What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

pinuram রচনাসমগ্র (12 Viewers)

(৯)

আমাদের সব বন্ধুদের নেমন্তন্য করা হল, আমার আর অনুর বন্ধু সংখ্যাই কুড়ি ছাড়িয়ে গেল। বিয়ের একদিন আগেই অনু ছন্দাকে ডেকে নিল, অনুর বান্ধবী হিসাবে ছন্দাকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অনু যখন ছন্দাকে মা জেঠিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আমি তখন বাড়ির ত্রিসীমানায় ছিলাম না। পরে শুনেছিলাম যে ছন্দাকে দেখে আমার জেঠিমার খুব পছন্দ হয়েছে, সেই কথা শুনে আমি তাধিন তাধিন করে নেচে নিলাম।

ছন্দা আমাকে মজা করে বলেছিল, “তোদের যা পঙ্গপালের গুষ্টি সবাইকে প্রনাম ঠুকতে ঠুকতে আমার কোমর বেঁকে গেল।”

দুই বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার আর আকাশদার ঘাড়ে। বিশ্বজিৎদা তো মজাসে ছোড়দিকে নিয়ে কেনাকাটা করাতে ব্যস্ত। ধুর ব্যস্ত না ছাই, আমি হলফ করে বলতে পারি কেনাকাটার নাম করে ওরা ওই কয়দিনে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেননা যা কেনার সব আমি আকাশদা নবীন আর অনু মিলে করেছিলাম।

বিয়ের দিনে সাজসাজ রব, এ বাড়িতে ফুল নেই তো ওই বাড়িতে এখন পর্যন্ত বিদ্ধি পুজোর ঠাকুর মশাই আসেনি। খাবার জায়গা এক জায়গাতেই। দুই বাড়ির মাঝের মাঠেই সামিয়ানা টাঙানো। তখন ক্যাটারার ছিল না, ঠাকুর মশায় রান্না করতেন আর বাড়ির ছেলেরা পরিবেশন করতো। আমাদের মাথা ব্যাথা হয়ে যাওয়ার যোগাড়।

এর মাঝে ছন্দা এসে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে গেল, “রাতে কোন শাড়িটা পরবো বলে দে।”

বিকেল হয়ে গেছে এদিকে তখন নিরামিষের জন্য ছানা এসে পৌঁছায় নি। আমি ওকে এক ধ্যাতানি দিয়ে বললাম, “তোর যা ইচ্ছে তাই পরিস এখন আমার মাথা খাস না।”

ব্যাস, অভিমানিনীর মুখ ফুলে লাল, “যা তোকে জিজ্ঞেস করাই বৃথা। আমি সাজবোই না বিয়েতে।”

একদিকে টেনে নিয়ে আবার ওকে শান্ত করলাম, “প্লিস সোনা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এদিকে ছানা এখন আসেনি সেগুলো আনতে নবীনকে পাঠিয়েছি, ওদিকে কয়লা ফুরাতে চলল তার জন্য বাপ্পাকে পাঠালাম আর শালা কোথায় মরতে চলে গেছে। আর এমনিতে তুই যা পরবি তাতেই তোকে সুন্দরী দেখাবে।”

চশমাটা একটু উপরের দিকে ঠেলে দুষ্টুমি ভরা হেসে বলল, “রাতে দেখিস তোকে কি করি।”

যাই হোক সেইসময়ে ওকে ক্ষান্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সন্ধের পরে যখন বাড়ি থেকে সেজে বের হল তখন আমি ওকে দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। ছন্দার পরনে একটা গাড় নীল রঙের সাউথ সিল্কের মেখলা। কাঁচুলিটার পিঠ একটা গিঁট দিয়ে বাঁধা, মেরুদণ্ডর খাঁজ যেন সুগভির কোন নদী। সুউন্নত, সুডৌল কুচ যুগল কাঁচুলির ভেতরে হাঁপিয়ে উঠছে, ঠিকরে বেরিয়ে আসতে উদ্যত। সেদিন বেনুনি ছেড়ে খোঁপা বেঁধেছে, খোঁপায় একটা সুন্দর হাতির দাঁতের ক্লিপ। গলায়, হাতে, কানে হায়দ্রাবাদি মুক্তোর সেট ঝলমল করছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। ডান কব্জিতে সোনার ঘড়ি আর বেশ কয়েক গাছা সোনার চুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও স্বর্গের নর্তকী এই মর্তধামে নেমে এসেছে। আমি চারপাশে চেয়ে দেখলাম, ওর রুপ আর সাজ দেখে অনেকের চোখ ওর দিকে চলে গেল। অনু আমাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল কেমন সাজিয়েছে। আমি শুধু বুক চেপে উফ একটা আওয়াজ করে থেমে গেলাম, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার উপায় ছিল না তখন। আকাশদার বন্ধুরা আর বিশ্বজিৎদার বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছন্দা আর অনুকে দেখার জন্য।

বিয়ের সারা সময়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম, মাঝে মাঝে ওদের দুইজনের দেখা পাওয়া যেতো। দুই ফুলটুসি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেশ মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাওয়ার সময়ে এদিকে লোক ওদিকে লোক, কে খেতে বসলো, কে খেয়ে চলে গেল, কে নিরামিষ খাবে, কার পাতে মাংস পড়েনি সেই সব নিয়ে হইচই রইরই ব্যাপার। দেবুকে কাজ দিতে গেলেই অনু বলে দেয়, না ও কিছু করবে না। আমি মনে মনে বললাম, আমাদের বাড়ির সব জামাইগুলো কুঁড়ে। বিয়ের দিকে কি হচ্ছে সেসবে আমার মাথা ব্যাথা ছিল না কারন ছোড়দি তো আর বেশি দূর যাচ্ছে না। আগে রোজ রাতে এবাড়িতে ঘুমাতো, সেদিনের পর থেকে মাঠ পেরিয়ে ওবাড়িতে ঘুমাবে এই যা তফাৎ।
দুটো ব্যাচের খাওয়ার মাঝে আমি আর নবীন অন্যদিকে গিয়ে সিগারেট টানছিলাম।

এমন সময়ে ছন্দার দেখা। ওকে দেখে নবীন মিচকি হেসে বেরিয়ে চলে গেল। আমার পাশ ঘেঁসে হাতখানি ধরে বলল, “কি রে কেমন দেখাচ্ছি একবার বলবি না।”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ওর কালো গভীর চোখের তারায় হারিয়ে গেলাম। ওর দেহের থেকে বিচ্ছুরিত অতীব আকর্ষণ আমাকে টেনে আনলো ওর কাছে, এত কাছে যে আমাদের শরীরের মাঝে জায়গা ছিল না। ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো আমার চাহনির বানে। আমার বুকের মাঝে তখন ঝড় উঠেছে, ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে যাবো কিন্তু হাত ছাড়িয়ে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বলল যে ওর সাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমি ওকে বললাম যে এই মন্ডপে বসার ইচ্ছে আছে নাকি। সেই শুনে লাজুক হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় এত তাড়াতাড়ি নয়।

আমি ওকে ফিসফিস করে বললাম, “তুই যে এতো সুন্দরী সেটা ধারনা ছিল না। শাড়ি ছেড়ে মেখলা, আমি তো ভাবতে পারছি না।”

আমাকে বলল, “গত বছর মামা বাড়ি গিয়ে কিনেছিলাম কিন্তু আর পরা হয়নি।”

আমি ওকে বললাম, “তোকে না আমার বুক পকেটে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।”

ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কি? বুক পকেটে কেন? বুকের মধ্যে আমি ছাড়া আর কে কে আছে?”

আমি ওর নরম গালে টোকা মেরে বললাম, “আরে না রে বোকা মেয়ে, বুকের মধ্যে রাখতে হলে যে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। এখন ওপেন হার্ট সার্জারি করার মতন বয়স হয়নি আমার।”

কেন জানিনা ওর চেহারা দেখে আমার মনে হল এখনো কিছু সাজ বাকি রয়েছে, যদি আমি নিজে হাতে ওকে সাজাতে পারতাম তাহলে হয়তো ওর সাজ সম্পূর্ণ হতো। ওর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তারপরে পকেট থেকে পেন বার করলাম। বাম হাতের তর্জনী দিয়ে ওর থুতনি ছুঁয়ে আমার দিকে তাকাতে বললাম। ছন্দা আমার তর্জনীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল, আসন্ন উত্তেজনায় ওর শরীর কাঠ হয়ে গেল। ডিসেম্বরের শীতেও ওর নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু দেখা দিল। ওর তপ্ত শ্বাসে আমার মুখ বুক সব ভেসে গেল। আমার দিকে মুখ উঁচিয়ে চোখ জোড়া আধাবোজা করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি পেন দিয়ে ছন্দার থুতনিতে তিনটে ছোটো ছোটো বিন্দু এঁকে দিলাম। লজ্জা ভরা লাল টুকটুকে চেহারা দেখে এবারে মনে হল যেন ওর সাজ সম্পূর্ণ। নিজের অজান্তেই ছন্দার হাত দুটি মুঠি হয়ে গিয়ে গাল, কান গরম হয়ে গেল। ভেজা পায়রার মতন কেঁপে ওঠে ছন্দার পেলব দেহ। চোখ বন্ধ করে আমার হাতখানি শক্ত করে ধরে নেয় আর নিজের অজান্তেই ওর গোলাপি নরম ঠোঁট দুটি অল্প ফাঁক হয়ে যায়। পদ্মের পাপড়ির মতন ঠোঁটগুলো কেঁপে ওঠে, যেন দখিনা বাতাস বইছে। আমি ওর নরম ঠোঁট জোড়া দেখে আর থেমে থাকতে পারলাম না, আমার আঙুল থুতনি ছাড়িয়ে ওর গালের ওপরে চলে গেল। আলতো করে গালের ওপরে আঙুল বুলিয়ে মাথা নিচু করে ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। তীব্র আবেগে বশে আমার ঠোঁট কামড়ে দিল ছন্দা। ঠিক কতক্ষণ ওইভাবে অধর ওষ্ঠ মিলিয়ে ছিলাম বলা মুশকিল তবে কেউ যেন আমাকে ডাক দিল আর আমাদের গভীর চুম্বনে ছন্দপতন ঘটে গেল।

অনু এদিক ওদিকে খুঁজে আমাদের ওইখানে পেয়ে ঝাঁজিয়ে উঠল, “তোরা দুইজনে এইখানে কি করছিস? ওইদিকে বিয়ে শেষ হতে চলল।”

অনুকে দেখেই ছন্দাকে ছেড়ে দিয়ে আমি ওকে বললাম, “কি হয়েছে এত গরম হয়ে আছিস কেন?”

অনু জানাল যে আগে ছোড়দির ঘরে বাসরের কথা ছিল কিন্তু লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে নিচের তলার বৈঠকখানায় বাসরের ব্যবস্থা করতে হবে। তার মানে কাজ বেড়ে গেল, আমি ভেবেছিলাম যে রাতে একটু খালি পাবো আর ছন্দার সাথে একটুখানি একলা সময় কাটাতে পারবো কিন্তু অনুর কথা শুনে মনে হল সে গুড়ে বালি। নিরুপায় হয়ে ছন্দা বাঁকা হাসি দিয়ে অনুর সাথে চলে গেল আর আমি আকাশদাকে নিয়ে বৈঠকখানা ঠিক করতে চলে গেলাম।

মেজদাকে জিজ্ঞেস করাতে মেজদা মিচকি হেসে বলল যে অনু আর অনুর বান্ধবী মানে ছন্দাকে দেখে ওর বন্ধুরা আর বড়দার বন্ধুরা রাতে থেকে গেছে। আমি মনে মনে হেসে ফেললাম, তোদের পাতে কাঁচ কলা, ওই দুইজনেই নিজেদের বর আগে থেকেই খুঁজে নিয়েছে। আমি অনু আর ছন্দাকে ওদের অভিপ্রায় জানিয়ে দিলাম, ছন্দা আকাশ থেকে পড়ল, কি হবে এবারে? অনু ওকে ক্ষান্ত করে দিয়ে বলল যে কিছুই হবে না কেউ ওদের টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না।

রাতে মেজদার বন্ধু আর বড়দার বন্ধুদের সাথে অনুর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে আড্ডা বসল। মেজদা মদ এনেছিল, বাড়িতে বসে মদ খাওয়া এক বিশাল ব্যাপার কিন্তু বিয়ের সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে সেইসব করা যেতে পারতো। ওরা সবাই মিলে নবীন আর আমাকে চেপে ধরল, একবার ছন্দার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। নবীন মদ খেয়ে ওদের সাফ কথায় জানিয়ে দিল যে আমরা কিছু করতে পারব না যা করার ওদের নিজেদের করতে হবে, পেছনে এক পয়সার মুরোদ নেই আবার প্রেমের বুলি গাইছে।

সারা রাত ধরে ছোড়দি আর বড়দাকে ঘুমাতে দেওয়া হল না, বাড়ি নয় যেন কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্র। একদিকে ছোড়দির বন্ধুবান্ধবীরা দল বাধলো অন্যদিকে বড়দার বন্ধুরা দল বাধলো, গানের লড়াই হাসি মজা অনেক কিছুই হল সেই রাতে। সেইরাতে দেবুও থেকে গেছিল। ফাঁকতালে ঘুমের অছিলায় আমরা চারজনে ওই বাসর থেকে সরে গেলাম আর অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে আড্ডা দিলাম। সকাল প্রায় হতে যায় তখন আমি আর দেবু বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।

ছন্দা বউভাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ছিল আর সেবারেও আমি ওকে ছাড়তে যেতে পারিনি। অবশ্য না ছাড়তে যাবার কারন ও বুঝেছিল, সর্ব সমক্ষে ওর কাছেই যেতাম না। বউভাতের পরেরদিন দেবু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। অনু তারপরে আমাদের খেপিয়ে বলতো ওই এক মন্ডপে আমাদের বিয়ে করালেই ভালো হতো।

ছোড়দির বিয়ের পরে সব থেকে বেশি লোকসান আমার হল, আগে অনায়াসে ওর পার্স মারতে পারতাম সেটা বন্ধ হয়ে গেল, ওদিকে অনুর পার্স মারতে গেলেই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু, “প্লিস টাকা নিস না, দেবুর সাথে সিনেমা দেখতে যাবো” অথবা, “ওকে জন্মদিনে একটা শার্ট কিনে দেব তাই টাকা জমাচ্ছি” ইত্যাদি প্রচুর বাহানা।

আর ছন্দা আমাকে বলতো, “তুই কেন এর তার কাছে হাত পাতিস? আমি টিউশানি করি আমার পার্সে অন্তত তোকে আর আমাকে চালানোর মতন টাকা আছে।”

তবে আমার পকেট কোনোদিন খালি থাকতো না কারন আমার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার আমার ছোট কাকিমা ছিলেন, যখন যা চাইতাম পেয়ে যেতাম।
 
(১০)

দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে গেল, আমাদের কলেজ শেষ হয়ে গেল। ছন্দা আগের থেকে অনেক বদলে গেছিল। আগে অনেক চুপচাপ লাজুক মেয়ে হয়ে থাকতো, শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরে কোনোদিন কলেজে আসতো না কিন্তু কলেজ শেষ হতে হতে ও অনেক খোলামেলা হয়ে গেল। অনুর দৌলতে আর আমার চাপাচাপিতে, শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ, লম্বা স্কারট শার্ট ইত্যাদি পরা শুরু করে দিল। আগে অনুর আঁচলের পেছনে লুকিয়ে থাকতো, কলেজ শেষ হতে হতে সর্ব সমক্ষে আমার পাশে দাঁড়াতে লজ্জা বোধ করতো না। কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখা, ঝালমুড়ি খাওয়া, ময়দানে ঘোরা, পুজোর সময়ে দল বেঁধে ঠাকুর দেখা, ছুটির দিনে ভিক্টোরিয়া থেকে হেঁটে হেঁটে হাওড়া যাওয়া আর সেখান থেকে বাসে চেপে বাড়ি ফেরা অনেক কিছুই করেছি।

দেবুর সাথে প্রেম করার পরে অনুও অনেক বদলে গেছিল। আগেকার যে অনু চারদিকে লাফিয়ে খেলে বেড়াতো বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক সংযত হয়ে গেল আর দেবু হয়ে গেল একটা মিনি বেড়াল। দেবুর সাথে ঘন ঘন যুদ্ধ হতো সেটা এখন প্রেমের বুলিতে হয়। তার সাথে আরো একটা পরিবর্তন ঘটেছিল যেটার ব্যাপারে ছন্দা আমাকে দেখালো সেটা হল নবীনের সাথে আগে যেমন খোলা মনে কথা বলতো অনু, সেটা অনেক কমে গেছে। আমি ওকে বললাম যে হয়ত এখন দেবুর সাথে বেশি মেশে তাই আমাদের সাথে ওই রকম ভাবে সময় দিতে পারে না, ছন্দা মিচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল এর পেছনে অন্য কোন গল্প আছে। তখন ছন্দার কথার আসল অর্থ বুঝতে পারিনি।

আমি আর ছন্দা ওকে দেখে আড়ালে হাসতাম আর অনুকে বলতাম একি করছে। অনু নাক কুঁচকে জবাবে বলতো, বাঃরে প্রেম করেছে বলে কি ওর মাথা কিনে নিয়েছে? ও তো মাঝে মাঝে শুধু একটু আধটু কাজ করিয়ে নেয়। কোথাও দল বেঁধে ঘুরতে গেলে অনু কোনোদিন নিজের ব্যাগ নিজে বইতো না দেবুর কাঁধে চাপিয়ে দিতো। একবার সবাই মিলে রায়চক গিয়েছিলাম, সেইখানে গিয়ে অনুর চটি ছিঁড়ে গেল তাই নিয়ে দেবুকে বকাঝকা শুরু করে দিল। দেবু বেচারা থতমত খেয়ে আবার দুই জোড়া চটি কিনে দিল তবে গিয়ে ক্ষান্ত হল।

দেখতে দেখতে আমরা সবাই যাদবপুর থেকে পাশ করা কেমিক্যাল ইঞ্জনিয়ার হয়ে গেলাম। সবাইকে অবাক করে নবীন ব্যাচে টপ করে ফেললো আর ছন্দা সেকেন্ড হল। আমি বেশ ভালো র‍্যাঙ্কে পাশ করলাম আর শ্যামলী কোন রকমে পাশ করেই খুশি। আমাদের দুই বছর আগেই ঋতুরাজ মেকানিকাল পাশ করে কানাডার ওন্টারিওতে চাকরি নিয়ে চলে গেছে, তাই শ্যামলীর পাশ করা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিল না, জানে পাশ করলেই বিয়ে করে চলে যাবে আমাদের টা টা বাই বাই করে। আর সেটাই হল, কলেজ শেষ হতে না হতেই শ্যামলী টুক করে বিয়ে করে ফেলল। শ্যামলীর বিয়ের দিনে অনু আর ছন্দার কি কান্না, কোথায় কোলকাতা আর কোথায় অন্টারিও হয়ত আর এই জীবনে দেখাই হবে না কারুর সাথে।

আমার চাকরি করার একদম মন ছিল না। বাবা জেঠার অনেক টাকা, একটু ধ্বংস না করলে হবে কি করে আর পেটের বিদ্যে বাড়াতে অসুবিধে কোথায়। মাস্টারস করতে চাই, তারপরে রিসার্চ করতে চাই এই খবর পেয়ে বাবা জ্যাঠা আরও খুশি। এইসব ভেবে আমি দেবু আর নবীন গেট পরীক্ষায় বসলাম। আমি এম টেক করতে ঢুকলাম যাদবপুরে আর দেবু এম টেক করতে চলে গেল ধানবাদের আই এস এমে। নবীন এম টেক পড়তে চলে গেল দিল্লির আই আই টিতে আর পরাশর গুজরাটের এক বড় টায়ারের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। বিশ্বজিৎদার ঘাড় ভেঙে আমি একটা মোটরবাইক হাতিয়ে নিলাম।

অনু পড়াশুনা করতে নারাজ, ওর কথা, সেই ছোটবেলা থেকে বই পড়া শুরু করেছে আর নয় আবার চাকরিও করতে চায় না, বাড়ি বসে বাবা কাকার অন্ন ধ্বংস করবে। এই শুনে ওর বাড়ির থেকে চাপ দিতে লাগলো যে মেয়ের বাইশ বছর বয়স হয়ে গেছে এবারে বিয়ে দিয়ে দাও। অনু দেবু দুইজনার মাথায় বাজ, কি ভাবে সামলানো যায়, শেষ পর্যন্ত ছন্দা ওকে বুদ্ধি দিল যে ডাব্লু বি সি এস অথবা সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিক তাহলে আর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দেবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ, মেয়ের সুবুদ্ধি হয়েছে দেখে ওর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পড়াশুনা করতো না ছাই, দেবুর সাথে সারা কোলকাতা ঘুরে বেড়াতো।

ছন্দা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কোলকাতার একটা নামকরা রঙের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল, পার্ক স্ট্রিটে ওর অফিস। যেদিন এপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েছিল সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। ওই অশ্রু ছিল আনন্দের, খুশির জীবনের জয়যাত্রার অশ্রু।

কোলকাতায় তিন জন থেকে গেলাম আর বাকিরা ছড়িয়ে গেল। এই বিশাল পৃথিবী মাঝে আমরা ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতন ছিটকে গেলাম।

ছন্দা আর আমার মাঝের “তুই” কখন যে “তুমি” তে পরিনত হয়ে গেছিল সেটা আর খেয়াল নেই। রোজকারের মতন আমি সকালে কলেজের জন্য বেরিয়ে যেতাম, বিকেলে কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা ছন্দার অফিসের তলায় ওর জন্য অপেক্ষা করা। আর সেই সাতজন একসাথে নেই, কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখা নেই, এর মাথায় চাঁটি মেরে ফুচকা খাওয়া নেই, কফি হাউসে বসে আড্ডা মারা নেই। ছন্দা আফসোস করতো, কলেজ পালানো কত সোজা কিন্তু অফিস পালানো বড় কঠিন। সাড়ে পাঁচটা বাজলেই পড়িমরি করে ছুটে এসে আমার বাইকের পেছনে বসে পড়তো। পার্ক স্ট্রিটের কোনার রোলের দোকান থেকে দুইজনে দুটো এগ রোল কিনতাম তারপরে সোজা গঙ্গার ঘাটে এসে বসতাম। সারাদিনের অফিসের কথা, কার সাথে কি হলো, কে লাইন মারতে চেষ্টা করলো, কে টিটকিরি মারলো এইসব নিয়ে হাসাহাসি চলতো। সন্ধ্যের পরে ওকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম।
কলেজ ছাড়ার পরে অনুর হলো সব থেকে বেশি অসুবিধে, কার সাথে বেড়াতে যাবে, দেবু ধানবাদে। দেবু কোলকাতা থাকলে আমি ওকে নিয়ে কলেজে চলে আসতাম আর সেদিন দেবুর সাথে ঘুরতে বেরিয়ে যেতো।

সেদিন সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু। ছন্দা সরাসরি কোনোদিন আমার বাড়িতে ফোন করতো না, অনুকে ফোন করতো আর যা খবরাখবর সেটা অনু আমাকে জানিয়ে দিতো। সেদিন অনু আমাকে ফোন করে বলল যে ছন্দা আমাকে দুপুরের পরে ওর অফিসের নিচে থাকতে বলেছে। কপাল খারাপ সেদিনেই আমার বাইক খারাপ হয়ে গেল, কি করি যেতে হবেই ওদিকে মাথার ওপরে কালো মেঘ কিন্তু মেঘের তোয়াক্কা কে করে। আমি কোনোদিন ছাতা নিয়ে বের হতাম না। সেই সময়ে কোলকাতার বাতাসে এত ধুলো বালি ছিল না তাই আমার ওই বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগতো। বৃষ্টিতে ভিজলে বাড়িতে যত না বকা খেতাম তার দশগুন মার খেতাম ছন্দার হাতে। ওই নরম হাতের চাঁটি খেতে আমার খুব ভালো লাগতো। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আর ঠিক লাঞ্চের পরেই ওর অফিসে পৌঁছে গেলাম।

ছাতা বিহীন আমাকে দেখে ক্ষেপে গেল ছন্দা, “তোমাকে কতবার বলি বর্ষাকালে ছাতা নিয়ে বের হবে কিন্তু তুমি কিছুতেই আমার কথা শুনবে না।” এদিক ওদিক দেখে আমার বাইক দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করল, “বাইকের কি হয়েছে? টায়ার পাংচার না ইঞ্জিন গেছে? এবারে কত টাকার ধাক্কা? স্টাইপেন্ড যা পাও সব তো সিগারেটে শেষ করেছো মনে হয়।”

আমি মাথা চুলকে অপরাধীর মতন বললাম, “পেট্রোল ট্যাংকে কিছু প্রবলেম হয়েছে গ্যারেজে দিয়ে এসেছি।”

আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলের মধ্যে বিলি কেটে বলল, “কাক ভিজে হয়ে গেছো এ অবস্থায় আর কোথায় যাবে?”

আমি হেসে বললাম, “বাঃরে এই বৃষ্টিতে তোমার সাথে ভিজবো বলে এসেছি।”

আমার বাজু ধরে মিষ্টি হেসে বলে, “ভিজবো বলেই তো তোমাকে ডাকা। সকালে কালো মেঘের ভেলা দেখে মনে হল দুইজনে একটু ভিজি। ভেবেছিলাম তোমার পেছনে বাইকে বসে সারা কোলকাতা ঘুরবো সেটা তাহলে আর হলো না।”

আমি এদিক ওদিক দেখে টুক করে ওর গালে টোকা মেরে বললাম, “বাইক নেই তো কি হয়েছে, দুই পা আছে আর আছে এই রাস্তা। দুইজনে হেঁটে হেঁটে ভিজবো।”

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম এক ছাতার নিচে। পায়ের নিচে ময়দানের সবুজ ঘাসে ঢাকা জাজিম, দুইজনেই জুতো খুলে বৃষ্টির জলে ভেজা মাটির ওপরে ছপাং ছপাং করে হেঁটে গেলাম কিছুক্ষণ। খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বারেবারে পিছিল খাচ্ছিল তাই আমার হাতখানি শক্ত করে ধরেছিল। একবার টাল সামলাতে না পেরে আমার গায়ের ওপরে পড়ে গেল আর টুক করে আমি ওর গালে চুমু খেয়ে নিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে মুখ লাল হয়ে গেল আর আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেল পার্থ, এইভাবে খোলা জায়গায় কেউ চুমু খায়?”

আমি বললাম, “কেউ কি আমাদের দেখেছে চুমু খেতে যে তুমি এত রেগে যাচ্ছো?”

আমার দিকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “ওই দূরে বাসে বসা লোকগুলো দেখছে আমাদের।”

আমি ওর কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে বললাম, “দেখলো তো কি হয়েছে, আমি কি ওদের বউদের চুমু খেয়েছি নাকি? আমি নিজের প্রেমিকাকে চুমু খেয়েছি তাতে ওরা বলার কে?”

একটা গাছের তলায় একটা চিনে বাদাম ওয়ালা দাঁড়িয়ে ছিল, তার কাছ থেকে এক ঠোঙা চিনে বাদাম কিনে চিবোতে চিবোতে আউট্রাম ঘাটের দিকে পা বাড়ালাম। পথে যেতে যেতে ছন্দা আমাকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো, আমি বললাম যে সবাই ভালো আছে সেই সাথে অনুর কথা বললাম, ও একদম ঘর বন্দি হয়ে হাঁসফাঁস করছে। তার চেয়ে ভালো হতো যদি আমাদের সাথে এম টেক করতে ঢুকতো অথবা কোথাও চাকরি করতো।

আউটট্রাম ঘাটে এসে বসার জায়গা খুঁজে পেলাম না, গঙ্গার পাড় ভিজে, বেঞ্চ ভিজে, ঘাট ভিজে। ছন্দা বায়না ধরল নৌকায় চাপবে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এই বৃষ্টিতে নৌকায় চেপে কোথায় যাবে? ছন্দা বলল নৌকায় চেপে হাওড়া যেতে চায়, বেশ রোমান্টিক ব্যাপার হবে। ঘাটের কাছে সারি সারি নৌকা বাঁধা, দুই ভিজে কপোত কপোতি দেখে মাঝি দর হাঁকলো দশ টাকা লাগবে। আমি জানতাম কি কারনে মাঝি দশ টাকা হেঁকেছে, জোড় বেঁধে কপোত কপোতি আসে এখানে আর নৌকার ছাউনির তলায় উদোম হয়ে প্রেম লীলা খেলে। ছন্দা ওদের জানিয়ে দিল পাঁচ টাকার এক পয়সা বেশি দেবে না, যাবে তো শুধু এপার থেকে ওপার তাতে আবার দশ টাকা কেন? শেষ পর্যন্ত ছয় টাকায় এক মাঝি আমাদের গঙ্গা পার করতে রাজি হল। নৌকায় উঠেই ছন্দা ছাতা বন্ধ করে দিল, আমি ওকে জিজ্ঞেস করাতে বলল মাঝ গঙ্গায় নৌকা দাঁড় করিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে।

আমি ওকে বললাম, “যখন আমি ভিজি তখন আমার ওপরে চোটপাট করতে ছাড়ো না এখন কি হয়েছে?”

ছন্দা আমার গলা জড়িয়ে বলল, “উম্মম প্লিস এই রোমান্টিক মুড নষ্ট করে দিও না, তোমার সাথে এই বৃষ্টিতে ভিজতে বড় ভালো লাগছে।”

নিচে ঘোলা জল, মাথার ওপরে কালো মেঘ আর পাশে ভিজে জলপরী। গায়ের শাড়িটা সারা অঙ্গের সাথে লেপ্টে গেছে তাতে ওর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, মাঝ গঙ্গায় নৌকা দাঁড় করিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভিজলাম দুইজনে। আমার সাথে একটা ক্যামেরা থাকলে সেই অপূর্ব দৃশ্য সেদিন ক্যামেরা বন্দি করে রাখতাম তবে হৃদয়ে আঁকা ছবির কাছে সেই ছবি ম্লান।

আমি ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললাম, “সত্যি তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে আজকে।”

আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যাঁ হয়েছে সত্যি সত্যি আমার মাথা খারাপ হয়েছে। আমি ভালো মেয়েই ছিলাম তুমি এসে আমার যা কিছু ছিল সব কেড়ে কুড়ে নিয়ে পাগল করে দিয়েছ।”

সেদিনের বৃষ্টি ভেজা আর মাঝ গঙ্গায় নৌকার মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা এখন বুকে আঁকা রয়েছে।
 
(১১)

ভিজে ভিজে ওই পারে গিয়ে বাস ধরলাম বেহালা আসার জন্য। হাওড়া ব্রিজ পার হতেই ছন্দা আমার হাত ধরে বাস থেকে টেনে নামিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার কি হয়েছে?

আমার হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ নিজের বুকে চেপে আদুরে কন্ঠে বলল, “আজকে না বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না আমার।”

আমি আঁতকে উঠে বললাম, “তুমি পাগল হয়েছ নাকি? কোথায় যাবে?”
একটুখানি নেচে নিয়ে বলল, “তোমার সাথে এই কোলকাতার রাস্তায় আজ ঘুরে বেড়াবো।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা এখন কি করতে চাও?”

ও বলল, “হেঁটে কলেজ স্ট্রিট যাই চলো, অনেক দিন কফি হাউসে বসে আড্ডা মারিনি।”

এক ছাতার তলায় হেঁটে হেঁটে বড়তলা স্ট্রিট, চারপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে টানা রিক্সা আর রিক্সাওয়ালা গুলো পাশের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমি ছন্দাকে বললাম যে হেঁটে যেতে, ছন্দা একবার আমার দিকে দেখল একবার ওই ভিজে রিক্সা গুলোর দিকে দেখে আবদার করল যে ওই টানা রিক্সায় চাপবে। শেষ পর্যন্ত দুইজনে মিলে টানা রিক্সায় চাপলাম। রিক্সা ওয়ালা ভাড়া চাইল তিন টাকা, ছন্দা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। ভিজে রাস্তার ওপর দিয়ে ভিজতে ভিজতে সেই লোকটা রিক্সা টানতে টানতে আমাদের কলেজ স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত নিয়ে গেল। যাওয়ার পথে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দেখতে পেয়েই ঢিপ করে একটা প্রনাম ঠুকে নিল।

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করাতে উত্তর দিল, “যা বাবা এনাকে ভুলে গেলে কি করে হবে। ওই ছোটবেলার সহজ পাঠের - ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া; এর মধ্যেই ভুলে গেলে? ওই জন্যই আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি।”

আমি হেসে দিলাম, ওর ধরন দেখে, সত্যি মেয়েটা পারেও বটে। রিক্সা থেকে নেমে ছন্দা পার্স থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। লোকটা বলল যে ওর কাছে খুচরো পয়সা নেই, ছন্দা ওকে টাকাটা রেখে দিতে বলল।

আমি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল, “ওর বাড়িতে নিশ্চয় একটা বৌ আছে আর আছে চার পাঁচটা বাচ্চা কাচ্চা। এই বৃষ্টিতে এরপরে আর কোন যাত্রী পাবে কিনা সন্দেহ আছে। ওর ছেলে মেয়েরা নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে কখন ওদের বাবা আসবে আর ওদের জন্য কিছু নিয়ে আসবে। আমি ওই বাচ্চাদের মনের কথা বুঝি কারন এক সময়ে আমিও আমার বাবার জন্য ওই রকম হাপিত্যেস হয়ে বসে থাকতাম।”

কথাটা আমার বুকে বড় বেজে উঠল, নারী তোমার এই অঙ্গে কত রুপ। ছন্দা হারায়নি তবে এই তিলোত্তমা হারিয়ে গেছে। কফিহাউসে বসেই আমাদের ভিজে কাপড় শুকিয়ে গেল। কোলকাতায় আমরা শুধু তিনজনে পড়ে রইলাম, বাকিরা সব দূরে দূরে। দেবুর সাথে মাসে একবার দেখা হতো, কোন মাসে হতো না। দিল্লী যাওয়ার পরে নবীনের সাথে বার তিনেক দেখা হয়েছিল, ও আর সেই আগেকার রোগা পটকা নবীন নেই, দিল্লী গিয়ে বেশ ফুলে গেছে। পচার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো গুজরাটে গিয়ে কোন গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে, শ্যামলীর বিয়ের পরে ওর সাথে একবার শুধু মাত্র কথা হয়েছিল আর হয়নি। কে আই এস ডি করবে আর গল্প করবে?
কফি হাউসে বসে ছন্দা বলল একবার কোথাও বেড়াতে গেলে কেমন হয়? হটাৎ ওর ভাবের এই পরিবর্তনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে চায়। চাকরি পাওয়ার পরে ওর ভাইকে দেওঘরের বেশ নামকরা এক মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল, সেখানে যেতে চায়। আমি বলাম বেশ, কিন্তু ওই বৈদ্যনাথ ধামের কথা শুনেই একটু বেঁকে গেলাম, সেই মন্দির আর মন্দির আর ছন্দার চটি খুলে ঢিপ করে প্রনাম করার কথা মনে পড়ে গেল। আমার চেহারা দেখে মনের ভাব বুঝতে ওর একটুকু সময় লাগলো না। আমি এই ভেবে রাজি হয়ে গেলাম যে এবারে একসাথে বেশ কয়েকদিন একসাথে কাটানো যাবে। তখন বাঙালির বেড়াতে যাওয়া মানে দার্জিলিং, সিমলা কুল্লু মানালি, সমুদ্র সৈকত বলতে পুরী ম্যাড্রাস কন্যাকুমারী, আমি কোনোদিন দেওঘর যাইনি ছন্দার দৌলতে যাওয়া।

ঠিক হল যে পুজোর ছুটির পরে নভেম্বরের মাঝের দিকে আমরা দেওঘর বেড়াতে যাবো। নভেম্বরে কোলকাতায় বিশেষ ঠাণ্ডা না পড়লেও দেওঘরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। ওইদিন কফিহাউসে বসে পরিকল্পনা করার পর থেকে আমার চোখে আর ঘুম নেই, যখনি ছন্দার সাথে দেখা হয় তখনি ওকে শয়তানি করে বলি, এক কামরায়, এক বিছানায় এক লেপের নিচে ওকে আমি ছিঁড়ে খাব। সেই শুনে বলতো যে একটা রামপুরি চাকু সাথে নিয়ে যাবে নিজের আত্মরক্ষা করার জন্য। প্রেমের আগুন দুইদিকেই সমান ভাবেই লেগেছিল। ছন্দার বিশেষ অসুবিধে হল না, বাড়িতে বলল এক বন্ধুর সাথে ভাইয়ের কাছে যাবে। আমিও সেই মতন বাড়িতে জানালাম যে কয়েক দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি, কার সাথে যাচ্ছি সে সব আর বলার দরকার পড়ল না।

ট্রেন রাত দশটায়, আমি আটটায় হাওড়া পৌঁছে গেছিলাম, কথা ছিল বড় ঘড়িটার নিচে আমি দাঁড়িয়ে থাকব। একটা সিগারেট ধরালাম আর চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রঙ বেরঙের শাল সোয়েটার জ্যাকেট পরা মানুষ এদিক ওদিকে চলাফেরা করছে। একটু বাদে ছন্দাকে দেখলাম, শালোয়ারের ওপরে একটা লম্বা সোয়েটার আর গলায় একটা শাল জড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আমি কাছে গিয়ে ওর হাতের থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। আমার কাছে একটা ছোট ব্যাগ ছিল দুই জোড়া জামাকাপড় আর দুটো জ্যাকেট কিন্তু মেয়েদের ব্যাগে পুরো সংসার যায় তাই ছন্দার ব্যাগের আকার আমার চেয়ে তিনগুন বড়।

লোকের ভিড় ঠেলে ব্যাগ কাঁধে প্লাটফরমের দিকে হাঁটা দিলাম। বিহারের ট্রেন, প্লাটফরম যেন জনসমুদ্র। ট্রেন দিতে না দিতেই ঠ্যালা ঠেলি শুরু, এটা অবশ্য আমার পক্ষে নতুন নয়। ছন্দা গজগজ করতে করতে আমার পেছনে কোন রকমে লুকিয়ে পড়ল। সেই সময়ে খুব বড়লোক ছাড়া মধ্যবিত্তরা এসিতে উঠতো না, আমরাও সেকেন্ড ক্লাসে রিসারভেসান করিয়েছিলাম। আমি ওকে বললাম যে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়াবে, ভিড় কমার পরে আমরা ট্রেনে উঠলাম। উঠে দেখি প্রায় পঙ্গপালের মতন একটা পরিবার আমাদের সিট দখল করে বসে, একটা বুড়ো, একটা মাঝ বয়সি লোক তার বউ, চার খানা বাচ্চা কাচ্চা। ওদের সঙ্গের মালের কোন সিমানা নেই, তিনটে বস্তা, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, দুটো কাপড়ের পুঁটুলি মার্কা ব্যাগ। আমি আমাদের সিট দেখিয়ে বললাম যে এই দুটো আমাদের সিট। বৌটা একটু সরে গিয়ে ছন্দাকে বসতে জায়গা দিল, যেন আমরা ওদের কাছে সিটে বসার জন্য ভিক্ষে চেয়েছি। ওই দেখে ছন্দার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।

ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে তেড়ে উঠল, “এই সিট আমাদের হ্যায়, পয়সা দেকে রিসার্ভ করা হ্যায় বিনা পয়সায় যাতা নেহি।”

বউটা কি বুঝল কি বুঝল না জানিনা হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছন্দা এক টানে সিটের ওপর থেকে ওদের মালপত্র গুলো নিচে ফেলে দিল সঙ্গে সঙ্গে সাথের যে লোকটা ছিল সে তেড়ে ফুঁড়ে উঠল। আমি লোকটাকে ওর টিকিট দেখাতে বললাম, লোকটা টিকিট দেখালো। ওদের জেনারেল কম্পারটমেন্টের টিকিট আমি ওদের ওইখান থেকে নেমে যেতে বললাম, সে লোক কিছুতেই বুঝতে চায় না, টিকিট কেটেছে আলবাত যাবে।

ছন্দা ওকে তেড়ে বলল, “তুম লোগ কে মুন্ডি মে কিছু নেই, খোট্টার জাত এখুনি না নামলে আমি টিটি বুলায়গা।”

আমি বুঝতে পারলাম যে এদের সাথে বচসা করে লাভ নেই। রাগে গজগজ করতে করতে বউটাকে ঠেলে দিয়ে ছন্দা জানালার কাছে গিয়ে বসে পড়ল আর আমাকে টেনে ওর পাশে বসিয়ে দিল। ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়লো আর বর্ধমানে টিটি উঠল।

ছন্দা তো টিটিকে তেড়ে ওঠে, “যাত্রী ওঠানোর সময়ে আপনাদের দেখা উচিত কার রিসারভেসান আছে আর কার নেই। এখুনি ওদের নামিয়ে দিন না হলে আমি স্টেসান মাস্টারের কাছে যাবো।”

টিটি হেসে বলল, “ম্যাডাম এত লোকের টিকিট চেক করে তো আর ওঠানো যায় না, তাহলে ট্রেন ছাড়তেই সকাল হয়ে যাবে।”

ওদেরকে বর্ধমানে নামিয়ে দিল টিটি। বর্ধমান ছাড়ার পরে দেখলাম যে ট্রেন বেশ খালি, কম্পার্টমেন্টে লোকজন বিশেষ নেই। আমাদের ওই ছয়জনার কুপে শুধু মাত্র দুইজনেই ছিলাম, তাতে আমাদের বেশ সুবিধে হল একটু একত্রে থাকার। ছন্দা বেশ কয়েকবার দেওঘর গেছে আর প্রত্যেকবার এই রকম কিছু না কিছু ঘটেছে। ট্রেন দুলকি চালে চলতে শুরু করল। ছন্দা বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে এনেছিল লুচি আর আলুর তরকারি, খবরের কাগজ পেতে খাওয়া দাওয়া সেরে বার্থ নামিয়ে শুয়ে পড়লাম। আসানসোল থেকে আরও কয়েকজন উঠল।

আমি চোখ বন্ধ করতে যাবো কি ছন্দা ধড়মড় করে আমাকে উঠিয়ে বলল একটু পরেই নাকি জসিডি এসে যাবে। যাঃ বাবা যাও বা একটু চোখ লেগেছিল তাও কেটে গেল।

সূর্যি মামা পুবদিক থেকে কোন রকমে উঁকিঝুঁকি মারছে আর সেই সময়ে আমরা নেমে পড়লাম জসিডিতে। জসিডিতে নামতেই ছ্যাঁক করে ঠাণ্ডা আমাদের চেপে ধরল। আমি আমার জ্যাকেটটা আরও জড়িয়ে ধরলাম আর ছন্দা শালটা বার করে ওর সোয়েটারের ওপরে চাপিয়ে নিল। ছন্দা জানাল সেখান থেকে কয়লার ইঞ্জিনের ছোট লাইনের অন্য একটা ট্রেন ধরে দেওঘর যেতে হবে। ওই ছোট ট্রেনে উঠলাম, সেখানে রিসারভেসানের কোন বালাই নেই, বেশির ভাগ যাত্রী বিনা টিকিটের। যাই হোক ঠেলে মেলে জায়গা করে সেই ছোট ট্রেন করে দেওঘর যাওয়া হল। স্টেসানে নামতেই এক গাদা হোটেল ওয়ালা, টাঙ্গা ওয়ালা আর বৈদ্যনাথ ধামের পান্ডা ছেঁকে ধরলো। ছন্দা পটীয়সী মহিলার মতন আমার হাত ধরে ওদের বাঁচিয়ে বেরিয়ে চলে এলো।

একটা এক ঘোড়া টানা টাঙ্গায় চেপে একটা হোটেলের নাম করে বলল সেখানে নিয়ে যেতে। সে এক অদ্ভুত অনুভুতি, ভোরের আকাশ হাল্কা রোদে মাখা, খালি রাস্তা আর চারপাশে কুয়াশা ভরা সকাল আর আমার কোল ঘেঁসে ছন্দা বসে। কোথাও বেশ কয়েকজন লোক আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছে, সেই কাঠের ধুঁয়োর গন্ধে এক অদ্ভুত গন্ধ। পথের দুপাশে উঁচু উঁচু সারবাঁধা ইউকেলিপ্টাস গাছ, নিম গাছ ইত্যাদি।

পথে যেতে যেতে আমাকে বলল, “ভাইয়ের স্কুলে গেস্ট হাউস আছে তবে সেখানে একসাথে থাকাটা একটু দৃষ্টিকটু লাগবে তাই আমরা একটা হোটেলে উঠবো।”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললাম, “মা তারা তুমি আমাকে যেখানে ফেলবে সেখানেই দেহ রাখবো।”

আমার ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, “ছিঃ দেহ রাখার কথা একদম বলতে নেই।”

শহরের ভিড় ছাড়িয়ে একটু তফাতে এক নিরিবিলি জায়গায় আমাদের হোটেল। খুব বড় না হলেও বেশ ছিমছাম, হোটেল দেখে ছন্দা বেশ খুশি, কিন্তু বাঙালি মেয়ে একটু খুঁতখুঁতে না হলে চলে না। রুমে ঢুকেই ছেলেটাকে বলল যে বিছানার চাদর বদলে দিতে। ছেলেটা যত বুঝাতে চায় যে বিছানার চাদর পরিষ্কার কিন্তু ছন্দা সে কথা মানতে নারাজ। একটানে চাদর সরিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে বলল এখুনি যদি চাদর না বদলায় তাহলে হোটেল থেকে চলে যাবে। অগত্যা কি করে একটা নতুন চাদর এনে পেতে দিল। সেই সাথে বালিশের ওয়াড় বদলে দিল। আমি চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে শুধু ছন্দাকে দেখে গেলাম।
 
(১২)

ছেলেটা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেকদিন পরে কাছে পেয়েছি তাও আবার একেবারে নিজের করে, এখানে বাধা দেওয়ার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই শুধু মাত্র দুইজনে এক কামরায়।

ছন্দা আমার হাতের ওপরে হাত রেখে আলিঙ্গন আরও নিবিড় করে সোহাগ ভরা কণ্ঠে বলল, “প্লিস ছেড়ে দাও না হলে কিন্তু কামড়ে দেবো, সত্যি বলছি।”

আমিও বদমাশি করে ওর নরম গালে আমার না কামানো গাল ঘষে দিলাম, “উম্মম এবারে সম্পূর্ণভাবে একা পেয়েছি আর ছাড়ছি না কোন মতেই।”

এই ঠাণ্ডার মধ্যেও আসন্ন উত্তেজনায় বুকের রক্ত চনমন করে ওঠে ছন্দার। আমি দুইহাতে ওর পেলব দেহ পল্লব জড়িয়ে ধরলাম, মনে হল যেন ও গলে যাবে আমার বাহু বেষ্টনীর মাঝে। ছন্দা কেঁপে উঠল আমার প্রগাড় আলিঙ্গনে, ধিরে ধিরে আমার বাঁ হাত ওর সুগৌল উদ্ধত কুচের নিচে উঠে এলো আর আর ডান হাতটি নেমে গেল নরম গোল তলপেটের ওপরে। ঠোঁট নামিয়ে আনলাম ওর মসৃণ মরালি গর্দানে, আলতো করে ভিজে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই কেঁপে উঠল ললনা। আমার ধমনীতে লেগেছে প্রেমের আগুন আর সেই আগুন ওর শরীরে ছড়াতে বেশি সময় নিল না। এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় ছন্দার সারা শরীরে। দুই হাত আমার হাতের ওপরে দিয়ে বাহুবেষ্টনীকে আরো চেপে দেয় নিজের শরীরের ওপরে। আমি ওর কামিজের ওপর দিয়েই অল্প অল্প করে নাভির নিচের নরম নারীমাংসে আদর করতে শুরু করে দিলাম। নিজের অজান্তেই আমার বাহু বেষ্টনী বজ্র কঠিন হয়ে গেল, এইবারে দুই হাতে যেন পিষে ফেলবে ওকে। নভেম্বরের ঠাণ্ডা আর দুই তৃষ্ণার্ত কপোত কপোতীকে আলাদা করে রাখতে পারেনা। ছন্দার বুকের মাঝে, হারিয়ে যাওয়ার এক লেলিহান শিখা ধিকি ধিকি করে জ্বলে ওঠে। মাথাটা পেছনের দিকে হেলিয়ে দেয়, আমার দাড়ি না কামানো গালে গাল ঘসতে থাকে। প্রেমের ঘর্ষণে নরম গালে অগ্নিস্ফুলিঙ্গর আবির্ভাব হয়। আমাদের মাঝে একটি সর্ষে দানা রাখলে যেন তেল বেরিয়ে আসবে, এমনভাবে এক জন আর একজনের সাথে আঠার মতন মিশে গেলাম।

আধবোঝা নয়নে, প্রেমঘন কাঁপা গলায় ছন্দা বলে ওঠে “জানো আমি ভাবতে পারছি না যে আমরা সত্যি এখানে একসাথে।”

সত্যি সেটা আমিও ভাবতে পারছিলাম না যদি না ও আমার গালে একটা হাল্কা আদরের কামড় বসিয়ে দিতো। আমি ওর ঘাড়ে গর্দানে কানের লতিতে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলাম। ছন্দার বুকের উষ্ণ রক্ত ত্বকের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়ার ফলে ওর দুই বুকে অন্তহীন সমুদ্রের ঢেউ খেলতে শুরু করে।

প্রেমঘন আপ্লুত কণ্ঠে বললাম, “ছন্দা আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

গালে গাল ঘসতে ঘসতে, ছন্দা মিহি স্বরে প্রেম নিবেদন করল, “তোমাকে ছাড়া আর কোথায় যাবো সোনা? জানো কফি হাউসে বসে প্ল্যান করার পরের দিন থেকেই আমার রাতের ঘুম ছিল না, কবে তোমার কাছে যাবো এই ভেবে।”

উত্তেজনায় আমার সিংহ কেশর ফুলিয়ে দিল আর নিটোল নিতম্বের খাঁজের মাঝে আমার সিংহের স্পর্শানুভুতি পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে ছন্দা। ক্ষিপ্ত সিংহ কেশর ফুলিয়ে কোমল নিটোল নিতম্ব মাঝে বিঁধে গেছে।

আমি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কিছুতেই তোমাকে ছাড়ছি না, এবারে পিষে ফেলব।”

আমার পৌরুষত্বের ছোঁয়া পেয়ে কিঞ্চিত উত্তেজিত হয়ে উঠল সেই সাথে সেটা দমিয়ে নিয়ে বলল, “আমার ওপরে একটু দয়া করবে না? সারা রাত ট্রেনে এসে জামা কাপড় নোংরা হয়ে গেছে দয়া করে স্নান সারতে দাও।”

ধিরে ধিরে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আর হটাৎ দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল আমার বুকের ওপরে। তারপরে খিলখিল করে হেসে উঠে আমার বাহুপাশ ছাড়িয়ে মুখ ভেঙিয়ে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। অগত্যা আর কি করি, একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রেমিকার অপেক্ষা করতে থাকলাম।

স্নান সেরে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো, আমি ওর ওই রুপ দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। ছন্দা বড় লজ্জা পেয়ে আমাকে বকা দিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিতে বলল। ওর দিকে দুই পা এগোতেই পালিয়ে গেল। আমি দাড়ি কাটার রেজর ব্লেড আর আমার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। বাথরুমে আলো কম তাই দাড়ি কাটার সময়ে আর দরজা বন্ধ করিনি।

আমি দাড়িতে সাবান লাগিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করলাম কি করছে। স্নান সেরে ললনা নীলাম্বরী হয়ে সেজে, পরনে হাল্কা নীল রঙের শাড়ি। ভিজে চুল পিঠের ওপরে এলো করা, সারা দেহ থেকে এক মিষ্টি গন্ধ নির্গত হচ্ছে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমার খালি ছাতি দেখে থমকে আমার দিকে চেয়ে রইল ক্ষণিকের জন্য তারপরে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। আমি ওকে দেখে চোখ মেরে ইশারায় বললাম যে একদম মার কাটারি লাগছে, পথে বের হলে মানুষ ওকে দেখবে আর হোঁচট খাবে। আমি ওর কাছে এসে দুষ্টুমি করে ওর নাকের ওপরে ফেনা মাখিয়ে দিলাম।

একটু রাগের ভান করে ছন্দা বলল, “ধুত, কি যে করো না তুমি, সাজটাই নষ্ট করে দেবে।”

এই বলে নাকটা আমার অনাবৃত বাজুর ওপরে মুছে নিল। নাক মুছতে গিয়ে নিজের অজান্তে, সুগৌল উদ্ধত কোমল বক্ষ আমার বাজুতে লেগে গেল। আঁচলে ঢাকা নরম কুচের স্পর্শে আমার শরীর গরম হয়ে যায়। ছন্দা, আমার দেহের বেড়ে ওঠা উত্তাপ বুঝতে পেরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কোমরে একটা দুলুনি দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার দিকে চলে যায়।

যাবার আগে আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয় “কালকেই তো দাড়ি কেটে বেরিয়েছো, এখন আবার দাড়ি কামাতে গেলে কেন?”

আমিও কম যাই না, সুন্দরী কপোতীর উত্তর জুতসই দিতে হয়, “তোমার ওই গোলাপি গালে গাল ঘষে মনে হল তোমার কিছুটা আমার গালে লেগে গেছে তাই সেগুলো উঠানোর জন্য দাড়ি কামাচ্ছিলাম।”

লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় ছন্দার, “এক চড় মারব এবারে, তাড়াতাড়ি স্নান করো মন্দির যেতে হবে।”

উফফফ বাঃবা আবার সেই মন্দির। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বেরিয়ে এলাম। ছন্দা ততক্ষণে গায়ের ওপরে একটা গাড় নীল রঙের ওভারকোট চাপিয়ে নিয়েছে আর সেই সাথে গলায় একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছে। আমি জামা কাপড় পরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে হবে এবারে। ছন্দা বলল, বৈদ্যনাথ ধামের মন্দিরে আগে পুজো দেবে তারপরে খাওয়া দাওয়া করবে। সেখান থেকে অনুকুল ঠাকুরের আশ্রম দেখতে যাবো এবং বিকেলে সত্যজিতের স্কুলে যাবো।

হোটেল থেকে বেরিয়ে আবার সেই টাঙ্গা চেপে মন্দিরের কাছে এলাম। দেওঘরে প্রচুর সংখ্যক বাঙালি। একসময়ে মধুপুর, দেওঘর, রাঁচি এইসব জায়গায় বড়লোক বাঙালিদের বাগান বাড়ি থাকতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেই বাগান বাড়িগুলো অনেকে বিক্রি করে দিয়েছে অথবা বেহাত হয়ে গেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। সরু অলিগলি পেরিয়ে লোকজনের ভিড় ঠেলে মন্দিরে পৌঁছালাম। বিশাল মন্দির প্রাঙ্গন লোকে লোকারণ্য, শিবের মন্দিরে দর্শন করার জন্য লম্বা লাইন। লাইন দেখে আমি ভিরমি খেলাম, লাইন দিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে রাজি, যাত্রা পালা দেখতে রাজি কিন্তু... ছন্দা চোখ পাকিয়ে আমাকে চুপচাপ ওর পাশে দাঁড়াতে বলল। এর মাঝে আবার পাণ্ডাদের উৎপাত, পুজো করিয়ে দেবে একদম সাক্ষাৎ বিগ্রহ দর্শন করিয়ে দেবে।

ছন্দা ওদের কথায় কোন কান দিল না, ওদের বলল, “ঠাকুর পুজো আমি দেবো আমার মতন করে, সেখানে মন্ত্রের কি দরকার, কারুর মধ্যস্ততা করার কি দরকার?”

প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করে শেষ পর্যন্ত দর্শন মিললো। একটা অতি ক্ষুদ্র দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম একটা অতি ক্ষুদ্র গর্ভ মন্দিরে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে শিবের মূর্তি কোথায়? ছন্দা আমাকে মেঝের মাঝে একটা কালো পাথর দেখিয়ে বলল, “ওই যে শিব লিঙ্গ।” চারপাশে যা লোকের ভিড় আর চিৎকার চেঁচামেচি তাতে কি আর শান্তি করে পুজো দেওয়া যায়? কিন্তু ছন্দার দেওয়া চাই, আমি ওকে দুই হাতে আগল করে একপাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। ডালিতে আনা ফুল বেল পাতা জল দিয়ে পুজো দিল। এর মাঝে একটা পান্ডা আবার আমার কপালে আর ছন্দার কপালে সিঁদুরের তিলক কেটে দিল।

ওইখান থেকে কোন রকমে বেঁচে বেরিয়ে ওকে বললাম, “আর যদি কোন মন্দিরে আমাকে ঢুকিয়েছ...”

হেসে আমাকে বলল, “দেখে শুনে প্রেম করতে পারতে তাহলে এই সমস্যা হতো না।”

আমি বললাম, “কলেজে পড়ার সময়ে জানতাম না যে তুমি পাথর দেখলেই পেন্নাম ঠুকবে।”

অভিমানিনীর মানে লেগে গেল, “এখন সময় আছে, অন্য মেয়ে খুঁজে নিতে পারো।”

আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, “যা বাবা, এইটুকু ঠাট্টা করতে পারবো না?”

আমার বাজুতে চিমটি কেটে বলল, “যা খুশি নিয়ে ঠাট্টা করো কিন্তু আমার ঠাকুর আমার বিশ্বাস নিয়ে একদম নয়।”

সেদিনের পর থেকে কোনোদিন ওর পুজো অর্চনা নিয়ে কিছু বলিনি। সেদিনের কথায় আমি বুঝেছিলাম কারুর বিশ্বাসে কোনোদিন আঘাত হানতে নেই। বিশ্বাসের জোরে এই পৃথিবী চলে, মানুষ পরস্পরকে ভালবাসে। তারপরে ছন্দা অবশ্য আমাকে, প্রনাম করতে অথবা মন্দিরে যেতে বিশেষ জোরাজুরি করতো না তবে ওর মন রাখতে আর বিশ্বাসের জন্য ওর সাথে যেতাম।

মন্দির প্রাঙ্গনে আরও দেব দেবীর ছোট ছোট মন্দির, সব বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে প্রনাম করল। পুজো সেরে মন্দির থেকে বের হতে আমাদের দুপুর হয়ে গেল। ছন্দা বলল আর অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমে যাবে না, খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে ভাইয়ের স্কুলে যেতে হবে।

মন্দির থেকে বেরিয়ে অলিগলি পেরিয়ে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এসে বলল, “এখানের রসগোল্লা খেয়ে দেখ, ওই কোলকাতার রসগোল্লাকেও হার মানিয়ে যাবে।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাই নাকি?”

অবন্তিকা নাম ছিল ওই মিষ্টির দোকানের, আজও আছে ওইখানে দাঁড়িয়ে, পুরানো নতুন যারাই যায় একবার অবন্তিকার রসগোল্লা খায়। আমরাও পুরি আর ছোলার ডাল খেয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হোটেলে যাওয়ার পথে দেওঘরের ইতিহাস আমাকে শুনালো, অত ধার্মিক আমি কোনোদিন ছিলাম না তাই মন দিয়ে শুনলাম ওর গল্প। ভাইকে ভর্তি করতে এসে নন্দন পাহাড়, ত্রিকুট পাহাড়, তপোবন আরো অনেক জায়গা ঘুরে এসেছে। কিন্তু সব জায়গায় মন্দির তাই ছন্দা আর আমাকে জোর করলো না। তবে আমরা ঠিক করলাম যে একবার দেওঘরের আশেপাশের জায়গাও ঘুরে দেখে নেব, পারলে ম্যসাঞ্জোর ড্যাম দেখে আসা যাবে।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের আগেই আমরা রওনা দিলাম মিশন স্কুলের দিকে। পথে যেতে যেতে সেই মিশনের কথা আমাকে বলল। বিশাল লোহার গেটের সামনে আমাদের নামতে হল। গেটের ভেতরে ঢুকতেই মনে হল এক অন্য জগতে এসে গেছি। সোজা একটা রাস্তা সদর গেট থেকে মন্দির পর্যন্ত, একটু ভালোভাবে তাকালে এমন কি মন্দিরের ভেতর পর্যন্ত দেখা যায়। চারপাশে বড় বড় খেলার মাঠ, এক পাশে স্কুল, আর মন্দিরের চারদিকে ছড়িয়ে ছেলেদের থাকার ধাম। আমরা যখন স্কুলে পৌঁছেছিলাম তখন ওদের স্কুলের ছুটি হয়েছিল। এক রঙের ড্রেস পরা অতগুলো ছেলে কিলবিল করে স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। আমি ভাবলাম এদের মধ্যে ছন্দার ভাইকে কি করে খুঁজে পাওয়া যাবে। ছন্দা ঠিক ওর ভাইকে খুঁজে বের করল আর দিদিকে দেখে সত্যজিত দৌড়ে এলো। সেই প্রথম ওর সাথে দেখা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো। ঠিক যেমন ভাবে বড়দি আমাকে স্কুল যাওয়ার আগে জামা প্যান্ট ঠিক করে মাথা আঁচড়ে দিতো ঠিক সেইভাবে ওর ওই চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে আঁচড়ে দিল।

ছন্দা আমাকে সত্যজিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এত দুষ্টু ছেলে, মিচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি তো টুক করে দিদিকে নিয়ে পালাবে আর আমি কি করব?”

ছন্দা ওকে মৃদু বকে বলল, “হ্যাঁ তুই খুব পেকে গেছিস তাই না।” ব্যাগ খুলে ওর জিনিসপত্র দিয়ে বলল ওইগুলো রেখে আসতে।

আমি ছন্দার দিকে দেখে ওকে বললাম, “আমি যেখানে যাবো তোকে সঙ্গে নিয়ে যাবো, চিন্তা নেই।”

আমরা ঘুরে ঘুরে মিশন দেখলাম, বিকেলের প্রার্থনা দেখলাম, বিশাল মন্দিরের নাট মন্দিরে সাড়ে তিনশ ছেলের একসাথে বন্দনা গান। সেই সব শুনে অবাক হয়ে যেতে হয়, আমি যেন অন্য এক আধ্যাত্মিকতায় বিচরন করছিলাম সেই সময়ে।
 
(১৩)

বেশ কিছুক্ষণ সত্যজিতের মিশনে কাটিয়ে রাতের খাবার একেবারে সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। গত রাতে ঘুম হয়নি তার ওপরে আবার সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলাম দুইজনেই। হোটেল ঢুকে হাত পা ধুয়ে বিছানায় পড়তেই আমার শরীর ছেড়ে দিল কিন্তু মন ওদিকে কিছুতেই মানছে না। পাশে প্রেয়সী, এক বিছানায় একসাথে ঘুমাবে একটু আদর একটু সোহাগ।

আমি কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পরে আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম আর ছন্দাকে ঘুর ঘুর করতে দেখলাম। কামরায় ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল। পরনে একটা গোলাপি রঙের পাতলা রাত্রিবাস, দেখলেই বোঝা যায় যে তাঁর নিচে কোন অন্তর্বাস নেই। আমার দিকে চোখ কুঁচকে ভ্রুকুটি নিয়ে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিল, ঠোঁটে মাখা দুষ্টুমি ভরা হাসি যার অর্থ আমি যাই করি না কেন ওকে ছুঁতে পারবো না কিছুতেই। আমি ওর ওই পোশাক দেখে চট করে গেঞ্জি খুলে ফেললাম আর সেই দেখে ছন্দার চক্ষু চড়ক গাছ।

আয়নার সামনে বসে প্রসাধনি সারতে সারতে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল, “গেঞ্জি খুললে কেন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে।”

উত্তরে আমি বললাম, “তোমাকে এই পোশাকে দেখে গরম লেগে গেল।”
চশমা খুলে মুখে প্রলেপ লাগানোর সময়ে আমাকে বলল, “তাহলে আরো একবার স্নান করে এসো সব গরম নেমে যাবে।” প্রসাধনী সেরে বিছানার পাশে এসে নিজের বালিশ খাটের একপাশে টেনে নিয়ে মিচকি হেসে বলল, “এই দুরত্ব যেন একফোঁটা কম না হয়। আমি কিন্তু রামপুরি চাকু সাথে এনেছি, ধরতে এলেই কিন্তু চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করে ফেলবো।” একটাই লেপ সেটাই নিজের দিকে টেনে নিয়ে আমাকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “এবারে লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো।”

আমি ওর দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ আমি যেন এইখানে ঘুমাতে এসেছি।”

লেপের মধ্যে ঢুকে আমার গালে একটা চাঁটি মেরে বলল, “কি করতে এসেছো শুনি?”

আমি ওর হাত নিজের গালে চেপে ধরে বললাম, “একটু আদর।”

আমার গালে আদুরে চিমটি কেটে বলল, “হয়েছে অনেক প্রেম দেখানো হয়েছে, এবারে লাইট নিভিয়ে দাও।”

আমি আলো নিভিয়ে ছোট হলদে রঙের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম, ছন্দা চশমা খুলে বিছানার একপাশে রেখে লেপখানা বুক পর্যন্ত টেনে শুয়ে পড়ল, আমি ওর পাশে শুয়ে পড়লাম কিন্তু কিছুতেই আমাকে লেপ দিতে চায় না। কাক চড়াইয়ের মারামারি শুরু হল। ওর নরম তুলতুলে শরীর নিয়ে খেলতে আমার বড় ভালো লাগছিল, বারে বারে ওর নরম কুঁচ যুগল আমার প্রশস্ত বুকের ওপরে পিষে যাচ্ছিল আর সেই সঙ্গে আমার রক্ত আমার উত্তেজনার পারদ চড়তে লাগলো। ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম যে ভালোবাসার অগ্নিবীণা ওর হৃদয়ে রিনিঝিনি করে বাজতে শুরু করেছে। আমি ওকে টেনে আমার দেহের ওপরে উঠিয়ে নিলাম। বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে আমাদের মধ্যে একটা ব্যবধান রেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। আলতো করে গোলাপি জিবটা বের করে নিচের ঠোঁটের ওপরে বুলিয়ে নেয় ছন্দা। সুন্দর ওই চেহারা লাল হয়ে গেছে লজ্জায়, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে আমার আগুনে চাহনির সামনে।

আমার নাকের ওপরে তর্জনী দিয়ে আঁকি কেটে সোহাগ ভরা কণ্ঠে বলল, “তোমার নাকি ঘুম পাচ্ছিল, গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল? কোথায় গেল ওইসব?”

ওই কুহুডাক শুনে আমি আর শান্ত থাকতে পারলাম না, দুই বাহু দিয়ে ওর নরম দেহ পিষে নিলাম বুকের ওপরে আর ওর আঙুল কামড়ে বললাম, “পাচ্ছিল বটে তবে একটা সুন্দরী জল পরী এসে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো, এবারে একটু আদর না করলে আর থাকতে পারছি না সোনা।”

আমার লুঙ্গি আর অন্তর্বাস ফুঁড়ে আমার কঠিন পুরুষাঙ্গ ওর নরম পেটের ওপরে বিঁধে গেল।

আমার নাকের ডগায় একটা ছোটো চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল সুন্দরী ললনা, “আমাকে ছাড়া কোন মেয়ের দিকে তাকালে চোখ দুটো অন্ধ করে দেব।”

আমি ওর নরম গালে গাল ঘষে বললাম, “ওপেন হার্ট সার্জারি করে দেখে নাও কে আছে এই বুকে।”

আমার অন্তর্বাসের ভেতরের সিংহটি বারেবারে প্রবল ভাবে হুঙ্কার ছেড়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে। ওর নরম তুলতুলে পেটের সাথে চেপে গেছে একেবারে। শরীরের উত্তাপ দুই শরীরে ছড়িয়ে পড়তে দেরি লাগলো না। আমি ছন্দাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়িয়ে গেলাম। নরম বিছানায় চিত হয়ে শুতেই আমার গলা জড়িয়ে ধরল ছন্দা, পরনের পাতলা রাত্রিবাস স্থানচ্যুত হলো, সুগোল বক্ষ যুগল আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল, উদ্ধত কুঁচ শৃঙ্গের মাঝের কালচে বৃন্ত দুটি যেন আমার পানে চাতকের ন্যায় চেয়ে রয়েছে একটু ঠোঁটের ছোঁয়া পাওয়ার আকুল আকাঙ্খায়।

আমার দৃষ্টি আটকে যায় ওর কুঁচ শৃঙ্গ দেখে। ছন্দার প্রতি নিঃশ্বাসে কামনার আগুন, প্রেমের আবেগে নয়ন জোড়া সিক্ত নয়নে হয়ে ওঠে আর ঝরে সোগাহের প্রবল কামনা। আমার লুঙ্গির গিঁট কখন খুলে গেছে সেটার খেয়াল নেই, ওর রাত্রিবাস আমাদের কামকেলির ফলে প্রায় কোমরে কাছে উঠে এসেছে। ছন্দা কোন অন্তর্বাস পরেনি সেটা আমার পুরুষাঙ্গের ছোঁয়ায় বুঝতে পারলাম। আমাদের মিলিত শরীরের আনাচে কানাচে থেকে আগুনের ফুল্কি নির্গত হচ্ছে থেকে থেকে। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে, বুকের ওপরে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে।

আমি ওর মুখখানি আঁজলা করে তুলে ধরে বললাম, “তুমি অনেক দুষ্টু মেয়ে, এবারে তার শাস্তি দেব।”

আমি জিব বের করে ওর নাকের ওপরে আলতো করে চেটে দিলাম। ছন্দা আর থাকতে না পেরে দু’হাত দিয়ে আমার চুল আঁকড়ে ধরে টেনে নেয় নিজের ঠোঁটের ওপরে, চেপে ধরে কোমল অধর ওষ্ঠ। গোলাপি জিব বের করে বুলিয়ে দেয় আমার পুরু ঠোঁটের ওপরে, দুই জোড়া অধর ওষ্ঠ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

ছন্দার পেলব জঙ্ঘার ওপরে আমার ক্ষিপ্ত পুরুষাঙ্গ বারেবারে অস্তিত্বের জানান দেয়। আমার ডান পা ওর জঙ্ঘা পায়ের মাঝে ভাঁজ হয়ে ঢুকে যায়, নগ্ন কঠিন জঙ্ঘার ওপরে ছন্দার সিক্ত নারীত্বের অধর পিষ্ট হয়ে যায়। ছন্দা থরথর করে কেঁপে ওঠে আর আমার ঠোঁট কামড়ে ধরে। প্রতিনিয়ত ঘর্ষণের ফলে সিক্ত নারীত্বের অধর হতে ফল্গুধারা অঝোর ঝরনা ধারায় পরিণত হয়। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয় আমার ঠোঁট, গাল, থেকে থেকে কামড়ে ধরে ঠোঁট। প্রেম উন্মাদিনী আমার মাথার চুল, দশ আঙুলে খামচে ধরে।

মাথা ছেড়ে ওর হাত চলে আসে আমার পুরুষালি কাঁধের ওপরে, আমি ওর নরম গোলাপি ঠোঁট ছেড়ে নিচের দিকে মুখ নামিয়ে আনলাম, ধিরে ধিরে ওর গালে, চিবুকে, গলায় অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলাম। প্রশস্ত বুকের নিচে পিষ্ট হয়ে সমতল হয়ে যায় ছন্দার কোমল তুলতুলে কুঁচ যুগল। ছন্দা চোখ দুটি বন্ধ করে নেয়, ধিরে ধিরে আমার ঠোঁট নেমে আসে ওর কোমল বক্ষের ওপরে। একটা কুঁচ মুখের মধ্যে নিয়ে আলতো করে কামড়ে দিলাম ওর ফুটন্ত বৃন্ত। সারা শরীরের প্রতিটি রোমকূপ আমাদের আসন্ন মিলনের প্রতীক্ষায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

কামড় দিতেই কেঁপে উঠল ছন্দা, “শয়তান এই ছিল তোমার মনে? আমাকে একেবারে পাগল করে দিচ্ছো যে......”

নিঃশ্বাস প্রেমাগ্নি অঝোরে ঝরে পড়ছে। আমার কাঁধে এক হাত রেখে আমার মাথা চেপে ধরে নিজের বুকের ওপরে। আমার সর্বাঙ্গে শতশত ক্ষুদ্র পতঙ্গ যেন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ধিরে ধিরে ঠোঁট নামিয়ে আনলাম ওর বক্ষ বলয়ের নিচে। ডান হাত নেমে আসে ছন্দার জঙ্ঘা মাঝের কোমল অধরে। ছন্দা নারীত্বের কোমল অধরে আমার কঠিন আঙুলের পরশ পেতেই টানটান হয়ে যায়। সেই প্রথম কোন সম্পূর্ণ নারীকে আস্বাদন করতে চলেছি, আমার শয়তান আঙুল ওর শিক্ত অধর ওষ্ঠদ্বয় নিয়ে এক উন্মাদের খেলায় মেতে উঠল।

দুই চোখের পাতা শক্ত করে বন্ধ, ওর ঘাড় বেঁকে গেল পেছন দিকে, বালিশের ওপরে মাথা চেপে ধরে মিহি শীৎকার করে ওঠে ছন্দা, “উমমমমম আর পারছি না যে সোনা, তুমি আমাকে পাগল করে দিলে একেবারে......”

দু’হাত দিয়ে সারা শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে আমার চুল আঁকড়ে ধরে টেনে নেয় নিজের বুকের ওপরে। ছন্দার অঙ্গে অঙ্গে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে বেড়ায়। আমি মধ্যমা আর অনামিকা ওর জঙ্ঘা মাঝের অধরে প্রবেশ করিয়ে দিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে নিচের ঠোঁটটি কামড়ে ধরে ছন্দা। আমার দুই আঙুল ভিজে গেল, ওর নারীত্বের গহ্বর যেন এক উষ্ণপ্রস্রবণ। ওর সারা শরীর ধনুকের মতন বেঁকে গেল, কেউ যেন ওর মাথা থেকে কোমর অবধি ছিলা দিয়ে টেনে বেঁধেছে।

অস্ফুট শীৎকার করে ওঠে আমার হৃদ সুন্দরী, “মেরে ফেললে যে...... সোনা...”

শরীরের শেষ শক্তিটুকু গুটিয়ে নিয়ে দু পা দিয়ে চেপে ধরে নিজের ওপরে টেনে নেয় আমাকে। আমি আঙুল সঞ্চালনের গতি বাড়িয়ে দিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিলা ভঙ্গ ধনুকের মতন টঙ্কার দিয়ে নেতিয়ে পড়ল ছন্দা, সেই সাথে বুকের ওপরে আমাকে চেপে ধরল। আমার আঙুল ভিজে গেল, বাঁধ ভাঙা নদীর মতন শত ধারায় সুধা ঝরে পড়ল। সেই ধারার যেন কোন অন্ত নেই অবিশ্রান্ত অবিরাম। আমার পেশি বহুল দেহের নিচে ঝরা পাতার মতন নেতিয়ে পড়ল ছন্দা।

বেশ কিছু পরে পদ্ম পাপড়ির মতন চোখের পাতা খুলে দুষ্টু মিষ্টি হাসি মাখিয়ে দিল আমাকে, চোখের কোলে টলটল করছে এক বিন্দু খুশীর জোয়ার। দুই হাতে অঞ্জলির মতন আমার মুখ ধরে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি দেখছ এমন ভাবে?”

মৃদু প্রেমের বকা দিল আমাকে, “আমি আমার ভালোবাসা দেখছি তাতে তোমার কি?” বলেই আমার নাকের ওপরে আলতো করে নাক ঘষে দিল, “তুমি খুব শয়তান ছেলে, বলেছিলাম লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়তে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে পাগল করে দিলে একেবারে।”

আমি আমার অন্তর্বাস খুলে নগ্ন হয়ে গেলাম। আমার দন্ডায়মান পুরুষাঙ্গ ছন্দার শিক্ত নিম্ন অধরের দোর গোরায় কড়া নেড়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে দিল। ছন্দার উত্তপ্ত নারীত্বের ছোঁয়া পেয়ে আমি ব্যাকুল হয়ে গেলাম শেষ বাধাটুকু কাটিয়ে দেহের মিলনের আকাঙ্খায়। দেহ জোড়া যেন আর আমাদের বশে নেই, দুই কাতর কপোত কপোতী মেতেছে নরনারীর আদিম মিলনের খেলায়। ছন্দা ওর কোমর উপরের দিকে ঠেলে ধরে, নিজের নিম্ন অধর চেপে ধরে আমার পুরুষাঙ্গের ওপরে। লজ্জাবতীর লজ্জা নেই, নেই পিছিয়ে যাওয়ার পথ। ওর সিক্ত নারীত্বের ছোঁয়ায় আমার পুরুষাঙ্গ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আমি মিলন আখাঙ্খায় উন্মাদ হয়ে গেলাম, হৃদয় সঙ্গিনীর জঙ্ঘার মাঝে নিজেকে হারিয়ে দিতে উন্মুখ হয়ে উঠলাম।

আবেগ ভরা কণ্ঠে ওকে বললাম, “এবারে কিন্তু আর আঙুল যাবেনা সোনা।”

ওর শরীরে ভর দিয়ে এলো প্রচন্ড কামিনী শক্তি, আমাকে ঠেলে ওপরে উঠাতে চায় ছন্দা, নিজের নারীত্বের অভ্যন্তরে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে নিতে চায় আমাকে। মিহি শীৎকারে আমাকে আহবান জানায়, “আমি তোমার, পার্থ, আমাকে নিজের করে নাও একেবারে।”

আমি ওর মাথার নিচে হাত দিয়ে ওর মাথা উঠিয়ে দিলাম আর ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দিলাম। সেদিনের আগে পর্যন্ত মিলনের সুখের আনন্দ যে কতটা চরম হতে পারে সেটা আমাদের অজানা ছিল। আমার কটিদেশ নেমে আসতেই ওর নারীত্বের দ্বার খুলে যায়। কখন যে আমি ওর মধ্যে প্রবেশ করলাম তার বোধ রইল না, ধিরে ধিরে হারিয়ে গেলাম দুইজনে। শৃঙ্গারে রত কপোত আমি, আমার সুন্দরী কপোতীর কোমল শরীর নিয়ে আদিম ক্রীড়ায় মেতে উঠলাম। মন্থনের গতি কখন ধিরে, কখন তীব্র। আমার দেহের নিচে পিষ্ট হয়ে যায় সঙ্গিনী। চূড়ান্ত শৃঙ্গ মাঝে মাঝে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়, দুরে নয় বেশি, তবুও সেই শৃঙ্গ অধরা রাখতে প্রবল প্রচেষ্টা চালায় দু’জনেই। কেউ চাইছিলাম না এই রাত শেষ হয়ে যাক। সেই ঠাণ্ডায় আমাদের কেলির ফলে ঘেমে গেলাম, ললনার শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম নির্যাস মিশে যায় আমার গায়ের ঘাম। অনাবিল আনন্দের সমুদ্র সৈকতে বয়ে গেলাম দুইজনে, ঢেউয়ের তালে তালে নেচে উঠলাম পরস্পরের দেহ নিয়ে। অবশেষে আমার ফুটন্ত লাভা মোহনার পানে ধেয়ে যায়, ছন্দার নারীত্বের বারিধারার সাথে মিলিত হবার জন্য। শরীরের শেষ শক্তিটুকু গুছিয়ে নিয়ে চেপে আমি আমার প্রানের কপোতীকে নরম বিছানার সাথে চেপে ধরলাম। ছন্দা কোমল বাহু দিয়ে শেষ শক্তিটুকু উজাড় করে পেঁচিয়ে ধরে আমার শরীর, দুই পায়ে আঁকড়ে ধরে আমার কোমর। আর আমরা দুটি আলাদা প্রান রইলাম না, সব বন্ধন কাটিয়ে পরস্পর মাঝে বিলীন হয়ে গেলাম।

মিলন শেষে আমার প্রশস্ত বুকের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে প্রশ্ন করল, “চিরদিন আমাকে এইভাবে ভালবাসবে?”

ওর শরীরে মাদকতাময় সুবাস বুকের মধ্যে টেনে ওকে বললাম, “কাল কে দেখছে সোনা, তবে আগামি প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে এই ভাবে ভালবাসবো। কাল এক নতুন সকাল হবে, এক নতুন দিনে আবার নতুন করে তোমাকে ভালবাসবো।”

ছন্দা আলতো করে চুমু খায় আমার বুকে, ওর বুকটা এক অনাবিল ভাললাগার অনুভূতিতে ভরে যায়, চোখের কোলে অশ্রু দানা দেখা দেয়। দুইজনে কখন যে পরস্পরকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটা আর খেয়াল নেই।

দুইদিন ছিলাম দেওঘরে, পরের দিন আর ম্যাসাঞ্জর দেখতে যাওয়া হয়নি। দিনের আলোতে ছন্দা আমার কাছে আসতে নারাজ তাও আমরা দুষ্টুমি করেছিলাম।
 
(১৪)

এম টেক প্রায় শেষ হতে চলল, রিসার্চ করব না চাকরি করব সেই নিয়ে একটু দোটানায় পড়লাম। একবার ছন্দার সাথে আলোচনা করেছিলাম, ছন্দা আমাকে বলেছিল যে রিসার্চ করতে।

সেদিন ছন্দার অফিসের পরে আমরা ফ্লুরিসে বসে কেক আর চা খাচ্ছিলাম। ছন্দা আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি নিয়ে রিসার্চ করবে কিছু ঠিক করলে?”

আমি তখন পর্যন্ত সেই রকম কিছু ভাবিনি কিন্তু বড় ইচ্ছে ছিল থারমো ডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, আমি সেটাই ওকে জানালাম। ছন্দা চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বলল, “এখানে না বিদেশে?”

আমি ওকে হেসে বললাম, “থারমোডায়নামিক্স নিয়ে করবো এইটুকু জানি, এখানে না বিদেশে সেটা এখন ভাবিনি। তবে জি আর ই দেওয়ার ইচ্ছে আছে সেটা অনেক কঠিন ব্যাপার তারপরে দেখা যাবে।” কিছুক্ষণ থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মাসিমাকে আমাদের ব্যাপারে কিছু বললে কি?”

ছন্দা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিচকি হেসে বলল, “নিজেই নিজের বাড়িতে কিছু বলেনি আর আমাকে আগে বলতে বলছে। যাই হোক আমি মাকে তোমার ব্যাপারে একটুখানি বলে রেখেছি, মা তোমাকে এই রবিবার বাড়িতে ডেকেছে।”

আমি হেসে বললাম, “বাপ রে একদম শাশুড়ির সামনে যেতে হবে? এযে বাঘের মুখে পড়ার চেয়েও সাঙ্ঘাতিক।”

আমার হাতের ওপরে চাঁটি মেরে বলল, “তুমি না একদম যাঃতা আমার মা মোটেই রাগি নয়। আর তোমাকে দেখে গলে যাবে দেখো। এম টেক করা জামাই তার ওপরে আবার রিসার্চ করবে, সেতো বিশাল ব্যাপার।”

আমি ওর হাত চেপে প্রশ্ন করলাম, “তোমার অমত নেই তো?”

হাতের তালুতে চিমটি কেটে বলল কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ খুব আছে, রবিবার যদি না আসো তাহলে আর বিয়েই করব না।”

সেই রবিবার দুপুরের আগেই আমি ছন্দার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। তার আগের রাতে আমার ঘুম হল না, কি ভাবে কি কথা বলব। এদিকে নিজের বাড়িতে কিছুই জানানো হয়নি এমত অবস্থায় ছন্দার মায়ের সামনে কি বলব। ওর বাড়িতে ঢোকার আগে আমার ঘাম ছুটে গেল, মনে হল বুকের ওপরে শক্তিশেল বিদ্ধ হয়েছে। কলিং বেল বাজানোর আগে আমি বার কয়েক বড় বড় শ্বাস নিলাম। কলিং বেল বাজাতেই ছন্দা এসে দরজা খুলে দিল, প্রেম করার পরে সেই প্রথমবার ছন্দার বাড়িতে পা রাখলাম। ছোট দুটো কামরার ঘর আর একটা ছোট বসার ঘর, ছোট হলেও বেশ সুন্দর করে সাজানো। আমি ওকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার, চোখের ইশারায় আমাকে উত্তরে বলল যে সব ঠিক আছে শুধু আমি যেন ঠিক থাকি। কিছু পরে ছন্দার মা, যূথিকা দেবী ঘরে ঢুকলেন। আমি উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম। আমার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া। আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করে দিল, ছাগল কাটার আগে যেমন তাকে খাইয়ে পড়িয়ে পুজো করা হয় নিজেকে ঠিক তেমন মনে হল। আমি যদিও বেশি খেতে ভালোবাসি না তাও মাসিমা অনেক কিছু রান্না করেছিলেন।

খেতে বসে এটা খাও সেটা খাও আর ছন্দা মাসিমাকে বারন করে বলে, “আরে মা ওকে অত কিছু দিও না, ওকে শুধু ডাল ভাত আলু ভাজা দিও তাতেই খুশি। হ্যাঁ ইলিশটা আর মিষ্টিটা একটু ভালো খায়, তোমার খরচ বেঁচে যাবে।”

সেই কথা শুনে মাসিমা হেসে ফেললেন, “প্রথম বার এসেছে একটু খাবে না?”

আমিও মন রক্ষার্থে অনেক কিছু খেয়ে ফেললাম আর বললাম, “আপনার মেয়ে কি সত্যি রান্নাবান্না পারে না?”

মাসিমা হেসে বললেন ওকে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেইনি তবে মাঝে মাঝে নিজে থেকে কিছু করতে চেষ্টা করে। আমি বললাম যেদিন ওর হাতের রান্না খেতে হবে সেদিন আমাকে হস্পিটাল যেতে হবে। ছন্দা ওর মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ ভেঙিয়ে জানিয়ে দিল, যে পরে আমাকে দেখে নেবে।

খাওয়ার পরে মাসিমা আমাকে বাড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তরে বাবার নাম বললাম, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে সব কিছু জানালাম, আমি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, আমাদের বাড়ির সাথে অনুসুয়ার বাড়ির যোগাযোগ ইত্যাদি সব কিছু খুলে জানালাম।

সবকিছু শোনার পরে মাসিমা আমাকে বললেন, “শোন বাবা, আমরা পূর্ববঙ্গের মানুষ।” আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে ছন্দা আমাকে ওর ইতিহাস আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছে। মাসিমা মেয়ের হাতখানি নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আমাকে বললেন, “আমার একটাই মেয়ে, বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলে আমার চেয়ে ওর বেশি কাছের, ওর পড়াশুনা সবকিছু এই করেছে। অনেক কষ্টে একে আমি এই পর্যন্ত এনেছি বাকিটা ওর হাতে আর তোমার হাতে। আমার অমত নেই তবে তুমি নিজের বাড়িতে একবার এই বিষয়ে বিস্তারে কথা বল। তোমরা পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা তাঁর ওপরে ব্রাহ্মণ পরিবার, কথা বলে দেখো তাদের কি মতামত।”

আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ছন্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে মাসিমার কথা শুনে ওর চোখ ছলছল করছে। আমি মাসিমার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, “আমি ঠিক সময়ে সব কিছু ঠিক করে দেব।”

এর মাঝে একদিন বউবাজার গিয়ে ওর জন্য একটা সোনার হার কিনলাম। সেই হার গলায় পরে খুব খুশি, আর আমার খুশি ওর ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে। হার কেনার সময়ে আমাকে বকা শুনতে হয়েছিল, ছয় মাসের স্টাইপেন্ডের টাকা জমিয়ে ওকে ওই সোনার হার কিনে দিয়েছিলাম।

জানিনা কি করে কি ঠিক করব তবে সেদিন মাসিমার সামনে কথা দিয়ে এসেছিলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলাম কি করা যায়। ভাবতে ভাবতে সকালের দিকে পথ খুঁজে পেলাম, নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাতে হবে যে বাড়ির কেউ আমার কথা ফেলতে পারবে না। ঠিক করলাম যে এম টেক করার পরে জি আর ই দেব আর বিদেশ যাবো রিসার্চ করতে। জ্যাঠা বাবা সবাই একবার বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে, সেই চুড়ায় আমাকে পৌঁছাতেই হবে।

এরপরে একদিন আমি সবকিছু খুলে বললাম ছন্দাকে। আমার কথা শুনে ছন্দা বেঁকে বসল, কিছুতেই আমাকে বিদেশে ছাড়বে না। আমি নাকি বাইরে গেলে ওকে ভুলে যাবো। একদিকে আমার প্রেম আমার ভালোবাসা আর অন্যদিকে আমার পড়াশুনা। আমি ছন্দাকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না যে রিসার্চ সেরে আমি দেশে ফিরে আসব। ছন্দার এক কথা, আমি বিদেশে গিয়ে ওইখানকার মেয়েদের দেখে ওকে ভুলে যাবো আর সেখানেই থেকে যাবো। ছন্দা আমার সাথে দেখা করা এমনকি কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিল।

একদিন বিকেলে ফ্লুরিসে বসে ওকে বললাম, “এই সব আমি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য করছি, সোনা। আমাকে সেই চুড়ায় পৌঁছাতেই হবে। তুমি সোজা পথে কোনোদিন ভাবতে চেষ্টা করো না তাই না?”

ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি দুই বছরের জন্য বাইরে চলে যাবে, কোন বড় একটা ইউনিভারসিটি থেকে এম ফিল করার পরে কি কেউ দেশে ফিরে আসে? তুমিও আসবে না আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি।”

আমি ওর হাত ধরে কাতর মিনতি করে বললাম, “ছন্দা, তুমি আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে এই বুকে কোনোদিন ঠাঁই দিতে পারবো না।”

ছন্দা ধরা গলায় বলল, “তার মানে তুমি এই বলতে চাও যে বিয়ে করে আমি তোমার সাথে বিদেশ চলে যাবো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “যদি আমি বিদেশে থেকে যাই তাহলে সেটাই।”

ছন্দা মাথা দুলিয়ে বলল, “না সেটা কখনই সম্ভব নয় পার্থ, আমার ভাই এখন অনেক ছোট ওর পড়াশুনা আছে, মাকে দেখার আছে, আমি তোমার সাথে কখনই বিদেশ যেতে পারবো না।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি চাও, আমি তাহলে কি করব?”

ছন্দা চশমা খুলে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে আমাকে অবাক করে বলল, “তুমি আমাকে ভুলে যাও, পার্থ।” আমাকে কিছু বলার অবকাশ দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে আমার দেওয়া গলার হার দেখিয়ে বলল, “আমার কপাল খালি থাকবে তোমার জন্য, যদি তুমি ফিরে আসো তাহলে এই কপালে সিঁদুর পরিও না হলে... এটাই আমার সর্বস্ব, এটাকে সম্বল করেই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।”

আমি স্থানুবৎ ওইখানে অনেকক্ষণ বসে রইলাম, বসে বসে আমার জেদ চেপে গেল আমি জি আর ই দেবো আর বাইরে যাবো। আমি আলবাত ফিরে আসব আর ওকে দেখিয়ে দেব যে আমার ভালোবাসা ফেলনা নয়, মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম ওই ফ্লুরিসে বসে।

আমার ইচ্ছে ছিল ইউনিভারসিটি কলেজ লন্ডনে থারমো ডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, এম টেক শেষ করে আমি জি আর ই দিলাম আর সেই ছাড়পত্র পেয়েও গেলাম। আমার সাথে সাথে নবীন ও জি আর ই দিয়েছিল, জার্মানির খুব নামকরা একটা ইউনিভারসিটিতে পি এইচ ডি করার ছাড়পত্র পেয়ে গেল।

দুই বছরে অনু শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছে তাই কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারল না আর না পারাটাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিল যাতে ওর বাড়ি থেকে বিয়ের ব্যাপারে চাপ না দেয় আর ততদিনে যাতে দেবু একটা ভালো চাকরি পেয়ে যায়। এম টেক করার পরে কলেজের লেকচারার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল দেবু। দেবুর লেকচারার হওয়াতে অনু আহ্লাদে আটখানা এবারে ওদের বিয়ে করাতে বিশেষ অসুবিধে হবে না।

ছন্দার সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ কোন কথাবার্তা হলো না, রোজ রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার বিনিদ্র রজনী কাটতো, ভাবতাম আমি যে পথে যাচ্ছি সেটা ঠিক না ভুল, উত্তর হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার জি আর ই পাওয়ার খবর ছন্দাকে অনু দিয়েছিল, ছন্দা তার উত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দেখে অনু বিস্মিত হয়েছিল। আমি ওর বিস্ময় দূর করে ওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিলাম এবং এও বলেছিলাম যে ছন্দাকে আর কিছু যেন না বলে। আমি ওকে বলেছিলাম সব কিছু যেন সময়ের ওপরেই ছেড়ে দেয়।
 
(১৫)

বহুদিন পর সেদিন নবীন, দেবু, আমি আর পচা একসাথে আড্ডা মারলাম। পচা চাকরি করে ফুলে গেছে, গুজরাটে গিয়ে এক গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে তার নাম সঞ্জনা। নবীন বেশ ভারিক্কি হয়ে গেছে, তবে আগে মদ খেতো না এখন মাঝে মাঝেই মদ খায়। দেবু চাকরি পাওয়ার পরে বেশ খোশমেজাজে ছিল। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে বসে চারজনে হুইস্কি গিললাম আর পুরানো দিনের কথা মনে করলাম। মন বড় বলছিল যে যদি ছন্দা, অনু আর শ্যামলী পাশে থাকতো তাহলে আমাদের সেই পুরানো দিন এক বিকেলের জন্য ফিরে আসতো। তিন মেয়ের মধ্যে শুধু অনু হয়তো আসতে পারতো, কারন ছন্দার সাথে আমার অনেকদিন কথাবার্তা নেই। এর মাঝে ওর অফিসে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার সাথে কথা বলেনি ঠিক করে, দূর থেকে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সি করে বেরিয়ে গেল, আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এই সব ঘটনা আর ওদের বললাম না। দেবু আমাকে বলল যে এবারে বিয়ে করতে চায়, নিজের বাড়িতে বলেছে এই ব্যাপারে, ওর মা এক কথায় রাজি, বি টেক করা সুন্দরী বৌমাকে হাতছাড়া করতে চায়, ওর বাবা হ্যাঁ না কিছু বলেনি তবে রাজি হয়ে যেতে পারেন। ওদিকে অনু তখনো কিছু বাড়িতে বলেনি, আমি যত বার বলি এইবারে বাড়িতে বলে দে, ওর কালঘাম ছুটে যায় আর আমাকে ঠেলে দেয়। আমি নিজেও বাড়িতে ছন্দার ব্যাপারে কিছুই বলিনি, আগে লন্ডন থেকে ফিরি তারপরে বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম। নবীনকে জিজ্ঞেস করাতেই কথা এড়িয়ে গেল, ছন্দা ওর মনের কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল তাই আর ওকে বেশি ঘাঁটালাম না।

সন্ধে নাগাদ বাড়িতে পা রাখতেই ভিরমি খেলাম। আমাদের বৈঠকখানা লোকে লোকারণ্য, না না, বাইরের লোকজন নয় সবাই বাড়ির। কিন্তু দুই বাড়ির বাবা কাকা জ্যাঠা, মা জেঠিমা কাকিমা, ওদিকে দেখি বড়দি আর বড় জামাইবাবু, অনুর বড় পিসি পিসেমশায়, ওর মামা রা, এদিকে বড় মামা মামি আমার মামা মামি সব মিলে প্রায় জনা ত্রিশ জন। বৈঠকখানা ভরে সবাই বসে হাসাহাসি গল্পে মেতে। মামা পিসিদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম না হটাৎ করে এই বাড়িতে আবার কোন উৎসব লাগতে চলল।

বড় জামাইবাবু মানে সমীরণদা আমাকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল, “ঐ যে পুটু এসে গেছে।”

আমি ত্রস্ত পায়ে বৈঠক খানায় ঢুকে সবার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে রইলাম। সমীরণদা আমার পাশে এসে বলল, “এই যে শালা তোমার বিয়ের কথা হচ্ছিল এখানে।”

ওই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, বলা নেই কওয়া নেই হটাৎ করে কেউ ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেয় নাকি? আমি অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিদ্ধার্থ জ্যাঠা মানে অনুর বাবা, আমাকে বললেন, “আমার পুরানো বন্ধু, অধিরের নাম শুনেছিস তো? ওর মেয়ে, বৈশাখী, ইংলিশে বি এ পড়ছে। ওর কথা ভেবেছি তোর জন্য।”

আমি বার কয়েক ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে বললাম, “আমার বিয়ে মানে এখুনি, কেন?”

বাবা বললেন, “তুই লন্ডন চলে যাবি, ওইখান থেকে যদি বিলিতি মেম ধরে আনিস সেই ভয়ে আগে ভাগেই তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো।”

বাবার কথা শুনে সবাই হেসে দিল আর আমার চক্ষু চড়ক গাছ। গলা শুকিয়ে গেছে, কান মাথা ভোঁভোঁ করছে, চোখের সামনে হটাৎ করে সব কিছু ঘুরতে শুরু করে দিল।

আমার ছোট কাকা বললেন, “তোদের দুইজনের একসাথে বিয়ে। মানে অনু আর তোর, অধির বাবুর একমাত্র ছেলে, অনিন্দ্য ডিভিসিতে ইঞ্জিনিয়ার। আমরা ভাবলাম এই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে যখন যাবে তখন ওই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে এই বাড়িতে আসুক।”

আমি ছাদের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, ছাদখানা অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে আর একটু হলে আমাকে পিষে মেরে ফেলবে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে বললাম, “অনু জানে এই ব্যাপারে?”

আমার মা হেসে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ জানে, ওর অমত নেই। তোর ঘরে মানুর সাথে বসে আছে।”

ওই কথা শুনে আমি কি বলব ভেবে পেলাম না, অনু কি করে মেনে নেয় এই কথা? ওর আর দেবুর প্রেম কি সত্যি পুতুল খেলা ছিল? না হতে পারে না। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়, কি বলা যায় কোথা থেকে কথা শুরু করা যায়। ওইদিকে দরজা দিয়ে ভাই বোনগুলো সব উঁকিঝুঁকি মারছে। একটু পরে দেখলাম ভাই বোনের ভিড়ের পেছনে অনু আর ছোড়দি। কেঁদে কেঁদে অনুর চোখ জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গেছে, ছোড়দিকে ওকে জড়িয়ে ধরে আমাকে ইশারা করল ওই বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসতে। আমি মাথা নিচু করে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এলাম।

আমি বের হতেই ছোড়দি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গেল আর অনু ভেঙে পড়ল, “আমি দেবুকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না, আমাকে অন্য কারুর সাথে বিয়ে দিলে আমি বিষ খেয়ে মরব।”

আমি কি করব কিছু বুঝে পাচ্ছি না, ছোড়দি আমাকে বকা দিয়ে বলল, “তুই কেন তোর কথা আমাকে জানাস নি? একসাথে দুই দিক কি করে সামলাই বল। শ্বশুর মশায় আর বাবা কাকে নেমতন্ন করবে, কি কি খাওয়ানো হবে সেইসব নিয়ে ফর্দ বানাতে বসে গেছে, বড় কাকা তো খুশিতে পাগল, রাঙা কাকা বলছে...”

আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “থাম দিকি, কে কি আটঘাট বাঁধছে সেই শোনার সময় নেই আমার কাছে।”

ছোড়দি রেগে গিয়ে আমাকে বলল, “তোমরা দুইজনে লুকিয়ে প্রেম করবে আর ম্যাও সামলাতে আমাকে ঠেলে দিবি?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি করব, আমি ভাবলাম বড়দা আর তোর সময়ে কোন অসুবিধে হয়নি তাই আমাদের সময়ে হবে না। তা বিশুদা কোথায়?”

ছোড়দি বলল, “আমি তোর বড়দাকে ফোন করে দিয়েছি, হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। ওই সব ঠিক করে দেবে বলেছে, তুই শুধু এই একঘণ্টা ওদের কিছু একটা বলে ক্ষান্ত রাখ।”

এমন সময়ে অনুর মা আর আমার মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তাঁদের বের হতে দেখেই ছোট ভাই বোন গুলো দূরে সরে গেল। আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অনুর কান্নার কারন, আমি একবার ছোড়দির দিকে তাকালাম একবার অনুর দিকে তাকালাম তারপরে চোখ বন্ধ করে বোমা ফাটিয়ে দিলাম, “এই বিয়ে হতে পারে না।”

সেই কথা শুনে অনুর মা হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলছিস তুই? কেন বিয়ে হতে পারে না? তুই আর অনু কি...”

ছোড়দি তেড়ে উঠল অনুর মায়ের দিকে, “কি যে বলো না তুমি, বলার আগে একবার ভাববে না কি বলছো?”

আমার মা আমাকে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে অনু ওইভাবে কাঁদছে কেন আর তুই ওই ভাবে দাঁড়িয়ে কেন?”

আমি দেখলাম এবারে কিছু না বললে নয়, খাঁড়া একদম গলার কাছে নেমে এসেছে। আমার হয়ে ছোড়দি বলল, “ভেতরে চল কথা আছে।” অনুর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল আমি পেছন পেছন গেলাম। সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে নিজের প্রেমের বক্তব্য রাখা খুব বড় ব্যাপার। ছোড়দি খানিকক্ষণ চুপ থেকে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বৈশাখীর সাথে পুঁটুর আর অনিন্দ্যর সাথে অনুর বিয়ে অসম্ভব।”

সিদ্ধার্থ জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কি অসুবিধে? অনু আর পুটু কি পরস্পরকে...”

ছোড়দি আবার তেড়ে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল, শ্বশুর মশাইয়ের সামনে শান্ত কণ্ঠে বলল, “না ওইসব কিছু না। অনুর একজনকে পছন্দ হয়েছে আর পুটু একজনকে ভালবাসে।”

সবার চাহনি দেখে মনে হল ঘরে বোমা ফেটেছে আর তারপরেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। এত চুপ যে বেড়াল চলে গেলে তার পায়ের শব্দ শোনা যেতে পারে। আমি নিজের বুকের ধুকপুকানি শুনতে পেলাম, হাতুড়ির মতন বারেবারে বাড়ি মারছে ফুসফুসে। বড় কারুর দিকে তাকাবার একটুও সাহস নেই, সবাই যেন আমাদের দিকে ক্ষুধার্ত বাঘের মতন তাকিয়ে, পারলে এখানেই খেয়ে ফেলবে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে উঁচু গলায় কথা বলা অথবা প্রেম ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার ছিল, কি করে কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু একটা বিহিত করতেই হবে।

বাবা আমার দিকে বাঘের মতন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে গুরু গম্ভির কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যাপার এইসব?”

আমি চোখ বন্ধ করে দেখলাম যে হাসি কান্না মিশিয়ে আমার সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে, মনের কথা না বললে আমার ভালোবাসা চিরদিনের মতন চলে যাবে। আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে সাহস জুগিয়ে নিজের কথা না বলে আগে অনুর ব্যাপারে বললাম, “অনু একজনকে ভালবাসে, আমাদের কলেজের বন্ধু।”

সিধু জেঠা গম্ভির কণ্ঠে অনুকে জিজ্ঞেস করল, “কি নাম কি করে কোথায় থাকে?”

অনু ধরা গলায় আমতা আমতা করে কিছু একটা বললো কিন্তু কেউ শুনতে পেল না। ওর হয়ে ছোড়দি বলল, “ছেলের নাম দেবাশিস রায়, একসাথে এরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। দেবাশিস ধানবাদ থেকে এম টেক করেছে, বর্তমানে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে লেকচারার।”

কথা শুনে মনে হল সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন, বাবা আমাকে জিজ্ঞস করলেন, “আর তোর কি ব্যাপার?”

আমি বার কতক ঢোঁক গিলে কোন রকমে বললাম, “আগে অনুর ব্যাপারে বলি তারপরে আমার কথায় আসছি। আগে বল কি বলতে চাও তোমরা? দেবাশিস ভালো বাড়ির ছেলে। তোমাদের পছন্দ করা ছেলের চেয়েও বেশি ভালো, অনু কোন ভুল পথে যায়নি।”

সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন হুঙ্কার পাড়লেন, “প্রেম করেছে আর ভুল পথে যায়নি? কি সব আবোল তাবোল কথাবার্তা।”

ওই হুঙ্কার শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল, অনু ডুকরে কেঁদে উঠল, “আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব না।”

দুই জ্যাঠা মিলে আমাদের দিকে প্রায় তেড়ে আসে কিন্তু ছোড়দি মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল আর আমাদের বাঁচিয়ে দিল। ছোড়দি মাঝে দাঁড়াতেই আমার জেঠু বললেন, “তোর ব্যাপার আলাদা, বিশুকে ছোট বেলা থেকে চিনি আর এখানে? কাউকেই চিনি না কাউকেই জানি না, কি বৃত্তান্ত কি ব্যাপার।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে, আমি দেবাশিসকে ডেকে নিচ্ছি পরিচয় হয়ে যাবে।”

সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন শুধু মাত্র একটা শব্দ করলেন, “হুম।”

বাবা গম্ভির কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “ওর ব্যাপার বুঝলাম আর তোর কি ব্যাপার সেটা শুনি?”

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আর তখন আমার জেঠিমা আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ধির পায়ে জেঠিমার কাছে যেতেই আমার কান ধরে টেনে বললেন, “তোর কি মধুছন্দাকে পছন্দ?”

আমি ওই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম, আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ মানে তুমি কি করে জানলে?”

জেঠিমা কান টেনে লম্বা করে বললেন, “এমনি এমনি চুল সাদা হয়নি রে আমার পুটু। আকাশের বিয়েতে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘোল পাকিয়েছিস তোরা।”

বাবা আমাকে প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে দিলেন, “কি নাম মেয়ের, কি বৃত্তান্ত, বাবা কি করেন একটু শুনি।”

দেখলাম এবারে না বলে কোন উপায় নেই, হাড়ি ভাঙতেই হবে, “না মানে আমার কলেজের বান্ধবী, মধুছন্দা সমাদ্দার। বর্তমানে পার্ক স্ট্রিটে একটা বড় রঙের কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবা নেই, মা এস এস কে এম হস্পিটালে নার্স।”

জ্যাঠা আঁতকে উঠলেন, “সমাদ্দার? মানে পূর্ববঙ্গের? না না এ হতে পারে না, সমাদ্দার জাতে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট। তুই কি না শেষ পর্যন্ত আমাদের কুলের নাম ডুবাবি? আমরা ব্রাহ্মণ পরিবার সেটা জেনে বুঝে তুই এই করলি?”

বাবা কাকা সবাই এক কথায় নারাজ, “পূর্ববঙ্গের মেয়ে বাড়িতে আনা চলবে না তার ওপরে আমাদের চেয়ে নিচু জাতের।”

সেকালে হোক কি একালে হোক এই বৈষম্য এখন আছে, সেই একটা ব্যাপারে কোলকাতা কেন সারা পৃথিবী আজও একত্র।

আমি দেখলাম আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এই সময়ে বুকের পাটা চুপসিয়ে গেলে হবে না, “অতীতে তোমাদের কুল যে ব্রাহ্মণ ছিল তাঁর কি প্রমান?”

জ্যাঠা বাবা প্রায় তেড়ে ওঠেন আমার ওপরে, “কি বলছিস তুই, আমরা চট্টোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ। সেই সুতানুটির সময় থেকে এইখানে বাস আমাদের।”

হটাত কি যে হয়ে গেল আর আমি বলে ফেললাম, “ছোট বেলায় বায়োলজি টিচার আমাদের পড়িয়েছিল যে আমরা সবাই নাকি বাঁদর গোষ্ঠি থেকে উদ্ভুত। সেটা ঠিক না ভুল?”

অনেকেই আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন কিন্তু জ্যাঠা মশায়, সিধু জ্যাঠা বাবা তেড়ে উঠলেন, “বড় বাড় বেড়ে গেছিস, বাপ ঠাকুরদার নাম ডুবিয়ে দিলি শেষ পর্যন্ত।”

মানা না মানা, কথা কাটাকাটি আরও বেশ কিছুক্ষণ চললো এই ভাবে, জ্যাঠা বাবা কিছুতেই মানতে রাজি নয় ছন্দার ব্যাপারে। মা কাকিমা জেঠিমা এর মাঝে তর্ক জুড়ে দিলেন, বৈঠকখানা মাছের বাজারের মতন হয়ে গেল। অনু কান্না থামিয়ে চুপচাপ ছোড়দির হাত ধরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইল। আমিও সমান তালে বচসা করলাম বুঝাতে চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ ধরে যে এই জাতপাত নিয়ে কি হবে, কে পূর্ববঙ্গের কে পশ্চিমবঙ্গের, কি হয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম যে যখন তিনি অপারেশান থিয়েটারে অপারেশান করেন তখন কি অন্য জাতের মানুষের রক্ত নীল রঙের দেখতে পান? আমি অনড় যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে ওই মধুছন্দাকেই করবো নচেত আর কাউকে নয়। কথাবার্তা শুনে মনে হল দেবুর আর অনুর ব্যাপারে বিশেষ অসুবিধে হবে না। আমি বারেবারে দরজার দিকে তাকাই এবারে যদি বিশুদা এসে কিছু করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত আমার জেঠিমা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি একটা কথা বলি, আগে এই দেবাশিসকে ডাকা যাক তারপরে পুটুর ব্যাপারে কথা বলছি।”

অনু এক দৌড়ে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। জেঠিমা ওকে সান্তনা দিয়ে বলল, “আচ্ছা বাবা আগে তোর ওই দেবাশিসকে দেখি আমরা তারপরে বাছ বিচার করব।”

সিধু জ্যাঠা আমাকে বললেন, “দেবাশিসকে ডাক।”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “এখুনি?”

বাবা বললেন, “হ্যাঁ এখুনি। আর তারপরে তোর বিচার হবে।”

জেঠিমা বাবাকে বললেন, “গগন, মধুছন্দাকে আমার পছন্দ, মানুর বিয়েতে, আকাশের বিয়েতে তোমরা সবাই ওকে দেখেছ। বি টেক করা চাকরি করা বৌমা, এর পরে আর কারুর কিছু কি বলার আছে?”

জেঠিমার ওই কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ। কিছু পরে আমার মা হেসে সিধু জ্যাঠাকে বললেন, “তাহলে অধিরকে একটা ফোন করে দিন, ওদের আসতে বারন করে দিন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে, ওদের নিজেদের পছন্দ অপছন্দ আছে। বিয়ের তারিখ একটু দেখে শুনে করতে হবে তাহলে। এই বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে আর ওই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা, ঢাক ঢোল একটু বেশি না বাজলে কি করে হবে।”

আমাদের বাড়ির কোন বিয়েতে ঢাক ঢোল কম বাজে না, এর মধ্যে তিন তিনখানা বিয়ে হয়ে গেছে, বড়দির বিয়ে, ছোড়দির সাথে বিশুদার বিয়ে আর একবছর আগেই মেজদার বিয়ে। এতক্ষণ বুকের মাঝে বেঁধে থাকা স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এলো, শেষ পর্যন্ত তাহলে সবার মতামত আছে, যাক তাহলে সব মিটমাট হয়ে গেল।

ঠিক সেই সময়ে বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে দুম করে বললে ফেলল, “না না অনুর বিয়ে হতেই পারে না। আমি সব বলছি আগে আমার কথা শোনা হোক...”

বড়দার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল আর ছোড়দি এক ধমক দিয়ে বলল, “তুমি থামো তো। শেষ পাতে শুক্তো দিয়ে আর মুখ মারতে হবে না। তোমার আশায় বসে থাকলে এদের এতক্ষনে বিয়ে হয়ে যেতো।”
 
(১৬)

এই সবে অনেক সময় চলে গেল। জেঠিমা আমাকে বললেন দেবুকে ফোন করে দিতে। আমার আগেই অনু দেবুকে ফোন করে জানিয়ে দিল সব কথা, সেই শুনে দেবুর চক্ষু চড়ক গাছ। এত লোকের সামনে তাকে কাটা হবে শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর, আমি ওকে বললাম যদি এখন না আসে তাহলে যেন অনুকে ভুলে যায়। অনু ওকে এক ধ্যাতানি দিয়ে বলল যদি আধ ঘন্টার মধ্যে না আসে তাহলে ফিনাইল খাবে। দেবু বেচারা আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

ওদিকে মা জেঠিমা ছন্দার মাকে ফোন করে দিল আমার কিছু বলার আগেই, সাথে এও জানাল যে পরের দিন বাড়ির সবাই ছন্দাকে দেখতে আসবে আর সেই সাথে আশীর্বাদ করে যাবে। মাসিমা সব শুনে আঁতকে উঠলেন, এত তাড়াতাড়ি এক রাতের মধ্যে এত সব কি করে হবে। আমাদের আবার পঙ্গপালের পরিবার আশীর্বাদ করতে বাবা কাকা জ্যাঠা, মামা মাসি পিসি আর এই গুটি কতক ভাই বোন মিলে জনা পঞ্চাশ যাবে। সেই শুনে মাসিমা হার্ট ফেল করার যোগাড়, এত লোকতো বর যাত্রী হয়। অনুর মা আমাদের পরিবারের ব্যাপারে বুঝিয়ে বললেন আর বললেন যে সবাই বাড়ির লোক, কেউ বাইরের নয় সব কাজ হাতেহাতে করে নেবে। জেঠিমা বড়দা মেজদাকে আর শুভকে বললেন আশীর্বাদের জন্য ছন্দার বাড়ির সব কিছু ব্যবস্থা করতে। কি কি কেনা হবে তাঁর ফর্দ বানানো হয়ে গেল। মেজদা আর শুভ জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়ে গেল।

আমি অনুর বাড়ি গিয়ে ছন্দাকে ফোন করলাম কারন আমাদের বাড়ি তখন হরি শার হাটের মতন অবস্থায় ছিল। আমার ফোন পেয়েই তেড়ে ফুঁড়ে উঠল, “যাও তোমার সাথে একদম কথা বলব না।” অভিমানিনীর ওই সুর অনেকদিন শুনিনি, আমার দু'কানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিল। ছন্দা চেঁচিয়ে উঠল ওইপাশ থেকে, “তোমার কোন আক্কেল নেই? এই রাতে বলছো ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে? আমি তোমাকে বলেই দিয়েছি যে বিয়ে করব না।”

আমি আর কি বলি, “তুমি যে আমার সাথে এতদিন কথা বলোনি, তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম একেবারে বিয়ে করেই লন্ডন যাবো।”

ছন্দা আবেগে কেঁদে ফেলল, “বড্ড শয়তান ছেলে তুমি, একবার হাতের কাছে পাই এমন মারব না...”

আমি উত্তরে বললাম যে কিছুক্ষণের মধ্যে আমি, বড়দা আর মেজদা সব কিছু কেনা কাটা সেরে ওদের বাড়ি যাবো আর সব ব্যাবস্থা করে দেব। সেই শুনে একটু ক্ষান্ত হলো ছন্দা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবু এসে পৌঁছালো, ওর অবস্থা আমার চেয়েও সঙ্গিন। আমি আর অনু ওকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে সব কিছু পাখি পড়ার মতন বুঝিয়ে দিলাম আর বললাম যে সবাই ঠিক আছে শুধু ও যেন বেঠিক না হয়ে যায়। দেবু বৈঠকখানায় ঢুকে অত লোকজন দেখে চমকে গেল। বাবা জ্যাঠা দেবুকে রিতিমত সি বি আইয়ের মতন প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে দিলেন। কি কর, বাড়িতে কে কে আছেন, কোথায় বাড়ি বাবা কি করেন, কয় ভাইবোন ইত্যাদি। আমি আর ছোড়দি দুর থেকে ওকে দেখে হাসি থামাতে পারলাম না ওদিকে অনুর গলা শুকিয়ে আমাদের বকাঝকা শুরু করে দিল।

আমার ছোট পিসেমশায় বড় মজার লোক, এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, দেবুর ওই অবস্থা দেখে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বললেন, “এই যে দেবাশিস, একবার কান ধরে উঠ বোস করো তো।” তাঁর কথা শুনে দেবু হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না, ছোট পিসে মশায় গম্ভির কণ্ঠে বললেন, “বাড়ির দুই জামাই যখন মেয়ে দেখতে এসেছিল ওদের কিন্তু কান ধরে উঠ বোস করিয়েছিলাম এটা আমাদের বাড়ির রীতি। জামাইকে আগে আমরা কান ধরে উঠবোস করাই, যদি ভালো করে করে তবেই মেয়ে নিয়ে যেতে দেই নচেৎ নয়।”

অতগুলো লোকের সামনে ওই কথা শুনে দেবুর হার্ট ফেল করার যোগাড়, সবাই হেসে ফেলল দেবুর অবস্থা দেখে। শেষ পর্যন্ত বিশুদা ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলো ওইখান থেকে। অনুর মায়ের জামাই দেখে কত খাতির, এটা খাও সেটা খাও। অনু লাজুক হেসে ছোড়দির পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে গেল। ঠিক হল যে বাড়ি গিয়ে দেবু বাবা মায়ের সাথে কথা বলে আমাদের জানাবে সেইমতন আমার জ্যাঠা আর সিধু জ্যাঠা ওর বাবার সাথে কথাবার্তা বলবেন।

শুভ আর মেজদা বাজার করে আসার পরে আমার ছোট কাকিমা আর ভাইদের নিয়ে আমরা গাড়ি করে চলে গেলাম ছন্দার বাড়িতে। আমাদের পৌঁছানোর খবর মা আগে থেকেই মাসিমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। অনুর দুই ভাই আর আমার দুই ভাই মিলে ঘর সাজাতে লেগে গেল, বড়দা আর মেজদা জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিল সেই সাথে রান্নার ঠাকুরের ব্যাবস্থা। ছোট কাকিমা আর মাসিমা পরের দিনের ব্যবস্থায় লেগে গেলেন। সব যেন যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় ঘটে গেল। ছাড়পত্র পেয়ে গেছিলাম তাই ছন্দাকে নিয়ে একটু আড়ালে বসার অবকাশ পেয়ে গেছিলাম।

ছাদে উঠতেই ছন্দা আমাকে কষে এক চাঁটি লাগিয়ে দিল আর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো, “যাও তোমার সাথে একদম কথা বলব না। বলা নেই কওয়া নেই, এই ভাবে কেউ বিয়ে করতে আসে নাকি?”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললাম, “কি করি সোনা, নাহলে কোন উদো পাড়ার বৈশাখিকে আমার গলায় বাঁধতে চলেছিল।”

ছন্দা বুকের ওপরে আঁকিবুঁকি কেটে বলল, “এতদিন কথা বলোনি কেন?”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “আমি কথা বলিনি না তুমি কথা বলোনি? কত বার তোমার অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তুমি বের হতে আর আমাকে দেখেই ট্যাক্সি নিয়ে নিতে।”

ঠোঁট কামড়ে ধরে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বলল, “বাস ধরলে তো জানতাম যে তুমি আমার পেছন পেছন বাসে চাপবে তাই ট্যাক্সি নিতাম। এবারে ওই চারদিনের ট্যাক্সি ভাড়া দাও?”

আমি আমার মানিব্যাগ ওর হাতে সঁপে দিয়ে বললাম, “আগে হৃদয় নিয়েছিলে আজকে এই পকেট তোমার।”

মানিব্যাগ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “মনে থাকে যেন এই কথা।”

আমি ওর নাকের ডগায় নাক ঘষে বললাম, “লন্ডন তাহলে একসাথেই যাচ্ছি?”

মৃদু হেসে মাথা নাড়াল, “হ্যাঁ, তবে এত তাড়াতাড়ি ভিসা পাবো কি করে?”

আমি বললাম যে সেই চিন্তা জ্যাঠা মশায়ের, কাস্টমসে চাকরি করেন দূতাবাসের অনেক লোকজন তাঁর চেনাজানা। ওই নিয়ে বিশেষ অসুবিধে হবে না।

সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে গেল, একে একে সবার আশীর্বাদ হয়ে গেল, প্রথমে ছন্দার তারপরে অনুর তারপরে দেবুর শেষে আমার। দুই সপ্তাহ পরেই অনুর বিয়ে আর তার চার দিন পরে আমার। বাড়িতে সাজ সাজ রব, কেনা কাটা, বাজার করা মেরাপ বাঁধা সবকিছু যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাবার পরে ছন্দার সাথে একটু নিরিবিলিতে কথা বলতে পারবো, সেই কবে থেকে কত কথা জমে আছে বুকের মধ্যে ওইদিকে ছন্দার অবস্থা আমার মতন। ওর পেট প্রায় ফেটে যাচ্ছিল, এর মাঝে কোন রকমে একবার দেখা পেয়েছিলাম সেদিন আমাকে খুব মেরেছিল আর বুকে মুখ লুকিয়ে এক ঘন্টা ধরে কেঁদেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্ত, তারপরে আর ছন্দাকে একা পাওয়া গেল না। রোজ দিন কেউ না কেউ ওকে নিয়ে বিয়ের কেনা কাটা করতে বেরিয়ে যায়, আমি কিছুতেই সাথে থাকতে পারি না। ধিরে ধিরে অনুর বিয়ের দিন কাছে চলে এল।

অনুর বিয়ের দুই দিন আগেই মা জেঠিমা ছন্দাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলো। উঠতে বসতে ছন্দা বাবা জেঠার “বৌমা” ডাকে সাড়া দিতে শুরু করল। এক বেলার মধ্যেই বাড়ির বড় বৌমা হয়ে উঠল, সবার চোখের মণি, ভাই বোনেদের বড় বৌদি আর মায়ের চেয়েও কাকিমার বড় আদুরে হয়ে গেল। সব থেকে অবাক করে দিল আমাকে, “পার্থ” ছেড়ে “ওগো, হ্যাঁ গো” শুরু করে দিল, আমি ওই ডাক শুনে হেসে আর কুল পাই না।

এর মাঝে আমরা নবীনকে একদম ভুলে গেছিলাম। সন্ধের দিকে ছন্দা আমাকে নবীনের কথা মনে করিয়ে দিতেই আমার মাথায় হাত। আমি আর ছন্দা সেদিন বিকেলে নবীনের বাড়িতে গেলাম। নবীন যে বদলে গেছে সেটা আর বলে দিতে হলো না।

আমাদের দেখে হেসে বলল, “তোদের বিয়েতে আমি থাকতে পারব না রে।”

আমরা দুইজনেই অবাক হয়ে গেলাম, ছন্দা ওকে জিজ্ঞেস করল, “কেন, তোর তো ফ্রাঙ্কফারট যেতে অনেক দেরি আছে, তাহলে?”

নবীন বাঁকা হেসে বলল, “নারে আমি কাল দিল্লী চলে যাচ্ছি, ওইখানে কিছুদিন থাকব তারপরে ফ্রাঙ্কফারট চলে যাবো।”

ছন্দা আর আমি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম, ছন্দা আক্ষেপের সুরে বলল, “অনুকে জানিয়েছিস যে তুই চলে যাচ্ছিস? ও শুনলে কিন্তু খুব দুঃখ পাবে।”

নবীন কাষ্ঠ হেসে বলল, “না রে ওর সাথে দেখা করার আর সময় পাইনি। এক বার ভেবেছিলাম যে তোদের বাড়ি যাবো কিন্তু তোরা এসেছিস তাই আর যাবো না।”

ছন্দা ওকে চেপে ধরল, “তোর নিশ্চয় এখন কোন বিশেষ কাজ নেই আর কাজ থাকলেও পরে করা যাবে। এখুনি চল অনুর সাথে দেখা করবি।”

নবীন বেশ কিছুক্ষণ ভাবল তারপরে ওকে বলল, “না রে ছন্দা আমি আর যাবো না ওর সামনে।”

ছন্দা ছাড়তে নারাজ, “কেন যাবি না। তোরা নাকি ছোট বেলার বন্ধু আর আজকে এত আনন্দের দিনে তুই ওর সাথে দেখা না করেই চলে যাবি?” নবীন চুপ, ছন্দা ওকে চেপে ধরল, “যতক্ষণ না আসল কথা খুলে বলছিস ততক্ষন আমি এখান থেকে যাবো না।”

নবীন ওর আলমারি থেকে একটা পুরানো জুতোর বাক্স এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি বাক্স খুলে দেখলাম ওর মধ্যে একটা অতি পুরাতন মাটির পুতুল। পুতুল দেখে আমার পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। আমার বেশ মনে আছে ওই পুতুল বড়দা অনুকে চড়কের মেলায় কিনে দিয়েছিল। আমরা তখন অনেক ছোট, ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। এক বিকেলে আমি নবীন পিতু বিষ্টু সবাই মিলে উঠানে ডাঙ্গুলি খেলছিলাম আর অনু ওই পুতুলকে শাড়ি পরাচ্ছিল বারান্দায় বসে। আমাদের ডাঙ্গুলির গুলি গিয়ে লাগে ওর পুতুলে আর পা ভেঙে যায়, আমি অনুর ওপরে খুব তোড়বাড় করেছিলাম কিন্তু নবীন ওই পুতুল নিয়ে বলেছিল যে পুতুলের পা জোড়া লাগিয়ে দেবে। তারপরে আমি আর খোঁজ নেইনি পুতুলের কি দশার হয়েছিল।

ছন্দা আমার দিকে একবার তাকাল তারপরে নবীনকে বলল, “তুই এতদিন কেন চুপ ছিলিস, কেন বলিসনি যে অনুকে তুই ভালবাসিস।”

নবীনের কাষ্ঠ হেসে জবাব দিল, “কে বলেছে আমি অনুকে ভালোবাসি?”

ছন্দা ছাড়ার পাত্রী নয়, “তোর চোখ তোর সারা শরীর চেঁচিয়ে বলছে যে তুই ওকে ভীষণ ভালবাসিস আর তাই ওকে না জানিয়ে চুপিচুপি চোরের মতন পালিয়ে যাচ্ছিস। তুই কি ভাবিস আমাদের চোখ নেই?” ছন্দা আমার হাত থেকে জুতোর বাক্স নিয়ে ওকে ধরা গলায় বলল, “এতদিন এই মাটির পুতুল অতি সযত্নে রেখেছিস কেন? চার বছর আগের ষষ্টির রাতের কথা মনে আছে তোর? অনু তোকে বারেবারে জিজ্ঞেস করেছিল যে তোর কিছু বলার আছে কি না, তুই তাও চুপ করেছিলি, কেন? আমি সেদিন পার্থকে বলতে গিয়েও বললাম না, ভেবেছিলাম কোনোদিন তোর মনের কথা বলবি কিন্তু... ছাড় আর কিছু বলার নেই আমার রে।”

নবীন ধরা পড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মনের কথা খুলে বলল আমাদের কাছে, “আমি কালো কুৎসিত দেখতে ছন্দা, এই চেহারা নিয়ে কি ওর মতন সুন্দরীকে ভালোবাসা যায় বল? আমার চেহারায় পক্সের দাগ, ছোট বেলা থেকে রোগা পটকা ছিলাম। ভেবেছিলাম বড় হলে মনের কথা বলব কিন্তু যত বড় হলাম পেঁচি অনু তত সুন্দরী হয়ে উঠল। আমার মতন কুৎসিত দেখতে একটা ছেলে ওর পাশে বড় বেমানান দেখাবে তাই সরে এলাম। দেবু আমার চেয়ে দেখতে শুনতে ভালো, ওদের দুইজনের জুটি একদম হর পার্বতী।” একটু থামল নবীন, ছন্দা আর আমি মন দিয়ে ওর কথা শুনে গেলাম। নবীন বলে চলে, “আমি ইচ্ছে করেই দিল্লীতে এম টেক নিলাম যাতে আর ওর সামনে না থাকতে হয়। ভেবেছিলাম যে দেবু হয়ত বাইরে চলে যাবে কিন্তু দেবু যখন গেল না তখন আমাকেই যেতে হবে তাই ফ্রাঙ্কফারট চলে যাচ্ছি চিরদিনের জন্য। আমি বাড়িতে বলিনি তবে তোদের বলছি আমি কোনোদিন দেশে ফিরব না। এখানে আর কিছু নেই আমার জন্য...” কথাটা আর শেষ করতে পারলো না নবীন, ছন্দার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল নবীন, “এইসব অনুকে দয়া করে বলিস না তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব না। শুধু এই বাক্সটা আমাকে দিয়ে দে, এটাই আমার অনুসুয়া। আমার হয়ে প্লিস দেবুকে বলিস কোনোদিন যেন অনুকে কষ্ট না দেয় তাহলে আমি কিন্তু ওকে মেরে ফেলবো।”

আমরা ওকে কি সান্তনা দেব ভেবে পেলাম না, অনু কি সত্যি এতদিনে বোঝেনি যে নবীন ওকে ভালবাসে? আমরা বেশ কিছুক্ষণ ওর সাথে বসলাম আর তারপরে চলে এলাম। ছন্দার মন ভারি হয়ে গেছিল, সারাটা সময় আমার হাত শক্ত করে ধরেছিল। দুইজনে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। নবীনের ওই কথা কোনোদিন অনুকে আমরা জানাই নি।

অনুর বিয়ের দিন কাক ভোরে নবীন দিল্লী চলে গেছিল আমি ওকে কোলকাতা এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিলাম। ছন্দা যেতে পারেনি। নবীন ছন্দাকে একটা দামী সোনার হার উপহার দিয়েছিল আর আমার জন্য একটা রোলেক্সের ঘড়ি।

ঘটা করে অনুর বিয়ে হল আর তারপরের দিনেই ছন্দাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল মা। ওর বাড়ির বিয়ের ব্যবস্থা মেজদা আর আমার দুই ভাই মিলে করেছিল। বউভাতের পরের দিনেই দেবু আর অনু বাড়িতে এসে গেছিল। বিয়ে ভালো ভাবেই মিটে গেছিল। আমাদের ভিসা পেতে বিশেষ বেগ হয়নি তবে একমাসের মতন লেগেছিল আর আমাদের লন্ডন যাওয়া এক মাসের মতন পিছিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার দিনে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছন্দা আর অনুর কি কান্না, দেবু অনেকক্ষণ আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।

প্লেনে উঠে অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল ছন্দা, মন বড় কেঁদে উঠেছিল ওর সেইসাথে আমার। আমার হাতখানি ধরে দিল্লী পর্যন্ত চুপ করে চোখ বন্ধ করে ছিল। গভীর রাতে দেশ ছাড়লাম, ছেড়ে গেলাম রোদে ভেজা কল্লোলিনী সাথে রইল আমার তিলোত্তমা যাকে নিয়ে ওই রোদে কতবার ভিজেছি।
 
নতুন করে আবিষ্কার করছি । দু'জনকে । - পিনুরাম স্যর । এবং ''নির্জনমেলা'' । সালাম ।
 
রবিবারের দুপুর

রবিবারের খাঁ খাঁ দুপুর, একটা কাক অনেকক্ষণ ধরে পাশের বাড়ির কার্নিশে বসে কা-কা করে ডেকে চলেছে। বড় রোদ বাইরে তার ওপরে ঘাম, গায়ের গেঞ্জিটা গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। এইতো সবে স্নান সেরে উঠল আর এইমাত্র ঘেমে গেল। জানালার বাইরের আম গাছটায় ছোটো ছোটো আম লেগেছে। কচি আমের গন্ধে ঘরটা মম-মম করছে। দুপুরের গরম বাতাসে লেগে আছে মন কেমন করা একটা ভাব। মাথার ওপরের পাখাটা বনবন করে ঘুরছে আর মাঝে মাঝে ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ করে উটছে।

রূপক বেডরুমে বসে পেপার পড়ছিল আর মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিচ্ছিল। একবার জানালার বাইরে কাকটার দিকে ভ্রুকুটি নিয়ে তাকালো, বড় জ্বালাচ্ছে তখন থেকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো, গাড় নীল আকাশের বুকে এক ফোঁটা মেঘের লেপ মাত্র নেই। বেশ কয়েকটা চিল দুরে উঁচুতে গোলাকার চক্কর কেটে চলেছে।

“এই কিগো মাংসটা একটু নেড়ে দাও না?” বাথরুম থেকে চেঁচিয়ে উঠল আম্বালিকা।

বউয়ের আওয়াজ শুনে যেন পৃথিবীতে ফিরে এল রূপক। এতক্ষণ কি যে ভাবছিল সেটা নিজেই জানেনা। পেপার তো খোলা ছিল চোখের সামনে কিন্তু ঠিক পড়তে মন করছিল না।

“হুম এই নাড়িয়ে দিচ্ছি।” এই বলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো রূপক। “তোমার আর কতক্ষণ, বাপ রে বাপ, আজ কি ট্যাঙ্কির জল পুরোটা শেষ করবে বলে ধরে নিয়েছো।”

“তোমার তাতে কি দরকার, তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো না।” একটু রেগে গিয়েই আম্বালিকা বলে উঠল। ওর স্নান করতে একটু বেশি জল আর সময় লাগে ঠিকই তার ওপরে এই গরম।

শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে নিজের উদ্ধত স্তনে ওপরে জলের ছোঁয়া বেশ উপভোগ করছে। ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়ায় স্তনের বোঁটা দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে। দুই হাত দিয়ে নিজের কোমল বক্ষ আলতো করে চেপে ধরলো আম্বালিকা। মাথা নিচু করে জলের স্রোত গড়াতে দেখে, কিছু সরু ধারা নরম গল পেটের ওপর দিয়ে বয়ে গভীর নাভির চারদিকে মাখামাখি করে আরও নিচে নেমে যায়। স্রোতটা হারিয়ে যায় দুপায়ের ফাঁকে, বেশ সুন্দর করে ছাঁটা ছোট্ট ঘাসের বাগান ওর নারীত্বের দোরগোড়ায় সাজানো। ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়ায় সেই বাগানে ঘাস গুলো কোমল পাপড়ির সাথে লেপ্টে গেছে। সুগোল পেলব থাইয়ের ভেতরে হাঁটু পর্যন্ত রূপকের আঁচড়ের দাগ। অজান্তেই আম্বালিকার রক্ত চনমন করে ওঠে।

হেসে ফেলে আম্বালিকা। মনে মনে বলে, “দুষ্টু ছেলে, শুধু খেলা আর খেলা।”
দু আঙুলের মাঝে স্তনের বোঁটা দুটি নিয়ে একটু একটু করে চাপ দেয় আম্বালিকা। এখন একটু একটু ব্যাথা আছে বুকে, যেরকম ভাবে সকাল বেলায় চুষে টিপে পাগল করে তুলেছিল রূপক, আর বলার নয়। ফ্যাকাসে গোলাপি ঠোঁট ছোটো হা করে অস্ফুট প্রেমের শীৎকার করে ওঠে।

রূপক মাংসটা নাড়িয়ে পা টিপে টিপে বাথরুমের দরজায় কান পাতে। ভেতরে থেকে জল পড়ার শব্দে মনটা আকুলি বিকুলি করে ওঠে। সকালে ঠিক করে মন ভরেনি যেন। ভেতর থেকে অস্ফুট আওয়াজ শুনে রূপক আর থাকতে পারেনা, বলে ওঠে “বেবি নিজেকে নিয়ে না খেলে, আমারটাকে একটু আদর করলে তো পারো।”

লজ্জায় লাল হয়ে যায় আম্বালিকা, এই যাঃ ধরা পড়ে গেল যে। “আমি যখন স্নান করবো একদম দরজায় কান পাতবে না। তোমাকে কতবার বারন করেছি তাও তুমি শুনবে না।”

“বেরিয়ে এসো প্লিস আর কতক্ষণ আমি উপোষ থাকবো।” মিনতির সুরে বলে রূপক।

“তুমি না, একদম যা তা। তুমি আগে বেডরুমে যাও তার পরে আমি বের হব।” আদর করে হুকুম করলো আম্বালিকা। তোয়ালে জড়িয়ে যখন ও বের হবে তখন ওর দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকবে রূপক। দু চোখ ভরে পান করবে ওর রুপসুধা আর সেই দৃষ্টি বাণে জর্জরিত হয়ে যাবে আম্বালিকার কমনীয় শরীর।

দরজা ফুটো করে যেন রূপক দেখতে পাচ্ছে আম্বালিকার নগ্ন শরীর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলের ফোঁটা সারা অঙ্গে। বারমুডার ভিতরে সিংহ বাবাজি দণ্ডায়মান। অস্ফুট স্বরে বলে রূপক, “ওকে বেবি।” অজান্তেই হাত চলে যায় ফুলে ওঠা সিংহের ওপরে, যেন আর মাথা নত করতে পারছে না। চাপা হাসি হেসে সরে আসে রূপক, মনে মনে বলে, “একবার তো বের হও সোনা তারপরে তোমাকে কে বাঁচাবে।”

আম্বালিকা নিজের ভেজা শরীরের চারদিকে আকাশী রঙের তোয়ালে জড়িয়ে নেয়। বুকের খাঁজে গোঁজা তোয়ালে, সুগোল নিতম্বের ঠিক নিচ পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। মাথার চুল চুড় করে তার ওপরে আরেকটা তোয়ালে জড়িয়ে নেয়। বুকটা চনমন করে ওঠে, “দরজার বাইরে রূপক দাঁড়িয়ে নেইতো?” দরজাটা হাল্কা ফাঁক করে দেখে নেয় যে আম্বালিকা, “যাক শয়তানটা নেই।” হাঁটার ছন্দে একটু দোলা লাগিয়ে হাল্কা হেসে বেরিয়ে আসে।

একবার বসার ঘরে উঁকি মেরে দেখে নেয় রূপক নেই তো। না, ফ্যানটা বন্ধ তার মানে শোয়ার ঘরে ওর অধির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। শোয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো আম্বালিকা। ঢুকে দেখল যে রূপক বিছানায় নেই, পেপারটা হা করে পড়ে আছে বিছানার ওপরে। এস্ট্রেতে আধা জ্বলা সিগারেট পুড়ছে, মাথার ওপরের ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে। মনটা চনমন করে ওঠে আম্বালিকার, রূপক এখুনি দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরবে। চেপে ধরবে দুই বলিষ্ঠ বাহুপাশে, পিষে নিংড়ে নিতে চাইবে ওর কোমলতা। সেটা জেনেও না জানার ভান করে ড্রেসিং টেবিলের দিকে পা বাড়ায় আম্বালিকা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top