সরকারি হাসপাতালের সরঞ্জাম কেনাকাটা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক পুরনো। এ নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এখনো ইউটিউবে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু জবাবদিহিতার সংস্কৃতি বঙ্গ সমাজে নেই। “জোর যার মুল্লুক তার” কথাটির যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন এদেশের গদিতে বসে থাকা ক্ষমতাবানেরা। মাঝে মধ্যে যদি কোন অপকর্মের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় তবে এদেশের জনগণের কানে পৌঁছে দেয়া হয় চিরচেনা সেই মুখস্ত বাণী, “তদন্ত চলছে। অপরাধী যেই হোক না কেন, কোন ছাড় দেয়া হবে না।”
কোভিড-১৯ নতুন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির চিত্র খুবই নগ্নভাবে উন্মোচন করে দিয়েছে। এবারও দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যাবে কিনা সেটি নির্ভর করছে সরকারের নীতি নির্ধারকদের উপর। কিন্তু সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানলেই নয়।
গত ২১ মার্চ কোভিড-১৯ মোকাবেলার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতর রিজেন্ট নামের এক বেসরকারি হাসপাতালের সাথে চুক্তি করে। কিন্তু গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের একটি শাখায় র্যাবের অভিযানের পর উঠে আসে ভয়াবহ সব তথ্য। জানা যায় ২০১৪ সালের পর রিজেন্ট হাসপাতাল তাদের অনুমতিপত্র আর নয়াবয়ন করে নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাথে তাদের চুক্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নমুনা নিয়ে ফ্রিতে টেস্ট করাবার কথা। কিন্তু তারা সেটি না করে মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে ৩০০০-৩৫০০ টাকার বিনিময়ে নমুনা সংগ্রহ করেছে। টাকার অঙ্কে প্রায় ২-৩ কোটি টাকা এভাবে তারা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি মানেন নি। তারা রোগীদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা যেমন নিয়েছেন, তেমনি রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে জানিয়ে সরকারের কাছে ১ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার টাকার একটি বিলও পাঠিয়েছে।
এই প্রশ্নটি করা নিশ্চয়ই অমূলক হবে না, যেই হাসপাতালের গত ৬ বছর ধরে অনুমোদনই নেই তারা কীভাবে প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ডিঙ্গিয়ে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে চুক্তিটি পেল? স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে এই বলে, “পরিদর্শনের সময় চিকিৎসার পরিবেশ উপযুক্ত দেখতে পেলেও ক্লিনিক দুটির লাইসেন্স নবায়ন করা ছিল না। বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অপর বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও উৎসাহ দেওয়ার লক্ষে লাইসেন্স নবায়নের শর্ত দিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।”
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমন মনগড়া ব্যাখ্যা আমাদের আরও কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। প্রথম শ্রেণীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর অনুরোধ করেছে- এমন সংবাদ কোন গণমাধ্যমে দেখা যায় নি। লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালকে সুযোগ করে দিয়ে অন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে “উৎসাহ” দেয়ার মতো “মহৎ” কাজ না করে, উপযুক্ত কোন বেসরকারি হাসপাতালকে এই কাজের জন্য বাধ্য করার মতো ক্ষমতা কি অধিদফতরের ছিল না?
পাশাপাশি অধিদফতর বলেছে, তারা চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু অভিযানের দিন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম তো বলেছেন একদম ভিন্ন কথা। সারোয়ার আলমের বক্তব্যের সার কথা ছিল, এটি কোন হাসপাতালের মধ্যেই পরে না। ঢাকা মেডিকেলের বারান্দাও এই হাসপাতালের আইসিইউ এর চেয়ে ভালো।
অন্য দিকে একটি বেসকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অধিদফতরের সাথে সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী সরকারি ডাক্তারদের রিজেন্টে যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী ডা. শরীফ সাম্মিরুল আলম ১১ মে রিজেন্ট হাসপাতালে যোগ দেন। তিনি রিজেন্টের বেহাল অবস্থা দেখে ১৫ মে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর চিঠি লিখেন। ১৫ মে চিঠি দেয়া হয়েছে আর র্যাব অভিযান চালিয়েছে ৬ জুলাই। সব কিছু জেনেও মাঝের এই সময়টায় স্বাস্থ্য সচিব কোন ব্যবস্থা নেন নি। কিন্তু কেন? এই উত্তর কে দেবে?
র্যাবের অভিযানের পর যখন রিজেন্টের মালিক সাহেদের একের পর এক কুকীর্তি ফাঁস হওয়া শুরু হলো তখন মন্ত্রণালয় আর অধিদপ্তরের সবাই নড়েচড়ে বসলেন বটে, কিন্তু দায় কেউ নিলেন না। ৯ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় লাইসেন্স নবায়ন না করেই কীভাবে রিজেন্ট কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের সনদ পেয়েছে তার ব্যাখ্যা তলব করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে। ১১ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়’। এরপর ১২ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিন দিন সময় বেঁধে দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর “মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ” বলতে কী বুঝিয়েছে তা জানতে চায়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ১৬ জুলাই মন্ত্রণালয়ের কাছে তার লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। মহাপরিচালক তার লিখিত ব্যাখ্যায় রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তির আগে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল তা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ের ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ বলতে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব আসাদুল ইসলাম বোঝানো হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেছেন,
“স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, সাবেক স্বাস্থ্যসচিবের মৌখিক নির্দেশে এ চুক্তি করা হয়েছে। সচিব মৌখিক নির্দেশ দিতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি এখন তা অস্বীকার করেন, তাহলে বিষয়টি প্রমাণ করা যাবে না। বাস্তবে মৌখিক নির্দেশের কোনো ‘গ্যারান্টি’ নেই।
তাহলে করোনা চিকিৎসার মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার দায় কার, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আগে দেখি, সচিব রিঅ্যাক্ট করেন কি না।’ তখন চুক্তির বিষয়ে সচিব কি আপনাকে জানিয়েছিলেন? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার খেয়াল নেই। তবে সচিব এটা নিজেই পারেন। আর চুক্তি করা কোনো অন্যায় নয়।” [প্রথম আলো- ১৬ জুলাই ২০২০]
রিজেন্টের সাথে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চুক্তির সময় অধিদফতরের মহাপরিচালকের সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রী, সচিবসহ আরও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এখন কেউই কিছু জানেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রী ১৪ জুলাই নিজের দায় এড়িয়ে বলেছেন, “জেকেজি এবং রিজেন্ট হাসপাতালকে কিছু কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তারা কিছু স্যাম্পল কালেকশন করবে। আমরা অতোটুকুই জানি এবং করেও আসছিল। তারপরও যদি অন্যায় কিছু করে, তাহলে তার জন্য সে এবং তার প্রতিষ্ঠান দায়ী।”
এ তো গেল রিজেন্ট হাসপাতালের কথা। স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক নিযুক্ত অপর প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (জেকেজি) প্রতারণায় কোন অংশে কম নয়। এই প্রতিষ্ঠানেরও লাইসেন্স ছিল না। কিন্তু তারপরেও স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের সাথে চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী কিছু নির্দিস্ট স্থানে বুথ বসিয়ে শুধু মাত্র নমুনা সংগ্রহের কথা থাকলেও, তারা জন প্রতি ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে এবং সেই নমুনাগুলো পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে না পাঠিয়ে ড্রেনে ও ওয়াশ রুমে ফেলে নষ্ট করেছে।
আজ পৃথিবী ব্যাপী বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস চলছে। কোভিড-১৯ টেস্টের ব্যবসা বাংলাদেশে জমজমাট হয়ে উঠেছে এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করছে বিখ্যাত সব সংবাদ মাধ্যমগুলো। দেশকে এমন বিপদের মুখে ফেলে দেয়া রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির পেছনের কারিগরদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা এত কিছু করলো তাদের কি হবে? লাইসেন্স ও হাসপাতালে চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকার পরেও যারা তাদের অনুমোদন দিয়েছেন, যেই স্বাস্থ্য সচিব চিঠি পাওয়ার পরও কোন ব্যবস্থা নেন নি তাদের কি হবে? তারা কি বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন?