করোনাভাইরাস আতঙ্ক জাগিয়েছে অনেকেরই মনে। ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে মানুষ সচেতন। নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতেও সচেষ্ট। মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার নিয়মকানুন জানা এবং হাঁচি-কাশি ছড়াতে না দেওয়া, যেখানে–সেখানে কফ-থু তু না ফেলা—এসবই সুস্বাস্থ্যের জন্য আবশ্যক। তবে মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই যে ভালো নয়, এ কথা সবাই জানেন। তাই সচেতনতাও থাকা চাই স্বাভাবিক মাত্রায়।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অতিরিক্ত ভাবনাচিন্তা করা কিংবা ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর কাজগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় করাটা হতে পারে মানসিক সমস্যা। এমনটাই জানালেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রশিদুল হক। তিনি বলেন, যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে একজন মানুষ কীভাবে চিন্তা করেন বা পরিস্থিতিটিকে তিনি কীভাবে বিশ্লেষণ করেন, তা নির্ভর করে অনেক বিষয়ের ওপর। শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান, অতীত জীবনের কোনো আঘাত, ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা, জেনেটিক কারণ কিংবা আগে থেকে অতি–উদ্বিগ্নতা রোগে আক্রান্ত থাকা—এ রকম নানা বিষয়ের কারণে একেকজনের প্রতিক্রিয়া একেক রকম হয়ে থাকে। করোনা মহামারির সময়েও হচ্ছে এমনটা।
হাত পরিচ্ছন্ন রাখা নিয়ে সারাক্ষণ খুঁতখুঁতে মনোভাব রাখা ঠিক না, স্বাভাবিক সচেতনতা বজায় রাখুন
কেন আতঙ্ক মনে?
দেশে প্রথমবার করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার সময়টা থেকে শুরু করলেন এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। শুরুর দিকের সেই সময় থেকেই অনেকের মনে এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল, এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। একসময় কারও কারও ধারণা হয়ে গেল, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেই অক্সিজেন নিতে হবে, লাইফ সাপোর্ট মেশিনে দিতে হবে, ভর্তি হতে হবে আইসিইউতে। এ রোগে মৃত্যু যেন অবধারিত। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা খবর, নানা ‘আপডেট’ নিতে নিতে মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল ভীতি। সাধারণ মানুষের মধ্যে রোগটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না, আবার পরীক্ষা–নিরীক্ষার অপ্রতুলতাও ছিল দুশ্চিন্তার বড় এক কারণ। আবার ধীরে ধীরে সরকারি-বেসরকারি নানা হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হলেও আতঙ্ক কাটেনি কারও কারও। আক্রান্ত ব্যক্তির আইসোলেশন সম্পর্কে জেনে সেটি নিয়েও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশে শনাক্তের হার কমেছে, করোনা আইসিইউগুলোতে রোগীর চাপ কমেছে, মৃত্যুর হার কমেছে, কিন্তু দেশে–বিদেশে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’, অর্থাৎ দ্বিতীয় দফায় মারাত্মক আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সংবাদে আতঙ্কেই থাকছেন কেউ কেউ।
মনের রোগের বহিঃপ্রকাশ
কারণ যেটাই হোক, করোনার সংক্রমণ নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে। কেউ হয়তো গৃহবন্দী থাকছেন এখনো, প্রয়োজনেও বের হতে চাচ্ছেন না ঘর থেকে, পরিবারের সদস্যদেরও আটকে রাখতে চাইছেন ঘরে। তাঁর নিষেধ অমান্য করে কেউ বাইরে গেলে বাধিয়ে ফেলছেন লঙ্কাকাণ্ড। কারও হয়তো হাত ধোয়াটা হয়ে যাচ্ছে প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত, যা মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। কেউ আবার দরজার হাতল ঠিকভাবে স্পর্শই করছেন না। হয়তো ভাবছেন, কোনো বস্তু স্পর্শ করলেই ভাইরাস ঢুকে যাবে শরীরে। হয়তো বাইরে থেকে আনা জিনিসকে বারবার স্যানিটাইজারের সাহায্যে পরিষ্কার করেই চলেছেন। করোনভাইরাস নিয়ে কেউ ভুগছেন দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ কিংবা আতঙ্কে, কেউ পড়ছেন হতাশায়। হয়তো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে, মেজাজ হচ্ছে খিটখিটে। কেউ হয়তো করোনা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ঠিকঠাক থাকলেও বারবার পরীক্ষা করাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছেন।
কাছের মানুষ আছেন যাঁরা
অতিরিক্ত আতঙ্কিত হওয়া এবং সংক্রমণ থেকে বাঁচতে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ, তা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারেন না আক্রান্ত ব্যক্তিটি। পরিবারের অন্যরা হয়তো তাঁর সমস্যাটা ধরতে পারছেন। এ রকম ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে স্বাভাবিক আচরণের জন্য জোর করা যাবে না। ‘আমরা তো এভাবে করছি, তুমি করলে সমস্যা কী?’—এ জাতীয় কথা বললে তাঁর সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। বরং তাঁকে মানসিকভাবে সমর্থন জোগাতে হবে। তাঁর ভয়টা যে অস্বাভাবিক, এটা ভালোভাবে বুঝিয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো চিকিৎসা নিলে এমন সমস্যা সম্পূর্ণভাবে ভালো হয়ে যায়। তাই কাছের মানুষের সমালোচনা বা তাঁর সঙ্গে রাগ না করে তাঁকে সাহস জোগান সুস্থতার পথে চলতে। ভাইরাস ফোবিয়া, প্যানিক ডিজঅর্ডার, ইলনেস অ্যানজাইটি ডিজঅর্ডারের (রোগাক্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আক্রান্ত মনে করা) মতো মানসিক রোগ এখন দেখা যাচ্ছে। সঠিক সময়ে এসব রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।