রুমঝুম বৃষ্টিতে হারিয়ে যাওয়ার দিনে। মডেল: প্রিয়ন্তি ও মৌসুমী, শাড়ি: তেজস্বী, ছবি: কবির হোসেন, ছবি নির্দেশনা: বিপাশা রায়। স্থান: কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
বর্ষা প্রাণবন্ত ঋতু। শৈশব বা কৈশোরের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিতে বর্ষার জুড়ি নেই। এ ঋতুর উচ্ছলতা আর সরলতার দর্শনকে পোশাকে আনতে চাইলে সহজ-সাধারণ পোশাক বেছে নেওয়ার বিকল্প নেই। ভারী পোশাকের চেয়ে হালকা বা ছিমছাম পোশাকই এ সময়ে বেশি মানানসই।
বৃষ্টি ঝরছে। কখনো টিপটিপ, কখনো টুপটাপ, কখনো রুমঝুম আর কখনো ঝমঝম। কখনো অফিসের জানালার শার্শিতে বিপুল বিক্রমে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি, কখনো মৃদু ছন্দে ছুটির সকালে বাড়িয়ে দিচ্ছে আরাম-ঘুমের গভীরতা। কখনো ঝলকে ওঠা বজ্রের সঙ্গে হাজির হচ্ছে নিউজফিডের ১০ সেকেন্ডের ভিডিওতে, কখনো হেঁশেলের ইলিশ-খিচুড়ির ঘ্রাণে বলছে উদ্যাপনের গল্প। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সব কটি স্পর্শ করে এভাবেই আসে বর্ষা, সবচেয়ে সাড়ম্বরে।
নীল রঙের শাড়িতে বর্ষা উদযাপন
বাস্তবতায় নান্দনিকতা
সোঁদামাটির ঘ্রাণে ভরা এই সব বর্ষার দিনে মন থাকে উচাটন। প্রায়ই মনে হয়, কাজের সঙ্গে আড়ি নিয়ে নিঃসংকোচে ঘোষণা দিই, 'মন মোর মেঘের সঙ্গী'। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। বাদলদিনে যতই কদম ফুল ফুটুক, অফিসে তো যেতেই হয়। মেঘ যতই ডমরু বাজাক, ব্যস্ত–ত্রস্ত জীবনের নানা প্রয়োজনে ছুটতে হয় শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তাই জল-কাদা থেকে শাড়ির আঁচল বাঁচানোর আর কবিগুরুর কথা মেনে নিজেকে 'মেঘনীল বেশে' সাজানোর দুই বিপরীতমুখী তাগাদা শহুরে জনপদে প্রায় সমান গুরুত্ব নিয়ে বিরাজমান।
সতর্কতা আর নান্দনিকতা—বৃষ্টিদিনে পোশাক নির্বাচনে এ দুটি বিষয় মাথায় রাখলে শহুরে বৃষ্টির প্রকোপ আর সহজে আপনার ভ্রুপল্লবে ভাঁজ ফেলতে পারবে না। বর্ষা বড় প্রাণবন্ত ঋতু। উচ্ছল শৈশব বা রোমান্টিক কৈশোরের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিতে বর্ষার জুড়ি নেই। এ ঋতুর সেই উচ্ছলতা আর সরলতার দর্শনকে পোশাকে প্রতিফলিত করতে চাইলে তাই সহজ-সাধারণ পোশাক বেছে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভারী কাপড় ও ভারী কাজ করা পোশাকের চেয়ে হালকা বা ছিমছাম পোশাকই এ সময়ের জন্য বেশি মানানসই।
বৃষ্টিজলে ভিজে গেলেও যাতে ঝঞ্ঝাটে না পড়তে হয়, তেমন কাপড়ের পোশাকই বেছে নেওয়া শ্রেয়। আবার আমাদের আর্দ্রতাপ্রবণ আবহাওয়ায়, বর্ষাকালীন ভ্যাপসা গরমে স্বস্তি পেতে আরামদায়কও তো হওয়া চাই কাপড়। তাই বর্ষাকালের উপযোগী কাপড়ের তালিকায় শুরুতেই থাকবে হাফ সিল্ক, জর্জেট, লিনেন। সুতি কাপড় আরামদায়ক হলেও শুকাতে সময় নেয় বেশি, তাই সুতিতে যাঁরা বেশি স্বচ্ছন্দ, তাঁরা বেছে নিতে পারেন মেশানো সুতি। রাজশাহী সিল্কের মতো খাঁটি সিল্কের কাপড় এ সময় না পরাই ভালো। কেননা, বৃষ্টির পানিতে এ ধরনের কাপড়ের বুনন নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে।
সোঁদামাটির গন্ধে মনও থাকে এলোমেলো।
বৃষ্টির দিনে জর্জেট পরা নিয়েও অনেকে দ্বিধায় ভোগেন। স্বচ্ছতা নিয়ে অস্বস্তি বা গায়ের সঙ্গে মিশে থাকবে কি না, এমন প্রশ্নও আছে অনেকের। সে ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বেছে নিন কিছুটা ভারী জর্জেট; ডাবল জর্জেট বা ক্রেপ কাপড়ও বৃষ্টিতে হতে পারে ভীষণ আরামদায়ক।
শুধু কাপড়ই নয়, পোশাকের ডিজাইনও যেন জলকাদা বাঁচানোর উপযোগী হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। এ নিয়ে বলছিলেন ফ্যাশন হাউস বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার বিপ্লব সাহা, বেশি ঘেরওয়ালা বা লম্বায় বেশি বড় পোশাকগুলো বর্ষার জন্য ঠিক উপযোগী না। লম্বা পোশাকে কাদার ছোপ ছোপ দাগ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। পথে-ঘাটে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে সহায়ক হবে, অ্যালাইন কাটের সেমি লম্বা পোশাক। পায়জামা বা প্যান্টও আঁটসাঁট হলেই ভালো।
আকাশি নীল শাড়ির স্নিগ্ধতায়
নীল কিংবা ধূসরে বৃষ্টির আবহ
বাংলার সবচেয়ে রোমান্টিক ঋতুতে পোশাক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু এমন সতর্কতার বাণীই শুনিয়ে যাব, সেটি কিন্তু ভাববেন না। মেঘ বিষণ্ন হলেই যে প্রিয় নীল শাড়িতে সাজতে চান, সে খবর কিন্তু আমার এক্কেবারেই অজানা নয়! অজানা হবেই–বা কেন? জানালার বাইরে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ কানে গেলে আমিও তো আলমারি হাতড়ে খুঁজে আনি নীলরঙা পোশাক, মনে মনে গুনগুনিয়ে উঠি ভানুসিংহের পদাবলী, 'পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয় প্রণয় কুসুমরাশ।'
বর্ষাদিনে নীলের প্রতি এমন পক্ষপাতিত্বের কথা শোনালেন বিপ্লব সাহাও, 'বর্ষার পোশাক মানেই নীলের নানা শেড; ধূসর নীল, আকাশ নীল, গাঢ় নীল। কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের গল্প-কবিতা-উপন্যাসে বর্ষার রংকে নীল বলেই বর্ণনা করে গেছেন। জলের ধারাও বরাবরই শিল্পীর তুলিতে নীল। তাই বোধ হয় আমাদের নকশা করা বর্ষার পোশাকে নীলের আধিক্য বড় বেশি।' তবে নীলের পাশাপাশি ধূসর বা সাদা রঙের উপস্থিতিও পোশাকে আনবে বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধতার আবেশ। পোশাকে বর্ষার নীলাভ সৌন্দর্য বা প্রকৃতির সজীবতা ফুটিয়ে তুলতে টাই-ডাই বা হাতে আঁকা পোশাকেরও জুড়ি নেই।
মেঘলা আকাশে মন চলে যায় দূরে কোথাও....
রং ও কাপড় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে খানিকটা ভালোবাসার পরশ যোগ করতেও ভোলেননি বিপ্লব সাহা। বর্ষার ছাপ কাপড়ে তো থাকবেই। থমথমে প্রকৃতির ধূসর আবেশে বৈপরীত্য আনতে অনেকেই হয়তো বেছে নেবেন টুকটুকে লাল, কচি সবুজ বা গাঢ় নীলের মতো উজ্জ্বল রং। সে ক্ষেত্রে খেয়াল রাখুন, কাপড় থেকে রং ওঠার প্রবণতা আছে কি না। কেননা, এ ধরনের কাপড় বৃষ্টিতে ভিজে গেলে আপনার সহযাত্রীর পোশাকে ছাপ ফেলতে পারে, এমনকি নষ্ট করতে পারে আপনার পোশাকেরই হালকা রঙা অংশ।
সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে সাধারণ, হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের রঙের পোশাক নিঃসংকোচে পরে ফেলা যায় বর্ষায়। অফিসযাত্রায় লিনেনের টপের সঙ্গে আপনার বর্ষাযাপনের সঙ্গী হতে পারে নীল টাই-ডাইয়ের স্কার্ফ। ছুটির বিকেলে গায়ে জড়াতে পারেন আকাশি নীল শাড়ির স্নিগ্ধতা।
শুরুতে বলেছিলাম, বর্ষা মানেই মন উচাটন! এবারের বর্ষায় সেই উচাটন মনের খোরাক জোগাতে না হয় পোশাকেও হোক বৃষ্টিবিলাস। নজরুলের কবিতার মতো নীলাম্বরি শাড়ি পরে নীল যমুনায় যাওয়া না হলে বাড়ির বারান্দা বা অফিস ডেস্কই সই!
এক কাপ চা হাতে নিয়েই না হয় এবার আমরা ছড়া কাটব, 'নেবুর পাতায় করমচা, যা বৃষ্টি ধরে যা!'
* তাবাসসুম ইসলাম, ঢাকা