি করিয়া টাকা উড়াইব না, আর বাজার করিতে গিয়া”।

ভজবাবু চোট্টা গোবিন্দকে ধমক দিলেন, “ওসব আপনাকে কে বলতে বলেছে? আপনি বরং সুদের কারবার ছেড়ে এবার থেকে ফুর্তি করেই টাকা ওড়াবেন। আপনার সেইটেই দরকার।”

“তাই করব বাবা। তবে বুড়ো বয়সে কিছু মনে থাকে না। যা সব শপথ করালে তা মনে থাকলে হয়।”



ভজবাবু একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বেরিয়ে এলেন। এবার যাবেন বাজারে। কানাই মাছওলাকে ঢিট করতে না পারলে সুখ নেই।

কিন্তু বৈকালী বাজারে আজ কানাই বসেনি। মেছুনী অনঙ্গবালা ভজবাবুকে চুপি চুপি বলল, “আসবে কী করে বাবু, আজ যে কানাইয়ের কালীপুজো।”

“কালীপুজো! কালীপুজো তো কবে হয়ে গেছে।”

অনঙ্গবালা পান-খাওয়া মুখে একটু হেসে বলে, “সে পুজো নয় বাবু। আপনাকে বলেই বলছি, আজকের পুজো হচ্ছে ডাকাতি করার পুজো।”

“বটে!” ভজবাবুর মুখখানা অসুরের মুখের মতো হয়ে গেল। বাজার থেকে বেরিয়ে তিনি সোজা শহরের উত্তরদিকে যাওয়ার রাস্তায় পড়লেন। বেগে হাঁটছেন আর আপনমনে মাঝে মাঝে বলছেন, “বটে! বটে! বটে! বটে!”

বাঁশঝোঁপের আড়াল থেকে ভজ বাজাড় সবই দেখলেন, শুনলেন। তারপর আপনমনে বলে উঠলেন “বটে।”

আলোয়ানের তলা থেকে পিস্তলটা বের করে একটু আদর করলেন অস্ত্রটাকে। পিস্তল থাকলে আর কোনও ভয় নেই। পিস্তলের সামনে সব ডাকাত, বদমাশ, চোর, গুণ্ডা ঠাণ্ডা।

ওদিকে ডাকতরা খুব চিল্লামিল্লি করছে। তাদের আনন্দ আর ধরে না। পুজো হয়ে গেছে। বলির পাঁঠা কাটাকুটি করে মস্ত কড়াইতে কাঠের জ্বালে রান্না চেপে গেছে। গোটা পঁচিশ মশাল জ্বলছে চারধারে। চারদিকটা আলোয় আলো।

এদিকে মাংসের গন্ধে ভজবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আজ সেই দুপুরের পর এ পর্যন্ত তাঁর কিছুই খাওয়া হয়নি। বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। তার ওপর বাঁশঝাড় থেকে হাজার হাজার মশা পিন্ পিন্ করে উড়ে এসে ঘেঁকে ধরেছে তাঁকে।

ইচ্ছে ছিল ডাকাতদের ওপর আরো কিছুক্ষণ নজর রাখবেন। ওরা যখন ডাকাতিতে বেরোবে ঠিক তখন গিয়ে যমের মত পিস্তল হাতে মুখোমুখি হবেন। কিন্তু খিদে আর মশার জ্বালায় ভজবাবু বসে থাকতে পারলেন না। আহাম্মক মশাগুলো তো পিস্তলের মর্ম বোঝে না যে ভয় পাবে। তাই ভজবাবু ভাবলেন তাড়াতাড়ি ডাকাতগুলোকে শিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে পেট ভরে ভাত খাবেন। সারাদিন ভারী ধকল গেছে।

এই ভেবে ভজবাবু ব্যাপারটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে পিস্তল বাগিয়ে ধরে বাঘের গলায় ‘খবরদার! খবরদার!’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চার-পাঁচ লাফ দিয়ে কালীবাড়ির চাতালে পড়লেন। তারপরই গুড়ম করে একটা গুলি আকাশে ছুঁড়ে বললেন, “হ্যান্ডস আপ। সবাই হাত তোলো।”

ভজবাবুর সেই চেঁচানি আর গুলির শব্দে ডাকাতদের মধ্যে প্রথমটায় এক প্রচণ্ড আতঙ্ক দেখা দিল। ভড়কে গিয়ে সবাই এদিকে সেদিক পাঁই-পাঁই করে পালাতে লাগল। একটা মোটা ডাকাত মাংসের ঝোল হাতায় তুলে নুনঝাল পরীক্ষা করছিল সে তাড়াহুড়োয় পালাতে গিয়ে সেই ফুটন্ত ঝোল হাতা থেকে মুখে ঢেলে গরমে মাংসের কড়াইয়ের জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে গিয়ে ফুটন্ত মাংসের কড়াইয়ের মধ্যে একটা পা ডুবিয়ে দিল। তারপর ‘বাবা রে গেছি রে’ বলে লেংচে লেংচে খানিক দূরে গিয়ে পড়ল।

কানাই দায়ে ধার দিচ্ছিল, আচমকা ভজবাবুর মূর্তি আর পিস্তলের শব্দে সে মনে করল, পুলিশ এসেছে। সে হাঁটু গেড়ে বসে খুব অভিমানের সুরে হাতজোড় করে বলতে লাগল, “এসব কি ঠিক হচ্ছে পুলিশ সাহেবদের? আজ সকালেই দু সের বড় বড় কই মাছ দারোগাবাবুদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি, তবু এই মন্দিরে এসে জুলুম কেন? নিরালায় বসে কয়েকজন ভক্ত মায়ের পুজো করছে, তার মধ্যে এসে এই হুজ্জতের কোনও মানে হয়?”


কিন্তু ভজবাবুর কানে সেসব কথা যাচ্ছে না। ডাকাতদের পালাতে দেখে তাঁর সাহস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সোল্লাসে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলেন, “সব ব্যাটাকে মেরে ফেলব। খুন করব। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাব। আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন।”

তারপর হঠাৎ কানাইকে দেখতে পেয়ে ভজবাবু এক লাফে তার সামনে এসে নাকের ডগায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বললেন, “কানাই!”

ভজবাবুকে দেখে কানাই অবাক। পিস্তল দেখে আরো অবাক। কাঁপা গলায় বললেন, “আজ্ঞে!”

“এবার?” ভজবাবু একগাল হেসে বললেন।

কানাই কাঁপা গলায় বলে, “রোজ তো আপনাকে নিজের ক্ষতি করে কম দামে মাছ দিই ভজবাবু!”

“আজ সকালে যে বড় কৈ মাছগুলো লুকিয়েছিলি।”

“পরে তো বের করে দিচ্ছিলাম ভজবাবু, কেবল গোয়েন্দাচরণ

এসে–”

“চোপ,” বলে ভজবাবু এক ধমক দিয়ে বললেন, “বেশি কথা বলতে হবে না। দশবার ওঠবোস কর। তাড়াতাড়ি।”

কানাই খুব বাধ্য ছেলের মতো ওঠবোস করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আর দরকার হল না। কোথা থেকে একটা মাছ ধরার জাল উড়ে এসে ভজবাবুকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে ভজবাবু চাতালে গড়াগড়ি।

মাছের জালের দড়িটা হাতে নিয়ে ডাকাতের মেজ সর্দার সেই সুন্দরপানা ছেলেটা চেঁচিয়ে বলল, “ওরে, তোরা সবাই আয় রে। লোকটাকে ধরেছি। আজ বড় করে পুজো হবে ফের। আর সেই পুজোতে নরবলি হবে।”

সেই শুনে ভজবাবু মূর্ছা গেলেন। যতক্ষণ হাতে পিস্তল ছিল ততক্ষণ ভজবাবু আর ভজবাবু ছিলেন না, মহাবীর হয়ে গিয়েছিলেন। যেই পিস্তলটা হাত থেকে ছিটকে গেল অমনি তিনি রোজকার ভিতু, নিরীহ, গোবেচারা ভজহরি হয়ে গেছেন।

মুর্ছা যখন ভাঙল তখন দৃশ্য ভজবাবুর আবার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। দেখেন ডাকাতরা আবার সব জমায়েত হয়েছে। চারদিকে মহা উল্লাস চলছে। তিনি টের পেলেন তাঁর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, গলাটা হাড়িকাঠে আটকানো। ঢাক আর কাঁসিতে কারা যেন বলির বাজনা বাজাচ্ছে। কানাই মাছওলা বলছে, ‘এই ছ্যাঁচড়া বাজাড়টার জন্য আর মাছ বেচে সুখ ছিল না। আজ এটাকে নিকেশ করতেই হবে।’

রোগা পুরুতমশাই এসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভজবাবুর কপালে একটা সিঁদুরের তিলক এঁকে দিলেন। ডাকাতরা চেঁচাল, ‘জয় মা জয় মা!’
 
বেশ রাত হয়েছে।

মনোজদের বাড়ির অবস্থা বেশ থমথমে। হারানো ছবিটা পাওয়া যায়নি বলে রাখোবাবু প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সন্ধেবেলার পর যেসব খবর এসেছে তাতে তাঁর রাগ জল হয়ে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে।

প্রথমেই থানা থেকে একদল সেপাই নিয়ে দারোগা নিশিকান্ত এসে হাজির। নিশিকান্ত ভারী কড়া দারোগা, একবার তাঁর দুই ছেলে মারপিট করে একজন অন্যজনের মাথা ফাটিয়েছিল বলে তাদের দুদিন করে হাজতবাস করিয়েছিলেন। আর একবার তাঁর স্ত্রী রাগ করে বাপের বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীর নামে ওয়ারেন্ট বের করেন। শুধু অন্যের বেলাতেই নয়, নিজের বেলাতেও তিনি সমান কড়া। যদি চোর ডাকাত ধরতে না পারেন, কোনও অপরাধের যদি কিনারা না হয় তবে তিনি নিজে নাকে খত দেন, উপপাস করেন, কখনও বা সেপাইকে ডেকে বলেন–আমাকে দশ ঘা বেত মার তো! ভারী কালীভক্ত লোক। যদি কেউ নিশি দারোগাকে কালীর গান শোনায় তবে তাঁর ভর হয়। চিতপাত হয়ে পড়ে গোঁ-গোঁ করে মুখে গাঁজলা তোলেন। নিশি দারোগাকে সবাই তাই সমঝে চলে।


সন্ধেবেলা এসেই তিনি বাইরে থেকে হাঁক ছাড়লেন, “ভজবাবু, আমরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছি, পালাবার চেষ্টা করবেন না বা গুলি ছুঁড়বেন না। যদি গুলি ছোঁড়েন তবে আমরাও ছুঁড়ব। যদি পালান তো আমরাও পালাব–থুড়ি আমরা আপনাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলব। কোন চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।”


এমনিতে নিশিকান্ত যতই কড়া হোন না কেন, লোকে বলে তিনি ভারী ভিতু লোক। ঘুষ নেন না বটে তবে ঘুষিও চালান না। গুলিটুলি চালাতেও তাঁর অনিচ্ছে ভীষণ। চোর-ডাকাতদের পিছু নেওয়া বা বিপজ্জনক লোককে গিয়ে ধরা-টরার কাজেও তিনি নেই।

তবু তাঁর হাঁক-ডাক শুনে বাড়ির লোক সব হন্তদন্ত হয়ে বেরোল।

দুঃখবাবু মনোজ, সরোজ আর পুতুলকে পড়াচ্ছিলেন। গণেশবাবু একমনে একটা তান ধরেছেন। পুলিশের বুটের আওয়াজ আর গলার দাপট শুনে দুঃখবাবু তাড়াতাড়ি উঠে সরোজ, মনোজ আর পুতুলকে বললেন, “চলো ভিতরবাড়িতে যাই। এখানটায় গরম হচ্ছে।”


গণেশবাবুরও সুরটা কেটে গেল। বাড়িতে পুলিশ এসেছে টের পেয়ে তিনি তানপুরাটা বগলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। ইচ্ছে, পালিয়ে যান। কিন্তু বেরোতেই বাগানের ফটক থেকে একেবারে মুখের ওপর একটা টর্চের আলো এসে পড়ল। সেই আলোতে একটা রাইফেলের নল বা পুলিশের লাঠি যাহোক একটা বস্তুও দেখা গেল। নিশি দারোগা হুংকার ছাড়লেন, “বন্দুক ফেলে দিয়ে হাত তুলুন।”

গণেশবাবু চিচি করে বললেন, “বন্দুক নয়, তানপুরা।”

“তানপুরাই ফেলুন।”

এ সময়ে রাখোবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, “এসব কী। কী হয়েছে নিশিবাবু?”

নিশিকান্ত অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বললেন, “আপনার ভাই ভজহরিবাবুর নামে ওয়ারেন্ট আছে।”

“ওয়ারেন্ট মানে? কিসের ওয়ারেন্ট?”

এই শীতেও নিশিকান্ত কপালের ঘাম মুছে বললেন, “একজন মার্ডারারকে ঘরে লুকিয়ে রেখে আর ভান করবেন না রাখোবাবু। দয়া করে ওঁর পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে হাত দুটো ভাল করে বেঁধে আমাদের কাছে এনে দিন।”

“কার পিস্তল? কে মার্ডারার? কাকে বাঁধব?”

নিশিকান্ত খুব বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “সবই তো জানেন রাখোবাবু, কেন অভিনয় করছেন? ভজবাবু যে এত বড় মার্ডারার তা যদি আগে জানতাম। ভদ্রবেশে এত বড় খুনি এতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেউ টেরই পায়নি। কত দারোগাই তো এ শহরে এর আগে এসেছে, কেউ ধরতেও পারেনি। কিন্তু এবার ভজবাবুর খেলা শেষ। আমার হাতেই আজ এত বড় রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে। কই, নিয়ে আসুন তাকে! সাবধান, যখন আনবেন তখন যেন পিস্তলটা হাতে না থাকে।”

রাখোবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “ভজু মার্ডারার?”

পিছন থেকে আদ্যাসুন্দরী বলে উঠলেন, “এ দারোগাটাকে পেত্নীতে পেয়েছে।”

ঠাকুমা কেঁদে উঠে বললেন, “বন্দুক পিস্তল দূরে থাক বাবা, আমার ভজু দা দিয়ে বাঁশ পর্যন্ত কাটে না, পাছে বাঁশ ব্যথা পায়।”



কিরমিরিয়া দারোগা পুলিশ দেখে বিলাপ করে কাঁদছিল, “ওগো, আমাকে ধরে নিয়ে যেও না গো। আমি কালই মুলুকমে চলে যাব গো। ভজবাবু কেন পিস্তল দিয়ে খুন করল গো!”

“চুপ কর তো কিরমিরিয়া!” বলে রাখোবাবু ধমক দিলেন।

গণেশবাবু তানপুরাসুদু হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, “হাত দুটো কি নামাব দারোগাবাবু?”

দুঃখবাবু পড়ার ঘরের দরজায় খিল এঁটে জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখেছেন। তাঁর পাশে সরোজ, মনোজ, পুতুল।

সরোজ বলল, “পিস্তল?”

মনোজ বলল, “পিস্তল।”

পুতুল বলল, “পুতুলের বাক্সে ছিল।”

দুঃখবাবু ধমক দিয়ে বললেন, “আঃ, গোল কোরো না। ইম্পট্যান্ট কথা হচ্ছে সব, শুনতে দাও।”

গোলযোগ শুনে পাড়ার লোকও এসে জড়ো হয়েছে কম নয়। তবে তারা একটু দূরে দূরে।


নিশিকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “শুনুন রাখোবাবু, আসল অপরাধীকে কোনওদিন বাইরে থেকে চেনা যায় না। আমাদের ক্রিমিনোলজিতে দেখবেন, বেশির ভাগ অপরাধীই দেখতে এবং আচরণে অতি নিরীহ। আর এদের অপরাধ প্রবণতা অনেক নিকট আত্মীয়স্বজনও টের পায় না। কাজেই ভজবাবুকে আপনারা যত নির্দোষ ভেবে এসেছেন ততটা মোটেই নয়। এ শহরের অন্তত দশ বারোজন লোক ভজবাবুর শিকার হয়েছেন। প্রত্যেকেই অল্পের জন্য বেঁচে যান। এমন কী, আমার একটা সেপাইকে পর্যন্ত তিনি দশবার ওঠবোস করিয়েছেন। আর কী করেননি শুনি। হরশঙ্কর গয়লাকে প্রায় মেরে ফেলেছিলেন, সে হাতে পায়ে ধরে বেঁচে যায়। ইউরোপিয়ান ক্লাবে গিয়ে গুলি ছুঁড়েছেন, গোবিন্দবাবু আর শার্দুলবাবুকে আধমরা করেছেন, বাজারে গিয়েছিলেন কাকে যেন তাক করতে। সবাই এসে থানায় রিপোর্ট করেছে। আমরা ইয়ার্কি করতে আসিনি রাখোবাবু। বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে, ভজবাবুকে বের করে দিন।”

রামু এতক্ষণ বারান্দায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। চেঁচামেচি শুনে উঠে এসে বলল, “ভজবাবু? ভজবাবু তো সেই সঝাবেলা পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বললেন কী, আজ সব গুণ্ডা বদমাশ আর খারাপ লোককে ঢিট করে আসবেন।”

রাখোবাবু ধমক দিয়ে বললেন, “তা সেটা এতক্ষণ বলিসনি কেন?”

রামু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হরশঙ্কর পাহলোয়ান আমাকে এমন ঘিসা দিল কি আমার তবিয়ত খারাপ হয়ে গেল।”


দারোগাবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাখোবাবু এ লোকটার নামই কি রামু?”

“হ্যাঁ।”

“তা হলে এর নামেও একটা মোষ চুরির নালিশ আছে। এ আজ হরশঙ্করের একটা দুধেল মোষ চুরি করে এনে আপনাদের গোয়ালে বেঁধে রেখেছিল।”

এই বলে দারোগাবাবু তাঁর সিপাইদের দিকে ফিরে বললেন, “লোকটাকে আগে সার্চ করে দেখ আর্মস আছে কিনা। তারপর অ্যারেস্ট করো।”

শুনে রামু সটান মাটিতে শুয়ে চেঁচাতে থাকে, “হনুমানজিকে কিরিয়া হো পুলিশ সাহেব, চোরি আমি কভি করি না।”

নিশিকান্ত সে কান্নায় কর্ণপাত করলেন না। রাখোবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “ভজবাবু বাড়িতে নেই বলছেন?”

রাখোহরিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথায় বিশ্বাস না হয় খুঁজে দেখতে পারেন।”

“সে তো দেখতেই হবে। তবে আমার ভয় হচ্ছে, এখনো যদি ফিরে থাকেন তবে এর মধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও আরো কয়েকজনকে খুন করেছেন বা করছেন ভজবাবু।”

ঠাকুমা ডুকরে উঠে বলেন, “না না, সে যে মশা মারতে মায়া করে।”

ঠাকুরঝি পরিষ্কার গলায় বললেন, “দ্যাখো বাবা দারোগা, সার্চ করার সময় জুতো পরে ঘরে ঢুকতে পারবে না বলে দিচ্ছি। তোমার সেপাইদেরও জুতো খুলতে বলল। এই রাতে গোবরছড়া দিয়ে মরব নাকি, সে হবে না।”

.
 
এদিকে তখন ডাকাতে কালীবাড়িতে ভজবাবু হাড়িকাঠে পড়ে আছেন। একটা জোয়ান ডাকাত রামদা হাতে দাঁড়িয়ে। বাজনদাররা বলির বাজনা বাজাচ্ছে। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছেন না ভজবাবু। কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইচ্ছে করে যে অজ্ঞান হওয়া যায় না সেটা বুঝে মা কালীকে ডাকতে লাগলেন। একমনে বলতে লাগলেন, “আমাকে অজ্ঞান করে দাও মা।”

একটা ঝাঁকড়া চুলওলা ডাকাত আর একটার কানে গোঁজা বিড়ি নিয়ে খেয়ে ফেলেছে বলে দুজনে খুব ঝগড়া হচ্ছিল। পা-পোড়া মোটা ডাকাতটা পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। ডাকাতের মেজ সর্দার সেই সুন্দরমতো ছেলেটা ভজবাবুর পিস্তল নিয়ে আমোদ করার জন্যই গোটা দুই দুমদাম গুলি ছুড়ল আকাশের দিকে।

ভজবাবুর বড় তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকটা চড়চড় করছে। প্রাণপণে বললেন, “জল!”

বিড়ি-চোর ডাকাতটা সবচেয়ে কাছে। সে ভজবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “চোপ! যার বলি হবে তার আবার অত কথা কী? আর ক মুহূর্ত পরেই সব খিদে তেষ্টা মিটে যাবে।”

ওপাশ থেকে কানাই জিজ্ঞেস করল, “কী বলছে রে বাজাড়টা?”

“জল চায়।”

কানাইয়ের মায়া হল, বলল, “দে না একটু।”

খাঁড়া হাতে লোকটা খাঁড়া নামিয়ে বলল, “ওরে, তোদর আর কতক্ষণ লাগবে। বলি দিবি বলে ফেলে রেখেছিস লোকটাকে তো দেরি করছিস কেন? লোকটার এ ভাবে পড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?”

বিড়ি-চোর ডাকাতটি ঘটি করে জল আনছিল, সুন্দর মতো ছেলেটা চোখের ইঙ্গিতে তাকে নিষেধ করে এক গ্লাস শরবত নিয়ে গিয়ে কাছে বসে ভজবাবুকে বলল, “হাঁ করুন।”

ভজবাবু চোখ বুজে রেখে হাঁ করলেন। ডাকাতটা তাঁর মুখে খানিকটা শরবত ঢালতেই শিউরে উঠে বিষম খেলেন ভজবাবু, খানিকটা পেটে গেল, খানিকটা ফেলে দিয়ে বললেন, “এ কী রে বাবা, এ তো জল নয়।”

“জলের চেয়ে দামি জিনিস। আর একটু খান। আজকের দিনে খেতে হয়। আমরা সবাই খাচ্ছি তো।”

তেষ্টায় বুক কাঠ, না খেয়ে করেন কী ভজবাবু! আবার হাঁ করে আর একটু মুখে নিয়ে চুকচুক করে খেলেন। এবার অতটা খারাপ লাগল না। আবার খেলেন। আবার।

কিছুক্ষণ পরে চোখে ঘোর-ঘোর দেখতে লাগলেন। শরবতের মধ্যে কী ছিল কে জানে, ভজবাবুর মাথাটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যেতে লাগল। ভয়ডর কেটে গিয়ে ঠাণ্ডা শরীরটা গরম হয়ে উঠতে লাগল। খুব একটা তেজ এল মনের মধ্যে। হাড়িকাঠে গলা দিয়েও হঠাৎ হুংকার ছাড়লেন, “সব ব্যাটাকে দেখে নেব! সব ব্যাটাকে দেখে নেব!”

সেই হুংকার শুনে রোগা আর ভিতু ডাকাতরা একটু দূরে সরে বসল। মেজ সর্দার ভজবাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এই তো চাই। এ না হলে বাপের ব্যাটা! তা ভজবাবু, আজ চলুন না আমাদের সঙ্গে ডাকাতি করতে, দেখি কেমন সাহস আপনার?”

ভজবাবু একটা ফুঃ করে বললেন, “এ আর কী কথা! এক্ষুনি চলো। কার বাড়ি লুট করবে?”

“রাজবাড়ি।”

“আরে দূর দূর। রাজবাড়িতে আছে কী? আছে একটা খুঁটের পাহাড় আর নটে শাকের জঙ্গল। রাজাদের কি আর সেই দিন আছে! লুটবে তো চলো একটা ব্যাঙ্ক লুট করি।”

“না। আমরা আজ রাজবাড়ি লুট করব ঠিক করেছি। সেখানে মাটির নীচে অনেক টাকা আছে। ভয় পাবেন না তো ভজবাবু?”

ভজবাবু হাড়িকাঠে শুয়ে থেকেই খুব হেঃ হোঃ করে হেসে বললেন, “ভজহরি কখনও ভয় কাকে বলে জানে না। হাড়িকাঠের খিলটা খুলে আমার হাতে একটা পিস্তল দাও, তোমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি।”

মেজো সর্দার বলল, “আমরা পিস্তল বন্দুক রাখি না। বড় সদারের একটা বন্দুক আছে, কিন্তু তার আজ বড় আমাশা হয়েছে বলে সে যাচ্ছে না। আর আপনার এ পিস্তলেও আর গুলি নেই।”

“ছ্যাঃ ছ্যাঃ কেমন ডাকাত হে তোমরা যে পিস্তলবন্দুক রাখো। ঠিক আছে, দারোগাবাবুকে বলে আমি তোমাদের পিস্তলের বন্দোবস্ত করে দেব। আমাকে আজকের মতো একটা রাম দা-ই দাও, কী আর করা!”

মেজ সদর হাড়িকাঠের খিল খুলে দিতেই ভজবাবু লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চেঁচিয়ে বললেন, “অ্যাটেনশন।”

সেই চেঁচানিতে ডাকাতরা আবার ভয় খেয়ে চমকে উঠল। মেজ সর্দার হেসে বলল, “তোরা সব সোজা হয়ে দাঁড়া। আজ ভজবাবুই আমাদের সর্দার।”

ভজুবাবুও মাথা নেড়ে বললেন, “আলবাত আমি সর্দার। এই কানাই, রামদা দে একটা।”


কানাই ভয়ে ভয়ে একটানা রামদা এগিয়ে দিতেই ভজবাবু সেটা হাতে নিয়ে তিন চারটে লাফ মেরে বাঁই বাঁই করে ঘোরালেন চারদিকে। তারপর একগাল হেসে বললেন, “দেখলে তো সবাই।”

সবাই তারিখ করে বলল, “বাঃ। বহুত খুব!”

ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এক বাটি মাংস নিয়ে আয়।”

বিড়ি-চোর এক বাটি ভর্তি মাংস নিয়ে এল। ভজবাবু রামদা পাশে নিয়ে বসে বললেন, “তোরাও বসে যা। রাতে অনেক কাজ আছে।”

আদ্যাসুন্দরী দেবী এক হাতে লাঠি আর এক হাতে গুলতি নিয়ে উঠোনে ঢুকবার দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রক্ত-জলকরা গলায় হেঁকে বললেন, “দ্যাখো বাবা দারোগা, ভাল চাও তো বাড়িতে ঢুকবার আগে তোমার সেপাইদের জুতো খুলতে বলল, আর তুমিও খোলো। জুতো পরে যে ঢুকবে, তার আমি রক্ষে রাখব না।”

নিশি দারোগা গম্ভীর হয়ে বললেন, “ডিউটির সময়ে আমাদের জুতো খুলবার আইন নেই পিসিমা, আমাদের কাছে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। মারাত্মক খুনিকে ধরতে এসেছি আমরা, ইয়ার্কির সময় নেই।”

আদ্যাসুন্দরীদেবী জীবনে কাউকে ভয় করেননি। গত বছরও গ্রীষ্মকালে একটা চোর জানালা দিয়ে গেঞ্জি চুরি করার চেষ্টা করেছিল বলে আদ্যাসুন্দরী হাত বাড়িয়ে তার কান মলে দেন। তা ছাড়া গুলতিতে তাঁর হাতের টিপের কথাও সবাই জানে। ব্রত-পার্বণে আম্রপল্লব বেলপাতা দরকার হলে তিনি নিজেই গাছে গুলতি মেরে-মেরে আমপাতা বেলপাতা পেড়ে আনেন। কাজেই আদ্যাসুন্দরী দেবীকে যারা জানে, তারা চট করে এ বাড়িতে ঢোকে না, একটু চিন্তা করে ঢোকে।

কিন্তু নিশি দারোগা করেন কী? চাকরি বাঁচাতে তাঁকে তো বাড়িতে ঢুকতেই হবে, তা ছাড়া এত লোকের চোখের সামনে যদি তাঁকে বা সেপাইদের জুতো খুলতে হয়, তবে সেটা পুলিশের পক্ষে বেইজ্জতির ব্যাপার।

কিন্তু আদ্যাসুন্দরীদেবীর এক কথা। “খুনি ধরতে বারণ করছে কে? কিন্তু জুতো পায়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। রাজ্যের নোংরা আবর্জনা মাড়িয়ে এসেছ বাবা, রাত-বিরেতে কে গোবর গুলে ছড়া দেবে!”

দারোগাবাবু মিনমিন করে বললেন, “আইন নেই, পিসিমা। আমরা ছাপোষা মানুষ, কেন আমাদের লাঠিসোটা দেখাচ্ছেন?”

“দেখাচ্ছি কী! যে ঢুকবে জুতো নিয়ে, তার কপালে লাঠির ঘা আছে আজকে।”

কিন্তু সেপাইরা তো আর ঘাসজল খায় না। তারাও নানারকম লেক চরিয়েছে। মেলা ফন্দি-ফিকির জানে।

হঠাৎ হল কী, সেপাইরা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। তারপর অন্ধকারে এধার সেধার দিয়ে টপাটপ সব লাফিয়ে লাফিয়ে দেওয়াল ডিঙোতে শুরু করে দিল। বুট-মেত সেপাইরা ঝুপঝাঁপ করে ভিতরের উঠোনে পড়ছে। আদ্যাসুন্দরীদেবী মহা খাপ্পা হয়ে ছোটাছুটি করে হাতের কাছে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ফটাফট লাঠি লাগাচ্ছেন। কিন্তু একা তিনি কতজনের সঙ্গে পেরে উঠবেন? ওদিকে দরজা ছাড়া পেয়ে আরও সেপাই ঢুকে পড়েছে উঠোনে। আদ্যাসুন্দরী দেবী চেঁচাচ্ছেন, “ডাকাত! ডাকাত! ওরা তোরা পুলিশে খবর দে!”

নিশি দারোগা কপালের ঘাম মুছে রাখোবাবুকে বললেন, “ওরে বাবা, জীবনে এরকম সিচুয়েশন ফেস করিনি। তা আপনাদেরও বোধহয় এ বাড়িতে একটু ভয়ে-ভয়েই থাকতে হয়, তাই না? ওরকম ডেঞ্জারাস পিসিমা আর মার্ডারার ভাই বাড়িতে থাকলে তো মহা বিপদের কথা মশাই।”

রাখোবাবু খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “কোথাও কিছু-একটা গণ্ডগোল হচ্ছে নিশিবাবু।”

“সে তো হচ্ছেই।” নিশি দারোগা গম্ভীর হয়ে বলেন, “খুব গণ্ডগোল হচ্ছে। আমি যতই শান্তি চাই, ততই অশান্তি এসে কপালে জোটে। আপনারা কিছুতেই আমাকে দু দণ্ড চুপচাপ বসে মায়ের নাম করতে দিচ্ছেন না।”

গণেশবাবু এখনও তানপুরা ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। এবার একটু সাহস পেয়ে বললেন, “দারোগাবাবু, তানপুরাটা কি নামাব?”




দারোগাবাবু অবাক হয়ে বলেন, “তানপুরা নামাবেন, তা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? তানপুরা নামাতে তো পুলিশের পারমিশন লাগে না! তবে এটা গান-বাজনার সময় নয় বটে। তা তানপুরা তুলল কে?”

গণেশবাবু বললেন, “আপনি আমাকে হাত তুলতে বললেন যে!”

“তানপুরা তুলতে বলিনি তো!”

“হাতে তানপুরা ছিল যে!” দারোগাবাবু একগাল হেসে বললেন, “তাই বলুন, হাতে তানপুরা ছিল। তা তানপুরা নিয়ে যাচ্ছিলেন কোথায়?”

গণেশবাবু যে পালাবার তালে ছিলেন, তা আর বললেন না, একটু অপ্রস্তুতভাবে বললেন, “কোথাও বিশেষ নয়। এই একটু বেড়াতে যাচ্ছিলাম আর কী।”

দারোগাবাবু ভারী অবাক হয়ে বলেন, “লোকে ছাতা বা লাঠি হাতে বেড়াতে বেরোয় বটে, কিন্তু তানপুরা নিয়ে কাউকে বেড়াতে শুনিনি তো!”

এইসব কথা যখন হচ্ছে তখন হঠাৎ ভিতরবাড়ি থেকে সেপাইদের আর্ত চিৎকার শোনা গেল। ঝপাঝপ দেয়াল ডিঙিয়ে সেপাইরা এ-পাশে পড়ে পালাচ্ছে।

দেখে নিশি দারোগাও বাবা রে বাবা বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাখোবাবু তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনারা কিছু হয়নি। ও নিশিবাবু, আপনি চেঁচাচ্ছেন কেন? আপনার কিছু

হয়নি।”

হয়েছে কী, বাইরে যখন এত সব কাণ্ড চলছে, তখন বৈজ্ঞানিক হারাধন তার গবেষণাগারে গবেষণার কাজে মগ্ন হয়ে ছিল।

চারদিকের এত হইচই তার কানেও যায়নি।

ওদিকে মনোজ সরোজ আর পুতুল যখন দেখল, ঠাকুরঝির সঙ্গে পুলিশদের মহা হাঙ্গামা বেধেছে, আর পুলিশ জোর করে ঘরে ঢুকছে তখন তিনজন আর থাকতে পারল না।

মনোজ বলল, “ছোটকাকা।”

সরোজ বলল, “ঠিক বলেছিস! ছোটকাকা ছাড়া উপায় নেই।”

পুতুল বলল, “ছোটকাকা ঠিক শিক্ষা দিয়ে দেবে।”

বলতে বলতে তিনজন দৌড়ে গিয়ে দরজার খিল খুলতে লাগল। দুঃখবাবু হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে বললেন, “করো কী, করো কী! ফাঁক পেলেই পুলিশ ঢুকে পড়বে।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা! দরজা খুলে দুদ্দাড় তিন ভাই-বোনে বেরিয়ে পড়ল। অন্ধকারে বাগান পেরিয়ে তারা সোজা গিয়ে হাজির হল ছোটকাকার ল্যাবরেটরিতে।
 
হারাধনের ল্যাবরেটরি দেখলে তাক লেগে যায়। সেখানে কী নেই? বাগানের দিক থেকে ঢুকলে প্রথমেই পড়বে বিরাট একটা উদ্ভিদ-ঘর। কাঁচের শার্শি দেওয়া এই ঘরটায় নানান ধরনের টবে কিম্ভুত সব গাছপালা। তাতে চাগম (চাল+গম), লামড়ো (লাউ+কুমড়ো) ইত্যাদি গাছও আছে। এ ঘর পেরোলে একটা অন্ধকার-মতো ঘর। চামসে গন্ধে সেখানে টেকা দায়। এ-ঘরে অসংখ্য খাঁচায় রাজ্যের পাখি রাখা আছে। পাখিদের মধ্যে কাক, শালিখ, পায়রা থেকে শুরু করে ধনেশ, চিল, শকুনের মতো বিচিত্র সব নমুনা আছে। আর-একটা ঘরে বানর, গিনিপিগ, ব্যাং, খরগোশ, সাদা ইঁদুর। তার পাশের ঘরের নানান ঝাঁপিতে সাপ, বিছে, কীট-পতঙ্গ। এ ছাড়া একটা রসায়ানাগার, একটা পদার্থবিদ্যার ঘর আর একটা টেলিস্কোপ-ঘরও আছে।

মনোজ সরোজ পুতুল আলাদা হয়ে তিনজনে তিন ঘরে হারাধনকে খুঁজতে থাকে।

পুতুলই ছোটকাকাকে খুঁজে পেল পাখির ঘরে। সেখানে বৈজ্ঞানিক হারাধন একটা কাকের খাঁচার সামনে বসে একমনে একটা প্যাডে কী লিখছে।

পুতুল হাঁফাতে-হাঁফাতে ছুটে গিয়ে বলে, “ছোটকাকা, পুলিশ! মেজকাকাকে ধরতে এসেছে। কী ভীষণ কাণ্ড দেখবে চলো।”

বৈজ্ঞানিক হারাধন এত চিন্তাকুল যে, প্রথমটায় পুতুলকে চিনতেই পারেনি। অনেকক্ষণ বাদে চিনতে পেরে বলল, “কী বলছিস?”

পুতুল তখন খাঁচাটার মধ্যে রাখা কাকটাকে একমনে দেখছে। কাকটার গলায় এখনও পৈতে জড়ানো, পায়ে একটা ঝুমঝুমির মতো কী যেন বাঁধা। খুবই চেনা কাক।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, “আরে! এই কাকটাই তো সকালে আমাদের বাড়িতে কুরুক্ষেত্র করেছে। এটার জন্যই কত সব কাণ্ড হয়ে গেল! তুমি কাকটাকে ধরলে ছোটকাকা?”

হারাধন বিরক্ত হয়ে বলে, “ধরব কেন? এটা তো আমারই কাক। সকালে ছেড়ে দিয়েছিলাম এক্সপেরিমেন্টের জন্য। তারপর বিকেল হতেই আবার নিজে থেকে এসে খাঁচায় ঢুকেছে।”

“তোমার কাক! তোমার কাক এত বদমাশ কেন বলো তো!” হারাধন একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে বলে, “বদমাশ হবে কেন? একটু তেজী আর কী! অন্য চার-পাঁচটা সাধারণ কাকের মতো নয়। তা সে ওর দোষ নয়, আমিই নানারকম ওষুধ আর ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে দিয়ে এটাকে ওরকম বানিয়েছি। এ আর কী দেখছিস! চারটে যা হনুমান বানিয়েছি না, তারা একেবারে ডাকাত। ছেড়ে দিলে লঙ্কাকাণ্ড করে আসবে।”

পুতুল হারাধনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “হনুমানের কথা পরে। আগে চলো। পুলিশের সঙ্গে ঠাকুরঝির মারামারি হচ্ছে যে!”

“বলিস কী!” বলে হারাধন লাফিয়ে ওঠে।

“শুধু তাই বুঝি! পুলিস আবার মেজকাকুকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। যা বিচ্ছিরি কাণ্ড না, আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।”

হারাধন দুই লাফে ল্যাবরেটরি পার হয়ে উঠোনের দিকে দরজা খুলে দেখে, বাস্তবিক সারা উঠোন জুড়ে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। পাঁচিল টপকে টপকে সব সিপাইরা উঠোনে নামছে আর ঠাকুরঝি প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করছে। কিন্তু তারা কাবাডি খেলোয়াড়ের মতো ঠাকুরঝির লাঠির নাগাল এড়িয়ে দৌড়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। ঠাকুরঝি চেঁচাচ্ছেন, “ডাকাত! ডাকাত! ওরে তোরা কেন পুলিশকে খবর দিচ্ছিস না?”

ঠিক এই সময়ে অন্ধকারে সতীশ ভরদ্বাজ মশাইও উঠোনে ঢুকে পড়েছেন। তিনি বললেন, “উঁহু, এরা ডাকাত নয়, এরা হল পুলিশ। আপনি বরং ডাকাতদের ডাকুন, নইলে এ পুলিশদের ধরবে কে?”

আদ্যাসুন্দরীর তখন হুঁশ হল। তিনি একটা রোগা পুলিশের ঠ্যাঙে পটাং করে লাঠির ঘা বসিয়ে নতুন করে চেঁচাতে লাগলেন, “ওগো, তোমরা কে কোথায় আছ, শিগগির ডাকাতদের খবর দাও। আমাদের বাড়িতে পুলিশ পড়েছে।”

তখন চারদিকে আরও কয়েকজন চেঁচাল, “ওরে, শিগগির ডাকাতদের খবর দে, এবাড়িতে পুলিশ ঢুকেছে।”




হারাধন দৃশ্যটা দু মিনিট দাঁড়িয়ে দেখল। তার দুধারে পুতুল, সরোজ, মনোজ। তারপর ধীরে ধীরে ভাইপো-ভাইঝিদের হাত ধরে ঘরে টেনে এনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “শোন্, এখন আমি যে ব্যবস্থা করব তা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলবি না। আমার সন্দেহ হচ্ছে পুলিশের ছদ্মবেশে অন্য কোনও রাষ্ট্রের চর আমার ফরমুলা চুরি করতে এসেছে। এদের শিক্ষা দেওয়া দরকার।”

বলে হারাধন গটগট করে গিয়ে তার জীবজন্তুর ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সরোজ, মনোজ আর পুতুল। ঘরের একেবারে কোণের দিকে চারটে বিশাল খাঁচা। সেগুলোর চারদিকে চটের পর্দা ফেলা। হারাধন গিয়ে খাঁচার পা তুলে দিল। ভিতরের দৃশ্য দেখে সরোজ মোজ আর পুতুলের চোখ ছানাবড়া। তারা তাড়াতাড়ি ছোটকাকার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

খাঁচার ভিতরে চারটে বিশাল চেহারার হনুমান। এত বড় হনুমান যে থাকতে পারে, তা তিন ভাইবোনের জানাই ছিল না। সরোজ প্রথমটায় বলে উঠল, “গোরিলা।”

“বনমানুষ!” পুতুল বলে ওঠে।

মনোজ বলল, “না, হনুমান। তবে বড় বড়।”

হারাধন খাঁচার দরজার তালা খুলতে খুলতে বলল, “এ হচ্ছে গোরিমান।”

“তার মানে?” সরোজ জিজ্ঞেস করে।

মনোজ ছোটকাকার ব্যাপার-স্যাপার ভালই জানে, সে তাই বলে উঠল “খানিকটা গোরিলা, খানিকটা হনুমান, না ছোটকাকা?”

“হুঁ। তবে ওষুধ দেওয়া হনুমান, আর পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের কারসাজি। তোরা দৌড়ে গিয়ে বাড়ির লোকজনকে সব ঘরে ঢুকে যেতে বল। আমি হনুমান ছেড়ে দিচ্ছি। তারপর লঙ্কাকাণ্ড কাকে বলে তা সবাই টের পাবে।”

সরোজ, মনোজ আর পুতুল দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরঝি, ঠাকুমা, মা, কিরমিরিয়া সবাইকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। আর সেই সময়ে আধো অন্ধকারে অতিকায় চারটে বিভীষিকা বিভীষণ লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে এসে পিলে চমকানো ডাক ছাড়ল “গাপ! ধর! গাপ! ধর।”

সে-ডাক শুনলে রক্ত জল হয়ে যায়, সে-চেহারা দেখলে ভিরমি খেতে হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, তারা এক একটা পুলিশকে নেংটি ইঁদুরের মতো এক-এক হাতে তুলে যখন এ-ধার ওধার ছুঁড়ে ফেলছিল, তখন তাদের এলেম দেখে সবাই তাজ্জব।


প্রথমটায় পুলিশরা ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। একজন আবার একটা হনুমানকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়েও উঠেছিল, “এইবার খুনিকে ধরেছি।” তারপরই সে হঠাৎ তারস্বরে বলতে লাগল, “না না, এর যে লেজ রয়েছে! ও বড়বাবু, খুনির কি লেজ আছে নাকি?”

তারপরই দেখা গেল হনুমানকে জড়িয়ে ধরেছিল যে পুলিশটা, সে শুন্যপথে উড়ে পাঁচিলের ওধারে পড়ল। একজন পুলিশ গিয়ে পড়ল টিনের চালে। হনুমানদের একজন দুটো পুলিসকে দু বগলে নিয়ে মহানন্দে এক চক্কর নাচ নেচে নিল।

সতীশ ভরদ্বাজ ঘর থেকে জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে বললেন, “আদ্যাদিদির ডাকের গুণ আছে। এ যে দেখছি চার-চারটে পালোয়ান ডাকাত! না..না…ডাকাত তো নয়! সর্বনাশ! এ যে স্বয়ং রামচন্দ্রের ভক্ত। ও আদ্যাদিদি, কলিকালে দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে ম্লেচ্ছরা ধর্ম মানতে চায় না। কিন্তু নিজের চোখে সবাই এসে দেখুক ভক্তের বিপদের সময় ভগবান তাঁর অনুচর পাঠান কিনা। ওই দেখ সবাই, দু চোখ ভরে চেয়ে দেখ, স্বয়ং রামভক্ত হনুমানেরা এসেছেন!…আহা! কী করাল বিশাল চেহারা! কী সাংঘাতিক গায়ের জোর! …জয় বাবা হনুমানের জয়!”

বাইরে রামু আর রঘুও বিকট সুরে চেঁচাচ্ছিল, “জয় বজরঙ্গবলী! জয় মহাবীর হনুমানজিকি! জয় রামভগবানকি! জয় জানকী মায়জিকি!”

সেই বিশাল হনুমানের মারমূর্তি দেখে পুলিশরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দুদ্দাড় দৌড়ে পালাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে সব ফর্সা। খালি উঠোনে হনুমানগুলো লাফাচ্ছে। আদ্যাশক্তিদেবী তাড়াতাড়ি ঠাকুরঘর থেকে এককাঁদি কলা নিয়ে উঠোনে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “খাও, বাবারা খাও।”

হারাধন দরজার আড়াল থেকে সাঙ্কেতিক শিস দিতেই হনুমানগুলো কলার কাঁদি নিয়ে চোখের পলকে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেল।

বাইরে নিশি দারোগা, রাখোবাবু, দুঃখবাবু, গণেশবাবু বা পাড়ার লোকজন কেউ কিছু বুঝতে পারলেন না কাণ্ডটা কী! সবাই দেখলেন, সেপাইরা কার যেন তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে। একজন সেপাইও অবশ্য দাঁড়াল না, যাকে ধরে জিজ্ঞেস করা যায় যে ব্যাপারটা কী, সবাই পাঁই পাঁই করে ছুটে পালাল।

নিশি দারোগা দুহাতে রাখোবাবুকে জাপটে ধরে চেঁচাতে লাগলেন, “বাবা রে, বাবা রে! ভূত! ডাকাত! খুনি! রাখোবাবু, রক্ষে করুন।”

দুঃখবাবু তাঁর খিল-আঁটা ঘরের মধ্যে থেকেও ভয়ে পড়ার টেবিলের তলায় ঢুকে গেলেন। গণেশবাবু তানপুরাটা গদার মতো ঘঘারাতে ঘোরাতে চেঁচাতে লাগলেন, “আমার কাছে কেউ এলে খুন করে ফেলব বলে দিলাম।”

হনুমানরা চলে গেছে দেখে সতীশ ভরদ্বাজ বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “এখন ওই ঘোর নাস্তিক হারাধনটাকে ডেকে নিয়ে এসো। দেখে যাক ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কিনা! দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে সব পণ্ডিত হয়েছে। আমার হাঁদুর্ভুদুকে তুচ্ছজ্ঞান করে। একদিন বুঝবে ঠেলা, তখন এসে হাতে-পায়ে ধরে বলতে হবে, ঠাকুরমশাই, ধর্মে বিশ্বাস না করে বড় অন্যায় করেছি।

সেপাইরা সব পালিয়েছে। দারোগাবাবু একা বাড়ি ফিরতে সাহস করছে না। রাখোবাবু রঘুকে ডেকে টর্চ হাতে দিয়ে বললেন, “যা, দারোগাবাবুকে এগিয়ে দিয়ে আয়গে যা।”



বাড়ি আবার ঠাণ্ডা হলে রাখোবাবু সবাইকে ডেকে মিটিং বসালেন। বললেন, “ভজুটার কোনও খোঁজ নেই। বাড়ির মেয়েরা বাদে সবাই লাঠি, টর্চ বা হ্যারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। তাকে খুঁজে না আনা পর্যন্ত রহস্যটা পরিষ্কার হবে না। আর এও বোঝা যাচ্ছে না, পুলিশরা হঠাৎ সার্চ থামিয়ে পালাল কেন! সবাই তোমরা বলছ বটে হনুমানে তাড়া করেছিল। কিন্তু তাতে ঘটনাগুলো আরও জট পাকাচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে, হনুমানই বা এল কোত্থেকে! হনুমানগুলোকেও খুঁজে দেখ। এবাড়িতে তো তাদের উৎপাত ছিল না!”

এই কথা শুনে হারাধন খুব গম্ভীর হয়ে গেল। আর মনোজ, সরোজ, পুতুল নিজেদের মধ্যে গা-টেপাটেপি করতে লাগল।

সতীশ ভরদ্বাজ জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, “ভক্তের ডাকে স্বয়ং ভগবান তাদের পাঠিয়েছিলেন। তাদের আর কোথায় খুঁজবে?”

খোঁজাখুঁজির নামে দুঃখবাবু বলে উঠলেন, “আমার পায়ে বড় ব্যথা।”

গণেশবাবু বললেন, “আমারও। আমি বরং বাড়ি পাহারা দেব।”

রাখোবাবু তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছাত্রছাত্রীদের সামনে কোনও কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন না। ভজুকে খুঁজে না-পেলে অনেক গোলমাল দেখা দেবে।”

তারপর রাখোবাবু সকলের দিকে চেয়ে বললেন, “আর দেরি নয়। সবাই বেরিয়ে পড়ো। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য পিসিমা একাই যথেষ্ট। তিনি আজ পুলিশের বিরুদ্ধে যে পৌরুষ দেখিয়েছেন, তা কোনও পুরুষেও দেখাতে পারেনি। কাজেই আমি তাঁর ওপর বাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত। পুরুষরা সবাই ভজুকে খুঁজতে যাবে।”

একথার পর সবাই উঠে পড়ল।

শরবতের গুণে ভজবাবুর ভারী ফুর্তি এসে গেছে। এত ভাল লাগছে তাঁর যে বলার নয়। মাঝে মাঝে গান গেয়ে উঠছেন।

রাত বারোটা বেজে গেল। ভরপেট মাংস আর ভাত খেয়ে ডাকাতরা খানিক গড়াগড়ি দিয়ে উঠে পড়েছে। পুরুতমশাই সকলের কপালে তেল সিঁদুর আর যজ্ঞের কালি লাগিয়ে দিয়েছেন। কানে জবা ফুল গোঁজা।

ভজবাবু মন্দিরের চাতালে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে খাঁড়া নিয়ে রক্তচোখে সব দেখছিলেন। একটা হাঁক দিয়ে বললেন–সব লাইন করে দাঁড়া।

ডাকাতরা চটপট দাঁড়িয়ে গেল। সুন্দরমতো মেজ-সদার ভজবাবুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে চেয়ে ভজবাবু এক গাল হেসে বললেন, “দেখলে! সবাই কেমন আমাকে মানে!”

“আপনার কথা আলাদা।”

“হে হে” বলে ভজবাবু নিজের হাতের খাঁড়াটা আবার বাঁই বাঁই করে চারদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ডাকাতদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “ভাইসব, আজ বড় আনন্দের দিন। আমি কথা বলতে পারছি না। আজ আমার কথাগুলি সব আনন্দের চোটে গান হয়ে যেতে চাইছে। তা ভালই। আমি গানে গানেই তোমাদের আদেশ করব। তোমরা সেইমতো চলবে। কেমন?”

ডাকাতরা একবাক্যে বলে ওঠে, “সদারের যেমন হুকুম।”

ভজবাবু গলাটা একটু সাফ করে নিয়ে গেয়ে উঠলেন, “হে দস্যবর্গ, হাতে নাও খঙ্গ, চলো যাই লুণ্ঠনকর্মে..”

ডাকাতরা সবাই ঝটপট খাঁড়া, তলোয়ার, লাঠি আর বল্লম যে যা পারল হাতে নিয়ে দাঁড়াল।

ভজবাবু এবার অন্য গান ধরলেন, “চল রে চল, বন্ধুদল, সামনে চল্ সবাই…”

ডাকাতরা চলতে থাকে। সবার সামনে ভজবাবু আর মেজ সদার। মেজ সদারের হাতে একটা মশাল জ্বলছে।

ভজবাবু খাঁড়া ঘুরিয়ে গাইতে লাগলেন, “বিঘ্ন বন্ধ, খানা ও খন্দ ডিঙিয়ে চল সবাই…”
 
ভজবাবুকে খুঁজতে বেরিয়ে বাড়ির লোকজন শহরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

সররাজের হাতে একটা হকি স্টিক আর মননজের হাতে একটা ক্রিকেটের স্টাম্প। দুজনে শহরের উত্তর ধারে চলে এসেছিল।

জায়গাটা আগাছা আর জঙ্গলে ভরা। রাত নিশুত। এ অঞ্চলে লোকজনের বসবাস খুবই কম। শোনা যায়, এ অঞ্চলের বাসিন্দারা খুব একটা ভাল লোক নয়। দিনের বেলাতেও ভয়ে লোক এদিকে আসে না।

মনোজ হঠাৎ সরোজের হাত টেনে ধরে বলে, “এই দাদা!”

সরোজ থমকে গিয়ে বলে, “কী?”

“গান শুনছিস?”

সোজ কান পেতে শোনে। ঝিঁঝির ডাক, গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ আর ঘুম ভাঙা পাখির অস্পষ্ট ডাক, মাঝে মাঝে শেয়ালের “হুয়া, হুয়া”। এইসব ভেদ করে অনেক দূর থেকে ক্ষীণ একটা গানের শব্দ আসছে বটে। কে যেন গাইছে, “ভাঙব লোহার কপাট ভাই, আর তো কোনও শঙ্কা নাই.”

সরোজ বলল, “এ দিকেই আসছে!”

মনোজ খানিকটা গান শুনে বলল, “মেজকাকার গলা।”

“যাঃ!”

“দেখিস। ওই শোন আরও কাছে এসে গেছে। ওই দ্যাখ মশালের আলো! দাদা, লুকিয়ে পড়।”

দুই ভাই তাড়াতাড়ি গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে চেয়ে রইল। তারপর যা দেখতে পেল তা প্রত্যয় হয় না। তারা দেখল, ভজবাবু গান গাইতে গাইতে বিশাল এক দল ডাকাত নিয়ে চলেছেন।

দলটা দুই ভাইয়ের একেবারে নাকের ডগা দিয়েই যাচ্ছিল।

সরোজ বলে, “মেজকাকার হাতে খাঁড়া।”

মনোজ বলে, “মেজকাকার চোখ চকচক করছে।”

সরোজ বলে, “মেজকাকার হল কী?”

মনোজ হঠাৎ মেজকাকার পাশে মশাল হাতে মেজ সদারকে দেখতে পেল। একটু চমকে উঠল সে। কিন্তু শব্দ করল না।

ডাকাতের দল তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ভজবাবু তখন গাইছেন, “বুকের ভিতরে ঘোড়া ছুটে যায়, ওরে তোরা ছেড়ে দে ছেড়ে দে আজ আমারে…”


সরোজ একটু ভেবে চিন্তে বলে, “মনে হচ্ছে, ডাকাতরা মেজকাকাকে কোথাও ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাই ছেড়ে দেওয়ার জন্য গান গাইছে মেজকাকা।”


মনোজ মাথা নেড়ে বলে, “মেজকাকাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না, মেজকাকাই ডাকাতদের নিয়ে যাচ্ছে।”

সরোজ বলে, “কিন্তু মেজকাকার যে দারুণ চোর-ডাকাত আর ভূতের ভয়!”

একটু দূর থেকে ভজবাবুর গলার গান ভেসে আসছিল, “সামনে রাজার বাড়ি, চল যাই তাড়াতাড়ি, বিবাদ-বিসম্বাদ থামা রে…”

মনোজ সবরাজের হাত চেপে ধরে বলল, “দাদা, ডাকাতদের নিয়ে মেজকাকা রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছে। এক্ষুনি ছোটকাকাকে খবরটা দেওয়া দরকার।”


সরোজ বিরক্ত হয়ে বলে, “অত ঝামেলায় কী হবে? চল তার চেয়ে মেজকাকাকেই গিয়ে ধরলেই তো হয়। বলব, শিগগির বাড়ি চলো, বাবা ডাকছে। বাবা ডাকছে শুনলেই সুড়সুড় করে চলে আসবে।”


মনোজ মাথা নেড়ে বলে, “দূর, তুই মেজকাকাকে ভাল করে দেখিসনি। দেখলি না, মেজকাকার চোখ কেমন চকচকে, মুখটা ফোলা ফোলা, হাতে খাঁড়া, গলায় গান! এ সেই মেজকাকাই নয়, দেখলে আমাদের চিনবেই না। আর ডাকাতরাই বা ছাড়বে কেন? চল, বাড়ি গিয়ে ছোটকাকাকে ডেকে আনি।”

দুই ভাই বাড়ির দিকে দৌড়তে থাকে। বাড়ির ফটকেই ঠাকুরঝি। তাঁর সাদা থান তিনি মালকোঁচা মেরে পরেছেন, হাতে টর্চ, লাঠি, আর কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা হাত দা। ঠাকুরমা উঠোনের দরজায় চুপটি করে বসে চোখের জল মুছছেন। মা তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে।

সরোজ আর মনোজ ফটকের দিকে গেল না। ছোটকাকা হারাধন বলেছিল, ভাল করে তৈরি হয়ে বেরোতে তার কিছু দেরি হবে। দুই ভাই তাই গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢোকে।

ঢুকতেই দেখে, হারাধন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। একটা গোরিমানকে শিকলে বেঁধে নিয়েছে হারাধন, অন্য হাতে একটা টস্তল (টর্চ+পিস্তল, এটা হারাধনের নিজের আবিষ্কার, একই সঙ্গে টর্চ এবং পিস্তলের কাজ করে), আর তার কাঁধে সেই বদমাশ কাকটা বসে আছে। পাখির ঘরে পাখিগুলো খুব চেঁচাচ্ছে।


মনোজ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “ছোটকাকা, মেজকাকা ডাকাতের দল নিয়ে রাজবাড়ি লুট করতে যাচ্ছে। শিগগির চলল। “


হারাধন আকাশ থেকে পড়ে বলে, “মেজদা! ডাকাতের দল নিয়ে! রাজবাড়ি! আর কী বললি?”

সরোজ : “লুট করতে…”

মনোজ : “যাচ্ছে…”

হারাধন চোখ বুজে দাঁড়িয়ে বলল, “আবার বল। এবার একটু আস্তে আস্তে।”

সরোজ আর মনোজ পালা করে বলল। পাখির ঘরে পাখিরা খুব চেঁচাচ্ছে এখনও। হারাধন পিছনে ফিরে ঘরটা দেখে নিয়ে বলল, “পাখিগুলোর আজ হল কী? যাকগে। যা, রাজবাড়ি। রাজবাড়িই বললি তো!”

সরোজ আর মনোজ পালা করে বলল। পাখির ঘরে পাখিরা খুব চেঁচাচ্ছে এখনো। হারাধন পিছনে ফিরে ঘরটা দেখে নিয়ে বলল, “পাখিগুলোর আজ হল কী? যাকগে। তাঁ, রাজবাড়ি। রাজবাড়িই বললি তো!”

সরোজ আর মনোজ একসঙ্গে–”হ্যাঁ হ্যাঁ, রাজবাড়ি।”

“মেজদা?”

সরোজ আর মনোজ–”মেজকাকা। গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে।”

“রাজবাড়ি!” বলে হারাধন তবু ইতস্তত করে। ঠিক এ সময়ে হারাধনের পিছন থেকে কে যেন বিরক্তির গলায় বলে ওঠে, “শ্যা মশাই, রাজবাড়ি। রাজার বাড়ি, যাকে বলে ষষ্ঠীতৎপুরুষ সমাস। জলের মতো সোজা।”

সবাই অবাক হয়ে দেখে, শালিখের খাঁচার পিছন থেকে দুঃখবাবু বেরিয়ে আসছেন।

হারাধন বলে, “আপনি এখানে?”

দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে বলেন, “আর কোথায় লুকোব বলুন, কিন্তু এই বদমাশ পাখিগুলোই কি লুকিয়ে থাকতে দেয়। তখন থেকে চেঁচাচ্ছে।”

“লুকিয়ে ছিলেন কেন?”

দুঃখবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “লুকোব না? একে তো খুনি, তার ওপর পুলিশ, তিন নম্বর হনুমান, চার নম্বর এই রাতে ভজবাবুকে খুঁজতে যাওয়া। চাকরি করতে এসে তো আর প্রাণটা দিতে পারি

মশাই।” হারাধন বলল, “কিন্তু পাখিগুলো এখনও চেঁচাচ্ছে কেন?”


“গণেশবাবুও আছেন যে!” বলতে না বলতে টিয়ার খাঁচার পেছন থেকে গণেশবাবু বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, “গান গাইলেই হল না কি না! সবাই যদি গান গাইতে পারত তবেই হয়েছিল আর কি!”

হারাধন অবাক হয়ে বলে, “হঠাৎ গানের কথা কেন?”

গণেশবাবু বললেন, “ওই তো শুনলেন সরোজ আর মননজের মুখে, ভজবাবু নাকি গান গাইতে গাইতে ডাকাতি করতে যাচ্ছেন। ডাকাতি করা খারাপ কাজ বটে, কিন্তু যে গানের গ জানে না তার গান গাওয়া ডাকাতির চেয়েও খারাপ কাজ।”

হারাধন বলে, “তা বটে, কিন্তু মেজদা তো কখনও ভুলেও গান গায় না।”

গণেশবাবু গায়ের ধুলো-টুলো ঝেড়ে বললেন, “আপনার এই চিড়িয়াখানাটা বড় জব্বর জায়গা মশাই। যে ঘরেই লুকোতে যাই সে ঘরেই ডিসটার্বেন্স। এ ঘরে গেলে হনুমান দাঁত খিচোয়, ও ঘরে সাপ ফোঁস ফোঁস করে, সে ঘরে ব্যাং ডাকে, এ ঘরটায় পাখিদের কী কিচির মিচির বাবা! এর চেয়ে ভজবাবুর গান শোনা ভাল। চলো দেখি সরোজ মনোজ, তোমাদের মেজকাকু কেমন গাইছে সেটা শুনে আসি।”

দুঃখবাবু মনের দুঃখে বলে, “সবাই গেলে আমিই বা একা থাকি কী করে? এ বাড়ি খুব সেফ নয়। চলুন আমিও না হয় একটু ঘুরে আসি।”

.
 
রাত্রিবেলা রাজা গোবিন্দনারায়ণের ভাল ঘুম হয় না। তার কারণ হল, শোওয়ার আগে তিনি কোমরে একটা মোটা ঘুনসিতে রাজবাড়িতে যত চাবি আছে সব বেঁধে নিয়ে তবে ঘুমোতে যান। রাজবাড়ির চাবির সংখ্যা কম নয়। দেউড়ির চাবি থেকে শুরু করে ভাঁড়ারের চাবি মিলিয়ে ছোট বড় শত খানেক তো হবেই। কোমরের চারধারে গোল, মোটা, লম্বা, ছোট বড় হরেক চাবি ঝুলিয়ে রাজা যখন শোন তখন সেগুলো গায়ে ফোটে। তার ওপর একটু নড়লে চড়লেই চাবিগুলোর ঝনঝন করে বিকট শব্দ হয়।

গোবিন্দনারায়ণের আজ রাতে ঘুম না হওয়ার একটা তৃতীয় কারণও আছে। গোয়েন্দা বরদাচরণের কাছ থেকে তিনি আজই। জানতে পেরেছেন যে, চোরকুঠুরির জমানো টাকাগুলো সবই অচল। তাঁর অবশ্য বিশ্বাস হয়নি। তাই সন্ধের পর তিনি চোরকুঠুরি থেকে দুটো টাকা বের করে চাকরকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন মুড়ি কিনে আনতে। চাকর এসে টাকা দুটো ফেরত দিয়ে বলেছে, “দোকানদার জিজ্ঞেস করল এ নোট দুটোয় কি উটের ছবি ছাপা আছে?”

গোবিন্দনারায়ণ তখন থেকে শোকমগ্ন। তার ওপর হাড় হাভাতে গোয়েন্দাটা মহা জ্বালাতন শুরু করেছে তখন থেকে। কেবল বলছে, “আপনি আমার মাস মাইনেটা কি ওইসব টাকা দিয়ে দেবেন নাকি? আপনার মতলব তত ভাল ঠেকছে না।“

গোবিন্দনারায়ণ তাকে যতই ধমকান সে কিছুতেই শোনে না। কেবল বলে, “ও হোঃ হোঃ, আমি যে অনেক আশা করে কেসটা হাতে নিয়েছিলাম!”

তর্কে বিতর্কে রাত হয়ে যাওয়ায় বরদাচরণ আর বাড়ি ফেরেননি, তিনি রাজা গোবিন্দনারায়ণকে বলেছেন, “সকাল হলে আমি রাজবাড়ির রূপোর বাসন নিয়ে গিয়ে বাজারে বেচে দেব।” এই বলে গোয়েন্দাটা রাজার হেঁসেলে রাতের খাওয়া সেরে বাইরের দরবার ঘরে ঘুমোতে গেছে।

সেই থেকে গোবিন্দনারায়ণের ঘুম নেই। চোর কুঠুরির সব টাকা অচল। গোয়েন্দা সকালবেলা রুপোর বাসন নিয়ে যাবে। ভাগ্নেটা গাওয়া ঘিয়ের লুচি খেয়ে গেল।

.

রাত বারোটার পর গোবিন্দনারায়ণ আর বিছানায় থাকতে পারলেন না। এই শীতেও বিছানাটা গরম ঠেকছে। উঠে চাবির শব্দ তুলে একটু পায়চারি করছিলেন। সে সময়ে শুনতে পেলেন কে যেন দেউড়ির কাছে গান গাইছে, “দরজা খোলো হে, ঝটপট খোলো, দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা…”

গান গোবিন্দনারায়ণের খারাপ লাগে না। তিনি তাই ভাল করে শোনার জন্য দোতলার অলিন্দে এসে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়িয়েই মূৰ্ছিত হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

ভজবাবু উঁচু গায় গাইলেন, “দরজা যদি না খোলো তবে আজ টেনে তুলে নেব চামড়া…”

রাজবাড়ির দুচারজন বুড়ো দারোয়ান এখনও অবশিষ্ট আছে। তারা সব ঘুমোচ্ছিল, গান শুনে উঠে সবাই বাইরে এসে ফটকের বাইরের দৃশ্য দেখে হাঁ।

মেজ সদর বাইরে থেকে গর্জন করে ওঠে, “এই! সব হাঁ করে দেখছিস কী? ফটক খুলে দে!”।

একজন বুড়ো দারোয়ান চাবির জন্য রাজার কাছে দৌড়ে এল। রাজা মূর্ছা ভেঙে বললেন, “দুগা দুর্গতিনাশিনী! গোয়েন্দাটা বসে বসে মাইনে খায়, ওটাকে ঘুম থেকে তুলে দে তো! আর দৌড়ে পিছনের ফটক দিয়ে গিয়ে পুলিশে খবর দে।”

দারোয়ান চলে গেল।

বাইরে ভজবাবু গেয়ে উঠলেন, “লাথি মেরে ভাঙব তালা, দারোয়ান দৌড়ে পালা, বাঁচতে যদি চাস..”

মুহূর্তের মধ্যে চল্লিশ-পঞ্চাশটা মশাল জ্বলে উঠল। সেই সঙ্গে রাজবাড়ির পুরনো মরচে পড়া ফটকে দমাদম লাথি পড়তে থাকে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফটক ভেঙে ডাকাতরা রাজবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে থাকে।

.

দারোগাবাবু রাতে কিছু খাননি। দু চুমুক দুধ বার্লি খেয়ে শুয়ে মা কালীর নাম করছিলেন। একটা সেপাই তার গা হাত পা টিপে দিচ্ছিল।

সদ্য ঘুমটা এসেছে এমন সময় থানা থেকে লোক এসে খবর দিল, “রাজবাড়িতে ডাকাত পড়েছে। যেতে হবে।”

শুনে দারোগাবাবু দুঃস্বপ্ন মনে করে এক পাশ থেকে আর এক পাশ ফিরে শুলেন।

কিন্তু থানার লোকটা ছাড়ে না। কেবল ডাকাডাকি করে, “বড়বাবু, উঠুন, রাজবাড়িতে ডাকাত পড়েছে।”

ঘুম-চোখে দারোগাবাবু বললেন, “রাজবাড়ির ডাকাত তো। আমাদের বাড়ির তো নয়! আমাদের কী তাতে?”

“সব লুঠ হয়ে গেল বড়বাবু!”

দারোগাবাবু ফের পাশ ফিরে বললেন, “লুঠ করে যাবে কোথায়? কাল সকলেই সব কটাকে ধরে ফেলব।”

“খুন-খারাবি হবে যে!”

“খুন করতে বারণ করে দে। একটু ভয় দেখিয়ে দিবি। বলবি খুন করলে ফাঁসি হবে। লুঠ করলে জেল।”

লোকটা কাকুতিমিনতি করতে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে ঘুমের ঘোর ভেঙে দারোগাবাবু বলেন, “ওঃ বাবা! এক দিনে আর কত হবে। মাডারার, হনুমান, ডাকাত! ব্যাটারা পেয়েছে কী আমাকে। আমি কি ওদের চাকর যে যা খুশি করবে আর আমাকে দৌড়ে বেড়াতে হবে!”

কিন্তু কর্তব্যবশে দারোগাবাবুকে উঠতেই হল। পোশাক পরে মা কালীকে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললেন, “মা গো। আমি যাওয়ার আগেই যেন ডাকাতি করে ডাকাতরা সরে পড়ে। ধর পাকড়ের অনেক হাঙ্গামা মা।”

.
 
বরদাচরে ঘুম কুকুরের ঘুমের মতো পাতলা। গোয়েন্দাদের এটাই গুণ। ফটক ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন তিনি। রাজবাড়ি থেকে তাঁকে শোওয়ার জন্য একটা মোটা কুটকুটে কম্বল দিয়েছে, তাই সারা গা চুলকোচ্ছিল।

বরদাচরণ গা চুলকোতে চুলকোতে বেরিয়ে এসেই ভজবাবুর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলেন। দেখলেন, ভজবাবুর হাতে খাঁড়া, কপালে তেল সিঁদুরের ছাপ, কানে জবাফুল, কণ্ঠে গান। ভজবাবু খাঁড়াটা ঘোরাতে ঘোরাতে গেয়ে ওঠেন, “ছুঁসনে আমাকে, দূরে দূরে থাক, নইলে মাথাটা করব দুফাঁক, ওরে গোয়েন্দা পাজি…”

কিন্তু ভজবাবুকে ছোঁওয়ার ইচ্ছে বরদাচরণের একটুও নেই। ছুঁয়ে হবেটা কী? এত রাতে কারই বা চোর-পুলিশ খেলতে ইচ্ছে যায়? তিনি বললেন, “ভজবাবু, এত রাতে কী ব্যাপার?”

পিছন থেকে ডাকাতরা রে-রে করে ওঠে। বরদাচরণ পিস্তলের জন্য খাপে হাত দিলেন। পিস্তল নেই। আর পিস্তলহীন গোয়েন্দা যে কত অসহায় তা বুঝতে পেরে বরদাচরণ পিছু ফিরে দৌড় লাগালেন।

কিন্তু পারবেন কেন? দৌড়ে হয়তো পারতেন, কিন্তু প্রথমেই সিংহাসনে হোঁচট খেয়ে মেঝেয় পড়লেন। উঠে ছুটতে গিয়ে ফের দেওয়ালে ধাক্কা লাগল।

ভজবাবু এসে দাঁড়িয়ে গাইতে থাকেন, “বলো আজ তুমি কোথায় পালাবে, যেখানেই যাও সেখানেই যাবে দরা তোর পিছনে…”

“হচ্ছে না! সুর হচ্ছে না।” অন্ধকারে কে যেন চেঁচিয়ে বলে ওঠে।

ভজবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “কে বলে সুর হচ্ছে না?”

“আমি বলছি,” বলে ডাকাতদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গণেশবাবু ঘরে ঢুকে বলেন, “গানটা ইয়ার্কি নয় ভজবাবু! শিখতে হয়। ওটা কীরকম গান হল শুনি! সর্বেশ্বর কারফমার ‘দস্যু নৃত্যনাট্য আমি নিজে ডিরেকশন দিয়েছি কতবার। শুনবেন? তাহলে শুনুন।” বলে গণেশবাবু হাত নেড়ে নেড়ে গাইলেন, “বলো আ…আজ তু..উম কোথায় পা..আলাবে…”

ভজবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কাজের সময় এখন দিক করবেন না তো গণেশবাবু! আমি এখন ডাকাতদের ডিরেকশন দিচ্ছি…”

“এঃ, ডিরেকশন যত খুশি দিন, তা বলে গানের অপমান আমি সহ্য করব না।”

এ নিয়ে একটা ঝগড়া বেধে উঠল বেশ।

মেজ সদার বা অন্য ডাকাতরা এসব ঝগড়া কাজিয়া দেখে ভূক্ষেপ করল না। তারা কাজ হাসিল করতে এসেছে। ঝগড়া কাজিয়া নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে কেন?

মেজ সদার গিয়ে সোজা গোবিন্দনারায়ণের গলায় খাঁড়া ধরে বলল, “চাবিগুলো দিয়ে দিন রাজামশাই।”

রাজা গোবিন্দনারায়ণ বললেন, “তাঁতিরাচি গামা হন্ডুরাস।”

মেজসদার অবাক হয়ে বলে, “তার মানে?”

রাজামশাই আবার বলেন, “গিমি গড়গড়ি কেরোসিন বোম।”

মেজসদার হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “ওরে তোরা শোন তো এসে, রাজামশাই কী ভাষায় কথা বলছে।”

রাজামশাই নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল বোধহয় দৈবক্রমে তিনি স্বপ্নাদ্য কোনও নতুন ভাষা শিখে ফেলেছেন। অর্থ না বুঝলেও তাঁর মুখ দিয়ে অনবরত ওই সব কিম্ভুত কথা বেরিয়ে যাচ্ছে। এবার তিনি বললেন, “গমেসি গদাধর ভাগভাগ ফুংকাসুন।”

কানাই খুব মন দিয়ে শুনে বলে, “নাঃ, বোঝা যাচ্ছে না। তেলুগু হতে পারে।”

বিড়ি-চোর বলে, “তেলু টেলু নয়। আমি সেবার পাহাড়ে গিয়ে ঠিক এই ভাষা শুনে এসেছিলাম। তবে মানে বলতে পারব না।”

একটা অল্পবয়সী ডাকাত বলল, “রাজাদের ব্যাপারই আলাদা। তারা কি আর আমাদের ভাষায় কথা বলে নাকি? আর কথায় কাজই বা কী?”

মেজদারও বলে, “ঠিক বলেছিস। এত কথায় কাজ কী? কানাই, রাজামশাইয়ের কোমরের ঘুনসি থেকে চাবির গোছাটা খুলে দে তো।”

কানাই চাবির গোছা খুলে নিল।

রাজামশাই শুধু বললেন, “সামসাদিঘি টক দৈ হামলা খামলা।” বলতে বলতে রাজামশাই তখনও অবাক হয়ে ভাবছেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে এসব কথা বেরোচ্ছে কী করে। মনে-মনে তিনি যা ভাবছেন তা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু যেই সেকথা বলতে চাইছেন অমনি তাঁর জিভ যেন বদমাইশি করে কথাগুলোকে অন্য একটা বিদঘুঁটে ভাষায় ট্রানসলেট করে দিচ্ছে। যেমন তিনি এখন বলতে চাইছিলেন ‘বাবারা, হামলা কোরোনা, যা চাও নিয়ে যাও।’ এর মধ্যে কোত্থেকে সামসাদিঘি বা টক দৈ আসে তা বোধের অগম্য।

ডাকাতরা চাবি খুলে নিয়ে রাজামশাইকে একা রেখে চলে গেল। রাজামশাই দাঁড়ানো অবস্থাতেই মূৰ্ছিত হয়ে রইলেন। এটা অবশ্য তাঁর পুরনো অভ্যাস, দাঁড়িয়ে মূছ যেতে তাঁর কোনও অসুবিধেই হয় না।

অন্দরমহলের একটা বড়-সড় ঘরে রাজমাতা আর রানী-মা দুটো পাশাপাশি খাটে শোন। মাঝখানে মেঝেয় শোয় রাজবাড়ির পুরনো দাসী।



রাজমাতার ভাল ঘুম হয় না। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। সারাদিন খুঁটে দেন, সেই ঘুঁটে শুকিয়ে পাহাড়প্রমাণ জমিয়ে রাখেন রাজমাতা খুঁটে বিক্রি করলে নিন্দে হবে, সেইজন্য নিজে না বিক্রি করে বুড়ি দাসীকে দিয়ে বিক্রি করেন। তাতে বেশ দু পয়সা আয় হয় তাঁর। কিন্তু তিনি যতই গোপন করুন রাজ্যিসুব্ধ সবাই জানে যে, রাজমাতার খুঁটের ব্যবসা আছে। ঘুঁটে অবশ্য তিনি ভালই দেন, সেজন্য লোকে তাঁর প্রশংসাও করে। রাজমাতার দুশ্চিন্তা হল সেই খুঁটে নিয়েই। কখন কোন ফাঁকে চোর এসে খুঁটে চুরি করে নিয়ে যায়, তা ভেবে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। এ রকম কয়েকবারই চুরি গেছে। কতবার ছেলে গোবিন্দনারায়ণকে বলেছেন, “আমাকে একটা নেড়ী কুকুর এনে দে, পুষি। সে আমার খুঁটে পাহারা দেবে।” কিন্তু তাঁর রাজা-ছেলে সেকথা কানে নেয়নি।

রাজমাতার আরও দুশ্চিন্তা একমাত্র নাতিটার কথা ভেবে। সে যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে রইল।

এইসব ভেবে তাঁর ঘুম আসে না। রাতবিরেতে জেগে বসে মাথা চুলকোন। বড় উকুন হয়েছে। আজও চুলকোচ্ছিলেন। হঠাৎ হট্টগোল শুনে উঠে বসে ছেলের বউকে ডাকতে লাগলেন, “অ বউমা, ওঠো তো! ও কারা গণ্ডগোল করছে?”

রানীমারও ঘুম নেই। এক কথা, ছেলে নিরুদ্দেশ। তা ছাড়া কিপটে রাজার ঘর করেন বলে তাঁকে সব সময় সংসারের নানা দুশ্চিন্তা করতে হয়। ঘুম তাঁরও হয় না। শাশুড়ির গলা শুনে বললেন, “শুনছি মা। মনে হচ্ছে ডাকাত-টাকাত পড়েছে।”

“হায় ভগবান! ডাকাতই যদি পড়েছে তবে শুয়ে আছ কেন? ওঠো দেখি কী হল।”

রানী-মা নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, “উঠে হবেই বা কী! ডাকাতরা ঘুরে ফিরে নেওয়ার মতো জিনিস না-দেখে নিজেরাই লজ্জা পেয়ে ফিরে যাবে।”

রাজমাতা মশারি তুলে বেরিয়ে আসতে-আসতে বললেন, “ নেওয়ার জিনিস নেই মানে? এখনও আমার তিন হাজার চারশ পঞ্চান্নখানা খুঁটে জমা আছে, তা জানো?”

“ডাকাতরা ঘুঁটে নিতে আসে না মা।”

“চোর-কুঠুরিতে আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকা আছে তা জানো?”

“সব অচল।”

রাজমাতা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, না হয় নাই নিল কিছু কিন্তু আমার গোবিন্দকে যদি মারধোর করে? চলো দেখি গিয়ে।”

রানী-মা উঠে পড়লেন। ডাকাতরা যে মারধোর করতে পারে এটা তাঁর আগে খেয়াল হয়নি।

এদিকে দরবার-ঘরে গোয়েন্দা বরদাচরণের অবস্থা খুবই করুণ। মনোজদের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেওয়াল থেকে পড়ে মাজায় ব্যথা পেয়েছিলেন, এখন সেই ব্যথার ওপর আবার সিংহাসনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অচল হয়ে পড়েছেন। যাকে বলে চলচ্ছক্তিহীন। তা ছাড়া, পালাতে গেলে প্রাণ যাবে বলে ভজবাবু শাসিয়ে রেখেছেন। সেকথাটা অবিশ্বাসই বা করেন কী করে? ভজবাবুর হাতে খাঁড়া, ভাবসাবও ভাল নয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top