What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

[HIDE]

(#৪৯)

ডক্টর মুখার্জী কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে চুপ করে চেয়ে থেকে বললেন, “মিনুদেবী, এ প্রসঙ্গে বলতে চাইলে অনেক কথাই বলা যায়। রীতিমত একটা ডিবেট করে ফেলা যায়। কিন্তু এ মূহুর্তে তেমন কিছু না করাই ভাল। তবে শুধু এটুকু শুনে রাখুন, আমি একজন ডাক্তার। ভদ্র হোক অভদ্র হোক, নোংরা পরিচ্ছন্ন যা-ই হোক, সব রুগীর চিকিৎসাই তো আমাদের করতে হয়। কোন রুগীকে ঘেন্না করলে আমাদের জীবিকাকেই অপমান করা হয়। আপনারা যেমন নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে গ্রাহকের ভাল মন্দ বিচার করেন না। আমরাও ঠিক তেমনই রুগীর জাতপাত ভাল মন্দ বিচার করি না। তাই আমার মধ্যে ও’ ব্যাপারে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আর আমার মিসেস মানে আদির মা, সে-ও যে এসব ব্যাপারে কতটা উদার, সেটা তো তার সাথে কথা না বললে বুঝতে পারবেন না। তবে তারও যে এতে কোন রকম আপত্তি হবে না, এটা আমিই জোর দিয়েই বলতে পারি। তাই আপনি যদি আমার ছেলের মুখে একটু খাবার তুলে দেন, তাতে আমি বা আমার স্ত্রী কেউই কিছু মনে করব না। বরং আমার ছেলের একটা সাধ পূরণ করলে আমাদের ভালই লাগবে।”

আমি আবার কিছু বলতে যেতেই ডাক্তার হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনারা দু’জন আজ হয়ত এমন পরিবেশে আছেন। কিন্তু চিরদিন তো তা ছিলেন না মিনুদেবী। কোন না কোন সময়ে আপনারাও নিশ্চয়ই নিজেদের মা বাবা পরিবারের সাথে থাকতেন। তখন আপনাদের সাধ আহ্লাদ পূরণ করতে আপনাদের বাবা মায়েরাও নিশ্চয়ই তাদের সাধ্য মত অনেক কিছুই করেছেন। সেটুকু ভেবেই না হয় আমার ছেলের আর্জিটা রাখুন, প্লীজ।”

ডক্টর মুখার্জির কথা শুনে আমার মুখে আর কোন কথা যোগাল না যেন। আমি মাথা নিচু করে কিছু একটা বলতে যেতেই পেছনের দরজা দিয়ে আদি ‘মামি মামি’ বলতে বলতে দৌড়ে ঘরে ঢুকল। তাকে ওভাবে ছুটতে দেখে ডক্টর মুখার্জি আর অনুরাধা দু’জনেই প্রায় একসাথে বলে উঠল “আরে আরে, আস্তে। পড়ে যাবে তো।”

পেছন পেছন কাজের মেয়েটি ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “জোর করে আমার কোল থেকে নেমে ছুটে এসেছে।”

আমি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে আদিকে ধরে বললাম, “অমন করে ছুটতে নেই আদি সোনা। তুমি ব্যথা পাবে তো।”

আদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমাদের ঘরে চল মামি। আমাদের ঘরে গিয়ে আমাকে তুমি চকলেট খাইয়ে দেবে। কী মজা। মা বলেছে তুমি চকলেট খাইয়ে দিলে সে আমায় বকবে না আজ।”

আমি আদিকে কোলে নিয়ে আবার আমার চেয়ারে বসতেই আদি আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “না না মামি, এখানে নয়, এখানে নয়। আমাদের ঘরে চল। ও বাপি তুমি মামিকে বলনা আমাদের ঘরে যেতে।”

আদির কথা শুনে আমি অসহায় ভাবে ডক্টর মুখার্জির দিকে চাইতেই তিনি মিষ্টি করে হেসে বললেন, “মিনুদেবী, এখন আমার ছেলেকে আমিও কন্ট্রোল করতে পারব না। ও, যখন চাইছে, তাহলে একটু কষ্ট করে ওর কথাটা রাখুন না। ভয়ের তো কিছু নেই। এখানে কেউ আপনাকে কোনও রকম অসম্মান করবে না।”

আমি তবু কিন্তু কিন্তু করে বললাম, “কিন্তু ডক্টর, ঘরে তো আপনার পরিবারের লোকেরাও আছেন নিশ্চয়ই। এভাবে হঠাৎ হুট করে অজানা অচেনাদের সামনে যাওয়াটা কি সমীচীন হবে?”

ডক্টর মুখার্জী একটু রসিকতার সুরে বললেন, “হু, তা অবশ্য মন্দ বলেন নি। তবে আমার ঘরে তো আপাততঃ এই শেফালী আর আদি ছাড়া আছে শুধু আদির মা, মানে আমার মিসেস। ও অবশ্য একটু কড়া ধাঁচের মানুষ। যাকে তাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিয়ে নেওয়া পছন্দ করে না। তবে আমার মনে হয়, আদির মুখে সে-ও আপনার কথা শুনেছে বলেই ওকে চকলেট খাবার অনুমতি দিয়েছে। তাই আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। অবশ্য যদি আমার ছেলের অনুরোধটা আপনি রাখতে না চান, তাহলে আর আমার কিছু বলার নেই।”

আমি এবার অনুরাধার দিকে চাইতেই ও বলল, “যাও না মিনুদি। আদি যখন এত করে বলছে তখন ওদের ঘরে গিয়েই নাহয় চকলেটটা খাইয়ে এস। আমি বরং ডাক্তার বাবুর সাথে এখানে বসেই একটু গল্প করি। এত বড় একজন ডাক্তারের সাথে বসে আড্ডা দেবার সুযোগ পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? এ দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে” বলে আমাকে চোখ টিপে ঈশারা করল।

আমি নিরূপায় হয়েই আদিকে কোলে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চকলেটের প্যাকেটটা হাতে নিতেই কাজের মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “আসুন দিদি, আমার সাথে আসুন।”

পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কাজের মেয়েটার পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় একটা ঘরে ঢুকেই মনে হল সেটা ও বাড়ির ড্রয়িং রুম। খুবই রুচিসম্মত ভাবে সাজানো ঘরটা। কাজের মেয়েটা আমাকে একটা সোফার দিকে ঈশারা করে বলল, “এখানে বসুন দিদি।”

আমি আদিকে নিয়ে সোফায় বসতেই আদি আমার কোল থেকে নেমে সোফায় বসে বলল, “জানো মামি। মা আমাকে একদম চকলেট খেতে দেয় না। বলে চকলেট খেলে নাকি দাঁত খারাপ হয়ে যাবে। আজ তুমি আমার জন্য চকলেট এনেছ শুনেই শুধু আমাকে খেতে বলেছে। আচ্ছা মামি, তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে বল তো? মা বাবা মামু বিড্ডুমামু সব্বাই তোমাকে কত খুঁজেছে।”

আমি চকলেটের প্যাকেটটা খুলে সামনের দিকের কিছুটা অংশ বাইরে বের করে আদির মুখের সামনে তুলে ধরতেই আদি কামড় দিয়ে একটা টুকরো মুখে নিয়েই আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে চুমু খেয়ে বলল, “তুমি আমার মিষ্টি মামি। আমি আর তোমাকে এখান থেকে যেতে দেব না। তুমি এখন থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমি রাতে তোমার সাথে ঘুমবো।”

আমি একটু হেসে বললাম, “মাকে ছেড়ে আমার সাথে ঘুমোবে তুমি? মা রাগ করবে না?”

আদি মুখের ভেতর চকলেট চিবোতে চিবোতে বলল, “মা তো খুব খুশী হবে। তোমাকেও তো মা আর মামু কত ভালবাসে। তুমি হারিয়ে গেছ বলে তোমার কথা বলতে বলতে মামু আর মা দু’জনেই তো কাঁদে। কাল রাতেও তো কেঁদেছে।”

আদির কথা শুনে আমি আবার অবাক হলাম। কাজের মেয়েটা সোফার পাশেই আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। আমি অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই আদি সোফা থেকে নেমে বলল, “তুমি বস মামি। আমি মাকে দেখিয়ে আসছি যে তুমি আমায় চকলেট খাইয়ে দিয়েছ”

বলেই আমি কিছু বলবার আগেই সে ছুটে পাশের আরেকটা ঘরে ঢুকে গেল।

ছোট বাচ্চার খামখেয়ালী ভেবেই আমি একটু দ্বিধান্বিত ভাবে কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আদির মামি কি সত্যি হারিয়ে গেছে?”

মেয়েটা বলল, “আমি সেটা ঠিক জানিনে দিদি। আমি এ বাড়িতে আসবার পর তো ওর কোন মামিকে দেখিনি। ওই যে দেয়ালের কোনায় একটা ফটো দেখতে পাচ্ছেন ওই ফটোর মাঝখানের ভদ্রমহিলাকেই আদি মামি বলে। কিন্তু আমি তাকে আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু আপনার মুখের সাথে ওই ফটোর ভদ্রমহিলার মুখের খুব মিল আছে। দাদাবাবুর মানিব্যাগেও ওই ভদ্রমহিলার একটা ফটো আছে।”

আমি নেহাৎ কৌতূহল বশতঃই সোফা থেকে উঠে দেয়ালে টাঙানো ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার সারাটা শরীর যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। পাঁচজনের একটা গ্রুপ ফটো সুন্দর আধুনিক ডিজাইনের একটা ফটোফ্রেমে বাঁধানো। কিন্তু ওই পাঁচজনের ছবি দেখতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন একলাফে আমার গলার কাছে চলে এল। আমার গলা দিয়ে একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছিল যেন। নিজের মুখটা দু’হাতে চেপে ধরতেই আমার মনে হল চারপাশটা যেন কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। আশেপাশের সবকিছু যেন চারদিকে গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে। আমার চোখের পাতাদুটো যেন বুজে আসতে চাইছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই যেন আর তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। দুর থেকে কে যেন ‘দিদি দিদি’ বলে ডাকছে আমায়। আর কিছু মনে নেই।

একসময় আমার মনে হল আমার আশেপাশে অনেক লোকের ভিড়। আমি যেন কোন একটা নরম কোলে মাথা পেতে শুয়ে আছি। আমার গালে কেউ যেন আস্তে আস্তে চাঁটি মারছে। আমি চোখ মেলে চাইতেই দেখি আমার মুখের সামনে অনেক লোকের ভিড়। বিজলীমাসি, শ্যামলীদি, অনুরাধা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা অচেনা মুখ। আমার কোমরের কাছ থেকে একজন উঠতে উঠতে বলল, “এই তো, সেন্স ফিরে এসেছে। শ্যামলী, তুই তাড়াতাড়ি এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আয় তো।”

সে মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখি ডক্টর মুখার্জী। আমার মনে হল গলার ভেতরটা একেবারে শুকিয়ে আছে। কোন কথা বলতে পারছি না। অনেক কষ্টে দু’বার ‘জল জল’ বলতেই শ্যামলীদি আমার ঠোঁটের সাথে একটা গ্লাস চেপে ধরে বলল, “নে মিনু, এই যে জল। খা।”

আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম কেউ আমাকে তার কোলে শুইয়ে রেখেছে। তেমনিভাবে শুয়ে থেকেই ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খাবার পর নিজেই মুখটা সরিয়ে নিলাম।

এমন সময় দুটো মেয়েলী হাত আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম আমি যার কোলে শুয়ে আছি, এ হাতদুটো তারই। কাঁদতে কাঁদতেই সে মহিলা বলতে লাগল, “রুমু, সোনা বোন আমার। কেন তুই আমাদের কাছে ফিরে যাসনি রে? আমরা তো সবাই তখনও বেঁচে ছিলাম।”

এমন সময় ডক্টর মুখার্জি বললেন, “আহ ঝুনু। নিজেকে সামলাও। এভাবে তোমরা সবাই মিলে কান্নাকাটি শুরু করলে, কে কাকে সামলাবে বল তো?”

ঝুনু নাম শুনেই আমি আরেকবার কেঁপে উঠলাম। মহিলার হাতের বাঁধনের ভেতরে থেকেই আমি অনেক চেষ্টা করে নিজের শরীরটাকে একটু ঘুরিয়ে মুখ ওপরে তুলতেই দেখতে পেলাম ঝুনুদিকে। আমাদের পাশের বাড়ির রমেন কাকু আর সোনা কাকিমার মেয়ে, টুপুর দিদি ঝুনুদি! সাথে সাথে আমি গলা ছেড়ে ‘ঝুনুদি’ বলে চিৎকার করে উঠে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম। আর ঝুনুদিও আমাকে দু’হাতে জাপটে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

কতক্ষণ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম জানিনা। একসময় বিজলীমাসি আমার মুখটা জোর করে টেনে তার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “মিনু, আর কাঁদিস নে বোন। এই দুধটুকু খেয়ে নে। একটু ভাল লাগবে।”

আমি বিজলীমাসির মুখের দিকে দেখে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “মাসি তুমি এখানে?”

বিজলীমাসি নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে জবাব দিল, “নিজের পরিচয়টা এতদিন আমার কাছে গোপন রেখে তুই আমাকে দিয়ে কত পাপ করিয়েছিস জানিস? আর শোন, এখন থেকে আমাকে আর মাসি বলে ডাকবি না। পারলে আমাকে দিদি বলে ডাকিস। তুই যে আমার নীলু জেঠুর মেয়ে রে, আমার একটা ছোট বোন।”

আমি মাসির কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলছ তুমি? নীলু জেঠু…. মানে?”

বিজলীমাসি আমাকে ধরে ঝুনুদির কোল থেকে টেনে তুলে দুধের গ্লাসটা আমার ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল, “আগে এ দুধটুকু খেয়ে নে। তারপর সব শুনতে পারবি।”

আমি দুধের গ্লাসে চুমুক দিতেই পেছন থেকে ডক্টর মুখার্জির গলা শুনতে পেলাম। উনি কাউকে জিজ্ঞেস করছেন, “ওদিকের খবর কি বিদ্যুৎ? সব ঠিক আছে তো?”

কোন পুরুষ কণ্ঠ জবাব দিল, “হ্যাঁ শান্তুদা। মোটামুটি ঠিক আছে। কান্না থেমেছে। কিন্তু আপনার আদিবাবুকে সামলানোই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। উনি তার মামির কাছে আসবার জন্য খুব ছটফট করছে।”

ঝুনুদি এবার বলল, “না বিদ্যুৎ। ওকে এখনই এখানে নিয়ে এস না। আরেকটু সময় থাক।”

আমি ঝুনুদির মুখের দিকে কৌতুহলী চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আদি তোমার ছেলে ঝুনুদি? সত্যি?”

ঝুনুদি আমাকে একহাতে তার শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “হ্যাঁরে রুমু। আদি আমার আর তোর এই ডাক্তার মুখার্জির ছেলে।”

আমি সে’কথা শুনে আবার অবাক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ডক্টর মুখার্জির দিকে একবার চেয়ে ঝুনুদিকে বললাম, “আমায় ছাড়ো ঝুনুদি। জামাইবাবুকে একটা প্রণাম করি।”

ডক্টর মুখার্জি দরজার সামনে থেকে জবাব দিলেন, “সে সব পরে দেখা যাবে। তবে ওই জামাইবাবু টামাইবাবু চলবে না। তুমি যদি আমার ছেলের মামি হও, তাহলে আমি সম্পর্কে তোমার নন্দাই হব। আর আজকের যুগে কেউ নন্দাইকে ঠাকুরজামাই বা জামাইবাবু বলে না। ব্যাকডেটেড বলে মনে হয়। শুধু শান্তনুদা বা শান্তুদা বলে ডাকলেই খুশী হব।”

আমি ডক্টর মুখার্জির কথা শুনে ভীত চোখে ঝুনুদির মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ঝুনুদি, ডক্টর মুখার্জী আমার ট্রিটমেন্ট করেছেন বলে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এ’সব তোমরা কি বলছ গো?”

ঝুনুদি আমার মুখটাকে নিজের দু’হাতের মধ্যে ধরে বলল, “কেন রে? আমরা সবাই তো তোকে আগে থেকেই টুপুর সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলাম। জেঠু জেঠিমাও তো মনে মনে সেটাই চাইতেন। শুধু কাস্ট নিয়েই যা একটু দ্বিধা ছিল সকলের মনে। কিন্তু সকলের মনের সে দ্বিধাও তো একটা সময় কেটে গিয়েছিল। তারা তো আর কেউ বেঁচে নেই। আর আমার ধারণা, তারা বেঁচে থাকলে আরও অনেক বছর আগেই তোদের বিয়েটা হয়ে যেত। সেই দুর্ঘটনার পর থেকে তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলেই না এতদিন সেটা সম্ভব হয়নি। এখন আর সেটা হতে বাঁধা কিসের?”

আমি ঝুনুদির কথা শুনে শিউড়ে উঠে বললাম, “না না ঝুনুদি, এ তুমি কি বলছ? এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। তোমরা জানো না। তোমাদের চেনা রুমু সেই দুর্ঘটনার রাতেই মরে গিয়েছে। এখন শুধু বেঁচে আছে এই মিনু। আর গত বারোটা বছর ধরে এই মিনুর ওপর দিয়ে যত ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে, তাতে কোন ভদ্রলোকের স্ত্রী হওয়া তো দুরের কথা, একটা ভদ্রপরিবারের আশ্রিতা হবার যোগ্যতাও তার নেই।”

ঝুনুদি আমার মাথায় গালে হাত বোলাতে বোলাতে ছলছল চোখে বলল, “তুইই শুধু তোর মা বাবা বড়দা ছোড়দাকে হারাসনি রুমু। তাদের সবাইকেই আমাদের পরিবারের সকলেও আপনজন বলে ভাবত। আমিও তো তাদের সকলকে হারিয়েছি। তারপর হারালাম নিজের মা বাবাকে। এখন শুধু স্বামী আর ছেলে বাদে নিজের বলতে আর কেউ যদি আমার জীবনে থেকে থাকে, তারা হল তুই আর টুপু। আমাদের ওই দুটো বাড়ির ন’জনের মধ্যে আমরা দু’ভাই বোন ছাড়া শুধু তুই বেঁচে আছিস। ভাইকে আমি বারোটা বছর ধরে কাঁদতে দেখে আসছি। পাগলের মত আমরা দু’ভাই বোন মিলে তোকে খুঁজেছি। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তোকে আমরা খুঁজে বের করতে পারিনি। মাস দুয়েক আগেই এই বিদ্যুতের মুখে প্রথম শুনলাম তুই বেঁচে আছিস। তোর খবরটা পাবার পর তোর পরিণতির কথা শুনে আমরা দু’ভাইবোন মিলে শুধু কেঁদেই যাচ্ছি। তোর কথা শুনে আমরা দু’জনেই ছটফট করছিলাম তোকে দেখতে। আজ এতদিন এত বছর বাদে ভগবান আমাদের যখন দয়া করে একসাথে মিলিয়ে দিয়েছেন, তখন আয় না বোন আমরা তিনজন মিলে আবার নতুন করে একটা পৃথিবী বানাই। তুই তো জানিস না। আমার বিয়ের পর বৌভাতের দিন মা বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হল। খবর পেয়ে শান্তুর বাড়ির সকলে যখন আমাকে আর ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছল, তখন মা আর নেই। বাবার প্রাণটা তখনও ছিল। বাবা আমার আর টুপুর একটা একটা হাত ধরে বলেছিলেন যে তিনি জেঠু জেঠিমাকে কথা দিয়েছিলেন যে তোর বড়দার সাথে আমার বিয়ে দেবেন, আর তোকে আমাদের ঘরের বৌ করে আনবেন। কিন্তু ভগবান তো সবাইকে আগেই তার কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তবে তুই যে বেঁচে ছিলি এ’কথা বাবা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই আমাদের দু’জনকে বলেছিলেন, যে করেই হোক, আমরা যেন তোকে খুঁজে বের করি। আর তুই যে পরিস্থিতিতে যে ভাবেই থাকিস, টুপু যেন তোকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে বাবার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে। তাহলেই তার আত্মা শান্তি পাবে। এতগুলো বছর ধরে আমরা দু’ভাই বোন যে সে স্বপ্নটাই বুকে ধরে রেখেছি রে। এতগুলো বছর কেটে যাবার পর যখন আমরা প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম, তখনই বিদ্যুৎ একটা আশার খবর নিয়ে এসেছিল। তাই তো আজকের এই সুদিনটা আমাদের জীবনে এসেছে। ভগবান আবার আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে করে দিয়েছেন আজ। ভগবানও নিশ্চয়ই চান যে বাবার শেষ ইচ্ছেটা আমরা রক্ষা করি। তুই কেন বাদ সাধছিস এতে, বল তো বোন?”

আমি ঝুনুদির কথা শুনতে শুনতে একনাগাড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছিলাম। ঝুনুদিরও দুটো চোখ থেকে অবিরত অশ্রুধারা বেরোচ্ছিল। তার কথা শেষ হতেই আমি ঝুনুদির থেকে একটু সরে যাবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, “না গো ঝুনুদি। সেটা যে হবার নয় গো। আমি যে একেবারে শেষ হয়ে গেছি। আমার সারা গায়ে এমন নোংরা লেগেছে যে, কোন সুস্থ মানুষের কাছাকাছিও আমি যেতে পারব না। আমি তোমার দুটি পায়ে পড়ি ঝুনুদি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও। আমার এ নোংরা শরীর নিয়ে তোমার কথা মেনে নিলে কাকু কাকিমার আত্মাও যে কষ্ট পাবে গো।”

ঝুনুদি আবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোকে আর আমাদের ছেড়ে চলে যেতে দেব না রে রুমু। তোর সব খবর আমরা সবাই জানি। তোর শরীরের যে কলঙ্কের কথা বলছিস, আমরা সে’সব কিছুই মেনে নিয়েছি। কারন আমরা জানি, এ’সবের জন্য তোর নিজের কোন দোষই নেই। দোষ যদি কারো হয়ে থাকে, তা করেছিল কেবল ওই গজানন। আর সে পাপের শাস্তি সে পেয়েছে। ওই দলের আর যারা জীবিত ধরা পড়েছে, তারাও ফাঁসিতে ঝুলবে। তাই এখন থেকে তুই আর মিনু নোস। তুই আবার আগের সেই রুমু হয়ে উঠবি। আর সেটা হতে তোকে সাহায্য করব আমি, ভাই আর আমরা সবাই।”

এ’সব কথার ফাঁকে ডক্টর মুখার্জি যে কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমি সেটা বুঝতেই পারিনি। ঝুনুদির কথা শেষ হতেই তিনি বললেন, “ঝুনু, রুমুকে ধরে পাশের গেস্টরুমে নিয়ে যাও। ওর আগে একটু বিশ্রাম নেওয়া খুব দরকার।”

এ’কথা শুনেই ঝুনুদি, অনুরাধা আর শ্যামলীদি আমাকে ধরাধরি করে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে তারা বিছানায় শুইয়ে দিতেই ডক্টর মুখার্জী আমার হাতে একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। ইঞ্জেকশনটা পুষ করতে করতেই ডক্টর মুখার্জী বললেন, “দু’ঘণ্টা যাবার আগে কেউ আর এ ঘরে আসবে না। রাত আটটায় আমি এসে ওকে একবার পরীক্ষা করে দেখব। তারপর বাকি কথা হবে। তোমরা ততক্ষণে সবাই মিলে ও’দিকের অন্যান্য কাজকর্ম গুলো দেখ।”

আর শুনতে পেলাম না আমি। ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম। একটা সময় আমার ডানহাতে চাপ অনুভব করতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি ডক্টর মুখার্জী আমার প্রেসার মেপে দেখছেন একটা যন্ত্রের সাহায্যে। আর সেই সাথে আমার পালসও পরীক্ষা করছেন। আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখেই উনি মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুমটা কেমন হয়েছে রুমু? আমার শালাবাবুর স্বপ্ন দেখনি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে?”

আমি তার কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে বললাম, “ইশ কত রাত হয়ে গেল ছিঃ ছিঃ। আর কত ভাবেই না আপনাদের বিরক্ত করছি আমি। তা ডক্টর আমার সঙ্গে যে রাধা এসেছিল, সে কি চলে গেছে?”

ডক্টর আমার বাহুতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে খুলতে বলল, “ঠিক আছে। এখন তোমার কণ্ডিশন অনেকটা স্ট্যাবল। আমি অনুরাধাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে তুমি কিন্তু এখনই উঠে বসবে না। শুয়ে শুয়েই তার সাথে কথা বলবে।”

আমি হা হা করে উঠে বললাম, “ওমা, না না। এ আপনি কী বলছেন? আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে তো। আপনি বুঝতে পাচ্ছেন না। কত রাত হয়ে গেল। ড্রাইভারটা বোধহয় এখনও গাড়ি নিয়ে বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।



[/HIDE]
 
[HIDE]



(#৫০)

ডক্টর মুখার্জী আমার মাথায় হাত রেখে শান্ত গলায় বললেন, “কেউ তোমাকে ছেড়ে যাবে না আজ রুমু। বিজলীমাসি, শ্যামলীদি, অনুরাধা এরা সবাই আছে। আমি তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। শুয়ে শুয়ে তাদের সাথে কথা বল। আধঘণ্টা বাদে আমি তোমাকে আরো একটা ওষুধ দেব। সেটা খাবার দশ মিনিট পর তুমি বিছানা থেকে উঠতে পারবে। এখন এভাবেই শুয়ে থাক। আর ডাক্তার ছুটি না দিলে পেশেন্ট তার বাড়ি যেতে পারে না। এটা জান না?”

আমি তার কথা শুনে নিরুত্তর রইলাম। ডাক্তার বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে বিজলীমাসি, শ্যামলীদি আর অনুরাধা ঘরে এসে ঢুকল। শ্যামলীদি আর অনুরাধা আমার একপাশে আর মাসি অন্যপাশে বসল। মাসি আমার মাথায় তার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন লাগছে রে মিনু তোর? একটু ভাল লাগছে?”

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ মাসি। এখন অনেকটা ভাল লাগছে। কিন্তু কত রাত হল বল তো? আমরা বাড়ি কখন যাব?”

বিজলীমাসি একটু হেসে বলল, “তোকে এ’সব নিয়ে ভাবতে হবে না এখন। ডাক্তারবাবু আমাদের সকলকে রাতের খাবার না খেয়ে যেতে দেবেন না। আর আমরা সবাই তো আছি। ভাবিস না। কিন্তু তোকে না তখন বললাম যে আমাকে আর মাসি বলে ডাকবি না। দিদি বলে ডাকবি।”

আমি বিজলীমাসির একটা হাত ধরে বললাম, “তুমি সত্যি আমার বাবাকে চিনতে মাসি?”

বিজলীমাসি মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “আবার মাসি? বলছি না এখন থেকে দিদি বলে ডাকবি। আর তোর বাবাকে চেনার কথা বলছিস? ওই ভগবানের মত লোকটা যে কতদিন আমাকে তার কোলে বসিয়ে আমার মুখে আদর করে খাবার তুলে দিয়েছেন রে। অত ছোট বয়সের কথা আমার আর বেশী কিছু মনে নেই। দু’একটা কথা একটু একটু মনে আছে। আমি যে নীলু জেঠুর কোলে বসে খেতাম, সে’কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার”

বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “জেঠু জেঠীমার মুখটা আবছা আবছা মনে ছিল শুধু। ক’দিন আগে ডাক্তার বাবুদের এ বাড়িতে এসে তাদের ছবি দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। তুই যে সেই নীলু জেঠুর মেয়ে, সেটা জানবার পর থেকে আমি রোজ রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদি। যে লোকটা আমার মুখে আদর করে খাবার তুলে দিয়েছে, তার মেয়েকে দিয়েই আমি আর মা দশটা বছর ধরে ব্যবসা করেছি। আমার যে নরকেও ঠাঁই হবেনা রে”

বলতে বলতে শাড়ির খুঁট দিয়ে নিজের চোখ মুছতে লাগল।

বিজলীমাসিকে কাঁদতে দেখে আমার চোখেও জল চলে এসেছিল। কিন্তু অদম্য কৌতূহলের বশে আমি তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু আমার মা বাবার সাথে তোমার দেখা কবে কোথায় হয়েছিল।”

বিজলীমাসিও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “সে তো প্রায় চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা। তখন তো তোর জন্মও হয়নি। আমি তখন একটা কোলের শিশু। তখন নীলু জেঠু আর জেঠিমার কোন সন্তান হয় নি। আমি আর মা তো তোদের বাড়িতেই থাকতাম। আমার জন্মের পর পরই আমার বাবা আমাদের মা মেয়েকে একা ফেলে কোথাও চলে গিয়েছিল। আমার বাবা নীলু জেঠুর অফিসেই কাজ করত। মা-র মুখে শুনেছিলাম, তখন আমাদের আশ্রয় বলতে কিছু ছিল না। নীলু জেঠুই নাকি মাকে আর আমাকে তোদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর পাঁচ বছর আমরা তোদের বাড়িতে ছিলাম। নীলু জেঠু আর জেঠিমা আমাকে খুব ভালবাসতেন। যখন মা আমাকে নিয়ে ওখান থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল তখন নীলু জেঠুর ছেলের বয়স ছিল প্রায় তিন বছর। তোর বড়দা আদির জন্মের পর থেকেই তো আমি সব সময় ওকে কোলে নিয়ে থাকতাম। আমার ঘরের ট্রাঙ্কের ভেতরে এখনও একটা সাদা কালো ছবি আছে। আমি তোর বড়দাকে কোলে নিয়ে সে ছবিটা উঠেছিলাম। ওখান থেকে চলে আসবার পর অনেক জায়গা ঘুরে শেষমেশ মা আমাদের ওই বাড়িটায় এসেছিল। বাসন্তী থেকে সে হয়ে গিয়েছিল ঝিমলি। আর আমি রেখা থেকে হয়ে উঠেছিলাম বিজলী। সে সব ইতিহাস এখন বলতে গেলে এক রাতেও বোধহয় শেষ হবে না। তবে সেই সময়কার একটা দিনের কথা এখনও আমার পরিস্কার মনে আছে। তোর বড়দা আদি একদিন বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আমি ছুটে গিয়ে সে মেঝেতে পড়বার আগেই তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেদিন নীলু জেঠু আর জেঠিমা আমাকে খুব আদর করেছিলেন। আমাকে নতুন একটা ফ্রক কিনে দিয়েছিলেন নীলু জেঠু।”

আমি বিজলীমাসির হাতটাকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে বললাম, “সত্যি বলছ তুমি মাসি?”

বিজলীমাসি একটু ম্লান হেসে বলল, “গত দু’মাসের মধ্যে তোকে অনেকগুলো মিথ্যে কথা বলেছি রে মিনু। অনেক কথা তোর কাছে গোপন করে গেছি। শুধু আজকের এই দিনটার আশায়। আজ আর তোকে কোন মিথ্যে বলছি না রে। নীলু জেঠুর মত আর কাউকে আমি দেখিনি। আমি যে তাকে নিজের বাবার মতই ভালবাসতাম শ্রদ্ধা করতাম রে। আর উনিও আমাকে খুব ভালবাসতেন। আর গত দশটা বছর ধরে সেই নীলু জেঠুর মেয়েকে দিয়ে আমি বেশ্যাবৃত্তি করিয়েছি! এ’কথা যেদিন বুঝতে পেরেছি সে’দিন থেকেই যে মনে মনে জ্বলে পুড়ে মরছি আমি রে। যে লোকটাকে আমি ভগবানের মত শ্রদ্ধা করতাম তার আদরের মেয়েটাকে দিয়েই আমি এ’সব করিয়েছি, এ’কথা ভাবতেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বোন, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তো জানতাম না যে তুই আমার সেই জেঠুর মেয়ে। মা-ও যদি তোর আসল পরিচয় জানতে পারত, তাহলে সেও তোকে এ ব্যবসায় কিছুতেই নামাত না। আর ওই গজানন আরও দশ বছর আগেই এ দুনিয়া থেকে সরে যেত। কিন্তু প্রায় দু’মাস আগে যেদিন জানতে পারলাম যে তোদের পাশের বাড়ির রমেন কাকুর ছেলে তোর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোকে আমি তার হাতে তুলে দেব। রমেন কাকু আর সোনালী কাকিমার কথাও মনে আছে আমার। তাদের শেষ ইচ্ছে পূরণ করবার জন্য আমাকে যা কিছু করতে হয় আমি সব করব। আজ সেই শুভদিনটা এসে গেছে। এখন আমি মরে গেলেও আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। তবে যে’কটা দিন বেঁচে থাকব রোজ নীলু জেঠু আর জেঠিমার কাছে প্রার্থনা করব, তারা যেন আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেন। আর পরকাল বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে, আর সেখানে যদি তাদের সাথে আমার দেখা হয়, তাহলে নীলু জেঠু আর জেঠিমার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব আমি।”

আমি বিজলীমাসির হাত ধরে বললাম, “তুমি সত্যি আমাদের ওই বাড়ীতে ছিলে? আমার বড়দাকে তুমি তোমার এই কোলে নিয়েছিলে?”

এমন সময় ঝুনুদি একটা গ্লাস হাতে করে ঘরে ঢুকে বলল, “হ্যাঁরে রুমু। রেখাদি একদম ঠিক কথা বলছে। আমি তো রেখাদি বা তার মাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু মা-র মুখে তাদের কথা শুনেছি। তোদের বাড়িতে বাসন্তীমাসি আর রেখাদি প্রায় বছর পাঁচেকের মত ছিল। আচ্ছা, এটা তুই আগে খেয়ে নে তো। তারপর বাকি কথা শুনিস” বলে গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

আমি বিজলীমাসির কোল থেকে উঠবার চেষ্টা করতেই বিজলীমাসি আর শ্যামলীদি আমাকে ধরে টেনে ওঠালো। ঝুনুদিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন আবার কী এনেছ এ’সব তুমি ঝুনুদি?”

ঝুনুদি আমার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশে বিছানায় বসতে বসতে বলল, “হরলিক্সের সাথে কিছু একটা ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছেন তোর ডাক্তারবাবু। আর কথা না বলে আগে এটা খেয়ে নে তো।”

আমি কোন কথা না বলে গ্লাসে চুমুক দিতেই ঝুনুদিদের কাজের মেয়ে শেফালী ঘরে ঢুকে বলল, “ও দিদি, লিপি বৌদি জানতে চাইল মুড়িঘণ্টটা কি আজই বানাবে তুমি?”

ঝুনুদি জবাব দিল, “নারে। আজ আর আমি কিচেনে যেতে পারব না। তুই লিপিকে বল, মাছের মুড়োটা যেন ভেঁজে রেখে দেয়। মুড়িঘণ্ট কাল দিনের বেলায় বানাবো।”

শেফালী পেছন ফিরে যাবার উদ্যোগ করতেই ঝুনুদি আবার বলল, “একটু দাঁড়া শেফালী। ওর খাওয়া হলে গ্লাসটা নিয়ে যা। আর শোন, দাদার ঘর থেকে আদিকে এনে এখানে দিয়ে যাস তো। ও ওর মামির কাছে আসবার জন্য খুব কান্নাকাটি করছে। একটু এসে দেখে যাক। আর লিপিকে বলিস আজ রুমুকে কী খেতে দিতে হবে তা যেন তোর জামাইবাবুর কাছ থেকে জেনে নেয়। আমি এখানে কিছুক্ষণ বসব।”

আমি খালি গ্লাসটা শেফালীর হাতে ফিরিয়ে দিতেই শেফালী চলে গেল। ঝুনুদি আমার কাঁধে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর এখন কেমন লাগছে রে রুমু? ভাল লাগছে তো? না অন্য কিছু কোন অসুবিধে হচ্ছে?”

আমি ঝুনুদির মুখের দিকে চেয়ে শান্ত ভাবে বললাম, “এখন ঠিকই আছি। কিন্তু ঝুনুদি ওই ছবিটা তোমরা কোত্থেকে পেলে গো? আমার মনে পড়ছে যেদিন আমাদের ওই সর্বনাশটা হয়েছিল তার আগের দিনই বড়দার কেনা নতুন ক্যামেরায় এ ছবিটা তোলা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটা তো তখনও প্রিন্ট করা হয়নি।”

ঝুনুদি আমার একটা হাত ধরে বলল, “তোর বড়দা আদিদা ছবিটা প্রিন্ট করতে দিয়েছিল মডার্ন স্টুডিওতে। তোর মনে আছে মডার্ন স্টুডিওর কথা? আমাদের স্কুলে যাবার রাস্তাতেই তো ছিল।”

আমার সে স্টুডিওর কথা মনে পড়তে বললাম, “হ্যাঁ মনে আছে। ঘোষপাড়ার মোড়ের মাথাতেই তো ছিল, তাই না?”

ঝুনুদি বলল, “হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। ওই ঘটনার মাস খানেক বাদে বাবা যেন কিভাবে জানতে পেরেছিলেন ছবিটার কথা। আদিদাই ছবিটা প্রিন্ট করতে দিয়েছিল সেখানে। বাবাই সে স্টুডিও থেকে ছবিটা এনেছিলেন। ছবিটা তখনই এভাবে বাঁধিয়ে আমাদের খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। আমার বিয়ের ঠিক পর পরই মা বাবা চলে যাবার পর ভাইও সিভিল সার্ভিস পাশ করে চাকরীতে জয়েন করতে বাড়িটা তখন থেকেই খালি পড়ে ছিল। ভাই বাইরে চলে যাওয়াতে সে বাড়িতে থাকবার মত আর কেউ ছিল না। আমি ভাইকে বলেছিলাম বাড়িটা বেচে দিতে। কিন্তু ও তা করেনি। ভাড়া দিয়েছিল। বছর সাতেক পর ভাই যখন এখানে কোলকাতায় পোস্টিং পেল তখন আমার কথাতেই সে বাড়িটা বেচে দিয়ে এখানে এই বাড়িটা বানিয়েছে। আমরা তো তার বছর চারেক আগে থাকতেই দমদমের ওদিকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতাম। এ বাড়ি কমপ্লিট হবার পর ভাই আমাদের সবাইকে এখানেই নিয়ে এসেছে। আর পুরোনো বাড়ির অনেক জিনিসের সাথে এ ছবিটাও নিয়ে এসেছে। তখন থেকেই এটা ড্রয়িং রুমের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে।”

ঝুনুদির গলাটা কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছিল। একটু থেমে সে আবার বলল, “তবে শুধু এ ছবিটাই নয়। তোদের বাড়ি থেকে ভাই একটা অ্যালবাম চেয়ে নিয়েছিল তোর মামাদের কাছ থেকে। আর এ বাড়িতে আসবার পর সে অ্যালবাম থেকে কয়েকটা ছবি স্টুডিওতে দিয়ে নতুন করে প্রিন্ট করে এনেছে। সে’সব ওপরে ভাইয়ের বেডরুমে আর ওপরের ড্রয়িং রুমে লাগানো হয়েছে। তোকে ফিরে পাবার আশা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ভাইকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারিনি কিছুতেই। মা বাবা জেঠু জেঠিমা আদিদা আর অভির ছবিগুলোতে ভাই রোজ মালা পড়িয়ে দেয় আর কাঁদে। এ বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে আমরা সবাইকে বলি যে ওগুলো টুপুর শ্বুশুর শাশুড়ি আর সম্বন্ধীদের ছবি। আর তোর ছবি দেখিয়ে বলি, এটা আমার ভাইবৌ”

বলতে বলতে ঝুনুদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঝুনুদিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমিও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আর বিজলীমাসি, শ্যামলীদি আর অনুরাধা আমাদের দু’জনের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সান্তনা দিতে লাগল।

এমন সময় শেফালী আদিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই আদি শেফালীর কোল থেকে নেমে ছুটে এসে আমাকে আর ঝুনুদিকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, “ও মামি, ও মা তোমরা কাঁদছ কেন গো?”

আমি ঝুনুদিকে ছেড়ে আদিকে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, “আদি সোনা। সোনা বাবা আমার। আমরা যে তোমাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না তাই তো কাঁদছিলাম। এবার তুমি এসে গেছ। আর কাঁদব না আমরা” বলে আদির দু’গালে একের পর এক চুমু খেতে লাগলাম।

আদি তার ছোট্ট ছোট্ট তুলতুলে হাতে আমার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “আমি তো কখন থেকে তোমার কাছে আসতে চাইছিলাম। ওই বিড্ডু মামুটা খুব খারাপ। আমাকে শুধু শুধু আটকে রাখছিল। তাই তো আসতে পারিনি। বলে কি, তুমি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছ।”

ঝুনুদিও নিজের চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে আদিকে জিজ্ঞেস করল, “তোর মামু কী করছে রে আদি?”

আদি আমার কোলে বসে বলল, “এতক্ষণ তো শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল মামু। তবে এখন শুধু শুয়ে আছে। কিন্তু মা আমি কিন্তু মামির সাথে শোব আজ। তুমি না করবে না কিন্তু।”

ঝুনুদি মুখে হাসি টেনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। কিন্তু মামির তো শরীরটা ভাল নেই। তুমি তাকে একটু রেস্ট নিতে দাও। তুমি এখন বাপীর কাছে যাও। নইলে মামির সাথে শুতে পারবে না কিন্তু।”

আদি প্রায় সাথে সাথে আমার কোল থেকে নেমে বলল, “ঠিক আছে। আমি তোমার কথা শুনছি। তুমিও কিন্তু আমাকে মামির সাথে শুতে দেবে।”

ঝুনুদি তার কথায় সায় দিতেই আমি আদির হাত ধরে বললাম, “ও ঝুনুদি, আমি যে তখন ওকে চকলেটটা খাওয়াচ্ছিলাম সেটার কি হল গো?”

ঝুনুদি কিছু বলার আগেই আদি বলে উঠল, “ওটা তো আমি খেয়ে ফেলেছি মামি। কিন্তু জানো মামি, মামুও আমার চকলেটটা থেকে একটা টুকরো খেয়েছে।”

আমি হেসে আদির মাথার চুল নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “খুব ভাল করেছ সোনা।”

ঝুনুদি বলল, “ঠিক আছে। মামি দিয়েছে বলেই আজ তোমাকে চকলেট খেতে দিয়েছি। কিন্তু মামির কাছে কিন্তু আর চকলেট খাবার বায়না ধরবে না। তাহলে মামি কিন্তু আবার হারিয়ে যাবে।”

আদি আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল, “না, আমি মামিকে আর হারিয়ে যেতে দেব না। চকলেট চাই না আমি।”

আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আদিকে বুকে চেপে ধরে আবার কেঁদে ফেললাম। ঝুনুদি আমার কাছ থেকে আদিকে টেনে নিতে নিতে বলল, “শেফালী ওকে নিয়ে যা ওর বাবার কাছে।”

শেফালী আদির হাত ধরে ওকে টানতে আদি যেতে যেতে বলল, “আমি আর চকলেট চাইব না মামি। তুমি কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাবে না।”

আমি আদির কথা শুনে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এবার অনুরাধা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেঁদো না রুমুদি। এতগুলো বছর ধরে অনেক যন্ত্রণা তুমি সহ্য করেছ। আজ ভগবান যখন তোমাকে এমন একটা সুযোগ দিচ্ছেন, সেটাকে তুমি আর অবহেলা কোর না। টুপু যে তোমাকে কত ভালবাসে, তা তুমি না জানলেও আমি তো অনেক বছর আগে থেকেই তা জানি গো। টুপুর সাথে তুমি খুব সুখে থাকবে।”

আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, “না রে অনু। সেটা হয় না রে। তুই তো জানিস আমি কতটা নোংরা। আমাদের সারা শরীরে যে নর্দমার পাঁক লেগে আছে রে। টুপুর মত পবিত্র নিষ্পাপ একটা ছেলের জীবন আমি জেনে বুঝে কি করে নষ্ট করি বল তো?”

এমন সময় ডক্টর মুখার্জির গলা শুনতে পেলাম, “এ পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে ম্যাডাম, যাতে একজন আরেকজনের জীবন নষ্ট করে দেয়। তোমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছিল ওই গজানন নামের বদমাশটা। সে বদমাশটা তার কৃতকর্মের একেবারে উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ রুমু। যেখানে ভালবাসা থাকে সেখানে কেউ কারো জীবন নষ্ট করে না। বরং সব রকম বিপদে আপদে একে অন্যের পাশে থেকে সাহায্য করে। একে অন্যের জন্য নিজের সর্বস্য বিলিয়ে দিতে পারে। আর টুপু যে তোমাকে কতটা ভালবাসে সেটা তোমাকে আমি ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। বয়সে আমি ওর থেকে প্রায় ছ’বছরের বড়। কিন্তু তোমার প্রতি ওর মনের মধ্যে যত ভালবাসা আমি দেখেছি, তাতে আমি ওকে মনে মনে প্রণাম করি। নিজের চোখে না দেখলে এমন ভালবাসার কথা শুনে আমি সেটাকে শুধু একটা গল্প বলেই ভাবতাম। কিন্তু নিজের চোখে যা দেখেছি, তাকে তো আর গল্প বলা যায় না।”

ডক্টর মুখার্জী যে কখন ঘরে এসে ঢুকেছেন সেটা বুঝতেই পারিনি। শ্যামলীদি ঘরের কোণ থেকে একটা চেয়ার এনে আমাদের বিছানার সামনে রেখে বলল, “আপনি এখানে বসুন ডাক্তারবাবু।”

ডক্টর মুখার্জী চেয়ারে বসতে আমি তাকে কিছু একটা বলতে যেতেই অনুরাধা পেছন থেকে বলল, “হ্যাঁ রুমুদি। আমিও ঠিক সে’কথাই বলছি। তবে আমি তো টুপুকে অতটা কাছে থেকে দেখিনি যেমনটা উনি দেখেছেন। তবে টুপু যে তোমাকে কতটা ভালবাসত তার আন্দাজ আমিও করতে পেরেছিলাম অনেক আগেই। তোমাকে তো কিছুটা আগেই বলেছি। কিন্তু কয়েকটা কথা তোমার কাছ থেকে আমি গোপন করে গিয়েছিলাম রুমুদি। অবশ্য শুধু আমিই নই, শ্যামলীদি আর মাসিও কয়েকটা কথা তোমার কাছে গোপন রেখেছিল। আমার মনে হয় আজ সে কথাগুলো তোমাকে জানানো উচিৎ। শোনো রুমুদি, বিজলী মাসির বাড়িতে আমার আসা আর তোমার সাথে আমার দেখা হওয়াটা কিন্তু একেবারেই কাকতালীয় নয়। তোমার কাছাকাছি যাবার জন্যেই আমি এখানে এসেছি। তবে প্রথম থেকে গুছিয়ে না বললে তুমি সেটা বুঝতে গিয়েও গুলিয়ে ফেলবে। তাই তোমার সাথে আমার দেখা হবার অনেক আগে থেকে সব গুছিয়ে বলছি শোন।”

আমি পেছন ঘুরে অনুরাধার হাত ধরে বললাম, “না অনু। ঝুনুদি আর ডক্টর মুখার্জির সামনে আমাকে এভাবে লজ্জা দিস না, প্লীজ।”

অনুরাধা এবার ঝুনুদি আর ডক্টর মুখার্জির দিকে দেখে বলল, “শান্তুদা, ঝুনুদি। তোমরা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সবটাই জানো। আমরা কী কাজ করি, কী আমাদের পেশা এসব তোমরা সবই জানো। কিন্তু অনেক কথাই এখনও রুমুদির অজানা আছে। সে’কথা গুলো বিশদভাবে খুলে না বললে রুমুদি আসল সত্যিটা বুঝতে পারবে না। কিন্তু সে’সব কথা খুলে বলতে গেলে দু’চারটে অনুচিত বা অশ্লীল কথা আমার মুখ থেকে বেরোতে পারে। রুমুদি তো আমার অতীত সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে। ঝুনুদিও নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে। কিন্তু শান্তুদা, আপনি তো সে’সব জানেন না। তাই আমার কিছু কিছু কথা আপনাদের দু’জনের কাছেই শ্রুতিকটু মনে হতে পারে। কিন্তু এই মূহুর্তে রুমুদিকে কথাগুলো বলা খুবই জরুরী। তাই আমি আপনাদের কাছে আগে থেকেই হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”

এ’কথা বলে অনুরাধা আমার হাতটা ধরে বলল, “রুমুদি, তুমি যদি ভেবে থাক যে ঝুনুদি আর শান্তুদা আমার মুখে কথাগুলো প্রথমবার শুনছেন, তাহলে বলে রাখি, তোমার সে ধারণা সম্পূর্ণ ভূল। তারা অনেকটাই জানেন। আর গত দু’ তিন মাসে তোমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তার তো প্রতিটা কথাই তারা জানেন। আর জেনেছেন আমাদের মাধ্যমে। আমি, মাসি আর শ্যামলীদি সকলেই তাদের সব কিছু জানিয়েছি। আমাদের বাড়ির ডাক্তার ঘোষালও একটা পর্যায়ে আমাদের সাথে ছিলেন। তবে শুরুটা হয়েছিল বিদ্যুৎদার মাধ্যমে। আজ বিদ্যুৎদাও এ বাড়িতে আছেন। তিনিও সাক্ষী দেবেন যে আমি কোন কিছু বানিয়ে বলছি না। তবে বিদ্যুৎদার কথা বলার আগেও তোমাকে আরো কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। রুমুদি, তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি যে টুপু আমাকে একদিন বলেছিল যে ও কোন একটা মেয়েকে ভালবাসে আর তাকেই তখনও সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তোমাকে আমি বলিনি, কিন্তু আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম যে টুপু তোমাকেই ভালবেসেছিল। আর তোমাকেই যে টুপু ভালবাসত, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম সেদিন। ওই দুর্ঘটনার পরের দিন সকালে যখন আমাদের সারাটা শহর তোলপাড় হয়ে উঠেছিল, সেদিন আমি টুপুদের বাড়ি গিয়ে তোমাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তখন আমি টুপুর মা বাবা আর ঝুনুদিকে যেভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম অমন কান্না মানুষ শুধু তখনই কাঁদে যখন তাদের অত্যন্ত ভালবাসার কেউ সারা জীবনের জন্য তাদের ছেড়ে যায়। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যে পাশের বাড়ির কেউ নয়, ওদের বাড়িরই কেউ যেন মারা গেছে। আমি সেদিন ওদের বাড়িতে প্রায় ঘণ্টা চারেক ছিলাম। ওই চারটে ঘণ্টা আমি টুপুকে একভাবে জানালার শিক ধরে তোমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম যে বয়সে তোমার চেয়ে ছোট হলেও টুপু তোমাকেই ভালবাসত। আর আমার ধারণাই যে ঠিক সেটা বুঝতে পেরেছিলাম ওদের বাড়ি থেকে চলে আসবার সময়। আলুথালু বেশে ঝুনুদি আর তার বাবা মা পাগলের মত কাঁদতে শুরু করেছিলেন।”

এমন সময় হঠাৎ ঝুনুদি চাপা গলায় বলল, “অনু, তুই ওই দিনটার কথাগুলো আর তুলিস না রে ভাই। ও’কথা মনে পড়লে আমি যে আজও শিউড়ে উঠি। প্লীজ তুই ও’সব কথা তুলিস না।”




[/HIDE]
 
[HIDE]

(#৫১)

অনুরাধা ডক্টর মুখার্জীকে বলল, “শান্তুদা, তুমি ঝুনুদিকে বোঝাও। আমি তাকে কষ্ট দেবার জন্য কিছু বলছি না। আর ঝুনুদি, বারো বছর পুরোনো কান্নার রেশ থেমে গেলেও রুমুদির খোঁজ পাবার দিন থেকেই তো তুমি আবার নতুন করে কাঁদতে শুরু করেছ। একটু একটু করে কেঁদে নিজেদের মনের বোঝা হালকা করেছ তোমরা দু’ভাইবোন। কিন্তু আজ রুমুদির মনের ভেতর যে কত কান্নার আবেগ একসাথে উথলে উঠতে চাইছে, সেটা বুঝতে পারছ না? ওর মনের ভেতর যে এখনও প্রচুর দ্বন্দ্ব আছে তার কারন এখনও প্রচুর প্রশ্ন ওর মনে জমা হয়ে আছে। সে প্রশ্নগুলোর জবাব পরিস্কার ভাবে না বোঝা পর্যন্ত রুমুদি পরবর্তী সিদ্ধান্তটা যে নিতে পারবে না, সেটা বুঝতে পারছ না?”

ডক্টর মুখার্জী ঝুনুদির পাশে বসে তাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, “হ্যাঁ ঝুনু, অনুরাধা একদম ঠিক কথা বলছে। আমিও সেটাই চাই। যারা যারা আমাদের এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল আজ তারা প্রায় সকলেই এখানে আছে। তাই রুমু বুঝতে পারবে যে আমরা মিথ্যে বানিয়ে কিছু বলছি না। অনুরাধা তুমি বলে যাও।”

অনুরাধা আমার ধরে থাকা হাতটায় আবার চাপ দিয়ে বলল, “হ্যাঁ রুমুদি। বিশ্বাস কর, আমি এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। আমি সেদিন ওদের দরজার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুনছিলাম মেশোমশাই কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন যে আগের দিনই তোমাদের দুই পরিবারের কর্তাদের মাঝে নাকি কথা হয়েছিল যে তোমার বড়দার সাথে ঝুনুদির বিয়ে দেওয়া হবে। তুমি তোমার মা-বাবার মুখে এ’কথা শুনেছিলে কিনা জানিনা। কিন্তু ঝুনুদির বাবার মুখ থেকেই কথাটা শুনেছি আমি সেদিন। আর মাসিমা, মানে ঝুনুদির মা, কেঁদে কেঁদে বলছিলেন যে উনি তোমার মা বাবার হাতেপায়ে ধরে যে কোন ভাবেই তোমাকে তাদের পূত্রবধূ করে নেবার কথা ভাবছিলেন। তার কয়েক মাস বাদে আমি টুপুর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু টুপু আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে পরিস্কার ভাবে বলে দিয়েছিল যে সে তার ভালবাসার পাত্রীকে হারিয়ে ফেলেছে। আর তাকেই খুঁজে যাচ্ছে। আমি টুপুকে অনেক চেষ্টা করেও কব্জা করতে পারিনি। তারপর একদিন ওর পার্সে আমি তোমার ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিনই আমার কাছে পরিস্কার হয়েছিল যে টুপু শুধু তোমাকেই ভালবাসত। আর তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মন দিয়েছিলাম।”

ঝুনুদি অনুরাধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দাঁড়া অনু। এখানে আমি একটু বলে নিই। তোর বোধহয় মনে আছে রুমু, সেদিন আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। সকাল থেকেই মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছিল। মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হচ্ছিল। সেদিন বাবার অফিসের এক কলিগের বাড়িতে কালীপুজো উপলক্ষ্যে বাবা আমাকে আর মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাই একা বাড়িতে ছিল। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দামুদার দোকানের পাশের একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় আমরা গিয়ে উঠেছিলাম। প্রায় সাথে সাথেই জেঠুও, মানে তোর বাবা, সেখানে এসে উঠেছিলেন। তিনি অফিস ফেরত বাড়ি ফেরার পথে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলেন। জেঠু আমার চিবুক ধরে আদর করে হঠাতই বাবাকে বলেছিলেন যে বাবা মা যদি রাজী থাকেন তাহলে আমাকে আদিদার বৌ করে তোদের বাড়ি নিয়ে যাবেন। বাবাও তার জবাবে বলেছিলেন যে দু’এক দিনের মধ্যেই তারা এ ব্যাপারে কথা বলবেন। তবে আমার সামনেই তিনিও জেঠুকে বলেছিলেন যে আদিদার সাথে আমার বিয়ে দিতে এমনিতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তার একটা শর্ত ছিল। জেঠু জানতে চেয়েছিলেন কী শর্ত। বাবা তখন বলেছিলেন যে তিনি দু’বাড়ির মধ্যে মেয়ে বদল করতে চান। মানে আমাকে তোদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন আর তোকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবেন। জেঠু শুনে খুব খুশী হয়ে বলেছিলেন যে ভাই তোর থেকে বছর দেড়েকের ছোট হলেও তার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু জেঠিমার সাথে পরামর্শ না করা পর্যন্ত কোন কথা দিতে পারবেন না। আমি আর মা সে’কথা শুনে খুব খুশী হয়েছিলাম। কারন আমরা জানতাম জেঠিমা এ দুটো সম্পর্কই মেনে নেবেন। তখন বাবা জেঠুকে নিমন্ত্রন করেছিলেন পরের রবিবার দুপুরে তোদের বাড়ির সকলে যেন আমাদের বাড়িতে খেতে আসে। কিন্তু সে দুপুর তো আর কোনদিন আসেনি আমাদের জীবনে। বাবার কলিগের বাড়ি সারা রাত জেগে কালীপুজো দেখে শেষ রাতের দিকে আমরা ঘুমিয়েছিলাম। পরের দিন সকাল সাতটা না বাজতেই ওই বাড়ির লোকেরা আমাদের ডেকে উঠিয়ে জানিয়েছিল সেই দুঃসংবাদটা। বাবা সাথে সাথে ভাইকে ফোন করেছিলেন। ভাই ফোন ধরে কোন কথা বলতে পারেনি। শুধু হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। আমরা তড়িঘড়ি সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেকটা দুরেই ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতে হয়েছিল। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, রিপোর্টার, নিউজ চ্যানেলের গাড়ি দিয়ে ছয়লাপ হয়ে ছিল পুরোটা এলাকা। আর হাজার হাজার লোকের ভিড় কাটিয়ে কোনরকমে আমরা পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পেরেছিলাম। বাড়িতে ঢোকবার আগেই লোকের মুখে মুখে ছাড়া ছাড়া ভাবে শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে কত বড় একটা সর্বনাশ হয়েছে। মা বাবা তখনও জানতেননা যে ভাই তোকে ভালবাসত। কিন্তু আমরা ভাইবোন তো একঘরেই থাকতাম। আমি সেটা তার অনেক আগে থেকেই জানতাম। বাড়িতে গিয়ে ঢুকতেই ভাই আমাদের দেখে হাউহাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। কিন্তু কে আর কাকে সান্ত্বনা দেয় তখন। বাবা মা আর আমি নিজেও তো তখন একইভাবে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। জেঠু, জেঠিমা আর তোদের সবাইকে আমিও যে বড্ড ভালবাসতাম রে। মনে মনে স্বপ্নও দেখতাম আদিদার বৌ হয়ে আমি তোদের ও বাড়িটায় গিয়ে উঠব। তুই আমাকে বৌদি বলে ডাকবি। আমি আজও আদিদাকে ভুলতে পারিনি। আমাদের বিয়ের আগেই আমি শান্তুকে আদিদার কথা, তোদের সকলের কথা খুলে বলেছি। শান্তুও খুব ভাল। ছেলে হবার পর ও-ই ছেলের নাম রাখে আদিত্য। আদিদা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু যতবার আমার ছেলের নাম মুখে আনি ততবারই আদিদার কথা, তোর কথা, তোদের বাড়ির আর সকলের কথা আমার মনে আসে।”

ঝুনুদির গলাটা আবার খুব ভারী শোনাল। ডক্টর মুখার্জি ঝুনুদির কাঁধে হাত রেখে বললেন, “কেঁদো না ঝুনু। গত ছ’সাতটা বছর ধরেই তো তুমি আর টুপু রোজ এভাবে কেঁদে আসছ, সে তো আমি দেখেছিই। আজ ভগবান আমাদের দিকে মুখে তুলে তাকিয়েছেন। তার দয়াতেই আজ রুমুকে আমাদের মাঝে পেয়েছি। আজ আর কান্না কীসের? আজ তো আমাদের সকলের খুশীর দিন। তোমার মা বাবার স্বপ্ন আজ পূর্ণ হতে চলেছে। এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে বল তো? তাই নিজেকে সামলে রুমুকে বোঝাও যে আমরা সকলেই তাকে ফিরে পাবার জন্য কত কী করেছি। টুপুর ভালবাসায় যদি শক্তি থাকে তাহলে রুমুও ওর মনের সন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে টুপুকে আপন করে নেবে। তবে ওর মনের ওপরেও তো এখন অসম্ভব চাপ রয়েছে। বারোটা বছরের গ্লানি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে ওকে একটু সময় তো দিতেই হবে। তাই অনুরাধা যা বলছে সেটাই আমাদের করা উচিৎ। আমাদের সব কথা শুনলেই রুমু হয়তো নিজের মনের গ্লানি আর সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারবে।”

আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। এদের সকলের কথা শুনতে শুনতে ঠিক করতে পারছিলাম না, আমার এ মূহুর্তে কী করা উচিৎ। আমি ঝুনুদির মুখের দিকে চাইতেই ঝুনুদি আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুই তো জানিস না রুমু। ভাইয়ের সাথে তো তোকে আমি কখনো কথা বলতে দেখিনি। ওকে নিয়ে তোর মনের মধ্যে কোন ফিলিংস ছিল কি না সেটাও জানিনা। আর সেটা না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু ভাই যে স্কুলে পড়বার সময় থেকেই মনে মনে তোকে ভালবাসতে শুরু করেছিল, সেটা আমার অজানা ছিল না। আমাদের ঘরে তো রুম বেশী ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আমি আর ভাই একঘরে ঘুমোতাম। ও যখন ক্লাস নাইনে পড়ত তখন একদিন ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে তোর নাম মুখে আনছিল। তার পরের দিন ওকে চেপে ধরতেই ও সেটা আমার কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে ওর ভালবাসা হয়ত কোনদিনই স্বার্থক পরিণতি পাবে না। তোদের আর আমাদের দুটো বাড়ির মধ্যে ভাব ভালবাসা যতই থাকুক না কেন, দুটো বিরাট বাধা যে ভাইয়ের ভালবাসার পথে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে এটা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ভাইকে তখন থেকেই বুঝিয়েছিলাম যে কাউকে ভালবাসা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সমাজ সংসারের প্রথার বিরূদ্ধে গিয়ে কিছু করাটা সত্যিই খুব কঠিন। ভাইও হয়ত আমার কথার মানেটা বুঝেছিল। কিন্তু নিজের মনকে যে সে আয়ত্বে রাখতে পারেনি, তোকে যে ও নিজের মন থেকে সরাতে পারেনি সেটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি ওকে মাঝে মাঝেই বোঝাতাম। একে আমাদের দুটো পরিবারের ভেতর সামাজিক জাতপাতের পার্থক্য। তার ওপর ভাই তোর চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। তাই ইচ্ছে থাকলেও ভাইয়ের হয়ে মা বাবার কাছে কোন অনুরোধ করতে পারিনি। কিন্তু যখন তোদের বাড়ি যেতাম, তখন জেঠিমার সাথে কথা বলবার সময় আমার মনে হত জেঠিমাও ভাইকে খুব পছন্দ করতেন। হালকা কথাবার্তার মাধ্যমে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমরা যদি জাতের বৈষম্যটা মেনে নিতে পারি, আর ভাই যদি তোর থেকে বয়সে ছোট না হত, তাহলে তিনিও তোদের বিয়ে দিতে রাজি হতেন। মা তো আদিদাকে যতটা ভালবাসতেন তার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসতেন তোকে। বারবার বলতেন তুই যদি ভাইয়ের চেয়ে বয়সে বড় না হতিস তাহলে তোকেই আমাদের বাড়ির বৌ করে ঘরে আনতেন। আর সেদিন সকালে যখন জেঠু আর বাবা ওই দোকানটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ও’সব বলাবলি করছিলেন, সেদিন আমি আর মা দু’জনেই খুব খুশী হয়েছিলাম। বাবার কলিগের বাড়িতে সে রাতে মা শুধু তোর আর আদিদার কথাই বলছিলেন। কিন্তু ওই রাতেই যে আমাদের সব স্বপ্ন ওভাবে চুড়মার হয়ে যাবে, সেটা তো আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সকালে বাড়ি ফিরে ও’সব দেখে আমরা যখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছিলাম তখনই মা বাবা বুঝে গিয়েছিলেন যে ভাই তোকে ভালবাসত। আর আমিও যে আদিদাকে পছন্দ করতাম এ’কথা তো মা আগে থেকেই জানতেন। তুই হারিয়ে যাবার পর ভাই তো প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। একদম চুপচাপ থাকত। কারুর সাথেই কথা বলত না। শুধু রাতে আমার কাছে কেঁদে কেঁদে বলত যে তোকে ছাড়া ও বাঁচতে পারবে না। রাতের পর রাত জেগে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমি মা বাবাকে কথাটা জানিয়েছিলাম। প্রায় ছ’মাস ও ঘর থেকেই বেরোয় নি। সে বছর স্কুলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাও দিতে পারেনি। তখন প্রথমে আমাদের ওখানকার ডক্টর দেব আর পরে সেই ডাক্তারের নির্দেশে ওকে কলকাতার এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে আসতে হয়েছিল। ও তো বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হত। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষায় কোন রকমে শুধু পাসমার্কটুকুই স্কোর করেছিল। বাবা, মা আর আমি কোনভাবেই ওর মন থেকে তোকে সরাতে না পেরে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাতে শুরু করেছিলাম যে ডাকাতগুলো বাকি চারজনের মত তোকেও খুন করে ফেলে যায়নি মানেই হচ্ছে তুই বেঁচে আছিস। আমরা যে কোন ভাবেই তোকে খুঁজে বের করব। কিন্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর পেড়িয়ে গেল, কেউ তোর হদিশ খুঁজে বের করতে পারল না। পুলিশ গোয়েন্দা কেউ সে মর্মান্তিক খুনগুলো আর তোর কিডন্যাপিং-এর ব্যাপারে কোনও সুরাহা করতে পারল না। একটা সময় আমি তোকে ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দিলেও বাবা মা কিন্তু তাদের জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে তুই বেঁচে আছিস। আর একদিন না একদিন আমরা ঠিক তোকে খুঁজে পাব। ওই ডাকাতগুলো তোকে ধরে নিয়ে যাবার পর তুই কতটা দুর্ভোগ ভোগ করবি, তা আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারছিলাম। মনে মনে ভয় হত, সেসব দুর্ভোগ সহ্য করতে না পেরে তুই আবার আত্মহত্যা করে না বসিস। কিন্তু তোকে কোনভাবে ফিরে পেলে তুই যে অবস্থাতেই থাকিস না কেন মা বাবা তোকে তাদের ছেলের বৌ করে নিতে রাজি ছিলেন। তোর মামারা যেদিন খবর পেয়ে এসেছিলেন, সেদিন বাবা তাদেরকে আমাদের বাড়ি এনে খাইয়ে ছিলেন। আর আমাদের ইচ্ছের কথা তাদের জানিয়েছিলেন। তারাও কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন যে তোকে পেলে আমাদের হাতেই তুলে দেবেন। রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম আমরা সবাই। ঠাকুর যেন তোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল। তোকে আর আমরা কেউ খুঁজে পেলাম না। একসময় পুলিশের খাতাতেও তোদের কেস ফাইল চাপা পড়ে গেল। আমাদের বিয়ের দু’দিন পরেই তো মা বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বাবা তার শেষ কথায় আমাকে আর ভাইকে বলেছিলেন যে তুই একদিন না একদিন ঠিক আমাদের কাছে ফিরে আসবি। আর সেদিন আমরা যেন তোকে খুঁজে বের করে ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে দিই। কিন্তু এতগুলো বছরেও তোর কোন হদিস আমরা পাইনি। ভাই চাকরি পেয়ে নর্থ বেঙ্গলের একটা জায়গায় চলে গেল। আমিও শান্তুর সাথে কালিয়াগঞ্জ থেকে কোলকাতা চলে এলাম। পাঁচ বছর পর ভাইও হুগলী কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কলকাতায় ফিরে এল। আমাদের বাড়িটা বেচে দেওয়া হল। এখানে বাড়ি বানানো হল। চার বছর আগে এ বাড়িতে আসবার পর থেকে আমি ভাইকে বোঝাতে শুরু করলাম যে তোকে আর আমরা ফিরে পাব না। ও যেন অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতে। কিন্তু আমার আর শান্তুর হাজার বোঝানো সত্বেও ভাই কিছুতেই রাজি হয়নি। ও জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তোর জন্যে অপেক্ষা করে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিল। তোকে না পেলে আজীবন অবিবাহিত থাকবে বলে শপথ নিয়েছিল। আমি আর শান্তুও হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম একটা সময়। মাস দুয়েক আগে ……”

শেফালী একটা বড় ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঝুনুদি তার কথা থামাল। শেফালীর পেছন পেছন আরেকজন সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম। সে ভদ্রমহিলাও ট্রে হাতে নিয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, “দিদি, তোমাদের জন্যে একটু চা করে আনলাম। ওপরেও দু’কাপ দিয়ে এসেছি তোমার ভাইদের।”

ঝুনুদি ভদ্রমহিলার হাত ধরে বলল, “ইশ, তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি গো লিপি। তোমাকে একা একা রান্নার সমস্ত কিছু দেখতে হচ্ছে। কিন্তু আমার যে কিচ্ছু করার নেই গো। আমাকে যে এদিকে একটু থাকতেই হচ্ছে। একটু কষ্ট করে সামলে নিও প্লীজ।”

লিপি নামের ভদ্রমহিলা সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বলল, “দিদি, তুমি এমন করে কেন বলছ বল তো? টুপুদার এমন একটা খুশীর দিনে আমরা সামিল না হয়ে থাকতে পারি। বল?”

সবার শেষে আমার সামনে এসে আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়েই লিপি আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “হুঁ, এবার বুঝতে পেরেছি। টুপুদা কি এমনি এমনি ভীস্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিল? ইশ এমন রূপসী এক প্রেমিকাকে কোন মানুষ কি ভুলতে পারে? সত্যি গো দিদি। টুপুদার প্রেমের জোর আছে গো, মানতেই হবে।”

আমি লিপির কথা শুনে একটু লজ্জা পেতেই ঝুনুদি বলল, “রুমু, এ হচ্ছে লিপি। মানে লিপিকা সেন। টুপুর অফিসের কলিগ আর আমার ছোট ভাইয়ের মত বিদ্যুৎ সেনের বৌ। বিদ্যুতের সাথেও তোর পরিচয় হবে। এই বিদ্যুতের মুখেই আমরা তোর খোঁজ পেয়েছিলাম তিনমাস আগে। লিপি অবশ্য বয়সে তোর থেকে বেশ ছোট। তুই ওকে নাম ধরেই বলবি আজ থেকে। ওরাও আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ আর হিতৈষী।”

আমি হাতজোড় করে লিপিকে নমস্কার করতেই লিপি আমার হাতদুটো ধরে বলল, “বয়স যার যাই হোক না কেন, আমি কিন্তু তোমাকে টুপুবৌদি বলে ডাকব। কিন্তু তোমার সাথে আমি আজ আর আড্ডা দিতে পারব না। রান্না কিছুটা এখনও বাকি আছে। আমি কাল তোমার সাথে চুটিয়ে গল্প করব। আসছি গো দিদি”

বলে লিপি চলে গেল। শেফালীও লিপির পেছন পেছন বেরিয়ে গেল।

ঝুনুদি এক চুমুক চা খেয়ে বলল, “নাহ, মেয়েটা ঠিক সময়ে চা নিয়ে এসেছে রে। গলাটা শুকিয়ে আসছিল আমার। তা হ্যাঁ রুমু, তারপর শোন। সেটা বোধহয় ভাইয়েরই ভালবাসার জোর। মাস তিনেক আগে এই লিপির বর বিদ্যুৎ এসে আমাকে জানাল যে ঠিক তোর মতই দেখতে একটা মেয়ের ছবি সে আরেকজনের কাছে দেখে এসেছে। আর সে মেয়েটার নাম নাকি মিনু। ওর মুখে শুনলাম তার পরিচিত কোন এক সামন্তর ফার্ম হাউসে তুই নাকি আসছিস। বিদ্যুতের মুখে সব ঘটনা শুনে আমাদের মনটা সেদিন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে তুই বেঁচে থাকলে তোর জীবনে যে এমন একটা পরিণতিই হতে পারে, সেটা তো আমরা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। তাই দুঃখ হলেও অবাক ততটা হইনি আমরা। তখন আমরা সবাই মিলে বসে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে তুইই আমাদের হারিয়ে যাওয়া রুমু কি না সেটা আগে কনফার্ম করতে হবে। ভাইও বলল যে তুই যদি সত্যিই আমাদের রুমুই হয়ে থাকিস, তাহলে তোর এমন পরিণতিতেও সে তোকে মেনে নেবে। তখন সবাই মিলে পরামর্শ করে বিদ্যুৎকেই দায়িত্ব দিলাম তোর আসল পরিচয়টা জানতে। আমি আর আমরা সকলেই জানি বিদ্যুতের ও’সব ব্যাপারের সাথে কোন সংস্পর্শ নেই। তাই অমন পরিবেশে ওকে পাঠাতে একটু ভয়ও হচ্ছিল আমার। কিন্তু সে ভয় দুর করে দিল লিপি। লিপি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল যে বিদ্যুৎকে কিভাবে কী করতে হবে তা সে নিজেই তাকে শিখিয়ে দেবে। কিন্তু বিদ্যুৎ তোকে কী করে চিনতে পারবে সেটা বুঝিয়ে দিতে বলল। তোর বাঁ কানের লতির কাছে যে একটা কালো তিল আছে, সেটা আমার জানাই ছিল। আমি বিদ্যুৎকে সেটার কথা বললাম। তারপর ওই ফার্ম হাউসে তুই যেদিন সামন্তর কাছে গিয়েছিলি সেখানে কি হয়েছিল তা তোর জানাই আছে। সেদিন রাত দশটা নাগাদ বিদ্যুৎ এসে তার মোবাইলে তোর ছবি দেখিয়ে যখন জানাল যে আমার দেওয়া আইডেন্টিফিকেশন মার্কটা মিলে গেছে তখন আমি আর ভাই আবার কেঁদে ফেলেছিলাম”

বলতে বলতে ঝুনুদি আবার ফুঁপিয়ে উঠল।

আমার মনে পড়ল ফার্ম হাউসের ওই রাতের কথা। সেনসাহেব বলে একজন সামন্তবাবুর সঙ্গে ছিল। কিন্তু সে লোকটা আমাকে ছোঁয়ও নি। তার মোবাইলে আমার ছবি উঠিয়েছিল আর আমার মুখটাকে লোকটা কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। সেদিন তার ব্যবহারে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, লোকটা কোন উদ্দেশ্যে সেখানে হাজির ছিল সেদিন।

বিজলীমাসি ঝুনুদিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, “এবার তুমি একটু বিশ্রাম নাও ঝুনু। অনেকক্ষণ ধরে তুমি কথা বলছ। এরপরের কথাগুলো না হয় আমরা বলছি। রাধা এর পরের কথাগুলো তুই বল।”

অনুরাধা পেছন থেকে আমার আরও একটু কাছে সরে এসে বলল, “সেরাতে বিদ্যুৎবাবুর মুখে সব কিছু শুনেই ঝুনুদিরা বুঝতে পেরেছিল যে তুমিই তাদের রুমু। আর সে রাতেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আর সময় নষ্ট না করে তারা তোমার ঠিকানা খুঁজে নিয়ে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। পরের দিনই বিদ্যুৎবাবু সামন্তর কাছ থেকে মাসির বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়েছিল। কিন্তু অমন একটা বেশ্যাপল্লীতে যাবার মত সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছিল না এরা কেউ। আর অমন পরিবেশ থেকে তোমাকে বাইরে বের করে আনতেও নানা ধরণের ঝামেলা হতে পারে ভেবে তারা কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এর প্রায় মাস দেড়েক বাদে হঠাৎ একদিন টুপুর সাথে আমার দেখা হল মেদিনীপুরে। ও কোন একটা কাজে সেখানে গিয়েছিল। টুপুর ওপর যে একসময় আমার লোভ ছিল সে তো তোমাকে আগেই বলেছি। আর টুপু যে তোমাকেই ভালবাসত, আর তোমাকেই খুঁজে যাচ্ছিল, এ’কথাও তো আমার অজানা ছিল না। আমি ওর সাথে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তোমার কোনও খোঁজ পেয়েছে কি না। তখন প্রথমে ও বলতে না চাইলেও অনেক জোরাজুরির পর আমাকে বলেছিল যে তুমি বিজলীমাসির বাড়িতে আছ। কিন্তু তোমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসবার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। জগা দালালের মুখে আমি বিজলীমাসির নাম আগেই শুনেছিলাম। তখন আমি ওকে বললাম যে আমি ওকে এ ব্যাপারে সাহায্য করব। জগা দালালের মাধ্যমেই আমি সে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছই। কিন্তু কোন বাড়িউলিই যে তাদের কেনা মেয়েকে কারো হাতে ছেড়ে দেয় না এটাও আমার আগে থেকেই জানা ছিল। আর তোমার মত সুন্দরী একটা মেয়েকে যে মাসিও সহজে ছেড়ে দেবে না, সেটা নিয়েও মনে একটা দুশ্চিন্তা ছিলই। আমার প্রথম কাজ ছিল তুমিই আমাদের রুমু কি না সেটা নিশ্চিত করা। সেটা তো ও বাড়িতে যেদিন গিয়ে উঠেছিলাম, সেদিনই হয়ে গিয়েছিল। আরও দুটো কাজের দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। আমার দু’নম্বর কাজ ছিল তোমার মানসিকতাটা জানা। টুপুর জীবনে তুমি আসতে রাজি আছ কি না, সেটা বোঝা। চেষ্টাও করেছি তা জানার। কিন্তু তোমার মনের ভেতর যে কতটা দ্বিধা ছিল সে’কথাও এদের সবাইকে জানিয়েছি আমি। আর তৃতীয় কাজটা ছিল তোমাকে মাসির ওই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসা। সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে কঠিণ কাজ। সেটা নিয়েই প্ল্যান করছিলাম আমরা। কিন্তু মাসি নিজেও যে তার ছোটবেলায় তোমাদের বাড়িতে থাকত এটা তো আমার জানা ছিল না। আমি যাবার পরের দিনই তো ডক্টর ঘোষালের চেম্বারে ফুল চেকআপ করতে গিয়েছিলাম আমরা দু’জন। সেদিন ডক্টর ঘোষালের ফোন নম্বর নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম শান্তুদাকে। শান্তুদা তারপর ডক্টর ঘোষালের কাছ থেকে মাসির ফোন নাম্বার জেনে নিয়েছিলেন। মাসির সাথে ফোনে কথা বলে তিনি জানতে পারলেন যে নগদ দশ লাখ টাকা পেলে মাসি তোমাকে তাদের হাতে তুলে দেবে…….”

এমন সময় মাসি অনুরাধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আহা, এটা তো বলবি যে আমি তখনও রুমুর আসল পরিচয়টা জানতাম না। আমি যদি সেটা জানতুম তাহলে কি আর




[/HIDE]
 
[HIDE]



(#৫২)

বিজলীমাসির কথার মাঝপথেই অনুরাধা তাড়াতাড়ি বলল,”হ্যাঁ হ্যাঁ মাসি বলছি। কিন্তু একটু গুছিয়ে না বললে রুমুদি তো ঠিক মিল খুঁজে পাবে না। হ্যাঁ রুমুদি। মাসি তখনও জানত না যে তুমি তার নীলু জেঠুর মেয়ে। কারন সে যখন তোমাদের বাড়ি থাকত তখন তো তোমার আর তোমার ছোড়দা অভির জন্মই হয় নি। আর তাছাড়া তুমি তো মাসিদের বাড়ি যাবার আগে থেকেই মিনু হয়ে গিয়েছিলে। আর মাসিকেও তুমি কখনও নিজের আসল পরিচয়, নিজের অতীতের কথা বা মা বাবার কথা বলনি।

তাই শান্তুদা যখন তোমাকে ফিরে পাবার বিনিময়ে পয়সা দেবার কথা বলেছিলেন তখনও কিন্তু মাসি তোমার আসল পরিচয় জানতে পারেনি। তাই ব্যবসায়িক কথা বার্তাই বলেছিল। আমি ও বাড়িতে যাবার পরের দিন রাতেই তুমি মাসির ঘরে তোমাদের বাড়ির ওই দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ করেছিলে। মাসি তখনই বুঝেছিল যে গজানন তোমার পরিবারের সবাইকে মেরে তোমাকে কিভাবে সর্বসান্ত করেছিল। সেদিন রাতেই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে গজাননকে তার পাপের শাস্তি দেবে। আর তোমাকে বেশ্যাবৃত্তি থেকে সে চিরতরে নিষ্কৃতি দেবে। কিন্তু তখনও মাসি তোমার আসল পরিচয় জানতে পারেনি। তুমিই যে তার নীলু জেঠুর মেয়ে এটা সে তখনও বুঝতে পারেনি। শান্তুদা যেদিন তাকে এ বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল সেদিনই সে বুঝতে পেরেছিল তুমি তার নীলু জেঠুর মেয়ে। সেদিন মাসি এ বাড়িতে এসে ওই ছবিটা দেখে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। তোমার বারোটা বছরের দুর্ভোগের কথা ভেবে মাসি সেদিনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল যে তোমাকে সে বিনে পয়সাতেই শান্তুদার হাতে তুলে দেবে। শান্তুদা টুপু আর ঝুনুদিকেও সে সেদিনই কথা দিয়েছিল যে তোমাকে সে তাদের হাতে যে করেই হোক তুলে দেবে। তোমার মুখ থেকে সেদিন রাতে তোমাদের ওই দুর্ঘটনার কথা জানতে পেরে আর পরদিন তোমার ঘরে বসে তোমার সবটুকু কথা শোনার পর মাসি শান্তুদাকে ফোন করে বলেছিল যে সে তার সাথে দেখা করতে চায়। শান্তুদা সেদিন তাকে এ বাড়িতেই ডেকে পাঠিয়েছিল। সেদিন ঝুনুদি আর শান্তুদার সাথে কথা বলে মাসি তোমার আসল পরিচয় জানতে পেরে আর তোমাদের সকলের ছবি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তখনই মাসি ঝুনুদি আর শান্তুদাকে কথা দিয়ে যায় যে তোমাকে পরের রবিবারেই তাদের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলে মাসি যখন জানতে পারল যে তুমি মাসির বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে রাজি নও, তখন সে মনে মনে ভাবল তোমাকে কিছুটা সময় দিতে হবে। তাই সেই রবিবারে তোমাকে এখানে নিয়ে আসার প্ল্যান ক্যানসেল করে ঝুনুদি আর শান্তুদাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর সেদিন থেকেই তোমার ঘরে খদ্দের পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। আর সেদিন থেকেই আমি আর শ্যামলীদিও মাসির দলে ভিড়ে গিয়েছিলাম। আমিও টুপুর কাছ থেকে সব খবর পেতাম। মাসির কাছে তখন আমিও আমার পরিচয় দিয়ে বললাম যে আমিও চাই তুমি যেন টুপুর কাছে ফিরে আসো। তারপর থেকে মাসি আমি আর শ্যামলীদি মিলে তোমার সাথে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছিলাম। শান্তুদা আর টুপুর অনুরোধে মাসি সেদিন থেকেই তোমার কাছে আর কোন খদ্দের পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। তোমার শরীরের ফাঙ্গাল ইনফেকশন শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে তোমাকে আমরা এতদিন যা কিছু বলেছি তার পুরোটাই পুরোপুরি মিথ্যে কথা ছিল। কিন্তু তোমার ঘরে মাসি কেন খদ্দের পাঠানো বন্ধ করবে তার তো একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ থাকতে হবে। তাই ও’সব কথা বলা হয়েছিল। তুমি আজও যেমন ফিট আছ, তখনও তাই ছিলে। মাঝে মধ্যে টুপুর কথা উত্থাপন করে আমি তোমাকে বাজিয়ে দেখেছি। বুঝতে চেষ্টা করেছি যে টুপুর প্রতি তোমার মনোভাব কেমন। তুমি টুপুর জীবনে আসতে চাও কি না। খুব একটা লাভ হয়নি। আমি যে মাঝে মধ্যে সকালের দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতাম সেটা তো তুমি জানো। কিন্তু তোমাকে আমরা সবাই বলেছিলাম যে আমি ক্লায়েন্টের কাছে যেতাম। কিন্তু আসলে আমি এখানে টুপু, শান্তুদা আর ঝুনুদির সাথে শলা পরামর্শ করতে আসতাম। মাঝে মাঝে মাসিও আমার সাথে আসত। কিন্তু তোমার কাছে সে’সব গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারন তুমি আমার আর মাসির কথায় কিছুতেই রাজি হচ্ছিলে না। তখন আমরা সবাই ভাবলাম যে তুমি হয়ত তোমার ওই ভুয়ো অসুস্থতার কথা ভেবেই পিছিয়ে যাচ্ছ। তখন ভাবলাম, তুমি যদি জানতে পার যে তোমার কোনরকম শারিরীক অসুস্থতা নেই, আর টুপু তোমার জন্যেই বারোটা বছর ধরে অপেক্ষা করছে, তাহলে হয়ত তুমি টুপুর কাছে আসতে রাজি হলেও হতে পার। তাই পরের বার শান্তুদার ওই নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে তার সাহায্যেই ও’সব টেস্ট ফেস্ট করা হল। ওদিকে মাসিও তোমাকে এমনভাবে বোঝাতে শুরু করেছিল যে তুমি ভেবে নিয়েছিলে যে তোমার মতের তোয়াক্কা না করেই মাসি তোমাকে কারো হাতে বেচে দিতে চাইছে। তাই নিরূপায় হয়ে তুমিও সেটাকেই তোমার ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছিলে। কিন্তু সবরকম লুকোচুরির অবসান ঘটিয়ে আমরা আজ শান্তুদার প্রাইভেট চেম্বারে আসবার নাম করে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আর আমাদের সকলেরই ধারণা ঝুনুদি আর টুপুকে দেখে, তাদের সব কথা শুনে তুমি কিছুতেই আর আমাদের সবার অনুরোধ ফেলতে পারবে না।”

শ্যামলীদি এবার প্রথম মুখ খুলল। সে পেছন থেকে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “হ্যাঁরে মিনু। রাধা একদম সত্যি কথা বলছে। এতদিন বাধ্য হয়েই তোর কাছে আমরা এ’সব কথা গোপন রেখেছিলাম। কিন্তু আজ তো বুঝতে পারছিস যে আমরা তোর ভালোর কথা ভেবেই এ’সব করেছি। দ্যাখ বোন, গজাননের হাতে থাকতেই তো নিজেকে মেরে ফেলেছিস মনে মনে। আর ধান্দাই বলি বা ব্যবসাই বলি, আমাদের ও বাড়িটায় থেকে তোকে দশটা বছর ধরে যা কিছু করতে হয়েছে, তা তোর মত ভদ্র পরিবারের মেয়ের কাছে নরক যন্ত্রণার সমান। আমরা তো সবাই ওই নরকের কীট। ওই নোংরা কুয়োর মধ্যেই আমাদের সাঁতরে বেঁচে থাকতে হবে সারাটা জীবন। কিন্তু ডাক্তার বাবুর গোটা পরিবারটাই যখন তোকে আপন করে নিতে চাইছে, তোকে সেই নরক থেকে উদ্ধার করতে চাইছে, আর মাসিও যখন তোকে স্বেচ্ছায় একটা ভালো জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাইছে, তখন তুই আর এতে আপত্তি করিস না বোন। আমাদের সকলের অনুরোধটা মেনে নে।”

আমি সকলের কথা শুনে দিশেহারা বোধ করছিলাম। কী করব, কী বলব কিছুই যেন বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় বিজলীমাসি আবার বলল, “মিনু, তোকে তো আমি আগেই কথা দিয়েছি যে তুই নিজের ইচ্ছেয় আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে না চাইলে আমি কখনও তোকে তাড়িয়ে দেব না। এখনও তোকে আমি একই কথা বলছি। আজ এতসব কিছু জেনে বুঝেও তুই যদি আমার ওই বাড়িতেই থাকতে চাস, আমি তাতেও তোকে বাঁধা দেব না। কিন্তু এতদিন তুই যেভাবে ছিলি, সেভাবে আর থাকতে পারবি না। তোর ঘরে কক্ষনো কোন খদ্দের ঢুকতে দেব না আমি। তোর সাথে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক তো নেই। কিন্তু নীলু জেঠুকে আমি আমার বাবার মতই শ্রদ্ধা করতাম। তাই তুই তো আমার বোনই হলি। তোর দাদাকে আমি কোলে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। এতদিন তো না জেনে আমি আর মা দু’জনেই অনেক পাপ করে ফেলেছি। ভেবেছিলাম ঝুনু আর ডাক্তারবাবুর হাতে তোকে তুলে দিলে আমাদের পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয়ত করতে পারব। কিন্তু তুই তাতে রাজি না হলে আমি তো তোর ওপর আর অবিচার করতে পারব না। তোকে আমার সাথেই ফিরিয়ে নিয়ে যাব। আমার বাড়িতেই তোকে সারাজীবন আটকে রাখব আমি। কিন্তু এখন যখন আমি জেনে গেছি যে তুই আমার নীলু জেঠুর মেয়ে, আগের মত তোকে আর আমার ব্যবসার কাজে নামাতে পারব না। গত দু’ আড়াইমাস ধরে তুই যেভাবে একা একা ঘরে বসে সময় কাটিয়েছিস, সারাজীবন তোকে এভাবেই থাকতে হবে।”

আমি মাসির কথা শুনে তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বললাম, “মাসি ……”

বিজলীমাসি ধমক দিয়ে বলল, “চুপ। মাসি বলে ডাকবি না, এ’কথা আর কতবার বলতে হবে? আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা। তোর মনে একটা ভয় ছিল যে তুই যেখানেই যাবি গজানন তোর পিছু ছাড়বে না। আমিও সেটাই বিশ্বাস করতাম। নইলে এই দু’মাস আমি অপেক্ষা করতাম না। আরো আগেই তোকে এদের কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু এখন তো আর গজানন তোকে জ্বালাতে পারবে না। সে তো চিরতরে এ দুনিয়া থেকে সরে গেছে। এখন আর তোর ভাবনা কিসের রে বোন? এখন তুই মুক্ত। আজ থেকে তোর জীবনে না কোন গজানন থাকবে, না থাকবে কোন বিজলীমাসি। এখন থেকে তোর জীবনে থাকবে টুপু, ঝুনু, ডাক্তার বাবু আর তাদের ওই ছোট্ট মিষ্টি ফুটফুটে ছেলেটা আদি। এনারা সকলে যখন তোকে আদর করে কাছে টেনে নিতে চাইছে, তুই আর আপত্তি করিস না বোন। আমি তোর দুটি পায়ে পড়ি। আমাকে তোর বাবা মার কাছে আর বেশী অপরাধী করে তুলিসনা রুমু। এদের সকলের কথা মেনে নে লক্ষ্মী বোন আমার। আর একবার আমাকে দিদি বলে ডাক। তোর মুখের দিদি ডাক শুনলেই আমার মনে হবে নীলু জেঠু আর জেঠীমা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন”

বলে বিজলীমাসি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

আমিও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। পেছন ফিরে বিজলীমাসিকে বুকে জড়িয়ে ধরে “দিদি” বলে কেঁদে ফেললাম।

অনেকক্ষণ কাঁদবার পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “ঝুনুদি, আমি একবার তোমাদের ড্রয়িং রুম থেকে ঘুরে আসছি।”

ঝুনুদি আমার হাতটা ধরে বলল, “তোকে যেতে হবে না। কি চাই তোর বল। আমি এনে দিচ্ছি। না কি টয়লেটে যাবি?”

আমি দুর্বল গলায় বললাম, “না গো ঝুনুদি, টয়লেট নয়। ওই ছবিটা আরেকটু দেখব আমি।”

ডক্টর মুখার্জি সাথে সাথে উঠে গেলেন। ঝুনুদি বিজলীমাসির হাত ধরে বলল, “আপনি আর আপনারা সকলে এভাবে আমাদের সাহায্য না করলে আমরা রুমুকে ফিরে পেতাম না। এবার রুমুকে পেয়েও যদি হারাতে হত তাহলে আর আমার ভাইটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম না আমি। আপনাদের সকলের কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। বিজলীদি টাকা যে আপনি নেবেন না সেটা তো আগেই বলে দিয়েছেন। তবু বলে রাখছি যে কোনও সময়ে যে কোনও কারনে যদি আমাদের কারুর সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে একেবারে নির্দ্বিধায় আমাদের এখানে চলে আসবেন, বা একটা ফোন করবেন।”

ডক্টর মুখার্জি ফটোফ্রেমটা নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “রুমু, এ বাড়িটার আসল মালিক টুপু হলেও আমাকেই এ বাড়ির অভিভাবকের দায়িত্বে রাখা হয়েছে। সেই অধিকারেই একটা কথা তোমাকে বলছি। এই ছবিটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকো। তোমার মা বাবা দাদাদের আশীর্বাদ অনুভব করতে পারবে। মনে মনে তাদের তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ তোমার কী করা উচিৎ। আমার মনে হয় তাদের নির্দেশও তুমি অনুভব করবে।”

আমি ডক্টর মুখার্জির হাত থেকে ছবিটা নিয়ে সেটার দিকে তাকাতেই মা বাবা দাদাদের হাসি মুখ গুলো দেখতে পেলাম। বড়দা নতুন ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে এনেছিল সেবার। নিচের তলায় বাবা মা-দের বেডরুমেই ছবিটা ওঠানো হয়েছিল। একবারে মধ্যিখানে আমি। আমার বাঁ পাশে বাবা আর ডান পাশে মা। মার ডানদিকে ছোড়দা দাঁড়িয়েছিল। সেলফ টাইমার সেট করে বড়দা ছুটে এসে বাবার বাঁ পাশে দাঁড়িয়েছিল। ছোট্ট ডিসপ্লে মনিটরে ছবিটা খুব ঝকঝকে দেখাচ্ছিল। সবাই সেটা দেখে খুব খুশী হয়েছিল। মা তখনই বড়দাকে বলেছিলেন ‘বড়খোকা, ছবিটা বড় করে ছাপিয়ে বাঁধিয়ে আনিস তো। ড্রয়িং রুমের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখব। খুব সুন্দর লাগবে দেখতে’।

মা-র সে কথাগুলো যেন এখনও আমার কানে বাজছে। চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এল। নিজের অজান্তেই ছবিটাকে বুকে চেপে ধরে চোখ বুজলাম।

বারোটা বছর পর এই প্রথম বাবা মা আর দাদাদের ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। চোখ বুজে থেকেই মনে হল বাবা যেন আমায় বলছেন ‘ভাল আছিস মা? কতদিন পর তোকে দেখছি আজ। সুখে থাকিস তুই’। মা-ও যেন বলছেন ‘টুপুর মত ভদ্র ছেলে আমাদের শহরে আর একটাও নেই। রমেনদা আর সোনাবৌদি রাজি হলে টুপুর সাথেই তোর বিয়ে দেব, দেখিস’।

এমন কথা মা বেঁচে থাকতেও দু’একদিন আমায় বলেছিলেন। টুপুকে আমারও খুব ভাল লাগত। তবে নিজের প্রেমিক বা স্বামী হিসেবে ওকে কখনোই ভাবিনি। টুপুর চেহারা আমার মনে পড়ছে না। শুধু ওর ভাসা ভাসা দুটো চোখে সরু সোনালী ফ্রেমের চশমাটার কথাই মনে পড়ছে।

টুপু দেখতে কেমন? এতক্ষণে একটি বারও তো ওকে দেখতে পেলাম না। আদি একবার বলেছিল ওর মামু ওপরের ঘরে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল। কিন্তু সে তো একটি বারও আমাকে দেখতে এল না। ওদের বাড়ির ছাদের ওপর পায়চারি করতে করতে ও প্রায়ই আমার জানালার দিকে তাকাতো। কিন্তু ও যে মনে মনে আমাকে এত ভালবাসত তা তো আমি ভাবতেই পারিনি।

মনে আছে মা-র সাথে যেদিন আমি প্রথম সেক্স করেছিলাম সেদিন অসংলগ্ন অবস্থায় টুপুর সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। আমার খোলা বুকটা বোধহয় টুপু সেদিন দেখেও ফেলেছিল। তারপর ছোড়দার সাথেও আমার রুমেই বেশ কয়েকবার সেক্স করেছি। অবশ্য আমার সেক্স লাইফ শুরু হবার কয়েকমাস বাদেই মা আমাকে সচেতন করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমার ঘরে আর কারুর সাথে সেক্স করিনি। তবে বড়দা যেদিন প্রথমবার আমায় করেছিল সে রাতেও তো আমার ঘরেই সে ঘটনাটা ঘটেছিল।

টুপুকি কখনো সে’সব দেখেছিল? আর সে’সব দেখার পরেও কি আমাকে এমনভাবে ভালবাসতে পেরেছিল ও? ওই চরম সর্বনাশের দিন টুপুর সাথে ওদের বাড়ির ছাদের ওপরে গিয়ে দেখেছিলাম যে ওদের ছাদের একটা জায়গা থেকে আমার ঘরের ভেতরের অনেকটা অংশই দেখা যাচ্ছিল। সেখান থেকে বড়দা বা ছোড়দার সাথে আমাকে কিছু করতে দেখেনি তো সে? মা তো টুপুর সাথে আমার বিয়ে দিতেই চাইতেন। বেশ কয়েকবার এমন কথা আমাকেও বলেছেন তিনি। কিন্তু সেটা হবার নয় জেনেই বোধহয় আমি ওকে নিয়ে কিছু ভাবিনি। কিন্তু শান্ত শিষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার টুপুকে দেখতে খুব ভালই লাগত।

আর আমার বাবা আর রমেন কাকুও যে আমাদের দু’জনের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন সেটা তো আমি কখনো জানতে পারিনি। অবশ্য সেটা তো ওই শেষ দিনের ঘটনা। বাবা হয়ত মাকেও সে’কথাটা বলতেই পারেননি। সে রাতেই তো সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে আলোচনার সময় আর যারা উপস্থিত ছিলেন, তারাও তো আর কেউ বেঁচে নেই। ঝুনুদির কথার সত্যাসত্য প্রমাণ করবার আর কেউ নেই।

তবে ঝুনুদি তো নিশ্চয়ই আমাকে মিথ্যে কথা বলবে না। আর এই ছবি গুলো? বারো বছর ধরে এত যত্ন করে আমাদের সকলের ছবি রাখবার মানে কি? বিদ্যুৎবাবু আমার ছবি দেখেই কী করে চিনতে পেরেছিলেন আমাকে? সেদিন ফার্ম হাউসে সেনবাবু নামের ওই লোকটা ছুটে পালিয়ে যাবার পর আমি মনে মনে অবাক হয়েছিলাম। সেই সেনবাবুই যদি এই বিদ্যুৎ হয়ে থাকে, তাহলে তার অমন আচরনের পেছনের কারনটা আজ বোঝা যাচ্ছে। আর সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বিদ্যুৎ যে এ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো ছবিটা অথবা টুপুর ঘরে কিংবা তার মানিব্যাগে রাখা আমার ছবি দেখেই আমাকে সেদিন চিনতে পেরেছিলেন, সে ব্যাপারে তো আর সন্দেহ নেই।

ছবিটা বুকে চেপে ধরে আমি চোখ বুজে এ’সব কথা ভাবতে ভাবতে আমার বন্ধ চোখের পাতা ছাপিয়েই দরদর করে জল বেরোতে লাগল। ঘরের মধ্যে কেউ কোন শব্দ করছিল না। ছবিটাকে বুকে চেপে ধরেই আমি মনে মনে ভাবলাম এখন আমার করণীয় কী? এদের সকলের অনুরোধ মেনে এ বাড়িতে আসা আর টুপুর জীবনে দাখিল হওয়া কি ঠিক হবে? যদি আমি এ প্রস্তাবে রাজি না হই তাহলে আমার পরিণতি কী হতে পারে? বিজলীমাসি তো স্পষ্টই বলে দিল যে আমাকে দিয়ে সে আর বেশ্যাবৃত্তি করাবে না। তাহলে দিনের পর দিন ওই বাড়ির ওই ঘরটার ভেতরেই তো আমাকে একঘরে হয়ে থাকতে হবে। সেটাই কি খুব সহনীয় ব্যাপার হবে? ঘরে খদ্দের আসবে না বলে রোজ দুপুরের পর থেকে আমাকে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত একা বসে থাকতে হবে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হয়ত বিজলীমাসি, শ্যামলীদি, অনুরাধা বা অন্যান্য মেয়েরাও আমার ঘরে আসতে পারে। কিন্তু দুপুরের পর থেকে ন’ দশ ঘণ্টা তো আমাকে একাই কাটাতে হবে

না, সেক্সের কথা নিয়ে ভাবছি না। গত বারোটা বছর ধরে হাজার হাজার খদ্দেরের সাথে সেক্স করলেও নিজের ভেতরে সেক্সের তাগিদ বলতে সত্যিই কিছু ছিল না। গত দু’মাস ধরে তো পুরোপুরি সেক্স বিহীন জীবনই কাটিয়ে আসছি। কৈ, তেমন কোন অসুবিধে হয়েছে বলে তো মনে হয়নি আমার। তাই সেক্স ছাড়া সময় কাটাতে কোন অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কোন কাজ ছাড়া বিজলী মাসির একটা ঘর দখল করে বসে থাকব, তারা আমার খাওয়া পড়ার বন্দোবস্ত করে যাবে দিনের পর দিন, সেটাই কি আর মেনে নেওয়া যায়? তারা আমাকে খাওয়াবে পড়াবে অথচ তাদের কোন কাজে আমি লাগব না। এমন পরগাছার মত জীবন কতদিন কাটাতে পারব?

আর যদি এদের সকলের প্রস্তাব মেনে নিই, তাহলে এমন একটা পরিবারে এসে আমি অনেক সুখে থাকতে পারব। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। হলই বা টুপু আমার চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। এ পৃথিবীতে স্ত্রীর চেয়ে বয়সে ছোট স্বামী তো অনেকই আছে। তারা সকলেই সুখে সংসার করছে। মা বলতেন, সাংসারিক জীবনে কে কতটা সুখী হবে সেটা নির্ভর করে নিজেদের স্বভাব আর পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর। পরিবারের আর সকলের মানসিকতা বুঝে তাদের ভালমন্দ তাদের পছন্দ অপছন্দ গুলোকে যে নিজে মন থেকে মেনে নিতে পারে, সে-ই সুখী হয়। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপরেই সংসারের শান্তি অশান্তি নির্ভর করে। সেখানে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বয়সের স্বাভাবিক ফারাক না থাকলেও, বা অস্বাভাবিক ফারাক থাকলেও কিছু এসে যায় না। মা বলতেন আমার বিয়ে হলে আমি নাকি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে খুব সুখী হব। কারন আমার মধ্যে সবাইকে মেনে নেবার মত একটা মানসিকতা আছে। তাই স্ত্রী হিসেবে আমি যে কোন পুরুষকেই সুখী করতে পারব। যে কোন পরিবারের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠতে পারব।

মা হয়ত ঠিকই বুঝেছিলেন। গত বারোটা বছরে নিজের শরীরটা বিলিয়ে দিতে মনের সায় না থাকলেও আমি কাউকে কোন কাজে বাধা দিইনি। অবশ্য বাধা দেবার মত সাহসও তো আমার ছিল না। যখন যে পরিস্থিতিতে পড়েছি তাকেই নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছি। এ বাড়িতে টুপুর স্ত্রী হিসেবে এসেও আমি যে সকলের সাথে মানিয়ে চলতে পারব তাতে আমার মনে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু নিজের স্বার্থ, নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে আর পাঁচটা লোককে সমাজের চোখে ছোট করে তুলতেও যে মন থেকে সায় পাচ্ছি না।

টুপু, ঝুনুদি, ডক্টর মুখার্জি, ঝুনুদির ছোট্ট ছেলেটা আদি এরা সকলে আমাকে যতই আপন করে নিক না কেন, গত বারোটা বছর ধরে আমি যে জীবন কাটিয়ে এসেছি তার কালো ছায়া কি এদের ওপরেও এসে পড়বে না? গত বারো বছরের মধ্যে যারা আমার দেহটাকে ভোগ করেছে তাদের কারুর সাথে কি আর আমার মুখোমুখি হবে না কখনো? তখন টুপু, ঝুনুদি, ডক্টর মুখার্জিরা পরিস্থিতির মোকাবিলা কি করে করবে?

আমার তো মান সম্মান বলতে কিছুই নেই। কিন্তু টুপু, ডক্টর মুখার্জি, বিদ্যুৎ- এরা সকলেই তো নিজ নিজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের সকলেরই সুন্দর সামাজিক প্রতিষ্ঠা আছে। আমার মত একটা বারবনিতাকে তাদের ঘরের বৌ করে তুলে তারা কি করে নিজেদের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে পারবে? আমি যখন তাদের সাথে পথে ঘাটে বেরোব তখন আমার পুরোন খদ্দেররা আমাকে চিনে ফেললে? তারা যদি অসম্মানজনক কোনও মন্তব্য করে বসে, তখন এদের সম্মান হানি হবে না? শুধু নিজের স্বার্থের জন্য তাদের সকলকে পদে পদে অপমান হতে বাধ্য করে ফেলব আমি!

না না, এ কিছুতেই হতে পারে না। মানছি, টুপু আমাকে অনেক আগে থেকেই মনে মনে ভালবাসত। আমিও হয়ত শুরুতে একটু জড়সর থাকব। ওকে প্রেমিকের মত ভালবাসতে হয়ত কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। তারপর আমিও ওকে স্বামী বলে ভাবতে পারব। ওর সব রকম চাহিদা পূরণ করে ওকে সুখী করতে চেষ্টা করব। হয়ত সে কাজে সফলও হব। কিন্তু আমার জন্য ওকে যদি কখনও অসম্মানিত হতে হয়, সেটা কি আমি নিজেই সহ্য করতে পারব? না না, এ আমি কিছুতেই পারব না। বিনা দোষে এদের সকলকে আমি অতখানি বিপদের মুখে ফেলতে পারি না।

হঠাৎ মনে হল মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললাম, ‘আমি কী করব মা? কী করা উচিৎ আমার? আমি যে কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তুমি আমাকে বলে দাও মা। তুমিই যে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু সব থেকে বড় হিতৈষী আমার’। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, ‘এমন পাগলামো করছিস কেন রুমু সোনা? টুপুকে যে আমিও মনে মনে আমার জামাই করতে চেয়েছিলাম রে। আমি জানি ও তোকে খুব ভালবাসবে। তোকে সারাজীবন সুখে রাখবে। টুপুর মত ভাল ছেলে আর একটাও দেখিনি আমি। ওর মানসিক শক্তিও খুব প্রবল। তোকে ও যেমন মন থেকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে, তেমনি তোর জীবনের সমস্ত কালিমাকেও ও নিজের ভালবাসা দিয়ে ধুইয়ে দেবে। সব রকম প্রতিকূলতার মোকাবিলা করার ক্ষমতা ওর আছে। ওর ভালবাসায় তুই খুব শিগগীরই নিজের কালো অতীতটাকে ভুলে যেতে পারবি। তুই যেমন বারোটা বছর ধরে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছিস, টুপুও তেমনি তোকে দেখতে না পেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছে। টুপু তোর গত বারো বছরের সব কিছু জেনেও তোকে স্ত্রীর মর্য্যাদা দিতে চাইছে। কত বড় মনের মানুষ হলে কেউ এমনটা করতে পারে। তুই আর একদম অন্য কিছু ভাবিস না। টুপুকে বিয়ে কর। আমি, তোর বাবা, বড়খোকা, ছোটখোকা সবাই এতে খুব খুশী হব। আজ থেকে আর আমাদের মনে তোকে নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। আমরা সবাই চাই, টুপু তোর মাথায় সিঁদুর পড়িয়ে তোকে তার স্ত্রীর মর্যাদা দিক। আমরাও সবাই তোদের দুটিকে প্রানভরে আশীর্বাদ করব। তুই নিশ্চয়ই সুখী হবি মা। আর আমরা সকলেই তো সবসময় তোর পাশে আছি। আমরা তোকে আর দুঃখ পেতে দেব না’।

এমন সময়ে কেউ আমার দু’কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে আমার নাম ধরে ডাকতেই আমি চোখ মেলে চাইলাম। দেখি ঝুনুদি। ঘরে আর তৃতীয় প্রাণী বলতে কেউ নেই। ঝুনুদি তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার গালদুটো মুছে দিতে দিতে বলল, “কিরে? এখনও মনস্থির করতে পারিস নি বুঝি?”

আমি কান্না ভেজা সুরে খুব দুর্বল গলায় বললাম, “জানিনা গো ঝুনুদি। তোমরা সবাই যা বলছ তা মেনে নিতে আমি যে মন থেকে সায় পাচ্ছিনা। আমার মত একটা নষ্টা মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে তোমরা যে সমাজের সকলের চোখেই ছোট হয়ে যাবে, সেটা তোমরা ভেবে দেখেছ?”

ঝুনুদি আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অনেক ভেবেছি রে রুমু, অনেক ভেবেছি। সেই রাতটার পর থেকে বারোটা বছর ধরে রোজই এ’কথা ভেবেছি আমরা। তবে তখন তো তোকে সত্যি সত্যি ফিরে পাব কি না, সেটা নিয়েও আমাদের মনে সন্দেহ ছিল। তিনমাস আগে বিদ্যুৎ যেদিন প্রথম তোর কথা বলেছিল আর তারপর কোন এক ফার্ম হাউসে তোকে দেখে চিনতে পারার পর থেকে বিদ্যুৎ, লিপি, টুপু, আমি আর শান্তু মিলে সম্ভাব্য সব রকম প্রতিকূলতার কথাই আমরা ভেবে দেখেছি। আর সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই বিজলীদি যেদিন আমাদের বাড়ি এসে জানাল যে তোকে আমাদের হাতে তুলে দেবে সেদিন থেকেই নতুন করে ভাববার আর কিছু ছিলনা। এখন ওঠ তো। চল এবার তোকে ওপরে নিয়ে যাই। টুপুটা তোর মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ না শোনা অব্দি শান্ত হবে না। তখন থেকে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে ও। চল, সোনা বোন আমার”

বলতে বলতে আমাকে টেনে ওঠাল। আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে বিছানার ওপরে রেখে আমার পড়নের শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করে দিল। মাথার কয়েকটা অবিন্যস্ত চুল হাতের আঙুল দিয়ে ঠিক করে দিয়ে আমার হাত ধরে বলল, “চল।”

আমি ঝুনুদির হাতটা ধরে বললাম, “বাকিরা সব কোথায় গো?”

ঝুনুদি আমার হাত ধরে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “সবাই ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছে। এখন ভাই ওর ঘরে একা আছে। বিদ্যুৎও ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসেছে। আমি চাই তোরা দুটিতে মুখোমুখি হয়ে একটু কথা বলে নে। আমি তোকে ওর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েই নেমে আসব।”

আমি তার পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই তার একটা হাত চেপে ধরে শান্ত গলায় বললাম, “ঝুনুদি, ছোটবেলায় বাবা আর দাদাদের ছাড়া আর কোনও পুরুষের সাথেই আমি কথা বলতাম না। কিন্তু এখন আর পুরুষ মানুষের সামনে একা যেতে আমি ভয় পাই না। কিন্তু আমি চাই তুমি আমার সাথে থাকো।”

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ঝুনুদি আমার কানে ফিসফিস করে বলল, “বারোটা বছর বাদে নিজের প্রেমিকাকে কাছে পেয়ে ভাই যদি তোর ওপর হামলে পড়ে? তাহলে আমার সামনে লজ্জা পাবি না?”

আমি ঝুনুদির রসিকতা বুঝতে পেরেও শান্তভাবে জবাব দিলাম, “লজ্জা শরমের বালাই তো বারো বছর আগেই ঘুচে গেছে ঝুনুদি। তোমরাই শুধু সেটা কেন বুঝতে চেষ্টা করছ না, জানিনা।”

ঝুনুদি আমাকে তার শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “সে’সব কথা এখন থেকে ভুলে যা রুমু। এই বারোটা বছরে তোর ওপর দিয়ে যে কত ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে তার সব কথাই আমরা শুনেছি। তাই তোকে আর কিছু বলতে হবে না। এখন থেকে ওই কথাগুলো মুখে বলা তো দুরের কথা, মনেও আনবি না, বুঝেছিস?” বলতে বলতে একটা ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাতে নক করে বলল, “ভাই, ঘরে আছিস তুই?”

ভেতর থেকে খুব ভারী গলার জবাব এল, “হ্যাঁ, দিদি। আয়।”


[/HIDE]
 
[HIDE]



(#৫৩)

আমার বুকের ভেতরটা যেন আবার দুরুদুরু করতে শুরু করল। ঝুনুদি আমাকে একহাতে তার শরীরের সাথে চেপে ধরে অন্য হাতে দরজার পাল্লা ঠেলে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জী পড়া অপূর্ব সুন্দর এক যুবক ঘরের প্রায় মাঝামাঝি দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে চোখ পড়তেই আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সুন্দর সুগঠিত শরীর, মাথায় এক ঝাঁকরা কালো কচকুচে কোঁকড়ানো চুল, চোখে সোনালী সরু ফ্রেমের একটা চশমা পড়া টুপুকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, বারো বছর আগে দেখা মুখটাকে চিনতে বেশ কষ্টই হবে আমার। কিন্তু ঘরের উজ্জ্বল আলোয় টুপুকে চিনতে আমার এতটুকু কষ্ট হল না। সেই বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। সেই ভাসা ভাসা চোখের চাউনি। শুধু শরীরটাই যা ফুলে ফেঁপে উঠেছে আগের চেয়ে অনেকটা বেশী।

টুপুও আমার মুখের দিকে চেয়ে যেন আর চোখ সরাতে পারছিল না। ঝুনুদি বাঁ হাতে আমার একটা হাত ধরে ডানহাতে টুপুর বাঁ হাতটাকে ধরে বলল, “এদিকে আয় ভাই” বলেই ঘরের একটা দেয়ালের দিকে আমাদের দু’জনকে টেনে নিয়ে গেল।

দেয়ালটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল দেয়ালে একই রকমের আধুনিক ফ্রেমে একের পর এক চারটে ছবি বাঁধিয়ে রাখা এক লাইনে। আর নিচের লাইনে আরও দুটো ছবি একই রকম বাঁধানো। ওপরের শারির প্রথম ছবিটা আমার বাবার। পরের ছবিটা মা-র। তারপরের দুটো রমেন কাকু আর সোনালী কাকিমার। আর নীচের লাইনের দুটো ছবি বড়দার আর ছোড়দার। প্রত্যেকটা ছবিতে টাটকা রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। তার নিচে বেশ লম্বা মত একটা তাক। তাতে ছ’টা ধূপদানী। ধূপদানী গুলোর তলায় ধূপকাঠির কিছু ছাই জমা হয়ে আছে।

ছবিগুলো দেখেই আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে উঠতে চাইল। আমার মনে পড়ল, মা বাবা দাদাদের এ রঙিন ছবিগুলো একটা অ্যালবামে রাখা ছিল। অ্যালবামটা রাখা হত মা বাবার বেডরুমের একটা আলমারিতে। তবে সে ছবিগুলো এত বড় সাইজের ছিল না। ওগুলো ছিল পোস্টকার্ড সাইজের। কিন্তু এ ছবিগুলো আরও অনেক বড়। মনে হচ্ছে আগের ছবিগুলোকেই নতুন করে বড় করে ছাপানো হয়েছে। কিন্তু এত বছর পর ছবির সেই মানুষগুলোকে দেখে আমার দু’চোখ জলে ভরে গেল।

ঝুনুদি তার দু’হাতে আমাকে আর টুপুকে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলল, “নে রুমু, মা বাবা আর দাদাদের প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নে” বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। আমিও দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে করতে হু হু করে কেঁদে ফেললাম। আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। কিন্তু ঝুনুদি কাঁদতে কাঁদতেও আমাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু আমাকে বেশী সময় ওভাবে থাকতে দিল না। আমাকে টেনে সোজা করতে করতে ঝুনুদি টুপুকে বলল, “ভাই, আর দেরী করিস নে। রুমুর মনের ওপর আজ খুব স্ট্রেস পড়েছে। ওকে বেশীক্ষণ কাঁদতে দিলে আবার হয়ত ও অজ্ঞান হয়ে পড়বে” বলে আমাকে আর টুপুকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। ঝুনুদি একহাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “কাঁদিস না রুমু। আজ মা-বাবা, জেঠু-জেঠিমা, আদিদা, অভি সকলেই খুব খুশী হবে। তোদের দু’জনকে তারা নিশ্চয়ই প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করছেন ওপর থেকে।”

টুপু কোন কথা না বলে তার পাজামার পকেট থেকে একটা গোল কৌটো বের করে সেটার ভেতর থেকে একটা হীরের আংটি বের করে আমার বাঁ হাতের অনামিকায় পড়িয়ে দিল। আমি বারন করতে চাইলেও গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না। ঝুনুদি তাকটার ওপর থেকে খানিকটা ধূপের ছাই আঙুলের ডগায় তুলে আমার কপালে একটা টিপের মত লাগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা হচ্ছে মা-বাবা, জেঠু-জেঠিমা আর তোর দাদাদের আশীর্বাদ। এবার আয় এখানে বোস” বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে টুপুর হাতের কৌটোটা থেকে একটা সোনার নেকলেস নিয়ে আমার গলায় পড়িয়ে দিতে চাইতেই আমি তার হাতটা ধরে বললাম, “এ কি করছ ঝুনুদি। আমি যে এ’সবের উপযুক্ত….”

ঝুনুদি আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, “চুপ, আর একটি কথাও নয়। অনেক কথা বলেছি। অনেক বুঝিয়েছি তোকে। আর নতুন করে কিছু বলতেও চাই না শুনতেও চাই না। একদম চুপটি করে বসে থাক” বলে আমার গলায় নেকলেসটা পড়িয়ে দিয়ে আমার পাশে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। কেঁদে কেঁদেই বলতে লাগল, “বাবা, তোমার শেষ ইচ্ছেটা আজ পূর্ণ করতে পেরেছি। তোমরা সবাই টুপু আর রুমুকে প্রানভরে আশীর্বাদ কর। বারোটা বছর ধরে ওরা দুটিতে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন থেকে ওরা যেন সুখে থাকতে পারে।”

আমিও ঝুনুদিকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে ফেললাম। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে টুপুও নিজের চোখের জল মুছল। বেশ কিছুক্ষণ পর ঝুনুদি আমার দু’গালে চুমু খেয়ে বলল, “আর আপত্তি করিস না লক্ষ্মী বোন আমার। বারোটা বছর ধরে তুই অনেক যন্ত্রণা সয়েছিস। ভাইকেও আমি বারোটা বছর ধরে ব্যথায় কষ্টে ছটফট করতে দেখেছি। আমি জানতাম ওর ব্যথা আর যন্ত্রণার উপশম তখনই হবে, যখন তোকে কাছে পাবে। তুই ওকে ভালবাসতিস কি না জানিনা। কিন্তু এটা জানি যে, ও তোকে যতটা ভালবাসে এমন ভাবে কাউকে ভালবাসতে দেখিনি। অনেক মেয়ে ওকে পাবার জন্যে পাগল হয়েছিল। আজও অনেকেই ওকে পাবার অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওর মন প্রাণ জুড়ে যে শুধু তুইই ছিলি। ওই অনুরাধার মত সুন্দরীও ওর মনে দাগ কাটতে পারে নি। মা-বাবা আর জেঠু-জেঠিমা সকলেই তোদের দু’জনের বিয়ে দেবার কথা ভেবেছিলেন। তাদের কথা ভেবেই না হয় তুই ওকে মেনে নে। আমি জানি, ভাই তোকে সারাটা জীবন নিজের বুকে করে রাখবে। তুইও খুব সুখে থাকবি আমি জানি। আর দেখিস, আমি তোকে একটা কথাও বানিয়ে বলিনি। যে কোনও মেয়ে ওকে স্বামী হিসেবে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করবে। ও শুধু বয়সেই তোর থেকে একটু ছোট। অনেক মেয়েই তো নিজেদের চেয়ে বয়সে ছোট ছেলেদের বিয়ে করেছে। আর তারা সুখে সাচ্ছন্দে সংসারও করছে। তোরাও দুটিতে সুখী হবি, আমি জানি। শুধু তুই একটু রাজি হয়ে যা বোন। বারো বছর আগে তোদের সকলের অমন সর্বনাশ হবার পর ভাইকে সামলাতে মা বাবা আর আমি হিমসিম খেয়েছিলাম। তুই নিশ্চয়ই বেঁচে আছিস, আর একদিন না একদিন ঠিক আমাদের কাছে ফিরে আসবি, এ আশ্বাসবাণী শুনিয়েই অনেক কষ্টে আমরা ওকে সামলাতে পেরেছিলাম। কিন্তু আজ তুই আমাদের ফিরিয়ে দিলে ও বোধহয় এবার পাগলই হয়ে যাবে রে। আমি হাতজোড় করে তোর কাছে এ ভিক্ষেটুকু চাইছি। আমাকে ফিরিয়ে দিস না বোন।”

ঝুনুদির কথা শুনে আমিও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “চুপ কর ঝুনুদি। দোহাই তোমার, এবার তুমি চুপ কর। কিন্তু আমার সারাটা শরীরে যে বারো বছরের নোংরা কাদা জমে আছে। এ নোংরার দাগ যে তোমাদের গায়েও লেগে যাবে গো।”

ঝুনুদি আবার আগের মত সুরেই বলল, “তোর শরীরে কতটা নোংরা কাদা লেগে আছে জানি। কিন্তু দেখিস তোর শরীরের সমস্ত নোংরা খুব অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের ভালবাসার জলে ধুয়ে যাবে। বল রুমু, আর তো তোর বাধা নেই?”

আমি এবার নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের চোখের জল মুছে ঝুনুদির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম, “শান্ত হও ঝুনুদি। তোমার ভাইয়ের মত একটা ছেলেকে যে সব মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে এ তো জানা কথাই। কিন্তু আমার মত একটা নষ্টা মেয়েকে বিয়ে করে ও নিজেকে আর তোমাদের সবাইকে সমাজের চোখে ছোট করবে কেন? আমাকে …..”

এবার টুপু আমার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে খুব শান্ত ভাবে বলল, “রুমু, কবে থেকে আমি তোমাকে মনে মনে ভালবাসতে শুরু করেছি, তা নিজেও ঠিক জানিনা। তোমাকে ভালবাসাটা আমার কাছে সুন্দর একটা স্বপ্নের মত ছিল। জীবনের অর্ধেকটা সময় সে স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিলাম। আজ তুমি সে ভালবাসায় সাড়া দিলেই আমার স্বপ্ন সত্যি হবে। আর নিজের সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে সমাজের কাছে যতই ছোট হই না কেন, আমি তা হাসিমুখে মেনে নিতে প্রস্তুত আছি। আর দিদি আর শান্তুদাও আমাদের পাশে থাকবে। সবরকম প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করবার মত সাহস এবং ক্ষমতা, দুটোই আমার আছে। শুধু তোমার মনের দ্বিধাটুকু ঝেড়ে ফ্যালো। আর আমি কিচ্ছুটি চাই না।”

আমি টুপুর মুখের দিকে অবাক চোখে চাইলাম। ওর চোখ মুখও যেন একই কথা বলছে।

রুমুদির একটা হাত চেপে ধরে আমি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রেখে বললাম, “ঝুনুদি, বারোটা বছর বাদে আজ আমার নিজেকে একটা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। এতদিন তো শুধু একটা পণ্য সামগ্রী ছিলাম। আজ এখানে এসে, মা-বাবা, কাকু-কাকিমা আর দাদাদের ছবি দেখে, ডক্টর মুখার্জি আর তোমার ছেলে আদিকে দেখে মনে হচ্ছে, মিনু নামের নষ্টা মেয়েটা মরে যাচ্ছে। আর বারো বছর আগের রুমু যেন আবার বেঁচে উঠতে চাইছে। কিন্তু রুমুদি, তোমরা হয়ত বিজলীমাসি আর অনুরাধার মুখে আমার অনেক কথাই শুনেছ। কিন্তু তোমাদের কথায় রাজী হবার আগে আমার যে আরও কয়েকটা এমন কথা বলার আছে, যা তোমরা জানতে বা ভাবতেও পারনি। সে’টুকু বলার সুযোগ দেবে না আমায়?”

রুমুদি আমাকে খুশীতে জড়িয়ে ধরে বলল, “বল না, কে তোকে বারণ করছে বলতে। আমরা তো তোর মুখের কথা শোনবার জন্যেই অপেক্ষা করছি রে। বল রুমু, যা বলতে চাস, মন খুলে বল।”

আমি রুমুদির হাতটা দু’হাতে ধরে মাথা নিচু করে বললাম, “তোমার ভাইকেও বসতে বল। কথা গুলো তোমাদের দু’জনেরই শোনা উচিৎ।”

ঝুনুদি টুপুর হাত ধরে তাকে টেনে বিছানার ওপর তার অন্যপাশে বসিয়ে দিতেই আমি তাদের দু’জনের মুখের দিকে একটু দেখে মাথা নীচু করে বললাম, “ঝুনুদি, বারোটা বছর আমি যে কী কী করেছি তা হয়ত তোমরা নিশ্চয়ই কিছু কিছু শুনেছ। কিন্তু এ ছাড়াও আমার জীবনের আরও কিছু গোপন কথা আছে। তোমাদের জীবনের সাথে নিজের জীবনটা জড়িয়ে নেবার আগে সে কথাগুলোও যে তোমাদের খুলে বলা খুব প্রয়োজন”

বলে একটু থেমে বললাম, “আমাদের ওই শহরের কথা তো তোমরা সবই জানতে। অনুরাধার মত অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও প্রায় প্রতিটা মেয়েই তাদের বয়ফ্রেন্ডদের সাথে চুটিয়ে সুখ ভোগ করত। আমার সাথে পড়া প্রত্যেকটা মেয়েই সে’সব করত। আমাকেও তাদের দলে টেনে নিতে কম চেষ্টা করেনি তারা। কিন্তু ওই উঠতি বয়সে মা আমার সবচেয়ে বড় বান্ধবী এবং পথ প্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। মা-র সাহায্য পেয়েছিলাম বলেই আমি ওই স্রোতে গা না ভাসিয়ে থাকতে পেরেছিলাম। তিনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন যে ছেলেমেয়েরা নিজেদের শারিরীক সুখের জন্যেই ও’সব করে থাকে। তাই আমিও যাতে অন্যান্য বান্ধবীদের মত বয়েফ্রেন্ডদের সাথে শারিরীক সুখ পাবার চেষ্টায় নিজেদের পরিবারের বদনাম না করে বসি, মা তার একটা বৈকল্পিক উপায় বের করে দিয়েছিলেন।”

এতোটা বলে আমি একটু থামতেই টুপু ঝুনুদিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “এই দিদি, শোন না। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আমরা দু’জনই একে অন্যের সাথে আলোচনা করে নিলে ভাল হবে। তুই, বরং নিচে গিয়ে শান্তুদা আর অন্য সবাইকে সুখবরটা দে। সকলেই তো উদ্গ্রীব হয়ে আছে এ’কথাটা শোনার জন্যে।”

ঝুনুদি সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে বলল, “ঠিক বলেছিস ভাই। ওদের সকলকে খবরটা দিয়ে ওদের দুশ্চিন্তা দুর করা দরকার” বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে একটা আদরের চুমু খেয়ে বলল, “যা বলার আছে, মন খুলে বল সে’সব ভাইকে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনরকম গোপন কথা লুকিয়ে রাখতে নেই। কিন্তু আদি অনন্তকাল ধরে ভাইয়ের সাথে গল্প বলার সুযোগ পাবি না আজ। জাস্ট পনের মিনিট বাদেই আমি আবার এ’ঘরে চলে আসব। যা বলার, আর যা করার, তা এরই মধ্যে শেষে করে ফেলিস”

বলে দুষ্টু হাসি দিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে কথাগুলো কিভাবে বলব না বলব, তাই ভাবতে লাগলাম। এমন সময় টুপু নিজেই বলে উঠল, “গজানন তোমাদের পরিবারের সর্বনাশ করবার আগেও যে তুমি সেক্স এনজয় করতে, সে’কথাই কি বলতে চাইছ?”

আমি টুপুর কথা শুনে কেঁপে উঠলাম। অবাক চোখে ওর দিকে চাইতেই ও মিষ্টি করে হেসে বলল, “সে’সব ব্যাপার আমার জানা আছে। ও’সব নিয়ে আমার মনের ভেতর কোন দ্বিধাদ্বন্দ নেই। তাই সে’সব কথা বলে তোমাকে আর সময় নষ্ট করতে হবে না। তবে এর বাইরেও যদি আর কিছু বলার থাকে, অবশ্যই বলতে পার।”

আমি থতমত খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলাম, “তু-তু-মি সে’স-স-ব জানো?”

টুপু শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ সে’সবের মূল কথা প্রায় সবটাই জানি। ডীটেইলস না বললেও চলবে। তবে এ ব্যাপারে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। সে’সব কথা দিদি বা শান্তুদাকে কিন্তু একেবারেই জানাবার দরকার নেই। এ’গুলো শুধু আমাদের দু’জনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাক। আর আমার মনে হয়, সে’সব কথা অনুরাধা, বিজলীদিরাও কেউ জানে না, তাই না?”

আমি কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে তার কথায় সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, আর কেউ জানে না। যারা জানতেন তারাও আর বেঁচে নেই। মা বলতেন, স্বামী-স্ত্রীর ভেতরে কোন কিছুই গোপন করতে নেই। মা আমাকে আরও বুঝিয়েছিলেন যে সব সত্যি কথা সবাইকে খুলে না বললেও দোষের কিছু নেই। কিন্তু হাজার লুকোলেও সত্য চিরদিন গোপন করে রাখা যায় না। কোন না কোন ভাবে সেটা কারো না কারুর কাছে ঠিকই প্রকাশ হবে। কিন্তু স্বামীর কাছে কখনও কোন কথা গোপন করতে নেই। যত লজ্জারই হোক যত কলঙ্কময় ঘটনাই হোক, স্বামীর কাছে ঘটবার সাথে সাথেই সে’সব জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। আর তুমি যখন আমাকে নরক থেকে উদ্ধার করে আমাকে নিয়ে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখছো, তখন সকলের অজানা ওই কথাগুলোই তোমাকে জানাতে চাইছিলাম। আমি তো চাইছিলাম সে কথাগুলো তোমার আর ঝুনুদি দু’জনের কাছেই খুলে বলি। কিন্তু তুমি যখন চাইছ, তবে ঠিক আছে, অন্য কাউকে আর এ ব্যাপারে কিছু জানাব না। কিন্তু সে’ কথাগুলো তুমি কী করে জানতে পেরেছিলে?”

টুপু আগের মতই খুব শান্ত স্বরে জবাব দিল, “তোমার মনে আছে কি না জানিনা। তোমার ঘরের অনেকটা অংশই যে আমাদের ছাদ থেকে দেখা যেত সেটা কিন্তু তোমাকে আমি দেখিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ঘরের একটা কোণা থেকে তোমার বিছানার অনেকটাই দেখা যেত। জেঠিমার সাথে আর অভিদার সাথে ওই বিছানায় তোমার কাটানো কিছু ঘটনার সাক্ষী আমি হয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ওপর কেন জানিনা, আমার কোন ঘৃণা জন্মেনি। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, জেঠিমার সাথে তোমাকে প্রথম যেদিন ও’সব করতে দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই বুঝি তোমায় ভালবাসতে শুরু করেছিলাম।”

আমি নিজে কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “মা আর ছোড়দার সাথে আমার কেমন সম্পর্ক ছিল, তা জানার পরেও তুমি আমাকে ভালবাসতে?”

টুপু আবার খুব শান্ত গলায় বলল, “যদি জিজ্ঞেস কর ‘কেন’, তাহলে তার জবাব দিতে পারব না। আসলে জবাবটা জানাই নেই আমার। কিন্তু সেটাই হয়েছিল। সে’সব জানবার পরেও তোমাকে মনে মনে ভালবাসতাম। তোমার ওপর কখনও রাগ বা অভিমান হয়নি আমার। আর ওই চরম ঘটনাটার পর প্রায় বছর খানেক বাদে তোমার মামাদের হাতে যখন পুলিশ তোমাদের ঘরের চাবি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা এ কেসের কোন হদিস করতে পারল না, তখন তোমার তিন মামাই প্রথমে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তোমাদের বাড়িটা তখন জঙ্গল আর আগাছায় ভরে গিয়েছিল। ঘরের ভেতর সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে ছিল। তারপর তোমার মামাদের অনুরোধে দু’তিনটে লেবার সঙ্গে নিয়ে আমি ও বাবা সে বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঘরের ভেতর বাইরের সব কিছু পরিস্কার করতে দু’দিন সময় লেগেছিল। নিচের তলার ড্রয়িং রুমের মেঝে থেকে কালো হয়ে থাকা রক্তের দাগগুলো ঘষে ঘষে তুলবার সময় আমি আর বাবা কেঁদে ফেলেছিলাম। আমাদের দেখাদেখি তোমার মামারাও সকলেই কাঁদতে শুরু করেছিলেন।”

এতটুকু বলে টুপু কিছু সময়ের জন্য থেমে গেল। কান্নার আবেগে তার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার চোখ দিয়েও আবার জলের ধারা নামতে শুরু করেছিল।

টুপু কয়েকবার ঢোক গিলে গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, “তোমাদের নিচের তলার একটা ঘরের আলমারি গুলো খুলে সবুজ অ্যালবামটা দেখতে পেয়ে আমি সেটা তোমার মামাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। অবশ্য তাদের আমরা বলেছিলাম যে এটা তারা নিতে চাইলে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে পারবেন যে কোন সময়। কিন্তু কেন জানিনা, তারা আর সেগুলো ফেরত নিতে আসেননি কখনও। সে অ্যালবামটা এখনও আমার কাছে আছে। এ’ঘরের দেয়ালে যে ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছো সেগুলো ওই অ্যালবামের ছবি থেকেই বড় করে প্রিন্ট করে নিয়েছি। আর একটা জিনিস আমি তোমার ঘর থেকে চুরি করে নিয়েছিলাম। একটা নোটবুক। সেটাকে তুমি বোধহয় একটা ডাইরীর মত করে মেনটেন করতে। সেটা পড়ে আমি সবটা, মানে আদিদা, অভিদা, জেঠিমা আর জেঠুর কথা গুলোও জানতে পেরেছি।”

আমার মনে পড়ল সেই নোটবুকটার কথা। সেটাতে আমি আমার সেক্স লাইফের ঘটনাগুলো লিখে রাখতাম। আর সেটাকে সব সময় আমার ড্রেসিং রুমের আলমারির ভেতর তালাচাবি মেরে রেখে দিতাম। সেটার খবর বাড়ির আর কেউ জানত না। টুপু যখন সেটা পড়েছে, তখন মা, বাবা আর দুই দাদার সাথে আমার সেক্স কিভাবে শুরু হয়েছিল, তার সব কিছুই জানতে পেরেছে। তাই এ ব্যাপারে ওকে আর কিছু বলার কোন প্রয়োজনই নেই।

টুপু তখন আবার বলছে, “আজ তোমার মনের ওপর অনেক প্রেসার পড়েছে। তাই আজ আর সে’সব বের করছি না। ও’গুলো আমার ওই আলমারিতে রাখা আছে। পরে তোমার হাতে ওই জিনিসদুটো তুলে দেব। অ্যালবামের কথা দিদি আর শান্তুদা জানেন। কিন্তু তোমার ডাইরীতে যা লেখা আছে, সে’সবের খবর শুধু আমিই জানি। দিদিও সে’সব ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাই তুমি যখন বললে যে তোমার আরো কিছু বলবার আছে, আমি তখনই বুঝে নিয়েছিলাম যে তুমি ওই কথাগুলোই তুলবে। তাই একটা কায়দা করে দিদিকে নিচে পাঠিয়ে দিলাম। জেঠিমা তোমাকে ঠিক কথাই বলেছেন, সব গোপন কথা তো সবাইকে জানাবার দরকার নেই। এটা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই তো আমি চাইনি দিদি বা শান্তুদা বা আর কেউ এ সব জানুক। অবশ্য তোমার ডাইরীটা চুরি করার অপরাধ থেকে আমি তাতে মুক্ত হব না। সে অপরাধের শাস্তি তুমি আমায় দিও। আমি হাসিমুখে তা মেনে নেব। কিন্তু প্লীজ, আর আমাকে ফেলে চলে যেও না।”

টুপু থামতে আমি বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম। আমার মাথায় কিছুতেই একটা কথা পরিস্কার হচ্ছিল না। মা, বাবা, দাদাদের সাথে আমার সেক্স রিলেশনের কথা জানবার পরেও টুপু কি করে আমাকে এত ভালবাসতে পারে? বারোটা বছর ধরে ও কেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকবে শুধু? আমার চেয়ে ছোট হলেও ওর তো ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। পাঁচ ছ’ বছর ধরে সরকারী চাকুরিও করছে। ওর মত সুন্দর সুদর্শন একটা ছেলে বিয়ে করবার মত পাত্রী খুঁজে পাবে না, এ তো হতেই পারে না! ও আমার জন্যেই কেন অপেক্ষা করছে? আর ঝুনুদি তো বলল যে আমাকে না পেলে ও সারা জীবন আইবুড়ো থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। কিন্তু বারোটা বছর ধরে আমাকে যেভাবে বেশ্যাবৃত্তি করতে হয়েছে, সে’সব জেনেও ও আমাকে এখনও বিয়ে করতে আছে ভেবেই আমার বিস্ময়ের অবধি ছিল না।

এ’সব ভাবতে ভাবতে আমি গলা পরিস্কার করে সোজাসুজি বললাম, “দ্যাখো টুপু, যে সুন্দর স্বপ্নটা আমাকে তোমরা দেখাচ্ছ তাতে আমার জীবনের তো একটা সুন্দর পরিণতিই হবে। কিন্তু নিজেদের দিকটা তোমরা ভেবে দেখেছ? রাস্তা ঘাটে তোমার সাথে আমাকে কেউ দেখে যদি আমার দিকে আঙুল তুলে বলে যে এই মেয়েটাকে আমি এক রাতের জন্য দশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে মনের সুখে ভোগ করেছিলাম, তখন সে’কথা শুনে সহ্য করতে পারবে? নিজে তখন কতটা ছোট হয়ে যাবে, সেটা কখনও ভেবেছ? আর ঝুনুদি, ডক্টর মুখার্জিও তো তেমন কোন পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। তখন তারাই বা কী করবেন?”

টুপুও সোজাসুজি আমার মুখের দিকে চেয়ে জবাব দিল, “এ’সব যে আমরা ভেবে দেখিনি, এটা তুমি কী করে ভাবছ? আমি আর দিদি তো আগে থেকেই এ’সবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম, এখনও আছি। আর শান্তুদাও আমার মনের ইচ্ছে জেনে উনিও তাতে মত দিয়েছেন। আমরা সবাই তেমন ঘটনার মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছি। শুধু তুমি একটু আমাদের সাহায্য কোর প্লীজ।”

আমি তবু বললাম, “তোমরা তো শুনেছই যে বারোটা বছর ধরে আমি বেশ্যার জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছি। এতগুলো বছরের মধ্যে হাজার হাজার পুরুষ আমার এই শরীরটাকে ভোগ করেছে। আমাকে বিয়ে করে তুমি আমার এই অপবিত্র শরীরটাকে পাশে নিয়ে ঘুমোতে পারবে? স্বামী-স্ত্রীর ভেতরে যা কিছু হয়ে থাকে, সে’সব করতে তোমার কোন ঘেন্না করবে না? তোমার কি একবারও মনে হবে না যে যাকে তুমি ভালবেসে ছুঁতে যাচ্ছ তোমার পাশে শোয়া সে নারী শরীরটাকে রোজ আট থেকে বারোজন পুরুষ জানোয়ারের মত ভোগ করেছে। তখন তুমি কিকরে তোমার মনকে প্রবোধ দেবে? তুমি কি সত্যিই মন থেকে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবে? ঘেন্না করবে না আমাকে? আমার শরীরটাকে?”

টুপু খুব শান্ত ভাবেই জবাব দিল, “সেই ছোটবেলা থেকেই তুমি যে আমার অস্থি মজ্জার সাথে মিশে আছ রুমু। তোমার অস্তিত্ব তো আমার মনের সাথে একাকার হয়ে আছে। কাকে ঘৃণা করব আমি? কেউ কি নিজেকে ঘৃণা করতে পারে?”

টুপুর জবাব শুনে আমার ভেতর থেকে আরেকবার কান্না উথলে উঠতে চাইল। আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। কিন্তু টুপু সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর কান্না নয় রুমু। বারোটা বছর ধরে অনেক কেঁদেছ জানি। এসো ওঠো। চল মা বাবা জেঠু জেঠিমার কাছ থেকে তাদের আশীর্বাদ চেয়ে নিই আমরা” বলে আমাকে টেনে ওঠালো।

দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর নিচে মাথা ঠেকিয়ে আমি আবার কেঁদে উঠলাম। টুপুও সবগুলো ছবির ফ্রেমে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “নিজেকে সামলাও রুমু। আমার মনে হয় এখন আমাদের নিচে যাওয়া দরকার। বিজলীদিকে অন্ততঃ একটা কৃতজ্ঞতা সূচক ধন্যবাদ আমার জানানোই উচিৎ।”

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “হ্যাঁ ঠিক বলেছ তুমি। বিজলীদি মন থেকে আমার ভাল না চাইলে, আজ এ দিনটা কিছুতেই আমাদের জীবনে আসত না। সে তো প্রায় মাস দুয়েক আগে থেকেই আমাকে বলছিল। কিন্তু তখন তো আমি জানতাম না যে সে তোমার হাতে আমাকে তুলে দিতে চাইছে। আর তাছাড়া, আমার জীবনের রাহু ওই গজাননের কবল থেকে আমি যে সারা জীবনেও মুক্তি পাব না বলে ভেবেছিলাম। মাসির কথায় ও’খান থেকে চলে এলেও গজানন আমার পিছু ছাড়ত না। সে ঠিক আমাকে খুঁজে বের করত। তখন আমার সাথে সাথে যে আমাকে আশ্রয় দিত, সে-ও বিপদে পড়ত।”

টুপু আমার মাথাটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “তোমাকে একটা কথা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। অবশ্য এটা আমার ধারণা। তবে, ধারণাটা যে পুরোপুরি মিথ্যে হতে পারে না, এ ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহই নেই।”



[/HIDE]
 
[HIDE]



(#৫৪)

আমি ওর বুক থেকে মাথাটা তুলে কৌতূহলী চোখে ওর মুখের দিকে চাইতেই টুপু আমার গালে হাত রেখে বলল, “দু’মাস আগে ওই ফার্ম হাউসে গিয়ে বিদ্যুৎ যখন তোমার ছবি তুলে এনে আমাকে দেখিয়েছিল, আমি তো তখন থেকেই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। শান্তুদা যখন অনুরাধা আর ডাক্তার ঘোষালের মাধ্যমে মাসির ফোন নাম্বার পেয়ে তার সাথে কটাক্ট করেছিলেন, তখন মাসি তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দেবার বিনিময়ে টাকার দাবী করতেও আমরা টাকা দিতে প্রস্তুত ছিলাম।

অবশ্য এটা আমরা মনে মনে আগেই ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই মাসি আমাদের জানিয়েছিল যে গজাননের ভয়ে তুমি মাসির বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইছ না। তখন আমরা তাকে অনুরোধ করেছিলাম যে ব্যাপারটা পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত মাসি যেন তোমাকে সুরক্ষিত রাখে। গজাননের খোঁজ আমরা করছি। মাসি তখন বলেছিল যে শুধু গজানন নয়, ওর দলের অন্য সবাইকেও পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই তুমি পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে। তখন মাসি আর আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে যতদিন পর্যন্ত গজানন আর তার দলের অন্য সবাইকে জেলে পুরতে না পারব ততদিন তুমি মাসির ওই বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু মনে মনে একটা অস্বস্তি আমার থেকেই গিয়েছিল। মাসির বাড়িতে থাকা মানেই তো তোমাকে দিয়ে সে তার ব্যবসা চালিয়ে যাবে। কিন্তু ভগবান সদয় হয়েছিলেন বলেই অনুরাধা ও বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোবার দু’দিন বাদেই মাসি আবার আমাদের বাড়ি এসেছিল। তখন সে তোমার আসল পরিচয় জানতে পেরেছে। আর সেটা জানতে পেরেই সে আমাদের কথা দিয়েছিল। এখানে এসে মা, বাবা আর জেঠু জেঠিমার ছবি দেখে আর আমাদের সকলের ইচ্ছের কথা জানতে পেরে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর আমাদের বলেছিল যে গজাননের হদিশ তার জানা আছে। কিন্তু তার সঙ্গীসাথীদের খোঁজ দুর্গাপুরের ওদিকেই পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা। তবে সে সেদিনই আমাদের কথা দিয়ে গিয়েছিল যে করেই হোক তোমাকে সে আমাদের হাতে তুলে দেবেই। আর এর বিনিময়ে সে একটি পয়সাও নেবে না। তখন আমি, দিদি, শান্তুদা, বিদ্যুৎ, বিজলীদি আর অনুরাধা মিলে দলবদ্ধ ভাবে গজাননের সঙ্গীসাথীদের খোঁজ করতে শুরু করলাম। আমি নিজে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আর বিদ্যুৎ সরকারী উকিল হবার দৌলতে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে বারো বছর পুরোনো ওই কেসটাকে আবার নতুন করে খুলি। তবে সবচেয়ে বড় কাজটা কিন্তু বিজলীদিই করেছে। সে গজাননের ওই দলের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা খুঁজে বের করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল। আমরা সেটা সাথে সাথে মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। গত সপ্তাহেই মুর্শিদাবাদ পুলিশ আমাদের জানালো যে আসানসোলের কাছে গজানন সহ ওর দলের আরও পাঁচজনকে তারা অ্যারেস্ট করেছেন। তবে গজাননকে তারা জীবিতাবস্থায় ধরতে পারেনি। গজাননের মুখটাকে শুধু অক্ষত রেখে ওর শরীরের বাদবাকী গোটা অংশটাই নাকি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখা হয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে। ওর পুরুষাঙ্গের দুটো অংশ নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি। খবরটা পরের দিন প্রকাশিত হয়। জীবিত অন্য পাঁচজনের বিরূদ্ধে বারো বছর আগের সেই মামলায় লুঠতরাজ, ধর্ষণ আর খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আর গজাননের দলের আরও দু’জন দুষ্কৃতী নাকি ইতিমধ্যেই আলাদা আলাদা সময়ে মারা গেছে। কিন্তু গজাননের দলের সাথে অন্য কোন দলের সংঘর্ষ হয়েছিল, এ ব্যাপারে পুলিশ কোন সূত্র খুঁজে পায় নি। তবে আমার মনে হয়, ওই অন্য দলটার পেছনেও বুঝি বিজলীদির কোনও হাত আছে। কিন্তু পুলিশ যখন সেটা ধরতে পারেনি, সেটা নিয়ে আমিও কোন প্রশ্ন তুলিনি। তবে বিজলীদিই যদি সত্যি এ’সবের পেছনে থেকে থাকে, তাহলে সে নিজেও হয়ত কোন না কোন ভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে। তবে সেটা যা-ই হোক। বিজলীদির সাহায্য ছাড়া গজাননের ওই দলটাকে পুলিশ হয়ত কখনোই ধরতে পারত না। তাই তোমার জীবনের সমস্ত কাটা নির্মূল করার পেছনে তার একটা বিরাট অবদান আছে। তুমি এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস কোর না প্লীজ। গজাননকে খুন করার পেছনে বা গজাননের দলটাকে ধরিয়ে দেবার পেছনে যদিও তার কোনও হাত থেকে থাকে, আমি চাই না, যে সে’সব কথা নিয়ে আমরা কোনও আলোচনা করি। গতকাল মুর্শিদাবাদ জেলা আদালতে জীবিত পাঁচজন দুষ্কৃতীর যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তাই ওরা আর বেঁচে থাকতে জেল থেকে বেরোতে পারবে না। গজাননের কালো ছায়াটা তোমার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য সরে গেছে, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।”

টুপুর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ল, বিজলীদি আমাকে বলেছিল যে গজাননের বাড়া কেটে কুকুরকে দিয়ে খাওয়াবে। গজাননের মৃতদেহ টুকরো টুকরো অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার পুরুষাঙ্গের দুটো টুকরো খুঁজে পাওয়া যায়নি, এ’সমস্ত কথা কাগজে প্রকাশিত হয়নি। কেন কে জানে। তবে আমারও মনে হল গজাননকে বুঝি বিজলীদিই খুন করেছে।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে টুপু আমার হাতটা ধরে বলল, “কী ভাবছ রুমু? আমার কথাটা রাখবে তো? বিজলীদিকে গজাননের মৃত্যুর ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন করবে না তো?”

আমি মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বললাম, “নাহ, কিচ্ছু বলব না। তবে বিজলীদি আমার জন্য যা করল তাতে আমি সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।”

টুপু আমার দুটো হাত একসাথে মুঠো করে ধরে বলল, “উহু, শুধু তুমি একা নও রুমু। আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব চিরকাল। কিন্তু এবার ওঠো। চলো, নিচে দিদিরা সবাই যে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে” বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে তুলল।

আমিও দাঁড়িয়ে বললাম, “কিন্তু টুপু, আমার মনে হয় তোমরা ব্যাপারটা নিয়ে আরো একটু ভেবে দ্যাখ। আমার মত একটা মেয়ে, যে কিনা বারো বছর ধরে একটা বেশ্যা হয়ে জীবন কাটিয়েছে, তাকে বিয়ে করে তোমরা প্রতিদিন প্রতি পদে পদে হেনস্থা হবে। নিজের কষ্ট সইবার মত ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু তোমাকে, ঝুনুদিকে যে আমি কোন কষ্ট দিতে চাই না। আমার জন্য তোমরা সবাই কেন এমন …………”

আমার মুখের ওপর টুপুর ঠোঁটদুটো নেমে এসে আমার কথা থামিয়ে দিল। আমাকে দু’হাতে নিজের বুকে চেপে ধরে টুপু আমার ঠোঁট দুটোকে নিজের মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে আবেগভরা চুমু খেতে লাগল। কয়েকটা মূহুর্তে পেরিয়ে যাবার পর আমার মনে হল আমার শরীরটা যেন টুপুর দু’হাতের বন্ধনের মাঝে গলতে শুরু করেছে। টুপু বেশ কিছুক্ষণ ধরে এমন পাগলের মত আমায় চুমু খেল যে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হল এক যুগ বাদে কেউ যেন আমাকে আদর করছে। নিজের অজান্তেই আমার হাতদুটো টুপুর গলা জড়িয়ে ধরল। আমিও যে কখন ওর চুমুর জবাবে চুমু দিতে শুরু করেছি, এটা বুঝতেই পারিনি।

একসময় টুপু আমাকে চুমু খেতে খেতেই দেয়ালের দিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে একসময় আমার মুখ থেকে নিজের ঠোঁট টেনে তুলে বলল, “এসো আমরা একসাথে মা-বাবা আর জেঠু জেঠিমাকে প্রণাম করি।”

আমার শরীরটা তখন অল্প অল্প কাঁপছিল। কিন্তু এ কম্পন যে আগের মত নয় সেটাও বুঝতে পারছিলাম। জীবনে প্রথমবার প্রেমিকের চুম্বনজনিত কম্পনের স্বাদ পেয়ে ক্ষণিকের জন্য অভিভূত হয়ে পড়লাম যেন। টুপু আমার গালে গাল চেপে মা-বাবার ছবিতে কপাল ছোঁয়াল। আমিও সে ছবিতে প্রণাম করলাম। দু’চোখ ছাপিয়ে এল আমার আবার।

কাকু কাকিমার ছবিতে প্রণাম করবার সাথে সাথেই বাইরে থেকে ঝুনুদির গলার ডাক শুনলাম, “ভাই।”

আমরা তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে দাঁড়াতেই টুপু জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদি, আয়” বলতেই ঝুনুদি আদিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি নিজেকে সামলে নিতে ঝুনুদি জিজ্ঞেস করল, “কিরে হয়েছে তোদের কথা? চল। সবাই যে তোদের দুটিকে জোড়ে দেখবার জন্য আকুল হয়ে বসে আছে।”

টুপু বলল, “হ্যাঁ দিদি, আমরা তো বেরোচ্ছিলাম এখনই।”

আদি ঝুনুদির কোল থেকে নেমে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও মামি, চল না। আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে। আজ আমি তোমার হাতে খাব তো।”

আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে আমার বুকে চেপে ধরে বললাম, “হ্যাঁ বাবাসোনা। চল। এখন থেকে আমিই তোমাকে রোজ খাইয়ে দেব।”

নিচের ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠল আমাকে আর টুপুকে একসাথে ঘরে ঢুকতে দেখে। ঘরের সোফায় কুলোয়নি। আরও অনেকগুলো চেয়ারে অনেকে বসে ছিল। ডক্টর মুখার্জী, শ্রীময়ী, বিজলীদি, শ্যামলীদি, অনুরাধা, শেফালী ছাড়াও আরও একজনকে দেখেই বুঝলাম ইনিই সেই বিদ্যুৎবাবু। ফার্ম হাউসে সামন্তর সাথে এই লোকটাকেই সেদিন দেখেছিলাম আমি। আমাকে আদিকে কোলে নিয়ে ঢুকতে দেখে ঘরের সবাই উঠে দাঁড়াল। ঝুনুদি আর টুপু আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকতেই কে যেন শাঁখে ফুঁ দিল। আর সেই সাথে সামনে পেছনে থেকে দু’তিনজন উলু দিয়ে উঠল। আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নামাতেই অনুরাধা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কনগ্রেচুলেশনস রুমুদি। তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু কন্যাপক্ষের লোক। কনের বোন আমি। তোমার মামারাও সবাই আসছেন বিয়েতে। তাদের সবাইকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। তারা তো কালই আসতে চাইছিলেন। শান্তুদা তাদেরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন যে আসছে মাসের সাত তারিখে তোমাদের বিয়ে। তারা সবাই দু’ তিন দিন আগেই সপরিবারে চলে আসবেন এখানে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। কালই তোমাদের বিয়ের অ্যাপ্লিকেশন রেজিস্ট্রি অফিসে জমা করা হবে। বিদ্যুৎ-দার হাতের ফর্মটায় শুধু এখন সই করে দাও।”

বিদ্যুৎ সেন্টার টেবিলের ওপর একটা ফর্ম আর কলম দেখিয়ে বলল, “এসো টুপুদা, তোমরা দু’জন এটাতে এখনই সই করে দাও। আমি এটা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাব আজ। কাল সকালে কল্যান আমার বাড়ি থেকে এটা নিয়ে যাবে।”

অনুরাধা আমার কোল থেকে আদিকে টেনে নিতেই ঝুনুদি আমাকে আর টুপুকে টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। ম্যারেজ অ্যাপ্লিকেশনে সই করবার পর আমি ডক্টর মুখার্জীর কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত ছোঁয়াতে যেতেই সে আমার হাত ধরে ফেলে বলল, “উহু উহু, আমি আমার শালা বৌয়ের প্রণাম নিতে পারব না। শালা বৌ আর নন্দাইয়ের সম্পর্কের মাঝে প্রণাম এসে গেলে তো এমন রোমান্টিক সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, গুরুজন হিসেবে একটা আশীর্বাদ তোমাকে করাই যায়” বলে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “ভাল থেকো। সুখী থেকো। আর আমার এতদিন বাউণ্ডুলে হয়ে থাকা শালাবাবুটাকে সুখে রেখো।”

আমি ঘুরে ঝুনুদির মুখোমুখি হতেই সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “নারে সোনা, তোকে কাউকে প্রণাম করতে হবে না। শুধু আমার ভাইটাকে নিয়ে তুই সুখে থাকিস, তাহলেই আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে” বলে কেঁদে ফেলল।

আমি নিজেকে সামলে বিদ্যুতের দিকে ঘুরতেই বিদ্যুৎ হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, “নমস্কার ম্যাডাম। টুপুদাকে আমি দাদার মত শ্রদ্ধা করি। তাই আমাকে যদি আপনি আপনার দেবর বলে ভাবেন, তাহলেই আর কিছু চাই না। আর আমার স্ত্রীর সাথে আপনার পরিচয় তো হয়েই গেছে।”

আমি একটু মুচকি হাসতেই শ্রীময়ী আমার কাছে এসে বলল, “সে আর তোমাকে বলতে হবে না। আমি তো বৌদিকে টুপুবৌদি বলে ডাকব আজ থেকে।”

আমি সকলের সাথে হাসি বিনিময় করে ঘরের এক কোনায় শ্যামলীদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্যামলীদি আমাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমারও দু’চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল। শ্যামলীদিকে বুকে চেপে ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আমাকে আশীর্বাদ কর শ্যামলীদি। বাকি জীবনটা যেন ভালভাবে কাটাতে পারি। গুবলুকে ভাল করে পড়তে বলবে। ওর সারা জীবনের পড়া শোনার খরচ আমি দেব। তুমি শুধু ওকে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বোলো।”

শ্যামলীদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ভগবান এতদিন বাদে যখন মুখ তুলে চেয়েছেন তখন তুই নিশ্চয়ই সুখে থাকবি রে বোন। জানিনা আর তোর সাথে বসে আগের মত সুখ দুঃখের কথা বলতে পারব কি না। তবু তোর যদি কখনও এই বুড়ি শ্যামলীদির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে ফোন করিস। মাসির ফোন নাম্বার তো তোর বরের কাছে আছেই। তবে গুবলুটার খুব মন খারাপ হবে রে।”

শ্যামলীদিকে ছেড়ে বিজলীদির দিকে চাইতেই দেখি তার চোখদুটোও জলে ভরা। আমি তার দিকে চাইতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই প্রায়শ্চিত্তটুকু করবার সুযোগ আমাকে দিয়েছিস বলে তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রে মিনু। না না, আর মিনু নয়। তোকে এখন থেকে রুমু বলেই ডাকব। এখন আমি মরে গেলেও আমার কোন আফসোস নেই। জেঠু জেঠিমাকে অন্ততঃ বলতে পারব যে তোমাদের রুমু ভাল আছে। ও সুখে আছে। ওকে আমি ভাল লোকের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। আর শোন, ডাক্তার বাবু তো আজ কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়ছেন না। অনেক রাত হয়ে গেল। ফিরে যেতে তো ঘণ্টা দুয়েক আরও লাগবে। তাই আজ এখন খেয়েই আমরা তিনজনে চলে যাব। তোকে কথা দিয়েছিলাম যে তুই নিজে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে না চাইলে আমি তোকে কখনও তাড়িয়ে দেব না। এখন তুই বল। তুই কি আমার বাড়িতেই থাকবি? না এখানে ডাক্তারবাবুর এই পরিবারে থাকবি?”

আমি কোন কথা না বলে বিজলীদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। বিজলীদি আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলল, “আর কাঁদিসনে বোন। ভগবানের দয়ায় তোর দুঃখের দিন আজ শেষ হল। তবে শোন, আমি জানি, এ বাড়িতে তুই খুব সুখে থাকবি। তবু যদি কখনো কোন প্রয়োজনে আমার কথা মনে পড়ে তাহলে একফোটাও ইতস্ততঃ না করে আমাকে ফোন করবি। আমি যেখানেই থাকিনা কেন, সব সময় আমাকে তোর পাশে পাবি। আগে তোকে যে’সব কথা দিয়েছিলাম। তা যেমন রেখেছি, ভবিষ্যতেও তাই করব। শুধু গত দশটা বছরের জন্য আমাকে মাফ করে দিস বোন। আর মনে রাখিস এ বাড়ির এনারা সকলে ছাড়াও তোর আরেকটা দিদি আছে। আর সে দিদিটা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোর পাশে থাকবে। বিপদে আপদে যে কোনও কাজে প্রয়োজন হলে শুধু আমার কাছে খবরটা পাঠাস। আমি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে তোর কাছে চলে আসব।”

আমি বিজলীদিকে জড়িয়ে ধরে “দিদি” বলে কেঁদে ফেললাম। বিজলীদি আবার আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কান্না থামা বোন। বারোটা বছর ধরে তো অনেক কেঁদেছিস তুই। আজ থেকে আমি তোর মুখে শুধু হাসি দেখতে চাই। তুই তো জানিস, আমরা বেশ্যা। সকলেই জানে আমাদের মধ্যে কোন ভালবাসাবাসি থাকে না। আমরা শুধু আমাদের শরীর বিলিয়ে পয়সা কামাতে পারি। সেটাই তো আমাদের ধর্ম। আমাদের কর্ম। আজ তোর জন্য আমি ধর্মুচ্যুত হয়েও খুব সুখ পাচ্ছি রে। তবে তোকে কিন্তু আর আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না। তুই এখন থেকে এ বাড়িতেই থাকবি। তোর ঘর থেকে পুরোনো জামাকাপড় টাপর কিচ্ছু আনতে হবে না তোকে। ঝুনু আর টুপু তোর জন্যে প্রচুর নতুন নতুন পোশাক শাড়ি ব্লাউজ কিনে রেখেছে। তাই ওই পুরনো জিনিসগুলো এ বাড়িতে না আনাই ভাল। তবে তোর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যদি কিছু থেকে থাকে, যা তোর কাজে লাগবে, তাহলে আমাকে ফোনে জানিয়ে দিস। আমি সে’সব এখানে পৌঁছে দেব।”

বিজলীদির কথা শুনে নিজের চোখ মুছতে মুছতে অনুরাধার দিকে চাইতেই সে আমার কাছে এসে হেসে বলল, “জানো রুমুদি? আজ থেকে মাসি আমাকেই তার বাড়ির মক্ষিরানী করে দিয়েছে।”

আমি জোর করে একটু হেসে বললাম, “ভালই তো। বিজলীদির ব্যবসায় খুব পসার হবে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম যে তুই যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ওখানে গিয়েছিলিস সেটা তো পুরো হয়ে গেছে। তাই হয়ত আর ওখানে থাকবি না।”

অনুরাধাও হেসে গলা নামিয়ে বলল, “প্রথমে তো আমিও খানিকটা সে’রকমই ভাবছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেটা করাটা ঠিক হবে না। এমন নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় পেয়ে সেটাকে ছেড়ে যাওয়াটা ভুল হবে। তাই ভাবছি এখানেই থেকে যাব। এমন সুন্দর বাড়িউলী আর এমন নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কোথায় পাব বলো তো? আর আমি যা চাই, সেটা তো এখানে থেকেও পাবো। মাঝে মাঝে ফোন কোরো। তোমাদের খবরাখবর জানিও।”

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বিজলীদিরা রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ফিরে গেল। পরের মাসের সাত তারিখে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হল। এই একটা মাস আমি বাড়ির দোতলার গেস্টরুমে শান্তুদা আর ঝুনুদির ছেলে আদিকে সঙ্গে নিয়ে শুয়েছি। স্কুলের সময়টুকু ছেড়ে আদি সর্বক্ষণ আমার সাথে সাথে থেকেছে।

বড়মামা, মেজমামা আর ছোটমামারা সকলেই মামিদের নিয়ে আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিয়ের তিনদিন আগে চলে এসেছিল। তিন মামাই আমাকে এতগুলো বছর পর দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। মামাদের থাকবার জন্য বাড়ির কাছাকাছি আলাদা একটা গেস্ট হাউস ভাড়া করা হয়েছিল।

তিনতলার ছাদের ওপর ছোটখাটো একটা প্যাণ্ডেল বানানো হয়েছিল। যেখানে জনা পঞ্চাশেক লোকের খাবার ব্যবস্থা আর পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। বাইরের লোকজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। বিজলীদির বাড়ি থেকে প্রত্যেকেই নাকি আমাদের বিয়েতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু বিজলীদি আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে ও বাড়িতেই আলাদা করে এক বৃহস্পতি বারে পার্টির আয়োজন করার কথা দিয়ে সবাইকে থামিয়েছিল। এসেছিল শুধু বিজলীদি, শ্যামলীদি, অনুরাধা আর গুবলু। বিদ্যুৎ আর শ্রীময়ীও এসেছে। গত একমাসে শ্রীময়ী আমার বান্ধবী হয়ে উঠেছে। কিন্তু টুপুবৌদি ছাড়া আমাকে সে আর অন্য কোন নামে সম্বোধন করে না। বড়মামাদের বাড়ির চারজন, মেজমামার বাড়ির ছ’জন আর ছোটমামার বাড়ির পাঁচজন এসেছিল। টুপুর কাকা জ্যেঠা মামা মাসি বলে কেউ নেই। শুধু এক পিসি আছেন রাঁচিতে। কিন্তু বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন বলে তার পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। তিনি সেখান থেকে তার আশীর্বাদী একটা খুব সুন্দর বেনারসি শাড়ি আর একটা গলার হার পাঠিয়েছেন আমার জন্যে। এ বাড়ির চার পাঁচ জন ছাড়া সান্তুদার প্রাইভেট চেম্বারের কর্মচারী আর স্টাফেরা ছাড়া বিয়েতে হাজির ছিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, আর তার অফিসের এক এসিস্ট্যান্ট আর কয়েকজন চাকর বাকর। আর বাইরের লোক বলতে ছিল ডেকোরেটর আর ক্যাটারিং-এর লোকজনেরা। আর কয়েকজনের গাড়ির ড্রাইভার। সবমিলে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশজন লোকের সমাগম হয়েছিল।

শ্রীময়ী আর অনুরাধা মিলে কনে সাজানোর কাজ করল। আয়নায় নিজের চেহারাকে দেখে আমি নিজেই যেন চিনতে পারছিলাম না। রেজিস্ট্রির সময় কনের তরফ থেকে সাক্ষ্য দিলেন আমার তিন মামা আর অনুরাধা। বরের পক্ষ থেকে সাক্ষী দিলেন সান্তুদা, ঝুনুদি আর বিদ্যুৎ। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার মধ্যেই বিয়ে সমাধা হয়ে গেল। তারপর পার্টি। আর রাত ন’টার পর থেকে ডিনার চালু হয়েছিল। প্রচুর ছবি তোলা হল। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ অতিথিরা সবাই চলে গেল। বাড়িতে রয়ে গেল শুধু বিদ্যুৎ আর শ্রীময়ী।

সবাই চলে যাবার পর ঝুনুদি আর শ্রীময়ী আমাদের দু’জনকে ধরে তিনতলার টুপুর বেডরুমে নিয়ে যেতেই চমকে উঠলাম। দারুণ সুন্দর করে ফুলশয্যার খাট সাজানো হয়েছে। ঝুনুদি আর শ্রীময়ী আমাদের দু’জনকে নিয়ে দেয়ালে টাঙানো মা-বাবাদের ছবিগুলোর সামনে নিয়ে যেতেই আমি আর টুপু ছবি হয়ে যাওয়া লোকগুলোকে প্রণাম করলাম। মনে মনে মা-কে বললাম, ‘মাগো, আমাকে আশীর্বাদ কর মা। আমি যেন এ বাড়ির সবাইকে খুশী রাখতে পারি। ঝুনুদি শান্তুদা আর টুপুর মনে যেন কখনও দুঃখ না দিয়ে ফেলি’।

মনে মনে এমন প্রার্থনা করতেই মনে হল আমার মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিল। চমকে চোখ মেলে এদিক ওদিক চাইতেই শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করল, “কিগো টুপুবৌদি, এভাবে চমকে উঠলে কেন?”

আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, “না না, কিছু না এমনি।”

ঝুনুদি বলল, “ভাই, রুমু, তোরা বাবা মা আর জেঠু জেঠিমার কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নে। তারা যেখানেই থাকুন, সকলেই আজ প্রাণভরে তোদের দুটিকে আশীর্বাদ করবেন।”

আমরা প্রণাম সেরে উঠতেই ঝুনুদি আমাদের বিছানার দিকে নিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, “কিরে রুমু? কী আশীর্বাদ চাইলি মা বাবার কাছে?”

আমি ঝুনুদির দিকে একটু ঘুরে বললাম, “আমি মা বাবা, কাকু কাকিমা আর দাদাদের কাছে শুধু এ আশীর্বাদই চেয়েছি যে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি যেন তোমাদের সাথে একসাথে থেকে তোমাদের সবাইকে খুশী রাখতে পারি।”

ঝুনুদি মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “পাগলী কোথাকার। নিজের জন্যে কিছু চাইলি না?”

আমিও মৃদু হেসে বললাম, “নিজের জন্যেই তো অমন আশীর্বাদ চাইলাম।”

“আচ্ছা বেশ করেছিস” বলতে বলতে আমাকে আর টুপুকে পাশাপাশি বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “শ্রীময়ী এ ঘরের সবগুলো আলো জ্বেলে দে তো। আর পাশের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ওপর দেখ একটা ক্যামেরা আছে, ওটাও নিয়ে আয়”

বলে টুপুকে বলল, “ভাই তখন হুড়োহুড়িতে রুমুর সাথে আমি আলাদা করে একটাও ছবি ওঠাতে পারিনি। এবার তুই কয়েকটা স্ন্যাপ নে। রুমুর সাথে আমি আর শ্রীময়ী উঠব। তারপর আমি শুধু তোদের দু’জনের দুটো স্ন্যাপ নেব। আজকের এ দিনটা যে আমার সবচেয়ে খুশীর দিন। এ দিনটার স্মৃতি তো সারাজীবন চেরিশ করবআমরা সবাই।”


[/HIDE]
 
[HIDE]

৫৫

(শেষ পর্ব) )

ফটো ওঠাবার পর তারা বেরিয়ে যাবার আগে শ্রীময়ী আমার কানে কানে বলল, “ও টুপুবৌদি, তোমার তো এখন সীজন টাইম চলছে। আমারও তাই। আমার কর্তা তো বলেছে যে এ সপ্তাহেই বীজ বুনবে। তুমিও টুপুদাকে রাজি করিয়ে বীজ বুনিয়ে নাও এক সপ্তাহের মধ্যেই। আমরা দু’জন একসাথে মা হতে চাই। তাই আমার সাথে সাথে দৌড়িও।”

আমি লজ্জা পেয়ে শ্রীময়ীকে মৃদু ধমক দিতেই তারা বেরিয়ে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি নতমস্তকে বিছানার কাছে এসে টুকুকে বললাম, “একটু নামো না।”

টুপু চমকে উঠে বলল, “মানে? কী করতে চাইছ তুমি? প্রণাম করবে আমাকে? না না, ও’সব প্রণাম টনাম ছাড়ো। আমার ও’সব ভাল লাগবে না।”

আমি ওর একটা হাত ধরে টানতে টানতে বললাম, “প্লীজ লক্ষ্মীটি। শুধু একটি বার। তুমি না চাইলে এর পর না হয় আর করব না। কিন্তু আজ এই দিনটায় মা-বাবা, দাদাদের আর কাকু-কাকিমাকে সাক্ষী রেখে একটিবার শুধু আমাকে সুযোগ দাও।”

টুপু আর কোন কথা না বলে আমার হাত ধরে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আমি আগে মা-বাবা, কাকু-কাকিমা আর দাদাদের ছবিতে আরেকবার প্রণাম করলাম। তারপর মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে টুপুর পায়ে মাথা ছোঁয়াতেই টুপু নিচু হয়ে আমার দু’কাঁধ ধরে টেনে তুলে আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হয়েছে, আর নয়। আজকের পর থেকে তুমি শুধু আমার বুকে থাকবে। ছোটবেলা থেকেই এ বুকটা যে আমি তোমার জন্যেই সুরক্ষিত রেখেছি।”

টুপুর কথা শুনে আমার দু’চোখ জলে ভরে এল। আমিও আবেগ আর ভালবাসায় ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমার বুকটা তো এতদিন খালিই ছিল। কাউকে সেখানে বসাবার স্বপ্ন দেখবার আগেই আমি সবকিছু হারিয়ে বসেছিলাম। আজ তোমার দয়ায় আমার বুকের খালি সিংহাসনে তোমাকে বসাতে পারছি।”

টুপু আমাকে জড়িয়ে ধরেই খাটের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “না দয়া নয়। কৃতজ্ঞতাও নয়। শুধু ভালবাসা। আমার ভালবাসার স্বার্থেই তোমাকে খুঁজে বের করেছি। তোমার জন্য আলাদা করে আমি কিছুই করিনি। যা করেছি সবটাই নিজের তাগিদে, নিজের জন্য। তবে দুঃখ শুধু একটাই। তোমাকে আরও দশ বারোটা বছর আগে খুঁজে পেলে তোমার জীবনে দুর্ভোগগুলো হয়ত হত না।”

আমি টুপুর দু’হাতের আলিঙ্গনের ভেতর আটকা পড়ে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার শরীরটা যেন জড়তার মাঝেও কেঁপে উঠল। মনে মনে শঙ্কিত ছিলাম। হাজার হাজার পুরুষের ভোগে লাগা এই শরীরটা পুরোপুরি ভাবে স্বামীর হাতে তুলে দিতে পারব কি না। কিন্তু টুপুর ভেতর তেমন কোন অস্বস্তি বা জড়তা চোখে পড়ছিল না। গত বারোটা বছর ধরে রোজ একের পর এক কত পুরুষই আমার শরীরটাকে লুটেপুটে খেয়েছে। কিন্তু আমার শরীর আর মন কোনটাই তাতে সাড়া দিত না। আমি শুধু সুখের অভিনয় করে খদ্দেরদের খুশী করে এসেছি। মা বলতেন, পুরুষ নারী দু’জনের শরীর আর মন যখন চায়, তখনই সার্থক সেক্স উপভোগ করা যায়। তেমন সেক্স উপভোগ করবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার প্রথম যৌবনের তিন চার বছর সময়ের মধ্যে। তারপর থেকে গত বারোটা বছরে আমি শুধু সকলের কাছে শরীরটা বিলিয়ে এসেছি। সেক্সের সুখ বলতে কিছুই পাইনি আমি। গত তিন মাসে কোন পুরুষ আমার শরীর ভোগ করেনি। তা সত্বেও নিজের ভেতরে সেক্সের তাগিদ একেবারেই অনুভব করিনি। তাই মনে মনে ভয় ছিল, আমার শরীর থেকে সেক্স কি একেবারেই চলে গেল? তাহলে স্বামীকে আমি কিভাবে সুখী করব? টুপুর তো কোন দোষ নেই। নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে সেক্স উপভোগ করবার পুরোপুরি অধিকার তো তার আছে। কিন্তু আমার শরীর মন তাতে যদি সাড়া না দেয়। টুপুও তো তাতে অতৃপ্ত থেকে যাবে। কিন্তু এটা তো হতে দেওয়া যায় না। নিজের স্বামীকে যৌনসুখ দিতে না পারার মানে হচ্ছে স্ত্রী হিসেবে আমার ব্যর্থতা। তাই গত একটা মাস ধরে মনে মনে মা-র কাছে বারবার মিনতি করেছি, মা যেন আমাকে আশীর্বাদ করেন। আমি যেন আমার স্বামীকে সবদিক দিয়ে সুখী করতে পারি।

অবশ্য নিজের শরীর মনের তাগিদ না থাকলেও টুপুকে যে আমি যৌনতার সুখ দিতে পারব, এ ব্যাপারে মনে কোন সন্দেহ ছিল না। যেভাবে আমার খদ্দেরদের খুশী করতাম। কিন্তু নিজে অতৃপ্ত থেকে তৃপ্তি পাবার অভিনয় করে টুপুকে ঠকাবো ভাবতেও লজ্জা হচ্ছিল। তাই গত একটা মাস ধরে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছি। নিজের ভেতরের সে তাগিদটা যেন এত তাড়াতাড়ি মরে না যায়। স্বামীকে সুখী করতে আমাকে যেন অভিনয়ের সাহায্য নিতে না হয়।

এই মূহুর্তে টুপুর বাহুবন্ধনে আমার চোখ দুটো যেন আপনা আপনি বুজে এল। আমিও কাতর চাতকিনীর মত ওর গলা জড়িয়ে ধরতে ও আমাকে বিছানার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “এবার আমি কি আমার বৌকে একটু আদর সোহাগ করতে পারি?”

আমি কোন কথা না বলে চোখ বুজে থেকেই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলাম। টুপু প্রথমেই আমার বুকের ওপর থেকে শাড়িটা সরিয়ে নিল। শাড়ির সাথে ম্যাচিং লো কাট ব্লাউজের ওপর দিয়ে আমার ফর্সা স্তনের অনেকটা অংশই বেরিয়েছিল। আমার স্তনান্তরের খাঁজটা সব পুরুষকেই আকৃষ্ট করে এসেছে এতদিন। চোখ বুজেই টের পেলাম টুপু আমার স্তন দুটোর খাঁজে তার গরম ঠোঁট দুটো চেপে ধরেছে। সেই খাঁজে কয়েকবার নাক ঘষে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমার পূর্ণ সৌন্দর্য দেখতে চাই রুমু। দেবে তো?”

আমি আগের মতই চোখ বুজে রেখে অস্ফুট গলায় শুধু বললাম “হুম।”

টুপু আমার শরীর থেকে শাড়ি খুলতে খুলতে বলল, “তুমি তোমার নাক কান গলা থেকে তোমার গয়নাগুলো খুলে ফ্যালো।”

আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রথমে কপালের ওপরের টিকলীটা খুলে ফেললাম। তারপর কানের দুল, নাকের নথ আর গলার চেন আর নেকলেস গুলো খুলে ফেললাম। গয়নাগুলো বিছানার এক কোনে রাখতে রাখতেই টুপু আমার ব্লাউজের হুকগুলো খুলতে লাগল। স্তনে টুপুর হাতের ছোঁয়া পেতেই আমার মুখ দিয়ে একটা আলতো শিতকার বেরিয়ে এল। কিন্তু এটা যে মেকি শীৎকার নয়, এ শীৎকার যে স্বতঃস্ফুর্ত, এটা বুঝতে পেরেই আমার মন আনন্দে ভরে উঠল। মনে মনে মাকে আর ভগবানকে আরেকবার প্রণাম করলাম। খুব ইচ্ছে করছিল, ওর শরীর থেকে শেরোয়ানি পাজামা গুলো খুলে নিয়ে ওর নগ্ন সৌন্দর্য দেখতে। কিন্তু কেন জানিনা রাজ্যের লজ্জা এসে যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলল।

আমার গা থেকে সবকিছু খুলে নেবার পরও আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না। কিন্তু মনটা যেন আরও অনেক কিছু পাবার আশায় উন্মনা হয়ে উঠল। নিজের বড় বড় স্তন দুটোকে দু’হাতের আড়ালে ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে আমি দু’পা চেপে দাঁড়িয়ে আমার যৌনাঙ্গটাকে ঢাকবার চেষ্টা করলাম। বেশ কিছু সময় পেড়িয়ে যাবার পরেও ওর তরফ থেকে আর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি একটু একটু করে চোখ মেলে চাইতেই দেখি টুপুর ধবধবে ফর্সা শরীরটা একেবারে জন্মদিনের পোশাকে আমার চোখের সামনে। অপূর্ব সুন্দর সুগঠিত দেহের গড়ন ওর। ফর্সা বুকের ওপর হালকা কালো লোমগুলো যেন ওকে আরও বেশী আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পা দুটো সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকবার ফলে আমার চোখের দৃষ্টি যেন এক অদৃশ্য চুম্বকের আকর্ষণে তার দু’পায়ের মাঝের আসল জায়গাটার দিকে ধেয়ে গেল। শক্ত উত্থিত বাদামী রঙের পুরুষাঙ্গটা একটা ফনা তোলা সাপের মতই যেন দুলছিল। আমার অভিজ্ঞ চোখের দৃষ্টিতে আমি এক নজরেই বুঝলাম যে এ পুরুষাঙ্গটা একেবারেই অনাঘ্রাত অচ্ছুত। খুব ইচ্ছে করছিল আমার সে জিনিসটাকে হাতে নিয়ে ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখতে। কিন্তু আমার মত পাকা বেশ্যার মনেও কোত্থেকে যে এত লজ্জা, সঙ্কোচ, জড়তা এসে জমেছে সেটা ভেবেই আমি লজ্জায় আবার চোখ বুজে ফেললাম। কিন্তু যৌনাঙ্গের ভেতর সড়সড় করে উঠতেই আমি মনে মনে খুশী হলাম। আমার দেহের যৌন উত্তেজনা ফুরিয়ে যায়নি। টুপুর সামনে আমাকে অভিনয় করে যেতে হবে না।

একটু বাদেই টুপু আমাকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দিতেই আমি বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম। চোখ বুজেই ঠোঁটের ওপর গরম শ্বাস প্রশ্বাসের ছোঁয়া পাবার সাথে সাথে আর আমার ঠোঁটের ওপর দুটো তপ্ত পুরুষালী ঠোঁট চেপে বসতেই আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। টুপুর মুখটা দু’হাতে ধরে তার ঠোঁট চেপে ধরলাম নিজের ঠোঁটের ওপর। আমার সারা শরীরে কামাবেগের সঞ্চার হচ্ছে বুঝতে পেরেই আমি মনে মনে পুলকিত হলাম।

প্রথমবারে টুপু বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। তাতেও আমাকে একবার চরম সুখ দিতে পারল। আধঘণ্টা বিশ্রাম নেবার পর আমি নিজেই আদর সোহাগে ওকে জাগিয়ে তুললাম। পরের বারে প্রায় মিনিট কুড়ি সম্ভোগ করে আমরা দু’জনে জড়াজড়ি করে পরম তৃপ্তিতে শুয়ে পড়লাম। আমি দু’বার রতিতৃপ্তি পেলাম। বারো বছর বাদে পরিপূর্ণ সেক্স করে আমার মনের সব শঙ্কা দুর হল। স্বামীকে সুখী করবার, স্বামীর সোহাগ গ্রহন করার ক্ষমতা আমার এখনও আছে। টুপুর আদর সোহাগে বারো বছর আগের সুখ ফিরে পেলাম যেন। মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলাম।

টুপুর মুখটাকে আমার স্তন দুটোর মাঝে চেপে ধরে মনে মনে মাকে বললাম, “আমাকে আশীর্বাদ কোর মা। এমন ভাবেই যেন আমি আমার স্বামীকে চিরকাল সুখ দিতে পারি। আমাকে যেন আর একটা ছিন্নপত্রের মত আবার কোনও খরস্রোতা ঝরনায় গিয়ে পড়তে না হয়। পাথরে পাথরে আঘাত পেয়ে পেয়ে যেন আর ছিন্ন ভিন্ন হতে না হয় আমাকে। টুপুর বিশাল শান্ত সমুদ্রে আমি যেন শান্তিতে থাকতে পারি। টুকুকে আর তার আশেপাশের সবাইকে সুখে রেখে আমি নিজেও যেন শান্তিতে মরতে পারি?”

আমার মন বলছে মা-ও আমাকে সে আশীর্বাদই করছেন।



শুভমস্তু


[/HIDE]
 

Users who are viewing this thread

Back
Top