-মিলি? মিলি?
-কি হয়েছে অভি? এতো চিৎকার কেন করছো?
-আমাকে শেভ করিয়ে দাও। দাঁড়িগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে।
-আচ্ছা জনাব আপনি কি জানেন না আপনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো আমি ভীষন ভালোবাসি?
অভি মিলির কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। ওর কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে বললো,
-আমার বউটার পছন্দ অপছন্দের খবর আমি রাখবো না তো কে রাখবে?
বলেই ওর হাতে শেভিং মেশিনটা তুলে দিলো। আর মিলিও ওকে শেভিং করাতে লাগল। এই ছোট ছোট ভালবাসা ভরা কাজগুলো মিলিকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করে অভি। কাজটা শেষ করে মিলি রান্নাঘরে গেল। এখনও বাকি রয়েছে কিছুটা রান্না। আর অভি ওয়াশরুমে ঢুকলো।
-মিলি আমার ওয়ালেটটা পাচ্ছি না।
-মিনি ওয়ার্ডরোবে রাখা আছে।
-মিলি আমার বেল্টটা পাচ্ছি না।
-বেডেই রাখা আছে।
-মিলি আমার শার্টটা পাচ্ছি না।
কোনো উত্তর না দিয়ে মিলি রুমে এসে দেখলো অভি পুরো তৈরি হয়ে রয়েছে অফিসের জন্য। ওকে রুমে দেখেই ওর দিকে এগিয়ে এলো অভি।
-এতক্ষণ ধরে নাটক করছিলে কেনো?
-তুমি তো জানোই তোমাকে না দেখে আমি অফিসে যাই না। এসেই যখন পড়েছো আমাকে টাইটা পরিয়ে দাও।
মিলি, অভির চেয়ে অনেকটাই হাইটে ছোটো। অভির কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা মিলির। তাই পা দুটো উঁচু করে দাঁড়িয়ে টাই বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করলো আর অভি ওর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। মিলি শাড়ি পড়ে থাকায় ওর উন্মুক্ত কোমড়ে পেটে হাতের আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকলো অভির দুষ্ট হাতজোড়া।
-কি হচ্ছে কি? ঠিক করে বাঁধতে দাও।
চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে উঠলো মিলি।
-ইশ বউ এভাবে তাকিয়ে না প্লীজ, আমাকে অফিসে যেতে হবে তাই তোমার সঙ্গে রোমান্স করতে পারবো না।
-দিন দিন তোমার অসভ্যতামি বেড়েই চলেছে।
-বউয়ের কাছে কোনো পুরুষই সভ্য নয়।
-তুমি কিন্তু......
ততক্ষণে অভি ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
-এখন হাতে বেশি সময় নেই তাই বাকিটুকু রাতে সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব।
মিলি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো।
-খেতে দেবেন নাকি অফিসে চলে যাবো?
-চলো দিচ্ছি।
দুজনে খেয়ে নিল। অভি মিলির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে মিলির মা ফোন করলো।
-হ্যাঁ মা, কেমন আছো?
-হ্যাপি বার্থডে মিলু।
-মা তোমারও মনে আছে?
-তো আমার একমাত্র মেয়ের জন্মদিন কি আমার মনে থাকবেনা নাকি?
-মা?
-আজকে সময় করে যদি জামাইকে নিয়ে আসতে পারতিস।
-মা আজকে যাওয়া হবে না। ও অফিসে চলে গেছে। আসতেই তো রাত্রি আটটা বেজে যাবে।
-আচ্ছা যেদিন সময় হবে আসিস।
-হুম মা। রাখছি।
-হুম, সাবধানে থাকবি।
-আচ্ছা।
সবাইয়েরই মনে আছে জন্মদিনের কথা আর তুমি একটা উইশ পর্যন্ত করলে না মিস্টার অভি। মিলি মন খারাপ করে টিভি অন করে ড্রামা দেখতে শুরু করলো। দুপুরে একটু ঘুমিয়েও নিলো। উঠে ফোন চেক করে দেখলো অভি কল করেনি। অথচ প্রতিদিন দুই তিন বার করে কল করে। তাই মিলি নিজেই ফোন করলো কিন্তু ফোন রিসিভ হল না।
লোকটা পেয়েছেটা কি নিজেও কল করেনি আবার আমি করলাম ধরছে না।
আবারও মন খারাপ করে বাগানে গিয়ে গাছ গুলোতে জল দিলো তারপর ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসলো। এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ছয়টা বাজছে আর এখন কল করেছে অভি। ও কলটা রিসিভ করল।
সকাল থেকে তোমার ফোনের আশায় বসে আছি আর এখন সময় পেলে ফোন করার?
-ম্যাম আপনি কি মিলি বলছেন?
-হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
-ফ্লাওয়ার স্ট্রীটে যেই ব্যক্তির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তারই মোবাইল এটা আর এমারজেন্সি থেকে আপনার নাম্বার পেয়ে কল করলাম। হ্যালো! হ্যালো! ম্যাম আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
মিলি প্রথম কথাটুকু শুনেই বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে ওর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে "আমার অভির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে"।
বাড়ির একটা গাড়িতে বসেই বলে উঠল,
-কাকা তাড়াতাড়ি ফ্লাওয়ার স্ট্রীটে চলো।
ড্রাইভার কাকাও আর বাক্য বিনিময় না করে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
ওনার স্পট ডেথ হয়েছে।
ইশ বেচারার বয়সটাও বেশি না। হয়তো কিছুদিন হয়েছে বিয়ে হয়েছে তাই হয়তো ফুল কিনতে এসেছিল।
আজকালকার লরির ড্রাইভাররাও সিগন্যাল মানে না যদি মানতো তাহলে আর এই দুর্ঘটনা ঘটতো না।
গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল মিলি।
অভির শরীরের রক্তে পুরো রাস্তা ভেসে আছে। নিথর শরীরটার পাশে রক্তলাগা একগোছা নীল গোলাপগুলো ছড়িয়ে আছে।
-ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন? প্লীজ কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন প্লীজ।
-ওনার স্পট ডেথ হয়েছে।
কথাটা মিলির ফাঁকা মস্তিষ্কে আঘাত হানলো। ফলস্বরূপ জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল মিলির শরীরটা। ড্রাইভার কাকা এসে তাড়াতাড়ি অচেতন মিলিকে গাড়িতে বসিয়ে হসপিটালে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরতেই ডক্টর বললেন কংগ্রাজুলেশন মিসেস চৌধুরী আপনি প্রেগন্যান্ট। কথাটা শুনেই ও চিৎকার করে উঠল,
-অভি, অভি কোথায়?
ওর মা এসে শান্ত করতে চাইলো কিন্তু পারলো না তাই ওকে বাড়িতে নিয়ে এলো। এসেই দেখলো বাড়িতে প্রচুর লোকের ভিড়। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে অভির নিথর শরীরটার পাশে বসলো মিলি।
-এই অভি দেখো আমি মা হবো আর তুমি বাবা। তোমার ভালোবাসার অংশ আমার মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে উঠবে। তোমায় পাপাই আর আমাকে মাম্মাম ডাকবে। এই তুমি চুপ করে আছো কেন? কথা বলো না আমার সাথে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে অভি। প্লীজ কিছু তো বলো। তুমিই তো বলতে আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তাহলে এখন কেনো আমাকে একা করে দিয়ে চলে যেতে চাইছো? তোমার পাগলামিগুলোকেই ভালোবাসি অভি। ভীষন ভালোবাসি তোমায়।
বলেই অভির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো মিলি। তারপর ওর নিথর শরীরটা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে আবারও জ্ঞান হারালো।
বাবার ইচ্ছে ছিলো তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিবাহ দিবেন। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম ভেবেছিলাম বাবা যেহেতু আমার বিয়ে ঠিক করেছেন তাহলে ভালোই হবে। কিন্তু একদিন আম্মা আমাকে বলল মেয়েটাকে দেখে আসতে। আমিও খুশিমনে রাজি হলাম। ভাবলাম দেখা হোক, কথা হোক, প্রণয় হোক তাতে কিছুটা ভাব বিনিময় হবে। বিবাহের মতো সম্পর্ক আরও মজবুদ হবে।
সকালবেলা দ্রুত উঠলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে মসজিদে। বাসায় ফিরে বোয়া কে বললাম পানি গরম করে দিতে৷ কুসুম-গরম পানি তে সুন্দর করে গোসল সেরে একটা পাঞ্জাবি পরে খেতে বসলাম তারপর আম্মার কাছে বললাম “মেয়ে আমার পছন্দ হলে জানাবো” আম্মা শুনে রাজি হলো।
বাইক নিয়ে বের হলাম স্টেশনের দিকে। মেয়েটা আসছে আমার জন্য দেখা করতে। আমি তাকে ওখান থেকে নিয়ে একটা রিসোর্টে যাবো। প্লান আগেই করা। মেয়েটাকে নিয়ে চললাম রিসোর্টে, প্রথমে ভালমতো খেয়াল করিনি। কারণ মুখ বাধা ছিলো হিজাব দিয়ে। ওখানে প্রবেশ করার পর মেয়েটা আমার সামনে মুখ খুলে বসেছে। এই মুহূর্তে আমি যেন একটা শক খেলাম। মেয়েটা দেখতে একদম যা-তা। আমার সাথে কোনোভাবেই যায়না। কালো একটা মেয়ে যাকে বলে “গেয়ো” বাবার পছন্দ এমন? বাবা আমার জন্য এরকম একটা মেয়ে কিভাবে পছন্দ করতে পারলো? ভেবেই অবাক হচ্ছি। বাবা কী তাহলে আমার ভালো চায় না? আবার দেখলাম, না মেয়েটা একদম কালো। মুহূর্তে আমার রাগ উঠে গেল। ইচ্ছ করছিলো এই নিয়ম মেপে দেখা করা আমার উচিৎ হয়নি। আগে লুকিয়ে দেখা উচিৎ ছিলো তারপর বাবাকে বলে দিতাম 'এই মেয়ে আমার অপছন্দ' এখন বাবা আমাকে কি ভাববে?
মেয়েটা চুপচাপ আমার সামনে বসে আছে। তার চেহারা দেখে আমি মুগ্ধ নই সে বুঝে নিয়েছে। নাম পর্যন্ত শুনিনি রাগে। এরকম কালো একটা মেয়ের নাম শুনে আমার কী কাজ? ভেতরে ভেতরে আমার জ্বলছে। তবুও রাগ সামলে নিয়ে তাকে বললাম,
'কেমন আছেন?'
"আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি''
'সেইম! নাম কী আপনার'
"মায়া"
'কই আমি তো কোনো মায়া খুঁজে পাচ্ছিনা আপনার কাছে, তবে নাম মায়া কেন?'
''জ্বী''
'এই নাম কে রেখেছে?'
"বাবা"
'আমরা আজ কেন দেখা করেছি জানেন?'
"জ্বী"
'কী জানেন?'
"বাসা থেকে আপনার আর আমার বিবাহের ব্যাপারে কথা বলছে এজন্য"
'হুম! তা তোমার কী মনেহয় এই বিয়ে করা ঠিক হবে?'
কথাটা বলতেই মায়া চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আর চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। মায়া এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। চুপ করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।
'কী হলো বলেন?'
"আমি জানি আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। আমি কালো এজন্য। কী করব বলেন আমার যে কোনো হাত নেই। আমি তো ইচ্ছা করে কালো হইনি। জানেন, কালো বলে কেও কখনো প্রেম/বন্ধুত্ব করতে চায়নি। কালো বলে আমার পাশে কেও বসেনি। কালো বলে কেও কখনো তাদের বাচ্চা আমার কোলে দেয়নি। বলতে পারবেন কালো কী অভিশপ্ত কোনো রং? কালো মানেই কী কলঙ্ক? কালো দের কী কোনো স্বপ্ন বা ইচ্চা থাকতে নেই? আজ কালো বলে আপনি আমার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেন না। ফর্শা হলে ঠিক আমার প্রশংসা করতেন। মন বলে কিছু আছে তার কোনো দামই নেই এই ইঁটকাঠের শহরে। আমি জানি আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি বাবার ইচ্ছে ছিলো এজন্য দেখা করতে এসেছেন। চিন্তা করবেন না আমাকে বিবাহ করতে হবেনা। যারা কেবল বাইরের চেহারা দেখে আমি তাকে বিবাহ করতে চাইনা। এই বিয়ে হবেনা চিন্ত করবেন না, ভালো থাকবেন"
কথা গুলো বলে কিছুটা কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো এখান থেকে৷ আমি ঠাঁই চেয়ে থাকলাম ওর চলে যাবার দিকে। একটা মেয়ে কতটা অবহেলা পেলে এসব বলতে পারে। একটা মেয়ে কতটা কষ্ট জমিয়ে রেখেছে তার বুকের গহীনে যা কাউকে বুঝতে দেয়নি। শুনেছিলাম মেয়েরা তাদের বাবার রাজকন্যা হয়। এই মুহুর্তে কল্পনা করছি “আমারও একটা মেয়ে হয়েছে আমি সুন্দর আমার বউ সুন্দর কিন্তু মেয়েটা কালো, এই মেয়েটা তার জীবনে কি পরিমাণ লাঞ্চনা অবজ্ঞা পেয়েছে? ভাবতেই কেমন শিহরে উঠলাম আর ভাবলাম, গায়ের রং দিয়ে মানুষ কে বিচার করা উচিৎ নয়”
বাড়ি ফিরলাম, বাবা-মা আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। আমি শুধু বাবাকে একটা প্রশ্ন করলাম,
'আপনি কেন এই বিয়েটা করাতে চাচ্ছেন?'
বাবা খুব সহজ ভঙ্গিতে বললেন,
'এই মেয়েটা অনেক লক্ষী আর বুদ্ধিমতী সে তোমাকে ভালো রাখতে পারবে এজন্য'
আমি চুপচাপ রুমে চলে গেলাম। তারপর মায়ের কাছে বললাম।
'আম্মা আমি বিয়েটা দ্রুত করতে চাই, বিয়ের কাজ শুরু করো'
আম্মা আমার কথা শুনে অবাক আর বিষ্মিত হলেন তারপর হাসিমুখে বলল 'ঠিক আছে বাবা'
শুনেছিলাম মেয়েটা নাকি রাজি ছিলোনা প্রথমে। তারপর আমার বাবা ওই মেয়ের সাথে কথা বলার পর মেয়েটা রাজি হয়েছে। মেয়েটা শেষ আমার বউ হতে চলেছে। যেহেতু সে সুন্দরী নয় সেহেতু কোনো উপমা পাবার যোগ্যতা সে রাখেনা। কিন্তু না তার উপমা আছে।
বিয়ের দিন রাতে তার সাথে আবার আমার কাছাকাছি চলে আসা। সে বসে আছে বিছানার উপরে। তাকে বললাম,
'ছাদে যাবেন?'
সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তারপর বলল,
"এতো রাতে ছাদে''
'আহা চলেন না প্লিজ'
সে রাজি হলো, শর্ত আমি চোখ বেধে নিয়ে যাবো। এবং সে বোকার মতো আমার সব শর্ত শুনতে রাজি হলো। একটা সময় ছাদে তাকে নিয়ে গেলাম তারপর একটা চেয়ারে বসতে বললাম। কিছুক্ষণ পরে আমি উধাও হয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পেল না হতাশ হলো।
এমন সময় আতসবাজি ও ফটকা ফুটে উঠলো বেশ জোরে। মেয়েটা ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে এলো। এবার তার পায়ের কাছে একটা চিরকুট, তাতে লেখা 'মায়া ফুচকা চলবে?' লেখাটা পড়ে হেসে দিলো। আমি ফুচকার বাটি হাতে হাজির। সাথে অনেক বেলুন আর একটা ফানুস। তাতে লেখা 'গল্পটা মেঘ ও মায়ার' ফুচকা পেয়ে মেয়েটা খেতে শুরু করলো। এবার আর লজ্জা পাচ্ছেনা।
তারপর অবশ্য বাবার কথায় সত্যি হয়। মেয়েটা তার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন আমাদের পরিবারকে খুশী রাখতে ব্যস্ত হতো। বাড়ির সবকিছু একা সামলানো, বাড়ির কখন কার কী লাগবে সবকিছু। আমার আম্মা ভীষণ খুশী ছিলেন মেয়েটাকে আমার বউ বানাতে পেরে সাথে বাবার অনেক খুশী।
মায়া যখন বাড়ির সব কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যায় তবুও মুখে হাসি এনে বলে, আমার আসল বাবা-মা তো এনারাও। আর মেয়েদের আসল ঠিকানা হচ্ছে শশুরবাড়ি। তাই আমি বাবা-মা কে পেয়ে অনেক খুশী তাদের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি। অনেক মেয়েই তো বিয়ের পর শশুর শাশুড়ি পায় না।
মায়াকে নিয়ে সত্যিই আমি খুব ধন্য। মেয়েটা কালো বলেই বোধহয় মন টা এত ভালো। কালো যগতের প্রকৃত আলো। মেয়েটা ধার্মিক আর সব গুণে গুণান্বিত। গায়ের রঙে কী যায় আসে। আমার বাবা-মা আর আমি মিলে খুব ভালো আছি।
বাবা চেয়েছিলেন বলেই এমন একটা বউ পেয়েছি। এজন্য বিয়ের সময় গুরুজনের কথা শুনতে হয়। তারাই ভালো বোঝেন কোন মেয়ে সংসার করবে আর সবাইকে ভালো রাখবে।
মোড়াল: সুখী হবার জন্য অনেক টাকাপয়সা লাগেনা, একটা সুন্দর মনের মানুষ হলেই হয়। হোক সে শ্যামলা বা কালো।
বিয়ের পরপর দুই তিনবার বোধহয় যাওয়া হয়েছিল। মার্কেটে এই দোকান থেকে ঐ দোকানে ঘোরাঘুরি ভালো লাগতো না। আমি টাকা দিতাম,সে কিনে আনতো। যখন বাচ্চারা হলো, তখনো আমি টাকা দিতাম,সে পছন্দ করে বাচ্চাদের জামা কাপড় কিনে আনতো।
বিয়ের বহু বছর পর, কাজ সেরে একবার বসুন্ধরা সিটি গেছি একটা জনপ্রিয় ইংরেজি মুভি দেখতে। মুভি আরম্ভ হতে কিছুটা দেরি হবে,আমি টিকিট কেটে ফুডকোর্টের এক কোনায় এককাপ কফি নিয়ে বসলাম টাইম পাস করার জন্য।
কফি খাচ্ছি, সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি,আমার বন্ধু আরফান আর ওর বউ। আমি কফি হাতে নিয়ে ওদের টেবিলে গেলাম। আরফান আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো।
ওর বউকে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো।
টেবিলের উপর অনেকগুলো ব্যাগ। বুঝা যাচ্ছে বেশ কেনাকাটা করেছে। আমি মজা করে বললাম, ভাবী, আরফানকে আজ ফতুর করে ছেড়েছেন, দেখছি!
ভাবী বললেন, না ভাই, আমি এতোকিছু কিনতে চাইনি, আপনার বন্ধু পছন্দ করে জোর করে কিনে দিয়েছে।
ভাবী একটা একটা করে ব্যাগ খুলে আমাকে দেখাতে লাগলেন। ভাবী একটা জিনিস দেখাচ্ছেন আর বর্ননা করছেন আরফান কীভাবে কোন জিনিসটা পছন্দ করেছে। তার খুশি উপচে উপচে পড়ছে!
আমি জিনিসপত্র দেখছি আর ভাবছি,আরফানের বউ কতো আগ্রহ নিয়ে তার জামাইয়ের পছন্দ করে কেনা জিনিস দেখাচ্ছে। আচ্ছা, আমার বউয়ের কী এমন ইচ্ছে করে?
অনেকদিন পর আমার মনে হলো,আহা! কতদিন বউকে নিয়ে মার্কেটে আসা হয় না!
তারও নিশ্চয় ইচ্ছে করে করে স্বামীর হাত ধরে মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে। সেও চায় তার স্বামী তাকে পছন্দ করে কিছু কিনে দিক। মুখে হয়তো কিছু বলে না।
আরফান আর তার বউ চলে গেছে।
আমি চুপচাপ খালি কফি মগ হাতে নিয়ে বসে আছি। নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। মানিব্যাগ খুলে দেখলাম, বেশি টাকা নাই,তবে এটিএম কার্ড আছে।
মুভি দেখার টাইম চলে যাচ্ছে। আমার উঠা দরকার, উঠতে পারছি না।
আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম, বউকে ফোন দিয়ে বললাম, তুমি বাচ্চাদের রেখে এক ঘন্টার মধ্যে আমার এখানে চলে আসতে পারবে? একটা সিএনজি নিয়ে চলে আসো।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, মনে হচ্ছে শরীর কিছুটা খারাপই হয়েছে। তুমি কি আসতে পারবে?
বউ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি এখন কোথায়?
—আমি বসুন্ধরা সিটির লেভেল এইটে আছি।
হায় আল্লাহ! তুমি ওখানেই বসে থাকো,আমি এক্ষুনি আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত ওখান থেকে উঠবে না!
এক ঘন্টার কম সময়ে বউ এসে হাজির। সে এসেই আমার কপালে ঘাড়ে হাত বুলাতে লাগলো,জ্বর এসেছে কিনা যাচাই করার জন্য!
আমি হাসিমুখে বললাম, আমার কিছুই হয় নাই, আজ দুইজন মিলে একসাথে মুভি দেখবো,এজন্যই তোমাকে ফোন করে এনেছি। আগে এককাপ কফি খেয়ে ঠাণ্ডা হও।
তবুও তার উৎকন্ঠা যায় না, সে বারবার কপালে,বুকে হাত বুলাতে লাগল। ডাক্তার দেখাতে তাগাদা দিতে লাগল। লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি দুটো কফি অর্ডার করলাম।
বউ কফি খাচ্ছে আর আমার দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছে। সে পরিস্হিতি বুঝার চেষ্টা করছে। এমন একজন মানুষকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে,যার সাথে সে পরিচিত নয়!
আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।
লজ্জা গোপন করে হাসতে হাসতে বললাম, ভয় পাওয়ার কিছু নাই,তোমাকে খুন করার জন্য এখানে আনা হয় নাই। আমি জানি,তোমার নামে তোমার বাবা একটা জমি আলাদা করে রেখেছেন বাড়ি করার জন্য,এখন খুন করলে সেই জমি আমি পাবো না। তোমাকে খুন করলে আমার লস হয়ে যাবে। কফিটা আরাম করে খাও।
কফি খাওয়া শেষ করে বললাম, চল, মুভি দেখবো।
বউ অবাক হয়ে বলল, মাথা খারাপ! বাচ্চাদের বাসায় রেখে এসেছি না? আগে বললে বাচ্চাদের নিয়ে আসতাম!
আমি রোমান্টিক মুড নিয়ে বললাম, আরে দূর! বাচ্চাদের সামনে তোমার সাথে প্রেম করতে পারতাম নাকি!
—বুড়ো বয়সে ভীমরতি কেন হলো, জানতে পারি?
—জানি না। হঠাৎ প্রেম করতে ইচ্ছে হল, কাউকে না পেয়ে ভাবলাম, তোমাকেই ফোন করি!
—আচ্ছা, তাহলে এই ঘটনা!
একটা শাড়ির দোকানে গিয়ে আমি নিজে একটা শাড়ি পছন্দ করলাম, যা আগে কখনোই করিনি। বউকে বললাম, দেখ তো শাড়িটা পছন্দ হয় কিনা!
বউ বলল, তুমি একটা জিনিস পছন্দ করে দিবে,আমার পছন্দ হবে না, তা কি হয়? কিন্তু তুমি আজকে এই দামী শাড়ি কিনছো কেন? বাসায় তো আমার প্রচুর শাড়ি আছে। ওগুলোই ঠিক মতো পরা হয় না। কোন অনুষ্ঠানে গেলে একটু আধটু পরি।
শাড়ি কিনে গেলাম কসমেটিক্সের দোকানে। তার পছন্দসই অনেক জিনিস কিনলাম। বাচ্চাদের জন্যও কিছু কেনাকাটা হলো। আগে তাকে নিয়ে দোকানে ঘুরতে বিরক্তি বোধ করতাম, আজকে সারাক্ষণ তার হাতটা ধরে রাখলাম।
কেনাকাটা করে খেতে গেলাম। সে খাচ্ছে আর গল্প করছে। আমার মনে হলো, বউ অনেকদিন আমার সাথে এতো আনন্দ নিয়ে গল্প করেনি। তার প্রতিটি কথায়, খুশি উপচে উপচে পড়ছে। আনন্দিত মানুষের মুখ দেখাও আনন্দের।
নিজের অজান্তেই মন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল, হায়! জীবন থেকে অনেককিছুই মিস করে ফেলেছি, যা আমার হাতের মুঠোয় ছিল!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সে বাচ্চাদের জন্যও কিছু খাবার প্যাক করে নিলো।
সিএনজিতে উঠে বসে আমার একটা হাত চেপে ধরে রাখলো, যা আগে কখনো করেনি। তক্ষুনি আমার মনে হলো, আরে!বউয়ের ভালবাসা পাওয়া কতো সহজ! অথচ আমরা বেশিরভাগ পুরুষ তা নিতেই জানি না!
এখন যে কোন অনুষ্ঠানে গেলে, বেশিরভাগ জায়গায় সে এই শাড়িটা পরে যায়,যদিও এরচেয়ে দামী শাড়ি তার আছে। শাড়ি নিয়ে কথা উঠলে সে গর্ব করে বলে, এটা আমার হাজবেন্ড পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। আগ্রহ নিয়ে সে শাড়িটা অন্যকে দেখায়। আগে সে কখনোই এসব কথা বলতে পারতো না!
আগে বিভিন্ন অজুহাতে তাকে মার্কেটে নিয়ে যেতে চাইতাম না, এড়িয়ে যেতাম। এখন মন খারাপ হলেই বলি, চল মার্কেট থেকে ঘুরে আসি। মন ভালো লাগবে।
এখন সে আগের মতো যেতে চায় না। সেই মন আর নাই।
মনে মনে ভাবি, যদি আগের জীবনটা ফিরে পেতাম, নিজেকে সংশোধন করে নিতাম।
তা যে হওয়ার নয়!
আমার মনে হয়, বিয়ের পর একটা মেয়ের গর্বের একমাত্র জায়গা হচ্ছে তার স্বামী। মা, বাবা, ভাইবোন বা অন্য আত্বীয় স্বজন নয়।