জীবাণু নানা রকমের—ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক (ফাঙ্গাস), প্যারাসাইট। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্যানসারের জন্য দায়ী জীবাণুর সংক্রমণ। তবে একটা বিষয় জানা দরকার যে সংক্রমণের মতো ক্যানসার কোনোক্রমেই ছোঁয়াচে রোগ নয়। কিন্তু কিছু কিছু সংক্রমণ দীর্ঘ মেয়াদে থাকলে কোষের পরিবর্তন করে ক্যানসারের সূচনা করতে পারে।
এক-তৃতীয়াংশের বেশি ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য। এটা সম্ভব জীবনযাপনে কিছু বর্জন আর কিছু গ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে টিকার ভূমিকাও আছে। টিকা অন্তত দুটি ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকিয়ে কয়েকটি ক্যানসার থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। একটি হলো হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস এবং অন্যটি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস।
এইচপিভি ও এর টিকা
এইচপিভি একধরনের ডিএনএ ভাইরাস। জরায়ুমুখের ক্যানসারের ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ভাইরাস দায়ী। বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে মা হওয়া, বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া, ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই কেবল টিকা দিলেই হবে না, ঝুঁকিগুলোও কমাতে হবে।
এইচপিভির পুরো নাম হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। এটি কোনো একক ভাইরাস নয়। এর আছে প্রায় দুই শ রকমের জেনোটাইপ বা স্ট্রেইন। এর প্রায় ৪০ শতাংশ ছড়ায় শারীরিক সম্পর্ক বা যৌনতার মাধ্যমে। যোনিপথ, পায়ু কিংবা মুখে সংক্রমণ করে। যৌনবাহিত এইচপিভি ভাইরাসকে দুই ভাগে ফেলা যায়। কম ও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
কম ঝুঁকির এইচপিভি বেশির ভাগই কোনো সংক্রমণ ঘটায় না। তবে কেউ কেউ আঁচিল বা জড়ুল সৃষ্টি করতে পারে যৌনাঙ্গ, পায়ু, মুখ, গলা বা এর আশপাশে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি কয়েক ধরনের ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।
৮০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে এইচপিভি সংক্রমণ আপনা-আপনি সেরে যায়, দুই বছরের মধ্যে। যেসব সারে না, সেসব ধীরে ধীরে কোষের পরিবর্তন ঘটিয়ে ঠেলে দেয় ক্যানসারের দিকে।
যৌন সক্রিয় প্রায় সবাই এইচপিভি ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। অস্বাভাবিক বা বিকৃত যৌনাচার এর ঝুঁকি বাড়ায়। নারী-পুরুষ উভয়েই সংক্রমিত ও ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। সংক্রমিত হলেই ক্যানসার হয় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা এটাকে সামলে নেয়।
এইচপিভি-জনিত ক্যানসার হতে পারে জরায়ুমুখে, পায়ুপথে, মুখের ভেতরে টনসিল ও জিহ্বার পেছন দিকটায়, পুরুষ ও নারীর যৌনাঙ্গে।
এইচপিভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা আছে, যা বেশ জোরালো প্রতিরোধে সক্ষম। তবে একবার সংক্রমণ ঘটে গেলে তা আর সারতে বা ঠেকাতে পারে না। তাই এই টিকা দেওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ থেকে ১৩ বছর। যৌনতা শুরুর আগেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত টিকা নেওয়া যেতে পারে।
এযাবৎ তিন ধরনের টিকা তৈরি হয়েছে এর বিরুদ্ধে। সারভারিক্স নামের বাইভেলেন্ট প্রতিরোধ করে দুটিকে, এইচপিভি ১৬ ও ১৮। গারডেসিল নামের টেট্রাভ্যালেন্ট চারটিকে একসঙ্গে প্রতিরোধ করে ৯, ১১, ১৬, ১৮। গারডেসিল-৯ নামের ন্যানোভ্যালেন্ট মোট ৯টিকে। টিকার দুটি দিতে হয় ১৫ বছর বয়সের মধ্যে। এরপর তৃতীয় ডোজের প্রয়োজন হয়।
টিকা দিলেই আজীবন নিশ্চিন্ত থাকা যাবে না। জরায়ুমুখ ক্যানসারকে প্রতিরোধ করতে ৩০ বছর বয়স থেকে নারীদের নিয়মিত জরায়ুমুখের ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে অংশ নিতে হবে।
হেপাটাইটিস বি ও লিভার ক্যানসার
হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ থেকে যকৃৎ বা লিভার সিরোসিস হতে পারে। এ দুটি সংক্রমণে বাড়ে লিভার ক্যানসারের ঝুঁকিও। তবে টিকা আছে শুধু বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে সব নবজাতক জন্মের পরপরই, সব শিশু ১৮ বছর পর্যন্ত, সংক্রমিত ব্যক্তির যৌনসঙ্গী, অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ব্যক্তি, ইনজেকশন ব্যবহার্য মাদকাসক্ত, ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্যকর্মী, এইচআইভি পজিটিভ রোগীকে এই টিকা দিতে হবে।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই থেকে শিশুদের বিনা মূল্যে এই টিকা দেওয়া হয়। পেন্টাভালেন্ট, অর্থাৎ পাঁচটি রোগের টিকা একত্রে দেওয়া হয়। ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি (হিব)। শিশুর জন্মের ছয় সপ্তাহ থেকে পরপর তিনটি ডোজ, চার সপ্তাহ বিরতিতে ঊরুর মধ্যভাগের বহিরাংশের মাংসপেশিতে দেওয়ার নিয়ম। তিন-পাঁচ বছরের মধ্যে একটি বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
বড়দের বেলায় হেপাটাইটিস বি টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার এক ও ছয় মাস বিরতিতে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি নিতে হয়। পাঁচ বছর পর একটি বুস্টার ডোজ নিতে হয়, যদি পর্যাপ্ত প্রতিরোধ গড়ে না ওঠে। ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত যে কেউ এই টিকা নিতে পারবেন, তবে সংক্রমিত হয়ে গেলে নয়।