What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি -শির্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় 🥴 (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
329
Messages
6,256
Credits
48,364
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
fgd.jpeg


মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি– অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

[এই উপন্যাসের শেষ দিকে একটা দৃশ্য আছে, যেখানে ভজবাবু ডাকাতের দল নিয়ে রাজবাড়ি লুট করতে যাচ্ছেন, সেই দৃশ্যে ভজবাবুর মুখে কিছু গান রয়েছে। এই গানগুলি লিখে দিয়েছেন বিখ্যাত কবি শ্রীনীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।]
 
ফটোটা কী করে যে মনোজদের বাসায় এল, তা কেউ জানে। ফটোটা কার, তাও কেউ বলতে পারে না। মনোজদের বাড়িতে অনেকের ফটোর মধ্যে এই ফটোটাও বরাবর আছে। অথচ কেউ ঠিক করে বলতে পারে না যে, এটা কোত্থেকে কবে এসেছিল, ফটোর ছেলেটাই বা কে?

ফটোটা একটা ছেলের। তার বয়স হবে আট নয় বা দশ। একটা বাংলোবাড়ির সামনের বারান্দার সিঁড়িতে সে বসে আছে। সামনের বাগান থেকে বারান্দায় উঠতে মোট তিন ধাপ সিঁড়ি। ঠিক মাঝের ধাপে ছেলেটা বসে আছে, নীচের সিঁড়িতে পা, ওপরের সিঁড়িতে কনুই রেখে সে একটু পিছনে হেলে বসে আছে। তার পায়ে বুটজুতো আর মোজা, সাদা হাফপ্যান্ট, গায়ে

ফুলহাতা সোয়েটার, আর সোয়েটারের গলার কাছে সাদা শার্টের কলার বেরিয়ে আছে। ছেলেটা দেখতে ভীষণ সুন্দর। বড় বড় চোখ, লম্বাটে মুখ, চোখা পাতলা নাক, গালগুলো ভরাট, কিন্তু লুচির মতো ফোলা ফোলা নয়। তার চুলে ডানদিকে সিঁথি, আর কপালটার অনেকখানি ঢেকে চুলগুলো পাট করা। ছেলেটা অল্প একটু হাসিমুখে চেয়ে আছে। সেই হাসি আর তাকানো এত জীবন্ত যে, যে-কোনও সময়ে ছেলেটা যেন কথা বলে উঠবে। ছবিটার মধ্যে আরও দুটো অদ্ভুত ব্যাপার আছে। ছেলেটার পিছনে যে বারান্দা, তাতে টেরছা হয়ে রোদ পড়েছে। বারান্দার পিছনে দরজা, দরজায় একটা গোলাপ ফুলের ছাপওলা পর্দা ঝুলছে। সামনে রোদ, কিন্তু পদাটা ছায়ায়, তাই পদার গায়ে গোলাপের ছাপ একটু অস্পষ্ট। আর সেই পদাটা একটুখানি সরিয়ে একটা মুখ উঁকি মেরে আছে। মুখটা খুবই অস্পষ্ট। শুধু সেই মুখে একটু হাসি বোঝা যায়। যেন কেউ হাসিমুখে ছেলেটার ছবি-তোলানো দেখছে। কিন্তু সেই মুখটা ছেলের না মেয়ের, তা বোঝা যায় না। আরও একটা মজার ব্যাপার হল, ছেলেটার বাঁ দিকে একটা কাঁচের গেলাসে তিন পোয়া ভর্তি দুধ রয়েছে। দুধ কিনা তা ঠিক করে বলা যায় না, তবে সাদামতো তরলটা দুধ ছাড়া আর কীই বা হবে। আর সেই প্রায় পৌনে এক গেলাস দুধে মুখ ডুবিয়ে দুধটা খেয়ে নিচ্ছে একটা বেশ বড়সড় মোটা বেড়াল। বেড়ালটার লেজও খুব মোটা। বোঝা যায়, ছেলেটা দুধ খাচ্ছিল, সেই সময়ে ফটো তোলাতে গিয়ে গেলাসটা পাশে রেখেছিল, আর তখন ছেলেটাকে অন্যমনস্ক দেখে বেড়ালটা চুপিচুপি এসে চুরি করে দুধ খেয়ে নিচ্ছে। ছেলেটা টের পায়নি। ছবিটার মধ্যে আরও কিছু কিছু জিনিস লক্ষ করা যায়। যেমন, বারান্দার নীচে বাগানের একটু অংশ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বাগানে অনেক গাঁদা, ক্রিসেনথিমাম, পপি ফুল ফুটেছে। বাংলোবাড়িটার টিনের চাল। বারান্দার ওপরে টিনের চালটার একটু ঢালু অংশ দেখা যায়। বারান্দার থাম বেয়ে একটা লতানে গাছ উঠেছে চালে।

মনোজ যে কতবার ছবিটা দেখেছে তার হিসেব নেই। ছবিটা দেখতে তার বড় ভাল লাগে। কেন ভাল লাগে তাও সে জানে না। যদি কখনও তার মন খারাপ হয়, বা কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া হয়, বা মায়ের ওপর অভিমান হয়, তখন সে এসে একা ঘরে ছবিটা বের করে চেয়ে বসে থাকে। ছবি থেকে ছেলেটাও তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে থাকে। তখন মনোজের মনের মধ্যে কী যেন হয়, সে ভাবে–এই তো আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। তখন তার মন ভাল হয়ে যায়। মনোজ খুব ছেলেবেলা থেকেই তাদের বাড়িতে ছবিটা দেখে এসেছে। আর ছবিটা বেশ পুরনো, একটু হলদে-হলদে পুরনো ছাপও পড়ে গেছে তাতে। অর্থাৎ ছবিটা অনেক আগে ভোলা হয়েছিল, এবং ছবির ছেলেটা নিশ্চয়ই এখন আর ছোট নেই। সে হয়তো অনেক বড় হয়ে এখন মনোজের কাকা বা বাবার মতো বড় মানুষ হয়ে গেছে। তবু ছবির ছেলেটাকে মনোজ বন্ধু বলেই ভাবে। ভাবতে ভাল লাগে। এই ছবিটার কোনও ঠিকানা নেই, কোথায় কবে তোলা হয়েছিল কেউ জানে না। তাই বাড়ির লোকেরা এই ছবিটা দেখলেই বেশ বিব্রত হত। বলত, এ ছবিটা যে কার কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের কেউ নয় নিশ্চয়ই। মনোজ তাই একটু বড় হয়ে ছবিটা অন্যান্য ছবি থেকে আলাদা করে নিয়ে এসে তার গল্পের বইয়ের তাক-এ একটা ছোটদের রামায়ণ বইয়ের পাতার ভাঁজে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। নিজের কাছেই রাখা ভাল, নইলে কে কবে বাজে ছবি ভেবে ফেলে-টেলে দেবে।

মনোজদের বাড়িতে অনেক লোক। ঠাকুমা, বাবার এক বুড়ি পিসি, মা, বাবা, দুই কাকা, দিদি, দাদা, দুটো ডলপুতুলের মতো ছোট ভাইবোন। এ ছাড়া বাড়িতে থাকে একটা নিরাশ্রয় বুড়ো লোক, তার বাড়ি বিহারে। একটা বাচ্চা চাকর, একটা রান্নার ঠাকুর, এক বুড়ি ঝি। তা ছাড়া বিস্তর বাইরের লোকজনের রোজ আসা-যাওয়া তো আছেই। যেমন পুরুতমশাই সতীশ ভরদ্বাজ, মাস্টারমশাই দুঃখহরণবাবু, দিদির গানের মাস্টারমশাই গণেশ ঘোষাল, এমনি আরও কত কে!

উবু হয়ে না বসলে দুঃখহরণবাবু পড়াতে পারেন না। যদি কেউ তাঁকে আসন-পিঁড়ি করে বসিয়ে দেয়, বা চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসতে বলে, তা হলেই দুঃখহরণবাবুর বড় বিপদ। তখন তিনি অঙ্ক ভুল করেন, ইতিহাসের সঙ্গে ভূগোল গুলিয়ে ফেলেন, ইংরেজি ট্রাস্লেশন করতে হিমসিম খান। যেই উবু হয়ে বসলেন, অমনি তাঁর আঙুল দিয়ে পেনসিল বেয়ে হড়হড় করে অঙ্ক, ট্রানস্লেশন, জ্যামিতি সব নেমে আসতে থাকে, মুখে খই ফোটে ইতিহাস আর ভূগোলের।
 
সকালবেলাতেই দুঃখহরণবাবুর বিপদ। সেই সময়টায় মনোজের বাবা রাখোহরিবাবু পড়ার ঘরে এসে বসে গম্ভীরভাবে খবরের কাগজ পড়েন। রাখোবাবু ভীষণ রাশভারী লোক, বাড়ির কুকুরটা বেড়ালটা পর্যন্ত তাঁকে ভয় খায়, বাড়ির লোকজনের তো কথাই নেই। কিন্তু সকালবেলাতে রাখোবাবু যে মনোজদের পড়ার ঘরে এসে বসেন তার একটা কারণ আছে। এবাড়িতে একজন মানুষ আছেন, যিনি রাখোবাবুকে মোটেই ভয় খান না, বরং উল্টে রাখোবাবুই তাঁর ভয়ে অস্থির। তিনি রাখোবাবুর পিসিমা আদ্যাশক্তি দেব্যা। বাবার পিসিকে ঠাকুমা ঠাকুরঝি বলে ডাকেন, সেই থেকে মনোজরা সবাই তাঁকে ‘ঠাকুরঝি’ ডাকে। তিনি খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন, সেই থেকে উপোস-টুপোস করে করে বুড়ো বয়সে ভীষণ তেজস্বিনী হয়ে গেছেন। কারও তোয়াক্কা করেন না। তাঁর আবার ভয়ংকর শুচিবাই। সকালে কাঁচা গোবর জলে গুলে সেই জল সারা বাড়িতে ছিটিয়ে দেন। মনোজদের পড়ার ঘরটা বাড়ির বাইরে, বাগানের ধারে। একটেরে ছোট্ট একটু ঘর, তাতে এক ধারে পড়ার টেবিল চেয়ার, অন্য ধারে তক্তপোশের ওপর দুঃখহরণবাবুর বিছানাপত্র। এই ঘর অবধি ঠাকুরঝি আসতে পারেন না, খোঁড়া পায়ে বাগান পেরোতে কষ্ট হয়। তাই এ-ঘরটা গোবরজলের হাত থেকে বেঁচে যায়। রাখোবাবু তাই গোবরের গন্ধ এড়িয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস নেওয়ার জন্য এই ঘরে এসে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে যান, ততক্ষণে ঘরদোরের জল শুকিয়ে যায়।

রাখোবাবু কড়া ধাতের লোক, আদবকায়দার নড়চড় দেখলে খুব রাগ করেন। তাই সেসময়টায় দুঃখহরণবাবুকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হয়। আর ওই এক ঘণ্টায় দুঃখহরণবাবু রাজ্যের ভুলভাল করতে থাকেন। একদিন তিনি ওই অবস্থায় ট্রানস্লেশন করতে গিয়ে তখন হলঘর ভরিয়ে গিয়াছে এই বাক্যটার ইংরেজি করলেন বাই দেন দি হল রুম ওয়াজ ফুলফিলড়। এই ইংরেজি শুনে বাবা তাঁর ইংরেজি খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বিরক্ত হয়ে তাকালেন। ছেলেমেয়ের সামনে মাস্টারমশাইয়ের ভুল ধরলে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কমে যেতে পারে, সেই জন্য বললেন–”দুঃখবাবু, ইংরিজিটা ঠিকই আছে, তবে একটু কানে কেমন যেন লাগছে। আর একবার অন্যভাবে করুন।” কিন্তু দুঃখহরণবাবু পা ঝুলিয়ে বসে আছেন যে, তার ওপর রাশভারী রাখোবাবুর কথা শুনে আরও ঘাবড়ে গিয়ে খুব শক্ত ইংরেজিতে বললেন–”দি হল’স ফুলফিলমেন্ট ওয়াজ অ্যাচিভড বাই দেন।” শুনে রাখোবাবু আর মুখ তুললেন না। দুঃখহরণবাবুও গোলমালটা বুঝতে পারছেন, কিন্তু উবু হয়ে না বসলে তাঁর মুড আসে না। তাই তিনি ঠ্যাং দুটো জোর-নাচাতে নাচাতে মুখে ‘হুঁ হুঁ করে একটা শব্দ করে যেতে লাগলেন। দাদা সরোজ, দিদি পুতুল, আর মনোজ চুপিসারে হাসাহাসি করছে।

শীতকাল। বাগানে, খুব ফুল ফুটেছে। সামনের দিকটায় মস্ত মস্ত গাঁদা ফুটে আছে, সেগুলো এত বড় যে দু হাতে মুঠো করেও বেড় পাওয়া যায় না। মোরগ ফুল, পপি, গোলাপ তো আছেই। ফটফটে রোদে প্রজাপতি আর ফড়িং উড়ছে অনেক, পোকামাকড় টি টি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগানের অন্য ধারে পালং খেত, ফুলকপি, ওলকপি, ধনেপাতা, বেগুন লাগানো হয়েছে। সেই সবজি খেতে দেহাতি বুড়ো মানুষ রামখিলাওন খুরপি হাতে ঘুরঘুর করছে। যদিও একটা ঠিকে মালী এসে বাগানের কাজ করে যায় রোজ, তবু রামখিলাওন কাজ দেখানোর জন্য বাগানে সব সময়ে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি করবেই। চোখে ভাল দেখতে পায় না, অনেক সময়ে গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়ে আলগা করতে গিয়ে শেকড়বাকড় উপড়ে ফেলে। আগাছা তুলতে গিয়ে ফুলগাছ তুলে ফেলে দিয়ে আসে। বকুনি খেলে খুব গম্ভীরভাবে থাকে, যেন এ-সব বকাবকি তার তেমন গায়ে লাগে না। গতবার ঠাকুমার চশমা পালটানো হল, আর রামখিলাওন ঠাকুমার পুরনো চশমাটা চেয়ে নিল। সেই চশমাটা এখন সব সময়ে চোখে পরে থাকে। তাতে যে সে ভাল দেখতে পায় তা নয়। কিন্তু এমন ভাব দেখায় যে খুব ভাল দেখছে। চশমা পরে ইজ্জতও বেড়ে গেছে তার। বাজারের কাছে দেশওয়ালী ভাইদের কাছে চশমা পরে যাওয়ায় সেখানে তার খাতিরও নাকি বেড়ে গেছে। বাড়ির চাকর রঘু তাকে ‘রামু বলে ডাকলে বা তুই-তোকারি করলে সে ভারী চটে যায়। রঘু তাই তাকে আজকাল রামুবাবু বলে ডেকে আপনি-আজ্ঞে করে। কিন্তু সন্ধে হলেই রঘু নানা কায়দা করে রোজ রামুকে ভূতের ভয় দেখাবেই।

.
 
আজ দুঃখহরণবাবুর ভুলভাল কিছু বেশি হচ্ছে। দাদা সরোজকে ইতিহাস বোঝাতে গিয়ে তিনি বরাবার ওয়ার্ড মিনিং বোঝাতে লাগলেন, ইতিহাস বইতে দুটো ব্যাখ্যাও দাগিয়ে দিলেন। পুতুলকে সুদকষা বোঝাতে গিয়ে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, “মুখস্থ যেন ভুল না হয়, আর দাঁড়ি কমা সেমিকোলন সম্পর্কে সাবধানে থাকবে।” মনোজের ভুগোল বই খুলেও তিনি গোলযোগ করে ফেললেন, পশ্চিমবঙ্গের কোন্ কোন্ জেলায় ধান ও পাট জন্মায় তা বলতে গিয়ে তিনি বারবার নর’ শব্দের রূপ এনে ফেলছিলেন। তাই শুনে রাখোবাবু বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন। ঘরে গোবরের গন্ধ, পড়ার ঘরে ভুলভাল পড়ানো, কোথায় আর যাবেন! তাই বাগানে পায়চারি করতে করতে দেখেন, রামু একমুঠো দুব্বো ঘাস, কয়েকটা কড়াইশুটি আর একটা গাজর বাগান থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

রাখোবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ওসব কোথায় নিচ্ছিস রে রামু? দেখি, কী তুলেছিস?”

রামু একগাল হেসে হাতের জিনিসগুলো দেখিয়ে বলল, “বুড়ি মা পাঠালেন কিছু ধনেপাতা, কাঁচা লঙ্কা আর একটা মুলো তুলে আনতে।”

রাখোবাবু রেগে অস্থির। বললেন, “স্টুপিড, কবে থেকে বলছি হাসপাতাল থেকে চোখের ছানি কাটিয়ে আয়। কিছুতেই শুনবি না? কোন্ আকেলে তুই লঙ্কা বলে কড়াইশুটি, মুলো মনে করে গাজর আর ধনেপাতার বদলে গুচ্ছের ঘাস তুললি। আজই চল্ তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাব, চোখ কাটিয়ে আসবি।”

শুনে রামু ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল। রাখোবাবু রাগারাগি করতে করতে ভিতরবাড়িতে চলে গেলেন। পড়ার ঘরে দুঃখবাবু চেয়ারের ওপর টপ করে উবু হয়ে বসতেই তাঁর চেহারা পাল্টে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ধান ও পাটের জেলা ঝরঝরে মুখস্থ বলতে লাগলেন, সুদকষা জল করে দিলেন, ইতিহাসের সন-তারিখ সুন্ধু আকবরের খুড়তুতো ভাইয়ের নাম পর্যন্ত তাঁর মনে পড়ে গেল।

ঠাকুমা বামাসুন্দরী ডালের বড়ি দিচ্ছিলেন রোদে বসে। একটা কাক তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাতন করছে। কাকটার সাহসেরও বলিহারি! এ বাড়িতে ঠাকুরঝি জেগে থাকতে বেড়াল কুকুর কাকপক্ষী ঢুকতে বড় একটা সাহস পায় না। কে কোথাকার এঁটোকাঁটা আঁস্তাকুড় টেনে আনে ঘরে, সেই ভয়ে ঠাকুরঝি লাঠিটি হাতে সারা বাড়ি খোঁড়া পায়ে ডিং মেরে-মেরে ঘুরে বেড়ান। কত কুকুর, বেড়াল, কাকপক্ষী যে তাঁর হাতে রামঠ্যাঙ্গা খেয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইদানীং তিনি শুধু লাঠির ওপর ভরসা না-রেখে পেয়ারা গাছের ডাল কাটিয়ে একটা গুলতি বানিয়ে নিয়েছেন। গুলতির যে চামড়ার অংশটুকুতে গুড়ল ভরতে হয়, সে-জায়গাটায় চামড়ার বদলে কয়েক পাল্লা ন্যাকড়ার পট্টি লাগিয়ে নিয়েছেন, চামড়া ছুঁতে পারেন না। গুলতি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ঠাকুরঝির হাতের টিপও হয়েছে চমৎকার। সট সট করে গুড়ল ছোড়েন, ঠিক গিয়ে বেড়ালের লেজের লোম খসিয়ে দেয়, কাকপক্ষীর ডানার পালক ঝরে যায়, কুকুরের ঠ্যাং খোঁড়া হয়। এ বাড়িতে আদ্যাশক্তি আছেন জেনেও কাকটা ঘুরঘুর করছে। তেল-মাখানো কাঁসার থালা, টিনের টুকরো রোদে পেতে দিয়েছেন বামাসুন্দরী, ডাল ফেটাচ্ছেন। ডাল ফেটানোতে তাঁর জুড়ি নেই। বারো মাস ডাল ফেটিয়ে তাঁর ডান হাতে বেশ জোর হয়েছে। পাঞ্জা কষলে মেজকাকা ব্যায়মবীর হারাধনও ঠাকুমাকে হারাতে বেগ পাবেন। তা ঠাকুমা ডাল ফেটাচ্ছেন। কাকটা ঘুরঘুর করছে। ডালে কালোজিরে মেশাবেন বলে কালোজিরের পুরিয়াটা পাশেই রেখেছেন। কাকটা এক ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল।

ঠাকুমা চেঁচালেন, “ও ঠাকুরঝি!”

.
কিন্তু ঠাকুরঝি তখন কোথায়! কেউ সাড়া দিল না।

ঠাকুমা বকবক করতে করতে উঠলেন। কাকটা পেঁপে গাছে উঠে বসে ছিল। কী খেয়ালে হুউশ করে উড়ে এসে ঠাকুমার খোঁপায় একটা ছোঁ মারল। তাতে ঘোমটা খসে গেল। ঠাকুমা ফের চেঁচালেন, “ও ঠাকুরঝি! কাকটার ভাবসাব মোটেই ভাল দেখছি না। গুলতিটা নিয়ে এসো?”

.

পুরুতমশাই সতীশ ভরদ্বাজ ঘোষালবাড়ির নারায়ণ পুজো সেরে ফিরছেন। এসময়টায় মনোজদের বাড়িতে বসে তিনি খানিক খবরের কাগজ পড়ে যান, যাওয়ার সময়ে গৃহদেবতার ভোগটাও নিবেদন করে যান। এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট আর পাঁচটা পয়সা তাঁর রোজকার বরাদ্দ। তিনি উঠোনে ঢুকে দেখেন, বামাসুন্দরী ডালের বাটি ফেলে বারান্দায় উঠে গিয়ে চেঁচামেচি করছেন, কাকটা ফেটানো ডালে নেচে বেড়াচ্ছে, সব ছয়ছত্রখান। বামাসুন্দরী তাঁকে দেখে প্রায় কেঁদে ফেললেন, “দেখেছেন ঠাকুরমশাই, দজ্জাল কাকের কাণ্ডটা?”

.

সতীশ ভরদ্বাজ বড় খাইয়ে মানুষ। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, বড় ভুড়ি, বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এবয়সেও জোয়ানমদ্দরা মাছ বা রসগোল্লার কম্পিটিশনে তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। পাতে পড়তে-না-পড়তে তুলে ফেলেন। লোকে বলে তাঁর নাকি দুটো পোষা ভূত আছে, খাওয়ার সময়ে আবডাল থেকে তারাই সব তুলে খেয়ে ফেলে। নইলে ঠাকুরমশাই কি আর ওই অত চারটে মানুষের সমান খাবার খেতে পারেন? তবে সতীশ ভরদ্বাজ যে ভূত পোষেন, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রায় সময়েই দেখা যায়, খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎ তিনি ‘উঁ’ বলে যেন কার নিঃশব্দ ডাকে সাড়া দেন, ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ যেন কার সঙ্গে ফিসফিস করে খানিক কথা বলে নেন, আবার কখনও হঠাৎ রাস্তাঘাটে চেঁচিয়ে ‘হাঁদু’, ‘ভুঁদু’ বলে কাদের ডাকাডাকি করেন। এইসব কারণে সবাই তাঁকে খানিকটা ভয় খায়।

কাকের কাণ্ড দেখে সতীশ ভরদ্বাজ দাঁড়িয়ে গেছেন।

কিছুক্ষণ দেখেটেখে একটা শ্বাস ফেলে খড়মের শব্দ তুলে বারান্দায় উঠে এলেন। তাঁর জন্য রোদে গদিওলা মোড়া পেতে রাখা আছে, তাইতে বসে বললেন, “কাক! এবাড়িতে মা আদ্যাশক্তি থাকতে কাক আসবে কোত্থেকে! তেমন সাহসী কাকই বা কই?”

ঠাকুমা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, “ওই দেখুন লক্ষ্মীছাড়া এক বাটি মাসকলাইবাটা নষ্ট করল। কত কষ্ট করে ফেটিয়েছি।”

“ও কাক নয় মা।” সতীশ ভরদ্বাজ গম্ভীর হয়ে বলেন।

“তবে কী?”

সতীশ ভরদ্বাজ আবার একটা শ্বাস ছাড়েন।

রঘু এসে খবরের কাগজ দিয়ে গেল। সতীশ ভরদ্বাজ কাগজ খুলে আইন-আদালতের খবর পড়তে-পড়তে বললেন, “চল্লিশ বছর আগে জয়দেবপুরে একবার এই রকম কাকের পাল্লায় পড়েছিল মোক্ষদা ঠাকুমা। দেখতে অবিকল দাঁড়কাক, কিন্তু তার হাবভাব আর দুষ্টুবুদ্ধিতে ঠাকুমা অস্থির। রোজ এসে সব লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করে যায়। তীর-ধনুক, ঢিল-পাটকেল, কাকতাড়ুয়া কোনও কিছুকে গ্রাহ্য করে না। সবশেষে জ্বালাতন হয়ে ডেকে পাঠাল আমাকে। গিয়েই বুঝলাম কাকের রূপ ধরে এ কোনও আত্মা-টাত্মা এসেছে। বললাম, এ কাক তো তাড়ালে যাবে না ঠাকুমা, নারায়ণ-পুজো দাও, আর শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করাও। সেই করতেই কাকটা যে পালাল, আর এল না। এ কাকটাকেও দেখুন না, যেন ঠিক কাক। কিন্তু কাকের মতো ব্যবহার কি? একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, এ-পাখিটা কাকের চেয়েও কালো, ওর লাফানোটাও কাকের মতো নয়। এসব কিসের লক্ষণ সে আমি জানি। বাড়িতে একটা অমঙ্গল না হয়!”

ঠাকুমা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখে কথা নেই।

আর এ-সময়ে গোয়ালঘরের দিক থেকে সোরগোল উঠল, রঘু আর বুড়ি কি কিরমিরিয়া চিৎকার করে বলছে, “ঠাকুরঝি পড়ে গেছে, ঠাকুরঝি পড়ে গেছে।”
 
তা এরকম সোরগোল প্রায়ই ওঠে। ঠাকুরঝি সাত দিনে সাতবার আছাড় খান। লোকে বলে, ওইটাই তাঁর নেশা। তাঁর হবি। যেখানে কেউ কোনওদিন পড়ে যায় না এমন শুকনো সমতল জায়গাতেও ঠাকুরঝি তাঁর বরাদ্দ আছাড়টা খেয়ে নেন। শোনা যায়, দেশের বাড়িতে সেই ঢাকা জেলার গ্রামে থাকতেও তিনি প্রায়ই ঘরের পাটাতনে মই বেয়ে পুরনো তেঁতুল কি আমচুড় পাড়তে উঠে আছাড় খেতেন, পুকুরঘাটে পড়তেন, উঠোনে হড়কাতেন, এমন কী খোঁটায় বাঁধা গরু পর্যন্ত তাঁকে দেখলে দৌড়ে এসে দড়ির প্যাঁচ মেরে ফেলে দিত। অত সব আছাড় খেয়ে খেয়েই তাঁর পা একটু খোঁড়া, হাতও একটু বাঁকা, গ্রামদেশে তো হাড় জোড়া দেওয়ার ডাক্তার ছিল না, গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার পট্টি বেঁধে ছেড়ে দিত। ভাঙা হাড় বাঁকা হয়ে জোড়া লেগে যেত।

ঠাকুরঝি আছাড় খেয়েছেন শুনে পড়া ভণ্ডুল হয়ে গেল। মনোজ, সরোজ, পুতুল তিন ভাই-বোন যথাক্রমে ভূগোল, অঙ্ক, ইতিহাস ফেলে দৌড়ে উঠে এল। দুঃখবাবু উবু হয়ে বসে মন দিয়ে অঙ্ক কষছিলেন। অনেকক্ষণ বাদে টের পেলেন যে, সামনে ছাত্রছাত্রীরা কেউ নেই।

ভারী বিরক্ত হয়ে তিনি তখন গানের মাস্টারমশাই গণেশ ঘোষালের ঘরে গেলেন দুটো গল্প করতে। গিয়ে দেখেন, সেখানেও এক গোলমাল।

গণেশবাবু আত্মহত্যা করবেন বলে চালের বিমের সঙ্গে একটা মোটা দড়ির ফাঁস ঝুলিয়ে দড়িটা টেনেটুনে দেখছেন।

দুঃখবাবু বললেন, “এ কী?”

দৃশ্য দেখে দুঃখহরণবাবু চমকে উঠলেন না। মাসের মধ্যে দু-তিনবার গণেশ ঘোষাল আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকেন। দুঃখবাবু দড়িটা দেখে বললেন, “ভাল বাঁধা হয়নি।”

গণেশবাবু ফাঁসটা ধরে একটু ফুল খেয়ে বলেন, “না, দিব্যি শক্ত হয়েছে।“

দুঃখবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “দড়িটাও বেশ পুরনো, মাঝখানে ফেঁসে বেরিয়ে আছে। ফাঁস গলায় দিয়ে ঝুলবার সময়ে যদি দড়ি ছিঁড়ে যায় তো পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে।”

গণেশবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ভাঙে ভাঙুক। ভারী তো তুচ্ছ হাত-পা। মরতে গেলে হাত-পায়ের চিন্তা করলে চলে না মশাই।”

দুঃখবাবু ভেবে চিন্তে বলেন, “সে অবশ্য ঠিক। দড়িটা কি গোয়াল থেকে আনলেন নাকি?”

গণেশবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “হ্যাঁ। গরুর গলা থেকে খুলে এনেছি। বদমাশ গরুটা ঢুসিয়ে দিতে এসেছিল, কোনওক্রমে বেরিয়ে এসে দরজার ঝাঁপটা টেনে দিয়েছিলাম ভাগ্যিস।”

দুঃখবাবু চেয়ারে পা তুলে বসে বললেন, “এই সকালবেলাতেই মরতে চাইছেন কেন? সকালবেলাটা সুইসাইড করার পক্ষে ভাল না। হুটহাট লোকজন এসে পড়তে পারে। এসব গভীর রাতে করতে হয়, যখন কেউ এসে বাঁচাতে পারবে না।”

“ঃ।” বলে গণেশবাবু দুঃখবাবুর দিকে একটু কটমট করে চেয়ে থেকে বললেন, “গভীর রাত পর্যন্ত আমি জেগে থাকতে পারি না। এত ঘুম পায় যে, মরা-টরার কথা মনেই থাকে না।”

“আজকে কী হয়েছিল যে, মরতে যাচ্ছেন?”

গণেশবাবু মুখখানা ভার করে চোখ ছলছলিয়ে বললেন, “আবার কী! সেই সুরে ভুল। সকালে বসে হংসধ্বনি রাগটার ওপর একটু ঘষামাজা করছিলাম, পরপর দুবার তালে লয়ে ভুল হয়ে গেল। কালু মিশিরের শিষ্য আমি, আমার ভুল হওয়ার মানে তো পৃথিবীতে প্রলয় হয়ে যাওয়া। গুরুজি তো আজ প্রায় ত্রিশ বছর হল দেহ রক্ষা করেছেন, তবু যখন সকালে রেওয়াজ করতে বসি তখন যেদিন ঠিকঠাক সুরে-লয়ে-তালে গাই সেদিন নির্ঘাত শুনতে পাই অনেক দূর থেকে যেন মৃদু একটা তবলায় ঠেকা দেওয়ার শব্দ আসছে। গায়ে কাঁটা দেয় মশাই, পরিষ্কার বুঝতে পারি স্বর্গে বসে গুরুজি আমার গান শুনছেন, আর তবলার ঠেকা দিয়ে দিয়ে সম আর ফাঁক দেখিয়ে দিচ্ছেন। কখনও কখনও তারিফ করে ‘কেয়াবাত’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।”

“ওরে বাবা, দুঃখবাবু বলে ওঠেন। অবশ্য কথাটা তিনি গণেশবাবুর গুরুজির কথা শুনে বলেননি, আসলে তাঁকে এ সময়ে কুটুস করে একটা ছারপোকা কামড়েছিল। তিনি উবু হয়ে বসেই চেয়ারে ছারপোকা খুঁজতে লাগলেন।

গণেশবাবু চোখ মুছে বলেন, “জীবন তুচ্ছ, তালেই যদি ভুল হল, লয়ই যদি গোল পাকাল, তা হলে বেঁচে থেকে লাভ কী?”

ছারপোকা খুঁজতে খুঁজতে দুঃখবাবু বলেন, “কাজটা ভাল করেননি।”

“না না, বেশ করছি। আপনি আমাকে বাধা দেবেন না। মরে গুরুজির কাছে যাব, তিনি আমাকে মুখোমুখি পেয়ে পায়ের নাগরাটা দিয়ে আচ্ছাসে জুতোপেটা করবেন, তবে আমার শান্তি। একাজে আমাকে বাধা দেবেন না দুঃখবাবু।”

দুঃখবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, “কে বাধা দিচ্ছে! মরতে হয় মরুন, তা বলে গোয়াল থেকে দড়িটা আনা আপনার ঠিক হয়নি। একটু আগেই গোয়ালঘর থেকে চেঁচামেচি আসছিল, বোধহয় আদ্যাশক্তিদেবী গোয়ালে গোবর আনতে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে ছাড়া গরুটা তাঁকে বুঝি খুব টুসিয়ে দিয়েছে। ও গরুটা রামু ছাড়া কাউকে মানে না! এখন যদি সকলে গরুটা কে ছাড়ল তা খুঁজে দেখতে গিয়ে আপনার ঘরে এসে চোরাই দড়িটা পায় তো বড় লজ্জার কথা।”

গণেশবাবুর মুখটা শুকিয়ে গেল, বললেন, “তাই তো!”

“সব কিছুই ভেবেচিন্তে করতে হয়। গলায় দড়ি দেওয়ারও একটা ক্যালকুলেশন আছে। হু-হুঁ! পটেশ্বর ওঝা রেল লাইনে গলা দিতে গিয়েছিল তার বউয়ের সঙ্গে রাগারাগি করে। রাতে গিয়ে লাইনে গলা দিয়ে পড়ে রইল, কিন্তু গাড়ি আর আসে না। পটেশ্বরকে খাতির করতে গাড়ি তো আর আগেভাগে এসে পড়তে পারে না, তারও টাইম আছে। তা পটেশ্বর অপেক্ষা করতে করতে কখন লাইনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোরবেলা গাড়ি এল, কিন্তু অনেক দূর থেকেই ড্রাইভার সাহেব রেল লাইনে মানুষ শুয়ে আছে দেখে গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিনের কু দিল। সেই কু শুনে ঘুম ভাঙতেই পটেশ্বর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে ভাবল, যাক বাবা, মরা-টরা হয়ে গেছে। ব্যথাট্যথাও খুব একটা পেতে হয়নি। এই ভেবে সে ঘাড়ে হাত দিতে ঘাড়খানা আস্ত দেখে আরও খুশি হয়ে হয়ে গেল। ভাবল, মরার পর বোধহয় কাটা ঘাড় ফের জোড়া লেগে যায়। এই সময়ে ড্রাইভারসাহেব নেমে এসে পটেশ্বরকে এই মার কি সেই মার। বলে–রেল লাইনটা তোমার মামদোগিরির জায়গা? সেই মার খেয়ে পটেশ্বর পনেরো দিন হাসপাতালে ছিল। ক্যালকুলেশনের ভুলে তার মরাও হল না, বরং মার খেয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হল। তাই বলছিলাম।”

আদ্যশক্তিদেবী আছাড় খেয়েছেন শুনলে কেউ আজকাল আর অবাক হয় না। কেউ যদি কাউকে গিয়ে বলে, জানো, আদ্যাশক্তি দেবী আছাড় খেয়েছেন? তা হলে যাকে বলা হয় সে একটু অবাক হয়ে বলবে, হ্যাঁ, সে আর বলার কী? উনি তো প্রায়ই তো খেয়ে থাকেন। ওটাই ওঁর অভ্যাস, নেশা।

তবু কেউ যদি আছাড় খায়ই, সে আদশ্যক্তি দেবীই হোন বা আর যে কেউ হোক, নিয়ম হল লোজন গিয়ে তাকে ধরাধরি করে তুলবে। গোয়ালঘরের চেঁচামেচি শুনে তাই সবাই দৌড়ে গেল।

গিয়ে দেখে, গোয়ালঘরের এক কোণে যেখানে মনোজের কাকা বৈজ্ঞানিক এবং ব্যায়ামবীর হারাধন গোবর গ্যাস তৈরি করার জন্য বিশাল এক গর্তে গোবরের তাল জমিয়ে রেখে পচাচ্ছিল সেখানে আদ্যাশক্তিদেবীর অর্ধেক ডুবে আছে। তিনি নিঃশব্দে চেঁচাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর মুখ নড়ছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।

রাখোবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “এ নিশ্চয়ই হারিকেনের কাজ।”

বুড়ি ঝি কিরমিরিয়ার অভ্যাস হল, বাড়িতে কোনওরকম ঘটনা ঘটলেই সে বিলাপ করে কাঁদতে বসবে। রাখোবাবু যদি মনোজকে বকেন তো কিরমিরিয়া কাঁদতে বসে। পুতুলের ড্রইং-এর খাতা হারালেও কারও কিছু নয়, কিরমিরিয়া বিলাপ করতে বসল–ও বাবাগো, খখাঁকির খাতাটা কোথায় গেল গো? খোঁকির এখন কী হবে গো! ইস্কুলের দিদিমণি এখন খোঁকিকে বকবে গো! সারাদিন তার বিলাপের জ্বালায় সবাই অস্থির। এখন বাড়িতে যাই ঘটুক, কিরমিরিয়াকে কেউ কিছু খবর দেয় না।
 
প্রায় দুদিন কিরমিরিয়া বিলাপ করেনি। বিলাপ না করলে তার পেট ফেঁপে যায়, খিদে নষ্ট হয়ে মুখে অরুচি হয়। রোগাও হয়ে যায় সে। দুদিন বাদে আজ জবর ঘটনা দেখে কিরমিরিয়া গিয়ে গোবরে অর্ধেক ডুবে-থাকা আদ্যাশক্তি দেবীর মুখের সামনে উবু হয়ে বসে মনের সুখে কেঁদেকেটে বিলাপ করতে লাগল, “ও ঠাকুরঝি গো, এত জায়গা থাকতে তুমি কেন গোবরে গিয়ে পড়লে গো! উঠোনে পড়লে না, পুকুরে পড়লে না, ছাদ থেকে পড়লে, গোবরে গিয়ে পড়লে গো! এখন তোমারই বা কী হবে, গোবরেই বা কী হবে গো?”

খবর পেয়ে পাড়ার লোকজনও সব এসে জুটেছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে শ্রুতিধর ঘোষ। শ্রুতিবাবুর এক অভ্যাস, কিছু দেখলে বা শুনলে তাঁর আর-একটা কিছু মনে পড়ে যায়। কিন্তু ঠিক মনে পড়ে বলেও বলা যায় না। কী যেন একটা মনে আসি-আসি করে, কিন্তু আসে না। যেমন একবার দুঃখবাবুর পেটের ব্যথা হওয়ায় তিনি এসে বললেন, “পেটের ব্যথার তিনটে খুব ভাল ওষুধ আমি জানি।”

“কী বলুন তো!” দুঃখবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে বলেন।

তখন অনেকক্ষণ চিন্তা করে শুতিবাবু বললেন, “একটা হল গিয়ে ইয়ে, মানে ওই আর কী!”

রাখোবাবু পাশেই ছিলেন, বললেন, “আর দুটো?”

শুতিবাবু আবার চিন্তা করে বললেন, “আর একটা যেন কী! আর তৃতীয় ওষুধটার নাম ভুলে গেছি।”

তবু সবসময়েই শুতিবাবুর কী যেন মনে-পড়ি-পড়ি করে, এই যেন এক্ষুনি মনে পড়ে যাবে, প্রায় এসে গেছে মাথায়।

সেই শুতিবাবু আদ্যাশক্তির অবস্থা দেখে বললেন, “গোবরে..গোবরে…কী যেন?”

তার ভাইপো ফচকে ফটিক বলল, “গোবরে পদ্মফুল?”

“না, না। গোবরে আর একটা কী যেন!”

“গুবরে পোকা।”

“দুর ফাজিল।” সুতিবাবু রেগে যান। তারপর রাখোবাবুর দিকে চেয়ে বলেন, “ব্যাপারটা কী হল মশাই? গোবরে পিসিমা কেন?”

রাখোবাবু খুব ভেবেচিন্তে বলেন, “আমরাও তাই ভেবে মরছি। তবে মনে হয় এটা হারিকেনের কাজ।”

“হারিকেন!” বলতে গিয়েই শুতিবাবুর আবার কী যেন মনে আসি-আসি করে। ভাবতে ভাবতে বলেন, “হারি,হারি! হারি আপ কী-একটা কথা আছে না? তার মানে বলতে চাইছেন, হারি মানে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পিসিমার এই দশা! এখন প্রশ্ন হল কেন, কেন এই হারি! হারি কেন? তাই না?”

রাখোবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, “মোটই না। আমাদের বদমাশ গরুটার নাম হারিকেন। হারিকেন হচ্ছে একরকমের সামুদ্রিক ঝড়। ও বাচ্চা ছেলেও জানে। আমাদের গরুটা ঝড়ের মতো দৌড়য়, অঁতোয়, বেড়া ভাঙে, গাছ ওপড়ায় বলে ওর ওই নাম রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে সেই গরুটাই পিসিমাকে গুঁতিয়ে নিয়ে গোবরে ফেলেছে। কিন্তু গরুটা তো বেশ ভাল করে বাঁধা ছিল, একটু বাদে তাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে রঘু খোঁটা পুঁতে দিয়ে আসবে কথা ছিল। সেটা ছাড়া পেল কীভাবে?”

এক গাল হেসে শুতিবাবু বললেন, “ওই হল। হারিকেনের গুঁতোর ভয়ে হারি করতে গিয়ে তাড়াতাড়ি পিসিমা গোবরে পড়েছেন। কিন্তু গোবর নিয়ে কী একটা কথা আছে, কিছুতেই মনে পড়ছে না।”

এই বলে শুতিবাবু ভাবেন। ফটিক বলে, “যাঁড়ের গোবর।”

“দূর।“

“মাথায় গোবর।” ফটিক ফের বলে।

শ্রুতিবাবু তার দিকে কটমট করে তাকান।

ফটিক ফচকে হেসে বলে, “পালোয়ান গোবরবাবু?”

কিরমিরিয়া একটু কান্না থামিয়ে কথাবার্তা শুনে নিয়ে ফের ডুকরে ওঠে, “ও বাবা গো, হারিকেনটাই বা কোথায় গেল গো! সে যে এখনও ভাল করে সকালের জাবনা খায়নি গো! সে যে না খেয়ে খেয়ে ল্যাজে গোবরে হয়ে যাবে গো!”

“ওই!” শ্রুতিবাবু চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “ওই মনে পড়েছে। ল্যাজে গোবরে! হেঃ হেঃ, এ যে দেখছি পিসিমার একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা!”

আদ্যাশক্তিদেবী বুক সমান গোবরের গর্তের মধ্যে পোঁতা। ঘন গোবরের টালের ভিতর থেকে নিজে নিজে বেরিয়ে আসবেন সে সাধ্য নেই। ঘন মধুর মধ্যে পড়লে মাছি যেমন আটকে যায়, তাঁর অনেকটা সেই দশা। অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করায় গলা বসে গেছে, বাক্য বেরোচ্ছে না। তিনি দুহাত বাড়ির সবাইকে বলতে চাইছেন, “ওরে তোরা আমাকে টেনে তোল।”

কিন্তু সেকথায় কেউ কান দিচ্ছে না।

দুঃখবাবু আর গণেশবাবু এসে গোয়ালঘরে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গণেশবাবুর চাঁদরের তলায় গরুর দড়িটা সুকোনো আছে, কিন্তু সেটা বের করতে সাহস হচ্ছে না।

মনোজ দুঃখবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “মাস্টারমশাই গোবরের ইংরিজি কী?”

“কাউডাংগ।”

“আর পিসিমা হল আন্ট, না?”

“হ্যাঁ।”

“তা হলে গোবরে পিসিমা কেন, এর ইংরিজি হবে হোয়াই আন্ট ইজ ইন কাউডাংগ, না মাস্টারমশাই?”

“হুঁ।”

“ল্যাজে গোবরের ইংরিজি কী হবে মাস্টারমশাই?”

দুঃখবাবু বলতে পারলেন না। সন্তর্পণে একবার রাখোবাবুর দিকে তাকালেন। রাখোবাবু ভ্রূ কুঁচকে দুঃখবাবুর দিকেই চেয়ে ছিলেন। বললেন, “এরকম ছোটখাটো সব ঘটনার ভিতর দিয়ে শেখালে ছেলেদের শিক্ষা ভাল হয়। ল্যাজে গোবরের ইংরিজিটা ওকে শিখিয়ে দিন দুঃখবাবু।”

দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা চুলকোলেন। বললেন, “টেইল ইন কাউডাংগ। অ্যান্ড কাউডাংগ ইন টেইল।”
 
সারা উঠোনে ডালবাটা ছত্রখান হয়েছিল। এখানে সেখানে ডালবাটায় কাকের পায়ের ছাপ। এতক্ষণ সারা উঠোনে হুটোপাটা করে কাকটা পেঁপে গাছে বসে ঠোঁট দিয়ে তার গা পরিষ্কার করছিল।

বামাসুন্দরী হাতজোড় করে কাকটাকে প্রণাম করে বললেন, “যাই, ঠাকুলুঝি আজ আবার কী কাণ্ড বাধালে দেখে আসি। আছাড় খেতে পারেও বটে মানুষটা, আমাদের এত বয়স হল, এখনও তো অত আছাড় খেতে পারি না।”

সতীশ ভরদ্বাজ গম্ভীরভাবে বারান্দার চেয়ারে বসে পুজোর চালকলার পেতলের রেকাবিখানা টেবিলের ওপর রেখে খবরের কাগজটা পড়ছিলেন। তারপর শব্দ করে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন, “জিনিসপত্রের দাম ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে। এইরূপ বৃদ্ধি পাইলে গরিব মনুষ্যেরা কী করিয়া প্রাণধারণ করিবে, কাহার কাছে হাত পাতিবে? হ্যাঁ, ঠিকই তো, ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? ইহারা কী করিয়া ইয়ে করিবে?”


ঠাকুরমশাই একটু অন্যরকম করে কাগজ পড়েন। বেশ বসে জোরে জোরে খবর পড়ছেন, পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে তার ভিতরেই নানারকম মন্তব্য করতে থাকেন। শুনলে মনে হয় যেন ওসব কথাও কাগজে ছাপা আছে।


যেমন তিনি এখন পড়ছেন, “কালিচরণ সাধুকে পুলিশ দায়রায় সোপর্দ করিয়াছে। সে নাকি পঞ্চবর্ষীয়া এক বালিকার কান হইতে দুল ছিনাইয়া লইয়া…ইস, ছিঃ ছিঃ-বালিকাটির কান কাটিয়া প্রবল রক্তপাত হইতে থাকে…চামারটাকে জুতোপেটা করতে হয়।…দুই দলের খেলায় কেহই গোল করিতে পারে নাই–তা পারবে কেন, অপদার্থ সব। সিমলায় প্রচণ্ড তুষারপাত…উঃ ঊঃ ইঃ ইঃ, বরফ বড় ঠাণ্ডা রে বাপ! মুরগিহাটায় জোড়া খুন…ছুরিকাঘাতে..বাবারে, ছুরি যখন কচ্ করে শরীরে ঢোকে তখন না জানি কেমন লাগে!”


ঠিক এসময়ে ঝপাত করে কাকটা নেমে এল বারান্দার রেলিঙে। বসে ডাকল, কা?


ঠাকুরমশাই কাগজটা নামিয়ে ডবল পাওয়ারের চশমার ওপরের অংশটা দিয়ে কাকটাকে দেখে বললেন, “কা তব কাস্তা কন্তে পুত্রঃ? তোমার স্ত্রীই বা কোথায় ছেলেপুলেই বা কোথায়? পশুপাখির আত্মীয়স্বজন থাকে না। বড় হতভাগ্য হে তোমরা।” বলে খবরের কাগজটা ফের তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন “বর্ধমানে বড় কাকের উৎপাত বাড়িয়াছে। এই কাকগুলি কিছু অন্যরকম। সাধারণ কাক নয়। গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকিয়া ইহারা দিনে ডাকাতি করিতেছে…”

কাকটা ডাকল, ক্কঃ।

ঠাকুরমশাই ফের কাকটার দিকে চেয়ে বললেন, “কং? কে। তুমি? কোত্থেকে আসছ? বর্ধমান নয় তো? তোমার ভাব সাব ভাল ঠেকছে না হে! গচ্ছ, গচ্ছ।”

কাকটা একটু কাসির শব্দ করে বলল, “ক্যায়াও?”

“ঝোলালে। ক্যায়াওটা আবার কী?”

কাকটা এক লাফে টেবিলের ওপর চলে এল। তারপর চোখের সামনে, হাতের নাগালে বসে টাউ-টাউ করে চালকলা খেতে লাগল।

ঠাকুরশাই তেড়ে গিয়ে বললেন, “হুঁশ।”

কাকটাও চাল ঠুকরে দিতে এসে বলল, কবয়ঃ।”

সতীশ ভরদ্বাজ পিছিয়ে এলেন।

“কবয়ঃ?” ঠাকুরমশাই বললেন, “এ তো বিশুদ্ধ সংস্কৃত!”

“কয়।” কাকটা বলল।

ঠাকুরশাইয়ের হাত থেকে কাগজটা খসে পড়ে গেল। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন, এতক্ষণে ধরে যা হচ্ছে তা খুব সাধারণ ঘটনা নয়। বামাসুন্দরীকে ভয় খাওয়ানোর জন্য যা বানিয়ে বলেছিলেন তাই বুঝি সত্যি হল! তিনি হঠাৎ হাউ মাউ করে দৌড়ে গিয়ে উঠোনের ওপাশে বৈজ্ঞানিক হারাধনের ল্যাবরেটরিতে ঢুকে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সেখানে একটা উপুড় করা গামলার মতো কী-এক যন্ত্র, সেটা ছোঁয়ামাত্র ঠাকুরমশাইয়ের গা কাঁটা দিয়ে উঠল, মাথার চুল এমন কী টিকিটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল। শরীরে একটা শিরশির ভাব।


টেবিলের ওপাশ থেকে হারাধন গম্ভীরভাবে বলল, “সাকসেসফুল।”

“কী বাবা, কী সাকসেসফুল?”

“স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি। এতক্ষণ এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম।”

মনোজের মেজকাকা ভজহরি বাজার করার ব্যাপারে খুব পাকা লোক। সবাই বলে, ভজবাবুর মতো বাজাড় দুনিয়ায় দুটো নেই। বাজারের যত ব্যাপারী আর দোকানদার বাজাড় ভজহরিকে দেখলেই ভয় খায়। যে তে-এঁটে সবজিওলা সকাল থেকে ফুলকপির দর দেড় টাকার এক পয়সা নীচে নামায়নি, সে পর্যন্ত বাজাড় ভজবাবুকে দেখলে নাভাস হয়ে নিজে থেকেই ‘পাঁচসিকে’ বলে ফেলে। যে-সব দোকানদার গোলমেলে দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারা দিয়ে ওজন করে, তারা ভজবাজাড়র গন্ধ পেলেই সব সরিয়ে ফেলে ভালমানুষ সাজে। অবশ্য ভজবাবু কখনও দোকানদারের দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারায় মেপে জিনিস কেনেন না, তাঁর সঙ্গে সবসময়ে নিজস্ব দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারা থাকে। রান্নার ঠাকুর গুফো মিশির আর চাকর রঘু সেসব বাজারে বয়ে নিয়ে যায়।


ভজবাবুর বাজার করার কায়দা একটু অন্যরকম। সে কায়দাটা এমনই অদ্ভুত যে অন্য খদ্দেররা নিজেদের বাজার করা বন্ধ রেখে ভজবাজাড়র বাজার করা হাঁ করে দেখে।


যেমন আজ টমেটোওলা ভজবাবুকে দেখে খুব বিনয়ী হাসি হেসে এক গালের পান অন্য গালে নিয়ে আড়াই টাকার টমেটোর দাম ন সিকে চেয়ে বলল, “আপনি বলেই চার আনা ছেড়ে দিলাম।”

ভজবাবু নির্নিমেষলোচনে টমেটোওলার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। পাড়ার থিয়েটারে কেপুবাবু সিরাজদ্দৌলা সেজে মহম্মদী বেগ-এর হাতে ছোরা খেয়ে যেমনভাবে চেয়েছিলেন (সে-দৃশ্যে যে হাততালি পড়েছিল তা দু মাইল দূর থেকে শোনা যায়) ঠিক তেমনি চোখের দৃষ্টি ভজবাবুর। সেই চোখ দেখে টমেটোওলার রক্ত জল হয়ে যেতে লাগল। মিনমিন করে সে আরও দু আনা ছেড়ে বলল, “ঠিক আছে ভজবাবু, না হয় দু আনা কম দেবেন।”

ভজবাবু সে কথার উত্তর দিলেন না। তাঁর থমথমে মুখচোখ ক্রমে লাল হয়ে উঠেছিল। চোখ দুটো স্থির, নাকের পাটা কাঁপছে। এক পাশে বেগুন দর করতে করতে, অন্য পাশে পালং শাক থলিতে ভরতে ভরতে দুজন-চারজন করে লোক এগিয়ে এসে আশেপাশে দাঁড়িয়ে গেল। ভজবাবুর পার্ট দেখবে।

ভজবাবুর ঠোঁট কেঁপে উঠল, ফিসফিস করে প্রথমে বললেন, “মহাপাপ।”

কথা শোনার জন্য দু-চারজন কান এগিয়ে আনল। ভজবাবু এবার আর-একটু জোরে বলে উঠলেন, “মহাপাপ!” সেই গম্ভীর ধ্বনি শুনে টমেটোওলার মুখ শুকিয়ে গেল।

পরক্ষণেই ভজবাবু হঠাৎ দু হাত লাফিয়ে উঠে বিকট হুংকার ছাড়লেন, “মহাপাপ! মহাপাপ! মহাপাপ!”


যারা কান এগিয়ে এনেছিল, তারা এই বিকট শব্দে কান চেপে ধরে পাঁচ হাত করে পিছিয়ে গেল।

ভজবাবু লাফাচ্ছেন আর হুংকার দিচ্ছেন, “মহাপাপ! পৃথিবী রসাতলে যাবে।”

তারপর টমেটোওলার দিকে আঙুল তুলে চেঁচাতে লাগলেন, “তুইও রসাতলে যাবি। এখনও সময় আছে, বল ঠিক করে।”

টমেটোওলা নিথর হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ চোখে মুছে ধরা গলায় বলল, “সাত সিকে। দিন বাবু, আপনার দাঁড়িপাল্লা দিন।”

ভজবাবু সব জায়গায় এক কায়দা খাটান না। তা হলে আর বাজাড় হিসেবে তাঁর অত নাম-ডাক কিসের?

টমেটোওলাকে কাঁদিয়ে তিনি পালং শাক বেচতে-আসা একটা ছোট মেয়ের ঝুড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেয়েটার বয়স দশ বছর হবে। পান-খাওয়া রাঙা ঠোঁট চেপে খুব গম্ভীরমুখে নাকে নোলক দুলিয়ে বসে ছিল।

ভজবাবু তার সামনে উবু হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে ভারী মোলায়েম হেসে ছড়া কাটার মতো সুর করে বলতে লাগলেন, “ও খুকি, তুমি পান খেয়েস? বাঃ বাঃ, পান খেয়েস! নাকে নোলক মুখে পান, জয় জয় বলল জয় ভগবান।”

মেয়েটা ভয় পেয়ে খুব সন্দেহের চোখে ভজবাবুকে দেখতে থাকে।

ভজবাবু মাথা নেড়ে নেড়ে বলেন, “খুকি নোলক পরেসে, খুকি পান খেয়েসে। খুকি নোক পরেসে, খুকি পান খেয়েসে। পালং শাক কত করে গো খুকি?”

মেয়েটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “টাকা টাকা।”

ভজবাবু মুখখানা ভার করে বললেন, “পান খাওয়ার কথায় রাগ করলে খুকুমোনা? এমাঃ, রাগ করলে! পালং কখনও এক টাকা হয়?”

মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “বাবা বলে গেছে, এক টাকার কমে কাউকে বেচবি না।”

ভজবাবুর দুচোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। হাপুস চোখে কেঁদে ভজবাবু বললেন, “ও খুকি, তুই আমার ওপর

রাগ করলি শেষে। পান খাওয়ার কথা বললাম বলে রাগ করলি?”

কান্নাকাটি দেখে ছোট মেয়েটা ঘাবড়ে গিয়ে দিশেহারার মতো বলে ফেলে, তা আমি কী করব? বাবা বলে গেল যে।”

ভজবাবু চোখ মুছে ধরা-গলায় বলেন, “তুই বুঝি বাপের সব কথা শুনিস খুকি? চুরি করে তেঁতুল খাস না? নতুন জামার জন্য বায়না করিস না? কাজের সময়ে পালিয়ে খেলতে যাস না?”

মেয়েটা ফিরিক করে হেসে বলল, “আচ্ছা, বারো আনা করে দাও।”
 
Last edited:
মেছোবাজারের কানাই মাছওলা বড় ভয়ংকর লোক। সবাই জানে, কানাই দিনে মাছ বেচে, রাতে ডাকাতি করে। গুলিপাকানো বিশাল চেহারা তার, চোখ দুখানা সবসময়ে গাঁজাখোরের মতো লাল, খদ্দেরদের সঙ্গে ধমকধামক দিয়ে কথা বলে। আধমন একমন ওজনের বড় বড় মাছ হেলাফেলায় তুলে ভচাং ভচাং করে কেটে ফেলে লহমায়। বুকের পাটা না থাকলে কেউ কানাইয়ের সঙ্গে দরাদরি করতে যায় না।

কানাইয়ের দোকানে আজ মস্ত মস্ত কইমাছ। দূর থেকে ভজবাজাড়কে দেখেই কানাই তড়িঘড়ি কইমাছগুলোকে গামছা-চাপা দিয়ে রাখল। পনেরো টাকা দর দিয়ে রেখেছে, ভজবাবু দেখলেই দশ টাকায় নামিয়ে ফেলবে। তার চেয়ে চেপে রাখা ভাল।

কিন্তু কইমাছ চাপা কি সোজা! তারা লাফায়, হাঁটে, ছোটে। গামছায় চাপা কইমাছেরা গামছাটা ছেঁড়ার জোগাড় করে তুলল।

ভজবাবু এসে গম্ভীরমুখে বললেন, “গামছাটা কত দিয়ে কিনেছিলি?”

কানাই মাথা চুলকে বলে, “কত আর! তিন টাকা বোধ হয়।”

ভজবাবু তেমনি গম্ভীর মুখে বলেন, “মাছের দামের সঙ্গে গামছার দামটা যোগ করে বল কইমাছের দর কত।”

কানাই মুখখানা কাঁচুমাচু করে বলল, “ও মাছ বিক্রি হয়ে গেছে, তাই ঢেকে রেখেছি।”

“কে কিনেছে?” কানাই অন্যদিকে চেয়ে বলল, “দারোগাবাবু।”

এ সব চালাকি ভজবাবু জানেন, তাই একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “আমি তো থানার কাছ দিয়েই যাব। মাছগুলো দিয়ে দে বরং, পৌঁছে দিয়ে যাবোখন। দারোগাবাবু আবার নিশিকান্তপুরের ডাকাতির ব্যাপারে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন।”

কানাইয়ের মুখের চেহারা পালটে যায়। পনেরো টাকার মাছ সে তখন বারো টাকায় ছাড়তে রাজি। নিশিকান্তপুরের ডাকাতিটা নিয়ে হইচই করছে পুলিশ।

ওর মুখের চেহারা দেখে ভজবাবু বুঝতে পারলেন যে, কানাইকে এবার বাগে পাওয়া গেছে। জজ যখন আসামীর ফাঁসির হুকুম দেয়, তখন যেমন গম্ভীর করুণ মুখের ভাব করে, ঠিক তেমনি মুখ করে ভজবাবু কানাইয়ের দিকে চেয়ে আছেন। তা দেখে কানাইয়ের বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয়ে-ভয়ে বলে, “দারোগাবাবু বোধহয় মাছের কথা ভুলেই গেছেন। আপনি যখন বলছেন–”

ভজবাবু ইঙ্গিতে রঘু দাঁড়িপাল্লা আর খুঁফো মিশির বাটখারা বের করে ফেলেছে। ঠিক এসময়ে একটা বাধা পড়ল।

হয়েছে কী, গোয়েন্দা বরদাচরণ আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাগ্নে চাকুও বাজারে এসেছে। সবাই জানে, ভজবাবু বাজারে এলে সব জিনিস সস্তা হয়ে যায়। তাই ভজবাবুর পিছু পিছু বাজার করার জন্যে অনেকেই তক্কে তক্কে থাকে। যেই ভজবাবু আড়াই টাকার

মাল সাত সিকেতে কিনে নেন অমনি অন্য বাজাড়রা সেই দোকানিকে হেঁকে ধরে সব মাল সাত সিকে দিয়ে চিলু-চি করে কিনে নেয়। বরদাচরণও সেই দলের।

বরদাচরণ কইমাছ বড় ভালবাসেন। এবছর এখন পর্যন্ত কইমাছ খাওয়ার ভাগ্য তাঁর হয়নি। আজই প্রথম কানাই-মাছওলা কইমাছ নিয়ে বসেছে। অথচ বরদাবাবুর কিছু করারও নেই, কারণ বাজাড় ভজহরি মাছগুলিকে প্রায় গ্রেফতার করে ফেলেছেন।

তাই গোয়েন্দা বরদাচরণের মুখটা খুবই বিষণ্ণ হয়ে গেল।

ভাগ্নে চাকু ব্যাপারটা লক্ষ করে খানিক ভেবে নিয়ে মামার কানে কানে কী যেন একটু বুদ্ধি দিল। তখন মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল বরদাচরণের।

তিনি কাঁচুমাচু মুখ করে ভজবাবুর কাছে গিয়ে খুব কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “ভজহরিবাবু, একটু কথা ছিল।”


বাজার করার সময়ে ভজবাবু তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসেন না। ওস্তাদ কালোয়াত যেমন গানের সময়ে কেবল তবলচি বা তানপুরোওলা ছাড়া জগতের আর সব ভুলে যায়, ভজবাবুও বাজার করার সময়ে দোকানদার ছাড়া আর কাউকে মনে রাখতে চান না। বাজার করাটাও একটা আর্ট, আর আর্টের সময়ে কে ভ্যাজাল পছন্দ করে?

বিরক্ত ভজবাবু বলেন, “কথার আর সময় ছিল না? কইমাছগুলো, তুলছি, ঠিক এই সময়েই যত কথা!”

বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাগ করবেন না ভজবাবু। আপনার বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”

“অ্যাকসিডেন্ট!” ভজবাবুর হাত থেকে একটা মাছ লাফিয়ে পালিয়ে গেল। সেটাকে সাঁ করে ধরে ট্যাঁকে খুঁজে ফেলল কানাই। যা বাঁচানো যায়।

বরদাচরণ বিষণ্ণমুখে বললেন, “খুব খারাপ ধরনের অ্যাকসিডেন্ট। বাজারে আসবার পথে আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যখন আসছি তখন শুনি, ভিতরবাড়িতে তুমুল চেঁচামেচি হচ্ছে। বহু লোক ভিড় করেছে। আপনি একটু তাড়াতাড়ি চলে যান।”

ভজবাবু আর কইমাছের দিকে ফিরেও চাইলেন না। সর্বনাশ বলে চেঁচিয়ে উঠে বাড়িমুখো ছুটতে লাগলেন।

.

ভজবাবু বাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পড়েছেন তখন শুতিধর ঘোষ আর ফচকে-ফটিকের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। শ্রুতিবাবু একগাল হেসে ভজবাবুকে বললেন, “পড়ে গেছেন।”

হন্তদন্ত ভজবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মরে যায়নি তো?”

শুতিবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, “না বোধহয়।”

তখন ভজবাবুর মাথায় আর-একটা প্রশ্ন এল, উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “কে পড়েছে বলুন তো।”

“পিসিমা।”

খুব হতাশ হয়ে ভজবাবু বললেন, “ওঃ! তাই বলুন।”

শুতিবাবু খুব হেসেটেসে বললেন, “গণেশবাবু গরুর দড়ি চুরি করেছিলেন ফাঁসি যাওয়ার জন্য। ধরা পড়ে খুব নাকাল হচ্ছেন রাখোবাবুর কাছে। রাখোবাবু বলেছেন, এবার থেকে যেন গণেশবাবু ফাঁসি যাওয়ার জন্য নিয়মিত বাজার থেকে নতুন দড়ি আনিয়ে নেন।”

ভজবাবু বললেন, “আর কিছু হয়েছে?”

শুতিবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, “হয়েছে। কিন্তু কী যেন! ফটিক, কী যেন..ইলেকট্রিক দিয়ে কী যেন হল…!”

ফটিক বলল, “পুরুতমশাই শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ।” শুতিবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, “আর, দুঃখবাবুকে মনোজ ঠাকুরঝির ইংরিজি জিজ্ঞেস করেছিল, দুঃখবাবু পারেননি।”

“আর কিছু?”

“আরও চান?” শুতিবাবু ভারী অবাক হয়ে বলেন।

ফটিক বলে, “আরও একটা আছে।”

“কী যেন?” শুতিবাবু বলেন।

“সেই যে কাকটার কথা।” ফটিক মনে করিয়ে দিল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা কাক।”

ভজবাবু আর দাঁড়ান না, দৌড়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকেন।

এদিকে ততক্ষণে ঠাকুরঝিকে গোবর থেকে তুলে স্নান করানো হয়েছে। সতীশ ভরদ্বাজ জ্ঞান হয়ে উঠে বসে গরম দুধ খাচ্ছেন। দুঃখবাবু তাঁর ঘরে বসে ডিকশনারি খুলে প্রাণপণ খুঁজে ‘ঠাকুরঝি শব্দের ইংরিজি খুঁজে পাচ্ছেন না। সরোজ একবার সিস্টার-ইন-ল বলায় ভারী রেগে গিয়েছিলেন তার ওপর। গণেশবাবু নিজের ঘরে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছেন। রামু চশমা-চোখে হারিকেনকে খুঁজতে বেরিয়েছিল, খুব ঠাহর করে দেখে সে মাঠ থেকে হরশঙ্কর গয়লার একটা মোষকে ধরে এনে চুপিসাড়ে গোয়ালে বেঁধে রেখে এখন কদমগাছের তলায় বসে কাঁচা মুলো দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। রাখোবাবুর অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করে দেখেন, স্নানের আগে যখন গেঞ্জি ছেড়েছেন তখন সেই গেঞ্জির সঙ্গে গলার পৈতে খুলে গেছে। কিরমিরিয়া গেঞ্জি কেচে শুকোতে দেওয়ার সময়ে বাজে সুতো ভেবে সেটা কোথায় গুটলি পাকিয়ে ফেলে দিয়েছিল, বজ্জাত সেই কাকটা পৈতে মুখে নিয়ে পেঁপে গাছে গিয়ে বসে ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, পৈতেটা কাকের গলায় ঝুলছে। তাই দেখে মনোজের ঠাকুমা রেকাবিতে নৈবেদ্য সাজিয়ে পেঁপেতলায় রেখে প্রণাম করছেন। গলায় পৈতে না থাকায় রাখোবাবু কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে মুখ নেড়ে ভয়ংকর রাগারাগি করছেন, আর হাত-পা ছুড়ছেন। মুখের নানারকম ভঙ্গিতে কখনও ‘গাধা’ কখনও ‘গরু’, কখনও ‘বোকা’ শব্দগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
 
বাবা কখন কী বলছে তাই নিয়ে মনোজ, সরোজ আর পুতুল উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাজি ধরছে। যেমন, একবার রাখোবাবু মুখটা অ্যা-এর মতো করে আবার উ-এর মতো করায়

সরোজ বলল, “এখন বাবা ঘেউ করল।”

পুতুল বলে, “দূর! ও তো কুকুরের ডাক। বাবা বলল, ধ্যাততেরি।”

“মোটেই না।” মনোজ বলে, “বাবা ওভাবে ঢেকুর তোলে।”

রাখোবাবু আ করে একটা ই করলেন।

মনোজ বলল, “পাজি।”

পুতুল বলে, “উঁহু। হায় এ কী বলল বাবা।”

সরোজ বলল, “না। বাবা আমাদের বাড়ি থেকে বেরোতে বলছে।”

ব্যায়ামবীর এবং বৈজ্ঞানিক হারধন ভূতে বিশ্বাস করে না। বাড়িতে নানারকম চেঁচামেচি শুনে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে সব ব্যাপারটা ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করছিল। কিরমিরিয়া গিয়ে তার পা ধরে কাঁদতে বসল, “ও হারাদাদাবাবু গো, বাড়িতে এ-সব কী হল গো? একটা কাকভূত এসে বড়দাদাবাবুর পৈতে নিয়ে গেল গো। বড়দাদাবাবু কথা বলতে পারবে গো?”

হারাধন কাকটার দিকে চেয়ে বলল, “কাকভূত! কাকভূত! কথাটা কেমন চেনা-চেনা ঠেকছে! অনেকটা চাগম কিংবা লামড়োর মতো!”

এখন হয়েছে কী, হারাধন শুধু ব্যায়ামবীর নয়। সে ব্যায়াম জানে, কুস্তি, বকসিং, জুডো, কারাটে জানে। আবার বৈজ্ঞানিক হিসাবেও রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, বলবিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি সব কাজের কাজী। তার গবেষণাগারের পিছনে উদ্ভিদবিদ্যার নানারকম পরীক্ষা চালানোর একটা আলাদা বাগান আছে। সেখানে অনেকগুলো কিম্ভুত গাছ রয়েছে। তার মধ্যে একটা আছে চাগম গাছ, আর একটা লামড়ো। অর্ধেক ধান আর অর্ধেক গমের বীজকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জুড়ে দিয়ে একটা সংকর বীজ তৈরি করে সে তার নাম দিয়েছে চাগম। অর্ধেক লাউবিচির সঙ্গে অর্ধেক কুমড়োবিচি জুড়ে হয়েছে লামড়ো গাছের বীজ। চাগম আর লামড়ো দুটো বীজ থেকেই গাছ বেরিয়েছে বটে, তবে তাতে এখনও কোনও ফসল ধরেনি। চাগম বা লামড়ো কেমন হয় তা জানবার জন্য শহরসুন্ধু লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

হারাধনের পা ধরে কিরমিরিয়া বিলাপ করছে, “বাড়িতে কাকভূত থাকলে আমি মরে যাব গো। ও হারাদাদাবাবু, আমি মরে গেলে তোমার চাগম দিয়ে লামড়োর ঘণ্টা কে চেখে দেখবে গো?

হারাধন গম্ভীরভাবে কিরমিরিয়ার হাত থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের বাগানের দিকে চলে যেতে যেতে বলল, “ওটা কাকভূত নয় রে কিরমিরিয়া। ওটা হয় কাক, না হয় তো ভূত।”

সতীশ ভরদ্বাজ একটা সুস্থ হয়ে বসে রাখোবাবুর জন্য নতুন পৈতে গ্রন্থি দিচ্ছিলেন। শেষ গ্রন্থিটা দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বললেন, “ভূত।”

রাখোবাবু সতীশ ভরদ্বাজের হাত থেকে পৈতেটা কেড়ে নিয়ে ৩৮

গলায় পরেই বললেন, “কাক।”

সতীশ ভরদ্বাজ মাথা নেড়ে বললেন, “ভূত। ওকে আমি বিশুদ্ধ সংস্কৃত বলতে শুনেছি নিজের কানে।”

রাখোবাবু বললেন, “কাক। নোংরা, বজ্জাত, পাজি, ছুঁচো একটা কাক। নিজের চোখে দেখেছি।”

সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ভুল দেখেছেন।”

রাখোবাবু বললেন, “ভুল শুনেছেন।”

সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “না।”

রাখোবাবু বললেন, “আমারও ওই এক কথা। না।”

সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ওটা যে ভূত নয় তা প্রমাণ করতে পারেন?”

“করছি।” বলে রাখোবাবু পেল্লায় চেঁচিয়ে ডাকলেন, “মনোজ।”

মনোজ গুটিগুটি এগিয়ে বলল, “কী?”

“তোর গুলতিটা নিয়ে আয় তো। কয়েকটা বেশ ভারী দেখে পাথরও আনিস। কাকটার উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত।”

মনোজ দৌড়ে তার গুলতি আর কয়েকটা পাথর নিয়ে এল। রাখোবাবু বড়সড় একটা পাথর গুলতিকে ভরে টিপ করতে লাগলেন। মনোজের ঠাকুমা যে নৈবেদ্য রেখে গেছেন কাকটা উঠোনে নেমে এসে তা খাচ্ছিল। মনোজ, সোজ আর পুতুল বাবার হাতের টিপ দেখবে বলে দম বন্ধ করে আছে।

সরোজ বলল, “বাবা ঠিক লাগাবে।”

মনোজ বলল, “পারবে না।”

পুতুল বলল, “তিন বারে পারবে।”

ঠিক এই সময়ে পেঁপে গাছের পিছনের দেয়াল টপকে একটা টুপিওলা মুখ উঁকি মারল।

সরোজ মনোজ একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, “চাক্কুদা!”

রাখোবাবু কাকটাকে টিপ করতে করতে বিরক্ত হয়ে বললেন, “কাজের সময়ে বড় বিরক্ত করিস তোরা। আর এ কাকটাও অসম্ভব বজ্জাত। কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে বসছে না।”



চাকু খুব ভাল ফুটবল ক্রিকেট খেলে, জুড়ো জানে, বকসিং করে। ব্যায়াম আর প্যাঁচ শিখতে সে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যায়ামবীর হারাধনের কাছে আসে। তাকে যে লুকিয়ে আসতে হয় তার কারণ চাকুর মামা গোয়েন্দা বরদাচরণের সঙ্গে মনোজের কাকা হারাধনের একেবারেই সদ্ভাব নেই। হারাধন আর বরদাচরণ কেউ কাউকে দেখতে পারেন না।

হারাধনের নাম শুনলে বরদাচরণ বলেন, “বৈজ্ঞানিক? হুঁ!”

আশ্চর্য এই, বরদাচরণের নাম শুনলে হারাধনও অবিকল একই সুরে বলেন, “গোয়েন্দা! হুঁঃ!”

বরদাচরণও কুস্তি, বকসিং, জুডো ইত্যাদি নাকি ভালই জানেন। তবে এসব ব্যাপারে বরদা আর হারার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তার কোনও মীমাংসা হয়নি।

চাকু দেয়ালের ওপর মুখ তুলে বাড়ির ভিতরটা ভাল করে দেখে নিয়ে মুখে আঙুল পুরে দুটো অদ্ভুত শিস দিল। শিসের শব্দ হতে-না-হতেই দেয়ালের ওপর বরদাচরণের মুখখানা ভেসে উঠল এবার। তিনিও বাড়ির ভিতরটা দেখতে লাগলেন।

সরোজ মনোজ ফের চেঁচাল, “গোয়েন্দাকাকু!”

রাখোবাবু মনোজ ফের চেঁচাল, “গোয়েন্দাকাকু!”

রাখোবাবু চাকু বা বরদাচরণকে লক্ষই করেননি। তিনি অতি নিবিষ্ট মনে গুলতির তাকের মধ্যে কাকটাকে আনবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নচ্ছার কাকটা কিছুতেই স্থির থাকছে না, কেবল লাফিয়ে-লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সরোজ-মনোজের চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত রাখোবাবু বললেন, “আঃ, একটু চুপ করবি তোরা? কনসেনট্রেশন নষ্ট করে দিলে লোকে কী করে জরুরি কাজ করবে? যতক্ষণ কাকটার গায়ে না লাগছে ততক্ষণ আমি অফিস যাব না বলে মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছি।”

কাকমারা ভুলে গিয়ে সরোজ মনোজ পুতুল তখন হাঁ করে দেখছে, গোয়েন্দা বরদাচরণ আর চাকু দেয়ালের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে।

দুজনের দেয়াল টপকানো দেখে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাধারণত গোয়েন্দা বরদাচরণ কখনও সদরদরজা দিয়ে ঢোকেন না। তাতে নাকি গোয়েন্দার বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়, লোকে গোয়েন্দা বলে খাতির করে না। গোয়েন্দাদের আচার-আচরণে একটা রহস্যময়তা না থাকলে লোকে সেই গোয়েন্দাকে মানবেই বা কেন? গোয়েন্দারা কখনও সহজ পথে চলবেন না, সহজ পথে ভাববেন না, সহজ চোখে চাইবেন না। সব সময়ে এমন আচরণ করবেন যাতে লোকে চমকে, আঁতকে, ভয় খেয়ে বা ভিরমি খেয়ে যায়। তাই গোয়েন্দা বরদাচরণ বেশির ভাগ বাড়িতেই দেয়াল টপকে, জানালার শিক বেঁকিয়ে ঢোকেন। শোনা যায়, এক বাড়িতে নাকি সিঁধ কেটেও ঢুকেছিলেন।

তবে চেনাজানা লোকের বাড়ি না-হলে তিনি এতটা করেন না।

যাই হোক, বরদাচরণ দেয়ালের ওপর উঠে গলা থেকে ঝোলানো একটা বাইনোকুলার তুলে চোখে লাগিয়ে চারদিক দেখছিলেন। তাঁর সেই দেখা আবার দেখছিল সরোজ, মনোজ পুতুল, সতীশ ভরদ্বাজ। আর ঠিক সেই সময়ে স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাকুরঝি ভেজা পায়ে আর একবার পড়ি-পড়ি করেও সামলে গিয়ে দাঁড়িয়ে চাকু আর বরদাচরণকে দেখতে পেলেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top