What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (3 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
326
Messages
6,139
Credits
46,364
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
জোছনা ও জননীর গল্প
[FA]pen[/FA] লেখক: হুমায়ুন আহমেদ



পূর্বকথা

মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেইশ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেমিস্ট্রিতে অনার্স থিয়োরি পরীক্ষা দিয়েছি, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা। সুন্দর সময় কাটছে। আর মাত্র এক বৎসর–M.Sc পাশ করে ফেলব। ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগ দেব। পিএইচডি করতে যাব দেশের বাইরে।

গল্প-উপন্যাসে আদর্শ ভালো ছাত্রের কিছু চিত্র আঁকা হয়। আমি ছিলাম। সে রকম একজন। আদর্শ ভালো ছাত্রের বন্ধু-বান্ধব থাকবে না, আমার ছিল না। তাদের সময় কাটবে বই পড়ে – আমারও তাই কাটে। উনসত্ত্বরের গণআন্দোলনের অতি উত্তেজনাময় সময়ে আমি ছিলাম উত্তেজনামুক্ত তরুণ যুবক, যার একমাত্র বিনোদন পাবলিক লাইব্রেরিতে গল্পের বই পড়া। শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে চা খাওয়া, মাঝে-মধ্যে বাংলা একাডেমীতে উঁকি দেয়া। সেখানে প্রায়ই গানের আসর হতো।

যেখানেই থাকি সন্ধ্যার আগে আগে মহসিন হলে নিজের ঘরে ফিরে আসতাম। ভালো ছাত্র হিসেবে সেখানে আমি একটি সিঙ্গেল সিটের রুম পেয়েছিলাম। নানান ধরনের বই দিয়ে রুম ভর্তি করে ফেলেছিলাম। গানের প্রতি আমার প্রবল দুর্বলতা দেখে বাবা আমাকে একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছিলেন। বাইরে যখন ভয়াবহ আন্দোলন চলছে, তখন আমি দরজা বন্ধ করে গান শুনছি–কেন পান্থ এ চঞ্চলতা?

আমার সাজানো অতি পরিচিত ভুবন পুরোপুরি ভেঙে পড়ল ১৯৭১ সনে। যে পরিস্থিতিতে আমি পড়লাম, তার জন্যে কোনোরকম মানসিক প্ৰস্তুতি আমার ছিল না! ছায়াঘেরা শান্ত দিঘির একটা মাছ কি হঠাৎ যেন নিয়ে যাওয়া হলো চৈত্রের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া স্থলভূমিতে। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা! ভাইবোন নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাচ্ছি। জীবন বাঁচানোর জন্যে মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে গেছি শর্ষিনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। পাকিস্তান মিলিটারি মাথায় গুলির বাক্স তুলে দিয়েছে। অকল্পনীয় ওজনের গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে বারহাট্টা থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছি নেত্রকোনা পর্যন্ত। মিলিটারির বন্দিশিবিরে কাটল কিছু সময়। কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার! এক সকালে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল সাইজের একটা সাগরকলা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে। এটা তোমার জন্যে ভালো। তুমি যদি নিরপরাধ হও, সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। আর যদি অপরাধী হও, তাহলে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি।

এইসব ঘটনা আমি নানান সময়ে নানান পত্র-পত্রিকায় লিখেছি। মুক্তিযুদ্ধের আনন্দ, বেদনা, হতাশা, গ্লানি নিয়ে বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছি। কয়েকটা উপন্যাসও লিখেছি। একসময় মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে রাখার জন্যে একটা উপন্যাস লেখা উচিত। মানুষকে যেমন পিতৃঋণ-মাতৃঋণ শোধ করতে হয়, দেশমাতার ঋণও শোধ করতে হয়। একজন লেখক সেই ঋণ শোধ করেন লেখার মাধ্যমে।

লেখা শুরু করলাম। জোছনা ও জননীর গল্প ধারাবাহিকভাবে ভোরের কাগজে ছাপা হতে লাগল। আমি কখনোই কোনো ধারাবাহিক লেখা শেষ করতে পারি না। এটিও পারলাম না। ছয়-সাত কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ করে দিলাম। দুবছর পর আবার শুরু করলাম। আবারো কয়েক কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ। আর লেখা হয় না। অন্য লেখা লিখি, নাটক বানাই, সিনেমা বানাই, মুক্তিযুদ্ধের লেখাটা আর ধরা হয় না। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে–তখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই যে, লিখব একদিন লিখব। ব্যস্ততা কমলেই লেখা শুরু করব। এখনো সময় আছে। অনেক সময়।একদিন হঠাৎ টের পেলাম অনেক সময় আমার হাতে নেই। সময় শেষ হয়ে গেছে। জোছনা ও জননীর গল্প আর লেখা হবে না। তখন আমি শুয়ে আছি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের একটা ট্রলিতে। দুজন নার্সট্রিলি ঠেলে আমাকে অপারেটিং টেবিলে নিয়ে যাচ্ছেন। ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। আমাকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। চোখের পাতা ভারী হতে শুরু করেছে। হাসপাতালের আলোর তীব্ৰতা দ্রুত কমে যাচ্ছে।

যখন অচেতন হতে শুরু করেছি, তখন মনে হলো জোছনা ও জননীর গল্প তো লেখা হলো না। আমাকে যদি আর একবার পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হয়–আমি এই লেখাটি অবশ্যই শেষ করব। অচেতন হবার আগ মুহুর্তে হঠাৎ আনন্দে অভিভূত হলাম। কারণ তখনই প্রথম টের পেলাম আমি আসলেই একজন লেখক। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাবার আগের মুহূর্তে অসমাপ্ত লেখার চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা।

দেশে ফিরে লেখায় হাত দিলাম। শরীর খুব দুর্বল। দিনে দুই তিন পাতার বেশি লিখতে পারি না। এইভাবেই লেখা শেষ করেছি। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি দেশমাতার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছি। এই আনন্দের কোনো সীমা নেই।

জোছনা ও জননীর গল্প কোনো ইতিহাসের বই না, এটা একটা উপন্যাস। তারপরেও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। সেখানেও ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। হওয়াটাও স্বাভাবিক। উপন্যাস যেহেতু কোনো আসমানী কিতাব না, এইসব ভুল-ভ্ৰান্তি দূর করার উপায় আছে।

উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষজন এনেছি। এই স্বাধীনতা একজন ঔপন্যাসিকের আছে। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলায় কোনো ভুল। যদি করে থাকি, তার জন্যে আগেভাগেই ক্ষমা চাচ্ছি। অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি–একজন লেখক যা লিখবেন, সেটাই সত্যি।

সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি রামের জনম স্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।।

উপন্যাসে বর্ণিত প্ৰায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেয়া। প্রকাশিত হবার আগেই এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি (এই প্রজন্মের পাঠকদের কথা বলছি)। তারা পড়ার পর বলেছে–উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এরকমও কি হয়?

তাদের কাছে আমার একটাই কথা–সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।

জোছনা ও জননীর গল্প বইটি লেখার ব্যাপারে নানান তথ্য দিয়ে যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত বইগুলি আমাকে খুব সাহায্য করেছে। বিশেষ করে উল্লেখ করছি। রবীন্দ্রনাথ ত্ৰিবেদীর লেখা ৭০১-এর দশমাস গ্রন্থটি। দীর্ঘ দশমাসের প্রতিদিনের ঘটনা তিনি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। লেখকলেখিকাদের ডায়েরির মতো লেখা বইগুলিও আমাকে সাহায্য করেছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন কী ঘটছিল ডায়েরি পড়ে তা বোঝা যাচ্ছিল। তবে এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা খটকার কথাও বলি। ডায়েরি জাতীয় গ্রন্থগুলি পড়ে আমার মনে হয়েছে সেগুলি তখনকার লেখা না। পরে তারিখ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কারণ একজন কোনো একটি বিশেষ দিনে লিখছেন–ঢাকা শহরে সকাল থেকেই প্ৰবল বর্ষণ, আরেকজন একই দিনে লিখছেন–কঠিন রোদ। রোদে ঢাকা শহর ঝলসে যাচ্ছে। একজন লিখছেন–এই মাত্র খবর পেলাম প্ৰবাসী সরকার শপথ নিয়েছে। অথচ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে তার দুদিন পরে। ডায়েরি রচনায় রাজনৈতিক মতাদর্শও কাজ করেছে। কারো কারো ডায়রিতে প্রতিদিনকার সমস্ত খুঁটিনাটি আছে, কিন্তু জিয়াউর রহমান নামের একজন মেজর যিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে সবাইকে আহবান করেছেন সেই উল্লেখ নেই। তাঁর নামটিও নেই।


জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণ প্রসঙ্গেও একই ব্যাপার। জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেবের বিখ্যাত গ্ৰন্থ বাংলাদেশের তারিখ প্রথম সংস্করণে তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, জয় বাংলা। জিয়ে পাকিস্তান। দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি জিয়ে পাকিস্তান অংশটি বাদ দিলেন। কবি শামসুর রহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকণ্ঠে কালের ধূলোয় লেখা শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল জিয়ে পাকিস্তান। আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাবধারার মানুষ। সমস্যা হলো আমি নিজে ৮ এবং ৯ মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম কোনো তথ্য পাই নি। তাহলে একটি ভুল ধারণা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?

বঙ্গবন্ধু যদি জিয়ে পাকিস্তান বলে থাকেন তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। তিনি যা বলেছেন। অবশ্যই ভেবে চিন্তেই বলেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে। তাকে সময় নিতে হবে। ৭ই মার্চে যুদ্ধ ঘোষণার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ গেটেসবার্গ এড্রেসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। এখানে কোনো অস্পষ্টতা থাকা বাঞ্ছনীয় না।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের দলিলের পনেরো খণ্ডের মধ্যে সাতটি খণ্ড আমি মন দিয়ে পড়েছি। আমার উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের দলিল থেকে সরাসরি অনেক অংশ ব্যবহার করেছি। এই দলিল নিয়েও আমার কিছু খটকা আছে। একটি শুধু বলি–রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বন্দি তরুণীদের উপরে নির্যাতনের সাক্ষ্য গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে তাদেরকে পায়ে দড়ি বেঁধে বুলিয়ে রাখা হতো। যে তরুণীদের রাখা হয়েছে ভোগের জন্যে তাদেরকে এভাবে বুলিয়ে রাখার পেছনের যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার না। তারপরেও ধরে নিলাম। তাই করা হয়েছে। যা আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য না। তা হলো সাক্ষ্যদানকারী বলছেন এইসব তরুণীদের সঙ্গে বই-খাতা-কলম ছিল। অর্থাৎ স্কুল বা কলেজে যাবার পথে তাদের ধরা হয়েছে। যে ভয়ঙ্কর সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে-সময় স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সবই বন্ধ। বইখাতা নিয়ে কারো বাইরে যাবার প্রশ্নই উঠে না। আমার ধারণা সাক্ষ্যপ্রমাণমূলক তথ্যগুলি ভালোমতো যাচাই করা হয় নি। তাছাড়া জাতিগতভাবেও আমরা অতিকথন পছন্দ করি।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছোট করে দেখানোর একটি প্রবণতাও আমাদের আছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর কেউ যদি বাংলাদেশে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস এবং ছোটগল্প পড়ে যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা করতে চায় তাহলে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিষয়ে কিছুই জানবে না। আমাদের গল্প উপন্যাসে বিদেশী সৈন্যবাহিনীর বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। লেখকরা হয়তো ভেবেছেন এতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবের হানি হবে।

ঋণ স্বীকারে অগৌরবের কিছু নেই। মহান জাতি এবং মহান মানুষরাই ঋণ স্বীকার করেন। আমি আমার বইটিতে আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্যে যেসব ভারতীয় সৈন্য প্ৰাণ দিয়েছিল তাদেরে একটি তালিকা দিতে চেয়েছিলাম, যাতে পাঠকরা এই দীর্ঘ তালিকা পড়ে একবার শুধু বলেন–আহারে!

তালিকা শেষপর্যন্ত দিলাম না, কারণ তাতে বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা আরো একশ বাড়ত। তাছাড়া এই তালিকা যুক্ত করলে অবশ্যই যুদ্ধে শহীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সেসময়কার ইপিআর (বর্তমান বিডিআর), পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিতে হতো। আপনারা শুনে বিক্ষিত হবেন, পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমাদের হাতে নেই। এখনো তৈরি হচ্ছে। তেত্রিশ বছর আগে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয় নি। কবে শেষ হবে?

বীরশ্ৰেষ্ঠ তালিকার দিকে আমি প্রায়ই তাকাই। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলি। এই তালিকায় একজনও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা নেই। অথচ আমি জানি এবং খেতাব যারা দিয়েছেন তারাও জানেন, বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। যুদ্ধের ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই তারা যা করেছেন তার তুলনা হবে না। অথচ এরা কেউ স্বীকৃতি পান না। কেন না?

আমার এই বইটির অসম্পূর্ণতার মধ্যে একটি হলো আমি পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা অত্যাচারিত নারীদের বিষয়টি আনতে পারি নি। বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর এবং এতই কষ্টকর যে কিছুতেই লিখতে পারলাম না। আশা করছি। অন্যরা লিখবেন। তাদের কলমে এইসব হতভাগ্য তরুণীর অশ্রুজল উঠে আসবে।

এখন নিতান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয় উল্লেখ করি, আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে আমার জন্মদিনে গুলতেকিনে আমাকে একটা খাতা উপহার দিয়েছিল। স্পাইরেল বাইন্ডিং করা পাঁচশ পৃষ্ঠার নীল মলাটের খাতা। তার অনুরোধ ছিল প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা করে হলেও যেন আমি খাতাটায় মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় উপন্যাস লিখি।

সারা জীবনই গুলতেকিনকে অসুখী করেছি। মনে হয় আজ সে খুশি হবে। পরম করুণাময় আমাকে এই গ্রন্থটি লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি জানাচ্ছি। আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। দল-মত-ধর্ম সবকিছুর উর্ধে একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশের কামনা করে পূর্বকথা শেষ করছি।

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্পী, গাজীপুর



দ্বিতীয় সংস্করণের শুদ্ধি অভিযান

জোছনা ও জননীর গল্প নির্ভুল করার চেষ্টা হিসেবে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাকে সবচে বেশি সাহায্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক মেজর (অব) কামরুল হাসান ভূইয়া। আমি জানতাম না যে ৩৬তম ডিভিশন হয় না। তম বাদ যাবে, কিংবা আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ান হবে না। ব্যাটেলিয়ান স্বাধীনতার পরে হয়েছে। শুদ্ধ পাঠ হবে আর্মড পুলিশ। মেঘালয়ের বাংলাদেশ হাসপাতাল হবে না। হবে ত্রিপুরায় বাংলাদেশ হাসপাতাল। এই ভুলটি বেশ বড় ভুল। হারুন হাবীবের লেখায় ডা. সিতারা বেগম বীর প্রতীকের আত্মজৈবনিক অংশে তিনি লিখেছেন মেঘালয়ে বাংলাদেশ হাসপাতাল। আমি সরাসরি সেই লেখা উদ্ধৃত করেছি বলে ভুলটি হয়েছে। ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার টেলিভিশনে যে ভাষণ দিয়েছেন বলে আমি লিখেছি সেটাও ভুল। তিনি কোনো ভাষণ দেন নি, তাঁর বিবৃতি পাঠ করা হয়েছে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ত্ৰিবেদী তীর বহুল পঠিত গ্রন্থে ভাষণের কথা বলেছেন। সূত্র হিসেবে দৈনিক পাকিস্তান উল্লেখ করেছেন। আমি রবীন্দ্রনাথ ত্ৰিবেদীর ভাষাটাই নিয়েছিলাম।

প্ৰথম দফা শুদ্ধি অভিযানের পর আমি আরো একটি শুদ্ধি অভিযানের জন্যে অপেক্ষা করছি।

আমার ছোটভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বইটিতে বৈজ্ঞানিক তথ্যের একটি ভুল বের করেছে। যে সময়ের কথা বইটিতে আছে সে সময়ে আকাশে কালপুরুষ থাকে না। এই ভুলটি শুদ্ধ করলাম না। কালপুরুষে যে রহস্যময়তা আছে। অন্য তারামণ্ডলীতে সেই রহস্যময়তা নেই।

থাকুক কিছু ভুল। খাদবিহীন গয়নায় অলংকার হয় না। চাঁদের সৌন্দর্যের একটি কারণ তার কলঙ্ক।

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্পী, গাজীপুর
 
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর বয়স প্রায় ষাট। স্থূলকায় বেঁটেখাটো মানুষ। মুখভর্তি দাড়ি। দাড়ির রঙ সাদাও না কালোও না। সাদাকালোর মাঝামাঝি। মাথা সম্পূর্ণ কামানো। জুম্মাবার সকালে নাপিত এসে তাঁর মাথা কামিয়ে দিয়ে যায়। কামানো মাথায় না-কি পাগড়ি পরতে সুবিধা। শুক্রবারে তিনি পাগড়ি পরেন। চোখে সুরমা দেন। কানের লতিতে সামান্য আন্তর দেন। জানু পর্যন্ত লম্বা পিরান। পরে জুম্মার নামাজে ইমামতি করতে যান। গত পনেরো বছর ধরেই তিনি এই কাজ করছেন। নীলগঞ্জ জুমা মসজিদের আলাদা ইমাম আছে। শুধু জুম্মার নামাজের দায়িত্ব তিনি পালন করেন।

ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর হাতে ধবধবে সাদা রঙের একটা রাজহাঁস। তিনি ডান হাতে রাজহাঁসের গলা চেপে ধরে আছেন। রাজহাঁস ছটফট করছে, পাখা ঝাপটাচ্ছে। কাশেমপুরীর মুখ থমথম করছে, কারণ ট্রেন থেকে নামার সময় এই বিশাল পক্ষী ঠোকর দিয়ে তাঁর কনুই থেকে রক্ত বের করে দিয়েছে। তাঁকে ঘিরে ছােটখাটো ভিড়। জনতা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কাশেমপুরী ও তার রাজহঁ ন জনতার মধ্যে একধরনের আনন্দ মিশ্ৰিত আগ্ৰহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

ইরতাজউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, ব্যাপারটা কী? আপনারা রাজহাঁস। এর আগে দেখেন নাই? যান যান, কাজে যান। অকাজে সময় নষ্ট করছেন কেন? আপনাদের কোনো কাজ নাই?

কাজে যাওয়ার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ দেখা গেল না, কিংবা কারো হয়তো কোনো কাজ নেই। তারা ইরতাজউদ্দিনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের সঙ্গে আবো কয়েকজন যুক্ত হলো। এই পর্যায়ে রাজহাঁস আরেকবার ঠোকর দিল। সেই আগের জায়গায়, বা হাতের কনুইয়ে। ইরতাজউদ্দিন বাপ রে! বলে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। জনতার আনন্দের সীমা রইল না। তাদের প্রতীক্ষ্ণ বৃথা যায় নি। এতক্ষণে দেখার মতো ঘটনা ঘটেছে। ইরতাজউদ্দিন বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, মানুষ তার নিজ প্রজাতির দুঃখ-কষ্টে এত আনন্দিত হয় কেন? তিনি ব্যথা পেয়েছেন। এতে অন্যরা আনন্দিত হবে কেন? এর মধ্যে রহস্যটা কী? ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে একসময় ভাবতে হবে। এখন কিছুই ভাবা যাবে না। মাথা গরম হয়ে আছে। এর মধ্যে একজন উপদেশ দিতে এগিয়ে এলো। গম্ভীর গলায় উপদেশ দিল। জাতি হিসেবে বাঙালির উপদেশগ্ৰীতি আছে।

চাচামিয়া, ঠোঁট চাইপ্যা ধরেন। ঠোঁট চাইপ্যা ধরলে আর ঠোকর দিব না।

ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার যা করার আমি করব। এ নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি কথা বলবেন না।

উপদেশদাতার উৎসাহ তাতে কমল না। সে জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, জোড়া সাথে না থাকনে এই অবস্থা। জোড়া সাথে থাকলে রাজহাঁস শান্ত থাকে। মাওলানা সাব, এর জোড়াটা কই?

ইরতাজউদ্দিন কটমট করে তার দিকে তাকালেন। জবাব দিলেন না।
 
ফাল্লুন মাসের শুরু। রাত এগারোটার মতো বাজে। গ্রামে এই সময়ে শীত থাকে। নীলগঞ্জে তাঁকে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমুতে হয়। এখানে ভ্যাপসা গরম। আকাশে মেঘ আছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ফাল্লুন মাসে এরকম ভ্যাপসা গরম থাকার কথা না। আকাশে মেঘ থাকার জন্যেই বোধহয় এই অস্বাভাবিক উত্তাপ। বিদ্যুৎ যেভাবে চমকাচ্ছে তাতে মনে হয় বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামলেও সমস্যা। তিনি ছাতা আনেন নি। বাইরে বের হলে তিনি সবসময় ছাতা সঙ্গে রাখেন। এবারই ভুল করে ছাতা আনেন নি। বয়স যে হচ্ছে এটা তার লক্ষণ। বয়সকালেই মানুষ ছোটখাটো ভুল করতে থাকে। ছোটখাটো ভুল করা যখন অভ্যাস হয়ে যায়। তখন করে বড় ভুল।

ইরতাজউদিনের গায়ে তসরের গলাবন্ধ কোটি। গলায় মাফলার। গরমে তার গা ঘেমে যাচ্ছে। কে জানত ঢাকা শহরে ফায়ুন মাসের শুরুতে শীত থাকে না। শহরে মানুষ বেশি হয়ে গেছে। মানুষের শরীরের গরমে শহর গরম। কত লক্ষ লোক এখন এই শহরে বাস করছে কে জানে! সংখ্যাটা জানা থাকা দরকার।

তাঁর পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি কোথায় পাওয়া যায় ইরতাজউদ্দিন জানেন না। এরা এত বড় স্টেশন বানিয়ে রেখেছে কিন্তু পানির ব্যবস্থা রাখে নি। পুটলা-পুটলি, পানির পিপাসা এবং কনুইয়ে হাঁসের কামড় নিয়ে তিনি বড়ই বিব্রত বোধ করছেন। তাকে যেতে হবে মালিবাগ। ১৮/৬ পশ্চিম মালিবাগ, গলির ভেতর বাসা। আগে একবার মাত্র এসেছেন, এখন খুঁজে পাবেন কিনা কে জানে। ঢাকা শহরের সব গলি তাঁর কাছে একরকম লাগে। শুধু গলি কেন, এই শহরের মানুষগুলিও একরকম লাগে। মানুষ তো না, যেন মানুষের ছায়া। মানুষের সঙ্গে মানুষের তফাত করা যায়, ছায়ার সঙ্গে ছায়ার তফাত করা যায় না। ঢাকা হলো ছায়ামানুষের দেশ। ছায়ানগরী।

কমলাপুর থেকে মালিবাগ এক টাকা ভাড়ায় ইরতাজউদ্দিন একটা রিকশা জোগাড় করে ফেললেন। রিকশাওয়ালা তাঁকে ঠকালো কিনা। তিনি বুঝতে পারছেন না। ঢাকা শহরে তাঁর আসা হয় না। রিকশা ভাড়া সম্পর্কে তাঁর ধারণা নেই। তিনি কাউকে ঠকাতে চান না। কারো কাছ থেকে ঠকাতেও চান না। শহরের মানুষ অন্যকে ঠকাতে ভালোবাসে।

রিকশাওয়ালা ভাই, আপনার নাম কী?

বদরুল।

শুনেন ভাই বদরুল, এক টাকার বদলে আমি আপনাকে দুই টাকা দেব, আপনি বাসাটা খুঁজে বের করে দেবেন। আমার কাছে ঠিকানা আছে— ১৮/৬ পশ্চিম মালিবাগ। রাজি আছেন? রাজি থাকলে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। রাজি না থাকলে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নাই।

বাসা রেল গেইটের লগে?

এইসব আমার কিছুই মনে নাই। একবার মাত্র এসেছিলাম। শুধু মনে আছে বাসার সঙ্গে একটা ছাতিম গাছ আছে। মরা গাছ। ছাতিম হলো পল্লী গ্রামের গাছ। এরা শহরে বাঁচে না বলেই মরা।

উঠেন দেহি আল্লাহ ভরসা।

আপনাকে আলহামদুলিলাহ বলতে বলেছিলাম, বলেন আলহামদুলিল্লাহ।

রিকশাওয়ালা বিস্মিত গলায় বলল, আলহামদুলিল্লাহ।

রাত কম হয় নি। অথচ দোকানপটি খোলা, রাস্তায় প্রচুর লোক, চায়ের দোকানে গান বাজছে। এর মানে কী? এরকম কি সারারাতই চলবে? এরা রাতে ঘুমুবে না? কিছুদূর যেতেই তাঁর রিকশা একটা মিছিলের মধ্যে পড়ে গেল। বড় কিছু না, পঁচিশ-ত্রিশজনের মিছিল। তবে তাদের সবার হাতেই মশাল। মশাল থেকে আলো যত না বের হচ্ছে তারচে বেশি বের হচ্ছে ধোয়া। প্রত্যেকের মুখ ঘামে চকচক করছে। তাদের গলা তত জোরালো না। মনে হয় অনেকক্ষণ মিছিল করে তারা ক্লান্ত।
 
বদরুল রাস্তার একপাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে কৌতূহলী চোখে মিছিলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা একটাই স্লোগান দিচ্ছে–জ্বলো জ্বলো আগুন জ্বলো। ইরতাজুদ্দিন ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন–এটা কেমন স্লোগান? জ্বলো জ্বলো আগুন জ্বলো কেন? শ্লোগান হওয়া উচিত শান্তিবিষয়ক—নেভাও নেভাও আগুন নেভাও।

মিছিল দেখে রাজহাঁস উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। লাফ দিয়ে নেমে পড়তে চাচ্ছে। ইরতাজউদ্দিন বিরক্তমুখে হাঁসের গলা চেপে ধরে বসে আছেন। রাজহাঁস অবাক হয়ে মিছিলের মশাল দেখছে। তার জীবন কেটেছে কুপি এবং চাঁদের আলোর আশপাশে। মশালের আলোয় সে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের মতোই অভ্যস্ত নয়। মাঝে মাঝেই সে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

মিছিল হুট করে একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল। হঠাৎ চারদিক শান্ত হয়ে গেল। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে শুরু করল। খুশি খুশি গলায় বলল, রাজহাঁসটার দাম কত হইছে ছার?

ইরতাজউদ্দিনের মন খারাপ হয়ে গেল। শহরের মানুষ সবকিছু বিবেচনা করে দাম দিয়ে। ভালো কিছু দেখলে প্রথমেই সে দাম জিজ্ঞেস করবে।

থাকে মালিবাগে, তার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। না, ঠিক তার জন্য না। তার একটা মেয়ে আছে, এপ্রিল মাসে তার বয়স হবে চার। তার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। শিশুরা পশুপাখি পছন্দ করে।

ও।

শহর বন্দরে থাকে, এইসব জিনিস তো দেখে না।

ইরতাজউদ্দিন সাহেব লক্ষ করলেন তাঁর ক্ষুধাবোধ হয়েছে। নানান উদ্বেগ ও উত্তেজনায় তাঁর ক্ষুধার কথা এতক্ষণ মনে হয় নি, এখন ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। সন্ধ্যায় কিছু খাওয়া হয় নি। রাত হয়েছে মেলা। বারোটার কম না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিধে সহ্য করার ক্ষমতাও মানুষের কমে যায়। বয়সে শুধু যে শরীর ভাঙে তাই না, শরীরের ভেতরে যে আত্মা বাস করে সেই আত্মাও ভাঙতে থাকে। আত্মা ক্ষতিগ্ৰস্ত হবার কারণে বুড়োরা নিজের অজান্তেই ভ্ৰান্তির জগতে চলে যায়। তিনি নিজেও চলে গিয়েছেন। কিনা কে জানে। একমাত্র সত্যবাদীতাই ভ্ৰান্তির জগতে প্রবেশে বাধা দেয়। তিনি এই কারণেই সত্য কথা বলেন। গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে তিনি মিথ্যা বলেছেন–এরকম মনে পড়ে না।

মালিবাগে অনেকক্ষণ ধরেই রিকশা ঘুরছে। বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নাম্বারের কোনো ঠিকািঠকানা নেই। এই তেরো নম্বর বাড়ি, পরেরটাই একশ এগারো। মাঝখানের নম্বরগুলি গেল কোথায়? পশ্চিম মালিবাগ যদি থাকে তাহলে পূর্ব মালিবাগও থাকার কথা। পূর্ব মালিবাগ বলে কিছু নেই। আশ্চর্য কথা। গলিতে লোকজন তেমন নেই, মাঝে মাঝে যে দুএকজনকে পাওয়া যাচ্ছে তারা এই পৃথিবীতে বাস করে বলেই মনে হয় না। ১৮/৬ বাসাটা কোথায়?–জিজ্ঞেস করার পর অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর হাই তোলে। বিস্মিত মানুষ হাই তুলতে পারে না। এদের বিস্ময় যেমন মেকি, হাইটাও তেমনি মেকি। শহরের সবকিছুই মেকি।

এতক্ষণ ধরে মাফলার পরে থাকায় গলা চুলকাচ্ছে। দুটা হাতই বন্ধ, গলা চুলকানো সম্ভব না। মানুষের তিনটা করে হাত থাকলে ভালো হতো। তিন নম্বর হাতটা সময়ে অসময়ে কাজে লাগত। এই ধরনের অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসায় ইরতাজউদ্দিন মনে খুবই দুঃখ পেলেন। আল্লাহপাক অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মানুষ বানিয়েছেন। তিনি যদি মনে করতেন মানুষের তিনটা হাত প্রয়োজন, তিনি তিনটাই দিতেন। ইরতাজউদ্দিন মনে মনে তিনবার বললেন, তওবা আস্তাগাফিরুল্লাহ।

রাজহাঁসটা বড়ই যন্ত্রণা করছে। তিনি গলা চেপে ধরে আছেন এই অবস্থাতেও কামড়াতে চেষ্টা করছে। দুটা হাঁস আনেন নি। তাঁর দুটা আনারই পরিকল্পনা ছিল। একটাকে ধরা গেল না। মেয়ে-হাঁসটা ধরা পড়ল। তার পুরুষ সঙ্গী ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরে। বেচারা এখন বোধহয় সঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জোড় ভেঙে একটাকে আনা ঠিক হয় নি। ইরতাজউদিনের মন খারাপ লাগছে। বোবা প্ৰাণী মনের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারবে না। একজন আরেকজনকে খুঁজবে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় ব্যথিত হবে। তারপরেও তাকে বাস করতে হবে মানুষের সঙ্গে। এই তাদের নিয়তি।
 
বাসা শেষপর্যন্ত পাওয়া গল। এই তো লেখা–১৮/৬। এই তো ছাতিম গাছ। আগে যেমন মরা মরা ছিল, এখনো মরা মরা। ইরাতাজউদ্দিন সাহেব; রিকশাওয়ালাকে দুই টাকার বদলে অতিরিক্ত একটা আধুলি দিলেন। তাঁর ইচ্ছা! করছে এক টিন মুড়িও দিয়ে দিতে। শাহেদের কথা মনে করে এনেছেন বলে দিতে পারছেন না।

বদরুল মিয়া।

জি ছার। আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। আমি আপনার জন্য খাস দিলে দোয়া করব।

বদরুল গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, আপনি আজিব লোক।

আজিব কেন?

বখশিশ দিলেন। আবার দোয়া করলেন। কেউ এমুন করে না।

ইরতাজউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, আমরা সবাই আজিব। আমি যেমন আজিব, আপনিও আজিব। আল্লাহপাক আজিব পছন্দ করেন বলেই এই দুনিয়ায় আজিবের ছড়াছড়ি।



বাসার সবাই ঘুমে।

ঘর অন্ধকার। গেট তালাবন্ধ। ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত হচ্ছেন। শহরের লোকজনের অবিশ্বাস দেখে বিরক্ত। গেটে তালা দেওয়ার দরকার কী?

অনেকক্ষণ গেট ধরে ধাক্কাধাব্ধি এবং উচু গল্পায় শাহেদ শাহেদ বলে চিৎকারের পর ঘরের ভেতরে বাতি জুলল। অপরিচিত একজন লোক দরজা খুলে বের হয়ে এসে বললেন, কে?

লোকটা লম্বা ও ফর্সা। গলার স্বর মেয়েলি। গলার স্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে তিনি ভয় পেয়েছেন।

আপনি কে?

আমি ইরতাজউদ্দিন। নীলগঞ্জ থেকে আসছি। এসিসটেন্ট হেডমাস্টার, আরবি ও ধর্ম শিক্ষক। নীলগঞ্জ হাইস্কুল।

কাকে চান?

শাহেদের কাছে এসেছি। আমি শাহেদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছি। গোস্তাকি মাফ হয়। আসসালামু আলায়কুম।

লোকটি এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখন দরজার আড়ালে চলে গেলেন। তবে দরজা খোলা, লোকটাকে এখনো দেখা যাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক তিনি ভয় পাচ্ছেন। তাকে দেখেও লোকজন ভয় পেতে পারেএই চিন্তাটা ইরতাজউদ্দিনকে পীড়িত করছে। কী করে তিনি লোকটার ভয় ভাঙাবেন তাও বুঝতে পারছেন না। লোকটা সালামের জবাব দেয় নাই। এটা তো ঠিক না। সালাম হচ্ছে শান্তির আদান-প্ৰদান।

শাহেদ নামে কেউ এই বাড়িতে থাকেন না।

থাকেন না মানে?

উনি চলে গেছেন। আমি নতুন ভাড়াটে।

কোথায় গেছে জানেন?

না।

কেউ কি জানে?

আমি জানি না কেউ জানে কি-না।

ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করার উপক্রম করেছেন। ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, ভাইসাহেব, আপনি একটু আসবেন। এদিকে। গোটটা খুলবেন?

কেন?

আমার সঙ্গে একটা রাজহাঁস ছিল, ঐটা আপনাকে দিয়ে যেতাম।

রাজহাঁস?

শাহেদের বাচ্চার জন্যে এনেছিলাম। এত রাতে এই হাঁস নিয়ে কোথায় ঘুরব? হাঁসটা আপনি গ্রহণ করলে আমার উপকার হয়।

অন্যের হাঁস। আমি খামাখা রাখব কেন?

আপনার ঘরেও নিশ্চয়ই বাচ্চা-কাচ্চা আছে, তারা খুশি হবে।

ভদ্ৰলোক দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এলেন। দরজার ফাঁকে তার স্ত্রীর মুখ দেখা যাচ্ছে। তিনিও কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন হাঁসটার দিকে। ইরতাজউদ্দিন ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, এই রাজহাঁসটা আর জিনিসগুলি রাখলে আমি খুশি হবো। অস্বস্তি বোধ করার কিছুই নেই! হাঁসটা নিয়ে আমি বিপদে পড়েছি।

দরজার ফাঁকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের অপরূপ রূপবতী একটি কিশোরীর মুখ দেখা গেল। মেয়েটির নাম রত্নেশ্বরী, সে ভিকারুন নিসা নুন স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ে; রত্নেশ্বরী বড়ই অবাক হয়েছে। তার জীবনে এমন বিস্ময়কর ঘটনা আর ঘটে নি। রাতদুপুরে সাধু সাধু চেহারার এক লোক এসে তাদের রাজহাঁস দিতে চাচ্ছে। আগামীকাল ক্লাসে গল্পটা কীভাবে বলবে, তা ভেবেই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। গল্পটা অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। সন্ন্যাসী ধরনের এই লোকটার একটা ছবি তুলে রাখতে পারলে ভালো হতো!

রত্নেশ্বরী ফিসফিস করে তার মাকে বলল, মা, এই হাঁসটা কি আমরা রাখব?

রত্নেশ্বরীর মা নিচু গলায় বললেন, জানি না। দেখি তোর বাবা কী বলেন।

ভদ্রলোক কে মা?

জানি না।

ইরতাজউদ্দিন সাহেব রত্নেশ্বরীর বাবার দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ছোট মেয়েটা কি আপনার কন্যা? বড়ই মিষ্টি চেহারা। কী নাম তোমার মা?

রত্নেশ্বরী জবাব দেয়ার আগেই তার বাবা বললেন, আপনি এখন যান। আমরা হাঁস-ফাস কিছু রাখব না।

ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আচ্ছা না রাখলেন, গোটটা খুলুন। আমার বাথরুমে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

রত্নেশ্বরীর বাবা বললেন, গেট খোলা যাবে না। আমার কাছে গেটের চাবি নাই।

কথা সত্যি না। চাবি ঘরেই আছে–ওয়ারড্রোবের উপর রাখা আছে। রত্নেশ্বরীর মা ফিসফিস করে বললেন, খুলে দাও না। বেচারা বুড়ো মানুষ। রত্নেশ্বরীর বাবা চাপা গলায় বললেন, যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। যাও, ভেতরে যাও। স্ত্রী-কন্যাকে ভেতরে ঢুকিয়ে তিনি শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
 
বারান্দার বাতির সুইচ ভেররে। ভেতর থেকে সুইচ নিভিয়ে দিয়ে বারান্দা অন্ধকার করে দেয়া হলো। ইরতাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যথা ও বিস্ময়ে তিনি খানিকটা কাতর। এরা এমন করল কেন? মানুষের প্রতি মানুষের সামান্য মমতা থাকবে না!

গেটের উপর দিয়ে তিনি রাজহাঁসটা ভেতরে ছুঁড়ে দিলেন। হাঁসটা থাকুক। মুড়ির টিন পুটলা-পুটলি সঙ্গে নিয়েই বা কী হবে? রিকশাওয়ালাটা থাকলে তাকে দিয়ে দেয়া যেত। থাকুক পুটলা-পুটলি গেটের সামনে। অভাবী লোকজন এসে নিয়ে যাবে। বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না। তবু ইরতাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। তার কেন জানি মনে হচ্ছে বন্ধ দরজা আবার খুলে যাবে। পরীর মতো দেখতে কিশোরী মেয়েটা তাকে বলবে, আপনি ভেতরে আসুন। মা আপনাকে ভেতরে আসতে বলেছে।

রাজহাঁসটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি হাঁসটাকে বললেন, যাই রে। রাজহাঁস কুৎসিত একধরনের শব্দ করল। সম্ভবত তাকে যাবার অনুমতি দিল। ইরতাজউদিনের মনে হলো, যে পাখি যত সুন্দর তার কণ্ঠস্বর তত কুৎসিত। যেমন ময়ূর। সে দেখতে সুন্দর কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কর্কশ। একমাত্র ব্যতিক্রম কাক। সে নিজে অসুন্দর, তার কণ্ঠস্বরও অসুন্দর।

টিপটপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অসহ্য গরমের পর বৃষ্টিটা ভালো লাগছে। ইরতাজউদ্দিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছেন। বৃষ্টির মধ্যে কেমন যেন আঠালো ভাব। শরীরের যে জায়গায় পড়ছে। সেখানটাই আঠা আঠা হয়ে যাচ্ছে।

তিনি গলি থেকে বের হলেন, বৃষ্টিও থেমে গেল। বড় রাস্তায় আবারো একটা মশাল মিছিল। এই মিছিলটিা আগেরটার চেয়ে ছোট। না-কি আগের মিছিলটাই ঘুরে এসেছে? ইরতাজউদ্দিন মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। যেন তিনি মিছিলের একজন। এই মিছিল কোন দিকে যাচ্ছে তিনি জানেন না। তিনি নিজে কোথায় যাবেন তাও জানেন না। পল্লী অঞ্চল হলে যে-কোনো একটা বাড়িতে গিয়ে বিপদের কথা বললেই আশ্রয় পাওয়া যেত। তারা অজ্বর পানি দিত। ভাত-ডালের ব্যবস্থা করত। গরম ধোঁয়া উঠা ভাতের সঙ্গে ডাল। একটা ঝাল কাঁচামরিচ, একটা পেয়াজ। ইরতাজউদিনের পেট মোচড় দিয়ে উঠল। এতটা ক্ষিধে পেয়েছে তিনি বুঝতেই পারেন নি। ধোঁয়া উঠা ভাতের ছবি মাথা থেকে যাচ্ছেই না।

মিছিলের সঙ্গে তিনি কোথায় যাচ্ছেন? কেনই বা যাচ্ছেন? তার উচিত রাতের জন্যে একটা আশ্রয় খুঁজে বের করা। এত রাতে কোনো হোটেল খুঁজে বের করা সম্ভব না। তাছাড়া হোটেলে রাত কাটাবার মতো সঙ্গতিও তাঁর নেই। সবচে ভালো হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাওয়া। কোনো একটা বেঞ্চিতে শুয়ে রাতটা পার করে দেয়া। স্টেশনের আশেপাশে অনেক ভাতের দোকান আছে। প্রথমেই হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেতে হবে।

একজন মশালিধারী ইরতাজউদিনের কাছে চলে এসেছে। পাশাপাশি হাঁটছে এবং কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। ইরতাজউদ্দিনের ইচ্ছা হচ্ছে তাঁকে বলেন, মশাল শব্দটা আরবি, এটা জানেন? জ্ঞান জাহির করার জন্যে বলা না। আলাপ আলোচনা শুরুর জন্যে বলা। আলাপ শুরু হলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন—মধ্যরাতে মশাল মিছিল কেন হচ্ছে? ইলেকশন হয়ে গেছে। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টা আসনের মধ্যে ১৬৭টা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো পেয়েছে ৮৩টা। হয়েই তো গেছে, আর কী? এখন কেন মধ্যরাতে জালো জ্বলো আগুন জ্বলো? হাতে মশাল আছে বলেই কি আগুনের কথা মনে আসছে?

হাতে মশাল থাকলেই আগুন জ্বালাতে ইচ্ছা করে। হাতে তলোয়ার থাকলে কোপ বসাতে ইচ্ছা করে। বন্দুক থাকলে ইচ্ছা করে গুলি করতে। মানবচরিত্র বড়ই অদ্ভুতা! আচ্ছা কারোর হাতভর্তি ফুল দিয়ে দিলে সে কী করবে? ফুল বিলাতে শুরু করবে?
 
ইরতাজউদ্দিন থমকে দাঁড়ালেন, কী আশ্চৰ্য্য, তিনি শাহেদের আগের বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিশ্ৰীক্ষণ চক্রাকারে ঘুরছে। তাকে এনে ফেলেছে আগের জায়গায়। গেটের সামনে রাখা মুড়ির টিন দুটা নেই, তবে গেটের ভেতরে রাজহাঁসটাকে দেখা যাচ্ছে। ঘরের এক কোনায় অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে। এরাও বোধহয় মানুষের শরীরের গন্ধ চেনে। রাজহাঁস গোপন আশ্রয় ছেড়ে ডানা মেলে ছুটে আসছে ইরতাজউদ্দিনের দিকে। কী অপূর্ব দৃশ্য!

ইরতাজউদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। এখন গন্তব্য ঠিক করা–কমলাপুর রেলস্টেশন। রাজহাঁসটা ঘাড় ঘুরিয়ে ইরতাজউদ্দিনকে দেখছে। সে কি বিস্মিত হচ্ছে? বিস্মিত হবার ক্ষমতা কি এদের দেয়া হয়েছে?



শাহেদের ঠিকানা বের করতে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা লেগেছে। এই চব্বিশ ঘণ্টা বলতে গেলে তার পথে পথেই কেটেছে। রাত কাটিয়েছেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে। স্টেশনের কাছেই এক মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে শাহেদের খোজে বের হলেন। সেই অনুসন্ধানের ইতি হলো রাত নটা পঁচিশ মিনিটে। রায়েরবাজারের গলির ভেতর পুরনো ধরনের দোতলা বাড়ি। একতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার এই বাড়ির সামনেও একটা ছাতিম গাছ। তবে এই গাছটা সতেজ। শাহেদ কি ঠিক করেছে। ছাতিম গাছ নেই এমন কোনো বাড়ি সে ভাড়া করবে না?

ইরতাজউদিনের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। শাহেদকে খুঁজে বের করার পরিশ্রমে মনে হয় তার বয়স বেড়ে গেছে। চোখ টকটকে লাল। প্ৰচণ্ড গরমেও তার শীত শীত লাগছে, জ্বরের পূর্বলক্ষণ।

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, ভাইজান, আপনার এ-কী অবস্থা? এরকম দেখাচ্ছে কেন আপনাকে, শরীর খারাপ নাকি?

ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীর ঠিকই আছে। পরিশ্রম হয়েছে। তোমার বাসা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষপর্যন্ত অফিসে গেলাম। আজ যে অফিস ছুটি তাও জানতাম না।

বাসার ঠিকানা পেলেন কী করে?

অফিসের দারোয়ানের কাছ থেকে তোমার এক কলিগের ঠিকানা পেলাম, রহমান সাহেব। তিনি থাকেন বাসাবো নামের একটা জায়গায়। তাকে খুঁজে বের করলাম। তিনি আবার তোমার ঠিকানা জানেন না। তবে অন্য একজনকে চিনেন যে তোমার ঠিকানা জানে। সে এক লম্বা গল্প। শুনে লাভ নেই। বাসার লোকজন কোথায়? রুনি, রুনির মা?

শাহেদ ইতস্তত করে বলল, আসমানী তার মার বাসায় গেছে। আপনি আসার কিছুক্ষণ আগে গেল। আমার শাশুড়ির শরীর খারাপ, খবর পেয়ে গেছে।

তুই যাস নি কেন? শাশুড়ি হলেন মাতৃসম। তার সেবা করলে মাতৃঋণ শোধ হয়। তোর জন্মের পর পর মা মারা গেলেন। তুই তো আর মাতৃঋণ শোধ করার সুযোগ পাস নাই। পিতৃঋণ শোধ না করলে চলে, মাতৃঋণ শোধ করতে হয়। যাইহোক, তোদের বাথরুম কোনদিকে? গোসল করব। অনেক নামাজ কাজা হয়েছে। ঘরে জায়নামাজ আছে?

শাহেদ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জি-না। পরিষ্কার চাদর আছে, বিছিয়ে দিচ্ছি। ইরতাজউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, নামাজ পড়িস। আর না পড়িস মুসলমানের ছেলে এই কারণেই ঘরে একটা জায়নামাজ, একটা তসবি, একটা টুপি এইসব থাকা দরকার।

ভাইজান, গরম পানি লাগবে? পানি গরম করে দেই?

গরম পানি লাগবে না।

আপনি কি খেয়ে এসেছেন ভাইজান?

না। তবে রাতে কিছু খাব না। জ্বর জ্বর লাগছে। উপাস দেব। উপাস হলো জ্বরের একমাত্র ওষুধ।

জ্বর গায়ে গোসল করবেন?

বললাম না। শরীর অশুচি হয়ে আছে। গোসল না করলে নামাজ পড়তে পারব না।
 
শাহেদের ইচ্ছা করছে তার ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখতে। সাহসে কুলাচ্ছে না। তাদের ভাইয়ে ভাইয়ে দূরত্ব অনেক বেশি। ইরতাজউদ্দিনের জন্মের পর আরো পাঁচ ভাইবোনের পরের জন শাহেদ। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, তাদের মাঝখানের পাঁচ ভাইবোন জন্মের এক মাসের ভেতর মারা গেছে। সবারই একই অসুখ–হাত-পা ঠাণ্ড হয়ে শরীরে খিচুনি। নিঃশ্বাসের কষ্ট। জন্মের পনেরো দিনের দিন শাহেদেরও এই রোগ হলো। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। প্রবল খিচুনি। শাহেদের বাবা আধাপাগলের মতো হয়ে গেলেন। তিনি মসজিদে ছুটে গিয়ে ইমাম সাহেবকে বললেন, আমি আমার জীবনে একটা ভয়ঙ্কর পাপ করেছি। আমার পুত্রকন্যারা মারা যাচ্ছে–তার কারণ আর কিছু না, পাপের শাস্তি। আমি সবার সামনে অপরাধ স্বীকার করব, আল্লাহ যেন আমার পুত্রের জীবন রক্ষা করে।

জানা গেল। তিনি একটা খুন করেছেন। অপরাধ স্বীকার করে তিনি পুলিশের কাছে ধরা দেন। বিচারে তার যাবজীবন হয়। তিনি হাসিমুখে জেল খাটতে যান। কারণ তার কনিষ্ঠ পুত্রটির জীবন রক্ষা হয়। শাহেদের বাবার মৃত্যু হয়। জেলখানাতে। ইরতাজউদ্দিন অতি অল্পবয়স থেকেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন। ছোটভাইকে প্ৰায় কোলে করেই তিনি বড় করেন। অনেক বয়স পর্যন্ত শাহেদ ইরতাজউদ্দিনের বুকে না শুয়ে ঘুমুতে পারত না। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় শাহেদের একবার টাইফয়েড হলো। একুশ দিনের জ্বরের আটদিন ইরতাজউদ্দিন তার ভাইকে কোলে নিয়ে বসে থাকলেন। কোল থেকে নামালেই সে চিৎকার করতে থাকে। কোলে তুলে নিলেই শান্ত। শাহেদের সঙ্গে ইরতাজউদিনের সম্পর্ক ভাই-ভাই সম্পর্ক না। অনেকটাই পিতা-পুত্র সম্পর্ক।

শাহেদ বলল, ভাইজান, আপনি এক কাজ করুন। বাসার দরজা বন্ধ করে গোসল করতে যান। আমি আসমানীকে নিয়ে আসছি। বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি যাব। আর আসব।

ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, সে গেছে তার অসুস্থ মাকে দেখতে, তুই তাকে নিয়ে আসবি কেন? এটা আবার কী রকম কথা?

শাহেদ লজ্জিত গলায় বলল, আমার শাশুড়ি ভালো আছেন ভাইজান, আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। আসমানী আমার সঙ্গে রাগারগি করে চলে গেছে।

ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্ত্রীর সঙ্গে রাগারগি, এ কেমন কথা? মেয়েরা হচ্ছে জন্মদাত্রী জননী। হাজার ভুল করলেও এদের উপর রাগ করতে নেই। এদের উপর রাগ করাটাই কাপুরুষতা। অক্ষম এবং দুর্বল পুরুষরাই শুধু স্ত্রীর সঙ্গে রাগারগি করে।

ভাইজান, বেশিক্ষণ লাগবে না, একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে যাব। আর চলে আসব।

আচ্ছা।



আসমানীর সঙ্গে শাহেদের ঝগড়ার কারণ অতি তুচ্ছ। মজার ব্যাপার হলো, তাদের সব বড় বড় ঝগড়াই তুচ্ছ কারণে হয়েছে। আজকের ঝগড়ার বিষয়বস্তু বাথরুমের ছিটিকিনি। ছিটিকিনি খুলে পড়ে গেছে। আসমানী কয়েক দিন ধরেই বলছে তিনটা আধা ইঞ্চি পেরেক আনতে। শাহেদ রোজই বলছে নিয়ে আসব কিন্তু আনছে না।

এই ছিটিকিনি নিয়েই শাহেদের সঙ্গে আসমানীর ঝগড়া হয়ে গেল। ভয়াবহ ধরনের ঝগড়া। আজ সন্ধ্যাবেলা শাহেদ মোহাম্মদপুর বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে ফিরেছে। ঘরে ঢোকা মাত্র আসমানী বলল, পেরেক এনেছ?

শাহেদ পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বলল, পেরেক পেরেক করে তুমি দেখি আমার মাথা খারাপ করে ফেললে। কানু বিনে গীত নেই। তোমারও দেখি পেরেক ছাড়া কথা নেই। মাথার মধ্যে একটা জিনিস ঢুকলে আর বের হয় না।

আসমানী বলল, তার মানে তুমি আনো নি?

না।

আনো নি কেন?

ভুলে গেছি। এই জন্যে আনি নি। সবার স্মৃতিশক্তি তো আর তােমার মতো না। সবাই তো আর হাতি না যে সব কিছু মনে থাকবে।

তার মানে কি এই যে তুমি কোনোদিনই আনবে না?

শাহেদ গম্ভীর মুখে বলল, এখনই তোমার পেরেক এনে দেব। এটা নিয়ে আর কথা শুনতে চাই না।

এমন কী কথা আমি তোমাকে বললাম?

যা বলেছ। যথেষ্টই বলেছ।
 
শাহেদ হন।হন করে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় দরজাটা ধড়াম করে লাগিয়ে রাগ দেখিয়ে গেল। আসমানীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারা বাজার নিয়ে ফিরেছে। এর মধ্যেই পেরেকের ব্যাপারটা না তুললেও হতো। বাড়িওয়ালার শালা মজনুকে একটা টাকা দিলে সে এনে দিত। শাহেদের যখন মনে থাকে না, তখন শুধু শুধু তাকে বিরক্ত করা কেন? আসমানীর নিজের উপরই রাগ লাগছে। সে ঠিক করে ফেলল, শাহেদ এলে সে এমন কিছু করবে: যেন সে রাগ ভুলে আচমকা খুশি হয়ে উঠে। শাহেদকে হঠাৎ খুশি করার একটা পদ্ধতি সে জানে। সমস্যা হলো পদ্ধতিটা ব্যবহার করতে তার খুব লজ্জা লাগে।

তিনটা পেরেক হলেই হয়, শাহেদ এক কেজি পেরেক নিয়ে ফিরল। পেরেকের সঙ্গে হাতুড়ি, স্কুড্রাইভার। নিজেই খুটাখুটি করে বাথরুমের ছিটিকিনি লাগাল। আসমানীকে বলল, যাও, তোমার বাথরুম ঠিক হয়েছে। এখন ছিটিকিনি লাগিয়ে বাথরুমে গিয়ে বসে থাক। ঘড়ি দেখে দুঘণ্টা বসে থাকবে। দুঘন্টার আগে যদি বের হও তোমার খবর আছে।

আসমানী আহত গলায় বলল, আমাকে বাথরুমে বসে থাকতে হবে কেন?

বসে থাকতে হবে কারণ পেরেক এনে ছিটিকিনি লাগানো হয়েছে। পেরেক, পেরেক, পেরেক! আমার জীবন অতিষ্ঠা করে তুলেছে। দেশের কী অবস্থা! বেতন হবে কি হবে না, অফিস থাকবে কি থাকবে না—-এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। পেরেক পেরেক পেরেক। আমার লাইফটাকে কয়লা বানিয়ে ফেললে।

আমি তোমার জীবন কয়লা বানিয়ে ফেলেছি?

হ্যাঁ।

আসমানীর চোখে পানি এসে গেল। চোখের এই পানি শাহেদকে কোনোক্রমেই দেখানো যায় না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আমার জন্য তোমার জীবন যেন কয়লা না হয়। সেই ব্যবস্থা করছি। এখন থেকে তোমার জীবন হবে চন্দনকাঠ।

বলেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। শাহেদ সামনে থাকলে সে দেখে ফেলবে আসমানী কাঁদছে। এটা হতে দেয়া যায় না। কাঁদতে কাঁদতেই আসমানী ডাল চড়াল, ডিমের ঝোল রান্না করল। রাত নটায় সহজ গলায় বলল, আমি যাচ্ছি।

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

কলাবাগানে মার কাছে যাচ্ছি। এখন থেকে মার জীবন কয়লা বানাব। তোমার মূল্যবান চন্দনকাঠ জীবন কয়লা করব না।

আসমানী, তোমার কি মনে হয় না। তুমি বাড়াবাড়ি করছ?

না, আমার সে-রকম মনে হচ্ছে না। আলমারির চাবি ড্রেসিং টেবিলে রেখে গেলাম। রুনির জামা-কাপড় পাঠিয়ে দিও। আমার কোনো কিছু পাঠাতে হবে না।

তার মানে কি পুরোপুরি বিদায়?

হ্যাঁ।

রুনি মায়ের কোলে। গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। এমনিতে সে রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকে, আজ নটা বাজতেই ঘুম। রুনি জেগে থাকলে আসমানীর যাওয়া এত সহজ হতো না। রুনি কিছুতেই বাবাকে ছেড়ে যাবে না। শাহেদ শুকনো গলায় বলল, যেতে চাও যাবে। রাতদুপুরে যাবার দরকার দেখি না। সকাল হোক তারপর যাবে।

আসমানী বলল, কোনো অসুবিধা নেই। মজনু আমাকে পৌঁছে দেবে। ওকে রিকশা আনতে বলে এসেছি।

ওকে আবার কখন বললে?

আধঘণ্টা আগে বলে এসেছি। তোমার সামনে দিয়েই গিয়েছি। তুমি খবরের কাগজ পড়ছিলে বলে দেখ নি।

আসমানীর গলার স্বরে কোনো রাগ নেই। যেন তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয় নি। সবকিছু স্বাভাবিক আছে।

শাহেদ দ্রুত চিন্তা করছে। এই মুহুর্তে ঠিক কী করা উচিত? ক্ষমা প্রার্থনা করা যেতে পারে। সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করলেই যে লাভ হবে তাও মনে হচ্ছে না। আসমানী প্রচণ্ড রেগে গেছে। এই রাগ সহজে যাবে না। ভোগাবে। সবচেয়ে ভালো হবে রাগ কমানোর জন্যে সময় দিলে। দুদিন পর কলাবাগানে মুখ কালো করে উপস্থিত হলেই আসমানীর রাগ অনেকটা কমে যাবে। যেতে হবে গভীর রাতে, সাড়ে এগারোটা-বারোটার দিকে। গভীর রাতে যাওয়ার সুবিধা হলো, আসমানী তাকে এত রাতে একা একা বাসায় ফিরতে দেয় না।

কাজেই এই মুহূর্তে রাগ কমানোর জন্যে ব্যস্ত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং নিজের রাগ খানিকটা দেখানো যেতে পারে। শাহেদ রাগ দেখানোর জন্যে কঠিন চোখে আসমানীর দিকে তাকিয়ে রইল। চেষ্টা করল পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে। আসমানী স্বামীর সর্পদৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সহজ গলায় বলল, আমি যাচ্ছি। দরজা লাগিয়ে ঘুমুবে।

দরজা লাগিয়ে ঘুমাই না খোলা রেখে ঘুমাই সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না। তুমি যাও, তোমার মায়ের কোলে গিয়ে ঘুমিয়ে থাক।

দয়া করে চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে রাতদুপুরে উপস্থিত হবে না।

এত শখ আমার নাই। তুমি বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে আমার সব শখ মিটিয়ে ফেলেছি।

শাহেদ আরো কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিল, সেই সুযোগ পাবার আগেই আসমানী বের হয়ে গেল। শাহেদ পরের পাঁচ মিনিট বিম ধরে বসে থাকল। তার মাথায় ভালো একটা আইডিয়া এসেছে। আসমানী রিকশা করে গিয়েছে। সে যদি দ্রুত বের হয়ে একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে কলাবাগানে চলে যায়, তাহলে মজা মন্দ হয় না। আসমানী রিকশা থেকে নেমে দেখবে–শাহেদ বারান্দায় বসে। গম্ভীরমুখে খবরের কাগজ পড়ছে। হাতে চায়ের কাপ।

পরিকল্পনা কাজে লাগানো গেল না, কারণ শাহেদ যখন বেবিট্যাক্সির সন্ধানে যাবে বলে ঠিক করেছে তখন ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর গলা শোনা গেল, শাহেদ আছ? শাহেদ? এটা বিষ শাহেদের বাসা?
 
ইরতাজউদ্দিন সাহেব কাজা নামাজ শেষ করলেন। একঘণ্টার মতো লাগল নামাজ শেষ করতে। নিজেই খবরের কাগজ খুঁজে বের করে পড়লেন। খবরের কাগজের কোনো কিছুই বাদ দিলেন না! শুধুই মিটিং-মিছিলের খবর। অফিসআদালত কলকারখানা শেখ সাহেবেয়া আঙুলের ইশারায় চলছে। মেয়েরা গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে। রেডিও-টিভিতে জাতীয় সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। কাগজ পড়ে আরো আধা ঘণ্টা গেল। শাহেদ ফিরল না, ইরতাজউদ্দিন সাহেব খুবই বিরক্ত হলেন। যাবে আর আসবে বলে কেউ দেড় ঘণ্টার জন্যে উধাও হয়? কথায়-কাজে মিল থাকতে হয়। গোসলের পর তার ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। যে জ্বর আসব আসব করছিল তা মনে হয়। আপাতত সরে গেছে। ইরতাজউদ্দিন সাহেব একফাঁকে রান্নাঘর থেকে ঘুরে এলেন। খাবার থাকলে খেয়ে নেবেন। ডিমের ঝোল আছে, ডাল আছে, কিন্তু ভাত নেই। চারটা চাল তিনি নিজেই চড়িয়ে দিতে পারেন। নিজের রান্না তিনি নিজে করেন। কয়েক মুঠ চাল সিদ্ধ করা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু আসমানী ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। মুখে প্রকাশ না করলেও বিরক্ত হবে। মেয়েরা কোনো এক বিচিত্র কারণে বাড়ির পুরুষদের রান্নাঘরে দেখলে বিরক্ত হয়।

ইরতাজউদ্দিনের সময় কাটছে না। তিনি বাস্ত্রান্দায় চলে এলেন। ছোট বারান্দা। দুটা বেতের চেয়ার পাশাপাশি সাজানো। বারান্দা থেকে রাস্তার খানিকটা দেখা যায়। তিনি চেয়ারে বসলেন।

বারান্দায় কিছু হাওয়া আছে। বসার চেয়ারটাও আরামদায়ক। বসে থাকতে ভালো লাগছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়াটা ঠিক হবে না। শাহেদ এত দেরি করছে কেন? রাত বেশি হয়ে গেলে আসমানীকে সঙ্গে নিয়ে ফেরা ঠিক হবে না। ইরতাজউদ্দিন ঝিমুতে লাগলেন। ঘুমটা কাটানো দরকার। রুনি এসে দেখবে তার বড় চাচা বারান্দায় চেয়ারে বসে হা করে ঘুমাচ্ছে। বিকট শব্দে তার নাক ডাকছে। এই দৃশ্য তার ভালো লাগবে না। সে সারাজীবন মনে করে রাখবে। বড় চাচার কথা মনে হলেই এই দৃশ্য তার চোখে ভেসে উঠবে। একটা কোনো জিনিস শিশু অবস্থায় মাথায় ঢুকে গেলে আর বের হয় না।

ইরতাজউদ্দিন ঘুম তাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তিনি তাঁর বিয়ের দিনের কথা মনে করলেন। ঘুম তাড়াবার এটা হলো অব্যর্থ ওষুধ, কোরামিন ইনজেকশান। বিয়ের স্মৃতি একবার মনে হলে কোথায় যাবে ঘুম! তিনি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন–বরযাত্রী নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন বড়লেখা গ্রামে। সুন্দর করে সাজানো বিয়েবাড়ি। কলাগাছ দিয়ে একটা গেট করা হয়েছে। গেটে লেখাস্বাগতম। বানানটা ভুল, আকার বাদ পড়েছে। কিন্তু বিয়েবাড়ি কেমন যেন ঝিম ধরে আছে। কন্যাপক্ষ কারো মুখে কোনো কথা নেই।

চারদিকে ফিসফাস। কানাকানি। কিছুক্ষণের মধ্যে জানা গেল কন্যার কলেরা হয়েছিল। সকাল থেকে ভেদবমি হয়ে আছরের নামাজের ওয়াক্তে মারা গেছে। তারপর শোনা গেল–এখনো মারা যায় নি, বেঁচে আছে। চিকিৎসার জন্যে তাকে সদরে নেয়া হয়েছে। তবে বাচার আশা ক্ষীণ। আসল খবর জানা গেল অনেক পরে। মেয়ের কলেরা হয় নি, তাকে সদরেও নেয়া হয় নি। সে পালিয়ে গেছে। তার এক দূরসম্পর্কের খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে শেষরাতের ট্রেনে কোথায় যেন চলে গেছে।

ইরতাজউদ্দিন আর বিয়ে করেন নি। তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বিয়েতে রাজি করানোর তেমন চেষ্টাও কেউ করে নি। তাঁর মুরুবি কেউ ছিল না।

ভোররাতে যে মেয়েটি পালিয়ে গিয়েছিল, তাকে ইরতাজউদ্দিন মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে সে তার স্ত্রীর মতোই আচরণ করে। স্বপ্ন দেখার সময় ইরতাজউদ্দিন লজ্জা পান। স্বপ্ন ভেঙে যাবার পরেও লজ্জা পান। স্বপ্ন ভেঙে যাবার পর তিনি আল্লাহপাকের কাছে করুণ গলায় বলেন–হে পারোয়ার দিগার! তুমি আমাকে নিয়ে কেন এই খেলা খেলছ? আমি তো খুবই নাদান বান্দা। আমি যখন মেয়েটিকে পুরোপুরি ভুলে যাই, তখন স্বপ্নে আবার তাকে আমার কাছে নিয়ে আসা কেন? এই ধরনের হৃদয়হীন খেলা শুধু শিশুরাই খেলে। তুমি কি শিশু?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top