সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে জাবেদ (ছদ্মনাম)। মা-বাবা খেয়াল করলেন, ইদানীং সে কেমন যেন আনমনা থাকে। আগে সে বাবা-মায়ের উপস্থিতিতেই টেলিফোনে কথা বলত, এখন বেশির ভাগ সময় আলাদা ঘরে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। বাসায় ফেরে দেরি করে। আগের চাইতে একটু ফিটফাট হয়ে আর সুগন্ধি মেখে বাইরে যায়। মা-বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁদের সন্তান কি প্রেমে পড়েছে?
জাবেদের মতো বয়সী কিশোর বা কিশোরীদের নিয়ে মা-বাবা এমনিতেই চিন্তায় থাকেন। এসব চিন্তার মধ্যে একটা বড় চিন্তা হচ্ছে কার সঙ্গে না জানি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যেকোনো ধরনের প্রেম বা আবেগীয় সম্পর্ককে বাবা-মায়েরা ভয় পান। তাঁরা সন্তানকে কঠোর শাসন করেন, মুঠোফোন কেড়ে নেন, ঘরে আটকে রাখেন, কখনো সন্তানের বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবীটিকে শাসন বা তাদের বাবা-মাকে নালিশ পর্যন্ত করেন। কেউ কেউ দু ঘা বসিয়েও দেন।
এ ধরনের আচরণ সন্তানের জন্য সুফল বয়ে আনে না। এই বয়সী ছেলেসন্তান প্রেম করলে মা-বাবা এক কারণে চিন্তিত হন, পড়ালেখা বুঝি গোল্লায় গেল আর মেয়েসন্তান প্রেমে পড়লে তার নিরাপত্তা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে মা-বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বয়ঃসন্ধিকাল কিন্তু আরেকজনকে ভালো লাগারই বয়স। কখনো এটি সত্যিকারের প্রেম, আবার কখনো নিতান্ত সাময়িক মোহ। মোহ সহজেই কেটে যায়, তখন কেউ কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রেমে পড়লে কেউ কেউ বাবা-মায়ের কাছে তার সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি সরাসরি বা আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করে, কেউ আবার আপ্রাণ চেষ্টা করে বিষয়টি লুকিয়ে রাখার। বাবা-মায়েদের উচিত হবে এ সময় অস্থির না হয়ে, ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে সন্তানের সঙ্গে আলাপ করা।
যদি কখনো মনে হয় বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে বা মেয়েটি হঠাৎ করে প্রেমে পড়েছে, তখন বাবা-মায়েদের যা করা উচিত—
- সন্তানের অনুভূতিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। সম্পর্কটি আদৌ প্রেম নাকি নিছক মোহ, বোঝার চেষ্টা করুন। সম্পর্কটিতে দায়বদ্ধতা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সেটি প্রেম নয়, বিষয়টি সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন।
- সন্তানের বয়স যদি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী না হয়, তবে তাকে উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখুন। অপেক্ষা করতে বলুন। হুট করে সম্পর্ক ভেঙে ফেলার জন্য চাপ দেবেন না, আবার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিশ্রুতিও দেবেন না। যেমন, ‘তোমাদের বয়স ১৮/২০ হোক, তখন আমরা এটিকে স্বীকৃতি দেব,’ এ ধরনের আগাম কথা বলবেন না।
- উত্তেজিত হবেন না। প্রেমে পড়লে মানুষের কেমন ভালো লাগা কাজ করতে পারে, সেটা বুঝে আপনার সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করুন। এ বয়সে প্রেমে পড়লে অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে, সেটা মাথায় রেখে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। বয়স বিবেচনা করে তাকে যৌন বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দিন। নয়তো সে বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারে। নৈতিকতা আর নিরাপত্তার বিষয়গুলো তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখাতে চেষ্টা করুন।
- সন্তানের সঙ্গে এমনভাবে সময় কাটান, যেন আপনার কাছে সে কিছু না লুকায়। তার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করুন। তার বন্ধু, খাবার, ঘোরাফেরার খবর রাখুন, তবে তা গোপনে না। তার সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরি করুন, যেন সে এগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে নিজেই আলাপ করে। ঠিকঠাক পরিবেশ পেলে সন্তান অবশ্যই আপনাকে এসব বিষয়ে বলতে চাইবে।
- তার সাম্প্রতিক সম্পর্কের প্রতি অতি উৎসাহ দেখিয়ে খুব উদার মা-বাবা হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। মনে রাখতে হবে, আপনার সন্তানের বয়স খুব বেশি নয়। সুতরাং তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর আগে সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করুন।
- আপনার সন্তান তার ভালোবাসার মানুষটিকে কোনো বিপদে ফেলছে কি না, সেদিকে নজর দিন। সন্তান নিজেও কোনো বিপদে পড়ছে কি না, খেয়াল করুন।
- সন্তানের আস্থা অর্জন করুন। যাতে তারা আপনার কাছে তাদের সম্পর্ক ও এর জটিলতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। প্রয়োজনে আপনার সন্তানের বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন।
- অনেক সময় দেখা যায়, মা-বাবা একে অপরের কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখেন। এমনটা করা যাবে না। বাবা-মাকে পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
প্রেম কোনো অপরাধ নয়। কেবল খেয়াল রাখুন বয়স কম হওয়ার কারণে আপনার সন্তান সম্পর্কটিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারছে কি না, কোনো ধরনের বিপদে পড়ছে কি না বা এই সম্পর্কের কারণে তার সামাজিক দক্ষতা আর পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে কি না। তার সম্পর্কটিকে অনুমোদন করবেন নাকি করবেন না, বিষয়টি সার্বিক পরিস্থিতি ও আপনার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করবে।
[FA]pen[/FA] লেখক: ডা. আহমেদ হেলাল | মনোচিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা