What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

শেষের পাতায় শুরু (1 Viewer)

পর্ব ছয় – (#5-28)

রক্ত নেওয়া আর হল না, যেভাবে বাচ্চাদের মতন রাগারাগি শুরু করে দিয়েছে সেই দেখে রিশু হাসি থামাতে পারে না। আধা ভেজান দরজার দিকে তাকিয়ে রিশু হেসে ফেলে, ঝিনুকের আচার আচরন গুলো অনেক কচি মনোবৃত্তির, হয়ত চঞ্চলমতি, উচ্ছল রমণী কিন্তু ভেতর থেকে এখন একটা শিশু। এখন আগছলা থাকে, ঘরের বেশির ভাগ জিনিসপত্র ওকেই গুছাতে হয়, কিন্তু তাও ঝিনুকে কে কিছুই বলে না। অগত্যা সিরিঞ্জ রেখ দিয়ে ঝিনুককে বেড়িয়ে আসার অনুরোধ করে। দরজার আড়াল থেকে উঁকি মেরে আগে যাচাই করে রিশুকে, তারপরে যখন দেখে যে ওর হাতে সিরিঞ্জ নেই তখন বীরদর্পে মুচকি হেসে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে, যেন যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। সারা সকাল দুই জোড়া চোখের মিষ্টি মধুর বারতালাপেই কেটে যায়, কাল সকালে দেখব কি করে ব্লাড দেবে না, হ্যাঁ দেখে নিও, কোন কথা শুনবো না, দরজা খুললে তবে না নেবে ইত্যাদি।

কাজের লোক ঘরের কাজ, রান্না বান্না সেরে যাওয়ার পরে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নেয় দুজনেই। কথা ছিল খাওয়ার পরেই বেড়িয়ে যাবে বাজার করতে। শীতের দিন ছোট হয়, তার ওপর ঝিনুকের জন্য এটা প্রথম দিল্লীর শীত, বেশিক্ষন বাইরে থাকলে যদি আবার ঠান্ডা লাগে তখন সবাই রিশুকেই দোষারোপ করবে।

কাজের লোক নিরামিষ রান্না করে গিয়েছিল তাই রিশু দুটো ডিমের অমলেট বানিয়ে নেয় খাওয়ার আগে। ঝিনুক স্নান সেরে বেড়িয়ে দেখে অমলেট তৈরি হয়ে গেছে, একটু আহত হয়ে ঝিনুক, একটু অপেক্ষা করলে আমি বানিয়ে দিতে পারতাম। মাথায় তোয়ালে জড়ানো, পরনে একটা ঢিলে গোল গলার টপ আর একটা ঢিলে প্যান্ট, প্রসাধন হীন সদ্য স্নাত ঝিনুককে দেখে বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক গুচ্ছ ভিজে চুল তোয়ালে থেকে উঁকি মেরে বেড়িয়ে ওর লালচে গালের ওপরে লেপটে গেছে, এক ফোঁটা জলের বিন্দু নাকের ডগায় হীরের মতন চকচক করছে। মরালী গরদনের দিকে চোখ পড়তেই বুকের রক্তে হিল্লোল উঠে যায়। মসৃণ ঘাড় বেয়ে জলের এক সরু ধারা বয়ে পরনের টপের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে গেছে। বারান্দার এক চিলতে শীতের আলোর নরম রেখা ঝিনুকের মসৃণ ত্বকের ওপরে পিছলে গিয়ে ঝলসে দেয় রিশুর হৃদয়।

রান্না ঘর থেকে রিশুকে ওইভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায় ঝিনুক। ওর মুখের দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারে না। সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর, জীবনে প্রথম বার এইভাবে লজ্জা পেয়েছে ঝিনুক, এ এক নতুন ঝিনুকের আবির্ভাব। কলেজে থাকাকালীন কত ছেলেরা ওর দিকে তাকিয়েছে, এইভাবে লজ্জা কোনদিন পায়নি, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই তড়িৎ প্রবাহ, এই শিহরণ ওর কাছে একদম নতুন। এমন কি সেই ছেলেটা যে ওর সাথে প্রেমের ছলনা করে গেছে তার চোখের ভাষা ওর শরীরে এক আন্দোলনের সৃষ্টি করত সত্যি কিন্তু তাতে শুধু মাত্র কামনা বাসনার লিপ্সা জড়িয়ে থাকত। রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়ানো সুঠাম ডাক্তারের চোখের ভাষার চুম্বকীয় আকর্ষণে হারিয়ে যায় ঝিনুক। লজ্জিত ত্রস্ত পায়ে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে সেই আগুনে দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে।

ছোট খাওয়ার টেবিলের ওপরে ডিমের অমলেট দুটো রেখে ডাক পারে রিশু, “হল তোমার?”

গলার স্বর কানে যেতেই লুকিয়ে যেতে পারলে যেন বেঁচে যায় ঝিনুক, “এই আসছি।”

খাওয়াটা জরুরি ছিল না রিশুর কাছে, এই ক্ষণিকের জন্য যে চোখের আড়াল হয়েছে সেটাই সইতে পারছিল না রিশুর হৃদয়, যেন ওর একমাত্র উদ্ভিন্ন যৌবনা স্ত্রী কোথাও হারিয়ে গেছে। চঞ্চল কোনদিন ছিল না রিশু তবে ঝিনুকের এই আচরন দেখে একবার মনে হয় যেন আবার করে ফিরে যায় পুরানো দিনে, এই মেয়েটার হাত ধরেই সুপ্ত স্বপ্ন গুলো পূর্ণ করতে। ঠিক মায়ের ভয়ে নয়, কোন কিছুতে মায়ের যদি খারাপ লাগে যদি মা দুঃখ পায় সেই চিন্তায় অনেক কিছুই করেনি রিশু। চুপচাপ শান্ত হয়ে থাকতে থাকতে বয়সের আগেই গম্ভির স্বভাবের হয়ে গেছে। এখন মেয়েটা সেই ভাবে কথা বলে না, এই সকালেই এদের মধ্যে যা কথাবার্তা হয়েছে সেটা এই পাঁচ দিনের মধ্যে সব থেকে বেশি। কি করনীয় ওর? পুরুষ শাসিত সমাজ, হয়ত ঝিনুক ওর অপেক্ষায় আছে কখন ওর দিকে এক পা বাড়াবে।

ছটফট করে ওঠে রিশুর বুকের ভেতরটা, “তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলে ভালো হয়।”

উফফ ডাক্তারের যেন আর তর সয়না, এমনি সময়ে সাত চড়ে রা কাড়ে না এখন আবার ডেকে খাওয়াতে বসাতে চায়। ভিজে চুল আরো একবার তোয়ালে দিয়ে মুছে উত্তর দেয়, “বললাম ত আসছি।”

রিশু টিভি চালিয়ে দেয়, কারণ চুপচাপ খাওয়ার চেয়ে টিভি চলা বশি ভালো, নিস্তব্ধতা ভীষণ ভাবেই জোরে বাজে সেটা এই কয়দিনে রাতের খাওয়ার সময়ে বুঝে গেছে রিশু। নুপুরের নিক্কন কানে যেতেই চোখ তুলে তাকায় দরজার দিকে, ভুরু কুঁচকে ঠোঁটে এক চিলতে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ঝিনুক, চোখের তারায় লাজুক রঙের আভাস। লাজে রাঙ্গা কাজল কালো নয়নের দিকে চোখ পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় রিশুর, ভীষণ ভাবে জানতে ইচ্ছে করে কে সেই পার্থ নামের ছেলেটা, যে এই নীল সাগরের ঢেউয়ের ফেনায় স্নাত ঝিনুকের চোখে জল এনেছিল। যে চঞ্চলা উচ্ছল ললনার ছবি ওর বোন সেদিন গাড়ির মধ্যে দেখিয়েছিল, সেই হারিয়ে যাওয়া উচ্ছল ললনাকে ফিরে পেতে চায়। চোখ কিছুতেই ফেরাতে পারে না ঝিনুকের সদ্যস্নাত মুখবয়াবের ওপর থেকে। লালচে নাকের ডগায় এক ফোঁটা জল হীরের টুকরোর মতন চিকচিক করে ঝিনুকের চেহারার দ্যুতি সহস্র গুন বাড়িয়ে তোলে, সেই সাথে রিশুর হৃদয়ের তুমুল ঝঞ্ঝার বান ডেকে আনে।

চোখ নামিয়ে চেয়ারে বসে পরে ঝিনুক। দুইজনের মুখেই কোন কথা নেই, চুপচাপ খাওয়া সারে দুজনে। ঝিনুক পারলে থালা নিয়ে উঠে পালিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যায়। কেন মরতে রবিবার আসে? কোন সপ্তাহে রবিবার একদম থাকা উচিত নয় অথবা ডাক্তারের ছুটি হওয়া উচিত নয়। থাকুক না হসপিটালে সুন্দরী নার্সদের সাথে, সুন্দরী মহিলা ডাক্তারদের সাথে, ও কি জানে না যে ডাক্তারদের কথা? ওর বান্ধবী বন্দনার বয়ফ্রেন্ড নীলরতন মেডিকেল কলেজে পড়ত, বন্দনার মুখেই শুনেছে ওর বয়ফ্রেন্ডের হস্টেলের চারপাশে ছড়িয়ে থাকত বীর্যে ভরা কন্ডমের প্যাকেট। শুধু মাত্র কি চন্দ্রিকা, আর কি কেউ সত্যি ছিল না এই ডাক্তারের হৃদয়ের কোন এক গোপন কোনায়? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে ঝিনুকের।

খাওয়া শেষে ঝিনুক ঢুকে পরে নিজের ঘরের, প্রথম বার ডাক্তারের সাথে বেড়াতে বের হবে, বেড়াতে ঠিক নয় কাজের জিনিস কিনতেই বের হবে। অনেক কিছু কেনার আছে, ডাক্তারের সাথে ছোট পোশাক অথবা জিন্স পরে বের হতে কেমন যেন মনে হয় ওর যেটা এর আগে কোনদিন ওর মনে হয়নি, খানিকটা বিব্রতবোধ খানিকটা লজ্জা খানিকটা আশঙ্কা কি পোশাক ওর ভালো লাগে সেটা জানা নেই। এই বিব্রতবোধটা ওর মধ্যে আগে কোনদিন ছিল না। কোলকাতায় থাকতে যা খুশি ইচ্ছে জামা কাপড় পড়তে পারত, জেদ ছিল বিয়ের পরেও সেই এক ভাবেই খোলামেলা জীবন যাপন করবে, যেরকম ওর ভালো লাগবে সেই মতন পোশাক আশাক পড়বে, যখন যেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হবে সেখানে বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু ওর সেই সব আশা অধরা স্বপ্ন হিসাবেই রয়ে গেল। বাইরে বেড়াতে যাওয়ার মতন সালোয়ার কামিজ নেই বলতে গেলেই চলে, তিনটে সালোয়ার কামিজ নিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে দুটো ওর আর একটা ডাক্তার বিয়েতে দিয়েছিল। অগত্যা সেটাই পরে নিল, ওপরে রিশুর দেওয়া সেই গাড় নীল রঙের ওভারকোট, পায়ে মোজা পড়তে ভীষণ বাধে তাও ডাক্তারের আদেশ, মোজা পড়তেই হবে, গলায় শাল নিতেই হবে, ধ্যাত এইভাবে সাজা যায় নাকি? কিন্তু না, ডাক্তার কি আর সাজার ব্যাপারে কিছু বোঝে নাকি, ওর কথা শরীর খারাপ করবে, কতবার বুঝাতে চেষ্টা করে যে মেয়েদের ঠান্ডা কম লাগে বিশেষ করে বেড়াতে বের হলে অথবা শপিং করতে বের হলে তখন ওদের রক্তে নতুন শক্তির জাগরণ হয়।

সঠিক অর্থে ঝিনুকের ব্যাপারে কিছুই জানা হয়নি রিশুর, সেইভাবে জানা শোনার সময় হাতেই ছিল না। প্লেন থেকে নেমেই ওর মা ধরে বেঁধে বলে দিল এর সাথেই বিয়ে এই মেয়েকেই বোউমা করতে চায়। যদিও সুন্দরী বেশ মিষ্টি দেখতে তবে কথায় আছে বিষ কুম্ভ পয়োমুখম, জেদি চঞ্চলমতি বলেই পরিচয় ওর কাছে, সেটা অবশ্য এই কয়দিনে একবারের জন্য মনে হয়নি রিশুর। বরং ওর মনে হয়েছিল খুব নরম স্বভাবের, একটু লাজুক প্রকৃতির মিষ্টি মেয়ে। প্রথম দুই তিন দিনে ওর চোখে ছিল ভীষণ আর আশঙ্কা আর ভীতির ছবি, যদিও সেটা এই তারপরে অনেকটা কেটে গেছে তাও মেয়েটা এখন পর্যন্ত যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। সর্বদা এত চুপচাপ কেন থাকে? কি এত চিন্তা করে, কার কথা চিন্তা করে? কই যখন বাড়ির সাথে নিজের মায়ের সাথে অথবা ওর মায়ের সাথে কথা বলে তখন ত এইসব কিছুই দেখা যায় না, তখন বেশ হাসি খুশি হয়েই কথাবার্তা গল্প গুজব চলে। ঝিনুকের বাবা মা যতবার ওর সাথে কথা বলেছে ততবার ওর মনে হয়েছে যে তাদের কন্ঠে এক অপরাধীবোধ ভাব, যেন ওর ওপরে এক পাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন তারা। বেশি কথাবার্তা কোনদিন হয় না তাদের সাথে, “কেমন আছো? হসপিটাল কেমন চলছে? ভালো থেকো।” ব্যাস এই কয়টা বাক্য ঘুরে ফিরে আসে প্রত্যেক বার।

প্রত্যেক দিনের এক ব্যাপার, রিশু জামা কাপড় পরে তৈরি আর সেই ললনার দেখা নেই। পায়ে মোজা কিছুতেই পড়তে চায় না, জোর করেই পড়তে বললে তাও মুখ বেঁকিয়ে এমন একটা ভাব দেখাবে যেন নিম পাতা খাইয়ে দিয়েছে, তবে কোনদিন মুখের ওপরে এটা বলেনি যে যাও পড়ব না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরে নিত মোজা। সেই প্রথম রাতে সেই যে একবার ওর সামনে উঁচু গলায় কথা বলেছিল তারপর এই কয়দিনে কোনদিন উঁচু গলায় কথা বলেনি মেয়েটা। সেই রাতের ঝিনুকের মনের অবস্থা বুঝতে অসুবিধে হয়নি রিশুর। সকাল থেকে রক্ত দেওয়া নিয়ে যেমন ভাবে ছনছন করে একটানা বেজে চলেছে, হেসে ফেলে রিশু।

“ঠিক আছে?” কথাটা কানে যেতেই এক অদ্ভুত শিহরন খেলে যায় রিশুর সর্বাঙ্গে।

ওই ঠিক আছের শব্দের শ্রোতের দিকে ঘুরে তাকায়, ওর দেওয়া সেই তুঁতে রঙের সালোয়ার পড়েছে, গাড় নীল রঙের কোট গায়ে দেওয়া, বোতাম লাগায়নি তখন। মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে রিশুর, চোখের পাতায় মনে হয় আইল্যাস লাগিয়েছে নাকি ওর চোখের পাতা এতটাই লম্বা। হাতের মধ্যে ভাঁজ করা শাল আর কাঁধে একটা ব্যাগ। মাথার চুল একপাশে করে আঁচড়ানো, সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুরের ছোঁয়া। ওর ওইভাবে তাকাতে দেখে লাজুক ঝিনুক মাথা নিচু করে দরজার দিকে এগিয়ে যায় জুতো পড়ার জন্য। পায়ের দিকে তাকায় ওর, এবারে আর বলতে হয়নি মোজা পরেই নিয়েছে আর তার ওপরে নুপুর। জুতো পড়তে পড়তে রিশুর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চোখের প্রশ্ন বাণ ছুঁড়ে মারে, এবারে দেরি হচ্ছে না, বসে বসে হ্যাংলার মতন তাকিয়ে আছো? বাইকের চাবি নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পরে রিশু, সুন্দরীকে এরপর অপেক্ষা করালে আবার রেগে যাবে।

বরাবরের মতন, বাইকে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “ঠিক করে বসেছ?”

বাইকের পেছনে বহুবার বসেছে ঝিনুক, তবে কোনদিন সালোয়ার কামিজ পরে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসেনি। এই দিল্লী এসে ডাক্তারের সাথে বাইকে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসা। এর আগে পার্থের সাথে যখন বের হত তখন ওর পরনে হাফ প্যান্ট অথবা জিন্সের প্যান্ট পরা থাকত, সিটের দুপাশে পা দিয়ে পেছন থেকে পার্থকে জাপ্টে ধরে বসতে পারত, কিন্তু এখন ডাক্তারের কাঁধে আলতো হাত রেখে নিজের ভার সামলে এক সৌজন্যমূলক ব্যাবধান রেখেই বসে। শারীরিক ব্যাবধানটা ইঞ্চি খানেক হলেও মানসিক দিক থেকে সেটা শত যোজনের। রিশুও বুঝতে পারে ওদের এই সম্পর্ক ভীষণ ভাবেই মার্জিত সৌজন্য মূলক হয়ে চলেছে।

মার্কেট পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না ওদের। কয়েকদিন পরেই ক্রিস্টমাস তায় আবার রবিবারের বিকেল, দক্ষিণ দিল্লী যেন সেদিন ওইখানেই চলে এসেছে সারা মাসের শপিং করতে। ভিড় দেখে দমে যাওয়ার পাত্রী নয় ঝিনুক, ভিড়ের মধ্যে খুব ইচ্ছে করছিল হারিয়ে যেতে, ইচ্ছে করছিল রিশুর সাথে লুকোচুরি খেলে একটু, খুব জানতে ইচ্ছে করছিল যদি ছেড়ে যায় তাহলে ওকি ওকে খুঁজবে? না, পারেনি সেটা করতে, চুপচাপ রিশুর পেছন পেছন ছিল। গত পাঁচ বছরে, কলেজে আর এমবিএ পড়ার সময়ে, প্রত্যেক বার ক্রিস্টমাসে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে কোন না কোন ডিস্কোতে পার্টি করেছে, সারা রাত ধরে নাচানাচি, মদ খাওয়া ইত্যাদি। শুরুর দিকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসত কিন্তু পরের দিকে মদের নেশায় এত মত্ত হয়ে থাকত যে কোন বন্ধুর অথবা বান্ধবীর বাড়িতে রাত কাটাতে হত। এবারে সেই ইচ্ছেটা অতটা প্রবল না হলেও জন মানুষের ভিড় দেখে সেই ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, কিন্তু এই কয়দিনে রিশুর চাল চলন দেখে বুঝে গিয়েছিল যে এইবার আর ওর ডিস্কোতে যাওয়া, আনন্দ ফুর্তি করা আর হবে না।

পার্টির ইচ্ছেটা চেপে রেখে যার জন্য আসা সেটাই শুরু করল ঝিনুক, কেনাকাটা। একটার পর একটা দোকান ঢুকে খুঁজে তোলপাড় করে আবার নতুন দোকানে ঢুকে পরে, ঝিনুকের আর সালোয়ার কামিজ পছন্দ হয় না। এই জন্যেই মা আর বোনের সাথে কোনদিন বাজার করতে যেত না রিশু, কিন্তু এই সময়ে না গেলেই নয়। অগত্যা মুখ বুজে ঝিনুকের পেছন পেছন এক দোকান থেকে অন্য দোকান করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এই সালোয়ার কামিজের ডিজাইন পছন্দ হয় ত রঙ পছন্দ হয় না, কখন রঙ পছন্দ হয় তার ডিজাইন পছন্দ হয় না, কখন সব কিছু পছন্দ হলেও ওড়না পছন্দ হয় না। মেয়েদের কিছুই এক বারে পছন্দ হয় না সেটা জানে, কেন যে এরা আগে থেকে ভেবে আসেনা যে এটাই কিনবে সেটাই ভেবে পায় না রিশু। এইভাবে ঘন্টা খানেক এ দোকান সে দোকান ঘোরার পরে পাঁচ খানা সালোয়ার কামিজ কেনে ঝিনুক।
 
পর্ব ছয় – (#6-29)

পোশাক হাতে নিয়ে একবার অন্তত ঝিনুক ভাবে যে জিজ্ঞেস করে রিশুকে, তোমার কোন পছন্দ অপছন্দ নেই আমি কি পড়ব না পড়ব? কিন্তু রিশুর নির্বিকার চেহারার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে সেই প্রশ্ন করা ছেড়ে দিয়েছিল। তাও বার দুয়েক ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করেছিল ঝিনুক, এটা নেব? এই রঙটা ভালো? রিশু মাথা দুলিয়ে সায় দিয়েছিল, হ্যাঁ, ভালো লাগলে নিয়ে নাও। ধ্যাত কি রসকস হীন মানুষ রে বাবা, এই লোকের সাথে চন্দ্রিকা কি ভেবে যে প্রেম করেছিল কে জানে? তারপর আর কথা বলার ইচ্ছে হয়নি ওর সাথে। প্রথম দুবার সালোয়ার কেনার সময়ে নিজের ব্যাগ খুলেছিল দাম দেওয়ার জন্য, রিশু মানা করে দিয়েছিল ওকে, টাকা আমি দিচ্ছি।

রিশু আর ঝিনুক, দুইজনের হাতে ভর্তি শপিং ব্যাগ, পাঁচটা সালোয়ার কামিজ, দুটো বড় ভারী জ্যাকেট, বেশ কয়েকটা বিছানার চাদর, তিনটে ঘরে পড়ার ঢিলে টপ আরো অনেক কিছু, পারলে প্রায় সেদিন পুরো বাজার কিনে নিয়ে আসে। বাপরে, কি ঘুরতে না ভালোবাসে মেয়েটা, এর আগে চন্দ্রিকার সাথে বের হওয়াটা আলাদা ব্যাপার ছিল, তখন জিনিস পত্র কেনার থাকত না বিশেষ, শুধু ঘুরে বেড়ান ছাড়া। কিন্তু ঝিনুকের সাথে জিনিস কিনতে বেড়িয়েছে, ঘুরতে বের হয়নি তাই মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও মেয়েটার মুখের উজ্জ্বলতা দেখে চুপ করে যায়। চারপাশের দোকানে যা দেখছে একবার সব নতুন জিনিস গুলো হাতে নিয়ে দেখা চাই, এটা কি ওটা কি, এর কত দাম ওর কত দাম, না কিনলেও একবার অন্তত জিজ্ঞেস করা চাই। চন্দ্রিকার মধ্যে একটা পরিপক্ক ভাব ছিল, ঝিনুকের মধ্যে ভীষণ কচি কচি উচ্ছল ভাব, দেখে মনে হয় যেন খাঁচায় বাঁধা পাখি ছেড়ে দিলেই উড়ে যাবে খোলা আকাশে। বারবার দুপুরের কথা মনে পরে যায় রিশুর, যেভাবে পা দাপিয়ে লাফিয়ে উঠে মুখ ব্যজার করে বলেছিল, “তুমি ডাক্তার না হাতির মাথা” মনে মনে হেসে ফেলে রিশু। মনের কোনায় অনেক দুরন্ত লুক্কায়িত স্বপ্ন ছিল, পূরণ হবে কি না জানা নেই ওর।

প্রায় ঘন্টা খানেক এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে, অনেক কিছু কেনা কাটার পরে খিধে পেয়ে যায় ওদের। ঝিনুকের খুব ইচ্ছে ফুচকা খাওয়ার, কোলকাতার ফুচকার স্বাদ আর এখানে যে ফুচকাওয়ালা গুলো ফুচকা বিক্রি করছে, সেগুলো দেখলেই মনে হয় এর স্বাদ আলাদা হবে। ফুচকার সাথে চাট আছে, দেখে জিবে জল চলে আসে ঝিনুকের কিন্তু রিশুর দিকে তাকিয়ে সে কথা বলার সাহস হয় না ওর। কিন্তু এই কয়দিনে ডাক্তারের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে একটা ধারনা ওর হয়ে গিয়েছিল, কোন রকম বেশি তেল ঝাল মশলা একদম খায় না, রাস্তার খাবার হয়ত একদম খায় না। তরকারি বা ডিমের ঝোল খাওয়ার সময়ে মনে হত যেন হসপিটালের রান্না খাচ্ছে, মুখ বুজে এই কয়দিনে তাই খেয়েছিল ঝিনুক। এতক্ষন ঘুরে ফিরে আরো একটা চাহিদা ওর বুকের ভেতরে জেঁকে বসে, একটা সিগারেট পেলে ভীষণ ভালো হত, কিন্তু এই কয়দিনে ডাক্তারকে চিনে গেছে, হয়ত সিগারেটের নাম শুনলে ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। সবাই ওকেই ধিক্কার জানাবে, বাড়ির কেউই জানে না শুধু মাত্র বোন ছাড়া যে ও সিগারেট খেত।

রিশু ঝিনুকের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারে যে খিধে পেয়েছে, পাশেই একটা ম্যাক ডোনাল্ডস দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ম্যাক ডোনাল্ডস যাবে নাকি?”

ঝিনুকের ইচ্ছে ছিল ফুচকা, চাট ইত্যাদি খাওয়ার চিকেন বার্গার, পিজ্জা, এসব অনেক খেয়েছে এসবের বিশেষ ইচ্ছে ছিল না ওর। মাথা নাড়িয়ে বলে, “না থাক।” বুকে বল বেঁধে খুব নিচু গলায় বলে, “ফুচকা?”

কথাটা কানে গেছিল রিশুর, তাও না শোনার ভান করে বলে, “খিধে পায়নি ত? বাড়িতে রান্না অবশ্য করাই আছে।”

এতক্ষন হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে পেটের মধ্যে নাড়ি ভুড়ি তালগোল পাকিয়ে গেছিল ঝিনুকের, নিজের ওপরে রাগ হয় ঝিনুকের, বেশ’ত ম্যাক ডোনাল্ডসে খেতে নিয়ে যাচ্ছিল, আদিখ্যেতা করে না বলতে কেন গেল? “হুম চল।”

ভাই বোনের সাথে বের হলেই ফুচকা খাওয়ান চাই, এখানে আবার কোলকাতার মতন শুধু তেঁতুল জল থাকে না, বিভিন্ন ধরনের জল থাকে আর বিশেষ করে দিয়ার সেই জল খেতে খুব ভালো লাগে। ঝিনুকের চেহারার অভিব্যাক্তি ধরে ফেলে রিশু, “ফুচকা খাবে?”

চোখ দুটো চকচক করে ওঠে ঝিনুকের, এতক্ষন তাহলে ওর সাথে ইয়ার্কি মারা হচ্ছিল, চোখ বড় বড় করে রিশুর দিকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বলে, “আচ্ছাআআ, তুমি ফুচকা খাও?”

নিভু নিভু চোখের তারায় নতুন আলোর ঝলকানি দেখে বেশ খুশি হয় রিশু, “আমার দুটো ভাই বোন আছে, তাদের জ্বালায় খেতে হয় আর কি।”

নেচে ওঠে ঝিনুক কিন্তু , “হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও টেস্ট করব।” ফুচকা ওয়ালার কাছে একটাই বাটি চায় রিশু, ঝিনুক একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে, “তুমি খাবে না?”

মুচকি হাসি দিয়ে রিশু উত্তর দেয়, “ওই তোমার থেকে একটা কি দুটো খেয়ে নেব।” চোখ কপালে উঠে যাওয়ার যোগার হয় ঝিনুকের, ডাক্তার ওর হাত থেকে ফুচকা খাবে, কথাটা বিশ্বাস হয় না একদম। রিশু একটু হেসে বলে, “কি হল ভাগ দেওয়ার ইচ্ছে নেই?”

আনন্দের অতিশজ্যে আর একটু হলেই রিশুকে জড়িয়ে ধরত ঝিনুক, সেই প্রবল ইচ্ছেটা দমন করে নরম গলায় উত্তর দেয়, “না মানে...”

ওর নরম গলা আর চোখের তারায় উজ্জ্বল দ্যুতি দেখে ক্ষনিকের জন্য রিশুর মনে হয় যে টুক করে ঝিনুকের টোপা নরম গালে যেখানে এখন একটা ক্ষীণ আঁচড়ের দাগ লেগে, সেখানে একটা ছোট চুমু খায়। কোথায় যেন একটা বাঁধা পায় রিশু, এক এক সাথে এক ছাদের তলায় থেকেও দুই অচেনা ব্যাক্তির মাঝের ব্যাবধান একটু কমলেও একদম নির্মূল হয়ে যায়নি।

ফুচকা ওয়ালার চারপাশে অনেক ভিড় তাও সেই ভিড় ঠেলে হাত বাড়িয়ে দেয় ঝিনুক, প্রথম ফুচকাটা মুখে পুরতেই বুঝে যায় এতে সেই পুরানো স্বাদ নেই, হিন্দিতেই ফুচকা ওয়ালাকে নির্দেশ দেয়, “আর ঝাল বানাও, একি তেঁতুল জল নেই?” তারপর একের পর এক ফুচকা খেয়েই চলেছে।

রিশুর দিকে একটা ফুচকা এগিয়ে দিয়ে শিশুসুলভ কন্ঠে বলে, “খাও খাও... এবারে ঝাল দিয়েছে, ইসসস ঝাল আর মিষ্টি মিলে এখানের জলের টেস্ট একদম আলাদা।”

ঝিনুকের এই চপল চঞ্চল শিশুসুলভ আচরন দেখে হেসে ফেলে রিশু, মা বলেছিল ওকে, আজকাল মেয়েদের ছাব্বিশ সাতাসের আগে বিয়ে হয় না, সেখানে ঝিনুক মাত্র তেইশ, একটু যেন মানিয়ে নিয়েই চলে। দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ, ঝিনুকের হাতেও যেগুলো ছিল সেগুলো ধরতে হয়েছে।

দুই ভর্তি হাত দেখিয়ে মাথা নাড়ায় রিশু, “না না, তুমি খাও।”

কিছু না ভেবেই রিশুর মুখের কাছে ফুচকা ধরে বলে, “আমি খাইয়ে দিচ্ছি খাও না প্লিজ” মাথা নাড়ায় রিশু, রাস্তার মাঝে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর হাত থেকে এই ভাবে খাবার খেতে ভীষণ লজ্জা করে ওর। ঝিনুকের সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, ওর মুখের কাছে হাত উঠিয়ে কাতর কন্ঠে আদর করে বলে, “এই একটা প্লিজ, খাইয়ে দিচ্ছিত...”

নিরুপায় রিশু ঝুঁকে যায় ঝিনুকের দিকে, ফুচকার সাথে কোমল চাঁপার কলি আঙ্গুল তিনটে ওর ঠোঁটে স্পর্শ করে, ইচ্ছে করেই নাকি, ওর ঠোঁটের ওপরে বেশ কিছুক্ষন ধরে ছিল আঙ্গুল। একটা ফুচকা খেয়ে হেসে উত্তর দেয়, “এবারে তুমি খাও আমি আর খাব না।”

ঝিনুকের আঙ্গুলের ডগায় রিশুর ঠোঁটের পরশ বেশ অনেকক্ষণ লেগে থাকে, শয়তান ডাক্তার আরেকটু হলে মনে হয় আঙ্গুল গুলো খেয়ে নিত। লাজুক হেসে চোখ পাকিয়ে তাকায় রিশুর দিকে, “আর দেব না কিন্তু।”

হেসে ফেলে রিশু, “না না তুমি খাও।”

শুধু কি আর চোখের দেখায় ভালোবাসা হয়? ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে যা রেখে দেওয়া হয় সে তাই গোগ্রাসে খেয়ে নেয়, রিশুর হৃদয় একটু একটু করে ভরতে শুরু করেছে বটে কিন্তু ক্ষুধার্ত নয়। রাতের অন্ধকার থাকতেই হসপিটালের জন্য বেড়িয়ে যাওয়া, যদিও তাড়াতাড়ি ফেরা হয় কিন্তু ঝিনুক বেশির ভাগ সময়ে নিজের ঘরের মধ্যেই থাকে, বেশি ওর সামনে আসে না। রিশুও নিজের পড়াশুনা নিয়েই ব্যাস্ত থাকে, মাঝে মধ্যে খাওয়ার সময়ে এই দু’একটা কথা হয়, “বাড়িতে ফোন করেছিলে আজকে?” “সকালে কি খেলে?” ইত্যাদি ছোট ছোট প্রশ্ন, উত্তর বেশির ভাগ, হ্যাঁ আর না তেই সমাপ্ত হয়। মাঝে মাঝে যখন ঝিনুক নিজের মায়ের সাথে কথা বলে তখন টুকরো কিছু কথা কানে যায়, “হ্যাঁ হ্যাঁ বেশি বলতে হবে না জানি।” “আমি’ত বলিনি দিতে, তাহলে একা আমাকে কেন বলতে যাও। ওকেও ত বলতে পারো।” আবার কখন নিচু গলা শোনা যায়, “না, ও উঁচু গলায় কথা বলে না।” চুপ করে শুনে যায় ওর কথা, কি বলার আর কি বোঝার সেটা জানে রিশু, তাই বিশেষ ঘাঁটায় না ঝিনুককে।

মায়ের সাথেও যখন ওর কথাবার্তা হয়, তখন মা ওকে বিশেষ কোন জোর করে না, মা বোঝে এত তাড়াতাড়ি সব কিছু মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। গতকাল রাতেই যখন মায়ের সাথে কথা বলছিল তখন ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, “হ্যাঁ রে বাবা, সত্যি করে বল, কি ইচ্ছে তোর?” চুপচাপ মনে মনে হেসে ছিল রিশু, “জানিনা মাম্মা।”

ফুচকা খাওয়া শেষে রিশু ঝিনুক কে বলে, “আর কিছু খাবে?”

মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ায় ঝিনুক, “না বাবা আর নয়, অনেক হয়েছে।”

রিশু জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এবারে বাড়ি?”

মাথা দোলায় ঝিনুক, হ্যাঁ বাড়ি।

এবারে পারকিঙ্গের দিকে হাঁটার সময়ে রিশুর পাশাপাশি হাঁটে ঝিনুক, ঝিনুকের ছোট পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে এবারে আর তাড়াতাড়ি হাঁটে না রিশু। হাত ধরাধরি যদিও হয় না তবে মাঝে মাঝেই ওদের বাজু একে অপরকে ছুঁয়ে যায় মাঝে মাঝেই। অনেকদিন পরে ঝিনুককে মন খুলে একটু হাসতে দেখে ভীষণ ভালো লাগে। আবার সেই খাঁচায় ফিরে যেতে হবে ভেবেই ঝিনুকের একটু খারাপ লাগে। সবাই বিয়ের পরে কত নতুন জায়গায় ঘুরতে যায়, কিন্তু ঝিনুকের কপালে বন্দী খাঁচা ছাড়া আর কিছু জোটেনি। ঘুরতে গেলেও যাবে কার সাথে, যার সাথে যাবে সে এখন ওকে নিজের করে নিতে পারেনি হয়ত।

এত’কি সব সময়ে ভাবে মেয়েটা, মাঝে মাঝেই কোথায় যেন হারিয়ে যায়, পুরানো দিনের চিন্তা করে নাকি? হয়ত করে, জানা নেই ওর। হয়ত সেইজন্যে এখন পর্যন্ত মন খুলে ওর সাথে কথা বলতে পারেনি। ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ওর খুব ইচ্ছে হয়েছিল ঝিনুকের হাত ধরে, নরম কোমল পদ্ম কুড়ির মতন হাতের স্পর্শ, সকালের সেই কোমল স্পর্শের রেশ এখন যেন ওর হাতের মুঠোর মধ্যে লেগে। বাজুর দাগ গুলো কি মিলিয়ে গেছে? আর কোথায় কোথায় আঁচর কেটেছিল সেটা কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি রিশু।

বাইকে বসার সময়ে সব কটা ঝিনুকের হাতে ধরিয়ে দিতেই নরম কন্ঠেই বিরক্তি প্রকাশ করে, “এত গুলো আমি ধরব কি করে?”

হেসে ফেলে রিশু, “আচ্ছা তাহলে তুমি বাইক চালাও আমি তোমার পেছনে ব্যাগ নিয়ে বসি।”

আশে পাশের সব মেয়েদের হাত খালি, সেই মেয়েদের সাথে যে পুরুষেরা এসেছে তাদের হাতে ভর্তি ব্যাগ শুধু একমাত্র ঝিনুকের ক্ষেত্রেই অবস্থাটা উল্টো। ছাতার মাথা, কে জানত যে ডাক্তার শেষ পর্যন্ত এইভাবে ছল চাতুরি করবে, চোখে মুখে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমি অটো নিয়ে চলে যাবো কিন্তু।”

হেসে ফেলে রিশু, নাকের ডগা ইতিমধ্যে লাল হয়ে গেছে, ক্ষেপে গেছে সুন্দরী তাও মজা করার সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায়না রিশু, একটু দুষ্টুমি করেই বলে, “যাও কে মানা করেছে, বাড়ির চাবি কিন্তু...”

একটু হলেই কেঁদে ফেলত ঝিনুক, রাগে চোখ জ্বালা করতে শুরু করে দিয়েছিল প্রায়, “আচ্ছা আমিই নিয়ে নেব।”

মামদোবাজি পেয়েছে, রাস্তার মাঝে এইভাবে দাঁড়িয়ে মস্করা করা হচ্ছে ওর সাথে, আর একটু হলেই পা দাপিয়ে চলে যেত, কতবার এমন করেছে এর আগে, কিন্তু ডাক্তারের সামনে সেই পুরানো দুরন্তপনা দেখানর মতন শক্তি নেই ওর। চারপাশে লোকজন না হলে চেঁচিয়ে দিত ঝিনুক, কি লাগিয়েছ বলত? বাড়ি যাবে নাকি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? গোমড়া মুখ করে ব্যাগ গুলো কোন রকমে দুই হাতে জাপটে ধরে বাইকের পেছনে উঠে বসতে চেষ্টা করে।

যে মেয়ে কোনদিন এই সব কথায় কাঁদেনি বরং উল্টো অন্যকে কাঁদিয়ে এসেছে তার চোখে জলের রেখা দেখে হেসে ফেলে রিশু, বলতে যাচ্ছিল ওরে পাগলি মস্করাও বুঝিস না নাকি? তোকে একা ছেড়ে যেতে পারি নাকি? “দাও জ্যাকেট আর সালোয়ারের ব্যাগ গুলো দাও, ওগুলো সামনে নিয়ে নেব।”

ঠোঁটে (অনু)রাগ চোখে হাসি নিয়ে বেশ কয়েকটা ব্যাগ রিশুর হাতে ধরিয়ে দেয়, বাকি ব্যাগ গুলো নিয়ে বাইকের পেছনে বসে পরে ঝিনুক। কিছু ব্যাগ ওদের মাঝে ছিল বটে সেদিন, কিন্তু সেই সহস্র যোজনের ব্যাবধান আর ছিল না ওদের মাঝে। আসার সময়ে ওর কাঁধের ওপরে ছিল এক আলতো ছোঁয়া, ফিরে যাওয়ার সময়ে নরম হাতের স্পর্শ ছিল রিশুর কাঁধে, মাঝে মাঝেই সেই কোমল হাত ওর কাঁধ খামচে ধরত, মাঝে মাঝে অল্প ধাক্কা দুই শরীরের মাঝে। এবারে আর বলতে হয়নি যে শাল জড়াতে, বাইকে উঠেই কান মাথা শালে ঢেকে নিয়েছিল ঝিনুক। বুঝে গিয়েছিল খোলা বাইকে এই ঠান্ডায় ওর শরীর কাহিল হয়ে যাবে। অন্যদিনে বাজারে গেলে বারেবারে ঘড়ি দেখত রিশু, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে খাওয়া সেরে নিত, যে যার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ত। সেদিন আর ঘড়ির দিকে দেখার মতন সময় ছিল না ওদের হাতে। বাড়িটা কাছাকাছি না হলেই বেশ ভালো হত মনে হয়, সারাটা রাস্তা দুজনের মনের মধ্যে একটাই ইচ্ছে করছিল, আর একটু রাস্তা হলে ক্ষতি কি ছিল।

======================== পর্ব ছয় সমাপ্ত ========================
 
দারুণ হচ্ছে দাদা. চালিয়ে যান আছি আপনার সাথে ' বাকি গল্পটা দেন
 
পর্ব সাত – (#1-30)

অরথপেডিক ওপিডিতে ভীষণ চাপ, হসপিটাল পৌঁছে ঝিনুককে ফোন করে দিয়েছিল যে ভালো ভাবেই পৌঁছে গেছে। মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়েছিল দরজায়, যেন জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল কখন আসবে। রিশু নিজেই উত্তর দিয়েছিল, তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবে। গতকাল রাতে ওর বাড়ির সবার সাথে অনেকক্ষণ ভিডিও কলে গল্প চলেছিল, শপিং করেছিল বলে ঝিনুক বেশ খুশি ছিল। শুধু মাত্র রিশুর মা ছাড়া দুই বাড়ির কেউই জানে না যে ওরা দুজনে একসাথে এক বিছানায় শোয় না, দুইজনের ঘর আলাদা। প্রত্যেকদিন ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করে, কি রে কেমন আছিস? প্রত্যেক বার এই একটা ছোট প্রশ্নের মধ্যে অনেক বড় প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে, হেসে উত্তর দেয়, এই চলছে। হয়ত ওর মা যদি ঝিনুকের ব্যাপারে একটু রাখঢাক করে বলত তাহলে হয়ত ওর মানিয়ে নিতে এত অসুবিধে হত না। বারে বারে ঝিনুকের মেজাজি উদ্ধত ব্যাবহার গুলো মনে পড়তেই পা পিছিয়ে নেয় রিশু। চঞ্চল উচ্ছল সেই পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু জেদি বদরাগী মেজাজি মেয়েটার সাথে শেষ পর্যন্ত কতটা মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে সেটাই চিন্তার বিষয়। ছোট ভাই বোন দুটো ওর চোখের মণি, মায়ের আত্মত্যাগের সম্পর্কে অবগত রিশু। মাঝে মাঝেই ভীষণ ভাবে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পরে, গত পাঁচ ছয়দিনে এক নতুন ঝিনুকের আবির্ভাব অন্যদিকে আবার যদি খোলস থেকে সেই পুরানো ঝিনুক বেড়িয়ে পরে তখন কি করবে। দোদুল্যমান হৃদয় দোলা খায়, কার পাল্লা ভারী হবে সঠিক জানা নেই।

রোগী দেখার মাঝেই ব্রিজেশের ফোন আসে, “কি রে, কবে বিয়ের খাওয়া খাওয়াবি?”

উত্তর দেয় রিশু, “হবে রে হবে।”

ব্রিজেশ ছাড়ার পাত্র নয়, “ক্রিসমাস পার্টি হয়ে যাক।”

হেসে ফেলে রিশু, “আচ্ছা দেখা যাবে, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি।”

অট্টহাসিতে ফেটে পরে ব্রিজেশ, “পাঁচ দিন হল না বিয়ে হয়েছে এর মধ্যে বউয়ের আঁচলের তলায়। অহহহহহ না পারি না, আজকাল ত শাড়ি কেউ পরে না, তাহলে কি টপের তলায় নাকি রে?”

শেষের কথাটা কানে যেতেই লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় রিশুর, “তুই তোরটা দ্যাখ আমি আমারটা বুঝে নেব। আর হ্যাঁ, কোমল কেমন আছে?”

কোমল, ব্রিজেশের স্ত্রী, দক্ষিণ দিল্লীর একটা স্কুলের টিচার, গত বছরের শুরুর দিকে ওদের বিয়ে হয়েছিল। ব্রিজেশ উত্তর দেয়, “ভালো আছে, তোর বিয়েতে যেতে পারেনি ক্ষেপে আছে কিন্তু তোর ওপরে।”

হেসে দেয় রিশু, “আমি কিন্তু তোকে ফোন করেছিলাম, একদম বলবি না যে বলিনি।”

ব্রিজেশ ইয়ার্কি মেরে বলে, “হ্যাঁ, সকালে ফোন করলি যে বিয়ে চলে আয়, শালা এইভাবে একদিনে হসপিটাল ফেলে যাওয়া যায় নাকি।”

সেটা জানে রিশু, এইচওডি ওর ওপরে একটু বেশি সদয় কিন্তু সেটা সবার ওপরে প্রযোজ্য নয়। “আচ্ছা দিয়ে দেব, টুয়েন্টিফিফথে কোন হোটেলে সবাইকে ডিনার করাব।”

ব্রিজেশ জিজ্ঞেস করে, “ইন্দ্রিজিত ফিরেছে কি?”

উত্তর দেয় রিশু, “হ্যাঁ ফিরেছে, ফোনে একবার কথা হয়েছিল এর মাঝে।”

গত সপ্তাহে একবার ইন্দ্রিজিতের ফোন এসেছিল, ওদের ফেরার দিন কয়েক পরে ফিরে এসেছিল কোলকাতা থেকে। যেহেতু অন্য হসপিটালে চাকরি করে তাই আর কথাবার্তা হয়নি দেখাও হয়নি। ফোন ছাড়ার আগে ব্রিজেশ জানিয়ে দেয়, বিকেলের দিকে একটা ওটি আছে ওর, হিপ ফ্রাকচার। মাথা দোলায় রিশু, ভেবেছিল একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে, সেটা হয়ত কপালে নেই। ওটি তে ঢুকলে কখন বের হবে সঠিক জানা নেই।

সেই সকালে একবার ঝিনুকের সাথে আর মায়ের সাথে কথা হয়েছিল তারপরে আর হয়নি। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যায় কিন্তু রোগীর সংখ্যা কমে না, কারুর হাঁটুতে ব্যাথা, কারুর কাঁধে ব্যাথা, কারুর ঘাড়ে ব্যাথা, কেউ পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গেছে, একের পর এক পেশেন্ট এসেই চলেছে। এমন সময়ে একটা মেসেজ আসে ওর মোবাইলে, হয়ত এর জন্যেই অপেক্ষা করেছিল। অন্য দিনের মতন খুব ছোট মেসেজ, “লাঞ্চ হয়েছে?” ডান হাতে প্রেস্রিকপ্সান লিখতে লিখতে বা হাতের আঙ্গুল দিয়ে মোবাইল কি বোর্ড টিপে উত্তর দেয়, “না, এই যাবো। তুমি খেয়েছ?” সাধারণত এতদিন এর উত্তর আসত, “হ্যাঁ” অথবা “না”, তবে সেদিন একটু ভিন্ন আসে, “কখন খাবে? এতদেরি হয়ে গেল, দুটো বেজে গেছে।” মনে মনে হেসে ফেলে রিশু। সকালে রক্ত দেওয়ার পরে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে অনেকক্ষণ খ্যান খ্যান করেছিল ঝিনুক, উফফফ এখন ব্যাথা করে যে, কত গুলো রক্ত নিয়ে নিল এমনিতেই নাকি ওর শরীরে রক্ত কম। হেসে ফেলে রিশু, হাড়ের মজ্জা থেকে রক্তের সৃষ্টি হয়, বুঝাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেই মেয়ে কি আর বোঝে। রিশু মেসেজ করে, “খেয়ে নিও।” উত্তর আসে, “আচ্ছা খেয়ে নেব।” বিকেলে ওটি আছে, ফিরতে দেরি হবে, সেটা একবার জানিয়ে দেওয়া দরকার, “একটা এমারজেন্সি ওটি আছে, ফিরতে দেরি হবে।” এবারে খুব ছোট্ট উত্তর আসে, “ওকে।” বুঝে যায় রিশু, নিশ্চয় আশা করে বসেছিল বিকেলে একটু বাজারে বের হবে, নিজেরও একটু খারাপ লাগে বৈকি তাই এইচওডি কে বলে ট্রমা সেন্টারের ডিউটি বদলে ওপিডি ডিউটি করিয়ে নিয়েছিল।

সকালে রিশু বেড়িয়ে যাওয়ার পরেই স্নান সেরে নিয়েছিল ঝিনুক। কাজের লোক ভোর বেলা এসেই রিশুর টিফিন, দুপুরের রান্না আর বাড়ির কাজ সেরে চলে গিয়েছিল। রিশু বেড়িয়ে যাওয়ার পরে পুরো বাড়ি ফাঁকা। আবার করে গতদিনের কেনা জিনিস গুলো বিছানার ওপরে ছড়িয়ে একবার দেখে। জ্যাকেট দুটো ওর খুব পছন্দের, একটা লাল রঙের বড় ভারী জ্যাকেট অন্যটা অফ হোয়াইট রঙের ফারের লম্বা জ্যাকেট। খুব ইচ্ছে ছিল কয়েকটা জিন্স কেনে, কিন্তু মনের মধ্যে সংশয় ছিল যে রিশু ওকে জিন্স পড়তে দেবে কি না তাই আর জিন্স কেনেনি, তবে বাড়ি থেকে আনা বেশ কয়েকটা জিন্স আছে ওর। এই কয়দিন ওর মানসিক অনেক ধকল গেছে, সঠিক ভাবে নিজেকে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না এই বদ্ধ জীবনে তবে গতকাল শপিং যাওয়ার পর থেকে মেজাজ অনেক বেশি ফুরফুরে হয়ে গেছে ওর। শেষের মেসেজটা পড়ে বেশ খারাপ লাগে, আবার দেরি হবে, মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। দুপুরে একা একা খেতে বেশ খারাপ লাগে, কিন্তু কিছুই করার নেই ওর। খাওয়া সেরে টিভিতে একটা সিনেমা দেখতে দেখতে ভাবে, বন্ধু বান্ধবী কেউই নেই দিল্লীতে যার সাথে একটু বেড়াতে যাবে অথবা মনের কথা খুলে বলবে, এখানে কাউকেই চেনে না ঠিক ভাবে।

দুই দিনের মধ্যে ওদের ছোট মেসেজ গুলো একটু একটু বড় হয়, একটা বাক্যের জায়গায় দুটো তিনটে বাক্য। সেদিন সকালেই এইচওডি ধিলোন স্যার ওকে জানিয়ে দিয়েছিল যে পরের বছর জানুয়ারি মাসের মাঝের দিকে রয়াল ন্যাশানাল অরথোপেডিক হসপিটালে একটা সেমিনার উপলক্ষে ওকে ইংল্যান্ড যেতে হবে আর সেই সাথে ট্রেনিং আছে। সেমিনারে যাবে শুনে ভীষণ খুশি হয় রিশু, ওর ব্যাচের এখন পর্যন্ত কেউই হসপিটালের তরফ থেকে বাইরে যায়নি, যারা গেছে তারা বেশির ভাগ নিজের খরচে গেছে। অবশ্য অনেক সময়ে বাইরের হসপিটাল কনফারেন্সের জন্য টাকা দেয়, তবে এখন সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ওর পরের পেপারে এই ট্রেনিং অনেক সাহায্য করবে, এক দিকে বাড়িতে নব বিবাহিতা স্ত্রী অন্যদিকে পড়াশুনা হসপিটাল আর কেরিয়ার, একটু ভাবনায় পরে যায় রিশু। সময় হলে জানিয়ে দেবে ঝিনুককে, যদি ততদিনে ওদের মাঝের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায় তাহলে সাথে নিয়ে যাবে। এতদিনে এক পা এক পা করে এগোলেও পথ এখন অনেক বাকি।

সেদিন আর মেসেজ না করে দুপুরে খাওয়ার সময়ে রিশু ফোন করে ঝিনুককে, “কি করছ?”

মোবাইলে রিশুর ছবি দেখে একটু খুশি হয়, বিগত কয়েকদিনে শুধু মাত্র মেসেজেই কথাবার্তা হত ওদের, হসপিটাল থেকে বিশেষ একটা ফোন করত না। “এই’ত টিভিতে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি দিচ্ছিল সেটা দেখছি। তোমার খাওয়া হল?”

এর আগে কাজের মেয়ে রাতে আসত ওর বাড়িতে, টিফিনের এই ব্যাপারটা ছিল না, ক্যান্টিনে যা পাওয়া যেত তাই খেতে হত। ঝিনুক আসার পরে টিফিন বক্স কেনা হয়, অন্যদের মতন বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসে, যদিও রান্না নব বিবাহিতা স্ত্রীর হাতের নয় তাও টিফিন খুলে খেতে বেশ ভালো লাগে রিশুর। ব্লাড রিপোর্ট আর ইউরিন রিপোরট এসে গিয়েছিল, গায়নোকোলজিস্ট সঞ্জনা ম্যাডামকে দেখিয়েছিল ঝিনুকের রিপোর্ট, ইউরিনে এমোনিয়ার গন্ধ পেয়েই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল রিশু, সিস্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে একটু। একটা ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন যে অনেক জল আর ফল খেতে। কথায় কথায় একটা প্রশ্ন করেছিল রিশু, সঞ্জনা ম্যাডামের উত্তরে ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায়, এত তাড়া কিসের, এক সপ্তাহ হয়নি বিয়ে হয়েছে এর মধ্যেই? সেই সব ব্যাপার ঝিনুককে জানায়নি যদিও, তবে রোজদিন বাড়ি ফেরার সময়ে যা ফল পেত কিনে নিয়ে যেত ঝিনুকের জন্য। মেয়েটা জল অনেক কম খায়, বারবার বললেও শোনে না।

বাড়ি থেকে আনা টিফিন খুলে খাওয়া শুরু করে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ এই খাচ্ছি। তুমি ফল গুলো খেয়েছ?”

লাজুক হাসে ঝিনুক, সঠিক ভাবে জানে না ওর ইউরিন আর ব্লাড রিপোরটে কি পেয়েছে রিশু তবে রিপোর্ট পাওয়ায় পর দিন থেকে ওর জন্য আপেল, কলা, কমলালেবু যা ফল পায় সেইগুলো নিয়ে আসে। রোজ রাতে একটা করে ক্যালসিয়াম আর আয়রন ট্যাবলেট খেতে হয়। বাড়িতে থাকাকালীন এতফল কোনদিন খায়নি ঝিনুক, এখানে ডাক্তারের পাল্লায় পরে রোজ সকালের খাওয়ার পরে ফল খেতে হয়, মুসাম্বির জুস খেতে হয়। মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্তি লাগে আবার সেই সাথে ভালো লাগে, অদ্ভুত এক মিশ্রিত অনুভব হৃদয়ে দোলা দেয়।

বিছানায় আধা শোয়া হয়ে পা দুলাতে দুলাতে লাজুক হেসে উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ বাবা সব শেষ করেছি।”

দুষ্টু মিষ্টি বিরক্তি ভাব দেখে হেসে ফেলে রিশু, ওর ভালো লাগে বলে এখন পায়ের নুপুর খোলেনি, “আজ তাড়াতাড়ি ফিরব, কোথাও যাবে নাকি?”

কোথায় আর নিয়ে যাবে, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত সেই’ত এই সামনের বাজারে। বাজার থেকে আনার কিছুই নেই, দেখার কিছুই নেই শুধু বাজার ছাড়া তাই মানা করে দেয় ঝিনুক, “না থাক। আজকে আবার ওটি আছে নাকি?”

একদম মায়ের মতন প্রশ্ন, একদিন দেরি হয়েছিল বটে তবে কোন প্রকার রাগ প্রকাশ করেনি ঝিনুক। হেসে উত্তর দেয়, “না খালি ওপিডি আছে।” দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে শেষ পর্যন্ত ফোন রেখে দেয়, “রাখছি, বের হওয়ার আগে ফোন করব।”

অল্প সুর টানে ঝিনুক, “আচ্ছাআআ...”

ফোন রাখার পরে হটাত ওর খুব নাচতে ইচ্ছে করে, ছোট বেলায় রানীগঞ্জে থাকাকালীন আষাঢ়ের প্রথম বারিধারায় ভিজতে ভিজতে যেমন ভাবে নাচানাচি করত, ঠিক তেমনি ভাবে এই ঘরের মধ্যেই ওর খুব নাচতে ইচ্ছে করে। বাইরে বের হতে খুব ইচ্ছে করে আর ভালো লাগে না এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে সারাদিন বসে। এর আগে এইভাবে এতদিন টানা ঘর বন্দী হয়ে থাকেনি, কিন্তু এখানে কাউকেই চেনে না কার সাথে বের হবে। ডাক্তারের ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে হয়ে যায়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে এসেও হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়ে ওকে নিয়ে এই সামনের বাজারে বের হয়। ওর ক্লান্ত চেহারা দেখে তখন ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে যায়। এই সব ভাবতে ভাবতে আবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, ধ্যাত শুধু এই চার দেওয়াল। একটা সিগারেট পেলে ভালো হত, মাথাটা বড্ড কেমন কেমন করছে।

এমন সময়ে রিতিকার ফোন পেয়ে বেশ ভালো লাগে ঝিনুকের। রিতিকা ফোন করেই প্রশ্নের জালে জর্জরিত করে দেয় ওকে, “কি রে কি করছিস? কোথায় হানিমুনে গেলি? সেই সেদিন ফোন করার পরে একদিন ও ফোন করলি না। ডাক্তার বাবু কেমন আছে?”

হেসে ফেলে ঝিনুক, এত কথা রিতিকার সাথে আগে কোনদিন করেনি। উত্তর দেয়, “না রে, হসপিটালে খুব ব্যাস্ত থাকে তাই এখন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ছুটি পেলেই যাবো ভাবছি। তুই কেমন আছিস?”

রিতিকা হেসে উত্তর দেয়, “দারুন আছি রে। তোর খবর বল।”

কেমন আছে ঝিনুক, ভালো মন্দ মিশিয়ে মোটামুটি আছে। পার্থের দেওয়া ঘা এখন সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়নি ওর বুক থেকে তাও রিশুর সাথে এইমাত্র বলা কথা গুলো ওর বুক ভরিয়ে দেয়, “আমি ভালো আছি রে।”

রিতিকা জিজ্ঞেস করে, “বেড়াতে যাবি, শপিং?”

মুখ ব্যাজার করে উত্তর দেয় ঝিনুক, “না রে, কি করে বের হব বল ওকে বলা হয়নি।”

একটু থেমে ওকে জিজ্ঞেস করে রিতিকা, “টুয়েন্টিফিফথ কি করছিস?”

কোলকাতা থাকলে না হয় বন্ধু বান্ধবী মিলে কোন ডিস্কোতে গিয়ে পার্টি করত, এখানে সে গুড়ে বালি, মুখ ব্যাজার করে উত্তর দেয়, “জানি না রে।”

হেসে ফেলে রিতিকা, “ইসসস আমাদের ব্যাচের মোস্ট বিউটিফুল পার্টি এনিম্যাল একদম খাঁচায় বন্দী হয়ে গেছে দেখছি।”

হেসে ফেলে ঝিনুক, “আচ্ছা কমপ্লিমেন্টস শুধু আমার একার নাকি? তুই কম করেছিস পার্টি?”

রিতিকা হেসে দেয়, “আমি ত এখন পার্টি করে যাচ্ছি রে।”

রিতিকার কথা শুনে একটু হিংসে হয় ঝিনুকের, সুন্দরী বলে দুই মেয়ের বেশ নামডাক ছিল কলেজে। রিতিকা এখন পাখীর মতন উড়ছে আর ঝিনুক খাঁচায় বন্দী, “কি করব কপাল।” বলেই হেসে ফেলে।

রিতিকা গলা নামিয়ে প্রশ্ন করে, “একটা সত্যি কথা বলবি?” ঝিনুক ভেবে পায় না কি প্রশ্ন করতে চলেছে। রিতিকা জিজ্ঞেস করে, “পার্থের সাথে আসলে কি ঝামেলা হয়েছিল?”

পার্থের নাম কানে যেতেই কান লাল হয়ে যায় ঝিনুকের, যে ঘটনা ভুলতে চায় সেই সব আবার কেন মনে করিয়ে দেয় এই মেয়েটা? একটু বিরক্ত হয়েই উত্তর দেয়, “হয়েছিল কিছু ছাড় সেই সব কথা।”

রিতিকা বুঝতে পারে যে ঝিনুক সেই পুরানো ব্যাথা গুলো ভুলতে চাইছে তাই ওর মন রাখার জন্য বলে, “আচ্ছা বাবা, সরি। কাল কি করছিস? বের হবি শপিং করতে?”

হেসে ফেলে ঝিনুক, বাইরে যাওয়ার নাম শুনেই ছটফট করে ওঠে ওর হৃদয়, “আচ্ছা ও এলে জিজ্ঞেস করে নেব। কাল সকালে তোকে জানিয়ে দেব।”

রিতিকা ফোনের মধ্যেই একটা চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “চল ডারলিং লেটস পেন্ট দ্যা টাউন রেড।”

খিলখিল করে হেসে ফেলে ঝিনুক, কলেজে যাকে দেখতে পারত না সেই মেয়ে আজকে ওকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বলছে, ওর জীবনে একের পর এক নতুন আলোর ছটা দেখা দিচ্ছে, “ডেফিনিটলি ডারলিং।” বলেই দুই বান্ধবী হেসে ফেলে।
 
পর্ব সাত – (#2-31)

ওপিডি শেষ, তারপরে কাজের রিপোর্ট জমা দেওয়া, ফারস্ট ইয়ারের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে একটু পড়াশুনা নিয়ে আলাপ আলোচনা, এই সব সেরে যখন বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ায় তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। প্রত্যকেদিন ভাবে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোন কাজ এসে পরে আর ঠিক সময়ে কোনদিন বের হওয়া যায় না। ঝিনুকের কথা মনে পড়তেই মনে মনে হেসে ফেলে রিশু। এত দিনেও তার সাথে ঠিক ভাবে পরিচয় করা হয়ে ওঠেনি, কি ভালোবাসে, কিসে অপছন্দ, এরপর কি করতে চায় কিছুই জানে না, শুধু জানে যে মেয়েটা সাজতে ভীষণ ভালোবাসে, একটু ভুলো মনের, স্নানের পরে জামা কাপড় গুলো সেই বাথরুমেই পরে থাকে, বিকেলে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে নিজেই ওর জামা কাপড় গুলো বারান্দায় শুকাতে দেয়। তখন ঝিনুকের মনে পরে যে নিজের জামা কাপড় শুকাতে দেয়নি আর তখন ওর হাত থেকে নিয়ে যায়। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, সেই সাথে বুঝতে চেষ্টা করে দুষ্টু মিষ্টি ঝিনুকের মানসিক অবস্থা। যখন চন্দ্রিকা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন চন্দ্রিকাকে ভোলার জন্য ওর কাছে অঢেল সময় ছিল, পড়াশুনায় নিজেকে ডুবিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু ঝিনুকের বয়স সবে মাত্র তেইশ, একদিনের মধ্যে ওর ওপরে যে ঝঞ্ঝা গেছে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসা দুস্কর। নিজেকেই প্রশ্ন করে রিশু, পা বাড়াতে দ্বিধা কেন? শুধু কি মেয়েটা একটু দুরন্ত আর অবাধ্য ছিল তাই? ওদের বিয়ের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, সেই দুরন্তপনার কিছুই ওর চোখে পরেনি, তার চেয়ে ওর বাড়িতে যে তন্বী তরুণীর বাস তার ফর্সা পায়ের সুগোল গোড়ালিতে বাঁধা নুপুরের নিক্কনে রোজ সকালে আনমনা হয়ে যায় রিশুর চিত্ত।

পারকিঙ্গের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রিশু মাকে ফোন করে, সারাদিনের খবরা খবর না জানানো পর্যন্ত ওর স্বস্তি হত না, অন্যপাশে ওর মা সারাদিন উন্মুখ হয়ে থাকে ছেলের ফোনের জন্য। প্রত্যকে বারের মতন এক প্রশ্ন মায়ের, কেমন আছিস বাবা? এই চলছে, ছাড়া এর বেশি আর কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না আজকাল। আগে এর উত্তরে অনেক কিছু বলার থাকত ওর কাছে, আজকে হসপিটালে এই করেছে, কত গুলো অপারেশান হয়েছে, কাজের মেয়ে কি রান্না করে গেছে, ঠান্ডা কেমন পড়েছে ইত্যাদি। ভাই বোনের স্কুলের পরীক্ষা চলছে, মাঝে মাঝে দিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, রাতে ইন্টারনেট ঘেঁটে সেই উত্তর খুঁজে মেসেজ করে পাঠিয়ে দেয়। মাকে জানিয়ে দেয় আগামী জানুয়ারিতে লন্ডনের সেমিনারে যাওয়ার ব্যাপারে। মা ভীষণ খুশি তবে প্রশ্ন করেছিল যে ততদিন ঝিনুক কোথায় থাকবে। এর উত্তর এখন জানে না রিশু, পরিচয়ের পরিধি যদি বাড়ে ততদিনে তাহলে সঙ্গে নিয়ে যাবে এটাই ভেবে রেখেছিল।

মায়ের ফোন রাখতেই মোবাইলে মেসেজের আওয়াজ আসে, খুলে দেখে ঝিনুকের মেসেজ, “কখন ফিরবে?”

মুচকি হেসে মাথা দোলায় রিশু, উত্তর লিখে পাঠায়, “বেড়িয়ে গেছি।”

সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসে ঝিনুকের, “কতক্ষনে লাগবে আসতে? চা বসিয়ে দেব?”

উচ্ছল চপলার কন্ঠস্বর শুনে হেসে ফেলে রিশু, “পরে বানিও, জ্যামে ফেঁসে গেলে কতক্ষন লাগবে জানি না।”

জ্যামের কথা শুনে দমে যায় ঝিনুক, ভারাক্রান্ত মনেই উত্তর দেয়, “আচ্ছা, সাবধানে এসো। আজকে আবার ঠান্ডাটা খুব বেশি করেই পড়েছে।”

কথাটা শুনে ভীষণ ভালো লাগে রিশুর, এতদিন এই ধরনের দুশ্চিন্তার ভাবনা কি আসেনি ওর মধ্যে? হয়ত এসেছে কিন্তু এতদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি। রিশুও নিজে আগ বাড়িয়ে কোনদিন সেই ধরনের কোন উক্তি প্রকাশ করেনি ঝিনুকের সমক্ষে। পুরুষ শাসিত সমাজে ওকেই সরবাগ্রে পদক্ষেপ নিতে হবে, কিন্তু যে ঝিনুকের কথা শুনেছে সেই ঝিনুক কি কোনদিন ওর সমক্ষে আসবে না। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, বারবার সেই ছবিটার কথা মনে পরে যায়, প্রথমদিনে ওর বোন গাড়িতে যে ঝিনুকের ছবি দেখিয়েছিল।

ঝিনুকের ফোন রাখা মাত্র ইন্দ্রিজিতের ফোন আসে, “কি রে কি ব্যাপার, একদম উধাও হয়ে গেলি?”

হেসে ফেলে রিশু, “বিয়ের পরে পালিয়ে গেলি, দিল্লী ফিরে সেই যে একবার ফোন করলি তারপর তোর আর দেখা নেই যে। আবার আমাকে কেন বলতে যাস।”

ইন্দ্রজিত উত্তর দেয়, “ওকে বস, আমরা দুইজনে এই পৌঁছে যাচ্ছি তোর বাড়ি। ডিনার কিন্তু তোর তরফ থেকে।”

রিশু উত্তর দেয়, “আচ্ছা আয়, ডিনার বাইরে কোথাও করে নেব।”

ইন্দ্রজিত অবাক হয়েই প্রশ্ন করে, “বাইরে কেন?”

হেসে ফেলে রিশু, “না মানে এখন ঝিনুক ঠিক ভাবে সড়গড় নয়, নতুন জায়গা তাই এখন রান্না করে না। ওই কাজের লোকটাই রান্না করে যায়।”

ইন্দ্রজিত কিছুক্ষন চুপ থাকার পরে জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে ত?”

কি উত্তর দেবে, মা আর বোনের পরে এই ইন্দ্রজিত আর শালিনী, এদের কাছে কিছুই লুকায় না রিশু। তবে ইদানিং মা ছাড়া আর কাউকে সব কথা জানায় না তাই উত্তর দেয়, “বিন্দাস আছি রে, তুই বাড়ি আয়।”

শালিনী ইন্দ্রজিতের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “ভাইয়া, আমরা কিন্তু তোমার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি প্রায়।”

শালিনীর কথা শুনে রিশু অবাক হয়ে যায় ওরা যে এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছে যাবে সেটা আশা করেনি। বিয়ের সময়ে ঝিনুকের সাথে ইন্দ্রজিত আর শালিনীর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি কারণ ওদের মাঝে কোন কথাবার্তা হয়নি সেই সময়ে। বাড়িতে ঝিনুক একা ভেবেই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পরে রিশু, সঙ্গে সঙ্গে ওদের বলে, “আরে, ঝিনুক একা বাড়িতে।”

হেসে ফেলে শালিনী, “না না, ভাবীকে নিয়ে পালাচ্ছি না চিন্তা নেই।”

হেসে ফেলে রিশু, “আচ্ছা আমি ঝিনুককে ফোন করে দিচ্ছি।”

ওদের ফোন রেখে আবার ঝিনুককে ফোন করে রিশু জানিয়ে দেয় ইন্দ্রজিত আর শালিনীর আসার কথা। কলেজে থাকাকালীন মেয়েদের সাথে গায়ে পরে খেজুরে আলাপ করত ইন্দ্রজিত, যদিও এখন আর সেইভাবে কোন মেয়েদের সাথে গায়ে পরে আলাপ পরিচিতি করে না তবুও ঝিনুকের ব্যাপারে মনের কোন এক গভীর কোনায় অধিকারবোধ জেগে ওঠে, যতই হোক ওর বিবাহিতা স্ত্রী। হেলমেট পরে তাড়াতাড়ি বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পরে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

যদিও একটু দোনামনা করছিল ঝিনুক, রিশুর অবর্তমানে কোন অচেনা মানুষের সাথে কিভাবে কথাবার্তা বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছিল না, কিন্তু রিশু জানিয়েছে যে ইন্দ্রজিত ওর প্রিয় বন্ধু তাই কিছু বলতে পারেনি। বলার জন্য অনেক কিছুই ভেবে রেখেছিল, বাড়িতে একা একা থাকতে থাকতে ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল ওর, রিতিকার সাথে পরেরদিন বেড়াতে যাওয়ার কথা একটু বুঝে শুনে বলতে হবে তার জন্য নিজেকে তৈরি করেছিল। ভেবেছিল রিশু এলে এক সাথে চা খেতে খেতে রিতিকার ব্যাপারে জানাবে। এই সুদুর দিল্লীতে রিতিকা ছাড়া আর কোন জানাশোনা নেই। অগত্যা রিশুর বন্ধু এবং বন্ধু পত্নীর আগমন হবে শুনে একটা সালোয়ার কামিজ পরে তৈরি হয়ে নেয় ঝিনুক। দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধুক করে ওঠে ওর। অপরিচিত মানুষ কিন্তু রিশুর প্রিয় বন্ধু কেমন ভাবে তাদের আদর আপ্যায়ন করবে সেটা ভেবেই পায়না। দরজা খুলে শালিনী আর ইন্দ্রজিতকে দেখে কি ভাবে সম্বোধন করবে ভেবে পায় না ঝিনুক। বার্তালাপ ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে শুরু হয় কারণ শালিনী অথবা ইন্দ্রজিত কেউই বাংলা জানে না।

শালিনী ওর ইতস্তত ভাব দেখে হেসে ওর হাত ধরে বলে, “আমি শালিনী, বিয়েতে ঠিক ভাবে পরিচয় হল না।”

কি বলবে ভেবে পায়না ঝিনুক, প্রত্যুত্তরে একটু হেসে বলে, “হ্যাঁ, অনেক ঝামেলার মধ্যে সবাই ছিলাম। আপনারা আসবেন জানিয়ে ও এই একটু আগেই ফোন করেছিল।”

বাইরের মানুষের সামনে রিশুকে কি ভাবে সম্বোধন করবে সেটা ভেবে পায় না। মায়ের সাথে কথা বলার সময়ে রিশুর নাম হয়ে যায় “তোমার জামাই” বোনের সাথে কথা বলার সময় সেটা পালটে যায় “তোর জিজু” কিন্তু নিজের ঠোঁটে আজ পর্যন্ত নাম নিতে পারেনি, “এইযে” বলেই বরাবর সম্বোধন করে গেছে।

ইন্দ্রজিত ঝিনুকের সামনে একটু ঝুঁকে হেসে বলে, “রোজ ইজ ভেরি ডাল ইনফ্রন্ট অফ ইউ (গোলাপ তোমার সামনে তুচ্ছ), থ্রিবার্ড অর ক্যাটলেয়া অর্কিড? এইবারে বুঝেছি ব্যাটা এক রাতের মধ্যে কেন দৌড়াতে দৌড়াতে কোলকাতা পৌঁছে গেল।”

মনে মনে হেসে ফেলে ঝিনুক, ডাক্তার ওর জন্য কোলকাতা দৌড়ে যায়নি, গিয়েছিল নিজের ভাইয়ের হাত ভাঙ্গার কথা শুনে। ইন্দ্রজিতের কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায়। যে অর্কিড ফুলের নাম বলল ইন্দ্রজিত তার একটারও নাম কোনদিন শোনেনি। একেবারে অচেনা মানুষের মুখ থেকে এই ধরনের কথাবার্তা একদম আশা করেনি।

শালিনী স্বামীকে মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে, “আরে তুমি থামবে। এসেই শুরু করে দিয়েছ?” তারপরে ঝিনুককে সোফায় বসিয়ে হাত ধরে বলে, “সো, ভাইয়া কখন ফিরবে বলেছে?”

ঝিনুক উত্তরে বলে, “হস্পিটাল থেকে বেড়িয়ে পড়েছে, এই কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসবে।”

ইন্দ্রজিত নিজেই রান্না ঘরে ঢুকে একটা ডেকচিতে চায়ের জল বসিয়ে দিয়ে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে, “ও ব্যাটা ত গরম জল গেলে, তুমিও কি ওর সাথে গরম জল খাও নাকি?”

হটাত করে ইন্দ্রজিতকে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাতে দেখে, ঝিনুক ভীষণ ভাবেই অপ্রস্তুত হয়ে পরে। ও সঙ্গে সঙ্গে সোফা ছেড়ে উঠে বাধা দিয়ে বলে, “এই না না আপনাকে চা বানাতে হবে না, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

শালিনী ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে হেসে বলে, “তুমি এই বাড়িতে নতুন, এখানে আমাদের যাওয়ার আসা বিগত ছয় বছর ধরে। ও যা করছে করতে দাও, তুমি আমার পাশে বস।” ওর গালে হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, “আর ওই আপনি বলা ছাড়তে হবে কিন্তু। নো ফরমালিটিস, উই আর ফ্রেন্ডস।” শালিনীর কথা শুনে বেশ ভালো লাগে ঝিনুকের।

চা বানাতে বানাতে রান্নাঘর থেকেই ইন্দ্রজিত ওদের উদ্দেশ্যে বলে, “গেট রেডি, আমরা আজকে বাইরে ডিনার করব।”

ইন্দ্রজিতের কথায় ভীষণ ভাবেই অপ্রস্তুত হয়ে পরে ঝিনুক তাই আমতা আমতা করে বলে, “ও আসুক তারপরে না হয়ে...”

ইন্দ্রজিত হেসে ফেলে, “ও ব্যাটার জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই, আমরা তোমাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যেতে এসেছি।”

শালিনীও হেসে বলে, “ভাইয়া কে চেনা আছে, বাড়ি ফিরবে তারপর স্নান করবে, এপাশ ওপাশ ধপাস করবে তারপরে আবার জামা কাপড় পড়বে তাতে অনেক দেরি, তুমি রেডি হও তাহলে ভাইয়া আর বেশি দেরি করতে পারবে না।”

হয়ত সেই রিশু আর নেই, বাড়ি ফিরেই সব থেকে আগে স্নান সেরে কোন মতে এক কাপ চা খেয়েই ওকে জিজ্ঞেস করে বাজারে যাওয়ার কথা। ঝিনুক তাও ওদের বলে, “না মানে ক্লান্ত হয়ে আসবে এসেই আবার...”

শালিনী চোখ টিপে হেসে বলে, “আচ্ছাআআ, ভাইয়ার জন্য এত চিন্তা?”

লজ্জায় পরে যায় ঝিনুক, প্রত্যেক দিন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে কিছু কেনাকাটা না থাকলেও ওকে নিয়ে এই সামনের বাজারে যায়। ঝিনুক বুঝতে পারে যে রিশু অন্তত এটা বোঝে যে সারাদিন ও একা একা বাড়িতে থেকে একঘেয়ে হয়ে যায়। রিশু কোনদিন ওর পোশাকের দিকে নজর দেয়নি তাও রিশুর মার্জিত স্বভাব পাশে আধুনিক পোশাক অর্থাৎ জিনস টপ শারট ইত্যাদি পরে বের হতে কেমন যেন লাগে। কথায় গল্পে ঝিনুক জানতে পারে যে শালিনী আর ইন্দ্রজিত দুইজনেই ডাক্তার, শালিনী নিওন্যাটালোজিস্ট আর ইন্দ্রজিত জেনারেল মেডিসিন নিয়ে এমডি করেছে। এরা সবাই কত শিক্ষিত ভেবেই নিজেকে খুব হীন বলে মনে হয় ওর, কিন্তু শালিনীর মিষ্টি ব্যাবহারের ফলে সেই জড়তা কিছুক্ষনের মধ্যেই কেটে যায়। ওদের সাথে গল্প করলেও ঝিনুকের কান সজাগ ছিল, অপেক্ষায় ছিল কখন রিশুর বাইকের আওয়াজ শুনতে পাবে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওর চিরপরিচিত বাইকের আওয়াজ শুনেই মনে হল দৌড়ে বারান্দায় যায়, কিন্তু শালিনী আর ইন্দ্রজিত থাকার ফলে সেই উত্তেজনা দমন করে নেয়।

কিছুক্ষনের পরে দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে ঝিনুক হেসে বলে, “ওই শেষ পর্যন্ত এসে গেছে।”

বাইক পার্ক করার সময়ে রোজদিনের মতন একবার ওর ফ্লাটের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখে, না সেদিন আর দাঁড়িয়ে নেই, বুঝতে দেরি হয় না যে এতক্ষনে নিশ্চয় ইন্দ্রজিত আর শালিনী ওর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি চেপে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলে বাজায়। ঝিনুক যেন দরজার কাছেই অপেক্ষা করেছিল, কলিং বেলের আওয়াজ শেষ হওয়ার আগেই দরজা খুলে দেয়। ঝিনুকের চোখের মিষ্টি হাসির টানে ক্ষনিকের জন্য সব কিছু ভুলে যায় রিশু।

ইন্দ্রজিত ঝিনুকের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে দেখে হেসে ফেলে বলে, “আরে ভাই নিজের বাড়ি ইয়ার, ঢুকে পর, ওইখানে অত দাঁড়িয়ে কি হবে।”

হেসে ফেলে রিশু, “এতদিন পরে তোর আসার সময় হল?”

ইন্দ্রজিত ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বোকা... আমি ত তাও এসেছি, তুই ত এসে শুধু একবার ফোন করলি।”

রিশু হেসে উত্তর দেয়, “কাজের চাপে আছি ভাই।”

ইন্দ্রজিত উত্তর দেয়, “বালের ঢপের চপ। চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে আজকে বাইরে ডিনার করব।”

রিশুর হাত থেকে ব্যাগ আর এপ্রন নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় ঝিনুক। বাকিদের অলক্ষ্যে ঝিনুকের দিকে একটু মাথা নুইয়ে একটু হেসে ওর হাতের ব্যাগ দিয়ে দেয়। সেই প্রথম দিনে এক বার ঝিনুক ওর হাত থেকে ব্যাগ নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিল, সেদিন বারণ করে দেওয়ার পরে কোনদিন নিজের গন্ডি উলঙ্ঘন করেনি। ঝিনুক ওর ব্যাগ, এপ্রন আর স্টেথো নিয়ে ছোট ঘরের দিকে রাখতে চলে যায়। ইন্দ্রজিতের সাথে কথা বললেও ওর চোখ আটকে থাকে ঝিনুকের চলে যাওয়া দিকে। ভারী নিতম্বের দুলুনি, ছোট ছোট পায়ের চলন আর পিঠের ওপরে ঢেউ খেলানো চুলের আলোড়ন রিশুর বুকের রক্ত জলে ভরা ঘড়ার মতন ছলাত ছলাত করে ওঠে। উফফ মেয়েটা সত্যি মন কাড়তে ওস্তাদ। কোথায় ছিল এই রূপ? রোজদিন যেন এক নতুন রূপে ওর সামনে আবির্ভাব হয় ওর প্রেয়সী, যেন চোখের ভাষায় ওকে সাবধান করে বলে, শুধু দেখবে ছুঁতে অত সহজে দেব না। ঠিক যেন কারটুনের টম আর জেরির খেলা, কে কাকে বেশি উত্যক্ত করে তুলতে পারে সেই নিয়েই এদের যুদ্ধ।
 
পর্ব সাত – (#3-32)

রিশুর চোখের চাহনি দেখে শালিনী হেসে ফেলে, “ভাইয়া, ঝিনুক কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না।”

শালিনীর কথা শুনে লজ্জায় পরে যায় রিশু, হেসে ওকে বলে, “হটাত বাইরে ডিনার কেন? বাড়িতেই অর্ডার করে দিচ্ছি।”

ইন্দ্রজিত নাছোড়বান্দা, “না না, ও সব হবে না। আমি অলরেডি একটা বড় রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করে ফেলেছি।”

অবাক হয়ে যায় রিশু, “মানে?”

শালিনী হেসে বলে, “সারপ্রাইজ আছে ভাইয়া, তুমি তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডি হয়ে নাও।” ঝিনুক নিজের শোয়ার ঘরের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওর দিকে তাকিয়ে শালিনী বলে, “এবারে ঠিক আছে ত? তুমিও রেডি হয়ে নাও।”

রিশু আর ঝিনুকের চোখে চোখে কথা হয়, ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, কি করবে। রিশুর কাছ থেকে উত্তর আসে, ও নিরুপায়, সুতরাং তৈরি হতেই হবে। তৈরি হতে হবে শুনে ভীষণ ভাবনায় পরে যায় ঝিনুক, শাড়ি পড়তে নারাজ, একা একা শাড়ি পড়তে জানে না, ভালো সালোয়ার কামিজ বলতে বিশেষ নেই। আলমারি খুলে দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করে দেয় কি পরা যায়। শালিনীর পরনে জিন্স শারট আর একটা লম্বা ফারের জ্যাকেট, তার সাথে মিলিয়ে কি কিছু পড়বে? জিন্স শারট ফারের জ্যাকেট ওর কাছে আছে বটে কিন্তু রিশুর সামনে কোনদিন জিন্স পরেনি। রিশুকে শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে বুকে একটু বল পায় ঝিনুক।

খোলা আলমারির সামনে ওকে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই রিশুর বুঝতে পারে যে পোশাকের ব্যাপারে ঝিনুক ধন্দে পরে গেছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আলমারির ভেতরে একবার চোখ বুলিয়ে বলে, “সেদিন একটা ওফ হোয়াইট জ্যাকেট কিনে ছিলে না?” মাথা দোলায় ঝিনুক, হ্যাঁ। রিশু বলে, “বাইরে কিন্তু অনেক ঠান্ডা, ওটা পরে নিও।”

ঝিনুক প্রশ্ন করে, “আর?”

স্মিত হাসে রিশু, যেকোনো পোশাকেই ঝিনুককে মানায়, ওর সামনে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি পছন্দ?”

এতটাই ঝুঁকে এসেছিল রিশুর মাথা ওর মুখের সামনে যে ওর সারা মুখ ভেসে গিয়েছিল রিশুর উষ্ণ শ্বাসে। খানিকটা ইতস্তত করেই নরম গলায় ঝিনুক ওকে জিজ্ঞেস করে, “জিন্স পড়ব?”

জিন্স শুনেই বুকের ভেতরটা উফফ করে ওঠে রিশুর। ছবিতেই ঝিনুককে জিন্স পড়তে দেখেছে, আলমারির মধ্যে আরো অনেক ধরনের সাম্প্রতিক কালের ডিজাইনার পোশাক আসাকে ভর্তি, মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে হয় ওই পোশাকে ঝিনুককে দেখতে।
মৃদু হেসে রিশু সম্মতি দেয়, “হ্যাঁ, পর কে মানা করেছে।”

আলমারি থেকে জিন্স বার করার পরে নিজের অজান্তেই আচমকা রিশুর বুকের ওপরে হাত রেখে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “এই তুমি স্নানে যাবে না?”

কোনদিন ঝিনুক এইভাবে রিশুকে স্পর্শ করেনি, বাইকে বসার সময়ে ওর কাঁধের ওপরে হাত রাখা ছাড়া আর সেই রবিবার ফুচকা খাওয়ানোর সময় ছাড়া এতদিনে ওকে ছোঁয়নি ঝিনুক। তন্বী সুন্দরী মোহময়ী স্ত্রীর লাজে রাঙ্গা চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যায়। হটাত করেই এইভাবে আদরের ছোঁয়ায় বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পরে রিশু। এইটুকু ছোঁয়াতেই ঝিনুকের কান লাল হয়ে গেছে, আর ওর সাথে চোখ মেলাতে পারছে না দেখে নিজের ও একটু লজ্জা লাগে।

বুকের ওপরে যেখানে ঝিনুকের হাতের ছোঁয়া লেগেছিল সেখানে ডান হাত চেপে মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “এই যাচ্ছি।”

রিশুর ঠোঁটের হাসি দেখে ভীষণ ভাবেই লজ্জিত হয়ে পরে ঝিনুক, ধ্যাত কি যে করে না মাঝে মাঝে, নিচের ঠোঁট দাঁতে কেটে নরম কন্ঠে বলে, “আমি চেঞ্জ করব।”

রিশু বলতে যাচ্ছিল, করে ফেল অন্য কেউ কি আর দেখছে নাকি? লাজুক হেসে নিজের মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে বলে, “আমার জামা কাপড় গুলো নিতে দেবে ত?”

রিশুর হাসি হাসি চোখের সামনে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে পরে ঝিনুক। নরম পায়ে আলমারি ছেড়ে পেছনে সরে দাঁড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বলে, “আচ্ছা তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও।”

আলমারি থেকে একটা সাদা রঙের শারট আর জিন্স বের করার পরে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিও।”

আবার সেই সাদা শারট, নাক কুঁচকে একটু ইতস্তত করেই জিজ্ঞেস করে, “আবার সেই সাদা শারট?”

মাথা চুলকায় রিশু, “কি পড়ব তাহলে?”

দু’পা রিশুর দিকে এগিয়ে আসতেই, রিশু আলমারি ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। রিশুর শারটের তাকের মধ্যে থেকে একটা লাল আর কালো চেক জামা বার করে বলে, “এটা পর।”

জামাটা ওর খুব প্রিয়, মা অনেক বছর আগে কিনে দিয়েছিল কিন্তু ওই জামা নিয়ে একবার চন্দ্রিকার সাথে মন কষাকষি হওয়ার পর থেকে সেই জামা আর কোনদিন পরা হয়নি। এই জামার ইতিহাস ঝিনুকের অজানা কিন্তু নিজের অজান্তেই মায়ের পছন্দের জামা ওর হাতে তুলে দেওয়াতে আবেগের বশে ওর চোখ জোড়া অল্প ঝাপসা হয়ে আসে।

ঝিনুকের সামনে অল্প মাথা নুইয়ে হেসে বলে, “জো হুকুম...” ইচ্ছে করছিল গাল দুটি চটকে আদর করে দেয়।

লাজে রাঙ্গা নবোঢ়া ঝিনুক চোখ তুলে তাকায় রিশুর চোখের দিকে, ছোট শব্দটা বলার সময়ে কি ওর গলা কেঁপে গেল নাকি? এই মানুষকে দেখেত মনে হয় না। পরস্পরের চোখের তারা আটকে যায়। ক্ষণিকের জন্য রিশুর মনে হয় ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে, পর মুহূর্তে মনে হয় এইভাবে ছুঁতে গেলে যদি আবার যদি কিছু বলে বসে? দরজার বাইরে যদি শালিনী আর ইন্দ্রজিত উপস্থিত না থাকত তাহলে রিশু কোন বাহানা করে ঝিনুকের গাল একটু ছুঁয়ে দেখত। রোজদিন রাতে খাওয়ার পরে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে ঝিনুক যখন বিছানায় বসে রাতের প্রসাধনি সারে তখন টিভি দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে রিশুর চোখ চলে যায় ওইদিকে। হাতের তালুর মধ্যে ওর দেওয়া সেই অয়েন্টমেন্টটা অতি যত্নে এখন নিজের গালের আঁচড়ের দাগের ওপরে লাগায়। খুব কাছ থেকে না দেখলে সেই দাগ এখন আর বোঝা যায় না যদিও। রিশুর সেই সময়ে একবারের জন্য মনে হয়েছিল ওই সেই আঁচড়ের দাগের ওপরে একটু আঙ্গুল বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন করতে গিয়েছিলে? একবার যদি কোনভাবে সেই শয়তান পার্থকে হাতে পায় তাহলে সরবাগ্রে ধর থেকে মাথা আলাদা করবে তারপরে সেই কাটা মাথাকে প্রশ্ন করবে, কেন ওর ঝিনুকের হৃদয় এইভাবে ভেনে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। জীবনের অর্থ কি শুধু মাত্র টাকা আর শরীর? সময় স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল ওদের চোখের তারার মাঝে। বিয়ের দিনের সেই শুভ দৃষ্টি এতদিন পরে এই ফাঁকা ঘরের মধ্যে আলমারির সামনে হয়।

শালিনী এতক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করছিল, ঝিনুকের লাজুক অপ্রস্তুত হাসি আর রিশুর লজ্জা দেখে একটু অবাক হয় সেই সাথে দুই আনকোরা কপোত কপোতীকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “পুরো রাত কি এখানেই দাঁড়িয়ে টুকুর টুকুর করবে নাকি?”

শালিনীর গলার আওয়াজ পেয়ে রিশু ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে ওর কান আলতো টেনে বলে, “তু বহত বদমাশ হো গ্যায়ি হ্যায়। (তুমি ভীষণ বদমাশ হয়ে গেছ।)”

রিশু নিজের জামা কাপড় নিয়ে স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢুকে পরে। অন্যদিনের মতন বাথরুমের রডে ঝিনুকের ভিজে জামা কাপড় দেখে মনে মনে হেসে ফেলে, ঝিনুক না হয়ে প্রজাপতি নাম হলে মনে হয় ভালো হত, সারাদিন মনে হয় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই কয়দিনে ঝিনুকের জড়তা ভাব অনেকটাই কেটে গেছে, সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে হাত নাড়ায়, বিকেলে বাড়ি ফিরলে আর ওর হাত থেকে এপ্রন অথবা ব্যাগ নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়না, নিজের পরিধি সম্পর্কে ভালো ভাবেই সচেতন। এই কয়দিনে বাড়িতে শুধুমাত্র বাড়িতে বসে থাকার ফলে ঝিনুকের শরীরে একটু গোলগাল হয়ে গেছে, গাল দুটো বেশ ফুলোফুলো লাল রঙের শিমলার আপেলের মতন মিষ্টি। শুরু থেকেই জানত যে ঝিনুকের পোশাক আশাক অনেক খোলামেলা, আগে তেমন দেখতে ইচ্ছে করত না তবে আজকাল না চাইতেও চোখ চলে যায় ঝিনুকের দিকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ঝিনুক পায়ের তোড়া বেশি করে নাড়িয়ে বাজিয়ে ওর সামনে ঘোরাফেরা করে ওর নজর কাড়ার জন্য সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। রাতের খাওয়ার পরে যখন সারা বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে যায়, রিশু নিজের ঘরে ঢুকে পরে পড়াশুনা করার জন্য তখন যেন বেশি করে ঝিনুকের এদিক ওদিক চলাফেরা করা চাই। মাঝে মাঝে বই থেকে মাথা উঠিয়ে দেখে, রাতেই যেন ওর সব কাজ মনে পরে, বারান্দা থেকে আগের দিনের শুকনো জামা কাপড় ভেতরে নিয়ে আসা চাই, খাওয়ার টেবিল গোছান চাই, সোফায় আধাশোয়া হয়ে টিভি দেখার সময়েও বারেবারে নড়া চড়া করা চাই, যেন ইচ্ছে করেই করে যাতে ওর কানে নুপুরের নিক্কন বারেবারে প্রতিধ্বনিত হয়। স্নান সেরে বেড়িয়ে নিজের জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নেয় রিশু। শোয়ার ঘরের দরজা তখন বন্ধ, শালিনী আর ঝিনুক ঘরের মধ্যে নিশ্চয় সাজতে ব্যাস্ত।

ইন্দ্রজিত ওর কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করে, “কি রে সব ঠিক ঠাক?”

মৃদু হেসে উত্তর দেয় রিশু, “হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক, কি আর হবে।”

ইন্দ্রজিত মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “হানিমুনে কোথায় যাচ্ছিস?”

মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, এখন পর্যন্ত সেই অর্থে কাছাকাছি আসতে পারেনি, “দেখি কবে ছুটি পাই তারপর। পরের মাসে আবার লন্ডন যাওয়ার আছে, সেমিনার আছে।”

চোখ টিপে ইন্দ্রজিত ওকে বলে, “সাথে নিয়ে যা, কি আছে। সেমিনার ও হবে আবার হানিমুন ও হয়ে যাবে।”

সেই বিষয়ে ভেবেছিল তবে আলোচনা করা হয়নি ঝিনুকের সাথে, তাই মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ দেখি কি হয়।” একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বলত আজকের এই ডিনার পার্টিতে কে কে আসছে?”

ইন্দ্রজিত উত্তর দেয়, “এই হোটেলের ম্যানেজার, সুজিত গোরবোলে, শালিনীর চেনা শোনা। ওর স্ত্রীর পক্স হয়েছিল, প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সাড়ে ছয় মাসে সিজেরিয়ান করতে হয়েছিল না হলে মা মেয়ে কাউকেই বাঁচানো সম্ভব ছিল না। মোটে সাড়ে ছয়শ গ্রাম ওজনের তিন মাস পুরো ইঙ্কিউবেটরে ছিল, বিশেষ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে যমে আর ডাক্তারে টানাটানি। সেই থেকেই শালিনীকে খুব মানে, বলতে পারিস ভগবানের মতন।”

বেশ কিছু পরে ঝিনুককে সঙ্গে নিয়ে শালিনী ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে। ঝিনুকের সাজ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় রিশু, জিনসের পরিবর্তে পরনে একটা চওড়া পাড়ের ওয়াইন রেড রঙের শাড়ি, চওড়া আঁচলখানি রুপোলি সুতোর কাজে ভর্তি। আশা করেনি যে ঝিনুক এই সাজে সাজবে। ফর্সা কপাল আর দুই বাঁকা ভুরুর মাঝে ছোট একটা লাল টিপ, চোখের পাতা গুলো বেশ লম্বা আর চোখের পাতার ওপরে আবছা লালচে রঙের আইশ্যাডো। ঠোঁটে গাড় বাদামি রঙ্গে রঞ্জিত, কোমল গাল দুটো পিচ ফলের মতন লালচে, মরালী গর্দানে সজ্জিত একটা সুন্দর সোনার হার, দুই হাতে বেশ কয়েক গাছা সোনার চুড়ি আর সাথে সোনায় বাঁধানো শাঁখা পলা। হারের লকেট দুই পিনোন্নত স্তন যুগলের মাঝে আটকে পরে গেছে। দুই কানে দুটো ঝুমকো দুল। পরনের লাল রঙের ব্লাউজ অতীব আঁটো হয়ে স্তন জোড়ার আকার অবয়াব অতীব নিখুঁত ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে। ডান কাঁধের ওপরে একটা শাল আর হাতে একটা জ্যাকেট। পাতলা ঠোঁটের মিষ্টি লাজুক হাসি দেখে চোখ আটকে যায় রিশুর। মাথার চুল একপাশে করে আঁচড়ান আর পেছনে একটা খোঁপার মতন করে বেশ সুন্দর করে বাঁধা।

শালিনী ঝিনুককে পেছন থেকে আলতো ধাক্কা মেরে রিশুর পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হেসে বলে, “এইবারে একদম হর পার্বতী মনে হচ্ছে। এই একটু পাশাপাশি দাঁড়াও একটা ফটো তুলি।”

হটাত করেই ধাক্কা খাওয়ার ফলে ঝিনুকের কোমল উষ্ণ সুডৌল স্তন জোড়া ভীষণ ভাবেই রিশুর উপরি বাজুর সাথে পিষ্ঠ হয়ে যায়। নিজেকে সামলানোর জন্য রিশুর বাজু আঁকড়ে ধরে ঝিনুক। কোমল চাঁপার কলি আঙ্গুলের স্পর্শে ওর হাতের ওপরে হাত রেখে সামলে নেয় ঝিনুককে। হটাত করেই এইভাবে ধাক্কা খাওয়ার ফলে লজ্জায় ঝিনুকের কান লালিমা রঞ্জিত হয়ে ওঠে। ঝিনুকের চোখ নেমে আসে ওর বুকের ওপরে, রিশুর দিকে তাকানোর মতন শক্তি ছিল না তার ওপরে আবার সামনে শালিনী আর ইন্দ্রজিত দাঁড়িয়ে। নব বিবাহিতা স্ত্রীর লাজে রাঙ্গা রক্তিম চেহেরা দেখে নিজেও ভীষণ ভাবেই লজ্জিত হয়ে পরে রিশু, পারলে এখুনি যেন ওকে বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলে।

ইন্দ্রজিত হাসিতে ফেটে পরে, “ইসসস কি লজ্জা দেখো ঝিনুকের।”

রিশু মৃদু হেসে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তুই থামবি নাকি এখানেই আমরা দাঁড়িয়ে থাকব?”

শালিনী মোবাইলে ওদের কয়েকটা ছবি তোলার পরে হেসে বলে, “চল চল বেড়িয়ে যাক না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

গাড়িতে ওঠার আগে গায়ে জ্যাকেট পরে নেয় ঝিনুক, ঠান্ডা হয়ত সহ্য হয়ে যেত কিন্তু রিশুর দিকে তাকিয়ে ওর অনুল্লেখিত আদেশ বুঝতে অসুবিধে হয় না। ওর ঠান্ডা লাগুক অথবা কোন প্রকার কষ্ট হোক সেটা রিশু কোনমতেই চায়না। বাইকে বসলে বসার আগেই ওকে কানে মাথায় শাল জড়িয়ে বসতে হয়। ইন্দ্রজিত নিজের গাড়ি আনেনি সুতরাং উবের ক্যাবে করেই ওদের হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়। সামনের সিটে ইন্দ্রজিত আর পেছনের সিটে ঝিনুককে মাঝখানে বসিয়ে দুইপাশে রিশু আর শালিনী। বিয়ের দিন ভোররাতে বাড়ি ফেরার সময়ে এইভাবে পাশাপাশি বসেছিল ওরা তারপরে আর কোনদিন এইভাবে পাশাপাশি বসা হয়নি ওদের। রিশুর পায়ের সাথে মাঝে মাঝেই ঝিনুকের পা লেগে যাচ্ছিল, সিট ছোট হওয়ার ফলে চেপে বসতে হয়েছিল ওদের যার ফলে ঝিনুক আরো বেশি করেই রিশুর গায়ের দিকে সরে এসেছিল। রিশু ইচ্ছে করেই সিটের পেছনে বাঁ হাত উঠিয়ে দিয়ে ঝিনুকের বাম কাঁধের গোলের ওপরে আলতো করে ধরে রেখেছিল। কাঁধের সেই স্পর্শ যদিও জ্যাকেট ভেদ করে ঝিনুকের ত্বকে পৌঁছায়নি তাও ঝিনুকের মনে হয়েছিল যেন রিশু ওকে আঁকরে ধরে রয়েছে বুকের কাছে। খুব ইচ্ছে করছিল সেই অন্ধকার ক্যাবের পেছনের সিটে রিশুর চওড়া বুকের ওপরে মাথা রেখে চোখ বুজে হৃদস্পন্দন শোনার। সেই প্রবল ইচ্ছেটা অতি কষ্টে দমন করে কোলের ওপরে হাত রেখে চুপচাপ বসে ছিল। বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভুতি, শেষ গন্ডি উলঙ্ঘন করার এক প্রবল প্রবৃত্তি জেগে ওঠে রিশুর বুকের মাঝে। মাঝে মাঝেই ঝিনুকের মাথা ওর প্রায় নাকের পাশে এসে যায় সেই সাথে ঝিনুকের গায়ের মিষ্টি গন্ধে ওর নাক ভরে ওঠে।

গাড়িতে বসে ঝিনুকের কানে ফিসফিস করে জিজ্জেস করে রিশু, “হটাত শাড়ি পড়তে গেলে? বলছিলে যে জিনস পড়বে?”

কাঁধের ওপরে রিশুর আঙ্গুলের চাপ অনুভব করতেই বুকের মাঝের ধড়ফড়ানি বেড়ে ওঠে ঝিনুকের। হটাত করে এইভাবে জিজ্ঞেস করবে সেটা ভাবতে পারেনি, কথা বলতে গিয়ে গলা অবশ হয়ে আসে ওর। কোনমতে সেই অনুভুতি সামলে উত্তর দেয়, “ওই এমনি।” ভীষণ ভাবেই জানতে ইচ্ছে করছিল যে ওকে কেমন দেখতে লাগছে।

কানের কাছে মাথা নামিয়ে আনার ফলে ঝিনুকের শরীরের মাদকতাময় ঘ্রাণ ওর নাকের মধ্যে প্রবেশ করে ওর মাথার মধ্যে তান্ডব শুরু করে দেয়। গাড়িতে অন্য কেউ না থাকলে ড্রাইভারকে হয়ত বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আদেশ দিত রিশু। ঠোঁট জোড়া ভীষণ ভাবেই ওকে কাছে ডাকছে, ভীষণ মায়াবী আঁখি জোড়া ওর দিকে দেখেও দেখতে পারছে না লাজে। একবার মনে হয়েছিল, গায়ের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। নিঙরে পিষে একাকার করে ফেলে তন্বী তরুণী উদ্ভিন্ন যৌবনা স্ত্রীকে। শাড়ি পরিহিত ঝিনুককে যত দেখে তত বেশি মুগ্ধ হয়ে যায় রিশু, বিয়ের দিনে ঠিক ভাবে তাকিয়ে দেখেনি তারপরে যতবার দেখেছে ততবার ঝিনুক সালোয়ার কামিজ পরেছে।

ঝিনুকের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, “শাড়ি পড়বে সেটা সত্যি ভাবতে পারিনি। ভীষণ সুন্দরী লাগছে তোমাকে...” সেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে আর চোখ ফেরাতে পারছে না।

প্রেমের বারিধারায় ঝিনুকের চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে যায়।
 
পর্ব সাত – (#4-33)

প্রথমে জিনস পড়তে ইচ্ছে করেছিল ওর কিন্তু রিশু সাথে প্রথমবার কোন বড় রেস্তোরাঁতে ডিনারের জন্য বেড়িয়েছে সেই ভেবেই শাড়ি পড়েছিল। শালিনী সাহায্য না করলে শাড়ির কুঁচি আর আঁচল ঠিক ভাবে ভাঁজ করতে পারত না, এই নিয়ে শাড়ি পরার সময়ে বেশ হাসাহাসি হয় ওর আর শালিনীর। শালিনীকে দেখে মনেই হয়নি যে এরা অচেনা, অতি সহজেই মিশে গিয়েছিল ওর সাথে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিল রিশুর কথা, নিপুন ভাবেই সেই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছিল ঝিনুক। নিজেদের সম্পর্কের ব্যাপারে বাইরের কারুর সামনে উজাগর করতে একদম ইচ্ছুক নয়, হয়ত হতে পারে যে এখন পর্যন্ত ওদের মাঝের বরফের দেয়াল গলেনি তবুও কোনদিন রিশু ওর সাথে খারাপ ব্যাবহার করেনি। এই শাড়িটা কে দিয়েছিল সেটা মনে নেই আর কখন নিজের সুটকেসে গুছিয়েছিল সেটাও আর ওর মনে নেই। নরম গালের ওপরে রিশুর উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ আর কানের মধ্যে ওর সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে মাতাল হয়ে যায় ঝিনুক, খুব ইচ্ছে করে ওই বুকের ওপরে মাথা রাখতে, হয়ত গাড়িতে কেউ না থাকলে রিশুর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিত।

নিচু গলায় উত্তর দেয় ঝিনুক, “শালিনী একটু হেল্প করল তাই।”

রিশু জিজ্ঞেস করে, “এর আগে ত এই শাড়িটা দেখিনি?”

মৃদু স্বরে উত্তর দেয় ঝিনুক, “ছিল একটা আমিও ঠিক জানতাম না।”

ঝিনুক মনে মনে বলে, হ্যাঁ কত যেন ওর আলমারি ঘেঁটে দেখেছে রিশু, নিজেও জানত না যে এই শাড়িটা আছে, হটাত করেই সুটকেস থেকে একটা টপ বার করার সময়ে চোখে পরে এই শাড়ি। এখন কিছু কিছু জামা কাপড় ওর সুটকেসে আছে, সম্পূর্ণ ভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি নিজের গাফিলতির জন্য।

রাস্তায় গাড়ির জ্যামের ফলে হোটেল পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে যায় ওদের। ওরা হোটেলে প্রবেশ করা মাত্রই ম্যানেজার, সুজিত নিজে এসে ওদের অভ্যর্থনা করে। এই হোটেলে এর আগেও বন্ধুদের সাথে ডিনারে এসেছে রিশু, তবে ঝিনুকের জন্য এইরকম হোটেলের রেস্টুরেন্টে প্রথমবার। সুজিত ওদের নিয়ে লিফটে করে ছাদে নিয়ে যায়। হোটেলের ছাদে সুইমিং পুলের পাশে ওদের জন্য আলাদা করে জায়গা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেহেতু ম্যানেজার শালিনীর পরিচিত তাই ওদের আপ্যায়ন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। সুইমিং পুলের একপাশে এক জায়গায় কাঠ জ্বালিয়ে একটা ছোট বনফায়ার তৈরি করা আর তার দুইপাশে বেশ বড় দুটো সোফা পাতা। সোফার পাশে দুই দিকে ছোট ছোট সাউন্ড বক্সে বেশ মৃদু সঙ্গীত বেজে চলেছে। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, বেশ উঁচু বিল্ডিং হওয়ার ফলে দিল্লীর অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ছাদ থেকে। একটু কুয়াসা আর গাড়ির ধোঁয়ায় এক আবছা আবরণ চারপাশে ছড়িয়ে, একটু দূরে রাস্তার ওপরে সারি সারি গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। ঝিনুক এই সব দেখে অবাক হয়ে রিশুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে, ওর কাছে এইসব একদম নতুন।

সুজিত একটা বেশ বড় ফুলের তোড়া নিয়ে এসে রিশু আর ঝিনুকের হাতে তুলে দিয়ে হাত মিলিয়ে বলে, “আপনাদের মতন এতবড় বড় ডাক্তারদের আথিতিয়তা করা সৌভাগ্যের ব্যাপার।”

ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ঝিনুক বেশ বিব্রতবোধ করে। ঝিনুকের বিব্রতবোধ কাটিয়ে রিশু সুজিতের সাথে আময়িক হেসে হাত মিলিয়ে বলে, “উই ডু জাস্ট আওয়ার ডিউটি, (আমরা শুধু মাত্র নিজেদের কর্তব্য করি।)” ইন্দ্রজিতের দিকে দেখে রিশু বলে, “সো দিস অয়াজ ইউর আইডিয়া?”

ইন্দ্রজিত মাথা নাড়ায়, “না রে আমার নয়, শালিনীর আইডিয়া।”

শালিনী ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, “হাউ ইজ দ্যা সারপ্রাইজ?”

ঝিনুক কি বলবে ভেবে পায়না, একবার রিশুর দিকে দেখে উত্তর দেয়, “সত্যি অবাক করে দিয়েছ।”

শালিনী ঝিনুককে বলে, “আমার বাড়িতে আমরা দুই বোন, ভাই বলে কেউ নেই, এই ডাক্তারি পড়তে এসে ভাইয়া কে পেয়েছি।” রিশুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ঝিনুককে বলে, “ওর ওপরে অনেক অত্যাচার করেছি।”

রিশু ওর কথা শুনে হেসে ফেলে, “এই সময়ে আবার শুরু হয়ে যেয় না যেন।”

চন্দ্রিকার ঘটনার আসল ব্যাখ্যা ঝিনুকের জানা নেই, তাই একবার রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে আর একবার শালিনীর দিকে তাকিয়ে দেখে।

ইন্দ্রজিত ওর অবাক মুখবয়াব দেখে হেসে ফেলে, “তুমি ওদের কথা ছাড়ো বস বস।”

একটা সোফায় পাশাপাশি রিশু আর ঝিনুক আগুনের অন্যপাশের সোফায় ইন্দ্রজিত আর শালিনী বসে পরে। খালি ছাদ পাশেই সুইমিং পুল, চারপাশ থেকে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে সেই সাথে সামনে গনগনে কাঠের আগুনের তাপ এক ভিন্ন ধরনের উত্তাপ জাগিয়ে তোলে রিশু আর ঝিনুকের মাঝে। পাশে রাখা সাউন্ড বক্সে নতুন হিন্দি সিনেমার গান একটানা বেজে চলেছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পরনের জ্যাকেট একটু বেশি করে গায়ে জড়িয়ে নেয় ঝিনুক। ঝিনুক অবাক চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখে, মাথার ওপরে খোলা আকাশ, সুইমিং পুলের অন্যপাশে কাঁচের দেয়ালের পেছনে রেস্টুরেন্ট, বছরের শেষের দিকের দিনে রেস্টুরেন্টে বেশ ভিড় সেই তুলনায় ওদের এই আয়োজন বেশ রোমান্টিক। শালিনী আর ইন্দ্রজিত না থাকলে হয়ত রিশুর বাজু জড়িয়ে শরীরের উত্তাপ গায়ে মাখিয়ে বসে থাকত।

রিশু একটু ঘন হয়ে বসে ঝিনুকের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “ঠান্ডা লাগছে নাকি?”

মিষ্টি হেসে মাথা দোলায় রমণী, “না না ঠিক আছে, আগুনের তাপে বেশ ভালোই লাগছে।”

সুজিত কিছুক্ষন পরে হাতে একটা বোতল নিয়ে এসে ঝিনুককে দেখিয়ে বলে, “এটা আমার তরফ থেকে আপনার জন্য, স্যাটু দু বোরদে সেভেন্টি থ্রি।”

কলেজে থাকতে ঝিনুক মদ খেয়েছে ঠিক তবে ওর দৌড় ওই কয়েক পেগ হুইস্কি অথবা ভদকা। সুজিতের কথা বুঝতে না পেরে অবাক চোখে রিশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি?”

রিশু ওকে বুঝিয়ে বলে, “এটা ড্রাই ফ্রেঞ্চ ওয়াইন।” তারপরে সুজিতের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার খাতিরে বলে, “এতসব কেন করতে গেলেন?”

সুজিত আময়িক হেসে শালিনীর দিকে দেখে রিশুর প্রশ্নের উত্তরে বলে, “শালিনী ম্যাডাম আমাদের জন্য যা করেছেন তার জন্য সব কিছু দিতে পারি। ম্যাডাম না থাকলে আমার স্ত্রী আর মেয়ে কেউই হয়ত বাঁচত না। আমরা এক সময়ে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম...” কথাটা বলতে বলতে গলা ধরে আসে সুজিতের।

শালিনী সোফা ছেড়ে উঠে সুজিতের হাত ধরে বলে, “এমন করে কেন বলছেন, ওটা আমাদের কর্তব্য আমাদের কাজ।”

সুজিত ধরা গলায় বলে, “ম্যাডাম আপনি ভগবান।”

সুজিত দুইজন ওয়েটারকে ডেকে বলে, “দিজ আর মাই গেস্ট, এদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়। যাও লবস্টার নিয়ে এস।”

এবারে শালিনীর অবাক হওয়ার পালা, “এরপরে লবস্টার?”

সুজিত আময়িক হেসে বলে, “হ্যাঁ, গত কাল চারটে ক্রাব এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে, খেলে বলবেন।”

ইন্দ্রজিত বলে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ একটা ক্রাব, সিঙ্গেল মল্টের সাথে দারুন জমবে।”

রিশু চোখ পাকিয়ে ইন্দ্রজিতের দিকে দেখে বলে, “তুই কি হার্ড ড্রিঙ্কস নিবি?”

ইন্দ্রজিত হেসে বলে, “কত ইচ্ছে ছিল তোর বিয়েতে পুরো আউট হয়ে নাচব, সেটা আজকে হয়ে যাক। লবস্টার ক্রাব হোয়াইট ড্রাই ওয়াইন আর স্কচ, আজকের রাত মনে হচ্ছে এই হোটেলেই রুম বুক করতে হবে।”

সুজিত বাবু হেসে ফেলেন, “এট ইওউর সার্ভিস।”

শালিনী ইন্দ্রজিতকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “এই ডিনার কিন্তু ঝিনুকের জন্য, ওকেই চয়েস করতে দাও।”

ঝিনুক হাঁ করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সি ফুড অর্থাৎ সামুদ্রিক মাছ বলতে কোলকাতার মাছের বাজারে যা পাওয়া সচারাচর পাওয়া যায় তার বেশি কিছুই খায়নি। এই লবস্টার আর অস্ট্রেলিয়ান ক্রাব কোনদিন চোখেও দেখেনি। একটু বিব্রতবোধ নিয়েই রিশুকে প্রশ্ন করে, “এ গুলো কেমন খেতে?”

রিশু ওর মনের ভাব বুঝে ওকে জিজ্ঞেস করে, “লবস্টার অনেকটা চিংড়ি মাছের মতন খেতে, আর ক্রাব ও ভালোই খেতে। তোমার এলারজি নেই ত?”

গলদা চিংড়ি অনেক খেয়েছে, তাই উৎফুল্ল হয়ে বলে, “না না এলারজি নেই, নতুন ডিস ট্রাই করতে পারি।”

একজন ওয়েটার ওদের জন্য দুটো প্লেটে দুটো বড় লবস্টার সাজিয়ে নিয়ে ওদের সামনে রেখে দেয়। অন্য ওয়েটার চারটে গ্লাসে ওদের জন্য ওয়াইন ঢেলে দেয়। মদের প্রতি রিশুর কোনদিন আসক্তি ছিল না, বন্ধুদের চাপে না পরলে কোনদিন মদের গ্লাস মুখে তোলে না। ওয়াইনের গেলাস তুলে সবাই চিয়ার্স করে ওয়াইন গ্লাসে হাতেই ধরে থাকে ঝিনুক। এত দামী মদ কোনদিন খায়নি, তার ওপরে রিশুর পাশে বসে মদের গ্লাস হাতে মদ খাবে ভেবেই বেশ বিব্রতবোধ করে ঝিনুক। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে ওর মনের দ্বিধা বুঝতে পারে রিশু, মনে মনে হেসে ফেলে, লাজ দেখ মেয়ের, যেন কোনদিন ভাজা মাছ উলটে খায়নি এমন ভাব দেখাচ্ছে। গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে ইশারা করে ঝিনুকের দিকে, চুমুক দিতে পারো অসুবিধে নেই। স্বামীর সম্মতি পেয়ে ছোট গ্লাসে চুমুক দেয়। খাওয়া দাওয়া শুরু হয় তার সাথে ওদের গল্প শুরু হয়। ইন্দ্রজিত, শালিনী আর রিশু নিজেদের কলেজের গল্প হসপিটালের গল্প শুরু করে দেয়, ঝিনুকের এর মধ্যে বিশেষ কিছুই গল্প করার থাকে না। ঝিনুক চুপচাপ মাঝে মাঝে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে লবস্টার খায় আর ওদের দেখে ভদ্রতার খাতিরে একটু মৃদু হাসি দেয়। কথায় গল্পে ইন্দ্রজিত আর শালিনীর গ্লাস শেষ হয়ে যায়, রিশুর ওয়াইনের গ্লাস তখন অর্ধেকও পৌঁছায়নি। ঝিনুকের গ্লাসও শেষ দেখে ইন্দ্রজিত ওর গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে দেয়। ঝিনুক প্রথমে একটু বারণ করলেও রিশু মাথা দুলিয়ে ইশারায় সম্মতি দেয়, অসুবিধে নেই খেতে দোষ নেই। ওয়াইনের দ্বিতীয় গ্লাস শেষের পরে, ক্রাবের অর্ডার করে ইন্দ্রজিত সেই সাথে গ্লেনলিভেট স্কচ।

রিশুর ওয়াইনের গ্লাস প্রায় শেষের দিকে, দেখে ইন্দ্রজিত ওকে মজার ছলেই জিজ্ঞেস করে, “কি রে আজকে শেষ পর্যন্ত মেরেই দে।”

মাথা দোলায় রিশু, “না রে ওটা আমার সহ্য হয় না জানিস।”

শালিনী ওকে বাঁচিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি জানো ভাইয়া খায় না তাও কেন জোর করছ?” তারপরে ঝিনুকের দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার হুইস্কি চলে নাকি?”

নিচের ঠোঁট দাঁতে কামড়ে লজ্জার মাথা খেয়ে মাথা দোলায় ঝিনুক, “মাঝে মাঝে চলে।”

সেই কথা শুনে হাসিতে ফেটে পরে ইন্দ্রজিত, রিশুর দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, “আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া।”

রিশু ঘাড় ঘুরিয়ে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ইউ ক্যান এঞ্জয়, (তুমি আনন্দ করতে পারো) আমার আপত্তি নেই।”

ওয়েটার ওদের গ্লাসে একটা লারজ পেগ বানিয়ে চলে যায়। কাঁকড়ার টুকরোর সাথে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেয় ইন্দ্রজিত, এক চুমুক দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝিনুক আর শালিনীকেও ইশারায় জানিয়ে দেয় গ্লাসে চুমুক দিতে। গ্লাস হাতে ঝিনুক ভীষণ ভাবেই অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পরে যায়, ও ভেবেছিল যে হয়ত রিশু ওর সাথে সঙ্গ দেবে কিন্তু রিশুর হাতে ওয়াইনের গ্লাসের বদলে একটা মকটেলের গ্লাস দেখে ভীষণ বিব্রতবোধ করে। রিশু চোখের কোনা থেকে ঝিনুককে দেখে আর মনে মনে হাসে, দুই গ্লাস ওয়াইনের পরেও এই মেয়ে হুইস্কি খেতে চাইছে, কোলকাতায় থাকাকালীন তাহলে কি না বাউন্ডুলেপনা করেছে তার ইয়াত্তা নেই। হোক মাতাল, সেটাই চায় রিশু, হয়ত মাতাল হলে ওদের মাঝের আগল ভেঙ্গে যাবে, যে দুর্ভেদ্য দেয়ালের দুইপাশে দুইজনে দাঁড়িয়ে হয়ত সেই দেয়াল আর থাকবে না। এক পা এক পা করে এগোতে গেলে অনেক দেরি, একটা ছোট দেশলাই কাঠির ঝলকানির খুব দরকার ওদের মাঝের এই আগুন জ্বালানোর জন্য। ওদের বসার জায়গার মাঝ খানে যে আগুন জ্বালানো হয়েছিল একজন লোক এসে সেই আগুনে আরো কয়েকটা কাঠের গুড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যায়।

ঝিনুকের দ্বিধাবোধ কাটিয়ে সহজ হওয়ার জন্য ওকে বলে, “আরে ওটা কি শুধু দেখবে নাকি?”

গলা শুকিয়ে আসে ঝিনুকের, “না মানে, তুমি নেবে না?”

মাথা নাড়ায় রিশু, “না, আমার এইসবের গন্ধ একদম সহ্য হয় না।”

ঝিনুক মুখ গোমড়া করে হুইস্কির গ্লাস টেবিলে রেখে দিয়ে বলে, “তাহলে আমিও খাবো না।”

ইসস, তোমার এই অনুরাগের ছোঁয়ায় মরতে রাজি আমি। মনের মধ্যে গানের কলি জেগে উঠেছিল, হয়ত পরিস্থিতি অন্য হলে সেই গান গেয়ে ফেলত রিশু। রাগ যে তোমার মিষ্টি অনুরাগের চেয়ে সাধ করে যে তোমায় রাগাই ওগো সোনার মেয়ে।

ঝিনুকের কাঁধে কাঁধ দিয়ে আলতো ধাক্কা মেরে মজার ছলে বলে, “তোমার খাওয়াতেই আমার খাওয়া হয়ে যাবে।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে লাজুক হেসে চোখ রাঙ্গিয়ে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তাই নাকি? সেটা কেমন করে হবে?”

রিশু ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলে, “সেদিন ফুচকা খেলে যেমন ভাবে ঠিক তেমন ভাবেই।” রিশুর ঠোঁটে যেন সেদিনের ঝিনুকের চাঁপার কলি আঙ্গুলের পরশ এখন লেগে রয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে ঠোঁটের ওপরে আঙ্গুল বুলিয়ে নেয়।

ওই ভাবে ঠোঁটে আঙ্গুল বুলাতে দেখে সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে ঝিনুকের, ইসস কি শয়তান দেখ, “সেদিন আর একটু হলে ত আমার আঙ্গুল খেয়ে ফেলতে।”

খেতে আর দিল কোথায়, চারপাশে যা লোকজনের ভিড় ছিল সেদিন না হলে শুধু আঙ্গুল নয়, ওই মিষ্টি মেয়েটাকে আদর করে পাগল করে খেয়ে ফেলত রিশু, “কামরাতে আর দিলে কোথায় বল।” মুচকি হেসে ঝিনুককে বলে।

শালিনী হাসিতে ফেটে পরে ওদের প্রেমালাপ দেখে, গান গেয়ে ওঠে ওদের দিকে তাকিয়ে, “রাত বাকি বাত বাকি, হোনা হ্যায় জো হো জানে দো... ”

হুইস্কির গ্লাস দুই ঢোকে শেষ করে ইন্দ্রজিত হো হো করে হেসে বলে, “তোদের দেখে আবার প্রেম...”

শালিনী সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রজিতের পিঠের ওপরে একটা চড় মেরে বলে, “আই উইল কিল ইউ নাই (তাহলে আমি মেরে ফেলব।)”

গ্লাস শেষ হতে না হতেই আরো এক লারজ পেগ সোজা গলায় ঢেলে ইন্দ্রজিত শালিনীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ডারলিং প্রেম আবার তোমার সাথেই করব।”

গ্লাস শেষ করে উঠে দাঁড়ায় শালিনী, ঝিনুকের হাত ধরে বলে, “ওয়ানা ডান্স? লেটস হিট দ্যা ফ্লোর। (নাচতে চাও? চল নাচি)।”

ইন্দ্রজিত ওয়েটারকে ডেকে পার্টির উপযুক্ত হিন্দি গান চালাতে অনুরোধ করে। গ্লাসের বাকি হুইস্কি গলায় ঢেলে শালিনীর সাথে সোফা ছেড়ে উঠে পরে ঝিনুক। জ্যাকেট খুলে আঁচল খানি কোমরে গুঁজে ফেলার ফলে ফর্সা নরম তুলতলে পেটের খানিক অংশ বেড়িয়ে পরে। আঁচল খানি সামনের দিকে উঁচিয়ে থাকা আঁটো ব্লাউজে ঢাকা দুই উন্নত স্তনের মাঝে নিয়ে কোমরে পেচিয়ে গুঁজে নেয়। শাড়ির কুঁচি নাভির বেশ নিচে বাধার ফলে সুগভীর নাভি খানি অনায়াসে দেখা যায়। সারা অঙ্গে ছন্দ তুলে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে পরে সুন্দরী ঝিনুক। চোখে তারায় হাজার বাতির ঝলকানি হেনে তাকায় রিশুর দিকে। রিশু জুলুজুলু চোখে মত্ত হরিণীর হাঁটার ছন্দের দিকে নিস্পলক চোখ তাকিয়ে থাকে। গানের তালে ওর পা নাচতে শুরু করেছিল কিন্তু কোনদিন নাচেনি তাই আর সোফা ছেড়ে ওঠেনা। দুই গ্লাস ওয়াইনের পরে এক গ্লাস হুইস্কির লারজ পেগ ঝিনুকের শিরা উপশিরায় নেশার মাতন জাগিয়ে তুলেছে। শালিনীও গায়ের জ্যাকেট খুলে ফেলে গানের তালে তালে নাচতে শুরু করে দেয়। সেই সাথে ধিরে ধিরে তাল মেলায় ঝিনুক। ওর দুই হাত মাথার ওপরে উঠে যায়, সারা শরীর সাপের মতন এঁকে বেঁকে মত্ত ছন্দে নাচতে শুরু করে ঝিনুক।

ইন্দ্রজিত গ্লাস হাতে সোফা ছেড়ে উঠে রিশুর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “ইউ আর আ ড্যাম লাকি গাই, (তুই অনেক ভাগ্যবান)। কি ভেবে এখন পিছিয়ে আছিস জানি না, তবে একে হারাস না।”

শালিনী আর ঝিনুক গানের তালে নাচে মেতে উঠেছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝিনুক আর শালিনীর দিকে দেখে। উচ্চ গানের তালে দুই নারী সব কিছু ভুলে নেচে চলেছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মৃদু হেসে ইন্দ্রজিতের কথার উত্তরে বলে, “কেউ কি আর ইচ্ছে করে কিছু হারাতে চায় রে?”
 

Users who are viewing this thread

Back
Top