What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ফাউন্টেনপেন (হুমায়ুন আহমেদ) (1 Viewer)

নামধাম



মানুষের প্রথম পরিচয় তার নাম। দ্বিতীয় পরিচয় কি ‘ধাম’? নামধাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় বলেই এই জিজ্ঞাসা। আমি মনে করি না নামধাম মানুষের পরিচয়। চুরুলিয়াতে কাজী নজরুল নামের আরেকজন থাকলেই দুই নজরুলের এক পরিচয় হবে না। যদিও তাদের নামধাম এক।

নাম বিষয়ে আজকের লেখা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। সুরা বাকারায় আল্লাহপাক বলছেন, “আমি আদমকে প্রতিটি বস্তুর নাম শিখিয়েছি।” এখানে ‘নাম’ নিশ্চয়ই প্রতীকী অর্থে এসেছে। নাম হলো বস্তুর property বা ধর্ম। আল্লাহপাকের অনুগ্রহে আল্লাহপাক যে জ্ঞান আদমকে দিলেন সব ফেরেশতা তা থেকে বঞ্চিত হলো।

আমরা মানব সন্তানরা বস্তুর নাম জানি। আগ্রহ নিয়ে নতুন নতুন নাম দেই। গ্যালাক্সির নাম দিলাম ‘এনড্রমিডা’। মঙ্গলগ্রহের দুই চাঁদের একটির নাম দিলাম ‘ডিমোস’, আরেকটি ‘ফিবোস’।

কিছু কিছু নাম আমরা আবার বাতিলও করে দেই। উদাহরণ ‘মীরজাফর’। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা ছেলেমেয়ের নাম ’মীরজাফর’ রাখবে না। মীরজাফর এবং বিশ্বাসঘাতকতা আজ সমার্থক। মীরজাফরের চেয়েও বড় বিশ্বাসঘাতক ছিল সিরাজের হত্যাকারী মিরন। তার প্রতি আমাদের তেমন রাগ নেই যেমন আছে মীরজাফরের প্রতি। মিরন নাম নিষিদ্ধ না, কিন্তু মীরজাফর নিষিদ্ধ, কেন?

কুখ্যাতদের নামে বাবা-মা তাদের সন্তানদের নাম রাখেন না, আবার অতি বিখ্যাতদের নামেও রাখেন না। ইংল্যান্ডের বাবা-মা’রা তাদের সন্তানের নাম শেক্সপিয়র রাখেন না। আইনস্টাইন নাম রাখা হয় না। তবে আমেরিকার ফার্গো শহরে আমার এক অধ্যাপকের কুকুরের নাম ছিল আইনস্টাইন। তিনি আইনস্টাইনকে সম্মান দেখানোর জন্যে তার প্রিয় কুকুরের এই নাম রেখেছিলেন।

চিন্তায় এবং কর্মে আমেরিকানদের মতো জাতি দ্বিতীয়টি নেই। তাদের দু’টা নামের নমুনা দেই (এই দু’জন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র)।

Mr. Long Frog (TET TIE)
Mr. Brown Fox (খয়েরি শিয়াল)

এখন আমার নিজের নামের জটিলতা বিষয়ে বলি। ১৯৭২ সাল। মা গিয়েছেন বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলতে। টাকা তুলতে পারলেন না। কারণ বাবা কোনো এক অদ্ভুত কারণে মাকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি করে যান নি। তিনি নমিনি করে গেছেন তার বড় ছেলেকে। কাজেই আমি গেলাম। আমিও টাকা তুলতে পারলাম না। কারণ বাবা তার ছেলের নাম লিখেছেন শামসুর রহমান। আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমার বাবার অনেক অদ্ভুত স্বভাবের একটি হচ্ছে তিনি কিছুদিন পরপর ছেলেমেয়েদের নাম বদলাতেন। শুরুতে আমার নাম ছিল শামসুর রহমান। তিনি আমার নাম বদলে হুমায়ূন আহমেদ রেখেছেন, কিন্তু এই তথ্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের কাগজপত্রে দিতে ভুলে গেছেন।

যাকে এত কথা বলা হলো তিনি মুখ গম্ভীর করে বললেন, আপনি প্রমাণ করুন। যে শুরুতে আপনার নাম ছিল শামসুর রহমান।

আমি অতি দ্রুত তা প্রমাণ করলাম। ভদ্রলোকের হাতে একশ টাকা ধরিয়ে দিলাম। জীবনে প্রথম কাউকে ঘুষ দেওয়া।

আমাদের নবিজী (দঃ) সন্তানের নামকরণ বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সন্তানদের জন্যে সুন্দর সুন্দর নাম রাখবে। যেমন, আসিয়া নামটা রাখবে না। আসিয়া নামের অর্থ দুঃখিনী। দুঃখিনী নাম কেন রাখবে।

আমার বড় চাচির নাম আসিয়া। দুঃখে দুঃখে তাঁর জীবন কেটেছে। শেষজীবনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

আমরা বাংলাদেশী মুসলমানরা ছেলেমেয়েদের ইসলামী নাম রাখতে আগ্রহী। আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। যেমন, আব্দুল কাদের (আল্লাহর দাস)। গোলাম রসুল (রসুলের গোলাম)।

আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে কখনো কোনো মেয়ের নাম কেন রাখা হয় না। আল্লাহপাক তো নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে, তারপরেও তাঁর নাম পুরুষবাচক কেন ভাবা হয়? এই বিষয়ে জ্ঞানীরা কেউ কি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন?

বাংলাদেশের শিক্ষিত এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ভাবে উজ্জীবিতরা সন্তানদের জন্যে বাংলা নাম খোঁজেন, তবে ডাকনাম। ভালো নাম অবশ্যই ইসলামী।

বাংলা নাম নিয়ে আমি আছি বিপদে। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে, লেখকরা সুন্দর সুন্দর নাম জানেন। আমি কিন্তু জানি না। তাতে রক্ষা নেই, পরিচিতজনদের নাম দেওয়ার জন্যে আমাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। সিলেটের নাট্যকর্মী আরজুর ছেলে হয়েছে। নামের জন্যে দিনে চার-পাঁচবার টেলিফোন। আকিকা আটকে আছে।

আমি বললাম, নাম রাখো মানব।

আরজু বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার সে তো মানবই, অন্য কিছু তো না। তাহলে মানব কেন রাখব?

আমি বললাম, সেটাও একটা কথা। এক মাস সময় দাও নাম ভাবতে থাকি।

না স্যার, খাসি কেনা হয়ে গেছে। আজই নাম রাখা হবে। মানবই রাখা হবে।

হবিগঞ্জের আরেক অভিনেতার নাম সোহেল। তার প্রথম ছেলে হয়েছে। নামের জন্যে অস্থির। নাম আমাকেই রাখতে হবে। আমি বললাম, যেহেতু প্রথম সন্তান নাম রাখো প্রথম।

সোহেল বলল, নাম খুবই পছন্দ হয়েছে স্যার। অদ্ভুত।

এক বছর না ঘুরতেই আবারও তার এক ছেলে। তার নাম রাখলাম দ্বিতীয় এবং সোহেলকে বললাম, তৃতীয় ছেলেমেয়ে যাই হয় আমার কাছে নাম চাইবে না। সরাসরি নাম রাখবে তৃতীয়। পরেরজন চতুর্থ, তারপরের জন পঞ্চম… এইভাবে চলবে। ঠিক আছে?

জি স্যার ঠিক আছে।

সম্প্রতি ছেলের নামের জন্যে আমার কাছে এসেছে অভিনেতা মিজান। আমি বললাম, নাম রাখো ‘লুব্ধক’।

মিজান মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, লুব্ধক জিনিসটা কী স্যার?

আমি বললাম, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইংরেজিতে বলে Sirius.

মিজান-পুত্র এখন আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কেউ যখন আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ি বানায় তখন বেশ আয়োজন করে বলে তার কী কী প্রয়োজন। যেমন, মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে বারান্দা থাকতে হবে। ফ্যামিলি স্পেসে বই রাখার লাইব্রেরি হবে। সার্ভেন্ট টয়লেট আলাদা হবে। ইত্যাদি।

আমার কাছে যারা নাম চাইতে আসে, তারাও বেশ আয়োজন করেই তাদের দাবিগুলি তোলে। যেমন, এক মা তার ছেলের নামের জন্যে এসেছে—

স্যার! ছেলের নামের প্রথম অক্ষর হবে আ। কারণ আমার নামের প্রথম অক্ষর ‘আ’, আতিয়া। শেষ অক্ষর হবে ‘ল’। কারণ ছেলের বাবার নামের প্রথম অক্ষর ‘ল’, লতিফ। নামের অর্থ যদি নদী, আকাশ বা মেঘ হয় তাহলে খুব ভালো হয়। তারচেয়েও বড় কথা–নামটা হতে হবে আনকমন।

আমি বললাম, ছেলের নাম রাখো আড়িয়াল খাঁ। নদীর নামে নাম। আড়িয়াল খাঁ নামে আমাদের একটা নদী আছে, জানো নিশ্চয়ই?

ছেলের মা গম্ভীর মুখে বলল, আড়িয়াল খাঁ নাম রাখব?

হা। তোমার সব ইচ্ছা এই নামে পূরণ হচ্ছে। নদীর নামে নাম, আনকমন নাম, শুরু হয়েছে তোমার নামের আদ্যক্ষর ‘আ’ দিয়ে, শেষ হচ্ছে তোমার স্বামীর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে।

আমার স্বামীর বংশ খাঁ বংশ না।

তাতে কী? তোমার ছেলে খাঁ বংশের পত্তন করবে। তার থেকেই শুরু হবে খাঁ বংশ।

স্যার, আপনাকে আমার ছেলের নাম রাখতে হবে না। ধন্যবাদ।

তোমাকেও ধন্যবাদ।

শুধু যে ছেলেমেয়েদের নাম তা-না, আমাকে অনেক স্থাপনার নামও রাখতে হয়েছে। কাকলী প্রকাশনীর মালিক সেলিম সাহেব উত্তরায় বিশাল চারতলা বাড়ি তুললেন। আমাকে নাম রাখতে হলো। নাম রাখলাম ‘বৃষ্টি বিলাস’।

সেলিম সাহেব বাড়ির সামনে শ্বেতপাথরের ফলকে লিখলেন–এই বাড়ির নাম রেখেছেন…।

সময় প্রকাশনীর ফরিদ ময়মনসিংহে বাড়ি করবে। বাড়ির নাম আমি ছাড়া কে রাখবে? নাম দিলাম ‘ছায়াবীথি’।

নামকরণ চলছেই। এই নামকরণের একটা ভালো দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নামের পরিবর্তন হবে না।

পাদটিকা

ওল্ড ফুলস ক্লাবের সান্ধ্যসভায় কলকাতার এক ভাষাতত্ত্ববিদ উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই চেষ্টা করতে লাগলাম জ্ঞানী টাইপ কথা বলার। তেমন কোনো জ্ঞানী কথা খুঁজে না পেয়ে আমি বললাম, আচ্ছা ভাই, আম নামটা কীভাবে এল? আমের বদলে জাম নাম আমরা কেন রাখলাম না।

ভদ্রলোক বললেন, আমের নাম যদি জাম রাখা হতো তাহলে আপনি বলতেন, জাম রাখা হলো কেন? কেন আম রাখা হলো না?

আমি বললাম অত্যন্ত সত্যি কথা। বাংলা ভাষাভাষী বিশাল ভূখণ্ডে সবাই একসঙ্গে আম’কে আম ডাকা শুরু করল কেন? মিটিং করে কি ঠিক করা হয়েছিল এই ফলটার নাম হবে আম? আমি যতদূর জানি অতি প্রাচীনকালে মানব সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের যোগাযোগই ছিল না। অথচ সবাই একটা ফলের নাম রাখল আম। এক হাজার মাইল লম্বা নদী ব্রহ্মপুত্র। সবাই তাকে ব্রহ্মপুত্রই ডাকছে। কে রেখেছিল আদি নাম?

ভাষাতত্ত্ববিদ হকচকিয়ে গেলেন। আবোল-তাবোল কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর জন্যে ওই দিনের আসর ছিল শিক্ষাসফর।

কুইজ

আমাদের পাঁচ আঙুলের একটির নাম অনামিকা (রিং ফিঙ্গার) অর্থাৎ নামহীন। এই আঙুলটির নাম নেই কেন?

উত্তর : মহাদেব শিব তাঁর হাতের অনামিকা দিয়ে চারমাথা ব্রহ্মার একটা মাথা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছিলেন।

এই কাজের পরপর মহাদেব অনুতাপে দগ্ধ হলেন। যে আঙুল দিয়ে তিনি এই কাজটি করেছেন সেই আঙুলকে তিনি অভিশাপ দিলেন। বললেন, আজ থেকে তুই নাম গ্রহণের যোগ্যতা হারালি। আজ থেকে তুই অনামিকা।

[উৎস : বাংলা শব্দের উৎস অভিধান। ফরহাদ খান।]
 
পড়াশোনা



বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার–পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।

আমরা যেভাবে পডি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। বৃদ্ধ বোকা সংঘের আসরে অন্য কেউ কথা বললেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে বকবক করে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না। ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়ার আনন্দ পাই।

একটা বয়স পার হলে মানুষ ‘কথা বলা রোগ’-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ধরা হয় ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তারপর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো সর্বনাশ।

প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরতেন। এই স্নান থেকেই এসেছে ‘স্নাতক’ শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।

পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালে স্নান করে নি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষদিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।

আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।

ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গভীর আবেগে ধর্মগুরুর কথা শুনত।

নবিজীকে (দঃ) আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়–’পড়ো! তোমার প্রভুর নামে…’

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।

আমার আত্মীয়স্বজনরা মাঝে মাঝে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাদের ধারণা আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলি নাকি ‘অতি উত্তম’। তাদেরকে কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে ‘অতি উত্তম’ কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা। তারা আবার ফরমাশ করেন–হুমায়ূণ, ঐ ফকিরের গল্পটা আরেকবার বলো। ফকিরের গল্প মনে নেই, তারাই মনে করিয়ে দেন।

লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন–এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। এই শ্রেণীর লেখকরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারও সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহা বিরক্ত হতেন।

উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধুমাত্র তার মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্রান্ডমাস্টার আইজাক অ্যাসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।

আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম সেটা ব্যাখ্যা করি। আমি লক্ষ করেছি, গল্প যখন শুরু করি সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। অনেকেই অতি বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমি একবার আপনার আজ্ঞায় এসেছিলাম। আরেকদিন কি আসতে পারি? দূরে এক কোনায় বসে থাকব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন–

‘হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করেন সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।…’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ-পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?

মাজহার বলল, স্যার ভয়েস রেকর্ডার।

ভয়েস রেকর্ডার কেন?

এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না। আমি এমন কোনো বাণী দেই না যা রেকর্ড করে রাখতে হবে।

শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, সরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্মজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তারচেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে। সেখানে আমি কী করে বলছি, আমি ভালো কথক? থুকু ফিরিয়ে নিলাম।

নিজের প্রশংসা নিজে করার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ ইমদাদুল হক মিলন। গত বইমেলা বিষয়ে তার একটা লেখা কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়েছে। সে লিখেছে…

তখন আমার একটা বই বাংলা একাডেমী বেস্ট সেলার ঘোষণা করেছে। পাঠক-পাঠিকা বইটির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রকাশক চাহিদামতো বই যোগান দিতে পারছে না। বইটির জন্যে বইমেলার অনেক জায়গায় কাটাকাটি মারামারি হচ্ছে…

কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতা মিলন দেখে। আমার ‘ফাউনটেনপেন’ তার হাত দিয়েই যাবে। আজকের লেখাটা পড়ে তার মুখের ভাব কী রকম হবে কল্পনা করেই মজা পাচ্ছি। হা হা হা। মিলন, সরি। তুমি তোমার কোনো একটি লেখায় আমাকে তুলোধোনা করে দিয়ো। আমি কিছু বলব না।

.

যখন লেখালেখি করি না, আড্ডা দিতে বসি না, তখন কী করে সময় কাটাই? এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে টেলিফোনে এক সাংবাদিক করলেন। আমি বললাম, তখন আমি একটা কাচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটে সময় কাটাই।

সাংবাদিক আমার কথায় আহত হয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর জানার জন্যে এবং পাঠকদের জানার জন্যে বলি–তখন আমি সিনেমা দেখি এবং পড়ি। আমার কাছে মোটা একটা বই আছে। বইয়ের নাম ‘One thousand one film that you must see before you die. ‘এক হাজার একটি ছবি যা মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতেই হবে। বই দেখে দেখে ভিডিওর দোকান থেকে ফিল্ম আনি। ছবি দেখার পর বই থেকে নামটা কেটে দেই। বইয়ে নাম নেই এমন ছবিও দেখা হয়। যেমন, সম্প্রতি দেখেছি Avater, Time traveller’s wife. ‘এভেটার’ ছবি। দেখে আনন্দ পেয়েছি।

বলতে ভুলে গেছি, আমি নিজে এক হাজার একটি বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করছি। যে বইগুলি মৃত্যুর আগে অবশ্যই পড়া উচিত। একটা বই পড়তে তিন দিন লাগলে ১০০১টি বই পড়তে লাগবে মাত্র দশ বছর।

লেখকদের নানান দোষ থাকে, তার প্রায় সবগুলিই আমার মধ্যে আছে। তবে একটা গুণও আছে। আমিও লেখকদের মতো প্রচুর বই পড়ি। একসময় গল্প উপন্যাস পড়তাম। এখন জানি না কেন, গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে না।

বই সবচেয়ে বেশি পড়ি যখন দেশের বাইরে যাই। বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আমার দু’টা স্যুটকেস গোছানো হয়। একটায় থাকে কাপড়চোপড়! এটা শাওন গোছায়। আরেকটায় থাকে ‘Reading Material’, বাংলায় ‘পাঠবস্তু। এই স্যুটকেস আমি গোছই। দুমাস আগে মিশরের পিরামিড দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া বাতিল হয়েছে। ‘Reading Material’-এর স্যুটকেস গোছানোই আছে।

সেখানে কী কী বই নেওয়া হয়েছে তার তালিকা দিচ্ছি–

১. একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশান। আগরতলা বইমেলা থেকে একগাদা সায়েন্স ফিকশান কিনেছিলাম। একটাও পড়া হয় নি। যখনই বাইরে যাই একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাই। কেন জানি কখনো পড়া হয় না।

Ambassador Without Credentials
Sergei Snegov (Raduga Publishers)

২. The Travels of Marcoplo

এই বইটি আমি আগে একবার পড়েছি। আবারও সঙ্গে নিচ্ছি, কারণ মার্কোপোলোর গাঁজাখুরি ভ্রমণকাহিনী পড়তে ভালো লাগে।

সচেতন পাঠক নিশ্চয় ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনীকে আমি গাঁজাখুরি বলছি। কারণ ব্যাখ্যা করি। তিনি ভারতবর্ষে (বর্ণনা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ) একদল মানুষ দেখেছেন যাদের মুখ কুকুরের মতো। এরা কুকুরের মতোই ডাকে।

মার্কোপোলো বাংলাদেশেই আরেকদল মানুষ দেখেছেন যারা প্রকাশ্যে যৌনসঙ্গম করে। এতে কোনো লজ্জা বোধ করে না।

তিনি চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু গ্রেট চায়নীজ ওয়াল তাঁর চোখে পড়ে নি।

৩. The End of Time

এটি বিজ্ঞানের বই। সময় কী তা ব্যাখ্যা করা। সহজপাঠ্য।

8. The Demon Hanunted World

Carl Sagan

কার্ল সেগান আমার অতি পছন্দের লেখকদের একজন। তার লেখা Cosmos বইটির আমি একসঙ্গে দুটি কপি কিনেছিলাম যাতে একটি হারিয়ে গেলে অন্যটি থাকে। হায় খোদা, দুটাই হারিয়েছে!

৫. বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বাবরনামা। এই বইটিও আগে ইংরেজিতে পড়া। আবারও পড়ছি, কারণ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার বাসনা আছে। সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস। নাম দেব ‘বাদশাহ নামদার’। হুমায়ূন প্রসঙ্গে যেখানে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি। বাবরনামাকে world classic বলা হয়। আমি পড়তে গিয়ে ধাক্কার মতো খেয়েছি। পাতায় পাতায় তার মদ খাওয়ার বর্ণনা। ভোরবেলায় একবার, আসর এবং মাগরেবের নামাজের সময় একবার। এশার নামাজের পর আরেকবার। যখন মদ খাচ্ছেন না তখন ভাং-এর নেশা করছেন।

মানুষ হত্যার নির্বিকার বর্ণনা আছে। যেমন, আমি কয়েকজনকে শূলে চড়ালাম। বাকিদের নাক কেটে দিলাম। তারা কাটা নাক নিয়ে আমার তাঁবুর চারপাশে ঘুরতে লাগল। এরকমই নির্দেশ।

আরেক জায়গায় আছে, আমি দুর্গ দখল করলাম। দুর্গের নারী এবং শিশুদের বাদ দিয়ে সমস্ত পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিলাম।

এই বাবুর মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এবং তাঁর কালের একজন বড় কবি। কিছুই হিসাব মিলাতে পারি না। তার একটা কবিতা (তুর্কি ভাষায়)–

“গোলাপ কুঁড়ির মতো আমার হৃদয়
তার দলের উপর রক্তের ছাপ,
লক্ষ বসন্ত ও আমার সে হৃদয়ের ফুল
কুঁড়ি ফুটাতে পারে না।”

কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?

কোনোই প্রয়োজন নেই। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি–তা জানানো অর্থহীন। পাঠাভ্যাসের রুচি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়।

এখন অন্য প্রসঙ্গ। আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেvছ একটা বিষয় জানার জন্যে বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোপাশাকের কথা আছে, সঙ্গীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।

লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।

অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা। প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণকে দিয়ে শুরু।

লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখা–১. পথের পাঁচালি ২. দৃষ্টি-প্রদীপ ৩. আরণ্যক ৪. ইছামতি ৫. দেবযান

.

পাদটিকা

Books are a delightful society. If you go into a room filled with books, even without taking them down from their shelves, they seem to speak to you, to welcome you.

-William F Gladstone
 
বন্দুক-মানব



গানম্যানের বাংলা করলাম ‘বন্দুক-মানব’। ঘন বাংলা হয় নি, পাতলা বাংলা হয়েছে। ‘গানম্যানে’ যে কঠিন ভাব আছে, ‘বন্দুক-মানবে’ তা নেই। এখানে মানব শব্দটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বন্দুক হয়েছে গৌণ। বাংলা ভাষার এ এক মজার খেলা।

অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন, মন্ত্রী-মিনিস্টার, দেশের প্রধান, রাজনৈতিক নেতাদের সরকার গানম্যান দেয়। গানম্যানরা শাদা পোশাকে থাকে। তাদের পকেটে থাকে আধুনিক মারণাস্ত্র।

বিজ্ঞাপনে দেখি লাইফবয় সাবান জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। গানম্যানরাও গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষা দেন।

এক সকালের কথা। থাকি ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে। সম্পূর্ণ ‘একা’। একজন বাবুর্চি ছিল, সে রাত একটা-দুটায় আমি ডিনার খাই দেখে কাউকে কিছু না-বলে (এবং তার পাওনা বেতন না নিয়ে চলে গেছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা বানিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি, তখন ঘরে সুশ্রী চেহারার এক যুবক ঢুকল। তার গায়ের শার্ট দামি, প্যান্ট দামি, জুতাজোড়াও চকচক করছে। তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে।

আমি বললাম, কী ব্যাপার?

যুবক বলল, স্যার আমি গানম্যান।

গানম্যান খুব ভালো কথা। আমার কাছে কী?

স্যার, আমি আপনার গানম্যান।

পানি খেতে গিয়ে লোকে বিষম খায়, আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিষম খেলাম। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললাম, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমার কোনো গানম্যান নেই। থাকার কথাও না।

কোনো ভুল হয় নাই স্যার। এই যে আমার পরিচয়পত্র। পুলিশ। হেডকোয়ার্টার থেকে আপনাকে একটা চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এই যে চিঠি।

চিঠি পড়ে দেখি ঘটনা সত্যি। সরকার আমার জন্যে গানম্যানের ব্যবস্থা করেছে। গানম্যান সার্বক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে সুরক্ষা দেবে।

আমি বললাম, হলি কাউ!

গানম্যান বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না।

আমি বললাম, বুঝতে হবে না। ঘরে সিগারেট নেই বলে সিগারেট খেতে পারছি না। তুমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনতে পারবে?

অবশ্যই পারব স্যার।

গানম্যান সিগারেট কিনতে গেল, আমি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসলাম।

গানম্যান নিয়ে ঘোরার মধ্যে আত্মশ্লাঘার বিষয় আছে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা এবং অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করা। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। গানম্যানের আনা সিগারেট টেনেও মাথা পরিষ্কার হলো না। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি একজন লেখক মানুষ। লেখক ঘুরবে ঝোলা নিয়ে, ঝোলাতে থাকবে কাগজ-কলম। লেখক কখনো গানম্যান নিয়ে ঘুরবে না। আপনি গানম্যান উঠিয়ে নিন।

কয়েকদিন থাকক। তারপর আপনার কথামতো উঠিয়ে নিব।

কয়েকদিন শুনে রাজি হলাম, সেই কয়েকদিন তিন বছর পর্যন্ত গড়াল। যাই হোক, প্রথম দিনের কথা বলি। দুপুর তিনটার দিকে গানম্যান বলল, স্যার দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা কী?

খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। আজ মনে হয় ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে তারা খাবার পাঠাতে ভুলে যায়।

আমরা দুপুরে খাব না?

তেহারির দোকান থেকে দু’প্যাকেট তেহারি নিয়ে আসো।

আপনার কি গাড়ি আছে?

গাড়ি আছে। ড্রাইভার নাই। রিকশা করে চলে যাও।

গানম্যান চিন্তিত ভঙ্গিতে তেহারি আনতে বের হলো।

সন্ধ্যার কথা। বন্ধুবান্ধব আসবে। ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা বসবে। আমার বসার ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে। হিমু তার ঘরের দরজা খোলা রাখে, আমি হিমুর বাবা। আমারও ঘরের দরজা খোলা রাখা উচিত।

আজ দরজা বন্ধ। দরজার পাশে চেয়ার নিয়ে গানম্যান বসে আছে। তার চোখমুখ কঠিন।

দরজার বেল বাজল। গানম্যান দরজা খুলে বলল, হাত উপরে তুলুন, বডি চেক। ভয় পাবেন না। রুটিন চেক। হুমায়ূন স্যারের সিকিউরিটির বিষয়।

আমার কাছে এসেছে ছেলেবেলার বন্ধু ডাক্তার করিম (অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান)। সে হাত তুলল। বডি চেক করা হলো। গানম্যান বলল, আপনার ব্যাগে কী? ব্যাগ খুলুন, ব্যাগে কী আছে দেখব।

করিম ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কে?

আমি হুমায়ূন স্যারের গানম্যান। এখন বলুন, আপনি কে, কোত্থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন?

করিম বলল, আমি পাঁচতলায় এসেছিলাম আলমগীর রহমানের কাছে। ভুলে ছয়তলায় চলে এসেছি। হমায়ূন আহমেদকে আমি সেভাবে চিনি না।

একটা চৈনিক প্রবাদ আছে–”হাঁচি, কাশি এবং প্রেম কারও কাছ থেকে লুকানো যায় না।“ আমি এই তিনটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করেছি- “হাঁচি, কাশি, প্রেম এবং গানম্যান কারও কাছ থেকে লুকানো যায় না।“ কিছুদিনের মধ্যে সবাই জেনে গেল আমার সঙ্গে একজন দুর্ধর্ষ গানম্যান আছে। বন্ধুবান্ধবদের বাসায় আসা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেল।

দশ দিনের মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল। আমি গানম্যানকে বললাম, আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে, কাউকে চেক করা যাবে না। অতিথিদের নাম-ঠিকানা লেখা যাবে না। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব তখন সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা যাবে না।

গানম্যান নতুন রুটিনে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে আমার পাশে একটা ঘরে ঘুমায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। ঘুম ভাঙার পর সে আমার লেখা গল্প-উপন্যাসের বই হাতে নিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বই পড়ে। যেন পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে। সাহিত্য নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু আলোচনাও হয়। যেমন, স্যারের এই বইটা তেমন ভালো হয় নাই। এন্ডিং-এ ঝামেলা আছে।

আমাদের দুজনের জীবনচর্যায় মিল পাওয়া গেল। সে তার ঘরে একা থাকে, আমিও আমার ঘরে একা থাকি। সে সারা দিন ঘুমায়, আমি সারা দিন লিখি। সন্ধ্যার পর থেকে সে বই পড়ে, আমিও বই পড়ি। গভীর রাত পর্যন্ত সে হিন্দি সিরিয়াল দেখে। গভীর রাত পর্যন্ত আমিও ভিসিআরে সিনেমা দেখি।

গানম্যানের নিঃসঙ্গতা কাটল, আমার একজন বাবুর্চি জোগাড় হলো। গানম্যান বাজার করে আনে, দু’জনে মিলে কোটাবাছা করে। রান্না চাপায়। একদিন মজার এক দৃশ্য দেখলাম, রান্নাঘরে গানম্যান লেপটা দিয়ে বসে কচুর লতি বাছছে। পাশেই লোডেড পিস্তল।

কোরবানির ঈদে সে ছুটি নিয়ে দেশে গেল না। আমাকে একা ফেলে যাবে না। ঈদের দিন আমাকে কে দেখবে? আমি.কোরবানি দেব না শুনে সে মুষড়ে পড়ল। আমি বললাম, মাংস কাটা, রান্না করা, এইসব কে করবে? ঘরে কেউ নাই। বাবুর্চি ছুটি নিয়ে চলে গেছে।

স্যার আমি তো আছি। টাকা দিন, খাসি কিনে নিয়ে আসি। আরেকটা কথা, আপনার অনুমতি ছাড়াই পাশের বাসার মাজহার স্যারের গরুতে একটা নাম দিয়ে দিয়েছি।

তাকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে আরেক যন্ত্রণা। সিজদায় গিয়েছি, টুপ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি পকেট থেকে গানম্যানের পিস্তল জায়নামাজে পড়ে গেছে। মুসুল্লীরা তাকিয়ে আছেন আতংকিত চোখে।

গানম্যানদের প্রতিমাসেই গাজীপুরে পিস্তল শুটিং-এর পরীক্ষা হয়। একবার পরীক্ষা দিয়ে আমার গানম্যান খুব মন খারাপ করে ফিরল।

আমি বললাম, কী হয়েছে?

সে বলল, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। হাতের টিপ নষ্ট হয়ে গেছে।

কচুর লতি বাছলে হাতের টিপ তো নষ্ট হবেই।

তারপরেও স্যার অসুবিধা নাই। আপনার উপর কোনো হামলা হলে পঁচিশ গজের ভিতর যে আসবে তারেই শুট করে ফেলে দিব। একটা হামলা হোক, দেখেন স্যার কী করি?

গানম্যান হামলার আশায় দিন কাটাতে লাগল। সন্ত্রাসী হামলা হলো না, তবে অন্য ধরনের হামলায় জীবনসংশয় হলো। এই হামলার নাম হার্টঅ্যাটাক। ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, গানম্যান সঙ্গে যাবে। ডাক্তার বললেন, অসম্ভব! আপনি যেতে পারবেন না।

গানম্যান বলল, অবশ্যই আমাকে যেতে হবে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যদি স্যারের উপর হামলা হয় কে সামলাবে? আপনারা সামলাবেন? জবাবদিহি তো আপনাদের করতে হবে না। আমাকে করতে হবে।

আমাকে সিডেটিভ দেওয়া হয়েছিল। গানম্যান এবং ডাক্তারদের তর্কবিতর্ক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। চোখ মেলে দেখি, আমি পর্দাঘেরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছি। আমার পাশে গানম্যান দাঁড়িয়ে। তার চোখ মমতায় আর্দ্র। সে বলল, স্যার আমি আছি। কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। কেউ এসে হামলা করুক দেখেন কী করি?

তার মমতাভেজা কণ্ঠ বলে দিল সে গানম্যান না, বন্দুক-মানব।

.

পাদটিকা

জমিকে লালাউ গুল জিনহে খেয়াল নেহি।
ও লোগ চান্দসিতারো কি বাৎ করতে হ্যাঁয়।

খয়াল কানপুরী

পৃথিবীর বুকের ফুলফল লতাগুল্মে যার চোখ নেই, সে-ই শুধু আকাশের চন্দ্র এবং নক্ষত্রের গল্প করে।
 
‘বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা’



রবীন্দ্রনাথের লেখা এই লাইনটি আমার অতি অতি প্রিয়। কবি ধরতে পেরেছেন ততেও নেশা ধরিয়ে দেয়। মানুষ কোন ছাড়।

বৃষ্টি আমাকে নেশাগ্রস্ত করে। ভালোভাবেই করে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আমার শৈশবে। তখন সিলেটে থাকি। সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। একবার শুরু হলে সাতদিন আটদিন থাকে। ইচ্ছা করে ভিজে চুপচুপা হয়ে স্কুলে যাই। স্যার আমাকে দেখে আঁৎকে উঠে বলেন, এ-কী অবস্থা! নিউমোনিয়া বাধাবি তো। যা বাড়ি যা। ভেজা কাপড়ে স্কুল করতে হবে না। গাধা কোথাকার! বাসায় ফিরে বই খাতা রেখে আবার বৃষ্টিতে নেমে যাওয়া। কাঁচা আমের সন্ধানে আমগাছের নিচে নিচে ঘুরে বেড়ানো। তখনকার অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সন্তানরা তাদের কাছে হাঁস-মুরগির মতো। সন্ধ্যা হলে হাঁস-মুরগির মতো তারা ঘরে ফিরলেই চলবে।

আমাদের সময় ‘রেইনি ডে’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। জটিল বৃষ্টি হলে স্কুল ছুটি। হেডস্যার ভাব করতেন ছুটি দিতে গিয়ে তিনি মহা বিরক্ত। কিন্তু তার মুখেও থাকত চাপা আনন্দ। বৃষ্টি তার আনন্দ সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়।

আজকালকার ইংরেজি স্কুলের শহুরে ছেলেমেয়েরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা গাড়ি করে স্কুলে আসে গাড়ি করে চলে যায়। ঝড়-বৃষ্টি তাদের স্পর্শ করে না।

যে কথা বলছিলাম, বৃষ্টির ব্যাপারে আমি নেশাগ্রস্ত। বৃষ্টি হলে আমি জলধারায় নিজেকে সমর্পণ করব–এটা নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নুহাশপল্লী এবং নুহাশ চলচ্চিত্রের স্টাফরা বিষয়টায় খুবই আনন্দ পায়। অতিথিদের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা–

‘বৃষ্টি নামছে আর স্যার ঘরে বসা, এই জিনিস হবে না। তখন স্যাররে যদি তালাবন্ধ করে রাখেন স্যার তালা ভেঙে বের হয়ে যাবে। যতক্ষণ বৃষ্টি থাকবে ততক্ষণ স্যার বৃষ্টিতে ব্যাঙের মতো লাফালাফি করবে।‘

সমস্যা হয়েছে ইদানীং বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছা করে না। নিশ্চয়ই বয়স ফ্যাক্টর। তারপরেও বাধ্য হয়ে নামি। না নামলে আমার স্টাফদের ইজ্জত থাকে না।

গত বর্ষায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আমি আমার ঘরে বসে আছি। রিডার্স ডাইজেস্টের একটা পুরনো সংখ্যায় চোখ বুলাচ্ছি, দরজা খুলে নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুল ঢুকল। উত্তেজিত গলায় বলল, স্যার মনে হয় খেয়াল করেন নাই। বিরাট বৃষ্টি। ভিজবেন না?

আমি বই বন্ধ করতে করতে বললাম, আসছি।

পুকুরে নৌকা রেডি করেছি যদি নৌকায় বসে বৃষ্টি দেখতে চান।

পুকুরপাড়ের দিকে যাব, তোমরা দলবেঁধে পিছে পিছে আসবে না। আমি বৃষ্টিতে ভিজছি এটা হা করে দেখার কিছু নাই।

অবশ্যই নাই। আমরা দীঘির দিকে যাব না।

বৃষ্টিতে নেমেই যৌবনকালের মাহাত্ম বুঝলাম। তখন বৃষ্টির আনন্দে অভিভূত হতাম এখন থরথর করে শীতে কাঁপছি। দাঁত কিড়মিড় করা শুরু করেছে। যাচ্ছি পুকুরপাড়ের দিকে। পরিকল্পনা হলো, শ্বেতপাথরের ঘাটে বসে বৃষ্টি দেখব। ঘাটে বসে আছি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানোর কিছুক্ষণ পর বজ্রপাতের শব্দ। ঐ যে আলোর গতি এবং শব্দের গতির পার্থক্য, নাটক সিনেমায় অবশ্যি বিদ্যুতের ঝলক এবং বজ্রপাতের শব্দ একসঙ্গে দেখানো হয়। বিদ্যুৎচমকের পর পর বজ্রপাতের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করার অদ্ভুত টেনশানও উপভোগ করার মতো ব্যাপার। শব্দটা বড় হবে, না ছোট হবে? অল্পক্ষণ হবে নাকি অনেকক্ষণ?

বজ্রপাতের অপেক্ষা করছি হঠাৎ আমার ভেতরের সিক্সথ সেন্স আমাকে সতর্ক করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার ছয় থেকে সাত হাত দূরে একটা সুপারি গাছের উপর বজ্রপাত হলো। গাছ সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে কয়লা।

আমি প্রথম এত কাছে বজ্রপাত দেখলাম। বজ্রপাতের আলো দূর থেকে নীল দেখা যায়। খুব কাছ থেকে এই আলো কিন্তু গাঢ় কমলা।

বজ্রপাতে মৃত্যু না হওয়ায় একটি কারণে যথেষ্ট সন্তোষ লাভ করলাম– আমাকে আল্লাহ সরাসরি শাস্তি দিয়েছেন এটা এখন কেউ বলবে না। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, অতি অতি দুষ্টদের আল্লাহপাক বজ্রপাতের মাধ্যমে সরাসরি শাস্তি দেন।

উদাহরণ সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী মিরন। তার ঘটনা এরকম– সিরাজউদ্দৌলার আপন খালা ঘসেটি বেগম বজরায় করে বুড়িগঙ্গা নদী পার হচ্ছেন। ব্যবস্থা করে দিয়েছে মিরন। ঘসেটি বেগম হঠাৎ দেখলেন, মাঝনদীতে বজরা আসামাত্র নৌকার মাঝিমাল্লারা বজরা ফেলে ঝাঁপিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ল এবং প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল তীরের দিকে। বজরার নিচ ফুটো করা হয়েছে। বজরা পানিতে ডুবতে শুরু করেছে। ঘসেটি বেগম মিরনের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারলেন। তিনি বজরার ছাদে উঠে চিৎকার করে বললেন, মিরন! তুই মারা যাবি বজ্রাঘাতে।

ইতিহাস বলে বজ্রপাতের কারণেই মিরনের মৃত্যু হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহপাক কি সরাসরি শাস্তি দেন? যদি দিতেন তাহলে পৃথিবীর চেহারা অন্যরকম হতো। অতি দুষ্টলোকদের আমি কখনোই শাস্তি পেতে দেখি নি। তারা পরম সুখে জীবন পার করে। এক পর্যায়ে মাদ্রাসা মসজিদ বানায় বলে পরকালেও হয়তো তারা পরম সুখে বাস করবে।

আল্লাহপাক সম্বন্ধে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন বলা হয় নর নারীর বিবাহের ব্যাপারটা তিনি দেখেন। Bible-এ এই কথা আছে–Marriges are made in heaven.

আমার এক বন্ধু চার-পাঁচটা বিয়ে করেছেন (সঠিক সংখ্যা রহস্যাবৃত) এবং ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ কোনো স্ত্রী তাকে সুখ দিতে পারে নি। বর্তমানে সুখের জন্যে তিনি স্ত্রীর বিকল্পের সন্ধানে ব্যস্ত। এখন তিনি যদি বলেন, বিয়ে-শাদি তো আল্লাহর হাতে। উনি যা ঠিক করেছেন আমার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে–তাহলে কি চলবে?

ইসলামের দুটি ধারা। এক ধারা বলছে Free will-এর কথা, অর্থাৎ মানুষকে বিবেচনাশক্তি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। আরেক দল ফ্রি উইল অস্বীকার করেন। তারা বলেন, সবই পূর্বনির্ধারিত। এই ক্ষেত্রে তারা সূরা বনি ইসরাইলের একটি আয়াত উল্লেখ করেন

“আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।”

বলা হয়ে থাকে পাঁচটা জিনিস আল্লাহপাক সরাসরি নিজের কনট্রোলে রেখেছেন। যেমন–

১. হায়াত ২. মৃত্যু ৩. ধনদৌলত ৪. রিজিক ৫. বিবাহ

ধর্ম বিষয়ে আমার সীমিত পড়াশোনায় যা জানি তা হচ্ছে, পাঁচটা বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর হাতে

১. কেয়ামত কখন হবে। ২. কোথায় কখন বৃষ্টি হবে। ৩. মায়ের গর্ভে কী আছে (ছেলে, মেয়ে তাদের ভাগ্য ইত্যাদি) ৪. মানুষ আগামীকাল কী উপার্জন করবে। ৫. তার মৃত্যু কোথায় কীভাবে ঘটবে।

(সূত্র : সূরা লোকমান আয়াত ৩৪।)

আমি কোনো ভুল করেছি এরকম মনে হয় না, তারপরেও এই বিষয়ে জ্ঞানী। আলেমদের বক্তব্য আমি আগ্রহের সঙ্গে শুনব।

.

পাদটিকা

আমার তিন বছর বয়েসী পুত্র নিষাদকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা! আল্লাহ কোথায় থাকেন?

সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলল, আকাশে থাকেন।

তার সঙ্গে আমাদের দেশের ক্রিকেট প্লেয়ারদের চিন্তাতেও মিল দেখলাম। ক্রিকেট প্লেয়াররা কোনোক্রমে একটা হাফ সেঞ্চুরি করলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন। তারাও জানেন আল্লাহ আকাশে থাকেন।

শিশুপুত্র নিষাদ আল্লাহর অবস্থান বলেই ক্ষান্ত হলো না। সে বলল, আল্লাহর কাছে দুটা বড় এসি আসে। একটা এসি দিয়ে তিনি গরম বাতাস দেন, তখন আমাদের গরম লাগে। আরেকটা এসি দিয়ে তিনি ঠান্ডা বাতাস দেন, তখন আমাদের ঠান্ডা লাগে।

কুইজ-১

কোন মোগল সম্রাট টাকশাল থেকে স্বর্ণমুদ্রা ছেড়েছিলেন, সেখানে লেখা—’আমি আল্লাহ’। কিন্তু সেই সময়কার মাওলানারা তার জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেন নি।

উত্তর : সম্রাট আকবর। তিনি স্বর্ণমুদ্রায় লিখলেন, আল্লাহু আকবর। এর একটি অর্থ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্য অর্থ আকবর আল্লাহু। সম্রাট আকবর তখন নতুন ধর্মমত প্রচার শুরু করেছেন–দিন-ই-এলাহি। মোল্লারা যখন তাকে স্বর্ণমুদ্রায় লেখা নিয়ে প্রশ্ন করল তখন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, যে অর্থ গ্রহণ করলে আপনারা খুশি হন সেই অর্থ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ-–এই অর্থ নিন।

কুইজ-২

প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীপৃষ্ঠে কতবার বজ্রপাত হয়?

উত্তর : দুইশত বার।
 
বেঁচে আছি



কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন?’–তার উত্তরে ‘ভালো আছি’ বলাটাই ভদ্রতা। খারাপ থাকলেও বলতে হয় ভালো আছি।

বৃদ্ধদের জন্যে এই নিয়ম খাটে না। এক বৃদ্ধ যখন অন্য বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন?’–তার উত্তরে ভালো আছি’ না বলে যেসঝ অসুখ বিসুখে তিনি ভুগছেন তার বিশদ বর্ণনা দেওয়াটাই ভদ্রতা। যেমন, কিছুই হজম হচ্ছে না। গ্যাসের যন্ত্রণা। রাতে ঘুম হয় না বললেই হয়। মাথার তালু, পায়ের পাতা গরম হয়ে থাকে। মনে হয় ভাপ বের হচ্ছে।

আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছেন?’–আমি বলি ‘বেঁচে আছি’। বেঁচে থাকা আমার কাছে বিস্ময়কর একটা ঘটনা বলেই ‘বেঁচে আছি’ বলি। আমার বেঁচে থাকা কোনোক্ৰমে টিকে থাকা না। আনন্দময় অবস্থায় থাকা।

যে-কোনো অবস্থায় যে-কোনো পরিস্থিতিতে আমি আনন্দে থাকতে পারি। এইদিকে হিমু চরিত্রের সঙ্গে আমার কিছুটা মিল আছে।

আমার চরম দুঃসময়ে আনন্দে থাকার কয়েকটা ঘটনা বলি।

(ক)

১৯৭১ সন। মহসিন হল থেকে আমাদের কয়েকজনকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে। ভোরবেলা মেরে ফেলা হবে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। রাত দশটার দিকে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল আকৃতির একটা সাগর কলা। ধরিয়ে দিল। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কলাটা খাও। মনে হচ্ছে তোমাকে মেরে ফেলা হবে। তবে তোমার জন্যে সান্ত্বনার একটি বিষয় আছে। শুনতে চাও?

চাই।

তুমি যদি অপরাধী হয়ে থাকো তাহলে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি। আর যদি অপরাধী না হও তাহলে সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। হুরপরীদের সঙ্গে থাকবে।

আমি তার যুক্তি শুনে শব্দ করে হেসে ফেললাম। মৃত্যুভয়জনিত টেনশন একপাশে রেখে সহবন্দিদের সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করলাম।

পরদিন কীভাবে বেঁচেছি সেই গল্প অনেক জায়গায় করেছি বলে উহ্য রাখলাম।

(খ)

মালিবাগ রেলক্রসিং। ট্রেন আসছে। রেলক্রসিং-এ ঘণ্টা বাজছে। গেটের লৌহদণ্ড উপর থেকে ধীরে ধীরে নামছে। গাড়ির যাত্রীরা চাচ্ছে এই ফাঁকে পার হয়ে যেতে। হুড়মুড় করে গাড়ি ক্রসিং পার হচ্ছে। আমার ড্রাইভারও গাড়ি রেললাইনের উপর তুলল। তখনই ঘটল সাড়ে সর্বনাশ। গাড়ি জ্যামে আটকে গেল। আমাদের সামনে অসংখ্য গাড়ি, পেছনে গাড়ি, আমরা রেললাইনে। ট্রেন ঘণ্টা বাজিয়ে আসছে।

আমার সঙ্গে আছেন অভিনেতা মোজাম্মেল সাহেব। ( অয়োময়ের হানিফ, খুকখুক করে কেঁশে যিনি সবার হৃদয় হরণ করেছিলেন।) হানিফ সাহেব আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলেন। একবার দরজা ধরে টানেন, একবার লাফিয়ে সামনের দিকে আসেন, পরক্ষণেই এক লাফে পেছনে যান। আমি বললাম, হানিফ সাহেব! অস্থির হবেন না। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, অবস্থা বুঝতেছেন না? এক্ষুনি মারা যাব। আমি তার উত্তরে হাসতে হাসতে বললাম, ঐ দেখুন ট্রেনের ইঞ্জিন। রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম।

প্রবল আতঙ্কের সময় শরীরে এনডলিন নামের একটি এনজাইম আসে। এই এনজাইম ভয় কাটিয়ে দেয়। এই এনজাইম বাইরে থেকেও শরীরে দেওয়া যায়।

আমি তখন সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ওটি-তে নেওয়া হবে। ওপেন হার্ট সার্জারি। ডাক্তার বললেন, ভয় পাচ্ছেন?

আমি বললাম, পাচ্ছি।

ডাক্তার বললেন, একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, ভয় কেটে যাবে।

আমি বললাম, এনড্রলিন জাতীয় কিছু?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ।

ইনজেকশন দেওয়া হলো। আমার ভয় কেটে গেল। ভয় কাটানোর এই ওষুধ টেবলেট আকারে পাওয়া গেলে ভালো হতো। ভয় পাচ্ছি, চট করে একটা টেবলেট গিলে ফেলা।

ভয়কে আমি মোটামুটি জয় করেছি এটি বলা যেতে পারে। অপমান’ জয় করতে পারি নি। আনন্দে বেঁচে থাকার জন্যে অপমান জয় করা অতি জরুরি। লেখকজীবনে আমাকে নানান ধরনের অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এখনো যাচ্ছি। চামড়া গণ্ডারের কাছাকাছি করে ফেলেছি। এখন লেখালেখি নিয়ে অপমান গায়ে লাগে না। তবে পুত্রকন্যাদের অপমান গায়ে লাগে। তখন বেঁচে থাকা খুব আনন্দময় মনে হয় না।

একটা ঘটনা বলা যেতে পারে।

আমার মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ। ইকনমিক্সে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাস করেছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে একগুচ্ছ ফুল এবং এক প্যাকেট মিষ্টি পাঠালাম। সে থাকে ভাইবোনদের নিয়ে তার মা’র সঙ্গে। আমার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় বিয়ে করায় বাবার প্রতি তাদের কঠিন রাগ।

ফুল পাঠানোর এক ঘণ্টার মধ্যে ফুল এবং মিষ্টির প্যাকেট ফেরত এল। সঙ্গে শীলার কঠিন এক নোট–

বাবা,

ফুল-মিষ্টি ফেরত পাঠালাম। একটা মিষ্টি ভুলে খেয়ে ফেলেছি। সরি।

ইতি

শীলা

ভুলে একটা মিষ্টি খেয়ে ফেলার মধ্যে যে কৌতুক আছে তা-ই আমাকে অপমান থেকে রক্ষা করল। আমি অনেকক্ষণ হো হো করে হাসলাম।

আধুনিক মানুষ যেসব কাল্পনিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তার একটির নাম ভালো না-লাগা রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কিছুই ভালো লাগে না। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি ভালো লাগে না। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে, জোছনা ভালো লাগে না। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ ভালো লাগে না।

আমার সবই ভালো লাগে। উদাহারণ দেই।

৮ জুলাই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট খেলা। আমার জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে ভালো লাগতে শুরু করে। এই তো আর কয়েকটা মাত্র দিন, তারপর আরাম করে ক্রিকেট খেলা দেখব। এক সপ্তাহ আগে থেকেই আনন্দ শুরু।

ভিডিওর দোকান থেকে পছন্দের ভিডিও কিনে আনা হয়েছে। আলাদা সাজানো আছে। কোনো একসময়ে ছবি দেখা হবে, এই চিন্তাই আনন্দের।

পড়ার জন্যে প্রচুর বই আছে। যে-কোনো একটা হাতে নিলেই জগৎ-সংসার ভুলে যাওয়া। ছোটবেলার কথা মনে আছে, ভালো কোনো বই হাতে এসেছে (তখনকার ভালো বই মানে ডিটেকটিভ বই, কিরীটি রায়, দস্যু মোহন…) বইটা গোগ্রাসে পড়ার কথা, পড়ছি না। পড়লেই শেষ হয়ে যাবে। এক পাতা দু’পাতা করে পড়া। শিশুর হাতের সন্দেশের মতো। সে সন্দেশ হাতে নিয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে শুকে দেখছে। খাচ্ছে না। খেলেই তো শেষ হয়ে যাবে।

আনন্দময় বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত ভালো সঙ্গিনী। প্রাচীনকালে স্ত্রীদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো

১. ঘর জ্বালানি, পাড়া জ্বালানি

(এরা ঘর জ্বালায়, পাড়াপ্রতিবেশিকে জ্বালায়)

২. ঘর জ্বালানি, পাড়া ভালানি। ৩. ঘর ভালানি, পাড়া ভালানি।

(আদর্শ স্ত্রী)

এই সময়ে, ফ্ল্যাট বাসের যুগে, পাড়া বলে কিছু নেই। সবই ঘরকেন্দ্রিক। আমি এই সময়ের স্ত্রীদের কয়েকটা ভাগ করেছি।

১. সন্দেহ নারী

এরা স্বামীর মোবাইল চেক করবে। স্বামী বাইরে থেকে ফিরলে শার্ট খুঁকে দেখবে, শার্টে কোনো অপরিচিত গন্ধ আছে কি না। কিংবা লম্বা চুল লেগে আছে কি না। গাড়ির ড্রাইভার তাদের প্রধান স্পাই। স্যার কোথায় কোথায় গেল, কার সঙ্গে কথা বলল, সব ম্যাডামের কাছে রিপোর্ট করা হবে। ম্যাডাম দরাজ হাতে বখশিশ দেবেন।

২. না নারী

এরা স্বামীর প্রতিটি কথাতেই ‘না’ বলবেন। স্বামী যদি বলেন, আজ ইলিশ। মাছ রান্না করো। স্ত্রী বলবে, না ইলিশ না। ছোট মাছ খাও। স্বামী যদি অবসরে একটা ছবি দেখার জন্যে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলেন, এসো এই ছবিটা দেখি। স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, এটা না অন্য একটা দেখব।

৩. মার্কেট নারী।

এরা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আট ঘন্টাই মার্কেটে মার্কেটে ঘোরেন এবং দুনিয়ার আবর্জনা কিনে ঘর ভর্তি করেন।

৪. নারী চিৎকারক

এরা থাকেন চিঙ্কারের উপর। এদের ধারণা কাজের মেয়েদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হলে সারাক্ষণই চিৎকার করতে হবে। একসময় এরা স্বাভাবিক কথা বলতেও ভুলে যান। স্বামী-সন্তান সবার সঙ্গেই চিৎকার করতে থাকেন।

৫. নারী দ্রৌপদী (শৌখিন)

এদের বেশির ভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে। বই দেখে অদ্ভুত অদ্ভুত রান্না করতে এরা ভলোবাসেন। সেইসব অখাদ্য স্বামীকে গিলতে হয় এবং বিস্মিত হওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলতে হয়, অদ্ভুত হয়েছে। রেসিপি কোথায় পেয়েছ? তাদের রান্না করা অদ্ভুত খাদ্যের নমুনা, আনারস করলার প্যান ফ্রাই।

এতক্ষণ রসিকতা করলাম। স্ত্রীরা সংসার নামক অতি জটিল নৌকার একমাত্র মাঝি। যে নৌকা চলছে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের ভেতর দিয়ে। তাদের সব ভুল সব ক্রটি স্বামীদের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করতে হবে।

সংসারের সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট। তিনি, ‘Home is a place where, if you want to go there, They have to take you in’.

এমন ‘Home’ কয়জনের ভাগ্যে আছে! রবার্ট ফ্রস্টের ভাগ্যে তো ছিল না।

পাদটিকা

আমার আনন্দময় বেঁচে থাকায় গায়িকা এবং অভিনেত্রী শাওনের বড় ভূমিকা আছে। তার ভূমিকা বলার প্রয়োজন বোধ করছি

১. সে কখনোই কোনো কিছু নিয়ে আমাকে বিরক্ত করে। একদিন সে বলল, একজন লেখক যখন লিখেন না, চুপচাপ বসে থাকেন তখনো তিনি মনে মনে লিখছেন। এই সত্যটা জানি বলেই বিরক্ত করি না।

২. ঢাকা শহরে শাওনের প্রচুর আত্মীয়স্বজন। তাদের অনুষ্ঠান লেগেই আছে, আজ অমুকের বিয়ে তমুকের খত্না। তারা টেলিফোন করে। শাওন বলে, ও গর্তজীবি মানুষ। কোথাও যেতে পছন্দ করে না। কাজেই ও যাবে না। তাকে একা ঘরে ফেলে আমিও যাব না।

৩. আমি যে ফ্ল্যাটে বাস করি সেখানে কোনো বারান্দা ছিল না। বৃষ্টি দেখতে পারতাম না। আকাশ দেখতে পারতাম না। আমি যাতে বৃষ্টি দেখতে পারি তার জন্যে পুরো ফ্ল্যাট সে ভেঙেছে। এখন বৃষ্টি দেখার জন্যে আমার অপূর্ব একটা জায়গা হয়েছে। আমি বেশির ভাগ সময় সেখানে বসে থাকি এবং তারাশংকরের নায়কের মতো বলি–”জীবন এত ছোট কেন?”

লেখার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। সুন্দর একটা কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাচ্ছি। এই মুহূর্তে বিশেষ কোনো কবিতা মনে পড়ছে না। কবিতাটি এমন হওয়া উচিত যেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ প্রকাশিত হয়। সব আনন্দের সঙ্গেই দুঃখ মেশানো থাকে। সেই দুঃখও যেন থাকে। একটা পাওয়া গেছে–

Where shall I go
To escape from folly?
For now there is love i know.
Or else this melancholly.
Heigh, heigho.
 
স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন



দুঃস্বপ্ন নিয়ে লেখা সাইকোলজির একটা বই পড়ছিলাম, Nightmare You Hate. মানুষ কী কী দুঃস্বপ্ন দেখে, কেন দেখে–তা-ই বিতং করে লেখা। আমি আমার দুঃস্বপ্নগুলি বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম। বই পড়ে জানলাম, মানুষ সবচেয়ে বেশি যে দুঃস্বপ্ন দেখে তা হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে পতন। এই পতনের শেষ নেই। একসময় সে আতঙ্কে জেগে ওঠে।

এই বিশেষ দুঃস্বপ্ন আমি যৌবনকালে দেখতাম। এখন আর দেখি না। বইয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে–এই দুঃস্বপ্ন অসহায়ত্বের প্রতীক। কেউ যদি অসহায় বোধ করে তখনই এই দুঃস্বপ্ন দেখে। হয়তো যৌবনে আমি অসহায় বোধ করতাম।

দ্বিতীয় দুঃস্বপ্ন যা মানুষ প্রায়ই দেখে তা হচ্ছে, জনসমাবেশে নিজেকে নগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করা। নিজের সম্মান নিয়ে যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তারাই নাকি এই দুঃস্বপ্ন দেখেন। আমি নিজে কয়েকবার নগ্ন অবস্থায় নিজেকে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখেছি। স্বপ্নে পুরো ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়েছে।

আজকাল কেন জানি স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন কোনোটাই দেখি না। গভীর রাতে ঘুমাতে যাই। এমনিতেই আমার ঘুম ভালো হয়, তারপরেও ডাক্তারের পরামর্শে ডিজোপেন নামের একটা ঘুমের ওষুধ খাই। সাইকিয়াট্রিস্ট এবং লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক আমি ডিজোপেন খাই শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এটা তো পাগলের ওষুধ। আপনি পাগলের ওষুধ খাচ্ছেন কেন?

আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, আমি তো পাগলই!

কড়া ঘুমের ওষুধ মাথা থেকে স্বপ্ন তাড়িয়ে দেয়। যারা ঘুমের ওষুধ খায় তাদের স্বপ্ন দেখার কথা না, তারপরেও কয়েকদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম, আমি ক্লাস নিচ্ছি। একদল ছাত্র গম্ভীরমুখে বসে আছে। আমি তাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের Particle in a box problem পড়াচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার প্যান্টের ফ্লাই ভোলা। প্রবল আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় বসে আছি আর ভাবছি, এই স্বপ্নটা কেন দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা মিস করছি বলে দেখছি? ক্লাসে পড়াচ্ছি ঠিক আছে, প্যান্টের ফ্লাই খোলা কেন? এর অর্থ কী?

সাইকিয়াট্রিস্টরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন, এই ফাঁকে আমি বলে ফেলি যে অধ্যাপনার বিষয়টা আমি মিস করি। ‘মিস’ করার ভালো বাংলা পাচ্ছি না বলে ইংরেজি শব্দটাই লিখলাম। বাংলায় মিস করা হলো অভাববোধ, দুঃখবোধ। কোনোটাই মূল ইংরেজি শব্দের সঙ্গে যাচ্ছে না।

অধ্যাপনার সময়টা ছিল আমার অর্থকষ্টের কাল। টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে বাসায় টেলিভিশন ছিল না। হাতের কাছের সমুদ্রে পা ভেজানোর সামর্থ্যও ছিল না। তারপরেও দুঃখে-কষ্টে সময়টা ভালো কেটেছে। কেমিস্ট্রির দুরূহ বিষয় ছাত্রদের কাছে পরিষ্কার করতে পারছি এই আনন্দ তুলনাহীন।

বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে তখন বরিশাল-পটুয়াখালি যেতাম। যাওয়া-আসার TA, DAটা সংসারের কাজে আসত। ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ত সন্ধ্যাবেলায়। লঞ্চের ডেকে একা বসে থাকার আনন্দও ছিল সীমাহীন। আজকাল একা থাকতে পারি না। সবসময় আশপাশে মানুষজন লাগে। মানসিক এই পরিবর্তন কেন হচ্ছে কে জানে!

আমি বহিরাগত একজামিনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি বরিশাল বি এম কলেজে। আমার থাকার ব্যবস্থা হতো কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরির একটা ঘরে। ঘরভর্তি মাকড়সা। মেঝেতে তেলাপোকা। ল্যাবরেটরি গাছপালার মাঝখানে। সন্ধ্যার পর পরিবেশ ভুতুড়ে হয়ে যেত। অধ্যাপক নিজের বাড়ি থেকে ভদ্রতা করে খাবার আনতেন তা-না। বহিরাগত পরীক্ষকের ‘সেবার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হতো।

রাত নটার পর রসায়নের কোনো এক অধ্যাপকের বাসা থেকে খাবার আসত। রাত নটাতেই মনে হতো নিশুতি রাত। মশারি খাঁটিয়ে মশারির ভেতর বসে থাকতাম। ঘুম আসত না। মাকড়সা-তেলাপোকা ছাড়াও অন্য একটি ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করত। সেটা হলো ভূতের ভয়। এতে একটা লাভ অবশ্যি হয়েছে, আমি বেশকিছু ভূতের গল্প লিখেছি।

বিএম কলেজে দিন যাপনের একটা গল্প বলা যেতে পারে। এক সন্ধ্যায় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা বিশাল বাহারি কাজ করা পিতলের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সাজগোজ দেখার মতো। হাতভর্তি সোনার গয়না। (সেই সময় নকল গয়নার চল শুরু হয় নি।) গলায় চন্দ্রহার। ভদ্রমহিলা অতি পরিচিতজনের গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, ভালো আছেন?

আমি বললাম, জি। আপনাকে চিনতে পারলাম না।

ভদ্রমহিলা তার নাম বললেন। তিনি যে আমার কিছু বই পড়েছেন সে তথ্য জানালেন। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি পোলাও, কোর্মা, ঝালমাংস এবং ইলিশ মাছ ভাজা এনেছেন তাও শুনলাম।

একজন নতুন প্রায় অখ্যাত লেখকের জন্যে বিপুল আয়োজন আমাকে বিস্মিত করল। ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনিও একজন লেখিকা। একটা উপন্যাস সম্প্রতি লিখে শেষ করেছেন। উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়তে হবে।

আমি বললাম, আপনি পাণ্ডুলিপি রেখে যান। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ব।

ভদ্রমহিলা বললেন, পাণ্ডুলিপি রেখে গেলে আপনি পড়বেন না। তারচেয়েও বড় কথা, আমি আমার পাণ্ডুলিপি কখনো হাতছাড়া করি না। বলা তো যায় না, কোত্থেকে কী হয়। আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব।

কত পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি?

চার শ’ পৃষ্ঠার।

চার শ’ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি পড়তে আপনার কতক্ষণ লাগবে?

আট ঘণ্টা লাগবে। আমি একজনকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। আট ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট লেগেছে।

সারা রাত আপনি আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনাবেন?

আমি খবর নিয়েছি আপনি আরও চারদিন আছেন। আমি রোজ সন্ধ্যায় এসে দু’ঘণ্টা পড়ব। সময় নষ্ট না করে শুরু করে দেই।

আমি তখন পুরোপুরি হতাশ। এই মহিলার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ দেখছি না। প্রতি সন্ধ্যায় কালজয়ী কোনো লেখাও আমি লেখকের মুখ থেকে শুনব না।

ভদ্রমহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই, এটা একটা প্রেমের করুণ উপন্যাস। নৌকাতে নায়ক-নায়িকার প্রেম হয়। নৌকা ঝড়ের মধ্যে পড়ে। নায়িকা সাঁতার জানে না। তাকে বাঁচাতে গিয়ে নায়কেরও সলিল সমাধি হয়। দু’জনকে উদ্ধারের পর দেখা যায়, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে মরে পড়ে আছে। পড়া শুরু করি?

আমি হতাশ গলায় বললাম, করুন।

ভদ্রমহিলা পাঠ শুরু করলেন। তাঁর উপন্যাসের প্রথম বাক্য’নৌকার মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছেড়ে দিল।

আমি বললাম, থামুন। আমি ভাটি অঞ্চলের দিকের মানুষ। জীবনে অসংখ্যবার নৌকায় চড়েছি। কখনো শুনি নি কোনো মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছাড়ৈ। আপনি শুনেছেন?

না।

তাহলে কেন লিখেছেন, মাঝি বদর বদর করে নৌকা ছেড়ে দিল? আপনার পর্যবেক্ষণে ভুল আছে। আপনি আশপাশে কী হয় দেখেন না। আপনার লেখা কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। আমি আপনার লেখা শুনব না।

পুরোটা না শুনলে কীভাবে বুঝবেন?

হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না জানার জন্যে একটা ভাত টেপাই যথেষ্ট। প্রতিটি ভাত টিপতে হয় না। আপনার ভাত সিদ্ধ হয় নাই।

আপনার নিজের ভাত সিদ্ধ হয়েছে? নিজেকে আপনি কী মনে করেন?

ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চেঁচামেচি করে টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত নিয়ে চলে গেলেন। আমার মাংস-পোলাও খাওয়া হলো না।

এধরনের সমস্যা আমার এখনো মাঝে মাঝে হয়। তার একটা গল্প বলি। এক তরুণী কবি আমাকে কবিতার বই দিতে এসেছেন। বইটা তাঁকে নিজ হাতে আমাকে দিতে হবে কারণ কবি বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছেন। এটি তার প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।

আমি তাকে বাসায় আসতে বললাম। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েসী এক তরুণী। বিষাদগ্রস্ত চেহারা। খুবই অস্থিরমতি। স্থির হয়ে তাকাচ্ছেও না।

আমাকে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। সে বলল, স্যার আমি আপনার কিছু সময় নেব। সবগুলি কবিতা আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব। আপনি না বললে শুনব না।

বলেই সে অপেক্ষা করল না। বই খুলে কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। চটি বই। কবিতা পড়ে শেষ করতে আধঘণ্টার মতো লাগল। আমি বললাম, ভালো হয়েছে।

কবি হতাশ গলায় বলল, ভালো হয়েছে বলে শেষ করলে হবে না। আপনার অনুভূতি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে হবে। কেন ভালো হয়েছে সেটা বলবেন। প্রতিষ্ঠিত কবিদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করবেন।

আমি বললাম, তাহলে বলব ভালো হয় নি।

কেন?

তুমি ছন্দ বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা-ই জানো না।

আমি লিখি আমার নিজস্ব ছন্দে। ছন্দের পুরনো ধারণায় আমি বিশ্বাসী না।

কবিতার নানান ছন্দ আছে–এই বিষয়টা কি তুমি জানো?

হুঁ।

দু’একটা ছন্দের নাম বলতে পারবে?

এখন মনে পড়ছে না। শুধু অমিত্রাক্ষর ছন্দের নাম মনে আসছে। মাইকেল মধুসূদনের আবিষ্কার।

পয়ার ছন্দ জানো?

না।

আমি বললাম, “চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে
কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’ এইটি কোন ছন্দে লেখা বলতে পারবে?

না।

আমি বললাম, ছন্দের নাম ‘ললিত’! ললিতের অনেক ভাগ আছে। যেমন, ভঙ্গ ললিত, মিশ্র ললিত, ললিত ত্রিপদী, ললিত চতুষ্পদি, ভঙ্গ ললিত চতুম্পদি।

আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন যে আপনি ছন্দ বিশেষজ্ঞ?

আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। একবার আমার ছবির জন্যে গান লেখার প্রয়োজন পড়ল। তখনি ছন্দ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তোমার প্রতি আমার উপদেশ হলো, ছন্দ বিষয়টা পুরোপুরি জেনে তারপর কবিতা লিখবে।

বরিশালের মহিলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে চলে গিয়েছিল, এই কবি তার বই ফেরত নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে অপমানসূচক একটি বাক্য বলে গেল। সেই বাক্যটি বলতে ইচ্ছা করছে না। অভিমানী কবি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।

.

পাদটিকা

There are, in actual fact man who talk like books. Happily however, there are also books that talk like men.

—Theodor Haecker.

কিছু মানুষ আছে যারা বইয়ের মতো কথা বলে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, কিছু বই আছে মানুষের মতো কথা বলে।

–থিওডর হেকার।

কুইজ

এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশী তরুণ মুসা ইব্রাহিমের বাবার নাম কী?

উত্তর : জনাব মোঃ আনসার আলী।

(মুসা ইব্রাহিম! অভিনন্দন, বাপকা ব্যাটা!)
 
হাসপাতাল


ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একটি কেবিন।

কবি শামসুর রাহমান শুয়ে আছেন। তার নাকে অক্সিজেনের নল। গায়ে হাসপাতালের পোশাক নেই। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে শুয়ে আছেন। গেঞ্জি গলা পর্যন্ত ওঠানো বলে কবির বুক যে হাপরের মতো ওঠানামা করছে তা দেখা যাচ্ছে। কবি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টিতে প্রাণের স্পর্শ নেই।

হাসপাতালের ঐ কেবিনে আমার সঙ্গে আছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী। আরও কেউ কেউ হয়তো ছিলেন, তাদের নাম মনে করতে পারছি না। আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কবির রোগযন্ত্রণা দেখছি, হঠাৎ সৈয়দ শামসুল হক নৈঃশব্দ ভঙ্গ করলেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কবি, আপনাকে বাঁচতেই হবে। আমি আমার আয়ু থেকে খানিকটা আপনাকে দিলাম।

ঘোষণায় নাটকীয়তা ছিল, আবেগ ছিল, যুক্তি ছিল না। একজন তার আয়ুর খানিকটা অন্যকে দিতে পারেন না। বাংলাদেশের সব মানুষ এক মিনিট করে আয়ু কবিকে দান করলে কবি বেঁচে থাকতেন তিনশ’ বছর।

তবে মোঘল সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ূনকে নিজের আয়ু দান করেছিলেন। ঘটনাটা এ রকম–হুমায়ূণ মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসকদের সব চিকিৎসা ব্যর্থ। এইসময় সুফি দরবেশ মীর আবুল কাশেম সম্রাটকে বললেন, আপনি আপনার জীবনের একটি অতি প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইতে পারেন। এটা হবে শেষ চেষ্টা।

সম্রাট বাবর বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো নিজ জীবন। এর বিনিময়ে আমি পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।

মীর আবুল কাশেম আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! নিজের জীবন না, আপনি বরং বহুমূল্যবান কোহিনূর হীরা দান করে দিন।

সম্রাট বললেন, আমার পুত্রের জীবন কি সামান্য হীরকখণ্ডের তুল্যমূল্য? আমি আমার জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।

সম্রাট তিনবার পুত্রের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রার্থনা করলেন। তিনবার বললেন, পুত্র, তোমার সমস্ত ব্যাধি আমি নিজ দেহে তুলে নিলাম। পরম করুণাময় আমার প্রার্থনা কবুল করো।

হুমায়ূন অবচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থায় এসে পানি খাইতে চাইলেন আর বাবর হলেন অসুস্থ।

আমার নিজের জীবনেও এরকম একটি ঘটনা আছে। আমার ছেলে রাশেদ হুমায়ূনের বয়স দুই দিন তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। সে মারা যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল থেকে শহীদুল্লাহ হলের বাসায় ফিরে এলাম। অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ালাম। আমি ঠিক করলাম, সম্রাট বাবরের মতো নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইব। জায়নামাজে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো এই প্রার্থনা কবুল হবে।

শেষ মুহূর্তে প্রবল ভীতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি জীবনের বিনিময়ে জীবনের প্রার্থনা করতে পারি নি। আমি আমার মৃত শিশুপুত্রের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।

নুহাশপল্লীর ঔষধি উদ্যানে একটি স্মৃতিফলক আছে– রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান। তার নিচে লেখা–”আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি।”

আমার শিশুপুত্র তিন দিনের আয়ু নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে এসেছিল। সে এই সৌন্দর্যের কিছুই দেখে নি। আমি প্রায়ই নিজেকে এর জন্যে দায়ী করি।

থাকুক পুরনো কথা, হাসপাতালের অন্য গল্প করি।

গল্প-১

স্থান : হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। শেরেবাংলা নগর।

আমার বড় ধরনের হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। ভর্তি হয়েছি হাসপাতালে। নানান যন্ত্রপাতি এবং মনিটর শরীরে লাগানো। আমার বড় ছেলে নুহাশ আমাকে দেখতে এসেছে। নুহাশের বয়স পাঁচ। সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। মনিটরে ঢেউয়ের মতো রেখা দেখা যাচ্ছে।

নুহাশ বলল, বাবা এখানে কী হচ্ছে আমি জানি।

কী হচ্ছে?

এই যে ঢেউয়ের মতো রেখাগুলি দেখছ, একসময় রেখা সমান হয়ে স্ট্রেইট লাইন হবে। তখন তুমি মারা যাবে।

আমি বললাম, ও!

নুহাশ গভীর আগ্রহ নিয়ে মনিটর দেখছে। কখন স্ট্রেইট লাইন হবে কখন তার বাবা মারা যাবে এই প্রতীক্ষা।

গল্প-২

স্থান : বেলিভিউ হাসপাতাল। নিউইয়র্ক।

আমার এনজিওগ্রাম করা হবে। পায়ের ধমনী কেটে একটা সুই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সুঁই চলে যাবে হৃৎপিণ্ডে। আমাকে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে প্রতি এক হাজারে একজন মারা যায়। আমি কাগজপত্রে সই করে জানিয়েছি মৃত্যু হলে দায়দায়িত্ব হাসপাতালের না, আমার।

অপারেশন হবে ভোর নটায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম?

হ্যাঁ।

কাল ভোরে তোমার অপারেশন। তুমি কি চাও তোমার জন্যে তোমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হোক?

তার মানে কী?

এই হাসপতালে রোগীদের জন্যে প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। প্রার্থনার জন্যে আলাদা ফি আছে। তুমি ফি’র ডলার জমা দিলেই প্রার্থনা ব্যবস্থা হবে।

হাসপাতাল হলো চিকিৎসার জায়গা। প্রার্থনার জায়গা এটা জানতাম না।

কাউন্সিলর বললেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে যাদের জন্যে প্রার্থনা করা হয় তাদের আরোগ্যের হার বেশি। এইজন্যেই প্রার্থনা বিভাগ খোলা হয়েছে।

আমি প্রার্থনা করাব না। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই।

তোমার অপারেশনটি জটিল। তুমি যদি চাও আমি ডিসকাউন্টে প্রার্থনার জন্যে সুপারিশ করতে পারি। একজন মুসলমান আলেম প্রার্থনা করবেন?

ডিসকাউন্টের প্রার্থনাতেও আমার বিশ্বাস নেই।

তুমি কি নাস্তিক?

আমি নাস্তিক না বলেই ডিসকাউন্টের প্রার্থনায় বিশ্বাসী না।

ভোর ন’টায় এনজিওগ্রাম শুরু হলো। ডাক্তার একজন অল্পবয়েসী তরুণী। আমেরিকান না, ভারতীয় তরুণী। সে কিছু একটা গণ্ডগোল করল। ধমনী ফেটে রক্ত ছিটকে বের হয়ে আমার সামনের মনিটরে পড়ল। ডাক্তারের চোখেমুখেও পড়ল। আমি ইংরেজিতে জানতে চাইলাম, কোনো সমস্যা কি হয়েছে?

তরুণী বলল, Stay calm, অর্থাৎ শান্ত থাকো।

আমাকে শান্ত থাকতে বলে সে যথেষ্টই অশান্ত হয়ে পড়ল। একটা পর্যায়ে তাকে সাহায্য করার জন্যে অন্য ডাক্তার চেয়ে পাঠাল। আমি মনে মনে বললাম, ডিসকাউন্টের প্রার্থনা নেওয়াই মনে হয় উচিত ছিল।

গল্প-৩

স্থান : মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল। সিঙ্গাপুর। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চতুর্থবারের মতো আমার এনজিওগ্রাম করা হয়েছে। রাতটা হাসপাতালের কেবিনে কাটাতে হবে। পরদিন ছুটি। খরচ কমানোর জন্যে সিঙ্গেল কেবিন না নিয়ে ডাবল কেবিন নিয়েছি। আমার পাশে আরেকজন অতি বৃদ্ধ চায়নিজ রোগী। দু’জনের মাঝখানে পর্দা আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি বৃদ্ধ রোগীকে দেখতে পাচ্ছি।

রোগীর অবস্থা শোচনীয়। তার মুখে বেলুনের মতো কী যেন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বেলুন ফুলছে এবং সংকুচিত হচ্ছে। অনেকটা ব্যাঙের গলার ফুলকার মতো। রোগী ঘড়ঘড় শব্দ করছে। ভয়ঙ্কর রকম আহত জন্তু হয়তোবা এরকম শব্দ করে।

রোগীকে দেখার জন্যে একের পর এক তার আত্মীয়স্বজন আসছে। কিছুক্ষণ কেঁদে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। অনেককে দেখলাম রোগীর বালিশের নিচে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে আসছে। বাবা-মা বাচ্চাদের। উঁচু করে রোগীকে দেখাচ্ছে। অনেকটা শেষ দেখার মতো। কুমিরের বাচ্চার মতো দেখানো শেষ হওয়ামাত্র বাচ্চাগুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার দিকে। এরা শুরু করে কিচিরমিচির। কেউ কেউ চেষ্টা করে আমার বিছানায় উঠতে।

একসময় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা এসে বিনয়ে নিচু হয়ে আমাকে জানাল, তার দাদা মারা যাচ্ছেন বলে সবাই দেখতে আসছে। আমাকে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে তাদের লজ্জার সীমা নেই। আমি যেন ক্ষমা করে দেই।

রাত দশটায় নার্স আমার জন্যে ওষুধ নিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ বৃদ্ধের কী হয়েছে?

নার্স বলল, বার্ধক্য ব্যাধি।

অবস্থা কি খারাপ?

যথেষ্টই খারাপ। ঘটনা রাতেই ঘটবে।

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেউ রাতে মারা গেলে তার ডেডবডি কি তোমরা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাও, না পরে নাও?

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা হয়।

আমি বললাম, আমি মৃত মানুষ পাশে নিয়ে কখনো শুয়ে থাকি নি। আমাকে কি অন্য একটা কেবিনে দেওয়া যাবে?

নার্স বলল, অবশ্যই যাবে। তুমি ওষুধ খাও, আমি ব্যবস্থা করছি।

আমি ওষুধ খেলাম। নিশ্চয়ই কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। আমি আমার নিজের কেবিনেই আছি। পর্দার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোনো শব্দও নেই। সুনসান নীরবতা। ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটে গেছে।

আমি অতি কষ্টে বিছানা থেকে নামলাম। উঁকি দিলাম পাশের বিছানায়। বৃদ্ধ হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বৃদ্ধের মুখ হাসিহাসি। সে চামচ দিয়ে স্যুপ খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, গুড মর্নিং।

আমি বললাম, গুড মর্নিং।

বৃদ্ধ হাত ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকল। বিড়বিড় করে চায়নিজ ভাষায় কী, যেন বলল। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বালিশের নিচে হাত দিয়ে একশ’ সিঙ্গাপুর ডলারের একটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, টেক টেক টেক। মনে হয় জীবন ফিরে পেয়ে সে মহা আনন্দিত। এই আনন্দের খানিকটা ভাগ আমাকে দিতে চায়। (পাঠকদের কী ধারণা–আমি কি বৃদ্ধের উপহার নিয়েছি, নাকি নেই নি? কুইজ।)

.

পাদটিকা-১

এইবার ইউরোপের অতি উন্নত একটি দেশের অদ্ভুত চিকিত্সার গল্প। দেশটির নাম সুইডেন। সেই দেশে বাঙালি এক মহিলা দাঁতের সমস্যা নিয়ে গেছেন। দাঁতের ডাক্তার পরীক্ষা করে আঁতকে উঠে বললেন, দাঁতের গোড়ায় ভয়ঙ্কর এক জীবাণু পাওয়া গেছে। এই জীবাণু হার্টে চলে যাওয়া মানে হার্ট ফেইলিউর। তিনি ব্যবস্থা দিলেন রোগীর সব দাঁত জরুরি ব্যবস্থায় তুলে ফেলতে হবে। মহিলা শুরু করলেন কান্না। মহিলার মেয়ে একজন ডাক্তার। সে মাকে বলল, মা, তোমার চিকিৎসা হচ্ছে সুইডেনে, এত ভালো চিকিৎসা কোথাও হবে না। দাঁত ফেলতে বলছে ফেলে দাও।

বেচারির সব সুস্থ দাঁত টেনে তুলে ফেলে দেওয়া হলো। তাকে ভর্তি করা হলো ভয়ঙ্কর জীবাণুর চিকিৎসা যে হাসপাতালে হয় সেখানে। ডাক্তররা ভয়ঙ্কর জীবাণুর সন্ধানে লেগে গেলেন। একসময় ঘোষণা করলেন, এই জীবাণুর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। ভুল হয়েছে। ভুলের কারণেই সব দাঁত ফেলা হয়েছে। তারা দুঃখিত।

ভদ্রমহিলা হচ্ছেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মা। তসলিমা নাসরিন মা’কে চিকিৎসা করাতে সুইডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

পাদটিকা-২

আমি কখনোই মনে করি না মানুষ এমন কোনো অপরাধ করতে পারে যার শাস্তি তার কাছ থেকে দেশ কেড়ে নেওয়া। মানুষ মানুষকে ত্যাগ করে। দেশ কখনো তার সন্তানকে ত্যাগ করে না। যারা তসলিমা নাসরিনের রচনা পছন্দ করে না তারা পড়বেন না। তসলিমা নাসরিন যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তিনি থাকবেন তার বিভ্রান্তি নিয়ে, আমরা কেন তাকে দেশছাড়া করব? কেন বাংলাদেশের একটা মেয়ে ভবঘুরের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরবে? ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধাপরাধী তো ঠিকই বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তো তাদেরকে দেশান্তরী করি নি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top