বর্তমান বিশ্বে রূপচর্চায় প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। একদিকে যেমন ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সবাই, সেই সঙ্গে প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনো উপায়ে চুল কমে যাওয়া রোধ করার ব্যাপারে সবার মধ্যেই ব্যাপক সচেতনতা দেখা যাচ্ছে। মহামারির এই সংকটকালে পারলার, রূপচর্চা কেন্দ্র, হেয়ার স্যালনে না গিয়ে বাড়িতে বসেই চুল ও ত্বক বা নখের যত্নে বিভিন্ন বিশেষায়িত রূপচর্চার উপকরণ, হোম ফেশিয়াল কিট, হেয়ার প্যাক, বিউটি ট্রিটমেন্ট মাস্ক ইত্যাদি কেনা ও ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছে মানুষ। এ যুগে সুস্থ ও সুন্দর ত্বক আর চুল, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার কাছেই আরাধ্য। সামাজিক মাধ্যমে সবার সক্রিয় উপস্থিতি এখন এতটাই স্বাভাবিক সবার কাছে যে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন এখন একটা সর্বজনীন ব্যাপার। এই সব দিক বিবেচনায় এগ ইয়ক অয়েলের মতো রূপচর্চার প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতি সবার অপরিসীম আগ্রহ বাড়ছে।
এগ ইয়ক অয়েল কী?
ডিমের কুসুমের তেল, ছবি: উইকিপিডিয়া
ডিমের কুসুমের প্রাকৃতিক তেলই হচ্ছে এগ ইয়ক অয়েল, যা মূলত ন্যাচারাল কোলেস্টেরল। সেই সঙ্গে এতে থাকে ওমেগা থ্রি ও সিক্সের মতো ফ্যাটি অ্যাসিড, ট্রাই গ্লিসারাইড ও ফস্ফোলিপিড। এই তেল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা হয়। কোনো রকম উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োগ করা হয় না বলে একে এক্সট্রা ভার্জিন এগ অয়েলও বলা হয়। নিজেরা তৈরি করা বেশ ঝকমারির ব্যাপার হলেও অনলাইন বিউটি স্টোর ও ন্যাচারাল স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট বিক্রি করা হয়, এ রকম বিশেষায়িত দোকানে এগ অয়েল সহজেই পাওয়া যায়।
এগ অয়েলের ইতিহাস
ডিম থেকে তৈরি এই তেলের ব্যবহারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। সেই এগারো-বারো শতকের প্রচলিত চায়নিজ মেডিসিন এবং গ্রিক সমাজের রূপচর্চার দলিল ছাড়াও ‘আমাদের উপমহাদেশের আয়ুর্বেদ’ গ্রন্থেও ডিমের কুসুমের প্রাকৃতিক তেলের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্রিম, লোশন, মলম, প্রসাধনীতে এই তেল ব্যবহার হয়ে আসছে সারা বিশ্বেই।
এগ অয়েলের ব্যবহার বয়সজনিত বলিরেখা, কুঞ্চন, ত্বক ঝুলে যাওয়া—এই লক্ষণগুলোকে অনেকটাই রুখে দেয়, ছবি: সাইনি ডায়মন্ড, পেকজেলস
ত্বকের যত্নে এগ অয়েল
ঘষা খাওয়া বা কাটাছেঁড়া ত্বককে প্রাকৃতিক উপায়ে সারিয়ে তুলতে এগ অয়েলের জুড়ি নেই। বিশেষত পোড়া ক্ষত ও সেই ক্ষতজনিত দাগ দূর করার ক্ষেত্রে খুবই উপকারী এই তেল। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, এগ অয়েলের ব্যবহার বয়সজনিত বলিরেখা, কুঞ্চন, ত্বক ঝুলে যাওয়া—এই লক্ষণগুলোকে অনেকটাই রুখে দেয়। বর্তমানে তারুণ্য ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে বোটক্স, সিরাম ইনজেকশন আর কসমেটিক সার্জারির মতো যেসব বিপজ্জনক উপায় খুঁজছে দুনিয়ার সবাই, এগ অয়েল আমাদের কিছুটা হলেও এই ব্যাপারে সুপথে আনতে পারবে। এ ছাড়া এই তেলের ব্যবহার ত্বকের প্রদাহ, যেমন সোরিয়াসিস বা একজিমায় বেশ আরাম দেয়।
ঝলমলে একমাথা চুলের জন্য এগ অয়েল
চুলের হারানো প্রাণ ফিরিয়ে দিতে বা ঝলমলে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুলের জন্য এগ অয়েলের প্রয়োগ এখন সারা পৃথিবীতে খুবই জনপ্রিয়। চুল পড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া, রুক্ষ হয়ে যাওয়া রোধ করতে এই তেল ব্যবহার করে অনেক উপকার পাওয়া যায়। মাথার ত্বকের শুষ্কতা দূর করে চুলের গোড়ায় পুষ্টি জোগায় এগ অয়েল। চুলের ফলিকলকে এগ অয়েল রক্ষা করে বলে তা চুল পড়া অনেকাংশেই রোধ করে। চুলের পেকে যাওয়া প্রতিরোধ করে বলে রূপচর্চার মাধ্যমে যাঁরা অ্যান্টি-এজিং বিপ্লব ঘটাতে বদ্ধপরিকর, তাঁদের বিশ্বস্ত বন্ধু এই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক তেল।
এগ ইয়ক অয়েলের অন্যান্য ভূমিকা
এগ ইয়ক অয়েলে আছে পর্যাপ্ত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণের কথাও বলতে হয়। তাই ওষুধশিল্পে বিভিন্ন ইমোলিয়েন্ট, মলম বা সলিউশনে এগ অয়েল ব্যবহৃত হয়। অ্যারোমাথেরাপিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নির্যাস তেলের বেস অয়েল হিসেবে ডিমের কুসুমের এই তেল বেশ জনপ্রিয়। বারবার ভেঙে যাওয়া বা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া নখের যত্নে মেনিকিউর করতেও এগ অয়েলের ব্যবহার করা হয়। এমনকি সুন্দর ত্বক ও চুল নিশ্চিত করতে ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির অনুসারী ডার্মাটোলজিস্টরা এগ অয়েল নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
সামনের দিনের অ্যান্টি-এজিং বা তারুণ্য ধরে রাখার প্রধানতম উপকরণ হিসেবে নিজের জায়গাটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে ডিমের কুসুমের তেল, ছবি: উইকি হাউ
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে ডিমের কুসুমের তেলের ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও আধুনিক যুগের এই দিনে এগ ইয়ক অয়েলের বিপণন ও ব্যবহার এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে দেখা যায়, বিশেষত অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্স ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্রেতাদের সরাসরি এগ অয়েল কেনার প্রবণতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও ইউটিউবের মতো ভিডিওসাইটে প্রচুর টিউটরিয়াল ভিডিও আছে এগ অয়েল তৈরি ও সব রকমের রূপচর্চা করতে তার ব্যবহারের ওপর। প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতি থেকেই তৈরি বলে একেবারেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন এগ অয়েল। পৃথিবীতে সামনের দিনের অ্যান্টি-এজিং বা তারুণ্য ধরে রাখার জন্য রূপচর্চার প্রধানতম উপকরণরূপে নিজের জায়গাটা শক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে এগ ইয়ক অয়েল বা ডিমের কুসুমের তেল—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
সূত্র:
১। ‘হেন এগ ইয়ক অয়েল: আ পটেনশিয়াল সোর্স অব বায়ো-অ্যাভেইলেবল লুটেইন অ্যান্ড জিয়াজ্যান্থিন ফর স্কিন অ্যান্ড সান প্রটেকশন’, কুমুদ মদন এবং সাঞ্জু নন্দা, ওয়ার্লড জার্নাল অব ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সেস, ৫(১), ৭১-৮০, জানুয়ারি ২০১৭
২। ‘রোল অব এগ অয়েল ইন কসমেটিকস: অ্যান আইসিনিং অন আ কেক’, দীপশিখা শর্মা, অমৃতপাল কউর, শীতু ওয়াঢ়া শচীন কুমার সিং, রিসার্চ জার্নাল অব ফার্মাসি অ্যান্ড টেকনোলজি, ১২(৯) ৪৫৮৯, জানুয়ারি ২০১৯
৩। ‘হেলথ বেনিফিটস অব এগ অয়েল’, শন ডিমেলো, মেডিইন্ডিয়া, নভেম্বর ২০২০
৪। ‘অ্যান্টি-এজিং বেনিফিট অব এগ অয়েল লেইড আউট বাই ন্যাচারাল সোর্সিং’, অ্যান্ড্রু ম্যাকডাউগ্যাল, কসমেটিকস ডিজাইন ডট কম, নভেম্বর ২০২০
৫। ‘ডিমান্ড ফর এগ ইয়ক অয়েল টু সারপাস ওয়ান মিলিয়ন লিটারস অন ব্যাক অব সারজিং অ্যাপ্লিকেশনস ইন হেয়ার কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি’, ফ্যাক্ট এম আর, গ্লোবাল নিউজ ওয়ায়ার, মে ২০১৮
৬। ‘বেনিফিটস অব এগ অয়েল ফর স্কিন, হেয়ার অ্যান্ড নেইল কেয়ার!’, লাভ সূত্র, জানুয়ারি ২০১৯
৭। ‘ই ও- এগ অয়েল’, ইকোভাটেক, জানুয়ারি ২০২১