দানকে আরবিতে বলা হয় সদকা, এর অর্থ হলো সত্য। প্রকৃত প্রস্তাবে দান–সদকার মাধ্যমে ব্যক্তির অন্তরের বিশ্বাসের অবস্থার সত্যিকারের সত্যায়ন হয়। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে উত্তম সে ব্যক্তি, যে মানুষের উপকার করে।’ (তাবরানি)। ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কল্যাণকামী ও শ্রেষ্ঠ দাতা ছিলেন, আর রমজান এলে তিনি সবচেয়ে বেশি দান করতেন; জিবরাইল (আ.)–এর আগমন হলে তিনি প্রবাহিত বাতাসের মতো দান–খয়রাত করতেন।’ (মুসলিম: ২৩০৮)।
দান–সদকা–খয়রাত সসম্মানে পবিত্র মনে প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিতে হয়। দানের ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। দানদাতার ইহকালীন ও পরকালীন সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি করে, তাই তা ইজ্জত হুরমত ও তাজিমের সঙ্গে সযত্নে প্রদান করতে হয়। সম্পদ ব্যয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ খাত পিতা–মাতা। পিতা–মাতা ও ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্য সব আত্মীয়স্বজনকেই ফিতরা ও জাকাত প্রদান করা যায়। আত্মীয়দের মধ্যে ভাইবোনের হক সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি শ্বশুর–শাশুড়ি ও বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় যারা, তাদেরও অগ্রাধিকার রয়েছে। রমজানে, ঈদে, কোরবানি ও নানা উপলক্ষে তাদের হাদিয়া দেওয়া সুন্নাত। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা দয়াদাক্ষিণ্য ও করুণা গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করেন; তাই তাঁদের হাদিয়া বা উপহার উপঢৌকন হিসেবে দেওয়াই সমীচীন। এটাই দানের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। জাকাত–ফিতরাও উল্লেখ না করে দেওয়া যায়; যাতে গ্রহীতা বিব্রত না হন।
আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিন, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। আপনজনকে ভালোবাসুন, গরিবকে সম্মান করুন, সবাইকে ক্ষমা করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে তোমার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে, তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ো; যে তোমার প্রতি অবিচার করে, তাকে ক্ষমা করো।’ (মুসলিম)। রহমত ও মাগফিরাতের মাসে দয়া ও ক্ষমার অনুশীলন করুন। ক্রোধ ও প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া শয়তানি বৈশিষ্ট্য; নাজাতের মাসে এর থেকে মুক্তি লাভে সচেষ্ট হোন। বান্দার সঙ্গে সুসম্পর্ক করুন, আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে। এই করোনাকবলিত রমজানে অখণ্ড অবসরে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করুন; সালাম–কালাম বিনিময় করুন।
ঈদের জন্য নতুন জামাকাপড়, পোশাক–আশাক, জায়নামাজ, টুপি, তসবিহ, আতর ইত্যাদি কেনা জরুরি নয়। করোনায় কর্মহীন, আয়রোজগারহীন, অভাবী গরিবদের সাহায্য–সহযোগিতা ও দান–খয়রাত করা এর চেয়ে অনেক বেশি উত্তম।
আপনজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মনোমালিন্য বা মান–অভিমান হতে পারে। কিন্তু এটা দীর্ঘদিন ধরে রাখা যাবে না। কোনো মুমিন মুসলমানের সঙ্গে তিন দিনের অধিক রাগ করে কথাবার্তা বন্ধ রাখা বৈধ নয়। যদি কারও সঙ্গে কোনো লেনদেন বা দেনা–পাওনা থাকে, তা শরিয়তসম্মতভাবে ও আইনি উপায়ে আদায়ের চেষ্টা করুন। স্বাভাবিক সম্পর্ক বহাল রাখুন; প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। দুনিয়াতে না পেলে আখিরাতে অবশ্যই পাবেন; থাক না পরকালের জন্য কিছু বাড়তি সঞ্চয়। বিশ্বাসী মুমিন মুসলমানের কোনো কিছুই বৃথা নয়।
সামর্থ্যমতো হাদিয়া বা উপহার দিন। হাদিয়া বা উপহার পেলে সাগ্রহে গ্রহণ করুন, তা যতই সামান্য হোক না কেন। উপহারদাতাকে উপহার দিয়ে সম্মানিত করুন। হাদিয়া উপহার দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই সুন্নাত আমল।
উপহারের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিস বাছাই করি। যেমন: কখনো মিষ্টি, কখনো ফলফলাদি, কখনো চকলেট, বিস্কুট, চিপস ইত্যাদি এবং কখনো কাপড়চোপড়, কখনো শাড়ি–চুড়ি, কখনো তেল–সাবান, কখনো কসমেটিকস ইত্যাদি। এই করোনাকালে আমরা উপহারসামগ্রীর সঙ্গে মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশ যুক্ত করতে পারি।
বেশি বেশি দান–খয়রাত করুন। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে, যখন যেমনটি প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যদি তোমরা দান প্রকাশ্যে করো তবে তা উত্তম; আর যদি তা গোপন করো এবং অভাবীদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য শ্রেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা অবগত আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৭১)। দান করে খোঁটা দিতে নেই। এতে দানের ফজিলত বিনষ্ট হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সদ্ব্যবহার, সুন্দর কথা ওই দান অপেক্ষা উত্তম, যার পেছনে আসে যন্ত্রণা। আল্লাহ তাআলা ঐশ্বর্যশালী ও পরম সহিষ্ণু। হে মুমিনগণ! তোমরা খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে বাতিল কোরো না। তাদের মতো, যারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে লোকদেখানোর জন্য এবং তারা আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে না।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬৩-২৬৪)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘খোঁটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (তিরমিজি)।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম