গানের মৌসুমে মাসে গড়ে ১৫টি করে স্টেজ শো করতেন আঁখি আলমগীর। করোনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় স্টেজ শো। কয়েক মাস পর সংক্রমণ কিছুটা কমে এলে গত অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে ৪-৫টি শো করেছেন তিনি। সর্বশেষ মার্চে শো করেছেন। এরপর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেছে শো। আঁখি আলমগীর বলেন, ‘করোনা শিল্পীদের ওপর দুই রকম প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, শো বন্ধ থাকায় শিল্পীরা আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। দ্বিতীয়ত, আমরা মানসিক চাপে আছি। হতাশ হয়ে পড়ছি। আমরা কাজের মানুষ, কাজ নিয়ে বাঁচি। মানসিকভাবে দমে যাচ্ছি আমরা।’
স্টেজে কুমার বিশ্বজিত গান পরিবেশন করছেন
করোনা মহামারির মধ্যে বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমে কিছুটা গতি ফিরলেও এখনো অনেকটাই স্থবির সংগীতাঙ্গন। কিছু সিনেমার গানের রেকর্ডিং ও টুকটাক টেলিভিশনে শো হচ্ছে। তবে কণ্ঠশিল্পীদের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস নিয়মিত স্টেজ শো প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ। ফলে আঁখি আলমগীরের মতো অনেক কণ্ঠশিল্পীই নিয়মিত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক শিল্পীর আর্থিক অবস্থা অতটা স্থিতিশীল না, তাঁরা সংকটে পড়ে গেছেন।
কনসার্টে গান গাইছেন আঁখি আলমগীর, ফেসবুক থেকে
গায়ক-গায়িকাদের সংগঠন কণ্ঠশিল্পী পরিষদ বাংলাদেশ-এর যুগ্ম আহ্বায়ক কুমার বিশ্বজিতের ধারণা, ছোট–বড় মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক কণ্ঠশিল্পী আছেন সংগীতাঙ্গনে। তিনি বলেন, অডিও কোম্পানিগুলোর কাছে সংগীতশিল্পীদের আয় এখন কিছুটা কম। কোম্পানিগুলো নাটকের দিকে ঝুঁকেছে। স্টেজ শো-ই তাই শিল্পীদের মূল আয়ের জায়গা। কিন্তু দেড় বছর ধরে কমবেশি স্টেজ শো বন্ধ থাকায় এসব শিল্পী ২০০ কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
স্টেজ শো বন্ধ থাকার কারণে আর্থিক সংকটে পড়ার কথা স্বীকার করলেন এ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী পুলক অধিকারী
স্টেজ শো বন্ধ থাকার কারণে আর্থিক সংকটে পড়ার কথা স্বীকার করলেন এ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পী পুলক অধিকারী। তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে অডিও কোম্পানিতে শিল্পীদের গানের চাহিদা কম। গান তৈরি করে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে শিল্পীরা যে নিজেদের ইউটিউবে ছাড়বেন, সেই আর্থিক সক্ষমতাও এখন অনেক শিল্পীর নেই। স্টেজ শো মৌসুমের আয় দিয়ে তাঁদের সারা বছর চলত। দেড় বছর ধরে সেই পথও বন্ধ। পুলক বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর শো থেকে বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করেছিলাম। সেই টাকা দিয়ে দেড় বছর ধরে চললাম। এখন কী করব, বুঝতে পারছি না। আরও ছয় মাস এই পরিস্থিতি চললে অন্য কাজ খুঁজতে হবে।’
এর মধ্যেই গানের পাশাপাশি অন্য পেশায় নিজেকে যুক্ত করার কথা ভাবছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সময়ের এক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। তিনি বলেন, ‘স্টেজ শো নেই। অডিও কোম্পানিতেও গানের চাহিদা কম। বাসায় মা ও বোন আছে। আমাকে সংসার দেখতে হয়। লেখালেখি ও ছবি আঁকার অভ্যাস আছে। ভাবছি, গানের পাশাপাশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হব। সেখান থেকে একটা আয় আসবে।’
স্টেজ শো-ই তাই শিল্পীদের মূল আয়ের জায়গা
সারা বছর প্রতি মাসে গড়ে ১০টি করে স্টেজ শো করতেন সংগীতশিল্পী কনা। করোনার প্রথম ঢেউয়ের শেষ দিকে পরিস্থিতির উন্নতি হলে এই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিছু শো করতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার সব বন্ধ। কনা জানান, স্টেজ শো বন্ধ থাকার কারণে দেড় বছরে প্রায় কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দেড়টা বছর কিছু টিভি শো, জিঙ্গেল গেয়ে কোনোমতে কাজ করে যাচ্ছি। গানে আছি অনেক দিন। সঞ্চিত টাকা থাকায় হয়তো আমার সমস্যা কম হচ্ছে। কিন্তু যাঁরা শো করেই সংসার চালান, তাঁদের অবস্থা করুণ। এভাবে আর কত দিন তাঁরা চলতে পারবেন, কে জানে!’
এ রকমই একজন শিল্পী পলাশ আচার্য। ২০০৮ থেকে তবলা বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। সংসারে এক ছেলে, এক মেয়ে। শো বন্ধ থাকায় চরম আর্থিক সংকটে আছেন এই যন্ত্রশিল্পী। তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের মার্চের পর থেকে শো বন্ধ। মাঝেমধ্যে কিছু ইনডোর শো করেছি। সবশেষ গত ঈদে টেলিভিশনে একটিমাত্র শো পেয়েছিলাম। আয়–রোজগার না থাকায় ঠিকমতো বাসাভাড়া দিতে পারছিলাম না। গত সপ্তাহে স্ত্রী ও সন্তানদের দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। বাবা-মাকেও খরচ দিতে হয়। বেশ কিছুদিন ধরে ধারদেনা করে চলছি। ভবিষ্যতে কীভাবে চলব, বুঝতে পারছি না। অন্য কিছু করার জন্যও তো অর্থের প্রয়োজন। সেটা আমার নেই।’
কনসার্টে গান গাইছেন জেমস।
কুমার বিশ্বজিতের শঙ্কা, ছয় মাস, এক বছর—এ রকম চলতে থাকলে অনেক শিল্পীই সংসার চালাতে অন্য কাজ খুঁজে নেবেন। কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে, ‘সংগীতাঙ্গনের চরম দুরবস্থা যাচ্ছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবছেনই না। আমরা দুস্থ শিল্পী হতে চাই না। আমাদের যোগ্য প্রাপ্তিটা আমরা চাই। সরকার যদি উদ্যোগ নিত, কপিরাইটসহ নানা জটিলতাগুলো যদি একটি সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারত, তাহলে দুর্দিনেও টিকে থাকতে পারতেন শিল্পীরা।’