আর্ল রবার্ট অব কান্দাহারের ভাস্কর্য, গ্লাসগো
সিদ্ধান্ত হলো ফ্লাইটে না গিয়ে লন্ডন থেকে গ্লাসগো যাব ট্রেনে। কারণ একটাই, যাতে যাত্রাপথে চেটেপুটে সব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি। আগে থেকেই টিকিট বুক করা ছিল। একেবারেই ট্রাভেলারদের মতো দুটো ব্যাকপ্যাক নিয়ে লন্ডন ইউস্টোন স্টেশন থেকে রাতের শেষ ট্রেনে উঠে পড়লাম আমি আর মৌনী। প্রায় সাত ঘণ্টার যাত্রা। গ্লাসগো পৌঁছাবো ভোর সাড়ে ছয়টায়।
শান্ত ক্লাইড নদী, ছবি: লেখক
ট্রেনে উঠেই পরের দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে ঘুমানোর পরিকল্পনা করলাম। কারণ শুনেছি স্কটল্যান্ডের যাত্রাপথে ভোরের দৃশ্য নাকি হার মানায় সাতটি তারার অমরাবতীকেও। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমকাতুরে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ভার্জিন ট্রেনের সিটে (ট্রেন কী করে ভার্জিন হয় আমার জ্ঞানে কুলোয় না)। ঘুম ভাঙল ভোর সাড়ে পাঁচটায়।
চোখ খুলেই ম্যাজিকের মতো এক অন্য মাত্রার শিহরণ খেলে গেল আপাদমস্তক। যেদিকে তাকাই সেদিকেই পাহাড়, অরণ্য, নীল জলরাশি। যেন উপচে পড়া সৌন্দর্যের মাঝে অলৌকিক ঈশ্বর খেলা করছেন প্রকৃতির রূপ ধরে। প্যানারোমিক জানালার কাচকে মনে হচ্ছিল বৈতরণি। যার ঠিক ওপারেই পরম সৌন্দর্যময় অমরাবতী।
এর মধ্যে আখাউড়া জংশনের মতো এই চা, এই ডিম এসব আওয়াজ না তুলে একেবারেই নিঃশব্দে ট্রলি নিয়ে বিপণন সুন্দরী আমার মতো রূপ পিপাসুদের জন্য ধোঁয়া ওঠা গরম চা, কফি আর ক্রঁশে নিয়ে যাচ্ছেন। দেরি না করে ক্যাপুচিনোর উষ্ণ কাপে ছোঁয়ালাম ঠোঁট, দাঁত বসলাম মুচমুচে ক্রঁশেতে; আর হেডফোনে বাজল, ‘ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী, নিশিত নীল পদ্ম লাগি।’
ক্লাইড নদীর ধারে, ছবি: মৌনী
অবশেষে সকাল আটটায় আমাদের ট্রেন এসে থামল গ্লাসগো সেন্ট্রাল রেলস্টেশনে। রাতের ট্রেনে ঘণ্টা চারেকের ঘুম আর ভোরের নিসর্গ দর্শনের আনন্দে দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল নিমেষে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কাছের একটা ম্যাকডোনাল্ডে ব্রেকফাস্ট শেষে সিদ্ধান্ত হলো হোটেলে পৌঁছানোর আগেই সকালের গ্লাসগো শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা হবে। ব্যাস ব্যাকপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে কফি কাপ হাতে স্কুল পালানো ছাত্রের মতো আমরাও বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশে। কোনো গুগল ম্যাপ ছাড়াই শুরু হলো পথচলা। শান্ত ধীর স্থির এই শহর প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ধরে রেখেছে জৌলুশ।
গ্লাসগোর স্কটল্যান্ডের সব থেকে বড় শহর। স্কটিশরা এখন যে ধরনের ইংলিশে কথা বলে তার প্রাচীন নাম হলো গ্যালিক। এ ভাষায় গ্লাসগোর আদি নাম ছিল গ্ল্যাসচু, যার অর্থ গ্রিন গ্লেন বা সবুজ উপত্যকা। নামের যথার্থতা আজও পাওয়া যায় সবুজে ঘেরা শান্ত গ্লাসগো শহরে। এমন শান্ত নিসর্গই জন্ম দিতে পারে উইলিয়াম মিলার, এডউইন মরগ্যান বা ক্যাথরিন কারসওয়েলের মতো বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের। আধুনিক শহর হিসেবে গ্লাসগো ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্বীকৃতি পেলেও প্রাগৈতিহাসিক গ্রামের স্থাপনা পাওয়া গিয়েছে এই প্রাচীন সবুজ উপত্যকায়।
স্কটিশ ইভেন্ট ক্যাম্পাস, গ্লাসেগা, ছবি: লেখক
ইতিমধ্যে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট এন্ড্রুস ভবনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ঢুকে পড়েছি ক্যালভিন গ্রোভ পার্কে তা নিজেই জানি না। ইতিমধ্যে সূর্য খানিকটা উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছেন। কিছুটা ক্লান্তিও ভর করছে। অগত্যা পার্কে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। এই ফাঁকে বলেনিই, এই ক্যালভিন শব্দটা দেখলাম গ্লাসগোতে খুব জনপ্রিয়। বিশেষ করে জায়গার নামকরণে। যেমন ক্যালভিন গ্রোভ পার্ক, ক্যালভিন ব্রিজ সাবওয়ে স্টেশন, ক্যালভিন ওয়ে রোড ইত্যাদি।
কিংসগ্রোভ পার্কে সস্ত্রীক লেখক, ছবি: সংগৃহীত
যা হোক, পাহাড়ের মতো উঁচু এলাকা জুড়ে এই ক্যালভিন পার্কের চূড়ায় রয়েছে ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে সফল ব্রিটিশ কমান্ডারদের একজন ফিন্ড মার্শাল রবার্ট দা ফার্স্ট আর্ল অব কান্দাহারের ভাস্কর্য। যিনি ১৮৫৭ সালে দিল্লি, আগ্রা, কানপুর এবং লক্ষ্ণৌ জুড়ে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্ত হাতে দমন করেন। ১৮৮০ সালে কান্দাহারে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে আফগান আর্মিকে পরাজিত করে ফার্স্ট আর্ল অব কান্দাহার খেতাব অর্জন করেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সে মারা যান। ইতিহাসের কি নির্মম খেলা। এক দেশের নিপীড়নকারী আরেক দেশে পায় জাতীয় সম্মান।
রয়্যাল কনসার্ট হল, গ্লাসগো, ছবি: লেখক
ইতিমধ্যে সময় চলে এসেছে আমাদের হোটেলে চেক-ইন করার। অগত্যা গুগল ম্যাপে গন্তব্য স্থির করে হাঁটা শুরু করলাম গ্রেট ওয়েস্টার্ন রোড ধরে।
হোটেলে চেক-ইন করে স্নানাহার শেষে হালকা বিশ্রাম নিয়ে ম্যাপ নিয়ে বসলাম পরের দিনের স্কটিশ হাইল্যান্ড ভ্রমণের রোডম্যাপ তৈরি করতে। সেইসঙ্গে হালকা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাঁচশত পঞ্চাশ বছরের পুরোনো শহর গ্লাসগোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। শুরুতেই যে জায়গায় গেলাম সেটা হলো ক্যালভিন গ্রোভ আর্ট গ্যালারি অ্যান্ড মিউজিয়াম। তারপরে হেঁটে হেঁটে যে জায়গায় থামলাম তার নাম গ্লাসগো সিটি সেন্টার; যেখানে বড় বড় করে লেখা ‘পিপল মেক গ্লাসগো’। কথাটা খুব মনে ধরল। আসলেই তো মানুষ ছাড়া কি শহর হতে পারে? অথবা অন্যভাবে বললে প্রকৃতিকে ডিঙিয়ে মানুষই শহর তৈরি করে।
স্কট ওয়াল্টার ভাস্কর্য, ছবি: লেখক
সেই সিটি সেন্টার থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বে জর্জ স্কয়ার। যেখানে রয়েছে দুটো ভাস্কর্য। একটা স্যার ওয়াল্টার স্কটের, আরেকটা উইলিয়াম এডওয়ার্ড গ্লাডস্টোনের। স্যার ওয়াল্টার স্কট ছিলেন আঠারো শতকের অন্যতম স্কটিশ সাহিত্যিক, নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক। আর উইলিয়াম এডওয়ার্ড গ্লাডস্টোন ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী; যিনি ১৮৬৮ সাল থেকে বারো বছর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্কটিশ পিতামাতার সন্তান উইলিয়াম এডওয়ার্ড গ্ল্যাডস্টোনের পিতা স্যার জন গ্ল্যাডস্টোন ছিলেন স্লেভ ট্রেডার বা দাস ব্যবসায়ী; যিনি আফ্রিকা থেকে মানুষদের দাস হিসেবে কিনে আনতেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দাস প্রথা বিষয়ে উইলিয়াম এডওয়ার্ড গ্লাডস্টোনের অবস্থান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের চাপের মুখে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে জর্জ স্কয়ার থেকে অপসারণ করা হয় গ্ল্যাডস্টোনের ভাস্কর্য।
গ্রীষ্মের দীর্ঘ বিকেলের আলোয় জর্জ স্কয়ার থেকে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম গ্লাসগোর অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ক্লাইড নদীর কাছে। গ্লাসগোর বুক চিরে বয়ে গেছে গ্রেট ব্রিটেনের অষ্টম বৃহৎ নদী ক্লাইড। শুভ্র শান্ত অমরাবতীর পরিবেশ চারপাশে। নেই শব্দদূষণ বা বায়ুদূষণের মতো আত্মঘাতী দূষণ। প্রকৃতিকন্যা স্কটল্যান্ডের ক্লাইড নদী নিয়ে হয়তো টেমস নদীর মতো কাব্য হয়নি, হয়নি কবিতা। তবু গ্লাসগো শহরের বুক চিরে বহমান ক্লাইড নদীর মধ্যে আছে এক অদ্ভুত মাদকতা। আছে এক উচ্চমার্গীয় শিল্পসত্তা। টেমসের মতো দুই কূল জুড়ে নেই জাগতিক ব্যস্ততা। নেই নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক মনুষ্য সৃষ্ট চাকচিক্যের বাহার।
জর্জ স্কয়ারের সামনে লেখক, ছবি: মৌনী
আধুনিক গ্লাসগো শহরের গোড়াপত্তনের এক শ বছর আগে অর্থাৎ ১৩৫০ সালে ক্লাইড নদীর বুকে তৈরি হয় স্টোন ব্রিজ। সেইসঙ্গে রয়েছে সাসপেনশন ব্রিজ এবং সর্বশেষ সংযোজন ২০০৬ সালের ক্লাইড আর্ক নামের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন সেতুটি।
গ্লাসগোর সায়েন্স সেন্টার
সুগভীর ব্যাপ্তি নিয়ে দুই পারে সুদৃশ্য স্থাপত্যের নিদর্শন বিবিসি স্কটল্যান্ড, গ্লাসগো বিজ্ঞান কেন্দ্র, ক্লাইড অডিটরিয়ামকে ধারণ করে সৌম্য শান্ত কাক চক্ষু নিয়ে বয়ে চলেছে অনন্তের পানে। এমন ইন্দ্রপুরীর সৌন্দর্যের সামনে গিয়ে কথা বলতে হয় না। চুপ করে আস্বাদন করতে হয় তার অপার রূপমাধুর্য। আমরাও কোনো কথা বলতে পারিনি সেই আলোকমঞ্জরীময় সন্ধ্যায়। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেই যাচ্ছিলাম ক্রমাগত আর মনে পড়ছিল সবুজে ঘেরা সিলেটের অদূরে জৈন্তাপুরের পাহাড়ি সারি নদীর কথা। যে নদীর স্বচ্ছজলের গভীরে থাকা মাছটাও দৃষ্টিগোচর হয় অবলীলায়। সেই সঙ্গে রয়েছে একই ধরনের নৈঃশব্দ্যের কাব্যিক পঙ্ক্তিমালা।
গ্লাসগোর এসইসি অ্যান্ড হাউড্রো বিল্ডিং
লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ।