গল্পটি সংগ্রহীত, লেখক: OMG592
অরুণাচল প্রদেশের এই জায়গাটা কোনদিনও বিজনের ভাল লাগে নি, সেই ছোটবেলা থেকেই এই জায়গাটাকে সে মনে প্রাণে ঘৃণা করে এসেছে। মাইল খানেক পরিধির ভেতরে হাতে গোনা কয়েকটা ঘর মাত্র, আবার সেখানে সমবয়সী বলতে কেউই নেই। ওর পরিবারে মানুষ বলতে তিন জন, বিজন , ওর বুড়ো বাপ আর ওর মা।
সংসারে পিছুটান বলতে এই মা শুধুমাত্র পড়ে আছে, আর ছিলো ওর দাদা সানি, শুধু দাদা বললে ভুল হবে, ওর সৎ দাদা, ওর বাপের আগের পক্ষের ছেলে, বয়সে বেশ খানিক বড়। এর মধ্যে চিনা সেনারা এখানে হামলা করে বলে, সে বর্ডার ফোরস জয়েন করেছে। পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে সানি, কিছুই তো নেই এখানে, আছে বলতে গেলে অনেকটা চাষ করার মতন জমিন।
যখন ওর দাদা এখানের থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো, সে খুব ঝামেলা হয়েছিলো বাড়িতে , ওর বাপের বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছিলো, ওর মাও মনমরা হয়ে পড়ে থাকতো। এ জীবনে নিজের বড় ছেলের মুখ দেখতে পাবে কিনা, বুড়োর সে আশাও চলে গিয়েছিলো।
বুড়ো বাপ যখন তখন মদ খেয়ে শুয়ে শুয়ে বকতে থাকে, নিজের বড় ছেলের উদ্দেশ্যে গালাগালি দিয়ে বলে, "বেশ হয়েছে, শালা ঘর থেকে পালালি, এবার গুলি খেয়ে মর"
কিন্তু বুড়োর বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না, নেশা কিছুটা নামলে চোখের কোন দিয়ে নেমে আসা জলের দাগ বুড়ো নিজেই হাত দিয়ে মোছে। সামনে বিজনকে পেলে, খিস্তি দিয়ে বলে, "তোর ভাইয়ের মতন দুরবুদ্ধি এলে, তোকে সেদিনই মাটিতে গেড়ে দেব, কাকপক্ষীতে টেরও পাবে না"
"ও সংসারটাকে খালি করে দিয়ে গেলো, একটু ভাবেও না, বুড়ো বাপ মা এর কি দশা হবে, এত ক্ষেত খামারের কাজ কে করবে?"
সত্যি কথা বলতে বিজনের ঘাড়ে অনেকটা কাজ চাপিয়ে চলে গেছে সানি, ওদের জমির পরিমান নেহাত কম নয়, এখন দুগুন খাটনি ওকেই করতে হয়। ওর দাদা ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে স্বভাবের ছিলো, সে ওর দাদা এমনিতেই হয়ত ঘর ছেড়ে পালাতো কোন না কোনোদিন।
সানির পালানোর দায়টা ওর বাপ কিছুটা হলেও ওর মায়ের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিলো ওর বাপ, বলে কিনা নিজের পেটের ছেলে নয় বলে ওকে আটাকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা ওর মা করে নি।
দিনটা বেশ ভালো করে মনে আছে বিজনের, সেই হপ্তাতে বেশ খাটা খাটুনি গিয়েছিলো, বিজন আর ওর বাপ দুজনেরই। কি মনে করে ওর মা সেদিন মোরব্বা বানিয়েছিল, খুবই প্রিয় বিজনের। গ্রামের পোষ্ট মাস্টার এসে চিঠিটা দিয়ে গিয়েছিল ওর মা'কে। ওর মার বেশিদুর লেখাপড়া নেই, চিঠিটা খাবার টেবিলেই রাখা ছিলো।
ঘরে ঢুকে বিজনের চোখ সোজা গিয়ে পড়েছিলো ওর উপরে, আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাপ মায়ের দিকে, কেউই হাত বাড়িয়ে চিঠিটা খোলার সাহস করে উঠতে পারছিলো না। শেষএ বুড়োই গিয়ে চিঠিটা তোলে, কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলে চিঠিটাতে দুচোখ বুলিয়েই যেন শ্বেতপাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। মা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়।
ওর জানাই ছিলো চিঠিতে কি লেখা থাকবে, তবুও হাতে নিয়ে চোখ বোলায় চিঠিটার উপরে, ছাপা অক্ষরে লেখা গুলো পড়তেই যেন পায়ের তলা থেকে মাটিটা কেউ টেনে সরিয়ে নেয়, ওর দাদা আর নেই, চিনা সৈনিকদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে।
ওর বাপের মতোই বিজনও জানলা পেরিয়ে ঘাসে মোড়া দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখনও ওর মা সমানে কেঁদেই চলেছে।
সেদিন ওর বাড়িতে আর উনুন জলেনি, শীতল নিস্তব্ধতার কম্বলে যেন পুরো ঘরটা ঢাকা, বিজন নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে পড়ে, জানে না ওর মা বাপ কি নিজেদের ঘরে ফিরে শুয়েছিল, না খাবার ঘরেই মেঝেতে কাটিয়েছিলো।
ঘটনাটার পরদিন থেকে, বুড়ো নিজের জীবনিশক্তি ধীরে ধীরে খোয়াতে শুরু করে। বিজন বাপকে খুশি করার জন্যে, আরো বেশি করে খেতখামারির কাজে লেগে পড়ে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বুড়ো কোন দিকেই আর নজর দেয় না, মেজাজ এ যেন মরচেটা আরও বেশি করে পড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে সময়ের প্রলেপ ওর মায়েরও ক্ষতস্থান নিরাময় করে শুরু করে দেয়।
ব্যতিক্রম শুধু বুড়ো, সামনে এসে তাকালে মনে হয়, শূন্য এক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ওর মা এখন বেশি করে চিন্তিত হয়ে পড়ে , মনে হয় আগের থেকেও বেশি করে চিন্তিত ওর বাপকে নিয়ে। খামারের কাজ যেন বিজনের অভ্যেস হয়ে দাঁড়ায়, মনে মনে মেনেই নেয়, এর ভবিতব্য এটাই ছিলো।
যদিও বুড়োর প্রলাপ উল্টো কথা বলে, বুড়ো ধরেই নিয়েছে ছোট ছেলেটাও একদিন ওর দাদার মতনই ঘর ছেড়ে ছুড়ে পালাবে, সে বিজন ওর বাপকে যতই না বোঝানোর চেষ্টা করে, লাভের লাভ কিচ্ছু হয় না।
আরেকটা দিনের কথা, সেদিন ওর বাপ ওর সাথেই জমিতে কাজ করছিলো, ফেরার পথে কেউ যেন বলাবলি করছিলো, যুদ্ধটা এবার আরও বেশি করে লাগবে, আর দেখে কে, বুড়োর কপালে চিন্তার বলিরেখা আরও বাড়ে, গোটা পথটা দিয়ে আসতে আসতে বিড়বিড় করে বলে, "শালা, আমি জানতাম, শালা আমি জানতাম",
বুড়ো কি যে জানে, সেটা বুড়ো জানে, আর জানে ওপরওয়ালা।
বাড়ি ফিরে গরু ছাগলগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে যখন বিজন ঘরে ঢোকে , বুড়োর উচ্চস্বরে গলার আওয়াজ পায়।
"মাগি, তোকে তো পই পই করে বলেছিলাম", মায়ের উত্তরটা ওর কানে আসে না,
"ছেলেটা ঘর থেকে পালাত না, যদি না একটু আঁচলের তলায় বেঁধে রাখতিস"
ওর বাপ সমানে বকে চলেছে, "এ ছেলেটা তোর পেটের ছেলে, একটু নজরে নজরে রাখ, এও না ফস্কে বেরিয়ে যায়", দরজার কাছে বিজনকে দেখে ওর বাপটা থেমে যায়।
"আজ আমার শরীরটা যুত লাগছে না, জলদি ঘুমিয়ে পড়বো"
"কিরে, তোর জন্যে মাংসের ঝোল বানালাম, না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি?", ওর মা জিজ্ঞেস করে, বেশি কথা না বাড়িয়ে সোজা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়, বিছানার উপরে নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দেয়।