চুমুর অভিজ্ঞতা সবারই কমবেশি আছে। কারণ, চুমু বা চুম্বন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, আবেগের প্রকাশ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সুস্থ জীবনযাপন করতে হলে আবেগের সুষ্ঠু বিকাশ ও প্রকাশের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তবে চুমুর প্রকারভেদ আছে, শিশুসন্তানের গালে বাবা-মায়ের আদরের চুমু আর প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্টিক চুমু, দুটিতে অনেক পার্থক্য। আর ফরাসি সংস্কৃতিতে ঘনিষ্ঠ নারী-পুরুষের দেখা হলে সম্ভাষণ জানিয়ে একে অপরের গালে মৃদু শব্দ করে চুমু বিনিময়ের রীতি আছে। সেখানে আন্তরিকতা, স্নেহ, ভালোবাসা মুখ্য, অন্যভাবে দেখার উপায় নেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, ভালোবাসা প্রকাশের জন্য চুমু শুধু বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের একচেটিয়া অধিকারে নেই, অন্যান্য প্রাণী বিশেষ করে স্তন্যপায়ী জীবেরা অনেক দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করেছে ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ, অনুঘটক এই ‘চুম্বন’কে।
সংস্কৃতিভেদে রোমান্টিক চুম্বনের তারতম্য আর ভেদাভেদ থাকলেও প্রায় সব সংস্কৃতিতে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চুমু দুটি মানব-মানবীর স্পন্দিত হৃদয়ের কথা বলে। সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, ফ্যাশন, রুচি ও ভালোবাসার দেশ ফ্রান্স। এ দেশের মানুষেরা চুম্বনকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। ‘ফরাসি চুমু’ পৃথিবীর সব আবেগপ্রবণ প্রেমিক-প্রেমিকার মনে উদ্দীপনা, আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে। এ দেশেই জন্ম নিয়েছিলেন জগৎখ্যাত ভাস্কর অগুস্ত রদ্যাঁ। তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘চুম্বন’, শীতল পাথরের বুকে খোদাই করা উচ্ছ্বসিত দুটি হৃদয় উৎসারিত নির্মল ভালোবাসার আবেগঘন উত্তাপ আজও প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে পুষ্পিত সৌরভে পূর্ণ করে। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা মজার একটা তথ্য দিয়েছেন, তা হলো বিশ্বের ৪৬ শতাংশ মানুষ এই ফরাসি চুমুর চর্চা করে থাকেন। আর মার্কিন মুলুকে ৩ চতুর্থাংশ মানব-মানবী ব্যাপারটি তেমন গ্রহণ করেননি। এ পরিসংখ্যান করোনাকালের আগের।
ইতিহাস
ইতিহাস নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁরা ফরাসিদের মধ্যে চুমু সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের জন্য রোমানদের কথা বলেন। ল্যাটিন ‘সাভিয়াম’ অর্থ হচ্ছে ‘উষ্ণ চুম্বন’। রোমান সংস্কৃতিতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে উষ্ণ বা গভীর চুম্বন খুবই স্বাভাবিক ছিল। ‘ফরাসি চুমু’ কথাটির উৎপত্তি সম্পর্কে যে কথাটি বেশি প্রচলিত তা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন সেনারা ফ্রান্সে যখন বিজয় উৎসব করছিল, তখন ফরাসি নারী-পুরুষেরা তাঁদের হৃষ্টচিত্তে স্বাগত জানাচ্ছিল। সে সময় মার্কিন সেনাদের বাহুতে ধরা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি বহু ফরাসি তরুণী। দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে এমন রোমান্টিক উষ্ণ চুম্বনের স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে মার্কিন সেনারা ফিরে গিয়েছিলেন অতলান্তিকের অপর পারে। তাঁরা ঘুরেফিরে এমন মধুর ‘ফরাসি চুমু’র স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁদের লেখায়, কথায়।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষের পর উদযাপনের বিখ্যাত সেই চুমু ছবি। ছাপা হয়েছিল লাইফ ম্যাগাজিনে, ছবি: উইকিপিডিয়া
সেই থেকে ভালোবাসার গভীরতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের এই মানবিক সহজাত আবেগ উৎসারিত প্রবৃত্তি। এদিকে ২০১৪ থেকে ফরাসি চুমুকে বোঝাতে নামকরা ফরাসি অভিধান ‘লারুস’-এ স্থান করে নিয়েছে একটি শব্দ, তা হলো ‘Galocher’। সে যা-ই হোক, ভালোবাসার কোনো আলাদা ভাষা নেই, তেমনি ভালোবাসার প্রকাশে চুমু বা চুম্বন হচ্ছে সারা পৃথিবীতে সব মানুষের হৃদয়ের ভাষা। পশ্চিমা বা ফরাসি সংস্কৃতিতে প্রেমিক-প্রেমিকারা বিশেষ করে তরুণেরা একে অপরকে প্রকাশ্যে চুম্বন করতে কোনো জড়তা বোধ করে না। পথচারীরা ফিরেও দেখে না। এমন আচরণকে কেউ মোটেই গর্হিত মনে করে না, বরং তা ব্যক্তিস্বাধীনতার অংশ এবং অধিকার হিসেবেই সর্বজনস্বীকৃত। কখনো চোখাচোখি হয়ে গেলে, মৃদু হাসি দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
অণুজীববিজ্ঞানীদের চোখে ফরাসি চুমু
তবে কেউ ফিরে দেখুক বা না দেখুক, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অণুজীববিজ্ঞানীরা ঠিকই প্রবল আগ্রহে এদিকে মনোযোগ দিয়েছেন। সেই ২০১৪ সালে, তখনো করোনাভাইরাসের কথা কেউ শোনেনি। সে সময় নেদারল্যান্ডসের একদল অণুজীববিজ্ঞানী ২১টি দম্পতির ওপর গবেষণা করে যা জেনেছেন, তা হলো ১০ সেকেন্ড স্থায়ী গভীর অর্থাৎ ফরাসি চুম্বনে দুজনের মুখে ৮ কোটি ব্যাকটেরিয়ার বিনিময়ে ঘটে। তাঁরা তাঁদের এমন গবেষণানির্ভর নিবন্ধটি সে বছর ১৭ নভেম্বর মাইক্রোবায়োম জার্নালে প্রকাশ করেছেন।
মুখের লালা থেকে নেওয়া ব্যাকটেরিয়ার রঙিন স্ক্যানিং পদ্ধতিতে তোলা ৫০০০ গুণ বড় অতি আণুবীক্ষণিক চিত্র। ছবি: স্টিভ জিচমাইসনার।
আমাদের মুখ, মুখের লালা হচ্ছে প্রাণের অপূর্ব সমাহার। সেখানে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রকম আকৃতি, প্রকৃতির ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস। সে এক বিশাল অভয়ারণ্য, সেখানে আমাজনের গভীর জঙ্গলও হার মানে। আমাদের মুখে ভাইরাস, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া, আর্চিয়া, ব্যাকটেরিয়াসহ ৭০০টিরও বেশি বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। স্বাস্থ্যকর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ১ মিলিলিটার লালাতে পাওয়া যাবে প্রায় ১০ কোটি অণুজীব। এদের বেশির ভাগই আমাদের কোনো ক্ষতি করে না। গবেষকদের মতে, যখনই কেউ তাঁর ভালোবাসার জনকে ফরাসি চুমুতে আবেগ বিনিময় করেন সেই সঙ্গে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া বিনিময় আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
উপকারী ব্যাকটেরিয়া হজম, প্রয়োজনীয় জৈব যৌগ উত্পাদন, বিশেষ করে ভিটামিন এবং আমাদের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে পক্ষান্তরে আমাদের প্রতিনিয়ত বন্ধুর মতো উপকার করে চলছে। মুখে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে এই গবেষকদের একজন বিখ্যাত ‘টাইম’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছেন। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ‘অনেক গবেষণায় এটা পরিলক্ষিত হয়েছে যে ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য যত বেশি বৃদ্ধি পায়, আমাদের জন্য তত ভালো’।
করোনা বদলে দিয়েছে জীবন
নতুন করোনা একেবারে বদলে দিয়েছে জীবন, জীবনধারা। এখন কেউ কাউকে সম্ভাষণ জানাতে তেমন করে এগিয়ে আসে না। গালে গাল ঠেকিয়ে চুমু দিয়ে আন্তরিকতা, ভালোবাসা প্রকাশ করে না। করমর্দন করতে হাত বাড়িয়ে দেয় না কেউ। কারণ, কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী করমর্দনের সময় একের হাত থেকে অন্যের হাতে বিনিময় হয় কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস।
ছবি: রয়টার্স
সেসব ভাইরাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে চরম মারণক্ষমতার খলনায়ক করোনাভাইরাস। অনেক বিজ্ঞানী অনেকটা সতর্ক করে এইডস আক্রান্তদের এমন ধরনের চুমু থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর এ সময় স্বাভাবিক কারণে করোনার বিপদ মাথায় রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যুগলদের পরামর্শ দিয়েছেন, এ সময় যতটা সম্ভব চুম্বন এড়িয়ে চলতে।
করোনা একদিন বিদায় হবে। বেঁচে থাকবে কবিতা, ভালোবাসার মধুর সংগীতের মতো ফরাসি চুমু।
* লেখক: মইনুল হাসান, ফ্রান্স