গতোকাল গরমটা একটু বেশীই অনুভূত হয়েছিলো। অন্তত দুপর বেলায় রৌদ্রের মাঝে দৌড়-ঝাপের সময় তো বটেই। সকাল সকাল যাওয়াতে কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো দুটো নাগাত। কিশোরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে এসে নন এসি বাসে আগে থেকে চড়ে বসা লোকেদের শরীর থেকে ছুটতে থাকা ঘাম দেখে আর নন এসি বাসে চড়তে মনে সাহস পেলাম না। গেলাম এসি কাউন্টারে। বাস ছারবে তিনটায়। তার মানে প্রায় একটি ঘন্টা বসে থাকতে হবে। দেখলাম আমার আগে আরো ক'জন টিকেট কেটে বসে আছে। প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর বাস। একবার ছায়াতে ফ্যানের বাতাসে চেয়ার বসা অপেক্ষায় রত এসি বাসের ওয়েটিং রুমের দিকে আরেকবার রৌদ্রে দাঁড়ানো নন এসি বাসের ভিতর ঘামতে থাকা যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে এসি বাসের একখান টিকিট কেটে ফেলার মনস্থির করে ফেললাম। মাত্র তো একটি ঘণ্টা। ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসে কাটিয়ে দেয়া যাবে অলস এই সময়টুকু। আমার সাথে লাগেজ বা ব্যাগ কিচ্ছু নেই, ঝাড়া হাত-পা নিয়ে ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখলাম আগে থেকে টিকেট কাটা জনা ছয়েক যাত্রীর সবারই লাগেজ আর ব্যাগ পাশে রেখে অপেক্ষায় আছে কখন তিনটা বাজবে। এর মাঝে একজোড়া যাত্রী আছে যারা সদ্য বিবাহিত কাপল। তাদের পাশেই বসতে হলো মাঝের দুটো চেয়ার ছেড়ে দিয়ে। মাত্র বিয়ে করেছে তারা। তাদের আলাপ-আলোচনায় যেনো অস্বস্তি বোধ না করে সেজন্যই এই সৌজন্যতা দেখালাম আমি। বেশ সাহসী কাপল বলতেই হবে তাদের। আমাকে প্রায় তোয়াক্কা না করেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের টু -এক্স কথার ফুলঝুরি। মাঝে সাঝে চুড়ির টুং-টাং আর রিনিঝিনিতে মাথা না ঘুরিয়ে শুধু চোখ ঘুরিয়ে তাদের আর কিছু সাহসি কার্য্যকলাপও চোখের কোন দিয়ে দেখে নিলাম। আমি না হয় দুটো চেয়ার মাঝে রেখে সরে বসেছি, কিন্তু তাদের সামনেই তো আরেকজন যাত্রী বসে আছে। বসে আছে তাদের ঠিক ওপাশেই আরো দুজন। ওদের সামনেই সদ্য বিবাহিত পুরুষের হাতটি যেভাবে শাড়ির পাশ দিয়ে মেয়েটির এখানে সেখানে মাঝে মধ্যেই ল্যান্ড করছে তাতে আমার লজ্জা পাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। জানতে পারলাম তারা আরো ঘণ্টা দেড়েক আগেই টিকিট কেটে এখানে অবস্থান করছে। বেশীক্ষন সেখানে আর বসতে পারলাম না। নিজেই নিজের মনে বিড়ি টানার বাহানা তৈরী করে বেরিয়ে এলাম ওয়েটিং রুম থেকে। একটা চা খেলাম পাশের চা-স্টল থেকে। বাইরে গাছের একটা ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ফুঁকলাম। কিন্তু আয়েশ হলো না। গাছের ছায়ায় দাঁড়ালেও বাতাসের অভাবে কিছুক্ষনের মাঝেই ঘেমে সার্ট ভিজিয়ে ফেললাম। এই গরমে বিড়ি ফুকার কারনেই কিনা জানি না, মাথাটা ঝিমঝিম করা শুরু হলো। অগত্যা আবার ওয়েটিং রুমে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে আরো কজন যাত্রী বেড়েছে। আমার চেয়ারটি বেদখল হয়ে গেছে। তিনজন উঠতি বয়সের ছেলে বসে আছে এখন কাপলের পাশে। তারা তিনজন এখন বেশ মস্তি করছে নিজেদের মাঝে আলোচনায়। বলা বাহুল্য তাদের আলোচনারও কোনো শুরু শেষ নেই। বেশীরভাগই মেয়ে পটানো টাইপের কথা। নতুন জুটির মেয়েটি মাঝে মধ্যেই তাদের দিকে তাকাচ্ছে। তাতে তিনজনের উৎসাহ বেড়ে যাচ্ছে এধরনের আলোচনায়। তিনজনের সামনে তেড়ছা করে রাখা একটি চেয়ার ছাড়া আর কোনো চেয়ারও নেই যে আমি বসবো। ঐ তেড়ছা করা চেয়ারে আবার উঠতি বয়সের ছেলেদের ব্যাগ রেখে দিয়েছে। বলতেও পারছি না ব্যাগ সরিয়ে নেয়ার জন্য আবার দাঁড়িয়ে থাকতেও খারাপ লাগছে। মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পর টিকেট মাস্টার এসে আমাকে উদ্ধার করলো। ছেলেদেরকে বেশ ধমকের সাথেই ব্যাগ সরিয়ে নেয়ার কথা বললো। তারা ব্যাগ সরিয়ে নেয়ার পর চেয়ারটা ওনি নিজে সোজা করে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। চেয়ারে ব্যাগ রেখে লাফাঙ্গাগিরিটা যেমন আমার পছন্দ হয়নি, ঠিক তেমনি পছন্দ হয়নি টিকেট মাস্টারের ঐ তিন যাত্রীদের প্রতি যে ব্যবহার করেছে সেটিও। যদিও পরে বুঝেছি, টিকেট মাস্টার ঠিকই করেছিলেন। কারন ঐ তিনজন আসলে এসি বাসের যাত্রীই ছিলো না। আরো মিনিট পনেরো বাকি আছে তিনটা বাজতে। ঘন ঘন ঘড়ি দেখেও সময় দ্রুত পার করতে পারছিলাম না। ঘন ঘন ঘড়ি দেখার কারনে মনে হয় সময় ব্যাটা তার দৌড়ের গতি আরো কমিয়ে দিয়েছে। অবশেষে পনেরো মিনিট পার হলো আধা ঘণ্টায়। আমার কাছে তখন অন্তত এরকমই মনে হয়েছিলো। কাউন্টারের সামনে বাস এসে দাঁড়ালো ঠিক তিনটায়। বাসে উঠার পর ওয়েটিং রুমের থেকেও গরম বেশী মনে হলো বাসের ভিতরে। জিজ্ঞেস করাতে বাসের একজন স্টাফ জানালো মাত্রই এসি ছাড়া হয়েছে, সে জন্য একটু সময় লাগবে ঠান্ডা হতে। যদিও বাস ছাড়ার সময় লিখা ছিলো তিনটায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস ছাড়লো সাড়ে তিনটায়। কোন এক ভিআইপি যাত্রীর জন্য এই অপেক্ষা। সেই সাথে একজন একজন করে নতুন যাত্রীও যোগ হচ্ছিলো বাসের মধ্যে। বাসের ভিতরের তাপমাত্রা তখনো ২৭ ডিগ্রী। সামনের দিকে সিট থাকার কারনে ড্যাশ বোর্ডে তাপমাত্রার ইন্ডিকেটর দেখতে পাচ্ছিলাম পরিষ্কার। দরজা খোলা থাকার কারনে তাপমাত্রা দ্রুত নামতে পারছিলো না। সিটে পিঠ লেগে থাকার দরুন আমার পিছনটা তখন বেশ ঘামছিলো। শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের একটা স্রোতও যে নেমে যাচ্ছিলো তা বেশ অনুভব করছিলাম। অবশেষে দরজা লাগিয়ে বাস যখন ছাড়লো তখন বাসের টেম্পারেচার ২৫ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। পুলেরঘাট এলাকায় আসার পর দেখলাম ২৪.৫ ডিগ্রি। পিছন দিয়ে ঝরতে থাকা ঘাম বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এরপর এক লম্বা ঘুম দিলাম ভৈরব পর্যন্ত। তখন বাসের ভিতর বেশ শীতল গেছে। ইন্ডিকেটরে দেখলাম তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি। ইয়াল্লা... গরমের কথা বলতে গিয়ে কিসব লিখে ফেলেছি... দুঃখিত, মামা।