What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নারী (প্রবন্ধ) (2 Viewers)

নারীর ভবিষ্যৎ


নারী কি বিপন্ন? নারী কি এমন কোনো প্ৰজাতি, যা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে, বা ব্যাপক নিধনের ফলে পৌচেছে অবলুপ্তির প্রান্তে, যাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জনো? না, নারী এমন কোনো প্ৰজাতি নয়; নারী সংখ্যায় হ্রাস পাচ্ছে না, ব্যাপক সংহারেরও শিকার নয়, বরং গ্রহ জুড়ে বাড়ছে নারীর সংখ্যা। তবে প্রতি প্রজন্মের রক্ষণশীলেরাই আৰ্তনাদ করেছে; এখন আর খাঁটি নারী নেই, যারা ছিলো সুখ শান্তি কল্যাণ সতীত্ব পাতিব্ৰত্য প্রভৃতি বৰ্মণীয়তার আধার, তারা অবলুপ্ত হয়েছে। প্রতি প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাদের চারপাশে প্রাচীন পুণ্যময়ী নারীর বদলে বিকশিত হ’তে দেখেছে দানবী, যারা নষ্ট করছে সংসার, পতিকে পদচ্যুত করছে দেবাসন থেকে, এবং সন্দেহজনক যাদের সতীত্ব। উনিশশতকের বাঙলায় প্রাচীনার অবলুপ্তিতে আর্তনাদ করেছে। পুরুষতন্ত্র; দিকে দিকে, সংসারবৃক্ষের ডালে ডালে, ঝুলতে দেখেছে ‘বিষময় ফল’। বিষাক্ত নারী ফুল ফুটিয়েছে ফল ধরিয়েছে বিষবৃক্ষের। পুরুষের চোখে চিরকালই নারী নয়, নারীত্ব বিপন্ন, তাই পুরুষ সব সময়ই চেষ্টা করেছে নারীকে আদিম অবস্থায় রেখে দিয়ে ‘নারীত্ব’ উপভোগ করতে। নারীর মৃত্যুতে তাদের দুঃখ নেই, তাদের উদ্বেগ নারীত্বের মৃত্যুতে। নারীর সামনে সময় থাকে, নারীর বয়স বাড়ে, সময়ের কামড় বোধ করে নারী; কিন্তু নারীর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। পুরুষ এগোয় ভবিষ্যতের দিকে, নারী এগোয় বার্ধক্য ও ভবিষ্যৎইৗনতার দিকে; তাই বিশশতকের শেষ দশকে পৌঁছেও মনে হয় নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, যদি নারী তা সৃষ্টি করতে না চায়। পুরুষের হাতে নারীর ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়ার অর্থ বিপন্নতা, পুরুষের হাতে পর্যুদস্ততা। প্ৰণতির অগ্ৰগতি ধারাবাহিক ব্যাপার নয়, প্রগতির পর প্রতিক্রিয়াশীলতা মাঝেমাঝেই দেখা দেয়: বিশশতকের শেষাংশে প্রতিক্রিয়াশীলতাই হয়ে উঠছে প্রবল, তাই তা নারীর জন্যে বড়ো আতঙ্কের কারণ। সব ধরনের প্রগতিশীলতা নারীর জন্যে শুভ, প্রতিক্রিয়াশীলতা অশুভ। পিতৃতন্ত্র যতো সংস্থা তৈরি করেছে, —পরিবার, বিয়ে, সমাজ, ধর্ম, বিদ্যালয় সবই মৰ্মমূলে প্রতিক্রিয়াশীল, এগুলোকে অনেক শতকেও প্রগতিশীল করা যায় নি; কেননা সমাজরাষ্ট্র যারা অধিকার ক’রে আছে, তাদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতাই আধিপত্য রক্ষার উপায়। কয়েক সহস্ৰক ধরে নারী ভবিষ্যৎইন, বিশশতকের শেষাংশেও নারী ভবিষ্য ৎইন। তার সামনে অনেক শতাব্দী, কিন্তু তার সামনে ভবিষ্যৎ নেই।

পৃথিবী জুড়ে আগের থেকে নারীর অবস্থা কিছুটা ভালো, অবশ্য খারাপও হয়েছে অনেক দেশে : ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ও কযেকটি মুসলমান রাষ্ট্রে দু-তিন দশক আগের থেকে অনেক শোচনীয় এখন নারীর অবস্থা। তবে অধিকাংশ দেশে আগের থেকে কিছুটা ভালো আছে নারী, কিন্তু বেশি ভালো নেই; এখন এমন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহাদেশে যে শিগগিরই নারীর অবস্থা হবে খুবই খারাপ। নারী এখন কয়েকটি মুসলমান দেশ ছাড়া এক ঘর থেকে বেরোতে, ভোট দিতে, শিক্ষা লাভ করতে, কিছু পেশায় জড়িত হতে পারে, এবং কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে। শোনা যায় পৃথিবীর খুব উন্নতি ঘটেছে, ঘাঁটি চলছে দ্রুত পরিবর্তন; কিন্তু ওই উন্নতি আর পরিবর্তন যতোটা কিংবদন্তি ততোটা বাস্তব নয়। গত আড়াই শো বছরের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীর ঘটেছে নানা বাহ্যিক পরিবর্তন; মানুষ চাঁদে গেছে, ঘরে বসে আজ সারা পৃথিবী দেখা যায়, টেস্টটিউবে উৎপাদিত হচ্ছে শিশু, কিন্তু নারীকে এখনোও রেখে দেয়া হয়েছে আদিম অবস্থায়ই। সংখ্যাধিক্যবশত পৃথিবী নারীদেরই গ্রহ, কিন্তু তারা রখনো এখানে পরবাসী, পুরুষের শোষণসামগ্ৰী। পুত্বপশ্চিমে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, পুরুষতন্ত্রের কাছ থেকে কিছুটা সুবিধা আদায় ক’বে নিয়েছে কিছু নারী, কিন্তু অধিকাংশ নারীর অবস্থা শোচনীয়। গত দুশো বছরে গৃহপালিত পশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি। কিছু নারী এখন বিখ্যাত, কিছু নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তিধর, কিন্তু তা নারীর অবস্থার সূচক নয়; বিখ্যাত ও শক্তিধর নারীরাও পুরুষাধীন, পুরুষশোষিত; কেননা পৃথিবী পুরুষতান্ত্রিক।

নারীপুরুষের বিশুদ্ধ সাম্য কোথাও এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি; নারী তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার পায় নি, যদিও তার অধিকার আন্দোলনের বয়স দুশো বছর। নারীর সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা ও বিধান তৈরি করছে এখনো পুরুষই, পুরুষই স্থির করছে কী মঙ্গলজনক নারীর জন্যে। শোষণমুক্তির জন্যে শোষিতরা এক সময় স্বপ্ন দেখেছে সমাজতন্ত্রের, কিন্তু সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাও নষ্ট ক’রে দিয়েছে; এবং যারা মনে করছে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলে দিতে না পারলে মুক্তি আসবে না। নারীর, তারা নারীমুক্তিকে সমর্পণ করছে অনিশ্চিত সময়ের হাতে। আসলে তারা চায় প্রথমে পুরুষের মুক্তি, পরে ভেবে দেখবে নারীর মুক্তি, সাম্য, অধিকার প্রভৃতির কথা। কবে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলাবে, তার জন্যে যদি অপেক্ষা করতে হয় নারীকে, তাহলে হয়তো নারী সম্পূর্ণ ভুলে যাবে নিজের মুক্তির কথা। নারীমুক্তিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না; সম্পূর্ণ সমাজসংগঠন বদলের অপেক্ষায়ও স্থগিত ক’রে রাখা যায় না। নারীর মুক্তি। আর সমাজসংগঠন বদলালেই যে মুক্তি পাবে নারী, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই; কেননা দেখা গেছে সামজতন্ত্রের মধ্যেও নারী পুরুষের সমান অধিকার পায় নি। তবে সব ধরনের সমাজতন্ত্রই নারীর জন্যে মঙ্গলজনক, যদিও তা-ই যথেষ্ট নয়; নারীমুক্তির জন্যে দরকার সমাজতন্ত্রাতিরিক্ত কিছু: এবং গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মধ্যেও অর্জন করা সম্ভব অনেক অধিকার। নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধু ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের মধ্যে, মৌলবাদ নারীর চরম শত্র। আড়াই শতকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো পৃথিবীর বাহ্যিক বদল ঘটিয়েছে, আভ্যন্তর বদল বিশেষ ঘটাতে পারে নি; মানব মন ও সমাজের আজো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি, মৌলিক বদল ঘটানো ওই আবিষ্কারগুলোর লক্ষ্যও নয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর থেকে আজো মানুষের ওপর বেশি প্রভাবশালী পুরোনো পুরুষাধিপত্যবাদী সংহিতাগুলো, বিজ্ঞানকে ওগুলোকে প্রতিরোধ করার কাজেও ব্যবহার করা হয় নি; বরং বিজ্ঞানকে নতজানু ক’রে রাখা হয়েছে ওই সব পুরোনো কুসংস্কারের কাছে। তাই আধুনিক পৃথিবীও যথেষ্ট আধুনিক নয়; এর ভেতরে আদিমতারই প্রাধান্য। নারী ওই আদিমতারই শিকার। বিজ্ঞান পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব জিনিশ, তাই ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষতন্ত্র ও বিশেষ একগোত্র পুরুষের স্বার্থে।

যে-সব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা, সেগুলো হচ্ছে পরিবার, বিয়ে, শিক্ষা, পেশা, রাজনীতি, ও ধর্ম। পিতৃতান্ত্রিক সব সংঘ আর ব্যবস্থাই নারীর বিরুদ্ধে। এগুলো প্রথাগত সমাজব্যবস্থা স্থায়ী ক’রে রাখার প্রয়াসে লিপ্ত। পুরুষাধিপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান পরিবার, বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র রাষ্ট্র কাজ ক’রে চলছে পরিবারের মধ্য দিয়ে, তাই পুরুষতন্ত্র খুবই ব্যাকুল পরিবারসংগঠন অপরিবর্তিত রাখার জন্যে। পরিবারে আজো প্রধান পুরুষ; সমাজ তাকে এ-প্রাধান্য দিয়েছে, এবং এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে রক্ষা পায় তার প্রাধান্য। পুরুষকে দিয়েছে আর্থনীতিক অধিকার; আজো পুরুষই সাধারণত আয় ও সংসার ভরণপোষণ করে, তাই পুরুষই আধিপত্য করে সংসারে। নারী পরিশ্রম করে পুরুষের থেকে অনেক বেশি, তার শ্রম পুরুষের শ্রমের থেকে অনেক বেশি ক্লান্তিকর, কিন্তু তা নিরর্থক। দরিদ্র নারীদেব শ্রমের শেষ নেই, সংসার সচল রাখার পেছনে তাদের শক্তি তারা পুরোপুরি নিয়োগ করে; কিন্তু তাদের সাংসারিক শ্রমের কোনো মূল্য নেই। পৃথিবী জুড়ে এখন প্রধান শ্রমিক শ্রেণী নারী, তারা উৎপাদন করে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক নূ্যনতম। বাঙলাদেশে এবার বৈদেশিক আয়ের প্রায় সবটাই উপার্জন করেছে নারীরা, বস্ত্ৰবালিকারা; কিন্তু তারা তার ভাগ পায় নি, পরিবারেও তাদের স্থান গৌণ, সমাজে তারা অসম্মানিত ৷ যে-বস্ত্ৰবালিকার আয়ে সংসার চলে, তার স্বামী বা পিতা হয়তো কোনো আয়ই করে না, কিন্তু সেই প্রাধান্য করে পরিবারে ও সমাজে। শিক্ষিত নারীদের বেলা একই ঘটনা ঘটে, তারা তাদের যোগ্যতাব থেকে আয় করে অনেক কম। তাদের, দরিদ্র নারীদের থেকেও, অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় স্বামীর আয়ের ওপর; এক নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হ’লে অধিকাংশ শিক্ষিত নারীই বস্তিজীবন কাটাতে বাধ্য হতো। শিক্ষা আজো নারীকে আর্থনীতিক স্বনির্ভরতা দেয় নি; কাজে আসে নি নারীমুক্তিতে।

এক শ্রেণীর শিক্ষিত নারীই সহযোগিতা ক’রে চলছে। পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা রক্ষায়; ওই নারীরা পরগাছা, তারা আজো সুখ পায় সুখকর ক্রীতদাসীত্বে। নারীর প্রধান শত্ৰু শিক্ষিত গৃহিণীরা, যারা শিক্ষিত কিন্তু শুধুই গৃহিণী। ওই নারীরা শুধুই মাংস, তারা পুরুয্যের প্রমোদসঙ্গিনী, স্বামীর প্রমোদবালা; তারা বেছে নিয়েছে অধীনতা। তারা অনেক বেশি অসহায় শ্রমিক নারীর থেকেও, শ্রমিক নারী যে-স্বাধীনতা ভোগ করে তারা তাও ভোগ করে না, এবং স্বামী তাদের ছেড়ে দিলে পথনারী হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তাদের থাকে না। তারা এটা জানে, তাই নিজেদের স্বার্থে সেবা ক’রে চলে পুরুষতন্ত্রের; তাবা সুবিধার বিনিময়ে বাতিল ক’রে দেয় নিজেদের সত্তা ও স্বাধীনতা। শুধু নিজেদের নয়, তারা শত্ৰুতা৷ ক’রে চলে স্বাধীন নারীর সাথে, নিজের স্বাধীনতা হারানোর পর অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট করা হয় তাদের কাজ। শিক্ষিত ধনী গৃহিণীরা যে-সচ্ছলতার মধ্যে থাকে শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা সাধারণত ততোটা সচ্ছলতায় থাকে না; তারা বিচিত্র বিলাসের মধ্যে থেকে উপহাস করে চলে কর্মজীবী শিক্ষিত নারীদের। তাদের কৃতিত্ব তারা ধনী স্বামী ধরতে পেরেছে। একটি শিক্ষিত নারী যখন দেখে সে কাজ করে, কিন্তু ওই বিলাস নেই তার জীবনে, তখন তার মনে এমন বোধ জন্ম নেয়া স্বাভাবিক যে শিক্ষিত না হয়ে বা পেশা গ্ৰহণ না করে একটি ধনী স্বামী ধরাই ছিলো অনেক ভালো। এ-বোধটা আরো প্রবল হয়ে উঠতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে;–কোনো বালিকা যখন দেখে তার মায়ের মতো পেশা গ্ৰহণ করে কষ্ট করার চেয়ে পাশের বাড়ির মহিলাটির মতো একটা ধনী স্বামী ধরলে জীবন অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, তখন সে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছে ছেড়ে দিতে পারে। এমন ঘটছে এখন বাঙলাদেশে। পরগাছারা এখন এতো আকর্ষণীয় যে অনেক বালিকাই নিজের শেকড় গভীরে ছড়ানোর অভিলাষ ছেড়ে দিয়ে সোনালি পরগাছা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পরগাছারা ওই বিলাস কেনে নিজেদের সত্তার বিনিময়ে, তারা সুস্বাদু মাংসের থেকে বেশি মূল্য পায় না।

বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্যে প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হ’তে বলে সুগৃহিণী ও সুমাতা, তার কাছে দাবি করে সতীত্ব ও পাতিব্ৰত্য! সমাজ পুরুষকে দেয় বাস্তব শর্ত, অর্থাৎ পুরুষের কাজ সংসার চালানো: নারীকে দেয় নৈতিক শর্ত, তাকে হতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতী। নারীর সুমাতা, সুগৃহিণীত্বকে ঐশী ভাবাদর্শে পরিণত করা হয়েছে নারীকে পুরুষাধীন রাখার জন্যে। মা হওয়ার অর্থ গর্ভধারণ, তবে সুমাতার অর্থ নারী গর্ভধারণ করবে: সমাজসম্মতভাবে, সমাজের জন্যে, নিজের জন্যে নয়; শঙ্ধারণ করবে নারী বিবাহিত হয়ে, বিবাহিত না হয়ে নারী সন্তান চাইতে পারবে না। এর অর্থ তার শরীর, তার জরায়ু তার নয়, তার মালিক পুরুষ ও পিতৃতন্ত্র। পুরুষ এসব বিধি প্রচার করেছে বিধাতার নামে, তবে এসব হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের সমাজ সংরক্ষণের বিধিনিষেধ। নারীর গৰ্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ! নারীকে কি চিরকালই ধারণ ক’রে যেতে হবে গর্ভ, পালন ক’রে যেতে হবে পশুর ভূমিকা? গৰ্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুরই মতো, দৃশ্য হিশেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এক দিন হয়তো গৰ্ভধারণ গণ্য হবে আদিম ব্যাপার ব’লে, মানুষ বেছে নেবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায়; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তার জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গৰ্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা থেলে আনন্দে তা গ্ৰহণ করবে; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই। এক সময় নিয়ত গর্ভিণী থাকাই ছিলো নারীর কাজ, এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয় নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গৰ্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ ব’লে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।

সুমাতার ভুল ধারণাও আজো প্রবল সমাজে। উনিশশতকে মনে করা হতো যে সুমাতার কাজ মহাপুরুষ জন্ম দেয়া ও লালনপালন করা। পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষেরা’ নারীর কাছে বারবাব সুমাতা দাবি করেছে, সমাজকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে নারী যদি তাদের সুমাতা দেয়, তবে তারা দেশকে উন্নতির চুড়োয় পৌঁছে দেবে। এর অর্থ নারী নষ্ট হযে গেছে, তার জবায়ুর অপরাধেই মহাপুরুষেরা সম্পন্ন করতে পারছে না দেশের উন্নতি; অর্থাৎ যে-অপরাধ তাদের, তারা তা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর। উনিশ শতক নারীর কাছে দাবি করে দলে দলে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন বিয়োনো; কিন্তু কারো পক্ষে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওয়াশিংটন বা আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ বা একটি একনায়ক জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। আর যে-মায়ের এ-ধরনের মহাপুরুষ জন্ম দিয়েছেন, তারা যে সুমাতা ছিলেন, তাও নয়। রবীন্দ্রনাথের মা তো রবীন্দ্রনাথকে লালনপালনই করেন নি, ওই মহাকবি পালিত হয়েছেন ভৃত্যদের দ্বারা। এটা প্রমাণ করে যে মহাপুরুষ লালনের জন্যে কোনো সুমাতা’ দরকার করে না; এবং কোনো মায়ের পক্ষে লালনপালন ক’রে মহাপুরুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। লালনপালনের ওপর মানুষের বিকাশ খুব নির্ভর করে না। সুমাতা বলতে সমাজ বোঝায় এমন মা, যে এমনভাবে চালাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, যার ফলে তার সন্তানরা মেনে নেবে সমাজের সমস্ত বিধিনিষেধ, এবং রোধ করবে সমাজের বিবর্তন। সুমাতার সন্তানরা পৃথিবীকে বদলায় না, তারা পৃথিবীকে অচল ক’রে রাখে। শিশু অবশ্যই মায়ের এবং পিতার কাছে থেকে স্নেহপ্ৰীতি ও অনেক কিছু পাবে, এটা তাদের অধিকার; কিন্তু প্রথাগত সুমাতা দরকার শুধু প্রথাগত সমাজ রক্ষার জন্যে।

প্রথাগত সমাজের আরেক রোগের নাম সুগৃহিণী। সুগৃহিণী হচ্ছে সে-নারী, যার জীবন নানা নিরর্থক কাজে ভারাক্রান্ত: যে একই কাজ বারবার করে, যার কাজ কখনো শেষ হয় না, যার জীবন হচ্ছে একই দিনের আমৃত্যু একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। এক সময় গৃহিণীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো সংসারের সমস্ত কাজ, এখন দরিদ্র নারীদের ওপরও ততোটা কাজের ভার নেই। সুগৃহিণীর সারাটি জীবনই অপব্যয়, এবং এক সময় তা হয়ে ওঠে। ক্লান্তিকর, নিঃসঙ্গ, নিজীব। এক বালিকার যদি বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সে, বাইশ বছর বয়সের মধ্যে সে যদি দুটি সন্তান প্রসব ক’রে মুক্তি নেয়। গৰ্ভধারণ থেকে, তাহলে চৌত্ৰিশ বছর বয়সে সে দেখবে তার সন্তান দুটি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, স্বামী ব্যস্ত উন্নতি ও অন্য নারী নিয়ে, শুধু তারই হাতে কোনো কাজে নেই। সে যদি আরো ত্ৰিশ বছর বাঁচে, তাহলে ওই ত্ৰিশ বছর তাকে কাটাতে হবে অসীম ক্লান্তির মধ্যে। তখন তার পক্ষে অসম্ভব মানসিক রোগগ্ৰস্ত না হওয়া। তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই, তার কোনো সত্তা নেই। এমনকি তার যৌন জীবনও তখন বিপন্ন। নারীকে ছেড়ে দিতে হবে গৃহিণীর ভাবমূর্তি যদি সে জীবনকে ক’বে তুলতে চায় তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে এ নয় যে সে স্বামীকে তালাক ও সন্তানদের ছেড়ে দিয়ে একলা জীবন শুরু করবে। এ-মুহূর্তেই জরুরি হচ্ছে নারীকে একটি পেশা নিতেই হবে, আর সে-পেশাটি কিছুতেই সংসার হবে না।

দরিদ্র দেশগুলো যেমন দরিদ্র, তেমনই প্রথাগত্ব। অধিকাংশ দেশে নারীর পেশা গ্রহণের সুযোগ নেই। বাঙলাদেশ এমন এক দেশ। শিক্ষিত নারীদেরই এখানে পেশা গ্রহণের সুযোগ কম, দরিদ্র নারীদের সুযোগ আরো অনেক কম; তবু এখানে দরিদ্র নারীরাই জীবিকার জন্যে পেশা গ্রহণ করে বেশি। তা গৃহপরিচারিকার পেশা হ’তে পারে, হতে পারে ছাইআলির পেশা, বা ইটভাঙানির, বা বস্ত্ৰবালিকার পেশা। কোনো পেশাই নারীর জন্যে অস্বাভাবিক নয;–পুরুষ যে-সব পেশা দখল ক’রে আছে, তার প্রতিটির জন্যেই নারী উপযুক্ত; এমনকি শারীরিক শ্রমের পেশায়ও। নারীর শারীরিক অশক্তি অনেকটা পুরুষতন্ত্রেরই সৃষ্টি: পুরুষ তার কাছে চেয়েছে অশক্তি, তাই নারী অশক্ত দুর্বল হওয়াকেই নিজের গুণ ব’লে মনে করেছে। নারীর পক্ষে হাল চাষ, মাছ ধরা, নীেকো বাওয়া কঠিন কাজ নয়; তবে নারী সাধারণত এসব করে না, কেননা সমাজ নারীকে তা করতে দেয় না! এক সময় নারীর জন্যে সমস্ত পেশাই নিষিদ্ধ ছিলো, আজ নিষিদ্ধ অধিকাংশ পেশা, যার ফলে রক্ষা পাচ্ছে পুরুষের প্রাধান্য। বাঙলায় নারীশিক্ষা এগিয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ব্যৰ্থ ক’রে দিতে কোনো আয়োজন বাকি রাখে নি। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বড়ো চক্রান্ত নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ করা নয়, সবচেয়ে বড়ো চক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষিত নারীকে নিষ্ক্রিয় ক’রে দিযে তাকে নিজের, পরিবার, ও সমাজের কাছে বোঝা ক’রে তোলা } এটা করা হয়েছে শিক্ষা ও পেশার থেকে বিয়েকে নারীর জন্যে প্রধান ক’রে রেখে। শিক্ষা যদি নারীকে আর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী করে, তখন বিয়ে হয়ে ওঠে। ঐচ্ছিক ব্যাপার; নারী তার শারীরিক বা মানসিক প্রয়োজনে বিয়ে করতে পারে, না : করতে পারে। করা না-করা তার নিজের পছন্দ; কিন্তু শিক্ষিত নারীকেও পুরুষের ওপর আর্থনীতিকভাবে নির্ভরশীল ক’রে ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া হয়েছে শিক্ষাকে; সফল ক’রে রাখা হয়েছে বিয়ে ও সংসারকে।

নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে এখন চলছে সুগভীর সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। বাঙালি মুসলমান সমাজে কয়েক দশকের নারীশিক্ষা নারীকে পরিণত করেছে। পুরুষের শিক্ষিত প্রমোদসহচরী, শিক্ষিত পরিচারিকায়, অর্থাৎ নারীশিক্ষা উপকারে এসেছে পুরুষের, নারীর নয়। এক সময় নারীশিক্ষার যে-যৌনাবেদন ছিলো, বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীলতার পর্বে নারীশিক্ষা সে-আবেদনও হারিয়ে ফেলছে; শিক্ষিত স্ত্রী আর তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। শিক্ষিত তরুণেরা এখন আকর্ষণ বোধ করছে অল্পশিক্ষিত কচি কিশোরীদের প্রতি, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত নারীর সাথে বসবাসের প্রাপ্তবয়স্কতা হারিয়ে ফেলছে তরুণেরা। এর ফলে নারীর প্রথাগত পেশাটি নষ্ট হচ্ছে, তার সংসারের সম্ভাবনা কমছে; আবার সে যে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন জীবন যাপন করবে, তার সুযোগও নেই। রাষ্ট্র পুরুষদেরই কোনো পেশা দিতে পারছে না, নারীকে কোনো পেশা দেয়ার কথা তার জন্যে দুঃস্বপ্ন। এর ফলে নারীর উচ্চশিক্ষা শুধু ব্যর্থই হচ্ছে না, তা পরিহাস ও পরিহারের বিষয় হয়ে উঠছে। প্ৰবেশিকা পাশের আগে থেকেই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ছে পিতামাতা, এমনকি প্রগতিশীলেরাও নিজেদের কন্যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগেই বিয়ে দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছেন। উচ্চশিক্ষিত নারীরা হয়ে উঠছেন সমাজের কৌতুক, করুণা, ও নিজের জন্যে বোঝা। এভাবেই চলছে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রিক-সামাজিক চক্রান্ত।

পিতৃতান্ত্রিক সতীত্বের ধারণা রখনো প্রবলভাবে রক্ষা ক’রে চলছে তার মধ্যযুগীয় চরিত্র। সব পিতৃতন্ত্রেই সতীত্ব নারীর জন্যে প্রথম বিধান, সতীত্বই নারীত্ব; কিন্তু পুরুষের জন্যে সততা বা কমনিষ্ঠা গৌণ ব্যাপার। পৃথিবী জুড়েই পুরুষের বিবাহপূর্ব ও

সাফল্যমণ্ডিত; খুব কম পুরুষই পাওয়া যাবে, যাদের বিবাহপূর্ব কামের অভিজ্ঞতা নেই, এবং বিবাহবহির্ভূত কামের সুযোগ নেয় নি। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ ক’রে প্রথাগত সমাজগুলোতে, নারীর বিবাহপূর্ব পুরুষসংসৰ্গ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিপজ্জনক। তাই নারীর কামতৃপ্তির একমাত্র পথ বিয়ে, যদিও বিয়েও পুরুষেরই কামতৃপ্তির জন্যে আয়োজিত হয়; নারীর তৃপ্তি ওপরিপাওনামাত্র, না পেলেও তা উদ্বেগের কারণ নয়। নারী বহু শতাব্দী ধ’রে প্রথাগত সতীর ভাবমূর্তি বহন ক’রে ক্লান্ত, প্রথাগত সতীর ধারণা তাকে মুক্ত হ’তে দিচ্ছে না, প্রথাগত সতীর ভাবমূর্তি নারীর জন্যে ক্ষতিকর। প্রথাগত সতী পুরুষের এমন দাসী, যার শরীরটিও তার নিজের নয়; একটি পুরুষের। প্রথাগত সতীর ধারণা চূড়ান্তে নিয়ে গিয়েছিলো হিন্দুরা, যারা নারীর দেহকে জন্মজন্মান্তর ধ’রে একটি পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলো, যার সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্যে ব্যবস্থা করেছিলো সতীদাহের। পশ্চিমে এখন প্রথাগত সতী নেই, কেউ চায়ও না; কিন্তু উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রগুলোতে সতীত্ব আজো ঐশী ব্যাপার। এ-পিতৃতন্ত্রগুলো দ্বৈত মান বজায় রাখার জন্যে ব্যস্ত; পুরুষের জন্যে এক নৈতিকতা, নারীর জন্যে আরেক নৈতিকতা এগুলোর আদর্শ। এ-অনৈতিক নৈতিকতার কবল থেকে নারী বাচতে পারে শুধু আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন হয়ে। সব অঞ্চলের নারীই, পুরুষের মতোই, নিজের শরীর উপভোগ পছন্দ করে; নারী জৈবিকভাবে একপুরুষতৃপ্ত নয়, যদিও পুরুষতন্ত্র এটা ভাবতে পছন্দ করে। একটি মাত্র পুরুষের সংসৰ্গকে নারী তার জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য মনে করে না; পুরুষের মতো নারীও বহু শরীরের সংসর্গ কামনা করে। বদ্ধ সমাজের নারী যখন মুক্ত সমাজে যায়, তার তখনকার যৌন আচরণ বুঝিয়ে দেয় যে সতীত্ব তার কাছে মূল্যবান নয়; শুধু সমাজের পীড়নেই সে সতীর ভূমিকায় অভিনয় করে। সতীত্ব অনেকটা অভিনয়। প্রথাগত সমাজগুলো নারীকে সতী ক’রে রেখেছে দুটি প্রক্রিয়ায়; দারিদ্র্য ও কঠিন বিধিনিষেধে। যেমন, বাঙলাদেশে নারী বাধ্যতামূলকভাবে সতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে দারিদ্র্যবশত, এটি সচ্ছল সমাজ হ’লে অনেক আগেই ভেঙে পড়তো ওই দেয়ালটি; আব্ব সৌদি আরবে নারী সতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে হিংস্ৰ বিধানের ফলে। সমাজ যদি কামসততা চায়, তবে চাইতে হবে নারীপুরুষ উভয়েরই জন্যে; শুধু নারীর জন্যে সতীত্বের বিধান হচ্ছে নারীপীড়ন।

মানুষের প্রধান শত্রু এখন মৌলবাদ, নারীরও প্রধান শক্ৰ এখন মৌলবাদ: তবে নারীর জন্যে মৌলবাদ অনেক বেশি মারাত্মক। সব ধরনের মৌলবাদেরই লক্ষ্য নারীকে আবার অবরোধে ঢুকিয়ে পুরুষের ভোগ্যবস্তু ও দাসী ক’রে তোলা। মৌলবাদীর কাছে নারীপুরুষের এলাকা ও ভূমিকা সম্পূর্ণ বিপরীত; মৌলবাদী বিশ্বাস করে না মুক্তি ও সাম্যে। নারী থাকবে গৃহে, অবরোধের মধ্যে, পালন করবে। ভোগ্যবস্তু ও গর্ভধারিণীর ভূমিকা, এ-ই মৌলবাদীর স্থির সিদ্ধান্ত। শিক্ষা নারীকে মুক্তি দেয় এ-ভূমিকা ও অবস্থান থেকে, যা মৌলবাদীর কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর; তাই মৌলবাদী প্রচণ্ড প্রতিপক্ষ নারীর শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, ও মুক্তির। মুসলমান দেশগুলোতে মৌলবাদীরা এখন শরিয়া আইন প্রবর্তনের জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, কারণ ওই আইনের সাহায্যেই তারা নারীকে চূড়ান্তরূপে পযুঁদিস্ত করতে পারবে। নারীকে আবার অন্ধ বোরখা পরানো হচ্ছে, বোরখায় জানোলা লাগানো হচ্ছে, সামান্য বিচূতির জন্যে নারীকে দেয়া হচ্ছে লোমহর্ষক শাস্তি: কিন্তু শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে পুরুষ। ইসলামে জিনা অবৈধ সঙ্গম নারীর জন্যে মারাত্মক অপরাধ। নারী এক জিনা করতে পারে না, কিন্তু এ-অপরাধের জন্যে দণ্ডিত হয় শুধু নারী। পুরুষটি সাধারণত মুক্তি পেয়ে যায়, কারণ সে নিজের শরীরে জিনার কোনো চিহ্ন রাখে না; কিন্তু নারীটি পায় কঠোর দণ্ড, কারণ নারী জিনার প্রমাণ অনেক সময় অবৈধ সন্তানরূপে ধারণ করে গর্ভে। পাকিস্তানে সাফিয়া বিবির ঘটনা মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের অন্ধ নির্বিবেক নারীপীড়নের এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ। সাফিয়া, আঠারো বছরের অন্ধ চাষীকন্যা, দাসীর কাজ করছিলো জমিদার বাড়িতে। তাকে প্রথম ধর্ষণ করে জমিদারপুত্র, তারপর জমিদার নিজেই। সফিয়া এর ফলে জন্ম দেয় এক অবৈধ সন্তান। সাফিয়ার বাবা তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে, কিন্তু শরিয়া আইনের বিধি অনুসারে পুরুষ দুটি মুক্তি পায়, ধরা পড়ে নারীটি তার গর্ভই প্রমাণ করে সে অপরাধী, সে ইসলামি আইন অমান্য করেছে। শরিয়া বিচারক ওই অন্ধ ধৰ্ষিত নারীটিকে ব্যভিচারের অপরাধে দণ্ডিত করে প্রকাশ্যে ১৫টি বেত্ৰাঘাত, ৩ বছর কারাদণ্ড, ও ১০০০ টাকা জরিমানায় মমতাজ ও শহীদ (১৯৮৯, ৫১-৫২)। এ হচ্ছে মৌলবাদীর শরিয়াপ্রয়োগ। ইরানে নারী এখন নৃশংস পুরুষতন্ত্রের শিকার; এক সময়ের মুক্ত ইরানি নারী এখন বোরখার ভেতরে ঢুকে প্রশংসা করতে পারে শুধু আল্লা, মেহেদি ও আয়াতুল্লার।

ইসলামে নারী ফিৎনা বা বিশৃঙ্খলা, যে তার কাম দিয়ে বিপর্যস্ত করে সমাজ, তাই তাকে অবরুদ্ধ ক’রে রাখতে হবে অবরোধে। ফাতিমা মেরনিসসির (১৯৭৫, ৩৪) মতে নারীপুরুষ সম্পর্ক ইসলামি সমাজে রয়েছে দুটি তত্ত্ব, একটি স্পষ্ট, আরেকটি অন্তর্নিহিত : স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ সক্রিয়, আক্রমণাত্মক; নারী অক্রিয়, মর্ষকামী; অন্তর্নিহিত তত্ত্বটি হচ্ছে নারীর কাম অসীম। অন্তর্নিহিত তত্ত্বটির চূড়ান্ত রূপ মেলে। গাজ্জালির ইহয়া উলুম আল-দিন বা ধর্মতত্ত্বের পুনরুজ্জীবন-এ। তাঁর মতে সভ্যতা নিরন্তর সংগ্ৰাম ক’রে চলছে নারীর সর্বগ্রাসী সর্বনাশী শক্তির সাথে তাই পুরুষ যাতে অবিচলিতভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্যে দরকার নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা। সমাজ টিকে থাকতে পারে এমন সব সংস্থা তৈরি করে, যেগুলোর কাজ নারীকে অবরুদ্ধ ও পুরুষের বহুবিবাহের ব্যবস্থা ক’রে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নারীপুরুষ সম্পর্কে ইসলামি স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ; পুরুষের প্রবণতা জয়লাভ ও আধিপত্য করা; নারীর প্রবণতা পরাভূত, অধীনস্থ হওয়া। ইসলামি মৌলবাদীর মধ্যে এ-দুটি বিশ্বাসই কাজ করে; সে নারীকে যেমন ভয় পায়, নারীর মুখোমুখি। যেমন অসহায় বোধ করে, তেমনই তাকে অবরুদ্ধ, পর্যুদস্ত ক’রে রাখতে চায়। শুধু ইসলামি মৌলবাদী নয়, সব মৌলবাদীর স্বপ্নই এক : নারীকে পর্যুদস্ত করা। হিন্দু মৌলবাদী নারীকে মনুসংহিতানুসারে আবদ্ধ ও দগ্ধ করতে চায়; খ্রিস্টান মৌলবাদী নারীর ওপর চাপাতে চায় মানুষের সমস্ত পাপের ভার।

বাঙলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে-বিস্তার ঘটছে, তা প্রগতির জন্যে উদ্বেগজনক, এবং নারীর জন্যে বিশেষভাবেই ভীতিকর। চারপাশে এখন কালো বোরাখার ভৌতিক প্রচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে, নারীদের এখন বেরোতে হয় আগের থেকে অনেক সাবধানে, নারী এখন আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে নিজের শরীর ঢেকে রাখতে বাধ্য হয়; এবং সবচেয়ে শোচনীয় হচ্ছে অনেক নারীও দীক্ষিত হচ্ছে মৌলবাদে। শ্বশুরবাড়ি হচ্ছে তরুণীদের জন্যে কারাগার, প্রতিক্রিয়াশীলতায় দীক্ষার মন্দির, যেখানে তাদের বাধ্য করা হয়। পুরুষাধিপত্য ও মধ্যযুগীয়তা মেনে নিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরখা প’রে যে-ছাত্রীরা আসে, তারা বিবাহিত বা জামাতের সদস্য;–এ-দুটির একটি, বা দুটিই; বোরখাপরা বিবাহিত ছাত্রীরা কেউ বিয়ের আগে বোরখা পরতো না, বিয়েই তাদের তুলে দেয় মধ্যযুগের হাতে। এতে তারা সবাই খুবই পীড়িত বোধ করে, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা বাধ্য হয় মধ্যয়ুগকে মেনে নিতে। কিছু কিছু মেয়ের জন্যে এটা এতো পীড়াদায়ক যে তারা আক্রান্ত হয় মানসিক রোগে। আধুনিক তরুণীর মুখের ওপর কালো বোরখা চাপিয়ে তাকে কেমন বিকৃত ক’রে দেয়া হয়, তার কিছু অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে, তার মধ্যে একটি কখনো ভুলবো না। কয়েক বছর আগে জাতীয় উদ্যানে বিভাগীয় বনভোজনে একটি ঝোপের মাঝে দুটি অত্যন্ত রূপসী আকর্ষণীয় প্রাণবন্ত তরুণী আমাকে ঘিরে ধরে। তারা জিজ্ঞোস করে, ‘আমাদের চিনলেন, স্যার?’ আমি তাদের চিনতে পারি নি। তখন তারা আরেকটুকু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, ‘যে-দুজনকে ক্লাশে আপনি বোরখাপরা দেখেছেন, যাদের মুখ কখনো দেখেন নি, আমরা সে-দুজন।’ আমি অত্যন্ত আহত বোধ করি এজন্যে যে এমন সুন্দর প্রাণবন্ত দুটি তরুণী বোরখাচাপা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে নিম্প্রাণ। তারা কেনো বোরখা পরে জানতে চাইলে তারা জানায়, কারণ হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি ও এক অধ্যাপক-চিকিৎসক চাচা। বনভোজনে ওই তরুণী দুটি ছিলো সবচেয়ে প্রাণবন্ত, তারা উদ্যানের নিসর্গের স্তরে স্তরে সেদিন প্রাণসঞ্চার করেছিলো, কিন্তু জীবনে তারা বোরখাচাপা পড়ে নিজেরাই থাকে নিম্প্রাণ। এ-ক-বছরে হয়তো তারা সম্পূর্ণ নিজীব হয়ে পড়েছে, বা শিকার হয়েছে মনোব্যাধির। এখন বোরখা বেড়ে চলছে, ষাটের দশকে বোরখা খুঁজে পাওয়া যেতো না কলাভবনে, এখন কলাভবনের বারান্দায় চলে অন্ধ বোরখার মিছিল।

মুসলমান পিতৃতন্ত্র একটি কথার ব্যাপক প্রচার দিয়েছে যে সপ্তম শতক থেকে ইসলামই নারীকে মুক্তি দিয়েছে; নারীকে দিয়েছে সামাজিক অধিকার। পাকিস্তানপর্ব থেকে এ-প্রচারটি ধ্রুবপদের মতো উচ্চারিত হতে থাকে, এ-অঞ্চলে; নারীরাও এতে বিশ্বাস করে, এবং কী অধিকার দিয়েছে, সে-সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না ক’রে তারাও এটা আবৃত্তি করে। কোনো ধর্মই নারীকে প্রকৃত অধিকার দেয় নি, ইসলামও দেয় নি; চোদো। শো বছর ধ’রে নারীর অধিকার যতোটা বুলি ততোটা বাস্তব সত্য নয় [দ্র ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’]। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারীর অবস্থা দেখলেই তা বোঝা যায়। ইসলামের আগে আরবে নারীর অবস্থা যতোটা খারাপ ছিলো বলে প্রচারিত, ততোটা খারাপ ছিলো না; ঐতিহাসিকদের মতে নারী অনেক বেশি স্বাধীন ছিলো অন্ধকার যুগের আরবে [দ্র ফাতিমা (১৯৭৫, ৬৪-৭৩)]। বাঙলাদেশে কিছু শিক্ষিত নারীও না বুঝে, বা কপটতাবশত, বা নিজেদের সুবিধার জন্যে চোদো শো বছর ধরে নারীর অধিকার ও ধর্মের জয়গানে এমন মুখর হয় যে সমগ্র পরিবেশ অতিপ্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। টেলিভিশনে পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞায় এবং কিছুটা লোভে যে-নারী ধর্মের গাথা প্রচার করে, সে জানে না। অন্যদের আত্মত্যাগের ফলে সে ধর্মের অনেক কঠোর বিধি অমান্য করতে পেরেছে ব’লেই টেলিভিশনে যেতে পেরেছে; যদি তার প্রশংসিত ধর্মের সব বিধি তার ওপর আবার চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাকে অবরুদ্ধ থাকতে হবে অন্ধকারে। মৌলবাদ যেদিন সমস্ত প্ৰগতিশীলতাকে ধ্বংস ক’রে, সেদিন কখনো না। আসুক, তাকে মানতে বাধ্য করাবে সমস্ত বিধান, সেদিন সে শুধু টেলিভিশন নয়, অন্য কোথাও কোনো কথা বলার অধিকার পাবে না। সে জানে না ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যে সে কাজ ক’রে চলছে নিজের, ও নারীমণ্ডলির বিরুদ্ধে।

রাজনীতি সবখানেই আজো পুরুষতান্ত্রিক; মৌলবাদী রাজনীতি উগ্র পুরুষাধিপত্যবাদী; আর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রও আজো পুরুষের কবল থেকে মুক্তি পায় নি। চিরকালই নারী থেকেছে রাজনীতিক ক্ষমতার বাইরে; ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন নারীর নাম মেলে, যারা রাজ্য শাসন করেছেন; তবে তারা এতো মুষ্টিমেয় যে পরিণত হয়েছেন কপকথায়। শাসক ও শাসিতদের মাঝামাঝি চিরকাল থেকেছে একদল মধ্যস্থতাকারী, তাদের অধিকাংশ সরকারি আমলা, এবং কিছু থাকে অসরকারি ব্যক্তি, যারা ব্যক্তিগত সম্পর্কবশত প্রভাব বিস্তার করে শাসকদের ওপর। ব্যক্তিগত সম্পর্কবশত শাসকদের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপদেষ্টাদের মধ্যে নারীই বেশি; তারা রানী, স্ত্রী, রক্ষিতা হিশেবে শাসকদের প্রভাবিত করেছে, আজো করে। তবে রানী, ও স্ত্রীদের থেকে রক্ষিতারা শাসকদের প্রভাবিত করেছে অনেক বেশি, কেননা রানী ও স্ত্রীদের থেকে রক্ষিতারাই বেশি প্ৰিয় শাসকদের। পুরুষতন্ত্র ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে, কারণ এটা রক্ষিতার কাজ; পুরুষ নারীকে রক্ষিতা হিশেবেই দেখতে পছন্দ করে, সরাসরি শাসক হিশেবে দেখতে পছন্দ করে না। শাসকদের উপদেষ্টার ভূমিকায় নারী এসেছে রক্ষিতারূপে; তাই নারীশাসকেরা উপদেষ্টা হিশেবে নারী নেয় না, তাদের উপদেষ্টামণ্ডলিতে সাধারণত নিয়োগ করে পুরুষই। আধুনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর শুধু রাজা নয়, দেখা দিয়েছে বিচিত্র ধরনের শাসক, যারা বাজনীতিক, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, আমলা ও আরো নানা ভূমিকায় ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু এটা হয়ে থাকে পুরুষের অধিকার, নারীর নয়। বিশশতকের দ্বিতীয় দশকের আগে পশ্চিমের সর্বজনীন মানবাধিকারবাদীরাও নারীদের কোনো রাজনীতিক অধিকার দেয়। নি; এমনকি দেয় নি প্ৰায়-নিরর্থক ভোটাধিকারও। আজো, নব্বইয়ের দশকেও, নারীর বিরুদ্ধে রাজনীতিক বৈষম্যের অভাব নেই; নারী আজো রাজনীতিতে অনভিপ্ৰেত, যদিও পুরুষতন্ত্র নিজের সুবিধার জন্যে তাকে কাজে লাগায,। পুরোনো কুসংস্কার আজো এতো প্রবল যে নারী আজো রাজনীতিতে প্ৰবেশাধিকারহীন; অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নারীর রাজনীতিক অধিকার সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ। আরব আমিরাত, ইয়েমেন, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরব প্রভৃতি মুসলমান রাষ্ট্রে নারীকে রাখা হয়েছে রাজনীতির বাইরে; তারা ভোটও দিতে পারে না, অবশ্য অনেক দেশে ভোট দেয়ার ব্যাপারই নেই।

এখন অধিকাংশ দেশে নারী ভোট দিতে পারে, তবে এর মানে নয় যে নারী তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে স্বাধীনভাবে। অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও নারী ভোট দেয় না, বা দিতে পারে না, বা দেয় পুরুষ অভিভাবকের নির্দেশমতো। নারী এখন অধিকাংশ দেশে ভোট দিতে পারে, তার রাজনীতিক অধিকারও রয়েছে, কিন্তু সে-তুলনায় তাদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত তুচ্ছ। আজো নারী রাজনীতিক রূপকথা বা রাজনীতিতে উৎকট দৃশ্য। এখন পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ দেশে রাজনীতিক পদে অধিষ্ঠিত নারীর সংখ্যা শোচনীয়রূপে স্বল্প। অধিকাংশ দেশে সংসদে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা খুবই কম; কোনো কোনো দেশে-যেমন বাঙলাদেশ, পাকিস্তান, ঘানায়-সংসদে নারীদের জন্যে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। এ-বোধ থেকে যে নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য। সংরক্ষিত নারী আসনগুলো নারীমুক্তির পক্ষে নয়, বিরুদ্ধে; এর ফলে দেখা দেয় এমন সুবিধাবাদী নারী, যারা শুধু ক্ষমতাশালীদের অনুগত থাকার ফলেই ওই আসন লাভ করে। তাদের কোনো রাজনীতিক যোগ্যতা থাকে না, তারা হয়ে থাকে সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী, পুরুষ রাজনীতিকদের মতোই দুশ্চরিত্র: তারা নারীদের যোগ্যতা অর্জনের বদলে শুধু শক্তিশালীদের অনুগত, এমনকি রক্ষিতা, হাতে শেখায়। গত কয়েক দশকে কয়েকটি দেশে নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে : শ্ৰীলঙ্কায় শ্ৰীমাভো বন্দরনায়েকে, ইসরাইলে গোল্ড মেয়ার, ভারতে ইন্দিরা গান্ধি, আর্জেন্টিনায় ইসাবেলা পেরন, যুক্তরাজ্যে মাৰ্গারেট থ্যাচার, ফিলিপিনসে কোরাজান অ্যাকিনো, পাকিস্তানে বেনজির ভট্টো, বাঙলাদেশে খালেদা জিয়া অধিকার করেছেন সর্বোচ্চ রাজনীতিক ক্ষমতা। কিন্তু তারা, গোল্ড মেয়ার ও মার্গারেট থ্যাচার বাদে, সবাই ক্ষমতায় এসেছেন কোনো মৃত বা নিহত পুরুষের উত্তরাধিকারী ও পুরুষতন্ত্রের পুতুল রূপে। কেউ কেউ অবশ্য পুতুল হয়ে থাকেন নি; যেমন ইন্দিরা গান্ধি। তারা যতোটা রূপকথা ততোটা বাস্তব নন; তারা অনেকাংশে নারীর জন্যে পুরুঘের থেকেও ক্ষতিকর। পুরুষতন্ত্রের কোনো পীড়িত পক্ষ যখন পুরুষতন্ত্রের অন্য কোনো হিংস্র পক্ষের দ্বারা পর্যুদস্ত হতে থাকে, তখন তারা ব্যবহার করে এমন কোনো নারীকে যে সম্পর্কিত কোনো কিংবদন্তিতুল্য পুরুষের সাথে। এভাবেই উদ্ভব ঘটেছে শ্ৰীমাভো, ইন্দিরা, ইসাবেলা, কোরাজান, বেনজির, খালেদার। এসব দেশে নারীর অবস্থা খুবই শোচনীয়, কিন্তু শবপুজোবাদী রাজনীতির ফলে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাই তারা নারীমুক্তির উদাহরণ নন, সম্ভাবনাও নন। রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক, রাজনীতিতে শক্তিশালী নারীরাও পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; তাই তারা নারীদের উপকারে আসছেন না। নারীকে নিজের স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্যে বিশ্বাস করতে ও সক্রিয় হ’তে হবে প্ৰগতিশীল রাজনীতিতে, নারীবাদী রাজনীতিতে। পুরুষদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা সুবিধাজনক ব্যাপার, নারীর জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।

নিজের ভবিষ্যতের জন্যে নারীকে ত্যাগ করতে হবে পিতৃ-ও পুরুষ-তন্ত্রের সমস্ত শিক্ষা ও দীক্ষা; ছেড়ে দিতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতীর ধারণা; তাকে আয়ত্ত করতে হবে শিক্ষা, এবং গ্রহণ করতে হবে পেশা। তাকে হ’তে হবে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত; তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে লড়াইয়ের জন্যে। তাকে কান ফিরিয়ে নিতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত মধুর বচন থেকে, তাকে বর্জন করতে হবে পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীত্ব। তাকে সাবধান থাকতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত মহাপুরুষ সম্বন্ধে, সন্দেহের চোখে দেখতে হবে সবাইকে, কেননা কেউ তার মুক্তি চায় নি। তাকে মনে রাখতে হবে সে মানুষ, নারী নয়; নারী তার লৈঙ্গিক পরিচয় মাত্ৰ; মনে রাখতে হবে পুরুষের সাথে তার পার্থক্য মাত্র একটি ক্রোমোসোমের, এবং একটি ক্রোমোসোমের জন্যে একজন প্ৰভু ও আরেকজন পরিচারিকা হয়ে উঠতে পারে না। নারীকে ঘৃণা করতে শিখতে হবে সম্ভোগের সামগ্ৰী হ’তে, এবং হতে হবে সক্রিয়, আক্রমণাত্মক। নিজের ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে নিজেকেই, পুরুষ তাঁর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে না। নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।
 
নারীবাদ, ও নারীবাদের কালপঞ্জী


নারীপুরুষ সমান, তাদের অধিকার অভিন্ন : এ হচ্ছে নারীবাদ। একে মনে হয় সরল, দিবালোকের মতো স্বচ্ছ, সত্য বলে; কিন্তু পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে মানা হয় নি এ-সরল সত্যটুকু। নারীবাদীরা মনে করেন মৌল যোগ্যতায় কোনো পার্থক্য নেই নরনারীতে; নারী ও পুরুষের মূল পরিচয় তাদের স্ত্রী বা পুংলিঙ্গ নয়, তাদের মূল পরিচয় তারা মানুষ। মানুষের প্রকৃতি ও যোগ্যতা লিঙ্গনিরপেক্ষ । কিন্তু পিতৃতন্ত্র এটা মানে নি। নারীবাদীদের বিদ্রোহ নারীপুরুষের আসাম্যের ধারণা ও অসম অধিকারের বিরুদ্ধে; তারা মনে করেন প্রথাগতভাবে নারীপুরুষকে যে মনে করা হয় অসম ব’লে, এবং নারীদের যে রেখে দেয়া হয়েছে নিকৃষ্ট সামাজিক অবস্থানে, তা অন্যায়। তাঁরা সবাই মনে করেন পরিবর্তন ঘটাতে হবে এ-ব্যবস্থার, তবে কী পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সে-সম্পর্কে তারা পোষণ করেন নানা মত। নারীমুক্তির জন্যে কী কৌশল নিতে হবে, সে-সম্পর্কেই শুধু তাঁরা ভিন্ন মত পোষণ করেন না; তাঁদের ভিন্নতা আরো গভীর স্তরের। নারীর প্রকৃত স্বাৰ্থ কী, কী হ’লে প্রকৃতই মুক্তি ঘটবে নারীর, এ-সম্পর্কে বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক পোষেণ বিভিন্ন মত। নারীবাদে চােখে পড়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্বদর্শ, প্রতিটিই বিশ্বাস করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে দরকার নারীর স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে সাম্য; কিন্তু বিভিন্ন মৌল বিষয়ে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা ভিন্নতা। প্রকৃত স্বাধীনতা ও সাম্য কী, মানুষ বা নারীর প্রকৃত স্বভাব বা প্রকৃতি কী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী হবে, এসব বিষয়ে তাঁদের মধ্যে রয়েছে দার্শনিক ভিন্নতা। নারীমুক্তি সম্পর্কে কয়েকটি তত্ত্বাদর্শ রয়েছে; এগুলো হচ্ছে ‘রক্ষণশীল মতবাদ’, ‘উদার (মানবতাবাদী) বা ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ’, ‘আমূল নারীবাদ’। রক্ষণশীল মতবাদটি নারীর মুক্তিবিরোধী, এটি ছাড়া অন্যগুলো বিশ্বাস করে নারীমুক্তিতে।

রক্ষণশীল মতবাদ ; এটি নারীমুক্তির বিরোধী, এটি পােষে প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস যে নারী যেভাবে যে-অবস্থানে আছে, তাই ঠিক । নারীবাদের লড়াই এ-মতবাদের বিরুদ্ধেই। এ-মতবাদ মেলে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে : ধৰ্মগ্রন্থ, আইন, দর্শন সবখানেই এ-মতবাদ ছড়িয়ে আছে। এ-মতবাদ অনুসারে নারীরা যে-অসাম্য ভোগ করছে, তা অন্যায় ন্যায়; এই চিরন্তন শাশ্বত । রক্ষণশীলদের মতে কোনো কোনো নারী পোহায় নানা দুর্ভোগ, তবে সমাজ নারীদের সুপরিকল্পিতভাবে পীড়ন করে না। রক্ষণশীলেরা মনে করেন নারীর যে-অবস্থা, তা প্রকৃতিনির্ধারিত, বা বিধাতার নির্দিষ্ট: প্রকৃতি বা বিধাতাই ঠিক ক’রে দিয়েছে যে নারীপুরুষ অসম; পুরুষ প্ৰভুত্ব করবে, নারী থাকবে তার অনুগত। এটা কোনো অন্যায় নয়, এটা ধ্রুব বিধান। রক্ষণশীলদের মধ্যে যাবা এতোটা বর্বর নন, তারা একই কথা একটু মধুর ক’রে বলেন। তাদের মতে, নারীপুরুষ কেউ অসম নয়, তাদের কারো ভূমিকা কম মূল্যবান নয়; তাদের উভয়ের ভূমিকাই সমান মূল্যবান, তবে তাদের ভূমিকা ভিন্ন। তারা সমান, তবে পরস্পরের পরিপূরক। রক্ষণশীলেরা মনে করেন নারী ও পুরুষের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ঠিক মতো পালন করাই তাদের সার্থকতা। তাঁরা শুধু নারীপুরুষের ভিন্নতা ও ভিন্ন ভূমিকায়ই বিশ্বাস করে না, তাঁরা মনে করেন সমাজরাষ্ট্রে বিধিবিধান প্রবর্তন ক’রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ভিন্নতা। তাঁরা বিশ্বাস করেন নারীপুরুষের সহজাত ভিন্নতায়, ও অসাম্যে; পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে, নারীর নিকৃষ্টতায়। তাঁরা মনে করেন নারীপুরুষ একই কাজের উপযুক্ত নয়, নারী উপযুক্ত নিকৃষ্ট কাজের, তাই সেগুলোই পালন করবে নারী। তাদের চোখে এটা অন্যায় তো নয়ই, বরং এটাই ন্যায়সঙ্গত; কেননা নিকৃষ্টকে নিকৃষ্টরূপেই রাখাই ন্যায়।

উদার (মানবতাবাদী) বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ; এ-মতবাদের উদ্ভব ঘটে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিডিকেশন অফ দি রাইটস্ অফ ওম্যান-এ (১৭৯২), এবং পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে জন স্টুয়ার্ট মিলের দি সাবজেকশন অফ উইমেন-এ (১৮৬৯)। এ-মতবাদটিই এখনো প্রধান নারীবাদী ধারা, কেননা পশ্চিমের গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের সাথে এটি বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। এ-মতবাদের লক্ষ্য বিভিন্ন বিধান প্রণয়ন করে সামাজিক রাষ্ট্রকভাবে নারীর অবস্থান উন্নত করা। গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার; তাই এ-মতবাদের মূলকথা হচ্ছে পুরুষ যেমন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, স্থির করে নিজের ভূমিকা, নারীকেও তেমনই দিতে হবে সমাজে প্রতিষ্ঠার ও নিজের ভূমিকা স্থির করার অধিকার। উনিশ শতকে এদের লক্ষ্য ছিলো ভোটাধিকার পাওয়া, কিন্তু তা পাওয়া সত্ত্বেও নারী আজো অনেক অধিকার পায় নি; কেননা রয়ে গেছে নানা আইন ও প্রথাগত বাধা। এসব বাধার ফলে নারী রাজনীতি, ব্যবসা, সামরিক ও অন্যান্য পেশায় সফল হতে পারছে না। উদার নারীবাদীদের দাবি হচ্ছে আইন ক’রে দূর করতে হবে এ-সমস্ত বাধা, প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমান নাগরিক অধিকার। এ-মতবাদের বক্তব্য হচ্ছে কোনো ভূমিকায় প্রতিষ্ঠার জন্যে বিবেচনা করতে হবে শুধু ব্যক্তিকে, ব্যক্তির যোগ্যতাকে, আর কিছু নয়। প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণের কোনো মূল্য নেই; তাই বিচার করতে হবে শুধু ব্যক্তিটিকে। উদার নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে ব্যক্তিগত ব্যাপারে রাষ্ট্র যতো কম হাত দেয়, ততোই ভালো; তাই রাষ্ট্রের নারীর ওপর অভিভাবকত্বের কোনো দরকার নেই। নারীকে আগে থেকেই বিশেষ কোনো ভূমিকায় আটকে ফেলা অন্যায়; নারী সব ভূমিকায় নিজেকে পরখ ক’রে একদিন নিজেই দেখবে সে কোন ভূমিকার উপযুক্ত।

উদার নারীবাদে সাম্য হচ্ছে প্রতিটি নারী ও পুরুষের নিজের ইচ্ছে ও শক্তি অনুসারে নিজের ভূমিকা বেছে নেয়ার অধিকার; স্বাধীনতা হচ্ছে নারীর নিজের ইচ্ছেমতো ভূমিকা অর্জনের পথে কোনো বাধা না থাকা। তবে এ-বিষয়ে পুরোনো ও আধুনিক উদার নারীবাদীদের মধ্যে মতের ভিন্নতা রয়েছে। আধুনিকদের মতে, আইন নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টি করতে তো পারবেই না, তার সাথে এমন আইন তৈরি করতে হবে যে সব রকম বৈষম্য অবৈধ। অসম বেতনহার নিষিদ্ধ করতে হবে, যে-সমস্ত পেশায় নারীবিরোধী আইন রয়েছে, সেগুলো অবৈধ করতে হবে, বিশেষ বিশেষ পেশায় নারী নিয়োগ না করে পুরুষ নিয়োগের যে-রীতি রয়েছে, তা নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে বাতিল করতে হবে নারীর স্বার্থবিরোধী সমস্ত আইন। আধুনিক উদার নারীবাদীরা অনেক ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে বৈষম্য সৃষ্টির পক্ষপাতী। তাঁরা দাবি করেন, এতো দিনের বৈষম্য দূর করার জন্যে, এখন অনেক পেশায় পুরুষ না নিয়ে নিতে হবে নারী, এবং বাইরের কাজে অক্ষম নারীদের দিতে হবে বিশেষ ভাতা। যেমন : নারীদের দিতে হবে প্রসব ছুটি ও ভাতা। এটা দয়া নয়, তার প্রাপ্য; কেননা সন্তান জন্ম দেয়া একটি সমাজ সেবা। তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতবিরোধী আইনেরও বিরোধী, কেননা এগুলো ক্ষুন্ন করে নারীর অধিকার। শিশুপালনের ব্যাপরটিকে তারা দেন বিশেষ গুরুত্ব। তারা মনে করেন শিশুপালন শুধু নারীর কাজ নয়, তা পুরুষেরও কাজ; তাই পুরুষকেও তাতে অংশ নিতে হবে। তারা এও মনে করেন। যতোদিন পুরুষের জন্যে সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, ততোদিন তা বাধ্যতামূলক করতে হবে নারীর জন্যেও। নারীপুরুষের কোনো বৈষম্যকে তারা প্রাকৃতিক ব’লে মনে করেন না, মনে করেন সমাজের সৃষ্টি, এবং শিক্ষা আরো বাড়িয়েছে ওই বৈষম্য। তাই নারীপুরুষকে দিতে হবে একই শিক্ষা, যাতে তারা তাদের শক্তি ও সম্ভাবনা যাচাই করতে পারে। উদার নারীবাদীদের কাছে নারীস্বাধীনতা হচ্ছে নারীর সামাজিক ভূমিকা নিজে স্থির করার, এবং পুরুষের সাথে সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে। এ-প্রতিদ্বন্দূিতা যাতে সুষ্ঠুভাবে ঘটতে পারে, তার ব্যবস্থা কর। তারা মনে করেন না যে নারীমুক্তির জন্যে বদলে দিতে হবে সমগ্র সমাজসংগঠন; এও মনে করেন না যে সব নারী একই সময়ে লাভ করবে: মুক্তি। তাঁরা মনে করেন সবাই মুক্তি পাওয়ার অনেক আগেই কোনো কোনো নারী মুক্তি পেতে পারে। তারা মনে করেন নারীমুক্তি শুধু নারীরই মুক্তি ঘটাবে না, ঘটাবে পুরুষেরও মুক্তি; এতে পুরুষের কিছু অবৈধ সুবিধা কমলেও পুরুষ মুক্তি পাবে সংসারের ভরণপোষণ ও দেশরক্ষার দায়িত্ব থেকে।



মার্ক্সীয় নারীবাদ : মার্ক্সীয় মতবাদ অনুসারে নারীশোষণ, ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানে, ব্যক্ৰিমালিকানার ফল; তাই নারীকে মুক্ত করা সম্ভব শুধু ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত ক’রে। মার্ক্সীয়দের মতে নারীমুক্তি-আন্দোলন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক সংগ্রামের একটি অংশ। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার অনেক কারণ রয়েছে, নারীবাদ ওই কারণগুলোর একটি। তাদের মতে নারী ও শ্রমিকের স্বাৰ্থ একই, কেননা নারী ও শ্রমিক একই রকমে শোষিত। মার্ক্সীয় নারীবাদের উদ্ভব ঘটে এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) সন্দর্ভে। মার্ক্সবাদ অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অধিকাংশ মানুষই শোষিত, কেননা উৎপাদনের উপকরণগুলো কিছু মানুষের অধিকারে। তারা উপকরণের জোরে আধিপত্য করে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ওপর, যারা বেঁচে থাকার জন্যে শস্তায় বেচে দিতে বাধ্য হয় তাদের শ্রমশক্তি। নারীও এ-শোষণের শিকার। মাস্ত্রীয়রা স্বীকার করেন যে নারী শিকার হয় আরো বিশেষ কিছু শোষণের, পুরুষ যা থেকে থাকে মুক্ত; তবে শোষণেঝ মূল রয়েছে পুঁজিবাদে, তাই পুঁজিবাদ উৎখাত নারীর জন্যে আরো বেশি জরুরি। মার্ক্সবাদ অনুসারে নারী বিশেষভাবে শোষিত হয় প্রথাগত পরিবারের জন্যে : নারী হচ্ছে পারিবারিক দাসী, সে বাইরের কোনো উৎপাদনমুখি কাজে অংশ নিতে পারে না। একপতিপত্নী বিয়ে উদ্ভাবনই করা হয়েছিলো কতিপয়ের মুঠোতে ধন জড়ো করার উদ্দেশ্যে; ওই কতিপয় পুরুষ। তাদের মতে পরিবার গঠিত হয়েছিলো শ্রেণীভিভক্ত সমাজে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে। পুরুষই পরিবারে সার্বভীেম। এঙ্গেলসের (১৮৮৪, ২২৯) মতে, একপতিপত্নী বিয়েনির্ভর ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ভিত্তির উপব দাড়িয়ে আছে।’ তবে এ-বিয়ে নামে মাত্র একপতিপত্নী বিয়ে; এতে নারীকেই থাকতে হয় সতী, কিন্তু পুরুষের কাছে যৌনসততা চাওয়া হয় না।

মার্ক্সীয়রা বলেন না যে নারীশোষণ পুঁজিবাদের সৃষ্টি; তবে তাদের মতে পুঁজিবাদ নারীশোষণ বহুগুণে বাড়িয়েছে, এবং নারীকে অবনতির শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। তাদের মতে পুঁজিবাদ। আর পুরুষাধিপত্য অবিচ্ছেদ্য, একটি শক্তিশালী করে আরেকটিকে। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৯, ২৩০) বলেছেন, ‘সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্ত্রী-ই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি’, এবং ‘সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে গোটা স্ত্রীজাতিকে আবার নিয়ে আসাই হচ্ছে তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত।’ তখন নারী আর স্বামীর ওপর ভরণপোষণের জন্যে নির্ভর করবে না, নারী স্বাধীন হবে। তবে এর জন্যে দরকার সমাজের মৌলিক রূপান্তর। নারী আজ যে-সকল কাজ করে-ঘরকন্না, শিশুপালন সব কিছুকে নিয়ে আসতে হবে সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে। তাঁরা মনে করেন নারীমুক্তির জন্যে দরকার পরিবার সংগঠনটির মৌলিক পরিবর্তন। এর জন্যে পরিবারের আর্থিক কাজগুলো পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে; রাষ্ট্রই বহন করবে পরিবারের ভার। পুঁজিবাদ। এ-ভার নেবে না; এ-ভার নিতে পারে শুধু সাম্যবাদ। তাই শুধু সাম্যবাদের মধ্যেই নারী পেতে পারে প্রকৃত মুক্তি; সেখানে আর পরিবারের মধ্যে স্বামীটি থাকবে না বুর্জেয়া, আর স্ত্রীটি প্রলেতারিয়েত। সাম্যবাদে ধ্বংস হয়ে যাবে ‘আর্থ একক রূপে বিরাজমান একপতিপত্নীক পরিবার, তবে তা টিকে থাকবে ‘সামাজিক একক’ রূপে। সাম্যবাদেও বিয়ে থাকবে, তবে তা এখনকার মতো আর্থ চুক্তি থাকবে না; তখনও পরিবার থাকবে, তবে তা গড়ে উঠবে নারীপুরুষের পরস্পরিক আকর্ষণে। তখন নারী ও পুরুষ হবে প্রকৃতই মুক্ত।



আমূল নারীবাদ : আমূল নারীবাদ নারীপীড়নের সমস্ত দিক ব্যাখ্যা করে একটি মূল ধারণা দিয়ে, সেটি হচ্ছে লৈঙ্গিক পীড়ন। উদার নারীবাদীরা মনে করেন নারীর সমস্যা বাজনীতিক সামাজিক অধিকারহীনতা, কিন্তু আমূল নারীবাদীরা তা মনে করেন না; মার্ক্সীয়দের মতো তারা মনে করেন না যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজই নারীর দুরবস্থার মূলে। তাঁরা মনে করেন নারীর দুরবস্থার মূল কারণ জৈবিক; গৰ্ভধারণ করতে গিয়েই নারী মেনে নিতে বাধ্য হয়। পুরুষের অধীনতা। তাদের মতে পরিবারের উৎপত্তি ঘটেছে জৈবিক কারণে, পরিবার একটি জৈবসংগঠন। তারা মনে করেন। ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে আদি ও মৌলিক পীড়ন হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক শারীরিকভাবে নারীকে নিজের অধীনে নিয়ে আসা। তারা যেনো মনে করেন যে দেহই নারীর নিয়তি, তবে নারীকে মুক্তি পেতে হবে এ-নিয়তি থেকে। তারা মনে করেন জৈবপরিবারে যে-শক্তির সম্পর্ক দেখা দেয়, তাই শক্তির মৌল কাঠামো; তাদের মতে জৈবপরিবারই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মূলে। তাদের মতে পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গীেণ ব্যাপার, মূল লড়াই হচ্ছে লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। আমূল নারীবাদী ভাবনার উন্মেষ বোভোয়ার, মিলেট, গ্রিয়ার ও আরো অনেকের মধ্যে দেখা যায়, তবে তা প্রবল রূপ পায় টাই-গ্রেস অ্যাটকিনসন ও শুলামিথ ফায়ারস্টোনের লেখায়। তাদের মতে নারী-অধীনতা মূলত জৈবিক, তাই নারীমুক্তির জন্যে দরকার জৈবিক বিপ্লব। তারা মনে করেন মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম প্রযুক্তিবিদ্যার এমন উন্নতি হয়েছে যে তার সাহায্যে নারীকে মুক্ত করা সম্ভব সন্তানধারণ ও পালনের মৌলিক অসাম্য থেকে। তারা মনে করেন গর্ভধারণ নারীর জন্যে অবধারিত নয়, মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়। যদি মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হয়, তবে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে পুরুষকেও। নারী আর গর্ভধারণ করবে না, শিশুপালন করবে না; কৃত্রিম উপায়ে জন্ম দিতে হবে সন্তান, আর সমাজ বহন করবে তার পালনের দায়িত্ব।

এ-মৌলিক পরিবর্তনের সাথে রাজনীতিক, সামাজিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি গৌণ ব্যাপারেও বদল ঘটাতে হবে; নারীকে দিতে হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার। তারা মনে করেন সমাজের সমস্ত কাজে নারীকে সম্পূর্ণরূপে জড়িত করতে হবে, এবং দিতে হবে যৌন স্বাধীনতা। তাদের মতে প্ৰযুক্তি শুধু নারীকে গর্ভধারণের দায় থেকে মুক্তি দেবে না, পরিশেষে তা মুক্তি দেবে নারীপুরুষ উভয়কেই কাজ করার দায় থেকে। প্রযুক্তি ধ্বংস ক’রে দেবে পরিবারের জৈবিক ও আর্থ ভিত্তি, বাতিল হয়ে যাবে পরিবার, নারীপুরুষের বিভিন্ন ভূমিকা, ও শক্তির সম্পর্ক। তাঁরা মনে করেন নারীকে নিজের ভূমিকা বেছে নেয়ার অধিকার দেয়াই যথেষ্ট নয়; জৈবিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিলুপ্ত করে দিতে হবে সমস্ত ভূমিকা’। তাদের মতে জৈবিক পরিবার বিলুপ্ত হ’লে যৌন পীড়নও লোপ পাবে। তখন কে কার সাথে, ও কোন ধরনের যৌনসম্পর্কে জড়িত হবে, তা স্থির করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে প্রতিটি নরনারীর। তখন সমকামী-পুরুষের সাথে পুরুষের, নারীর সাথে নারীর-নিন্দিত থাকবে না, বিকল্প বলেও গণ্য হবে না; যে যার রুচি মতো বেছে নেবে বিশেষ ধরনের যৌনসম্পর্ক। উদার নারীবাদীদের মতে সমকাম বিষমকামের বিকল্প, মার্ক্সীয়দের মতে সমকামী পুঁজিবাদী বিকৃতি; আমূল নারীবাদীদের মতে এটা স্বাভাবিক। তাদের মতে জৈবিক বিপ্লবের ফলে ‘সমকাম’, ‘বিষমকাম’ প্রভৃতি ধারণাই লোপ পাবে; লোপ পাবে ‘যৌনসঙ্গম’ নামের সংস্থাটি’ও, যাতে নারীপুরুষ পালন করে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। সাম্য বলতে আমূল্যবাদীরা শুধু সুযোগসুবিধার সাম্য বোঝেন না, বোঝেন সন্তানধারণ না করারও সাম্য। তবে সন্তানকে ভালোবাসাব অধিকার থাকবে তাদের। জৈবিক বিপ্লব বাস্তবায়িত হ’লে রাষ্ট্র লোপ পাবে; এর ফলে এমন মানুষ দেখা দেবে, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। এ-বিপ্লব শুধু নারীকে মুক্ত করবে না, মুক্ত করবে। পুরুষকেও; পুরুষ মুক্তি পাবে ভরণপোষণের ভার থেকে, কিন্তু তারাও সন্তান ধারণ ও লালনে পালন করবে। সমান দায়িত্ব।

আমূল নারীবাদের একটি ধারা হচ্ছে নারীসমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদ’। তাদের মতে পুরুষাধিপত্য বিলুপ্ত করার উপায় হচ্ছে পুরুষের সাথে কোনো সম্পর্কে না আসা। তাদের একদলের মতে, এটা সাময়িক ব্যবস্থা; আরেক দলের মতে, এটা হবে সব সময়ের ব্যবস্থা। তাদের মতে কে কার যৌনসঙ্গী, এটা কোনো গুরুত্বের ব্যাপার নয়; তবে এখনকার পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজে যৌনসঙ্গী নির্বাচনও রাজনীতি। তাই পুরুষাধিপত্য প্রতিরোধ করার জন্যে নারী পুরুষকে প্রত্যাখ্যান ক’রে যৌনসঙ্গী হিশেবে বেছে নেবে নারীকে। তাদের মতে বিষমসম্পর্কের ভেতরেই গোপন রয়েছে এমন বিশ্বাস যে পুরুষ প্রভুত্ব করবে নারীর ওপর। অনেক নারীসমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদী আবার প্রতিষ্ঠা করতে চান মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, কেননা তা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে উন্নত। সম্প্রতি মার্ক্সীয় নারীবাদ কিছুটা ভিন্ন রূপ নিয়েছে, যা ধ্রুপদী মার্ক্সীয় নারীবাদের সাথে যুক্ত কবেছে কিছু নতুনত্ব। তাঁরা সন্তানধারণে প্রস্তুত, এবং আমূল নারীবাদকে গণ্য করেন ইউটোপীয় ধারণা বলে। তারা মনে করেন সাম্যবাদই নারীমুক্তির পর্বশর্ত, তবে সাম্যবাদই যথেষ্ট নয়; কেননা সাম্যবাদী সমাজেও বিরাজ করতে পারে লিঙ্গবাদ। তাই নারীমুক্তির জন্যে বদলে দিতে হবে সামাজিক সম্পর্কের সম্পূর্ণ রূপটিকেই।



১৭৯২ মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্‌ট্‌-এর (১৭৫৯-১৭৯৭) ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস্ অফ ওম্যান। ভিণ্ডিকেশন নারীমুক্তি আন্দোলন বা নারীবাদের প্রথম মহাইশতেহার; একে মার্কিন ‘ডিক্লেয়ারেশন অফ ইন্ডিপেনডেন্স’-এর সাথে তুলনা করে নারীবাদী স্বাধীনতার ঘোষণা ও বলা হয়। প্রকাশের পর মেরি নিন্দিত, প্রশংসিত, ধিকৃত, অভিনন্দিত হন; রক্ষণশীলেরা মেতে ওঠে ধিক্কারে, প্রগতিশীলেরা জানায় অভিনন্দন। তেরো পরিচ্ছেদের তীব্ৰ তীক্ষু এ-বইটির মূল দাবি নারী মানুষ, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, নারী যৌনপ্রাণী নয়; তাকে দিতে হবে স্বাধিকার। আঠারোশতকের শেষভাগে যখন পুরুষেরা দেশে দেশে বিপ্লব ক’রে চলছিলো, সংগ্রাম ক’রে চলছিলো মানুষের অর্থাৎ পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন তেত্রিশ বছরের তরুণী মেরি ঘোষণা করেন নারীমুক্তির ইশতেহার। তাঁর বই সাথে সাথে কোনো বিপ্লব ঘটায় নি, তবে সূচনা ক’রে এক দীর্ঘ বিপ্লবের, যা আজো অসম্পূর্ণ।

১৮১৮ রামমোহন রায়ের সহমরণ বিষয় প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ। রামমোহন সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম নারীবাদী পুরুষ, যিনি নারীকে দিতে চেয়েছিলেন বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু, পিতৃতন্ত্র যা দিতে চায় নি।

১৮১৯ রামমোহন রায়ের সহমরণ বিষয়ে প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবাৰ্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ।

১৮২২ গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক। বিদ্যালঙ্কার বলেন :
‘যদি ফল স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অল্প এ কারণ তাহাদের বিদ্যা হয় না, অতএব পিতামোতও তাঁহাদের বিদ্যার জন্যে উদ্যোগ করেন না, একথা অতি অনুপযুক্ত। যেহেতুক নীতিশাস্ত্রে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর বুদ্ধি চতুর্গুণ ও ব্যবসায় ছয়গুণ কহিয়াছেন।…এদশের লোকেরা বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞানের উপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন না। বরং তাঁহাদের মধ্যে যদি কেহ বিদ্যা শিখিতে আরম্ভ কবে তবে তাঁহাকে মিথ্যা জনরব মাত্র সিদ্ধ নানা অশাস্ত্রীয় প্রতিবন্ধক দেখাইয়া ও ব্যবহার দুষ্ট বলিয়া মানা করান।

১৮২৫ সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক উইলিয়াম টমসন-এর মানবজাতির অর্ধেক, নারীদের, দাবি মানবজাতির অন্য অর্ধেক, পুরুষদের, দুরহঙ্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, নারীদের পরিণত করা হয়েছে ‘অনিচ্ছুক প্রসব যন্ত্র ও গৃহদাসীতে’, ‘গৃহ হচ্ছে গৃহিণীর কারাগার’। তিনি ডাক দেন : ‘ইংল্যান্ডের নারীরা, জাগো! নারী, যে-দেশেই তুমি অধীনস্থ, জাগো। যখন তোমার সম্পূর্ণ মন ও শরীরের চর্চা ও বিকাশ ঘটবে, তখন তোমার জন্যে যে-সুখ অপেক্ষা ক’রে আছে, তার জন্যে জাগো।’ এর বিনিময়ে তিনি পান অবজ্ঞা ও উপহাস।

১৮২৯ সতীদাহ নিষিদ্ধ : ৪ ডিসেম্বরে লর্ড বেন্টিংকের সতীদাহ নিষেধ বিধিতে স্বাক্ষর।

১৮৩১ বিদ্যাদর্শন-এ নামহীন পতিতার পত্র; কৌলীন্য প্রথার মুখোশ-উন্মোচন।

১৮৩৭ আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথাবিরোধী নারীসম্মেলন। দাসপ্রথারহিতকরণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মার্কিন নারীরা প্রবেশ করেন রাজনীতিতে, গড়ে তোলেন সংঘ, জনসভায় ভাষণের সুযোগ পান, এবং বিকাশ ঘটান সমাজে তাদের স্থান ও অধিকার সম্বন্ধে মতাদর্শ। উনিশ শতকের প্রথম তিন দশক ধ’রে দাসমুক্তি আন্দোলন ও নারীমুক্তি আন্দোলন ছিলো পরস্পরনির্ভর। প্রথম যুগের মার্কিন নারীবাদীরা : গ্রিমকে বোনেরা, লুসি স্টোন, এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মোট, সুসান বি অ্যান্থনি ছিলেন নিষ্ঠাপরায়ণ দাসপ্রথারহিতকরণবাদী।

১৮৩৮ গ্রিমকে বোনদের, এঞ্জেলিনা ই গ্রিমকের ক্রীতদাসপ্রথা ও দাসপ্রথা রহিতকরণ সম্পর্কে প্রবন্ধের উত্তরে ক্যাথেরিন বিচারের কাছে পত্রাবলি, এবং সারাহ এম গ্রিমকের নারীপুরুষের সাম্য ও নারীর অবস্থা সম্পর্কে পত্রাবলি। এ-দু মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ বোন ক্রীতদাস ও নারীর মুক্তিকে অভিন্ন ক’রে দেখে সমস্যার একই সমাধান দাবি করেন। তবে দাসপ্রথারহিতকরণবাদী পুরুষেরা ক্রীতদাসের মুক্তিতে বিশ্বাস করলেও নারীর মুক্তিতে বিশ্বাস করতো না: গৃহযুদ্ধে সাফল্যের পর তারা নারীদের প্রতারণা করতে দ্বিধা করে নি।

১৮৪৮ জুলাইয়ের ১৯ ও ২০ তারিখে নিউ ইয়র্কের সেনেকা ফলস্-এ প্রথম নারী অধিকার সম্মেলন। এতে অংশ নেন তিন শোর মতো নারীপুরুষ। এ-সম্মেলনে মার্কিন স্বাধীনতা ঘোষণার আদলে নারীমুক্তির ঘোষণা ক’রে বারোটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঘোষণার রচয়িতা এলিজাবেথ কোড স্ট্যান্টন। ঘোষণায় বলা হয় :
‘আমরা মনে করি এগুলো স্বতঃসিদ্ধ সত্য : যে সব পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে: স্রষ্টা তাদের ভূষিত করেছে কতিপয় হস্তস্তর অযোগ্য অধিকারে; এগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবন, স্বাধীনতা, এবং সুখলাভের প্রয়াস…
মানবজাতির ইতিহাস হচ্ছে নারীর ওপর পুরুষের পৌনপুনিক পীড়ন ও বলপ্রয়োগের ইতিহাস, যাব লক্ষ্য নারীর ওপর পুরুষেব চরম স্বৈব্যাচার প্রতিষ্ঠা। এটা প্রমাণের জন্যে অকপট বিশ্বের কাছে পেশ করতে চাই তথ্য। সে [পুরুষ] তাকে নারী কখনো তার সহজাত অধিকার ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার দেয় নি।
সে তাকে সে-সব বিধান মানতে বাধ্য করেছে, যা প্রণয়নে তার কথা শোনা হয় নি…
সে তাকে বিবাহিত অবস্থায়, আইনের চোখে, আইনগতভাবে মৃত বলে নির্দেশ কবেছে…
সে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সম্পত্তিক মালিক হওয়ার সব অধিকার, এমনকি নিজের উপার্জিত পারিশ্রমিকের ওপবের অধিকার…
সে তাকে পরিণত করেছে নৈতিক দায়িত্বহীন প্রাণীতে, কেননা সে স্বামীব উপস্থিতিতে যে-কোনো অপবাধ করে অব্যাহতি পেতে পাবে শাস্তি থেকে।…
সে নিজের জন্যে একচেটে বেখেছে সমস্ত লাভজনক পেশা, এবং নারীর জন্যে রেখেছে যে-সমস্ত কাজ, তার পারিশ্রমিক অত্যন্ত তুচ্ছ…
সে পুরুষ ও নারীর জন্যে ভিন্ন নৈতিকতা বিধি দিয়ে জনগণেব মধ্যে সৃষ্টি করেছে মিথ্যা সুভাবাবেগ…
সে জোর করে নিজে অধিকার কাবেছে জিহোভার সমস্ত অধিকার, দাবি করেছে যে নারীর জনো এক পৃথক এলাকা বরাদ্দ করা তার অধিকার…
সে সব রকমে চেষ্টা করেছে নারীর আত্মবিশ্বাস ধ্বংস ক’লে দিতে, তার আত্মসম্মানবোধ খৰ্ব করতে, এবং তাকে স্বেচ্ছায় পর্যাশ্রিত ও শোচনীয় জীবনযাপনে সম্মত হতে।…

এ-সম্মেলনের একটি লক্ষ্য ছিলো নারীর ভোট ‘ধকার অর্জন, তবে ভোটাধিকারের প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় নি। অনেকে মনে করেছিলেন ভোটাধিকার চাইতে গেলে তারা তা তো পাবেনই না, বরং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনে ও ব্যর্থ হবেন। তবে এলিজাবেথ স্ট্যান্টন ও ফ্রেডরিক ডগলাস মনে করেন শাসক নির্বাচন ও আইন প্রণয়নের অধিকার পেলেই অন্য অধিকারগুলোও পাওয়া যাবে, তাই তারা প্ৰস্তাবটি পাশ করাতে যারপরনাই চেষ্টা করেন। এর পর প্রায় প্রতি বছরই একেক শহরে অনুষ্ঠিত হয় নারী অধিকার সম্মেলন। তাদের আন্দোলন যতোই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে, রক্ষণশীলেরা হতে থাকে ততোই ক্ষিপ্ত। তাদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলেরা পত্রপত্রিকায়, গির্জায় আক্রমণ চালাতে থাকে অকথ্য ভাষায়। প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্রগুলো তাদের উপকারে আসবে না। ব’লে তারা প্ৰকাশ করেন নিজেদের সাময়িকী : দি লিলি, দি ইউনা, ওম্যানস অ্যাডভোকেট প্রভৃতি। রক্ষণশীলেরা নারীবাদীদের আক্রমণ করতো অশীল ভাষা ও পবিত্র বাইবেল দিয়ে। তারা আদি মার্কিন নারীবাদী ফ্যানি রাইটকে আখ্যা দেয় ‘ধর্মহীনতার লাল বেশা’, এরনেস্টিন রোজকে বলে ‘বেশ্যার থেকে হাজার হাজার গুণ নিচের পতিতা’। পাদ্রিরা নারীবাদী সম্মেলনে হানা দিয়ে বাইবেল উঁচিয়ে ধ’রে চিৎকার করতো, ‘সেইন্ট পল বলেছেন. সেইন্ট পিটার বলেছেন…।’

১৮৪৯ বাঙলায় প্রাতিষ্ঠানিক নারীশিক্ষার সূচনা। মে মাসে জে ই ডি বেথুন কলকাতায় স্থাপন করেন ভিক্টোরিয়া গার্লস স্কুল, পরে এটি পরিচিত হয় বেথুন স্কুল নামে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লেখেন :
আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল,
ব্ৰতধর্ম কর্তো সবে।
একা বেথুন এসে শেষ করেছে,
আর কি তাদের তেমন পাবে৷
যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে,
কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে।
তখন ‘এ বি’ শিখে, বিবি সেজে,
বিলাতী বোল কবেই কাবে।।

লেখাপড়া শিখে মেয়েরা ‘বিন্দু বিন্দু ব্ৰান্ডি খাবে’ বলেও আকর্ষণীয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। শিক্ষিত মেয়েদের নিয়ে কবিতায় কৌতুক করলেও ঈশ্বর গুপ্ত নারীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন না, তার সম্বাদপ্রভাকর-এ তিনি নারীশিক্ষার পক্ষে লিখতেন। সারা পৃথিবীর পুরুষদের মতো বাঙালি পুরুষেরাও যখন মেনে নেয় নারীশিক্ষা, স্ত্রীদের উৎসাহ দেয় শিক্ষায়, তখন তারা নারীশিক্ষাকে পণ্ড ক’রে দেয়ার জন্যে চমৎকার যাদু সৃষ্টি করে, নারীশিক্ষার প্রধান লক্ষ্য ক’রে তোলে ‘উৎকৃষ্ট গৃহিণী ও মাতা’ উৎপাদন। তারা স্টুয়ার্ট মিলকে ছেড়ে গ্রহণ করে রাসকিনের ক্ষতিকর আদর্শ: ‘ভদ্রমহিলা’ উৎপাদন ক’রে করে নষ্ট ক’রে দেয় নারীশিক্ষাকে।

১৮৫৫ ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্ৰস্তাব (প্রথম পুস্তক) ও বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (দ্বিতীয় পুস্তক)। রামমোহন নারীদের দিতে চেয়েছিলেন প্ৰাণ, বিদ্যাসাগর দিতে চান জীবন।

১৮৫৬ ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন।

১৮৬৬ মারিয়া দোসরাইসমে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ফরাশি নারী-অধিকার সংঘ।

১৮৬৮ সুসান বি অ্যান্থনি ও এলিজাবেথ স্ট্যান্টন-এর নারীবাদী সাময়িকী দি রেভোলিউশন f এর মূলমন্ত্র ছিলো : ‘পুরুষ, তার অধিকার এবং এর বেশি নয়; নারী, তার অধিকার এবং এর কম নয়।’ ভোটাধিকার ছাড়া এতে আলোচিত হতো বিয়ে, আইন, প্রথাগত ধর্ম প্রভৃতি।

১৮৬৯ জন স্টুয়ার্ট মিল-এর দি সাবজেকশন অফ উইমেন।
১৮৬১তে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে নারীবাদীবা নিজেদের আন্দোলন স্থগিত রাখেন, কিন্তু দেখেন যুদ্ধের পর নিগ্রোদের অধিকার মানা হ’লেও নারীদের অধিকার মানা হয় না। তাদের চোখে নারী নিগ্রোর থেকেও নিকৃষ্ট।
যুদ্ধের পর তারা ভোটাধিকারকেই প্রধান লক্ষ্য বলে গণ্য করেন; কিন্তু ১৮৬৯-এ নারীমুক্তি আন্দোলন আদর্শ ও কৌশলগত কারণে বিভক্ত হয় দুটি শিবিরে। মে মাসে সুসান বি অ্যান্থনি ও এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন গঠন করেন ‘জাতীয় নারী ভোটাধিকার সংঘ’; নভেম্বরে লুসি স্টোন গঠন করেন ‘মার্কিন নারী ভোটাধিকার সংঘ’। মার্কিন সংঘটি শুধু ভোটাধিকারেই নিজেদের সীমিত রাখে; জাতীয় সংঘটি ভোটাধিকারের সাথে অন্যান্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও নিজেদের ব্যাপৃত রাখে।

১৮৭১ বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার।

১৯৭৩ বিদ্যাসাগবের বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার–দ্বিতীয় পুস্তক।

১৯৭৯ হেনরিক ইবসেন-এর পুতুলের খেলাঘর। নায়িকা নোরা হয়ে ওঠে নারীবাদের কণ্ঠস্বর।
জর্মন ভাষায় আউগুষ্ট বেবেল-এর নারী ও সমাজতন্ত্র। প্রথম সংস্করণ গোপনে প্ৰকাশিত। ১৮৮৩তে সংশোধিত সংস্করণ : নারী : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নামে। জর্মন নারীবাদী ক্লারা জোঁটকিন এ-বই সম্পর্কে বলেছেন : ‘ডিনামাইট যেমন চুরমার করে দেয় কঠিনতম আদিম পাথর, তেমনই এ-বইয়ের বক্তব্য ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে গভীরতম কুসংস্কারকে।‘

১৮৮৩ প্রথম বি এ : কাদম্বিনী বসু [ব্ৰাহ্ম]।

১৮৮৪ প্রথম এম এ : চন্দ্ৰমুখী বসু। [খ্রিস্টান।]
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি। তিনি দেখান পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও ব্যক্তি মালিকানাই নারীর বিপর্যয়ের কারণ।

১৮৮৯ পুনায় মহারাষ্ট্র নারীবাদী পণ্ডিত রমাবাইয়ের নারীমুক্তি সম্বন্ধে বক্তৃতা। পুরুষদের হামলায় বক্তৃতা স্থগিত; রবীন্দ্রনাথ, যদিও নারীমুক্তিবিরোধী, লেখেন ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (রর : ১২, ৪৫০-৪৫৫)।

১৮৯০ প্রথম এম বি; বিধুমুখী বসু। [খ্রিষ্টান]।
দুটি সংঘ মিলে গঠিত হয় ‘জাতীয় মার্কিন নারী ভোটাধিকার সংঘ’। প্রথম সভাপতি স্ট্যান্টন। কৃষ্ণভাবিনী দাসের প্রবন্ধ শিক্ষিতা নারী’। তিনি পেশ করেন একটি সরল ছোটো বক্তব্য :
পরোপকার ও অন্যের জন্য জীবন ধারণ করা যেমন নারীর উদ্দেশ্য, রমণী তেমনি নিজের নিমিত্তেও বাঁচিয়া থাকে।

১৮৯৫ স্টান্টন ও আরো তেইশজন নারীর ওমানস্‌ বাইবেল : নারীর বাইবেল।
স্ট্যান্টন ভোটাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, তবে তাঁর বিশ্বাস ছিলো গির্জা আর ধর্মই নারীর প্রধান শত্ৰু, কেননা নারীবাদবিরোধীদের প্রধান যুক্তিই ছিলো : নারী-অধীনতা ঈশ্বরের বিধান। দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৯৮। এতে আক্রমণ করা হয় বাইবেলে নারীর ভূমিকা ও ভাবমূর্তিকে। তাঁরা বলেন, ‘দীর্ঘকাল ধ’রে আমরা বাইবেলকে অন্ধভক্তির বস্তু ক’রে তুলেছি। এখন সময় এসেছে এটিকে অন্যান্য বইয়ের মতোই পড়ার, নিতে হবে এর ভালোটা বাদ দিতে হবে খারাপটা।’ স্ট্যান্টন ‘পাঁজরের হাড়ে’র উপাখ্যানকে ‘তুচ্ছ শল্যচিকিৎসা’ ব’লে দেখান যে সম্পূর্ণ বাইবেলই হাওয়া বা নারীর পাপের ওপর ভিত্তি ক’রে তৈরি। তিনি বলেন :
‘সাপটিকে, ফলগাছটিকে এবং নারীটিকে নিয়ে নাও, তখন আর কোনো পতন, রাগী বিচারক, নরক, চিরকালীন শাস্তি কিছুই থাকে না?–তাই কোনো ত্ৰাতাবও দবকার পড়ে না } এভাবে খসে পড়ে সমগ্র খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের তলদেশ। এ-কারণেই সমস্ত বাইবেল গবেষণা ও উচ্চতর সমালোচনায় পণ্ডিতেবা কখনো নারীর অবস্থানটিকে স্পর্শ করেন না।‘

এ-বই প্রকাশের পর হৈচৈ পড়ে যায়, রক্ষশীলেরা একটি ভালো শিকার পেয়ে মেতে ওঠে: অ্যান্থনি ও আর কয়েকজন ছাড়া ভোটাধিকার সংঘের সদস্যরাও স্ট্যান্টনকে অস্বীকার করেন। এর মাত্ৰ ন-বছর পর বাঙলায় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের নারী রোকেয়া বলেন, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্ৰ বলিয়া প্ৰকাশ করিয়াছেন।…এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’

১৮৯৮ শার্লোট পার্কিন্স গিলমানের নারী ও অর্থনীতি।

এমেলিন প্যাংকহাক্টের নেতৃত্ত্বে যুক্তরাজ্যে নারীর সামাজিক ও রাজনীতিক ইউনিয়ন গঠন; নারীমুক্তি আন্দোলনের চরম রূপ। তাদের ঘোষণা : ‘অবিলম্বে ভোটাধিকার’। ১৯০৫-এ আন্দোলনকে তীব্র, ও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ, করার জন্যে লিবারেল দলের নির্বাচনী জনসভায় প্যাংকহাক্টের মেয়ে ক্রিস্টাবেল ‘তোমরা কি নারীদের ভোটাধিকার দেবো?’ প্লাকার্ড বহন করে, প্রেফতার হওয়ার জন্যে পুলিশের মুখে থুতু দেয়। দেশে সৃষ্টি হয় প্রবল আন্দোলন।

১৯০৪ বেগম রোকেয়ার বিপ্লবী প্ৰবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’ [নবনুর, ২:৫]। মতিচুর (১৯০৫) গ্রন্থে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে সংকলিত। এ-প্রবন্ধেই ভারতে প্রথম ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে পেশ করা হয় তীব্র বক্তব্য। রোকেয়া বলেন :
‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, আমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিবোদ্ধাৰ্য করিয়াছি; আমাদিগকে অন্ধকাবে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্ৰ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।…এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।…এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্ৰভুত্ব সহা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।‘

তার বক্তেব্য রক্ষণশীলেরা উন্মত্ত হয়ে ওঠে,–তবে এখনকার মতো নয়, ব্রিটিশরাজে রক্ষণশীলদের উন্মত্ততারও সীমা ছিলো; গ্রন্থে প্রকাশের সময় তিনি আপত্তিকর অংশ বাদ দিতে বাধ্য হন। ওই আপত্তিকর ও নিষিদ্ধ অংশটুকুই হচ্ছে রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ রচনা। পৃথিবীর একটি পরিহাস হচ্ছে এখানে শ্রেষ্ঠরা নিয়ন্ত্রিত হন নিকৃষ্টদের দ্বারা।

১৯১১ কলকাতায় ১৬ মার্চে রোকেয়ার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা।

১৯১৩ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীর মূল্য [যমুনা, ১৩২০]৷ বেরিয়েছিলো অনিলা দেবীর ছদ্মনামে। গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৯২৪-এ। শরৎচন্দ্ৰ বলেন :

‘নারীত্বে মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পবিমাণে তিনি সেবাপরায়ণ, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অৰ্থাৎ তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী। অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পাবিবেন। দাম কৰ্ষিবার এ ছাড়া যে আর কোন পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিতে পারি।…
সতীত্বের বাড়া নারীর আর গুণ নাই। সব দেশেব পুরুষই এ কথা বোঝে, এটা পুরুষেবা কাছে সবচেয়ে উপাদেয় সামগ্ৰী।…এই সতীত্ব যে নারীর কতবড় ধর্ম হওয়া উচিত, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদিতে সে কথার পুনঃ পুনঃ আলোচনা হইয়া গিয়াছে।…এখানে স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত সতীত্বের দাপটে কতবার অস্থির হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত তর্কই একতরফা–এক নারীরই জন্য।‘

যুক্তরাষ্ট্রে এলিস পল নামে এক তীব্র তরুণীর আমূল্যবাদী সংঘ কংগ্রেসনাল ইউনিয়ন’ [পরবর্তী নাম ‘ওম্যানস পাটি’]। ভোটাধিকার লাভের জন্যে তিনি প্রয়োগ করেন সব কৌশল : তাঁর দল প্যারেড, গণবিক্ষোভ, অনশন ধর্মঘট করে; তাঁর দলের সদস্যরা কারাগারে যায়। তিনিই মার্কিন নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনকে অবসন্নতা উদ্ধার করেন।

যুক্তরাজ্যে নারী ভোটাধিকার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। তারা রাতে দেয়ালে দেয়ালে দাবি লেখে, ডাকবাক্সে জ্যাম ঢেলে ডাকবিভাগকে বিব্রত করে, দমকলঘন্টা বাজায়, প্রধান মন্ত্রী লয়েড জর্জের বাড়ির ক্ষতিসাধন করে, রেলস্টেশন স্টেডিয়াম গির্জায় আগুন লাগায়। জুনের ৮ তারিখে এপসম ডাউন্সে রাজার রেসের ঘোড়া যখন দৌড়োচ্ছিলো, তখন এমিলি ওয়াইন্ডিং ডেভিসন দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন। আহত এমিলি চার দিন পর মারা যান। এমিলি নারীবাদের প্রথম শহীদ।

১৯১৭ ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার দাবি; জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।

১৯১৮ যুক্তরাজ্যে ত্ৰিশোর্ধ নারীরা ভোটাধিকার পান; ১৯২৮-এ তাঁদের ভোটাধিকার বয়স কমিয়ে পুরুষের সমান, ২১ বছর, করা হয়।

১৯১৯ জর্মন নারীবাদের জনপ্ৰিয়তম নেত্রী, তাত্ত্বিক, বক্তা ডক্টর রোসা লুক্সেমবুর্গ ডানপন্থী সৈন্যদের হাতে নিহত [১৫ জানুয়ারি]।

১৯২০ আগস্টের ২৬ তারিখে মার্কিন কংগ্রেস নারী ভোটাধিকার (১৯তম) সংশোধনী বিল পাশ করে। ১৮৭৮ থেকে ‘অ্যান্থনি সংশোধনী’ নামে এটি কংগ্রেসের প্রতি অধিবেশনে উত্থাপি৩ হয়, কিন্তু গৃহীত হ’তে লাগে বেয়াল্লিশ বছর! এর সাথে আমেরিকায় ঘটে নারীবাদের মৃত্যু; পুনরুজীবিত হ’তে লাগে চল্লিশ বছর।

১৯২১ ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার লাভ। প্রথমে মাদ্রজ প্রদেশে, ১৯২১-এ; ১৯২৯-এর মধ্যে সব প্রদেশে। বাঙলায় ১৯২৫-এ। তারা ভোটাধিকার পান, তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার পান আরো পরে।

১৯২৭ প্রথম বাঙালি মুসলমান এম এ : ফজিলতুন্নেসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে প্ৰথম।

১৯২৯ ভার্জিনিয়া উল্‌ফ্‌-এর এ রুম অফ ওয়ান্‌স্‌ অঔন। তাঁর এ-বইয়ের বিষয় নারী ও কথাসাহিত্য, তিনি এ-বক্তৃতাগ্রন্থে একটিই প্রশ্ন করেন–নারী কেনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে নি? তাঁর উত্তর হচ্ছে–দারিদ্র্য। নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার সূত্রপাত।

১৯৪৯ আধুনিক আমূল্যবাদী নারীবাদের মহাগ্রন্থ সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর দ্বিতীয় লিঙ্গ। বোভোয়ার উগ্র বাঁজালো নন, তিনি গভীর মননশীল এবং আধুনিক নারীবাদের শ্রেষ্ঠ নারী; তাঁর প্রজ্ঞা অতুলনীয়, লক্ষ্য অবিচল। তাঁর বইয়ের দর্শন সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদ। এ-বইয়ে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে ইতিহাস ভ’রে নারী পরিণত হয়েছে। পুরুষের সামগ্ৰীতে; নারীকে তৈরি করা হয়ছে পুরুষের ‘অপর’রূপে, অস্বীকার করা হয়ছে তার নিজস্বতা, এবং নিজ দায়িত্বভারের অধিকার। বার বার তিনি, অস্তিত্ববাদী পরিভাষায়, বলেছেন, পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শ নারীকে দেখে সীমাবদ্ধ’ আর পুরুষকে ‘অসীম’ বা ‘সীমাতিক্রান্ত রূপে। এটি পরবতী নারীবাদী সমস্ত চিন্তা ও গ্রন্থের জননী। বইটি লেখাব সময় তার বিশ্বাস ছিলো সমাজতন্ত্রের বিকাশই সমাধান করবে: নারীর সব সমস্যার, তাই তিনি নারীবাদী নন, তিনি সমাজতান্ত্রিক। ক্রমশ তার বিশ্বাস ভেঙে যায়, ১৯৭২-এ তিনি যোগ দেন নারীবাদী আন্দোলনে, এবং প্ৰথমবারের মতো নিজেকে ঘোষণা করেন নারীবাদী বলে। তিনি বলেন। [দ্র মোই (১৯৮৫, ৯১-৯২)] :
‘১৯৭০-এ এমএলএফ নারীমুক্তি আন্দোলন স্থাপিত হওয়ার আগে ফ্রান্সে যে-সব নারীসংঘ ছিলো, সেগুলো ছিলো সাধারণত সংস্কার ও আইনবাদী। তাদের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি! তুলনায় নবনারীবাদ আমূল্যবাদী।…দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষভাগে বলেছিলাম। আমি নারীবাদী নই, কেননা আমি বিশ্বাস কবিতাম যে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের সাথে আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে নারীয় সমস্যা। নারীবাদী বলতে আমি বোঝাতাম শ্রেণীসংগ্রামনিরপেক্ষভাবে বিশেষ নারীসমস্যা নিয়ে লড়াইকে। আমি আজো একই ধারণা পোষণ কবি! আমাব সংজ্ঞায় নারীবাদীরা এমন নারী-বা এমন পুরুষও-যারা, সংগ্রাম কবছেন নারীর অবস্থা বদলেব জন্যে, সাথে থাকছে শ্রেণীসংগ্রাম; এবং তারা শ্রেণীসংগ্রামনিবাপেক্ষভাবেও, সমস্ত সমাজবদলেব ওপর নির্ভব না করে, নারীর অবস্থা বদলের জন্যে সংগ্রাম করতে পারেন। আমি বলবো, এ-অর্থেই আমি আজ নারীবাদী, কেননা আমি বুঝতে পেরেছি যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগে নারীর পরিস্থিতির জন্যে আমাদেবী লড়াই করতে হবে, এখানে এবং এখনই।

১৯৫৯ দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, প্রায় দেড় শো বছর স্বেচ্ছায় ভুলে থাকার পর, সেইন্ট প্যাংক্রাস পুরোনো গির্জায় মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য। অৰ্পণ করে ফসেট সমিতি।

১৯৬০ নারী সরকার প্রধানদের আবির্ভাব : শ্ৰীমাভো বন্দরনায়েক (শ্ৰীলঙ্কা, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৬০), ইন্দিরা গান্ধি (ভারত, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৭১, ১৯৮১), গোল্ড মেয়ার (ইসরায়েল, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৬৯), ইসাবেলা পেরন (আর্জেন্টিনা, রাষ্ট্রপতি, ১৯৭৪), মাৰ্গারেট থ্যাচার (যুক্তরাজ্য, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৭৯, ১৯৮৩, ১৯৮৭), কোরাজান অ্যাকিনো (রাষ্ট্রপতি, ফিলিপাইনস, ১৯৮৬), বেনজিব ভুট্টো (পাকিস্তান, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৮৮), খালেদা জিয়া (বাঙলাদেশ, প্ৰধান মন্ত্রী, ১৯৯১), শেখ হাসিনা (বাঙলাদেশ, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৯৬)। তবে এঁরা নারীবাদী নন, পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; অধিকাংশই নারীর জন্যে ক্ষতিকর।

১৯৬৩ বেটি ফ্রাইডান-এর দি ফেমিনিন মিষ্টিক। মার্কিন নরনারীবাদের প্রথম বই এটি, তিনি দেখান কীভাবে বিলাসে নষ্ট হচ্ছে মার্কিন গৃহিণীরা।

১৯৬৬ ফ্রাইডানের ‘ন্যাশনাল অরগানাইজেশন অফ উইমেন’ (নাউ)।

১৯৬৮ মেরি এলমানের নারীসম্পর্কে ভাবনা : নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা।

১৯৬৯ কেইট মিলেট-এর লৈঙ্গিক রাজনীতি, অ্যান কোড্‌ট্‌-এর ‘যোনীয় পুলকের উপকথা’। কেইট মিলেটই প্রথম নারীপুরুষের সম্পর্ককে নির্দেশ করেন রাজনীতিক সম্পর্ক ব’লে, যার নাম দেন। তিনি লৈঙ্গিক রাজনীতি’। এটি তাঁর পিএইচডি অভিসন্দৰ্ভ, একই সাথে মননশীল ও প্রচণ্ড। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর পর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রেরণাদায়ক গ্ৰন্থ। নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার জন্যেও উল্লেখযোগ্য : লরেন্স, মিলার, মেইলার, জাঁ জোনের সাহিত্য আলোচনা করে দেখান তাদের রুগ্ন পুরুষতান্ত্রিকতা।

১৯৭০ জারমেইন গ্রিয়ার-এর দি ফিমেল ইউনাক শুলামিথ ফায়ারস্টোন-এর লিঙ্গ দ্বাদ্রিকতা : নারীবাদী বিপ্লবের পক্ষে।

১৯৭২ সুজান কোপেলম্যান কোরানিলন সম্পাদিত নারীবাদী সমালোচনাসংগ্ৰহ কথাসাহিত্যে নারীভাবমূর্তি। তারা দেখান, কথাসাহিত্যে চিত্রিত হয়েছে ‘অসত্য’ নারীচরিত্র; এ-কাজে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছেন নারী লেখকেরা, তাঁরা পুরুষদের থেকেও নিকৃষ্ট; বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁরা নিজ লিঙ্গের সাথে।

১৯৭৩ আন্তর্জাতিক নারীবাদী সম্মেলন।

১৯৭৫ জাতিসংঘের নারী-অধিকার দশক।
ফাতিমা মেরনিস্‌সির বোরখা পেরিয়ে। মরোক্কোর এ-তীব্ৰ নারীবাদী দেখান মুসলমান নারীদের শোচনীয়তা, ধর্মকে আক্রমণ করেন বিস্ময়কর সাহসের সাথে। ১৯৮৪তে বেরোয় তাঁর প্রচণ্ডতর বই মুসলমানের অবচেতনায় নারী, লেখেন ফাতনা এ সাবাহ্‌ ছদ্মনামে।

১৯৭৮ শেরিল এল ব্ৰাউন ও করেন ওলসন সম্পাদিত নারীবাদী সমালোচনাসংগ্ৰহ নারীবাদী সমালোচনা : তত্ত্ব, কবিতা ও গদ্য বিষয়ক প্ৰবন্ধ।

১৯৮০ মিশরি নারীবাদী নওঅল এল সাদাওয়ির হাওয়ার লুকোনো সুখ : আরব বিশ্বে নারী। আমূল নারীবাদী নওঅল চিকিৎসক, ছিলেন মিশরের গণস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান; কিন্তু নারীবাদের অপরাধে সাদাতের কালে চাকুরি হারান, কারারুদ্ধ হন।

১৯৯৫ ১৯ নভেম্বর। নারী নিষিদ্ধ।

২০০০ ৭ মার্চ। উচ্চ বিচারালয় কর্তৃক নারীর নিষিদ্ধকরণ আদেশকে অবৈধ ঘোষণা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top