গর্ভধারিনী
লেখক- সমরেশ মজুমদার
লেখক- সমরেশ মজুমদার
০১.
টেলিফোনটা বাজছিল। মুখ তুলে দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল জয়িতা। এগারোটা দশ। অবশ্যই এই ফোনটা ওর জন্যে নয়। ওর বন্ধুরা কেউ এই সময়ে ফোন করবে না। যদি কোনও বিপদ আপদ হয় তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু বিপদ আপদের আশু সম্ভাবনা তো ছিল না। অতএব এই ফোনটি সীতা রায়ের। যদিও সীতা রায় এখনও বাড়িতে নেই, কখন ফিরবেন তারাই জানেন না এবং তার ওপর আজ যখন শনিবারের রাত তখন ওই টেলিফোন নিয়ে মাথাব্যথা করার কোনও মানে হয় না। অবশ্য করাত চালানোর মত শব্দটা বেজে যাচ্ছে। যে করছে তার ধৈর্য আছে। না ধরিয়ে ছাড়বে না।এই বাড়িতে দুটো কাজের লোক আছে। একজন দৈনিক আর একজনের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে আছে। কাজকর্ম ঠিকঠাক করে কিন্তু কানে শুনতে পায় না। সীতা রায়ের অবশ্য শ্রীহরিকে ওই কারণেই পছন্দ। বাড়ির কথা বাড়ির বাইরে যাবে না। কিন্তু মুশকিলটা হল টেলিফোনের আওয়াজটা শ্রীহরিকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। খানিক আগে ডাইনিং টেবিলে খাবার দিয়ে তিনি চলে গেছেন নিজের ঘরে। অতএব উঠতে হল জয়িতাকে। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্পোর্টস গেঞ্জি আর জিনসের টাইট প্যান্টে ওকে আরও রোগা দেখায় কিন্তু শাড়িটারির চেয়ে এই পোশাকই ভাল লাগে জয়িতার।রিসিভারটা অত্যন্ত অযত্নে কানে তুলে জয়িতা বলল, হ্যালো!একটু থিতনো ওপাশে, তারপর হাসির মাড় লাগানো কড়কড়ে শব্দ বাজল, উঃ কি ঘুম বাবা, এগারোটা বাজতে না বাজতেই যদি প্রেসিডেন্সির মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে কি করে চলবে! রিসিভার ধরে আমার হাতব্যথা হয়ে গেল।জয়িতার চোখ ছোট হল। সে কেটে কেটে উচ্চারণ করল, ঠিক কত নম্বর চাইছেন?আঃ কাম অন বেবি! তুমি তো জয়িতা, রামানন্দের মেয়ে?হ্যাঁ। তাই বলা হয়ে থাকে আমাকে।বলা হয়ে থাকে? হাসির তুবড়ি আকাশ ছুঁল এবার, সাবাস। শুনেছিলাম তুমি নাকি খুব স্মার্ট, শাড়ি ব্লাউজ পরো না, বাট আই হ্যাভ নেবার সিন ইউ অ্যারাউন্ড! রামানন্দ একটু আগে বলছিল তুমি খুব রোগা, খুব?জয়িতা বাঁ দিকে তাকাল। সেখানে বেলজিয়ামের আয়নায় তাকে দেখা যাচ্ছে। পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির একটা দাঁড়ি। নো বাঁক, মাংসের বাড়তি চমক কোথাও নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে তার কোনও রোগ নেই। ভাল হজম হয়, চমৎকার ঘুম হয়, এবং মেয়ে বলেই সারামাসের চারদিনের যন্ত্রণাটা নিয়ম মেনেই ঘটে যায়। সে প্রেসিডেন্সিতে শতকরা চুরাশি নম্বর পেয়ে ঢুকেছিল। তার কোনও শারীরিক অসুবিধে নেই। অথচ এই মহিলা মাঝরাতে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন সে খুব রোগা কিনা! হু ইজ সী?প্রশ্নটা করা মাত্রই মহিলা জবাব দিলেন না। বললেন, আসলে ব্যাপার কি জানো, আমার মনে হল তুমি এখন একা আছ। আমি জানি একজন কবিরাজকে। তার ওষুধ খেয়ে অনেকেই মোটা হয়েছে। মেয়েদের মোটা না হলে ভাল দেখায়, বল?আর ইউ ড্রাঙ্ক?ওমা, আমার কথা শুনে তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি! না ভাই, আমি ড্রিঙ্ক করি না, তবে খেতে চাইলে খাওয়াই। আসলে তোমার ওপর আমার স্নেহ, আই মিন, এক ধরনের অ্যাটাচমেন্ট এসে গেছে বলতে পার। জয়িতা, তোমাকে আরও বড় হতে হবে। আরও বড়। মন দিয়ে পড়াশুনা করতে হবে। তুমি জে. ই. দিলে না কেন?জয়িতা ঠোঁট কামড়াল। ইটস ইনটলারেন্স! সে শীতল গলায় প্রশ্ন করল, লুক, আমি আপনাকে চিনি না জানি না। আপনার কাছে অনাবশ্যক উপদেশ শুনতে আমি রাজি নই। এবং এখন রাত অনেক হয়েছে।রাত কত হলে তোমার বাবা বাড়িতে ফেরেন জয়িতা?আই ডোন্ট নো। আই অ্যাম নট কনসারন্ড।তাই তো এই ফোন। তোমাকে আমার খু-উ-ব নেগলেকটেড চাইল্ড বলে মনে হচ্ছে। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। তোমার বাবার চেয়েও বড় হতে হবে। তুমি কি এখন পড়াশুনা করছিলে জয়িতা?কিন্তু আমি জানতে চাই আপনি কে?দ্যাখো, কোন কোন সম্পর্ক জন্ম থেকেই তৈরি হয়, কোনটা পরে আসে। আমি তোমার সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ে সম্পর্কিত। এখন আমি তোমাকে নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। তোমার সম্পর্কে আমার মাদারলি ফিলিংস এসে গেছে।কিন্তু কেন? কি জন্যে? আমাকে কি আপনি দেখেছেন?নো। তবে শুনেছি তোমার কথা। আর এখন তো আমার সঙ্গে তোমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। তোমার কোন প্রব্লেম থাকলে আমাকে বলতে পার।আপনি এখনও পরিচয় দিচ্ছেন না! যদিও আপনাকে আমার ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। অ্যাট লিস্ট আপনার গলার স্বর খুব ভাল। সম্পর্কটা কি?মায়ের সঙ্গে মেয়ের যা সম্পর্ক। ইন ফ্যাক্ট আমি সীতার চেয়ে ভাল মা হব।মা! ভগবান। আপনার কি মাথা খারাপ! আমার বাবা এখনও ডিভভাসী নন এবং কখনও হবেন কিনা সন্দেহ আছে। আর ইউ ম্যাড?নট অ্যাট অল। তাহলে তোমাকে বলি। আমি আর রামানন্দ শ্লেস্ট টুগেদার। একটু আগে ও উঠে গেছে আমার বিছানা থেকে। আমি এসব কথা তোমাকে বলতে চাইনি কিন্তু তুমি বাধ্য করলে। ওর জামায় আমি একটা দাগ রেখে দিয়েছি ফর ইওর ইনফর্মেশন। এখন ব্যাপারটা হল, আমি ব্যাপারটাকে কেবল আনন্দ উপভোগ হিসেবে দেখেছি না। ওর সব কিছু আমাকে ইন্সপায়ার্ড করেছে। তা থেকেই তোমার সম্পর্কে আমার মাদারলি ফিলিংস এসেছে, বুঝতে পেরেছ? কথাগুলো শেষ করে আবার সেই কড়কড়ে হাসি জুড়লেন মহিলা।ডিসগাস্টিং! চিৎকার করে উঠল জয়িতা, যতক্ষণ আপনি আপনার নাম না বলছেন ততক্ষণই আমার–! ওয়েল, এসব কথা আমাকে বলে কোনও লাভ নেই!আমি মিসেস দত্ত। ঐন্দ্রিলা দত্ত। গুড নাইট।লাইনটা কেটে গেল। এখন রিসিভারে আবার ডায়াল টোন ফিরে এসেছে। একটানা শব্দটা যে কানে বাজছে প্রথমে খেয়াল করেনি জয়িতা। সে নিজের অজান্তেই ঠোঁট কামড়াল। তারপর রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ঘরে ফিরে এল।ঐন্দ্রিলা দত্ত। এই নাম সে জীবনে শোনেনি। হয়তো বাবার লেটেস্ট। কিন্তু মহিলা যেই হোন না কেন কথা বলতে জানেন। লেটেস্ট কায়দায় ব্ল্যাকমেল করা। অথচ ব্ল্যাকমেল বলে আপাত মনে হবে না। চেয়ারে বসে দুটো পা টেবিলের ওপর তুলে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট টেনে নিল সে। মাঝারি দামের সিগারেট। বেশ কড়া। বছর দুয়েক হল সে সিগারেট খাচ্ছে। ওর বন্ধুরাও এই সিগারেটই পছন্দ করে। অবশ্য আনন্দ সিগারেট খায় না। কোনও নেশাটেশার মধ্যে নেই। রিয়েল সিরিয়াস গাই। নরেন্দ্রপুরের ছেলেদের মধ্যে একটা গুডি গুডি ভাব থাকে। আনন্দটা সেটাকে ভিত্তি করে আরও এগিয়েছে। সব কিছু খুব সিরিয়াসলি ভাবে। কিন্তু বোর করে না। সুদীপ বা কল্যাণ ঠিক আছে। সুদীপটা ক্যালকাটা বয়েস থেকে বেরিয়েছে। বড্ড বেশি কথা বলে। কয়েকবার পাউডার অ্যাটেম্পট্ করে বলেছে, কেন যে ওরা এসব খায়! ধ্যুৎ। অনেস্ট কনফেশন। ওকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি জয়িতার। মুশকিলটা কল্যাণকে নিয়ে। ও পড়তো স্কটিশ স্কুলে। একদম মধ্যবিত্ত বলে যারা নিজেদের সান্ত্বনা দেয় তাদের একটা পরিবার থেকে। আনন্দও মধ্যবিত্ত কিন্তু কল্যাণের মত উল্টোপাল্টা মানসিকতার ছেলে নয়। কল্যাণ কোনও ব্যাপারে দারুণ স্মার্ট কথা বলল, আবার পরক্ষণেই এমন একটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা আঁকড়ে ধরল যে ওকে খুব বিরক্তিকর বলে মনে হয় তখন। কিন্তু সব মিলিয়ে এই তিনজনেই জয়িতার বন্ধু। আনন্দ হোস্টেলে থাকে। কল্যাণের বাড়িতে ফোন নেই। সুদীপের আছে। কিন্তু এখন সুদীপ বোধ হয় বাড়িতে ফেরেনি। ওদের দমদমে যাওয়ার কথা সন্ধ্যে সাতটায়। আনন্দ আর সুদীপের। পার্টির ডিসিশন জানতে যাবে ওরা।তবু জয়িতার মনে হল সুদীপকে একটা ফোন করলে হয়। যতই সে ব্যাপারটার গুরুত্ব না দিক, মনের মধ্যে নোংরা লাগার মত একটা অনুভূতি পাক খাচ্ছে। মহিলা স্পষ্ট বললেন আমি তোমার বাবার সঙ্গে ঘুমিয়েছি! এরকম কেউ বলতে পারে? অবশ্য সেটা যদি সত্যিই হয় তাহলে এখন জয়িতার কিছুই আসে যায় না। পুরো ব্যাপারটা সীতা রায়ের। রামানন্দ রায় এবং সীতা রায়ের। জন্মসূত্রে ওরা অবশ্য বাবা-মা। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক। রামানন্দ রায়ের বয়স পঞ্চাশ। হ্যান্ডসাম, স্টিল হ্যান্ডসাম, টল, চুলে কলপ দেন প্রতি রবিবার, মুখে ভাঁজ পড়েনি। ড্রিংকসের জন্যে চোখের তলায় সামান্য ব্যাগ তৈরি হয়েছে এবং পেটে ঈষৎ চর্বি। তবে স্মার্টনেসের জন্যে সেগুলো তেমন নজরে পড়ে না। মাঝে মাঝে দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পান। দাঁত তুলতে রাজি নন। সেই সময় ওয়াটারলু স্ট্রিটের বারীন রায় ওর ভগবান।
Last edited: