What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Review বাংলার ‘হাজার বছর ধরে (1 Viewer)

BtYbYz4.jpg


অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম 'হাজার বছর ধরে' ছবিটি নিয়ে কিছু লিখবো, যা আজ হঠাৎ করেই হয়ে গেল! আসলে এ রকম একটি কালজয়ী ছবি নিয়ে লিখতে গেলেও ভাবা লাগে।

ছবিটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক-ঔপন্যাসিক-গল্পকার শহীদ জহির রায়হানের কালজয়ী উপন্যাস 'হাজার বছর ধরে'র চিত্ররূপ, যা সেলুলয়েডের ফিতায় দারুণ যত্নে সাজিয়েছেন তারই সহধর্মিণী এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রমুখ কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছবিটি পরিচালনা করেন তিনি, যেন বইয়ের ভাষাটি চোখের সামনে মেলে ধরলেন নিপুণ দক্ষতায়।

এটি ছিল সুচন্দার পরিচালনার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র, ওনার প্রথম ছবি ছিল 'সবুজ কোট কালো চশমা'। যেখানে নায়ক ছিলেন তারই পুত্র তপু রায়হান, সঙ্গে ওডিশার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী।

যাই হোক, সরকারি অনুদানে নির্মিত 'হাজার বছর ধরে' মুক্তি পেয়েছিল ৮ জুলাই ২০০৫ সালে, সেদিনই ঈদ উপলক্ষে এনটিভিতে ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার হয়। আর ছবিটি আমি সে সময়ই উপভোগ করি।

দিগন্তজোড়া মাঠ। যত দূর চোখ যায় আপন মনে বাতাসে ঢেউ খেলে যাওয়া সবুজ ধানখেতের সমারোহ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শান্ত নদী, নদীর বুকে ছোট ছোট নৌকার পাল যেন শিল্পীর আঁকা কোন ছবি। সঙ্গে নানা রঙের পাখির ডাকে যেন চারিদিক মোহময় হয়ে যায়। এ যেন চিরায়ত আবহমান বাংলার রূপ… যা 'হাজার বছর ধরে' এই বাংলার মাটিতে বয়ে চলেছে আপন মনে আপন ধ্যানে, যেখানে বাসা বাঁধে প্রেম ভালোবাসা আশা-নিরাশা পাওয়া-না পাওয়ার গল্প।

যে গল্পে পুরুষদের প্রাধান্য থাকলেও নারীদের যেন কোন প্রাধান্য নেই, পুরুষ শাসিত সমাজের আর যাই হোক নারীদের কোন অধিকার নেই। বাল্য বিবাহ একাধিক বিবাহ থেকে ইচ্ছে মতো তালাক প্রথা যেন এই সমাজের পুরুষদেরই রাজত্ব, এখানে নারীদের যেন কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই। ঔপন্যাসিক জহির রায়হান মূলত সেই সময়ের প্রেক্ষাপটের নারীদের অবহেলা ও নিপীড়নের কথাই 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসে বলতে চেয়েছিলেন।

Bd3mKuu.jpg


কাহিনি সংক্ষেপ: বাস্তবে পরীর দিঘি নামের কোন জায়গা আছে কি-না জানা নেই। তবে উপন্যাসের শুরুটা হয়েছিল, এক পরীর ঘাটের জায়গাকে কেন্দ্র করেই। যেখানে এক বানে কলা গাছের ভেলায় ভেসে এসেছিল কাশেম শিকদারসহ তার স্ত্রী, গড়ে তুলেছিল 'শিকদার বাড়ি' নামের এক গেরস্ত বাড়ি। বংশবিস্তার পরিক্রমায় কাশেম শিকদাররা না থাকলেও বর্তমানে শিকদার বাড়ির মুরুব্বি এখন বৃদ্ধ মকবুল, যেখানে তার তিন বউ, ফকিরের মা, ভাই আবুল, রশিদ ও মন্তকে নিয়ে বেশ বড় পরিবার। সারা দিন গেরস্তের কাজ-কারবার শেষে বাড়ির উঠানে রাতে কুপির আলোয় বসে পুথি পড়ার আসর। সুরত আলীর গলায় ভেসে আসে পুথি— শোন বন্ধুগণ রে শোন দিয়া মন, কমলা সুন্দরীর কথা করি যে বর্ণন। হিরণ নগরের মেয়ে কমলা সুন্দরী, গুনের কথা কী কহিব রূপ ছিল তার ভারি। আরে হিরণ নগরে ছিল এক রাজকুমার, কমলা সুন্দরীর সঙ্গে বিয়া হইল তার। লাল নীল সবুজ পরীর দিঘি দিয়া পাড়ি, পালকি চড়ে যাইতেছিল নিজের বাপের বাড়ি….

বৃদ্ধ মকবুল তার খেত-খামারের কাজ করার জন্য জোয়ান দেখে বিয়ে করে আনে অষ্টাদশী টুনিকে। একটু এদিক-সেদিক হলেই কড়া শাসনের জাল বিছিয়ে দেয় মকবুল। কিন্তু চঞ্চলা টুনির মন যে মকবুলের শাসন মানতে চায় না! তার মন চায়— খোলা আকাশের নিচে ঘুরতে, কাশবনে বেড়াতে, নৌকা নিয়ে শাপলা তুলতে, রাতের আঁধারে টর্চ নিয়ে মাছ ধরতে। তাই তো টুনি তার মনের ইচ্ছা পূরণের সঙ্গী হিসেবে পায় অল্প বয়সী দেবর সুঠামদেহী মন্তকে। মন্ত দিনে নৌকা চালায় আর রাতের আঁধারে সকলের অগোচরে টুনিরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরতে। চুরি করে অন্যের গাছের খেজুরের রস, যায় শাপলা তুলতে, আর এমনি করতে করতে একসময় দুজনার মনে ভাব জমে আসে। অব্যক্ত ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যায় দুটি মন। কিন্তু লোক লজ্জার ভয়ে কেউ মুখ ফুটে তা বলতে পারে না। আবার পাশের বাড়ির আম্বিয়ার সঙ্গে মন্তর বিয়ের কথা উঠলে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে বিয়ে না হওয়ার ছল ছুঁতো খোঁজে টুনি। কিন্তু কঠিন সমাজের রক্ত চক্ষুর ভয়ে ঠিকই দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের।

সময় বয়ে যায়, হাজার বছরের নিয়মের জালে আজ মকবুল, রশিদ, আবুল ফকিরের মা কেউ বেঁচে নেই। সময়ের সঙ্গে চঞ্চলা টুনিরও পরিবর্তন এসেছে, তার শরীরে এখন সাদা বিধবার কাপড়। স্বামীহারা এই সংসার সমাজের কঠিন নিয়ম সে বুঝতে শিখেছে। তাই তো মন্তর মনোয়ারের বাড়িতে এক রাতের নাইওর থাকার কথায় টুনি ফিরে আসে। শুধু ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে বলে, 'তা আর হয় না মিঞা, তা আর হয় না…।'

টুনি জানে কঠিন এই সমাজের জালে তাদের ইচ্ছা কখনই পূরণ হবে না। এ দিকে শিকদার বাড়ির মুরুব্বি এখন মন্ত, আম্বিয়াকে বিয়ে করে সে এখন এক সন্তানের বাপ। এখনো শিকদার বাড়ির উঠানে পুথি পড়ার আসর বসে। সুরত আলীর জায়গায় এখন তার ছেলে পুথি পড়ে। জোছনার আলোয় ভেসে আসে পুথির সুর— শোন শোন বন্ধুগণে শোন দিয়া মন, ভেলুয়ার কথা কিছু শান সর্বজন, ভেলুয়া সুন্দরীর কথা…

FcQ5bKB.jpg


অভিনয়: মন্ত চরিত্রে রিয়াজ আর টুনি চরিত্রে একেবারে নবাগতা শশী পুরো ছবিতে যে প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন তা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। অভিনয় নিয়ে সামান্য জ্ঞান থাকা দর্শকেরা এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য থাকবে তাদের অভিনয় কতটা প্রাণবন্ত আর নিখুঁত ছিল। বিশেষ করে রাতের আঁধারে দুজনে মিলে মাছ ধরার দৃশ্য আবার সেই রাতের আঁধারে খেজুরের রস চুরি করে খাওয়া, বিলে শাপলা ফুল তোলা, শান্তির হাটে যাত্রাপালা দেখতে যাওয়া থেকে কাচের চুড়ি কেনা— যা এখনো চোখে লেগে আছে। আবার এর মাঝেও রিয়াজের খালি গায়ে দুয়ারে বসে ভাত খাওয়ার দৃশ্যটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। যেমন ছিল তার অভিনয় তেমনি ছিল এর চিত্রায়ণ, যা এখনো মনে গেঁথে আছে। বাড়ির দুয়ারে বসে অসহায়ভাবে অল্প একটু ভাত খাওয়ার দৃশ্যটি রিয়াজ ছাড়া আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতো কিনা সন্দেহ আছে। আবার টুনিদের বাড়িতে বসে মাষ কলাইয়ের ডাল চেয়ে খাওয়ার দৃশ্যে রিয়াজের চোখ ও মুখের যে অভিব্যক্তি যেন একেবারেই বাস্তব চিত্র হয়ে ধরা দেয়। ইষ্টি বাড়িতে খেতে বসলে যেমন অনেকের একটু লজ্জা বা আড়ষ্টতা থাকে ঠিক তেমনি রিয়াজের অসাধারণ অভিনয়ের মধ্যে দেখা গেছে। সেই হিসেবে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এমন সব প্রাণবন্ত দৃশ্যায়ন একমাত্র রিয়াজ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এ দিকে বৃদ্ধ চরিত্রে পাষাণ মকবুলরুপী এটিএম শামসুজ্জামানের বদ মেজাজ আর বউদের প্রতি অত্যাচার করা একটি চরিত্রে যে কীভাবে তিনি মিশে যেতে পারেন তা ছবিটি যারা দেখেছেন শুধু তারাই বলতে পারবেন। শেষে শুধু পরিচালক সুচন্দা ম্যাডামকে বলতে চাই, কোথায় পেয়েছিলেন শান্তির হাটের মেলার জায়গাটি? একবার হলেও সেখানে ঘুরে আসতে চাই, সেই শান্তির হাটে। যেখানে ছইঅলা নৌকা করে ঘাটে ভিড়িয়ে মেলা দেখা যায়।

পরিচালনা: 'হাজার বছর ধরে' সুচন্দার একটি সুনিপুণ নির্মাণ, যা ছবিটি দেখলে একবাক্যেই স্বীকার করতে হয়। এ যেন এক দক্ষ হাতের কোন কাজ। অথচ তিনি এর আগে মাত্র একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। মাত্র একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতায় সুচন্দা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একজন নারী নির্মাতা হয়েও কতটা সফল হওয়া যায়। তবে আফসোসের বিষয় পরবর্তীতে তাকে আর আমরা চলচ্চিত্র পরিচালনায় পাইনি।

'হাজার বছর ধরে' ছবির শুটিং হয়েছিল গাজীপুরের হোতাপাড়াসহ এর আশপাশের এলাকায় এবং নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছিল অনেকটা সময়। এখানে একটি কারণও ছিল। ছবিটির গল্পে ঋতু পরিবর্তনের ব্যাপার ছিল, যেখানে দর্শকদের ফাঁকি দিতে চাননি বলেই পরিচালক গ্রীষ্মের দৃশ্য গ্রীষ্মে, শীতের দৃশ্য শীতে, বসন্তের দৃশ্য বসন্তে আর বর্ষার দৃশ্যে বর্ষাকালেই চিত্রায়ণ করেছিলেন। যার জন্য এতটাই বাস্তবিক ছিল ছবির ফ্রেম টু ফ্রেমে।

TNiKRFw.jpg


পুরস্কার: 'হাজার বছর ধরে' যেমন দর্শকদের কাছে সমাদৃত, তেমনি সুচন্দার সুনির্মাণেও আদায় করে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার। ছয়টি বিভাগে পায় জাতীয় পুরস্কার— শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক (কোহিনূর আক্তার সুচন্দা), শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক (আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল), শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার (জহির রায়হান, মরণোত্তর), শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক (মাহফুজুর রহমান খান) ও শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক (মোহাম্মদ কলন্তর)। চারটি বিভাগে পায় মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার— শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (রিয়াজ), শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (শশী) ও বিশেষ পুরস্কার (মাহফুজুর রহমান খান, চিত্রগ্রাহক)। ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি প্রশংসাসূচক শুভেচ্ছা সনদ (২০১১) পায়।

সবশেষে 'হাজার বছর ধরে' নিয়ে ছোট্ট দুটি তথ্য জেনে নিই। ছবির টুনি চরিত্রের জন্য ১৪ বছরের চঞ্চল-উচ্ছল একটি মেয়ের প্রয়োজন ছিল। সুচন্দা ১৪ বছরের শশী নামের একেবারেই নতুন এক মুখকে নির্বাচন করেন, এত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। আর ছবিটির মন্ত চরিত্রের জন্য রিয়াজ পারশ্রমিক নিয়েছিলেন মাত্র ১০১ টাকা।

'আশা ছিল মনে মনে, প্রেম করিবো তোমার সনে। তোমায় নিয়া ঘর বাঁধিবো… গহীন বালুচরে … গহীন বালুচর', গানটির গীতিকার ছিলেন মরহুম জহির রায়হান। 'তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল, নাকি তোমার মন', গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

একেবারে শেষে বলতে চাই— দেখা না থাকলে দেখে নিতে পারেন এই অমর সৃষ্টি। ওপরের উল্লেখিত চমৎকার দুটি গানের সঙ্গে অসাধারণ বাংলার প্রকৃতি। আপনার মনে অন্যরকম এক আবেশ ছড়িয়ে দেবে, আমি নিশ্চিত!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top