রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্যের মাত্রা ছাড়িয়েছে। এর শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনই ঘটছে একাধিক দুর্ঘটনা। হতাহত হচ্ছেন যাত্রী ও পথচারীরা। যানবাহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের অদক্ষতা ও ট্রাফিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন, বেপরোয়া আচরণ, যানবাহনের ফিটনেস না থাকা, সর্বপরি এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও বিআরটিএর গাফিলতি ও অবহেলার কারণে রাজধানীর একেকটি সড়ক এখন একেকটি মৃত্যুফাঁদ। চালকরা অবতীর্ণ হয়েছেন মৃত্যুদূতের ভূমিকায়। গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা দূর করতে বিশেষজ্ঞ, সংগঠন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বারবার পরামর্শ দেয়ার পরও সমস্যা সমাধানে জোরালো ও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কেন নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনা? এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, পরিবহন নেতা, সামাজিক সংগঠনের নেতা, পুলিশ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্ন তথ্য জানা গেছে। তাদের বক্তব্যেও চালকদের অদক্ষতা, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অবহেলাকেই দায়ী করা হয়েছে। রাজধানীতে চলাচলরত প্রায় সব গণপরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধেও তারা গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত বলেও দাবি করেছেন। বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ আধুনিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে এখনো সনাতন পদ্ধতিতে নামকাওয়াস্তে জরিমানার মাধ্যমেই দায়িত্ব শেষ করছে। সর্বপরি পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতারা জড়িত থাকার কারণে গণপরিবহনের চালকদের বেপরোয়া ও অসহিষ্ণু আচরণ আজ সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ যাত্রীরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকদের বেপরোয়া ড্রাইভিংকে দায়ী করার পাশাপশি দুর্ঘটনায় চালকদের শাস্তি না হওয়া ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চলাচলের জন্য পুলিশ ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের দায়ী করেন।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এমআরআই) এর ভাষ্যমতে, রাজধানীতে মানুষের ঘনত্ব ও যানবাহনের সংখ্যা বেশি। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই নগরীতে সড়কের পরিমাণ কম এবং চালকরাও অদক্ষ-অস্থির চিত্তের। এ কারণে দুর্ঘটনার হারও বেশি। নগরীতে সড়কের জন্য ২৫ শতাংশ জায়গা থাকা প্রযোজন। কিন্তু মাত্র ৭ শতাংশ জায়গায় সড়ক আছে। রাজধানীর সড়কগুলোর মধ্যে অর্ধশতাধিক মোড় দুর্ঘটনাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত। এসব ঝুঁকিপূর্ণ মোড়ে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে।
রাজধানীতে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটে অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পুলিশও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনই একটি শক্তিশালী সংস্থা গঠন করে গণপরিবহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় চলার পথে যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা ও ওভারট্রেকিং বন্ধ করতে হবে। যাত্রীদের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশে নিরাপদ সড়কের জন্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আন্দোলন করে আসছেন। গণপরিবহনের নৈরাজ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে বর্তমানে ২৮ শতাংশ দুর্ঘটনা বেড়েছে। চালকদের অস্থিরতা ও বেপরোয়া আচরণই এর জন্য দায়ী। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই দেখা যায়, দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের ঘটনায় কয়জন চালকের শাস্তি হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। নৈরাজ্য থেকে গণপরিবহনকে রক্ষায় এখনই সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবহন সংগঠনের নেতারা গণপরিবহনে নৈরাজ্যের কারণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা জানিয়েছেন, রাজধানীর গণপরিবহনের চালকরা কেউই মালিকের মাসিক বেতনভুক্ত কর্মচারী নন। চালক ইচ্ছে হলে গাড়ি চালাতে পারেন, আবার নাও চালাতে পারেন। চালকরা বাস বা মিনিবাসটি প্রতিদিন নিদিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দেয়ার চুক্তিতে মালিকের কাছ থেকে নিয়ে নেন। দিনশেষে চালকরা জমার টাকা মালিককে বুঝিয়ে দেয়ার পর যা থাকে তা হেলপাড় ও কন্ট্রাকটরসহ তিনজনে ভাগ করে নেন। এর ওপর রাস্তায় সমিতির নামে এবং পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। এসব কারণে বেশি রোজগারের জন্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন চালকরা। ওভারটেকিং, আড়াআড়িভাবে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, সিগন্যাল মান্য না করা এবং রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রতিযোগিতার কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। বাস বা মিনিবাস মালিকরা আর্থিক ক্ষতির দিকটি মাথায় রেখে চুক্তিভিত্তিক ভাড়া দেন। কোন চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেবেন, তা মালিকের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এখানে পরিবহন সংগঠন বা পুলিশের কোনো হাত নেই। এ কারণে মালিকরা সব সময়ই দুর্ঘটনার পর চালককে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। চালকরা অশিক্ষিত। তাদের দক্ষতার অভাবও রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা চালকদের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। শিক্ষিত বেকাররা যদি বসে না থেকে এই পেশায় আসতো তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। এই সংকট কাটাতে হলে কয়েকটি কোম্পানি গঠন করে গণপরিবহনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
ডিটিসিএ এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, রাজধানীতে গণপরিবহনের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে কাজ করেছি। এরপর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নৈরাজ্য অনেকাংশেই কমে আসবে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে ২০ ধরনের ৩৩ লাখ ৮২ হাজার ২৪৭টি গাড়ির নিবন্ধন রয়েছে। এর বিপরীতে ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫২টি ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এই পার্থক্য থেকে দেখা যায়, ৯ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫টি নিবন্ধিত গাড়ির চালকদের লাইসেন্স নেই। কিন্তু লাইসেন্স না থাকার পরও এসব চালক গণপরিবহনসহ কোনো না কোনো গাড়ি চালাচ্ছেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন ১০ লাখ অনুমোদনহীন যানবাহন চলছে। এর মধ্যে ৫ লাখ সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য অনুসারে, সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৬৪ জন নিহত ও দেড় শতাধিক যাত্রী আহত হচ্ছে। সড়কে চলাচলরত প্রায় ৭২ শতাংশ যানবাহন ফিটনেবিসহীন চলাচল করছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চালকরাই মূলত বাস-মিনিবাসের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ কারণে চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়। কে মরলো আর কে বাঁচলো তা দেখার সময় চালকদের নেই। এ কারণেই পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য চলছে।
গত ২১ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে 'সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা উত্তরণে উপায়' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় অভিযোগ তোলা হয়, এতো দুর্ঘটনার পরও ট্রাফিক পুলিশ পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে জরিমানা আদায়, চাঁদাবাজি, রুট পারমিট বাণিজ্য ও টোকেনবাজির সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক পরিচয়ে সরকারের লোকজন পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব কারণে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য ও যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে নৈরাজ্য দূর করতে ১০টি সুপারিশও তুলে ধরা হয়।