What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

বিপ্লবতীর্থে পান্থশালা (1 Viewer)

zAH7R2g.jpg


পথের ধারে পুকুরপাড়ে শানবাঁধানো ঘাট। দুপাশে বসার আসন। ওপরে তোরণে জোড়া হস্তী সম্ভাষণ জানাচ্ছে অতিথিদের। অতিথি আর কে, ক্লান্ত পথিক। দূরের পথে যাবে যে। পায়ে হেঁটে ক্লান্ত–শ্রান্ত পথিক একসময় জিরিয়ে নেবে ঘাটে। পুকুরের স্বচ্ছ জলে মেটাবে তৃষ্ণা। কল্পনা নয়, সত্যি। গাড়িঘোড়াহীন সময়ে দূরের পথিকের আশ্রয়স্থল ছিল এ রকম শানবাঁধানো ঘাটসমেত বিশ্রামকক্ষ। পোশাকি নাম পান্থশালা।

ঠিক এ রকম একটি পান্থশালা অতীত দিনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। দক্ষিণ ভূর্ষির ডেঙ্গাপাড়ার জগতচন্দ্র মহাজনের পান্থশালা। প্রায় শত বছর আগে এই পান্থশালা নির্মিত হয়েছিল ডেঙ্গাপাড়ার পুকুরপাড়ে। আজও তা কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। নির্মাণকাল খোদাই করা রয়েছে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ)। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের যে রীতি, তারও একটি নজির এই বঙ্গাব্দ হরফ, যেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

Tsy79bX.jpg


চট্টগ্রামের পটিয়ায় প্রায় শত বছর আগে এই পান্থশালা নির্মিত হয়েছিল

তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলন চলছে চট্টগ্রামজুড়ে। বিপ্লবতীর্থ পটিয়া এবং বোয়ালখালীর এই মেঠো পথটি ব্যবহার করতেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনরা। এখন সড়কটি এ জনপদের বীরকন্যা প্রীতিলতার নামে নামাঙ্কিত। সড়কের ১৩ কিলোমিটার চিহ্নিত মাইলফলকের সামনে এই পান্থশালা। বিপ্লবী প্রীতিলতার বাড়ি বিপ্লবের সূতিকাগার ধলঘাটে। পান্থশালা থেকে সামান্য এগোলে কৃষ্ণখালী খালের সেতু পার হলেই ধলঘাট।

প্রীতিলতা ট্রাস্টের ট্রাস্টি পঙ্কজ চক্রবর্তী এই গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি জানালেন, একসময় পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি, ধলঘাট, গৈরলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপ্লবীরা দুর্গ গড়ে তোলেন। এটা দেখে ব্রিটিশরা ক্যাম্প করে। বিপ্লবীরা পান্থশালার এই সড়ক ধরে আসা–যাওয়া করতেন সাবধানে। মাস্টারদাকে গৈরলা থেকে আটকের পর পান্থশালার পথটি ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

2raMT7i.jpg


পান্থশালার ভেতরটা

পান্থশালার একটু অন্দরমহলে ঘুরে আসা যাক। বসার আসনের কথা আগেই বলা হয়েছে। আসনের পাশে বাইরের দিকে আবার ছোট্ট একটা সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে দোতলায় মাচাংঘরের মতো। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে মোট পাঁচটি খিড়কি। তিনটির মুখ দিঘির দিকে, বাকি দুটি পথপানে চেয়ে। আলো–বাতাস খেলা করে। পুকুরের স্বচ্ছ জলে চাঁদনি রাতে অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হতো নিশ্চয়।

ওপরে টিনের ছাউনি। দোতলার পাটাতনের ওপর মাচাংঘরটির বেড়ার মেঝে কিছুদিন আগেও ছিল। এখন নেই। সম্ভবত বাজে আড্ডার উৎপাতের কারণে তা খুলে নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু এখনো কাঠের বিমগুলো রয়ে গেছে।

দূর পথের পথিকেরা এখানে রাত যাপন করতে পারতেন। অনায়াসে আট–দশজনের জায়গা হতো। সঙ্গে থাকত পুঁটলি বাঁধা চিড়া মুড়ি আর মাটির কলস ভর্তি পুকুরের স্বচ্ছ জল। গ্রীষ্মের খররোদ বা বর্ষার বৃষ্টির তীব্রতা এড়াত পান্থশালার ছায়াতলে।

2LuT3m3.jpg


শানবাঁধানো ঘাটসমেত বিশ্রামকক্ষ

সেই স্মৃতিচারণা করলেন পান্থশালার পাশের দোকানি মীর আহম্মদ। বয়োবৃদ্ধ। বংশপরম্পরায় এই মুদিদোকান তিনি চালাচ্ছেন ডেঙ্গাপাড়ার পান্থশালার পাশে। মাটির ঘরের দোকান। তাঁর দাদার আমলের তৈরি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর বাবা মৃত রঞ্জু মিয়া। মীর আহম্মদ বলেন, বাপ–চাচা এবং পাড়ার মুরব্বিদের মুখে শুনেছি, পান্থশালাটি বানানো হয়েছিল পথচারীদের জন্য। তখন পায়ে হেঁটে দূরদূরান্তে মানুষকে যেতে হতো। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য জগত মহাজন সেটা করে দেন। রাতে সেখানে অনেকে বিশ্রামও নিতেন।

কে এই জগত মহাজন! মীর আহম্মদের দেখানো পথে মহাজনের বাড়ির খোঁজও মিলল। পুকুর থেকে একটু দক্ষিণে ডেঙ্গাপাড়া জগত মহাজন বাড়ি। আসল নাম জগত চৌধুরী। অনেক ভূসম্পদের মালিক জগতবাবু তখন স্থানীয়দের মুখে মুখে মহাজন বা জমিদার খেতাব পেয়েছিলেন। গরিব–দুঃখীদের সাহায্য–সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন। জমিদার বাড়িটি মাটির, দ্বিতল। বাইরে একটা পূজার ঘর। পাশে শূন্য গোয়ালঘর। বাড়ির বাসিন্দা বলতে দিলীপ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দিলীপ চৌধুরী জগত মহাজনের নাতি।

দিলীপ চৌধুরীর কাছে কিছু ইতিহাস জানা গেল। জগতবাবুর তিন ছেলে, তিন মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে মারা গেছেন। বেঁচে আছেন ছোটটি সুনীল চৌধুরী। তিনি থাকেন চট্টগ্রাম শহরে, ছোট একটি ব্যবসা করেন। দিলীপ বড় ছেলের সন্তান। তিনি বলেন, অনেক ভূসম্পদের মালিক ছিলেন দাদু। এখন তেমন নেই। বাইরের মানুষের জন্য আমাদের দাদু অনেক কিছু করেছেন। পান্থশালাটি করেছেন মানুষের কষ্টের কথা ভেবে। কিন্তু দেখেন, আমাদের ঘরের কী অবস্থা।

জগত মহাজনের মৃত্যুর সনটি সঠিক মনে করতে পারেন না দিলীপ। ফোন টিপে কাকা সুনীলকে ধরিয়ে দিলেন। আশির কাছাকাছি সুনীলের স্মৃতি ঝাপসা, 'যুদ্ধের অনেক আগে বাবা মারা গেছেন। আমি তখন ছোট। দিঘির ঘাটে পান্থশালাটি করেছেন প্রায় শত বছর আগে।'

এ রকম পান্থশালার আদলে কিছু অস্থায়ী মাচাং এখনো চোখে পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে। দুর্গম যাত্রায় সন্ধ্যা নামলে সে মাচাংয়ে এখনো দিব্যি রাত কাটিয়ে দেয় পাহাড়ের ক্লান্ত পথিক। জগত মহাজনের পান্থশালার সেই ব্যস্ততা এখন নেই।

একসময় এবড়োখেবড়ো কাদায় মাখামাখি সড়কটি ধরে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তর চট্টগ্রামের যোগাযোগ হতো, রচিত হতো বিপ্লবের সেতুবন্ধ। সড়কটি কালো পিচঢালা হয়েছে প্রায় দেড় যুগ আগে। হর্ন বাজিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলছে মোটরবাইক, অটোরিকশা কিংবা ব্যক্তিগত যান।

এখন আর পথের ক্লান্তি কোথায়। অথচ ক্লান্ত পথিক একসময় এই পান্থশালায় পেত বাকি পথ চলার রসদ। ঠিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ণনার মতো, 'ওরা পান্থশালা থেকে বেরিয়ে পড়েছে, পুবের দিকে মুখ করে চলেছে; ওদের কপালে লেগেছে সকালের আলো, ওদের পারানির কড়ি এখনো ফুরোয় নি; ওদের জন্যে পথের ধারের জানলায় জানলায় কালো চোখের করুণ কামনা অনিমেষ চেয়ে আছে; রাস্তা ওদের সামনে নিমন্ত্রণের রাঙা চিঠি খুলে ধরলে, বললে, ''তোমাদের জন্যে সব প্রস্তুত।''

'ওদের হৃৎপিণ্ডের রক্তের তালে তালে জয়ভেরী বেজে উঠল।'

লেখক: প্রণব কুমার বল, চট্টগ্রাম
 

Users who are viewing this thread

Back
Top