What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কৃষ্ণপক্ষ -উপন্যাস (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
330
Messages
6,279
Credits
48,462
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
কৃষ্ণপক্ষ
হুমায়ূন আহমেদ


॥ ১ ॥
‘নোটটা বদলাইয়া দেন আফা, ছিড়া নোট।‘
অরুর গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কুড়ি টাকার একটা নোটই তার কাছে আছে। ছেড়া নোট বদলাবে কোত্থেকে? অরু গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করত বলল, কই দেখি নোটটা? রিকশাওয়ালার মুখে অহংকার মেশানো বিজয়ীর হাসি। ছেড়া নোটটা আবিষ্কার করে সে খুব খুশী। যেন সে ক্রিষ্টফার কলম্বাস। আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে।
অরু বলল, কই আমি তো ছেড়া দেখছি না।
রিকশাওয়ালা তচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, নজর দিয়া দেহেন।
অরু ‘নজর‘ দিয়ে দেখল। হ্যাঁ ছেড়া। ছিড়ে দুখণ্ড করা। স্কচ টেপ দিয়ে এত সাবধানে জোড়া লাগানো যে রিকশাওয়ালা ছাড়া অন্য কারো বোঝার উপায় নেই।
‘কি আফা বিশ্বাস হইল?‘
অরু ক্ষীণ গলায় বলল, শোন, আমার কাছে আর কোন টাকা নেই। এই একটাই নোট।
তুমি এক কাজ কর পুরোটাই নিয়ে যাও।
‘ছিড়া নোট নিয়া ফায়দা কি?‘
‘ফায়দা আছে। গুলিস্তানে ছেড়া নোট বদলে নেয়। দু‘টাকা বাটা রাখবে। কুড়ি টাকার বদলে তুমি পাবে আঠারো টাকা। দশ টাকা লাভ।‘
‘আমার লাভের দরকার নাই।‘
‘এখন আমি টাকা পাব কোথায়? বলেছি না আমার কাছে একটাই নোট!‘
‘টাকা পয়সা না নিয়া রিকশাতে উঠেন ক্যান?‘
‘ভুল করে উঠি। তুমি ভুল কর না? মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে প্লাস্টিকের পর্দা ছাড়া চলে আস না?‘
যুক্তি রিকশাওয়ালাকে কাবু করল না। সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। অরু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি মিনিট দশেক অপেক্ষা কর। তোমাকে ভাল নোট দেব। রিকশার সিটে বসে আরাম করে চা খাও।
ফ্লাক্সে করে এক ছেলে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করছে। অরু তাকে ডেকে বলল, তুমি এই রিকশাওয়ালাকে এক কাপ চা দাও। রিকশাওয়ালা খানিকটা হকচকিয়ে গেল। এই জাতীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি সে এর আগে হয় নি।
অরু ঘড়ি দেখল – চারটা সাত।
কাটায় কাটায় চারটার সময় তার আসার কথা, সে তাই এসেছে। মুহিবের খোঁজ নেই। সে মনে হয় আজও দেরি করবে। আজকের দিনটিতেও সে কি সময় মত আসবে না?
কুড়ি একুশ বছরের একটি মেয়ের জন্যে একা একা অপেক্ষা করা যে কি যন্ত্রনা তা ক‘জন জানে? সেজেগুজে একা দাড়িয়ে থাকা মেয়ের দিকে সবাই খানিকটা কৌতুহল, খানিকটা করুণা এবং খানিকটা তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়। বুড়োরা এমন ভঙ্গি করে যেন দেশ রসাতলে যাচ্ছে। সংসদ ভবনের এই রাস্তা এখন বলতে গেলে বুড়োদের দখলে। সকাল বিকাল এদের দেখা যায় হাঁটাহাঁটি করছে। স্বাস্থ্য রক্ষা। যে করেই হোক আরো কিছুদিন বাঁচতে হবে। সমাজের অনাচার দেখে নাক সিঁটকাতে হবে। কিছুতেই মরা চলবে না।
রিকশাওয়ালা চা খেতে খেতে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে অরুকে দেখছে। এও এক যন্ত্রনা। একজন কেউ তাকিয়ে থাকলে কিছুতেই স্বাভাবিক হওয়া যায় না। অরু আবার ঘড়ি দেখল – মাত্র পাঁচ মিনিট পার হয়েছে। সময় কি পুরোপুরি থেমে আছে? না ঘড়ি বন্ধ?
মুহিবকে এতক্ষণে দেখা গেল। লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটতে ছুটতে আসছে। কোন দিকে তাকাচ্ছে না। অরু ডাকল, এ্যাই। মুহিব থমকে দাঁড়াল। যেদিক থেকে শব্দ এসেছে সেদিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকাচ্ছে। কি যে অদ্ভূত কাণ্ডকারখানা! রাগে অরুর গা জ্বলে যাচ্ছে।

আজকের দিনে সে এমন বিশ্রী পোশাক পরে এল কি করে? কে বলেছে তাকে পাঞ্জাবী পরতে? কটকটে হলুদ রঙের সিল্কের পাঞ্জাবীতে তাকে যে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না। আয়না দিয়ে নিশ্চয়ই নিজেকে দেখেনি। অরু গলা উচিয়ে ডাকল, এ্যাই এ্যাই।
মুহিব তাকাল। এবং হেসে ফেলল। সেই হাসি এত সুন্দর যে অরু তার দেরি করে আসার অপরাধ অর্ধেক ক্ষমা করে দিল। কটকটে হলুদ পাজ্ঞাবী পরার অপরাধ অবশ্যি এখনো ক্ষমা করা যাচ্ছে না।
‘তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। ভেবে রেখেছিলাম আজ অন্তত এক ঘণ্টা আগে উপস্থিত হব। গাড়ি যোগাড় করতে গিয়ে …‘
‘কে তোমাকে গাড়ি যোগাড় করতে বলেছে?‘
‘কেউ বলেনি। ভাবলাম … ‘
‘কোথায় তোমার গাড়ি?‘
‘তেল নেবার জন্যে পেট্রল পাম্পে থেমেছিল – তারপরে আর স্টার্ট নিচ্ছে না।‘
‘ঐখান থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছ?‘
‘হুঁ। খুব দূর না। আসাদ গেট পেট্রল পাম্প।‘
‘ভাংতি টাকা আছে তোমার কাছে?‘
‘আছে।‘
‘দেখি আমাকে দশটা টাকা দাও। আর ঐ চাওয়ালা ছেলেটাকে এক কাপ চায়ের দাম দাও।‘
অরু টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে গেল। হাসিমুখে বলল, এই নাও দশ টাকা। আট টাকা রিকশা ভাড়া। দু‘টাকা ওয়েটিং চার্জ।
তার ইচ্ছা ছিল কিছু কঠিন কথা রিকশাওয়ালাকে বলে। বলা হল না। আজ একটা শুভ দিন। আজ তাদের বিয়ে। এই দিনে কঠিন কথা বলা সম্ভব না। তার একুশ বছর জীবনের অনেক কথাই সে পরবর্তী সময়ে মনে করতে পারবে না। কিন্তু আজকের দিনের সব কথা মনে
থাকবে। কি দরকার আজ ঝগড়া করার? বরং রিকশাওয়ালার নাম জিজ্ঞেস করা যাক। এই রিকশায় করেই না হয় কাজি অফিসে যাওয়া যাবে। যে রিকশায় করে তারা বিয়ে করতে গেল সেই রিকশায়ালার নাম জানা রইল। এটা মন্দ কি?
‘তোমার নাম কি?‘
‘আমারে জিগান?‘
‘হ্যাঁ।‘
‘আমার নাম সুরুজ মিয়া।‘
‘সুরুজ মিয়া, আমরা খিলগাঁও কাজি অফিসে যাব। আজ আমাদের বিয়ে। তুমি কি নিয়ে যাবে আমাদের?‘
রিকশাওয়ালা হ্যাঁ না কিছুই বলছে না। মনে হচ্ছে সে গভীর সমস্যায় পড়ে গেছে। এতক্ষণ যাকে তুমি তুমি করে বলছিল এখন অরু তাকে কি মনে করে যেন আপনি বলল, আপনি চিন্তা করে একটা ডিসিশানে আসুন। বেশি সময় নেবেন না। আমরা দেরি করতে পারব না।
অরু মুহিবের দিকে এগিয়ে গেল। মুহিব সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনছে। সে কখনো একটার বেশি কিনে না। আজ এক প্যাকেট কিনে ফেলল। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, অরু, তুমি কি তোমাদের বাড়ির কাউকে বিয়ের ব্যাপরে কিছু বলেছ?
অরু বলল, না। তবে রাত দশটা নাগাদ সবাই জেনে যাবে। একটা চিঠি লিখে খামের মুখ বন্ধ করে বড় আপার টেবিলে রেখে এসেছি। আপা বিয়েবাড়িতে গেছে। দশটা নাগাদ ফিরবে।
তারপর হৈ চৈ বেধে যাবে। বাবার স্ট্রোক না হলেই হয়।
‘কি লিখেছ চিঠিতে?‘
‘তিন লাইনের চিঠি – আজ বিয়ে করছি তাই লেখা -‘
‘কিভাবে লেখা – ল্যাংগুয়েজটা কি?‘
‘তিস লাইনে তো খুব কাব্যিক ল্যাংগুয়েজ হয় না। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।‘
‘কাকে বিয়ে করছ এইসব কিছু লেখনি তো?‘
‘না। শুধু লিখলাম – একটি বেকার এবং আপাতদৃষ্টিতে অপদার্থ যুবককে বিয়ে করছি। আমার মনে হচ্ছে না আমি কোন অপরাধ করছি। তার পরেও ক্ষমা প্রার্থনা করছি – আপা, তুমি বাবা-মা‘কে শান্ত করবে এবং বুঝিয়ে বলবে।‘
মুহিব শুকনো গলায় বলল, তোমার বাবা-মা‘র রিএ্যকশান কি হবে?
‘কি করে বলব কি হবে! তাদের কোন মেয়েতো এর আগে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে নি। এই প্রথম এবং এই শেষ। চল রওনা হওয়া যাক।‘
তারা রিকশায় উঠল। মুহিব বলল, হুড তুলে দেব?
‘না।‘
‘খারাপ লাগছে অরু?‘
‘খারাপও লাগছে না আবার ভালও লাগছে না। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। জ্বর জ্বর লাগছে। দেখ তো জ্বর কি-না?‘
‘না জ্বর নেই।‘
অরু হাসতে হাসতে বলল, জ্বর নেই বলে হাত সরিয়ে নিলে কেন? লজ্জা লাগছে?
‘হু, আজ কেন জানি অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি লজ্জা লাগছে। আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।‘
‘তাকিয়ে আছে তো বটেই। তাকিয়ে আছে তোমার হলুদ পাঞ্জাবীর জন্যে। তুমি দয়া করে আজ রাতেই এই পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ফেলবে।‘
‘আচ্ছা।‘
অরু হালকা গলায় বলল, বিয়ের পর আমরা যাব কোথায়?
‘বাসর কোথায় হবে এই কথা জিজ্ঞেস করছ?‘
অরু অস্পষ্ট স্বরে বলল, হুঁ।
‘বজলুর বাসায়।‘
‘বজলু কে?‘


‘আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, অতি ভাল ছেলে। গত বৎসর বিয়ে করেছে। তার বৌটা তার চেয়েও ভাল। ওরা একটা ঘর আমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে হুলস্থুল করেছে।‘
‘অপরিচিত কারো বাসায় উঠতে আমার ইচ্ছে করছে না।‘
‘ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তোমার মনে হবে এরা অপরিচিত না। খুবই পরিচিত। তা ছাড়া আমার আর কোন জায়গাও নেই যেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।‘
‘তুমি তোমার আপাকে সব খুলে বলবে বলেছিলে – বলেছ?‘
‘না।‘
‘বলনি কেন?‘
‘কাল বলব। আপাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।‘
‘উনি রাগ করবেন না?‘
‘পাগল, আপার রাগ করার ক্ষমতাই নেই।‘
‘আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছ, একটু আগেই না একটা খেলে।‘
‘টেনশন বোধ করছি।‘
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই যে তোমার পাশে বসেছি – শেষবারের মত বন্ধুর পাশে বসেছি। এরপর বসব – স্বামীর পাশে।
‘স্বামী কি বন্ধু না?‘
‘গল্প উপন্যাসে বন্ধু। বাস-বে না। বাস-বের স্বামীরা যতটা না বন্ধু তার চেয়েও বেশী অভিভাবক।‘
মুহিব গম্ভীর গলায় বলল, তুমি ভুল করছ অরু। আমি তোমার বন্ধুই থাকব।
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাকলে তো ভালই।
‘তোমার মনে কোন সন্দেহ আছে?‘
‘আছে। হুডটা তুলে দাও। আসলেই সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি তাকাচ্ছে আমাদের রিকশাওয়ালা। যেভাবে সে পেছন ফিরে ফিরে রিকশা চালাচ্ছে মনে হয় এ্যাকসিডেন্ট করবে।‘
মুহিব হুড তুলে দিল। অরু বলল, আজ কত তারিখ বল তো?
‘এগারোই ডিসেম্বর।‘
‘বাংলা কত?‘
‘জানি না বাংলা কত।‘
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজ আমাদের বিয়ে আর আজকের বাংলা তারিখটা তোমার জানার ইচ্ছা হল না? আজ ২৬শে অগ্রায়ণ।
‘ও আচ্ছা ২৬শে অগ্রায়ণ।‘
‘আর আমাদের রিকশাওয়ালার নাম হচ্ছে সুরুজ মিয়া। তার নামটাও মনে রাখা দরকার। তার রিকশায় করে বিয়ে করতে যাচ্ছি।‘
মুহিব কিছু বলল না। অরু বলল, ভাল করে দেখ তো জ্বর কি-না। এত খারাপ লাগছে কেন? মাথা ঘুরছে। ভুলে জরদা দিয়ে পান খেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে।
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ধর আর আধ ঘণ্টা।‘

অরু ঘড়িতে দেখল তাদের বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান শেষ হতে মাত্র ১৬ মিনিট লাগল। কাজী সাহেবের কাছে অনুষ্ঠানটা হয়ত খুব ‘বোরিং‘ লাগছে। তিনি কয়েকবার হাই তুললেন এবং যন্ত্রের মত বললেন, এইখানে সই করেন। তারিখ দেন। অরু গোটা গোটা করে লিখল, অরুণা চৌধুরী। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ। কি আশ্চর্য! কটকটে হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এখন তার স্বামী। এই জীবনের সবচে‘ কাছে মানুষ। কোন ভুল হয়নি তো? প্রচণ্ড বড় কোন ভুল! যে ভুল এই জীবনে আর শোধরানো যাবে না। অরুর পানির পিপাসা পেয়ে গেল।
কাজী সাহেবকে সে কি বলবে পানির কথা? না-কি মুহিবকে বলবে? মুহিবের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগছে। মুহিবের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে।
বজলু এগিয়ে এসে বলল, ভাবী, চলুন যাওয়া যাক।
ভাবী ডাকটা কি অদ্ভূত শোনাচ্ছে! গা শির শির করে। অরু নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরুল।
মুহিবের অন্য বন্ধুরা এখনো কেউ তাকে কিছু বলেনি। একজন শুধু তাকে বলেছে – কনগ্র্যাচুলেশনস ভাবী, বলে হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়েছে। ফুলটার দিকে তাকাতেও কেন জানি লজ্জা লাগছে। মুহিবকেও অন্য রকম লাগছে। ও আচ্ছা এখন বোঝা গেল – বাবু চুল
কেটেছেন। নতুন হেয়ার স্টাইল।
গোলাপ ফুল দেয়া মানুষটা বলল, কোথাও বসে এক কাপ চা কিংবা কোল্ড ড্রিংস খাওয়া যাক। কাছেই একটা ভালো কনফেকশনারী দোকান আছে। যাবে?
বজলু বলল, না না – স্ট্রেইট আমার বাসায় চল। কেক কেনা আছে। কেক কাটা হবে।
রেনুকে চা রেডি রাখতে বলেছি। গাড়িতে উঠ সবাই। গাড়িতে উঠ। মুহিব তুই ভাবীকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বস। আমরা সবাই পেছনে আছি।
অরুর প্রচণ্ড পানির পিপাসা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক গ্লাস পানি খেতে না পারলে সে মরে যাবে। বজলু নামের মানুষটার বাসায় তার যেতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। এমন কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে যেখানে একটা মানুষও নেই। খুব নির্জন কোন জায়গা, যেখানে শুধু সে এবং মুহিব থাকবে। আর কেউ থাকবে না। কেউ না।
 
বজলুর স্ত্রী রওশন আরাকেও অরুর পছন্দ হল না। মেয়েটা এক সেকেণ্ডের জন্যে না থেমে কথা বলে যাচ্ছে। ক্রমাগত কথা। ছোটাছুটিও করছে অকারণে। এই সামান্য সময়ে একটা গ্লাস ভেঙেছে, টেবিল ক্লথের উপর পায়েস ফেলে দিয়েছে। সামান্য চা দেয়া নিয়ে সে যে
কথাগুলি বলল তা হচ্ছে –
‘ও মা। এখনো চা দিলাম না। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বোধহয়। ঠাণ্ডা হলে ঠাণ্ডা চা খেতে হবে। আমি আবার গরম করতে পারব না। সারাক্ষণ চুলার পাশে বসে থাকলে গল্প করব কখন? চায়ে কিন্তু চিনি দেই নাই। যার যার দরকার নিয়ে নেবেন। সরি সরি, চিনি বোধ হয় দেয়া হয়েছে। আগে চেখে দেখবেন। এখানে ডায়াবেটিসওয়ালা কেউ আছে? থাকলে আওয়াজ দিন। আর শুনুন, চায়ের কাপে সিগারেট ফেললে ঐ চা জোর করে খাইয়ে দেব। মাই গড, চামুচ দেয়া হয়নি।‘
মুহিব অরুকে বলল, একটু বারান্দায় এসো তো।
অরু বারান্দায় এসে ক্লান্ত গলায় বলল, সবাই এত কথা বলছে – আমার একেবারে মাথা
ধরে গেছে।
‘এরা বেশিক্ষণ থাকবে না, চলে যাবে। তুমি কি কিছুক্ষণ রেস্ট নেবে? রেস্ট নিতে চাইলে পাশের ঘরে চলে যাও – তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে শরীর খারাপ করেছে।‘
‘প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আর পানির পিপাসা হচ্ছে। তিন গ্লাস পানি খেয়েছি তবু পিপাসা মিটছে না।‘
‘মাথা ধরা কি খুব বেশি?‘
‘হুঁ।‘
‘দাঁড়াও, প্যারাসিটামল এনে দিচ্ছি। শোন অরু, আমাকে ঘণ্টা খানিকের জন্যে একটু বাইরে যেতে হবে।‘
অরু হকচকিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় বলল, কেন?
‘আমার দুলাভাই বলে রেখেছেন যেন ঠিক সাড়ে সাতটায় অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর কথা তো তোমাকে বলেছি – দেখা না করলে – স্ট্রেইট বলবে, বের হয়ে যাও।‘
অরু দুঃখিত গলায় বলল, আজকের দিনটা তুমি আলাদা রাখতে পারলে না? বলতে পারলে না যে তোমার কাজ আছে?
মুহিব অস্পষ্ট স্বরে বলল, না অরু বলতে পারি নি। দুলাভাইকে এটা বলা সম্ভব না। তাছাড়া আমার ক্ষীণ সন্দেহ কি জান? চাকরির কোন ব্যাপার। উনি হয়ত কিছু ব্যবস্থা করেছেন। ইচ্ছা করলে তো তিনি পারেন। তুমি ঘণ্টা খানিক থাক, আমি চলে আসব।
‘এই বাড়িতে আমার এক সেকেণ্ডও থাকতে ইচ্ছা করছে না। তোমার বন্ধু পত্নীকে আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।‘
‘ও কিন্তু খুব ভাল মেয়ে অরু। কথা বেশি বলে। কিন্তু মেয়ে চমৎকার। আমার একটা জেনারেল অবজারভেশন কি জান? যারা কথা বেশি বলে তারা মানুষ ভাল হয়। যাও, তুমি ভেতরে গিয়ে বস। এক ঘণ্টার বেশি আমি এক সেকেণ্ডও দেরি করব না। অনেস্ট।‘
‘এক ঘণ্টার বেশি আমাকে যদি এই বাড়িতে থাকতে হয় – আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব – ঐ মহিলাটিকে আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।‘
কথা শেষ হবার আগেই বারান্দায় রওশন আরাকে দেখা গেল। সে চেঁচিয়ে বলল, কাজকারবার এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল? সারা রাত তো ভাই পড়েই আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাল বাসাবাসি না করলে হয় না?
অরুর অসহ্য বোধ হলেও সে হাসার ভঙ্গি করল। এই মহিলা কিছুক্ষণ আগে তাকে
ভয়ঙ্কর গা-জ্বালা ধরানোর মত কিছু কথা বলেছেন। অরুর ইচ্ছা করছিল গলা চেপে ধরতে।
রওশন আরা ভাল মানুষের মত তাকে ডেকে পাশের ঘরে নিয়ে গেছে। গায়ে হাত রেখে কথা বলা শুরু করেছে –
‘এই দেখ ভাই তোমাদের বাসর ঘর। পছন্দ হয় কি না দেখ।‘
অরুর পছন্দ হল। ঘরটা আসলেই সুন্দর করে সাজানো। বালিশের ওয়ার এবং বিছানার চাদর হালকা গোলাপী। গোলাপী চাদরে বেলী ফুল এবং গোলাপ দিয়ে নানা রকমের নকশা করা। খাটের পাশে সাইড টেবিলে ফুলদানি ভরতি গোলাপ। ঘরের অন্য প্রানে- একটা টেবিলে পানির জগ এবং গ্লাশ। একটা ফ্লাক্স এবং চায়ের কাপও দেখা যাচ্ছে। ঘরের চার কোণায় চারটা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে।
‘অরু ভাই শোন, প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছি। বাসররাতে ঘর কখনো অন্ধকার করতে নেই। এই জন্যেই প্রদীপ। প্রদীপ নেভাবে না। ভয়ের কিচ্ছু নেই, তোমরা কি করছ বা করছ না আমরা দেখতে আসব না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে – ফ্লাক্সে চা আছে, টিফিন বক্সে কেক বিসকিট এবং লাড্ডু আছে। গল্প করতে করতে রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ক্ষিধে পেয়ে যাবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমাদের কি হয়েছে শোন – এমন ক্ষিধে পেয়ে গেল। হিহি-হি। পেটের ক্ষিধে কি আর চুমু খেলে মিটে? কি ভাই ঠিক না? তোমাদের জন্যে এই কারণেই সব খাবার-দাবার দিয়ে দিয়েছি। সবচে‘ ইম্পর্টেন্ট জিনিস রেখেছি তোষকের নিচে। ইম্পর্টেন্ট জিনিসটা কি বল তো?
‘জানি না।‘
‘বিয়ের রাতেই তুমি নিশ্চয়ই প্রেগনেন্ট হতে চাও না? যাতে না হতে হয় সেই ব্যবস্থা। এটাও ভাই আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। এখন তুমি আমাকে অসভ্য ভাবছ। পরে আমাকে থ্যাংস দেবে। বুঝলে?‘
অরু কোন কথা বলেনি। কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। মুহিব যে এক ঘণ্টা থাকবে না সেই এক ঘণ্টা তার কি করে কাটবে ভেবেই অস্থির লাগছে। তাছাড়া মাথা ধরাটা বাড়ছে। নির্ঘাৎ জ্বর এসে গেছে। বমি বমি ভাবও হচ্ছে।

মুহিব তার দুলাভাই ইস্ট এশিয়াটিক লিমিটেড-এর জেনারেল ম্যানেজার শফিকুর রহমান সাহেবের ঘরের দরজা ফাঁক করে মাথা ঢুকাল।
শফিকুর রহমান বললেন, অপেক্ষা কর। আমি তোমাকে ডাকব। বলেই তিনি হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাতটা পাঁচ বাজে। মুহিবকে সাতটায় আসতে বলেছিলেন। সে পাঁচ মিনিট দেরি করে এসেছে।
শফিকুর রহমান সাহেবের এই অফিস ঘরটি বেশ জমকালো। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। বিশাল আকৃতির সেক্রেটেরিয়েট টেবিলে তিনটা টেলিফোন। একটা টেলিফোনের রঙ লাল। মনে হয় কোন মিনিস্টারের ঘর। এয়ার কুলার আছে। এই শীতেও এয়ার কুলার চালু করা। বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে। মাথার উপর খুব আসে- ফ্যান ঘুরছে। শফিকুর রহমান মাঝে মাঝেই রাত ন‘টা-দশটা পর্যন্ত অফিস ঘরে থাকেন।
তিনি মানুষটা ছোটখাট তবে তাঁকে দেখলেই মনে হয় ঈশ্বর এ-জাতীয় মানুষদের একজিকিউটিভ বস বানানোর জন্যে বিশেষ করে তৈরি করেছেন। তাঁদের গলার স্বর এয়ার কুলারের হাওয়ার মতই শীতল। মেজাজও শীতল, তবে সেই শীতল মেজাজের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকের রক্তও শীতল হয়ে যায়।
ঠিক সাতটা কুড়ি মিনিটের সময় শফিকুর রহমান বেল টিপলেন। মুহিব দরজা খুলে ঢুকল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাকে ডাকিনি, তুমি বস। যথাসময়ে ডাকব। বেয়ারাকে ডেকেছি চা দেবার জন্যে।
‘একটা কাজ ছিল দুলাভাই।‘
‘আমিও তোমাকে কাজেই ডেকেছি। অকাজে ডাকিনি। অপেক্ষা কর।‘
মুহিব ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়েটিং রুমে বসল।
শফিকুর রহমান তাঁকে কফি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে টেলিফোন নিয়ে বসলেন। বিদেশের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের জন্যে এই সময়টাই উত্তম। কিছু জরুরী ট্রানজেকশন টেলিফোনের মাধ্যমেই হবে। এল সি সংক্রান্ত কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে।
রাত আটটায় মুহিব আবার উঁকি দিল। ক্ষীণ গলায় ডাকল, দুলাভাই।
শফিকুর রহমান ফাইল দেখছিলেন। ফাইল থেকে চোখ তুললেন না। মুহিব বলল, আমার খুব জরুরী একটা কাজ ছিল।
শফিকুর রহমান শীতল গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে বলেই তোমাকে আসতে বলেছি। গসিপ করার জন্যে ডাকি নি। তারপরেও তুমি যদি মনে কর তোমার কাজ অসম্ভব জরুরী তাহলে চলে যেতে পার। তোমাকে বেঁধে রাখা হয়নি।
তিনি টেলিফোন তুলে ডায়াল করা শুরু করলেন। মুহিব ফিরে গেল আগের জায়গায়। তার মুখে থু থু জমতে শুরু করেছে, অসম্ভব রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে পুরো অফিসটা পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দিতে। তার সামনেই এসট্রে তবু সে ইচ্ছে করে কার্পেটে সিগারেটের ছাই ফেলছে।
অফিস এ্যাটেণ্ডেন্ট রফিক মিয়ার অবস্থাও তার মত। সাহেব অফিসে আছেন বলে সেও যেতে পারছে না। শুকনো মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। কিছু করার নেই বলেই বোধহয় মুহিবকে এসে জিজ্ঞেস করল, এই বৎসর শীত কেমন বুঝতেছেন স্যার? মুহিব কোন কথা বলল না যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছে – কাছে আস রফিক মিয়া, তোমার গালে একটা চড় দেই। চড় খেলে বুঝবে শীত কত প্রকার ও কি কি?
মুহিবের ডাক পড়ল রাত দশটায়। শফিকুর রহমান হাই তুলতে তুলতে বললেন, সরি, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। তোমাকে কি কফি দেয়া হয়েছে?
‘জ্বি।‘
‘দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোস।‘
মুহিব বসল। মনে মনে বলল, আপনাকে আমি কোন কালেই পছন্দ করি নি। ভবিষ্যতে কখনো করব, সেই সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। আপনি অতি কুৎসিত একটি প্রাণী। মাকড়শা দেখলে মানুষের যেমন গা ঘিন ঘিন করে – আপনাকে দেখলেও আমার অবিকল সেই রকম গা ঘিন ঘিন করে। এখন আপনাকে দেখাচ্ছে একটা মাকড়শার মত। মেয়ে মাকড়শা। যে পেটে ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
‘মুহিব।‘
‘জ্বি।‘
‘তোমাকে চিটাগাৎ যেতে হবে।‘
মুহিবের গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুক ধক ধক করতে লাগল। মনে হচ্ছে মাকড়শাটা এখন বলবে – আজ রাতেই যেতে হবে। তুর্ণা নিশীথায়।
মুহিব চাপা গলায় বলল, কখন যেতে হবে?
‘দি আর্লিয়ার, দি বেটার। ভোড়ের ট্রেনে যেতে পার। কিংবা দুপুরের দিকে যেতে পার। দুপুরে অফিসের একটা গাড়ি চিটাগাং যাবে। যেটা তুমি প্রেফার কর। তোমার জন্যে চাকরির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। কি চাকরি বেতন কত সব চিটাগাং গেলেই জানবে। টেলিফোনে কথা বলে রেখেছি। আজ দুপুরেই কনফার্ম করা হয়েছে। ছয় সাত হাজার টাকা বেতন হবার কথা। তারচে‘ বেশিও হতে পারে। সবচে‘ যেটা ভাল সেটা হচ্ছে – কোয়ার্টার আছে। যতদূর শুনেছি ভালো কোয়ার্টার। বিদেশে ট্রেনিং-এর সুযোগ পাবে। সব সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে অল্প সময়ে ভালো উনড়বতি করবে।‘
মুহিবের হৃৎপিণ্ড এমন লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসবে। গলার ফুটো ছোট বলে বেরুতে পারছে না। এটা স্বপড়ব দৃশ্য নয়তো? চেয়ারে বসে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে স্বপড়ব দৃশ্য খুব বাস-ব হয়। দুলাভাই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্বপড়ব দৃশ্য হলেও এই মানুষটাকে ধন্যবাদ সূচক কিছু বলা উচিত। মুহিব ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, ‘থ্যাংকস দুলাভাই।‘
‘আমাকে থ্যাংকস দেবার দরকার নেই। তুমি আমাকে পছন্দ কর না তা আমি জানি। আমিও যে তোমাকে পছন্দ করি তাও না। যাই হোক, কাজকর্ম ঠিকমত করবে। রেসপনসিবিলিটি নামক ব্যাপারটি আ্তস্থ করার চেষ্টা করবে। ঠিক আছে এখন তাহলে যাও।‘
মানুষটাকে এখন আর মাকড়শার মত লাগছে না – বরং সুন্দর লাগছে। সুন্দর। ঘর থেকে বেরুনোর সময় দরজায় ধাক্কা খেয়ে কপালের একটা অংশ ফুলে গেল। ব্যথা লাগছে। এটা তাহলে স্বপড়ব নয়। স্বপ্নে শারিরীক ব্যথা বোধ থাকে না।
 
Last edited:
মুহিব আশঙ্কা করছিল রাত এগারটায় সে যখন উপস্থিত হবে অরু অসম্ভব রাগ করবে। কেঁদে-কেঁটে একাকার করবে। সে-রকম কিছু হল না। অরু হাসিমুখে বলল, আমি ভাবলাম তুমি পালিয়ে গেছ, প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। এসো খেতে বসি। আদর্শ বাঙালী স্ত্রীদের মত না
খেয়ে বসে আছি।
মুহিব বলল, ওরা কোথায়?
অরু হাসতে হাসতে বলল, তুমি চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই তোমার অন্য বন্ধুরা চলে গেল। তারপর মজার একটা ব্যাপার হল – তোমার প্রিয় বন্ধু বজলু এবং রওশন আরা ভারী অকারণে তুমুল ঝগড়া শুরু করলেন। সে এক দেখার মত দৃশ্য। আমি হতভম্ব। এত অল্প সময়ে ঝগড়া ক্লাইমেক্সে চলে যেতে পারে তা আমার জানা ছিল না। রওশন আরা ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি কি নাইলনের দঁড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রেখেছি? গো এওয়ে। তুমি চলে গেলে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। তুমি আমার লাইফ হেল করে দিয়েছ। তারপরই ভাবী উল্কার বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তোমার বন্ধুকে বললাম, আপনি দেখছেন কি উনাকে আটকান।
বজলু সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আমি আটকাব কেন? আমার কিসের দায়? আপদ বিদেয় হয়েছে ভাল হয়েছে। তার আধ ঘণ্টা পরই বজলু সাহেবের মাথা ঠাণ্ডা হল। উনি নরম গলায় বললেন, আমার মিসটেক হয়েছে। খুবই খারাপ লাগছে। কি করা যায় বলুন তো? ও গেছে তার ভাইয়ের বাড়ি, নিয়ে আসি কি বলেন? আমি কিছু বলার আগেই উনিও উল্কাল মত বেরিয়ে গেলেন। সেই থেকে আমি একা বসে আছি।
‘সে কি! আর কেউ নেই?‘
‘একটা কাজের মেয়ে আছে। সে বলল, সপ্তাহে এই ঘটনা দু‘ থেকে তিনবার হয়। সাধারণত হয় সন্ধ্যার দিকে। বেগম-সাহেব তার ভাইয়ের বাসায় চলে যান। সাহেব যান তাঁর পিছু পিছু। রাত বারোটা-একটার দিকে ভাই গাড়ি করে দু‘জনকে পৌঁছে দিয়ে যান।‘
‘তার মানে কি এই যে এ-বাড়িতে আমরা এখন মাত্র দু‘জন?‘
‘কাজের মেয়েটি আছে।‘
‘সে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। কোন কাজকর্ম না থাকলে এরা অতি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে পারে।‘
‘অরু হাসতে হাসতে বলল, ও ঘুমুচ্ছে। দাঁড়াও ওকে ডেকে দিচ্ছি, খাবার গরম করুক।‘
‘ডাকতে হবে না। খাবার যা গরম করার তুমি কর। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ডিরেকশন দেব। তোমার মাথা ধরা সেরেছে?‘
‘হু। ঘর ফাঁকা হওয়া মাত্র মাথা ধরা চলে গেল।‘
অরু রানড়বাঘরে ঢুকল। অরুর পেছনে পেছনে গেল মুহিব। অরু থালা-বাসন, হাড়ি-কুড়ি এমনভাবে নাড়ছে যেন এই রানড়বাঘর তার দীর্ঘদিনের চেনা। তার নিজেরই যেন বাড়িঘর। মুহিব বলল, একটা থালায় খাবার গরম করে দাও – রানড়বাঘরে দাঁড়িয়েই খেয়ে ফেলি।
অরু বলল – একসেলেন্ট আইডিয়া।
‘মেনু কি?‘
‘পোলাও টোলাও করে হুলস্থুল করেছেন।‘
মুহিব বলল – নিজেরা বোধ হয় না খেয়ে আছে। অরু পে−টে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, বিয়ের রাতে আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব না। শুধু জানতে চাচ্ছি কি মনে করে তুমি এত দেরি করলে?
‘ইচ্ছে করে করিনি।‘
‘ইচ্ছে করে যে করনি তা অনুমান করতে পারছি। তোমার দুলাভাই তোমাকে আটকে ফেলেছিলেন, এই তো ব্যাপার? তুমি তার হাত থেকে বের হয়ে আসতে পারলে না। একটি রাতের জন্যে কি এই সাহস দেখানো যেত না?‘
মুহিব বলল, তুমি কিন্তু ঝগড়ার সুরে কথা বলা শুরু করেছে। আজ ঝগড়া করলে সারা জীবন ঝগড়া হবে। এসো আজ রাতটা হেসে হেসে পার করে দি। আমি এগারটা হাসির গল্প রেডি করে রেখেছি। শুনবে আর হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়বে। এগারটা গল্পের মধ্যে পাঁচটা ভদ্র আর দু‘টা হচ্ছে মিড নাই স্পেশাল। রাত বারোটার পর বলা যায়।
অরু বলল, খবরদার কোন অশ্লীল গল্প চলবে না। অশ্লীল গল্প বললে আমি কিন্তু খুব রাগ করব।
‘পৃথিবীর সবচে‘ মজার গল্পগুলি হচ্ছে অশ্লীল গল্প।‘
‘আমি পৃথিবীর সবচে‘ মজার গল্পগুলি শুনতে চাচ্ছি না। তুমি বরং কম মজার গল্পগুলি বল। এখুনি শুরু কর। তার আগে জানতে চাচ্ছি কপাল ফাটালে কি করে?
মুহিব বলল, দুঃখে মানুষের কপাল ফাটে আমারটা ফেটেছে আনন্দে। পরে তোমাকে গুছিয়ে বলব এখন শোন স্টোরি নাম্বার ওয়ান। স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন। শেরশাহ প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। এক ছাত্র তাই শুনে অবাক হয়ে বলল, সে কি স্যার! শেরশাহের আগে কি ঘোড়া ডাকতে পারত না?
অরু হাসতে হাসতে বিষম খেল। হাসির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে কাজের মেয়েটি উঠে এসেছে। সে দুজনকে রানড়বাঘরে দেখে বেশ অবাক হল। অরু বলল, এ্যাই শোন, তোমার তো খাওয়া হয়ে গেছে। তোমার ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়। থালা-বাসন কিচ্ছু ধুতে হবে না। আমি দরজা-টরজা খুব ভাল মত বন্ধ করে ঘুমুতে যাব।
মুহিব বলল, সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না – দ্বিতীয় গল্পটি শোন। রোগশয্যায় শায়িতা স্ত্রী কাঁদো কাঁদো গলায় স্বামীকে বলছে, আমি জানি আমি মারা গেলেই তুমি বাঁচ, তাই না?
স্বামী স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এমন নির্মম সত্য কথা এভাবে বলতে নেই লক্ষ্মী সোনা। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।
অরু এই গল্পে হাসল না। বিরক্ত স্বরে বলল, মেয়েদের ছোট করা হয় যেসব গল্পে সেসব শুনতে আমার ভাল লাগে না।
‘এই গল্পে কোথায় মেয়েদের ছোট করা হল?‘
‘ছোট করা হয়েছে, তুমি বুঝবে না।‘
‘কোথায় ছোট করা হয়েছে বুঝিয়ে বল। আমি একটা সহজ রসিকতা করলাম। এখানে মেয়েদের কোথায় ছোট করা হল -?‘
অরু বলল, আলাপ আলোচনা আবার কিন্তু ঝগড়ার দিকে টার্ন নিচ্ছে।
‘আমি মজার কিছু গল্প বলার চেষ্টা করছি। তুমি যদি সেগুলি ঝগড়ায় নিয়ে যাও আমি কি করব?‘
‘গল্প বলা বন্ধ করে চল ঘুমুতে যাই। অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে।‘
মুহিব বলল, আজ তো ঘুমুনোর কথা না। পৃথিবীতে এমন কোন স্বামী-স্ত্রী পাবে না যারা বাসর রাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।
অরু বলল, আমরা তাহলে হব ব্যাতিক্রম। আমরা বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ব। এক ঘুমে রাত কাবার করে দেব।
‘আমি তোমাকে এক সেকেণ্ডের জন্যেও ঘুমুতে দেব না। দরকার হলে গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেব।‘
‘দ্যাট রিমাণ্ডইস মি। শোবার ঘরে তুমি কিন্তু সিগারেট ধরাতে পারবে না। ফুলের গন্ধে ঘর ম ম করছে। তুমি সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর দুর্গন্ধ করে ফেলবে তা হতে দেব না। দয়া করে সিগারেট যা খাওয়ার এই রানড়বাঘরে খেয়ে যাও। আর গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে দাও। আমি এখন এটা পুড়াব।‘
‘সত্যি পুড়াবে?‘
‘হ্যাঁ সত্যি। খোল। এক্ষুণি খোল।‘
‘কি পাগলামী করছ।‘
‘কোন পাগলামী করছি না। যা বলছি সুস্থ মাথায় বলছি। আমি তোমার পাঞ্জাবী পুড়াবই। এটা হবে আমাদের জীবনের একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে – বাসর রাতে কি করেছে? আমি বলব, স্বামীর পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ছাই বানিয়েছি।‘
যে পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করেছি সেই পাঞ্জাবী আমি পুড়াতে দেব না। যতড়ব করে তুলে রাখব। আমার ছেলে এই পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করতে যাবে।
পাঞ্জাবী পুড়ানো হল না। তারা এক সঙ্গে শোবার ঘরে ঢুকল। অরু বলল, তুমি শুয়ে পড়, আমি শাড়ি পাল্টে আসছি। সিল্কের শাড়ি পড়ে আমি ঘুমুতে পারব না। রওশন আরা ভাবীর কাছ থেকে আমি একটা সুতি শাড়ি রেখে দিয়েছি।
মুহিব বলল, শাড়ি পাল্টে আসতে চাচ্ছ আস, কিন্তু খবর্দার ঘুমের নাম মুখে আনবে না।
সারা রাত জেগে থাকতে হবে।
‘আচ্ছা যাও সারা রাত জেগে থাকব।‘
‘হাই তুলতে পারবে না, এবং বলতে পারবে না যে ঘুম পাচ্ছে।‘
‘আচ্ছা বাবা যাও বলব না।‘
শাড়ি পাল্টে এসে অরু দেখে মুহিব ঘুমুচ্ছে। গাঢ় ঘুম। অরু তাকে জাগাল না। মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অসংখ্যবার বলল, আমি তোমাকে কতটুকু ভালবাসি তা তুমি কোন দিনও জানবে না। তোমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে আজ এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখি মেয়ে কেউ নেই। তার চোখে পানি এসে গেল।
ঘরের চার কোণায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। ফুলের গন্ধে বাতাস সুরভিত। শেষ রাতে আকাশে চাঁদও উঠল। প্রদীপের আলোর সঙ্গে চাঁদের আলো মাখামাখি হয়ে নতুন এক ধরনের আলো তৈরি হল। অরুর খুব ইচ্ছা করছে ঘুম ভাঙ্গিয়ে মুহিবকে এই অদ্ভূত আলো দেখায়। কিন্তু বেচারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আহা! বেচারা ঘুমাক। অরুর জেগে থাকার কথা, সে জেগে থাকবে।
 
Last edited:
॥ ২ ॥
শফিকুর রহমান বাড়ি ফিরলেন রাত সাড়ে দশটায়।
সাড়ে দশটা হচ্ছে তাঁর বাড়ি ফেরার শেষ লিমিট। এপার্টমেন্ট হাউস। এগারোটার সময় কলাপসেবল গেট বন্ধ হয়ে যায়। যারা গভীর রাতে বাড়ি ফেরে তাদের স্ত্রীদের চাবি হাতে বসে থাকতে হয়। শফিকুর রহমান তাঁর স্ত্রী জেবাকে এই ঝামেলা পোহাতে দেন না। তিনি আরো কিছু কাজ করেন যা স্ত্রীরা পছন্দ করেন, যেমন উঁচু গলায় জেবার সঙ্গে কখনো কথা বলেন না। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তাঁর কোন খুঁত খুতানি নেই। রানড়বা কেমন হল, ভাল না মন্দ তা নিয়ে কথা বলা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। রাতে শোবার আগে একটা সিগারেট খান, তাও বারান্দায়। ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার করেন না।
শফিকুর রহমান ঘরে ঢোকা মাত্র জেবা বলল, মুহিব সেই যে সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে এখনো ফিরে নি। খুব চিন্তা লাগছে।
তিনি কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বললেন, চিন্তা লাগার কি আছে। ওতো কচি খোকা নয়। কোন খোঁজ না দিয়ে সারাদিন বাইরে। আমার খুব অস্থির লাগছে।
শফিকুর রহমান বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। তিনি স্ত্রীর অস্থিরতা কমাতে পারতেন, বলতে পারতেন – ‘মুহিব ভালই আছে। দেখা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।‘ তা বললেন না। অকারণ অস্থিরতা তাঁর ভাল লাগে না। জেবার অনেক কিছুই তাঁর ভাল লাগে না। তা তিনি প্রকাশ
করেন না। তিনি ঝামেলা বিহীন সংসার পছন্দ করেন। অফিসে অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়। সংসার ঝামেলা শূন্য হওয়া সেই জন্যেই এত দরকার। নিজের বিরাট বাড়ি ছেড়ে তিনি এপার্টমেণ্ট হাউসে উঠে এসেছেন ঝামেলা কমানোর জন্যে। ছোট্ট সংসার, ছবির মত গোছানো এপার্টমেন্ট থাকবে। কাজের লোক বা বাড়তি লোকের যন্ত্রনা থাকবে না। বাড়তি মানুষের যন্ত্রনা তাঁকে বলতে গেলে প্রায় সারা জীবন সহ্য করতে হয়েছে। মুহিব আছে তাঁর বিয়ের পর থেকেই। নিজের বাড়িতে যখন ছিলেন মুহিবের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে নি। এখানে চোখে পড়ছে। তাঁর মেয়ে ‘সারা‘ কে নিয়ে সে যেসব আহলাদী করে তাও তাঁর পছন্দ নয়। পরশু রাতে অফিস
থেকে ফিরে দেখেন বারান্দায় মুহিব লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার সমস- শরীরে সাদা চাদর পেঁচানো। সারা বারান্দায় টেবিলে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে কাঁপছে।
তিনি বললেন, কি ব্যাপার সারা?
সারা বলল, মামা কুমীর সেজেছে। কি ভয়ংকর তাই না বাবা?
একজন বয়স্ক মানুষ বারান্দায় গড়াগড়ি খাচ্ছে – এই ধারণাটাই তার কাছে রুচিকর মনে হয় নি। তার উপর দশ বছরের একটা বাচ্চাকে ভয় দেখানোরও কোন মানে হয় না। শফিকুর রহমান বাথরুম থেকে বের হয়ে সরাসরি খাবার টেবিলে চলে গেলেন। চেয়ারে
বসতে বসতে বললেন. সারা খেয়েছে?
‘হ্যাঁ।‘
তিনি লক্ষ্য করলেন শুধু তাঁকেই পে−ট দেওয়া হয়েছে। জেবা খেতে বসেনি। ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা। দুপুরে তিনি বাসায় খান না। রাতে একবেলা খান। সঙ্গত কারণেই আশা করেন রাতে জেবা তাঁর সঙ্গে খেতে বসবে।
জেবা বলল, কি যে দুশ্চিন্তা লাগছে। সকালে হঠাৎ আমাকে বলল, আপা আমাকে কি তুমি…
জেবা কথা শেষ করল না কারণ তার মনে হল মানুষটা কিছু শুনছে না। জেবা বলল, আর এক চামচ ভাত দেই?
শফিকুর রহমান বললেন, আরেক চামচ ভাত লাগলে আমি নিয়ে নেব। তোমাকে দিতে হবে না।
খাওয়া শেষ করে তিনি মেয়েকে দেখতে গেলেন। মেয়েটার সঙ্গে খানিক্ষণ কথা বলতে পারলে ভাল লাগতো। কথা বলা যাবে না। সারা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। দশটার পর সে এক সেকেণ্ডও জেগে থাকতে পারে না।
শফিকুর রহমান ঘরে বসে বাতি জ্বালাতেই সারা উঠে বসল। কোমল গলায় বলল, কেমন আছ বাবা?
‘ভাল আছি মা। তুমি ঘুমাও নি?‘
‘উঁহু। ঘুম আসছে না।‘
‘দুপুরে ঘুমিয়েছিলে?‘
‘না।‘
মশারি তুলে শফিকুর রহমান বিছানায় বসলেন। সারা কেমন গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। মেয়েটা দেখতে তার মার মত সুন্দর হয় নি। তাঁর মত হয়েছে। চিবুক চোখ সবই তাঁর মত। গায়ের রঙও শ্যামলা। কি ক্ষতি ছিল মেয়েটা যদি তার মা‘র গায়ের রঙের খানিকটা পেত।
‘বাবা!‘
‘কি মা?‘
‘তুমি এত গম্ভীর কেন?‘
আমিতো সব সময়ই গম্ভীর। তুমি গম্ভীর কেন?
‘মামার জন্যে আমার মন খারাপ। মামা আসছে না কেন?‘
‘তোমার মামা একজন বয়স্ক মানুষ। সে যদি সারাদিন নাও আসে তা নিয়ে এত চিন্তার কিছু নেই। আসবে। তাছাড়া আজ রাতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।‘
‘ও।‘
‘ঘুমুতে যাও মা।‘
শফিকুর রহমান নিজের ঘরে চলে গেলেন। খানিকক্ষণ কাগজ পড়লেন। রাতে বারোটার দিকে ঘুমুতে যাবার আগে শেষ সিগারেট খাবার জন্যে বারান্দায় এসে দেখেন জেবা বসে আছে। হাতে কলাপসেবল গেটের চাবি। ভাইয়ের জন্যে প্রতীক্ষা। এখনো সে না খেয়ে অপেক্ষা করছে। শফিকুর রহমান স্ত্রীকে কিছুই বললেন না।
জেবা একা একা বসে আছে। বারান্দায় আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। আধো আলো, আধো আঁধারে একা একা বসে থাকতে অদ্ভুত লাগে। মুহিব আজ সকালে তার কাছে চারশ টাকা চেয়েছিল। সে দিতে পারেনি। সংসারের টাকা তার কাছে থাকে না। বেচারা কোনদিন
তার কাছে টাকা-পয়সা কিছু চায় নি। আজই চেয়েছিল – সে দিতে পারে নি। জেবার চোখ ভিজে উঠছে। এই ভাইটি তার বড়ই আদরের।
 
॥ ৩ ॥
রাগে “হাত কামড়াতে“ ইচ্ছা করছে। এই বাগধারা কার সৃষ্টি কে জানে। মুহিবের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এরচে‘ সঠিক বাগধারা বাংলা সাহিত্যে আর নেই। সত্যি সত্যি তার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে। চিটাগাং যাবার জন্যে তৈরি হয়ে সে ভোর আটটায় চলে এসেছে।
কারণ তার দুলাভাই মানুষটি অফিসে আসেন কাঁটায় কাঁটায় আটটায়। অফিসে এসে তিনি যেন দেখেন মুহিব উপস্থিত আছে। এই কারণেই মুহিব ছুটে এসেছে অরুর কাছ থেকে। ঠিকমত বিদায়ও নেয়া হয় নি। কেন সে চিটাগাং যাচ্ছে, কবে ফিরবে কিছুই বলা হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা সে অরুকে বাসায় একা ফেলে এসেছে। বজলু এবং তার স্ত্রী ফেরে নি। ওদের ব্যাপারটা কি সেই খোঁজও নেয়া হয়নি। চলে আসবার সময় গরম চায়ের কাপে ফু দিতে দিতে শুধু বলেছে, তোমার সঙ্গে দেখা হবে দু‘দিন পরে। এই দু‘দিন আমি কোথায় যাচ্ছি কি করছি কিছু জিজ্ঞেস করবে না।
অরু বলেছে, জিজ্ঞেস করব না। ফর গডস সেক এইভাবে চা খেও না। মুখ পুড়বে।
‘মুখ অলরেডি পুড়ে গেছে। উপায় নেই। সকাল আটটার আগে অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে। শোন অরু, আমি যদি পিরিচে ঢেলে চা-টা খাই তাহলে কি তোমার সুক্ষ্ম রুচিবোধ খুব আহত হবে?‘
‘হবে। তবে আজকের জন্যে অনুমতি দেয়া গেল। পিরিচে ঢেলেই খাও।‘
মুহিব পিরিচে চা ঢালতে ঢালতে বলল, কাল রাতের ব্যাপারটার জন্যে আমি দুঃখিত।
‘কোন ব্যাপার?‘
‘এত প−্যান প্রোগ্রাম করেও শেষটায় শুয়ে লম্বা ঘুম। বুঝলে অরু এত আরামের ঘুম আমি কোনদিন ঘুমাইনি। সরি, ভুল বললাম। আরেকবার ঘুমিয়েছিলাম। এস. এস. সি. পরীক্ষার রেজাল্টের পর। অংক খুব খারাপ হয়েছিল। ধরেই নিয়েছিলাম পাশ করব না। রেজাল্ট হবার পর দেখি সেকেণ্ড ডিভিশন। এমন ঘুম দিলাম। ঘুম ভেঙ্গেছে পরদিন সকাল দশটায়। আনন্দে এবং দুঃখে মানুষের না-কি ঘুম হয় না। আমার মেকানিজম সম্পূর্ণ উল্টো। আনন্দ এবং দুঃখ এই দুই ব্যাপারেই আমার ঘুম বেড়ে যায়। বাবার মৃত্যুর কথা কি তোমাকে বলেছি? বাবার শ্বাস কষ্ট শুরু হবার পর বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হল। ভয়াবহ অবস্থা। সবাই ছোটাছুটি করছে। মৃত্যুর আগে আগে বাবা কি মনে করে জানি আমাকে দেখতে চাইলেন। কানড়বাকাটি … হুলসুল’ । আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ আবিষ্কার করা হল – আমি হাসপাতালের বারান্দার বেঞ্চিতে শুয়ে মরার মত ঘুমুচ্ছি।
অরু বলল, ঘুমের মধ্যে তোমার কি কথা বলার অভ্যাস আছে?
‘আছে। কথা বলার অভ্যাস আছে, নাক ডাকার অভ্যাস আছে, বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাবার অভ্যাস আছে। আরেকটা অভ্যাস খুব ছোটবেলায় ছিল – তোমার সুক্ষ্ম রুচির কারণে বলতে পারছি না। অভয় দিলে বলি …‘
‘বলার দরকার নেই।‘
‘বুঝতে পারছ বোধ হয় জল ঘটিত ব্যাপার।‘
‘আহ্‌ চুপ কর তো। সাতটা একুশ বাজে।‘
‘কি সর্বনাশ!‘
‘এরকম ছটফট করবে না তো। চুপ করে বস। জলে ভেসে যাক তোমার এপয়েন্টমেন্ট। আই ডোণ্ট কেয়ার।‘
‘আচ্ছা যাও বসলাম।‘
‘এখন বল আমাকে বিয়ে করে তুমি কি সুখী হয়েছ?‘
মুহিব হাসতে হাসতে বলল, বিয়ে যে করেছি তাই বুঝতে পারছি না। এখনো তোমাকে প্রেমিকার মত লাগছে। স্ত্রীর মত লাগছে না।
‘কি করলে স্ত্রীর মত লাগবে?“
‘একটু ঝগড়া করতো।‘
মুহিব হাসছে। শব্দ করে হাসছে। অরুর মনে হল – এক সুন্দর করে একটা মানুষ কি ভাবে হাসে?
খুব যেদিন তাড়া থাকে সেদিন বেবিটেক্সি পাওয়া যায় না। যদিও পাওয়া যায় সেই বেবিটেক্সির স্টার্ট কিছুক্ষণ পর পর বন্ধ হয়ে যায় এবং সেদিন রাস্তায় সবচে‘ বেশি জাম থাকে।
মুহিবের বেলায় কোনটাই ঘটল না। সে কাঁটায় কাঁটায় আটটার সময় অফিসে উপস্থিত হল। সে বেবিটেক্সি থেকে নামার কিছুক্ষণ পরে এলেন শফিকুর রহমান। মুহিবকে যথা সময়ে উপস্থিত দেখে তিনি আননিন্দত হলেন কি-না বোঝা গেল না। শুকনো মুখে বললেন, আমার পি.এ-কে চিঠি টাইপ করতে দিয়েছি। ওর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে যাও।
‘জ্বি আচ্ছা।‘
‘একটা পিক-আপ যাবে চিটাগাং। ড্রাইভার এলেই রওনা হয়ে যাবে।‘
‘জ্বি আচ্ছা।‘
‘কাল রাতে কোথায় ছিলে? বাসায় ফেরনি কেন? তোমার আপা দুশ্চিন্তা করছিল। যেদিন বাসায় ফিরবে না বলে আসবে।‘
মুহিব তৃতীয়বারের মত বলল, জ্বি আচ্ছা।
‘তাকে একটা টেলিফোন করে জানাও যে তুমি ভাল আছ এবং চিটাগাং যাচ্ছ। কি কারণে যাচ্ছ তাও জানাতে পার। সে খুশী হবে।‘
মুহিব বাসায় টেলিফোন করল না। সবাই খানিকটা দুশ্চিন্তা ভোগ করুক। চাকরি হবার পর সে দেখা করবে। আপাকে সালাম করে বলবে – আপা তুমি হচ্ছ এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা। তোমার মত ভাল মেয়ে এই পৃথিবীতে আগে জন্মায়নি, ভবিষ্যতেও জন্মাবে না।
এই কথাগুলি আপাকে অনেকবার বলতে ইচ্ছা হয়েছে – কখনো বলা হয়নি। এই ধরণের নাটুকে কথা বলা মুশকিল। তাছাড়া নাটুকে কথা শুনে আপা হেসে ফেলে বলতে পারে – এক চড় খাবি।
পিক-আপের ড্রাইভার সকাল দশটায় এসে উপস্থিত হল। বিরস মুখে বলল, গাড়ির ব্রেকে গণ্ডগোল আছে। ব্রেক ঠিক না করে গাড়ি বের করা যাবে না।
মুহিব বলল, ব্রেক সারাতে কতক্ষণ লাগবে?
‘এই ধরেন এক ঘণ্টা। ওয়ার্কশপে না নিলে বুঝব না।‘
সে যদি বলত ঘণ্টা দুই লাগবে তাহলে বজলুর বাসা থেকে ঘুরে আসা যেত। অরু নিশ্চয়ই এখনো যায় নি।
 
মুহিব বলল, আমরা তাহলে এগারোটার দিকে রওনা হচ্ছি?
‘জ্বি।‘
এক ঘণ্টা সময় কাটানোই সমস্যা। আপাকে একটা টেলিফোন করলে অবশ্যি অনেকটা সময় কাটবে। আপা আধা ঘণ্টার আগে টেলিফোন ছাড়বে না। মুহিব শুধুমাত্র সময় কাটানোর জন্যেই টেলিফোন করল।
‘আপা?‘
জেবা টেলিফোনেই প্রচণ্ড ধমক দিল – কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি? নিচে কলাপসিবল গেট আটকে দেয়, আমি রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চাবি হাতে বসা…‘
‘একটা কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।‘
‘কিসের তোর এত রাজকার্য? তোর কাজতো একটাই – টো টো করে শহরে ঘোরা। কাল রাতে না এসে ভালো করেছিস। এলে শক্ত করে গালে চড় বসিয়ে দিতাম। কোথায় রাত কাটিয়েছিস?‘
‘আমার এক ফ্রেণ্ডের বাসায়।‘
‘একটা টেলিফোন কি সেখান থেকে করা যেতো না?‘
‘গরীব ফ্রেণ্ড আপা, ওর টেলিফোন নেই।‘
‘ওর নেই, অন্যদের তো আছে। যে কোন দোকানে গিয়ে দু‘টা টাকা দিলে টেলিফোন করতে দেয়।‘
‘একটা ফার্মেসী থেকে টেলিফোন করেছিলাম আপা। লাইন ছিল এনগেজড।‘
‘খবর্দার মিথ্যা বলবি না। তুই মিথ্যা কথা বললে আমি টের পাই।‘
‘আচ্ছা আপা যাও আর মিথ্যা বলব না। সত্যি কথাই বলছি – কাল বিয়ে করেছি আপা। মেয়ের নাম অরু। হ্যালো আপা, শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো?‘
অনেকক্ষণ পর জেবা বলল, তোর কথার ধরণে মনে হচ্ছে সত্যি বিয়ে করেছিস। আসলেই করেছিস?
‘হুঁ।‘
‘আমার গায়ে হাত দিয়ে বল।‘
‘তোমার গায়ে হাত দেব কি করে? তুমি পাঁচ মাইল দূরে বসে আছ।‘
‘বিয়ে তাহলে সত্যি করেছিস?‘
‘হুঁ।‘
‘কোর্টে?‘
কোর্টে না – কাজীর অফিসে।‘
‘আমাকে বললে কি আমি ব্যাবস্থা করে দিতাম না?‘
‘অবশ্যই দিতে, তবে দুলাভাই তাতে রাগ করতেন। আমি তাঁকে রাগাতে চাইনি।‘
‘আর আমি যে রাগ করলাম সেটা কিছু না?‘
‘আমার উপর তুমি রাগ করতে পারবে না। তোমার পক্ষে তা সম্ভব না।‘
‘সম্ভব না কেন?‘
‘কারণ এই পৃথিবীতে যত মেয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং ভবিষ্যতে যত মেয়ে জন্মগ্রহণ
করবে তুমি তাদের সবার উপরে।‘
‘আমাকে খুশি করার চেষ্টা করছিস?‘
‘তা করছি তবে সেই সঙ্গে সত্যি কথা বলছি।‘
‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই বিয়ে করেছিস।‘
‘আমার নিজেরো বিশ্বাস হচ্ছে না।‘
‘মেয়েটা দেখতে কেমন?‘
‘মোটামুটি।‘
‘মোটামুটি মানে?‘
‘মোটামুটি মানে অসম্ভব সুন্দর।‘
‘কালো না ফর্সা?‘
‘মুখটা খুব ফর্সা কিন্তু হাত দুটি সেই তুলনায় কাল। হাতে মনে হয় μিম ট্রিম ঘসে না।‘
‘হাইট কত?‘
‘কে জানে কত!‘
‘পাশাপাশি যখন দাঁড়াস তখন সে-কি তোর কান পর্যন্ত আসে?‘
‘আসে বোধহয়।‘
‘তাহলে পাঁচ ফুট তিন। ওজন কত?‘
‘আরে কি মুশকিল। আমি কি তাকে দাড়িপাল্লা দিয়ে মেপেছি?‘
‘মেয়েটা আছে কোথায় এখন?‘
‘কেন?‘
‘আমি দেখা করব। বাসায় নিয়ে আসব।‘
‘অসম্ভব আপা। মেয়ে গোপনে আমাকে বিয়ে করেছে। এটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে জানাজানি হয়েছে। ওদের বাড়িতে এখন কেয়ামত হচ্ছে।‘
‘হোক কেয়ামত। তুই ঠিকানা বল।‘
‘ঠিকানা বলতে পারব না আপা। টেলিফোন নাম্বার দিতে পারি। কিন্তু তোমার পায়ে পড়ছি, ওকে সামলে নিতে সুযোগ দাও। আজ টেলিফোন করবে না।‘
‘বেশ করব না। তুই বাসায় চলে আয়।‘
‘না আমি এখন বিদেয় হচ্ছি। তোমার সঙ্গে দেখা হবে পরশু। রাখি আপা।‘
‘রাখি মানে? টেলিফোন নাম্বার দে।‘
মুহিব টেলিফোন নাম্বার দিল। জেবা বলল, মেয়েটার মুখ লম্বা না গোল?‘
মুহিব বিরক্ত হয়ে বলল, মুখ লম্বা না গোল তা দিয়ে কি হবে?
‘দরকার আছে। গোল মুখের মেয়েরা ভাগ্যবতী হয়।‘
‘তোমার মুখ তো গোল। তুমি কি ভাগ্যবতী?
জেবা খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গোল মুখের মেয়েরা ভাগ্যবতী হয়। মাঝে মাঝে একসেপশন হয়। যখন একসেপশন হয় তখনকার অবস্থা ভয়াবহ …
‘আপা, আমি আর কথা বলতে পারব না। ড্রাইভার এসে গেছে। আমরা এক্ষুণি রওনা হব।‘
‘মেয়েটার গালে কি তিল আছে? ডান গালে?‘
‘বড় যন্ত্রনা করছ তুমি আপা।‘
‘যন্ত্রনা করছি কেন জানিস? আমি একবার স্বপ্নে দেখেছিলাম তোর বিয়ে হয়েছে গোল মুখের একটা মেয়ের সঙ্গে। সেই মেয়েটার ডানদিকের গালে তিল।‘
‘অরুর ডানদিকের গালে তিল আছে।‘
‘সত্যি বলছিস?‘
‘হ্যাঁ সত্যি। আপা আমি এখন যাই। ড্রাইভার ব্যাটা দুলাভাইয়ের মত কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে।‘
জেবা খিলখিল করে হেসে ফেলল।
মুহিব ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এখন রওনা হব না-কি ভাই?
ড্রাইভার বলল, না।
‘না কেন?‘
‘খাওয়া-দাওয়া করে স্টার্ট করব। চিন্তার কিছু নাই। উড়াইয়া নিয়া যাব।‘
‘ভাই আপনার নাম কি?‘
‘মহসিন।‘
‘মহসিন সাহেব, উড়ায়ে নেয়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে যাবেন।‘
‘যে-রকম বলবেন সে-রকম যাব। আপনারে একটা কথা বলি ভাই সাহেব, যদি কিছু মনে না করেন।‘
‘না কিছু মনে করব না, বলে ফেলুন।‘
‘আমার কয়েকজন আত্মীয় যাবে চিটাগাং। যদি অনুমতি দেন এরারে গাড়ির পিছনের সিটে বসায়ে নিয়ে যাই।‘
‘আমার দিক থেকে কোন অসুবিধা নেই। শুধু সত্যি কথাটা বলুন এরা আপনার আত্মীয় না-কি ভাড়ার বিনিময়ে কিছু প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাচ্ছেন?‘
মহসিন উত্তর দিল না। হাই তুলল। মুহিব বলল, প্যাসেঞ্জার কোথা থেকে তুলবেন?
‘সায়েদাবাদ। বাস স্টেশনের কাছে।‘
‘গাড়ি ভর্তি করে প্যাসেঞ্জার নিয়ে নিন, শুধু লক্ষ্য রাখবেন আমার বসার জন্য যেন জায়গা থাকে। গাড়িতে উঠেই ঘুম দেব। সারারাত ঘুমাইনি। ঘুমাতে ঘুমাতে এবং স্বপড়ব দেখতে দেখতে যাব।
ড্রাইভার হেসে ফেলল।
গাড়ি রওনা হল দুপুর একটায়। মুহিব বসেছে ড্রাইভারের পাশের সীটে। সীটটা ঢালু, বসে আরাম পাওয়া যাচ্ছে না। গাড়ি ভর্তি মানুষ। দুটি পরিবার মালামাল নিয়ে উঠেছে। হৈ চৈ, চেচামেচি হচ্ছে। সবার জায়গাও হচ্ছে না। ছ‘সাত বছরের একটা বালিকা μমাগত বলছে,
সামনে বসব, সামনে বসব। বাধ্য হয়ে মুহিবকে বলতে হল, আস সামনে আস। মেয়েটিকে কোলে নিয়ে মুহিবকে বসতে হয়েছে। মেয়েটি তার গলা জড়িয়ে বসেছে। কথাবার্তা এমনভাবে বলছে যেন মুহিব দীর্ঘদিনের পরিচিত।
‘কি নাম তোমার খুকী?‘
‘আমার নাম লীনা। আমি ক্লাশ টুতে পড়ি।‘
‘বাহ্‌।‘
‘আমরা এই রকম একটা গাড়ি কিনব।‘
‘এত বড় গাড়ি কিনবে?‘
‘এরচেয়েও বড় কিনব। লাল রঙ-এর।‘
‘খুব ভাল।‘
‘আব্বু কিনে দিবে। আব্বুর অনেক টাকা আছে।‘
পেছনের সিটে বসা লীনার আব্বু বিরক্ত হয়ে ধমক দিল, চুপ কর লীনা। বেশি কথা বলে। আব্বু টাকার গাছ পুতেছে।
লীনা সাময়িকভাবে চুপ করল। লীনার বাবা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার একটা সিগারেট খাবেন? বেনসন আছে।
মুহিব বলল, এখন ইচ্ছা করছে না।
‘যখন ইচ্ছা করে আমাকে বলবেন। লম্বা জার্নি, সিগারেট ছাড়া হয় না। আমি দশটা বেনসন কিনেছি হা-হা-হা। আর স্যার মেয়ে যদি বেশি বিরক্ত করে চড় দিবেন ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বিচ্ছু মেয়ে। সাথে নিয়ে বের হই না। বাধ্য হয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম। আমার ছোট শ্যালকের বিবাহ ছিল। পরিবার নিয়ে যেতে হল। তিন হাজার টাকা গচ্চা। হাত একেবারে খালি। স্যারের গাড়ি পাওয়ায় রক্ষা হয়েছে।‘
মুহিব লক্ষ্য করল লীনার বাবারও কথা বলার রোগ আছে। মেয়ে সম্ভবত বাবার কাছ থেকেই কথা বলার বিদ্যা আয়ত্ব করেছে।
‘আমার শ্যালক ব্যাংকে কাজ করে। আরব বাংলাদেশ ব্যাংক।‘
‘তাই না-কি?‘
‘জ্বি স্যার। আর মেয়ের বাড়ি মেহেরপুর। অবশ্যি এখন তারা ঢাকায় সেটলড্‌। মেয়ে আপনার এম.এ. পাশ।‘
‘খুবই ভাল।‘
‘লীনা ঘুমিয়ে পড়েছে না-কি একটু দেখেন তো স্যার। ঘুমিয়ে পড়লে মুখের লালায় সার্ট ভিজিয়ে দেবে। একটু কেয়ারফুল থাকবেন স্যার।‘
গাড়ি প্রায় উড়ে চলছে। মহসিন একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করছে। এখন পাল্লাপালি− চলছে একটা ট্রাকের সঙ্গে। ট্রাক কিছুতেই সাইড দিচ্ছে না। ট্রাকের পেছনে লেখা ‘মায়ের দোয়া‘।
 
॥ ৪ ॥
অরুদের বাড়ির নাম রূপ নিলয়।
দশ কাঠা জায়গা নিয়ে বেশ বড় বাড়ি। সামনে বাগান আছে। উল্লাসিত হবার মত বাগান না বরং বিরক্ত হবার মত বাগান। যে-কেউ এই বাগান দেখে ভুরু কুঁচকে বলবে এত সুন্দর জায়গাটাকে গর্ত-টর্ত খুঁড়ে এসব কি করেছে? আপাতদৃষ্টিতে যেগুলিকে গর্ত বলে মনে হচ্ছে
তার কোনটাই গর্ত নয় – জলাধার। অরুর বাবা জামিল সাহেব এইসব জলাধারের পরিকল্পনা করেছেন, যেখানে ফুটে থাকবে জলপদ্ম। একেকটা জলাধার ঘিরে থাকবে মিনি ফুল বাগান। বাড়ি ঢেকে রাখবে নীল পাতার বাগান বিলাসে। বিশেষ ধরনের আকাশী নীল রঙের বাগান বিলাসের চারা আনানো হল শ্রীলংকা থেকে। চার বছরের মাথায় পাতা বেরুলে দেখা গেল পাতার রঙ নীল নয় গোলাপী। জামিল সাহেব মালীকে ডেকে বললেন, গাছ তিনটা কেটে ফেল। অরু বলল, সে কি বাবা! এত বড় গাছ কেটে ফেলবে?
জামিল সাহেব ভারী গলায় বললেন, অবশ্যই কাটব। এ-জাতীয় গাছে বাংলাদেশ ভর্তি। নীল পাতা চেয়েছিলাম – এগুলি কি নীল?
‘এখন নীল না, পরে হয়ত নীল হবে।‘
জামিল সাহেব আগের চেয়েও ভারী গলায় বললেন, হয়ত শব্দটা আমি অপছন্দ করি। হয়ত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। ইয়েস অথবা নো। তুমি যদি বল এই গাছের পাতা অবশ্যই নীল হবে, আমি মালীকে কাটতে নিষেধ করব।
অরু চুপ করে গেল। তিনটা গাছই কেটে ফেলা হল।
জলপদ্মের বেলাতেও এই ব্যাপার। জলাধারে জলপদ্ম ফুটল না। বিষেষজ্ঞ হার্টিকালচারিস্ট বললেন, পানির গভীরতা কম বলেই পদ্ম ফুটছে না। আরো দু‘ফুট গভীর করে দিন। তাহলেই হবে।
জামিল সাহেব জলাধার আরো দু‘ফুট গভীর করলেন। পদ্ম ফুটল না। হার্টিকালচারারিস্টকে আবার ডেকে আনা হল। তিনি বললেন, বেশি গভীর হয়ে গেছে।
‘বেশী গভীর হয়েছে?‘
‘জ্বি, অবশ্যই বেশি হয়েছে।‘
‘জলপদ্মের বিষয়ে আপনি জানেন তো?‘
‘জানব না মানে? কি বলছেন আপনি!‘
‘আমার ধারণা আপনি একজন মহামূর্খ। জলপদ্ম কেন কোন পদ্ম সম্পর্কেই আপনি কিছু জানেন না। যেহেতু এটা মূর্খের দেশ সেহেতু করে খাচ্ছেন। আপনি দয়া করে বিদেয় হোন।‘
জলপদ্ম প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে গেল। জলাধারের চারপাশে মিনি বাগানের প্রোজেক্টও বাতিল। জামিল সাহেব এখন পুরো বাগান নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করছেন। চিন্তা-ভাবনা শেষ হয়নি বলে বাগান শুরু হয়নি। যেহেতু মালী একজন আছে – নিয়মিত বেতন নিচ্ছে, সেহেতু সে এলোমেলোভাবে কিছু গাছ লাগিয়েছে। বেশির ভাগই গোলাপ। গোলাপ জামিল সাহেবের অপছন্দের ফুল। কিন্তু তাঁর ছোট মেয়ে গোলাপ-পাগল বলে তিনি গাছগুলি এখন পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছেন।
জামিল সাহেবের বয়স পঁয়ষট্টি। স্বাস্থ্য শুধু যে ভাল তা না অতিরিক্ত রকমের ভাল। দারোগা হয়ে চাকরিতে ঢুকেছিলেন, ডিআইজি হয়ে রিটায়ার করেছেন। সারদা পুলিশ একাডেমীতে ট্রেনিং নিতে যাবার আগের দিন তাঁর বাবা নবীগঞ্জ হাই স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেড
মাস্টার মুত্তালেব সাহেব তাঁকে নিয়ে বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। সেখানে জামিল সাহেবের মায়ের কবর।
মুত্তালেব সাহেব বললেন, তুমি তোমার মায়ের কবর ছুঁয়ে প্রতীজ্ঞা কর যে চাকরি জীবন সৎপথে কাটাবে। এমন চাকরিতে ঢুকেছ যেখানে সৎ থাকা খুবই কঠিন। প্রতীজ্ঞা কর।
জামিল সাহেব বললেন, প্রতীজ্ঞা করার প্রয়োজন নেই।
‘জানি প্রয়োজন নেই। তবু কর।‘
তিনি প্রতীজ্ঞা করলেন। এই প্রতীজ্ঞা রিটায়ার করার দিন পর্যন্ত বহাল রেখেছেন। বেতনের প্রতিটি পয়সা হিসেব করে খরচ করেছেন। রিটায়ার করার পর জীবনের সমস- সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি করলেন। দোতালা করার ইচ্ছা ছিল। একতলা করতেই সব শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যিস সস্তার সময়ে দশ কাঠা জায়গা কেনা ছিল।
 
জামিল সাহেবের আর্থিক অবস্থা এখন মোটেই সুবিধার না। সঞ্চয় কিছু নেই। পেনশনের অর্ধেক বিক্রি করে দিয়েছেন বলে প্রতিমাসে যা পান তার পরিমান নগণ্য। জামিল সাহেবের স্ত্রী রাহেলা একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। এই টাকাটা সংসারে লাগে।
মোটামুটি অভিজাত এলাকায় একটি চমৎকার বাড়ি। বাড়ির সামনের বাগান এবং চব্বিশ ঘণ্টার একজন মালী দেখে এই পরিবারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। জামিল সাহেবের ছোট মেয়ে অরুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সেই বিয়ে কিভবে দেয়া যাবে তা জামিল সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না। তাঁর মেজাজ খুব খারাপ যাচ্ছে। তাঁর ভয়ংকর মেজাজে বাড়ির সবাই আতংকগ্রস-। কারণ মানুষটির এর আগে দু‘বার স্ট্রোক হয়েছে। তৃতীয়বারের ধাক্কা সইতে না পারারই কথা।
অরু রিকশা থেকে খুব ভয়ে ভয়ে নামল।
বাসায় কি হচ্ছে কে জানে। ভয়ংকর কিছু নিশ্চয়ই হচ্ছে, কিংবা হয়ে গেছে। বাবা খুব সম্ভব হাসপাতালে। মীরু তার ছোট বোনের গোপনে বিয়ে করার খবর বাবাকে দেবে আর তিনি স্বাভাবিক থাকবেন এই আশা দুরাশা মাত্র।
বাড়িতে কাল রাতে কি ঘটেছে তা অরু খুব ভাল কল্পনা করতে পারছে। আপা বিয়েবাড়ি থেকে ফিরল রাত ন‘টায়। মা‘র সঙ্গে গল্প-টল্প করে রাত দশটায় ঘুমুতে গেল। তখন তার হাতে চিঠি পড়ল। চিঠি পড়ার পর খানিকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার পর সে একটা বিকট চিৎকার দিল। মা ছুটে এসে বললেন, কি হয়েছে? সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কিছু না মা – ঘুমাও। মা বললেন, হাতে কার চিঠি?
মা চিঠি পড়লেন। বাবা পড়লেন। বাবার স্ট্রোক হল। তাঁকে নিয়ে দুপুর রাতে সবাই গেল হাসপাতালে। এখনো সবাই হাসপাতালে, কেউ ফিরেনি। এই কারণেই বাড়ি খালি। মালী মতি ভাইকেও দেখা যাচ্ছে না। সকালবেলা খুড়পি হাতে মতি ভাই সব সময়ই বাগানে থাকে। আজ কেন থাকবে না?
অরু গেট খুলে বাগানে ঢুকল। মতি ভাইকে দেখা যাচ্ছে। ঝাঝড়ি করে পানি নিয়ে আসছে। অরু ভয়ে ভয়ে বলল, মতি ভাই বাসার খবর সব ভাল?
মতি বলল, হ।
তার মানে সে কিছুই জানে না। মতিকে কিছু জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। বাগান ছাড়া সে অন্য কিছু জানে না। জানার আগ্রহও নেই। এ-বাড়ির একটা মানুষ মরে গেলে সে যতটা কষ্ট পাবে তারচে‘ অনেক বেশি কষ্ট পাবে একটা গোলাপ গাছ মরো গেলে।
‘মতি ভাই বাসায় কি কেউ নেই?‘
‘আছে। খালি আম্মা গেছে কলেজে।‘
‘বাবা আছেন?‘
‘হ।‘
তার মানে কি? চিঠি পড়েও বাবা নিজেকে সামলে নিয়েছেন? অপেক্ষা করছেন তার জন্যে? বিশ্রী অবস্থাটা এড়াবার জন্যে মা চলে গেছেন বাইরে?
অরু কলিং বেল টিপল। আজ কলিং বেলটাও যেন অন্য রকম করে বাজছে। কানড়বার মত শব্দ হচ্ছে।
দরজা খুললেন জামিল সাহেব। তাঁর হাতে খবরের কাগজ। তিনি মেয়েকে কিছু না বলে আগের জায়গায় ফিরে গেলেন। অরু ভয়ে ভয়ে বলল, কেমন আছ বাবা?
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, যেমন সব সময় থাকি তেমন আছি। ভাল থাকার মত কিছু ঘটেনি, আবার খারাপ থাকার মত কিছু ঘটে নি। আজকের কাগজ পড়েছিস?
‘না বাবা।‘
‘মন দিয়ে পড়।‘
‘কি আছে কাগজে?‘
‘কি আছে সেটা জানার জন্যেই তো পড়তে বলছি। নে কাগজটা হাতে করে নিয়ে যা।‘
কাগজ হাতে অরু বাড়ির ভেতর ঢুকল। বোঝাই যাচ্ছে বাবা এখনো কিছুই জানেন না। আপা তাকে বলেনি। বুদ্ধিমতীর মত চেপে গেছে। মীরু বারান্দায় মোড়ায় বসে ছেলেকে ডিমপোচ খাওয়াবার চেষ্টা করছে। চেষ্টার ফল হয়েছে ভয়াবহ। সারা মুখে, গায়ে, মেঝেতে ডিমের ছড়াছড়ি। মীরু বলল, তুই না বললি দুপুরের দিকে আসবি, এখন চলে এলি যে?
‘ভাল লাগছিল না। আপা তুমি কি চিঠিটা পড়েছ?‘
‘কোন চিঠি?‘
‘তোমার টেবিলের উপর একটা চিঠি ছিল না?‘
‘ছিল না-কি? কই দেখিনি তো। কার চিঠি?‘
জবাব না দিয়ে অরু মীরুর ঘরে ঢুকে গেল। চিঠি সরিয়ে ফেলতে হবে। দু‘এক দিন পরে জানালেও কোন ক্ষতি নেই। ঘুমে তার শরীর ভেঙ্গে আসছে। অরু ঠিক করল গরম পানি দিয়ে সে দীর্ঘ একটা শাওয়ার নেবে। তারপর পর পর দু‘কাপ চা খেয়ে টানা ঘুম দেবে। তার আগে অবশ্যি খবরের কাগজটা পড়ে ফেলা দরকার। বাবা জেরা করবেন।
‘কলম্বোয় একদিনের সার্ক শীর্ষ বৈঠক।‘
‘বাকেরগঞ্জ ৫ আসনে আজ ভোট। ত্রিমুখী লড়াই।‘
‘সোভিয়েত ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি ইয়েলৎসিনের দখলে।‘
‘৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করুন : স্কপ নেতৃবৃন্দ।‘
‘বগি লাইনচ্যুত। সাতজন যাত্রী আহত।‘
হেডিং পড়ার পর আর কিছু পড়তে ইচ্ছা করে না। হেডিং পড়তে গেলেই হাই ওঠে, খবর
পড়বে কি।
 
অরু ময়নার মাকে গরম পানি করতে বলে আবার বারান্দায় এল। আপা ডিম খাওয়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন আরেকটা ডিম পোচ দেখা যাচ্ছে। আবীরের মুখের সামনে চামচ ধরে মীরু বলছে – একটু হা কর বাবু। একটু হা কর। আম্মু তোমার লাল টুক টুক ছোট্ট জিভটা দেখতে চায়। আমার বাবুর মত সুন্দর জিভ এই পৃথিবীতে আর কারোরই নেই।
অরু বলল, কেন যন্ত্রনা করছ আপা? ছেড়ে দাও না।
‘নিজের চোখে দেখছিস না স্বাসে’্যর হাল, তারপরেও বলছিস ছেড়ে দিতে?‘
‘জোর করে খাওয়াবে, তারপর বমি করে সবটা ফেলে দিবে।‘
‘ফেলুক। তোর বাচ্চাকে তুই তোর থিওরী মত মানুষ করিস।‘
‘খেতে চাচ্ছে না তবু তুমি জোর করে খাওয়াবে। তোমাকে কেউ জোর করে খাওয়ালে ভাল লাগত?‘
‘তুই আমার সামনে থেকে যা তো।‘
চিঠির ব্যাপারটা মীরু উল্লেখ করল না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বানিয়ে বানিয়ে এক গাদা কথা বলতে হত। অল্প কথায় মিথ্যা বলা যায় না। সামান্য মিথ্যাও অনেক ফেনিয়ে ফানিয়ে বলতে হয়।
মীরু বলল – কাল বিয়ে বাড়িতে দারুন মজার একটা ব্যাপার হয়েছে – আমি হাসতে হাসতে …
‘কি হয়েছে?‘
মীরু ‘কি হয়েছে‘ তা বলা বন্ধ রেখে বাবুকে ডিম খাওয়ানোয় ব্যস- হয়ে গেল। খাও লক্ষ্মীসোনা, খাও। হা কর। দেখি আমার বাবুর লাল টুকটুকে জিভটা?
অরু বলল, কাল বিয়ে বাড়িতে কি হয়েছিল? ওমাগো কি সুন্দর আমার বাবুর।
‘দেখছিস না বাবুকে খাওয়াচ্ছি, কেন বিরক্ত করছিস?‘
‘আচ্ছা আচ্ছা আর বিরক্ত করব না।‘
‘তুই বাবাকে এক কাপ চা দিয়ে আয় তো আমার কাছে চা চেয়েছিলেন, আমি বাবুর খাওয়া নিয়ে আটকা পড়ে গেলাম।‘
‘ছাড়া পাবে কখন?‘
‘কি জানি কখন। এতো হা করছে না।‘
‘ঠাশ করে একটা চড় দাও। চড় খেলে হা করবে। তখন মুখে ডিম ঢুকিয়ে আরেকটা চড় দাও। ভয় পেয়ে ডিম গিলে ফেলবে।‘
মীরু কঠিন চোখে তাকাল। অরু চলে গেল রানড়বাঘরে বাবার জন্যে চা বানাতে। ময়নার মা চা বানানোর কাজটা ভালই পারে কিন্তু তার চা বাবা মুখে দেবেন না। তার রানড়বাকরা খাবার খেতে কোন অসুবিধা নেই, শুধু চা খাওয়া যাবে না।
অরু বাবার সামনে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, বাবা চা। জামিল সাহেব চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে আছেন। তিনি চোখ খুললেন না। চোখ বন্ধ রেখেই বললেন – বোস মীরু।
‘মীরু না বাবা, আমি অরু।‘
‘তোকে তো চা বানাতে বলিনি। মীরুকে বলেছিলাম। দায়িত্ব ট্রান্সফার করে দেবার যে বদঅভ্যাস মীরুর হয়েছে তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী। তাকে যখন যা করতে বলি তখনি সে তা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এক সেকেণ্ড দেরি করে না। কাল তাকে বললাম সার্ট ইস্ত্রি করে দিতে। সে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, মা বাবার সার্ট ইস্ত্রি করে দাও।
‘বাবুকে নিয়ে ব্যস- থাকে।‘
‘তাই দেখছি। তুই বোস।‘
‘আমি এখন গোসল করব বাবা। পানি গরম করা হয়েছে, দেরি করলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।‘
‘গোসল ঠাণ্ডা পানি দিয়েই করতে হয়। শীতকালে গোসল করতে হয় বরফ শীতল পানি দিয়ে।‘
‘গরম কালে ফুটন্ত পানি দিয়ে?‘
‘গরম কালে লিউকওয়ার্ম পানি দিয়ে। খবরের কাগজ পড়তে বলেছিলাম, পড়েছিস?‘
‘হুঁ।‘
‘চোখে পড়ার মত কি পেয়েছিস?‘
‘তেমন কিছু পাইনি।‘
‘তোদের সমস্যা কি জানিস? তোদের সমস্যা হচ্ছে তোরা নিজেদের নিয়ে ব্যস-। আশে পাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই। উৎসাহও নেই। আজকের খবরের কাগজের ফ্রণ্ট পেজে একজন কুষ্ঠরোগীর কথা ছাপা হয়েছে। সে আসলে কুষ্ঠরোগী নয়। মেকাপ নিয়ে রোগী সাজত। ফার্মগেটের ওভারব্রীজে শুয়ে ভিক্ষা করত। সে ধরা পড়েছে। সমস্ত কাগজের ফ্রণ্ট পেজে তার ছবি, বিশাল নিউজ।‘
‘অরু ক্ষীণ স্বরে বলল, ভেরী ইন্টারেস্টিং।‘
জামিল সাহেব কড়া গলায় বললেন, মোটেই ইন্টারেস্টিং নয়। একজন অসহায় মানুষ রোগী সেজে মানুষকে ধোকা দিচ্ছে সেই খবর দেশের সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ হতে পারে না।‘
‘তা তো বটেই।‘
‘তুই কোন কিছু না বুঝেই বললি, তা তো বটেই।‘
‘গোসল করতে যাই বাবা। পানি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।‘
জামিল সাহেব জবাব দিলেন না। বিরক্ত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন।
 
অরু গোসল শেষ করে এসে দেখল, বাবুর ডিম ভক্ষণ পর্ব শেষ হয়েছে। এখন চলছে দুধপান পর্ব। দুধও ডিমের মত চামুচে করে খাওয়ানো হচ্ছে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অরু বলল, আপা একটা কাজ কর, ফুটবলের পাম্পার কিনে আন। তারপর সেই ফুটবল পাম্পারে দুধ ভরে বাবুর মুখে পাম্প করে দাও।
মীরু বলল, এইসব রসিকতা আমার ভাল লাগে না।
‘তোমার তো এখন পৃথিবীর কোন কিছুই ভাল লাগে না।‘
মীরু বলল, তুই সব সময় আমার পেছনে লাগিস না তো অরু, আমার অসহ্য লাগে। আর শোন আজ বিকেলে বাসায় থাকবি – আবরার সাহেব টেলিফোন করেছিলেন। কথার ভঙ্গি দেখে মনে হল বিকেলে আসবেন। ‘আসবেন বলেছেন?‘
‘সরাসরি বলেন নি। জিজ্ঞেস করছিলেন তোর কথা। আমি বললাম, বন্ধুর বাড়িতে গেছে। রাতে থাকবে। সেই বন্ধুর টেলিফোন আছে কি-না জিজ্ঞেস করছিলেন।‘
‘ও।‘
‘তুই আজ বিকেলে বাসায় থাকবি কি-না জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বলেছি থাকবে। আপনি আসতে চাইলে আসুন।‘
‘কি বললেন, আসবেন?‘
‘কিছু বলেন নি। আসবেন তো বটেই। তুই বিকেলে বাসায় থাকিস।‘
‘আমি বাসায়ই থাকব। যাব আর কোথায়?‘
গোসল করে এক কাপ গরম চা খাবার পর পর অরুর ঘুম কেটে গেল। একটু আগে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল – এখন ঘুম নেই। শরীরে কোন ক্লানি-বোধও নেই। সে ঠিক করল, আবরারকে লেখা চিঠিটা শেষ করে ফেলবে। আজ যদি আসেন তাঁকে হাতে হাতে দেবে। না এলে বাসায় গিয়ে দিয়ে আসবে। সে বিয়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বিয়ে হয়ে গেছে আর অপেক্ষা করার কিছু নেই।
অরু দীর্ঘ চিঠি লিখতে পারে না। অনেক কিছু লেখার জন্যে সে কাগজ কলম নিয়ে বসে, খানিকটা লেখার পর মনে হয় সব লেখা হয়ে গেল। সেই অর্থে আবরারকে লেখা তার চিঠিটা বেশ দীর্ঘ বলা যেতে পারে। চিঠিতে সম্বোধন নেই। কি সম্বোধন দেয়া যায় অনেক ভেবেও সে বের করতে পারেনি – সুজনেষু, প্রিয়জনেষু, শ্রদ্ধাষ্পদেষু … কোনটাই মানায় না। তাছাড়া চিঠি যতটুকু লিখে রেখেছে তার কাছে ভাল লাগেনি। মনে হয় পুরো ব্যাপারটা আরো সুন্দর করে আরো গুছিয়ে লেখা যেত।
“আপনি নিশ্চয়ই আমার এই দীর্ঘ চিঠি দেখে আঁৎকে উঠে ভাবছেন, ব্যাপারটা কি? হাতের লেখা দেখেও নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছেন। ভাবছেন এই মেয়েটার হাতের লেখা এত বাজে কেন। এ জীবনে আমি যত বকা খেয়েছি তার শতকরা ৬০ ভাগ হচ্ছে খারাপ হাতের লেখার জন্যে। এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি.-তে আমি কোনমতে টেনে টুনে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি। আমার ধারণা, আমি আরো ভাল করতাম। একজামিনাররা হয়ত আমার হাতের লেখা পড়তেই পারেন নি। আপনিও পড়তে পারছেন কি-না জানি না। পুরো চিঠি যদি না পড়েন তাহলে একজামিনারদের মত আপনিও আমাকে অনেক কম নম্বর দেবেন। দয়া করে পড়ুন।
বুধবার আমার বিয়ে হবার কথা, আজ সোমবার। বিয়ের এখনো দু‘দিন দেরি। আমি ঠিক করে রেখেছি চিঠি শেষ করে রাখব, আপনাকে দেব না। আপনাকে দেয়া হবে বিয়ের এক দিন পর। যেহেতেু আপনি এখন চিঠি পড়ছেন আপনি ধরে নিতে পারেন যেদিন বিয়ে হবার কথা ছিল সেদিনই হয়েছে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আপনার তুলনায় সে অতি নগন্য মানুষ, কমনার। এম.এ. পাশ করেছে – কোনমেতে একটা সেকেণ্ড ক্লাস জোগাড় করেছে। চাকরির সন্ধানে ঘুরছে শিকারী কুকুরের মত। যেখানেই তার মনে হয়েছে চাকরির সম্ভাবনা আছে সেখানেই সে উপস্থিত হয়েছে। আপনি শুনলে নিশ্চয়ই হাসবেন চাকরির জন্যে সে ময়মনসিংহের মদনের এক পীড় সাহেবের মাজার জিয়ারত করে এসেছে। এখনো কিছু হয়নি। চট করে যে হবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। দেশের চাকরি-বাকরি এখন পীর-ফকিরদের হাতে না। যাদের হাতে তারা মুহিবকে চাকরি দেবে না।
বুঝতেই পারছেন ওর নাম মুহিব। যেসব জিনিস মেয়েরা পছন্দ করে না তার সবই মুহিবের মধ্যে আছে। রুচি এক বস্থ তার নেই। এমন সব কুৎসিৎ রঙের শার্ট পরে সে আসে যা সুস্থ মাথায় কোন মানুষ কিনতে পারে না। একবার সে গোলাপী রঙের এক হাওয়াই শার্ট পরে
উপস্থিত হয়েছিল। সিল্কের শার্ট। সেকেণ্ড হেণ্ড মার্কেট থেকে তেত্রিশ টাকায় কিনেছে এবং তার ধারণা হয়েছে এত সুন্দর শার্ট সে তার জীবনে আগে কখনো পরে নি। সে অসম্ভব ভীরু। একদিন তাকে নিয়ে আমি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ বদ টাইপের এক আধবুড়ো লোক ইচ্ছে করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, ঐ বুড়োটাকে ডেকে জিজ্ঞেস কর তো এটা কেন করল। মুহিব বলল, আহা বাদ দাও না। পথ চলতে ধাক্কা লাগে না?
আমি কঠিন গলায় বললাম, পথ চলতে ধাক্কা এটা নয়। তুমি এক্ষুণি গিয়ে বুড়োকে ধরে আন।
মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি নাটক করতে পারব না। বুড়ো যদি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েই থাকে তাহলে আমি এখন বললে তো ধাক্কা ফেরত চলে যাবে না।
‘তা যাবে না – তবে সে সাবধান হবে।‘
‘তাকে সাবধান করার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছা করছে না। তুমি পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাও তো। তুচ্ছ জিনিস মনে ধরে রাখলে চলে না।‘
রাগে আমার গা জ্বলে গেল। তার কাছে সবই তুচ্ছ জিনিস। সে থাকে তার বোনের সঙ্গে। তার দুলাভাই তাকে দিনরাত অপমান করে। অপমানের দু‘একটা নমুনা শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেছে। সে নির্বিকার – তার কাছে এসব হচ্ছে তুচ্ছ জিনিস।তার টাইপ সম্পর্কে বুঝবার জন্যে একটা ঘটনার শুধু উল্লেখ করি। আপনি অসম্ভব বুদ্ধিমান। একটি ঘটনা থেকে তার চরিত্র ধরে ফেলতে পারবেন। বেশিদিন আগের কথা না, মাস তিনেক হবে। তার সঙ্গে গল্প করতে করতে আসছি। সে হঠাৎ বলল, এক সেকেণ্ড দাঁড়াও বাথরুম সেরে আসি।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, কোথায় বাথরুম সারবে?
সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, রাস্তার পাশে। ড্রেন আছে তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব। নো প্রবলেম।
আমি বললাম, রাস্তায় শত শত লোক যাচ্ছে এর মধ্যে তুমি বাথরুম সারবে?
‘হ্যাঁ।‘
‘তুমি কি প্রায়ই এরকম কর?‘
‘আমার মত যুবক, যাদের কাজই হচ্ছে সারাদিন শহরে ঘুরে বেড়ানো – বাথরুম সারার কাজ তাদের এভাবেই করতে হয়। এটাতো সানফ্রানসিসকো শহর নয় যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাবলিক টয়লেট থাকবে।‘
‘তুমি যদি সত্যি এরকম কর তাহলে আমি কিন্তু চলে যাব। আর কখনো আমার দেখা পাবে না।‘
‘তুমি চাও আমি ব্লাডার ফেটে মারা যাই?‘
এই বলে সে আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাস্তার পাশের একটি আম গাছের দিকে এগিয়ে গেল। এ থেকে আপনি নিশ্চয়ই ওর মানসিক গঠন বুঝতে পারছেন … আপনার সঙ্গে ওর কোনই মিল নেই …‘
চিঠি এই পর্যন্ত পড়েই অরুর ঘুম পেয়ে গেল। ময়নার মা ঘরে ঢুকে বলল, আফা আপনেরে বড় আফা ডাকে। অরু বিরক্ত মুখে বলল, কেন?
‘বাবু বমি করতেছে।‘
‘বমি করবে তা তো জানা কথাই – এতক্ষণ যে করে নি তাই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি। আপাকে গিয়ে বল আমি যেতে পারব না। আমি এখন ঘুমুব। খবর্দার দুপুরে আমাকে ডাকতে পারবে না। ভাত খাওয়ার জন্যেও ডাকবে না। যদি টেলিফোন আসে বলবে আমি বাসায় নেই।‘
 

Users who are viewing this thread

Back
Top