‘মনে হয় মাঝরাতে ঘুসঘুসে জ্বর হয় কারো কারো/কারো কারো হাঁপানির শ্বাসকষ্ট শুনতে পাই মাঝরাতে’।
কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘গাছপালাগুলো’ কবিতাটি পড়তে পড়তে যখন এ লাইন দুটির কাছাকাছি হই, তখন সত্যিই যেন কারও হাঁপানির শ্বাসকষ্ট কানে বাজে। নিজে চিকিৎসক বলেই কিনা বেদনাবোধটা একটু বেশি। আসলে এই যে প্রাণচঞ্চল প্রাণিদেহ পৃথিবীতে বেঁচে আছে, হাসছে, কাঁদছে—এর সবই তো ওই প্রাণবায়ুর আসা-যাওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস। সেই শ্বাসপ্রশ্বাসে যদি ব্যাঘাত ঘটে, বুকভরে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, তবে তা যে কতটা অস্বস্তির, খুব ভালো করেই বুঝতে পারি। শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত এ অস্বস্তির নামই ‘হাঁপানি’। ইংরেজিতে একে বলা হয় ‘অ্যাজমা’।
হাঁপানির ডাক্তারি ব্যাখ্যা
হাঁপানি বস্তুত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত একটি রোগ। এ রোগ দীর্ঘমেয়াদি। শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ হলে শ্বাসনালি ফুলে যায়। এরপর ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ, বুকে চাপ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। এসবের সমন্বিত রোগটির নামই হাঁপানি।
কেন হয়
হাঁপানির কারণ সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে কতগুলো বিষয় রয়েছে, যেগুলো হাঁপানি রোগের উৎপত্তি ও স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকে।
* এ রোগ জেনেটিক বা বংশগত কারণে হতে পারে। বংশে কারও এ রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের যে কারও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
* পশুর লোম, আরশোলা, রেণু, ছত্রাক প্রভৃতি হাঁপানির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
* বায়ুদূষণ, সিগারেটের ধোঁয়া, কারখানার বিভিন্ন উত্তেজক পদার্থ, রঙের ঝাঁজালো গন্ধ, ঠান্ডা হাওয়া, ঝাঁজালো মসলা প্রভৃতির কারণে হাঁপানির আশঙ্কা বেড়ে যায়।
* বিভিন্ন ব্যথানাশক ওষুধ, অ্যাসপিরিন, হেরোইন প্রভৃতির অতি ব্যবহারের কারণে হাঁপানি হতে পারে।
* মানসিক চাপ, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতাও অনেক ক্ষেত্রে হাঁপানির তীব্রতা বাড়াতে পারে।
* সাধারণত শিশু বয়সে ছেলেদের এ রোগ হয় এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হলে এ রোগ বেশি হয়।
* কারও কারও ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের খাবার, যেমন গরুর মাংস, চিংড়ি, ইলিশ, বেগুন—এসব খেলে হাঁপানির মাত্রা বাড়তে পারে।
হাঁপানির লক্ষণ
* দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট
* ঋতু পরিবর্তনের সময় শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া
* বুকে চাপ অনুভূত হওয়া
* কাশি বা শুকনা কাশি
* শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বুকে বাঁশির মতো হঠাৎ সাঁ সাঁ শব্দ
* দমবন্ধ লাগা
* নাকে-মুখে ধুলাবালু গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া
হাঁপানির পরীক্ষা-নিরীক্ষা
* স্পাইরোমেট্রি বা পিক ফ্লো মেট্রি পরীক্ষা: রোগীর শ্বাসনালিতে শ্বাস গ্রহণে বাধা আছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য এটি করা হয়
* মেথাকলিন চ্যালেঞ্জ পরীক্ষা: এর মাধ্যমে শ্বাসনালির অতি সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করা হয়।
* রক্ত পরীক্ষা: রক্ত ও কফে ইয়োসিনোফিল সিরাম আইজিইয়ের মাত্রা বেশি আছে কি না, তা নির্ণয় করা হয়।
* স্কিন প্রিক টেস্ট: অ্যালার্জেন বা ট্রিগার পরীক্ষার জন্য এ টেস্ট করা হয়।
হাঁপানির চিকিৎসা
* সালবিউটামল-জাতীয় উপশমকারী ওষুধ তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসনালির ছিদ্রপথ প্রসারিত করে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের বাধা কমিয়ে দেয়।
* স্টেরয়েড, অ্যামাইনোফাইলিন, ক্রোমগ্লাইকেট ইত্যাদি প্রতিরোধক ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
* হাঁপানির চিকিৎসায় ইনহেলার সবচেয়ে উপকারী এবং আধুনিক পদ্ধতি। এতে খুব অল্প মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করেই ভালো ফল পাওয়া যায়। খুব একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয় না।
* হাঁপানির চিকিৎসায় নেবুলাইজারের ব্যবহারও বেশ ফলপ্রসূ। হাঁপানির মাত্রা তীব্র হলে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তবে নেবুলাইজার যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত রাখা জরুরি।
* হাঁপানির আক্রমণ ঠেকাতে অনেক সময় শিরায় স্টেরয়েডের ইনজেকশন দেওয়া হয়।
হাঁপানির চিকিৎসায় ইনহেলার
আমাদের দেশে এখনো যে কয়েক ধরনের ইনহেলার পাওয়া যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে সুলভ ও বহুল ব্যবহৃত ইনহেলারটি হচ্ছে এমডিআই বা মিটার্ড ডোজ ইনহেলার। এখানে ওষুধের তরল ক্ষুদ্র কণা (১-৫ মাইক্রোমিটার) অ্যারোসল আকারে ফুসফুসে প্রয়োগ করা যায়।
এমডিআই প্রয়োগের কৌশল
মিটার্ড ডোজ ইনহেলার প্রয়োগের ধাপগুলো নিচের মতো।
* ইনহেলারের মাউথপিসের ঢাকনা খুলুন।
* চিবুক উঠিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকান।
* ধীরে শ্বাস ত্যাগ করুন এবং বুকের সব বাতাস বের করে দিন।
* এবার ইনহেলারের মাউথপিসটি দাঁতের ফাঁকে রেখে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরুন, যেন ফাঁক না থাকে।
* এবার ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে থাকুন এবং ক্যানিস্টারে দৃঢ়ভাবে চাপ দিয়ে অ্যারোসল ফুসফুসে টেনে নিন।
* নিশ্বাসে বুক ভরে গেলে ইনহেলার মুখ থেকে সরিয়ে ফেলুন এবং ৫-১০ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে রাখুন, যেন ওষুধ ফুসফুসের শ্বাসনালিতে জমা হয়।
* এবার স্বাভাবিক শ্বাস নিন। এভাবে রোগীর এক পাফ বা টান ওষুধ নেওয়া হয়।
* যদি ২ পাফ নিতে হয়, তবে অন্তত ৩০ সেকেন্ড পর প্রক্রিয়াটি পুনরায় করুন। তারপর ইনহেলারের ঢাকনাটি দিয়ে মাউথপিসটি বন্ধ করে রাখুন।
* স্টেরয়েড ইনহেলার ব্যবহারের পর মুখে পানি নিয়ে কুলকুচা করে পানি ফেলে দিন। পানি গেলা যাবে না। এতে মুখে জমে থাকা ওষুধ পরিষ্কার হয়ে যাবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।
ইনহেলারের মেয়াদ কত দিনের
* এমডিআই উৎপাদনের পর দুই বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। ব্যবহার শুরু করে দিলে ছয় মাসের বেশি কার্যকর থাকে না। অতিরিক্ত ও সরাসরি সূর্যরশ্মি থেকে দূরে রাখতে হবে। ঘরের তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হবে।
* এমডিআইয়ের ডোজ কাউন্ট ছাড়া ইনহেলার কখন খালি হয়, তা বোঝার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে ইনহেলারে কতটা ডোজ ছিল এবং কত দিন যাওয়া উচিত, এভাবে হিসাব রাখতে হবে।
জেনে রাখুন
* শ্বাসকষ্ট মানেই হাঁপানি নয়। হৃদ্রোগ, রক্তশূন্যতা প্রভৃতি কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। হাঁপানি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।
* পৃথিবীতে প্রায় ২৪ কোটি লোক হাঁপানিতে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রতিবছর হাঁপানির কারণে মারা যায়। হাঁপানিতে মারা যাওয়া মানুষের ৮০ শতাংশই তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসী।
* লেখক: সহ–উপাচার্য (শিক্ষা), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা