আজ ২৪ এপ্রিল, সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজিডির পঞ্চম বার্ষিকী। ২০১৩ সালের এই দিনে ৯ তলা ওই ভবন ধসের ভয়াবহতায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিমূঢ় হয়েছে গোটা বিশ্ব। মালিকের চরম উদাসীনতা ও অর্থলিপ্সায় সৃষ্ট এ 'দুর্ঘটনা'য় ওই ভবনে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। আহত হন আরো কয়েক হাজার। এদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকে চলাফেরা করতে পারলেও ভুগছেন নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়। দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়লে এখনো ঘুমাতে পারেন না কেউ কেউ। সর্বোপরি আহতের অধিকাংশই অর্থাভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছেন না।
রানা প্লাজা ট্র্যাজিডিতে আহত শ্রমিক হৃদয় জানান, সেই দিনের স্মৃতি মনে হলে এখনো বুক কেঁপে ওঠে তার, পাঁচ বছর হতে চলল এখনো রাতে ঘুমাতে পারেন না ঠিকমতো। তিনি আরো বলেন, টাকা-পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না, মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটি সবসময় যন্ত্রণা করে, ঠিকমতো চলা ফেরা করতে পারি না। ব্র্যাকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল। কার্যত তাদের দরকারে আমাদের ডেকে নেয়, আমাদের যখন চিকিৎসা দরকার তখন তাদের চিকিৎসা পাই না। বিনা চিকিৎসায় এভাবেই একদিন মরে যেতে হবে বলেও আক্ষেপ করেন তিনি।
শিউলি আক্তার বলেন, আমি রানা প্লাজার ৮ম তলায় নিউ ওয়েব স্টাইল লিমিটেডে কাজ করছিলাম, ২৪ তারিখ সকালে হঠাৎ করেই ভবন ধসের পরে জীবনের সব কিছু উলট পালট হয়ে যায়। মেশিনের নিচে চাপা পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে দেখি সাভার সিএমএইচ হাসপাতালে। এখন আমি ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেলা করতে পারি না, ঘরের কোনো কাজ করতে পারি না। রান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ আমার স্বামী করে দেয়। স্বামীর রোজগারেই সংসার চলে, নিজে কিছুই করতে পারি না। কোমড় ও মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা কোনো মতে বেঁচে আছি। কোমড়ে মেশিনের চাপ পড়ায় মাতৃত্বের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, কোনো দিনই আমি মা হতে পারব না- বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পরে।
জেসমিন আক্তার বলেন, আহত হলেও চাকরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরাঘুরি করেছি। কিন্তু রানা প্লাজার শ্রমিক শুনইে আর চাকরি দিতে চায় না। তারপর আত্বীয়স্বজনের সাহায্য নিয়ে একটি মুদি দোকান করে কোনো মতে খেয়ে পরে বেঁচে আছি।
হালিমা জানান, আমার পায়ে ৪ বার অপারেশন করা হয়েছে। কিছুদিন আগে পায়ের ভিতরে ভরা রড বের করা হয়েছে। এরপর থেকে আরো বেশি সমস্যা হচ্ছে। আজ ২ বছর ধরে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। একটা মুদি দোকান চালিয়ে তিন বেলা ভাতই খেতে পারি না, চিকিৎসা করব কিভাবে? সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি, কপালে কষ্ট আছে তাই বেঁচে আছি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, শ্রমিক নেতারা রানা প্লাজার জায়গাটা অধিগ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করার জন্য সরকার ও বিজিএমইএ এর কাছে দাবি করে আসছে দিনের পর দিন। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার বা বিজিএমইএ।
রফিকুল ইসলাম সুজন আরো জানান, ৩৬৫ নিখোঁজ শ্রমিকের মধ্যে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ২০৬ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছিল, শনাক্তকৃত শ্রমিকের পরিবার কিছু সহায়তা পেলেও বাকি ১৫৯ শ্রমিকের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে সব ধরনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শ্রমিকের পরিবার।
রানা প্লাজায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন:
রানা প্লাজা ধসের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে হতাহতদের স্মরণ কর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন স্বজন ও বিভিন্ন সংগঠন। মঙ্গলবার সকাল থেকে রানা প্লাজার সামনের অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে তারা শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছে। এসময় স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজা প্রাঙ্গণ। তাদের বুক ফাটা কান্নায় সেখানে হৃদয় বিদারক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন- ঢাকা জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণ মঞ্চ, বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন, সাস, গণতান্ত্রিক গণ মোর্চা, জাতীয় গণ ফ্রন্ট, ওএসকে গার্মেন্টস এন্ড টেক্সটাইল ফেডারেশন, জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্ট, প্রবাসী শ্রমজীবী ফ্রন্টসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। এ ছাড়া পোষাক কারখানার শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সাধারন মানুষ রানা প্লাজার সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পন করে নিহত শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানিয়েছে।
শ্রদ্ধা শেষে মানববন্ধন ও বিক্ষোভসহ সেখানে নানা কর্মসূচি পালন করে শ্রমিক সংগঠনগুলো।