![rzZ6IhQ.jpg](https://i.imgur.com/rzZ6IhQ.jpg)
মোরেলা - অনুবাদ - জুবায়ের আহমেদ
মোরেলার প্রতি আমার স্নেহ একটু বেশিই ছিল। মনে মনে ভালোও বাসতাম অবশ্য। সেই প্রথমবার দেখার পর থেকেই আমার মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে থাকতো ওর জন্য। কিন্তু এমনটা যে কেন হতো, তা আমার জানা নেই। সেটা আবার দমিয়ে রাখাও সম্ভব ছিল না। তাই বলে ওর প্রতি এই যে আমার দূর্বলতা, তা কিন্তু কোনোভাবেই প্রকাশ পায়নি। আমি ওর সামনে না করেছি আবেগ প্রকাশ, না বলেছি ভালোবাসার কথা। তারপরও আমাদের দেখা হলো একসময়। কীভাবে যেন একই বন্ধনে বাধা পড়ে গেলাম দুজনে। তাও আবার বিবাহবন্ধনে। আর মোরেলাও সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে আমার সাথে বসবাস করতে লাগলো। তখন আমার মনে আনন্দ আর ধরে না। সবকিছু মনে হচ্ছিল স্বপ্নের মতো।
মোরেলার যথেষ্ট লেখাপড়া ছিল। তার মেধা ছিল অসাধারণ। আত্মবিশ্বাস আর মনের জোরও ছিল বেশি। অনেক ব্যাপারে তার শিষ্যত্বও গ্রহন করতে হয়েছে। যাহোক, কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম, প্রায় সময় সে পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে পড়াশুনার বিষয়বস্তু যে কী তা জানা ছিল না। প্রথমদিকে এ ব্যাপারটা আমার ভালো লাগতো না। আমি বুঝতেই পারতাম না ওগুলোর প্রতি ওর এতো কীসের আকর্ষণ। অবশ্য মোরেলার সাহচর্যে এসে পরবর্তীতে সেগুলো আমারও প্রিয় হয়ে উঠলো।
কেউ যদি প্রশ্ন করে, কেন এমনটা হলো? তাহলে বলতে পারি, কোনো কারণ ছাড়াই আমার এই প্রীতি গড়ে উঠেছিল। মোরেলার পছন্দের যত বই আছে, সেগুলোও পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে ঘোরের মাঝে চলে যেতাম একদম। মনে হতে লাগলো, সেই পুরনো দর্শনশাস্ত্র থেকে, শুকনো পাতার মতো পৃষ্ঠাগুলো থেকে দু একটা শব্দ আমার কানে ভেসে আসছে। যার কোনো অর্থ নেই। অথচ নেশাগ্রস্তের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম বইগুলোর মধ্যে।
বই নিয়ে মোরেলা আর আমার মধ্যে কী আলোচনা হতো, তা এখানে বলা নিস্প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলা যায়। প্রত্যেক মানুষেরই নিজ নিজ স্বত্বা আছে। সবাই সবার থেকে আলাদা। এই ভিন্নতা বা বৈশিষ্ট্য যাই বলুন, এটা ছিল আমার প্রিয় বিষয়। আর আমাকে খুশি করার জন্যই বোধয় বেশিরভাগ সময় মোরেলা এ নিয়ে আলোচনা করত আমার সাথে।
আমার স্ত্রী মোরেলার এমন রহস্যময় ব্যবহার, তার সুরেলা কন্ঠস্বর, বিষণ্ন চোখের চাহনি, তার সবকিছুই আমাকে অভিভূত করে ফেলল। মোরেলা সেটা ভালোমতোই জানতো। আর জানতো বলেই কিছু বলতো না। তবে এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, আমার এহেন কান্ড দেখে আড়ালে নিশ্চয় হাসতো সে।
তারপরও, কেন যেন মোরেলার চেহারা দিনে দিনে ফ্যাকাশে হয়ে যেতে লাগলো। শরীরের নীল শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ওর দিকে তাকালেই আমার মন দুঃখে ভরে যেত। ও যখন আমার দিকে দুর্বল চোখে তাকাতো, সাথে সাথে কোন এক শূন্যতায় ভরে উঠত আমার মন।
এমন একটা সময়ে আমার কী করা উচিত, প্রার্থনা? হ্যাঁ, তাই করেছিলাম আমি। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। কিংবা হচ্ছিল অত্যন্ত ধীরগতিতে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল। আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। প্রার্থনা ছেড়ে উল্টো অভিশাপ দিতে শুরু করলাম সেই সময়গুলোকে।
সেদিন, শরতের এক সন্ধ্যায় মোরেলা আমাকে ডাকলো। বিছানায় তার পাশে বসতে বলল। ঘরের পরিবেশ কেমন থমথমে। বাতাসও যেন স্থির হয়ে আছে। "আজকের দিনটা বড় অদ্ভুত," মোরেলা বলল আমাকে, "আজকের দিন হয় বেঁচে থাকার, নয়তো মরণের। আমি মরে যাচ্ছি, তবু আমি বেঁচে থাকব।"
"মোরেলা!"
"তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা জানি না। যদি ঘৃণাও করে থাকো, তবু আমার জন্য একটু প্রার্থনা কর।"
"মোরেলা!"
"আবারও বলছি, মরে যাচ্ছি আমি। কিন্তু রেখে যাচ্ছি এই ছোট্ট মোরেলাকে। আমাকে ভালো না বাসলেও, তাকে অন্তত ভালোবেসো। এ শিশু তোমার আর মোরেলার।"
"মোরেলা!" আমি চিৎকার করে উঠলাম, "মোরেলা!" মোরেলা মুখ ফিরিয়ে নিল বালিশের ওপাশে। হঠাৎ মৃদু কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল তার শরীর। মারা গেল সে।
কিন্তু তার মৃত্যু মুহূর্তে জন্ম নিল একজন। আমার ছোট্ট মোরেলা। আস্তে আস্তে শারীরিক মানসিক দুদিক দিয়েই বিকাশ হতে থাকল তার। দেখতে হলো অবিকল তার মায়ের মতো, মোরেলার মতো। আমি আমার মেয়েকে ভালোবাসতে লাগলাম। এতটাই যে, পৃথিবীর আর কোনোকিছুকেই হয়তো অতটা ভালোবাসা সম্ভব নয়।
কিন্তু এই ভালোবাসা বেশিদিন টিকিয়ে রাখা গেল না। মোরেলা বড় হলো। তার মানসিক সত্তার পরিবর্তন ঘটল। অভিজ্ঞ হলো। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সে হলো পুরোপুরি তার মায়ের মতো। দেখতে শুনতে, শারীরিক, মানসিক, সবদিক দিয়েই মোরেলার সাথে গভীর সাদৃশ্য দেখা গেল ওর। মোরেলার সবকিছুই যখন পেয়েছে সে, তাহলে তার ব্যাধিটাই বা বাকি থাকে কেন? মেয়েটার চেহারাও ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করল। নিচু আর দুর্বল হতে থাকল গলার স্বর।
বছরের পর বছর গড়িয়ে যেতে লাগল। কিন্তু আমার মেয়ের এখনো কোনো নাম রাখা হয়নি। আমি তাকে আদর করে "মামণি" কখনো বা "সোনামণি" এমন সব নামে ডাকতাম। মেয়েটা আমার বাইরের কারো সাথে মিশতও না। আর মোরেলা মরে যাওয়ার পর তার নামটা যেন বাড়ি থেকেই একদম হারিয়ে গেল। আমিও মেয়েকে মায়ের সম্বন্ধে কিছু বলিনি। বলা যায় না আসলে। তাই বলে মেয়ের একটা নাম রাখব না, এমনটাই বা হয় কী করে। সুতরাং মেয়ের নাম কী রাখা যায় তা নিয়ে ভাবতে বসলাম। দেশি, বিদেশি, আধুনিক নানা ধরনের নাম মাথায় এলো। কোনোটাই পছন্দ হয় না। পুরোহিতকে ডেকে আনলাম। অনেকটা দ্বিধা নিয়ে, কিছু ইতস্তত করে শেষমেষ পুরোহিতের কানে ফিসফিস করে নামটা পাড়লাম- মোরেলা। এত আস্তে বলা শর্তেও মেয়েটা কীভাবে যেন শুনে ফেলল। আর তা শুনতেই আমার মেয়ের চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। সে চেহারায় শূন্যতা ছাড়া কিছুই নেই। তারপর হঠাৎ কালো পাথরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল ও। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল কয়েকটা শব্দ- "এইযে আমি, এখানে!"
স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি। শব্দগুলো আমার কান দিয়ে ঢুকে ফুটন্ত সিসার মতো মগজে ছড়িয়ে পড়ল যেন। সময় চলে যায়, কিন্তু স্মৃতি থাকে অটুট। যেদিকে তাকাই সবখানেই আমি শুধু মোরেলাকে দেখতে পেলাম। বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল শুধু একটাই নাম, মোরেলা! কিন্তু তার যে মৃত্যু হয়েছে। নিজ হাতে সমাধিস্ত করেছি তাকে। হঠাৎ আমার প্রচন্ড হাসি পেল। হা হা হা করে হেসে উঠলাম। প্রথম মোরেলাকে যেখানে সমাধিস্ত করা হয়েছিল, দ্বিতীয়ার জায়গাও হলো সেখানে। আর আমার তিক্ত হাসি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল সারা ঘরময়।
(মূল: এডগার অ্যালান পো)