What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

সুপ্তির সন্ধানে (1 Viewer)

পর্ব তিন (#1-#11)

কালী পুজো শেষ। আবহাওয়া বেশ মনোরম। বাতাসে একটু ঠান্ডার আমেজ। আকাশের রঙ ঘন নীল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট সাদা মেঘের ভেলা দেখা যায়। গতকাল ছিল শুক্রবার, অফিস থেকে মামাবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শনিবার নতুন ব্যাচ শুরু হবে তাই আর মামাবাড়ি যাইনি। মামিকে বলে দিয়েছিলাম যে ক্লাস শেষের পরে সোজা মধ্যমগ্রাম চলে যাবো। ঠান্ডার আমেজের জন্য সকালে উঠতে একদম ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল আরো একটু ঘুমাই। বাধ সাধে আমার কাজের মেয়েটা। রোজ সকালে এসে ঘর ঝাড়ু পোছা করে যায়। কাজের মেয়ে কাজ সেরে যাওয়ার পরে এক কাপ চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছিলাম সোফার ওপরে। এমন সময়ে ফোন বেজে উঠল।

অন্যপাশে অনির্বাণ, “হ্যালো, কি রে বাল, এখন ঘুমাচ্ছিস নাকি?”

আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রিসিভার কানে চেপে উত্তর দিলাম, “না রে বাঞ্চোত, চা খাচ্ছি।”

হাসিতে ফেটে পড়ল অনির্বাণ, “শালা তুই কি না দিশি দিয়ে কুলকুচি করিস। হটাত আজকে চা গিলছিস? ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছে তো?”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “বোকাচোদা, আমি তোর মতন রোজ রাতে পাড়ার ঠেকে বসে চুল্লু গিলি না। বল এত সকালে কেন ফোন করেছিস।”

অনির্বাণ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “ক্লাসে যাবি তো?”

মাথা দোলালাম আমি, “হ্যাঁ, এই একটু পরেই বের হব।”

অনির্বাণ আমাকে বলল, “হ্যাঁ রে তোর বাইকটা একটু দিবি?”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন বে?”

অনির্বাণ একটু লজ্জা পেয়েই উত্তর দিল, “না রে আজকে ভাবছি একটু ঘুরতে যাবো।”

আমিও হেসে ওকে উত্তর দিলাম, “উফফফ, কাবেরিকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

অনির্বাণ লজ্জা পেয়েই উত্তর দিল, “মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। ওই ভিক্টোরিয়া না হলে আউট্রাম আর কি। বাবার হোটেলে খাওয়া ছেলে পুলেদের ওই একটাই জায়গা।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে। আমার কপালে এখন সেটা জোটেনি। আমি ওকে বললাম, “চলে আয় তাহলে। তারপরে ক্লাস শেষের পরে বাইক নিয়ে চলে যাস। তবে বোকাচোদা, বাইক যেন আস্ত পাই, না হলে তোর বাঁড়া কেটে হাতে ধরিয়ে দেব। কাবেরিকে চুদতেও পারবি না।”

হেসে ফেলল অনির্বাণ, “হ্যাঁ রে বোকাচোদা হারামি গান্ডু। একদম দিয়ে দেব।”

আমি ওকে উত্যক্ত করার জন্য বললাম, “বাঁড়া না কাবেরি?”

হেসে ফেলল অনির্বাণ, “বাঞ্চোত, তোর কালো পুটকি মেরে লাল করে দেব আজকে।”

আমি ফোন রাখার আগে ওকে বললাম, “বাড়ি চলে আয় তাহলে। একসাথেই ইন্সটিটিউটে যাওয়া যাবে।”

এক ঘন্টার মধ্যে অনির্বাণ আমার বাড়িতে পৌঁছে গেল। অনির্বাণ পৌঁছাতেই আমরা বাইকে করে বেড়িয়ে পড়লাম। সারাটা রাস্তা কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করল। বুঝতেই পারলাম, প্রথম প্রেম। আমার মতন অবস্থা বেচারার। আমাদের কপালে কলেজে পড়ার সময়ে কেউ জোটেনি। কাবেরি কে নিয়ে বেড়াতে যাবে তাই ভীষণ উত্তেজিত অনির্বাণ। এই উত্তেজনা আমার মধ্যেও ছিল, যেদিন আমি তিতলির সাথে দেখা করতে প্রথমবার ওর কলেজে গেছিলাম। পুরানো কথা যদিও তবুও মনের আঙ্গিনায় সেই ছবি বারবার ভেসে ওঠে। আদি ফুচকা খাবো বলে বায়না ধরল। আর হয়ত দেখা হবেনা সুন্দরী ললনার সাথে। হয়ত অন্য ব্যাচে এডমিশান নিয়েছে। বুকের ভেতরটা হটাত করেই ফাঁকা হয়ে গেল। ইন্সটিটিউটে ঢোকার আগে, দুই বন্ধু বাইরে দাঁড়িয়ে একটা করে সিগারেট খেলাম। অনির্বাণের চোখে তখন শুধু কাবেরি আর আমার চোখ তখন কাউকে যেন খুঁজছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, যদি সামনে চলে আসে তাহলে কি হবে।

ক্লাসে ঢুকতে যাবো, একটা হাল্কা গোলাপি রঙের বহু পরিচিত সালোয়ার কামিজের দর্শন পেয়েই থমকে গেলাম। আমার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে গল্প করছে। সেই এক দেহের ঘঠন, যেন একটা বালির ঘড়ি। চওড়া পিঠের ওপরে মেঘের মতন ঢালাও কালো এলো চুল। মাথার পেছনে একটা ছোট সাদা ক্লিপে বাঁধা। মরালী গর্দানে পাতলা একটা চেন। পরনের পোশাক নধর দেহপল্লবের সাথে এঁটে বসে সুন্দরীর দেহ বল্লরীর সৌন্দর্য ভীষণ ভাবেই আমার চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলেছে। অনেকদিন পরে রূপসী ললনার কন্ঠস্বর শুনে ভালো লাগলো, সেই সাথে বুকের মধ্যে বেজে ওঠে করুন সুর। এখুনি যদি পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে তাহলে আবার ওর সুন্দর চেহারায় কালো মেঘের আস্তরন ঢেকে দেবে। অনির্বাণ আমার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে তিতলির দিকে ইশারা করল। আমি মাথা নাড়লাম অনির্বাণের দিকে দেখে।

অনির্বাণ ম্লান হেসে আমাকে বলল, “মনে হচ্ছে এক সুতোয় বাঁধা। গিঁট পরে গেছে, ছাড়ানো অসম্ভব।”

আমি ওকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু এক ব্যাচে? সেটা কি করে সম্ভব?”

অনির্বাণ উত্তর দিল, “আমার মনে হয় যেহেতু এটা লাস্ট সেমেস্টার তাই মনে হয় একটাই ব্যাচ।”

ইতি বাচকে মাথা দোলালাম আমি। তিতলির নজর বাঁচিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রূপসীর কাজল কালো নয়নের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেন আমার অপেক্ষায় ছিল তিতলি। মরালী গর্দান ঘুরে গেল আমার দিকে। চোখের কোনায় কাজল রেখা। আমাকে দেখতে পেয়ে চোয়াল ঈষৎ কঠিন হয়ে গেল। ভ্রূকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সুন্দরী ললনা। আমার বুকে বিঁধে গেল শক্তিশেল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। ওর হাতে একটা প্লাস্টিকের ফোল্ডার ছিল, বুকের কাছে দুই হাতে ধরে চেপে ধরা। আমার চোখের দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে যেন প্রশ্ন বানে আমাকে জর্জরিত করে তুলল, কেন আমার সাথে এটা করলে। নিরুত্তর আমি। অনির্বাণের হাত কাঁধে পড়তেই সম্বিত ফিরে পেলাম। অনির্বাণ ইশারায় আমাকে পেছনের চেয়ারে ডেকে নিয়ে গেল। তিতলি চুপচাপ সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। সারাটা ক্লাস, মাঝে মাঝেই চোখের কোনা আমার দিকে তিরস্কারের দৃষ্টি নিয়ে বিদ্ধ করে চলেছে। বিষিয়ে গেলাম আমি। ভাবলাম এই ব্যাচ ছেড়ে দেব, পরের কোন ব্যাচে আবার জয়েন করে নেব। কি আছে, দুই মাস পরেই না হয় শুরু হবে।

ক্লাসের শেষে আমি আর অনির্বাণ উঠে দাঁড়ালাম। বেড়িয়ে পড়তে হবে। তিতলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ওকেও নিশ্চয় বেড়িয়ে পড়তে হবে। বাঁকা হাসলাম মনে মনে, বড়লোকের মেয়ে ট্যাক্সিতেই যাবে, আমাকে মামাবাড়ি ফিরতে হবে বাসে করে। সিঁড়ি দিয়ে আমাদের আগেই নেমে গেল তিতলি। রাস্তার এইপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি আর অনির্বাণ। তিতলি রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে কটাক্ষ চাহনি দিয়ে আমার বুক ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। বুক ভরে একরাশ ধোঁয়া টেনে ছাড়লাম, ধোঁয়ার মধ্যে থেকে সুন্দরীর লালচে রাঙ্গা চেহারা মেঘের রাজ্যের পরীদেশের এক অপ্সরার মতন দেখতে লাগলো তিতলিকে। আমার দিকে তাকাতে তাকাতেই রাস্তা পার করতে গিয়ে হটাত করে একটা বাইক চলে আসে ওর সামনে। টাল সামলাতে না পেরে পা মচকে পরে যায় তিতলি। আচমকা আমার পেছনে অদৃশ্য দুটো হাত আমাকে ধাক্কা মারল।

কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে আমাকে বলল, “আদি, এইকানে দাঁড়ায়ে কি কচ্ছিস? পরি গেছে আর তুই দেকবি? যাবি না ওর কাছে? এই নাকি তোর ভালোবাসা আদি?” পরিস্কার আমার দিম্মার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

কাল চক্র আমাদের ভাগ্য এক সুতোয় জুড়ে দিয়েছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ঝাঁপ দিলাম আগুনে। এতদিন নিজের সাথে যে যুদ্ধ করছিলাম, হেরে গেলাম সেই যুদ্ধে। একবার চোখের জল ফেলতে দেখেছি, দ্বিতীয় বার সেই চোখে জল দেখতে চাই না। দৌড়ে গেলাম তিতলির দিকে। মাটিতে পরার আগেই ওর বাজু ধরে ফেললাম আমি। আমার দিকে কাজল কালো নয়নে বুক ভাঙা ব্যাথা নিয়ে তাকাল তিতলি। বাইকের চালককে ধরে ফেলে অনির্বাণ এই মারে কি সেই মারে। আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজন ছেলে মিলে বাইকের চালককে বেশ বকাবকি শুরু করে দিল। আমি ওর কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড় করাতে চেষ্টা করাতেই আমাকে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল তিতলি। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার যোগার, কিছুটা পায়ের ব্যাথায় তবে বেশির ভাগ বুকের ব্যাথায়। তিরতির করে কেঁপে উঠল মিষ্টি গোলাপি পাতলা ঠোঁট জোড়া। আমি কোন কথা না বলে একটু ঝুঁকে ওর বাঁ পায়ের গোড়ালিতে হাত বুলাতে গেলাম।

আমার দিকে আঙ্গুল তুলে চাপা গর্জে ওঠে রূপসী ললনা, “একদম আমাকে ছোঁবে না। আমি তোমার সাহায্য ছাড়াই যেতে পারব।”

আমার হাত থেকে কোন মতে পা ছাড়িয়ে একটু হাঁটতে চেষ্টা করল তিতলি। পা মচকে যাওয়াতে ঠিক ভাবে মাটিতে পা ফেলতে পারল না। টাল সামলাতে না পেরে আবার পরে যাচ্ছিল। আমি ওর পিঠে হাত রেখে সামলে নিলাম। ওর উপচে পরা কাজল কালো নয়নের বেদনা আমাকে ছারখার করে দিয়েছিল।

আমি ওর কোমর ধরে ওকে বললাম, “তোমার পা বেশ ভালোই মচকে গেছে।”

আমি অনির্বাণকে চেঁচিয়ে বললাম, “হাঁ করে কি দেখছিস। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করা তাড়াতাড়ি।”

অনির্বাণ আমার দিকে দেখে মৃদু হেসে দিল, “আচ্ছা।”

আমি ওকে বললাম, “বাইক নিজের কাছেই রাখিস। সোমবার নিয়ে আসিস।”

অনির্বাণ ট্যাক্সি দাঁড় করাতেই, তিতলিকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম আমি। ট্যাক্সির সিটে বসে আমার দিকে অশ্রুভরা ঝাপসা নয়নে তাকিয়ে রইল তিতলি। আমি ওর বাঁ পা কোলের ওপরে উঠিয়ে ফর্সা গোল নরম মসৃণ গোড়ালিতে হাত বুলিয়ে ব্যাথার লাঘবের চেষ্টা করলাম।

ওর গোড়ালিতে হাত বুলিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “খুব ব্যাথা করছে?”

ফর্সা গন্ড বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রুকণা লালচে গালের ওপরে সরু রেখা তৈরি করে দেয়। আচমকা ঠাস করে আমার গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিল তিতলি। চেঁচিয়ে উঠল আমার দিকে, “একদম আমার সাথে কথা বলবে না। আমি তোমার কে যে আমি তোমার সাথে কথা বলব?” মুখ ভেংচে আমার কথাটাই আওড়ে দিল, “ব্যাথা করছে... ন্যাকা।”

গাল জ্বলছে, জ্বলুক, এটাই আমার দরকার ছিল। কাপুরুষ ছিলাম আমি। আমি ওর পা কোলের ওপরে চেপে ধরে বললাম, “সরি তিতলি।”

অনেকদিন পরে আমার মুখে নিজের নাম শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলনা সুন্দরী। আমার কলার ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “কেন তুমি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে পারো না। কেন, একবার বলতে পারো। আমি ঘুমাতে পারি না জানো। তোমার জন্য আমি আর ঘুমাতে পারি না।”

আমার চোখ জোড়া জ্বালা করে উঠল। রাগে নয়, দুঃখে নয়, ভালোবাসার বেদনায় ঝাপসা হয়ে এলো। আমি মাথা নিচু করে বললাম, “আমাকে ক্ষমা করে দাও তিতলি। আমি জানি না আমার কি হয়েছিল।”

আরো একটা চড় আমার গালে। নরম আঙ্গুলের ছোঁয়া, তবে আগের চড়ের চেয়ে অনেক ধিরে। “না ক্ষমা তুমি পাবে না। কিসের ক্ষমা? আমার সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে এখন ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে?”

আমি ওর হাত গালের ওপরে চেপে ধরে বললাম, “মারো যত ইচ্ছে মারো। তবে প্লিজ আর কেঁদো না।”

আমার কলার ধরে বুকের ওপরে আছড়ে পড়েছিল তিতলি, “মরে যেতে ইচ্ছে করে আদি। তোমার জন্য... জানি না কি হবে আদি।” আমি ওর মাথা বুকের ওপরে চেপে ধরেছিলাম। আমার বুকের ওপরে মাথা রেখে বলে, “ক্ষমা তুমি পাবে না।”

অনেক দিন পরে রূপসী প্রেয়সীর ঠোঁটে নিজের সেই হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার নাম শুনে আবেগে আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। কালো মেঘের মতন ঘন কালো রেশমি চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে মাথায় ঠোঁট চেপে ধরে ওকে বললাম, “আচ্ছা বাবা ক্ষমা করতে হবে না।”

শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলল তিতলি। চোখে জল, পাতলা গোলাপি ঠোঁটে মৃদু হাসি। কম্পিত কন্ঠে আমাকে বলেছিল, “বাবা এবারে মেরে ফেলবে।”

আমি ওর গোড়ালিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে হেসে ফেললাম, “মুফাসা এবারে মেরেই ফেলবে বল।”

ধিরে ধিরে আমার হাত ওর বাম পায়ের গুলির ওপরে চলে গেল। সালোয়ারের ওপর দিয়েই ওর পায়ের গুলির ওপরে আদর করে দিতেই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল সুন্দরী ললনা।

দুম করে আমার হাতের একটা আলতো ওপরে চাঁটি মেরে বলে, “এই কি করছ? প্লিজ ওই ভাবে পায়ে হাত দেয় না।”

আমি ওর পা ছাড়তে পারলাম না। পায়ের গুলি থেকে গোড়ালিতে হাত নিয়ে গেলাম। “আচ্ছা বাবা।”

আমার গালে চাঁপার কলি আঙ্গুল বুলিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করল, “খুব জোরে মেরেছি তাই না।”

ওর নরম হাত গালের ওপরে থেকে সরিয়ে বুকের ওপরে টেনে এনে বললাম, “এখানে ব্যাথা করছে।” বলেই হেসে ফেললাম।

বুকের ওপরে একটা চিমটি কেটে চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে একটু খেপিয়ে তোলার জন্য বলল তিতলি, “বেশ হয়েছে। ব্যাথা করুক, আরো করুক।”

তিতলির ওই ভাবে চিবিয়ে বলার ধরন দেখে আমার ভীষণ হাসি পেয়ে গেল। আমি ওকে বললাম, “দেখে রাস্তা পার হতে পারো না?”

ঠোঁট উলটে অদ্ভুত ভঙ্গিমা করে আমাকে বলল, “দেখেই তো পার হচ্ছিলাম। তুমি চলে এলে সামনে।” আবার একটা আদরের কোমল চপেটা ঘাত আমার বাজুতে। “শয়তান ছেলে সব তোমার জন্য হয়েছে।” আমি শুধু ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। কতদিন দেখিনি, কতদিন এইভাবে পাশে বসেনি, কতদিন ওর গলা শুনতে পাইনি। গোলাপি ঠোঁট জোড়া নড়ছে, “জানো পারমিতার কত প্রশ্ন। আমি কেন খাই না, আমার কেন কিছুতেই মন বসে না, আমি কেন আনমনা। এই এক দেড় মাস কি যে গেছে আমার ওপর দিয়ে তুমি জানো? তুমি কিছুই জানো না। দুম করে ওইভাবে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়ে চলে গেলে। কেন?” গলা ধরে আসে তিতলির, “আমি কি দোষ করেছিলাম, আদি?”

কি করে ওকে বলি, তোমার কোন দোষ নেই তিতলি। তুমি নিষ্পাপ ফুলের মতন নির্মল, প্রজাপতির মতন সুন্দরী, ভোরের সদ্য ফোটা শিউলির মতন তোমার লাবন্য। সব দোষ আমার। সেই সময়ে যদি একটু সাহস দেখাতে পারতাম তাহলে তোমাকে এইভাবে পা মচকাতে হত না, এইভাবে তোমাকে আর আমাকে বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হত না।

একটু থেমে আমাকে প্রশ্ন করল, “তুমি আমার কাকার নাম কি করে জানলে?”

উত্তর দিলাম, “অনির্বাণ আমাকে বলেছে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে মাথা দুলিয়ে বলল, “আদি জানি না কি হবে।”

আমি ওর কোমল ফর্সা ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “হয়ত সেই বুধাদিত্য কাপুরুষ ছিল, তিতলি। তোমার আদি কাপুরুষ নয়। যখন এক সুতোয় বাঁধা পড়েছি তখন না হয় শেষ দেখা দেখেই যাবো।”

জানিনা আমার চোখে কি দেখেছিল তিতলি। আমার কাঁধে মাথা রেখে, আমার ডান হাত নিজের কোমল মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে বাকিটা রাস্তা চুপ করে ছিল।

ট্যাক্সি কাজিপাড়ার মোড়ে আসতেই আমি তিতলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি এখানে নেমে যাই।”

আমার বাজু শক্ত করে ধরে বলে, “হ্যাঁ, ছেলের আদিখ্যেতা দেখো। আমি এখানে নেমে যাই। ইসস, কোলে তুলে ট্যাক্সিতে করে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যাবে নাকি? বাড়ি চল না হলে আমি হাঁটব কি করে?” শেষের দিকে নিজেই হেসে ফেলে তিতলি।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “মুফাসা ক্ষেপে গেলে?”

ওর বাবা কে “মুফাসা” বলে সম্বোধন করতেই ঠোঁট চেপে হাসি চেপে নেয় তিতলি, “বাবা বাড়ি নেই। মুম্বাই গেছে কোন অফিসের কাজে, আসবে চারদিন পরে। ভাই নিজের বন্ধুদের সাথে কোথাও গেছে। বাড়িতে মা আর কাকিমা। তবে কাকিমা নিচের তলায় থাকে।”

ট্যাক্সি থেকে নামার আগে আমি ওর কাজল কালো চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বললাম, “তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”

ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল তিতলি। পদ্মকুড়ির মতন চোখের পাতা নেমে এলো বুকের ওপরে। আমার গালে হাত রেখে সরিয়ে দিল আমার নজর, “ধ্যাত, একদম ওইভাবে আমার দিকে দেখবে না।”
 
পর্ব তিন (#2-#12)

আমি ওর ফোল্ডার নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। আমার কাঁধে হাত রেখে কোনমতে ট্যাক্সি থেকে নিচে পা রাখতেই, আউ করে ব্যাথায় একটু ককিয়ে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হাঁটতে পারবে। মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিল পারবে। গেট খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখলাম, বাড়ির সামনে বড় বাগান। কাঁধে হাত রেখেই কোন রকমে সিড়ি চড়ে দোতলায় ওঠা হল। বসার ঘর বেশ বড়। তিতলিকে আমার সাথে ঢুকতে দেখেই ওদের কাজের মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে ওর মাকে ডেকে নিয়ে এলো। আমি তিতলির মাকে দেখে মাথা নুইয়ে প্রনাম জানিয়ে তিতলিকে সোফায় বসিয়ে দিলাম। তিতলির মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম, মমতাময়ী মাতৃ মূর্তি।

মেয়ের এই অবস্থা দেখে তিতলির মা অস্থির হয়েই ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে রে তোর?”

ওর হয়ে আমিই উত্তর দিলাম, “কাকিমা আর বলবেন না। আপনার মেয়ে রাস্তা দেখে পার হয় না। ব্যাস আর কি। পা মচকে গেছে।”

অস্থির হয়ে উঠলেন তিতলির মা, “কোথায় লেগেছে দেখি।”

তিতলি মৃদু হেসে ওর মাকে বলল, “না গো বেশি লাগে নি। এই একটু পা মচকে গেছে। মুভ লাগিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।” আমার দিকে চোখ পাকিয়ে একটু কটাক্ষ করে তাকিয়ে দেখল।

মেয়ের ভাব মনে হয় ওর মা বুঝতে পেরে গেছিলেন। মেয়ের পাশে বসতেই, তিতলি নিজের মাকে একটু আদর করে জড়িয়ে ধরল। মৃদু হেসে আমাকে বসতে বললেন, “বস।” আমি সোফায় বসার পরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম আদি?”

আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললাম। বুঝলাম ওর মা আমার সম্বন্ধে জানে। মনে মনে হেসে ফেললাম আমি। যখন নিজেই জানতাম না আমি কি তখন ওর মনে সেই বিশ্বাস ছিল। আমি তিতলির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিলাম। তিতলির মা কাজের মেয়েটাকে চা বানাতে বললেন।

তিতলি সোফা ছেড়ে উঠে বলল, “আমি বানিয়ে আনছি।”

কাকিমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলেন, “তুই চা বানাবি? তুই তো...”

কথাটা শেষ করতে দিল না তিতলি। ওর মাকে হেসে বলল, “কেন আমি কি চা বানাতে পারি না।”

মাথা নাড়িয়ে হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “না রে মা, তুই অনেক কিছুই পারিস।”

আমি দেখতে পেলাম, কাকিমার চোখের কোনা একটু ভিজে এসেছে। আনন্দে নাকি আসন্ন ভবিষ্যতরে কোন মেঘের ছায়া দেখে জানি না। আমি আর কাকিমা তিতলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। পায়ের ব্যাথায় একটু খুঁড়িয়ে চলছে তবে দেখে মনে হল না যে এই মেয়ে একটু আগে পায়ের ব্যাথায় হাঁটতে পর্যন্ত পারছিল না।

তিতলি কাজের মেয়েকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যাওয়ার পরে কাকিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি বাঙ্গুরে থাকো?”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ।”

কাকিমা কিছু একটা ভেবে মৃদু মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বললেন, “তুমি তো জানো যে তিতলি ক্লস্ট্রোফোবিক।” আমি মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিলাম, জানি। কাকিমা বললেন, “ছোট বেলায় খুব ভুগেছি ওকে নিয়ে। কিছুতেই স্কুলে পাঠানো যেত না। অনেক সাইকিয়েট্রিস্ট দেখিয়ে, অনেক কাউন্সিলিং করার পরে অনেক ঠিক হয়েছে। তারপরে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। এই কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি করে দিলাম। যাতে একটু মানুষ চেনে, মানুষের সাথে মিশতে পারে। এখন পর্যন্ত বাসে চড়তে ভয় পায়। ভিড় বাসে একদম চড়তে পারে না। এক নয় গাড়ি, না হলে ট্যাক্সি।” আমি মৃদু হাসলাম, সেটা জানি। কাকিমা আমার দিকে দেখে বললেন, “জানি না কি করবে।”

আমি কাকিমাকে আসস্থ করে বললাম, “এত চিন্তা করছেন কেন? আপনার মেয়ে যথেষ্ট কথা বলে।”

আমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে আমাকে বললেন, “কি বলছ তুমি?”

এই কথা আমি ছাড়া আর কে জানে। আমার বাইকের পেছনে চেপে কলেজ থেকে বাড়ি পর্যন্ত, সারাটা রাস্তা যে ভাবে গল্প করে সে মেয়ে মুখচোরা কখনই হতে পারে না।

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, কাকিমা। তবে কি জানেন। ও জানে কোন মানুষের সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয়।”

একটু ভেবে মাথা নাড়িয়ে আমার দিকে ম্লান হেসে বললেন, “ভালো হলেই ভালো।”

একটা ট্রেতে দুই কাপ চা বানিয়ে বসার ঘরে এলো তিতলি। আমাদের দেখে মিষ্টি হেসে নিজের মাকে বলল, “আমার নামে নালিশ চলছে নাকি?”

কাকিমা মেয়ের হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর পা ভালো হয়ে গেছে মনে হচ্ছে?”

আমার দিকে একটু তাকিয়ে লাজুক হেসে মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিল তিতলি, “তা একটু হয়েছে।”

কাকিমা আমাকে বললেন, “তুমি দুপুরে খেয়ে যেও।”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “না না, কাকিমা অন্যদিন খাওয়া যাবে। আমাকে মামাবাড়ি যেতে হবে।”

কাকিমা বললেন, “তুমি প্রথমবার এলে আর শুধু চা খেয়ে যাবে?”

আমি তিতলির দিকে আড় চোখে দেখে একটু ইয়ার্কি মেরে বললাম, “আপনি রান্না করলে খেতে পারি। এসব আনকোরা হাতের রান্না খেয়ে পেট খারাপ করতে চাই না।”

তিতলির মুখ গোমড়া হয়ে গেল। গোমড়া মুখেই আমার দিকে চাঁটি মারার ইশারা করে একটু ধ্যাতানি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ তুমি যেন কত আমার হাতের রান্না খেয়েছ।” বলেই নিজে লজ্জা পেয়ে গেল।

তিতলির বলার ধরন দেখে কাকিমা হেসে ফেললেন, সেই সাথে আমিও হেসে ফেললাম। কাকিমা আমাকে বললেন, “আচ্ছা তুমি বল তুমি কি খেতে চাও আমি তাই রান্না করে খাওয়াবো তোমাকে।”

আমি বললাম, “আপনার হাতের শুক্তো খেতে চাই।”

সেই শুনে কাকিমা আর তিতলি, দুইজনেই হেসে ফেলে। কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন, “শুক্তো কেন?”

আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, “শুরুতে তেতো ভালো।”

মনে হয় কাকিমা আমার কথার গুঢ় অর্থ অনুধাবন করতে পেরে ম্লান এক হাসি দিয়ে বললেন, “এমন কেন বলছ?”

আমি নেতি বাচক ভাবেই মাথা নাড়ালাম, কিছু না, মুখে কোন উত্তর দিলাম না। আরো একটু বসে তিতলির হাতের তৈরি চা খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। তিতলি নিচে আমাকে ছাড়তে না এলেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে বেড়িয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে ওকে বিদায় জানাতে গেলাম। একটা ছোট কাগজের টুকরো এসে পড়ল গায়ের ওপরে। আমি হাতে নিতে দেখি তিতলি আমার দিকে তাকিয়ে ওই কাগজের দিকে ইশারা করছে। মোড়া কাগজ খুলে দেখলাম, একটা লাইন লেখা। “সোমবার কলেজে আসবে। না হলে মার খাবে।” আমি মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিলাম, যথাআজ্ঞা মহারানী।

মামাবাড়ি পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিল। দুপুরে খাওয়া হয়নি। মামিমা আমার বাড়িতে ফোন করেছিল কিন্তু আমি ছিলাম না। মামাবাড়ি ঢুকতেই মামিমার বকা শুনতে হল। সেই দুপুর থেকে তোর ভাত বেড়ে বসে আছি, একটা ফোন করতে পারিসনি। মামিমার বকা খেতেও তখন বেশ ভালো লাগছিল। ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি, তাই রাতে আর ফোন করা হল না। তবে আমি অনির্বাণকে ফোন করে বলে দিলাম যে যদি পারে তাহলে যেন সোমবার আমার অফিসে বাইক নিয়ে চলে আসে। সোমবার বাইক না পেলে তিতলির কলেজ যাওয়া হবে না। তিতলির সাথে দেখা না করতে পারলে, চপেটা ঘাত আছে কপালে।

রাতে আর ঘুম হল না আমার। আগের অস্থিরতার কারণ ছিল ভিন্ন, বিরহের শূন্যতা ছিল বুকের ভেতরে। সেদিন বিরহের জন্য নয়, একটা অসীম ভালোলাগায় ভরে ছিলাম আমি। আমার কাঁধে মাথা রেখে বাকিটা রাস্তা আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে বসেছিল তিতলি। আমার জামায় তখন যেন ওর গায়ের গন্ধে মাখামাখি। আমার সারা মুখের ওপরে ওর রেশমি চুলের আবরণ, নাকে ভেসে আসে স্নিগ্ধ সুঘ্রাণ। আকাশের পোজা তুলোর মেঘের ভেলার মাঝে বাঁকা চাঁদ আর আমাকে দেখে কটাক্ষ করে হাসে না। রাতে হোঁৎকা তোতাপাখির সাথে কথা হল। কিন্তু তিতলির ব্যাপারে কিছুই জানালাম না। এখন সেই পর্যায়ে পৌঁছাইনি।

যথারীতি, সোমবার দুপুরে আমার অফিসে বাইক পৌঁছে দিয়েছিল অনির্বাণ। লাঞ্চ টাইমে অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন দুইজনে গল্প করলাম। অনির্বাণের মুখে হাসি ধরে না। কাবেরিকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া, ময়দান, আউট্রাম ঘুরেছে সারাদিন। ওদের প্রেম একটু একটু শুরু হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করাতে আমি বললাম তিতলির কথা। বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি এইমাত্র।

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম। বেশি দেরি করে সুন্দরী ক্ষেপে যাবে। অনেকদিন পরে কলেজের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। একটা হেলমেট এবারে কিনতেই হবে। দিন ছোট হয়ে এসেছে। বাইক নিয়ে যখন বেথুনের সামনে পৌঁছালাম ততক্ষনে সূর্যদেব পশ্চিমে পাটে বসে গেছেন। রাস্তার দুইধারে নিয়নের আলো জ্বলে উঠেছে। সন্ধ্যে হলেই রাস্তায় লোক চলাচল বেড়ে যায়। সবাই হয়ত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ওর কলেজের গেটে সন্ধ্যে বেলাতেও দেখলাম ছেলে মেয়েদের ভিড়। আমি ওর কলেজের গেট ছাড়িয়ে আরো একটু এগিয়ে বাইক দাঁড় করালাম। একটা সিগারেট ধরাতে যাবো কি পেছনে একটা কোমল হাতের ছোঁয়া।

পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, রূপসীর হাসি মুখ, “দেরি করলে কেন?”

আমি ওকে বললাম, “অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়েছি আর তুমি বলছ দেরি?”

বাইকের পেছনে উঠতে উঠতে বলল, “বাঃ রে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, সবাই চলে গেছে।”

আমি ওকে বললাম, “কি করব তাহলে?”

কথাবার্তার ধরনে বোঝা মুশকিল যে এই আমি কি আর সেই আমি, এই তিতলি কি আর সেই তিতলি। মনে হল যেন সকালেই দেখা হয়েছিল, ফিরতে একটু দেরি দেখে বকা খাচ্ছি। মনেই হল না যে প্রায় এক দেড় মাস পরে, হৃদয়ের সাথে দুইজনে যুদ্ধ করে ফিরছি। তিতলি বেশ সাবলীল ভাবেই বাইকের পেছনে বসে আমার কাঁধে হাত রাখল।

আমাকে বলল প্রেয়সী, “তাহলে কাল থেকে আমি কলেজের পরে তোমার অফিসে চলে আসব।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “তুমি না, পারো বটে।”

পিঠের কাছ ঘেঁষে বসে নিজেকে আমার প্রসস্থ পিঠের ওপরে নিবিড় করে উজাড় করে ঢেলে দিল। কানের কাছে ফিসফিসয়ে বললে ললনা, “আচ্ছা এবারে চল।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিক করে বসেছ?”

মাথা দুলালো, “হ্যাঁ।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার একটা হেলমেট কিনতে হবে এবারে।”

হেসে ফেলল তিতলি, “মনে পড়েছে তাহলে যে এবারে একটা হেলমেটের দরকার।”

আমি বাইকে স্টার্ট দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ। এই যাওয়ার পথে হাতিবাগান থেকে কিনে নেব।”

আদুরে কন্ঠে আবদার করল রমণী, “ওই কালো রঙের কিনব না কিন্তু। আর হ্যাঁ, শুধু মাথা ঢাকা ওয়ালা। এই তোমাদের মতন পুরো মাথা আটকে দেবে এমন নয় কিন্তু।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “আচ্ছা বাবা, তোমার পছন্দ মতন কিনে দেব।”

হাতিবাগানে এসে একটা রাস্তার পাশের দোকান থেকে দরদাম করে একটা লাল সাদা রঙের হেলমেট কেনা হল। যেহেতু ভিড় একদম পছন্দ করে না তাই একদম আমার গা ঘেঁষে আমার বাজু দুই হাতে আঁকরে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তিতলি। ভিড় দেখলেই ওর চোখে মুখে একটা ভীতির ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। বাইকে ওঠার পরে ললনার অভিব্যাক্তি পুরো বদলে যায়। দেখে মনেই হবে না এই মেয়ে একটু আগে হাতিবাগানের ভিড় দেখে ভয় পেয়ে গেছিল।

পেলব বাহুদ্বয় দিয়ে আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরে আমার ডান কাঁধে থুঁতনি রেখে জিজ্ঞেস করল, “এই আদি, পুজোতে কি করলে?”

পুজোর কথা মনে করাতেই দিম্মার কথা মনে পরে গেল। দিম্মার কথা মনে পড়তেই মনে হল “আদি” নামটা এই তিতলি না থাকলে হারিয়ে যেত দিম্মার সাথে। মনে হল বাইক থামিয়ে জড়িয়ে ধরি তিতলিকে।

আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ওকে বললাম, “আমার দিম্মা নবমীর দিন মারা গেছেন।”

কথাটা শুনে আঁতকে উঠল তিতলি, “কি ভাবে?”

আমি নরম গলায় বললাম, “এই আমরা সবাই মিলে হরিদ্বার ঋশিকেশ বেড়াতে গেছিলাম। বেশ ভালো ঘুরলাম। শেষ দিনে ঠিক ফিরে আসার আগের দিনে হরিদ্বারে মারা গেলেন।”

তিতলির মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষন আমার কাঁধের ওপরে গাল রেখে চুপ করে বসেছিল। বাতাসে একটু ঠান্ডার আমেজ। পিঠের ওপরে তিতলির কোমল নধর দেহের উষ্ণ পরশ আমাকে মাতিয়ে তোলে।

বেশ কিছুক্ষন ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল?”

মাথা নাড়ল তিতলি, “না কিছু না।” দুই হাতে আস্টেপিস্টে আমাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি মিহি কন্ঠে বলে, “তুমি না মহা শয়তান। তোমার ফোন নাম্বার ও দিলে না আমাকে।”

হটাত করেই পিঠ থেকে সরে গিয়ে, পিঠের ওপরে পাতলা নখের আঁচরে কি সব লিখতে লাগলো। কয়েকটা বুঝতে পারলাম, পাঁচ লিখল, তারপরে তিন, আবার তিন। বুঝলাম নিজের ফোন নাম্বার লিখছে, কিন্তু এইভাবে বাইকে বসে ওই লেখার ওপরে মনোযোগ দিলে একটা দুর্ঘটনা ঘটবেই। লেখার মনোযোগের চেয়ে বেশি, ওই নখের আঁচরে আমার সর্বাঙ্গের সবকটা ধমনী বেয়ে উষ্ণ রক্ত এলোপাথাড়ি ছুটে বেড়াতে শুরু করে দিয়েছিল। আমার শরীর বারেবারে শিউরে ওঠে, আর তাতে খিলখিল করে হেসে ফেলে তিতলি।

মিষ্টি হেসে বলল, “এইটা আমার ফোন নাম্বার।”

মনে হচ্ছিল বাইক থামিয়ে দুই হাতে পিষে ধরি, এতই শুরুশুরি লাগছিল পিঠের ওপরে, শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, “ওইসব থামাবে নাকি বাইক থামিয়ে দেব।”

খিলখিল করে হেসে ফেলল তিতলি, “বাঃ রে। এতদিন কষ্ট দিয়েছ তার উচিত শাস্তি দেব না?”

আমি ওকে একটু উত্যক্ত করার জন্য বললাম, “জানো দাদা বউদি আমার জন্য মেয়ে দেখেছে।”

আঁতকে উঠল তিতলি, “কি?”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “হ্যাঁ।” হাসিটা অবশ্য হেলমেটের আড়ালে ছিল তাই আর দেখতে পায়নি।

তিতলির হাতের বেড় আমার কোমর থেকে আলগা হয়ে গেল। প্রেয়সীর এই অভিমান দারুন লাগে আমার। ওই সেদিন যেভাবে মুখ ভার করে বলেছিল, “জাহান্নুমে যাবো”। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তারপরে?”

আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম ওর অভিমানী কন্ঠ শুনে। তাই ওকে আরো বেশি উত্যক্ত করার জন্য বললাম, “আবার কি। পল সায়েন্স নিয়ে গ্রাজুয়েট। দুর্গাপুরে বাড়ি।”

তিতলি বলল, “আচ্ছা তাই দুর্গাপুর যাওয়া হয়েছিল?”

মাথা দোলালাম আমি, “হ্যাঁ। দাদা মেয়ে দেখার জন্য ডেকেছিল। সংযুক্তা সাহা, বেশ ভালো দেখতে।”

মুখ ভার না দেখতে পেলেও ওর গলা শুনে বুঝতে পারলাম, “আচ্ছা, বেশ।” বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে প্রশ্ন করল, “তোমার পছন্দ হয়ে গেছে তাহলে?”

মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম, “ওই আর কি।” আসলে ওকে ওইভাবে বিরক্ত করতে বেশ ভালো লাগছিল আমার।

দুম করে পিঠের ওপরে কিল মেরে বললে, “আমাকে এখানে নামিয়ে দাও।”

আমি হেসে ফেললাম, “কেন? সবে তো বেলগাছিয়া এলাম।”

মুখভার, শুধু মাত্র কাঁধে হাত, পিঠের থেকে বেশ সরে বসেছে। চাপা অভিমানী কন্ঠে বলল ললনা, “ওই সংযুক্তাকে বাইকে চড়াতে পারতে।”

আমি হেসে বললাম, “বাঃ রে ওতো দুর্গাপুরে।”

তিতলি জিজ্ঞেস করল, “আর আমি?”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দিলাম, “এই একটু প্রাকটিস করছি। আসলে বাইকের পেছনে কোন মেয়েকে নিয়ে কোনদিন বসিনি তাই।”

শুরু হল পিঠের ওপরে দুমদাম কিল চাপড়, “তুমি বাইক থামাও এখুনি।”

যেমন ভাবে কিল মারতে শুরু করে দিয়েছিল, তাতে বাইক চালানো মুশকিল হয়ে গেছিল। শেষ পর্যন্ত রাস্তার পাশে একটা আইস্ক্রিমের দোকান দেখে বাইক থামিয়ে দিলাম। বাইক থামাতেই লাফিয়ে বাইক থেকে নেমে পরে দুম করে পিঠের ওপরে আরো একটা কিল বসিয়ে দিল রূপসী প্রেয়সী। আমি ওর হাত ধরে ফেলতেই টাল সামলাতে না পেরে একদম আমার গায়ের ওপরে পরে গেল। মুখ ভার, গোলাপি ঠোঁট জোড়া ভীষণ ভাবেই ফুলে গেছে। তীব্র আকর্ষণীয় দেহবল্লরির ছোঁয়ায় মাতাল হয়ে গেলাম।

আমি ওর দুই হাত ধরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই পাগলি। মুখ ভার কেন?”

মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল আমার সুন্দরী, “হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো তোমার প্রাকটিস করার জন্য রয়েছি তাই না।”

আমি ওর ভাসা ভাসা টানাটানা আঁখির কালো মণির মধ্যে গভীর ভাবে তাকিয়ে বললাম, “মিস ব্যানারজির সাথে প্রাকটিস না করলে মিসেস ঘোষকে পাবো কি করে বল।”
 
পর্ব তিন (#3-#13)

লাজুক হেসে আমার গালে হাত দিয়ে আমার গভীর প্রেমময় নজর সরিয়ে দিলে বলল, “তুমি একদম ওইভাবে আমার দিকে তাকাবে না।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আইস্ক্রিম খাবে?”

মাথা দুলিয়ে সায় দিল তিতলি, “হ্যাঁ।”

দুটো আইস্ক্রিম কিনে খেতে খেতে তিতলি বলতে শুরু করল, “তুমি জানো, মা না আমাদের ব্যাপারটা বুঝে গেছে।” আমি ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, কি ভাবে? উত্তরে বলল, “তুমি তো শয়তানি করে সেদিন আমাকে ট্যাক্সিতে চড়িয়ে দিয়ে কোথায় কোন মেয়ে দেখতে চলে গেলে। আমি না সারাটা রাস্তা...” শেষের দিকে কন্ঠস্বর ধসে গেল তিতলির।

আমি ওর হাত ধরে টেনে প্রবোধ দিয়ে বললাম, “বললাম তো সরি।” ঘড়ি দেখলাম, সারে সাতটা বেজে গেছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার দেরি হচ্ছে না?”

মুচকি হেসে উত্তর দিল, “না বাবা নেই, আগামীকাল ফিরবে। আমি বাড়িতে বলেছি যে একটু ফিরতে দেরি হবে। মা তাতে কিছু বলেনি।”

বললাম, “আচ্ছা বেশ। তোমার ভাইয়ের পড়াশুনা কেমন চলছে?”

বাঁকা একটা হাসি দিল তিতলি, “ছেলে তো তাই সব ভালো। ক্লাস ইলেভেনেই বাবার কাছে বায়না করে বাইক পেয়ে গেছে। পড়াশুনা আর করবে কি। কোচিঙের নাম করে আড্ডা মেরে বেড়ায় আর কি।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এত খবর কি করে পেলে?”

উত্তর দিল, “আমি কতবার দেখেছি ওকে, পাড়ার মোড়ে, বাইকে বসে আড্ডা মারতে।”

আমি একটু অবাক হলাম ওর কথা শুনে। ওর বাবা কড়া ধাতের মানুষ কিন্তু নিজের ছেলেকে শাসনে রাখেন না? মনে হয় তিতলি আমার চোখের প্রশ্ন পড়ে ফেলেছিল তাই বক্র হাসি দিয়ে বলল, “ওই আদরে বাঁদর হওয়া আর কি।”

আইস্ক্রিম শেষ করে আবার বাইকে চড়ে বাড়ির পথ ধরলাম। কাজিপাড়ার মোড়ে ওকে নামিয়ে দিয়ে একটা কাগজে আমার ফোন নাম্বার লিখে দিলাম।

তিতলিও আমাকে ওর ফোন নাম্বার দিয়ে বলল, “তুমি না প্লিজ ফোন করবে না। আসলে কি জানো আমার বাড়িতে আমাকে বিশেষ কেউই ফোন করে না। আর তার ওপরে যদি কোন ছেলে ফোন করেছে জানতে পারে তাহলে মুশকিলে পরে যাবো।”

আমি বুঝতে পারলাম ওর বন্দিনী জীবনের ছবি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়িতে এত কড়াকড়ি থাকা সত্ত্বেও তাহলে তুমি এই কম্পিউটার শিখতে একা কি করে বের হও?”

তিতলি উত্তর দিল, “ওটা তো তাও করা যায়, কিন্তু তাই বলে বাড়িতে কোন ছেলের ফোন। বাপরে মাথা খারাপ নাকি?”

বুঝতে বাকি রইল না যে, ওর বাড়িতে এই সব বিষয় নিয়ে ভীষণ কড়াকড়ি। অনেকদিন পরেই দেখা, তাই কেউই কাউকে ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে শেষ পর্যন্ত এক প্রকার জোর করেই ওকে বাড়ি যেতে বলে দিলাম। সেই আগের মতন, গলির বাঁকে আধো আলো আঁধারে ক্ষনিকের জন্য দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে মাথা নুইয়ে আমাকে বিদায় জানিয়ে হারিয়ে গেল।

রাত অনেক বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিচ্ছিলাম। মনের মধ্যে একটা খচখচ ছিল, কল করবে বলে এখন কল করল না। প্রায় তখন মধ্যরাত, হটাত করেই ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠল। দুইবার ফোন বেজে ওঠার পরে কেটে গেল। আবার কিছুক্ষন বেশ নিস্তব্দ, নিঝুম। আমি হাঁ করে তাকিয়ে ফোনের দিকে। ফোনটা আবার বেজে উঠল, ক্রিং ক্রিং, আগের মতন ঠিক দুবার। তারপরে আবার কেটে গেল। আমি মনে মনে হেসে ফেললাম। যার ফোনের অপেক্ষা করেছিলাম তার ফোন এসে গেছে। মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, নিঝুম রাতে পা টিপে টিপে বসার ঘরে ঢুকে চুপি চুপি একটা চেয়ারে বসে বোতাম টিপছে তিতলি। কানের কাছে রিসিভার ধরে রেখেছে সন্তর্পণে, চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা পাছে কেউ দেখে ফেলে। দুবার রিং হতেই কেটে দিল। সিগারেট শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, কিন্তু ঘুম আর এলো না। পিঠের ওপরে দুমদাম কিল চড়ের কথা মনে পড়তেই ভীষণ হাসি পেয়ে গেল।

শুরু হল এক নতুন জীবন যাত্রা। যার বেশির ভাগ সময়ে তিতলির আবর্তে চলে যায়। তিতলি যখন সাথে থাকে তখন আর যখন থাকে না তখন। কলেজ আগে ছুটি হয়ে গেলে ট্যাক্সি করে আমার অফিসে চলে আসে। সেখান থেকে বাইকে করে বাড়ি ফেরা হয়। প্রতি ক্লাসের পরে বাইকে করে বাড়ি ফেরা নিয়মিত বাঁধা ধরা ব্যাপার। কোনদিন কাঁকুড়গাছির মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করি, কোন শনিবার ক্লাসের পরে আমাদের ইন্সটিটিউটের পেছনের দিকে একটা শিশুউদ্যান ছিল, সেখানে বসে বসে আলু কাবলি খেতে খেতে গল্প করতাম। শুক্রবার রাতে মামাবাড়ি যাওয়ার বদলে সেটা শনিবার রাত হয়ে গেল। সম্পূর্ণ মিথ্যে বলিনি, শুধু সত্যিটা লুকিয়েছিলাম, মামিমাকে বলতাম যে শনিবার ক্লাস থাকে তাই দেরি হয়ে যায়।

দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। তিতলি এখন আর অনির্বাণকে দেখলে বিরক্ত হয় না। যতক্ষণ আমাদের সিগারেট শেষ না হয় ততক্ষন আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে। ইন্সটিটিউটের মধ্যে তিতলি এখন ওই সামনের চেয়ারে বসে আর আমি আর অনির্বাণ সেই পেছনের চেয়ারে বসে আড্ডা মারতে মারতে ক্লাস করি। ক্লাসের পরে মাঝে মাঝে প্রেয়সীর মুখ ঝামটা শুনতে হয়। তোমরা সিগারেট খাওয়া একটু কমাতে পারো না? অনির্বাণ বেশিক্ষন ওর সামনে দাঁড়াতে পারে না, তিতলিকে দেখলেই আমাকে বলে, এই আমি কাটছি, ধ্যাতানি মারার জন্য এসে গেছে। আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি।

ঠান্ডা যদিও নেই, তবে সকালের দিকে একটু ঠান্ডার আমেজ বেশ ভালো লাগে। পরেরদিন আমার জন্মদিন। তিতলির সাথে ক্লাসে দেখা। ক্লাসের পরে যথারীতি, প্রেয়সীকে বাইকের পেছনে বসিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করেছিলাম। দিনের বেলা ঠান্ডা লাগে না তবে রাতের বেলা বাইকে চাপলে একটু ঠান্ডা হাওয়া লাগে তাই তিতলির কলেজের ব্যাগে একটা কারডিগান রাখা থাকে। সেটা শুধু মাত্র বাইকে চাপলেই ব্যাবহার করা হয়। কথা ছিল আমার জন্মদিনের দিন আমি অফিস থেকে হাফ ডে ছুটি নিয়ে সোজা ওর কলেজ চলে যাবো। সেখান থেকে যেখানে প্রেয়সীর ইচ্ছে সেখানেই যেতে হবে। মাঝ রাতে সেই পরপর দুই বার দুটো ক্রিং ক্রিং ফোনের আওয়াজে বুঝে গেলাম আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেয়ে গেছি। ভীষণ আনন্দ হল সেদিন। দিম্মা আর তোতাপাখি ছাড়া আর কেউ আমার জন্মদিন মনে রাখে না।

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম। বোউবাজারে গিয়ে একটা সোনার কানের দুল কিনলাম। বেশি বড় পছন্দ নয়, তবে দেখতে সুন্দর হওয়া চাই। বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে ঘুরে একটা সোনার দুল পছন্দ হল। বাধ সাধল, হৃদয়, প্রেয়সীর পছন্দ হবে তো? না হলে আবার ফেরত দিতে আসতে হবে। কলেজের গেট ছাড়িয়ে একটু আগে গিয়েই দাঁড়ালাম। কলেজের গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছিল তিতলি, ওর সাথে পারমিতা। পোশাকে ভীষণ ভাবেই সুরুচিপূর্ণতা ধরা দিয়েছে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা গাড় নীল রঙের স্কারট, দুই পাশে একটু কাটা। পরনে একটা সাদা শার্ট, হাতা গুটানো। মেঘের মতন ঢালাও কেশ, একটা সুন্দর খোঁপায় বাঁধা। বাম হাতের সরু কব্জিতে বাঁধা সোনার ঘড়ি। হাতে একটা বাদামি রঙের একটা ফোল্ডারের মতন ব্যাগ। দেখে মনে হল কোন বড় অফিসের বড় ম্যানেজার। আমি ওদের দেখে ভদ্রতার খাতিরে মৃদু হাসি দিলাম। পারমিতা তিতলির কানে কানে কিছু একটা বলতেই, দুই কন্যে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। তারপরে পারমিতা আমাকে দেখে একটু হাত নাড়াল। পারমিতাকে বিদায় জানিয়ে ছোট ত্রস্ত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বাইকের পেছনে উঠে বসল তিতলি। তিতলির সুচারু সাজের বহর দেখে মনে হল জন্মদিন আমার নয়, ওর। মনে মনে হেসে ফেললাম আমি, সাজের মধ্যেও একটা মার্জিত ভাব, অসামান্য রুচিপূর্ণ সুন্দরী।

কাঁধে হাত রেখে আমাকে বলল, “আউট্রাম ঘাটে চল।”

এই ললনার আদেশ অমান্য করা আমার সাধ্যের বাইরে। সায় দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললাম, “যথাআজ্ঞা মহারানী।” আমি ঘাড় বেঁকিয়ে তিতলির গায়ের মদির ঘ্রাণে নিজেকে মাতাল করে বললাম, “তোমায় আজকে যা দেখাচ্ছে না।” কাঁধে একটা আলতো চাঁটি, “ধ্যাত” সলজ্জ ভঙ্গিমায় কাজল কালো নয়নে আমাকে ঘায়েল করল। ফিসফিস করে বললাম, “তোমার রূপে ঘায়েল হয়ে আজকে কতজন যে মারা পরবে কে জানে।”

খিলখিল করে হেসে ফেলল সুন্দরী, “এই যে মিস্টার, তুমি মরলে ক্ষতি নেই। আজকে আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে নিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে বুঝলে, তাই এই সাজ। চল চল, দেরি হচ্ছে। আমার বয়ফ্রেন্ডটা আবার একটু পাগলা আছে, দেরি হয়ে গেলে মুখ ব্যাজার করে বসে থাকবে।” বলেই আমাকে কাতুকুতু দিতে শুরু করে দিল।

তীব্র আকর্ষণীয় দেহপল্লব থেকে মদির ঘ্রাণ নির্গত হয়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করে দিল। সুড়সুড়ি দেওয়ার ফলে বাইক ঠিক ভাবে চালাতে পারছিলাম না। আমি ওকে বললাম, “দেখো, এরপরে আমি কিন্তু বাইক চালাতে পারব না।”

বাবুঘাট পর্যন্ত পিঠের ওপরে নিজেকে উজাড় করে বসে রইল। বাবুঘাটে বাইক রেখে রেল লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। সূর্য পশ্চিম গগনে ঢলে পড়েছে। দুর আকাশে সাদা মেঘের রাজ্যে কমলা আর গেরুয়া রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। আশে পাশের গাছের ডালে অসংখ্য গৃহপানে ফেরা পাখীদের কিচিরমিচির কলতান। গঙ্গা বক্ষে ধোঁয়াশা আভাস। মিহি কুয়াশা গঙ্গার হাওয়ায় উড়ে আসে রেল লাইনের ওপরে। লাইনের পাশে গঙ্গার পাশ ধরে ইট পাতা রাস্তা। একটা প্রাচিন বট গাছের নিচে একজন উনুন জ্বালিয়ে ভুট্টা পুড়িয়ে বিক্রি করছে। গঙ্গার জলো হাওয়া, কুয়াশা আর সেই উনুনের ধোঁয়া উড়ে এসে আমাদের ঢেকে দিল। বাচ্চা মেয়ের মতন আমার হাত ধরে একটা রেল লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছিল তিতলি। সেই ধোঁয়ায় আবর্তে গেল সুন্দরী ললনা। মনে হল যেন কোন মেঘের রাজ্যে চলে এসেছি। চারপাশে সবুজ গাছাপালা, একপাশ দিয়ে ধোঁয়া, সামনে লম্বা রেল লাইন। দূরে ওই গঙ্গা বক্ষে প্রচুর ছোট ছোট নৌকার মধ্যে টিম টিম করে আলো জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। পাশে সুন্দরী, আমার হাতে হাত রেখে হেঁটে চলেছে এক অনির্দিষ্টের পানে।

আমি ওর মুখের দিকে চেয়েছিলাম। মৃদু হেসে আমাকে বলল, “এই, ওইভাবে কেন দেখছ?”

আমি হেসে ফেললাম। জানি না কি দেখছি, বললাম, “তোমার ঠোঁটের ওপরের ওই তিলটা না দারুন সুন্দর।”

লজ্জা পেয়ে গেল সুন্দরী। রেল লাইন থেকে নেমে, আমার কোল ঘেঁষে আমার বাম বাজু দুইহাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে বলল, “আদি, এই রেল লাইনটা কোথায় যায়?”

আমি ওকে উত্যক্ত করার জন্য বললাম, “রেল লাইন আবার কোথায় যাবে। রেল লাইন এখানেই রয়েছে অনেকদিন ধরে পালাতে পারেনি।”

আমার উত্তর শুনে ক্ষেপে গেল ললনা, আদরের একটা চিমটি খেলাম বাজুতে, “ধ্যাত তোমাকে কোন প্রশ্ন করা বৃথা।”

রেল লাইন ছেড়ে ইটপাতা রাস্তা ধরে গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একদম শেষ প্রান্তে। দুইতলা একটা আইস্ক্রিমের দোকান, স্কুপ। বেশ সুন্দর। নিচে কাউন্টারে দুটো আইস্ক্রিমের অর্ডার দিয়ে উপরের বিশাল জানালার পাশে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। আমার পাশে বসে আমার বাম কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে আমার বাম হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে রইল তিতলি। আমার মনের মধ্যে শুধু একটা প্রশ্ন, এই সুন্দরীকে কোথায় রাখব। আমি হয়ত ওর সব কিছু জানি, কিন্তু তিতলিকে আমার ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। ও শুধুমাত্র এইটুকু জানে যে আমার বাড়ি বাঙ্গুরে, ব্যাস। কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি আমার ব্যাপারে। যদি জানতে পারে আমার কেউ নেই, বাবা অনেকদিন আগেই ছেড়ে চলে গেছে। একটা ছোট ফ্লাটে একা থাকি তখন কি করবে? আমি ওর ভাসা ভাসা কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। দুই চোখে কোন প্রশ্ন নেই, কোন উদ্বেগ নেই, কোন আশঙ্কা নেই, কোন ভয় নেই, কেমন যেন একটা প্রশান্তির স্নিগ্ধ ছায়া। যেন এটাই ওর জীবন। ওর কাঁধে হাত রেখে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরতেই আরো বেশি বুকের ওপরে নিবিড় হয়ে সরে এলো তিতলি। আমি ওর বাম কাঁধের গোলায় হাত রেখে কাছে টেনে নিলাম।

মিহি কন্ঠে ওকে বললাম, “এই, তিতলি...”

ঘুমের আবেশ মাখা কন্ঠে উত্তর এলো, “কিইইই...”

বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি, আমার অনেক কথা বলার আছে, “আমার কিছু বলার আছে।”

আমার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে আমার বুকের ওপরে নরম গাল ঘষে বলল প্রেয়সী, “প্লিজ, কিছু বল না। ভীষণ ভালো লাগছে এই ভাবে চুপচাপ বসে থাকতে।”

সত্যি, আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। দুই নীরব হৃদয়ের কথোপকথন শুনতে বেশ ভালো লাগছিল আমার। সম্বিত ফিরল যখন ওয়েটার আমাদের জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে এলো।

তিতলি আমার বুকের ওপর থেকে মাথা উঠিয়ে আমাকে মিহি কন্ঠে বলল, “কি হল কিছু বলবে না? চুপ করে থাকবে।”

আমি পড়লাম মহা সমস্যায়, “যাহ্‌ বাবা, আমি টেপ রেকরডার নাকি। একবার বল চুপ থাকতে একবার বল কথা বলতে।”

মুচকি হাসি দিল ওই মিষ্টি গোলাপি অধর জোড়া, “হ্যাঁ, তুমি আমার টেপ রেকর্ডার, আমার রেডিও, আমার ডিকশানারি, আমার অনে...ক কিছুউউউ...” শেষের টানটা এতটাই যে আশেপাশের ছেলে মেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল।

ওদের দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল তিতলি। আমি পকেট থেকে কানের দুলের কৌটো বার করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, “এটা তোমার জন্য।”

বাক্সটা খুলে সোনার দুল দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। মৃদু মিষ্টি বকুনি খেলাম একটু, “এত খরচ করতে হত নাকি, পাগল ছেলে। একবারে সোনার দুল।”

আমি মাথা নাড়িয়ে হেসে বললাম, “না গো এটা সোনার নয়। ওই রাস্তার পাশে একটা দোকান থেকে আনা।”

বাক্স হাতে নিয়ে দোকানের নাম দেখিয়ে আমাকে বললে ললনা, “হ্যাঁ জানা আছে। এতদামি উপহার আমি তোমার কাছ থেকে কোনদিন চাইনি, আদি।” তারপরে সোনার দুল দুটো নিজের কানের লতিতে পড়তে পড়তে মিষ্টি হেসে বলল, “আমার পছন্দ অপছন্দ মনে হয় খুব বেশি করেই বুঝে গেছ।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম। একটু মাথা নুইয়ে ওকে বললাম, “পছন্দ অপছন্দ মাথায় না রাখলে ভবিষ্যতে যে আমার পিঠে কাঁঠাল ভাঙবে।”

কথাটা শুনে হেসে ফেলল তিতলি। আইস্ক্রিম খাওয়া শেষ করে আমি ওকে বললাম, “এই এবারে বাড়ি ফিরতে হবে।”

বাড়ি ফেরার কথা শুনে ওর ফর্সা চাঁদপানা মুখমন্ডলে আষাঢ়ের বাদলের ছায়া নেমে এলো, “এত তাড়াতাড়ি?”

আমি ওকে বললাম, “দেখো, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।”

এতক্ষন ওর খেয়াল ছিল না, খেয়াল আমারও ছিল না। সামনের গঙ্গাবক্ষ কখন যে আঁধারে ঢেকে গেছে বুঝতে পারিনি। পাশের বিশাল দ্বিতীয় হুগলী সেতুর আলো জ্বলে উঠেছে। দূরে স্টিমারে আলো জ্বলে উঠেছে। গঙ্গার অন্যপাশে হাওড়ার কুলবর্তি বাড়ি কারখানায় আলো জ্বলে উঠেছে। গঙ্গার কালো জলের ওপরে সেই দুর আলোর ঝলমলে প্রতফলনে আবার যেন হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে আমাদের। তাও সময় বাঁধা দেয়। একপ্রকার জোর করে টেনে তুলতে হল প্রেয়সীকে।

আইস্ক্রিমের দোকান থেকে বেড়িয়ে ওর ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা ছোট বাক্স বের করল তিতলি। বাক্সটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “এতে একটা কেক আছে। আমি না গতকাল বানিয়েছি। তুমি বাড়ি গিয়ে খেয়ো।”

আমি কেকের বাক্স হাতে নিয়ে ওকে ইয়ার্কি মেরে বললাম, “তোমার হাতের কেক। বাড়ি গিয়ে খেয়ে যদি মরে যাই...”

সঙ্গে সঙ্গে ওর আঁখি জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। আমার ঠোঁটের ওপরে কোমল চাঁপার কলির মতন তর্জনী চেপে ধরে বললে ললনা, “একদম ওই সব অলুক্ষুনে কথা মুখে আনবে না তো।”

আমি ওর তর্জনীর ডগায় ছোট একটা চুমু খেতেই তিতলির সর্বাঙ্গ ভীষণ ভাবেই কেঁপে উঠল। আমার কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না ওর ওই পদ্ম কুড়ির মতন কোমল হাতখানি ছাড়তে। আঙ্গুলের দুটো কড় পর্যন্ত নিজের লালাশিক্ত মুখের মধ্যে পুড়ে একটু চুষে ধরতেই আমার সর্বাঙ্গ বেয়ে একটা তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হল, সেই সাথে বুঝতে পারলাম যে তিতলির তীব্র আকর্ষণীয় লাস্যময়ী দেহকান্ড কঠিন হয়ে গেছে প্রেমের উত্তেজনায়।

মিহি কন্ঠে কেকারবে ককিয়ে ওঠে ললনা, “ছাড়বে তুমি...”

বহুকষ্টে আমি ওর তর্জনী ছেড়ে দিলাম। দুষ্টু মেয়েটা আমার চোখে চোখ রেখে নিজের ভিজে তর্জনী নিজের গোলাপি অধর মাঝে চেপে ধরে চুষে নিল আমার লালা। আমি ওকে বললাম, “এবারে?”

মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল আমাকে, “এটা আমার আঙ্গুল, যা খুসি তাই করতে পারি।” তারপরে ব্যাগ থেকে আরো একটা বড় প্যাকেট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি জানি তুমি গল্পের বই পড়তে ভালোবাসো। এটা সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন। আমি হয়ত হাত খরচের জন্য অনেক টাকা পাই বাড়ি থেকে। কিন্তু তাও আমি তোমার মতন ওত বড়লোক নই, আদি। আমি চাকরি করি না। গত বছর বাবার অফিস থেকে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম, সেটাই জমিয়ে রেখেছিলাম একজনের জন্য, যে আমাকে প্রজাপতির মতন উড়তে শেখাবে।”

আমার বুকটা ভরে গেল। ভাবিনি এতটা ভালোবাসা আমার কপালে লেখা। আমি ওই বইটা হাতে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তুমি সত্যি পাগল।”

আমার নিবিড় বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে গলতে শুরু করে দিল তিতলির নধর আকর্ষণীয় দেহপল্লব। কতক্ষন ওইভাবে দুইজনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আঁধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। ভীষণ ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমার বুকের মধ্যে একটা ছোট পায়রাকে চেপে ধরে রেখেছি। সারাটা রাস্তা আমাকে আঁকরে ধরে চুপ করে বসেছিল তিতলি। ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না একদম। কাজিপাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল প্রজাপতির ডানায় কেউ যেন আবার শিকল লাগিয়ে দেবে। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল সেদিন ওকে ছেড়ে আসতে।

বাড়ি ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে বইটা খুলে বসলাম। প্রথম পাতার নিচে ছোট করে লেখা। “শুধু তার জন্য, যে আমাকে উড়তে শিখিয়েছে।” নতুন বইয়ে চুমু খেয়ে পড়তে শুরু করতে যাবো তখন ফোন বেজে উঠল। আমি নেচে উঠলাম, নিশ্চয় তিতলির ফোন।

ফোন উঠিয়ে খুশির উত্তেজনা নিয়ে উত্তর দিলাম, “কি হল কি করছ...”

কথাটা শেষ করার আগেই অন্যপাশ থেকে ভেসে এলো এক অচেনা নারীর কন্ঠস্বর, “হ্যাপি বার্থডে মিস্টার বুধাদিত্য ঘোষ।”
 
পর্ব তিন (#4-#14)

ফোন উঠিয়ে খুশির উত্তেজনা নিয়ে উত্তর দিলাম, “কি হল কি করছ...”

কথাটা শেষ করার আগেই অন্যপাশ থেকে ভেসে এলো এক অচেনা নারীর কন্ঠস্বর, “হ্যাপি বার্থডে মিস্টার বুধাদিত্য ঘোষ।”

আমি অবাক হয়েই সেই অচনা নারী কন্ঠের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কে বলছেন?”

ম্লান হাসি দিলেন সেই নারী কন্ঠস্বর, “সেই মানুষ যাকে হয়ত এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশি ঘৃণা করা হয়।”

সব কিছুই আমার কাছে ভীষণ ভাবেই হেঁয়ালির মতন লাগছিল। আমি ছিলাম একটা ভীষণ প্রেমের ঘোরের আবর্তে, সেখানে এই অচেনা নারীর প্রবেশ কি করে ঘটল? আমি একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই বললাম, “ম্যাডাম আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।”

সেই অচেনা নারীর কন্ঠস্বর ভীষণ শান্ত, “না, ভুল হচ্ছে না।” একটু হাসলেন, “এই যে এসে গেছে।”

তারপরের পুরুষের কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম সেই পুরুষ আমার বাবা। জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, “কেমন আছো?”

নির্বিকার ভাবেই উত্তর দিলাম, “ভালো আছি।” সেই সাথে বেশ কিছু ছবি পরিষ্কার হয়ে গেল আমার সামনে। ওই অচেনা নারী নিশ্চয় বাবার খুব কাছের কেউ, হয়ত তার স্ত্রী।

বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি আশা করেছিলাম যে তুমি আসবে।”

বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি, দেখা করার যদিও বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না আমার তাও বললাম, “আচ্ছা দেখছি। যদি পারি এই রবিবার হয়ত যেতে পারি।”

উত্তর দিলেন, “আচ্ছা অপেক্ষা করব। ব্লাকডায়মন্ডে আসবে তো?”

উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ।”

তারপরে আর ফোনে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। পরের দিন মামিমাকে জানিয়ে দিলাম যে রবিবার আমি ধানবাদে যাবো। তিতলিকে কিছুই বলিনি, কি বলব? বলব যে ছোট বেলায় আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে? বাঁধা পেলাম কোথায় যেন সেই কথা বলতে।

যথারীতি, রবিবার ভোরের বেলায় বেড়িয়ে পড়লাম ধানবাদের উদ্দেশ্যে। ট্রেন একটা একটা করে স্টেশান পার হচ্ছে আর আমার বিরক্তি ভাব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। দুপুর নাগাদ ধানবাদে পৌঁছাল ট্রেন। বেশ বড় রেল স্টেশান, সব দুর পাল্লার ট্রেন এই স্টেশানে থামে। বাড়ির ঠিকানা আমার কাছে ছিল। তাই স্টেশানের বাইরে বেড়িয়ে একটা অটো করে যাত্রা শুরু করে দিলাম। জায়গায় নাম লোহারকুল্লি। সেই এলাকায় ঢুকতেই মনে হল বেশ সম্ভ্রান্ত বড়লোকেদের এলাকা। বড় বড় অট্টালিকা রাস্তার দুইপাশে। খুঁজে খুঁজে একটা দুইতলা বিশাল সাদা রঙের অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে গেল অটো। হাতের কাগজের সাথে বাড়ির নাম্বার মিলিয়ে দেখলাম। বিশাল লোহার গেটের পাশের থামে শ্বেত পাথরের প্রস্তর ফলকের ওপরে লেখা “মঞ্জুষা মন্দির”। নামটা দেখে ঠোঁটের কোনায় একটা তির্যক কাষ্ঠ হাসি ফুটে উঠল। আমার মায়ের জায়গা শুধু মাত্র এই শ্বেত পাথরের প্রস্তর ফলকে। বিশাল লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একটু লম্বা মোরাম বিছানো রাস্তা, দুইপাশে বেশ সুন্দর ফুলের বাগান। আমাকে ঢুকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে একটা লোক দৌড়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই? আমি উত্তর দিলাম, মিস্টার সুবির ঘোষের সাথে দেখা করতে এসেছি। বিশাল ভারী কাঠের দরজা খুলে আমাকে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে অনুরোধ করল সেই লোকটা।

পায়ের নিচে চকচকে শ্বেতপাথরের মেঝে। মাথার ওপরে বিশাল দামী একটা ঝাড়বাতি। দেখে মনে হল ওই ঝাড়বাতির যা দাম আমার ছোট ফ্লাটের সব আসবাব পত্র বিক্রি করে দিলেও হয়ত আমি ওই ঝাড়বাতি কিনতে পারব না। একটা দেয়াল জুড়ে বিশাল একটা আলমারি, রকমারি বইয়ে ঠাসা। দেয়ালে বেশ কয়েকটা দামী ছবি ঝুলছে। কিছু ছবি দেখে মনে হল বিদেশী। নিজেকে এই অতিসজ্যের মধ্যে কেমন বেমানান ঠেকছিল। কেন এলাম হটাত করেই এখানে। লোকটা আমাকে সোফায় বসতে বলে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। চারদিক নিস্তব্দ, তার মাঝে একটা বাচ্চার হাসির শব্দ মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে।

একটু পরে এক ভদ্রমহিলা ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। রূপসী বললে ভুল হবে, দেখে মনে হল কোন দেবী দাঁড়িয়ে আমার সামনে। একটা চওড়া আঁচলের সবুজ পাড়ের ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরিহিত। চোখে মুখে সুচারু আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। মাথা ভর্তি কালো কোঁকড়ানো ঘন চুল, কপালে ছোট লাল একটা টিপ। চেহারায় যৎসামান্য প্রসাধনী তাও এক নির্মল লাবন্যের ছটা ঝরে পড়ছে। ঠোঁট আময়িক মিষ্টি হাসি। সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুর দেখে মনে হল তিনি এই বিশাল অট্টালিকার রাজ্ঞী। আমাকে দেখে দুই হাত জড় করে অভিবাদন জানালেন, আমিও উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে প্রতিউত্তরে অভিবাদন জানালাম।

সেই মহিলা আমাকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “মিস্টার ঘোষ গাড়ি নিয়ে স্টেসান গেছিলেন, দেখা হয়নি?”

মাথা নাড়লাম আমি, “কই না তো।”

একটা কাজের মেয়ে একটা ট্রেতে করে এক গ্লাস সরবত দিয়ে গেল। আমাকে সরবত খেতে অনুরোধ করলেন সেই মহিলা। মার্জিত মিষ্টি কন্ঠস্বর আর সুচারু মোহময়ী রূপের বসে আমার বাবা যে হেরে গেছেন সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না।

গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে তির্যক হেসে বললাম, “অনেক বছর পর তো তাই হয়ত কেউই কাউকে চিনতে পারিনি।”

আক্ষেপের ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালেন এই বিশাল অট্টালিকার রাজ্ঞী, “হ্যাঁ তা হতে পারে। আমি ড্রাইভারকে একটা প্ল্যাকার্ডে নাম লিখে নিয়ে যেতে বলেছিলাম।” মৃদু হেসে বললেন, “কে বা শোনে আমার কথা।”

কিছুক্ষনের মধ্যেই বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেতেই মহিলা বললেন, “ওই এসে গেছেন।”

দরজা খুলে ঢুকলেন, মিস্টার সুবির ঘোষ, আমার বাবা, সতেরো বছর পরে আমার সাথে দেখা। কেমন দেখতে সেটাও আমি ভুলতে বসেছিলাম। সামনের মানুষটাকে ঠিক বাবা বলে আর মনে হল না, একজন অচেনা বৃদ্ধ পুরুষ মানুষ বলেই মনে হল। কাঁচা পাকা চুল, ফ্রেঞ্চ কাট কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফ। পুরানো পরিচয়কে চাগিয়ে তুলে নতুন পরিচয়ের বাঁধনে আর বাঁধতে চাইনা। সুবির বাবু আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভদ্রমহিলা সুবির বাবুর পিঠের ওপরে হাত রেখে মনের মধ্যে বল জুগাতে চেষ্টা করলেন হয়ত। বাবাকে এতদিন পরে দেখে আমার বুকের খাঁচা শুন্য হয়ে গেল। চোয়াল কঠিন। মনে হল একবার জিজ্ঞেস করি, শেষ সময়ে মাকে দেখতে কেন আসনি? আর যখন ভুলেই ছিলে তখন এই বাড়িতে ডেকে এনে কি বুঝাতে চাইছ? ভালো আছো তোমরা এই দেখে গেলাম। না আমি এইসবের কিছুই বলতে পারিনি। আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি ভদ্রতার খাতিরে ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল, আলিঙ্গনের অতিশজ্যায় নয়, কষ্টে একরাশ বিরক্তিতে।

সুবির বাবুর আলিঙ্গনপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো?”

আমার পাশের একটা সোফায় বসে উত্তর দিলেন, “এই বেঁচে আছি।” পাশে দাঁড়ানো সুন্দরী দেবী প্রতিমার হাত ধরে বললেন, “দেবস্মিতা না থাকলে হয়ত বাঁচতাম না।”

বুঝতে পারলাম, এই অট্টালিকার রাজ্ঞীর নাম দেবস্মিতা, সত্যি দেবীর মতন রূপ। দেবস্মিতা সোফায় বসলেন না, সুবির বাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাড়ির মধ্যে থেকে ছোট একটা বাচ্চার গলা শোনা যাচ্ছিল। আমার কৌতূহলী চোখ যেন তাকেও খুঁজে বেড়াচ্ছিল। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল সেই বাচ্চাটার আসল পরিচয়। তবে চোখের সামনে সুবির বাবুর পেছনে যেভাবে দেবস্মিতা দাঁড়িয়ে সেই ছবি দেখে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম আমি। নিজের ভাগ্যের জন্য হাসি পেল। না, এই বিশাল অট্টালিকার জন্য নয়, শুধু এই জন্য যে একটা পদবী ছাড়া আর কিছুই আমার মনে নেই।

আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সুবির বাবু, “তোমার খবর বল।”

আমি তির্যক হেসে বাড়ির চারপাশে চোখ বুলিয়ে উত্তর দিলাম, “ভালো আছি।” তারপরে সুবির বাবুর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলাম, “কেন দেখা করতে চেয়েছ সেটা বল?”

সুবির বাবুর চোখের কোনা ভিজে আসে আমার গলা শুনে। কম্পিত কন্ঠে বলেন, “বাবা হই তোমার। একবার কি দেখা করার অধিকার নেই?”

আমি হিমশীতল কন্ঠে উত্তর দিলাম, “সতেরো বছর। শেষ দেখা হয়েছিল যখন আমি নরেন্দ্রপুরে পড়তে যাই। আমি তখন ক্লাস ফোরে।”

দেবস্মিতার হাত সুবির বাবুর কাঁধের ওপরে আলতো চাপ দিল বুঝতে পারলাম। নরম কন্ঠে সুবিরবাবুকে বললেন, “মিস্টার ঘোষ, একটু ভেবে ...”

ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল সুবির বাবুর। সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল এই মানুষটা আমার মায়ের শেষ সময়ে আসেনি। দেবস্মিতার ওইভাবে সুবির বাবুর কাঁধের ওপরে হাত রাখাতেই বুঝতে পারলাম, এই মহিলার জন্য হয়ত আমার মাকে কোনদিন কাছে টেনে নেয়নি আমার সামনে বসা মানুষটা। সারা শরীর চিড়বিড় করে জ্বলতে শুরু করে দেয় আমার। বেশিক্ষন বসার ইচ্ছে ছিল না আর, তাও এতদুর এসেছি এবং ভদ্রতার খাতিরে বসে থাকতে হল। শত্রুর বাড়িতে পা রেখেছি বলে মনে হচ্ছিল আমার। বেশ কিছুক্ষন সবাই চুপচাপ, কারুর মুখে কোন কথা বার্তা নেই। নিশ্তব্ধতা ভীষণ ভাবেই কানের মধ্যে বাঁধছিল আমার। শুধু মাত্র ঘড়ির আওয়াজ আর নিজের শ্বাসের আওয়াজ। আমি চুপচাপ বসে সামনে বসা সুবির বাবু আর দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

শেষ পর্যন্ত ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো?”

মাথা দুলিয়ে ইতিবাচক উত্তর দিলেন সুবির বাবু, “হ্যাঁ, এই চলছে। বয়স হয়েছে, যেমন থাকা যায় আর কি।”

মাথা দোলালাম আমি। কিছুপরে একটা কাজের মেয়ে একটা বিশাল ট্রেতে অনেক রকমের খাদ্য দ্রব্য পানীয় নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপরে রেখে চলে গেল। খাবারের বহর দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

আমি খাবারের বহর দেখে বললাম, “না না আমি এত খাই না। এক কাপ চা হলেই হবে।”

দেবস্মিতা স্মিত হেসে বললেন, “এমন কিছুই বানানো হয়নি। এই গুলো খাওয়া যায়। চা এনে দেওয়া যাবে।”

বুঝতে পারলাম, কি ভাবে আমাকে সম্বোধন করবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না দেবস্মিতা তাই ভাববাচ্যে কথাবার্তা চলছে। আমি একটা মিষ্টি আর কোল্ডড্রিঙ্কসের গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে বাকি গুলো সরিয়ে দিলাম। দেবস্মিতা আর সুবির বাবু আমার খাওয়া দেখে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বুঝতে পারলাম। দুপুর হয়ে গেছে, বিকেলের ব্লাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে আমাকে ফিরে যেতে হবে। আমি ঘড়ি দেখালাম, এখন কয়েক ঘন্টা বাকি।

আমাকে ওই ভাবে ঘড়ি দেখতে দেখে দেবস্মিতা বললেন, “পাশেই গেস্ট রুম, হাত মুখ ধুয়ে নিলে আমি খাবার বেড়ে দেব।” সুবিরবাবুর দিকে দেখে বললেন, “ওঠো, খাওয়ার আগের ওষুধটা খেয়ে নাও। বেশি ক্ষন না খেয়ে থাকলে তোমার আবার গ্যাস হয়ে যাবে। বাকি গল্প খাওয়ার টেবিলেই হবে।”

দেবস্মিতা আমাকে বসার ঘরের পাশের একটা ঘর দেখিয়ে দিল। ঘরটা বেশ বড়, কোন পাঁচ তারা হোটেলের কামরার মতন করে সাজানো বিছানা। বিছানার দুই পাশে ছোট টেবিলের ওপরে আলোর বাতি। একপাশে একটা বড় টেবিল আর চেয়ার। একপাশে একটা ছোট সোফা। এক পাশের দেয়াল জুড়ে জানালা, ভারী পর্দায় ঢাকা। বাথরুমটাও বেশ বড়। আমি বাথরুমে ঢুকে হাত মুখে সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে বেড়িয়ে এলাম। বসার ঘরের অন্যপাশে খাওয়ার ঘর। বেশ বড় খাওয়ার টেবিল, ছয়খানা চেয়ার পাতা।

আমি বেড়িয়ে আসতেই একটা ছোট কচি বাচ্চার সাথে দেখা। হাতে একটা খেলনা গাড়ি, মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। দেবস্মিতা সেই বাচ্চাকে কোলে তুলে আমাকে দেখিয়ে বললেন, “হাই বল।”

কচি বাচ্চাটাকে দেখে একটু হাসলাম। বাচ্চাটা আমার দিকে দেখে হাত তুলে বলল, “হাই, তোমার নাম কি?”

আমি আমার নাম বললাম, “বুধাদিত্য। তোমার নাম কি?”

বাচ্চাটা নিজের নাম বলল, “পাপ্পাতিত্ত।”

আমি একটু অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেবস্মিতা হেসে ফেললেন ছেলের কথা শুনে। আমাকে বললেন, “ওর নাম বাপ্পাদিত্য।” ছেলেকে বললেন, “তোমার দাদা হয়।”

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল বাপ্পাদিত্য, “দাদাদের গাড়ি মুচ হয় না। আঙ্কেলের গাড়ি মুচ হয়।” বলেই খিলখিল করে নিষ্পাপ হাসি হেসে দিল।

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, সেই সাথে দেবস্মিতাও ছেলের কথা শুনে হেসে ফেললেন। যত জমানো ক্রোধ ছিল, এই নিষ্পাপ শিশুটির নির্মল হাসিতে ভুলে গেলাম। আমার নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছে ভেবে বেশ ভাল লাগলো। বাচ্চাটাকে দেখে আমার একটু খারাপ লাগলো। আগে থেকে জানলে বাচ্চাটার জন্য হাতে করে কিছু নিয়ে আসা যেত, একটা চকলেট অন্তত। আমি ওর কোঁকড়া চুলে আদর করে দিলাম। বিশাল টেবিলে কাঁসার বাসনে খাবার ব্যাবস্থা। এলাহি ব্যাপার। টেবিলে শুধু মাত্র দুটো থালা পাতা। একটাতে বসে পড়লাম আমি, অন্যটাতে সুবির বাবু। দুটো কাজের মেয়ে এক এক করে খাবার এনে দিল, কিন্তু দেবস্মিতা নিজে হাতেই পরিবেশন করলেন।

আমি সুবিরবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার আরো বছর তিনেকের মতন চাকরি আছে তাই না?”

খেতে খেতে নাতি বাচক ভাবেই মাথা নাড়লেন সুবির বাবু, “না, পাঁচ বছর আগেই ভলেন্টিয়ারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছি। এই দ্বিতীয় বার এটাক হওয়ার পরে এখন বেশির ভাগ সময়ে বাড়িতেই থাকি। একটা হেভি মেসিনারির কোম্পানি খুলেছি। ট্রাক, হেভি আরথ মুভারস, ইত্যাদি। রাস্তা কন্সট্রাক্সান, বড় বড় বিল্ডিং কন্সট্রাক্সানে কাজে লাগাই।” দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “এই দেখে, এর অধিনেই সব। আমি এখন নিমিত্ত মাত্র।”

দেবস্মিতা লাজুক একটা হাসি দিলেন। ছেলে কোলে একটা চেয়ারে বসে একটা থালায় ভাত নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে শুরু করে দিলেন। চোখের সামনে সম্পূর্ণ একটা ছবি দেখে আমার ভালো লাগলো সেই সাথে বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা।

আমি খেতে খেতে সুবিরবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই বাড়িটা আগে তো ছিল না?”

নাতি বাচক ভাবেই মাথা নাড়লেন সুবির বাবু, “না।” তারপরে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কত বছর হল? এই বারো বছর হবে তাই না?” দেবস্মিতা মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন সুবির বাবুর কথায়।

আমি সুবির বাবু আর দেবস্মিতার কথা বলার ধরন দেখে বুঝতে পারলাম, সুবির বাবুকে সম্পূর্ণ রূপে আয়ত্তে করে রেখেছেন দেবস্মিতা। কিন্তু একটা জায়গায় খটকা লাগলো, এত সুন্দর সাজানো একটা ছবি, এর মধ্যে আমার জায়গা নেই আমি জানি, কিন্তু এই সতেরো বছর পরে কিসের জন্যে আমাকে মনে পরে গেল। খাওয়া শেষে দেবস্মিতা ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি আর সুবর বাবু বসার ঘরে বসলাম। ঘড়ির কাঁটা যেন নড়তে চায় না। সুবির বাবু একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন আমি একটা পেপার মুখস্থ করতে ব্যাস্ত। মনের মধ্যে খুঁতখুঁত, এই ছবিটার মধ্যে কালো কালির দাগ ফেলার জন্য কি আমাকে ডাকা।

কিছু পরে দেবস্মিতা বসার ঘরে এসে আমাদের এইভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সুবিরবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এমন চুপচাপ বসে কেন?”

সুবির বাবু ম্যাগাজিন থেকে মাথা উঠিয়ে একবার আমার দিকে তারপরে দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না মানে, এই ম্যাগাজিনটা দেখছি।”

দেবস্মিতা বাঁকা একটা হাসি হাসলেন সুবির বাবুর দিকে তাকিয়ে, “তুমি পারো বটে মিস্টার ঘোষ।” আমার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “অফিস কোথায়?”

ছোট উত্তর দিলাম, “পার্ক স্ট্রিটে।”

দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করলেন, “মামা মামি ভালো আছেন?”

আমি ইতিবাচক হিসাবে মৃদু মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ।”

দেবস্মিতা মৃদু হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “রাতে কি বানাবো?”

আমি ঘড়ি দেখলাম, ট্রেন ছাড়তে আরও এক ঘন্টা বাকি। আমি ওদের উত্তরে বললাম, “না না, রাতে থাকবো না। আগামী কাল অফিস আছে আমার।”

আমার কথাটা শুনে সুবির বাবু আর দেবস্মিতার চেহারা বেদনায় পাংশু হয়ে গেল। সুবির বাবু বললেন, “মানে এতদিন পরে এলে। একটা রাত থেকে যেতে পারতে।”

আমি ঘড়ি দেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, “না, অত কষ্ট করতে হবে না। এই তো আপনাদের সুখের সংসার দেখে গেলাম। আবার রাতে থেকে এই সুখের সংসারে ভাঙ্গন ধরাতে চাই না।”

দেবস্মিতা আর সুবির বাবুও আমার সাথে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কারুর মুখে কোন কথা নেই। আমার কথা শুনে দেবস্মিতার চোখের কোনায় একটু জলের রেখা দেখা দিল সেই সাথে বুঝতে পারলাম যে সুবিরবাবুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।

আমি দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই দেবস্মিতা বললেন, “আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।”

নাতি বাচকে মাথা নাড়লাম আমি, “না দরকার নেই। এতদুর একা একা পাড়ি দিয়েছি, বাকি পথটা আমি একাই হেঁটে চলে যেতে পারব।”

আমি আর দাঁড়ালাম না। দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়লাম। শেষ বারের মতন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে শ্বেত পাথরের প্রস্তর ফলকে লেখা মায়ের নামের ওপরে হাত বুলিয়ে দিলাম। পেছনে দেখলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে দেবস্মিতা আর সুবিরবাবু। দোতলার বারান্দায় একটা কচি বাচ্চা আমাকে দেখে হাত নাড়াচ্ছে। আমি বাপ্পাদিত্যের দিকে দেখে একটু হাত নাড়িয়ে লোহার গেট পেছনে বন্দ করে খালি রাস্তা ধরে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম।

বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছিল। সারাটা রাস্তা শুধু মাত্র মায়ের কথা মনে পড়ছিল। ট্রেনের বাথরুমে ঢুকে পার্সের মধ্যে থেকে মায়ের ছবিটা বার করে দেখলাম। ডুকরে কেঁদে উঠতে চাইল মন। মা গো তোমার জায়গা আমার মাথায়।
 
দারুন সুন্দর লিখেছেন। রগরগে চটি গল্পের আশায় পরে ফেললাম পুরো গল্পটা। কিন্তু চটি গল্প না হওয়াতে একটুও খারাপ লাগে নি।
গল্পের বাকি অংশের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
 
পর্ব তিন (#5-#15)

ডিসেম্বর কেটে গেল, নতুন বছর শুরু হয়ে গেল। তিতলি ভিড় ভয় পায় তাই ওকে নিয়ে পঁচিশে ডিসেম্বরে অথবা পয়লা জানুয়ারিতে কোথাও বেড়াতে যেতে পারিনি। বলে, ভিক্টোরিয়া একদম ভালো লাগে না, গাছের তলায় জোড়ায় জোড়ায় সব এক একজনের কোলের মধ্যে ঢুকে বসে থাকে। ময়দান একদম খালি জায়গা, সেখানেও যেতে চায় না। আউট্রাম ঘাটে ওই একবার গেছিলাম আমার জন্মদিনের দিন, তারপরে সেখানেও আর যাওয়া হয়নি। ওর শুধু মাত্র একটাই কথা, তোমার বাইকের পেছনে আমার সব কিছু। অনির্বাণ বলেছিল, চল কোথাও যাই, আমি আর কাবেরি তুই আর অনুস্কা। সেকথা তিতলিকে জানাতেই বলল, ওদের সাথে কি কথা বলব, চিনি না তো। অচেনা মানুষের সামনে কথা ফোটেনা একদম, সেটা ভীষণ ভাবনার বিষয়। উল্টোডাঙ্গার লাইব্রেরীতে গিয়ে ক্লস্ট্রোফোবিয়া নিয়ে একটু পড়াশুনা করলাম। জীবন শুধু মাত্র এই বাইকের পেছনে কাটবে না। মানুষের সাথে মেশার ভয়, অচেনা মানুষ দেখলে ভয় এই গুলো কিছু করে হোক কাটাতেই হবে।

একদিন আমার স্কুলের এক বন্ধুকে ফোন করলাম, কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি নিয়ে পড়ছে। তাকে জিজ্ঞেস করাতে জানালো যে একবার ওদের সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টের সাথে কথা বলতে। এই বিষয়ে তিতলিকে কিছুই জানালাম না। যথারীতি একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কোলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে আমার বন্ধু, সুদীপ্তের সাথে দেখা করলাম। ও আমাকে নিয়ে গেল সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টের হেডের কাছে। তার কাছে গিয়ে তিতলির এই ভয়ের ব্যাপারে সব কিছু জানালাম। তিনি বললেন, মানুষের মস্তিস্কের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান বিশেষ কিছুই আবিস্কার করতে পারেনি। এর একমাত্র পথ, কাউন্সিলিং করা। আমি জানালাম সেই সব অনেক হয়েছে, তাও এখন বাসে উঠতে ভয় পায়, নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে ভয় পায়, কোথাও ভিড় দেখলে ভয় পায়, কোন বাজারে যেতে চায় না। চিন্তায় পরে গেলেন ডক্টর ভবতোষ বাবু। তিনি বললেন একবার একটা এমআরআই করাতে, মাথায় বেশ ভেতরের দিকে দুটো ছোট আখরোটের মতন গোল গোল অঙ্গ আছে তাকে এমিগডালা বলে, আমাদের আবেগ অনুভূতি হাসি কান্না সব কিছু এই একটা অঙ্গ থেকে নির্ধারণ করা হয়। কখন এর একটা ভাগের থেকে অন্যভাগ বড় হয় তখন কিছু কারনে এই ভয় ভীতি এই সব আবেগ অনুভূতি একটু বেশি করেই প্রকাশিত হয়। তবে যেহেতু মস্তিস্কের সম্বন্ধে এখন ডাক্তারি বিজ্ঞান সেই জায়গায় পৌঁছায়নি তাই কথা বলে ভালোবেসে বুঝিয়ে এর চিকিৎসা করতে হয়। ভবতোষ বাবু বললেন একবার তিনি তিতলির সাথে দেখা করতে চান। আমি উত্তরে বল্লাম, চেষ্টা করে দেখতে পারি।

একদিন ইন্সটিটিউট থেকে ফেরার পথে আমি তিতলিকে বললাম, “তুমি আমার সাথে একবার একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে?”

প্রশ্ন করল তিতলি, “কেন আমার কি হয়েছে?”

আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, “না তেমন কিছু নয়। তবে এই যে তুমি ভিড় দেখলে ভয় পাও। নতুন কোন মানুষের সাথে কথা বলতে ভয় পাও এই সব নিয়ে।”

আমার কথা শুনে একটু ব্যাথা পেল তিতলি, “তাতে তোমার অসুবিধে হয়?”

আমি ওকে বললাম, “না রে পাগলি মেয়ে তাতে আমার কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু এই দেখো, এই যে অনির্বাণ আর কাবেরির সাথে দেখা করতে যাওয়ার দিনে তুমি বললে যাবে না।”

প্রশ্ন করল তিতলি, “ওদের সাথে দেখা করে কি করব?”

আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললাম, “তিতলি, জীবনটা তো আর আমার এই বাইকের পেছনে বসে কাটাবে না। এরপর লোকজনের সাথে মিশতে না পারলে কি করে হবে।”

মুখ ভার হয়ে গেল ললনার, “তার মানে আমার এই ব্যাবহার তোমার পছন্দ নয়।”

মাথা নাড়লাম আমি, কি বললে কি যে বোঝে মেয়েটা। আমি ওকে প্রবোধ দিয়ে বললাম, “না রে বাবা। আচ্ছা দেখো, এই তোমার বয়সের মেয়েরা শপিং করার নামে লাফিয়ে ওঠে। সেদিন একটা হেলমেট কিনতে গেলাম হাতিবাগানে সেখানে তুমি ভয়ে কুঁকড়ে আমার হাত ধরে রইলে। এমন করলে হবে? কোনদিন কোন রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যাওয়া যায় না তোমাকে।”

ভারী কন্ঠে উত্তর এলো, “এত যদি আমাকে নিয়ে অসুবিধে তাহলে আমাকে চুপ চাপ বাড়ি পৌঁছে দাও।”

আমি বাইক থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম তিতলির চোখ জোড়া ছলছল করছে। আমি ওর হাত দুটো ধরে বললাম, “এই পাগলি মেয়ে, আমি কখন বলেছি যে তোমাকে নিয়ে আমার অসুবিধে?” ঝাপসা আঁখি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল তিতলি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা একটা কথা বল। তুমি তো নতুন অথবা অচেনা কারুর সাথে কথা বলতে পারো না। তাহলে সেদিন বাস স্টান্ডে আমার সাথে কেন কথা বলতে গেলে?”

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে মৃদু হেসে উত্তর দিল তিতলি, “তোমার ওই ভারী গলার আওয়াজটা না আমার খুব ভালো লাগে।” বলেই লজ্জাবতী লতার মতন গুটিয়ে আমার পিঠের ওপরে মুখ গুঁজে নিল।

আমিও ওর কথা শুনে আর রেগে থাকতে পারলাম না। সেদিন বুঝে গেলাম একে ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই। তিতলিকে ঠিক করাতে হলে আমাকেই করাতে হবে। সেদিন বাকিটা রাস্তা চুপ করেই বসেছিল।

রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার পরে আমাকে বলল ললনা, “ঘুরতে কোথাও তো নিয়ে যাও না।”

আমি একটু রেগে গিয়েই ওকে বললাম, “কই নিয়ে যাই না? সেদিন বললাম ভিক্টোরিয়া যাবে, ময়দান যাবে? তোমার সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বললাম চল অনির্বাণ আর কাবেরির সাথে কোন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করি। তাও তুমি যাবে না। তুমি যাবে টা কোথায়?”

অভিমানিনীর মুখ ভার হয়ে গেল, “হ্যাঁ, তোমার তো শুধু এর তার সাথে দেখা করাতে চাও। আমি চাইছিলাম শুধু তুমি আর আমি কোথাও যাবো।”

আমি একটু ভেবে ওকে বললাম, “আচ্ছা দেখা যাবে। এই শনিবার তাহলে ক্লাস করব না। সকাল সকাল বেড়িয়ে যাবো কোথাও।”

ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে নেচে উঠল তিতলি। মুখমন্ডলে এক অদ্ভুত ছটা বিচ্ছুরিত হয়ে গেল, যেন খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়ার স্বাদ পেয়েছে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক দূরে যাবো। কোথায় যাবো আদি?”

আমি ওর চেহারা দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম, ওর ঠোঁটের ওই মিষ্টি হাসি দেখে আর থাকতে পারলাম না। আমি ওকে বললাম, “তুমি বাড়িতে বলবে যে তুমি ক্লাসের পরে পারমিতার বাড়ি যাবে, রাতে ফিরবে। ব্যাস তারপরে দেখা যাবে কোথায় যাওয়া যায়।”

মিষ্টি হেসে মাথা দুলিয়ে সায় দিল তিতলি, “ঠিক আছে।”

শনিবার সকাল সকাল বেড়িয়ে গেলাম। কথা ছিল ইন্সটিটিউটে চলে আসবে সেখান থেকে বেড়িয়ে পড়ব। জানুয়ারির শেষের দিক। ঠান্ডা না থাকলেও দিনের বেলা রোদের জন্য বেশ গরম লাগে। তাও ওকে বলেছিলাম যে ফিরতে যদি রাত হয় তার জন্য একটা শাল যেন নিয়ে আসে।

শনিবার আমি সময়ের আগেই, সাড়ে আট’টা নাগাদ ইস্টিটিউট পৌঁছে গেছিলাম। তিতলিকে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাই না। সেদিন আর ইন্সটিটিউটে ঢুকলাম না, বাইক বাইরেই পার্ক করে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষন পরে একটা সাদা রঙের গাড়ি থেকে নেমে এলো তিতলি। পরনে চাপা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ, কাঁধে একটা লাল শাল আর হাতে কলেজের ব্যাগ। মাথার চুল একপাশে আঁচড়ে পেছনের থেকে বাম কাঁধ বেয়ে সামনের দিকে ঢল নেমে এসেছে। বেড়াতে যাবে আবার ব্যাগ কেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখেই চোখের ইশারা করে সরে যেতে বলল। ওর সারা মুখমণ্ডলে প্রানবন্ত খুশির ছোঁয়া, চোখে মুখে উৎসাহের ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে, গাড়ির মধ্যে বসা কাউকে দেখে মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দিল।

গাড়িটা ছেড়ে যেতেই দৌড়ে এসে পাশে এসে দাঁড়িয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, “চল চল তাড়াতাড়ি চল। গাড়িতে বাবা।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতে হেলমেট ধরিয়ে দিতেই বাইকের পেছনে উঠে বসলো। তড়িৎ গতিতে বাইক চালিয়ে দিলাম। বুকের মধ্যে দুরুদুরু, ধরা না পরে যাই ওর বাবার সামনে। পাগলের মতন বাইক ছুটিয়ে পাঁচ মিনিটে মানিকতলা ক্রসিং পৌঁছে গেলাম। সারাটা সময়ে কাঁধ খামচে ধরে ছিল তিতলি। এপিসি রোড ধরলাম। বাইকের গতি ধিমে করে দিলাম। উত্তেজনায় দুইজনেই হাঁপাচ্ছিলাম তখন।

এপিসি রোড ধরতেই আমার কোমর জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে ফেলল, “আর বল না। বাবার আজকে কোলকাতার অফিসে কোন কাজ ছিল। সকালে বলল, চল তোকে ইস্টিটিউটে ছেড়ে দিয়ে আসি। আমি তো প্রমাদ গুনলাম। শেষ মেশ তাই কলেজের ব্যাগ নিয়ে বের হতে হল।”

আমি হেসে ফেললাম, “মুফাসা সত্যি আমাদের পেছন ছাড়বে না মনে হচ্ছে।”

পিঠের ওপরে তিতলির কোমল নধর উষ্ণ দেহ পল্লবের ছোঁয়া আমাকে ক্ষনে ক্ষনে মাতাল করে তুলছে। কোমল পীনোন্নত স্তন যুগল বারেবারে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার পিঠের ওপরে। বাইকের বাম পাশে পা ঝুলিয়ে বসার ফলে, আমার কোমরের নিচে তিতলির পুরুষ্টু নধর জঙ্ঘা চেপে গেছে। হেলমেট পরার ফলে শুধু মাত্র ওর কোমল গালের সাথে আমার গালের স্পর্শ হয়নি। নাকের মধ্যে তিতলির মদির দেহের ঘ্রাণে আমি ততক্ষনে মাতাল। এক প্রকার নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠেছি প্রেয়সীর সাথে প্রথম বার কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি ভেবেই।

আমার কোমর জড়িয়ে কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছি তাহলে?”

আমি সেই অর্থে কিছুই ঠিক করিনি, “আমি তো তেমন কিছুই ঠিক করিনি। দেখা যাক, ডায়মন্ড হারবার রোড ধরব, কোথায় শেষ হয় দেখা যাবে।”

অজানা পথের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছি জানতে পেরেই ভীষণ ভাবেই উত্তেজিত হয়ে উঠল তিতলি, আমাকে প্রানপনে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কানে কানে মধুঢালা কন্ঠে বলল, “জানো আজকে সত্যি হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।”

আমি ওকে বললাম, “চলো তাহলে হারিয়ে যাই।”

শিয়ালদা পার করার পরে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিলাম। ডায়মন্ড হারবার পৌঁছাতে হলে ধিমে গতিতে বাইক চালালে হবে না। আমি চুপ করে থাকলেও কি তিতলি চুপ থাকে নাকি? আর আমি একটা পাগল, যে মেয়ে এত কথা বলে তাকে নিয়ে কিনা আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলাম।

তিতলি একনাগারে কথা বলে চলেছে, “তুমি জানো, গতকাল রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। এই তুমি শুনছো তো?” ইতিবাচকে মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম, না হলে রূপসী প্রেয়সী আবার অভিমান করে বসবে। কলতান কানে ভেসে আসে, “ভাইটা একদম কথা শোনে না। বাবার সাথে গতকাল রাগারাগি করেছে। প্রায়দিন ওর বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা চাই এই নিয়ে হাত খরচের টাকা নিয়ে রাগারাগি হল। শেষ পর্যন্ত আমি আমার জমানো টাকা থেকে ওকে দিলাম। জানো পারমিতার জন্মদিন। পারমিতাকে মনে আছে?” যদিও আমার তেমন ভাবে মনে নেই, কারণ ওর কলেজে আজকাল খুব কম যাওয়া হয়। সন্ধ্যে হয়ে যায় বলে কলেজের পরে তিতলি আমার অফিসেই চলে আসে। তাও ইতিবাচকে মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম, মনে আছে। পিঠের ওপরে একটা ছোট আদরের কিল, “ঘেচু কলা মনে আছে তোমার। কি করে মনে থাকবে? দুইদিন তো দেখছ।” যা বাবা, না বললেও মরলাম, হ্যাঁ বললেও মরলাম। আমার হল ত্রিশঙ্কুর মতন অবস্থা। যাই হোক, রাস্তার দিকেও দেখতে হচ্ছিল সেই সাথে তিতলির কলতান, “মা গতকাল দুপুরে শুক্তো বানিয়েছিল জানো। ভাবলাম একটু নিয়ে আসি। তারপরে ভাবলাম, আমি টিফিনে শুক্তো নিয়ে যাবো সেটা একদম ভালো দেখায় না। এই তুমি জানো আমি না পায়েস রান্না করতে শিখে গেছি। তোমাকে বলেছি কি, সেদিন নলেন গুড় দিয়ে পায়েস বানিয়ে ছিলাম।” উফফ এই কথাটা গত চারদিনে অন্তত কুড়ি বার শুনেছি, তাও শুনতে হচ্ছে।

বেহালা চৌরাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে একটা জলের বোতল কিনে জল খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। জোকা পেরিয়ে যাওয়ার পরে দুইপাশে বাড়ি ঘরের ঘনত্ব কমে আসতে লাগলো। দুইপাশে ধানের ক্ষেত, গাছপালা, কারুর বাড়ির সামনে বড় বাগান, নারকেল গাছের সারি। সূর্য মধ্য গগনের দিকে চলতে শুরু করে দিয়েছে। একটু গরম লাগছে।

হটাত কি মনে হল, আমাকে বলল, “আচ্ছা আমরা কেন ডায়মন্ড হারবার যাচ্ছি?”

আমি অবাক হয়ে গেলাম, “যাহ্‌ বাবা, কোথায় যাবো?”

মাথা নাড়ল তিতলি, “না না, বাইক ঘুরাও আমি ডায়মন্ড হারবার যাবো না।”

আমি অবাক ওর কথা শুনে, “কেন?”

আমার কানে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ তুমি যেন কিছুই জানো না। ডায়মন্ড হারবারে আমাদের কলেজের মেয়ে গুলো ওদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে যায়। ওখানের হোটেলে গিয়ে রাত কাটায় ওরা।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “এই তিতলি, একদিন আমাদের তো রাত কাটাতে হবে নাকি? শুধু কি আর বাইকের পেছনে বসে থাকবে নাকি? একদিন তো আমার সামনে উর্বশি মেনকা হয়ে আসবে।”

ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল প্রেয়সী, “ধ্যাত যতসব নোংরা কথাবার্তা।”

আমি ওকে উত্যক্ত করে তলার জন্য বললাম, “বাহ রে, প্রেম করলে একদিন তো সেক্স হবে। আচ্ছা তুমি বল তোমার কি স্বপ্ন। কেমন চাও তুমি?”

দুম করে পিঠে কিল পড়ল, “ধ্যাত, তুমি চুপ করবে। আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না কিন্তু।” লজ্জাবতী লতার মতন কাঁধের খাঁজে মুখ গুঁজে দিল তিতলি।

আমি জানতাম এইসব কথাবার্তা এইভাবে শুনতে কোনদিন পছন্দ করে না। ওকে বললাম, “এতে লজ্জা পেলে কি করে হবে তিতলি?”

অনেকক্ষণ আমার কাঁধের খাঁজে মাথা গুঁজে থাকার পরে মিষ্টি মদির কন্ঠে বলতে শুরু করল, “ঘর হবে অন্ধকার, কয়েকটা মোমবাতি জ্বলবে ঘরের কোনায়। শুধু আমি আর তুমি বসে থাকব। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবে। আমার গাল তোমার কাঁধের ওপরে, আমার ঘাড়ে, আমার গালে ছোট ছোট চুমু খাবে। তোমার দুষ্টু আঙ্গুল নিয়ে আমি খেলা করব, তোমার ওই হাতের ওপরে হাত দিয়ে নিজেকে তোমার কোলের মধ্যে উজাড় করে দেব...”

বলতে বলতে ভীষণ লজ্জায় আমার সুন্দরী লজ্জাবতী প্রেয়সী কাঁধে মাথা গুঁজে দিল। ওর শ্বাস ফুলে উঠেছে এইটুকু কথা বলতেই। আমার ঘাড় গর্দান তিতলির উষ্ণ শ্বাসের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে। ওর বর্ণনা মানসচক্ষে অঙ্কিত করে আমার দেহের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দিল। বাকি রাস্তা নীরবে দুইজনা পরস্পরের মধুর সানিদ্ধ্যে ঢুবে গেলাম। বাইক ধেয়ে চলেছে, বিষ্ণুপুর, আমতলা, রাজারহাট, শিরাকোল, সরিষা, এক এক করে পার করে চলেছি।

দুপুর নাগাদ ডায়মন্ড হারবার গিয়ে পৌঁছালাম। রাস্তা আরো অনেকদুর চলে গেছে। ধানবেরিয়াতে বাইক থামিয়ে কিছু একটু খেয়ে কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করে নিলাম রাস্তার ব্যাপারে। জানতে পারলাম, এই রাস্তা কাকদ্বীপ হয়ে নামখানা পর্যন্ত চলে গেছে। বাইকে উঠে আবার সেই নিরুদ্দেশের পানে যাত্রা শুরু করে দিলাম। ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত দুইপাশে যাও বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছিল ধিরে ধিরে সেটা কমতে কমতে দুইপাশে শুধু সবুজ মাঠ আর দুর দিগন্তে ছোট ছোট গ্রাম দেখা গেল। হাটুগঞ্জ থেকে রাস্তা বেঁকে গেল। বাইক চলেছে নিরুদ্দেশের পানে। পেরিয়ে গেলাম ঝালবাড়ি, কুলপি, সিতারামপুর ইত্যাদি ছোট ছোট জায়গা।

দুপুরের বেশ পরে আমরা কাকদ্বীপ পৌঁছালাম। রাস্তা আরো এগিয়ে চলেছে, কিন্তু আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। তাই সেখানে থেমে গেলাম। খুব ছোট একটা গ্রামের মতন জায়গা। বঙ্গোপ সাগর এখান থেকে বেশি দূরে নয়। বাইক থামিয়ে নেমে পড়লাম আমরা। গরম লাগছে, সূর্য দেব মাথার ওপরে। যতদূর চোখ যায় ততদুর শুধু গঙ্গার জল। এখানে গঙ্গা নীল নয়, ধুসর রঙের মেটে জল। নদীর অন্যপাশে একটা দ্বিপের মতন। বাড়ি ঘরদোর, কোথাও নৌকা তৈরি হচ্ছে।

তিতলি আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওইদুর পানে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওইপাশে যেতে পারি?”

আমি একজন কে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম যাওয়ার ব্যাপারে। তারপরে বললাম, “হ্যাঁ, নৌকা করে যাওয়া যায়।”

আমার বাজু দুই হাতে শক্ত করে ধরে নেচে উঠল তিতলি, “তাহলে যাবো।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ক্ষিধে পায়নি?”

আশে পাশে দেখলাম, কি কি পাওয়া যায়। রাস্তার দুইপাশে খাওয়ার দোকান আছে বটে কিন্তু তেমন ভালো একটাও নয়। আমি একা থাকলে এইসবের তোয়াক্কা করি না কিন্তু সাথে তিতলি তাই দোটানায় পরে গেলাম।

মাথা দুলিয়ে সায় দিল তিতলি, “খুউউব ক্ষিধে পেয়েছে গো।”

ওর বলার ধরন দেখে হেসে ফেললাম, “মহারানী এখানে কিন্তু কোন ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট নেই।”

তিতলি মিষ্টি হেসে আমাকে বলল, “তুমি যেখানে যা খাওয়াবে তাই খাবো।”

আমি ওর নাকের ডগায় তর্জনী দিয়ে আদর করে বুলিয়ে বললাম, “তুমি না... একদিন সত্যি আমাকে মারবে...”

আমার বলার ধরনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল আমার রূপসী লজ্জাবতী প্রেয়সী।
 
পর্ব তিন (#6-#16)

একটা দোকানে ঢুকে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। দোকানি আমাদের জিজ্ঞেস করল কি খাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি পাওয়া যাবে এই দুপুরে। বললে, ভাত ডাল তরকারি। দেখলাম তিতলির ওই ভাত ডাল তরকারি খাওয়ার ইচ্ছে নেই। দোকানি বলল, পরোটা আছে দেবো? আমি বললাম দাও। দোকানি বলল, কত গ্রাম? তিতলি গাছ থেকে পড়ল, কত গ্রাম মানে? দোকানি বলল, এখানে পরোটা ওজনে বিক্রি হয়। আমি আর তিতলি হেসে ফেললাম। বললাম, আড়াইশো পরোটা দাও। ছোলার ডাল আর পরোটা খেলাম, খাওয়ার পরে তিতলির চেহারায় ভীষণ তৃপ্তির ছটা। কোনদিন বড় রেস্টুরেন্ট ছাড়া কোথাও খাবার খায়নি, সেই কন্যে আজকে আমার সাথে পথের ধারের, তাল পাতার ছাউনি দেওয়া একটা ছোট দোকানে বসে ওজনে করা পরোটা খেল। সেদিন এত ভালো লেগেছিল ওকে, দেখে মনে হচ্ছিল যেন পরোটার সাথে সাথে তিতলিকেও খেয়ে ফেলি। খাওয়া শেষে তালতলা স্টিমার ঘাট থেকে নৌকা করে বিশাল চওড়া গঙ্গা পেরিয়ে পৌঁছালাম কচুবেরিয়া ঘাটে।

নৌকায় চড়ে ওকে বললাম, “কি গো, টাইটেনিক করতে ইচ্ছে করছে নাকি?”

নৌকায় অনেক ভিড়, অনেকে আবার বাইক স্কুটার সাইকেল নিয়েও উঠেছে। নৌকা দুলে দুলে এগোতে লাগলো। তিতলি যে কি না ভিড় ভয় পায়, সেই মেয়ে অনায়াসে ভিড় নৌকায় চড়ে আমার পাশ ঘেঁষে বসে গঙ্গার সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম করে নিচ্ছে। আমি ওর নীরবতাকে খণ্ডন করলাম না। ওর কাঁধে হাত রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে থাকলাম। মনে হল যেন এক নতুন প্রজাপতির জন্ম দেখছি।

কচুবেড়িয়া ঘাটে নেমে একটা দোকানে বাইকে রেখে দিলাম। তারপরে দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধার দিয়ে এগিয়ে গেলাম। গঙ্গার পাড়ে কালো পলি মাটি ভর্তি। কোথাও কোথাও নৌকা তৈরি হচ্ছে। দূরে গঙ্গা বক্ষে বেশ কয়েকটা বিশাল মালবাহী জাহাজ নোঙ্গর করে দাঁড়িয়ে। নদীতে প্রচুর ছোট বড় নৌকা। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদুর চলে গেলাম আমরা। নদীর ধারে ছোট ছোট ভেজা ঘাসের জাজিম পাতা। নরম ঘাসের ওপরে জুতো খুলে দুইজনে মিলে হাতে হাত রেখে হেঁটে গেলাম। দুর দিগন্ত পানে চেয়ে দেখি, যেখানে আকাশ মিশে গেছে গঙ্গার সাথে হয়ত বা সাগরের সাথে। নদীর ধারে বেশ ফাঁকা জায়গা দেখে দুইজনে বসে পড়লাম। চুপ করে আমার বাম কাঁধে মাথা রেখে আমার হাত খানি নিজের কোমল হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বসে রইল তিতলি।

আকাশে এক গাদা বক উড়ে যেতে দেখে আমাকে বলল, “দেখো ওই বক গুলো কত ভাগ্যবান। ওরা যখন খুশি যেখানে খুশি উড়ে চলে যেতে পারে।”

আমি নিজের বাম হাত ছাড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বুকের কাছে টেনে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি খুশি নও?”

তিতলির গলাটা ধরে এলো, আমার কোলের মধ্যে হাত রেখে বলল, “আমি খুব খুশি, কিন্তু তাও কোথাও যেন আমার একটু ভয় করে জানো।” কাজল কালো নয়নে আমার দিকে দেখে বললে, “আদি, বাবার সাথে তোমাকে কথা বলতে হবে আদি।”

আমি ওর কপালে ঠোঁট চেপে ধরে উষ্ণ চুম্বন এঁকে বললাম, “আমার ওপরে বিশ্বাস আছে?” মাথা দুলিয়ে সায় দিল তিতলি, হ্যাঁ আছে। আমি ওকে আসস্থ করে বললাম, “সময় আসুক, তোমার কলেজ শেষ হোক। তোমার বাবার সাথে আমি নিশ্চয় কথা বলব।” একটু থেমে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকিমা কি জানে?”

তিতলির ঠোঁটে মৃদু একটা হাসির রেখা ফুতে উঠল, “হ্যাঁ, মা বুঝে গেছে। ওই পা মচকাবার দিন থেকেই মা বুঝে গেছে। মাকে নিয়ে সমস্যা নয় আদি। তবে কি জানো, আমাদের বাড়িতে মায়ের কথায় কাকিমার কথায় কেউ বিশেষ কান দেয় না। বাবা কাকা আর পিসির কথা চলে বেশি। আদি তুমি বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে তো?”

এই প্রশ্নের উত্তর নিজেও জানি না। চোখের সামনে সিনেমার মতন মনে হল সব। জাঁদরেল বাবা মেয়েকে একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছে, আমি হিরোর মতন ওর বাবার সাথে ঝগড়া করে রাজকন্যেকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি।

মনে মনে হেসে ফেললেও ওকে আসস্থ করে বললাম, “কাকিমা যখন সাথে আছে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তিতলি মৃদু হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাড়ির কি অবস্থা? মাসিমা মেসো মশায় জানেন আমাদের ব্যাপারে?”

প্রশ্নটা ভীষণ কঠিন। বুক ভাঙা একটা হাসি হাসলাম ওর প্রশ্ন শুনে। আমার হাসি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল তিতলি। আমি ওকে বললাম, “আমার মা সব জানে। প্রথম দিন থেকেই মাকে আর দিম্মাকে তোমার কথা সব বলেছি। আর বাবার ব্যাপারে, আমি কি করি না করি সে নিয়ে তার বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই।”

হাজার প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল তিতলি, “তুমি কোনদিন তোমার বাবা মায়ের ব্যাপারে কোন কথা বল না। কেন আদি?”

মায়ের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমার দৃষ্টি একটু ঝাপসা হয়ে গেল। তিতলির চোখে হাজার প্রশ্ন। আমি মৃদু হেসে ওকে বললাম, “আমার মা আমার কাছেই আছে। দেখবে?” বুঝতে পারল না তিতলি। আমি পার্স খুলে মায়ের ছবি দেখিয়ে ওকে বললাম, “আমার মা।” বলতে বলতে আমার গলা ধরে এলো।

আমার চেহারা দুই হাতে আঁজলা করে তুলে ধরল তিতলি। উষ্ণ তালুর পরশে আমার বুকের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বুদ্ধমতি প্রেয়সী আমার ব্যাথা বেদনা অনুধাবন করতে সক্ষম। তিতলি কম্পিত কণ্ঠে আমাকে বলল, “আমি সত্যি জানতাম না আদি।”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তিতলি তখন আমার গালে কোমল উষ্ণ হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি বলতে শুরু করলাম আমার কাহিনী। চুপ করে শুনতে লাগলো এই বুধাদিত্যের ভাঙা বুকের গল্প। দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে ওর। টিয়াপাখির মতন নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে দুঃখে আর চাপা কান্নায়।

সব কিছু বলার পরে আমি ওকে বললাম, “আমি বড় অভাগা, তিতলি। ছোট বেলায় মা চলে গেলেন, বাবা থেকেও নেই।”

আমার মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে রইল তিতলি। তিতলির চোখ জোড়া আমার মতন কান্নায় ভেসে গেছে। তাও তিতলি, ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে আমার মাথা উঠিয়ে কপালে একটা ছোট চুমু খেয়ে বলল, “তুমি অভাগা নও আদি। আমার আদি কখন অভাগা হতেই পারে না।”

সূর্য পশ্চিমে পাটে বসে গেছে। গঙ্গার জলে কমলা রঙ ধরে গেছে। দুর আকাশের মেঘের রঙ বদলে গেছে। ধিরে ধিরে পুব আকাশে আঁধার নেমে আসছে। দুই রিক্ত প্রান পরস্পরকে প্রানপনে নিজের নিজের বাহুপাশে বেঁধে নীরবে বসে। মধু ঢালা সেই দিনের সন্ধিক্ষনে দুই হৃদয় মাঝে নীরব প্রেমের কথোপকথন শুরু করে দেয়।

আমি বেশ কিছুক্ষন পরে নীরবতা ভঙ্গ করে তিতলিকে বললাম, “এই...”

যদিও তিতলি আমার পাশেই বসা তাও, বহুদুর থেকে মৃদু মদির কন্ঠ স্বর ভেসে এলো, “কিইই...”

আমি ওকে বললাম, “এই দেখো, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এবারে বাড়ি ফিরতে হবে।”

নাতি বাচকে মাথা নাড়ল তিতলি, “না, আজকে আমি তোমার সাথেই থাকব। ওই পাড়ে একটা পিসিও থেকে পারমিতাকে ফোন করে দেব।”

আমি চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে, “তুমি পাগল নাকি? যদি তোমার বাবা অথবা মা তোমার সাথে কথা বলতে চায় তখন কি করবে?”

দুই পেলব বাহু দিয়ে নাগপাশের বাঁধনে বেঁধে আমাকে বলল, “আমাকে তোমার সাথে কোথাও নিয়ে চল আদি। আমি শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই।”

ওর কাজল কালো ভাসা ভাসা নয়নের চাহনি দেখে রবি ঠাকুরের কবিতা মনে পরে গেল। দিনের শেষে আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। আমি তিতলির কোমল হাত দুটো ধরে সামনে দাঁড় করিয়ে কাজল কালো টানাটানা আঁখির দিকে এক দৃষ্টে চেয়েছিলাম। ভীষণ মোহময়ী ভাসা ভাসা কাজল টানা নয়ন তিতলির, হারিয়ে যেতে বড্ড ইচ্ছে করে ওই কাজলা দীঘির জলে। ভীষণ মোহময় এই চোখ জোড়া, তীব্র আকর্ষণে বেঁধে রেখেছে আমাকে।

আমার মাথা নেমে এলো তিতলির মুখের ওপরে, “তোমায় ঠিক কবে থেকে ভালোবেসে ফেলেছি, নিজেই জানি না।”

তিতলি এগিয়ে এলো আমার বুকের কাছে। পীনোন্নত নিটোল স্তন যুগল পিষ্ট হয়ে গেল আমার প্রসস্থ ছাতির ওপরে। আমার জামার কলার দুই হাতে খামচে ধরে মাথা উঠিয়ে তাকাল। তিতলির নয়ন জোড়া প্রেমশিক্ত অশ্রুতে টলটল করছে।

তিরতির করে কেঁপে ওঠে লাল শিক্ত ঠোঁট জোড়া, “তুমি শুধু কাঁদাতেই পারো। তোমার জন্য কতদিন ঘুমাতে পারিনি জানো। শুধু মনে হত কেন করলে? কেন আমাকে একা একা ফাঁকা টাক্সিতে উঠিয়ে চলে গেলে।”

তিতলির পান পাতার মতন মুখ খানি দুই হাতে আঁজলা করে নিজের দিকে তুলে ধরলাম। কোমল গালের ওপর আমার উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায়, প্রেয়সীর শ্বাস ঘন হয়ে এলো। মাথা নেমে যায় প্রেয়সীর মাথার ওপরে, নাকের কাছে চলে আসে নাক। আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে প্রতি মুহূর্তে। সেই সাথে রূপসী ললনার হৃদ কম্পন নিজের ছাতির ওপরে অনুভব করতে পারলাম। তিতলির চোখের কোল বেয়ে এক বিন্দু অশ্রু আমাকে ভীষণ ভাবেই কাঁদিয়ে তোলে।

বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তিতলির কোমল গোলাপি গালের অশ্রুধারা মুছিয়ে মিহি কণ্ঠে বললাম, “এই সোনা, কাঁদে না, দেখো আমি তোমার সামনেই আছি। সেই বুধাদিত্য আর নেই, এটা তোমার আদি।” আমি আলতো করে তিতলির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। বুক ভরিয়ে তুললাম ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধে।

আমাকে দুই পেলব বাহু দিয়ে আষ্টেপিষ্টে প্রানপনে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে উজাড় করে দিল আমার বুকের ওপরে। আমার ঠোঁট নেমে এলো তিতলির পদ্মকুড়ির মতন টানা টানা চোখের পাতার ওপরে। তিতলি চোখ বন্ধ করে নিল। আমি আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম প্রেয়সীর চোখের পাতায়। একবার বাম পাশে, তারপরে ডান দিকের চোখের পাতায়। শিক্ত উষ্ণ পরশে কেঁপে ওঠে প্রেয়সীর কমনীয় নধর দেহপল্লব। গঙ্গা বক্ষে দুই তৃষ্ণার্ত কপোতী চোখ বুজে ঠোঁট জোড়া আলতো মেলে ধরে আসন্ন অধর সুধার আশায়।

সারা হৃদয় ছাপিয়ে মিহি কণ্ঠে বলে ওঠে তিতলি, “আদি আমি তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারব না, আদি।”

আমি তিতলির কাঁপা ঠোঁটের ওপর আলতো করে জিব বুলিয়ে মিহি কণ্ঠে বললাম, “এবারে এই হাত ছাড়ব বলে ধরিনি, তিতলি।”

মৃদু কম্পমান ঠোঁটে তিতলি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আলতো করেই তিতলি কুসুম কোমল ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলাম। উপরের ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে আলতো একটা চুমু দিলাম। প্রেয়সীর মুখ ছেড়ে দিয়ে বাম হাতে তিতলির ঘাড় ধরে নিজের ঠোঁটের সাথে ওর ঠোঁট চেপে ধরলাম। অন্য হাত নেমে গেল তিতলির পিঠের ওপর। চোখ বুজে আলতো করে চুষে দিলাম মিষ্টি রসালো শিক্ত অধর। একবার ওপরের ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মধ্যে আলতো চুষে নিচের ঠোঁট চুষে দিলাম। তিতলির পিঠের ওপরে হাতের তালু চেপে ধরে প্রেয়সীর নধর উষ্ণ দেহপল্লব নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে দিলাম। আমার পিঠের ওপরে চলে আসে তিতলির হাত। জামা খামচে শক্ত করে ধরে নিজেকে ঢেলে দেয় আমার প্রেমগভীর চুম্বনে। খোলা মাঠ, গঙ্গার শীতের হিমেল হাওয়া কোন কিছুই বাঁধ মানে না। অনাবিল প্রেমের চুম্বনে হারিয়ে যায় দুটি প্রেম ঘন প্রান। না আমার হৃদয় মাঝে তখন কোন কাম তাড়নায় ছিল না। শুধু মাত্র অনাবিল প্রেমের জোয়ারে ভেসে যেতে উন্মুখ হুয়ে উঠেছিল আমার হৃদয়। আমার বলিষ্ঠ বাহুপাশের আলিঙ্গনে হারিয়ে যেতে উন্মুখ হয়ে ওঠে তিতলির নির্মল প্রশান্ত প্রান। প্রেমের তরল আগুনে একটু একটু করে গলতে শুরু করে প্রেয়সীর নধর আকর্ষণীয় দেহবল্লরী। প্রগাড় ভালোবাসার চুম্বনের আবেশে শ্বাস থেমে যায় তিতলির। আমি প্রেয়সীর শিক্ত মুখগহবরে জিব ঢুকিয়ে আলতো করে তিতলির শিক্ত কোমল জিব নিয়ে খেলা করতে শুরু করে দিলাম।

আমার বাম হাত প্রেয়সীর ঘাড় ছাড়িয়ে উঠে যায় তিতলির মাথার পেছনে। আলতো মুঠোতে মাথার রেশমি চুলের গোছা ধরে তিতলির শিক্ত উষ্ণ মুখের ভেতর জিব দিয়ে খেলতে শুরু করে দিলাম। সারা শরীর বয়ে অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভূতি খেলে বেড়ায়। পূর্ণবয়স্ক কোন যুবতীকে প্রথম প্রেম নিবেদন করলাম। তিতলির প্রথম প্রেমের চুম্বন স্মরণীয় করতে চাই। সময় থেমে যায় আমাদের চারপাশে, এইভাবে যদি সারারাত শুধু চুম্বনে হারিয়ে যেতে পারতাম তাহলে সত্যি কত ভালো হত। হটাত করে ঠোঁট গোল করে তিতলির দুই ঠোঁটের ওপর চেপে মুখের লালা চুষে নিলাম। আমার এই অদ্ভুত পাগলামো প্রক্রিয়ায় প্রেয়সীর নধর আকর্ষণীয় দেহবল্লরি কাল বৈশাখীর ঝড়ে দুলে ওঠা তরুর মতন কেঁপে ওঠে। উষ্ণ এক শ্বাস আলতো করেই তিতলির গলার ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে। গলা কেঁপে ওঠে তিতলির। প্রেয়সীর সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে আমার বাহুপাশের আবর্তে। যেন ওর হৃদয় চেঁচিয়ে কিছু বলতে চায়, ছাতির ওপরে ওর হৃদয়ের কম্পন কথা বলে, চুম্বনেই এত প্রেম, উম্মম্মম্ম, তাহলে তোমার বুকের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলে কি কি খুঁজে পাবে।

অল্পক্ষন না অনেক্ষন, কারুর ঠিক খেয়াল নেই। প্রেয়সীর সুমিষ্ট অধর ছাড়তেই, আমার প্রসস্থ ছাতির ওপরে মাথা গুঁজে নিঃসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তিতলি। দুই বলিষ্ঠ বাহুডোরে আষ্টেপিষ্টে তিতলির কমনীয় দেহলতাকে বেঁধে ফেললাম। ওর রেমশি মাথার ওপরে গাল চেপে গঙ্গার বিশাল পাড়ে, খালি মাঠের মাঝে, খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। আমাদের কারুর মুখে কোন শব্দ নেই, শুধু মাত্র দুটো প্রেমে বিভোর প্রানের হৃদস্পন্দন শোনা যায়, ধুকপুক ধুকপুক। বিনা বাক্যব্যায়েই দুই প্রেম ঘন কপোত কপোতীর হৃদয় মাঝে যে বাক্যালাপ ঘটে যায়, তার একমাত্র সাক্ষী গঙ্গার জল, এই সন্ধ্যের আকাশ, দূরে উড়ে যাওয়া বকের দল, শালিক চড়াই, এই হীমেল হাওয়া। দুরে কোন গাছের থেকে কোন এক নাম না জানা পাখী ডেকে উঠতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। প্রগাড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে থাকা দুটো প্রান, আবার জেগে উঠল। আমার বুকের ওপরে মৃদু কেঁপে উঠল তিতলি। এই হিমেল বাতাস থেকে বাঁচানোর জন্য আমি প্রেমিকার উষ্ণ দেহলতাকে দুই হাতে আরো বেশি করে চেপে ধরে রইলাম নিজের বুকের কাছে।

আমার জামা খামচে ধরে জামার ওপর দিয়েই বুকের বাম দিকে ঠোঁট চেপে ধরে প্রেমঘন কণ্ঠে বলে প্রেয়সী, “তোমায় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”

আমি ললনার ফর্সা থুঁতনি ধরে আলতো নাড়িয়ে বললাম, “এমন দুষ্টুমি করে না সোনা। বাড়ি ফিরতেই হবে, না হলে হিতে বিপরিত হবে।”

হাতে হাত রেখেই ফিরে আসা হল ঘাটে। যে তিতলিকে সকালে এই গঙ্গা বক্ষে নিয়ে এসেছিলাম, সেই তিতলি বদলে গেছে। মুখমন্ডলে প্রশান্তির পরিতৃপ্তির ছটা বিচ্ছুরিত। আমার বাজু দুই হাতে আঁকরে ধরে নৌকায় চাপল। আর ভয় নেই, ওর খুঁজে পেয়েছে নিজের আদি, আর আমি খুঁজে পেয়েছি আমার ভালোবাসার নাম।

পাগলের মতন বাইক ছুটিয়ে দিলাম। দেরি হলেই তিতলির বাড়িতে ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে যেতে পারে। হয়ত ওর খোঁজে যদি ওর বাবা মা পারমিতার বাড়িতে চলে যায় তখন খুব মুশকিলে পরে যাবো। সেদিকে কোন খেয়াল নেই ললনার, দুই হাতে আমাকে আঁকরে ধরে পিঠের ওপরে গাল ঠেকিয়ে সারাটা রাস্তা চুপ করে বসেছিল। কাজিপাড়া পৌঁছালাম তখন বাজে রাত ন’টা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার পিঠের ওপরে মধুর প্রলেপের মতন লেপটে বসেছিল তিতলি। যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।

গলির মুখে বাইক থামিয়ে ডাক দিলাম প্রেয়সীকে, “এই...”

পেলব বাহুর বেড় আলতো করে আমার দেহ থেকে খুলে গেল। কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে জিজ্ঞেস করল, “এত তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে গেল?”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম, “সোনা, চার ঘন্টার মতন টানা বাইক চালিয়েছি।”

মুখ ভার হয়ে গেল রূপসী ললনার। বেদনাটা নিজের জন্য নয় আমার জন্য, “ইসসস বাড়িতে থাকলে তোমার পিঠ কাঁধ একটু টিপে দিতে পারতাম।” বলেই আমার কাঁধ আর বাজু কোমল হাতে টিপতে শুরু করে দিল।

আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “রাস্তায় আছি সোনা...”

যে মেয়ে এতদিন একটা লাজুক মোড়কের আবদ্ধে ছিল সেই প্রজাপতি আজকে ডানা মেলে দিয়েছে। মিষ্টি হেসে বলল আমাকে, “তাতে কি হয়েছে, আমি তো অন্য কারুর বয়ফ্রেন্ডকে করছি না।”

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “পাগল তুমি, সত্যি।”

ধিরে ধিরে নেমে গেল আমার বাইক থেকে। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত পেতে বলল, “দাও...”

আমি কিছু না বুঝেই ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুমু খেতে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আলতো চাঁটি মেরে বললে ললনা, “চাবি দাও।”

প্রশ্ন করলাম, “বাইকের চাবি?”

একটু রাগ একটু হাসি মিশ্রিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি পাগল, বাড়ির চাবি দাও।”

আমি পড়লাম আকাশ থেকে, “কেন?”

কিঞ্চিত আদেশের সুরে বললে ললনা, “আমার বাড়ি তাই চাবি চাইছি।”

হেসে ফেললাম আমি, তিতলির কন্ঠস্বর অনেক বদলে গেছে, সেই কচি তিতলি আর নেই। আমার সামনে দাঁড়িয়ে এক সম্পূর্ণ নারী, সুন্দরী প্রজাপতি ডানা মেলে দিয়েছে। পকেট থেকে বাড়ির চাবি ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। বাইকের বাক্সে একটা অতিরিক্ত চাবি থাকে। ডান হাতের কোমল তর্জনী নিজের ঠোঁটের ওপরে রেখে আলতো চুমু খেয়ে আমার দিকে নাড়িয়ে গলি পর্যন্ত হেঁটে চলে গেল। আমি অবাক দৃষ্টি নিয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উচ্ছল তরঙ্গিণী নয়, শান্ত গঙ্গার মতন চলন ওর। গলির বাঁকে আধো আলো আঁধারে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সেদিন প্রথম বার হাত নাড়িয়ে হারিয়ে গেল গলির মধ্যে। সারা রাত শুধু ওর প্রথম প্রেমের চুম্বন বুকের মধ্যে এঁকে আর ঘুমাতে ইচ্ছে করল না।
 
পর্ব তিন (#7-#17)

সেদিন ক্লাসের শেষে বাড়ি ফেরার সময়ে তিতলি আমাকে বলল যে পরের সপ্তাহে ওর বান্ধবী পারমিতার জন্মদিন সেখানে যেতে চায়। আমি বললাম, যাও ক্ষতি কি? আমাকে ছাড়া রূপসী নড়বে না, বায়না ধরল, এর আগে কোনদিন কারুর জন্মদিনের পার্টিতে যায়নি। প্রথমবার কারুর জন্মদিনের পার্টিতে যেতে চায়, আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে। আমি পড়লাম মহা সমস্যায়, পারমিতার সাথে সেই ভাবে পরিচয়ের অবকাশ হয়নি। ওকে জানাতেই তিতলি বলল, পারমিতা নাকি আমাকেও আমন্ত্রন জানিয়েছে। অগত্যা তাহলে যেতেই হয়।

শনিবার বিকেলে পারমিতার বাড়িতে ওর জন্মদিনের পার্টি। দুপুরে ক্লাসের পরে তিতলিকে বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। জানিয়ে দিল, বিকেল ছটার মধ্যে যেন রাস্তার মোড়ে চলে আসি। যথারীতি রাজ্ঞীর আদেশ অনুযায়ী রথ নিয়ে সারথি পৌঁছে গেল। পরনে টকটকে লাল রঙের বেশ ঘের দেওয়া হাঁটু ছাড়িয়েও লম্বা স্কারট, কোমরে মোটা একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা আর সাদা একটা শার্টের মতন জামা। আমার দেওয়া কানের দুল ওর কানে। জানুয়ারি মাস হলেও তেমন ঠান্ডা নেই, তবে বাইরে বের হলে একটু ঠান্ডা লাগে তাই একটা ছোট লাল রঙের উলের স্টোল গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। ফর্সা গায়ের রঙের সাথে পোশাক দারুন মানিয়ে গেছে। মাথার চুল একপাশে করে আঁচড়ানো। ওর গোলাপি গাল দুটো দেখে আমার হাত দুটো ভীষণ ভাবেই নিশপিশ করছিল। মনে হচ্ছিল দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে টোপা গালের ওপরে একটা চুম্বন এঁকে দেই।

আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে আমার বাজুতে একটা ছোট চাঁটি মেরে অভিমানী কন্ঠে বলল, “এত দেরি করতে আছে? আমার একা একা দাঁড়াতে কেমন যেন লাগছিল জানো।”

আমি আশেপাশের লোকজনকে দেখলাম, সুন্দরী মেয়েদের যেন এরা কোনদিন দেখেনি এমন ভাবে তিতলির দিকে তাকিয়ে। কয়েকজনার দিকে বেশ রোষকষিত ভাবেই তাকাতে তারা চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। সত্যি এইভাবে ওকে এখানে একা দাঁড় করিয়ে রাখা উচিত হয়নি। কি করব, অফিসে যখন যায় তখন রিসেপসানে বসে থাকে তাই এইভাবে ওকে কোথাও দাঁড়াতে হয়না। অফিসের মোটামুটি সবাই জেনে গেছে একজন আসে। আমিও মুচকি হাসি ওদের কথা শুনে।

আমি নিজের কান ধরে ওকে বললাম, “সরি বাবা। তা তুমি এই ভাবে সাজলে তোমাকে দেখে তো সবাই পাগল হয়েই যাবে।”

লাজুক হেসে আমার হাত থেকে হেলমেট নিয়ে পড়তে পড়তে আমাকে বলল, “বেশিক্ষন থাকব না কিন্তু।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

উত্তর দিল, “ন’টার মধ্যে বাড়িতে না ফিরলে বাবা আবার বকাবকি শুরু করে দেবে।”

বুঝলাম অনেক কড়াকড়ি বাড়িতে। আমি হেসে বললাম, “মুফাসাকে কি বললে?”

হেসে ফেলল তিতলি, “একটু বলে কয়ে ম্যানেজ করতে হয়েছে। প্রথমে বলছিল যে ড্রাইভার গাড়ি করে ছেড়ে আসবে, আমি বললাম ট্যাক্সি করে চলে যেতে পারব।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন পার্টি?”

মুচকি হেসে উত্তর দিল, “আমি কি করে জানবো কেমন পার্টি। আমি কোনদিন কোন বন্ধু বান্ধবীর পার্টিতে যাইনি। এই প্রথমবার যাচ্ছি। তাও তুমি না থাকলে যেতাম না। আসলে কি জানো, পারমিতার জন্মদিন গত সপ্তাহে হয়ে গেছে। আজ ওর বাড়িতে বাবা মা নেই, বাড়ি খালি তাই বন্ধুদের নিয়ে পার্টি হবে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “পার্টিতে কি শুধু খাওয়া নাকি পানীয় আছে?”

দুম করে মিষ্টি একটা কিল মারল আমার পিঠে, “তুমি আমার সামনে ড্রিঙ্ক করবে?”

আমি ঘাড় বেঁকিয়ে তিতলির নরম হাতের ওপরে গাল ছুঁইয়ে বললাম, “নেশা তো অনেক আগেই লেগেছে।” মান্না দের একটা গান গেয়ে উঠলাম, “যখন নেশায় আমার রাস্তা টলে, কেউ আমাকে মাতাল বলে, আমি সোজা চলে যাই দেখিয়ে... যখন তুমি আমায় মাতাল বল...”

আমাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে গেয়ে উঠল তিতলি, “মরনদশা, পুরো পাগল আমি...”

জিজ্ঞেস করলাম, “কোন প্রেসেন্ট কিনেছ, নাকি খালি হাতে?”

জিব কেটে বলল, “এ যাহ্‌, সত্যি কিছুই কিনিনি গো। দাঁড়াও দাঁড়াও।”

লেকটাউনে ঢুকে একটা দোকান থেকে একটা সোপিস কেনা হল। সেই সাথে একটা কার্ড আর একটা চকোলেট। কিছুক্ষনের মধ্যেই পারমিতার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। পাইকপাড়া টালাপার্কের কাছে পারমিতাদের বাড়ি। পারমিতার বাড়ি পৌঁছাতে আমাদের একটু দেরি হয়েই গেছিল। দুতলা বাড়ি, নিচের তলায় ভাড়া থাকে। বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখলাম, অনেক ছেলে মেয়ে ভর্তি। সবার পরনে উপযুক্ত পার্টি পোশাক, শুধু মাত্র তিতলির পোশাক লম্বা, বাকি মেয়েদের পোশাক আশাকে বেশ আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। কোন মেয়ের পোশাক হাঁটুর নিচে নয় শুধু মাত্র তিতলির স্কারট ছাড়া। আমার বাজু দুই হাতের মধ্যে চেপে ধরে রইল তিতলি। আমাদের ঢুকতে দেখে পারমিতা একগাল হেসে এগিয়ে এলো।

তিতলির হাত দুটো ধরে বলল, “বাপরে তোর সময় হল।” আমার দিকে দেখে বলল, “নিয়ে আসতে পারলে তাহলে।”

আমি অবাক হয়েই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কেন নিয়ে আসব, ওই আমাকে নিয়ে এলো।”

মুচকি হাসল পারমিতা, “তুমি জানো না। এই প্রথমবার আমাদের কোন বন্ধু বান্ধবীর পার্টিতে এসেছে অনুস্কা।”

পারমিতার দিকে চেয়ে দেখলাম। টকটকে লাল রঙের একটা কাঁধ বিহীন ছোট ককটেল পোশাক পড়েছে। উপরিবক্ষের অনেকাংশ অনাবৃত, সুগোল মোটা জঙ্ঘার মাঝ পর্যন্ত নেমে এসে শেষ হয়ে গেছে সেই পোশাক। চোখের পাতায় রঙ করা, আইল্যাশ লাগানো, ঠোঁটে টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক। সেই তুলনায় আমার সুন্দরী ললনার কোন মেকি সাজ নেই। এমনিতেই ওর চোখের রোম গুলো লম্বাটে, শুধু মাত্র ঠোঁটে স্কারটের সাথে মিলিয়ে লাল রঙের লিপস্টিক ছাড়া অন্য কোন প্রসাধনে সজ্জিত নয়। দুই বান্ধবী দুই মেরুর দুই প্রান্ত মনে হল।

পারমিতার দিকে ওই ভাবে তাকাতে দেখে আমার বাজুতে একটা চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করল, “কি হল?”

নাতি বাচকে মাথা নাড়লাম আমি, “না না কিছু না।”

দাঁত কিরমির করে আমাকে বলল ললনা, “চোখ গেলে দেব কিন্তু।”

আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বুকের কাছে টেনে ধরে বললাম, “উফফ একটু দেখতেও পারি না নাকি? তুমি তো বুকের মধ্যে আছো।”

চোখ পাকিয়ে বললে প্রেয়সী, “চোখ মুখ বুক পেট মাথা সব জায়গায় আমি যেন থাকি।”

হেসে ফেললাম আমি, “হ্যাঁ রে বাবা।”

আমাকে ছেড়ে দিয়ে কোন এক বান্ধবীর সাথে চলে গেল তিতলি। ঘরে বেশ জোরেই গান চলছে। ছেলে মেয়েদের হাতের গ্লাসে রঙ্গিন পানীয়। আমি একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বারান্দায় চলে গেলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে বসার ঘরের সোফার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রূপসী মহারানী কে ঘরে ওর বান্ধবীরা সবাই। আসল জন্মদিন কার সেটাই বোঝা যাচ্ছে না, পারমিতার উপলক্ষে এই পার্টি নাকি তিতলির উপলক্ষে।

কিছু পরে পারমিতা একটা গ্লাস হাতে বারান্দায় এসে আমাকে বলল, “তুমি একি খাচ্ছো?”

আমি ওকে বললাম, “কোল্ড ড্রিঙ্কস।”

হেসে ফেলল পারমিতা, “তুমি কোল্ড ড্রিঙ্কস খাও?”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আর কি আছে?”

উত্তর দিল পারমিতা, “ব্রিজার আর বিয়ার আছে।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “আমি বাচ্চাদের পানীয় গিলি না।”

চোখ বড় বড় করে আমার দিকে দেখে বলল, “মানে?”

আমি ওকে বললাম, “স্কচ হবে?”

জিজ্ঞেস করল পারমিতা, “কি?”

বললাম, “স্কচ হুইস্কি হবে? সিভাস রিগাল?”

পারমিতা হেসে ফেলল আমার কথা শুনে, “না গো। বড় হয়েছি ঠিক তবে অত বড় হইনি। তবে তুমি বললে আমি আনিয়ে দিতে পারি।”

আমি ওকে বললাম, “দুই হাজার টাকা দাম কিন্তু।”

দাম শুনে অবাক হয়ে গেল পারমিতা, “না বাবা অত টাকা আমাদের নেই।”

আমি ওকে বললাম, “ছাড়ো তাহলে। আমি এই কোল্ড ড্রিঙ্কসেই ঠিক আছি।”

পারমিতার হাতে বিয়ারের গ্লাস, সেই গ্লাসে চুমুক দিয়ে বসার ঘরের মধ্যে তিতলির দিকে দেখিয়ে আমাকে বলল, “জানো আজকে সত্যি ওকে দেখে খুব ভালো লাগছে।” আমিও তিতলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মেয়েদের মাঝে মধ্যমণি হয়ে বসে গল্পে মেতে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দেয়। পারমিতা বলতে শুরু করল, “আমাদের ক্লাসে ষাট জন মেয়ে কিন্তু সবার থেকে একদম আলাদা অনুস্কা। শুরুতে কারুর সাথে মিশত না। ওকে দেখে নাক উঁচু মেয়ে বলেই জানতাম তখন। রোজ সকালে গাড়ি করে কলেজে আসে, কলেজ শেষ কারুর জন্য দাঁড়ায় না, সোজা ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরে। খুব কম কথা বলে, এই আমি আর সুস্মিতার সাথেই ওর বন্ধুত্ত।”

আমি মুচকি হেসে ওকে বললাম, “কম কথা বলে? দেখো” বসার ঘরের মধ্যে তিতলির দিকে দেখিয়ে বললাম, “ওই দেখো কত কথা বলে। তুমি জানো বাইকে বসে এত কথা বলে কি বলি।”

মৃদু হাসি দিল পারমিতা, “জানি, তাই তোমাকে বলতে এলাম। গত সেপ্টেম্বরে তোমাদের মধ্যে কি হয়েছিল আমি জানি না। তবে ক্লাসের মধ্যে ভীষণ ভাবেই আনমনা হয়ে যেত। ওর দৃষ্টি সব সময়ে ঝাপসা থাকত। খাতার মধ্যে কি সব উল্টোপাল্টা দাগ কেটে বসে থাকত। দেখে মনে হত যেন ওর জীবনে কিছুই নেই। কতবার জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে। পেটে বোম মেরেও কথা বের করতে পারিনি। তারপরে এই পুজোর পরে একদিন দেখলাম, দিব্বি সব ঠিক হয়ে গেছে। আর আজকে ওর হাসি দেখে মনে হচ্ছে যেন এক নতুন অনুস্কার জন্ম হয়েছে।”

আমি তিতলির দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রইলাম। ওর মুখের হাসি দেখে কেউ বলবে না যে এই মেয়ে কম কথা বলে। কিন্তু ওর মায়ের মুখেও শুনছি আর এই পারমিতার মুখেও শুনলাম। বুঝতে বাকি রইল না, সাতকাহনের প্রথম পাতার লেখাটা, “শুধু তার জন্য, যে আমাকে উড়তে শিখিয়েছে।” সত্যি মেয়েটা পাগল। মনে মনে হেসে ফেললাম আমি।

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পারমিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ওর ডাক নাম জানো কি?” নাতি বাচকে মাথা নাড়ল পারমিতা, না জানে না। আমি ওকে বললাম, “তিতলি, তিতলি মানে প্রজাপতি। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ডানা মেলে উড়বে।”

মৃদু হেসে মাথা দোলায় পারমিতা, “তুমি পাগল।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “ভীষণ ভাবেই।”

আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে একটা টান মেরে আমাকে বলল, “আমার জানো মাঝে মাঝে ওকে ভীষণ হিংসে হয়?”

আমি অবাক ওর কথা শুনে, “কেন?”

পারমিতার চোখে একটু নেশার ঘোর, বিয়ারের সাথে সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান মেরে চোখের তারায় মত্ততা এঁকে নিয়েছে ততক্ষনে। মদির কন্ঠে আমাকে বলল, “জানো কত ছেলে ওর পেছনে পরে। ও নিজেই জানে না। কত ছেলে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত শুধু ওর দেখা পাওয়ার জন্য। কিন্তু ওই যে, সকালে গাড়িতে আসতো আর বিকেলে ট্যাক্সিতে উঠে চলে যেত তাই কারুর সাহস ছিল না ওর সাথে কথা বলার। তারপরে একদিন দেখলাম তুমি এলে, বাইকে তোমার পেছনে উঠে বসলো। আমাদের দিকে একটু হাত নাড়িয়ে চলে গেল। তোমাদের দেখে কি মনে হল জানো। সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে এক রাজপুত্র এসে তার রাজকন্যে নিয়ে চলে গেলো।” আমি ওর কথা শুনে মৃদু হাসি দিলাম। বিয়ারের গ্লাসে শেষ করে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পারমিতা মদির নেশগ্রস্ত কণ্ঠে আবদার করল, “আমার সাথে একটু নাচবে?”

ওর গায়ের মদির গন্ধ আমাকে মাতাল করে দিল। কোমল উষ্ণ পরশে মাতন লাগলো আমার ধমনীতে। পারমিতার চোখের পাতা ইতিমধ্যে ঢুলুঢুলু হয়ে গেছে। কিন্তু বুকের মধ্যে শুধু মাত্র ওই অনন্যা সুন্দরীর ছবি আঁকা।

আমি পারমিতার কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে ওর কপালে একটা ছোট চুমু খেয়ে বললাম, “যাও ভেতরে যাও। দেখো তোমার জন্মদিনে ঘরের মধ্যে সবাই বসে। ওদের সাথে গিয়ে গল্প কর।”

কখন যে তিতলি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল ছিল না। কাঁধে তিতলির নরম হাতের স্পর্শে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তিতলি ভুরু কুঁচকে ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে পারমিতাকে জিজ্ঞেস করল, “কি রে কি হয়ছে?”

পারমিতা আমার বুকের ওপরে হাত রেখে তিতলিকে বলল, “হীরের ওপরে দাগ কাটতে চাইলেও দাগ কাটা সম্ভব নয় যতক্ষণ না অন্য একটা হীরা দিয়ে ওর ওপরে আঁচর কাটা হয়।”

তিতলি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ওর কোমর জড়িয়ে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর চকচকে উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিতলি আমাকে ইশারায় নাচতে অনুরোধ করল।

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “আমি নাচতে জানি না সোনা।”

আমার মুখে “সোনা” ডাক শুনে তিতলি আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, পেলব বাহু জোড়া আমার গলায় উঠে এলো। আমি ওর পাতলা কোমর নিজের বাহুবেষ্টনির আবর্তে বেঁধে নিলাম। টেনে ধরলাম তিতলির কমনীয় তীব্র আকর্ষণীয় দেহপল্লব। জামা ফুঁড়ে তিতলির পীনোন্নত স্তন যুগল আমার প্রসস্থ বুকের সাথে মিশে গেল। কালো চোখের তারায় নিজের ছবি দেখতে পেলাম আমি। আমি ওর পিঠের ওপরে বাঁ হাত দিয়ে তিতলির নধর লোভনীয় দেহবল্লরিকে আরো বেশি নিজের আলিঙ্গন পাশে বেঁধে নিলাম। গোলাপি ঠোঁট জোড়া অল্প মেলে ধরল আমার মুখের সামনে। পরস্পরের উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ দুইজনার মুখমন্ডলে অবিরত বয়ে চলে। ধিমে গানের তালে তালে ওর দেহপল্লব দুলে উঠছে। আমি তিতলির ধিমে লয়ের দোলার তালে তাল মিলিয়ে একটু নড়ে চড়ে নাচতে চেষ্টা করলাম।

আমার প্রসস্থ ছাতির ওপরে নিটোল কুঁচযুগল পিষে ধরে মদির কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে আদি?”

আমি ওর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নাকের ডগার সাথে নাকের ডগা মিলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “মারতে চাও নাকি আজকে?”

মৃদু মাথা নাড়ালো তিতলি, “না না, একা কেন মরবে, আমিও সাথে যাবো।”

আমি তিতলিকে জড়িয়ে ধরে কোমল রসালো গোলাপি ঠোঁটে একটা গভীর চুমু খেলাম। চুমু খেতেই মনে হল আমি হাওয়াতে ভাসছি। চারপাশে কিছু নেই, আমি আর আমার লজ্জাবতী প্রেয়সী এই জগতে নয় এক অন্য জগতে চলে গেছি। আমার চারপাশে পারমিতার বাড়ি নেই, বারান্দা নেই, কোলাহল, ব্যাস্ততা, দিনরাত কিছুই নেই। আমার চোখের সামনে শুধু আমার লজ্জাবতী লাস্যময়ী প্রেয়সী আর তার প্রেমের আলিঙ্গনে বেঁধে আমি তার প্রেমিক। দুই পেবল বাহু মেলে আমার গলা জড়িয়ে ধরল তিতলি। আমার মাথার পেছনে চুল আঁকড়ে মাথা বেঁকিয়ে ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট চেপে ধরল। আমি তিতলির পাতলা কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলাম। শার্ট, ব্রা ভেদ করে তিতলির কোমল তুলতুলে স্তন জোড়া আমার বুকের ওপরে পিষে গেল। তিতলির সারা পিঠের ওপরে আমি হাত বুলাতে লাগলাম। মিষ্টি গোলাপি রসালো ঠোঁট দুটো যেন কমলালেবুর মিষ্টি কোয়া, ভীষণ নরম ভীষণ শিক্ত। আমার মুখের ভেতরে প্রেয়সীর মিষ্টি লালা ঢুকে গেল। তিতলির জিব আমার ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে আমার জিব নিয়ে খেলা করতে শুরু করে দিল। তিতলির নরম জিবের স্পর্শে আমার শরীরে কামাগ্নি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। আমি প্রেয়সীকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতন ঠোঁট জোড়া চিবাতে লাগলাম আর প্রসস্থ ছাতি দিয়ে তিতলির কোমল নিটোল পীনোন্নত স্তন জোড়া চেপে ধরলাম। রূপসী ললনা আমাকে পাগলের মতন চুমু খেতে লাগলো আর আমার জিব চুষতে লাগলো। দুইজনে ঠোঁটের রসে মুখ চিবুক ভিজে গেল। তীব্র প্রেমঘন চুম্বনে পারমিতার বাড়ির নিস্তব্দ বারান্দা চকাস চকাস শব্দে ভরে উঠল। সেই সাথে তিতলির মিহি “উম্মম...” আওয়াজ। তিতলি আমার জামা একহাতে খিমচে ধরল অন্য হাতে আমার মাথার চুল খিমচে ধরল। আমি তিতলির পিঠের ওপরে এক হাত দিয়ে ছিলাম অন্য হাত তিতলির কোমরে ছিল। দুইজনে চোখ বুজে পরস্পরের ঠোঁটের মধুর মধ্যে ডুব দিলাম। কতক্ষণ এইভাবে চুমু খেতে খেতে হারিয়ে গেছিলাম ঠিক খেয়াল নেই।

আমি অনেকক্ষণ পরে রূপসী প্রেয়সীর নরম মিষ্টি ঠোঁট ছেড়ে বললাম, “আই লাভ ইউ তিতলি...”

কিছু বলল না তিতলি, শুধু মাত্র আমার দিকে কাজল কালো প্রেমাগ্নি ভরা নয়নে তাকিয়ে আমার বুকের ওপরে মাথা গুঁজে পরে থাকল আরো বেশ কিছুক্ষন।


অনেকক্ষণ পরে আমি নিচু কণ্ঠে তিতলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়ি যাবে না?”

বাহুপাশ ক্ষনিকের জন্যেও শিথিল না করেই বুকের ওপরেই মাথা নাড়িয়ে বলল ললনা, “না, এইভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো।”

আমি ওর দেহ থেকে বাহুপাশ আলগা করে নিতেই আরও বেশি করে আমাকে জড়িয়ে ধরল তিতলি। আমি ওর মুখ হাতের পাতায় আঁজলা করে ধরে নিজের দিকে তুলে ধরে বললাম, “রাত হচ্ছে, বাড়িতে চিন্তা করবে।”

ভাসা ভাসা চোখে আমার পানে চেয়ে উত্তর দিল তিতলি, “চলো না কোথাও চলে যাই আদি।”

আমি ওর নাকের ডগায় নাক ঘষে জিজ্ঞেস করলাম, “এমন করে কেন বলছ?”

বড় একটা শ্বাস ছেড়ে আমার বুকের ওপরে আছড়ে পরে বলল, “মাঝে মাঝে ভীষণ ভয় করে আদি।”

আমি ওর মাথা বুকের ওপরে চেপে ধরে বললাম, “সময় আসুক, তোমার বাবার সাথে কথা বলব।”

চুপ করে আরো বেশ কিছুক্ষন ওইভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিল তিতলি। রাতে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল বটে তবে সেটা সামলে নিয়েছিল তিতলি।
 
সত্যি বলতে অসাধারন লেগেছে। অপেক্ষায় থাকবো পরবর্তি পর্বের জন্য। ধন্যবাদ
 
পর্ব তিন (#8-#18)

দিন দিন অফিসে কাজের চাপ বেড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে তিতলিকে বলেই দেই যে আমি কলেজে যেতে পারব না। ওর কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে অফিসেই চলে আসতো তিতলি, কিন্তু কয়েকদিন কাজের চাপের ফলে অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়েছিল। ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিতেও দেরি হয়ে গেছিল। সেই থেকে অফিসে আসাটাও ওর বন্ধ করে দিলাম। আমাদের দেখা শুধু মাত্র ওই মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনিবার, কম্পিউটার ক্লাসে। সারা সপ্তাহে হয়ত শুধু মাত্র তিন চার ঘন্টার জন্য দেখা হত কিন্তু ওই তিন থেকে চার ঘন্টা আমাদের কাছে অনেক ছিল। মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার শুধু মাত্র ওকে বাড়িতে ছাড়তে যাওয়াটাই হত। তবে আমরা শনিবারের জন্য সারাটা সপ্তাহ বসে থাকতাম। বৃহস্পতিবার বাড়ি ফেরার পথে জল্পনা কল্পনা করতাম যে শনিবার কি করব। একদিন বাড়ি ফেরার পথে ওকে বললাম, যে শপিং করতে যাবো। ব্যাস বেঁকে বসলো ললনা। তুমি যাও, যা কেনার তুমি কেনো।

আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, “এই দেখো, যখন তুমি নিজের বাড়ি সাজাবে, তখন তোমাকে পছন্দ করেই জিনিস পত্র কিনতে হবে তাই না?”

চুপচাপ বাইকের পেছনে বসে সায় দিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল, “সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু ওই ভিড়ের মধ্যে...”

আমি ওকে আসস্থ করে বললাম, “তোমাকে ভিড় দেখতে হবে না। তুমি আমার হাত ধরে থাকবে।”

মাথা নাড়ল তিতলি, “না গো ভীষণ ভয় করে।”

আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, “কিসের ভয়?”

তিতলির চোখ জোড়া কিঞ্চিত ব্যাথায় ভরে গেল, “সবাইকে কেমন যেন ভুতের মতন মনে হয়। যেন সবাই আমাকে পিষে দেওয়ার জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে।”

আমি ওকে বললাম, “আচ্ছা মনে আছে, আমরা গঙ্গায় ওই নৌকায় বসেছিলাম।” সায় দিল তিতলি। আমি ওকে বললাম, “নৌকা দুলছিল, চারপাশে কত লোক ছিল, তুমি ভয় পেয়েছিলে?”

মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “তুমি ছিলে তো আমার পাশে।”

আমি ওকে বললাম, “এবারেও তো থাকব। আমি তো পাশ ছেড়ে যাচ্ছি না কোথাও।”

তিতলি একটু ভেবে আমাকে বলল, “তবে এই শ্যামবাজার হাতিবাগান যাবো না কিন্তু।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

উত্তর এলো, “আরে এখানে উইক এন্ডে আমাদের পাড়ার অনেকে চলে আসে শপিং করতে। কারুর সামনে পড় গেলে মুশকিলে পরে যাবো। তার চেয়ে ভালো, গরিয়াহাট অথবা এস্প্লানেড চল।”

যথারীতি প্রেয়সীর আদেশ অনুযায়ী সেই শনিবার ক্লাসের পরে ওকে নিয়ে গরিয়াহাটে গেলাম। কেনার কিছুই ছিল না, আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল ওর ভেতর থেকে ভিড়ের ভয়টাকে কম করার। একটা রাস্তার মধ্যে বাইক রেখে রাস্তায় বেড়িয়ে আসতেই দেখি জন সমুদ্রের ঢল। রাস্তার দুইপাশে ফুটপাথের ওপরে রকমারি দোকান। দোকানের সামনে দোকান। ফুটপাথে মানুষ চলার মতন জায়গা কম, দোকানেই ভর্তি আর সেই সব দোকানে যারা কিনতে এসেছে তাদের ভিড় বেশি। ভয়ে কুঁকড়ে গেল তিতলি, আমার হাত শক্ত করে আঁকরে ধরে বলল, বাড়ি চল। আমি ওর মাথা নিজের দিকে করে নিয়ে বললাম, একটা বিছানার চাদর কিনে চলে যাবো।

তিতলি আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি রঙের কিনবে?”

আমি ওকে মুখ ব্যাজার করে বললাম, “এই সবুজ বা হলদে, যা একটা রঙ পেলেই হল।”

মুচকি হাসি দিল তিতলি, “ইসস, সাদা রঙের বিছানার চাদর কেউ বাড়ির জন্যে কেনে নাকি? ওইগুলো হসপিটালে মানায়।”

আমি অগত্যা ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কি ধরনের পছন্দ?”

মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল, “দেখতে হবে, এইভাবে বলা যায় নাকি? তবে হ্যাঁ, একটা বড় দোকানে ঢোক, ছোট দোকান গুলোতে প্রচন্ড ভিড়।”


এই ভিড়ের সাথেই আলাপ পরিচয় করাতে এনেছিলাম, যাই হোক প্রথমবার তাই বেশি জোরাজুরি করলাম না। একটা বেশ বড় দোকানে ঢুকলাম বিছানার চাদর কিনতে। দোকানটা অন্য দোকানের তুলনায় একটু ফাঁকা ছিল। আমাদের ঢুকতে দেখেই দোকানি বেশ আময়িক হেসে এগিয়ে এলো, জিজ্ঞেস করল কি চাই। বিছানার চাদর বলাতে দোকানি একটার পর একটা বিছানার চাদর দেখাতে শুরু করে দিল। প্রথম দিকে আমার পাশ ঘেঁষে বিছানার চাদর দেখছিল, ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না একটাও। লাল, সাদা, হলদে ইত্যাদি। প্রেয়সীর পছন্দ আর হয় না, প্রশ্নে প্রশ্নে জের বার করে তুলল দোকানিকে, আচ্ছা বাটিক প্রিন্টের কিছু দেখান তো, বান্ধনি আছে কি? এপ্লিকের কাজের কোন চাদর আছে? ওই রাজস্থানি প্রিন্টের আছে? আচ্ছা কাঁথা স্টিচের কোন চাদর দেখান তো? আমি ওর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আমি ওর কানে ফিসফিস করে বললাম, তুমি দেখো আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে আসছি। তিতলি মিষ্টি হেসে বলল, তাড়াতাড়ি এসো। আসলে আমার সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, শুধু দেখতে চাইছিলাম, একা একা দোকানে বসে কি করে। আমি দোকান থেকে বেড়িয়ে এলাম। কাঁচের দরজার ভেতরে চোখ ছিল আমার। রূপসী একের পর এক চাদর বেছে চলেছে আর দাম জিজ্ঞেস করে চলেছে। বুঝে গেলাম, প্রজাপতি পাখনা মেলে দিয়েছে নীল গগনে। বেশ কিছু পরে আমার ডাক এলো। দুটো বেশ সুন্দর বিছানার চাদর পছন্দ করল তিতলি। দাম মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।

বাইকে বসে আমাকে আঁকরে ধরে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি ভাবো, আমি কিছু বুঝি না?”

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, “কি বলতে চাইছ?”

আমার ঘাড়ের ওপরে নাক ঠোঁট ঘষে বললে ললনা, “অত সরল সাজতে হবে না।” বলে দুই হাতে আমার ছাতি আঁকরে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমার ভয় কাটানোর জন্য তুমি আমাকে এখানে এনেছ তাই না? ওই সব বিছানার চাদর টাদর তোমার কোন কিছুর দরকার ছিল না, তাই না।”

ধরা পরে গেছি রূপসীর কাছে, সায় দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললাম, “তাই যদি না বলতাম তাহলে কি আর তুমি আসতে নাকি?”

আমাকে তিতলি বলল, “তুমি জানো এই মানুষের ভয় কাটানোর জন্য কত কাউন্সিলিং করিয়েছে আমাকে? সেই ছোট বেলায় জোর করে নিয়ে যেত আমাকে বাজারে। বড় হওয়ার পরে আর যেতাম না কোনদিন। এতদিন আমার সব জামা কাপড় মা পছন্দ করেই কিনে নিয়ে আসতো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “তোমার ওই ফ্রক, সালোয়ার কামিজ, তুমি কোনটাই পছন্দ করনি?”

মাথা নাড়ল তিতলি, “না, খুব কম। ওই নাগের বাজারে একটা চেনা দোকান আছে সেখানেই যেতাম এতদিন। আমার পুজোর বাজার ওখান থেকেই করা হয়।”

আমি ওকে বললাম, “তাহলে এবারে আমি তোমাকে একটা কিনে দেই?”

মিষ্টি হেসে বলল তিতলি, “ফালতু ফালতু বিছানার চাদরে পাচ’শ টাকা খরচ করলে। পরে একদিন কেনা যাবে।”

আমি ওকে হেসে বললাম, “ফালতু কেন, আজ না হলেও কাল তুমি বাড়ির জন্য বিছানার চাদর কিনতেই। সেটা আগামী কাল না হয়ে আজকে হয়ে গেছে।”

হেসে ফেলল তিতলি। তারপরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার দাদা বউদি আমাদের ব্যাপারে জানে?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না এখন বলা হয়নি দাদা বউদিকে।”

ভাবলাম এবারে হয়ত সময় এসেছে হোঁৎকা আর তোতাপাখিকে জানানোর। নিজের আত্মীয় বলতে মামা মামি আর হোঁৎকা আর তোতাপাখি। একজন পিসি আছেন জানি কিন্তু তার পরিচয় জানি না অথবা আর মনে নেই। বাবা চলে যাওয়ার পরে তিনিও আমার খোঁজ নেননি আমিও সেই পরিচয় হারিয়ে ফেলেছি।

তিতলি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবাকে জানাবে না?”

নাতি বাচকে মাথা নাড়লাম আমি, “মামা মামীর কাছেই বড় হয়েছি। তারা জানলেই হল। মিস্টার ঘোষকে জানিয়ে কোন লাভ নেই।”

কথাটা ঠিক পছন্দ হল না তিতলির, প্রশ্ন করল, “তুমি বাবাকে বাবা বলে ডাকো না?”

আমি মাথা নাড়লাম, “দেখো তিতলি, সেই পরিচয় পর্ব আমার মায়ের সাথে মায়ের চিতায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।”

তিতলি কিছু একটা বলতে চাইল, “তাও...”

ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলাম ওকে, “মিস্টার ঘোষকে নিয়ে তোমার কিসের দরকার? আমার মামা মামি আছেন, দাদা বৌদি আছেন। ব্যাস। এর বেশি আত্মীয় সজ্জন আমার নেই।”

তিতলি এই বিষয়ে আর বেশি কথা বাড়াল না। আমার গলা শুনে হয়ত বুঝে গিয়েছিল যে বাবার সম্বন্ধে কথা বলাতে আমি ক্ষুদ্ধ হয়ে গেছি। মেজাজটা শেষের দিকে আর ভালো ছিল না। দুইজনে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলাম। তবে সেদিন আমার পক্ষে একটা মস্ত বড় উপলব্ধি, তিতলিকে নিয়ে ভিড় ভর্তি বাজারে গিয়ে বাজার করতে পেরেছি। একা একা দোকানে বসে বিছানার চাদর কিনেছে।

বাইক থেকে নেমে আমার পাশে বেশ কিছুক্ষন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি না ভীষণ শয়তান। আজকে আরো অনেক কিছুই গোলমাল করে দিলে।”

আমি মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বললাম, “প্রজাপতি উড়তে শিখছে, এর থেকে বড় পাওনা আর কি আছে আমার বল।”

মিষ্টি হেসে চলে গেল তিতলি। আমি সেই রাতেই দুর্গাপুর ফোন করলাম।

হোঁৎকা ফোন তুলে প্রতিবারের মতন দাদা সুলভ কন্ঠে প্রশ্ন করে, “কাজ কর্ম অফিস ভালো চলছে তো?”

সায় দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ। তুই তোতাপাখিকে ফোন দে।”

হেসে ফেলল হোঁৎকা, “কেন রে, নতুন কাউকে পছন্দ হয়েছে নাকি?”

নাতি বাচকে মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম, “না রে সেই পুরানো প্রেম।”

হোঁৎকা অবাক সুরে বলল, “বলিস কি? তারপরে?”

আমি ওকে বললাম, “তুই তোতাপাখিকে ফোন দে আগে।”

তোতাপাখি ফোন ধরেই প্রান খোলা হাসি হেসে বলল, “আমি আগেই বলেছিলাম গেছো। তোমার চোখ জোড়া যেভাবে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সেই দেখেই আমি বুঝে গেছিলাম যে তুমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। কবে দেখা করাচ্ছ? কবে প্রস্তাব দিলে? কোথাও নিয়ে গেছিলে? ওহ আচ্ছা তিতলি তো একটু ক্লস্ট্রোফোবিক। যাই হোক গেছো তুমি ওর ভয় ডর ঠিক করিয়ে দেবে আমি জানি। কিছু উপহার কিনেছ ওর জন্য?”

এক নিঃশ্বাসে এত কথা শুধু মাত্র তোতাপাখির দ্বারাই সম্ভব। আমি উত্তরে বললাম, “তোমরা ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই তাই তোমাকে না বলে কি করে থাকি?”

চুপ করার পাত্রী নয় তোতাপাখি, “আচ্ছা বেশ এই শুক্রবার তোমার দাদাকে বলব। আমরা আসছি কোলকাতা। শনিবার তাহলে তোমার ক্লাসের পরে কোথাও লাঞ্চে যাওয়া যাবে।”

আমিও বললাম, “হ্যাঁ ভালো হয়। মানে মামা মামিকে বলার আগে একবার তোমাদের সাথে পরিচয় হলে ভালো হয়।”

তোতাপাখি মুচকি হেসে বলল, “বেশ ভালো জুটি মিলেছে তোমাদের। তিতলিও আগে কথা বলতে জানত না আর গেছো আগে কথা বলতে জানত না। এবারে দুইজনে মিলে কত কথা বলে দেখব।”

সত্যি বলতে এই কথাটা কোনদিন মাথায় আসেনি আমার। আমি হেসে ফেললাম, “তিতলিও কিন্তু বেশ কথা বলে। তোমার সাথে জমবে ভালো।”

পরিকল্পনা মতন সেই শুক্রবার হোঁৎকা আর তোতাপাখি কোলকাতা পৌঁছে গিয়েছিল। আমি তিতলিকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে শনিবার ক্লাসের পরে দাদা বৌদির সাথে দেখা করাব। তিতলি ভীষণ উত্তেজিত, আচ্ছা তোমার বৌদি কেমন? তোমার দাদা কেমন? রাগি না তো? আমি হেসে ওকে বললাম, না না আমার দাদা বৌদি একদম মাটির মানুষ। বৌদি ভীষণ মিষ্টি, তোমার মতন খুব গল্প করতে ভালোবাসে।

শনিবার ক্লাসে তিতলিকে দেখে সবাই অবাক। সবুজ পাড়ের চওড়া আঁচলের ঘিয়ে রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছে, সাথে সবুজ রঙের ব্লাউজ। বাম কাঁধে আঁচল আর ডান কাঁধে একটা নীল রঙের শাল। প্রত্যেকবারের মতন মুখমন্ডলে বিশেষ কোন প্রসাধনীর প্রলেপ নেই শুধু মাত্র কপালে একটা ছোট টিপ আর ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক ছাড়া। ক্লাসের সবাই অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে আর আমার বুক আমার সুন্দরীর সাজ দেখে গর্বে ফুলে ওঠে। শাড়ি পরে আসতে আমি বলিনি কিন্তু তিতলির নির্মল নিষ্পাপ চরিত্রের সাথে এই শাড়ির রঙ ভীষণ ভাবেই মিশে গেছে। অনির্বাণ হাঁ করে তিতলির দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার রে? এযে মারাত্মক সাজ, সাক্ষাৎ দেবী লক্ষ্মী। আমি মৃদু হেসে বললাম, আজকে দাদা বৌদির সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবো তাই। সারাটা ক্লাস মুচকি মুচকি হেসে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছিল তিতলি।

ক্লাসের বাইরে বেড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে তো?”

আমি কি বলে ওর রূপের প্রশংসা করব ভেবেই পেলাম না, “দারুন দেখাচ্ছে, একেবারে পুরো বৌমা হয়ে গেছ।”

বুকের উপরে আলতো চাঁটি মেরে বলল, “যাহ্‌, তোমার না সবেতেই বাড়াবাড়ি। আচ্ছা তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”

আমি ওকে বললাম, “দাদা বৌদি কিছুক্ষনের মধ্যে এখানেই এসে যাবে তারপরে ঠিক করব কোথায় যাওয়া হবে।”

কিছুক্ষনের মধ্যে হোঁৎকা আর তোতাপাখি, আমাদের ইন্সটিটিউটে পৌঁছে গেল। তোতাপাখিকে দেখতে এমনিতেই ভীষণ সুন্দরী, তার ওপরে গোলাপি রঙের শাড়িতে আরো সুন্দরী দেখাচ্ছিল। তিতলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই প্রবালদার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম ঠুকে দিল। তোতাপাখিকেও প্রনাম করতে যাচ্ছিল তিতলি।

তোতাপাখি হাঁ হাঁ করে উঠলো, “এই না না, তুমি করছ কি?” তিতলিকে জড়িয়ে ধরে থুঁতনি নাড়িয়ে আদর করে বলে, “বাহ বাঃ আমার গেছোর পছন্দ আছে।”

লজ্জায় মাথা নিচু করে আমার বাজু শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তিতলি। আমার সাথে এই প্রথমবার কোন অচেনা মানুষের সাথে দেখা করতে গেছে। ঠিক হল এস্প্লানেডের নিজামে যাওয়া হবে। তোতাপাখি তিতলিকে ছাড়বে না, তিতলি আমায় ছাড়া যাবে না। তিতলি একটু দোনামনা করতেই, ততাপখি ওকে বলল, এখন থেকেই পকেটে পুরে রেখেছ? এরপর আঁচল ছাড়বে তো? তিতলি আরো লজ্জা পেয়ে গেল তোতাপাখির কথা শুনে। হোঁৎকা, তোতাপাখি আর তিতলি একটা ট্যাক্সি করে যাত্রা শুরু করল, আমি ওদের ট্যাক্সির পেছনে বাইক নিয়ে যাত্রা শুরু করে দিলাম।

আমি ওদের আগেই নিজামে পৌঁছে গেছিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওদের ট্যাক্সি পৌঁছে গেল। ট্যাক্সি থেকে দুই সুন্দরী নেমে এলো। দেখলাম, তোতাপাখি আর তিতলি বেশ মিশে গেছে। আমার দিকে এমন ভাব নিয়ে তাকাল তিতলি যেন আমাকে চেনেই না। দুই সুন্দরী হেসে হেসে গল্প করতে করতে রেস্টুরেন্টের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি আর হোঁৎকা ওদের পেছন পেছন ঢুকে একটা টেবিলে বসে পড়লাম। অনেক পুরানো রেস্তোরাঁ, তেমন আহামরি বাহারের চেয়ার টেবিল নয়। কিন্তু এদের কাবাব কাঠি রোল আর বিরিয়ানি বিখ্যাত। টেবিলের একদিকে আমি আর তিতলি পাশাপাশি বসে অন্যপাশে হোঁৎকা আর তোতাপাখি। সামনে দাদা, তাই সন্মান বজায় রেখে আমার গা ঘেঁষে বসেনি তিতলি। টেবিলের তোলা দিয়ে ডান হাত দিয়ে আমার বা হাতটা চেপে ধরেছিল। হাতটা ধরেই বুঝতে পেরেছিলাম তিতলি ভীষণ উত্তেজিত, হাতের রোমকূপ কাটা দিয়ে উঠেছে। আমি ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে।

কানে ফিসফিস করে বলল, “কেমন একটা লাগছে জানো। ঠিক বুঝাতে পারছি না।”

কাঠি কাবার রোল খেতে খেতে তোতাপাখি আমাদের দিকে দেখে বলল, “তুমি বলছিলে ওর নাকি ক্লোস্ট্রোফোবিয়া আছে?” লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল তিতলির। তোতাপাখি মুচকি হেসে তিতলিকে বলল, “ও সব বাজে কথা। কে বলেছে তোমাকে?”

মুচকি হেসে উত্তর দিল তিতলি, “সত্যি বলছি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল। এই তোমরা দেওরের পাল্লায় পরে পালিয়ে গেছে।”

দুই সুন্দরীর গল্পের মাঝে আমি আর হোঁৎকা চুপ। একজন তার স্কুলের গল্প করে চলেছে, বাচ্চাদের স্কুল, কোন টিচার কি করে ইত্যাদি, অন্যজনে নিজের কলেজের গল্প শুরু করেছে। এর মাঝে হোঁৎকা আমাকে একবার মনে করিয়ে দিল ডিভিসেতে এপ্লাই করার ব্যাপারে। দুর্গাপুর যাবো শুনে তিতলি আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হোঁৎকা ওকে বুঝিয়ে বলল, যে কম্পিউটার শেষ হওয়ার পরে ওদের বাড়িতে কথা বলতে যাবে মামা মামি। কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়ে এলো তিতলির চোখের কোনায়। তবে বুদ্ধিমতী ললনা সঙ্গে সঙ্গে মৃদু মিষ্টি হাসিতে সেই মেগেহ্র ছায়া ঢেকে দিল। কেউ না বুঝতে পারলেও আমি ওর ভীতি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। টেবিলের নিচ দিয়ে ওর হাত চেপে ওকে আসস্থ করেছিলাম। তোতাপাখি একটা সোনার চেন ওকে উপহার দিয়েছিল। তিতলি কিছুতেই সেটা নেবে না, এই হার ওর বাড়িতে যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে খুব মুশকিলে পরে যাবে। বেশ অনেকক্ষণ গল্প গুজব করে, বাড়ি ফেরা হল।

ফেরার পথে তিতলি আমাকে তোতাপাখির দেওয়া হার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আদি তুমি বুঝতে পারছ না। মা অথবা বাবা এই হার দেখলে অনেক প্রশ্ন করবে। তখন ভীষণ কেলেঙ্কারি অবস্থা হয়ে যাবে।”

আমি ওকে আসস্থ করে বললাম, “আচ্ছা, এটা এখন আমার কাছে থাক। পরে যখন সময় হবে নিয়ে নিও।”

আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার বৌদি ভীষণ সুন্দরী গো। সারাদিন ওর কাছে বসে থাকলেও এক ঘেয়েমি লাগবে না।”

আমি হেসে ফেললাম, “তাই তো আমি ওর নাম দিয়েছি তোতাপাখি।”

হেসে ফেলল তিতলি। সেদিন রাতে তিতলিকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে, মামাবাড়ি ফিরে গেছিলাম। হোঁৎকাকে এখুনি মামা মামিকে সব কিছু বলতে বারণ করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যে আগে তিতলির কলেজ শেষ হোক, আমি ওর বাবার সাথে আগে কথা বলব, তারপরে মামা মামিকে নিয়ে না হয় ওদের বাড়ি যাওয়া যাবে। তোতাপাখি তিতলিকে পেয়ে খুব খুশি, গল্প করার একটা সাথী পেয়ে গেছে। তোতাপাখি অবশ্য তারপর থেকে প্রায় ফোনে তিতলির খবর নেয়। সারা সপ্তাহে আমার সাথেই খুব কম দেখা হয় তাও খবর দিতে হয়, ভালো আছে।

============ পর্ব তিন সমাপ্ত ============
 

Users who are viewing this thread

Back
Top