বিয়ের দুই তিনদিন পরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার স্বামী রাতুলের মাথায় কিঞ্চিৎ গন্ডগোল আছে । আমরা সাধারণ মানুষ সহজ ভাষায় যাকে পাগল বলি ।
বিয়ের রাতের কথাই প্রথমে বলি । এই রাতটার জন্য সব মেয়েরা যেমন ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে রাখে তেমনি আমিও রেখেছিলাম । যদিও এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে । দ্বিতীয় হোক বা প্রথম হোক বাসর রাততো ? আর লোকটা করলো কি ? সে বিয়ের শেরোয়ানি পড়েই ধপ্পাস করে খাটে শুয়ে নাক ডাকা শুরু করলো ? ইচ্ছে করছিলো হাতুরী দিয়ে ঠাটিয়ে মাথায় এক বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে দেই ।
শুধু মনে হচ্ছিলো বললে ভুল হবে , আমি আসলেই আতিপাতি করে খুঁজছিলাম ঘরের কোথাও শক্ত কিছু পাই কিনা ?
এমন সময় তিনি ধড়মড় করে উঠে বসে আমার দিকে কটমট করে তাঁকিয়ে বলেন - আমার ঘরে আপনি কে ? পর পুরুষের ঘরে আপনি কেনো ?
দাতে দাত চেপে রাগ সমলে বলি - আপনার ঘরে হাতুরী আছে ? হাতুরীর বাড়ি মাথায় পরলে বুঝবেন আমি কে ?
তাড়াতাড়ি দুহাতে মাথার তালু ঢেকে বলেন - ভয় দেখান কেনো ? এমনিতেই ঔষধ খেতে ভুলে গেলে আমার কিচ্ছু মনে থাকেনা !
- আজ ঔষধ খেয়েছেন ? নাকি ভুলে গেছেন ?
- ওরা যেনো আমাকে কোথায় নিয়ে গেলো! ফিরে এসে খেতে ভুলে গেছি । টেবিলের নিচের ড্রয়ারে ঔষধ আছে , দিবেন ?
- আর কিছু লাগবেনা ?
- উ উ উ মনে করতে পারছিনা তো !
- আপনি মনে করতে থাকেন ততোক্ষণে আমি চেঞ্জ করে আসি ।
- দাড়ান , দাড়ান মনে পরেছে , একগ্লাস পানিও লাগবে ।
ঔষধ আর পানির গ্লাস হাতে ধরিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে আমি ভাবনায় ডুব দেই ।
মধ্যবিত্ত বাবার আদুরে কন্যা ছিলাম আমি। পড়াশোনার মাঝপথে হঠাৎ বাবার ক্যান্সার ধরা পরার পর তার ইচ্ছেয় আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় । বড় মামার ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তার পরিচিত এক ঘটকের মাধ্যমে হুট করে আমার বিয়েটাও হয়ে যায় ।
প্রথমদিকে ভালো চললেও সাত বছরেও যখন মা হতে পারলামনা তখনই শুরু হলো বিপত্তি ।
শ্বাশুরী মায়ের ঘরে প্রায়ই গোপন আলোচনার কথা কানে আসে । আলোচনার বিষয় থাকে আমার মা না হওয়ার অপরাধ । ছেলের সাথে পরামর্শ করেন তিনি আবার ছেলের বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনির মুখ দেখবেন । আমার স্বামী মারুফও মায়ের সাথে একমত শুনে তাকে একদিন বলেছিলাম - চলো ডাক্তার দেখাই ।
সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হুঙ্কার দিয়ে বললো - আদিখ্যেতা বাদ দাও । আর অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই । আমি আবার বিয়ে করবো এই আমার শেষ কথা ।
- সমস্যাটা আমার না হয়ে যদি তোমার হয় সেই দায়ও আমার নিতে হবে ?
- আবোল তাবোল শোনার সময় আমার নেই ।
আর মায়া বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করিনি ! ফিরে এলাম বাবার বাড়ি । ততোদিনে ছোট সব ভাইবোনের কোল আলো করে আসা সন্তানেরাও বেশ বড় হয়ে গেছে ।
সেটাও ছয় বছর আগে ।
এই ছয়বছরে কোলেপিঠে করে বড় করা ভাইবোনের কথার হুলে আমার কলিজা ছিন্নভিন্ন ! আচ্ছা কলিজা চিড়ে দেখানো যায়না কেনো ? যদি যেতো তবে আমার কলিজাটা ওদের হাতে তুলে দিয়ে বলতাম - এই যে হাজার হাজার ক্ষতচিহ্ন দেখছিস এগুলো গুণে শেষ করতে পারবি তোরা ? এই ক্ষতগুলো তোদের তৈরী ! পারবি মুছে দিতে এই ক্ষতচিহ্নগুলো ?
আমার করুণ অবস্থা রাব্বানী চাচার সইতে কষ্ট হচ্ছিলো । তার পছন্দেই রাতুলের সাথে বিয়ে ।
হঠাৎ মাথায় কার যেনো স্নেহের ছোঁয়া পেয়ে বাস্তবে ফিরে আসি । ততোক্ষণে ফজরের আজান শুরু হয়েছে । চমকে উঠে তাঁকিয়ে দেখি আমার নতুন শ্বাশুরীমা । মিষ্টি করে বলেন - চলো মা একসাথে নামাজ পড়ে নেই ।
আমরা একসাথে ফজর আদায় করে চুপচাপ বসে আছি । নিরবতা ভেঙে তিনি বলেন - বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা । আমি চাইনি রাতুলের এই অবস্থায় কোন মেয়ে ওর সাথে জড়াক । দেখো ভাগ্যের কি খেলা কেমন করে তুমি জড়িয়ে গেলে !
- রাতুলের সমস্যা কি মা ?
- একটা সড়ক দূর্ঘটনা !
- মানে ?
রাতুল তার বউ ছেলে নিয়ে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছিলো । উল্টোদিক থেকে আসা একটা ট্রাকের ধাক্কায় বউমা স্পট ডেড ! মাথায় আঘাত পেয়ে রাতুল তিন মাস হাসপাতালে থাকার পর জানতে পারে মীরা নেই ! সেই থেকে রাতুলের এই অবস্থা ।
- রাতুলের ছেলেটার কি হলো ?
- সারা শরীর থেতলে গেছিলো । মাস দেড়েক চিকিৎসার পর সুস্থ হলে ওর খালা নিয়ে যায় । বয়সের কারণে নিজের কাছে রাখার সাহস পাইনা! ছেলেটা যে কদিনের জন্য খালার সাথে এই বাড়ি আসে সেই কদিন রাতুল সুস্থ থাকে । চলে গেলেই আবার অসুস্থ হয়ে যায়। ঠিকমতো ঔষধ না খাওয়ালে অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায় । একা সামলাতে পারিনা দেখে আমার দেবর তোমার সাথে রাতুলের বিয়ের ব্যাবস্থা করলো ! আমি বড় অসহায় মা ! স্বার্থপরের মতো রাতুলের বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম ! একটা অসুস্থ মানুষের সাথে তোমাকে জড়িয়ে দিলাম !
এতো আদর করে অনেকদিন কেউ আমার সাথে কথা বলেনা ! বাবা মা চলে যাওয়ার পর আর কেউ না ! মায়ের কথা শুনে টপটপ করে চোখ বেয়ে নোনাজল বইতে থাকলো ।
রাতুলের সাথে ওর ছেলেটার জন্যও মন খারাপ হয়ে গেলো । একটা দূর্ঘটনা রাতুলের সাথে সাথে ওর ছেলেটার জীবনও কেমন উলট পালট করে দিলো ! রাতুলের আজ স্ত্রী পুত্র নিয়ে একটা সাজানো সংসার থাকার কথা ছিলো ! সেই জায়গায় স্ত্রী পুত্রের শোকে রাতুল আজ পাগল ! ওর ছেলেটাও বাবা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে অন্যের ঘরে অবহেলায় বেড়ে উঠছে !
মাকে বলি - আমরা যদি রাতুলের ছেলেটাকে চাই তবে ওর খালা আমাদের কাছে ওকে ফিরিয়ে দিবে মা ?
- মাগো সময় সবার একরকম যায়না ! বেচারী রোজীও রাতুলের ছেলে শুভর জন্য ওর ছেলে বউদের কম কথা শোনেনা ! আমার যদি সাধ্যি থাকতো তবে কবেই নিয়ে আসতাম !
- আর দেরী কেনো মা ? চলেন কালই আমরা শুভকে নিয়ে আসি ।
- রাতুল একটু সুস্থ হোক !
পাশের ঘর থেকে রাতুলের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে - কাল রাতে যে মেয়েটাকে দেখলাম সে কই মা ? কেনো যে এলো আবার চলেও গেল বুঝতে পারছিনা কেনো ?
পাশের ঘর থেকে জবাব দেই - চলে যাইনি , এই যে আসছি ।
- তাড়াতাড়ি আসেন ।
রাতুলের পাশে গিয়ে দাড়ালাম - কিছু লাগবে ?
- হ্যা গোসলের জন্য গরম পানি লাগবে । ও হ্যা আপনি কে তা তো বললেননা ?
- বলতেই হবে ?
- বললে ভালো হয় । দরকারের সময় নইলে আপনাকে কি বলে ডাকবো ?
- আমি মীরা । আপনার নার্স ।
- মীরা , মীরা , মীরা ওহ্ মনে করতে পারছিনা কেনো ? আরো একজন মীরা যেনো কে ছিলো ? আচ্ছা ঠিকাছে মনে হলে একসময় বলবো ।
এক নিমেষেই আমি মৌরী থেকে মীরা হয়ে গেলাম!
রাতুলের নার্সের ভূমিকায় অভিনয় করে আরো দুইমাস কাটিয়ে দিলাম । সেবা যত্নে রাতুল এখন বেশ সুস্থ । আমাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই মীরা মীরা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে । মনে শান্তির দোলা পাই । রাতুল পুরোপুরি সুস্থ হলে আমরা স্বামী স্ত্রীর আসল জীবন শুরু করবো । একটা সুন্দর সংসারের লোভ আমাকে আবারো পেয়ে বসেছে । স্বামী সন্তান নিয়ে একটা লোভী সংসারের খুব লোভ হয় ইদানিং ।
শুভকে কাল রাতে তার খালার কাছ থেকে ফিরিয়ে এনেছি । রোজী আপা চোখের পানি আড়াল করে শুভকে আমার কোলে তুলে দেন । আড়াই বছরের শুভটা কি বুঝে আমার গলা আঁকড়ে ধরে আধো বোলে আমাকে তাড়া দেয় - মা আমলা বাবাল কাতে দাবো ।
শুভকে বুকে জড়িয়ে রাতুলের খাটে কুন্ডলি পাকিয়ে কখন শুয়েছি রাতুল টের পায়নি । পাশের ঘরে শুভকে ঘুম পাড়িয়ে পা টিপে টিপে রাতুলের পাশে ঘুমিয়ে গেছি।
শুভকে নিয়ে আজই প্রথম আমি রাতুলের খাটে শুয়েছি । আগে ঘুমাতাম রাতুলের পাশের ঘরে । ঐ ঘর থেকে বারে বারে উঁকি দিয়ে রাতুলকে দেখে যেতাম ।
সূর্য্যের আলোয় চারিদিক ফর্সা হয়ে এলে শুভর ঘুম ভেঙে আমার গাল টিপে বলে - মা , ও মা আল ঘুমাবোনা । তলো আমলা ছাদে দাই ।
- উহু বাবা আরেকটু ঘুমাও । কথা বললে তোমার বাবা জেগে যাবেন ।
- বাবাকেও নিয়ে দাবো । তলোনা মা ।
শুভর কথার শব্দে রাতুল জেগে উঠে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো জানালা মেলে দিয়ে বলে - মীরা , এই মীরা আরো এদিকে এসে শোও । ছেলেকে নিয়ে এতো কিনারায় শুয়েছ কেনো ? পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবেতো !
রাতুলের এহেন স্বাভাবিক আচরণে আমি অবাক হওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলি ! এও কি সম্ভব ? বিধাতা সত্যি সত্যি আমার ইচ্ছে পূরণ করেছেন ?
- রাতুল তুমি ঠিক আছতো ?
- আমি আবার বেঠিক ছিলাম কবে মীরা ! তোমার মাথায় কি গন্ডগোল দেখা দিলো নাকি ? হা হা হা ।
আজকের সূর্য্যটা আসলেই অন্যরকম !
আজকের সূর্য্য আমার জন্য একটা শুভদিন বয়ে এনেছে । এই সূর্য্যটার জন্য আমি কতোকাল অপেক্ষা করেছি !
কতোকাল !!!!!!!!!!
(সমাপ্ত)
বিয়ের রাতের কথাই প্রথমে বলি । এই রাতটার জন্য সব মেয়েরা যেমন ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে রাখে তেমনি আমিও রেখেছিলাম । যদিও এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে । দ্বিতীয় হোক বা প্রথম হোক বাসর রাততো ? আর লোকটা করলো কি ? সে বিয়ের শেরোয়ানি পড়েই ধপ্পাস করে খাটে শুয়ে নাক ডাকা শুরু করলো ? ইচ্ছে করছিলো হাতুরী দিয়ে ঠাটিয়ে মাথায় এক বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে দেই ।
শুধু মনে হচ্ছিলো বললে ভুল হবে , আমি আসলেই আতিপাতি করে খুঁজছিলাম ঘরের কোথাও শক্ত কিছু পাই কিনা ?
এমন সময় তিনি ধড়মড় করে উঠে বসে আমার দিকে কটমট করে তাঁকিয়ে বলেন - আমার ঘরে আপনি কে ? পর পুরুষের ঘরে আপনি কেনো ?
দাতে দাত চেপে রাগ সমলে বলি - আপনার ঘরে হাতুরী আছে ? হাতুরীর বাড়ি মাথায় পরলে বুঝবেন আমি কে ?
তাড়াতাড়ি দুহাতে মাথার তালু ঢেকে বলেন - ভয় দেখান কেনো ? এমনিতেই ঔষধ খেতে ভুলে গেলে আমার কিচ্ছু মনে থাকেনা !
- আজ ঔষধ খেয়েছেন ? নাকি ভুলে গেছেন ?
- ওরা যেনো আমাকে কোথায় নিয়ে গেলো! ফিরে এসে খেতে ভুলে গেছি । টেবিলের নিচের ড্রয়ারে ঔষধ আছে , দিবেন ?
- আর কিছু লাগবেনা ?
- উ উ উ মনে করতে পারছিনা তো !
- আপনি মনে করতে থাকেন ততোক্ষণে আমি চেঞ্জ করে আসি ।
- দাড়ান , দাড়ান মনে পরেছে , একগ্লাস পানিও লাগবে ।
ঔষধ আর পানির গ্লাস হাতে ধরিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে আমি ভাবনায় ডুব দেই ।
মধ্যবিত্ত বাবার আদুরে কন্যা ছিলাম আমি। পড়াশোনার মাঝপথে হঠাৎ বাবার ক্যান্সার ধরা পরার পর তার ইচ্ছেয় আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় । বড় মামার ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তার পরিচিত এক ঘটকের মাধ্যমে হুট করে আমার বিয়েটাও হয়ে যায় ।
প্রথমদিকে ভালো চললেও সাত বছরেও যখন মা হতে পারলামনা তখনই শুরু হলো বিপত্তি ।
শ্বাশুরী মায়ের ঘরে প্রায়ই গোপন আলোচনার কথা কানে আসে । আলোচনার বিষয় থাকে আমার মা না হওয়ার অপরাধ । ছেলের সাথে পরামর্শ করেন তিনি আবার ছেলের বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনির মুখ দেখবেন । আমার স্বামী মারুফও মায়ের সাথে একমত শুনে তাকে একদিন বলেছিলাম - চলো ডাক্তার দেখাই ।
সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হুঙ্কার দিয়ে বললো - আদিখ্যেতা বাদ দাও । আর অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই । আমি আবার বিয়ে করবো এই আমার শেষ কথা ।
- সমস্যাটা আমার না হয়ে যদি তোমার হয় সেই দায়ও আমার নিতে হবে ?
- আবোল তাবোল শোনার সময় আমার নেই ।
আর মায়া বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করিনি ! ফিরে এলাম বাবার বাড়ি । ততোদিনে ছোট সব ভাইবোনের কোল আলো করে আসা সন্তানেরাও বেশ বড় হয়ে গেছে ।
সেটাও ছয় বছর আগে ।
এই ছয়বছরে কোলেপিঠে করে বড় করা ভাইবোনের কথার হুলে আমার কলিজা ছিন্নভিন্ন ! আচ্ছা কলিজা চিড়ে দেখানো যায়না কেনো ? যদি যেতো তবে আমার কলিজাটা ওদের হাতে তুলে দিয়ে বলতাম - এই যে হাজার হাজার ক্ষতচিহ্ন দেখছিস এগুলো গুণে শেষ করতে পারবি তোরা ? এই ক্ষতগুলো তোদের তৈরী ! পারবি মুছে দিতে এই ক্ষতচিহ্নগুলো ?
আমার করুণ অবস্থা রাব্বানী চাচার সইতে কষ্ট হচ্ছিলো । তার পছন্দেই রাতুলের সাথে বিয়ে ।
হঠাৎ মাথায় কার যেনো স্নেহের ছোঁয়া পেয়ে বাস্তবে ফিরে আসি । ততোক্ষণে ফজরের আজান শুরু হয়েছে । চমকে উঠে তাঁকিয়ে দেখি আমার নতুন শ্বাশুরীমা । মিষ্টি করে বলেন - চলো মা একসাথে নামাজ পড়ে নেই ।
আমরা একসাথে ফজর আদায় করে চুপচাপ বসে আছি । নিরবতা ভেঙে তিনি বলেন - বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা । আমি চাইনি রাতুলের এই অবস্থায় কোন মেয়ে ওর সাথে জড়াক । দেখো ভাগ্যের কি খেলা কেমন করে তুমি জড়িয়ে গেলে !
- রাতুলের সমস্যা কি মা ?
- একটা সড়ক দূর্ঘটনা !
- মানে ?
রাতুল তার বউ ছেলে নিয়ে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছিলো । উল্টোদিক থেকে আসা একটা ট্রাকের ধাক্কায় বউমা স্পট ডেড ! মাথায় আঘাত পেয়ে রাতুল তিন মাস হাসপাতালে থাকার পর জানতে পারে মীরা নেই ! সেই থেকে রাতুলের এই অবস্থা ।
- রাতুলের ছেলেটার কি হলো ?
- সারা শরীর থেতলে গেছিলো । মাস দেড়েক চিকিৎসার পর সুস্থ হলে ওর খালা নিয়ে যায় । বয়সের কারণে নিজের কাছে রাখার সাহস পাইনা! ছেলেটা যে কদিনের জন্য খালার সাথে এই বাড়ি আসে সেই কদিন রাতুল সুস্থ থাকে । চলে গেলেই আবার অসুস্থ হয়ে যায়। ঠিকমতো ঔষধ না খাওয়ালে অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায় । একা সামলাতে পারিনা দেখে আমার দেবর তোমার সাথে রাতুলের বিয়ের ব্যাবস্থা করলো ! আমি বড় অসহায় মা ! স্বার্থপরের মতো রাতুলের বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম ! একটা অসুস্থ মানুষের সাথে তোমাকে জড়িয়ে দিলাম !
এতো আদর করে অনেকদিন কেউ আমার সাথে কথা বলেনা ! বাবা মা চলে যাওয়ার পর আর কেউ না ! মায়ের কথা শুনে টপটপ করে চোখ বেয়ে নোনাজল বইতে থাকলো ।
রাতুলের সাথে ওর ছেলেটার জন্যও মন খারাপ হয়ে গেলো । একটা দূর্ঘটনা রাতুলের সাথে সাথে ওর ছেলেটার জীবনও কেমন উলট পালট করে দিলো ! রাতুলের আজ স্ত্রী পুত্র নিয়ে একটা সাজানো সংসার থাকার কথা ছিলো ! সেই জায়গায় স্ত্রী পুত্রের শোকে রাতুল আজ পাগল ! ওর ছেলেটাও বাবা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে অন্যের ঘরে অবহেলায় বেড়ে উঠছে !
মাকে বলি - আমরা যদি রাতুলের ছেলেটাকে চাই তবে ওর খালা আমাদের কাছে ওকে ফিরিয়ে দিবে মা ?
- মাগো সময় সবার একরকম যায়না ! বেচারী রোজীও রাতুলের ছেলে শুভর জন্য ওর ছেলে বউদের কম কথা শোনেনা ! আমার যদি সাধ্যি থাকতো তবে কবেই নিয়ে আসতাম !
- আর দেরী কেনো মা ? চলেন কালই আমরা শুভকে নিয়ে আসি ।
- রাতুল একটু সুস্থ হোক !
পাশের ঘর থেকে রাতুলের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে - কাল রাতে যে মেয়েটাকে দেখলাম সে কই মা ? কেনো যে এলো আবার চলেও গেল বুঝতে পারছিনা কেনো ?
পাশের ঘর থেকে জবাব দেই - চলে যাইনি , এই যে আসছি ।
- তাড়াতাড়ি আসেন ।
রাতুলের পাশে গিয়ে দাড়ালাম - কিছু লাগবে ?
- হ্যা গোসলের জন্য গরম পানি লাগবে । ও হ্যা আপনি কে তা তো বললেননা ?
- বলতেই হবে ?
- বললে ভালো হয় । দরকারের সময় নইলে আপনাকে কি বলে ডাকবো ?
- আমি মীরা । আপনার নার্স ।
- মীরা , মীরা , মীরা ওহ্ মনে করতে পারছিনা কেনো ? আরো একজন মীরা যেনো কে ছিলো ? আচ্ছা ঠিকাছে মনে হলে একসময় বলবো ।
এক নিমেষেই আমি মৌরী থেকে মীরা হয়ে গেলাম!
রাতুলের নার্সের ভূমিকায় অভিনয় করে আরো দুইমাস কাটিয়ে দিলাম । সেবা যত্নে রাতুল এখন বেশ সুস্থ । আমাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই মীরা মীরা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে । মনে শান্তির দোলা পাই । রাতুল পুরোপুরি সুস্থ হলে আমরা স্বামী স্ত্রীর আসল জীবন শুরু করবো । একটা সুন্দর সংসারের লোভ আমাকে আবারো পেয়ে বসেছে । স্বামী সন্তান নিয়ে একটা লোভী সংসারের খুব লোভ হয় ইদানিং ।
শুভকে কাল রাতে তার খালার কাছ থেকে ফিরিয়ে এনেছি । রোজী আপা চোখের পানি আড়াল করে শুভকে আমার কোলে তুলে দেন । আড়াই বছরের শুভটা কি বুঝে আমার গলা আঁকড়ে ধরে আধো বোলে আমাকে তাড়া দেয় - মা আমলা বাবাল কাতে দাবো ।
শুভকে বুকে জড়িয়ে রাতুলের খাটে কুন্ডলি পাকিয়ে কখন শুয়েছি রাতুল টের পায়নি । পাশের ঘরে শুভকে ঘুম পাড়িয়ে পা টিপে টিপে রাতুলের পাশে ঘুমিয়ে গেছি।
শুভকে নিয়ে আজই প্রথম আমি রাতুলের খাটে শুয়েছি । আগে ঘুমাতাম রাতুলের পাশের ঘরে । ঐ ঘর থেকে বারে বারে উঁকি দিয়ে রাতুলকে দেখে যেতাম ।
সূর্য্যের আলোয় চারিদিক ফর্সা হয়ে এলে শুভর ঘুম ভেঙে আমার গাল টিপে বলে - মা , ও মা আল ঘুমাবোনা । তলো আমলা ছাদে দাই ।
- উহু বাবা আরেকটু ঘুমাও । কথা বললে তোমার বাবা জেগে যাবেন ।
- বাবাকেও নিয়ে দাবো । তলোনা মা ।
শুভর কথার শব্দে রাতুল জেগে উঠে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো জানালা মেলে দিয়ে বলে - মীরা , এই মীরা আরো এদিকে এসে শোও । ছেলেকে নিয়ে এতো কিনারায় শুয়েছ কেনো ? পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবেতো !
রাতুলের এহেন স্বাভাবিক আচরণে আমি অবাক হওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলি ! এও কি সম্ভব ? বিধাতা সত্যি সত্যি আমার ইচ্ছে পূরণ করেছেন ?
- রাতুল তুমি ঠিক আছতো ?
- আমি আবার বেঠিক ছিলাম কবে মীরা ! তোমার মাথায় কি গন্ডগোল দেখা দিলো নাকি ? হা হা হা ।
আজকের সূর্য্যটা আসলেই অন্যরকম !
আজকের সূর্য্য আমার জন্য একটা শুভদিন বয়ে এনেছে । এই সূর্য্যটার জন্য আমি কতোকাল অপেক্ষা করেছি !
কতোকাল !!!!!!!!!!
(সমাপ্ত)