শেষমেশ দুঃসাহস টা করেই ফেললাম।
ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন, কারন আমি অতি নগন্য একজন। লেখক বলে নিজের পরিচয় দেওয়ার মত সাহস আমার নেই। এই ফোরাম এ এত ভালো ভালো লেখকেরা আছেন যে নিজের এই লেখাটা সামান্যতম যায়গা পেলেও আমি বর্তে যাবো।
না। বিনয় দেখালাম না। এর আগে কুঁতিয়ে কাতিয়ে একটা গল্প লিখেছি, তাও বাংলায়, সেটা ছোট গল্প ছিলো, কিন্তু এটা এত ছোট হবে বলে মনে হয়না। কিছু ভয় মনে রয়েছে যেমন ভাষা, আমি সাহিত্যিক না তাই শব্দপ্রয়োগ হয়ত উপযুক্ত নাও হতে পারে আর বানান ভুল তো অবধারিত। তাই নিজগুনে পরে বুঝে নেবেন। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবেন।
এই গল্পটা উৎস আমার এক বন্ধু, হয়ত সত্যি ঘটনা বলতে পারেন। হ্যা সত্যি ঘটনাই, কিন্তু অনেক কিছু কাল্পনিক। যেমন স্থান কাল পাত্র। যেমন যৌন ঘটনার উপস্থাপনা (যা এখানকার বিভন্ন লেখকের থেকে ছোট ছোট টুকলি), কিন্তু সেটা সুধু যৌনক্রিয়ার বর্ননাতেই সিমিত।
তাই কেউ যদি বলে বসেন যে এই গল্পটা অমুক গল্পের অনুবাদ বা আগে অমুক জায়গায় বেরিয়েছিলো, তাহলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগের থেকেই আপনাদের কাছে যে, এখানে এটা না পরে দয়া করে যেখানে পরেছিলেন সেখানেই পরুন।
আর আমি বিখ্যাত হতে বা রেপু নিতে আসিনি, সুধু এরকম একটা ঘটনাও যে মানুষ জীবনে ঘটে সেটা জানানোর জন্যে সেই জন্যে। ইচ্ছে করলে লিখে রেখে দিতে পারতাম। পোস্ট না করলেই হোতো। তবু সবাই মিলে একজনের দুঃখ ভাগ করে নি তাহলে তার দুঃখ কমে।
অনেক ভাট বকলাম দয়া করে গালি দিবেন না।
জীবনে প্রথম শুন্যর নিচে তাপমাত্রা অনুভব করলাম। সাঙহাই এয়ারপোর্টে এসে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্যে অপেক্ষা করছি, স্বয়ংক্রিয় দরজা গুলো খুলছে যখন বুঝতে পারছি যে বাইরে কতটা ঠান্ডা।
মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে চলেছি, বুঝতে পারছিনা ভালো না মন্দ। ভালো থাকে কি করে, আমি তো একপ্রকার সন্ন্যাস নিতে চলে এসেছি এই সুদুর চিন দেশে। আজকে এই মুহুর্তে তো কলকাতার আলিপুরের এক শিল্পপতির বাংলোতে বিরাট রোশনাই, নহবত চলছে। আজ তার ছেলের বিয়ে। আমার কাছে এই মুহুর্তে যা যোগ্যতমের উদবর্তন।
জানিনা কার দোষ, কার ভুল, কার অন্যায়, কার ন্যায়, কে ঠিক, কে ভুল, কে খেলার নিয়ম ভঙ্গ করেছে। শুধু জানি আমি হেরে গেছি। আমার ক্ষমতায় কুলোই নি যে এই প্রবল ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে ঘর গুছোই।
স্লাইডিং দরজার সামনে কিছু চাইনিজ শিশু খেলে বেরাচ্ছে।
হ্যাঁ এবার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠলো। আমার চার বছরের ছেলে, পিয়ালের কথা মনে পরে গেলো। কি করছে এখন সে? বাবার কথা মনে পরছে কি?
বাবাই তো ওর একমাত্র বন্ধু ছিলো। আমি কিছু জানিনা ওর সন্মন্ধে এখন। অনেক দিন ও আমার থেকে দূরে ছিলো। বাবা হয়েও ওকে দেখতে পারিনি, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি এতটাই কাপুরুষ যে নিজের সন্তান কে কেউ আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলো আর আমি চুপ করে তা মেনে নিলাম প্রানের আর সন্মানের ভয়ে। ভগবান কি আমাকে এতটুকু শক্তি দিতে পারলো না নিজেকে শেষ করে দিতে পারলাম না। সারা জীবন বাকি রয়েছে, কি করে বাঁচবো নিজের কাউকে না দেখে তা আমি জানিনা। চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে, চশমাটা খুলে মুছে নিলাম।
হা কি পরিহাস! এই চশমাটার ফ্রেমটা তুলি নিজে আমাকে পছন্দ করে দিয়েছিলো। ওর কথাগুলো আমার কানে ভাসছে “ কি বুড়োটে বুড়োটে ফ্রেম পরো বলতো? রিমলেস পরো তোমার ফেসের সাথে ভালো মানাবে”।
এক প্রকার ধমক দিয়েই আমাকে এটা কিনিয়েছিলো। দু বছর বয়স হোলো এটার।
কিছুতেই কিছু মুছে ফেলতে পারছিনা। ডেল কারনেগির একটা বইএ পরেছিলাম যে মনের সুইচ অফ করা যায়। কিন্তু আমি তো পারছি না। ঢেউএর মত স্মৃতি আঁছড়ে পরছে মনের মধ্যে। অনেক ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এমন জায়গায় থাকবো যেখানে আমার ফেলে আসার দিনগুলো আর ছুতে পারবে না। কিন্তু মন কার কথা শোনে।
মনে হয় ছোটোখাটো কিছু ভুল সিদ্ধান্তর যেগুলো আপাত নিরিহ ছিলো সেগুলোই আমার জীবন তছনছ করে দিলো।
আমার অনেক বন্ধু, কিন্তু কাউকেই আমি এত কথা বলতে পারিনি তার কারন এগুলো বলা যায়না। কিন্তু রোজ চ্যাট করতাম আমার চাইনিজ বন্ধু চেন যিয়ুর সাথে। ওকে আমি সব কথা বলেছি কিছু লুকোই নি। ওই আমাকে শেংইয়াং এ একটা স্কুলে ইংলিশ টিচারের চাকরি জোগার করে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়েছে। চিন দেশে একমাত্র এই চাকরিটাই বিনা বাধায় পাওয়া যায়। অন্য কোনো জায়গায় চাকরি পেতে হলে আগে এটা প্রমানিত হতে হবে যে ওই পদে যোগ্য চাইনিজ ব্যক্তি নেই বা পাওয়া যাচ্ছেনা।
যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। চেন আমার ভগবান। কমিউনিস্টদের নাকি আবেগ থাকেনা। CCPর সক্রিয় সদস্য হওয়া সত্বেও চেন আর ওর সহকর্মিরা আমার এত ভালো বন্ধু যে নিজের স্কুল কলেজ বা পরিচিত বন্ধুরা আমার এত কাছের মনে হয়না। এদের সাথে ভাষার কত দুরত্ব, তবু মনের দুরত্ব শুন্য। চেন, ভালো ইংরেজি বলতে পারে যেহেতু ও ওর কোম্পানির আন্তর্যাতিক বিপনন বিভাগে আছে। বাকিরা কোনো রকমে কাজ চালানোর মতো বলতে পারে। তবুও আমি এদের কাছে অনেক কিছু। এরা আমাকে সন্মান দেয়, ভালোবাসে।
পেশা সুত্রেই এদের সাথে আমার পরিচয়, ধীরে
তা বন্ধুত্বে পরিনত হয়। তা আস্তে আস্তে পারিবারিক বন্ধুত্বে পরিনত হয়। যদিও বেশির ভাগ টা ইন্টারনেটের সৌজন্যে।
অতিত কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ডাক এসে গেলো। কান খাড়া করে ছিলাম কারন অর্ধেক উচ্চারন বুঝতেই পারছিনা, ইংরিজি তে বললেও। শুধু ফ্লাইট নঃ টা মনে আছে তাই সেই ডিস্প্লের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে বোর্ডিং শুরু হয়েছে। এরোব্রিজ দিয়ে হেটে গিয়ে নিজের টিকিট নম্বর মিলে বসে পরলাম। পাসের বসা চাইনিজ একটা মেয়ে হাসি মুখে আমাকে যায়গা করে দিলো। এরা এতটাই স্বভাব বিনয়ি অপরিচিত কাউকেও এরা সমাদর করে।
ব্যাংককের সুবর্নভুমি থেকে সাঙহাই উড়ানে অনেক ভারতীয়, বাংলাদেশি আর পাকিস্তানি ছিলো। সাংহাই যে একটা গুরুত্বপুর্ন ব্যাবসাস্থল তার থেকেই বোঝা যায়। মনে হচ্ছিল না যে বিদেশে এসেছি। এমন কি উড়ানে ভারতীয় স্টাইল এ চিকেন রাইস ও দেওয়া হোলো সংখ্যাগুরু যাত্রির কথা ভেবে।
কিন্তু এই ঊড়ানে সবাইই চীনদেশীয়। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো আবার, সত্যিই আমি সব ছেড়ে চলে এলাম। সাজানো ঘর, তুলতুলে শরীরের পিয়াল, আরামদায়ক সোফা, যেটাতে শুয়ে টিভি দেখতাম আর মাথার নোংরা লাগতো বলে তুলি বাড়ি মাথায় করতো।
এবার থেকে নতুন সব কিছু নতুন লোকজন, নতুন পরিবেশ, নতুন খাওয়া দাওয়া। সব কিছুতে হোঁচট খাওয়া। আর একদিন এদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠা। হয়তো এই নতুন সংগ্রামই আমাকে আমার অতিত ভুলে থাকতে সাহাজ্য করবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি, দুঃখ ভুলতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখার মত আর ভালো কোনো পথ থাকতে পারেনা।
চিন্তা পর চিন্তা, বার বার একই চিন্তা করতে করতে মাথাও বোধ হয় বিশ্রাম চাইছিলো তাই ঘুমিয়েই পরলাম। ঘুম ভাঙল ল্যান্ডিঙ্গের ঝাকুনিতে।
শেংইয়াং-এ ল্যান্ড করলো। দুরু দুরু বুকে লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে আস্তেই কেমন যেন জমে গেলাম। কান আর খোলা হাত মুহুর্তের মধ্যে জমে গেলো, কেমন যেন যন্ত্রনা হতে শুরু করলো। নাকের ভিতর দিয়ে হাওয়া যে বুক পর্যন্ত জাচ্ছে তাও টের পাচ্ছি।
কিন্তু কোথায় চেন নেই তো? কোনো প্ল্যাকার্ডে আমার নাম নেই যা আছে সব চিনা ভাষায় লেখা। আশা করি কেউ চিনা ভাষায় আমার লিখে আমার সাথে মস্করা করবেনা। এদিক থেকে ওদিক বেশ কয়েকবার ঘুরে নিলাম। শরীর অবস হয়ে আসছে ক্রমশঃ। কিন্তু আমার নামে কোনো গাড়ি বা কাউকে খোঁজ পেলাম না। আমার কাছে আমার কলকাতার সিম টাই আছে, দুর্লভ বলে তা আর আন্তর্যাতিক রোমিং করাই নি। আর করাবোই বা কেন? আমি আর পিছন ছুয়ে দেখবোনা বলেই এখানে এসেছি। পুরোনো নম্বর থাকলে তো সবাই আমার খোঁজ পেয়ে যাবে। আমি তো পালিয়ে এসেছি। জীবনের এই বীভৎসতা চাক্ষুস উপলব্ধি করে।
কিন্তু এখন উপায় কি? চেন কি ভুলে গেছে যে আমি আসবো? নাকি ও ভেবেছে যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবোনা।
কি করি? কি করি? যা বুঝলাম এখানে কেউ ইংরিজি বোঝেনা। আর আমিও নিজে কোথায় জাবো সেটাও কাউকে বলতে পারবোনা। হঠাৎ একটা জিনিসে চোখ পরে বুক ছ্যাঁত করে উঠলো, বাইরে একটা বড় ডিসপ্লেতে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে। বর্তমানে সেটা - ২০ ডিগ্রি।
আমার ভীষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। কি করবো জানিনা। হয়ত এই ঠান্ডায় জমেই মরে যাবো।
মনে পরলো আমি কিছু ডলার ভাঙ্গিয়েছি সাংহাইএ। ৫০০ চিনা ইউয়েন দিয়ে একটা কলিং কার্ড কিনলাম। কিন্তু নিয়ম জানিনা যে কি ভাবে ফোন করতে হয়। এখানে যেরকম ফোন সেরকম আমি কোনদিন দেখিনি।
ইংরেজিও কেউ বুঝছেনা যে আমি বলতে পারি আমি একটা ফোন করতে চাই। অবশেষে মাথায় এলো যে, বোবার ভাষা সবাই বোঝে, তাই ইঙ্গিতে বোঝাতে পারলাম একটি মেয়েকে যে আমাকে ফোনটা ব্যাবহার করতে সাহায্য করলো আর চেনের মোবাইলে কানেক্ট করিয়ে দিলো। উফঃ সাক্ষাৎ মা দুর্গা।
হেয়, তুমি পৌছে গেছো?
হ্যাঁ অনেকক্ষণ।
ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন, কারন আমি অতি নগন্য একজন। লেখক বলে নিজের পরিচয় দেওয়ার মত সাহস আমার নেই। এই ফোরাম এ এত ভালো ভালো লেখকেরা আছেন যে নিজের এই লেখাটা সামান্যতম যায়গা পেলেও আমি বর্তে যাবো।
না। বিনয় দেখালাম না। এর আগে কুঁতিয়ে কাতিয়ে একটা গল্প লিখেছি, তাও বাংলায়, সেটা ছোট গল্প ছিলো, কিন্তু এটা এত ছোট হবে বলে মনে হয়না। কিছু ভয় মনে রয়েছে যেমন ভাষা, আমি সাহিত্যিক না তাই শব্দপ্রয়োগ হয়ত উপযুক্ত নাও হতে পারে আর বানান ভুল তো অবধারিত। তাই নিজগুনে পরে বুঝে নেবেন। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবেন।
এই গল্পটা উৎস আমার এক বন্ধু, হয়ত সত্যি ঘটনা বলতে পারেন। হ্যা সত্যি ঘটনাই, কিন্তু অনেক কিছু কাল্পনিক। যেমন স্থান কাল পাত্র। যেমন যৌন ঘটনার উপস্থাপনা (যা এখানকার বিভন্ন লেখকের থেকে ছোট ছোট টুকলি), কিন্তু সেটা সুধু যৌনক্রিয়ার বর্ননাতেই সিমিত।
তাই কেউ যদি বলে বসেন যে এই গল্পটা অমুক গল্পের অনুবাদ বা আগে অমুক জায়গায় বেরিয়েছিলো, তাহলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগের থেকেই আপনাদের কাছে যে, এখানে এটা না পরে দয়া করে যেখানে পরেছিলেন সেখানেই পরুন।
আর আমি বিখ্যাত হতে বা রেপু নিতে আসিনি, সুধু এরকম একটা ঘটনাও যে মানুষ জীবনে ঘটে সেটা জানানোর জন্যে সেই জন্যে। ইচ্ছে করলে লিখে রেখে দিতে পারতাম। পোস্ট না করলেই হোতো। তবু সবাই মিলে একজনের দুঃখ ভাগ করে নি তাহলে তার দুঃখ কমে।
অনেক ভাট বকলাম দয়া করে গালি দিবেন না।
জীবনে প্রথম শুন্যর নিচে তাপমাত্রা অনুভব করলাম। সাঙহাই এয়ারপোর্টে এসে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্যে অপেক্ষা করছি, স্বয়ংক্রিয় দরজা গুলো খুলছে যখন বুঝতে পারছি যে বাইরে কতটা ঠান্ডা।
মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে চলেছি, বুঝতে পারছিনা ভালো না মন্দ। ভালো থাকে কি করে, আমি তো একপ্রকার সন্ন্যাস নিতে চলে এসেছি এই সুদুর চিন দেশে। আজকে এই মুহুর্তে তো কলকাতার আলিপুরের এক শিল্পপতির বাংলোতে বিরাট রোশনাই, নহবত চলছে। আজ তার ছেলের বিয়ে। আমার কাছে এই মুহুর্তে যা যোগ্যতমের উদবর্তন।
জানিনা কার দোষ, কার ভুল, কার অন্যায়, কার ন্যায়, কে ঠিক, কে ভুল, কে খেলার নিয়ম ভঙ্গ করেছে। শুধু জানি আমি হেরে গেছি। আমার ক্ষমতায় কুলোই নি যে এই প্রবল ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে ঘর গুছোই।
স্লাইডিং দরজার সামনে কিছু চাইনিজ শিশু খেলে বেরাচ্ছে।
হ্যাঁ এবার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠলো। আমার চার বছরের ছেলে, পিয়ালের কথা মনে পরে গেলো। কি করছে এখন সে? বাবার কথা মনে পরছে কি?
বাবাই তো ওর একমাত্র বন্ধু ছিলো। আমি কিছু জানিনা ওর সন্মন্ধে এখন। অনেক দিন ও আমার থেকে দূরে ছিলো। বাবা হয়েও ওকে দেখতে পারিনি, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি এতটাই কাপুরুষ যে নিজের সন্তান কে কেউ আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলো আর আমি চুপ করে তা মেনে নিলাম প্রানের আর সন্মানের ভয়ে। ভগবান কি আমাকে এতটুকু শক্তি দিতে পারলো না নিজেকে শেষ করে দিতে পারলাম না। সারা জীবন বাকি রয়েছে, কি করে বাঁচবো নিজের কাউকে না দেখে তা আমি জানিনা। চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে, চশমাটা খুলে মুছে নিলাম।
হা কি পরিহাস! এই চশমাটার ফ্রেমটা তুলি নিজে আমাকে পছন্দ করে দিয়েছিলো। ওর কথাগুলো আমার কানে ভাসছে “ কি বুড়োটে বুড়োটে ফ্রেম পরো বলতো? রিমলেস পরো তোমার ফেসের সাথে ভালো মানাবে”।
এক প্রকার ধমক দিয়েই আমাকে এটা কিনিয়েছিলো। দু বছর বয়স হোলো এটার।
কিছুতেই কিছু মুছে ফেলতে পারছিনা। ডেল কারনেগির একটা বইএ পরেছিলাম যে মনের সুইচ অফ করা যায়। কিন্তু আমি তো পারছি না। ঢেউএর মত স্মৃতি আঁছড়ে পরছে মনের মধ্যে। অনেক ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এমন জায়গায় থাকবো যেখানে আমার ফেলে আসার দিনগুলো আর ছুতে পারবে না। কিন্তু মন কার কথা শোনে।
মনে হয় ছোটোখাটো কিছু ভুল সিদ্ধান্তর যেগুলো আপাত নিরিহ ছিলো সেগুলোই আমার জীবন তছনছ করে দিলো।
আমার অনেক বন্ধু, কিন্তু কাউকেই আমি এত কথা বলতে পারিনি তার কারন এগুলো বলা যায়না। কিন্তু রোজ চ্যাট করতাম আমার চাইনিজ বন্ধু চেন যিয়ুর সাথে। ওকে আমি সব কথা বলেছি কিছু লুকোই নি। ওই আমাকে শেংইয়াং এ একটা স্কুলে ইংলিশ টিচারের চাকরি জোগার করে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়েছে। চিন দেশে একমাত্র এই চাকরিটাই বিনা বাধায় পাওয়া যায়। অন্য কোনো জায়গায় চাকরি পেতে হলে আগে এটা প্রমানিত হতে হবে যে ওই পদে যোগ্য চাইনিজ ব্যক্তি নেই বা পাওয়া যাচ্ছেনা।
যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। চেন আমার ভগবান। কমিউনিস্টদের নাকি আবেগ থাকেনা। CCPর সক্রিয় সদস্য হওয়া সত্বেও চেন আর ওর সহকর্মিরা আমার এত ভালো বন্ধু যে নিজের স্কুল কলেজ বা পরিচিত বন্ধুরা আমার এত কাছের মনে হয়না। এদের সাথে ভাষার কত দুরত্ব, তবু মনের দুরত্ব শুন্য। চেন, ভালো ইংরেজি বলতে পারে যেহেতু ও ওর কোম্পানির আন্তর্যাতিক বিপনন বিভাগে আছে। বাকিরা কোনো রকমে কাজ চালানোর মতো বলতে পারে। তবুও আমি এদের কাছে অনেক কিছু। এরা আমাকে সন্মান দেয়, ভালোবাসে।
পেশা সুত্রেই এদের সাথে আমার পরিচয়, ধীরে
তা বন্ধুত্বে পরিনত হয়। তা আস্তে আস্তে পারিবারিক বন্ধুত্বে পরিনত হয়। যদিও বেশির ভাগ টা ইন্টারনেটের সৌজন্যে।
অতিত কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ডাক এসে গেলো। কান খাড়া করে ছিলাম কারন অর্ধেক উচ্চারন বুঝতেই পারছিনা, ইংরিজি তে বললেও। শুধু ফ্লাইট নঃ টা মনে আছে তাই সেই ডিস্প্লের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে বোর্ডিং শুরু হয়েছে। এরোব্রিজ দিয়ে হেটে গিয়ে নিজের টিকিট নম্বর মিলে বসে পরলাম। পাসের বসা চাইনিজ একটা মেয়ে হাসি মুখে আমাকে যায়গা করে দিলো। এরা এতটাই স্বভাব বিনয়ি অপরিচিত কাউকেও এরা সমাদর করে।
ব্যাংককের সুবর্নভুমি থেকে সাঙহাই উড়ানে অনেক ভারতীয়, বাংলাদেশি আর পাকিস্তানি ছিলো। সাংহাই যে একটা গুরুত্বপুর্ন ব্যাবসাস্থল তার থেকেই বোঝা যায়। মনে হচ্ছিল না যে বিদেশে এসেছি। এমন কি উড়ানে ভারতীয় স্টাইল এ চিকেন রাইস ও দেওয়া হোলো সংখ্যাগুরু যাত্রির কথা ভেবে।
কিন্তু এই ঊড়ানে সবাইই চীনদেশীয়। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো আবার, সত্যিই আমি সব ছেড়ে চলে এলাম। সাজানো ঘর, তুলতুলে শরীরের পিয়াল, আরামদায়ক সোফা, যেটাতে শুয়ে টিভি দেখতাম আর মাথার নোংরা লাগতো বলে তুলি বাড়ি মাথায় করতো।
এবার থেকে নতুন সব কিছু নতুন লোকজন, নতুন পরিবেশ, নতুন খাওয়া দাওয়া। সব কিছুতে হোঁচট খাওয়া। আর একদিন এদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠা। হয়তো এই নতুন সংগ্রামই আমাকে আমার অতিত ভুলে থাকতে সাহাজ্য করবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি, দুঃখ ভুলতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখার মত আর ভালো কোনো পথ থাকতে পারেনা।
চিন্তা পর চিন্তা, বার বার একই চিন্তা করতে করতে মাথাও বোধ হয় বিশ্রাম চাইছিলো তাই ঘুমিয়েই পরলাম। ঘুম ভাঙল ল্যান্ডিঙ্গের ঝাকুনিতে।
শেংইয়াং-এ ল্যান্ড করলো। দুরু দুরু বুকে লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে আস্তেই কেমন যেন জমে গেলাম। কান আর খোলা হাত মুহুর্তের মধ্যে জমে গেলো, কেমন যেন যন্ত্রনা হতে শুরু করলো। নাকের ভিতর দিয়ে হাওয়া যে বুক পর্যন্ত জাচ্ছে তাও টের পাচ্ছি।
কিন্তু কোথায় চেন নেই তো? কোনো প্ল্যাকার্ডে আমার নাম নেই যা আছে সব চিনা ভাষায় লেখা। আশা করি কেউ চিনা ভাষায় আমার লিখে আমার সাথে মস্করা করবেনা। এদিক থেকে ওদিক বেশ কয়েকবার ঘুরে নিলাম। শরীর অবস হয়ে আসছে ক্রমশঃ। কিন্তু আমার নামে কোনো গাড়ি বা কাউকে খোঁজ পেলাম না। আমার কাছে আমার কলকাতার সিম টাই আছে, দুর্লভ বলে তা আর আন্তর্যাতিক রোমিং করাই নি। আর করাবোই বা কেন? আমি আর পিছন ছুয়ে দেখবোনা বলেই এখানে এসেছি। পুরোনো নম্বর থাকলে তো সবাই আমার খোঁজ পেয়ে যাবে। আমি তো পালিয়ে এসেছি। জীবনের এই বীভৎসতা চাক্ষুস উপলব্ধি করে।
কিন্তু এখন উপায় কি? চেন কি ভুলে গেছে যে আমি আসবো? নাকি ও ভেবেছে যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবোনা।
কি করি? কি করি? যা বুঝলাম এখানে কেউ ইংরিজি বোঝেনা। আর আমিও নিজে কোথায় জাবো সেটাও কাউকে বলতে পারবোনা। হঠাৎ একটা জিনিসে চোখ পরে বুক ছ্যাঁত করে উঠলো, বাইরে একটা বড় ডিসপ্লেতে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে। বর্তমানে সেটা - ২০ ডিগ্রি।
আমার ভীষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। কি করবো জানিনা। হয়ত এই ঠান্ডায় জমেই মরে যাবো।
মনে পরলো আমি কিছু ডলার ভাঙ্গিয়েছি সাংহাইএ। ৫০০ চিনা ইউয়েন দিয়ে একটা কলিং কার্ড কিনলাম। কিন্তু নিয়ম জানিনা যে কি ভাবে ফোন করতে হয়। এখানে যেরকম ফোন সেরকম আমি কোনদিন দেখিনি।
ইংরেজিও কেউ বুঝছেনা যে আমি বলতে পারি আমি একটা ফোন করতে চাই। অবশেষে মাথায় এলো যে, বোবার ভাষা সবাই বোঝে, তাই ইঙ্গিতে বোঝাতে পারলাম একটি মেয়েকে যে আমাকে ফোনটা ব্যাবহার করতে সাহায্য করলো আর চেনের মোবাইলে কানেক্ট করিয়ে দিলো। উফঃ সাক্ষাৎ মা দুর্গা।
হেয়, তুমি পৌছে গেছো?
হ্যাঁ অনেকক্ষণ।