(৯)
আমাদের সব বন্ধুদের নেমন্তন্য করা হল, আমার আর অনুর বন্ধু সংখ্যাই কুড়ি ছাড়িয়ে গেল। বিয়ের একদিন আগেই অনু ছন্দাকে ডেকে নিল, অনুর বান্ধবী হিসাবে ছন্দাকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অনু যখন ছন্দাকে মা জেঠিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আমি তখন বাড়ির ত্রিসীমানায় ছিলাম না। পরে শুনেছিলাম যে ছন্দাকে দেখে আমার জেঠিমার খুব পছন্দ হয়েছে, সেই কথা শুনে আমি তাধিন তাধিন করে নেচে নিলাম।
ছন্দা আমাকে মজা করে বলেছিল, “তোদের যা পঙ্গপালের গুষ্টি সবাইকে প্রনাম ঠুকতে ঠুকতে আমার কোমর বেঁকে গেল।”
দুই বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার আর আকাশদার ঘাড়ে। বিশ্বজিৎদা তো মজাসে ছোড়দিকে নিয়ে কেনাকাটা করাতে ব্যস্ত। ধুর ব্যস্ত না ছাই, আমি হলফ করে বলতে পারি কেনাকাটার নাম করে ওরা ওই কয়দিনে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেননা যা কেনার সব আমি আকাশদা নবীন আর অনু মিলে করেছিলাম।
বিয়ের দিনে সাজসাজ রব, এ বাড়িতে ফুল নেই তো ওই বাড়িতে এখন পর্যন্ত বিদ্ধি পুজোর ঠাকুর মশাই আসেনি। খাবার জায়গা এক জায়গাতেই। দুই বাড়ির মাঝের মাঠেই সামিয়ানা টাঙানো। তখন ক্যাটারার ছিল না, ঠাকুর মশায় রান্না করতেন আর বাড়ির ছেলেরা পরিবেশন করতো। আমাদের মাথা ব্যাথা হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
এর মাঝে ছন্দা এসে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে গেল, “রাতে কোন শাড়িটা পরবো বলে দে।”
বিকেল হয়ে গেছে এদিকে তখন নিরামিষের জন্য ছানা এসে পৌঁছায় নি। আমি ওকে এক ধ্যাতানি দিয়ে বললাম, “তোর যা ইচ্ছে তাই পরিস এখন আমার মাথা খাস না।”
ব্যাস, অভিমানিনীর মুখ ফুলে লাল, “যা তোকে জিজ্ঞেস করাই বৃথা। আমি সাজবোই না বিয়েতে।”
একদিকে টেনে নিয়ে আবার ওকে শান্ত করলাম, “প্লিস সোনা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এদিকে ছানা এখন আসেনি সেগুলো আনতে নবীনকে পাঠিয়েছি, ওদিকে কয়লা ফুরাতে চলল তার জন্য বাপ্পাকে পাঠালাম আর শালা কোথায় মরতে চলে গেছে। আর এমনিতে তুই যা পরবি তাতেই তোকে সুন্দরী দেখাবে।”
চশমাটা একটু উপরের দিকে ঠেলে দুষ্টুমি ভরা হেসে বলল, “রাতে দেখিস তোকে কি করি।”
যাই হোক সেইসময়ে ওকে ক্ষান্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সন্ধের পরে যখন বাড়ি থেকে সেজে বের হল তখন আমি ওকে দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। ছন্দার পরনে একটা গাড় নীল রঙের সাউথ সিল্কের মেখলা। কাঁচুলিটার পিঠ একটা গিঁট দিয়ে বাঁধা, মেরুদণ্ডর খাঁজ যেন সুগভির কোন নদী। সুউন্নত, সুডৌল কুচ যুগল কাঁচুলির ভেতরে হাঁপিয়ে উঠছে, ঠিকরে বেরিয়ে আসতে উদ্যত। সেদিন বেনুনি ছেড়ে খোঁপা বেঁধেছে, খোঁপায় একটা সুন্দর হাতির দাঁতের ক্লিপ। গলায়, হাতে, কানে হায়দ্রাবাদি মুক্তোর সেট ঝলমল করছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। ডান কব্জিতে সোনার ঘড়ি আর বেশ কয়েক গাছা সোনার চুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও স্বর্গের নর্তকী এই মর্তধামে নেমে এসেছে। আমি চারপাশে চেয়ে দেখলাম, ওর রুপ আর সাজ দেখে অনেকের চোখ ওর দিকে চলে গেল। অনু আমাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল কেমন সাজিয়েছে। আমি শুধু বুক চেপে উফ একটা আওয়াজ করে থেমে গেলাম, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার উপায় ছিল না তখন। আকাশদার বন্ধুরা আর বিশ্বজিৎদার বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছন্দা আর অনুকে দেখার জন্য।
বিয়ের সারা সময়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম, মাঝে মাঝে ওদের দুইজনের দেখা পাওয়া যেতো। দুই ফুলটুসি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেশ মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাওয়ার সময়ে এদিকে লোক ওদিকে লোক, কে খেতে বসলো, কে খেয়ে চলে গেল, কে নিরামিষ খাবে, কার পাতে মাংস পড়েনি সেই সব নিয়ে হইচই রইরই ব্যাপার। দেবুকে কাজ দিতে গেলেই অনু বলে দেয়, না ও কিছু করবে না। আমি মনে মনে বললাম, আমাদের বাড়ির সব জামাইগুলো কুঁড়ে। বিয়ের দিকে কি হচ্ছে সেসবে আমার মাথা ব্যাথা ছিল না কারন ছোড়দি তো আর বেশি দূর যাচ্ছে না। আগে রোজ রাতে এবাড়িতে ঘুমাতো, সেদিনের পর থেকে মাঠ পেরিয়ে ওবাড়িতে ঘুমাবে এই যা তফাৎ।
দুটো ব্যাচের খাওয়ার মাঝে আমি আর নবীন অন্যদিকে গিয়ে সিগারেট টানছিলাম।
এমন সময়ে ছন্দার দেখা। ওকে দেখে নবীন মিচকি হেসে বেরিয়ে চলে গেল। আমার পাশ ঘেঁসে হাতখানি ধরে বলল, “কি রে কেমন দেখাচ্ছি একবার বলবি না।”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ওর কালো গভীর চোখের তারায় হারিয়ে গেলাম। ওর দেহের থেকে বিচ্ছুরিত অতীব আকর্ষণ আমাকে টেনে আনলো ওর কাছে, এত কাছে যে আমাদের শরীরের মাঝে জায়গা ছিল না। ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো আমার চাহনির বানে। আমার বুকের মাঝে তখন ঝড় উঠেছে, ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে যাবো কিন্তু হাত ছাড়িয়ে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বলল যে ওর সাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমি ওকে বললাম যে এই মন্ডপে বসার ইচ্ছে আছে নাকি। সেই শুনে লাজুক হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় এত তাড়াতাড়ি নয়।
আমি ওকে ফিসফিস করে বললাম, “তুই যে এতো সুন্দরী সেটা ধারনা ছিল না। শাড়ি ছেড়ে মেখলা, আমি তো ভাবতে পারছি না।”
আমাকে বলল, “গত বছর মামা বাড়ি গিয়ে কিনেছিলাম কিন্তু আর পরা হয়নি।”
আমি ওকে বললাম, “তোকে না আমার বুক পকেটে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।”
ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কি? বুক পকেটে কেন? বুকের মধ্যে আমি ছাড়া আর কে কে আছে?”
আমি ওর নরম গালে টোকা মেরে বললাম, “আরে না রে বোকা মেয়ে, বুকের মধ্যে রাখতে হলে যে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। এখন ওপেন হার্ট সার্জারি করার মতন বয়স হয়নি আমার।”
কেন জানিনা ওর চেহারা দেখে আমার মনে হল এখনো কিছু সাজ বাকি রয়েছে, যদি আমি নিজে হাতে ওকে সাজাতে পারতাম তাহলে হয়তো ওর সাজ সম্পূর্ণ হতো। ওর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তারপরে পকেট থেকে পেন বার করলাম। বাম হাতের তর্জনী দিয়ে ওর থুতনি ছুঁয়ে আমার দিকে তাকাতে বললাম। ছন্দা আমার তর্জনীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল, আসন্ন উত্তেজনায় ওর শরীর কাঠ হয়ে গেল। ডিসেম্বরের শীতেও ওর নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু দেখা দিল। ওর তপ্ত শ্বাসে আমার মুখ বুক সব ভেসে গেল। আমার দিকে মুখ উঁচিয়ে চোখ জোড়া আধাবোজা করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি পেন দিয়ে ছন্দার থুতনিতে তিনটে ছোটো ছোটো বিন্দু এঁকে দিলাম। লজ্জা ভরা লাল টুকটুকে চেহারা দেখে এবারে মনে হল যেন ওর সাজ সম্পূর্ণ। নিজের অজান্তেই ছন্দার হাত দুটি মুঠি হয়ে গিয়ে গাল, কান গরম হয়ে গেল। ভেজা পায়রার মতন কেঁপে ওঠে ছন্দার পেলব দেহ। চোখ বন্ধ করে আমার হাতখানি শক্ত করে ধরে নেয় আর নিজের অজান্তেই ওর গোলাপি নরম ঠোঁট দুটি অল্প ফাঁক হয়ে যায়। পদ্মের পাপড়ির মতন ঠোঁটগুলো কেঁপে ওঠে, যেন দখিনা বাতাস বইছে। আমি ওর নরম ঠোঁট জোড়া দেখে আর থেমে থাকতে পারলাম না, আমার আঙুল থুতনি ছাড়িয়ে ওর গালের ওপরে চলে গেল। আলতো করে গালের ওপরে আঙুল বুলিয়ে মাথা নিচু করে ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। তীব্র আবেগে বশে আমার ঠোঁট কামড়ে দিল ছন্দা। ঠিক কতক্ষণ ওইভাবে অধর ওষ্ঠ মিলিয়ে ছিলাম বলা মুশকিল তবে কেউ যেন আমাকে ডাক দিল আর আমাদের গভীর চুম্বনে ছন্দপতন ঘটে গেল।
অনু এদিক ওদিকে খুঁজে আমাদের ওইখানে পেয়ে ঝাঁজিয়ে উঠল, “তোরা দুইজনে এইখানে কি করছিস? ওইদিকে বিয়ে শেষ হতে চলল।”
অনুকে দেখেই ছন্দাকে ছেড়ে দিয়ে আমি ওকে বললাম, “কি হয়েছে এত গরম হয়ে আছিস কেন?”
অনু জানাল যে আগে ছোড়দির ঘরে বাসরের কথা ছিল কিন্তু লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে নিচের তলার বৈঠকখানায় বাসরের ব্যবস্থা করতে হবে। তার মানে কাজ বেড়ে গেল, আমি ভেবেছিলাম যে রাতে একটু খালি পাবো আর ছন্দার সাথে একটুখানি একলা সময় কাটাতে পারবো কিন্তু অনুর কথা শুনে মনে হল সে গুড়ে বালি। নিরুপায় হয়ে ছন্দা বাঁকা হাসি দিয়ে অনুর সাথে চলে গেল আর আমি আকাশদাকে নিয়ে বৈঠকখানা ঠিক করতে চলে গেলাম।
মেজদাকে জিজ্ঞেস করাতে মেজদা মিচকি হেসে বলল যে অনু আর অনুর বান্ধবী মানে ছন্দাকে দেখে ওর বন্ধুরা আর বড়দার বন্ধুরা রাতে থেকে গেছে। আমি মনে মনে হেসে ফেললাম, তোদের পাতে কাঁচ কলা, ওই দুইজনেই নিজেদের বর আগে থেকেই খুঁজে নিয়েছে। আমি অনু আর ছন্দাকে ওদের অভিপ্রায় জানিয়ে দিলাম, ছন্দা আকাশ থেকে পড়ল, কি হবে এবারে? অনু ওকে ক্ষান্ত করে দিয়ে বলল যে কিছুই হবে না কেউ ওদের টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না।
রাতে মেজদার বন্ধু আর বড়দার বন্ধুদের সাথে অনুর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে আড্ডা বসল। মেজদা মদ এনেছিল, বাড়িতে বসে মদ খাওয়া এক বিশাল ব্যাপার কিন্তু বিয়ের সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে সেইসব করা যেতে পারতো। ওরা সবাই মিলে নবীন আর আমাকে চেপে ধরল, একবার ছন্দার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। নবীন মদ খেয়ে ওদের সাফ কথায় জানিয়ে দিল যে আমরা কিছু করতে পারব না যা করার ওদের নিজেদের করতে হবে, পেছনে এক পয়সার মুরোদ নেই আবার প্রেমের বুলি গাইছে।
সারা রাত ধরে ছোড়দি আর বড়দাকে ঘুমাতে দেওয়া হল না, বাড়ি নয় যেন কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্র। একদিকে ছোড়দির বন্ধুবান্ধবীরা দল বাধলো অন্যদিকে বড়দার বন্ধুরা দল বাধলো, গানের লড়াই হাসি মজা অনেক কিছুই হল সেই রাতে। সেইরাতে দেবুও থেকে গেছিল। ফাঁকতালে ঘুমের অছিলায় আমরা চারজনে ওই বাসর থেকে সরে গেলাম আর অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে আড্ডা দিলাম। সকাল প্রায় হতে যায় তখন আমি আর দেবু বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
ছন্দা বউভাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ছিল আর সেবারেও আমি ওকে ছাড়তে যেতে পারিনি। অবশ্য না ছাড়তে যাবার কারন ও বুঝেছিল, সর্ব সমক্ষে ওর কাছেই যেতাম না। বউভাতের পরেরদিন দেবু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। অনু তারপরে আমাদের খেপিয়ে বলতো ওই এক মন্ডপে আমাদের বিয়ে করালেই ভালো হতো।
ছোড়দির বিয়ের পরে সব থেকে বেশি লোকসান আমার হল, আগে অনায়াসে ওর পার্স মারতে পারতাম সেটা বন্ধ হয়ে গেল, ওদিকে অনুর পার্স মারতে গেলেই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু, “প্লিস টাকা নিস না, দেবুর সাথে সিনেমা দেখতে যাবো” অথবা, “ওকে জন্মদিনে একটা শার্ট কিনে দেব তাই টাকা জমাচ্ছি” ইত্যাদি প্রচুর বাহানা।
আর ছন্দা আমাকে বলতো, “তুই কেন এর তার কাছে হাত পাতিস? আমি টিউশানি করি আমার পার্সে অন্তত তোকে আর আমাকে চালানোর মতন টাকা আছে।”
তবে আমার পকেট কোনোদিন খালি থাকতো না কারন আমার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার আমার ছোট কাকিমা ছিলেন, যখন যা চাইতাম পেয়ে যেতাম।
আমাদের সব বন্ধুদের নেমন্তন্য করা হল, আমার আর অনুর বন্ধু সংখ্যাই কুড়ি ছাড়িয়ে গেল। বিয়ের একদিন আগেই অনু ছন্দাকে ডেকে নিল, অনুর বান্ধবী হিসাবে ছন্দাকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অনু যখন ছন্দাকে মা জেঠিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আমি তখন বাড়ির ত্রিসীমানায় ছিলাম না। পরে শুনেছিলাম যে ছন্দাকে দেখে আমার জেঠিমার খুব পছন্দ হয়েছে, সেই কথা শুনে আমি তাধিন তাধিন করে নেচে নিলাম।
ছন্দা আমাকে মজা করে বলেছিল, “তোদের যা পঙ্গপালের গুষ্টি সবাইকে প্রনাম ঠুকতে ঠুকতে আমার কোমর বেঁকে গেল।”
দুই বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার আর আকাশদার ঘাড়ে। বিশ্বজিৎদা তো মজাসে ছোড়দিকে নিয়ে কেনাকাটা করাতে ব্যস্ত। ধুর ব্যস্ত না ছাই, আমি হলফ করে বলতে পারি কেনাকাটার নাম করে ওরা ওই কয়দিনে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেননা যা কেনার সব আমি আকাশদা নবীন আর অনু মিলে করেছিলাম।
বিয়ের দিনে সাজসাজ রব, এ বাড়িতে ফুল নেই তো ওই বাড়িতে এখন পর্যন্ত বিদ্ধি পুজোর ঠাকুর মশাই আসেনি। খাবার জায়গা এক জায়গাতেই। দুই বাড়ির মাঝের মাঠেই সামিয়ানা টাঙানো। তখন ক্যাটারার ছিল না, ঠাকুর মশায় রান্না করতেন আর বাড়ির ছেলেরা পরিবেশন করতো। আমাদের মাথা ব্যাথা হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
এর মাঝে ছন্দা এসে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে গেল, “রাতে কোন শাড়িটা পরবো বলে দে।”
বিকেল হয়ে গেছে এদিকে তখন নিরামিষের জন্য ছানা এসে পৌঁছায় নি। আমি ওকে এক ধ্যাতানি দিয়ে বললাম, “তোর যা ইচ্ছে তাই পরিস এখন আমার মাথা খাস না।”
ব্যাস, অভিমানিনীর মুখ ফুলে লাল, “যা তোকে জিজ্ঞেস করাই বৃথা। আমি সাজবোই না বিয়েতে।”
একদিকে টেনে নিয়ে আবার ওকে শান্ত করলাম, “প্লিস সোনা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এদিকে ছানা এখন আসেনি সেগুলো আনতে নবীনকে পাঠিয়েছি, ওদিকে কয়লা ফুরাতে চলল তার জন্য বাপ্পাকে পাঠালাম আর শালা কোথায় মরতে চলে গেছে। আর এমনিতে তুই যা পরবি তাতেই তোকে সুন্দরী দেখাবে।”
চশমাটা একটু উপরের দিকে ঠেলে দুষ্টুমি ভরা হেসে বলল, “রাতে দেখিস তোকে কি করি।”
যাই হোক সেইসময়ে ওকে ক্ষান্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সন্ধের পরে যখন বাড়ি থেকে সেজে বের হল তখন আমি ওকে দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। ছন্দার পরনে একটা গাড় নীল রঙের সাউথ সিল্কের মেখলা। কাঁচুলিটার পিঠ একটা গিঁট দিয়ে বাঁধা, মেরুদণ্ডর খাঁজ যেন সুগভির কোন নদী। সুউন্নত, সুডৌল কুচ যুগল কাঁচুলির ভেতরে হাঁপিয়ে উঠছে, ঠিকরে বেরিয়ে আসতে উদ্যত। সেদিন বেনুনি ছেড়ে খোঁপা বেঁধেছে, খোঁপায় একটা সুন্দর হাতির দাঁতের ক্লিপ। গলায়, হাতে, কানে হায়দ্রাবাদি মুক্তোর সেট ঝলমল করছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। ডান কব্জিতে সোনার ঘড়ি আর বেশ কয়েক গাছা সোনার চুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও স্বর্গের নর্তকী এই মর্তধামে নেমে এসেছে। আমি চারপাশে চেয়ে দেখলাম, ওর রুপ আর সাজ দেখে অনেকের চোখ ওর দিকে চলে গেল। অনু আমাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল কেমন সাজিয়েছে। আমি শুধু বুক চেপে উফ একটা আওয়াজ করে থেমে গেলাম, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার উপায় ছিল না তখন। আকাশদার বন্ধুরা আর বিশ্বজিৎদার বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছন্দা আর অনুকে দেখার জন্য।
বিয়ের সারা সময়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম, মাঝে মাঝে ওদের দুইজনের দেখা পাওয়া যেতো। দুই ফুলটুসি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেশ মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাওয়ার সময়ে এদিকে লোক ওদিকে লোক, কে খেতে বসলো, কে খেয়ে চলে গেল, কে নিরামিষ খাবে, কার পাতে মাংস পড়েনি সেই সব নিয়ে হইচই রইরই ব্যাপার। দেবুকে কাজ দিতে গেলেই অনু বলে দেয়, না ও কিছু করবে না। আমি মনে মনে বললাম, আমাদের বাড়ির সব জামাইগুলো কুঁড়ে। বিয়ের দিকে কি হচ্ছে সেসবে আমার মাথা ব্যাথা ছিল না কারন ছোড়দি তো আর বেশি দূর যাচ্ছে না। আগে রোজ রাতে এবাড়িতে ঘুমাতো, সেদিনের পর থেকে মাঠ পেরিয়ে ওবাড়িতে ঘুমাবে এই যা তফাৎ।
দুটো ব্যাচের খাওয়ার মাঝে আমি আর নবীন অন্যদিকে গিয়ে সিগারেট টানছিলাম।
এমন সময়ে ছন্দার দেখা। ওকে দেখে নবীন মিচকি হেসে বেরিয়ে চলে গেল। আমার পাশ ঘেঁসে হাতখানি ধরে বলল, “কি রে কেমন দেখাচ্ছি একবার বলবি না।”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ওর কালো গভীর চোখের তারায় হারিয়ে গেলাম। ওর দেহের থেকে বিচ্ছুরিত অতীব আকর্ষণ আমাকে টেনে আনলো ওর কাছে, এত কাছে যে আমাদের শরীরের মাঝে জায়গা ছিল না। ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো আমার চাহনির বানে। আমার বুকের মাঝে তখন ঝড় উঠেছে, ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে যাবো কিন্তু হাত ছাড়িয়ে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বলল যে ওর সাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমি ওকে বললাম যে এই মন্ডপে বসার ইচ্ছে আছে নাকি। সেই শুনে লাজুক হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় এত তাড়াতাড়ি নয়।
আমি ওকে ফিসফিস করে বললাম, “তুই যে এতো সুন্দরী সেটা ধারনা ছিল না। শাড়ি ছেড়ে মেখলা, আমি তো ভাবতে পারছি না।”
আমাকে বলল, “গত বছর মামা বাড়ি গিয়ে কিনেছিলাম কিন্তু আর পরা হয়নি।”
আমি ওকে বললাম, “তোকে না আমার বুক পকেটে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।”
ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কি? বুক পকেটে কেন? বুকের মধ্যে আমি ছাড়া আর কে কে আছে?”
আমি ওর নরম গালে টোকা মেরে বললাম, “আরে না রে বোকা মেয়ে, বুকের মধ্যে রাখতে হলে যে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। এখন ওপেন হার্ট সার্জারি করার মতন বয়স হয়নি আমার।”
কেন জানিনা ওর চেহারা দেখে আমার মনে হল এখনো কিছু সাজ বাকি রয়েছে, যদি আমি নিজে হাতে ওকে সাজাতে পারতাম তাহলে হয়তো ওর সাজ সম্পূর্ণ হতো। ওর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তারপরে পকেট থেকে পেন বার করলাম। বাম হাতের তর্জনী দিয়ে ওর থুতনি ছুঁয়ে আমার দিকে তাকাতে বললাম। ছন্দা আমার তর্জনীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল, আসন্ন উত্তেজনায় ওর শরীর কাঠ হয়ে গেল। ডিসেম্বরের শীতেও ওর নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু দেখা দিল। ওর তপ্ত শ্বাসে আমার মুখ বুক সব ভেসে গেল। আমার দিকে মুখ উঁচিয়ে চোখ জোড়া আধাবোজা করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি পেন দিয়ে ছন্দার থুতনিতে তিনটে ছোটো ছোটো বিন্দু এঁকে দিলাম। লজ্জা ভরা লাল টুকটুকে চেহারা দেখে এবারে মনে হল যেন ওর সাজ সম্পূর্ণ। নিজের অজান্তেই ছন্দার হাত দুটি মুঠি হয়ে গিয়ে গাল, কান গরম হয়ে গেল। ভেজা পায়রার মতন কেঁপে ওঠে ছন্দার পেলব দেহ। চোখ বন্ধ করে আমার হাতখানি শক্ত করে ধরে নেয় আর নিজের অজান্তেই ওর গোলাপি নরম ঠোঁট দুটি অল্প ফাঁক হয়ে যায়। পদ্মের পাপড়ির মতন ঠোঁটগুলো কেঁপে ওঠে, যেন দখিনা বাতাস বইছে। আমি ওর নরম ঠোঁট জোড়া দেখে আর থেমে থাকতে পারলাম না, আমার আঙুল থুতনি ছাড়িয়ে ওর গালের ওপরে চলে গেল। আলতো করে গালের ওপরে আঙুল বুলিয়ে মাথা নিচু করে ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। তীব্র আবেগে বশে আমার ঠোঁট কামড়ে দিল ছন্দা। ঠিক কতক্ষণ ওইভাবে অধর ওষ্ঠ মিলিয়ে ছিলাম বলা মুশকিল তবে কেউ যেন আমাকে ডাক দিল আর আমাদের গভীর চুম্বনে ছন্দপতন ঘটে গেল।
অনু এদিক ওদিকে খুঁজে আমাদের ওইখানে পেয়ে ঝাঁজিয়ে উঠল, “তোরা দুইজনে এইখানে কি করছিস? ওইদিকে বিয়ে শেষ হতে চলল।”
অনুকে দেখেই ছন্দাকে ছেড়ে দিয়ে আমি ওকে বললাম, “কি হয়েছে এত গরম হয়ে আছিস কেন?”
অনু জানাল যে আগে ছোড়দির ঘরে বাসরের কথা ছিল কিন্তু লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে নিচের তলার বৈঠকখানায় বাসরের ব্যবস্থা করতে হবে। তার মানে কাজ বেড়ে গেল, আমি ভেবেছিলাম যে রাতে একটু খালি পাবো আর ছন্দার সাথে একটুখানি একলা সময় কাটাতে পারবো কিন্তু অনুর কথা শুনে মনে হল সে গুড়ে বালি। নিরুপায় হয়ে ছন্দা বাঁকা হাসি দিয়ে অনুর সাথে চলে গেল আর আমি আকাশদাকে নিয়ে বৈঠকখানা ঠিক করতে চলে গেলাম।
মেজদাকে জিজ্ঞেস করাতে মেজদা মিচকি হেসে বলল যে অনু আর অনুর বান্ধবী মানে ছন্দাকে দেখে ওর বন্ধুরা আর বড়দার বন্ধুরা রাতে থেকে গেছে। আমি মনে মনে হেসে ফেললাম, তোদের পাতে কাঁচ কলা, ওই দুইজনেই নিজেদের বর আগে থেকেই খুঁজে নিয়েছে। আমি অনু আর ছন্দাকে ওদের অভিপ্রায় জানিয়ে দিলাম, ছন্দা আকাশ থেকে পড়ল, কি হবে এবারে? অনু ওকে ক্ষান্ত করে দিয়ে বলল যে কিছুই হবে না কেউ ওদের টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না।
রাতে মেজদার বন্ধু আর বড়দার বন্ধুদের সাথে অনুর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে আড্ডা বসল। মেজদা মদ এনেছিল, বাড়িতে বসে মদ খাওয়া এক বিশাল ব্যাপার কিন্তু বিয়ের সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে সেইসব করা যেতে পারতো। ওরা সবাই মিলে নবীন আর আমাকে চেপে ধরল, একবার ছন্দার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। নবীন মদ খেয়ে ওদের সাফ কথায় জানিয়ে দিল যে আমরা কিছু করতে পারব না যা করার ওদের নিজেদের করতে হবে, পেছনে এক পয়সার মুরোদ নেই আবার প্রেমের বুলি গাইছে।
সারা রাত ধরে ছোড়দি আর বড়দাকে ঘুমাতে দেওয়া হল না, বাড়ি নয় যেন কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্র। একদিকে ছোড়দির বন্ধুবান্ধবীরা দল বাধলো অন্যদিকে বড়দার বন্ধুরা দল বাধলো, গানের লড়াই হাসি মজা অনেক কিছুই হল সেই রাতে। সেইরাতে দেবুও থেকে গেছিল। ফাঁকতালে ঘুমের অছিলায় আমরা চারজনে ওই বাসর থেকে সরে গেলাম আর অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে আড্ডা দিলাম। সকাল প্রায় হতে যায় তখন আমি আর দেবু বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
ছন্দা বউভাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ছিল আর সেবারেও আমি ওকে ছাড়তে যেতে পারিনি। অবশ্য না ছাড়তে যাবার কারন ও বুঝেছিল, সর্ব সমক্ষে ওর কাছেই যেতাম না। বউভাতের পরেরদিন দেবু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। অনু তারপরে আমাদের খেপিয়ে বলতো ওই এক মন্ডপে আমাদের বিয়ে করালেই ভালো হতো।
ছোড়দির বিয়ের পরে সব থেকে বেশি লোকসান আমার হল, আগে অনায়াসে ওর পার্স মারতে পারতাম সেটা বন্ধ হয়ে গেল, ওদিকে অনুর পার্স মারতে গেলেই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু, “প্লিস টাকা নিস না, দেবুর সাথে সিনেমা দেখতে যাবো” অথবা, “ওকে জন্মদিনে একটা শার্ট কিনে দেব তাই টাকা জমাচ্ছি” ইত্যাদি প্রচুর বাহানা।
আর ছন্দা আমাকে বলতো, “তুই কেন এর তার কাছে হাত পাতিস? আমি টিউশানি করি আমার পার্সে অন্তত তোকে আর আমাকে চালানোর মতন টাকা আছে।”
তবে আমার পকেট কোনোদিন খালি থাকতো না কারন আমার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার আমার ছোট কাকিমা ছিলেন, যখন যা চাইতাম পেয়ে যেতাম।