সেই আদিকাল থেকেই মানুষের জীবনে অত্যন্ত পুষ্টিকর ও উপাদেয় পানীয় হিসেবে দুধ জুড়িহীন। বিশ্বব্যাপী ছাগল, উট, ভেড়া, মহিষ, এমনকি কোনো কোনো দেশে চমরী গাই বা ঘোটকীর দুধের প্রচলন থাকলেও সাধারণ অর্থে আমরা দুধ বলতে গরুর দুধই বুঝি, যা আসলে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। সেই হাজার হাজার বছর আগে থেকেই পশু পালন ও দুগ্ধ দোহনের প্রচলন রয়েছে পৃথিবীর সব প্রান্তে। তবে দুগ্ধবাহী নানা রোগবালাইয়ের বাধা পেরিয়ে বাণিজ্যিকভাবে দুধ উৎপাদন, নিরাপদে সংরক্ষণ ও সরবরাহ নতুন মাত্রা পায় পাস্তুরীকরণ ও জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার যথাযথ পদ্ধতি মানুষের হাতের নাগালে আসায়।
নানা রূপ ধরে দুধ
নানা রূপে দুধ
বিখ্যাত ফরাসি বৈজ্ঞানিক লুই পাস্তুরের মূলনীতি মেনে পাস্তুরিত করতে বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তিতে সেলসিয়াস স্কেলে ৬৩ ডিগ্রিতে আধঘণ্টা বা ৭২ ডিগ্রিতে দুধ ১৫-২০ সেকেন্ড গরম করে খুব দ্রুত ৩ ডিগ্রিতে ঠান্ডা করলেই দুধের ক্ষতিকর জীবাণুগুলো মরে যায়। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বেসরকারি কোম্পানিগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গার খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাস্তুরীকরণ, হোমোজেনাইজেশন ও প্যাকেটজাত করে থাকে। তবে এই প্যাকেটজাত দুধ সর্বদা ন্যূনতম ৪ ডিগ্রিতে রাখা উচিত, যা রেফ্রিজারেটর ছাড়া সম্ভব নয়। চার ঘণ্টা পর্যন্ত ঘরের সাধারণ তাপমাত্রা বা কক্ষ তাপমাত্রায় ভালো থাকে। আবার সারা বিশ্বেই লম্বা সেলফলাইফযুক্ত আলট্রা হিট ট্রিটেড বা ইউএইচটি দুধ খুব পরিচিত এক নাম। এখানে দুধ খুব অল্প সময়, যেমন ২-৩ সেকেন্ডের জন্য খুব উচ্চ তাপমাত্রায় তথা ১৩৫–১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত করে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে এর প্যাকিং নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় দুধের স্বাদ–গন্ধে খুব সামান্য পরিবর্তন এলেও এর পুষ্টিগুণ প্রায় পুরোটাই অক্ষুণ্ণ থাকে।
সুস্বাস্থের জন্য
আমাদের মতো দেশে যেখানে দুধ সংরক্ষণ ও বিপণনে তাপমাত্রা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন, সেখানে দুধের পুষ্টি সবার কাছে পৌঁছে দিতে ইউএইচটি মিল্ক একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তরল দুধকে স্প্রে ড্রাই বা ফ্রিজ ড্রাই পদ্ধতিতে মিল্ক পাউডারে পরিণত করা হয়ে থাকে। বাতাস ও পানিনিরোধী প্যাকেজিংয়ের বদৌলতে গুঁড়া দুধের সংরক্ষণকাল বেশ লম্বা হয়। স্বাদে কিছু হেরফের হলেও পুষ্টিগুণ খুব একটা নষ্ট হয় না পাউডার দুধে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বড় পরিসরে বেশি বেশি শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে গুঁড়া দুধের গুরুত্ব রয়েছে। তবে যে দুধই হোক, জন্মের পর দুই বছর বয়স অবধি মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই শিশুদের জন্য।
সুস্বাস্থ্যের জন্য দুধ
দুধকে আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যে আদর্শ খাদ্য বলা হয়, তা সত্যিই অনস্বীকার্য। এতে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ সহজপাচ্য প্রোটিন (১ কাপে প্রায় ৭ দশমিক ৭ গ্রাম), যা দেহের বৃদ্ধি, গঠন ও রোগ প্রতিরোধ করার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। সহজপাচ্য এই প্রোটিন শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক সবার জন্য সমান উপকারী। এতে আছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব কটি ভিটামিন। ভিটামিন সি অবশ্য তাপে নষ্ট হয়ে যায় বলে দুধ থেকে সেভাবে পাওয়া যায় না। ক্যালসিয়ামের খুবই ভালো উৎস দুধ। ১ কাপ দুধে প্রায় ২৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়, যা অন্যান্য খাদ্যের ক্যালসিয়ামের চেয়ে সহজে শরীরে শোষিত হয়। দুধ নিয়মিত পান করলে তাই বয়সকালে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়ের মতো রোগের আশঙ্কা কমে যায়।
চা ও কফির সঙ্গী
দুধের ল্যাকটোজ–জাতীয় শর্করা অবশ্য অনেকের হজমে সমস্যা করতে পারে, যাকে চিকিৎসকেরা ল্যাকটোজ অসহনীয়তা বা ইনটলারেন্স বলে থাকেন। সে ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ একটি ভালো উপায়। এদিকে প্রাপ্তবয়স্ক, যাঁদের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের সমস্যা আছে, তাঁরা দুধ বাদ না দিয়ে ননীমুক্ত দুধ খেতে পারেন। করোনার এ সময়ে করোনায় আক্রান্ত ও করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদের পথ্য হিসেবে দুধ গ্রহণের ব্যাপারে জোর তাগিদ রয়েছে ডব্লিউএইচওর স্বাস্থ্য নির্দেশিকাতে।
দেশ–বিদেশে দুধ উৎপাদন
দুধ
সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি দেশেই দুধ উৎপাদিত হয়। ২০১৫ সালে বিশ্বে মোট ৪৯৭ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়েছিল যে পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ২০২০-এ কোভিড সংকটের মধ্যেও ৫৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টনে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলে, সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দুধ গ্রহণ করেছে ভারতের অধিবাসীরা (৮১ মিলিয়ন মেট্রিক টন)। এরপরেই আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্থান। আমাদের বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। এই পরিমাণ আসলে দেশের চাহিদার তুলনায় এমন বেশি কিছু নয়।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য
আইসক্রিম
সারা পৃথিবীতেই দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যগুলোর আছে বহুবিধ ব্যবহার। বিভিন্ন ডেজার্টের মূল উপাদানই দুধ। দুধ ছাড়া আইসক্রিম, পুডিং, কাস্টার্ড, আইসক্রিম, ফালুদা, ক্ষীর, ট্রাফল কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না। এ ছাড়া দুধ থেকেই তৈরি হয় ননী, মাখন, ঘি, পনির আর দই। বিভিন্ন রকমের বিচিত্র সব চিজ বা পনির ছাড়া পৃথিবীর খাদ্য মানচিত্র আঁকা অসম্ভবই বটে। আছে ইতালির গরগনজোলা, পারমেজান আর মোৎজারেলা, সুইস চিজ এমেন্টাল আর গ্রুইয়ের, ফ্রেঞ্চ চিজ ব্রেই আর ক্যামেমবার্ট, গ্রিক চিজ ফেটা, ব্রিটিশ চিজ চেডার আর আমাদের চিরচেনা ঢাকাই পনির। এদিকে মাখন তো ঝাল, মিষ্টি, নোনতা—সব স্বাদের খাবারেই সমান দাপটে উপস্থিত।
ফালুদা
মাখন আর ক্রিম না থাকলে পৃথিবীতে কোনো কেক আর পাই তৈরি হতো না, ভাবলেই দুনিয়ার খাদ্যরসিকেরা আঁতকে উঠবেন। যত সব উপাদেয় স্টেক, স্টু, স্যুপ থেকে শুরু করে বাটার চিকেন আর ডালমাখানি, মাখনেরই কারবার সব। আমাদের উপমহাদেশের ক্ল্যারিফায়েড বাটার বা ঘি অবশ্য এক সম্পূর্ণ আলাদা রাজকীয় স্বাদ ও গন্ধ এনে দেয় মোগলাই, আওধি আর পার্সিয়ান প্রভাবে সমৃদ্ধ বিরিয়ানি, রেজালা, মোসাল্লামে।
উপমহাদেশীয় রান্নায় ঘি অপরিহার্য, ছবি: উইকিপিডিয়া
ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ রান্নায়ও ঘি এক অপরিহার্য নাম। আবার সারা বিশ্বেই প্রচুর পরিমাণে দই খেয়ে থাকে সবাই। ফ্রেশ দইতে প্রোবায়োটিক থাকে বলে তা ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা জোরদার করতে অনন্য ভূমিকা রাখে। তাই করোনার এই কঠিন সময়ে আমাদের দই খাওয়ার ওপরে জোর দেওয়া উচিত।
চিজ
আন্তর্জাতিক দুগ্ধ দিবস মানেই সুস্বাস্থ্যের জন্য দুধের উপকারিতাগুলো আবারও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখে নেওয়া। এদিনের প্রত্যয় হলো, দুধকে একটি বৈশ্বিক সর্বজনীন পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে সর্বস্তরে প্রচলন করা। এ জন্য আমাদের দুধের পুষ্টিগুণ ও প্রয়োজনীয়তাগুলো আরো বেশি বেশি প্রচার করতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে।