পিঠেপিঠি পাঁচ বোন আমরা। ভাই নেই। সবার বড় রোকসানা আপা নিউ টেন এ পড়ে। তারপর নাজমা আপা। নাজমা আপার ছোট মিলু আপা। নাজমা আপা আর মিলু আপা একই ক্লাসে। ক্লাস এইট। নাজমা আপা একবার ফেল করে এখন মিলু আপার সাথেই পড়ে। তারপর আমি। আমি পড়ি সেভেনে। তারপর মিনু। মিনু পড়ে ক্লাস থ্রি।
নাজমা আপা ছাড়া আমরা সবাই ভালো খুব ছাত্রী। বড় আপা বেশি ভাল। সব সময় ক্লাসে ফাস্ট হয়। নাজমা আপাতো পড়তেই চায় না্। মা রোজ দিন চিৎকার চেঁচামেচি করেই পড়াতে বসান। তার মাথা ভর্তি উকুন। উকুনের ভয়ে তার সাথে কেউ শুতে চায় না। এত উকুন বুঝি মানুষের হয়। আম্মা বলেন, উকুনে মাইয়্যাটার সব ব্রেইন খাইছে। পড়ালেখা হইবো কি করে!
ভাই নেই দেখে আমাদের সব বোনের অনেক আফসোস। তবে এখন আমাদের ভাই হলো মিনু। মিনুকে আমরা মাঝে মাঝে ভাই সাজাই। এই বুদ্ধি মিলু আপার। তার মাথায় খুব বুদ্ধি। একদিন বলে কি, মিনু আমাদের ভাই। চল, সবাই মিলে মিনুকে ভাই সাজাই।
ওমনি আমরা সবাই নেমে পড়লাম মিনুকে ভাই সাজাতে। বড় আপা না করলেন। কিন্তু তার কথা কেউ পাত্তা দিলাম না। পাশের বাসার মিলু আপার বান্ধবী শাহনাজ আপার ছোট ভাইয়ের শার্ট প্যান্ট ধার করে আনা হয়েছে। একটু বড় তারপরও সেই শার্ট প্যান্ট পরানো হলো মিনুকে। ওমা দেখতে একেবারে ছেলে। আমাদের সেই কি খুশি। মিনুকে দেখে বড় আপা মুচকি হাসছেন। হাসতে হাসতে বললো, এই মা! এটা দেখি একেবারে ছেলে।
মিনু আমাদের খুশি দেখে খুব মজা পাচ্ছে। সবাই তাকে ভাই বলে ডাকছি। আদর করছি। মিনুকে নিয়ে যাওয়া হলো আম্মার কাছে। আম্মা দেখে প্রথমে চিনতেই পারেনি। একটু পর দেখি আম্মাও হাসছে। তারপর থেকে মিনুকে আমরা মাঝে মাঝে ভাই সাজিয়ে খেলা করি। রোকসানা আপা টিউশনির টাকা দিয়ে মিনুর জন্য ছেলেদের একটা শার্ট একটা প্যান্ট কিনেছে। এই সব আমরা আব্বার কাছ থেকে লুকিয়ে করি। আব্বা খুব রাগী মানুষ। তাছাড়া মিনুকে তিনি বেশ আদর করেন। তাকে ছেলে বানিয়ে এসব করছি শুনলে রাগ করবেন।
আব্বা জেলা কোর্টে হিসাবরক্ষকের চাকরী করেন। খুব সৎ মানুষ। হিসেব করে চলেন। অযথা খরচপাতি তার খুব অপছন্দ। ভাই নেই বলে রোজ রোজ আম্মার আফসোসের বয়ান শুনতে শুনতে আমাদের সব বোনের আম্মার বয়ান মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কখনো আব্বাকে ছেলের জন্য আফসোস করতে দেখিনি। আব্বা আমাদের খুব আদর করেন। মাঝে মাঝে মনে হয় আব্বা বোধয় খুশি তার এতগুলো মেয়ে নিয়ে।
আম্মার মত আমাদের পাঁচ বোনেরও খুব কষ্ট কোন ভাই নেই বলে। আমরা সবাই আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি। রোকসানা আপা এখন কলেজে পড়ে। আমরাও আরও উপরের ক্লাসে। মিনুও বড় হচ্ছে। ছোট বেলায় শার্ট প্যান্ট পরানোর অভ্যাসে মিনু এখনো মাঝে মাঝে বাসায় শার্ট প্যান্ট পরে। আব্বা এই নিয়ে খুব রাগ করেন। তারপরও মিনু পরে।
দিন দিন বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের অনেক কিছুতে অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। একসাথে কোথাও গেলে সবাই কেমনজানি তাকিয়ে থাকে। আত্নীয় স্বজনদের অনেকে নানা কথা বলে। আমাদের শুনতে বেশ খারাপ লাগে। সেদিন মিজান কাকার ছেলে হাসান ভাইয়ের বিয়ে থেকে এসে রোকসানা আপা খুব কেঁদেছিল। অনেক অনেক কেঁদেছে। আপার কান্না দেখে নাজমা আপা ছাড়া আমরা সব বোন কেঁদেছি। বিয়েতে আমার এক দুর সর্ম্পকের ফুপু সবার সামনে হাসতে হাসতে বলল, কিরে তোর বাপ তো তোদের বিয়ে দিতে দিতেই শেষ হবে।
এরপর আমরা সব বোন এক সাথে কোথাও যাওয়া খুব কমই হতো। বিশেষ করে রোকসানা আপা আর মিলু আপা খুব একটা যেত না। জোর করলেও যেতে চায়তো না। নানা অজুহাত দেখাতো। এক বাপের এতগুলো মেয়ে বলে সবাই আড় চোখে তাকাতো। আব্বাকে নিয়ে হাসি তামাশা করতো। এসব দেখে, শুনে আস্তে আস্তে আমাদেরও মন খারাপ হতে শুরু করল। আমি আর নাজমা আপাও পড়া লেখার বিষয় ছাড়া রোকসানা আপা আর মিলু আপার মত তেমন কোথাও যাই না।
আব্বা বিষয়টা লক্ষ্য করলেন। বৃহস্পতিবার রাতে রোকসানা আপা নিজ হাতে আব্বার চুলে কালি লাগায়। আব্বার চুলে যখন কালি লাগানো হয় তখন আমরা সব বোন আব্বাকে ঘিরে বসে থাকি। আব্বা চোখ বন্ধ মাঝে মাঝে কবিতা আবৃতি করেন, মাঝে মাঝে গান করেন। আব্বার গলাটা ভীষণ সুন্দর। আমরা সব বোন অপেক্ষায় থাকি এই বৃহস্পতিবারের জন্য। আব্বা আজ কোন গান বা কবিতা না বলে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবলেন। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আব্বা বলা শুরু করলেন, আমি জানি মায়েরা। কোন ভাই নাই বলে তোমাদের মনে খুব দুঃখ। তাছাড়া এতগুলো বোন তোমরা। নানা জনে নানা কথা বলে। তোমাদের মন খারাপ হয়। বাবা মায়ের উপর রাগ হয়। কোথাও যেতে চাওনা। আমি সব জানি, সব বুঝি।
কথাগুলো বলে আব্বা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার বলা শুরু করলেন, তোমরা বিশ্বাস করো আর নাই করো আমার ছেলে নিয়ে কোন আফসোস নাই। রোকসানা জন্মানো পর্যন্ত ছিল কিন্তু নাজমা জন্মের পর আমার কেনজানি মেয়েদের জন্য মায়া বেড়ে গেল। ভীষণ মায়া। তারপর আমি প্রতি রাতে এশার নামাজের পর আল্লাহর কাছে এই মেয়েই চাইতাম। মিলু, বিথী আর মিনুর জন্মের খবরগুলো আমার কাছে কি ছিল আমি জানি। রোজ দিন আমি আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে শুকরিয়া জানিয়েছি। কেঁদেছি। জানিনা কেন। এত মেয়ে তারপর আমার মায়া ছাড়েনি। তোমার মা খুব বেজার হয়। আমি মনে মনে খুশি। ভীষণ খুশি।
আব্বা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন স্কুল থেকে এসে দেখি আমার মা মারা গেছেন। সেই ছোট বেলা থেকে আমি মা দেখিনি। সৎ মায়ের সংসারে থাকলেও মায়ের আদর যত্ন, ভালোবাসা কখনো চোখে দেখিনি। এভাবেই আমি বড় হলাম। রোকসানার জন্মের পর মনে হল আমার মা ফিরে এসেছেন। একটার পর একটা মেয়ের জন্ম হতে লাগলো আর তাদের মুখ দেখে আমার মনে হত আমার মায়ের চেহারা বুঝি এমন ছিল। তখন কি যে খুশি লাগতো। খুশিতে প্রতিবার আমার চোখে পানি চলে আসত। আমি সেই চোখের পানি তোমাদের মায়ের কাছে লুকাতাম। তোমার মা আবার মনে করবে মেয়ে হয়েছে বলে আমি কষ্টে কাঁদছি । আমি জানি আমার এই মায়েরা একদিন আমাকে আলোয় ভরিয়ে দিবে। এই যে এতগুলো মা নিয়ে আমি রোজ বৃহস্পতিবার বসে থাকি, আমার মনে হয় আমি বেহেস্তে আছি। আমার মায়েরা আমাকে আগলে রেখেছে। মাথায় কালি করে দেয়, নক কেটে দেয়। আমার সাদা পাঞ্জাবীগুলোতে যত্ন করে নীল দেয়। আরো কত কি। এই সবতো সুখের আলো। যে আলো আমি আমার মায়ের মত কন্যাদের কাছ থেকে পাচ্ছি সেখানে কেন আমি ছেলের জন্য মন খারাপ করবো। আল্লাহ খুশি হয়ে আমাকে এতগুলো মেয়ে দিয়েছেন। আমি কি করে অখুশি হব। আমার কাজ এই মেয়েগুলোকে সৎভাবে মানুষ করা। আগলে রাখা। আল্লাহই আমার মায়েদের ব্যবস্থা করবেন। মায়েদের কোন অযত্ন করতে নাই। এতে আল্লাহ অখুশি হন।
কথাগুলো শেষ করে আব্বা চোখ বন্ধ অবস্থায় গান ধরেন, এই পৃথিবী যেমন আছে, তেমনই ঠিক রবে............. সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন...........
আব্বার গান শুনে বড় আপা কাঁদছে। খুব কাঁদছে। বড় আপার কান্না দেখে আমি, মিলু আপা, নাজমা আপা মিনু সবাই কাঁদছি। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী, সুন্দর, ভালো বাবাটার সামনে আমরা বসে আছি। আমাদের কান্না শুনেও বাবা গান গাওয়া থামাচ্ছে না। বাবার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাবা নিশ্চয় চাইছে আমরা কাঁদি। কেঁদে কেঁদে সমাজের কটুক্তি, অবহেলা আর আড় চোখের গ্লানিগুলো ঝেড়ে ফেলি।
হ্যাঁ আমরা পেরেছি। বড় আপা মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেল। নিলু আপা দেখি মেডিকেলে। নাজমা আপা, আমি মিনু ভার্সিটিতে। আস্তে আস্তে আমরা সব বোন একের পর এক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলাম। সবার বিয়ে হল। ভীষণ ভালো বিয়ে। মিনু স্বামীর সাথে এখন কানাডায় থাকে ।
আব্বা আম্মার বয়স হয়েছে। এখন আব্বা আম্মা পরেছেন মজার বিপদে। মাসের পনেরদিন আব্বার বাড়িটা প্রায় খালিই থাকে। আমরা বোনেরা জোরাজুরি করে আব্বাকে নিয়ে রাখি। আব্বা যেতে চান না। এদিকে আমাদের ভালোবাসা ফেলতেও পারেন না। এই নিয়ে আমাদের বোনদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া ঝাটিও হয়। বড় আপা মিমাংসা করেন। বড় আপাই ঠিক করেন কখন কার বাসায় আব্বা আম্মা থাকবেন । সেদিন কথা ছিল আব্বা আমার বাসায় আসবে। এদিকে নাজমা আপা ফোন দিয়ে কাঁদছে। আব্বার জন্য নাকি তার খুব মন খারাপ হচ্ছে। গত রাতে আব্বাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। নাজমা আপার ইচ্ছা এই সপ্তাহে আব্বা যেন তার বাসায় থাকে। বাধ্য হয়ে আমি হ্যাঁ বলি।
গত ডিসেম্ভর মাসে মিনু আব্বা আম্মাকে নিয়ে গেল কানাডায়। দুই মাস ছিল। এই দুই মাস আমাদের কেমন যে কেটেছে। মিলু আপাতো ফোন দিয়ে মিনুকে সেই কি বকা ঝকা। কেন আব্বাকে এতদিন ওখানে নিয়ে রেখেছে। মিলু আপার বকা ঝকা শুনে মিনু অভিযোগ দিল বড় আপাকে। এই নিয়ে কত কি।
কানাডা থেকে আব্বা আম্মা ফিরে আসার মাস ছয়েক পরে মিনু দেশে বেড়াতে আসল। মিনু দেশে আসার পর আমরা সব বোন সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা সবাই সপ্তাহ খানেক আব্বা আম্মার সাথে থাকবো আমাদের পুরনো বাসায়।
এখন আমরা সব বোন আছি আব্বার বাসায়। সন্ধ্যা থেকে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিক ভাসিয়ে নেয়া বৃষ্টি। আমরা সব বোন জানি বৃষ্টি আব্বার ভীষণ পছন্দ। বৃষ্টি হলে আব্বা খিচুড়ি খেতেও পছন্দ করেন। বিশেষ করে বড় আপার রান্না করা। আজ বড় আপা খিচুড়ি রান্না করলেন। আমরা সব বোন আব্বা আম্মার সাথে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির কোণার ঘরটায় আব্বাকে ঘিরে বসে আছি। আব্বা বসে আছে তার পুরনো বেতের চেয়ারে। মিনু আব্বার পেছনে দাড়িয়ে মাথার চুল বিনি কেটে দিচ্ছে। আব্বা চোখ বন্ধ করে আছেন। আমরা বসে আছি আব্বা গান ধরবেন। আব্বা একটু লজ্জাও পাচ্ছেন। বয়স হয়েছে। তাছাড়া অনেক বছর গান টান করেছেন বলে মনে হয়না।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ হল। হঠাৎ চারিদিক আলো করে চাঁদের জোছনা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পর এত আলো দিয়ে জোছনা খুব কম সময়ই দেখা যায়। আমরা যে রুমটায় বসে আছি তার বাতি নেভানো। পূর্ব দিকের জানালাটা নিয়ে জোছনা এসে পুরো ঘর আলো ভরিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ আব্বা বলা শুরু করলেন, কন্যা সন্তান আল্লাহর উপহার। আল্লাহর এই উপহার যদি আমি সৎভাবে লালন পালন করতে পারি তবে আমার জন্য পরকালে জান্নাতও উপহার থাকবে। এই জান্নাততো আমার পরকালে কিন্তু আমিতো জান্নাত এই ইহকালে পেয়ে গেলাম। এই জান্নাত আমার মেয়েরা আমাকে দিয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এই পুরো ঘরটা জান্নাতের একটা অংশ।
এবার আব্বা আর সময় নিলেন না। কথাগুলো শেষ করেই আব্বা চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন, মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন…………
আব্বার গলায় সুরের যাদুটা এখনো ঠিক আগের মতই আছে। আমরা সব বোন বিভোর হয়ে শুনছি আব্বার গান। রোকসানা আপা আব্বার কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। আব্বা গাইতে গাইতে আপার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আমাদের সব বোন কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিনা। তবে এই কান্না সুখের। আব্বার কথার মত সত্যিই মনে হচ্ছে এই পুরো ঘরটা একটা জান্নাত। জোছনার রুপালি আলোয় পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। এই আলোর মাঝে একজন সুখি বাবা তার পাঁচ কন্যা নিয়ে বসে আছেন। গান গাইছেন। এই সুখইতো জান্নাতের সুখ।
(সমাপ্ত)
নাজমা আপা ছাড়া আমরা সবাই ভালো খুব ছাত্রী। বড় আপা বেশি ভাল। সব সময় ক্লাসে ফাস্ট হয়। নাজমা আপাতো পড়তেই চায় না্। মা রোজ দিন চিৎকার চেঁচামেচি করেই পড়াতে বসান। তার মাথা ভর্তি উকুন। উকুনের ভয়ে তার সাথে কেউ শুতে চায় না। এত উকুন বুঝি মানুষের হয়। আম্মা বলেন, উকুনে মাইয়্যাটার সব ব্রেইন খাইছে। পড়ালেখা হইবো কি করে!
ভাই নেই দেখে আমাদের সব বোনের অনেক আফসোস। তবে এখন আমাদের ভাই হলো মিনু। মিনুকে আমরা মাঝে মাঝে ভাই সাজাই। এই বুদ্ধি মিলু আপার। তার মাথায় খুব বুদ্ধি। একদিন বলে কি, মিনু আমাদের ভাই। চল, সবাই মিলে মিনুকে ভাই সাজাই।
ওমনি আমরা সবাই নেমে পড়লাম মিনুকে ভাই সাজাতে। বড় আপা না করলেন। কিন্তু তার কথা কেউ পাত্তা দিলাম না। পাশের বাসার মিলু আপার বান্ধবী শাহনাজ আপার ছোট ভাইয়ের শার্ট প্যান্ট ধার করে আনা হয়েছে। একটু বড় তারপরও সেই শার্ট প্যান্ট পরানো হলো মিনুকে। ওমা দেখতে একেবারে ছেলে। আমাদের সেই কি খুশি। মিনুকে দেখে বড় আপা মুচকি হাসছেন। হাসতে হাসতে বললো, এই মা! এটা দেখি একেবারে ছেলে।
মিনু আমাদের খুশি দেখে খুব মজা পাচ্ছে। সবাই তাকে ভাই বলে ডাকছি। আদর করছি। মিনুকে নিয়ে যাওয়া হলো আম্মার কাছে। আম্মা দেখে প্রথমে চিনতেই পারেনি। একটু পর দেখি আম্মাও হাসছে। তারপর থেকে মিনুকে আমরা মাঝে মাঝে ভাই সাজিয়ে খেলা করি। রোকসানা আপা টিউশনির টাকা দিয়ে মিনুর জন্য ছেলেদের একটা শার্ট একটা প্যান্ট কিনেছে। এই সব আমরা আব্বার কাছ থেকে লুকিয়ে করি। আব্বা খুব রাগী মানুষ। তাছাড়া মিনুকে তিনি বেশ আদর করেন। তাকে ছেলে বানিয়ে এসব করছি শুনলে রাগ করবেন।
আব্বা জেলা কোর্টে হিসাবরক্ষকের চাকরী করেন। খুব সৎ মানুষ। হিসেব করে চলেন। অযথা খরচপাতি তার খুব অপছন্দ। ভাই নেই বলে রোজ রোজ আম্মার আফসোসের বয়ান শুনতে শুনতে আমাদের সব বোনের আম্মার বয়ান মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কখনো আব্বাকে ছেলের জন্য আফসোস করতে দেখিনি। আব্বা আমাদের খুব আদর করেন। মাঝে মাঝে মনে হয় আব্বা বোধয় খুশি তার এতগুলো মেয়ে নিয়ে।
আম্মার মত আমাদের পাঁচ বোনেরও খুব কষ্ট কোন ভাই নেই বলে। আমরা সবাই আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি। রোকসানা আপা এখন কলেজে পড়ে। আমরাও আরও উপরের ক্লাসে। মিনুও বড় হচ্ছে। ছোট বেলায় শার্ট প্যান্ট পরানোর অভ্যাসে মিনু এখনো মাঝে মাঝে বাসায় শার্ট প্যান্ট পরে। আব্বা এই নিয়ে খুব রাগ করেন। তারপরও মিনু পরে।
দিন দিন বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের অনেক কিছুতে অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। একসাথে কোথাও গেলে সবাই কেমনজানি তাকিয়ে থাকে। আত্নীয় স্বজনদের অনেকে নানা কথা বলে। আমাদের শুনতে বেশ খারাপ লাগে। সেদিন মিজান কাকার ছেলে হাসান ভাইয়ের বিয়ে থেকে এসে রোকসানা আপা খুব কেঁদেছিল। অনেক অনেক কেঁদেছে। আপার কান্না দেখে নাজমা আপা ছাড়া আমরা সব বোন কেঁদেছি। বিয়েতে আমার এক দুর সর্ম্পকের ফুপু সবার সামনে হাসতে হাসতে বলল, কিরে তোর বাপ তো তোদের বিয়ে দিতে দিতেই শেষ হবে।
এরপর আমরা সব বোন এক সাথে কোথাও যাওয়া খুব কমই হতো। বিশেষ করে রোকসানা আপা আর মিলু আপা খুব একটা যেত না। জোর করলেও যেতে চায়তো না। নানা অজুহাত দেখাতো। এক বাপের এতগুলো মেয়ে বলে সবাই আড় চোখে তাকাতো। আব্বাকে নিয়ে হাসি তামাশা করতো। এসব দেখে, শুনে আস্তে আস্তে আমাদেরও মন খারাপ হতে শুরু করল। আমি আর নাজমা আপাও পড়া লেখার বিষয় ছাড়া রোকসানা আপা আর মিলু আপার মত তেমন কোথাও যাই না।
আব্বা বিষয়টা লক্ষ্য করলেন। বৃহস্পতিবার রাতে রোকসানা আপা নিজ হাতে আব্বার চুলে কালি লাগায়। আব্বার চুলে যখন কালি লাগানো হয় তখন আমরা সব বোন আব্বাকে ঘিরে বসে থাকি। আব্বা চোখ বন্ধ মাঝে মাঝে কবিতা আবৃতি করেন, মাঝে মাঝে গান করেন। আব্বার গলাটা ভীষণ সুন্দর। আমরা সব বোন অপেক্ষায় থাকি এই বৃহস্পতিবারের জন্য। আব্বা আজ কোন গান বা কবিতা না বলে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবলেন। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আব্বা বলা শুরু করলেন, আমি জানি মায়েরা। কোন ভাই নাই বলে তোমাদের মনে খুব দুঃখ। তাছাড়া এতগুলো বোন তোমরা। নানা জনে নানা কথা বলে। তোমাদের মন খারাপ হয়। বাবা মায়ের উপর রাগ হয়। কোথাও যেতে চাওনা। আমি সব জানি, সব বুঝি।
কথাগুলো বলে আব্বা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার বলা শুরু করলেন, তোমরা বিশ্বাস করো আর নাই করো আমার ছেলে নিয়ে কোন আফসোস নাই। রোকসানা জন্মানো পর্যন্ত ছিল কিন্তু নাজমা জন্মের পর আমার কেনজানি মেয়েদের জন্য মায়া বেড়ে গেল। ভীষণ মায়া। তারপর আমি প্রতি রাতে এশার নামাজের পর আল্লাহর কাছে এই মেয়েই চাইতাম। মিলু, বিথী আর মিনুর জন্মের খবরগুলো আমার কাছে কি ছিল আমি জানি। রোজ দিন আমি আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে শুকরিয়া জানিয়েছি। কেঁদেছি। জানিনা কেন। এত মেয়ে তারপর আমার মায়া ছাড়েনি। তোমার মা খুব বেজার হয়। আমি মনে মনে খুশি। ভীষণ খুশি।
আব্বা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন স্কুল থেকে এসে দেখি আমার মা মারা গেছেন। সেই ছোট বেলা থেকে আমি মা দেখিনি। সৎ মায়ের সংসারে থাকলেও মায়ের আদর যত্ন, ভালোবাসা কখনো চোখে দেখিনি। এভাবেই আমি বড় হলাম। রোকসানার জন্মের পর মনে হল আমার মা ফিরে এসেছেন। একটার পর একটা মেয়ের জন্ম হতে লাগলো আর তাদের মুখ দেখে আমার মনে হত আমার মায়ের চেহারা বুঝি এমন ছিল। তখন কি যে খুশি লাগতো। খুশিতে প্রতিবার আমার চোখে পানি চলে আসত। আমি সেই চোখের পানি তোমাদের মায়ের কাছে লুকাতাম। তোমার মা আবার মনে করবে মেয়ে হয়েছে বলে আমি কষ্টে কাঁদছি । আমি জানি আমার এই মায়েরা একদিন আমাকে আলোয় ভরিয়ে দিবে। এই যে এতগুলো মা নিয়ে আমি রোজ বৃহস্পতিবার বসে থাকি, আমার মনে হয় আমি বেহেস্তে আছি। আমার মায়েরা আমাকে আগলে রেখেছে। মাথায় কালি করে দেয়, নক কেটে দেয়। আমার সাদা পাঞ্জাবীগুলোতে যত্ন করে নীল দেয়। আরো কত কি। এই সবতো সুখের আলো। যে আলো আমি আমার মায়ের মত কন্যাদের কাছ থেকে পাচ্ছি সেখানে কেন আমি ছেলের জন্য মন খারাপ করবো। আল্লাহ খুশি হয়ে আমাকে এতগুলো মেয়ে দিয়েছেন। আমি কি করে অখুশি হব। আমার কাজ এই মেয়েগুলোকে সৎভাবে মানুষ করা। আগলে রাখা। আল্লাহই আমার মায়েদের ব্যবস্থা করবেন। মায়েদের কোন অযত্ন করতে নাই। এতে আল্লাহ অখুশি হন।
কথাগুলো শেষ করে আব্বা চোখ বন্ধ অবস্থায় গান ধরেন, এই পৃথিবী যেমন আছে, তেমনই ঠিক রবে............. সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন...........
আব্বার গান শুনে বড় আপা কাঁদছে। খুব কাঁদছে। বড় আপার কান্না দেখে আমি, মিলু আপা, নাজমা আপা মিনু সবাই কাঁদছি। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী, সুন্দর, ভালো বাবাটার সামনে আমরা বসে আছি। আমাদের কান্না শুনেও বাবা গান গাওয়া থামাচ্ছে না। বাবার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাবা নিশ্চয় চাইছে আমরা কাঁদি। কেঁদে কেঁদে সমাজের কটুক্তি, অবহেলা আর আড় চোখের গ্লানিগুলো ঝেড়ে ফেলি।
হ্যাঁ আমরা পেরেছি। বড় আপা মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেল। নিলু আপা দেখি মেডিকেলে। নাজমা আপা, আমি মিনু ভার্সিটিতে। আস্তে আস্তে আমরা সব বোন একের পর এক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলাম। সবার বিয়ে হল। ভীষণ ভালো বিয়ে। মিনু স্বামীর সাথে এখন কানাডায় থাকে ।
আব্বা আম্মার বয়স হয়েছে। এখন আব্বা আম্মা পরেছেন মজার বিপদে। মাসের পনেরদিন আব্বার বাড়িটা প্রায় খালিই থাকে। আমরা বোনেরা জোরাজুরি করে আব্বাকে নিয়ে রাখি। আব্বা যেতে চান না। এদিকে আমাদের ভালোবাসা ফেলতেও পারেন না। এই নিয়ে আমাদের বোনদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া ঝাটিও হয়। বড় আপা মিমাংসা করেন। বড় আপাই ঠিক করেন কখন কার বাসায় আব্বা আম্মা থাকবেন । সেদিন কথা ছিল আব্বা আমার বাসায় আসবে। এদিকে নাজমা আপা ফোন দিয়ে কাঁদছে। আব্বার জন্য নাকি তার খুব মন খারাপ হচ্ছে। গত রাতে আব্বাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। নাজমা আপার ইচ্ছা এই সপ্তাহে আব্বা যেন তার বাসায় থাকে। বাধ্য হয়ে আমি হ্যাঁ বলি।
গত ডিসেম্ভর মাসে মিনু আব্বা আম্মাকে নিয়ে গেল কানাডায়। দুই মাস ছিল। এই দুই মাস আমাদের কেমন যে কেটেছে। মিলু আপাতো ফোন দিয়ে মিনুকে সেই কি বকা ঝকা। কেন আব্বাকে এতদিন ওখানে নিয়ে রেখেছে। মিলু আপার বকা ঝকা শুনে মিনু অভিযোগ দিল বড় আপাকে। এই নিয়ে কত কি।
কানাডা থেকে আব্বা আম্মা ফিরে আসার মাস ছয়েক পরে মিনু দেশে বেড়াতে আসল। মিনু দেশে আসার পর আমরা সব বোন সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা সবাই সপ্তাহ খানেক আব্বা আম্মার সাথে থাকবো আমাদের পুরনো বাসায়।
এখন আমরা সব বোন আছি আব্বার বাসায়। সন্ধ্যা থেকে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিক ভাসিয়ে নেয়া বৃষ্টি। আমরা সব বোন জানি বৃষ্টি আব্বার ভীষণ পছন্দ। বৃষ্টি হলে আব্বা খিচুড়ি খেতেও পছন্দ করেন। বিশেষ করে বড় আপার রান্না করা। আজ বড় আপা খিচুড়ি রান্না করলেন। আমরা সব বোন আব্বা আম্মার সাথে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির কোণার ঘরটায় আব্বাকে ঘিরে বসে আছি। আব্বা বসে আছে তার পুরনো বেতের চেয়ারে। মিনু আব্বার পেছনে দাড়িয়ে মাথার চুল বিনি কেটে দিচ্ছে। আব্বা চোখ বন্ধ করে আছেন। আমরা বসে আছি আব্বা গান ধরবেন। আব্বা একটু লজ্জাও পাচ্ছেন। বয়স হয়েছে। তাছাড়া অনেক বছর গান টান করেছেন বলে মনে হয়না।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ হল। হঠাৎ চারিদিক আলো করে চাঁদের জোছনা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পর এত আলো দিয়ে জোছনা খুব কম সময়ই দেখা যায়। আমরা যে রুমটায় বসে আছি তার বাতি নেভানো। পূর্ব দিকের জানালাটা নিয়ে জোছনা এসে পুরো ঘর আলো ভরিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ আব্বা বলা শুরু করলেন, কন্যা সন্তান আল্লাহর উপহার। আল্লাহর এই উপহার যদি আমি সৎভাবে লালন পালন করতে পারি তবে আমার জন্য পরকালে জান্নাতও উপহার থাকবে। এই জান্নাততো আমার পরকালে কিন্তু আমিতো জান্নাত এই ইহকালে পেয়ে গেলাম। এই জান্নাত আমার মেয়েরা আমাকে দিয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এই পুরো ঘরটা জান্নাতের একটা অংশ।
এবার আব্বা আর সময় নিলেন না। কথাগুলো শেষ করেই আব্বা চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন, মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন…………
আব্বার গলায় সুরের যাদুটা এখনো ঠিক আগের মতই আছে। আমরা সব বোন বিভোর হয়ে শুনছি আব্বার গান। রোকসানা আপা আব্বার কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। আব্বা গাইতে গাইতে আপার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আমাদের সব বোন কাঁদছি। কেন কাঁদছি জানিনা। তবে এই কান্না সুখের। আব্বার কথার মত সত্যিই মনে হচ্ছে এই পুরো ঘরটা একটা জান্নাত। জোছনার রুপালি আলোয় পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। এই আলোর মাঝে একজন সুখি বাবা তার পাঁচ কন্যা নিয়ে বসে আছেন। গান গাইছেন। এই সুখইতো জান্নাতের সুখ।
(সমাপ্ত)