ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও তাঁর আন্দোলনের কারণ
বেহেশ্তের যুবকদের নেতা ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম আশুরার দিনে কারবালার মরুপ্রান্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইসলামের এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রতি বছরই স্মরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের এ মুসলিম সমাজে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাকেই বড় করে দেখা হয়, অথচ যে আদর্শের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই আদর্শের কথা তেমন একটা আলোচিত হয় না। কোথাও আলোচনা করা হলেও সেখানে শুধু এতটুকু বলা হয় যে, ইমাম হুসাইন একজন ফাসেক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন এবং তাঁকে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও পটভূমি এবং তাঁর আন্দোলনের কারণ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হয় না বললেই চলে।কিন্তু আমরা যদি কারবালার ঘটনার সাথে জড়িত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা না করি তা হলে আমাদের কাছে ইমাম হুসাইনের মহান আত্মত্যাগ কেবল একটি মর্মান্তিক ঘটনা হিসাবেই রয়ে যাবে, আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারব না। তাই আমাদের অবশ্যই ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পেক্ষাপট এবং তাঁর আন্দোলনের কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত। তবে সবচেয়ে আগে প্রাসঙ্গিকভাবে যে আলোচনা একান্ত প্রয়োজন তা হলো ইসলামের দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা। যদি আমরা ইমাম হুসাইনের মর্যাদা বুঝতে না পারি তা হলে তাঁর আন্দোলনকেও ঝুঝতে পারব না। কেননা তাঁর মর্যাদা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারার জন্যই তাঁর আন্দোলন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা
মহানবী (সা.)-এর আহ্লে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম হুসাইন (আ.) মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ঘোষিত নিষ্পাপ ব্যক্তি। পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ যাঁর নিষ্পাপ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন১ :
إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرَا
"হে নবীর আহ্লে বাইত! আল্লাহ্ চান তোমাদের থেকে পাপ-পঙ্কিলতা দূর করে তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।"
মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সব হাদীসের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ দু'টি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো। মহানবী (সা.) বলেছেন :
اَلْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلَ الْجَنَّةِ
"হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।"২
মহানবী (সা.) আরো বলেছেন :
إِنَّ الْحُسَيْنَ مِصْبَاحُ الْهُدَى وَ سَفِيْنَةُ النَّجَاةِ
"নিশ্চয়ই হুসাইন হেদায়েতের প্রদীপ ও মুক্তির তরণী।"৩
অনেক সময় আমরা ইমাম হুসাইনের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এসব হাদীসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হই। অনেকে মনে করেন, যেহেতু ইমাম হুসাইন মহানবীর দৌহিত্র ছিলেন সেজন্য তিনি ভালোবেসে তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন, এমনকি 'বেহেশতের যুবকদের নেতা' উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক উক্তি বা তাঁকে 'বেহেশতের যুবকদের নেতা' উপাধিতে ভূষিত করার পেছনে আত্মীয়তার সম্পর্কের কোনো ভূমিকা ছিল, নাকি ইমাম হুসাইন এর যোগ্য ছিলেন বলেই রাসূল তাঁকে এ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এর জবাবের জন্য ইমাম হুসাইনের জীবন ও কর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
আমরা যদি তাঁর জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত জীবন পর্যালোচনা করি তা হলে আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হবে যে, তিনি কীভাবে নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আর ইসলামের জন্যই বা তিনি কতটুকু অবদান রেখেছেন!
ইমাম হুসাইন মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্যে তাঁর শৈশবের সাতটি বছর অতিবাহিত করেছেন। ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন। রাসূলের ওফাতের পর তিনি তাঁর পিতা রাসূলের 'জ্ঞান নগরীর দ্বার' হযরত আলী (আ.) ও 'বেহেশতের নারীদের নেত্রী' হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়ে তুলেছেন। পিতা-মাতার সংগ্রামী জীবন থেকেও তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাফের-মুশরিকদের সাথে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ তিনি পান নি; কিন্তু আলী (আ.)-এর খেলাফতকালে ইসলামের প্রকৃত রূপ বজায় রাখার জন্য তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়। রাসূলের ওফাতের পর যখন আলী (আ.)-এর কোষবদ্ধ তরবারি আবার কোষমুক্ত হলো তখন তিনি পিতার পাশে তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। পিতার শাহাদাতের পর বড় ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতকালেও তিনি একই ভূমিকা পালন করলেন। ইসলামের জন্য একে একে মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের আত্মত্যাগ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। অবশেষে সময় হলো নিজেকে উৎসর্গ করার। কিন্তু তিনি কীভাবে এ উৎসর্গ করলেন? তিনি কি শুধু নিজেকেই উৎসর্গ করলেন? না; বরং নিজের কলিজার টুকরো সন্তানদের, ভাইয়ের সন্তানদের ও নিকটাত্মীয়দেরকেও নিজের সাথে উৎসর্গ করে পৃথিবীর বুকে আত্মোৎসর্গের অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
মহান আল্লাহ্র ধর্ম ইসলামকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবার-পরিজনসহ নিজেকে চূড়ান্তভাবে উৎসর্গ করার মাধ্যমে যে ধারাবাহিক ভূমিকা তিনি রেখে গেছেন সেজন্যই তিনি 'বেহেশতের যুবকদের নেতা'Ñ রাসূলের দৌহিত্র হিসাবে তাঁর এ মর্যাদা নয়। আবার আমরা এ বিষয়টিও লক্ষ্য করি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সকল আত্মীয়ের মর্যাদাও সমান নয়। রাসূলের কোনো কোনো আত্মীয় অন্য সকল আত্মীয়ের চেয়ে অধিক সম্মানের অধিকারী। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁদের মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত হামযা (রা.)-কে 'সাইয়্যেদুশ শুহাদা' (শহীদদের নেতা), হযরত ফাতিমা (আ.)-কে 'সাইয়্যেদাতু নিসায়িল আলামীন' (জগতসমূহের নারীদের নেত্রী), হযরত হাসানকে 'সাইয়্যেদু শাবাবি আহ্লিল জান্নাহ্' (বেহেশতের যুবকদের নেতা), হযরত জাফর বিন আবি তালিব (রা.)-কে 'তাইয়্যার' (পাখি) উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আর এসকল মহান ব্যক্তিত্বের খোদাভীরুতা এবং ইসলামের জন্য তাঁদের অতুলনীয় ভূমিকার কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে। তাই বলা যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রক্ত-সম্পর্ক থাকার কারণে কাউকে কোনো মর্যাদায় ভূষিত করেন নি; বরং মহান আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের ভালোবাসা এবং ইসলাম ধর্মের জন্য তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের কারণেই তাঁদের মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। আর এ বিষয়টিই ইসলামে মর্যাদার ভিত্তি যা পবিত্র কোরআনেই বর্ণিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَى كُم
"নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু ব্যক্তিই আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে সম্মানিত।"৪
এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলাম মানুষের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে খোদাভীরুতা ও পরহেজগারীকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা দানের বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। খোদাভীরু (মুত্তাকী) ব্যক্তি নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ্র নির্দেশের কাছে সমর্পণ করেন। তিনি তাঁর করণীয় কাজ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করেন এবং মহান আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহ্র নির্দেশ পালনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, দীন ইসলামের কল্যাণে কোনো বিষয়ই তাঁর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
ইমাম হুসাইন (আ.) তেমনি এক ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের জীবনে যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি ইসলাম ধর্মের খেদমতে নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োগ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যেরূপ ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ইমাম হুসাইনও সেরূপ এ ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং এ ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত শাহাদাতের অমিয় সুধা পানের মাধ্যমে এ ধর্মের খেদমতের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা দানকে অস্বীকার করার বিষয়টি পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের জীবনী থেকেও প্রমাণিত হয়। যেমন হযরত নূহ (আ.)-এর স্ত্রী ও পুত্র এবং হযরত লূত (আ.)-এর স্ত্রী কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। নবীর স্ত্রী বা সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামে তাদের কোনো মর্যাদা দেয়া হয় নি; বরং তাদেরকে জাহান্নামের অধিবাসী বলা হয়েছে।
তাই পবিত্র কোরআনের আলোকেই আমরা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি। আবার রাসূলের মর্যাদার সাথেও এটি মোটেও খাপ খায় না যে, তিনি কেবল তাঁর সাথে রক্ত-সম্পর্ক থাকার কারণে কারো প্রশংসা করবেন। কারণ, পবিত্র কোরআন তাঁরই ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তিনি যা বলেন তা 'ওহী ব্যতীত আর কিছুই নয়'।* প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর তাকওয়া-পরহেজগারী এবং ইসলাম ধর্মের জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন সে কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে 'বেহেশতের যুবকদের নেতা' উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের প্রেক্ষাপট রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে এমন কী হয়েছিল যার পরিণতিতে তাঁর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁরই বংশধর বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনকে? ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের ঘটনা এমন নয় যে, হঠাৎ করেই ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া মুসলিম বিশ্বের খলিফা হয়ে ইমাম হুসাইনকে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করার নির্দেশ দেয় এবং ইমাম হুসাইনও বাইয়াত করতে অস্বীকার করে তাঁর আন্দোলন শুরু করেন; আন্দোলনের এক পর্যায়ে কুফা যাবার পথে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় নীত হন এবং সেখানে তিনি নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার একটি দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। আমরা জানি, নবিগণের ওফাতের পর তাঁদের উম্মতদের মধ্য থেকে কিছু লোক তাঁদের প্রচারিত ধর্মের মধ্যে বিকৃতি সাধন করত এবং একটা সময়ে সেই বিকৃতি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ধর্মের অস্তিত্বকেই বিলীন করে দিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের সময়ও মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকদের অস্তিত্ব ছিল যারা মনে-প্রাণে ইসলামকে গ্রহণ করে নি; বরং পরিস্থিতির কারণে মুখে ইসলাম প্রকাশ করেছিল। তারা সবসময় ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে চাইত, ইসলামের মধ্যে বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে একে ধ্বংস করতে চাইত। তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এমন মুনাফিক গোষ্ঠীর কারণেই ধীরে ধীরে কারবালার এ হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়।
মুনাফিক গোষ্ঠীর কারণেই তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের সময় মুসলিম বিশ্বে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, এমনকি এদের কারণেই হযরত উসমান নিহত হন। এরপর হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতকালেও এ বিশৃঙ্খল অবস্থা অব্যাহত থাকে; বরং এটি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফ্ফিনের মতো দু'টি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর মুনাফিকরা ষড়যন্ত্র করে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। এরপর মুসলমান সমাজে প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে আমীরে মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে মুসলমানদের খেলাফতে অধিষ্ঠিত করেন।
ইসলামবিরোধী যে সব কাজ অতীতে গোপনে সংঘটিত হতো, সেগুলো প্রকাশ্যে সংঘটিত হতে থাকে। এমনকি, মুসলিম বিশ্বের খলিফা ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কাজ শুরু করে। সে পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ইমাম হুসাইন (আ.) তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
তাই আমরা যদি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতকে পূর্ববর্তী পেক্ষাপট ছাড়া ৬১ হিজরীতে আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা মনে করি তা হলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পূর্ববর্তী দু'তিন বছরের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝতে পারব যে, রাসূলের ওফাতের পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনের ওপর বিপদ নেমে আসাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। কাফের-মুশরিক নয়; বরং মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত মুনাফিকদের দ্বারা স্বয়ং রাসূলের জীবনই সবসময় হুমকির মুখে ছিল। রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে যেমন হযরত সালমান (রা.), হযরত আবু যার (রা.), হযরত আম্মার (রা.), হযরত মিকদাদ (রা.), হযরত আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন, এর বিপরীতে অনেক মুনাফিকও ছিল। এর প্রমাণ মেলে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূলকে পাহাড় থেকে ফেলে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের ঘটনায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হুযাইফাকে এসব মুনাফিকের নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। এসব মুনাফিকের ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণও রাসূল বলেছেন : "আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করলে বিধর্মীরা বলবে, মুহাম্মদ শক্তি ও ক্ষমতার তুঙ্গে পৌঁছার পর নিজ সঙ্গী-সাথীদের গর্দানের ওপর তরবারির আঘাত হেনেছে।"৫
রাসূলকে হত্যা চেষ্টার পাশাপাশি তাঁর সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হওয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটতে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিরোধিতার বিষয়টি ধীরে ধীরে প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। হযরত উসামাকে সেনাপতি নিয়োগের বিরোধিতা করা, রাসূলের আদেশ অমান্য করে সিরিয়া অভিযানে যেতে বিলম্ব করা অথবা রাসূলের শেষ অসিয়তনামা লেখতে বাধা দানের ঘটনায় রাসূলের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। তাই বলা যায়, রাসূলের ওফাতের পূর্বেই মুসলমানদের বিচ্যুতি শুরু হয় এবং রাসূলের ওফাতের পর তা চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ইসলামের মুখোশ পরে ইসলামের নামেই ইসলামবিরোধী কাজ চলতে থাকে। পরে প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কাজ শুরু হয়। ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাসনামলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হয় যে, ইসলামের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর কালজয়ী আন্দোলন শুরু করেন এবং বুকের রক্ত দিয়ে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের কারণ
ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের পেছনে বাহ্যিকভাবে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়ে থাকে :
১. ইয়াযীদের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ নেয়ার চাপ;
২. কুফাবাসীর পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ এবং
৩. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।
বেহেশ্তের যুবকদের নেতা ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম আশুরার দিনে কারবালার মরুপ্রান্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইসলামের এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রতি বছরই স্মরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের এ মুসলিম সমাজে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাকেই বড় করে দেখা হয়, অথচ যে আদর্শের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই আদর্শের কথা তেমন একটা আলোচিত হয় না। কোথাও আলোচনা করা হলেও সেখানে শুধু এতটুকু বলা হয় যে, ইমাম হুসাইন একজন ফাসেক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন এবং তাঁকে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ও পটভূমি এবং তাঁর আন্দোলনের কারণ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হয় না বললেই চলে।কিন্তু আমরা যদি কারবালার ঘটনার সাথে জড়িত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা না করি তা হলে আমাদের কাছে ইমাম হুসাইনের মহান আত্মত্যাগ কেবল একটি মর্মান্তিক ঘটনা হিসাবেই রয়ে যাবে, আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারব না। তাই আমাদের অবশ্যই ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পেক্ষাপট এবং তাঁর আন্দোলনের কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত। তবে সবচেয়ে আগে প্রাসঙ্গিকভাবে যে আলোচনা একান্ত প্রয়োজন তা হলো ইসলামের দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা। যদি আমরা ইমাম হুসাইনের মর্যাদা বুঝতে না পারি তা হলে তাঁর আন্দোলনকেও ঝুঝতে পারব না। কেননা তাঁর মর্যাদা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারার জন্যই তাঁর আন্দোলন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা
মহানবী (সা.)-এর আহ্লে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম হুসাইন (আ.) মহান আল্লাহ্ কর্তৃক ঘোষিত নিষ্পাপ ব্যক্তি। পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ যাঁর নিষ্পাপ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন১ :
إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْرَا
"হে নবীর আহ্লে বাইত! আল্লাহ্ চান তোমাদের থেকে পাপ-পঙ্কিলতা দূর করে তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।"
মহানবী (সা.)-এর নিকট থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সব হাদীসের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ দু'টি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো। মহানবী (সা.) বলেছেন :
اَلْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلَ الْجَنَّةِ
"হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।"২
মহানবী (সা.) আরো বলেছেন :
إِنَّ الْحُسَيْنَ مِصْبَاحُ الْهُدَى وَ سَفِيْنَةُ النَّجَاةِ
"নিশ্চয়ই হুসাইন হেদায়েতের প্রদীপ ও মুক্তির তরণী।"৩
অনেক সময় আমরা ইমাম হুসাইনের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর এসব হাদীসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হই। অনেকে মনে করেন, যেহেতু ইমাম হুসাইন মহানবীর দৌহিত্র ছিলেন সেজন্য তিনি ভালোবেসে তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন, এমনকি 'বেহেশতের যুবকদের নেতা' উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক উক্তি বা তাঁকে 'বেহেশতের যুবকদের নেতা' উপাধিতে ভূষিত করার পেছনে আত্মীয়তার সম্পর্কের কোনো ভূমিকা ছিল, নাকি ইমাম হুসাইন এর যোগ্য ছিলেন বলেই রাসূল তাঁকে এ উপাধিতে ভূষিত করেছেন এর জবাবের জন্য ইমাম হুসাইনের জীবন ও কর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
আমরা যদি তাঁর জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত জীবন পর্যালোচনা করি তা হলে আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হবে যে, তিনি কীভাবে নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আর ইসলামের জন্যই বা তিনি কতটুকু অবদান রেখেছেন!
ইমাম হুসাইন মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্যে তাঁর শৈশবের সাতটি বছর অতিবাহিত করেছেন। ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন। রাসূলের ওফাতের পর তিনি তাঁর পিতা রাসূলের 'জ্ঞান নগরীর দ্বার' হযরত আলী (আ.) ও 'বেহেশতের নারীদের নেত্রী' হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়ে তুলেছেন। পিতা-মাতার সংগ্রামী জীবন থেকেও তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাফের-মুশরিকদের সাথে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ তিনি পান নি; কিন্তু আলী (আ.)-এর খেলাফতকালে ইসলামের প্রকৃত রূপ বজায় রাখার জন্য তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়। রাসূলের ওফাতের পর যখন আলী (আ.)-এর কোষবদ্ধ তরবারি আবার কোষমুক্ত হলো তখন তিনি পিতার পাশে তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। পিতার শাহাদাতের পর বড় ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর খেলাফতকালেও তিনি একই ভূমিকা পালন করলেন। ইসলামের জন্য একে একে মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের আত্মত্যাগ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। অবশেষে সময় হলো নিজেকে উৎসর্গ করার। কিন্তু তিনি কীভাবে এ উৎসর্গ করলেন? তিনি কি শুধু নিজেকেই উৎসর্গ করলেন? না; বরং নিজের কলিজার টুকরো সন্তানদের, ভাইয়ের সন্তানদের ও নিকটাত্মীয়দেরকেও নিজের সাথে উৎসর্গ করে পৃথিবীর বুকে আত্মোৎসর্গের অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
মহান আল্লাহ্র ধর্ম ইসলামকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবার-পরিজনসহ নিজেকে চূড়ান্তভাবে উৎসর্গ করার মাধ্যমে যে ধারাবাহিক ভূমিকা তিনি রেখে গেছেন সেজন্যই তিনি 'বেহেশতের যুবকদের নেতা'Ñ রাসূলের দৌহিত্র হিসাবে তাঁর এ মর্যাদা নয়। আবার আমরা এ বিষয়টিও লক্ষ্য করি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সকল আত্মীয়ের মর্যাদাও সমান নয়। রাসূলের কোনো কোনো আত্মীয় অন্য সকল আত্মীয়ের চেয়ে অধিক সম্মানের অধিকারী। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁদের মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত হামযা (রা.)-কে 'সাইয়্যেদুশ শুহাদা' (শহীদদের নেতা), হযরত ফাতিমা (আ.)-কে 'সাইয়্যেদাতু নিসায়িল আলামীন' (জগতসমূহের নারীদের নেত্রী), হযরত হাসানকে 'সাইয়্যেদু শাবাবি আহ্লিল জান্নাহ্' (বেহেশতের যুবকদের নেতা), হযরত জাফর বিন আবি তালিব (রা.)-কে 'তাইয়্যার' (পাখি) উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আর এসকল মহান ব্যক্তিত্বের খোদাভীরুতা এবং ইসলামের জন্য তাঁদের অতুলনীয় ভূমিকার কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে। তাই বলা যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রক্ত-সম্পর্ক থাকার কারণে কাউকে কোনো মর্যাদায় ভূষিত করেন নি; বরং মহান আল্লাহ্র প্রতি তাঁদের ভালোবাসা এবং ইসলাম ধর্মের জন্য তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের কারণেই তাঁদের মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন। আর এ বিষয়টিই ইসলামে মর্যাদার ভিত্তি যা পবিত্র কোরআনেই বর্ণিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَى كُم
"নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু ব্যক্তিই আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে সম্মানিত।"৪
এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলাম মানুষের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে খোদাভীরুতা ও পরহেজগারীকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা দানের বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। খোদাভীরু (মুত্তাকী) ব্যক্তি নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে মহান আল্লাহ্র নির্দেশের কাছে সমর্পণ করেন। তিনি তাঁর করণীয় কাজ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করেন এবং মহান আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহ্র নির্দেশ পালনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, দীন ইসলামের কল্যাণে কোনো বিষয়ই তাঁর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
ইমাম হুসাইন (আ.) তেমনি এক ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের জীবনে যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি ইসলাম ধর্মের খেদমতে নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিয়োগ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যেরূপ ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ইমাম হুসাইনও সেরূপ এ ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং এ ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত শাহাদাতের অমিয় সুধা পানের মাধ্যমে এ ধর্মের খেদমতের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে মর্যাদা দানকে অস্বীকার করার বিষয়টি পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের জীবনী থেকেও প্রমাণিত হয়। যেমন হযরত নূহ (আ.)-এর স্ত্রী ও পুত্র এবং হযরত লূত (আ.)-এর স্ত্রী কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। নবীর স্ত্রী বা সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইসলামে তাদের কোনো মর্যাদা দেয়া হয় নি; বরং তাদেরকে জাহান্নামের অধিবাসী বলা হয়েছে।
তাই পবিত্র কোরআনের আলোকেই আমরা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি। আবার রাসূলের মর্যাদার সাথেও এটি মোটেও খাপ খায় না যে, তিনি কেবল তাঁর সাথে রক্ত-সম্পর্ক থাকার কারণে কারো প্রশংসা করবেন। কারণ, পবিত্র কোরআন তাঁরই ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তিনি যা বলেন তা 'ওহী ব্যতীত আর কিছুই নয়'।* প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর তাকওয়া-পরহেজগারী এবং ইসলাম ধর্মের জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন সে কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে 'বেহেশতের যুবকদের নেতা' উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের প্রেক্ষাপট রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানদের মধ্যে এমন কী হয়েছিল যার পরিণতিতে তাঁর ওফাতের মাত্র পঞ্চাশ বছর পর প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁরই বংশধর বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনকে? ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের ঘটনা এমন নয় যে, হঠাৎ করেই ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া মুসলিম বিশ্বের খলিফা হয়ে ইমাম হুসাইনকে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করার নির্দেশ দেয় এবং ইমাম হুসাইনও বাইয়াত করতে অস্বীকার করে তাঁর আন্দোলন শুরু করেন; আন্দোলনের এক পর্যায়ে কুফা যাবার পথে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় নীত হন এবং সেখানে তিনি নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার একটি দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। আমরা জানি, নবিগণের ওফাতের পর তাঁদের উম্মতদের মধ্য থেকে কিছু লোক তাঁদের প্রচারিত ধর্মের মধ্যে বিকৃতি সাধন করত এবং একটা সময়ে সেই বিকৃতি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ধর্মের অস্তিত্বকেই বিলীন করে দিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের সময়ও মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকদের অস্তিত্ব ছিল যারা মনে-প্রাণে ইসলামকে গ্রহণ করে নি; বরং পরিস্থিতির কারণে মুখে ইসলাম প্রকাশ করেছিল। তারা সবসময় ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে চাইত, ইসলামের মধ্যে বিকৃতি সাধনের মাধ্যমে একে ধ্বংস করতে চাইত। তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এমন মুনাফিক গোষ্ঠীর কারণেই ধীরে ধীরে কারবালার এ হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়।
মুনাফিক গোষ্ঠীর কারণেই তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের সময় মুসলিম বিশ্বে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, এমনকি এদের কারণেই হযরত উসমান নিহত হন। এরপর হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতকালেও এ বিশৃঙ্খল অবস্থা অব্যাহত থাকে; বরং এটি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফ্ফিনের মতো দু'টি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর মুনাফিকরা ষড়যন্ত্র করে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। এরপর মুসলমান সমাজে প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে আমীরে মুয়াবিয়া ইয়াযীদকে মুসলমানদের খেলাফতে অধিষ্ঠিত করেন।
ইসলামবিরোধী যে সব কাজ অতীতে গোপনে সংঘটিত হতো, সেগুলো প্রকাশ্যে সংঘটিত হতে থাকে। এমনকি, মুসলিম বিশ্বের খলিফা ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কাজ শুরু করে। সে পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ইমাম হুসাইন (আ.) তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
তাই আমরা যদি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতকে পূর্ববর্তী পেক্ষাপট ছাড়া ৬১ হিজরীতে আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা মনে করি তা হলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পূর্ববর্তী দু'তিন বছরের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা বুঝতে পারব যে, রাসূলের ওফাতের পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনের ওপর বিপদ নেমে আসাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। কাফের-মুশরিক নয়; বরং মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত মুনাফিকদের দ্বারা স্বয়ং রাসূলের জীবনই সবসময় হুমকির মুখে ছিল। রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে যেমন হযরত সালমান (রা.), হযরত আবু যার (রা.), হযরত আম্মার (রা.), হযরত মিকদাদ (রা.), হযরত আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন, এর বিপরীতে অনেক মুনাফিকও ছিল। এর প্রমাণ মেলে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূলকে পাহাড় থেকে ফেলে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের ঘটনায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হুযাইফাকে এসব মুনাফিকের নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। এসব মুনাফিকের ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণও রাসূল বলেছেন : "আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করলে বিধর্মীরা বলবে, মুহাম্মদ শক্তি ও ক্ষমতার তুঙ্গে পৌঁছার পর নিজ সঙ্গী-সাথীদের গর্দানের ওপর তরবারির আঘাত হেনেছে।"৫
রাসূলকে হত্যা চেষ্টার পাশাপাশি তাঁর সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হওয়ার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটতে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিরোধিতার বিষয়টি ধীরে ধীরে প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। হযরত উসামাকে সেনাপতি নিয়োগের বিরোধিতা করা, রাসূলের আদেশ অমান্য করে সিরিয়া অভিযানে যেতে বিলম্ব করা অথবা রাসূলের শেষ অসিয়তনামা লেখতে বাধা দানের ঘটনায় রাসূলের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। তাই বলা যায়, রাসূলের ওফাতের পূর্বেই মুসলমানদের বিচ্যুতি শুরু হয় এবং রাসূলের ওফাতের পর তা চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ইসলামের মুখোশ পরে ইসলামের নামেই ইসলামবিরোধী কাজ চলতে থাকে। পরে প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কাজ শুরু হয়। ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাসনামলে পরিস্থিতির এতটা অবনতি হয় যে, ইসলামের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর কালজয়ী আন্দোলন শুরু করেন এবং বুকের রক্ত দিয়ে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের কারণ
ইমাম হুসাইনের আন্দোলনের পেছনে বাহ্যিকভাবে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়ে থাকে :
১. ইয়াযীদের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ নেয়ার চাপ;
২. কুফাবাসীর পক্ষ থেকে পত্র প্রেরণ এবং
৩. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।