What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

অন্তর্বর্তী শূণ্যতা (2 Viewers)

Joined
Sep 9, 2020
Threads
1
Messages
24
Credits
5,483
Untitled-1.jpg


অন্তর্বর্তী শূণ্যতা

রতিমোহিনী দেবী


বি.দ্র. – এই কাহিনীর স্থান-কাল-চরিত্রের নাম সবই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিল একেবারেই নেই।

পরিচিতি পর্ব

এই কাহিনী রায় পরিবারের। কাহিনী শুরুর আগে এই পরিবার এবং এই পরিবারের মানুষজন সম্পর্কিত কয়েকটি কথা আগে থেকে উল্লেখ করে নেওয়া প্রয়োজন। রায় পরিবারের কর্তা অর্থাৎ বিমলবাবু গত হয়েছেন প্রায় বছর আষ্টেক আগে। ওনার স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী বর্তমানে বয়সজনিত কারণে অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। রায় পরিবার কলকাতারই এই বহুতল আবাসনে বসবাস করে, তবে আলাদা আলাদা ফ্লোরে। তাহলে আসুন, সবার প্রথমে এক এক করে পরিচয় করে নেওয়া যাক এই রায় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সাথে।



১) দূর্নিবার রায় – রায় পরিবারের বড় ছেলে। বিমলবাবুর মৃত্যুর পর এখন উনিই এই পরিবারের মাথা বলা যেতে পারে। বয়স ৫২ বছর। এক নামকরা বেসরকারী ব্যাঙ্কে কর্মরত। নেশা বলতে ইংরেজী খবরের কাগজ। আর প্রতি শনিবারে বন্ধুর বাড়িতে দু-পাত্তর রঙিন জল। দুনিয়ায় নিজের বিয়ে করা বউকে ছাড়া আর বোধহয় সাপকে ভয় পান। শরীরস্বাস্থ্যের গঠন মোটামুটি। কানের পাশে জুলপি দুটোতে রূপোলী রঙ ছাড়া আর যেটা দেখে ওনার বয়স সম্পর্কে একটা আঁচ পাওয়া যায় তা হল ওনার মাথা জোড়া টাক। কলেজ বেলা থেকেই চুল ওঠা শুরু। বিবাহের অব্যবহিত পরেই টাকের সূত্রপাত। বর্তমানে তা গোটা মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সমেত শহরের এক বহুতল আবাসনের অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন।

২) ইন্দুমতি রায় – রায় পরিবারের বড় বউ। দূর্নিবার বাবুর স্ত্রী। বয়স ৪৬। সামনের বছর ওনাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী পূ্র্তী হবে। অতি অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছেন। বিয়ের পর থেকেই সেই যে নিজের স্বামী দেবতাটিকে নিজের শাড়ির আঁচলের খুঁটে বেঁধে রেখেছেন, সেই বাঁধন আজও অটুট। পড়াশোনায় প্রীতি দেখে শ্বশুরমশাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করিয়ে ছিলেন। সেই সুবাদে কলকাতার এই বড়ো কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপিকা। নাকের ডগায় পুরু মাইনাস পাওয়ারের চশমার কাঁচের আড়ালে থাকা চোখদুটো সুন্দরবনের বাঘিনীর মত সবসময়ই জ্বলতে থাকে। কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে পতি দেবতাটি শুদ্ধ তাঁর গলার স্বর ও বাক্যবাণে জড়ো। তবে বয়সের তুলনায় শরীর স্বাস্থ্যটি একটু বেশীই ভারী। শরীরের আনাচে কানাচে মেদাধিক্য সহজেই চোখে পড়ে। তবে নিজের এবং পতি দেবতাটির মোটা আয়ের কারণে ওর নাকটা একটু বেশীই উঁচুতে থাকে। নেশা বলতে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসাইনমেন্ট চেক করা আর মোবাইলে একটু আধটু বিদেশী সিরিজ দেখা। শরীরের গড়ন মোটা হলেও রঙ ফর্সা। দৈহিক গড়নের হিসাব বলতে 38C সাইজের ব্রা পরেন। এবং ওনাকে সাধুভাষায় গুরুনিতম্বিনীও বলা যেতে পারে।

3) আয়ুষ রায় – দূর্নিবার ও ইন্দুমতির ছেলে। বয়স ২১। বয়েসের তুলনায় শারীরিক গঠন বেশ মজবুত। তার উপর আবার ইদানিং জিমেও ভর্তি হয়েছে। তবে শরীর যতটা মজবুত মনটা ততটাই কোমল। লাজুক স্বভাবের আয়ুষ মাকে যমের মত ভয় পায়। তাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও মায়ের কথা অনুসারে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা নেহাতে আঙুলে গোণা। সবসময়ের সঙ্গী বলতে ল্যাপটপ আর নিজের মুঠোফোন।

4) আয়ুষী রায় – দূর্নিবার ও ইন্দুমতির মেয়ে এবং আয়ুষের যমজ বোন। আদরে বাঁদর বলা যেতে পারে। মাকে একদমই ভয় পায় না। উল্টে পৃথিবীতে একমাত্র তারই ক্ষমতা আছে মায়ের মুখে মুখে কথা বলার। কলকাতার এক নামী অথচ কুখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। সেই সাথে গিটার বাজিয়ে গান গায়। মাকে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেটও খায়। ছেলে ও মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা প্রায় সমান। ইন্সটাগ্রামে প্রায় এক লাখের কাছাকাছি ফলোয়ার। শরীরের দূশ্য ও অদূশ্য স্থানে ট্যাটুর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতন। এবং সেই সব দৃশ্য-অদৃশ্য ট্যাটু দেখিয়ে ইন্সটা রিল করাটা ওর নেশা। কাঁধ পর্যন্ত কাটা ববছাঁট চুলে কালোর সাথে সাথে আরো অনেক রঙের মিশেল চোখে পড়ে। তবে শরীরের গঠন রোগার দিকেই। দৈহিক গড়ন বলতে 32-30-32, ব্রা পরে কিনা জানা নেই।

5) সুনির্মল রায় – রায় বাড়ির ছোটোছেলে ও দূর্নিবার বাবুর ভাই। বয়স ওনার তুলনায় অনেকটাই কম। বয়স ৪৩ বছর। দাদার মতন খুব বেশী শিক্ষিত নন। তাই এই ছোটো প্রাইভেট কোম্পানীতে ততোধিক ছোটো ও কম মাইনেতে কাজ করেন। দাদার আবাসনেরই তৃতীয় তলায় স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে থাকেন। দাদার তুলনায় কম রোজগার বলে দাদাকে ভয় পাওয়ার সাথে সাথে হিংসেও করেন। তবে রায়বাঘিনীর বৌদির ভয়ে তা মনেতেই থেকে যায় সর্বদা। বৌদির আদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অসুস্থ ও শয্যাশায়ী মাকে নিজের কাছেই রাখতে হয়েছে। তবে ডাক্তার ও ওষুধের খরচা বাবদ মাসোহারা দাদার কাছ থেকে আদায় করতে ভোলে না। নেশা বলতে কলেজবেলার সিগারেট আর ক্রিকেট। বউকে অতিরিক্ত ভালোওবাসে না আবার বিনা কারণে হতোচ্ছেদাও করে না। এক কথায় অম্ল মধুর সম্পর্ক। শারীরিক গঠন সামান্য হলেও ক্ষয়িষ্ণু। তার সাক্ষ্য ওর বেরিয়ে থাকা কণ্ঠার হাড় দুটো দেয়।

6) অনুরাধা রায় – রায় বাড়ির ছোটো বউ সুনির্মলের স্ত্রী। প্রথমে কলেজের প্রেম, সেখান থেকে ছাদনাতলা পেরিয়ে রায়বাড়ির অন্দরমহল। বিয়ের এক যুগ কেটে যাওয়ার পরে প্রেম জানালা দিয়ে পালাবার চেষ্টায় রত। তার প্রতি স্বামীর বর্তমান ঔদাসিন্য কয়েক বছর আগে হলেও এখন আর মনে দাগ কাটে না। সাংসারিক কাজ, অসুস্থ শাশুড়ির দেখভাল, ছেলের হোমওয়ার্ক এতেই দিন কেটে যায়। মাঝেমধ্যে যেরাতে বরের বুকের তলায় পিষে যাওয়ার সুযোগ পায়, সেই রাতে ঘুমটা একটু বেশীই গাঢ় হয়, এইটুকুই। বয়স ৩৭। তবে শরীর স্বাস্থ্যের বাঁধুনী বেশ মজবুত। তা না হলে বছর দশেকের এক ছেলের মা হয়েও যে এই বয়সে শরীরের চটক রাখা যেতে পারে, তা ওকে দেখে শেখা যেতে পারে। তবে তার জন্য জিম-যোগার প্রয়োজন পড়ে না। উদয়াস্ত সাংসারিক খাটুনিই ওর ব্যায়ামের কাজ করে। আর পাঁচটা সাধারণ গৃহবধূর মতোই সিরিয়ালের নেশা। আর মুঠোফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা মায়ের সাথে কথোপকথন। ভাসুরকে ভালোবাসে। শ্রদ্ধাও করে। তবে জায়ের প্রতি মনোভাব একটু হলেও প্রচ্ছন্ন। মুখে মুখে কথা বলে না ঠিক কথা, তবে মাঝে মধ্যে দু একটা কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় বৈকী। যাইহোক গায়ের রঙ মাঝারী। দৈহিক গড়ন বলতে 34-32-34। এবং শোনা যায় 34B সাইজের ব্রা পরে।

৭) ইভান রায় – বয়স ১০ বছর। গোলগাল মিষ্টি চেহারার একটি ছেলে। ক্লাস ফোরে পড়ে। মায়ের থেকে বাবাকে যথেষ্ট ভয় পায়। ভিডিও গেম একমাত্র নেশা। এই কাহিনীতে এর উপস্থিতি অনেকটা নুনের মত। অর্থাৎ স্বাদ অনুযায়ী।



পরিচয়পর্বের পালা যখন শেষ তখন এবার মূল কাহিনীতে প্রবেশ করা যাক। এরা ছাড়াও পরবর্তিকালে হয়তো আরো অনেক চরিত্রের আনাগোনা হতে পারে। তাদের আগমণের পূর্বেই তাদের যথোচিত পরিচয় ও বর্ণণা দিয়ে দেওয়া হবে। আপাতত এই ছয়জনের মধ্যেই এই কাহিনীর অবতারণা চলবে। গোটা কাহিনীটি এই রায় পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যদের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখানো হয়েছে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
 
পরিচ্ছদ ১ - প্রস্তুতি

অনুরাধা – ঘড়ির কাঁটা যত আটটা পেরিয়ে সাড়ে আটটা এবং তারপরে ন'টার দিকে এগোতে থাকে, ততই অনুরাধার ব্যস্ততাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। একদিকে সুনির্মলের অফিসের তাড়া। আর অন্য দিকে বাবানের স্কুলের বাস মিস হয়ে যাওয়ার ভয়। এই দুইদিকে পাল্লা দিতে দিতে এই সময়টায় একপ্রকার নাভিশ্বাস ছুটে যায় অনুরাধার। দম ফেলতেও বোধহয় মাঝে মাঝে ভুলে যায় সে। আর কাজের মেয়েটাও হয়েছে একনম্বরের ত্যাঁদড়! বারবার বলা সত্ত্বেও ন'টা পনেরো-কুড়ির আগে কিছুতেই তার দর্শন পাওয়া যাবে না। দরকারের সময়েই যদি তাকে পাওয়া না যায়, তাহলে তাকে রাখা কিসের জন্য তা বুঝে উঠতে পারে না অনুরাধা। কিন্তু শত অসুবিধের পরেও তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে পারে না। কারণ ওর একার পক্ষে শয্যাশায়ী শাশুড়িমায়ের সেবা যত্ন করা এককথায় অসম্ভব। তাই অনেক ভেবেও তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে পারেনি অনুরাধা। মেয়েটার সবই ভালো। কিন্তু বড়ই বাচাল। একবার বকতে শুরু করলে আর থামার নাম থাকে না। তখন অনেক কষ্টে থামাতে হয়। এই দুটি অবগুণ ছাড়া মেয়েটির আর সবই ভালো। যাইহোক কিচেনে বর আর ছেলের জন্য সেঁকা পাঁউরুটিগুলোতে মাখনের প্রলেপ লাগাতে লাগাতে ঘাড় উঁচিয়ে ডাইনিং রুমের দেওয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার দিকে উঁকি মেরে দেখলো অনুরাধা। আটটা চল্লিশের ঘর পেরিয়ে পঁয়তাল্লিশের দিকে দৌড়াচ্ছে ঘড়ির কাঁটাটা। এক্ষুণি সুনির্মলের হাঁকডাক শুরু হয়ে যাবে। এতক্ষণে বোধহয় স্নান সেরে জামাকাপড়ও পরা হয়ে গেছে ওর। ছেলেরও বোধহয় ইউনিফর্ম পরা কমপ্লিট। হাতের গতি আরো বাড়িয়ে দিল অনুরাধা। কিন্তু তখনই হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। মাখনের ডিব্বার পাশে পড়ে থাকা ওর স্মার্টফোনটা একবার করুণ স্বরে কেঁপে উঠল। লকস্ক্রিণের উপরে হোয়াটসঅ্যাপের একটা নোটিফিকেশন চোখে পড়ল অনুরাধার। সেটাকে অগ্রাহ্য করে আবারও নিজের হাতের কাজে মনোযোগ দিতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু আবারও আগের মত ছন্দপতন। সেই একই করুণ স্বরে কেঁপে উঠল ওর স্মার্টফোনটা। তবে এবার আর একবার নয়, বারবার তিনবার। এবং তিনবারই হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন ভেসে উঠল লকস্ক্রিণের উপরে। এত সকালে কেউ যে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে মনে করতে পারে, সেটা ওর ধারণার বাইরে। কাজের সময় যত দেরী! বিরক্তিতে নিজের অজান্তেই মুখটা সামান্য হলেও বেঁকে গেল অনুরাধার। কে বা কি, সেটা দেখার জন্য ফোনটার দিকে হাত বাড়াতেই পিছন থেকে সুনির্মলের তাড়া লাগানো কণ্ঠস্বর ওর কর্ণকুহরে একপ্রকার মধুবর্ষণ করতে শুরু করল। "কি হলো, রাই? আজকে কি আর কপালে কিছু জুটবে না? নাকি খালি পেটেই অফিসে দৌড়াতে হবে? তোমাকে কতদিন বলেছি, একটু তাড়াতাড়ি করো। আমার কথা কানে কি ওঠে না?..." হয়তো আরো কিছুক্ষণ মধুবর্ষণ জারি থাকতো, কিন্তু অনুরাধা তাড়াতাড়ি "যাচ্ছি। হয়ে গেছে।" বলে তাতে দাঁড়ি টেনে দিল। তাতে অবশ্য গজগজানি থামার লক্ষণ দেখা গেলো না। অনুরাধা তাড়তাড়ি মাখন মাখানো সেঁকা পাঁউরুটিগুলোকে কিচেন থেকে ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে ছেলের উদ্দেশ্যে একবার হাঁক পাড়লো, "তোর হলো, বাবান? ব্রেকফাস্ট রেডী। এরপর বাস মিস হলে আমাকে বলতে আসিস না।" বেডরুম থেকে বাবান অর্থাৎ ইভানের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, "যাচ্ছি মা। হয়ে গেছে।" অনুরাধা পাঁউরুটিগুলো ডাইনিং টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে আরো একপ্রস্থ গজগজানি করতে শুরু করল সুনির্মল। "একটু তাড়াতাড়ি করলে তোমার যে কি অসুবিধে হয়, তা বুঝি না। বসের টিটকিরি তো আর তোমাকে শুনতে হয় না, হলে বুঝতে পারতে।" গজগজানি হয়তো আরো কিছুটা বাড়তো। কিন্তু তাতে একেবারে রাশ টানার সিদ্ধান্ত নিল অনুরাধা। কিচেনের দিকে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বরের দিকে তাকিয়ে বলল, "রোজ রোজ আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে ফুটুনি না মেরে, কাল থেকে ভোরবেলায় উঠে মায়ের পায়খানা আর পেচ্চাপটা ফেলো, তাহলেই সময়ে ব্রেকফাস্ট পাবে। আর বসের টিটিকিরিও শুনতে হবে না।" জোঁকের মুখে নুনের মতোই ততক্ষণে সুনির্মলের মুখে পাঁউরুটি ঢুকে গেছে। কিচেনের দিকে যেতে যেতে ছেলেকে আরো একবার হাঁক পেড়ে বলল, "থাক বাবান, আজ তোকে আর স্কুলে যেতে হবে না। ন'টা প্রায় বাজতে গেল।" বাবানও ততক্ষণে বিপদ আন্দাজ করে উপস্থিত হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চেয়ার বসে পড়ে বলল, "এই তো মা, আমি এসে গেছি।" মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হেসে কিচেনে ঢুকে গেল অনুরাধা। বাপ-বেটার একই স্বভাব। ও মুখ খুললেই সব ঠাণ্ডা।

ঘড়ির কাঁটা আরেকটু এগিয়ে ন'টার গায়ে ঘেঁষতেই আরো একদফা তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেল অনুরাধার। সু-এর পার্স, বাবানের বাঁ পায়ের মোজা। বাবানের টিফিন কৌটোয় ডিম-পরোটা ভরা। সু-এর চেঁচামেচি আর বাবানের গুড-বাই কিসের পর যখন বাপ-বেটা ঘর থেকে বের হল তখন অনুরাধার মনে হল ছোটোখাটো একটা সুনামির স্রোত যেন বয়ে গেল গোটা ফ্ল্যাট থেকে। আজ যবে থেকে বাবান স্কুলে যেতে শুরু করেছে, তবে থেকে ওর সোমবার থেকে শনিবারের সকালগুলো এইভাবেই শুরু হয় প্রতিদিন যুদ্ধ করে। ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে কাপ, প্লেট, ডিস সহ বর আর ছেলের উচ্ছিস্ট খাবারের টুকরোগুলোকে তুলে নিয়ে কিচেনের দিকে হাঁটা শুরু করতেই ওর কানে ভেসে এল কিচেন থেকে ওর ফোনটা সুরেলা স্বরে বাজতে শুরু করেছে। এত সকালে কে ফোন করতে পারে? মা তো সেই দুপুরের আগে ফুরসতই পায় না ফোন করার। বাবার দোকানে যাওয়ার আগে ভাত রাঁধতে হয় মাকে। তাও আবার একলা হাতে। বৌদি তো কুটি নেড়ে দুটি করার সময় পায় না। তাহলে কি দিদিভাই? হলেও হতে পারে। হয়তো বাবানের জন্য কোনো রান্না করেছে। কলেজ বের হওয়ার আগে ওকে দিয়ে যাবে। তাই আগেভাগে জানিয়ে রাখা। দিদিভাইয়ের এই এক স্বভাব। সব কাজ গুছিয়ে আর পরিপাটি করে করতে পছন্দ করতে পারে। কোত্থাও এতটুকুও ফাঁক পাওয়ার বা খোঁজার উপায়ই থাকে না। এতবছর ধরে সমান তালে ঘরে-বাইরে কাজ সামলে চলেছে দিদিভাই। সংসার সামলে কলেজ করা, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার খাতা দেখা। সবকিছু। নিয়মমাফিক। ও জানে ও সারাজীবন চেষ্টা করলেও দিদিভাইকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা ওর নেই। অজান্তেই বোধহয় দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর নাক ও মুখ থেকে। তারপর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কিচেনের দিকে চলল অনুরাধা। এটা যদি দিদিভাইয়ের ফোন হয়, আর তার ধরার আগেই যদি ফোনটা কেটে যায়, তাহলে ওর কপালে অশেষ দুঃখ লেখা আছে। সকালবেলাতেই এককাঁড়ি কথা শুনতে হবে ওকে। কথা শোনাবার এতবড় সুযোগ জীবনেও ছাড়বে না দিদিভাই। কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ। তাড়াতাড়ি পা চালিয়েও কোনো লাভ হল না। কিচেনে ঢুকে সিঙ্কে এঁটো থালাবাসনগুলোকে রেখে, হাতটা জলে ধুয়ে নিয়ে ফোনটা হাতে নেওয়ার আগেই সেটা চুপ করে গেল। হাইসকোটে হাতদুটো মুছে নিয়ে ফোনটাকে হাতে তুলে নিল অনুরাধা। ওর ধারণা ছিল ফোনস্ক্রিণে দিদিভাইয়ের নামটা ফুটে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। ও দেখল ফোনস্ক্রিণে দিদিভাইয়ের পরিবর্তে তপতীর নামটা ভেসে আসছে। 1 Missed Call: Tapati. এত সকালে তপতী কেন ফোন করছে ওকে? এই তো কাল সন্ধ্যেবেলাতেই ওর সাথে কথা বলছিল অনুরাধা। আর তাই নিয়ে সু-এর কি রাগ! কত কথাই না ওকে শোনাল কালকে। কি না, কাল সন্ধ্যেবেলায় অফিস থেকে বেরিয়ে বাবুর ইচ্ছে হয়েছিল বউ আর ছেলেকে নিয়ে বাইরে কোথাও একটা খেতে যাবে। কিন্তু আধঘন্টা ছাড়িয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে পরে ফোন করেও বউয়ের ফোন লাগাতে পারেনি সে। বারবার এনগেজ টোন আসছিল। নিশ্চয়ই ওর মা। মায়ের ফোন এলে ওর বউ যে শুধু ও কেন, বিশ্বসংসার অবধি ভুলে যেতে পারে তা ও ভালো করেই জানে। তাই হাল ছেড়ে সু যখন বাড়ি ফিরল, দেখল বউ তখনও ডাইনিং রুমের সোফায় বসে দিব্বি হাসতে হাসতে ফোন করে চলেছে। অবশ্য অনুরাধারও যে খুব একটা দোষ এতে আছে, তাও অবশ্য জোর গলায় বলা যায় না। রাতে হোটেলে খেতে যাওয়ার ইচ্ছা তো আর ওর বরের রোজ রোজ হয় না। আজই হবে, সেটা ও জানবে কি করে? আর তপতীর সঙ্গেও ওর রোজ রোজ ফোনে কথা হয় না। সপ্তাহে একবার বা মাসে দু' – তিনবার। তার বেশী নয়। কথাও খুব একটা ফোনে বলা হয়ে ওঠে না। তবে কালকের কথা আলাদা। কথা বলতে বলতে যে এত দেরী হয়ে গেছে, তা ওদের দুজনেরই খেয়াল থাকেনি। যতই হোক সেই স্কুলবেলার বন্ধু ওরা দুজনে। প্রথমে প্রাইমারী, পরে হাইস্কুল পেরিয়ে কলেজ। অনেক কিছুরই সঙ্গী ওরা দুজন। কিন্তু কালকের ফোনালাপের ব্যাপারটা একটু আলাদা। সে যাই হোক। কাল অতক্ষণ ফোনে কথা বলার পর আজই হঠাৎ এত সকালে ফোন করছে কেন তপতী? ওর শরীর খারাপ নয়তো? কিম্বা ওর বরের? ওর মেয়েরও হতে পারে। কিন্তু শরীর খারাপ হলে তপতী ওকে ফোন করবে কেন? আর যাই হোক ও তো আর ডাক্তার নয়। তাহলে? সাতপাঁচ ভেবে তপতীকে ফোন করবে বলে ঠিক করল অনুরাধা। কিন্তু করতে হল না। ওর ফোন করার আগেই তপতী আরো একবার ফোন করেছে ওকে। স্ক্রিণের উপরে ওর নামটা দেখেই ফোনটা তাড়াতাড়ি রিসিভ করল ও। ওপাশে তপতী কিছু বলার আগেই ও বলল, "কিরে, সব ঠিক আছে তো?" ফোন ধরেই অনুরাধার মুখে এই প্রশ্নবাণ শুনেই বোধহয় একমুহুর্তের জন্য থেমে গেল তপতী। তারপর ফোনের ওপাশ থেকে সে বলল, "কেন? হঠাৎ এরকম বলছিস কেন?" অনুরাধা বলল, "না, আসলে এত সকালে ফোন করছিস, তাই ভাবলাম কারোর কোনো বিপদ আপদ হয় নি তো? তাই জিজ্ঞাসা করলাম। যাই হোক ছাড়। এখন বল ফোন করেছিস কেন?"

- "কেন আবার? খুলেছিস কিনা সেটা জানার জন্য ফোন করলাম।"

তপতীর কথার কোনো মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বোকার মত প্রশ্ন করল অনুরাধা, "খুলবো! কি খুলবো?!"

- "মানে!? তুই কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস, অনু?" কিছুটা বিস্ময় আর বাকীটা বিরক্তি নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল তপতী। কিন্তু অনুরাধা এখনও বুঝতে পারল না তপতী কি বলছে বা বলতে চাইছে। তাই ও আবার বলল, "ইয়ার্কি করব কেন? তুই কি খোলার কথা বলছিস, সেটাই তো ছাই বুঝতে পারছি না। তাই জিজ্ঞাসা করছি, কি খুলবো?"

- "একটু আগে যে তোকে হোয়াটস্অ্যাপে ম্যাসেজ পাঠালাম, সেটা কি খুলেও দেখিস নি, অনু?" আরোও একবার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল তপতী।

অনুরাধা এতক্ষণে বুঝতে পারল একটু আগে হোয়াটস্অ্যাপে যে ম্যাসেজগুলো ঢুকছিল, সেগুলো তপতী পাঠাচ্ছিল। কিন্তু কি পাঠিয়েছে ও? সত্যিই তো ও এখনও সেগুলো খুলে দেখেনি। কিন্তু এতে ওর দোষটাই বা কোথায়? তারপর থেকে সময় পেয়েছে কোথায় ও? সে কথাটা তপতীকে বুঝিয়ে বলার আগেই সে ফোনের ওপাশ থেকে বলল, "বুঝেছি। এখনও ম্যাসেজটা তুই দেখিসইনি। শোন। তোকে হোয়াটস্অ্যাপে লিঙ্কটা পাঠিয়েছি। খোল। আর শোন সাইন আপ করার সময় কেবল ইমেল অ্যাড্রেসটাই দিবি। খবরদ্দার ফোন নম্বর দিবি না। আর হ্যাঁ, হাঁদির মত নিজের আসল নামটা আবার দিস না যেন। কিছু একটা বানিয়ে দিবি। কিন্তু মনে রাখিস নামটা ক্যাচি হয় যেন। তা নাহলে সবার নজরে পড়বে না। বুঝেছিস? আমি পরে ফোন করব। দুপুরের দিকে কিম্বা বিকালের দিকে। এখন রাখছি। মনে রাখবি ফোন নম্বর ভুলেও দিবি না। তাহলেই ফোন করে করে বিরক্ত করে ছাড়বে। বুঝলি? এখন রাখছি। বাই।" একটানা কথা বলে থামল তপতী। কিন্তু অনুরাধার কিছু বলার আগেই ও ফোনটা কেটে দিল। ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকমুহুর্ত ভাবল ও। কিসব বলল তপতী? অর্দ্ধেক কথা তো বুঝতেই পারল না। হোয়াস্অ্যাপে কিসের লিঙ্ক পাঠিয়েছে ও? হোয়াটস্অ্যাপটা খুলল ও। একদম উপরেই তপতীর নামটা জ্বলজ্বল করছে। তার পাশেই সবুজ রঙের ছোট্ট একটা বৃত্তের মধ্যে সাদা রঙে লেখা আছে, 4। তার মানে তপতী ওকে চারটে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজটা খুলতেই সবার প্রথমে অনুরাধার চোখে পড়ল একটা লিঙ্ক। একটা অ্যাপের লিঙ্ক পাঠিয়েছে তপতী। তার নিচে তিনটে আরো ম্যাসেজ। তাতে লেখা আছে, যেগুলো ও একটু আগেই ওকে ফোনে বলল। অর্থাৎ সাইন আপ করার সময় ইমেল অ্যাড্রেস দিবি। ফোন নম্বর দিবি না। আর নিজের আসল নাম দিবি না। কিন্তু কোন অ্যাপের লিঙ্ক এটা? এটা কি সেই অ্যাপটার লিঙ্ক, যেটার কথা তপতী ওকে কাল সন্ধ্যেবেলায় ফোনে বলছিল? এবং এই আলোচনার কারণেই কাল অতক্ষণ ওদের ফোনালাপ চলেছিল। কালকের ওদের কথাবার্তাগুলো মনে পড়তেই বুকটা একবার হলেও ধুকপুক করে উঠল ওর। ও স্পষ্ট বুঝতে পারল ফোনস্ক্রিণের উপরে থাকা ওর বুড়ো আঙুলটা হঠাৎ করেই কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে বিশ্রীভাবে। সেটা ভয়ে নাকি উত্তেজনায় সেটা সেই মুহুর্তে বুঝে উঠতে পারলো না ও। গলাটা হঠাৎ করেই কেমন যেন শুকনো শুকনো লাগছে। একগ্লাস জল খেলে ভালো হত। শুকিয়ে আসা ঠোঁটদুটোতে একবার জিভটা বুলিয়ে নিয়ে, ঢোঁক গিলে তপতীর পাঠানো অ্যাপের লিঙ্কটার উপরে আঙুল রাখল ও। মুহুর্তের মধ্যে অ্যাপটা ইনস্টল হতে শুরু করে দিল। দুরু দুরু বুকে আর তার সাথে নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থাকল অনুরাধা।
 
আর কই?
নাকি পড়ে দিবেন?
ভালো হচ্ছে
 
আয়ুষ – অনেকদিন পর আজ অ্যালার্মটা বেজে বেজে ক্ষান্ত হয়ে অবশেষে চুপ করে গেল, কিন্তু ওর ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করল না। গায়ের উপরের আলতো চাদরটার মতোই একটা অবাধ্য আলসেমি হঠাৎ করেই ওর সারা গায়ে লেগে রইল। অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুটা জোর করেই চোখদুটো বুজে শুয়ে রইল চুপচাপ। অ্যালার্মটা থেমে যেতেই হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটাকে তুলে নিল আয়ুষ। তারপর অ্যালার্মের স্নুজটাকে বন্ধ করে দিয়ে যথাস্থানে রেখে দিল ফোনটাকে। তারপর আবার কিছু একটা ভেবে ফোনটাকে তুলে নিয়ে ওটার এয়ারপ্লেন মোডটাকে অন করে দিল। তারপর ফোনটাকে সাইলেন্ট করে দিল। এমনটা করার কি কোনো সঙ্গত কারণ আছে? এই মুহুর্তে তা ভেবে উঠতে পারল না ও নিজেই। কিম্বা হয়তো ভাবতে চাইলই না। আজ মন চাইছে বেলা পর্যন্ত বালিশ আঁকড়ে পড়ে থেকে ঘুমোতে। যেটা আবার ওর একদমই স্বভাব বিরুদ্ধ। অনেক ছোটোবেলা থেকেই ও ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠতে পটু। অভ্যেসটা অবশ্য মায়ের কাছেই হাতেখড়ি। শুরুতে যে এসব একদমই ভালো লাগত না, সেটা বোধহয় বলাই বাহুল্য। কিন্তু মায়ের মুখের উপরে কথা বলা ওর চিন্তাতেও স্থান পাবে না। বাবা হলেও না হয় ব্যাপারটা আলাদা ছিল। কিন্তু মা? ওরে বাবা, সে ওর ক্ষমতার বাইরে। তাই মাকে কিছু বলতেও পারেনি মুখ ফুটে। প্রথম প্রথম মা-ই ওকে জোর করে তুলে দিত ভোরবেলা। চিৎকার, চেঁচামেচি, ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না – কিছুই মায়ের মনকে টলাতে পারেনি। রোজ ঠিক ভোরবেলায় ঘুম থেকে তুলে নিয়ে সটান চলে যেত ওদের অ্যাপার্টমেন্টের দিগন্তজোড়া ছাদে। সেখানেই মায়ের সাথে ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ, প্রাণায়াম আর অতি অবশ্যই ধ্যান। মা বলত ধ্যান করলে নাকি চঞ্চল মন শান্ত হয়। কিন্তু ওর মন তো অশান্ত নয়। এই কথাটা ও আজও মাকে বুঝিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ধ্যানটা ও আজও করে। এইভাবেই মা একটু একটু করে ওর মনের মধ্যে শরীর চর্চার একটা বীজ পুঁতে দিয়েছিল। একটু বড় হতেই মা নিজে ওকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিল পাড়ারই এক জিমে। প্রতি মাসে তার টাকা মা-ই দেয়। এখনও। এই এতগুলো বছরে জিমে কতদিন অ্যাবসেন্ট থেকেছে সেটা ও আঙুল গুণে বলে দিতে পারে। এই যেমন আজ। অ্যালার্মের শব্দে ওর ঘুম কিন্তু ভেঙ্গে গেছে। ও চাইলেই দিব্বি কিট ব্যাগটা পিঠে নিয়ে জিমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে পারে বাড়ি থেকে। কিন্তু এটাই মুশকিল। ও চাইছে না। কিন্তু কেন? এটার চটজলদি কোনো ধরতাই উত্তর এই মুহুর্তে ওর কাছে নেই। জাস্ট আজ যেতে ইচ্ছে করছে না, তাই যাবে না। এরকমই একটা বালখিল্য মার্কা এক্সকিউজ মনের কোণে উঁকি দিল ওর।

ফোনটাকে আবার বালিশের পাশে ফেলে দিয়ে চিৎ হয়ে শুল আয়ুষ। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের জানালার উপরে পাখার হাওয়ায় দুলতে থাকা পর্দাটার দিকে তাকালো। কম্পমান পর্দাটার পিছন দিয়ে দিনের প্রথম আলো কিছুটা পিছলে ঘরে ঢুকছে। অন্যান্যদিন এতক্ষণে ওর ব্রাশ পর্যন্ত হয়ে যায়। কথাটা মনে আসতেই জানালার দিকে পিছন ফিরে পাশ হয়ে শুলো ও। কালকে রাত্রে শুতে শুতে বেশ রাত্রিই হয়ে গিয়েছিল ওর। যখন শুতে যায় মোবাইলে দেখেছিল রাত একটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। ল্যাপটপের নীলচে আলোটার দিকে একটানা তাকিয়ে থাকার কারণেই হয়তো কপালের ঠিক মাঝখানটায় একটা টিপটিপে ব্যথা অনুভব করতে পারছিল ও। সেটার জন্য আরো বেশ কিছুক্ষণ ঘুম আসেনি। কিন্তু ঠিক যখন তন্দ্রাটা ঘরে পাতা দইয়ের মত একটু একটু করে জমতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল আওয়াজটা থেমে গেছে ঠিকই, কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিণের আলোটা জ্বলছে। সামান্য নোটিফিকেশন টোনের আওয়াজে যে ওর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে, সেটা আজই ও জানল। এর আগে এসব কখনো কিচ্ছু হয়নি। এতদিন নিজের ঘুমকে গাঢ় বলেই জেনে এসেছে। যাই হোক ফোনটাকে হাতে তুলে নিয়ে দেখল একটা ইমেল ঢুকেছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসল বিছানার উপরে। এতক্ষণে এল মেলটা! একবার ভাবল রেখে দিই, যা হবে কাল সকালে দেখা যাবে। কিন্তু রেখে দিতে গিয়েও পারল না। মেলটা খুলেই ফেলল। ও যা ভেবেছিল ঠিক তাইই। ওটা ওর কাঙ্খিত মেলটাই বটে। মোবাইলের স্ক্রিণটার উপরে কয়েক মুহুর্ত নিশ্চল আঙুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে গুম হয়ে বসেছিল ও। মনের ভিতরের ক্রমাগত দোলাচলটাকে ও বেশ বুঝতে পারছিল। তারপর হঠাৎ করেই আঙুলের একটা আলতো চাপেই বদলে গেল অনেককিছুই। মোবাইলের সাদাটে স্ক্রিণের ঠিক মাঝখানে ঘূর্ণায়মান নীলচে বৃত্তটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন একটা ঝিমুনি গোছের এসে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করেই বৃত্তটা থেমে গেল। তার জায়গায় মোবাইলের স্ক্রিণের মাঝখানে একটা লেখা ফুটে উঠল। Congratulations! Your profile has been activated. Enjoy! লেখাটা বার দুয়েক পড়ল আয়ুষ। ততক্ষণে আরো একটা মেল ঢুকেছে ওর ইমেলে। ও নিশ্চিত ভাবে জানে এতে ওর ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ডটা আছে। একবার মনে হল খুলে দেখি। কিন্তু পরক্ষণেই শরীর আর মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ক্লান্তি অনুভব করল ও। ফোনের স্ক্রিণে দেখল দুটো বেজে আঠেরো। ফোনটাকে বালিশের পাশে রেখে দিয়ে যখন আয়ুষ শুতে গেল তখন বুকের ধুকপুকানি আওয়াজটা বেশ জোরেই শুনতে পাচ্ছিল।

দ্বিতীয়বারের জন্য আবার যখন ঘুমটা ভাঙ্গল তখন কটা বাজে সেটা বুঝে উঠতে পারল না। তবে যে বেলাটা অনেকটাই বেড়েছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কারণ জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে এখন আর আলো নয়, বরং রোদ এসে পড়ছে মেঝের উপরে। দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙ্গার কারণটা যে আর অ্যালার্ম হতে পারে না, তাতে ও একপ্রকার নিশ্চিত। তার একটাই কারণ, এত বেলায় ও কখনো ঘুম থেকে ওঠে না। তাই অ্যালার্ম দেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। কিন্তু ও যে একটা শব্দ শুনেই ঘুম থেকে উঠেছে, তাতে ও নিশ্চিত। কারণ ঘুম ভাঙ্গার অল্পক্ষণ পরেও ওর কানে শব্দটা একবার এসেছিল। তবে সেটা অ্যালার্ম মোটেও নয়। যাইহোক ও আবার বিছানায় উঠে বসল। আর ঠিক তখনই ঘুম ভাঙ্গার কারণটাও বুঝতে পারল। কারণ শব্দটা আবার হতে শুরু করেছে। কে যেন ওর বেডরুমের দরজার উপরে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। কে নয়। মা ধাক্কা দিচ্ছে। কারণ এবার ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের গলার আওয়াজও শুনতে পেল আয়ুষ। "আয়ুষ, আয়ুষ। দরজাটা খোলো। কি হলো? শুনতে পাচ্ছো না? দরজাটা খোলো তাড়াতাড়ি।"

"যাচ্ছি।" বলে বিছানা থেকে নামল ও। ততক্ষণে বাইরের সব আওয়াজ থেমে গেছে। যেমন ঝড়ের আগে সব শান্ত হয়ে যায়। দরজাটা খুলতেই মা একপ্রকার ওকে ঠেলা মেরে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। বেলা যে অনেকটাই হয়েছে সেটা কেবল মায়ের রাগী থমথমে মুখ দেখে নয়, তার সাথে মায়ের পরণের কাপড়টা দেখেও আন্দাজ করতে পারল ও। মা কলেজ যাওয়ার জন্য রেডী হয়ে গেছে। তার মানে মিনিমাম ন'টা বেজেইছে। ম্যাক্সিমামটা আর আন্দাজ করতে পারল না ও। তার সুযোগই পেল না। তার আগেই ঝড় শুরু হয়ে গেল। "কটা বাজে খেয়াল আছে? কবে থেকে এরকম ইনডিসিপ্লিনড হতে শিখলে? দুদিন কলেজ যেতে না যেতেই ডানা গজিয়েছে নাকি? না বোনকে দেখে এসব শিখতে শুরু করেছো? ওটাকে তো হোপলেস বললেও কম বলা যায়। তোমার উপরে আমার একটু হলেও আস্থা ছিল। কিন্তু এখন দেখছি আমারই ভুল। জিন বলেও তো একটা কথা আছে নাকি। বংশধারা আর যাবে কোথায়। বাপ-কাকা সবকটাই তো জন্ম বাউন্ডুলে। তুমিও কি তাই হতে চাও? বাপ-কাকার মত দশটা-পাঁচটার গাধার খাটুনি খেটে জীবন কাটাবে বলে ঠিক করেছো?..." ঝড় নিশ্চিত ভাবেই আরো কিছুক্ষণ চলতো। চলল না কারণ উপরে ভগবান বলেও তো একজন আছে তো। ঝড় যখন পুরোদস্তুর চলমান, তখনই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল ওর বোন। বোনের অবস্থা দেখে মা কেন ও নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল। চুলগুলো এলোমেলো। বাঁ চোখের কাজলটা ধেবড়ে গিয়ে কালশিটের মত দেখতে লাগছে। বোন কাজল পড়েছে মানে কাল কোথাও ওর প্রোগাম ছিল। পরণে একটা ঢোলা গেঞ্জী, যার ডানদিকের কাঁধটা ঝুলে নিচে পড়ে আছে। লম্বা গেঞ্জীর তলা দিয়ে শর্ট প্যান্টের একটা কোণা শুধু দেখা যাচ্ছে। হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, "ছেলেকে শাসন করতে হলে বাড়ির বাইরে গিয়ে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে করতে পারো। কিন্তু প্লিজ সাতসকালে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে নাটক কোরো না, মা, প্লিজ।"

"শাট আপ! এত বয়স হয়ে গেল এখনো ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখোনি? আর সাতসকাল মানে কি? জানো কটা বাজে?..." ঝড়টা এবার ক্রমশ বোনের দিকে অগ্রমান বুঝতে পেরে আয়ুষ তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে পড়ল। ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে যখন ও ডাইনিং টেবিলে এসে পৌঁছাল ততক্ষণে ঝড় থেমে গেছে। তবে আবহাওয়া আগের মতই থমথমে। ও চেয়ারে এসে বসতেই আরেকপ্রস্থ শুরু হল, "একি! তুমি চান করে এলে না?"
- "না। পরে করবো।" পাঁউরুটিটাতে শান্ত কামড় বসিয়ে উত্তর দিল আয়ুষ।

- "পরে করবো মানে?! পরে করলে কলেজ যাবে কখন?"

-"কলেজ আজ যাবো না ভাবছি।" আরো একটা শান্ত কামড় পাঁউরুটিতে।

- "ভাবছো!? কেন যাবে না কেন?" একটু থেমে আবার "শরীর খারাপ? কই দেখি কপালটা?"


মায়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের নাগাল থেকে নিজের মাথাটা একটু সরিয়ে নিয়ে বলল, "না। শরীর খারাপ হয়নি।"
- "তাহলে? কলেজ যাবে না কেন?"

- "পরের সপ্তাহে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। কাল অনেক রাত্রি অবধি জেগে তৈরী করেছি। এখনো কিছুটা বাকী আছে। আর ঘরে থেকে সারবো ভাবছি।" হাতের পাঁউরুটিটা শেষ করেই দ্বিতীয়টার দিকে হাত বাড়াল ও।

-"তোমাদের জেনারেশনের এই এক রোগ। তোমরা সব কাজ ইলিভেন্থ আওয়ারে করো। ঠিক আছে। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি বেরোচ্ছি। তুমি খেয়ে নাও। তোমার বোন ঘুম থেকে উঠলে ওকেও খেয়ে নিতে বোলো। আর শরীর খারাপ লাগলে আমাকে বা বাবাকে কল করবে। বাই।"


ব্যাগটা তুলে নিয়ে মা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। মেনগেটটা লক করে দিয়ে ও আবার চেয়ারে এসে বসল। প্রায় জুতোর শুকতলা হয়ে যাওয়া পাঁউরুটিগুলোকে কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে নিয়ে আবার নিজের রুমে এল ও। দরজাটা লক করে দিতে ভুলল না। বিছানার উপরে বসে বালিশের পাশে পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকাল একবার। তারপর দোনামনা করে ফোনটাকে হাতে তুলে নিল। এয়ারপ্লেন মোডটা অফ করতেই নোটিফিকেশনের ছোটোখাটো সুনামি বয়ে এল। প্রথমেই চোখে পড়ল হোয়াটস্অ্যাপের নোটিফিকেশনে। এটা তিতাস ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। একমাত্র তিতাসই ওকে হোয়াটস্অ্যাপে ম্যাসেজ করে। হোয়াটসঅ্যাপটা খুলতেই দেখল ওর আন্দাজ সঠিক। একসাথে খান তিন চার ম্যাসেজ পাঠিয়েছে তিতাস। বিভিন্ন বিভিন্ন সময়ে। সাতটা একচল্লিশে পাঠিয়েছে, "তোর ফোনটা সুইচড অফ বলছে কেন রে?" আটটা সাতাশে, "এখনও সুইচড্ অফ! শরীর খারাপ নাকি?" ন'টা দুইয়ে, "আজকে কি আর কলেজ আসবি না?" আর একটু আগে, ন'টা বাহান্নয়, "কি ব্যাপার রে তোর? দত্ত স্যারের ক্লাস মিস করলি? কলেজ কি আসবি নাকি ডুব মারলি?" ম্যাসেজের সাগর কোনোরকমে সাঁতরে উঠে ও একলাইনে লিখে পাঠাল, "শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ বাড়িতেই আছি। নোটসগুলো পরে পাঠিয়ে দিস।" মুহুর্তের মধ্যে টিকদুটো নীল হয়ে গেল। আর তার পরেই একটা ইমোজি। এক চোখ বুজে জিভ বের করে ওকে ভেঙচাচ্ছে ইমোজিটা। মনে মনে "পাগলী!" শব্দটা একবার আউড়ে নিয়ে ফোনটাকে রেখে দিতে গেল ও। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে গেল কি কারণে ফোনটা হাতে নিয়েছিল ও। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল প্রায় সাথে সাথেই। মেলটা খুলে বের করল ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ডটা। তারপর কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চল বিরতি। বুকটা আবার অকারণেই ধুকপুক করতে শুরু করে দিয়েছে। কপালে কি ঘামের ফোঁটা দেখা দিয়েছে? হতেও পারে। বাঁ হাতটা দিয়ে একবার কপালটা মুছে নিল ও। তারপর অ্যাপসটা খুলেই ফেলল। যথা যথাস্থানে ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ডটা টাইপ করে আরো একটু বিরতি নিল। তারপর লগ ইনের বোতামটায় আলতো ছোঁয়া দিল। নীলচে একটা বৃত্ত ঘুরতে ঘুরতে থেমে গেল। তারপর লেখা ফুটে উঠতে শুরু করল একটু একটু করে। Welcome to the world of… পড়তে পড়তে এবার সত্যি সত্যিই কপালে ঘাম ফুটে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিণটার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরো একবার কপালের ঘামগুলোকে মুছে নিল আয়ুষ।
 
দূর্নিবার – সেই সকাল ন'টা – সওয়া ন'টা থেকে দুপুর বারোটা – সাড়ে বারোটা অবধি যেন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় থাকে না দুর্নিবারের। অবশ্য এমনটা হওয়াও কিছু আশ্চর্যের নয়। রিসেন্টলি প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার থেকে সটান ম্যানেজার হলে মাইনের সাথে সাথে কাজের চাপটাও যে সমানুপাতিক হারে সাধারণত বেড়ে থাকে, তা ওর ভালো করেই জানা আছে। অবশ্য কাজ করতে যে, ওর খারাপ লাগে বা ভালো লাগে না, তাও নয়। তবু কাজের তো একটা গতি বা রিদম থাকা দরকার নাকি। কখনও কমবে আবার কখনও বাড়বে। কিন্তু ব্যাঙ্কের কাজের ক্ষেত্রে তা হওয়াটা সম্ভব নয়। যতই সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় লোকেরা তাদের মত ব্যাঙ্ক এমপ্লয়ীদের নিয়ে মজা করে বা ট্রোল করে, তার এক শতাংশও জানে না, ব্যাঙ্কে তাদের সারাদিনে ঠিক কতটা পরিমাণে কাজ করতে হয়। তারা তো মজা করেই খালাস। এই যেমন দূর্নিবারের কথাই ধরা যাক। প্রমোশনটা ও পেয়েছে মাস আড়াই হল। মাইনেও বেড়েছে একলাফে অনেকটাই। সেইসাথে বেড়েছে কাজের চাপও। আগে তবু কিছুটা রিল্যাক্স হওয়ার অন্তত সময় পেত। কলিগদের সাথে খোশগল্প করারও সময় বেরিয়ে যেত ঠিক। এখন আর তা হওয়ার নয়। ম্যানেজার হওয়ার পর থেকে আলাদা কেবিনে একলা কয়েদীর মত সময় কাটাতে হয় তাকে। কশ্চিৎ কদাচিৎ কলিগদের মধ্যে কেউ কেউ আসে তার কেবিনে। ফাইলে সই করাতে বা অন্য কোনো কাজে। বাকিটা সময় একা একাই কাটাতে হয় তাকে। মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে ও। মনে মনে ভাবে প্রমোশনটা না অ্যাকসেপ্ট করলেই বোধহয় ভালো হত। ঐ যে কথায় বলে না, "সুখের থেকে শান্তি অনেক ভালো।" সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও। এই যেমন আজকেই। সেই যে সকাল ন'টা থেকে ঢুকে ল্যাপটপে মুখ ঢুকিয়েছিল, বের করল সাড়ে বারোটা নাগাদ। এর মাঝে কেবল দেড় কাপ র' চা আর খান তিনেক সিগারেটের বিরতি। ঘাড়টা টনটন করছে। বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়টায় হালকা ম্যাসাজ করতে করতে চেয়ারের নরম গদিতে পিঠটা ঠেকাল ও। দিনটা মোটেও সুবিধের যাচ্ছে না। যেমন – সকালের ঘুমটা ভেঙ্গেছিল ইতু অর্থাৎ বউয়ের ঠেলানি খেয়ে। ও সাধারণত এরকম করে না। কিন্তু আজ করল। আধো ঘুমে আধো জাগরণে বউয়ের মুখে হাঁকাহাঁকি শুনে যেটুকু ও বুঝেছিল তা হল, বুবান অর্থাৎ ওদের ছেলে নাকি আজ ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে জিমে যায় নি। বিছানায় পড়ে পড়ে নাকি ভোঁশ ভোঁশ করে ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা, এটা কি কোনো কথা হল? উঠতি বয়সের একটা ছেলে, এক-আধদিন কি বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না? এক কথাটাই ও বউকে বোঝাতে গিয়েছিল। তাতে বিপদ বাড়ল বৈ কমল না। বউ আরও বেশী করে হাঁউমাউ করে ওকে চল্লিশটা কথা শুনিয়ে চলে গেল। ওর জন্যই নাকি ছেলে-মেয়ে দুটো মানুষ হল না। মা যতই চেষ্টা করুক বাবা ছেলেমেয়েদের মানুষ হতে দেবে না। ইত্যাদি, প্রভৃতি। ও তখনই বুঝে গিয়েছিল আজকের দিনটা কেমন যেতে চলেছে। তাই দেরী না করে ঘুম থেকে উঠে গুড বযের মত রেডী হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে যখন ঘর থেকে বের হচ্ছে তখনও ওর বউ ছেলের দরজায় ধাক্কা মারছে। এরকম ছিটমস্তিষ্কপ্রবণ মহিলার সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর জন্য তার জন্য একটা না একটা পুরষ্কার প্রাপ্য, এতে ওর নিজের কোনো সন্দেহই নেই।

হাল্কা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের উপর থেকে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল দূর্নিবার। লাইটারটা রাখতে গিয়ে নজর পড়ল ফোনটার উপর। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল গতকালের টিফিনের কথা। ইন্টারকমের বোতামটা টিপে ও বলল, "তনিমা, এক্ষুণি একবার আমার কেবিনে এসো। কুইক। আর সাহেব তুমি ক্যাশে একটু বোসো। আমার টাইম লাগবে।" ইন্টারকমটা রেখে দিয়ে সিগারেটটায় আরামের একটা টান দিল ও। গতকালের কথাগুলো মনে পড়তেই কেমন একটা সলজ্জ হাসি খেলে গেল ওর গোটা মুখ জুড়ে। ফোনটা হাতে নিয়ে আলতো করে নাড়তে লাগল। ঠিক তখনই ওর কেবিনের দরজাটা খুলে একটি মেয়ে মুখ বাড়ালো, "মে আই কাম ইন, স্যার?"

- "এসো, এসো তাড়াতাড়ি এসো।" বলে হাতের সিগারেটটাকে অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল ও।

তনিমা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি একটা গন্ধ এই এয়ারকন্ডিশনড বদ্ধ ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই গন্ধটা ইউনিক। সেই সাথে নতুন। মেয়েটার বোধহয় পারফিউমের কালেকশন আছে। প্রায় প্রতিদিনই একটা করে নতুন পারফিউম মেখে আসে। গন্ধগুলোও বেশ মিষ্টি হয়। এটার কি নাম কে জানে। তনিমা মুচকি হেসে সামনের একটা চেয়ার টেনে বসল। দূর্নিবার ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রইল। আজকে ও পরে এসে ক্রিম কালারের একটা শার্ট আর কালো জিন্স। তাও আবার টাইট ফিটিংস। শরীরের আনাচ কানাচের ভাঁজগুলো খালি চোখেই ধরা পড়ছে। আরো একটা জিনিস নজরে পড়ল ওর। তনিমার শার্টের একদম উপরের বোতামটা খোলা। ভিতরের অন্ধকার কেমন যেন ভয়ঙ্কর ভাবে হাঁ হয়ে আছে। এইটা মেয়েটার আরো একটা বদ স্বভাব। কিন্তু এটা যে ও কেন করে, তার কারণ আজও বুঝে উঠতে পারেনি দূর্নিবার। মেয়েটার বয়স মেরে কেটে সাতাশ। আজ তিন বছর এই ব্যাঙ্কে ক্যাশিয়ারের চাকরী করছে। বিয়ে করেনি। অথচ বয়ফ্রেন্ডের সাথে লিভ ইনে থাকে। কলকাতা শহরটাও যে সাবালক হয়ে উঠেছে তা এই তনিমার মত মেয়েদের দেখলেই বোঝা যায়। দূর্নিবার একবার ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "লিভ ইনে না থেকে, বিয়েটা করে নিচ্ছো না কেন?" তাতে ঠোঁটচাপা একটা হাসি হেসে তনিমা উত্তর দিয়েছিল, "সব চাহিদা যখন এতেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে, তখন বিয়ের বোঝাটা ঘাড়ে নিতে যাবো কেন শুধুশুধু?"

- "স...সব চাহিদা মানে?" তুতলিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল ও।

- "সব চাহিদা মানে, সঅঅঅব চাহিদা।" ঠোঁটচাপা হাসিটা ততক্ষণে অনেকটা প্রকাশ পেয়েছিল।

সেই সাথে চোখের একটা ইশারা। সেই ইশারা দেখে অর্থটা বোধগম্য বিশেষ দেরী হয়নি ওর। আর কথাও বাড়ানি সে। এই মেয়ে একটা আস্ত আগুনের ফুলকি। সাবধানে না হ্যান্ডেল করলে পুড়ে মরাও অসম্ভব নয়।

চেয়ারে বসেই প্রথমে বলল, "ডাউনলোড করেছেন?" ও ঘাড় নেড়ে উত্তর দিল, "না।" তারপর একটু থেমে বলল, "আমি ওসব পারি না। তুমিই করে দাও।" ওর বিখ্যাত ঠোঁটচাপা হাসিটা হেসে দিয়ে তনিমা হাত বাড়িয়ে বলল, "কই দিন আপনার ফোনটা। আমিই সব করে দিচ্ছি।" ফোনটা তনিমার হাতে সঁপে দিল দূর্নিবার। ফোনটা হাতে পেয়েই তাতে মনোযোগ দিয়ে ঘাঁটতে শুরু করে দিল তনিমা। ততক্ষণে ওকে জরিপ করতে শুরু করল দূর্নিবার। মেয়েটার বয়স ছাব্বিশ/সাতাশ। রঙ ফর্সাই বলা চলে। মুখশ্রীও বেশ ভালো। তবে সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ে তা হল ওর শরীর। যাকে বলে চাবুকের মতো। লম্বা। ছিপছিপে। মেদহীন। কিন্তু বুক আর পাছাদুটো বেশ মাংসল। টাইট ফিটিংস শার্ট আর প্যান্টের দৌলতে তা ভালোই বোঝা যায়। একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখদুটো যেন স্ক্যান করতে লাগল তনিমার গোটা শরীরটাকে। বিশেষ করে বোতাম খোলা জায়গাটাকে। সামান্য গোলাপীর একটা আভাস যেন ফুটে উঠেছে কি? চোখদুটোকে সরু করে সেদিকে ভালো করে তাকালো ও। হ্যাঁ। ঠিকই। বোতমা খোলা ক্রিম কালারের শার্টের তলা থেকে গোলাপী রঙের ইনারটার একটা হদিশ যেন পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি নিচেরটাও গোলাপী? নাকি অন্য কোনো কালার? মাথায় যেন রক্ত চলকে উঠল ওর। কল্পনাগুলো আবার যেন লাগামছাড়া হয়ে চলেছে। মাথাটাকে ঠান্ডা রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল ওর। তনিমার অবশ্য এসব দিকে একদমই খেয়াল নেই। সে ফোনের দিকেই চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করল, "তাহলে ফোন নম্বরটা দেবো না তো?"

- "না। ওতে রিস্ক বেশী। তুমি ইমেলটা দাও। আবার আমার পার্সোনালটা দিও না যেন। কালকেই একটা ফেক ইমেল তৈরী করেছি। ওটা দাও। তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কালকেই পাঠিয়ে দিয়েছি দেখো।"

ফোন থেকে একবার মাত্র চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে আরো একবার ঠোঁটচাপা হাসিটা হাসল তনিমা। তারপর আবার চোখ নামিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি আগেভাগেই সব কাজ গুছিয়ে রেখেছেন দেখছি। গুড!" তারপর নিজের ফোন দেখতে দেখতে টাইপ করতে লাগল। তারপর একবার চোখ তুলে বলল, "এই ইউজার নেমটা দেবেন?" ও ঘাড় নেড়ে বলল, "হ্যাঁ।" তনিমা বলল, "বাঃ! বেশ সেক্সী একটা নাম তো? কোথায় পেলেন?"

- "নেটে। কালকেই সার্চ করে বের করে রেখেছিলাম।"

তনিমা আরো কিছুক্ষণ ওর ফোনটাকে নিয়ে নাড়াঘাঁটা করার পর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, "নিন। হয়ে গেছে। পাসওয়ার্ডটা আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর আপনার প্রোফাইলে আমাকেও অ্যাড করে দিয়েছি। আপনার কপালে আর কেউ না জুটলেও আমি রইলাম।" তনিমার হাত থেকে ফোনটা ফেরত নিয়ে ও মুচকি হেসে বলল, "তুমিই তো আমার একমাত্র ভরসা।"

- "কথাটা মনে রাখবেন। আমার কোনো দরকার পড়লে আপনাকেও হেল্প করতে হবে কিন্তু।"

- "এনিটাইম।"

-"এখন চলি। বাইরে ভীড় আছে। আর হ্যাঁ, একবার সব দেখে নিয়ে বুঝে টুঝে নিন। কিছু প্রবলেম হলে আমি হেল্প করে দেবো।"

তনিমা কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই ফোনটার দিকে তাকালো দূর্নিবার। অ্যাপটা তখনও খোলা রয়েছে। সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গতকাল দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল ওর। টিফিনের সময় বাকী কলিগদের সাথে খাবার আর সময় শেয়ার করাটা ওর অনেকদিনেরই অভ্যেস। কিন্তু ওর ম্যানেজার পদে উন্নীত হওয়ার পর থেকে সেই অভ্যাসে কিছুটা হলেও দাঁড়ি পড়েছে। তার কারণ অবশ্য সে নয়, বরং বাকীরা। বাকীরা তার সঙ্গে আর টিফিনে খেতে আসে না। আসলে তাদের যে আর সাহসে কুলায় না, সেটা ও ভালো করেই বুঝতে পারে। কিন্তু তনিমা মেয়েটা যে অন্য ধাতুতে গড়া সেটা ও ভালো করেই জানে। তাই স্রোতের উল্টোদিকেই সাঁতার কেটে সে সটান চলে আসে ওর কেবিনে। ও আপত্তি করেনি। একা একা খাবার খাওয়ার চেয়ে কারো সঙ্গে খেতে ওর ভালোই লাগে। আৎ তনিমা হলে তো কোনো আপত্তি থাকারও কথা নয় অবশ্য। ওরও নেই। তাই ওরা দুজনেই ওর কেবিনে খাবার খায়। গল্প করে। হাসিঠাট্টা করে। তাই নিয়ে অবশ্য গোটা ব্যাঙ্ক জুড়ে যে একটা কানাকানি চলে, সেটাও ওর চোখ বা কান কোনোটাই এড়ায় নি। 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' কথাটা বেশ কয়েকবারই ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে মধুবর্ষণ যে করেনি তা নয়। কিন্তু ও তাতে বিশেষ কর্ণপাত করেনি। বা করার প্রয়োজন মনে করেনি। তনিমাও যে করেনা, তাতে ও একশো শতাংশ নিশ্চিত। নিজের বয়ফ্রেণ্ড বা লিভ ইন পার্টনারের প্রতি ও বেশ কমিটেড। ওর কথাবার্তায় তা অনেকবারই টের পেয়েছে দূর্নিবার। মেয়েটা যে একটা আস্ত ফুলকি। সেটা তো আর ও এমনি এমনি বলে না। তার যথেষ্ট কারণও আছে। এই যেমন গতকাল। টিফিনের সময়। এটা ওটা কথার মাঝেই হঠাৎ করে তনিমা ওকে জিজ্ঞাসা করে বসল, "আপনার ম্যারেজ লাইফ কত বছর হল?"

- "এ বছর টোয়েন্টি ফিফথ হবে।" চিবোতে চিবোতে উত্তর দিয়েছিল ও।

- "বাব্বা! পঁ...চিশ বছর!!!" পঁচিশ কথাটা কেমন যেন টেনে টেনে উচ্চারণ করল তনিমা।

- "হ্যাঁ। কিন্তু কেন বলোতো?" তনিমার কথা বলার ঢংয়ে ও কিছুটা আশ্চর্যই হয়ে গেছিল।

- "না এমনি।" আরো একবার যেন খাবারে মন দিল তনিমা।

- "এমনি এমনি কথা বলার মেয়ে তো তুমি নও।"

- "তার মানে আমি সব বাজে বকি?" গুলির মত প্রশ্ন ওর দিকে একপ্রকার ছুঁড়ে মারল তনিমা।

- "মোটেও না। বরং তোমার সব কথার পিছনে একটা নির্দিষ্ট কার্যকারণ থাকে। এবার বলোতো হঠাৎ এই কথাটা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে কেন?" ধীরে সুস্থে নিজেকে প্রমাণ করে পাল্টা প্রশ্নটা করে বসেছিল ও।

- "কয়েকদিন থেকেই আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে?"

- "কি প্রশ্ন?"

- "এই যে আপনি বিবাহিত। ম্যাডামের সঙ্গে একসাথে একই বাড়িতে থাকেন। একই বিছানায় শোন। আপনার দুটো ছেলে মেয়ে আছে। আর আমিও আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একই বাড়িতে থাকি। একই বিছানায় পাশাপাশি শুই। মাঝেমধ্যে 'ইয়ে'ও করে থাকি..."

- "'ইয়ে'টা কি?" তনিমার প্রগলভ বক্তৃতার মাঝেই তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে মেরেছিল দূর্নিবার।

- "উফ! দিলেন তো কথার ফ্লো টা নষ্ট করে..." তার মার্কামারা ঠোঁটচাপা হাসিটা হেসে বলেছিল তনিমা।

- "সরি, সরি, সরি। বলো, কি বলছিলে?"

-m"হ্যাঁ। যা বলছিলাম। তো আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একই বাড়িতে থাকি। কিন্তু ক'দিন?"

- "মানে?" তনিমার প্রশ্নের আত্মিক অর্থটা ওর বোধগম্য হল না।

- "মানে। এভাবে আমি কতদিন ওর সাথে থাকতে পারবো? বা থাকবো? সারাজীবন তো নিশ্চয়ই নয়।"

- "কেন? সারাজীবন নয় কেন? তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের প্রতি কি কমিটেড নও?"

- "এই হচ্ছে আপনাদের জেনারেশনেই একটা মস্ত বড়ো দোষ। সে আমার বয়ফ্রেন্ড। আমি ওর গার্লফ্রেন্ড। আমরা একসাথে আজ বছর পাঁচেক হতে চলল লিভ ইন করছি। জানিনা কোনোদিন ওকে বিয়ে করবো কিনা, কিন্তু এখানে কমিটমেন্টের কথা আসছে কোথা থেকে? আমি ওকে ভালোবাসি। ওও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তার মানে ওই নয় আমরা একে অপরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে বা পছন্দ করতে পারবো না?" একটানা কথা বলে থামল তনিমা।

- "আমি এখনও তোমার কথা বুঝতে পারলাম না, তনিমা।"

- "Voyeurism মানে জানেন?" ওর কথার উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করল তনিমা। ও তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিতে পারল না। শব্দটা আগে কোথাও শুনেছে কিন্তু মানেটা জানা নেই ওর। ও চুপ করে আছে দেখে তনিমাই আবার বলল, "আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি মানেটা আপনি জানেন না। শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হল ঈক্ষণকাম।" তারপর একটু থেমে আবার বলল, "কি? আরোও বেশী করে গুলিয়ে গেল তো? গোদা বাংলায় যাকে বলে এমন ব্যক্তি যে কোনো গুপ্তস্থান থেকে অন্যের সেক্স দেখে নিজে তৃপ্তিলাভ করে। Voyeur বা cuckold এসবের প্রায় একই মানে। অবশ্য Voyeurism আর cuckolding আলাদা বস্তু। কিন্তু ধরে নিন কিছুটা হলেও জিনিস দুটো প্রায় এক। তা আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমি বা আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসলেও যে voyeur বা cuckold হতে পারবো না, সেটা কে বলল?"

- "আমি এখনও তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।"

- "দেখুন, আমার বয়ফ্রেণ্ড হচ্ছে একজন cuckold. ওর ইচ্ছে আমি ওর সামনে অন্য কারোর সাথে সেক্স করি। আর ও সেটা বসে বসে এঞ্জয় করবে।"

- "ধ্যাৎ! এরকম আবার হয় নাকি? এ তো ইললিগ্যাল!"

- "আপনি সত্যিই প্রাগৈতাসিক যুগেই পড়ে রয়েছেন। এটা তখনই ইললিগ্যাল হতো, যদি এতে আমার কনসেন্ট না থাকতো।"

- "মানে??!! এতে তোমার কনসেন্ট আছে??!!!" খাবার প্রায় ওর গলায় আটকে যাওয়ার জোগাড় তখন।

- "অফকোর্স আছে। এই তো বয়স এক্সপেরিমেন্ট করার।"

- "কিন্তু এসব করবে কিভাবে?"

- "Gigolo মানে জানেন?"

- "সে আবার কি? কিসব বলছো কিছুই বুঝতে পারছি না।"

- "Gigolo মানে হচ্ছে male prostitute, বুঝলেন?"

- "কলকাতায় ওসব আছে নাকি?"

- "সব আছে। কেবল খুঁজে বের করার অপেক্ষা। male – female সব আছে আপনার হাতের মুঠোয়।"

-"হাতের মুঠোয় মানে?" প্রশ্নটা শুনে চোখটা একবার নাচিয়ে নিয়ে ঠোঁটচাপা হাসিটা হেসে তনিমা বলেছিল, "এখন নয়, পরে বুঝিয়ে বলবো আপনাকে।"

সুমিষ্ট একটা আওয়াজে ঘোর কাটল দূর্নিবারের। অতীত থেকে বর্তমানে দ্রুত ফেরৎ এল ও। শব্দটা এসেছে ওর হাতে ধরে থাকা ফোনটা থেকে। চমকে তাকিয়ে ও দেখল ফোনের স্ক্রিণে ফুটে উঠেছে, One Message Received বার্তাটি। অপশনটিতে ক্লিক করতেই তড়িৎ গতিতে অ্যাপটা খুলে গেল। নীলচে একটা বৃত্ত একটু ঘোরার পরেই স্ক্রিণটা সাদা হয়ে গিয়ে মেসেজটা খুলে গেল। একবার ঢোঁক গিলে চোখ বড়ো বড়ো করে সেই দিকে তাকিয়ে থাকল দূর্নিবার।
 
ইন্দুমতি – চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের মরা আলোটা এসে পড়েছিল ইন্দুমতির মুখের বাঁদিকটায়। কপালে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো ঐ আলোর জন্য নাকি অন্য কোনো কারণে সেটা অবশ্য ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। হাতের ব্যাগটা থেকে রুমালটা বের করে ধীরে সুস্থে মুখটা একবার মুছে নিল ও। তারপর সেটাকে আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে বাসের সীটটায় গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসে চোখ বুজল। উফ! সারাটা দিন গেলো বটে একটা! কেমন যেন ক্লান্তি বোধ করছে শরীর আর মনের ভিতরে। এদের দুজনেরই বা দোষ কী! সারাটা দিন জুড়ে কম ধকল গেলো ওদের উপরে। সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে দৌড়োদৌড়ি। আজকেই হঠাৎ করে বুবান অর্থাৎ ওর ছেলে দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছে। অন্যদের কাছে হয়তো এটা নিতান্তই একটা ছোট্ট ঘটনা হতে পারে। এমন কি তার বরের কাছেও। কিন্তু তার কাছে একদমই নয়। মেয়েকে সে একেবারেই মানুষ করতে পারেনি। যাকে বলে হোপলেস। কিন্তু ছেলেকে সে ছোটোবেলা থেকেই নিজের মনের মতো করে বড়ো করে তুলেছে। অন্তত করে তোলার চেষ্টা করেছে। চেষ্টার সে কসুর করেনি। তার মতে একজন মানুষ তখনই সাকসেসফুল হতে পারে, যখন সে জীবনে ডিসিপ্লিনড হয়। সে ছেলেকে ডিসিপ্লিনড করে তোলার সর্বত চেষ্টা করে গেছে। এবং এখনও করে যাচ্ছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের তো সে দেখতে পাচ্ছে নিজের চোখের সামনেই। কি অধঃপতনেই না তারা যেতে শুরু করেছে। এমনকি নিজের পেটের মেয়েটাও তো সেই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। তাই তার জেদ ছেলেকে সে কিছুতেই যেতে দেবে না। তাই আজকের সকালের ঘটনা কিছুটা হলেও তার মনে দাগ কেটে গেছে। তাহলে কি তার ছেলেও তার নাগালের বাইরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে? কথাটা ভাবতেই নিজের মনেই শিউড়ে উঠল ইন্দুমতী।

- "ম্যাডাম. ভাড়াটা দিন।" কন্ডাক্টরের ডাকে বর্তমানে ফিরে এল ও।

চোখ খুলে দেখল আধবয়সী লোকটা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্ষয়াটে চেহারার লোকটাকে প্রতিদিনই দেখতে পায় ও। প্রতিদিনই কলেজ থেকে এই বাসে করেই বাড়ি ফেরে। রোজকার রুটিন বলা যেতে পারে। অবশ্য যেদিন কাজের চাপে বা অন্য কারণে দেরী হয়ে গেলে আলাদা কথা। কিন্তু তা না হলে ও এই বাসেতেই বাড়ি ফেরে ডেলী। নিজের রোজকার রুটিনটা চট করে ভাঙ্গতে চায় না ও। কেমন যেন কমফোর্টেবল ফিল করে না। আর তাই নিয়ে ওর বর আর মেয়ে ওকে নিয়ে মজা করে। ঠাট্টা করে। কিন্তু ও সেসব গায়ে মাখে না। কারণ ওর কাছে ডিসিপ্লিনটাই শেষ কথা। ও চোখ খুলতেই কন্ডাক্টারটা আবার বলল, "ম্যাডাম, ভাড়াটা?"

- "দিচ্ছি।" বলে পার্স থেকে কুড়িটা টাকা বের করে লোকটার হাতে দিয়ে দিল।

টাকাটা নিয়ে অকারণেই নিজের পান আর গুটখা খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে একটা দেঁতো হাসি হেসে পিছনের দিকে চলে গেল লোকটা। সে প্রতিদিনই এই হাসিটা হাসে ওর দিকে চেয়ে। হয়তো আলতো সৌজন্যের হাসি, কিন্তু হাসিটা দেখলেই ওর কেমন যেন গাটা গুলিয়ে ওঠে। হয়তো ওর ক্ষয়াটে গালে না কামানো কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা সাদাকালো দাড়িগুলো দেখে। কিম্বা ওর বিশ্রী দর্শন লালাভ দাঁতগুলো দেখে। কিম্বা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গায়ের তীব্র ঘামের গন্ধের কারণে। কারণ যাই হোক, লোকটাকে দেখে ওর একদমই ভালো লাগে না। অথচ লোকটা কোনোদিন ওর সঙ্গে মিসবিহেভ করেনি। বরং ও কলেজে পড়ায় শুনে ওকে সম্মান দিয়ে 'ম্যাডাম' বলে ডাকে। তবুও ওর লোকটাকে একদমই পছন্দ হয় না। কেমন যেন একটু গায়ে পড়া। আর এইরকম গায়ে পড়ে লোক ওর একদমই অপছন্দের। সিটের ব্যাকরেস্টে শরীরের সমস্ত ভারটা ছেড়ে দিয়ে আরামে চোখ বুজল ইন্দুমতি। ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকে মনটা কেমন যেন টক হয়ে গেছিল ওর। কলেজে পৌঁছাবার পরেও সেই ভাবটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাটেনি। পর পর দুটো ক্লাস নেওয়ার পর স্টাফরুমে ঢুকে টেবিলের উপরে হাতের বইগুলোকে সশব্দে আছড়ে ফেলে ও বলল, "আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যেন উচ্ছন্নে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বসে আছে।" পাশের চেয়ারে বসে থাকা ফিলোসফির প্রফেসর এবং ওর বন্ধু তন্নিষ্ঠা ম্যাডাম হাতের ম্যাগাজিনটাকে নামিয়ে ওর দিকে মৃদু হেসে বলল, "কেন, আজকে আবার ক্লাসে কি হলো?" ওর পাশের খালি চেয়ারটায় ধপাস করে বসে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, "হেসো না তো, গা জ্বলে যাচ্ছে। এমনিতেই সকাল থেকে মাথাটা গরম হয়ে আছে।" হয়তো ওর গলার স্বরে বা বলার ধরণে তন্নিষ্ঠা বুঝতে পারল সত্যিই ওর মেজাজটা খারাপ আছে। সঙ্গে সঙ্গে ও সিরিয়াস কণ্ঠে বলল, "কেন, কি হয়েছে? তবে তার আগে একটু জল খাও। পুরো ঘেমে গেছো দেখছি।" ইন্দুমতি নিজের ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা জল খেল। তারপর রুমাল দিয়ে মুখ, ঘাড়, গলা ভালো করে মুছে নিয়ে তন্নিষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বলল, "কি বলবো বলো তো? একটা কারণ হলে হয়, এখানে হাজারটা কারণ।"

- "প্রথমে একটু শান্ত হয়ে পাখার তলায় বসো। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় এক এক করে বলো, কি হয়েছে।"

- "সে সব বাদ দাও। তোমাকে যেটা বলেছিলাম করেছো?"

- "কি?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল তন্নিষ্ঠা।

- "কি মানে? কালকেই তো তোমার সঙ্গে কথা হলো!! তুমি বললে ব্যাপারটা জেনে আমায় বলবে!!! আর আজকেই ভুলে গেলে?" ততোধিক আশ্চর্য হয়ে ইন্দুমতি বলল।

- "ওহ, কালকের ঐ ঘটনাটার কথা বলছো? তোমার চিন্তা নেই। আমি কালকেই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ছেলেটার সঙ্গেও বলেছিলাম। অবশ্য আলাদা আলাদা করে..."

- "কি বলল ওরা?" তন্নিষ্ঠাকে একপ্রকার থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ও।

- "বলছি। তবে আগেই জানিয়ে রাখি ওরা আমাকে শর্ত দিয়েছে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি যেন তোমার বা অন্য কারোর সাথে কোনোরকম আলোচনা না করি।"

- "শর্ত!! ওরা শর্ত দেওয়ার কে? তুমি এক্ষুণি চলো আমার সঙ্গে।"

- "কোথায়?"

- "কোথায় আবার? প্রিন্সিপালের কাছে। ওনাকে এই বিষয়টা জানাতে হবে।"

- "তোমার কি মনে হয়, তাতে ব্যাপারটা মিটবে?"
- "কেন মিটবে না?"

- "তার কারণ, আমরা যদি প্রিন্সিপালের কাছে যাই, এবং ওনাকে বিষয়টা জানাই, তাহলে ব্যাপারটা আর তোমার আমার মধ্যে লুকানো থাকবে না। আর একবার জানাজানি হলেই আমরা এইটা আর জানতে পারবো না, এই বিষয়টার মধ্যে আর কে কে বা কি কি লুকিয়ে আছে।" শান্ত স্বরে ওকে তামিয়ে দিয়ে বলল তন্নিষ্ঠা।

তন্নিষ্ঠার কথায় যুক্তি আছে বুঝতে পেরে থেমে গেল ইন্দুমতি। উত্তেজনায় ও আবার ঘেমে উঠেছে বুঝতে পেরে রুমাল দিয়ে আবার ঘামগুলোকে মুছতে মুছতে বলল, "কি কি জানতে পেরেছো বলো আমায়।"

- "এইটুকুই যে, অ্যাপটা নেটে সহজেই পাওয়া যায়। যে কেউ সেটাকে ডাউনলোড করে ইন্সটল করতে পারে। ওরাও তাইই করেছে। তুমি আমিও করতে পারি। যে কেউ এটা করতে পারে।"

- "কিন্তু এটা তো বেআইনী!"

- "কথাটা তুমি নিতান্তই বাচ্চা মেয়ের মত বললে।" মুচকি হেসে বলল তন্নিষ্ঠা।

- "কেন?"

- "যে জিনিসটা নেটে সহজেই অ্যাভেইলেবল সেটা বেআইনী হয় কি করে? আর হলেও বা সেটাকে আটকাবে কি করে? তুমি কি ভিপিএনের কথা শোনোনি?"

- "শুনেছি।" তেতোমুখ করে বলল ও। তারপর একটু থেমে বলল, "আর কি জানতে পারলে?"

- "প্রথমত ওরা স্বীকার করল যে তোমার ক্লাসে ওটা ব্যবহার করা ওদের উচিত হয়নি। এর জন্য ওরা ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। এবং বারবার আমার কাছে অনুরোধ করেছে যেনো এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশি জলঘোলা না করি। প্রিন্সিপাল বা ওদের গার্জেন যেন জানতে না পারে।"

- "আর?"

- "আর, ওর এটাও বলল যে, কলেজের অনেক ছেলেমেয়েই নাকি এই অ্যাপটা ইউজ করে।"

- "মাই গড! এদের কিস্সু হবে না। সামান্য কলেজে পড়ে, আঠারো, উনিশ বছর বয়স সব। এখনো সামনে গোটা জীবনটা বাকী... ছিঃ ছিঃ ছিঃ!! কি নোংরামী।" বলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ইন্দুমতি।

তারপর হঠাৎ মুখ তুলে তন্নিষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বলল, "অ্যাপটার নাম জানতে পেরেছো?" তন্নিষ্ঠা বলল, "হ্যাঁ। ওরা আমাকে অ্যাপটার নাম বলেছে?" ইন্দু তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে বলল, "অ্যাপের নামটা আমায় বলোতো..." ওর এই কর্মোদ্যম দেখে অবাক হয়ে গেল তন্নিষ্ঠা। ও অবাক হয়েই বলল, "কেন, তুমি অ্যাপটার নাম জেনে কি করবে?"

- "আঃ বলোই না। একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়।" বিরক্ত জড়ানো কণ্ঠে বলল ইন্দু।

- "কি আইডিয়া?"

- "বলছি, তার আগে আমায় অ্যাপটার নামটা তাড়াতাড়ি বলো। আমার ক্লাস আছে। তার আগেই সব করতে হবে।" ব্যস্ততার সুরে বলল ইন্দু।

চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল ইন্দুমতি। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে হাতে নিল। তারপর আবার দোনামোনা করে সেটাকে ব্যাগে পুরে রেখে দিল। বাসে বসে এসব জিনিস না করাই ভালো হবে মনে করে ফোনটাকে রেখে দিল সে। উত্তেজনার বশে কিছু না করাই ভালো হবে। তার চেয়ে বরং ঠান্ডা মাথায় এসব কিছু করতে হবে। কথাটা ভেবেই ইন্দু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। এখনো ওর স্টপেজ আসেনি। একটা স্টপেজ বাকী। কিন্তু ও সিট ছেড়ে উঠে পড়ল। তারপর বাসের গেটের দিকে এগিয়ে গেল। বাসটা সম্পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। গেটের কাছে আসতেই একটু বেটাল হয়ে গেল ও। কন্ডাক্টারটা দাঁড়িয়ে ছিল গেটের ঠিক মুখেই। ভীড়ও যে খুব একটা ছিল তা নয়। দুজন মাত্র দাঁড়িয়ে ছিল গেটের কাছে। হয়তো সামনের স্টপেজে নামবে। ইন্দু বেটাল হয়েই মাথার উপরের রডটাকে ধরতে গেল। কিন্তু হাতে ব্যাগ থাকায় তা পারল না। এবং তার ফলে ও আরো বেটাল হয়ে গেল। হয়তো ও মুখ থুবড়ে পড়েও যেতে পারত, কিন্তু পড়ল না। কারণ একজোড়া শক্ত হাত ওকে ধরে ফেলল। "আরে, আরে, ম্যাডেম, পড়ে যাবেন যে। ঠিক করে দাঁড়ান। আর আপনি এখন উঠে এলেন কেন। আপনার স্টপেজ এখনো আসেনি।" শতব্যস্ত হয়ে কন্ডাক্টারটা বলল। ইন্দু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বুক থেকে খসে পড়া শাড়ির আঁচলটাকে আবার যথাস্থানে গুছিয়ে রাখল। তারপর কঠোর স্বরে বলল, "আমি এখানেই নামব।" ততক্ষণে ওর শরীর থেকে হাতজোড়া সরিয়ে নিয়ে লোকটা। উফ! লোকটার হাতদুটো কি শক্ত আর খড়খড়ে!! মনে হচ্ছে ওর শরীরটা জ্বলছে। "ও আচ্ছা।" বলে নির্লীপ্ত ভাবে আগের মত দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। একটু পরেই স্টপেজ এল। বাকী লোকদুটোর সাথে ইন্দুও বাস থেকে নেমে পড়ল। এর আগে ও কখনও এমন করেনি। যদিও এমনটা নয় এই এলাকাটা ওর অচেনা। কিন্তু এর আগে ও কখনও এখানে নামেনি। এই আজ প্রথম নামল। ও নামার সাথে সাথেই বাসটা আবার আগের মত ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেল। ইন্দু পায়ে পায়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে এগিয়ে গেল কিছুটা। দিনের আলো তখন একেবারেই মুছে গেছে। কালো কালো অন্ধকারটা চারিদিকে নেমে আসছে একটু একটু করে। রাস্তার লাইটগুলো জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। ইন্দু কাঁধের ব্যাগটা সামলে আরো কিছুটা এগিয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে যেতেই একটা গলির মতো রাস্তা পড়ল। চওড়া নয় বরং কিছুটা সরুই। বেশী কিছু চিন্তা না করেই সেই সরু গলিটায় ঢুকে পড়ল ও। কিছুটা দূর যেতেই বুঝতে পারল ভিতরটা বেশ অন্ধকার। চলা থামিয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল। তারপর ফোনের টর্চটা জ্বেলে আরো কিছুটা এগিয়ে গেল ও। দুপাশের বাড়ি থেকে নানান রকমের শব্দ আসছে। টিভির শব্দ। কথাবার্তার আওয়াজ। কোনো কোনো বাড়ি থেকে আবার শাঁখের শব্দও ওর কানে এল। আরো কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর একটা কোণা মত জায়গা দেখে ও দাঁড়াল। তারপর কাঁধের ব্যাগটাকে নামিয় রাখল মাটিতে। কাঁধটা টনটন করছে। একমূহুর্ত দাড়িয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল ও। কেউ আসছে না তো? তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিণটার দিকে তাকালো। দুপুরের পর থেকে একবারও অ্যাপটা খোলেনি। প্রথমে তন্নিষ্ঠার কথা কানেই তোলেনি সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঝোঁকের মাথায় কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে না তো? মনটা অল্পসময়ের জন্য হলেও দূর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু তারপরেই মনস্থির করে ফেলল ও। বুক ভরে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর অ্যাপটায় একটা আলতো চাপ দিল। নীলচে রঙের বৃত্তটা ঘুরতে শুরু করেছে কিন্তু ধীরে ধীরে। কেটে কেটে যাচ্ছে। হাতের ফোনের স্ক্রীণটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল নেট কানেকশনটা কেটে গেছে। গলির এতটা ভিতরে আসার কারণেই হয়তো। মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে নির্জন কোণটা থেকে বেরিয়ে এল ও। তারপর কিছুটা পিছিয়ে এল গলির সরু পথটা ধরে। ও যেদিক থেকে এসেছিল সেইদিকে অল্প কিছুটা ফিরে আসতেই নেট কানেকশনটা আবার ফিরে এল ওর ফোনে। ও দেখল নীলচে বৃত্তটা আবার পূর্ণগতিতে ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। গলির ভিতরে হওয়ার কারণে এখানটা বেশ গরম। ওর গোটা শরীরটা ঘেমে উঠেছে ইতিমধ্যে। বড় বড় ঘামের ফোঁটা ঘাড় আর গলা বেয়ে ক্রমশ নীচের দিকে নামতে শুরু করে দিয়েছে। বিরক্তি লাগছে। শাড়ির আঁচলটা দিয়ে একবার গলা আর বুকটা মুছে নিল ও। তারপর আবার তাকাল ফোনটার স্ক্রিণের দিকে। নীলচে বৃত্তের ঘূর্ণণটা থেমে গিয়ে অ্যাপটা খুলে গেছে। যথাস্থানে ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ডটা দিয়ে লগ ইন বোতামটায় আরো একটা চাপ দিল ও। প্রায় পূর্ণগতিতে নীলচে বৃত্তটা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। অল্প ঘোরার পরেই বৃ্ত্তটা থেমে গিয়ে অ্যাপটা খুলে গেল। আবারও গরম লাগতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আর সেইদিকে খেয়াল নেই। ঘাড়টা একপ্রকার ফোনের স্ক্রিণটার দিকে ঝুঁকিয়ে বাহ্যজ্ঞানশূণ্য হয়ে দ্রুতগতিতে আঙ্গুল চালাতে শুরু করল ইন্দুমতি।
 
ভাই দয়াকরে গল্পটির পরের পর্ব গুলি দেন। না পড়তে পেরে কষ্ট হচ্ছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top