মান্দার ফুলে গো-শালিক
কিছুদিন আগে ঢাকা শহরের গাছপালা কাটার খবর পড়েছি অনলাইনে। বিশেষত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটা প্রসঙ্গে। এ উদ্যানে রেস্তোরাঁ তৈরির জন্য শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, উদ্যানে ও পার্কের ভেতর রেস্তোরাঁ কেন হবে? কেন এমন অপরিকল্পনা? ঢাকা শহরের সড়কে সড়কে খাবার হোটেল, দোকান ও ভাসমান দোকান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে খাবারের দোকান আছে। হকার সারা দিন খাবার নিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়ান। ইউরোপের কোনো দেশে আমি উদ্যানে ও পার্কের ভেতর রেস্তোরাঁ দেখিনি। এই খোলা জানালার যুগে বড়ই অদ্ভুত আমাদের নগর শাসকদের পরিকল্পনা। এপ্রিল থেকে জুন মাস আমাদের দেশে পাখির প্রজনন মৌসুম। ঢাকা শহরের পাখিরা ওই কেটে ফেলা গাছে বাসা বেঁধেছিল। বিশেষ করে কয়েক প্রজাতির শালিক, দোয়েল, কাক, ঘুঘু, বুলবুলি, সবুজ টিয়া ইত্যাদি। যাঁরা এ গাছপালা কেটেছেন, তাঁরা কি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছেন?
রমনা পার্কের গাছপালা নিয়ে আমি একটা গবেষণাকাজ করেছি এবং সেখানে পার্কের ভেতর থেকে রেস্তোরাঁ অপসারণ করার জন্য বলেছি। পুরো পার্কে অপরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে বিদেশি গাছ। মেহগনি সবচেয়ে বেশি। মেহগনি কেটে সেখানে দেশি গাছ লাগানোর কথা বলেছি। একটি শহরে মানুষ, পশুপাখির জন্য ও পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত গাছপালা, জলাধার, পার্ক, খোলা মাঠ থাকা অতি জরুরি। কিন্তু ঢাকা শহর থেকে ক্রমাগত সবুজ ও জলাধার বিদায় নিচ্ছে। শহরের শিশুদের মনের বিকাশ ও খেলাধুলার জন্য প্রকৃতির এ উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহরে সাঁতার কাটার জন্য ভালো একটি পাবলিক পুকুর নেই!
ঢাকার সংসদ ভবন সড়কে সোনালু বীথি
এ কথা সত্য, ঢাকা শহরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সুন্দর ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে গাছপালা লাগানো হয়নি। কেবল দু–একটি বীথি হয়েছে, যেমন সংসদ ভবনের সড়কে সোনালু ও কৃষ্ণচূড়ার বীথি। হাতিরঝিলেও কোনো ভালো পরিকল্পনা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে গাছপালা লাগানো হয়নি। সর্বত্রই বিদেশি গাছের সমাহার। অথচ আমার আমাদের দেশি বৃক্ষ দিয়ে শহর সাজাতে পারি। জাপানে চেরি উৎসবের মতো আমরাও করতে পারি সোনালু, জারুল, হিজল, মান্দার বা কুরচি উৎসব। আমাদের শাল, পারুল, শিউলিসহ নানা দেশি গাছপালা দিয়ে তৈরি করতে পাড়ি ছয় ঋতুর শহর। প্রকৃতিবিদ ও গুরু দ্বিজেন শর্মা বহুবার এসব নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন ও পত্রিকায় লিখেছেন। দেশের শহর ও উদ্যান বৃক্ষায়ানের জন্য পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু সরকার তা খুলে দেখিনি। ব্রিটিশ আমলে উদ্যানবিদ রবার্ট লুইস প্রাউডলক দ্বারা ঢাকা শহরের যতটুকু সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছিল, তা–ও উন্নয়নের তোড়ে বিলীন হয়ে গেছে। তাঁর রোপিত বৃক্ষস্মৃতি নিয়ে শুধু টিকে আছে হেয়ার রোড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সড়ক।
সুগন্ধি ফুল কুরচি
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের শহর সবুজ করার জন্য টেকসই পরিকল্পনা করছে, কোটি কোটি টাকা ঢালছে। সিঙ্গাপুর আজ সবুজ ও পাখিদের শহর। অপর দিকে আমরা আমাদের এ উর্বর ভূমি থেকে সবুজ বিতাড়িত করছি এবং ভিনদেশি গাছপালা আনছি, যা কিনা দেশীয় জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। গাছপালা ও জলাধার কমে যাওয়াতে দেশের শহরগুলো আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শহরে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এক মহাসংকট ঘনিয়ে আসছে শহরবাসীর জন্য।
কোভিড আমাদের শহরের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে বাড়ির আঙিনায় বা ছাদবাগানে বসে বৃক্ষের শোভা বা পাখির গান এমন বন্দিদশায় কতটা মানসিক প্রশান্তি দেয়। তবে এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহর দেশি গাছপালার সমারোহে সুন্দরভাবে সাজানো যেতে পারে। এ জন্য দেশের প্রকৃতিবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, উদ্ভিদবিদ, পাখিবিদ ও নন্দনতত্ত্ববিদদের সুন্দর সমন্বয় প্রয়োজন। তাহলেই একদিন শহর সাজবে অনাবিল সৌন্দর্যে।
* লেখক: সৌরভ মাহমুদ | প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক