What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected পদ্মা নদীর মাঝি (উপন্যাস) (1 Viewer)

১০

কেতুপুরে ফিরিয়া কুবের এক আশ্চর্য সংবাদ শুনিল।

পীতমের বাড়িতে চুরি হইয়া গিয়াছে। গভীর রাত্রে সিঁদ কাটিয়াছে চোর। ঘরের কোণে কোথায় পীতম মস্ত একটি ঘটি ভরিয়া টাকা পুতিয়া রাখিয়াছিল, চোরের তাহা জানিবার কথা নয়। তবু সেইখানটা খুঁড়িয়াই ঘটিটা চোব নিয়া গিয়াছে।

টাকার শোকে বড়ো কাতর হইয়া পড়িয়াছে পীতম। চুরির ব্যাপারে রাসুকেই সে সন্দেহ করে। রাসু নিজে সিঁদ দিয়াছে এ কথা সে স্পষ্ট বলে না, তবে চোরের সঙ্গে রাসুর যে যোগ আছে তাতে পীতমের সন্দেহ নাই। ঘরের লোক বলিয়া না দিলে ঘটির সন্ধান চোর পাইত কোথায়? পীতমের গালাগালিতে রাসু কখনও রাগ করে নাই। কিন্তু এবার চুরির অপবাদ দেওয়ামাত্র পীতমকে আচ্ছা করিয়া কড়া কড়া কথা বলিয়া সে চলিয়া গিয়াছে। এটাও বড়ো সন্দেহজনক।

চুরির অপবাদের জন্য যেন নয়! টাকার সঙ্গেই যেন সে গিয়াছে, এতদিন গেল না কেন তবে, পীতমের যতদিন টাকা ছিল?

কুবের খবর নিতে গেলে পীতম কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোর, রাসু ও বিশ্বসংসারের বিরুদ্ধে তার নালিশ জানাইতে লাগিল। হায়, তার সারা জীবনের সঞ্চয়, সাতকুড়ি তেরোটা টাকা! কোথায় আছে তার সেই পলাতক পুত্র, বুড়ো বাবাকে মনে করিয়া কবে সে ফিরিয়া আসিবে সেই আশায় পীতম যে টাকাগুলি জমাইয়া রাখিয়াছিল। সে কি চোরকে দিবার জন্য? লক্ষ্মীছাড়া রাসুর পেটে যাওয়ার জন্য?

কুবের বলে, রাসু জানল কিবা কই থুইছিলা ঘটি?

তা কি পীতম জানে? যে শয়তান মানুষ রাসু, কেমন করিয়া যেন টের পাইয়া গিয়াছে ঘটিটা কোথায় পোতা ছিল, রাসুর অসম্ভব কাজ নাই। ঘটির সন্ধান করিতেই হযতো সে আসিয়াছিল পীতমকে সেবা করিবার ছলে। সারাদিন ঘরের মধ্যে ঘুরিত রাসু—একোণ ওকোণ করিয়া বেড়াইত, আর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মেঝের দিকে চাহিয়া কী যেন খুঁজিত। তখনই সন্দেহ হইয়াছিল পীতমের। হায়, তখন যদি সে সাবধান হইত!

কুবের বিশ্বাস করিল না রাসুর অপরাধ। ঘটি কোথায় পোতা ছিল তাই যদি রাসু জানিবে, চোরের সঙ্গে যোগ দিয়া টাকার সে ভাগিদার জুটাইবে কেন? নিজেই তো অনায়াসে চুপিচুপি ঘটিটা সরাইয়া ফেলিতে পারিত, তারপর গর্ত বুজাইয়া লেপিয়া মুছিয়া ঠিক করিয়া রাখিলে কতকাল পরে পীতম টাকা চুরির কথা টের পাইত ঠিক ছিল না। সিঁদ কাটিবার হাঙ্গামা রাসু করিতে যাইবে কেন?

চৌকিদার থানায় খবর দিয়াছিল। পুলিশ আসিয়া চুরির তদন্ত করিল। পুলিশ দেখিয়া কুবেরের বুকের মধ্যে কাঁপিতে আরম্ভ করিয়া দেয়, হোসেন মিয়ার সঙ্গে এবার নৌকাযাত্রা করিয়া আসিয়া পুলিশের জন্য চিরন্তন স্বাভাবিক ভীতিটা কুবেরের অস্বাভাবিক রকম প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। পুলিশের কাছে পীতম অম্লান বদনে বলিয়া দিল রাসুকে সে সন্দেহ করে।

রাসুকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হইল, তার ঘরখানা খুঁজিয়া দেখা হইল, তারপর রাসুর হাতে হাতকড়া না দিয়াই পুলিশ চলিয়া গেল। না, রাসুর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নাই।

পুলিশ চলিয়া গেলে পীতমের বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ রাসু যা মুখে আসিল তাই বলিয়া পীতমকে অভিসম্পাত করিল। শুনিয়া কে বলিবে পীতম তার মামা!

তারপর একদিন সকালে কুবেরের কাছে আসিয়া রাসু জিজ্ঞাসা করিল, কবে বিয়া দিবা?

কুবের তৎক্ষণাৎ সন্দিগ্ধ হইয়া বলিল, গতিক কী রে রাসু? পীতম খুড়ার টাকা নি তুই নিছস?

রাসুর মুখখানা একটু বিবর্ণ হইয়া গেল বইকী!

সে বলিল, কী কও লখার বাপ, আঁই? টাকা নাই আমার? কাম করি না আমি?

কী কাম করস?

শেতলবাবু কাম দিছেন, বাবুগো নায়। মামা্র ঘরে চুরি করুম? অমন কথা কইয়ো না লখার বাপ!

তখন কুবের বলিল, পণের টাকা দিয়া থো না ক্যান তবে?

রাসু বলিল, দিমু। কবে বিয়া দিবা কও?

গোপি সারিয়া উঠিতেছিল। এখনও সে ভালো করিয়া হাঁটিতে পারে না বটে, তবে ক্রমেই পায়ে জোর পাইতেছে। মাসখানেক পরে বিবাহ তাহার দেওয়া যায়। কিন্তু বিবাহের আগে টাকা কুবেরের পাওয়া চাই, মেয়ের গায়ে ওঠা চাই গহনা। রাসুর মুখের কথায নির্ভর করিয়া থাকিবার পাত্র সে নয়।

যথাসময়ে টাকা ও গহনা দিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া রাসু বিদায় লইল। প্রতিজ্ঞা করিল সে অবলীলাক্রমে, রাসুর যেন টাকার ভাবনা শেষ হইয়াছে বাবুদেব নৌকায় কাজ পাইয়া, সে যেন বড়োলোকই হইয়া গিয়াছে। টাকা ও গহনার কথা শুনিয়া একদিন মুখে তাহার কালিমা ঘনাইয়া আসিয়াছিল, আজ সে নির্ভয় নিশ্চিন্ত!

মালা বলে, রাসুরে য্যান কেমন কেমন দেহি, আমি ডরাই মাঝি।

কুবের বলে, ডরাইযা কাম নাই তর।

আঁই? বলিয়া মালা অবাক হইয়া থাকে।

কুবের গোপিকে ডাকে। লাঠি ধরিয়া হাঁটিতে বলে গোপিকে। গোপি কষ্টে উঠিয়া দাঁড়ায়, কষ্টে দু-এক পা হাঁটে। কুবের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিয়া বলে, সারব গোপির মা, খাসা সারব পাওখান গোপির। রাসুর লগে ক্যান দিমু বিয়া?

কইলা যে রাসুরে?

কুবের একগাল হাসে। বলে, তুই নি মাইয়ালোক গোপির মা, বোঝস না। রাসুরে হাতে থুইছি, পাও যদি না সারে মাইয়ার, রাসুর লগেই দিমু। আর সাইরা যদি যায় গোপির মা, পাওখান যদি সাইরা যায় গোপির-—

মহোৎসাহে কুবের গোপির হাঁটুতে হাসপাতালের দেওয়া ওষুধ মালিশ করিতে থাকে। জোরে জোরে ঘষে কুবের, ব্যথায় গোপি কাতরায়। কুবের ধমক দিয়া বলে, চুপ থাক, চুপ থাক। জোর জোর না দিমু তো সারব ক্যান? মালিশ করিতে করিতে থামিয়া গিয়া হাঁটুটা সে টিপিয়া টিপিয়া পরীক্ষা করিয়া দ্যাখে। বলে, ফুলা কমে নাই গোপির মা?

হ। কম য্যান লাগে।

বলিয়া মালা উৎসুক চোখে গোপির পায়ের দিকে চাহিয়া থাকে। অনেকক্ষণ পরে সলজ্জভাবে বলে, মনে এউক্‌কা সাধ ছিল মাঝি। কমু?

হ, এমনইভাবে ভনিতা করে মালা। মালার তামাটে মুখখানা একটু রাঙা দেখায়। আস্তে আস্তে সে জিজ্ঞাসা করে কুবেরকে, হাসপাতালের যে ডাক্তার গোপির পা ভালো করিয়া দিয়াছে সে কি মালার পা-খানার কিছু করিতে পারে না? একবার গিয়া দেখাইয়া আসিলে হয় কিন্তু। কিছু যদি ডাক্তার না করিতে পারে নাই করিবে, মালার বড়ো সাধ একবার গিয়া দেখাইয়া আসে। কুবের কী বলে?

কুবের গম্ভীর হইয়া বলে, তর পায়ের কিছু হইবো না গোপির মা।

কেন? হইবে না কেন? মালা জিজ্ঞাসা করে। আহা, একবার দেখাইয়া আসিতে দোষ কী? ডাক্তার যদি বলে কিছু হইবে না, নিজের কানে শুনিয়া আসিয়া মালা নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিবে। একবার লইয়া চলুক কুবের তাহাকে। একফোঁটা যদি মায়া থাকে তার জন্য কুবেরের বুকে, একবার সে তাকে লইয়া চলুক সদরের হাসপাতালে। কুবের কী বুঝিবে খোঁড়া পায়ের জন্য সারাজীবন কী দুঃখ মালা পুষিয়া রাখিয়াছে মনে।

না? লইয়া যাইবে না কুবের? আঁই গো কুবেরের পাষাণ প্রাণ! মালার চোখে জল আসে। বিনাইয়া বিনাইয়া সে বলিতে থাকে যে মেয়ের জন্য কুবের দশবার হাসপাতাল যাইতে আসিতে পারে, মালাকে একবার, শুধু একটিবার লইতে তাহার আপত্তি! হ, অনেক পাপ করিয়াছিল আর জন্মে মালা, এবার তাই এমন কপাল লইয়া জন্মিয়াছে। কোলের ছেলেটাকে মালা মাই ছাড়াইয়া নীচে ফেলিয়া দেয়, ঘুরিয়া বসিয়া দরজার খুঁটিতে ঠকঠক করিয়া মাথা ঠোকে আর কাঁদিতে কাঁদিতে আহ্বান কবে মরণকে—যে মরণ এমনই নির্দয় যে মালার মতো পোড়াকপালির দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।

চুপ যা গোপির মা, চুপ যা!

কেন চুপ যাইবে? কুবেরের দরদ আছে নাকি মালার জন্য? সে তো কপিলার মতো ভঙ্গি করিয়া হাঁটিতে পারে না যে তাকে লইয়া কুবের আমিনবাড়ির হাসপাতালে যাইবে, হোটেলে রাত কাটাইয়া আসিবে পরমানন্দে!

কুবের বিবর্ণ হইয়া বলে, কিবা কথা কস গোপির মা? মাইরা ফেলুম কইলাম। তারপর সে সুর বদলাইয়া বলে, হাসপাতালে যাওনের লাইগা কাঁদনের কাম কী আঁই! যাইবার চাস নিয়া যামুনে। যা মুখে লয় কইয়া রাগাইস না গোপির মা!

মালা ফোঁসফোঁস করিতে করিতে বলে, নিবা? নিয্যস? নিবা?

নিমু।

কিন্তু মালাকে আমিনবাড়ি নিয়া যাওয়ার সময় কুবেরের হয় না। হোসেন মিয়ার কাজের এখন অন্ত নাই, অবিরত চালান আসিতেছে, চালান যাইতেছে, এ বছর সতেজে ব্যাবসা আরম্ভ করিয়াছে হোসেন। মাঝখানে আবার একবার নৌকা লইয়া নারিকেলের ও চোরাই আপিমের চালান আনিতে কুবেরকে সেই নোয়াখালির উপকূলে যাইতে হইল। এবার আপিম পৌঁছাইয়া দিল একটি স্টিমলঞ্চ, লঞ্চে এক সাহেব আসিয়াছিল, হোসেন মিয়াকে কী তার খাতির! আপিমের পুঁটুলি নিয়া নৌকা চালাইতে এবারও কুবেরের বুকের মধ্যে সমস্ত পথ একটা আতঙ্ক জাগিয়া রহিল। গতবার ফিরিয়া গিয়া হোসেন প্রত্যেক মাঝিকে দশটা করিয়া টাকা—বখশিশ দিয়াছিল— এবারও দিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু টাকার কথা ভাবিয়া কুবেরের একবিন্দু আনন্দ হইল না।

গণেশ জিজ্ঞাসা করে, কী ভাব কুবিরদা? ঝিমাও ক্যান? মিয়া বাই আপিম দিছে নাকি?

কুবের বলে, চুপ যা বলদ!

গণেশ বলে, কুকীর মা রূপার পইছা চায় কুবিরদা। ভাবি কী, ইবার মিয়াবাই টাহা দিলি দিমু পইছা গড়াইয়া কুকীর মারে—গণেশের খুশি ধরে না, কুবেরের গায়ে ঠেলা দিয়া বলে, হোসেন মিয়ার নায় কাম নিয়া বড়ো কাম করছ কুবিরদা! টাহার মুখ দেখিলাম।

কুবের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুদুর নদী বক্ষে চাহিয়া বলে, উটা কী রে গণশা? পুলিশের লন্‌চো নাকি?

হ।

কুবের শিহরিয়া বলে, কোন দিকে যায়?

আমাগো দিকে আহে দেহি কুবিরদা।

কুবের বিবর্ণ মুখে হোসেন মিয়ার কাছে যায়। ফিসফিস করিয়া বলে, পুলিশ লন্‌চো আহে মিয়াছাব।

হোসেন মৃদু মৃদু হাসে, বলে, বইঠা ধর গিয়া কুবির বাই। হোসেন মিয়া থাকতি কারে ডরাও? নদীর মধ্যি জাল ফেলাইয়া মাল উঠাইবো কোন হালার পুত?

হ? বিপদ ঘনাইয়া আসিলে আপিমের বান্ডিল নদীর জলে ফেলিয়া দিলেই চুকিয়া গেল? তাই হইবে বোধ হয়! সেই জনাই হয়তো হোসেন সর্বদা জলপথে আপিমের চালান নিয়া আসে, নতুবা নোয়াখালি হোক চট্টগ্রাম হোক রেলে স্টিমারে চাঁদপুর আসা ঢের সুবিধা। কুবেরের ভয় কিছু কমে। তবু, সুদূর পুলিশ লঞ্চের দিক হইতে দৃষ্টি সে ফিরাইতে পারে না। লঞ্চটি যখন ক্ৰমে ক্ৰমে কাছে আসিয়া পাশ দিয়া চলিয়া যায় কুবের শ্বাসরোধ করিয়া থাকে।



একদিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবের মালাকে দেখিতে পাইল না। গোপি বলিল, রাসুর সঙ্গে মালা আমিনাবাড়ির হাসপাতালে গিয়াছে।

কুবের রাগিয়া বলিল, কার নায?

বাবুগো নায়।

তিনদিন নদীর বুকে কাটাইয়া আসিয়াছে, মেজাজ গরম হইয়া ছিল কুবেরের। রাগে সে গুম খাইয়া রহিল। গোপি গড়গড় করিয়া ব্যাপারটা বিস্তারিত বলিয়া গেল। মালা কদিন হইতে রাসুকে তোষামোদ করিতেছিল, কাল মেজোবাবু মকদ্দমাব জন্য আমিনবাড়ি গিয়াছেন, সেই সুযোগে বাবুকে বলিয়া কহিয়া মালা ও রাসু সঙ্গে গিযাছে।

মেজোবাবু? মেজোবাবুব নৌকায় মালা আমিনবাড়ি গিয়াছে? মেয়ের দিকে কুবের কটমট করিয়া তাকায়। গোপিই যেন অপরাধিনী।

গোপি ভয়ে ভয়ে বলে, লখা লগে গেছে বাবা।

সারাদিন কুবের বাড়ি ছাড়িয়া নড়িল না। জীবনটা হঠাৎ তিতো হইয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। সমস্ত সকালবেলাটা সে রাগে আগুন হইয়া রহিল, নিধু মাঝি আলাপ করিতে আসিলে তাহাকে অকথ্য গালাগালি করিয়া ভাগাইযা দিল, বিনাদোষে মারিয়া চণ্ডীকে করিয়া দিল আধমরা। তারপর রাগ কমিয়া অপরাহ্নে আসিল বিষাদ। কেবলই মনে হইতে লাগিল কুবেরের, মালা প্রতিশোধ লইয়াছে। কপিলার সঙ্গে সে কিনা একদিন আমিনবাড়িতেই রাত কাটাইয়া আসিয়াছিল, মালা তাই মেজোবাবুর সঙ্গে সেই আমিনবাড়িতেই গিয়াছে, হাসপাতালে যাওয়ার সেই একই উপলক্ষের ছল করিয়া।

সন্ধ্যা হইল, মালা ফিরিল না। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া আসিল হোসেন। কুবের ছাড়া বড়ো ঘরখানা হইতে সকলকে সরাইয়া দিয়া ঘরের মাঝখানের খুঁটি বাহিয়া উঠিয়া নিজে সে চালের খড় ফাঁক করিয়া ছোটো ছোটো দুটি বান্ডিল লুকাইয়া ফেলিল। খুঁটি বাহিতেও জানে হোসেন, গুণের লোকটার অন্ত নাই।

কুবের নীরবে এই অদ্ভুত কাণ্ড চাহিয়া দেখিল, কিছু বলিল না। নামিয়া আসিয়া হোসেন বলিল, ডরাইয়ো না কুবির বাই, ডর নাই।

কুবের মুহ্যমানের মতো মাথা নাড়িল।

হোসেন বসিল। বলিল যে পুটলি দুটি যতদিন সে না লইয়া যায়, কুবেরের ছুটি। সারাদিন বাড়ি বসিয়া আরাম করিবে কুবের, কেমন? চালে গোঁজা জিনিস দুটিকে সে পাহারা দিবে বটে কিন্তু বারবার ওদিকে চাহিবার প্রয়োজন নাই কুবেরের। একেবারে না তাকানোই ভালো। না, ঘরের চালায় কিছুই গোজা নাই কুবেরের। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া আজ হোসেন তাহার বাড়ি আসে নাই, খুঁটি বাহিয়া উঠিয়া ঘরের চালে কিছুই সে গুঁজিয়া রাখে নাই।

কী কও কুবির বাই, তাই না? হোসেন মৃদু মৃদু হাসে।

হ, বলিয়া কুবের সায় দেয়।

সকলের চেয়ে বিশ্বাসী, সকলের চেয়ে নিরাপদ এই সরল পদ্মানদীর মাঝিটাকে হোসেন মিয়া যেন ভালোবাসে। কত টাকা হোসেন মিয়ার, দূরে দূরে ছড়ানো কত বড়ো তাহার ব্যাবসা, এগারো মাইল লম্বা একটা দ্বীপের সে মালিক, কুবের তো তাহার চাকর, তবু কুবেরের ঘরের ছেঁড়া চাটাইয়ে হোসেন আরাম করিয়া বসে, বন্ধুর মতো গল্প করে কুবেরের সঙ্গে। চেনাই যেন যায় না এখন হোসেনকে। হোসেনের নৌকায় কাজ নেওয়ার আগে কুবের তো তাকে শুধু সঙ্গতিপন্ন বলিয়া জানিত, অসংখ্য উৎস হইতে হোসেনের যে কত টাকা আসে এখন ভাবিতে গেলে কুবেরের মাথা ঘোরে! সে আর গণেশ শুধু জানিয়াছে, কেতুপুরের আর কেহ হোসেন মিয়ার রহস্য জানে না।

টাকাওলা মানুষের সঙ্গে মেশে না হোসেন, তাদের সঙ্গে সে শুধু ব্যাবসা করে, মাল দিয়া নেয় টাকা, টাকা দিয়া নেয় মাল। মাঝিরা তাহার বন্ধু। অবসর সময়টা সে পদ্মার দীন দরিদ্র মাঝিদের সঙ্গে গল্প করিয়া কাটাইয়া দেয়, টাকায় ফাঁপানো ব্যাগ পকেটে নিয়া বর্ষার রাত্রে জীর্ণ চালার তলে চাটাইয়া শুইয়া নির্বিবাদে ঘুমাইয়া পড়ে।

সেদিন রাত্রে মালা ফিরিল না।

পরদিন বেলা বারোটার সময় হাতের ভরে দুলিয়া দুলিয়া সে গৃহে প্রবেশ করিল, নদীর ঘাট হইতে এতটা পথ এমনিভাবে আসিতে কাপড়খানা তাহার কাদা মাখা হইয়া গিয়াছে। কুবের খাইতে বসিয়াছিল, একবার চাহিয়া দেখিয়া আবার খাওয়ায় মন দিল। ঘরে গিযা কাপড় বদলাইয়া মালা দাওয়ায় আসিয়া বসিল। কুবের চোখ তুলিয়া তাকায় না। চড়া গলায় পিসিকে আর দুটি ভাত আনিতে বলে।

মালা বলে, আগো শুনছ?

না, কুবের শুনিতে পায় না, সে বধির হইয়া গিয়াছে!

মালা বলে, তুমি ত নিলা না, রাসুর লগে তাই হাসপাতাল গেছিলাম। গোসা নি করছ?

জবাবের জন্য মালা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর সজল কণ্ঠে বলে, ডাক্‌তর কয়, পাও সারনের না আমার।

আরও কত কথা মালা বলে, কুবের সাড়া-শব্দ দেয় না। খাইয়া উঠিয়া নীরবে তামাক টানিতে থাকে। গোয়ার কী সহজ কুবের!

মালা শেষে রাগিয়া বলে, ক্যান মাঝি ক্যান, এত গোসা ক্যান? কবে কই নিছিলা আমারে, চিরডা কাল ঘরের মধ্যি থাইকা আইলাম, এউক্‌কা দিনের লাইগা বেড়াইবাব যাই যদি গোসা করবা ক্যান?

যা, বেড়া গিয়া মাইজ কত্তার লগে—হারামজাদি, বদ!

কী কইলা মাঝি, কী কইলা?

তারপর কী কলহই দুজনের বাধিয়া গেল! প্রতিবেশীরা ছুটিয়া আসিল, দাঁড়াইযা দেখিতে লাগিল মজা। শেষে রাগের মাথায় কুবের হঠাৎ কলিকাটা মালার গায়ে ছুঁড়িয়া মারিল। কলিকার আগুনে মালা ও তাহার কোলের শিশুটির গা স্থানে স্থানে পুড়িয়া গেল, কাপড়েও আগুন ধরিয়া গেল মালার। সিধুর বোন ছুটিয়া আসিয়া কাপড়খানা টানিয়া খুলিয়া লইল, নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়া লজ্জা নিবারণ করিল মালার। দুঃখিনী সে, বড়ো ছেঁড়া তাহার কাপড়খানা।

স্ত্রী-পুরুষে ভিড় করিয়াছে অঙ্গনে, তাদের সামনে পঙ্গু অসহায়া স্ত্রীর এই দশা, মালার দুরবস্থায় আমোদ পাইয়া সকলে হাসিয়াছে, কে যেন হাততালি দিল। এতক্ষণে চমক ভাঙিল কুবেরের। লাফাইয়া দাওয়া হইতে নামিয়া গাল দিতে দিতে সকলকে সে বাড়ির বাহির করিয়া দিয়া আসিল। তারপর নিজের একখানা কাপড় আনিয়া দিল মালাকে।
 
১১

ক্রমে ক্ৰমে শীত কমিয়া আসিল।

কেতুপুর গ্রাম ও জেলেপাড়ার মাঝামাঝি খালটা শুকাইয়া গিয়াছে। পদ্মার জলও কমিয়াছে অনেক। ক্ৰমে ক্ৰমে মাঠগুলি ফসল-শূন্য হইয়া খাঁ খাঁ করিতে লাগিল, পায়ে চলা পথগুলি স্পষ্ট ও মসৃণ হইয়া আসিয়াছে অনেকদিন আগে। আমগাছে কচিপাতা দেখা দিয়াছে। দেখিতে দেখিতে পাখির সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে দেশে। ঝাক বাঁধিয়া বুনোহাঁসের দলকে উড়িতে দেখা যায়। উত্তরাভিমুখী নৌকাগুলি দক্ষিণের জোরালো সমগতি বাতাসে বাদাম তুলিয়া তরতর করিয়া ভাসিয়া যায়, দূরে গেলে অতিথি হাঁসগুলির মতোই রহস্যময় মনে হয় তাদের। মাছ দুধ সস্তা হইয়াছে, পদ্মার চর হইতে কলসিভরা দুধ আসিয়া বাজারে চার পয়সা সের বিকাইয়া যায়।

শীতে কুঁকড়ানো গ্রামগুলি গা মেলিয়াছে। সকাল সন্ধ্যায় মালা কাপড় ভাঁজ করিয়া লখা ও চণ্ডীর শরীর ঢাকিয়া গলায় বাঁধিয়া দেয় না, খালি গাযেই তালা শুকনো ডোবা পুকুরে কাদা ঘাঁটিয়া মাছ ধরিতে যায়। ফাটা চামড়া উঠিয়া গিযা ত্বক মসৃণ হইয়া। সিতেছে সকলেব, মালার রং যেন আরও ফরসা হইয়া আসিয়াছে, একমুষ্টি যৌবন যেন অতিবিক্ত আসিয়াছে মালার দেহে। মালাকে চাহিয়া রাত্রে কুবেরের ঘুম ভাঙে কোনোদিন গৃহে, কোনোদিন পদ্মার বুকে।

রাসুর সঙ্গে গোপির বিবাহের বন্দোবস্ত কিন্তু হইয়া গিয়াছে বাতিল। এ কীর্তিও হোসেন মিয়ার। সোনাখালির একটি পাত্র হোসেন ঠিক করিয়া দিয়াছে গোপির জন্য, নাম তার বঙ্কু, বয়স বেশি নয। এ জগতে বঙ্কুর আপনার কেহ নাই বটে কিন্তু হোসেন মিয়া আছে। হোসেন মিয়া যার মুরুব্বি, কীসের অভাব তার? বঙ্কু পাঁচকুড়ি টাকা পণ দিবে কুবেরকে, গোপিকে গহনা দিবে তিনকুড়ি টাকার, আর একদিন জেলেপাড়ার সকলকে দিবে ভোজ।

এ কথা জানিতে কুবেরের বাকি নাই যে বিবাহের পর নবদম্পতিকে হোসেন ময়নাদ্বীপে লইয়া যাইবে, কিন্তু জানিয়া কী লাভ? হোসেন মিয়ার অবাধ্য কুবের কেমন করিয়া হইবে? তা ছাড়া পাঁচকুড়ি টাকার মায়া ত্যাগ করিবাব সাধ্য কুবেবের নাই। বিবাহ দিলে মেয়ে পরের ঘরে যায়, কাছে অথবা দূরে। গোপি না হয় যাইবে দূরে–অনেক দূরের ময়নাদ্বীপে। হয়তো কখনও একটু মন কেমন করিবে কুবেরের, কিন্তু তার প্ৰতিকার কী? মন তো অনেক কারণেই কেমন করে মানুষের।

খবর শনিয়া রাসু গালাগালি করিয়া গিয়াছে। বলিয়াছে, কথা দিয়া কথা রাখিল না কুবের, কুবেরের সে সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে। যুগীকে গিয়া রাসু বুঝি ধরিয়াছে, তারপর একদিন শীতল আসিয়া রাসুর সপক্ষে খানিকক্ষণ ওকালতি করিয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। বলিয়াছে টাকা যদি বেশি চায় কুবের, সে তা বলে না কেন? সোনাখালির পাত্র যত টাকা দিতে চায তাই দিবে রাসু। গ্রামে রাসুর মতো পাত্র থাকিতে দূর দেশে মেযেকে কুবের পাঠাঁইবে কেন?

কেন? এ কেনর জবাব দিবার ক্ষমতা নাই কুবেরের! ময়নাদ্বীপে গিয়া গোপিকে বাস করিতে হইবে ভাবিলে জালে আবদ্ধ ইলিশ মাছের মতো মাঝে মাঝে তারও মনটা কি ছটফট করে না? তবু তাকে এ সব বলা মিছে।

একদিন গোয়ালন্দে অধরের সঙ্গে কুবেরের দেখা হইয়া গেল। অধর বলিল, কয়েকদিন আগে কপিলা চরডাঙায় আসিয়াছে, কিছুদিন থাকিবে। বাড়ি ফিরিয়া কুবের সেদিন মালাকে বড়ো দবদ দেখায়। বলে, মালা কতকাল বাপের বাড়ি যায় নাই, ইচ্ছা করে না যাইতে? ইচ্ছা যদি হয় তবে না হয় চলুক মালা কাল, দু-চারদিন থাকিয়া আসিবে। মালা বলে, না, বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা তাহার নাই। বাপ কি যাইতে বলিয়াছে তাকে? এতকাল সে যে যায় নাই, একবার কি দেখিতে আসিয়াছে তাকে? মালা কাঁদো কাঁদো হইয়া যায়। বলে, তার মনটা শুধু পোড়ায় বাপভাইয়ের কথা ভাবিয়া, তার জন্য ওদের কারও দরদ নাই। কেন সে যাইবে বাপের বাড়ি যাচিয়া? কুবের বিপন্ন হইয়া বলে, গেলে দোষই বা কী? বাপের বাড়ি তো বটে, যাচিয়া বাপের বাড়ি যাইতে কারও লজ্জা নাই। কালই চলুক মালা, দু-দিন একদিন পরেই ফিরিয়া আসিবে?

এবার মালা সন্দিগ্ধ হইয়া বলে, যাওনের লাইগা জিদ কর ক্যান মাঝি?

জিদ কিবা? দরদ কইরা কইলাম, জিদ!

মালার উপর রাগের সীমা থাকে না কুবেরের। চরডাঙা যাওয়ার আর তো কোনো ছুতা তাহার নাই! জামাই অকারণে শ্বশুরবাড়ি গেলে দোষ অবশ্য কিছুই হয় না, কিন্তু এখন কপিলা ওখানে আছে, হঠাৎ কুবেরের আবির্ভাব ঘটিলে কে জানে কে কী ভাবিয়া বসিবে। বসিয়া বসিয়া কুবের উপায় চিত্ত করে আর কুদ্ধ চোখে মালার দিকে থাকিয়া থাকিয়া তাকায়। হ, আজ বসন্তের আদর্শ আবহাওয়া আসিয়াছে কেতুপুপে, দোলের উৎসব হইবে কাল, লখা ও চণ্ডী আবিব কিনিয়া আনিয়া আজই অঙ্গনে খানিক ছড়াইয়াছে।

বিকালে পদ্মার ঘাটে নৌকার তদবির করিতে গিয়া কুবেরের আরও মন-কেমন করিতে থাকে। কাব্যের মসৃণ মার্জিত মন-কেমন করা নয়, তার ভীরু প্রকৃতির সঙ্গে যতখানি খাপ খায় ততখানি দুরন্ত মানসিক অস্থিরতা। পেট ভরিয়া খাইতে পাইয়া শরীরটা কুবেরের ভালো হইয়াছে—খাদ্য যতটুকু শক্তি দিত আগে ব্যয় করিতে হইত তার দশগুণ, এখন সেটা শুধু বন্ধ হয় নাই, বিশ্রামও জুটিয়াছে অনেক। মনেরও যেন তাতে ব্যাকুল হওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়াছে এবং কমিয়া গিয়াছে দুর্বল অভিমান, সিদ্ধি বা আপিমের নেশার মতো আগে যা কুবেরের মনকে অনেকটা শান্ত করিয়া রাখিত। নৌকায় বসিয়া কুবের যেন ভুলিয়া যায় যত নিষ্ঠুরতা করিয়াছে কপিলা, যত দুর্বোধ্য নির্মম খেলা সে খেলিযাছে তার সঙ্গে। মনে পড়ে শুধু কপিলাকে, কপিলার লীলা-চাপলা, কপিলার হাসি ও ইঙ্গিত, তেলে ভেজা চুল ও কপাল আর বেগুনি রঙের শাড়িখানি। আর মনে পড়ে শ্যামাদাসের উঠানে ভোরবেলা গোবব লেপায় রত কপিলাকে, মালাকে বলিবার অনুরোধ মেশানো তার শেষ সকাতর কথাগুলি। ক্যান আইছিলা মাঝি, জিজ্ঞাসা করিয়াছিল না কপিলা? হ, ও জিজ্ঞাসার মানে কুবের বোঝে। আবার তাই যাইতে চায় কুবের কপিলার কাছে, এখনই যাইতে চায় শস্যহীন শুকনো মাঠগুলি ঊর্ধ্বশ্বাসে পার হইয়া চরডাঙ্গায়, কপিলা যেখানে চুল বাঁধিতেছে।—কুবেরকে দেখিয়া তার বোতলটি কাত করিয়া আরও খানিকটা তেল মাথায় ঢালিবে কপিলা : তার উত্তোলিত দুটি বাহু, মুখের ছলনাভরা হাসি, বসিবার দুর্বিনীত ভঙ্গি সব পাগল করিয়া দিবে কুবেরকে। ঘাটে আরও নৌকা আছে, মাঝি আছে। এখানে থাকিতে ভালো লাগে না কুবেরের, বাড়ি ফিরিতেও ইচ্ছা হয় না। নদীর ধারে ধারে সে হাঁটিতে আরম্ভ করে, ভাঙিয়া পড়ার জন্য প্রস্তুত তীরের ফাটলধরা অংশগুলির উপর দিয়া। চলিতে চলিতে এক সময় দশ-বারোহাত ডাঙা তাকে সঙ্গে করিয়া ধসিয়া পড়ে নীচে, শীতের পদ্মার জল যেখান হইতে হাত পনেরো পিছাইয়া গিয়াছে। মাটির একটা চাপড়াই বুঝি মাথায় ঘা দিয়া কুবেরকে অজ্ঞান করিয়া দেয়। মিনিট দশেক পরে চেতনা হয় কুবেরের। প্রথমে কুবেরের মনে হয় এ বুঝি কপিলারই এক কৌতুক। তারপর কষ্টে উঠিয়া বসিয়া সে নিঝুম হইয়া থাকে। শেষ বেলার সূর্য যেন পদ্মাকেও নিঝুম করিয়া দিয়াছে, দূরের নৌকাগুলি এবং আরও দূরের স্টিমারটি যেন হইয়া গিয়াছে গতিহারা। বাতাসের জোর নাই, নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন ক্লান্ত। নিজের এলোমেলো চিন্তাগুলিকে কুবের ভালো বুঝিতে পারে না। মাথার মধ্যে একটা ভোঁতা বেদনা টিপটিপ করিতেছে। মাথার বা পাশটা দিয়া একটু রক্তও পড়িয়াছে। তাই বলিয়া কেবলই এখন মনে আসিতে থাকিবে কেন গণেশের সেই গান—পিরিত কইরা জ্বইলা মলাম সই, আলো সই? কার সঙ্গে পিরিত করিয়া জ্বলিয়া মরিতেছে কুবের? কপিলার সঙ্গে? হ, ভারী মেয়েমানুষ কপিলা। তার সঙ্গে আবার পিরিত। ছেলেমানুষ নাকি কুবের?

পদ্মায় স্নান করিয়া কুবের বাড়ি ফিরিল। ভাত খাইতে বসিয়া হঠাৎ কুবের বলিল, চরডাঙ্গা যাবি লখা?

যামু বাবা, যামু।

কাইল বিয়ানে মেলা দিমু, আঁই?

হ, এ ফন্দি মন্দ নয়। দোলের উৎসবে মামাবাড়ি যাইবে ছেলেবা। একা তো যাইতে পারিবে না তারা, কুবের তাই সঙ্গে যাইবে। কেহ টেরও পাইবে না কীসে কুবেরকে টানিয়া আনিয়াছে চরডাঙ্গাতে।

মালা বলিল, আগো, নিয়া যাইবা ত আমারেও নিয়া চল।

কুবের বলে, না তরে নিম্ না। যাবি না কইলি ক্যান?

কুবের বাঁচিযাছে। মালাকে লইয়া চরড়াঙ্গা যাওয়া কী সহজ কথা! রাজি না হইয়া ভালোই করিয়াছে মালা, যাতায়াতের ডুলিভাড়াটা কুবেরের বাঁচিয়া গেল।

মালা এখন যাইতে চায। ছেলেদের লইযা কুবের যদি সত্যসত্যই যায় চরডাঙ্গা তবে আব সে যাইবে না কেন? কুবের তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা তুলিয়াছিল বলিয়াই না প্রথমটা সে রাজি হয নাই? মালা স্বামীর তোষামোদ আরম্ভ করে। রাত্রে খানিক রাগারগি কাঁদাকাঁটি করিতেও ছাড়ে না। কিন্তু কুবের অটল। যাইবে না বলিল কেন মালা? কুবের যখন তোষামোদ আরম্ভ করিয়াছিল বাহাদুরি করিয়া তখন যাইতে অস্বীকার করিল কেন? মরিয়া গেলেও কুবের তো তাকে চরডাঙ্গায় লইবে না। হুঁ কুবেরের গো মালা জানে না। কী ভাবিয়াছে সে কুবেরকে?

রাত্রি থাকিতে উঠিয়া লখা ও চণ্ডীকে টানিয়া তুলিয়া কুবের রওনা হইয়া গেল। মাথা-কপাল কুটিয়া যাওয়ার জন্য কাঁদিতে লাগিল মালা, কুবের ফিরিয়াও তাকাইল না। সকাল সকাল তাহারা পৌঁছিল চরডাঙ্গায়। হাঁটিতে হাঁটিতে ছেলে দুটার পা ব্যথা হইয়া গিয়াছে। চণ্ডীকে মাঝে মাঝে কোলে করিয়া চলিতে হওযায় কুবেরের ধরিয়া গিয়াছে হাঁপ। শ্বশুরবাড়ির দাওযায় বসিয়া গামছা দিয়া সে ঘাম মুছিতে লাগিল। একটু পরে কপিলা একখানা পাখা আনিয়া দিল। কুবের খুশি হইয়া বলিল, আছস কিবা কপিলা?

কিবা দ্যাখ?

কাহিল য্যান লাগে তরে।

হ, কহিল হইছি।

কুবের ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, ক্যান রে কপিলা, অসুখ নি করছে তর?

মনডার অসুখ মাঝি, তোমার লাইগা ভাইবা ভাইবা কাহিল হইছি।

বলিতে বলিতে আঁচলের আড়াল হইতে হাত বাহির করিয়া এক ভাড় চুন-হলুদ কপিলা কুবেরের গায়ে ঢালিয়া দেয়। হাসিয়া গলিয়া পড়ে কপিলা। কুবের মূঢ়ের মতো চাহিয়া থাকে। আনন্দ অথবা দুঃখ কীসে তাহার রোমাঞ্চ হয় সে বুঝিতে পারে না। কেতুপুরে থাকিবাব সময় এমনিভাবে হাসিত কপিলা। আকুরটাকুরে শ্যামাদাসের বাড়িতে এ হাসির আভাসও কপিলার মুখে সে দেখিতে পায় নাই।

কপিলার হাসির শব্দে বৈকুণ্ঠ বাহিরে আসে। লখা ও চণ্ডীকে সঙ্গে করিয়া কপিলা চলিয়া যায় ভিতরে।

শ্যামাদাসের কাছে বৈকুণ্ঠ ময়নাদ্বীপের কথা শুনিয়াছে। সে সেই কথা আরম্ভ করিল। কথায় কুবেরের মন ছিল না, সে অন্যমনে বৈকুণ্ঠের কথাব জবাব দিয়া গেল।

রং ও কাদা নিয়া গ্রামে দোলের উৎসব চলিয়াছে রঙের চেয়ে কাদার পরিমাণটাই এ পাড়ায় বেশি। চাষাভূষা জেলে-মাঝির পাড়া এটা, এখানে রঙের বড়ো অনটন। অনেক বেলায় কাদামাখা মূর্তিসমূহের একটা শোভাযাত্রা পাড়া হইতে গ্রাম প্রদক্ষিণ করিতে বাহির হইল। গাধার মতো ক্ষুদ্রকায় একটা ঘোড়ার উপরে বিচিত্র সাজে দোলের রাজা অতি কষ্টে বসিয়া আছে, গলায় তাহার ছেঁড়া জুতোর মালা, গায়ে গোটা দশেক ছিন্নভিন্ন জামা, চারিদিকে লড়বড় করিয়া ঝুলিতেছে অনেকগুলি ছেঁড়া ন্যাকড়া। সামনে দিয়া যাওয়ার সময় শোভাযাত্রার লোকেরা কুবের, বৈকুণ্ঠ ও অধরকে কাদা মাখাইয়া দিয়া গেল, অধর ভিড়িয়া গেল দলে। তাথৈ তাথৈ নাচ, ছুটাছুটি, হইচই, ডোবা পুকুরের পাঁক তুলিয়া যাকে খুশি ছুঁড়িয়া মারা—আনন্দ বটে দোলের। খানিক ইতস্তত করিয়া লখা ও চণ্ডী অধরের সঙ্গে যোগ দিবার জন্য ছুটিয়া গেল, কুবেরের বারণ কানেও তুলিল না।

কাদা ধুইয়া স্নান করিয়া আসিবাব উদ্দেশ্যে কুবের গেল পুকুরে। কপিলা বুঝি টের পাইয়াছিল। খানিক পরে সেও পুকুর ঘাটে আসিয়া হাজির।

আমারে রং দিলা না মাঝি?

পাঁক দিমু কপিলা? রং ত নাই!

দূর অ! রং নাই, পাক দিবার চায়! দিয়ো না মাঝি পাঁক, দিয়ে না কইলাম!

পাঁক দিতে বারণ করে কপিলা কিন্তু পা পিছলাইয়া কাদা মাখিয়া জলে সে গড়াইয়া পড়ে। হাতের ঠেলায কলসি ভাসিয়া যায় কুবেবের দিকে। কপিলা বলে, ধরে মাঝি, কলস ধরে।

বলে, আমারে ধর ক্যান? কলস ধরো।

হ, ভীত চোখে চারিদিকে চাহিয়া কলসির মতোই আলগোছে কপিলা ভাসিয়া থাকে, তেমনই ত্রাসের ভঙ্গিতে—স্তন দুটি ভাসে আর ডোবে। চোখের পলকে বুকে কাপড় টানিয়া হাসিবার ভান করিয়া কপিলা বলে, কথা যে কও না মাঝি?

কুবের বলে, তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা।

কপিলা চোখ বুজিয়া বলে, ক্যান মাঝি, ক্যান? আমারে ভাব ক্যান? সোয়ামির ঘরে না গেছি আমি? আমারে ভুইলো মাঝি—পুরুষের পরান পোড়ে কয়দিন? গাঙের জলে নাও ভাসাইযা দূর দ্যাশে যাইয়ো মাঝি, ভুইলো আমারে। ছাড়, মানুষ আহে।

সাঁতার দিয়া কপিলা কলসি ধরিয়া আনে। কাপড় ঠিক করিয়া ভরা কলসি কাঁখে তুলিয়া পিছল ঢালু পাড় বাহিয়া উপরে উঠিয়া যায়। হ, ফিরিয়া একবার তাকায় কপিলা। ভরা কলসির জল খানিকটা উছলাইয়া পড়ে।

দুপুরে খাইয়া উঠিয়া কুবের বলে, লখা, চণ্ডী, ল মেলা কবি। দিনে দিনে গাঁয় ফিরুম।



মালা বিস্মিত হইয়া বলিল, আইজ ফিবা আইলা যে?

মাইনষে থাকে তর বাপের বাড়ি?

পথ হাঁটিয়া হঁটিযা লখা ও চণ্ডী আধমরা হইয়া গিয়াছিল। কুবেরও কম শ্রান্ত হয় নাই। জিরাইয়া জিরাইয়া গ্রামে পৌঁছিতে তাহদের সন্ধ্যা পার হইয়া গিয়াছিল। লখা ও চণ্ডী দুটি দুটি ভাত খাইয়া শুইয়া পড়িল। কপিলা চরডাঙ্গায় আসিয়াছে তাদের মুখে এ খবর শুনিয়া মালা গম্ভীর হইয়া গেল। কুবেরকে আর সে কিছুই জিজ্ঞাসা করিল না। খোঁড়া পা-টি টান কবিবার চেষ্টাতেই বোধ হয় একবার তাহার মুখখানা হইয়া গেল বিকৃত। কপিলা চলিয়া যাওয়ার পর হইতে নিজের পঙ্গুতা সম্বন্ধে মালা সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। কুঁকড়ানো শীর্ণ পা-টিকে সে মাঝে মাঝে সিধা করিবার চেষ্টা করে, দুহাতে মাঝে মাঝে পা-টিকে ঘষিতে থাকে সজোরে। জন্ম হইতে অভ্যস্ত বিকলাঙ্গটি এতকাল পরে মালাকে বিশেষভাবে কাতর করিয়াছে।

বাড়ির দক্ষিণে খানিকটা ফাঁকা জমি ছিল। গোপির বিবাহের আগে ওখানে একখানা ঘর তুলিবার কথা ভাবিতেছিল কুবের। এতকাল সময় ছিল না, হোসেনের চালানি কারবারে এখন একটু মন্দা পড়িয়াছে। বাড়িতে থাকিবার সময় পায় কুবের। চরডাঙ্গা হইতে ফিরিবার পরদিন সে ঘর তুলিবার জন্য বাবুদের অনুমতি আনিতে গেল।

কুবের কি জানিত অনুমতির জন্য মেজোবাবুর কাছেই তাহাকে দরবার করিতে হইবে। নিচু হইয়া প্রণাম করিয়া জোড় হাতে মেজোবাবুর সামনে দাঁড়াইতে হইল কুবেরকে। করুণ কণ্ঠে জানাইতে হইল আবেদন। ঘর তুলিবে কুবের? খুব টাকা হইয়াছে নাকি কুবেরের? মেজোবাবু হাসিয়া কথা বলেন। ফরাসের সামনে মেঝেতে উবু হইয়া বসিবার অনুমতি কুবের পায়, কিন্তু যুক্তকর মুক্ত করিবার নিয়ম নাই। জেলেপাড়ার খবর জিজ্ঞাসা করেন মেজোবাবু; কে কেমন আছে, কার কেমন অবস্থা, কী রকম মাছ পড়িতেছে এ বছর। জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে একদিন মেজোবাবুর যাতায়াত ছিল, শিক্ষা ও স্বাস্থানীতির জ্ঞান বিতরণ করিয়া মাঝিদের জীবনগুলি উন্নততর করিবার ঝোকে তিনি আভিজাত্য ভুলিয়াছিলেন। শিক্ষা মাঝিরা পায় নাই, মাঝিদের বউ-ঝিরা শুধু পাইয়াছিল দুর্নাম, গ্রামে গ্রামে খবর বটিয়াছিল যে কেতুপুরেব মেজোকর্তা জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে রমণী চাখিয়া বেড়াইতেছেন—জেলেপাড়া মেজোবাবুর প্রণয়িনীর উপনিবেশ। আজ আর জেলেপাড়ার দিকে যাওয়ার সময় মেজোবাবু পান না। মাঝিদের কারও সঙ্গে দেখা হইলে খবর জিজ্ঞাসা করেন। সকালে দুপুরে জেলেপাড়ার ভাঙা কুটিরে গিয়া সময় যাপন করিবার সময়েও যে দুস্তর ব্যবধান মাঝিদের সঙ্গে মেজোবাবুর থাকিয়া গিয়াছিল, কোনো মস্ত্রে তাহা ঘুচিবার নয়। মাঝিরা বিব্রত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, ভালো করিবাব খেয়ালে বড়োলোক কবে গরিবের হূদয় জয় করিতে পারিয়াছে? মেজোবাবু তো হোসেন মিয়া নয়। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, অন্তহীন সবলতার সঙ্গে নিচু স্তরের চালাকি, অবিশ্বাস ও সন্দেহের সঙ্গে একান্ত নির্ভর, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অধর্মকে অনায়াসে সহিয়া চলা—এ সব যাদের জীবনে একাকার হইয়া আছে, পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়া যারা ভাবুক কবি, ডাঙায় যারা গরিব ছোটোলোক, মেজোবাবু কেন তাদের পাত্তা পাইবেন? ও কাজ হোসেন মিয়ার মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব, মেজোবাবুর চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করিয়াও যার মাঝিত্ব খসিয়া যায় নাই।

মালা? মালার কথাও মেজোবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন। মালার পাযের যে চিকিৎসা চলিতেছিল, কী হইল তার? তারপর ফাঁকা জমিটুকুতে ঘর তুলিবার অনুমতি দিয়া কুবেরকে মেজোবাবু বিদায় দিলেন।

মালা আজও মুখ ভাব করিয়া ছিল। কিন্তু কৌতুহল দমন করা যায় না।

কী কইল মাইজা কত্তা?

কী কইব? তব কথা জিগাইল।

হ?

নায় তুইলা আবার তরে হাসপাতাল নিয়া যাইব কইল গোপির মা।

গোঁয়ার কি সহজ কুবের! গো ধরিলে আর তো সে তাহা ছাড়িবে না! মেজোবাবুব নৌকায় মালা যে আমিনবাড়ি গিয়াছিল, কতকাল সে এ কথা মনের মধ্যে পুষিয়া রাখিবে সেই জানে, হয়তো মালা যখন বুড়ি হইয়া যাইবে, বিকল পা-টির মতো সর্বাঙ্গ শীর্ণ হইয়া আসিবে তাহার, তখনও এ কথা ভুলিবে না কুবের। কলহ করিয়া মালা কাঁদে। মৃত্যু কামনা করে নিজের। কিন্তু এ বিষযে কুবের কঠোর, নির্মম। অন্য বিষয়ে মালার সঙ্গে তাহার ব্যবহার বদলায় না, পঙ্গু অসহায় স্ত্রীর জীবন তারই বক্ষের আশ্রয়ে আজও উথলিয়া ওঠে, কিন্তু আমিনবাড়ি যাওয়ার জন্য অম্লান বদনে মালাকে সে পীড়ন করে। আজ রাত্রেই হয়তো কুবের মালাকে বুকে জড়াইয়া মিঠা মিঠা কথা বলিবে, পদ্মার ঠাণ্ডা বাতাসে জুড়াইয়া জুড়াইয়া কী যে মধুর হইয়া উঠিবে কুবেরের ব্যবহার! কাল হয়তো আবার সে কাঁদাইবে মালাকে মেজোবাবুর কথা তুলিয়া। এমনই প্রকৃতি পদ্মানদীর মাঝির, ভদ্রলোকের মতো একটানা সংকীর্ণতা নয়, বিরাট বিস্তারিত সংমিশ্রণ।

ঘর তোলা শেষ হইতে দিন দশেক সময় লাগিল। তারপর একদিন বঙ্কুব সঙ্গে বিবাহ হইয়া গেল গোপির।

কপিলা আসিল বিবাহে। সে না আসিলে বিবাহের কাজ করিবে কে? মালা তো পঙ্গু। কুবের খুশি হইয়া বলিতে লাগিল, আইছস কপিলা, আইছস? কুবের যেন ভুলিয়া গিযাছে চরডাঙ্গার পুকুরের জলে কী কথা তাহার হইয়াছিল কপিলার সঙ্গে। কিন্তু কপিলা সব মনে পড়াইয়া দেয়। সরিয়া সরিয়া পালাইয়া বেড়ায় কপিলা, টেঁকিঘরের ভিতরে দাঁড়াইয়া কুবের ইশারা করিয়া কাছে ডাকিলে মুখ ঘুরাইয়া থাকে। এ তো ছলনা নয়, খেলা নয় কপিলার। কী যেন ভাবিয়া আসিয়াছে কপিলা এবার, বড়ো সে গম্ভীর। একটু হাসি, দুটি কথাব কাঙাল কুবের, কপিলার হাসি কই, কথা কই কপিলার মুখে?

হলুদ মাখিতে মাখিতে হলদে হইয়া বিবাহ হইয়া গেল গোপির। বর-কনেকে কুবের পদ্মার নৌকায় তুলিয়া দিল। গোপি আবার ফিরিয়া আসিবে। হোসেন মিয়ার তাড়াতাড়ি নাই। বঙ্কু ও গোপি দুমাস দেশে থাক, তাতে সে আপত্তি করিবে না।

বিবাহের পরই কপিলার ফিরিয়া যাওয়ার কথা ছিল, কী ভাবিয়া সে রহিয়া গেল। কদিন পরে শ্যামাদাস আসিয়া তাকে আকুরটাকুর লইয়া যাইবে। দিন দুই পরে কুবেরকে হোসেন মিয়ার একটা চালান আনিতে যাইতে হইল। মাইল দশেক উজানে একটা গ্রামের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া সে পাট বোঝাই করিল নৌকায়। তারপর দেবীগঞ্জ ফিরিয়া আসিল অনেক রাত্রে।

সকলে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। অত রাত্রে কেতুপুরে ফিরিতে রাজি হইল না। কুবেরের মন পড়িয়াছিল বাড়িতে। নদীর ধারে ধারে সে হাঁটিতে আরম্ভ করিল গ্রামের দিকে। নদীতে জেলে নৌকার আলোগুলি ইতস্তত সঞ্চালিত হইতেছে, মাছ ধরিবাব কামাই নাই পদ্মায়। চলিতে চলিতে কত কী ভাবে কুবের। কারও ঘুম না ভাঙাইয়া কপিলাকে কি তোলা যাইবে না? আর কিছু চায় না কুবের কপিলার কাছে, গোপনে শুধু দুটা সুখ-দুঃখের কথা বলিবে। একটু রহস্য করিবে কপিলার সঙ্গে। বাঁশের কঞ্চির মতো অবাধ্য ভঙ্গিতে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কপিলা টিটকারি দিবে তাকে, ধরিয়া নোয়াইযা দিতে গেলে বসিয়া পড়িবে কাঁদায়, চাপা হাসিতে নির্জন নদীতীরে তুলিয়া দিবে রোমাঞ্চ।

আর কিছুই কুবের চায় না।

কেতুপুরের ঘাটে পৌঁছাইয়া কুবেরের বুকের মধ্যে হঠাৎ কাঁপুনি ধরিয়া গেল, গলা শুকাইয়া গেল কুবেরের। স্পষ্ট সে দেখিতে পাইল সাদা কাপড় পরিয়া এতরাত্রে একটি রমণী ঘাটে দাঁড়াইয়া আছে। কোনো দিকে মানুষের সাড়া নাই, পদ্মার জল শুধু ছলাৎ ছলাৎ করিয়া আছড়াইযা ভাঙা তীরকে ভাঙিবার চেষ্টা করিতেছে, নদীর জোরবাতাসে সাদা কাপড় উড়িতেছে একাকিনী রমণীর।

ভীত কর্কশ কণ্ঠে কুবের বলিল, কেডা খাড়াইয়া আছ গো, কেডা?

নদীর দিকে মুখ করিয়া রমণী দাঁড়াইয়া ছিল, কুবেরের গলার আওয়াজে চমকাইয়া অস্ফুট শব্দ করিয়া উঠিল। তারপর ব্যগ্ৰকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, কেডা? মাঝি আইলা?

কুবের অবাক হইয়া বলিল, কপিলা? দুপুর রাইতে ঘাটে কী করস কপিলা?

কপিলা কাছে আসিল, বলিল, ডরাইছিলাম মাঝি!

তারপর আরও কাছে আসিল কপিলা, কুবেরের বক্ষের আশ্রয়ে সে কাঁদিতে লাগিল। কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, বড়ো বিপদ হইয়াছে আজ। আজ বিকালে হঠাৎ পুলিশ আসিয়া বাড়ি তল্লাশ করিয়াছে কুবেরের, টেঁকিঘরের পাটখড়ির বোঝার তলে পীতম মাঝির চুরি যাওয়া ঘটিটা পাওয়া গিয়াছে। বাড়ি ফিরিলেই চৌকিদার ধরিবে কুবেরকে। সন্ধ্যার পর চুপিচুপি কপিলা তাই ঘাটে আসিয়া বসিয়া আছে। কুবের ফিরিলে সতর্ক করিয়া দিবে।

কুবেরের মুখে কথা সরিল না।

অনেকক্ষণ পরে সে বলিল, রাসুর কাম। সব্বোনাশ করব কইছিল না রাসু—-রাসুর কাম।

কী করবা মাঝি? কে জানে কী করিবে! বিপদে-আপদে মুখ চাহিবার একজন আছে কুবেরের, তার কাছে গিয়া দাঁড়াইবে। ঘাটে হোসেনের নৌকা বাধা আছে দেখিয়া কুবের একটু আশ্বস্ত হইল।

কপিলার চোখ মুছাইয়া দিল কুবের, বলিল, বাড়িত্ যা কপিলা।

তুমি কী করব?

হোসেন মিয়ারে বিত্তান্ত কই গিয়া, দেখি স্যায় কী কয়।

আমি লগে যামু মাঝি।

হ, বাঁশের কঞ্চির মতো অবাধ্য কপিলা। কোনোমতেই কুবের তাহাকে বাড়ি পাঠাইতে পারিল না। কুবেবের সঙ্গে সে হোসেন মিয়ার বাড়ি গেল। হোসেনকে কিছু বলিতে হইল না, খবর সে আগেই শুনিয়াছে। লালচে দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া সে ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ময়নাদ্বীপি যাবা কুবির? চুরি আমি সামাল দিমু।

আমি চুরি কবি নাই মিয়া!

তা কি হোসেন মিয়া জানে না? কিন্তু চোরাই মাল যখন বাহির হইয়াছে কুবেরের ঘরে, চোরকে সেখানে মাল বাখিয়া আসিতে কেহ যখন দেখে নাই, কে বিশ্বাস করিবে কুবেবের কথা? বাহিরের কেহ শত্ৰুতা করিয়া রাখিয়া যাইতে পারে এমন কোনো স্থানে মাল বাহির হয় নাই, একেবারে ঘরের মধ্যে লুকানো অবস্থায মাল পাওযা গিয়াছে। তা ছাড়া গরিব নয় কুবের?

বিবর্ণ মুখে কুবের মাথা হেঁট করিয়া থাকে। ঘোমটার ভিতর হইতে সজল চোখে কপিলা তার দিকে তাকায়। একজন মুনিষ তামাক সাজিয়া দিয়া যায় হোসেনকে। তামাক টানিতে টানিতে হোসেন জিজ্ঞাসা করে, যারা ময়নাদ্বীপি?

ঘাড় নাডিয়া কুবের সায় দেয়।

চোখ বুজিযা হোসেন ব্যবস্থার কথা বলিয়া চলে। আজ এই রাত্রেই রওনা হইয়া যাক কুবের। স্ত্রী-পুত্রের জন্য ভাবনা নাই কুবেরের, হোসেন রহিল। পরে গোপি আর বঙ্কুর সঙ্গে ওদের সকলকে হোসেন ময়নাদ্বীপে পৌঁছাইয়া দিবে। কেন, কাঁদে কেন কুবের? ময়নাদ্বীপ তো নিজেব চোখে সে দেখিয়া আসিয়াছে, সেখানে গিয়া বাস করিতে হইবে বলিয়া কান্নার কী আছে?

তামাক শেয করিয়া হোসেন উঠিল। বাহিরের একটা ঘরে সাতজন মুসলমান মাঝি ঘুমাইয়া ছিল, তাদের মধ্যে পাঁচজনকে সঙ্গে করিয়া সকলে নদীর ঘাটের দিকে চলিল। কুবের ও কপিলা চলিতে লাগিল সকলের পিছনে।

কপিলা চুপিচুপি বলে, না গেলা মাঝি, জেল খাট। কুবের বলে, হোসেন মিয়া দ্বীপি আমাকে নিবই কপিলা। একবার জেল খাইটা পার পামু না। ফিরা আবার জেল খাটাইব।

কপিলা আর কথা বলে না। ঘাটের খানিক তফাতে হোসেনের প্রকাণ্ড নৌকাটি নোঙর করা ছিল। একজন মাঝি ঘুমাইয়া ছিল নৌকায়। তাকে ডাকিয়া তুলিলে সে নৌকা তীরে ভিড়াইল। কুবের নীরবে নৌকায় উঠিয়া গেল। সঙ্গে গেল কপিলা।

ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, আমারে নিবা মাঝি লগে? হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। এক অতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারবে না।

সমাপ্ত
 
মাঝি এখন ময়নাদ্বীপে। কপিলাও সাথে। অবশেষে কুবেরের স্বপ্ন পুরন হলো।
এই শাটডাউনে না জানি পুকুরে কি আকাম টা করতেছে 😃
 
ইন্টার লেভেলে এই উপন্যাসটা পাঠ্য করে ভালই করেছিল। নইলে এত সুন্দর একটা উপন্যাস থেকে অনেকে বঞ্চিত হত।
 
ইন্টার লেভেলে এই উপন্যাসটা পাঠ্য করে ভালই করেছিল। নইলে এত সুন্দর একটা উপন্যাস থেকে অনেকে বঞ্চিত হত।
আমার কাছে মনে হয়, এটা কোন উপন্যাস নয়। এ যেন নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top