সারা দিন অবসন্নতা আর দুশ্চিন্তায় না ভুগে নিজের যত্ন নিন, মন ভালো রাখুন।
আবার সেই গৃহবন্দী সময়। মহামারির দুঃসময়ে কেউ ভুগছেন শারীরিক অসুস্থতায়, কেউ আবার কষ্ট পাচ্ছেন আপনজনের অসুস্থতায়। যিনি করোনায় ভুগছেন, তিনি ভাবছেন, শারীরিক জটিলতা বাড়বে কি না। যিনি আক্রান্ত হননি, তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন, কখন না জানি সংক্রমিত হয়ে পড়ি। অস্থির সময়টা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে যেন। তবে সময়ের এই আঁচড়ে জীবনটা যেন অবসন্নতায় ডুবে না যায়, খেয়াল রাখুন সে বিষয়ের দিকেও।
লেখাটা নিয়ে যখন বসেছি, ভাবনায় এল বিগত দিনগুলোয় করোনায় আক্রান্ত রোগী ও তাঁদের স্বজনদের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা আর আক্ষেপের চিত্রগুলো। পেশায় চিকিৎসক আমি প্রায় ১০ মাস কাজ করেছি কোভিড আইসিইউতে। তাই হয়তো এই চিত্রগুলো আরও বেশি ‘প্রাণবন্ত’ হয়ে ওঠে চোখের সামনে, পৃথিবীটাকে মনে হয় ‘নিষ্প্রাণ’। না পাঠক, কোভিড আইসিইউর দিনলিপি লিখতে বসিনি। বসেছি করোনা প্রতিরোধের অবিচ্ছেদ্য ‘পদক্ষেপ’—‘ঘরে থাকা’র সময়কে পাঠকদের জন্য একটু প্রাণবন্ত করে তুলতে।
কেমন করে থাকি ঘরে
ঘরে থাকতে আর ভালো লাগে না। ঠিক কথা। তবে করার আছে অনেক কিছুই। ব্যক্তিভেদে ভালো লাগার কাজে তফাত আছে, তাই তফাত থাকে ভালো থাকার চেষ্টাতেও। কেউ বই পড়তে ভালোবাসেন। তো বসে যান বই নিয়েই। ঘরে থাকা পুরোনো বই (আগে পড়া কিংবা না পড়া) দিয়েই শুরু হোক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাকাটা হতে পারে অনলাইনেই। তাহলে বইটাই বা বাদ যায় কেন? সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, যা ভালো লাগে পড়ুন। ঠিক করে নিতে পারেন, এক সপ্তাহে কতটা পড়তে চান। সময় যখন পেয়েছেন, পড়ার মতো দারুণ কাজেই লাগান। শুনতে পারেন পছন্দের অডিও ক্লিপ। দেখতে পারেন পছন্দের ভিডিও। পুরোনো অ্যালবাম? দেখুন না বসে দু–একটা দিন।
পারিবারিক সময়
সহায়তা করুন একে অপরকে। সময় কেটে যাবে আনন্দে
পরিবারের সবাই একসঙ্গে হওয়াটাই তো দুষ্কর আমাদের ব্যস্ত জীবনে। গৃহবন্দী সময়টায় তাই প্রিয়জনকে সঙ্গ দিন। ঘরের কাজে হাত লাগান। ‘আমি তো এসব পারি না, কোনো দিন করিনি’—এমন ভেবে হাত গুটিয়ে থাকবেন না যেন। না পারার সময়টাই তো বেশি মজার। কাজ শিখতে গিয়ে সব হলো গুবলেট? হোক না। কেঁচে গণ্ডূষ করার পর্যাপ্ত সময় তো রয়েছেই। অন্দরে যা আছে, সেগুলোকেই এদিক-ওদিক করে ভিন্নতা আনতে পারেন। হাতে সেলাইয়ের দিন ফিরিয়ে আনতে পারেন। কাগজ, পুরোনো বোতল, পুরোনো শো পিসের ভাঙা অংশ দিয়ে নানা কিছু করা যায় সময় কাটাতে। শিশুদের সময়টাকে রঙিন ও প্রাণবন্ত করে তুলুন। ছোট্ট শিশুকে পিঠে নিয়ে আপনিই যদি হামাগুড়ি দেন, কেমন মজা পায় ওরা! আপনার কাজে ও কথায় ওদের আনন্দ দিন, ওদের আপন হয়ে উঠুন। ওদের সময়টা ভালো রাখতে হলেও আপনাকে প্রাণবন্ত থাকতে হবে কিন্তু। পরিবারের অভ্যন্তরে ছোট-বড় সবার মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলার দারুণ এক সুযোগ এই গৃহবন্দী সময়টা।
ডিজিটাল যোগাযোগ
স্কুলজীবনের বন্ধু কিংবা হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে নতুন করে আলাপ হতে পারে ডিজিটাল মাধ্যমে। ভিনদেশে থাকা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করতে পারেন। তবে পরিচিত পরিসরে যোগাযোগের কাজটুকু ছাড়া অতিরিক্ত সময় ডিজিটাল মাধ্যমে কাটানো ঠিক নয়, তাতে চোখ, ঘাড় কিংবা মনোজগতের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হতে পারে।
রসনাবিলাস
রান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা মন্দ নয়। ভিন্ন স্বাদের কিছু রান্না করতে পারেন প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে। দেশের কিংবা বিদেশের খাবার পদগুলো নিজেই তৈরি করতে পারেন একটু চেষ্টা করলে। ইফতার কিংবা ঈদের আয়োজনেই না হয় তাক লাগিয়ে দিন বাড়ির সবাইকে।
মন ভালো রাখতে রান্না করা যায়
নিজের যত্ন
ঘরেই ব্যায়াম করুন। ঘরে থেকেই কিন্তু নানা ব্যায়াম করা যায়। শরীরটাকে অবহেলা করবেন না। ‘আটা-ময়দা মাখার গল্পই তো সার তোমাদের’—নিন্দুকের এমন কথায় ভ্রুক্ষেপ করবেন না। নিজেকে সময় দিন, নিজেকে ভালোবাসুন। নিষ্প্রাণ ত্বক-চুলে প্রাণ ফেরাতে যদি রান্নাঘরের উপকরণ একটু নিতেই হয়, নেবেন না কেন? ভালো থাকার সংজ্ঞায় কি নিজের যত্ন নিতে বারণ? চুলে গরম তেল মালিশ কিংবা উষ্ণ পানিতে পা ডুবিয়ে রাখার সময় পাননি স্বাভাবিক দিনগুলোয়? এখনই তবে সময়। নিজের জন্য সময় ব্যয় করছেন, অন্যের কথায় তাতে ছেদ ফেলবেন না যেন।
লেখক: রাফিয়া আলম | ঢাকা, চিকিৎসক।