পতিতাবৃত্তি কিংবা বেশ্যাবৃত্তি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পেশাগুলোর একটি। পতিতা বলতে এখনো আমাদের দেশে শুধু মেয়েদেরকেই বোঝানো হয়। পুরুষ পতিতা বলে যে কিছু থাকতে পারে, সে সম্পর্কে এখনো আমাদের খুব একটা ধারণা নেই। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কেবল নারীদেরই জন্যই এই শব্দটা রেখেছে। অথচ পুরুষরাও কিন্তু এই পেশার সাথে জড়িত, তা বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। আসুন জেনে নেই পুরুষ পতিতা, পুরুষ পতিতালয়, পুরুষ পতিতাদের ইতিহাস এবং তাদের আয় সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য…
পুরুষ পতিতা
পতিতা বলতে সেসব মানুষদের বুঝানো হয় যারা সরাসরি কিংবা প্রত্যক্ষভাবে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়ে যৌনসেবা প্রদান করে। যেসব পুরুষ পতিতাবৃত্তি করে, তাদের ইংরেজিতে বলা হয় জিগোলো (GIGOLO)। জিগোলো শব্দটির অর্থ, কোনো মহিলাকে পুরুষের সামাজিক সঙ্গ দেওয়া। তবে কেবলমাত্র আক্ষরিক অর্থে সীমাবদ্ধ নয় জিগোলো !
যেসব পুরুষ সমকামী নয়, কিন্তু সমকামী পুরুষদের জন্য কাজ করে, তাদেরকে জিপি (গে ফর পে) নামে ডাকা হয়। সাধারণত এই পেশায় জড়িত সকল পুরুষদেরই পেশাদারী নাম 'পুরুষ বেশ্যা' বা 'পুরুষ পতিতা'।
পুরুষ পতিতাবৃত্তির ইতিহাস
পুরুষের দেহব্যবসা বা পুরুষ পতিতাবৃত্তি বিষয়টি নতুন মনে হলেও এটি সভ্যতার নতুন কোন বিষয় নয়। রোমান এবং গ্রীক পুরাণেও এমন অনেক চরিত্র পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে সেই সময়েও পুরুষ দেহব্যবসা প্রচলিত ছিলো। এবং পুরুষদেরকে বাধ্য করা হত এই পেশা বেছে নিতে।
ইতিহাসেও পাওয়া যায় এমন ঘটনা ! প্লেটোর রচনা 'ইলিসের ফিডো' এমনই একটা সত্যকাহিনী, যাতে পুরুষ পতিতাদের বর্ননা রয়েছে। হিব্রু বাইবেলেও পুরুষের যৌনব্যবসার কাহিনীর উল্লেখ আছে। অতীতে অনেক যুদ্ধ ফেরত সৈনিক এই পেশায় লিপ্ত ছিলো, কিন্তু সেইসময় পুরুষের বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করত না কেউ। সেটা কতিপয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যেমন সীমাবদ্ধ ছিল, তেমনি এই বিষয়ে তৎকালীন সমাজে সাধারণ মানুষের ধারণাও ছিলো সামান্য।
কাজেই বলা যেতে পারে, পুরুষের যৌনব্যবসা কোনো নতুন বিষয় নয়, বরঞ্চ এই ঘটনাটি নারীদের পাশাপাশি চলে আসছে বহুকাল ধরেই।
পুরুষ পতিতালয়
শুনতে অবাক লাগলেও মহিলা পতিতাদের মত পুরুষদেরও পতিতালয় আছে ! কিন্তু তার প্রায় সবগুলাই উন্নত দেশগুলোতে।
পুরুষ বেশ্যালয়ের বহুল পরিচিত ডাকনাম হল 'আস্তাবল'। যুক্তরাষ্ট্রে নেভাডায়, যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও পুরুষ পতিতালয় আছে। যেগুলো প্রধানত 'বাথহাউজ' নামে পরিচিত। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে ২০১০ সালে প্রথম বিলাশবহুল সমকামী পুরুষদের জন্য বেশ্যালয় তৈরি করা হয়। ১৮১০ সালে লন্ডনের ভেরা স্ট্রিটে এমনই এক পুরুষ বেশ্যালয় গড়ে ওঠে, যা ওই শহরে ডাকা হতো 'মলি হাউজ' নামে।
পতিতালয়ের পুরুষরাও নানাভাবে নির্যাতিত হয়। পুরুষ হওয়ার কারণে এরা নির্যাতিত হয় না, সেটা সঠিক তথ্য নয়। নারী যৌনকর্মীদের মতই এরা ধর্ষিত হয়, শারীরিকভাবে অত্যাচারিত হয়, আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়।
পুরুষ পতিতাদের আয়
সময়, অভিজ্ঞতা এবং চাহিদার উপর নির্ভর করে পুরুষ পতিতা তথা জিগোলোদের পারিশ্রমিক নির্ধারন করা হয়। অবাক করা বিষয় হলো, পতিতাবৃত্তিতেও নারী পুরুষের বৈষম্য রয়েছে ! একজন নারী দিন প্রতি আনুমানিক যদি ২,০০০ ডলার উপার্জন করে, সেক্ষেত্রে একজন পুরুষ রেন্ট বয় দিন উপার্জন করে ৩,০০০ ডলার !
বাংলাদেশের জিগোলোদের কারো ২০০ টাকা রেট ঘন্টায়, আবার কেউ ২০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা রেটে পুরো রাত সার্ভিস দেয়। ভারতে ব্যক্তিভেদে একজন পুরুষ পতিতা ঘন্টায় উপার্জন করে ২০০ রুপী থেকে ৫০০ রুপী পর্যন্ত।
পুরুষ পতিতাদের বিস্তারিত
পতিতালয়ের বাইরের পুরুষ পতিতাদের মূলত বিভিন্ন মহিলারা ভাড়া করেন। সাধারণত কয়েকটি মাধ্যমে তারা পতিতাবৃত্তি করেন। এই পেশায় চাহিদা থাকায় তাদের সুদর্শন এবং সুসজ্জিত হতে হয়। আয়ত্ত করতে হয় নারীর মনরঞ্জনের বিভিন্ন কলাবিদ্যা।
তাদের শনাক্তকরন, শর্তাবলী, পতিতাবৃত্তির ধরন একেকরকম। যেমনঃ
- এজেন্সি : পেশাদার হিসেবে যারা পুরুষ পতিতা (জিগোলো) হচ্ছেন, তাদের ডিউটি সাধারণত বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে তারা রেজিস্ট্রেশন করেন। সেই এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন মহিলারা পুরুষ পতিতা ভাড়া করেন। কোনো এজেন্সির মাধ্যমে অন্য এই পেশায় যোগদান করতে হলে প্রথমে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করতে হয়। জমা দেয়া ওই টাকাকে এজেন্সির ভাষায় বলা হয় রেজিস্ট্রেশন ফি। রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দেয়ার পর একটি আইডি নম্বর দেয়া হয়। তারপরই পুরুষ পতিতারা সার্ভিস দিতে প্রস্তুত হন। কোনো একজন পুরুষ পতিতার ক্ষেত্রে তার একটি নামও প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন জিগোলোরা। দিন হোক অথবা রাত, যেকোনো সময়েই ডিউটি করতে হয় কোনো কোনো জিগোলোকে। তবে যে সময়েই ডিউটি হোক না কেনো, সাধারণত এই বিষয়টি ঠিক করেন গ্রাহক অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মহিলাই। তাদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ এজেন্সিকে ফি হিসাবে দিতে হয়।
- ওয়েবসাইট ভিত্তিক : অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম কিংবা ওয়েবসাইটে পুরুষ পতিতাদের ছবি, ফিগার, বয়স, পারিশ্রমিক ইত্যাদি দেওয়া থাকে। সেখান থেকেই মহিলারা শর্তসাপেক্ষে ভাড়া করেন জিগোলো তথা পুরুষ পতিতাদের।
- জন : যেসব পুরুষ যৌনকর্মীরা পথের উপর অপেক্ষা করে, তাদেরকেই সাধারণত ডাকা হয় জন, ট্রিক বা টার্নিং ট্রিক। এদের হাতে থাকা লাল রুমাল দেখে মূলত এদের চেনা যায়। ছুটির দিনে এদের অনেকেই মোটা অর্থে অনেক নারীর সঙ্গী হন। অনেকে এদেরকে ডাকে রেন্ট বয় বা ভাড়াটে পুরুষ নামে, যেমনটা নারী পতিতাদের ক্ষেত্রে বলা হয় কল গার্ল। এদের অনেকের নিজস্ব পছন্দ আছে, আগে থেকেই জানিয়ে দেয় নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দগুলো। যেমনঃ ভালো গাড়ি চালাতে হবে, ভালো হোটেল বা কটেজে রাখতে হবে, এইসব বিভিন্ন পেশাদারী আবদার।
শুনে অবাক হলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশেও রয়েছে পুরুষ পতিতা ! আমাদের দেশে পতিতাবৃত্তি একেবারেই অন্ধকার জগতের একটি অংশ। তাই পুরুষ পতিতারা এখানে জোরেসোরে সক্রিয় হতে না পারলেও ফেসবুক টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন এডাল্ট পেজ এবং ফেক অ্যাকাউন্ট বানিয়ে এরা বিভিন্ন জায়গায় কমেন্টিং, পোস্টিংয়ের মাধ্যমে নারীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এবং অবাক হলেও সত্য যে, এভাবে তারা গ্রাহক জোগাতে সক্ষমও হন ! নারী গ্রাহক খুব কম পাওয়া গেলেও এরা পুরুষ গ্রাহক পান। টাকার বিনিময়ে এরা পুরুষদের সাথেও সমকামীতামূলক সম্পর্কে লিপ্ত হন। তবে এদের মাঝে বেশিরভাগই থাকে অপরাধী চক্র, যারা যৌনসম্পর্ক স্থাপনের কথা বলে নারী বা পুরুষদের সাথে সামনাসামনি দেখা করেন, এবং তাদের ব্লাকমেইল করে বড়ধরণের টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। বেশ কয়েকমাস আগে বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট এরকম একটি দলকে চিহ্নিত করেছে বলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। তাদের মতে, ঢাকা শহরে এরকম হাজারখানেক পুরুষ পতিতা রয়েছে, যার মধ্যে শতাধিক জনকে তারা চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছেন !
এছাড়াও কথিত আছে, ঢাকার বিভিন্ন বড় বড় পার্লারে নারীরা স্পা ও ম্যাসাজ করাতে গিয়েও নাকি সেখানে পুরুষ পতিতাদের সাথে পরিচিত হন। সেখান থেকেই অনেকে এদের পাল্লায় পরে আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। এবং এভাবেই পুরুষ পতিতারা চালিয়ে যায় অন্ধকার জগতে তাদের রমরমা ব্যবসা। যা কিনা আজও আমাদের লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গেছে…
পুরো লেখাটি পড়ে অন্তত আপনি এতটুকু নিশ্চিত হয়ে গেছেন, পুরুষ পতিতাবৃত্তি সম্পর্কে এখনো আমাদের ধারণা একেবারে নেই বললেই চলে ! পুরোটাই ধোঁয়াশা..