What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

সুপ্তির সন্ধানে (2 Viewers)

Nagar Baul

Board Senior Member
Elite Leader
Joined
Mar 2, 2018
Threads
1,152
Messages
13,339
Credits
547,441
Pen edit
Sailboat
Profile Music
সুপ্তির সন্ধানে - by pinuram

HHu3Nkd.jpg


গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, সম্পূর্ণ ভাবেই লেখকের চিন্তাধারা এবং মস্তিস্ক প্রভুত। গল্পের চরিত্র নামকরন, চরিত্র চিত্রায়ন, ঘটনাবলি ইত্যাদি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যাক্তির সাথে কোন মিল নেই। কেউ যদি কোন নাম, চরিত্র, ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পান সেটা নিতান্তই কাকতালীয়। এটা শুধু মাত্র একটা প্রেমের গল্প নয় এটা একটা ভালোবাসার গল্প, ভালো তে বাস করার গল্প। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য গল্প তাই বলে রগরগে যৌনতা একদম নেই এই গল্পে!

পর্ব এক (#1-#1)

মন দিলে আর মন নিলে,
আমি তো তোমার চিরদিনের হাসি কান্নার সাথী।
দু চোখে আমার অশ্রু তোমার, আমার যত সুখ সবই তো তোমার।
জীবনে তোমার হাসি টুকু রেখে, কান্না যা কিছু ছিল সবই তো নিলাম।
সেদিন থেকে, যেদিন তুমি, মন দিলে আর মন নিলে।।

মাথাটা একটু ব্যাথা ব্যথা করছিল বিকেল থেকে। ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ টেবিলের ওপরে মাথা নিচু করে ছিলাম। বৃষ্টি হলেই আমার মন ভীষণ বিষাদে ভরে যায়। আমার বন্ধু অনির্বাণের ডাকে শেষ পর্যন্ত টেবিল থেকে মাথা উঠিয়ে ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম। আকাশ গুড়গুড় চড়চড় করছে। যেকোন সময়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে। আর দেখতে দেখতে নেমেও গেল। আমি আর অনির্বাণ দৌড় লাগালাম বাস স্টান্ডের দিকে। বাস স্টান্ডে বেশ ভিড়। দৌড়ে গেলেও বৃষ্টিতে দুই জনেই একটু ভিজে গেলাম। শেডের তলায় লোকজন ভর্তি। সবাই বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ঢুকে পড়েছে ছোট বাস স্টান্ডের শেডের নিচে। রাত বেশ হয়ে গেছে। আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে নই, এই অনির্বাণের জন্য রোজদিন আমাকে দাঁড়াতে হয়। ও বাসে না ওঠা পর্যন্ত আমার মাথা খায়। বাস স্টান্ডের পাশেই আমার বাইক পার্ক করে রাখা। অনির্বাণ বাসে ওঠার পরেই আমি বাইকে করে বাড়ি ফিরি। যদিও আমার বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া নেই। কেউ আমার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করে বসে থাকে না। বাঙ্গুর এভিনিউ পোস্ট অফিসের পেছনে একটা ফ্লাট বাড়ির দোতলায় একা একটা বেশ বড় ফ্লাটে থাকি। বিগত পঁচিশ বসন্তে অনেক কিছুই দেখলাম এই পৃথিবীতে।

অনির্বাণ দুটো সিগারেট ধরিয়ে একটা আমার হাতে দিয়ে বলে, “কি রে অফিসে কিছু হয়েছে নাকি?”

সিগারেটে একটা টান মেরে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ শালা ওই হারামি এইচ আর। একটা সি এল নিয়েছিলাম তাই নিয়ে শালা, পয়সা কাটবে বলছে। বলছে এই মাসের ছুটি সব নাকি আগেই নিয়ে নিয়েছি।”

বছর তিনেক আগে, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজ থেকে ফিসিক্সে স্নাতক হয়ে পার্ক স্ট্রিটে একটা মোটামুটি কন্সট্রাক্সান কোম্পানিতে চাকরি করি। যা মাইনে পাই তাতে আমার বেশ চলে যায়। চাকরি বদল করব তাই কাঁকুড়গাছির একটা কম্পিউটার ইন্সটিটিউট থেকে কম্পিউটার শিখি। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস, সোম বুধ শুক্র, সন্ধ্যে সাতটা থেকে আটটা। অফিসের পরেই আমাদের ব্যাচ। অনির্বাণের বাড়ি এক নম্বর গেট। আমার মতন বয়স, বাবার কাপড়ের দোকান সেখানেই বসে। এখন বিয়ে করেননি। কপাল আমার মতন ফুটো, প্রেম করার জন্য এখন কোন মেয়ে জোটেনি। বাস গুলো আসছে, ভীষণ ভিড়। ধিরে ধিরে অনেকে বাসে চেপে যাওয়ার পরে বাস স্টান্ড বেশ খালি হয়ে যায়। একটা কুকুর এক কোনায় কুঁকড়ে কন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে। সিগারেট প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে।

আমি অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে বাঁড়া, বাড়ি যাবি না নাকি?”

অনির্বাণ আমার দিকে চোখ টিপে বলে, “দাঁড়া বাল, যাবো বাড়ি।” ভুরু নাচিয়ে কোন একদিকে ইশারা করে গলা নিচু করে বলে, “মাল দেখছি।”

ওর দৃষ্টি অনুসরন করে তাকালাম। অদুরে দাঁড়িয়ে এক ভীষণ সুন্দরী, উদ্ভিন্ন যৌবনা তন্বী রূপসী ললনা। পরনে ঘিয়ে রঙের চাপা সালোয়ার কামিজ, বুকের ওপরে ওড়না মেলে ধরা। বৃষ্টির ছাঁটে নিজেকে বিশেষ বাঁচাতে পারেনি। আমাদের এই কম্পিউটার ব্যাচের সব থেকে সুন্দরী মেয়ে, অনুস্কা ব্যানারজি। দেখা হয় ক্লাসে তবে বিশেষ কথা হয়নি কোনদিন ওর সাথে। জানি না কোথায় থাকে, জানি না কি পড়ে, শুধু জানি নামটা। ব্যাচে আরো মেয়ে আছে কিন্তু রূপসী অনুস্কা অনন্যা। অন্যদের থেকে ভীষণ আলাদা। বিশেষ কথা বলে না কারুর সাথে। ওর পেছনে সবাই ওকে ভীষণ নাক উঁচু বলে। তাই আমিও কোনদিন আগ বাড়িয়ে কথা বলিনি ওর সাথে। যখনি ক্লাসে আসে, রোজ দিন ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরে আসে আর প্রত্যেকটাই বেশ দামী বলেই মনে হয়। কোনদিন সালোয়ার কামিজ, কোনদিন স্কারট ব্লাউজ, কোনদিন ফ্রক। ফ্রক আর স্কারট কোনদিন ওর হাঁটুর ওপরে থাকত না। এক নয় হাঁটু পর্যন্ত না হলে তার নিচে পর্যন্ত লম্বা হত ওর স্কারট আর ফ্রক গুলো। অনুস্কা বসত একদম সামনের চেয়ারে আর আমি আর অনির্বাণ বেশির ভাগ সময়ে পেছনের দিকেই বসতাম। ওইভাবে অনুস্কাকে “মাল” বলে সম্বোধন করাতে আমার একটু রাগ হল। আশেপাশের লোকজন যেন চোখ দিয়েই অনুস্কাকে খুবলে খাওয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে, দেখেও বেশ রাগ হল। অস্বস্তি ভাব আয়ত্তে রাখার জন্য সিগারেটে বেশ কয়েকটা বড় বড় টান দিলাম।

সুন্দরীদের থেকে একটু নিজেকে বাঁচিয়েই চলি বরাবর। দেখতে শুনতে বিশেষ ভালো নই, গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণ, নাকটা আমার একটু ভোঁতা বললেও খারাপ ভাবি না। চোখে চশমা। গালে তিন দিনের না কাটা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভর্তি। মাথার চুল উস্কস্খুস্ক। নাকের নিচে অসমান গোঁফ। তবে আমি বেশ লম্বা চওড়া।

আমার সাথে চোখা চুখি হতেই কয়েক পা আমাদের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গিয়ে ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসি দিল। চোখ মুখ দেখে বোঝা যায় যে ওর ওইভাবে একা একা দাঁড়াতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। ওর আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেখেই অনির্বাণ হাহা করে উঠল আমার কাঁধ চেপে।

আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “যা শালা তুই বাড়ি যা।”

আমার কানে কানে বলল, “কেন বাল, তুই একা একা এখানে ঝারি মারবি নাকি?”

বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “না রে, এবারে বাড়ি যাবো।”

অনির্বাণের বাস চলে আসাতে ও বাসে উঠে গেল। আমিও আমার বাইকে উঠতে যাবো তখন দেখি অনুস্কা আমার দিকেই এগিয়ে এসেছে। আমার ব্যাগ থেকে একটা শুকনো কাপড় বার করে বাইকের সিট মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কি ব্যাপার। তাকিয়ে দেখলাম, লজ্জা ঢাকতে বুকের কাছে ব্যাগ চেপে ধরেছে। অনুস্কার অবস্থা দেখে বেশ খারাপ লাগলেও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাইনি, কার মনে কি আছে, কে কি ভাবে নেবে ভেবেই চুপ করে ছিলাম। দেখা রোজদিন হলেও সেদিন ওর রূপ প্রথম লক্ষ্য করলাম। পিঠের দিকটা অনেকটাই ভিজে গেছে। চাপা কামিজ ভিজে ত্বকের সাথে লেপটে গেছে। আদিম কাঁচের বালির ঘড়ির মতন দেহবল্লরির আকার। তীব্র আকর্ষণীয় নধর দেহপল্লবের গিরিখাদ ভাঁজ সুউচ্চ শৃঙ্গ উপত্যকা অতি সুন্দর ভাবেই পরিস্ফুটিত আমার চোখের সামনে। মাথার বাম দিক ভিজে গেছে। ঘন কালো লম্বা চুলের অনেকটাই ভিজে গেছে। পিঠের ওপরে বেনুনিটা যেন কালো ময়াল সাপের মতন। ভুরু জোড়া চাবুক, পদ্ম কুড়ির মতন নয়ন জোড়া, চোখের পাতা গুলো বেশ বড় বড়। কয়েক গোছা ভেজা চুল ওর বাম গালের ওপরে লেপটে গিয়ে ওর নরম গোলাপি গালের ওপরে আদর করছে। নাকের ডগায় এক ফোঁটা বৃষ্টির জল। আধ আলো আঁধারে হীরের টুকরোর মতন জ্বলজ্বল করছে। ফর্সা মরালী গর্দানে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। গলায় পাতলা একটা সোনার হার জ্বলজ্বল করছে। ফর্সা ত্বকের সাথে বেশ মিলিয়েছে সোনার হার। কাজল কালো চোখের ভাষায় একটা কাতর অনুরোধ।

আমি বাইকে উঠতে যাবো। আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে আমাকে বলল, “প্লিজ, একটু দাঁড়িয়ে যাবে?”

গলাটা শুনে মনে হল প্রভাতী বাঁশির সুর। বাইকে উঠতে গিয়েও থেমে গেলাম। ছোট উত্তর দিলাম, “আচ্ছা ঠিক আছে।” সেই প্রথমবার সামনা সামনি কথা।

কয়েকটা লোক দেখলাম আমাদের দিকে, বিশেষ করে অনুস্কার দিকে জঘন্য লিপ্সা মাখা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে। মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে গেল ওদের চোখের নজর দেখে। লোকটার চোখের ওপরে কটমট করে চোখ রাখতেই লোকটা অন্যদিকে নজর সরিয়ে নিল। হয়ত সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল অনুস্কা, তাই অল্প মাথা নুইয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানালো। বুঝতে পারলাম, বৃষ্টির রাতে একা একা এত সুন্দরী মেয়ে ফাঁকা বাস স্টান্ডে নিশ্চয় নিজেকে ভীষণ অসহায় ভাবছে। কি আছে, না হয় আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করা যাবে। আমার অদুরেই দাঁড়িয়ে হোক অনুস্কার একাকীত্ব কাটবে অন্তত। দ্বিতীয় সিগারেট বার করতে যাবো, দেখি অনুস্কা নাকে হাত দিল। টিয়া পাখির মতন টিকালো নাক। নাকে হাত দেওয়ার সময়ে লক্ষ্য করলাম, ডান দিকে ঠোঁটের ওপরে একটা ছোট তিল আছে ওর। ওর নাক ছোঁয়া দেখে হেসে ফেললাম আমি। সিগারেট আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।

অনুস্কা মিহি গলায় আমাকে বলল, “এই তো একটা খেলে এখুনি আবার?”

মাথা নাড়ালাম, “না এই দেখো আর নেই।” বলে দুই হাত ওর দিকে দেখালাম।

বৃষ্টি থেমে গেছে, আমি আর অনুস্কা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি বাস স্টান্ডে। লোকজন অনেক কমে এসেছে। অনেক বাস এলো অনেক বাস চলে গেলো। ভেবেই পেলাম না কোন বাসে উঠতে চায়। জিজ্ঞেস করব কি করব না সেটা নিয়েই দ্বিধায় পরে গেলাম। জিজ্ঞেস করলে হয়ত ভাববে, একা পেয়ে হয়ত গায়ে পরে আলাপ করতে যাচ্ছি।

শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “তুমি চাইলে আমি তোমাকে তোমার বাড়িতে ড্রপ করতে পারি।”

মৃদু হেসে না সূচক ভাবে মাথা নাড়ায় অনুস্কা, “না না অত কষ্ট করতে হবে না।” মুচকি হেসে বলে, “আমাকে নিতে আসছে।”

হা পোড়া কপাল, সারথি ছিল তাও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। যাক তাই সই। অন্তত এই সুযোগে এই সুন্দরীর সান্নিধ্য একটু পাওয়া যাবে।

আমি অনুস্কাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাতের ব্যাচ কেন নিয়েছ?”

অনুস্কা উত্তর দেয়, “কলেজ থাকে। তারপরেই আসি।” একটু চুপ করে থাকার পরে, ডান হাত দিয়ে ডান কানের ওপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে ফর্সা কানের লতি আমার চোখের সামনে উন্মুক্ত করে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার দেরি হচ্ছে না তো?” ফর্সা কানের লতিতে ছোট একটা হলদে রঙের দুল।

দেরি তো হচ্ছে বটে। বাড়ি গিয়ে প্রেসার কুকারেই ডালে চালে বসাতে হবে। তাও ভদ্রতার হাসি দিয়ে বললাম, “না না ঠিক আছে। তোমার সারথি না আসা পর্যন্ত আমি দাঁড়াচ্ছি।”

অনুস্কা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় থাকো?”

উত্তর দিলাম, “বাঙ্গুরে।”

অনুস্কা একটু আশ্চর্য হয়েই বলল, “ওহ তাই নাকি? আমার বাড়ি নাগেরবাজার, কাজিপাড়া।”

আমি যেন একটু সাহস পেয়ে গেলাম, “একদম বাড়ির কাছে তো। চলো আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।”

হাঁহাঁ করে উঠল অনুস্কা, “না না, থাক তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।”

মনে মনে ভাবলাম, হ্যাঁ, তোমার সারথি, তোমার বয়ফ্রেন্ড আসছে আমার সাথে কেন যাবে।

বেশ কিছু পরে আমাকে জিজ্ঞেস করল অনুস্কা, “তুমি কেন এত দেরির ব্যাচ নিলে?”

আমি উত্তর দিলাম, “অফিস থাকে তাই।”

চোখ বড় বড় হয়ে গেল অনুস্কার, “আচ্ছা তুমি চাকরি কর?”

আমি হেসে বললাম, “কেন বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি? আমি কি চাকরি করতে পারি না।”

লজ্জায় পড়ে গেল একটু অনুস্কা, “না না সেটা নয়।” কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে চাকরির জন্য তুমি কম্পিউটার শিখছ।”

আমি মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ। নিজেকে একটু এনহ্যান্স না করলে আর চলছে না।” মাথা চুলকে বললাম, “এই চাকরিতে একটু সমস্যা হচ্ছে তাই ভাবছি চেঞ্জ করব।”

মাথা দোলায় অনুস্কা, “ওহ আচ্ছা। তোমার অফিস কোথায়?”

আমি উত্তর দিলাম, “পার্ক স্ট্রিটে একটা কন্সট্রাক্সান কোম্পানিতে আছি।”

আবার মৃদু মাথা দোলায় অনুস্কা, “ওহ আচ্ছা।”

আবার আমরা দুইজনে চুপ। কথা যেন শেষ হয়ে গেছে। কিছু পড়ে নিজে থেকেই বলল আমাকে, “আমি বেথুনে, সেকেন্ড ইয়ার। ইংলিশ অনার্স।”

বেশ কিছু পরে একটা বাইকে করে একটা ছেলে এলো। হেলমেট পরে থাকায় ছেলেটার চেহারা দেখতে পেলাম না।

অনুস্কা বাইকটা দেখে আমার দিকে হাত নাড়িয়ে মৃদু হেসে বলল, “থ্যাঙ্কস বুধাদিত্য।”

বাইকে উঠেছে দেখে আমিও সিগারেট প্যাকেট থেকে একটা সিগেরট বার করলাম। আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটু হাত নারালাম ওর দিকে। অনুস্কা আমার দিকে হাত নাড়িয়ে বাইকের পেছনে উঠে বসে পড়ল। উঠে বসেই ছেলেটার পিঠে চটাস চটাস করে কয়েকটা চাঁটি মেরে দিল। দূরে ছিল তাই ওদের কথা আমি আর শুনতে পারলাম না। বাইক ছেড়ে দিতে আরো একবার আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল অনুস্কা। আমি সিগারেট শেষ করে বাইকে উঠে বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। ওদের বাইকের পেছনে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমার। তবে সারাটা রাস্তা কানের মধ্যে বারেবারে প্রতিধ্বনিত হয় একটা মিষ্টি আওয়াজ, “থ্যাঙ্কস বুধাদিত্য।”

ভিআইপি রোড থেকে বাঙ্গুর এভিনিউতে ঢুকতে যাবো, হটাত করেই মনে পড়ল, হয়ত এই রাস্তা দিয়েই গিয়ে যশর রোড ধরেছে। মনে মনে হেসে ফেললাম সেই কথা ভেবে। বাড়ির দরজা খুলতে যাবো, শুনতে পেলাম আমার ফোন বাজছে। দরজায় তালা খুলে ফোন উঠালাম। ওইপাশে থেকে ভেসে আসে এক মিষ্টি সুর, যার কন্ঠস্বর না শুনলে আজও রাতে ঘুম আসে না আমার। আমার দিদা।

দিম্মা স্নেহের বকুনি দিল আমাকে, “এত দেরি করলি কেন? দুই বার ফোন করলাম।”

আশি বছর হতে চলল, মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, একটু ঝুঁকে চলে তবে আজও আমার কাছে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী মহিলা। মা অনেক ছোট বেলায় ইহলোক ছেড়ে, আমায় ছেড়ে চলে গেছেন। বাবার কথা মনে পরে না আর, মনেও করতে চাই না। মধ্যমগ্রামে আমার মামা বাড়ি, সেখানেই মানুষ হয়েছি। ছোট বেলা থেকে হস্টেলে থেকেই পড়াশুনা করেছি, এমন কি কলেজ ও হস্টেলে থেকেই করতে হয়েছে। ছুটিতে মামার বাড়িতেই যেতাম। মা গত হওয়ার পরে সেটাই ছিল আমার বাড়ি। মা মরা ছেলেকে আমার মামিমা, প্রভাতী দেবী নিজের ছেলের সাথে আমাকেও কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মায়ের ভাগের টাকা দিয়েই দিম্মা আর মামা বাঙ্গুরে আমার জন্য এই ফ্লাট কিনে দিয়েছিলেন। মামিমা ছাড়তে চায়নি প্রথমে তবে চাকরি পাওয়ার পরে বাড়ি ফিরতে মাঝে মাঝে অনেক রাত হয়ে যেত। পার্ক স্ট্রিট থেকে মধ্যমগ্রাম অনেক দুর। দিম্মা মামা খেয়ে নিলেও মামিমা আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকতেন দেখে আমার খুব খারাপ লাগত। তারপরে একদিন আমি মামাকে বললাম যে আমি কোলকাতার দিকে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে চাই। সেই নিয়ে বেশ কয়েকদিন বাড়িতে বেশ কান্নাকাটি শোরগোল হল। আসলে আমার মামাতো দাদা, প্রবালের বিয়ে হওয়ার পরে মামা মামিও একটু একা হয়ে গেছিলেন। ঠিক সেই সময়ে বাঙ্গুরে মামার এক বন্ধু তার ফ্লাট বিক্রি করার কথা বলেছিলেন মামাকে। তালধারিয়ার দিকে বেশ কয়েক বিঘা ধানা জমি ছিল, মায়ের ভাগের জমি বিক্রি করে দিয়ে এই ফ্লাট কেনা হল তখন।

আমিও চেয়ারে বসে জুতো খুলতে খুলতে কানের নিচে রিসিভার চেপে উত্তর দিলাম, “আরে বৃষ্টি পড়ছিল তো তাই দেরি হল।”

দিম্মা আমাকে বলল, “শনিবার পারলে বাড়ি আসিস। প্রবাল আসবে।”

আমিও মুচকি হেসে দিম্মাকে বললাম, “তোতাপাখি আসছে নাকি?”

প্রবালদা আমার মামাতো দাদা। আমার থেকে তিন বছরের বড়। দুর্গাপুর আরই কলেজ থেকে ইলেক্ট্রিকাল নিয়ে পাস করে ডিভিসিতে চাকরি করে। দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে প্রবালদার। বেশ মিষ্টি সুন্দরী বউদি, সুরঞ্জনা। বিয়ের পরে দুর্গাপুরেই একটা বাচ্চাদের স্কুলের শিক্ষিকার চাকরি করে। ভীষণ গল্প করতে আর কথা বলতে ভালোবাসে। আদর করে আমি বউদিকে তোতাপাখি বলে ডাকতাম। আর বউদিও আমাকে খেপানর জন্য গেছো বাঁদর বলে ডাকত। গেছো বাঁদর নামটা বেশ বড় তাই ছোট করে গেছো বলে ডাকত। দিম্মা, মামিমা প্রভাতী দেবী, ছাড়া এই তোতাপাখির সাথেই যা একটু গল্প করি, তা ছাড়া আমার জীবনে আর কোন মেয়ের আগমন ঘটেনি।

দিম্মাও হেসে ফেলল, “শনিবার আসবে ওরা।”

আরও কিছুক্ষন দিম্মার সাথে গল্প করে ফোন রেখে দিলাম। বাড়িটা আর আজকাল খাঁখাঁ করে না। একাকীত্ব সয়ে গেছে। জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে প্রেসার কুকারেই ডালে চালে বসিয়ে দিলাম। রাত অনেক হয়েছে। টিভিতে রাতের খবর শুনতে শুনতে খাওয়া সারলাম। টিভিটা বেশ পুরানো, তবে আমার চলে যায়। সকালে কাজের মেয়েটা এসে ঘর ঝাড়ু মোছা করে গেছে। রান্নার জন্য একটা লোক রেখেছিলাম, কিন্তু কয়েক মাস সেই রান্না খেয়ে আমার আর পোষাল না তাই ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপরে নিজেই হাত পুড়িয়ে যা পারি তাই রান্না করি। আর মাঝে মাঝে ছুটি পেলে মামাবাড়িতে গেলে দিম্মা বেশ ভালো খাওয়ায়। প্রবালদার যখন বিয়ে হয়নি, তখন আমার বাড়িতে প্রবালদা আর আমি অনেকবার বসে মদ গিলেছি। তাছাড়া মাঝে মাঝে, কলেজের বন্ধুরা আসে বাড়িতে তখন একটু আধটু মদ খাওয়া হয়। মদের আসর ছাড়া বাড়িতে আর কেউ আসে না। কারণ আমার বাড়ি ফাঁকা, কেউ নেই মাথার ওপরে যে আমাদের শাসন করবে। তবে আমার বেশি মদ পছন্দ হত না তাই একা একা কোনদিন মদ খেতাম না। ওই কালে ভদ্রে বন্ধুরা এলেই তবেই মদের আসর বসত।

যথারীতি দুই দিন পরে কম্পিউটার ক্লাসে অনির্বাণের সাথে দেখা। সারাটা ক্লাসে অনির্বাণ আমার মাথা খেল, এই বল না কি হল। কথা হল ওর সাথে? কোথায় থাকে? কি করে? হাজার প্রশ্ন। আমি হেসে ওকে বললাম, ভাই ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। অহহহ, করে ঠোঁট উলটে একটু ভাঙা হাসি দিয়ে চুপ করে গেছিল। যথারীতি অন্য সব দিনের মতন বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে অনির্বাণের সাথে একটা সিগারেট খেতাম তারপরে বাইকে চেপে বাড়ি। এই ভাবেই দেখা হল বেশ কয়েক সপ্তাহ। বাস স্টান্ডে অনুস্কার সাথে দেখা হত। চোখে চোখে একটু কথা হত আমার সাথে, ভালো আছো? মাথা দুলিয়ে উত্তর হত, হ্যাঁ। আমাদের সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই আমার দিকে অল্প হাত নাড়িয়ে সেই বাইকের পেছনে উঠে চলে যেত। একদিন অনির্বাণ আশাহত মর্মাহত হয়ে আমাকে বলল, যাহ্‌ শালা সব সুন্দরী গুলো এক এক করে হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম।
 
পর্ব এক (#2-#2)

সেদিন বৃষ্টি নেই। অনির্বাণের তাড়া ছিল তাই ক্লাসের শেষেই বাসে চেপে চলে গেল। অনুস্কা সেদিন আমার আগে থেকেই বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল। লক্ষ্য করেছিলাম যে ক্লাসের সময়েও বেশ আনমনা ছিল। অনির্বাণ ইয়ার্কি মেরে বলেছিল, নিশ্চয় বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে নয়ত বয়ফ্রেন্ড বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অনুস্কার চোখে মুখে ভীষণ একটা অস্বস্তিকর অস্থিরতার ভাব, যেন কিছু হারিয়ে গেছে। পরনে গোলাপি রঙের একটা চাপা সালোয়ার কামিজ, কপালে ছোট একটা গোলাপি টিপ। বাম হাতের কব্জিতে একটা পাতলা সোনার চেন দেওয়া ঘড়ি, টাইটানের মনে হয়। কাঁধে কলেজের ব্যাগ। পাতলা ঠোঁট জোড়া মিষ্টি গোলাপি রঙের। প্রসাধন বলতে তেমন কিছুই নেই মুখ মন্ডলে। মেকি সাজ নেই চেহারায় তাই হয়ত অনন্যা। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো, মনে হল যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সেই সাথে একটু অচেনা উত্তেজনা যেটা এর আগে কোনদিন অনুভব করিনি। আসলে এত সুন্দরী কেউ নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে আমার সাথে গল্প করেনি তাই। ছোট বেলা থেকে ছেলেদের স্কুলে পড়াশুনা, ছেলেদের কলেজে পড়াশুনা। সেখানে মেয়েদের যাওয়া আসা মানে ছাত্রের পরিবারের কেউ। তাদের সাথে কোনদিন কথাবার্তা হত না।

আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বলল, “তোমার তাড়া আছে নাকি?”

আমি নেতি সূচক মাথা নাড়ালাম, “না না তেমন তাড়া নেই।” অনুস্কা একটু দোনামনা করছে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?”

একটু অস্বস্তি, একটু ইতস্তত ভাব নিয়েই বলল, “না মানে আমার পার্সটা না হারিয়ে গেছে।”

শুনে একটু খারাপ লাগলো তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় হারালো?”

ভারাক্রান্ত চেহারা করে অনুস্কা উত্তর দিল, “কলেজ থেকে আসার সময়ে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাসে নাকি? বাসের টিকিট আছে?”

মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল অনুস্কা, “না না ট্যাক্সিতে হয়ত পরে গেছে। ইন্সটিটিউটে এসে দেখি আমার ব্যাগ খোলা ছিল সেখান থেকে কখন পরে গেছে খেয়াল নেই।”

আমার চক্ষু চড়ক গাছ। কলেজ থেকে ট্যাক্সি করে ইন্সটিটিউট আসে রোজ দিন। কলেজের সামনে থেকে খালি মিনিবাসে চাপলেই হয়, সোজা কাঁকুড়গাছি। বেশ বড় লোকের মেয়ে তাহলে।

আমার বাইকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আমাকে বলল, “আমাকে বাড়িতে ছেড়ে দেবে প্লিজ।”

ওর অসহায় কাতর আবেদনে সারা না দিয়ে থাকতে পারলাম না। আমিও মাথা দুলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ।” তবে পার্স হারিয়ে গেছে শুনে একটু দুঃখ পেলাম।

আমি বাইকে বসলাম। বাঁ দিকে পা ঝুলিয়ে বাইকে বসে পড়ল অনুস্কা। একটা মিষ্টি গন্ধ মাতাল করে দিল আমাকে, অনুস্কার গায়ের মদির ঘ্রাণ।

বাইকের পেছনে বসতে বসতে আমি জিজ্ঞেস করলাম অনুস্কাকে, “আজ, তোমার সারথি আসেনি?”

অনুস্কা বলল, “না ভাইয়ের জ্বর হয়েছে তাই আসতে পারেনি।”

কথাটা শুনে আমার বুক থেকে যেন একটা বড় পাথর সরে গেল। আচ্ছা তাহলে যে ছেলেটা অনুস্কাকে নিতে আসত সে ওর ভাই। আমি তো কত কিছুই ভেবে বসেছিলাম। মনের মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ গ্যাদা শিউলি জবা কত কিছুর ফুল ফুটে গেল, ইয়াত্তা নেই। মনে মনে কড় গুনে দেখলাম, অনুস্কা এই কুড়ি হবে আমার পঁচিশ, জমবে ভালো। ইতর শয়তানি মানসিকতা। ধ্যাত, বলে নিজেই হেসে ফেললাম।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “পার্সে ইম্পরট্যান্ট কিছু ছিল কি?”

মাথা নাড়াল অনুস্কা, “না বিশেষ কিছুই ছিল না। এই চার পাঁচ’শ টাকা আর কলেজের আইডি কার্ড।”

চার পাঁচ’শ টাকা মানে আমার কাছে অন্তত অনেক টাকা। কত অনায়াসে অনুস্কা বলে দিল যে বিশেষ কিছুই ছিল না। আমিও বুঝলাম বেশি ফুল ফুটানো একদম উচিত নয়। ওই বাইকের পেছনে পর্যন্ত ঠিক আছে। আমার কাঁধে হাত রাখল, নরম চাঁপার কলি ফর্সা আঙ্গুল দিয়ে একটু চেপে ধরল কাঁধ। দুইজনের মাঝে ওর ব্যাগ রাখা, দুই দেহের মাঝে একটা ভদ্রতার ব্যাবধান। বাইকে স্টার্ট দিলাম। রাত অনেক, বৃষ্টি না হলেও জলো হাওয়া আমাদের উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। নাগের বাজার পর্যন্ত কারুর মুখে কোন কথা ছিল না। চুপচাপ আমার কাঁধে হাত রেখে বসেছিল। কাজিপাড়ার মোড়ের অদুরে আসতেই আমার কাঁধে আলতো চাপ দিল অনুস্কা।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল?”

অনুস্কা নিচু গলায় বলল আমাকে, “এইখানে নামিয়ে দাও।”

আমি ভদ্রতার খাতিরে বললাম, “না না, এত রাতে এই রাস্তায় কেন নামিয়ে দেব। চলো বাড়ির সামনে পৌঁছে দিচ্ছি।”

অনুস্কা মাথা দুলিয়ে বলল, “না না বাড়িতে নয়।” গলাটা একটু ভীত সন্ত্রস্থ শোনাল। “তুমি আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও। এই তো সামনেই বাড়ি। আমি হেঁটে চলে যাবো।”

অগত্যা আমি বাইক থামিয়ে দিলাম একটা গলির সামনে। আমার কাঁধে হাত রেখে বাইক থেকে নেমে পড়ল অনুস্কা।

বাইক থেকে নেমে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে ডান হাত তুলে মিষ্টি হেসে বলল, “এই আমি আসছি।”

আমিও মাথা দোলালাম, বাড়ি দেখা হল না তবে জানা গেল কোন গলিতে ওর বাড়ি। জেনেও কি লাভ, যে মেয়ে সব সময়ে ট্যাক্সি চড়ে, দামী জামা কাপড় পরে তার বাড়ি জেনে কোন লাভ নেই। অলীক স্বপ্ন দেখে কি হবে, শুধু শুধু রাতের ঘুম নষ্ট হবে আর কিছুই হবে না।

দুই কদম এগিয়ে গিয়ে আবার আমার দিকে ফিরে এলো। বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “পরের ক্লাসে আসছ তো?”

আমি একটু হেসে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ আসছি।” মনে মনে বললাম, তোমার জন্য না এসে কি আর পারা যায় নাকি।

টিয়াপাখির মতন টিকালো নাক কুঁচকে বলে, “এই আজকের ক্লাসের কিছুই আমার মাথায় ঢোকেনি।”

আমি ওকে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে স্যারকে প্রশ্ন করনি কেন?”

একটু হারিয়ে যাওয়া চেহারা করে বলল, “পার্স হারিয়ে যাওয়াতে মন খারাপ লাগছিল। কার কাছে টাকা চাইব ভেবে পাচ্ছিলাম না। কে আবার কি ভেবে বসে জানি না।”

বুকটা ভরে গেল আমার, তাহলে আমার প্রতি একটু সদয় হয়েছে মহারানী। ভরসা জেগেছে আমার ওপরে একটু। কিন্তু ওর মুখ থেকে শোনার জন্য মন ছটফট করছিল।

তাই শয়তান মন শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে ওকে, “তারপর?”

মুচকি লাজুক হাসি দিল আমাকে, “কিছু না। তোমার রাত হচ্ছে না তো?”

আমি মাথা দোলালাম, আমার রাত কি আর দিন কি। “না না, বাড়িতে দেরি করেই ফিরি।”

অনুস্কা মুচকি হেসে বলল, “তোমার সাথে যে থাকে, আই মিন তোমার বন্ধু।”

মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ, অনির্বাণ, এই এক নম্বর গেটে থাকে।”

নাক কুঁচকে বাঁকা হেসে বলে, “একটু কেমন যেন।”

আমার ভীষণ হাসি পেয়ে গেছিল। আমি মাথা চুলকে অপরাধীর হাসি দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ একটু শয়তান।”

ফিক করে হেসে ফেলল সুন্দরী ললনা। গোলাপি ঠোঁটের মাঝে দুই সারি মুক্তো ঝকমক করে উঠল। সত্যি বলতে অনির্বাণটা এমন শোঁক শোঁক করে আমার নিজেরই মাঝে মাঝে বড্ড খারাপ লাগে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই অনির্বাণ আর আমি গল্প করার সময়ে মেয়েদের দেখে একটু টিপ্পনি কাটত। মালের পাছা দেখ মাইরি, চাঁটি মারতে ইচ্ছে করে। উফফফ, কি মাই রে, ডাব ঝুলছে। ইসস, এটা একদম ম্যঞ্চেস্টার বাঁড়া। দেখ বাঁড়া, পুরো এম্বাসেডরের ডিগি রে। আমার ভীষণ হাসি পেত ওর কথা শুনে। আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কারণ আমি ওর সাথেই থাকতাম, নিশ্চয় ওর সাথে মিলিয়ে আমার চরিত্র এতক্ষনে মনের মধ্যে ধরে নিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষন কারুর মুখে কোন কথা নেই। হটাত করেই যেন সব কথা শেষ হয়ে গেছে আমাদের, অবশ্য কি বা বলব, এইভাবে কোন মেয়ের সাথে কোনদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে এইভাবে কথা বলিনি। ল্যাম্প পোস্টের হলদে আলোয়, গোলাপি চাপা সালোয়ার কামিজে স্বর্গের অপ্সরা রম্ভার মতন লাগছিল ওকে। আমি হা করে ওর দিকে চেয়ে দেখাতে চোখ নামিয়ে নিল অনুস্কা। মনে হল ওর যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছে।

লাজুক হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নামটা এত বড় কেন?”

কথাটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। নাম তো দিম্মার দেওয়া। এখন তো আর কেটে ছেঁটে ছোট করতে পারি না। ইয়ার্কি মেরে উত্তর দিলাম, “তখন তোমার সাথে দেখা হয়নি, না হলে তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিজের নাম রাখতাম।”

হেসে ফেলল অনুস্কা। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠল, গালে রক্তিমাভা, নিচের ঠোঁট দাঁতে চেপে খুব নরম গলায় বলল, “আদি।”

প্রথমেই কানে গেছিল শব্দটা কারণ আমার দিম্মা শুধু মাত্র আমাকে এই নামে ডাকে, বাকি আরো একজন ডাকতেন তিনি এখন ইহলোকে নেই। সেই আদরের নাম শুনে আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজের কান কে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সবার কাছে আমি বুধাদিত্য অথবা বুধো, শুধু মাত্র দিম্মার কাছে আদি। সেই নাম আমার সামনে দাঁড়ানো লাজুক রূপসীর ঠোঁটে।

শুনেও না শোনার ভান করে ওর দিকে মাথা এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু বললে কি?”

বাঁ দিকে ঘাড় কাত করে মৃদু হেসে যেন ইশারায় একটু বকুনি দিল। মাথা দুলিয়ে বলল, “কিছু না, যাও তুমি বাড়ি যাও।”

আমি বাইকে স্টার্ট দিয়ে ওকে বললাম, “তুমি আগে যাও তারপরে আমি যাবো।”

ঘড়ি দেখল অনুস্কা, আমিও দেখলাম। রাত পৌনে ন’টা বাজে। মুখ শুকনো হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য, “আচ্ছা আজকে আমি আসি।”

এক্সেলেটরে মোচর দিয়ে আওয়াজ করে দিলাম। ওর চোখ জোড়া কিছু একটা বলতে চাইছে। হটাত করে ডান হাত আর বাঁ হাত নিজের বুকের সামনে আনল। দুই হাতের উল্টো পিঠ করে, আড়াআড়ি করে একটার উপরে আরো একটা রেখে, একত্রে জুড়ে দিল। দুই হাতের তালু নিজের দিকে ফেরানো, দুটো বুড়ো আঙ্গুল পরস্পরের সাথে মেশান। ইশারায় কি যে বলতে চাইছে বুঝতে পারলাম না। দুই হাতের ধাঁচ দেখে মনে হল এক পাখির মতন কিম্বা প্রজাপতির মতন একটা আকার। আমি অবাক হয়েই ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপরে নিজের দিকে দেখিয়ে ইশারা করল। মাথায় কিছুই ঢুকল না আমার। বোকা, ভীষণ বোকা আমি।

ফিসফিস করে বলল আমাকে, “তিতলি।”

বলেই লাজুক হেসে সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে ত্রস্ত পায়ে গলির মধ্যে যাত্রা করল। আমি ওর ত্রস্ত পায়ের চলনের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি কত বোকা, প্রজাপতিকে তিতলি ও বলে। কিন্তু তিতলি কি? গলির মোড় পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। ওই দিকটা একটু অন্ধকার হলেও দুর থেকে দেখতে পেলাম দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি হাত তুলে একটু নাড়ালাম। দুর থেকে ওর মুখের ভাব বোঝা গেল না তবে মাথা নিচু করে হারিয়ে গেল। বাইক চালিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবতে বসলাম, এই তিতলি কি জিনিস। ওহ শালা, নিজেকে বেশ কয়েকটা উত্তম মধ্যম গালাগালি দিলাম। ওর নাম তিতলি, সেটাই বলতে চেয়েছিল। মনে হচ্ছিল বাইক ফিরিয়ে নিয়ে একবার ওকে ডাকি, তারপরে ভাবলাম, বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছ আদি।

দুই দিন পরে যথারীতি আবার ক্লাসে দেখা। সবার সামনে যেন আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। সেই বসলো গিয়ে সামনের সিটে, ওর পাশে আরও দুটো মেয়ে। সাদা বোর্ডে পেন দিয়ে লিখে লিখে কিছু বুঝিয়ে চলেছে স্যার। আমি মাথা দুলাই আর আড় চোখে তিতলির দিকে তাকাই। না, ওর নজর পেছনের দিকে নেই একদম। আমি সারাক্ষন ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কারণ আকাশী নীল রঙের একটা লম্বা বেশ বড় ঘেরের ফ্রক পরে এসেছিল সেদিন। একদম নীল আকাশের পরীর মতন দেখতে লাগছিল তিতলিকে। ফ্রকের পেছনের দিকটা বেশ কাটা ছিল, ফর্সা চওড়া পিঠ দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল আমার। নিশ্চয় আরো অনেকের হচ্ছিল সেই অবস্থা। ওর ঠিক পেছনে একটা ছেলে বসেছিল, সে বোর্ডে কম তিতলির পিঠের দিকে বেশি করেই চেয়েছিল। স্যার ঝড়ের গতিতে বলেই চলেছে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ প্রশ্ন করলে তাদের উত্তর দিচ্ছেন বটে। অনেকের প্রশ্নের হাত উঠানোর মধ্যে তিতলিও ছিল। গলায় জোর না থাকায় সেই প্রশ্ন আর স্যারের কানে পৌঁছায় না। ক্লাসের শেষের দিকে বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু পেছনে মুড়ে আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল তিতলি। আমি ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হল। ঠোঁট উলটে চোখের ইশারায় স্যারের দিকে দেখিয়ে মাথা নেতি সূচক একটু দুলিয়ে দিল। বুঝলাম কিছুই বুঝতে পারছে না। আমি মুচকি হেসে চোখ টিপে ইশারায় বললাম, দাঁড়াও কিছু একটা করছি।

একটা সাদা কাগজে লিখলাম “বম্ব”। কাগজটা দলা পাকিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। পড়ল গিয়ে স্যারের টেবিলের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম “বম্ব, বম্ব” সবাই থ।

স্যার থতমত খেয়ে পড়া থামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় বম্ব।” সবাই বোমার নাম শুনে তটস্থ।

অনির্বাণ হেসে ফেলল। আমি বললাম, “স্যার, টেবলের ওপরে।”

পড়া থামিয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন স্যার, “এটা কি হচ্ছে ঘোষ বাবু?”

আমি উত্তর দিলাম, “বোমা ফাটালাম, না হলে থামছিলেন না তো।”

স্যার আমাকে প্রশ্ন করল, “মানে? কেন?”

আমি স্যারের চোখে চোখ রেখে বললাম, “আশিকে নব্বুই করার জন্য দৌড়াচ্ছেন। সেটা তো সবাই পারে। কোনদিন দশকে চল্লিশ করে দেখান।”

কেউ কি বুঝল না বুঝলো জানি না, কারণ সবাই আমার কথা শুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। শুধু মাত্র দেখলাম, মুখ চেপে তিতলি হেসে চলেছে। চোখা চুখি হতেই মৃদু মাথা দুলিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। স্যার হয়ত বুঝলেন কি বলতে চাইছি, তাই পড়া থামিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন কি প্রশ্ন। আমি ইশারায় তিতলিকে বললাম প্রশ্ন কর। তখন তিতলি প্রশ্ন করল। আর তার উত্তর পেল।

ক্লাস শেষের পরে আমি আর অনির্বাণ অন্যদিনের মতন বাইরে বেড়িয়ে এলাম। আমার চোখ তিতলিকে খুঁজে বেড়ায়। মনে হয় বেড়িয়েছিল আমাদের আগেই, কারণ সামনের চেয়ারে বসে ছিল তিতলি। বাইরে বের হতেও দেখেছিলাম মনে হয়, একটা নীল রঙের পোশাকের কেউ। কিন্তু বাইরে বেড়িয়ে আর ওর দেখা পেলাম না। বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম বাস স্টান্ডে সেদিন। হয়ত আমার দেখার ভুল হতে পারে, হয়ত ক্লাসের শেষে ওয়াশ রুমে গেছে। কিন্তু মিনিট পনেরো পরেও যখন আর দেখা পেলাম না তখন বুঝলাম যে তিতলি চলে গেছে। দিনটা শুক্রবার, সেই সোমবারে দেখা হবে। দুটো দিন তিতলিকে দেখতে পাবো না ভেবেই বুকের মধ্যে একটু শূন্যতা ভর করে এলো। কারণ জানি না। ভালোবাসি নাকি ওকে, কই না তো। প্রেমে পড়লে নাকি ঘুম হয় না, কাজে মন বসে না। আমি তো দিব্বি খাই দাই ঘুমাই কাজ করি। মন ভালো ছিল না, শুধু মনে হচ্ছিল হাত নাড়াল না। আমার আগেই চলে গেল আমাকে বিদায় না জানিয়ে। মনকে শান্ত করলাম, নিশ্চয় ওর ভাই আগেই চলে এসেছিল তাই হয়ত আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। দেখা যদিও বেশ কয়েকদিনের তবে মোটে দুই দিন কথা হয়েছে। এই তো শুধু নাম জানা জানি হল। এর মধ্যে এইভাবে কাতর হয়ে পরাটা ভীষণ খারাপ। তারপরে আমি কি জানি ওর মনে কি আছে?
 
পর্ব এক (#3-#3)

পাড়ার রাস্তায় ঢুকতেই দেখলাম কারেন্ট চলে গেল। ধ্যাত এই কারেন্ট নিয়ে বড় সমস্যা। বাইক রেখে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে কোন মতে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুললাম। কোন মতে জুতো খুলে রান্না ঘরে গিয়ে একটা মোমবাতি ধরালাম। শুন্য ফ্লাট সেদিন ভীষণ ভাবেই শুন্য লাগছিল। কারণ সত্যি সেদিন অজানা ছিল। বারেবারে মনে হচ্ছিল, ওর জন্য করলাম আর দাঁড়াল না। ভীষণ ভাবেই অকৃতজ্ঞ মনে হচ্ছিল তিতলিকে, ভীষণ রাগ হচ্ছিল ওর ওপরে। রান্না করতে আর ইচ্ছে করছিল না। সকালে রান্না করে রেখে গিয়েছিলাম তাই রক্ষে না হলে হয়ত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। একা একা অন্ধকারে খেতে বসে ভাবলাম, একি জীবন। এত বড় একটা ফ্লাটে সম্পূর্ণ একা। ফ্লাটে আসবাব পত্র বিশেষ কিছুই নেই। দুটো বেশ বড় শোয়ার ঘর, কিন্তু একা মানুষ তাই খাট বিছানা একটাতেই। অন্য ঘরে একটা পড়ার টেবিল আর চেয়ার। যদিও পড়াশুনা আর তেমন হয় না। ভেবেছিলাম একটা কম্পিউটার কিনব, কিন্তু যা দাম তাতে আর পোষাল না। বসার ঘরে একটা লম্বা সোফা আর একটা ছোট টেবিল। ওই সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতেই আমার খাওয়া দাওয়া হয়। কিন্তু কারেন্ট না থাকায় মোমবাতির আলোতেই সেদিন রাতের খাওয়া সারতে হল।

রাত অনেক, প্রায় সাড়ে দশটা, হটাত করেই ফোন বেজে উঠল। সাধারণত এতরাতে আমাকে কেউই ফোন করে না। ফোন তুলে দেখলাম, অন্য পাশে প্রবালদা।

প্রবালদা, “হ্যাঁ রে খাওয়া দাওয়া হল?”

আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ এই হল। তোদের হয়েছে?”

উত্তর দিল প্রবালদা, “হ্যাঁ।” একটু থেমে আমাকে বলল, “ঠাম্মা বলছিল হরিদ্বার ঋশিকেশের কথা।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমাকেও বলছিল।”

প্রবালদা আমাকে বলল, “তোর কি পুজোর সময়ে ছুটি হবে?”

আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ রে বাবা, পুজোতে কার না ছুটি হয়।”

হেসে ফেলল প্রবালদা, “আচ্ছা, তাহলে সবার টিকিট কাটবো।”

আমি একটু ভেবে বললাম, “আচ্ছা কেটে ফেল। কত কি দিতে হবে জানিয়ে দিস।”

প্রবালদা, হুম করে একটু চুপ করে গেল। তারপরে আমাকে বলল, “আরো একটা কথা ছিল তোর সাথে। তুই কি পরের সপ্তাহে আমাদের বাড়ি আসতে পারবি?”

আমি একটু ভেবে বললাম, “শুক্রবার লাস্ট লোকাল ধরে চলে আসব। কিন্তু কি কথা একটু বল?”

প্রবালদার হাসি শুনতে পেলাম সেই সাথে পেছন থেকে তোতাপাখির হাসিও শুনতে পেলাম। প্রবালদার হাত থেকে তোতাপাখি ফোন নিয়ে আমাকে বলল, “গেছো, তোমায় অনেকদিন দেখিনি তাই।”

তোতাপাখির গলার আওয়াজ শুনে আমিও ইয়ার্কি মেরে বললাম, “বসে আছো তো হোঁৎকার কোলে চেপে।” প্রবালদা একটু মোটা গোলগাল তাই আমি ওকে হোঁৎকা বলে ডাকতাম ছোট বেলা থেকে। এক সপ্তাহ আগেই মামাবাড়িতে দেখা হয়েছিল। আমাকে শুধু মাত্র দেখার জন্য নিশ্চয় এত রাতে ফোন করেনি প্রবালদা। আমি বললাম, “আমার বিরুদ্ধে দুই জনে মিলে কি জল্পনা কল্পনা করছ বল তো?”

খিলখিল করে হেসে ফেলল তোতাপাখি, “না না কিছু না। তুমি কিন্তু পরের সপ্তাহে এসো।” তারপরে শুরু হল তোতাপাখির গল্প, “এই জানো, বাড়ির পেছনে যে পেয়ারা গাছটা ছিল তাতে অনেক পেয়ারা হয়েছে।” আমি মাথা নাড়লাম, সেটা অবশ্য ফোনের মধ্যে থেকে দেখা যায় না। খিলখিল করে হেসে বলল, “তুমি আসো তোমার জন্য পেয়ারা গুলো গাছেই রেখে দিয়েছি। আচ্ছা আজকে তুমি কি রান্না করলে?”

আমি বললাম, “সকালের রান্না ছিল। ঐ ডাল আর ভাত। তুমি কি রান্না করলে আজকে?”

তোতাপাখির গল্প কি আর থামে, “আজকে মোরলা মাছের ঝোল বানিয়ে ছিলাম আর পুঁই শাকের চচ্চড়ি আর সোনা মুগের ডাল।”

আমি হেসে বললাম, “আমাকে এখন বলছ, দেখো তোমার পেট খারাপ করবে।” আমি গলা নামিয়ে বললাম, “মোরলার ঝোল খেয়ে রাতে বিছানায় তো...”

তোতাপাখি ফিক করে হেসে ফেলল, “কি আছে তোমার দাদা পরিষ্কার করবে।”

আমিও হেসে ফেললাম তোতাপাখির কথা শুনে, “পেট খারাপ করে তুমি বিছানায় পটি করবে সে কথা কিন্তু বলতে যাইনি।”

তোতাপাখিও ফিক করে হেসে বলল, “আমিও জানি তুমি শয়তান কি বলতে চাইছিলে।” একটু চুপ করে থাকার পরে তোতাপাখি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাড়িটা বেশ ফাঁকা, তাই না?”

আমি প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। তাও ইয়ার্কি মেরে গলা নামিয়ে বললাম, “কেন কেন, হোঁৎকাকে ছেড়ে পালাচ্ছও নাকি? তাহলে বল, টেবিল চেয়ার সোফা সব কিনে ফেলব।”

তোতাপাখির পাশ থেকে হোঁৎকা আওয়াজ দিল, “কেটে হাতে ধরিয়ে দেব কুত্তা।”

আমিও ইয়ার্কি মেরে প্রবালদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার বাড়িতে কি আছে কি নেই সেটা তোর বউ আমাকে কেন জিজ্ঞেস করল সেটা আগে বল।”

প্রবালদা হেসে বলল, “তুই আগে আয় না বাড়িতে তারপরে বলব।”

তোতাপাখির সাথে আরো কিছুক্ষন গল্প করার পরে মন বেশ ভালো হয়ে গেল। দুর্গাপুর খুব কম যাওয়া হয়, হয়ত কোন মাসে একবার, মামাবাড়িও খুব কম যাওয়া হয় আজকাল। শনি রবি জামা কাপড় কাচা, অন্য অনেক কাজ থাকে যে গুলো কাজের দিনে করা হয় না। তবে তোতাপাখির দুষ্টুমি ভরা কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম স্বামী স্ত্রী মিলে আমার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর একটা ষড়যন্ত্র করছে। কি সেই ষড়যন্ত্র সেটা অনুধাবন করতে সক্ষম হলাম না।

সোমবার যথারীতি ইন্সটিটিউটে তিতলির সাথে দেখা। আমাকে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। আমিও মনে মনে হেসে শেষের দিকের টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম। অনির্বাণ আসেনি আমার মাথা খাওয়ার কেউ নেই। স্যার পড়ালেও মাঝে মাঝেই তিতলি ঘাড় ঘুরিয়ে আড় চোখে আমার দিকে দেখছিল। চোখা চুখি হতেই সেই রোষকষিত নয়ন, যার অর্থ বিন্দুমাত্র বোধগম্য হল না। বার কতক ওর ওই রোষ কষিত নয়নের দর্শনের পরে ক্লাস আমার মাথায় উঠে গেল। কি করলাম রে বাবা। ওই মিষ্টি চেহারায় এমন রাগরাগ ভাব একদম মানায় না। যাক গে, যা করছে করতে দাও। আদার কারবারি আমার জাহাজের খবর নিয়ে কি দরকার।

অন্যদিনে ক্লাস শেষ হওয়ার পরে সবার থেকে আগেই ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে যায় তিতলি, কিন্তু সেদিন বসেই আছে টেবিলে। ক্লাস শেষ হওয়ার পরে প্রায় অনেকেই বেড়িয়ে গেল। ক্লাস একটু ফাঁকা হয়ে যেতেই আমিও চেয়ার ছেড়ে উটে দাঁড়ালাম। এবারে আমি আর কেন বসে থাকি। সেদিন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল আজকে আমি কেন ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকব। আমাকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে দেখে তিতলিও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোখ আমার চোখের ওপরে নিবদ্ধ, চোয়াল মাঝে মাঝে শক্ত হচ্ছে, দাঁতে দাঁত পিষছে। সেই রক্তিম চেহারা দেখে আমি প্রমাদ গুনলাম, কিন্তু কিছুতেই ভেবে পেলাম না আমার দোষ কোথায়।

ক্লাসের দরজা দিয়ে বের হতে যাবো, একদম পিঠের পেছনে দাঁড়িয়ে গম্ভির গলায় তিতলি বলল, “দাঁড়াও কথা আছে।”

আমি ওর দিকে দেখে বললাম, “কি?”

নিচু গম্ভির গলায় আমাকে বলল, “নিচে চল তারপরে।”

ইন্সটিটিউট থেকে বের হতে যাবো কি হোঁচট খেল তিতলি আর ওর জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গেল। আমি পাশেই ছিলাম তাই টাল সামলাতে না পেরে আমার জামা খামচে ধরে ফেলল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ওর সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম যাতে পরে না যায়। এক হাতে আমার জামা ধরে অন্য হাতে আমার হাত সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল।

ছেঁড়া জুতো পায়ে ফুটপাথের একপাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে রোষকষিত নয়নে আগুন ঝরিয়ে বলল, “এই তোমার জন্য আমার জুতো ছিঁড়ে গেল।”

আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার জুতো ছেঁড়ার পেছনে আমার হাত কোথায়?”

আমার হাতের মধ্যে দুম করে নিজের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আগে বল রবিবার কোথায় ছিলে।”

আমি ওর প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেলাম, “বাড়িতে আর কোথায় থাকব।”

তিতলি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে দেখে বলল, “এক্সট্রা ক্লাস ছিল তুমি জানতে না?”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “না।”

দাঁত কিড়মিড় করে বলল তিতলি, “থাকো আরো তোমার ওই ওই বন্ধুর সাথে।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এর মধ্যে অনির্বাণ কি করল?”

দাঁত কিরমির করেই উত্তর এলো, “ক্লাসের পরে সিগারেট টানার জন্য দৌড় দিয়ে চলে গেলে।”

আমিও তখন ওকে বললাম, “তুমিও তো চলে গেলে সেদিন।”

কটমট করে আমার দিকে দেখে বলল, “একদম মিথ্যে কথা বলবে না। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ভাইকেও বলেছিলাম দাঁড়িয়ে থাকতে।”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “সেদিন আমি সচক্ষে দেখেছি তুমি ক্লাস শেষে ইন্সটিটিউট থেকে বেড়িয়ে গেলে। আমিও তোমার পেছন পেছন ইন্সটিটিউট থেকে বেড়িয়ে দেখলাম যে তুমি আর নেই।”

অভিমানিনীর ক্রোধ কিছুতেই কম হয় না। ঝাঁঝিয়ে উঠল আমার দিকে দেখে, “হ্যাঁ, কাকে না কাকে দেখে তার পেছনে দৌড়েছে কি জানে রে বাবা। ক্লাসের পরে আমি কোওরডিনেটরের কাছে গেছিলাম এক্সট্রা মেসিন রুমের জন্য। ভেবেছিলাম বাইরে বেড়িয়ে তোমাকে বলব। কিন্তু তোমার দেখা নেই। প্রায় কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাই বার বার জিজ্ঞেস করছিল তাও দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি না...” বলেই আমার হাত থেকে নিজের ব্যাগ টানতে গেল।

অভিমানিনীর রোষকষিত নয়নের কারণ এতক্ষনে আমার সামনে সব পরিষ্কার হল। সত্যি বড় অপরাধ, এই অপরাধের ক্ষমা নেই। কাকে দেখে যে সেদিন কি ভেবে নিয়েছিলাম জানি না। আমি অপরাধীর মতন মাথা চুলকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিতলি। কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছি না। ওর হাত এখন ওর ব্যাগের ওপরে আর ওর ব্যাগ আমার বাঁ হাতের মধ্যে। ব্যাগের ওপরে টানাটানি চলছে না তবে টানাটানি চলছে বুকের মধ্যে।

আমি মৃদু হেসে ওকে বললাম, “আচ্ছা বাবা, এই ছেঁড়া জুতো পায়ে দিয়ে যাবে নাকি বাড়ি?”

ঝাঁঝিয়ে উঠল রূপসী ললনা, “হ্যাঁ, খালি পায়ে যাবো।”

সেই প্রথম বার ওকে ওইভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠতে দেখলাম। যে মেয়ের মুখে কোনদিন জোরে আওয়াজ শুনিনি তার মুখ থেকে এই ভাবে ঝাঁঝালো শব্দ শুনে হাসিও পেয়ে গেল।

আমাকে হাসতে দেখে আরও রেগে গেল তিতলি, “তুমি হাসছ?”

আমি এপাশ ওপাশ দেখে দেখলাম মোড়ের মাথায় রাস্তার পাশেই একটা মুচি বসে আছে। আমি তিতলিকে বললাম, “দেখো আমার ওপরে রাগ করে খালি পায়ে বাড়ি গেলে পা কেটে রক্ত বেড়িয়ে যাবে।”

নিজের ব্যাগে টান মেরে বলল, “যায় যাক, তুমি যাও তোমার সিগারেট ধরাও।”

আমি পড়লাম মহা সমস্যায়, কি করা যায়। শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইলাম, ভুল আমার, কাঁচুমাচু মুখ করেই বললাম, “আচ্ছা সরি। তুমি এখানে দাঁড়াও, জুতোটা দাও আমি ঠিক করিয়ে নিয়ে আসছি।”

সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত ধরে ফেলে তিতলি, প্রায় চেঁচিয়ে বলল, “এই না না, ছিঃ জুতো নয়।”

তারপরে কোন রকমে জুতো পায়ের মধ্যে ঘষতে ঘষতে মুচির ওইখানে গেলাম দুইজনে। মুচি কে দিয়ে জুতো সারানোর সময়ে আমার বাঁ পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল তিতলি। আমার বাজুর সাথে ওর বাজুর ছুঁয়ে থাকে। এমন সময়ে ওর আনমনা ডান হাতের আঙ্গুল আমার আঙ্গুলের সাথে ছুঁয়ে যায়। চাঁপার কলি নরম ফর্সা হাতের আঙ্গুলের ছোঁয়ার মধ্যে একটা বিদ্যুৎ চমকায় জানতাম না। আমি ডান হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে ওর আঙ্গুল ছুঁয়ে দিলাম। আড় চোখে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে দেখল আমি সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলাম। মুচকি হাসি ঝিলিক দিলো মিষ্টি গোলাপি ঠোঁটে।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আজ তোমার ভাই আসছে না?”

মৃদু হেসে মাথা দোলায় রমণী, “না আর আসবে না। ওর কোচিং ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। বাবা বলেছে ক্লাস শেষে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরতে।”

আমার চক্ষু চড়ক গাছ, জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি সব সময়ে ট্যাক্সিতেই চড় নাকি?”

ম্লান হেসে শুকনো মুখে আমাকে উত্তর দিল তিতলি, “আমি না একটু ক্লস্ট্রোফোবিক। মানুষের ভিড় দেখেলেই আমার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। ভিড় ভর্তি বাসে একদম চড়তে পারি না। মনে হয় যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। পাগল পাগল লাগে, শ্বাস নিতে পারি না একদম।”

আমি বুঝলাম, মাথা দুলিয়ে বললাম, “আচ্ছা, এবারে বুঝলাম।”

মৃদু হাসি দিল আমাকে দেখে, “কি বুঝলে?”

আমিও চোখ নাচিয়ে উত্তর দিলাম, “এই যে তুমি ভিড় একদম পছন্দ কর না। তাই বিশেষ কারুর সাথে মেলা মেশাও করো না।”

মুচকি হাসি দিল তিতলি, “অনেক কিছুই বুঝে গেলে দেখছি।”

আমি মাথা নাড়লাম, বুঝতে চাইলেও কি আর বুঝতে পারি নাকি, নাকি বুঝতে চাইছি না একদম। জুতো ঠিক হয়ে গেলে আমি আর তিতলি আমার বাইকের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। রাত সাড়ে আটটা, কোলকাতার রাস্তায় তখন মনে হয় যেন সন্ধ্যে নেমেছে, মানুষের ঢল চারপাশে। ভিড় বাঁচিয়েই ওকে আগলে নিয়েই বাস স্টান্ডের দিকে চলে এলাম যেখানে আমার বাইক রাখা থাকে। মুচির জায়গা থেকে বাস স্টান্ড বড় জোড় বিশ পা হবে, তবে সেই বিশ পা পাশাপাশি হাঁটতে খুব ভালো লেগেছিল। কারুর মুখে কোন কথা ছিল না। ওর ব্যাগ তখন আমার হাতের ছিল আর আমার ব্যাগ ছিল আমার কাঁধে। বাইক পারকিঙ্গের ওইখানে দাঁড়িয়ে আমি ওর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিলাম।

ব্যাগ হাতে নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “বাড়িতে ড্রপ করে দেবে?”

সেই শুনে আমার মনে হল যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেছি। আমি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। মহারানীর জন্য রথ হাজির, সারথিও হাজির।” বলে কুর্নিশ করার ভান করে একটু মাথা নোয়ালাম।

লজ্জা পেয়ে গেল তিতলি, নাকের ডগা লাল হয়ে গেল, ফোলা নরম গালে রক্তিমাভা দেখা দিল। “ধ্যাত।” বলে আমার বাইকের পেছনে উঠে বসলো।

ব্যাগের ব্যাবধান আর নেই আমাদের মাঝে। আমার পিঠ ঘেঁষেই বসলো তিতলি। আমার চওড়া পিঠের ওপরে রূপসী ললনার নধর দেহবল্লরির উষ্ণ পরশ পেলাম। ডান হাতে আমার ডান কাঁধ ধরে বসলো। নরম চাঁপার কলি আঙ্গুলের পরশে মাতন লাগলো আমার শরীরে। শক্ত পিঠের ওপরে আরও একটা কোমল স্পর্শ পেয়েছিলাম। তিতলির পীনোন্নত নিটোল কোমল ডান স্তনের। একটু লজ্জা লেগেছিল সেই পরশে। শরীরের রক্ত এলোপাথারি ছুটে বেড়িয়েছিল সারা দেহের সব ধমনী দিয়ে।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিক করে বসেছ?”

কাঁধে চাপ দিয়ে উত্তর দিল রূপসী ললনা, “হ্যাঁ।”

বাইকে স্টার্ট দিলাম আমি। মনে হল পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে কোন রাজকুমারীকে নিয়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে চলেছি। সেই সাথে মনে হল, শুধু মাথা ঢাকা ওয়ালা একটা হেলমেট কেনার হয়ত সময় হয়ে এসেছে। পিঠের ওপরে শরীরের প্রায় সম্পূর্ণ ভার ঢেলে দিয়েছিল তিতলি। দেহের উষ্ণ পরশে মাতাল হয়ে যাওয়ার যোগার আমার।

যেতে যেতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার অফিস ক’টায় ছুটি হয়?”

উত্তর দিলাম, “এই সাড়ে পাঁচটা কি ছ’টা নাগাদ।”

জিজ্ঞেস করল তিতলি, “কাল তো ক্লাস নেই, তাহলে অফিসের পরে কি করছ?”

আমি উলটে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু না, অফিস শেষে বাড়ি ফিরব। একটু বাজার ঘাট করার আছে এই আর কি।”

একটু চুপ করে থাকার পরে মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে একটু ভিসুয়াল বেসিকটা বুঝিয়ে দেবে? ওই ডায়লগ বক্স গুলো কি করে বানায়।”

আমি মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ, পরশু দিন ক্লাসের আগে না হয় বুঝিয়ে দেব।”
 
পর্ব এক (#4-#4)

মনমরা একটা উত্তর পেলাম, “আচ্ছা ঠিক আছে।” গলাটা বেশ শুকনো।

বুঝতে পারলাম না কেন তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল?”

সেই শুকনো গলায় উত্তর এলো, “না মানে তুমি তো একদম ক্লাসের সময়ে আসো, তাই কখন সময় হবে সেটাই ভাবছি।”

সেটাও ঠিক, মাঝে মাঝে ক্লাসে ঢুকি একদম সাতটায়। ওকেই জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বল।”

কাঁধের ওপরে ওর নরম চাঁপার কলি আঙ্গুলের চাপটা একটু শক্ত হয়ে গেল। পিঠের ওপরে ওর নধর কোমল দেহপল্লবের ভার একটু বেড়ে গেল। “কাল বিকেলে কলেজে চলে আসতে পারবে?” মিহি কন্ঠস্বরের বদলে একটা উচ্ছল ভাব ওর কন্ঠে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপরে?”

মুচকি হেসে উত্তর দিল, “তারপরে হেদুয়াতে বসে তুমি আমাকে ভিসুয়াল বেসিকটা বুঝিয়ে দিও।”

সেটা শুনে আমি সত্যি হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। এতদিন কপালে কিছুই জোটেনি আর যখন একজন বলছে তখন কি আর না করা যায়। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে, ওই ছ’টা কি সাড়ে ছ’টার মধ্যে আমি চলে আসব।”

আবার গলা শুকিয়ে গেল ললনার, “একটু তাড়াতাড়ি হতে পারে না?”

আমি বাইক চালাতে চালাতেই উত্তর দিলাম, “আচ্ছা দেখছি, চেষ্টা করব।” চেষ্টা মানে, করতেই হবে চেষ্টা, না হলে কি করে মিটবে তেষ্টা। আমি তিতলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “আজকে কোথায় নামাবো তোমাকে?”

তিতলি একটু চিন্তা করে উত্তর দিল, “ওই রাস্তার মুখেই নামিয়ে দিও।” গলাটা শুকিয়ে গেল মনে হল, “আসলে কি জানো, পাড়ার কেউ দেখলে যদি বাড়িতে বলে দেয় তাহলে ভীষণ মুশকিলে পরে যাবো। আমার বাবা একটু অন্য ধরনের মানুষ।” বুঝলাম আসলে কি বলতে চাইছে। আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বাড়ির গল্প শুরু করে দিল, “বাবা এয়ারপোর্ট অথরিটি তে আছেন। ভাই এই ক্লাস টুয়েলভ দেবে পরের বছর। নিচের তলায় কাকা থাকেন। কাকা আবার পার্টি পলিটিক্স করে, বুঝলে। আমার না জানো খুব গাছ লাগানোর শখ। বাড়িতে একটা বেশ বড় বাগান আছে। চারটে নারকেল গাছ, একটা আম গাছ, একটা পেয়ারা গাছ। ছাদেও একটা ছোট ফুলের বাগান করেছি জানো। ওটা আমার একদম নিজের।” কথা গুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু ওই ওর বাবার কথা শুনে মনের ভেতরে একটু খচখচ করে উঠল। “এই ক্লস্ট্রোফোবিয়ার জন্য রোজ দিন সকালে ড্রাউভার গাড়িতে করে কলেজ ছেড়ে আসে আর ফেরার সময়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরি।” বুঝলাম যে বাড়িতে একটা গাড়ি আছে, গাড়ি চালানর জন্য একটা ড্রাইভার আছে। বেশ ধনি পরিবার ওদের সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। “জানো, আমার মা আমার এই ক্লস্ট্রোফোবিয়ার জন্য খুব আমাকে আগলে আগলে রাখত। আগে তো কোথাও ভিড় দেখলে চেঁচামেচি করতে শুরু করে দিতাম। কারুর সাথে মিশতে পারতাম না, জানো। বাড়িতে একা একাই থাকতাম। পরে আমাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দিল।”

উরিব্বাস, কন্যে তাহলে নাচতেও জানে। তাই ললনার চলনে এত মত্ততা, যেন এক পাহাড়ি নদী আপন খুশিতে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে। মন বেশ খুশি হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “কি ধরনের নাচ শিখতে?”

বাইকের আওয়াজে কথাটা মনে হয় ওর কানে গেল না, তাই নিজের গল্পেই মশগুল ছিল তিতলি। তবে উত্তরটা নিজেই দিয়ে দিল, “তারপরে একটু আধটু ওই বন্ধুত্ত হল। মানুষের সাথে মিশতে পারতাম। বাইরে বের হতে পারতাম। তবে কি জানো, বাসে চড়লেই আমার এখন দম বন্ধ হয়ে আসে। জানো আমার নাচের স্কুলটা বাড়ির পাশেই বুঝলে। কত্থক শিখি।”

বাইক লেকটাউন দিয়ে ভেতরে নিতেই আমাকে বলল, “এই এই শোন, আমি না এই লেকটাউন গার্লসে পড়তাম।” বাইকের আওয়াজে আর হেলমেট থাকার জন্য আমি বিশেষ কথা বলতে পারছিলাম না, শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করা ছাড়া। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় পড়তে?”

আমি উত্তর দিলাম, “ছোটবেলা থেকে সব কিছুই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। স্কুল কলেজ সব।”

কাঁধের ওপরে হাতের চাপ বেড়ে গেল, মাথা আরও বেশি করে ঝুঁকিয়ে দিল আমার কাঁধের ওপরে, “কি বললে?”

বুঝলাম আওয়াজে শুনতে পায়নি। আমি হেসে বললাম, “এইভাবে কি আর কথা বলা যায় নাকি? তুমি বল আমি শুনছি তোমার কথা।”

কাঁধের ওপরে আলতো একটা চাঁটি পড়ল ললনার, “শুধু আমি বলব, তুমি শুনবে? ক্লাস নাকি এটা না ইন্টারভিউ দিচ্ছি?” শেষের দিকে মুচকি ইয়ার্কি মার্কা একটা হাসি।

জয়া সিনেমা হলের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে দিতেই আমাকে বলল, “এই এখানে দাঁড়াচ্ছ কেন?”

আমি হেলমেট খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এবারে আমি বলি তুমি শোন। না হলে খোঁটা শোনাতে ছাড়বে না, বলবে ইন্টারভিইউ দিচ্ছ।”

পিঠের ওপরে চাঁপার কলি কোমল আঙ্গুলের একটা ছোট চিমটি খেলাম, “ধ্যাত, তুমি চালাও না হলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।” চিমটিতে ব্যাথার চেয়ে মিষ্টি মধুর ছোঁয়া বেশি করে ছিল। “বাবা আবার না ইন্সটিটিউটে ফোন করে দেয়। ভীষণ কড়াকড়ি বাড়িতে।” শেষের দিকে মনমরা হয়ে গেছিল তিতলির।

বাইক ছুটিয়ে দিলাম, আমার জন্য ওকে যেন কারুর কাছে বকা না খেতে হয়। পিঠের ওপরে সারা ভার দিয়ে বাকিটা রাস্তা চুপটি করে বসেছিল তিতলি। ওর হৃদপিণ্ডের মৃদু কম্পন পিঠের ওপরে অনুভব করতে পেরেছিলাম। ধুকধুক ধুকধুক করে কাঁপছে ওর বুকের ভেতরটা। সাতগাছি পার হতেই ওর ভার আমার পিঠের ওপরে বেড়ে গেল, কেন জানি না মনে হল যেন আমাকে ছাড়তে চাইছে না। হুহু করে উঠল আমার বুকের ভেতরটা। বড় জোর আর পাঁচ মিনিট তারপরেই চলে যাবে। কাজিপাড়া মোড় আসতেই আবার সোজা হয়ে বসে গেল তিতলি। আগের দিনের মতন রাস্তার ওপরেই ওকে নামিয়ে দিলাম।

ব্যাগ বুকের কাছে ধরে বাইক থেকে নেমে আমার অদুরে দাঁড়িয়ে রইল। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় বুঝতে পারলাম, সারা চেহারা এক রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হয়ে গেছে ওর। ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে। জানি না কেন, থেমে গেলাম। আমি হয়ত একটু ভিতু।

যাওয়ার আগে মৃদু হেসে আমাকে বলল, “কাল একটু তাড়াতাড়ি এসো। প্লিজ...”

মাথা দোলালাম আমি, “একদম, চলে আসব।”

হটাত কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “শেভ করে আসবে। ওই খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে একদম আসবে না।”

কথাটা আমার কানে যেতেই আমি ওর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। তিতলির কাজল কালো চোখের মণিতে ঝিলিক, গাল দুটো পিচ ফলের মতন লালচে হয়ে গেছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল গলির ভেতরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ ওকে দেখা যায়। গলির বাঁকে এসে একটু থেমে আমার দিকে চেয়ে একটু মাথা নোয়াল। বুঝতে পারলাম হাত নাড়ালে পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে আর বাড়িতে বলে দেয় তাহলে ওর বাড়িতে ধুন্দুমার কান্ড ঘটে যাবে। গলির বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার পরে ওইখানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিলাম। পিঠের ওপরে যেখানে চিমটি কেটেছিল, সেখানে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। ভীষণ মিষ্টি ব্যাথা, পিঠে নয় ওর হারিয়ে যাওয়ার পরে বুকের বাঁ দিকে হয়েছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে সারাটা রাত শুধু ভাবলাম। কি করছি? ওর বাবা বড়লোক, ওর বাবা বেশ কড়া। আমি ঘোষ ও ব্যানারজি। কত কিছু ভেবে নিলাম, ভবিষ্যতের কথা। একদিকে অলীক স্বপ্নপুরীর রাজকন্যে, অন্যদিকে ভাঙা কুঁড়ে ঘর।

সকালে উঠে একবার ভাবলাম, না যাবো না। তারপরে ভাবলাম, বেচারি আমার জন্য কলেজের বাইরে অপেক্ষা করে থাকবে। শুধু তো পড়া বুঝাতে হবে। এই হেদুয়াতে বসে একটু পড়া বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসব। আর বলেও আসব। কি বলে আসব, ভেবে পেলাম না। ওর মনে কি আছে সেটা তো জানিই না আমি। হয়ত বন্ধুত্ত্ব শুধু মাত্র।

অফিসে ঢুকে দেখলাম যে কাজের চাপ, টেবিলে এক গাদা ফাইল, কোথায় কোন সাইটে কোন মাল যাবে তার লেখাজোকা করতে বসতে হবে। পড়েছি ফিসিক্স নিয়ে করতে হচ্ছে কেরানির কাজ। খাতা লিখছি যেন কোন মুদি খানার দোকানে। কম্পিউটার তখন সবে আসছে আর আমাদের এই কোম্পানির মালিক আবার একটু বামপন্থি। কম্পিউটার এলে মানুষের কাজবাজ থাকবে না, ব্যাবসা লাটে উঠে যাবে। হিসাবে গড়বড় হয়ে যাবে। আসলে সব কিছু কম্পিউটারে থাকলে কারচুপি করা যাবে না সেটা আসল কথা। খাতায় লিখলে যখন অডিট হবে তখন পুড়িয়ে দিলেই কাজ শেষ। কোন প্রমান নেই কিছুই নেই। কোম্পানির কর্ণধার, সঞ্জীব বারুই এমনিতে বেশ ভালো লোক তবে মাঝে মাঝে অকথ্য গালিগালাজ করে যেটা আমার একদম পছন্দ নয়। আমার ম্যানেজার, সন্তোষ স্যার বেশ আময়িক, রামকৃষ্ণ দেবের ভক্ত, প্রতি রবিবার সস্ত্রীক বেলুড় যাওয়া চাই তাঁর। আমি নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করেছি তাই ওনার প্রিয় পাত্র নেক নজরে থাকি।

খাতা লিখেই চলেছি, ডাক পড়ল বিকেলের দিকে। একবার জোকার একটা সাইটে যেতে হবে। আমার মাথায় বাজ পড়ল। মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, তিতলি কলেজের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ভীষণ বিষিয়ে গেল। আমি সন্তোষ স্যারকে জানালাম যে আমার একটু কাজ আছে আমাকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেড়িয়ে যেতে হবে। যেহেতু আমার বাড়িতে কেউ নেই সেহেতু অন্যদিনে কাজ করি, দেরি করেই বাড়ি ফিরি। সন্তোষ স্যার একটু ভেবে আমাকে বললেন যে তিনি ম্যানেজ করে নেবেন। তবে পরেরদিন আমাকে অফিসে ঢোকার আগেই জোকা গিয়ে তদারকি করে বিকেলের মধ্যে একটা রিপোর্ট বানিয়ে দিতে হবে। আমি মাথা দোলালাম, হ্যাঁ হয়ে যাবে।

কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আকাশ মেঘলা, হাওয়া চলছে। বৃষ্টি শুরু হলে হেদুয়াতে বসা যাবে না। বৃষ্টি শুরু হলে তিতলিকে ট্যাক্সি করেই বাড়ি পাঠাতে হবে। বুকের বাঁ দিকে একটু চিনচিন ব্যাথা শুরু হল। আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে অকথ্য গালিগালাজ করলাম, তোদের কি আর সময় হয় না নাকি? এখুনি গুড়গুড় চড়চড় করতে হত? বাইক ছুটিয়ে দিলাম রবীন্দ্র সরণি দিয়ে। একদম সোজা পথ, রবীন্দ্র কাননের মোড় ঘুরলেই ওর কলেজ পৌঁছে যাবো। অফিস থেকে বেথুন পৌঁছাতে আধা ঘন্টার মতন সময় লাগলো। সেই আধা ঘন্টা আমার কাছে অর্ধ শত বছরের মতন মনে হয়েছিল। ক্রসিং গুলোতে কিছুতেই আর তর সইছিল না। বাস ট্রাম গাড়ির ফাঁক দিয়ে এপাশ ওপাশ ফাঁক ফোঁকর যেখানে পেয়েছি সেখানেই বাইক ঢুকিয়ে দিয়েছি। ওর কলেজের সামনে পৌঁছাতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। বেথুন সম্পূর্ণ মেয়েদের কলেজ, গেটের সামনে অনেক মেয়ের জটলা। মেয়েদের দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। রবীন্দ্র কাননের দিকেই আমি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরে যাওয়ার জো নেই, কাকে জিজ্ঞেস করব তাও জানি না, কি জিজ্ঞেস করব।

হটাত কানে ভেসে আসল তিতলির গলা, “এই আদি।”

চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি তিতলি দাঁড়িয়ে। একটা কচি কলাপাতা রঙের বেশ লম্বা মতন ফ্রক পড়েছে। ফ্রকের ঘের বেশ ফোলা ফোলা। দুই মসৃণ পেলব বাহু চকচক করছে। ঠোঁটে মিষ্টি গোলাপি রঙে রঞ্জিত। মাথার ঢালাও কালো চুল একটা খোঁপা করে বাঁধা তাতে আবার একটা কাঠের ক্লিপ লাগানো। ওর সাথে ওর আরো দুই বান্ধবী ছিল। এতক্ষন ওর কলেজের গেটের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তিতলি আমায় দেখে মিষ্টি হেসে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপরে দুই বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, একজন পারমিতা অন্যজন সুস্মিতা। ওর দুই বান্ধবীকে দেখে আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটু মাথা নত করলাম। নিজে থেকেই বেশ আমার বাইকের পেছনে উঠে বসে পড়ল। বান্ধবীদের দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।

হেলমেটটা বাইকের হ্যান্ডেলে গুঁজতে যাবো, তিতলি আমাকে বলল, “দাও, আমি ধরছি।”

আমি ওর হাতে হেলমেট দিয়ে বললাম, “তাহলে হেদুয়া?”

আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে দেখল তিতলি। মুখ ব্যাজার করে বলল, “বৃষ্টি এলে কি করব?”

আমি হেসে উত্তর দিলাম, “বৃষ্টি এলে ভেজা যাবে আর কি।”

তিতলি মুখ ব্যাজার করে বলল, “ধ্যাত, বাবা বকবে।”

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “বৃষ্টি এলে ভিজে যাবে তাতে বকা খাওয়ার কি আছে?”

তিতলি শুকনো মুখে বলল, “বাঃ রে, আমার না কলেজ শেষে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার কথা। ট্যাক্সির মধ্যে কি আর বৃষ্টি হয় নাকি?”

ঠিক কথা, আমি তো গাড়ির মালিক নই, সামান্য একটা বাইক আমার রথ। তাও সেই সামান্য রথেই আমার পেছনে বসা রূপসী রাজকন্যে আমার কোমর জড়িয়ে ডান কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে মিহি কন্ঠে বলল, “বাড়ি চল।”

আমার মাথা গরম হয়ে গেল। কত স্বপ্ন দেখতে দেখতে এসেছিলাম। ওকে সাথে নিয়ে বসব, পাশাপাশি বসব, একটু গল্প করব। আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “মানে? ভিসুয়াল বেসিকের কি হবে?”

খিলখিল করে হেসে ফেলে তিতলি, “ভিসুয়াল বেসিকের কি হবে আমি কি করে জানবো। আমি বিল গেটস নাকি?” তারপরে গলা নামিয়ে আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল, “একা একা ট্যাক্সিতে উঠতে ভালো লাগে না, আদি।”

কানের কাছে ঠোঁট আনতেই ওর উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ লেগে গেল আমার কানের লতিতে আমার গালে। আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বললাম ওকে, “তুমি না খুব দুষ্টু। জানো আমার আজকে একটা সাইটে যাওয়ার কথা ছিল।”

একটু শুকনো গলায় আমাকে বলল তিতলি, “বান্ধবীর জন্য এতটুকু ও করতে পারবে না আদি?”

পাঁজর চেঁচিয়ে উঠল আমার, তোর জন্য সব কিছুই করতে রাজি। একবার মুখে বল, আমি চাঁদের আলোয় তোর রাত ভরিয়ে দেব। আমি মুচকি হেসে বললাম, “আচ্ছা।”

বাইকে স্টার্ট দিলাম। বাড়ির পথের দিকেই যাত্রা শুরু করলাম। হেদুয়ার সামনে আসতেই, হা হা করে উঠল তিতলি, “এই দাঁড়াও দাঁড়াও।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল কিছু পরে গেছে নাকি?”

মুচকি হেসে আমাকে বলল, “ফুচকা খাবো।”

আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম। গঙ্গার দিক থেকে জোলো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি ওকে বললাম, “ধ্যাত ফুচকা খেতে হবে না বাড়ি চল।”

নাক মুখ কুঁচকে পিঠের ওপরে গাল চেপে ধরে মিষ্টি মধুর কন্ঠে আবদার করল তিতলি, “প্লিজ আদি, অনেকদিন ফুচকা খাইনি।”

আমি বাইক না থামিয়েই ওকে আবার বললাম, “তিতলি অন্যদিন ফুচকা খাওয়াব। আজকে না।”

আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধের ওপরে মাথা রেখে আবদার করতে শুরু করল, “আদি আদি, প্লিজ আদি। অনেকদিন ফুচকা খাইনি। প্লিজ চলো না। বেশিক্ষন লাগবে না। দশ টাকার ব্যাস।”

দশ টাকার ফুচকা মানে অনেক গুলো ফুচকা। কিন্তু তিতলি যে ভাবে দুই পেলব বাহু দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ওইভাবে আমার পিঠের ওপরে নিজেকে ঢেলে দিয়ে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, ওর সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না। বাইক উল্টো দিকে হেদুয়ার গেটের সামনে নিয়ে পার্ক করলাম। বাইক থামাতেই কচি বাচ্চার মতন লাফিয়ে বাইক থেকে নেমে পড়ল তিতলি। ফুচকা ওয়ালার সামনে অনেক ভিড়, তাও সেই ভিড় ঠেলে হাত বাড়িয়ে দিল।

হাতে শাল পাতার দোনা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে ডাক দিল, “এই এসো না।”

আমি শুধু ওর মিষ্টি চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে ছিলাম। কচি কলাপাতা রঙের ফ্রকে তিতলিকে একদম ইংরেজি দেশের রূপকথার গল্পের পরীদের মতন লাগছিল দেখতে। আমি মাথা দুলিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

নাক ঠোঁট কুঁচকে আমার দিকে কাতর ভাবে তাকিয়ে বলল, “এই আদি রাগ করে না, প্লিজ।”

আমি ওর কাজল কালো নয়নের কালো মণির ভেতরে নিজের ছায়া দেখতে পেলাম। গোলাপি ঠোঁট জোড়া ভীষণ ভাবেই আমাকে নিঃশব্দে আদর করে ডাকছে। আমি ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে নিলাম। ফুচকা ওয়ালার সাথে ফুচকার ঝাল নিয়ে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটাল, এটা ঝাল দিয়েছে নাকি? একটু শুকনো লঙ্কা আরো দাও। জলে একটু আরো তেঁতুল গোল, একদম টক হয়নি। এমন সাদা মাটা জল দিলে দুটো ফাউ দিতে হবে কিন্তু ... ইত্যাদি।
 
পর্ব এক (#5-#5)

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনে গেলাম। একের পর এক টপাটপ দুটো মুখের মধ্যে পুরে নিল তিতলি। কষ বেয়ে কিছুটা জল বেড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই। ফুচকা খেতে খেতে গোলাপি নরম গাল ফুলে গেছে। ইসস উফফ করছে ঝালে তাও চেহারায় এক ভীষণ খুশির ছটা। ঝালের জন্য চোখের কোল বেয়ে জল বেড়িয়ে আসার যোগার, তাও রূপসী ললনার ফুচকা খাওয়া চাই।

আমি ওকে বললাম, “বেশি খেও না।”

কে কার কথা শোনে, উলটে আমাকেই একটা ধ্যাতানি দিল, “চুপচাপ দাঁড়াও, অনেক দিন পরে খাচ্ছি।” তারপরের ফুচকাটা আমার দিকে উঁচিয়ে ধরে বলল, “এই নাও খাও একটা।”

অগত্যা ওই ভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের হাত থেকে প্রথমবার ফুচকা খাওয়া ভেবেই আমার গা হাত পা শুকিয়ে গেল। প্রেম কেন জীবনে এর আগে এইভাবে কোন মেয়ের সাথে ঘুরতে পর্যন্ত বের হইনি। আর প্রথম বারেই এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে ফুচকা খাওয়াবে বলছে ভেবেই আমার ভীষণ অসস্থি বোধ হল। সেদিকে তিতলির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।

সরু পেলব চাঁপার কলি আঙ্গুল দিয়ে ফুচকা আমার মুখের সামনে ধরে কাতর কন্ঠে বলে ওঠে, “নাও না, কি করছ। জল সব পরে গেল যে।”

আমি ওর হাত থেকে ফুচকা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। ওইভাবে কেউ আমাকে রাস্তার মাঝে খাইয়ে দেবে ভাবতেই ভীষণ বিব্রতবোধ করছিলাম।

আমি ফুচকা নিয়ে ওকে বললাম, “তুমি খাও আমি তোমার দোনা থেকেই খেয়ে নেব।”

টপ করে পরের ফুচকাটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে আমাকে বলল, “এর পরেরটা তোমার কিন্তু।”

আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না, “আচ্ছা বাবা, কিন্তু তাড়াতাড়ি খেও। আকাশের অবস্থা কিন্তু একদম ভালো নয়।”

দুইজনে মিলে দশ টাকার ফুচকা খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “উফফ কি শান্তি।”

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ বুঝলাম। এবারে বাড়ি যাওয়া যাক।”

বাচ্চা মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

বাইকে উঠে যথারীতি বাড়ির পথ ধরলাম। আমাকে দুই হাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরল তিতলি। সারা পিঠে শুধু একটা নরম উষ্ণ পরশ ছাড়া আর কিছুই নেই। মনে হল যেন আমার পিঠে জামাটাও নেই। মনে হল শুধু তিতলির শরীর আমার পিঠের ওপরে গলে গিয়ে মধুর প্রলেপ লাগিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁকুড়গাছি মোড় পর্যন্ত চুপচাপ আমার পিঠের ওপরে নিজেকে ঢেলে, কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে চুপচাপ বসেছিল। কাঁকুড়গাছি মোড় আসতেই ইন্সটিটিউটের দেখা পেল।

দেখা পেতেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কাল আসবে তো? নাকি সাইটে যাওয়ার আছে?”

আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলাম, “কাল সাইটে যাওয়ার আছে। জানি না কখন ফিরব।”

জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সাইট?”

আমি উত্তর দিলাম, “জোকা।”

একটু মনমরা হয়েই উত্তর দিল তিতলি, “অনেক দুর তো।”

সত্যি অনেক দুর। সাইটে গিয়ে সব কিছু দেখে শুনে আবার অফিস এসে একটা রিপোর্ট বানাতে হবে। জানি না পরেরদিন কখন ছুটি পাবো। মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল আমার। সেই সাথে আকাশ গুড়গুড় চড়চড় করা শুরু করে দিল। ঝোড় হাওয়া বইতে শুরু করে দিল। তিতলির রেশমি চুল উড়ে এসে আমার হেলমেটের সামনে বার বার চলে আসছে। প্রানপনে আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে তিতলি। উল্টোডাঙ্গা পার হতেই ঝড় উঠে গেল।

তিতলি ভয়ে ভয়ে আমার কানে বলল, “আদি কি হবে?”

আমি ওকে অভয় দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, “এই তিতলি, চিন্তা করো না। বৃষ্টি আসার আগেই তোমাকে কাজিপাড়া পৌঁছে দেব।” চেঁচাতে এইজন্য হল কারণ আমার মাথায় হেলমেট আর চারপাশে ঝড় হাওয়া।

পাগলের মতন বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। বাসের পাশ ঘেঁষে, গাড়ির পাশ কাটিয়ে বাইক ছুটে চলেছে। মনে হল যেন ফরমুলা ওয়ান রেস করছি। লেকটাউন থেকে যশোর রোডে বাঁক নেওয়ার সময়ে পুরো বাইক ডান দিকে কাত করে দুটো বাসের মাঝখান থেকে বের করে দিয়ে একটা টাক্সির কানের পাশ একদম ঘেঁষে বেড়িয়ে গেলাম। তিতলিকে আমাকে প্রানপনে জড়িয়ে ধরে। দশ মিনিট লাগলো, উল্টোডাঙ্গা থেকে কাজিপাড়া পৌঁছাতে। উত্তেজনায় তিতলির হৃদপিণ্ড গলার কাছে আটকে গেছিল। ওর বুকের তীব্র ধুকপুকানি পিঠের ওপরে অনুভব করতে পারছিলাম। আমার চোখের সামনে তখন শুধু মাত্র একটা লাল ফিতে, কাজি পাড়ার মোড়, তিতলির বাড়ির গলির মুখ। বাইক থামাতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তিতলি বাইক থেকে নেমে ব্যাগ থেকে ছাতা বার করে খুলে নিল।

আমি ওকে বাড়ি চলে যেতে বললাম, “আর দাঁড়াতে হবে না যাও।” সে মেয়ে কি আর কথা শোনে নাকি, সেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন। আমি ওকে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন দেরি হচ্ছে না?”

মাথা নাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “থ্যাঙ্কস ফর ফুচকা।”

আমি আকাশের দিকে তাকালাম, ধিরে ধিরে বৃষ্টির ধারা বাড়তে শুরু করেছে। আমি ওকে মুচকি হেসে বললাম, “ওরে পাগলি মেয়ে, বাড়ি যাও।”

বুকের কাছে ব্যাগ চেপে ধরে, দুই হাতে ছাতা ধরে আমাকে বলল, “তোমার ফোন নাম্বার।”

আমি ওকে বললাম, “কাল দেবো। তুমি এখন যাও না হলে ভিজে যাবে।”

মুখ শুকনো হয়ে গেল আমার কথা শুনে, একটু পরে হেসে বলল, “কাল তাড়াতাড়ি এসো।”

আমি মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ। এবারে যাও।”

হেসে ফেললাম আমি। সত্যি পাগলি মেয়ে। হরিণীর মতন লাফাতে লাফাতে, না না, ঠিক সেই অর্থে লাফাতে লাফাতে যায়নি। তবে মায়া মৃগের ন্যায় মত্ত চালে সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে চলে গেল তিতলি। যথারীতি সেই গলির বাঁকে গিয়ে একটু থেমে যাওয়া, আধো আলো আঁধার থেকেই মাথা দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানানো। বৃষ্টি জোরেই শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না আমার। ছোট বেলায় হোস্টেলে বৃষ্টিতে বেশ ভিজতাম আর ধাম ওয়ার্ডেন, বিশেষ করে মনিষ মহারাজের কাছ থেকে খুব বকা খেতাম। বাইক চালিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। ভিজতে ভিজতে বাড়ি পৌছালাম সেদিন। জামাটা খুলে রেখে দিলাম। জামাটা ধুতে একদম ইচ্ছে করছিল না। সারা জামায় তিতলির শরীরের মিষ্টি গন্ধে মম করছিল। বারেবারে মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে আমার জামা কত বেশি ভাগ্যবান। জামার ওপরে তিতলির গাল, তিতলির হাতের ছোঁয়া, তিতলির শরীরের কোমল পরশ, তিতলির গায়ের গন্ধ সব কিছুই মাখামাখি। মনে মনে হেসে ফেললাম।

পরেরদিন একদম ভোর বেলায় সন্তোষ স্যারকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে সোজা জোকা চলে যাবো। সেখানে তদারকি করে তবেই অফিসে যাবো। কথা মতন কাজ। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। গতদিন অনেক রাত পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তা ঘাট ভেজা তাই একটু সাবধানে বাইক চালাতে হচ্ছিল। তাও এক ঘন্টার মধ্যে সাইটে পৌঁছে গেলাম।

ঠাকুরপুকুর, বরিশা, বাবুর বাগান, কালুয়া, জোকা এখানে আগে অনেক ধানা জমি ছিল। ইদানিং চারপাশের এই সব ধানা জমি হুহু করে চড়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন হাইরাইজ উঠছে, নতুন নতুন আবাসন গড়ে উঠছে। সবুজ গাছপালা মরে যাচ্ছে। পাখীদের কলতান চেপে দেওয়া হচ্ছে। শুধু মাত্র মনে পরে গেল আমার তিতলির কথা। যেখানে মানুষ গাছ কাটতে ব্যাস্ত সেখানে তিতলি নিজের বাড়িতে গাছ লাগায়, ছাদেও একটা বাগান করেছে। কনক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পেলাম কচি কলাপাতা রঙের ফ্রক পরিহিত এক পরী। তার হাতে একটা জাদুর দন্ড। এই কংক্রিট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে সবুজের ছোঁয়ায় পৃথিবী আবার হরিত করে তুলতে ব্যাস্ত।

দুপুরের পরে অফিস ফেরার পথে ন্যাশানাল লাইব্রেরি পার করেছি কি বৃষ্টি শুরু। কোলকাতায় বর্ষা কালে যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। অগত্যা চিড়িয়াখানার বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রমাদ গুনলাম, বৃষ্টি মাথায় যদি সময় মতন অফিসে না পৌঁছাতে পারি তাহলে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য আমাকে থেকে যেতে হবে। ওইদিকে চোখের সামনে ভেসে আসে তিতলির চেহারা, কানের মধ্যে বেজে উঠল, “কাল আসবে তো? একটু তাড়াতাড়ি এসো।” সাথে রেনকোট ছিল, সেটা পরেই নিলাম আর অফিসের দিকে রওনা দিলাম। মুষলধারে বৃষ্টি, তাও বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। হেলমেটের কাঁচ ফেলা, সব কিছুই আবছা দেখাচ্ছে। ধ্যাত, রেস কোর্সের ওইখানে আবার লম্বা জ্যাম লেগেছে। প্রতিবার এইখানে জল জমবে আর জ্যাম হবেই, মিউনিসিপালিটি যে কি দেখে কে জানে। গালাগালি দিতে ইচ্ছে করল, কবে যে এই সরকার যাবে। অফিসে একপ্রকার কাক ভেজা হয়েই ঢুকলাম। ঘড়ি দেখলাম চারটে বাজে, হাতে মাত্র দেড় থেকে দু ঘন্টা রয়েছে রিপোর্ট তৈরি করতে।

সন্তোষ স্যার আমাকে ডেকে বললেন, “তুই তো ভিজে চুপসে গেছিস রে।” হেসে ফেললেন আমাকে দেখে।

ব্যাগটা ভাগ্যিস রেন কোটের মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম তাই রক্ষে। ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজ পত্র গুলো টেবিলে রাখার সময়ে আমার ডাক পড়ল কর্ণধার সঞ্জীব স্যারের কেবিনে।

আমাকে কাক ভেজা হয়ে ঢুকতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে হেসে ফেললেন, “বাড়ি যা, কালকে সকালের মধ্যে রিপোর্ট বানিয়ে দিস।”

আমি হেসে বললাম, “না স্যার, এক ঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে।”

সঞ্জীব স্যার বললেন, “আচ্ছা বেশ, যদি ছুটির আগে রিপোর্ট বানিয়ে দিতে পারিস তাহলে কাল তোর ছুটি।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “একা একা ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে কি করব স্যার, তার চেয়ে অফিস ভালো।”

সঞ্জীব স্যার বললেন, “প্রেম কর একটা তখন দেখব তোর হাতে কত সময়।”

আমি লাজুক হেসে মাথা নিচু করে নিলাম। দেড় ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট তৈরি করে ফেললাম, ছুটি আমার চাই না, শুধু মাত্র তিতলির সাথে দেখা করতে চাই। পৌনে ছ’টা নাগাদ রিপোর্ট নিয়ে সঞ্জীব স্যারের কেবিনে পৌঁছে দিলাম। স্যার সব কিছু দেখে নিয়ে খুব খুশি। বললেন যে পুজোতে আমার জন্য দুই দিন ছুটি বশি দেবে। সেটা অবশ্য আমার খুব দরকার। দিম্মা কে নিয়ে মামা বাড়ির সবাইকে নিয়ে হরিদ্বার ঋশিকেশ যাওয়ার কথা আছে। আমিও মাথা নাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বেড়িয়ে পড়লাম অফিস থেকে। বৃষ্টি ধরে এসেছে একটু তবে শেষ হয়নি। ইলশেগুঁড়ির খেলা চলছে মেঘের সাথে কোলকাতার মাটির।

বৃষ্টি মাথায় করে ইন্সটিটিউট পৌঁছাতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। ক্লাস শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই পৌঁছালাম। ক্লাসের মধ্যে ঢুকতেই প্রথম সারির কোনার চেয়ারে বসা রূপসী ললনার সাথে চোখা চুখি হল। আমার জামা ভেজা দেখে ওর মুখ শুকনো হয়ে গেল। সবার অলক্ষ্যে ওকে চোখের ইশারায় চিন্তা করতে বারণ করে দিলাম। শেষের দিকের টেবিলে আমার বন্ধু অনির্বাণ বসে। যথারীতি তার পাশেই আমার স্থান গ্রহন করতে হল।

বসা মাত্রই অনির্বাণের প্রশ্ন, “কি রে, কোথায় ছিলিস রে বোকাচোদা? আমি তো তোর দেরি দেখে ভাবলাম আর আসবি না।”

চোখের কোনা দিয়ে ইতিমধ্যে তিতলি আমার দিকে দুই বার দেখে নিয়েছে। আমি ওর দিকে আড় চোখে তাকিয়েই অনির্বাণকে উত্তর দিলাম, “সাইটে গেছিলাম, সেই জোকা।”

অনির্বাণ আমার কানেকানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “অনুস্কা কয়েকবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। কি ব্যাপার একটু সত্যি করে বলবি?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অনির্বাণের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কতটা কি ধরতে পেরেছে। শয়তানের মস্তিস্ক, ধোঁয়া দেখলে আগুনের ছোঁয়া বলেই ধরেই নেয়। এখন আমি নিজেই সেই আগুনের দেখা পাইনি তাই তার আগেই ছাই চাপা দিতেই হবে।

ওর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি পালটা ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “রবিবার এক্সট্রা মেসিন রুম ছিল সেটা তুই জানতিস?”

অনির্বাণ অবাক হয়েই প্রশ্ন করল, “কবে রে?”

আমি বললাম, “গত রবিবার।”

উত্তর এলো, “ধ্যাত, বালের ঢপের চপের মেসিন রুম ছিল।”

আমিও বললাম, “তুই ছিঁড়ে আঁটি বাঁধ।”

অনির্বাণ বলল, “সত্যি না বললে তোর গাঁড়ে লাত্থি মারব শালা।”

আমিও মিথ্যে বলে দিলাম ওকে, “রবিবার আমার একটা বই নিয়ে গেছিল সেটা সোমবার আনেনি তাই হয়ত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তোকে...”

অনির্বাণ আমার মতন শয়তান ছেলে। আড় চোখে সামনের চেয়ারে বসা তিতলিকে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, “তোর বিচি চটকে হাতে ধরিয়ে দেব চোদনা। বইয়ের জন্য বারেবারে অনুস্কা পেছন ঘুরে তাকাচ্ছে তাই না।”

ধরা পরে গেছি, এবারে সত্যিটা বলতেই হয়। আমি শেষ পর্যন্ত ওর মায়ের দিব্যি দিয়ে ওকে ছোট করে তিতলির পরিচয় দিলাম। সেই সাথে এটাও জানালাম যে এখন পর্যন্ত এর আগে কিছুই হয়নি। শুধু মাত্র ভালো বান্ধবী।

আমার সব কথা শুনে থমকে গেল অনির্বাণ। বেশ কিছুক্ষন আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আমাকে বলল, “অনুস্কা ব্যানারজি, কাজিপাড়া থাকে? ওর কাকা বামপন্থি? পার্টি করে বলছিস? বুধাদিত্য, যদি এই মেয়ে অমিত ব্যানারজির ভাইঝি হয় তাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে রে ভাই।” আমি ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকাতে ও আমাকে বলল, “অমিত ব্যানারজি শালা মহা শয়তান ঢ্যামনা মাল। ওই এলাকার বেশ বড় গুন্ডা। এই সাতগাছি ওইদিকে দমদম ক্যান্টন্মেন্ট থেকে এক নম্বর গেট পর্যন্ত মস্তানি করে বেড়ায়। প্রোমটারদের থেকে তোলা আদায় করে বেড়ায়। সাবধানে থাকিস ভাই। কোনদিন তোকে কেটে ওই বাগজোলা খালে লাশ ভাসিয়ে দেবে। আমি শালা তোর চিতায় আগুন দিতে পারব না রে ভাই।” শেষের কথাটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলল।

কথাটা শুনে ক্ষনিকের জন্য ভয় ঢুকে গেল মনের মধ্যে। মা নেই, বাবা কোথায় জানি না। আমি যদি মারা যাই তাহলে দিম্মা হয়ত তার আগেই মারা যাবে তবে হোঁৎকার মুখটা মনে পড়তেই সব থেকে কষ্ট হল। হোঁৎকা আর তোতাপাখি আমাকে খুব স্নেহ করে। ক্লাসের পড়া আমার মাথায় উঠে গেল। কি করব কিছুই ভেবে পেলাম না। সামনের সাদা বোর্ডের কালো অক্ষর আর মাথার মধ্যে ঢুকছে না। সব কিছু কেমন এলোমেলো হতে শুরু করে দিল। আমাদের মধ্যে ঠিক কি ধরনের সম্পর্ক? একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কি ভালো বন্ধু হতে পারে না? শুধু মাত্র ভালো বন্ধু? কিন্তু যেভাবে গতকাল বাড়ি ফেরার সময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। আমি তিতলিকে সেই মুহূর্তে ভীষণ ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, দেখা যাবে কি হয়।

ক্লাস শেষে অনির্বাণ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি ভাবছিস?”

আমি মাথা নাড়লাম, “জানি না রে।”

জানি না কি উত্তর দেব, বারেবারে হোঁৎকার মুখ মনে পড়ছে। একবার ছোট বেলায় ছাদে উঠেছিলাম দুই ভাই খেলতে। মামা বাড়ির ছাদে রেলিং দেওয়া ছিল না তখন। আমি বল ধরতে গিয়ে ছাদের ধারে চলে গেছিলাম। পা ফস্কে পরে গেলাম। হোঁৎকা দৌড়ে এসে আমার পা টেনে ধরে ফেলল। দুইজনেই তখন অনেক ছোট। হোঁৎকা আমাকে টেনে তুলতে পারেনি, ত্রাহি চিৎকার করে উঠছিল। দিম্মা আর মা দৌড়ে এসেছিল তখন। দোষ আমার ছিল যদিও কিন্তু হোঁৎকা সেদিন মামিমার কাছে বকা খেয়েছিল। ভাইকে দেখতে পারিস না?

কিছুক্ষন বসে থাকার পরে ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমি আর অনির্বাণ। তিতলির সাথে চোখা চুখি হল। বিল্ডিঙের বাইরে বেড়িয়ে দেখলাম তখন বৃষ্টি পরেই চলেছে। বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে একটা দোকানের নিচে আমি আর অনির্বাণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তিতলি বৃষ্টি দেখে বিল্ডিঙের ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল।

অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল, “বুকের পাটা আছে?”

বুক ভরে শ্বাস নিলাম, সিগারেটে একটা বড় টান মেরে বললাম, “জীবন একটাই, মরব একবার। শেষ দেখেই মরি তাহলে।”

মৃদু হাসি দিল অনির্বাণ, “শালা তুই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছিস। মর শালা তাহলে।”

বেশ কিছুপরে দেখলাম তিতলি ছাতা মাথায় করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। অনির্বাণকে দেখে একটু হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই, কেমন আছো?”

অনির্বাণ সিগারেট ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে ওকে মুচকি হেসে উত্তর দিল, “ভালো আছি।” তারপরে আমাকে বলল, “এই আমি চললাম রে। কথাটা মনে রাখিস।” বলে ছাতা মাথায় বেড়িয়ে চলে গেল।
 
পর্ব এক (#6-#6)

অনির্বাণ রাস্তা পেরিয়ে চলে যেতেই তিতলি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছো?”

আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ ঠিক আছি।”

তিতলি আমার চোখের ভেতর দিয়ে গভীর ভাবে তাকিয়ে আমার হৃদপিন্ডের গভীরে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখ শুকনো কেন গো?”

মাথার মধ্যে তখন অনির্বাণের কথা গুলো আওড়াচ্ছিলাম। এই যাঃ ধরা পরে গেলাম নাকি? না না, হেসে ফেললাম তিতলির দিকে দেখে, “আরে আর বল না। সেই সকালে বেরিয়েছি। প্রথমে জোকা গেলাম, সেখান থেকে ভিজে ভিজে অফিস। অফিসে বসে আবার রিপোর্ট বানাতে হল। তারপরে আবার ভিজে ভিজে ইন্সটিটিউট এলাম তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”

কথাটা যেন ওর বিশ্বাস হল না। গভীর ভাবে আমার চোখ জোড়া নিরীক্ষণ করে আবার প্রশ্ন করল তিতলি, “তুমি সত্যি বলছ?”

আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ রে বাবা, সত্যি বলছি।”

বৃষ্টি এক নাগাড়ে পরেই চলেছে। বাস গুলো বেশ ভিড়। কাঁকুড়গাছির মোড়ে একটা বাস খারাপ হয়ে যাওয়াতে মানিকতলা রোডে জ্যাম লেগে গেছে। তিতলি একদম আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, ওর বাজুর সাথে আমার বাজু স্পর্শ করে রয়েছে। ইন্সটিটিউট থেকে আমাদের ব্যাচের কয়েকজন বেড়িয়ে এলো, আমাদের ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভদ্রতার খাতিরে একটু হেসে চলে গেল। হয়ত মনে মনে কত কিছুই ভেবে নিয়েছে ওরা। ভাবে ভাবুক আমার তাতে কি। সেই বৃষ্টিতে দোকানের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে পাশে তিতলিকে দেখে হটাত আমার মনে হল একটু ওর কাঁধে হাত রাখি, আরো একটু কাছে টেনে আনি। আমি ওর দিকে তাকালাম, সেই সাথে তিতলিও আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল। চোখ জোড়া ভীষণ ভাবেই ভাসা ভাসা। কিছু একটা বলতে চাইছে ওর কেঁপে ওঠা ঠোঁট জোড়া, বিশেষ করে ডান দিকের ঠোঁটের ওপরের তিলটা। ফর্সা নরম মসৃণ লালচে গালের ওপরে আমার চোখ আটকে গেল। বৃষ্টির ছাঁটে কয়েক ফোঁটা জল ওর ছাতা বেয়ে কখন ওর গালের ওপরে পরে ছিল ওর হয়ত খেয়াল নেই। কয়েক ফোঁটা জল মিলে একটা অতি ক্ষীণ ধারা ওর গাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। সেই ক্ষীণ ধারার ওপরে আমার চোখ আটকে গেল।

সময় আমাদের মাঝে থমকে। আমার মুখের ওপরে ওর দৃষ্টি আটকে গেছে। ধিরে ধিরে আমাদের বাজুর স্পর্শ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। আমার বুকের কাছে জড়সড় হয়ে আসছে তিতলি। জোলো হাওয়া ভীষণ ভাবেই একটা তীব্র আকর্ষণের মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে আমাদের দুই তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের মাঝে। কিসের তৃষ্ণা জানি না, তিতলিকে যে ভীষণ ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছি আমি। প্রশ্নটা, ওকি আমাকে ভালোবাসে নাকি শুধু মাত্র বন্ধুর চোখে দেখে?

আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, “তিতলি...”

ঘুমের আবেশ কাটিয়ে ওর যেন ঘুম ভেঙ্গে গেল। মৃদু মদির কন্ঠে উত্তর এলো, “কি...”

জড়িয়ে আসছে আমার কন্ঠ, “বাড়ি যাবে না?”

নেতি বাচক সুরে মাথা নাড়িয়ে বলে, “নাহ...” ওর গলাটা অনেক অনেক দূরে থেকে শোনা গেল বলে মনে হল। গলা বসে গেছে তিতলির।

আমি ওকে বললাম, “তিতলি, বৃষ্টি পড়ছে, বাড়ি যাও।”

তিরতির করে কেঁপে উঠল ওর ঠোঁট, “ছাতা মাথায় কি করে বাইক চালাবে?”

কথাটা শুনে আমার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে গেল। মেয়েটা আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, “আজকে প্লিজ ট্যাক্সি করে চলে যাও।”

জোরে জোরে মাথা নাড়াল তিতলি, “নাহ, বৃষ্টি থামুক তারপরে তুমি আমাকে দিয়ে আসবে।”

আকাশের দিকে দেখিয়ে ওকে বললাম, “দেখো, সেই দুপুর থেকে কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের অবস্থা কিন্তু এখন ভালো নয়। মনে হয় রাতে এই বৃষ্টি থামবে না।”

ধস নামছে দুই হৃদপিণ্ডের মাঝে। কাঁপা কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “একা একা?”

আমি ওকে হাসি মুখে প্রবোধ দিয়ে বললাম, “একা কেন রে বোকা মেয়ে। আমি তোমার ট্যাক্সির পেছনেই বাইক নিয়ে থাকব।”

আমার কথা শুনে তখন মনে বল পেল তিতলি। এতক্ষন পরে তিতলির মিষ্টি গোলাপি ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিল ও যেতে রাজি। হাত ধরে রাস্তা পার করলাম। পারলে তিতলি আমার বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়, এমন অবস্থা। এবারে আর বাসস্টান্ডে দাঁড়াতে হল না। আমি বাইকের বাক্স খুলে আমার রেনকোট গায়ে চাপিয়ে নিলাম। সারাক্ষন আমার মাথার ওপরে ছাতা ধরে দাঁড়িয়েছিল তিতলি। ট্যাক্সি পেতে একটু বেগ পেতে হল। বৃষ্টির জন্য বেশির ভাগ ট্যাক্সি ভর্তি আর যারাই আসে তারা কেউই ওইদিকে যেতে চাইছে না। এদিকে প্রায় পৌনে ন’টা বাজে। তিতলির চেহারায় অস্থিরতা ফুটে ওঠে।

কাঁপা কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করে তিতলি, “আদি কি হবে?”

আমি ওকে আসস্থ করে বললাম, “ট্যাক্সি এসে যাবে এত চিন্তা করো না।”

বেশ কিছুক্ষন পরে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। তিতলিকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিতেই ট্যাক্সির দরজা ধরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি ওকে আসস্থ করে বললাম, এই পেছনেই বাইকে আছি। বাইক নিয়ে ওর ট্যাক্সির পিছু নিলাম। বারে বারে জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে। আমাকে একদম ট্যাক্সির পেছনে নয়ত একদম পাশে পাশেই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় গাড়ির চলাচল ধিমে গতিতে হয়ে গেছে। একটানা বৃষ্টিতে উল্টোডাঙ্গার ব্রিজের নিচে জল জমেছে, সেখানেও জ্যাম। বাইক নিয়ে ওর ট্যাক্সির পাশে যেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল ললনার। ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে, বাঁ দিকের দরজার সামনে সরে এসে কাঁচের জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসি দিল। আমি হেলমেটের কাঁচ উঠিয়ে ওকে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, কি হল? মিষ্টি একটা লাজুক হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে দিল তিতলি। কখন ওর ট্যাক্সির পেছনে, কখন ওর ট্যাক্সির পাশে, এইভাবেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওর বাড়ির ওইখানে পৌঁছালাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে ওর চোখ মুখের অভিব্যাক্তি দেখে মনে হল এতক্ষন যেন একটা খাঁচায় বন্ধী ছিল। মুক্তির স্বাদ পেতেই ডানা মেলে দিয়েছে সুন্দরী প্রজাপতি, তিতলি।

ট্যাক্সি থেকে নেমে প্রতিবারের মতন ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন। তারপরে দুষ্টুমি ভরা একটা হাসি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “প্লিজ কাল আমাকে ওই ভিসুয়াল বেসিকটা বুঝাতে আসবে?”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে। ওই দুষ্টু মিষ্টি অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। বললাম, “আচ্ছা আসব। তবে আর ফুচকা নয় কিন্তু।”

ছোট বাচ্চার মতন নেচে উঠল তিতলি। মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল, “না আর ফুচকা নয়।”

আমি ওকে বাড়ি যেতে বলে বাড়ির পথ ধরলাম। বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। সেই সাথে প্রানের মধ্যে এক নতুন জোয়ারের ধারা দেখা দিয়েছে। যে ভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আমার সাথে যাওয়ার জেদ করছিল আর মাথা নাড়িয়ে “নাহ” বলেছিল, সেই কথা ভেবে আপন মনেই হেসে ফেলছিলাম। ট্যাক্সির ভেতরে ওর আশঙ্কা ভীতিপূর্ণ অভিব্যাক্তি মনে পড়তেই বিষণ্ণ ভাব জেগে উঠছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। এক অদ্ভুত অনুভূতি মন প্রান জুড়ে ছেয়ে রইল।

পরের দিন বৃষ্টি থেমে গেছিল। চারপাশে গাছে গাছে নতুন সবুজের ভিড়। মেঘলা আকাশের ফাঁকে মাঝে মাঝে সূর্য দেখা দেয়। সারাদিন অফিসে বসে শুধু ওর অপেক্ষায় ছিলাম। কাজেও সেই ভাবে মন বসছিল না। শুধু ভাবছিলাম, কখন বেথুনের সামনে যাবো। মনে মনে ভাবছিলাম, তিতলি কি ভাবছে? পুরুষ শাসিত সমাজ, নিশ্চয় আমার অপেক্ষায় বসে আছে তিতলি।

সকালের দিকে তাও মানসিকতা ঠিক ছিল। মাঝে মাঝে ভয় করছিল ওর কাকার কথা ভেবে। যত দিন গড়ায় তত একটা অজানা ভয় ভর করতে শুরু করে আমার বুকের ভেতরে। অনির্বাণের কথা গুলো ভীষণ ভাবেই মনে পরে যায়। ওর কাকা যদি জানতে পারে তাহলে কি পরিনতি হবে জানি না। যদি হাত পা ভেঙ্গে রেখে দেয় তাহলে আমায় কে দেখবে? আমার তো সেই অর্থে কেউই নেই। আমি যদি বিছানায় পরে থাকি তাহলে হোঁৎকা কি চিরকাল আমাকে দেখবে? তোতাপাখিকে নিয়ে ওর একটা সংসার আছে। মামা মামির বয়স হয়েছে, তাদের গলগ্রহ হয়ে না থাকার জন্য তো এই ফ্লাটে এসে একা একা থাকছি। বিকেলে অফিস থেকে বেড়িয়ে একবার ভাবলাম, না সোজা বাড়ি চলে যাই। শুক্রবার রাতে তো আমাকে দুর্গাপুর যেতে হবে। তারপরে রূপসী ললনার টোপা টোপা লালচে গালের কথা মনে পরে গেল। আকুল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, একা একা ট্যাক্সিতে উঠবে না। থাকতে পারলাম না। ভাবলাম শেষ বারের মতন একবার দেখা করে আসি। এই ব্যাচ শেষ হতে বেশি দিন নেই। আগস্ট শেষ হতে চলছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমাদের কম্পিউটারের ব্যাচ শেষ হয়ে যাবে। তারপরের সেমেস্টারে আর তিতলির ব্যাচের সাথে এডমিশান নেব না। চোখের সামনে না থাকলে হয়ত কিছুদিনের মধ্যে ভুলে যেতে পারে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাইক চালাতে চালাতে কখন যে বিধান সরণি ধরেছি খেয়াল নেই। কখন যে বেথুনের সামনে পৌঁছে গেছি সেটাও বুঝতেও পারিনি। একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে এনেছিল ওর কলেজের সামনে। সেদিন একদম গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল তিতলি। ওর আশেপাশে আরো বেশ কয়েকটা মেয়ের জটলা ছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই সবার অলক্ষ্যে আমাকে ইশারায় একটু এগিয়ে যেতে বলে দিল। আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে যদি ওর বান্ধবিরা দেখে ফেলে তাতে ওর অসুবিধে হতে পারে। আমি বসন্ত কেবিন ছাড়িয়ে গিয়ে বাইক দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমি সিগারেট ধরিয়ে একটু অপেক্ষা করলাম তিতলির জন্য। বেশ কিছুক্ষন পরে দুর থেকে দেখতে পেলাম তিতলি বেশ তাড়াতাড়ি আমার দিকে হেঁটে আসছে। ওর চোখ মুখের লালিমা দেখে মনে হল কোন মতে বিডন স্ট্রিট পার করেই যেন ঝাঁপিয়ে পরবে আমার ওপরে। ওকে দেখে সিগারেটে বেশ কয়েকটা জোরে জোরে টান মেরে শেষ করে দিলাম।

আমার কাছে এসে মৃদু বকুনি দিল, “সিগারেট না খেলেই নয় নাকি?”

মৃদু হাসলাম আমি, “এটাই আছে একমাত্র সঙ্গী।”

ক্ষনিকের জন্য ফর্সা চেহারা মেঘে ঢেকে গেল। তারপরে বাইকের সিট দেখিয়ে বলল, “চল।” কন্ঠে একটা আদেশের ভাব।

আমি মনে মনে হেসে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম, “ভিসুয়াল বেসিক?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো অভিমানী ললনার, “জলে ডুবে মরেছে।”

আমার ওপরে অভিমানের কারণ বুঝতে পারলাম না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?”

বুকের ওপরে পেলব ফর্সা হাত দুটো ভাঁজ করে রাখা, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগ, পরনে একটা কাঁচা হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ। কালো চাবুকের মতন বাঁকা ভুরুর মাঝে একটা ছোট মেরুন রঙের টিপ, আর ঠোঁট জোড়ায় সব দিনের মতন গোলাপি রঙ। রূপসী ললনা কোনদিন মেকি সাজে সেজে আসতে দেখিনি।

আমার কাছে সরে এসে মৃদু ঝাঁঝিয়ে উঠল, “মিতাটা খুব শয়তান।”

আমি অবাক হয়েই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল মিতার সাথে?”

মৃদু ঝাঁঝিয়ে উঠল ললনা, “তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে না এখানে দাঁড়িয়েই জেরা করবে?”

বুঝতে পারলাম, কিছু একটা নিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছে। অগত্যা রথ তৈরি করে সারথি চেপে বসলো। যথারীতি রাজকন্যে রথে চেপে বসে সারথির কাঁধ ধরে রথ চালাতে আদেশ করল। হেলমেট আর পড়লাম না। ধিরে ধিরেই বিধান সরনি ধরে এগোতে লাগলাম। চুপচাপ আমার কাঁধে হাত রেখে পেছনে বসে তিতলি।

মিনার পার করার পরে মুখ খুলল রূপসী ললনা, “আমি আজ একটা রেনকোট কিনেছি, সেই নিয়ে কত প্রশ্ন। কেন আমি রেনকোট কিনেছি। রেনকোট পরে কেউ কি ট্যাক্সিতে চাপে নাকি।” আমি ওর কথা শুনে অবাক। মেয়ে বাইকে চাপবে বলে রেনকোট কিনেছে? তিতলির বুকের জমানো কথা কি আর থামতে চায়, “আমিও বললাম, যা তুই নিজের চরকায় তেল দে। মিতা জিজ্ঞেস করল তোমার কথা। আমি ওকে বললাম যে আমার কম্পিউটার ব্যাচের, আমাকে ওই ভিসুয়াল বেসিক বুঝাতে এসেছিল। কিছুতেই বিশ্বাস করে না। আচ্ছা বল, আমি কি মিথ্যে বলেছি নাকি?” আমি মাথা নাড়লাম, একদম নয়। আমি তো ভিসুয়াল বেসিক বুঝাতেই এসেছিলাম। বাধ সেধেছিল ওই আকাশ আর ফুচকা। ললনা পেছনে বসে বলেই চলেছে, “কত যেন চিন্তা আমার জন্য। আমার কাকা জানতে পারলে আমার কি হবে। আরে বাবা তোর তাতে কি? তুই তো কোন বুড়োর সাথে ঘুরে বেড়াস আমি কি দেখতে গেছি নাকি? এমনিতে তো কফিহাউস কিম্বা এই বসন্ত কেবিনে বসে কতদিন আমার টাকায় সিঙ্গারা কচুরি খেয়েছিস। তখন?” কি যে বলছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, তাও অগত্যা মাথা নাড়াতে হচ্ছিল আমাকে। শুধু মনে হচ্ছিল বাইক থামিয়ে ওর লালচে গালে একটা চুমু খাই। পাগলি মেয়েটা আমার বাইকে বসবে বলে রেনকোট কিনেছে। কিছু পরে ঝাঁঝিয়ে উঠল রমণী, “কিছু বলবে নাকি চুপ করে থাকবে?”

আমি পড়লাম আকাশ থেকে। তাও ওর মন রক্ষা করার জন্য বললাম, “না না, এটা শিখার খুব বড় ভুল হয়েছে।”

কাঁধে চিমটি কেটে কানের কাছে চেঁচিয়ে উঠল তিতলি, “শিখা কোথা থেকে এলো এখানে?” আমি চিন্তায় পরে গেলাম। শিখা নয় তাহলে কার নামে আমাকে এতক্ষন ধরে নালিশ করছিল তিতলি। দুম করে পিঠের ওপরে কিল মেরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “তুমি আমার কোন কথা শোন না। যাও আমি আর তোমাকে কিছুই বলব না।”

অগত্যা পাঁচমাথা পার করে বাইক দাঁড় করাতে হল আমাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম চোখের কোল ছলকে আসার যোগার রূপসী কন্যের। আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “এই দেখো। বাইক চালালে কথা শোনা যায় নাকি? তুমি বল। প্লিজ কাঁদে না।” আমি ওর চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি রেনকোট কিনেছ?”

মাথা দোলায় তিতলি, “হ্যাঁ।” টিয়াপাখির মতন নাকের ডগায় লালচে রঙ ধরে যায়। লাজুক হেসে আমাকে বলল ললনা, “ছাতা নিয়ে বাইকে চড়া যায় নাকি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হেসে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম, “ছাতাও এনেছ?”

মুচকি হেসে মাথা দোলাল, “হ্যাঁ, ওটা তো নিতেই হবে।”

আমি ওকে বললাম, “ঝামেলা তাহলে বাড়ল কি বল।”

নিচের ঠোঁট দাঁতে চেপে বলল, “মনে হয়।” আকাশের দিকে দেখে বলল, “কোলকাতায় কেন যে মরতে এত বৃষ্টি হয় জানি না বাপু।”

আমিও হেসে ফেললাম, “তাহলে তো কোলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হয়।”

চোখ জোড়া চকচক করে উঠল তিতলির। কন্ঠে ভরা উৎফুল্ল, “কোথায় নিয়ে যাবে?”

হটাত ওইভাবে চোখ জোড়া চকচক করতে দেখে আমার ভয় পেয়ে গেল। করছি কি আমি? আগুনে ঘৃতাহুতি কেন দিচ্ছি? আমি তো এসেছিলাম একটু দেখা করতে। অনির্বাণের সাবধান বানী মনে পরে যেতেই গলাটা শুকিয়ে গেল। সেই সাথে এই একটু আগেই কথা বলতে বলতে ওর কাকার ব্যাপারে তিতলির মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেছিল। ভয় ঢুকে গেল আমার মনের মধ্যে। সত্যি ভিতু ছেলে আমি। আবার বাইক স্টার্ট করে দিলাম। আমাকে পেছন থেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল তিতলি।

পিঠের ওপরে নরম গাল ঘষে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি পুজোতে কি করছ?”

বুক ভরে শ্বাস নিলাম আমি। একটু ভেবে উত্তর দিলাম, “দিম্মা মানে আমার দিদাকে নিয়ে হরিদ্বার ঋশিকেশ ঘুরতে যাবো।”

শুকনো কন্ঠে উত্তর এলো, “তুমি পুজোতে কোলকাতায় থাকবে না?”

মাথা নাড়লাম আমি, “না গো। দিম্মা অনেকদিন ধরেই হরিদ্বার ঋশিকেশ যাওয়ার কথা বলছেন, এইবারে নিয়ে যেতেই হবে।” চুপ করে আমার পিঠের ওপরে ওর মৃদু শ্বাসের লয় অনুভব করতে পারছি। পরের দিন রাতে আমি থাকব না সেটা জানানো দরকার। বুকে বল নিয়ে আমি ওকে বললাম, “কাল রাতে ক্লাসের পরে আমি দুর্গাপুর যাবো।”

তিতলি আমাকে জিজ্ঞেস করল, “রাতে দুর্গাপুর যাবে?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, ওইখানে আমার মামাতো দাদা থাকে।”

আমাকে জিজ্ঞেস করল, “রাতে কেন? সকালের ট্রেনে চলে যেও।”

আমি ওকে বললাম, “দাদা রাতেই যেতে বলেছে।”

তিতলি ছোট করে একটা উত্তর দিল, “আচ্ছা।” ওর গলা শুনে বুঝতে পারলাম যে ও আমার কথা একদম বিশ্বাস করেনি।

যদিও কথাটা ঠিক নয়। পরেরদিন সকালে গেলেও কোন অসুবিধে হত না। ভয়টা আমার বুকের মধ্যে কাঁটার মতন বিঁধে গেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। যদি কোনদিন ধরা পরি তাহলে যদি মেরে ফেলে তাহলে তো ঠিক আছে। কিন্তু যদি না মেরে হাত পা ভেঙ্গে রেখে দেয় তাহলেই মুশকিল। কার গলগ্রহ হয়ে বাকি জীবন কাটাবো?

বাকি রাস্তা আমার পিঠের ওপর থেকে সরে গিয়ে শুধু মাত্র কাঁধে হাত রেখে নিজের ভার সামলে বসে রইল। কারুর মুখে কোন কথা নেই। যথারীতি ওকে ওর গলির মুখে নামিয়ে দিলাম। অন্যদিনের মতন আর সেদিন দাঁড়াল না তিতলি। বাইক থেকে নামার পরেই, আমাকে বিদায় না জানিয়েই মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। গলির বাঁকে আধো আলো আঁধারে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটু তাকিয়ে দেখল। মাথা নারল না। চুপচাপ হারিয়ে গেল গলির বাঁকে।

সারাটা রাত আমি শুধু ছটফট করেই বিছানায় কাটিয়ে গেলাম। কেন দেখা করতে গেলাম আমি ওর সাথে। এর আগেও বৃষ্টি হয়েছে, এর আগেও ওই বাসস্টান্ডের নিচে নিশ্চয় অনেকবার দাঁড়িয়ে থেকেছে তিতলি। সেদিন কেন বৃষ্টি এলো? না আসলেই পারত। সেদিন না হয় দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু তারপরে তো বেশ কয়েকবার শুধু মাত্র দেখাই হয়েছিল। কেন মরতে সেদিন ওকে বাইকে চাপাতে গেলাম? আসল কথাটা নিজেকে একদম বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না আমি। কেন মরতে এক নিষ্পাপ সুন্দরী ললনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

পরেরদিন ক্লাসের পরে, যদিও তিতলি আমার দিকে আর ঘুরে তাকায়নি তবে আমি বারবার ওর করুন চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলাম। অফিসে ব্যাগ নিয়েই গেছিলাম, সেই ব্যাগ আমার সাথেই ছিল। ইন্সটিটিউট থেকে বেড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম আমার অদুরে তিতলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আমি থাকতে পারলাম না ওর ওই করুন চেহারা দেখে। আমি দুই পা এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। ভাসা ভাসা ঝাপসা হয়ে আসা কাজল কালো নয়ন মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল তিতলি।

আমি আমার ব্যাগ হাতে ওর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?”

অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছোট রুমাল দিয়ে চোখের কোল মুছে উত্তর দিল, “কিছু না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়ি যাবে না।”

মাথা নাড়ল, “নাহ।”

আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, “রাত হয়েছে। বাড়ি না গেলে রাতে কোথায় থাকবে?”

চাপা ঝাঁঝিয়ে উঠল ললনা, “জাহান্নুমে যাবো আমি। তোমার তাতে কি?”

আমি মাথা নিচু করে ওর সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। ভীষণ ভাবেই ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে বুকের মধ্যে টেনে ধরতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু পারিনি সেদিন। ভিতু ছেলে। এই নাকি ভালোবাসা, ছিঃ।

কি ভেবে হটাত করেই আমি তিতলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কাকুর নাম কি অমিত ব্যানারজি?”

আমার মুখে নিজের কাকার নাম শুনেই তিতলির চেহারা রক্ত শুন্য হয়ে গেল। আমার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট জোড়া অল্প খোলা। ধিরে ধিরে ওর চোখ জোড়া ভরে গেল জলে। ওর ওই ভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আমার সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল।

ওর চোখে জল দেখে ওকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম, “তিতলি বাড়ি যাও।” একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল সেটা কে দাঁড় করিয়ে ওর মধ্যে এক প্রকার জোর করেই ওকে চড়িয়ে দিলাম। ট্যাক্সির জানালা ধরে আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে রইল। আমি ওকে বললাম, “তিতলি, বাড়ি গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে একবার ভেবো। তুমি আর আমি দুই মেরুর দুই প্রান্ত। তুমি আমার সম্বন্ধে কিছুই জানো না।” কথা গুলো বলার সময়ে আমার হৃদপিণ্ড পাঁজরের বাঁধন ছিঁড়ে গলার কাছে এসে ধাক্কা মারছিল। তিতলির চোখ জোড়া ভেসে গেছিল। টপটপ করে জলের ফোঁটা ওর ফর্সা হাত ভিজিয়ে দিচ্ছিল। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, “এই পর্যন্ত হয়ত আমাদের দেখা তিতলি। আমি ভিতু, আমি কাপুরুষ।” তারপরে আমি ট্যাক্সির ড্রাইভারকে বললাম তিতলিকে কাজিপাড়া নামিয়ে দিতে।

ট্যাক্সি ছাড়ার মুহূর্তে আমার হাত চেপে ধরল তিতলি। ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে, দুই নয়নে বন্যা, “আদি আমি তোমায়...”

বাকিটা আর শুনতে পারলাম না, তার আগেই ওর ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। ওর চোখের একফোঁটা অশ্রু আমার হাতের ওপরে পড়ল। আমি সেই ট্যাক্সির দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমি বড় পাপী মানুষ। হাতের উল্টো পিঠের ওপরে ওর এক ফোঁটা অশ্রু মনে হল যেন একটা দামী হীরের কণা। ঠোঁট চেপে ধরলাম ওর অশ্রু ফোঁটার ওপরে। কানের মধ্যে শুধু সেই কান্নার রোল প্রতিধ্বনিত হয়, “আদি আমি তোমায়...” বাকি কথা আর শুনতে পেলাম না।

============== পর্ব এক সমাপ্ত ==============
 
n1oxWQh.jpg


পর্ব দুই (#1-#7)

মিনিবাস ধরে বেড়িয়ে পড়লাম। রাত বেশ হয়েছিল তাই বাসে বিশেষ ভিড় ছিল না, বসার জায়গা পেয়ে গেছিলাম। সিটে বসার পরে মনে হল যেন আমি কত বড় এক ভীতু কাপুরুষ ছেলে। প্রথমত মুখ ফুটে নিজের মনের কথা বলতেই পারলাম না, দ্বিতীয়ত যেটা প্রথমের চেয়েও বেশি গুরুতর, সেটা হচ্ছে মার খাওয়ার ভয়ে পিছিয়ে আসা। ভীতি আমলুক নয়, কি করব পঙ্গু হয়ে কারুর গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকাটাই মুশকিল। হাওড়া পৌঁছে একটা পিসিও থেকে প্রবালদাকে ফোন করে দিলাম। লাস্ট বর্ধমান লোকালে বর্ধমান পৌঁছে তারপরে অন্ডাল লোকালে দুর্গাপুর পৌঁছে যাবো। দুর্গাপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বারোটা হয়েই যাবে। সারাটা রাস্তা শুধু চোখের সামনে তিতলির তিরতির করে কম্পিত নরম গোলাপি ঠোঁট জোড়া ভেসে উঠছিল, কানের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, “আদি আমি তোমায়...” একটু দাঁড়িয়ে গেলে হয়ত ওর কথাটা শুনতে পেতাম। কিন্তু ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছিল।

দিনের শেষের লোকাল ট্রেন, যাত্রী বলতে কেউ নেই ট্রেনে, শুধু কয়েকজন হকার, কয়েকজন দোকানি হয়ত ব্যাবসাদার। দিন আনি দিন খাই এরা মানুষ, ওদের দেখে নিজেকেও অনেকটা তাই বলেই মনে হল। পরনে খুব সাধারন পোশাক আশাক, এমন কিছু বড় অফিসে চাকরি করি না, এমন কিছু বিশাল কোন মাইনেও পাইনা। হুহু করে রাতের অন্ধকার চিড়ে ধেয়ে চলেছে লাস্ট বর্ধমান লোকাল। বর্ধমান পৌঁছে, লাস্ট অন্ডাল লোকাল ধরলাম। বর্ধমান লোকালে যাও কয়েকজন মানুষ ছিল, অন্ডাল লোকালে তাও নেই। একটা বেঞ্চিতে একজন কেউ শুয়ে রয়েছে তাছাড়া কামরা সম্পূর্ণ শুন্য। ছেঁড়া চাদরের মধ্যে থেকে মুখ বের করে সেই অপরিচিত বৃদ্ধ মানুষ মাথা বের করে আমার দিকে তাকাল। মাথার চুল অনেকটাই সাদা হয়ে গেছে। গাল ভর্তি দাড়ি। চাদরটা শতছিন্ন, অনেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রঙের কাপড়ের তালি তাপ্পি দেওয়া। ওই মানুষের কাঁথার মতন আমার মনের অবস্থা, শতছিন্ন বহু প্রশ্নে বিদ্ধ। আমি কি সত্যি তিতলিকে ভালোবাসি? যদি ভালোবাসি তাহলে এতদিন, প্রায় এক মাসের মতন হয়ে গেল, কেন কেউ মুখ ফুটে কেউ কাউকে বলতে পারলাম না? আমি কেন কাপুরুষ? বিদায় বেলায় ট্যাক্সিতে উঠে তিতলি আমাকে ঠিক কি বলতে চেয়েছিল? আমি গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, এক হাতে রড ধরে অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে। দুইপাশে অন্ধকার ঘেরা ধানের খেত, দূরে দিগন্তে কোথাও কোন গ্রামের কোন বাড়িতে ছোট ছোট আলো জ্বলছে। আকাশে মেঘ, তাও তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে এক ফালি চাঁদ উঁকি মারছে। চাঁদের ওই বাঁকা হাসি যেন আমাকে ভীষণ ভাবেই তিরস্কার করছে। দুর্গাপুর পৌঁছাতে রাত প্রায় বারোটা বেজে গেল। প্রবালদা আমার জন্য বাইক নিয়ে স্টেসানের বাইরে অপেক্ষা করছিল।

বাইকে উঠে আমি প্রবালদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে কি ব্যাপার বলতো?”

প্রবালদা হেসে উত্তর দিল, “চল চল বাড়ি চল তারপরে বলছি।”

হাসিটা ভালো লাগলো না সত্যি বলছি, এমনকি প্রবালদার গলাটাও কৌতুকপূর্ণ ছিল। কি হতে চলেছে বলা মুশকিল। রেল স্টেশান থেকে ডিভিসি কলোনি বেশ দুর। ওর কোয়াটারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল। তোতাপাখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাইকের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে এক গাল হাসি দিল তোতাপাখি।

প্রবালদা আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল, “যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নে, তারপরে খেয়ে দেয়ে নে। অনেক রাত হয়েছে।”

তোতাপাখির হাসি দেখে আমার ভীষণ সন্দেহ হল। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে আমি তোতাপাখিকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা বর বউ মিলে কি প্লান করছ বলতো?”

তোতাপাখি আমার হাত ধরে মুচকি হেসে বলল, “তুমি না সত্যি। আজকে তোমার জন্য সর্ষে ইলিশ বানিয়েছি। যাও যাও আগে হাত মুখ ধুয়ে নাও তারপরে খেতে খেতে গল্প করা যাবে।”

কোয়াটারটা বেশি বড় না হলেও, তোতাপাখির হাতের ছোঁয়ায় বেশ সুন্দর উঠেছে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে গল্প করতে করতে সব প্রশ্নের সমাধান হল। যা বোঝা গেল তাতে হোঁৎকা আর তার সুন্দরী স্ত্রী, তোতাপাখি মিলে চক্রান্ত করে আমার ছোট ফ্লাটে আরো একজনের প্রবেশ ঘটাতে চাইছে। ভীষণ দুরাভিসন্ধি। প্রবালদার অফিসের ম্যানেজার, বুদ্ধদেব সাহা, বেশ বড় পোস্টে চাকরি করেন। তার কন্যে সংযুক্তা সাহা, সেই বছরেই দুর্গাপুর ওমেন’স কলেজ থেকে পল সায়েন্স নিয়ে পাশ করেছে। বুদ্ধদেব বাবুর বড় ছেলে, সেও ডিভিসিতে চাকরি করে। দক্ষিণ পল্লীতে বিশাল দোতলা বাড়ি। বেশ বড়লোক মানুষ, দুর্গাপুরে বুদ্ধদেব বাবুর বেশ নামডাক আছে। বেশ কয়েকমাস ধরেই নাকি তিনি তাঁর কন্যের জন্য ছেলে খুঁজছিলেন। আমার পরিচয় ইত্যাদি পেয়ে বিশেষ করে আমার পড়াশুনা স্কুল কলেজের ব্যাপারে জানার পরে তাঁরা নাকি একবার আমাকে দেখতে চায়। মামা মামী নাকি গত গ্রীষ্মের সময়ে এসে সংযুক্তাকে দেখে গেছেন। মামীর ওপরে বেশ রাগ হল আমার, একবার বললেন না আমাকে। প্রবালদা অবশ্য তাঁদের কে আমার ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছে, আমার বাড়ির কথা ইত্যাদি। তাতে নাকি তাঁদের কোন আপত্তি নেই। খাওয়ার পরে একটা সাদা খামের ভেতর থেকে একটা ফটো বার করে দেখাল তোতাপাখি। ছবিতে সবাইকে ডানা কাটা পরীর মতন দেখায়। ছবিটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটা দেখতে মন্দ নয়।

আমি শোয়ার আগে একটা সিগারেট ধরানোর জন্য বাইরের বারান্দায় এলাম। আকাশের ছড়ান ছিটানো মেঘের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে ওই এক ফালি চাঁদ আমাকে দেখে তিরস্কারের হাসি হেসে চলেছে। বাঁ হাতের দুই আঙ্গুলের মাঝে সিগারেট ধরা, ডান হাত মুঠো করে উল্টো পিঠ দেখলাম আমি, যেখানে এই কয়েক ঘন্টা আগে এক সুন্দরী প্রজাপতির এক ফোঁটা চোখের জল পড়েছিল। বুকের পাঁজর গুলো এক এক করে জ্বলছে। সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকে গেলাম। পাশের ছোট শোয়ার ঘরে আমার বিছানা পাতা। ঘুম আসছে না। জানালা খোলা, বেশ হাওয়া দিচ্ছে, আকাশের মেঘের মধ্যে চাঁদ লুকোচুরি খেলা করছে। আমি চাদর গায়ে বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে বুকের মধ্যে। চোখ বন্ধ করলেই কানের মধ্যে ভেসে আসে তিতলির করুন কন্ঠ, “আদি আমি তোমায়...”। বাঁচার লড়াই, কিন্তু কার সাথে সেই বাঁচার লড়াই সেটাই যে জানি না আমি। ভোর রাতের দিকে চোখ বুজে এলো, শুতে যাওয়ার আগে ঠিক করলাম, হোঁৎকাকে বলে এই দুর্গাপুরে ডিভিসিতে চাকরি নিয়ে নেব। যদি সংযুক্তা চায় তাহলে ওকেই বিয়ে করব।

ঘুম ভাঙল তোতাপাখির মিষ্টি ডাকে, “এই গেছো, ওঠো।” চোখ মেলে দেখলাম তোতাপাখি বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে। মিষ্টি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “রাতে ঘুম হয়েছে?”

আমি ওকে ইয়ার্কি মেরে বললাম, “তুমি আর হোঁৎকা রাতে যা শুরু করছিলে তাতে কি আর ঘুম হয় নাকি?”

ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল মিষ্টি তোতাপাখি। কান গাল লাল হয়ে গেল ওর। পদ্ম কুড়ির মতন চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে এলো তোতাপাখির বুকের ওপরে। মিষ্টি একটা “ধ্যাত” বলে বিছানার ওপরে চায়ের কাপ রেখে লজ্জিত ত্রস্ত পায়ে পালিয়ে গেল আমার সামনে থেকে। তোতাপাখির লজ্জা দেখে মনে মনে হেসে ফেললাম আমি।

সকালের জল খাবারের সময়ে প্রবালদা জানিয়ে দিল যে দুপুরে বুদ্ধদেব বাবুর বাড়িতে আমাদের খাওয়ার নেমতন্ন সেই সাথে সংযুক্তাকে দেখাও হয়ে যাবে। একটা গাড়ি বলা ছিল। স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম আমরা তিনজনে। জীবনে প্রথম বার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। অবশ্য হোঁৎকার বিয়ের আগে একবার আমি আর হোঁৎকা তোতাপাখির জাগুলিয়ার বাড়িতে গেছিলাম। সেটা অবশ্য হোঁৎকার বিয়ে ছিল। এটা আমার জন্য দেখতে যাওয়া। বুকের ভেতরটা একটু ধুরুক ধুরুক করছে। চাকরির ইন্টারভিউতে এত ভয় পাইনি যতটা রাস্তায় গাড়িতে যেতে যেতে ভয় করছিল। তোতাপাখি বারে বারে আমাকে সহজ হতে বলছিল। সে কথা কি আর কানে যায় নাকি আমার।

ডিভিসি কোয়াটার থেকে দক্ষিণ পল্লীতে বুদ্ধদেব বাবুর বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগে গেল। আমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়েই আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বেশ কয়েকজন বেড়িয়ে এল বাড়ি থেকে। দোতলা বাড়িটা বেশ বড়, সামনে একটা বড় ফুলের বাগান। বাড়ির একপাশে একটা গ্যারেজ তার মধ্যে একটা স্টিল রঙের ওপেল এস্ট্রা দাঁড়িয়ে। গাড়ি বাড়ি দেখে বেশ বড়লোক বলেই মনে হল। বসার ঘরে ঢুকে বসলাম, বেশ বড়সর বসার ঘর। প্রবালদা আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বুদ্ধদেব বাবু, তার পাশে তার শ্যালক, সমরেশ, বুদ্ধদেব বাবুর ভাই, বেশ কয়েকজন মহিলা, বসার ঘরে রিতিমত লোকজনে ভর্তি। আমি চুপচাপ বসে এদিকে ওদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জরিপ করে নিচ্ছি। আমার বউদি, তোতাপাখি মুখে ফুলঝুরি ছোটে সুতরাং বাড়ির মহিলাদের সাথে মিশে যেতে বেশি সময় নিল না। আমার দিকে ছোঁড়া প্রশ্ন গুলোর বেশির ভাগ উত্তর প্রবালদা দিয়ে দিচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষন পরে আমাকে অথই জলের মধ্যে ফেলে দিয়ে তোতাপাখি বাড়ির মধ্যে মহিলাদের সাথে কোথায় যেন চলে গেল।

বুদ্ধদেব বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কোম্পানি কেমন চলছে?”

আমি উত্তর দিলাম, “ছোট প্রাইভেট কোম্পানি মোটামুটি চলছে। আমি সময় মতন মাইনে পাই তাই এর বেশি খবর রাখি না।”

মৃদু হাসলেন বুদ্ধদেব বাবু, “প্রবাল বলছিল তুমি যদি একবার ডিভিসিতে এপ্লাই কর।”

মাথা দোলালাম আমি, “হ্যাঁ দেখি। এখন তো একটা কম্পিউটার কোর্স করছি। এটা শেষ হওয়ার পরেই চাকরি চেঞ্জ করার কথা ভাবা যাবে।”

বুদ্ধদেব বাবু একটু ভেবে বললেন, “না না ঠিক আছে। তা এই কম্পিউটার কোর্স কতদিন আর বাকি আছে?”

আমি উত্তর দিলাম, “আরো একটা সেমেস্টার বাকি আছে। মানে শেষ হতে আরো মাস সাত আট বলতে পারেন।”

মৃদু হেসে বললেন, “তাই হোক। তুমি তাহলে তোমার কম্পিউটার কোর্স শেষ করে একবার ডিভিসিতে পরীক্ষা দিও। প্রবালতো আছেই আমিও না হয় দেখব।”

মাথা দোলালাম আমি, বাঙালি মেয়ের বাবা, জামাই সরকারি চাকুরেরত খুঁজবে এটাই ধর্ম।

বুদ্ধদেব বাবুর পাশে বসা একজন ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাঙ্গুরে তোমার নিজের ফ্লাট? একাই থাকো?”

মাথা দোলালাম আমি, “হ্যাঁ আমার নিজের ফ্লাট, একাই থাকি।”

সেই ভদ্রলোক বললেন, “একা থাকো, তাহলে তো এখানে চাকরি হলে অসুবিধে কিছু নেই।”

ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল আমাকে একা পেয়ে এদের আরও বেশি করেই পছন্দ হয়ে গেছে। সাথে এটাও বুঝতে অসুবিধে হল না যেহেতু আমার কেউ নেই তাই মেয়ের বাড়ির কাছেই টেনে আনলে এদের সুবিধে হবে। নিজের আত্মসন্মানে একটা ঘা লাগলো। আমি প্রবালদার দিকে আড় চোখে একবার তাকালাম। প্রবালদা বুঝে গেল আমার অস্বস্তি, তাও চোখের ইশারায় আমাকে একটু চুপ করে থাকতে বলল। প্রবালদার বস তাই সন্মানের সাথেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছিল।

বেশ কিছুপরে সংযুক্তাকে সঙ্গে নিয়ে আমার বউদি বসার ঘরে প্রবেশ করল। ছবিতে দেখা মেয়েটার সাথে মেলাতে চেষ্টা করলাম, একটু অসুবিধে হল। একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ির পরতে পরতে ঢাকা উদ্ভিন্ন যৌবনা এক তন্বী ললনা। সজিয়ে গুছিয়ে একদম পটে আঁকা ছবির মতন বসার ঘরে আনা হয়েছে। বেশ মিষ্টি দেখতে তবে দেখে মনে হল অনেক কচি, অনেক কম বয়স। গায়ের রঙ ফর্সা। আমার অবচেতন মন তিতলিকে সংযুক্তার পাশে দাঁড় করিয়ে একবার মানসপটে দুইজনের তুলনা করতে শুরু করে দিল। তিতলি অনন্যা, না সাজলেও অতীব সুন্দরী, যদিও সংযুক্তাকে সেই হিসাবে দেখিনি তাও মনে হল তিতলির লাবন্যের কাছে পাশে ম্লান হয়ে যাবে। সেই টিয়াপাখির মতন নাক নেই, পদ্মপাতার মতন চোখের পাতা নয়। সব থেকে যেটা বাধ সাধল, তিতলির মতন সংযুক্তার ঠোঁটের ওপরে ডান পাশে কোন তিল নেই। মনে মনে হেসে ফেললাম আমি, এই তো গতকাল রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম যে যা হয় হোক সংযুক্তাকে বিয়ে করে এই দুর্গাপুরে না হয় চলে আসব। কিন্তু সংযুক্তাকে সামনে নিয়ে আসার পরে বুকের ভেতরে দ্বন্দযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হাত মুঠো করে নিলাম আমি, চোখের দৃষ্টি সেই জায়গায় নিবদ্ধ, যেখানে গতকাল রাতে তিতলির এক ফোঁটা অশ্রুকণা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। কর্ণ কুহরে প্রতিধ্বনিত হল ওর শেষ আকুতি, “আদি আমি তোমায়...” আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে ধিরে ধিরে।

প্রবালদা আমার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ফিরিয়ে আনল ওদের মধ্যে। চোখের ইশারায় আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি রে কি হয়েছে? মাথা নাড়লাম আমি, মৃদু হেসে বললাম, না রে কিছু না। তোতাপাখি আগে থেকেই সব জেনে বসে আছে, সেই আমার সাথে সংযুক্তার পরিচয় করিয়ে দিল। পাতলা ঠোঁটে মৃদু হাসি মাখিয়ে লাজুক চোখে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকায় সংযুক্তা। সেই হাসির প্রতি আমি নিঃস্পৃহ, আমার হাসি ওই মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। আমার দৃষ্টি সামনের সোফায় বসা সংযুক্তাকে ছাড়িয়ে কাজিপাড়ার সেই গলির মুখে চলে গেছে। রাস্তার নিয়নের আধো আলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তিতলি, মৃদু মাথা দুলিয়ে একটু হেসে গলির বাঁকে হারিয়ে গেল।

এমন সময়ে তোতাপাখি আমার পাশে এসে আমার কানে কানে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি হয়েছে?”

অনেকক্ষণ পরে কানের পাশে তোতাপাখির গলার আওয়াজ পেয়ে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললাম, “কিছু না।”

তোতাপাখি আমাকে বলল, “কিছু কথা বল? এমন চুপচাপ কেন বসে আছো?”

আমি মৃদু হেসে ওকে উত্তর দিলাম, “সব তো তুমি জেনে বসে আছো। আমার কি আর জিজ্ঞাস থাকবে।”

তোতাপাখি ভুরু কুঁচকে আমাকে বলল, “তাও, কিছু তো জিজ্ঞেস করবে, নাকি।” আমার হাতের ওপরে হাত রেখে বলল, “লজ্জা পাচ্ছো নাকি?”

আমি মুচকি হেসে জানালাম, “তা একটু। আসলে কি জিজ্ঞেস করব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।”

তোতাপাখি মৃদু হেসে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “এই মেয়ে কিন্তু আমার মতন ভীষণ কথা বলে।”

আমি হেসে দিলাম ওর কথা শুনে, “তাহলেই হয়েছে। বাড়িতে ঝগড়া লাগলো বলে।”

তোতাপাখি সবার চোখের আড়ালেই আমার বাজুতে একটা চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, “তুমি না যাতা।” একটু থেমে সংযুক্তার দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল, “একা ছাড়তে হবে নাকি তোমাদের?”

আমার ইচ্ছে ছিল না কারুর সাথে কোন কথা বলার। তাও ভদ্রতার খাতিরে বললাম, “তাই সই। দেখি কত কথা বলে।”

মুচকি হসি দিল তোতাপাখি। গভীর ভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “পছন্দ হয়েছে নাকি?”

উত্তর দিতে পারলাম না। আমার চোখের ভাষা খোলা বইয়ের মতন পড়ে ফেলতেই নিরুত্তর হয়ে গেল তোতাপাখি। ফিসফিস করে বলল আমাকে, “দয়া করে, ভদ্রতার খাতিরেই না হয় কিছু জিজ্ঞেস কর। বাকিটা আমি আর তোমার দাদা সামলে নেব।”

তোতাপাখির কথা শুনে কি বলব কিছু ভেবে পেলাম না। তাও ভদ্রতার খাতিরেই সংযুক্তাকে ওর কলেজের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলাম। একদম মুখ বন্ধ করে বসে থাকাটা ভীষণ দৃষ্টি কটু লাগছিল সেটা আমিও বুঝতে পারছিলাম। দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করাই ছিল, কিন্তু তোতাপাখি আমাকে বাঁচিয়ে দিল। শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে মিষ্টি মুখ করেই আমরা বুদ্ধদেব বাবুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। বিদায় নেওয়ার আগে বুদ্ধদেব বাবু বারবার আমাকে দুর্গাপুরের চাকরির ব্যাপারে জোর করলেন। আমিও ভদ্রতার খাতিরে শান্ত গরুর মতন মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম, কম্পিউটার কোর্স শেষ হলেই এখানে ডিভিসিতে এপ্লাই করে দেব।

গাড়িতে চাপতেই প্রবালদা আমাকে চেপে ধরল, “দেখ বুধো, বুদ্ধদেব স্যার আমার বস। আমার একটু মান সন্মান রাখিস।”

প্রবালদাকে থামিয়ে দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করল তোতাপাখি, “মেয়ের নাম কি? কি ঘটনা?”

প্রবালদা হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি তোতাপাখিকে উত্তর দিলাম, “জানি না গো আমার কি হবে।”

তোতাপাখি আমাকে জিজ্ঞেস করল, “অফিসের কেউ নাকি ওই ইন্সটিটিউটের?”

আমি উত্তর দিলাম, “আমার ব্যাচের একজন। নাম অনুস্কা ব্যানারজি, ডাক নাম তিতলি।”

ধিরে ধিরে এক এক করে সব কিছুই তোতাপাখি আর হোঁৎকাকে খুলে বললাম। তিতলির স্বভাব, তিতলির পরিচয় ওর বাবার কথা, ওর কাকার কথা, ওরা বড়লোক সেই কথা আর সব শেষে গতকাল রাতে ট্যাক্সির কথা। আমার হাতের ওপরে এক ফোঁটা অশ্রুকণা এখন যেন লেগে রয়েছে। সব শুনে হোঁৎকা একটু চিন্তায় পরে গেল। একদিকে ওর অফিসের বস বুদ্ধদেব বাবু, অন্যপাশে আমি নিজেই জানি না কি করব। আমার আর দুর্গাপুরে থাকতে ভালো লাগছিল না। আমি ওদের জানিয়ে দিলাম যে বিকেলের ব্লাক ডায়মন্ডে বাড়ি ফিরে যাবো। বাড়ি ফিরে যাবো শুনে তোতাপাখির ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই আমার সব কথা শোনার পরে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না তোতাপাখি। কোয়াটারে ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। বাড়ি ফিরতে হবে। আমার ঘুম ট্যাক্সি করে জল ভরা চোখে চলে গেছে। নিজেই জানিনা কি করব।

বিদায়ের শেষ বেলায় তোতাপাখি আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি করবে তাহলে?”

আমি শুন্য দৃষ্টি নিয়ে তোতাপাখির দিকে দেখে নিঃস্পৃহ ভাবেই উত্তর দিলাম, “জানি না গো। মধ্যবিত্ত মানুষ। ভয় ডর আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমার সামান্য চাকরি, আমার পেছনে দাঁড়ানোর মতন কেউই নেই। না আছে আমার লোকবল না আছে আমার অর্থ বল। এই সেমেস্টার শেষ হতে আর তিন সপ্তাহের মতন বাকি। এই কয়দিন ওকে এড়িয়ে চলব। তারপরে আর কি, দেখা হবে না কথা হবে না। আশা করি একদিন ভুলেও যাবে, আমিও ভুলে যাবো। তখন না হয় নতুন করে আবার শুরু করা যাবে। তিন সপ্তাহের ব্যাপার।” শেষের দিকে একটা ম্লান হাসি হাসলাম।

বেশিক্ষন আর দাঁড়াইনি। হোঁৎকা আমাকে বাইকে করে স্টেসানে পৌঁছে দিল। ট্রেনে উঠে বারে বারে তোতাপাখি আর হোঁৎকার মুখ মনে পড়ছিল। কারুর গলগ্রহ হয়ে থাকতে পারব না তবে অন্য কাউকে এই পোড়া বুকে স্থান দিতেও পারব না। ভালোবাসা কি সেটা বোঝার আগেই আমি জ্বলে পুড়ে ছারখার।
 
পর্ব দুই (#2-#8)

ব্লাকে প্রচন্ড ভিড় তাও আবার মাঝ পথ থেকে চড়েছি। বর্ধমান পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এতটাই নিজের চিন্তায় মশগুল ছিলাম যে বর্ধমানে জায়গা পাওয়ার পরে সেই যে বসে গেলাম আর কিছুই মনে নেই। ট্রেন হাওড়া ঢুকে গেছে, এক এক করে যখন লোকজন নামতে শুরু করল তখন সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। বাড়ি যেতে হবে, রাত অনেক হয়ে গেছে। একা একা বাড়িতে যেতে একদম ইচ্ছে করছিল না। স্টেশানের বাইরে বেড়িয়ে একটা টেলিফোন বুথ থেকে মামা বাড়ি ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে বাড়িতে আসছি। মামা বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। মামা ঘুমিয়ে পড়লেও মামিমা জেগে ছিলেন আমার জন্য।

বাড়িতে পা রাখতেই, মামিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে রে তোর?”

আমি মৃদু হেসে মামিমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কই কিছুই হয়নি তো।”

মামিমা আমাকে বললেন, “বিকেলে বোউমা ফোন করেছিল।”

আমি প্রমাদ গুনলাম, তোতাপাখি যে বাড়িতে বলে দেবে সেটা জানতাম। কারণ অনেক। বুদ্ধদেব বাবু প্রবালদার বস, তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে হয়ত প্রবালদার চাকরি সুত্রে উন্নতি হত। মামা মামিও মেয়ে দেখে এক প্রকার পছন্দ করে এসেছিলেন। হয়ত এটাই ভেবেছিলেন, যদি আমি আর প্রবালদা, দুই ভাই এক সাথে এক জায়গায় থাকি তাহলে দুইজনের অনেক সুবিধা।

আমি মামিমাকে বললাম, “কয়েক সপ্তাহ সময় দাও। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম এলো না। আকাশ মেঘলা, হাওয়া বইছে। বাড়ির পেছনে একটা ছোট পুকুর আছে সেই পুকুর পাড়ের বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ আর সুপারি গাছ মাথা দুলিয়ে ভুতুরে অন্ধকারে আমাকে মনে হয় ডাকছে। মাথাটা পুরো শুন্য, হারিয়ে গেছি কোথাও। খাটের ওপরে চুপচাপ বসে থাকলাম সারা রাত। আঁধার কাটিয়ে, কালো মেঘের আড়াল থেকে পুব আকাশে একটু খানি লাল রঙের ছোঁয়া লেগেছে। পাখির কিচির মিচির একটু শুরু হয়েছে, চড়াই, শালিক, টিয়া। আচমকা কাঁধে একটা হাত পড়তেই ভীষণ চমকে গেলাম।

দিম্মা অনেক ভোর বেলায় ওঠে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল অনেক রাতে এইচিস?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ।” তারপরে মৃদু হেসে আমি আমার বিশ্ব সুন্দরীর কাছে আবদার করলাম, “আজকে একটু পাটি সাপটা বানিও তো, অনেকদিন খাইনি।”

হেসে ফেললেন দিম্মা, “আচ্ছা প্রভাকে বলে দেব। তা তুই সারা রাত ঘুমাসনি কেনে?”

আমিও দিম্মাকে ইয়ার্কি মেরে বললাম, “তুমি দেখেছ নাকি যে আমি ঘুমাইনি?”

আমার উষ্কখুষ্ক চুলে সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে বললেন, “এডা দেকতি হয় নাকি? তুই ঘুমাসনি সেটা তোর চোকে মুখে লেকা আছে। কি হইছে রে তোর? গতকাল বিকেলে তোর তোতাপাখি ফোন করিছেলো। মৃগেন চিন্তেয় পরি গেছল।” দিম্মাকে কি করে বলব কিছুই বুঝে পেলাম না। দিম্মা নিজেই আমাকে জিজ্ঞস করলেন, “সংযুক্তা তো দেকতি শুনতি ভালো।” আমি মাথা দোলালাম, ওকে নিয়ে তো আমার সমস্যা নয়। দিম্মা বললেন, “সত্যি কতা কি জানিস। যেখানে মনের মধ্যে দোটানা রইচে সে পথে যাতি নাই।” আমিও দিম্মার কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়ালাম। দিম্মা বললেন, “দেক, সময় আছে। তোরা দুই ভাই এক সাতি থাকলে আপদে বিপদে এক জনের পেচনে অন্যজনে দাঁড়াতি পারবি।” আমার মনের কথাই বলছে আমার দিম্মা। “তবে কি জানিস আদি। দোনামনা এক ব্যাপার আর ভয়ে পিচিয়ে আসা অন্য ব্যাপার।” আমি অবাক হয়ে গেলাম দিম্মার কথা শুনে। দিম্মা মৃদু হেসে আমাকে বললেন, “তোর চোকে নেকা যে তুই ভয়ে পিচিয়ে গেছিস। কেন?”

আমি নিরুত্তর, এত কথা নিশ্চয় তোতাপাখি মামিমাকে বলেনি আর মামিমাও নিশ্চয় দিম্মাকে বলেনি। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেছি সেই ব্যাপারে দিম্মা কি করে জানল তাহলে? আমি বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে দিম্মাকে ধিরে ধিরে সব কথা খুলে বললাম। যেটা তোতাপাখি কেও বলিনি সেটাও বললাম। আমি মরতে ভয় পাইনা তবে পঙ্গু হয়ে কারুর গলগ্রহ হয়েও থাকতে চাই না। শেষ কথাটা দিম্মাকে ভাবিয়ে তুলল।

দিম্মার হাতের পাটিসাপটা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। সোমবার অফিসে ভীষণ কাজের চাপ ছিল। সারাদিন মাথা উঠানোর পর্যন্ত সময় ছিল না। অফিস থেকে বের হতে অন্যদিনের চেয়ে একটু দেরি হয়েই গেছিল। বাইক ছুটিয়ে দিলাম ইন্সটিটিউটের দিকে। ক্লাস শুরুর মাত্র দু মিনিট আগে পৌঁছালাম। যথারীতি দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসে ঢুকলাম। প্রথম সারির চেয়ারে বিদ্যমান তিতলি। আমাকে দেখতে পেয়েই ওর হাসি হাসি মুখে একটা মেঘের ছায়া নেমে এলো। চুপচাপ দাঁতের মাঝে পেন চেপে ধরে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি অনির্বাণের পাশে বসতে বসতে ওর দিকে চেয়ে দেখলাম। ক্লাস শুরু হল। একবার শুধুমাত্র চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে দেখল তিতলি। কিছু যেন বলতে চাইছে ওর ওই কাজল কালো ভাসা ভাসা নয়ন।

ক্লাসের শেষে তিতলি আর দাঁড়ায়নি। আমার আগেই ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে গেছিল। আমি ওর যাওয়ার পথের দিকে একটু চেয়ে থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ভুলে যাওয়াই ভালো। বড় লোকের সুন্দরী মেয়ে, যে পথ আমার নয় সেই পথে না চলাই শ্রেয়। বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে অনির্বাণের সাথে সিগারেট টানতে টানতে একটু গল্প করলাম। আগের দিন দুর্গাপুর গেছিলাম নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে সেটা জানাতেই লাফিয়ে উঠল অনির্বাণ।

অনির্বাণ আশ্চর্য হয়ে বলল, “বিয়ে করছিস তাহলে?”

আমি হাসলাম ওর কথা শুনে, “ঠিক নেই।”

অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল, “কেন রে? দেখতে শুনতে খারাপ নাকি? নাকি অন্য কিছু আছে?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না না, সেটা নয় রে। সংযুক্তা দেখতে ভালো। ওর বাবা ডিভিসিতে খুব বড় পোস্টে চাকরি করে, ওর দাদাও ডিভিসিতে আমার দাদাও ডিভিসিতে।”

হেসে ফেলল অনির্বাণ, “শালা তোদের পুরো ফ্যামিলিকে মনে হচ্ছে ডিভিসি পুষছে।” একটু চুপ করে থাকার পরে জিজ্ঞেস করল, “আর এদিকের কি খবর?”

আমি মাথা নাড়লাম, “জানি না। এই সেমেস্টার শেষ হলে আর এক ব্যাচে এডমিশান নেব না।”

মাথা দোলাল অনির্বাণ, “হুম। বুঝলাম। তা আমাকে জানিয়ে দিস কোন ব্যাচে নিবি তাহলে আমিও তোর ব্যাচেই এডমিশান নেব।”

আমি হেসে ফেললাম, “হ্যাঁ রে জানিয়ে দেব। পরের মাসে তো সেমেস্টার এক্সাম। প্রিপারেশান হয়েছে?”

হেসে ফেলল অনির্বাণ, “ওই যা হওয়ার হয়েছে। দেখা যাবে। আমি শালা কোন চাকরি করব।”

আমাকে রিতিমত পড়াশুনা করতেই হবে। অন্তত ভালো গ্রেড নিয়ে পাস করতে হবে। ডিভিসি না হোক অন্য কোথাও একটা চাকরি খুঁজতে হবে। অফিসের বস ভালো হলে কি হবে মাইনে দেয় না যে। মাইনে দেওয়ার বেলায় যত নাকে কান্না, নতুন প্রোজেক্ট ভালো বিক্রি হয়নি, সেই এলাকার ক্লাব রাজনৈতিক দলের লোকদের টাকা দিতে হয় ইত্যাদি অনেক কিছুই গল্প শুরু হয়ে যায়।

সেপ্টেম্বর শেষ। আকাশে বাতাসে আগমনীর সুর। নীল আকাশে মাঝে মাঝে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়, সেই সাদা পোজা তুলোর মতন মেঘের দর্শন এখন আসতে দেরি। গত দুই সপ্তাহে শুধু মাত্র ওই চোখের দেখাই হয়েছিল তিতলির সাথে। যতবার ওর সাথে চোখা চুখি হত, মন বাঁধ মানতে চাইত না। প্রতিবার একটা কথাই মনে হত, কেন সেদিন ওকে বাইকে নিয়ে ওর বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। একটা ট্যাক্সি ডেকে ভাড়া দিয়ে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যেত। প্রথম দিনে যদিও ওর আর আমার মাঝে সহস্র যোজনের ব্যাবধান ছিল, কিন্তু ওই কাঁধে হাত রেখে চুপ করে বসে থাকাটাই আমার কাছে অনেক।

সেমেস্টারের শেষ ক্লাস, দুই দিন পরেই সেমেস্টার পরীক্ষা। তার পরে আর হয়ত কোনদিন তিতলির সাথে দেখা হবে না। শেষ দিনের ক্লাসে মন খুব খারাপ লাগছিল আমার। সারাটা সময় মাথা নিচু করে বসে ছিল তিতলি। আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এক এক মিনিট করে ক্লাস এগোয় আর আমার বুকের মাঝে ধস নামতে শুরু করে। ভীষণ এক অব্যাক্ত বেদনা। দুর থেকেই বুঝতে পারছিলাম ওর ফর্সা টিয়াপাখির মতন নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। সেদিন ওর পরনে একটা সাদা রঙের ঢিলে সালোয়ার কামিজ, আর রঙচঙে ওড়না। সাদা রঙ যেন ওর জীবনের রঙ। ক্লাস শেষের পরেও সেদিন বসেছিল কিছুক্ষন। আমার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল। অনির্বাণ আমার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইশারায় তিতলির দিকে দেখতে অনুরোধ করল। চুপ করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। আষাঢ়ের কালো মেঘের মতন ঢালাও চুল একটা হাত খোঁপা করে বাঁধা। প্রতিবারের মতন প্রসাধনহীন লাবণ্যে সজ্জিত সুন্দরী, কাজল কালো নয়নে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। আমি আমার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওর কাজল কালো চোখ জোড়া আমার বুকের ভেতর পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। আমি কত ভীতু কত কাপুরুষ সেটা যেন ও দেখে ফেলল। নিচের ঠোঁট ওপরে ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে মাথা নিচু করে বেড়িয়ে চলে গেল।

একটা আবেগ দলা পাকিয়ে এলো গলার কাছে। অনির্বাণকে বললাম তুই বাড়ি চলে যা। ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল অনির্বাণ, জিজ্ঞেস করল আমি কি করতে চাই। আমি উত্তর দিলাম যে আমি একটু একা থাকতে চাই। অনির্বাণের অপেক্ষা না করেই বেড়িয়ে গেলাম ইন্সটিটিউট থেকে। রাস্তার ওপাশে বাসস্টান্ডের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। তিতলি তখন বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে। রাস্তার একপাশে আমি দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্যপাশে তিতলি। বেশ কয়েকটা খালি ট্যাক্সি বেড়িয়ে চলে গেল রাস্তা দিয়ে। বাস স্টান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে, বুকের কাছে ওর পড়ার ব্যাগ চেপে ধরে, চোখের দৃষ্টি রাস্তায় নেই। রাস্তা পেরিয়ে রাস্তার বিপরিতে আমার দিকে। ওর তীক্ষ্ণ গভীর নজর এড়াতে একটু অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু কাজে দেয়নি। সেই অন্ধকার আমাকে লুকাতে পারেনি ওর কাজল কালো নয়নের বেদনা থেকে। আমি সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। চোয়াল কঠিন, চোখ জোড়া ভীষণ জ্বলছে। ফুসফুস একটানে যতটা ধোঁয়া টানতে পারে ততটা টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। আমি যে পালিয়ে যাবো তার উপায় ও নেই। আমার বাইক ওই বাসস্টান্ডের পাশেই পার্ক করা। প্রায় আধা ঘন্টা যুদ্ধ চলল দুই প্রানের। শেষ পর্যন্ত দুইজনেই হেরে গেল সেই যুদ্ধে। রাত বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেল তিতলি।

ট্যাক্সি চলে যেতেই আমি আকাশের দিকে তাকালাম। কি থেকে কি হয়ে গেল জীবনটা। এতদিন শুধু ওই গানের মধ্যেই শুনেছি, ভালোবাসা পোড়ায় যে মন পোড়ে না তো অঙ্গ, এ কেমন রঙ্গ জাদু এ কেমন রঙ্গ। সেই শেষ দিনের দেখায় তখন আমি বুঝতে পারিনি যে আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু এই আজকের রাতের দেখায়, রাস্তার ওইপাশে ওর আঁখি দেখে বুঝতে পারলাম, যে হ্যাঁ আমি ওকে ভালোবাসি। তাই আমি এইপাশে ভিতুর মতন অন্ধকারে ওর চোখের আড়াল করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আর তিতলি ছিল বাসস্টান্ডের আলোয় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষায়। রাস্তা আমি পার করতে পারলাম না।

বাইকে উঠে শেষ পর্যন্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উল্টোডাঙ্গার খালপারের বস্তির মধ্যে ঢুকে এক বোতল দেশি আর গিলা মেটে কিনলাম। তারপরে বাইক ছুটিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছালাম তখন বাজে রাত সাড়ে ন’টা। বাড়িতে ঢুকেই আগে জামা কাপড় কোন মতে খুলে সোজা বোতল খুলে গলায় ঢেলে নিলাম দেশি মদ। গলা জ্বলে গেল, গরল গলা দিয়ে নামছে পুরো টের পেলাম। সেই সাথে একটা সিগারেট ধরালাম। মাথা ঝনঝন করে উঠল। বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে উত্তম মধ্যম গালা গালি দিলাম। শালা বোকাচোদা তোর কপালে সুখ বলে কিছুই নেই। তোর মা অনেক বছর আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তোকে ছেড়ে চলে গেছে। তোর বাবার কোন খবর নেই, তুই নিজেই জানিস না সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। যদি বেঁচেও থাকে তাহলে কোনদিন তোর খবর নিতে আসবে না। তোর দিম্মা একা কি করবে? তোর মামা মামির বয়স হয়েছে, তুই নিজে তাঁদের বাড়িতে থাকিস না। তোর কি হবে। তুই শালা এই রাতে এই মদ খেয়েই মর। মরেই যা, কাল সকালে যখন তুই অফিসে পৌঁছাবি না অথবা তোর মামা অথবা হোঁৎকা যখন তোকে ফোন করে পাবে না তখন তোর মৃতদেহ পাবে এখানে।

ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। শালা এত রাতে কে ফোন করে। ঘড়ি দেখলাম, রাত দশটা। ফোন তুলেই গালাগালি দিতে যাবো কি থমকে গেলাম। মামিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ছিলিস রে তুই? সেই সাড়ে আট’টা থেকে তোকে ফোন করে যাচ্ছি।”

কথা জড়িয়ে এলো, “কি হয়েছে বলো।”

আমার গলা শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেলেন মামিমা, “এটা কি করছিস রে তুই, বুধো? তুই কালকেই বাড়ি আসবি। তোর আর ওইখানে একা একা থাকতে হবে না।”

মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার কিছু হয়নি। এই একটু খানি আর কিছু না। তুমি ওই নিয়ে চিন্তা করো না।”

জানি না মামিমা আমার কথা কতটা বিশ্বাস করলেন। তবে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে বললেন, “সুবির, মানে তোর বাবা আজ বিকেলে ফোন করেছিল। তোর মামার সাথে কথা বলেছে, আমার সাথেও কথা হয়েছে।”
সুবির ঘোষ, আমার বাবার নাম শুনেই মাথাটা আরো বেশি গরম হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে মামিমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, তা কি বলতে চায়?”

মামিমা নরম কন্ঠে বললেন, “তুই কাল বাড়ি আয় বাবা, তারপরে সব কিছু বলব।”

আমিও মাথা দোলালাম, “ঠিক আছে, অফিসের পরে সোজা চলে আসব।”

ফোন ছাড়ার আগে ধরা কন্ঠে মামিমা বললেন, “কেন ওইসব ছাইপাঁশ গিলছিস বলতো।”

আমি আরও এক ঢোঁক গলায় ঢেলে মামিমাকে আসস্থ করে বললাম, “আরে না না, তুমি কি ভাবছ আমি ওই মেয়েটার জন্য গিলছি নাকি?”

সত্যি নিজের বুকের জ্বালা কমাতে মদ গিলছিলাম, কিন্তু জ্বালা আরও বেশি করেই জ্বলে উঠল আমার বাবার নাম শুনে। ফোন রাখার পরে কি করেছি ঠিক মনে নেই। মাথা ঝিমঝিম করছিল ভীষণ ভাবেই। সোফার ওপরেই ধপ করে পরে গেলাম, সেখানেই মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পরে ওই সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরেরদিন অফিস থেকে সোজা মামা বাড়ি। বাড়িতে পা রাখতেই মামিমা ভীষণ বকাঝকা শুরু করে দিলেন। এত বড় ছেলে কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই, একা একা থাকিস কিছু একটা হয়ে গেলে কে দেখবে। তারপরে কিছুক্ষন মামার অবর্তমানেই মামার মুন্ডপাত করা হল, কেন মরতে যে ছেলেটাকে ওইখানে পাঠিয়ে দিল। সেদিন বুঝালাম মামিমা আমাকে খুব ভালোবাসে। এমন নয় যে আমার মাকে মনে নেই। মাকে ভালো করেই মনে আছে তবে মা মারা যাওয়ার পর মামিমার কাছেই মানুষ হয়েছি।

রাতে খাওয়ার পরে মামিমা আমার ঘরে এসে বললেন “গতকাল বিকেলে সুবির, তোর বাবা ফোন তোর মামাকে ফোন করেছিল। বুধো তোর বাবা কালকে তোর মামার কাছে কাঁদছিল রে।”

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল সেই শুনে। চাপা ক্রোধ ভরা গলায় বললাম, “তা আমি কি করব।”

মামিমা বললেন, “তোকে একবার ফোন করতে বলেছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমার ফোন নাম্বার দাওনি তো?”

মামিমা মাথা নাড়লেন, “না তোর ফোন নাম্বার দেয়নি তোর মামা। তবে সুবির নিজের ফোন নাম্বার দিয়েছে আমাদের।”

আমি মাথা নাড়লাম, “আচ্ছা দেখা যাবে।”

মামিমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “দেখ বাবা, সবার অনেক বয়স হয়েছে। একবার কথা বলে দেখ। কি বলতে চায় সেটা শোন। কথা বলতে ক্ষতি কোথায়? সবাই একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তাও শেষ বেলায় পুরানো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে একটা অন্তত সুযোগ দেওয়া উচিত।”

আমি মামিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মা চলে যাওয়ার পরে তোমার কাছে মানুষ হয়েছি...”

মামিমা মৃদু হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তো একটা ফোন করলেই কি আমার ছেলে পর হয়ে যাবে নাকি? আমি কি এমনি এমনি ছেড়ে দেব?”

আমি হেসে মামিমাকে জড়িয়ে ধরলাম, “না না একদম না।”

আমার কান টেনে ধরে স্নেহ ভরা শাসন করে বললেন, “ওই ছাইপাঁশ গেলা ছাড়। তোর মামা শুনলে খুব রাগারাগি করবে।”

আমিও বললাম, “আরে না গো, রোজদিন তো খাই না। এই মাঝে মধ্যে এই আর কি।”
 
পর্ব দুই (#3-#9)

মহালয়ার পরের দিন আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা। এদিকে সেমেস্টার পরীক্ষার দিন চলে এলো। সেদিন অফিস থেকেই সোজা ইন্সটিটিউটে গেলাম পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। সারাক্ষন অনির্বাণের ফিসফিসানি, এই এটা কি হবে রে? ওটা কি হবে রে? এর এন্সারটা বল। এর জ্বালায় কি আর ঠিক মতন পরীক্ষা দেওয়া যায় নাকি। পরীক্ষার মাঝেই মাঝে মাঝে তিতলির দিকে আড় চোখে দেখছিলাম। চুপচাপ মাথা নিচু করে কি সব লিখে যাচ্ছে কে জানে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে আবার ঘাড় নিচু করে খাতায় লেখে। যখন ভাবতে বসে তখন ভীষণ সুন্দরী দেখায় ওকে, দাঁতের মাঝে পেন চেপে ধরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়, তারপরে হটাত হয়ত মনে পড়তেই আবার লিখতে বসে। কালো লম্বা বেনুনিটা পিঠের ওপরে বিশাল একটা অজগর সাপের মতন দুলছে। কব্জিতে বাঁধা সোনার চেনের ঘড়িটা বেশ জ্বলজ্বল করছে। অনির্বাণের ফিসফিসানি ছেড়ে আমি আমার পরিক্ষাতে মন দিলাম, কিন্তু মাঝে মাঝে বাধ সাধে ওই সামনের চেয়ারে বসা নির্বাক সুন্দরী। সেদিনেও একটা খুব হাল্কা হলদে রঙের ফ্রক পরে এসেছিল ক্লাসে। আমি যেন ওর জীবন থেকে সব রঙ কেড়ে নিয়েছি। আগে রঙ্গিন জামা কাপড় পড়ত সেটাও যেন ছেড়ে দিয়েছে। কি যে পরীক্ষা দিলাম কে জানে। অন্যদের থেকে আগেই খাতা জমা দিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম, তবে আসল কথা, ওর সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকার মতন শক্তি আমার মধ্যে ছিল না। ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সময়েও পেছন ঘুরে তাকাতে সাহস পাইনি আমি।

মহালয়ার পরেদিন দিম্মাকে নিয়ে বাকি সবাইকে নিয়ে হরিদ্বার ঋশিকেশ বেড়াতে যাওয়ার কথা। দুন এক্সপ্রেসে আমাদের টিকিট কাটা হয়েছে, থার্ড এসি। আমি হাওড়া থেকে দিম্মা মামা মামিকে নিয়ে ট্রেনে চড়ে যাবো। দুর্গাপুর থেকে হোঁৎকা আর তোতাপাখি চড়বে। ট্রেন ছাড়ার আগে হাওড়া স্টেসান থেকে হোঁৎকাকে একটা ফোন করে দিলাম। রাত সাড়ে আট’টা নাগাদ আমাদের ট্রেন, দুর্গাপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে যাবে। ট্রেন ছাড়ার পরে দিম্মাকে মামিমা খাইয়ে দিল। বাকিরা ঠিক করলাম যে হোঁৎকা ট্রেনে ওঠার পরেই খাওয়া দাওয়া করব। এর আগে কোনদিন পশ্চিম বঙ্গের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাইনি। আমার দৌড় বন্ধুদের সাথে ওই দিঘা আর হোঁৎকার বাড়ি দুর্গাপুর, এর বেশি আর কোথাও নয়। এক পাশের বাঙ্ক খুলে একদম নিচের বাঙ্কে দিম্মাকে শুইয়ে দিলাম। মামা মামি বসে রইলেন হোঁৎকার অপেক্ষায়। আমি দরজার দিকে চলে গেলাম একটা সিগারেট ধরাতে। হুহু করে রাতের অন্ধকার কেটে ধেয়ে চলেছে ট্রেন। দরজা খুলে একটা সিগারেট ধরালাম। দুই পাশে ধানের ক্ষেত, দূরে ছোট ছোট গ্রাম মাঝে মাঝে কিছু স্টেসান আর বাড়ি ঘরদোর। অন্ধকারের মাঝে গাছ গুলো ভুতের মতন দাঁড়িয়ে। আকাশে বাতাসে আগমনীর সুর। বুকের মাঝে বেজে ওঠে এক করুন সুর, “তুমি পুজোতে কোলকাতায় থাকবে না?” আমার ঠোঁটে এক ম্লান হাসি ফুটে উঠল, থাকতে চাইলেও কি আর তোমার সাথে বেড়াতে যেতে পারতাম নাকি। কি জানি কি হত।

মাঝরাতে দুর্গাপুরে ট্রেন দাঁড়াল। হোঁৎকা আর তোতাপাখি ট্রেনে উঠে পড়ল। আমাদের ছয়জনার বাঙ্ক আবার মুখর হয়ে উঠল গল্প গুজবে। বিশেষ করে তোতাপাখির কলতানে। তোতাপাখি আলুর দম বানিয়ে এনেছিল সেই দিয়েই রুটি খাওয়া হল। মামা খেয়ে দেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবেন তাই তাঁকে একদম উপরের বাঙ্কে পাঠিয়ে দেওয়া হল। নিচের বাঙ্কে একপাশে দিম্মা অন্য পাশে মামিমা। মাঝের বাঙ্কে এক পাশে হোঁৎকা আর অন্যপাশে তোতাপাখি। আমার জায়গা হল একদম উপরের বাঙ্কে।

আমার ঘুম ভাঙল সোজা ডেহেরি-অন-সোন গিয়ে। ব্রিজ পেরিয়ে ঝমাঝম করে ট্রেন চলছে, সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিচের তলায় ততক্ষনে সবাই উঠে পড়েছে। বাড়িতে দিম্মা আর মামিমা অনেক সকালে ওঠেন, ট্রেনেও সেই এক। সব থেকে অসুবিধে হয়েছে তোতাপাখির, সেটা তোতাপাখির মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। দিম্মা আর মামিমাকে দেখে সেও উঠে পড়েছে। ওকে দেখে ঘুম চোখেই আমার হাসি পেয়ে গেল। ওইদিকে হোঁৎকা বেশ ভসভস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।

আমি ওপর থেকেই দিম্মাকে বললাম, “আরে তুমি ঘুরতে যাচ্ছও। ট্রেনেও তোমার এত সকালে ওঠার কি দরকার?”

দিম্মা হেসে বললেন, “উটি পর। আর কত শুবি?”

আমি দিম্মাকে বললাম, “তা তোমার নাত বৌকে তো একটু ঘুমাতে দেবে।”

তোতাপাখি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ঘুমের রেশ তখন ঠিক ভাবে কাটেনি ওর চোখের থেকে। পদ্ম পাতার মতন চোখের পাতা মেলে আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, “তুমি তো সত্যি গেছো।” তারপরে দিম্মাকে বলল, “দেখো দেখো কেমন বাঙ্কে চড়ে সারারাত নাক ডেকে ঘুমিয়েছে।”

বড়রা না থাকলে তোতাপাখিকে একটা উচিত জবাব দিতাম। বাঙ্ক থেকে নামার সময়ে হোঁৎকাকে এক লাত্থি মেরে জাগিয়ে দিয়ে বললাম, “ওঠ অনেক নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছিস। তোর নাক ডাকার জ্বালায় আমারা কেউই ঘুমাতে পারিনি।”

সারাটা দিন বেশ গল্প গুজবেই কেটে গেল। ট্রেন দুই ঘন্টা দেরিতে চলছে। হরিদ্বার পৌঁছাবে ভোরের দিকে। রাতে হোঁৎকা তোতাপাখি আর আমি গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। জ্বালাপুর আসতেই সবাইকে উঠিয়ে দিলাম। কিছুপরেই হরিদ্বার চলে আসবে। হরিদ্বারে ট্রেন অনেকক্ষণ থামে, তাই নামতে অসুবিধে হল না। ট্রেন থেকে নামতেই এক গাদা রিক্সাওয়ালা আমাদের ছেঁকে ধরল। তোতাপাখি আর মামিমা ভাঙা হিন্দি ভাষায় তাদের সাথে কোমরে গামছা বেঁধে বচসা করতে নেমে পড়ল। হোটেল হোটেল করে লোকজন মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতন অবস্থা। হোঁৎকা আগে থেকেই গঙ্গার ধারে একটা হোটেল ঠিক করে রেখেছিল। ভৈরব ঘাটের কাছেই একটা বেশ বড় হোটেল, হোটেল আনন্দ নিকেতনে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা। তিনটে রিক্সা করে সেখানে যাওয়া হল।

দিম্মা তো জানালা খুলে গঙ্গা দেখেই অস্থির। দুই নাতিকে একসাথে সঙ্গে পেয়ে দিম্মার আনন্দ আর ধরে না। “ব্যাস এবারে গঙ্গা প্রাপ্তি হলে আমার মুক্তি।”

তোতাপাখি আরো এক ধাপ এগিয়ে দিম্মাকে জড়িয়ে বলে, “তুমি বুড়ো কোথায় হলে ঠাম্মা। আমার বাড়িতে একজন আসবে তাকে কোলে নিয়ে ঘুরবে এবারে।”

ফোকলা দাঁতেই আমার বিশ্ব সুন্দরী হেসে বললেন, “তোরা সবাই আমার পাশে, আর কি চাই বল।”

দিম্মার কথা শুনে আমার গলা ধরে এলো, “আর কয়টা দিন অপেক্ষা কর। আরো একটা নাত বউয়ের মুখ দেখেই যাবে।”

আমার কান টেনে দিম্মা বললেন, “তোরে দেকাতে কলুম। তুই তো দেকালি না আমাকে।”

তোতাপাখি দিম্মাকে বলল, “ঠাম্মা এবারে বাড়ি গিয়েই গেছোর বিয়ে দিয়ে দেব।”

দিম্মা হেসে ফেললেন, “হ্যাঁ একটা আরো এলে তোর সাথে ঝগড়া করতি পারবে। দুইজনে মিলে কোমরে গামছা বেঁধে ঝগড়া করিস।”

ব্যাস শুরু হয়ে গেল তোতাপাখির গোসা, “আমি শুধু ঝগড়া করি? তুমি এই দেখলে ঠাম্মা?”

তোতাপাখির অভিমানী কণ্ঠ শুনে দিম্মা হেসে ফেললেন, “টিরেন থেকে নেমে তুই আর প্রভা যেমন ভাবে হামলে পরিছিলিস তাতে আর কি বলব।”

তোতাপাখি তারপরে আমার নালিশ করতে শুরু করে দিল দিম্মার কাছে, “জানো ঠাম্মা, গেছোর একজনকে ভালো লাগে।”

দিম্মা মৃদু হেসে বললেন, “জানি ওই কইচে আমার কাছে।”

তোতাপাখি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে দেখে বলল, “তাহলে এবারে বাড়ি ফিরে সব থেকে আগে ওর সাথে আমার দেখা করাতে হবে।”

আমি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললাম, “সে গুড়ে বালি।”

দিম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন রে? এই কদিনে দেকা হয়নি ওর সাথে?”

আমি বললাম, “দেখা হলেই কি আর হয় দিম্মা। তোমাকে সব বলেছি। আমি নিজেই জানি না আমাদের মধ্যে কি সম্পর্ক। তার ওপরে ওরা ব্যানারজি আমি ঘোষ। ওর বাবা কাকা অনেক কড়া ধাতের মানুষ নাকি। আমার মা নেই, বাবার খোঁজ জানি না। মামা বাড়িতে মানুষ হয়েছি। অনেক বড় ব্যাবধান দিম্মা, অনেক সমস্যা আছে।”

তোতাপাখি আর দিম্মা এক সাথেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তোতাপাখি দিম্মাকে বলল, “ঠাম্মা, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার গেছো, বেশি দিন কেউকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না।” আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “তাই তো গেছো?”

হোঁৎকা এতক্ষন চুপ করেই ছিল। তোতাপাখির কথা শুনে আমরা চারজনেই হেসে ফেললাম।

দিম্মা আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, “আদি, সুবির কিন্তু মৃগেনরে ফোন করিছেলো। একবার পারলে বাড়ি ফিরে একটা ফোন করিস।”

বাবার কথা শুনে আমার একটু বিরক্তি হল। আমি দিম্মাকে বললাম, “কি হবে ফোন করে? এতদিন পরে কেন কথা বলতে চাইছে জানো কি?”

দিম্মা আমাকে বুঝিয়ে বললেন, “যখন গায়ের রক্ত গরম থাকে তখন অনেকে অনেক কিছুই করে। বিপথে যায়। বয়সের সাথে সাথে বিচার বুদ্ধি বাড়ে। মৃগেনের কাছে অনেক দুক্ক করছিল। তোর মামীর সাথেও কতা বলিচে তোর বাবায়।”

আমি মাথা দোলালাম, “আচ্ছা ফোন করা যাবে খানে।”

হোঁৎকা যদিও আমার বাবার কথা জানে কিন্তু তোতাপাখি আমার বাবার কথা শুনে অবাক। আমার মুখে কেন, বাড়ির কারুর মুখে কোনদিন আমার বাবার নাম পর্যন্ত উচ্চারন করা হয়নি। তোতাপাখি জিজ্ঞেস করাতে আমার যা মনে ছিল তাই জানালাম। ছোট বেলায় যতদূর আমার মনে আছে, ধানবাদে বিসিসিএল এর কোয়লা নগরে আমাদের কোয়াটার ছিল। বাবা ধানবাদের আইএসএম থেকে পাশ করে গোন্দুডিহি কোল মাইনসে চাকরি করতেন। বাবার সম্পর্কে এর বেশি কিছু আর মনে নেই, এমনকি মুখটাও তেমন আর মনে পরে না। শুধু মনে আছে, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন একবার আমাকে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি করাতে এসেছিলেন। তারপরে আর তার সাথে কোনদিন দেখা হয়নি। ক্লাস সিক্সে যখন আমার মা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন বাবা এক বারের জন্যেও আসেনি। সেই ক্লাস ফোরে মিস্টার সুবির ঘোষ, আমার বাবার সাথে শেষ দেখা। তারপর সতেরো বছর কেটে গেছে।

স্নান সেরে গঙ্গার ধার দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া হল বিখ্যাত দাদা-বউদির হোটেলে খেতে। একদম বাড়ির খাওয়া দাওয়া। গরম ভাত, তার মধ্যে আবার ঘি দেওয়া, সাথে আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, মুগ ডাল, একটা কোন শাকের চচ্চড়ি, আলু পটলের একটা তরকারি আর শেষ পাতে পাঁপড় আর দই। এলাহি খাবার। খাওয়া পর্ব সেরে আমরা একটা গাড়ি করে বেড়িয়ে পড়লাম হরিদ্বার ঘুরে বেরানর জন্য। অসংখ্য ছোট বড় মন্দির চারদিকে। তবে সব থেকে আকর্ষণীয় হচ্ছে বিল্ব পর্বতের ওপরে স্থিত মনসা দেবীর মন্দির। মামা মামি দিম্মা আর তোতাপাখিকে রোপওয়েতে বসিয়ে দিয়ে আমি আর হোঁৎকা হেঁটে হেঁটেই সেই পাহাড় চড়লাম। ওরে বাবা, চড়তে চড়তে হাঁপিয়ে গেলাম। এমনিতে চলাফেরা বিশেষ হয় না। সারাদিন অফিসে বসেই কাজ, বাইক আসার পর থেকে বাজারে গেলেও সেই বাইকে। হোঁৎকারও আমার মতন অবস্থা। মনসা দেবীর মন্দির দর্শনের পরে ঘুরে ঘুরে হরিদ্বারের বেশ কয়েকটা মন্দির দর্শন করা হল। সন্ধ্যে বেলায় হর কি পৌরিতে বসে সন্ধ্যা আরতি দেখলাম সবাই মিলে।

পরেরদিন আবার গাড়ি করে কঙ্খল যাওয়া হল। সেখানে দক্ষেশ্বর শিবের মন্দিরে বেশ কিছুক্ষন কাটিয়ে সেদিন ফিরে আসা হল। পরেরদিন সকালে উঠে গাড়ি নিয়েই সোজা ঋশিকেশ। ঋশিকেশ ঘুরে দেখা হল আমাদের। রামঝুলা, লছমনঝুলা ইত্যাদি। যদিও ঋশিকেশে বিশেষ কিছুই দেখার নেই, সেই একগাদা মন্দির আর মন্দির। দুই দিন ঋশিকেশে কাটিয়ে এক বিকেলে রাজাজি ন্যাশানাল পার্কের মধ্যে দিয়ে গাড়ি করে আবার হরিদ্বারে ফেরা হল। ঠিক ছিল যে একদিন হরিদ্বারে একটু বিশ্রাম নিয়ে তার পরের দিন রাতে আমরা দুন এক্সপ্রেসে ফিরে যাবো। রাতের খাওয়ার পরে সবাই মিলে হোটেলের সামনের গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলাম। সবাই একসাথে থাকায় তিতলির কথা একেবারে ভুলেই গেছিলাম। আমার মধ্যে সেই একাকীত্ব একদম হারিয়ে গেল, আমি পূর্ণ হয়ে গেলাম। পাশে দিম্মা, মামা মামি হোঁৎকা তোতাপাখি, সবাই আছে।

আমি আর দিম্মা একটা কামরায়। দিম্মাকে শুইয়ে দিয়ে আমি আর হোঁৎকা একটু বাইরে বের হলাম সিগারেট খেতে। সারাদিন লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক কম সিগারেট খাওয়া হয়েছে। রাত অনেক। মহালয়ার পরের দিন আমরা বাড়ি থেকে বেড়াতে বেড়িয়েছিলাম। দশমীর পরের দিন বাড়ি ফিরব। অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নেওয়া ছিল, তাই পরের দিন আমাকে অফিসে জয়েন করতে হবে। নতুন ব্যাচের খোঁজ নিতে যেতে হবে একবার ইন্সটিটিউটে। নতুন ব্যাচ আমার শেষ সেমেস্টার মনে হয় কালী পুজোর পরেই শুরু হবে। সিগারেট শেষ করে আমি আর হোঁৎকা হোটেলে ফিরে এলাম। হোঁৎকা নিজের কামরায় ঢুকে গেল।

আমি আমার কামরার দরজায় টোকা দিলাম। দিম্মা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও ঘুম বেশ পাতলা। বেশ কয়েকবার দরজায় টোকা দেওয়ার পরেও দেখলাম দিম্মা দরজা খুলছেন না। আমার একটু ভয় লেগে গেল। আমি একটু জোরেই দরজায় ধাক্কা মারলাম। জোর গলায় চেঁচিয়ে ডাক দিলাম, “দিম্মা...” ভেতর থেকে কোন আওয়াজ না পেয়ে আমার বুকের ভেতরটা ভীষণ ভাবেই ধুকধুক করতে শুরু করে দিল। আমি আবার ডাক দিলাম, “দিম্মা... দরজা খোলো...”

আমার গলার আওয়াজ শুনে হোঁৎকা নিজের কামরা ছেড়ে বেড়িয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। আমি ওকে বললাম, দিম্মা দরজা খুলছে না। হোঁৎকাও বেশ কয়েকবার দরজায় ধাক্কা মেরে দিম্মাকে ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ না আসাতে আমি আর হোঁৎকা মুখ চাওয়া চায়ি করলাম। আমাদের দুইজনের এক অবস্থা, একটা ভীতি ভর করে এলো আমাদের বুকের মধ্যে। আমি হোঁৎকাকে বললাম মামাকে ডেকে আনতে। আমি হোটেলের ম্যানেজারকে ডাকতে চলে গেলাম। আমাদের আওয়াজ পেয়ে আমাদের আশে পাশের কামরার লোকজন বেড়িয়ে এলো। হোটেলের ম্যানেজার আমার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চাবি নিয়ে চলে এলেন। ততক্ষনে মামিমা কান্না শুরু করে দিয়েছেন, তোতাপাখির চেহারা থমথমে। মামিমাকে জড়িয়ে ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে। হোঁৎকা আর মামার চেহারা থমথমে। আমি চুপ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য নিজেকে তৈরি করছি। এরপরে ডাক্তার ডাকতে হবে, একটা ডেথ সারটিফিকেট নিতে হবে, গাড়ি ঠিক করতে হবে, কোথায় শ্মশান সেখানে নিয়ে যেতে হবে। সব কিছুই মনের মধ্যে আওড়ে নিলাম একবার।

হোটেলের ম্যানেজার চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিল। সাদা বিছানায় একটা চাদর মুড়ি দিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত আমার বিশ্ব সুন্দরী দিম্মা। মামিমা ভেঙ্গে পড়লেন। দুইজনে মিলে ঝগড়া করলেও সেই মামিমার হাতের ভাত না খেলে দিম্মার ঘুম হত না। বুকের পাঁজর ককিয়ে দুমড়ে আসছিল কিন্তু বুঝলাম দিম্মা চলে গেছেন। আমি অবশ্য অনেকদিন হোস্টেলে থেকে মানুষ হয়েছিলাম, কিন্তু হোঁৎকা বরাবর বাড়িতে থেকেই মানুষ হয়েছিল। যদিও দুই নাতি দিম্মার খুব কাছের তবে দিম্মাকে হারিয়ে হোঁৎকা বেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। হোটেলের অন্যেরাও আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই সময়ে। হোটেলের ম্যানেজার ডাক্তার ডেকে এনেছিল। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যাবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই হোটেলের ম্যানেজার ঠিক করে দিয়েছিলেন। দিম্মাকে নিয়ে শেষ যাত্রায় বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। দিম্মাকে কঙ্খলের শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হল। বুঝলাম “আদি” নামে ভালোবেসে আর আমাকে কেউ ডাকবে না। দিম্মার চিতার সাথে আমার সেই ভালোবাসার নামটা হারিয়ে গেল। শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল। একদিকে দুর্গা পুজো শেষ অন্য দিকে আমার বিশ্ব সুন্দরী যার কোলে পিঠে সেই ছোট বেলা থেকে খেলা করে বেরিয়েছি, যার কাছে আমার সব আদর আবদার, যার কোলে বসে দুই ভাই মিলে কত গল্প শুনেছি, সেই দিম্মা আর নেই। বেড়িয়েছিলাম বেড়াতে ছয়জনে। ট্রেনে চড়ার সময়ে ফাঁকা সিট দেখে ভীষণ খারাপ লাগছিল আমাদের। তবে সবার মনের মধ্যে একটাই স্বস্তি, দিম্মার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। শেষ বয়সে দুই নাতিকে নিয়ে, নাতবৌকে নিয়ে হরিদ্বারে গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা প্রাপ্তি পেয়েছেন আমার দিম্মা।

ট্রেনে আসার সময়ে হোঁৎকা আমাকে বলল, “আমি ভাবছি এরপরে বাবা মাকে দুর্গাপুর নিয়ে চলে যাবো। তুইও এই তোর কোর্স শেষ হলে ডিভিসিতে এপ্লাই করে দে। বাকিটা আমি দেখে নেব আর বুদ্ধদেব বাবু আছেন তো।”

মামা মামিকে নিয়ে যাবে শুনে আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। হোঁৎকাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই মামা মামিকে নিয়ে দুর্গাপুর চলে যাবি, মানে?”

হোঁৎকা বলল, “বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল।”

আমি ওকে বললাম, “দ্যাখ, আমার যা মনে হয় মামা ওই বাড়ি ছাড়বেন না। ওটা ভিটে বাড়ি, হোঁৎকা। মামার জন্ম ওইখানে, আমার মায়ের জন্ম হয়েছে ওইখানে। আমার জন্ম তোর জন্ম সব ওই বাড়িতে। এত সহজে ওই বাড়ি ছাড়তে ইচ্ছে করে না রে হোঁৎকা।”

হোঁৎকা কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে আমাকে বলল, “আমি ভাবছিলাম সবাই একসাথে থাকার। না হলে দ্যাখ, তুই বাঙ্গুরে থাকিস, আমি দুর্গাপুরে। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। কে দেখবে?”

কথাটা অনেকটাই ঠিক। আমি কিছুক্ষন ভেবে হোঁৎকাকে বললাম, “তুই সেই নিয়ে কেন ভাবছিস? আমি আমার ফ্লাট ছেড়ে বাড়ি চলে যাবো। অনেকেই মধ্যমগ্রাম থেকে চাকরি করে। আমিও রোজদিন না হয় যাতায়াত করব।”

বাড়ি ফিরে এলাম আমরা। হরিদ্বারেই থেকে গেলেন আমার দিম্মা। শুরুর দিকে মধ্যমগ্রাম মামা বাড়িতে থেকেই অফিস যাতায়াত শুরু করে দিলাম।
 
পর্ব দুই (#4-#10)

আকাশে পোজা তুলোর মতন মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। দশমী শেষ, পুজো পুজো ভাবের রেশ একটু আকাশে বাতাসে তখন মাখামাখি। দুর্গাপুজো শেষ হলেই পুজো শেষ হয়ে যায় না। মানুষের মনে তখন রঙের ভিড়। অনেকের পরনে নতুন জামা কাপড়। একদিন অনির্বাণের সাথে ইন্সটিটিইউট গেলাম চতুর্থ সেমেস্টারের জন্য এডমিশান নিতে। দিম্মার কথা বলাতে একটু দুঃখ প্রকাশ করল। সাধারণত পুরো কোর্স অনেক কম লোকেই করে। বেশির ভাগ মানুষ প্রথম দুটো সেমেস্টার করে। আমাদের চতুর্থ সেমেস্টার, ছাত্র সংখ্যা আগের চেয়ে কম। এবারে ব্যাচ পেলাম, মঙ্গল বৃহস্পতি রাতের বেলায় আর শনিবার দুপুরের ব্যাচ। শনিবার অনেকের ছুটি থাকে তাই ওইদিন দুপুরের ব্যাচ। বেশ ভালোই হল। অন্তত শনিবার বাড়িতে বসে কাটাতে হবে না, একটা কাজে অন্তত ব্যাস্ত থাকা যাবে। কালীপুজোর পরে নতুন ক্লাস শুরু হবে। এডমিশান নেওয়ার পরে ইন্সটিটিউট থেকে বেড়িয়ে বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে আমি আর অনির্বাণ সিগারেট ধরিয়ে গল্প করছিলাম।

অনির্বাণকে বেশ খোশ মেজাজে দেখে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার বলতো তোর?”

অনির্বাণ যেন আমার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছিল, “এই পুজোতে একটা মাল পটিয়েছি মাইরি।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “বাঃ কাজের কাজ করেছিস। কি নাম, কোথায় থাকে?”

অনির্বাণ ওর গল্প শুরু করল, “আরে এই আমাদের পুজো মন্ডপে দেখা। মানে আমাদের পাড়ায় ওর মামাবাড়ি। পুজোতে মামাবাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। কাবেরি বারুই। ওদের বাড়ি কসবায়। বেশ চুটিয়ে পুজোর কয়দিন একটু ঝারি মারলাম।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন দেখতে?” উফফ, অনির্বাণের কি হাসি। আমি তখন ওকে বললাম, “এবারে তুই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছিস?”

মাথা দোলাল অনির্বাণ, “তা একটু। গোলগাল দেখতে, বেশ সুন্দরী।”

জিজ্ঞেস করলাম, “তা কত দুর এগোলি?”

একটা লাজুক হাসি দিল অনির্বাণ, “ফোন নাম্বার নেওয়া হয়েছে এই আর কি। তবে ফোনে কি আর কথা বলা যায় নাকি। আসলে এক নম্বর গেট থেকে কসবা। শালা অনেকদুর পরে যাচ্ছে।”

আমি হেসে ফেললাম, “ফোন করে বাড়ির বাইরে কোথাও দেখা করলেই হয়।”

অনির্বাণ মাথা চুলকে বলল, “বাপের হোটেলে খাই। নিজে থেকে একটা কিছু না করা পর্যন্ত কিছু হচ্ছে না।”

সেটা ঠিক কথা বটে। অনির্বাণ এখন নিজে থেকে কিছুই করে না। তাও ওকে বললাম, “তাতে প্রেম করা ছেড়ে দিবি নাকি?”

মৃদু হাসল অনির্বাণ, “না ঠিক তা নয়।” একটু থেমে আমাকে জিজ্ঞেস করল অনির্বাণ, “তোর খবর?”

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “ব্যাচ শেষ, দেখা সাক্ষাৎ শেষ। এবারে যে যার রাস্তায়, আর কি।”

অনির্বাণ আমার চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বলল, “তুই সত্যি কি ওকে ভুলতে পারবি?”

জানি না, কি ভুলতে পারব আর কি পারব না। তবে ওই ট্যাক্সিতে বসে শেষ দেখা আর আমার হাতের ওপরে ওর অশ্রুকণা হয়ত কোনদিন ভুলতে পারব না। ম্লান হেসে ওকে বললাম, “সময়ের সাথে সাথে হয়ত ঝাপসা হয়ে আসবে।”

মাথা নাড়ল অনির্বাণ, “তাই?”

আমি ওর পিঠের ওপরে একটা থাবড় মেরে বললাম, “শালা তোর দোষ সব।”

অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি এর মধ্যে কি করলাম রে বোকাচোদা?”

আমি ওকে বললাম, “না তুই কিছুই করিস নি। শালা আমি একটা কাপুরুষ আর কিছু না।”

হেসে ফেলল অনির্বাণ, “দ্যাখ ভাই। তুই বন্ধু তাই সাবধান করে দিয়েছিলাম। এই আর কি। কারণ অমিত ব্যানারজির ব্যাপারে আমি জানি।”

আরো কিছুক্ষন গল্প করে সেদিন বাড়ির পথ ধরলাম। সেদিন আর মামাবাড়ি গেলাম না, নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম। দিম্মা যদিও আমার বাড়িতে এসে বেশি দিন থাকতেন না তাও বাড়িটা ভীষণ খালি খালি লাগছিল। আসলে কেউ চলে যাওয়ার পরে মন ভীষণ খালি খালি লাগে। ভাগ্যিস যেদিন তিতলিকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম সেদিন বাড়িতে ফিরিনি, না হলে এই বাড়িটা ভীষণ ভাবেই খাঁখাঁ লাগত আমার। এমনিতেই আমার বাড়ি ফাঁকা। বেশি আসবাব পত্র বলতে কিছুই নেই। আর দিম্মা চলে যাওয়াতে আরো বেশি খাঁখাঁ লাগছিল।

দিম্মার কথা মনে পড়তেই দিম্মার শেষ অনুরোধের কথা মনে পরে গেল। বাবাকে একটা ফোন করতে বলেছিলেন দিম্মা। আসার আগে মামিমাও আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখ সবার বয়স হয়েছে, কার কপালে কখন ডাক আসে, কে কখন চলে যাবে বলা যায় না। পারলে একবার ফোন করিস। আমাকে ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন মামিমা। রাতে খাওয়া পরে ফোন হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকলাম। মনের মধ্যে দ্বন্দযুদ্ধ, এতদিন পরে ফোন করে কি কথা বলব।

রাত তখন দশটা বাজে। ফোনের বোতাম টিপে কাগজে লেখা নাম্বার ডায়াল করলাম। বেশ কিছুক্ষন রিং বেজে যাওয়ার পরে ফোন রাখতে যাবো তখন অন্যপাশে একজন মহিলা ফোন উঠিয়ে উত্তর দিলেন, “হ্যালো।” পরিস্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন সেই কন্ঠস্বর, “কে বলছেন?”

আমি ঠিক বুঝে পেলাম না। আসলে বাবার ছবি আমার চোখের সামনে কোনদিন ছিল না তাই সামনের মানুষ আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যাক্তি। আমিও তার উত্তরে ইংরেজিতেই বললাম, “মিস্টার সুবির ঘোষের সাথে কথা বলতে চাই।”

আবার প্রশ্ন এলো সেই মহিলার, “আপনি কে বলছেন?”

হটাত আমার যে কি হল জানি না, আমিও উলটে অন্যপাশের মহিলাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আপনি কে বলছেন?”

সেই মহিলা আমার প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে না গিয়ে একটু রেগেই গেলেন, “ইজ দিস এ জোক। এত রাতে কি ইয়ার্কি মারার জন্য ফোন করেছেন?”

বুঝলাম, অন্যপাশের মহিলা এত সহজে নত হওয়ার নয় অথবা পিছিয়ে যাওয়ার মহিলা নয়। তিনি নিশ্চয় অনেক দৃঢ় ব্যাক্তি। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, “আমি বুধাদিত্য ঘোষ বলছি। একবার কি মিস্টার সুবির ঘোষের সাথে কথা বলতে পারি?”

আমি চুপ করে গেলাম কথাটা বলে। কোন শব্দ নেই আমার মুখে, অন্যপাশে থেকেও কোন সাড়াশব্দ নেই। আমি একবার ভাবলাম, হয়ত ভুল নাম্বারে ফোন করে ফেলেছি। বুকের মধ্যে হাপর টানছে। কাকে কি বলেছি জানি না। কারণ অন্যপাশের মহিলার কণ্ঠস্বর শুনে বেশ সম্ভ্রান্ত মহিলা বলেই মনে হল। তার দৃঢ় কন্ঠস্বরে তার ইংরেজি বলার ধরনেই বোঝা যায় তার চরিত্র।

বেশ কিছু পরে শুনতে পেলাম বাবার গলা। মিস্টার সুবির ঘোষের কন্ঠস্বর কেমন শোনায় সেটা ভুলেই গেছিলাম। সতেরো বছর পরে শুনলাম কম্পিত এক বয়স্ক পুরুষের কন্ঠস্বর। “কেমন আছো?” অন্যপাশের পুরুষের গলা কাঁপছে বেশ।

আমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম, কি উত্তর দেব? কেমন আছি? আমি কেমন আছি এই মানুষটা জেনে কি করবে? তাও ভদ্রতার খাতিরে অচেনা মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিলাম, “ভালো আছি।”

জিজ্ঞেস করলেন বাবা, “বাড়ির সবাই ভালো?”

মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ বাড়ির সবাই মোটামুটি আছেন আর কি। এই নবমীর দিন দিম্মা চলে গেলেন।”

বাবা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “হ্যাঁ, অনেক বয়স হয়েছিল শাশুড়িমায়ের।” কন্ঠস্বরে একটু দুঃখ, একটু কুন্ঠা।

আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ এই তিরাশির মতন হয়েছিলেন।”

বেশ কিছুক্ষন আমরা দুইপাশে চুপ। আমার কথা বলার কিছুই নেই। বাবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি বাঙ্গুরে একা থাকো?”

উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ একটা ছোট ফ্লাট।”

বাবার কন্ঠে একটু আক্ষেপ, “ওহ, আচ্ছা। তোমার অফিস কোথায়?”

আমি উত্তর দিলাম, “পার্ক স্ট্রিটে একটা ছোট কন্সট্রাক্সান কোম্পানিতে চাকরি করি।”

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মামাতো দাদা...”

কথাটা আমি মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে হিমশীতল কন্ঠে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, আমার দাদা ডিভিসিতে চাকরি করে। দুর্গাপুরে। বউদি ওইখানেই একটা বাচ্চাদের স্কুলের টিচার।”

আমার হিমশীতল কন্ঠ শুনে একটু থেমে গেলেন অন্যপাশের কন্ঠস্বর। কথাবার্তা গুলো যেন রাবার ব্যান্ডের মতন টেনে টেনে লম্বা করে করা হচ্ছিল। যে মানুষটা আমার মায়ের মৃত্যু শয্যায় মাকে দেখতে আসেনি তার সাথে কোন রকমের সম্পর্ক রাখার মতন মানসিকতায় ছিলাম না। আমার বেশিক্ষন কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছিল না অন্যপাশের সেই মানুষটার সাথে।

তাই শেষ পর্যন্ত সব বাধা কাটিয়ে হিমশীতল কন্ঠে অন্যপাশের সেই মানুষটাকে প্রশ্ন করলাম, “কি কারনে আমাকে এতদিন পরে মনে পড়ল? আসল কথাটা জানতে পারি কি?”

অন্যপাশে ধস নেমে গেছে বুঝতে পারলাম। ফোনের রিসিভার ধরে বাবা কেঁদে ফেললেন, “কিছু না, এমনি। তোমাকে অনেকদিন দেখিনি। কতদিন আর বাঁচব জানি না, তাই তোমাকে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।”

আমার চোখ জোড়া জ্বালা করে উঠল, সেই সাথে রাগে দুঃখে চিড়বিড় করে উঠল আমার সর্বাঙ্গ। বাবার কান্না উপেক্ষা করেই চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলাম, “এই তো আমার গলা শুনেছ। জেনে গেছ আমি বেঁচে আছি। ব্যাস আর কিছু চাই কি?” অন্যপাশে কোন কথা নেই, শুধু মাত্র চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে এলো। আমি শেষে বললাম, “আচ্ছা ফোন রাখছি তাহলে।”

বাবা ধরা কন্ঠে বললেন, “একবার ধানবাদ আসতে পারবে?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

আমতা আমতা করে বললেন বাবা, “একবার দেখা করার ইচ্ছে ছিল। তা তোমার যদি সময় না হয় তাহলে তোমার ঠিকানা দাও। আমরা না হয় একদিন দেখা করে আসব তোমার সাথে।”

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, “দেখা করার খুব দরকার আছে কি?”

অন্যপাশে বাবা কি উত্তর দেবেন সেটা হয়ত ভেবে পেলেন না তাই বেশ কিছুক্ষন চুপ করেই ছিলেন। মামিমার কথা মনে পরে গেল, বয়স হয়েছে, হয়ত প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যেই ফোন করেছেন। মামিমার কথা মনে পড়তেই মনে মনে হেসে ফেললাম “তো একটা ফোন করলেই কি আমার ছেলে পর হয়ে যাবে নাকি? আমি কি এমনি এমনি ছেড়ে দেব?”

আমি বাবাকে বললাম, “আচ্ছা,তোমার ঠিকানা দাও, দেখি কোনদিন সময় পেলে যাবো।”

আমাকে ধানবাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বাবা বললেন, “এসো একদিন। আমার ভালো লাগবে।”

আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটু হেসে বললাম, “আচ্ছা।”

ফোন ছাড়ার পরে আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল মামার ওপরে। কিন্তু মামার ওপরে তো আর রাগারাগি করতে পারি না। মা মারা যাওয়ার পরে আমার সব আদর আবদার দিম্মা আর মামিমা। তাই ফোন করে মামিমাকেই রাগারাগি করলাম। কি দরকার ছিল সুবির বাবুর সাথে কথা বলার? বলে দিতে পারো নি, তুমি জানো না আমি কোথায় থাকি। ওত প্রেম উথলে পড়ছিল তা তুমি নিজে কেন গেলে না ধানবাদে। মামিমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমার নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগলো। কার রাগ কার দুঃখ কার ওপরে করছি।

মামিমার কাছে ক্ষমা চাইতেই মামিমা সস্নেহে বললেন, “যাক বাবা, তুই ফোন করেছিস সেটা জেনে ভালো লাগলো। মাও চেয়েছিলেন তুই একবার অন্তত তোর বাবার সাথে কথা বল।”

রিসিভার রেখে দিলাম। চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসার যোগার। না, মামা মামীর ওপরে রাগের জন্য নয়। সব রাগ ওই কোন দূরে, এক অট্টালিকায় নরম বিছানায় শায়িত এক পুরুষের প্রতি, যার ঔরসে আমার জন্ম শুধু মাত্র আমার পদবী ছাড়া আর কিছুই অবদান নেই। রান্নাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে একটা অর্ধেক মদের বোতল পেলাম। বোতল খুলে ঢকঢক করে গিলে নিলাম মদ। জ্বলছে সারা শরীর। মাথায় আগুন জ্বলছে। বসার ঘরে সোফার ওপরে শুয়ে পড়লাম। বসার ঘরের দেয়ালে মায়ের একটা বেশ বড় ছবি টাঙ্গানো। হাসি হাসি মুখে রোজদিন মা আমাকে আশীর্বাদ করেন।

মায়ের তখন একুশ হবে, বাবার সাতাস মনে হয়। বয়সের বেশ ব্যাবধান ছিল আমার বাবা মায়ের মধ্যে। তিন বছর পরেই আমার জন্ম হয়, এই মধ্যমগ্রামের বাড়িতে। আমার দাদু তখন বেঁচে ছিলেন। চোখের সামনে পুরানো দিন গুলো এক এক করে ছবির মতন ভেসে উঠতে লাগলো। মনে আছে, তারপরে আমরা ধানবাদে চলে যাই। বিসিসিএল এর কোয়াটারে। ছোট দুই কামরার কোয়াটার, সামনে একটা বাগান ছিল। সেখানে একটা দোলনা ছিল। একটু একটু করে বড় হলাম সেখানে। মনে পরে, মাঝে মাঝেই বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া হত কিছু কারনে। ছোট ছিলাম তাই বুঝতাম না। অনেক রাত মাকে দেখেছি চুপ করে খাবার বেড়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে। দরজার ফাঁকা দিয়ে দেখতাম, বাবা মদে চুড় হয়ে বাড়ি ফিরতেন। একদিন কি হল, খুব ঝগড়া হল। বিকেলের ট্রেনে মা আমার হাত ধরে মামা বাড়ি চলে এলেন। আর ফিরে যাননি ধানবাদে। আমি ভর্তি হলাম নরেন্দ্রপুর রাম কৃষ্ণ মিশনে। ভর্তি করার সময়ে সেই এক বার মাত্র বাবা এসেছিলেন। তারপরে আর কোনদিন বাবার মুখ দেখিনি।

চোখ চলে যায় মায়ের ছবির দিকে। কাঁচের ফ্রেমের ভেতর থেকে মা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসছেন। চোখ দুটি ভারী মিষ্টি, অসীম মমতা মাখা। রোজ সকালে স্নান সেরে মায়ের ছবির নিচে ধুপ কাঠি জ্বালিয়ে দেই। মা আমাকে রোজ দিন আশীর্বাদ করেন। বাবা একটু সাবধানে বাইক চালাস। কারুর সাথে এক্সিডেন্ট হলে মাথা গরম করিস না। মারপিট করিস না। আদি রে, আমি তোর পথ চেয়ে বসে থাকবো।


ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। শীতের ছুটির আর কয়েকদিন বাকি। একদিন স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সবাই। হস্টেল ওয়ার্ডেন এসে আমাকে সেক্রেটারি মহারাজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি মামা বসে আছেন। মামাকে দেখে আমি খুব খুশি। ছুটির আগেই আমি ছুটি পেয়ে যাবো। আমি মামাকে দেখে আনন্দে আঠখানা। জিজ্ঞেস করলাম, কি এনেছো মামা। মামার চেহারা থমথমে। তখন বুঝতে পারিনি কি হচ্ছে। সেক্রেটারি মহারাজ আমাকে বললেন, বুধাদিত্য, তুমি বাড়ি যাও। তোমার মামা তোমাকে নিতে এসেছেন। আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছেন শুনে আমি খুব খুশি। নরেন্দ্রপুর থেকে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত মামা আমাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন। ক্ষনিকের জন্যেও আমাকে বুঝতে দেননি যে তার ছোট বোন মৃত্যু শয্যায় আর তার একমাত্র ভাগ্নের সেই শেষ হাসি।

বাড়িতে পা দিতেই পা আটকে যায় মাটিতে। মামাবাড়ি বিশাল উঠানে আমার স্নেহময়ি মা শুয়ে আছেন অন্তিম শয্যায়। আমি মামার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠেছিলাম, মা একি হলো, তুমি যে বলেছিলে শীতের ছুটিতে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে? মা ওঠ মা, দেখ আমি এসে গেছি। চল না মা, ঘুরতে যাব। মায়ের কানে আমার সেই আওয়াজ পৌঁছায়নি। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে মাকে নিয়ে চলে গেল। মায়ের মুখাগ্নি করার সময়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি কোনদিন বাবার সাথে দেখা হয় তাহলে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করব। কেন এমন করলে? মায়ের চিতা জ্বলে উঠেছিল সেই এক শীতের রাতে। সেই সাথে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল আমার স্বপ্ন আমার মনের আনন্দ। দিম্মা আর মামিমা আমাকে বুকের মধ্যে আঁকরে না ধরলে আমিও এক অনাথ হয়েই বেঁচে থাকতাম। দিম্মা আমাকে ছাড়তে চায়নি। তবে আমার ভবিষ্যৎ আমার পড়াশুনার কথা ভেবেই মামা আমাকে নরেন্দ্রপুরে দিয়ে এসেছিলেন।

দিম্মার শেষ অনুরোধ রেখেই বাবাকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু দেখা করতে যাওয়ার কথা ঠিক মানতে পারছিলাম না কিছুতেই।

============= পর্ব দুই সমাপ্ত =============
 

Users who are viewing this thread

Back
Top