১০
“ কি করছো?”
আনিকা ঘুম থেকে উঠে নিজের মোবাইল অন করতেই দেখলো ম্যাসেজ টি , অরুপ পাঠিয়েছে । আজকাল অরুপ এর সাথে বেশ জমে উঠেছে ওর । সবাই অরুপ কে নিয়ে যেমন বলে ছেলেটি অমন না একদম । সবাই বলতো বড়োলোক বাবার দুষ্ট ছেলে , একটু বখাটে কিন্তু আনিকা কথা বলে দেখছে , ওর কাছে অরুপ কে ঠিক ঠাক মনে হয়েছ । বেশ গুছিয়ে কথা বলে ছেলেটা , এছাড়া এতদিন যাবত কথা বলছে অথচ একটাও সীমা লঙ্ঘন করার মতো কথা অপ্রু বলেনি । আজাকাল আনিকার ই মাঝে মাঝে মনে হয় একটু সীমা লঙ্ঘন করলে কি বা হয় । ছেলেটা একটু বেশিই ভালো বলে আনিকার মনে হয় ।
ছেলেদের সাথে কথা বলা অথবা মেলামেশা করার যে ভয় বা সংকোচ আনিকার মাঝে ছিলো সেটা অনেকটাই দূর হয়েছে । অবশ্য এর ক্রেডিট দিতে হয় অরুপ কে । অনেক বছর বিপরীত লিঙ্গের উপেক্ষার পাত্রি হয়ে থাকার পর হঠাত করেই যখন কলেজ এর ছেলেদের দিক থেকে ইশারা আসতে শুরু হলো তখন এক প্রকার সংকোচ আর ভয় ঘিরে ধরেছিলো আনিকাকে । আর ওই সংকোচ থেকেই নিজেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রেখেছে আনিকা , কিন্তু গত প্রায় এক মাস যাবত নিজের সবচেয়ে কাছের বান্ধবি ইভার সাথে দূরত্ব তৈরি হলো , অনেকটা জেদের বসেই অরুপ এর সাথে কথা বলা শুরু করে আনিকা ।
একে তো লক ডাউন তার উপর , জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে দুজন মানুষ আনিকার সবচেয়ে কাছের ছিলো , তারা দুজন ও একে অপর কে নিয়ে বিজি হয়ে যাওয়ায় প্রায় একেকি হয়ে পরেছিলো আনিকা । এমন নয় যে অনিক আর ইভা ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছে । আসলে তেমন কিছু নয় । আনিকার ই মনে হয়ছে ওদের দুজনের মাঝে ওর থাকাটা কেমন জানি দেখায় । নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতো আনিকার । এছাড়া যখন ইভা না থাকতো তখন অনিক আর আগের মতো গল্প করে না আনিকার সাথে । এখানে অবশ্য আনিকার নিজের ও কিছুটা দোষ আছে , ও নিজে থেকেও ভাইয়ের সাথে আগের মতো কথা বলে না , বা হুট হাট অনিক এর ঘরে গিয়ে হানা দেয় না । প্রথমে অভিমানে এমনটা করেছিলো , ভেবেছিলো হয়ত অনিক ই ওকে ডেকে কথা বলবে , কিন্তু তেমন কোন লক্ষন দেখা না যাওয়ায় অভিমান আরও গভির হয়েছে । সেই অভিমান এক পর্যায়ে গিয়ে ইগো প্রবলেম এ রুপান্তরি হয়েছে । “আমি কেন আগে যাবো , ও কেন আসে না” এই ধরেনের একটা জেদ চেপে বসে আনিকার মাঝে । আর বান্ধবি ইভার উপর রাগ হলো , ওর ভাই তো আগেও প্রেম করেছে , কিন্তু কোনদিন তো এমন হয়নি , কোন দিন তো ওকে উপেক্ষা করেনি , তাহলে ইভার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর এমন হলো কেনো? ইভার মাঝে কি এমন বিশেষ কিছু পেলো যে ভাই ওর সাথে একটু কথা বলার সময় বের করতে পারছে না ? এসব অভিমানি প্রশ্ন গুলি দিন দিন আনিকাকে নিজের ভাই থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে । আর অরুপ এর কাছা কাছি নিয়ে এসেছে ।
“ ঘুম থেকে উঠলাম” আনিকা লিখে পাঠাল । আর যা ভেবেছিলো তাই হলো , ত্রিশ সেকেন্ড সময় ও লাগলো না অপ্রু এর রিপ্লে আসতে
“ এতো দেরি”
মুচকি হাসল আনিকা , তারপর লিখে পাঠাল “ তুমি বুঝি খুব তাড়াতাড়ি ওঠো”
“ হ্যাঁ আমি রোজ সকালে উঠি , সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা ভালো” অরুপ লিখে পাঠাল ,
“ আমিও সকালেই উঠি মাস্টার মশায় , কাল রাতে একটু দেরিতে ঘুমিয়েছি” মেসেজটা লিখে পাঠানোর পর ই আনিকার মনে পরলো নিজের বাবার কথা । গতকাল রাত থেকেই করিম মিয়াঁর জ্বর আর কাশি । দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বাবার ঘরের দিকে গেলো ।
“ আব্বা উঠসেন “ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞাস করলো আনিকা ,
“ হ্যাঁ আম্মা আমি উঠসি , কিন্তু আপনি ঘরের ভেতর আইসেন না , বলা তো যায় না” করিম মিয়াঁ দুর্বল কণ্ঠে বলল । কিন্তু আনিকা ততোক্ষণে ঘরের ভেতর চলে এসেছে । বিছানার সামনে দাড়িয়ে পিতার কলাপের উপর হাট রেখে বলল “ কিচ্ছু হবে না আব্বা , ঐসব কিচ্ছু হয়নি আপনার , আমি নাস্তা নিয়া আসি আপনার জন্য “
এই বলে আনিকা বেড়িয়ে গেলো ঘর থকে , তারপর ভালো করে সাবান দিয়ে হাট ধুয়ে নিলো । যদিও করিম মিয়াঁর সামনে বলে এসেছে কিছু হয়নি । তারপর ও সাবধান থাকা ভালো । হাট ধুয়ে আনিকা রান্না ঘরে ঢুকল , আজ রান্না ওকেই করতে হবে , গতকাল জ্বর এর কথা শোনার পর আনু খালা বলে গেছে সে আর আজকে আসবে না । তার নাকি কোথায় যেতে হবে , আনিকা জানে যে আনু যার পুরো নাম আনোয়ারা তার কোন কাজ নেই , ভয় পেয়েছে । কিন্তু আনিকা তাতে কিছু বলেনি , এই রোগে সবাই ভয় পায় ।
“ কোথায় গেলা” অরুপ লিখে পাঠাল , আসলে বাবার কথা মনে হতেই আনিকা দৌরে চলে এসেছিলো আনিকা , তাই অরুপ কে কিছুই বলা বলা হয়নি ।
“ নাস্তা বানাচ্ছি , তুমি নাস্তা করেছো” আনিকা আটা মাখা হাতেই লিখলো কষ্ট করে
“ তুমি রান্না করতে জানো নাকি? , বাহ ভালো তো “ একটা থামস আপ ইমোজির সাথে অরুপ লিখলো
“ এখানে বাহ এর কি হলো , সবার রান্না করতে জানা উচিৎ , তহলে বিপদে আপদে অন্য কারো উপর ভরসা করে থাকতে হবে না”
“ না তবে আজকাল এর মেয়েরা বেশির ভাগ তোমার বয়সে রান্না করে না তাই বললাম “
“ এখানে মেয়ে কথাটা এলো কেনো ? তুমি কি রান্না করতে পারো ?” আনিকার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মেসেজটি পাঠানোর সময় । আনিকার এই ধরনের কথা বেশ বিরক্ত লাগে ।
“ এই আনিকা কি করছিস রে? দে আমি রুটি বানিয়ে দেই “
আনিকা যখন অরুপ এর রিপ্লের জন্য অপেক্ষা করছিলো ঠিক তখনি অনিক এসে ঢুকল রান্না ঘরে । তাই আনিকা দ্রুত মোবাইল টা কোমরে গুজে ফেলল । তারপর ভাই এর দিকে তাকিয়ে বলল “ তোর রুটি বানাতে হবে না , আব্বার খবর নিয়েছিস?”
“ এই তো দেখা করে এলাম , আমার মনে হয় আব্বা কে ডাক্তার দেখানো দরকার” অনিক এসে আনিকার পাশে দাঁড়ালো । একবার আড় চোখে আনিকার দিকে তাকিয়েই চোখে সরিয়ে নিলো । এই একটা যুদ্ধে বার বার পরাজিত হচ্ছে অনিক । ইভার সাথে একটা রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পর মনে করেছিলো এই সমস্যা আড় হবে না । কিন্তু তেমন কোন ফল হয়নি , যে মেয়ে কে ও ছোট বেলা থেকেই জানে , কত বার উলঙ্গ দেখছে তার কোন খেয়াল নেই । অথচ সেই মেয়ের দিকে আজকাল ঠিক করে তাকাতেই পারছে না , শরীর এর স্পর্শ কাতর অংশ গুলোতে সুধু চোখ চলে যায় । আড় চোখ সুধু গেলে সমস্যা ছিলো না , দৃষ্টিটা ভাইয়ের মতো থাকে না , নিজেকে তাই দূরে দুরেই রাখে অনিক ।
এই তো কদিন আগের কথা , রাতে একা ভয় পেত বলে অনিক কে সাথে যেতে হতো বাথরুমে , অনিক এর সামনেই প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে পস্রাব করতো ও , কই তখন তো কোন খারাপ চিন্তা আসতো না । এখন হঠাত করে কি হলো অনিক ভেবে পায় না ।
“ কোন ডাক্তার কি আসবে” আনিকা একটা রুটি বানিয়ে ভাইয়ের হাতে দিতে দিতে বলল ।
অনিক আনিকার হাট থেকে কাঁচা রুটি টা নিতে নিতে বলল “ না আসলে ঔষধ তো নিয়ে আসতে পারি”
আনিকা ঝুকে রুটি বেলছিলো , অনিক এর দৃষ্টি আপনা থেকেই চলে যায় ওদিকে । ঝুকে রুটি বেলার কারনে আনিকার কামিজ এর গলা বেশ নিচে নেমে আছে , সেখান দিয়ে আনিকার সুগঠিত স্তন এর অনেকটাই দেখা যাচ্ছে । দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় অনিক । মনে মনে নিজে গালাগাল করতে থাকে । যদি একবার আনিকার চোখে ধরা পড়ে তাহলে কি হবে সেটা অনিক ভাবতেও চায় না । হয়ত কোনদিন আর কথা বলবে না আনিকা ওর সাথে ।
“ ভাইয়া রুটি পুড়ে যাচ্ছে তো!!!” আর্ত চিৎকার করে ওঠে আনিকা , তারপর বলে “ নে ভাইয়া তুই রুটি তৈরি কর আমি সেঁকে নিচ্ছি ।
অনিক বিনা বাক্যে তাই মেনে নিলো ।
আনিকা রুটি সেঁকতে সেঁকতে আড় চোখে একবার অনিক এর দিকে তাকিয়ে দেখলো । আসলে অনিক মানুষটা অন্য রকম , এই কেমন এসে রান্নায় সাহায্য করছে । ৯০ ভাগ ছেলেই এমন হয় না । আর অনিক নিজে তো এমনি, সাথে আনিকাকেও এমন শিক্ষাই দিয়েছে । একটু আগে অরুপ এর কথায় রেগে যাওয়ার কারন অনিক এর কাছ থেকে পাওয়ার শিক্ষা । একটা দীর্ঘশ্বাস ছারলো আনিকা , তারপর মনে মনে ভাবল , সব ছেলে তো আর ওর ভাইয়ের মতো হবে না , আসলে অনিক এর কাছ থেকে পাওয়া বেশিরভাগ সিক্ষাই এই সমাজে অচল । সবাই চাইবে মেয়ে মানেই ভালো রান্না করতে জানতে হবে , ভালো ঘর পরিচালনা করতে জানতে হবে । আনিকা ঠিক করলো অরুপ কে সরি বলতে হবে অমন আচরন এর জন্য ।
<><><>
“এই মেয়ে জাচ্ছিস কই ?” ঘর থেকে বেরুবার সময় পেছন থেকে নিজের মায়ের ডাকে থেমে গেলো ইভা । উঠানের কল পারে বসে কয়েকটা জামা কাপড় ধুচ্ছিলো ইভার মা আনোয়ারা বেগম । সেখান থেকেই ডাক দিলো । আজকাল মেয়ের রকম সকম তার ভালো ঠেকছে না । একটা অতিপরিচিত পরিবর্তন তিনি নিজের মেয়ের মাঝে দেখতে পাচ্ছেন । নিজে একজন অভিজ্ঞ নারী তাই মেয়ের এই পরিবর্তন তার চোখ এড়ায়নি । তাই ঠিক করেছেন মেয়ের অবাধ স্বাধীনতায় কিছুটা হস্তক্ষেপ করা দরকার ।
“ আনিকাদের বাড়ি যাচ্ছি না , এই সময় আর কোথায় যাবো”
“ না না এখন ওই বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই , জানিস না করিম ভাইয়ের জ্বর এসেছে , বলা তো যায়না কি না কি হয়েছে” মেয়ের গন্তব্বের কথা শুনে হায় হায় করে উঠলেন আনোয়ারা বেগম । যদিও আজকাল আর এক সরকারের দেয়া লকডাউন মানছে না , তবুও কারো জ্বর সর্দি হয়েছে শুনলে মানুষ সেদিকে আর পা বাড়ায় না । আনোয়ারা বেগম জেনে শুনে কিছুতেই নিজের মেয়েকে এমন বিপদে ঠেলে দিতে চান না ।
“ এটা তুমি কি বললা মা , বান্ধবীর বাবা অসুস্থ , আমি যাবো না!!!!”
“ আহারে আমার দরদি রে” মুখ ভেংচে বললেন আনোয়ারা বেগম , .” নিজের মায়ের জন্য তো এতো দরদ নাই , একদিন কি বলেছিস দেও মা তোমার কাজ করে দেই , খাটতে খাটতে আমি নিজের হাড় মাংস এক করে ফেললাম, আর উনি এসেছেন সমাজ সেবা করতে”
“ মা...” হাত পা নাচিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আবদারের স্বরে বলল ইভা । কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না । ইভার মা কড়া ভাবে জানিয়ে দিলো এখন জেনো ইভা বাড়ি থেকে না বেরোয় । তার বদলে রান্না ঘরে গিয়ে কিছু সবজি কেটে কুটে দিতে বলল ।
“ আমি এখন কোন কাজ করতে পারবো না ,” সাফ জানিয়ে দিলো ইভা , কারন বেশ সেজে গুজে বেরিয়েছিলো ও , এখন রান্না ঘরে গেলে সব নষ্ট হয়ে যাবে ।
“ ধিঙ্গী মেয়ে , একটা কাজ জানিস না , বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলবে কি? সব দোষ হবে আমার বলবে মা কিছুই শিখিয়ে দেয়নি”
“ অমন বাড়িতে আমি বিয়েই করবো না” পেছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো ইভা , এটা হচ্ছে ইভার বিশেষ টেকনিক , ও জানে এটা করলে মা পানির মতো গলে যায় ।
হলো ও তাই , নরম হয়ে এলেন আনোয়ারা বেগম মেয়ের আহ্লাদে গলে গেলেন । বললেন “ হয়েছে হয়েছে , অমন খুজতে গেলে আর বিয়ে হবে না , আমাকে দেখসছিস , বিয়ের পর থেকে শ্বশুর শাশুড়ি , ননদ ননদীর জন্য খেটেছি , এখন তোদের জন্য খেঁটে মড়ছি”
“ আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করছি না , আগে লেখাপড়া শেষ করবো তারপর বিয়ে ততো দিনে অমন একটা ভেজাল মুক্ত পরিবার খুঁজে নিয়ো “ মায়ের গলা জড়িয়ে গালের সাথে গাল মিলিয়ে আদুরে স্বরে বলল ইভা , অবশ্য অমন পরিবারের খোঁজ ওর নিজের ই জানা আছে মনে মনে ।
“ অমন পাওয়া যায় না রে মা , কিছু কিছু কাজ সব খানেই করতে হবে , স্বামীর সেবা , শ্বশুর শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলা “ আনোয়ারা বেগম একটা হাত নিজের শাড়িতে মুছে নিয়ে মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন । মেয়েটা তার বড় আদরের , প্রথম মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়েছিলো বলে খানিকটা মন খারাপ হয়েছিলো , তবে সে কথা কাউকে বলেনি , তাই দ্বিতীয় বার যখন মেয়ে হলো এতো খুসি হয়েছিলেন যে বলার মতো নয় ।
“ তুমি খালি আমাকেই এসব বলো মা , কই নিজের ছেলেকে তো কোনদিন কোন কাজ করাও না “ ঠোট ফুলিয়ে বলল ইভা ,
“ পাগলী মেয়ে তোর ভাই কে তো আর অন্য বাড়ি গিয়ে ঘর করতে হবে না , করতে হবে তোকে” হেঁসে বললেন আনোয়ারা বেগম ,
“ সে দেখা যাবে , আমি যতদিন আছি রানীর হালে থাকবো , তুমি তোমার ছেলে কে দিয়ে এইসব কাজ করাও , এখন আমি গেলাম” এই বলে আর দেরি করলো না ইভা , দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো । কারন বেশি অপেক্ষা করলে আবার বাধা আসবে , গত তিন চারদিন দেখা হয়নি অনিক এর সাথে , আজ দেখা না হলে মড়েই যাবে ও ।
“ এই এই মেয়ে , এই শোন আমার কথা “ আনোয়ারা বেগম পেছন থেকে ডেকেও থামাতে পারলো না ইভাকে , কিন্তু রাগ করতে পারলেন না উনি , রাগের বদলে একটা কেমন জানি একটা উদাসীনতা এসে ভর করলো ওনার মনে , আনোয়ারা বেগম সব সময় শুনে এসেছেন যে মেয়েরা বাপ সোহাগী হয় , আর বাবারাও মেয়েদের বেশি আদর করে । তবে উনার ক্ষেত্রে একটু অন্য রকম , উনি কেন জানি ছেলের চেয়ে মেয়েকে বেশি আদর করেন , এটা যে উনি ইচ্ছে করে করেন তেমন নয় , চেষ্টা করেও উনি পক্ষপাতহীন হতে পারেন না । তাই যখনি মনে হয় এই মেয়েকে একদিন পরের বাড়ি দিয়ে দিতে হবে তখন ভেতরটা কেমন জানি হাহাকার করে ওঠে ।
এসব ভাবতে ভাবতেই আনোয়ারা বেগম এর মনে একটা ভাবনা উদয় হলো , মেয়ের মাঝে ইদানীং যে উরু উরু ভাব দেখছেন , এটা কার জন্য ? আনোয়ারা বেগম মুচকি হাসলেন , ওনার মনে হচ্ছে উনি ধরতে পেরেছেন , এই রোজ রোজ আনিকাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য যে মেয়ে পাগল হয়ে যায় , এটা হয়ত আনিকার ভাই অনিক এর জন্য । ছেলেটাকে আনোয়ারার ভালোই লাগে , তার উপর বাড়ির পাশে বাড়ি , এছাড়া তেমন ঝাক্কি ঝামেলেও নেই । ছোট পরিবার , একটা সুধু বোন , আর বাবা, দুজনেই ভালো মানুষ । নিজে কে কষ্ট ভোগ করেছেন আনোয়ারা বেগম সেটা যেন মেয়ে না ভোগে মনে প্রানে তাই চান উনি । ঠোঁটের মুচকি হাঁসি চওড়া হলো আনোয়ারা বেগম এর । উনি ঠিক করলেন স্বামীর সাথে এই নিয়ে কথা বলবেন । তবে মেয়ের সাথে আগে কথা বলে নিতে হবে । উনি অনিক কে পছন্দ করে বলে এই নয় যে অবাধ মেলামেশা করতে দেয়া হবে । আজকাল এর ছেলে মেয়েরা খুব ফাজিল , কত কত অঘটন ঘটছে আজকাল চারপাশে । এসব জেনো না হয় এর জন্য মেয়ে কে সাবধান করে দিতে হবে । যা হওয়ার পারিবারিক ভাবেই হোক ।
<><><><>
বাড়িতে ডাক্তার এলো না , রোগীর প্রচুর ভিড় , তাই অনিক বুদ্ধি করে বাবাকেই নিয়ে গেলো ডাক্তার এর চেম্বারে । ডাক্তার করিম মিয়াঁর পূর্ব পরিচিত আতাই এক ফাঁকে দেখে দেবে বলছে । আসলে আজকাল জ্বর সর্দি শুনলে সবাই ভয় পেয়ে যায় । তাই বেসিক্ষন চেম্বারে বসানো হবে না করিম মিয়াকে । ভাই আর বাপ কে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে ফেসবুক নিয়ে বসেছে আনিকা । অরুপ এর তরফ থেকে অনেকগুলো মেসেজ এসেছে । সব গুলিতেই সকালের ঘটনার জন্য সরি বলা আছে । ইনিয়ে বিনিয়ে সরি বলেছে অরুপ । অনেকটা সময় নিয়ে মেসেজ গুলি পড়লো , তারপর লিখলো
“ এতো সরি বলার কি আছে , আমি ই একটু বেশি রিএক্ট করে ফেলেছি” সেন্ড বাটন চাপার পর খুব বেশি ওয়েট করতে হলো না , সাথে সাথে আনিকা দেখতে পেলো অরুপ টাইপ করছে ।
“ না না আমি ই ভুল করেছি , আসলে আমারা ধরেই নেই মেয়ে মানে রান্না জানবে , এটা এই যুগে অচল , সবার ই রান্না জানা উচিৎ”
“ সত্যি বলছো ? আসলে আমার ভাইয়া এমন কথা বলে সব সময় , ও নিজেও আমাকে ঘরের কাজে সাহায্য করে , অবশ্য মাঝে মাঝে করে না , উল্টো জ্বালায় , যখন ওর চা খাওয়ার ইচ্ছা হয় তখন খালি আমাকে চায়ের জন্য জ্বালায়”
“তুমি কি অনিক ভাইয়ের সাথে খুব ফ্রি?” অরুপ লিখে পাঠাল ,
“ হ্যাঁ , কেনো বলতো?”
“ না আগে তোমাকে অনেকবার অনিক ভাইয়ের সাথে বাইরে দেখছি , সত্যি বলতে কি আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে উনি তোমার বড় ভাই,”
“ কেনো?” অবাক হলো আনিকা ।
“ রাগ করো না আবার , আমি মনে করতাম অনিক ভাই তোমার বয় ফ্রেন্ড”
অরুপ এর মেসেজ দেখে অনেক্ষন হাসল একা একা , তারপর লিখলো , “ ধুর কি বলো , আমাদের দেখে প্রেমিক প্রেমিকা মনে হবে কেনো? আমারা কি প্রেমিক প্রেমিকার মতো হাত ধরে হাঁটতাম নাকি ?”
“ নাহ তবে সত্যি বলছি দেখে অমন ই মনে হতো “
“ কি জানি , আমার কোনদিন কোন বয়ফ্রেন্ড ছিলো না , তাই আমি বুঝিও না”
“ তুমি তো নিজেকে সব সময় দূরে দূরে রাখতে , কাউকে পাত্তা দিতে না , তাই যখন তোমাকে অনিক ভাইয়ার সাথে একদিন ফুচকা খেতে দেখলাম তখন মনে হলো ,তোমার বয় ফ্রেন্ড আছে , তাই তুমি কাউকে পাত্তা দাও না “
“ আরে না , বরং উল্টো , ছেলেরাই আমাকে পাত্তা দিতো না “ এই লিখে আনিকা দুটো হাসির ইমোজি দিয়ে পাঠিয়ে দিলো ।
“ কে বলেছে তোমায় , তোমার জন্য অনেক ছেলে পাগল ছিলো”
“ তাই নাকি ? কোনদিন তো দেখিনি”
“ সবাই ভয় পেতো , একে তুমি ভীষণ সুন্দরী তার উপর সবাই মনে করতো খুব দেমাগ”
অরুপ এর কথা গুলি ভীষণ ভালো লাগছে আনিকার , লাস্ট এক বছরে বেশ কিছু ছেলে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওরা ওকে পছন্দ করে কিন্তু আনিকা তখন ওদের কে তেমন আস্কারা দেয় নাই । এখন মনে একটা প্রশ্ন জাগছে ওর , অরুপ ও কি এদের মাঝে ছিলো ? কই কোনদিন তো অরুপর মাঝে তেমন কিছু দেখেনি ও । “আচ্ছা কবেকার কথা বলছো তুমি অরুপ , কবে আমাদের ফুচকা খেতে দেখছো?”
“সেটা স্কুলে থাকতে , আর ভুলটা ভেঙ্গেছে গত বছর, এক দিন কলেজের এক ছেলে বলল ওটা তোমার ভাই, আমি বিশ্বাস করতে চাই নি , তবে ও যখন সব কিছু বলল তখন খুব আফসোস হয়েছিলো”
অরুপ এর আফসোস লেখাটা দেখে আনিকার বুকটা ধক করে উঠলো , আফসোস কেনো হয়েছিলো ওর ? তাহলে কি স্কুল থেকেই অরুপ ওকে পছন্দ করতো? আনিকা এতদিনে ভালোভাবেই জেনে গেছে অরুপ ওকে পছন্দ করে । কিন্তু আনিকা মনে করতো বাকি সব ছেলেদের মতো অরুপ ও ওর শরীরে পরিবর্তন আসার পর থেকেই ওকে নোটিস করেছে । তাই এতদিন অরুপ এর সাথে কথা বলে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করলেও আলাদা তেমন ফিলিং ছিলো না । তবে এখন যখন বুঝতে পারলো অরুপ বাকিদের মতো নয় । তখন ছেলেটার প্রতি একটা অন্য রকম ভালো লাগা এসে ভর করলো ওর আনিকার উপর ।
“ আফসোস কেনো হয়েছিলো?” লেখার সময় আনিকার হাতদুটো একটু কেঁপে গেলো , বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে । আনিকা নিজের করা এই প্রশ্নের উত্তর জানে , কিন্তু ও দেখতে চাইছে অরুপ কিভাবে এর উত্তর দেয় । তবে বেশ কিছুক্ষন অরুপ কিছুই লিখলো না , অরুপ কোনদিন এতো স্ময় নেয়েনি কোন মেসেজ এর রিপ্লে দিতে ।
অপেক্ষা করতে লাগলো আনিকা , আর এই অপেক্ষার সময়টুকুর প্রতিটি মুহূর্ত ওর কাছে একটি ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছিলো । নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছিলো । দম বন্ধ হওয়া সেই মুহূর্ত গুলি যেন শেষ হচ্ছিলো না ।
<><><><>
“ আনিকা আমার ননদী, কি করছিস” বলতে বলতে ইভা প্রবেশ করলো আনিকার ঘরে , আনিকা তখন এক দৃষ্টিতে মোবাইল স্ক্রিনে অরুপ এর উত্তর এর আশায় তাকিয়ে । ইভার আওয়াজ শুনে দ্রুত মোবাইল অফ করে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল আনিকা। ওকে দেখে সাথে সাথে মোবাইল অফ করে দেয়া, দ্রুত বুক ওঠা নামা করা এবং ফর্সা গালে গোলাপি আভা দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলল ইভা ।
হাসতে হাসতে বলল “ আনিকা তুই দরজা খোলা রেখে এসব দেখছিস” বান্ধবীর এমন সাহসিকতা দেখে ইভা যেমন অবাক হচ্ছে তেমনি বেশ মজাও পাচ্ছে ।
“ কেনো ওসব ছাড়া কি মোবাইলে করার মতো আর কিছু নেই” বিরক্ত ওয়ে ভ্রূ কুচকে বলল আনিকা , এমন মহেন্দ্র ক্ষণে এসে ইভার আগমন একদম ভালো লাগছে না আনিকার । কারন একটু আগে ঘটতে চলা ব্যাপারটা ও নিজের বান্ধবিকে জানাতে চাচ্ছে না , মন থেকে সায় আসছে না । নিজের এমন আচরণে আনিকা নিজেও একটু অবাক হচ্ছে , আগে এসব খবর প্রানের বান্ধবিকে কতক্ষনে বলবে তার জন্য অপেক্ষা করতো । কিন্তু এখন ভেতর থেকে তেমন তাগিদ বোধ করছে না ।
“ দেখি দেখি কি অমন কাজ করছিলি , দে তো মোবাইল টা” ভ্রূ নাচিয়ে আনিকার কাছ থেকে মোবাইল চাইলো ইভা ,
“ সব কিছু কি তোর দেখতে হবে নাকি , আর এই ঘরে কি চাই তোর , যার কাছে এসেছিস তার কাছে না” চোখ মুখ কঠিন করে বলল আনিকা। আসলে ইভাকে রাগিয়ে দেয়ার জন্যই এমনটা করছে ও , কারন একমাত্র রাগিয়ে দিলেই ইভা হাল ছাড়বে , নইলে মোবাইল নিয়েই ছাড়বে ।
“ আমি তোর কাছেই এসেছি , দে এবার মোবাইল দে” ইভা নাছোড় বান্দার মতো বলল , তারপর আনিকার আশা বাদ দিয়ে নিজেই আনিকার বালিশের নিচে রাখা মোবাইল নেয়ার জন্য এগিয়ে গেলো । হালকা ধ্বস্তাধস্তি শুরু হলো , একপর্যায়ে আনিকা রেগে গিয়ে বলল ।
“ ইভা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে , সবার নিজের একটা প্রাইভেসি আছে , তুই সেটা লঙ্ঘন করছিস”
“ ওলে ওলে আমার প্রাইভেসি ওয়ালারে , তোর কি এমন গোপন জিনিস আছে , যে আমায় বলা যাবে না?” হাপাতে হাপাতে বলল ইভা , আনিকার সাথে ধ্বস্তাধস্তিতে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে ও , এছাড়া কিছু চুক এলমেলো হয়ে সামনের দিকে চলে এসেছে । আনিকার অবস্থাও তাই, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে , চুল এলমেলো ।
“ অনেক কিছুই আছে , আমি কি তোর সব গোপন কথা জানতে চাই ? এই যে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস আমি কি তোর ওখানে বাধা দিচ্ছি”
“ কি বলতে শুনতে চাস বল আমি বলছি , কিন্তু আমাকে তোর মোবাইল দে” ইভা এক গুয়ের মতো করে বলল ।
“ দেখ ইভা তুই কিন্তু বেশি বেশি করছিস , আমাকে আমার কাজ করতে দে , তুই তোর কাজে যা , ও... তুই যার জন্য এসেছিস সে এখন বাসায় নেই , সবচেয়ে ভালো হয় তুই চলে যা এখন পরে আসিস” বেশ বাজে ভাবেই বলল আনিকা , ইভার একগুঁয়ে আচরন ওকে বেশ রাগিয়ে দিয়েছে ।
“ আনিকা !!!” এতটা খারাপ আচরন করবে আনিকা ইভা কোনদিন কল্পনা ও করেনি ইভা , “ তুই এমন করছিস কেনো? আমি তোর এমন কি করেছি” ইভাও বেশ চড়া কণ্ঠে বলল ।
“ কিছুই করিস নি , আমি সুধু চাচ্ছি তুই তোর মতো থাক আমাকে আমার মতো থাকতে দে”
“ তাই ?” ভ্রূ উচিয়ে জিজ্ঞাস করলো ইভা “ এখন তোর আর আমার পর্যায়ে চলে এসেছে, আগে তো এমন ছিলো না”
“ আগে ছিলো না , এখন হয়েছে , এখন তো আরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে?” আনিকাও ছেড়ে বলার পাত্রি নয় ।
“ কি পরিবর্তন হয়েছে?” ইভা চ্যালেঞ্জ এর সুরে বলল
“ তুই নিজেই দেখে নে, আমি বলার কে ?”
কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলো ইভা , তারপর হঠাত করে বলল , “ ওকে ফাইন , আমি চলে যাচ্ছি , তবে একটা দুঃখ রয়ে গেলো , সেটা হচ্ছে তোকে আমি এতদিনের চিনতে পারিনি”
এই বলে ইভা আর থাকলো না , উঠে চলে গেলো । আনিকা সেই দিকে তাকিয়ে রইলো , ওর কাছে মনে হলো ইভা যাওয়ার সময় একবার চোখ মুছে নিলো ।
“ কি করছো?”
আনিকা ঘুম থেকে উঠে নিজের মোবাইল অন করতেই দেখলো ম্যাসেজ টি , অরুপ পাঠিয়েছে । আজকাল অরুপ এর সাথে বেশ জমে উঠেছে ওর । সবাই অরুপ কে নিয়ে যেমন বলে ছেলেটি অমন না একদম । সবাই বলতো বড়োলোক বাবার দুষ্ট ছেলে , একটু বখাটে কিন্তু আনিকা কথা বলে দেখছে , ওর কাছে অরুপ কে ঠিক ঠাক মনে হয়েছ । বেশ গুছিয়ে কথা বলে ছেলেটা , এছাড়া এতদিন যাবত কথা বলছে অথচ একটাও সীমা লঙ্ঘন করার মতো কথা অপ্রু বলেনি । আজাকাল আনিকার ই মাঝে মাঝে মনে হয় একটু সীমা লঙ্ঘন করলে কি বা হয় । ছেলেটা একটু বেশিই ভালো বলে আনিকার মনে হয় ।
ছেলেদের সাথে কথা বলা অথবা মেলামেশা করার যে ভয় বা সংকোচ আনিকার মাঝে ছিলো সেটা অনেকটাই দূর হয়েছে । অবশ্য এর ক্রেডিট দিতে হয় অরুপ কে । অনেক বছর বিপরীত লিঙ্গের উপেক্ষার পাত্রি হয়ে থাকার পর হঠাত করেই যখন কলেজ এর ছেলেদের দিক থেকে ইশারা আসতে শুরু হলো তখন এক প্রকার সংকোচ আর ভয় ঘিরে ধরেছিলো আনিকাকে । আর ওই সংকোচ থেকেই নিজেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রেখেছে আনিকা , কিন্তু গত প্রায় এক মাস যাবত নিজের সবচেয়ে কাছের বান্ধবি ইভার সাথে দূরত্ব তৈরি হলো , অনেকটা জেদের বসেই অরুপ এর সাথে কথা বলা শুরু করে আনিকা ।
একে তো লক ডাউন তার উপর , জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে দুজন মানুষ আনিকার সবচেয়ে কাছের ছিলো , তারা দুজন ও একে অপর কে নিয়ে বিজি হয়ে যাওয়ায় প্রায় একেকি হয়ে পরেছিলো আনিকা । এমন নয় যে অনিক আর ইভা ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছে । আসলে তেমন কিছু নয় । আনিকার ই মনে হয়ছে ওদের দুজনের মাঝে ওর থাকাটা কেমন জানি দেখায় । নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে হতো আনিকার । এছাড়া যখন ইভা না থাকতো তখন অনিক আর আগের মতো গল্প করে না আনিকার সাথে । এখানে অবশ্য আনিকার নিজের ও কিছুটা দোষ আছে , ও নিজে থেকেও ভাইয়ের সাথে আগের মতো কথা বলে না , বা হুট হাট অনিক এর ঘরে গিয়ে হানা দেয় না । প্রথমে অভিমানে এমনটা করেছিলো , ভেবেছিলো হয়ত অনিক ই ওকে ডেকে কথা বলবে , কিন্তু তেমন কোন লক্ষন দেখা না যাওয়ায় অভিমান আরও গভির হয়েছে । সেই অভিমান এক পর্যায়ে গিয়ে ইগো প্রবলেম এ রুপান্তরি হয়েছে । “আমি কেন আগে যাবো , ও কেন আসে না” এই ধরেনের একটা জেদ চেপে বসে আনিকার মাঝে । আর বান্ধবি ইভার উপর রাগ হলো , ওর ভাই তো আগেও প্রেম করেছে , কিন্তু কোনদিন তো এমন হয়নি , কোন দিন তো ওকে উপেক্ষা করেনি , তাহলে ইভার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর এমন হলো কেনো? ইভার মাঝে কি এমন বিশেষ কিছু পেলো যে ভাই ওর সাথে একটু কথা বলার সময় বের করতে পারছে না ? এসব অভিমানি প্রশ্ন গুলি দিন দিন আনিকাকে নিজের ভাই থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে । আর অরুপ এর কাছা কাছি নিয়ে এসেছে ।
“ ঘুম থেকে উঠলাম” আনিকা লিখে পাঠাল । আর যা ভেবেছিলো তাই হলো , ত্রিশ সেকেন্ড সময় ও লাগলো না অপ্রু এর রিপ্লে আসতে
“ এতো দেরি”
মুচকি হাসল আনিকা , তারপর লিখে পাঠাল “ তুমি বুঝি খুব তাড়াতাড়ি ওঠো”
“ হ্যাঁ আমি রোজ সকালে উঠি , সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা ভালো” অরুপ লিখে পাঠাল ,
“ আমিও সকালেই উঠি মাস্টার মশায় , কাল রাতে একটু দেরিতে ঘুমিয়েছি” মেসেজটা লিখে পাঠানোর পর ই আনিকার মনে পরলো নিজের বাবার কথা । গতকাল রাত থেকেই করিম মিয়াঁর জ্বর আর কাশি । দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বাবার ঘরের দিকে গেলো ।
“ আব্বা উঠসেন “ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞাস করলো আনিকা ,
“ হ্যাঁ আম্মা আমি উঠসি , কিন্তু আপনি ঘরের ভেতর আইসেন না , বলা তো যায় না” করিম মিয়াঁ দুর্বল কণ্ঠে বলল । কিন্তু আনিকা ততোক্ষণে ঘরের ভেতর চলে এসেছে । বিছানার সামনে দাড়িয়ে পিতার কলাপের উপর হাট রেখে বলল “ কিচ্ছু হবে না আব্বা , ঐসব কিচ্ছু হয়নি আপনার , আমি নাস্তা নিয়া আসি আপনার জন্য “
এই বলে আনিকা বেড়িয়ে গেলো ঘর থকে , তারপর ভালো করে সাবান দিয়ে হাট ধুয়ে নিলো । যদিও করিম মিয়াঁর সামনে বলে এসেছে কিছু হয়নি । তারপর ও সাবধান থাকা ভালো । হাট ধুয়ে আনিকা রান্না ঘরে ঢুকল , আজ রান্না ওকেই করতে হবে , গতকাল জ্বর এর কথা শোনার পর আনু খালা বলে গেছে সে আর আজকে আসবে না । তার নাকি কোথায় যেতে হবে , আনিকা জানে যে আনু যার পুরো নাম আনোয়ারা তার কোন কাজ নেই , ভয় পেয়েছে । কিন্তু আনিকা তাতে কিছু বলেনি , এই রোগে সবাই ভয় পায় ।
“ কোথায় গেলা” অরুপ লিখে পাঠাল , আসলে বাবার কথা মনে হতেই আনিকা দৌরে চলে এসেছিলো আনিকা , তাই অরুপ কে কিছুই বলা বলা হয়নি ।
“ নাস্তা বানাচ্ছি , তুমি নাস্তা করেছো” আনিকা আটা মাখা হাতেই লিখলো কষ্ট করে
“ তুমি রান্না করতে জানো নাকি? , বাহ ভালো তো “ একটা থামস আপ ইমোজির সাথে অরুপ লিখলো
“ এখানে বাহ এর কি হলো , সবার রান্না করতে জানা উচিৎ , তহলে বিপদে আপদে অন্য কারো উপর ভরসা করে থাকতে হবে না”
“ না তবে আজকাল এর মেয়েরা বেশির ভাগ তোমার বয়সে রান্না করে না তাই বললাম “
“ এখানে মেয়ে কথাটা এলো কেনো ? তুমি কি রান্না করতে পারো ?” আনিকার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মেসেজটি পাঠানোর সময় । আনিকার এই ধরনের কথা বেশ বিরক্ত লাগে ।
“ এই আনিকা কি করছিস রে? দে আমি রুটি বানিয়ে দেই “
আনিকা যখন অরুপ এর রিপ্লের জন্য অপেক্ষা করছিলো ঠিক তখনি অনিক এসে ঢুকল রান্না ঘরে । তাই আনিকা দ্রুত মোবাইল টা কোমরে গুজে ফেলল । তারপর ভাই এর দিকে তাকিয়ে বলল “ তোর রুটি বানাতে হবে না , আব্বার খবর নিয়েছিস?”
“ এই তো দেখা করে এলাম , আমার মনে হয় আব্বা কে ডাক্তার দেখানো দরকার” অনিক এসে আনিকার পাশে দাঁড়ালো । একবার আড় চোখে আনিকার দিকে তাকিয়েই চোখে সরিয়ে নিলো । এই একটা যুদ্ধে বার বার পরাজিত হচ্ছে অনিক । ইভার সাথে একটা রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পর মনে করেছিলো এই সমস্যা আড় হবে না । কিন্তু তেমন কোন ফল হয়নি , যে মেয়ে কে ও ছোট বেলা থেকেই জানে , কত বার উলঙ্গ দেখছে তার কোন খেয়াল নেই । অথচ সেই মেয়ের দিকে আজকাল ঠিক করে তাকাতেই পারছে না , শরীর এর স্পর্শ কাতর অংশ গুলোতে সুধু চোখ চলে যায় । আড় চোখ সুধু গেলে সমস্যা ছিলো না , দৃষ্টিটা ভাইয়ের মতো থাকে না , নিজেকে তাই দূরে দুরেই রাখে অনিক ।
এই তো কদিন আগের কথা , রাতে একা ভয় পেত বলে অনিক কে সাথে যেতে হতো বাথরুমে , অনিক এর সামনেই প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে পস্রাব করতো ও , কই তখন তো কোন খারাপ চিন্তা আসতো না । এখন হঠাত করে কি হলো অনিক ভেবে পায় না ।
“ কোন ডাক্তার কি আসবে” আনিকা একটা রুটি বানিয়ে ভাইয়ের হাতে দিতে দিতে বলল ।
অনিক আনিকার হাট থেকে কাঁচা রুটি টা নিতে নিতে বলল “ না আসলে ঔষধ তো নিয়ে আসতে পারি”
আনিকা ঝুকে রুটি বেলছিলো , অনিক এর দৃষ্টি আপনা থেকেই চলে যায় ওদিকে । ঝুকে রুটি বেলার কারনে আনিকার কামিজ এর গলা বেশ নিচে নেমে আছে , সেখান দিয়ে আনিকার সুগঠিত স্তন এর অনেকটাই দেখা যাচ্ছে । দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় অনিক । মনে মনে নিজে গালাগাল করতে থাকে । যদি একবার আনিকার চোখে ধরা পড়ে তাহলে কি হবে সেটা অনিক ভাবতেও চায় না । হয়ত কোনদিন আর কথা বলবে না আনিকা ওর সাথে ।
“ ভাইয়া রুটি পুড়ে যাচ্ছে তো!!!” আর্ত চিৎকার করে ওঠে আনিকা , তারপর বলে “ নে ভাইয়া তুই রুটি তৈরি কর আমি সেঁকে নিচ্ছি ।
অনিক বিনা বাক্যে তাই মেনে নিলো ।
আনিকা রুটি সেঁকতে সেঁকতে আড় চোখে একবার অনিক এর দিকে তাকিয়ে দেখলো । আসলে অনিক মানুষটা অন্য রকম , এই কেমন এসে রান্নায় সাহায্য করছে । ৯০ ভাগ ছেলেই এমন হয় না । আর অনিক নিজে তো এমনি, সাথে আনিকাকেও এমন শিক্ষাই দিয়েছে । একটু আগে অরুপ এর কথায় রেগে যাওয়ার কারন অনিক এর কাছ থেকে পাওয়ার শিক্ষা । একটা দীর্ঘশ্বাস ছারলো আনিকা , তারপর মনে মনে ভাবল , সব ছেলে তো আর ওর ভাইয়ের মতো হবে না , আসলে অনিক এর কাছ থেকে পাওয়া বেশিরভাগ সিক্ষাই এই সমাজে অচল । সবাই চাইবে মেয়ে মানেই ভালো রান্না করতে জানতে হবে , ভালো ঘর পরিচালনা করতে জানতে হবে । আনিকা ঠিক করলো অরুপ কে সরি বলতে হবে অমন আচরন এর জন্য ।
<><><>
“এই মেয়ে জাচ্ছিস কই ?” ঘর থেকে বেরুবার সময় পেছন থেকে নিজের মায়ের ডাকে থেমে গেলো ইভা । উঠানের কল পারে বসে কয়েকটা জামা কাপড় ধুচ্ছিলো ইভার মা আনোয়ারা বেগম । সেখান থেকেই ডাক দিলো । আজকাল মেয়ের রকম সকম তার ভালো ঠেকছে না । একটা অতিপরিচিত পরিবর্তন তিনি নিজের মেয়ের মাঝে দেখতে পাচ্ছেন । নিজে একজন অভিজ্ঞ নারী তাই মেয়ের এই পরিবর্তন তার চোখ এড়ায়নি । তাই ঠিক করেছেন মেয়ের অবাধ স্বাধীনতায় কিছুটা হস্তক্ষেপ করা দরকার ।
“ আনিকাদের বাড়ি যাচ্ছি না , এই সময় আর কোথায় যাবো”
“ না না এখন ওই বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই , জানিস না করিম ভাইয়ের জ্বর এসেছে , বলা তো যায়না কি না কি হয়েছে” মেয়ের গন্তব্বের কথা শুনে হায় হায় করে উঠলেন আনোয়ারা বেগম । যদিও আজকাল আর এক সরকারের দেয়া লকডাউন মানছে না , তবুও কারো জ্বর সর্দি হয়েছে শুনলে মানুষ সেদিকে আর পা বাড়ায় না । আনোয়ারা বেগম জেনে শুনে কিছুতেই নিজের মেয়েকে এমন বিপদে ঠেলে দিতে চান না ।
“ এটা তুমি কি বললা মা , বান্ধবীর বাবা অসুস্থ , আমি যাবো না!!!!”
“ আহারে আমার দরদি রে” মুখ ভেংচে বললেন আনোয়ারা বেগম , .” নিজের মায়ের জন্য তো এতো দরদ নাই , একদিন কি বলেছিস দেও মা তোমার কাজ করে দেই , খাটতে খাটতে আমি নিজের হাড় মাংস এক করে ফেললাম, আর উনি এসেছেন সমাজ সেবা করতে”
“ মা...” হাত পা নাচিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আবদারের স্বরে বলল ইভা । কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না । ইভার মা কড়া ভাবে জানিয়ে দিলো এখন জেনো ইভা বাড়ি থেকে না বেরোয় । তার বদলে রান্না ঘরে গিয়ে কিছু সবজি কেটে কুটে দিতে বলল ।
“ আমি এখন কোন কাজ করতে পারবো না ,” সাফ জানিয়ে দিলো ইভা , কারন বেশ সেজে গুজে বেরিয়েছিলো ও , এখন রান্না ঘরে গেলে সব নষ্ট হয়ে যাবে ।
“ ধিঙ্গী মেয়ে , একটা কাজ জানিস না , বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলবে কি? সব দোষ হবে আমার বলবে মা কিছুই শিখিয়ে দেয়নি”
“ অমন বাড়িতে আমি বিয়েই করবো না” পেছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো ইভা , এটা হচ্ছে ইভার বিশেষ টেকনিক , ও জানে এটা করলে মা পানির মতো গলে যায় ।
হলো ও তাই , নরম হয়ে এলেন আনোয়ারা বেগম মেয়ের আহ্লাদে গলে গেলেন । বললেন “ হয়েছে হয়েছে , অমন খুজতে গেলে আর বিয়ে হবে না , আমাকে দেখসছিস , বিয়ের পর থেকে শ্বশুর শাশুড়ি , ননদ ননদীর জন্য খেটেছি , এখন তোদের জন্য খেঁটে মড়ছি”
“ আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করছি না , আগে লেখাপড়া শেষ করবো তারপর বিয়ে ততো দিনে অমন একটা ভেজাল মুক্ত পরিবার খুঁজে নিয়ো “ মায়ের গলা জড়িয়ে গালের সাথে গাল মিলিয়ে আদুরে স্বরে বলল ইভা , অবশ্য অমন পরিবারের খোঁজ ওর নিজের ই জানা আছে মনে মনে ।
“ অমন পাওয়া যায় না রে মা , কিছু কিছু কাজ সব খানেই করতে হবে , স্বামীর সেবা , শ্বশুর শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলা “ আনোয়ারা বেগম একটা হাত নিজের শাড়িতে মুছে নিয়ে মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন । মেয়েটা তার বড় আদরের , প্রথম মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়েছিলো বলে খানিকটা মন খারাপ হয়েছিলো , তবে সে কথা কাউকে বলেনি , তাই দ্বিতীয় বার যখন মেয়ে হলো এতো খুসি হয়েছিলেন যে বলার মতো নয় ।
“ তুমি খালি আমাকেই এসব বলো মা , কই নিজের ছেলেকে তো কোনদিন কোন কাজ করাও না “ ঠোট ফুলিয়ে বলল ইভা ,
“ পাগলী মেয়ে তোর ভাই কে তো আর অন্য বাড়ি গিয়ে ঘর করতে হবে না , করতে হবে তোকে” হেঁসে বললেন আনোয়ারা বেগম ,
“ সে দেখা যাবে , আমি যতদিন আছি রানীর হালে থাকবো , তুমি তোমার ছেলে কে দিয়ে এইসব কাজ করাও , এখন আমি গেলাম” এই বলে আর দেরি করলো না ইভা , দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো । কারন বেশি অপেক্ষা করলে আবার বাধা আসবে , গত তিন চারদিন দেখা হয়নি অনিক এর সাথে , আজ দেখা না হলে মড়েই যাবে ও ।
“ এই এই মেয়ে , এই শোন আমার কথা “ আনোয়ারা বেগম পেছন থেকে ডেকেও থামাতে পারলো না ইভাকে , কিন্তু রাগ করতে পারলেন না উনি , রাগের বদলে একটা কেমন জানি একটা উদাসীনতা এসে ভর করলো ওনার মনে , আনোয়ারা বেগম সব সময় শুনে এসেছেন যে মেয়েরা বাপ সোহাগী হয় , আর বাবারাও মেয়েদের বেশি আদর করে । তবে উনার ক্ষেত্রে একটু অন্য রকম , উনি কেন জানি ছেলের চেয়ে মেয়েকে বেশি আদর করেন , এটা যে উনি ইচ্ছে করে করেন তেমন নয় , চেষ্টা করেও উনি পক্ষপাতহীন হতে পারেন না । তাই যখনি মনে হয় এই মেয়েকে একদিন পরের বাড়ি দিয়ে দিতে হবে তখন ভেতরটা কেমন জানি হাহাকার করে ওঠে ।
এসব ভাবতে ভাবতেই আনোয়ারা বেগম এর মনে একটা ভাবনা উদয় হলো , মেয়ের মাঝে ইদানীং যে উরু উরু ভাব দেখছেন , এটা কার জন্য ? আনোয়ারা বেগম মুচকি হাসলেন , ওনার মনে হচ্ছে উনি ধরতে পেরেছেন , এই রোজ রোজ আনিকাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য যে মেয়ে পাগল হয়ে যায় , এটা হয়ত আনিকার ভাই অনিক এর জন্য । ছেলেটাকে আনোয়ারার ভালোই লাগে , তার উপর বাড়ির পাশে বাড়ি , এছাড়া তেমন ঝাক্কি ঝামেলেও নেই । ছোট পরিবার , একটা সুধু বোন , আর বাবা, দুজনেই ভালো মানুষ । নিজে কে কষ্ট ভোগ করেছেন আনোয়ারা বেগম সেটা যেন মেয়ে না ভোগে মনে প্রানে তাই চান উনি । ঠোঁটের মুচকি হাঁসি চওড়া হলো আনোয়ারা বেগম এর । উনি ঠিক করলেন স্বামীর সাথে এই নিয়ে কথা বলবেন । তবে মেয়ের সাথে আগে কথা বলে নিতে হবে । উনি অনিক কে পছন্দ করে বলে এই নয় যে অবাধ মেলামেশা করতে দেয়া হবে । আজকাল এর ছেলে মেয়েরা খুব ফাজিল , কত কত অঘটন ঘটছে আজকাল চারপাশে । এসব জেনো না হয় এর জন্য মেয়ে কে সাবধান করে দিতে হবে । যা হওয়ার পারিবারিক ভাবেই হোক ।
<><><><>
বাড়িতে ডাক্তার এলো না , রোগীর প্রচুর ভিড় , তাই অনিক বুদ্ধি করে বাবাকেই নিয়ে গেলো ডাক্তার এর চেম্বারে । ডাক্তার করিম মিয়াঁর পূর্ব পরিচিত আতাই এক ফাঁকে দেখে দেবে বলছে । আসলে আজকাল জ্বর সর্দি শুনলে সবাই ভয় পেয়ে যায় । তাই বেসিক্ষন চেম্বারে বসানো হবে না করিম মিয়াকে । ভাই আর বাপ কে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে ফেসবুক নিয়ে বসেছে আনিকা । অরুপ এর তরফ থেকে অনেকগুলো মেসেজ এসেছে । সব গুলিতেই সকালের ঘটনার জন্য সরি বলা আছে । ইনিয়ে বিনিয়ে সরি বলেছে অরুপ । অনেকটা সময় নিয়ে মেসেজ গুলি পড়লো , তারপর লিখলো
“ এতো সরি বলার কি আছে , আমি ই একটু বেশি রিএক্ট করে ফেলেছি” সেন্ড বাটন চাপার পর খুব বেশি ওয়েট করতে হলো না , সাথে সাথে আনিকা দেখতে পেলো অরুপ টাইপ করছে ।
“ না না আমি ই ভুল করেছি , আসলে আমারা ধরেই নেই মেয়ে মানে রান্না জানবে , এটা এই যুগে অচল , সবার ই রান্না জানা উচিৎ”
“ সত্যি বলছো ? আসলে আমার ভাইয়া এমন কথা বলে সব সময় , ও নিজেও আমাকে ঘরের কাজে সাহায্য করে , অবশ্য মাঝে মাঝে করে না , উল্টো জ্বালায় , যখন ওর চা খাওয়ার ইচ্ছা হয় তখন খালি আমাকে চায়ের জন্য জ্বালায়”
“তুমি কি অনিক ভাইয়ের সাথে খুব ফ্রি?” অরুপ লিখে পাঠাল ,
“ হ্যাঁ , কেনো বলতো?”
“ না আগে তোমাকে অনেকবার অনিক ভাইয়ের সাথে বাইরে দেখছি , সত্যি বলতে কি আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে উনি তোমার বড় ভাই,”
“ কেনো?” অবাক হলো আনিকা ।
“ রাগ করো না আবার , আমি মনে করতাম অনিক ভাই তোমার বয় ফ্রেন্ড”
অরুপ এর মেসেজ দেখে অনেক্ষন হাসল একা একা , তারপর লিখলো , “ ধুর কি বলো , আমাদের দেখে প্রেমিক প্রেমিকা মনে হবে কেনো? আমারা কি প্রেমিক প্রেমিকার মতো হাত ধরে হাঁটতাম নাকি ?”
“ নাহ তবে সত্যি বলছি দেখে অমন ই মনে হতো “
“ কি জানি , আমার কোনদিন কোন বয়ফ্রেন্ড ছিলো না , তাই আমি বুঝিও না”
“ তুমি তো নিজেকে সব সময় দূরে দূরে রাখতে , কাউকে পাত্তা দিতে না , তাই যখন তোমাকে অনিক ভাইয়ার সাথে একদিন ফুচকা খেতে দেখলাম তখন মনে হলো ,তোমার বয় ফ্রেন্ড আছে , তাই তুমি কাউকে পাত্তা দাও না “
“ আরে না , বরং উল্টো , ছেলেরাই আমাকে পাত্তা দিতো না “ এই লিখে আনিকা দুটো হাসির ইমোজি দিয়ে পাঠিয়ে দিলো ।
“ কে বলেছে তোমায় , তোমার জন্য অনেক ছেলে পাগল ছিলো”
“ তাই নাকি ? কোনদিন তো দেখিনি”
“ সবাই ভয় পেতো , একে তুমি ভীষণ সুন্দরী তার উপর সবাই মনে করতো খুব দেমাগ”
অরুপ এর কথা গুলি ভীষণ ভালো লাগছে আনিকার , লাস্ট এক বছরে বেশ কিছু ছেলে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওরা ওকে পছন্দ করে কিন্তু আনিকা তখন ওদের কে তেমন আস্কারা দেয় নাই । এখন মনে একটা প্রশ্ন জাগছে ওর , অরুপ ও কি এদের মাঝে ছিলো ? কই কোনদিন তো অরুপর মাঝে তেমন কিছু দেখেনি ও । “আচ্ছা কবেকার কথা বলছো তুমি অরুপ , কবে আমাদের ফুচকা খেতে দেখছো?”
“সেটা স্কুলে থাকতে , আর ভুলটা ভেঙ্গেছে গত বছর, এক দিন কলেজের এক ছেলে বলল ওটা তোমার ভাই, আমি বিশ্বাস করতে চাই নি , তবে ও যখন সব কিছু বলল তখন খুব আফসোস হয়েছিলো”
অরুপ এর আফসোস লেখাটা দেখে আনিকার বুকটা ধক করে উঠলো , আফসোস কেনো হয়েছিলো ওর ? তাহলে কি স্কুল থেকেই অরুপ ওকে পছন্দ করতো? আনিকা এতদিনে ভালোভাবেই জেনে গেছে অরুপ ওকে পছন্দ করে । কিন্তু আনিকা মনে করতো বাকি সব ছেলেদের মতো অরুপ ও ওর শরীরে পরিবর্তন আসার পর থেকেই ওকে নোটিস করেছে । তাই এতদিন অরুপ এর সাথে কথা বলে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করলেও আলাদা তেমন ফিলিং ছিলো না । তবে এখন যখন বুঝতে পারলো অরুপ বাকিদের মতো নয় । তখন ছেলেটার প্রতি একটা অন্য রকম ভালো লাগা এসে ভর করলো ওর আনিকার উপর ।
“ আফসোস কেনো হয়েছিলো?” লেখার সময় আনিকার হাতদুটো একটু কেঁপে গেলো , বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে । আনিকা নিজের করা এই প্রশ্নের উত্তর জানে , কিন্তু ও দেখতে চাইছে অরুপ কিভাবে এর উত্তর দেয় । তবে বেশ কিছুক্ষন অরুপ কিছুই লিখলো না , অরুপ কোনদিন এতো স্ময় নেয়েনি কোন মেসেজ এর রিপ্লে দিতে ।
অপেক্ষা করতে লাগলো আনিকা , আর এই অপেক্ষার সময়টুকুর প্রতিটি মুহূর্ত ওর কাছে একটি ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছিলো । নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছিলো । দম বন্ধ হওয়া সেই মুহূর্ত গুলি যেন শেষ হচ্ছিলো না ।
<><><><>
“ আনিকা আমার ননদী, কি করছিস” বলতে বলতে ইভা প্রবেশ করলো আনিকার ঘরে , আনিকা তখন এক দৃষ্টিতে মোবাইল স্ক্রিনে অরুপ এর উত্তর এর আশায় তাকিয়ে । ইভার আওয়াজ শুনে দ্রুত মোবাইল অফ করে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল আনিকা। ওকে দেখে সাথে সাথে মোবাইল অফ করে দেয়া, দ্রুত বুক ওঠা নামা করা এবং ফর্সা গালে গোলাপি আভা দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলল ইভা ।
হাসতে হাসতে বলল “ আনিকা তুই দরজা খোলা রেখে এসব দেখছিস” বান্ধবীর এমন সাহসিকতা দেখে ইভা যেমন অবাক হচ্ছে তেমনি বেশ মজাও পাচ্ছে ।
“ কেনো ওসব ছাড়া কি মোবাইলে করার মতো আর কিছু নেই” বিরক্ত ওয়ে ভ্রূ কুচকে বলল আনিকা , এমন মহেন্দ্র ক্ষণে এসে ইভার আগমন একদম ভালো লাগছে না আনিকার । কারন একটু আগে ঘটতে চলা ব্যাপারটা ও নিজের বান্ধবিকে জানাতে চাচ্ছে না , মন থেকে সায় আসছে না । নিজের এমন আচরণে আনিকা নিজেও একটু অবাক হচ্ছে , আগে এসব খবর প্রানের বান্ধবিকে কতক্ষনে বলবে তার জন্য অপেক্ষা করতো । কিন্তু এখন ভেতর থেকে তেমন তাগিদ বোধ করছে না ।
“ দেখি দেখি কি অমন কাজ করছিলি , দে তো মোবাইল টা” ভ্রূ নাচিয়ে আনিকার কাছ থেকে মোবাইল চাইলো ইভা ,
“ সব কিছু কি তোর দেখতে হবে নাকি , আর এই ঘরে কি চাই তোর , যার কাছে এসেছিস তার কাছে না” চোখ মুখ কঠিন করে বলল আনিকা। আসলে ইভাকে রাগিয়ে দেয়ার জন্যই এমনটা করছে ও , কারন একমাত্র রাগিয়ে দিলেই ইভা হাল ছাড়বে , নইলে মোবাইল নিয়েই ছাড়বে ।
“ আমি তোর কাছেই এসেছি , দে এবার মোবাইল দে” ইভা নাছোড় বান্দার মতো বলল , তারপর আনিকার আশা বাদ দিয়ে নিজেই আনিকার বালিশের নিচে রাখা মোবাইল নেয়ার জন্য এগিয়ে গেলো । হালকা ধ্বস্তাধস্তি শুরু হলো , একপর্যায়ে আনিকা রেগে গিয়ে বলল ।
“ ইভা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে , সবার নিজের একটা প্রাইভেসি আছে , তুই সেটা লঙ্ঘন করছিস”
“ ওলে ওলে আমার প্রাইভেসি ওয়ালারে , তোর কি এমন গোপন জিনিস আছে , যে আমায় বলা যাবে না?” হাপাতে হাপাতে বলল ইভা , আনিকার সাথে ধ্বস্তাধস্তিতে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে ও , এছাড়া কিছু চুক এলমেলো হয়ে সামনের দিকে চলে এসেছে । আনিকার অবস্থাও তাই, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে , চুল এলমেলো ।
“ অনেক কিছুই আছে , আমি কি তোর সব গোপন কথা জানতে চাই ? এই যে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস আমি কি তোর ওখানে বাধা দিচ্ছি”
“ কি বলতে শুনতে চাস বল আমি বলছি , কিন্তু আমাকে তোর মোবাইল দে” ইভা এক গুয়ের মতো করে বলল ।
“ দেখ ইভা তুই কিন্তু বেশি বেশি করছিস , আমাকে আমার কাজ করতে দে , তুই তোর কাজে যা , ও... তুই যার জন্য এসেছিস সে এখন বাসায় নেই , সবচেয়ে ভালো হয় তুই চলে যা এখন পরে আসিস” বেশ বাজে ভাবেই বলল আনিকা , ইভার একগুঁয়ে আচরন ওকে বেশ রাগিয়ে দিয়েছে ।
“ আনিকা !!!” এতটা খারাপ আচরন করবে আনিকা ইভা কোনদিন কল্পনা ও করেনি ইভা , “ তুই এমন করছিস কেনো? আমি তোর এমন কি করেছি” ইভাও বেশ চড়া কণ্ঠে বলল ।
“ কিছুই করিস নি , আমি সুধু চাচ্ছি তুই তোর মতো থাক আমাকে আমার মতো থাকতে দে”
“ তাই ?” ভ্রূ উচিয়ে জিজ্ঞাস করলো ইভা “ এখন তোর আর আমার পর্যায়ে চলে এসেছে, আগে তো এমন ছিলো না”
“ আগে ছিলো না , এখন হয়েছে , এখন তো আরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে?” আনিকাও ছেড়ে বলার পাত্রি নয় ।
“ কি পরিবর্তন হয়েছে?” ইভা চ্যালেঞ্জ এর সুরে বলল
“ তুই নিজেই দেখে নে, আমি বলার কে ?”
কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলো ইভা , তারপর হঠাত করে বলল , “ ওকে ফাইন , আমি চলে যাচ্ছি , তবে একটা দুঃখ রয়ে গেলো , সেটা হচ্ছে তোকে আমি এতদিনের চিনতে পারিনি”
এই বলে ইভা আর থাকলো না , উঠে চলে গেলো । আনিকা সেই দিকে তাকিয়ে রইলো , ওর কাছে মনে হলো ইভা যাওয়ার সময় একবার চোখ মুছে নিলো ।