তা এরকম সোরগোল প্রায়ই ওঠে। ঠাকুরঝি সাত দিনে সাতবার আছাড় খান। লোকে বলে, ওইটাই তাঁর নেশা। তাঁর হবি। যেখানে কেউ কোনওদিন পড়ে যায় না এমন শুকনো সমতল জায়গাতেও ঠাকুরঝি তাঁর বরাদ্দ আছাড়টা খেয়ে নেন। শোনা যায়, দেশের বাড়িতে সেই ঢাকা জেলার গ্রামে থাকতেও তিনি প্রায়ই ঘরের পাটাতনে মই বেয়ে পুরনো তেঁতুল কি আমচুড় পাড়তে উঠে আছাড় খেতেন, পুকুরঘাটে পড়তেন, উঠোনে হড়কাতেন, এমন কী খোঁটায় বাঁধা গরু পর্যন্ত তাঁকে দেখলে দৌড়ে এসে দড়ির প্যাঁচ মেরে ফেলে দিত। অত সব আছাড় খেয়ে খেয়েই তাঁর পা একটু খোঁড়া, হাতও একটু বাঁকা, গ্রামদেশে তো হাড় জোড়া দেওয়ার ডাক্তার ছিল না, গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার পট্টি বেঁধে ছেড়ে দিত। ভাঙা হাড় বাঁকা হয়ে জোড়া লেগে যেত।
ঠাকুরঝি আছাড় খেয়েছেন শুনে পড়া ভণ্ডুল হয়ে গেল। মনোজ, সরোজ, পুতুল তিন ভাই-বোন যথাক্রমে ভূগোল, অঙ্ক, ইতিহাস ফেলে দৌড়ে উঠে এল। দুঃখবাবু উবু হয়ে বসে মন দিয়ে অঙ্ক কষছিলেন। অনেকক্ষণ বাদে টের পেলেন যে, সামনে ছাত্রছাত্রীরা কেউ নেই।
ভারী বিরক্ত হয়ে তিনি তখন গানের মাস্টারমশাই গণেশ ঘোষালের ঘরে গেলেন দুটো গল্প করতে। গিয়ে দেখেন, সেখানেও এক গোলমাল।
গণেশবাবু আত্মহত্যা করবেন বলে চালের বিমের সঙ্গে একটা মোটা দড়ির ফাঁস ঝুলিয়ে দড়িটা টেনেটুনে দেখছেন।
দুঃখবাবু বললেন, “এ কী?”
দৃশ্য দেখে দুঃখহরণবাবু চমকে উঠলেন না। মাসের মধ্যে দু-তিনবার গণেশ ঘোষাল আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকেন। দুঃখবাবু দড়িটা দেখে বললেন, “ভাল বাঁধা হয়নি।”
গণেশবাবু ফাঁসটা ধরে একটু ফুল খেয়ে বলেন, “না, দিব্যি শক্ত হয়েছে।“
দুঃখবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “দড়িটাও বেশ পুরনো, মাঝখানে ফেঁসে বেরিয়ে আছে। ফাঁস গলায় দিয়ে ঝুলবার সময়ে যদি দড়ি ছিঁড়ে যায় তো পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে।”
গণেশবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ভাঙে ভাঙুক। ভারী তো তুচ্ছ হাত-পা। মরতে গেলে হাত-পায়ের চিন্তা করলে চলে না মশাই।”
দুঃখবাবু ভেবে চিন্তে বলেন, “সে অবশ্য ঠিক। দড়িটা কি গোয়াল থেকে আনলেন নাকি?”
গণেশবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “হ্যাঁ। গরুর গলা থেকে খুলে এনেছি। বদমাশ গরুটা ঢুসিয়ে দিতে এসেছিল, কোনওক্রমে বেরিয়ে এসে দরজার ঝাঁপটা টেনে দিয়েছিলাম ভাগ্যিস।”
দুঃখবাবু চেয়ারে পা তুলে বসে বললেন, “এই সকালবেলাতেই মরতে চাইছেন কেন? সকালবেলাটা সুইসাইড করার পক্ষে ভাল না। হুটহাট লোকজন এসে পড়তে পারে। এসব গভীর রাতে করতে হয়, যখন কেউ এসে বাঁচাতে পারবে না।”
“ঃ।” বলে গণেশবাবু দুঃখবাবুর দিকে একটু কটমট করে চেয়ে থেকে বললেন, “গভীর রাত পর্যন্ত আমি জেগে থাকতে পারি না। এত ঘুম পায় যে, মরা-টরার কথা মনেই থাকে না।”
“আজকে কী হয়েছিল যে, মরতে যাচ্ছেন?”
গণেশবাবু মুখখানা ভার করে চোখ ছলছলিয়ে বললেন, “আবার কী! সেই সুরে ভুল। সকালে বসে হংসধ্বনি রাগটার ওপর একটু ঘষামাজা করছিলাম, পরপর দুবার তালে লয়ে ভুল হয়ে গেল। কালু মিশিরের শিষ্য আমি, আমার ভুল হওয়ার মানে তো পৃথিবীতে প্রলয় হয়ে যাওয়া। গুরুজি তো আজ প্রায় ত্রিশ বছর হল দেহ রক্ষা করেছেন, তবু যখন সকালে রেওয়াজ করতে বসি তখন যেদিন ঠিকঠাক সুরে-লয়ে-তালে গাই সেদিন নির্ঘাত শুনতে পাই অনেক দূর থেকে যেন মৃদু একটা তবলায় ঠেকা দেওয়ার শব্দ আসছে। গায়ে কাঁটা দেয় মশাই, পরিষ্কার বুঝতে পারি স্বর্গে বসে গুরুজি আমার গান শুনছেন, আর তবলার ঠেকা দিয়ে দিয়ে সম আর ফাঁক দেখিয়ে দিচ্ছেন। কখনও কখনও তারিফ করে ‘কেয়াবাত’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।”
“ওরে বাবা, দুঃখবাবু বলে ওঠেন। অবশ্য কথাটা তিনি গণেশবাবুর গুরুজির কথা শুনে বলেননি, আসলে তাঁকে এ সময়ে কুটুস করে একটা ছারপোকা কামড়েছিল। তিনি উবু হয়ে বসেই চেয়ারে ছারপোকা খুঁজতে লাগলেন।
গণেশবাবু চোখ মুছে বলেন, “জীবন তুচ্ছ, তালেই যদি ভুল হল, লয়ই যদি গোল পাকাল, তা হলে বেঁচে থেকে লাভ কী?”
ছারপোকা খুঁজতে খুঁজতে দুঃখবাবু বলেন, “কাজটা ভাল করেননি।”
“না না, বেশ করছি। আপনি আমাকে বাধা দেবেন না। মরে গুরুজির কাছে যাব, তিনি আমাকে মুখোমুখি পেয়ে পায়ের নাগরাটা দিয়ে আচ্ছাসে জুতোপেটা করবেন, তবে আমার শান্তি। একাজে আমাকে বাধা দেবেন না দুঃখবাবু।”
দুঃখবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, “কে বাধা দিচ্ছে! মরতে হয় মরুন, তা বলে গোয়াল থেকে দড়িটা আনা আপনার ঠিক হয়নি। একটু আগেই গোয়ালঘর থেকে চেঁচামেচি আসছিল, বোধহয় আদ্যাশক্তিদেবী গোয়ালে গোবর আনতে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে ছাড়া গরুটা তাঁকে বুঝি খুব টুসিয়ে দিয়েছে। ও গরুটা রামু ছাড়া কাউকে মানে না! এখন যদি সকলে গরুটা কে ছাড়ল তা খুঁজে দেখতে গিয়ে আপনার ঘরে এসে চোরাই দড়িটা পায় তো বড় লজ্জার কথা।”
গণেশবাবুর মুখটা শুকিয়ে গেল, বললেন, “তাই তো!”
“সব কিছুই ভেবেচিন্তে করতে হয়। গলায় দড়ি দেওয়ারও একটা ক্যালকুলেশন আছে। হু-হুঁ! পটেশ্বর ওঝা রেল লাইনে গলা দিতে গিয়েছিল তার বউয়ের সঙ্গে রাগারাগি করে। রাতে গিয়ে লাইনে গলা দিয়ে পড়ে রইল, কিন্তু গাড়ি আর আসে না। পটেশ্বরকে খাতির করতে গাড়ি তো আর আগেভাগে এসে পড়তে পারে না, তারও টাইম আছে। তা পটেশ্বর অপেক্ষা করতে করতে কখন লাইনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোরবেলা গাড়ি এল, কিন্তু অনেক দূর থেকেই ড্রাইভার সাহেব রেল লাইনে মানুষ শুয়ে আছে দেখে গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিনের কু দিল। সেই কু শুনে ঘুম ভাঙতেই পটেশ্বর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে ভাবল, যাক বাবা, মরা-টরা হয়ে গেছে। ব্যথাট্যথাও খুব একটা পেতে হয়নি। এই ভেবে সে ঘাড়ে হাত দিতে ঘাড়খানা আস্ত দেখে আরও খুশি হয়ে হয়ে গেল। ভাবল, মরার পর বোধহয় কাটা ঘাড় ফের জোড়া লেগে যায়। এই সময়ে ড্রাইভারসাহেব নেমে এসে পটেশ্বরকে এই মার কি সেই মার। বলে–রেল লাইনটা তোমার মামদোগিরির জায়গা? সেই মার খেয়ে পটেশ্বর পনেরো দিন হাসপাতালে ছিল। ক্যালকুলেশনের ভুলে তার মরাও হল না, বরং মার খেয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হল। তাই বলছিলাম।”
আদ্যশক্তিদেবী আছাড় খেয়েছেন শুনলে কেউ আজকাল আর অবাক হয় না। কেউ যদি কাউকে গিয়ে বলে, জানো, আদ্যাশক্তি দেবী আছাড় খেয়েছেন? তা হলে যাকে বলা হয় সে একটু অবাক হয়ে বলবে, হ্যাঁ, সে আর বলার কী? উনি তো প্রায়ই তো খেয়ে থাকেন। ওটাই ওঁর অভ্যাস, নেশা।
তবু কেউ যদি আছাড় খায়ই, সে আদশ্যক্তি দেবীই হোন বা আর যে কেউ হোক, নিয়ম হল লোজন গিয়ে তাকে ধরাধরি করে তুলবে। গোয়ালঘরের চেঁচামেচি শুনে তাই সবাই দৌড়ে গেল।
গিয়ে দেখে, গোয়ালঘরের এক কোণে যেখানে মনোজের কাকা বৈজ্ঞানিক এবং ব্যায়ামবীর হারাধন গোবর গ্যাস তৈরি করার জন্য বিশাল এক গর্তে গোবরের তাল জমিয়ে রেখে পচাচ্ছিল সেখানে আদ্যাশক্তিদেবীর অর্ধেক ডুবে আছে। তিনি নিঃশব্দে চেঁচাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর মুখ নড়ছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।
রাখোবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “এ নিশ্চয়ই হারিকেনের কাজ।”
বুড়ি ঝি কিরমিরিয়ার অভ্যাস হল, বাড়িতে কোনওরকম ঘটনা ঘটলেই সে বিলাপ করে কাঁদতে বসবে। রাখোবাবু যদি মনোজকে বকেন তো কিরমিরিয়া কাঁদতে বসে। পুতুলের ড্রইং-এর খাতা হারালেও কারও কিছু নয়, কিরমিরিয়া বিলাপ করতে বসল–ও বাবাগো, খখাঁকির খাতাটা কোথায় গেল গো? খোঁকির এখন কী হবে গো! ইস্কুলের দিদিমণি এখন খোঁকিকে বকবে গো! সারাদিন তার বিলাপের জ্বালায় সবাই অস্থির। এখন বাড়িতে যাই ঘটুক, কিরমিরিয়াকে কেউ কিছু খবর দেয় না।