What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected সাক্ষাৎকার (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
324
Messages
6,070
Credits
45,737
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বেশকিছু গ্রন্থের ভূমিকা অংশে অকপটে নিজের কথা জানিয়েছেন।

উপন্যাস : বাদশাহ নামদার ফেব্রুয়ারি ২০১১-এর ফ্ল্যাপ




১৩ নভেম্বর মধ্যরাতে আমার জন্ম। সন ১৯৪৮। হ্যাঁ, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। লেখালেখি করে ত্রিশ বছর পার করলাম। আমি আনন্দিত, ক্লান্তি এখনো আমাকে স্পর্শ করেনি।

ধানমণ্ডির ১৮শ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে কাটছে আমার দিবস রজনী।

আমি কোথাও যাই না বলেই মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে জম্পেশ আড্ডা হয়। যে রাতে আড্ডা থাকে না, আমি শাওনকে নিয়ে ছবি দেখি।

জোছনা আমার অতি প্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই নুহাশ পল্লীতে যাই জোছনা দেখতে, সঙ্গে পুত্র নিষাদ, নিনিত এবং তাদের মমতাময়ী মা। প্রবল জোছনা আমার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার তৈরি করে। সেই হাহাকারের উৎস অনুসন্ধান করেই জীবন পার করে দিলাম।



উপন্যাস সমগ্র—১ম খণ্ড

কুড়ি বছর আগের কথা।

বর্ষার রাত। বাইরে ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আমি বইপত্র মেলে বসে আছি। থার্মোডিনামিক্সের একটি জটিল অংশ যে করেই হোক পড়ে শেষ করতে হবে।

হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। কেমিস্ট্রির বইখাতা ঠেলে সরিয়ে দিলাম, লিখতে শুরু করলাম—

“রাবেয়া ঘুরে ঘুরে সেই কথা কটিই বারবার বলছিল।

রুনুর মাথা নিচু হতে হতে থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল।…”

আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস—নন্দিত নরকে। ঐ রাতে কেন হঠাৎ উপন্যাস লেখায় হাত দিলাম, কেনই বা এরকম গল্প মাথায় এল তা বলতে পারব না।

লেখকরা যখন লেখেন তখন তারা অনেক কিছুই বলতে চান। সমাজের কথা বলেন, কালের কথা বলেন, জীবনের রহস্যময়তার কথা বলেন। লেখার ভেতর আদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন—আমরা কোত্থেকে এসেছি? আমরা কারা ? আমরা কেনই বা এলাম ? আমরা কোথায় যাচ্ছি ?

নন্দিত নরকে লেখার সময় আমার বয়স উনিশ-কুড়ির বেশি নয়। এই বয়সের একজন তরুণ কি এত ভেবে-চিন্তে কিছু লেখে ? আমার জানা নেই—আমি শুধু জানি, ঐ রাতে একটি গল্প আমার মাথায় ভর করেছিল। গল্পের চরিত্রগুলো স্পষ্ট চোখের সামনে দেখছিলাম, ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ভেতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছিলাম—যেভাবে ওদের দেখছি হুবহু সেইভাবে ওদের কথা বলতে হবে এবং আজ রাতেই বলতে হবে। এই মানসিক চাপের উৎস কী আমি জানি না।

এক রাতে লেখা ষাট পৃষ্ঠার এই লেখাটির কাছে আমি নানানভাবে ঋণী। এই লেখাই আমাকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছিল। এই একটি লেখা প্রকাশিত হবার পর অন্য লেখা প্রকাশে আমার কোনো রকম বেগ পেতে হয়নি।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, নন্দিত নরকে আমার প্রথম উপন্যাস নয়। আমার প্রথম লেখা ‘শঙ্খনীল কারাগার’, প্রকাশিত হয় নন্দিত নরকের পরে।

শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটির সঙ্গে আনন্দ-বেদনার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমার বাবা আমার কোনো লেখাই পড়ে যেতে পারেননি—এই পাণ্ডুলিপিটি পড়েছিলেন। বাবা যাতে উপন্যাসটি পড়েন সেই আশায় আমি ভয়ে ভয়ে পাণ্ডুলিপিটি তার অফিসে অসংখ্য ফাইলের এক ফাঁকে লুকিয়ে রেখে এসেছিলাম। উপন্যাস পড়ে তিনি কী বলেছিলেন, তা এই রচনায় লিখতে চাচ্ছি না। পৃথিবীর সব বাবাই তাদের পুত্রকন্যাদের প্রতিভায় মুগ্ধ থাকেন। সন্তানের অতি অক্ষম রচনাকেও তারা ভাবেন চিরকালের চিরদিনের লেখা।

‘শঙ্খনীল কারাগার’ উৎসর্গ করি আহমদ ছফা এবং আনিস সাবেতকে। আহমদ ছফা আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অসাধারণ একজন মানুষ। আনিস সাবেত—আরেকজন অদ্ভুত মানুষ! রোগা লম্বা বৈশিষ্ট্যহীন এই মানুষটি হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করেছিলেন। মানুষ ফেরেশতা নয়। তার মধ্যে অন্ধকার কিছু দিক থেকেই যায়। আনিস সাবেতের ভেতরে অন্ধকার বলে কিছু ছিল না। সচেতন পাঠক হয়তো লক্ষ্য করেছেন, আমার অনেক উপন্যাস ও নাটকে আনিস নামটি ঘুরেফিরে এসেছে। যখনই কোনো অসাধারণ চরিত্র আঁকতে চেয়েছি, আমি নাম দিয়েছি আনিস।

তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। আমি, আহমদ ছফা এবং আনিস ভাই তিন জন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকি। আমাদের চোখে কত না স্বপ্ন! সাহিত্যের সাধনায় জীবন উৎসর্গ করব, চিরকুমার থাকব; জীবনকে দেখার ও জানার জন্যে যা করণীয় সবই করব। তারা দু’জন তাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। আমি পরাজিত হলাম জীবনের মোহের কাছে।

শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটি আরও একটি কারণে আমার বড় প্রিয়। এই লেখা পড়ে অষ্টম শ্রেণীর একটি বালিকা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। তার নাকি বইটি বড় ভালো লেগেছে। তার ধারণা, বইটির লেখকও বইটির একটি চরিত্রের (খোকা) মতো খুব ভালোমানুষ। সে এই ভালোমানুষটির সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকতে চায়।

অষ্টম শ্রেণীর সেই বালিকা এখনো ভালোমানুষটির ( ?) সঙ্গেই আছে। তাকে নিয়ে সুখে-দুঃখে জীবনটা পার করেই ফেললাম। যখন পেছনের দিতে তাকাই, বড়ো অবাক লাগে।

শুধুমাত্র এই বালিকাটিকে অভিভূত করবার জন্যই আমি একটি উপন্যাস লিখি। নাম—নির্বাসন। সেই উপন্যাসটি তার নামে উৎসর্গ করা হয়। বালিকা আনন্দে অভিভূত হবার বদলে ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। তার ধারণা হয়, তার বাবা-মা যখন উৎসর্গপত্রটি দেখবেন, তখনি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তার আশঙ্কা খুব অমূলক ছিল না।

‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ এবং ‘অচিনপুর’ এই দুটি রচনা ময়মনসিংহ শহরে লেখা। তখন ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। কাউকেই চিনি না। কথা বলার লোক নেই, গল্প করার কেউ নেই। কিচ্ছু ভালো লাগে না। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হাঁটাহাঁটি করি। একসঙ্গে অনেক গল্প মাথায় আসে। ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দিনরাত লিখি। শুধুই লিখি। কত কথা আমার বুকে জমা হয়ে আছে। সব কথা সবাইকে জানিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই মনে হয়— এই মানুষটার জীবনটা কেমন ? কী গল্প লুকিয়ে আছে তার ভেতরে ? কিন্তু আগ বাড়িয়ে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। সব সময় নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাই। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যখন ঘরের একটি নিরিবিলি কোণ পেয়ে যাই, যেখান থেকে সামান্য একটু আকাশ দেখা যায়। এক চিলতে রোদপোষা বেড়ালের মতো পায়ের কাছে পড়ে থাকে। আমি বসে যাই কাগজ-কলম নিয়ে—‘আমি বলি এই হৃদয়েরে। সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।’

লিখে যাচ্ছি ক্রমাগত। কুড়ি বছর হয়ে গেল লেখালেখির বয়স। খুব দীর্ঘ সময় না হলেও খুব কমও তো নয়। অনেক লেখকই ক্রমাগত কুড়ি বছর লিখতে পারেন না। মৃত্যু এসে কলম থামিয়ে দেয়। কেউ কেউ আপনাতেই থেমে যান। তাদের লেখার ইচ্ছা ফুরিয়ে যায়। আমার অসীম সৌভাগ্য, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লেখার ইচ্ছা বেড়েই চলছে। আজকাল প্রায়ই বলতে ইচ্ছা করে— ‘জীবন এত ছোট কেন ?’



উপন্যাস সমগ্র-১ম খণ্ড, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯০

এই যে এত লিখছি, কী বলতে চাচ্ছি এসব লেখায় ? ‘চারপাশের দুঃসময়, গ্গ্নানিময় এবং রহস্যময় জগৎকে একজন লেখক গভীর মমতায় ভালোবাসেন’—এই কি আমার লেখার সার কথা ? নাকি এর বাইরেও কিছু আছে ? আমি জানি না—আমার জানতে ইচ্ছাও করে না। আমার ইচ্ছা করে—থাক। সব কথা বলে ফেলা ঠিক হবে না। কিছু রহস্য থাকুক।

হুমায়ূন আহমেদ

শহীদুল্লাহ হল।



মিসির আলী অমনিবাস, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৩

‘মিসির আলির কথা’ শিরোনামে নিজের কথা বলে নিই আমি। তখন থাকি নর্থ ডেকোটার ফার্গো শহরে। এক রাতে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি মন্টানায়। গাড়ি চালাচ্ছে আমার স্ত্রী গুলতেকিন। পেছনের সিটে আমি আমার বড় মেয়েকে নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। গুলতেকিন তখন নতুন ড্রাইভিং শিখেছে। হাইওয়েতে এই প্রথম বের হওয়া। কাজেই কথাবার্তা বলে তাকে বিরক্ত করছি না। চুপ করে বসে আছি এবং খানিকটা আতঙ্কিত বোধ করছি। শুধু মনে হচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হবে না তো ? গাড়ির রেডিও অন করা। কান্ট্রি মিউজিক হচ্ছে। ইংরেজি গানের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না। কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না এই অবস্থা। হঠাৎ গানের একটা কলি শুনে চমকে উঠলাম—

বাঃ, মজার কথা তো! আমি নিশ্চিত, মিসির আলি চরিত্রের ধারণা সেই রাতেই আমি পেয়ে যাই। মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।



আরো অনেক দিন পর ‘দেবী’ লিখি। মিসির আলি নামের অতি সাধারণ মোড়কে একজন অসাধারণ মানুষ তৈরির চেষ্টা ‘দেবী’তে করা হয়—একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না। সাধারণত যুক্তিবাদী মানুষরা আবেগবর্জিত হন। যুক্তি এবং আবেগ পাশাপাশি চলতে পারে না। মিসির আলির ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমের চেষ্টা করলাম। যুক্তি ও আবেগকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে দিলাম। দেখা যাক কী হয়।

যা হল তা অভাবনীয়! পাঠকরা মিসির আলিকে গ্রহণ করলেন গভীর ভালবাসায়। তাঁদের কাছে মিসির আলি শুধু গল্পের চরিত্র হয়ে থাকল না, হয়ে গেল রক্তমাংসের একজন—বিপদে যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়।

আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয়, মিসির আলি বলে কি আসলেই কেউ আছে ? এই চরিত্রটি কি আমি কাউকে দেখে তৈরি করেছি ? তাঁদের অবগতির জন্যে বিনীতভাবে জানাই—না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন, লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকেও বিনীতভাবে জানাচ্ছি—আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনো মিসির আলির মতো মনে করি না—প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়।



মিসির আলিকে নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছি। কিছু ভুলভ্রান্তিও করেছি। যেমন ‘অন্য ভুবনে’ মিসির আলিকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি বড় ধরনের ভুল। এই চরিত্রটি বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। মিসির আলিকে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবেই মানায়, যিনি ভালবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন; কিন্তু সেই ভালবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনো কাছে পান না।

ভুলত্রুটি সত্ত্বেও আমার প্রিয় চরিত্রের একটি হচ্ছে মিসির আলি। মিসির আলিকে নিয়ে লিখতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। এই নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষষ্ট ধীশক্তির মানুষটি আমাকে সব সময় অভিভূত করেন। যতক্ষণ লিখি ততক্ষণ তাঁর সঙ্গ পাই, বড় ভালো লাগে।

হুমায়ূন আহমেদ

এলিফ্যান্ট পার্ক, ফেব্রুয়ারি-‘৯৩



সাইন্স ফিকশান সমগ্র, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯০

উনিশ শ’ পঁয়ষট্টি সালের কথা। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি। বাবা-মা, ভাই-বোন ছেড়ে প্রথম থাকতে এসেছি হোস্টেলে। কিছুই ভালো লাগে না। কোনো কিছুতেই মন বসে না। দিন পনেরো অনেক কষ্টে থাকলাম। তারপর—‘দূর! আর পড়াশোনা করব না’—এই ভেবে রাতের ট্রেনে রওনা হয়ে গেলাম বগুড়ায়। হাতে চটি একটা রাশিয়ান বইয়ের বাংলা অনুবাদ। বইটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর। রাতের ট্রেনে গাদাগাদি ভিড়, আলোও কম, তার ওপর এক ঘুমকাতুরে যাত্রী বারবার ঘুমের ঘোরে আমার গায়ে পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই পড়তে শুরু করলাম—‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পটি। কার লেখা এখন আর মনে পড়ছে না—শুধু মনে পড়ছে গল্প পড়ে আমি বিস্মিত, রোমাঞ্চিত ও মুগ্ধ। এ ধরনের গল্প তো আগে পড়িনি! এগুলি যদি সায়েন্স ফিকশান হয়, তাহলে এত দিন এইসব পড়িনি কেন ? একই গল্প ময়মনসিংহ পৌঁছবার আগে আগে তিন বার পড়ে ফেললাম। আমার নেশা ধরে গেল। সেই নেশা এখনো কাটেনি। এখনো আমার প্রিয় পাঠ্যতালিকার শুরুতেই আছে সায়েন্স ফিকশান। তারাশঙ্করের ‘কবি’ পড়ে আমি যে আনন্দ পাই, ঠিক সেই রকম আনন্দ পাই এসিমভের ‘এন্ড অব ইটারনিটি’ পড়ে। সম্ভবত আমার মধ্যে কোনো গণ্ডগোল আছে।

সায়েন্স ফিকশানের প্রতি গাঢ় ভালোবাসার কারণেই হয়তো আমার তৃতীয় প্রকাশিত বইটি একটি সায়েন্স ফিকশান—‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’, প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’তে। আমার ধারণা ছিল, কেউ এই লেখা পড়বে না। পড়লেও বিরক্ত হয়ে বলবে—এসব কি ছাইপাঁশ শুরু হল ? সাহিত্য কোন পথে যাচ্ছে ? আশ্চর্যের ব্যাপার—সে রকম কিছু হল না, বরং অনেকেই আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে লেখা পড়তে শুরু করলেন। খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি বইটি প্রকাশ করলেন। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তারা সন্দিহান ছিলেন বলেই হয়তো একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের ভাষা এরকম—

‘ছোটদের জন্যে লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী

তবে বড়রাও পড়িলে মজা পাইবেন।’

‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ ভালোবাসার সঙ্গে পাঠকরা গ্রহণ করলেও আমি কিন্তু দ্বিতীয় সায়েন্স ফিকশান লেখার ব্যাপারে অনেক দেরি করলাম। প্রায় দশ বছর। কারণ খুব সহজ। আইডিয়া পাচ্ছিলাম না। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আইডিয়া ‘হুট’ করে মাথায় আসে না। আমার দ্বিতীয় সায়েন্স ফিকশানের ‘আইডিয়া’ মাথায় এল ঢাকা থেকে বরিশাল যাবার পথে—লঞ্চের কেবিনে। শীতের রাত। চাদর মুড়ি দিয়ে লঞ্চের কেবিনে বসে আছি, হাতে ঢাকা থেকে কেনা একগাদা ম্যাগাজিন। হঠাৎ কেবিনের দেয়ালে দৃষ্টি আটকে গেল— কুৎসিত একটা মাকড়সা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। এই প্রাণীটিকে কোনো এক বিচিত্র কারণে আমি অসম্ভব ভয় পাই। …একটি প্রকাণ্ড গ্রহে তিনটি মাত্র প্রাণী, দেখতে মাকড়সার মতো। তাদের বুদ্ধি অসাধারণ, কল্পনাশক্তিও সীমাহীন। তারা নির্জন, নিষ্প্রাণ গ্রহে ঘুরে বেড়ায় এবং সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কল্পনা করে। একসময় তাদের পরিচয় হল মানুষ নামের আরেক দল বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে। এই হচ্ছে ‘তারা তিন জন’-এর গল্প। ‘অন্য ভুবন’ গ্রন্থটির চিন্তা মাথায় আসে ছোট একটি মেয়েকে দেখে। মেয়েটির নাম তিনি্ন। সে গাছের সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে। তার গল্প বলার ধরন দেখে মনে হয়, সে গাছের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে; মাঝে মাঝে গাছের সঙ্গে রাগ করছে। মেয়েটির কাণ্ড-কারখানা দেখে আমার মনে হ’ত গাছের সঙ্গে আমাদের প্রাণের যোগ আছে। সেই যোগসূত্রটি এখন ছিন্ন। হয়তো বা এক সময় আমাদের ছেঁড়া সুতা জোড়া লাগবে, আমরা গাছের সঙ্গে কথা বলা শুরু করব।

‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’তে আমি একটি চক্রের কথা বলতে চেষ্টা করেছি। চক্র এমন একটি ব্যাপার, যার শুরু নেই, আবার শেষও নেই। যে বস্তুর শুরু এবং শেষ নেই, তা হল অসীম। অথচ চক্র অসীম নয়, চক্র সসীম। ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’ লেখার সময় আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। নতুন ‘আইডিয়া’ ব্যবহার করার গাঢ় আনন্দ।

‘ইরিনা’ লেখার পেছনে তেমন কোনো গল্প নেই। শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে যে, ইরিনা খুব ভেবেচিন্তে লেখা। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ছবি আঁকতে চেয়েছি। সমাজ ব্যবস্থাটা তখন কী রকম হবে ? শোষক এবং শোষিতের প্রাচীন সম্পর্ক তখনো কি থাকবে ? কারা হবে শোষিত ? ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষ কি অমর হবে ? অমরত্বের কোনো অভিশাপ কি তাকে স্পর্শ করবে ?

হুমায়ূন আহমেদ

শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 
ছুটিরদিনে মুখোমুখি


জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ প্রথম বার চিকিত্সার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পথে রওনা হওয়ার দুই দিন আগে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর মুখোমুখি হয়েছিলেন ছুটির দিনের।



ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটবাড়ির দরজাটা হাট করে খোলা। আমরা আসব বলে নয়, গৃহকর্তা ঘরের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখতে চান বলে। বসার ঘরে বসি। দেয়ালে ঝোলানো পূর্ণেন্দু পত্রী আর এস এম সুলতানের চিত্রকর্মে চোখ বোলাতে বোলাতেই গৃহকর্তা হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেন আমাদের মাঝে। গায়ে সবুজরঙা বাটিকের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা।

আমরা ঘরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে বসি। এক পাশে বুকশেলফ। সেটা এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা আর নানাবিধ জার্নালে ঠাসা। অন্য পাশে একটা অ্যাপল কম্পিউটার। একটা স্ট্যান্ডওয়ালা ফ্যান ঘুরছে। মাঝখানে একচিলতে বারান্দা।

হুমায়ূন আহমেদ গদিতে আয়েশ করে বসতে বসতে বলেন, শুরু করো। এরপর আমাদের কথোপকথন শুরু হয়।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় আপনার মেঘের ওপর বাড়ি উপন্যাসটি পড়েছি। ভালো লেগেছে। আপনার অন্য উপন্যাসের তুলনায় অন্য রকম।

হুমায়ূন আহমেদ: বইটা আরেকটু বিশদভাবে লেখার দরকার ছিল।

এ ধরনের আরেকটা বই আমি লিখেছিলাম। বইটার নাম যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ। এক লোক তাঁর বউকে খুন করে। মৃত বউয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে।

মেঘের ওপর বাড়ি বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান যে সমস্যা হয়েছে, সেটা ধর্মীয়। মৃত্যুর পরবর্তী জগত্ নিয়ে যদি আমি এমন কিছু লিখি, যেটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না, তাহলে ধর্মবিশ্বাসী লোকজন তো রাগ করবে। তবে এই বিষয় নিয়ে আগেও বই লেখা হয়েছে। আমাদের এখানে প্রথম এই বিষয় নিয়ে যিনি লেখেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বইটার নাম দেবযান। এই বইয়ে তিনি মৃত্যুর পরের জগতের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবি। মৃত্যুর পরের জগত্ নিয়েও অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছি। সম্ভবত এটা থেকেই মেঘের উপর বাড়ি বইটার ভাবনা মাথায় এসে থাকবে।

ট্রেতে করে চা আসে। তিন কাপ। এই ফাঁকে সঙ্গী আলীম আজিজ প্রসঙ্গ পাল্টান

আলীম আজিজ: দীর্ঘদিন ধরে আপনি লেখালেখি করছেন, এখন পেছনে তাকালে কী মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদ: মনে হয়, কিছু পরিশ্রম করেছি (হাসি)। কিছু অর্জন হয়তো আমার আছে। আমার স্ত্রী শাওন আমাকে বলে, ‘আমি খুব সৌভাগ্যবান একটা মেয়ে। কারণ, আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার স্বামী লিখছে। এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে!’ এই কথাটা আমাকে ভীষণ আনন্দিত করে। আমি ভালো বোধ করি। এটাই লেখক জীবনের বড় পাওয়া মনে হয়।

আলীম আজিজ: অতীতের অনেক তুমুল জনপ্রিয় লেখক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ: আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান। লেখক হিসেবে আমার আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, এত দিনে আসলে আর কোনো লেখক তৈরি হয়নি।

আমি নিজেকে মনে করি নতুন লেখকদের জন্য একটা বিভীষিকা। কথাটা বুঝিয়ে বলি। বিভীষিকা এই অর্থে যে, পাঠক বই কেনে লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের বিক্রেতারা যেসব বই বিক্রি হবে, সেগুলো সাজিয়ে রাখে। যেগুলো বিক্রি হয় না, সেগুলো রাখে না। তারা তো সাহিত্যসেবা করতে আসেনি। তারা চায় বই বিক্রি করতে। আমার নতুন বই বের হবে, আমি জায়গা দখল করব। দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। অন্যদের বই প্রদর্শন করারই সুযোগ নেই। এই অর্থে আমি একটা বিভীষিকা।

আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়ালে তো সবার বই-ই বেশি বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু আমার নিজের পাঠক বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।

পড়ার ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়। যে বইটা তুমি পড়তে চাও না, সেটা তোমাকে বিনা পয়সায় উপহার দিয়ে সঙ্গে ২০০ টাকা দেওয়া হলেও তুমি বইটা পড়বে না। জোর করে আর যা-ই হোক, কখনো বই পড়া হয় না।

আলীম আজিজ: কলম্বিয়ার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একটা বয়সে এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার। আপনার কি সে রকম কিছু মনে হয়েছে?

হুমায়ূন আহমেদ: আমারও প্রায়ই মনে হয়, একটা ঘোষণা দিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিই। ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করি। কিন্তু এটা হবে একটা লোক দেখানো ব্যাপার। কারণ, আমি জানি, লেখালেখি ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য অসম্ভব। এই যে শরীরটরীর খারাপ, তাও কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। যেহেতু লেখালেখি ছাড়া থাকতে পারব না, আলতু-ফালতু ঘোষণা দিয়ে তো লাভ নাই। সাধারণত, আমি যে কথা বলি, সেটা রাখার চেষ্টা করি। যেমন, আমি বলতে চাই, ঘেটুপুত্র কমলা আমার পরিচালিত শেষ ছায়াছবি।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ছবিটির কাজ কি শেষ?

হুমায়ূন আহমেদ: ছবির সব কাজ শেষ। শুধু প্রিন্টটা করা হয়নি। প্রিন্ট হচ্ছে ব্যাংককে। প্রিন্টিংয়ে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। টাকার অঙ্কটা মোটামুটি আঁতকে ওঠার মতো।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার সাম্প্রতিক কিছু লেখা পড়ে মনে হয়েছে, অমরত্ব বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে অমরত্বপ্রাপ্তির উপায় আবিষ্কৃত হবে—আপনি লিখেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ: এটা আমার কথা না। এটা বিজ্ঞানীদের কথা। আমিও বিশ্বাস করি। আমরা ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে যাচ্ছি। কলম দাও, বুঝিয়ে বলি।

তাঁর হাতে বলপয়েন্ট কলম তুলে দিই। তিনি দারুণ আগ্রহের সঙ্গে কাগজে গ্রাফ এঁকে বোঝাতে শুরু করেন।

এই দেখো। ধরো, এই রেখাটা হচ্ছে টাইম। আর এই দিকে আছে বড় আবিষ্কার। সব ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান বাড়ছে। আমরা এখন কাছাকাছি চলে এসেছি। ২০২১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিস্ফোরণ হবে। এই বিস্ফোরণটাই হচ্ছে সিঙ্গুলারিটি।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অমরত্ব যদি আমাদের নাগালে চলে আসে, ব্যাপারটা কেমন হবে?

হুমায়ূন আহমেদ: ইরিনা নামে একটা উপন্যাস আমি লিখেছি। সেখানে সবাই অমর। যেহেতু মানুষ অমর, তাই মানুষের উত্পাদন বন্ধ হয়ে যাবে। আরও অনেক কিছু ঘটবে। এটার বড় ধরনের একটা সাইড এফেক্ট অবশ্যই থাকবে।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: অথবা এমন কি হতে পারে যে মানুষ একসময় সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? যেহেতু তার আর মৃত্যুঝুঁকি, অনিশ্চয়তা—এসব কিছুই থাকছে না।

হুমায়ূন আহমেদ: এ রকম কিছুও হতে পারে। পুরো বিষয়টাই আসলে খুব বিচিত্র। আজকেই পত্রিকায় পড়লাম। আমরা আসলে বর্তমানের চেয়ে সব সময় ৪০ মিলিসেকেন্ড পেছনে আছি। ৪০ মিলিসেকেন্ড লাগছে শরীরের সমস্ত বিষয়টা প্রসেস করতে। সব মিলিয়ে এত অদ্ভুত! আরেকটা কথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। স্টিফেন হকিং বলছেন, বাইরের জগতের উন্নত প্রাণীর বিষয়ে চিন্তা না করাটাই ভালো। তারা যেন এখানে না আসে। আমরা চিন্তা করছি, তারা এখানে এলে ভালো হয়। আসলে সেটা হবে না। ওরা তো অভাবনীয় উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। আমরা উন্নত প্রাণী। গরু-ছাগল আমরা কেটে খাই, আমাদের প্রয়োজনে। অন্য বিশ্ব থেকে যারা আসবে, তাদের কাছে আমরা হব গরু-ছাগল। তখন সংঘাত অনিবার্য।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি কি মনে করেন, অন্য গ্রহে উন্নত প্রাণী আছে?

হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই আছে। না থাকার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে না কেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: SETI (সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স) নামের একটা সংগঠন আছে। ওরা ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করে। ওরা কিন্তু এখনো সে রকম কিছু পায়নি।

হুমায়ূন আহমেদ: আমি জানি। কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীদের যদি অন্য কোনো সিস্টেম থাকে, তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না। ওদের কার্বন-বেসড লাইফ কেন হবে? ওদের সিলিকন-বেসড লাইফ হতে পারে। ওদের যদি ঠিক চোখ-কান না, অন্য কোনো সিস্টেম থাকে? তাহলে তো আমরা ওদের ধরতে পারব না।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: ঘেটুপুত্র কমলা ছবির বিষয়টা একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই নামে একটি গল্প আপনি লিখেছিলেন। ছবিটি কি কোনো বিতর্ক তৈরি করতে পারে?

হুমায়ূন আহমেদ: মূলত, গল্পটা থেকেই এই ছবি। এখন তো এই কালচার নেই। গল্পে বিষয়টা আন্ডার কারেন্ট ছিল। ছবিতেও তা-ই। ছেলেটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করেছে, ওই পর্যন্তই। তবে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে। আমার শুধু একটা অনুরোধ, বাচ্চারা যেন এই ছবিটা না দেখে। আমার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছে, ঘেটুপুত্র ছেলে, না মেয়ে? আমি চাইছি না বাচ্চারা এই ছবিটা দেখুক। ছবিটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: কোনো ঘেটুপুত্রের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?

হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে। ২০-২৫ বছর আগে তো হবেই। গল্পটা লিখেছি তারও পরে। জিনিসটা মাথায় ছিল। ঘেটুগান ছিল মূলত হাওরভিত্তিক। ওখানকার লোকদের তিন মাস কিছুই করার থাকে না। কর্ম ছাড়া একদল লোক কীভাবে বাঁচবে। তারা গানবাজনা করে। গানগুলোর সুর ক্লাসিক্যাল। একদম ক্লাসিক্যাল সুর। দাঁড়াও, তোমাদের শোনাই।

প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা এসে অ্যাপল কম্পিউটারের পর্দায় ঘেটুপুত্র কমলার গান বাজিয়ে দেন—‘পাখি উড়ি লো…উড়ি লো’।

আমরা শুনি।

গান শেষে আবার আলাপে ফিরি।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আমি দেশের অনেক নামি জাদুশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আপনাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন পামিং (হাত সাফাই) শিল্পী হিসেবে স্বীকার করেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ: পামিং। এটা শেখার জন্য বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়। এখন আর কেউ সেটা করতে চায় না। আমার শুরুই হয়েছে পামিং দিয়ে। বছরের পর বছর আমি এর পেছনে সময় দিয়েছি। হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর চেষ্টা করেছি।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার প্রিয় জাদুশিল্পী কে?

হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই জুয়েল আইচ। ম্যাজিকের প্রতি তাঁর যে আগ্রহ, ডেডিকেশন, সেটার কোনো তুলনা হয় না। আচ্ছা, বলে রাখি, আমার জাপানি ভাষায় একটা বই প্রকাশিত হচ্ছে।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: এর আগে জাপানি টেলিভিশনে আপনার ওপর একটা তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে।

হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ। সেটা বহুদিন আগে। এই বইটার নাম বনের রাজা। বাচ্চাদের বই। আমাদের এখানে অলংকরণ করেছিল ধ্রুব এষ। যেসব প্রাণীর কথা বলা হয়েছে, ওরা সেগুলো তৈরি করেছে। তারপর সেগুলোর ছবি তুলেছে। খুব যত্ন নিয়ে করেছে বইটা।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: হিমু প্রসঙ্গে আসি। হিমুর এবারের বইয়ে দেখা যাচ্ছে, মাজারের হুজুরের কাছে হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই, মানে একজন বড় বিজ্ঞানী, গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। মাজারে আসার পর তাঁর মাথার জট খুলে যাচ্ছে। আপনার অবচেতন মনে, এটা ছিল যে বিজ্ঞান সবকিছুর উত্তর দিতে পারে না?

হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, পারে না। বল্টু ভাইয়ের মতো বই পড়েই আমরা সবকিছু জানতে পারব না। যেমন, ওই হুজুর বলেছেন, যে চিনি খায়নি সে কি বই পড়ে বুঝতে পারবে চিনির কী স্বাদ?

ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটোই রহস্যময়।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনার লেখার মধ্যে এমনিতে মোটা দাগে কোনো ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনেক সময় আপনাকে পাঠক ধরে রাখার কিছু সহজ কৌশল অবলম্বন করতে দেখি। ধরা যাক, সাধারণ একটা লোকজ ধাঁধা আপনি বইয়ের শুরুতে ব্যবহার করছেন। যার উত্তর মেলে বইয়ের শেষের দিকে। এটা কি সচেতনভাবে করেন?

হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য করি। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠক যাতে পরের পৃষ্ঠাটা পড়ে। কৌশলটা যে খুব ভালো, তা বলব না। তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস। প্রথম দেড় শ পৃষ্ঠা আমার কাছে খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে। পাতার পর পাতা শুধুই একটা পার্টির বর্ণনা। কিন্তু যখন তুমি গল্পটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছো, তখন তুমি বারুদের গন্ধ পাবে। যুদ্ধটাকে অনুভব করতে পারবে। আমি প্রথম পৃষ্ঠায় আটকে ফেলতে পেরেছি, তার মানে আমি বিরাট লেখক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একটা বই পড়ছি। পড়ে মুগ্ধ হলাম। তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। খুব সহজ কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে এত গভীর কথা বলে যাচ্ছে।

আলীম আজিজ: আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?

হুমায়ূন আহমেদ: , ঈশ্বরবিশ্বাস আমার আছে। ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ। গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।

সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে। ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে। ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।

মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই। চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা। মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। ‘ডারউইন থিওরি’ কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ। আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই। তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মৃত্যুর পরবর্তী জগত্ নিয়ে আপনার নিজের চিন্তাভাবনা কী?

হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়ে আমার প্রবল একটা আগ্রহ সব সময় ছিল। একবার আমি চেষ্টা করলাম প্রার্থনা করব। প্রতিদিন একটা সময়ে বসি। পৃথিবী থেকে বিদায়মুহূর্তটা কেমন হবে, এটা জানা যায় কি না চেষ্টা করি। দিনের পর দিন এটা চলল। তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন আমাকে দেখানো হলো। অথবা আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, দিনের পর দিন একটা ব্যাপার চিন্তা করার ফলে আমার মস্তিষ্ক সেটা তৈরি করল। অনেক বড় বিজ্ঞানীর বেলায়ও এটা হয়েছে।

আমি কী স্বপ্নে দেখেছি সেটা বলি—

বিশাল একটা হাওর। হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে আমি ভাসছি। পানি অল্প ঠান্ডা। কলাগাছের মতো জিনিসটা মনে হচ্ছে একটা যান। সেটা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে মনে হলো—মাই গড! এ তো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা বন্ধ হলো। আবার ফিরে এলাম। আমার এই বাড়িঘর—সব আগের মতো। আমি দেখলাম। তখন আমার মনে হলো—আর কী? এবার যাই। আমার যাত্রা আবার শুরু হলো। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো—ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি! আবার ফিরে এলাম। তারপর আবার মনে হলো—এই তো সব। আর কী? এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু করল। কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। দূরে ছোট্ট একটা আলো।

এটাই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা। হতে পারে, আমার মস্তিষ্ক এটা তৈরি করেছে। আবার না-ও হতে পারে।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: মেঘের ওপর বাড়ি বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আমরা দেখি, নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য একজন।

হুমায়ূন আহমেদ: আমরা তো সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ কী বলে গেছেন? বলে গেছেন, আমি তো লিখি না, জীবনদেবতা আমাকে দিয়ে লেখান। আবার, এমনও হতে পারে, আমরা খুব অসহায় বোধ করি বলেই একজন বড় পথনির্দেশকের কথা চিন্তা করি।

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: আপনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দেশটা আপনার কেমন লাগে?

হুমায়ূন আহমেদ: ওখানে যাওয়াটা আমার জন্য ভয়ের ব্যাপার। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর। আর বিমান ভ্রমণ আমার জন্য এমনিতেই আতঙ্কজনক। কারণ আমার উচ্চতাভীতি আছে। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে—এই বুঝি সব ভেঙেচুরে নিচে পড়ে যাব।

এই সাক্ষাতকারের ঘণ্টা চল্লিশেক পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
 
আটমাস পর দেশে ফিরে নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান নুহাশ পল্লী। দিনের প্রথমভাগে বিশ্রাম নেওয়ার পর বিকেলে দিকে তিনি নুহাশ পল্লীর গাছপালার সান্নিধ্যে সময় কাটান। নিজের হাতে লাগানো বিরল প্রজাতির গাছপালার পরিচর্যার জন্য নুহাশপল্লীর কর্মীদের নির্দেশ দেন এবং নতুন কিছু চারাগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন।

নিউইয়র্কে আটমাস ক্যান্সার চিকিৎসাধীন থাকার পর শুক্রবার ভোরে হুমায়ূন আহমেদ তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে দেশে ফেরেন। কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন এই লেখক তিন সপ্তাহ দেশে থাকবেন। নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটরিং হাসপাতালের কয়েক দফা কেমোথেরাপি নেওয়ার পর আগামী ১২ জুন বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের অস্ত্রোপচারের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। এই অস্ত্রোপচারটা করা হবে নিউইয়র্কের বেইলি হাসপাতালে। তার আগে দেশের জন্য খানিকটা অস্থীর হয়ে উঠায় চিকিৎসকরা তাকে শর্ত সাপেক্ষে ২০দিনের জন্য দেশ থেকে ঘুরে আসার অনুমতি দেন বলে জানান লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

চিকিৎসকরা হুমায়ূন আহমেদকে লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা না-বলার শর্ত দিয়েছিলেন কিন্তু দেশে ফেরার প্রথম দিন তিনি চিকিৎসকদের সেই শর্ত পুরোপুরি পালন করতে পারেন নি। গাজীপুরে নুহাশ পল্লীতে তাকে দেখতে আসা মা-শাশুড়ি, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। পাশাপাশি তাকে দেখতে আসা সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় ও মৃদু কথাবার্তা বলেছেন তিনি।

নুহাশ পল্লীতে বাংলানিউজ কথা বলে লেখকের মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এখন কেবল আমার একার সন্তান না। সারাদেশের মানুষের সম্পদ সে। তাকে মানুষ কতোটা ভালোবাসে, সেটি আমি বুঝেছি তার অসুস্থতার সময়। কতোদিন পরে ছেলেকে আমি কাছে পেলাম। সামনে তার বড় একটা অপারেশন। সেই অপারেশন শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে হুমায়ূন যেন আমার কাছে, দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসতে পারে, সেজন্য আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।

বিকেলের দিকে রোদ পড়ে এলে হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে তার গড়ে তোলা বিরল প্রজাতি গাছপালার বাগানে খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ান। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, নুহাশ পল্লীর গাছপালাই বোধহয় আমার সবচেয়ে আপনজন। কারণ নিউইয়ার্কে এদেরই আমি সবচেয়ে বেশি মিস করেছি। তাই বলে যে মা আর আত্মীয়-স্বজনকে মিস করিনি, তা কিন্তু নয়। তাদের মিস করা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু গাছপালাকে মিস করাটা স্বাভাবিক নয়। কারণ দেশে ঢাকায় থাকার সময় তো এদের মিস করতাম না।

নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের নিজের হাতে লাগানো আপেল গাছটি এখন বেশ বড় হয়েছে। সেই গাছের নিচে বসে শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দীর্ঘদিন পর আমার প্রিয় গাছপালার সান্নিধ্য পেয়ে আমি আনন্দিত। গাছপালা আমাকে তাদের মাঝে ফিরে পেয়ে আনন্দ পেয়েছে কিনা তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নাই।

তিনি বলেন, আমার নুহাশপল্লীতে কয়েকটি বিরল প্রজাতির গাছ আছে। যা বাংলাদেশের আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এখানে এমন কিছু গাছ আছে যেগুলোর নাম আমি নিজেও জানি না। প্রতি বছরই নতুন কিছু চারাগাছ নুহাশ পল্লীতে লাগানো হয়। আসছে বর্ষা হলো গাছ লাগানোর সিজন। কিন্তু এই সময়টায় আমি দেশে থাকছি না। গাছ লাগানো যাতে থেমে না থাকে সেজন্য কোথায় কোন গাছ লাগানো হবে, এতক্ষণ ঘুরে আমার লোকদের তা দেখিয়ে দিলাম।

নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে একপ্রশ্নের উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, দেশে আসার পরপর বেশ কয়েকটি চ্যানেলের লোকজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। চ্যানেল আই থেকে এসেছে ইবনে হাসান। বাংলাভিশন থেকে এসেছে শামীম শাহেদ। তাদের ইচ্ছা, দেশে থাকার এই সময়টায় তাদের চ্যানেলে ঈদে প্রচারের জন্য দু’চারটা নাটক তৈরি করি। আমি তাদের কাউকে কোনো কথা দিতে পারি নি। আমার তৈরি ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ ছবিটির সব কাজই শেষ। সেন্সরও হয়ে গেছে। এটি কবে মুক্তি পাবে, সেটা ছবি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস ভালো বলতে পারবে।

নিজের লেখালেখি প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ডাক্তার শুরুতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন লেখালেখি করা যাবে না। একান্তই যদি না পারেন, তাহলে আপনি বলবেন আপনার স্ত্রী লিখবে। ডাক্তারদের সব পরামর্শ তো মেনে চলা যায় না। তাই আমি টুকটাক করে নিজেই লেখালেখিটা চালিয়েছি। এখনও পর্যন্ত আমার কোন সমস্যা হয় নি। এখনও নিজেই লিখতে পারছি। এর মধ্যে একটি নাটক লিখবো। আর কি লিখবো তা এখনও বলতে পারছি না।

হুমায়ূন আহমেদ তার চিকিৎসা প্রসঙ্গে বলেন, ক্যান্সার অসুখটা সত্যিই খুব ভয়াবহ। আমাকে যিনি চিকিৎসা করছেন তার নাম ডাক্তার ভিচ। তিনি এমন এক ঘোষণা দিলেন যে, শুরুতেই ঘাবড়ে গেলাম। আমার চেকআপ করানো সময় একদিন তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, কেমো থেরাপি দিলেও তুমি বেশি দিন বাঁচবে না। তোমার আয়ু বড়জোর দুই বছর। আমি মনে মনে গোছাতে শুরু করলাম দুই বছরে আমার কী কী কাজ করা উচিত? কয়েকবার কেমো নেওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন হলে তিনিই আবার আমাকে আশ্বস্ত করলেন, মনে হচ্ছে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি তার সবকথা স্বাভাবিক আর সহজভাবেই নিয়েছি। আসলে বিশ্বাসটা তো একান্ত নিজের ব্যাপার। তাই কোন কিছুর সামনেই আত্মবিশ্বাস হারানোর কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না। যদি আর একদিনও বাঁচি, আমি আনন্দের সঙ্গে বাঁচতে চাই। আমি লিখতে পারছি, এটাই বড় আনন্দের কথা। আমি আনন্দ নিয়ে আছি।

হুমায়ূন আহমেদ আরও বলেন, যে হাসপাতালে আমি প্রথম ভর্তি হই তার ব্যয় বহন করা ছিল আমার জন্য ছিল দুঃসাধ্য। কেমো নেওয়ার পর এবার তাই একটি সরকারি হাসপাতালে আমি ভর্তি হয়েছি। এর নাম বেইলি হাসপাতাল। আমার যে অপারেশনটা তা এই বেইলি হাসপাতালেই হবে। তিনি বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা খরচ সাংঘাতিক ব্যয়বহুল। এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আমাকে ঋণ করতে হয়েছে। চ্যানেল আইয়ের কাছ থেকে আমি ৫০ লাখ টাকা ধার নিয়েছি। আমি ঋণগ্রস্ত থাকতে অভ্যস্ত নই। পরেরবার অপারেশন শেষে দেশে ফিরে সেই টাকা পরিশোধ করে দেব।

অনেকটা আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আমার মায়ের বয়স এখন ৮০ বছর। তিনি আমেরিকায় আমার চিকিৎসার জন্য তার আজীবনের সঞ্চয় ৫৫০০ ডলার পাঠিয়েছেন। একেই বলে মা। পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কে এরকম করবে!

মা আয়েশা ফয়েজসহ পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ দুই দিন নুহাশপল্লীতে কাটানোর পর ১৩ মে তার ঢাকার ধানমন্ডির বাসভবন ‘দখিন হাওয়া’-তে যান।
 
নিউইয়র্ক এ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হুমায়ুন আহমেদ বাংলানিউজের প্রতিনিধি শিহাব উদ্দিন কিসলুর কাছে এই সাক্ষাৎকার দেন।



“মা অপেক্ষা করছেন। ছেলেকে দেখতে। ছেলেও উদগ্রীব। তাই দেশে যাচ্ছি। ডাক্তারকে সেটাই বলেছি। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিল, “দেশে যাওয়া কেন?”

নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকার ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় দেশের উদ্দেশে রওনা করার আগে এভাবেই নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদ বাংলানিউজের সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাৎকারটির সূচনা করেন।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই গুণী মানুষটির সঙ্গে যেন সাক্ষা‍ৎকার নয়, গল্প জমে উঠেছিল। আলাপচারিতায় জানালেন, দেশের খাওয়া-দাওয়া খুব মিস করছেন।

এ প্রসঙ্গটি উঠতেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলেলেন, “ঢাকায় খবর হয়ে গেছে। বুঝেছ, খবর দিয়ে দিয়েছি। প্লেন সকালে নামবে। আমি বড় কই মাছ আলু দিয়ে, পেটে ডিম ভর্তি বড় বড় শিংমাছের ঝোল, আর বড় সাইজের কাতলের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট খাবো। বাংলাদেশি খাবারটা খুব মিস করছি।”

মানুষ হিসেবে অতি সজ্জন হুমায়ূন আহমেদের কথাবার্তায় মোটেও মনে হয়নি তিনি আসলেই চরম বেরসিক এক শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। শুধু বাইরের অবয়বে খানিকটা আঁচ করা যায়।

“দেশে গিয়ে কি কি করবেন, কোথায় কোথায় যাবেন স্যার?“ সোজা প্রশ্ন করলাম।

কোথাও যাবো না,” বললেন হুমায়ূন আহমেদ।

শুধু নূহাশ পল্লীতে যাবো। ওখানেই থাকবো কিছুদিন। ওখানে আমার বাবুর্চি আছে, দারুণ রান্না করে। ওর মত মুড়িঘণ্ট আর কেউ করতে পারে না। সেই মুড়িঘণ্ট খাবো।”

মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, “মা তো মা-ই, সবার উপরে। এই মা আমার চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা ডলার করে সাড়ে ৫ হাজার ডলার আমেরিকা পাঠিয়েছেন। জমানো টাকাগুলো কিন্তু আমারই দেওয়া। সেই টাকাই আমাকে পাঠিয়েছেন। এই আমার মা।”

হুমায়ূন আহমেদ চোখের অশ্রু লুকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কণ্ঠের আবেগ আর চেহারার রক্তিম আভা জানিয়ে দিয়েছে মা তার কত প্রিয়। শরতের মেঘে সূর্যের লুকোচুরির মতই হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া সাক্ষা‍ৎকারে তার অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে গেছে সাংবাদিকের কলমে।

“স্যার আপনার দেশে ফেরার অনুভূতি…“

বললেন, “দেশে ফেরা তো হচ্ছে না। আগে তো দেশে ফিরেছি স্থায়ীভাবে। কিন্তু এবার আগে থেকেই জানছি আবার ফিরে আসতে হবে। তাই দেশে ফেরার যে সত্যিকারের অনুভূতি, যে ভালো লাগা সেটা ততটা নেই। দেশ যে আমার কাছে অনেক আপন, সেখানে কি ক’দিনের জন্য যাওয়া ভালো লাগে!”

কথোপকথনের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য ঘরে ঢুকেছিলেন মামুন ভাই। স্বনামখ্যাত ফটো সাংবাদিক নাসির আলী মামুন। তিনি সুযোগ পেয়ে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদের পারিবারিক বন্ধু গাজী কাশেমকে আমার অ্যানড্রয়েড ফোনের ক্যামেরায় আমাদের কয়েকটি ছবি তুলতে অনুরোধ করলাম। এ সময় হুমায়ূন আহমেদ সেল ফোনটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “মামুন, গুগলের লেটেস্ট এই ফোনটা দেখেছো?”

মামুন ভাই জবাব দিলেন, “জ্বি, খুবই ভালো।”

হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওন ছেলে নিষাদকে সামলানো আর ‍মালপত্র গোছানোতো ব্যস্ত। এরই মাঝে বাইরে গিয়ে ছবি তোলার জন্য গাজী কাশেমের অনুরোধ। ছবি তুললাম। ছবিটা হুমায়ূন আহমেদকে দেখিয়ে বললাম, “স্যার, মামুন ভাইয়ের চেয়ে ভালো হয়েছে না? উনার ব্যবসা তো এবার শেষ!”

বললেন, “হ্যাঁ, ওর ব্যবসা আসলেই শেষ।”

মামুন ভাই খানিকটা সরল হাসিতে সেই `সত্য` যখন স্বীকার করে নিলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, “শোনো, এতে তোমার কোনো কৃতিত্ব নেই। তোমরা কি জানো বাংলাদেশে ফটোগ্রাফারের সংখ্যা কত?“

আমি আর মামুন ভাই দু’জনই ভাবছিলাম সংখ্যাটা কত হতে পারে।

ওদিকে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, “সংখ্যাটা এক কোটির বেশি। কিভাবে? শোনো। ঢাকায় আমি একদিন পাবলিক টয়লেটে গেছি। অমনি পাশ থেকে কয়েকজন বলে উঠলো, “স্যার একটা ছবি তুলি?”

বলেই সেলফোনে ছবি তোলা শুরু করলো।

বললাম, “বাবারা, আমি তো পাবলিক টয়লেটে দাঁড়িয়ে!”

হাসির জোয়ারে ভেসে গেলাম সবাই। শেষে বললেন, “দেশে সবার হাতেই সেলফোন।

সবাই ক্যামেরাম্যান।”

ওদিকে বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কথোপকথন এখানেই শেষ।
 
কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস বাদশাহ নামদার। মোগল সাম্রাজ্যের রংদার চরিত্র সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে লিখেছেন লেখক হুমায়ূন। একেবারে ভিন্ন ধরনের এই বই নিয়ে লেখকের কৌতূহলোদ্দীপক সাক্ষাৎ কার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও তৈমুর রেজা।




প্রশ্ন: সরাসরি বইয়ের প্রসঙ্গে চলে আসি। বাদশাহ নামদার উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে অনেক বেশি মিল আছে গুলবদন বেগম প্রণীত হুমায়ুন-নামা গ্রন্থের।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, সেই বইটা আমার কাজে এসেছে। তবে আমি অনেক কিছু নিয়েছি জওহর আফতাবচির কাছ থেকে, বাদশাহ হুমায়ুনকে যিনি পানি পান করাতেন।
এই লোকটি সব সময় বাদশাহ হুমায়ুনের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। তিনি যখন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখনো তিনি তাঁকে ছেড়ে যাননি। এমন কি আকবরের যখন জন্ম হয়েছে তখনো জওহর আফতাবচি সঙ্গে ছিলেন।
প্রশ্ন: আপনি সাধারণত সমকাল নিয়েই লেখালেখি করেন। হঠাৎ বাদশাহ হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন?
হুমায়ূন: বাদশাহ নামদার বইটি লেখার কারণ আমি বইয়ের ভূমিকাতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। ছোটবেলায় আমি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ি, তখন আমাকে বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ছাত্ররা আমাকে ডাকত ‘হারু হুমায়ূন’। কারণ শেরশাহর সঙ্গে প্রতিটি যুদ্ধে আমি হেরেছি। পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমি বলতাম, আমি হারছি নাকি? সবাই বলত, ‘হারু হুমায়ূন, হারু হুমায়ূন’। এটা একটা কারণ। আরেকটা হতে পারে, চিতোরের রানি যখন সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে রাখিবন্ধন পাঠালেন, তিনি যে সঙ্গে সঙ্গে সব ফেলে রেখে ছুটলেন—এই পাগলামিগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
প্রশ্ন: হারু হুমায়ূন আপনার লেখায় আগে বোধহয় কখনো আসেনি। হঠাৎ করে আপনার সঙ্গে এর যোগসূত্র হলো কীভাবে? হঠাৎ করে কেন মনে এল হুমায়ূনকে নিয়ে লিখতে হবে?
হুমায়ূন: আসলে আমার আকর্ষণ তাঁর খ্যাপা ধরনের জন্য। এই রকম একটা পাগল লোক। ভিস্তিওয়ালা তাঁর জীবন রক্ষা করেছে বলে আধাবেলার জন্য তাকে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। এটা পাগলামি ছাড়া আর কী! তুমি তাকে টাকা-পয়সা দাও। একেবারে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া—এটা কোনো কাজ হলো? তার মানে তুমি এত হেলাফেলা করে ভাবো? এইটা আমাকে খুবই সারপ্রাইজ করল। চিতোরের রানিকে সাহায্য করতে তিনি সব ফেলেফুলে ছুটলেন। এটাও সারপ্রাইজিং। তারপরে রক্তবর্ণ কাপড় পরে তিনি যে মানুষ হত্যা শুরু করলেন—এটা কিন্তু ইতিহাস থেকে নেওয়া। সেখানে একটা ছেলে এসে গান গাইল। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। মোগল চিত্রকলার শুরুটা কিন্তু হুমায়ুনের হাতে। তাঁর আগে মোগল চিত্রকলা ছিল না। তিনি পারস্য থেকে চিত্রকর নিয়ে এলেন। ভারতে তিনিই প্রথম মানমন্দির তৈরি করেছেন। কেন? কারণ তিনি পারস্যে মানমন্দির দেখে আসছেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে কিন্তু ওই মানমন্দিরের কারণে। সকালে ফজরের আজান হয়েছে। তিনি জানেন সকালে ফজরের আজানের সময় শুক্রগ্রহ মানে সন্ধ্যাতারাটা ওঠে। ওটা দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। পরনের কাপড়ে আটকে তিনি পড়ে যান। এ সব ঘটনা, একটা ক্যারেক্টার এত বিচিত্র হতে পারে? এত খেয়ালি হতে পারে। বৈরাম খাঁর কথা পড়েছ না?
প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন, দুই ধরনের সাহিত্যিক থাকে। পপুলার লেখক আর সিরিয়াস লেখক। সিরিয়াস সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা যায়, তাঁরা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। এই বই দিয়ে আপনি ইতিহাসের দিকে ঝুঁকছেন। জনপ্রিয় সাহিত্যিকের খাতা থেকে নিজের নাম কি কাটাতে চাচ্ছেন?
হুমায়ূন: না, না। আমি আমার আগের যে খাতা সেটাতেই বহাল আছি। আমার খাতা একটাই। আমি এমনিতে ইতিহাসের খুব মনোযোগী পাঠক। ইতিহাসে আমার আগ্রহ আছে। এখানে বাসায় যে বইগুলো দেখছেন, সেটা কিন্তু আমার মূল লাইব্রেরি না। আমার অনেক বই স্কুলে আছে। তারপর নুহাশ পল্লিতে আছে। লেখার থেকে আমি পড়ার পেছনে বেশি সময় দিই। এত জানার জিনিস আছে পৃথিবীতে। কিন্তু বাংলা বইয়ে ইতিহাস খুবই কাঠখোট্টাভাবে লেখা। এই লেখাগুলো তো কেউ পড়ে না। আমার ইচ্ছে করে এসব গল্প পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে। গল্পগুলোই আসলে আমাকে ইনস্পায়ার করে। আমার বাসায় গুলবদনের বই সাত বছর ধরে আছে। শাওন কখনো পড়ার আগ্রহ পায়নি। কিন্তু বাদশাহ নামদার যখন ও পড়ে শেষ করল, তখন গুলবদনের বই তাকে টানতে শুরু করল। এখন সে গুলবদন পড়ছে, বাবরনামা পড়ছে।
প্রশ্ন: বাদশাহ নামদার লিখতে গিয়ে আপনি নিজেই হুমায়ুন চরিত্রটির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন এমন কি কখনো মনে হয়েছে?
হুমায়ূন: না, আমি নিজেকে কখনো তাঁর জায়গায় কল্পনা করিনি। কারণ যে নির্দয়তা তিনি দেখিয়েছেন, সেগুলো ভয়াবহ। আমি কখনো এসব ভাবতে পারি না। একটা মানুষের মধ্যে তো ভালো-মন্দ দুইটাই থাকবে, ওনার মধ্যেও পুরোপুরি ছিল।
প্রশ্ন: আপনার টিপিক্যাল চরিত্রগুলো এই বইয়ে প্রায় অনুপস্থিত। দুজন মাত্র চরিত্রকে আপনার চেনা ধরনের সঙ্গে মেলানো যায়। হরিশঙ্কর আচার্য আর হামিদা বানু। যেমন হামিদা বানু জোৎ স্না দেখতে ভালোবাসে।
হুমায়ূন: হামিদা বানু চরিত্রটা ঐতিহাসিকভাবেই এমন। জোৎ স্না দেখতে ভালোবাসে। একটু চঞ্চল, একটু ছটফটে। হুমায়ুনের সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হবে তখন হামিদা বানুর বয়স মাত্র পনেরো। হুমায়ুনের চারটা বউ আছে। হুমায়ুন মায়ের সঙ্গে রদখা করতে গিয়ে দেখলেন পনেরো বছরের একটি মেয়ে তাঁকে কুর্নিশ করছে। তিনি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, মেয়েটা কে? জানা গেল, একজন শিক্ষকের মেয়ে। হুমায়ুন বললেন, আমি একে বিবাহ করতে চাই। হামিদা বানু বিয়ের কথা শুনে বললেন, এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমি এমন কাউকে বিয়ে করব, যাঁর হাত আমি যখন ইচ্ছে ধরতে পারি, যাঁকে দেখলে আমার কুর্নিশ করতে হবে না। আর ইনি তো রাজ্যহারা লোক। একে আমি বিয়ে করতে যাব কেন? এসব আমার বইয়ের মধ্যে আছে।
প্রশ্ন: তো স্যার, এই বইয়ের মধ্যে আপনি যেমন আলাদা হয়ে উঠেছেন, এটা কি আপনি সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছিলেন?
হুমায়ূন: না, না। দেখো পৃথিবীতে দুই ধরনের লেখক আছে। একটা হলো স্পনটিনিয়াস রাইটার। আরেকটা ধরন হলো, চিন্তাভাবনা করে বইপত্র পড়ে ধীরেসুস্থে লিখবে। অল থ্রু মাই লাইফ আই ওয়াজ এ স্পনটিনিয়াস রাইটার। এর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। তবে এই স্পনটিনিয়াস রাইটিংয়ের জন্য আমাকে ইতিহাস পড়তে হয়েছে। তথ্যগুলো ব্রেইনের একটা অংশে ছিল। কিন্তু আমি লিখেছি স্পনটিনিয়াসলি। চিন্তাভাবনা করে, এটা করব ওটা করব—এসবের মধ্যেই আমি নেই।
প্রশ্ন: এই বইয়ে আপনার লেখার স্টাইলে পরিবর্তন স্পষ্ট, যেমন আপনার লেখায় হিউমার খুব পরিচিত ব্যাপার, কিন্তু এই বইতে কোথাও কোথাও ঝিলিক থাকলেও হিউমার প্রায় নেই।
হুমায়ূন: হ্যাঁ। এই বইয়ে আমার স্টাইলগত পরিবর্তন অবশ্যই আমার ইচ্ছাকৃত। এখানে আমি প্রচুর তৎ সম শব্দ ব্যবহার করেছি। পুরোনো বানানগুলো অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করেছি। পুরোনো আবহটা আনার জন্য। যেসব দীর্ঘ-ঈ কার আজকাল হ্রস্ব-ইতে লেখা হচ্ছে সেগুলোতে আমি দীর্ঘ-ঈকার ব্যবহার করেছি। পাণ্ডুলিপি হায়াৎ মামুদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে আমি বলেছি, আমি দীর্ঘ-ঈকারগুলো রাখছি, যাতে ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাটার্নে একটা পুরোনো দিনের ফ্লেভার তৈরি হয়। এটা সচেতনভাবে করা।
একটা গল্প তোমাদের বলি, এটা আমাকে বোঝার জন্য কাজে লাগতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো একটা উপলক্ষে আমাকে চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমি আগ্রহ করে গেলাম। গিয়ে দেখি হলভর্তি লোকজন বসে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক কায়সার বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলেন। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত নিয়ে লেখালেখি করেন। এর বাইরে তিনি যেতে পারেন না। মধ্যবিত্ত হলো আমাদের সমাজের টু পার্সেন্ট মাত্র। বাকি আটানব্বই লোক অন্য শ্রেণীর। কৃষিজীবী আছে, মৎ স্যজীবী আছে। অল থ্রু অব হিজ লাইফ তিনি এদের নিয়ে কিছু লেখেননি। মাত্র টু পার্সেন্ট লোক নিয়েই লিখেছেন। তাঁকে লেখক বলে স্বীকৃতি দেওয়ার তো কিছু নেই। যাঁরা দুর্বল মনের মানুষ, তাঁরা এসব শুনলে চিন্তায় পড়ে যান। আরে এভাবে তো কখনো ভাবিনি। মাত্র টু পার্সেন্ট লোককে নিয়ে লিখছেন। দেখলাম কিছু কিছু ছেলেপেলের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তারা এটা নিতে পারছে না। তাঁর কথা শেষ হওয়ার পর আমি বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লেখক যাঁকে বলা হয়, তিনি সারা জীবন শুধু রাজা-বাদশাহ আর রাজকন্যাদের নিয়ে লিখেছেন। তাঁর নাম শেকসপিয়ার। আমার শেকসপিয়ারের মতো ক্ষমতা নেই বলে আমি এগুলো লিখছি। কিন্তু মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখলেই যে সব স্পর্শ করা যাবে না, এটা কে বলেছে আপনাকে? এরপর তিনি খুবই লজ্জিত হয়ে আমাকে সরি বলেছেন।
আরেকটা ঘটনা বলি। বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী আমাকে বললেন, আপনি তো লেখালেখি করছেন, এক কাজ করি। আপনাকে ট্যাগ করে দিই সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। দুজনের মুখোমুখি একটা আলোচনা আমরা ছাপব। আমি রাজি হয়ে গেলাম। সৈয়দ হকের সঙ্গে বসলাম মুখোমুখি। তিনি প্রশ্ন শুরু করলেন এইভাবে, হুমায়ূন আহমেদ সাহেব। আপনার সব উপন্যাসই দেখি, হয় চার ফর্মায় শেষ হয়, নয় পাঁচ ফর্মায় কিংবা ছয় ফর্মায়। এভাবে ফর্মা হিসেবে কি উপন্যাস আসে আপনার মাথায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম, তাঁর ইনটেনশন খুব খারাপ। আমি তো পুরোপুরি ধরা খেয়ে গেছি। তখন বললাম, ‘হক ভাই, আপনি যে সনেটগুলো লেখেন, এগুলো তো ১৪ লাইনে লেখেন। আপনার ভাব যদি ১৪ লাইন মেনে আসতে পারে, আমার উপন্যাস ফর্মা হিসেবে এলে অসুবিধা কী?’
প্রশ্ন: আপনি এর আগে ঐতিহাসিক যেসব উপন্যাস লিখেছেন, সেখানে ন্যারেটর হিসেবে আপনার সাধারণ মানুষকে পাই। এখনকার সাব-অল্টার্ন স্টাডিস বা তলা থেকে দেখা ইতিহাসের সঙ্গে এই ব্যাপারটা খুব খাপ খায়। কিন্তু বাদশাহ নামদার উপন্যাসের প্রায় পুরো গল্পটাই অভিজাতদের পাটাতন থেকে বলা। ন্যারেটর হিসেবে নিম্নবর্গ বা তলার মানুষ নেই। এটা কেন হলো? আপনার কি কোনো লিমিটেশন ছিল?
হুমায়ূন: লিমিটেশন তো ছিলই। আমি যাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি, এঁদের
একজন হচ্ছেন আবুল ফজল। একজন হচ্ছেন হুমায়ুনের বোন। একজন তাঁর পানি সরবরাহকারী আফতাবচি। আমাকে তো এঁদের কাছ থেকে তথ্যগুলো নিতে হয়েছে। আর সেই সময় হুমায়ুনের রাজসভায় যাঁরা গেছেন, তাঁদের কারও কারও ভাষ্যের সাহায্য আমি নিয়েছি। কাজেই নিচু তলার কারও ভাষ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার কেউ নেই। এটা করতে গেলে আমাকে করতে হতো পুরোপুরি কল্পনার সাহায্য নিয়ে। সে ক্ষেত্রে আমি ইতিহাস থেকে আরও দূরে সরে যেতে পারতাম। এই উপন্যাসের একটা চরিত্র হচ্ছে ভিস্তিওয়ালা। সে যদি একটা বই বা উপন্যাস লিখে যেতে পারত, তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা আমরা জানতে পারতাম।
প্রশ্ন: এই উপন্যাসে আমরা দেখি, হুমায়ুন যখনই যুদ্ধ জয় করতেন, তখনই তিনি বিরাট উৎ সবে মেতে উঠতেন। হেরেমের ব্যাপারেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি আফিম খেতেন, এটা আপনার উপন্যাসেই আছে। কিন্তু বাদশাহ নামদার-এ হেরেমটাকে আপনি কিছুটা এড়িয়ে গেছেন।
হুমায়ূন: হ্যাঁ, এটা আমি কিছুটা বাদ দিয়েছি। এই জিনিসটাকে আমার কাছে একটু অরুচিকর মনে হয়। পতিতালয় থাকবে একজন সম্রাটের, এটা কেমন কথা।
প্রশ্ন: সেক্স বা সেক্সুয়ালিটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী—সাহিত্য বা ফিকশনের ক্ষেত্রে?
হুমায়ূন: এটা নিয়ে আসাটাকে খুব মডার্নিস্ট মনে করা হয়। যিনি যত ভালোভাবে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তত মডার্ন লেখক, এটা ভাবা হয়। আমাদের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় লেখক যিনি, তাঁর নাম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনার গল্প-উপন্যাসে কোথাও সেক্সুয়ালিটি পেয়েছ? এক জায়গায় শুধু আছে, ‘তখন তাহার শরীর জাগিয়া উঠিল।’ এর বেশি তিনি আর আনেননি। শুধু ‘জাগিয়া ওঠা’ পর্যন্ত। পাঠকের কল্পনার ওপর তিনি ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রশ্ন: বাদশাহ নামদার-এ ওই সময়ের জিওগ্রাফি, এনভায়রনমেন্ট, ওই সময়ের সোসাইটি, সাধারণ মানুষ—এর প্রায় কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এটা আপনার উপন্যাসে একটা ব্যত্যয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা একটা খামতিও। এ ব্যাপারে আপনার নিজের কী মনে হয়?
হুমায়ূন: তোমরা তো আমাকে কনফিউজ করে দিলে। ওই যে কালটা ধরা যাচ্ছে না বলছ, সেটা আমার মনে হয় না। আমাদের সেলিনা হোসেন গালিবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাসে গালিব বলছেন, একজন স্ত্রী ভাত রাঁধতে পারলেই হলো। গালিবের স্ত্রী তো ভাত রাঁধতে পারেন না। বড়জোর রুটি বানাতে পারেন। এই ত্রুটিগুলো কিন্তু আমি করিনি। আর সাহিত্যিক তো ঐতিহাসিক না। ভারবাটিম তার সবকিছু ধরার দরকার নেই। তোমাদের কল্পনার জন্য জায়গা রাখতে হবে না, বলো? সময় ধরার জন্য আর কী করতে পারতাম, বলো।
প্রশ্ন: যেমন ধরেন, ওই সময়ের পথঘাট। আমরা অনেক যাত্রার বিবরণ পেয়েছি যে সৈন্য দল যাচ্ছে।
হুমায়ূন: পথঘাট ছিল না, ফর ইয়োর ইনফরমেশন। পথঘাট শুরু করলেন শেরশাহ। গ্র্যান্ডটাংক রোড বানালেন উনি। পথঘাট ছিল না তো, যে পথের বর্ণনা দেব। পালকি-টালকি ছিল…আরেকটা কারণ হলো, আগে আমি ঐতিহাসিক যেসব উপন্যাস লিখেছি, যেমন—জোছনা ও জননীর গল্প, সেই সময়টা আমি নিজ চোখে দেখেছি বা মধ্যাহ্ন কিছুটা হলেও দেখেছি, বাবা-চাচাদের কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু এই উপন্যাসের সময়টা চাক্ষুস দেখেছে, এমন কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ নেই। বই যেগুলো হাতে আছে, এর বাইরে আমরা কিন্তু কিছু জানতে পারছি না। যে বইগুলো আমি পড়েছি, সেখানে প্রায় কোনো ডিটেইলই নেই। গুলবদন বেগমের বইয়ে যেমন—শুধু এভাবে লেখা যে আম্মা এটা বললেন বা আব্বা এটা করলেন। অমুক এটা করলেন, তমুক এটা করলেন। শুধু সারমর্মটা আছে। বর্ণনা সেভাবে নেই।
আর একটা সমস্যা হলো, হুমায়ুনের সময়ের কোনো স্থাপত্যকলাও নেই। সবই ধ্বংস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হয়েছে এইটিন ফিফটি সেভেনে। সিপাহি বিদ্রোহের কারণে ইংরেজরা খুবই খেপে গেল, মোগলের কিছুই থাকবে না এখানে, ইনক্লুডিং তাজমহল। সব ডেমোলিশ করতে হবে। তখন এটা রক্ষা করলেন একজন ইংরেজ সাহেব। তাঁর নামটা এই মুহূর্তে আমি ভুলে গেছি। তিনি এগিয়ে এসে বহু কষ্টে এটা রক্ষা করলেন। লালকেল্লা আর তাজমহল। ওরা ঠিক করেছিল, মোগলের কোনো চিহ্নই রাখবে না।
আর শোনো। আমার লেখার ধরন নিয়ে একটা ছোট্ট কথা তোমাদের বলি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঔপন্যাসিক বলতে হবে তলস্তয়কে। আরেকজন দস্তইয়েভস্কি। এঁরা করেন কী, একটা চরিত্রকে বর্ণনা করা শুরু করেন। ধরো, তোমাকে তারা বর্ণনা করছেন। অনেক লাইন কিন্তু খরচ করছেন তোমার পেছনে। তার চোখ এমন ছিল, তার অল্প কিছু গোঁফ ছিল, নাকটা খাড়া ছিল—টোটাল বর্ণনা দিয়ে তোমার চেহারাটা ফুটিয়ে তুলবেন। আমি কিন্তু ওই লাইনে যাই না। সাধারণত আমি চেহারার বর্ণনা দিই না। আমি এই ব্যবস্থাটা করি। ডায়ালগের ভেতর দিয়েই যেন পাঠক চরিত্রগুলোকে কল্পনা করতে পারে। এটার সুবিধাটা দেখো। আমরা পথের পাঁচালী উপন্যাসটা যখন পড়ি, তখন প্রত্যেকেই একজন করে দুর্গাকে কল্পনা করি। একটা অপু কল্পনা করি। সত্যজিৎ রায় যখন ছবি বানালেন, তখন সবার কল্পনাটা সীমিত হয়ে গেল। যে কারণে আমি এত কিছু লিখি, আমি কিন্তু হিমু নিয়ে কোনো সিনেমা বা নাটক করিনি। কারণ, সবার কল্পনায় নিজের মতো একটা হিমু আছে। আমি ওইটায় হাত দিতে চাইনি। মিসির আলিও আমি বানাইনি। অন্যরা দুয়েকজন বানিয়েছে। আমি এর থেকে দূরে থাকছি। শুভ্রও আমি বানাইনি। বানাতে চাচ্ছিও না। যার মনে যা আছে, সেটাই থাকুক।
প্রশ্ন: এখানে দেখা যায়, বাদশাহ হুমায়ুনের জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল।
হুমায়ূন: অত্যন্ত ঝোঁক ছিল। উনি তাঁর ছেলে আকবরের জন্মের পর নিজের হাতে ৪০ না ৪৫ পৃষ্ঠার একটা কোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। আকবরের জন্মতারিখটা ভুল লেখা আছে। কারণ, সত্যিকারের জন্মতারিখ সবাই জেনে ফেললে জাদুটোনা করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে। আকবরের জন্মের সময় আফতাবচি সেখানে উপস্থিত। আবুল ফজল এটা জানলেন অনেক পরে। আমরা তো নেব জওহর আফতাবচির মতো।
প্রশ্ন: আপনার উপন্যাসে হুমায়ুন প্রবলভাবে ভাগ্যবিশ্বাসী একজন মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্রের বিচার ছাড়া তিনি কিছু করেন না, কিন্তু তাঁর আশপাশে এমন কোনো চরিত্র নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী কারও দেখা কিন্তু আমরা পাই না।
হুমায়ূন: ঠিকই বলেছ। আমার উপন্যাসে এ রকম কোনো চরিত্র নেই। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ুনের লোক ছিল, যে এই গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাপারগুলো দেখত বা তিনি নিজেই দেখতেন বেশির ভাগ সময়। বাবর কিন্তু এসবের ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তলোয়ারের ওপর নির্ভর করতেন, রণক্ষেত্রের ওপর বিশ্বাস রাখতেন। হুমায়ুন দূর্বল মনের মানুষ। এ জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর নির্ভর করতেন।
প্রশ্ন: আপনি যখন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন, তখন এমন অনেক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয় যাদের আপনি দেখেননি, বইপত্র ছাড়া যাদের কথা জানার উপায় নেই। এ রকম চরিত্রগুলো আপনি কীভাবে ভিজুয়ালাইজ করেন? কোনো পদ্ধতি কি থাকে আপনার?
হুমায়ূন: পদ্ধতি থাকলে তো আমি লেখক বানানোর একটা স্কুল দিয়ে ফেলতে পারতাম। আর বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে বড় লেখক হতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ছেলে। কারণ, তাঁরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল বাপের কাছ থেকে লেখালেখির কলাকৌশল শিখে নেওয়ার। সে তো মোটামুটি গাধা ছাড়া কিছু হয়নি।
এটা আসলে বলা যাচ্ছে না। ব্রেইনের কোন অংশে কীভাবে আসলে প্রসেস হয়, আমি জানি না। তুমি কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালো ছুতার হতে পারবে। কিন্তু লেখকের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ভালো লেখক হতে পারবে—এটা আমি মনে করি না। এর প্রেরণাটা অন্যখান থেকে আসে। এটা রহস্যময়।
প্রশ্ন: স্যার, বাদশাহ নামদার-এর সূত্র ধরে এ রকম আরও ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছা কি আছে আপনার?
হুমায়ূন: না, এই মুহূর্তে আমি আর ভাবছি না। অনেক সময় নষ্ট হয় আমার। দুনিয়ার বই পড়তে হয়। আর ব্যাপারটা খুব কনফিউজিং। একেকজন ঐতিহাসিক একেক রকম কথা বলে যাচ্ছেন। ভেরি ভেরি কনফিউজিং। এক ধরনের ইতিহাস পড়লে তোমার মনে হবে, আওরঙ্গজেবের মতো নিষ্ঠুর মানুষ পৃথিবীতে নেই। আরেক ধরনের ইতিহাস পড়লে মনে হবে, ও মাই গড, আওরঙ্গজেবের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে নেই। একটা উদাহরণ দিই। রাজপুতানার এক রাজার দুজন রানি ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে গর্ভবতী হলেন। তখন রাজা মারা গেলেন। এই দুজনের এক রানি খবর পাঠালেন আওরঙ্গজেবের কাছে, ‘আপনি যদি আমার সন্তানকে স্বীকৃতি দেন রাজা হিসেবে, তাহলে আমি আমার লোকজন নিয়ে মুসলমান হয়ে যাব।’ আওরঙ্গজেব দুই রানির কোনো ছেলেকেই রাজত্ব দিলেন না। যে রাজা মারা গেছেন, তাঁর ছোট ভাইকে রাজত্ব দিলেন। সভাসদরা বললেন, ‘কী আশ্চর্য! আমরা এত বড় একটা সুযোগ পেলাম। আপনি সেটা নিলেন না কেন?’ আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আমি রাজ্য শাসন করতে এসেছি। ধর্মপ্রচার করতে আসিনি। নাবালক পুত্রকে বসিয়ে আমার চলবে না।’ আওরঙ্গজেব নিজে খুবই ধার্মিক লোক। তিনি বলছেন এই কথা।
 
হুমায়ুন আহমেদ ২০১১ সালের আগস্ট মাসে বিবিসি- বাংলায় একটি সাক্ষাতকার দেন। বিবিসি-র পক্ষে হুমায়ুন আহমেদের সাথে কথা বলেছেন অর্চি অতন্দ্রিলা। সাক্ষাতকারটি বিবিসি-র ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া।



বিবিসিঃ আপনি গত চার দশক ধরে লেখালেখি করছেন। এ লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো?

হুমায়ূন আহমেদঃ বাংলাদেশে আর ১০ টা মানুষ যে ভাবে লেখালেখি শুরু করে আমি একই ভাবেই শুরু করেছি। আলাদা কিছু নয়। তারা কি ভাবে শুরু করে? প্রথমে তারপরে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখে, তারপর কবিতা লেখে তারপর পত্রপত্রিকায় পাঠাবার চেষ্টা করে। তারা যে ভাবে শুরু করেছে আমিও সেই ভাবেই শুরু করেছি। আলাদা কিছু নয়।

বিবিসিঃ আচ্ছা, মিঃ আহমেদ, আপনার পড়াশোনার বিষয় ছিল রসায়ন। সাধারণত মনে করা হয় এটা সাহিত্যের বিপরীতে। কিন্তু অধ্যাপনা ছেড়ে লেখার আগ্রহটা কি ভাবে তৈরী হলো?

হুমায়ূন আহমেদঃ সাধারণত মনে করা হয় এটা সাহিত্যের বিপরীতে। আসলেই কি তাই? যদি সাহিত্যের পক্ষে বা সাহিত্যের স্রোতে যে সাবজেক্টগুলো আছে সেগুলো কী? তাহলে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্য? যদি সেটা হয়ে থাকে তাহলে আমার প্রশ্ন থাকবে প্রতি বছর যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বাংলা বা ইংরেজিতে পাস করে বের হচ্ছে তাদের মধ্যে কয় জন লেখালেখি করছে? কে কি পড়ছে সেটার সাথে লেখালেখির কোন সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না।

বিবিসিঃ সাহিত্যের সাথে সাথে নাটক এবং সিনেমা পরিচালনায় আপনি কি ভাবে আসলেন?

হুমায়ূন আহমেদঃ হঠাৎ করেই আসি বলা যেতে পারে। আমি দেখলাম, আমার কিছু গল্প নিয়ে ওরা বাংলাদেশ টেলিভিশন নাটক তৈরী করেছে। নাটকগুলি দেখে আমি ভাবলাম, আমি নিজেই যদি নাটক তৈরী করতে পারতাম তাহলে কি ওদের চেয়ে ভাল হত না মন্দ হত? আমি নতুন কিছু কি করতে পারতাম? ঐ আগ্রহ থেকেই আমি নাটক তৈরী শুরু করি। আর সিনেমা তৈরীর পেছনে মূল কারণটা হচ্ছে – এতো বড় একটা মুক্তি যুদ্ধ হয়ে গেছে আমাদের দেশে । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোন ভাল ছবি তৈরী হয়নি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে একটা ভাল ছবি হওয়া দরকার। এই থেকেই আগুণের পরশমণি ছবিটা বানিয়েছি। নট নেসেস্যারি যে বিশাল কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু চেষ্টাটা ছিল আর কি।

বিবিসিঃ আপনার লেখা অনেক চরিত্র মানুষকে কাদিয়েছে, হাসিয়েছে। আপনি নিজে কেঁদেছেন কোন চরিত্রের জন্য?

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি যখন লেখালেখি করি তখন কোন একটা চরিত্র খুব ভয়াববহ কষ্ট আর দুঃখের মধ্যে পড়ে যায় তখন নিজের অজান্তেই দেখি আমার চোখে পানি আসে। কাজেই কোন বিশেষ চরিত্র নয় সব চরিত্রের জন্যই আমার চোখে পানি আসে। আর আমি তো অনেক হিউমার পছন্দ করি। যখন আমি হিউমারগুলো লিখি আমি শিওর যে তখন আমার আশেপাশে কেউ থাকলে তারা দেখবে যে আমার ঠোটের কোণায় মুচকি হাসি দেখতে পাবে তারা। —

বিবিসিঃ আপনার নাটক কোথাও কেউ নেই –তে বাকের ভাইয়ের মৃত্যু ঠেকাতে মানুষ যখন প্রতিবাদ শুরু করল মানুষের আবেগের দিকে তাকিয়ে একবারও কি বাকের ভাইকে বাচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল?

হুমায়ূন আহমেদঃ এই নাটকের ২টি ভার্সন ছিল শেষে। একটি হচ্ছে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়েছি আরেকটি হচ্ছে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়নি। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়নি আমার খুব প্রিয় ভার্সন ছিল। কিন্তু বিটিভি শেষ পর্যন্ত ঠিক করে যেটায় ফাঁসি হয়েছে ঐটাই প্রচার করার ।

বিবিসিঃ কাল্পনিক চরিত্র বাকের ভাইয়ের সাথে মানুষের এমন একাত্ততা এনিয়ে আপনি কি ভাবছিলেন?

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি খুবই অবাক হচ্ছিলাম । কত রকম মানুষের ফাসি হয়ে যায়, মানুষ মারা যায় রাস্তার পাশে, নির্দোষ মানুষকে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এটা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। এটা একটা চরিত্র, একটা কাল্পনিক চরিত্র। তার ফাসি হচ্ছে এটা নিয়ে যে এতো মাতামাতি এটা আমাকে খুব বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছিল এই টুকু বলতে পারি । শুধু তাই নয়। মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায়নি। তারপর শুরু হল কুলখানি। আজ অমুক জায়গায় বাকের ভাইয়ের কুলখানি। কাল অমুক জায়গায় বাকের ভাইয়ের কুলখানি। পরশুদিন বাকের ভাইয়ের জন্য মিলাদ মাহফিল। আমি এই রকম বিস্ময়কর ঘটনা ভবিষ্যতে দেখব তা মনে হয় না।

বিবিসিঃ আচ্ছা মিঃ আহমেদ, আপনার কোন কালল্পনিক চরিত্র নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে বহুব্রীহি নাটকের কাজের ছেলে সৈয়দ বংশ হওয়া বা একজন ডাক্তারের চরিত্র বোকা ধরণের হওয়া নিয়ে আপনার পাঠকের রসবোধ নিয়ে কি বিশেষ কিছু মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদঃ তখন মনে হয় জাতি হিসাবে আমরা খুব সিরিয়াস। প্রতি দিনের ঘটনায় যে একটা ফানি পাঠ আছে এটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আমরা সিরিয়াস পাঠের দিকে তাকাই। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মানুষ তো খুবই রসিক বলে আমি জানি। ওরা এই রসটা ধরতে পারে না কেন এটা নিযে আমি খুব আপসেট হই বলা যেতে পারে। তবে বেশী পাত্তা দিই না।

বিবিসিঃ আচ্ছা , আপনার উপন্যাসের একটা জনপ্রিয় চরিত্র হিমু। এটা কি নিছক কাল্পনিক না এর ভেতর আপনি আপনার পরিচিত কাউকে তুলে ধরেছেন?

হুমায়ূন আহমেদঃ না, হিমুতে আমি আসলে পরিচিত কাউকে তুলে ধরিনাই। যে হিমু আমি লিখি ঐ হিমু হওয়া খুবই জটিল ব্যাপার তো বটেই। আমি মানুষের অনেক আশা –ইচ্ছা পূরণের ব্যাপার আছে মানুষ অনেক কিছু করতে চায় কিন্তু করতে পারে না। মানুষের যে ইচ্ছাপূরণের যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো আমি হিমুর মাধ্যমে ঐ ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারগুলো ঘটাই। যে কারণেই আমার ধারণা পাঠক এটাকে এতো পছন্দ করে। এরা হতে চায়। এরা করতে চায়। এরা চায় প্রত্যেকেই যে আমার একটা আধ্যাত্বিক ক্ষমতা থাকবে। মানুষের ভুত-ভবিষ্যত বলে দিতে পারব। সবার ভেতরে এটা একটা গোপণ বাসনা। ওদের গোপন বাসনা আমি পথে ঘাটে হেটে বেড়াবো- কেউ আমাকে কিছু বলবে না। আমাকে চাকরি করতে হবে না। কোন কিছুই করতে হবে না। আমার জীবন চলবে জীবনের মতো। কোন বাড়ির সামনে গিয়ে যদি দাড়াই ওরা আমাকে খাবার দিবে। এই যে গোপন ইচ্ছেগুলো যেগুলো থাকে সেই ইচ্ছেগুলি আমি পূরণ করি হিমু উপন্যাসে। কাজেই কারো সাথে যে মিল আছে এটা মনে হয় না।

বিবিসিঃ আচ্ছা মিঃ আহমেদ, এই হিমু তো পাঠকদের কাছে প্রায় অনুকরণীয় একটা চরিত্র হয়ে দাড়িয়েছে। এই হিমুকে নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস সম্পর্কে কোন বিশেষ কোন ঘটনা আছে কি যা আপনাকে নাড়া দিয়েছে?

হুমায়ূন আহমেদঃ হ্যাঁ, একটা বলা যেতে পারে। আমি হঠাৎ করে ইয়ে থেকে একটা ম্যাগাজিন পেলাম রাশিয়া এম্বাসী থেকে। ও ই ম্যাগাজিনে দেখি কি ওদের রাশিয়াতে একটা হিমু ক্লাব আছে। ওই হিমু ক্লাবের সদস্যরা সবাই কিন্তু রাশিয়ান; বাংলাদেশী ছেলে-পেলে না। ওরা একটা অনুষ্ঠান করেছে সেই অনুষ্ঠানে সব এম্বাসেডরদের ডেকেছে। এম্বাসেডরদের হলুদ পোশাক পরতে হবে। তারা জানে এম্বাসেডররা হলুদ পোশাক পরবেন না। কাজেই ঐ ক্লাবের তরফ থেকে প্রতিটি এম্বাসেডরকে একটি করে হলুদ নেকটাই দেয়া হয়েছে। তারা এই হলুদ নেকটাই পরে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এটা শুনে বা বইয়ের লেখাতে পড়ে আমি খুবই একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।

আরেক বার ধাক্কা খেয়েছি জার্মানীতে। জার্মানীতে গিয়েছিলাম আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলায়। সেখানে একটা বাসায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এক ছেলে এসে আমাকে বলল যে, স্যার, আমি কিন্তু হিমু। হলুদ একটা কোট গায়ে দিয়ে আসছে। আমি বললাম, তুমি হিমু। হিমুর তো খালি পায়ে থাকার কথা। এই প্রচন্ড ঠান্ডা জার্মানীতে। তোমার কি খালি পা? বলল, স্যার, দেখেন। তাকিয়ে দেখি তার খালি পা। ওই দিনও আমি ধাক্কার মতো খেয়েছিলাম।

বিবিসিঃ বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায়, যারা নতুন লেখালেখি শুরু করে নতুন বই প্রকাশ করতে তাদেরকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়। আপনি যখন প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন তখন সেটা প্রকাশ করতে কি আপনার কি রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?

হুমায়ূন আহমেদঃ খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমাকে তেমন কোন প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমার প্রথম উপন্যাসের নাম “নন্দিত নরকে”। এটি প্রকাশ করতে খুব একটা সমস্যা হয়েছে আমি মনে করি না। কারণ, আহমদ ছফা বলে এক জন ছিলেন আমাদের দেশের খুবই স্পিরিটেড এক জন মানুষ। তিনি উপন্যাসটি পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। এই উপন্যাসটি যে কোন কারণেই তার খুব মনে ধরেগিয়েছিল। তিনি জান দিয়ে ফেললেন এটি প্রকাশ করার জন্য। এই উপন্যাসের পান্ডুলিপি বগলে নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিটি প্রকাশকের ঘরে ঘরে গেলেন। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তো। আমি ব্যাপারটি জানিই না। শুধু ছফা ভাইয়ের সাথে দেখা হয় । ছফা ভাই খবর দেন – আজকে অমুকের কাছে গেছি, কালকে অমুকের কাছে গেছি। এভাবে বলে বলে তিনি এক জন প্রকাশককে মোটামুটি কনভিনসড করে য়েললেন যে উপন্যাসটি প্রকাশ করতে হবে।কাজেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে গেল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার আগে প্রকাশকের সাথে আমার পরিচয়ও হয়নি । আমি লাজুক টাইপের তো । যাইনি। লজ্জা লাগত খুব। যে দিন প্রকাশিত হল সে দিন গেলাম। গিয়ে কিছু বইপত্র নিয়ে আসলাম ওনার কাছ থেকে।

বিবিসিঃ মিঃ হুমায়ূন আহমেদ, সাহিত্যিক হিসাবে গত কয়েক দশক ধরে আপনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তুমুল জনপ্রিয়তা অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ হয় বলে শোনা যায়। আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই হয়?

হুমায়ূন আহমেদঃ যে অর্থে বিড়ম্বনার কথা বলা হচ্ছে সে অর্থে আমি বিশেষ বিড়ম্বনার ভিতর যে পড়ি তা নয়। যদি বই মেলাতে যাই তখন পাঠকদের হুড়াহুড়িটা দেখে একটু ইয়ে লাগে- সামান্য ভয় ভয় লাগে। এছাড়া তো আমি নরমালি ঘোরাফেরা করি। আমি দোকানে যাই । বাজারে যাই। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরি। কোন সমস্যা তো দেখি না আমি। যেটা হয় সাধারণত বই মেলাতেই হয়। বই মেলার বাইরে ধর, এগোরাতে গেলাম বাজার করতে। সেখানে দুই এক জনকে পাওয়া যায় তারা আমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চায় । এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এটা তো বিড়ম্বনা ধরার কিছুই না । তাই না?

বিবিসিঃ আচ্ছা আপনি লেখালেখি থেকে অবসর নেবার কথা কি কখনো ভেবেছেন?

হুমায়ূন আহমেদঃ যখন খুব লেখালেখির চাপ যায় যেমন ধর, বই মেলার সামনে বা ঈদ সংখ্যার সামনে খুবই যখন চাপের ভিতর থাকি তখন দেখা গেল শেষ হয় যে দিন সে দিন মনে হয় এখন থেকে আমি অবসরে । আর লেখালেখির ভিতরে নাই। বাকি সময়টা আরামে থাকব, সিনেমা দেখব, গল্পের বই পড়ব। সে দিন মনে হয় । তারপরের দিন মনে হয় । কিন্তু ২য় দিন থেকে আবার মনে হয় আমার যেন কিছুই করার নেই । আমি মারা যাচ্ছি। এক্ষুনি বই/ কিছু একটা লেখা শুরু করতে হবে। লেখা শুরু করি । সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বস্তি ফিরে আসে। হ্যা, আমি অবসর নিব। আমি ঠিক করেছি অবসর নিব। মৃত্যূর ঘন্টা খানেক আগে অবসর নিব। তার আগে নিব না। আমি চাই মৃত্যুর ১ ঘন্টা বা ২ ঘন্টা আগে আমি যেন এক লাইন বাংলা গদ্য লিখে যেতে পারি।

বিবিসিঃ এটা কি মৃত্যুর সময়? আপনি কি ভাবে বুঝতে পারবেন?

হুমায়ূন আহমেদঃ বোঝা যাবে। বোঝা যায় না? অনেকেই তো বলে টের পায় যে আমি মারা যাচ্ছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওই যে কি শেষ নিঃশ্বাস ফেলার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি। মৃত্যু তো শুধু হার্ট বন্ধ হয়ে যায় তা না। মৃত্যু তো প্রতিটি জীবকোষ – প্রতিটি কোষ মারা যায়। প্রতিটি কোষের মৃত্যু তো একটি ভয়াবহ ব্যাপার। বুঝতে পারার তো কথা।

বিবিসিঃ তো আপনি শেষ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান?

হুমায়ূন আহমেদঃ আমি পারব কিনা আমি জানি না । আমার গোপন ইচ্ছা এবং প্রগাঢ় ইচ্ছা হচ্ছে যে মৃত্যুর এক/দেড় ঘন্টা আগে যেন আমি এক লাইন বাংলা গদ্য লিখতে পারি। যেন হা হুতাশ করে না মরি। এই মইরা গেলাম রে, বাঁচাও রে। এই আল্লাহ-খোদাকে ডাকাডাকি করতেছে। এটা না করে আমি প্লেন এন্ড সিম্পল লাস্ট একটা ওয়ান লাইন আমি লিখতে চাই। এখন তুমি যদি বল কি সেটা – সেটা আমার মাথায় আছে; তোমাকে আমি বলব না।

বিবিসিঃ অনেক ধন্যবাদ। আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য ।

হুমায়ূন আহমেদঃ অর্চি , তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। তুমি অনেক ভাল থাক এবং মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে ব্যস্ত থাক। যাও।”
 
১৮ জুলাই ২০০৮ সালে সুইডেনে হুমায়ুন আহমেদ দৈনিক সমকালের সাংবাদিক সাব্বির রহমান খান কে একটা সাক্ষাৎকার দেন।



সাব্বির খানঃ আপনাকে স্যার বলছি, ঠিক আছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ ২২ বছর মাস্টারী করেছি, স্যার বলবে নাতো কি বলবে। ২ বছর আমেরিকায়, আর বাকী সময় বাংলাদেশে। সারা বাংলাদেশে সবাই-ই আমাকে স্যার ডাকে। এখন বলো, আমার কোন ইন্টারভিউ তো না?



সাব্বির খানঃ আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। কিছু কথা জানার আগ্রহ নিয়েই আমার আসা।

হুমায়ুন আহমেদঃ আমিতো ইন্টারভিউ দেশেও দেইনা, তাই বাইরে এসে যদি ইন্টারভিউ দেয়া শুরু করি, তাহলে দেশের সাংবাদিকদের জন্য সেটা হবে অস্বস্তিকর ব্যাপার। তারা খুব ভালো ভাবে জানে যে, আমি ইন্টারভিউ দেইনা। এই হলো প্রব্লেম।



সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনার ছবির শুটিং সম্বন্ধে একটু জানতে এসেছি। সুইডেনকে শুটিংয়ের জন্য কেন বেছে নিলেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি সুইডেনে যে ব্যাপারে এসেছি, তার মেইন ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলি। আমরা বাংলাদেশে ছবি বানাই ৩৫ মিমি ক্যামেরায়। ওই ছবিগুলোতে প্রয়োজন হয় ফিল্মের। ফিল্মে ছবিগুলো এক্সপোজড হয়। যেহেতু পৃথিবী বহুদুর এগিয়ে গিয়েছে, এখন শুরু হয়েছে ফটোগ্রাফি ডিজিট্যালি নেয়া। যদি ডিজিটেলি ফটোগ্রাফি করা হয়, তাহলে অনেক কিছু করা যায়। ফিল্মে ফটোগ্রাফিতে বেশি কিছু করা যায়না। ডিজিটেল ফটোগ্রাফিতে একটাই সমস্যা হয়, তাহলো Depth of field এর সমস্যা। ধরুন আমরা যদি ৩৫ মি.মি.-এ দুজনকে ধরি, তাহলে দুজনের পিছনে যা থাকবে, তা থাকবে খুবই ক্লিয়ার এবং এটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ডিজিটেলি এটা করতে পারে না। তবে নতুন একটা টেকনোলজি এসেছে। সেটা হচ্ছে কি, একটা হাই ডেফিনিশন ভিডিও ক্যামেরা ব্যাবহার করে, তার সাথে একটা এডাপ্টার লাগায়। তার পরে যে সমস্ত লেন্সগুলো আছে, সেগুলো বসায়। এই প্রক্রিয়ায় যে রেজাল্ট হয়, তা ৩৫ মিমি ক্যামেরার খুব কাছাকাছি। হলিউডে যে সব ছবি করা হয়, তারা তাতে এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে, যা দুএকটা উদাহার আমি দেখেছি। তাতে কোন রকম পার্থক্য আমি পেলাম না ৩৫ মি.মি. ক্যামেরার ফিল্মের সাথে। কিন্তু বোম্বেতে কিছু ছবি তারা করেছে, তাতে বোঝা যায় যে, ওগুলো ভিডিওতে করা। হলিউডের ছবিগুলোতে তা বোঝা যায়না। যেহেতু নতুন জিনিসের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ আছে বলে আমরা ঠিক করলাম যে আমরা চেষ্টা করবো এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে। প্রথম কারন হচ্ছে নূতন একটা টেকনোলজির কাছে যাওয়া, আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, এটা এতো এক্সপেন্সিভ না। আর তৃতীয় কারন হচ্ছে, কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা যে চেঞ্জগুলো করতে পারবো, ৩৫ মি.মি. তা সম্ভব না। এই তিনটি কারনে উৎসাহীত হলাম। তারপরে মাসুদ আখন্দ (সহকারী পরিচালক) এই এডাপ্টারটা যোগার করেছে এবং লেন্সগুলো তাতে সেট করা যাচ্ছে, তাই ঠিক করলাম যে ছবির প্রথম পর্বটা সুইডেনে করবো এবং দ্বিতীয় পর্বটা বাংলাদেশে করবো। যেহেতু এই টেকনিকে আমি অভ্যস্ত না, তাই এটা দিয়েই শুরু করলাম।



সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি শুটিং করতে গিয়ে কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ নানাবিধ সমস্যা আছে এখানে। প্রথমতঃ লোকবলের সমস্যা, দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, এখানে প্রতিটা জিনিসই খুব এক্সপেন্সিভ। যেমন আমি যে একটা ক্রেন ভাড়া করবো, যেটা উপর থেকে নীচে যাবে বা নীচ থেকে উপরে যাবে, সেটা ভাড়া করতে পারছিনা। তাতে আমাদের বাজেটে কুলোবে না। কিন্তু দেখা যাক কি হয়। কাজতো শুরু করলাম। আগামি শীতে আবার যখন আসবো, তখন এখনকার শুটিংয়ে যে ত্রুটিগুলো ধরা পড়বে, সেগুলোর আবার নতুন করে শট নেবো। যেহেতু আমাদের ছবিতে গ্রীস্মের এবং শীতের দুটি পর্ব আছে, সেহেতু আমাদের এখানে দুবারই আসতে হবে। গ্রীস্মেরটা এখন হয়ে গেলো, শীতেরটা পরে হবে। আমার পরিকল্পনা ছিল স্কটল্যান্ডে এই ছবিটা করতে। কিন্তু এখানে যেহেতু মাসুদ আছে, সে ফিল্ম লাইনে পড়াশুনা করেছে। তার মেধা এবং অভিজ্ঞতাকে ব্যাবহার করা যাবে এবং তার কম্পিউটারের জ্ঞ্যান ভালো, সেটাকে পুরোপুরিভাবে ব্যাবহার করা যাবে। সর্বোপরি, এখানকার ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে কাজ করবে। এই সব বিষয় বিবেচনা করে ভাবলাম যে, এই জায়গাটা ঠিক আছে। এইভাবেই আমরা ছবিটা তৈরিতে অগ্রসর হয়েছি। পূর্বে দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করেছি। এবার ইউরোপে একজন ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করছি। দেশের অংশটা দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে করবো।



সাব্বির খানঃ দেশীয় এবং ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানের মধ্যে পার্থক্য কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ এই দুই ক্যামেরাম্যানের মধ্যে প্রথমতঃ শিক্ষাগত পার্থক্য। ইউরোপীয়ানরা ক্যামেরা বিষয়ক সমস্ত থিওরী জানে। আর আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা হচ্ছে গুরুর কাছ থেকে শেখা, অর্থাৎ গুরুমুখী বিদ্যায় শিক্ষিত। তারা গুরুর কাছ থেকে আস্তে আস্তে সবকিছু শিখে নেয়। আমাদের ক্যামেরাম্যানদেরকে ছোট করার কোনই কারন নাই। এদের অভিজ্ঞতা খুব বেশি। এরা ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছে। আমি নিজে দেখেছি, এরা ক্যামেরার আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারে যে, ক্যামেরাটা রান করছে, না স্লো হয়ে যাচ্ছে। এটা শুধুই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারনে সম্ভব।



সাব্বির খানঃ কেন দেশী এবং বিদেশী দুই ধরনেরই ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করবেন? তাতে অসুবিধা হবেনা?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের দেশটা হচ্ছে খুব স্লো, এশিয়ার সব দেশই বলা যায় স্লো এবং এই স্লো ব্যাপারটা ছবিতেও চলে আসে। একটা উদাহারন না দিলে বোঝা যাবে না, ধর তুমি একটা কাগজে কিছু একটা লিখছো। ক্যামেরাটা তোমার মুখের উপরে ধরা। সেখান থেকে ক্যামেরাটা কাগজের উপর নামবে। আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা খুব স্লোলী ক্যামেরাটা মুখ থেকে কাগজের উপর নামাবে, অথবা মুখ থেকে কাট করে দ্বিতীয় শটে কাগজটা দেখাবে। ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানরা ধাম করে নীচে নামাবে। এরা খুব দ্রুত। আমাদের দেশে সে স্পিডটা নাই। আমরা জাতীগতভাবে স্লো, দেশটা স্লো, কথাবার্তায় স্লো। আমরা সবকিছুতেই খুব স্লো। আমি চাই, ফিল্মের ইউরোপীয়ান পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে ইউরোপীয়ান স্টাইলে, খুব ফাস্ট। আর বাংলাদেশী পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে আমাদের দেশীয় স্টাইলে, খুব স্লো। তাতে স্পস্ট একটা পার্থক্য তৈরি হবে।



সাব্বির খানঃ ছবিটার নাম কি হবে?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমার “নক্ষত্রের রাত” নামের উপন্যাস অবলম্বনে হবে এই ছবিটা। উপন্যাসের নামে অবশ্য ছবির নাম হবে না। ছবির নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে প্রথমিকভাবে “ চোখে আমার তৃষ্ণা ” নামটি ঠিক করেছি ছবির জন্য। এটা রবীন্দ্র নাথের গানের একটা লাইন। তবে নামটা বদলানো হতে পারে।



সাব্বির খানঃসুইডিশ কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকছেন কি এই ছবিতে?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যা থাকছে। অনেকেই অভিনয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।



সাব্বির খানঃ সুইডিশদের সাথে কাজ করতে কেমন লাগছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ ভালোই লাগছে। তবে ওরা খুব রোবোটিক । ওরা হুকুমের বাইরে এক পা-ও নড়বেনা। ওদের যা বলে দেয়া হচ্ছে, ওরা ঠিক ততটুকুই করছে। তার বাইরে না। ওদের বলেছি মাঝে মাঝে একটু ইম্প্রোভাইস করতে, কিন্তু তারা তা করছে না। শুধু আমি যতটুকু বলছি, ততটুকুই করছে। তবে তারচেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে লাইটিংয়ের ব্যাপারে। ডিজিটেলেতো লাইটের খুব একটা বেশি প্রয়োজন পড়ে না, আর আমি প্রচুর লাইট নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। তাতে আমার বেশ একটু অসুবিধা হচ্ছে। তবে দেখা যাক, কাজতো এগিয়ে চলছে!



সাব্বির খানঃ এই ছবিটা তৈরিতে খরচ কেমন হবে বলে মনে করছেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমার সব ছবিতে সাধারনত এক কোটি টাকার মতো খরচ হয়। আমার মনে হয়, এটাতেও তাই হবে। ইউরোপে টাকার এই অংকটা খুবই কম হলেও, আমাদের দেশে অনেক বেশি।



সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি এখন শুটিং করছেন এবং আগেও এসেছেন। সুইডেন এবং বাংলাদেশের মধ্যে আপনি কোন ব্যাপারগুলোর মিল বা অমিল খুঁজে পান?

হুমায়ুন আহমেদঃ মিল তেমন কিছু নাই। বাংলাদেশের মানুষরা খুব সুখী মানুষ। ধরুন, বন্যায় ঘর ডুবে গেছে, ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে মানুষ, ঠিক তখন সেখান দিয়ে দেশী বা বিদেশী কোন টিভি টিম যাচ্ছে, তখন তারা কি করবে? হাসবে অথবা হাত নাড়বে। এই ঘটনা সুইডেনে কখনোই সম্ভব না। এটা শুধুই আমাদের দেশে সম্ভব। আবার পেটে ভাত নাই, নৌকায় কোথাও যাচ্ছে। নৌকায় চড়েও দেখবেন একটা গান ধরছে। এটা আমাদের দেশেই সম্ভব। সুইডিশরা তা পারবেনা।



সাব্বির খানঃ আপনি বলতে চান যে বাংলাদেশের মানুষ আসলেই খুব সুখী?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। কিছুদিন আগে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষদের দেশের একটা তালিকা বের করেছিল। সেখানে বাংলাদেশ ছিলো পাচ নাম্বারে। দুর্নীতির তালিকায় এক নাম্বারে থাকলেও সুখীর তালিকায় কিন্তু পাঁচ নাম্বারে।



সাব্বির খানঃ আপনিতো মুলতঃ একজন লেখক। কিন্তু আপনি একই সাথে নাট্যকার ও চলচিত্র পরিচালক। আপনি নিজেকে কি হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি আসলেই একজন লেখক। আমি নিজেকে বলি ফিকশন রাইটার। কখনোই আমি নিজেকে ফিল্মমেকার বলিনা। ছবি দেখার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার খুব আগ্রহ ছিল। আমি কত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখি, কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম বানাতে পারছেনা। এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো, অথচ মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি নাই। এই আফসোস থেকেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি বানালাম “আগুনের পরশমনি”। এই ছবি করতে সমস্ত খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারপর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি ছবি বানানো। আসলে ছবির লাইনটা হচ্ছে একটা নেশার মতো। সিগারেটের যেমন নেশা, গাঁজার যেমন নেশা, সিনেমা বানানোর নেশা তারচেয়েও বেশি।



সাব্বির খানঃ আপনি থামবেন কোথায়? লেখালেখিতে, সিনেমায় না অন্য কিছুতে? নাকি সবকিছু একসাথে নিয়ে চলবেন, কোথাও থামবেন না? শিক্ষকতায় ফিরে যাবেন কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি লিখে যাবো। অন্য কিছুর কি হবে জানিনা, তবে লেখালেখি থামবেনা। আর আমরাতো ভবিষ্যতের ব্যাপারে খুব একটা ভাবিনা। তাই জানিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে। আমরা হচ্ছি, “প্রডাক্ট অব দ্য প্রেজেন্ট”! প্রেজেন্ট নিয়েই আমাদের সমস্যা বেশি।



সাব্বির খানঃ আপনি কিছুক্ষন আগে বলেছেন যে, আমরা খুব স্লো-জাতী। এটা যদি আমাদের জন্য একটা নেতিবাচক দিক হয়, তাহলে আমাদের ঠিক হওয়ার জন্য কি করা উচিত?

হুমায়ুন আহমেদঃ এটাকে ঠিক করার কিছু নাই। এটা যেমন সেরকমই থাকবে। এর মাঝখান থেকে নতুন নতুন ছেলেপেলে বেরোচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। তারা খুবই স্মার্ট, খুবই আধুনীক। বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার দায়িত্ব এদের। এরা করবে।



সাব্বির খানঃ আপনিতো বাংলাদেশ প্রচন্ড জনপ্রিয়। আপনার এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষে কিছু একটা করা যায়না?

হুমায়ুন আহমেদঃ একজন লেখক কিন্তু সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করতে পারেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান তিনি দেবেন না বা এটা তার দায়িত্ব না।



সাব্বির খানঃ এটা কার দায়িত্ব?

হুমায়ুন আহমেদঃ এ দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের। সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব। একজন লেখক রাজনীতিবিদ না, বা সমাজ সংস্কারক না। এটা তার দায়িত্বও না।



সাব্বির খানঃইঙ্গিত থাকবে কিন্তু প্রস্তাবনা থাকবেনা, এটা কি ঠিক?

হুমায়ুন আহমেদঃ ইঙ্গিতের ভিতরেইতো প্রস্তাবনা থাকে। কিন্তু সেগুলোকে গুরুত্ত্বের সংগে বিবেচনা করার কিছু নাই।



সাব্বির খানঃ আমাদের রাজনীতিবিদ বা প্রশাসনগুলো কি এই ইঙ্গিত বা প্রস্তাবনাগুলো যাচাই করে থাকেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ না না না। এই সমস্ত ইঙ্গিত বা প্রস্তাবকে গুরুত্ত্বের সংগে নেয়ার কিছু নাই। আমাদের মুসলমানদের কথাই যদি ধরি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট পবিত্র গ্রন্থ কোরান যদি আমাদের চেঞ্জ করতে না পারে, একজন ঔপোন্যাসিক কি একটা উপন্যাস লিখে তাদের চেঞ্জ করতে পারবেন? সেটা কিভাবে সম্ভব?



সাব্বির খানঃ লেখক হুমায়ুন আহমেদের সমাজের প্রতি অঙ্গিকার বা দায়বদ্ধতা কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ লেখক হিসেবে আমার অঙ্গিকার একটাই, যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের জন্ম, সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা সবাইকে জানিয়ে রাখা। কারন আমি যখন একজন যুবক, তখন সেই যুবকের দৃষ্টি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধটি দেখেছি।



সাব্বির খানঃ আপনিতো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। আপনার দৃষ্টিতে একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদী এবং বর্তমানের মৌলাবাদ ও মৌলবাদীর মধ্যে তফাৎ কোথায়?

হুমায়ুন আহমেদঃ একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা ছিল একটা বিদেশী শক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যে মৌলবাদ ও মোলবাদীরা কোন বিদেশী শক্তির অংশ না। এটাই পার্থক্য। তবে আমাদের এতো মৌলবাদ-মৌলবাদী বলে চিৎকার করে লাভ নেই কিছু, কারন বিশ্বের সব দেশেই এখন এসব আছে। ইন্ডিয়াতে আছে বিজেপি, আমেরিকাতে আছে ক্লু ক্লাক্স ক্লান, সারা পৃথিবীতেই আছে মৌলবাদী।



সাব্বির খানঃ বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা কি সমস্যা না? বিএনপি-জামাত সরকারের সময়ে বাংলা ভাই, শায়খুল, ৬৩টা জেলায় এক সাথে বোমাবাজী এসব কি সমস্যার আওতায় পড়ে না?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি মনে করি না। বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা এতো বড়ো কোন সমস্যা এখনো হয়নি। জনগন যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদিদের নির্বাচন করে, গনতান্ত্রিকভাবে কি তাদের বাদ দেয়া যায়? হোক না তারা মৌলবাদী।



সাব্বির খানঃ এই দুর্মূল্যের বাজারে বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালীরা এখন কেমন আছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ সবাই খুবই ভালো আছে। বিশ্বের সব জায়গায়ই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এখনো বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের যে কোন জায়গার চেয়ে কম।



সাব্বির খানঃবাংলাদেশের বর্তমান সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি তাদের খুব ভালো দৃষ্টিতে দেখি। তারা খুব ভালো কাজ করছে।



সাব্বির খানঃ একটা স্বাধীন দেশে এতদিন জরুরী অবস্থা জারী করে রাখা কি উচিত?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা এতদিন দেশটাকে যে অবস্থা করে রেখেছিল, আগামী আরো দুবছরও যদি জরুরী অবস্থা জারী থাকে, আমি তার বিরূদ্ধে একটি কথাও বলবো না। কারোর পক্ষে কখনোই কি সম্ভব ছিল তারেক জিয়া, কোকো এদেরকে জেলে ঢোকানো? এর পরে যদি আওয়ামী লীগ সরকারও আসতো, পারতো কি এদের ধরে ধরে জেলে ঢোকাতে? কখনোই পারতো না। কারন একাজ করতে গেলে সবার থলেরই বিড়াল বেরিয়ে পড়তো। প্রত্যেকেইতো যার যার থলেতে একটা করে বিড়াল নিয়ে ঘুরছে।

আমাদের যে জেনারেল মইন ঊ আহমেদ, খুব নরম মনের মানুষ, কিন্তু খুব শক্ত। যেই ইন্ডিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করলো, আমাদের জেনারেল ভারতে গেলেন, সেখানে যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসলেন, সম্মান দিলেন। এই কাজটা কি আওয়ামী লীগ সরকার করতে পারতো না? আমাদের জাতী হিসাবে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবেনা? এতোগুলো ভারতীয় সৈন্য আমাদের জন্য আত্নত্যাগ করলো, আমরা কি পারতাম না তাদের স্মরনে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে? আমরা করিনি কিন্তু! একটা অন্য দেশের সন্তানরা আমাদের দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, এটা আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল।



সাব্বির খানঃ বাংলাদেশ থেকে জামাতের মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। আপনি কি বলেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি কোন রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষপাতি না। “সারভাইভ্যাল ফর দ্য ফিটেস্ট”। যে ফিটেস্ট, সে সারভাইভ করবে। যে আন-ফিট সে সারভাইভ করবে না। রাজনীতি বন্ধ করে কিন্তু একটা জিনিস বন্ধ করতে পারবে না।



সাব্বির খানঃ বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদ বিতাড়নের উপায় কি বলে আপনি মনে করেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ বাঙ্গালীদের শিক্ষিত হতে হবে। এখানে মাদ্রাসা শিক্ষা নয়, আমি সাধারন বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলছি। যদি সাধারন শিক্ষায় বাংলাদেশীরা শিক্ষিত হয়, তাহলে বাংলার মাটিতে মৌলবাদীদের চিহ্ন থাকবে না। অশিক্ষিতকেই একজন মৌলবাদীর পক্ষে ভুল বোঝানো সম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষার জন্যতো আমার ঘরই যথেষ্ঠ। মাদ্রাসায় গিয়ে পড়তে হবে কেন। আমাদের যদি যেতে হয়, তাহলে সাধারন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়েই আমাদের শিক্ষা গ্রহন করতে হবে।



সাব্বির খানঃআপনার কি মনে হয় ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই হবে।



সাব্বির খানঃ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে কথিত মাইনাস-টুর যে ফর্মূলা, এব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ এই সরকারের আগে দেশের যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে দেশের সাধারন মানুষই বলতো দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে দেশ পরিচালনার কথা। এটা এই সরকারের কোন কথা নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষেরই কথা। আমাদের দেশে অসংখ্য জোকস (কৌতুক) আছে এই দুই নেত্রীকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে। আর আমরা হচ্ছি কি… আমরা এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট। যখনই এই সরকারের এক বছর পূর্তি হল এবং তারা কিছুটা এস্টাবলিশ হলো, তখনই আমরা এন্টি- এস্টাবলিশমেন্টের ধাঁচে কথা বলা শুরু করলাম। অথচ এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার কি ছিল? নাথিং!



সাব্বির খানঃ বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ?

হুমায়ুন আহমেদঃ তারা যথা সম্ভব সংবিধান মেনে চলছেন বলে আমার বিশ্বাস।



সাব্বির খানঃ বর্তমানে দুই নেত্রীর একজন জেলে, আর অন্যজন চিকিৎসার জন্য বাইরে। এব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ তারা যদি দোষী হয়, তাহলে তাদের সাজা হওয়া উচিত। আর যদি দোষী না হয়, তাহলে তাদের বিচারের মাধ্যমে জেল থেকে বের হয়ে আসা উচিত।



সাব্বির খানঃ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারকে দেখা গেছে মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে। কেন তারা মৌলবাদের সংগে আঁতাত করে?

হুমায়ুন আহমেদঃ আঁতাতটা হয় মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দেখেছেন না, আওয়ামী লীগ কিভাবে খেলাফত আন্দোলনের সাথে পাঁচ দফার চুক্তি করেছিল। কেন করেছিল? মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে। বিএনপিতো মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করবেই। কারন তারা সেই ধরনেরই রাজনীতি করে। কিন্তু যেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নেতৃ্ত্ব দিয়েছে, জনগন কি অন্তত তাদের কাছ থেকে এই রাজনীতি আশা করে?



সাব্বির খানঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এই সরকার কেন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

হুমায়ুন আহমেদঃ এই সরকারই প্রথম যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কথা বলেছে। এর আগে আর কোন সরকার এই ব্যাপারে কথা বলেনি। এমন কি আওয়ামী লীগ সরকারও না। তবে আমার ধারনা, বর্তমান সরকার বিদায়ের আগে এব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদায় নেবে।



সাব্বির খানঃ আপনার কি চান যে এই সরকার নিজ উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্র্যাইবুনাল গঠন করুক?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই চাই। কারন এটা সরকারেরই দায়িত্ব এদের বিচার করা। এরকম অন্যান্য দেশেও হয়েছে এবং হচ্ছে।



সাব্বির খানঃ আপনি এখন সুইডেনে। বাংলাদেশের তসলিমা নাসরিনের সাথে কি আপনার যোগাযোগ হয়েছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ না হয়নি।



সাব্বির খানঃ কিছুদিন আগে আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে পশ্চিম বঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তসলিমাকে একজন বিতর্কিত লেখিকা বলেছেন। আপনি কি এই ব্যাপারে একমত?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, আমার মনে হয় উঁনি একজন বিতর্কিত লেখিকা। কারন ওঁনার লেখা দিয়ে উনি নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। তবে তসলিমা নাসরিন যে নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আছেন, সেজন্য আমি খারাপ বোধ করি। কারন একজন লেখক তার মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকার রাখে। তসলিমাকে দেশে ফিরতে দেয়া উচিত।



সাব্বির খানঃ আপনি কি কোন রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদের প্রতি অনুগত?

হুমায়ুন আহমেদঃ যে কোন লেখকে জন্য রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা ক্ষতিকর। কারন তার লেখা কোন সাহিত্য হবেনা, সেটা হবে একটা মূখপত্র। আনুগত্য স্বীকার করার মত কোন সমস্যার মধ্যে আমি পড়িনি। কারন যে সব দর্শনের কথা বলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগইতো আমার নিজের। আর আমি লেখালেখি করি প্রথমত আমার নিজের আনন্দের জন্য। সে আনন্দের ভাগ যদি পাঠকরা পায়, তাহলেতো গুড এনাফ। লেখক হিসেবে মতবাদ প্রচার করার দায়-দায়িত্ব আমার না।



সাব্বির খানঃ বাংলাদেশের লেখকরা কি স্বাধীন?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন।



সাব্বির খানঃ তাহলে ডঃ হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ কারন যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিৎ যে, যে-কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয়না।



সাব্বির খানঃ ঠিক একই কারনে কি তাসলিমা নাসরিন দেশ থেকে বিতাড়িত?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, হয়তোবা।



সাব্বির খানঃ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশ-দ্রোহীর মামলার মাথায় নিয়ে মৃত্যু বরন করেছেন। ওঁনার অপরাধ কি ছিলো? আপনি কেমন বোধ করেন এব্যাপারে?

হুমায়ুন আহমেদঃ ওনাকে তো কেউ খুন করেনি। উনিতো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। ওঁনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহীর কথাটা ভুল ইনফরমেশন। তার বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা করা হয়নি। তাছাড়া সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, সমস্তটাই ছিল একটা সাজানো খেলা। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নাই। মৌলবাদীরাতো কতবার আমাকে মুরতাদ বলেছে, তাতে কি আমি মাথা ঘামিয়েছি কখনো? কখনোই না।



সাব্বির খানঃ আপনি কি সমাধীকারে বিশ্বাস এবং নিজের জীবনে চর্চা করেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। এটা বাংলাদেশে সবাই করে। বিশেষ করে আজকালকার অফিস আদালতের দিকে তাকালে প্রচুর মেয়েদের দেখা যায়, যা পূর্বে ছিলনা। আমি নিজেওতো আমার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ না করে কিছু করিনা। তার মতামতের যথেষ্ঠ গুরুত্ব আমি দেই।



সাব্বির খানঃ আপনার নিজের ব্যাপারে কি শুনতে আপনার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমার ব্যাপারেতো আমি খারাপ কিছু শুনিনা। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি বলে যে, আপনার এই বইটা খুব একটা সুবিধার হয় নাই, তাহলে খারাপ লাগে। পরচর্চাও খারাপ লাগে। আমি নিজেই তার শিকার হয়েছিলাম যখন একটা ফ্যামিলি ছেড়ে দিয়ে, নতুন একটা ফ্যামিলি শুরু করলাম, তখন এরকম হয়েছিল।



সাব্বির খানঃ আপনি কেমন আছেন স্যার?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি ভালো, আমি খুব ভালো আছি।

সাব্বির খানঃ আপনি কি সুখী? আপনার সংসার কেমন চলছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, আমি ১০০% সুখী। আমার সংসার ভালো চলছে। আমার সংসার ভালো না চললে কি আমি আমার স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে আসতাম! আমার বড় ছেলেটিও আমার সাথে এসেছে।

সাব্বির খানঃ স্যার, আপনি অনেক সময় দিয়েছেন আমাকে আজ। আমার এবং দৈনিক সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই এবং আপনার সুখী-সমৃদ্ধ জীবন কামনা করি। ভালো থাকবেন।

হুমায়ুন আহমেদঃ তোমাকে এবং তোমার মাধ্যমে আমার পাঠকদের জানাই অনেক ধন্যবাদ।
 
২০০৭ সালের ৩ মার্চে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় নূহাশ হুমায়ুন, গুলতেকিন ও হূমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও অনুলিখন করেছিলেন আরিফুর রহমান।



মা গুলতেকিনের সঙ্গে নূহাশ হূমায়ূন

চশমা পরা হ্যাংলা ফরসা ছেলেটাই নূহাশ, নূহাশ হূমায়ূন। পড়ে সানবিম স্কুলে নবম শ্রেণীতে। ওর বয়স এখন ১৫ বছর। অবসরে ছবি আঁকে, অ্যানিমেশন করে, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, ছবি তোলে, গল্প লেখে, গান লেখে। এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে নূহাশের প্রথম বই ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’। ,বইটি সে ইংরেজিতে আনুবাদ করেছে যা বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ওর বাবা হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন। নূহাশ এবং তার বন্ধুরা বেশকিছু ত্রিমাত্রিক ছবিও নির্মাণ করেছে। সে খেলাধুলা করতে খুব একটা পছন্দ করে না। তার পড়তেও ভাল লাগে না। তবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে ও খুব পছন্দ করে। নূহাশ ছবি আঁকছে দু’তিন বছর হলো। সে মূলত পেন্সিল স্কেচ করে। ওর ছবির বিষয় মানব শরীর।

আমার বইঃ ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটা লেখা হয়েছিল ১৯৮১ অথবা ’৮২ সালে। কিন্তু পড়ে মনে হয় অনেক আধুনিক। আমি যখন বইটা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলাম, তখন আমার প্রধান ভয়টা ছিল, বাংলাটা পড়ে যেমন চোখে পানি চলে আসে, ইংরেজিটা পড়েও কি চোখে পানি আসবে! তাই কয়েক পৃষ্ঠা লিখেই আমি বাবার কাছে লেখাগুলো নিয়ে যাচ্ছিলাম প্রায় প্রতিদিন। বাবা দেখে তার মতামত জানাচ্ছিলেন। পড়তে পড়তে বাবা এক সময় বললেন, ‘এখন তো আমি আর তোমার প্রুফ রিডার না। আমি পড়ে তো আর ভুল ধরতে পারছি না। আমি গল্পের ভেতর পুরো ঢুকে গেছি।’ এটা শুনে আমার খুব ভাল লাগল। মনে হলো, আমি সফল হয়েছি ।

আমার আছেঃ আমার অনেক ধরণের সংগ্রহ আছে। আমার সংগ্রহে আছে অনেক বড় বড় রোদ চশমা, যা কেউ পরে না। আছে মজার কিছু মুখোশ । এর কিছু বাবা দিয়েছেন, কিছু আমি কিনেছি। একটি কঙ্কাল আছে, আমার খুব প্রিয়। আমরা বন্ধুরা মিউজিক নিয়ে এক সঙ্গে অনেক কাজ করি। আমাদের সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য আমরা কিছু গান লিখেছি। আমি সব ধরনের গানই শুনি। তবে প্রোগ্রেসিভ রক বেশি শুনি। মাঝে মাঝে পপ অথবা হেভি মেটালও শুনি। বাংলা গান তেমন শোনা হয় না। নতুন একটা সিনেমা করছি ‘কোকিল’। আর বাবার লেখা বই গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা একটা বই আমার এত ভাল লাগবে, আমি কখনো ভাবিনি। অন্যগুলোর মধ্যে ময়ুরাক্ষী আমার অনেক মজা লেগেছে। মিসির আলীর বইগুলো ভাল লাগে। কারণ এগুলো পড়লে বোঝা যায়, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লেখা। মন খারাপ থাকলে হিমু পড়তে ভাল লাগে।

প্রিয় বাবা-মাঃ বাবার সঙ্গে আমার পছন্দের মিলটা খুব বেশি। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় আমার। বাবার কথা বলার ঢঙ আমার খুব ভালো লাগে। খুব চমৎকার করে কথা বলতে পারেন তিনি। আর মায়ের সঙ্গে হচ্ছে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। মায়ের সঙ্গে আমি সবসময় থেকে এসেছি। একজনের সঙ্গে সারাজীবন থাকলে যে রকম একটা টান হয়ে যায় ওরকম। আর বাবার মধ্যে অনেক জিনিস আছে, যেটা ভাল লাগার মতো, যা স্বাভাবিকভাবেই ভাল লাগে। আমি যদি বাবাকে নাও চিনতাম তাহলেও আমি হয়ত তাকে এত ভালোবাসতাম। বাবার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, কথা বলার আগে তিনি চিন্তা করে কথা বলেন, চিন্তা না করে একটা শব্দও বলেন না। তার বইয়ের রুচি, তার সিনেমার রুচি সব আমার খুব ভালো লাগে। আমার সঙ্গে খুব মেলে। কখনো লিখলে বাবাকে নিয়েই লিখব। আমার বাবা খুবই চালাক। তিনি খুব জটিল ভাষায় নিজের মতো করে কথা বলতে পারেন; তার কথা শুনে মনে হবে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ! আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় এটা তার সবচেয়ে ভালো দিক। মাঝে মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে খারাপ দিক।

মা’র চোখেঃ ইকুয়েশন ফিহা বইটি আমি এখনো পড়িনি। আমার মনে হয়, নূহাশ এবং আমার সম্পর্কটা ওর সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কের তুলনায় অনেক বেশি কাছের। আমি কখনো কাউকে তুই বলি না কিন্তু নূহাশকে আমি তুই বলি। ও বিখ্যাত না হলে কিছু যায়-আসে না বরং বিখ্যাত না হলেই আমি খুশি হবো। কারণ বিখ্যাত হওয়ার পর আমাদের পরিবারে একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমি চাই ও তার বড় চাচার মতো, ইকবাল ভাইয়ের (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) মতো হোক। আমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নূহাশ এবং শিলা। নোভা, শিলা, বিপাশা যখন ছোট ছিল তখন তারা একটা সুখী পরিবার দেখেছে। ওই রকম পারিবারিক আনন্দস্মৃতি নূহাশের নেই। ওরা তিন বোন দেখেছে ওদের বাবা কি করেছে, যার জন্য ওরা বাবার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না। কিন্তু নূহাশ নিজ চোখে দেখেনি। ওর সবই আমাদের কাছ থেকে শোনা। তাই ওর ওপর প্রভাবটা পড়ে না। এ কারণে বাবার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা আছে।

বাবার চোখেঃ নূহাশ একদিন এসে একটা মেয়ের ছবি আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা এই মেয়েটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়, এই যে তার ছবি। আমার জায়গায় আমার বাবা হলে তো একটা ধাক্কার মতো খেতেন। আমি ধাক্কা খেলাম না বরং আগ্রহ নিয়ে ছবিটি দেখলাম। দেখে বললাম, ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে দেখতে তো খারাপ না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নূহাশের খুব বই পড়ার নেশা। আমি বিদেশ থেকে প্রচুর বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস এবং ইংরেজি সাহিত্যের ইংরেজিতে লেখা বই কিনি। বইগুলো এনেই প্রথমে ভাগাভাগি করি। অর্ধেক আমার কাছে থাকে আর অর্ধেক নূহাশের কাছে। আমি যেহেতু খুব ব্যস্ত থাকি তাই নূহাশেরগুলো আগেই পড়া শেষ হয়ে যায়। এরপর সে আমারগুলোও নিয়ে যায়। নূহাশের অনুবাদ করা ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটি আমি পড়েছি। ও বেশ ভালই অনুবাদ করেছে। বইটির কিছু অংশ অনুবাদ করার পর প্রকাশক তার ইংরেজি অনুবাদ কেমন হচ্ছে জানতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক শফি আহমেদের কাছে মান যাচাইয়ের জন্য পাঠায়। তিনি তার ইংরেজি ভাষায় দখল দেখে বিস্মিত হন। আমি আশা করি নূহাশ ভবিষ্যতে অনুবাদ অব্যাহত রাখবে।
 
ইমদাদুল হক মিলন একবার হুমায়ূন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।



ইমদাদুল হক মিলন: আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-এর দিকে বোধহয় ? তার আগে, মাত্র চারটা বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন৷ এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা৷ আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা ভাবলেন কী করে?

হুমায়ূন আহমেদ: হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সবসময়৷ যদি ভেতরে থাকে তাহলে ‘লেখালেখি’ বিষয়টা মাথার গভীরে একধরনের চাপ দিতেই থাকে৷ এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে৷ দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি৷ আবার আমি যে একজন লেখকও, ঐটাও তো মাথায় ছিল৷



মিলন: লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়৷ আপনার সে অস্বস্তিটা কি তৈরি হয়েছিল যে, এতদিন পরে আমি আবার শুরু করলাম!

হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে মনে করতে পারছি না৷ মনে হয় না ছিল৷ কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা লেখালেখি করে, তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ অনেকদিন লিখিনি তাতে কি হয়েছে? আবার লিখব৷ ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব৷



মিলন: কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল নাকি আস্তে আস্তে?

হুমায়ূন আহমেদ: না, আমার মনে হয় এটা শুরু থেকেই ছিল৷ মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো৷ কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই চিন্তা-ভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে৷ একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না৷ এই অবস্থা৷



মিলন: এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পরে একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন৷ তারপর ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরু করেছিলেন৷ একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, এর পেছনে রহস্যটা কি বলে আপনার মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদ: এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আধিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে৷



মিলন: আপনি বলেন- আমরা দুটোই শুনি৷

হুমায়ূন আহমেদ: নরমাল ব্যাখ্যা হলো- আমি নাটক লেখা শুরু করলাম৷ আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি৷ ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরু করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরু করল৷ পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা৷ একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে- এটা তো হবার কথা না৷ আমার ধারণা আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে- এটা হতে পারে৷ আর আধিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো- শহীদুল্লাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাত্‍ কিছু বড় অংকের টাকা পেয়ে গেলাম৷ ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা৷ বই বিক্রির টাকা৷ তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেয়া শুরু হয়নি৷ যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার খুব হাত উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য৷ কাজেই করলাম কী গুলতেকিন এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়াতে৷ এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশ ভ্রমণ হবে এই হলো পরিকল্পনা৷ প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিল্লী৷ ভাবলাম এত কাছে যখন এলাম মরুভূমি দেখে যাই৷ জয়সলমীরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম৷ জয়সলমীরের পথে পড়লো আজমীর শরীফ৷ এত নাম শুনেছি- পথে যখন পড়লই তখন ভাবলাম যে, আজমীর শরীফ দেখে যাই৷ আজমীর শরীফ গেলাম৷ আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল- কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷ ফকিরে ভর্তি জায়গাটি৷ বিপাশার বয়স তখন তিন সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে, এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷ দেখা গেল যে, এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বস্তি বোধ করলো৷ তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসবো, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে৷ ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, আমি যেটা চেয়েছি সেটা তো পাইনি৷ না পেলে যাব না৷ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, আল্লাহর কাছে আমি এক হাজার বস্তা টাকা চেয়েছি৷ এই টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি যাব না৷ করবস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম৷ না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না৷ এদিকে বাংলাভাষাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল৷ একটি মেয়ে এক হাজার বস্তা টাকা আল্লাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যন্ত সে যাবে না- এটা তো মজার বিষয়ই৷ তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে, এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে৷ এতগুলো টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে৷ কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই৷ দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে৷ অবশ্যই পাবে৷ আমরা দেশে ফিরে এলাম৷ আসার পর পরই জলের মতো হুহু করে টাকা আসতে লাগল৷ কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কীভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি- এখানে আমার কোনো হাত নেই৷



মিলন: … কবিতার ছন্দ, শব্দের ব্যবহার এসব নিয়েও আপনি অনেক ভেবেছেন৷ এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা কী?

হুমায়ূন আহমেদ: না, আমি কোনো ব্যাখ্যায় যেতে চাচ্ছি না৷ আমি নিজেকে একজন গল্পকার মনে করি এবং গল্পকার পরিচয়েই আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি৷ কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের ফাইনেস্ট ফর্ম৷ এই ফাইনেস্ট ফর্মে কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই৷ গদ্যটা হয়তো খানিকটা লিখতে পারি৷ কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চেষ্টা চলতে পারে, তাই বলে নিজেকে কখনোই আমি কবি বলি না৷ সেই প্রতিভাও আমার নেই৷



মিলন: স্বাধীনতাউত্তর সময়ে এদেশের সাহিত্যের দুটি শাখা খুবই ডেভেলপড্- কবিতা ও মঞ্চনাটক৷ এদেশের কবিদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

হুমায়ূন আহমেদ: বাংলাদেশের সাহিত্যে যারা কবিতা লিখছেন- আগে যারা লিখেছেন, এখন যারা লিখছেন- তাদের কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই৷ বাংলাদেশ কবির দেশ৷



মিলন: একটি ভিন্ন বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই৷ বিষয়টি হলো ‘মৃত্যু-চিন্তা’৷ আমি জানি যে, আপনি মৃত্যু নিয়ে ভাবেন৷ জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃত্যু-পরবর্তী জগত্‍ নিয়েও আপনি ভাবেন৷ আপনার মৃত্যু-চিন্তাটা কী রকম?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে৷ বর্ষা আসবে, জোছনা হবে৷ কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না৷ আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ঐদিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই আর পারছি না৷



মিলন: বড় লেখকদের ক্ষেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে৷ যারা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে৷ আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন, এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?

হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না৷ আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায় আসে?



মিলন: কিন্তু এরকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?

হুমায়ূন আহমেদ: না, সেরকম মনে হয় না৷ মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্ট – এই চিন্তাটা কখনো আমার হয় না যে, ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারাজীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্যে।
 
২০১০ এর ২৭ অক্টোবর বাংলানিউজে সাক্ষাৎকারভিত্তিক এই লেখাটি প্রকাশিত হয়।



সে এক বিশাল আয়োজন, ব্যয়বহুল প্রস্তুতি। স্বঘোষিত শেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র সেটকে আকর্ষণীয় ও সময়োপযোগী করে তোলার জন্য দীর্ঘ চার মাস ব্যয় করেছেন জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ। নূহাশপল্লীর স্টুডিওতে সেই সেট এখন শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুত। বর্তমানে ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়াতে চলছে ছবিটির আউটডোরের শুটিং। ২ নভেম্বর থেকে নূহাশপল্লীতে শুরু হবে ইনডোর শুটিং।

প্রায় দেড়শ বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেটুগান নামে নতুন সঙ্গীতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়ের পোশাক পরে কিছু সুদর্শন কিশোর নাচগান করত। এদের নামই ঘেটু। গান হতো প্রচলিত সুরে, কিন্তু সেখানে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। অতি জনপ্রিয় এই সঙ্গীতধারায় নারী বেশধারী কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এর মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। বিত্তবানরা এইসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার জন্যে লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের বিত্তবান শৌখিন মানুষরা জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্যে হলেও ঘেটুপুত্র নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। আর তাদের স্ত্রীরা ঘেটুপুত্রদের দেখতেন সতীন হিসেবে। এমন এক ঘেটুপুত্রের গল্প নিয়েই হুমায়ুন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।

গল্পের প্রধান পটভূমি ভাটি-অঞ্চলের এক বিত্তবান জমিদার বাড়ি। ১৫০ বছর আগে ওই অঞ্চলের জমিদারবাড়ির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র ইনডোর সেটে তুলে ধরতে চেষ্টার কোনও কমতি রাখেননি হুমায়ূন আহমেদ। ২৬ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে নূহাশপল্লীতে গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র। দ্বিতল প্রাসাদের অবকাঠামো, সিংহমূর্তিবিশিষ্ট প্রবেশ দরোজা, নকশাখচিত দেয়াল ও কার্নিশ, অন্দরমহল, বৈঠকখানা, রঙমহল ইত্যাদি সবকিছুতে রয়েছে পরিকল্পনার ছোঁয়া। আসবাবপত্র এবং উপকরণ-সামগ্রী সংগ্রহেও নির্মাতা দিয়েছেন যথেষ্ট গুরুত্ব। প্রাচীন আমলের তিনটি খাট তৈরিতেই ব্যয় করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। কারুকাজ করা এ ধরনের খাট আজকাল শুধু জাদুঘরেই দেখা যায়। রেলিং দেওয়া একটি কাঠের সিন্দুক বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা। পুরনো দিনের আরাম কেদারা, আলমিরা, জলচৌকি, ক্যাশবাক্স, বজরা ইত্যাদি সংগ্রহ ও তৈরির পেছনেও খরচের কথা নির্মাতা মাথায় রাখেন নি। উপকরণাদির মধ্যে আগের আমলের দুরবিন, হাতপাখা, বাঘের চামড়া, হরিণের মাথা, পিতলের হুকো, বল্লম, চাবুক, ঝাড়বাতি, গালিচা, বালিশ, বিছানাপত্র, বাসনকোসন, পানপাত্র, গয়নাগাটি, শো-পিস সবমিলিয়ে নূহাশপল্লীর স্টুডিওটাকে যেন মিনি জাদুঘরে রূপান্তর করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রডাকশন সূত্রে জানা যায়, পনের লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়ে গেছে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য সেট নির্মাণ ও উপকরণাদি সংগ্রহের পেছনে।

ছবির সেট ডিজাইন ও সামগ্রী সংগ্রহের কথা জানতে চাইলে বাংলানিউজকে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ভাটি অঞ্চলের বিত্তবান জমিদারদের গল্প আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। তাদের বিলাসিতার নমুনা পাওয়া যায় হাওড় এলাকার প্রাচীন কিছু জমিদারবাড়িতে। আমি তাদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন সম্পর্কে যতোটা পারি তথ্য সংগ্রহ করেছি। নূহাশ চলচ্চিত্রের একটি টিম এজন্য সুনামগঞ্জ আর হবিগঞ্জে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মতভাবে দেড়শ বছর আগের বিলাসিতা ও শৌখিনতার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা আমাদের আছে। সেট নির্মাণ ও উপকরণাদি সংগ্রহ করতে চার মাসেরও বেশি সময় লেগে গেছে। খরচের কথা নাইবা বললাম। তারপরও আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। মনে হয়েছে ফাঁক-ফোকর রয়েই গেছে। আমার কাছে যদি একটা টাইমমেশিন থাকতো তাহলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আমি ওই সময়ের কোনো জমিদার বাড়িতে চলে যেতাম। বলতাম, ভাই আমি আপনাদের নিয়ে একটা ছবি বানাতে চাই। দয়া করে আমাকে অনুমতি দিন। কিন্তু আমার কাছে তো কোনো টাইমমেশিন নেই। তাই দেড়শ বছর আগের সময়টা ধরার জন্য আমাদের যতো চেষ্টা।

ঘেটুপুত্র কমলা’র সেট নির্মাণ ও সামগ্রী সংগ্রহে নির্মাতার পাশে ছিলেন শিল্প-নির্দেশক মাসুম রহমান। হুমায়ূন আহমেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট সময় ও শ্রম তিনি ব্যয় করেছেন বলে জানা গেছে।

ঘেটুপুত্র কমলা’-এর মহরতের দিন হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা দেন, এটিই তার শেষ ছবি। মহরতে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাৎক্ষণিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top